প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিপূ)

Table of Contents

ভূমিকা

প্লেটো-পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দের চিন্তাধারায় সংহতির অভাব : গ্রীক দর্শনের বিশিষ্ট ইতিহাসকার স্টেইস মনে করেন যে, প্লেটোর পূর্ববর্তী গ্রীক দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে কেউই দার্শনিক চিন্তাধারার সংহতি (System) রচনা করতে সক্ষম হননি। প্লেটো পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে দার্শনিক চিন্তার প্রাচুর্যের অভাব পরিলক্ষিত হয় না, কিন্তু তাদের সেইসব দার্শনিক চিন্তা অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পর সম্পর্কবিহীন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্লেটো প্রথম ব্যক্তি যিনি এক সর্বব্যাপক দার্শনিক জ্ঞানের সংহতি রচনায় সার্থকতা লাভ করেছিলেন। দার্শনিক চিন্তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন শাখায় তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই কার্যে প্লেটো, তার পূর্ববর্তী দার্শনিক চিন্তার মধ্যে যা উল্লেখযোগ্য, তাকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। সেই কারণে প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে পিথাগোরাস, এলিয়ার দর্শন, হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস প্রমুখ মহান দার্শনিকবৃন্দের দার্শনিক চিন্তার মধ্যে যা মহত্তম তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তবে এ কারণে এরূপ সিদ্ধান্ত করা সমীচীন হবে না যে, প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দের চিন্তার মধ্যে যা কিছু ভাল তাকে গ্রহণ করেছিলেন বা পরের ভাব চুরি করে তাকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন।

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার মৌলিকতা : প্লেটোর ছিল অদ্ভুত সৃজনী ক্ষমতা, তার চিন্তা ছিল মৌলিক। অন্যান্য মহৎ চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন তা অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী চিন্তা থেকেই উদ্ভূত হয়, প্লেটোর ক্ষেত্রেও হয়ত তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না। কিন্তু অপরের দার্শনিক চিন্তাকে তিনি গ্রহণ করেছেন এই অর্থে যে, এক মহৎ চিন্তাধারার বিকাশের ক্ষেত্রে তা ছিল বীজম্বরূপ। তাঁদের ভিত্তি করেই তিনি দর্শনের বিরাট সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর প্রতিভার স্পর্শে পূর্বতন চিন্তাধারা এক মৌলিক ও নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগের সব দার্শনিকদের মধ্যে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী এবং দুজনের মধ্যে প্লেটোরই পরবর্তী যুগের উপর অধিকতর প্রভাব ছিল।” (Bertrand Russell : A History of Western Philosophy : Page 184) এর দুটি কারণ তিনি ব্যক্ত করেছেন – প্রথমত, অ্যারিস্টটল নিজেই হলেন প্লেটোর পরিণতি। দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শন ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত অ্যারিস্টটলের তুলনায় প্লেটোর দ্বারাই অধিকতরভাবে প্রভাবিত।

প্লেটোর জীবনী

নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, জগতের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে প্লেটো ছিলেন অন্যতম। প্লেটোর জন্মের সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ লক্ষ করা যায়। তবে ৪২৭ খ্রিঃ পুঃ অব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই সাধারণত ধারণা করা যায়। এথেন্স নগরের এক সভ্রান্ত এথেনীয় পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জেলারের অভিমতানুসারে এথেন্সের কর্ণধার পেরিক্লিস (Pericles)-এর পরলোকগমনের এক বছর পরে এবং এথেন্সে জর্জিয়াসের আসার ঠিক পূর্বে প্লেটো জন্মগ্রহণ করেন।

প্লেটোর পরিবারের পরিচয় : প্লেটোর পিতার নাম ছিল অ্যারিস্টন (Ariston)এবং তাঁর মাতার নাম ছিল প্যারিকটিয়ন (Perictione)। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত একটি কবিতা থেকে জানা যায় তার পিতা ছিলেন একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি। প্লেটো যখন শিশু তখনই সম্ভবত তাঁর পিতা অ্যারিস্টন মারা যান; কেননা প্লেটোর মা প্যারিকটিয়ন দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। কথিত আছে যে, প্লেটোর প্রকৃত নাম ছিল অ্যারিস্টক্লিস (Aristocles)। তাঁর প্রশস্ত বক্ষ অথবা বিস্তৃত কপােলদেশের জন্য অর্থাৎ কিনা, তাঁর উত্তম স্বাস্থ্যের জন্যই তার নাম হয় প্লেটো। অবশ্য এই ব্যাপারে সকলে একমত হতে পারেননি। প্লেটোর ছিল দুই ভাই ও এক বোন। ভাইদের নাম ছিল অ্যাডিয়াইম্যানটাস এবং গ্লৌকন। রিপাবলিক গ্রন্থে উভয়ের নামের উল্লেখ লক্ষ করা যায়। ভগ্নির নাম ছিল পােটোন।

গণতন্ত্রের প্রতি প্লেটোর বীতরাগ : প্লেটো তাঁর সৎ পিতার বাড়িতেই লালিতপালিত হয়েছিলেন। অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করাতে এবং অভিজাত পরিবারে লালিত-পালিত হওয়াতে তার অর্থের অভাব ছিল না। কাজেই দর্শন অনুশীলনের জন্য যে অবসরের প্রয়োজন, আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য সেই অবসরের অভাব তার হয়নি। তবে যখন তিনি যুবক তখন এথেন্সের খুব দুর্দিন। প্লেটোর জন্মের পূর্ব বছর পার্টার সঙ্গে এথেন্সের যুদ্ধ শুরু হয়। সুদীর্ঘকাল যুদ্ধ চলার পর যখন এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। তখন এথেন্সের বিস্তৃত সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও খুব অশান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র অজ্ঞ জনতার শাসনতন্ত্রে পরিণত হয়। এর ফলে প্লেটোর গণতন্ত্রের প্রতি বীতরাগ জন্মায়। অনেকে ধারণা করেন যে, গণতন্ত্রের প্রতি প্লেটোর বিরূপভাবের মূলে রয়েছে শুধুমাত্র তার অভিজাত পরিবারে জন্ম এবং লালিত-পালিত হওয়া নয়, তার উপর সক্রেটিসের প্রভাব এবং বিশেষ করে সক্রেটিসের গণতন্ত্রের দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা। কিন্তু অনেকের মতে, সক্রেটিসের মৃত্যুর পূর্বেই গণতন্ত্রের ওপর প্লেটো আস্থা হারিয়েছিলেন। পিলোপােনেসিয়ান যুদ্ধের শেষের দিকে অভিজাত দল আবার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দেশের উন্নতি সাধন করা দূরে থাক, তারা রক্তপাত, নিপীড়ন ও অত্যাচারে দেশের অবস্থা আরও খারাপ করে তোলে। প্লেটো উপলব্ধি করলেন যে, গণতন্ত্রে যোগ্য ও দায়িত্বশীল নেতার একান্ত অভাব। আর অভিজাত কার্যকলাপও ঐ শাসন ব্যবস্থার প্রতি তার বিশ্বাস খর্ব করেছিল। এর ফলে, গণতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র উভয়ের প্রতি বিরূপ ভাবের জন্যই, তিনি এথেন্সের রাজনীতি অংশগ্রহণের চিন্তা থেকে বিরত হলেন এবং নির্জনে জ্ঞানালোচনায় নিজেকে নিয়োগ করলেন। এথেন্সের পতনের অভিজ্ঞতা তার মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল যে, রাষ্ট পরিচালনার জন্য সুযোগ্য কর্ণধার প্রয়োজন এবং এই কর্ণধার হবেন এমন ব্যক্তি যিনি কিভাবে রাষ্ট্রকে যথাযথ পথে চালিত করতে হয় তা জানেন।

প্লেটোর যৌবনকালের ঘটনা : প্লেটোর যৌবনকাল কিভাবে অতিবাহিত হয় সেই সম্পর্কে বিশদ তত্ত্ব জানা যায় না। ডায়োজিনিসের বিবরণ অনুসারে তিনি কবিতা রচনা করতেন এবং চিত্রশিল্প পাঠে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি সবচেয়ে উত্তম যে শিক্ষা তাই লাভ করেছিলেন এবং সেই শিক্ষা ছিল সাংস্কৃতিক শিক্ষা (Cultured Education)। তাঁর শিক্ষক ক্ৰেটিলাস (Cratylus) ছিলেন দার্শনিক হেরাক্লিটাসের একজন অনুগামী এবং প্লেটো তাঁর কাছ থেকে সম্ভবত শিক্ষা করেছিলেন যে, যেহেতু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জগৎ পরিবর্তনশীল, সেহেতু জগৎ যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু হতে পারে না। অবশ্য যথার্থ জ্ঞান যে প্রত্যক্ষের মাধ্যমেই লন্ধ হয় না— এই জ্ঞান তিনি সক্রেটিসের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। সক্রেটিসের সাহচর্য ও বস্তুত তার যৌবনকালের যে বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে আমরা সুনিশ্চিতভাবে অবহিত হই তা হল তার সক্রেটিসের সঙ্গে সাহচর্যের বিষয়। প্লেটোর যখন কুড়ি বছর বয়স, তখন থেকেই তিনি সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সাহচর্যে দিন অতিবাহিত করেন। অবশ্য এই সম্পর্কে মতবিভেদ লক্ষ করা যায়। কপলস্টোনের মতে, দর্শনের আলোচনায় পরিপূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করবেন, এই মনে করেই প্লেটো সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, এ রূপ সিদ্ধান্ত করার পিছনে কোন যুক্তি নেই। কেননা প্লেটো নিজেই বলেছেন যে, তাঁর আত্মীয়বর্গ তাকে রাজনীতিতে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র উভয়ের প্রতি বিতৃষ্ণাহেতু তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা বর্জন করেন। সক্রেটিসের বিচারের সময় প্লেটো উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অসুস্থ থাকার জন্য সক্রেটিসের মৃত্যুর দৃশ্যে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী। সক্রেটিসের ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষা তার দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি ও শ্রদ্ধা দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। প্লেটোর দৃষ্টিতে সক্রেটিস ছিলেন একজন আদর্শ দার্শনিক।

প্লেটোর দেশভ্রমণ : সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটোর জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু হয় এবং সেটি হল প্লেটোর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর তিনি সর্বপ্রথম মেগারায় গেলেন যেখানে তার বন্ধু এবং শিষ্য ইউক্লিড মেগারা দর্শন সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেছিলেন। স্টেইসের মতে, এখানেই ইউক্লিডের প্রভাবাধীনে প্লেটো পারমিনাইডিসের দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হন, যে দর্শন তার নিজের দার্শনিক চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মেগারা থেকে তিনি সিরিণ, মিসরদেশ, ইটালি এবং সিসিলি পরিভ্রমণে যান। অবশ্য প্লেটো প্রকৃতই মিসরদেশে পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন কিনা তা বিতর্কমূলক বিষয়। তবে তিনি যে ইটালি এবং সিসিলিতে নিয়েছিলেন তা সুনিশ্চিতভাবে বলা চলে। ইটালিতে তিনি পিথাগোরাস্ সম্প্রদায়ের সংসগর্শে আসেন। প্রায় দশ বছর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে তিনি এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করেন। এথেন্সে ফিরে আসার পর প্লেটোর জীবনের তৃতীয় বা শেষ অধ্যায় শুরু হয়। এইবার এথেন্সে ফিরে আসার পর তিনি একজন পেশাদার শিক্ষক এবং দার্শনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে বহুলোক তার কাছে আসতে থাকে।

প্লেটোর অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা : এথেন্সে ফিরে এসে প্লেটো নগরের বাইরে একটি নির্জন উদ্যানের ব্যায়ামাগারে অ্যাকাডেমি (Academy) স্থাপন করেছিলেন। পৌরাণিক বীর একেডেমাস (Academus)-এর নামে অ্যাকাডেমির নামকরণ হয়। এই অ্যাকাডেমি যে শুধুমাত্র দর্শন আলোচনার স্থান ছিল তা নয়, এটিকে অনেকের মতে, ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রূপে গণ্য করা যেতে পারে। কারণ এখানে শুধু যে দর্শন আলোচনা হতো তা নয়, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেরও আলোচনা হতো। এখানে কেবলমাত্র এথেন্স থেকেই নয়, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্র আসত। এখানে প্লেটো ধীরে ধীরে বেশ কিছু ছাত্র এবং শিষ্যকে তার চারপাশে জড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কথা সত্য যে, শেষ পর্যন্ত সব আলোচনাই দার্শনিক আলোচনাতেই পর্যবসিত হত, কিন্তু গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোচনা দিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হতো। এ কথাও সত্য যে, প্লেটোর একটা উদ্দেশ্য ছিল, রাজনীতিবিদ, এবং শাসনকর্তা তৈরি করা। কিন্তু তার উপযোগী বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়াই তার লক্ষ ছিল না। কোন স্বার্থের কথা চিন্তা না করেই তিনি বিজ্ঞানের অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দিতেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা তার অ্যাকাডেমির অন্যতম আদর্শ ছিল। সেই কারণে তিনি অ্যাকাডেমিতে বৈজ্ঞানিক বিষয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্লেটো নগর জীবনের হৈচৈ থেকে দূরে নির্জন উদ্যানে কিছু বিশ্বস্ত শিষ্যকে তার চারপাশে জড় করে দর্শন আলোচনা করতেন। এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে স্টেইস বলেন যে, “পথের ধারে দর্শনালোচনা থেকে কোন সংহতিপূর্ণ চিন্তা জন্মলাভ করতে পারে না। প্লেটোর মত দার্শনিকের সুসংহত দার্শনিক চিন্তার বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়োজন শ্রমসাধ্য অধ্যয়ন এবং শান্ত নির্জন পরিবেশ।”

প্লেটোর শেষ জীবন : শিক্ষক এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টারূপে প্লেটোর খ্যাতি চতুর্দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৮ অব্দে প্রথম ডায়োনিসিয়াস মৃত্যুমুখে পতিত হন। তখন দ্বিতীয় ডায়োনিসিয়াস সাইরাকজ (Syracuse)-এর শাসনকর্তা হন। তাঁকে শিক্ষাদানের জন্য প্লেটোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্লেটো মনে কর দেশের শাসনকর্তাকে সঠিক শাসনকর্তা হতে হলে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। পেষ্ট তার চিন্তার সুষ্ঠু রূপায়ণের একটি সুযোগ লাভ করলেন অর্থাৎ একজন দর্শন পাঠে আগ্রহী রাজাকে শিক্ষা দেওয়া। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু ডায়োনিস প্লেটোকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেও আলোচনায় যথাযথভাবে মনোনিবেশ করতে পারলেন না। বিরক্ত হয়ে প্লেটো এথেন্সে ফিরে এলেন। কয়েক বছর পরে দিন ডায়োনিসিয়াসের কাছ থেকে পুনরায় আমন্ত্রণ আসাতে তিনি আবার সাইরাকস যাত্রা করলেন। কিন্তু এবারও নানা কারণে তাকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হল। তিনি এথেন্সে ফিরে এলেন। তখন তাঁর সত্তর বছর বয়স। তার জীবনে ছিল সুখ এবং প্রশান্তি। ৮২ বছর বয়সে তিনি শান্তিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনার মধ্যে পার্থক্য : অ্যাকাডেমি পরিচালনা করা ছাড়াও প্লেটো বক্তৃতা দিতেন এবং শ্রোতাবর্গ বক্তৃতার সারকথা লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁর এই সব বক্তৃতার সঙ্গে তাঁর ‘ডায়ালগস (Dialogues)-এর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ‘ডায়ালগস, ছিল সর্বসাধারণের জন্য লেখা। এই গ্রন্থগুলো হল কথােপকথনের মাধ্যমে দার্শনিক আলোচনা। এই প্রসঙ্গে প্লেটোর রচনার সঙ্গে অ্যারিস্টটলের রচনার পার্থক্য লক্ষ করা যায়। প্লেটোর সাধারণের জন্য লেখা ডায়ালগস প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তার বক্তৃতাগুলো প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু অ্যারিস্টটলের রচনা যেগুলো প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো হল অধিকাংশই অ্যাকাডেমিতে প্রদত্ত অ্যারিস্টটলের বক্তৃতা। সর্বসাধারণের জন্য লেখা অ্যারিস্টটলের রচনাগুলোর অংশমাত্র পাওয়া যায়। তাই কপলস্টোন মন্তব্য করেছেন যে, আমরা যেন প্লেটোর ‘ডায়ালগ’-এর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের বক্তৃতার তুলনা করে, অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া উভয় দার্শনিকের সাহিত্যিক দক্ষতা, বা আবেগগত, সৌন্দর্যগত এবং অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে উভয়ের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত না টানি। প্লেটো তাঁর জীবনের অবশিষ্টকাল অর্থাৎ চল্লিশ বছরকাল ধরে অ্যাকাডেমির পরিচালনা, দর্শন ও সাহিত্যচর্চায় অতিবাহিত করেন। এই ব্যাপারে সক্রেটিসের সঙ্গে তাঁর জীবন যেভাবে অতিবাহিত হতো, তার পার্থক্য লক্ষ করা যেতে পারে। এক বিষয়ে উভয়ের মধ্যে মিল ছিল। কেউই শিক্ষাদানের নিমিত্ত অর্থ গ্রহণ করতেন না। সক্রেটিস উন্মুক্ত স্থানে, হাটে সর্বসাধারণের সামনে দার্শনিক আলোচনা করতেন।

প্লেটোর রচনাবলী

প্লেটোর রচিত গ্রন্থ বলে আখ্যাত এরূপ ছত্রিশখানা গ্রন্থ ও কতকগুলো পত্র পাওয়া যায়। গ্রন্থগুলো কথােপকথনের আকারে লেখা বলে গ্রন্থগুলো ‘ডায়ালস (Dialogues) নামে পরিচিত।

‘ডায়ালগ’-এর পরিচয় : ‘ডায়ালগস’ কথাটির মানে কথােপকথন। ডায়ালগগুলোতে প্লেটোর বক্তব্য বিষয় তার গুরু সক্রেটিসের কথােপকথনের মাধ্যমে হয়েছে। প্লেটো অ্যাকাডেমিতে যে সব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে, কোন ভাবেই পাওয়া যায় না। যেহেতু ডায়ালগগুলো শিক্ষিত সাধারণ আনষের লেখা এবং অ্যাকাডেমিতে প্রদত্ত প্লেটোর বক্তৃতা দর্শনের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত, সেহেতু অনেকে তুলনামূলকভাবে বক্তৃতাগুলোর মধ্যে দর্শনের উৎকর্ষের কথা চিন্তা করেন। এগুলো পাওয়া না যাওয়ার জন্য তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন মন্তব্য করেন যে, ‘ডায়ালগ’ ও বক্তৃতায় প্রদত্ত মতবাদের মধ্যে খুব সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে এরূপ অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

প্লেটোর রচনার অকৃত্রিমতা : প্রশ্ন হল, প্লেটোর রচিত গ্রন্থগুলোর অর্থাৎ ‘ডায়ালগস’গুলোর, সব কটিই কি প্লেটোর রচিত? পণ্ডিতরা মনে করেন যে, প্লেটোর নামে যে ছত্রিশটি ডায়ালগ প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবগুলোই প্লেটোর লেখা নয়। এই সম্পর্কে তাদের মতামত সংক্ষেপে বিবৃত করা যেতে পারে।

  • ১. পণ্ডিতরা যে সব ডায়ালগ প্লেটোর লেখা নয় বলে সিদ্ধান্ত করেছেন সেগুলো হল, অ্যালসিবিয়াডেস (দ্বিতীয় খণ্ড), হিপারকাস, অ্যামাটোরস বা রাইভ্যাইল্স, থিয়াগেস, ক্লিটোফোন, মাইনাস ইত্যাদি গ্রন্থ। (Alcibiades 11, Hipparchus, Amatores, or Rivales, Theages, Clitophon, Minus.)
  • ২. যে ছয়টি ডায়ালগ, প্লেটোর রচনা কিনা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে এবং যা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক বা মতভেদ দেখা দিয়েছে সেগুলো হল, অ্যালসিবিয়াডেস (প্রথম খণ্ড) আইয়ন, মেনেক্সেনাস, হিপিয়াস ম্যায়িয়র, এপিনোমিস, এপিসিস। (Alcibiades. 1. Ion, Menexenus, Hippias Maior, Epinomis, Epistles.)।
  • ৩. পূর্বোক্ত উল্লিখিত বারটি ডায়ালগ ছাড়া অবশিষ্ট চব্বিশটি ডায়ালগ যে প্লেটোরই লেখা, এ সম্পর্কে পণ্ডিতেরা কোন রকম সন্দেহ প্রকাশ করেননি। কাজেই প্লেটোর চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য প্লেটোর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা যে নেহাত কম— এমন কথা বলা যেতে পারে না।

প্লেটোর রচনার কালানুক্রম : কোন দার্শনিকের দার্শনিক চিন্তাধারার বিকাশ ও বিবর্তন অনুসরণের জন্য তার রচনার কালানুক্রম সম্পর্কে পরিচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্লেটোর রচনার ক্রম সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এই ক্রম নিরূপণের জন্য বিশেষ পদ্ধতির কথা গ্রীকদর্শনের সমালোচকবৃন্দ উল্লেখ করেছেন –

  • প্রথমত, প্লেটোর রচনার কালানুক্রম নিরূপণে যে বিষয়টি বিশেষভাবে সহায়ক, সেটি হল ডায়ালগের ভাষা। এই ভাষা লক্ষ করেই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, প্লেটোর রিপাবলিক (Republic) গ্রন্থটি তার ‘ল’ (Laws) গ্রন্থটির তুলনায় অনেক আগের রচনা। কেননা শেষের গ্রন্থটি তার পরিণত অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সে লেখা।
  • দ্বিতীয়ত, প্লেটোর রচনার কালানুক্রম নিরূপণে প্রাচীন গ্রন্থকার প্রদত্ত সাক্ষ্যপ্রমাণও সহায়ক, যদিও সকল সময় তা প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না। অ্যারিস্টটল যখন ঘােষণা করেন যে প্লেটোর রিপাবলিকের তুলনায় তাঁর ‘ল’ তাঁর জীবনের পরবর্তীকালের রচনা, তখন তা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু ডায়োজেনস ল্যাইরসিয়াস যখন বলেন যে, যেহেতু ফিডাস (Peaeadius) ডায়ালটিতে প্লেটো প্রেম নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং যেহেতু, ডায়ালগুটি তার যৌবনকালের অর্থাৎ এতে প্রথম দিকের রচনা, তখন তার বক্তব্যের প্রমাণ্য সম্পর্কে মনে সংশয় জাগে।
  • তৃতীয়ত, কপলস্টোন বলেছেন যে, ডায়ালগে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা ঘটনার থাকলে তার কালক্রম নিরূপণ সহজতর হয়। যেমন প্লেটোর ফিডাে (Phaedo) নামক ডায়ালগুটিতে সক্রেটিসের মৃত্যুর উল্লেখ থাকাতে বলা যেতে পারে যে, ডায়ালগটি সক্রেটিসের মৃত্যুর পরে লেখা। যদিও তার ভিত্তিতে গ্রন্থ রচনার সঠিক তারিক নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।
  • চতুর্থত, কোন একটি ডায়ালগে অপর একটি ডায়ালগের উল্লেখ থাকলে, তার ভিত্তিতে ডায়ালগের কালক্ৰম নিরূপণ সম্ভব। কেননা, যেটির উল্লেখ থাকবে সেটি যে পূর্বে লেখা হয়েছে সেই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। যেমন, ট্যাইম্যায়িয়স (Timaeus) গ্রন্থে ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের উল্লেখ দেখে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, প্রথম গ্রন্থটি দ্বিতীয় গ্রন্থের পরে লেখা।
  • পঞ্চমত, ডায়ালগের বক্তব্য বিষয় অনুধাবন করেও তাদের কালক্ৰম নিরূপণ করা যেতে পারে। তবে এই ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানতা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন। যেমন, প্লেটোর ধারণাবাদ (The doctrine of Ideas)-এর প্রতি লেখকের মনোভাব লক্ষ করে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, থিয়্যায়িটিটাস, পরমিনাইডিস, সােফিস্টেস, পলিটিকাস, ফাইলিবাস, টাইম্যায়িয়ূস প্রভৃতি একই শ্রেণীভুক্ত। (Theaetetus, Parmenides, Sophistes, Politicus, Philebus, Timaeus.)
  • ষষ্ঠত, বক্তব্য বিষয় এবং বক্তব্য বিষয় উপস্থাপনে শিল্পজনোচিত পদ্ধতি অনুসরণ-এই দুটির মধ্যে কোনটির ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতেও ডায়ালগের রচনার ক্রম নিরূপণ সম্ভব। যেমন, কোন কোন ডায়ালগে প্লেটো বক্তব্য উপস্থাপনের কলাকৌশলের ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে, শুধুমাত্র বক্তব্য বিষয়টির ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। টাইম্যায়িয়ূস (Timaeus) এবং ‘লস’ (Laws)-এর উল্লেখ এই প্রসঙ্গে করা চলে। আবার কোন কোন ডায়ালগে, ডায়ালগুটি উপস্থাপনে, তাতে অংশগ্রহণকারী চরিত্রগুলোর চরিত্র চিত্রণে, কৌতৃকপূর্ণ মন্তব্য পরিবেশনে তার শিল্পীসুলভ বিচক্ষণতা পরিদৃষ্ট হয়। সিমপােসিয়াম (Symposium) এই ধরনের ডায়ালগ উভয় ধরনের ডায়ালগের ভিত্তিতেই ডায়ালগের কাল নিরূপণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। বক্তব্য বিষয় উপস্থাপনের পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে সব ডায়ালগে সেগুলো জীবনের প্রথমকালের রচনা, যেহেতু রচনা শৈলীর ব্যাপারে লেখক ঐ সময়েই যত্নবান হয়েছেন। পরিণত বয়সে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বক্তব্য বিষয়ের ওপর।

রচনার কালক্রম নিরূপণের যে মানদণ্ডের কথা উপরে উল্লিখিত হয়েছে সেই সম্পর্কে কিন্তু পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিভেদ লক্ষ করা যায়। জেলার তাঁর গ্রীক দর্শন গ্রন্থে প্লেটোর দার্শনিক ও সাহিত্য রচনার সময়কালকে চারটি বিভাগে ভাগ করেন। দর্শনের ইতিহাস রচয়িতা কপলস্টোন তাঁর গ্রন্থে এই বিভাগকে সমর্থন করেন। আমরা এই সম্পর্কে নিচে আলোচনা করছি—

(ক) সক্রেটিস প্রভাবিত কাল (The Socratic Period) : এই সময় যে গ্রন্থগুলো রচিত হয় সেগুলো ক্ষুদ্রাকার এবং সরল। সক্রেটিসের চিন্তাধারা এই সব গ্রন্থের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্লেটো এই সময় পর্যন্ত নিজস্ব কোন দার্শনিক অতিমত গঠন করতে পারেননি। সক্রেটিসের দর্শন প্রতিপাদন করাই ছিল তার লক্ষ। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, তিনি শুধু অপরের ভাবকেই তার গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছেন। তার এই সময়কার ডায়ালগগুলোতে মৌলিকতার একান্ত অভাব রয়েছে তা নয়, তবে রচনাগুলো যতটা না দার্শনিক রচনা তার তুলনায় সাহিত্যিক রচনা। এসব গ্রন্থে সক্রেটিসের প্রিয় আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলোই আলোচিত হয়েছে। যেমন সততাই জ্ঞান, সততা এক, সততা শিক্ষালভ্য। সক্রেটিসের মতই প্লেটো এখানেও প্রশ্ন তুলেছেন, মিতাচার কাকে বলে, বিজ্ঞতা কাকে বলে ইত্যাদি। এই সময়কার রচিত ডায়ালগগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাপােলজি (Apology)। এই ডায়ালগে সক্রেটিসের বিচারকালে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের বর্ণনা রয়েছে। ক্ৰিটো (Crito)-তে সক্রেটিসকে একজন বিশ্বস্ত রাজভক্ত নাগরিক রূপে দেখানো হয়েছে। ইউথিফ্রন (Euthyphron), ল্যাচেস (Laches), চারমাইডেস (Charmides) ডায়ালগে যথাক্রমে ধর্মের প্রকৃতি, সাহসিকতা এবং মিতাচার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রােটেগোরাসে আলোচনা করা হয়েছে সততাই জ্ঞান এবং সততা শিক্ষালভ্য। লাইসিসে (Lysis) বন্ধুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আইয়ন (Ion)-এ কবিদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রিপাবলিক (Republic) গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ন্যায়পরায়ণতা। উপরের যে ডায়ালগগুলোর কথা উল্লেখ করা হল সেগুলোতে সক্রেটিসের জীবনী সম্পর্কীয় বিষয় আলোচিত হয়েছে। স্টেইস বলেন, বিষয়বস্তুর তুলনায় রচনা কুশলতাই অনেক বেশি’, (There is more art than matter)। জেলার বলেন, “অধিকাংশ ডায়ালগে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেই যা সক্রেটিসের ‘না জানা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এগুলো থেকে বোঝা যায় যে, প্লেটো নিজে কিভাবে সত্যানুসন্ধানে মগ্ন।” (Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy : Page 121.)

(খ) পরিবর্তন কাল (Transition Period) : এই সময় যে ডায়ালগগুলো রচিত হয় তার মধ্যে প্রথমেই জর্জিয়াস (Gorgias)-এর নাম করা যায়। এই ডায়ালগে দুই ধরনের জীবনের মধ্যে বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। বাস্তব রাজনীতিবিদের জীবন যিনি শক্তিমানের অধিকার নীতিতে বিশ্বাসী ও বাহ্য সাফল্য এবং ব্যক্তিগত সুবিধার দিকে যার নজর। অপরপক্ষে, দার্শনিকের জীবন, যার কাছে ন্যায়পরায়ণতাই হল নৈতিক সততা, আচরণের একমাত্র মানদণ্ড। মেনো (Meno)-তে আলোচনা করা হয়েছে যে, সততা শিক্ষা দেওয়া যায় না। ইউথিডেমাসে পরবর্তীকালের সােফিস্টদের যৌক্তিক আনুপপত্তি (Logical Fallacies) বিষয়ে ব্যাঙ্গাত্মক আলোচনা স্থান পেয়েছে। হিপিয়াসে (প্রথম খণ্ডে) সৌন্দর্য সম্পর্কে এবং দ্বিতীয় খণ্ডে ইচ্ছাকৃতভাবে, না অনিচ্ছাকৃতভাবে, অন্যায় করা ভাল, সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ক্র্যাটিলাস (Cratyles)-এ ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এবং অ্যান্টিথিনিসের বিরুদ্ধে সওয়াল পরিলক্ষিত হয়। মেনফেনাস (Menexenus)-এ অলঙ্কারশাস্ত্র সম্পর্কে ব্যাঙ্গাত্মক আলোচনা দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, এই সময়ে রচিত তার ডায়ালগগুলোর সঙ্গে তার দেশভ্রমণের সম্পর্ক আছে। এই যুগের কোন কোন ডায়ালগ মেগারের দর্শন চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। দেশভ্রমণের সময় প্লেটো নতুন নতুন দার্শনিক মতের সঙ্গে পরিচিত হন। তার প্রভাব এইসব ডায়ালগে পরিলক্ষিত হয়। সক্রেটিসের প্রভাবের অতিরিক্ত এলিয়ার দর্শনের প্রভাব এই সব ডায়ালগগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়।

(গ) পরিণত কাল (Period of Maturity) : এই সময়ে রচিত প্লেটোর ডায়ালগগুলো তার পরিণত চিন্তাধারার সাক্ষ্য বহন করে। এই সময় তিনি তার নিজস্ব অভিমত বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। এই যুগে তার রচনায় চিন্তার গভীরতার সঙ্গে সাহিত্যিক শিল্পীকুশলতার সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। তার সার্বিক ধারণাবাদ, জর্জিয়াসে যে আলোচনার শুরু তাকেই চিন্তার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করতে প্রয়াসী। এই সময়কার রচিত ডায়ালগুলোর মধ্যে প্রথমেই সিম্পােসিয়াম (Symposium)-এর উল্লেখ করা চলে। এই গ্রন্থে ধারণা মতবাদ (The Theory of Ideas)-কে সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সব পার্থিব সৌন্দর্য আসলে সৌন্দর্য যা (The Beautiful in itself) অর্থাৎ আদর্শ সৌন্দর্যের ছায়ামাত্র। আদর্শ সৌন্দর্যকেই আত্মা আকাঙ্ক্ষা করে। ফিডাে (Phaedo) নামক ডায়ালগুটিতে ধারণা মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থটিতে বহু দিন থেকে যার প্রস্তুতি চলছে, সেই আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে। ‘ফিড্রাস’ (Phaedrus)-এ রয়েছে প্রেমের প্রকৃতি এবং দর্শনসম্মত অলঙ্কার শাস্ত্রের সম্ভাবনার আলোচনা। এই গ্রন্থটির রচনাসুষমা এবং গ্রন্থটিতে ধারণা মতবাদটি যে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, তার উল্লেখ প্রমাণ করে যে, গ্রন্থটি প্লেটোর পরিণত কালের রচনা। কাজেই জেলার যে তাকে প্লেটোর প্রথম দিকের রচনা বলে অভিহিত করেছেন তা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না।

(ঘ) বৃদ্ধ বয়সের রচনাবলী (The Works of old Age) : এই বয়সের রচনাবলির বৈশিষ্ট্য হল, সার্বিক ধারণা মতবাদের তত্ত্বের দিকটির প্রতি প্লেটোর আর ততখানি আগ্রহ দৃষ্ট হয় না, যতখানি দৃষ্ট হয় তার যৌক্তিক দিকের প্রতি। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, পিথাগোরীয় সংখ্যাতত্ত্বের কাছাকাছি সার্বিক ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদকে নিয়ে আসা এবং বিশ্বজগত সম্পর্কে গভীরতর আলোচনায় মনোযোগী হওয়া। এই সময়কার ডায়ালগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পারমিনাইডিস (Parmenides)। এই ডায়ালগে, পরমতত্ত্বকে, এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের মতই এক হলে গণ্য করা হবে কিনা, আলোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে প্লেটো আকার বা ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের সমালোচনার বিরুদ্ধে ঐ মতবাদ সমর্থন করেন এবং তার দর্শনের সঙ্গে এলিয়ার দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ‘থিয়্যায়িটিটাস’ (Theaetetus) ডায়ালগে প্লেটো দেখান যে, সােফিস্টদের অভিমত, ‘মানুষই সব কিছু পরিমাপ করার মানদণ্ড’, সত্য নয়। ব্যক্তির ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ যথার্থ জ্ঞান বা সত্যতা লাভের উৎস নয়। সত্যতা ব্যক্তিসাপেক্ষ নয়, সত্যতা হল বস্তুগত। ‘সােফিস্ট’ (sophist) ডায়ালগে সােফিস্টদের আক্রমণ করা হয়েছে এবং অ্যান্টিথিনিসকে তাদের প্রতিনিধিরূপে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। তা ছাড়াও এলিয়াটিক দর্শনে এক ও বহুর সমস্যা এবং ধারণাবাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। ‘পলিটিকাস’ (Politicus)-এ আলোচনা করা হয়েছে যে, বিজ্ঞ ব্যক্তিই কেবলমাত্র জানে কাকে যথার্থ শাসনকার্য বলা হয়। ‘ফাইলিবাস’ (Philebus)-এ কল্যাণের সঙ্গে সুখের সম্বন্ধের আলোচনা করা হয়েছে। ‘ক্রিটিয়াস’ (Critias)-এ আদর্শ কৃষি রাষ্ট্র (Ideal Agrarian State) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ‘লস’ (Laws) এবং ‘এপিনোমিস’ (Epinomis)-এ রিপাবলিক গ্রন্থের আদর্শ রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণাগুলো বজায় রেখে, বাস্তব জীবনের কিছু সুখ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের উপাদানকে একত্রিত করে একটি শাসনতন্ত্রের ধারণা ব্যক্ত করা। হয়েছে এই গ্রন্থগুলোতে। কোন কোন লেখক প্লেটোর রচনাবলীর কালক্রম অনুসরণ করে তার দার্শনিক চিন্তাধারার আলোচনা করেছেন। বর্তমান গ্রন্থে তা করা সম্ভব নয়। আমরা প্লেটোর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্বগুলোই পর পর আলোচনা করে যাব।

প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার প্রকৃতি, পদ্ধতি এবং শ্রেণীবিভাগ

প্লেটো তাঁর দার্শনিক চিন্তা সুসংহতভাবে প্রকাশ করেননি : প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা সুসংহতভাবে একটি বিশেষ ডায়ালগে প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন ডায়ালগের মধ্য দিয়ে তার দার্শনিক চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, তার দার্শনিক চিন্তা সুসংহত ও সুবিন্যস্ত নয়। আসল কথা হল, তিনি সুসংহতভাবে তার দার্শনিক চিন্তাকে প্রকাশ করেননি। বিভিন্ন ডায়ালগে তাঁর দার্শনিক চিন্তা ছড়ানো রয়েছে। তিনি খেয়াল-খুশিমত তাদের বিভিন্ন ডায়ালগে ব্যক্ত করেছেন। যা প্রথমে বলার কথা তাকে শেষে ব্যক্ত করেছেন এবং কোন যুক্তির পরবর্তী ধাপটিকে প্রথমেই ব্যক্ত করেছেন বা সেই ডায়ালগুটি বাদ দিয়ে অন্য ডায়ালগে তাকে ব্যক্ত করেছেন। কাজেই প্লেটোর দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য, প্লেটোর ডায়ালগ রচনার কালানুক্রম অনুসরণ করে তাঁর ডায়ালগের সারবস্তুর সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা না করে, বিভিন্ন ডায়ালগের আলোচনার ভিত্তিতে তার প্রধান মতবাদগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবার প্রচেষ্টাই হবে যুক্তিযুক্ত পন্থা।

প্লেটো সারগ্রাহী ছিলেন না : প্লেটোর দর্শনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে বলা যেতে পারে যে, প্লেটোর পূর্ববর্তী বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তার সংযোজন প্লেটোর লক্ষ করা যায়। কিন্তু তাই বলে এরূপ সিদ্ধান্ত করা সমীচীন হবে না যে, ‘তিনি ছিলেন সারগ্রাহী, বিভিন্ন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোকে তিনি শুধু, ঐক্যবদ্ধ করেছেন।’এই ধরনের সিদ্ধান্ত করার অর্থ প্লেটোর মত অসামান্য প্রতিভাবান দার্শনিক সৃজনী শক্তিকে উপেক্ষা করা। কাজেই সেই প্রশ্ন ওঠে না। তিনি প্রাচীন দার্শনিক চিন্তাধারাকে সমালোচনামূলক বিচারের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তার অনুসন্ধানের পরিসরকে বিস্তৃত করার জন্য। তার আসল লক্ষ ছিল সত্যানুসন্ধান।

প্লেটোর দর্শনের প্রভাব : জেলার-এর মতানুসারে প্লেটোর দর্শনের উৎপত্তির মূলে পূর্ববর্তী চারটি দার্শনিক চিন্তাধারার প্রভাব বা প্রবণতা (Philosophic Tendencies) লক্ষ করা যায়। এগুলো হল হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস, পিথাগোরীয় দর্শন সম্প্রদায় এবং এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের দার্শনিক চিন্তাধারা। এর সঙ্গে পরমাণুবাদীদের চিন্তাধারাকে যুক্ত করা চলে, যদিও প্লেটোর ওপর তাদের প্রভাব তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। হেরাক্লিটাসের দর্শনের সঙ্গে প্লেটো পরিচিত হয়েছিলেন সক্রেটিসের সঙ্গে তার পরিচিতির পূর্বে এবং এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি, অর্থাৎ সব কিছুই পরিবর্তনশীল, প্লেটোকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল— জ্ঞানের যথাযথ বিষয়টি কি, তা নিরূপণ করার জন্য। এই ব্যাপারে সক্রেটিসের কল্যাণের স্বরূপ (Nature of Good) অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা প্লেটোকে সহায়তা করেছিল। প্লেটো বুঝে নিয়েছিলেন যে চরিত্র, জ্ঞানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কিন্তু পিথাগোরীয় দর্শন সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচয়, তাঁর চিন্তার রাজ্যে এক নবদিগন্তের সূচনা করল। এর থেকেই জন্মলাভ করল প্লেটোর দ্বৈতবাদ, যার পরিচয় মেলে তার তত্ত্ববিদ্যায়, মনোবিদ্যায় এবং নীতিবিদ্যায়। আয়োনিয়ার দার্শনিকবৃন্দের প্রচারিত অদ্বৈতবাদের বিরোধী যে দ্বৈতবাদী দর্শন, তার সমর্থকবৃন্দের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করলেন প্লেটো। (E. Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy, Page 112.)। যা শাশ্বত এবং অপরিণামী, প্লেটো তার স্বরূপ অনুসন্ধান করতে চান; তাই প্লেটো স্বাভাবিকভাবেই এলিয়ার দার্শনিক মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। এই মতবাদ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অবভাস বলে ব্যক্ত করে এবং এক ও বহুর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। সক্রেটিসের, পিথাগোরাস সম্প্রদায়ের এবং এলিয়ার দর্শন-এই তিন উপাদান থেকেই জন্ম নিল প্লেটোর দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ-আকার বা ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ (The doctrine of forms or ideas) এবং হেরাক্লিটাসের দর্শন জড়ের ব্যাখ্যার সূত্র যুগিয়ে দিল। প্লেটোর পদার্থবিদ্যা এবং ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের পরবর্তী রূপের ক্ষেত্রে পরমাণুবাদের অবদান পরিলক্ষিত হয়। প্লেটোর নীতিবিদ্যা এবং রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে সক্রেটিস ও পিথাগোরাস দর্শন সম্প্রদায়ের দর্শনের প্রভাব বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্লেটোর দর্শন হল ভাববাদী দ্বৈতবাদী দর্শন-যেখানে জড় ও মন, ঈশ্বর ও জগৎ, দেহ ও মনের দ্বৈত নির্দেশিত য়েছে। প্লেটোর মতে, পরমতত্ত্ব অ-জড়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ধারণার জগতের একটা ক্ষীণ প্রতিলিপি এবং এই মতবাদ থেকেই প্লেটোর অন্যান্য সিদ্ধান্ত যৌক্তিকভাবে নিঃসৃত হয়েছে। বাট্রান্ড রাসেলের মতে, প্লেটোর ওপর বিশুদ্ধ দার্শনিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন চারজন দার্শনিক– পিথাগোরাস, পারমিনাইডিস, হেরাক্লিটাস এবং সক্রেটিস। তার মতে পিথাগোরাসের কাছ থেকে প্লেটো তার দর্শনে পেয়েছিলেন অরফিক উপাদান, ধর্মীয় প্রবণতা, অমরত্বয় বিশ্বাস, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতিরিক্ত অন্য এক জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস, পুরোহিতের মনোভাব, গুহার রূপকের সঙ্গে জড়িত সব উপাদান (প্লেটো রিপাবলিক গ্রন্থের সপ্তম পরিচ্ছেদে জ্ঞান সম্পর্কীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এই রূপকের ব্যবহার করেন), গণিতশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগ এবং বুদ্ধির সঙ্গে অতীন্দ্রিয়বাদকে সংমিশ্রিত করার প্রবণতা। পারমিনাইডিসের কাছ থেকে তিনি এই বিশ্বাসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, সত্তা নিত্য ও অপরিণামী এবং যুক্তিসম্মতভাবে স্বীকার করে নেওয়া যায় যে, সব পরিবর্তনই হল অলীক। হেরাক্লিটাসের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন একটা নঞর্থক মতবাদ। সেটি হল এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের কোন কিছুই শাশ্বত বা অপরিণামী নয়। পারমিনাইডিসের সঙ্গে এই মতবাদকে যুক্ত করে যে সিদ্ধান্তে তিনি উপনীত হলেন তা হল— জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়, কেবলমাত্র বুদ্ধির দ্বারা জ্ঞান লব্ধ হয়। সিদ্ধান্তটি পিথাগোরীয় মতবাদের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সক্রেটিসের কাছ থেকে সম্ভবত তিনি নৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার শিক্ষা লাভ করেছিলেন। জগতের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা পরিহার করে উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেওয়ার মনোভাবও হয়ত তিনি সক্রেটিসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। প্রাকসক্রেটিস যুগের দার্শনিকবৃন্দের চিন্তাতে ‘কল্যাণের’ (The Good) ধারণা যতখানি না স্থান অধিকার করেছিল তার থেকে অনেক বেশি প্রাধান্য লাভ করেছিল প্লেটোর চিন্তাতে এবং এই ব্যাপারে সক্রেটিসের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা খুবই কঠিন।

মত ও জ্ঞানের পার্থক্য : দার্শনিক পদ্ধতি হল কথােপকথনের মাধ্যমে জ্ঞানের অনুসন্ধান। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের তুলনায় চিন্তনের উৎকর্ষ অবশ্যই স্বীকার্য। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ দ্বারা যা লব্ধ হয় তা হল মত (Opinion), জ্ঞান নয়। যদিও প্লেটো বুদ্ধিকেই জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি বলে স্বীকার করেছেন, তবু প্লেটো এই পদ্ধতির মধ্যেই যেন স্বজ্ঞা বা অপরোক্ষ অনুভূতিকে, যা মনের এক অ-বুদ্ধিজনিত উপাদান (Irrational Element), স্বীকার করে নিয়েছেন। এই অপরোক্ষ অনুভূতির সঙ্গেই সামঞ্জস্য রক্ষা করে প্লেটো তারই পাশাপাশি অবাস্তব কাল্পনিক কাহিনী (Myths) বিবৃত করেছেন যাতে তাঁর দার্শনিক চিন্তার গূঢ় অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্লেটোর দর্শনের তিনটি বিভাগ ও প্লেটো নিজে তাঁর দর্শনের কোন শ্রেণীবিভাগ করেননি বা সেই শ্রেণীবিভাগের নীতিও সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করেননি। সাধারণত যে নীতি গ্রহণ করা হয় সেই নীতি অনুসারে তাঁর দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – (১) ডায়ালেকটিক (Dialectic), (২) পদার্থবিদ্যা (Physics), এবং (৩) নীতিবিদ্যা (Ethics)। ডায়ালেকটিক বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ (Theory of Forms) হল প্লেটোর পরমতত্ত্বের প্রকৃতি সম্পর্কীয় মতবাদ। প্লেটোর দর্শনে আকার বা তাত্ত্বিক, যৌক্তিক এবং উদ্দেশ্যমূলক তাৎপর্য নিরূপণের বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে আছে। পদার্থবিদ্যায় দেশকালে অবস্থিত অবসিক জগতের অস্তিতে আলোচিত হয়েছে। আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদ এবং আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তির বিষয়ও একই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। রাষ্ট্রতত্ত্ব নীতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত; নাগরিক হিসেবে মানুষের কর্তব্য এবং ব্যক্তির নৈতিকতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই বিভাগে। অনেক ডায়ালগেই উপরিউক্ত আলোচ্য বিষয়গুলোর মিশ্র আলোচনা লক্ষ করা যায়। তবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ডায়ালগগুলো উপরিউক্ত শ্রেণীবিভাগের কোন না কোন একটি অন্তর্ভুক্ত। যেমন, টাইম্যায়িয়ুস, ফিডাে এবং ফিড্রাস পদার্থবিদ্যার; ফাইলিবাস জর্জিয়াস এবং রিপাবলিক নীতিবিদ্যার এবং থিয়্যায়িটিটাস, সােফিস্ট এবং পারমিনাইডিস ডায়ালেকটিকস্-এর অন্তর্ভুক্ত। রাসেলের মতে, প্লেটোর দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হল, প্রথমত, কাল্পনিক রাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র, দ্বিতীয়ত, তার ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ, তৃতীয়ত, অমরত্বের পক্ষে তার যুক্তিসমূহ, চতুর্থত, তার সৃষ্টির উৎপত্তিতত্ত্ব, পঞ্চমত, তার জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদ।

জ্ঞানতত্ত্ব 

‘থিয়্যায়িটিটাস’ গ্রন্থে জ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা : কোন একটিমাত্র ডায়ালগে প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব সুসংহতভাবে ব্যক্ত এবং বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি। থিয়্যায়িটিটাস (Theaetetus) গ্রন্থটিতেই তিনি জ্ঞান কি, এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং জ্ঞান সম্পর্কীয় বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই আলোচনার মাধ্যমে কোন সদর্থক সিদ্ধান্তে তিনি উপনীত হতে পারেননি। এই গ্রন্থের সিদ্ধান্ত নঞর্থক, কারণ এই গ্রন্থে প্লেটো জ্ঞান সম্পর্কীয় ভ্রান্ত মতবাদগুলো খণ্ডন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। প্রােটেগোরাস ইন্দ্রিয় সংবেদনকেই জ্ঞান বলেছেন। জ্ঞান সম্পর্কীয় এই মতবাদ খণ্ডন করার জন্য প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে জ্ঞানের প্রকৃতি এবং জ্ঞানের স্তরভেদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই বিষয়টি লক্ষ করে কপলস্টোন মন্তব্য করেছেন যে, জ্ঞানের নঞর্থক এবং বিচারমূলক দিকটির আলোচনার পূর্বেই প্লেটো তার সদর্থক দিক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন বা প্লেটো যথার্থ জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথমে অবহিত হয়ে তার পরে ভ্রান্ত জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদগুলো খণ্ডনে ব্রতী হয়েছিলেন। (F. Copleston : A History of Philosophy; Page 166.)

ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয় 

সক্রেটিসের কাছ থেকে প্লেটো শিক্ষা করেছিলেন যে, জ্ঞান যেহেতু শাশ্বত মূল্যের জ্ঞান ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষনির্ভর হতে পারে না। কেননা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষনির্ভর জ্ঞান নশ্বর বস্তুর জ্ঞান হওয়াতে ব্যক্তিভেদে পৃথক ও পরিবর্তনশীল।

জ্ঞান নিত্য, বস্তুগত ও সর্বকালে ও সর্বদেশে সত্য : যথার্থ জ্ঞান হল নিত্য, সুতগত এবং সর্বকালে ও সর্বদেশে সত্য। এই বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য তিনি জ্ঞান সমর্কীয় সমস্যার আলোচনায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। জ্ঞান কি, কিসের জ্ঞান, এই সত্য উদঘাটনই ছিল তার লক্ষ। থিয়্যায়িটিটাস গ্রন্থে প্লেটো ভ্রান্ত জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদগুলো খণ্ডনে প্রথমে ব্রতী হলেন। প্রােটেগোরাস মনে করেন প্রত্যক্ষই জ্ঞান, ব্যক্তির কাছে যা সত্য বলে প্রতিভাত হয় তাই সত্য। প্রােটেগোরাসের এই মত প্লেটো খণ্ডন করার জন্য ব্রতী হলেন। প্লেটোর মতে, যথার্থ জ্ঞান অবশ্যই অভ্রান্ত (Infallible) হবে এবং সৎ বা অস্তিত্বশীল (of what is) বিষয়ের অর্থাৎ কিনা বিষয় যা, তার জ্ঞান হবে।

ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয় – এই মতবাদের সপক্ষে যুক্তি : ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ যে জ্ঞান নয়, এই সম্পর্কে প্লেটোর যুক্তিগুলো নিচে সংক্ষেপে বিবৃতি করা হচ্ছে (প্লেটোর যুক্তিগুলো থিয়্যায়িটিটাস গ্রন্থে, থিয়্যায়িটিটাস এবং সক্রেটিসের কথােপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে) :

  • ১. ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রােটেগোরাস এবং সােফিস্টদের, এই যুক্তি স্বীকার করে নিলে ব্যক্তিবিশেষের জ্ঞানই সত্যতার মানদণ্ড হয়ে পড়বে। অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তির কাছে যা সত্য বলে গণ্য হবে, ব্যক্তি তাকেই সত্য বলে গণ্য করবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তিবিশেষের অবধারণ অনেক ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত হতে দেখা যায়। কাজেই প্রোটাগোরাসের অভিমত স্বীকার করে নিলে ভবিষ্যতের জ্ঞান সম্ভব হবে না। কোন ব্যক্তি যাকে নিজের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে করে ভবিষ্যতে তা তার পক্ষে কল্যাণকর প্রমাণিত নাও হতে পারে। যখন কোন চিকিৎসক কোন ব্যক্তির ব্যধি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে, তখন দেখা যায় যে চিকিৎসক, সেই ব্যক্তি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যতটা না জানে তার তুলনায় অনেক বেশি কিছু জানে। কিছু ব্যক্তি যে অপর অনেক ব্যক্তির তুলনায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞানের অধিকারী তা অস্বীকার করা যায় না। কাজেই জ্ঞানী ব্যক্তি যে মূর্খ ব্যক্তির তুলনায় সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড হিসেবে অনেক বেশি উপযুক্ত, এ সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করা চলে না।
  • ২. ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ-লব্ধ জ্ঞান স্ববিরোধী। কেননা, ব্যক্তিবিশেষের প্রত্যক্ষণ সব সময়ই পরিবর্তনশীল। একই বস্তু কাছে থেকে বৃহৎ এবং দূর থেকে ক্ষুদ্র মনে হয়, কোন বস্তু কোন বস্তুর তুলনায় ভারী এবং অপর কোন বস্তুর তুলনায় হাল্কা মনে হয়, কোন এক সময় সাদা, অপর সময়ে ধূসর, কখনও শীতল, কখনও উষ্ণ মনে হয়। একই বস্তু সম্পর্কে উপরিউক্ত পরস্পর বিরুদ্ধ সকল জ্ঞানকেই অভ্রান্ত গণ্য করা যেতে পারে না; কিন্তু ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষই জ্ঞান— এই মতবাদ স্বীকার করে নিলে প্রতিটি প্রত্যক্ষণকেই সত্য গণ্য করতে হয়। একাধিক প্রত্যক্ষণের মধ্যে কোন এক প্রত্যক্ষণ সত্য, অপরগুলো মিথ্যা, এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কোন অধিকার মানুষের নেই।
  • ৩. প্রােটেগোরাসের মতবাদকে যথার্থ বলে স্বীকার করে নিলে কোন ব্যক্তিই অপর ব্যক্তির তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী হতে পারে না। কেননা, ব্যক্তিবিশেষই যেহেতু তার ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ সত্য না মিথ্যা, তার একমাত্র বিচার কর্তা; সেহেতু ব্যক্তিবিশেষই হয়ে পড়ে তার জ্ঞানের সত্যমিথ্যা বিচারের একমাত্র মানদণ্ড। এর ফলে উপদেশ, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক আলোচনা, তর্ক – এ সকলের অবকাশ থাকে না। কোন বিষয় সম্পর্কে তর্ক করার অর্থই হল কোন বস্তুগত সত্যতার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া। তা না হলে তর্কের দ্বারা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় না। কেননা তর্কের ক্ষেত্রে দুই ব্যক্তির অভিমত পরস্পরবিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর সে রকম সম্ভাবনা না থাকলে ব্যক্তি তর্কে নিয়োজিত হবে কেন? কাজেই প্রােটেগোরাসের অভিমত স্বীকার করে নিলে সব প্রমাণ এবং খণ্ডন ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে।
  • ৪. অধিকাংশ ব্যক্তি জ্ঞান ও অজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য করে এবং বিশ্বাস করে যে, তারা বা অপর ব্যক্তিরা কোন কিছুকে সত্য বলে গণ্য করতে পারে যা বস্তুত পক্ষে সত্য নয়। কাজেই কোন ব্যক্তি যদি প্রােটেগোরাসের মতবাদকে (মানুষই সব কিছুর পরিমাপ করার মানদণ্ড) ভ্রান্ত বলে গণ্য করে, তাহলে প্রােটেগোরাসের নিজেরই মতানুসারে সে সত্যতাকে জানছে এমন কথা বলা যেতে পারে।
  • ৫. যদি প্রত্যক্ষ ও জ্ঞান অভিন্ন হয়, প্রত্যক্ষ করা ও জানা, এই দুই এর মধ্যে যদি কোন পার্থক্য না থাকে, তাহলে যে ব্যক্তি পূর্বে কোন বস্তুকে জেনেছে (অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করেছে) এবং বর্তমানে তাকে প্রত্যক্ষ না করলেও স্মরণ করতে সক্ষম, তার জ্ঞানকে জ্ঞান বলে অভিহিত করা চলবে না, কেননা মরণ তো প্রত্যক্ষণ নয়। কিন্তু তা কি মেনে নেওয়া চলে?
  • ৬. প্রত্যক্ষণ জ্ঞানের সবটুকু নয়। কারণ যাকে সত্য বলে সাধারণত স্বীকার করা হয় তার অধিকাংশ অংশই প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের যে জ্ঞান তা পুরোপুরি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, তার অনেকটুকুই বৌদ্ধিক মনন (Intellectual Reflection)-এর মাধ্যমে জানতে হয়। কোন ব্যক্তি মরীচিকা প্রত্যক্ষ করছে। সাক্ষাৎ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতার কথা তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বিচার মননের সাহায্যেই সে তা জানতে পারে। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের সাহায্যে গাণিতিক যুক্তি বা সিদ্ধান্তের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে যে জ্ঞান আমরা লাভ করি তাও প্রত্যক্ষের সাহায্যে লব্ধ হয় না।
  • ৭. ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ তার নিজ পরিসরের বা ক্ষেত্রের মধ্যেও জ্ঞান পদবাচ্য নয়। কোন কিছু সম্পর্কে আমরা জ্ঞান অর্জন করেছি, এ কথা বলতে পারি না যদি আমরা তার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা, অপর বস্তুর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যের কথা জানতে না পারি। একখণ্ড বস্তুকে আমি কাগজ এবং সাদা কাগজ বলে জানছি। তাহলে কাগজ সম্পর্কে এবং তার শ্বেতবর্ণ সম্পর্কে আমার পূর্বে যে সংবেদন হয়েছে তার সঙ্গে বর্তমান সংবেদনের তুলনা করা, তাকে একই জাতীয় বস্তুর সঙ্গে শেণীবদ্ধ করা, কাগজের শ্বেতবর্ণের সংবেদনকে অন্য বর্ণের সংবেদন থেকে পৃথক করা রূপ ক্রিয়াগুলো সম্পাদিত না হলে জ্ঞান সম্ভব হবে না। কিন্তু এর জন্য মননের (Reflection) প্রয়োজন। কাজেই সত্যতাকে জানতে হয় বিচার বা মননের মাধ্যমে, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষে সত্যতা ধরা পড়ে না। স্পর্শের দ্বারাই আমরা কঠিন এবং নরম প্রত্যক্ষ করি কিন্তু মনই বিচার করে যে তারা অস্তিত্বশীল এবং তারা পরস্পরের বিপরীত। শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই আমরা বস্তুকে জানতে পারি না কেননা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা জানতে পারি না বস্তু অস্তিত্বশীল। কাজেই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান পদবাচ্য নয়। আমাদের অনেক জ্ঞানেরই কোন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অস্তিত্ব এবং নাস্তিত্ব, সাদৃশ্য এবং অসাদৃশ্য, একরূপতা এবং বৈষম্য, ঐক্য এবং সাধারণভাবে সংখ্যা এগুলোর জন্য কোন বিশেষ ইন্দ্রিয় নেই। সম্মানজনক এবং অসম্মানজনক, ভাল ও মন্দ-এর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। জ্ঞান হল যা শাশ্বত, যা অপরিণামী তার জ্ঞান। সে কারণে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান হতে পারে না। যথার্থ জ্ঞান অবশ্যই হবে অভ্রান্ত এবং বিষয় যা, তার জ্ঞান। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষে বিষয়ের উপলব্ধি হয় কিন্তু তা যথার্থ জ্ঞান নয়।

জ্ঞান শুধুমাত্র সত্য বচন বা মত নয় এবং তার সঙ্গে জুড়ে দেয়া নিছক ব্যাখ্যা নয় 

জ্ঞান শুধুমাত্র সত্য বচন বা মত নয় : বচন মাত্রই জ্ঞান নয়। মিথ্যা বচন (False Judgment) বা ভ্রান্ত মত (Wrong Opinion) কখনই জ্ঞান নয়। মিথ্যা বচনের একাধিক উৎস রয়েছে, যেমন দূরে অবস্থিত কোন ব্যক্তি বলতে পারে— ঐ হল আমার বন্ধু, যদিও ঐ ব্যক্তি তার বন্ধু নয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার বাস্তব প্রত্যক্ষণকে স্মৃতি প্রতিরূপের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ঐ জাতীয় ভুল বিবৃতি দিচ্ছে। ফলে তার বচনটি মিথ্যা হচ্ছে। মিথ্যা বচন জ্ঞান নয়। কিন্তু তাই বলে জ্ঞান শুধুমাত্র সত্যবচন নয়। কোন ব্যক্তি, কোন কিছুর ওপর ভিত্তি না করে শুধুমাত্র ধারণা করে বসল যে, আসছে শনিবার ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হবে। এমন হতে পারে যে, তার বচন বা বিবৃতিটি নির্ভুল হল। কিন্তু সেক্ষেত্রে বলা যাবে না যে, ব্যক্তিটির ঐ ঘটনা সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল, কেননা ব্যক্তিটি নিছক অনুমান করেছিল যা সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। আবার কোন কোন সময় ব্যক্তি সাক্ষাতভাবে অনুভব করতে পারে যে, কোন কিছু সত্য, যদিও সে তার বিশ্বাসের সপক্ষে কোন সুনির্দিষ্ট হেতু নির্দেশ করতে পারে না। এ জাতীয় ক্ষেত্রে বিশ্বাস সত্য প্রমাণিত হলেও, প্লেটোর মতে, জ্ঞান পদবাচ্য হবে না। এটা হবে নিছক সত্য বচন (True Judgment) বা মত (Right Opinion)।

জ্ঞান সত্য বচন এবং তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ব্যাখ্যা মাত্র নয় : সত্য বচনের সঙ্গে একটি ব্যাখ্যা সংযুক্ত করে দিলেই যে তা জ্ঞান হবে, প্লেটো তা মনে করেন না। কেননা, ব্যাখ্যা দেওয়া বলতে যদি বোঝায় সত্য বচনের বা বিশ্বাসের মৌলিক অংশগুলোর অর্থাৎ উপাদানগত অবয়বগুলোর গণনা মাত্র তাহলে স্বীকার করতে হয় যে, মৌলিক অংশগুলোকে জানা গেছে বা জানা যেতে পারে। নতুবা জ্ঞান হয়ে পড়বে অজ্ঞাত উপাদানকে যথার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করা, যা হবে এক উদ্ভট সিদ্ধান্ত কাজেই ব্যাখ্যা বলতে তা বোঝাতে পারে না। আবার ব্যাখ্যা দেওয়া বলতে যদি বোঝায় যথার্থ বচনকে মৌলিক অংশগুলোতে বা জ্ঞানগম্য অংশগুলোতে বিশ্লেষণ, তা হলে এই জাতীয় ব্যাখ্যা যথাযথ বিশ্বাসকে কখনও জ্ঞানে পরিণত করতে পারবে না। তাই যদি হতো তাহলে কোন একটি রেলওয়ে ওয়াগনের অংশগুলো, যেমন চাকা, অক্ষ প্রভৃতি গণনা করলেই বা কোন শব্দ বর্ণমালা যে বর্ণগুলোর দ্বারা গঠিত, সেগুলো ব্যক্ত করলেই যথাক্রমে রেলওয়ে ওয়াগনের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা শব্দ সম্বন্ধে ব্যাকরণসম্মত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করা গেছে বলা যেতে পারত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নয়। আবার ‘ব্যাখ্যা’ বলতে যদি মনে করা হয় কোন বিশেষ বস্তুর এমন কোন বৈশিষ্ট্যের বা চিহ্নের নামকরণ, যার দ্বারা তাকে অন্যসব বস্তু থেকে পৃথক করা যায়। তাহলেও তা যথার্থ জ্ঞান হবে না। কেননা এই বিষয়টি স্বীকার করে নিলে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। মনে করা যাক্, কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমার যথাযথ ধারণা রয়েছে। এই যথাযথ ধারণাকে জ্ঞানে পরিণত করতে হলে আমাকেই সেই ব্যক্তির কোন একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দোষ-গুণ সম্পর্কে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারণা পূর্ব থেকে থাকলে আমার ব্যক্তিটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রয়েছে কিভাবে বলতে পারি? আর যদি এ কথা বলা হয় যে, ব্যক্তিটির যথাযথ ধারণা বলতে অপরের থেকে তার স্বাতন্ত্র্য নিরূপক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারণাও বোঝায় তাহলে ব্যক্তিটির যথাযথ ধারণার সঙ্গে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সংযুক্ত করা হল জ্ঞান, এ কথা বলা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

যথার্থ জ্ঞান ও তার বৈশিষ্ট্য

প্লেটোর মতে, মানুষ জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সেই জ্ঞান অবশ্যই হবে অভ্রান্ত এবং সৎ অর্থাৎ যা অস্তিত্বশীল, তার জ্ঞান। তার মতে, যথার্থ জ্ঞানের অবশ্যই উপরিউক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য থাকবে। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বা সত্য বিশ্বাসের এই বৈশিষ্ট্য দুটি না থাকার জন্য তারা যথার্থ জ্ঞান বলে আখ্যাত হতে পারে না। প্লেটো প্রােটেগোরাসের ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের আপেক্ষিকতা সম্পর্কীয় অভিমত মেনে নিতে রাজি কিন্তু কোন সার্বিক আপেক্ষিতায় (Universal Relativism) তিনি বিশ্বাসী নন। কারণ তিনি মনে করেন, অনপেক্ষ এবং অভ্রান্ত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। তবে এই অনপেক্ষ এবং অভ্রান্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অভিন্ন নয়, কারণ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের দ্বারা লব্ধ জ্ঞান আপেক্ষিক ও পরিণাম।

হেরাক্লিটাসের মতবাদ— সবকিছুই সবরকমভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এই মতবাদ মেনে নিলে অনেক বিভ্রান্তিকর পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, প্রতিটি বস্তুরই সব গুণ সব সময় পরিবর্তিত হচ্ছে, এ কথা বলা হলে ‘এটি শ্বেতবর্ণ’, এ কথা আমরা বলতে পারি না। কারণ যখন আমরা এটিকে শ্বেতবর্ণ বলেছিলাম তখন এটি শ্বেতবর্ণ থাকলেও আমাদের কথা শেষ হবার আগেই এটি আর শ্বেতবর্ণ থাকছে না। হেরাক্লিটাসের মতবাদ স্বীকার করে নিলে দেখাকে অদেখা (Not-Seeing) না বলে দেখা বলার, প্রত্যক্ষণকে অপ্রত্যক্ষণ না বলে প্রত্যক্ষণ বলার কোন অধিকার আমাদের নেই। এবং যখন আমরা বলি ‘প্রত্যক্ষণ’ হল জ্ঞান তখন আমরা এ কথাও বলতে পারি ‘প্রত্যক্ষণ হল যা জ্ঞান নয়’। আসলে সব কিছু পরিণামী এ কথা বলা হলেও, শব্দের অর্থকে কিছুক্ষণের জন্য অবশ্যই স্থায়ী (Fixed) হতে হবে, তা না হলে কোন ঘােষণাই সুনির্দিষ্ট হবে না। কোন ঘােষণাকেই মিথ্যা না বলে সত্য বলা যাবে না।

প্লেটো হেরাক্লিটাসের অভিমতও স্বীকার করতে রাজি। এই অভিমত অনুসারে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বস্তু , ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিশেষ বস্তু , সবই পরিণামী বা পরিবর্তনশীল এবং সে কারণে তারা যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু প্লেটো তাই বলে স্বীকার করতে রাজি নন যে, এমন কোন বস্তু নেই যা যথার্থ জ্ঞানের বিষয় হতে পারে। তার মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বস্তু জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, জ্ঞানের বস্তুকে স্থায়ী ও অপরিণামী হতে হবে। তা ছাড়া জ্ঞানের বস্তু হবে তা-ই যা সুস্পষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞার (Definition) মাধ্যমে জ্ঞাত হবে। জাতি বা সার্বিকের (Universal)-ই এই বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব, কাজেই জাতি বা সার্বিক হল যথার্থ জ্ঞানের বস্তু। যখন আমরা কোন বিশেষ বস্তুকে ভাল বা কল্যাণপ্রদ (Good) বলি তখন বিশেষ বস্তুটির নানা পরিবর্তন হলেও, ‘কল্যাণ’ প্রত্যয়টি (Concept of Goodness) অপরিবর্তিত থাকে। এখানে কল্যাণ (Goodness) হল সার্বিক বা জাতি, এবং এই বস্তুটি হল কল্যাণপ্রদ’ একটি সার্বিক বা জাতি, যা অপরিণামী, তার সম্পর্কে অবধারণ বা বচন। বিশেষ বিশেষ বস্তু পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু কল্যাণ প্রত্যয়টি অপরিবর্তিত থাকে এবং এই অপরিণামী প্রত্যয়টির প্রেক্ষিতেই আমরা বিশেষ বস্তু কল্যাণপ্রদ কিনা বিচার করি।

বিশেষ বস্তুর জ্ঞান হল সবচেয়ে নিম্নস্তরের জ্ঞান এবং সার্বিক (Highest Universal)-এর জ্ঞান হল সবচেয়ে উচ্চস্তরের বা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। প্লেটোর মতে, যথার্থ জ্ঞান সার্বিকের জ্ঞান হলেও, এ জ্ঞান অমূর্ত বা অসৎ-এর জ্ঞান নয়। কেননা প্লেটোর সার্বিক বিশেষের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত নয়। সার্বিক বিশেষ বহির্ভূত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও বিশেষ সার্বিকের অসম্পূর্ণ বাস্তব প্রতিরূপ (Image)।

মত এবং জ্ঞানের পার্থক্য 

মত এবং জ্ঞান

প্লেটো মত (Opinion) এবং জ্ঞান (Knowledge) – এর মধ্যে প্রভেদ করেছেন। মতের সম্পর্ক প্রতিরূপ বা নকল (Copies)-কে নিয়ে আর জ্ঞানের সম্পর্ক আসল বা আদর্শ (Original or Archetype)-কে নিয়ে। কোন ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ণতার স্বরূপ কি জিজ্ঞাসা করা হলে সে যদি কোন বিশেষ দেশের আইন, যার মধ্য দিয়ে ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ প্রকাশ ঘটেনি তার কথা বলে তাহলে তার সেই মনের অবস্থা হবে মত (Opinion)। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণতার যথাযথ স্বরূপ উপলদ্ধি করতে পারে, নকল ছেড়ে আসল জানতে পারে তাহলে তার মনের অবস্থা হবে জ্ঞান।

প্লেটোর মতে মত হল অজ্ঞতার শামিল এবং মত থেকে জ্ঞানে মানুষ উপনীত হতে পারে। মানুষ মূল বা আদর্শের স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারে। মানুষের মনকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে উপনীত হতে হলে যে ক্রমবিকাশের স্তরগুলোর (Stages of Development) মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয় প্লেটো বিস্তারিতভাবে সেগুলো আলোচনা করেছেন।

জ্ঞান এবং জ্ঞানের স্তরভেদ

প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে জ্ঞান এবং জ্ঞানের স্তরভেদ নিয়ে আলোচনা করেছেন (Republic VI, 509 D to end.)। একটি খুব সুস্পষ্ট প্রতীক অর্থাৎ কিনা সরলরেখার উপমার সাহায্যে তিনি জ্ঞানের স্তরভেদ ব্যাখ্যা করেছেন। সরলরেখাটির চারটি অংশ বা এ ভাবেও বলা যেতে পারে, সরলরেখাটির দুটি ভাগ— মত (Opinion) ও জ্ঞান (Knowledge)। উভয়েরই আবার দুটি স্তর।

সরলরেখাটিকে ধারণা করতে হবে এই ভাবে— এর একটি প্রান্ত পুরোপুরি অন্ধকারে আবৃত এবং এই প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অগ্রসর হতে থাকলে পরিপূর্ণ আলোকে এসে পৌছানো যাবে। যদিও বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত রেখাটি অবিচ্ছেদ্য। রেখাটির দুটি প্রধান স্তর নির্দেশ করছে— দৃশ্যমান (Visible) জগৎ ও বুদ্ধিগম্য (Intelligible) জগৎ এবং এই দুই জগতের মধ্যে কোন আকস্মিক ছেদ নেই। সমালোচক নেটেলশিপ (Nettleship) বলেন, “যখন আমরা মনের চিন্তনের বিভিন্ন স্তরে তার বস্তুর কথা বলি তখন আমাদের এই ধারণা দূর করতে হবে যে চার ধরনের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর বাস্তব বস্তুর কথা বলা হচ্ছে আসলে তারা জগৎ সম্পর্কে চারটি ভিন্ন ভিন্ন অভিমত বোঝাচ্ছে বা একই বস্তুর বিভিন্ন দিককে বোঝাচ্ছে” (R.L. Nettleship: Lectures on the Republic of Plato, Page 239)। আসলে প্লেটো দেখাতে চাইছেন যে, জ্ঞানের অগ্রগতি হল বস্তুর অগভীর বা ভাসা ভাসা জ্ঞান থেকে বস্তুর গভীর তাৎপর্যের জ্ঞান। সে কারণে প্রতিটি উপরের স্তরের এবং প্রতিটি নিচের স্তরের মধ্যে সম্পর্ককে ব্যক্ত করতে গিয়ে প্লেটো তাকে ব্যক্ত করেছেন যে, এ হল একটি প্রতিরূপ বা ছায়া দেখার সঙ্গে বস্তুটিকে প্রতিবিম্বিত বা ছায়াবৃত হতে দেখা (The relation between seeing an image or shadow and seeing the thing imaged or shadowed)।

সরলরেখার একটি ভাগ হচ্ছে মত (Opinion), পূর্বেই বলা হয়েছে এর আবার দুটি স্তর আছে। মতের সর্বনিম্ন স্তরে প্রথমত, প্রতিরূপ বা ছায়া এবং দ্বিতীয়ত, জলে বা মসৃণ কিছুতে বা অনুরূপ কিছুতে পতিত প্রতিবিম্ব যা হল প্রতিরূপের প্রতিরূপ (Image of Image)। মতের সর্ব নিম্নস্তরে রয়েছে যা দৃশ্যমান (অর্থাৎ কিনা যা আকার বা জাতির প্রতিরূপ), তার প্রতিরূপ। প্রশ্ন হল, নিম্নস্তরে মনের বস্তুগুলোকে। প্রতিরূপ, ছায়া এবং প্রতিবিম্ব হিসেবে নির্দেশ করার কারণ কি? নেটেলশিপ (Netteship) এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন যে, ছায়া, প্রতিরূপ, স্বপ্ন এগুলো স্পষ্টতই অবাস্তব এবং বাস্তবের সঙ্গে এদের পার্থক্য মনের কাছে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়, বিশেষ করে যে মন প্রথম চিন্তা করতে শুরু করেছে। কাজেই যা অবাস্তব তাকে নির্দেশ করার জন্যই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

মতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্তর

উদাহরণের সাহায্যে মতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্তরগুলোকে বুঝে নেওয়া যাক : প্রতিরূপ বলতে কি বোঝাচ্ছে? ন্যায়পরায়ণতার ধারণা করতে গিয়ে প্লেটো বলেন, কেউ যদি এথেন্সের আইনের মধ্য দিয়ে যে ন্যায়পরায়ণতা প্রকাশ পেয়েছে তাকে বোঝার চেষ্টা করে তা হবে মতের অন্তর্ভুক্ত প্রতিরূপের উদাহরণ। কেননা, এথেন্সের আইন হল ন্যায়পরায়ণতার অসম্পূর্ণ প্রতিরূপ। এখন কোন আইনজ্ঞ যদি এথেন্সের আইনকে ভুলভাবে উপস্থাপিত করেন তাহলে সেটা হবে প্রতিরূপের ছায়া, যেটি হবে মতের সর্বনিম্নস্তর। কেননা, কোন ব্যক্তি যদি ঐ আইনজ্ঞের ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকেই ন্যায়পরায়ণতা বলে ধারণা করে তাহলে তা হবে মতের সর্ব নিম্নস্তর। কেননা ন্যায়পরায়ণতা এক্ষেত্রে দুইবার বিকৃত হচ্ছে। প্রথমত, এথেন্সের প্রণীত আইনের মধ্য দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত, ঐ আইনজ্ঞের কথার মধ্য দিয়ে। এখানে একটা কথা বুঝে নেওয়া দরকার। নেটেলশিপ বলেন, যখন প্লেটো ‘প্রতিরূপ’ (Image)-এর কথা বলেন তখন তিনি কোন চিত্র বা খােদাই করা প্রতিমূর্তির কথা চিন্তা করছেন না। তিনি প্রধানত শব্দের দ্বারা যে প্রতিরূপ মনে সৃষ্ট হয় তার কথা বলছেন। ভাষাই মানুষের মন এবং বস্তুর মাঝামাঝি প্রতিরূপের সৃষ্টি করে।

মতের অন্তর্গত আর একটু উচ্চস্তরের প্রতিরূপের জ্ঞান হল দৃশ্যমান বস্তু সম্পর্কে অর্থাৎ প্রাণী বা যা কিছু বর্ধনশীল তার সম্পর্কে জ্ঞান, দৃশ্যমান বস্তুর ছায়া বা প্রতিবিম্ব সম্পর্ক নয়। যে ব্যক্তির ঘােড়ার ধারণা হল শুধুমাত্র বাস্তবে অস্তিত্বশীল ঘােড়ার ধারণা, যে উপলব্ধি করেনি যে, বাস্তবে অস্তিত্বশীল ঘােড়া আদর্শ ঘােড়ার অসম্পূর্ণ বাস্তব রূপ, তার মনের অবস্থা হল মত। তবে মতের উচ্চস্তরের সঙ্গেই তার মানসিক অবস্থার সম্পর্ক; যে প্রতিরূপকেই বাস্তব জগৎ বলে গণ্য করে (অর্থাৎ মতের সর্ব নিম্নস্তরের মানসিক অবস্থা যার) তার তুলনায় উচ্চস্তরের। কিন্তু উচ্চস্তরের হলেও তা মত; এমন মনে করা যুক্তিযুক্ত হবে না যে সে যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী। আর একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টাকে বুঝে নেওয়া যেতে পার : কোন ব্যক্তি, যার আদর্শ মানুষের কোন ধারণাই নেই, বিশেষ বিশেষ মানুষ প্রত্যক্ষ করে তাকেই মানুষ বলে জানছে, তার মানসিক অবস্থা মতের উচ্চস্তরের অন্তর্গত। যে ব্যক্তি মােমের তৈরি কোন মানুষের প্রতিকৃতিকেই বাস্তব মানুষ বলে মনে করছে তার মানসিক অবস্থা মতের নিম্নস্তরের অন্তর্ভুক্ত। কেননা প্রথম ব্যক্তি বাস্তবে যে মানুষকে দেখছে সে হল আদর্শ মানুষের নকল কিন্তু সে নকলকে নকল বলে জানছে না বলে তার জ্ঞান যথার্থ জ্ঞান নয়, মত (Opinion)। আর যে মােমের তেরি লোকটিকে, যে তন নকলের নকল, তাকেই আসল মানুষ মনে করছে, সেই যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী নয়। এ হল মত যা মতের নিম্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যে ব্যক্তি আদর্শ মানুষকে জানে বাস্তব মানুষ যার ত্রুটিপূর্ণ প্রকাশ, সে জ্ঞানের অধিকারী এবং তার এই মানসিক অবস্থা জ্ঞানের উচ্চস্তরের অন্তর্ভুক্ত।

মানসিক বিকাশের স্তর-দুটি বৈশিষ্ট্য

প্লেটো এরপর মানসিক বিকাশের সেই স্তর নিয়ে আলোচনা করেছেন যে স্তরে মন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে বুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এটি হল জ্ঞানের নিম্নস্তর। এই স্তরে দুটি বৈশিষ্ট্যর কথা প্লেটো বলেছেন, যদিও তাদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি তিনি ব্যক্ত করেননি। প্রথমত, মন এই স্তরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তবে তাদের কোন কিছুর প্রতীকরূপে ব্যবহার করে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। দ্বিতীয়ত, মন এই স্তরে প্রকল্পের ভিত্তিতে যুক্তি গঠন করে। এই বুদ্ধিগ্রাহ্য বিষয় হল গণিত এবং জ্যামিতির বিষয় অর্থাৎ সংখ্যা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, জ্যামিতিক ক্ষেত্র প্রভৃতি।

জ্যামিতিতে ত্রিভুজের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে ত্রিভুজ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। কোন কিছু প্রমাণ করার জন্য যে ত্রিভুজ অঙ্কন করা হয় তাকে ত্রিভুজের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট ত্রিভুজ বলে গণ্য করা যেতে পারে না। আসলে অঙ্কিত বিশেষ ত্রিভুজের মধ্য দিয়ে যা ব্যাখ্যা করা হয় তাকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিতে হয়। এখানে হয়ত কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারে যে, তাহলে প্লেটো কি দুটি ভিন্ন ত্রিভুজের কথা বলেছেন— ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং বুদ্ধিগম্য? প্লেটো দুটি ত্রিভুজের কথা বলেননি। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ত্রিভুজই হল বুদ্ধিগম্য ত্রিভুজ, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু বৈশিষ্ট্য যা ত্রিভুজত্ব থেকে অন্য কিছু (A property distinguishable from all its other properties which makes it a triangle)।

প্রকল্পের অর্থ

মন এই স্তরে প্রকল্পকে ভিত্তি করে যুক্তি গঠন করে। প্রকল্প (Hypothesis) বলতে প্লেটো সাময়িকভাবে গৃহীত মতবাদকে বোঝাচ্ছেন না, প্রকল্প হল সব বিজ্ঞানের মূলে রয়েছে যে সব সত্য, সেগুলো (“…a ‘hypothesis’ is regarded as conditional or dependent upon something; but Plato’s hypotheses are by no means provisional theories, they are the truths at the truths at the basis of all the sciences.” – Nettleship: Lectures on the Republic of Plato: Page 202.) গণিত এবং জ্যামিতি কতকগুলো আনুমানিক ধারণা বা প্রকল্পের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন গণিতের আনুমানিক ধারণার প্রাথমিক অবস্থা হল সংখ্যা, যার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল যুগ্ম এবং অযুগ্ম হওয়া। এই সংখ্যাকে কেন মেনে নেওয়া হয়েছে গণিতজ্ঞ তার কোন কৈফিয়ৎ দিতে চান না। এই সংখ্যাকে মেনে না নিলে গণিত শিক্ষার শুরুতে স্বীকার করে নেওয়া হয় তাহলে গণিতবিদ এই সংখ্যাকে ভিত্তি করে যুক্তি গঠন করতে পারেন এবং যে কোন গাণিতিক সত্য তার থেকে আবিষ্কার করতে পারেন।

জ্যামিতিবিদ সম্পর্কেও সেই একই কথা বলা চলে। শুরুতে যাকে তিনি স্বীকার করে নেন তা হল জ্যামিতিক ক্ষেত্র (Geometrical Space) এবং তার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব।

কিন্তু এই ধরনের ধারণাকে প্রকল্প বলতে অর্থাৎ কিনা এদের যথার্থ অন্য সত্যের ওপর নির্ভর বলতে প্লেটো কি বোঝাতে চান? প্লেটো বোঝাতে চান না যে তারা অসত্য কারণ তিনি তাদের সত্তার এক ধরনের আকার (A form of ‘Being’) বলে অভিহিত করেছেন। এদের প্রকল্প বলার কারণ এই যে, যদি বস্তুকে সমগ্রভাবে দেখা যায় এবং বস্তু সামগ্রিক বস্তুই, তাহলে দেখা যাবে সে সত্তা হল এক অখণ্ড সমগ্র এবং সেহেতু সমগ্র-এর বিভিন্ন রূপগুলো অবশ্যই পরস্পর সংযুক্ত হবে। কিন্তু গণিতবিদ এবং জ্যামিতিবিদ সত্তার বিভিন্ন রূপকে সম্পূর্ণভাবে স্ব-নির্ভর মনে করেন কিনা তাদের কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে তাদের স্বীকার করে নেন। যাকে ভিত্তি করে তারা সত্য আবিষ্কার করেন, সেগুলো যে এক পরস্পর সংযুক্ত সমগ্রের উপাদান, সেটিকে প্রমাণ করার যে অবকাশ রয়েছে সেদিকে তারা মনোযোগী হন না। কাজেই যাদের নিয়ে তাদের কাজ শুরু হয় (Starting Points) সেগুলো প্রকল্প, কেননা তাদের পরিপূর্ণ সম্পর্কযুক্ত করে দেখানো হয় না।

বিজ্ঞানের লক্ষ হল কোন বিষয়কে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা এবং তাকে সকল বিষয়ের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত, সেটি দেখানো। পরিপূর্ণ জ্ঞান হল প্রত্যক্ষ করা, কিভাবে একটি নিরপেক্ষ নীতি (Unconditional Principle)-র ওপর সকল কিছু নির্ভর এবং কিভাবে নির্ভর। মানুষের মন যদিও কখনও এরূপ নীতিতে উপনীত হতে পারে না, তবুও উপনীত হতে চায়, এবং এই নীতিতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত জ্ঞানের আদর্শে উপনীত হতে পারে না। এই কারণেই বিচারবুদ্ধির চরম স্তরের বর্ণনা দেবার প্রয়োজন আছে বলে প্লেটো উপলব্ধি করেছিলেন।

অ্যারিস্টটল বলেন যে, গণিতিক বিষয়গুলো হল আকার (Forms) এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মধ্যবর্তী বিষয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে এদের পার্থক্য হল, এরা অনাদি এবং অপরিণামী, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নয়। আর আকারের সঙ্গে এদের পার্থক্য হল, গাণিতিক বিষয় সংখ্যায় অনেক, কিন্তু আকার বা জাতি প্রতিটি ক্ষেত্রে এক। কাজেই বুদ্ধিগ্রাহ্য গাণিতিক বিষয়গুলোকে আকারের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখা চলে না। এরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে অর্থাৎ তাদের তুলনায় উৎকৃষ্ট কিন্তু প্রকৃত সার্বিক বা জাতির নিম্নে হওয়াতে নিকৃষ্ট।

জ্ঞানের বা বিচারবুদ্ধির সর্বোচ্চ স্তর হল বিশুদ্ধ আদর্শের স্তর। মানুষের মনের পক্ষে এই আদর্শকে লাভ করা সম্ভব নয়, কিন্তু জ্ঞানের লক্ষ এই আদর্শে উপনীত হওয়া। প্লেটোর মতে, প্রথমত, এটি হল বিশুদ্ধ বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞা (Perfect Intelligence)-র অবস্থা যেখানে কোন ইন্দ্রিয়ের উপাদান (Element of Sense) নেই। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের অনুপস্থিতি এই স্তরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরিপূর্ণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন ইন্দ্রিয়ের উপাদান থাকে না। এর অর্থ হল, বস্তুর প্রতিটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বৈশিষ্ট্যকেই কোন বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারের প্রকাশ রূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। কাজেই কোন প্রতীকী বা অবান্তর উপাদান (Symbolic or Irrelevant Element) থাকে না, বিষয়টি সম্পূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য হয়। যেমন, জ্যামিতিবিদ তার অঙ্কিত ত্রিভুজের প্রতীকটির সব বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাহ্য করে ত্রিভুজত্বের (Triangularity) ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

তেমনি কোন বস্তুকে তিনি যদি পরিপূর্ণভাবে বুঝে নিতে চান তাহলে তিনি তার বৈশিষ্ট্যকে সেভাবেই প্রত্যক্ষ করবেন। তখন তিনি প্রত্যক্ষ করবেন যে, বস্তটি স্থায়ী এবং অপরিণামী আকারের (Form) মিলন স্থল। বস্তুটিকে তার সকল রকম সম্পর্ক ও সাদৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত করেই তখন প্রত্যক্ষ করা হবে। | এটি হল একটি আদর্শ কিন্তু পরিপূর্ণ বিচারবুদ্ধিকে বুঝে নিতে হলে আমাদের এমন একটি মনের কথা অনুমান করে নিতে হবে, যে মনের কাছে প্রতিটি বস্তুর সর বৈশিষ্ট্য, অন্য বস্তুর সঙ্গে তার সব সম্পর্ক এবং সাদৃশ্য পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত হয়েছে। পরিপূর্ণ বিচার বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে কোন প্রকল্পের স্থান নেই। পরিপূর্ণ বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে জগতটি কিভাবে উপস্থাপিত হবে তা বলতে গিয়ে প্লেটো বলেন যে, জগৎ অস্তিত্বসূচক আকারের ক্রম (Series of Forms or Existence) রূপে উপস্থাপিত হবে, যেখানে প্রতিটি আকার তার উপরের এবং নিচের আকারের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত এবং সমগ্র, একটি নিরপেক্ষ নীতি যাকে ‘কল্যাণ’ (the good) রূপে অভিহিত করা চলে তার দ্বারা ঐক্যবদ্ধ। এই জগতে প্রত্যেক কিছুর অবস্থান এবং ক্রিয়া জগতের পরম উদ্দেশ্য, অর্থাৎ কল্যাণের দ্বারা নিরূপিত হয়। এই বিচারবুদ্ধির অবস্থাকে কেবলমাত্র ডায়ালেকটিক্ (Dialectic) বা দার্শনিক জ্ঞানের মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে। জ্ঞানের ক্রমােন্নতির অর্থ হল জ্ঞানের ঐক্য প্রত্যক্ষ করা।

গুহার রুপক

প্লেটো ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের সপ্তম পরিচ্ছেদে তাঁর বিখ্যাত গুহার রূপকের (Allegory of the Cave) মাধ্যমে তার জ্ঞান সম্পর্কীয় তত্ত্বকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

যেসব ব্যক্তিদের মধ্যে কোন দার্শনিক জ্ঞান নেই তাদের প্লেটো তুলনা করেছেন। গুহার মধ্যে বন্দী একদল লোকের সঙ্গে। প্লেটো মাটির নিচে আমাদের একটি গুহার কথা কল্পনা করতে বলেছেন, যে গুহাটির প্রবেশমুখ আলোকের দিকে এবং এই প্রবেশমুখ থেকে গুহার অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত রয়েছে একটি দীর্ঘপথ। এই গুহার মধ্যে অবস্থিত বন্দীরা কেবলমাত্র একটি দিকেই তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পারে। কারণ শৈশব থেকেই তাদের হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা। তাদের কিছু দূরে পিছনের দিকে রয়েছে একটা আগুন, যা জ্বলছে এবং বন্দীদের ও আগুনের মাঝে রয়েছে পর্দার মত ছােট একটা দেওয়াল।

গুহার বন্দীদের মুখ দেওয়ালের দিকেই। এই বন্দীরা আগুনের আলোকে দেওয়ালে প্রতিফলিত নিজেদের ছায়া এবং পিছন দিক দিয়ে মানুষের নিয়ে যাওয়া কৃত্রিম বস্তু যেমন গাছ বা পাথরের তৈরি মানুষের মূর্তিগুলো শুধুমাত্র দেখতে পায়। তারা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখার সুযোগ পায় না।

এই বন্দীরাই হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ যারা সারা জীবন শুধু ছায়াকেই দেখে, যার ছায়া, সেই কায়াকে বা সেই বস্তুর অস্তিত্বশীল বস্তুকে দেখার সুযোগ লাভ করে না। তারা সত্তাকে বা বাস্তবকে দেখে না, সত্যকে জানতে পারে না। তাদের জগৎ সম্পর্কে অভিমত অসঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যবিহীন। তাদের নিজেদের কামনা, সংস্কার প্রভৃতি এবং ভাষার মারফৎ ব্যক্ত অপর ব্যক্তির কামনা-বাসনা প্রভৃতির দ্বারা তাদের জগতের ধারণা বিকৃত। তারা তাদের এই বিকৃত ধারণাগুলোকেই আঁকড়ে ধরে থাকে। সত্যের দিকে তাকাতে বললেও এরা তাকায় না। ছায়াকে তারা বাস্তবের থেকেও অধিকতর বাস্তব বলে মনে করে। অবশেষে কোন একজন লোক গুহা থেকে পালিয়ে গুহার বাইরে সূর্যালোকে এসে উপস্থিত হয়। এই প্রথম সে বাস্তব বস্তুকে দেখে, কায়াকে দেখে এবং বুঝতে পারে যে এতদিন যাবত সে ছায়ার দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। এমন হতে পারে যে, এই ব্যক্তি গুহার মধ্যে গিয়ে তার পূর্বের সঙ্গী বন্দীদের গিয়ে সত্য কি, বলার চেষ্টা করতে পারে এবং তাদের পথ দেখিয়ে গুহার বাইরে নিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট হতে পারে। কিন্তু সঙ্গীদের বুঝিয়ে বলতে গিয়ে সে হয়ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। কেননা সুর্যালোক থেকে চলে আসার জন্য সে ছায়াগুলোকে আগের মত আর স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হবে না এবং গুহা থেকে পালিয়ে যাবার আগে সে যত না বোকা ছিল, তার সঙ্গী বন্দীরা তাকে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি বোকা ভাবতে পারে।

রূপকের তাৎপর্য ও এই রূপকের মাধ্যমে প্লেটো যা বলতে চেয়েছেন তা হল এই যে, মানুষের মধ্যে অনেকেই আছে যারা ছায়ার জগৎ থেকে কায়ার জগতে চলে আসে, যদিও তখনও পর্যন্ত বুদ্ধির দ্বারা জ্ঞেয় যে অতীন্দ্রিয় সত্তা তাকে জানার কোন সুযোগ তাদের হয়নি। এই কায়ার জগৎ হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জগৎ। আবার ঐ ব্যক্তিরাই নিজের প্রচেষ্টায় জ্ঞাতি বা আদর্শকে প্রত্যক্ষ করতে পারে, যাকে শুধুমাত্র বুদ্ধির দ্বারাই জানা যেতে পারে, এবং আরও সচেষ্ট হলে সকল কিছুর হেতু, সব সত্য এবং বুদ্ধির উৎস, কল্যাণের ধারণাকে (Idea of the Good) তারা জানতে পারে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে ছায়ার থেকে কায়ার জগতে, কায়ার থেকে আকারের বা আদর্শের জগতে এবং সবশেষে সমস্ত আদর্শের যে উৎস তাতে উত্তরণের সম্ভাবনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির সজ্ঞান প্রয়াস ও অধ্যবসায়। এই উত্তরণের জন্য প্লেটো শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারাই এই অন্তহীন সর্ব-নিরপেক্ষ সত্য এবং মূল্যকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে এবং মানুষ মিথ্যা, ভুল, সত্য এবং মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতার যে ছায়ার জগৎ তার থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রের শাসকবর্গের পক্ষে এই শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। কেননা রাষ্ট্রের শাসকবর্গ শিক্ষিত না হলে তারা হবেন অন্ধ নাগরিকের অন্ধ পরিচালক। প্লেটোর মতে, যিনি মানুষের যথার্থ কল্যাণের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত নন, তিনি কখনও রাষ্ট্রের নাগরিকদের যথার্থ কল্যাণ-সাধনে সমর্থ হননা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব রাষ্ট্রের কল্যাণ-তত্ত্বের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।

ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ 

আকারের তাৎপর্য ও উৎস

যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু, প্লেটোর মতে, নিত্য এবং অপরিণামী। তাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নয়, বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যে জানতে হয়। প্লেটো এর নাম দিয়েছেন আকার (Form)। এই আকারকে ধারণা (Idea) নামেও তিনি অভিহিত করেছেন। বা ধারণাকে সার্বিকও (Universal) বলা হয়। জেলার বলেন যে, প্লেটোর দর্শনে আকার বা ধারণার তিন ধরনের আছে। তাত্ত্বিক (Ontological), উদ্দেশ্যগত (Teleological), এবং যৌক্তিক বা যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত (Logical)। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, এই তিনাটি দিকই প্লেটোর দর্শনে সমান গুরুত্বপূর্ণ নয় (Zeller: ‘Outlines of the History of Greek Philosophe’; Page 131.)।

যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে প্লেটোর আকারের তাৎপর্য : জাতিবাচক বা সাধক শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখলেই এই আকারের তাৎপর্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যখন আমরা বলি এটি একটি ‘অশ্ব’, তখন এই অশ্ব, শব্দটির দ্বারা কী বুঝি? স্পষ্টতই আমরা প্রতিটি বিশেষ অশ্ব থেকে স্বতন্ত্র কিছু বুঝে থাকি। একটা বিশেষ অশ্বকে আমরা অশ্ব বলি। কারণ সব অশ্বের মধ্যে বর্তমান একটা সাধারণ প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যতে সে অংশগ্রহণ করে। ‘অশ্ব’, ‘বৃক্ষ’, ‘মানুষ’ প্রভৃতি সাধারণ বা জাতিবাচক শব্দের ব্যবহার ভাষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কাজেই এই ধরনের শব্দ অর্থহীন এ কথা বলা যেতে পারে না। কাজেই ‘অশ্ব’ শব্দটির যদি কোন অর্থ থাকে, তাহলে ঐ শব্দটি কোন বিশেষ অশ্বকে না বুঝিয়ে ‘অশ্বত্ব’ নামে কোন সাধারণ বা সার্বিক ধর্মকে বোঝাবে, বিশেষ বিশেষ জন্ম বা মৃত্যুর সঙ্গে এই সার্বিক অশ্বত্বের কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ কিনা বিশেষ বিশেষ অশ্বের জন্ম বা মৃত্যুর সঙ্গে এর জন্ম বা মৃত্যু ঘটে না। বস্তুত দেশে কালে এর কোন অবস্থান নেই, এ হল নিত্য (Eternal)।

তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে আকারের তাৎপর্য : আধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে আকারবাদের তাৎপর্য হল, ‘অশ্ব’ শব্দটি একটি আদর্শ অশ্বকে বোঝায়। বিশেষ বিশেষ অশ্ব এই আদর্শ অশ্বের প্রকৃতিতে অংশগ্রহণ করে কিন্তু পরিপুর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাদের এই অংশগ্রহণ ত্রুটিপূর্ণ, সেই কারণে প্রকাশও ত্রুটিপূর্ণ, এর জন্যই আমরা অনেক অশ্বের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করি। বিশেষ বিশেষ অশ্ব, আদর্শ অশ্বের ত্রুটিপূর্ণ বা অপরিপূর্ণ (Imperfect) প্রকাশ, আদর্শ অশ্বই হল সত্য। বাস্তবে যে বিশেষ বিশেষ অশ্ব প্রত্যক্ষ করা হয়, তারা হল অবভাস বা অসৎ, তাদের যথার্থ সত্তা নেই।

ধারণা মতবাদের তিনটি উৎস : অ্যারিস্টটলের মতে, প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের তিনটি উৎস আছে – এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ, হেরাক্লিটাস এবং সক্রেটিসের শিক্ষা। হেরাক্লিটাসের কাছ থেকে প্লেটো পরিণাম বা ভবনের (Becoming) ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন যেটি তার দর্শনে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের রূপ লাভ করেছে। এলিয়ার দার্শনিকদের কাছ থেকে তিন পরম সত্তার ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। সক্রেটিসের কাছ থেকে তিনি প্রত্যয় সম্পর্কীয় মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন এবং এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের সত্তার ধারণার সঙ্গে সক্রেটিসের প্রত্যয়কে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন।

সার্বিক প্রত্যয় ও ঐক্যবিধায়ক সূত্রের প্রয়োজনীয়তা

সুন্দর-এর সার্বিক প্রত্যয় : প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রথে ‘আকারবাদ’ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে, যখন অনেকগুলো বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তির একটি সাধারণ নাম দেওয়া হয়। তখন সেই নাম অনুযায়ী তাদের একটা ধারণা (Idea) বা আকার (form) থাকে। এটিই হল সার্বিক (Universal)। এটিই হল সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম, যা আমরা সৌন্দর্য এই প্রত্যয়টিতে উপলব্ধি করি। আমরা অনেক সুন্দর বস্তু প্রত্যক্ষ করি, যেমন-সুন্দর গোলাপ ফুল, সুন্দর প্রাকৃতিক দশ্য, সুন্দর রমণীর মুখমণ্ডল, সুন্দর চন্দ্রালোকিত রাত্রি। অনেক সুন্দর বস্তু থাকলেও আমরা সুন্দর এরই একটি সার্বিক প্রত্যয় গঠন করতে পারি , যা হল সৌন্দর্য (Beauty)।

সার্বিক প্রত্যয়ে বস্তুগত সারধর্মকে উপলব্ধি : প্রশ্ন হল, সৌন্দর্যের যে সামান্য প্রত্যয় গঠন করা হল তা কি বস্তুনিরপেক্ষ বা ব্যক্তিসাপেক্ষ (Subjective) নয়? আমরা অনেক সময় বলে থাকি, এটি আমাদের মনের ধারণা মাত্র, যার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। প্লেটো কিন্তু এই অর্থে তাকে বোঝেননি? প্লেটোর মতে, এই সার্বিক প্রত্যয় বস্তুনিরপেক্ষ বা ব্যক্তিসাপেক্ষ নয়। প্লেটোর মতে, আমরা এই সার্বিক প্রত্যয় বস্তুগত স্বরূপ ধর্ম (Objective Essence)-কে উপলব্ধি করি। প্লেটোর মতে, সার্বিক প্রত্যয়ের অবশ্যই সত্তা (Reality) আছে। সত্তা না থাকলে আমাদের চিন্তনের বিষয়বস্তু তারা হতে পারে না। কাজেই তারা মনোগত বা বস্তু নিরপেক্ষ প্রত্যয় মাত্র নয়। আমাদের মন তাদের সৃষ্টি করে না, আবিষ্কার করে মাত্র।

নৈতিক এবং সৌন্দর্য বিষয়ক সার্বিক প্রত্যয় : প্লেটো প্রথমে নৈতিক এবং সৌন্দর্য বিষয়ক সার্বিক প্রত্যয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর মতে, সর্বনিরপেক্ষ বা পরম কল্যাণ (Absolute Good) এবং সর্বনিরপেক্ষ বা পরম সৌন্দর্য (Absolute Beauty)-এর স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে। বস্তুত তিনি তাদের অভিন্নও গণ্য করেছিলেন। কিন্তু প্লেটো কল্যাণ, সৌন্দর্য, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি নৈতিক এবং সৌন্দর্য-বিষয়ক প্রত্যয়েরই যে সত্তা স্বীকার করেছেন তা নয়, তিনি ‘অশ্ব’, ‘মানুষ’, ‘বিড়াল’ প্রভৃতি জাতিবাচক প্রত্যয়ের অনুরূপ সার্বিক-এর অস্তিত্বও স্বীকার করেছেন। তিনি শ্বেতত্ব, মিষ্টত্ব প্রভৃতি গুণের ধারণার বা আকারের কথা, এমনকি বিছানা, টেবিল, চেয়ার প্রভৃতির আকারের কথাও বলেছেন। (B. G Lodge তার গ্রন্থ Plato’s Theory of Ethics-এ ‘idea’-র আলোচনা প্রসঙ্গে তাদের এগারোটি ভাগে শ্রেণীবিভক্ত করেছেন। যেমন, প্রাকৃতিক বিষয় (Natural Phenomena)-চুল, কাদা, ময়লা, জল, আগুন, উত্তাপ, শীতল ইত্যাদি; জীব (Organisms), মানুষ, ঘােড়া, বলদ ইত্যাদি; দেহের বিষয় (Goods of Body)-স্বাস্থ্য, শক্তি, রোগ, দুর্বলতা, দুঃখ ইত্যাদি; মনের বিষয় (Goods of Mind)-চতুরতা, জড়তা, জ্ঞান, অজ্ঞতা ইত্যাদি। এই রকম আরও বিভাগ আছে।) বস্তুগত স্বরূপধর্মরূপে এরা নিজ অধিকারে অস্তিত্বশীল।

ঐক্যবিধায়ক সূত্রের প্রয়োজনীয়তা : পরমকল্যাণ-সার্বিক প্রত্যয়কে পরম সৌন্দর্যের সার্বিক প্রত্যয়ের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু অশ্ব-এর সার্বিক প্রত্যয়কে যদি মানুষের সার্বিক প্রত্যয়ের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা হয় তাহলে তা হবে এক হাস্যকর ব্যাপার। কাজেই কোন ঐক্যবিধায়ক সূত্রের (Principle of Unity) অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে, যাতে স্বরূপধর্মগুলোর (যেমন— অশ্বের, বৃক্ষের, মানুষের) একটি থেকে আর একটিকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় না রেখে একটি সর্বোপরি ঐক্যবিধায়ক সূত্রের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ করা যায়। প্লেটো সে ব্যাপারেই মনোযোগী হলেন।

ধারণা হলো বস্তুগত স্বরূপ ধর্ম, এর বৈশিষ্ট্য ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বস্তুগত স্বরূপ ধর্মকেই প্লেটো ধারণা বা আকার বলে অভিহিত করেছেন। ধারণা সাধারণত মনে অবস্থিত কোন ব্যক্তি সাপেক্ষ (Subjective) প্রত্যয়কে বোঝায়। এ প্লেটো যখন ধারণা বা আকারের কথা বলেন তখন তিনি সার্বিক প্রত্যয়ের বস্তুগত স্বরূপ ধর্মের বিষয়টিই নির্দেশ করছেন এবং তাকেই প্লেটো ধারণা নামে অভিহিত করেছেন। এই ধারণার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে –

  • (১) এদের স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে।
  • (২) এরা হল সার্বিক। ধারণা কোন বিশেষ বস্তু নয়। অশ্বের ধারণা হল সার্বিক অশ্ব (Universal Horse), কোন বিশেষ অশ্ব নয়।
  • (৩) ধারণা হল চিন্তন, কোন বস্তু নয়। কেননা, বস্তু হলেই সেটি বিশেষ হয়ে যাবে। তবে তারা কোন বিশেষ ব্যক্তিমনের চিন্তন নয়। তারা হল বস্তুগত ধারণা বা চিন্তন, যারা কোন বিশেষ মনের ওপর নির্ভর না করেও নিজ অধিকারে অস্তিত্বশীল।
  • (৪) প্রতিটি ধারণা হল এক ঐক্যবিধায়ক সূত্র। এটি হল এক, যদিও বিশেষ বস্তু হল বহু। যেমন, সৌন্দর্যের ধারণা হল এক, যদিও সুন্দর বস্তুর সংখ্যা বহু।
  • (৫) ধারণা হল অপরিণামী, অনাদি এবং অবিনশ্বর। অর্থাৎ এরা নিত্য। অসংখ্য সুন্দর বস্তু এক নিত্য সৌন্দর্যের ত্রুটিপূর্ণ প্রকাশ।
  • (৬) ধারণা হল সকল বস্তুর স্বরূপ ধর্ম (Essence), অশ্বের ধারণা হল প্রতিটি বিশেষ বিশেষ অশ্বের স্বরূপ ধর্ম, যা বস্তুগত।
  • (৭) প্রতিটি ধারণা তার নিজের দিক থেকে পূর্ণ (Perfect)। যেমন – মানুষের ধারণা হল এক আদর্শ ও পূর্ণ মানুষের ধারণা, বিশেষ বিশেষ মানুষের মধ্য দিয়ে যার প্রকাশ। তবে কোন বিশেষ ধারণাই এই পূর্ণ আদর্শ ধারণার পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি হতে পারে না। বিশেষ বস্তুর ক্ষেত্রে এই অভিব্যক্তি অপূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ। সেই কারণে বিশেষ বিশেষ বস্তু হল অপূর্ণ ও অনিত্য।
  • (৮) ধারণাগুলো দেশে কালে অবস্থিত নয়, কেননা তাহলে তারা হয়ে পড়বে বিশেষ।
  • (৯) ধারণা বুদ্ধিগম্য।
  • (১০) প্লেটো তাঁর জীবনের শেষের দিকে ধারণাগুলোকে পিথাগোরাসের সংখ্যার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন। প্লেটো অবশ্য এ কথা বলেননি, অ্যারিস্টটলের কাছ থেকেই এ কথা জানা যায়।

প্লেটো ধারণা বা আকার বলতে বস্তুগত স্বরূপ ধর্ম (Objective Essence) বুঝেছেন। এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, এই স্বরূপ ধর্মকে কি অর্থে তিনি বস্তুগত গণ্য করেছেন? বিশেষ বস্তুকে অতিক্রম করে তাদের কি নিজস্ব কোন অস্তিত্ব (Transcendental Existence) আছে? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেবে যে, তাহলে বস্তুগত স্বরূপ ধর্মগুলোর পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক কী? জগতের বিশেষ বস্তুর সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কী? তাহলে প্লেটো কি দুটি জগৎ— একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ এবং আর একটি প্রত্যক্ষ এ অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন? আর একটি প্রশ্ন, এই বস্তুগত স্বরূপ ধর্মের যে জগৎ তার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী? 

প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের অযথাযথ উপস্থাপন : প্লেটো তার রচনার বিভিন্ন জায়গায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অতিক্রম করে স্বরূপ ধর্মের এক ভিন্ন জগত (A separate world of transcendental essences)-এর কথা বলেছেন। কিন্তু কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে সতর্ক হতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হল, মানুষের পক্ষে কোন কিছু বোঝাবার জন্য সাধারণ মানবীয় ভাষা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ভাষার সাধারণ অর্থ গ্রহণ না করে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধানই হল সমীচীন পন্থা। কপলস্টোন বলেন যে, প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদকে অনেক সময় অযথার্থভাবে উপস্থাপিত করা হয়। বলা হয় যে, প্লেটোর ধারণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই জগতকে অতিক্রম করে এক অতীন্দ্রিয় জগতে অবস্থান করে। বিভিন্ন হওয়ার অর্থে তারা বলতে চান দেশগত সম্পর্ক শূন্য হওয়া। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু এই সার্বিক ধারণাগুলোতে অংশগ্রহণ করে বা তার নকল বা অনুলিপি (Copies), কিন্তু ধারণাগুলো তাদের এক নিজস্ব অপার্থিব জগতে অবস্থান করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলো পরিবর্তনশীল। বস্তুত, সব সময়ই তারা পরিবর্তিত হচ্ছে, তাদের কখনও যথার্থভাবে সত্তাবান বলা যেতে পারে না। ধারণাগুলো এক অতীন্দ্রিয় জগতে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন মনের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে অবস্থান করছে। প্লেটোর মতবাদকে এইভাবে উপস্থাপিত করতে গিয়ে বলা হয় যে, সার্বিকের এক রহস্যময় অনিবার্য সত্তা আছে। প্লেটোর মতবাদকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের কারণ ও কপলস্টোন বলেন যে, প্লেটোর মতবাদকে এইভাবে উপস্থাপিত করার মূলে রয়েছে তিনটি কারণ –

  • (১) ফিডাে-তে প্লেটো বলেছেন যে, আত্মা দেহের সঙ্গে যুক্ত হবার পূর্বে এক অতীন্দ্রিয় রাজ্যে অস্তিত্বশীল ছিল, যেখানে আত্মা পরস্পর বিচ্ছিন্ন বহুসংখ্যক স্বরূপ ধর্মকে (Essences) ধারণারূপে প্রত্যক্ষ করেছিল। জ্ঞান হল আত্মার দেহের সঙ্গে যুক্ত হবার পর এই ধারণাগুলোকে স্মরণ করা, যে ধারণাগুলোকে আত্মা দেহের সঙ্গে যুক্ত হবার পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছিল।
  • (২) অ্যারিস্টটল তার ‘মেটাফিজিকস্’ গ্রন্থে প্লেটোর আকারবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, প্লেটো বার বার অনুমান করেছেন যে, ধারণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু ছাড়াও অস্তিত্বশীল হতে পারে।
  • (৩) টাইম্যায়িয়ুস গ্রন্থে প্লেটো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ঈশ্বর বা জগৎ নিয়ন্ত্রণকর্তা আকারের নমুনা (Model of the Forms) অনুসারে জগতের বস্তুগুলোকে গঠন করেন। এর অর্থ হল আকার বা ধারণাগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু এবং ঈশ্বর উভয়ের থেকেই স্বতন্ত্র অবস্থায় থাকতে পারে।

সমালোচকদের বক্তব্য 

প্লেটোর সমালোচকবৃন্দ উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলেন যে, প্লেটো দুটি জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। তিনি স্বনির্ভর অসংখ্য স্বরূপ ধর্ম-এর কথা বলেছেন, যাদের কোন তত্ত্বগত (Ontological) ভিত্তি নেই, তারা ঈশ্বরের ওপরও নির্ভর নয়। প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু এবং ধারণার মধ্যে ও ধারণাগুলোর পরস্পরের মধ্যেও সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে মূলত বিফল হয়েছেন। কপলস্টোন মনে করেন, সমালোচকদের এই সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন না হলেও, পুরোপুরি সত্য নয়। সমালোচকবৃন্দ কতকগুলো বিষয়ের তেমন মনোযোগী হননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, অসংখ্য ধারণাকে ঐক্যবদ্ধ করার প্লেটো যে একটি ঐক্যবিধায়ক নীতির সন্ধান করেছিলেন অর্থাৎ তিনি যে ধারণাগত তত্ত্বগত ভিত্তির অনুসন্ধান করেছিলেন সমালোচকবৃন্দ তা লক্ষ করেননি। এলিয়ার দার্শনিকদের ‘এক’ (One) সম্পৰ্কীয় মতবাদের সাহায্যে প্লেটো যে এক ও বহুর সম্পর্ক বিষয়ক সমস্যার সমাধানেও সচেষ্ট হয়েছিলেন এই বিষয়টিও উপেক্ষা করার প্রবণতা সমালোচকদের মধ্যে দেখা যায়। কাজেই প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদে যে সব প্রশ্ন দেখা দিতে পারে সেগুলো বাস্তবিকই প্লেটো সমাধান করেছিলেন কিনা তা বিতর্কের বিষয় হতে পারে কিন্তু পরবর্তীকালে যেগুলো অ্যারিস্টটলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু প্লেটোর করেনি, সমালোচকদের এই ধারণা যুক্তিসঙ্গত নয়। অ্যারিস্টটল যে সব অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন তার অনেকগুলোকে প্লেটো পূর্ব থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। সাধারণত প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ যে প্রচলিত ধরণে উপস্থাপিত হয় এবং এই উপস্থাপনের সমর্থনে যে যুক্তিগুলো দেখানো হয় তার সম্পর্কেও কিছু বলা প্রয়োজন। এগুলো হলো – 

  • (১) প্লেটো আকার বা ধারণার কথা বলতে গিয়ে ধারণাগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকে, একথা বলেছেন সত্য, কিন্তু প্লেটোর বক্তব্যের যথাযথ অর্থ করতে গেলে বলতে হয় যে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপর নির্ভর না করেও তাদের স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে। ধারণা যদি প্লেটোর অভিমতানুসারে অভৌতিক স্বরূপ ধর্ম (Incorporeal Essence) হয়, প্লেটো কি করে বলতে পারেন যে তারা দেশে অবস্থিত হবে? ধারণা আধ্যাত্মিক, এর অর্থ এই নয় যে, কোন অতীন্দ্রিয় জগতে তারা অবস্থান করে। আসলে প্লেটো বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিশেষ বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বিনাশ বা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধারণারও পরিবর্তন বা বিনাশ সাধিত হয় না।
  • (২) দেহ বিযুক্ত আত্মার অবস্থান এবং আত্মার অমরত্বের বিষয়টিকে অনেকে অলীক বা মিথ্যা গণ্য করলেও কপলস্টোনের মতে, এর অলীকত্ব সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হয়নি। কাজেই আত্মা দেহের সঙ্গে যুক্ত হবার পূর্বে ধারণাগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছে, এই অভিমত মেনে নিলে তার থেকে সিদ্ধান্ত করা যুক্তিসঙ্গত নয় যে, ধারণাগুলো কোন স্থানে (Space) অর্থাৎ দেশে অবস্থান করছিল। এটাকে একটা উপমা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্লেটোর ঐ বক্তব্য থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও সঙ্গত নয় যে, স্বরূপ ধর্মগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তারা কোন তত্ত্বগত ঐক্যের সূত্র বা নীতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধও হতে পারে।
  • (৩) অ্যারিস্টটল যদি বলে থাকেন যে, প্লেটো আকারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, তা হলে অ্যারিস্টটল বিষয়টি বুঝেই সমালোচনা করেছেন, এ কথা বলা হলে অ্যারিস্টটলের সমালোচনার প্রতি সুবিচার করা হবে না।

তবে কপলস্টোন যে কথা বলেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তা হল এই যে, অ্যারিস্টটল বিচ্ছিন্ন করা বলতে যা বুঝেছেন, প্লেটো তা-ই বলতে চেয়েছেন কিনা সেটা বিচার করে দেখতে হবে। আরও বিচার করে দেখতে হবে যে, প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল যে সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেগুলো প্লেটোর স্বীকৃত হেতুবাক্য থেকে যৌক্তিকভাবে নিঃসৃত হয় কিনা। প্লেটো টাইম্যায়িয়ুসে বলেছেন যে, আকার বা ধারণাগুলো ‘ডেমিয়ার্জ’ (Demiurge) বা জগৎ নিয়ন্ত্রণকর্তা থেকে স্বতন্ত্র। তাহলে মেনে নিতে হয় যে, তিনি তাদের শুধুমাত্র এই জগতের বস্তু থেকে নয়, নিয়ন্ত্রণকর্তা এবং যদি আমরা তাকে ঈশ্বর বলে অভিহিত করি তার থেকেও তাদের অতিবর্তী (Outside) বলেছেন। তবে এমন কথাও মনে করার অবকাশ আছে টাইম্যায়িয়ুসে যে নিয়ন্ত্রণকর্তার কথা বলা হয়েছে তা হল নিছক একটা আনুমানিক ধারণা। প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ তার একাডেমিতে বক্তৃতামালার মধ্যে যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে, ডায়ালগে প্রকাশিত মতবাদ থেকে তা স্বতন্ত্র।

বিভিন্ন ডায়ালগে আকার সম্পর্কীয় মতবাদের উপস্থাপন

ডায়ালগে ‘ফিডাে’-তে বলা হয়েছে, সত্যকে ইন্দ্রিয় মারফত জানা যায় না, শুধুমাত্র বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে জানতে হয়। বিচারবুদ্ধি, যার ‘প্রকৃত সত্তা’ আছে, তাকে জানে। ‘যার প্রকৃত সত্তা আছে’, বলতে গিয়ে প্লেটো তাদের বস্তুর স্বরূপ ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন এবং উদাহরণস্বরূপ ন্যায়পরায়ণতা, সৌন্দর্য, কল্যাণ প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন। একথাও বলা হয়েছে যে, কোন বিশেষ বস্তু সুন্দর, কারণ এক অমূর্ত সৌন্দর্যের অস্তিত্ব আছে, বিশেষ বস্তু যাতে অংশগ্রহণ করে। ফিডােতে প্লেটো ধারণাগুলিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে মনে হয় তারা হল স্ব-নির্ভর সার্বিক (Subsistent Universals)। কিন্তু তারা বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন (Detached) স্ব-নির্ভর সার্বিক, এরূপ অভিমত প্লেটো পােষণ করেছেন মনে হয় না। তাছাড়া প্লেটো যে এক’কে কল্যাণের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছেন, সেই ঐক্য বিধায়কসূত্রের কোন উল্লেখ ফিডােতে নেই।

সিম্পােসিয়াম-এ পরম সৌন্দর্যের কথা : ‘সিম্পােসিয়াম’ ডায়ালগে প্লেটো এক সর্বনিরপেক্ষ পরম সৌন্দর্যের কথা বলছেন যা নিত্য, নিজে নিজে অস্তিত্বশীল, অপরিণামী এবং যার কোন ধ্বংস নেই। অন্যান্য বস্তু সুন্দর, কারণ তারা এই সর্বনিরপেক্ষ সৌন্দর্যে অংশগ্রহণ করে। সিম্পােসিয়ামের এই আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, সৌন্দর্যের এই স্বরূপধর্ম এর বস্তুগত সত্তা আছে, এটি নিছক একটি মনোগত প্রত্যয় নয়। প্রশ্ন হল, সৌন্দর্যের স্বরূপ ধর্ম কি সুন্দর বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন? এটি বিচ্ছিন্ন এই অর্থে যে, এটি বাস্তবে অস্তিত্বশীল, তবে বস্তুর সঙ্গে দৈশিক সম্পর্ক শূন্য হয়ে এক নিজস্ব জগতে এটি অস্তিত্বশীল নয়। যেহেতু নিরপেক্ষ সৌন্দর্য আধ্যাত্মিক সেহেতু এর ক্ষেত্রে দেশগত বা কালগত, বিচ্ছিন্নতা আরোপ করা যেতে পারে না। এটি দেশ কাল ঊর্ধ্ব। কাজেই এটি কোথায়, এই প্রশ্ন এই ক্ষেত্রে ওঠে না। কাজেই বিচ্ছিন্ন কিনা এই প্রশ্ন এর উত্তরে বুঝে নিতে হবে না প্লেটোর স্বরূপধর্ম-এর মনোগত প্রত্যয়ের অতিরিক্ত অস্তিত্ব আছে কিন্তু দৈশিক দিক থেকে তারা বিশেষ বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য এমন বোঝায় না। আসল কথা, এর অস্তিত্ব আছে। অস্তিত্বশীল বললে কোথায় অস্তিত্বশীল, এই প্রশ্ন এক্ষেত্রে ওঠে না। এটি বিশেষ বস্তুর অন্তর্বর্তী এবং অতিবর্তী উভয়ই। এই বস্তুগত স্বরূপ-ধর্ম ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অধিগম্য নয়, কেবলমাত্র বুদ্ধির দ্বারা অধিগম্য। ‘সিম্পােসিয়াম’ ডায়ালগে এমনও বলা হয়েছে যে, সর্বনিরপেক্ষ সৌন্দর্য হল চরম ঐক্যবিধায়ক নীতি। তাই যদি হয় তাহলে রিপাবলিক ডায়ালগের পরমকল্যাণের (Absolute Good) সঙ্গে একে অভিন্ন গণ্য করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে।

রিপাবলিক-এ ধারণার কথা : ‘রিপাবলিক’ ডায়ালগে বলা হয়েছে যে, সত্যিকারের বা প্রকৃত দার্শনিকের জ্ঞানের বিষয়বস্তু হল আকার বা ধারণা, যা পরিপূর্ণভাবে বাস্তব এবং যার সত্তা আছে। প্রকৃত দার্শনিক সৌন্দর্যের এবং কল্যাণের স্বরূপধর্মকে জানতে চায় যা যথাক্রমে বিশেষ বিশেষ সুন্দর বস্তুতে বা কল্যাণপদ বস্তুতে বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে। যারা অদার্শনিক, তারা অনুধাবন করতে পারে না যে, সৌন্দর্যের স্বরূপ ধর্ম অসংখ্য সুন্দর বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েও তার থেকে পৃথক। তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব, তাদের রয়েছে মত (Opinion), তাদের যথার্থ জ্ঞান নেই।

কল্যাণের ধারণা

আকারের স্ব-নির্ভর অস্তিত্ব আছে : আকারের যে স্ব-নির্ভর অবস্থান (Subsistence) রয়েছে, আকার যে বাস্তব; রিপাবলিক-এ’ ‘কল্যাণের’ ধারণার (The Idea of the Good) বিবরণ থেকে জানা যায়। রিপাবলিক-এ কল্যাণের ধারণাকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সেখানে কল্যাণের ধারণার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তার থেকে জানা যায় যে, কল্যাণকে তিনি একটি ঐক্যবিধায়ক সূত্র রূপে গ্রহণ করেছেন। এই কল্যাণের ধারণাকে একটি সার্বিক ধারণা মাত্র বা একটি অবাস্তব অস্তিত্বহীন উদ্দেশ্যমূলক সূত্র রূপে গ্রহণ করা যায় না। এটি কেবলমাত্র একটি জ্ঞানবিদ্যা সম্বন্ধীয় সূত্র নয়। এটি একটি আধিবিদ্যক বা তাত্ত্বিক সূত্র, একটি সত্তা সম্পর্কীয় সূত্র। কাজেই মেনে নেওয়া যায় যে, এটি বাস্তব এবং এর স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে।

কল্যাণের ধারণা সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে অভিন্ন : রিপাবলিক-এর কল্যাণের আকার বা ধারণাকে সিম্পােসিয়াম-এর সৌন্দর্যের স্বরূপ ধর্মের বা আকারের সঙ্গে অবশ্যই ভিন্ন গণ্য করা যেতে পারে। কল্যাণের ধারণাকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করার উদ্দেশ্য হল এই বিষয়টি নির্দেশ করা যে, এটি বস্তুর, শুধু কল্যাণের নয়, তার সৌন্দর্যেরও উৎস। প্লেটোর উদ্দেশ্য এক সর্বনিরপেক্ষ, সর্ব ত্রুটিহীন, পরম আধিবিদ্যক নীতি বা সূত্রের ধারণা দান করা। এই সর্বনিরপেক্ষ সত্তা বস্তুর অন্তর্বর্তী, কেননা বস্তু এই সত্তার প্রতিলিপি (Copy), তাতে অংশগ্রহণ করে, বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করে। এই সর্বনিরপেক্ষ সত্তা আবার বস্তুর অতিবর্তীও, কেননা এটি বাস্তবে অস্তিত্বশীল বস্তু যা সত্তাকেও অতিক্রম করে যায়। প্লেটো যে কল্যাণকে ‘এক’-এর সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছেন অ্যারিস্টটল সে কথা ব্যক্ত করেছেন। অ্যারিস্টটল সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, প্লেটো মনে করেন যে, অন্য সব বস্তুর স্বরূপধর্মের কারণ হল আকার (Forms) এবং এক (One) হল আকারের স্বরূপ ধর্মের কারণ (The cause of the essence of the forms)।

কল্যাণ-এর ধারণা এক-এর সঙ্গে অভিন্ন : প্লেটো ‘রিপাবলিক’-এ কল্যাণের ধারণাকে সব সুন্দর বস্তুর উৎস রূপে গণ্য করেছেন। কাজেই এরূপ সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত যে, তিনি এক, কল্যাণ এবং সৌন্দর্যের স্বরূপ ধর্মকে অভিন্ন গণ্য করেছেন এবং তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আকারের বুদ্ধিগম্য জগৎ কোন না কোন ভাবে ‘এক’এর কাছেই তার সত্তার জন্য ঋণী।

এক, কল্যাণের ধারণা ও সৌন্দর্যের ধারণা অভিন্ন : কিভাবে এই ‘এক’ থেকে আকারগুলো তাদের সত্তাকে প্রাপ্ত হল প্লেটো তার কোন ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু তিনি যে ‘এক’কেই ঐক্যবিধায়ক সূত্র রূপে গণ্য করেছেন তা বেশ সুস্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায়। এই ‘এক’ আকারের অন্তর্বর্তী হয়েও অতিবর্তী, কেননা আকারের সঙ্গে তাকে অভিন্ন গণ্য করা চলবে না। প্লেটোর মতানুসারে কল্যাণ স্বরূপধর্ম নয়। মর্যাদা এবং ক্ষমতার বিচারের এটি স্বরূপ ধর্মকে (Essence) অনেকখানি অতিক্রম করে যায়। অপরপক্ষে, এটি সব জ্ঞানের বস্তুর বোধগম্যতার উৎস মাত্র নয়, তাদের সত্তা এবং স্বরূপধর্মও বটে। কল্যাণের ধারণা সত্তার অতিবর্তী, কেননা সব দৃশ্যমান এবং বুদ্ধিগম্য বস্তুর উর্ধ্বে এই কল্যাণের ধারণা। আবার অপরদিকে এটি সর্বতোভাবে বাস্তব, প্রকৃত সর্বনিরপেক্ষ সত্তা। সব বস্তুর সত্তা ও স্বরূপ ধর্মের এটিই হল উৎস। কাজেই ‘এক’ হল প্লেটোর পরম সূত্র এবং আকারের জগতের উৎস। রিপাবলিকে প্লেটো বলেছেন, দার্শনিক জ্ঞানের বা ডায়ালেকটিকের সাহায্যেই, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যেই এই ‘এক’ বা কল্যাণের ধারণা লাভ করা যায়।

বিশেষ বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে প্লেটোর অভিমত

প্রশ্ন হল, বিশেষ বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে প্লেটোর অভিমত কি? প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জগৎ-কে অধ্যাস (Illusion) গণ্য করেননি। কিন্তু একটা অবাস্তবতার উপাদান এই জগতে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আকার বা ধারণার যথার্থ সত্তা আছে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর নেই। প্লেটোর দর্শনে পরিপূর্ণ অসত্তার একটি নীতি (A Principle of absolute not-being) স্বীকৃত হয়েছে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, ধারণা এবং এই সত্তাতে অংশগ্রহণ করে। কাজেই তারা হল সত্তা এবং অ-সত্তার মাঝামাঝি (half way between being and not-being); তারা অর্ধ বাস্তব (half real)। কিন্তু প্লেটো যা-ই বলুন না কেন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত এবং বুদ্ধিগম্য জগতের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য সেই সমস্যার কোন সমাধান তিনি করতে পারেননি।

অ্যারিস্টটল এই প্রসঙ্গে প্লেটোর তীব্র সমালোচনা করেন। অ্যারিস্টটলের মতে, আকার এবং আকারে রয়েছে যে উপাদান এই দুটি অবিচ্ছেদ্য, উভয়ই বাস্তব জগতের অন্তর্ভুক্ত। অ্যারিস্টটলের মতে, প্লেটো এই সমস্যাটির প্রতি উদাসীন ছিলেন এবং দুটি উপাদানের মধ্যে যৌক্তিকভাবে বিচ্ছিনতাই কথা বলেছেন।

ধারণাগুলোর পরস্পরের মধ্যে এবং ধারণার সঙ্গে বিশেষ বস্তুর সম্পর্ক

প্রশ্ন হল, ধারণাগুলোর পরস্পরের মধ্যে এবং ধারণার সঙ্গে বিশেষ বস্তুর সম্পর্ক কি? ধরা যাক, ‘মানুষ’ এই ধারণা কি প্রতিটি বিশেষ মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বর্তমান না আংশিকভাবে বর্তমান। যদি এ রকম বলা সমীচীন হয় যে, বিশেষ মানুষ এবং মানুষের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে তাহলে এই সাদৃশ্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য কি আর একটি ধারণাকে স্বীকার করতে হবে না? এর ফলে কি অনবস্থা দোষ দেখা দেবে না? এই জাতীয় অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটল।

‘পারমিনাইডিসে’ বিশেষ বস্তুর সঙ্গে ধারণার সম্পর্কের ব্যাখ্যা : ‘পারমিনাইডিস’ নামক ডায়ালগে বিশেষ বিশেষ বস্তুর সঙ্গে ধারণার সম্পর্কের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যায় সক্রেটিসের জবানীতে বলা হয়েছে যে, (১) বিশেষ বস্তু ধারণাতে অংশগ্রহণ করে, (২) বিশেষ বস্তু ধারণার নকল বা প্রতিলিপি। পারমিনাইডিস’-এ প্লেটো ‘পারমিনাইডিস’-এর জবানীতে এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে তাঁর মতবাদের বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রশ্ন হল, বিশেষ বিশেষ বস্তু কি সমগ্র ধারণায় অংশগ্রহণ করে বা তার অংশবিশেষে অংশগ্রহণ করে? যদি প্রথমটি মেনে নেওয়া যায় তাহলে স্বীকার করতে হয় যে, ধারণা এক, তা অসংখ্য বিশেষ বস্তুর প্রতিটিতে সম্পূর্ণভাবে বর্তমান। যদি দ্বিতীয় বিকল্পটি স্বীকার করে নেওয়া হয় তাহলে আকার বা ধারণা একই সঙ্গে এবং একই সময়ে এক এবং বিভাজ্য (অর্থাৎ অনেক) হবে। কিন্তু এ জাতীয় সিদ্ধান্ত বিরোধিতা দোষে দুষ্ট।

ধারণা অপর একটি বিশেষ বস্তু নয় : বিশেষ বস্তু ধারণার প্রতিলিপি। সাধারণভাবে প্লেটোর মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল ধারণার ক্ষীণ, অপরিপূর্ণ নকল বা প্রতিলিপি। তারা হল নিছক ছায়া এবং অর্ধ বাস্তব। বিশেষ বস্তুর সঙ্গে ধারণার সাদৃশ্যের কারণ বিশেষ বস্তুর ধারণায় অংশগ্রহণ। সুন্দর বস্তু সৌন্দর্যের ধারণায় অংশগ্রহণ করে। সৌন্দর্যের ধারণার দ্বারা সুন্দর বস্তুর ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু ‘পারমিনাইডিস’ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন যে, শ্বেতবস্তু যদি শ্বেতত্বের সদৃশ হয়, তাহলে শ্বেতত্বও শ্বেতবস্তু সদৃশ। কাজেই যদি শ্বেত বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য শ্বেতত্বের আকার-এর অনুমান করতে হয় তাহলে শ্বেতত্বের সঙ্গে শ্বেতবস্তুর সাদৃশ্যের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আর একটি আকারের প্রয়োজন হবে। সমালোচনার বক্তব্য বিষয় হল যে, ধারণাকে একটি বিশেষ বস্তুরূপে গণ্য করা চলে না। সেই কারণে বিশেষ বস্তুর সঙ্গে ধারণার সম্পর্ক, বিশেষ বস্তুর সঙ্গে বিশেষ বস্তুর সম্পর্কের অনুরূপ হতে পারে না। এ ছাড়াও আর একটি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে যে, ধারণা হল অজ্ঞেয়। মানুষ, বিশেষ বস্তু এবং বিশেষ বস্তুর মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে, কিন্তু ধারণার জ্ঞানের জন্য সর্বনিরপেক্ষ জ্ঞান (Absolute Knowledge)-এর প্রয়োজন যার অধিকারী আমরা নই। কাজেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সমান্তরাল ধারণার জগতকে গণ্য করা চলে না।

পারমিনাইডিসে সমস্যার সমাধান মেলে না : পারমিনাইডিসে উপরিউক্ত অভিযোগগুলো খণ্ডনের কোন চেষ্টা দেখা যায় না। তবে পারমিনাইডিস কোন বুদ্ধিগম্য জগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চায় না। পারমিনাইডিসের বক্তব্য হল, কেউ যদি সর্বনিরপেক্ষ ধারণা বা আকারের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তাহলে দার্শনিক চিন্তন সম্ভব হবে না। আকারের জগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সম্পর্কের বিষয়টি পারমিনাইডিসে কোন সমাধান হয়নি। পারমিনাইডিসে একের অস্তিত্বের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যদিও একের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি।

জাতি বা শ্রেণী প্রত্যয় : ‘সােফিস্ট’ নামক ডায়ালগে প্লেটো জাতি বা শ্রেণী প্রত্যয় (Class Concepts) নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ধারণা একই সময়ে এক এবং বহু হতে পারে। যেমন, ‘জীব’ এই জাতিটি এক। কিন্তু একই সময়ে তাকে বহু বলা যেতে পারে কেননা এই জাতির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘অশ্ব’, ‘গরু’, ‘মানুষ’ প্রভৃতি উপজাতি। প্লেটো যেন বলতে চান যে, পরজাতি আকার (Generic Form) তার অধীনস্থ বিশেষ বিশেষ আকারের অর্থাৎ উপজাতি আকারে (Specific Forms) মধ্যে ছড়িয়ে আছে; তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মিশে আছে, তবু নিজের ঐক্য বজায় রেখেছে। বিভিন্ন আকারের মধ্যে সংযোগ রয়েছে। এবং একটি আকার অপর আকারের অংশ গ্রহণ করে, যেমন— ‘গতি অস্তিত্বশীল।’ গতি অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, বিশেষ বস্তু বিশেষ আকারে (Specific Form) যেভাবে অংশগ্রহণ করে, কোন আকার অপর আকারে সেইভাবে অংশগ্রহণ করে না। বিশেষ বস্তু বিশেষ আকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এ কথা প্লেটো বলতে চান না।

আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ

আসলে আকারগুলোর ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ বা হায়ারার্কি রয়েছে। ‘এক’ হল সর্বোচ্চ এবং সর্বব্যাপক আকার। অন্যান্য আকার তার অধীনস্থ। যেমন, শ্বেতত্ব, পীতত্ব, কৃষ্ণত্ব প্রভৃতি বর্ণের আকারের অধীনস্থ। আবার বর্ণ ও স্বাদের আকার গুণের আকারের অধীনস্থ। এভাবে আমরা সর্বশেষ আকার, ‘কল্যাণ’ (Good)এর আকারে উপনীত হই। প্রতিটি পৃথক পৃথক আকার বা ধারণা একাধারে এক এবং একধারে বহু। নিজের দিক থেকে এক; অন্য ধারণার সম্পর্কে বহু। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে কোন আকার যত উচ্চ ততই সেটি ঐশ্বর্যবান (Richer)। কাজেই সেই দিক থেকে তার দৃষ্টিভঙ্গি অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত, কেননা অ্যারিস্টটলের মতে, কোন প্রত্যয় ধারণা যত বেশি অমূর্ত, তত বেশি সেটি নিঃস্ব (Poorer)।

‘সােফিস্ট’ গ্রন্থে আকারের এক ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগের কথা জানা যায় কিন্ত একেবারে নিচের স্তরের অর্থাৎ ‘আণবিক আকারের’ সঙ্গে বিশেষের সম্পর্কের সমস্যার সমাধান ঐ গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সােফিস্ট গ্রন্থে প্লেটো সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন, যে সমস্ত আকার, আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ, একটি সর্বব্যাপক আকার। অর্থাৎ কিনা, সত্তার (Being) অন্তর্ভুক্ত এবং তিনি সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতেন যে, আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ নিরূপণ করতে গিয়ে, তিনি যে যৌক্তিক আকারের গঠন (Structure)-ই শুধু নিরূপণ করেছিলেন তা নয়; তিনি যা বাস্তব তার তত্ত্বগত আকারের গঠন (Structure of Ontological Forms of the Real)-ও নিরূপণ করেছিলেন। সােফিস্ট ডায়ালগে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে এই ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ সম্পাদন করতে হয়। ‘সােফিস্ট’ এবং ‘ফিলিবাস’ ডায়ালগ দুটি থেকে জানা যায় যে, প্লেটো আকারের ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ করতে গিয়ে শ্রেণীবিভাগের একটি সমাপ্তিরেখা টেনে দেবার সিদ্ধান্ত করলেন যাতে যা অসীমিত তার ক্ষেত্রে একটা সীমারেখা আরোপ করা যায় এবং সর্বশেষ শ্রেণীতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বস্তুতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

কিন্তু, আর একটি প্রশ্ন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বস্তু অস্তিত্বশীল হল কিভাবে? যদিও আকারের সমগ্র ক্রমােচ্চ শ্রেণীবিভাগ, সমগ্র জটিল সংগঠনটি সর্বব্যাপক এক-এর সত্তার ধারণার বা কল্যাণের (যা একটি পরম সর্বনিরপেক্ষ নীতির) অন্তর্ভুক্ত, তবু এটা দেখাবার প্রয়োজন আছে যে, অবভাসের জগৎ, যা নিছক সত্তা না হলেও একেবারে যে, অ-সত্তা নয়, কিভাবে অস্তিত্বশীল হল? তাহলে এই অবভাসের জগৎ কি এক থেকেই উদ্ভূত? যদি না হয় তাহলে এর কারণ কি? টাইম্যায়িয়ুসে প্লেটো এর একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে যে, ডেমিয়ার্জ বা জগত নিয়ন্ত্রণকর্তা দেশে অবস্থিত মুখ্য বা প্রাথমিক গুণগুলোতে জ্যামিতিক আকার দান করেছেন এবং তার দ্বারা বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা এনেছেন। অবশ্য এই জগৎ গঠনের কাজে বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারের জগৎ-ই ছিল তার কাছে নকশাস্বরূপ। প্লেটোর সৃষ্টি সম্পর্কীয় বিবরণ কোন কালিক বিবরণ নয়, বা নিছক শূন্যতা থেকেও জগৎ সৃষ্টি হয়নি। এই জড়জগতের যেটা অ-বুদ্ধিগ্রাহ্য অংশ সেটি বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের পাশাপাশি অবস্থিত ছিল।

আসলে নিছক বিশেষ অ-বুদ্ধিগ্রাহ্য উপাদান ছিল বিশৃঙ্খল এবং অবিন্যস্ত (Discordant) গতির অন্তর্ভুক্ত। জগৎ সৃষ্টির জন্য নিয়ন্ত্রণকর্তাকে একেই গ্রহণ করতে হয়। প্লেটোর যুক্তিবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বস্তুগুলোকে কিছু থেকে নিঃসৃত করা যায় না, তাদের পরিপূর্ণরূপে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলা যায় না, যে রকম প্লেটোর পদার্থবিদ্যাতে বিশৃঙ্খল উপাদান, যাতে বুদ্ধির দ্বারা শৃঙ্খলা প্রবর্তিত হয়, অব্যাখ্যাত থেকে যায়। নিঃসন্দেহে প্লেটো মনে করেছিলেন যে, এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটাকে কোন কিছু থেকে নিঃসৃত করা যায় না, আর নিছক শূন্যতা থেকে এটা সৃষ্টি নয়। এটা রয়েছে, এটা অভিজ্ঞতার বিষয়, এর সম্পর্কে শুধু এইটুকুই বলা যেতে পারে, এটা অস্তিত্বশীল কিছু নয়, এটা জগতের একটা উপাদান, যাকে প্লেটো ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ পুরোপুরিই উদ্দেশ্যমূলক (Teleological)। প্রতিটি ধারণা তার দিক থেকে পরিপূর্ণ (Perfect)। আবার প্রতিটি ধারণা তার অধীনস্থ বিশেষ বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বের হেতু (Ground of Existence)। সুন্দর বস্তুর ব্যাখ্যা পেতে হলে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের ধারণা বা সৌন্দর্যের আকারের সাহায্যেই পেতে হবে। প্লেটোর এই উদ্দেশ্যের শেষ পরিণতি কল্যাণের ধারণা। এই ধারণাতেই অন্য সব ধারণার এবং সমগ্র বিশ্বজগতের চরম ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে।

ধারণার সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক ও কল্যাণের ধারণার সাথে ঈশ্বরের অভিন্নতা

এখন প্রশ্ন হল, এই ধারণাগুলো কি ঈশ্বরের ধারণা (Ideas of God) বা ঈশ্বরনিরপেক্ষ (Independent of God)। নব্য-প্লেটোনিকরা ধারণাগুলোকে ঈশ্বরের চিন্তা বলে গণ্য করতেন। প্রশ্ন হল, নব্য-প্লেটোনিকদের এই মতবাদ কি প্লেটোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে? যদি আরোপ করা যায় তাহলে দেখানো যাবে যে, আকারের জগৎ বা আদর্শের জগৎ (Ideal world) একাধারে এক এবং বহু-ঈশ্বরের মনে অবস্থিত এক ঐক্য, ঈশ্বরের অধীনস্থ এক পরিকল্পনা, এক বহুত্ব, যা ঈশ্বরের চিন্তার বিষয়বস্তুর ঐশ্বর্যের পরিচায়ক এবং প্রকৃতিতে অসংখ্য অস্তিত্বশীল বস্তুর মধ্য দিয়েই যার উপলদ্ধি।

ঈশ্বরের সঙ্গে ধারণার এবং বিশেষ করে কল্যাণের ধারণার সম্পর্ক কী? ঈশ্বর যদি সর্বোচ্চ ধারণা থেকে পৃথক হন তাহলে জেলার-এর মতে, তিনটি সম্পর্কের কথা বলা যেতে পারে, যার প্রতিটির বিরুদ্ধেই, সমানভাবে আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে।

  • (১) ঈশ্বরকে কল্যাণের ধারণার হেতু গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু এতে স্টেইস্-এর মতে, ধারণার প্রকৃতি (Substantality)-ই বিনষ্ট হবে। কেননা প্লেটোর মতে, ধারণা হল স্বনির্ভর কিন্তু উপরিউক্ত অভিমত অনুসারে ধারণা তার অস্তিত্বের জন্য ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল হবে।
  • (২) ঈশ্বর তার অস্তিত্বের জন্য যদি ধারণার ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বের হানি ঘটবে।
  • (৩) ঈশ্বর এবং ধারণা, উভয়কেই যদি আদি স্বনির্ভর পরম তত্ত্বরূপে স্বীকার করা হয়, তাহলে এক হতাশাব্যঞ্জক দ্বৈতবাদের সৃষ্টি হবে।

কাজেই উপরের তিনটি অভিমতের যে কোন একটিকেই যখন স্বীকার করা যায় না, তখন কল্যাণের ধারণাকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করতে হয়। ‘ফিলিবাস’-এ এই সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তবে এই ঈশ্বর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ঈশ্বর নয়, বা এই ঈশ্বর পুরুষ নয়। প্লেটো ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বা ঈশ্বরকে পুরুষরূপে কল্পনা করে যেসব কথা বলেছেন সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করে রূপক হিসেবে গ্রহণ করলেই প্লেটোর দর্শনের প্রতি সুবিচার করা হয়।

রিপাবলিক-এর দশম পরিচ্ছেদে প্লেটো বলেছেন যে, ঈশ্বর হলেন আদর্শ শয্যা বা খাটের রচয়িতা। যদিও অনেক শয্যা আছে, শয্যার কেবলমাত্র একটি ধারণা বা আকার আছে। দর্পণে কোন শয্যার প্রতিবিম্ব নিছক অবভাস, বাস্তব নয়। সে রকম নানা ধরনের বিশেষ ব্যাখ্যা শয্যা বাস্তব নয়, তারা ধারণার প্রতিলিপি; যেটি হল একটি বাস্তব শয্যা, ঈশ্বরের দ্বারা নির্মিত। এই একটি শয্যা যেটি ঈশ্বরের দ্বারা নির্মিত, তার জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু মানুষের দ্বারা নির্মিত অন্যান্য শয্যার আমরা মত (Opinion) পেতে পারি। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে যে অসংখ্য শয্যা বা খাট দেখতে পাওয়া যায় দার্শনিক তাতে আগ্রহী নয়, কেবলমাত্র একটি আদর্শ শয্যায় বা শয্যার আকারে (Form) আগ্রহী। ঈশ্বরকে অন্য জিনিসেরও রচয়িতা বলা হয়েছে। অবশ্য জিনিস বলতে অন্য স্বরূপধর্ম (Essences)। এটা থেকে এমন কথা মনে হতে পারে যে, ঈশ্বর আদর্শ শয্যার কথা চিন্তা করে তাকে সৃষ্টি করেছিলেন অর্থাৎ কিনা, ঈশ্বর মনে মনে জগৎ, মানুষ এবং মানুষের সব প্রয়োজনের কথা চিন্তা করেছিলেন।

প্লেটো কল্যাণের ধারণাকে আকারের সৃষ্টিকর্তা বলে অভিহিত করেছেন। তার থেকে মনে হয় প্লেটো ঈশ্বরকে কল্যাণের ধারণার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছেন। যারা মনে করেন যে, এই হল প্লেটোর প্রকৃত ধারণা এবং যারা ঈশ্বরকে ঈশ্বরবিদ্যার দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে চান তারা স্বাভাবিকভাবেই ‘ফিলিবাস’-এর কথা উল্লেখ করছেন। যেখানে বলা হয়েছে যে, যা অর্থাৎ যে মন (Mind) বিশ্বজগতে শৃঙ্খলা আনয়ন করে তা আত্মার (Soul) অধিকারী। কাজেই ঈশ্বর হবেন এক জীবন্ত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য সত্তা। কাজেই আমরা পাব এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ঈশ্বর (A Personal God), যার মন হল আকারের আবাসস্থল এবং যিনি বিশ্বজগতে শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং এই বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ঈশ্বর হলেন পৃথিবী এবং স্বর্গের রাজা।

কিন্তু প্লেটোর চিন্তাধারায় এই জাতীয় ব্যাখ্যা সমীচীন বলে মনে হয় না। ‘টাইম্যায়িয়ুস’-এ প্লেটো ডেমিয়ার্জ বা এক জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিকে জগতে শৃঙ্খলা আনয়নকারী এবং আকারের বা জাতির আদর্শ অনুযায়ী প্রাকৃতিক বস্তু গঠনকারী বলে বর্ণনা করেছেন। এখন এই ‘ডেমিয়ার্জ’ সম্ভবত কপলস্টোনের মতে, প্রতীক-মাত্র যাকে বিচারবুদ্ধির প্রতীকরূপে ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয়, যে আকার বা ধারণা থেকে ডেমিয়ার্জকে স্বতন্ত্র করার ব্যাপারটা এক কাল্পনিক কাহিনী এবং প্লেটোর যখন অভিমত হল যে, ডেমিয়ার্জ হল কল্যাণ এবং আকারের উৎস। যেহেতু টাইম্যায়িয়ুসে কখনও এ কথা বলা হয়নি যে, ডেমিয়ার্জ ধারণার স্রষ্টা বা তাদের উৎস বরং ঐ গ্রন্থে ডেমিয়ার্জ থেকে (যাকে নিমিত্ত কারণ রূপে অভিহিত করা হয়েছে) তাদের সতন্ত্র করে দেখা হয়েছে, তার থেকে প্রমাণিত হয় না যে, প্লেটো তাদের এক করে দেখেননি। তবে এর ভিত্তিতে একটা বিষয় সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। সেটা হল যে, তিনি যে তাদের এক করে দেখেছেন সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কোন কিছু না বলা।

আকার সম্পর্কীয় মতবাদের গাণিতিক দিক

প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদের একটা গাণিতিক দিক আছে। অ্যারিস্টটলের মতে, প্লেটো ঘােষণা করেছিলেন যে, আকারগুলো হল সংখ্যা, সংখ্যাতে অংশগ্রহণ করেই বস্তু অস্তিত্বশীল হয় এবং সংখ্যাগুলো এক এবং বড় ও ছােটর (One and the great and small) দ্বারা বা অনির্ণেয় গুণের দ্বারা গঠিত (“Numbers are composed of the one and the great and small or indeterminate quality.”)। এই প্রসঙ্গে কতকগুলো প্রশ্ন দেখা যায় –

  • প্রথমত, কেন প্লেটো আকারকে সংখ্যার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলেন এবং তিনি কি বোঝাতে চাইছেন?
  • দ্বিতীয়ত, কেন প্লেটো বলেছেন যে, বস্তু সংখ্যাতে অংশগ্রহণ করে অস্তিত্বশীল হয়।
  • তৃতীয়ত, সংখ্যাগুলো এক এবং বড় ও ছােটর দ্বারা গঠিত বলতে প্লেটো কি বোঝাতে চাইছেন?

কপলস্টোন বলেন, এই সব প্রশ্নের আলোচনার জন্য গণিতবিদ্যায় বিশেষ ব্যুৎপতি থাকা প্রয়োজন। কাজেই এসব জটিল প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা না করে কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আকারের সঙ্গে সংখ্যাকে অভিন্ন গণ্য করার পিছনে প্লেটোর উদ্দেশ্য হল রহস্যময় এবং অতীন্দ্রিয় আকারের জগতকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলা। এই ক্ষেত্রে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলার অর্থ হল শৃঙ্খলার নীতির (The principle of order) সন্ধান করা।

ডায়ালেক্টিক

ডায়েলেকটিক-এর মাধ্যমে ধারণাকে জানা যায় : এখন প্রশ্ন হল, প্লেটোর মতে, ধারণা বা আকারকে কিভাবে জানা যায়? প্লেটোর মতে, ডায়েলেকটি বা দার্শনিক জ্ঞানের সাহায্যেই ধারণাকে জানা যায়। ডায়েলেকটি হল জ্ঞানের চরম উৎকর্ষ। অনেক সময় বলা হয় ডায়েলেকটিক হল ধারণার মতবাদ (Theory of Ideas)। ডায়েলেকটিক্ হল সব ধারণার পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের জ্ঞান। কিন্তু এখানেও আর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। প্লেটো কি এক বা কল্যাণকে জানার জন্য কোন ধর্মীয় বা অতীন্দ্রিয় (Mystical) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি? ‘সিম্পােসিয়াম’-এ এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেই প্লেটোকে বুদ্ধিবাদীরূপে গণ্য করতে আগ্রহী, অতীন্দ্রিয়বাদী হিসেবে নয়। স্টেইস্ (Stace) বলেন, “ধারণাগুলো বৌদ্ধিক, অর্থাৎ কিনা, তাদের বুদ্ধির মাধ্যমেই জানা যায়। পরম সত্তা কোন স্বজ্ঞা (Intuition) বা অপরোক্ষ অনুভূতি বা কোন অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগের মাধ্যমে জ্ঞাত হয় না, কেবলমাত্র বৌদ্ধিক জ্ঞান এবং শ্রমসাধ্য চিন্তনের মাধ্যমেই জ্ঞাত হয়।” অধ্যাপক সি. রিটার (C. Ritter)-ও প্লেটোকে অতীন্দ্রিয়বাদীরূপে নির্দেশ করার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন।

সার্বিক আদর্শ অর্থাৎ কল্যাণকে ডায়েলেকটিকের মাধ্যমে জানা যায় : প্লেটো কোন আপেক্ষিক নীতিবিদ্যা স্বীকার করেন না। তিনি নিরপেক্ষ মানদণ্ড আদর্শ স্বীকার করেন। যেমন, ন্যায়পরায়ণের আদর্শ, মিতাচারের আদর্শ, সাহসিকতার আদর্শ ইত্যাদি। এই আদর্শগুলো বাস্তব এবং নিরপেক্ষ যেহেতু এসব আদর্শ অপরিবর্তনশীল এরা হল আচরণের অপরিবর্তনশীল মানদণ্ড, এরা বস্তু নয়, এরা আদর্শ, কিন্তু নিছক বস্তুনিরপেক্ষ বা ব্যক্তিসাপেক্ষ নয়। কেননা এরা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মানুষ এক সর্ব ব্যাপক আদর্শের সন্ধান পায়, অন্যসব বিশেষ আদর্শ যার অধীনস্থ। এই সার্বিক আদর্শ হল কল্যাণ (Good)। একে ডায়েলেকটিক বা দার্শনিক জ্ঞানের সাহায্যে জানা যায়। মানুষের প্রকৃত জীবন হল দার্শনিক জীবন বা জ্ঞানের জীবন। কেবলমাত্র দার্শনিকই সত্তার বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য যে, আকারকে ডায়েলেকটিকের মাধ্যমে জানা যায়। প্লেটো তার ডায়ালগের কোন কোন অংশে এক অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন বলে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, আমরা কিন্তু এ রকম কোন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুনিশ্চিত নই। প্লেটোর ভালবাসা বা অনুরাগ সম্পর্কীয় মতবাদ (Doctrine of Love) অনুসারে ভালবাসার সঙ্গে সবসময়ই সৌন্দর্যের সম্পর্ক বর্তমান। আত্মা কোন বিশেষ বসুকে ভালবাসতে শিখে অন্য বস্তুকে ভালবাসে। তারপর আত্মা দেখে যে, এক সৌন্দর্যই সর্ববস্তুতে বর্তমান। ভালবাসা সৌন্দর্যের ধারণার জ্ঞানে পরিণতি লাভ করে। এর ফলে আকারের জগতের জ্ঞানলাভে আত্মা আগ্রহী হয়।

প্লেটোর মতবাদে অগ্রগতি

প্লেটোর মতবাদ প্রাক-সক্রেটিস দর্শনের ওপর অগ্রগতি : প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ প্রাক-সক্রেটিস দর্শনের ওপর নিঃসন্দেহে অগ্রগতি। প্রাক-সক্রেটিস যুগের জড়বাদ পরিহার করে তিনি অজড় এবং অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য সত্তার অস্তিত্ব ঘােষণা করেছেন যা, এই জড় জগৎ যে অর্থে বাস্তব, তার থেকে গভীরতর অর্থে বাস্তব। একদিকে তিনি হেরাক্লিটাসের সঙ্গে একমত যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল পরিবর্তনশীল। তাদের যথার্থভাবে অস্তিত্বশীল আখ্যাত করা যায় না। অপরপক্ষে, তিনি দেখলেন যে, এক যথার্থ সত্তার অস্তিত্ব আছে। এক অপরিণামী স্থির সত্তার অস্তিত্ব আছে যাকে জানা যায়, যা জ্ঞানের চরম বস্তু। অপরদিকে প্লেটো পারমিনাইডিসের বক্তব্যকেও মেনে নিতে পারেননি, যিনি বিশ্বজগতকে এক স্থির অপরিণামী একের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করে, সব পরিবর্তন এবং ভবন (Becoming)-কে অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্লেটোর মতে ‘এক’ হল অতিবর্তী। সেই কারণে ভবন বা পরিবর্তন অস্বীকৃত হয়নি, বরং সৃষ্ট জগতে পরিপূর্ণভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তা ছাড়া সত্তা নিজে মন, প্রাণ, আত্মা বহির্ভূত নয়। কাজেই সত্তার মধ্যে আধ্যাত্মিক গতি রয়েছে। অতিবর্তী এক যেমন বহুকে বর্জন করে না, তেমনি এই জগতের বস্তুসমূহ এক এর বহির্ভূত নয়। কারণ তারা আকারের প্রতিলিপি (Imitations) বা আকারে অংশগ্রহ করে এবং সেহেতু শৃঙ্খলায় কিছু পরিমাণে অংশগ্রহণ করে। তারা পরিপূর্ণভাবে সত্তা নয়, তবে তারা নিছক অসত্তাও নয়। সত্তাতে তাদের অংশ আছে, যদিও যথার্থ সৎ জড় নয়। মন এবং শৃঙ্খলা এই জগতে অন্তঃস্যূত। মন বা বুদ্ধি এই জগতে পরিব্যপ্ত এবং অ্যানাক্সাগোরাসের নাউস (Nous)-এর মত নিছক বহিঃস্থ সত্তা (Deus ex Machina) নয়।

প্লেটোর দর্শন সােফিস্ট এবং সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তার ওপরও অগ্রগতি : প্লেটোর দার্শনিক চিন্তা শুধুমাত্র যে প্রাক সক্রেটিস দর্শনের ওপরই অগ্রগতি, তা নয়; সােফিস্ট এবং সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তার ওপরও অগ্রগতি সূচনা করে। বৈজ্ঞানিক এবং নৈতিক মূল্যের আপেক্ষিকতা তিনি অস্বীকার করেছিলেন। সক্রেটিসের ওপর অগ্রগতি এই কারণে যেহেতু প্লেটো নৈতিক মানদণ্ড এবং সংজ্ঞার রাজ্য অতিক্রম করেও তর্কবিদ্যা এবং তত্ত্ববিদ্যার রাজ্যে তার অনুসন্ধানের কার্যকে বিস্তৃত করেছিলেন। সক্রেটিস সত্তার সুসঙ্গত ঐক্যবিধানের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, সুনিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় না। প্লেটোর কাছ থেকে আমরা এক পরম সত্তার ধারণা পাই। সক্রেটিস এবং সােফিস্টরা পূর্ববর্তী সৃষ্টি সম্পর্কীয় মতবাদগুলো এবং এক ও বহু সম্পর্কীয় অভিমতগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। সক্রেটিস এই সম্পর্কে যে অভিমত উপস্থাপিত করেছিলেন প্লেটো তাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার না করে এক বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলো পুনরায় আলোচনা করেন। কপলস্টোন বলেন, “তাঁর সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, প্রাক-সক্রেটিস এবং সক্রেটিস দর্শনে যা কিছু মূল্যবান বা যা কিছু তার কাছে মূল্যবান মনে হয়েছিল, তিনি তার সামঞ্জস্য বিধানের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।” বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদের অনেক স্পষ্ট ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দর্শনের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সূচনা করে। সার্বিকের সমস্যার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার ব্যাপারে এটিই প্রথম মতবাদ, যে সমস্যা আজও নানা আকারে নিজেকে প্রকাশ করছে।

আকার সম্পর্কীয় মতবাদের ত্রুটি

প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের সম্পর্ক সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে ভবন বা অসৎ (Becoming)-এর জগৎ-এর ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। টাইম্যায়িয়ুসে প্লেটো সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, আকার কখনও কোথাও অন্য কিছুর মধ্যে প্রবেশ করে না। এর থেকে বোঝা যায় যে, প্লেটো আকার বা ধারণাকে ভৌতিক জগতের বস্তুর কোন অন্তর্নিহিত উপাদান বলে গণ্য করেননি। কাজেই প্লেটোর নিজস্ব বক্তব্যের ভিত্তিতেই প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর মধ্যে যে পার্থক্য তাকে দূর করা যায় না। প্লেটো হয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যার প্রতি অ্যারিস্টটল সুবিচার করতে পারেননি কিন্তু অ্যারিস্টটল সার্বিক (Universal) সম্পর্কে যে মতবাদ পােষণ করতেন, প্লেটো তা করতেন না। অংশগ্রহণ (Participation) অর্থে প্লেটো ঘটনাতে (Events) অনন্ত বস্তুর উপাদান রয়েছে একথা কখনও মনে করেননি। ঘটনা বা ভৌতিক বস্তু প্লেটোর মতে, ধারণার প্রতিলিপি ছাড়া কিছুই নয় এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের ছায়া বা পরিবর্তনশীল প্রতিরূপ হিসেবে পাশাপাশি বর্তমান, এই সিদ্ধান্তকে কোনমতেই এড়ানো যায় না। ঘটনা বা ভৌতিক বস্তু ধারণার প্রতিলিপি গণ্য হওয়াতে প্লেটোর দর্শনে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের পাশাপাশিই অবস্থান করছে। প্লেটোর ভাববাদ এক উন্নত ধরনের দর্শন হলেও এই দর্শনের মহিমা অনেকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কেননা, প্লেটো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অধ্যাস এবং অ-সত্তা রূপে গণ্য করেননি।

আসলে প্লেটোর দর্শনে বিশেষকে নিয়ে যেমন অসুবিধা দেখা দিয়েছে যে, অ্যারিস্টটল যুক্তিযুক্তভাবে নির্দেশ করেছেন, তেমনি এ কথাও বলা যেতে পারে যে অ্যারিস্টটলের সামান্য সম্পর্কীয় মতবাদ-এর ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দেয়। আসল কথা হল, এই দুই মহান দার্শনিক, সত্তার বিভিন্ন দিকের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এক পরিপূর্ণ সময়ের মধ্যে উভয়ের সমন্বয় সাধিত হওয়া প্রয়োজন।

কপলস্টোন বলেন যে, “প্লেটো যে সিদ্ধান্তেই উপনীত হন না কেন এবং তার ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদে যে ত্রুটিই থাকুক না কেন আমরা কখনই ভুলব না যে, প্লেটো সত্য অনুধাবন করার পর তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।” যেমন প্লেটো বলেছেন যে, আমরা স্বরূপ-ধর্ম সম্পর্কে চিন্তা করতে পারি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমাদের মনের সৃষ্টি নয়, আমরা তাদের আবিষ্কার করি মাত্র। আমরা নৈতিক সৌন্দর্য সম্পর্কীয় মানদণ্ডের সাহায্যে বস্তুর বিচার করি এবং আমাদের বৈজ্ঞানিক অবধারণ যদি বস্তুগত হয় তাহলে এই মানদণ্ডগুলোও বস্তুগত। কিন্তু যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে তাদের প্রত্যক্ষ করা যায় না, সেহেতু তারা পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতিবর্তী। প্লেটো অবশ্য এই সব সমস্যা উত্থাপন করেননি। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই সব মানদণ্ডের বস্তুগত অস্তিত্বে বিশ্বাস না করলে অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্লেটো প্রত্যয়ের বস্তুগত প্রাসঙ্গিকতায় সত্যিই বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন যে, সত্তাকে জানা যায় এবং সত্তা বুদ্ধিগ্রাহ্য।

প্লেটো দার্শনিক। তিনি কবি নন। একটা আদর্শ জগতের কল্পনা করে বাস্তব জগৎ থেকে পালিয়ে বেড়াবার মনোবৃত্তি তার ছিল না। তিনি একটি অতীন্দ্রিয় এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর মতে দার্শনিক এটাকে সৃষ্টি করে না, আবিষ্কার করে মাত্র। প্লেটো বাস্তবকে স্বপ্নে পরিণত করতে চাননি। তিনি এই প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জগৎ থেকে শুদ্ধ ধারণার জগতে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। এসব ধারণার স্বনির্ভর অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু নীটশে প্লেটোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন যে, জগতের প্রতি শত্রুতাবশতই প্লেটো একটি অতীন্দ্রিয় জগতের কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই সমালোচনা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না।

এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। প্লেটো কি তার বক্তব্য বিষয় প্রকাশ করতে পেরেছিলেন, কি পারেননি এই প্রশ্ন নিয়ে হয়ত নীটশে মাথা ঘামাবেন না। কিন্তু এই পৃথিবীতে যেখানে শৃঙ্খলা এবং বোধগম্যতা বর্তমান, এক অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং জগৎ-অতিবর্তী সত্তায় তার বস্তুগত প্রতিষ্ঠাভূমি বা ভিত্তি রয়েছে, এই ধারণাকে আমরা চট করে বাতিল করে দিতে পারি না। প্লেটো তাঁর অধিবিদ্যায় এই সত্যকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন বলে কপলস্টোন মনে করেন। কোন মানুষকে কথা বলতে গেলেই কিছু মূল্যকে স্বীকার করে নিতে হয়, তাকে বস্তুগত আদর্শ এবং মানদণ্ডকে অনুমান করে নিতে হয়, যে মূল্যকে অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে জানা যায়। এই মূল্যগুলো নিজে নিজে বাস্তব হয় না সত্য, মানুষের ইচ্ছার ওপর এদের বাস্তবতা নির্ভরশীল, যে ইচ্ছা মানবজীবনে মূল্য এবং আদর্শকে ঈশ্বরের সহযোগিতায় উপলব্ধি করতে চায়। সর্বনিরপেক্ষ সত্তাকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি না, কিন্তু বৌদ্ধিক মননের সাহায্যে আমরা বহুগত মূল, আদর্শ এবং লক্ষ্য-এর জ্ঞান লাভ করতে পারি এবং এটাই হল প্লেটোর বক্তব্যের মূল কথা।

প্লেটোর মনোবিজ্ঞান

আত্মার সত্তা স্বীকার করেন এবং দেহের ওপর আত্মার প্রাধান্য

প্লেটো জড়বাদী দার্শনিক নন। সে কারণে তিনি আত্মাকে বায়ু, অগ্নি বা পরমাণুতে পরিণত করেননি। তিনি মনে করেন না যে, আত্মা হল একটি উপবস্তু, তিনি হলেন আধ্যাত্মবাদী। তাঁর মতে, দেহ থেকে আত্মা স্বতন্ত্র এবং আত্মা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। প্লেটো আত্মার সত্তা স্বীকার করেন এবং দেহের ওপর আত্মার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন।

প্লেটো প্রদত্ত আত্মার সংজ্ঞা : প্লেটো আত্মার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আত্মাকে স্বপ্রবর্তিত গতি বা গতির উৎস বলে আখ্যাত করেছেন (Laws 96.)। তার এই সংজ্ঞা থেকে মনে হয় তিনি আত্মাকে দেহের তুলনায় অনেক উন্নত মনে করতেন এবং আত্মা যে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে এরূপ সিদ্ধান্ত করেন। প্লেটো মনে করেন যে, অস্তিত্বশীল বস্তুর মধ্যে একমাত্র আত্মাই বুদ্ধির অধিকারী এবং আত্মা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এর মত দৃশ্যগোচর নয় (Timaeus 46.)। প্লেটোর মতে, আত্মা দেহের কোন উপবস্তু নয় (Phaedo 85.)। আত্মা দেহের সামঞ্জস্য বা সঙ্গতি মাত্র, প্লেটো এই অভিমত গ্রহণ করতে রাজি নন। তা ছাড়া সঙ্গতি বা সামঞ্জস্যের হ্রাস-বৃদ্ধি আছে, একটা আত্মা অপর একটা আত্মা থেকে বেশি হতে পারে এ ধরনের চিন্তাও এক উদ্ভট চিন্তা। তাঁর মতে– আত্মা দেহ এবং তার কামনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। কাজেই কোন সঙ্গতি, সেটি যার সঙ্গতি, তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, এ রকম অনুমান করাটাই এক উদ্ভট ব্যাপার।

দেহ আত্মাকে প্রভাবিত করে : প্লেটোর মতে, আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র হলেও দেহ আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি শারীরিক ব্যায়ামকে যথার্থ শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং মনে করেন যে, কোন কোন ধরনের সঙ্গীত আত্মার পক্ষে ক্ষতিকর (Republic)। আবার তিনি মনে করেন যে, মন্দ শারীরিক শিক্ষা এবং মন্দ দৈহিক অভ্যাস আত্মার ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার করতে পারে (Timeaus 86.)। ব্যক্তির ওপর বংশের প্রভাবের কথাও তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন আত্মার অবনতির মূলে রয়েছে মাতাপিতার কাছ থেকে বংশসূত্রে পাওয়া দৈহিক কোন ত্রুটি, দোষদুষ্ট বা ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা বা পরিবেশ। স্বেচ্ছায় কোন ব্যক্তি মন্দ হয় না। দেহের মন্দ অভ্যাস, মন্দভাবে সন্তানের প্রতিপালিত হওয়া, ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই মন্দগুলো দেখা দিতে পারে, যদিও তা ব্যক্তির অভিপ্রেত নয়। কাজেই উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, প্লেটো দেহ ও আত্মার মিথস্ক্রিয়া বা পারস্পরিক প্রভাবের (Interaction) কথা অস্বীকার করেননি।

আত্মার তিনটি অংশ

প্লেটো আত্মার তিনটি অংশের কথা বলেছেন। কেউ মনে করেন প্লেটোর এই মতবাদ পিথাগোরিয় দর্শন সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নেয়া। ‘রিপাবলিক’ এবং ‘টাইম্যায়িয়ুস’ উভয় গ্রন্থেই প্লেটো এই মতবাদের উল্লেখ করাতে বোঝা যায়, প্লেটো এই অভিমতে বরাবরই বিশ্বাসী ছিলেন। আত্মার তিনটি অংশ – প্রজ্ঞাংশ (The rational part), সাহসের অংশ (The courageous part) এবং ক্ষুধার অংশ (Appetitive Part)। যদিও উপরে অংশ কথাটি ব্যবহার করা হল তবু আত্মা জড় বা বিস্তৃতিযুক্ত, এ রকম ধারণা প্লেটো কখনও করেননি। আসলে প্লেটো তিনটি অংশকে জড়ের ভিন্ন ভিন্ন অংশরূপে মনে না করে, আত্মার বিভিন্ন ক্রিয়া বা আকার (Forms) বা নীতিরূপে গ্রহণ করেছেন।

আত্মার প্রজ্ঞাংশের তাৎপর্য : আত্মার প্রজ্ঞাংশ হল আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ। এই অংশের জন্যই মানুষ ইতর জন্তু থেকে পৃথক। প্রজ্ঞার সাহায্যেই মানুষ আকার বা সার্বিককে জানে। আত্মার এই অংশ অবিনশ্বর এবং অমর। অমর হওয়ার জন্য আত্মার এই অংশ ঐশ্বরিক। আত্মার অপর দুই অংশ অ-প্রজ্ঞাংশ (Irrational) হওয়াতে নশ্বর এই দুই অংশের মধ্যে একটি উন্নত (Noble)। আত্মার শৌর্যাংশ তার ক্ষুধার অংশের তুলনায় উন্নত। সাহস, খ্যাতির জন্য অনুরাগ এবং সাধারণভাবে সব মহৎ আবেগ এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। অপর অংশ যেটি ক্ষুধার অংশ সেটি শৌর্যাংশের তুলনায় হীন। মানুষের ইন্দ্রিয় ক্ষুধা এই অংশের অন্তর্ভুক্ত। এই অংশটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির দিক, সেহেতু অপ্রজ্ঞাজনিত (Timaeus 64.)। প্লেটো প্রজ্ঞাংশের স্থান নিরূপণ করেছেন দেহের মস্তিকে, শৌর্যাংশের স্থান নিরূপণ করেছেন বক্ষে এবং ক্ষুধার অংশের স্থান দেহের নিম্নাংশে। কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে তার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন যে, আত্মার অংশগুলোর স্থান বা অবস্থান নিরূপণের ক্ষেত্রে প্লেটো তাদের আক্ষরিক অর্থেই বুঝে নিয়েছেন কিনা বলা কঠিন (Copleston : A History of Philosopy: Page 244)। প্লেটোর মতে, মানুষের মধ্যে আত্মার তিনটি অংশ, প্রাণীদের মধ্যে প্রথমটি বাদে অপর দুটি এবং উদ্ভিদের মধ্যে শেষেরটি বর্তমান। কাজেই মানুষই সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে প্রজ্ঞার অধিকারী। কোন কিছুকে নশ্বর মনে করার অর্থ তাকে বিভাজ্য গণ্য করা। আত্মার প্রজ্ঞা অংশ যেহেতু অবিনশ্বর সেহেতু তা বিভাজ্য হতে পারে না। যেহেতু প্লেটো আত্মাকে অমর বলেছেন সেহেতু সিদ্ধান্ত করতে হয়, আত্মার প্রজ্ঞা অংশই অমর এবং অপর দুই অংশ প্রজ্ঞা অংশ থেকে কোন না কোনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা তারা ভিন্ন কোন আত্মা গঠন করে। কিন্তু প্লেটো রি’পাবলিক’ এবং ‘ফিড্রাস’ গ্রন্থের কাল্পনিক কাহিনী (Myths)-তে আত্মা সামগ্রিকভাবে অমর হয়ে থাকে এই কথাই বলতে চেয়েছেন। অবশ্য প্লেটো কাহিনীগুলোতে যা বলেছেন তাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ নাও করা চলে। প্লেটোর মতে আত্মার প্রজ্ঞাংশই থাকে এবং অপর দুই অংশ দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যায়।

আত্মার তিনটি অংশে বিভাগের কারণ : একটা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, প্লেটো আত্মার তিনটি অংশের বিভাগের কথা বলতে গেলেন কেন? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, আত্মার মধ্যে যে সংঘাত বা দ্বন্দ্ব দেখা যায় তাকে ব্যাখ্যা করার জন্যই তিনি আত্মার তিনটি অংশের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এক চৈতন্যের ঐক্যের দ্বারা আত্মার মধ্যে এই দ্বন্দ্বের সমন্বয় কিভাবে সাধিত হতে পারে প্লেটো তা নির্দেশ করেননি। আসল কথা হল, আত্মার তিনটি অংশ থাকা সত্ত্বেও আত্মা কিভাবে এক অধ্যাত্ম সত্তা হতে পারে, তিনটি কর্মের নীতি এক অভিন্ন আত্মার নীতি কিভাবে হতে পারে, প্লেটোর মনোবিজ্ঞানে তার কোন সমাধানের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।

কপলস্টোন-এর মন্তব্য : প্লেটো যে আত্মার তিনটি অংশের কল্পনা করেছেন সেই প্রসঙ্গে কপলস্টোন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, আসলে মানুষের প্রজ্ঞা অংশের যে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে, সেটা নির্দেশ করে প্লেটো নৈতিকতার প্রতি তার আগ্রহই প্রকাশ করেছেন। আসলে প্রজ্ঞা অংশ হল আত্মার অমর বা অবিনশ্বর ও ঐশ্বরিক অংশ; বিশ্ব আত্মা যে উপাদানে গঠিত, জীবাত্মাও সেই একই উপাদানে গঠিত। প্রজ্ঞা অংশ অদৃশ্য এবং বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতকে প্রত্যক্ষ করতে পারে, আকারকে (Forms) প্রত্যক্ষ করতে পারে। আত্মার অপর অংশ দেহের সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত হয়ে থাকার জন্য আকার বা সার্বিকের জগতকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। আত্মার নশ্বর অংশ বিশ্ব-আত্মা যে উপাদানে গঠিত সেই উপাদানে গঠিত নয়। প্লেটো স্বীকার করেছেন যে, মানুষ তার মধ্যে, আত্মার বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে সংঘাত তাকে অনুভব করে। কিন্তু সেই সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মা সম্পর্কে যে সুবিন্যস্ত ঐক্যবদ্ধ অভিমত প্লেটোর মনোবিজ্ঞানে প্রত্যাশা করা গিয়েছিল তা কিন্তু পাওয়া যায় না।

আত্মার অমরত্ব

প্লেটো আত্মার অমরত্ব (Immortality) বা অবিনশ্বরতার কথা স্বীকার করেছেন। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তিনি আত্মার অমরত্বের কথা স্বীকার করতে গেলেন কেন? কপলস্টোন-এর মতে, এর মূলে রয়েছে মৃত্যুর পরেও মানুষের নৈতিক আচরণের ফলাফল লাভের প্রশ্ন। সৎ ব্যক্তি তার সততার জন্য পুরস্কৃত হবে এবং অসৎ ব্যক্তি তার অসততার জন্য শাস্তি ভােগ করবে, এই নৈতিক দাবি মেনে নিতে গেলে আত্মার অবিনশ্বরতা স্বীকার করে নিতে হয়। আত্মার অবিনশ্বরতাকে স্বীকার করে প্লেটো নৈতিক জীবনের এই দাবিকেই স্বীকার করেছিলেন। প্লেটো আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে নিম্নলিখিত প্রমাণগুলো উপস্থাপিত করেছেন—

  • (ক) বিপরীত থেকে বিপরীতের সৃষ্টি হয়। যেমন শক্তি থেকে দুর্বলতার, নিদ্রা থেকে জাগরণের। জীবন এবং মৃত্যু হল পরস্পরের বিপরীত। জীবন থেকে মৃত্যুর উদ্ভব; কাজেই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, মৃত্যু থেকে জীবনের উদ্ভব। এর থেকে যে সিদ্ধান্ত অনুসৃত হয় তা হল, মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন না কোন স্থানে অস্তিত্বশীল থাকে এবং সময়মত পৃথিবীতে ফিরে আসে (Phaedo 70.)। এই যুক্তিটি সন্তোষজনক নয়। কেননা বিপরীত থেকে বিপরীতের সৃষ্টি তা বিষয়টিকে প্রমাণ করা হয়নি। এই যুক্তি থেকে জানা যায় না, দেহবিযুক্ত অবস আত্মার অবস্থার স্বরূপ কি? তা ছাড়া এই যুক্তির পরিণতি হল জন্ম-মরণ-চক্র (wheel of Rebirth), অর্থাৎ জন্মের পর মৃত্যু, মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম , আবার মৃত্যু, আহত পুনর্জন্ম–এর শেষ কোথায়?
  • (খ) জ্ঞানের মধ্যে যে অভিজ্ঞতা-পূর্ব উপাদান (A Prori Factor) রয়েছে তার ভিত্তিতে প্লেটো দ্বিতীয় যুক্তিটি উপস্থাপন করেছেন (Phaedo 19.)।
    • প্রথমত, মানুষের মূল্যের তুলনামূলক বিচার দেখেই অনুমান করতে হয় যে, মানুষের মূল্য সম্পর্কীয় মানদণ্ডের ও সর্বনিরপেক্ষ আদর্শের জ্ঞান আছে। কিন্তু সর্বনিরপেক্ষ মূল্যের আদর্শের অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে দেখা যায় না। কাজেই অনুমান করতে হয় যে, বর্তমান জীবনের পূর্ববর্তী কোন বিদেহী অবস্থায় আত্মা সেই আদর্শ প্রত্যক্ষ করেছে। এই প্রসঙ্গে স্টেইস (Stace) মন্তব্য করেছেন যে, স্মরণ এবং জন্মান্তর সম্পর্কীয় মতবাদের সাহায্যে প্লেটো আত্মার অমরত্ব সম্পর্কীয় মতবাদটিকে ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। প্রথম মতবাদ অনুসারে সব জ্ঞানই হল আত্ম জন্মগ্রহণের পূর্বে বিদেহী অবস্থায় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারই স্মরণ। সব জ্ঞানই স্মরণ, এই বিষয়টি প্লেটো মেনো (Meno)-তে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে, শেখানো বলে কিছু নেই, যা আছে তা হল শুধুমাত্র স্মরণ (There is no teaching, but only recollection)। আকার বা ধারণার জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লব্ধ হতে পারে না, কাজেই আত্মা পূর্বে বিদেহী অবস্থায় এই জ্ঞান লাভ না করলে, এই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। সব জ্ঞানই স্মরণ, প্লেটোর এই অভিমতের সমালোচনায় বলা যেতে পারে যে, অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্লেটোর এই অভিমত খাটে না। কখন পিরামিড তৈরি হয়েছিল বা ট্রয় নগরীর অবরোধ যথার্থই ঘটেছিল কিনা এগুলো কারও পক্ষে স্মরণ করা সম্ভব নয়, যদি ঘটনা ঘটার সময় সে সেখানে উপস্থিত না থাকে। যে জ্ঞান অভিজ্ঞতাপূর্ব (Apriori), যেমন যুক্তিবিজ্ঞান এবং গণিতের জ্ঞান অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ হয়ে প্রত্যেকের মনে বিদ্যমান থাকতে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারে; কিন্তু অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান জ্ঞান নয়। অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করা যায়। অবশ্য অভিজ্ঞতা-পূর্ব জ্ঞানকেই প্লেটো যথার্থ জ্ঞান বলে গণ্য করার পক্ষপাতী।
    • দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ অনিবার্য এবং সঠিক সত্যের জ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু যে যুবক কোন গাণিতিক জ্ঞানের অধিকারী নয়, সেও তার গাণিতিক জ্ঞানের পরিচয় দিতে পারে। যেহেতু সেই জ্ঞান সে কারও কাছ থেকে শিক্ষা করেনি বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ থেকে সে জ্ঞান লাভ করতে পারে না, সেহেতু সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, এই জীবনের পূর্ববর্তী কোন অবস্থায় সে গাণিত্যিক সত্য উপলব্ধি করেছে এবং বর্তমান স্মৃতি থেকে তার পুনরুৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। গাণিতিক জ্ঞান তার মনের মধ্যে পূর্ব থেকে বিদ্যমান থাকে। গণিত শিক্ষা দেওয়ার অর্থ হল যা সে প্রচ্ছন্নভাবে জানে, তাকে সেটা দেখিয়ে দেওয়া। তাকে সেই জ্ঞান লাভ করার জন্য নিজের মনের দিকে তাকাতে হয়। (স্টেইস মন্তব্য করেছেন যে, বর্তমানকালে অনিবার্য এবং সম্ভাব্য জ্ঞানের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয়েছে, পরবর্তীকালে যে পার্থক্যের ওপর কান্ট অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন সেই পার্থক্য যে প্লেটোই আবিষ্কার করেছেন, তার কৃতিত্ব প্লেটো দাবি করতে পারেন।)। এই যুক্তি খুব সন্তোষজনক নয়। কেননা প্লেটো যা-ই বলুন না কেন, যে যুবকের মধ্যে গাণিতিক জ্ঞান নেই তাকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে গাণিতিক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। আর সম্ভব হলেও মনে করতে হবে যে, প্রশ্নের মধ্য দিয়েও তাকে শেখানো হয়েছে, বা তার মধ্যে পূর্ব থেকে গাণিতিক জ্ঞান রয়েছে, এটা মেনে নেওয়া। তাছাড়া গণিতকে অভিজ্ঞতা পূর্ব (Apriori) বিজ্ঞান বলে স্বীকার করতে গেলেই যে বর্তমান জীবনের পূর্ববর্তী কোন অস্তিত্বশীল অবস্থার কথা চিন্তা করতেই হবে, এমন সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত নয়। এই যুক্তি সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করতে পারে না যে, মানুষের মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব থাকে।
  • (গ) প্লেটো তৃতীয় যুক্তিটিকে নিম্নলিখিতভাবে উপস্থাপিত করেছেন। এই পৃথিবীতে যা কিছু দেখা যায় তা হল অংশযুক্ত বা যৌগিক (Compound), সেহেতু নশ্বর, যেমন মানুষের দেহ। কিন্তু আত্মা যেহেতু অতীন্দ্রিয় আকার বা সার্বিককে প্রত্যক্ষ করতে পারে, দেহকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, সেহেতু আত্মা অযৌগিক এবং নশ্বর জড়বস্তু থেকে স্বতন্ত্র। আত্মা ঐশ্বরিক ও আধ্যাত্মিক সেহেতু অবিনশ্বর। প্লেটোর মতে, যা সরল বা মৌলিক অর্থাৎ অ-যৌগিক, তার শুরু নেই, শেষ নেই। তা পরিবর্তিত হতে পারে। স্বরূপ-ধর্ম (Essence) অপরিবর্তনীয়; উদাহরণস্বরূপ চিরন্তন সৌন্দর্য (Absolute Beauty) সব সময এক, কিন্তু সুন্দর বস্তু অবিরত পরিবর্তনশীল। কাজেই প্লেটো মনে করেন, প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তু হল পার্থিব। অদৃষ্ট বা অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তু হল অবিনশ্বর। দেহকে দেখা যায়, আত্মাকে দেখা যায় না। কাজেই আত্মাকে অবিনশ্বর বস্তুর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই যুক্তিও সন্তোষজনক নয়। কেননা আত্মাকে অযৌক্তিক ও আধ্যাত্মিক বলে স্বীকার না করা হলে এই যুক্তি দাঁড়াতে পারে না অর্থাৎ এই যুক্তি আত্মার অবিনশ্বরতা প্রমাণ করতে পারে না।
  • (ঘ) চতুর্থ প্রমাণটি আকারবাদের (Doctrine of Forms) ভিত্তিতে উপস্থাপিত করেছেন প্লেটো। আত্মা বার বার দেহ পরিগ্রহণ করলে, আত্মা ক্রমশ জীর্ণ হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মা বিনষ্ট হবে। এই ধরনের যুক্তির দ্বারা আত্মা নশ্বর প্রমাণ করা যেতে পারে। কিন্তু এর উত্তরে বলা যায় যে, জাতি বা আকার তার মধ্যে তার বিপরীত আকারের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না। যেমন, আগুন উষ্ণ হলে শীতল হতে পারেনা। আত্মা জীবনের আকার গ্রহণ করাতে, মৃত্যুর আকার গ্রহণ করতে পারে না। আসলে আত্মার আধ্যাত্মিকতা স্বীকার করলে তার জীর্ণ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এই যুক্তিটির ভিত্তি হল আকারবাদ। কোন ব্যক্তি যদি আকারবাদকে যথার্থ মতবাদ বলে স্বীকার না করে তাহলে আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে উপরিউক্ত যুক্তিটি তার কাছে। অর্থহীন হয়ে পড়ে।
  • (ঙ) কোন বস্তু তার অন্তর্নিহিত ত্রুটি ছাড়া ধ্বংস হতে পারে না। আত্মার ত্রুটি হল অজ্ঞতা, ভীরুতা, ন্যায়পরায়ণহীনতা, অসংযম। কিন্তু আত্মার এসব ত্রুটি যে আত্মাকে ধ্বংস করতে পারে না, তার প্রধান প্রমাণ হল যে, একজন ন্যায়পরায়ণহীন ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যত দীর্ঘ বাঁচে ততদিন তো বাচেই, তার থেকেও বেশি দিনও বাঁচে। কাজেই আত্মার অন্তর্নিহিত ত্রুটির দ্বারা যদি আত্মা বিনষ্ট না হয় তবে বাহ্য কোন ত্রুটির দ্বারা আত্মা ধ্বংস হয়, এমন সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়। এই যুক্তিও সন্তোষজনক নয়। কেননা বাহ্য আঘাতে বস্তু ধ্বংস হতে পারে এই প্রমাণিত সত্য। তবে আত্মা যেহেতু আধ্যাত্মিক সেহেতু বাহ্য আঘাত তাকে ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু কেউ যদি আত্মাকে আধ্যাত্মিক বলে স্বীকার না করে তাহলে এই যুক্তি তার কাছে মূল্যহীন।
  • (চ) যে বস্তু অপরকে গতিশীল করে এবং অপরের দ্বারা গতিশীল হয়, তা বিনষ্ট হতে পারে (Phaedo 26.)। কিন্তু আত্মা নিজে নিজেই গতিসম্পন্ন। আত্মা গতির উৎস। কাজেই আত্মা যদি গতির উৎস হয় তাহলে আত্মা কোন কিছুর দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে না। কেননা আত্মা যদি অসৃষ্ট হয় তবে আত্মা অবিনশ্বর। আত্মা সকল গতির উৎস হয়ে যদি নশ্বর হয় তাহলে বিশ্বজগৎ এবং সব সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি আত্মাকে গতির উৎস হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তাহলে আত্মা সবসময়ই অস্তিত্বশীল, এ ধরনের সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা ব্যক্তিগত অমরত্বের বিষয়টি প্রমাণিত হয় না।

প্লেটো আত্মার অমরত্বের কথা বলেছেন কিন্তু একই আত্মা যে দেহ বিনষ্ট হবার পর পুনরায় দেহ পরিগ্রহণ করে তার সমর্থনে প্লেটো কিছু বলেননি। অথচ ব্যক্তি অভিন্নতার চেতনা না থাকলে ব্যক্তি-আত্মার অমরত্ব প্রমাণিত হয় কিভাবে? যে আমি এই জন্মে দীনদরিদ্র সেই আমিই যে পরজন্মে ধনী ব্যক্তি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি তার চেতনা আমার মধ্যে না থাকলে আমার আত্মা অমরত্ব লাভ করল কি না করল, তাতে আমার কি আসে যায়?

মােট কথা প্লেটো জর্জিয়াস, ফিডাে, রিপাবলিক প্রভৃতি ডায়ালগগুলোতে আত্মার অমরত্ব বা অবিনশ্বরতার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ব্যক্তির দেহ বিনষ্ট হবার পর তার আত্মার অবস্থা কি রকম হবে তা নির্ভর করে এই পৃথিবীতে সেই ব্যক্তির আচরণ কিরূপ তার ওপর। তিনি জন্মান্তরবাদের কথা বলেছেন। তবে ডায়ালগে প্লেটো জন্মান্তরবাদের কথা বললেও তিনি নিজে সেই মতবাদে কতখানি বিশ্বাসী ছিলেন বলা কঠিন। তবে ডায়ালগে তিনি বলেছেন যে, দার্শনিক জ্ঞানসম্পন্ন আত্মার পক্ষে জন্মমরণ চক্র থেকে মুক্তি লাভের আশা আছে। তবে কপলস্টোন, সি. রিটার প্রমুখ দার্শনিক প্লেটোর দর্শনের সমালোচকবৃন্দ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সুনিশ্চিতভাবে বলা চলে না যে, প্লেটো আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে সুদৃঢ় প্রত্যয় লাভ করেছিলেন।

আত্মার অমরত্বের পক্ষে প্লেটো যে-সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেই সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জি. সি. ফিল্ড বলেন “এইসব যুক্তির মধ্যে কতকগুলো যুক্তি সেই যুগের ধারণারই বৈশিষ্ট্যসূচক এবং আমাদের কাছে তাদের আবেদন খুবই অল্প”। জন্মান্তরবাদের তাৎপর্য ও জন্মান্তরবাদের ধারণাটি প্লেটো পিথাগোরাসের থেকে গ্রহণ করেছেন বলে অনেক লেখকই নিঃসংশয়। প্লেটো জন্মান্তরবাদের যে সব বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন তার অধিকাংশই কাল্পনিক কাহিনী বা অতি কাহিনী (Myth)। প্লেটো বিভিন্ন ডায়ালগে এই সব বিশদ বিবরণের ভিন্ন ভিন্ন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন যা লক্ষ করে অনেকে মনে করেন যে, প্লেটো তাদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেননি। তিনি যেটুকু বিশ্বাস করতেন তাকে সংক্ষেপে এভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে—আত্মা দেহ ধারণ করার পূর্বেও অস্তিত্বশীল হয় এবং আত্মা অমরও। আত্মার স্বাভাবিক আবাসস্থল হল ধারণার জগৎ, যেখানে আত্ম বিদেহী অবস্থায় ধারণার শুদ্ধ এবং আনন্দময় ধ্যানে নিমগ্ন থাকে। কিন্তু যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সঙ্গে এর সম্বন্ধ আছে সেহেতু আত্মাকে দেহ ধারণ করতে হয়। মৃত্যুর পরে যদি কোন ব্যক্তি সৎ জীবন-যাপন করে, বিশেষ করে যদি ধারণার জ্ঞান অর্থাৎ দার্শনিক জ্ঞান লাভ করে, তাহলে আত্মা আবার তার ধারণার জগতের আনন্দময় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে। আবার দীর্ঘকাল পরে দেহধারণ করে আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। যারা মন্দ কাজ করে মৃত্যুর পরে তারা পূর্ব অবস্থার তুলনায় নিম্নতর কোন প্রাণীর দেহ ধারণ করে। প্লেটোর এই জাতীয় বিশ্বাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জি. সি. ফিল্ড বলেন যে, এই ধরনের বিশ্বাস কতকগুলো ধর্মীয় আন্দোলন, বিশেষ করে যা সাধারণভাবে ‘অরফিকবাদ’ (Orphism) নামে পরিচিত, তার সঙ্গে যুক্ত এবং আরও দার্শনিক চিন্তার, বা পিথাগোরাসের শিক্ষার অনুগামিতার দ্বারা প্রভাবিত, তার সঙ্গে যুক্ত।” (G.C. Field; Philosophy of Plato; Page 85.)।

প্লেটোর মনোবিজ্ঞানের সমালোচনা

প্লেটোর মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে, অতি কাহিনীর মাধ্যমে তিনি যে মনোবিজ্ঞান উপস্থাপিত করেছেন তা কোন সুসংবদ্ধ, সুবিন্যস্ত বিবরণ নয়। বহু সমস্যার কথা তিনি বলেছেন কিন্তু সমস্যার সমাধান তিনি করতে পারেননি। মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়বস্তুর আলোচনা করা অপেক্ষা নৈতিক দিক থেকে তাদের আলোচনায় তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। তবে তাঁর ডায়ালগগুলোতে মনোবিজ্ঞান সম্পৰ্কীয় কিছু কিছু বিষয়ের উল্লেখ আছে , যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আত্মার প্রকৃতির তিন অংশে বিভাগ, আত্মা ও দেহের দ্বৈত, আত্মার অবিনশ্বরতা প্রভৃতি বিষয়গুলো পরবর্তীকালের মনোবৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদেরও বিশেষ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। স্মরণ ও নিস্মরণ প্রক্রিয়ায় যে উপকরণগুলো তিনি দিয়েছেন (Theatetus), বা স্মৃতি ও স্মরণের মধ্যে যে পার্থক্য তিনি করেছেন (Philebus.) তা তার সূক্ষ্ম মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিচায়ক।

প্লেটোর পদার্থবিদ্যা

জগৎ উৎপত্তির বর্ণনায় কল্পনার আশ্রয় : ডায়েলেকটিকে প্লেটো সকল কিছুর হেতুরূপে এক মূল তত্ত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু এই মূল তত্ত্ব থেকে বিশ্ব জগতের উৎপত্তি কিভাবে এই ধারণা বা কিভাবে ঘটল তাও ব্যাখ্যা করা দরকার। অর্থাৎ কিনা, আকার বা ধারণা যদি হল মূল নিরপেক্ষ তত্ত্ব, তাহলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, অস্তিত্বশীল বিশ্বজগৎ কিভাবে এই আকার থেকে উদ্ভূত হল সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু প্রেটো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কোন সন্তোষজনক মতবাদে উপনীত হতে পারলেন না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় ধারণার ‘নকল’ বা ‘প্রতিলিপি’। এগুলি ধারণাতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ধারণার নকল বা প্রতিলিপিরই বা প্রয়োজন কি? কেন ধারণাগুলি নিজে থেকে প্রতিলিপিগুলিকে সৃষ্টি করবে এবং এই সৃষ্টি কিভাবে সংঘটিত হয়? এই সব প্রশ্নে কোন বিজ্ঞানসম্মত উত্তর দিতে প্লেটো সমর্থ হলেন না। সেই কারণে তিনি কাল্পনিক কাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বদলে আমরা পেলাম কবি সুলভ বর্ণনা। প্লেটোর পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় মতবাদগুলি প্লেটোর ডায়ালগ টাইম্যায়িয়ুসে (Timaeus) আলোচিত হয়েছে। এই ডায়ালগৃটিই প্লেটোর একমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক ডায়ালগ। টাইম্যায়িয়ুস গ্রন্থটিতে প্লেটো জড় জগৎ, প্রাণী ও মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

পরিণত বয়সে জগৎ-এর উৎপত্তির আলোচনার কারণ : সক্রেটিস প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনায় মােটেও আগ্রহী ছিলেন না। প্লেটোও এই আলোচনায় সময় ক্ষেপণ করতে উৎসাহী ছিলেন না। কারণ তার দৃষ্টিতে যথার্থ জ্ঞানের বিষয়বস্তু হল এক অতীন্দ্রিয় মানস জগৎ। ভৌতিক জগৎ সম্পর্কে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অস্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান লাভ করা যায় কিন্তু এই জ্ঞান মােটেও বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য নয়। তাই পরিণত বয়সে প্লেটো টাইম্যায়িয়ুস গ্রন্থে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সম্পর্কে আলোচনায় ব্রতী হলেন। এরূপ করার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ ছিল। অবশ্যই সেই কারণ অনুমান করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। একটি কারণ সম্পর্কে প্লেটো নিজেই কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তিনি মনোজগৎ এবং জড়জগতের ধারণা পেয়েছিলেন এবং দুই জগতের মধ্যে একটি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গণিত পার্থিব জগৎ বা শাশ্বত বা নিত্য তাই শিক্ষা দেয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মধ্যেই অতীন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান এই পৃথিবী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকে বিশ্বজগতের অভ্যন্তরে প্রসারিত করে দেয় যেখানে রহস্যময় দিব্য জ্যোতিষ্কমণ্ডলী নিজে নিজেই গতিশীল হয়। এদের মন হয় প্রাণসংযুক্ত দৃশ্যমান দেবতা; এদের গতি সংখ্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এদের শুধুমাত্র চিন্তনশীল মনের দ্বারা জানা যায়। এই বিষয়টিকেই জেলার প্লেটোর বিশ্বজগতের আলোচনায় মনোযোগী হবার একটি কারণরূপে গণ্য করেছেন। আরও এক কারণের কথা উল্লেখ করেছেন জেলার। মােট হল, জড়বাদী দার্শনিক মতবাদ অর্থাৎ পরমাণুবাদের যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করা। কপলস্টোন বলেন যে, ‘টাইম্যায়িয়ুস’ রচনার পিছনে প্লেটোর নিঃসন্দেহে অন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। সেটি ছিল, তিনি দেখান যে, এই সুসংগঠিত বিশ্বজগৎ বুদ্ধির ক্রিয়া এবং মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য উভয় জগতেরই অংশগ্রহণ করে। ‘সব কিছুই বিশৃঙ্খলা’—ডেমােক্রিটাসের এই বক্তব্য প্লেটো স্বীকার করে নিতে পারেননি। প্লেটোর মতে মনই সব কিছুর মধ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করে। কাজেই টাইম্যায়িয়ুস গ্রন্থে প্লেটো ‘মনই বিশ্বজগতের সব কিছুর মধ্যে বুদ্ধিনির্ভর শৃঙ্খলা বিধান করছে’—তারই চিত্র অঙ্কিত করেছেন এবং মানুষের অমর আত্মার ঐশ্বরিক উৎসের কথা ব্যক্ত করেছেন। টাইম্যায়িয়ুস গ্রন্থে প্লেটো স্পষ্টই বলেছেন যে, এই গ্রন্থে জড়জগৎ সম্পর্কে তিনি যে সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেগুলো সম্ভাব্য মাত্র, সুনিশ্চিত নয়। এটা হচ্ছে নিছক একটা খেলা এবং অবসর বিনোদন (a game and a recreation)। প্লেটোর মতে, পদার্থবিদ্যা যথার্থ বিজ্ঞানরূপে গণ্য হতে পারে না, কেননা পদার্থবিদ্যায় কোন সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। এই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক অবরোহের আকারে লন্ধ নয়।

পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় মতবাদগুলো সম্ভাব্য : যেহেতু প্লেটো স্পষ্টতই বলেছেন। যে, তাঁর পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় মতবাদগুলো সম্ভাব্য সেহেতু প্লেটো প্রদত্ত জগৎ বিষয়ক বিবরণগুলোকে কি আমরা সম্ভাব্য মনে করব? কেউ কেউ তাই মনে করেছেন। যেমন এ. ই. টেলর-এর অভিমতানুসারে টাইম্যায়িয়ুস আদপেই প্লেটোর রচনা নয়। তাদের মতে, পিথাগোরাসের গণিত বিষয়ক সিদ্ধান্তের সঙ্গে এম্পেডােক্লিজের জীববিদ্যা সম্পর্কীয় বিভিন্ন অভিমতকে সংযুক্ত করে কেউ হয়ত এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক করণফোর্ড (Cornford) টেলরের উপরিউক্ত অভিমত অস্বীকার করেছেন, এই যুক্তির ভিত্তিতে যে, তাহলে অ্যারিস্টটল এবং থিয়োফ্রাসটাসের মত প্রাচীন বিদগ্ধ ব্যক্তিরা এই সম্পর্কে কিছু বলতেন, কিন্তু তারা তা বলেননি। কপলস্টোনও করণফোর্ডকেই সমর্থন করেছেন। কাজেই সিদ্ধান্ত করা অযৌক্তিক হবে না যে, টাইম্যায়িয়ুস প্লেটোরই রচনা। তবে এমন হতে পারে যে, প্লেটো পিথাগোরাস সম্প্রদায়ের দার্শনিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

প্লেটোর মতবাদ : প্লেটোর পদার্থবিদ্যার যথাযথ অনুধাবনের জন্য একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, তিনি জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জগৎ সম্পর্কে তার দ্বৈতবাদ অর্থাৎ দুটি জগৎ সম্পর্কীয় মতবাদের প্রেক্ষিতেই তা করেছেন। এই দুটি জগতের একটি হল ধারণার বা আকারের অতীন্দ্রিয় জগৎ এবং অপরটি হল ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জগৎ। এই দুই জগতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা প্লেটোর পক্ষে ছিল এক প্রধান সমস্যা। ধারণা এক, কিন্তু যে সব বস্তু ধারণার অধীনস্থ তারা সংখ্যায় অসংখ্য। প্রত্যেকটি ধারণা শাশ্বত এবং অপরিণামী; বস্তু উৎপন্ন বা সৃষ্ট হয়েছে, তারা ক্ষণস্থায়ী এবং অনবরত পরিবর্তনশীল। ধারণার পরিপূর্ণ সত্তা আছে; বস্তু সত্তা এবং অসত্তার মধ্যে ঘােরাফেরা করছে। কাজেই প্রত্যক্ষগ্রাহ্য অস্তিত্বশীল বস্তুর এই অপূর্ণতা, প্লেটোর মত যেভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে তা হল যে, এরা অংশত ধারণায় অংশগ্রহণ করে, এবং অংশত অন্য একটি পৃথক তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু অংশত বাস্তব এবং অংশত অবাস্তব। তারা অংশত বাস্তব কারণ তারা সত্তাতে অংশগ্রহণ করে। তারা অংশত অবাস্তব কেননা তারা অসত্তাতে (Not-being) অংশগ্রহণ করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে যা বাস্তব বা পূর্ণ (Real and Perfect) তা হল ধারণা। দ্বিতীয় তত্ত্বটির প্রকৃতি তাতেই সন্ধান করে পাওয়া যাবে যেটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়কে আদর্শ থেকে পৃথক করছে। এটিকে ধারণা করা হয়েছে এমন কিছু যা অসীম সদাপরিণামী, অ-সত্তা এবং অজ্ঞেয় (Some thing infinite, everchanging, not-being and unknowable)। এই দ্বিতীয় তত্ত্বটি হল একটি উপাদান (Material), যেমন কোন উপাদান নিয়ে কোন কারিগর কাজ করে। কাজেই জগৎ উৎপত্তির ব্যাপারে কারিগরেরও প্রশ্ন এসে যায়। কাজেই একদিকে হল ধারণার জগৎ, অন্যদিকে উপাদান যা একান্তভাবেই আকারবিহীন, বিশৃঙ্খলপুঞ্জ মাত্র। এই উপাদানের ওপর ধারণার প্রতিলিপি মুদ্রিত করলেই বস্তু অর্থাৎ কিনা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশেষ বিশেষ বস্তুর সৃষ্টি হয়। কাজেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সত্তা এবং অ-সত্তা উভয়েতেই অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সত্তা ও অ-সত্তার এই মিশ্রণ কিভাবে সংঘটিত হয়? ধারণার প্রতিলিপিগুলো কিভাবে উপাদানের ওপর মুদ্রিত হয়? এই স্তরেই শুরু হয় কবি কল্পনা। ধারণাই যদি সব বস্তুর মূলীভূত হেতু, তাহলে প্রতিলিপি সৃষ্টির প্রক্রিয়া ধারণাগুলোর নিজেদের দ্বারাই সম্পাদিত হয় মনে করতে হবে। কিন্তু প্লেটো তা অসম্ভব মনে করেন। কেননা উৎপত্তি বা সৃষ্টি পরিবর্তন সূচিত করে। ধারণাগুলো অপরিণামী, কাজেই ধারণাগুলোর পক্ষে কোন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কাজেই এখন আর কল্পনার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া প্লেটোর পক্ষে অন্য কোন উপায় নেই।

জগতের স্রষ্টা ডেমিয়ার্জ : জগৎ যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, শাশ্বত হতে পারে না, সুতরাং এই জগতের অবশ্যই কোন স্রষ্টা থাকবে। কাজেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের উৎপত্তির মূলে রয়েছে কোন নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause)। এই নিমিত্ত কারণ হল এক ঐশ্বরিক কারিগর যাকে প্লেটো ডেমিয়ার্জ (Demiurge) নামে অভিহিত করেছেন। যা কিছু তিনি বিসদৃশ এবং বিশৃঙ্খল দেখলেন তাতে তিনি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলেন এবং এক শাশ্বত আদর্শ অনুসারে তিনি জড়জগৎ সৃষ্টি করলেন। এক আদর্শ সজীব প্রাণীর নমুনা অনুসারে এই জগৎ হল আত্মা ও বুদ্ধি সমন্বিত একটি সজীব প্রাণী। ডেমিয়ার্জ একটিমাত্র জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন কারণ একটির অধিক জগৎ হতে পারে না, কেননা ঈশ্বর যে নিত্য মূল জগতের ধারণা করেছিলেন, সৃষ্ট জগৎ তারই প্রতিলিপি। সমস্ত জগৎ একটি দৃশ্যমান প্রাণী যার মধ্যে রয়েছে আরও অন্যান্য প্রাণী।

ডেমিয়ার্জের ক্রিয়া করার মূলে উদ্দেশ্য : প্রশ্ন হচ্ছে, এইভাবে ডেমিয়ার্জ-এর ক্রিয়া করার মূলে কি উদ্দেশ্য ছিল? ডেমিয়ার্জ কল্যাণময়। তিনি যা শাশ্বত তার নমুনা অনুসারেই জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি অসূয়ামুক্ত, তিনি চেয়েছিলেন যতদূর সম্ভব সব কিছু তার নিজের মতই হােক। তিনি মনে করেছিলেন শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভাল। বাহ্য উপাদান গ্রহণ করে তাঁকে কাজ করতে হয়েছিল। কাজেই উপাদানের দোষত্রটির জন্য তার কাজ নিখুঁত হতে পারেনি। কিন্তু তিনি তার সাধ্যমত কাজ করেছিলেন যাতে সৃষ্ট জগৎ যতখানি সম্ভব ও নিখুঁত হতে পারে।

ডেমিয়ার্জ ঐশ্বরিক ধী-শক্তি : ডেমিয়ার্জ-এর স্বরূপ কি? তাকে স্রষ্টা ঈশ্বর (Creator God) রূপে গণ্য না করে ঐশ্বরিক ধী-শক্তি (Divine Reason) রূপে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। প্লেটোর ডেমিয়ার্জ খ্রিস্টানদের ঈশ্বরের মত নিছক শূন্যতা থেকে জগৎ সৃষ্টি করেননি, তিনি পূর্বস্থিত উপাদানের মধ্যেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পূর্বস্থিত উপাদানের সাহায্যে যত ভাল জগৎ সৃষ্টি করা যায় তা তিনি করেছিলেন।

সৃষ্টির ব্যাপারে দুটি বিষয়ের সংযোগ : প্লেটোর মতে, এই জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে দুটি বিষয়ের সংযোগ লক্ষ্য করা যায়-(১) উদ্দেশ্যহীন উপাদান, (২) বুদ্ধি (Intelligence)। ডেমােক্রিটাস বা এপিকিউরাস যেমন জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্দেশ্যবিহীন পরমাণুকে উপাদানরূপে গ্রহণ করেছেন, তেমনি প্লেটোও মনে করেন যে, ডেমিয়ার্জ কোন উদ্দেশ্যহীন উপাদান গ্রহণ করে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তবে ডেমােক্রিটাস ও এপিকিউরাস যেমন পরমাণুর আকস্মিক সংযোগহেতু জগতের উৎপত্তি ঘটেছে বলে বলেছেন, প্লেটো তা বলেননি। কাজেই জগতের উৎপত্তির মূলে কোন মন বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই এবং আকস্মিকতা হেতু জগতের উৎপত্তি প্লেটো তা মেনে নেননি। প্লেটোর মতে, উদ্দেশ্যহীন উপাদানে বুদ্ধি ক্রিয়া না করলে, উদ্দেশ্যহীন উপাদানকে উদ্দেশ্যের অধীনস্থ না করলে, জগতের উৎপত্তি সম্ভব নয়। তবে এ কথা সত্য যে, উদ্দেশ্যহীন উপাদান বুদ্ধি দ্বারা সর্বোতভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।

উপাদানের প্রকৃতি : পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল, এই উপাদানের প্রকৃতি কি? প্লেটো এর বর্ণনা দিতে গিয়ে আকারহীন, অদৃশ্যমান, সর্বগ্রহণক্ষম (All-receiving), যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তার জননী এবং আশ্রয়, সব সৃষ্টির ধাত্রী (The nurse of all becoming) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি একে এক ধরনের দেশ (A sort of space) হিসেবে বর্ণনা করেছেন যেখানে সৃষ্টি সম্ভব হয়। এই দেশ হল চিরস্থায়ী, ধ্বংসশীল নয়; যা কিছু সৃষ্টি হচ্ছে দেশ তাকে স্থান যুগিয়ে দিচ্ছে। এই দেশ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, তবে বোধগম্য। দেশ থেকেই প্রাথমিক উপাদানগুলো (Primary Elements) সৃষ্টি হয় না, দেশেই তাদের আবির্ভাব ঘটে। তিনি এটি কোন ধরনের সত্তা (Any form of being), এমন কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এর অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেননি। আবার শূন্য দেশ-এর মত এটা কিছুই নয় এমন কথা বলেননি। তিনি কেবলমাত্র ধারণার অপরিণামী স্থির সত্তার সঙ্গে তুলনা করে একে সদাপরিণামী বলে বর্ণনা করেছেন।

চারটি উপাদানের সৃষ্টি : জগৎ সৃষ্টির পূর্বে উপাদান এক অনিয়মিত গতিশীল অবস্থায় ছিল। এক প্রাকৃতিক অনিবার্যতাবশত উপাদানের অদৃশ্য ক্ষুদ্র কণাগুলো তাদের রকম অনুসারে একত্র সংযুক্ত হল এবং চারটি পৃথক স্থানে চারটি উপাদানের (Element) সৃষ্টি হল—অপ, ক্ষিতি, মরুৎ এবং অগ্নি বা তেজ। প্লেটোর সৃষ্টি বর্ণনায়, জগতের যে মৌলিক অবস্থার কথা আছে, ডেমােক্রিটাসের সৃষ্টি বর্ণনায় জগতের যে মৌলিক অবস্থার কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। তবে একটা কথা ভুললে চলবে না যে, প্লেটোর দৃষ্টিতে এরা হল জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে সহ-কারণ (Co-causes)। ধারণার জগৎ-ই হল আসল জগৎ। ডেমােক্রিটাসের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়মই হল একমাত্র গতি শক্তি, কিন্তু প্লেটো একে সৃজনশীল ঐশ্বরিক মনের একটি করণ (Instrument) রূপে গ্রহণ করেছেন। প্লেটোর মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ সদা পরিবর্তনশীল। সেহেতু এদের দ্রব্যরূপে আখ্যাত করা যেতে পারে না। এরা হল গুণ; দেশে এদের আবির্ভাব এবং তিরোভাব লেগেই থাকে। ডেমিয়ার্জ, সৃষ্টির জন্য দুটি বিষয় গ্রহণ করেছিলেন – প্রথমত, আধার, যা অদৃশ্যমান, গুণবর্জিত কিন্তু সর্বগ্রহণক্ষম, কিন্তু যাকে বোঝা দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক গুণ যেগুলোর আধারে আবির্ভাব ঘটে এবং যেগুলোকে আকার-এর নমুনা অনুসারে ডেমিয়ার্জ গঠন করতে থাকেন। জগৎ সৃষ্টির জন্য ডেমিয়ার্জ এই চারটি উপাদানকেই ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই কারণে জগতের কোন বার্ধক্য বা ব্যাধির কথা বলা যেতে পারে না। ডেমিয়ার্জ ছাড়া কেউ জগতকে ধ্বংস করতে পারে না।

উপাদানের ওপর জ্যামিতিক আকার প্রদান : আকার এবং সংখ্যার (Forms and Numbers) দ্বারা গঠিত হওয়াই দৃশ্যমান জগতের মৌলিক প্রকৃতি। ডেমিয়ার্জ চারটি প্রাথমিক উপাদান-এর ওপর জ্যামিতিক আকার প্রদান করলেন। জ্যামিতিক আকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি ত্রিভুজের কথা উল্লেখ করেছেন। আদি জ্যামিতিক আকার হল ত্রিভুজ। তিনি দুধরনের সমকোণী ত্রিভুজের কথা বলেছেন। একটি হল অর্ধ বর্গাকার এবং অপরটি অর্ধ সমবাহু ত্রিভুজাকার, যার থেকে বর্গক্ষেত্র এবং ঘন পদার্থের সমপার্শ্ববিশিষ্ট পার্শ্বগুলো গঠিত হবে। এরপর ঘন পদার্থগুলো গঠিত হয়। প্লেটো পাঁচটি ঘন পদার্থের মধ্যে চারটিকে উপাদানের মৌলিক আকাররূপে বিবৃত করেছেন। ক্ষিতির আকার ঘনক্ষেত্র (Cube), তেজের হল পিরামিড, মরুৎ-এর হল অষ্ট তলক, জলের বিংশ তলক। জগতকে সমগ্র হিসেবে পরিকল্পনা করার জন্য পঞ্চমটিতে ডেমিয়ার্জের প্রয়োজন হয়েছিল। এগুলো এত ক্ষুদ্র যে, এদের কোন একটিকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, যদিও বেশ কিছু একত্রিত হলে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই ক্ষেত্রগুলোকে আবার রেখাতে এবং রেখাগুলোকে বিন্দুতে পরিণত করা হল। কণাগুলোকে এভাবে ক্ষুদ্র জ্যামিতিক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার ফলে উপাদানগুলোর একটি আর একটিতে পরিবর্তন বা রূপান্তর সম্ভব হল। যেমন জল, অগ্নির ক্রিয়াতে তার উপাদানগত ত্রিভুজে পরিণত হতে পারে এবং এই ত্রিভুজগুলো দেশেতে ঐ একই আকার বা ভিন্ন আকার লাভ করতে পারে। অবশ্য ক্ষিতির ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় , কেননা এর উপাদানগত ত্রিভুজগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও এই ত্রিভুজগুলোর নিজস্ব প্রকৃতি রয়েছে। যার জন্য ক্ষিতির কণাগুলো অন্য কণাতে পরিণত হতে পারে না। অ্যারিস্টটল অবশ্য এর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছেন এবং বলেছেন যে, ক্ষিতির সপক্ষে এই বক্তব্য অযৌক্তিক এবং প্রত্যক্ষের দ্বারা সমর্থিত নয়। প্রাথমিক উপাদান থেকে দ্রব্যের (Substances) সৃষ্টি। কিন্তু প্লেটো বলেন যে, দব্যের উৎপত্তি এবং তার প্রকৃতি সম্পর্কে অনুমান করা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তা হল নির্দোষ আমােদ-প্রমােদের শামিল।

বিশ্ব-আত্মার সৃষ্টি : ডেমিয়ার্জ প্রথমে বিশ্ব-আত্মা (World-Soul) সৃষ্টি করলেন। তারপর ঐ একই উপাদান থেকে তিনি অবিনশ্বর আত্মার (Immortal Soul) সৃষ্টি করলেন। বিশ্ব-আত্মা হল অ-ভৌতিক। কিন্তু এটি দেশে অবস্থান করে। তিনি শূন্য দেশে একটি বড় জালের মত তাকে বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি তাকে দুভাগে ভাগ করলেন এবং দুই অর্ধাংশকে বাঁকিয়ে একটি ভেতরের এবং একটি বাইরের বৃত্ত গঠন করলেন। এরাই হল যথাক্রমে গ্রহ এবং নক্ষত্রের মন্ডল। গ্রহ এবং তারকা হল আত্মবিশিষ্ট, যারা স্বর্গীয় দেবতা। এই স্বর্গীয় দেবতারা ডেমিয়ার্জের সৃষ্টি। ডেমিয়ার্জ স্বর্গীয় দেবতাদের ওপর মানবাত্মার নশ্বর অংশ এবং মানবদেহের সৃষ্টির ভার অপর্ণ করেন।

জীবন্ত প্রাণীর আদর্শ : ডেমিয়ার্জ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করার পর তাকে আরও আদর্শের অনুরূপ অর্থাৎ জীবন্ত প্রাণীর মত করার জন্য সচেষ্ট হলেন। এখন জীবন্ত প্রাণীর আদর্শটি হল নিত্য বা শাশ্বত। কাজেই সৃষ্ট বস্তুগুলোকে আদর্শতে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত করা সম্ভব নয়। কাজেই তিনি যা শাশ্বত বা নিত্য তার একটি গতিশীল প্রতিরূপ সৃষ্টির প্রয়াস করলেন। তিনি স্বর্গরাজ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করলেন এবং গণনার অতীত নিত্যকালের এমন প্রতিরূপ সৃষ্টি করলেন যাকে গণনা করা যায়। এই প্রতিরূপ হল কাল (Time)। ডেমিয়ার্জ কাল পরিমাপের জন্য মানুষকে দিলেন উজ্জ্বল সূর্য যাতে এই উজ্জ্বলতার সাহায্যে মানুষ দিন-রাত্রির পার্থক্য করতে সমর্থ হয়।

চার ধরনের প্রাণী সৃষ্টি : চার ধরনের প্রাণী আছে, যথা-দেবতা, পাখি, মাছ এবং স্থলচর প্রাণী। দেবতারা হল মুখ্যত তেজ। স্থির নক্ষত্র হল ঐশ্বরিক এবং শাশ্বত প্রাণী। স্রষ্টা দেবতাদের বললেন যে, তিনি তাদের ধ্বংস করতে পারেন কিন্তু তিনি তা করবেন না। তিনি তাদের ওপর অন্য প্রাণীর নশ্বর অংশ গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। তিনি নিজে তাদের ঐশ্বরিক এবং অবিনাশশীল অংশগুলো গঠন করলেন। স্রষ্টা প্রতিটি নক্ষত্রের জন্য একটি করে আত্মা সৃষ্টি করলেন। আত্মার আছে সংবেদন, ভালবাসা, ভয় এবং ক্রোধ। তারা যদি এদের অতিক্রম করতে পারে, তারা সততার সঙ্গে বসবাস করতে পারে এবং যদি তাদের জয় করতে না পারে, তা হলে তা পারে না। যদি কোন ব্যক্তি ভালভাবে বসবাস করে, তাহলে সে মৃত্যুর পরে তার নক্ষত্রে ভালভাবে বাস করার জন্য ফিরে যায়। যদি সে খারাপভাবে বসবাস করে তাহলে সে পর-জীবনে স্ত্রীলোকে পরিণত হয়। স্রষ্টা কিছু আত্মা পৃথিবীতে, কিছু আত্মা চন্দ্রে, কিছু আত্মা গ্রহ-নক্ষত্রে স্থাপিত করলেন এবং দেবতাদের ওপর তাদের দেহ গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।

প্লেটোর বিশ্ব-আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস : জগতের উৎপত্তির উপরিউক্ত বিবরণ নিছক কাল্পনিক কাহিনী, প্লেটো নিজেও জানতেন যে, এটি কাল্পনিক। তবে তিনি এক বিশ্ব-আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্ব-আত্মা প্লেটোর দর্শনে ধারণা এবং ইন্দ্রিয়ের জগতের মধ্যে মধ্যস্থতা করে। প্লেটো মনে করেছিলেন যে বৌদ্ধিক আচরণ এবং গতির ব্যাখ্যা করার জন্য জগতে কোন আত্মা থাকা দরকার। জগতকে যে বিচার বুদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিচালিত করে তা বিশ্বজগতের মধ্যেই থাকে। বহির্বিশ্বজগতে গতির কারণ হল জগৎ-আত্মা, যেমন জীব-আত্মা মানুষের দেহে গতির কারণ। বিশ্বজগৎ হল একটা জীবন্ত সত্তা।

জেলারের মন্তব্য : জেলার বলেন, “জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে জগতের তুলনা যেন আমাদের প্লেটোর জগৎ সম্পর্কীয় মতবাদকে অদ্বৈতবাদী সর্বেশ্বরবাদ রূপে গণ্য করার জন্য ভুল পথে চালিত না করে।” (Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy, Page 149.)। প্লেটোর দৃষ্টিতে প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী দুটি তত্ত্বের বা নীতির সংমিশ্রণ—একটি তত্ত্ব আধ্যাত্মিক, অপর তত্ত্বটি ভৌতিক। এই ধারণা পুরোপুরি দ্বৈতবাদী। টাইম্যায়িয়ুসে প্লেটো ধারণা এবং আত্মাকে অতীন্দ্রিয় গণ্য করেছেন, যারা প্রকৃতির দিক থেকে এক। কিন্তু জীবন্ত প্রাণী এবং তাদের সর্বোত্তম রূপ যে মানুষ, তারা, বিশ্বজগৎ যে উপাদানের সংমিশ্রণ, তারই সংমিশ্রণ অর্থাৎ কিনা, নিত্য অধ্যাত্ম সত্তা এবং ক্ষণস্থায়ী ভৌতিক সত্তার সংমিশ্রণ। বার্ট্রান্ড রাসেল প্লেটোর জগৎ সম্পর্কীয় বিবরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “টাইম্যায়িয়ুসে জগতের উৎপত্তির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার কোন্ কোন্ বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন্ কোন্ বিষয়ক কাল্পনিক বলে গ্রহণ করা যেতে পারে তা বোঝা কঠিন।” (Bertrand Russell : A History of Western Philosophy.)। তাঁর মতে দর্শন হিসেবে এর কোন গুরুত্ব নেই কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে যার জন্য এর আলোচনার প্রয়োজন হয়েছে। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের চিন্তাধারার ওপর এর বিরাট প্রভাবের জন্যই সমগ্র ডায়ালগটি পাঠ করা প্রয়োজন।

প্লেটোর রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ

রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদের সঙ্গে নৈতিক মতবাদের সংযোগ

প্লেটোর রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ তার নৈতিক মতবাদের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্য থেকেই মানষ তার কল্যাণময় জীবন-যাপন করতে পারে এবং সমাজ বলতে বুঝতে হবে নগর রাষ্ট্র (City-State)। কাজেই প্লেটোর মত দার্শনিক যিনি মানুষের প্রকৃত জীবন নিয়ে আলোচনা করেন তাকে রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ এবং কার্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। প্লেটোর মতে, ব্যক্তি ও রাষ্টের নৈতিকতা ভিন্ন নয়। এক সর্বনিরপেক্ষ নৈতিক নিয়ম সব ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রের নৈতিক নিয়মের প্রতি মনোযোগী হবার কোন প্রয়োজন নেই, প্লেটো এ কথা স্বীকার করেন না। রাষ্ট্র নিজেই তার নৈতিক নিয়মের উৎস হতে পারে প্লেটোর মতে, যেহেতু ক্ষুদ্র ক্ষেত্রের তুলনায় বৃহত্তর ক্ষেত্রেই কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করা সহজতর হয়, সেই কারণে প্রথমে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার অর্থ নিরূপন করে তারপর ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার অর্থ নিরূপণ করাই যুক্তিযুক্ত। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার নীতি অভিন্ন। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়েই ন্যায়পরায়ণতার চিরন্তন নীতি মেনে চলতে বাধ্য।

আদর্শ রাষ্ট্রের স্বরূপ আবিষ্কার করার উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্র সম্পর্কিয় তত্ত্বের উৎস

প্রচলিত রাষ্ট্রগুলোর স্বরপ নিয়ে আলোচনা না করে রাষ্ট্র কি রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনার সংকল্প করলেন প্লেটো। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করেছেন। তার উদ্দেশ্য হল, আদর্শ রাষ্ট্রের স্বরূপটি আবিষ্কার করা। বাস্তবে অস্তিত্বশীল প্রতিটি রাষ্ট্র যার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করা চলবে, অবশ্য যতদূর তা রাষ্ট্রের পক্ষে করা সম্ভব। বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি যে সব রাষ্ট্র দেখেছেন, প্রত্যেকটিরই অনেক ত্রুটি রয়েছে। তিনি মনে করেন যে, এদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করার কিছু নেই।

প্লেটোর রাষ্ট্র সম্পর্কিয় তত্ত্বের উৎস : প্লেটোর রাষ্ট্র সম্পর্কীত তত্ত্ব তাঁর ‘রিপাবলিক; (Republic) ‘স্টেটম্যান’ (Statesman) এবং ‘লস’ (Laws) গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। আমরা উপরিউক্ত গ্রন্থগুলোকে অনুসরণ করে তার রাষ্ট্রতত্ত্ব বুঝে নেবার চেষ্টা করব। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কীয় যে মতবাদ তিনি উপস্থাপিত করেছেন সেটি, তার অন্য দুটি ডায়ালগে রাষ্ট্র সম্পর্কীয় যে মতবাদ উপস্থাপিত করেছেন, তার থেকে নীতিগতভাবে পৃথক। অ্যারিস্টটল তার ‘পলিটিকস্ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতে রিপাবলিক’ এবং ‘লস’-এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের কয়েকটি সাধারণ সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিলেও প্রধানত, ‘স্টেটসম্যান’ এবং লসে প্লেটো যে রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপন করেছেন, তাকেই অনুসরণ করেছেন। বস্তুত অ্যারিস্টটল তার রাষ্ট্রতত্ত্বের জন্য ‘রিপাবলিক’-এর তুলনায় ‘লস’-এর কাছে বেশি ঋণী এবং তিনি প্লেটোর প্রথম দিকের রচনায় যে রাষ্ট্রতত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে, তার তুলনায় তার শেষের দিকের রচনায় উপস্থাপিত রাষ্ট্রতত্ত্বকে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত বলে গণ্য করেন।

রিপাবলিকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কন : ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো শুধুমাত্র যে অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রগুলোরই বর্ণনা দিয়েছেন তা নয়। তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্রও অঙ্কিত করেছেন। তিনি সকল রাষ্ট্রের অনুসরণযোগ্য একটা ‘নমুনা’ (Model) আবিষ্কার করতে চান এবং বাস্তবে অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রগুলো তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেই প্রশ্ন নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। প্লেটোর মতে, একটি সৎ লোকের গুণ একটি সৎ নাগরিকের গুণের সঙ্গে অভিন্ন এবং সৎ মানুষ কেবলমাত্র সৎ রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে। কাজেই যা মানুষের পক্ষে ভাল কল্যাণকর, তা রাষ্ট্রের পক্ষেও কল্যাণকর। প্লেটো সমাজের ক্রমবিকাশের স্তরগুলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন না; তিনি আগ্রহী ছিলেন যৌক্তিক ধারার (Logical Order) দিক থেকে আলোচনায়। অর্থাৎ এথেন্সের আবির্ভাব কিভাবে ঘটল সেই প্রশ্নে তিনি আগ্রহী নন। সমাজের অস্তিত্বের মূলে যে শর্তগুলি কার্যকর, তিনি সেগুলো আবিষ্কারে আগ্রহী। তিনি যে প্রশ্নে আগ্রহী সেটি হল মানুষের প্রকৃতির সেই বৈশিষ্ট্যটি কি যা তাকে সামাজিক করেছে বা যার জন্য সমাজ অস্তিত্বশীল হয়েছে। কাজেই তিনি আমাদের সমাজের, উৎপত্তির একটি যৌক্তিক চিত্র উপস্থাপিত করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কিত করতে গিয়ে প্লেটো সক্রেটিসের ‘সততাই জ্ঞান’ (Virtue is Knowledge) মতবাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই মতবাদ অনুসারে বস্তুগত কল্যাণের (Objective Good) অস্তিত্ব আছে এবং প্লেটোর মতে, কেবলমাত্র দার্শনিকেরাই এই কল্যাণ সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে। এই কারণে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকবর্গ হবেন দার্শনিকবৃন্দ, যারাই কেবলমাত্র কল্যাণের জ্ঞানের অধিকারী।

প্লেটোর সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্র সামাজিক চুক্তির ফল নয়

প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুধাবন করার জন্য আমরা তার সমাজ সম্পর্কীয় বিশ্লেষণ নিয়ে শুরু করব। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের জীবন তার নাগরিকদের জীবনের মধ্যেই অস্তিত্বশীল। মানুষই রাষ্ট্র গঠন করে। তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র হল এমন একটি সংগঠন যার মাধ্যমে মানুষের জাগতিক প্রয়োজনের পরিতৃপ্তি ঘটে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। সমাজ দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে প্রথমত, কোন মানুষই স্বনির্ভর নয়, এবং দ্বিতীয়ত, প্রথম বিষয়টির পরিপূরক বিষয়টি হল মানুষ মানুষের সাহচর্য চায়। মানুষের পক্ষে অপর মানুষের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীন জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের জন্য মানুষের পারস্পরিক সহায়তার প্রয়োজন হয়। তাই তারা সঙ্গী, বন্ধু এবং সাহায্যকারীদের একটা বাসস্থানে জড় করে এবং তার নাম দেয় নগর।

প্লেটোর সময় নগরই ছিল রাষ্ট্র, যাকে বলা হতো নগর-রাষ্ট্র। এসব নগর রাষ্ট্রের মৌলিক উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য। বিচিত্র ধরনের পারস্পরিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য ধর্ম-বিনিময়ের একান্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যেমন, নরনারীর প্রয়োজনগুলো মেটাবার ব্যবস্থা করা; তেমনি সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্ম বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। কাজেই প্লেটোর মতে, কোন সামাজিক চুক্তি থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেনি। প্লেটোর মতে, সমাজে কর্ম-বিনিময় দুটি নীতি সূচনা করে শ্রমবিভাগ (Division of Labour) বা কর্ম বিভাগ এবং বিশেষ কোন কর্মে দক্ষতা (Specialistion of Tasks)। এই দুটি নীতি মানুষের মনস্তত্ত্বের দুটি মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত –

  • (১) মানুষে মানুষে মনোভাবের (Aptitudes) দিক থেকে পার্থক্য আছে এবং কাজেই অপরের তুলনায় মানুষ কোন কোন কাজ ভালভাবে করতে পারে।
  • (২) কোন ব্যক্তি দক্ষ কর্মী হতে পারে যদি যে কাজের জন্য সে স্বভাবত উপযুক্ত, সেই কাজ সে অবিচলিতভাবে সম্পাদন করতে পারে। কোন ব্যক্তি তার স্বাভাবিক ক্ষমতা অনুযায়ী যদি একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে তাহলে তার কাজের গুণগত ও পরিমাণগত উৎকর্ষ অনেক বেশি হয়।

মানুষের আত্মার তিনটি উপাদান ও প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির যান্ত্রিক সংগঠন নয়। এটি একটি আঙ্গিক ঐক্য, যেখানে প্রতিটি অংশেরই একটি ক্রিয়া আছে। রাষ্ট্র, প্লেটোর মতে, মানুষের মনের দ্বারা একটি সৃষ্টি বিষয়। এই কারণে মানুষের প্রকৃতির বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। প্লেটোর মতে, মানুষের আত্মার তিনটি উপাদান –

  • (১) অবিচার-বুদ্ধিজনিত বা ক্ষুধার উপাদান (Irrational or Appetitive)। মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতির উৎস এই উপাদানটি।
  • (২) বিচার-বুদ্ধিজনিত উপাদান বা আত্মার প্রজ্ঞাংশ। এই উপাদানের সাহায্যে ব্যক্তি সাহিত্য, কলা অনুধাবন করতে পারে এবং সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।
  • (৩) শৌর্যের উপাদান (The Spirted Element)। এই উপাদানটি মানুষকে যুদ্ধে প্রণােদিত করে, তাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে এবং তার মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে।

রাষ্ট্র গঠনের জন্য তিনটি উপাদানের প্রয়োজন— অর্থনৈতিক (Economic), সামরিক (Military) এবং দার্শনিক (Philosophic)। ক্ষুধার উপাদান খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতি প্রয়োজন সৃষ্টি করে। এর ফলে কোন সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা এই প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজন আছে। যেমন-কাব্য, সঙ্গীত, পােশাক পরিচ্ছদ, চিত্র ইত্যাদি। এসব প্রয়োজন মেটাবার জন্য একটি বৃহৎ জনসংখ্যার প্রয়োজন এবং এই বৃহৎ জনসংখ্যার বসবাসের জন্য একটি বৃহৎ এলাকা বা অঞ্চলের প্রয়োজন। এর পর দেখা দেয় যুদ্ধের সমস্যা এবং ঐ অঞ্চল বা রাজ্যকে রক্ষা করার প্রশ্ন। এর জন্য প্রয়োজন একটি সামরিক সংগঠনের, যেটি শৌর্যের উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু প্লেটো বিশেষ কর্মদক্ষতার নীতিকে এবং কর্ম-বিভাগকে সমর্থন করেন, সেহেতু তিনি পেশাদার এবং সুশিক্ষিত সৈন্যদল গঠনের অনুমােদন করেছেন। এদের কাজ হবে শুধু যুদ্ধ ছাড়া অপর কিছু না করা।

সবশেষে দেখা দেয় দার্শনিক উপাদান। রাষ্ট্রের সামরিক সংগঠন যখন কাজ করতে থাকে, বিচার-বুদ্ধির উপাদানও কাজ করতে থাকে। কেননা শৌর্যের উপাদান বিচার-বুদ্ধির উপাদানের সাহায্যকারী। বিচার-বুদ্ধির উপাদান দার্শনিক অভিভাবকদের ক্ষেত্রে, যারা রাষ্ট্র শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।

কর্মবিভাগের ফলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্ভব : কর্ম-বিভাগের ফলে সমাজে দেখা দেবে বিভিন্ন শ্রেণী। যেমন কৃষক, তাঁতী, মুচি, কর্মকার, ব্যবসায়ী, ছুতোর। ক্রমশ প্রয়োজন দেখা দেবে সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, শিক্ষক, নার্স বা সেবিকা, নাপিত, রাধুনি। এবং আরও অনেক ব্যক্তির। প্লেটোর রাষ্ট্রে আমরা তিনটি বিশেষভাবে দক্ষ শ্রেণীর দেখা পাই—(১) শাসক শ্রেণী বা অভিভাবকবৃন্দ, (২) সৈনিক শ্রেণীর, (৩) উৎপাদক। প্রত্যেকেই তাদের নির্দিষ্ট কার্যই কেবলমাত্র সম্পাদন করবে। শাসকবর্গ এবং সৈনিকদের এই উদ্দেশ্যে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সৈনিকদল সর্বোতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে নিজেদের নিয়োজিত করবেন। এরা হবেন তেজস্বী, দার্শনিক দৃষ্টিসম্পন্ন, যার দ্বারা তারা অতি সহজেই নিরূপণ করতে পারবেন তাদের প্রকৃত শত্রু কারা। প্লেটো চারটি সৎ গুণকে প্রধান বা মৌলিক বলে স্বীকার করেছেন— এই চারটি সৎ গুণ হল— বিজ্ঞতা (Wisdom), সাহস (Courage), মিতাচার (Temperance) বা আত্মসংযম এবং ন্যায়পরায়ণতা (Justice)। 

রাষ্ট্রের যারা অভিভাবক, তাদের শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এই শিক্ষা শুরু হবে সঙ্গীত দিয়ে, কাহিনী শিক্ষার বিষয়টিও তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তবে যে সব কাহিনীতে দেবতাদের মন্দ ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা আছে, যেমন হেসিয়ড ও হােমারের কাহিনীতে দেখা যায়, শৈশবে এসব কাহিনী ভাবী অভিভাবকদের পড়তে দেওয়া হবে না। ঈশ্বর মন্দের স্রষ্টা-শিশুদের মনে এরূপ ধারণার সৃষ্টি না হওয়াই সর্বতোভাবে বাঞ্চনীয়। 

অর্থনৈতিক প্রয়োজন থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভব হলেও প্লেটো শিক্ষা সমস্যা নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো নয়, ন্যায়পরায়ণতার নীতি অনুসারে রাষ্ট্রের নাগরিক যাতে কল্যাণময় জীবনের অধিকারী হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য।

আদর্শ রাষ্ট্রে মহাকবি এবং নাট্যকারদের কোন স্থান নেই : প্লেটোর মতে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে মহাকবি এবং নাট্যকারদের কোন স্থান নেই। কবিদের ভাষার সৌন্দর্য, শব্দ চাতুর্য ও কল্পনা সত্য উপলব্ধির পথে বাধার সৃষ্টি করে। তা ছাড়া কবিরা অনেক ‘নীতি-বিগর্হিত’ চরিত্র চিত্রণ করেন। যদি আদর্শ রাষ্ট্রে কবিতাকে স্থান দিতে হয় প্লেটোর মতে, সেই স্থান দিতে হবে গীতি কবিতাকে। প্লেটোর মতে সঙ্গীত ছাড়া ব্যায়াম চর্চা (Gymnastics) রাষ্ট্রের তরুণ নাগরিকদের শিক্ষার একটা অঙ্গ হবে। রাষ্ট্রের অভিভাবকবৃন্দ অলস ক্রীড়াবিদ হবেন না, তারা হবেন যোদ্ধা ক্রীড়াবিদ, যাঁরা প্রহরী কুকুরের মত সজাগ থেকে সব কিছু দেখবেন এবং শুনবেন।

মানুষের সামাজিক সম্পর্ক : প্লেটো মানুষের সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। মানুষ সমাজে শুধু পরিবারেই জন্মগ্রহণ করে না। সে একটি বৃহত্তর সংগঠনেরও সভ্য। কাজেই সমাজের মধ্যে সে সৎ জীবন-যাপন করবে এবং তার লক্ষ লাভে সচেষ্ট হবে। তার সঙ্গে এমনভাবে আচরণ করা সমীচীন হবে না যাতে সে মনে করে যে, সমাজের মধ্যে সে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শুধু নিজের জন্যই বাস করছে। তার যদি সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে তবেই তার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা থাকে। যে ব্যক্তি রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন নয়, তার কাছে রাষ্ট্র এক অপরিচিত বস্তু বলেই মনে হবে। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্র হল এমনই একটি সংগঠন যাতে তার একটা অংশ রয়েছে। এই বোধ তার মধ্যে এলেই সে রাষ্ট্র সম্পর্কে একটা মতবাদ গঠন করার জন্য উৎসাহিত হবে। প্লেটো রাজনৈতিক জীবনের মূলে যে নীতিগুলো কার্যকর সেগুলো আবিষ্কার করেছিলেন এবং যথার্থভাবে বলা যেতে পারে তিনি রাষ্ট্রের একটি দার্শনিক মতবাদের গোড়া পত্তন করেছিলেন। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র মানুষকে সৎ জীবন-যাপনে প্রণোদিত করে।

অভিভাবকদের প্রকৃতি

প্রশ্ন হল, রাষ্ট্রের দু’শ্রেণীর নাগরিক নিম্নশ্রেণীর কারিকর এবং উচ্চ শ্রেণীর অভিভাবকদের মধ্যে রাষ্ট্রের শাসনকর্তা বা পরিচালক হবেন কারা? প্লেটোর মতে, অভিভাবক শ্রেণীর মধ্য থেকেই খুব সতর্কতার সঙ্গে রাষ্ট্রের শাসকদের নির্বাচন করতে হবে।

এই শাসকরা কি রকম হবেন? তারা তরুণ হবেন না, তারা হবেন তাদের শ্রেণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, বুদ্ধিমান, ক্ষমতাশালী, রাষ্ট্রের ব্যাপারে মনোযোগী। বিজ্ঞতার সারবস্তু হল বিবেচনা। এই বিবেচনাশক্তি কেবলমাত্র স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। সে কারণে অভিভাবকরাই কেবলমাত্র বিজ্ঞতার অধিকারী। তারাই কেবলমাত্র সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। তারাই রাষ্ট্রকে ভালবাসেন এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে অভিন্ন গণ্য করবেন। অর্থাৎ কিনা, এঁরা নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা না করে রাষ্ট্রের যথার্থ কথা সকল সময়ই চিন্তা করবেন।

আদর্শ রাষ্ট্রে তিন শ্রেণীর লোক থাকবে। সবচেয়ে নিচে হল কারিকর শেণী। তাদের উপরে যোদ্ধাশ্রেণী এবং সকলের উপরে অভিভাবকশ্রেণী। ‘সাহস’ বলতে প্লেটো শুধুমাত্র শৌর্য বোঝেননি। তিনি বুঝেছেন কোন কিছুকে যথাযথ মনে করে তাতে লেগে থাকা। সাহস হল সৈনিকদের সৎ গুণ। যোদ্ধশ্রেণী কারিকর শ্রেণী থেকে শক্তিশালী হলেও অত্যাচারী হবে না, তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে। মিথ্যাচার বা আত্মসংযমের অধিকারী যে শুধুমাত্র কারিগর শ্রেণীই হবে এমন কোন কথা নেই, রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীই এই সৎগুণের অধিকারী হবে। ন্যায়পরায়ণতা একাধারে রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির সৎ গুণ। ব্যক্তির মধ্যে যে উপাদান আছে বিচার-বুদ্ধি, শৌর্য এবং ক্ষুধা এই তিনটি উপাদান যখন যথাযথভাবে তাদের ক্রিয়া সম্পাদন করে তখন আমরা ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতার কথা বলি। রাষ্ট্রের মধ্যে যে তিনটি শ্রেণী রয়েছে – যখন এই শ্ৰেণীগুলো যথাযথভাবে নিজ কর্ম সম্পাদন করে তখনই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার কথা বলা হয়।

প্লেটোর মতে, জন্ম বা সম্পদের ভিত্তিতে নয়, ব্যক্তিগত চরিত্র এ শাসনকার্যে দক্ষতার ভিত্তিতেই ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়ে শাসককেও রাষ্ট্রের আইন মেনে চলতে হবে। কোন বিশেষ শ্রেণীর কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র নয়, সকল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির কল্যাণময় জীবন-যাপনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সার্থকতা। আত্মার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষের যত সম্পদ আছে, তার মধ্যে তার আত্মাই সবচেয়ে দিব্য সম্পদ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীতে যত স্বর্ণ আছে তার তুলনায় সততা শ্রেষ্ঠ।

আদর্শ রাষ্ট্রে নারীর ভূমিকা ও রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বৈবাহিক সম্পর্ক

‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে নারীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন নারীদের পুরুষদের মতই শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আদর্শ রাষ্ট্রে তাদের কাজ শুধু ঘরে থেকে সন্তান পালন করা নয়। তারা সঙ্গীত চর্চা করবে, ব্যায়ামের অনুশীলন করবে এবং পুরুষদের মতই সামরিক নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা করবে। পুরুষদের মত সব কাজেই তারা অংশগ্রহণের উপযোগী, এমনকি প্রয়োজনীয় গুণাবলির অধিকারী হলে তাদের রাষ্ট্রের অভিভাবকদের কার্য সম্পাদন করার জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে।

প্রজনন নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের উচ্চতর শ্রেণীর নরনারীর বিবাহ-সম্পর্ক রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এই নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হল যাতে রাষ্ট্রের কর্ম ভালভাবে সম্পাদিত হয় এবং সুসন্তান লাভ করা যায়। এই শ্রেণীর নর-নারীর সন্তানেরা রাষ্ট্র পরিচালনাধীন ধাত্রীগৃহে লালিত-পালিত হবে। তবে প্লেটো অনিয়ন্ত্রিত যৌন-বাসনা পূরণ করার কথা কখনও বলেননি। কারিগর শ্রেণীর লোকেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারবে। তাদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কোন বাধা-নিষেধের কথা প্লেটো বলেননি।

উচ্চতর শ্ৰেণীগুলোই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত মালিক হতে পারবে না বা পারিবারিক জীবন-যাপন করতে পারবে না। এদের জীবন-যাপনের প্রণালী হবে অত্যন্ত কঠোর। যাদের উপযুক্ত বয়স, রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের দ্বারা তাদের যৌন জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে এবং কাদের ঔরসজাত সন্তান তাদের পিতার অজান্তে রাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিপালিত হবে। অনেকের মতে, প্লেটোর এই জাতীয় সিদ্ধান্ত কষ্ট-কল্পিত এবং কুরুচিপূর্ণ। তবে অনেকের মতে, এ হল আত্মীয় পােষণ এবং পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মত অকল্যাণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার জন্য চরম প্রচেষ্টা।

রাষ্ট্রে একটি নারী কমিটি থাকবে যার কাজ হবে বিবাহের পর দশ বছর পর্যন্ত নব-দম্পতিদের তত্ত্বাবধান করা। বিবাহের পর দশ বছরের মধ্যে কোন সন্তান না হলে দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হবে। পুরুষেরা ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বৎসরের মধ্যে বিবাহ করবে। মেয়েদের বিবাহের বয়স হবে যোল থেকে কুড়ির ভেতর। দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাস ভঙ্গ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুরুষদের পক্ষে সামরিক বিভাগে কাজ করার বয়স কুড়ি থেকে ষাট। স্ত্রীলোকেরা সন্তানধারনের পর এবং পঞ্চাশ বছর হওয়ার আগে পর্যন্ত সামরিক বিভাগে যোগদান করতে পারবে। প্লেটো মনে করতেন, যেহেতু বিবাহিত নরনারীর কর্তব্য ভাল সন্তানের জন্মদান করা, সেহেতু রাষ্ট্র কর্তৃক বিবাহিত নর-নারীর সম্পর্কের তত্ত্বাবধান অবাঞ্ছিত মনে হলেও তাকে সমর্থন করা চলে।

দার্শনিক নরপতির হাতে রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পণের যৌক্তিকতা

প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তার বাস্তব সম্ভাব্যতার প্রশ্নের উত্তরে প্লেটো বলেন যে, আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করার প্রত্যাশা করা চলে না। তবে তিনি মনে করেন যে, দার্শনিক-রাজা (Philosopher King) অর্থাৎ দার্শনিক শাসনকর্তার হাতে রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পিত হলে প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবে রূপ লাভ করবে। প্লেটোর মতে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এক অদ্ভূত শাসন ব্যবস্থা। শাসনকর্তাকে অবশ্যই জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সেই জ্ঞান অবশ্যই হবে সত্যের জ্ঞান। অর্থাৎ সত্যের জ্ঞানের অধিকারী হয়ে শাসকবর্গ রাষ্ট্র শাসন করবে। যথার্থ দার্শনিকই সত্যের জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন।

প্লেটো একটি জাহাজ, তার কাপ্তান বা চালক এবং নাবিক দলের উপমার সাহায্যে বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। এমন একটি জাহাজের কল্পনা করা যাক যার কাপ্তান জাহাজের অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় বেশ ঢেঙ্গা এবং বেশ শক্তিশালী কিন্তু সে কানে কম শােনে এবং চোখে কম দেখে, তা ছাড়া জাহাজ চালাবার ব্যাপারে তার যে বেশ ভাল জ্ঞান আছে, এমন কথা বলা চলে না। ফলে যা ঘটবার তাই ঘটে। নাবিকরা বিদ্রোহী হয়ে জাহাজের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে এবং পান-ভােজে মত্ত হয়ে জাহাজ চালাতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের জাহাজ চালাবার ব্যাপারে তেমন দক্ষতা প্রকাশ পায় না। নিজেরা যেমন পারে তেমনি চালায় কারণ কাপ্তানের জাহাজ চালাবার দক্ষতার অধিকারী তারা নয়। তারা জানে না একজন দক্ষ জাহাজ চালকের কতখানি জ্ঞানের অধিকারী হওয়া উচিত। কাজেই প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার (এথেন্সে যে ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল) বিরুদ্ধে এই কারণেই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, গণতন্ত্রে জনসাধারণ খুশিমত শাসনকার্যে নিযুক্ত রাজনীতিবিদদের হাত থেকে শাসনভার কেড়ে নেয় এবং নিজেরাই শাসনকাজ চালাতে থাকে, যেমন জাহাজরূপী রাষ্ট্রের শাসনকাজের জন্য কোন বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এই ধরনের রাষ্ট্র চালাবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য প্লেটো প্রস্তাব করেন যে, রাষ্ট্রের দায়িত্বভার দার্শনিক-রাজা বা শাসনকর্তাদের (Philosopher-kings) গ্রহণ করা উচিত, যারা জানেন রাষ্ট্ররূপী জাহাজকে কিভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় এবং ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে কিভাবে অগ্রসর হতে হয়।

প্রশ্ন হল, দার্শনিক-রাজা (Philosopher-king) কি সাধারণ স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তার মত হবে, অর্থাৎ নিজের খুশি মত রাষ্ট্র চালনা বা শাসন করবে? প্লেটো মনে করেন যে দার্শনিক শাসনকর্তা কখনও সে রকম হবেন না বা কখনও তা করবেন না। বরং বিপরীত কথাই সত্য। তাকে তুলনা করা যেতে পারে একজন শিল্পী যেমন অনড় বা স্থির মডেলের দিকে নজর রেখে তার কাজ করে যায় , মনে করেন দার্শনিক শাসনকর্তাও তাই করবেন। দার্শনিকের ধারণা বা আয় জগতের (World of Ideas or Forms) সঙ্গে পরিচয় আছে এবং তার কাজে ধারণা বা আকারগুলোকে নমুনা বা মডেল হিসেবে গ্রহণ করে আদর্শ রাষ্ট্রে রূপরেখাকে বাস্তবে মূর্ত করে তুলবেন।

প্রশ্ন হল, জনসাধারণ কি দার্শনিকদের শাসনকর্তা হিসেবে স্বীকার করে নেবে, প্লেটোর উত্তর হল, জনসাধারণ, দার্শনিকরা ঠিক কি ধরনের লোক অর্থাৎ তাদের যথার্থ পরিচয় পেলে, তাদের শাসনকর্তা হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করবে না। জনসাধারণ যখন জানবে যে, দার্শনিকরা সততা ও ন্যায়পরায়ণতার অধিকারী, মিতাচারী, তাদের কথা ও কাজে মিল আছে, তখন তারা উপলব্ধি করবে যে, এই সব ব্যক্তি সাধারণ ব্যক্তিদের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। সত্যের ওপর দার্শনিকদের দৃষ্টি সব সময় নিবদ্ধ, সাধারণ মানুষের মত ঈর্ষা, ঘৃণার বশবর্তী হয়ে এরা কিছু করেন না। তারা এমন একটা জগতের কথা চিন্তা করেন যেটি অপরিবর্তনীয় ও শৃঙ্খলাপূর্ণ, যেখানে বিচারবুদ্ধিই শাসন করে কেউ অন্যায় কিছু করতে পারে না। দার্শনিক জগতের স্বর্গীয় শৃঙ্খলার নিয়ত সাহচর্যে সেই শৃঙ্খলাকে নিজের আত্মাতে ফুটিয়ে তুলতে চায় এবং ঐশ্বরিক পূর্ণতাকে লাভ করার জন্য সচেষ্ট হয়, অবশ্য কিছুটা খুঁত যে থাকতে পারে না, তা নয়। দার্শনিক-শাসনকর্তা তখন অপরের চরিত্রকে নিজের মত করে গঠন করতে এবং তার আদর্শের আলোকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনসাধারণের জীবনকে সুগঠিত করতে বাধ্য হয়। জনসাধারণ দার্শনিক-শাসনকর্তার এই পরিচয় পেলে আর তাকে অবিশ্বাস করে না। তখন তারা বিশ্বাস করে যে, রাষ্ট্রে সুখ তখনই আসতে পারে যখন স্বর্গীয় ছাঁচে শিল্পী তার চিত্রের রূপরেখাকে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়।

জনসাধারণ আর দার্শনিক শাসনকর্তাদের উপেক্ষা করবে না, কেননা তারা উপলদ্ধি করবে যে দার্শনিক সত্য ও বাস্তবের অনুরাগী এবং তার চরিত্র যেভাবে বর্ণনা করা হল তাতে জনসাধারণ উপলদ্ধি করবে যে সে পূর্ণতার কাছাকাছি উপনীত এবং যথাযথ শিক্ষাদান করা হলেও তার মত কেউ সৎ বা সংস্কৃতিসম্পন্ন হবে না। কাজেই দার্শনিক শাসনকর্তাদের বাদ দিয়ে ভণ্ড শাসনকর্তাদের তারা বেশি পছন্দ করবে না।

এখানে একটা প্রশ্ন দেখা দেয় (S.E. Barkely: Greek Political Theory, Pages 236-237.)। সরকারের অস্তিত্ব থাকলেই শিক্ষা এবং শিক্ষাদান করা সরকারের কাজ, কিন্তু প্লেটো সরকারকেই শিক্ষার ফলশ্রুতি এ দার্শনিক শাসনকর্তারা শিক্ষার দ্বারা শাসনকর্তারূপে গঠিত হবে, এমন আপাতঃবিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কেন? এর কারণ খুব সহজ। রাষ্ট্র হল একটা শিক্ষার সংহতি (Educational System) এবং সরকার হল তার প্রকৃতির ফল। কারণ এই সংহতি অবশ্যই জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং যেহেতু কেবলমাত্র যথার্থ জ্ঞান হল দর্শন, সেহেতু এটি অবশ্যই দার্শনিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। দার্শনিকরা রাজা বা শাসনকর্তা না হলে বা রাজা এবং যুবরাজ যদি দর্শনের মাধুর্য এবং ক্ষমতার অধিকারী না হয়, নগর রাষ্ট্র কখনও অকল্যাণ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কেবলমাত্র এই ভাবেই অজ্ঞ এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের অকর্মণ্যতা ও দলাদলিকে বন্ধ করা সম্ভব হবে। কেবলমাত্র এই ভাবেই রাষ্ট্র এমন শাসনকর্তা পাবে যারা বিজ্ঞতার সাহায্যে রাষ্ট্র শাসন করে কারণ তারা সত্যের সন্ধান পেয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তা থেকে তারা মুক্ত, তারা মনে করেন তাদের দায়িত্ব হল কঠিন কর্তব্য, যে দায়িত্ব জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তাদের বহন করতে হবে।

দার্শনিক অধিপতিদের শাসনকে প্লেটো রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু যে নামই দেওয়া হােক না কেন দার্শনিকরা কোন লিখিত আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না। কিন্তু প্লেটো দার্শনিক-শাসনকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে চান না। প্লেটো মনে করেন দার্শনিক-শাসনকর্তারা নিজেদের খুশিমত রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন না। তারা রাষ্ট্রের মূল নীতির প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে রাষ্ট্র শাসন করবেন। প্লেটো চারটি মূল নীতির কথা বলেছেন –

  • (১) শাসকবর্গকে নজর রাখতে হবে যাতে দারিদ্র বা সম্পদ যেন রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে।
  • (২) রাষ্ট্রের আকার যাতে খুব বড় বা খুব ছােটো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্র হবে স্বনির্ভর।
  • (৩) তারা ন্যায়ের শাসন চালাবেন এবং লক্ষ রাখবেন যাতে প্রতিটি নাগরিক তার জন্য নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকে।
  • (৪) সবশেষে তাদের সুনিশ্চিত হতে হবে যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন কোন নতুন সংস্কার না সাধিত হয়।

এইভাবে প্লেটো দার্শনিক-অধিপতি (Philosopher-Kings) বা শাসনকর্তা সম্পর্কীয় মতবাদের অনুকূলে যে যুক্তি দেখাতে চান তা হল, রাজনীতিবিদরা আইনের অধীনে বাগ্মিতার সহায়তায় যে সরকার চালান তার বিরোধী হল দার্শনিক-শাসনকর্তাদের সরকার যা হল কলা বা বিজ্ঞান। আর এই নীতিতে রয়েছে এই দাবির স্বীকৃতি যে রাষ্ট্রলভ্য সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হবে (It is a recognition of the demand that the state be ruled by the highest available intelligence) (Paul Friedlander; Plato, An Introduction (Translated from the German By Hans Meyerhoff) Page 288.)

ডায়েলেকটিকস শিক্ষা

প্রশ্ন হল, দার্শনিক শাসনকর্তাদের শিক্ষা কি রকম হবে? যারা ভবিষ্যতে শাসক হিসেবে নির্বাচিত-হবেন, তারা শুধু যে সঙ্গীত এবং ব্যায়াম শিক্ষা করবেন তা নয়, তাঁরা গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানও শিক্ষা করবেন। এইসব শিক্ষা হল ‘ডায়েলেকটিকস’ বা দর্শন শিক্ষার ভূমিকাস্বরূপ। ডায়েলেকটিকস্ শিক্ষার দ্বারা অভিভাবকবৃন্দ ইন্দ্রিয়ের সহায়তা ছাড়া বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যে সর্বনিরপেক্ষ পরম সত্তাকে আবিষ্কার করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত তারা প্রজ্ঞামূলক দৃষ্টির সাহায্যে পরম কল্যাণ লাভ করতে পারবেন। কাজেই রাষ্ট্রের নির্বাচিত শাসকবৃন্দ বা অভিভাবকবৃন্দের পদের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হবে তাদের দেহ ও মন উভয় দিক থেকেই পরিপূর্ণভাবে সুস্থ এবং সৎ হতে হবে। এঁদের ত্রিশ বছর বয়সকালে ডায়েলেকটিকস্ বা দর্শন শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা হবে। পাঁচ বছর শিক্ষা লাভ করার পর তাদের সৈন্য বিভাগে বা সরকারি বিভাগে পনে শিক্ষানবিস করতে হবে। এই সময় তারা জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করতে সময় বোঝা যাবে যে, প্রলোভনের মুখে তারা অবিচলিত বা স্থির থাকতে পারেন কিনা। এইভাবে তাদের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে তখন তারা ধারণা বা সার্বিকের উৎস যে কল্যাণ (Absolute Good) তার জ্ঞান লাভ করবেন এবং এই জ্ঞানের আলো রাষ্ট্র ও ব্যক্তির কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবেন।

গ্রীসের প্রচলিত রাষ্ট্রগুলোর গঠন সম্পর্কে আলোচনা

‘রিপাবলিক’ গ্রহের অষ্টম এবং নবম খণ্ডে প্লেটো গ্রীসের প্রচলিত রাষ্ট্রগুলোর গঠন বিশ্লেষণ করেন। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গে ঐ রাষ্ট্রগুলোর তুলনা করেন এবং তার আদর্শ রাষ্ট্রের, যা হল ‘নিখুঁত মনের এক নিখুঁত সৃষ্টি’ (A perfect product of perfect mind) থেকে বাস্তবে অস্তিত্বশীল রাষ্ট্র কতখানি আদর্শচ্যুত, তার বিচার করেন। এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বার্কার বলেন, “বাস্তবে অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রগুলো সম্পর্কে তার বিচার ঐ আদর্শের ধারাবাহিক স্তরে বিকৃতির বর্ণনার রূপ পরিগ্রহ করে।” (Barker : Greek Political Theory; Page 283.)।আদর্শ রাষ্ট্রে বৃত্তিগুলোর একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সঙ্গতি, অভিযোজন বা যথাযথ আন্তর সম্পর্ক বর্তমান থাকে, কিন্তু আদর্শচ্যুত বা বিকৃত রাষ্ট্রে এই আন্তর সম্পর্ক কম বা বেশি ব্যাহত হয়। প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের চার ধরনের বিকৃতির কথা বলেছেন। প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্র হবে অভিজাততান্ত্রিক (Aristocratic)। কিন্তু যদি উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত লোকেরা নিম্নশ্রেণীর লোকদের সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় এবং নিম্নশ্রেণীর লোকদের দাসশ্রেণীতে পরিণত করে, তখন অভিজাততন্ত্র টিমােক্রেসি (Timocracy)তে পরিণত হয়, যা কালক্রমে ধনিকতন্ত্রে (Oligarchy) পরিণত হয়। ধনিকতন্ত্রের বিকৃত রূপ হল গণতন্ত্র। ধনিক শ্রেণীর অধীনে এক দরিদ্র শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং সর্বশেষে এই দরিদ্রেরা ধনীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবার টিমােক্রেসি (Timocracy)-র সৃষ্টি করে।

‘স্টেইটসম্যান’ (Statesman) গ্রন্থে প্লেটো রাষ্ট্রের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন তার থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই প্রসঙ্গে বার্কার-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রিপাবলিকের তুলনায় স্টেটসম্যানে অধিকতর মাত্রায় বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়।

শাসনকর্তার সংখ্যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের শ্রেণীবিভাগ : স্টেটসম্যানে সভাব্য রাষ্ট্রের শ্রেণী থেকে আদর্শ রাষ্ট্রকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কেননা, এই রাষ্ট্র এত নিখুত যে মানুষের পক্ষে তা লাভ করা সহজসাধ্য নয়। তা ছাড়া স্টেটসম্যান গ্রন্থে রিপাবলিকের তুলনায় গণতন্ত্র প্লেটোর অধিকতর আনুকূল্য লাভ করেছে। শাসনক সংখ্যার ভিত্তিতে, অর্থাৎ একজন, কিছু ব্যক্তি এবং বহু-ব্যক্তির শাসনের ভিত্তিতে সরকারের প্রচলিত শ্রেণীবিভাগ প্লেটোর হাতে দুটি শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। অনুসারী রাষ্ট্র (Law-States) এবং স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র (Arbitrary States)। আইন অনুসারী রাষ্ট্র যেহেতু আইন মেনে চলে সেহেতু তারা আদর্শ রাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এবং স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র আইন মেনে না চলার জন্য আদর্শ রাষ্ট্র থেকে দুভাবে বিচ্যুত। স্টেটম্যান-এ প্লেটো রাষ্ট্রের ছয় রকম শ্রেণীবিভাগের কথা। বলেছেন—তিন ধরনের আইন অনুসারী রাষ্ট্র এবং তিন ধরনের স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র। আইন অনুসারী রাষ্ট্রে যদি একজনের শাসন দেখা যায় তাকে রাজতন্ত্র (Morarchy) বলে, কিছু লোকের শাসনকে অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং বহুজনের শাসনকে গণতন্ত্র বলে। সুশৃঙ্খল বা আইন অনুসারী সরকারের কথা বলা হলে রাজতন্ত্রই সবচেয়ে ভাল। বহুজনের গঠিত সরকার নিকৃষ্টতম আর অল্প কিছুজনের পরিচালিত সরকার এই দুইয়ের মধ্যবর্তী। স্বেচ্ছাচারী বা বিশৃঙ্খল সরকারের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র হল নিকৃষ্টতম সরকার। তারপর নিকৃষ্টতম হল অল্প কিছুসংখ্যক লোকের শাসন এবং নিকৃষ্ট হল বহুজনের শাসন। কাজেই প্লেটোর মতে, গণতন্ত্র বা বহুজনের দ্বারা পরিচালিত সরকার হল আইনানুগ সরকারের মধ্যে নিকৃষ্টতম এবং বিশৃঙ্খল সরকারের মধ্যে উৎকৃষ্টতম।

দ্বিতীয় সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র : প্লেটো প্রণীত গ্রন্থ ‘ল’ (Laws)-এ প্লেটোর রাষ্ট্রনৈতিক মনোভাবের আরও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ‘ল’-এ প্লেটো আইনের সার্বভৌমিকতা এবং জনগণের সম্মতির বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং দার্শনিক রাজতন্ত্রের তুলনায় রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশ্র সরকারের কথা বলেছেন। রিপাবলিকের আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিকবৃন্দের শাসনের কথা বলা হয়েছে, যারা রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত এবং যারা আইন ব্যতিরেকেই রাষ্ট্র শাসন করেন। ‘লস’-এ প্লেটোর রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারার রূপায়ণ ও ‘ল’-এর রাষ্ট্র আইনকেই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে স্বীকার করে। শাসক এবং শাসিত উভয়ই আইন মানতে বাধ্য। প্লেটো রিপাবলিকে বর্ণিত তার রাষ্ট্রতত্ত্বকে ভ্রান্ত বলে গণ্য করেননি। তার উদ্দেশ্য হল, লস্ এ একটি দ্বিতীয় সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্রের (A second best state) বর্ণনা করা। প্লেটো আইনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, কারণ ‘আইনই হল সভ্যতা। আইনের মাধ্যমেই কোন ব্যক্তিকে সামাজিক জীবনে যা সর্বোৎকৃষ্ট তাকে অনুসরণ করার জন্য বাধ্য করা যেতে পারে। আইনের মাধ্যমেই সমাজের সাধারণ কল্যাণের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা যেতে পারে এবং উৎকৃষ্ট নাগরিকত্ব অর্জন করা যেতে পারে। কাজেই রাষ্ট্রকে ‘আইনের স্বর্ণসূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ‘ল’-এ মিশ্র রাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন ও লস্’-এ প্লেটো রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠনের একটি ভিন্ন নীতির কথা ব্যক্ত করেছেন। সেই নীতিটি হল মিশ্র রাষ্ট্রনীতি—যেখানে রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ দৃষ্ট হবে। শাসকের বিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করা হবে শাসিতের স্বাধীনতা এবং এই সংযোগের ফলে ভ্রাতৃত্বের (Fraternity) উদ্ভব হবে। লস্ এ প্লেটো সমভােগবাদ (Communism) বর্জন করেছেন। শাসকবর্গ সম্পত্তি ও পরিবারের অধিকারী হবে। যারা শাসিত তাদের নিজেদের শাসনকর্তা নির্বাচনের অধিকার থাকবে। এখানে প্লেটো তার পুরাতন অভিমত ধরে রাখেননি যে, রাষ্ট্রই একটি পরিবার হবে এবং স্ত্রী ও শিশু হবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি।

প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়া বাঞ্চনীয় কেননা কাছে থাকলে রাষ্ট্র হয়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। এর ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষমতা কলুষিত হবে। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক না কৃষিভিত্তিক হবে।

রাষ্ট্রের আয়তন, অপরাধ-শাস্তি, আইন, দাসপ্রথা ও যুদ্ধ

রাষ্ট্র খুব বৃহৎ না হওয়া যুক্তিযুক্ত : প্লেটো খুব বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষপাতী ছিলেন না এবং রাষ্ট্রে অতিরিক্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হােক, এটা তার ইচ্ছা ছিল না। রাষ্ট্রে ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ পদ্ধতি এবং কার্যাবলি নিয়ে প্লেটো বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, আইনের তত্ত্বাবধায়ক হবে সঁইত্রিশ জন ব্যক্তি, যাদের বয়স পঞ্চাশ বছরের কম হবে না এবং তাঁরা সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তাদের কাজে নিযুক্ত থাকবে। রাষ্ট্রে ৩৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংসদ থাকবে, যার সদস্যরা নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হবে। রাষ্ট্রে কয়েকজন মন্ত্রী থাকবে যাদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর পদ হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। রাষ্ট্রে শিক্ষাকে কখনও গৌণ বিষয় রূপে গণ্য করা চলবে না।

অপরাধ ও শান্তি : তিনি কৃষি, অপরাধীর শাস্তি, এই সকল বিষয়কে কেন্দ্র করেও আইন প্রণয়ন করার কথা বলেছেন। অপরাধীকে শাস্তি দেবার সময় তার মানসিক অবস্থা বিচার করা উচিত বলে প্লেটো মনে করেন। রাষ্ট্রের ধর্ম-সকার অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও তিনি আইন প্রণয়ন করেন। প্লেটো নাস্তিকতা ও ধর্মবিরোধিতার অপরাধে অপরাধী-ব্যক্তিদের শাস্তির প্রস্তাব করেছেন। অবস্থা বিশেষে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা প্রাণদণ্ড হতে পার। চেতনাশূন্য ভৌগোলিক উপাদানের গতির ফলে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্ট হয়েছে, এইরূপ ধারণা করা প্লেটোর মতে নাস্তিকতা। তার মতে, গতির উৎস্বরূপে কোন স্বয়ং—গতিশীল নীতি, যা হল মন বা আত্মা, স্বীকার করতে হবে। ঈশ্বর মানুষের প্রতি উদাসীন, এই ধারণা এক ধরনের ধর্মবিরোধিতা। আবার উৎকোচ দিলে ঈশ্বর অন্যায় কার্যকে ক্ষমা করেন এও ধর্মবিরোধিতার শামিল।

আইন সম্পর্কীয় বিষয় : আইন সম্বন্ধে অনেক কথাই আলোচনা করেছেন প্লেটো। ভিক্ষাবৃত্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাষ্ট্রের নাগরিক এবং রাষ্ট্রপ্রদত্ত শিক্ষালাভ করেছে এমন ব্যক্তি যদি সাধারণের অর্থ তছরূপ করে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যকাল শেষ হলে তাদের হিসাবপত্র পরীক্ষা করার জন্য একটা বোর্ড গঠন করা হবে। রাষ্ট্রের অনুমােদন ব্যতীত কেউ বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবে না।

দাস প্রথা সমর্থন : ‘লস্’ গ্রন্থে প্লেটো দাস প্রথাকে সমর্থন করেছেন। তার মতে, ক্রীতদাস হল তার প্রভুর সম্পত্তি। ক্রীতদাসীর গর্ভজাত সন্তানের অধিকারী সকল সময়ই ক্রীতদাসীর মালিক বা প্রভু। গণতান্ত্রিক এথেন্সে দাস-দাসীরা যে স্বাধীন ও সহজভাবে জীবন-যাপন করত, প্লেটো তা সমর্থন করতেন না সত্য কিন্তু ক্রীতদাসের প্রতি নির্মম আচরণের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন মন্তব্য করেন, “সুতরাং আমরা অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত করব যে, প্লেটো শুধুমাত্র ক্রীতদাস প্রথা সমর্থন করেছিলেন এবং ক্রীতদাসের প্রতি আচরণ সম্পর্কে তিনি একদিকে যেমন এথেন্সের শিথিলতা তেমনি অপরদিকে স্পার্টার নির্মমতা অপছন্দ করতেন।”

শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে বা বৃহত্তর কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ সমর্থনযোগ্য : প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের সুখ শান্তিই কাম্য বস্তু। কাজেই যুদ্ধের দ্বারা সেই শান্তি ব্যাহত হােক, কোন রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের তা আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হতে পারে না। যুদ্ধের জন্য যুদ্ধকে সমর্থন করা চলে না। তা সত্বেও একান্তই যদি কোন রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তা নিশ্চয়ই শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। প্লেটো বলেন, অনেক যুদ্ধজয়ই বিজেতার পক্ষে আত্মহত্যার শামিল হয়েছে এবং হবে কিন্তু শিক্ষা কখনও আত্মহত্যার শামিল হয় না।’

প্লেটোর ন্যায়বিচার

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীসের নির্জন ও নৈসর্গিক শােভামণ্ডিত পরিবেশে স্ব-প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাকেন্দ্রে “একাডেমিতে” বসে চিন্তা জগতের মহান দিশারী প্লেটো তার ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে যে সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তার মধ্যে ন্যায়বিচার সম্পর্কিত আলোচনা হচ্ছে প্রধান। প্লেটো ‘দি রিপাবলিক গ্রন্থের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত বার বার কেবল ন্যায়বিচারের কথাই উল্লেখ করেছেন। তাই রিপাবলিককে ন্যায়বিচার সম্পর্কীয় গ্রন্থও বলা হয়।

রিপাবলিক রচনার পটভূমি : প্লেটো ৪২৮ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এথেন্সের এক সভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমাদের নিকট একজন আদর্শবাদী দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। সাময়িক এথেন্সের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ঘটনাবলি প্লেটোর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সমাজের প্রচলিত দুরাবস্থা তার মনে যে রেখাপাত করে তা থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান কার্যে লিপ্ত হন আর এই অনুসন্ধানের অব্যবহিত ফলই তার দি রিপাবলিক গ্রন্থখানা যা জগৎ জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। Republic প্লেটোর পরিণত বয়সের রচনা। এ গ্রন্থের মধ্যে তার পরিপূর্ণ জ্ঞানের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়।

ন্যায় কি? : ন্যায় শব্দটি ইংরেজি Justic শব্দের প্রতিশব্দ। ইংরেজি Justice শব্দটি গ্রীক ডিকাইসুনি শব্দ হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। ডিকাইসুনি শব্দের অর্থ ন্যায় ধর্ম ভিত্তিক আলোচনা যা ইংরেজি Morality শব্দের অর্থের অনেক নিকটবর্তী। ন্যায় একটা বিশিষ্ট নীতিবোধক কথা। প্রত্যেক ভাষা ও সমাজের মত প্রাচীন গ্রীসের ভাষা ও সমাজে ন্যায় একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হত। ন্যায় বলতে সব যুগে সব সমাজে সাধারণত দায়িত্ব পালন করা, অপরের ঋণ পরিশােধ করা, সভাবে চলা, দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করা, অন্যের ক্ষতি সাধন না করা প্রভৃতি গুণকে বুঝায়। মােট কথা সমস্ত মহৎ গুণের সমন্বয়ে ন্যায়ের সৃষ্টি।

ন্যায়বিচার সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ : ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্লেটো তার নিজস্ব মতামত প্রচার করার পূর্বে রিপাবলিক গ্রন্থে কিছু চরিত্রের কথােপকথনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন।

  • সিফালাসের মতামত – তিনি বলেন, সত্য কথা বলা এবং অপরের প্রাপ্য পরিশােধের মধ্যেই ন্যায়বিচার নিহিত। প্লেটো এর প্রতিবাদ করে বলেন, এক উম্মাদের কাছে তার প্রাপ্য অস্ত্রটি ফেরত দেয়া এবং সত্য কথা বলা উচিত নয়। তাই প্লেটোর মতে, সত্য কথা বলা এবং ঋণ পরিশােধের মধ্যেই ন্যায়বিচার নিহিত নয়।
  • পলিমার্কাসের মতামত – তিনি বলেন, প্রত্যেককে তার প্রাপ্য পরিশােধ করার নামই ন্যায়বিচার। তিনি প্রাপ্য কথাটি দ্বারা বুঝিয়েছেন যে, বন্ধুর প্রতি সদ্ব্যবহার করা এবং শত্রর অনিষ্ট সাধন করা। কিন্তু প্লেটো এর বিরোধিতা করে বলেন যে, অপরের অনিষ্ট সাধন করা ন্যায়বান ব্যক্তির ধর্ম হতে পারে না। সে বন্ধুই হােক আর শত্রুই হােক।
  • থ্রাসিমেকাসের মতামত – তিনি বলেন, ন্যায়বিচার হল শক্তিমানের স্বার্থ এবং দলকে শােষণ করার জন্য শক্তিমানের কৌশল। প্রকৃত কল্যাণ অন্যায় পথেই আসতে পারে। প্লেটো এর প্রতিবাদ করে বলেন যে, চিকিৎসকের ধর্ম রুগ্ন ব্যক্তিকে রোগ মুক্ত করা। মেষপালকের ধর্ম মেষপালের যত্ন করা। তদ্রপ ন্যায়ধর্মী শাসকের কর্তব্য নিঃস্বার্থভাবে শাসিতের কল্যাণ বিধান করা।
  • গ্লাকোনের যুক্তি – তিনি বলেন চুক্তির মাধ্যমে কারও ক্ষতি না করা কিংবা কারও দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার নামই ন্যায়বিচার। তাই তার মতে, ন্যায়বিচার হচ্ছে কৃত্রিম ধারণা ও চুক্তির ফল। প্লেটো অত্যন্ত সুন্দর যুক্তির সাহায্যে বুঝিয়ে দেন যে ন্যায়বিচার কোন কৃত্রিম ধারণা নয় এবং এটা চুক্তির ফলও নয়।

উপরিউক্ত চিন্তানায়কদের মতবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে প্লেটো একটা আদর্শ রাষ্ট্রকে সামনে রেখে ন্যায়বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেন।

ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্লেটোর মতবাদ :

  • প্লেটো মনে করেন ন্যায়বিচার হল আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা। আর আদর্শ রাষ্ট্র হল ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রকাশ। ন্যায়বিচার হবে প্রাণ আর আদর্শ রাষ্ট্র হবে দেহ। তিনি মনে করেন প্রকৃত ন্যায়বিচার মানবাত্মা ও রাষ্ট্র দেহ উভয়ের মধ্যেই সমানভাবে বিরাজমান। কারণ রাষ্ট্র হল ব্যক্তি সত্তার বৃহত্তম অভিব্যক্তি। রাষ্ট্র ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তি বলে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের ধারণা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। কারণ ছােট অক্ষরের পাণ্ডুলিপি অপেক্ষা বড় অক্ষরের পাণ্ডুলিপি অধিকতর স্পষ্ট।
  • প্লেটোর মতে, মানবাত্মার তিনটি উপাদান আছে যথা—প্রজ্ঞা, তেজ ও প্রবৃত্তি। প্রজ্ঞার কাজ হল জানা ও শেখা। তেজ—এর কাজ হল মানুষকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা আর বাসনা বা প্রবৃত্তির ফলে আত্মা ক্ষুধার্ত হয় তৃষ্ণার্ত হয়, ভালবাসা করে ও আকাঙ্ক্ষা করে। তাই প্লেটো ব্যক্তির ন্যায়বিচার বসতে ব্যক্তির অন্তর্লোকে পরিপূর্ণ শৃংখলা রক্ষা করে ব্যক্তির অন্তরের উপাদানগুলো কখনও তাদের যথাযোগ্য কর্মসীমা অতিক্রম না করে নিজ নিজ কাজ করাকে বুঝিয়েছেন।
  • মানবতার উপাদানগুলোর ভিত্তিতে প্লেটো রাষ্ট্রের জনগণকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। যথা—দার্শনিক রাজা, সৈনিক শ্রেণী ও উৎপাদক শ্ৰেণী। দার্শনিক রাজার কাজ হল রাষ্ট্র শাসন করা, সৈনিক শ্রেণীর কাজ হল রাষ্ট্রকে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ হতে রক্ষা করা এবং উৎপাদক শ্রেণীর কাজ হল দার্শনিক রাজা ও সৈনিক শ্রেণীকে প্রতিপালনের জন্য খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করা। তিনি রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার বলতে রাষ্ট্রের প্রত্যেক শ্রেণীর জনগণের তাদের যথাযোগ্য কর্মসীমা অতিক্রম না করে স্ব স্ব কর্তব্য পালন করাকেই বুঝিয়েছেন। প্রতিভা ও যোগ্যত কর্ম সম্পাদন করাকেই প্লেটো ন্যায়বিচার বলে মনে করেন। অধ্যাপক বার্কার বলেন যে, “ন্যায়বিচার নাগরিকদের কর্তব্যপরায়ণতার ফল স্বরূপ।”

প্লেটোর ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্য : প্লেটোর ন্যায়বিচারের যে সমস্ত বৈলি বিদ্যমান তা নিম্নে আলোচনা করা হল—

  • ১. যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মবিভাগ – প্লেটোর ন্যায়বিচার প্রত্যেকের জন্য প্রয় যোগ্যতা ও শিক্ষার ভিত্তিতে সমাজে তার নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেয়।
  • ২. ব্যক্তি ও রাষ্ট্র অবিচ্ছেদ্য – তার ন্যায়বিচারের ধারণায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রকৃতির মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।
  • ৩. এটি একটি শিল্পকৌশল বিশেষ – ন্যায়বিচার একটি শিল্পকৌশল বিশেষ এবং অন্যান্য শিল্পের ন্যায় ন্যায়বিচারের অনুশীলন ও উৎকর্ষতা লাভ শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব।
  • ৪. রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক জীবন অভিন্ন – প্লেটোর ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে মানুষের রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
  • ৫. সামাজিক বন্ধন – ন্যায়বিচার একটি সামাজিক বন্ধন। এই বন্ধন সমাজকে সংহত করে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।
  • ৬. চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ – ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তির কর্মজীবনে। যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় তার ফলে তার চারিত্রিক বিকাশ ব্যাহত না হয়ে বরং পরিপূর্ণতা লাভ করে।
  • ৭. সৎ মানুষে রূপান্তরিত করে – ন্যায়নীতি শুধু পূর্ণ ও সৎ নাগরিকই সৃষ্টি করে না বরং তা ব্যক্তিকে সৎ মানুষেও রূপান্তরিত করে।
  • ৮. পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি – ন্যায়বিচার হল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি। এটা একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার স্বীকার করে না।
  • ৯. স্থাপত্য শিল্পের অনুরূপ – ন্যায়বিচার স্থাপত্য শিল্পের অনুরূপ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয় তা স্থাপত্য শিল্পেরই বহিপ্রকাশ।
  • ১০. পরিপূর্ণতা অর্জনে সাহায্য করে – ন্যায়নীতি মানুষকে সৎ জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে এবং জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জনে সাহায্য করে।
  • ১১. কল্যাণ নিহিত – ন্যায়বিচারের মধ্যে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ নিহিত।
  • ১২. ব্যক্তি ও সমাজ অভিন্ন – এই ধারণায় ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।
  • ১৩. আধ্যাত্মিক পদ্ধতি – ন্যায়বিচার ব্যক্তি সংঘাত ও শ্রেণী সংঘাতের জন্ম দেয় না। এটি একটি আধ্যাত্মিক পদ্ধতি।
  • ১৪. শ্রম বিভাগ কর্ম বিশেষীকরণের ওপর নির্ভরশীল – ন্যায়বিচারেন ধারণা শ্রম বিভাগ ও কর্ম বিশেষীকরণের ওপর নির্ভরশীল।

প্লেটোর ন্যায়বিচারের সাথে আধুনিক ন্যায়বিচারের পার্থক্য : 

প্লেটোর ন্যায় ধর্ম –

  • ১. প্লেটোর ন্যায়বিচার আইনগত ধারণা নয়। এটা এক প্রকার নৈতিক ধারণা।
  • ২. প্লেটোর ন্যায়নীতি বৈষম্যমূলক। এতে দার্শনিক শ্রেণীর বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
  • ৩. প্লেটোর ন্যায়বিচার অগণতান্ত্রিক।
  • ৪. প্লেটোর ন্যায়বিচার কেবল নাগরিকদের কর্তব্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকার দান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
  • ৫. প্লেটোর ন্যায়নীতি মূলত কার্যসম্পাদন ও কর্মের বিভাগ সংক্রান্ত।
  • ৬. প্লেটোর ন্যায়নীতি অভিজাত প্রকৃতির।
  • ৭. প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বে মানুষের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের আদৌ কোন প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না।

আধুনিক ন্যায় ধর্ম –

  • ১. কিন্তু আধুনিক ন্যায়বিচারের ধারণা মূলত আইনগত এবং এটা নৈতিকতা বিবর্জিত নয়।
  • ২. কিন্তু আধুনিক ন্যায়নীতিতে আইনের চোখে সবাই সমান।
  • ৩. কিন্তু আধুনিক ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক।
  • ৪. পক্ষান্তরে, আধুনিক ন্যায়বিচার নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য উভয়ের নিশ্চয়তা বিধান করে।
  • ৫. কিন্তু আধুনিক ন্যায়নীতি অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট।
  • ৬. কিন্তু আধুনিক ন্যায়নীতি সার্বজনীন।
  • ৭. কিন্তু আধুনিক ন্যায়নীতিতে মানুষের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সমালোচনা : যদিও প্লেটো ন্যায়বিচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি চিরস্থায়ী সমাধান দিতে চেয়েছেন। তথাপি তার এ ন্যায়বিচার অন্যান্য তত্ত্বের ন্যায় তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচনাসমূহ হলো –

  • ১. ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীনতাপাশে আবদ্ধ করা হয়েছে – তারই সমসাময়িক কালে তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের অধীনতা পাশে আবদ্ধ করা হয়েছে।
  • ২. সর্বাত্মকবাদের সহায়ক – আধুনিককালে সর্বাত্মকবাদ বলতে যা বোঝানো হয় কোন কোন সমালোচকদের মতে তার মূল উৎসও প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের মধ্যে নিহিত।
  • ৩. অধিকার প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে – প্লেটোর ন্যায়বিচার কেবলমাত্র নাগরিকদের কর্তব্যের ওপর জোর দিয়েছে কিন্তু তাদের অধিকার প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
  • ৪. এটা অগণতান্ত্রিক – প্লেটোর ন্যায়বিচারের ধারণা অগণতান্ত্রিক , উৎপাদক শ্রেণীর রাজনৈতিক অধিকার না দিয়ে মানব সাম্যের বিরোধিতা করে।
  • ৫. শ্রেণী শাসনের মূল স্থপতি – অধ্যাপক পপারের মতে, যে শ্রেণী বিলোপ সাধনের জন্য আধুনিক সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংগ্রাম, প্লেটোর ন্যায়বিচারের তত্ত্বই হচ্ছে সে শ্রেণী শাসনের মূল স্থপতি।
  • ৬. পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার অনুপস্থিত – আধুনিক যুগে ন্যায়নীতি বলতে তা সকল মানুষের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি বলে যে জিনিসের কথা বলে তা প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বে তার আদৌ কোন প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না।
  • ৭. মানবতাবিরোধী – প্লেটোর ন্যায়নীতি মানবতাবিরোধী। এতে সন্তান ও সম্পত্তির ওপর অভিভাবকদের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে।
  • ৮. ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী – প্লেটোর ন্যায়ধর্ম ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। রাষ্ট্রকে সুসংহত করতে গিয়ে প্লেটো ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন।
  • ৯. শ্রেণীভেদ সৃষ্টি – প্লেটো মূলত মানুষকে তিনটি শ্রেণীতে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করেছেন। এর ফলে তিনি সাম্য ও স্বাধীনতার মুলে কুঠারাঘাত করেছেন। এরূপ সাম্য ও স্বাধীনতাহীন সমাজে ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

উপসংহার ও উপসংহারে বলা যায়, প্লেটোর ন্যায়বিচারের ধারণা আধুনিক রাজনৈতিকগণের নিকট পরিত্যক্ত হয়ে থাকলেও সকল যুগের দার্শনিকগণই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তার মতবাদ ত্রুটিপূর্ণ হলেও তার অনুসৃত ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে যে সংহতি ও ঐক্য বিধান করতে চেয়েছিলেন তা সকল রাজনীতিবিদগণের নিকটই অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাজনৈতিক বাস্তববাদ

প্লেটোর রিপাবলিক একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা। ন্যায়পরায়ণতার বিমূর্ত ধারণাকে কি করে মূর্ত ও স্পষ্ট করে তোলা যায় এবং কি করে একে কথায় ও কাজে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুশীলন ও প্রয়োগ করা যায় তা প্লেটোর রাষ্ট্র দর্শনের প্রধান সমস্যা। ব্যক্তি মানুষের সীমিত গণ্ডিতে ন্যায়পরায়ণতার প্রতিফলন দুর্বোধ্য মনে করে ন্যায়কে বৃহৎ অবয়বে প্রত্যক্ষ করার জন্য তিনি এক আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অংকন করেন। বস্তুত জগতে একটি রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ কিরূপ হওয়া উচিত আদর্শ রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্লেটো তা দেখানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। মূলত জ্ঞানকে কার্যত বাস্তবায়িত করার জন্য প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অংকন করেন। নিম্নে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ বা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল

(ক) শ্রেণী কাঠামাে ও কর্মবিশেষীকরণ : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। তাই তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের শাসক, সৈনিক এবং উৎপাদক— এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের শ্রেণীগত কার্যক্রম বা দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেন।

  • ১. শাসক শ্রেণী – শাসক শ্রেণীর নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রের শাসনভার থাকবে এই শাসক শ্রেণীর ওপর। এদের প্রধান গুণ হল জ্ঞান।
  • ২. সহায়ক শ্রেণী – সহায়ক শ্রেণী বা সৈনিক শ্রেণীর প্রধান কাজ দেশ রক্ষাশান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করা। সমাজের যারা সাহসী ও দৈহিক শক্তিসম্পন্ন তারাই এই শ্রেণীর উপযুক্ত সাহস ও বিক্ৰম তাদের গুণ।
  • ৩. উৎপাদক শ্রেণী – দৈহিক পরিশ্রম দ্বারা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমৃদ্ধ এদের মূল দায়িত্ব। সংযম তাদের প্রধান গুণ। চাহিদা মেটানো ছাড়া রাজনৈতিক জীবনে এদের ভূমিকা থাকবে না।

প্লেটো মনে করেন, এ তিন শ্রেণীর নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে পালন করার মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্রের ক্রিয়াশীলতা নিহিত। যে রাষ্ট্রে এই ত্রিবিধ শ্রেণী তাদের কর্তব্যকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে এবং একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে। সেটিই হচ্ছে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র।

(খ) আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা : ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য প্লেটো এক পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার বর্ণনা দেন। প্রথমে আসবে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর – প্লেটোর মতে, প্রাথমিক শিক্ষার বয়সসীমা হচ্ছে শৈশব থেকে ২০ বছর পর্যন্ত। প্রাথমিক অবস্থায় ৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের অপরিণত মানসিক বৃত্তিগুলো বিকশিত করার জন্য সাধারণ শিক্ষা দিতে হবে। তারপর ৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরকে শুধু সাহিত্য, সঙ্গীত ও প্রাথমিক গণিত শিক্ষাদান করা হবে। এবং ১৮ থেকে ২০ বছর, এই দুই বছর সংরক্ষিত থাকবে মূলত শরীর চর্চা ও সামরিক কৌশল শিক্ষার জন্য। প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তিতে একটি বাছাই পরীক্ষা হবে এবং এই পরীক্ষায় যারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে তাদেরকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুযোগ প্রদান করা হবে।

প্লেটোর সাম্যবাদ 

প্রগতিশীল বর্তমান বিশ্বে দুটি সমাজ ব্যবস্থা বর্তমান। একটি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এবং অন্যটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। প্লেটো যে সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন তা সাম্যবাদ (Soialism) নামে পরিচিত। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জীবন ব্যবস্থা কিরূপ হবে তার সুবিধার্থক রূপায়ণ হল প্লেটোর সাম্যবাদ। মহান চিন্তানায়ক প্লেটো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, অভিভাবক তথা শাসক শ্রেণীর সামগ্রিক চিন্তাভাবনা ও কর্মসাধনা পরিচালিত হবে একমাত্র রাষ্ট্রীয় মঙ্গলের জন্য। আর এ মহান লক্ষ যাতে কোন অবস্থাতেই বিঘ্নিত না হয় তার জন্য তিনি অভিভাবক শ্রেণীকে পারিবারিক জীবন যাপনের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভােগের অধিকার থেকে দূরে রেখেছিলেন। কেননা প্লেটো মনে করতেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন যাপনের চিন্তা-ভাবনা রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে ব্রতী অভিভাবকদের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। ফলে আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন ব্যবস্থাকে উন্নত করার মহান লক্ষে প্লেটো যে সাম্যবাদের প্রবর্তন করে তা নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল –

  • ১. যৌথ জীবনে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব ও সম্পর্ক : প্লেটো তার সামারা প্রথমেই ব্যক্তিগত জীবন যাপনের পরিবর্তে যৌথ জীবন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। তিনি নারী ও পুরুষদের একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। তার মতে, নারী ও পুরুষের ক্ষমতা সমান বলে দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান। উভয়ের লালন-পালন ও শিক্ষা দীক্ষা হবে সমান। পুরুষেরা যেমন শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও শরীরচর্চার অধিকার পাবে নারীরাও তা পাবে। এমনকি নারীরা পুরুষদের ন্যায় যুদ্ধ বিদ্যাও শিখতে পারবে অর্থাৎ প্লেটোর মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকবে না।
  • ২. নারী ও পুরুষের কোন বৈষম্য থাকবে না : যে শিক্ষা একজন পুরুষকে একজন যথার্থ অভিভাবক হিসেবে পরিণত করতে পারে সেই একই শিক্ষা একজন নারীকেও যথার্থ অভিভাবিকায় রূপায়িত করতে পারবে। প্লেটোর মতে, নারী ও পুরুষদের মধ্যে যে পার্থক্য তা মাত্রাগত পার্থক্য, গুণগত নয়। পুরুষরা মেয়েদের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষে কোন বৈষম্য নেই। রাষ্ট্রের ঐক্য ও শক্তির স্বার্থে পুরুষের সাথে সাথে মেয়েরাও সমান এবং একই দায়িত্ব বহন করবে বলে প্লেটো উল্লেখ করেন। নারী ও পুরুষদের মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেটগণ নারী পুরুষদের যোগ্যতা অনুসারে নির্বাচন করবেন কাকে কোন্ কাজ দেয়া হবে। অর্থাৎ কে হবে সৈনিক, কে হবে দার্শনিক, কে হবে শ্রমিক তা নির্ধারিত হবে আইনজীবী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে।
  • ৩. ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ : প্লেটোর সাম্যবাদ অনুসার অভিভাবক শ্রেণীর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারবে না। কারণ প্লেটো মনে করতেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির চিন্তা মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। আর এরই ফলশ্রুতিতে অভিভাবক শ্রেণীর মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। প্লেটো আরও বলেন যে, আইনজীবী এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক নির্বাচিত নারী পুরুষগণ একই সাথে থাকবে এবং একই সাথে খাবে। তাদেরও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু থাকবে না। সকলেই একই পরিবেশে প্রতিপালিত হবে। আর এভাবে একত্রে বসবাস করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি হবে বলে প্লেটো মত প্রকাশ করেন। নারী-পুরুষ একই সাথে বসবাস করার ফলে যাতে করে মানবিক মূল্যবোধ না হারায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। আর এভাবে বসবাস করায় রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপিত হবে।
  • ৪. প্রচলিত পরিবার প্রথার উচ্ছেদ : তৎকালীন এথেন্সে পরিবার ব্যবস্থা স্থায়ী বিবাহ বন্ধনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। বিবাহ বন্ধন রচনা ও সন্তান উৎপাদনে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্লেটো এ ধরনের পরিবার ব্যবস্থাকে তার আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। আর তাই তিনি এরূপ স্থায়ী বিবাহভিত্তিক পরিবার প্রথার বিলোপ সাধনপূর্বক এক অভিনব প্রজনন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন। এই অভিনব পদ্ধতি অনুসারে বংশ বৃদ্ধির ব্যাপার নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্র কর্তৃক এ ব্যবস্থা অনুসারে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত উপযুক্ত মা-বাবারই সন্তান হতে পারবে এবং সন্তান সংখ্যাও নির্ধারিত হবে রাষ্ট্র কর্তৃক। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত নয় এমন কোন সন্তান হলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে না এবং তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হবে। প্লেটোর সাম্যবাদ অনুসারে যেসব নারীর বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর তারাই কেবল সন্তানের মা হতে পারবে; আর যেসব পুরুষের বয়স ২৫ থেকে ৫৫ বৎসরের মধ্যে তারাই কেবল সন্তানের বাবা হতে পারবে। এই নির্ধারিত বয়সসীমার বাইরে যাদের সন্তান হবে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। প্লেটো আরও বলেন যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে নারী-পুরুষদের মিলনের ফলে যে সন্তানের জন্ম হবে তা সকলের সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে একই সাথে রাখা হবে। সন্তানদের ওপর কারও ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না। এভাবেই প্লেটোর সাম্যবাদ প্রচলিত পরিবার প্রথার উচ্ছেদ সাধনপূর্বক সন্তানদের ওপর অভিভাবকদের যৌথ মালিকানা স্থাপন করে।

সমালোচনা : প্লেটোর সাম্যবাদের সমালোচনাগুলো হলো – 

  • ১. প্লেটোর সাম্যবাদে যে শ্রেণী চেতনার অনুভূতি ছিল তা মূলত অভিভাবক শ্রেণীর। প্লেটো তাঁর মতবাদে শ্রমজীবী মানুষের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। কিন্তু প্লেটো হয়তো ভেবে দেখেননি যে, শ্রমজীবী মানুষকে বাদ দিয়ে কোন রাষ্ট্রই যথার্থ রাষ্ট্র হতে পারে না। যে দেশে শ্রমজীবী মানুষ উপেক্ষিত সে দেশের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। তা ছাড়া শ্রেণী চেতনার এরূপ বৈষম্য রাষ্ট্রে বিদ্রোহ সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে।
  • ২. প্লেটোর সাম্যবাদ মানব সভ্যতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পক্ষে অসঙ্গতিপূর্ণ।
  • ৩. প্লেটোর সাম্যবাদ মূলত রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক দিকটা এখানে উপেক্ষিত। কিন্তু সমাজ জীবনে অর্থনীতির প্রভাব রাজনীতির চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
  • ৪. প্লেটো অভিভাবক শ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং শ্রমিক শ্রেণীর হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদের সম্পর্ক : 

সাদৃশ্যসমূহ –

  • ১. আধুনিক সাম্যবাদ ও প্লেটোর সাম্যবাদ উভয়ই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী।
  • ২. উভয় মতবাদের লক্ষই হল সামাজিক কল্যাণ সাধন।
  • ৩. উভয় মতবাদেই এ কথা বিবৃত যে, সবকিছুই রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।

বৈসাসৃশ্যসমূহ –

  • ১. আধুনিক সাম্যবাদে শ্রমজীবী মানুষের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়, কিন্তু প্লেটোর সাম্যবাদে শাসক শ্রেণীর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
  • ২. আধুনিক সাম্যবাদকে এক অর্থে সার্বজনীন সাম্যবাদ বলতে পারি, কিন্তু প্লেটোর সাম্যবাদকে আমরা সার্বজনীন সাম্যবাদ বলতে পারি না।
  • ৩. আধুনিক সাম্যবাদের লক্ষ হচ্ছে শ্রেণী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন করে শােষণহীন শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা কিন্তু প্লেটোর সাম্যবাদের উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা।
  • ৪. আধুনিক সাম্যবাদে অর্থনৈতিক দিকটা মুখ্য এবং রাজনৈতিক দিকটা গৌণ, কিন্তু প্লেটোর সাম্যবাদে রাজনৈতিক দিকটা মুখ্য ও অর্থনৈতিক দিকটা গৌণ।
  • ৫. আধুনিক সাম্যবাদ বস্তুতান্ত্রিক, কিন্তু প্লেটোর সাম্যবাদ আদর্শভিত্তিক।

প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্ব

রিপাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র : প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এক আদর্শ রাষ্ট্রের স্বরূপ চিত্রিত করেছেন এবং এই আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবকদের শিক্ষাব্যবস্থা শৈশব থেকে কোন্ পথে পরিচালিত হবে তা বিবৃত করেছেন। অভিভাবকদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যে আলোচনা করেছেন তার থেকেই প্রধানত আমরা প্লেটোর শিক্ষা সম্পর্কীয় তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি।

প্লেটোর মতে শিক্ষার প্রকৃতি : শিক্ষা বলতে কি বোঝায়? প্লেটোর মতে, শিক্ষা অন্ধ চোখে দৃষ্টি নিয়ে আসা নয়, এ হল চক্ষুকে আলোকের দিকে চালিত করা। শিক্ষা হল, আত্মা স্বাভাবিকভাবে যে দৃষ্টিশক্তির অধিকারী , তাকে আলোকের দিকে চালিত করা। এই উপমার মাধ্যমে প্লেটো যে কথা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল এই যে, আত্মা, যে জ্ঞানের অধিকারী নয় তার মধ্যে সেই জ্ঞান প্রবিষ্ট করানোকে শিক্ষা বলে অভিহিত করা যেতে পারে না। শিক্ষা হল আত্মার মধ্যে যে সব উৎকৃষ্ট গুণ প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সেগুলোকে প্রকট করে তোলা এবং আত্মাকে যথাযথ বিষয়ের দিকে চালিত করে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা। শিক্ষা হল শুধুমাত্র বুদ্ধিকে প্রদীপ্ত করা নয়, সমত আত্মাকে যথাযথ পথে চালিত করা। 

শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ : প্লেটোর মতে, প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা সত্য শিক্ষা করার প্রয়োজনীয় শক্তির অধিকারী এবং সত্যকে প্রত্যক্ষ করার ইন্দ্রিয়ও তার রয়েছে। শিক্ষার জন্য যে বিষয়টির প্রয়োজন, তা হল আত্মার পক্ষে পরিবর্তনশীল জাগতিক পরিবেশের ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ না করে, পরমসত্তা বা কল্যাণ (Good)-কে উপলদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশ যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ প্লেটো তা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর মতে, শিক্ষার প্রধান সমস্যা হল আত্মাকে তার যথাযথ পরিবেশে রাখা। সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাটি হবে এমন, যাতে আত্মা যা হতে চায় তার দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত রাখা যায়। সােজা কথায়, শিক্ষা হল আত্মার জন্য সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা।

আত্মার পক্ষে প্রয়োজন মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করা : প্লেটোর মতে, মানুষের আত্মা বিশেষভাবে অনুকরণধর্মী। অপর ব্যক্তির কার্যকলাপ আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করে তা থেকেই এই অনুকরণ প্রবণতার দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ করতে পারি। সেই কারণে প্রয়োজন আত্মার পক্ষে মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে চিন্তা করা এবং যে দেবতাদের মানুষ উপাসনা করে তাদের সম্পর্কে মহৎ ধারণা পােষণ করা। আত্মার ওপর কলার (Arts) প্রভাবও লক্ষণীয়, কেননা প্লেটোর মতে, সৌন্দর্যের ধ্যান করতে গিয়ে আত্মা সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে। আত্মা বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে। পরের প্রশ্ন হল, কোন বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষাকার্য সম্পন্ন হবে? প্লেটোর মতে, তা হল দেশের প্রচলিত আদর্শ সাহিত্য, কলার (Arts) প্রাথমিক জ্ঞান, গঠিত ও জ্যামিতির জ্ঞান। এ ছাড়াও রয়েছে শরীর চর্চা বা ব্যায়ামের (Gymnastics) প্রয়োজনীয়তা। প্লেটো মনে করতেন যে, প্রথম জীবনে, আত্মার মধ্যে প্রচ্ছন্ন সৎগুণগুলোকে প্রকট করে তোলার জন্য প্রয়োজন সাহিত্য, শিশুদের কাহিনী নিয়ে যার শুরু; তারপর কাব্য। দ্বিতীয় প্রয়োজন হল সঙ্গীত এবং তৃতীয় প্রয়োজন হল মৃন্ময়শিল্প, সূচিশিল্প , ভাস্কর্য প্রভৃতি কলার চর্চা এই শিক্ষা আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত চলবে। তারপর ছাত্রকে সামরিক কাজের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে বিশেষ ধরনের ব্যায়াম চর্চার প্রয়োজন। তারপর বিজ্ঞানের শিক্ষা, সর্বশেষে দর্শনের শিক্ষা। প্লেটোর রিপাবলিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডকে পঞ্চম এবং সপ্তম খণ্ডের সঙ্গে একত্রে যুক্ত করে পাঠ করলে দেখা যাবে যে, শিক্ষার ক্রম (Order) সম্পর্কে তাঁর অভিমত আত্মার প্রকৃতি সম্পৰ্কীয় এক বিশেষ মতবাদের সঙ্গে যুক্ত। আত্মার বিকাশের মূলে রয়েছে শিক্ষার প্রভাব এবং এই শিক্ষা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। আত্মার বিকাশের বিভিন্ন স্তর ও আত্মার বিকাশের প্রথম স্তরে শিক্ষা কল্পনার মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। দ্বিতীয় স্তরে শিক্ষা বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে এবং তৃতীয় স্তরে সত্যের প্রতি অনুরাগের মাধ্যমে আত্মাকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার লক্ষ হল কল্যাণ (Good)-কে নানাভাবে আত্মার কাছে উপস্থাপিত করা, কেননা সৌন্দর্য এবং সত্যতা হল কল্যাণেরই রকমভেদ। সবচেয়ে প্রধান যে বিষয়টি মানুষ শিক্ষালাভ করতে পারে তা হল মানুষের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এই বিশ্বজগতে বিচার বুদ্ধি এবং ঐশ্বরিক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা। যে কল্যাণকে আত্মা পরে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করবে, প্রথম জীবনের শিক্ষার লক্ষ হল নানা ধরনের কল্পনার মধ্য দিয়ে তাকে প্রত্যক্ষ করতে সহায় এই বয়সের শিক্ষা শুরু হবে গদ্য বা কাব্যের মধ্যদিয়ে বর্ণিত গল্প বা কাহিনী ও শিক্ষার উদ্দেশ্য হল দেহ ও মনের বিকাশ। প্লেটো প্রথমে মনের শিক্ষার ওপর দিয়ে তারপর দেহের শিক্ষার কথা বলেছেন।

শিক্ষার শুরু পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে : কি দিয়ে শিক্ষা শুরু হবে? বস্তত, শিক্ষা শুরু হবে ধর্ম দিয়ে, শিশুদের কাছে ঈশ্বরের চরিত্রকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে প্লেটোর শিক্ষা-ব্যবস্থা শুরু হবে পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে এবং এসব কাহিনীগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কাহিনীর মাধ্যমে যদি দেবতাদের এবং বীরদের চরিত্র যথাযথভাবে অর্থাৎ কল্যাণকরভাবে প্রকাশিত না হয় তাহলে সেই সব কাহিনী শিশুদের মনের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। মহাকাব্য, গীতিকাব্য, নাটক যা-ই রচনা করা হােক না কেন তাতে। দেবতাদের চরিত্রকে সুন্দর করে চিত্রিত করতে হবে। কেননা, যা সুন্দর তা কখনও শিশুমনের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে না। দেবতাদের যেমন কল্যাণময় করে চিত্রিত করতে হবে তেমনি বীরপুরুষ ও মানুষের চরিত্রকেও তাদের সবচেয়ে উন্নতরূপে চিত্রিত করতে হবে। কোন মন্দ বা অকল্যাণকর কিছু দেবতারা সম্পাদন করছেন এভাবে যেন দেবতাদের চিত্রিত করা না হয়। সােজা কথায় , যা ভাল তাকে মন্দের জন্য দায়ী করা চলবে না। দেবতাদের এমনভাবে চিত্রিত করতে হবে যাতে তারা কাজে এবং কথায় সরল ও সত্য বলে প্রতিভাত হন। দেবতারা হবে অপরিবর্তনীয়। কোন অবস্থাতেই দেবতারা কাউকে প্রতারিত করছে, এভাবে দেবতাদের চিত্রিত করা চলবে না। পৌরাণিক কাহিনী যে মূলত অবাস্তব সেই সম্পর্কে প্লেটো সচেতন ছিলেন, তবে অবাস্তব হলেও কোন কাহিনীতে দেবতা কোন মন্দ কার্য সম্পাদন করছেন, এভাবে তাদের চিত্রিত করা। উচিত হবে না। যা কিছু ভাল, ঈশ্বর কেবলমাত্র তারই কারণ হতে পারেন। তা ছাড়া ঈশ্বর সত্যবাদী, অপরিণামী এবং অ-প্রতারক। প্লেটো ঈশ্বর এক, এরূপ ধারণা করলেও, লৌকিক ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন দেবতারা (Gods) কার্য সম্পাদন করেছেন, এরূপ বলা হয়, সেরূপ ভাষা ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি।

কাহিনীর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সৎ গুণের উন্মেষ : প্লেটো শিশুদের মধ্যে কাহিনীর মাধ্যমে দেবতাদের প্রতি ও মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভাই-বোনদের প্রতি ভালবাসা জাগাবার কথা বলেছেন এবং সাহসিকতা, সত্যবাদিতা এবং আত্মসংযম প্রভৃতি সৎ গুণগুলো যাতে তাদের মধ্যে উন্মােষিত হয় তার কথাও বলেছেন। শিশুদের সামনে বীর চরিত্র উপস্থাপিত করে উপরিউক্ত গুণগুলো তাদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করতে হবে। রিপাবলিকের দ্বিতীয় খণ্ডে প্লেটো বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষার কথা বললেও তৃতীয় খণ্ডের শুরুতে তিনি যুবকদের শিক্ষার কথাই আলোচনা করেছেন।

সাহিত্যের আকার সাহিত্যের বিষয়বস্তুর মতই গুরুত্বপূর্ণ : সাহিত্যের বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সাহিত্যের আকার (Form) অর্থাৎ যে আকারে সাহিত্য আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকদের কাছে উপস্থাপিত হবে তাও সমান গুরত্বপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষা শিশুদের মনে কতকগুলো সরল ও সুনির্দিষ্ট নৈতিক গুণ প্রবিষ্ট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ, ততক্ষণ পর্যন্ত শিল্পসুলভ চেতনার প্রশ্ন দেখা দেয় না, সত্য কিভাবে উপস্থাপিত হল সেই প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু শিক্ষার একটা বিশেষ স্তরে এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয়।

কোন ধরনের মানব চরিত্র সাহিত্যে অনুকরণীয় : সাহিত্যের আকারের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্লেটো সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনুকরণের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। অনুকরণের ধর্ম হল বাস্তব হওয়া (to become the real thing)। যদিও সব সাহিত্যই অনুকরণধর্মী তবু অনুকরণের মাত্রা এবং কিভাবে অনুকরণ করা হচ্ছে তার ব্যাপারে কোন একটি সাহিত্যের সঙ্গে অন্য একটি সাহিত্যের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কাব্য, নাটক, মহাকাব্য সকলেই অনুকরণ করে। কিন্তু প্লেটো সাহিত্যের আকার কাব্য, নাটক বা মহাকাব্য কোনটি হওয়া উচিত, সেই প্রশ্নের সমাধান না করে, কোন ধরনের মানবচরিত্র সাহিত্যে অনুকরণীয় সেই প্রশ্ন আলোচনা করেছেন। প্লেটোর মতে, কেবলমাত্র যে-সব মানুষ সাহসী, ধার্মিক, আত্মসংযত এবং উদার, তাদের চরিত্রই সাহিত্যে অনুকরণযোগ্য এবং সাহিত্যিক সেই সব চরিত্রই চিত্রিত করবেন।

কবিদের দায়িত্ব : এরপর প্লেটো কবিদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন, কারণ কবিরা জীবনকে বাস্তবভাবে চিত্রিত করতে সমর্থ। কবি এবং কাহিনীকার কেবলমাত্র উন্নত চরিত্রের লোকের আচরণ তাঁদের রচনায় চিত্রিত করবেন। কবি ভালও হতে পারেন, মন্দও হতে পারেন। মন্দ কবি হলেন তিনি, যিনি প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও সকল অবস্থায় সব ধরনের চরিত্র অঙ্কিত করেন। আর ভাল কবি কেবলমাত্র সৎ চরিত্র অঙ্কনের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করবেন। কোন মহান চরিত্রের দুর্বলতা, ত্রুটি বা অসাফল্যের চিত্র তিনি বিশদভাবে চিত্রিত করার জন্য সচেষ্ট হবেন না। অবশ্য কি আকারের সাহিত্য প্লেটোর অভীষ্ট সিদ্ধ করবে, প্লেটো সেই প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি।

কলাও চরিত্রের প্রকাশক : প্লেটোর সাহিত্যের মত কলাও চরিত্রের প্রকাশক। কেননা, কলা (Art) মাত্রই চরিত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেই কারণে কলা মাত্রকেই শিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে হবে। সকল কলার ক্ষেত্রেই আত্মার সঙ্গে আত্মা কথা বলে (in all forms of arts soul speaks to soul)। প্রত্যেক কলারই নিজস্ব ইন্দ্রিয়। আছে এবং ইন্দ্রিয়ের মারফত আত্মা আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও প্লেটো মনে করেন যে, সঙ্গীতবিদকে মনে করতে হবে যে, রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য আছে। প্লেটো সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েক ধরনের গ্রীক সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অনুমােদন করেছেন। তিনি কয়েকটি সরল ধরনের সঙ্গীতের তাল বা মাত্রার ব্যবহারের কথা বলেছেন এবং তার মতে, সুরকে শব্দের সঙ্গে বা কথার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে হবে। সুর হবে কথার অধীন। নেটেলশিপ (Nettleship) এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, প্লেটো তার সময়ের সঙ্গীত, কলা, সাহিত্য, সকল কিছুর সমালোচনার ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা হল, জটিলতা পরিহার করে সরলতাকে গ্রহণ করা। সরলতার অর্থ কোন নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করা। সাহিত্যিক, সঙ্গীতবিদ, কলাবিদ যা দেখবেন তা-ই চিত্রিত করবেন, এই নীতি সরল নীতি কাজেই সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও যে-কোন সুর, তাল, মাত্রার ব্যবহার অনুমােদন করা যেতে পারে না। যা কিছু আকর্ষণীয় তার অনুকরণ চলতে পারে না।

কলার নৈতিক প্রভাবের গুরুত্ব : প্লেটো কণার নৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন। তাই তাঁর মতে, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, বয়নশিল্প , সূচিশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, আসবাব নির্মাণ শিল্প, অর্থাৎ যে-সব কলার একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার আছে, তা সুন্দর বা কুৎসিত হতে পারে এবং তা চরিত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবলের জন্য এমন এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে যে-কোন দিক থেকেই তারা যা কিছু ভাল তাকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে, এবং যা কিছু কুৎসিত, নোংরা ও কদর্য তাকে পরিহার করতে পারে। চক্ষু ও কর্ণের মাধ্যমেই আত্মা বাহ্য জগতের সৌন্দর্যের সংস্পর্শে আসে। প্লেটোর মতে, জগৎ সমগ্রভাবে সুন্দর, জগতের মধ্যে বুদ্ধি আছে, তাই জগৎ বুদ্ধিগম্য এবং জগতের এই বুদ্ধি সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েও নিজেকে প্রকাশ করে। শিল্পীর কাজ হল আমাদের এই জগতের সৌন্দর্য দেখানো এবং যে শিল্পীরা তা করতে সক্ষম তাদেরই আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। সব রকম কলার ক্ষেত্রেই ছন্দ, তাল, সঙ্গতি বা আকারের ভালত্ব ও মলত্ব বর্তমান এবং যথাযথ ছন্দ বা আকার একাধারে এই জগতের মধ্যে যে বুদ্ধি রয়েছে এবং মানুষের মধ্যে যে বিচারবুদ্ধি রয়েছে তার সমগোত্রীয়। এই হল কলা এবং চরিত্রের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক।

কাব্য ও সঙ্গীতে শিক্ষার গুরুত্ব : কাব্যে এবং সঙ্গীতে শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে কেননা ছন্দ এবং সঙ্গীত আত্মার গভীরে প্রবেশ করে তার ওপর গভীর রেখাপাত করে, যার ফলে যে ব্যক্তি যথাযথভাবে লালিত-পালিত হয় তার মধ্যে দেহ ও সৌন্দর্যের সুষমা সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা মানুষকে প্রকৃতিতে বা যে-কোন কলার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও কোন দোষ বা ত্রুটিকে দ্রুত অনুধাবন করতে সমর্থ করে। যা কিছু সুন্দর, তাকে অনুধাবন করে সে হয়ে ওঠে এক তেজোদীপ্ত পুরুষ। যা কিছু কুৎসিত ও নোংরা তাকে সে সুনিশ্চিতভাবেই ধিকৃত করে। এই অভিভাবকবৃন্দকে এমনভাবে শিক্ষিত করতে হবে যাতে তারা বাস্তব ও প্রতিবিম্বের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে অর্থাৎ কিনা, যাতে তারা মিতাচারী, সাহসী, উদার এবং উন্নতমনা হয়। এদের এমন হতে হবে যাতে এরা উপরিউক্ত সৎ গুণগুলোর প্রয়োজনীয় আকারগুলোকে যেমন চিনে নিতে পারবে? তেমনি তাদের বিপরীত আকারগুলোকেও চটপট অনুধাবন করতে পারবে। এভাবে ব্যক্তি শিক্ষিত হবে তার কোন্‌টি সুন্দর এবং কোন্‌টি কুৎসিত, সেই সম্পকে অন্তর্দৃষ্টি জাগবে। সে সুন্দরকে ভালবাসবে আর কুৎসিতকে ঘৃণা করবে। পরে সে কেন তাকে ভালবাসছে বা ঘৃণা করছে সেই সম্পর্কে তার মনে যুক্তি গঠন করতে পারবে। যে ব্যক্তির ওপর এই শিক্ষা যথাযথভাবে ক্রিয়া করবে, তিনি সর্বত্র সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবেন; তিনি দেহের সৌন্দর্যের তুলনায় আত্মার সৌন্দর্যকে অধিক মূল্য দেবেন। অত্যধিক রিপুর উত্তেজনা সৌন্দর্য অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সৌন্দর্যের বোধ যত গভীর, পশু উত্তেজনার সঙ্গে তা তত বেশি সঙ্গতিবিহীন। কাজেই দেখা গেল কাব্য ও সঙ্গীতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি।

শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যায়াম-চর্চার গুরুত্ব : আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবৃন্দের শিক্ষার ক্ষেত্রে, শারীরিক ব্যায়াম-চর্চারও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। শৈশব থেকেই এর প্রতি যত্নবান হতে হবে, যা চলবে সারা জীবন ধরে। সৎ নাগরিক, সৈন্য গঠনের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শরীর চর্চা। শরীর চর্চার নামে পেশাদার মল্লবীর তৈরির উপযোগী শিক্ষা প্লেটো অনুমােদন করেননি। প্রথমত, এতে একটা তার স্বভাব (a drowsy condition), একটা ঝিমুনে ভাব গঠিত হয় এবং এই ধরনের শরীর চর্চা খাদ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না। ঐ জাতীয় পরিবর্তন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে দেহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আদর্শ রাষ্ট্রের যোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ ধরণের শরীর চর্চা, যাতে তাদের চক্ষু ও কর্ণ সদাজাগ্রত থাকে। তারা যেন সকল রকম খাদ্য ও জলবায়ুর পরিবর্তন সহ্য করতে পারে, তারা হবে পানাহারে মিতাচারী। কাব্য ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন, এক্ষেত্রেও প্লেটো যে নীতি অনুসরণ করতে চান তা হল সরলতার নীতি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্র্য আত্মায় উচ্ছলতার বোধ সৃষ্টি করে এবং সরলতা সংযম নিয়ে আসে, দেহের ক্ষেত্রেও তাই। দেহের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ব্যাধির সৃষ্টি করে, সরলতা সৃষ্টি করে সুস্থ দেহ। কাজেই ভাবী অভিভাবকবৃন্দ যদি যথাযথভাবে ব্যায়ামচর্চা করে তাহলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাদের শরীরকে নীরোগ করার জন্য ঔষধের প্রয়োজন হবে না। সাধারণ মল্লবীর ব্যায়ামচর্চা করে শারীরিক শক্তি অর্জন করার জন্য, কিন্তু ভাবী অভিভাবকবৃন্দ শরীরচর্চা করবে তাদের প্রকৃতিতে যে তেজের অংশ বা শৌর্যের অংশ আছে তাকে উদ্দীপিত করার জন্য। প্লেটো শারীরিক ব্যায়ামচর্চা (Gymnastics) পদটিকে দেহের সাধারণ বিজ্ঞান (General Science of Body) এই ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহার করেছেন।

শরীর চর্চার ব্যাপারে সতর্কতা : শিক্ষার উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রেই আত্মার উন্নতি সাধন। সংস্কৃতির অবহেলা যেমন চরিত্রকে প্রভাবিত করে তেমনি শরীরচর্চার অবহেলাও চরিত্রকে প্রভাবিত করে। আত্মার উপাদানকে বিকশিত করার জন্য উভয়েরই প্রয়োজন। ব্যায়ামচর্চা ব্যক্তির শৌর্যাংশকে উদ্দীপিত করে। শরীরচর্চা যথাযথভাবে সম্পাদিত হলে সাহস ও পৌরুষের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু শরীরচর্চা করতে গিয়ে যদি আত্মার অন্যান্য উপাদানকে অবহেলা করা হয় তাহলে ব্যক্তির চরিত্রে কঠোরতা ও বর্বরতা প্রকাশ পায়।

শিক্ষার উদ্দেশ্যে চরিত্রের সামঞ্জস্য বিধান : সাহিত্য এবং কলার অনুশীলন মানুষের মধ্যে যে দার্শনিক বা শান্ত (Gentle) উপাদান রয়েছে তাকে প্রভাবিত করে। এর যথাযথ বিকাশ মানুষকে মিতাচারী বা আত্মসংযত করে তোলে। আবার যদি ঐ উপাদানকে অতিরিক্ত বিকশিত করে তোলা হয় তাহলে সে হবে অতিমাত্রায় কোমল পৌরুষহীন, অস্থির ও দুর্বলচিত্ত। শিক্ষার সমস্যা হল চরিত্রের এই দুটি দিকের সঙ্গতিসাধন করা এবং যে ব্যক্তি প্রকৃত সঙ্গীতবিদ সেই মানুষের চরিত্রের মধ্যে সঙ্গতিসাধন করা সম্ভব।

সাহিত্য, সঙ্গীত ও শরীরচর্চা যথার্থ শিক্ষা পদবাচ্য নয় : প্লেটোর শরীরচর্চা সম্পর্কীয় শিক্ষা ভাবী অভিভাবকদের দেওয়া হলেও এই শিক্ষা যথার্থ শিক্ষা নয়, কেননা শরীরচর্চা শিক্ষার সম্পর্ক ধ্বংসমূলক বিষয়ের সঙ্গে, কেননা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও হ্রাস পায়। সাহিত্য ও সঙ্গীত শিক্ষাও যথার্থ নয়, কেননা এ হল সুর ও ছন্দের মধ্য দিয়ে চরিত্রে এক ধরনের সঙ্গতি নিয়ে আসা। এই উভয় প্রকার শিক্ষার কোনটিই যথার্থ শিক্ষা পদবাচ্য নয়, কেননা অভিভাবকদের লক্ষ কল্যাণ (Good)-এর জ্ঞান লাভ করা। উপরিউক্ত শিক্ষা সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির পক্ষে সহায়ক নয়। কাজেই আত্মাকে কল্যাণের জ্ঞানের পথে চালিত করার জন্য কোন্ শিক্ষার প্রয়োজন? প্লেটো তার উত্তরে বলেছেন, বিজ্ঞানের জ্ঞান।

গণিত শিক্ষা : কোন কোন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতে গেলে দেখা যাবে যে, তাদের প্রকৃতিই এমন যে তারা আমাদের চিন্তাকে উদ্দীপিত করে, যেমন পাটীগণিত যা সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করে প্রতিটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু একাধারে এক এবং বহু। কাজেই, যেহেতু এক এবং বহু একই বস্তুতে সহাবস্থান করে, এককে প্রত্যক্ষ করা মানেই বহুকে এবং বহুকে প্রত্যক্ষ করা মানেই এককে প্রত্যক্ষ করা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এককে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলোচনা শুধু প্রত্যক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, আত্মাকে প্রত্যক্ষণ থেকে, সত্তার চিন্তন (Contemplation of Reality) এর দিকে চালিত করে। সুতরাং যেহেতু সংখ্যার বৈশিষ্ট্য মানুষকে সত্তার স্বরূপ উপলব্ধির দিকে চালিত করে, সেহেতু সংখ্যা দিয়ে আলোচনা করে যে পাটীগণিত, তা অভিভাবকদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। এই শিক্ষা তাদের লাভ করা প্রয়োজন। কেননা তারা যেহেতু দার্শনিক তাদের পরিবর্তনশীল জগতের উর্ধে যে শুদ্ধ সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে তাকে উপলদ্ধি করতে হবে। তা না হলে তারা কখনও বিচারবুদ্ধির গণনায় দক্ষ হবে না। শুদ্ধ চিন্তনের সাহায্যে তারা সংখ্যার যথার্থ প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারবে। যুদ্ধের জন্য এবং অসৎ-এর জগৎ থেকে সৎ-এর জগতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাদের গণনার অনুশীলনের প্রয়োজন। সংখ্যার আলোচনা করতে হবে জ্ঞানের জন্যে, কোন ব্যবসাদারী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। পাটীগণিতের আলোচনা মনকে শুদ্ধ সংখ্যা সম্পর্কে যুক্তিতর্ক করতে শেখায়। সংখ্যাকে কেবল বুদ্ধির সাহায্যেই জানা যায়। কাজেই গণিতশাস্ত্রের আলোচনা শুদ্ধ চিন্তার প্রয়োগের দ্বারা বিশুদ্ধ সত্যতাতে উপনীত হতে মনকে বাধ্য করে।

জ্যামিতি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : অভিভাবকবৃন্দকে জ্যামিতিও শিক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে এই বিদ্যার অনুশীলন যুদ্ধের নানা কাজের পক্ষে সহায়ক। তবে জ্যামিতি হল যা অনন্তকাল ধরে অস্তিত্বশীল তার জ্ঞান (Knowledge of the Eternally Existent), এবং সেই কারণে এই বিদ্যার অনুশীলন আত্মাকে সত্যের দিকে চালিত করবে এবং জগতের দিকে চালিত না করে দার্শনিক বুদ্ধিকে ঊর্ধ্ব দিকে চালিত করবে। জ্যামিতির অনুশীলন অন্যান্য যেকোন বিদ্যার অনুশীলনের জন্য মনকে প্রস্তুত করে। অভিভাবকদের জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা করতে হবে। কৃষিকাৰ্য, নৌচালনাবিদ্যা। ছাড়াও সরকারি কাজে এর প্রয়োজনীয়তা আছে। তা ছাড়া জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা আত্মার বুদ্ধিকে তার যথাযথ কাজে লাগায়। সুরবিজ্ঞান (Harmones)-ও অভিভাবকদের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে সৌন্দর্য ও কল্যাণের জ্ঞানের মাধ্যম রূপে এর অনুশীলন করা হলে তবেই এর যথার্থ সার্থকতা।

বিজ্ঞানের আলোচনা দার্শনিক জ্ঞানের পূর্ব প্রস্তুতিস্বরূপ : উপরে যে-সব বিজ্ঞানের উল্লেখ করা হল তারা সাধারণভাবে মনকে চিন্তা করতে শিক্ষা দান করে। তাছাড়া, পূর্বোক্ত বিজ্ঞানগুলো শিক্ষা করতে গিয়ে মন ধীরে ধীরে কতকগুলো সূত্র বা সত্তার আকার (Principles or Forms of Being) অনুধাবন করতে পারে, যেগুলো তাদের কল্যাণের নীতিকে জানতে সহায়তা করে। এই নীতি অন্যান্য নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথমত, এই বিজ্ঞানগুলোর আলোচনা হল মানসিক ব্যায়াম এবং দ্বিতীয়ত, এই বিজ্ঞানগুলো কতকগুলো মৌলিক আকারে জ্ঞান দেয়, যে আকারে এই জগতের কল্যাণের উপস্থিতি প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, এ সব বিজ্ঞানের আলোচনা দার্শনিক জ্ঞানের পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ।

জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : গণিতশাস্ত্র দশ বছর ধরে শিক্ষা গ্রহণ করার পর আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবী অভিভাবকবৃন্দকে ত্রিশ বছর থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত ‘ডায়েলেকটিক’ অনুশীলন করতে হবে। ইতোপূর্বে যে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে তার একটি প্রধান ত্রুটি হল এই যে, বিভিন্ন জ্ঞানের শাখাগুলো যে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এক অখণ্ড সমগ্র— এভাবে তাদের জানা হয়নি। তাদের পৃথক পৃথকভাবে শিক্ষা করা হয়েছে। প্রতিটি জ্ঞানের শাখাই কতকগুলো হেতুবাক্যকে বিনা প্রশ্নে স্বীকার করে নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সচেষ্ট হয়েছে। কাজেই প্রতিটি গাণিতিক বিজ্ঞান যে-কোন নিরপেক্ষ স্বপ্রকাশ এবং শর্তহীন নীতির সঙ্গে যুক্ত, তা জানা যায়নি। ডায়েলেকটিকএর লক্ষ হল , অবশ্য যখন তাকে এই গণিতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, সব গাণিতিক জ্ঞান সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টি দান করা এবং সমগ্র সত্তার সঙ্গে তা কিভাবে যুক্ত দেখানো। আসলে ডায়েলেকটিক হল দার্শনিক জ্ঞান, বিচারবুদ্ধির সাহায্যে কল্যাণের নিজের স্বরূপটিকে উপলব্ধি করা (To grasp by pure intelligence the very nature of goodness itself)। ডায়েলেকটিক পদ্ধতি ছাড়া, প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব স্বরূপ কী, তা অনুসন্ধান করার জন্য অন্য কোন পদ্ধতি নেই। ডায়েলেকটিক পদ্ধতি হল একমাত্র পদ্ধতি যা বিনা প্রমাণে কোন হেতুবাক্যকে স্বীকার করে নেয় না, এবং ধীরে ধীরে কিছুর আদি সূত্রে উপনীত হয়। প্রতিটি বস্তুর স্বরূপ-ধর্ম বা সারমর্ম (Essence) এর বিবরণ দেওয়া ডায়েলেকটিকের মাধ্যমেই সম্ভব হয়। যে ব্যক্তি ডায়েলেকটিকের অনুশীলন করেছে সে কল্যাণের প্রকৃতিকে অন্যান্য আকারের বা (Forms)-র প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র করতে পারে।

কোন্ বয়স থেকে কোন স্তরের শিক্ষা শুরু হবে? : শিক্ষার ক্রম বর্ণনা করতে পর প্লেটো কোন্ বয়স থেকে কোন স্তরের শিক্ষা শুরু হবে তা নির্দেশ করেছেন। সতের অথবা আঠার বছর বয়স পর্যন্ত সাহিত্য, সঙ্গীত এবং প্রাথমিক গণিতের অনুশীলন চলতে থাকবে। সতের-আঠার বছর থেকে কুড়ি বছর পর্যন্ত শরীরচর্চা এবং সামরিক শিক্ষা চলতে থাকবে। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত নির্বাচিত কিছু যুবক গণিতের উন্নত শিক্ষাক্রমে অংশগ্রহণ করবে যাতে বিভিন্ন গণিতের মধ্যে সংযোগ এবং সত্তার সঙ্গে তাদের যোগ তারা উপলব্ধি করতে পারে। এরপর আবার এদের মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত ‘ডায়েলেকটিক’ শিক্ষা দিতে হবে। বিশেষ করে নৈতিকতার পর, কল্যাণের স্বরূপকে জানাই হবে এদের লক্ষ। পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সরকারি পদ গ্রহণ করে ব্যক্তিকে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে এদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তারা কল্যাণের স্বরূপ সম্পর্কে দৃষ্টির অধিকারী হবে। এরপর এরা দেশ শাসনে ও গ্রন্থাদি পাঠে নিজেদের নিয়োজিত করবে।

প্লেটোর নৈতিক মতবাদ

প্লেটোর নৈতিক মতবাদ, আনন্দবাদ : প্লেটোর নৈতিক মতবাদকে কি নামে অভিহিত করা যেতে পারে? প্লেটোর নৈতিক মতবাদকে কল্যাণবাদ বা আনন্দবাদ (Eudaemonism) নামে অভিহিত করা যেতে পারে। এই মতবাদ অনুসারে মানুষের জীবনের লক্ষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীবনযাপন এবং নৈতিক জীবন হিসেবে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। এটি এমন একটি নৈতিক মতবাদ যা মানুষের সমগ্র প্রকৃতির পূর্ণতাকে নৈতিক আদর্শরূপে গণ্য করে এবং এই আদর্শ লাভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে আনন্দ বা কল্যাণ। ‘Eudaemonia’ শব্দটির অর্থ হল কল্যাণ (wellbeing)।

কল্যাণময় জীবনের স্বরূপ : প্রথম প্রশ্ন হল, কল্যাণ (Good) বলতে কি বোঝায়? কল্যাণময় জীবনই (Good Life) বা কাকে বলা যায়? প্লেটোর মতে কল্যাণময় জীবন কেবলমাত্র সুখী জীবন নয়, যে কারণে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সুখের জীবনকে সুখময় জীবন বলে অভিহিত করা যায় না। আবার মানুষের মনের সবচেয়ে বড় উপাদান তার বিচারবুদ্ধি হলেও শুধুমাত্র বিচার-বুদ্ধির জীবন যদি সুখ-বর্জিত জীবন হয় তাহলে তা মানুষের কাম্য হতে পারে না। কাজেই কল্যাণময় জীবন বলতে বোঝায় বিজ্ঞতা। বিচারবুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয় সুখ, এই দুই-এর সম্মিলিত জীবন। কল্যাণময় জীবন শুধুমাত্র বিচারবুদ্ধি বা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়সুখের জীবন নয়। কাজেই প্লেটোর কল্যাণময় জীবনে যেমন বৌদ্ধিক সুখ (Intellectual Pleasures), তেমনি ইন্দ্রিয় সুখেরও থান আছে। তবে ইন্দ্রিয় সুখ বলতে নির্দোষ সংযত ইন্দ্রিয় সুখকেই বুঝতে হবে। প্লেটো বলেন, যে-কোন পানীয়কে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে যেমন মধু ও জলের সুষম মিশ্রণের প্রয়োজন, তেমনি সুখের অনুভূতি এবং বিচারবুদ্ধির সুষম সংমিশ্রণই মানুষের জীবনকে কল্যাণময় করে তুলতে পারে। জ্ঞানের সঙ্গে সুখের সংমিশ্রণের অনুপাত হল খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কল্যাণ হল সুন্দরেরই একটি রূপ, তাই কল্যাণময় জীবনে কামনা-বাসনায় পরিমিত নির্দোষ পরিতৃপ্তিই কাম্য। কল্যাণময় জীবনের জন্য কল্যাণ বা সুখ লাভের বাসনা থাকবে।

কল্যাণময় জীবনের জন্য সার্বিক-এর জ্ঞানের প্রয়োজনীয় : প্লেটোর মতে যে ব্যক্তি কল্যাণময় জীবনের অধিকারী তিনি অবশ্যই যথার্থ জ্ঞান অর্থাৎ সার্বিক বা আকারের (Universal) জ্ঞানের অধিকারী হবেন। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, তিনি জড় জগতের সাধারণ বস্তুর জ্ঞানের অধিকারী হবেন না। তবে তাকে খেয়াল রাখতে হবে যে, সার্বিক বা আকারের জ্ঞানের তুলনায় জড়বস্তুর জ্ঞান হল মামুলি জ্ঞান। আসলে প্লেটো যা বলতে চান তা হল এই যে, কল্যাণময় জীবন-যাপনের জন্য মরজীবন ও জড় জগতের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হতে হবে এমন কথা নেই। তবে তাকে স্বীকার করতে হবে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতই একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ জগৎ নয়। বরং এই জগৎ আদর্শ জগতের একটি নকল। প্লেটোর মতে, মানুষের পরম পুরুষার্থ বা পরম কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত হ’ল ঈশ্বরের জ্ঞান। ঈশ্বর হলেন আকার বা সার্বিকের স্রষ্টা। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবার ‘টাইম্যায়িয়ুস’ গ্রন্থে প্লেটো বলেছেন সার্বিক বা আকার হল মানুষের মননের (Contemplation) বিষয়। কোন মানুষ আনন্দিত হতে পারে না যদি সে উপলদ্ধি না করে যে ঈশ্বরের বিধানেই জগৎ চলে। সততা অনুশীলন করেই আত্মা আনন্দ লাভ করতে পারে। তার অর্থ, মানুষের পক্ষে যতদূর সম্ভব ঈশ্বরের মত হওয়া এবং মানুষ যত ঈশ্বরের মত হবে তত ঈশ্বরের প্রিয় হবে। সংযত ব্যক্তি ঈশ্বরের মত, সেই কারণে ঈশ্বরের বন্ধু। প্লেটোর মতে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা বা ঈশ্বরের কাছে কোন বস্তু উৎসর্গ করা খুব মহৎ ভাল কাজ এবং আনন্দদায়ক জীবন লাভের উপযোগী। তবে মন্দ ও অসাধু ব্যক্তির উৎসর্গীকৃত বস্তু ঈশ্বর গ্রহণ করেন না। যদিও সততার অনুশীলন। এবং সৎ জীবন-যাপন আনন্দ লাভের উপায়, সততা আনন্দের অঙ্গীভূত কোন বাহ্য বিষয় নয়। যথার্থ সৎ ব্যক্তি হলেন প্রকৃত সাধু ব্যক্তি এবং তিনিই প্রকৃত আনন্দের অধিকারী।

সততার অর্থ ব্যাখ্যা : দ্বিতীয় প্রশ্ন , প্লেটো সত্যতা (Virtue) বলতে কী বুঝেছেন? সক্রেটিসের মত প্লেটোও মনে করতেন, জ্ঞান সততার সঙ্গে অভিন্ন। অসংযত বা অমিতাচারী ব্যক্তি, যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর তাই অনুসরণ করে কিন্তু সংযত ব্যক্তি যা কল্যাণকর এবং উপকারী তাই অনুসরণ করে। এখন যা ক্ষতিকর তা অনুসরণ করা মুর্খতা এবং যা যথার্থ কল্যাণকর তা অনুসরণ করা জ্ঞান। কাজেই সংযম এবং জ্ঞান পরস্পর সম্পর্ক শূন্য হতে পারে না। প্লেটোর মতে সততা এক নয় বহু, আত্মার বিভিন্ন অংশ রূপে সততা বিভিন্ন কিন্তু এইসব বিভিন্ন সততা বহু হয়েও এক। কেননা তারা একই কল্যাণ ও অকল্যাণের জ্ঞানের প্রকাশ। জ্ঞানই সততা। সততা শিক্ষা দেওয়া যায়-এতে যেমন প্লেটো বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি প্লেটো বিশ্বাস করতে যে কেউ জেনে শুনে স্বেচ্ছায় মন্দ বা অকল্যাণজনক কিছু সম্পাদন করে না। প্রকৃতই যা মন্দ বা অন্যায়, কোন মানুষ যদি তাকে নির্বাচন করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তাকে সে কল্যাণকর বা ভাল জেনেই কামনা করেছে, হতে পারে আসলে তা মন্দ। এখন প্লেটো যদি এই জাতীয় সিদ্ধান্ত করেন তা হলে মানুষের কাজের নৈতিক দায়ীত্বের প্রশ্নটি কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? প্লেটোর এ সম্পর্কে বক্তব্য হল যে, যে মানুষ জানে প্রকৃত কল্যাণ কি, সেও সাময়িকভাবে রিপুর তাড়নার বশবর্তী হলে তার বিচারশক্তি যথাযথভাবে ক্রিয়া করতে পারে না। এর ফলে যা আপাতঃদৃষ্টিতে কল্যাণকর তাই তার কাছে যথার্থ কল্যাণকর মনে হয়। অবশ্য সে যে তার বিচারবুদ্ধিকে রিপুর দ্বারা আচ্ছন্ন হতে দিয়েছে তার জন্য সে অবশ্যই দায়ী।

সততা শিক্ষা দেওয়া যায় : সততা যদি হয় জ্ঞান, তাহলে সততা শিক্ষা দেওয়া যায়। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো বলেছেন যে একমাত্র দার্শনিকেরই জানা আছে মানুষের যথার্থ কল্যাণ কী। কাজেই মানুষের কল্যাণ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হওয়াতে দার্শনিকই সততা শিক্ষাদানের ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তি। ‘সততা হয় জ্ঞান’-এর অর্থ হল ‘কল্যাণ’ পদটি কোন আপেক্ষিক পদ নয়; এটি এমন কিছু নির্দেশ করে যা সর্বনিরপেক্ষ এবং সত্য বা অপরিণামী। তা না হলে এটা জ্ঞানের বিষয় হতে পারত না।

চারটি প্রধান সদ্গুণ : ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো চারটি প্রধান সদ্‌গুণের (Chief or Cardinal Virtues) কথা উল্লেখ করেছেন—বিজ্ঞতা (Wisdom), সাহসিকতা, (Courage), মিতাচার (Temperance), ন্যায়পরায়ণতা (Justice)। আত্মার প্রজ্ঞা অংশের সৎ গুণ হল বিজ্ঞতা, সাহস আত্মার শৌর্যাংশ, মিতাচার হল প্রজ্ঞার নিয়ন্ত্রণাধীনে আত্মার শৌর্যাংশ এবং ক্ষুধাংশের মিলনের ফলে উৎপন্ন সদ্‌গুণ। বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত (Conflict) যদি সৎভাবে কার্য করার ব্যর্থতার পক্ষে একটি কারণ হয়; সততার কাজ হবে এই সংঘাত দূর করা এবং যদি সততার জন্য বিজ্ঞতার অংশের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে বিজ্ঞতার বা বিচার-বুদ্ধিজনিত নিয়ন্ত্রণ (Rational control)-এর জন্য সততার প্রয়োজন সংঘাত দূর করা। আত্মার বিভিন্ন অংশ যথাযথ সঙ্গতি বজায় রেখে তাদের যথােচিত কার্য সমাধান করলে যে সদগুণ হয় তার নাম ন্যায়পরায়ণতা। ন্যায়পরায়ণতা আত্মার কল্যাণ সাধন করে। আর পক্ষপাতীত্ব (Injustice) আত্মার অকল্যাণ সাধন করে।

কল্যাণ ও সুখ ভিন্ন : প্লেটো কল্যাণকে সুখ এবং অকল্যাণকে দুঃখের সঙ্গে অভিন্ন বলে স্বীকার করতে চান না। অন্যায় ভােগ করার তুলনায় অন্যায় করা অধিক মন্দ, কেননা অন্যায় করা হল আত্মাকে অধঃপতিত করা এবং এটাই হল মানুষের জীবন সবচেয়ে বড় অকল্যাণ। অন্যায় করে শাস্তি না পেয়ে রেহাই পাওয়া খুবই খারাপ। শাস্তির ফলে মানুষের সংশােধন হতে পারে। তবে অন্যায় করে কেউ রেহাই পেতে পারে না। মৃত্যুর পরে হলেও তাকে অন্যায়ের শাস্তি ভােগ করতেই হবে। বন্ধুদের ভাল করতে হবে এবং শত্রুদের মন্দ করতে হবে এই নীতি প্লেটো স্বীকার করেন না। কারণ তার মতে শত্রুর মন্দ করা সকল সময়ই অকল্যাণকর কাজ।

ভালমানুষের পরিচয় : ভাল মানুষ বলতে প্লেটো কাকে বুঝেছেন? প্লেটো ভাল মানুষ বলতে বিচারককে বুঝিয়েছেন, আচরণের বিচারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হল বিশ্বাসযোগ্যতা। এই জাতীয় ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে একথা বলা যেতে পারে যে, যৌবনকালে কোন মন্দ বা অকল্যাণকর কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি তার চরিত্রকে কলঙ্কিত করেননি। এই জাতীয় ব্যক্তি নৈতিক মানদন্ডকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। সেই কারণেই তার বিচার হল নির্ভরযোগ্যতা। সকল রকম নৈতিক মূল্যায়নের প্রশ্নে তার বিচার গ্রহণযোগ্য। যাকে তিনি ভাল বলে বিচার করেন তাই ভাল। যাকে তিনি মন্দ বলে বিচার করেন তাই মন্দ। তার বিচার সাধারণ ব্যক্তির বিচারের মত খামখেয়ালির ব্যাপার নয়। সৎ নৈতিক চরিত্রের ব্যক্তি সব কিছুর পরিমাপ করতে পারেন। এই ধরনের ব্যক্তির উচিত-অনুচিতের ধারণা আছে। সাধারণ ব্যক্তির বিচার ক্ষমতা যেমন মন্দের সংস্পর্শে এসে কলুষিত হতে পারে, এ জাতীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে তেমনি ঘটে না। তার মধ্যে মানুষের প্রকৃতির সর্বোৎকৃষ্ট রূপটি পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া এক বিশেষ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি তার চরিত্রকে গঠন করে। প্লেটো নৈতিক বিচার সম্পর্কীয় বিভিন্ন প্রশ্নের আলোচনা করেছেন। প্রথমত, নৈতিক বিচার করার কর্তা কে? মানুষের আচরণ নীতিসম্মত বা নীতিবিগর্হিত হল, এই বিষয়টি বিচার করার উপযুক্ত ব্যক্তি কে? প্লেটোর মতে যদিও সাধারণ ব্যক্তি নৈতিক বিচার সম্পর্কীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে কোন না কোন ধরনের অভিমত দিতে সক্ষম, তবু প্রকৃত নৈতিক বিচারক (Moral Judge) হলেন দার্শনিক, বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রের অভিভাবক (Guardian)।

প্লেটোর সৌন্দর্যতত্ত্ব 

প্লেটো কি ললিতকলার সমঝদার ছিলেন? : কপলস্টোন প্লেটোর সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন। প্রশ্নটি হল, প্লেটো কি ললিতকলার একজন যথার্থ সমঝদার ছিলেন? এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কিত করেছেন, সেই আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নাট্যকার এবং মহাকবিদের তিনি নির্বাসিত করেছেন। কাজেই তিনি ললিতকলার সমঝদার ছিলেন এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না। কিন্তু এর উত্তরে বলা হয় যে, প্লেটো যে কবিদের আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করেছিলেন তার কারণ আধিবিদ্যক (Metaphysical) এবং সর্বোপরি নৈতিক। তার মতে, নাটক এবং মহাকাব্যের বিষয়বস্তু সত্যকে চিত্রিত করে না এবং নৈতিক দিক থেকে মানুষের মনের ওপর তাদের প্রভাব মন্দ তবে নাটক বা কাব্যের রস প্লেটো উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলেন না, এ ধরনের সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

প্লেটোর কাছে সত্যতার আদর্শই ছিল সবচেয়ে বড় আদর্শ : আসলে প্লেটো নাটক এবং কাব্যের রসের তুলনায়, তার, সত্যতার আদর্শ বিকৃত করছে কিনা, তারই গতি অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। প্লেটোর মতে, কাব্যের বিষয়বস্তু যদি হয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তুতি ও প্রশংসা, তাহলে সেই কাব্যের আদর্শ রাষ্ট্রে স্থান থাকা যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু কাব্যে যদি দেবতাদের মন্দ বা অকল্যাণকর হিসেবে চিত্রিত করা হয় তাহলে সেই কাব্যের আদর্শ রাষ্ট্রে কোন প্রবেশাধিকার স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে না। প্লেটোর বক্তব্য হল, কাব্যের সৌন্দর্য আমাদের যতই মুগ্ধ করুক না কেন, সত্যকে পরিহার করার প্রশ্ন কোনমতেই সমর্থন করা যেতে পারে না।

সৌন্দর্য বস্তুগত : প্লেটোর মতে সৌন্দর্য বস্তুগত (Objective), মনোগত নয়। হিপিয়াস ম্যায়িয়র (Hippias Maior) এবং সিম্পােসিয়াম (Simposium) এই দুই গ্রন্থে প্লেটোর সৌন্দর্য সম্পর্কীয় যে অভিমত লক্ষ করা যায় তা হল, সার্বিক সৌন্দর্য বা আদর্শ সৌন্দর্য সম্পর্কে। সৌন্দর্যে অংশগ্রহণ করার জন্যই সব সুন্দর জিনিস সুন্দর। সুতরাং সৌন্দর্য বাস্তব, অলীক কিছু নয়।

সৌন্দর্যের মাত্রাভেদ : উপরিউক্ত মতবাদ স্বীকার করে নিলে, তারই অনুসিন্ধান্ত হিসেবে সৌন্দর্যের মাত্রাভেদ স্বীকার করে নিতে হয়। কেননা যদি কোন বাস্তব আদর্শ সৌন্দর্যের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সুন্দর বস্তু কম-বেশি তার অংশীদার হবে। অর্থাৎ যে বস্তু সেই আদর্শ সৌন্দর্যের যত বেশি অংশীদার হবে সেই বস্তু তত সুন্দর হবে, যে কম সে কম সুন্দর হবে। প্লেটো হিপিয়াস ম্যায়িয়র গ্রন্থে সৌন্দর্য সম্বন্ধে আপেক্ষিকবাদ (Relativism) ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, সবচেয়ে সুন্দর বাঁদর একটি সুন্দর মানুষের তুলনায় কুৎসিৎ। আবার সুন্দরী নারী দেবতার তুলনায় কুৎসিৎ।

সৌন্দর্য সম্পর্কে আপেক্ষিকতাবাদ : আদর্শ সৌন্দর্য সম্পর্কে আপেক্ষিকতাবাদ প্রযোজ্য নয়। আদর্শ সৌন্দর্য হল নিত্য সুন্দর, তার পক্ষে সুন্দর এবং কুৎসিৎ দুটোই হওয়া সম্ভব নয়। আদর্শ সৌন্দর্য অংশত সুন্দর বা অংশত কুৎসিৎ নয়, বা কোন এক সময় সুন্দর, অন্য সময়ে কুৎসিৎ, তাও নয়। কোন কিছুর সম্পর্কে আদর্শ সৌন্দর্য সুন্দর, কিন্তু অন্য কোন কিছুর সম্পর্কে কুৎসিৎ, যা কারও দৃষ্টিতে সুন্দর এবং অপরের দৃষ্টিতে কুৎসিৎ, আদর্শ সৌন্দর্য সম্পর্কে এই জাতীয় কোন অভিমতই গ্রহণযোগ্য নয়। আদর্শ সৌন্দর্য নিত্য বা শাশ্বত সুন্দর। আদর্শ সৌন্দর্য আপেক্ষিক নয়, নিরপেক্ষ এবং সব সৌন্দর্যের উৎস হওয়াতে কোন সুন্দর বস্তু নয়। সেই কারণে আদর্শ সৌন্দর্য জড়াত্মক হতে পারে না। আদর্শ সৌন্দর্য হল অতীন্দ্রিয় এবং অজড়াত্মক। আদর্শ সৌন্দর্য যদি হয় অতীন্দ্রিয়, তাহলে সুন্দর ললিতকলা, সাহিত্য জড়াত্মক (Material) হওয়াতে, সৌন্দর্যের আদর্শের খুব নিম্ন স্তরে অবস্থিত। সুন্দর বস্তুর আবেদন মানুষের ইন্দ্রিয়ের কাছে, কিন্তু আদর্শ বা নিরপেক্ষ সৌন্দর্যের আবেদন মানুষের বুদ্ধির কাছে।

যা প্রয়োজন সাধন করে তা-ই সুন্দর : ‘হিপিয়াস ম্যায়িয়র’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যা প্রয়োজন সাধন করে, তা-ই সুন্দর, তাহলে প্রশ্ন দেখা দেবে যে, কি অর্থে আদর্শ সৌন্দর্যকে প্রয়োজন সাধক বলা হবে? আদর্শ সৌন্দর্য প্রয়োজনসাধক মেনে নেওয়াও কঠিন। আবার যা প্রয়োজন সাধন করে তাই যদি সুন্দর হয়, প্রশ্ন দেখা দেবে যে, কোন কিছু ভাল মন্দ যদি উভয় প্রকার প্রয়োজন সাধন করে, তবে তাকে কি সুন্দর বলা হবে? কিন্তু যা মন্দ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে তাকে নিশ্চয়ই সুন্দর বলা যেতে পারে না। আবার যা কল্যাণ বা ভাল উৎপাদন করে তাকে যদি সুন্দর বলতে হয় তাহলে কল্যাণকে সুন্দরের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা চলে না। কেননা কারণ কার্যের সঙ্গে অভিন্ন হতে পারে না। কিন্তু যা সুন্দর তা কল্যাণকর নয়, এই সিদ্ধান্ত যদি মেনে নেওয়া না যায় তাহলে এমন কথা বলা যেতে পারে কি যে, যা সুন্দর তা চক্ষু-কর্ণকে আনন্দ দেয়? কিন্তু আদর্শ সৌন্দর্য ইন্দ্রিয় যদি হয় অজড়াত্মক তাহলে সৌন্দর্যের এই জাতীয় সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য হয় না। প্লেটোর মতে, আদর্শ সৌন্দর্য ও আদর্শ কল্যাণ এক। একটিকে আর একটি থেকে পৃথক করা চলে না। সুন্দর বস্তু যেমন—সুন্দর আকৃতি, বর্ণ, শব্দ আমাদের আনন্দ দেয় তবে আদর্শ সৌন্দর্য সুখ দেয় না। প্লেটোর মতে, পরিমিত এবং সামঞ্জস্য সর্বক্ষেত্রে সৌন্দর্য এবং সততাতে রূপান্তর লাভ করে (Measure and symmetry everywhere pass into beauty and virtue)। এর অর্থ হল, পরিমিত ও সামঞ্জস্য-এর মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত। প্লেটোর ডায়ালগে তার সৌন্দর্য সম্পর্কীয় অভিমতগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখা যায় কিন্ত সৌন্দর্য সম্পর্কে তার বিভিন্ন মন্তব্যের মধ্যে যে তিনি সৌন্দর্য ও কল্যাণের অভিন্নতা স্বীকার করে নিয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত করা খুব অযৌক্তিক নয়।

ললিতকলা সম্বন্ধে প্লেটোর অভিমত

ললিতকলা সম্পর্কে প্লেটোর কোন সুসংগত মতবাদ নেই। ললিতকলা সম্পর্কে এখানে ওখানে তিনি যে সব অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে যেগুলো খুব গুরুত্বপুর্ণ সেগুলো আমরা এখানে আলোচনা করা যাক।

প্লেটোর মতে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় এবং মানুষের প্রকাশের এই স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই ললিতকলার জন্ম।

ললিতকলা হচ্ছে অনুকরণের অনুকরণ : অধিবিদ্যার দিক থেকে ললিতকলা হল প্লেটোর দৃষ্টিতে শুধুমাত্র অনুকরণ। ললিতকলা হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অনুকরণ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল ধারণার অনুকরণ; তাহলে ললিতকলা হচ্ছে অনুকরণের অনুকরণ। প্লেটোর মতে, আকারই সত্য। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আকারের অনুকরণ বলে আকারের মত সত্য নয়। আর ললিতকলা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অনুকরণ বলে সত্যতা থেকে অনেক দূরে সরে থাকবে। প্লেটোর কাছে সত্যতাই বড়, সেহেতু সাহিত্য, চিত্র বা ভাস্করের তৈরি মূর্তির সৌন্দর্য যতই তিনি অনুভব করুন না কেন ললিতকলাকে সত্যতার উর্ধ্বে কখনও স্থান দেননি।

চিত্রকরের চিত্রাঙ্কন নিছক বাস্তবের বাহ্য অনুকরণ : প্লেটোর এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পপষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে রিপাবলিক গ্রন্থে। ‘রিপাবলিক’-এ যে আদর্শ রাষ্ট্র চিহ্নিত হয়েছে সেখানে কবি ও চিত্রকরদের প্রতি তার মনোভাব থেকেই তার উপরিউক্ত দষ্টিভঙ্গির কথা জানা যায়। সময় সময় কবি, চিত্রকর সম্পর্কে তার মন্তব্য বেশ ব্যঙ্গাত্মক। কেননা তিনি বলেন, চিত্রকরের অনুকরণ ক্রিয়াও যথার্থ নয়। কেননা, যখন কোন চিত্রকর একটি শয্যার বা খাটের চিত্র অঙ্কিত করেন তখন তিনি সেটি সেই সময়ে যেভাবে তার ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থাপিত হয়, সেভাবে চিত্রিত করেন অর্থাৎ কিনা, একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেটিকে চিত্রিত করেন। কবিরা অনেক বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই সেগুলো কবিতায় বর্ণনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, কোন কবি হয়ত তাঁর কবিতায় যুদ্ধের কথা বর্ণনা করেছেন যদিও যুদ্ধের সঙ্গে তার কোন রকম পরিচয়ই নেই। কাজেই প্লেটোর সিদ্ধান্ত হল ‘অনুকরণমূলক ললিতকলা অবশ্যই সত্যতা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত থাকবে।’ এ হল যা বাস্তব তার দু’ধাপ নিচে থাকা, নিছক বাস্তবের বাহ্য অনুকরণ।

প্লেটোর অভিমতের সমালোচনা : প্লেটোর ললিতকলা সম্পর্কে উপরিউক্ত অভিমত আলোচনা করলেই বোঝা যাবে যে, ললিতকলা যে ব্যক্তির সৃজনীশক্তির প্রকাশ, তা প্লেটো মনে করেন না। নিঃসন্দেহে প্লেটোর এই অভিমত ভ্রান্ত। ললিতকলার উদ্দেশ্য যদি হয় নিছক অনুকরণ তাহলে যে কোন আলোকচিত্র (Photograph)-ই হবে সবচেয়ে নিখুঁত চিত্র কেননা এটি হল বস্তুর সবচেয়ে নিখুঁত অনুকরণ। যে বিষয়টি প্লেটোর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে তা হল, চিত্রকর বস্তুর অনুকরণ করে না, তাকে আদর্শস্বরূপ গণ্য করে। এর অর্থ হল, তাকে একটি ধারণা বা আকারের (Idea of Form) প্রকাশ রূপেই দেখেন। তিনি বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আবরণটিকে ভেদ করে যান এবং ধারণাকে প্রকাশ করেন।

ললিতকলা সম্পর্কীয় প্রতিভার মূল্যায়ন : এই প্রসঙ্গে ললিতকলা সম্পর্কীয় প্রতিভার মূল্যায়ন সম্পর্কে প্লেটোরও অভিমত লক্ষণীয়। চিত্রকর বা শিল্পী আবেগবশতই ক্রিয়া করেন, বিচারবুদ্ধিবশত নয়। কোন নিয়ম বা নীতি প্রয়োগ করে তিনি সুন্দরকে সৃষ্টি করেন না। কলা সৃষ্টির পরই সমালোচকবৃন্দ তার মধ্যে নিয়ম বা নীতি আবিষ্কার করেন। আসলে সমালোচকের আবিষ্কৃত নিয়মগুলো যে ভ্রান্ত তা নয়, তবে কলাবিদ সেগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা অজ্ঞাতসারেই অনুসরণ করেন। এই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগই হল কলাবিদের কাজের অন্তরালে প্রেরণা। প্লেটো কিন্তু এই প্রেরণার কোন উৎকর্ষ স্বীকার করতে নারাজ, বরং তাঁর দৃষ্টিতে এই ধরনের প্রেরণা যেহেতু বিচার বুদ্ধি-ভিত্তিক নয় সেহেতু হীন এবং ঘৃণ্য। তিনি এই ধরনের প্রেরণাকে ঐশ্বরিক উন্মাদনা (Divine Madness) বলে অভিহিত করেছেন; এই ধরনের প্রেরণা ঐশ্বরিক কেননা কলাবিদ সুন্দরের সৃষ্টি করেন কিন্তু এই প্রেরণা উন্মাদনার নামান্তর যেহেতু কলাবিদ নিজেই জানেন না, কিভাবে এবং কেন তিনি তা সৃষ্টি করেছেন। কবি অনেক সুন্দর জিনিসের বর্ণনা করেন। কিন্তু তিনি জানেন না কেন সেটি সুন্দর। তিনি অনুভব করেন কিন্তু কোন কিছু বোঝেন না। কাজেই তাঁর আবেগ বা প্রেরণা জ্ঞানের স্তরে অবস্থিত নয়, যথাযথ মত (Right Opinion) মাত্র। তিনি কোন কিছুকে সত্য বলে জানেন কিন্তু কেন, তা জানেন না।

ললিতকলা সম্পর্কীয় আধুনিক মতবাদ : ললিতকলা সম্পর্কে আধুনিক মতবাদ হল কলার জন্যই কলা (Art for arts sake)। অর্থাৎ কলা কোন উদ্দেশ্য লাভের জন্য উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হবে না, কলার উদ্দেশ্য কলার মধ্যেই নিহিত। সৌন্দর্যের নিজস্ব মূল্য আছে। কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ লাভের জন্য তা উপায় মাত্র নয়। ললিতকলা সম্পর্কে এই ধরনের মতবাদকে স্বীকৃতি জানানোর অর্থ হল যে, ললিতকলার যে নিজস্ব রাজ্য আছে, সেই রাজ্যে সে স্বাধীন। সে তার নিজের নিয়মের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। তাকে বিচার করতে গেলে তার নিজস্ব মানদণ্ডের সাহায্যেই বিচার করতে হবে। সৌন্দর্য-বহির্ভূত কোন নৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ললিতকলার বিচার গ্রাহ্য হবে না। সুন্দর কল্যাণকে লাভ করার কোন উপায় নয়, সুন্দর নিজেই উদ্দেশ্য বা লক্ষ।

প্লেটোর সমালোচনা : প্লেটো কিন্তু ললিতকলা সম্পর্কে উপরিউক্ত অভিমত স্বীকার করেন না। তার মতে, ললিতকলা নীতি (Morals) এবং দর্শনের অধীন। ললিতকলা যে নীতির অধীন, রিপাবলিক গ্রন্থেই আমরা তা দেখতে পাই। সেখানে যে কবিতা নীতিবিগর্হিত, তার কোন স্থান আদর্শ রাষ্ট্রে নেই। কবিতা সুন্দর হলেই চলবে না, তা যদি কোন নৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ না করে তাহলে আদর্শ রাষ্ট্রে তার প্রবেশাধিকার নেই। দর্শন হল লক্ষ, ললিতকলা হল সেই লক্ষ লাভের উপায়। সব জ্ঞানের লক্ষ হল ধারণার বা আকারের জ্ঞান (Knowledge of Ideas or Forms) এবং বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, ললিতকলা, প্লেটোর মতে শিক্ষাসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে উপরিউক্ত লক্ষ সিদ্ধ করার জন্য, তাদের নিজস্ব কোন মূল্য নেই। “রিপাবলিক” গ্রন্থ পাঠে এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে। ‘সিম্পােসিয়াম’ গ্রন্থেও দেখা যায় সুন্দরের প্রতি অনুরাগ হল ‘দর্শন’ (Philosophy) রূপ লক্ষ্যকে লাভ করার উপায়স্বরূপ।

ললিতকলা এবং সঙ্গীতের অস্তিত্বের সার্থকতা : ললিতকলা এবং সঙ্গীতের অস্তিত্বের সার্থকতা নিহিত রয়েছে তাদের আনন্দ বা সুখ প্রদান করাতে—এই লৌকিক মতবাদ প্লেটো মেনে নিতে চান না। কোন কিছু নিছক সুখ বিধান করে, এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় যখন সে কল্যাণ বা সত্যের অনুকরণ না হয়। কিন্তু কলা বা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সে-কথা বলা যেতে পারে না। উৎকৃষ্ট সঙ্গীত হল তাই যা কল্যাণ ও সত্যের অনুকরণ। অনুকরণের সত্যতা বলতে বোঝায় যে অনুকরণের সময় বস্তুটির গুণ ও পরিমাণকে যথাযথভাবে অনুকরণ করতে হবে। বিভিন্ন ললিতকলার রাষ্ট্রে স্থান হবে যদি তারা শিক্ষামূলক কার্য সম্পাদন করতে পারে। এই ক্রিয়া হল লাভজনক আনন্দ বিধান বা সুখ প্রদান। ‘লস’ গ্রন্থে প্লেটো ললিতকলার নির্দোষ আনন্দ বিধান-এর ক্রিয়াটিকে অস্বীকার করেননি সত্য, কিন্তু তিনি তার শিক্ষামূলক এবং নৈতিক ক্রিয়ার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ললিতকলা সুখ বা আনন্দ প্রদান করবে তবে সেই সুখ হবে লাভজনক সুখ।

‘লস’-এ ললিতকলার আলোচনা : রিপাবলিক গ্রন্থে প্লেটো ললিতকলার প্রতি যে মনভাব দেখিয়েছেন, লস্ গ্রন্থে তার মনোভাব, সেই-তুলনায় অনেক উদার কিন্তু প্লেটোর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির কোন পার্থক্য ঘটেনি। উভয় গ্রন্থেই রাষ্ট্রের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, ললিতকলায় তত্ত্বাবধান এবং তার অনুমােদনের জন্য সরকারি পরীক্ষার ব্যবস্থা অবশ্যই রাষ্ট্রে থাকতে হবে। সমালোচককে দেখতে হবে ললিতকলার ক্ষেত্রে অনুকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা, অনুকরণ সুন্দরভাবে করা হয়েছে কিনা। তিনি ললিতকলা যে বিষয়ের অনুকরণ তার পরিচয়ও জানবেন।

প্লেটোর কলা সম্পর্কীয় অভিমতের সমালোচনা : প্লেটোর কলা সম্পর্কীয় অভিমত সন্তোষজনক নয়। আবেগের উপরে বিচার-বুদ্ধিকে স্থান দিয়ে এবং কলার উপরে দর্শনের স্থান নির্দিষ্ট করে তিনি যুক্তিযুক্ত কাজই করেছেন। তবে ললিতকলার কাজ দর্শনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা, এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কলা যে নিজেই একটি লক্ষ বা উদ্দেশ্য, কোন লক্ষ লাভের উপায় মাত্র নয়, এই সত্য প্লেটোর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ললিতকলার প্রতি প্লেটোর অবিচার ও অ্যারিস্টটলের দর্শন আলোচনার সময় আমরা দেখতে পাই যে, প্লেটোর তুলনায় অ্যারিস্টটল ললিতকলার প্রতি অধিকতর সুবিচার করেছিলেন এবং তার প্রচারিত মতবাদ প্লেটোর মতবাদের তুলনায় অধিকতর সন্তোষজনক। কলার রাজ্য যে দর্শনের রাজ্যের তুলনায় একটি স্বতন্ত্র রাজ্য, অ্যারিস্টটল তা স্বীকার করেছিলেন এবং ললিতকলার নিজস্ব নীতি ও নিয়মের কথা তিনি স্বীকার করেছিলেন। প্লেটো ললিতকলাকে দর্শনের অধীনস্থ করাতে ললিতকলার নিজস্ব নিয়ম ও নীতি স্বীকার করে নিতে পারেননি এবং দর্শন ও ললিতকলাকে পরস্পরের থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারেননি। তার ফলেই ললিতকলার প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারেননি। তবে প্লেটো অ্যারিস্টটলের মত ললিতকলা বা আর্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও, আর্ট সম্পর্কে প্লেটোর কোন বিশেষ বক্তব্য ছিল না, এমন সিদ্ধান্ত করাও সমীচীন হবে না।

প্লেটোর দর্শনের সমালোচনামূলক বিচার

প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয় হল তার আকার বা ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ। তাঁর জগততত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব সবগুলোকেই তার আকার সম্পর্কীয় মতবাদ থেকে অবরোহের আকারে নিঃসৃত করা যেতে পারে। প্লেটো তার আকার সম্পৰ্কীয় মতবাদে ধারণার আধিবিদ্যক সত্তা (Metaphysical Reality) স্বীকার করে ভাববাদের গোড়া পত্তন করেছেন। প্লেটো-পরবর্তী যুগে বিভিন্ন ধরনের ভাববাদের উদ্ভব ঘটলেও, এইসব ধরনের ভাববাদের প্রবর্তক যে প্লেটো, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। অনেকেই মনে করেন যে, এই কারণেই দর্শনের ইতিহাসে প্লেটো একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছেন। এক্ষেত্রে স্টেইস্ বলেন, “পরমতত্ত্ব থেকে সার্বিক চিন্তন, জগতের দার্শনিক মননক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই হচ্ছে প্লেটোর অবদান – এই হল তার শ্রেষ্ঠ মূল্য।”

প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমাদের দুটি বিষয় দিকে লক্ষ রাখতে হবে – প্রথমত, প্লেটোর ধারণাতত্ত্ব বিশ্বজগতের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারে কিনা। দ্বিতীয়ত, প্লেটোর ধারণাতত্ত্ব নিজেকেই ব্যাখ্যা করতে পারে কিনা। প্লেটো ধারণা এবং বস্তুর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, বস্তু হল ধারণার নকল বা প্রতিলিপি, বস্তু ধারণায় অংশগ্রহণ করে। ধারণা বস্তুর মূল আদর্শ। ধারণা এবং বস্তুর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, প্লেটো যে সব কথা বলেছেন, সেগুলো হল রূপক মাত্র। তার দ্বারা ধারণার সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া যায় না। বস্তুকে ধারণার ‘নকল’ বলে স্বীকার করে নিলেও প্রশ্ন ওঠে, ওই নকল বা প্রতিলিপিগুলো কেন অস্তিত্বশীল হয় এবং কিভাবে অস্তিত্বশীল হয়। এদের অস্তিত্বশীল হবার হেতুটি ব্যাখ্যাত হওয়া দরকার। এই হেতুকে ধারণার প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত থাকতে হবে। ধারণার অতিবর্তী হলে চলবে না।

ধারণার প্রকৃতির মধ্যেই এমন কোন অন্তর অনিবার্যতা (Inner Necessity) থাকা দরকার, যার জন্য ধারণা বস্তুর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ কিনা, বস্তুর অস্তিত্বের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা ধারণা থেকে পেতে হবে। কিন্তু প্লেটোর ধারণার প্রকৃতির মধ্যে এই অনিবার্যতা নেই। ধারণাই হল একমাত্র সত্তা। মূর্ত বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবার জন্য তাদের মধ্যে কোন অনিবার্যতা নেই। শ্বেতত্বের ধারণা কেন শ্বেতবস্তু উৎপন্ন করবে? সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বের ব্যাখ্যার কোন সূত্র ধারণার মধ্যে নিহিত নেই। প্লেটো এই সমস্যার সমাধানের জন্য ঈশ্বরকে টেনে নিয়ে এলেন। ঈশ্বর এক অতিবর্তী সত্তা হিসেবে জড়কে বিন্যস্ত করে ধারণার প্রতিলিপিতে পরিণত করেন। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, ধারণার মধ্যে বস্তুর। ব্যাখ্যার হেতুটি নিহিত নেই। বস্তু ধারণার নিজস্ব প্রকৃতির দ্বারাই ব্যাখ্যাত হওয়া দরকার। কিন্তু প্লেটো তা করতে না পেরে ঈশ্বরকে টেনে নিয়ে এলেন। ঈশ্বরকে কল্যাণের ধারণা (idea of Good) রূপে অভিহিত করলেও সমস্যার সমাধান মেলে না। কেননা কল্যাণের ধারণা কিভাবে বস্তু উৎপন্ন করে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

প্লেটোর দর্শনে ধারণাই হল একমাত্র সত্তা। তাহলে জড় (Matter)-এর ধারণা বহির্ভূত ভিন্ন সত্তা স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে না। কিন্তু প্লেটোর দর্শনে জড়-এর ধারণা-বহির্ভূত স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু জড় স্বতঃউদ্ভূত, কাজেই জড়কে প্লেটো চরম অ-সত্তা হিসেবে অভিহিত করলেও, এর সত্তাকে অস্বীকার করা চলে না। এর ফলে প্লেটোর দর্শনে ধারণা এবং জড়, দুই ভিন্ন সত্তার স্বীকৃতিতে এবং উভয়ই স্ব-নির্ভর হওয়াতে, দ্বৈতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। প্লেটো ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির মধ্যে চিরন্তন ভেদ স্বীকার করার জন্য, ইন্দ্রিয়ের জগৎ এবং বুদ্ধির জগতের মধ্যে এ বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে প্লেটোর দর্শনে দ্বৈতবাদের উদ্ভব। কাজেই দেখা গেল যে প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ বস্তু-জগতকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

এবার দেখা যাক্, প্লেটোর ধারণাতত্ত্ব এমন একটি তত্ত্ব কিনা যা নিজেকে নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে? অথাৎ প্লেটোর ধারণাগুলো কি এমন যে, তাদের অস্বীকৃতির বিষয়টি আত্ম-বিরোধিতা দোষে দুষ্ট? প্লেটোর মতে, শ্বেতবস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে, কেননা শ্বেতত্ত্বের ধারণার (idea of whiteness) অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু শ্বেতত্ত্বের ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে কেন, তার কোন হেতু নেই। শ্বেতত্ত্বের ধারণার অস্বীকৃতি কোন আত্ম-বিরোধিতা দোষে দুষ্ট নয়। অন্যান্য ধারণা সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। প্লেটো অবশ্য বলেছেন যে, সব ধারণার হেতু হল কল্যাণের ধারণা। কিন্তু অন্যান্য ধারণা কল্যাণের ধারণা থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় না। তাছাড়া কল্যাণের ধারণাও যে একটি অনিবার্য ধারণা প্লেটো তা প্রমাণ করেননি। কাজেই প্লেটোর ধারণাতত্ত্ব নিজেকে নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

প্লেটোর দর্শনের আর একটি বড় রকম ত্রুটি হল সত্তা (Reality) এবং অস্তিত্ব (Existence), এই দুই-এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলা। প্লেটো ধারণাকে সার্বিক (Universal), বলে অভিহিত করেছেন কিন্তু এক নিজস্ব জগতে তারা বিশেষ বিশেষ বস্তুর মতই অস্তিত্বশীল বলে ধারণা করেছেন। ধারণার জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতিরিক্ত এক স্বতন্ত্র জগৎ, যার অস্তিত্ব আছে। এর ফলে সার্বিক (Universal)-হয়ে পড়েছে এক অস্তিত্বশীল বিশেষ (Particular)। প্লেটো চিন্তাকেই বস্তু বলে ধারণা করেছেন। এতে প্লেটোর ভাববাদের মর্যাদা বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। বিশেষ কোন অশ্বের অস্তিত্ব আছে, সত্তা (Reality) নেই। কিন্তু সার্বিক (Universal)-এর সত্তা আছে, অস্তিত্ব নেই। কিন্তু প্লেটো সার্বিক-এর অস্তিত্ব মেনে নিতে গিয়ে তাকে সাধারণ বস্তুর পর্যায়ে টেনে নিয়ে এলেন এবং তার ভাববাদের মহিমাকে বিশেষভাবে ক্ষুন্ন করলেন।

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের নানা দোষ-ত্রুটি আছে। সেই দোষ-ত্রুটি সংশােধন করে নেবার পরও কিছু বলার থাকে। প্লেটোর মতবাদের যারা বিরোধী তাদের মতে, যা অবশিষ্ট থাকে তা হল এই যে, আমরা শুধুমাত্র বিশিষ্ট নাম (Proper Names) দিয়ে তৈরি এমন ভাষার মারফত নিজেদের প্রকাশ করতে পারি না। ‘মানুষ’, ‘কুকুর’, ‘বিড়াল’ এই ধরনের সাধারণ শব্দ (General Words), আর এদের কথা বাদ দিলেও ‘সদৃশ’ (Similar), ‘পূর্বে’ এই জাতীয় সম্বন্ধসূচক শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজন রয়েছে। এই সব শব্দ শুধুমাত্র অর্থহীন ধ্বনি নয় জগৎ যদি শুধুমাত্র বিশেষ নামের দ্বারা নির্দেশিত বিশেষ বস্তু দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে এসব শব্দ কিভাবে অর্থবিশিষ্ট হতে পারে তা নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যুক্তির নানাভাবে মােকাবেলা করা যেতে পারে, তবে সার্বিক (Universal)-এর অনুকূলে যে একটা বক্তব্য খাড়া করা যেতে পারে তা অস্বীকার করা যায় না।

বাট্রান্ড রাসেল বলেন, প্লেটোর এই মতবাদকে সাময়িকভাবে কিছু মাত্রায় বৈধ বলে স্বীকার করে নিলেও, প্লেটো ধারণা সম্পর্কে অন্যান্য যা কিছু বলেছেন তা তাঁর মতবাদ থেকে কোন মতেই নিঃসৃত হয় না। যেমন প্লেটো মনে করেন যে, সার্বিক মানুষ হল ঈশ্বর-সৃষ্ট মানুষের নমুনার একটা নাম, বাস্তব মানুষ অসম্পূর্ণ এ কিছুটা অবাস্তব প্রতিলিপি। সার্বিক এবং বিশেষের মধ্যে ফাঁকটুকু যে কত বিরাট সেটা তিনি বুঝতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ধারণাগুলো (Ideas) বাস্তবিকপক্ষে অন্য কতকগুলো বিশেষ (Really just other particulars)-যা নৈতিক এবং সৌন্দর্যগত বিচারে সাধারণ বিশেষের থেকে শ্রেষ্ঠ। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, ‘পারমিনাইডিস’-এ এই অসুবিধার ব্যাপারটি প্লেটো বুঝে উঠতে পেরেছিলেন এবং ‘পারমিনাইডিস’ হল একজন দার্শনিকের আত্ম সমালোচনা।

প্লেটোর মনোবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং কলা সম্পর্কীয় বিষয়গুলো যখন আলোচনা করা হয়েছে তখন সেই বিষয়ের সমালোচনাও সেই আলোচনার শেষে যুক্ত করা হয়েছে। সেই কারণে এখানে প্লেটোর দর্শনের সমালোচনায় সেই সমালোচনার আর পুনরাবৃত্তি করা হল না।

জনৈক লেখক বলেন, “প্লেটো পাঠ করা শুধুমাত্র যে বিরাট সুখের ব্যাপার তা নয়, মহা আনন্দের ব্যাপার। তার চিন্তার অনুপম গভীরতার সঙ্গে তার চিন্তার বিন্যাসের অনুপম উৎকর্ষের নিপুণ সম্পর্ক এতই প্রশংসনীয় যে, তার গ্রন্থরাজি নিষ্ঠুর কালকে প্রতিরোধ করেছে, তারা বুড়িয়ে যায়নি। তারা সবসময়ই জীবন্ত, বহু যুগ পূর্বে যখন তারা রচিত হয়েছিল তখন যেমন জীবন্ত ছিল, আজও একই রকম জীবন্ত। প্লেটোর দর্শন পাঠ সর্বকালের ও সর্বযুগের আনন্দ পাঠ বলে উল্লেখ করা যায়।” (Alexandre Koyre: Discovering Plato; Page 1.)।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ১৮৪-২৮১

4 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. এপিকিউরীয় দর্শন – বিবর্তনপথ
  3. মঁতেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তা ও ক্ষমতাবিভাজন নীতি – বিবর্তনপথ
  4. এরিজেনা ও খ্রিস্টীয় মরমিবাদ – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.