ত্রিশবর্ষ যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) ও ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি সন্ধি

ভূমিকা ও প্রেক্ষিত

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপে ত্রিশবর্ষযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ত্রিশ বছর এ যুদ্ধ বিদ্যমান থাকায় ইতিহাসে একে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধ বলা হয়। ১৬১৮ সালে এ যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। জার্মানিতে বোহেমিয়া একটি স্থানীয় ধর্মযুদ্ধ হিসেবে এর শুরু হলেও কালক্রমে এর মধ্যে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের বিষয় ঢুকে একটি ইউরোপীয় যুদ্ধে পরিণত হয়। সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে এর বিস্তার ঘটেছিল। একটি ধর্মযুদ্ধ হিসেবে শুরু হলেও কালক্রমে বিভিন্ন পক্ষ ও দল এতে অংশগ্রহণ করলে এটি জটিল আকার ধারণ করে। ক্রমে ইউরোপের তৎকালীন অনেক জাতি রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে এ যুদ্ধে জড়িত হয়।

যুদ্ধের প্রেক্ষিত : মধ্যযুগে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য এবং রোমের ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ইউরোপে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঐক্য বজায় রেখে আসছিল। কালক্রমে ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্রে আবির্ভাব হলে শক্তিশালী রাজবংশ গড়ে ওঠে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব নিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপ-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে সম্রাট ও পোপ উভয়ের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি কমে আসতে থাকে। ইতোমধ্যে ইউরোপে রেনেসাঁস এবং ধনতন্ত্রের প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শ প্রসার ঘটলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মার্টিন ল্যুথার ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শোষণ ও অনাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করলে জার্মানিতে অনেক রাষ্ট্র ক্যাথলিক ধর্মে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ও পোপের কর্তৃত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। ক্রমে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ও পবিত্র রোমান সম্রাট প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে ধর্মনিপীড়ন গ্রহ করলে প্রোটেস্ট্যান্টরা আত্মরক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়। এদিকে জার্মানিতে সম্রাটের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের কারণ

ধর্মীয় কারণ : ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের অনেকগুলো কারণ ছিল এর মধ্যে ধর্মীয় কারণেই প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারিত হলে সেখানে ক্যাথলিক, ল্যুথারপন্থী, ও ক্যালভিনপন্থী এ তিনটি ধর্মগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। ১৫৫৫ সালে অগসবার্গের সন্ধিতে ধর্মীয় বিষয়ে ক্যাথলিক ও ল্যুথারবাদের মধ্যে আপস হলেও তা পুরোপুরি শান্তি আনয়ন করতে পারেনি। Ecclesiastical Reservation বা ধর্মীয় সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতির ফলে প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মের প্রসারে এক বাধা তৈরি করা হয়েছিল। ফলে তারা অগসবার্গের সন্ধিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন নি। এ ছাড়া রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম—এ নীতি জনগণের মনঃপুত হয়নি। এতে জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা উপেক্ষিত হয়েছিল। ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম বিশ্বাসীদের মনে অশান্তি ছিল। অগসবার্গের সন্ধিতে শুধু লুথারপন্থীদের আইনত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, এতে ক্যালভিনপন্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। জার্মানিতে ল্যুথারবাদ ও ক্যালভিনবাদের মধ্যে অনৈক্যের সুযোগে ক্যাথলিকরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সুযোগ পেয়েছিল। কাউন্টার রিফরমেশন বা প্রতিসংস্কার আন্দোলন শুরু হলে জেসুইটগণ জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্যাথলিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ (১৫৭৬-১৬১২) এ বিষয়ে জেসুইটদের উৎসাহ দিতে থাকে। এ অবস্থায় জার্মানিতে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। প্রোটেস্ট্যান্টরা আত্মরক্ষার্থে ১৬০৮ সালে একটি ইউনিয়ন গঠন করে, ক্যাথলিকগণও ১৬০৯ সালে অনুরূপ একটি হলি লীগ গঠন করে। ফলে সামরিক শক্তির মাধ্যমেই ধর্মীয় বিরোধ সমাধান হবে এমন ধারণা উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেয়। ক্যাথলিকরা বেভেরিয়ার ডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ানের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় এবং ল্যুথারপন্থী প্রোটেস্ট্যান্টরা প্যাল্যাটিনের ইলেক্টর ফ্রেডারিকের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলে এ দু পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

জাতীয়কারণ : অনেক ঐতিহাসিক ত্রিশবর্ষ যুদ্ধকে টিউটন ও ল্যাটিন জাতির মধ্যে একটি জাতিগত দ্বন্দ্ব হিসেবে বিচার করেন। এ ধর্মযুদ্ধে যেসব পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল তারা ছিল উত্তর জার্মান, রাষ্ট্রসমূহ সুইডেন, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। অন্যদিকে ক্যাথলিকদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল হ্যাপসবার্গ রাজ্যভুক্ত শাসক যথা : অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, স্পেন এবং দক্ষিণ জার্মান রাষ্ট্রসমূহ। জাতিগত দিক থেকে প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রগুলো ছিল টিউটোনিক জাতিভুক্ত রাষ্ট্র এবং ক্যাথলিক পক্ষভুক্ত দেশসমূহ ছিল ল্যাটিন জাতিভুক্ত। (জার্মানির ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ক্ষোভ বিদ্যমান ছিল। ১৬০৬ সালে এপ্রিলে ডোনওয়ার্থ ঘটনার মাধ্যমে এ চাপা উত্তেজনা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। ডোনওয়ার্থ শহরে প্রোটেস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে অবহেলা করে স্থানীয় মঠের অ্যাবট একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। ফলে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী ক্যাথলিকদের সাথে প্রোটেস্ট্যান্টদের সংঘর্ষ হয়। পৌরশাসককে (রাখেসফ্রাট) এ বিষয়টি জানানো হলে তিনি ডায়েটের অনুমোদন ছাড়া শহরটিকে সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার অধীনে আনেন। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার দায়িত্ব স্বাধীন সার্কেলের ডাইরেক্টর ওয়াটেমবুর্গের ডিউককে না দিয়ে ব্যাভেরিয়া সার্কেলে ডাইরেক্টর ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ানকে দেওয়া হয়। এতে প্রোটেস্ট্যান্টপন্থী নাগরিকরা বিক্ষুব্ধ হয়। শহর কাউন্সিলে ক্যাথলিকদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করা হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়। এবং শহরকে ব্যাভরীয় শাসনের অধীনে স্থাপন করা হয়। ফলে জার্মানির ল্যুথারপন্থী ও ক্যালভিনপন্থী ধর্মগোষ্ঠীর লোকেরা এর প্রতিবাদ করে। এ ঘটনার পরেই ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক সংঘ গড়ে তোলে। ১৬০৮ সালে প্যানাটিনির ইলেক্টর ফ্রেডারিকের নেতৃত্বে আহসানে অনুষ্ঠিত প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের এক সভায় প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়ন গঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল ক্যালভিনপন্থী প্রোটেস্ট্যান্টদের ১৫৫৫ সালে অর্গসবার্গের শান্তিচুক্তির আওতায় এনে সাধারণভাবে সকল প্রোটেস্ট্যান্টদের রক্ষা করা। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি প্রোটেস্ট্যান্টদের মদদ দিতেন। এর এক বছর পর ক্যাথলিকরা একটি পবিত্র সংঘ গঠন করে। এর নেতৃত্ব দেন ব্যাভিরিয়ার ডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ন ও তিনজন আর্চ বিশপ।)

রাজনৈতিক কারণ : ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পশ্চাৎ তৎকালীন জার্মানির রাজনৈতিক জটিলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর (১৫১৯-১৫৫৬) শাসনামলে জার্মানিতে ধর্মীয় অনৈক্য রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং হলি রোমান সাম্রাজ্যের ঐক্যে কুঠারাঘাত করে। পবিত্র রোমান সম্রাট এ বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেয়নি। পরবর্তী সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৫৫৬-১৫৬৪) জার্মানির ধর্মীয় বিবাদের সুযোগে জার্মানির উপর নিজ আধিপত্য সুদৃঢ় করতে পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। এমনকি ক্যাথলিক রাজারাও দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের আধিপত্য অগ্রাহ্য করে নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। এ রাজনৈতিক জটিলতায় ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।

জার্মানির রাজাদের কায়েমি স্বার্থের প্রভাব : জার্মানিতে ক্যাথলিক ধর্মের প্রসার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা রোমান সম্রাটের অধীনতা থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য ধর্মীয় সংঘর্ষকে ব্যবহার করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ বিশপরিকের রাজস্ব ভোগ করে কিছু প্রোটেস্ট্যান্ট শাসক একই সময়ে তাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রসার নিজেদের স্বার্থে কামনা করতেন। একই রকম উদ্দেশ্যে ক্যাথলিক শাসকদের কেউ কেউ প্ররোচিত করত। কিছু ক্যাথলিক রাজন্যবর্গ দু’মুখো নীতি অনুসরণ করতেন-(১) গির্জার সম্পত্তি দখল করে বিত্তশালী হওয়ার আশা করতেন। (২) ক্যাথলিক ধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে স্বর্গ প্রাপ্তির আশা করতেন। ব্যাভিরিয়ার ইলেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ন এরকম আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন ক্যাথলিক ধর্মের গোঁড়া সমর্থক। কিন্তু অপর দিকে পবিত্র রোমান সম্রাটের বিরোধী। এমনকি পোপ পঞ্চম পলেরও (১৬০৫-১৬২১) এমন নীতি ছিল, তিনি ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের প্রধান হয়েও সম্রাটের বিরুদ্ধাচারী ছিলেন। সম্রাটের সেকুলার উপদেষ্টাগণের মধ্যে ওয়ালেনস্টিন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতেন, যা একচেটিয়াভাবে ক্যাথলিক ছিল না। সম্রাট ও তার উপদেষ্টা শাসকগণ কর্তৃক দখলকৃত তার বংশের ঐতিহ্যগত ক্ষমতা পূর্ণ দাবি করতে আগ্রহী ছিলেন।

বিদ্রোহের আসন্ন কারণ – প্রাগের বিদ্রোহ : ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে আসন্নকারণ ছিল বোহেমিয়ার রাজধানী প্রাগের বিদ্রোহ। সম্রাট প্রথম ফার্দিনান্দ (১৫৫৬-১৫৬৪) ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক। বোহেমিয়ার বেশিরভাগ মানুষ ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী তাই তারা ক্যাথলিক ধর্মী সম্রাটকে অপছন্দ করত। ১৬০৯ সালে সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ (১৫৭৬-১৬১২) বোহেমীয় প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে লেটার অফ ম্যাজিস্ট্রি মঞ্জুর করেন। এটি ল্যুধারীয় প্রোটেস্ট্যান্টদের পূর্বে প্রদত্ত প্রকাশ্যে প্রার্থনা পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করেছিল। সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ-এর ভ্রাতা ম্যাথিয়াস (১৬১২-১৬১৯) ১৬১২ সালে সম্রাট নির্বাচিত হন। তার পক্ষে লেটার অব ম্যাজিস্ট্রি কার্যকর করা কঠিন ছিল। কারণ বোহেমিয়ার ক্যালভিনপন্থী ও বোহেমিয়া ব্রিদেনপন্থীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৬১৭ সালে সম্রাটের উত্তরাধিকারী অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্দিনান্দ বোহেমিয়ার বংশানুক্রমিক রাজা হন (যিনি পরে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৬১৯-১৬২৯) নাম নিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হন)। বোহেমিয়ার অভিজাতদের ডেকে ফার্দিনান্দকে ম্যাথিয়াস-এর উত্তরাধিকারী স্বীকার করতে বলা হয়। অভিজাতরা তা সমর্থন করে সিংহাসনে অভিষেকের সময় ফার্দিনান্দ লেটার অব ম্যাজিস্ট্রিকে বজায় রাখতে অঙ্গীকার করেন। কিন্তু ফার্দিনান্দ রাজসিংহাসনে বসলে বোহেমীয় প্রোটেস্ট্যান্টরা উপলব্ধি করে যে, তারা তাদের শত্রুকে রাজা হিসেবে মেনে নিয়ে ভুল করেছেন। এ ব্যাপারে প্রোটেস্ট্যান্ট অভিজাতরা একটি সভা ডেকে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্রাটকে একটি স্মারকলিপি দেয়। সম্রাটের উত্তর অসন্তোষজনক হওয়ায় অভিজাতদের নেতা হেনরি থার্ন ১৬১৮ সালের ২৩ মে প্রাগের রাজপ্রাসাদে ঢুকে রাজ্যের দুজন রিজেন্ট মার্টিনিজ ও স্লাভাকে ধরেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন এরা উপর্যুক্ত উত্তরের হোতা এবং তিনি তাদের সেক্রেটারি ফ্যাব্রিয়ারসহ তাদেরকে প্রাসাদের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। তারা ৫০ ফুট নিচে একটি পরিখায় পতিত হন। আহত হলেও সকলে বেঁচে গিয়েছিল। ফেলে দেওয়ার সময় একজন দর্শক চিৎকার করে বলেছিল তোমার মেরি পারলে তোমাকে রক্ষা করুন। পরে পরিখা থেকে ওঠার সময় মার্টিনিজ উচ্চস্বরে বলেছিল সৃষ্টিকর্তার নামে মেরি রক্ষা করতে পেরেছেন। এ নাটকীয় ঘটনার কারণেই বোহেমীয় বিদ্রোহ ও একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের সময়কে চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা :

  • (১) বোহেমিয়া প্যালাটিন পর্যায় (Bohemian Palatune Period), ১৬১৮–১৬২৩
  • (২) ডেনীয় পর্যায় (Danish Period), ১৬২৪-২৯
  • (৩) সুইডীয় পর্যায় (Swedish Period), ১৬৩০-৩৫
  • (৪) ফরাসি সুইডীয় পর্যায় (French Swedish Period), ১৬৩৫-১৬৪৮

রোহিমিয়া-প্যালাটিন পর্যায় (১৬১৮ – ১৬২৩)

বোহেমিয়ার প্রোটেস্ট্যান্টরা বিদ্রোহ শুরু করলে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৬১৯-১৬৩৭) বোহেমিয়ার বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্যাভিরিয়ার ইলেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ানের সাহায্য গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী প্রোটেস্ট্যান্টরা একটি বিদ্রোহী সরকার গঠন করে। তারা হেনরি অব থার্নকে বোহেমীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেন। বোহেমীয় থেকে জেসুইটদের বিতাড়িত করা হয়। হেনরি অব থার্ন দশ হাজার সেনা নিয়ে ভিয়েনা অভিমুখী হন। ১৬১৯ সালে মার্চ মাসে সম্রাট ম্যাথিয়াস (১৬১২-১৬১৯) মৃত্যুবরণ করলে আর্চডিউক ফার্দিনান্দ সম্রাট নির্বাচিত হওয়ার জন্য সমর্থন পাওয়ার সমস্যায় পড়েন। তিনি ধর্মযুদ্ধে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন না। প্রোটেস্ট্যান্ট অভিজাতরা বোহেমিয়া, মরেভিয়া, লুসাটিয়া, মাইলেসিয়া এবং উচ্চ ও নিম্ন অস্ট্রিয়ায় বিদ্রোহ করে। এ সময় ফার্দিনান্দ ক্যাথলিক অভিজাতদের সমর্থন লাভ করেন। ইতালিতে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিয়ে তিনি স্পেনের সামরিক সাহায্য লাভ করেন। এদিকে হেনরি অব থার্ন উপলব্ধি করেন যে ভিয়েনা অভিযানের জন্য তার এ সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট নয় এবং বোহেমিয়াতে প্রোটেস্ট্যান্টরা পরাজিত হয়েছে এ সংবাদ শুনে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এ পর্যায়ে ফার্দিনান্দ সম্রাট নির্বাচনের জন্য ফ্রাংকফোর্টে যান। এ সময় প্রোটেস্ট্যান্ট রাজারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে ফার্দিনান্দ সফল হতে পারতেন না। স্যাক্সনির ইলেক্টর ও ব্রান্ডেনবুর্গের ইলেক্টর গোঁড়া প্রোটেস্ট্যান্ট নীতি অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। প্যালাটিনের ইলেক্টর ফার্দিনান্দের বিরোধী পক্ষে থাকলেও দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ্স সম্রাট পদ লাভ করেন। সম্রাট নির্বাচন হওয়ার আগে ট্রানসিলভানিয়ার ক্যালভিনপন্থী অভিজাত প্রিন্স বেথলেন গাবোর বিদ্রোহ করেন এবং এতে অধিকাংশ হাঙ্গেরীয় অংশগ্রহণ করেন। এ সময় বোহেমিয়ার অভিজাতগণ প্যালাটিনেটের ইলেক্টর পঞ্চম ফ্রেডারিককে রাজা নির্বাচিত করে। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ড রাজা প্রথম জেমসের (১৬০৩-১৬২৫) জামাতা এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়নের নেতা। তিনি অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিলাসী না হলেও তিনি চরমপন্থী ক্যালতিনপন্থী নেতা প্রিন্স ক্রিশ্চিয়ান ভন আন হল্ট কর্তৃক প্রবোচিত হয়ে বোহেমিয়ার সিংহাসন দখল করেন। এর ফলে বোহেমীয় বিদ্রোহ একটি আন্তর্জাতিক সংঘাতে পরিণত হয়। ১৯১৯ সালে নভেম্বর মাসে বোহেমিয়ার রাজা হিসেবে পঞ্চম ফ্রেডারিকের অভিষেক হয়। কেবল প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়ন ভেনিস, নেদারল্যান্ড ও সুইডেন তাকে বোহেমিয়ার বাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বেথলেন গাবোর একাকী ১৬২০ সালে প্রথম দিক পর্যন্ত বোহেমিয়ার মিত্র হিসেবে সংগ্রাম চালিয়ে যান। এ সময় তিনি একটি যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করেন। সম্রাট তখন বোহেমিয়ার উপর সামরিক শক্তি প্রযোগ করেন। পোপ পঞ্চম পল (১৬০৫-১৬২১), জেনোয়া, স্পেন তাকে আর্থিক সাহায্য দেয়।

তিনি ক্যাথলিক লীগের সামরিক সাহায্য পান। তখন ক্যাথলিকের নেতা ছিলেন ব্যাভিরিয়ান ম্যাক্সিমিলিয়ান। এ সমর্থনের বিনিময়ে ফার্দিনান্দ তাকে ইলেক্টর পদবি দিতে অঙ্গিকার করেন। ফ্রেডারিক এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ফলে যেসব ভূখণ্ড ম্যাক্সিমিলিয়ানের অধিকারে আসবে সেগুলোও তাকে দিতে সম্রাট প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি স্যাক্সনির ল্যুথারপন্থী শাসক ইলেক্টর প্রথম জন জর্জ অতিরিক্ত ভূখণ্ড পাওয়ার লোভে সম্রাটকে সমর্থন দেন। ১৬২০ সালে এপ্রিলে সম্রাট একটি মেন্ডো ইস্যু করেন। এর দ্বারা ফ্রেডারিককে বোহেমিয়া ত্যাগ করতে বলা হয়। অন্যদিকে জুলাই মাসে কাউন্ট টিলি সম্রাটের সমর্থনে একটি বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে উচ্চ অস্ট্রিয়ায় উপস্থিত হন। এ সময় কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্রতার দ্বারা পথ প্রস্তুত না করে বোহেমিয়ার সিংহাসন গ্রহণ করা ফ্রেডারিক-এর চরম ভুল হয়েছিল। এমনকি তার শ্বশুর প্রথম জেমস তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেননি। ফ্রান্সের ত্রয়োদশ লুই (১৬১০-১৪৪৩) এর অভিভাবক মেরি ডি মেডিচি ফ্রেডারিক ও ফার্দিনান্দ-এর মধ্যে মধ্যস্থতা করার ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়নকে নিরপেক্ষ করা হয় এবং পরে ভেঙে দেওয়া হয়। কাজেই ফ্রেডারিক কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হন। তার দুর্বল নেতৃত্ব এবং ব্যয়বহুল প্রশাসনের জন্য এমনকি প্রাগে তিনি ও তার ইংরেজ সহধর্মিনী সাহায্য পাননি। ইতোমধ্যে আনহল্ট ও থার্নের অধিনায়কত্বে ফেডারিক-এর সেনাবাহিনী টিলির অধীনে সম্রাটের সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৬২০ সালে ৮ নভেম্বর হোয়াইট হিলের যুদ্ধে পরাজিত হয়। এক ঘণ্টার মতো সময়ের মধ্যে অতর্কিতে আক্রান্ত প্রোটেস্ট্যান্টরা কুমারী মেরির জন্য রণহুঙ্কার দেয়া ক্যাথলিকদের হিংস্র আক্রমণের মুখে অবসন্ন হয়ে পড়ে।

এ পরাজয় বোহেমিয়ায় ফ্রেডারিকের রাজত্বের অবসান ঘটায় এবং ব্যাভিরিয়ার ম্যাক্সিমিলিয়ান বিজয়ীর বেশে প্রাগে প্রবেশ করে। ১৬২১ সালে বসন্তকালের মধ্যে বোহেমিয়ার সর্বত্র বিদ্রোহ দমন করা হয়। একই সময় স্যাক্সনির ইলেক্টর সাইলেসীয় অভিজাতদের পরাজিত করেন ও লুথারীয় ভূখণ্ড দখলে আনেন। যুদ্ধের ব্যয় পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য সম্রাট উপযুক্ত ভূখণ্ড তার অধীনে রাখতে দেন। প্রোটেস্ট্যান্ট প্রতিরোধ ভেঙে যাবার পর বোহেমিয়ায় আরম্ভ হয় অত্যাচারমূলক ধর্মান্তরিতকরণ, নির্বাসন ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। বিদ্রোহীদের বিচার করার জন্য একটি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। তাদের অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সম্রাটের জন্য বোহেমিয়ার অর্ধেকেরও বেশি সম্পত্তি দখল করা হয়। এ সম্পত্তি সম্রাট তার সমর্থকদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং অর্থ লাভের জন্য স্বল্পমূল্যে এসকল জমি বিক্রয় করেছেন। এ সম্পত্তি হস্তান্তর থেকে তার রাজনৈতিক কর্মকর্তা ও সেনা নায়করা প্রভূত অর্থ লাভ করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধা লাভ করেন আলবার্ট ভোন ওয়াল্ডস্টিন তিনি প্রথমে বোহেমিয়ার ব্রিদেনপন্থী ছিলেন। কিন্তু পরে ক্যাথলিক ধর্মে পুনঃধর্মান্তরিত হন। বোহেমিয়াতে বিয়ের যৌতুকবাবদ অনেকে জমিদারি লাভ করেন। বোহেমিয়ায় সামরিক শক্তি ব্যবহার করে প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরকরণ করা হয়। এ কাজে জেসুইটরা বেশি ভূমিকা পালন করেছিল। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় জেসুইটদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়। ১৬২৪ সালের মধ্যে সকল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজককে বোহেমিয়া থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রোটেস্ট্যান্টরা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ১৬২৭ সালে একটি বিশেষ রিফরমেশান ট্রাইবুনাল গঠন করে ত্রিশ হাজারেরও অধিক সকল শ্রেণীর প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারকে বোহেমিয়া থেকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট তাদের সম্পদ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে স্যাক্সনিতে আশ্রয় নেয়। অনেক শহর স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত হয় এবং শহরগুলোর সম্পত্তি দখল করা হয়। চেক ভূম্যধিকারী অভিজাতরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভূম্যধিকারী শ্রেণি যারা সম্রাটের অনুগত ছিল তারা এ সকল ভূসম্পত্তি লাভ করে। বোহেমিয়ার রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। নতুন সংবিধান তৈরি করে বোহেমিয়ার নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে বোহেমিয়াকে একটি বংশানুক্রমিক রাজ্যে পরিণত করা হয়। বোহেমিয়ার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মরেভিয়াতেও বোহেমিয়ার অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়। উচ্চ ও নিম্ন লুসাটিয়া স্যাক্সনির ইলেক্টর দখল করে সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা মঞ্জুর করা হয়। হাঙ্গেরিতে ক্যাথলিকবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। উচ্চ অস্ট্রিয়াতে ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলে এই বিদ্রোহীদেরকে নির্বাসিত করা হয়। নিম্ন অস্ট্রিয়াতে অভিজাতরা তাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল রাখে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজক ও শিক্ষকদের বিতাড়িত করা হয়। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়কে জেসুইটদের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

হোয়াইট হিলে ফ্রেডারিকের সৈন্যবাহিনীর পরাজয় প্রোটেস্ট্যান্টদের সাময়িক পরাজয় হলেও যুদ্ধের শেষ হয়নি। হ্যাপসবার্গ পরিবারের সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের জয়লাভ ফ্রান্স ও সুইডেনকে ঈর্ষান্বিত করে। হ্যাপসবার্গ পরিবারের শক্তিবৃদ্ধি ফ্রান্সের কাম্য ছিল না। ফ্রান্স ও সুইডেন এ পর্যায়ে যুদ্ধে যোগদানের সুযোগ খুঁজতে থাকে। পোল্যান্ডের সাথে যুদ্ধের কারণে সুইডেন প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধে যোগদান করতে পারেনি। কিন্তু ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (১৫৮৮-১৬৪৮) জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগদান করলে ইংল্যান্ডের প্রথম চার্লস (১৬২৫-১৬৪৯) জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্টদের গোপনে অর্থ সাহায্য দিতে থাকে।

ডেনীয় পর্যায় (১৬২৪ – ১৬২৯)

ডেনমার্কের প্রোটেস্ট্যান্ট রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (১৫৮৮-১৬৪৮) সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৬১৯-১৬৩৭) ও ক্যাথলিক লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করেন। ফলে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস (১৬২৫-১৬৪৯) স্পেনীয় উপকূল আক্রমণ করার নিমিত্তে একটি ইংরেজ নৌবহর প্রেরণ ও ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানকে মাসে ত্রিশ হাজার পাউন্ড অর্থ সাহায্য দিতে রাজি হন। ১৬২৫ সালে ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রিশল্যু (১৬২৪-১৬৪২) গোপনে ডেনমার্কে সমর্থনের আশ্বাস দেয়। ফলে ত্রিশ বছর যুদ্ধের ইউরোপীয় সংস্করণ শুরু হয়। ক্যাথলিকদের সমর্থনে অস্ট্রিয়া ও স্পেন সৈন্য সমাবেশ করে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ডেনমার্ক যুদ্ধের সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সম্রাটের পক্ষে ওয়ালেনস্টিন ও অস্ট্রিয়ার সেনাপতি টিলি লুটারের যুদ্ধে ডেনমার্ককে পরাজিত করে। ওয়ালেনস্টিন ডেনমার্কের কিয়দংশ দখল করেন। কিন্তু ১৬২৯ সালে তিনি স্ট্রেলসান্ড নামক শহর অবরোধ করতে গিয়ে পরাজিত হন। ব্রিটিশ নৌবহর স্পেনীয় উপকূলে কার্ডিজ দখল করতে ব্যর্থ হয়। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডে রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানকে প্রতিশ্রুত অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ডেনমার্কের রাজা উত্তর জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের মধ্য থেকে মিত্র সংগ্রহ করতে পারেনি। কারণ উত্তর জার্মানিতে ডেনমার্কের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হোক তা প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা প্রত্যাশা করত না। ক্যাথলিক সেনাপতি টিলি নিম্ন স্যাক্সনির বহু অঞ্চল দখল করেন। ম্যানসফেন্ড ফরাসি মন্ত্রী বিশল্যুর সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ম্যাক্সিমিলিয়ন আশঙ্কাগ্রস্ত হন যে তার বিরুদ্ধে একটি নতুন কোয়ালিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। তাই তিনি সম্রাটকে একটি নতুন সেনাবাহিনী গঠন করতে অনুরোধ করেন। এ সময় ওয়ালেনস্টিন নিজ খরচে একটি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। সম্রাট প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাকে তার সব সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন। ওয়ালেনস্টিন ২০ হাজার সৈন্যের সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। এমন সেনাবাহিনীতে ইতালীয়, স্পেনীয় ও ফরাসি ক্যাথলিকদের সেনা অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সম্রাটের নির্দেশ না নিয়ে ওয়ালেনস্টিন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভিয়েনা থেকে পশ্চিমে যাত্রা করেন। যেসব জায়গা দিয়ে তিনি সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন সেসব অঞ্চল লুণ্ঠন করে সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ না করে তিনি মিত্র ও শত্রু উভয় শহর ও রাজ্যকে বড় অঙ্কের অনুদান দিতে বাধ্য করেন।

এ অর্থ তার অফিসার ও সেনাদের মধ্যে বিতরণ করা হত। ওয়ালেনস্টিন ১৬২৫ সালে নিম্ন স্যাক্সনিতে পৌঁছে শরৎকাল ও বর্ষাকাল অতিবাহিত করেন। এভা নদীর উপর ড্রেস সেতুর নিকট তিনি তার অবস্থান শক্তিশালী করেন। ডেনমার্কের রাজা ক্রিশ্চিয়ান অস্ট্রিয়ার সেনাপতি টিলিকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সে সময় ১৬২৫ সালে এপ্রিল মাসে ড্রেস সেতু অঞ্চলে ম্যান্সপিল ওয়ালেস্টিনকে আক্রমণ করে। কিন্তু ম্যান্সপিল পরাজিত হয়ে সকল সৈন্য নিয়ে পালিয়ে যান। এই আক্রমণ দ্বারা তিনি ওয়ালেস্টিনকে চিকিৎস্বার্থে মিলিত হতে বাধা দেন। ১৬২৬ সালে অগাস্ট মাসে ক্রিশ্চিয়ান টিলিকে আক্রমণ করে পরাজিত হন। এর ফলে সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ ও ম্যাক্সিমিলিয়ান অনেক অঞ্চল দখল করেন। টিলি ব্রান্সউইক দখল করেন ও ব্রান্ডেনবার্গে সৈন্য পাঠান। ওয়ালেনস্টিন সাইলেশিয়া দখল করেন। এরপর টিলি ও ওয়ালেনস্টনের সেনাবাহিনী যৌথভাবে শেজউইগ, হলস্টিন ও জুটল্যান্ড দখল করেন। ১৬২৮ সালে প্রথম দিকে ডেনমার্কের রাজাকে সাহায্যের জন্য মেকলেনবার্গ স্কিউয়ারিন ও মেকলেনবার্গ-স্ট্রেলিজের ডিউকদেরকে সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনে তাদের ভূখণ্ড দখল করতে ওয়ালেনস্টিনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে ডেনিস রাজ চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের সাথে ১৬২৯ সালে ল্যুবেকের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান ডেনমার্ক শেজুইক, হলস্কিন তার নিজ অধিকারে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু নিম্ন স্যাক্সনির বিশপ্রিকের উপর সব দাবি ত্যাগ করেন। তদুপরি তিনি সম্রাটের সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করেন এবং এডিক্ট অব রেস্টিটিউশন গ্রহণ করেন। এডিক্ট অব রেস্টিটিউশন দ্বারা অগসবার্গের সন্ধি হতে প্রোটেস্ট্যান্টগণ যেসব ক্যাথলিক গির্জার, জমি ইত্যাদি দখল করেছিলেন তা ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেন। এ আদেশ জারি হওয়ার ফলে ক্যালভিনপন্থী ও লুথারপন্থী সকল প্রোটেস্ট্যান্ট প্রমাদ গুনতে শুরু করে। তারা নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। অপরদিকে সম্রাটের সমর্থক ওয়ালেনস্টিনের অত্যাচারে জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক সকল রাজাই ওয়ালেনস্টিনের বিরোধী হয়ে ওঠে। ওয়ালেনস্টিন সম্রাট ফার্ডিনান্দের রেস্টিটিউশনের আদেশ সমর্থন করতেন না। এতে ক্যাথলিকগণ তার উপর বিরক্ত হয়। ফরাসি মন্ত্রী রিশল্যু ওয়ালেনস্টিনের পদত্যাগ দাবি করেন। এ অবস্থায় সম্রাট ওয়ালেনস্টিনকে পদচ্যুত করেন। ওয়ালেনস্টিনের পদচ্যুতির ফলে ক্যাথলিক ইউনিয়নের শক্তি অনেকটা ক্ষয় হয়। এই অবস্থায় সুইডেনের রাজা গুস্টাভাস এডোলফাস (১৬১১-১৬৩২) প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগদান করেন।

সুইডীয় পর্যায় (১৬৩০ – ১৬৩৫)

১৬৩০ সালের জুন মাসে ১৩ হাজার সৈন্য নিয়ে গুস্টাভাস এডোলফাস (১৬১১-১৬৩২) জার্মানিতে অবস্থিত হন। গুস্টাভাস এডোলফাস শুধু ধর্মীয় কারণে এ যুদ্ধে যোগদান করেননি। তার এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বাল্টিক উপসাগরে পোল্যান্ডরাজ তৃতীয় সিগিসমান্ডের (১৫৮৭-১৬৩২) সম্রাটের আধিপত্য ছিল। তিনি পূর্বে পোল্যান্ডকে পরাজিত করে বাল্টিক উপকূলে সুইডেনের প্রাধান্য স্থাপন করেছিলেন। এখন সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের (১৬১৯-১৬৩৭) প্রভাব ধ্বংস করার জন্য সম্রাটের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি জার্মানিতে পৌঁছলে অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট শাসক তার সাথে যোগদান করেন। অনেকেই তার আক্রমণের সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে তাকে সমর্থন করেননি। এজন্য স্যাক্সনির ইলেক্টর তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টর গুস্টাভাস-এর শ্যালক ছিলেন। তিনিও গুস্টাভাসকে দেশে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গুস্টাভাস তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তার সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে পোল, ডেন ও রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বহু অভিজ্ঞতা ছিল। ইতোমধ্যে ওয়ালেনস্টিনের পদচ্যুতি ও ক্যাথলিক লীগের সেনাপতি টিলির অধীনে সম্রাটের সেনাবাহিনীর পূর্ণ গঠনের জন্য ৬ মাস গুস্টাভাস কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হননি। ইতোমধ্যে ফরাসি মন্ত্রী রিশল্যু ১৮৩১ সালে জানুযারি মাসে ফার্দিনান্দের বিরুদ্ধে ৩৬ হাজার সৈন্য রাখার জন্য রিশল্যু গুস্টাভাসকে ৬ মাসের জন্য ৪০ হাজার ফ্রা দিতে অঙ্গীকার করেন। গুস্টাভাসের সাহায্যকারী নগর মেগডেবার্গ প্রথমে ক্যাথলিক সৈন্যবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ক্যাথলিক সৈন্যবাহিনীর পক্ষে প্রথমে জেনারেল পাপেম হিম ও পরে টিলি একে দখল করে অগ্নিসংযোগ করে। প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টিলি নগরকে ব্যবহার করতে পারেননি। ক্যাথলিক সৈন্যদের অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ প্রোটেস্ট্যান্টদের আশঙ্কাগ্রস্থ করে এবং সকলেই গুস্টাভাস-এর পতাকাতলে সমবেত হয়। ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টরসহ অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট গুস্টাভাসকে সমর্থন করে। বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সম্রাট ফার্দিনান্দ দাবি করেন যে স্যাক্সনির জন জর্জকে তার সেনাবাহিনী ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু জর্জ তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে সম্রাটের বাহিনী লিপজিক ও স্যাক্সনি লুণ্ঠন করে। এই অবস্থায় স্যাক্সনির জন জর্জ গুস্টাভাস এর সাথে এক চুক্তি করেন। চুক্তিমতো স্যাক্সন সেনাবাহিনী সুইডিশ সেনাবাহিনীর অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। ১৬৩১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্যাক্সন সুইডিশ যৌথবাহিনী টিলির অধিনে সম্রাটের সেনাবাহিনীর সাথে ব্রাইটেনফেন্ডের (Breitenfeld)-এর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিক পক্ষকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। ১৬৩২ সালের মে মাসে গুস্টাভাস মিউনিকে প্রবেশ করেন এবং প্রোটেস্ট্যান্ট বাহিনী ব্যাভেরিয়া লুণ্ঠন করে। বোহেমিয়ার রাজধানী প্রাগ ইলেক্টর জন জর্জের অধীনে আসে। ১৬৩২ সালে মিউনিকের নিকট সেনাপতি টিলি মারাত্মক আহত হন। এ সময় ফার্দিনান্দের অনুরোধে ওয়ালেনস্টিন ক্যাথলিক পক্ষে যোগদান করেন। ওয়ালেনস্টিন বোহেমিয়া থেকে স্যাক্সনি বাহিনীদের বিতাড়িত করেন। ম্যাক্সিমিলিয়ানের সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান করে তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের সঙ্গে বেশ কয়টি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ১৬৩২ সালের ১৬ নভেম্বর লুটেবেনের যুদ্ধে গুস্টাভাস ক্যাথলিক পক্ষকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন। কিন্তু এ সময় গুস্টাভাস মৃত্যুবরণ করেন। গুস্টাভাস এডোলফাস-এর মৃত্যুতে প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে। গুস্টাভাস-এর মৃত্যুর পর তার কন্যা ক্রিশ্চিনা (১৬৩২-১৬৫৪) সুইডেনের রানী হন, ও তিনি নাবালিকা থাকায় তার রিজেন্ট বা অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মন্ত্রী এক্সেল অক্সেনস্ট্রিয়ার্না। তিনিই প্রোটেস্ট্যান্ট-পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ সময় ওয়ালেনস্টিন গুপ্তঘাতকের খঞ্জরের আঘাতে নিহত হন। ১৬৩৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে সম্রাটের সেনাবাহিনী নর্ডলিজেনের যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের পরাজিত করে। এ পর্যায়ে দুই যুদ্ধে স্পষ্ট হয় যে, ক্যাথলিক সেনাবাহিনী প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত উত্তর জার্মানি দখল করতে পারবে না এবং প্রোটেস্ট্যান্টগণ ক্যাথলিক অধ্যুষিত দক্ষিণ জার্মানি অধিকার করতে পারবেনা। ফলে ১৬৩৫ সালে ৩০ মে প্রাগের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সুইডিশ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ফরাসি-সুইডীয় পর্যায় (১৬৩৫ – ১৬৪৮)

এ শান্তি চুক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান যুদ্ধের প্রতি অনিহা প্রকাশ করলেও সুইডেন ও ফ্রান্স যুদ্ধকে তাদের স্বার্থে চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধ ধর্মীয় যুদ্ধ থেকে রাজনৈতিক যুদ্ধে পরিণত হয়। নর্ডলিনজেনের পরাজয়ের পর প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষ দুর্বল হয়ে গেলে ফ্রান্সের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিফল হওয়ার উপক্রম হলে ফরাসি মন্ত্রী রিশল্যু প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দক্ষিণ জার্মানিতে সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের (১৬১৯-১৬৩৭) প্রাধান্য ফরাসি স্বার্থের প্রতিকূল ছিল। রিশল্যু ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী হয়েও প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগদান করেন। তিনি ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক স্বার্থকে অবহেলা করতে রাজি ছিলেন না। তিনি ফ্রান্সে ক্যাথলিক, কিন্তু জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট – এই নীতি গ্রহণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজপরিবারকে দুর্বল করা। কারণ ফ্রান্সে সীমান্তবর্তী চতুর্দিকে সকল স্থানই স্পেন ও অস্ট্রিয়ার অধীনে ছিল। স্পেন ও অস্ট্রিয়ার দুর্বলতার মধ্যে ফরাসি শক্তির উত্থান নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে ফ্রান্স ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে যোগদান করেছিল। ক্রমে এই যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ থেকে বুরবোঁ-হ্যাপসবার্গ রাজপরিবারে রাজদ্বন্দ্বে পরিণতি লাভ করে। যুদ্ধে প্রথমদিকে ক্যাথলিকদের বিজয় সম্ভাবনা সূচিত হলেও সুইডিশ সেনাপতি বেনার উইস্টকের যুদ্ধে (Battle of wittstock) সম্রাট দ্বতীয় ফার্দিনান্দের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। বারনার্ড নামক অপর এক সুইডিশ সেনাপতি পরপর কয়েকটি যুদ্ধে ক্যাথলিকদের পরাজিত করে আলসাম দখল করে। ফরাসি সেনাপতি টুরেন ও কন্ডি স্পেন ও অস্ট্রিয়ার সম্মিলিত ক্যাথলিক বাহিনীকে পরাজিত করে রাইন নদী উপকূল দখল করে। এই অবস্থায় যুদ্ধের ফলাফল যখন ফ্রান্স ও সুইডেনের অনুকূলে তখন ১৬৪২ সালে রিশল্যু মৃত্যুবরণ করেন। রিশল্যুর মৃত্যুর পর তার যোগ্য উত্তরসূরি সফলতার সঙ্গে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৬৪৩ সালে রকরয়ের (Battle of Rocroi) যুদ্ধে ফরাসি সেনাপতি কন্ডি স্পেনীয় সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী কন্ডিও টুরেনের নিকট পরাজিত হয়। ব্যাভেরিয়ার ডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ানও প্রোটেস্ট্যান্ট সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার নিরাপত্তা বিপন্ন হয়। ইতোমধ্যে ১৬৩৭ সালে সম্রাট দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র তৃতীয় ফার্দিনান্দ (১৬৩৭-১৬৫৭) সম্রাট পদ লাভ করেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় তৃতীয় ফার্দিনান্দ ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটান। স্পেন অবশ্য কোনো সন্ধি না করে পরবর্তী আরো এগার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অবশেষে ১৬৫৯ সালে পিরেনীজের সন্ধির মাধ্যমে ফ্রান্স ও স্পেনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপিত হয়।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের ফলাফল

জনসংখ্যার ক্ষতি : ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের ফলাফল ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে ধ্বংসাত্মক। এই যুদ্ধে সৈনিকদের অত্যাচার, ধর্মীয় উন্মত্ততা জার্মানির সমাজজীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। যুদ্ধ জার্মানিকে জনসংখ্যার ২৫-৪০% লোকের অন্তর্ধান ঘটিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের অবস্থাও ছিল খারাপ। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পাঁচ ষষ্ঠমাংশ গ্রাম ধ্বংস হয়েছিল। প্যালাটিনেট দু বছরে আটাশবার লুণ্ঠিত হয়েছিল। স্যাক্সনির জনসংখ্যা হ্রাস পেলে অনেক জমি পতিত হয়ে গিয়েছিল।

শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষতি : জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছিল। এর ফলে জনসাধারণের নৈতিক জীবনের অধঃপতন দেখা দিয়েছিল। শিক্ষার অভাবে কুসংস্কার দেখা দেয় এবং অনেক মানুষকেই বেআইনীভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এটি তৎকালীন জার্মান জনগণের নৈতিক অবক্ষয়ের নিদর্শন।

অর্থনৈতিক অবক্ষয় : জার্মানিতে বিশবর্ষ যুদ্ধ জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ব্যাপক খাদ্যাভাবে জার্মানির বহুস্থানের লোক সমাজকে অর্ধপশুতে পরিণত করেছিল। খাদ্যাভাবে মানুষ তৃণভোজী হতে বাধ্য হয়েছিল। উত্তর জার্মানির দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি একেবারে ধ্বংস হয়েছিল। জার্মানির শহরগুলোর সমৃদ্ধির অবনতি কৃষকদের অবস্থার অধোপতি বাণিজ্য ধ্বংস হয়েছিল। ১৫৮৫ সালে এন্টওয়ার্প-এ লুণ্ঠন, হেনলিয়াটীয় শহরসমূহের বাণিজ্যিক ক্ষতি এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। জার্মানির কৃষকরা সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্তও হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধি বিশেষ করে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে বড় বড় কৃষি খামারের জন্ম দেয় যা কৃষকদেরকে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে এবং খাজনা বৃদ্ধি করে। সম্ভবত যুদ্ধ এ পক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কারণ যুদ্ধ শস্য রিকুইজিশন ব্যবস্থা চালু করে যা পূর্বের সেনাবাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠনকে প্রতিস্থাপন করে। বৃহৎ ভূস্বামীর নীতি ও বিদেশী সৈন্যের লুটপাট উভয়ই কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে জার্মানিতে লুণ্ঠন ও ধ্বংস জনশূন্যকৃত পকেট সৃষ্টি করে ও জনগণকে গ্রাম থেকে শহরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।

নৈতিক অবক্ষয় : যুদ্ধের বস্তুগত ক্ষতির সাথে সাথে নৈতিক অবক্ষয় ত্বরান্বিত করেছিল। জার্মান জনগণ সাধারণত ভদ্র ও শালীন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তাদের আচরণ রুঢ় ও রুক্ষ হয়েছিল। রেনেসাঁসধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে জার্মানিরা বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ তাদের কুসংস্কার আচ্ছন্ন করে। যুদ্ধে অনেক মহিলা স্বামী ও সন্তান হারিয়ে ভারসাম্যহীন হলে তাদেরকে ডাইনি ভেবে আগুনে পুড়ে মারা হয়। যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক বেসামরিক জনগণের মধ্যে আন্তর্ভুক্তি জটিল ও কঠিন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পাশবিকতা ও নৃশংসতা একটি ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। উন্মত্ততা ও হিংস্রতা, জনশূন্যকরণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ পরস্পরবিরোধী সেনাবাহিনীর পশ্চাতে একটি নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জার্মান সাম্রাজ্য বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। জার্মানির জাতীয় ঐক্যসংহতি বিপন্ন হয়েছিল। পবিত্র রোমান সম্রাট নামে মাত্র জার্মানির শাসকদের পদে বহাল থাকলেন। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের ফলে জার্মানির রাজনৈতিক জীবনে দুর্যোগের যে ঘনঘটা নেমে এসেছিল তা অর্ধশতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল।

ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার উত্থানে ভূমিকা : এ যুদ্ধের পর ব্রান্ডেনবার্গ বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধার অধিকারী হয় এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড লাভ করে। ফলে এটি শীঘ্রই পরাক্রমশালী প্রাশিয়ারূপে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়। প্রাশিয়া ক্রমে অস্ট্রিয়াকে জার্মানি থেকে বহিষ্কার করে সমগ্র জার্মানিতে জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য আনয়ন করে।

সাংস্কৃতিক অবক্ষয় : পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মান সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইত্যাদিতে ইতালি ও ফ্রান্সের সমপর্যায়ে ছিল। কিন্তু শতধা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর হতে জার্মানির সৃজনি শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেয়েছিল।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুফল : ত্রিশবর্য যুদ্ধের ফলাফল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুফল নিয়ে এসেছিল। এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ধ্বংসলীলা, হত্যাযজ্ঞ ও দুঃখ-কষ্ট বিবাদ মেটানোর এ বর্বর পন্থার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিবেক জাগ্রত হয়েছিল। ১৬২৫ সালে হিউগো প্রোটিয়াস নামে একজন ওলন্দাজ আইনজ্ঞ এ নৃশংসতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহে কতগুলো মূলনীতি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ থেকেই তিনি de jure belli et pacis রচনা করেন। এ গ্রন্থে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকল্পে একটি আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টা করা হয়। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আচার আচরণে প্রক্রিয়া নির্ধারণ, রাষ্ট্রদূতদের অধিকার, ন্যায়সঙ্গতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধবন্দিদের প্রতি উপযুক্ত ব্যবহার সম্পর্কে নীতি চালু প্রবর্তন করা হয়।

হ্যাপসবার্গ রাজবংশের ক্ষমতা হ্রাস : ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের ফলে ইউরোপে অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশের প্রতিপত্তি ও রোমন সম্রাটের ক্ষমতা হ্রাস পায়। স্পেন তার ঐতিহ্য ও সামরিক দক্ষতা হারিয়ে ফেলে। ইউরোপে ফ্রান্স ও সুইডেন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি সন্ধি, ১৬৪৮

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৬৪০ – ৪১ সালে রেজেন্সবুর্গ ও হ্যামবুর্গে যুদ্ধরত দলসমূহের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ১৬৪৮ সালে ৮ আগস্ট ওয়েস্টফেলিয়ার ওসনাব্রুকে সুইডেন যুদ্ধে তার অংশ এবং ১৬৪৮ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ওয়েস্টফেলিয়ার মুনস্টারে ফ্রান্স তার অংশ শেষ না করা পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রাখে। ১৬৪৮ সালে হল্যান্ড স্পেনের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে। গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মে অস্বীকৃতি এবং যুদ্ধের পক্ষে তিক্ত প্রচারপত্র বিতরণ সত্ত্বেও উভয়পক্ষ সমঝোতার মনোবাসনা লাভ করে এবং ১৬৪৮ সালে ২৪ অক্টোবর ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির ধারাসমূহকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এ দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।

রাজনৈতিক ধারাসমূহ :

  • (১) বোহেমিয়ার সিংহাসনে হলি রোমান সম্রাটের অধিকার স্বীকৃত হয়। অস্ট্রিয়ার উত্তরাংশ বোহেমিয়ার সাথে একত্র করার অধিকার লাভ করেন। তিনি তার নিজ রাজ্যের অর্থাৎ যে সকল অংশ তিনি পৈত্রিক সম্পত্তির বা কোনো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সে সকল স্থানের উপর নিজ ইচ্ছামতো ধর্ম ব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বাধীনতা লাভ করেন।
  • (২) ব্যাভিরিয়ার ইলেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ান বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করার অধিকার লাভ করেন। তিনি ব্যাভিরিয়ার ডাচিতে উচ্চ প্যালাটিনেটের একাংশ রাজ্যভুক্ত করার অধিকার লাভ করেন।
  • (৩) প্যালাটিনেটের মূল ইলেক্টর ফ্রেডারিকের পুত্র চার্লস লুই-এর জন্য একটি নতুন ইলেক্টরেট (ক্ষুদ্র রাজ্য) সৃষ্টি করা হয় এবং নিম্ন প্যালাটিনেট তাকে পূর্ণ প্রত্যাবর্তন করা হয়। সুইডেন ওডার নদীর মোহনাসহ পশ্চিম পোমেরানিয়া, ব্রেমেন ও ভারডেন ইত্যাদি স্থান লাভ করে। এগুলো ছাড়াও সুইডেন স্টেটিন, উইজমার নামক শহর দুটি এবং ওলিন নামক দ্বীপ লাভ করে। জার্মানি থেকে সুইডেনের সৈন্য অপসারণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সুইডেনকে প্রচুর অর্থ দেওয়া হয়। সুইডেন জার্মান ডায়েটে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার লাভ করে।
  • (৪) ফ্রান্স, মেজ, টাউলন, ভার্দুন – এ তিনটি ধর্মাধিষ্ঠান লাভ করে। এগুলো ছাড়া বাইসাক, ময়েনতিক এবং পিনেরোলা নামক তিনটি দুর্গ ফিলিপসবার্গ নামক স্থানে সেনানিবাস স্থানের অধিকার এবং অস্ট্রিয়া আলসেস নামক স্থানের অধিকাংশ লাভ করে। এ ছাড়া অ্যালসেশিয়া নামক স্থানের হেগেনো, কোলমার, লেন্ডো, কাইসারবার্গ, মানস্টার ইত্যাদি দশটি শহর এবং সান্টগো নামক স্থান লাভ করে।
  • (৫) ব্রান্ডেনবার্গের অধীনে আসে কামিন, মিনডেন, ম্যাগডেরাণ, হলরাস্ট্যাডেট ও পূর্ব পোমেরেনিয়া। এগুলো ছাড়া ক্লিভেজ-মার্ক, রাভেন্সবার্গ নামক ডাচিদ্বয়ের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এই স্থানগুলো ১৬১৪ সালের জান্টেন নামক সন্ধির শর্ত অনুসারে ব্রান্ডেনবার্গকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় বিবাদমান স্পেনীয় ও ওলন্দাজ সেনাবাহিনী এগুলো দখল করে নিয়েছিল। এখন ব্রান্ডেনবার্গ এসকল স্থানের অধিকার লাভ করে।
  • (৬) স্যাক্সনি লুসেশিয়া ও ম্যাগাডেবার্গের একাংশে লাভ করে। এটি ম্যাগাডেবার্গের বিশপের জেলা লাভ করে।
  • (৭) হল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
  • (৮) জার্মানির রাজ্যগুলো পবিত্র রোমন সম্রাটের অধীনে থাকলেও তাদেরকে স্বাধীনভাবে অপরাপর শক্তির সাথে যোগাযোগ ও মিত্রতা স্থাপনের অধিকার দেওয়া হয়। তবে শর্ত করা হয় যে, এসব সন্ধি বা মিত্রতা যেন সম্রাটের স্বার্থবিরোধী না হয়। এ শর্ত ছাড়া সম্রাটের পক্ষে জার্মানির উপর কর স্থাপন করা, জার্মানি হতে সৈন্য সংগ্রহ করা, জার্মানির অভ্যন্তরে কোনো দুর্গ স্থাপন করা বা কোনো যুদ্ধ সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

ধর্মীয় ধারাসমূহ :

ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির ধর্মীয় ধারাগুলো জার্মানিতে ক্যাথলিক, লুথারপন্থী, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যালভিনপন্থীদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর প্রেক্ষিতেই –

  • (১) ১৫৫৫ সালের অগসবার্গের শান্তিচুক্তির সময় থেকে লুথারপন্থীরা যেসব সুযোগসুবিধা ভোগ করে আসছিল সেসব সুযোগ-সুবিধা ক্যালভিনপন্থীরাও ভোগ করার অধিকার লাভ করে।
  • (২) ১৬২৪ সালের প্রথম দিবসকে সূচনা দিবস ধরে তখন থেকে ধর্মীয় ভূ-সম্পত্তি সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ তারিখে যা কিছু ক্যাথলিকদের অধিকারে ছিল তা ক্যাথলিকদের অধীনে থাকবে এবং যা কিছু প্রোটেস্ট্যান্টদের হাতে ছিল তা প্রোটেস্ট্যানদের হাতে থাকবে। নির্ধারিত সীমারেখা বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়। এটি দক্ষিণ অঞ্চলের ধর্মীয় অঞ্চলের (বিশপরিক) ক্যাথলিকপন্থীদের জন্য সংরক্ষিত করে; ব্রেমেন, ভারডেন, হলবাস্টার্ড, ও ম্যাগডেবার্গ সেখানে প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তা প্রোটেস্ট্যান্টদের জন্য সংরক্ষিত করা হয় এবং এটি অস্ট্রিয়া, রোহিমিয়া, ব্যাভিরিয়া ও উচ্চ প্যালাটিনেটে প্রতিসংস্কার আন্দোনের সাফল্য ক্যাথলিকদের জন্য রেখে দেওয়া হয়।
  • (৩) ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তির ধারা রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম (cujus religio ejus reli glo) কে সম্মতি দেওয়া হয়।
  • (৪) পবিত্র রোমান সম্রাটের আদালতে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকপন্থীদের সমানসংখ্যক সদস্য রেখে উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়।

ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির গুরুত্ব ও সমালোচনা

ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধি ইউরোপের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল সূচনা করেছিল। ঐতিহাসিক J. E Swain বলেন, “The theaty of westphalia was the first major attempt to build up an international system based on the priciple of independent national soverignty. It ended the religious wars. ইউরোপের ইতিহাসে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি ইউরোপের ইতিহাসে ধর্মযুদ্ধে অবসান ঘটায় এবং ইউরোপীয় রাজনীতির ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধের অবসান ঘটায়।

  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ইউরোপের ইতিহাসে ধর্মসংস্কার আন্দোলন প্রসৃত বীভৎস ধর্মগ্রন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধির ফলে ১৫৫৫ সালে অগসবার্গের শান্তিচুক্তির দ্বারা তারা স্বীকৃত রাজ্যে জনগণের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার এখতিয়ার রাজ্যের শাসকের উপর অর্পণ করা হয়। ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে ক্যাথলিকবাদ ও প্রোটেস্ট্যান্টবাদের মধ্যে ভূখণ্ড সম্পর্কিত রেখা টেনে আন্তঃধর্মবিবাদ দূরীভূত করা হয়।
  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা নতুনভাবে নির্মাণ করে। এ সন্ধির দ্বারা জার্মানিতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙন ত্বরান্বিত করে। তখন পর্যন্ত পবিত্র রোমান সম্রাটের প্রশাসন ব্যবস্থা যেমন সম্রাট, ডায়েট, ইলেক্টরগণ আদালত ইত্যাদি অপরিবর্তিত থাকলেও জার্মানির শাসন শক্তি হিসেবে তাদের সকল কার্যকারিতা তিরোহিত হয়। জার্মান জনগণ জার্মান শাসক দ্বারা শাসিত হয়। এবং সম্রাটেরা সার্বভৌমত্ব অধিকার লাভ করে। জার্মান শাসকরা মুদ্রা উৎকীর্ণ করা, যুদ্ধ ঘোষণা, সেনাবাহিনী গঠন ও অন্যরা সবাই প্রতিনিধি পাঠাতে পারতেন।
  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি জার্মানিতে ব্রান্ডেনবার্গকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করেছেন। ব্রান্ডেনবার্গ পরবর্তীকালে প্রাশিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠশক্তিতে পরিণত হয়। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ইউরোপীয় রাজনীতিতে পোপের গুরুত্বকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি অনুমোদন না করায় কাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রসমূহ পোপকে বয়কট করে। ফলে তখন থেকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে পোপের প্রভাবের চির অবসান ঘটে।
  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ইউরোপে ফ্রান্স ও সুইডেনের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসে। শান্তিচুক্তি ফ্রান্সকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সুইডেন বান্টিক অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ফ্রান্স রাইন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরে ফ্রান্স তার প্রাকৃতিক সীমায় নিজের সীমান্ত সুরক্ষিত করার সুযোগ পায়। এর ফলে ফ্রান্স মেজ, ভজগিস, ব্রিসাচ ও ফিলিফসবার্গে আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক উভয় কৌশল ব্যবহারের সুযোগ পায়। সে আরো এলাকা দখলের সুযোগ পায়।
  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি রাজনীতি থেকে ধর্মের প্রভাবকে চিরবিদায় করে। এ সন্ধিতে ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে প্রভেদ দূর করে ক্যালভিনপন্থী ও ল্যুথারপন্থীগণকে সমপর্যায়ে স্থাপন করে ধর্মকে প্রত্যেক রাজার নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে ধর্মকে চিরবিদায় করতে সক্ষম হয়। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি আন্তর্জাতিক আইন কানুনের সৃষ্টির ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। পবিত্র রোমন সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে জার্মানির সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর এবং অন্যান্য দেশের বিরোধ মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে এ সময় থেকেই আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও রাজনীতির ক্রমবিকাশ আরম্ভ হয়।
  • ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর ইউরোপে রাজবংশের মর্যাদা বৃদ্ধি, বলপূর্বক নিজ রাজ্যসীমা বিস্তার এবং শক্তিসাম্য বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের প্রতিপত্তি ও মর্যাদা ধ্বংস করার জন্য ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
  • কূটনৈতিক ফলাফল : ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগের রীতিনীতি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে এক নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এ সময় প্রত্যেক দেশের স্থায়ী দূতাবাস এবং দূতাবাসের নিরপত্তা ইত্যাদি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনকানুন গড়ে ওঠে।
  • মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের প্রসার : ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্মের চাইতে মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংস্কৃতি হিসাবে মর্যাদা পায়। এ সব প্রভাবের ফলেই পরধর্মসহিষ্ণুতা মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়।

ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির সমালোচনা : ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধি ত্রিশবর্ষ যুদ্ধ প্রসূত সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের প্রতিক্রিয়া থেকে ইউরোপকে রক্ষা করলেও এর স্থায়ীভাবে বিরোধ দূর করতে পারেনি। রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম-এ নীতি বাস্তবায়ন করে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। এর ফলে যে কোনো দেশের রাজার পক্ষেই বলপূর্বক প্রজাদেরকে যে কোনো ধর্মমত পালনে বাধ্য করার অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। এতে ধর্মীয় নিপীড়নের ক্ষেত্র বহাল রাখা হয়েছিল। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে সাম্প্রদায়ীকতার বিষ চিরতরে ক্ষয় করার জন্য এ চুক্তিতে পরধর্মসহিষ্ণুতার কোনো ধারা যোগ করা হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এ সন্ধি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক আদর্শকে বিনষ্ট করেছিল যার ফলে জার্মানিতে তিনশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এতকাল যাবৎ যে ঐক্য অক্ষুণ্ণ ছিল তা বিনষ্ট হয়েছিল। যার ফলে পরবর্তী দুইশত বৎসর জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাইন অঞ্চলে ফ্রান্সের আধিপত্য স্থাপন ইউরোপে গোলযোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পরবর্তী সময় ইউরোপীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাইন অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির দ্বন্দ্ব। প্রবর্তীকালে ইউট্রেকটের সন্ধি, ভিয়েনা কংগ্রেস, প্যারিস ও বার্লিনে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছিল ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি থেকে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক সমস্যা।

পিরেনিজের সন্ধি, ১৬৫৯

স্পেন ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে আরো ১২ বছর সংঘর্ষ চলে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর ফ্রান্স স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্পেনীয় হ্যাপসবার্গ রাজবংশের শক্তি ক্ষয় করতে সমর্থ হয়। স্পেন নিরুপায় হয়ে ১৬৫৯ সালে ফ্রান্সের সাথে পিরেনিজের সন্ধি (Peace of Pyrenees) স্বাক্ষর করে। স্পেন পিরেনিজের সন্ধির দ্বারা আরটয়েস, রুসিলন, চেরডাগনি, থিওনভাইল, ল্যানড্রেসিস ও এডেসনিস শহরসমূহ লাভ করে। নান্সির আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা ধ্বংস ও ডাচির ভেতর দিয়ে ফরাসি সৈন্যবাহিনীর অবাধে যাতায়াতের শর্তসাপেক্ষে লোরেনের ডিউককে তার ডাচিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। স্পেনের চতুর্থ ফিলিপের (১৬২১-১৬৬৫) কন্যা মেরিয়া থেরেসা-এর সাথে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই-এর বিয়ের বন্দোবস্ত করে উভয় দেশের মিত্রতা সুদৃঢ় করা হয়। ৫ লক্ষ ক্রাউন যৌতুকের বিনিময়ে মেরিয়া থেরেসা স্পেনের সিংহাসনে তার ও তার সন্তানদের অধিকার পরিত্যাগ করে। অনেক ঐতিহাসিক পিরেনিজের সন্ধিকে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির বর্ধিত অংশ মনে করে। পিরেনিজের সন্ধি ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তিকে সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে ফ্রান্স তার প্রাকৃতিক সীমারেখা প্রাপ্ত হয়। দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব ও পূর্বে ফ্রান্স এমন একটি সীমান্ত পায় যা আত্মরক্ষা ও আক্রমণের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়েছিল। প্রাকৃতিক সীমারেখা লাভ করার ফলে ফ্রান্স পিরেনিজ, আল্পস ও ভজগিসের গিরিপথ দিয়ে অল্প সময়ের নোটিশে ফরাসি সৈন্য এব্রো, পোপ ও রাইন উপত্যকায় প্রবেশ করতে পারত। স্পেনের জন্য পিরেনিজের শান্তি চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। এ সন্ধির পর থেকে ফ্রান্সের সাথে স্পেনের সাবেক বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটে। এ চুক্তির পর ফ্রান্স ও স্পেন অতীতের ভয়ংকর শত্রুতা পরিহার করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। স্পেনের হ্যাপসবার্গ পরিবার ফ্রান্সের বুরবোঁদের আত্মীয়ে পরিণত হয়।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধোত্তর ইউরোপ

ত্রিশ বছর যুদ্ধের পর ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হলে অনেকগুলো রাজ্যের আবির্ভাব হয়, যেগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে বিরোধ দেখা দেয়। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ক্ষয় হলে শুধু অস্ট্রিয়ার রাজ্যসীমার মধ্যেই সম্রাট ও সাম্রাজ্যের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন শুধু মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে অনেকেই পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ লাভ করতে চাইতেন। জার্মানিতে আইনত পবিত্র রোমান সম্রাটের কর্তৃত্ব স্বীকৃত থাকলেও জার্মান শাসকরা সম্রাটকে গুরুত্ব দিত না। জার্মানিতে সম্রাটের এ দুর্বলতার কারণে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে কুক্ষিগত করে। ব্যাভিরিয়া ও ব্রান্ডেনবার্গ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো দখল করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ব্রান্ডেনবার্গ প্রাশিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাশিয়া জার্মানিতে আধিপত্য স্থাপনের জন্য অস্ট্রিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। জার্মান ডায়েটে, সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া সদস্যপদ লাভ করে। জার্মানিতে ফ্রান্স আলসেস, লোরেন্স প্রভৃতি অঞ্চল দখল করলে ক্রমে এসব অঞ্চল নিয়ে ভবিষ্যতে জার্মানি ও ফ্রান্সের বন্ধু দেখা দেয়। ইউরোপে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে জার্মানির জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। এর ফলে জার্মানির বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর উত্তর উইরোপে সুইডেন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বান্টিক সাগর অঞ্চল এবং জার্মানির উত্তরাংশ ওডার নদীর মোহনায় প্রাধান্য স্থাপন করে সুইডেন পরাক্রমশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ক্রমে প্রাশিয়া ও রাশিয়া প্রভৃতি উদীয়মান রাষ্ট্রের সঙ্গে সুইডেনের বিরোধ দেখা দেয়। রাশিয়া সুইডেনকে পরাজিত করে অনেক অঞ্চল নিজ রাজ্যভুক্ত করে।

ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর স্পেন দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ষোড়শ শতকে স্পেন ছিল ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী রাষ্ট্র। কিন্তু স্পেনের রাজাদের দুর্বল শাসন এবং ধর্মীয় অনুদারনীতি স্পেনের অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি করে। ফ্রান্স স্পেনের অভ্যন্তরীণ দুবর্লতার সুযোগ গ্রহণ করে স্পেনকে যুদ্ধে পরাভূত করে। স্পেন ফ্রান্সকে অনেক অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে পিরেনিজের সন্ধি স্বাক্ষর করে। এ সময় থেকে স্পেন আক্রমণাত্মক নীতি ত্যাগ করে আত্মরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করে। ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির শর্ত অনুসারে হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছিল। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর হল্যান্ড ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

হল্যান্ড উপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ক্রমে হল্যান্ড বাণিজ্য ও উপনিবেশিক কারণে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) হল্যান্ড দখল করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করলে হল্যান্ড ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠন করে ফ্রান্সের আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিরোধ করে। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর ইউরোপে হল্যান্ড একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়নি। এ সময় ইংল্যান্ড অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে বাস্তু ছিল। এ যুগে রাশিয়া ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়নি। তুরস্ক তার শক্তি পুনঃরুদ্ধারে সচেষ্ট ছিল। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর ইউরোপে পোপের মর্যাদা হ্রাস পায়। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে পোপ স্বাক্ষর করেনি। এজন্য ক্যাথলিক ও অক্যাথলিক রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ হয়েছিল। পূর্বে ইউরোপ বড় বড় শক্তিতে বা সন্ধিতে পোপের স্বাক্ষর থাকত। কিন্তু ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে ক্যাথলিকদের সমপর্যায়ভুক্ত করায় পোপ তাতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করে। ফলে এরপর থেকে ইউরোপের রাজনীতি থেকে পোপকে গুরুত্বহীন করা হয়। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে পোপের ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয়। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধের পর ইউরোপে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ক্ষয় হলে ফ্রান্স শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে ফ্রান্স অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে দুর্বল থাকলেও ক্রমে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি ও পিরেনিজের সন্ধির পর ইউরোপে শক্তিশালী দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। ফ্রান্স অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হিউগেনোদের দমন, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, অভিজাতদের দমন করে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ফ্রান্স শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়। সুদৃঢ় রাজ্য সীমা, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ফ্রান্সকে আত্মরক্ষা ও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করার সুবিধা এনে দেয়। ফ্রান্স পূর্বে রাইন নদী উত্তর পূর্বে নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত রাজ্যসীমা বিস্তারে সক্ষম হয়। সমর্থ ইউরোপে এ পর্যায়ে ফ্রান্সের ন্যায় শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল না।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৬৫-১৮১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.