দেবী মাতঙ্গী (তন্ত্রের নবম মহাবিদ্যা)

(স্পয়লার অ্যালার্ট!! এই ১লা মে-তে হইচই-এ একটা নতুন ওয়েব সিরিজ আসে, নাম ‘ভোগ’। সুপারন্যাচারাল থ্রিলার জঁরার একটা সিরিজ, মানে ঐসব ভুত-প্রেত, রহস্যময় ব্যাপার স্যাপার আরকি। বানিয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তবে গল্পটা তার নিজের না, গল্পটা লিখেছেন অভীক সরকার। তার লেখা একই নামের গল্প থেকেই এই সিরিজটা বানানো হয়েছে। মজার কথা হলো, অভীক সরকারের এই ‘ভোগ’ গল্পটা নিয়ে কিন্তু আগেও একটা সিনেমা হয়েছে। পরিচালক ছিলেন রাজর্ষি দে, সিনেমার নাম ছিল ‘পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ উত্তর আসবেই’। একই গল্প, কিন্তু এবার পরমব্রত বানিয়েছেন সিরিজ হিসেবে। গল্পের মূল চরিত্র হলো অতীন নামের এক যুবক। একা থাকে, বিয়ে-থা করেনি। একদিন পার্ক স্ট্রিটের এক পুরনো জিনিসের দোকান থেকে সে অদ্ভুত একটা পিতলের মূর্তি কিনে আনে। মূর্তিটা এক অচেনা দেবীর। অতীন জানে না এই দেবীর পুজোর নিয়মকানুন কী। ওর বন্ধুরা, এমনকি বাড়ির কাজের মাসি পুষ্পা দি’ও বারবার বারণ করে। বলে, এই অচেনা মূর্তির পুজোআচ্চা না করাই ভালো। আসলে দেবীটি হলেন তন্ত্রের দেবী মাতঙ্গী, দশমহাবিদ্যার নবম মহাবিদ্যা। কিন্তু অতীন কি আর সে সব শোনে! এর মধ্যেই ডামরী নামের এক অসহায় বিধবা মহিলা অতীনের বাড়িতে এসে আশ্রয় চায়। অতীন থাকতে দেয়। কিন্তু তারপর থেকেই কেমন সব গোলমেলে হতে শুরু করে। পুষ্পা দি হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়। আর অতীন? সেও কেমন বদলে যেতে থাকে। দুনিয়ার সব কিছু ভুলে সে শুধু ঐ দেবীর আরাধনাতেই মগ্ন হয়ে পড়ে। নিজের জীবন, ভালো-মন্দ কিছুই আর খেয়াল থাকে না। অতীন বুঝতে পারে না, ঠিক নিয়ম না জেনে এই মূর্তির পুজো করলে কী ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে পারে। পরে কী হলো তা জানতে ওয়েবসিরিজটা দেখতে পারেন। অভিনয়ে অতীনের ভূমিকায় আছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য (সেই যুবক, যে মূর্তিটা কেনে), অতীনের ভবেশ কাকার চরিত্রে আছেন রজতাভ দত্ত, ডামরী / দেবী মাতঙ্গীর চরিত্রে আছেন পার্নো মিত্র, পুষ্পা দির চরিত্রে আছেন সুদীপা বসু। সেই সাথে নবারুণ বোস ও সুভাশীষ মুখোপাধ্যায়ও আছেন। যাই হোক, ওয়েবসিরিজটা দেখার পর মনে হলো এই দেবী মাতঙ্গীকে নিয়ে লেখা দরকার। আর যেমন কথা তেমন কাজ…)

ভূমিকা

আচ্ছা, এবার তাহলে মাতঙ্গী দেবীর গল্প শোনা যাক। হিন্দু দেবদেবীদের জগৎটা কিন্তু বেশ রহস্যে ঘেরা, আর মাতঙ্গী (Matangi) সেই জগতেরই একজন বাসিন্দা। তিনি দশমহাবিদ্যা (Mahavidyas) নামে পরিচিত যে দশজন ডাকসাইটে তান্ত্রিক দেবী আছেন, তাদের একজন। আবার তাকে হিন্দু দিব্য মাতৃকার (Divine Mother) একটা রূপও বলা হয়। এখানেই শেষ নয়, মজার ব্যাপার হলো, জ্ঞান আর গানের দেবী সরস্বতীর (Saraswati) যে একটা তান্ত্রিক রূপ আছে, সেটাও নাকি এই মাতঙ্গীই।

তো, এই মাতঙ্গী দেবী হলেন কথা, গান-বাজনা, জ্ঞান আর শিল্পকলার দেবী। তার পূজা করলে নাকি দারুণ সব ক্ষমতা লাভ করা যায়। যেমন ধরুন, আপনার শত্রুকে বশে আনতে চান? বা এমন চান যেন লোকজন আপনাকে খুব পছন্দ করে? কিংবা গান-বাজনা-ছবি আঁকায় একেবারে ওস্তাদ হয়ে উঠতে চান? এমনকি সবচেয়ে বড় যে জ্ঞান, সেই পরম জ্ঞান লাভ করতে হলেও লোকে মাতঙ্গীর আরাধনা করে।

তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। মাতঙ্গীর সঙ্গে প্রায়ই জুড়ে দেওয়া হয় এমন সব জিনিস যা সাধারণ হিন্দুধর্মে ঠিক ভালো চোখে দেখা হয় না – যেমন দূষণ (Pollution), অশুভ ব্যাপার-স্যাপার (Inauspiciousness), এমনকি সমাজের একেবারে নিচু তলার মানুষের অনুষঙ্গ। তার সবচেয়ে পরিচিত যে রূপ, তার নাম হলো উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী (Uchchhishta-Chandalini) বা উচ্ছিষ্ট-মাতঙ্গিনী (Uchchhishta-Matangini) (Kinsley, 1997)। ভাবা যায়? এই রূপে তাকে বলা হয় একজন অস্পৃশ্য (Outcaste) বা চণ্ডালিনী (Chandalini)। আর তাকে নাকি পুজোয় দিতে হয় উচ্ছিষ্ট (Uchchhishta) বা এঁটো খাবার! তাও আবার এঁটো হাতে বা খাওয়ার পরে যেমন থাকে, তেমন অবস্থায়। সনাতন হিন্দু ধর্মে এই দুটো জিনিসই কিন্তু ভয়ঙ্কর অপবিত্র (Impure) বলে ধরা হয়। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে, তাই না?

সাধারণত মাতঙ্গীকে দেখতে পান্নার মতো সবুজ রঙের বলা হয়। ওই যে উচ্ছিষ্ট-মাতঙ্গিনী রূপের কথা বললাম, সেই রূপে তার হাতে থাকে একটা ফাঁস (Noose), তলোয়ার (Sword), অঙ্কুশ (Goad) মানে হাতি চালানোর অঙ্কুশ, আর একটা গদা (Club)। তবে তার আরেকটা খুব পরিচিত রূপও আছে, নাম রাজ-মাতঙ্গী (Raja-Matangi)। এই রূপে তিনি বীণা (Veena) বাজান, আর তার সাথে প্রায়ই একটা টিয়াপাখি দেখা যায়। ভারী সুন্দর দৃশ্য নিশ্চয়ই!

একনজরে মাতঙ্গী

বিষয় তথ্য
উপাধি জ্ঞান, কলা, কথ্য শব্দ এবং অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার দেবী; দশমহাবিদ্যার একজন সদস্য
অন্যান্য নাম রাজ মাতঙ্গী (Raja Matangi), মন্ত্রিণী দেবী (Mantrini Devi)
দেবনাগরী मातङ्गी
সংস্কৃত Mātangī
অনুষঙ্গ মহাবিদ্যা (Mahavidya), দেবী (Devi), সরস্বতী (Saraswati)
বাসস্থান প্রচলিত সমাজের বাইরে, যেমন বন-জঙ্গল এবং কথার জগতে
সঙ্গী মতঙ্গ ভৈরব (Matang Bhairava) (শিবের একটি রূপ)
সন্তান উচ্ছিষ্ট গণপতি (Uchishta Ganapathi) (গণপতির একটি রূপ)
চিত্র

উনিশ শতকের শেষদিকের লিথোগ্রাফে দেবীকে তলোয়ার, ঢাল, অঙ্কুশ ও গদা হাতে দেখানো হয়েছে।

কেমন দেখতে দেবী? শাস্ত্র কী বলছে? (Iconography and textual descriptions)

আসুন দেখি, পুরোনো পুঁথিপত্রে মাতঙ্গীর কেমন বর্ণনা দেওয়া আছে।

তার একটা খুব চালু রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’ (Brhat Tantrasara) বইয়ের ধ্যানমন্ত্রে (Dhyana mantra) – এ হলো সেই উচ্ছিষ্ট-মাতঙ্গিনীর (Uchchhishta-Matangini) রূপ। সেখানে বলা হচ্ছে, মাতঙ্গী বসে আছেন এক মরা মানুষের (Corpse) উপর! তার পরনে টকটকে লাল কাপড়, গায়ে লাল গয়না আর গলায় জড়ানো গুঞ্জা ফলের (Gunja seeds) মালা। দেবীকে বর্ণনা করা হয়েছে ষোলো বছরের এক তরুণী হিসেবে, একেবারে ভরা যৌবন, স্তনযুগল সুগঠিত। তার দুই হাতে ধরা আছে একটা মানুষের মাথার খুলির বাটি (Skull bowl) আর একটা তলোয়ার (Sword)। আর তাকে পুজোর ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় এঁটো খাবার (Uchchhishta) (Kinsley, 1997)। অদ্ভুত না?

আবার দেখুন, ‘পুরশ্চর্যার্ণব’ (Purashcharyarnava) আর ‘তন্ত্রসার’ (Tantrasara) বইয়ের ধ্যানমন্ত্র বলছে, মাতঙ্গী নাকি নীল রঙের! তার কপালে জ্বলজ্বল করছে একটা বাঁকা চাঁদ (Crescent moon)। দেবীর তিনটে চোখ আর মুখে মিষ্টি হাসি। তিনি নানান গয়না পরে রত্ন বসানো এক সিংহাসনে (Jewelled throne) বসে আছেন। তার চার হাতে ধরা আছে ফাঁস (Noose), তলোয়ার (Sword), অঙ্কুশ (Goad) আর গদা (Club)। তার কোমর খুব সরু আর বুক দুটো বেশ পুষ্ট (Kinsley, 1997)। একই দেবী, অথচ কত ভিন্ন রূপ!

‘পুরশ্চর্যার্ণব’ বইতেই আবার রাজ-মাতঙ্গী (Raja-Matangi) রূপের ধ্যানমন্ত্রে তাকে বলা হয়েছে সবুজ রঙের। কপালে সেই একই রকম বাঁকা চাঁদ। তার চুল বেশ লম্বা, মুখে হাসি কিন্তু চোখ দুটো যেন নেশায় ঢুলুঢুলু। তিনি কদম্ব ফুলের (Kadamba flowers) মালা আর অনেক রকম গয়না পরে আছেন। তার মুখের চারপাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তাতে তাকে নাকি আরও সুন্দর লাগছে! নাভির নিচে চামড়ায় তিনটে আনুভূমিক ভাঁজ দেখা যায়, আর চুলের একটা সরু রেখা নেমে গেছে নিচের দিকে। তিনি বসে আছেন একটা বেদীর (Altar) উপর, আর তার দুপাশে বসে আছে দুটো টিয়াপাখি। এই রূপটা নাকি চৌষট্টি কলার (64 arts) প্রতীক (Kinsley, 1997)। ‘সারদাতিলক’ (Saradatilaka) বই আবার এর সাথে যোগ করেছে যে, এই রাজ-মাতঙ্গী বীণা (Veena) বাজান, কানে পরেন শাঁখের দুল (Conch-shell earrings), গলায় ফুলের মালা আর কপালে ফুলের নকশা আঁকা থাকে (Kinsley, 1997, notes to pages 209–216)। তাকে আবার সাদা পদ্মের (White lotus) মালা পরা অবস্থাতেও দেখানো হয়েছে (এখানে পদ্ম মানে বহু রঙে ভরা এই জগৎ তৈরির প্রতীক), যা কিনা দেবী সরস্বতীর (Saraswati) মূর্তির সাথে মেলে – আগেই তো বলেছি, সরস্বতীর সঙ্গে তার একটা যোগ আছে (Pravrajika Vedantaprana, 2015)।

মহাকবি কালিদাসের (Kalidasa) লেখা ‘শ্যামলদণ্ডকম্’ (Shyamaladandakam) বই অনুযায়ী, মাতঙ্গী নাকি চুনি পান্না বসানো এক বীণা (Ruby-studded veena) বাজান আর তার গলার স্বর মধুর মতো মিষ্টি। এখানকার ধ্যানমন্ত্রে তাকে চার-হাতওয়ালা (Four-armed) বলা হয়েছে। গায়ের রং ঘন পান্না সবুজ (Dark emerald complexion), ভরা বুকে মাখানো লাল কুমকুম (Red kumkum powder), আর কপালে সেই বাঁকা চাঁদ। তার হাতে থাকে ফাঁস (Noose), অঙ্কুশ (Goad), একটা আখ বা ইক্ষুর তৈরি ধনুক (Sugarcane bow) আর ফুলের তীর (Flower arrows) – এই শেষ দুটো জিনিস আবার দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীরও (Tripura Sundari) হাতে দেখা যায় (Frawley, 1994)। এও বলা হয়েছে যে, তিনি টিয়াপাখি খুব ভালোবাসেন আর তিনি যেন গানের মধুর রসের (Nectar of song) মূর্ত রূপ (Frawley, 1994)।

দেবীর এই যে সবুজ গায়ের রং, এটা নাকি গভীর জ্ঞানের (Deep knowledge) প্রতীক। আবার এই একই রং হলো বুধ গ্রহের (Budha, the planet Mercury), যিনি হলেন বুদ্ধির (Intelligence) দেবতা (Frawley, 1994)। মাতঙ্গীকে যে প্রায়ই হাতে টিয়াপাখি (Parrot) নিয়ে দেখানো হয়, সেটা হলো কথার (Speech) প্রতীক (Frawley, 1994)। আর বীণা (Veena) তো বোঝাই যাচ্ছে, তার সাথে গান-বাজনার (Music) যে যোগ আছে, তারই চিহ্ন (Frawley, 1994)।

মাতঙ্গীর উনিশ শতকের একটি লিথোগ্রাফ বা পাথুরে ছাপা ছবি।

আচ্ছা, তাহলে এবার মাতঙ্গী দেবীকে নিয়ে যে গল্পগুলো চালু আছে, সেগুলো একটু শোনা যাক। দেবদেবীদের নিয়েও কিন্তু কম গল্প নেই!

কিংবদন্তী ও গল্পগাছা (Legends)

দশমহাবিদ্যাদের (Mahavidyas) মধ্যে মাতঙ্গীকে নয় নম্বর দেবী হিসেবে ধরা হয়। ‘মুণ্ডমালা’ (Mundamala) নামে একটা বই আছে, সেখানে বিষ্ণুর যে দশজন অবতার (Vishnu’s ten avatars), তাদের সঙ্গে দশমহাবিদ্যার একটা তুলনা করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সেখানে গৌতম বুদ্ধকে (Buddha) মাতঙ্গীর সমান বলা হয়েছে। আবার ‘গুহ্যাতিগুহ্য-তন্ত্র’ (Guhyatiguhya-Tantra) নামে আরেকটা তালিকায় মাতঙ্গীর নামই নেই! তবে পণ্ডিত ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার (Sircar) মনে করেন, ওই তালিকায় দেবী দুর্গাকে (Durga) কল্কি অবতারের (Kalki) সাথে মেলানো হয়েছে, আর সেটাই হয়তো মাতঙ্গীর দিকে একটা ইশারা (Benard, 2000)। কে জানে বাবা, দেবদেবীদের ব্যাপার!

শাক্তদের (Shakta) একটা খুব পরিচিত বই হলো ‘মহাভাগবত পুরাণ’ (Maha-Bhagavata Purana)। সেখানে সব মহাবিদ্যারা কী করে এলেন, সেই গল্প আছে। গল্পটা হলো এরকম: দক্ষ রাজার (Daksha) মেয়ে সতী (Sati) ছিলেন শিবের (Shiva) স্ত্রী। একবার দক্ষ রাজা বিরাট এক যজ্ঞের (Yagna বা “fire sacrifice”) আয়োজন করলেন, কিন্তু মেয়ে-জামাই কাউকেই নেমন্তন্ন করলেন না। এতে সতী ভয়ানক অপমানিত বোধ করলেন। শিব বারণ করা সত্ত্বেও তিনি ঠিক করলেন বাপের বাড়ির যজ্ঞে যাবেনই। কিন্তু শিব কিছুতেই রাজি হন না। তখন সতী রেগেমেগে দশমহাবিদ্যার রূপ ধারণ করলেন, যাদের একজন হলেন এই মাতঙ্গী। সেই দশ দেবী দশ দিক থেকে শিবকে ঘিরে ফেললেন। মাতঙ্গী দাঁড়িয়েছিলেন উত্তর-পশ্চিম (Northwest) কোণে (Kinsley, 1988; Kinsley, 1997; Benard, 2000)। ভাবা যায় অবস্থাটা! আরেকটা গল্পে আবার সতীর বদলে দেবী কালীকে (Kali) (যিনি প্রধান মহাবিদ্যা) শিবের স্ত্রী বলা হয়েছে, আর তিনিই নাকি মাতঙ্গী ও অন্য মহাবিদ্যাদের উৎস (Kinsley, 1997)। আবার ‘দেবীভাগবত পুরাণ’ (Devi Bhagavata Purana) বলছে, মাতঙ্গী আর অন্য মহাবিদ্যারা হলেন দেবী শাকম্ভরীর (Shakambhari) যুদ্ধের সঙ্গী এবং তারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ (Kinsley, 1997)।

এবার শোনা যাক উচ্ছিষ্ট-মাতঙ্গিনীর (Uchchhishta-Matangini) জন্মের গল্প। ‘শক্তিসংগম-তন্ত্র’ (Shaktisamgama-tantra) বইয়ে আছে এই কাহিনি। একবার হলো কী, বিষ্ণু (Vishnu) আর তার স্ত্রী লক্ষ্মী (Lakshmi) বেড়াতে এলেন শিব (Shiva) আর পার্বতীর (Parvati) (সতীরই আরেক জন্ম) কাছে। তাদের জন্য এলাহি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হলো। খাওয়ার সময় অসাবধানে কিছু খাবার মাটিতে পড়ে গেল। আর সেই ফেলে দেওয়া খাবার থেকে জন্ম নিলেন এক পরমাসুন্দরী কুমারী (Beautiful maiden)! তিনি আসলে দেবী সরস্বতীরই (Saraswati) এক প্রকাশ। জন্ম নিয়েই তিনি চাইলেন দেবতাদের এঁটো (Uchchhishta) খাবার। চারজন দেব-দেবীই তাদের এঁটো খাবার তাকে প্রসাদ (Prasad) হিসেবে দিলেন। প্রসাদ মানে তো আমরা জানি, দেবতাকে দেওয়ার পর বা দেবতা খাওয়ার পর যে খাবার পবিত্র (Sacred) হয়ে যায়। যদিও এঁটো জিনিসটাকে খারাপ ভাবা হয় বলে ‘উচ্ছিষ্ট’ শব্দটা সরাসরি প্রসাদের সাথে ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু ঘটনাটা ছিল এইরকমই। তখন শিব ঘোষণা দিলেন, যারা এই কুমারীর মন্ত্র জপ করবে আর পুজো করবে, তাদের দুনিয়ার সব ইচ্ছে পূরণ হবে, আর তারা শত্রুকেও বশে আনতে পারবে। শিব তাকে বরদানকারী (Giver of boons) হিসেবে ঘোষণা করলেন। সেদিন থেকেই এই কুমারীর নাম হলো উচ্ছিষ্ট-মাতঙ্গিনী (Kinsley, 1997)। কী অদ্ভুত জন্মবৃত্তান্ত, তাই না?

আরেকটা গল্প আছে, এটা পাওয়া যায় ১৮ শতকের ‘প্রাণতোষণী তন্ত্র’ (Pranotasani Tantra) আর ‘নারদপঞ্চরাত্র’ (Naradpancharatra) বইতে (Pravrajika Vedantaprana, 2015)। একবার পার্বতীর খুব ইচ্ছে হলো ক’দিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবেন। শিবের কাছে অনুমতি চাইলেন। শিব তো ছাড়তে চান না! শেষে এই শর্তে রাজি হলেন যে, পার্বতী যদি কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে না আসেন, তিনি নিজেই গিয়ে ধরে নিয়ে আসবেন। পার্বতী রাজি হয়ে বাবা হিমালয়ের (Himalaya) বাড়ি চলে গেলেন, আর গিয়ে তো বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দিলেন। এদিকে শিব আর থাকতে পারেন না, প্রেমে একেবারে আকুল! তিনি কী করলেন, এক গয়না বিক্রেতার (Ornament seller) ছদ্মবেশ ধরে হিমালয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির। পার্বতীকে শাঁখার গয়না বিক্রি করতে লাগলেন। গয়না তো দিলেন, কিন্তু পার্বতীর মন পরীক্ষা করার জন্য ছদ্মবেশী শিব বদলে চাইলেন যৌনতা! পার্বতী তো রেগে আগুন, অভিশাপ দিতে যাবেন, এমন সময় নিজের যোগবলে (Yogic powers) ধরে ফেললেন, এ তো গয়নাওলা নয়, স্বয়ং মহাদেব! তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে, যৌন আনুকূল্য দেবেন, তবে সঠিক সময়ে। সেদিন সন্ধ্যায় পার্বতী এক চণ্ডাল শিকারীর (Chandala huntress) বেশ ধরে শিবের ডেরায় ফিরে এলেন। পরনে লাল কাপড়, শরীর ছিপছিপে কিন্তু স্তন দুটো বিশাল। তিনি শিবকে লোভ দেখানোর জন্য নাচতে শুরু করলেন। শিবকে বললেন, তিনি তপস্যা করতে এসেছেন। শিব উত্তর দিলেন, তিনিই তো সব তপস্যার ফল দেন! এই বলে পার্বতীর হাত ধরলেন, চুমু খেলেন, তারপর তার সাথে মিলিত হলেন। মিলনের সময় শিব নিজেও এক চণ্ডালের (Chandala) রূপ ধরলেন আর বুঝলেন, এই চণ্ডাল রমণীই তার স্ত্রী পার্বতী। এরপর পার্বতী শিবের কাছে বর চাইলেন, তার এই যে চণ্ডালিনী (Chandalini) রূপ – যে রূপে শিব তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন – এই রূপটা যেন উচ্ছিষ্ট-চণ্ডালিনী (Uchchhishta-Chandalini) নামে চিরকাল থেকে যায়। আর শিবের পুজো করে ফল পেতে হলে যেন আগে এই রূপে পার্বতীর পুজো করা হয় (Kinsley, 1997)। কী কাণ্ড দেখুন! এই গল্প আবার অনেক বাংলা মঙ্গলকাব্যেও (Mangalkavyas) পাওয়া যায়। তবে সেখানে পার্বতীকে সরাসরি মাতঙ্গী বলা হয়নি (Kinsley, 1997, notes to pages 209–216)।

ব্রুকলিন মিউজিয়ামে রাখা দেবী মাতঙ্গীর একটি ছবি
উনিশ শতকের প্রথমদিকের এই দক্ষিণ ভারতীয় ছবিতে রাজ-মাতঙ্গীকে প্রায়ই বীণা বাজাতে আর সঙ্গে টিয়াপাখি নিয়ে দেখা যায়

‘স্বতন্ত্র-তন্ত্র’ (Svatantra-tantra) বইয়ে আরেক গল্প আছে। মতঙ্গ (Matanga) নামে এক ঋষি ছিলেন। তার ইচ্ছে হলো এমন ক্ষমতা লাভ করবেন যাতে সব জীবজন্তুকে বশ করতে পারেন। এর জন্য তিনি হাজার হাজার বছর ধরে কঠোর তপস্যা (Austerities) করলেন। শেষে দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী (Tripura Sundari) দেখা দিলেন। তার চোখ থেকে এক আলোকরশ্মি বেরিয়ে এল, আর তা থেকে জন্ম হলো দেবী কালীর (Kali), যার গায়ের রং ছিল সবুজ মতো, আর নাম হলো রাজ-মাতঙ্গিনী (Raja-Matangini)। তার সাহায্যেই মতঙ্গ ঋষি নিজের মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন (Kinsley, 1997)। ‘মতঙ্গ তন্ত্র’ (Matanga Tantra) আর ‘শ্যামলদণ্ডকম্’ (Shyamaladandakam) সহ আরও অনেক বইতে আবার মাতঙ্গীকে ওই মতঙ্গ ঋষির (Sage Matanga) মেয়ে বলা হয়েছে (Frawley, 1994)।

বারাণসী (Varanasi) শহরের তথাকথিত নিচু জাতের এলাকায় কৌরী-বাই (Kauri-bai) নামে মাতঙ্গীর এক রূপের আবির্ভাব হয়েছিল। তাকে নিয়েও একটা গল্প আছে। কৌরী-বাই নাকি ছিলেন শিবের বোন। তিনি ব্রাহ্মণদের রীতিনীতি আর শুচিবাই নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করতেন। শিবের চালচলন – যেমন শ্মশানে থাকা, নেশা করা, ভূত-প্রেতের সাথে মেশা – এসব তার একদম পছন্দ হতো না। শিব প্রথমদিকে বোনের কথায় পাত্তা দিতেন না। কিন্তু বিয়ের পর তার স্ত্রী পার্বতী আর স্বামীর নামে এসব নিন্দা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি কৌরী-বাইকে অভিশাপ দিলেন, “তুমি যে এলাকাকে এত ঘৃণা করো, সেখানেই তোমার পরের জন্ম হোক আর সারা জীবন ওখানেই কাটাও!” অভিশাপ ফলে গেল। কউরী-বাইয়ের সত্যিই বারাণসীর সেই ‘অস্পৃশ্য’ এলাকাতে জন্ম হলো। তিনি তো খুব দুঃখী! তখন তিনি ভাই শিবের – যিনি বারাণসীর দেবতা – কাছে কান্নাকাটি করলেন। শিব তখন তাকে এই বর দিলেন যে, বারাণসীতে তীর্থ (Pilgrimage) করতে এলে কৌরী-বাইয়ের পুজো না দিলে সেই তীর্থ সম্পূর্ণ হবে না (Kinsley, 1997)।

কীসের সাথে তার যোগ? তাৎপর্যই বা কী? (Associations)

মাতঙ্গী দেবীর সঙ্গে প্রায়ই এমন সব জিনিসের নাম জুড়ে যায় যা সাধারণত অপবিত্র বলে মনে করা হয়। যেমন ধরুন দূষণ (Pollution), আর বিশেষ করে উচ্ছিষ্ট (Uchchhishta বা Ucçhishța) মানে এঁটো খাবার। হিন্দুধর্মে তো এঁটো জিনিস ছোঁয়াও বারণ, কিন্তু মাতঙ্গীকে নাকি এই এঁটো খাবারই নিবেদন করা হয়! একটা গল্পে তো শুনলামই, তার জন্মই নাকি এঁটো খাবার থেকে (Foulston & Abbott, 2009; Kinsley, 1997)। মাতঙ্গীকে নিজেই বলা হয় উচ্ছিষ্ট বা অবশিষ্টাংশ (Residue) – অর্থাৎ, সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যা টিকে থাকে, সেই পরম সত্তার (Divine Self) প্রতীক তিনি (Frawley, 1994)। এঁটো খাবার যাকে নিবেদন করা হয়, সেই দেবী তো প্রথা ভাঙারই প্রতীক হবেন, তাই না? তাই তিনি অশুভতা (Inauspiciousness) আর সমাজের নিয়ম ভাঙার (Forbidden transgression) মূর্ত প্রতীক (Foulston & Abbott, 2009)।

মাতঙ্গীকে প্রায়ই অস্পৃশ্য (Outcaste) আর অপবিত্র (Impure) বলা হয়। তার সাথে এই দূষণের সম্পর্কটা এসেছে মূলত সমাজের সেইসব দলিত বা তথাকথিত নিচু জাতের মানুষদের থেকে, যাদের পুরনো হিন্দু সমাজে অপবিত্র ভাবা হতো। এই মানুষগুলো এমন সব কাজ (Occupations) করত যা অশুভ বা নোংরা বলে মনে করা হতো – যেমন ধরুন, আবর্জনা সাফাই (Collection of waste), মাংস কাটা (Meat-processing), বা মড়া পোড়ানো শ্মশানে কাজ করা (Working in cremation grounds) (Foulston & Abbott, 2009)। নেপালে তো এই ধরণের দলিত গোষ্ঠীগুলোকে এক কথায় মাতঙ্গীই (Matangi) বলা হয়। তারা মানুষের বর্জ্য (Human waste) সহ যত অশুভ জিনিস আছে, সেগুলো জোগাড় করে গ্রামের বাইরে গিয়ে ফেলে আসে, আর নিজেরাও প্রায়শই গ্রামের বাইরেই থাকে (Kinsley, 1997)। কাজেই, মাতঙ্গী যুক্ত হয়ে আছেন মৃত্যু, দূষণ, অশুভ ব্যাপার আর পুরনো হিন্দু সমাজের একেবারে প্রান্তিক জীবনের (Periphery) সাথে (Foulston & Abbott, 2009; Kinsley, 1997)। তবে এর একটা অন্য দিকও আছে। যেহেতু উঁচু-নিচু সব জাতের মানুষই তার পুজো করে, তাই তিনি আবার সমতারও (Equality) প্রতীক।

মাতঙ্গীর সাথে বন-জঙ্গলেরও (Forests) একটা যোগ আছে, আর সেইসব আদিবাসী মানুষদেরও (Tribal peoples), যারা গতানুগতিক হিন্দু সমাজের বাইরে থাকে। ‘ননায়াবর্ত-তন্ত্র’ (Nanayavarta-tantra) নামে একটা বইতে তার হাজারটা নাম নিয়ে লেখা একটা স্তোত্রে (Thousand-name hymn) এমন লাইন আছে যেখানে তাকে বলা হয়েছে তিনি বনে থাকেন, বনে ঘোরেন, বনকে চেনেন, আর বন উপভোগ করেন (Kinsley, 1997)।

মাতঙ্গী হলেন কথ্য শব্দের (Spoken word বা Vaikhari) শক্তির দেবী – অর্থাৎ আমাদের মনের ভাবনা যেভাবে কথায় প্রকাশ পায়। শুধু তাই নয়, তিনি শোনার ক্ষমতারও (Power of listening) দেবী, মানে কথা শুনে তাকে বুঝে জ্ঞানে আর চিন্তায় বদলে ফেলার ক্ষমতা। কথা বলা ছাড়াও আমাদের ভেতরের চিন্তা আর জ্ঞানের যত রকম প্রকাশ আছে – যেমন ধরুন শিল্পকলা (Art), গান-বাজনা (Music), নাচ (Dance) – সে সবকিছুর উপরেও তার কর্তৃত্ব (Frawley, 1994)। তিনি কথার মধ্যম স্তর (Madhyama) নিয়ন্ত্রণ করেন – যেখানে ভাবনাগুলো কথায় রূপ নেয়। আর তার সবচেয়ে উঁচু স্তরে তিনি হলেন পরা-বৈখরী (Para-Vaikhari) – মানে পরম শব্দ (Supreme Word) যা কথার মাধ্যমে প্রকাশ পায় আর যাতে সব শাস্ত্রের জ্ঞান ধরা আছে। তাকে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী (Goddess of learning and speech) আর জ্ঞান ও প্রতিভার (Talent) দাত্রী বলা হয় (Frawley, 1994)। তাকে আবার মন্ত্রিণীও (Mantrini) বলা হয়, মানে পবিত্র মন্ত্রগুলোর (Sacred mantras) তিনি হলেন রানি (Frawley, 1994)। তিনি আবার গুরুর (Guru) কথারও প্রতীক, যিনি আমাদের আধ্যাত্মিক পথ (Spiritual guide) দেখান (Frawley, 1994)। বলা হয়, মাতঙ্গী বাস করেন আমাদের গলার কণ্ঠ চক্রে (Throat chakra) – যেখান থেকে কথা বেরোয় – আর জিভের ডগায় (Tip of the tongue)। আমাদের তৃতীয় নয়ন (Third eye) থেকে জিভের ডগা পর্যন্ত সরস্বতী (Saraswati) নামে যে একটা চ্যানেল বা পথ আছে, তার সাথেও তার যোগ আছে (Frawley, 1994)। ডেভিড ফ্রলি (David Frawley) নামে একজন পণ্ডিত মনে করেন, মাতঙ্গীকে অপবিত্র বলার একটা কারণ হলো এই কথ্য শব্দের স্বভাব। কথা দিয়ে আমরা জিনিসকে চিহ্নিত করি, একটা গণ্ডিতে বেঁধে ফেলি, যার ফলে সেই জিনিসের আত্মার সাথে আমাদের আসল যোগাযোগটা হয় না। মাতঙ্গী হলেন সেই দেবী যিনি আমাদের শেখান কীভাবে ঠিকঠাক শব্দ ব্যবহার করতে হয়, আবার কখন শব্দের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে আত্মা আর ভেতরের জ্ঞানকে (Inner knowledge) খুঁজতে হয় – যে জ্ঞান ধরাবাঁধা ঐতিহ্যের সীমানার বাইরে থাকে (Frawley, 1994)।

মাতঙ্গীর একটি কালীঘাট পটচিত্র

আগেই বলেছি, মাতঙ্গীকে মূলধারার হিন্দু ধর্মের জ্ঞান আর কলার দেবী সরস্বতীর (Saraswati) তান্ত্রিক রূপ (Tantric form) হিসেবে ধরা হয়। দুজনের মধ্যে মিলও অনেক। দুজনেই গান-বাজনার (Music) দেবী, দু’জনকেই বীণা (Veena) বাজাতে দেখা যায়। দু’জনকেই বলা হয় নাদ (Nada) – মানে সেই শব্দ বা শক্তি যা আমাদের শরীরের নাড়ী (Nadi channels) দিয়ে বয়ে চলে আর প্রাণশক্তি (Life force) জাগিয়ে রাখে। দু’জনের সাথেই আবার বর্ষার মেঘ (Rain clouds), বাজ পড়া (Thunder) আর নদীর (Rivers) যোগ আছে। যদিও দু’জনেই জ্ঞান (Learning) আর কথার (Speech) দেবী, তবে একটা পার্থক্য আছে। সরস্বতী হলেন ব্রাহ্মণদের (Brahmins) কেতাবি, প্রথাগত জ্ঞানের (Orthodox knowledge) দেবী। আর মাতঙ্গী হলেন বন্য (Wild), বাঁধনছাড়া (Ecstatic), অস্পৃশ্য – তিনি হলেন প্রথাগত সমাজের বাইরের সেই “অসাধারণ” (Extraordinary) জ্ঞানের প্রতীক, বিশেষ করে ভেতরের জ্ঞানের (Inner knowledge) (Frawley, 1994)। মাতঙ্গীর সাথে আবার গণেশেরও (Ganesha) যোগ আছে – সেই যিনি হাতির মাথাওয়ালা জ্ঞান আর বাধা দূর করার দেবতা। দু’জনের সাথেই হাতি (Elephant) আর বিদ্যার (Learning) সম্পর্ক। মাতঙ্গীকে গণেশের মা-ও (Mother) বলা হয় (Frawley, 1994)! আবার আরেক মহাবিদ্যা দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী (Tripura Sundari) বা রাজরাজেশ্বরী (Rajarajeshvari), যিনি হলেন রানীদেরও রানী (Queen of Queens), মাতঙ্গীকে তার মন্ত্রী (Minister) হিসেবেও বর্ণনা করা হয় (Frawley, 1994)।

দেখুন তাহলে, একই দেবী, অথচ কত রকম তার পরিচয়, কত রকম তার তাৎপর্য!

আচ্ছা, এবার আসা যাক মাতঙ্গী দেবীর পূজাপাঠের কথায়। কেমন করে তার আরাধনা করা হয়, কী নিয়মকানুন – সে সব ভারী অদ্ভুত ব্যাপার কিন্তু!

পূজা-আচ্চা (Worship)

দশমহাবিদ্যাদের মধ্যে বগলামুখী (Bagalamukhi) দেবীর মতো মাতঙ্গীর পূজাও করা হয় মূলত নানান আশ্চর্য ক্ষমতা (Supernatural powers) লাভের আশায়। যেমন ধরুন, ‘মহাভাগবত পুরাণ’ (Maha-Bhagavata Purana) বইয়ের এক শ্লোকে শত্রুকে জব্দ করার জন্য দেবীর দয়া চাওয়া হয়েছে। আবার ‘তন্ত্রসার’ (Tantrasara) বলছে, তার মন্ত্র যদি ঠিকঠাক জপ করা যায়, তার রূপ যদি মনে মনে ধ্যান করা হয়, আর নিয়ম মেনে যদি পুজো করা হয়, তাহলে নাকি লোকের উপর প্রভাব খাটানো যায়, এমনকি লোকে আপনার দিকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হবে (Kinsley, 1997)!

তান্ত্রিক সাধকেরা (Tantric sadhakas) একটা খুব অন্যরকম কাজ করেন – তারা দেবীকে উচ্ছিষ্ট (Uchchhishta) বা এঁটো খাবার নিবেদন করেন। মনে করা হয়, এই কাজটা করে তারা আসলে নিজেদের ভেতরের দূষণকে জয় করেন, নিজেদের অহংকারকে (Ego) ভেঙে ফেলেন। মাতঙ্গীর পূজা নাকি ভক্তকে এই সব নিষিদ্ধ জিনিসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, দূষণকে অতিক্রম করতে শেখায়। আর তার ফলে হয় মুক্তি (Salvation) মেলে, নয়তো দুনিয়াবী নানান লক্ষ্য (Worldly goals) পূরণের জন্য আশ্চর্য সব ক্ষমতা হাতে আসে (Foulston & Abbott, 2009)। ‘পুরশ্চর্যার্ণব’ (Purashcharyarnava) বইতে তো এও লেখা আছে, দেবী যদি আপনার উপর সন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি নাকি আপনার কানের কাছে ফিসফিস করে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর বলে দেবেন (Kinsley, 1997)! কী রহস্যময় ব্যাপার, তাই না?

মাতঙ্গীর যন্ত্র (Yantra), যা তার পূজায় কাজে লাগে

মাতঙ্গীর পূজায় প্রায়ই ‘ঐং’ (Aim) – এই ছোট্ট মন্ত্রটা (Mantra syllable) ব্যবহার করা হয়। এই ‘ঐং’ আবার দেবী সরস্বতীরও (Saraswati) মন্ত্র, আর এটা হলো জ্ঞান, বিদ্যা আর শিক্ষার বীজমন্ত্র (Seed-syllable)। তবে একটা লম্বা মন্ত্রও আছে (Frawley, 1994):

ওঁ হ্রীঁ ঐঁ শ্রীঁ নমো ভগবতি উচ্ছিষ্টচণ্ডালি শ্রী মাতঙ্গেশ্বরী সর্বজনবশঙ্করি স্বাহা
(Om Hrim Aim Shrim Namo Bhagvati Ucchishtachandali Shri Matangeswari Sarvajanavasankari Swaha)
“আরাধ্যা মাতঙ্গী, যিনি অস্পৃশ্য ও উচ্ছিষ্টস্বরূপিণী, যিনি সকল প্রাণীকে বশ করার ক্ষমতা দেন, তাকে প্রণাম।”

এই মন্ত্র নাকি দশ হাজার বার জপ করা যেতে পারে! কিংবা ধরুন, যজ্ঞে (Fire sacrifice) ফুল আর ঘি (Ghee) দেওয়ার সময় এক হাজার বার, অথবা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের (Brahmin priests) জল (Arghya) বা খাবার দেওয়ার সময় একশো বার জপ করলেও চলে (Kinsley, 1997)। তার একটা যন্ত্রও (Yantra) আছে – মানে একটা পবিত্র জ্যামিতিক নকশা। সেটা কাগজে এঁকেও পুজো করা যায়, আবার মনে মনে কল্পনা করেও (Kinsley, 1997)। পুজোর সময় মন্ত্রের সাথে এই যন্ত্রও লাগে (Frawley, 1994)।

আরও কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। বিশেষ কিছু জিনিস যদি বিশেষ জায়গায় – যেমন ধরুন শ্মশানে (Cremation grounds), নদীর ধারে (Riverbanks), জঙ্গলে (Forests) বা চৌরাস্তায় (Crossroads) – মন্ত্র জপ করতে করতে যজ্ঞে দেওয়া হয়, তাহলে নাকি মনের বিশেষ বিশেষ ইচ্ছে পূরণ হয়! যেমন, বেল পাতা (Bael leaves) দিলে নাকি রাজত্ব মেলে; লবণ (Salt) দিলে মেলে লোককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা; হলুদ (Turmeric) দিলে নাকি শত্রুকে অবশ করে ফেলা যায় (Power to paralyze); নিমের ডাল (Neem twigs) নাকি টাকা-পয়সা এনে দেয়; আর চন্দন (Sandalwood), কর্পূর (Camphor) আর জাফরান (Saffron) একসাথে, কিংবা নুন আর মধুর (Honey) মিশ্রণ দিলে নাকি লোকে আপনার দিকে আকৃষ্ট হবে (Power to attract people) (Kinsley, 1997)। তার মন্ত্র পড়তে পড়তে চালের গুঁড়ো দিয়ে রুটি (Rice-flour bread) বানিয়ে খাওয়ালে নাকি মেয়েরা আকর্ষিত হয়! এমনকি এও বলা আছে, একটা কাকের (Crow) পেটে শাঁখ (Conch) ভরে সেটাকে শ্মশানে পুড়িয়ে সেই ছাই যদি কাউকে খাওয়ানো যায় আর সাথে দেবীর মন্ত্র জপ করা যায়, তাহলে নাকি সেই লোক আপনার দাস (Slave) হয়ে যাবে (Kinsley, 1997)! বিশ্বাস করা কঠিন, তাই না?

কলকাতায় এক কালীপূজার প্যান্ডেলে অন্যান্য মহাবিদ্যাদের সাথে মাতঙ্গীর পূজা হচ্ছে

মাতঙ্গী পূজার সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রমী নিয়ম হলো, তাকে উচ্ছিষ্ট (Uchchhishta) বা এঁটো খাবার নিবেদন করতে হয়। শুধু তাই নয়, যে পুজো করছে, সে নিজেও তখন ওই দূষিত উচ্ছিষ্ট অবস্থাতেই থাকবে – মানে, খাওয়ার পর হাত না ধুয়ে, মুখে-হাতে খাবার লেগে থাকা অবস্থায়! ভাবুন একবার! যেখানে সাধারণ হিন্দু ধর্মে দেবতাদের এঁটো খাবার দেওয়া বা নিজে এঁটো অবস্থায় থাকা একেবারে নিষিদ্ধ (Taboo), সেখানে মাতঙ্গীর পূজায় এটাই নিয়ম (Kinsley, 1997)! আরও একটা ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ প্রথা আছে – দেবীকে মাসিকের রক্তে (Menstrual blood) ভেজা কাপড় নিবেদন করা! বলা হয়, এতে নাকি মনের মতো সঙ্গী আকর্ষণ (Attract a mate) করা যায়। মাসিকের রক্ত তো প্রায় সব হিন্দু শাস্ত্রমতেই অপবিত্র (Polluted) আর ঋতুমতী মহিলাদের তো পুজোআচ্চা বা মন্দিরে ঢোকা থেকেই দূরে রাখা হয় (Kinsley, 1997)। মাতঙ্গীর পূজায় এসব বাছবিচার নেই!

নেপালের (Nepal) অস্পৃশ্য ‘মাতঙ্গী’ সম্প্রদায়ের কথা আগে বলেছি। তারা নানান দূষিত জিনিস, মরা মানুষের জিনিসপত্র, বলির পশুর মাথা – এসব জোগাড় করে চৌরাস্তায় রাখা ‘চ্যাসাস’ (Chwasas) নামে এক ধরনের বিশেষ পাথরের উপর নিবেদন করে। মনে করা হয়, দেবী মাতঙ্গী সেগুলো নৈবেদ্য হিসেবে “খেয়ে” (“Consumes”) নেন আর তার ফলে সেই দূষণ দূর হয়ে যায় (Kinsley, 1997)। ‘তন্ত্রসার’ (Tantrasara) বইতে আবার শত্রুকে দমন করতে বা কাব্য লেখার প্রতিভা (Poetic talent) পেতে হলে গভীর রাতে চৌরাস্তায় বা শ্মশানে গিয়ে মাতঙ্গীকে মাংস (Meat), মাছ (Fish), রান্না করা ভাত (Cooked rice), দুধ (Milk) আর ধূপ (Incense) নিবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি এও বলা আছে, দেবীকে উচ্ছিষ্ট, বেড়ালের মাংস (Cat meat) আর ছাগলের মাংস (Goat meat) দিলে নাকি পরম জ্ঞান (Supreme knowledge) লাভ করা যায় (Kinsley, 1997)!

তবে এতসব নিয়ম ভাঙার পুজোর মধ্যে একটা জরুরি কথা বলা আছে – মাতঙ্গীর পূজা তখনই সফল হবে, যখন ভক্ত সব মেয়েদের দেবীর মতো সম্মান করবে আর তাদের নিন্দেমন্দ করবে না (Kinsley, 1997)। বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা কিন্তু!

আর হ্যাঁ, মাতঙ্গীর পূজার আগে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য কোনও উপোস (Fasts) বা বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান (Rituals) করার দরকার নেই, যা সাধারণত অন্য হিন্দু পুজোয় করতে হয়। যে কেউ, যে কোনও মন্ত্র ব্যবহার করে তার পূজা করতে পারে – তার দীক্ষা (Initiated) হয়েছে কি হয়নি, বা অন্য কোনও দেবতার পূজার জন্য সে যোগ্য (Unfit) কিনা, এসব দেখা হয় না (Kinsley, 1997)। দেবীর হাজারটা নাম নিয়ে লেখা একটা স্তোত্র আছে ‘ননায়াবর্ত-তন্ত্র’ (Nanayavarta-tantra) বইতে, আর একশোটা নাম নিয়ে লেখা স্তোত্র আছে ‘রুদ্রায়ামল’ (Rudrayamala) বইতে (Kinsley, 1997)। সংস্কৃত বর্ণমালা (Sanskrit alphabet) পড়া, মন্ত্র জপ করা (Chanting of mantras), চেঁচিয়ে শাস্ত্র পড়া (Loud reading of the scriptures), আর গান-বাজনা বা নাচ (Performance of music and dance) – এগুলোকেও তার পূজারই অংশ বলে ধরা হয় (Frawley, 1994)।

কোথায় তার মন্দির? (Temples)

মাতঙ্গী দেবীকে খুঁজে পাওয়া যাবে কোথায়?

আসামের কামাখ্যা মন্দির কমপ্লেক্স (Kamakhya Temple complex) তো তন্ত্র সাধনার জন্য বিখ্যাত এক শক্তিপীঠ। সেখানে অন্যান্য মহাবিদ্যাদের সাথে মাতঙ্গীরও স্থান আছে। তবে অন্য মহাবিদ্যাদের যেমন আলাদা মন্দির আছে, মাতঙ্গী আর কমলা (Kamala) দেবীর কিন্তু তেমন নেই। তারা কামাখ্যার মূল মন্দিরেই পূজিত হন, কামাখ্যা দেবীর সাথে, ‘যোনি’ (Yoni) রূপে।

দক্ষিণ ভারতের মাদুরাই শহরের বিখ্যাত দেবী মীনাক্ষীকেও কিন্তু রাজ মাতঙ্গী বলেই মনে করা হয়। সেখানে দেবীকে দেখা যায় দুই হাতে, দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, আর হাতে ধরা একটি টিয়াপাখি।

গুজরাটের মোধ সম্প্রদায়ের (Modh community) মানুষজন মাতঙ্গীকে মোধেশ্বরী (Modheshwari) নামে পূজা করেন। তিনি তাদের কুলদেবী (Patron deity)। সেখানে মাতঙ্গীকে দেখা যায় দেবী দুর্গার মতো রূপে, সিংহের উপর বসে আছেন।

এছাড়া, ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পা ছিন্নমস্তা মন্দিরেও (Rajrappa Chhinnamasta shrine) মাতঙ্গী এবং অন্যান্য মহাবিদ্যাদের জন্য উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির রয়েছে। আর দক্ষিণ ভারতে এমন বেশ কিছু মন্দির আছে যেখানে মাতঙ্গীকে শ্যামলা (Shyamala) বা মন্ত্রিণী (Mantrini) নামে পূজা করা হয়। শ্রীকুল নামক তান্ত্রিক ধারায় (Srikula tradition) দেবী ললিতার যিনি প্রধানমন্ত্রী, ইনি হলেন সেই মন্ত্রিণী।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মাতঙ্গী দেবী বেশ রহস্যময়ী, তার পূজাপাঠও যেমন অন্যরকম, তেমনি নানা জায়গায় নানা রূপে তাকে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Benard, E. A. (2000). Chinnamasta: The aweful buddhist and hindu tantric goddess. Motilal Banarsidass. ISBN 978-81-208-1748-7.

  • Foulston, L., & Abbott, S. (2009). Hindu goddesses: Beliefs and practices. Sussex Academic Press. ISBN 978-1-902210-43-8.

  • Frawley, D. (1994). Matangi: The utterance of the divine word. In Tantric yoga and the wisdom goddesses: Spiritual secrets of ayurveda. Lotus Press. ISBN 978-0-910261-39-5.

  • Kinsley, D. R. (1988). Tara, Chinnamasta and the Mahavidyas. In Hindu goddesses: Visions of the divine feminine in the hindu religious tradition (1st ed., pp. 161–177). University of California Press. ISBN 978-0-520-06339-6.

  • Kinsley, D. R. (1997). Tantric visions of the divine feminine: The ten mahāvidyās. University of California Press. ISBN 978-0-520-20499-7.

  • Pravrajika Vedantaprana. (2015, October 10). Saptahik Bartaman, 28(23), 20. Bartaman Private Ltd.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.