অস্তিত্ববাদ (Existentialism)

ভূমিকা

অস্তিত্ববাদ সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে সম্ভবত প্রথমে যে জটিল প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয়, তা হলো অস্তিত্ববাদ কি বা অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞা কি? ‘দর্শন’-এর যেমন সার্বিকভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়, যদিও আমরা জানি দর্শন কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে; অস্তিত্ববাদ সম্পর্কেও ঠিক একই কথা খাটে। আমরা জানি অস্তিত্ববাদ কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু বিতর্কহীন বা সার্বিক কোনো সংজ্ঞা এখনো পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয়নি। এর কারণে আজকের অস্তিত্ববাদ যেমন বোঝায় দর্শনকে, তেমনি বোঝায় সাহিত্যকে এবং ঠিক তেমনি বোঝায় অন্যান্য অনেক জিনিসকে। তদুপরি যারা অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসাবে পরিচিত তাদের অনেকেই এ নামে আখ্যায়িত হতে অস্বীকার করেন। অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে আবার অনেকে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী, অনেকে আস্তিক, অনেকে নাস্তিক এবং এ কারণে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্নতর।

তবে অস্তিত্ববাদীরা যে ধর্মবিশ্বাসেরই অন্তর্ভুক্ত হোন না কেন, তাতে কিন্তু অস্তিত্ববাদের মূল সুর, মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয় না। লক, হিউম ও বার্কলের মধ্যেও দার্শনিক চিন্তার অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে গ্রহণ করার জন্য যেমন তারা সবাই অভিজ্ঞতাবাদী; প্লেটো, লাইবনিজ, হেগেল প্রভৃতি ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে মতের বিশেষ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যেমন তারা সবাই ভাববাদী, ঠিক তেমনি অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানুষের অস্তিত্বকে তারা এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন বলে তারা সবাই অস্তিত্ববাদী।

অস্তিত্ববাদ কী

অস্তিত্ববাদের সমর্থক এবং বিরোধীরা যেভাবে অস্তিত্ববাদের মূল্যায়ন করেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং আজকের অস্তিত্ববাদ বলতে যেভাবে বিভিন্ন জিনিসকে বোঝানো হয়, এতে এর সঠিক পরিচয় বা সংজ্ঞা দেয়া একটা জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্তিত্ববাদ বলতে অনেকে মনে করেন, ‘শখবাদ’ (faddism), ‘অবক্ষয়বাদ’ (decadentism); ‘মানসিক অসুস্থতা’ (morbidity), ‘সমাধিক্ষেত্রের দর্শন’ (the philosophy of Graveyard): অনেকে আবার অস্তিত্ববাদ বলতে বুঝে থাকেন ভয়, গভীর ভীতি (dread), উদ্বেগ (anxiety), মনস্তাপ (anguish), একাকিত্ব (aloneness), দুঃখ (suffering) এবং মৃত্যু প্রভৃতি শব্দগুলোকে। সর্বতোভাবে অস্তিত্ববাদকে অবৌদ্ধিকতার (irrationalism) মতবাদ বলে গণ্য করা হয়। রাজনৈতিক উদারপন্থীরা একে ঘৃণার চোখে দেখেন। অনেকেই নাৎসিদের সঙ্গে হাইডেগেরের সম্পর্ককে ভুলতে পারেন না এবং যুক্তি দেখান যে, অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারাকে গ্রহণ করার অর্থ হলো ফ্যাসিবাদকে মেনে নেয়া। মার্কসবাদীরা অস্তিত্ববাদকে বুর্জোয়া দর্শনকে টিকিয়ে রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন এবং একজন মার্কসবাদী একে আত্মিকতার আনন্দোৎসব বলে আখ্যায়িত করেন। অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে এসব মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যার ফলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এটুকু বললে বোধহয় অসঙ্গত হবে না যে, প্রাথমিক অবস্থায় অস্তিত্ববাদের যদি কোনো একটা স্পষ্ট অর্থ থেকে থাকে, তা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। যেহেতু অস্তিত্ববাদের এখন অনেক সংজ্ঞা আছে, সেহেতু এর আর কোনো সংজ্ঞা দেয়া চলে না। সার্ত এ সমস্যাটুকু যথার্থভাবেই বুঝেছেন বলে মনে হয়, যখন তিনি মন্তব্য করেন: “অনেকেই যারা অস্তিত্ববাদ শব্দটি ব্যবহার করেন, শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গেলে বিব্রত বোধ করবেন, কেননা, যেহেতু এটা এখন, একটা প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সবাই আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করে যে, এই সঙ্গীতজ্ঞ বা ঐ চিত্রশিল্পী একজন অস্তিত্ববাদী। একজন সাধারণ সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিক তো নিজের নামটি সই করেছেন অস্তিত্ববাদী বলে। এভাবে শব্দটি এ পর্যন্ত এতই প্রসার লাভ করেছে এবং বিভিন্ন অর্থ ধারণ করেছে যে, এটি আর কোনো অর্থই প্রকাশ করে না।” (Jean-paul Sartre Existentialism and Humanism trans. Philip Mairet London 1970. পৃ. ২৫)

সার্ত অস্তিত্ববাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এমন “এক মতবাদ হিসেবে যে মতবাদ মানবজীবনকে সম্ভবপর করে তোলে; এবং যে মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি সত্য এবং প্রতিটি কর্ম পরিবেশ ও মানুষের আত্মিকতা উভয়কেই বোঝায়।”(Ibid, পৃ. ২৪) অস্তিত্ববাদের এ সংজ্ঞাটি কিন্তু সন্তোষজনক বলে মনে হয় না এ কারণে যে, সম্ভবত শোপেনহাওয়ারের দুঃখবাদী দর্শন ছাড়া আর সব জীবন দর্শনই মানবজীবনকে কমবেশি সম্ভবপর করে তোলার চেষ্টা করে অথবা কমপক্ষে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয় এবং ভাববাদী দর্শন কোনো না কোনো দিক দিয়ে পরিবেশ ও আত্মিকতাকে বোঝায় বলে বলা যায়। তবে সার্তের প্রদত্ত সংজ্ঞাটিতে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সত্য। এবং তা হলো: আত্মিকতাই অস্তিত্ববাদের প্রারম্ভিক সূত্র। সে আত্মিকতা অবশ্য ভাববাদী আত্মিকতা থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন।

নামটি থেকেই বোঝা যায় যে, ‘অস্তিত্ববাদ’ হলো এমন একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করে, সাধারণ অর্থে নয়, বিশেষ অর্থে; বিমূর্ত, কাল্পনিক বা বস্তুগত ধারণা হিসেবে নয়, মূর্ত ও বাস্তব ধারণা হিসেবে; অর্থাৎ অস্তিত্ব যেভাবে বাস্তবে কোনো একটা বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় প্রকাশিত হয়, সেভাবে। শুধু এটুকু বললে হয়তো স্পষ্ট হবে না, যদি না আরও অন্যান্য বিষয়গুলো বিবেচিত হয়, কেননা অস্তিত্ববাদ আরও অনেক দিক দিয়ে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। অস্তিত্ববাদের যেমন একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে তেমনি আছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। সেই ঐতিহাসিক পটভূমি, লক্ষ্য এবং বিশেষ দিকগুলোর আলোকেই হয়তো অস্তিত্ববাদের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।

ঐতিহাসিক পটভূমিকা

এক ঐতিহাসিক পটভূমিকায় অস্তিত্ববাদী দর্শনের উৎপত্তি। আধুনিক যুগ হলো যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। চারদিকে শুধু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিদ্যার জয়গান। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারে মানুষ হয়েছে ধন্য, কিন্তু তার সঙ্গে হারিয়েছে নিজেকে- নিজের ব্যক্তিসত্তাকে, স্বাধীনতাকে। প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভুত্ব বিস্তার করেছে মানুষের উপর মানুষ হয়েছে যন্ত্রের ক্রীতদাস। মানুষ তাই নিজের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন না হয়ে অনেক বেশি সচেতন বিজ্ঞানের আবিষ্কার সম্বন্ধে- অস্তিত্বের চেয়ে তার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যন্ত্র, শিল্প, কলকারখানা, গাড়ি, রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি।

যান্ত্রিক সভ্যতার চাপে মানুষ শুধু যে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে গেছে তা নয়, তার জীবনে এসেছে এক বিরাট শূন্যতা। সে এতই শিল্পমুখী বা যন্ত্রমুখী হয়ে পড়েছে যে, তার যেন আর কোনো স্বাধীনতা বা মর্যাদাবোধ নেই, যন্ত্রের উপরই যেন তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। আধুনিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তি মানুষকে মনে হয় খুবই নগণ্য ও অবহেলিত- সে যেন কেবল একজন নাগরিক, প্রজা বা ভোটার ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অস্তিত্ববাদ একটি প্রচণ্ড প্রতিবাদ। মানুষ যন্ত্র দ্বারা চালিত হবে না, যন্ত্রের উপর বরং সে প্রভুত্ব করবে। মানুষ শুধু একজন প্রজা বা করদাতা নয়-তার একটা ব্যক্তিসত্তা আছে, সে সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন হতে হবে, নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে হবে, জানতে হবে; সে নিজেই নিজের পরিচয় বা সংজ্ঞা দেবে, নির্বাচন করবে, নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, নিজের স্বভাবকে সৃষ্টি করবে।

মাত্র পঁচিশটি বছরের ব্যবধানে সংঘটিত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানুষের সভ্যতার ইতিহাসকে চিরতরে কলঙ্কিত করে রেখেছে। যুদ্ধের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ভয়াবহতা ও বিভীষিকার কালোমূর্তি আজও সভ্য মানুষের দেহে শিহরণ জাগায়। সার্ত, হাইডেগের প্রমুখ অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করেছেন কিভাবে নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী শক্তির কাছে শত শত মানুষ অত্যাচারিত ও পদদলিত হয়েছে, কিভাবে বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুর জীবন নিশ্চিহ্ন হয়েছে, নাগাসাকি ও হিরোশিমা কিভাবে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েছে। মহাযুদ্ধের এসব বিভীষিকাময় তাণ্ডবলীলা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মনে নিদারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যার ফলস্বরূপ তারা দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন তাদের বিপ্লবী দর্শন, যে দর্শন মূল্য দেয় ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে, তার ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধকে। দুটো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষ নিষ্পেষিত হয়েছে নির্মমভাবে, অপমৃত্যু হয়েছে মানবতাবাদ, ভ্রাতৃত্ববোধ-এ ধরনের সব আদর্শবাদের। মানুষ যখন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা, চোখের সামনে দেখে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের নির্মম মৃত্যু, তখন নিজের অস্তিত্ব ছাড়া তার কাছে আর কি মূল্যবান হতে পারে?

ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বই তাই অস্তিত্ববাদীদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয়। অস্তিত্ব কি? শুধু প্রাণে বেঁচে থাকাই কি অস্তিত্ব? আমাদের জন্ম ও মৃত্যু কেন হয়? এ পৃথিবীতে আমাদের জন্ম কি অপরিহার্য? কেন এক বিশেষ স্থানে আমাদের জন্ম হয়। জীবনের অর্থ কি? মৃত্যুই কি জীবনের সমাপ্তি? মানুষ কি সঠিক স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে? নাকি নিজের স্বভাবকে নিজেই তৈরি করে? মানুষ কি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট, নিয়ন্ত্রিত, না স্বাধীন? স্বাধীন হলে কতটুকু স্বাধীন? স্বাধীনতার অর্থই বা কি? মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা কি ধরনের?-অস্তিত্ব সম্পর্কীয় এরূপ প্রশ্ন নিয়েই অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা আলোচনা করেন এবং ঐতিহাসিক অবস্থানের পটভূমিকায় অস্তিত্বকে বিচার করেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা এসব প্রশ্নের যে সন্তোষজনক উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছেন তা নয়। তবে অস্তিত্ব সম্পর্কীয় অতীব বাস্তব প্রশ্ন নিয়ে তারা যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন, তাদের দর্শনের এ এক বড় কৃতিত্ব।

অস্তিত্ববাদীদের মতে মানুষের অস্তিত্বই দর্শনের মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত। জাগতিক বা অতি-জাগতিক, সহজ অথবা জটিল যে প্রশ্নই আমরা করি না কেন, প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে প্রশ্নকর্তা নিজেই জড়িত হয়ে যান। কেননা, প্রশ্ন করেন প্রশ্নকর্তা নিজেই। প্রশ্নকর্তার তাই উচিত নিজের জীবন সম্বন্ধে এবং কোন পরিবেশে তার অস্তিত্ব-সে বিষয়ে জানা। যে প্রশ্ন করে, তার নিজের সম্পর্কে না জেনে, কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি পরমসত্তা সম্বন্ধে প্রশ্ন করি বা জানতে চাই, প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে; কিন্তু তার আগে আমার পক্ষে যা সম্ভব; তা হলো নিজেকে জানা, নিজেকে প্রশ্ন করা এবং এর মাধ্যমে পরমসত্তা সম্বন্ধে আমি কেন প্রশ্ন করছি বা পরমসত্তা আমার জীবনে কি প্রয়োজন প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে।

হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে প্রাচীন ও আধুনিক যুগের অনেক বিখ্যাত দার্শনিক যেমন সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল, কার্ল মার্কস মানুষ সম্বন্ধে লিখেছেন, মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করেছেন-তাদের দর্শন থেকে অস্তিত্ববাদী দর্শনের পার্থক্য কোথায়? মনে রাখতে হবে, মানুষ সম্পর্কে লিখলে বা মানুষের অস্তিত্বকে নিয়ে চিন্তা করলেই কোনো দার্শনিক চিন্তা অস্তিত্ববাদী হয় না। দেখতে হবে কোনো বিশেষ দার্শনিক চিন্তায় মানুষের সার্বিক অস্তিত্ব বা সার্বিক সত্তা নয়, ব্যক্তিসত্তা কতটুকু স্থান পেয়েছে। অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেন, মানুষের সার্বিক অস্তিত্ব নিয়ে নয়। সার্বিক অস্তিত্বের প্রশ্নটি বিমূর্ত, কাল্পনিক, ব্যক্তির অস্তিত্ব ছাড়া যার কোনো আলাদা সত্তা নেই।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্লেটো, হেগেল প্রমুখ দার্শনিকরা কেউই অস্তিত্ববাদের মতো ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্বকে প্রাধান্য দেননি, প্রাধান্য দিয়েছেন সার্বিক অস্তিত্ব বা কোনো এক সার্বিক সত্তাকে এবং এ অবাস্তব কল্পিত সার্বিক সত্তার মাধ্যমেই তারা মানুষের অস্তিত্ব সহ সব জিনিসের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। তাইতো দেখি প্লেটো তার দর্শনে মানুষের বাস্তব অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে সবার ঊর্ধ্বে মূল্য দিয়েছেন সার্বিক ধারণাকে এবং এ পরিদৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে অবাস্তব ও অসত্য বলে বর্জন করে সার্বিক ধারণাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে চিহ্নিত করেছেন। প্লেটোর মতে আমরা এ পৃথিবীর রক্ত-মাংসের মানুষরা তার কল্পিত এক অবাস্তব, বিমূর্ত আদর্শ দুনিয়ার আদর্শ মানুষের নকলমাত্র। ঠিক তেমনি হেগেলের দর্শনেও দেখি মানুষ সার্বিক সত্তারই প্রকাশমাত্র। ব্যক্তির অস্তিত্বকে সেখানে খুঁজে পাবার কোনো উপায় নেই। সক্রেটিস সামাজিক ন্যায়-নীতি, ভালোমন্দ, আত্মার অমরত্ব প্রভৃতি জীবন-বিষয়ক অনেক মূল্যবান প্রশ্নের উপর আলোকপাত করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চিন্তায়ও সার্বিক অস্তিত্বের প্রশ্নটিই বড়, ব্যক্তির অস্তিত্বের কোনো স্থান নেই। কার্ল মার্কসের দর্শনেও ব্যক্তিসত্তার কোনো স্থান নেই, আছে সার্বিক অস্তিত্বের। তিনি সার্বিকের দৃষ্টিতে দেখেছেন ব্যক্তিকে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা এ ধরনের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের মতে একমাত্র ব্যক্তির অস্তিত্বই বাস্তব ও মূর্ত, সব প্রশ্নের মধ্যে প্রধান এবং অপরিহার্য। বিশ্বযুদ্ধের পর বিকাশ ও প্রসার লাভ করেছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন, অস্তিত্ববাদ যুদ্ধোত্তর একটি প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধারণা মারাত্মকভাবে ভ্রান্ত। অস্তিত্ববাদ কেবল একটি যুদ্ধোত্তর ক্ষণিক সাধারণ ঘটনা নয়। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বস্তুবাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি অনেক দার্শনিক মতবাদ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ প্রচলিত দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যা বাদ দিয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছে বস্তু, ঈশ্বর, জ্ঞান, তত্ত্ব বা অন্য কোনো একটা বিশেষ বিষয় বা সত্তার উপর। অস্তিত্ববাদই একমাত্র মতবাদ যা মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় অতিবাস্তব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। অস্তিত্ববাদীদের মতে দর্শন অবাস্তব, বিমূর্ত বা কাল্পনিক কোনো কিছুর সম্বন্ধে চিন্তন নয়, দর্শন হলো জীবনের পথ, বাঁচার পথ।

অস্তিত্ববাদ ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার এক বলিষ্ঠ দার্শনিক প্রচেষ্টা। আসলে মানুষের অস্তিত্ব, ব্যক্তি-সত্তা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি অবহেলার প্রতিবাদস্বরূপই জন্ম নিয়েছে অস্তিত্ববাদের। অস্তিত্ববাদ তাই একটি বিপ্লবী-দর্শন এবং এ বিপ্লব ঘোষিত হয়েছে শুধু প্রচলিত দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে নয়, যান্ত্রিক সভ্যতা বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে নয়, বলতে গেলে যে-কোনো মতবাদ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেখানে ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্ব অবহেলিত হয়েছে বা তার স্বাধীনতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

অস্তিত্ববাদ ও অধিবিদ্যা

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা যেভাবে প্রচলিত দর্শন বা অধিবিদ্যার তীব্র বিরোধিতা করেছেন, তাতে মনে হয় অস্তিত্ববাদ যেন প্রচলিত দর্শন বা অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিবাদের ফলস্বরূপই উদ্ভব হয়েছে। অস্তিত্ববাদীরা প্রধানত মানুষের অস্তিত্ব, অর্থাৎ ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্ব নিয়েই আলোচনা করেন। কিন্তু অধিবিদ্যাবিদরা এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করেছেন। এর মানে অবশ্য এ নয় যে, প্লেটো, হেগেল প্রভৃতি অধিবিদ্যাবিদরা মানুষ বা মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই লেখেননি। আসল কথা হলো, তাদের তাত্ত্বিক মতবাদের করাল গ্রাসে তাদের দর্শনে ব্যক্তি- মানুষের অস্তিত্বের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। মানুষের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে বিমূর্ত সত্তাকে জানার জন্যই তারা তাদের চিন্তাধারাকে নিয়োজিত করেছেন। অধিবিদ্যাবিদদের প্রধান কাজ ‘বীয়িং’, ‘রিয়্যালিটি’, ‘এ্যাবসলিউট’, ‘আইডিয়া’ (Being, Reality. Absolute, Idea) প্রভৃতি বিমূর্ত পরমসত্তার সন্ধান করা। মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নটি তাই তাদের কাছে খুবই নগণ্য। অন্যদিকে মানুষের অস্তিত্বই হচ্ছে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের প্রধান্য আলোচ্য বিষয়। অধিবিদ্যাবিদরা মানুষ বা মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে যা কিছু বলে থাকেন, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গৌণ এবং একমাত্র বিমূর্ত পরমসত্তার মাধ্যমেই তারা এর ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেন।

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা এ ধরনের অধিবিদ্যা-বিষয়ক মতবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। অস্তিত্বের উপরই তারা সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সত্তা হলো বিমূর্ত, অবাস্তব ও কাল্পনিক যার মাধ্যমে অস্তিত্বকে জানা বা ব্যাখ্যাদান করা সম্ভব নয়। অধিবিদ্যাকে কোনো মতবাদের অধীনে যেমন অস্তিত্বকে জানা যায় না, ঠিক তেমনি অস্তিত্বকে দিয়ে এ ধরনের কোনো মতবাদও সৃষ্টি করা যায় না, কেননা অস্তিত্বকে জানতে হবে নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে। অস্তিত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করা আর বেঁচে থাকা বা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া-এক কথা নয়। তাত্ত্বিক চিন্তা বা বহির্মুখী জ্ঞানের মাধ্যমে অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয়, একমাত্র অন্তর্মুখী অভিজ্ঞতা দিয়েই অস্তিত্বকে জানতে হবে।

তবে লক্ষ করার বিষয় যে, অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা প্রচলিত অধিবিদ্যার তীব্র বিরোধিতা করলেও তাদের দর্শন কিন্তু অধিবিদ্যা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নয়। প্রচলিত অধিবিদ্যাকে তারা বর্জন করেছেন সত্যি, কিন্তু এর পরিবর্তে তারা অন্য এক ধরনের অধিবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। প্লেটো, হেগেল প্রমুখ দার্শনিকদের প্রচলিত অধিবিদ্যা থেকে পৃথক করার জন্য অস্তিত্ববাদীদের প্রবর্তিত এ-ধরনের অধিবিদ্যাকে অস্তিত্ববাদী অধিবিদ্যা নামে অভিহিত করা যেতে পারে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা প্রচলিত অধিবিদ্যার যতদূর বিরোধিতা করেছেন, ঠিক ততদূর তাদেরকে অধিবিদ্যা-বিরোধী বলা চলে; কিন্তু আসলে অধিবিদ্যাকে তারা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেননি। এর প্রমাণ ‘বীয়িং’, ‘ঈশ্বর’, ‘বহির্জগৎ’, ‘এ্যাবসলিউট’ প্রভৃতি অধিবিদ্যার ধারণাগুলো শুধু যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান বিষয় তা নয়, অস্তিত্বকে জানা বা বোঝার জন্য এগুলো অপরিহার্যও।

স্বভাবতই তাই প্রশ্ন জাগে, ব্যক্তি-মানুষের অস্তিত্বই যদি তাদের আলোচ্য বিষয় হয়, তাহলে অস্তিত্ববাদীরা বাহ্যজগৎ, বীয়িং প্রভৃতি অধিবিদ্যার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন কেন? এর একটা সম্ভাব্য উত্তর হলো এ বিষয়গুলো থেকে আলাদা করে অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয় বলেই। এক অর্থে আমাদের অস্তিত্ব বহির্জগৎ থেকে অবিচ্ছেদ্য, কারণ অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই এ জগতের কোনো এক বিশেষ স্থান বা পরিবেশে অবস্থান করা। এ পৃথিবীতেই আমাদের জন্ম এবং এখানেই আমাদের অবস্থান। অস্তিত্ব বলতে তাই হাইডেগের বুঝেছেন পৃথিবীতে অবস্থান করা। সার্তের মতে শুধু চেতনা বলতে কিছু নেই; চেতনা সব সময়ই হবে কোনো কিছু সম্বন্ধে চেতনা, কোনো অচেতন বস্তু সম্বন্ধে চেতনা। সার্ত আঁ-সোয়া বা বহির্জগৎকে আমাদের অস্তিত্বের পৃষ্ঠদেশ বা ভিত্তি বলে অভিহিত করেছেন।

বহির্জগতের মতো বীয়িং-এর ধারণাও অস্তিত্ববাদী দর্শনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হাইডেগের, ইয়াসপের্স, মার্শেল ও সার্ত মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সরাসরি আলোচনা না করে বীয়িং-এর প্রশ্ন নিয়েই তাদের দর্শন শুরু করেছেন। সার্ত শুধু যে দর্শনের উপর তার প্রধান গ্রন্থটি Being and Nothingness নামে আখ্যায়িত করেছেন তা নয়, বীয়িং কী?-এ প্রশ্ন দিয়েই তিনি গ্রন্থটি শুরু করেছেন। ইয়াসপের্স তার Philosophy গ্রন্থের ভূমিকায় মন্তব্য করেছেন যে, বর্তমান যুগের দার্শনিক চিন্তাধারায় অনেক পরিবর্তন আসা সত্ত্বেও আসলে আজকের দর্শন পূর্বেকার দর্শনের মতোই বীয়িং-এর প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে। এবং বীয়িং সম্বন্ধে তার যে ধারণা, তার অস্তিত্ববাদী দর্শনের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। আর হাইডেগের তো নিজেকে অস্তিত্ববাদী না বলে আখ্যায়িত করেছেন বীয়িং-এর দার্শনিক বলে। তার দর্শনে প্রধান বিষয় অস্তিত্ব নয়, বীয়িং। এখন প্রশ্ন হলো, বীয়িং নিয়ে যদি তারা আলোচনা করে থাকেন, তাহলে তাদেরকে অস্তিত্ববাদী বলা হয় কেন? সম্ভবত এর একটা সহজ উত্তর হলো, তারা মোটামুটি সবাই একমত যে, বীয়িংকে জানতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদেরকে, অর্থাৎ আমাদের অস্তিত্বকে জানতে বা বুঝতে হবে। অন্য কথায়, একমাত্র আমাদের অস্তিত্বকে জানার মাধ্যমেই বীয়িংকে জানা সম্ভব। অস্তিত্ববাদীদের প্রধান লক্ষ্য হলো, ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা, কিন্তু যেহেতু অস্তিত্ব ছাড়া বীয়িং, বহির্জগৎ প্রভৃতি আরও সত্তা আছে যেগুলোর সঙ্গে আমরা সম্পর্কিত, সে কারণেই অস্তিত্বকে জানতে হলে এগুলোর সম্পর্কেও জানতে হবে।

আমাদের অস্তিত্বের মাধ্যমেই যদি বীয়িংকে জানতে হয়, তাহলে নিজ অভিজ্ঞতা বা মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টিকেই অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা অধিবিদ্যক জ্ঞানের ভিত্তি হিসাবে মেনে নিয়েছেন; কেননা অস্তিত্ব অপরিহার্যভাবেই আত্মগত, নিজস্ব এবং একমাত্র নিজ অভিজ্ঞতা দিয়েই জানা বা বোঝা সম্ভব। অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন মানুষই বস্তুতপক্ষে অধিবিদ্যা বিষয়ক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, এবং একারণেই প্রশ্নটি কি, ‘অর্থাৎ বীয়িং কি, তা জানতে হলে তাকে প্রথমেই তার নিজের অস্তিত্বকে জানতে হবে। হাইডেগেরের মতে কোনো কিছু সম্বন্ধে প্রশ্ন করা মানেই প্রশ্নকর্তার নিজেরই জড়িয়ে পড়া। সুতরাং বীয়িংকে বুঝতে হলে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে আগে জানতে হবে। হাইডেগেরের মতে কোনো কিছু সম্বন্ধে প্রশ্ন করা মানেই প্রশ্নকর্তার নিজেরই জড়িয়া পড়া। সুতরাং বীয়িংকে বুঝতে হলে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে আগে জানতে হবে। আমাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো আমরা আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে পারি। ইয়াসপের্স মনে করেন, আমরা যখন কোনো প্রশ্ন করি, তখন আমরা বিশেষ একটা অবস্থার সম্মুখীন হই এবং আমাদের পক্ষে প্রশ্নটি বা প্রশ্নটির উত্তর বোঝা সম্ভব নয় যদি না আমরা প্রশ্নটিকে অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বলে মনে করি বা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বকে এর অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করি। সার্তের মতে মানুষই একমাত্র জীব, যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে এবং তার এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নেতিবাচক বা অভাবের ধারণা জন্ম নিয়েছে। মানুষ যখন প্রশ্ন করে তার প্রশ্নটি স্পষ্টতই নঞর্থক কিছুকে বোঝায়, কেননা প্রতিটি প্রশ্নের মধ্যেই নেতিবাচক উত্তরের সম্ভাবনা আছে। মানুষ স্বভাবতই অসম্পূর্ণ এবং জন্মগ্রহণ করে অভাব নিয়ে; এবং এ কারণে সে নিজের সম্পর্কে বা নিজের অস্তিত্বের বাইরের জিনিস সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। কিন্তু একমাত্র নিজের অস্তিত্বকে বোঝার মাধ্যমেই তাকে সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে কিয়ের্কেগোরের দর্শনেই বীয়িং-এর গুরুত্ব ও প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি, কেননা তার মতে অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই বীয়িং-এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত হওয়া। এ বীয়িং হলেন ঈশ্বর যা যিশুখ্রিস্ট, যাকে কিয়ের্কেগোর, ‘অজ্ঞাত’ বা ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’ বলে অভিহিত করেছেন। কিয়ের্কেগোর অবশ্য সার্ত বা হাইডেগেরের মতো বীয়িং-এর বর্ণনা দিয়ে তার দর্শন শুরু করেননি। তার অস্তিত্ববাদী চিন্তার প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো কিভাবে ভালো খ্রিস্টান হওয়া যায়। তার মতে বীয়িং বা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া ছাড়া কারও পক্ষে ভালো খ্রিস্টান হওয়া সম্ভব নয়।

বৌদ্ধিকতা ও অবৌদ্ধিকতা

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা সবাই নিজ অভিজ্ঞতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের মতে অস্তিত্বকে জানতে হবে অন্তর্মুখী পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থাৎ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। অস্তিত্ববাদী দর্শনের এ বক্তব্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে সার্তের একটি কথায় যখন তিনি বলেছেন: আত্মিকতা (Subjective) থেকেই আমাদের সবাইকে শুরু করতে হবে। (Ibid, পৃ. ২৬)

আত্মিকতা অস্তিত্ববাদীদের জন্য এক বড় দার্শনিক অস্ত্র, কেননা এর মাধ্যমেই তারা অনস্তিত্ববাদী সব বস্তুগত চিন্তাধারা, বিশেষ করে হেগেলের তাত্ত্বিক দর্শনকে আক্রমণ করেছেন। তাত্ত্বিক দর্শনের বিরুদ্ধে তাদের বড় অভিযোগ হলো, এ-দর্শন বস্তুগত কোনো সত্তার খোঁজে অস্তিত্বকে শুধু যে অবহেলা ও নগণ্য মনে করে তা নয়, অস্তিত্বকে বিচার করে বিমূর্তভাবে কোনো এক অবাস্তব সত্তার আলোকে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন যে, অস্তিত্বকে কোনো ধারণার মাধ্যমে জানা যায় না, ‘অর্থাৎ বস্তুগত বা বিমূর্তভাবে অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয়। অন্য কথায় কোনো সত্তার সাহায্যে বা বহির্মুখী পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থাৎ অব্যক্তিক উপায়ে অস্তিত্বকে বোঝা সম্ভব নয়, একমাত্র অন্তর্মুখী অভিজ্ঞতার দ্বারাই এটি জানা সম্ভব। বেঁচে থাকা সম্বন্ধে চিন্তা করা আর বেঁচে থাকা এক জিনিস নয়। একমাত্র বেঁচে থাকার মাধ্যমেই একজন তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রকৃতভাবে জানতে পারে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা এ কারণেই নিজ অভিজ্ঞতার উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

এখানে লক্ষণীয় যে, শুধু আত্মিক-প্রবণতাই কোনো দার্শনিক চিন্তাধারাকে অস্তিত্ববাদী করতে পারে না। অন্যদিকে প্রত্যেক অস্তিত্ববাদী দর্শনই অত্যাবশ্যকভাবে আত্মিক প্রবণতামূলক। কোনো আত্মিক চিন্তাধারাকে অস্তিত্ববাদী হতে হলে শুধু ব্যক্তি-মানুষের মূর্ত অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করলেই চলবে না, সে অস্তিত্বকে জানতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। বস্তুতপক্ষে প্রত্যেক অস্তিত্ববাদী মনোভাব একই সঙ্গে আত্মিকও, কেননা প্রতিটি অস্তিত্ববাদী সমস্যা ব্যক্তির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। কিন্তু একটি আত্মিক মনোভাব অত্যাবশ্যকভাবে অস্তিত্ববাদী নয়। অবশ্য এক অর্থে যে কোনো দার্শনিক চিন্তাই আত্মিক এ কারণে যে, চিন্তনক্রিয়াটি সম্পাদিত হয় একজন ব্যক্তিকে দিয়ে, যে চিন্তা করে সেরকম একজন কর্তাকে দিয়ে। কিন্তু শুধু কর্তা কর্তৃক কোনো একটা বিষয় সম্বন্ধে চিন্তন ক্রিয়াকেই অত্যাবশ্যকভাবে আত্মিক বলা যায় না, অন্ততপক্ষে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। কোনো এক বিশেষ চিন্তাকারী হয়তো কোনো একটা বিশেষ মতবাদ দিতে পারে-যা আত্মিক হতে পারে, কিন্তু তা কখনো অস্তিত্ববাদী হবে না যদি না সে ব্যক্তিগতভাবে সে মতবাদে জড়িত হয় এবং যদি না তার বাস্তব ও মূর্ত অস্তিত্ব সম্পর্কিত হয়।

অন্যকথায়, একটা আত্মিক মনোভাবকে অস্তিত্বশীল হতে হলে ব্যক্তিকে, কর্তাকে সে মনোভাবের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে; যে কোনোভাবে এটি তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কিয়ের্কেগোর যখন বলেন যে, সত্য আত্মগত, এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চান যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই সত্যকে গভীর ভাবাবেগ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। এবং তা তার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না যদি না সে ব্যক্তিগতভাবে এর মধ্যে জড়িত হয়ে পড়ে বা যদি না তার কাছে তা তাৎপর্যময় মনে হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, কোনো ব্যক্তিই নিজেকে খ্রিস্টান বলে দাবি করতে পারে না, যদি না সে প্রত্যক্ষভাবে একটা বিশেষ ধর্মীয় জীবনযাপনে লিপ্ত হয়। ঠিক এভাবে আমি যদি কোনো কারণে মনস্তাপিত হই তার কারণ ব্যাপারটি আমার কাছে অর্থপূর্ণ, অথবা আমি যদি মনস্তাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই, এটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেজন্য; অথবা আমি যদি কোনো বিশেষ অবস্থার সম্মুখীন হই, আমাকেই সে পরিস্থিতিতে নির্বাচন করতে হবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, কারণ আমি জানি এর সঙ্গে আমি জড়িত। সুতরাং আমার অস্তিত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমার জড়িয়ে পড়াটা শুধু যে প্রয়োজন তা নয়, অত্যাবশ্যকও বটে। কারণ প্রত্যেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, নির্বাচন করা এবং প্রত্যেক বিষয়কে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার দায়িত্ব আমারই।

এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, অনেক বিখ্যাত দার্শনিকদের চিন্তাধারা আত্মিক মনোভাবসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও অস্তিত্ববাদী নয়। চিন্তাশীল দার্শনিকদের মধ্যে ডেকার্ট একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন বলে মনে হয়। কারণ মানুষের মনের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠার দাবি করে তিনিই আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম চিন্তার ক্ষেত্রে আত্মগত ধারার অবতারণা করেন। কিন্তু এ আত্মগত মনোভাব থাকা সত্ত্বেও ডেকার্টের দর্শনকে কোনো অবস্থাতেই অস্তিত্ববাদী বলা যায় না। তার দর্শন ছিল সর্বতোভাবে চিন্তাশীল। তার ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি’-এ বচনটি অস্তিত্ববাদী বক্তব্য নয়; বরং এটি হলো ব্যক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে এমন একটি চিন্তাশীল উক্তি যার অস্তিত্ব নির্ভর করে তার চিন্তার উপর। ডেকার্টের লক্ষ্য ব্যক্তির বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব নয়, ব্যক্তির চিন্তন বা চিন্তাশক্তিই ছিল তার কাছে বড়। তিনি অস্তিত্বের চেয়ে চিন্তনের উপর এতই গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, অস্তিত্ব হয়েছে সম্পূর্ণভাবে চিন্তনাধীন; অথচ সাধারণভাবেও বলতে গেলে আমরা অস্তিত্বশীল বলেই তো আমাদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব-এ বাস্তব সত্যটুকু তিনি অগ্রাহ্য করেছেন।

ডেকার্টের চিন্তাশীল দার্শনিক ধারা থেকে যদি আমরা অভিজ্ঞতাবাদী (empiricist) চিন্তাধারার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, সেখানেও দেখবো অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা যে ধরনের আত্মগত ধারণার কথা বলেছেন তা অস্তিত্ববাদী নয়, বরং অত্যাবশ্যকভাবে জ্ঞানোৎপত্তিমূলক। অভিজ্ঞতাবাদী অর্থে আত্মিকতা হলো মানসিক, এ অর্থে যে অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে আমরা যখন জানি আমরা শুধু মনের বিষয়গুলোকেই জানি। যেহেতু জ্ঞানই তাদের লক্ষ্য, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই অভিজ্ঞতাবাদীরা জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাতাকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু জ্ঞাতা বলতে এখানে অস্তিত্ববাদীদের সেই অস্তিত্বশীল ব্যক্তি-মানুষকে বোঝায় না, বোঝায় জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ক কর্তাকে, যে কর্তা জানে, জ্ঞান লাভ করে। এ কর্তা বা জ্ঞাতা কিভাবে অস্তিত্বশীল হয়-এটা অভিজ্ঞতাবাদীদের সমস্যা নয়, তাদের সমস্যা হলো, সে কিভাবে জানে, কিভাবে জ্ঞান লাভ করে। প্রোটেগোরাসের ‘মানুষই সব জিনিসের মাপকাঠি’-এ বচনটিকে একটি অস্তিত্ববাদী উক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটি আদৌ তা নয়। এটি মূলত একটি জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ এবং এ কারণে যে, যে মানুষটিকে প্রোটেগোরাস সব জিনিসের মাপকাঠি বলে মনে করে, সে মানুষটি কিন্তু অস্তিত্ববাদী নন, বরং একজন জ্ঞাতা যার মতানুসারে কোনো বস্তুগত জ্ঞান বা নৈতিকতা বলতে কিছু নেই, কারণ সব জ্ঞান নির্ভর করে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার উপর এবং নৈতিকতা হলো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ব্যাপার-অর্থাৎ ব্যক্তিই সবকিছুর মাপকাঠি।

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা বুদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করেছেন, কেননা নিজের জীবনকে, অস্তিত্বকে বুদ্ধির দ্বারা নয়, একমাত্র অন্তর্জ্ঞান দিয়েই বোঝা সম্ভব। বুদ্ধির পরিবর্তে নিজ অভিজ্ঞতার উপর এরূপ গুরুত্ব আরোপ করার ফলে অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারা হয়েছে অত্যাবশ্যকভাবে আত্মগত; এবং এ আত্মাগত প্রবণতার জন্যই অস্তিত্ববাদকে অবৌদ্ধিক বলে বিশেষিত করা হয়। এমনকি অনেক লেখক অস্তিত্ববাদীদেরকে ‘অবৌদ্ধিক মানুষ’ বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু অস্তিত্ববাদীদের সবাইকে সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধি-বিরোধী বললে ভুল হবে। কেননা, অন্ততপক্ষে সার্ত কান্টের ব্যবহারিক বুদ্ধির বিরোধিতা তো করেননি বরং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং তার মানবতাবাদ কান্টের নীতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত।

কান্টের নীতিবাদ একটি সার্বিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত-যে নীতি অনুসারে প্রতিটি মানুষের উচিত কোনো কাজ করার আগে বিবেচনা করে দেখা, সে যে কাজটি করতে যাচ্ছে অন্যেরাও সেই একই কাজ তার মতো একই অবস্থার মধ্যে সম্পাদন করবে কিনা। কান্টের এই নৈতিক দর্শন সার্তকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। সার্তের অস্তিত্ববাদী নৈতিক দর্শন ব্যবহারিক ও মানবতাবাদী। কান্টের মতো সার্তও নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে একটি সার্বিক নীতিকে গ্রহণ করেছেন, যদিও অন্যভাবে। সার্তের মতে মানুষ যখন নিজের জন্য নির্বাচন করে, সে সবার জন্য নির্বাচন করে, এবং সে শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য দায়ী থাকে। সার্ত মনে করেন, আমরা স্বভাবতই ভালো জিনিস নির্বাচন করি; কিন্তু কোনো জিনিসই ভালো নয়, যদি না তা সবারই জন্য ভালো হয়। এখানে সার্তের উদ্দেশ্য খুবই মহৎ। সমগ্র মানব জাতির মঙ্গল-সাধনই তার লক্ষ্য। আমাদের তাই উচিত কোনো কাজ করার আগে ভেবে দেখা, যে কাজটি করতে যাচ্ছি তা শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে কি না। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় মানবতাবাদী দর্শন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, অনেক সমালোচক অস্তিত্ববাদী দর্শনকে অবৌদ্ধিক বলে যে অভিযোগ করেছেন, তা সঠিক নয়। বিশেষ করে, বুদ্ধি বলতে যদি কান্টের ব্যবহারিক বুদ্ধিকে বোঝানো হয়, তাহলে সার্তের দর্শনকে কান্টের দর্শনের মতোই, অথবা তার চেয়েও অনেক বেশি বৌদ্ধিক বলে মনে হয়। অস্তিত্ববাদী দর্শনকে এক বিশেষ অর্থে অবৌদ্ধিক বলা যায়, যদি ‘বুদ্ধি’ বলতে বোঝায় যা যৌক্তিক, বস্তুগত বা বিজ্ঞান-সম্মত। কেননা, অস্তিত্ববাদীদের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় ধারণা কোনো লজিক বা তত্ত্ব থেকে প্রসূত নয়, বরং নিজ অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা বিজ্ঞানবিরোধী না হলেও বিজ্ঞান-সম্মত বা বস্তুগত হতে চান না, কারণ মানুষের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্ব-সম্পর্কীয় বিষয়গুলো যেমন, অনুভূতি, চিন্তা, ভীতি, স্বাধীনতা, নির্বাচন, বিশ্বাস প্রভৃতি অনাত্মগতভাবে বা সম্পূর্ণরূপে বস্তুগত পদ্ধতির মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়। একমাত্র ব্যক্তি নিজেই অস্তিত্ব বা অস্তিত্ব-সম্পর্কীয় বিষয়গুলো ভালোভাবে জানতে বা বুঝতে সক্ষম। এ কারণেই অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা নিজ অভিজ্ঞতার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের মতে নিজ অভিজ্ঞতাই সব দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি হওয়া উচিত।

অস্তিত্ববাদ, বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ

অস্তিত্ববাদ বৌদ্ধিক না অবৌদ্ধিক-এ প্রশ্নটি সম্ভবত আরও স্পষ্ট হবে যদি দর্শনের তিনটি প্রধান প্রশ্ন সম্পর্কে অস্তিত্ববাদীদের মতামত বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদীদের মতের আলোকে বিবেচনা করে দেখা হয়। এ তিনটি প্রশ্ন হলো: ১. আমরা কি কি জানি বা জানতে পারি, ২. কিভাবে তা জানি এবং ৩. সে জানার মূল্য কি?

বুদ্ধিবাদীদের মতে যা শাশ্বত, অনিবার্য, অপরিবর্তনীয় ও সার্বিক একমাত্র তাকেই আমরা জানি। যা সাময়িক, আকস্মিক, পরিবর্তনশীল ও বিশেষ, তাকে জানা যায় না। কিভাবে আমরা জানি এর উত্তরে বুদ্ধিবাদীরা বলেন যে, মন বা বুদ্ধিই আমাদের জ্ঞান লাভের উপায়। ইন্দ্রিয়জের মাধ্যমে কোনো কিছু জানা যায় না বললেই চলে; ইন্দ্রিয়জের যদি কোনো ভূমিকা থেকে থাকে, তা একমাত্র সহায়ক হিসেবে। মানুষের জন্য এ ধরনের জ্ঞানের কি মূল্য আছে এ সম্পর্কে বুদ্ধিবাদীদের উত্তর হলো দুটো; প্রথমত জ্ঞান নিজে-নিজেই মূল্যবান; দ্বিতীয়ত জ্ঞানের মাধ্যমে তা শাশ্বত ধারণা হোক, এরিস্টটলের সত্তা হোক বা বস্তু সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিশক্তিই হোক, মানুষ তার ক্ষমতাবলে সুখের অভিজ্ঞতা পায় এবং অমরত্ব লাভ করে। আরও একটা কারণে জ্ঞান মূল্যবান হতে পারে এবং তা হলো, জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ এ পরিদৃশ্যমান জগতে নিজেকে পরিচালনা করার শিক্ষা পায়। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা তার শাশ্বত ও সার্বিক সত্তা-সম্পর্কীয় জ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

শাশ্বত সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য দুটো প্রধান যুক্তি দেয়া হয়েছে। একটি যুক্তির ভিত্তি হলো, সিসটেম্যাটিক জ্যামিতি গ্রিকদের গাণিতিক আবিষ্কারের অন্যতম অবদান। এ জ্যামিতি থেকেই গ্রিকরা পেয়েছেন বিশুদ্ধ জ্যামিতি চিত্র যেমন, বিশুদ্ধ বৃত্ত, সমান্তরাল রেখা প্রভৃতি। যেহেতু সত্যিকারভাবে বিজ্ঞান হিসেবে জ্যামিতির অস্তিত্ব আছে, সেহেতু এ জ্যামিতিক চিত্রগুলোর অস্তিত্ব থাকতে হবে-জ্যামিতি কখনো সঠিক হতে পারে না যদি না এর চিত্রগুলো শাশ্বত না হয়ে পরিবর্তনশীল হয়।

এখন এ সত্যগুলোর, জ্যামিতিক চিত্রগুলোর অস্তিত্ব কোথায়? এদের অস্তিত্ব এ পরিবর্তনশীল, পরিদৃশ্যমান জগতে হতে পারে না-এ জগতের গোলাকার আকৃতি, সমান্তরাল লাইন সবই অপরিপূর্ণ। তদুপরি, এ জগতের সব বস্তুই পরিবর্তনশীল। এ সত্যগুলো কি তাহলে কল্পনা প্রসূত? না তাও নয়। আমাদের মনের কাল্পনিক ছবিগুলো বাহ্যবস্তুর ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। কল্পনায় আমরা বাহ্য জগতের বস্তুগুলোকেই পুনরুৎপাদন করি মাত্র। তাছাড়া জ্যামিতির চিত্রগুলোর এ জগতে বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন জ্যামিতিবিদের এমন একটা অদ্ভুত ত্রিভুজ সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে পারে-যা সমদ্বিবাহুও নয়, সমবাহুও নয়, বিষমবাহুও নয়- আসলে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। কে এ ধরনের ত্রিভুজের কল্পনা করতে পারে? গণিতে যে শূন্য আমরা পাই, তারও বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই, যদিও অবশ্য এ সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি।

গাণিতিক এ সত্যগুলোর অস্তিত্ব কি তাহলে নির্ভর করে মানুষের বুদ্ধির উপর? না, তা নয়। মানুষের মন হলো সসীম, অস্থায়ী; কিন্তু গাণিতিক সত্যগুলো শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়। মনকে কার্য-সম্পাদন করতে হয় এবং এর কাজ হলো ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া, এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে গমন করা। গাণিতিক সত্যগুলো যদি পূর্ব থেকে মনের আয়ত্তে থাকতো তাহলে আমাদের পক্ষে এগুলোকে জানা বা আয়ত্ত করার কোনো প্রশ্নই উঠতো না।

গাণিতিক সত্যগুলো তাহলে অবস্থান করে কোথায়? একমাত্র তিনটি স্থানেই এদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত এগুলো অবস্থান করে শাশ্বত ধারণার দুনিয়ায় যা এ জগৎ ও বিশেষ মানুষের অতিবর্তী (transcendent)। এটি হলো প্লেটোর মত। দ্বিতীয়ত এগুলোর অবস্থান হলো এমন একটা সার্বিক মনে যার কিছু অংশ মানুষ পেয়েছে বলে এরিস্টটল মনে করেন, অথবা যাকে খ্রিস্টানরা ঈশ্বরের মন বলে গণ্য করেন। সেন্ট অগাস্টিন প্লেটোর ভাবের দুনিয়াকে বাদ দিয়ে একটা নতুন মতবাদ দেন, যে মতবাদানুযায়ী ধারণাগুলো সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক বুদ্ধিতে অভিনিবিষ্ট। তৃতীয়ত এগুলো অবস্থান করে এ জগতেই এ অর্থে যে, এ জগৎকে ধারণা করতে হবে আমাদের ইন্দ্রিয়জ কর্তৃক প্রত্যক্ষিত জগৎ হিসেবে নয় বরং এর থেকে ভিন্ন এক জগৎ হিসেবে যা একমাত্র বুদ্ধির দ্বারাই বোঝা সম্ভব। এরিস্টটল, ডেকার্ট, স্পিনোজা, লাইবনিজ, হেগেল প্রভৃতি বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা এ মত পোষণ করেন।

গাণিতিক সত্যগুলো শাশ্বত ও অপরির্তনীয় এ মতবাদের উপর ভিত্তি করে বুদ্ধিবাদীরা দাবি করেন যে, যথার্থ জ্ঞানমাত্রই গাণিতিক, অথবা অগাণিতিক জ্ঞান গাণিতিক জ্ঞানের মতোই সমানভাবে সত্য এ অর্থে যে, এর বস্তুগুলো হলো শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় সত্তা যেগুলো এ বাহ্য জগতের অতিবর্তী এবং একমাত্র বুদ্ধি দ্বারাই এগুলোকে জানা সম্ভব। প্লেটোর দর্শনেই এ মতটি আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করি যখন প্লেটো সক্রেটিসের চরিত্রের মাধ্যমে ‘সাহস’, ‘মিতাচার’ প্রভৃতি শব্দগুলোর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। ‘সাহস’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট ও স্থায়ী অর্থ আছে, কিন্তু সাহসী লোক বা সাহসী কাজ হলো বহু ও পরিবর্তনশীল। সুতরাং শব্দের অর্থ কখনো অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল জগতে পাওয়া সম্ভব নয়। এ জগতের বিশেষ বিশেষ জিনিসগুলো এক একটা মাত্র শব্দ দ্বারাই বোঝানো হয় এ অর্থে যে, এগুলো এমন একটা বিষয়ের অংশবিশেষ বা অনুরূপ যা শব্দটিকে প্রকৃত অর্থ প্রদান করে। যেমন, সাহস ধারণাই ‘সাহস’ শব্দটির প্রকৃত অর্থজ্ঞাপক।

অভিজ্ঞতাবাদীরা মনে করেন যে, বিশেষ জিনিসসমূহ এবং এদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান একমাত্র তাই মানুষ জানতে পারে। মানুষ তা কিভাবে জানে এ প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণই এ জ্ঞান দান করে। মানুষ কেন জানতে চায় এ জানার মূল্য সম্বন্ধে তাদের বক্তব্য হলো: ক্ষমতার জন্য, বিশেষভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তন করার ক্ষমতার জন্য।

অভিজ্ঞতাবাদের ইতিহাস খুবই বিশাল ও বিস্তৃত। ফ্রান্সিস বেকন, টমাস হবস, জন লক জর্জ বার্কলে হলেন এর উদ্ভাবক। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ডেভিড হিউমের হাতে এ মতবাদ পূর্ণতা লাভ করে এবং অদ্যাবধি নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে টিকে আছে। বিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাায় যেসব দার্শনিক মতবাদ জন্ম নিয়েছে, যেমন, প্রয়োগবাদ (pragmatism), প্রত্যক্ষবাদ (posi- tivism), অবভাসবাদ (phenomenalism) এবং অতি সম্প্রতি বিশ্লেষণী দর্শন, সবই এ অভিজ্ঞতাবাদেরই অংশবিশেষ।

হিউমই সর্বপ্রথম স্পষ্টভাবে এবং আপসহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, গণিত অথবা যুক্তিবিদ্যার বাইরে যথার্থই অভিজ্ঞতাপূর্ণ জ্ঞান বলতে কিছু নেই এবং বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে সব জ্ঞানই হচ্ছে বিশেষ বস্তুসমূহ বা এদের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান। হিউম তার একটা বিখ্যাত পুস্তকে মন্তব্য করেছেন যে, দর্শনের কোনো বই হাতে নিয়ে যদি আমরা দেখি যে, বইটিতে অভিজ্ঞতামূলক বাস্তব ঘটনা বা গণিত অথবা যুক্তিবিদ্যার বিমূর্ত যুক্তি সম্পর্কে কোনো যুক্তি নেই, তাহলে বইটিকে পুড়িয়ে ফেলা উচিত, কারণ এতে ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তি আর ভ্রম ছাড়া অন্য কিছুই নেই।

হিউম অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মত প্রকাশ করেন যে, কোনো বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে সব সাধারণ জ্ঞানই নির্ভর করে সরল আরোহের উপর, অর্থাৎ দুই বা ততোধিক জিনিসের মধ্যে ক্রমাগত সম্পর্কের উপর। যেমন, আমরা জানি যে আগুন দাহ করে, কারণ আগুনে এক টুকরা কাগজ ফেলে দিলে অথবা আগুনের উপর হাত রাখলে কি ঘটে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। শুধু আগুনের সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করলে আমরা কখনো এ ব্যাপারটি জানতাম না এবং একটি মাত্র ঘটনা থেকে কখনো জানতে পারতাম না যে, সাধারণত এরকমই ঘটে থাকে। আগুন ও দাহশক্তির মধ্যে সম্পর্কের ঘটনাটি যদি আমরা একবার মাত্র অভিজ্ঞতায় জানতাম, তাহলে এ ঘটনাটি কি প্রকৃতির নিয়মের ফল না শুধু একটা আকস্মিক ঘটনা, তা জানার কোনো উপায় ছিল না। আগুন ও দাহশক্তির মধ্যে সম্পর্কের ঘটনা নিয়মিতভাবে ও বারংবার প্রত্যক্ষ করার ফলেই একমাত্র আমরা এ সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আগুন দাহ করে।

হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ হলো এই যে, তার মতে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান এবং প্রকৃতির সেই বহুল পরিচিত নিয়মগুলো সম্ভাব্য মাত্র। অতীতে যদি দুটো ঘটনাকে নিয়মিতভাবে সংযুক্ত হতে দেখা যায়, ভবিষ্যতে এগুলো সংযুক্ত হবে এরকম কোনো গ্যারান্টি নেই। যে পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা এ ধরনের সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হই, সেই আরোহ নিয়মটি স্বয়ং যুক্তিসঙ্গত কি না, তা বলা যায় না। কোনো সত্তা বা প্রকৃতি অনিবার্য বা শাশ্বত কি না, তা আমরা জানতে পারি না। ঈশ্বরের হয়তো অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তার সম্পর্কে বা তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।

হিউমের পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদীদের অবদান হলো, বুদ্ধিবাদীরা যে যুক্তির মাধ্যমে শাশ্বত সত্তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন সেসব যুক্তির হিউমের চেয়ে আরও বেশি যুক্তিসঙ্গত উত্তর দেয়া। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে এ উত্তরের রেশ পাওয়া গেলেও প্রধানত বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতাবাদীরা বিশেষভাবে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরাই চরম উত্তর প্রদান করেন।

বুদ্ধিবাদীরা যুক্তি দেখান যে, গাণিতিক ও যৌক্তিক সিস্টেমসমূহের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, যাদের বিষয়গুলো বাহ্যিকভাবে প্রত্যক্ষণীয় বস্তুও নয়, মানুষের মনের সত্তাও নয় এবং যাদের বচনগুলো শাশ্বত ও অনিবার্যভাবে সত্য। সাম্প্রতিককালের অভিজ্ঞতাবাদীরা এ ধারণার বিরোধিতা করে বলেন যে, অনিবার্য ও শাশ্বত সত্য সম্পর্কে আলোচনা করে বলেই কিন্তু গাণিতিক ও যৌক্তিক বচনগুলো অনিবার্যভাবে ও শাশ্বতভাবে সত্য নয়; বরং আমরাই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, এগুলো অনিবার্যভাবে ও শাশ্বতভাবে সত্য হবে। টেকনিক্যাল অর্থে অভিজ্ঞতাপূর্ব সত্যগুলো অনিবার্যভাবে ও শাশ্বতভাবে সত্য, কারণ এগুলো পুনরুক্তিমূলক বা বিশ্লেষণাত্মক। উদাহরণস্বরূপ, ‘সব কুমারেরাই অবিবাহিত পুরুষ’-এ বচনটি একটি অভিজ্ঞতাপূর্ণ সত্য, এটা প্রমাণ করার জন্য কুমারদের জরিপ নেবার প্রয়োজন নেই। একই সময়ে এ বচনটি বিশ্লেষণাত্মক বা পুনরুক্তিমূলক, কেননা এটি কুমার সম্বন্ধে কোন খবর দেয় না। কোন অর্থে তাহলে এ বচনটি শাশ্বতভাবে ও অনিবার্যভাবে সত্য? বৃদ্ধিবাদীদের মতে এটি শাশ্বতভাবে এ অনিবার্যভাবে সত্য এ কারণে যে, ‘কুমারত্ব’ বলে একটা ধারণা বা সত্তা আছে, যা পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, বচনটির মধ্যে সে ধারণা বা সত্তা নিহিত আছে। অন্যদিকে বচনটি অনিবার্যভাবে ও শাশ্বতভাবে সত্য বলতে অভিজ্ঞতাবাদীরা বলতে চান যে, আমাদের সামাজিক প্রথানুযায়ী ‘কুমার’ শব্দটি একমাত্র অবিবাহিত পুরুষকে বোঝানোর জন্যেই ব্যবহৃত হবে। যৌক্তিক সত্যের একটি উদাহরণ দেয়া যাক: ‘ক হয় খ অথবা ক নয় খ’। এ উক্তিটি অনিবার্যভাবে সত্য; কিন্তু এটি যে সত্য, তা কোনো শাশ্বত সত্তা বা ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত সে কারণে নয়, বরং ‘অথবা’, ‘বা’, ‘নয়’, প্রভৃতি শব্দগুলোর প্রচলিত রীতি ও বাক্য গঠনে শব্দের সমন্বয়ের নিয়মের জন্য। কেউ যদি ‘অথবা ক হয় খ বাক নয় খ’ এ সত্যটি অস্বীকার করে, তাকে শাশ্বত ধারণা বা সত্তা বোঝার জন্য তার দৃষ্টিশক্তির অভাব আছে বলে অভিযুক্ত করা যাবে না, বরং সে ভাষা ভুল ব্যবহার করার দোষেই অভিযুক্ত হবে।

শাশ্বত ও অনিবার্য সত্যের সপক্ষে বুদ্ধিবাদীদের আরো একটি যুক্তি হলো এই যে, শব্দসমূহের অর্থ যেখানে একক ও অপরিবর্তনীয়, সেখানে ইন্দ্রিয়জ কর্তৃক প্রত্যক্ষিত বস্তুগুলো বহু পরিবর্তনীয়। শব্দসমূহের বস্তুগুলোকে নির্দেশ করে এবং শাশ্বত ও অনিবার্য সত্যকে বোঝায়। এ যুক্তির বিরুদ্ধে অভিজ্ঞতাবাদীরা যুক্তি দেখান যে, শব্দের অর্থ অনিবার্যভাবে এককও নয়, অপরিবর্তনীয়ও নয়। শব্দগুলো প্রায়ই দুর্বোধ্য এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন অথবা ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, ‘সাহস’ শব্দটি বর্তমান ধারণা গ্রিক ধারণা থেকে খুবই আলাদা। এমনকি ‘বিশুদ্ধ জল’ বলতে এক কালে বোঝানো হতো ‘পরিষ্কার’ বা ‘অঘোলাটে’ জলকে। কিন্তু কালের পরিবর্তনে ‘বিশুদ্ধ জল’ বলতে এখন বোঝানো হয় মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকারক বীজাণু-মুক্ত জলকে। এবং একারণে বীজাণু-মুক্ত হলে ঘোলাটে জলকেও বিশুদ্ধ জল বলা যায়। প্রতিটি শব্দের একটি মাত্র স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় অর্থ আছে-এ ধরনের দৃঢ় বিশ্বাস যদি প্লেটোর না থাকতো, তাহলে তিনি হয়তো উপলব্ধি করতেন যে, ‘অর্থ’ শব্দটি স্বয়ং দুর্বোধ্য এবং একবার যদি এ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট হয়, তাহলে শব্দসমূহ যে শাশ্বত সত্যকে বোঝায় তা ধারণার করার কোনো যুক্তিই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

ইন্দ্রিয় জ্ঞানের মূল্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। ‘জ্ঞান শক্তি’ ইন্দ্রিয় জ্ঞানের মূল্য সম্পর্কে বেকনের উক্তিটিই মনে হয় সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ও সুবিদিত। এখানে ‘শক্তি’ বলতে প্রধানত প্রকৃতির মধ্যে পরিবর্তন সাধন করার শক্তিকেই বোঝানো হয়েছে। তবে এ উক্তিটির দু’রকমের ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। একটি হচ্ছে সাধারণ বা রক্ষণশীল এবং অন্যটি হলো উদারপন্থী। (Robert G. Alson. An Introduction of Existentialism. New York, 1962 পৃ. ৮৫) সাধারণ মানুষের জন্য ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান মূল্যবান এ কারণে যে, এর মাধ্যমে এমন কতকগুলো জিনিস লাভ করা যায়, যা তাদের জীবেন আনে অনেক সুখ ও সম্মান। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, অনেক প্রধান প্রধান অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক খুব সাধারণ মানুষই ছিলেন। আজকের ইংল্যান্ড ও আমেরিকার অনেক দার্শনিক বিশ্লেষণী (analytic) দর্শনকে বেছে নিয়েছেন যারা মনে করেন যে, দর্শনচর্চা একটি নির্দোষ আমোদ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্লেষণী দার্শনিকরা তাদের পূর্ববর্তী যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মত গ্রহণ করে বলেন যে, মূল্য সম্পর্কীয় উক্তিগুলো হয় অর্থহীন অথবা বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে ছন্দমূলক দাবি। মূল্য সম্পর্কে এমনকি, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের মূল্য সম্পর্কেও তারা সাধারণ কোনো মত গ্রহণ করতে রাজি নন। তবে তাদের দর্শনচর্চা দেখে তাদেরকে সাধারণ মানুষের দলে দলভুক্ত করা যায়-যে দল অনুযায়ী জ্ঞান যতটুকু ব্যক্তিগত সুখ ও নিশ্চয়তা দেয় ঠিক ততটুকু অর্থে মূল্যবান।

বেকনের উক্তিটির ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় ভলটেয়ার, রুশো প্রভৃতি অষ্টাদশ শতাব্দীর সংস্কৃতিমনা দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উনবিংশ শতাব্দীর উপযোগবাদী (Utilitarian) উদারপন্থী এবং জন ডিউই প্রভৃতি বিংশ শতাব্দীর প্রয়োগবাদীদের কাছ থেকে। এরাও ইন্দ্রিয়-জ্ঞানকে মূল্যবান মনে করেন, কেননা ইন্দ্রিয়-জ্ঞান হলো প্রকৃতিকে ধীরে ধীরে আয়ত্ত করার এবং সমাজকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পুনর্গঠন করার একটা উপায়। এদের মতে জ্ঞান মানেই হলো মানুষের প্রগতি, শুধু ব্যক্তিগত মঙ্গল নয়। রক্ষণশীল ও উদারপন্থী উভয় দলই অবশ্য মনে করেন যে, মানুষের প্রকৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠাসমূহের বোঝার জন্য অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। উভয় দলের মধ্যে আরও একটি মিল এই যে, তাদের মতে সুখ সন্তোষই হলো মানুষের প্রচেষ্টার চরম লক্ষ্য। দু’দলের মধ্যে বড় পার্থক্য হলো এই যে, মানুষের প্রকৃতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক-এটা রক্ষণশীল দল হয় বিশ্বাস করে না বা এ ব্যাপারে মনোযোগী নয়; কিন্তু উদারপন্থীরা এটা শুধু যে বিশ্বাস করেন তা নয়, এ সম্পর্কে তারা মনোযোগীও। এদের মধ্যে আরো একটা পার্থক্য হলো রক্ষণশীলরা যুক্তি দেখান যে, মূল্য সম্পর্কীয় অবধারণগুলো প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কীয় বচনও নয়, গণিত ও যুক্তিবিদ্যার অভিজ্ঞতাপূর্ণ বচনও নয়; বরং তারা এগুলোকে এক ধরনের অভিজ্ঞতামূলক বচন বলতে চান, যাদের সত্য-মিথ্যা সম্ভবত আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞান যাচাই করতে পারে।

বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদীদের মতামত আলোচনার পর এখন অস্তিত্ববাদী মত বিচার করে দেখা যেতে পারে। আমরা কি কি জানি এ প্রশ্নের উত্তরে অস্তিত্ববাদীরা বলেন যে, আমরা মানুষের অবস্থাকে জানি। কিভাবে তা জানি এর উত্তরে তারা বলেন: স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টি (intuitive insight) যা আত্মগত অভিজ্ঞতা যেমন, মনস্তাপ, উদ্বেগ, গভীর অনুভূতি প্রভৃতি থেকে আসে, তার মাধ্যমে। এ ধরনের জ্ঞানের মূল্য সম্পর্কে তারা বলেন যে, মানুষের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অস্তিত্ববাদী মূল্য একমাত্র যে মূল্য মানুষ লাভ করতে পারে-বোঝার জন্য অত্যাবশ্যক। প্রথম প্রশ্নটি সম্পর্কে অস্তিত্ববাদীদের উত্তর বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বুদ্ধিবাদীদের মতে যা শাশ্বত ও সার্বিক তাছাড়া মানুষ আর কিছুই জানতে পারে না। অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনাও মানুষের তৈরি অভিজ্ঞতাপূর্ব সত্য ছাড়া আমরা আর কিছুই জানি না। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা বলেন না যে, মানুষের অবস্থা ছাড়া আমরা আর কিছুই জানতে পারি না। তাদের মত হলো, মানুষের অবস্থা ছাড়া আমরা অন্য জিনিস সম্পর্কেও জানতে পারি, কিন্তু সে জানার কোনো মূল্য নেই।

অস্তিত্ববাদীরা প্রায়ই জ্ঞানের বস্তুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন এবং অস্বীকার করেন যে, বস্তুর যদি অস্তিত্ব থেকেও থাকে, তা আমরা জানতে পারি না। তাদের প্রধান যুক্তি হলো, বস্তুর যদি অস্তিত্ব থাকে এবং তা যদি জানাও যায়, তবুও বস্তু সম্পর্কে এ ধরনের জ্ঞানের মানুষের জন্য কোনো প্রয়োজন বা গুরুত্ব নেই। উদাহরণস্বরূপ, সার্ত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন; যদি বিশ্বাসী হতেন খ্রিস্টান অস্তিত্ববাদীদের মতোই সম্ভবত বলতেন যে, ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের প্রকৃত কোনো জ্ঞান নেই। সার্ত যুক্তি দেখান যে, ঈশ্বর যদি অস্তিত্বশীল হয় এবং তাকে যদি আমরা জানতেও পারি, এতে কোনো কিছুরই পরির্বতন হয় না। যেহেতু মানুষ স্বাধীন, সেহেতু তাকে নিজেকেই তার মূল্য নির্বাচন করতে হবে এবং সে নির্বাচনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। ঈশ্বরের উপর সে দায়িত্ব চাপানো যায় না। (Existentialism and Humanism, পৃ. ৫৬)

ঠিক একইভাবে অস্তিত্ববাদীরা বিমূর্ত ধারণা সম্পর্কে কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেননি এবং তাদের মধ্যে কেউই প্লেটোর ধারণা বা এরিস্টটলের সত্তাগুলোকে ভাষা সম্পর্কীয় রীতিতে পরিণত করার অভিজ্ঞতাবাদীদের প্রচেষ্টা স্বাগত জানাননি। অস্তিত্ববাদীদের প্রধান যুক্তি হলো, বিমূর্ত ধারণার অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক তাতে ব্যক্তি-মানুষের-যাকে মূর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় কিছু আসে যায় না।

অস্তিত্ববাদীরা এ বিষয়েও একমত যে, প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞানের কোনো মানবিক মূল্য নেই। টেলিভিশন ও যানবাহন মানুষকে সুখী করেনি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান অবদান হলো, বার্ধক্যকে টিকিয়ে রাখা। সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশসমূহ পার্থিব সম্পদে এত অধিক উন্নত এবং গড়পড়তায় এসব দেশের অধিবাসীরা দীর্ঘায়ু হওয়া সত্ত্বেও, এদেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আত্মহত্যা, মানসিক অসুস্থতা, মানুষের উপর সুরাসারের প্রতিক্রিয়া ও মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্তি।

অস্তিত্ববাদীদের মতে তাহলে মানুষের জ্ঞানের বিষয় হলো মানুষের অবস্থা, ঈশ্বরও নয়, বিমূর্ত ধারণাও নয়, প্রকৃতির নিয়মও নয়। মানুষের অবস্থার জ্ঞান বলতে তারা মানুষের ইতিহাস, মানুষের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ বা মানুষের আচরণের সেই প্রচলিত নিয়মের জ্ঞানকে বোঝান না। মানুষের অবস্থার জ্ঞান বলতে তারা বোঝাতে চান মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে কতকগুলো বিশেষ দিক যেগুলো সর্বকালে সমভাবেই থাকে, যেমন মানুষের সম্ভাব্যতা, বিশেষত্ব, স্বাধীনতা, মানুষের প্রধান প্রধান আকাঙ্ক্ষা এবং যে কতকগুলো প্রধান উপায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের এ জগতের সঙ্গে ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, সে সম্পর্কে জ্ঞান।

যা মূল্যবান তা আমরা কিভাবে জানি-সেদিক দিয়ে অস্তিত্ববাদীদেরকে অভিজ্ঞতাবাদীদের চেয়ে বুদ্ধিবাদীদের বেশি কাছাকাছি মনে হয়। তবে বুদ্ধিবাদী ও অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে দুটো প্রধান পার্থক্য আছে। প্রথমত প্রায় সব বুদ্ধিবাদীদের মতে স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধিরই কাজ; ভাবাবেগ প্রভৃতি বুদ্ধিকে দুর্বোধ্য করে। অন্যদিকে, অস্তিত্ববাদীরা হয় অস্বীকার করেন যে, বুদ্ধি ও ভাবাবেগের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো পার্থক্য আছে অথবা তারা দাবি করেন যে, ভাবাবেগ হলো বুদ্ধির সফল পরিচালনার শর্ত। তাদের মতে মানুষের অবস্থা মনস্তাপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী প্রায় সব দার্শনিকেরাই মনে করেন, জ্ঞান হলো বাহ্যিক কোনো বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্থাৎ, যা জানা যায় তার জ্ঞাতার বহির্ভূত। কিন্তু বিপরীতভাবে অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন যে, স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টি বা মনস্তাপের মাধ্যমে মানুষ যা জানে তা হলো তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কতকগুলো অবস্থা যে অবস্থার মধ্যে সে নিজে গভীরভাবে জড়িত। অন্যকথায়, অস্তিত্ববাদীদের মতে ব্যক্তি যা জানে তা বাহ্যিক কোনো বস্তু নয়, সে আসলে নিজেকেই জানে, অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। এবং এক অর্থে মনস্তাপের মাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়, তা সে পূর্ব থেকেই জানে। যেমন, মানুষ যা পূর্ব থেকে জানে এবং যা মনস্তাপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তা হলো তার স্বাধীনতা। মানুষ যে স্বাধীন তা অস্তিত্ববাদীদের কোনো তাত্ত্বিক যুক্তি বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের দ্বারা প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না। স্বাধীনতা হলো মানুষের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষভাবে ও তাৎক্ষণিকভাবে স্বজ্ঞাত একটি অতি বাস্তব ঘটনা এবং যে তা স্বজ্ঞা দিয়ে জানে না, তাকে কোনো যুক্তির মাধ্যমে তা বোঝানো বা গ্রহণ করানো যাবে না। অস্তিত্ববাদীরা দাবি করেন যে, মানুষ স্বাধীন এবং সে তার স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হয় মনস্তাপের মাধ্যমে।

তিনটি প্রধান প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে বুদ্ধিবাদী, অভিজ্ঞতাবাদী ও অস্তিত্ববাদীদের মতামত আলোচনার পর তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারা কি অবৌদ্ধিক না বৌদ্ধিক? এর পূর্ববর্তী বিভাগে বলা হয়েছে যে, ‘বুদ্ধি’ বলতে যদি কান্টের ব্যবহারিক বুদ্ধিকে বোঝানো হয়, তাহলে অস্তিত্ববাদকে সম্পূর্ণভাবে অবৌদ্ধিক বলা যায় না; কিন্তু একটি বিশেষ অর্থে অস্তিত্ববাদকে অবৌদ্ধিক বলা যায় যদি ‘বুদ্ধি’ বলতে বোঝায় যা বস্তুগত, যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে অস্তিত্ববাদ বৌদ্ধিক না অবৌদ্ধিক তা নির্ভর করছে ‘বুদ্ধি’ বলতে কি বোঝায় তার উপর। আসলে ‘সুখ’ শব্দটির যেমন বিভিন্ন অর্থ আছে, ‘বুদ্ধি’ শব্দটিরও তেমনি অনেক অর্থ রয়েছে। ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে একজন বুদ্ধিবাদী হলেন তিনি, যিনি মনে করেন যে, কোনো একটা পদ্ধতির মাধ্যমে মানবিকভাবে যেসব জিনিসকে জানা বাঞ্ছনীয়, তা জানা যায়। এ অর্থে একজন অস্তিত্ববাদীও হয়তো বুদ্ধিবাদী বলে দাবি করতে পারেন, কেননা তিনিও একটা পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের অবস্থাকে জানা যায় বলে মনে করেন। তবে প্রশ্ন হলো সে পদ্ধতিটি গ্রহণযোগ্য কি না। পদ্ধতি বলতে যদি বস্তুগত, বিজ্ঞানসম্মত বা যৌক্তিক পদ্ধতিকে বোঝায় অথবা প্লেটো, ডেকার্ট, হেগেল প্রভৃতি বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন একমাত্র তা অবলম্বন করলেই যদি কোনো দর্শনকে বৌদ্ধিক বলা যায়, তাহলে অস্তিত্ববাদীরা বুদ্ধিবাদী নন। অস্তিত্ববাদীরা বস্তুগত পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন আত্মগত পদ্ধতি।

কিন্তু বৌদ্ধিক হবার অর্থ যদি যুক্তি প্রদান বোঝায় তাহলে অভিজ্ঞতাবাদীরা যেমন বুদ্ধিবাদী, ঠিক তেমনি অস্তিত্ববাদীদেরকেও বুদ্ধিবাদী বলা যায়, কেননা তাদের মতামতের সপক্ষে তারাও যুক্তি দিয়েছেন, সে-যুক্তি গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক।

বৌদ্ধিকতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, লজিক বা যুক্তিবিদ্যার প্রাথমিক নিয়মগুলোকে গ্রহণ করা বা মেনে চলা। এ অর্থে অস্তিত্ববাদীদেরকে অনেকেই অবৌদ্ধিক বলে মনে করেন, কেননা তারা যুক্তিবিদ্যার নিয়মগুলোকে অবজ্ঞা করেন। এখানে অস্তিত্ববাদীদের প্রকৃত অবস্থা একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখা উচিত। পূর্বেই বলা হয়েছে, অস্তিত্ববাদীরা আসলে বিজ্ঞানবিরোধী বা লজিকের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল নন। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াসপের্স যখন বলেন, যে প্রত্যেক লোককে ভালোবাসে, সে কাউকেই ভালোবাসে না, অথবা সার্ত যখন মন্তব্য করেন, মানুষের স্বভাবই হলো, সে যা তা সে নয়-আসলে তাদের কেউই লজিকের বৈপরীত্য নিয়মকে (law of contradiction) অস্বীকার করেছেন বলে মনে হয় না। তারা তাদের মতগুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একটু অলংকারের মাধ্যমে প্রকাশ করার প্রয়াস পেয়েছেন মাত্র।

এমনকি যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী সেই খ্রিস্টান অস্তিত্ববাদী, বিশেষ করে কিয়ের্কেগোরের দর্শন আলোচনা করলে দেখা যায় লজিকের প্রতি অস্তিত্ববাদীদের কতটুকু শ্রদ্ধা ছিল। কিয়ের্কেগোর খ্রিস্টান ধর্মকে লজিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার পর ঘোষণা করেছেন যে, খ্রিস্টান ধর্ম হলো একটি অতীব বিমূর্ত ধর্ম। তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন যে, খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদ, যেমন সৃষ্টি সম্পর্কীয় মতবাদ, মানুষ-ঈশ্বর মতবাদ, ত্রি-ঈশ্বরের ধারণা প্রভৃতি বুদ্ধির সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, ঈশ্বর একজন সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন। যিনি সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক মানবীয়, যিনি একই সঙ্গে এক এবং তিন ব্যক্তি হতে পারেন। কিন্তু তবুও যৌক্তিকভাবে অসম্ভব এ ঈশ্বরের ধারণার উপরই খ্রিস্টান ধর্ম ন্যস্ত। কিয়ের্কেগোর ধর্মীয় সত্য বলতে বুঝেছেন, যা বস্তুগত বা যৌক্তিকভাবে সত্য তাকে নয়; আত্মগতভাবে যা সত্য তাকেই। এবং ধর্মীয় বিশ্বাস হলো ব্যক্তিগত অসীম গভীরানুভূতির ও বস্তুগত অনিশ্চয়তার মধ্যে বিরোধ। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, কিয়ের্কেগোর খ্রিস্টান ধর্মকে যৌক্তিকভাবে সমর্থন করার চেষ্টা করেননি, বরং যুক্তির আলোকে বিচার করলে খ্রিস্টান ধর্ম যে সম্পূর্ণভাবে অবাস্তব, অসত্য এবং অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়, তা দেখিয়ে তিনি লজিকের ক্ষেত্রে একটা বিরাট অবদান রেখে গেছেন।

অস্তিত্ববাদ, ভাববাদ ও প্রয়োগবাদ

যেহেতু অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, যেহেতু তারা ‘অস্তিত্ব’ শব্দটিকে একটা বিশেষ বা সীমিত অর্থে ব্যবহার করেছেন যা শুধু মানুষের বেলায় প্রযোজ্য, সেহেতু এটা মনে হতে পারে যে, অস্তিত্ববাদীরা শুধু ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বই স্বীকার করেন বা তাদের মতে মানুষের অস্তিত্বই শুধু বাস্তব। এ ধারণা ঠিক নয়। তবে একথা ঠিক যে, তারা যে অর্থে ‘অস্তিত্ব’ শব্দটিকে ব্যবহার করেন সে অর্থে শুধু মানুষেরই অস্তিত্ব আছে। এখানে হাইডেগেরের মত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাইডেগের বলেছেন যে, মানুষই একমাত্র অস্তিত্বশীল। একটি পাথর বাস্তব, কিন্তু অস্তিত্বশীল নয়। একটি গাছ বাস্তব, কিন্তু অস্তিত্বশীল নয়। একটি ঘোড়া বাস্তব, কিন্তু অস্তিত্বশীল নয়। ‘মানুষই একমাত্র অস্তিত্বশীল’ একথা বলার অর্থ এ নয় যে মানুষই একমাত্র সত্যিকার অর্থে বাস্তব, আর অন্য সব জিনিস অবাস্তব, ভ্রম বা মানুষেরই ধারণা। (John Macquarrie Existentialism, Penguin Books, 1987 পৃ. ২৯) মানুষেরই একমাত্র অস্তিত্ব আছে-একথার দ্বারা অস্তিত্ববাদীরা কিন্তু কখনো আত্মগত ভাববাদের (Subjective idealism) সমর্থন করছেন না; তারা শুধু ‘অস্তিত্ব” শব্দটিকে সাধারণ বা প্রচলিত অর্থে ব্যবহার না করে একটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন।

অস্তিত্ববাদ ও ভাববাদ যেভাবে বিষয়ের (object) চেয়ে বিষয়ী বা আত্ম-সত্তার (Subject) উপর গুরুত্ব দেয়, তাতে উভয় দর্শনের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে একটা মিল দেখা যায়। এ মিল কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ভাববাদীরা যে আত্ম-সত্তা নিয়ে শুরু করেন বা আলোচনা করেন তা হলো একটা চিন্তাশীল সত্তা; অন্যদিকে অস্তিত্ববাদীদের আত্ম-সত্তা হলো জগতে-অস্তিত্বমান একটি সামগ্রিক ব্যক্তি-সত্তা (individual subject)। ভাববাদীরা চিন্তা (thought), ধারণা (ideas) উপর জোর দেন। এবং বলতে গেলে এ দিয়েই তারা শুরু করেন। আধ্যাত্মিকতাই তাই তাদের দর্শনের ভিত্তি। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে মেনে নিয়েই শুরু করেন এবং শুরু করেন আত্ম-সত্তাকে নিয়ে যা প্রধানত অস্তিত্বশীল, চিন্তাশীল নয়। অস্তিত্ববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ডেকার্ট বা বার্কলের মতের ঠিক বিপরীত। তারা অস্তিত্বকে চিন্তার উপর নির্ভরশীল বা মানুষের ধারণা বলে চিহ্নিত করেননি কখনো। মানুষ প্রথমে অস্তিত্বশীল হয় এবং একমাত্র তারপরই সে চিন্তাশীল হতে পারে। বস্তু মনের ধারণা নয় কখনো। বার্কলেকে সমালোচনা করতে গিয়ে সার্ত বলেন, একটি টেবিল চেতনার (consciousness) মধ্যে নিহিত নয় এমনকি চেতনার প্রতিফলন হিসেবেও নয়। একটি টেবিলের অবস্থান হলো দেশের (space) মধ্যে…। দার্শনিক প্রতিক্রিয়ার কাজ হওয়া উচিত বস্তুকে চেতনা থেকে পার্থক্য করা। জগতের সঙ্গে চেতনার প্রকৃত সম্পর্ককে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং চেতনা যে সব সময় জগৎ সম্পর্কে চেতনা সে বিষয়ে জ্ঞাত হওয়া। (Ibid, পৃ. ৩০) অর্থাৎ সার্ত বলতে চান যে, চেতনা হলো নির্দেশক-চেতনা-বহির্ভূত জগতের কোনো না কোনো বস্তুকে বোঝানো বা নির্দেশ করা। চেতনা মানেই তাই অচেতন কোনো বস্তু সম্পর্কে চেতনা।

আত্মগত ভাববাদীরা মন বা আত্মার (self) বাইরে কোনোকিছুর অস্তিত্বকে স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে বাহ্যবস্তু মনেরই ধারণা মাত্র। বস্তুগত ভাববাদীরা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন বটে, কিন্তু এরও প্রকৃত বাস্তবতা নেই। জগতের সব বস্তু সত্তার (reality) অবভাস (appearance) মাত্র। যেমন প্লেটো, কান্ট, হেগেল প্রভৃতি দার্শনিকরা মনে করেন এ দৃশ্যমান জগতের সবই প্রত্যয়ের (forms), অতীন্দ্রিয় সত্তার (noumenon), পরম সত্তার (absolute) আভাস বা অবভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অস্তিত্ববাদীরা কিন্তু শুধু ব্যক্তি মানুষের নয়, জগতের বাস্তবতাকেও তারা স্বীকার করেন। কাজেই একজনের অস্তিত্বশীল হওয়ার অর্থই হলো জগতের সঙ্গে বা জগতের কোনো বস্তু, অবস্থান বা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া। ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বকে বোঝাতে গিয়ে অস্তিত্ববাদীরা তাই জগতের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ মানুষের সম্পর্কের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জগৎ আছে বলেই আমাদের পক্ষে চেতনাময় হওয়া সম্ভব; কেননা চেতনা হলো জগতের কোনো না কোনো বস্তু সম্পর্কে চেতনা। সার্তের মতে তাই পুর-সোঁয়া বা চেতনার ভিত্তিই হলো আঁ-সোঁয়া বা অচেতন। ইয়াসপের্সও মনে করেন যে, জগতের বিশেষ বস্তুসমূহের প্রকাশ ঘটে চেতনার মাধ্যমে, উদ্দেশ্য-বিধেয় ধারণার মধ্য দিয়ে। হাইডেগের মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জগতের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলেছেন। জগৎ না থাকলে যেমন আমার পক্ষে অস্তিত্বশীল হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি আমার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া ছাড়া জগৎ অর্থবহ নয়।

সাম্প্রতিককালে অস্তিত্ববাদ ছাড়া যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ (Logical Positivism), বিশ্লেষণী দর্শন (Analytic philosophy), প্রয়োগবাদ (Pragmatism), মার্কসবাদ (Marxism) প্রভৃতি আরও যে কয়েকটি দার্শনিক আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে, তার সবগুলোর সঙ্গেই অস্তিত্ববাদের অল্প-বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, অস্তিত্ববাদের মতোই এ দর্শনসমূহের উৎপত্তি হয়েছে হেগেলের বস্তুগত ভাববাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, হেগেলের দর্শনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। এ দর্শনসমূহের উপর হেগেলের প্রভাব প্রবাহিত হয়েছিল দুটো ধারায় প্রথমটি ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এবং দ্বিতীয়টি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটেন ও আমেরিকায়। প্রথম ধারাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মার্কস ও কিয়ের্কেগোর যারা হেগেলের ঐতিহাসিক, নৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক দর্শনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। হেগেলের ইতিহাস চেতনা, দ্বান্দিক ধারণা প্রভৃতির দ্বারা মার্কস এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি হেগেলের ধারণাকে সংশোধন করে ভাববাদী ব্যাখ্যার পরিবর্তে বস্তুবাদী ব্যাখ্যারই প্রয়াস পেয়েছেন। কিয়ের্কেগোরের উপর হেগেলের প্রভাব নেতিবাচক, ইতিবাচক নয়। হেগেলের ভাববাদী চিন্তাধারায় ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব কিভাবে অবহেলিত হয়েছে এবং বিমূর্ত এক সত্তাকে জানার জন্য যে বস্তুগত পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে তা দিয়ে যে অস্তিত্বকে জানা বা ব্যাখ্যা করা যায় না, তা উল্লেখ করে কিয়ের্কেগোর হেগেলেকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।

মার্কসের লক্ষ্য হলো মানুষের সমষ্টিতে, আর অস্তিত্ববাদীদের প্রধান দৃষ্টি ব্যক্তি মানুষে। মার্কসের কাছে ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বড়, মানুষ হলো সে যে রকম সমাজে বাস করে ঠিক সে সমাজেরই সৃষ্টি। অস্তিত্ববাদীদের অভিযোগ, এ ধরনের সমাজে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। কিয়ের্কেগোর, নীটশে, হাইডেগের, সার্ত প্রমুখ সবাই এ বিষয়ে একমত যে মানুষের সমষ্টিগত জীবন মানুষের প্রকৃত বা যথার্থ অস্তিত্ব নয়। নিজের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন না হয়ে শুধু সমাজের একজন হিসেবে সবাই যেভাবে চলে, খায় বা করে, ঠিক সেভাবে জনতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলা জীবনযাপন করাকে অস্তিত্ব বলতে চান না অস্তিত্ববাদীরা।

অস্তিত্ববাদীদের মতে একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার যা হওয়া উচিত তা না হয়ে যদি সমাজের অন্যান্য সবারই মতো নিজেকে পরিচালিত করে, তাহলে সে আসলে নিজেকে নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। মার্কসও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার (alienation) কথা বলেছেন। তবে তার ধারণাটির সঙ্গে অস্তিত্ববাদী ধারণার বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য একটা সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় এ অর্থে যে, মার্কসীয় পুঁজিবাদী সমাজের শ্রমিক এবং অস্তিত্ববাদের ব্যক্তিমানুষ উভয়ই যা হওয়া উচিত তা না হতে পারার কারণে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। কিন্তু মার্কস এ দোষটি দেখেছেন শুধু পুঁজিবাদে। পুঁজিবাদে সমাজের শুধু মুষ্টিমেয় লোকের হাতে থাকে সব সম্পত্তির মালিকানা এক বিরাট জনগোষ্ঠী তা থেকে থাকে বঞ্চিত। শ্রমিক জীবিকার জন্য তার উপর চাপানো শ্রম করতে বাধ্য হয়; কিন্তু তার সেই কর্ম-সম্পাদনে সে আর নিজের থাকে না, হয়ে যায় অন্যের অর্থাৎ মালিকের, এমনকি সে যে পণ্য উৎপাদন করে তা থেকেও সে থাকে বিচ্ছিন্ন, কারণ এতে তার কোনো অধিকার নেই। পুঁজিবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারণেই তাহলে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন থাকে নিজের থেকে, সমাজ ও প্রকৃতি থেকে। এ বিচ্ছিন্নতা থেকে সে মুক্তি পেতে পারে একমাত্র মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়। এখানেই অস্তিত্ববাদের সঙ্গে মার্কসবাদের বড় পার্থক্য। অস্তিত্ববাদীদের মতে শুধু পুঁজিবাদে নয়, যে কোনো সমাজ ব্যবস্থাতেই মানুষ বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার যা হওয়া উচিত তা হতে পারছে বা হবার চেষ্টা করছে। পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মার্কসের চিন্তাধারা অস্তিত্ববাদীদের উপর বিশেষত সার্তের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। মার্কসের সঙ্গে একমত না হলেও সার্ত ব্যক্তিগতভাবে মার্কসবাদকে পছন্দ করতেন। তার মতে মার্কসবাদ হলো একটি দর্শন, আর অস্তিত্ববাদ হলো একটি আদর্শ। মার্কসের কাছে সমাজতান্ত্রিক সমাজই আদর্শ সমাজ, আর সার্ত তার আদর্শ সমাজ খুঁজে পেয়েছেন মার্কসবাদ ও অস্তিত্ববাদ সমন্বয়ের মধ্যে।

ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় রাসেল (Russell), ম্যুর (Moore), ডিউঈ (Dewey), প্রমুখ যারা হেগেলের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, তারা কিন্তু হেগেলের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন নব্য-ভাববাদী ব্রিটিশ দার্শনিক ব্রাডলী (Bradley), ম্যাকট্যাগার্ট (Mctaggart) ও আমেরিকান রয়েস (Royce) এর লেখার মাধ্যমে। রাসেল ও ম্যুর উভয়ই একসময় ব্রাডলী ও ম্যাকট্যাগার্টের প্রভাবে দৃঢ়ভাবে হেগেলপন্থী ছিলেন, কিন্তু পরে হয়ে ওঠেন হেগেল বিরোধী। তারা ভাববাদী যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে হেগেলের মতবাদ, পদ্ধতি ও রচনাশৈলীকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিংশ শতকে নতুনভাবে বিকশিত বাস্তববাদ (Realism) নামে এ্যাংলো-আমেরিকান দার্শনিক আন্দোলনের প্রধান সমর্থক হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা বাস্তববাদ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিশ্লেষণের দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন। এদিক থেকে তারা ভিটগেনস্টেইন (Wittgenstein)কারনাপের (Carmap) সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ম্যুর ও রাসেল হলেন সাম্প্রতিক ‘যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদ (Logical empiricism)’, ‘বৈজ্ঞানিক দর্শন’ (Scientific philosophy), ‘অক্সফোর্ড বিশ্লেষণ’ (Oxford analysis), ‘কেমব্রিজ বিশ্লেষণ’ (Cambridge analysis): ‘ভাষা দর্শন’ (Language philosophy) প্রভৃতির নামে বলে পরিচিত বিশ্লেষণী দর্শনের পূর্বসূরি।

বিশ্লেষণী দর্শন অথবা এর প্রাথমিক রূপ ভিয়েনা চক্রের যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ এমন এক ভিন্নধর্মী কাজে ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণ-দর্শনকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন যার সঙ্গে অস্তিত্ববাদের আদৌ কোনো মিল বা সম্পর্ক নেই। যদি ধরাও যায় যে, অস্তিত্ববাদীরা ‘অস্তিত্ব’, ‘স্বাধীনতা’, ‘দায়িত্ব’, ‘মনস্তাপ’ প্রভৃতি শব্দসমূহের একটা বিশ্লেষণ দিতে চেয়েছেন তাহলেও তাদের সে ব্যাখ্যা যৌক্তিক অর্থে নয় কখনো। বরং অস্তিত্ববাদীরা এসব ধারণার যে একটা মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, আস্তিক বা নাস্তিক ব্যাখ্যা দিতে চান, তাও প্রত্যক্ষবাদীদের চোখে ভাবাবেগ আপ্লুত বলে অর্থহীন হতে বাধ্য। একজন প্রত্যক্ষবাদী বা বিশ্লেষণী দার্শনিক এমন এক এলাকায় বাস করেন যার একমাত্র ক্ষমতাবান শাসক হলো বিজ্ঞান এবং যার সবকিছু নির্ধারিত হয় যৌক্তিকভাবে বা বৈজ্ঞানিকভাবে অর্থপূর্ণতার ভিত্তিতে। অথচ এ এলাকার চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে অর্থহীনতাকে নিয়ে বৃহত্তর জগৎ যেখানে বাস করেন অস্তিত্ববাদীরা এবং অন্যেরা সবাই। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, অস্তিত্ববাদীরা কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করুক-এ ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। তারা বরং চান মানুষ নিজের সম্পর্কে সচেতন হোক, নিজের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করুক, স্বাধীনভাবে নির্বাচন করুক, নিজের ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করুক এবং বিজ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বিজ্ঞানকে পরিচালিত করুক।

অস্তিত্ববাদ ও প্রয়োগবাদ বিশেষত জেমস (James) এর প্রয়োগবাদী চিন্তাধারার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অনেকে জেমসকে প্রয়োগবাদী বলার চেয়ে অস্তিত্ববাদী বলা বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। (William Barrett. Irrational Man London, 1961 পৃ. ১৬) জেমস ছিলেন একজন প্রতিভাধর, সৃজনশীল ও মৌলিক চিন্তাবিদ, যদিও অবশ্য এখন আমেরিকান প্রয়োগবাদী সমাজে তাকে খুব একটা সুনজরে দেখা হয় না। তা অবশ্য তার ভিন্নধর্মী চিন্তাধারার কারণে। তার দর্শনচর্চায় ব্যক্তিগত মনোভাবের প্রকাশ, মনোবিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যার দ্বন্দ্বে মনোবিজ্ঞানের প্রতি তার চূড়ান্ত সমর্থন এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রত্যাদেশীয় গুরুত্বের প্রতি তার যে বিশ্বাস সবই চরমপন্থী ধারণা বলে মনে করা হয়। এসব ধারণাতে অস্তিত্ববাদী সুর এমনভাবে ধ্বনিত হয়েছে যে মনে হয় জেমস যেন কিয়ের্কেগোর হয়ে কথা বলছেন।

পার্স (Perice), জেমস ও ডিউঈ তিনজনই প্রয়োগবাদের প্রবক্তা হলেও তাদের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে যেমন অভিজ্ঞতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও লক (Locke) বার্কলে (Berkeley) ও হিউমের (Hume) মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। পার্স ছিলেন যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের প্রয়োগবাদী, ডিউঈ বিজ্ঞান ও নৈতিকতার এবং জেমস ধর্মের প্রয়োগবাদী দার্শনিক। জেমস যখন দর্শনচর্চায় প্রবেশ করেন তখন ছিল বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত আধিপত্য, দর্শন ছিল কঠোর বিজ্ঞানবাদের (Scientism) দ্বারা ধীকৃত। জেমস দেখতে পেলেন দর্শনের জগৎ দুটো শাখায় বিভক্ত-একদিকে বাস্তব ঘটনার (facts) উপর প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদ যা জড়বাদী (Materialistic), ধর্মবিরোধী (irreligious), নিরাশাবাদী (pessimistic)সংশয়বাদী (Sceptical) এবং অন্যদিকে নীতির (Principles) উপর স্থাপিত বুদ্ধিবাদ যা ভাববাদী, ধর্মভাবাপন্ন, আশাবাদী (optimistic)নির্বিচারবাদী (dogmatical)। জেমস প্রথম দলটিকে বলেছেন কঠোরপন্থী (toughminded) এবং দ্বিতীয়টিকে বলেছেন কোমলপন্থী (tender-minded); কিন্তু তার কাছে উভয়ই চরমপন্থী। জেমস তার প্রয়োগবাদ এ দুই চরম মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তাই তার ভাষায় তার প্রয়োগবাদ হলো বুদ্ধিবাদের মতোই ধর্মভাবাপন্ন, কিন্তু আবার একই সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদের মতো বাস্তব ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ডারউইন (Darwin)স্পেনসার (Spencer) ইংলিশ ও আমেরিকান দার্শনিক চিন্তায় কঠোরপন্থী ধারণার সূত্রপাত করেছিলেন। তাদের বিবর্তনবাদী চিন্তাধারা শুধু যে পার্সরাইটের (wright) জীববিদ্যক (biological) দার্শনিক চিন্তাধারাকে সমর্থন ও সঞ্জীবিত করেছে তা নয়, কোমলপন্থী চিন্তা-চেতনাকেও দুর্বল করে ফেলেছিল। বিজ্ঞানের সেই চরম চাপের মুখে তাই গ্রীন (Green), কেয়ার্ড (caird), ব্রাডলী ম্যাকট্যাগার্ট প্রভৃতি ব্রিটিশ ভাববাদী দার্শনিকদের তাদের দর্শনের সমর্থনে যুক্তি দেখাতে হয়েছে যে, বিবর্তনবাদের সঙ্গে ভাববাদী চিন্তাধারার কোনো অসঙ্গতি নেই। রয়েস ও ডিউঈ আরও জোরের সাথে যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে বিবর্তনবাদের সঙ্গে ভাববাদের বিরোধ থাকাতো দূরের কথা, বরং বিবর্তনবাদের দ্বারা ভাববাদ সমর্থিত হয়েছে, কেননা বিবর্তনবাদ হলো ভাববাদীদের উদ্ভাবিত সত্যেরই বৈজ্ঞানিক নিশ্চিতকরণ।

জেমসের কাছে কঠোর বিজ্ঞানবাদ বা এর বিকল্প হিসেবে ভাববাদ কোনোটিই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি লক, বার্কলে, হিউম ও মিলের মতোই নিজেকে একজন অভিজ্ঞতাবাদী ভাবতেন, কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদের পরিণতি হিসেবে জড়বাদ ও অজ্ঞয়বাদের (agnosticism) দ্বারা তিনি খুবই বিব্রত ছিলেন। তাই তিনি এমন একটি মতবাদ দেবার চেষ্টা করেছেন যা চরম দুই মতবাদকেই সমন্বয় করতে সক্ষম। জেমসের এ প্রয়োগবাদী মতবাদই চরম অভিজ্ঞতাবাদ (Radical empiricism) নামে পরিচিত। কিয়ের্কেগোরের দর্শন সমন্বয়ধর্মী নয়, কিন্তু জেমসের মতোই তিনি ছিলেন বিজ্ঞানবাদ, জড়বাদ এবং হেগেলের ভাববাদী চিন্তাধারার কঠোর সমালোচক ও বিরোধী। জড়বাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমগ্র ইউরোপীয় সমাজ আধ্যাত্মিকভাবে শূন্য বলে কিয়ের্কেগোর অভিযোগ করেন এবং এ শূন্যতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি আদর্শ খ্রিস্টান হিসেবে জীবনযাপনের কথা বলেন। জেমসও তার প্রয়োগবাদী চিন্তাধারায় যেভাবে ধর্মের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বুদ্ধির চেয়ে ব্যক্তি অভিজ্ঞতার উপর জোর দিয়েছেন তা স্পষ্টতই অস্তিত্ববাদী বলে মনে হয়। ভাববাদপন্থী হওয়া সত্ত্বেও ডিউঈর মধ্যেও অস্তিত্ববাদী কিছু দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। ডিউঈ যখন বলেন যে, আধুনিক একজন দার্শনিককে সমগ্র ক্লাসিক্যাল চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে তখন স্বভাবতই মনে হয় তিনি অস্তিত্ববাদের পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। একজন অস্তিত্ববাদীর মতোই তিনি দর্শনের একটা নেতিবাচক দিক দেখতে পেয়েছেন যখন তিনি বলেন যে, একজন চিন্তাবিদ যখন চিন্তা করতে শুরু করেন তখনই এ স্থায়ী জগতের কোনো না কোনো অংশ এর দ্বারা বিপদগ্রস্ত বা বাধাপ্রাপ্ত হয়, কেননা মানুষ তার চিন্তাকে ব্যবহার করে এ জগৎ বা পরিবেশকে প্রতিরোধ বা সামলানোর জন্যেই। তবে ডিউঈর সঙ্গে অস্তিত্ববাদী চিন্তার যদি কিছু সাদৃশ্য থাকে তা এ পর্যন্তই। আসলে ডিউঈ একজন ভিন্ন পথের যাত্রী।

এটা মনে রাখতে হবে যে, প্রয়োগবাদ ও অস্তিত্ববাদের মধ্যে সাদৃশ্য সত্ত্বেও দু’য়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সত্য সম্পর্কে প্রয়োগবাদী মত জীববিদ্যক ও উপযোগবাদী (utilitarian) যার মধ্যে অস্তিত্ববাদের সেই অন্তর্দৃষ্টি বা অন্তর্জানের (inwordness) কোনো স্থান নেই। প্রয়োগবাদীরা আশাবাদী এবং জীবনের যে দুঃখ ও হতাশার দিকটি অস্তিত্ববাদীরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাদের লেখার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, সে সম্পর্কে তারা আদৌ সচেতন নন। প্রয়োগবাদীদের কাছে জীবনের সফলতাই আসল এবং তারা সত্যকে বিচার করেন সফলতা বা সন্তোষজনক ফলাফলের ভিত্তিতে। অস্তিত্ববাদীরা এ বিশেষ বা সীমিত অর্থে সত্যকে বিচার করেন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সত্যকে জীবনের বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করা গেলেও সত্য কিন্তু এ পৃথিবীর কোনো প্রয়োজনীয় বা উপযোগী জিনিস নয়। বরং সত্য এ পৃথিবীর ভারসাম্যতা বা শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকারক বা ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

অস্তিত্ব ও সত্তা

অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মধ্যে মিল দেখাতে গিয়ে সার্ত মন্তব্য করেছেন যে, অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা ঈশ্বরবাদীই হোন আর নিরীশ্বরবাদীই হোন, সবাই সমানভাবে বিশ্বাস করেন যে, অস্তিত্ব সত্তার অগ্রগামী। (Ibid, পৃ. ২৬) সার্তের এ মন্তব্যটি কিন্তু আস্তিক অস্তিত্ববাদী দার্শনিক বিশেষ করে কিয়ের্কেগোরের বেলায় প্রযোজ্য নয়, কারণ কিয়ের্কেগোরের মতে মানুষ যে শুধু ঈশ্বর প্রদত্ত সার্বিক সত্তার অধিকারী তা নয়, অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই সে-সত্তার বাস্তব রূপদান করা। কিয়ের্কেগোরের ধারণা মানুষ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে প্রকৃত মানুষ হবার জন্য। প্রকৃত মানুষ হওয়ার অর্থই হলো ঈশ্বরের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পর্কিত হওয়া এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া মানেই প্রকৃত খ্রিস্টান হওয়া। এক কথায়, মানুষ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে খ্রিস্টান হবার জন্য এবং খ্রিস্টান হওয়া ছাড়া মানুষের অস্তিত্বের আর কোনো অর্থ নেই। কিয়ের্কেগোরের অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল সুর হলো, কিভাবে ভালো খ্রিস্টান হওয়া যায়। এ খ্রিস্টান হওয়াটাই মানুষের সার্বিক সত্তা যা তার অস্তিত্বের অগ্রগামী, কেননা তার জন্মের সময়ই তার মনের মধ্যে ঈশ্বর এ ধারণাটি অর্পণ করেন।

তবে অস্তিত্ব সত্তার অগ্রগামী কিনা-তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সত্তা বলতে কি বোঝায় তার উপর। সত্তা বলতে যদি আমরা বুঝে থাকি মানুষের এমন এক সার্বিক স্বভাব যা কিয়ের্কেগোর, স্পিনোজা বা লাইবনিজ প্রমুখ আস্তিক দার্শনিকদের মতে প্রত্যেক মানুষের উপর তার জন্মের সময় ঈশ্বর কর্তৃক অর্পিত, তাহলে অস্তিত্ব যে সত্তার অগ্রগামী সার্তের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত, কেননা তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন। সার্তের যুক্তি হলো, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে মানুষ সত্তার অধিকারী না হয়ে পারে না, কারণ ঈশ্বর তার পরিকল্পিত ধারণা ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু তার মতে, যেহেতু ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই, সেহেতু মানুষের কোনো সার্বিক স্বভাব বা সত্তাও নেই, এবং এ কারণেই নিজের স্বভাবকে তৈরি করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব মানুষের নিজের উপর। সার্ত মনে করেন, প্রত্যেক মানুষ অদ্বিতীয়, বিশেষ, স্বতন্ত্র এবং অন্য সবারই কাছ থেকে ভিন্ন। যেহেতু পূর্ব নির্দিষ্ট এমন কিছু নেই যা তাকে অবশ্যই হতে হবে, নির্দিষ্ট এমন। কোনো নিয়ম নেই, যা তাকে মানতেই হবে বা এমন কোনো নির্দিষ্ট নমুনা নেই, যার সঙ্গে তার জীবনকে সংগতিপূর্ণ হতেই হবে, সেহেতু প্রতিটি মানুষ তার স্বাধীন চিন্তা ও নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের ধারায় জীবনযাপন করে, তার জীবনকে মূল্যবান বা মূল্যহীন মনে করে, তাৎপর্যময় বা তুচ্ছ বলে গণ্য করে। একজন স্বাধীন জীব হিসেবে মানুষ নিজের অদৃষ্টকে বেছে নেয়, জিনিসের উপর মূল্য আরোপ করে, নিজের স্বভাবকে তৈরি করে এবং নিজের নৈতিক মানদণ্ড সৃষ্টি করে। কোনো মানুষের পক্ষেই তা করা সম্ভব নয়, যদি না সে প্রথমে অস্তিত্বশীল হয়। অর্থাৎ কোনো কিছু হতে হলে বা করতে হলে নিজের স্বভাব বা নৈতিক মূল্য সৃষ্টি করতে হলে আমাদেরকে আগে অস্তিত্বশীল হতে হবে। এ কারণেই সার্ত বলতে চান যে, অস্তিত্ব সত্তার অগ্রগামী।

কিন্তু সত্তা বলতে আমরা যদি মানুষের এমন এক স্বভাবকে বুঝি যা ঈশ্বর কর্তৃক অর্পিত না হলেও প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সার্বিকভাবে বিদ্যমান, তাহলে সার্তের দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এমনকি তার ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীতেও অস্তিত্বের পক্ষে সত্তার অগ্রগামী হওয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সার্ত শুধু সেই ধরনের সত্তাকে অস্বীকার করেছেন, যা ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষের উপর তার জন্মের পূর্বে আরোপ করে থাকেন; কিন্তু যে-সার্বিক অর্থে সার্ত মানুষের স্বভাবের কথা বলেছেন ঠিক সেই অর্থে তিনি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সার্বিক সত্তাকে মেনে নিয়েছেন যে, সত্তা ঈশ্বর কর্তৃক অর্পিত নয়, কিন্তু তবুও প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সমানভাবে রয়েছে এবং যা তার অস্তিত্বের উত্তরগামী নয়, পূর্বগামী। যেমন সার্ত জোরের সঙ্গে দাবি করেছেন যে, মানুষ হওয়া অর্থই হলো স্বাধীন হওয়া বা মানুষ হওয়া মানেই হলো ঈশ্বর হবার আকাঙ্ক্ষা করা, অথবা মানুষ অপরিহার্যভাবে অবস্তু (Nothing) বা মানুষ স্বভাবতই ভালো জিনিস নির্বাচন করে। এভাবে সার্ভের দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি কমপক্ষে চারটি সার্বিক সত্তার কথা বলেছেন। এ সত্তাগুলো হলো: ১. মানুষ স্বাধীন, ২. সে অপরিহার্যভাবে অবস্তু, ৩. সে সব সময় ভালো জিনিসকে নির্বাচন করে এবং ৪. সে ঈশ্বর হবার আকাঙ্ক্ষা করে।

মানুষ সম্বন্ধে সার্তের বক্তব্য হলো, মানুষ এবং স্বাধীনতা এক জিনিস-মানুষ হওয়া আর স্বাধীন হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অন্য কথায়, মানুষ হওয়া মানেই হলো স্বাধীন হওয়া বা স্বাধীন হওয়ার অর্থই হলো মানুষ হওয়া। (Jean-paul Sartre. Being and Nothingness. Tran. Hazel E. Barnes, London. 1957. পৃ. ২৫) মানুষ জন্মের পরেই যে স্বাধীন হয় বা স্বাধীন হতে চায়, ঠিক তা নয়। জন্মের মুহূর্ত থেকেই সে অপরিহার্যভাবে স্বাধীন, স্বাধীন হতে সে বাধ্য-স্বাধীন না হয়ে সে পারে না। যে স্বাধীন নয়, সার্তের মতে, প্রকৃত অর্থে সে মানুষই নয়।

মানুষ সম্বন্ধে সার্তের আরও একটা উল্লেখযোগ্য মত হলো, মানুষ অপরিহার্যভাবে অবস্তু বা অপূর্ণ। একটি জড়-বস্তু, যেমন চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ। একটি চেয়ার কেবল চেয়ারই, এর বেশিও নয়, কমও নয় এবং চেয়ার ছাড়া অন্য কিছু হবার উপায়ও নেই, সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু একজন মানুষ বস্তুর মতো সীমাবদ্ধ নয়, তার স্বভাব সীমিত নয়, বরং সম্ভাবনাময়। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন, শুধু শিক্ষকতার মধ্যেই তার স্বভাব নিহিত নয়, কারণ শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য কিছু হবার সম্ভাবনা তার মধ্যে সব সময়ই রয়েছে। মানুষের মধ্যে তাহলে একটা বড় অভাব, অপূর্ণতা বা সম্ভাবনা রয়েছে, যা বস্তুর মধ্যে নেই। এ অভাব বা অপূর্ণতাকে মানুষ যে জন্মের পরে নির্বাচন করে তা নয়, জন্মের মুহূর্ত থেকেই এ স্বভাব তার মধ্যে থেকে যায়। মানুষ হওয়া আর অপূর্ণ হওয়ার মধ্যে তা হলো কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ স্বভাবতই অপূর্ণ অর্থাৎ অবস্তু। (Ibid, পৃ. ৫৬৬)

মানুষ অপূর্ণ বা অবস্তু বলেই পূর্ণতা লাভ করতে চায়। পূর্ণতা লাভ করতে হলে তাকে বস্তুর মতো স্বভাবের অধিকারী হতে হবে। তবে মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে চায়, কিন্তু বস্তু হতে চায় না। মানুষ হলো চেতন, বস্তু হলো অচেতন-জড়। মানুষ চায় বস্তুর মতো পরিপূর্ণ হতে, কিন্তু চেতনাকে হারিয়ে নয়। সে হতে চায় পরস্পর বিরোধী অসম্ভব একটা কিছু সে চায় চেতন-অচেতন হতে, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে সে চেতনাময় থাকবে, আবার একই সঙ্গে বস্তুর মতো অচেতনও হবে, পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু তা অসম্ভব। এ অসম্ভব চেতন অচেতনের মিলনকেই সার্ত আখ্যা দিয়েছেন ঈশ্বর। সার্তের মতে মানুষও ঈশ্বরই হতে চায়, পরিপূর্ণতা লাভ করতে চায়। মানুষ হওয়া মানেই ঈশ্বর হবার আকাঙ্ক্ষা করা। মানুষের এ আকাঙ্ক্ষা স্বভাবগত, জন্মগত।

মানুষের স্বভাব সম্পর্কে সার্ত আরও বলেছেন যে, মানুষ সব সময় মন্দকে বাদ দিয়ে ভালো জিনিস নির্বাচন করে। সার্তের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হই বা না হই, তিনি মনে করেন যে, মানুষের স্বভাবই হলো ভালোকে নির্বাচন করা এবং কোনো জিনিসই ভালো নয়, যদি না সবারই জন্যে ভালো হয়। (Existentialism and Humanism. পৃ. ২৯) সার্ত মানুষ সম্পর্কে উপরে উল্লিখিত যে চারটি সত্তা বা স্বভাবের কথা বলেছেন সেগুলো মানুষের অস্তিত্বের অগ্রগামী বলেই মনে হয়। কিয়ের্কেগোরের সঙ্গে এখানে পার্থক্য হচ্ছে শুধু এটুকু কিয়ের্কেগোর যে-সার্বিক সত্তার কথা বলেছেন তা ঈশ্বর প্রদত্ত বা ঈশ্বর কর্তৃক অর্পিত, আর সার্ত যে সত্তাগুলোর কথা বলেছেন সেগুলো ঈশ্বর প্রদত্ত নয়, কিন্তু তবুও এগুলো সার্বিক এবং মানুষের অস্তিত্বের অগ্রগামী।

এখন তাহলে দেখা যাচ্ছে নাস্তিক বা আস্তিক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হোক না কেন, আসলে অস্তিত্ব সত্তার অগ্রগামী নয়, বরং সত্তাই অস্তিত্বের অগ্রগামী। অস্তিত্ববাদীরা অস্তিত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেও আসলে সত্তাকে বাদ দিয়ে অস্তিত্বকে বোঝা সম্ভব নয়। মানুষ যখন জন্ম নেয়, তার অস্তিত্বের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো সত্তাকে বাস্তবায়িত করা এবং সত্তার বাস্তবায়ন ছাড়া আর অস্তিত্বের আর কোনো অর্থই নেই। এ কারণেই অস্তিত্ব বলতে অস্তিত্ববাদীরা কেবল সাধারণ অর্থে প্রাণে বেঁচে থাকাকেই বোঝেন না, অস্তিত্বের অর্থই হলো মানুষের সত্তাকে সার্বিক স্বভাবকে বাস্তবে রূপদান করা। অর্থাৎ মানুষকে প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকতে হলে, অস্তিত্বশীল হতে হলে তার সত্তাকে উপলব্ধি করতে হবে, কার্যে পরিণত করতে হবে।

অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা

সার্ত মানুষের যে-চারটি সত্তার কথা বলেছেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রশ্নটি অস্তিত্ববাদী দর্শনের ‘অস্তিত্ব’ ও ‘আত্মিকতা’-এ দুটো ধারণার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্ক যুক্ত। বস্তুতপক্ষে, ‘অস্তিত্ব’, ‘আত্মিকতা’ ও ‘স্বাধীনতা’-এ তিনটিই হলো অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা বললে হয়তো অযৌক্তিক হবে না যে, অস্তিত্ব হলো অস্তিত্ববাদের বিষয়বস্তু, আত্মিকতা এর পদ্ধতি এবং স্বাধীনতা এর পরিচালক। আগেই বলা হয়েছে, অস্তিত্ব অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের বাস্তব অস্তিত্বই অস্তিত্ববাদীদের প্রধান আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এ অস্তিত্বকে জানার বা বোঝার উপায় কি? আত্মিকতা। নিজ অভিজ্ঞতাই অস্তিত্বকে জানার একমাত্র উপায় এবং সব দার্শনিক চিন্তার মূল। কিন্তু এ আত্মিকতাকে নির্ধারণ বা পরিচালনা করে কে? স্বাধীনতা। স্বাধীন বলেই মানুষ নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজের জীবন ও অস্তিত্বকে বুঝতে পারে, ব্যাখ্যা করতে পারে, নির্বাচন করতে পারে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। মানুষের স্বভাবের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সে নিজেই নিজের জন্যে নির্বাচিত করতে পারে। আস্তিক বা নাস্তিক উভয় দলের অস্তিত্ববাদীরাই মানুষের স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং মানুষকে স্বাধীন বলে চিহ্নিত করেছেন।

স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায়, মানুষ কি অর্থে স্বাধীন এবং কতটুকু স্বাধীন?- স্বাধীনতা সম্পর্কে এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেয়া অস্তিত্ববাদীদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা ছাড়াও অনেক দার্শনিক মানুষের স্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে জড়িয়ে ছিলেন। এদের সঙ্গে অস্তিত্ববাদীদের একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অস্তিত্ববাদীদের কাছে স্বাধীনতার প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব সমস্যা। স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দান করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য স্বাধীনতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, অর্থাৎ মানুষকে দেখানো বা বোঝানো যে, সে স্বাধীন এবং কোনো একটা বিশেষ সময়ে সে শুধু যে নির্বাচন করতে বা কিছু করতে স্বাধীন তা নয়, কি মূল্যায়ন করবে বা কিভাবে মূল্যায়ন করবে এবং কিভাবে জীবনযাপন করবে তা নির্বাচন করতেও সে স্বাধীন। অস্তিত্ববাদীরা চান না যে, আমরা শুধু আমাদেরই স্বাধীনতার স্বরূপকেই বিচার করি বা ব্যাখ্যা করি, তারা চান স্বাধীনতাকে আমরা নিজেরাই অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি বা বাস্তবে প্রয়োগ করি।

স্পিনোজার মতো অনেক দার্শনিক মানুষের স্বাধীনতাকে, ইচ্ছার স্বাধীনতাকে মিথ্যা, মায়া বা বিভ্রম বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা দেখাতে চেয়েছেন যে, স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা সত্য, বাস্তব এবং যৌক্তিক। এদিক থেকে বিচার করলে মনে হয়, অস্তিত্ববাদীদের একটা বিশেষ প্রচারণা ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ধারণাকেই আমরা শুধু মেনে নেই বা শুধু বুদ্ধি দিয়েই আমরা স্বাধীনতাকে বুঝি এটা তারা চান না, তারা চান আবেগ দিয়ে এবং বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতাকে অর্থকে আমরা উপলব্ধি করি, স্বাধীনতার অর্থ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে অভিনিবিষ্ট হোক এবং আমরা প্রত্যেকই স্বাধীনতাকে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করি।

অস্তিত্ববাদীরা মানুষকে স্বাধীন হিসেবে চিহ্নিত করলেও স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা দান কিন্তু এক নয়। তাদের এ মতপার্থক্য বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কিয়ের্কেগোরসার্তের মধ্যে। উভয় দার্শনিকই স্বাধীনতা শব্দটিকে দুই ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। কিয়ের্কেগোরই সর্বপ্রথম ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অস্তিত্ববাদী অর্থ প্রদান করেন। কিন্তু তার ধারণা সার্তের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, কেননা তিনি এক বিশেষ ও সীমিত অর্থে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন- ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর সার্ত ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত অর্থে যা নিঃসন্দেহে অধর্মীয় বা ধর্মবিরোধী।

স্বাধীনতা সম্পর্কে কিয়ের্কেগোরের ধারণা সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় ও নিয়ন্ত্রণবাদী। স্পিনোজা মনে করেন, এ পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস যেভাবে সৃষ্ট বা প্রতিটি মানুষ ও প্রাণী যেভাবে জন্ম নিয়েছে, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে এবং জীবন ধারণ করছে- এর সবকিছুই ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব থেকে এমনভাবে নির্ধারিত বা নিয়ন্ত্রিত যে, অন্যথা হবার কোনো উপায় নেই। মানুষের স্বাধীনতা তাই মিথ্যা ও বিভ্রম মাত্র। কিয়ের্কেগোরের কাছে স্বাধীনতা বিভ্রম নয়, বরং পরম সত্য। ঈশ্বরই হচ্ছেন এ স্বাধীনতার একমাত্র উৎস। কিয়ের্কেগোরের মতে স্বাধীনতা হলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন। মানুষ যদি স্বাধীন হতে চায় এবং স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে চায়, তাহলে একটি মাত্র উপায় আছে; তা হলে সঙ্গে সঙ্গে বিনা শর্তে ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত সেই স্বাধীনতাকে ঈশ্বরের কাছ ফিরিয়ে দেয়া এবং তার সাথে নিঃস্বার্থভাবে ও সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজকে বিলিয়ে দেয়া, সমর্পণ করা। তা না হলে, স্বাধীনতার আর কোনো অর্থ হয় না-স্বাধীনতাকে আমরা হারাতে বাধ্য।

কিয়ের্কেগোরের দর্শনে ঈশ্বরের উল্লেখ ছাড়া স্বাধীনতার আর কোনো অর্থ নেই। তার মতে, মানুষ স্বাধীনভাবে নির্বাচন করে, যখন সে নিজকে নির্বাচন করে; সে নিজকে নির্বাচন করে যখন ঈশ্বরকে নির্বাচন করে; সে ঈশ্বরকে নির্বাচন করে, যখন সে খ্রিস্টান ধর্মকে নির্বাচন করে, অর্থাৎ যখন সে খ্রিস্টান হয় বা হতে চায়। একমাত্র খ্রিস্টান হওয়ার মাধ্যমেই ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ সম্ভব। স্বাধীন হওয়ার অর্থই হলো খ্রিস্টান হওয়া। এ খ্রিস্টান হওয়ার জন্যই ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষের অদৃষ্ট তাই পূর্ব থেকেই ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত। এ পৃথিবীতে মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ভালো খ্রিস্টান হওয়া এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না খ্রিস্টান হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে স্বাধীনই নয়; প্রকৃত অর্থে সে মানুষই নয়, কেননা মানুষ হওয়ার মানেই খ্রিস্টান হওয়া এবং অস্তিত্বশীল হওয়া মানেই খ্রিস্টান হিসেবে বেঁচে থাকা।

স্বাধীনতা সম্পর্কে কিয়ের্কেগোরের এ ধারণা সার্ত কিন্তু সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছেন। স্পষ্টতই স্বাধীনতা শুধু খ্রিস্টান হওয়া বা কোনো একটা বিশেষ জিনিসকে নির্বাচন করতে বাধ্য হওয়াকে বোঝায় না। এরকম বাধ্যবাধকতা থাকলে মানুষ তাহলে স্বাধীন হলো কিভাবে? স্বাধীনতা বলতে বোঝানো উচিত দুই বা ততোধিক জিনিসের মধ্যে যে কোনো একটিকে নির্বাচন করার সুযোগ। এদিক থেকে বিচার করলে স্বাধীনতা সম্পর্কে সার্তের মত অত্যন্ত ব্যাপক, উন্মুক্ত ও অসীমিত। তবে সাধারণ অর্থে স্বাধীনতা বলতে যেমন ‘যা চাওয়া তা পাওয়াকে’ বোঝায়, সার্ত কিন্তু সে অর্থে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। ব্যাপক অর্থে স্বাধীনতা বলতে তিনি বোঝেন ‘ইচ্ছা করার মনস্থ করা’। স্বাধীনতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী ও জনপ্রিয় ধারণা হলো ‘আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে পাবার ক্ষমতা’। কিন্তু সার্তের মতে স্বাধীনতার কাছে সফলতার প্রশ্নটি গুরুত্বহীন। তার স্বাধীনতার অর্থ হলো নির্বচান করার স্বাধীনতা। (Being and Nothingness. পৃ. ৪৮৩) সাধারণ অর্থে একজন লোক যা করতে চায় তা করতে যদি অসমর্থ হয়, তাহলে সে স্বাধীন নয়। একারণে একজন বন্দিকে স্বাধীন বলা যায় না, যেহেতু সে জেল থেকে বেরুতে অসমর্থ। কিন্তু সার্তের অস্তিত্ববাদী ধারণানুযায়ী একজন বন্দিও স্বাধীন এ অর্থে যে, সে যে কোনো অবস্থাতেই পলায়ন করতে বা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে এবং এর জন্যে যে কোনো একটা পন্থা অবলম্বন করতে পারে। কাজেই কেউ তার আকাঙ্ক্ষিত জিনিসকে পেলো কি না তা বড় কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো সে স্বাধীনভাবে নির্বাচন করেছে কি না। অন্য কথায়, একজন লোক কি জিনিস নির্বাচন করলো সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হলো, সে কিভাবে জিনিসটা নির্বাচন করলো, সে স্বাধীনভাবে, সচেতনার সঙ্গে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন করেছে কি না।

সার্তের মতে স্বাধীন কাজ ইচ্ছাকৃত হওয়া চাই। বাধ্যবাধকতা থাকলে কোনো কাজই স্বাধীন হতে পারে না এবং ইচ্ছাকৃত না হলে কোনো কাজের জন্যে কার্য-সম্পাদনকারীকে দায়ী করা চলে না। কোনো ব্যক্তির অসতর্কার জন্যে সিগারেটের শেষাংশটি নিক্ষেপের ফলে যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, নিঃসন্দেহে কাজটি সে ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত নয় এবং এ কারণে কাজটি স্বাধীন কাজও নয়। কিন্তু যদি সচেতনভাবে ও ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ কোথাও বোমা নিক্ষেপ করে এবং এর ফলে বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে কাজটা নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত এবং স্বাধীন কাজ। (Ibid, পৃ. ৪৩৩) এবং এর জন্য সে দায়ী থাকতে বাধ্য। অস্তিত্ববাদী দর্শনে স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বের প্রশ্নটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে স্বাধীন বলে চিহ্নিত করলেও অস্তিত্ববাদীরা কখনো চাননি সে স্বাধীনতা দায়িত্বহীন হোক; এবং দায়িত্বহীন স্বাধীনতার তারা তীব্র বিরোধিতা করেছেন। যেমন কিয়ের্কেগোর উপভৌগিক, নৈতিক ও ধর্মীয়-মানুষের অস্তিত্বের এ তিনটি স্তরের মধ্যে উপভোগের স্তরকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেছেন, কেননা এ স্তরের মানুষ এমন দায়িত্বহীন এবং স্বেচ্ছাচারী যে শুধু আনন্দ-উল্লাস ও ভোগ- বিলাসের পিছনে ছুটে বেড়ায়। সার্ত প্রত্যেক মানুষের উপর সমগ্র মানবজাতির দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। সার্তের মতে মানুষ যা করে তা সে স্বাধীভাবেই সম্পাদন করে; কিন্তু সে যে কাজই করুক না কেন, তার প্রতিটি কাজের জন্যে সে নিজেই দায়ী-এ দায়িত্ব শুধু নিজের জন্যে নয়, সমগ্র মানুষের জন্যে।

স্বাধীনতার প্রশ্নে কিয়ের্কেগোর যেখানে নিয়ন্ত্রণবাদী, সার্ত সেখানে সম্পূর্ণভাবে অনিয়ন্ত্রণবাদী। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে সার্ত এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে, মানুষ অন্য কিছু দ্বারা চালিত হন, তা তিনি মানেন না। (Ibid, পৃ. ৪৩৬) তার মতে মানুষ সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু নিজে কোনো কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। প্রতিটি স্বাধীন কর্মই যদি ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলে প্রতিটি কর্মের পিছনে শুধু একটি উদ্দেশ্যই থাকবে না, একটি অভিপ্রায়ও থাকবে। অভিপ্রায়টি কর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যা একমাত্র উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই বুঝতে হবে। একজন শ্রমিক অনাহারে মরার ভয় (অভিপ্রায়) থেকেই কম বেতন গ্রহণ করতে রাজি হতে পারে; কিন্তু এ অভিপ্রায়টি আবার অর্থপূর্ণ হয় একমাত্র তার জীবন রক্ষা করা-এ উদ্দেশ্যটির মাধ্যমে। অন্য কথায়, এখানে মৃত্যুর ভয়-এ অভিপ্রায়টি বুঝতে হবে শ্রমিক তার জীবনকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে বা তার জীবনের উপর কি অর্থারোপ করে-এর ভিত্তিতে। সার্ত জোর দিয়ে বলেন যে, মানুষ তার প্রতিটি কর্মের উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়ের উপর অর্থারোপ করে এবং মূল্য প্রদান করে। নিয়ন্ত্রণবাদীরা ভুলে যান যে, আমরাই কর্মের কারণ, উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায়কে অর্থবহ করি; আমরা শুধু যে কাজ করতে মনস্থ করি তা নয়, কর্মের কারণ, উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়কে আমরাই নির্বাচন করি, স্থির করি এবং মূল্যারোপ করে অর্থপূর্ণ করি। (Ibid, পৃ. ৪৪০)

সার্ত মনে করেন আমাদের স্বাধীনতাই সব কর্মের কারণ, উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের ভিত্তি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করেন যে, ইচ্ছা ও ভাবাবেগ আমাদের কর্মকে পরিচালিত করে-এগুলোকে তিনি আমাদের স্বাধীনতার অধীন বলে দাবি করেন। “মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন, কিন্তু আত্মার ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত” ডেকার্টের এ সত্যকে সার্ত তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। সার্ত বলেন মানুষ হয় সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত, না হয় সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন-একসঙ্গে সে দুরকম হতে পারে না; (Ibid, পৃ. ৪৪১) এবং তিনি মনে করেন মানুষ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন-শুধু যে আকাঙ্ক্ষা করতে স্বাধীন তা নয়, ভাবাবেগকে অগ্রাহ্য করতেও স্বাধীন। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি কোনো বিপদের সম্মুখীন হই, আমি হয় ভয়ে পালাতে পারি, নতুবা সমস্ত শক্তি দিয়ে বিপদের মুখোমুখি হতে পারি। প্রথম কাজটি হলো আবেগপ্রবণ, দ্বিতীয়টি ঐচ্ছিক। সার্ত বলেন যে, কোনো কাজ, ঐচ্ছিক হোক আর আবেগপ্রবণ হোক, আমাদের স্বাধীনতারই প্রকাশ মাত্র। আমরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কাজ করি বা ভাবাবেগের সঙ্গে করি, সবক্ষেত্রেই আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করি। আমরা যেমন সাহসী হই, ঠিক তেমনি ভীতও হই। এ সাহসী হওয়াটা যেমন স্বাধীন, ঠিক তেমনি ভীত হওয়াটাও স্বাধীন। প্রবল আবেগের বশবর্তী হয়ে কেউ যদি কোনো কাজ করে ফেলে, সার্ত বলবেন, আসলে সে ইচ্ছা করেই আবেগপ্রবণ হয়ে কাজটি করেছে। সার্তের মতে তাহলে আমরা যখন ভীত হই, সাহসী হই, দুঃখ পাই, কাঁদি বা হাসি, সবক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে, ইচ্ছাকৃতভাবেই আমরা সবই করি।

সার্ত শুধু যে মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণবাদকে অস্বীকার করেছেন তা নয়, আমাদের শারীরিক কোনো কারণ আমাদের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে তাও তিনি মানতে রাজি নন। উদাহরণস্বরূপ, আমোদ বা ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে আমি যদি পথের পাশে বসে পড়ি, সাধারণত আমরা সবাই মনে করবো ক্লান্তিই আমাকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু সার্তের মতে এ কাজটি আমার সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নির্বাচিত, কেননা ইচ্ছা করলে আমি অন্য রকম করতে পারতাম অর্থাৎ রাস্তার পাশে বসে না পড়ে আরও কিছুদূর হাঁটতে পারতাম, দৃঢ়তার সঙ্গে আমার ক্লান্তি বা ব্যথাকে সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে আমি রাস্তার পাশে বসে পড়লাম বিশ্রামের জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবে, কাজেই এখানে ক্লান্তি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং ক্লান্তির উপরই আমি অর্থারোপ করছি এবং অসহ্য বলে স্বীকার করে নিচ্ছি।

ঠিক একইভাবে যুক্তি দেখিয়ে সার্ত অস্বীকার করেন যে, অতীত আমাদের বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার মতে, অতীতকে আমরাই অর্থবহ করি, মূল্যায়ন করি এবং আমাদের এ ধরনের অর্থারোপ ছাড়া অতীতের আর কোন মূল্য বা অর্থ নেই। আমার বর্তমান আমার অতীত দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না, আমার বর্তমান আমার নিজের দ্বারাই স্বাধীনভাবে নির্বাচিত করা এবং একমাত্র আমার পরিকল্পিত ভবিষ্যতের মাধ্যমেই এটি বোঝা যায়। আমাদের প্রত্যেকের সামনে রয়েছে এক উন্মুক্ত ভবিষ্যৎ, আমরা সবাই সে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমার ভবিষ্যৎ আমার নিজের পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ। আমার ভবিষ্যৎকে আমি নিজেই স্বাধীনভাবে নির্বাচন করি এবং আমার সে-ভবিষ্যতের মধ্যেই রয়েছে আমার বর্তমান, একমাত্র আমার ভবিষ্যৎই আমার বর্তমানের ব্যাখ্যা দিতে পারে।

তথ্যসূত্র

  • অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা : দর্শনে ও সাহিত্যে, নীরুকুমার চাকমা, অবসর প্রকাশ, ২০২০, ঢাকা
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র লেখার মধ্যেই আছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.