চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) এর যুগ, স্পেনীয় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ ও ইউট্রেক্টের সন্ধি

প্রাথমিক জীবন ও নীতি

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা : চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। ১৬৩৮ সালে চতুর্দশ লুই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খুব অল্প বয়সে (৫ বছরেরও কম বয়স) ফ্রান্সের সিংহাসন লাভ করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দী ছিল ইউরোপে জ্ঞানদীপ্তির যুগ এবং সে যুগে প্রত্যেক যুবরাজকে সিংহাসনের যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য পরিবারে দক্ষ শিক্ষ নিযোগ করা হত। চতুর্দশ লুইয়ের বয়স যখন ৭ বছর তখন ফিলিপফটিন নামে এক শিক্ষককে চতুর্দশ লুইয়ের শিক্ষার জন্য নিয়োগ করা হয়। তার শিক্ষক চতুর্দশ লুইকে রাজতন্ত্র সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দেন। ফিলিপফটিন চতুর্দশ লুইয়ের জন্য রাজতন্ত্রের প্রশ্নোত্তর (Catechisme Royale) এবং শিশুদের প্রতি উপদেশ (Testament de conseils enfants) নামক গ্রন্থ লিখেছিলেন। ইতিহাস (History), ভূগোল (Geography), পৌরাণিক গ্রন্থাদি (Mithology), অলঙ্কার শাস্ত্র (Rhetoric) নীতিশাস্ত্র (Ethic), তর্কশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে চতুর্দশ লুইকে জ্ঞান দেওয়া হয়। তৎকালীন ল্যাটিন সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক পিরিফিক্সির নিকট ল্যাটিন ভাষা শিক্ষা করেন। চতুর্দশ লুই সমকালীন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকদের রচনা পাঠ করেছিলেন। এদের মধ্যে জুলিয়াস সিজারের কমেন্টারি (Caesr’s Commentaries) সার্ভেন্টিসের ডন কুইকজোট (Don Qurxote), স্ক্যারোনের রোমান কমিক ইত্যাদি গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছিলেন। উপযুক্ত শিক্ষকের প্রভাবে লুই রাজতন্ত্র সম্পর্কে উচ্চধারণা লাভ করেছিলেন। তিনি দৈবতন্ত্রের সমর্থক হিসেবে বলেছিলেন- “রাজারা পরম প্রভু, স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে তাদের প্রজাদের সমস্ত সম্পত্তির সম্পূর্ণ এবং মুক্ত নিষ্পত্তি রয়েছে, তারা চার্চম্যানই হোক বা সাধারণ মানুষই হোক।”

চতুর্দশ লুই যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তার নাবালক অবস্থায় কার্ডিনাল ম্যাজারিন (১৬৪২-১৬৬১) রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৬৬১ সালে ম্যাজারিনের মৃত্যু হলে চতুর্দশ লুই স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন এবং ১৭৫১ সালে মৃত্যু আগ পর্যন্ত স্বীয়হস্তে শাসন দণ্ড ধরে রেখেছিলেন। তিনি ফরাসি রাজতন্ত্রকে মহামান্বিত করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত প্রাধান্য ও প্রভাব সমসাময়িক ইউরোপে এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে ইউরোপের ইতিহাসে লুই রাজত্বকালকে লুইয়ের যুগ বলা হয় (Age of Louis)।

চতুর্দশ লুই-এর উদ্দেশ্য ও নীতি : ফরাসি রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ডের উপর রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপনই ছিল চতুর্দশ লুইয়ের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তার অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়েছিল। চতুর্দশ লুই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে মহামান্বিত করেন। রাজার দৈব ক্ষমতায় বিশ্বাসী লুই নিজকে মানবিক আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতেন এবং তিনি তার কার্যাবলির জন্য একমাত্র ঈশ্বরের নিকট দায়ী। রাষ্ট্রের সকল শাসনব্যবস্থা তার ইচ্ছায় পরিচালিত হত। তার কর্তৃত্বের উপরে কোনোরকম শাসনতান্ত্রিক বাধা বা কোনো মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। তার কোনো প্রধানমন্ত্রী ছিল না। মন্ত্রীগণ তার আজ্ঞাবহ কেরানি ব্যতীত আর কিছুই ছিলেন না। রাষ্ট্রের কার্যাবলিতে তিনি এত অধিক জড়িত হয়ে পেরেছিলেন যে, তিনি নিজে বলতেন আমি রাষ্ট্র (I arn the state)। (তিনি হয়তো এই সঠিক শব্দগুলি কখনও উচ্চারণ করেননি, তবে বিখ্যাত এপিগ্রামটি অন্তত তার রাজত্বের ধারণাগুলিকে নিখুঁতভাবে মূর্ত করে। তার নিজের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ঐশ্বরিক আদেশ দ্বারা ফরাসি জাতির একমাত্র আইনপ্রণেতা, বিচারক এবং নির্বাহী)।

চতুর্দশ লুই-এর পূর্বে রিশল্যু (১৬২৪-১৬৪২) রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছিলেন। এরপর রিশল্যুর যোগ্য উত্তরসূরি ম্যাজারিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাষ্ট্রের প্রশাসন, অর্থনীতি সবকিছুই শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উপযোগী করে ফ্রান্সে অভ্যন্তরীণ আমলাতন্ত্রকে রাজতন্ত্রে অনুগত করে রেখে গিয়েছিলেন। যার ফলে চতুর্দশ লুই-এর সময় ফরাসি রাজতন্ত্র ইউরোপে আদর্শস্থানীয় হয়ে ওঠেছিল।

চতুর্দশ লুই-এর আমলের শাসনপদ্ধতি

বুরবোঁঁ রাজা চতুর্থ হেনরির (১৫৮৯-১৬১০) মৃত্যুর পর ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের মর্যাদা বিলুপ্ত হয়েছিল। চতুর্থ হেনরির মৃত্যুর পর রাজা ত্রয়োদশ লুই (১৬১০-১৬৪৩) ও তার শাসনকালের প্রথম দিকে রিজেন্ট হিসেবে তার মা মেরি ডি মেডিচি অভিজাত শ্রেণী ও মন্ত্রীদের পরামর্শে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়ের (১৬৪৩-১৭১৫) রাজত্বকালে বুরবোঁ রাজতন্ত্র সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। চতুর্দশ লুই রাজদরবারের ঐশ্বর্যকে রাষ্ট্রীয় নীতির একটি প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত করেন। তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিজ হাতে পরিচালনা করতেন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল রাজসভা। রাজার মনোনীত ব্যক্তিগণ রাজসভার কর্মচারী নিযুক্ত করতেন। শাসন পরিচালনার জন্য রাজসভার চারটি পৃথক বিভাগ ছিল। যথা : (১) রাষ্ট্র পরিষদ (কাউন্সিল অব স্টেট); (২) ব্যবস্থা পরিষদ (কাউন্সিল অব ডেসপাস); (৩) অর্থনৈতিক পরিষদ (কাউন্সিল অব ফিন্যান্স); (৪) প্রিভি কাউন্সিল বা কাউন্সিল অব পার্টিস।

  • (১) রাষ্ট্র পরিষদ (কাউন্সিল অব স্টেট): রাজার বা রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্কিত বিশেষ ব্যাপারে রাষ্ট্র পরিষদ আইন প্রণয়ন করত। এই বিভাগের অপর একটি দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা। রাজা নিজেই এবং তার অনুপস্থিতিতে রাজার চ্যান্সেলর এই পরিষদের সভাপতিত্ব করতেন।
  • (২) ব্যবস্থা পরিষদ (কাউন্সিল অব ডেসপাস): সাধারণত আইন প্রণয়ন এবং শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রদেশের সহিত কেন্দ্রের যোগাযোগ রক্ষা করা এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল।
  • (৩) অর্থনৈতিক পরিষদ (কাউন্সিল অব ফিন্যান্স): রাষ্ট্রের রাজস্ব সংক্রান্ত সকল বিষয় কাউন্সিল অব ফিন্যান্স বা অর্থনৈতিক পরিষদ দেখাশোনা করত। কর ধার্য, রাজস্ব সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও বিভিন্ন বিভাগের বরাদ্দের দায়িত্ব এই বিভাগের উপর অর্পিত ছিল।
  • (৪) প্রিভি কাউন্সিল বা (কাউন্সিল অব পার্টিস): কাউন্সিল অব পার্টি বা প্রিভি কাউন্সিল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বিচারালয় ছিল। রাজা ছিলেন এই বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা বিচার বিভাগ রাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা : চতুর্দশ লুইয়ের সময় ফ্রান্স অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ইনটেনডেন্ট নামক কর্মচারী ছিল। তারা মূলত রাজপ্রতিনিধি হিসেবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। রাজার ইচ্ছা অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ পালন এবং কেন্দ্রীয় আদেশ বাস্তবায়ন কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা এ সকল কর্মচারীদের প্রধান দায়িত্ব ছিল।

রাজস্ব ব্যবস্থা : রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল বিভিন্ন রকম কর। এর মধ্যে (১) টেইলি, (২) গ্যাবেলা, (৩) পলেট, (৪) কর্ভি ইত্যাদি ছিল প্রধান। কর্ভি জনসাধারণের নিকট থেকে প্রত্যক্ষ কর হিসেবে আদায় করা হত। গ্যাবেলা ছিল লবণ কর, যা পরোক্ষভাবে লবণের উপর ধার্য করা হত। পলেট ছিল অভিজাতদের নিকট থেকে আদায়কৃত বংশানুক্রমিক কর। অভিজাতরা যে সকল সরকারি রাজপদ লাভ করেছিল তাদের মৃত্যুর পর তার সন্তানদের কেউ উক্তপদে মনোনীত হলে এই কর দিতে হত। কর্ভি এক ধরনের ভ্রান্তমূলক শ্রমকর যা কৃষকদের নিকট থেকে সরকারি রাস্তা, পুল ইত্যাদি নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য আদায় করা হত। এ কাজের জন্য কৃষকদের কোনো মজুরি দিতে হত না এটি আমাদের দেশের বেগার খাটার অনুরূপ। এ ছাড়াও রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তির খাজনা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হতে প্রদত্ত আয়, সরকারি পদ বিক্রি করেও প্রচুর রাজস্ব সংগৃহিত হত।

আইন ও বিচার : চতুর্দশ লুইয়ের সময়কালে রাজসভায় আইন প্রণয়ন হত। ১৬১৪ সালে থেকে ফ্রান্সের আইন পরিষদ স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছিল। ফলে রাজসভায় রাজাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতেন। রাজসভা কর্তৃক আইন প্রণয়নের পর তা রাজার চ্যান্সেলরের কাছে প্রেরিত হত। চ্যান্সেলর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তা অনুমোদনের জন্য রাজার সম্মুখে উপস্থাপন করা হত। রাজা আইনে স্বাক্ষর দিলে তা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের নিকট লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য প্রেরিত হত। স্বেচ্ছাচারীর রাজতন্ত্রের অংশ হিসেবে এই সভা রাজার আদেশ ছাড়া কোনো কাজ করার স্বাধীনতা ভোগ করত না।

ফ্রান্সের বিচার বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন রাজা। তবে বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তর ছিল। বিচার বিভাগের সর্বনিম্নে ছিল প্রভোস্টের বিচারালয়। প্রতি জেলা শহরে একটি করে প্রভোস্ট বিচারালয় ছিল। এসব বিচারের মামলা আপিল হত “বেইলিফ” বিচারালয়ে। বিচার বিভাগের অনেক পদ সে সময় বিক্রয় করা হত। কর্মচারী পদ বিক্রয়ের ফলে কোনো কোনো শহরে প্রেসিডিফেন্স চেয়ার নামে এক প্রকার বিচারালয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। এ সকল বিচারালয়ের বিচারকগণ বংশানুক্রমে বিচারপতির কাজ করত।

উল্লিখিত বিচারালয় থেকে আপিলের জন্য প্রাদেশিক পার্লামেন্টে আপিল করতে হত। প্রাদেশিক পার্লামেন্টের মামলার আপিল গ্রহণ করতো প্যারিস পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট অব প্যারিস আবার কাউন্সিল অব পার্টির অধীন ছিল। ফ্রান্সের কোনো কোনো স্থানে সামন্তদের বিচারালয় ছিল। প্রজাদের মধ্যে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের বিচার সততা ও ন্যায় বোধের ভিত্তিতেই পরিচালিত হত। তবে যে সকল বিচারকার্যে রাজার স্বার্থ জড়িত ছিল সেই বিচার কার্যে রাজার পক্ষে পক্ষপাতিত্ব হত। যে সকল বিচারপতি পদ ক্রয় করে দায়িত্ব পালন করত তারা নির্ভিকভাবে বিচার করতেন।

প্রশাসন পরিচালনা : রাষ্ট্র শাসন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন, প্রাদেশিক শাসন, রাজস্ব আদায়, বিচার পরিচালনার জন্য যে সকল কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছিল তারা সবাই রাজার অনুগত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় রাজা ও চ্যান্সেলর ভিন্ন কম্পট্রোলার অব ফিন্যান্স এবং বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রীগণ দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। চ্যান্সেলর রাজাকে আইন প্রণয়ন ও অন্যান্য গুরুত্ব বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। রাজার প্রতিনিধি হিসেবে রাজার অনুপস্থিতিতে চ্যান্সেলর কাউন্সিল অব স্টেট এবং মাঝে মাঝে রাজসভায় সভাপতিত্ব করতেন। বিচার ব্যবস্থায় চ্যান্সেলর ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কম্পট্রোলার অব ফিন্যান্স রাজস্ব বিভাগ দেখাশোনা করতেন।

মন্ত্ৰী পৰিষদ : চতুর্দশ লুই শাসন ব্যাপারে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। তার কোনো প্রধানমন্ত্রী ছিল না। প্রশাসনের প্রত্যেক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা রাজার কেরানি হিসাবে কাজ করতেন। প্রত্যেক মন্ত্রী তাদের কাজের জন্য রাজার নিকট দায়ী ছিলেন।

স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা : চতুর্দশ লুই স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। কার্ডিনাল বিশল্যু স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার যে ঐতিহ্য সুদৃঢ় করে গিয়েছিলেন চতুর্দশ লুই তা পরিপূর্ণভাবে রূপায়ন করেন। বাজকীয় ক্ষমতার উপর বাধা-নিষেধ আরোপ হতে পারে এরূপ সকল সংস্থার ক্ষমতা তিনি খর্ব করেছিলেন। তিনি কোনোদিন স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করেননি এবং পার্লামেন্ট অব প্যারিসকে সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন। শাসনকার্যে অভিজাত শ্রেণীর কোনো গুরুত্ব ছিল না প্রাদেশিক এস্টেট (state) ও পরিসভা যে সমস্ত সুবিধা ভোগ করত তা লোপ করা হয়েছিল। প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনা করতেন রাজানুগত ইনটেনডেন্ট কর্মচারীরা। রাজা এদের নিযোগ দিতেন তাই রাজ স্বার্থে এরা কাজ করত। তবে শাসন ব্যাপারে রাজা অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। রাষ্ট্রের কোনো বিষয় তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারত না। লোক চরিত্র ও রাজকর্মকুশলতা সম্পর্কে চতুর্দশ লুইয়ের গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি কোলবার্টের (১৬৬১-১৬৮৩) অর্থনৈতিক সংস্কার ও লোগনেসের উপর সেনাবাহিনী সংগঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তারা কৃতিত্বের সহিত রাজ অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতি

চতুর্দশ লুই পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০) ও রিশল্যুর (১৬২৪-১৬৪২) অনুসৃত বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ৪র্থ হেনরী বুরবোঁ রাজশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে দুর্বল করে ফ্রান্সের রাজ্যসীমা প্রাকৃতিক সীমারেখায় পৌঁছানোর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বিশল্যু ফ্রান্সকে ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের সমর্থন দিয়েছিলেন। চতুর্দশ লুই এই নীতি অনুসরণ এবং বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

পররাষ্ট্রনীতি :

  • সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে স্পেন শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়ের সময় ফ্রান্স শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে সম্মানজনক স্থান লাভ করেছিল।
  • চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় চতুর্দশ লুইয়ের শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির আলামত দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।
    • এর মধ্যে ১৬৬১ সালে লন্ডনে এক রাজকীয় অনুষ্ঠানে সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের সংবর্ধনা শোভাযাত্রায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ডি-ইস্ট্রাডিস স্পেনীয় রাষ্ট্রদূতের অগ্রে স্থান গ্রহণ করতে গেলে দুপক্ষের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের গাড়ি উল্টে যায় এবং একটি ঘোড়া মারা যায়। চতুর্দশ লুই যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে বলে যে বৈদেশিক সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত স্পেনের রাষ্ট্রদূতের অগ্রে স্থান পাবে। এই অধিকার আদায় করেছিলেন ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে।
    • রোমের ফরাসি রাষ্ট্রদূতের ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে পোপের কসিকানগার্ড নামে এক যুদ্ধরক্ষী দল পোপ সপ্তম আলেকজান্ডারের (১৬৫৫-১৬৬৭) ভ্রাতার আদেশে রাষ্ট্রদূতের পত্নীকে আক্রমণ করেন। রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডিউক-ডি-ক্রেকি। ক্রেকির একজন বালক ভৃত্য এই আক্রমণে প্রাণ হারায়। লুই এজন্য পোপের অধীনে এভিগনন নামক স্থান দখল করেন। পোপ বাধ্য হয়ে নিজ ভ্রাতাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করেন। কসিকানগার্ডকে কর্মচ্যুত এবং এই ঘটনার স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি স্তম্ভ নির্মাণ করতে বাধ্য হন।
    • তুরস্কের সুলতান চতুর্থ মেহমেদ (১৬৪৮-১৬৮৭) ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে অপমানিত করেছিলেন বলে লুই অস্ট্রিয়ার সম্রাটকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য দান করেছেন। ফরাসি সাহায্য লাভের ফলেই অস্ট্রিয়ার অর্থাৎ রোমান সম্রাটের সেনাপতি মন্টিকুকুলি ১৬৬৪ সালে গোথার্ডের যুদ্ধে তুরস্কের সুলতানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
  • তিনি ১৬৬২ সালে ইংল্যান্ডের নিকট থেকে ডানকাক নামক বন্দরটি ক্রয় করে এটাকে এক সামরিক পোতাশ্রয়ে পরিণত করেন।
  • তিনি স্পেনের বিরুদ্ধে পর্তুগালকে গোপনে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দান করেন। এই সাহায্যের ফলে পর্তুগাল ভিয়া ভিসিওমা নামক যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১৬৬৫ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। এভাবে চতুর্দশ লুই ইউরোপের রাজনীতিতে ফরাসি রাজশক্তির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে এক অপ্রতিহত প্রাধান্য স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তার স্পর্ধা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল।

চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতি : চতুর্দশ লুই পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরি ও রিশল্যু অনুসৃত বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ৪র্থ হেনরি প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে দুর্বল করে ফ্রান্সের রাজ্যসীমা প্রাকৃতিক সীমারেখায় পৌঁছানোর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রিশল্যু ফ্রান্সকে ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ত্রিশ বর্ষব্যাপী প্রটেস্ট্যান্টদের সমর্থন দিয়েছিলেন। চতুর্দশ লুই এই নীতি অনুসরণ এবং বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

কোলবার্ট (১৬৬১-১৬৭১)

চতুর্দশ লুইয়ের আমলে যে সকল ব্যক্তি ফ্রান্সের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে কোলবার্টের নাম উল্লেখ করা যায়। কোলবার্ট চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ফ্রান্সে অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নতি সাধনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

জীবন, চরিত্র ও পটভূমি

কোলবার্টের প্রাথমিক জীবন : কোলবার্ট প্রথম জীবনে ফরাসি যুদ্ধ সচিব লা টেরিয়ারের অধীনে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। তার কর্মকুশলতার পরিচয় পেয়ে কার্ডিনাল ম্যাজারিন (১৬৪২-১৬৬১) তাকে নিজ পরিবারের সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। কেরানির কাজের পাশাপাশি তিনি অর্থনৈতিক বিষয়েও অভিজ্ঞ হন। কার্ডিনাল ম্যাজারিনের অধীনে চাকরির সময় ভালো জিনিস কম দামে ক্রয় করে পরে তা বেশি দামে বিক্রি করে অধিক টাকা লাভ করতেন। তার সুযোগ্য পরিচালনায় তার প্রভু ম্যাজারিন প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। ম্যাজারিনের মৃত্যুকালে কোলবার্টকে চতুর্দশ লুইয়ের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন।

কোলবার্টের চরিত্র : কোলবার্ট ছিলেন যোগ্য সংগঠক এবং মানব চরিত্র মূল্যায়নে তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। তার কর্তব্যনিষ্ঠা, প্রভুভক্তি, সততা ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তার প্রতিভা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতি, দেশপ্রেম তাকে তদানীন্তন ইতিহাসে উচ্চস্থান নির্ধারণ করেছিল।

কোলবার্টের পূর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি : কোলবার্ট যখন মন্ত্রীত্ব লাভ করেন তখন ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা অনেকটা দুর্বল ছিল। সরকারের রাজস্ব ব্যয় রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি হওয়ায় অর্থনৈতিক ঘাটতি বিদ্যমান ছিল। উচ্চ হারে সুদের টাকা ধার করে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করত। সরকারের বাৎসরিক আয় অপেক্ষা ৩২ মিলিয়ন লিভর বেশি ব্যয় হত। এই অর্থাভাব মেটাবার জন্য নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হত এবং সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হত। নতুন নতুন খেতাব বিক্রয় করে অর্থ জোগানের চেষ্টা করা হত। কিন্তু দিন দিন এই অর্থাভাব বেড়ে চলছিল। সরকারি কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করত। আদায়কৃত অর্থের অল্প অংশ রাজকোষে জমা হত। কোলবার্ট এই বিষয়টি তার পূর্ববর্তী মন্ত্রী ম্যাজারিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো প্রতিকার করা কঠিন ছিল। চতুর্দশ লুই কোলবার্টকে প্রথমে ইনটেনডেন্টের কাজে নিযুক্ত করলে তিনি হিসাব পরীক্ষা করতে গিয়ে সকল দুর্নীতি লক্ষ্য করে তা চতুর্দশ লুইয়ের দৃষ্টিগোচর করেন। ক্রমে তদানীন্তন রাজস্ব বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মচারী নিকোলাস ফকুয়ের (Nicholas Foquet) বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সরকারি অর্থ তছরুপ করার প্রমাণ পাওয়া গেলে চতুর্দশ লুই ফকুয়েকে পদচ্যুত করেন। ফকুয়ের বিচারের সময় সরকারি কর্মচারীদের নানারূপ দুর্নীতি প্রকাশ পায়। নিকোলাস ফকুয়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হন। চতুর্দশ লুই কোলবার্টকে ১৬৬৫ সালে রাজস্ব বিভাগের সর্বোচ্চ পদ কমপট্রোলার জেনারেলে নিয়োগ দেন। তার সততা ও কর্মদক্ষতার জন্য চতুর্দশ লুই কোলবার্টকে তার মন্ত্রীপদে উন্নীত করেন।

কোলবার্টের সংস্কার

কোলবার্ট ক্ষমতা লাভ করে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন –

  • কর আদায় ব্যবস্থার উন্নয়ন : সে সময় ফ্রান্সের রাজস্ব বিভাগ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল। কর আদায়কারী ও অর্থ জোগানকারীরা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে সম্পদশালী হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আদায়কৃত অর্থের সামান্য জমা হত। কোলবার্ট রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করে কর আদায় ব্যবস্থার উন্নতি করেন। অসাধু ও দুর্নীতিপরায়ণ কর সংগ্রহকারী কর্মচারীদের পদচ্যুত করে ইনটেনডেন্ট নামক কর্মচারীদের উপর কর আদায়ের দায়িত্ব দেন। যেসব কর্মচারী রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ করেছিল তা পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করেন। কোলবার্ট সরকারি আয়-ব্যয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সরকারি কর্মচারীদের আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায় করার ব্যবস্থা করেন।
  • রাজস্ব বিভাগের বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ : তিনি সরকারি অপচয় বন্ধ করে সরকারি রাজস্ব বিভাগের বিশৃঙ্খলা দূর করেন। তিনি ফকুয়ে কর্তৃক নেওয়া ঋণ বাতিল করেন এবং সেসব মহাজনকে স্বীকার করে নেন। তাদের সুদ অনেক হ্রাস করেন। ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনে তিনি কর আদায়ের দিকে মনোযোগ দেন। টেইলির বকেয়া মওকুফ করে দেন। টেইলির পরিমাণ পুনধার্য করা হয়, কর প্রদান থেকে মুক্ত থাকার দাবীর তদন্ত করা হয়। এবং কর আদায়ের রেজিস্টার যথাযথভাবে জরিপ ও অডিট করা হয়। কম্পটেলারা জেনারেল পদে যোগদানের একবছর পর ১৬৬২ সালে কোনো ব্যক্তির উপর করভার বৃদ্ধি না করে তিনি ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড উদ্বৃত্ত দেখান। তিনি প্রত্যক্ষ কর (Direct tax) হ্রাস করে পরোক্ষ করের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন।
  • সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ ন্যূনতম করা : কোলবার্ট সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার মতে একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে আর্থিক ব্যবস্থার উপর। তিনি মনে করতেন যারা কর দিতে সক্ষম তাদের উপর কর ধার্য করা উচিত। তার পূর্ববর্তী অর্থ উপদেষ্টারা কর ব্যবস্থাকে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখত। সেসব দ্রব্যের উপর কর ধায় করত যেসব দ্রব্যের উপর কর ধার্য করা সহজ ছিল এবং এমনভাবে কর ধার্য করত যা অল্প কষ্টে সরকারকে কিছু অর্থ প্রদান করা নিশ্চিত করে। কোলবার্ট লক্ষ্য করেন সহজে কর আদায়ে অধিক পরিমাণ রাজস্বের গোপন কথা নিহিত থাকে না। এটা নিহিত থাকে কর প্রদানের সহজসাধ্যতায়।
  • অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দুটি বৃহৎ পরিকল্পনা : কোলবার্ট ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দুটি বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। (১) সরকারি ক্ষমতার অধীনে থাকা সকল পন্থার দ্বারা ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সীমানার অভ্যন্তরে সম্পদ উৎপাদন উন্নতি সাধন করা ও (২) জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে কৃষিদ্রব্য কম মূল্যে বিক্রি করতে বিদেশীদেরকে বাধা প্রদানের জন্য বিদেশী দ্রব্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক ধার্য করা।
  • প্রাদেশিক ও স্থানীয় কর বিলুপ্তি : তিনি প্রাদেশিক ও স্থানীয় কর বিলুপ্ত করেন। কারণ এগুলো প্রদেশ থেকে প্রদেশে দ্রব্যের মুক্ত চলাচলকে বাধা প্রদান করে।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সব সড়কের উন্নয়ন সাধন করেন এবং সুলি কর্তৃক শুরু করা খালসমূহকে একটি বৃহৎ জলপথে উন্নয়ন করেন। এই খাল ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল লংগুয়েডক খাল যা ভূমধ্যসাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছিল। এটি ফ্রান্সের সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে অনেক অবদান রাখে। এটা ছিল জলপথ উন্নয়নের একটি প্রকৃষ্ট নমুনা।
  • শিল্পে উৎসাহ প্রদান : কোলবার্ট সফল প্রকার শিল্পকে উৎসাহ দেন। তার ব্যবস্থাপনায় ফিতা, কাচ, পর্দা, রেশম ও বুটি তোলা রেশমি বস্ত্র বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্রব্যে পরিণত হয়। শিল্প সম্পর্কিত ও বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠনে উৎসাহিত করেন। তিনি বিদেশী অভিজ্ঞ শিল্পীকে দেশে আনয়ন করে দেশীয় শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেন। রাষ্ট্রীয় বন উন্নয়নের জন্য তিনি একটি সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। অশ্ব প্রজননের জন্য বড় বড় প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। কোলবার্ট দেশের রপ্তানি দ্রব্যের উপর থেকে কর বিলুপ্ত করে ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একই ধরনের দ্রব্যের উপর উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক ধার্য করে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরকে সাহায্য করেন।
  • উপনিবেশ নীতি : কোলবার্ট ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য দৃষ্টি দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি নৌবাহিনীর উন্নতি সাধন করেন। উপনিবেশকে রক্ষার জন্য বহু সংখ্যক বাণিজ্য ও রণতরী নির্মাণ করেন। ফ্রান্সের উপকূল ভাগে বহু পোতাশ্রয় এবং জাহাজ নির্মাণের জন্য কারখানা স্থাপন করা হয়। তিনি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ফরাসি বণিকদের উৎসাহ দেন। তার চেষ্টায় কানাডা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা ও ভারতে ফরাসি বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। রাষ্ট্রীয় অর্থানুকূল্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি স্থাপন করা হয়।
  • কৃষির উন্নয়ন : কোলবার্ট কৃষির উন্নতিকল্পে কৃষকদের সরকারি সাহায্য দান করেছিলেন। কৃষকদের নির্যাতনকারী কর টেইলি অর্ধেক হ্রাস করে প্রধানত বিলাস দ্রব্যের উপর পরোক্ষ কর ধার্যের মাধ্যমে কোষাগারকে সমৃদ্ধ করে তিনি কৃষককুলকে সবচেয়ে ভারী আর্থিক বোঝা থেকে মুক্ত করেন। তিনি কৃষিজাত দ্রব্যাদি বিদেশে রপ্তানি বন্ধ করে দেন। তার এইরূপ সংস্কার কার্যের ফলে ফরাসি জাতির সম্পদ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।

কোলবার্টের অর্থনৈতিক নীতি রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হয়েছিল। ১৬৬১-১৬৭১ এই দশ বছর রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি কোলবার্টের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই সময়কালে জাতীয় ঋণ অনেক হ্রাস হয়, গচ্ছিত অর্থ আত্মসাৎ বন্ধ করা হয়, করভার হালকা করা হয় ও কর আগের থেকে ভালোভাবে বিতরণ করা হয়। তা ছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতে ও যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত করাতে সম্পদ বৃদ্ধির নতুন উর্বর উৎস বের করা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে ও বাণিজ্যিক উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান করে ফ্রান্স তখন সমৃদ্ধে সমৃদ্ধি যোগ করেছিল। বিশ্বের সকল অংশে তার উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তার সেনাবাহিনী ইউরোপে দ্বিতীয় ছিল না। তার জনগণ ছিল সমৃদ্ধশালী, সন্তুষ্ট, অনুগত, শাসকরা ন্যায়পরায়ণ, সজাগ ও সৎ, তার প্রশাসন ব্যবস্থা বিশুদ্ধ ও এমন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যা দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে প্রথম বিবেচনায় রাখে। তার গৃহীত অর্থনীতি মার্কেন্টাইলবাদের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল।

সমালোচনা 

কোলবার্টের সংস্কারসমূহ সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না –

  • কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা : তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। তাই তার সংস্কার দ্বারা মধ্যবিত্ত শ্ৰেণী উপকৃত হয়েছিল। ফ্রান্স ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু কৃষকের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না। দেশকে খাদ্য দ্রব্যের দিক দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করতে তিনি কৃষিজাত দ্রব্যাদির রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে কৃষিজাত দ্রব্যের দাম এত কমে গিয়েছিলেন যে, কৃষকদের অবস্থা প্রাচুর্যের মধ্যেও শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। কৃষিপণ্য রপ্তানি করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে এই বিষয়টি তিনি হয়তো বিবেচনায় আনেন নি। কোলবার্ট ইংল্যান্ডের সাথে অবাধ বাণিজ্য স্থাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। এজন্য ১৬৬৯ সালে ইংল্যান্ডের সাথে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তার এ চেষ্টা ফলপ্রপূ হয় নি। কিন্তু এটি স্বীকার্য যে, তিনি কার্যতঃ মার্কেন্টাইলবাদ বা সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করলেও অবাধ বাণিজ্যনীতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন।
  • ফ্রান্স ও হল্যান্ডের বিরোধ : উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে কোলবার্ট হল্যান্ডের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এর ফলে পরবর্তীকালে ফ্রান্সের সাথে হল্যান্ডের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে পরবর্তী ১০০ বছর পর্যন্ত যে সকল যুদ্ধ ইউরোপে ঘটেছিল সেগুলোর জন্য ফ্রান্সের সংরক্ষণ নীতি আংশিক দায়ী ছিল।
  • ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও উদ্যম ব্যাহত : কোলবার্টের নীতির কারণে ফ্রান্সের উৎপাদনকারীরা রাষ্ট্রের সাহায্যের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভরশীল হয়েছিল। এর ফলে তাদের স্বাধীন ও ব্যক্তিগত উদ্যম অনেকটা কমে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের সহায়তা হ্রাস পেলে এ সকল শিল্পের অবনতি হয়েছিল।
  • উপনিবেশিক ব্যবস্থায় ত্রুটি : কোলবার্টের উপনিবেশিক ও বাণিজ্য নীতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। বাণিজ্যিক বা ঔপনিবেশিক সাফল্য সম্পূর্ণভাবে জাতির যোগ্যতা ও সমর্থনের উপর নির্ভরশীল এই বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করেন নি। ইংল্যান্ডের বাণিজ্য-উপনিবেশ ইংরেজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চেষ্টায় গড়ে ওঠেছিল। এর পেছনে সরকারি সমর্থন থাকলেও সরকারি চেষ্টার পুরোমাত্রাই ছিল না। কিন্তু ফরাসি উপনিবেশ বা বাণিজ্যের পশ্চাতে ফরাসি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাগ্রতা বা সাহায্য ছিল না। এ ছাড়া তিনি ফরাসি দেশের অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের দ্বারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। ফলে ফরাসি উপনিবেশগুলো আত্মনির্ভরশীল হতে পারে নি। ইংরেজদের উপনিবেশিকদের ন্যায় ফরাসি উপনিবেশ শক্তিশালী হয় নি।

কোলবার্টের কৃতিত্ব বিচার 

কোলবার্টের সংস্কার নীতির ফলেই ফ্রান্স অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়েছিল। তিনি মার্কেন্টাইল নীতি অনুসরণ করে ফ্রান্সের শিল্পকে উন্নত করেছিলেন। তিনি বিদেশী পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করে দেশের নবজাত শিল্পকে রক্ষা এবং মৃতপ্রায় শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীকে সরকারি সাহায্য দান করেছিলেন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তিনি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বাণিজ্য ও রণতরী নির্মাণ করেছিলেন। তিনি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য কানাডা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা ও ভারতে কুঠি স্থাপনের উৎসাহ দেন। তার অর্থানুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং আরো অনেক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়।

আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ফ্রান্সের অর্থনীতি পুনর্গঠন করে কোলবার্ট ফ্রান্সকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তার সংস্কারের ফলে ফ্রান্সে সাময়িকভাবে অর্থ স্ফীতি হয়েছিল যা চতুর্দশ লুইয়ের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল যে এ অবস্থা চিরকাল থাকবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি রাজসভার ঐশ্বর্য ও আড়ম্বরের সমাবেশে মনোনিবেশ করেছিলেন এবং যুদ্ধের দ্বারা ফ্রান্সের রাজ্যসীমা বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার নীতি প্রথমদিকে যেমন অর্থ প্রাচুর্য এনেছিল তেমনি শেষের দিকে অস্বচ্ছলতা ও অর্থক্ষয়কারী যুদ্ধের সূচনা করেছিল। এ পরস্পরবিরোধী পরিবেশের জন্য কোলবার্ট দায়ী।

চতুর্দশ লুইয়ের ধর্মনীতি

চতুর্দশ লুই ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। তিনি ফ্রান্সের গির্জাকেও নিজ নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। ধর্মক্ষেত্রে তার আদর্শ ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এক রাজা, এক জাতি এবং এক ধর্ম চতুর্দশ লুইয়ের ধর্মনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। ধর্মক্ষেত্রে অনুসৃত আদর্শ ছিল – (১) ফরাসি নির্ঝর স্বাধীনতা, (২) ধর্মীয় ঐক্য প্রচেষ্টা।  প্রথমত, চতুর্দশ লুই ফরাসি গির্জাকে রোমের পোপের প্রভাবমুক্ত করে তা রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আনেন। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করা এবং জেনসেনিস্ট নামক গোড়া ক্যাথলিকদের দমন করে ধর্মক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

চতুর্দশ লুইয়ের সময় ফ্রান্স ছিল ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশ। ফ্রান্সের গির্জা রোমের পোপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চতুর্দশ লুই ফরাসি গির্জার ওপর পোপের আধিপত্য বিলুপ্ত করেন। এমনকি তিনি পোপকে প্রকাশ্যভাবে অপমান করেছিলেন। সে সময় রোমের ফরাসি দূত ক্রেকির (Crequi) আচরণে রোমের ক্যাথলিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ১৬৬২ সালে ক্রেকির পত্নী ও অনুচরদের আক্রমণ করে। ফলে সে সময় ক্রেকির এক বালক ভৃত্য মৃত্যুবরণ করে। পোপ পোপ সপ্তম আলেকজান্ডারের (১৬৫৫-১৬৬৭) ভ্রাতা এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। চতুর্দশ লুই তা জানতে পেরে পোপের অধীনস্থ রাজ্যের এভিগনন দখল করে নেন। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ভয়ে পোপ ক্ষমা ভিক্ষা করে এবং নিজ ভ্রাতাকে নির্বাসন দেন। এ ছাড়া যেসকল সৈন্য আক্রমণে জড়িত ছিল তাদের পদচ্যুত করেন। নিহত বালকের স্মৃতি রক্ষার জন্য পোপ একটি স্তম্ভ নির্মাণ করতে বাধ্য জন। এভাবে চতুর্দশ লুই পোপকে অপমান করেছিলেন।

১৬৭৩ সালে গির্জার প্রাপ্য রিগেল (Regale) নিয়ে পোপ এবং চতুর্দশ লুইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। প্রচলিত গির্জার নিয়ম অনুসারে কোনো গির্জার বিশপপদ শূন্য থাকলে ঐ সময়কার আয় রাজার প্রাপ্য হত। এ প্রাপ্যকে ‘রিগেল’ বলা হত। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যে সকল গির্জা ফরাসি রাজার ব্যক্তিগত জমির উপর স্থাপিত ছিল সেগুলো থেকেই রাজার ‘বিগেল’ প্রাপ্য হত। কিন্তু চতুর্দশ লুই রাষ্ট্রের সকল গির্জার রিগেল দাবি করলে কয়েকজন ফরাসি বিশপ আপত্তি জানায়। ফলে রাজপন্থি বিশপ এবং পোপের সমর্থক বিশপদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পোপ তার সমর্থক বিশপদের পক্ষ অবলম্বন করলে চতুর্দশ লুই ১৬৮২ সালে সেন্ট জার্মেন নামক স্থানে ফরাসি বিশপদের এক সম্মেলন ডাকেন, যেখানকার নিম্নলিখিত চারটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে ফরাসি গির্জার উপর পোপের প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় –

  • (১) পার্থির কোনো ব্যাপারে রাজার উপর পোপের প্রাধান্য থাকতে পারে না।
  • (২) ধর্ম সম্পর্কে যাজকদের সাধারণ সভাতে গৃহীত প্রস্তাব পোপের আদেশ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
  • (৩) পোপ ফরাসি গির্জার প্রচলিত নীতির বিরুদ্ধে আদেশ জারি করতে পারেন না।
  • (৪) পোপের কোনো আদেশ সর্বজনগ্রাহ্য হতে হলে তার পেছনে সমগ্র ক্যাথলিক গির্জার সমর্থন থাকা প্রয়োজন, নতুবা তার পরিবর্তন হতে পারে।

পোপের সাথে চতুর্দশ লুইয়ের বিরোধের ফলে ক্যাথলিকপন্থি দেশগুলো চতুর্দশ লুইয়ের প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন হয়ে উঠে। এ ছাড়া এ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়। এ দ্বন্দ্বের সুযোগে হল্যান্ডের উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সিংহাসন লাভের সুযোগ পান। তবে চতুর্দশ লুইয়ের রাজসভার এক মহিলা সদস্য ম্যাডাম-ডি-মেন্টিনন পোপের সাথে চতুর্দশ লুই-এর বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে ১৯৯৩ সালে লুই পোপের প্রাধান্য স্বীকার করেন এবং পোপ চতুর্দশ লুইয়ের বিগত দশ বছরের গির্জা সম্পর্কিত সকল নীতি অনুমোদন করেন।

চতুর্দশ লুই ফ্রান্সে ধর্মনৈতিক ঐক্য স্থাপনের জন্য ফরাসি হিউগেনো এবং গোড়া ক্যাথলিকপন্থি জেনসেনিস্টদের দমনের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। চতুর্দশ লুইয়ের পূর্বসূরি চতুর্থ হেনরি ১৫৯৮ সালে “এডিক্ট অব নান্টস” (Edict of Nantes) আইন প্রবর্তন করে হিউগেনোদের ধর্মীয় এবং সীমিত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কার্ডিনাল বিশল্যু হিউগেনোদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কিন্তু চতুর্দশ লুই তার সভাসদ ম্যাডাম-ডি-মেন্টিননের প্রভাবে হিউগেনোদের অর্থ ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরের চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে ‘কনভার্সন ব্যুরো’ নামে ধর্মান্তর সংঘ স্থাপন করেন। কিন্তু হিউগেনোরা ধর্মান্তরিত না হওয়ায় হিউগেনো পরিবারে সৈন্য মোতায়েন করে অত্যাচার চালান। এ সৈন্য মোতায়েন প্রথা ‘ড্যাগোনাড’ (Dragonnade) নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এতে হিউগেনোরা ধর্মান্তরিত না হওয়ায় তাদের গির্জা ভেঙে দেন। এবং হিউগেনোদের উপর দ্বিগুণ হারে কর চাপান। হিউগেনোদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। ১৬৮৫ সালে লুই ‘এডিক্ট অব নান্টস’ বাতিল করেন। এর ফলে হিউগেনোদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। ধর্মোন্মত্ত ক্যাথলিকরা হিউগেনোদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে অনেক হিউগেনো নর-নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়। হিউগেনোরা ক্যাথলিকদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য দেশত্যাগ করেন। কিন্তু তারা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য সীমান্তে পাহাড়া বসানো হয়। তবুও অনেক হিউগেনো ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে যান। চতুর্দশ লুইয়ের এ অসহিষ্ণু নীতি ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। চতুর্দশ লুই কর্তৃক ‘এডিট অব নান্টস’ বাতিলের ফলে ফ্রান্সের হিউগেনোপন্থি কর্মঠ, বিত্তশালী, বণিক, সুদক্ষ কারিগররা ফ্রান্স ত্যাগ করে। ফলে ফ্রান্স অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিউগেনোরা ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ব্রান্ডেনবার্গে পালিয়ে গেলে সেখানকার শাসকশ্রেণী হিউগেনোদের আশ্রয় দেয়। হিউগেনোরা হল্যান্ড ও ব্রান্ডেনবার্গের শিল্পোন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসময় থেকে ফরাসি শিল্প দ্রব্যের চাহিদা বিদেশে হ্রাস পেতে থাকে। ফ্রান্সের সামাজিক ক্ষেত্রেও এটি হতাশার সৃষ্টি করেছিল। হিউগেনোরা দেশত্যাগের ফলে অনেক গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল মারাত্মক। হিউগেনোদের ওপর অত্যাচারের কারণে অনেক প্রোটেস্ট্যান্ট দেশ ফ্রান্সের শত্রুদেশে পরিণত হয়েছিল, যা ফ্রান্সের জন্য ছিল সর্বনেশে।

চতুর্দশ লুই ফ্রান্সের গোড়া ক্যাথলিক জেনসেনিস্টদের উপর দমননীতি গ্রহণ করেছিলেন। কর্নেলিয়াস জেনসেন নামে একজন ধর্মবিশ্বাসী, জ্ঞানী, সেন্ট অগাস্টিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সৎকর্মের দ্বারা পাপখণ্ডনে ঘোর বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সেন্ট অগাস্টিনের আদর্শে তিনি অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অগাস্টাইনীয় আদর্শে তিনি জেনসেনিষ্ট ধর্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। এরা সততা, সত্যবাদিতা এবং কৃচ্ছসাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। এদেরকে ক্যাথলিক সমাজে ‘পিউরিটান‘ বলা হত। এদের ধর্মকেন্দ্র ছিল পোর্ট বয়্যালে। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও পণ্ডিত প্যাস্কাল ছিলেন জেনসেনিস্ট ধর্মসমাজের সদস্য। জেসুইটরা এদের পছন্দ করত না। কারণ তারা নিজেদের সমাজকে সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও সৎ মনে করত। এজন্য জেনসেনিস্ট এবং জেসুইটদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ ছিল। চতুর্দশ লুই জেসুইটদের পক্ষ সমর্থন করে ১৭১০ সালে জেনসেনিস্টদের ধর্মকেন্দ্র পোর্ট রয়্যাল ভেঙে দেন। চতুর্দশ লুই ক্যাথলিক পোপ ক্লিমেন্টের নিকট থেকে তার কার্যের সমর্থনে জেনসেনিস্টদের প্রতি নিন্দাসূচক একটি প্রচারপত্র আদায় করেন। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়ের ধর্মীয় ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা বিফল হয়।

চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতি

ইউরোপের ইতিহাসে চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতি ইউরোপে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের প্রভাব হ্রাস করার জন্য লক্ষ্য হিসাবে স্থির করা হয়েছিল। সে সময় অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশ ইউরোপের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। তাই ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিকল্প ছিল অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে দুর্বল করা। তবে এক্ষেত্রে চতুর্দশ লুই চতুর্থ হেনরি ও রিশল্যুর পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন। এ ছাড়া ইউরোপে ফ্রান্সের রাজ্যসীমাকে প্রাকৃতিক সীমারেখায় (Natural Frontiers) পৌঁছানো; সমগ্র ইউরোপে ফ্রান্সের অপ্রতিহত প্রাধান্য স্থাপন করতে হলে উত্তরপূর্বে রাইন নদী (Rhine) পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজ্যবিস্তার অপরিহার্য ছিল। সে সময় ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে বিপর্যন্ত জার্মানি ও স্পেনের দুর্বলতা চতুর্দশ লুইকে তার অভিষ্ট লক্ষ্য সাধনে প্ররোচিত করেছিল। চতুর্দশ লুই তার নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চারটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যথা : (১) ডিভল্যুশনের যুদ্ধ (The war of Devolution), (২) হল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ (War against the Dutch), (৩) অগসবার্গ লীগের যুদ্ধ (War of the League of Augsburg) (৪) স্পেনীয় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (War of Spanish Succession) |

(১) ডিভল্যুশনের যুদ্ধ (১৬৬৭-৬৮)

চতুর্দশ লুই স্পেনীয় নেদারল্যান্ড অধিকার করতে সামরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে ডিভল্যুশনের যুদ্ধ শুরু হয়। চতুর্দশ লুই স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের (১৬২১-১৬৬৫) কন্যা মেরিয়া থেরেসাকে বিবাহ করেছিলেন। মেরিয়া থেবেসা বিবাহের সময় স্পেনীয় সিংহাসনের উপর উত্তরাধিকার দাবি পরিত্যাগ করেছিলেন। ডিভল্যুশন আইন অনুসারে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তান অপেক্ষা প্রথম পক্ষের সন্তানের দাবি অগ্রগণ্য ছিল। কিন্তু ১৬৬৫ সালে চতুর্থ ফিলিপের মৃত্যুর পর চতুর্দশ লুই এই আইন অনুসারে স্পেনীয় নেদারল্যান্ডসের দেশগুলো দাবি করেন। এই ফিউডাল বা সামন্ততান্ত্রিক উত্তরাধিকার আইনটি স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডসের কোনো কোনো রাজ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই আইন অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হত। কিন্তু এটি স্পেনের সর্বত্র প্রচলিত ছিল না। চতুর্থ ফিলিপের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তান দ্বিতীয় চার্লস (১৬৬৫-১৭০০) পিতার মৃত্যুর পর ১৬৬৫ সালে স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ করলে চতুর্দশ লুইয়ের দাবি অগ্রাহ্য হয়। ফলে চতুর্দশ লুই স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। চতুর্দশ লুইয়ের সেনাপতি কন্ডি (Conde) ফ্ল্যান্ডার্স আক্রমণ করে কয়েকটি দুর্গ ও ফ্রেঞ্চ কমটে (French Comte) নামক গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি অধিকার করেন। অপরদিকে বিখ্যাত ফরাসি সেনাপতি টুরেনের হাতে স্প্যানিশ সৈন্যবাহিনী কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পশ্চাৎপসারণে বাধ্য হয়। ফ্রান্সের সামরিক সাফল্যে হল্যান্ড ভীত ও শঙ্কিত হয়। হল্যান্ড আত্মরক্ষার জন্য ইংল্যান্ড ও সুইডেনের সাথে এক ত্রিশক্তি মৈত্রী জোট গঠন করে ফরাসি বাহিনীর অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করে। ফলে চতুর্দশ লুই আয়লা স্যাপেলের সন্ধির (Treaty of Aix-la-chepelle) মাধ্যমে ডিভল্যুশনের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটান। এ সন্ধি অনুসারে ফ্রান্সকে নেদারল্যান্ডের অনেকগুলো দুর্গ ছেড়ে দেওয়া হয় এবং ফ্রান্সকে ফ্রেঞ্চ কম্‌টে ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

(২) হল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ (১৬৭২–১৬৭৮)

ডিভল্যুশনের যুদ্ধে হল্যান্ডের শত্রুতার কারণে চতুর্দশ লুই নেদারল্যান্ডস অধিকার করতে পারেন নি। এতে চতুর্দশ লুই ওলন্দাজদের উপর ক্ষুব্ধ হন। এ ছাড়া ওলন্দাজগণ ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে বিশ্বাসী, তাই ফ্রান্সের বিদ্রোহী হিউগেনোদের ডাচরা আশ্রয় দিয়েছিল। হিউগেনোগণ হল্যান্ডে অবস্থান করে চতুর্দশ লুইকে বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা দ্বারা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করত। এতে চতুর্দশ লুই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এ ছাড়া সে সময় ঔপনিবেশিক বাণিজ্য নিয়ে ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। চতুর্দশ লুই হল্যান্ডের একচেটিয়া বাণিজ্য সুবিধা ধ্বংস করে ফ্রান্সের উপনিবেশিক বাণিজ্য প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন।

যুদ্ধ প্রস্তুতি: হল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে চতুর্দশ লুই কূটনৈতিক কূটচালের মাধ্যমে হল্যান্ডকে মিত্রহীন করার পরিকল্পনা করেন। তিনি ডোভারের গোপন সন্ধির (Secret Treaty of Dover) দ্বারা ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে (১৬৬৫-১৭০০) ফ্রান্সের পক্ষে নিয়ে আসেন। সুইডেনের রাজা একাদশ চার্লসকে (১৬৬০-১৬৯১) প্রচুর অর্থ দিয়ে নিজ পক্ষে নিয়ে আসেন এবং জার্মান সম্রাট প্রথম লিওপোল্ডের (১৬৫৮-১৭০৫) সাথে আঁতাত করে যুদ্ধকালীন সময় জার্মানিকে নিরপেক্ষ রাখার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। চতুর্দশ লুই এভাবে কূটনৈতিক চাল চেলে হল্যান্ডের মৈত্রী জোট ‘ত্রিশক্তি’ মৈত্রী সংস্থা (Triple Alliance) ভেঙে দেন। অতঃপর ১৬৭২ সালে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

যুদ্ধের ঘটনাবলি : চতুর্দশ লুই যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের সীমান্তে পৌঁছেন। নৌযুদ্ধে ডাচগণ ফরাসিদের মোকাবেলায় সক্ষম হলেও স্থল যুদ্ধে ফরাসি সেনাপতি কন্ডি ও টুরেনের হাতে হল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ফ্রান্সের সেনাবাহিনী হল্যান্ডের অনেক অঞ্চল দখল করে রাজধানী আমস্টারডাম (Amsterdam) অবরোধ করে। এতে রাজধানীর নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। এই দুর্যোগের সময় আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী ডাচগণ ফরাসিদের প্রতিরোধের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয় এবং দেশের দুর্গতির জন্য প্রজাতন্ত্রী দলের নেতা দা উইটকে (De Witt) দায়ী করে তাকে হত্যা করে। অতঃপর অরেঞ্জ বংশীয় তৃতীয় উইলিয়াম (১৬৭২-১৭০২) হল্যান্ডের স্টেটহোল্ডার বা নেতা নিযুক্ত হন। উইলিয়াম সমুদ্রের বাঁধ কেটে দিয়ে রাজধানী আমস্টারডাম জলমগ্ন করে ফরাসি বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করেন। এ সময় অস্ট্রিয়া, স্পেন, লোরেন, ব্রান্ডেনবার্গ, ডেনমার্ক ও জার্মানির রাজাগণের অনেকেই হল্যান্ডের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে ডাচ যুদ্ধ ইউরোপের জাতীয় যুদ্ধের রূপ লাভ করে। ফ্রান্সকে কিছু সময়ের জন্য আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকতে হলেও পরপর কয়েকটি যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী ইউরোপীয় রাষ্ট্রজোটকে পরাজিত করে। দীর্ঘ ৬ বছর যুদ্ধ করে ফ্রান্স ও তার বিরোধী পক্ষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে ১৬৭৮ সালে নাইমুইজেনের সন্ধিতে (Treaty of Nymwegen) উভয় পক্ষ স্বাক্ষর করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। এ সন্ধির ফলে ফ্রান্স ফ্রেঞ্চ কমটের (French Corte) অধিকার লাভ করে, স্পেনীয় নেদারল্যান্ডে কয়েকটি দুর্গ ফ্রান্স লাভ করে, হল্যান্ড তার সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ অংশ লাভ করে এবং ফ্রান্সের নিকট থেকে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধাও আদায় করে। এ সন্ধির ফলে চতুর্দশ লুই হল্যান্ড অধিকার করার সুযোগ পান নি।

যুদ্ধের ফলাফল : হল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের এ ঐতিহাসিক যুদ্ধের ফলাফল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায় –

  • প্রথমত, এ যুদ্ধের ফলে ফ্রান্স ইউরোপীয় শক্তি জোটের মোকাবেলা করে কিছু সামরিক সাফল্য লাভ করেছিল। নাইমুইজেনের সন্ধির মাধ্যমে ফ্রান্স ফ্রেঞ্চ কটে ও নেদারল্যান্ডের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ লাভ করেছিল।
  • দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে এই যুদ্ধ ফ্রান্সের রাজনৈতিক কোনো সুবিধা দিতে পারে নি। কেননা হল্যান্ডের গণতন্ত্রী দল ও এ দলের নেতা দা উইট ফ্রান্সের বন্ধুভাবাপন্ন নেতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযান করে চতুর্দশ লুই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ তার হত্যাকাণ্ডের পর অরেঞ্জ বংশীয় তৃতীয় উইলিয়াম হল্যান্ডের সিংহাসনে বসেছিলেন। এ নেতা ফ্রান্সের প্রতি পরম শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। ফ্রান্সের আক্রমণে আমস্টারডামের পতন আসন্ন হলে তৃতীয় উইলিয়াম সমুদ্রের বাঁধ কেটে আমস্টারডামকে জলমগ্ন করলে ফ্রান্সের পক্ষে আমস্টাডাম দখল করা সম্ভব হয় নি। অতঃপর তৃতীয় উইলিয়াম ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে সংগঠিত করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করলে চতুর্দশ লুইয়ের পক্ষে হল্যান্ড দখল করা সম্ভব হয় নি।
  • তৃতীয়ত, চতুর্দশ লুই হল্যান্ড আক্রমণ করে প্রোটেস্ট্যান্টদের শত্রুতে পরিণত হন। এর ফলে জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রসমূহ চতুর্দশ লুইকে সমর্থন করে নি। ফলে পরবর্তীতে চতুর্দশ লুইকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।

চতুর্দশ লুইয়ের রি-ইউনিয়ন নীতি : চতুৰ্দশ লুইয়ে ইউরোপীয় শক্তিজোটের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তিতে ফ্রান্সের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। এতে ফ্রান্সের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময় ফ্রান্স ইউরোপে শক্তি ও সামর্থে শীর্ষে পৌঁছে ছিল। এই অবস্থায় চতুর্দশ লুই সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ওয়েস্টফেলিয়া ও নাইমুইজেনের সন্ধি অনুসারে রাইন সংলগ্ন কিছু অঞ্চল ফ্রান্সের রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত। এ সমস্ত অঞ্চলের আয়ত্বাধীন স্থানসমূহের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য চতুর্দশ লুই কতিপয় নিষ্পত্তি আদালত গঠন করেন। এই সকল আদালত চেম্বারস অব রি-ইউনিয়ন নামে অভিহিত এবং এগুলো আন্তর্জাতিক বিচার কমিশনের ক্ষমতার অধিকারী বলে চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন। যেহেতু রাজা চতুর্দশ লুই নিজে এ সমস্ত আদালতে বিচার প্রার্থী ও বিচারক এই দুই ছিলেন তাই আদালতের রায় আসত তার অনুকূলে। আদালতের রায় অনুসারে লুক্সেমবার্গ (Luxemburg) ও স্ট্রেসবার্গসহ ( Strassburg) প্রায় ২০টি জার্মান শহরের উপর ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতালির কেস্যালও লুই অবরোধ করেন। চতুর্দশ লুইয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাম্রাজ্য লিপ্সা প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি ইউরোপে ছিল না। এ সময় ইংল্যান্ড, স্পেন ও জার্মানি নানা সমস্যায় জড়িত থাকায় তারা অনেকটা দুর্বল ছিল। এ ছাড়া ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ছিল খুব শক্তিশালী। সে সময়কার ফ্রান্সের সামরিক শক্তি ও চতুর্দশ লুইয়ের যোগ্যতা সম্পর্কে দার্শনিক ভলতেয়ার মন্তব্য করেছিলেন, চতুর্দশ লুই যতগুলো স্থান অধিকার করেন, তার দশজন পূর্বপুরুষ ও একত্রে ততগুলি স্থান জয় করতে পারে নি।

(৩) অগসবার্গ-লীগের যুদ্ধ

চতুর্দশ দুইয়ের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা ইউরোপীয় রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ফলে চতুর্দশ লুইয়ের প্রধান শত্রু হল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ওয়েস্টফেলিয়া ও নাইমুইজেনের সন্ধির শর্তসমূহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য স্পেন, সুইডেন, জার্মান সম্রাট ও জার্মানের প্রোটেস্ট্যান্ট রাজ্যসমূহের সমবায়ে অগসবার্গ-লীগ (League of Augsburg) প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ইংল্যান্ড উক্ত লীগে যোগদান করে এর শক্তি বৃদ্ধি করে। ১৬৮৮ হতে ১৬৯৭ সালে পর্যন্ত নয় বছর চতুর্দশ লুই অগসবার্গ লীগের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। এই যুদ্ধের প্রধানক্ষেত্র ছিল নেদারল্যান্ডস। ১৬৯২ সালে লা হগের নৌযুদ্ধে ইংরেজরা ফরাসিদের পরাজিত করে। কিন্তু স্টেইন করিক (Stein kerik) ও নিয়ার উইনডেনের (Neerwinden) যুদ্ধে ফরাসিরা ইংরেজ সৈন্যদের পরাজিত করে। ফলে উভয়পক্ষ ১৬৯৭ সালে রাইস উইকের সন্ধি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সন্ধির ফলে চতুর্দশ লুই অধিকৃত রাজ্যসমূহ ফিরিয়ে দিতে রাজি হন। এবং তৃতীয় উইলিয়ামকে (ইংল্যান্ড – ১৬৮৯-১৭০২) ইংল্যান্ডের বৈধ রাজা হিসাবে মেনে নেন। এ সন্ধির ফলে চতুর্দশ লুইয়ের আগ্রাসী নীতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল।

(৪) স্পেনীয় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ

চতুর্দশ লুইয়ের বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধ। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের (১৬৬৫-১৭০০) কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। তাই তিনজন সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীর মধ্যে স্পেনীয় রাজ্য বণ্টনের গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই তিনজন উত্তরাধিকারীর মধ্যে ছিলেন চতুর্দশ লুইয়ের পুত্র ফিলিপ (Duke of Anjau), ব্যাভেরিয়ার যুবরাজ জোসেফ ফার্ডিনান্দ, অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম লিওপোল্ডের (১৬৫৮-১৭০৫) পুত্র অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক চার্লস (যিনি পরে তার বড় ভাই প্রথম জোসেফের (১৭০৫-১৭১১) এর পর ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০) হিসাবে পবিত্র রোমান সম্রাট হন)। এরা সকলেই ছিলেন স্পেনের রাজ পরিবারের দৌহিত্রকুলের সন্তানসন্ততি। স্পেনের মতো বিশাল দেশ এককভাবে শুধু ফ্রান্স বা অন্য কোনো দেশ প্রাপ্ত হলে ইউরোপের শক্তিসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই স্পেনের সিংহাসনের উত্তরাধিকার সমস্যার শান্তিপূর্ণ। সমাধানের জন্য ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় ১৬৯৮ সালে স্পেনীয় রাজ্য প্রথম বাটোয়ারা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে জার্মানির ব্যাভিরিয়ার যুবরাজ স্পেনীয় সাম্রাজ্যের এক বিশাল অংশের উত্তরাধিকার লাভ করেন। কিন্তু ১৬৯৯ সালে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করলে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৭০০ সালে পুনরায় দ্বিতীয় বাটোয়ারা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই বাটোয়ারা চুক্তি অনুসারে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের উপর অস্ট্রিয়ার যুবরাজ চার্লসের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয় এবং ফ্রান্সের যুবরাজ ডফিনের পুত্র ও চতুর্দশ লুইয়ের পৌত্র ফিলিপ (Duke of Anjau) স্পেনীয় ইতালির, নেপলস, সিসিলি এবং মিলান লাভ করেন।

বাটোয়ার সন্ধির বা পার্টিশন ট্রিটির ব্যর্থতা : স্পেনীয় সাম্রাজ্যের বাটোয়ারা চুক্তি স্পেনের মতামত ছাড়াই গোপনে সম্পাদিত হয়েছিল। তাই স্পেনরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুসজ্জায় একটি উইল সম্পাদন করেছিলেন। সে উইলে অখণ্ড স্পেনসাম্রাজ্য ফরাসিরাজ চতুর্দশ লুইয়ের পৌত্র ফিলিপ অব অঞ্জুকে দান করা হয়। চতুর্দশ লুই তখন স্পেনের দ্বিতীয় বাটোয়ারা চুক্তি অস্বীকার করে তার পৌত্র ফিলিপের পক্ষ হতে উক্ত উইল গ্রহণ করেন। ফলে স্পেনের সমস্যা যুদ্ধের সৃষ্টি করে।

স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের কারণ :

  • (১) ইউরোপে শক্তিসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আতঙ্কে স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। স্পেনীয় সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বাটোয়ারা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে চতুর্দশ লুই তার পৌত্র ফিলিপের পক্ষ হতে সমগ্র স্পেনীয় সাম্রাজ্য গ্রহণ করেন এবং পৌত্র ফিলিপকে স্পেন ও ফ্রান্স উভয় রাষ্ট্রের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে ইউরোপের শক্তিসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং বাটোয়ারা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড ও অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ ক্ষুব্ধ হয়।
  • (২) চতুর্দশ লুই হল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী সীমান্ত অঞ্চলে নেদারল্যান্ডসের দুর্গসমূহ থেকে হল্যান্ডের সেনাবাহিনী বহিষ্কার করে ফরাসি সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেন। এভাবে লুই হল্যান্ডের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বিপন্ন করে তোলেন। ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা ছিল বিধায় চতুর্দশ লুইয়ের অভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য তৃতীয় উইলিয়াম দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।
  • (৩) রাইস উইকের সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে চতুর্দশ লুই ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট বংশীয় পলাতক রাজা দ্বিতীয় জেমসের (১৬৮৫-১৬৮৮) পুত্রকে ইংল্যান্ডের ন্যায়সঙ্গত রাজা বলে ঘোষণা করেন। চতুর্দশ লুইয়ের এ আচরণে ইংল্যান্ডের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। কারণ এটি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে প্রোটেস্ট্যান্ট উত্তরাধিকার দাবি অগ্রাহ্য করে ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের সকল বিধি ব্যবস্থাকে আঘাত করেছিল। এ ছাড়া এটি ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ফ্রান্সের অবৈধ হস্তক্ষেপ হিসাবে মনে করত ইংল্যান্ড অধিবাসীগণ।

উল্লিখিত প্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের অনেক দেশ চতুর্দশ লুইয়ের আচরণে ক্ষুব্ধ হয় এবং তার পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামকে (ইংল্যান্ড – ১৬৮৯-১৭০২) এ রাজনৈতিক ইস্যুকে কূটনৈতিক দক্ষতায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কাজে লাগান। তিনি ইংল্যান্ড, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে এক রাষ্ট্র জোট গঠন করেন। পর্তুগাল এবং স্যাভয় পরবর্তীকালে এই রাষ্ট্র জোটে যোগদান করে। এই বাষ্ট্র জোটের উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্স ও স্পেনের একত্রিকরণ বন্ধ করা এবং স্পেনের সিংহাসনের উপর (আর্চডিউক চার্লস অব অস্ট্রিয়ার দাবি সমর্থন করা। এ নিয়ে চতুর্দশ লুইয়ের সাথে তৃতীয় উইলিয়াম গঠিত রাষ্ট্র জোটের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭০২ সালে এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা ইউট্রেকটের সন্ধির (Peace of utrecht) দ্বারা ১৭১৩ সালে সমাপ্তি ঘটে।

স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের ঘটনাবলি : ১৭০১ সালে হতে ১৭১৩ সালে পর্যন্ত ১৩ বছর স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধ চালু ছিল। ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং সামুদ্রিক যুদ্ধে চতুর্দশ লুইকে শক্তি সমবায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হয় প্রথম ইতালিতে। প্রিন্স উইজিনীর তৎপরতায় ফরাসী সৈন্যবাহিনী ইতালিতে প্রতিরোধের সম্মুখিন হয় এবং পরাজিত হয়। ১৭০৪ সালে ফরাসি সৈন্যবাহিনী অস্ট্রিয়া আক্রমণ করলে ব্লেন হিমের যুদ্ধে প্রিন্স ইউজিনি ও ডিউক অব মার্লবোরোর হাতে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়। ১৭০৬ সালে নেদারল্যান্ডসের র‍্যামিলিস নামক স্থানের যুদ্ধে মার্লবোরো ফরাসি সৈন্যবাহিনীকে পুনরায় পরাজিত করে। ১৭০৬ সালে ইউজিনি টুরিনের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৭০৯ সালে ইতালি থেকে ফরাসি সৈন্য বাহিনীকে বহিষ্কৃত করা হয়। এর পর ১৭১০ সালে ওডেনার্ড ম্যালপ্লেকুরেটের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফরাসি সৈন্য নেদারল্যান্ডস ত্যাগ কবে। জলযুদ্ধে ইংরেজ নৌবাহিনী ফরাসিদের পরাজিত করে সময় ভূমধ্যসাগরের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। কেবল স্পেনে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় চতুর্দশ লুইয়ের সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হয়েছিল। সেখানে আলমামাঞ্জা (১৭০৭), ব্রিহেগ ও ভিয়া ভিসিওসার যুদ্ধে ১৭১০ পরাজিত হয়ে শক্তি সমবায়ের সৈন্য স্পেন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

যুদ্ধের সমাপ্তি : স্পেনীয় উত্তরাধিকারের যুদ্ধে যখন ফরাসি সৈন্যবাহিনী বিপর্যন্ত অবস্থায় ছিল তখন ১৭১১ সালে সম্রাট প্রথম জোসেফ (১৭০৫-১৭১১) (আর্চডিউক চার্লসের ভ্রাতা) মৃত্যুবরণ করেন। আর্ক ডিউক চার্লস ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০) উপাধি ধারণ করে সম্রাট পদ লাভ করেন। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্ব পরিবর্তন হয়। পূর্বে আর্চডিউক চার্লসকে স্পেনের সিংহাসনে বসানোর যে আগ্রহ ছিল সে আগ্রহ স্বভাবতই তখন আর ছিল না। কারণ ফ্রান্সকে স্পেনের সিংহাসন অধিকার করতে দিলে ইউরোপীয় শক্তিসাম্য বিনষ্ট হওয়ার যে আশঙ্কা ছিল এখন সম্রাট ষষ্ঠ চার্লসকে স্পেনের সিংহাসন অধিকার করতে দিলে অনুরূপ ফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের মন্ত্রীসভার পরিবর্তন হয়েছিল এবং ১৭১১ সালে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সাথে এক গোপন চুক্তি সম্পাদন করে যুদ্ধ ত্যাগ করে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধ উভয় পক্ষের মধ্যে অধৈর্যের সৃষ্টি করেছিল। এ সকল কারণে ১৭১৩ সালে ইউট্রেক্টের সন্ধির মাধ্যমে স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান ঘটে।

ইউট্রেক্টের সন্ধি

ইউট্রেক্টের সন্ধি ইউরোপের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধ এ সন্ধির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ১৭১১-১২ সালে ইউট্রেক্টের সন্ধি এবং পরে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্স ও অপরাপর শক্তিবর্গের মধ্যে ব্যাস্টেডেট ও ব্যাডেনের সন্ধি – এ তিনটি সন্ধির শর্তাদি একত্রে ইউট্রেক্টের সন্ধি নামে পরিচিত। এ সন্ধির ফলে সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সন্ধির শর্তাবলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

  • (১) চতুর্দশ লুইয়ের পৌত্র ফিলিপ অব আঞ্জোকে স্পেনের রাজা বলে স্বীকার করা হয়, যিনি পঞ্চম ফিলিপ (১৭০০-১৭৪৬) নাম নিয়ে স্পেনের শাসক হন। কিন্তু স্পেন ও ফ্রান্সের সিংহাসন একই ব্যক্তির অধীনে রাখা হবে না এ শর্ত ফ্রান্সকে মেনে নিতে হয়।
  • (২) অস্ট্রিয়াকে সার্ডিনিয়া, ন্যাপলস, মিলান এবং নেদারল্যান্ডস ফিরে দেখা হয়, কিন্তু নেদারল্যান্ড ওলন্দাজদেরকে ফ্রান্সের আক্রমণ হতে আত্মরক্ষার জন্য কয়েকটি দুর্গ স্থাপনের অধিকার দেয়া হয়।
  • (৩) ফ্রান্সকে আলসেস ও স্টাসবার্গ অধিকার করতে দেয়া হয়। কিন্তু রাইন নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ফ্রেইবার্গ, কেহল ও ব্রাইসাক অস্ট্রিয়াকে ফিরিয়ে দিতে হয়।
  • (৪) ইংল্যান্ড এ সুযোগে জিব্রালটার, মিনার্কা, নিউফাউন্ডল্যান্ড, হাসডন উপসাগরীয় অঞ্চল, কিটস অ্যাকেডিয়া ইত্যাদি স্থান লাভ করে। কয়েকটি শর্তাধীনে স্পেনের আমেরিকানস্থ উপনিবেশে বাণিজ্য করার অধিকারও ইংল্যান্ড প্রাপ্ত হয়। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে হ্যানোভার রাজবংশের অধিকার স্বীকৃত হয়।
  • (৫) বেভারিয়ার ইলেক্টর ও কলনের ইলেক্টর নিজ নিজ রাজ্য ফিরে পান।
  • (৬) প্রাশিয়ার ইলেক্টরকে রাজা উপাধি দেয়া হয়। এটি ভিন্ন গিল্ডারল্যান্ডের একাংশ প্রাশিয়াকে দেয়া হয়।
  • (৭) স্যাভয়ের ডিউককে নিজ দেশ স্যাভয় ও নিস দেশ ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সিসিলি ও মিলানের একাংশ দেয়া হয়।

ইউট্রেক্টের সন্ধি ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আমূল পরিবর্তন সূচিত করে। নিম্নে এ সন্ধির ফলাফল আলোচনা করা হল—

  • (১) ইউট্রেক্টের সন্ধি সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
  • (২) ফ্রান্সের রাজ্য গ্রাস নীতি প্রতিহত হল ও শক্তি সাম্য নীতির জয় হল।
  • (৩) মূল নীতির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ইউট্রেক্টের সন্ধিকে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পরিপূরক বলা যেতে পারে। এ সন্ধির দ্বারা প্রমাণিত হল যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সম্মিলিতভাবে অপরের সম্পত্তি যথেচ্ছভাবে বণ্টন করতে পারে। এরূপ বণ্টন কার্য প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের অধিবাসীদের মতামত গ্রহণের কোনো প্রয়োজনই মনে করেনি।
  • (৪) ইংল্যান্ডের উপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রাধান্য পথ এ সন্ধির ফলে সহজ হল।
  • (৫) ইউরোপীয় শক্তি সাম্য নীতির সাফল্য এ সন্ধিতে প্রমাণিত হল। কোনো শাসক অত্যধিক ক্ষমতাশালী হলে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় সে শক্তিকে দমন করতে পারবে এটি ফ্রান্সের দৃষ্টান্ত হতে প্রমাণিত হল।
  • (৬) ফ্রান্সের অর্থবল ও লোকবল যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ ইউট্রেক্টের সন্ধিকে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইউরোপের ইতিহাসে একমাত্র ভিয়েনার সন্ধি ভিন্ন অপর কোনো আন্তর্জাতিক সন্ধির এরূপ বিরুদ্ধ সমালোচনা করা হয় নি। ঐতিহাসিক ওয়াকম্যানের মতে, এ সন্ধির শর্তাদি ক্ষুদ্র স্বার্থের দৃষ্টিতে বা বিভিন্ন দেশের স্বার্থের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

  • প্রথমত, ১৭১১-১২ সালে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। অপরাপর শক্তিবর্গকে ইংল্যান্ড এ ব্যাপারে অবহিত না করেই নিজ স্বার্থ সিদ্ধি হওয়া মাত্রই যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে। এরূপ আচরণ হীন মনোবৃত্তির পরিচায়ক সন্দেহ নেই। এটি ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের সততায় অরিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের প্ররোচনায়ই স্পেন সাম্রাজ্যাধীন সেভেনয় ও কাটালন উপজাতিগুলো স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাদের নিরাপত্তা বিধানের কোনো শর্ত না রেখেই তাদেরকে স্পেন রাজ পঞ্চম ফিলিপের দয়ার উপর ছেড়ে দেয়া ইংল্যান্ডের পক্ষে নীচ স্বার্থপরতার কাজ হয়।
  • তৃতীয়ত, আফ্রিকার সাম্রাজ্য রক্ষা স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম ছিল। কিন্তু ইউট্রেক্টের সন্ধিতে আলসেসের উপর ফ্রান্সের প্রাধান্য স্বীকার করে অস্ট্রিয়ার প্রতি অবিচার করা হয়েছিল।

ইউরোপীয় রাজনীতির দিক হতে বিচার করলেও এ সন্ধির ত্রুটি পরিলক্ষিত হবে। পরের সম্পত্তি ইচ্ছামত বণ্টন করার যে অবাধ অধিকার ইউরোপীয় রাজনীতিগণ এ সন্ধিতে দেখিয়েছিলেন তার বিষময় ফল সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ সন্ধির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার পরবর্তীকালে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ, তুরস্ক সাম্রাজ্য ভাগ, সাইলেশিয়া আক্রমণ প্রভৃতি হীনস্বার্থপরতা সংঘটিত হয়। ইউট্রেক্টের সন্ধি ইউরোপীয় কূটনৈতিক ইতিহাসে নীতিজ্ঞানহীনতা এবং নীচ স্বার্থপরতা দোষে দুষ্ট করেছিল।

ইউট্রেক্টের সন্ধির ফলাফল :

  • (১) ইউটেক্টের সন্ধির সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাসের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
  • (২) এ সন্ধি চতুর্দশ লুইয়ের সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতিকে প্রতিহত করে ইউরোপে শক্তিসাম্য বজায় রাখে।
  • (৩) এর আদর্শগত প্রকৃতি বিবেচনা করলে ইউট্রেক্টের সন্ধিকে ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির পরিপূরক বলা যায়। এই সন্ধি প্রমাণ করেছিল যে, ইউরোপীয় বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে অপরের রাজ্য ও সম্পত্তি ইচ্ছামতো বণ্টন করতে পারে। এতে বণ্টন কার্যে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট জনগণের মতামত গ্রহণের কোনো প্রয়োজন মনে করত না।
  • (৪) ইংল্যান্ডের উপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা করলে এ সন্ধি ইংল্যান্ডের জন্য সুবিধাজনক ছিল।
  • (৫) এ সন্ধির মাধ্যমে ইউরোপের শক্তিসাম্য নীতির কার্যকারিতার সফলতা প্রমাণিত হয়েছিল। কোনো শক্তি অত্যধিক ক্ষমতাশালী হলে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় সে শক্তিকে দমন করতে পারে, এ দৃষ্টান্ত প্রমাণিত হয়েছিল। এ সন্ধির ফলে ফ্রান্সের অর্থবল ও জনবল যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষয় হয়েছিল।

ইউট্রেক্টের সন্ধিতে ইংল্যান্ডের সুবিধা লাভ : ইউট্রেক্টের সন্ধিতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক সাময়িক সবক্ষেত্রেই সুবিধা লাভ করেছিল।

  • ইংল্যান্ড ফ্রান্সকে স্পেনের সিংহাসন ফরাসি সিংহাসনের সাথে যুক্ত হবে না, এ প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল। এর ফলে ফ্রান্সের স্পেনীয় আমেরিকাস্থ উপনিবেশ ও বাণিজ্য লাভ করে ইংল্যান্ড অপেক্ষা ফ্রান্স ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়েছিল।
  • ১৬৬২ সালে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের কাছ থেকে ডানকার্ক বন্দর কিনে নিয়েছিল। এরপর থেকে ডানকার্ক ফ্রান্সের প্রধান সামরিক নৌপোতাশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল। এ বন্দর সামরিকভাবে সুরক্ষিত ছিল। চতুর্দশ লুই ইউট্রেক্টের সন্ধির শর্তানুসারে এ বন্দর দুর্গ ভেঙে নিতে বাধ্য হন। এ ছাড়া উত্তরসাগর (North Sea) হতে নামুর পর্যন্ত এক সারি ওলন্দাজ দুর্গ নির্মাণের অধিকার হল্যান্ডকে দান করার ফলে হল্যান্ড, ফ্ল্যান্ডার্স প্রভৃতি স্থান ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ আক্রমণের আশঙ্কা হতে রক্ষা পায়। ইংল্যান্ড প্রয়োজনবোধে ওলন্দাজ দুর্গ রক্ষার অধিকার লাভ করে। ফলে ভবিষ্যতে ফরাসি আক্রমণ প্রতিরোধ করা ইংল্যান্ডের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের পৌত্র পঞ্চম ফিলিপের নিকট হতে জিব্রাল্টার ও মিনরকা লাভ করে ইংল্যান্ড ভূমধ্যসাগরে প্রভুত্ব স্থাপনের সুযোগ পেয়েছিল।
  • ইংল্যান্ড নিউফাউন্ডল্যান্ড, হাডসন উপসাগরীয় অঞ্চল এবং নোভাস্কশিয়া লাভ করার ফলে আটলান্টিক মহাসাগরে এবং এর উপকূল রেখার উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়। এ সুযোগ লাভ করে ইংল্যান্ড আমেরিকায় ফরাসি উপনিবেশ গ্রাস করার নীতি কানাডা পরিবেষ্টন করে রাখার নীতি অনুসরণ করে।
  • ইংল্যান্ড স্পেনের আমেরিকাস্থ উপনিবেশে দাস ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। এ চুক্তির ফলে ঈংল্যান্ড কতকগুলো শর্তাধীনে আমেরিকায় ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছিল। এভাবে ইংল্যান্ড ইউট্রেক্টের সন্ধিতে নিজ স্বার্থ ও সুবিধা কৌশলে আদায় করে নিয়েছিল।

ইউট্রেক্টের সন্ধি ও ফ্রান্স : ইউট্রেক্টের সন্ধিতে ফ্রান্সের প্রাপ্তি ছিল খুবই কম। এ সন্ধিতে ইংল্যান্ড যে পরিমাণ স্বার্থসিদ্ধি করেছিল ফ্রান্স ততটুকুক স্বার্থ হারিয়েছিল। যুদ্ধে ফ্রান্সের অর্থ ও জনবল অধিক ক্ষতি হযেছিল। চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০), রিশল্যু (১৬২৪-১৬৪২) ও ম্যাজারিনের (১৬৪২-১৬৬১) আমলে ফ্রান্স যে অগ্রগতি হাসিল করেছিল ইউট্রেক্টের সন্ধির সে অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিয়েছিল।

  • যদিও পূর্বদিকে রাইন নদী তখনো ফ্রান্সের সীমায় থেকে গিয়েছিল কিন্তু রাইন নদীর পূর্বতীরের স্থানগুলোর, যথা – ফ্রেইবার্গ, কেহল, ব্রাইসাক অস্ট্রিয়াকে প্রত্যর্পণের ফলে ফ্রান্স তখন থেকে আত্মরক্ষামূলকনীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য রাইন উপকূল অঞ্চল ফ্রান্সের জন্য আর সহায়ক ছিল না।
  • ওলন্দাজদের দুর্গ তৈরি করার অধিকার দেওয়ায় নেদাল্যান্ডস অঞ্চলে ফ্রান্সের শক্তি প্রতিহত হয়েছিল।
  • আল্পস পর্বতের দিকে স্যান্ডয়ের ডিউককে নিস ও স্যাভয় ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে ঐ অঞ্চলেও ফ্রান্সের প্রতিযোগী শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল।
  • প্রাশিয়াকে রাজতন্ত্রে পরিণত করে ফরাসি আক্রমণ হতে জার্মানি রক্ষার ভার প্রাশিয়ার উপর দেওয়া হয়। এভাবে ফ্রান্স চতুর্দিকে প্রতিযোগিতা শক্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়।

ইউট্রেক্টের সন্ধি ও অস্ট্রিয়া : ইউট্রেক্টের সন্ধি অস্ট্রিয়ার পতন স্বীকার করে নিয়েছিল। তবে অস্ট্রিয়াকে সার্ডিনিয়া, ন্যাপলস, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি প্রদান করে ভবিষ্যতে ফ্রান্সের শক্তিবৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। তথাপি অস্ট্রিয়ার পক্ষে দূরবর্তী সার্ডিনিয়া, ন্যাপলস, নেদারল্যান্ড সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন ছিল। প্রাশিয়াকে রাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকার করে জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য খর্ব করা হয়েছিল। ক্রমে প্রাশিয়া জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বিলুপ্ত করেছিল।

ইউট্রেক্টের সন্ধি ও হল্যান্ড : ইউট্রেক্টের সন্ধিতে হল্যান্ড নিজ স্বার্থ অপেক্ষা ইংল্যান্ডের স্বার্থ বড় করে দেখেছিল। কারণ সে সময় ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। হল্যান্ড ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হীনবল হয়ে পড়েছিল। ইউট্রেক্টের সন্ধি ফলে হল্যান্ড স্পেনে বাণিজ্য করার অধিকার এবং ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে নেদারল্যান্ডসে দুর্গ তৈরির সুবিধা পেয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফ্রান্সকে দুর্বল করে হল্যান্ড ইংল্যান্ডের স্বার্থ উদ্ধার করেছিল মাত্র।

চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য

চতুর্দশ লুইয়ের পররাষ্ট্রনীতি কতটা সফল হয়েছিল এবং ফ্রান্সের পক্ষে এই নীতি কতটুকু সুফল বয়ে এনেছিল তা বিস্তৃত আলোচনা করা যেতে পারে। তার পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি কতটুকু বিচক্ষণতা অনুসরণ করেছিলেন এবং তার অনুসৃত পন্থা যথার্থ ছিল কিনা তা আলোচনার প্রয়োজন।

চতুর্দশ লুই কয়েকজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদের একান্ত সুরদর্শীতার সুবাদে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা দেখতে পেরেছিলেন। ১৬৬১ সালে চতুর্দশ লুইয়ের প্রধান উপদেষ্টা ম্যাজারিন মৃত্যুবরণ করলে চতুর্দশ লুই স্বহস্তে শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ঐ সময় ইউরোপের রাজনীতির ক্ষেত্রে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওয়েস্টফেলিয়া ও পিরেনেজের সন্ধি ফ্রান্সের অনুকূলে ছিল এবং এর বদৌলতে ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সময় অস্ট্রিয়া ও স্পেনের হ্যাপসবার্গ রাজপরিবারের ক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়েছিল। পিরেনিজ পর্বতমালা এবং আল্প্স পর্বত ফ্রান্সের সীমান্তকে সুরক্ষা দিয়েছিল। উত্তর-পূর্বে নেদারল্যান্ডের সীমা ও ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য কোনোরূপ হুমকি ছিল না। পূর্বদিকে রাইন নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ফ্রান্সের শাসনাধীনে ছিল। ফ্রান্সের এই প্রাকৃতিক সীমারেখা পূর্ববর্তী শাসকগণ নির্বিঘ্ন রাখায় চতুর্দশ লুইয়ের পক্ষে কোনোরূপ নিরাপত্তা হুমকি ছিল না। চতুর্দশ লুই ফ্রান্সের অভিপ্রেত প্রাকৃতিক সীমারেখা প্রায় অর্জন করেছিলেন।

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সামরিক সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রাচুর্য নিশ্চিত করতে হয়। প্রথম দিকে ফ্রান্সের আর্থিক প্রাচুর্য পরিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু কোলবার্টের অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ফ্রান্সের রাজকোষ পরিপূর্ণ হয়। ডিভল্যুশনের যুদ্ধে ফ্রান্সের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব চতুর্দশ লুইয়ের মনে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। তার সময়কার ফ্রান্সের শক্তিবৃদ্ধি ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের মনে ভীতির সঞ্চার করে, যার দরুন শক্তিসাম্য রক্ষার জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে সামরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে নেদাল্যান্ডসে লিলি, টুরনে, সালেবয় ইত্যাদি দশটি শহর লাভ করায় ফ্রান্সের উত্তরপূর্ব সীমান্ত আরো সুরক্ষিত হয়েছিল। ১৬৭১ সালকে ঐতিহাসিকগণ ফ্রান্সের ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণ মনে করেন। ঐ বৎসরের পূর্বেই বিশল্যু, ম্যাজারিন ও কোলবার্টের প্রচেষ্টায় ফ্রান্স ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দখল করেছিল। আমেরিকা, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভারতীয় উপমহাদেশ, পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি সকল স্থানে ফ্রান্স উপনিবেশ ও বাণিজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের সময় ফরাসি ধর্মযাজকগণ চীন দেশে ফরাসি প্রভাব বিস্তারে অনেকটা সফল হয়েছিল। ইউরোপের প্রত্যেক দেশে ফ্রান্স ছিল আদর্শ রাষ্ট্র এবং সকল ইউরোপীয় রাষ্ট্র ফ্রান্সকে সম্মান জানাত। লেভান্টের বাণিজ্য ব্যাপারেও তৎকালীন ফ্রান্স তুরস্কের সুলতানদের কাছ থেকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল।

চতুর্দশ লুই দুই পন্থায় ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধির পন্থা নির্ধারণ করেছিলেন – (১) বাণিজ্যিক উপনিবেশিক প্রাধান্যের পথ ও (২) রাজনৈতিক প্রাধান্যের পথ। এই দুই পন্থার মধ্যে প্রথমটির সম্ভাবনা ছিল নিশ্চিত। কারণ এ সময় স্পেন ও পর্তুগালের বাণিজ্যিক ও উপনিবেশিক প্রাধান্যের অবস্থা শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ পতন পর্যায়ে ছিল। ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী ফরাসি জাতির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার শক্তি হল্যান্ডের ছিল না। ইংল্যান্ড তখন পর্যন্ত উপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গঠনে বিশেষ তৎপর হয় নি। তবে সামরিক প্রাধান্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রাধান্যের পথ ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু চতুর্দশ লুই এই বিপজ্জনক পদ গ্রহণ করেছিলেন।

ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিচারে চতুর্দশ লুইয়ের সামরিক প্রাধান্যের পথ গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত ছিল না। কিন্তু ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঐতিহ্য, তার সামরিক শক্তি বিশেষ করে লুভো, টুরেন, কন্ডি, ভেরিন প্রভৃতির ন্যায় সামরিক সেনাপতিদের আনুগত্য ও সেবা, কোলবার্টের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, চতুর্দশ লুইয়ের উচ্চ বিলাস ও গৌরব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা চতুর্দশ লুইকে সামরিক পথ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক আদর্শ এবং ইউরোপীয় বৃহৎ দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা চতুর্দশ লুইকে আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতি গ্রহণে প্ররোচিত করেছিল।

চতুর্দশ লুইয়ের আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতির সাফল্যের একমাত্র নিদর্শন নাইমুইজেনের সন্ধি। এ সন্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের প্রাধান্য ও শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল এ সন্ধির মাধ্যমে ফ্রোইবার্গ ও ফ্রেঞ্চ কমেটি লাভ করার ফল ফ্রান্সের সীমারেখা অধিকতর সুদৃঢ় হয়েছিল। কিন্তু এই সফলতা ও উন্নতির পশ্চাতে চতুর্দশ লুইয়ের নৈতিক পরাজয় নিহিত ছিল। হল্যান্ডকে তিনি সামরিক শক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি এবং ওলন্দাজরা তার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের পথে প্রতিরোধ তৈরি করেছিল।

চতুর্দশ লুই পরবর্তী ক্ষেত্রে একা যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন তা কূটনৈতিক বিচারে যথেষ্ট দূরদর্শিতাপূর্ণ ছিল না। তিনি ইউরোপীয় শক্তি জোটের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য কোনো কূটকৌশল গ্রহণ করেন নি। এটি তার জন্য পতন ত্বরান্বিত করেছিল। অগসবার্গের যুদ্ধে তিনি কিছুই লাভ করেন নি। উপরন্তু রাইসুইকের সন্ধি দ্বারা তাকে রি-ইউনিয়ন নীতির প্রযোগে অধিকৃত স্থানসমূহ ত্যাগ করতে হয়েছিল। একমাত্র স্ট্রাসবার্গ ফ্রান্সের অধিকারে ছিল। অগসবার্গের যুদ্ধ চতুর্দশ লুইয়ের পতনের ও ব্যর্থতার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। তিনি অদূরদর্শী ও বুদ্ধিহীনের মতো ভেবেছিলেন পরবর্তী চেষ্টার মাধ্যমে পূর্ববর্তী ক্ষতি পুষিয়ে নিবেন। কিন্তু সেটি সম্ভব কিনা তা বিবেচনা করার দূরদর্শিতা তার ছিল না।

স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্পেনীয় উত্তরাধিকার সমস্যায় তিনি দ্বিতীয় চার্লসের দ্বিতীয় উইল গ্রহণ করে অশান্তির সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি এর পূর্ববর্তী তিনটি যুদ্ধের ফলাফল বিবেনচায় নেন নি। তার অহংকার, আত্মবিশ্বাস এবং নিজ বুদ্ধির উপর অধিক নির্ভর করে নিজকে এক বিশাল যুদ্ধে জড়িত করেন। যুদ্ধ শেষে ইউট্রেক্টের সন্ধিতে ফ্রান্সকে ইউরোপের সর্বপেক্ষা শক্তিশালী দেশ হিসাবে স্বীকার করা হলেও ফ্রান্স কোনো প্রত্যাশিত সুবিধা দেয় নি। তার পৌত্র স্পেনের সিংহাসন লাভ করলেও এজন্য ব্যয়িত শ্রম, অর্থ ও সামরিক শক্তিক্ষয় প্রভৃতির সমীকরণ বিবেচনায় নিলে এর দ্বারা ফ্রান্স খুব একটা সুফল পেয়েছিল তা জোর করে বলা যায় না।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৮২-২০৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.