মেরি ডগলাসের পৃথিবী: পবিত্রতা, বিপদ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নকশা

ভূমিকা

আচ্ছা, কখনো ভেবে দেখেছেন, জুতা জিনিসটা পায়ে থাকলে ঠিক আছে, কিন্তু খাবার টেবিলে রাখলে কেন সেটা ভয়ানক অশুদ্ধ, নোংরা হয়ে যায়? কিংবা ধরুন, থুতু মুখের ভেতরে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ঠিক আছে, যেই না সেটা বাইরে ফেললেন, অমনি তা চরম ঘৃণার বস্তু। কেন এমন হয়? জিনিস তো একই! এই সহজ, কিন্তু গভীর প্রশ্নগুলো নিয়েই নাড়াঘাটা করেছিলেন একজন অসাধারণ বিদুষী মহিলা, মেরি ডগলাস (Mary Douglas)। তার যুগান্তকারী বই, পিউরিটি অ্যান্ড ডেঞ্জার: অ্যান অ্যানালিসিস অফ কনসেপ্টস অফ পলিউশন অ্যান্ড ট্যাবু (Purity and Danger: An Analysis of Concepts of Pollution and Taboo) (Douglas, 1966), আমাদের এই ‘কেন’গুলোর উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং দৈনন্দিন জীবনের অনেক নিয়মকানুনের পেছনের যুক্তি বুঝতে এক নতুন চোখ খুলে দেয়।

চলুন, আজ আমরা মেরি ডগলাসের সেই আশ্চর্য জগতে একটু ঘুরে আসি। চেষ্টা করব যতটা সম্ভব সহজ করে তার ভাবনাগুলোকে বুঝতে। ভাবনার জগতে ডুব দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই, এই পথচলাটা কিন্তু সহজ নয়, একটু মন দিয়ে সঙ্গ দিতে হবে। মনে হতে পারে, কী সব কঠিন কঠিন কথা! কিন্তু একটু ধৈর্য ধরলে দেখবেন, চারপাশের অনেক কিছুই নতুন করে চোখে পড়ছে। যেন এতদিনের চেনা জগতের ওপর থেকে একটা পর্দা সরে যাচ্ছে!

‘নোংরা’ আসলে কী? সেই পুরনো ধাঁধা

আমাদের সবারই ‘নোংরা’ (Dirt) বা ‘অশুদ্ধি’ (Impurity) নিয়ে নিজস্ব ধারণা আছে। ঘরের কোণে ধুলো জমলে আমরা বলি নোংরা। বাসি খাবার নোংরা। জামায় কাদা লাগলে নোংরা। কিন্তু মেরি ডগলাস এসে প্রথম যে প্রশ্নটা তুললেন, তা হলো – এই নোংরা বা অশুদ্ধি জিনিসটা কি বস্তুটার নিজের ভেতরের কোনো গুণ? নাকি অন্য কিছু?

তিনি বললেন, ধুলো ততক্ষণ নোংরা নয়, যতক্ষণ তা মাটিতে আছে। যেই না সেটা ঘরের মেঝেতে বা বইয়ের পাতায় জমছে, অমনি তা ‘নোংরা’ হয়ে যাচ্ছে। কাদা মাঠে থাকলে স্বাভাবিক, কিন্তু ঝকঝকে পোশাকে লাগলেই তা ভীষণ আপত্তিকর। তার মানে, কোনো জিনিস নিজে থেকে ‘নোংরা’ নয়। তাহলে নোংরা কী?

এখানেই ডগলাসের সেই বিখ্যাত উক্তি: “Dirt essentially is matter out of place.” (Douglas, 1966, p. 36)। অর্থাৎ, ‘নোংরা মানে হলো সেই বস্তু যা তার নির্দিষ্ট জায়গায় নেই’। ভাবুন তো কথাটা! জুতা পায়ের জন্য, জুতার র‍্যাকের জন্য। তাকে যখন খাবার টেবিলে তোলা হয়, তখন সে তার নির্ধারিত জায়গা থেকে সরে যায়, তাই সে ‘নোংরা’। মুখের থুতু মুখের ভেতরেই থাকার কথা, বাইরে এলেই সে ‘স্থানচ্যুত’, তাই সে ঘৃণ্য।

এই ধারণাটা আপাতদৃষ্টিতে খুব সরল মনে হলেও এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। ডগলাস বোঝাতে চাইলেন, আমাদের ‘নোংরা’ বা ‘অশুদ্ধি’র ধারণা আসলে আপেক্ষিক (Relative)। এটা নির্ভর করে আমরা আমাদের জগতটাকে কীভাবে সাজিয়েছি, কোন জিনিসের জন্য কোন জায়গাটা নির্ধারণ করেছি, তার ওপর। অর্থাৎ, এটা কোনো পরম (Absolute) ব্যাপার নয়, বরং আমাদের তৈরি করা শৃঙ্খলা (Order) এবং শ্রেণীকরণের (Classification) সাথে জড়িত।

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে – বস্তু, প্রাণী, মানুষ, ঘটনা – সবকিছুকে আমরা মনে মনে বা সামাজিকভাবে কিছু ছকে ফেলি, ভাগ করি, সাজাই। এই সাজানো গোছানো ব্যবস্থাটাই আমাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘শুদ্ধ’ (Pure)। যখনই কোনো কিছু এই ছকের বাইরে চলে যায়, এই শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটায়, তখনই তাকে আমরা ‘বেমানান’, ‘অস্বাভাবিক’ এবং শেষ পর্যন্ত ‘নোংরা’ বা ‘অশুদ্ধ’ বলে দাগিয়ে দিই।

সুতরাং, পবিত্রতা (Purity) আর কিছুই নয়, এই শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা। আর বিপদ (Danger) বা দূষণ (Pollution) হলো সেইসব জিনিস বা অবস্থা যা এই শৃঙ্খলাকে ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয়। ব্যাপারটা অনেকটা লাইব্রেরির মতো। বইগুলো বিষয় অনুযায়ী ঠিকঠাক সাজানো থাকলে লাইব্রেরিটা ‘শুদ্ধ’ বা কাজের। কিন্তু যদি ইতিহাস বই কবিতার র‍্যাকে আর বিজ্ঞান বই গল্পের র‍্যাকে চলে যায়, তখন একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, বই খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে – এটাই যেন এক ধরনের ‘দূষণ’।

দেয়াল তোলা – শৃঙ্খলা ও শ্রেণীকরণের খেলা

মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশের জগতটাকে বোঝার চেষ্টা করি। এই বোঝার চেষ্টার একটা প্রধান উপায় হলো শ্রেণীকরণ (Classification)। আমরা গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষজন, এমনকি ধারণা বা সময়কেও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করি। যেমন: এটা জীব, এটা জড়; এটা পশু, এটা পাখি; ইনি আত্মীয়, উনি পর; এটা ভালো কাজ, ওটা মন্দ কাজ; এটা সকাল, ওটা রাত। এই ভাগাভাগি ছাড়া আমাদের পক্ষে চিন্তা করা বা যোগাযোগ করাই সম্ভব হতো না।

মেরি ডগলাস দেখালেন, এই শ্রেণীকরণের প্রবণতা শুধু ব্যক্তি মানুষের নয়, গোটা সমাজের। প্রতিটি সমাজই তার নিজের মতো করে একটা বিশ্ববীক্ষা (Worldview) তৈরি করে, যেখানে সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট স্থান ও অর্থ থাকে। এই শ্রেণীকরণ ব্যবস্থাটা সেই সমাজের সদস্যদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক মনে হয় যে তারা এটাকে প্রকৃতির নিয়ম বলেই ধরে নেয়।

এই সামাজিক শ্রেণীকরণ ব্যবস্থাটাকেই (Social Classification System) ডগলাস বলছেন সেই ‘কাঠামো’ (Structure) বা ‘নকশা’ (Pattern) যা ‘শুদ্ধতা’ বা ‘পবিত্রতা’র ধারণার জন্ম দেয়। যা কিছু এই কাঠামোর মধ্যে সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায়, যা কিছু এর নিয়মকানুন মেনে চলে, সেটাই ‘শুদ্ধ’ বা ‘পবিত্র’। এটা অনেকটা বাড়ির নকশার মতো। বাড়ির ভেতরে শোবার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম – সবকিছুর আলাদা জায়গা এবং কাজ আছে। সবকিছু ঠিকঠাক জায়গায় থাকলে বাড়িটা গোছানো, ‘শুদ্ধ’ মনে হয়।

ডগলাস যুক্তি দিলেন, আদিম সমাজগুলোর (যাদের আমরা অনেকসময় ভুল করে ‘সরল’ বা ‘অসভ্য’ ভাবি) বিভিন্ন পবিত্রতার নিয়মকানুন (Purity Rules) বা ট্যাবু (Taboo) আসলে তাদের এই বিশ্ববীক্ষা বা শ্রেণীকরণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার এক জটিল কিন্তু কার্যকর উপায়। এগুলো নিছক কুসংস্কার নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক প্রকৌশল (Social Engineering), যা তাদের জগৎটাকে সুশৃঙ্খল রাখে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বাইবেলের পুরাতন নিয়মের (Old Testament) লেভিটিকাস (Leviticus) বইয়ের খাদ্যসংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। কেন কিছু প্রাণীকে খাওয়া যাবে (শুদ্ধ বা Clean) আর কিছুকে খাওয়া যাবে না (অশুদ্ধ বা Unclean)? ডগলাস প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলো (যেমন: স্বাস্থ্যগত কারণ বা রূপক অর্থ) নাকচ করে দিয়ে বললেন, এর মূল কারণ হলো ওই প্রাণীগুলো তৎকালীন হিব্রু সমাজের শ্রেণীকরণ ব্যবস্থায় ঠিকমতো খাপ খায়নি।

তাদের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী, পৃথিবীতে বিচরণকারী চতুষ্পদ প্রাণীর আদর্শ রূপ হলো যার পা চেরা (Cloven Hoof) এবং যে জাবর কাটে (Chews the Cud)। গরু, ছাগল, ভেড়া এই শর্ত পূরণ করে, তাই তারা শুদ্ধ। শূকর পা চেরা কিন্তু জাবর কাটে না – সে এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়েও পুরোপুরি পড়ে না, সে একটা ব্যতিক্রম (Anomaly)। তাই সে অশুদ্ধ। একইভাবে, জলের প্রাণীর আদর্শ রূপ হলো যার পাখনা (Fins) ও আঁশ (Scales) আছে। মাছ এই শর্ত পূরণ করে, তাই সে শুদ্ধ। কিন্তু চিংড়ি বা কাঁকড়া বা ঝিনুকের মতো প্রাণীগুলো জলে বাস করলেও তাদের পাখনা বা আঁশ নেই, তারা এই ছকের বাইরে – তাই তারা অশুদ্ধ (Douglas, 1966, Chapter 3)।

এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে ডগলাস দেখালেন, পবিত্রতার নিয়মগুলো আসলে এই শ্রেণীকরণের সীমানাগুলোকে (Boundaries) স্পষ্ট করে তোলে এবং সেগুলোকে রক্ষা করে। যা কিছু এই সীমানার ভেতরে নিয়ম মেনে থাকে, তা পবিত্র। যা কিছু এই সীমানার বাইরে বা সীমানার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে (অর্থাৎ, অস্পষ্ট বা ব্যতিক্রমী), তা অশুদ্ধ এবং বিপজ্জনক।

বিপদের এলাকা – ব্যতিক্রম ও অস্পষ্টতার কাঁটা

যদি পবিত্রতা মানে হয় শৃঙ্খলা আর পরিষ্কার শ্রেণীকরণ, তাহলে বিপদটা কোথায়? বিপদটা হলো সেইসব জিনিসে বা অবস্থায় যা এই শ্রেণীকরণের ছকে ঠিকঠাক আঁটে না। মেরি ডগলাস এদের বলছেন ‘ব্যতিক্রম’ (Anomaly) বা ‘অস্পষ্ট’ (Ambiguous)।

ভাবুন তো, এমন কিছু যা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এটা কী? বা এটা কোন দলে পড়বে? যেমন, বাদুড় – সে কি পাখি না পশু? উড়তে পারে, কিন্তু পাখির মতো পালক নেই, দাঁত আছে, বাচ্চা দেয়। এই ধরনের অস্পষ্টতা আমাদের স্বাভাবিক শ্রেণীকরণের ছককে চ্যালেঞ্জ করে। ডগলাসের মতে, যা কিছু আমাদের চেনা ছকের মধ্যে পড়ে না, যা কিছু দুটো বা তার বেশি ক্যাটাগরির মাঝখানে ঝুলে থাকে, সেটাই বিপদজনক (Dangerous) এবং দূষণকারী (Polluting) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

কেন বিপদজনক? কারণ, এগুলো আমাদের জগৎটাকে বোঝার যে কাঠামো, সেই কাঠামোটাকেই নড়বড়ে করে দেয়। আমাদের নিশ্চিত ধারণার জগতে একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। সমাজ চায় তার তৈরি করা নিয়ম এবং বিভাজনগুলো যেন স্পষ্ট থাকে, কিন্তু এই ব্যতিক্রমী জিনিসগুলো সেই স্পষ্টতাকে ঘোলাটে করে তোলে। তাই সমাজ এগুলোকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে বা বিশেষ নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে।

ডগলাস লেভিটিকাসের খাদ্যতালিকার বাইরেও অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শারীরিক বর্জ্য (Bodily Waste) – মল, মূত্র, থুতু, রক্ত, বীর্য – এগুলোকে কেন অশুদ্ধ বা অপবিত্র মনে করা হয়? কারণ, এগুলো শরীরের ভেতরের জিনিস যখন বাইরের জগতে বেরিয়ে আসে, তখন তারা শরীরের সীমানা (Body Boundary) লঙ্ঘন করে। শরীর হলো আমাদের ব্যক্তিগত জগতের প্রতীক। যখন ভেতরের জিনিস বাইরে আসে, তখন সেই ব্যক্তিগত জগতের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, সীমানা অস্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে সেইসব বর্জ্য যা শরীরের ছিদ্রপথ (Orifices) দিয়ে নির্গত হয়, সেই ছিদ্রপথগুলো হলো শরীরের সীমানার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। তাই এই নির্গত বস্তুগুলোও বিশেষ মনোযোগ (এবং প্রায়শই নেতিবাচক মনোযোগ) আকর্ষণ করে (Douglas, 1966, Chapter 7)।

একইভাবে, মানুষের জীবনের কিছু অবস্থাকেও (Marginal States) অনেক সংস্কৃতিতে বিপজ্জনক বা অশুদ্ধ মনে করা হয়। যেমন, জন্ম, মৃত্যু, অসুস্থতা, রজঃস্বলা অবস্থা (Menstruation), দীক্ষা (Initiation)। কেন? কারণ, এই অবস্থাগুলোতে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক সামাজিক অবস্থানে থাকে না। সে যেন দুটো অবস্থার মাঝখানে ঝুলে থাকে – জীবনের সীমানায় (জন্ম, মৃত্যু), স্বাস্থ্যের সীমানায় (অসুস্থতা), লিঙ্গ বা বয়সের সীমানায় (রজঃস্বলা, দীক্ষা)। তারা যেন সমাজের স্বাভাবিক কাঠামোর মধ্যে একটা ‘ফাঁক’ বা ‘ছেদ’ তৈরি করে। এই ‘মাঝামাঝি’ বা ‘অস্পষ্ট’ অবস্থানটাই তাদের সাময়িকভাবে বিপজ্জনক বা অশুদ্ধ করে তোলে। তাই এই সময়গুলোতে তাদের জন্য বিশেষ নিয়মকানুন বা আচার-অনুষ্ঠান পালন করার বিধান থাকে, যাতে এই ‘বিপদ’কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং ব্যক্তি আবার সমাজের স্বাভাবিক কাঠামোতে ফিরে আসতে পারে।

সুতরাং, ডগলাসের তত্ত্ব অনুযায়ী, বিপদ বা অশুদ্ধির ভয় নিছক অপরিচ্ছন্নতার ভয় নয়, বরং এটা হলো অস্পষ্টতা, ব্যতিক্রম এবং বিশৃঙ্খলার ভয়। এটা হলো সেই ভয় যা আমাদের পরিচিত জগতের কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থেকে জন্মায়।

রীতি বা আচার-অনুষ্ঠান – জঞ্জাল সাফাইয়ের কৌশল

যদি ব্যতিক্রমী আর অস্পষ্ট জিনিসগুলো এতই বিপজ্জনক হয়, তাহলে সমাজ সেগুলো সামলায় কীভাবে? এখানেই আসে রীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের (Ritual) ভূমিকা। মেরি ডগলাস মনে করেন, আচার-অনুষ্ঠানগুলো হলো সমাজের সেইসব হাতিয়ার যা দিয়ে সে এই ‘বিপদ’কে নিয়ন্ত্রণ করে, ‘অশুদ্ধি’কে দূর করে এবং ভেঙে যাওয়া শৃঙ্খলাকে আবার জোড়া লাগায়।

যখন কোনো কিছু ‘স্থানচ্যুত’ (out of place) হয়ে যায়, যখন কোনো নিয়ম বা সীমানা লঙ্ঘিত হয়, তখন আচার-অনুষ্ঠানগুলো যেন এক ধরনের ‘সাফাই অভিযান’ চালায়। এগুলো শুধু বাহ্যিক ময়লা পরিষ্কার করে না, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণভাবে এগুলো ধারণাগত বা প্রতীকী জঞ্জাল (Conceptual or Symbolic Mess) পরিষ্কার করে।

ধরুন, হিন্দুধর্মে গঙ্গাস্নান বা বিভিন্ন শুচিকরণের (Purification) আচার। এগুলো আপাতদৃষ্টিতে শরীর পরিষ্কার করার উপায় মনে হলেও ডগলাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এগুলো আসলে প্রতীকীভাবে সেইসব ‘অশুদ্ধি’ দূর করে যা সামাজিক বা কসমিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের ফলে তৈরি হয়েছে। এগুলো যেন সেই লঙ্ঘিত সীমানাগুলোকে আবার মেরামত করে, ব্যক্তিকে বা সমাজকে তার ‘শুদ্ধ’ বা ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।

আবার ধরুন, মৃত্যুর পর অশৌচ পালন বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এগুলো একদিকে যেমন মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতির জন্য করা হয়, তেমনি অন্যদিকে এগুলো জীবিতদের সাহায্য করে মৃত্যুর মতো একটা বিরাট ব্যতিক্রমী এবং সীমানা লঙ্ঘনকারী ঘটনাকে সামাজিকভাবে হজম করতে। এই আচারগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মৃতের পরিবারকে সমাজের স্বাভাবিক কার্যকলাপ থেকে একটু দূরে রাখে (কারণ তারা এখন একটা ‘অস্পষ্ট’ বা ‘বিপজ্জনক’ দশায় আছে), এবং তারপর কিছু নির্দিষ্ট ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে তাদের আবার সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা আসলে মৃত্যুর ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক শূন্যতা এবং বিশৃঙ্খলাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার একটা উপায়।

ডগলাস আরও দেখিয়েছেন, কিছু আচার-অনুষ্ঠান আছে যেগুলো সরাসরি এই ‘বিপদ’ বা ‘অস্পষ্টতা’কেই ব্যবহার করে। কিছু সংস্কৃতিতে দেখা যায়, যারা সমাজের স্বাভাবিক কাঠামোর বাইরে (যেমন: সাধু, সন্ন্যাসী, শামান), বা যারা এই ‘অস্পষ্ট’ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে (যেমন: দীক্ষার্থী), তাদের বিশেষ ক্ষমতা (Power) আছে বলে মনে করা হয়। কারণ, তারা যেহেতু স্বাভাবিক কাঠামোর নিয়মকানুনের ঊর্ধ্বে বা বাইরে অবস্থান করে, তাই তাদের মধ্যে সেই কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করার বা তার ভেতরের গোপন শক্তিকে ব্যবহার করার ক্ষমতা জন্মায়। তাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলো তখন এই ‘বিপদজনক’ শক্তিকেই সমাজের ভালোর জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করে (Douglas, 1966, Chapter 6)।

সুতরাং, আচার-অনুষ্ঠানগুলো হলো সমাজের এক ধরনের ভাষা। এই ভাষার মাধ্যমে সমাজ তার সদস্যদের কাছে বার্তা পাঠায় – কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা পবিত্র, কোনটা অপবিত্র, কোনটা নিরাপদ, কোনটা বিপজ্জনক। এই আচারগুলো বারবার পালন করার মধ্যে দিয়ে সমাজের সেই মৌলিক শ্রেণীকরণ ব্যবস্থা এবং তার পেছনের বিশ্ববীক্ষা আরও শক্তিশালী হয়, আরও গভীর হয়। এগুলো শুধু পুরনো জঞ্জাল সাফ করে না, ভবিষ্যতের জন্যও সঠিক পথের দিশা দেয়।

শরীর যখন মানচিত্র – সমাজ আর দেহের আখ্যান

মেরি ডগলাসের কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শরীর (Body) এবং সমাজের (Society) মধ্যেকার গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরা। তিনি যুক্তি দেন, আমরা আমাদের শরীরকে যেভাবে দেখি, যেভাবে অনুভব করি, তার সীমানাগুলোকে (যেমন: ত্বক, ছিদ্রপথ) যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, তার সাথে আমরা আমাদের সমাজকে কীভাবে দেখি এবং তার সীমানাগুলোকে (যেমন: সামাজিক গোষ্ঠী, জাতি, দেশ) কীভাবে রক্ষা করতে চাই, তার একটা গভীর মিল আছে। তার কথায়, “The body is a model which can stand for any bounded system. Its boundaries can represent any boundaries which are threatened or precarious.” (Douglas, 1966, p. 115)। অর্থাৎ, শরীর হলো যেকোনো সীমাবদ্ধ ব্যবস্থার (bounded system) একটি মডেল বা প্রতিরূপ। এর সীমানাগুলো সেইসব সীমানার প্রতীক হতে পারে যেগুলো হুমকির মুখে বা নড়বড়ে অবস্থায় আছে।

এই ধারণাটিকে বলা হয় ‘শারীরিক প্রতীকীবাদ’ (Body Symbolism) বা ‘দুই শরীর তত্ত্ব’ (Two Bodies Thesis) – একটি হলো আমাদের ব্যক্তিগত, ভৌত শরীর (Physical Body), অন্যটি হলো সামাজিক শরীর (Social Body) বা সমাজ নিজেই। ডগলাস দেখালেন, একটি সমাজ তার নিজের গঠন, তার ভেতরের বিভাজন, তার বাইরের জগতের সাথে তার সম্পর্ক – এই সবকিছুকে বোঝার এবং প্রকাশ করার জন্য প্রায়শই মানব শরীরের রূপক ব্যবহার করে।

যে সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ (Social Control) খুব বেশি, যেখানে গোষ্ঠীর পরিচিতি (Group Identity) খুব শক্তিশালী এবং বাইরের জগতের সাথে সীমানা খুব কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়, সেইসব সমাজে দেখা যায় মানুষের ব্যক্তিগত শরীরের ওপরও অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। কী খাওয়া যাবে, কী যাবে না; কার সাথে যৌন সম্পর্ক করা যাবে, কার সাথে যাবে না; শরীরের কোন অংশ ঢেকে রাখতে হবে, কোনটা খোলা রাখা যাবে; শারীরিক বর্জ্য ত্যাগের নিয়মকানুন – এই সবকিছু খুব কঠোরভাবে পালন করা হয়। শরীরের ছিদ্রপথগুলো (Orifices) – মুখ, কান, নাক, যৌনাঙ্গ, পায়ু – এগুলোকে বিশেষভাবে পাহারা দেওয়া হয়, কারণ এগুলো হলো সেইসব পথ যা দিয়ে বাইরের ‘অশুদ্ধি’ বা ‘বিপদ’ শরীরের (এবং প্রতীকীভাবে সমাজের) ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, বা ভেতরের জিনিস বেরিয়ে গিয়ে সীমানা লঙ্ঘন করতে পারে (Douglas, [1970] 1996)।

অন্যদিকে, যে সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলকভাবে শিথিল, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা বেশি এবং সামাজিক সীমানাগুলো ততটা কঠোর নয়, সেখানে দেখা যায় ব্যক্তিগত শরীরের ওপর বিধিনিষেধও কম। সেখানে শারীরিক প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিয়মকানুনের বাড়াবাড়ি কম।

এই তত্ত্বের মাধ্যমে ডগলাস বোঝাতে চাইলেন, পবিত্রতা বা অশুদ্ধির নিয়মকানুনগুলো শুধু বিমূর্ত কোনো ধারণা নয়, এগুলো আমাদের শরীরী অভিজ্ঞতার (Bodily Experience) সাথে গভীরভাবে জড়িত। আমরা শরীরকে যেভাবে অনুভব করি, সমাজ সেই অনুভূতিকেই ব্যবহার করে তার নিজের নিয়মকানুন এবং মূল্যবোধগুলোকে আমাদের মনের গভীরে গেঁথে দেওয়ার জন্য। যখন আমরা কোনো ‘অশুদ্ধ’ জিনিস স্পর্শ করতে বা খেতে ভয় পাই, তখন আমরা আসলে শুধু সেই জিনিসটাকে ভয় পাই না, আমরা সেই প্রতীকী বিপদকেও ভয় পাই যা আমাদের সামাজিক শরীরের (Social Body) ঐক্য এবং শৃঙ্খলাকে নষ্ট করে দিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, বর্ণপ্রথা (Caste System) বা জাতিবিদ্বেষের (Racism) মতো ব্যবস্থায় দেখা যায়, তথাকথিত ‘নিচু জাত’ বা ‘ভিন্ন বর্ণের’ মানুষের স্পর্শ, তাদের ছায়া, এমনকি তাদের হাতের জল পর্যন্ত ‘অপবিত্র’ বা ‘দূষণকারী’ (Polluting) বলে মনে করা হয়। এখানে দেখা যায়, কীভাবে শারীরিক সংস্পর্শের ভয়কে ব্যবহার করে সামাজিক সীমানাগুলোকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। ‘অপর’ গোষ্ঠীর শরীরকে ‘অশুদ্ধ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে আসলে নিজের গোষ্ঠীর ‘পবিত্রতা’ বা শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। এখানে ব্যক্তিগত শরীর এবং সামাজিক শরীরের প্রতীকীবাদ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

আদিমতার বাইরে – আধুনিক জীবনে পবিত্রতা ও বিপদের ছায়া

মেরি ডগলাসের তত্ত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো, তিনি দেখিয়েছেন যে পবিত্রতা (Purity) এবং বিপদ (Danger) বা দূষণের (Pollution) ধারণাগুলো শুধু ‘আদিম’ বা ‘ধর্মীয়’ সমাজের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এগুলোর মূল যুক্তি বা কাঠামো (underlying logic or structure) আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) সমাজেও একইভাবে কাজ করে, যদিও তার প্রকাশভঙ্গি হয়তো ভিন্ন হয়।

আমরা হয়তো বাইবেলের খাদ্যতালিকা মানি না, বা মৃত্যুর পর অশৌচ পালন করি না, কিন্তু আমরাও প্রতিনিয়ত এক ধরনের ‘শুদ্ধি’ এবং ‘অশুদ্ধি’র ধারণার দ্বারা চালিত হই। ডগলাস বলছেন, আধুনিক সমাজে ‘স্বাস্থ্যবিধি’ (Hygiene) বা ‘পরিচ্ছন্নতা’র (Cleanliness) ওপর যে জোর দেওয়া হয়, তা অনেকক্ষেত্রেই প্রাচীন পবিত্রতার নিয়মকানুনের মতোই কাজ করে।

যেমন, খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। এটা নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যকর, জীবাণুনাশক। কিন্তু এর পেছনে কি শুধু জীবাণুর ভয়ই কাজ করে? নাকি এর সাথে আমাদের ‘নোংরা’ বা ‘স্থানচ্যুত বস্তু’কে (matter out of place) শরীর থেকে দূরে রাখার সেই পুরনো ধারণাও জড়িয়ে আছে? আমরা যখন বাইরের জগৎ থেকে ঘরে ফিরি, তখন বাইরের ‘নোংরা’ (ধুলো, জীবাণু, বা প্রতীকী অর্থে বাইরের জগতের বিশৃঙ্খলা) ঘরে বা শরীরে নিয়ে আসতে চাই না। হাত ধোয়াটা যেন সেই বাইরের জগতের সাথে একটা সীমানা টেনে দেওয়া।

একইভাবে ভাবুন, সামাজিক শিষ্টাচার (Social Etiquette) বা আদবকায়দার কথা। পাবলিক প্লেসে জোরে কথা বলা, নাক খোঁটা, বা খাওয়ার সময় শব্দ করা – এগুলোকে কেন ‘খারাপ’ বা ‘অসামাজিক’ মনে করা হয়? কারণ এগুলোও এক ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলা বা সীমানা লঙ্ঘন করে। এগুলো সেই ‘স্থানচ্যুত আচরণ’ (behavior out of place) যা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে নষ্ট করে, সামাজিক পরিমণ্ডলকে ‘দূষিত’ করে।

রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রেও এই ‘দূষণে’র ধারণা দেখা যায়। কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে যখন ‘ভাইরাস’, ‘ক্যান্সার’ বা ‘আবর্জনা’র সাথে তুলনা করা হয়, তখন আসলে তাকে প্রতীকীভাবে ‘দূষণকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, সে সমাজের ‘স্বাস্থ্য’ বা ‘শুদ্ধতা’র জন্য বিপজ্জনক এবং তাকে সমাজ থেকে ‘পরিষ্কার’ বা ‘নির্মূল’ করা দরকার।

পরিবেশ দূষণ (Environmental Pollution) নিয়ে আমাদের আজকের উদ্বেগও ডগলাসের তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা যখন কলকারখানার বর্জ্য বা প্লাস্টিককে ‘দূষণ’ বলি, তখন আমরা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে ভাবি না, আমরা এই ধারণাও প্রকাশ করি যে এই বস্তুগুলো তাদের ‘সঠিক’ জায়গায় নেই। তারা প্রকৃতির স্বাভাবিক শৃঙ্খলাকে নষ্ট করছে, আমাদের বসবাসের পৃথিবীকে ‘অশুদ্ধ’ করে তুলছে। এই বোধ আমাদের মধ্যে এক ধরনের নৈতিক উদ্বেগ (Moral Anxiety) তৈরি করে, যা প্রাচীন অশুদ্ধির ধারণার থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

এমনকি তথাকথিত ‘রাজনৈতিক শুদ্ধতা’ (Political Correctness) বা সংবেদনশীল ভাষা ব্যবহারের যে প্রবণতা, তার মধ্যেও এক ধরনের ‘শুদ্ধি’ বজায় রাখার চেষ্টা দেখা যায়। কিছু শব্দ বা বাক্যকে ‘দূষণকারী’ বা ‘আপত্তিকর’ মনে করা হয় কারণ সেগুলো সামাজিক সম্প্রীতি বা সম্মানের সীমানা লঙ্ঘন করে।

সুতরাং, মেরি ডগলাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, ‘পবিত্রতা’ ও ‘বিপদ’-এর ধারণাগুলো মানব সমাজের এক মৌলিক সাংগঠনিক নীতি (Fundamental Organizing Principle)। সমাজ বদলায়, ধর্মের প্রভাব কমে বা বাড়ে, কিন্তু এই নীতিগুলো নতুন নতুন রূপে প্রকাশ পেতেই থাকে। এগুলো আমাদের জগৎটাকে অর্থপূর্ণ এবং বাসযোগ্য রাখার এক নিরন্তর চেষ্টার অংশ।

তত্ত্বের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা – একটি মূল্যায়ন

মেরি ডগলাসের পিউরিটি অ্যান্ড ডেঞ্জার নিঃসন্দেহে নৃবিজ্ঞান (Anthropology) এবং সমাজবিজ্ঞানের (Sociology) জগতে এক মাইলফলক। এই বই প্রকাশের পর থেকে এটি অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা, গবেষণা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

শক্তি:

  1. মৌলিকত্ব ও অন্তর্দৃষ্টি: ‘Dirt as matter out of place’ – এই সরল কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টিটিই বইটির প্রধান শক্তি। এটি পবিত্রতা ও দূষণের মতো জটিল এবং প্রায়শই রহস্যময় ধারণাকে একটি যুক্তিসঙ্গত কাঠামোর মধ্যে এনেছে।

  2. সার্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতা: ডগলাসের তত্ত্ব শুধু কিছু সংস্কৃতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে এর মূল যুক্তিগুলো বিভিন্ন সমাজে, এমনকি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জগতেও খুঁজে পাওয়া যায়। এটি তত্ত্বটিকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী করে তুলেছে।

  3. আন্তঃশাস্ত্রীয় প্রভাব: এই বইয়ের প্রভাব শুধু নৃবিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম অধ্যয়ন (Religious Studies), ইতিহাস (History), সাহিত্য সমালোচনা (Literary Criticism), এমনকি ঝুঁকি অধ্যয়ন (Risk Studies) এবং পরিবেশ অধ্যয়নের (Environmental Studies) মতো ক্ষেত্রেও এর ধারণাগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে (Fardon, 1999)।

  4. কাঠামোগত বিশ্লেষণের শক্তি: ডগলাস দেখিয়েছেন কীভাবে সমাজের প্রতীকী ব্যবস্থা (Symbolic System) এবং সামাজিক কাঠামো (Social Structure) একে অপরের সাথে জড়িত। তার বিশ্লেষণ সাংস্কৃতিক নিয়মকানুনকে নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে একটি বৃহত্তর ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বুঝতে সাহায্য করে।

সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা:

  1. অতি-সরলীকরণ (Oversimplification): কিছু সমালোচক মনে করেন, ডগলাস বিভিন্ন সংস্কৃতির জটিল এবং বৈচিত্র্যময় পবিত্রতার নিয়মগুলোকে একটিমাত্র কাঠামোর (Dirt = Matter out of place) মধ্যে ফেলতে গিয়ে সেগুলোকে অতি-সরল করে ফেলেছেন। সব দূষণের ধারণাকে কি শুধু শ্রেণীকরণের সমস্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? (Kuper, 1973)

  2. ঐতিহাসিক ও পরিবর্তনশীলতার অভাব: ডগলাসের বিশ্লেষণ মূলত কাঠামোগত (Structuralist), যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক কাঠামো এবং প্রতীকী ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। কিন্তু এই নিয়মকানুনগুলো কীভাবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, বা কীভাবে মানুষ এই নিয়মগুলোকে ভাঙা বা পরিবর্তনের চেষ্টা করে (Agency), সেই দিকগুলো তার বিশ্লেষণে কিছুটা কম গুরুত্ব পেয়েছে।

  3. অনুভূতির ভূমিকা: ডগলাসের তত্ত্বে দূষণের ধারণার যুক্তিসঙ্গত বা জ্ঞানীয় (Cognitive) দিকটার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘৃণা (Disgust), ভয় (Fear) বা শ্রদ্ধার (Awe) মতো অনুভূতিগুলো (Emotions) যে এই ধারণার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই দিকটা কিছুটা কম আলোচিত হয়েছে। যদিও তিনি বিপদ বা ক্ষমতার ধারণার কথা বলেছেন, মূল জোরটা ছিল কাঠামোর ওপর।

  4. নির্দিষ্ট ব্যাখ্যার বিতর্ক: তার কিছু নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা, যেমন লেভিটিকাসের খাদ্য তালিকার বিশ্লেষণ, পরবর্তীকালে বাইবেল পণ্ডিত এবং নৃবিজ্ঞানীদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারা বিকল্প ব্যাখ্যার প্রস্তাব করেছেন।

তবে এই সমালোচনাগুলো সত্ত্বেও পিউরিটি অ্যান্ড ডেঞ্জার-এর মৌলিক গুরুত্ব এবং প্রভাব অনস্বীকার্য। এটি আমাদের চিন্তার জগতে এমন কিছু নতুন দরজা খুলে দিয়েছে যা আগে বন্ধ ছিল। এটি আমাদের শিখিয়েছে যে, দৈনন্দিন জীবনের আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ বা অযৌক্তিক মনে হওয়া অনেক নিয়মকানুন বা আচরণের পেছনেও গভীর সামাজিক যুক্তি এবং অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে।

উপসংহার: মেরি ডগলাসের আয়নায় আমাদের প্রতিবিম্ব

মেরি ডগলাসের পিউরিটি অ্যান্ড ডেঞ্জার পড়ার পর মনে হয়, যেন এতদিনের চেনা জগৎটাকেই নতুন করে দেখছি। জুতাটা খাবার টেবিলে রাখলে কেন অস্বস্তি হয়, বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত না ধুলে কেন নিজেকে ‘নোংরা’ লাগে, নির্দিষ্ট কিছু খাবার খেতে কেন মন চায় না, সামাজিক অনুষ্ঠানে কোন পোশাকটা পরা উচিত আর কোনটা নয় – এই সবকিছুর পেছনে যে একটা গভীর সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক নকশা কাজ করছে, তা ডগলাসের লেখা না পড়লে হয়তো সেভাবে ভাবাই হতো না।

তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, পবিত্রতা আর কিছুই নয়, এক ধরনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা। আর বিপদ হলো সেইসব জিনিস যা এই শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করে, আমাদের চেনা জগতের সীমানাগুলোকে অস্পষ্ট করে তোলে। এই শৃঙ্খলা আর অস্পষ্টতার দ্বন্দ্বই জন্ম দেয় নানা রকম নিয়মকানুন, ট্যাবু আর আচার-অনুষ্ঠানের। আর এই পুরো খেলাটাতেই আমাদের শরীর হয়ে ওঠে সমাজকে বোঝার এবং নিয়ন্ত্রণ করার এক শক্তিশালী প্রতীকী হাতিয়ার।

ডগলাসের কাজ আমাদের এটাও মনে করিয়ে দেয় যে, ‘পরিষ্কার’ বা ‘নোংরা’, ‘পবিত্র’ বা ‘অপবিত্র’ – এই ধারণাগুলো কখনোই নিরপেক্ষ বা সার্বজনীন নয়। এগুলো সবসময়ই কোনো না কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ফসল। যা এক সংস্কৃতিতে চরম অপবিত্র, তা অন্য সংস্কৃতিতে হয়তো খুবই স্বাভাবিক। যা এক সময়ে বিপজ্জনক মনে করা হতো, তা অন্য সময়ে হয়তো গুরুত্বহীন।

তাই, পরের বার যখন কোনো কিছুকে ‘নোংরা’ বা ‘অপবিত্র’ বলে মনে হবে, তখন শুধু নাক সিঁটকে সরে না গিয়ে একবার থমকে দাঁড়াবেন। নিজেকে প্রশ্ন করবেন – কেন এটা নোংরা? এটা কি সত্যিই বস্তুটার ভেতরের কোনো দোষ? নাকি এটা আমাদের মনে গেঁথে থাকা কোনো সামাজিক নকশা বা শ্রেণীকরণের ফল? মেরি ডগলাস হয়তো সরাসরি উত্তরটা দিয়ে যাবেন না, কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবেই আপনাকে ভাবনার একটা নতুন পথ দেখিয়ে দেবেন। আর সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেই দেখবেন, মানব সমাজ আর সংস্কৃতির এক আশ্চর্য জটিল কিন্তু আকর্ষণীয় জগৎ আপনার সামনে খুলে যাচ্ছে। এই জগৎটা বোঝার চেষ্টা করাটাও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়!

গ্রন্থপঞ্জি

  • Douglas, M. (1966). Purity and Danger: An Analysis of Concepts of Pollution and Taboo. Routledge & Kegan Paul.

  • Douglas, M. ([1970] 1996). Natural Symbols: Explorations in Cosmology. Routledge.

  • Fardon, R. (1999). Mary Douglas: An Intellectual Biography. Routledge.

  • Kuper, A. (1973). Anthropologists and Anthropology: The British School 1922–1972. Allen Lane.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.