সপ্তদশ শতকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো, বিজ্ঞান, কৃষি ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ

সপ্তদশ শতকের সামাজিক অবস্থা

সপ্তদশ শতকে ইউরোপের সমাজব্যবস্থা ছিল সামন্তকেন্দ্রিক। তবে এ সময়ে সামন্ততন্ত্র অনেকটা দুর্বল থাকায় শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে ওঠেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি রাজ্যে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সামন্তরা রাজতন্ত্রের সহকারী হিসেবে অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা পালন করত। সমাজে রাজতন্ত্রের খুবই প্রভাব ছিল। রাজতন্ত্রের নিম্নস্তরে সমাজ সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত এই দুইভাবে বিভক্ত ছিল। সুবিধাভোগীদের মধ্য ছিল যাজক ও অভিজাত শ্রেণি, সামাজিক সুবিধার দিক থেকে যাজকরা প্রথম শ্রেণি এবং অভিজাতরা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল। সমাজে বসবাসকারী কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, প্রমুখ সাধারণ মানুষ তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল। সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা সম্মান সবই ছিল যাজক ও অভিজাতদের কুক্ষিগত। তারা এই সামাজিক সুবিধাকে ঈশ্বরের অভিপ্রায় হিসেবে মানুষকে বুঝাত। খ্রিস্টধর্ম এই শ্রেণি স্বার্থকে অনেকটা স্বীকার করে নিয়েছিল। যাজক ও অভিজাতরা তাদের এই সামাজিক সুবিধা হিসেবে ভূমির মালিকানা ও নানা সরকারি পদ দখল করত।

যাজক শ্রেণি : যাজকরা উপাসনা ছাড়া শিক্ষাদান, দরিদ্র সেবা, জন্ম, মৃত্যু হিসাব রাখা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্ব পালন করত। সপ্তদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গির্জা ও মঠের মালিকানাধীন প্রচুর সম্পত্তি ছিল। এতে গির্জার প্রচুর আয় হত। এ ছাড়াও গির্জা টাইর্থ বা ধর্ম কর থেকেও প্রচুর অর্থ পেত। গির্জার অন্যান্য আয়ের উৎস ছিল মৃত্যু কর, প্রার্থনা কর, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন কর ইত্যাদি। গির্জার অধীনস্ত যাজকদের মধ্যেও আবার শ্রেণিভেদ ছিল। বিশপরা ছিল উচ্চ যাজক শ্রেণি এবং এদের অধিকাংশই অভিজাত পরিবারের মানুষ ছিলেন। গির্জার জমিদারি আয় এবং গির্জার বিভিন্ন উপস্বত্ব তারা ভোগ করত। ধর্মের ধারক ও বাহক হিসাবে সমাজে এদের প্রতিপত্তি ছিল। উচ্চ যাজকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করত এবং শাসন কার্যেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল।

অভিজাত শ্রেণি : সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাশীল শ্রেণি হিসেবে অভিজাতদের বিশেষ প্রভাব ছিল। ভূমি ছিল তাদের ক্ষমতা ও আভিজাত্যের ভিত্তি। এই অভিজাত শ্রেণি কালক্রমে রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে থাকে। পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, জার্মান প্রভৃতি দেশে অভিজাতরা খুবই শক্তিশালী ছিল। অভিজাতরা ভূমি ও কৃষকের উপর অনেক অধিকার ভোগ করত। বংশানুক্রমিকভাবে জমিতে তালের মালিকানা স্বীকৃত ছিল। রাষ্ট্রের অধিকাংশ ভূমি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে তারা বহু ছাড় ও সুবিধাভোগ করত। অভিজাত পরিবারগুলোর নিয়ন্ত্রণে ইউরোপের বড় বড় ম্যানর ছিল। এই ম্যানরগুলো যাতে খণ্ডিত না হয় অর্থাৎ সন্তানদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাতে ছোট না হয়ে পড়ে এজন্য Law of Primo geniture আইন বা জ্যেষ্ঠত্বের অধিকার আইন স্বীকৃত ছিল অর্থাৎ তুমি অধিকারীর জ্যেষ্ঠপুত্র পিতার জমিদারিতে উত্তরাধিকার লাভ করত।

অভিজাতদের প্রধান অধিকার ছিল বংশ কৌলিন্য এবং তা ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত। অভিজাতরা নিজ সম্প্রদায় ছাড়া জন্য অসম্প্রদায়ের সহিত বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করত না। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশে অভিজাতদের নাম সরকারের তালিকাভুক্ত (Registered) থাকত। অভিজাতরা শিকার, বিভিন্ন ক্রিড়া প্রভৃতির মাধ্যমে চিত্তবিনোদনের সুযোগ পেত। তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা নির্বাহকারী শ্রমজীবী মানুষকে অভিজাতরা ঘৃণার চোখে দেখত। অভিজাতরা তাদের সামাজিক মর্যাদা (কৌলিন্য) ও অধিকার রক্ষার জন্য সদাসচেষ্ট থাকত। এজন্য অভিজাত পরিবার তাদের সন্তানদের সামরিক শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং আভিজাত্যের নানা বিষয় শিক্ষা দিত। কৃষক ও ভূমিদাসদের নিকট থেকে অভিজাতরা তাদের জমিদারিতে সামন্তকর আদায় করত। ইউরোপে ম্যানর প্রথা বা খামার প্রথা প্রতিষ্ঠা হলে এগুলো অভিজাতদের নানা আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছিল। তা ছাড়াও রাজার সভাসদ, সেনাপতি, উচ্চ কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার একচেটিয়া অধিকার অভিজাতদের ছিল। এরা যুদ্ধবিগ্রহ শাসনকার্য প্রভৃতি বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ ও সহায়তা দিত।

ভূমিদাস প্রথা (Serfdom) : সপ্তদশ শতকে ইউরোপে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জার্মানি, বেভেরিয়া, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশের কৃষকরা ছিল ভূমিদাস (Serf)। জমিদার অর্থাৎ অভিজাত শ্রেণির জমিচাষ তাদের জন্য নানা ধরনের দৈহিক কাজ- কর্ম তাদেরকে করতে হত। তারা একখণ্ড জমি নিজেদের ভরণপোষণের জন্য পেত। জমি ত্যাগ করে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভূমিদাসকে ম্যানরে সামন্ত প্রভুর জমিতে কাজ করতে হত। যদিও এ সময় ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন নগর গড়ে ওঠেছিল। এবং সেখানে শিল্পকারখানায় ভূমিদাসদের কর্মসংস্থান হলেও তাদেরকে ম্যানর ত্যাগ করতে দেওয়া হত না। পরবর্তী শতাব্দীতে অনেক দেশে শিল্পকারখানায় অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দিল। পুঁজিপতিদের চাপে রাজাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করতে হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে একমাত্র রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক কারণে ভূমিদাস প্রথা উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে এই ভূমিদাসরাই পরবর্তীকালে শিল্পশ্রমিকের পেশা গ্রহণ করেছিল।

বণিক শ্রেণী : পঞ্চাশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণে বণিক শ্রেণি সমাজে ধনী শ্রেণিতে পরিণত হয়। সমাজে বণিক সম্প্রদায়, কারখানা মালিক ও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়। এই শ্রেণি শিক্ষাদীক্ষা অর্থবল সবদিক থেকেই অভিজাত শ্রেণি অপেক্ষা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছিল। এরা ছিল সামাজিক সচেতন গোষ্ঠী। শিল্পপতি, ধনী, ব্যবসায়ী, ধনী-মহাজন, ব্যাঙ্কার, শিক্ষক, উকিল, ঢাকার প্রভৃতি শ্রেণি ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণিগোষ্ঠী। এদেরকে পরবর্তীকালে বুর্জোয়া বলা হত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজ অভিজাত শ্রেণির সুবিধাগুলো ঘৃণা করত। এই শ্রেণিগত দর্মা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।

ইংল্যান্ডের সমাজব্যবস্থা : মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে সামন্তপ্রথা থাকলেও টিউডর রাজবংশের আমলে ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে বণিক শ্রেণির বিকাশ হয়। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে বণিক শ্রেণি সমাজে প্রভাবশালী ছিল এবং অভিজাতরা অধিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে অভিজাত ও বণিকশ্রেণির মধ্য থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হয়। ইউরোপের অপরাপর দেশে অতিজাত শ্রেণিরা জমিভোগ করলেও ন্যায্যহারে কর দিত না। কিন্তু ইংল্যান্ডে সকল শ্রেণির উপর সমানভাবে কর ধার্য করা হত। ইংল্যান্ডে ভূমিদাস প্রথার (Serfdom) উচ্ছেদ এবং Enclosure বা জমি বেষ্টন করার প্রথার প্রচলন হলে ম্যানর প্রথা অবলুপ্ত হয়।

তৃতীয় শ্রেণি (Third State): ইউরোপীয় সমাজে অভিজাত ও যাজক শ্রেণি ছাড়া বাকি সবই ছিল তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত।

  • বুর্জোয়া : ধনী বুর্জোয়া যথা – শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক প্রভৃতির কৌলিন্য প্রথা থাকলেও জন্মগত কৌলিন্যে অভাবে তারা তৃতীয় শ্রেণিভূক্ত ছিল। ফ্রান্সের বুর্জোয়াশ্রেণীকে বলা হত পাতি বুর্জোয়া। এরা ছিল ধনিক শ্রেণি। বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী সম্প্রদায় যথা – শিক্ষক, আইনজীবী, সাধারণ কর্মচারী প্রভৃতিও তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল। এদের মধ্যবিত্ত বা পাতি বুর্জোয়া বলা হত। এই শ্রেণিও কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করত না।
  • কৃষক : তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কৃষকরা। কৃষক শ্রেণি দুভাগে বিভক্ত ছিল। যথা— স্বাধীন কৃষক ও ভূমিদাস। ভূমিদাসরা ভূম্যধিকারী অভিজাতদের নানা কর পরিশোধ করত। যাজকদেরকেও বিভিন্ন রকম ধর্মকর দিতে হত। ভূমিদাসরা তাদের সামন্তদের জমিতে বেগার খাটত। নানারকম করের চাপে ও আর্থিক অনটনে ভূমিদাসদের দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হত। ভূমিদাসদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা ছিল অত্যন্ত কঠোর। ইংল্যান্ডে আবার কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ও বাণিজ্যিক কারণে ভূমিদাস প্রথাও উঠে গিয়েছিল। কারণ ঔপনিবেশিক শক্তিশালী রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক বাণিজ্যিক কারণে ইংল্যান্ডের বাহিরে বাজার গড়ে উঠেছিল, যার ফলে ইংল্যান্ডের কলকারখানায় প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। অর্থনৈতিক কারণেই এই ভূমিদাস প্রথা অলাভজনক ছিল। কৃষক শ্রেণি সমাজের সম্পদ উৎপাদন করত কিন্তু অভিজাত, বুর্জোয়া এবং শহরবাসী বণিকেরা এদের নিচু চোখে দেখত। কৃষকরা ছিল নিরক্ষর, তাই এদেরকে কুৎসিত শ্রেণি মনে করা হতো। তৎকালে ইউরোপে একটি ধারণা ছিল যে কৃষকের জন্ম হয়েছে জমিচাষ করতে, কর দিতে ও সমাজে উচ্চশ্রেণীর সেবা করতে। ইউরোপীয় প্রান্তিক কৃষকরা করভারে জর্জারিত, সামাজিকভাবে শোষিত এবং অভিজাতদের দ্বারা নির্যাতিত ছিল।

মধ্যবিত্তশ্রেণি (Middle Class): সপ্তদশ শতকে ইউরোপে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে বুর্জোয়াদের উত্থান হয়। সাধারণত ধনী বণিক, শিল্পপতি, বিভিন্ন পেশাজীবী, বিশেষ করে অধ্যাপক, আইনজীবী, চিকিৎসক প্রভৃতি বিত্তশালী মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ একই রকম না হওয়ায় এ শ্রেণির প্রভাব সব দেশে সমান ছিল না। ইংল্যান্ডে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণি বিশেষ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছিল। ইংল্যান্ডে শহরের উদ্ভব, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রভাবশালী হতে সাহায্য করে। কালক্রমে ইংল্যান্ডে রাজনীতি বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। বিশেষ করে পার্লামেন্টে এসময় বুর্জোয়াদের প্রভাব ছিল। তবে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্র বহুশক্তির সহায়তা প্রাপ্ত হওয়ায় সেখানে বুর্জোয়াদের প্রাধান্য ছিল না। ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণি বংশ কৌলিন্যের জোড়ে সবকিছু দখল করে রেখেছিল। বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থকৌলিন্যে বলীয়ান হলেও সমাজে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজ বিকশিত না হওয়ায় বুর্জোয়াদের সংখ্যা ছিল সীমিত। অন্ততঃ বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি সরকারি উদাসীনতা, বুর্জোয়া শ্রেণিকে সামন্তশাসনের প্রতি বিরূপ করে তোলে। বুর্জোয়ারা ছিল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সচেতন মানুষ। এজন্য তারা পুরাতন তন্ত্রের প্রতি (Old regime) শ্রদ্ধা হারায়। ইল্যান্ডে মধ্যবিত্তশ্রেণী বুর্জোয়ারা রাজক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করে। এ নিয়ে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের সাথে বুর্জোয়া শ্রেণির বিরোধ দেখা দেয়। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে রাজা ও পার্লামেন্টের বিরোধ মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে রাজশক্তির বা অভিজাত শক্তির বিরোধের প্রমাণ বহন করে এবং এই স্বপ্নে বুর্জোয়া শ্রেণি জয়লাভ করেছিল।

সর্বহারা শ্রেণি (Have not): সপ্তদশ শতকে ইউরোপে গ্রামে ও শহরে একশ্রেণীর ভূমিহীন দিনমজুর ও শ্রমিক ছিল। এদের বাসগৃহ এবং চাষের জমি বলতে কিছু ছিল না। এরা অন্যের জমিতে মজুর খাটত। শহরে এসে এরা কারখানায় কাজ বা গৃহভৃত্যের কাজ করত। অভিজাতরা এই সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীকে সমাজের নিম্নশ্রেণী বলে গণ্য করত। এ ছাড়া ভিক্ষুক ও উপজীবিকাবিহীন লোক ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে বাস করত। তৎকালীন ফ্রান্সের ১/৫ অংশ ছিল উপজীবিকাবিহীন লোক। এরা পরবর্তী শতাব্দীতে প্যারিসের জনতায় (Parisian mob) যোগ দিয়ে রুদ্রমূর্তি রূপ ধারণ করেছিল। এদের নাম হয়েছিল সাকুলোত (Sans-culottes) এ শ্রেণি ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণির ডাকে অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটায়।

সপ্তদশ শতকের অর্থনৈতিক অবস্থা

সপ্তদশ শতকে ইউরোপের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। তবে এ যুগে ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে। ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুবাদে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশ এশিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে। উপনিবেশ স্থাপনের ফলে এ সকল দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে ইউরোপে মূলধন সঞ্চিত হতে থাকে। এই সামুদ্রিক বাণিজ্যের কারণে যৌথ শিল্প, কারকাখানা প্রথা, ব্যাংকিং বাণিজ্য প্রসার ঘটে। এই অর্থনৈতিক প্রসারে সমাজে বণিকশ্রেণী সবচেয়ে ধনী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তবে এ সময় পর্যন্ত ভূমি সমাজে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বণিকরা বাণিজ্যে প্রচুর অর্থ আয় করে সেই অর্থে জমি কেনে। ভূম্যধিকারী হওয়াকে সমাজের সম্মান বৃদ্ধিতে ও আয় বৃদ্ধির পথ মনে করত। কৃষিতে বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত ছিল না। কৃষকরা বৃষ্টি এবং প্রকৃতির দেয়ার উপর নির্ভর করে কৃষি কাজ করত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেত। জমিগুলো মধ্যযুগের অনুরূপ পালাক্রমে আবাদ করে তার উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালাত। কেবলমাত্র ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে উন্নত প্রথার কৃষির প্রচলন ছিল।

মার্কেন্টাইলবাদ (Mercantilism): সপ্তদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা কাঠামো ছিল মার্কেন্টাইলবাদ। ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মার্কেন্টাইলবাদ বা সংরক্ষণবাদ অর্থনীতি স্বীকৃতি লাভ করে। মার্কেন্টাইলবাদ বা সংরক্ষণবাদ অনুযায়ী খাদ্যশস্য দেশের বাইরে রপ্তানি করা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যশস্য রপ্তানি ও অবাধ বিক্রয় নিষিদ্ধ থাকার কারণে কৃষকরা খাদ্য দ্রব্যের ন্যায্য দাম পেত না। সরকার এবং সাধারণ মানুষ মনে করত যে, খাদ্য রপ্তানি করলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে। এজন্য সরকার বিদেশে খাদ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়। কৃষকরা নিজ পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং সামন্তপ্রভু বা রাষ্ট্রের জন্য প্রদেয় করের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই উৎপাদন করত। সেখানে কৃষির বাণিজ্যকরণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। ফলে কৃষিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার ছিল সীমিত। ফলে অধিক ফলনের কোনো বাণিজ্যিক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছিল না।

সপ্তদশ শতাব্দীতে স্বৈরাচারী শাসকরা এই মার্কেন্টাইলবাদকে আদর্শ রাষ্ট্রীয় নীতি মনে করত। মার্কেন্টাইলীয় অর্থনীতির দর্শন ছিল এরূপ : পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত, কাজেই বৈদেশিক মাল অবাধে আমদানি করলে বা খাদ্যদ্রব্য অবাধে রপ্তানি করলে সম্পদের অবক্ষয় হয়। এজন্য দেশের শিল্পদ্রব্যের রপ্তানি বাড়িয়ে আমদানি কমাবার চেষ্টা করা হত, যাতে বিদেশী মাল বেশি আমদানি না হয়। সেজন্য বিদেশী পণ্যের উপর অধিক শুল্ক আরোপ করা হত। এর দরুন অন্যান্য দেশের সাথে অবাধ বাণিজ্য চলত না। এই ব্যবস্থায় দেশের শিল্প বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে রক্ষা পেত। কিন্তু শিল্প সংরক্ষণের নীতি নেয়ার ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্য ব্যহত হত। প্রতিটি দেশ চাইত অন্যদেশে তার মালের বিক্রি বাড়াতে এবং অন্যদেশ থেকে মাল আমদানি করতে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য- বিরোধ দেখা দিত। এই বিরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হত।

সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ফিজিওক্র্যাফট অর্থনীতির ধারণা মার্কেন্টাইলবাদের সমালোচনা শুরু করে। ফিজিক্যাফট বা অবাধ বাণিজ্যের সমর্থকরা প্রচার করে যে, বিশ্বের সম্পদের সাম্য নেই। যতই খাদ্য ও শিল্পবস্তুর উৎপাদন বাড়বে ততই সম্পদ বাড়বে। এজন্যে তারা শিল্প ও বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ লোপ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের দাবি জানায়। মার্কেন্টাইলবাদজনিত সংরক্ষণনীতির ফলে বাণিজ্যে মন্দা এবং দারিদ্র্য বাড়ছে একথা তারা বোঝাতে চেষ্টা করত। এর ফলে ইংল্যান্ডে মার্কেন্টাইলবাদ অনেকটা উঠে গেলেও অর্থনীতি তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয় নি। সংরক্ষণবাদ সত্ত্বেও সপ্তদশ শতাব্দীতে স্পেন, ইতালি, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, ভারতে, পর্তুগিজ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করে। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য অনেক ইউরোপীয় দেশ ক্যানালের মাধ্যমে নৌচলাচলের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। তবে অধিকাংশ বাণিজ্য পণ্য পরিবাহিত হত সমুদ্রপথে ও স্থলপথে। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স রাজপথগুলো বাণিজ্যপণ্য চলাচলের জন্য মেরামত করেছিল তা সত্ত্বেও অধিকাংশ রাস্তা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, পর্তুগাল সমুদ্র পথে বাণিজ্যের জন্য বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজ তৈরি করত।

ঔপনিবেশিক বাজার : পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো যে অর্থ সঞ্চয় করে তার অধিকাংশ বণিকদের অর্থভাণ্ডারে জমা হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার সোনা- রুপা ইউরোপীয় বণিক শ্রেণির হাতে জমা হলে এরা মূলধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। এই শ্রেণি তাদের উদ্ধৃত্ত অর্থ সরকারকে সুদে ঋণ দিত। বাকি অর্থ শিল্পে ও ব্যাংকে লগ্নি করত। এদের মূলধনের সাহায্যে পরবর্তীকালে লন্ডনের বেয়ারিং, ফ্রান্সের সুইস ব্যাংক প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যাংকগুলো গড়ে ওঠে।

সাধারণ মানুষের অবস্থা ও পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলাফল : সপ্তদশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে রাজপরিবার ও বণিকশ্রেণী সম্পদশালী হলেও সাধারণ মানুষ ছিল অভাবগ্রস্ত। শিল্পপতি মহাজন ও ভূম্যধিকারী শ্রেণি অর্থবিত্তের মাধ্যমে জৌলুস ও বিলাসী জীবনযাপন করলেও সমাজে শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষ দরিদ্রক্লিষ্ট হয়েছিল। রুটি ও অন্যান্য জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র মানুষ কষ্টে জীবনযাপন করত। তবে মূলধন ও উপনিবেশের বাজার প্রসারের ফলে শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান বেড়েছিল। এসময় অনেক ইউরোপীয় মানুষ ভাগ্য উন্নয়নে আমেরিকা, ভারত ও অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। এতে ইউরোপীয় অনেক দেশে বাড়তি লোকসংখ্যার চাপ কমে এসেছিল। তবে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ছিল। ইউরোপ থেকে মানুষ বিদেশে চলে যাওয়ায় শিল্পকারখানায় শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তা পূরণের জন্য নারী ও শিশুদের কাজে লাগানো হয়েছিল। এতে নারীদের কর্মসংস্থান, নারী অধিকার, শ্রম আইন ও মজুরি, ন্যায্য অধিকারের বিষয়টি অনেক বুদ্ধিজীবীর ভাবনায় এসেছিল। আর পরবর্তীকালে সামাজিক কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল।

বণিকি পুঁজিবাদ : শিল্প, ব্যবসা এবং বাণিজ্যের বিকাশ

ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব ইউরোপে জনপ্রিয় ছিল তা হল বণিকি পুঁজিবাদ তা মার্কেন্টাইলবাদ। ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্র (National state) উদ্ভবের সাথে বণিকি পুঁজিবাদ (Mercantilism) মতবাদ সকল জাতি-রাষ্ট্র গ্রহণ করে। জাতীয় সরকার দেশের অর্থনীতির স্বার্থ ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগরিত হওয়ার পূর্বে নগরগুলোতে বণিকশ্রেণী শাসকশ্রেণীর সমর্থক হয়ে দাঁড়ায় এবং নগরগুলোতে বণিকদের তৎপরতায় পুঁজি সঞ্চিত হতে থাকে। জাতীয় রাষ্ট্রে বণিকশ্রেণী অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ফলে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মার্কেন্টাইলবাদ বিকাশ লাভ করে।

মার্কেন্টাইলবাদের উদ্ভবের পটভূমি : মার্কেন্টাইলবাদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠে। ফ্রান্সে কোলবার্টিজম, জার্মানিতে ক্যামেরালিজম প্রভৃতি নামে গড়ে উঠলেও এর বৈশিষ্ট্য ছিল একই ধরনের। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সামন্ততন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের অবসান ঘটে। শুরু হয় ইউরোপে নবজাগরণের পালা। ইউরোপের অধিবাসীদের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ সূচনা করে আধুনিক যুগের। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক সমস্ত দিক দিয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেখা দেয় দেশের সকল নাগরিকের কার্যাবলির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার। কিন্তু কোনো ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্ব ছাড়া এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব ছিল না। ফলে ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষমতার এ কেন্দ্রীকরণ এবং জাতীয়তাবোধের উদ্ভবের অনুষঙ্গ হিসেবেই বিকাশ ঘটে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী চেতনার। এ অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদই ‘বণিকি পুঁজিবাদ’ বা মার্কেন্টাইলিজম নামে পরিচিত।

মার্কেন্টাইলিস্ট নীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি দেন ফিলিপ ভন হরনিক (১৬৩৮ – ১৭১২) নামক একজন অস্ট্রিয় সরকারি কর্মচারী। তিনি তার পশ্চাৎপদ স্বদেশের পক্ষে লিখতেন, যে দেশ ছিল সর্বদা তুরস্কের ভয়ে ভীত। তিনি ১৬৮৪ সালে ব্যাপকভাবে পঠিত একটি গ্রন্থের রচয়িতা। এ গ্রন্থটির নাম “সবার উপরে অস্ট্রিয়া, যদি শুধু সে ইচ্ছা করে” এবং তিনি ‘জাতীয় অর্থনীতির জন্য নয়টি প্রধান নীতির’ উল্লেখ করেন :

  • (১) দেশের মাটির গুণাগুণ যত্নসহকারে পরীক্ষা করতে হবে, কোথাও কৃষির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলেও তা যেন অবহেলা করা না হয়।
  • (২) দেশের অভ্যন্তরে যেসব জিনিস পাওয়া যায় তা যদি কাঁচা (বা খনিজ) অবস্থায় ব্যবহার করা না হয়ে থাকে তবে দেশের মধ্যেই তা দিয়ে জিনিস বানাতে হবে।
  • (৩) দেশে যত লোককে যেতে দেওয়া সম্ভব তত বেশি লোক যেন থাকে।
  • (৪) সোনা আর রুপো, এ দুটি বস্তু কোনো গতিতে একবার দেশের মধ্যে এলে কোন কারণেই আর তা যেন বের হয়ে না যায়।
  • (৫) দেশবাসীর উচিত যতটা সম্ভব নিজের দেশের জিনিসই ব্যবহার করা।
  • (৬) (বিদেশী জিনিস) যদি আনতেই হয় তা সোনা-রুপোর বিনিময়ে নয়, বরং দেশের প্রস্তুত কোনো জিনিসের বিনিময়েই আনতে হবে।
  • (৭) তা যতটা সম্ভব কাঁচামাল অবস্থাতেই আনতে হবে, যাতে দেশে এনে তা থেকে ব্যবহার্য জিনিস বানিয়ে নেওয়া যায়।
  • (৮) দেশের কোনো জিনিস যদি অব্যবহৃত থাকে তবে দিনরাত চেষ্টা করতে হবে যাতে তা দিয়ে কিছু বানিয়ে বিদেশে কোথাও বিক্রি করা যায়।
  • (৯) যে জিনিস নিজের দেশেই প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন এবং যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া সম্ভব তা কোনো অবস্থাতেই যেন বিদেশ থেকে আমদানি করা না হয়।

ইউরোপের সকল দেশেই মোটামুটি জাতীয়তাবাদ, স্বনির্ভরতা আর জাতীয় শক্তির এই বুনিয়াদি কর্মপন্থাগুলো গ্রহণ করা হয়। শিল্প উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হল, ভর্তুকি, বিশেষ সুবিধা, প্যাটেন্ট আর একচেটিয়া উৎপাদনের অধিকার দিয়ে। বৈদেশিক বাণিজ্যের উৎসাহ দেওয়া হল উপনিবেশ দখল করে আর মজুরি কম রাখার চেষ্টা করে, এবং এজন্য সৃষ্টি করা হল শুল্ক ব্যবস্থা; নেভিগেশন ল (Navigation laws) আর বাণিজ্যিক বিষয়ে নানা ধরনের বাধানিষেধ। কয়েক ধরনের কর্মপন্থার মাধ্যমে কৃষিকার্যকে উৎসাহ দেওয়া হল। ইংল্যান্ডে বিদেশী প্রতিযোগীদের সরিয়ে রাখার জন্য কৃষিজ পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক বসানো হয়, আবার ফ্রান্সে কৃষিজ পণ্য রপ্তানির ওপর শুল্ক বসানো হয়, যাতে দেশের উৎপন্ন দ্রব্য দেশবাসীই ব্যবহার করতে পারে। বিশেষভাবে গড়ে তোলা হল বন্দুক, বারুদ, জাহাজ, জাহাজের উপকরণ – এসব যুদ্ধোপকরণ প্রস্তুতের শিল্পগুলো।

ইংল্যান্ডে যখন বাণিজ্য সম্প্রসারণের ফলে সম্পদ এবং জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি পেল, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধির ওপর খুব জোর দেওয়া হল। সেকালে বাজারও ছোট ছিল এবং ক্রয়ক্ষমতাও অপর্যাপ্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে অন্যতম বাধা ছিল খরিদ্দারদের হাতে নগদ টাকার অভাব আর ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের স্বল্পতা। শাসনকর্তাদেরও প্রায়ই ঋণ করতে হত, তাই যদি নগদ টাকা আর ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং সুদের হারটা কম থাকে, তবে তারাও একইভাবে উপকৃত হত। আধুনিক ব্যাংকিং তখন শৈশব অবস্থায়, তাই টাকা ও ঋণের সহজলভ্যতা ছিল নগদ টাকার সরবরাহের ওপর একান্ত নির্ভরশীল অর্থাৎ স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রার সরবরাহের ওপর। তাই অনিবার্যভাধেই মুদ্রাবিষয়ক নীতি (Monetary Policy) হয়ে পড়ে মার্কেটাইলিস্ট অর্থনীতিবিদদের একটা প্রধান চিন্তার বিষয়। প্রধানত তারা চাচ্ছিলেন ‘সহজ মুদ্রানীতি’ (easy money policy) – অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহ যথেষ্ট থাকবে, যাতে ব্যবসা উৎসাহিত হয় এবং সুদের হার কম থাকে। অপরপক্ষে, মুদ্রাস্ফীতির চাপও তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হত দুটি কারণে – (১) জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি শ্রমিক আর পবিত্র শ্রেণীর জন্য মুশকিলের ব্যাপার ছিল। কারণ সাধারণত মজুরিটা মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় পেছনেই থাকে, যার ফলে দেখা দেবে রাজনৈতিক অসন্তোষ; (২) মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের উৎপাদিত জিনিসের বৈদেশিক চাহিদা হ্রাস পাবে এবং তা থেকে দেশের অভ্যন্তরেও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটবে।

কাজেই অভ্যন্তরীণ আর আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক নীতিমালা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ইংল্যান্ডের মার্কেন্টাইলিষ্টরা বুঝতে পারে যে, সাধা দুনিয়ার অর্থনীতিটাই পরস্পরের সাথে একটা সম্পর্কের জালে আবদ্ধ। কঠিন বাস্তবের অভিজ্ঞতা আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ থেকে তারা বুঝতে পারে যে, যদি দেশের অভ্যন্তরে মুদ্রার সরবরাহ আর ক্রয়ক্ষমতা বিক্রয়যোগ্য জিনিসের সরবরাহের চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি বাড়ে, তবে দেশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, আমদানি বাড়বে এবং রপ্তানি হ্রাস পাবে। রপ্তানি হ্রাস আর আমদানি বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যের ঘাটতি পূরণের জন্য সোনা-রুপো রপ্তানি করতে হবে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে টাকার সরবরাহ হ্রাস পাবে আর সেটি অর্থনীতির অবনতির কারণ হবে। এসব পারস্পরিক সম্পর্ক ভালোভাবেই বোঝা গিয়েছিল এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্য দেশের অনুকূলে রাখাটা ছিল বণিকবাদের বা বণিক পুঁজিবাদের মূলকথা।

বণিকবাদ অনুসারে তৎকালীন ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশে সোনা- রুপোর মতো মূল্যবান ধাতুর সঞ্চয় বাড়ানো। এজন্য লুটতরাজ করে মূল্যবান সম্পদ আহরণ নিন্দনীয় ছিল না। বণিক পুঁজিবাদের বক্তব্য ছিল অন্য দেশকে প্রথমে জয় করা এবং তারপর তার সম্পদ লুণ্ঠন করা। সপ্তদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ এ ধরনের অনৈতিক ভাবনা থেকে সরে এসে পরে বাণিজ্যের কথা বলা হলেও জোর দেওয়া হয় একমাত্র রপ্তানি বাণিজ্যের দিকে। কারণ রপ্তানি বাণিজ্যের ফলেই দেশে মূল্যবান ধাতুর আগমন সম্ভব। এ কারণে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে বেছে বেছে এমন দেশের সাথে বাণিজ্যের উৎসাহ দেওয়া হত যে দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যের লেনদেনের ব্যালান্স তাদের অনুকূলে থাকে। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ বণিক পুঁজিবাদের সমর্থকরা অনুধাবন করে যে, এভাবে বেছে বেছে বাণিজ্য করার প্রয়োজন নেই। কারণ এক দেশের সাথে লেনদেন ব্যালান্স প্রতিকূল হলেও অন্য দেশের সাথে যে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স হবে তাতে ঘাটতি পুষিয়েও লাভ থাকা সম্ভব।

বণিকবাদের বা বণিক পুঁজিবাদের এ দর্শন ইংল্যাণ্ডে শক্তিশালী করে ইংল্যান্ডের টিউডর রাজাদের ক্ষমতা। ইংল্যান্ড বণিক পুঁজিবাদ গ্রহণ করেছিল এ কারণে যে, সে সময় ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা বেড়েছিল। ১৪৫০ থেকে ১৫০০–এ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ইউরোপের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এক কোটি সত্তর লক্ষ। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাড়িয়ে তোলে এবং সামন্ততন্ত্রকে ভেঙে দেয়। অধিক জনসংখ্যার ফলে গ্রাম থেকে শহরগুলোতে জনস্রোতের বেগ বাড়তে থাকে। শিক্ষানবিশের সংখ্যা ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা সবকিছুই বৃদ্ধি পায়। জাহাজে বেশি লোক নিয়োগ করা যায়, সৈন্যদল আরো ভারী করা যায়, সমুদ্রের ওপারের উপনিবেশগুলোতে অনেক বেশিসংখ্যক বসতি স্থাপনকারী দেখা যায়। এরই ফলে উদ্ভূত হয় অধিকতর চাহিদা। মাছ, গম, মাংস, কাপড়, বাসন, টুপি, জুতো, ছুরি, বাইবেল সবকিছুর দরকারই বৃদ্ধি পায়। এরই ফলে এসব পণ্য উৎপাদক ও বিক্রেতাদের মুনাফা বাড়ে, মুনাফার অংশ সঞ্চিত হয়ে পুঁজি বাড়ে, মুনাফার অপর অংশ থেকে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। এ ব্যবসায়িক সমৃদ্ধিকে ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

বণিক পুঁজিবাদ বা মার্কেন্টাইলবাদ সোনা-রুপোর ব্যাপকহারে দেশে অনুপ্রবেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে সব জিনিসপত্রের দামস্তর খুব নেমে এসেছিল, তাই উন্নয়নের চাপ ছিল কম। নিম্নগামী সামন্তর ঊর্ধ্বগামী শিল্প উৎপাদন ঘটায় না। উপনিবেশগুলো থেকে দস্যুতা ও লুটপাটের ফসল এই সোনা-রুপো প্রথমে আসে স্পেনে ও পর্তুগালে। পরে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। দাম এক লাফে বাড়ে চতুর্গুণ। মজুরি ও খাজনা পিছিয়ে পড়ে। তাই হঠাৎ দেখা যায় ফাটকার আবহাওয়া, ধুলো- মুঠি থেকে সোনা-মুঠি করার আবেগ, পুঁজি সঞ্চয়।

বণিক পুঁজিবাদ বা মার্কেন্টাইলবাদের আর একটি কারণ ছিল একদল সাহসী নারিকের সাহসী অভিযানের ফলে নতুন আবিষ্কার দেশের সম্পদ লাভ। ১৪৯২ সালে কলম্বাস উত্তর আমেরিকা এবং ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কার ইউরোপীয়দের বাজার বৃদ্ধি করেছিল এবং উপনিবেশগুলোর দিকে জনসংখ্যার চাপ সরে গিয়েছিল। উপনিবেশ থেকে সস্তায় কাঁচামাল, প্রচুর দাস শ্রমিক, প্রসারিত বাজারের বর্ধিত চাহিদার চাপে গিল্ড প্রথা ভেঙে যায় এবং কারখানা প্রথা গড়ে ওঠে। ইউরোপের বাইরে বিপুল বাজারের সন্ধান পাওয়ার পরপরই বাজার দখলের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো লড়াই শুরু করে। তিনশ শতাব্দীর লড়াইয়ে শেষে জয়লাভ করে ইংল্যান্ড। এ জয়ের পেছনে ছিল তীব্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা। বণিক পুঁজিবাদের উদ্ভব তাই ষোড়শ শতাব্দীর ভৌগোলিক আবিষ্কারের পর একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।

বণিক পুঁজিবাদ ইংল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশকে শিল্পবিপ্লবের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ বণিকরা উপনিবেশগুলোতে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে যথেষ্টভাবে পুঁজি সঞ্চয় করেছে। প্রথম দিকে তারা উপনিবেশগুলো থেকে সস্তায় শৌখিন জিনিস কিনে ছড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপের বাজারে। পরের দিকে উপনিবেশগুলো থেকে কম দামে কিনে নিয়ে গিয়েছে কাচামাল এবং চড়া দামে বিক্রি করেছে সেই কাচামাল দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি বা পণ্য। এ দ্বিবিধমুখী শোষণে পুঁজির সঞ্চয় বেড়েছে লাফ দিয়ে। আমেরিকার খনিগুলো থেকে সোনা লুট করে এনে সে সোনা-রুপোর সাহায্যে প্রাচ্যের বাজারকে তারা কবজায় এনে ফেলেছে। কেইনসের মতে, এ সাহায্য না পেলে প্রাচ্যের সাথে প্রতিকূল বাণিজ্য বেশি দিন চালানো সম্ভব হত না। আমেরিকা থেকে সংগৃহীত ধাতুসমূহের অধিকাংশেরই সদ্‌গতি হয়েছে প্রাচ্যে। বণিক পুঁজিবাদের ফলেই শিল্পবিপ্লবের প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল এবং সামন্ততন্ত্রের পতন সম্ভব করেছিল। বণিক পুঁজিবাদ পুঁজিবাদী চেতনা জাগিয়ে শিল্পবিপ্লব সম্ভব করেছিল।

আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ষোড়শ, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে ধনরত্নের সঞ্চয় যত বাড়তে থাকে, বণিকশ্রেণীর হাতে যত সম্পদ জমা হতে থাকে ততই সামন্ত শ্রেণীর ক্ষমতা কমে, তাদের শক্তির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে ওঠে। অর্থনীতিতে টাকার প্রচলন বাড়ার সাথে সাথে খাজনার রূপ বদলে যায়। অর্থের আকারে কর প্রদান চালু করা হয়। নগদ টাকা হাতে আসায় সামন্ত প্রভুদের ওপর রাজদরবারের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে আসে বণিকশ্রেণী। এভাবেই তারা হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে রাজা বা রানীর ডান হাত, তার প্রধান উপদেষ্টা। রাজদরবার হয়ে ওঠে বণিকশ্রেণীর প্রধান সমর্থক। বদল ঘটতে থাকে পুরোনো আইনকানুনে। নয়ানীতি সচেষ্ট হয়ে ওঠে পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষায়। রাজ আনুকূল্যে পুঁজিবাদ তার শৈশব ছেড়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। প্রসার হয় শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা।

সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞান ও কৃষি

১৬০৩ সালে রোমে প্রতিষ্ঠিত হয় একাডেমি অব লিঙ্কসেস (Academy of Lynxes)। ইতালি ও জার্মানির বহু শহরে এই ধরনের বহু বিজ্ঞানের কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস (১৬৬০-১৬৮৫) ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, মতবাদ নীতি, প্রতিপাদ্য বিষয়, প্রাকৃতিক শক্তি, ইতিহাস সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গণিত, বলবিদ্যা, প্রাচীন ও আধুনিককালের যা কিছু এ যাবৎ করা হয়েছে বা আবিষ্কৃত হয়েছে সেই বিষয়ে বিচার-বিবেচনা করা এই সোসাইটির উদ্দেশ্য বলে বর্ণনা করে তিনি এক সনদ দান করেছিলেন।

ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার ঘটে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ লুইয়ের মন্ত্রী কেলবেয়ারের (বা কোলবার্ট) (১৬৬১-১৬৮৩) প্রভাবে চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) ফরাসি একাডেমি অব সায়েন্সেসের (Academy of Sciences) উন্নতি সাধন করেন। ইংল্যান্ডের রয়্যাল একাডেমির অনুকরণে ম্যাসাচুসেটসে একটি দার্শনিক সোসাইটি স্থাপিত হয়েছিল ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে এবং আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে অনুরূপ আরেকটি একাডেমি স্থাপিত হয় ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি এবং ফ্রান্সের ‘একাডেমি অব সায়েন্সেস’ বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করে। অল্পকালের মধ্যে ইতালি, জার্মানি, ডেনমার্ক ও অপরাপর আরো বহু দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্যাদিসংবলিত পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানচর্চা হত এবং অধিক হারে মানমন্দির, মিউজিয়াম প্রভৃতির সংখ্যাও ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রাগের টাইকোব্রাহের মানমন্দির ফরাসি মানমন্দির অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী যন্ত্রপাতি দ্বারা গঠিত ছিল। বৈজ্ঞানিক মিউজিয়াম স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন রবার্ট বয়েল। তার অনুকরণে অন্যান্য স্থানেও মিউজিয়াম স্থাপিত হয়। ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ডে বৈজ্ঞানিক মিউজিয়াম স্থাপিত হয় এবং ডক্টর এনমোল বহুবিধ বৈজ্ঞানিক বিস্ময়কর বস্তু সেই মিউজিয়ামে দান করেন।

এ যুগে কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিকগণ নন, ইউরোপের অনেক দেশের রাজা ও অভিজাত শ্রেণী বিজ্ঞানের উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন। এর কারণ ছিল বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন দ্বারা সামরিক চিকিৎসা ও শিল্পের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা। চতুর্দশ লুইয়ের ভ্রাতা নিজে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার স্থাপন করে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ইংল্যান্ড রাজ দ্বিতীয় চার্লস একটি কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি (Chemical laboratory) স্থাপন করে সেখানে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অবসর বিনোদন করতেন। অনুরূপভাবে হল্যান্ডের জন ডিউইটও বিজ্ঞান সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন। স্যামুয়েল পেপিস ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি হয়েছিলেন। সে সময়ে বিজ্ঞানের ওপর বই লিখে বহু গ্রন্থকার প্রচুর অর্থ রোজগার করতেন।

সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। বস্তুত সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের মধ্যে তার মতো বিরল প্রতিভার আর কোনো বিজ্ঞানীর জন্ম হয় নি। তিনি ছিলেন গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী। তার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ক্যালকুলাস। তিনি ১৬৮৭ সালে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের আবিষ্কার করেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের সমসাময়িক জার্মান দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ লাইবনিৎসও (Leibnitz) পৃথকভাবে গবেষণা করে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র কপারনিকাসের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তথ্যাদি আরো দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে। এডমান্ড হোলি (Edmand Holley) ও উইলিয়াম হারসেল (William Herschel) সে সময়কার দুজন প্রসিদ্ধ ইংরেজ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে পদার্থবিদ্যার বিশেষ উন্নতি হয়। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী।

সপ্তদশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার : সপ্তদশ শতকে উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখ করা যায় টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপের উন্নত সংস্করণ। টেরিসেলি (Torrieclls) নামে ইতালীয় বিজ্ঞানী ব্যারোমিটার আবিষ্কার করেন। অটোফন গুয়েরিক (Ottovon Guericke) বাতাস পাম্প করার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। জনৈক জার্মান কর্তৃক ফারেনহাইট (Fahrenheit) নামক থার্মোমিটার আবিষ্কার জনসাধারণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছিল। লেডেন কর্তৃক বিদ্যুৎ সংরক্ষণের উপায় আবিষ্কার পৃথিবীকে এক নতুন সভ্যতার সুযোগ করে দিয়েছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীতে রসায়নশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখ করা যায় বরার্ট রয়েলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যোসেফ ব্ল্যাক কর্তৃক কার্বন-ডাই-অক্সাইড আবিষ্কার, যোসেফ প্রিস্টলি কর্তৃক অক্সিজেন আবিষ্কার, ক্যাভেন্ডিস কর্তৃক অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন হতে জল পাওয়া এই বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ। এগুলো রসায়নশাস্ত্রের উন্নতির পথ দেখিয়েছিল। এ যুগে ভূবিদ্যা (Geography), প্রাণিবিদ্যা (Zoology). উদ্ভিদবিদ্যা (Botany) প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীতে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক অবধি কৃষি জমি পরপর দুই বছর চাষের পর জমির উর্বরতা পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য এক বছর পতিত রাখা হত। এতে দুই বছর চাষের ফলে যে উর্বরতা বিনষ্ট হত তা পুনরায় জমিতে ফিরে আসত। এ সময় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেল যে, একই জমিতে একই ফসল যদি পরপর কয়েক বছর চাষ না করে নানা ধরনের ফসল একের পর এক চাষ করা যায় তা হলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায় না এবং উর্বরতা ফিরিয়ে আনার জন্য এক বছর জমি পতিত রাখার কোনো প্রয়োজন হয় না। ইংল্যান্ডের মন্ত্রী টাউনশোল্ড চার বছর চার প্রকার ফসল উৎপাদনের পর এক বছর শালগম চাষ করলে জমির উর্বরতা অব্যাহত থাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে গবাদিপশুর উন্নয়নের জন্য কিছু পরিমাণ উন্নতি সাধিত হয়েছিল। মাংস, দুধ, উল প্রভৃতির প্রয়োজন মেটানোর জন্য পশু প্রজননের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে পশু প্রজননের ফলে উন্নত ধরনের ঘোড়া, গরু, ভেড়া জন্মানো সহজ হল। উন্নত ধরনের পশুর জন্য উন্নত ধরনের পশুখাদ্যের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পশুর পুষ্টির প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয়। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়েছিল।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ও প্যারিসের শান্তিচুক্তি, ১৭৬৩

সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপের ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনের সাথে প্রাশিয়া ও রাশিয়া শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে ইংল্যাণ্ড ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন এবং পরবর্তী সময়ে হল্যান্ড ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ইংল্যান্ড ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সমুদ্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলে। বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে ইংল্যান্ড, স্পেন, হল্যান্ড ও ফ্রান্স একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে। ১৪৮৫ সালে ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হলে টিউডর রাজারা ইংল্যান্ডকে ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। টিউডর আমলে ইংল্যান্ডে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত বণিক শ্ৰেণী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য করার জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য কোম্পানি গড়ে তোলে। ব্যবসা- বাণিজ্য ও সামরিক প্রয়োজনে ইংল্যান্ডের টিউডর রাজারা শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। রানী প্রথম এলিজাবেথের (১৫৫৮-১৬০৩) রাজত্বকালে ইংল্যান্ড ইউরোপে সবচেয়ে শক্তিশালী সামুদ্রিক শক্তিতে পরিণত হয়। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮) ইংল্যান্ডের প্রতিপত্তি ধ্বংস করতে ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন। কিন্তু নৌযুদ্ধে স্পেনীয় আর্মাডার পরাজয় ইংল্যান্ডের নৌশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।

ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ড আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড ওলন্দাজদের (ডাচ) পরাজিত করেঅলিভার ক্রমওয়েলের শাসনকালে ইংল্যান্ড সমুদ্রে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয় এবং ওলন্দাজরা ইংরেজদের প্রাধান্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে দ্বিতীয় চার্লস (১৬৬০-১৬৮৫)দ্বিতীয় জেমস (১৬৮৫-১৬৮৮) কখনো ফ্রান্সে কখনো বা হল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন। তবে ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের উইলিয়াম তৃতীয় উইলিয়াম (১৬৮৯-১৭০২) নাম ধারণ করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করলে হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসে এবং ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি প্রায় একই সমান্তরালে আসে। ফলে এই দু দেশই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। সপ্তদশ শতকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ইউরোপের বাইরে আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতবর্ষে একে অপরের প্রতিবেশী হিসেবে উপনিবেশ ও বাণিজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আমেরিকা অথবা আফ্রিকা অপেক্ষা সাম্রাজ্য বিস্তারের সুযোগ ছিল অনেক বেশি। আমেরিকা ও আফ্রিকা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ দান করলেও ভারতবর্ষ বাণিজ্য ও উপনিবেশ উভয় দিক থেকে অধিকতর সম্ভাবনাপূর্ণ ছিল। কাজেই ভারতীয় উপমহাদেশেই ইংরেজ ও ফরাসিদের বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে যা কালক্রমে যুদ্ধের রূপ লাভ করে। ভারতের দাক্ষিণাত্য ও বাংলায় উপনিবেশসহ বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইংরেজ ও ফরাসিরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ভারতের সবচেয়ে লাভজনক পণ্য ছিল মশলা, নীল, তুলা এবং বিভিন্ন ধরনের রঙ, ওষুধ, রেশম, মূল্যবান পাথর প্রভৃতি। প্রথম দিকে ইংরেজ ও ফরাসিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশি তৎপর ছিল। কিন্তু ভারতের মুঘল কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক স্তরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দেশীয় নৃপতিরা পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদে ইংরেজ ও ফরাসিদের সাহায্য গ্রহণে তৎপর হলে ইংরেজ ও ফরাসিরা ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ লাভ করে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে রাইসুইকের সন্ধি (১৬৯৭ সালে), অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউট্রেক্টের সন্ধি ( ১৭১৩ সালে) এবং ১৭৬৩ সালে প্যারিসের সন্ধি ইউরোপের রাজনীতি বিশেষ করে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সিংহাসন লাভ করেন। এরপর থেকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে। ফরাসি রাজ চতুর্দশ দুই হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে ইংল্যান্ড লিগ অব অগসবার্গে যোগদান করে হল্যান্ডের পক্ষে চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৬৯৭ সালে রাইসুইর্গের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ইংল্যান্ড যেসব স্থান ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ থেকে দখল করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়। ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তৃতীয় উইলিয়ামের দাবি স্বীকার করে নেয়। কিন্তু ১৬৯৭ সালে রাইসুইকের সন্ধি ফ্রান্সের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা এনে দেয় নি। ফলে পাঁচ বছর পর স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার সম্রাট এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাজার সাথে এক গ্রান্ড অ্যালায়েন্সে (Grand Alliance) স্বাক্ষর করে চতুর্দশ লুইয়ের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইউট্রেক্টের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংল্যান্ড ফ্লাপ থেকে নোভাস্কশিয়া, হাডসন বে টেরিটোরি, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিটস দ্বীপগুলো দখল করে। ফরাসি মিত্র স্পেনের নিকট থেকেও ইংল্যান্ড অনেক সুবিধা আদায় করে এবং কতিপয় স্থান দখল করে।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পরবিরোধী পক্ষে যোগদান করলে ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের সূত্র ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশ্য দেশীয় রাজাদের পারস্পরিক যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ইংরেজ ও ফরাসিরা প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ এবং বাংলায় পলাশীর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এসব যুদ্ধে ফরাসিরা যেসব দেশীয় রাজাদের পক্ষ অবলম্বন করছিল তারা পরাজিত হলে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। ইউরোপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান ঘটলে ১৭৬৩ সালে প্যারিসের শান্তিচুক্তি দ্বারা ইংল্যান্ড আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। আমেরিকার কানাডা ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ থেকে ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ফরাসিরা পণ্ডিচেরী, চন্দননগর প্রভৃতি বাণিজ্য কুঠি ফিরে পেলেও এগুলো শুধু বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান থাকবে এবং কোনো রকম সামরিক তৎপরতা চালাতে পারবে না – এই শর্ত ফরাসিদের মানতে হয়েছিল। এভাবে আমেরিকা ও ভারতে উপনিবেশ স্থাপনে ফরাসি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইংরেজরা ভারত ও আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে এবং ইংল্যান্ড বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। আফ্রিকার সেনেগাল ফরাসি উপনিবেশ হলেও ফ্রান্স সেনেগাল ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে বিশ্বের সর্বত্র ইংল্যান্ড বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২০৫-২২১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.