গ্রামসির সিজারবাদ: যখন নায়ক এসে সব গুলিয়ে ফেলে (আবার গুছিয়েও তোলে?)

ভূমিকা

রাজনীতি বড় অদ্ভুত জিনিস। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। কখনো মনে হয় সব একদম ঠিকঠাক চলছে, যেন এক শান্ত নদী বয়ে চলেছে। আবার কখনো সবকিছু এমন তালগোল পাকিয়ে যায় যে মনে হয় এই বুঝি সব গেল! চারদিকে ধোঁয়াশা, বিভ্রান্তি। কে বন্ধু, কে শত্রু, বোঝাই দায়। ঠিক এরকম এক ধোঁয়াশাপূর্ণ সময়েই মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে কিছু বিশেষ ধরনের নেতার। তাদের হাঁটাচলায় রাজ্যের ভাব, কথায় যেন মধু ঝরে, আবার কখনো কখনো বজ্রের হুঙ্কার। সাধারণ মানুষ তাদের দেখে মুগ্ধ হয়, ভরসা পায়। মনে হয়, যাক বাবা, এইবার একজন কাজের মানুষ পাওয়া গেল! ইনিই পারবেন সব সমস্যার সমাধান করতে।

আন্তোনিও গ্রামসি (Antonio Gramsci) নামের এক ইতালিয়ান চিন্তাবিদ, যিনি জীবনের একটা বড় অংশ জেলে বসেই কাটিয়েছেন, ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতির কথাই ভেবেছিলেন। জেলখানার নির্জনতায় বসে, ফ্যাসিবাদের উত্থান চোখের সামনে দেখে, তিনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন – কেন এমন হয়? কেন একটা জলজ্যান্ত সমাজ হঠাৎ করে একজন বিশেষ নেতার হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেয়? এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় তার ‘সিজারবাদ’ (Caesarism) তত্ত্বটি।

ভাবছেন, সিজারবাদ? সে আবার কী? জুলিয়াস সিজারের কথা মনে পড়ছে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম থেকেই এই তত্ত্বের নামকরণ। কিন্তু গ্রামসি শুধু সিজারের গল্প শোনাতে চাননি। তিনি সিজারকে একটা প্রতীকের মতো ব্যবহার করেছেন। একটা বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতীক।

আসুন, আজ আমরা গ্রামসির এই সিজারবাদ তত্ত্বের গভীরে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করি। চেষ্টা করব সহজ ভাষায়, গল্পের ছলে বিষয়টা বুঝতে। যেন কঠিন তত্ত্বকথা মাথার উপর দিয়ে না গিয়ে সোজা মনের ভেতরে ঢুকে যায়। তৈরি তো? চলুন শুরু করা যাক।

প্রেক্ষাপট: গ্রামসি কেন ভাবলেন এসব?

কোনো তত্ত্বই আকাশ থেকে পড়ে না। তার একটা প্রেক্ষাপট থাকে, একটা কারণ থাকে। গ্রামসির সিজারবাদ তত্ত্ব বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপ। বিশেষ করে ইতালি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু শান্তি আসেনি। অর্থনৈতিক সংকট চরমে, পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর উপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। একদিকে সমাজতন্ত্রের ডাক জোরালো হচ্ছে, শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধছে। অন্যদিকে, পুরনো অভিজাত শ্রেণি আর শিল্পপতিরা ভয় পাচ্ছে – এই বুঝি সব গেল! তাদের এতদিনের আরাম-আয়েশ, ক্ষমতা – সব যদি শ্রমিকদের দখলে চলে যায়?

এইরকম একটা টালমাটাল অবস্থায় ইতালির রাজনীতিতে উত্থান ঘটল বেনিতো মুসোলিনির (Benito Mussolini) এবং তার ফ্যাসিস্ট পার্টির (Fascist Party)। মুসোলিনি এলেন এক ত্রাণকর্তার বেশে। তিনি একদিকে জাতীয়তাবাদের জিগির তুললেন, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। সাধারণ মানুষ, যারা এতদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক কষ্টে ভুগছিল, তাদের অনেকেই মুসোলিনির মধ্যে আশার আলো দেখতে পেল। আবার শিল্পপতি আর জমিদার শ্রেণি ভাবল, এই লোকটাই পারবে সমাজতন্ত্রের ভূতকে তাড়াতে।

গ্রামসি তখন ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির (Italian Communist Party) একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি নিজের চোখে দেখলেন কীভাবে মুসোলিনি ক্ষমতায় এলেন, কীভাবে ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করলেন, কীভাবে বিরোধী মতকে দমন করলেন। জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যে বসে তিনি শুধু ইতালির পরিস্থিতি নয়, বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন, এই যে বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব, যারা একটা গভীর সংকটের সময় উঠে আসে এবং আপাতভাবে সব পক্ষের ঊর্ধ্বে থেকে সমস্যার সমাধান করার ভান করে – এদের চরিত্রটা আসলে কী? এরা কি সত্যিই নিরপেক্ষ? নাকি কোনো বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতেই এদের আগমন? এই ভাবনাগুলোই দানা বেঁধে তৈরি হলো সিজারবাদ তত্ত্ব।

সিজারবাদ আসলে কী? সরল কথায়

একদম সহজ করে বললে, সিজারবাদ হলো এমন একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেখানে সমাজের প্রধান দুই বিবদমান শক্তি (যেমন, ধরা যাক, একদিকে বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণি, অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত) লড়াই করতে করতে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছায় যে কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়। পুরনো শাসক শ্রেণি আর আগের মতো শাসন করতে পারছে না, তাদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে, মানুষের আস্থা হারিয়েছে। আবার নতুন যে শক্তিটা উঠে আসছে (যেমন শ্রমিক শ্রেণি), তারাও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি যে ক্ষমতা দখল করে নেবে।

এই অবস্থাকে গ্রামসি বলেছেন ‘ভারসাম্যের সংকট’ বা আরও পরিষ্কার করে বললে ‘দুর্যোগপূর্ণ ভারসাম্য’ (Catastrophic Equilibrium)। ভাবুন তো, দুজন কুস্তিগীর লড়াই করতে করতে এমনভাবে একে অপরকে জাপটে ধরেছে যে নড়াচড়া করতে পারছে না। কেউই জিতছে না, কিন্তু লড়াইও থামছে না। চারদিকে একটা থমথমে অবস্থা। (Gramsci, 1971, pp. 219-223)

ঠিক এইরকম একটা ‘ক্যাটাস্ট্রফিক ইকুইলিব্রিয়াম’-এর সুযোগেই মঞ্চে প্রবেশ করেন ‘সিজার’ চরিত্রের কেউ। এই ‘সিজার’ একজন ব্যক্তি হতে পারেন (যেমন জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, বা মুসোলিনি), আবার একটি দল বা গোষ্ঠীও হতে পারে। এই সিজারতুল্য শক্তি এসে দুই বিবদমান পক্ষকেই কিছুটা দাবিয়ে দেয়। সে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে আসলে কোনো নির্দিষ্ট পক্ষের লোক নয়, সে এসেছে সবার ঊর্ধ্বে থেকে দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে, শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সে হয়তো পুরনো ব্যবস্থার কিছু জিনিস ভাঙে, আবার কিছু জিনিস রেখে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, তার এই আপাত নিরপেক্ষ ভূমিকার আড়ালে কোনো একটা বিশেষ শ্রেণির স্বার্থই রক্ষিত হচ্ছে, যদিও হয়তো একটু ভিন্ন মোড়কে।

গ্রামসির ভাষায়, সিজারবাদ হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে একটি তৃতীয় শক্তি (Third Force), যা প্রায়শই সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল, বিবদমান প্রধান শক্তিগুলোর মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে এবং আপাতভাবে তাদের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে। কিন্তু এই মীমাংসা প্রায়শই প্রগতিশীল শক্তিগুলোর (যেমন শ্রমিক শ্রেণি) অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয় এবং পুরনো শাসক শ্রেণির মূল ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে, যদিও তার রূপ হয়তো কিছুটা বদলে যায়। (Hoare & Smith, Introduction to Gramsci, 1971, p. lxxxvii)

সিজারবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?

গ্রামসির আলোচনা থেকে আমরা সিজারবাদের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারি:

  • কর্তৃত্বের সংকট (Crisis of Authority) বা হেজিমনির ক্রাইসিস: সিজারবাদের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো বিদ্যমান শাসক শ্রেণির কর্তৃত্বের সংকট। অর্থাৎ, যারা এতদিন ধরে শাসন করে আসছে, তারা আর আগের মতো জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাদের কথা আর মানুষ শুনছে না, তাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। গ্রামসির ভাষায়, তাদের ‘হেজিমনি’ (Hegemony) বা মতাদর্শিক আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়েছে। হেজিমনি মানে শুধু জোর করে শাসন করা নয়, বরং শাসিতের সম্মতি আদায় করে শাসন করা। যখন সেই সম্মতি কমে যায়, তখনই কর্তৃত্বের সংকট বা হেজিমনির ক্রাইসিস তৈরি হয়। (Gramsci, 1971, p. 210)

  • শক্তির ভারসাম্যহীন ভারসাম্য (Catastrophic Equilibrium): আগেই বলেছি, এটা হলো সেই পরিস্থিতি যেখানে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ শক্তি – যারা ক্ষমতা দখল করতে চায় – কেউই নির্ণায়কভাবে জিততে পারছে না। পুরনো শক্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, আর নতুন শক্তি যথেষ্ট সবল হয়ে ওঠেনি ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য। এই অচলাবস্থাই সিজার বা সিজারতুল্য শক্তির উত্থানের পথ খুলে দেয়।

  • ‘মহান ব্যক্তি’ বা দলের আবির্ভাব (Emergence of a ‘Great Personality’ or Party): এই শূন্যস্থানে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা বা একটি সুসংগঠিত দলের আবির্ভাব ঘটে। এই নেতা বা দল নিজেদেরকে সংকটের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা এমন ভাব দেখায় যেন তারা প্রচলিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে, কোনো দলের বা শ্রেণির প্রতিনিধি নয়, বরং সমগ্র জাতির ঐক্যের প্রতীক। তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘মসিহা’ ভাব থাকে।

  • সামরিক বা দমনমূলক শক্তির ব্যবহার (Use of Military or Coercive Force): সিজারবাদী শক্তি প্রায়শই রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনমূলক অংশগুলোর (যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ) উপর খুব বেশি নির্ভর করে। যেহেতু তাদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি বা হেজিমনি সবসময় খুব মজবুত থাকে না, তাই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বা বিরোধীদের দমন করতে বলপ্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

  • আপাত মধ্যস্থতা কিন্তু পক্ষপাতমূলক ফলাফল (Apparent Mediation but Biased Outcome): সিজারবাদী নেতা বা দল এমন ভাব দেখায় যেন তারা দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়ে দিচ্ছে, একটা নিরপেক্ষ সমাধান দিচ্ছে। কিন্তু গ্রামসি বলছেন, এই মধ্যস্থতা প্রায়শই নিরপেক্ষ হয় না। শেষ বিচারে, এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে, যদিও সেই স্বার্থ রক্ষার ধরণটা হয়তো আগের চেয়ে ভিন্ন হয়। প্রায়শই এটি বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে, কিন্তু পুরনো উদারনৈতিক (Liberal) পথে নয়, বরং আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী (Authoritarian) পথে।

  • রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি (Increased State Intervention): সিজারবাদী শাসনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অনেক বেড়ে যায়। অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি – সবকিছুতেই রাষ্ট্রের নাক গলানো বাড়ে। ব্যক্তি স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে প্রধান নিয়ন্ত্রক।

সব সিজার কি একই রকম? প্রগতিশীল বনাম প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদ

গ্রামসি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সব সিজারবাদ একরকম নয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং ফলাফলের উপর নির্ভর করে সিজারবাদ দুই ধরনের হতে পারে:

  • প্রগতিশীল সিজারবাদ (Progressive Caesarism): কখনো কখনো সিজারবাদ ঐতিহাসিক বিচারে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। কখন? যখন পুরনো সমাজ ব্যবস্থা এতটাই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে যে তার পতন অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু যে নতুন শক্তি উঠে আসছে সে এককভাবে সেই পতনকে ত্বরান্বিত করতে বা নতুন সমাজ গড়তে পারছে না। তখন একজন সিজারতুল্য নেতা এসে পুরনো ব্যবস্থার বাঁধনগুলোকে ভেঙে নতুন, আরও উন্নত (ঐতিহাসিক বিচারে) ব্যবস্থার পথ খুলে দিতে পারেন। গ্রামসি উদাহরণ হিসেবে প্রথম নেপোলিয়ন বোনাপার্টের (Napoleon Bonaparte) কথা বলেছেন। ফরাসি বিপ্লবের পর যখন বিপ্লবীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র দেশকে আবারও পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন নেপোলিয়ন এসে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি বিপ্লবের অনেক অর্জনকে রক্ষা করেন এবং বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থাকে সুসংহত করেন, যা সামন্ততন্ত্রের তুলনায় একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ ছিল। যদিও তিনি একনায়ক ছিলেন, তার শাসন ফ্রান্স এবং ইউরোপে বুর্জোয়া ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। (Gramsci, 1971, p. 222)

  • প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদ (Regressive Caesarism): এই ধরনের সিজারবাদ ঐতিহাসিক বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল বা পশ্চাৎপদ ভূমিকা পালন করে। এটি তখন ঘটে যখন পুরনো শাসক শ্রেণি সংকটে, কিন্তু প্রগতিশীল শক্তিগুলো (যেমন শ্রমিক শ্রেণি) ক্ষমতা দখলের কাছাকাছি চলে এসেছে। এই সময় একজন সিজারতুল্য নেতা বা দল এসে ক্ষমতা দখল করে এবং প্রগতিশীল শক্তির উত্থানকে জোর করে থামিয়ে দেয়। তারা হয়তো পুরনো ব্যবস্থার কিছু সংস্কার করে, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থাকে পুরনো শোষণমূলক কাঠামোকেই টিকিয়ে রাখা, হয়তো একটু নতুন মোড়কে। গ্রামসি এক্ষেত্রে লুই নেপোলিয়ন বা তৃতীয় নেপোলিয়নের (Louis Napoleon / Napoleon III) উদাহরণ দিয়েছেন, যিনি ১৮৫১ সালে ফ্রান্সে ক্ষমতা দখল করে শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করেছিলেন এবং বুর্জোয়াদের শাসনকেই টিকিয়ে রেখেছিলেন, যদিও এক ভিন্ন রূপে। গ্রামসির কাছে, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ। এটি ইতালিতে শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং পুঁজিপতি শ্রেণির শাসনকেই আরও নৃশংসভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। (Gramsci, 1971, p. 222; Sassoon, 1991)

গ্রামসির জন্য এই পার্থক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তিনি মনে করতেন, ফ্যাসিবাদ কোনো ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা নয়, বরং পুঁজিবাদী সমাজের গভীর সংকটের একটি সম্ভাব্য (এবং ভয়ঙ্কর) পরিণতি। এটা হলো প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদ, যা প্রগতির চাকাকে উল্টোদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে।

সিজারবাদ আর গ্রামসির অন্যান্য ধারণা: একটা আন্তঃসম্পর্ক

সিজারবাদ তত্ত্বটিকে গ্রামসির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো থেকে আলাদা করে বোঝা মুশকিল। এগুলো যেন একই সুতোয় গাঁথা বিভিন্ন ফুল। আসুন, কয়েকটা মূল ধারণার সাথে সিজারবাদের সম্পর্কটা একটু বোঝার চেষ্টা করি:

  • হেজিমনি (Hegemony) ও কর্তৃত্বের সংকট: আগেই বলেছি, সিজারবাদের জন্ম হয় হেজিমনির সংকট থেকে। যখন শাসক শ্রেণি শুধু জোর করে নয়, মানুষের মনে নিজেদের শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে (অর্থাৎ হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে) শাসন করে, তখন সাধারণত সিজারবাদের দরকার হয় না। কিন্তু যখন এই মতাদর্শিক আধিপত্য বা হেজিমনি ভেঙে পড়ে, মানুষ আর শাসককে মন থেকে মানতে চায় না, তখনই বলপ্রয়োগের প্রয়োজন বাড়ে এবং সিজারবাদের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সিজারবাদী শক্তি এসে এক ধরনের নতুন, প্রায়শই আরও বেশি দমনমূলক, হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

  • প্যাসিভ রেভোলিউশন বা নিষ্ক্রিয় বিপ্লব (Passive Revolution / Rivoluzione Passiva): গ্রামসির আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ‘প্যাসিভ রেভোলিউশন’। এর মানে হলো, উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার বা পরিবর্তন, যা সমাজের নীচুতলার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই ঘটে। শাসক শ্রেণি যখন দেখে যে নীচ থেকে একটা বড় পরিবর্তনের (বিপ্লবের) ঢেউ আসছে, তখন তারা নিজেরাই কিছু সংস্কার করে সেই ঢেউকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা জনগণের কিছু দাবি-দাওয়া হয়তো মেনে নেয়, কিন্তু এমনভাবে যাতে ক্ষমতার মূল কাঠামোটা তাদের হাতেই থাকে। গ্রামসি মনে করতেন, সিজারবাদ প্রায়শই এই প্যাসিভ রেভোলিউশনের একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সিজারবাদী নেতা এসে কিছু পরিবর্তন আনেন বটে, কিন্তু সেটা জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয়, বরং উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন, যা শেষ পর্যন্ত পুরনো ব্যবস্থাকেই রক্ষা করে। ইতালির রিসর্জিমেন্টো (Risorgimento) বা একত্রীকরণ প্রক্রিয়াকেও গ্রামসি এক ধরনের প্যাসিভ রেভোলিউশন হিসেবে দেখেছিলেন, যেখানে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়াই বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতা দখল করেছিল। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদও ছিল এক ভয়াবহ প্যাসিভ রেভোলিউশন, যা বিপ্লবের সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল। (Gramsci, 1971, pp. 105-120; Buttigieg, 1995)

  • অর্গানিক ক্রাইসিস বা জৈব সংকট (Organic Crisis): যখন সংকট শুধু অর্থনীতির বা রাজনীতির নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো সমাজ কাঠামোকে, তার ভিত্তি এবং উপরিকাঠামো (Base and Superstructure) উভয়কেই নাড়িয়ে দেয়, তখন তাকে গ্রামসি বলেছেন ‘অর্গানিক ক্রাইসিস’। এই সংকটে পুরনো সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কিন্তু নতুন কিছুই স্পষ্টভাবে গড়ে ওঠে না। সিজারবাদ প্রায়শই এইরকম গভীর, অর্গানিক ক্রাইসিসেরই একটি লক্ষণ বা ফলাফল। এটা নির্দেশ করে যে সমাজ একটা গভীর ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। (Gramsci, 1971, p. 210)

  • রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ (State and Civil Society): গ্রামসি রাষ্ট্রকে শুধু সরকার বা দমনমূলক যন্ত্র (পুলিশ, আর্মি, আদালত) হিসেবে দেখেননি। তিনি ‘রাষ্ট্র’ বলতে বুঝিয়েছেন ‘রাজনৈতিক সমাজ’ (Political Society) অর্থাৎ সরাসরি দমন-পীড়নের প্রতিষ্ঠান এবং ‘নাগরিক সমাজ’ (Civil Society) অর্থাৎ স্কুল, চার্চ, ট্রেড ইউনিয়ন, মিডিয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগফলকে। এই নাগরিক সমাজের মাধ্যমেই শাসক শ্রেণি সাধারণত তাদের হেজিমনি বা মতাদর্শিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সিজারবাদের পরিস্থিতিতে দেখা যায়, নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো আর আগের মতো শাসক শ্রেণির আধিপত্য ধরে রাখতে পারছে না। তখন রাজনৈতিক সমাজের (অর্থাৎ দমনমূলক শক্তির) ভূমিকা প্রধান হয়ে ওঠে। সিজারবাদী শক্তি প্রায়শই নাগরিক সমাজকে কুক্ষিগত করে বা ধ্বংস করে দিয়ে সরাসরি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসন কায়েম করে। (Gramsci, 1971, pp. 261-263)

  • ওয়ার অফ পজিশন বনাম ওয়ার অফ ম্যানুভার (War of Position vs. War of Maneuver): উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে, যেখানে নাগরিক সমাজ খুব শক্তিশালী এবং শাসক শ্রেণির হেজিমনি গভীরে প্রোথিত, সেখানে ক্ষমতা দখল করতে হলে শুধুমাত্র একটা আকস্মিক আঘাত বা ‘ওয়ার অফ ম্যানুভার’ (যেমন রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব) যথেষ্ট নয়। গ্রামসি মনে করতেন, এখানে দরকার ‘ওয়ার অফ পজিশন’ বা অবস্থানগত যুদ্ধ। অর্থাৎ, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (স্কুল, মিডিয়া, সংস্কৃতি) দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম চালিয়ে শাসক শ্রেণির হেজিমনির ভিতকে দুর্বল করে দিতে হবে, এবং নিজেদের বিকল্প হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সিজারবাদ তখন ঘটে যখন ওয়ার অফ পজিশনে শাসক শ্রেণি কোণঠাসা হয়ে পড়ে, কিন্তু বিরোধী শক্তি ওয়ার অফ ম্যানুভার বা চূড়ান্ত আঘাত হানার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না। অথবা, বিরোধী শক্তির ওয়ার অফ ম্যানুভার ব্যর্থ হয়। এই অচলাবস্থায় সিজারবাদী সমাধান উঠে আসে। (Gramsci, 1971, pp. 229-239)

দেখুন, কীভাবে গ্রামসির ধারণাগুলো একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে! সিজারবাদকে বুঝতে হলে তাই হেজিমনি, প্যাসিভ রেভোলিউশন, অর্গানিক ক্রাইসিস – এই সব ধারণাকে একসাথে মিলিয়ে দেখতে হবে।

ইতিহাসে সিজারবাদের উদাহরণ: গ্রামসির চোখে

গ্রামসি তার লেখায় বেশ কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এবং পরিস্থিতিকে সিজারবাদের উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন:

  • জুলিয়াস সিজার (Julius Caesar): মূল অনুপ্রেরণা। রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষ দিকে যখন অভিজাত সিনেটরদের সাথে পপুলার বা জনগণের পক্ষের নেতাদের দ্বন্দ্ব চরমে, এবং গৃহযুদ্ধে দেশ জর্জরিত, তখন সিজার তার সামরিক শক্তি এবং জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি এক অর্থে পুরনো অভিজাততন্ত্র এবং উঠতি গণশক্তি – উভয়ের সাথেই আপোস করেছেন, আবার দমনও করেছেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের কাঠামোকে ভেঙে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। গ্রামসির কাছে, এটি একটি জটিল উদাহরণ, যার মধ্যে প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল উভয় উপাদানই ছিল। (যদিও গ্রামসি সরাসরি সিজারকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেননি, তার তত্ত্বের নামই সিজারের নামে।)

  • প্রথম নেপোলিয়ন (Napoleon Bonaparte): আগেই বলেছি, গ্রামসি একে প্রগতিশীল সিজারবাদের উদাহরণ মনে করতেন। ফরাসি বিপ্লবজাত বুর্জোয়া সম্পর্কগুলোকে তিনি সুসংহত করেছিলেন, যা সামন্ততন্ত্রের তুলনায় এগিয়ে ছিল। তিনি বিপ্লবের বিশৃঙ্খলা থামিয়ে এক নতুন, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

  • তৃতীয় নেপোলিয়ন (Napoleon III): ইনি ছিলেন গ্রামসির চোখে প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদের ক্লাসিক উদাহরণ। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর ফ্রান্সে বুর্জোয়া এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তীব্র সংঘাত তৈরি হয়। লুই নেপোলিয়ন এই সুযোগে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে পরে সামরিক অভ্যুত্থান করে সম্রাট হন। তিনি শ্রমিক আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করেন এবং বড় বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করেন, যদিও তিনি নিজেকে সব শ্রেণির ঊর্ধ্বে বলে দাবি করতেন। কার্ল মার্কসও তার ‘The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte’ বইতে এই পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করেছেন, যা গ্রামসিকে প্রভাবিত করেছিল। (Marx, 1852)

  • বিসমার্ক (Otto von Bismarck): জার্মান একত্রীকরণের প্রধান কারিগর বিসমার্ককেও গ্রামসি সিজারবাদের আলোকে দেখেছেন। প্রুশিয়ার রাজতন্ত্র এবং উঠতি বুর্জোয়াদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে, এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে, বিসমার্ক ‘লোহা ও রক্ত’ (Iron and Blood) নীতিতে জার্মানিকে একত্রিত করেন এবং এক শক্তিশালী, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠন করেন। এটিও এক ধরনের প্যাসিভ রেভোলিউশন ছিল, যেখানে উপর থেকে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানেও সিজারবাদী উপাদান স্পষ্ট – একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব যিনি বিবদমান শক্তিগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন। (Gramsci, 1971, p. 220)

  • মুসোলিনি (Benito Mussolini) ও ফ্যাসিবাদ: গ্রামসির সবচেয়ে জীবন্ত এবং ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ছিল ইতালির ফ্যাসিবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির অর্গানিক ক্রাইসিস, যেখানে উদারনৈতিক রাষ্ট্র ব্যর্থ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী কিন্তু ক্ষমতা দখলে অক্ষম, এবং পুঁজিপতি শ্রেণি ভীত – এই পরিস্থিতিতে মুসোলিনি ‘সিজার’ হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি একদিকে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেন, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের ভয় দেখিয়ে শিল্পপতি ও মধ্যবিত্তের একাংশের সমর্থন লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের মিশেলে তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং এক সর্বগ্রাসী (Totalitarian) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামসির কাছে, এটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদের চূড়ান্ত রূপ, যা ইতালির প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। (Gramsci, 1971; Femia, 2004)

এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, গ্রামসি সিজারবাদকে একটি বিমূর্ত তত্ত্ব হিসেবে দেখেননি, বরং ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে ঘটে যাওয়া বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

সিজারবাদ ও ফ্যাসিবাদ: এক বিপজ্জনক যুগলবন্দী

গ্রামসির সিজারবাদ তত্ত্বের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি আমরা ফ্যাসিবাদের সাথে এর সম্পর্কটা পরিষ্কারভাবে না বুঝি। সত্যি বলতে কি, গ্রামসির জেলখানায় বসে এই তত্ত্ব নিয়ে এত গভীর ভাবনার অন্যতম প্রধান কারণই ছিল ইতালিতে চোখের সামনে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ উত্থান দেখা। তার কাছে, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ কোনো আকস্মিক ঘটনা বা নিছক একনায়কতন্ত্র ছিল না, বরং এটি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল সিজারবাদের (Regressive Caesarism) এক ধ্রুপদী এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক উদাহরণ (Gramsci, 1971, pp. 219-223)।

ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল ঠিক সেই পরিস্থিতিতে যা গ্রামসি সিজারবাদের জন্মক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন:

১. কর্তৃত্বের গভীর সংকট (Profound Crisis of Authority): প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালিতে উদারনৈতিক রাষ্ট্র (Liberal State) জনগণের আস্থা হারিয়েছিল, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল। পুরনো শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির হেজিমনি ভেঙে পড়েছিল।

২. দুর্যোগপূর্ণ ভারসাম্য (Catastrophic Equilibrium): একদিকে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল (যেমন ‘বিয়েন্নিও রোসসো’ বা দুই লাল বছর, ১৯১৯-২০), যা পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের মধ্যে তীব্র ভীতি সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এই শ্রমিক আন্দোলন ক্ষমতা দখলের মতো যথেষ্ট নির্ণায়ক শক্তি অর্জন করতে পারেনি বা সঠিক রণকৌশল নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অন্যদিকে, পুরনো শাসক শ্রেণি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তারা এই চ্যালেঞ্জকে চিরাচরিত উদারনৈতিক পদ্ধতিতে মোকাবেলা করতে পারছিল না। এই অচলাবস্থাই তৈরি করেছিল এক ‘ক্ষমতার শূন্যতা’ (Power Vacuum)।

৩. ‘সিজার’-এর ভূমিকায় ফ্যাসিবাদ: এই শূন্যস্থান পূরণ করতেই মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি এক ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা নিজেদেরকে সব শ্রেণির ঊর্ধ্বে, শুধুমাত্র জাতির স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা বিশৃঙ্খলা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জাতীয় গৌরব পুনরুদ্ধার এবং সমাজতন্ত্রের ‘বিপদ’ থেকে দেশকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

৪. প্রগতিশীল শক্তির বিনাশ: ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় এসে নির্মমভাবে শ্রমিক আন্দোলন, কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলোকে দমন করে। তারা ট্রেড ইউনিয়ন ভেঙে দেয়, বিরোধী নেতাদের হত্যা বা কারারুদ্ধ করে (যেমন গ্রামসি নিজে)। অর্থাৎ, যে প্রগতিশীল শক্তি পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারত, ফ্যাসিবাদ সেই শক্তিকেই ধ্বংস করে দেয়।

৫. পুঁজিবাদের রক্ষা কবচ: আপাতদৃষ্টিতে ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াদেরও কিছু স্বাধীনতা খর্ব করলেও, গ্রামসির বিশ্লেষণে, এটি শেষ পর্যন্ত বৃহৎ পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের স্বার্থই রক্ষা করেছিল। ফ্যাসিবাদ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিল, যদিও তা এক নতুন, অতি-কর্তৃত্ববাদী ও সামরিকীকৃত রূপে। এটি ছিল এক ধরনের সহিংস ‘প্যাসিভ রেভোলিউশন’ (Passive Revolution), যা উপর থেকে রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনর্গঠন করেছিল শ্রমিক শ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই, বরং তাদের দমন করে (Gramsci, 1971; Femia, 2004)।

তাই, গ্রামসির চোখে, ফ্যাসিবাদ হলো সেই বিশেষ ধরনের সিজারবাদ যা আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী সংকটের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল পথে সেই সংকটের ‘সমাধান’ করে – আর তা করে প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিগুলোকে নির্মমভাবে ধ্বংস করার মাধ্যমে। এটি সিজারবাদের সবচেয়ে অন্ধকার এবং বিধ্বংসী রূপ।

আজকের দুনিয়ায় সিজারবাদের প্রাসঙ্গিকতা: গ্রামসি কি আজও বেঁচে আছেন?

প্রশ্ন আসতেই পারে, গ্রামসি তো সেই কবেকার কথা বলে গেছেন! আজকের এই অত্যাধুনিক যুগে, বিশ্বায়নের কালে, তার সিজারবাদ তত্ত্বের কি কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে?

একটু চারপাশে তাকালেই হয়তো উত্তরটা পাওয়া যাবে। আজকের দুনিয়াতেও কি আমরা এমন পরিস্থিতি দেখি না যেখানে পুরনো রাজনৈতিক দল বা ব্যবস্থাগুলো মানুষের আস্থা হারাচ্ছে? যেখানে সমাজে গভীর বিভাজন তৈরি হচ্ছে – অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক? যেখানে মানুষ প্রচলিত নেতাদের উপর বিরক্ত হয়ে এমন কাউকে খুঁজছে যে এসে সব সমস্যার ম্যাজিকের মতো সমাধান করে দেবে?

আমরা কি দেখি না এমন নেতাদের উত্থান, যারা নিজেদেরকে প্রচলিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে বলে দাবি করেন, যারা ক্যারিশমা দিয়ে জনগণকে মুগ্ধ করেন, যারা জাতীয়তাবাদের বা ধর্মীয় আবেগের পালে হাওয়া লাগান, যারা প্রতিপক্ষকে ‘দেশের শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিকে ব্যবহার করে বিরোধী মতকে দমন করতে চান?

গ্রামসি হয়তো আজকের কোনো নির্দিষ্ট নেতাকে সরাসরি ‘সিজার’ বলতেন না, কারণ তিনি জানতেন প্রতিটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই ভিন্ন। কিন্তু তার দেওয়া বিশ্লেষণের চশমাটা দিয়ে দেখলে আজকের অনেক রাজনৈতিক ঘটনাকেই হয়তো নতুন আলোয় বোঝা সম্ভব। যখন আমরা দেখি:

  • উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সংকট (Crisis of Liberal Democracy) বাড়ছে।

  • অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র হচ্ছে এবং তা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে।

  • বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী, কর্তৃত্ববাদী (Authoritarian) বা জনতুষ্টিবাদী (Populist) নেতাদের উত্থান ঘটছে।

  • রাষ্ট্রীয় নজরদারি এবং জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

  • মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো চাপের মুখে পড়ছে।

তখন গ্রামসির ‘কর্তৃত্বের সংকট’, ‘ক্যাটাস্ট্রফিক ইকুইলিব্রিয়াম’, ‘হেজিমনির লড়াই’, ‘প্যাসিভ রেভোলিউশন’ এবং ‘সিজারবাদ’-এর ধারণাগুলো খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, এই ধরনের নেতাদের উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি সমাজের গভীরতর কাঠামোগত সংকটেরই প্রতিফলন। (Hall, 1984; Thomas, 2009)

সিজারবাদ আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, যখন সমাজের প্রধান শক্তিগুলো নিজেদের দ্বন্দ্বের সমাধান গণতান্ত্রিক পথে করতে ব্যর্থ হয়, তখন অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী শক্তির উত্থানের পথ খুলে যায়। এই শক্তি হয়তো সাময়িকভাবে স্থিতিশীলতা আনার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু তার আড়ালে প্রায়শই লুকিয়ে থাকে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ এবং জনগণের স্বাধীনতার সংকোচন।

কিছু সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা

কোনো তত্ত্বই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। গ্রামসির সিজারবাদ তত্ত্ব নিয়েও কিছু প্রশ্ন তোলা যেতে পারে:

  • অতি সরলীকরণ?: কেউ কেউ মনে করতে পারেন, সিজারবাদ তত্ত্বটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে হয়তো কিছুটা সরল করে ফেলে। সব কর্তৃত্ববাদী নেতার উত্থানকেই কি ‘সিজারবাদ’ বলা যায়? প্রতিটি পরিস্থিতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, যা হয়তো এই একক কাঠামোয় পুরোপুরি আঁটানো যায় না।

  • নেতার ভূমিকার উপর অতি গুরুত্ব?: তত্ত্বটি কি একজন ‘মহান ব্যক্তি’ বা নেতার ভূমিকার উপর একটু বেশি জোর দিয়ে ফেলেছে? সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত কারণগুলোর তুলনায় ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি বা ক্যারিশমাকে কি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?

  • প্রগতিশীল/প্রতিক্রিয়াশীল বিভাজন কি সবসময় স্পষ্ট?: ইতিহাসে কোন ঘটনাটা ‘প্রগতিশীল’ আর কোনটা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, তা নির্ধারণ করা সবসময় সহজ নয়। এই বিভাজন কিছুটা আপেক্ষিক এবং ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল হতে পারে।

তবে এই সমালোচনা সত্ত্বেও, সিজারবাদ তত্ত্বটি রাজনৈতিক সংকট এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান বোঝার জন্য একটি অত্যন্ত মূল্যবান বিশ্লেষণাত্মক হাতিয়ার হিসেবেই বিবেচিত হয়। এটি আমাদের দেখায় কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি, রাষ্ট্র এবং নেতৃত্বের মিথস্ক্রিয়া একটি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ফলাফলের জন্ম দিতে পারে।

শেষ কথা: যখন পথ হারিয়ে যায়

গ্রামসির সিজারবাদ তত্ত্ব আমাদের এক গভীর সংকটের সময়ের রাজনীতির ছবি দেখায়। যখন পুরনো পথ আর চলে না, নতুন পথও পরিষ্কার নয়, তখন এক ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সেই ধোঁয়াশার সুযোগেই কখনও কখনও এমন কেউ এসে হাজির হয়, যে আলো দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেই আলো আসল না নকল, তা বোঝা বড় কঠিন।

সিজারবাদ হলো সেই মুহূর্তের গল্প, যখন সমাজ তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে, যখন বিবদমান শক্তিগুলো একে অপরকে আঁকড়ে ধরে এমন এক অচলাবস্থা তৈরি করে যে শ্বাস নেওয়াই দায়। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে মানুষ অনেক সময় ভুল মানুষের হাত ধরে ফেলে। সেই ‘সিজার’ হয়তো সাময়িক স্বস্তি দেয়, হয়তো কিছু ভাঙা জিনিস জোড়াও লাগায়, কিন্তু প্রায়শই সে কেড়ে নেয় আরও অনেক বেশি কিছু – কেড়ে নেয় পরিবর্তনের আসল সম্ভাবনা, কেড়ে নেয় সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর।

গ্রামসি জেলে বসে শুধু তত্ত্বকথা লেখেননি, তিনি আসলে বিপদের ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক সংকটকে হেলাফেলা করতে নেই। যখন সমাজের চালিকাশক্তিগুলো – তা সে শাসক শ্রেণি হোক বা বিরোধী শক্তি – দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়, যখন তারা আলাপ-আলোচনা বা গণতান্ত্রিক পথে সমাধান খুঁজতে পারে না, তখনই সিজারবাদের মতো বিপজ্জনক বিকল্পের দরজা খুলে যায়।

তাই, গ্রামসির সিজারবাদ তত্ত্ব শুধু অতীতের বিশ্লেষণ নয়, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্যও এক জরুরি সতর্কতা। এটি আমাদের শেখায় রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে, আপাত ত্রাণকর্তাদের প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল উদ্দেশ্যকে বোঝার চেষ্টা করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে। কারণ, একবার পথ হারিয়ে ‘সিজার’-এর হাতে লাগাম চলে গেলে, সেই পথ থেকে ফিরে আসাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বড্ড বেশি কঠিন।

তথ্যসূত্র

  • Buttigieg, J. A. (1995). Gramsci on Civil Society. Boundary 2, 22(3), 1–32. https://doi.org/10.2307/303692

  • Femia, J. V. (2004). Gramsci’s Political Thought: Hegemony, Consciousness, and the Revolutionary Process. Wipf and Stock Publishers. (Original work published 1981)

  • Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks (Q. Hoare & G. N. Smith, Eds. & Trans.). Lawrence & Wishart.

  • Hall, S. (1984). The Rise of the Representative/Interventionist State. In G. McLennan, D. Held, & S. Hall (Eds.), State and Society in Contemporary Britain: A Critical Introduction. Polity Press.

  • Hoare, Q., & Smith, G. N. (1971). Introduction. In A. Gramsci, Selections from the Prison Notebooks (pp. xvii–xcvi). Lawrence & Wishart.

  • Marx, K. (1852). The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte. (Multiple editions available).

  • Sassoon, A. S. (1991). Hegemony, War of Position and Political Intervention. In A. S. Sassoon (Ed.), Approaches to Gramsci. Writers and Readers Publishing Cooperative.

  • Thomas, P. D. (2009). The Gramscian Moment: Philosophy, Hegemony and Marxism. Brill.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.