ডাইনি শিকার (Witch hunt)

Table of Contents

ভূমিকা

ডাইনি শিকার (Witch hunt) ব্যাপারটা কী, বলুন তো? কেউ কেউ আবার বলেন ডাইনি নিধন (witch purge)। সহজ করে বললে, ঘটনা হলো – কিছু মানুষকে ‘ডাইনি’ (witch) বলে দাগিয়ে দেওয়া, তারপর তাদের খুঁজে বের করা। কেন? হয় তাদের বিচার করার জন্য, নয়তো তাদের ডাইনিগিরির (witchcraft) কোনো প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, সেই আশায়।

সেই আদিমকালে, যখন মানুষ কেবল গুছিয়ে বসতে শুরু করেছে, মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) কিন্তু এই নিয়ে আইনকানুন ছিল। কেউ যদি আজেবাজে মন্ত্রতন্ত্র (evil spells) বা উল্টোপাল্টা জাদুটোনা (incantations) করত, ব্যস, হয়ে গেল! সেটা ছিল একেবারে বারণ। ধরা পড়লে শাস্তিও ছিল বেশ জবরদস্ত।

ইউরোপে যখন মধ্যযুগ (medieval Europe) এল, ব্যাপারটা ধরল অন্য মোড়। খ্রিস্টধর্মের (Christianity) চোখে যারা একটু অন্যরকম, মানে ধর্মবিরোধী (heresy), তাদের ঘাড়ে প্রায়ই চাপত ডাইনি হওয়ার দায়। তারপর এল এক ভীষণ সময়। ইউরোপ জুড়ে সে কী ডাইনি খোঁজার ধুম! সময়টা মোটামুটি ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সাল। একদিকে চলছে ধর্ম নিয়ে বিশাল গোলমাল (Counter Reformation), আরেকদিকে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (Thirty Years’ War) – সব মিলিয়ে এক চরম অস্থির সময়। আর এর মধ্যেই, ভাবা যায়, প্রায় ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরেই ফেলা হলো! (Golden, 1997; Levack, 2006)। সংখ্যাটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়। ইউরোপে ডাইনি নামের কলঙ্ক নিয়ে শেষ মৃত্যুদণ্ডটা হয়েছিল ১৮ শতকে। কিন্তু মজার (নাকি ভয়ের?) ব্যাপার হলো, পৃথিবীর অন্য কোণে, যেমন আফ্রিকায় (Africa), এশিয়ায় (Asia), বিশেষ করে সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকায় (sub-Saharan Africa) বা পাপুয়া নিউগিনিতে, আজও নাকি ডাইনি খোঁজাখুঁজি চলে। এমনকি সৌদি আরব, ক্যামেরুন বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে রীতিমতো সরকারি আইন আছে!

এখন অবশ্য ‘উইচ-হান্ট’ (witch-hunt) শব্দটা শুনলে আমরা একটু অন্য জিনিস বুঝি। ধরুন, খুব হইচই করে একটা তদন্ত (investigation) হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে, বিরাট কোনো ষড়যন্ত্র (subversive activity) বা বিশ্বাসঘাতকতা (disloyalty) ধরা হবে। কিন্তু আসল মতলব হয়তো অন্য – কাউকে হেনস্তা করা। এর মধ্যে মিশে থাকতে পারে অহেতুক ভয় বা আতঙ্ক (moral panic) (Goode & Ben-Yehuda, 2010), এমনকি গণ হিস্টিরিয়াও (mass hysteria) (Martin, 2010)। সেই পুরনো দিনের ডাইনি শিকারের ছায়া আরকি!

নৃতাত্ত্বিক কারণ (Anthropological causes)

আচ্ছা, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? ইউরোপ, আফ্রিকা, নিউ গিনি – পৃথিবীর কত দূরে দূরে এই জায়গাগুলো! সংস্কৃতিও কত আলাদা। অথচ সেই ১৯৬০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, সবখানেই এই ডাইনি শিকারের চল (practice) আছে। নৃতাত্ত্বিকরা (anthropologists) তো এই মিল দেখে অবাক! তারা এর পেছনের কারণটা জানতে খুব আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

আসলে, জাদু (magic) বা ভবিষ্যদ্বাণীতে (divination) বিশ্বাস, কিংবা নিজের ভালো চেয়ে (যেমন আয়ু বাড়ুক, প্রেম হোক) জাদু দিয়ে কিছু করার চেষ্টা – এগুলো কিন্তু কমবেশি সব মানব সমাজেই (human cultures) পাওয়া যায়।

আর ডাইনিবিদ্যায় (witchcraft) বিশ্বাসটাও পৃথিবীর নানা সমাজে অনেকটা একই রকম। যেন একটা তৈরি করা ছক (framework)। জীবনে হঠাৎ করে খারাপ কিছু ঘটলে – অসুখবিসুখ, মৃত্যু – মানুষ এই ছকে ফেলে তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। আর বেচারা ডাইনি বা যাদুকর (witch sorcerer), সে হয়ে যায় সব মন্দের প্রতীক (image of evil) (La Fontaine, 1998)।

যখন ইউরোপীয়রা পৃথিবী ঘুরতে বেরোল (Age of Exploration), আমেরিকা (Americas), এশিয়া, আফ্রিকার নানা জাতির কথা লিখল, তখন তাদের লেখা পড়ে মনে হতে পারে, শুধু ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসই নয়, এই যে মাঝে মাঝে ডাইনি শিকারের (witch-hunts) ধুম পড়ে যায়, এটাও বোধহয় সব মানুষের মধ্যেই আছে – একটা সার্বজনীন ব্যাপার (human cultural universal) (Behringer, 2004)।

একটা গবেষণায় তো দেখা গেছে, যারা ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে সমাজবিরোধী ভাব (antisocial attitudes) বেশি। তারা অন্যদের কম বিশ্বাস (trust) করে, দানধ্যান (charitable giving) কম করে, দল বেঁধে কোনো কাজেও (group participation) তেমন থাকে না (Gershman, 2016)। আরেকটা মজার (আসলে তো ভয়ঙ্কর!) তথ্য পাওয়া গেছে তানজানিয়া (Tanzania) থেকে। সেখানে যখন খুব বেশি বৃষ্টি হয়ে আয় রোজগারে টান পড়ে, তখন ‘ডাইনি’ সন্দেহে মানুষ খুন করার ঘটনা হু হু করে বেড়ে যায় (Miguel, 2005)!

ইতিহাস (History)

প্রাচীন নিকট প্রাচ্য (Ancient Near East)

শাস্তির ব্যাপারটা কিন্তু আজকের নয়। সেই প্রাচীন মিশর (ancient Egypt) বা ব্যাবিলনেও (Babylonia), একদম পুরনো দিনের আইনগুলোতেও (earliest law codes), কেউ খারাপ জাদু (malevolent magic) করলে তার শাস্তির কথা লেখা আছে। হাম্মুরাবির কোড (Code of Hammurabi) (সময়টা সেই খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৮০০ বছর আগে) তো একেবারে খোলাখুলিই বলছে:

যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো উপর জাদু (spell) করে এবং তা প্রমাণিত না হয়, তবে যার উপর জাদু করা হয়েছে সে পবিত্র নদীতে (holy river) যাবে; পবিত্র নদীতে সে ডুব দেবে। যদি নদী তাকে গ্রাস করে আর সে ডুবে যায়, তবে যে জাদু করেছিল সে তার বাড়িঘরের মালিক হবে। আর যদি নদী তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে এবং সে অক্ষত থাকে, তবে যে জাদু করেছিল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। যে নদীতে ডুব দিয়েছিল, সে ঐ লোকটির বাড়িঘরের মালিক হবে যে তার উপর জাদু করেছিল। (The Avalon Project; “Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)

হিব্রু বাইবেলেও (Hebrew Bible) জাদুবিদ্যাকে (sorcery) ভালো চোখে দেখা হয়নি। যেমন, দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ১৮:১০-১২ অংশে আছে: ‘তোমাদের মধ্যে এমন কাউকে যেন পাওয়া না যায় যে… ভাগ্য গণনা করে (divination)… বা যাদুকর (sorcerer)… বা মন্ত্র পড়ে (casts spells)… কারণ যে এই কাজগুলো করে, সে প্রভুর (Lord) কাছে ঘৃণ্য।’ আবার যাত্রাপুস্তকে (Exodus) ২২:১৮ তো সোজাসাপ্টা নির্দেশ: ‘ডাইনিকে বাঁচতে দিয়ো না’ (“Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)। ১ স্যামুয়েলের (1 Samuel) ২৮ অধ্যায়ে শৌলের (Saul) গল্প আছে, যিনি ‘ফ্যামিলিয়ার আত্মাওয়ালা (familiar spirits) আর জাদুকরদের (wizards) দেশছাড়া করেছিলেন’ (1 Samuel 28:3)। এসব থেকে বোঝা যায়, জাদুবিদ্যা করলে কপালে অন্তত নির্বাসন (exile) জুটত।

আবার দেখুন, জুডিয়ার দ্বিতীয় মন্দির যখন ছিল (Judaean Second Temple period), সেই ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দে, রাব্বি শিমন বেন শেতাখ (Rabbi Simeon ben Shetach) নামে একজন নাকি আসকালন (Ascalon) শহরে একদিনেই আশি জন মহিলাকে ডাইনি সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন! তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। পরে ওই মহিলাদের আত্মীয়রা মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়ে রাব্বির ছেলেরই মৃত্যুদণ্ড ঘটিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল (Yerushalmi Sanhedrin, 6:6)। বোঝো ঠ্যালা!

প্রাচীন গ্রেকো-রোমান জগৎ (Ancient Greco-Roman world)

প্রাচীন এথেন্সে (Classical Athens) আবার জাদু নিয়ে কোনো আলাদা আইন পাওয়া যায় না (Collins, 2008, p. 133)। তবে ‘ফার্মাকা’ (pharmaka) নিয়ে মামলার নজির আছে। এই শব্দটার মানে ঠিক পরিষ্কার নয় – হতে পারে ‘বিষ’ (poison), ‘ওষুধ’ (medicine), আবার ‘জাদুকরী দাওয়াই’ও (magical drug) হতে পারে। গণ্ডগোল হতো তখনই, যখন এই ফার্মাকা কারো ক্ষতি করত বা মেরে ফেলত (Collins, 2008, pp. 133-134)। যেমন ধরুন, অ্যান্টিফোন (Antiphon) নামে একজন এক ভাষণে (“সৎ মায়ের বিরুদ্ধে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ”) এক মহিলার কথা বলছেন, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ফার্মাকন দিয়ে স্বামীকে খুন করার ফন্দি এঁটেছেন। যদিও এক দাসকে আগেই এই দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, মৃতের ছেলে বলছিল, আসল দোষী তার সৎ মা-ই (Collins, 2008, p. 135)।

ক্লাসিক্যাল গ্রীসে ডাইনিবিদ্যার দায়ে সবচেয়ে বিখ্যাত বিচার বোধহয় লেমনোসের থেওরিসের (Theoris of Lemnos) ঘটনাটা। বেচারিকে তার ছেলেমেয়ে সমেত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটু আগে। অভিযোগ? তিনি নাকি মন্ত্র পড়তেন (casting incantations) আর ক্ষতিকর ওষুধপত্র (harmful drugs) ব্যবহার করতেন (Collins, 2001)।

প্রাচীন রোমেও (ancient Rome), যখন প্যাগান ধর্ম (pagan era) চালু, তখনও ক্ষতিকর জাদুর (harmful magic) বিরুদ্ধে আইন ছিল (Dickie, 2003)। প্লিনি (Pliny) লিখেছেন, সেই খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের টুয়েলভ টেবিলসের আইনে (laws of the Twelve Tables) খারাপ মন্ত্র পড়লে বা জাদু দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করলে শাস্তির কথা বলা ছিল (Dickie, 2003)। তবে এই আইন দিয়ে বিচার হয়েছে বলে মাত্র একজনের কথাই জানা যায় – গাইয়ুস ফিউরিয়াস ক্রেসিমাস (Gaius Furius Cresimus) (Dickie, 2003)।

ল্যাটিন ভাষায় ‘ভেনেফিসিয়াম’ (veneficium) বলে একটা শব্দ ছিল। এর মানে দুটোই হতে পারত – বিষ দেওয়া (poisoning), আবার জাদু দিয়ে ক্ষতি করাও (causing harm by magic), যেমন ধরুন জাদুকরী পানীয় খাইয়ে। সেকালের লোকেরা হয়তো এ দুটোর মধ্যে খুব একটা তফাৎও করত না (Hutton, 2017)। ঘটনা শুনুন, ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে এক সাংঘাতিক মহামারী (deadly epidemic) হলো। আর তার জন্য ‘ভেনেফিসিয়াম’-এর দায়ে প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড! (Livy, Book VIII, Chapter xviii)। আবার ১৮৪ থেকে ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইতালিতে আরেক মহামারী, আর তাতে প্রায় পাঁচ হাজার লোককে একই দায়ে বিচার করে মেরে ফেলা হলো (Hutton, 2017)। ঐতিহাসিক হাটন (Hutton) তো লিখেই ফেলেছেন, এই রিপোর্ট যদি সত্যি হয়, ‘তাহলে রিপাবলিকান রোমানরা (Republican Romans) এমনভাবে ডাইনি শিকার করেছিল, যা প্রাচীন দুনিয়ার অন্য কোথাও ভাবাই যায় না’ (Hutton, 2017)।

পরে, ৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এল লেক্স কর্নেলিয়া (Lex Cornelia de sicariis et veneficis) আইন। এই আইন অনুযায়ী, ‘ভেনেফিসিয়াম’ দিয়ে কাউকে মারলে শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড (Hutton, 2017)। শুধু তাই নয়, ক্ষতিকর ওষুধ বা বিষের লেনদেন বা নিজের কাছে রাখা, জাদুটোনার বই (magical books) বা ঐসব হাবিজাবি গুপ্ত জিনিসপত্র (occult paraphernalia) রাখাও বারণ ছিল। সম্রাট অগাস্টাস (Emperor Augustus) এসব বন্ধ করতে আইন আরও কড়া করলেন। যেমন, ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি রোমের প্রায় দু’হাজার জাদুকরী বই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন, শুধু সিবিলিন বইয়ের (Sibylline Books) কিছু জরুরি অংশ বাদে (Suetonius; Garnsey & Saller, 1987)। সম্রাট ক্লডিয়াসের (Tiberius Claudius) আমলে ৮৫ জন মহিলা আর ৪৫ জন পুরুষকে জাদুবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Ogden, 2002)। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের দিকে এসে লেক্স কর্নেলিয়া আইনটা আরও নানা ধরনের ক্ষতিকর জাদুর বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে লাগল (Hutton, 2017)। আর জাদুকরদের (magicians) শাস্তি? পুড়িয়ে মারা (burnt at the stake) (Dickie, 2003)।

এই যে রোমান সাম্রাজ্যে (Roman Empire) ডাইনিদের ধরে ধরে শাস্তি দেওয়া, এটা চলেছিল সেই চতুর্থ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত। তারপর যখন ৩৯০ সালের দিকে খ্রিস্টধর্মই হয়ে গেল রাজ্যের প্রধান ধর্ম (Roman state religion), তখন এই বাড়াবাড়িটা একটু কমল (Behringer, 2004)।

মধ্যযুগ (Middle Ages)

সেই শুরুর দিনগুলো: যখন খ্রিস্টধর্ম এল (Christianisation in the Early Middle Ages)

এক জার্মান লেখক ছিলেন, উইলহেম গটলিব সোল্ডান (Wilhelm Gottlieb Soldan)। তিনি তার ‘হিস্ট্রি অফ দ্য উইচক্র্যাফ্ট ট্রায়ালস’ (History of the Witchcraft Trials) বইয়ে একটা ভারী মজার (অথবা দুঃখের) কথা বলেছেন। হাইপেশিয়া (Hypatia) নামে একজন বিদুষী মহিলা ছিলেন, গণিত জানতেন, দর্শন বুঝতেন। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে কিছু লোক তাকে মেরে ফেলে, কারণ তারা ভাবত তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার সিরিলের (Cyril of Alexandria) প্রভাবের জন্য হুমকি। সোল্ডান সাহেব বলছেন, এই হাইপেশিয়াই নাকি খ্রিস্টান শাসকদের (Christian authorities) হাতে শাস্তি পাওয়া প্রথম নামকরা ‘ডাইনি’! (Soldan, 1843)। যদিও, সিরিলের হাত ছিল কিনা, তা নিয়ে সেকালেও কথা ছিল (Watts, 2008), আর ঘটনার যে মূল বিবরণ সক্রেটিস স্কলাস্টিকাস (Socrates Scholasticus) লিখে গেছেন, তাতে ধর্মটর্মের কোনো ব্যাপারই নেই (Cameron, Long, & Sherry, 1993)। কে জানে সত্যিটা কী!

আবার ষষ্ঠ শতকে জর্ডানেস (Jordanes) নামে একজন ‘গেটিকা’ (Getica) বলে একটা বই লেখেন। তাতে হুন (Huns) জাতির উদ্ভবের এক গল্প আছে। সেখানে গথ (Goths) জাতির মধ্যে ডাইনি তাড়ানোর কথা পাওয়া যায়। এক কিংবদন্তীর রাজা, নাম ফিলিমার (King Filimer), তিনি নাকি:

…তার লোকেদের মধ্যে কিছু ডাইনি খুঁজে পেলেন, যাদের তিনি নিজের ভাষায় বলতেন হালিউরুনাই (Haliurunnae)। এদের সন্দেহ হওয়ায় তিনি তাদের দল থেকে বের করে দিলেন, তার সেনাবাহিনী থেকে দূরে, একা একা বনেবাদাড়ে ঘুরতে বাধ্য করলেন। সেখানে ঘুরতে দেখে কিছু নোংরা আত্মা (unclean spirits) তাদের পেয়ে বসল, আর জন্ম হলো এক বুনো জাতির। তারা থাকত জলা জায়গায়, ছিল বেঁটেখাটো, নোংরা আর দুর্বল – মানুষ বলে চেনার জো নেই। তাদের কোনো ভাষাও ছিল না, কেবল মানুষের কথার মতো সামান্য কিছু আওয়াজ করত। (Jordanes, § 24)

শুরুর দিকে চার্চের (Church) হাবভাব কিন্তু বেশ নরমসরমই ছিল। এলভিরা (Elvira) (৩০৬ খ্রি.), অ্যানসিরা (Ancyra) (৩১৪ খ্রি.), ট্রুলো (Trullo) (৬৯২ খ্রি.) – এসব জায়গায় যে কাউন্সিল বা সভা বসেছিল, সেখানে শয়তানের পুজোআচ্চা (devil-worship) করলে কিছু ধর্মীয় শাস্তির (ecclesiastical penances) বিধান দেওয়া হয়। ব্যস, ওইটুকুই। অনেক কাল ধরে চার্চের এটাই ছিল দস্তুর। পাদ্রিরা (Catholic Church’s clergy) বরং চাইতেন ডাইনিবিদ্যা বা কালো জাদু (necromancy) নিয়ে লোকের বাড়াবাড়িটা (fanaticism) একটু কমাতে। যেমন, পাডারবোর্নের কাউন্সিল (Council of Paderborn) ৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে পরিষ্কার বলে দিল, কাউকে ডাইনি বলাটাই বেআইনি, আর কেউ যদি ডাইনি পোড়ায়, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের লোম্বার্ড আইনেও (Lombard code) লেখা ছিল:

কোনো বিদেশি দাসী বা মহিলা চাকরকে ডাইনি বলে মেরে ফেলার সাহস যেন কেউ না দেখায়, কারণ এটা সম্ভবই না, আর খ্রিস্টান মনে (Christian minds) এসব বিশ্বাস করা উচিতও নয়। (Hutton, 1993)

এই কথারই প্রতিধ্বনি মেলে প্রায় ৯০০ খ্রিস্টাব্দের ক্যানন এপিস্কোপি (Canon Episcopi) নামের এক নথিতে (লোকে বলত এটা নাকি ৩১৪ খ্রিস্টাব্দের)। সেখানে সাফ বলা হয়েছে – ডাইনিবিদ্যা বলে আসলে কিছু নেই, আর এটা যে সত্যি, তা শেখানোটাও একটা মস্ত ভুল আর ধর্মবিরুদ্ধ (heterodox) কাজ। এরকম আরও উদাহরণ আছে, যেমন ৮০০ খ্রিস্টাব্দের এক আইরিশ সভা (Irish synod) (Behringer, 2004), বা লিয়নের অ্যাগোবার্ডের (Agobard of Lyons) ধর্মোপদেশ (sermon) (৮১০ খ্রি.) (Behringer, 2004)।

হাঙ্গেরির রাজা ক্যালমান (King Kálmán (Coloman)) তো আরও এক কাঠি সরেস। ১১০০ সালে তার জারি করা আইনের ৫৭ নম্বর ধারায় তিনি ডাইনি শিকার বন্ধ করে দিলেন। কারণ? তিনি বললেন, ‘আরে, ডাইনি বলে কিছু আছে নাকি!’ (“witch hunts”, Bible Apologetics; Behringer, 2004)। ওয়ার্মসের বিশপ বুর্চার্ডের (Burchard, Bishop of Worms) (সময়কাল ১০২০ খ্রি. নাগাদ) লেখা ‘ডিক্রেটাম’ (Decretum), বিশেষ করে এর ১৯ নম্বর বইটা (যেটাকে লোকে ‘সংশোধনকারী’ বা Corrector বলত), খুব জরুরি। বুর্চার্ড সাহেব লিখছেন লোকে কী সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে – জাদুকরী পানীয় (magical potions) নাকি পুরুষত্ব নষ্ট করে (impotence), গর্ভপাত (abortion) ঘটায়! এসব অবশ্য অন্য অনেক চার্চ ফাদারও (Church Fathers) মানা করেছিলেন (“Abortion, Contraception and the Church Fathers”, 2012)। কিন্তু বুর্চার্ড আরও এগিয়ে গেলেন। তিনি ডাইনিদের নিয়ে চালু থাকা অনেক গালগল্পই উড়িয়ে দিলেন। যেমন? রাতে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো, কারো মন ভালোবাসা থেকে ঘৃণায় বদলে দেওয়া, ঝড়বৃষ্টি-রোদ নিয়ন্ত্রণ করা, মানুষকে পশু বানিয়ে দেওয়া, ইনকিউবি-সাকিউবি (incubi and succubi) নামে ভূতের সাথে মানুষের মেলামেশা – এসবই তার কাছে ছিল বাজে কুসংস্কার। বুর্চার্ডের মতে, এসব করার চেষ্টা করা তো বটেই, এমনকি এসব যে সম্ভব, তা বিশ্বাস করাটাও মিথ্যে আর কুসংস্কার (false and superstitious)।

এমনকি পোপ সপ্তম গ্রেগরিও (Pope Gregory VII) ১০৮০ সালে ডেনমার্কের রাজা তৃতীয় হ্যারাল্ডকে (King Harald III of Denmark) চিঠি লিখে মানা করেছিলেন, ঝড়-বাদলা বা ফসল নষ্টের জন্য যেন ডাইনিদের দায়ী করে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া হয়। নিরপরাধ মানুষকে বাঁচানোর এমন চেষ্টা কিন্তু আরও অনেক হয়েছে (Behringer, 2004)। অনেক বড় বড় পাদ্রিও (ecclesiastics) চেষ্টা করেছেন লোকের মন থেকে ডাইনিবিদ্যার আজগুবি বিশ্বাস দূর করতে (Migne, Patrologia Latina, CIV, 147; Behringer, 2004)। রাশিয়ায়ও একই অবস্থা। ভ্লাদিমিরের সেরাপিয়ন (Serapion of Vladimir) (১২৭৪-৭৫ সালের লেখা) এক ভাষণে লোকের এই কুসংস্কারকে ধিক্কার দিচ্ছেন যে ডাইনিরাই নাকি ফসল নষ্টের জন্য দায়ী (Behringer, 2004)।

এদিকে হিপ্পোর অগাস্টিন (Augustine of Hippo) বা তার মতো পুরনো দিনের ধর্মগুরুদের (theologians) লেখায় ডাইনিবিদ্যার নিন্দেমন্দ পাওয়া যায়। তারা আবার ডাইনিবিদ্যা আর পুরনো পৌত্তলিক ধর্মগুলোর (pagan religions) মধ্যে খুব একটা ফারাক করতেন না (Kieckhefer, 2014)। অনেকে আবার ভাবতেন, ডাইনিবিদ্যা ব্যাপারটা আসলে দার্শনিক দিক থেকে নেই বললেই চলে। এ সবই নাকি চোখের ধাঁধা (illusions), শয়তানের খেল (powers of evil)। অগাস্টিন শয়তানের শক্তিকে তুলনা করতেন অন্ধকারের সাথে – মানে, আলোর না থাকা, একটা শূন্যতা (non-entity) (Kieckhefer, 2014)। কিন্তু মজা হলো, অগাস্টিন আর তার সাগরেদরা, যেমন ধরুন সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস (Saint Thomas Aquinas), তারাই আবার শয়তান নিয়ে বিশাল বিশাল তত্ত্ব (demonologies) ফাঁদলেন। বললেন, মানুষ নাকি শয়তানের (demons) সাথে চুক্তিও (pacts) করতে পারে! আর এটাই হয়ে দাঁড়াল ভবিষ্যতের ডাইনি শিকারের মস্ত বড় ভিত্তি (Davies, 2017; Kieckhefer, 2014)। আরও মজার ব্যাপার কী জানেন? মধ্যযুগের অনেক পাদ্রি নিজেরাই কিন্তু প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে ‘গোয়েটিয়া’ (goetia) বা ঐ জাতীয় জাদুবিদ্যা করতেন। তাদের যুক্তি ছিল, স্বয়ং খ্রিস্ট যখন তার শিষ্যদের শয়তানকে আদেশ করার ক্ষমতা দিয়েছেন, তখন শয়তান ডেকে আনা বা বশ করা আর পাপ কিসের? (Kieckhefer, 2014)।

তাই, কে কী ভাবছে তাতে কী আসে যায়! ডাইনি শিকার কিন্তু লোকের মধ্যে একটা সংস্কৃতির (cultural phenomenon) মতো চলতেই থাকল। মধ্যযুগের শুরুর দিকে অনেক বড় বড় রাজা-বাদশা ডাইনিবিদ্যা আর পুরনো ধর্ম দুটোই নিষিদ্ধ করেছিলেন, প্রায়ই বলতেন ধরা পড়লে গর্দান যাবে (pain of death)। যেমন, শারলামেনের (Charlemagne) আমলে কোনো খ্রিস্টান ডাইনিবিদ্যা করলে তাকে চার্চের গোলাম (enslaved by the Church) হতে হতো, আর যারা শয়তানের (Devil) পুজো করত (মানে পুরনো জার্মানিক দেবদেবী), তাদের সটান মেরে ফেলা হতো (Kieckhefer, 2014)। সেকালের গল্প-সাহিত্যেও ডাইনি শিকারের কথা আছে। স্নোরি স্টারলুসন (Snorri Sturluson) লিখেছেন, রাজা ওলাফ ট্রিগভাসন (King Olaf Trygvasson) নাকি নরওয়েকে খ্রিস্টান বানানোর জন্য পুরনো দিনের জাদুকরদের ভোজের নেমন্তন্ন করে ডেকে আনতেন, তারপর দরজা বন্ধ করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতেন! যারা কোনোমতে পালাত, তাদের ধরে এনে পরে জলে ডুবিয়ে মারা হতো (“Heimskringla: King Olaf Trygvason’s Saga”)।

রাজা অ্যাথেলস্টানও (King Athelstan) (৯২৪-৯৩৯) ডাইনিবিদ্যা নিয়ে আইন করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল:

আর আমরা ডাইনিবিদ্যা (witch-crafts), লাইব্যাকস [“জাদুবিদ্যা”] (lybacs [“sorcery”]), আর মর্থডেডস [“হত্যা”] (morthdaeds [“murder”]) নিয়ে এই আদেশ দিচ্ছি: যদি এসব করে কেউ মারা যায়, আর দোষী তা অস্বীকার করতে না পারে, তবে তার জান যাবে। কিন্তু যদি সে অস্বীকার করে, আর তিনবার অগ্নিপরীক্ষায় (threefold ordeal) দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তাকে ১২০ দিন জেলে থাকতে হবে। তারপর আত্মীয়রা তাকে ছাড়িয়ে আনবে, রাজাকে দেবে ১২০ শিলিং, মৃতের আত্মীয়কে দেবে ক্ষতিপূরণ (wer), আর তার হয়ে জামিন দেবে (enter into borh for him) যে সে আর কোনোদিন এমন কাজ করবে না। (“Internet History Sourcebooks Project”)

কিছু ক্ষেত্রে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে অত্যাচার বা নির্যাতন (torture) করা হতো (রোমান আইনে এর অনুমতি ছিল)। তবে পোপ প্রথম নিকোলাস (Pope Nicholas I) ৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু নির্যাতনের ব্যবহার একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একই রকম নির্দেশ নাকি সিউডো-ইসিডোরিয়ান ডিক্রেটালসেও (Pseudo-Isidorian Decretals) পাওয়া যায় (“Witchcraft”, Catholic Encyclopedia)।

মধ্যযুগের শেষ ভাগ (Later Middle Ages)

রোমান ক্যাথলিক ইনকুইজিশন (Roman Catholic Inquisition) যখন চালু হলো, তাদের কেতাবপত্রে কিন্তু ডাইনি ধরার ব্যাপারে বেশ দ্বিধা (skeptical) দেখা যায়। তবে হ্যাঁ, ধর্মদ্রোহিতার (heresy) অভিযোগ আর ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ মাঝে মাঝে মিলেমিশে যেত। বিশেষ করে ১৩ শতকে, যখন ইনকুইজিশনকে পাঠানো হলো দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্যাথার (Cathars of Southern France) সম্প্রদায়ের মোকাবেলা করতে। ক্যাথারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের ধর্মশিক্ষার মধ্যে নাকি ডাইনিবিদ্যা আর জাদুও আছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, ইউরোপে ডাইনি শিকারের বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছিল ১৪ শতকের গোড়ায়, ক্যাথার আর নাইটস টেম্পলারদের (Knights Templar) দমন করার পর। কিন্তু ইতিহাসবিদরা প্রায় সবাই এই তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছেন (Cohn 1975; Kieckhefer 1976)।

১২৫৮ সালে পোপ চতুর্থ আলেকজান্ডার (Pope Alexander IV) তো ঘোষণাই করে দিলেন, ইনকুইজিশন ডাইনিবিদ্যার মামলায় নাক গলাবে না, যদি না তার সাথে ধর্মদ্রোহিতার সম্পর্ক থাকে (Selwood, 2016; Cross & Livingstone, 2005)। যদিও পরে, ১৩২০ সালে, পোপ দ্বাবিংশ জন (Pope John XXII) ইনকুইজিশনকে জাদুকরদের বিচার করার অনুমতি দেন (Russell, 1972), কিন্তু বাস্তবে ইনকুইজিটরদের আদালত (inquisitorial courts) ডাইনিবিদ্যার মামলা খুব কমই দেখত, কেবল অন্য কোনো ধর্মবিরোধী (heterodoxy) মতবাদ তদন্ত করার সময় প্রসঙ্গক্রমে যা আসত।

একটা উদাহরণ দিই। ম্যাডোনা ওরিয়েন্টে (Madonna Oriente) নামে এক ঘটনা। ১৩৮৪ সালে মিলানের ইনকুইজিশন (Inquisition of Milan) দুজন মহিলাকে নিয়ে পড়ল বিপাকে। মহিলারা স্বীকার করেছিল তারা নাকি সিগনোরা ওরিয়েন্টে (Signora Oriente) বা ডায়ানা (Diana) নামের এক দেবীর আরাধনার দলে ছিল। তাদের কথায় বেরিয়ে এল সাদা জাদুর (white magic) সব পুরনো লোকবিশ্বাসের কথা। ইনকুইজিশন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। পরে ১৩৯০ সালে তাদের আবার ধরা হলো, এবার ইনকুইজিটর তাদের দোষী সাব্যস্ত করলেন। শেষমেশ রাজদরবারের লোকেরা (secular arm) তাদের মৃত্যুদণ্ড দিল (Cohn, 2000)।

আরেকটা কুখ্যাত ঘটনা ঘটেছিল ১৪২৫ সালে। সেল্যের কাউন্ট দ্বিতীয় হারমান (Hermann II, Count of Celje) তার নিজের পুত্রবধূ, ভেরোনিকা অফ ডেসেনিসকে (Veronika of Desenice), ডাইনি বলে অভিযুক্ত করলেন। আদালত অবশ্য ভেরোনিকাকে নির্দোষ বলল, কিন্তু হারমান তাতে দমবার পাত্র নন, তিনি তাকে জলে ডুবিয়ে মেরেই ফেললেন! লোকে বলে, আসলে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগটা ছিল একটা অজুহাত। ভেরোনিকা ছিলেন একটু নিচু ঘরের মেয়ে, তাই হারমানের চোখে ছেলের বউ হিসেবে তিনি ছিলেন ‘অযোগ্য’, তাকে সরানো দরকার ছিল আরকি!

সেকালে ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে খুব প্রচার চালাতেন এক ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক, নাম সিয়েনার বার্নার্ডিনো (Bernardino of Siena) (১৩৮০-১৪৪৪)। তিনি ছিলেন ফ্রান্সিসকান সাধু, লোকে তার কথা খুব শুনত। তার ধর্মোপদেশগুলো পড়লে বোঝা যায়, একদিকে যেমন লোকে নানা কুসংস্কারে (superstitious practices) বিশ্বাস করত, তেমনি আবার সেগুলোর বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়াও (over-reaction) দেখাত (Mormando, 1999)। তবে বার্নার্ডিনো শুধু ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র (spells and enchantments) বা এই জাতীয় ছেলেমানুষি নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না। তার মাথায় ছিল আরও ভয়ঙ্কর সব অপরাধের কথা – খুন (murder), শিশুহত্যা (infanticide)। ১৪২৭ সালের এক বিখ্যাত ভাষণে তিনি বলছেন:

তাদের একজন কোনো চাপ ছাড়াই স্বীকার করেছে, সে নাকি ত্রিশটা বাচ্চাকে রক্ত ঝরিয়ে (bleeding them) মেরে ফেলেছে… আবার বলেছে, নিজের ছেলেকেও নাকি খুন করেছে… আমায় বলুন তো: আপনাদের কি সত্যিই মনে হয়, যে লোকটা এমন বিশ-ত্রিশটা কচি বাচ্চাকে অমন নৃশংসভাবে মেরেছে, সে এত ভালো কাজ করেছে যে শেষমেশ যখন তাকে বিচারসভার (Signoria) সামনে আনা হলো, তখন আপনাদের উচিত তার হয়ে সুপারিশ করা, তার জন্য করুণা চাওয়া?

ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে নাম কুড়ানো (নাকি বদনাম কুড়ানো?) ডাইনি বিচার (witch trial) বোধহয় জোয়ান অফ আর্কের (Joan of Arc) বিচার। মানছি, এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ (politically motivated) ছিল, আর সেই রায় পরেও বাতিল করা হয়। কিন্তু জোয়ানের মেয়ে হওয়াটা, আর তার উপর ডাইনি বলে অভিযোগ আসা – এগুলো তার মৃত্যুদণ্ডের (execution) পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল (Harrison, 2014)। জোয়ানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল (সাধারণত পোড়ানোর আগে শ্বাসরোধ করে মারা হতো)। এই শাস্তিটা দেওয়া হতো শুধু ডাইনি আর ধর্মদ্রোহীদেরই (heretics)। এর পেছনের ভাবনাটা ছিল – পোড়া শরীর নাকি শেষ বিচারের দিনে (Judgment Day) আর পুনরুত্থিত হতে পারে না! (Harrison, 2014)।

নতুন যুগের ডাইনি শিকারের দিকে (Transition to the early modern witch-hunts)

মধ্যযুগের শেষ দিকে এই যে ডাইনি শিকার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল (resurgence), তাতে চার্চের কিছুটা হলেও সায় বা অন্তত নীরব সম্মতি ছিল। এর সাথে সাথে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বেও (Christian doctrine) কিছু নতুন ভাবনা যোগ হলো। যেমন, ডাইনিবিদ্যাকে শয়তানের কারসাজি (Satanic influence) বলে মেনে নেওয়া হলো, আর একে ধর্মদ্রোহিতার (heresy) পর্যায়ে ফেলা হলো। যখন রেনেসাঁ যুগের গুপ্তবিদ্যা (Renaissance occultism) শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে লাগল, তখন ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস – যা কিনা মধ্যযুগে ছিল মূলত গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের লোকধর্মের (folk religion) অংশ – সেটা ঢুকে পড়ল এক বিশাল ধর্মতত্ত্বের (theology) মধ্যে। এই তত্ত্বে বলা হলো, সব খারাপ কাজের (maleficium) মূলে আছে ওই শয়তান (Satan) (Hinson, 1992; Larner, 2002)। এই চিন্তাভাবনার বদলটা (doctrinal shifts) ঘটল মোটামুটি ১৫ শতকের মাঝামাঝি, বিশেষ করে বাসেলের কাউন্সিলের (Council of Basel) পরে। এর কেন্দ্র ছিল পশ্চিম আল্পস (western Alps) অঞ্চলের স্যাভয়ের ডিউকের এলাকা (Duchy of Savoy) (Behringer, 2004)। আর এর ফলেই ১৫ শতকের শেষার্ধে সরকারি আদালত (secular courts) আর চার্চের আদালত (ecclesiastical courts) – দুই জায়গাতেই শুরু হলো ডাইনি বিচারের (witch trials) এক নতুন পর্ব (Behringer, 2004)।

১৪৮৪ সালে পোপ ইনোসেন্ট অষ্টম (Pope Innocent VIII) একটা ফরমান জারি করলেন – ‘সুমিস ডিসাইডার‍্যান্টিস অ্যাফেক্টিবাস’ (Summis desiderantes affectibus) নামে এক প্যাপাল বুল (Papal bull)। এতে শয়তানের চ্যালাদের (devil-worshippers) – যারা নাকি “শিশু হত্যা” (slain infants) সহ আরও নানা অপরাধ করেছে – তাদের “সংশোধন করা, জেলে পোরা, শাস্তি দেওয়া আর শায়েস্তা করার” (“correcting, imprisoning, punishing and chastising”) হুকুম দেওয়া হলো। পোপ এটা করেছিলেন হেইনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) নামে এক ইনকুইজিটরের অনুরোধে। ক্রেমারকে আবার জার্মানির স্থানীয় বিশপরা তদন্ত করতে দিচ্ছিলেন না (Levack)। তবে ইতিহাসবিদ লুডভিগ ফন পাস্টর (Ludwig von Pastor) মনে করেন, এই ফরমান নতুন কিছু বলেনি, আর এটা মানাটাও সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না (von Pastor, Vol. 5, pp. 349-350)। এর তিন বছর পর, ১৪৮৭ সালে, ক্রেমার সাহেব সেই কুখ্যাত বইটা ছাপালেন – ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum), মানে ‘দুষ্টদের দমন করার হাতুড়ি’। সদ্য আবিষ্কৃত ছাপাখানার (printing presses) দৌলতে বইটা হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। ১৫২০ সালের মধ্যে ১৪ বার ছাপা হলো! আর সরকারি আদালতগুলোতে (secular courts) এর প্রভাব পড়ল সাংঘাতিক রকম (Jolly, Raudvere, & Peters, 2002)।

ইউরোপের সব জায়গায় কিন্তু ডাইনি শিকারের মাতামাতি একরকম ছিল না। স্পেন, পোল্যান্ড বা পূর্ব ইউরোপে এটা তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু জার্মানি, সুইজারল্যান্ড আর ফ্রান্সে এর প্রকোপ ছিল সাংঘাতিক (Nachman Ben-Yehuda, 1980)।

আধুনিক ইউরোপের শুরু আর আমেরিকার উপনিবেশ (Early Modern Europe and Colonial America)

আধুনিক ইউরোপের (Early Modern Europe) শুরুর দিকে এই ডাইনি বিচারগুলো যেন ছিল জোয়ার-ভাটার মতো। আসত, আবার চলেও যেত। পনেরো শতকে, ষোলো শতকের গোড়ায় বিচার-আচার হলো বটে, কিন্তু তারপর ডাইনি নিয়ে ভয়টা (witch scare) একটু কমল। কিন্তু সতেরো শতকে এসে আবার যেন ভূতে ধরল! ব্যাপারটা চরম আকার নিল, বিশেষ করে যখন চলছিল সেই ত্রিশ বছরের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ (Thirty Years’ War)।

আগে লোকে ভাবত, কিছু মানুষের হয়তো বিশেষ ক্ষমতা (supernatural abilities) আছে, যা দিয়ে তারা কখনও কখনও অন্যের উপকারও করে। কিন্তু এই সময়ে এসে ধারণাটা গেল পাল্টে। এখন ভাবা হতে লাগল, এই বিশেষ ক্ষমতার মানে হলো শয়তানের (devil) সাথে পাকাঁপোক্ত চুক্তি (pact)! আর এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য সেকালের কিছু খ্রিস্টান আর তাদের হয়ে কাজ করা রাজ-রাজড়ারা (secular institutions) কী করত জানেন? তারা ডাইনিবিদ্যাকে জুড়ে দিত ভয়ঙ্কর সব শয়তানী জলসার (wild Satanic ritual parties) সাথে। গল্প ছড়ানো হতো, সেখানে নাকি চলে উদ্দাম নাচ (naked dancing), এমনকি মানুষের মাংস খাওয়া, কচি বাচ্চা মেরে ফেলা (cannibalistic infanticide)! (Ellerbe, 1995)। ভাবা যায়! আবার কখনও বলা হতো, এটা নাকি ঈশ্বরের দশ আদেশের (Ten Commandments) প্রথমটার লঙ্ঘন (“আমার আগে তোমার অন্য কোনো দেবতা থাকবে না”) – মানে ধর্মদ্রোহিতা (heresy)। অথবা বলা হতো, এ হলো মহিমা লঙ্ঘন (violating majesty), তবে রাজার নয়, স্বয়ং ঈশ্বরের (divine majesty) (Meewis, 1992)। ধর্মগ্রন্থ থেকেও লাইন তুলে আনা হতো প্রায়ই, বিশেষ করে যাত্রাপুস্তকের সেই আদেশটা – “ডাইনিকে বাঁচতে দিয়ো না” (Exodus 22:18)। অনেকেই এটা খুব মানত।

এই ডাইনি শিকারের ঢেউ কিন্তু সে সময় পুরো ইউরোপেই লেগেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছিল সম্ভবত মধ্য আর দক্ষিণ জার্মানিতে (central and southern Germany) (“The History Today Archive”, 2007)। যদিও জার্মানি কিন্তু এই বিচারে নেমেছিল অন্যদের চেয়ে একটু দেরিতেই। আসল মাতামাতিটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডে, সেই চোদ্দ আর পনেরো শতকে। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে ডাইনি শিকার চরমে উঠেছিল ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ সালের মধ্যে (Midelfort, 1972)। ইউরোপে প্রথম বড়সড় নিপীড়ন, যেখানে ডাইনিদের ধরা, বিচার করা, দোষী বানানো আর পুড়িয়ে মারা হলো, সেটা ঘটেছিল ১৫৬৩ সালে, দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির উইসেনস্টেইগে (Wiesensteig)। ঘটনাটা লেখা আছে “৬৩ জন ডাইনির সত্যি আর ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা” (“True and Horrifying Deeds of 63 Witches”) নামে একটা ছোট্ট বইয়ে (Behringer, 2004)। এই ডাইনিবিদ্যার নামে অত্যাচার ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের কোণায় কোণায়। শিক্ষিত ইউরোপীয়দের মধ্যে ডাইনিবিদ্যা আর শয়তান নিয়ে যেসব কেতাবি ধারণা ছিল, সেগুলো উত্তরের দেশগুলোতেও ডাইনি শিকারে ইন্ধন জুগিয়েছিল (Willumsen, 2013)। আর এই শিকারের পেছনে নাকি অর্থনৈতিক কারণও (economic factors) ছিল। যেমন বাভারিয়া (Bavaria) বা স্কটল্যান্ডের (Scotland) মতো জায়গায় যখন আর্থিক টানাটানি (economic pressure) পড়ত, তখন ডাইনি ধরার হিড়িক বেড়ে যেত – এমন একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে (Baten & Woitek)।

ডেনমার্কে (Denmark) দেখুন, ১৫৩৬ সালে ধর্মসংস্কারের (reformation) পর ডাইনি পোড়ানো বেড়ে গেল। বিশেষ করে রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান (Christian IV of Denmark) এই ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। তার আমলে শ’য়ে শ’য়ে লোককে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। উত্তর নরওয়ের ফিনমার্ক (Finnmark) অঞ্চলে ১৬০০ থেকে ১৬৯২ সাল পর্যন্ত চলেছিল ভয়ঙ্কর সব ডাইনি বিচার (Willumsen, 2010)। সেই হতভাগ্য শিকারদের স্মরণে সেখানে এখন একটা আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধও (Steilneset Memorial) তৈরি হয়েছে (Andreassen & Willumsen, 2014)। ইংল্যান্ডে ১৫৪১ সালে একটা আইন (Witchcraft Act 1541) হলো ডাইনিদের শাস্তির নিয়মকানুন নিয়ে। স্কটল্যান্ডের নর্থ বারউইক ডাইনি বিচার (North Berwick witch trials) তো এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! ৭০ জনেরও বেশি লোককে ডাইনি বলে ধরা হলো, কারণ? কারণ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস (James VI of Scotland) (ডেনমার্কের রাজার মতো তারও ডাইনি বিচারে খুব উৎসাহ ছিল) যখন তার হবু বউ ডেনমার্কের অ্যানের (Anne of Denmark) সাথে দেখা করতে ডেনমার্কে যাচ্ছিলেন, তখন নাকি আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল! “স্কটল্যান্ড থেকে খবর” (“Newes from Scotland”) নামে এক চটি বইয়ে লেখা আছে, রাজা জেমস নিজে নাকি ডক্টর ফিয়ান (Doctor Fian) নামে একজনকে নির্যাতন করা আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় হাজির ছিলেন! (“Daemonlologie by King James the First and Newes from Scotland”)। শুধু তাই নয়, জেমস সাহেব তো ডাইনি ধরার নিয়মকানুন নিয়ে ‘ডিমনোলজি’ (Daemonologie) নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন! তাতে একটা বিখ্যাত লাইন আছে: “রোজকার অভিজ্ঞতা দেখায়, মার না খেলে ওরা স্বীকার করতে চায় না।” এর পরে, ১৬১২ সালের পেন্ডল ডাইনি বিচার (Pendle witch trials) তো ইংরেজি ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ঘটনা হয়ে রইল (“Follow the Pendle Witches trail”, 2009)।

ইংল্যান্ডে ডাইনি শিকার একেবারে তুঙ্গে উঠেছিল ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৭ সালের মধ্যে। এর নায়ক ছিলেন ম্যাথিউ হপকিন্স (Matthew Hopkins) নামে এক পিউরিটান ভদ্রলোক। সরকারি কোনো হুকুমনামা (Parliament commission) ছাড়াই তিনি নিজেকে ‘উইচফাইন্ডার জেনারেল’ (Witchfinder General) ঘোষণা করে দিয়েছিলেন! তিনি আর তার দলবল ইংরেজি গৃহযুদ্ধের (English Civil War) সময় বিভিন্ন শহরে গিয়ে ডাইনি ধরে দেওয়ার নামে মোটা টাকা কামাতেন। হপকিন্সের এই তাণ্ডব চলেছিল অল্প কিছুদিন, কিন্তু তার ফল ছিল মারাত্মক – প্রায় ৩০০ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন তার জন্য! (Sharpe, 2002)। হপকিন্স আবার তার কাজের পদ্ধতি নিয়ে একটা বইও লিখেছিলেন। তাতে ছিল কীভাবে তিনি এই লাইনে এলেন, কীভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতেন, আর কীভাবে অভিযুক্তদের পরীক্ষা করতেন: যেমন, ডাইনিদের শরীরে বিশেষ চিহ্ন (Witches’ mark) খোঁজার জন্য তাদের বিবস্ত্র করা, জলে ডোবানোর পরীক্ষা (“swimming” test), আর চামড়ায় ছুঁচ ফোটানো (pricking the skin)। ওই জলে ডোবানোর পরীক্ষাটা (যেখানে ডাইনিকে চেয়ারে বেঁধে জলে ফেলে দেখা হতো সে ভাসে কিনা) অবশ্য ১৬৪৫ সালে আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। ১৬৪৭ সালে লেখা তার বই ‘দ্য ডিসকভারি অফ উইচেস’ (The Discovery of Witches) খুব তাড়াতাড়ি একটা প্রভাবশালী আইনের বই (legal text) হয়ে ওঠে। বইটা আমেরিকার উপনিবেশগুলোতেও (American colonies) পৌঁছে গিয়েছিল। ১৬৪৭ সালের মে মাসেই ম্যাসাচুসেটসে (Massachusetts) মার্গারেট জোন্স (Margaret Jones) নামে একজনকে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Jewett, 1881)। তিনি ছিলেন ১৬৪৭ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে ডাইনি সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে প্রথম (Fraden & Fraden, 2008)।

মজার ব্যাপার হলো, হপকিন্স যখন ইংল্যান্ডে ডাইনি খুঁজছেন, ঠিক তখনই উত্তর আমেরিকাতেও (North America) একই কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ১৬৪৫ সালে, সেই কুখ্যাত সালেম ডাইনি বিচারের (Salem witch trials) পুরো ৪৬ বছর আগে, ম্যাসাচুসেটসের স্প্রিংফিল্ড (Springfield, Massachusetts) শহরে আমেরিকার প্রথম ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ ওঠে। স্বামী-স্ত্রী হিউ আর মেরি পার্সন্স (Hugh and Mary Parsons) একে অপরকে ডাইনি বলে দোষারোপ করে! আমেরিকার প্রথম সেই ডাইনি বিচারে হিউ নির্দোষ প্রমাণিত হন, মেরিকে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ হয়। তবে ফাঁসিতে ঝোলার আগেই তিনি জেলে মারা যান (“Springfield’s 375th: From Puritans to presidents”, 2011)। ইংল্যান্ডের ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে (Massachusetts Bay Colony) প্রায় আশি জনের বিরুদ্ধে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তেরোজন মহিলা আর দুজন পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই ডাইনি শিকার চলেছিল নিউ ইংল্যান্ড (New England) জুড়ে, ১৬৪৫ থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত (Fraden & Fraden, 2008)। এর পরেই ১৬৯২-৯৩ সালে আসে সেই সাঙ্ঘাতিক সালেম ডাইনি বিচার।

একবার মামলা শুরু হলে, সরকারি উকিলরা (prosecutors) লেগে পড়ত আরও সঙ্গীসাথী (accomplices) খুঁজে বের করতে। জাদুর ব্যবহারটাকে ভুল মনে করা হতো, কিন্তু তা কাজ করে না বলে নয়, বরং ভুল কারণে কাজ করে বলে! ডাইনিবিদ্যা কিন্তু তখন রোজকার জীবনের অঙ্গ। অসুখ হলে বা বাচ্চা হওয়ার সময় লোকে যেমন পুরুতঠাকুরকে (religious ministers) ডাকত, তেমনি ডাকত ডাইনিদেরও। সমাজে তাদের একটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও (spiritual power) ছিল। গণ্ডগোল বাধলে কেউ কিন্তু পুরুত বা ডাইনির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত না। তারা বরং ভাবত, ডাইনি কি ইচ্ছে করে ক্ষতি (inflict harm) করতে চেয়েছিল? (Wallace, 2004)।

আজকের দিনের পণ্ডিতরা হিসেব করে দেখেছেন, এই ৩০০ বছরে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া লোকের সংখ্যাটা ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজারের মধ্যে হবে (“Estimates of executions”; Russell & Lewis, 2000)। ইউরোপে যতগুলো ডাইনি বিচার মৃত্যুদণ্ডে শেষ হয়েছে বলে পাকা খবর আছে, তার সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার (Hutton, 1999)। সেকালে কিন্তু এই ডাইনি শিকারের বিরুদ্ধে বলার লোকও ছিলেন। যেমন জিয়ানফ্রান্সেস্কো পনজিনিবিও (Gianfrancesco Ponzinibio), জোহানেস উইয়ার (Johannes Wier), রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot), কর্নেলিয়াস লুস (Cornelius Loos), অ্যান্টন প্রিটোরিয়াস (Anton Praetorius), আলোনসো সালাজার ওয়াই ফ্রিয়াস (Alonso Salazar y Frías), ফ্রেডরিখ স্পি (Friedrich Spee), বালথাসার বেকার (Balthasar Bekker) – এরা সবাই এর সমালোচনা করেছিলেন (Hoyt, 1989)। সবচেয়ে বড় আর নামকরা বিচারগুলোর মধ্যে ছিল ট্রিয়ার (Trier) (১৫৮১-৯৩), ফুলদা (Fulda) (১৬০৩-০৬), ওয়ারজবার্গ (Würzburg) (১৬২৬-৩১) আর ব্যামবার্গের (Bamberg) (১৬২৬-৩১) ডাইনি বিচার।

এই যে এত বিচারের কথা বললাম, এর বাইরেও কিন্তু লোকের হাতে ডাইনি শিকার চলত। কিছু লোক স্বনির্ভর আইনরক্ষক বা নিজ উদ্যোগে বিচার করা ব্যক্তি (vigilantes) হয়ে ডাইনি ধরত, মেরেও ফেলত হয়তো। যেমন স্কটল্যান্ডে, গরুমোষ মড়ক (cattle murrains) লাগলে দোষ পড়ত ডাইনিদের ঘাড়ে, মানে গ্রামের গরিব মহিলাদের। তাদের শাস্তিও দেওয়া হতো। একটা চালু রেওয়াজ ছিল “স্কোরিং অ্যাবাভ দ্য ব্রেথ” (“scoring above the breath”) – মানে, মহিলার কপালে ছুরি দিয়ে আঁচড় কেটে দেওয়া! ভাবা হতো এতে নাকি তার জাদুর ক্ষমতা চলে যাবে। এটা ছিল একরকম জরুরি ব্যবস্থা (emergency procedure), বিচারক ভূমিকা বা কর্তৃত্ব (judicial authorities) না থাকলেও করা যেত (Westwood, 2011)।

ডাইনিদের এই হেনস্তার পেছনে আরেকটা বড় কারণ ছিল লোকের নামে অভিযোগ, নিন্দা লাগানো (denunciations)। “ইংল্যান্ডে তো দেখা গেছে, যারা অভিযোগ করত বা ডাইনিদের বিরুদ্ধে লিখিত নালিশ জানাত, তাদের বেশিরভাগই ছিল মহিলা!” (“Witchcraft: Eight Myths and Misconceptions”, English Heritage)। কে নালিশ করেছে, তা অভিযুক্তকে জানানোর নিয়ম ছিল না। এটাই ডাইনি বিচারগুলোকে সফল হতে সাহায্য করত। আসলে হতো কী, একজন নালিশ করলে, আরও সাক্ষী খোঁজা হতো, ফলে একের পর এক লোক জুড়ে যেত। দোষী সাব্যস্ত হলে, যে নালিশ করেছে সে কখনও কখনও অভিযুক্তের সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পেত, নিদেনপক্ষে ২ গিল্ডার তো বটেই! এর একটা চমৎকার উদাহরণ হলো বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের (Johannes Kepler) মা, ক্যাথারিনা কেপলারের (Katharina Kepler) ঘটনা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি শয়তানের সাথে চুক্তি করেছেন আর ডাইনিবিদ্যা করেন। ১৬১৫ সালে, ভ্যুরটেমবের্গে (duchy of Württemberg) এক প্রতিবেশী মহিলা তার নামে এই অভিযোগ আনে। ঝগড়া হয়েছিল, কারণ ক্যাথারিনা নাকি তাকে একটা তেতো পানীয় খাইয়েছিলেন যা খেয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেচারিকে এক বছরের বেশি জেলে আটকে রাখা হয়েছিল, ভয় দেখানো হয়েছিল অত্যাচার করার। কিন্তু শেষমেশ তার ছেলের চেষ্টায় তিনি ছাড়া পান (Akademie Schloss Solitude)।

মৃত্যুর হিসেবনিকেশ (Execution statistics)

আজকের পণ্ডিতরা হিসেব কষে বলেন, ইউরোপে ডাইনি শিকারের সেই ৩০০ বছরে মোটমাট ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল (Levack, 2006; Gaskill, 2010)। যাদের ধরা হতো, তাদের বেশিরভাগই ছিল সমাজের গরিবগুর্বো মানুষ (lower economic classes), যদিও কালেভদ্রে বড় ঘরের লোকও (high-ranking individuals) বাদ যায়নি। এই দেখেই স্কার আর ক্যালো (Scarre and Callow) বলেছেন, “সাধারণ ডাইনি বলতে বোঝাত গ্রামের খেটে খাওয়া মজুর বা ছোটখাটো চাষীর বউ বা বিধবা, আর সে পরিচিত ছিল বেশ ঝগড়াটে আর দজ্জাল স্বভাবের (quarrelsome and aggressive nature) জন্য” (Scarre & Callow, 2001)।

জুলিয়ান গুডারের (Julian Goodare) মতে, ইউরোপে ডাইনি হিসেবে শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল মহিলা। তবে এস্তোনিয়া (Estonia), নরম্যান্ডি (Normandy) বা আইসল্যান্ডের (Iceland) মতো কিছু জায়গায় আবার পুরুষদের উপর অত্যাচারটা বেশি হয়েছিল (Goodare, 2016)। আইসল্যান্ডে তো অভিযুক্তদের ৯২% ছিল পুরুষ, এস্তোনিয়ায় ৬০%, আর মস্কোতে (Moscow) দুই-তৃতীয়াংশ! ফিনল্যান্ডে (Finland) অবশ্য ১০০ জনের বেশি মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা প্রায় সমান সমান ছিল, কিন্তু অ্যালান্ড দ্বীপপুঞ্জে (Ålanders) যাদের ডাইনিবিদ্যার দায়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা সবাই ছিল মহিলা (“Noituus – Kuolemantuomiot”, Finnish)।

ওয়ারজবার্গের বিচারে (Würzburg trials) ১৬২৯ সালে একটা সময় এমনও গেছে যখন অভিযুক্তদের ৬০ শতাংশই ছিল শিশু! যদিও বছর গড়াতে গড়াতে সেটা ১৭ শতাংশে নেমে এসেছিল (Scarre & Callow, 2001)। র‍্যাপলি (Rapley) (১৯৯৮) তো বলছেন, মোট “৪০ থেকে ৫০ হাজার” শিকারের মধ্যে “৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ” ছিল মহিলা (Rapley, 1998)। তবে এই যে লোকে বলে ইউরোপে নাকি “লাখ লাখ ডাইনি” (কেউ কেউ বলে “নয় মিলিয়ন”!) মারা হয়েছিল – এটা একেবারেই আজগুবি কথা। যদিও চটি বইপত্রে এটা মাঝে মাঝে দেখা যায়। আসলে এই ভুল ধারণাটা ছড়িয়েছিল গটফ্রিড ক্রিশ্চিয়ান ভয়গট (Gottfried Christian Voigt) নামে একজনের লেখা ১৭৯১ সালের একটা প্যামফলেট থেকে (Gaskill, 2010)।

ইউরোপে ১৪৫০-১৭৫০ সালে ডাইনিবিদ্যার বিচার (Monter, 2002; Levack, 2006)

অঞ্চল (Region) আনুমানিক বিচার (Trials approx) আনুমানিক মৃত্যুদণ্ড (Executions approx)
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ (British Isles) ৫,০০০ ১,৫০০-২,০০০
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য (Holy Roman Empire) (জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লোরেন, অস্ট্রিয়া, চেকিয়া) ৫০,০০০ ২৫,০০০-৩০,০০০
ফ্রান্স (France) ৩,০০০ ১,০০০
স্ক্যান্ডিনেভিয়া (Scandinavia) ৫,০০০ ১,৭০০-২,০০০
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ (Central & Eastern Europe) (পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, রাশিয়া) ৭,০০০ ২,০০০
দক্ষিণ ইউরোপ (Southern Europe) (স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি) ১০,০০০ ১,০০০
মোট (Total) ৮০,০০০ ৩৫,০০০

বেশ, এইবার আসা যাক শেষ পর্বটায়। কীভাবে থামল ইউরোপের সেই ডাইনি শিকারের যুগ? আর এখনকার দুনিয়ায় এর কী হাল?

ইউরোপে ডাইনি শিকারের শেষ দিনগুলো (End of European witch-hunts in the 18th century)

আঠারো শতক আসতে আসতে ইউরোপে ডাইনি শিকারের সেই রমরমা ভাবটা কমে এল। ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে ১৫৪২ থেকে ১৭৩৫ সালের মধ্যে ডাইনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা আইন (Witchcraft Acts) হয়েছিল বটে – শাস্তি মানে প্রায়ই মৃত্যু, কখনও বা জেল (Gibson, 2006)। ইংল্যান্ডে ডাইনিবিদ্যার দায়ে শেষ ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৬৮২ সালে। এক্সেটার (Exeter) শহরে তিনজনকে – টেম্পারেন্স লয়েড (Temperance Lloyd), মেরি ট্রেম্বেলস (Mary Trembles) আর সুসানা এডওয়ার্ডস (Susanna Edwards)। এর কিছু বছর পর, ১৭১১ সালে, জোসেফ অ্যাডিসন (Joseph Addison) নামে এক নামকরা লেখক ‘দ্য স্পেক্টেটর’ (The Spectator) নামের এক সম্ভ্রান্ত পত্রিকায় লিখলেন। তিনি বললেন, এই যে বৃদ্ধা, দুর্বল মহিলাদের (“মল হোয়াইট” বা Moll White নামে ডাকা হতো) ডাইনি বলে ধরা হচ্ছে, এটা একেবারে অর্থহীন আর অন্যায় (irrationality and social injustice) (Addison, 1711; Summers, 2003)। এর পরের বছরই, ১৭১২ সালে, জেন ওয়েনহাম (Jane Wenham) নামে একজনকে ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু ভাগ্য ভালো, তাকে ক্ষমা (pardoned) করে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কটল্যান্ডে শেষ মৃত্যুদণ্ডটা হয় ১৭২৭ সালে, জ্যানেট হর্ন (Janet Horne) নামে একজনের।

শেষমেশ ১৭৩৫ সালে একটা চূড়ান্ত আইন (Witchcraft Act 1735) এল। এই আইনটা মজার। এতে বলা হলো, ডাইনিবিদ্যা বলে কিছু নেই, কেউ যদি দাবি করে সে ডাইনি বা জাদু জানে, তাহলে সেটা আসলে ধাপ্পাবাজি (fraud)! কারণ লোকে আর বিশ্বাস করত না যে কারও সত্যিই আজগুবি ক্ষমতা থাকতে পারে বা শয়তানের সাথে যোগাযোগ (traffic with Satan) থাকতে পারে। তাই শাস্তিটা এখন ডাইনিবিদ্যার জন্য নয়, বরং জালিয়াতির জন্য। মজার ব্যাপার হলো, এই আইনটা কিন্তু ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল, আর এটা দিয়ে মাঝেমধ্যে প্ল্যানচেট করা লোক (spiritualists) বা জিপসিদের (gypsies) ধরা হতো। শেষ পর্যন্ত ১৯৫১ সালে গিয়ে এই আইন বাতিল হয় (Gibson, 2006)।

অন্যান্য দেশেও ধীরে ধীরে এই প্রথা বন্ধ হতে লাগল। ডাচ প্রজাতন্ত্রে (Dutch Republic) শেষ ডাইনি মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল সম্ভবত ১৬১৩ সালে (“Laatste executie van heks in Borculo”, 2003)। ডেনমার্কে ১৬৯৩ সালে আনা পালেস (Anna Palles) ছিলেন শেষ শিকার (“Last witch executed in Denmark”, 2010)। নরওয়েতে শেষ ঘটনাটা ঘটে ১৬৯৫ সালে, জোহানে নিলসড্যাটারের (Johanne Nilsdatter) সাথে (Hagen, 2018), আর সুইডেনে (Sweden) ১৭০৪ সালে আনা এরিকসডটারের (Anna Eriksdotter) মৃত্যুদণ্ড হয়। ফ্রান্সে ডাইনি হিসেবে শেষ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন ১৭৪৫ সালে লুই দেবারাজ (Louis Debaraz) (“Timeline The Last Witchfinder”, 2010)।

ক্রোয়েশিয়াতে (Croatia) শেষ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পান ম্যাগদা লোগোমার (Magda Logomer) ১৭৫৮ সালে। তবে সে বছরই সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা (Maria Theresa) তাকে খালাস দেন, আর ক্রোয়েশিয়াতে ডাইনি বিচারের যুগ শেষ হয় (Kern, 1999; Balog, 2017)। জার্মানিতে আনা শোয়েগেলিনকে (Anna Schwegelin) ১৭৭৫ সালে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হলেও, তা আর কার্যকর করা হয়নি (Petz, 2007)।

সরকারিভাবে শেষ ডাইনি বিচারটা হয়েছিল সম্ভবত ১৭৮৩ সালে, পোল্যান্ডের ডোরুচো-তে (Doruchów witch trial)। যদিও এই বিচারের রায় নিয়ে অধ্যাপক জানুস তাছবির্জ (Prof. Janusz Tazbir) প্রশ্ন তুলেছেন (Tazbir, 1994)। এরপর আর কোনো মৃত্যুদণ্ডের নির্ভরযোগ্য খবর নেই। তবে ১৭৯৩ সালে পোল্যান্ডের পজনানে (Poznań) আইনি বৈধতা নিয়ে সন্দেহ আছে এমন এক বিচারে দুজন নাম না জানা মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল (Gijswijt-Hofstra, 1999)।

সুইজারল্যান্ডের আনা গোল্ডিকে (Anna Göldi) ১৭৮২ সালে (“Last witch in Europe cleared”, 2008) আর প্রুশিয়ার বারবারা জডুঙ্ককে (Barbara Zdunk) ১৮১১ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (Klimczak, 2017)। এদের দুজনকেই ইউরোপের শেষ ডাইনি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বলা হয়। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই সরকারি রায়ে ডাইনিবিদ্যার কোনো উল্লেখ ছিল না। কারণ ততদিনে ডাইনিবিদ্যা আর কোনো অপরাধই (criminal offense) ছিল না!

ভারত (India)

এবার একটু ভারতের দিকে তাকানো যাক। এখানে ১৭৯২ সালের আগে ডাইনি শিকারের কোনো পাকাপোক্ত প্রমাণ নেই। প্রথম যে ঘটনার কথা জানা যায়, সেটা হলো ১৭৯২ সালের সাঁওতাল ডাইনি বিচার (Santhal Witch Trials) (Archer, 1979; Crooke, 1969)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে (Company-ruled India) ছোট নাগপুর অঞ্চলের (Chota Nagpur Division) সিংভূম জেলায় (Singhbhum District) শুধু ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তকেই নয়, তার আত্মীয়স্বজনকেও মেরে ফেলা হতো, পাছে তারা বদলা নেয়! (Roy Choudhary ১৯৫৮: ৮৮)। ছোটনাগপুরে সাঁওতাল (Santhals) নামে এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। ডাইনি আছে – এটা তাদের গভীর বিশ্বাস ছিল। ডাইনিদের তারা খুব ভয় পেত, ভাবত তারা সমাজের শত্রু (anti-social activities)। গুজব ছিল, ডাইনিরা নাকি মানুষের নাড়িভুঁড়ি (entrails) খায়, গরুর জ্বর (fevers) বাধায়! তাই আদিবাসীরা ভাবত, অসুখবিসুখ সারাতে হলে এই ডাইনিদের শেষ করে ফেলাই একমাত্র উপায় (Sinha, 2007)।

সাঁওতালদের ডাইনি শিকারের ধরনটা ছিল ইউরোপের চেয়েও ভয়ঙ্কর (brutal)। ইউরোপে তো পোড়ানোর আগে গলা টিপে মারত, কিন্তু সাঁওতালরা নাকি অভিযুক্তদের “…আগুনে ফেলার আগে মানুষের মল খেতে আর রক্ত ​​পান করতে বাধ্য করত!” (Varma, 2007)। ভাবা যায়!

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (EIC) অবশ্য ১৮৪০-৫০ এর দশকে গুজরাট (Gujarat), রাজপুতানা (Rajputana) আর ছোটনাগপুরে ডাইনি নিধন বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। লোকে এটাকে অপরাধ বলেই মনে করত না, তাই অভিযোগও তেমন আসত না। সাঁওতালরা বরং ভাবত, এই নিষেধাজ্ঞার জন্যই ডাইনিদের উৎপাত আরও বেড়েছে! কোম্পানির উদ্দেশ্য গেল ভেস্তে। ১৮৫৭-৫৮ সালে, যখন সিপাহী বিদ্রোহ (Indian Rebellion of 1857) চলছে, তখন ডাইনি শিকার আবার বেড়ে গেল। কেউ কেউ মনে করেন, এটা ছিল কোম্পানির শাসনের (Company rule) বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদ (resistance) (Sinha, 2007)।

আজকের দিনের ঘটনা (Modern cases)

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কিন্তু আজও পৃথিবীর অনেক জায়গায়, যেখানে লোকে জাদুটোনায় (belief in magic) বিশ্বাস করে, সেখানে ডাইনি শিকার চলে। বেশিরভাগ সময়েই এটা গণপিটুনি (lynching) বা পুড়িয়ে মারার (burnings) মতো ঘটনা। সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে, সৌদি আরব থেকে, পাপুয়া নিউগিনি থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। কিছু দেশে তো জাদুবিদ্যার (sorcery) বিরুদ্ধে এখনো আইন আছে। আর সৌদি আরব হলো একমাত্র দেশ, যেখানে ডাইনিবিদ্যার শাস্তি আইনত মৃত্যুদণ্ড (legally punishable by death)!

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) বারবার বলছে, এই আধুনিক ডাইনি শিকার হলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন (massive violation of human rights)। যাদের অভিযুক্ত করা হয়, তাদের বেশিরভাগই মহিলা বা শিশু। তবে বয়স্ক মানুষ বা সমাজের কোণঠাসা লোকেরাও (marginalised groups) – যেমন অ্যালবিনো (albinos) বা এইচআইভি আক্রান্তরা (HIV-infected) – এর শিকার হন (UNHCR, 2009)। এদেরকে সমাজের বোঝা (burdens to the community) ভাবা হয়। ফলে প্রায়ই তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, না খাইয়ে মারা হয়, বা খুব নৃশংসভাবে খুন করা হয় – কখনও কখনও নিজের বাড়ির লোকেরাই এই ‘সমাজ সাফাই’ (social cleansing) করে (Miguel, 2005)! এর পেছনের কারণগুলো হলো দারিদ্র্য (poverty), রোগ মহামারী (epidemics), সামাজিক অস্থিরতা (social crises), আর শিক্ষার অভাব (lack of education)। এই ডাইনি শিকারের যারা মাথা, তারা প্রায়ই হয় গ্রামের মাতব্বর বা কোনো ‘ডাইনি ডাক্তার’ (witch doctor)। তারা ভূত ছাড়ানোর (exorcism) নামে টাকা নেয়, অথবা খুন হওয়া মানুষের দেহাংশ (body parts) বিক্রি করেও পয়সা কামায় (UNHCR, 2011a; UNHCR, 2011b)!

মধ্যপ্রাচ্য (Middle East)

লেভান্ট (Levant)

২০১৫ সালের জুন মাসের শেষের দিকে, আইএসআইএস (ISIS) নামের এক ভয়ঙ্কর দল দেইর ইজ-জোর প্রদেশে (Deir ez-Zor province) দুটো দম্পতিকে গলা কেটে (beheaded) মেরে ফেলে। অভিযোগ? জাদুবিদ্যা আর “ওষুধের জন্য জাদু” (“magic for medicine”) ব্যবহার! (Mezzofiore, 2015)। এর আগেও আইএসআইএল সিরিয়া (Syria), ইরাক (Iraq) আর লিবিয়াতে (Libya) বেশ কয়েকজন “জাদুকর” (magicians) আর রাস্তার ভেল্কিবাজদের (street illusionists) একইভাবে মেরেছিল (Armstrong, 2015)।

সৌদি আরব (Saudi Arabia)

সৌদি আরবে ডাইনিবিদ্যা বা জাদুবিদ্যা এখনও ফৌজদারি অপরাধ (criminal offense), যদিও ঠিক কোন কাজটাকে অপরাধ বলা হবে, তা পরিষ্কার নয় (undefined) (Human Rights Watch, 2008)।

সারা দেশে বছরে ক’টা এমন মামলা হয়, তা জানা মুশকিল। তবে ২০০৯ সালের নভেম্বরে খবর বেরিয়েছিল, সে বছর মক্কা প্রদেশে (province of Makkah) ১১৮ জনকে জাদু করা আর “আল্লাহর কিতাবকে অসম্মানজনকভাবে ব্যবহার করার” (“using the Book of Allah in a derogatory manner”) দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৪% ছিল মহিলা! (“Distance witch finally caught”, 2009)। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch) ২০০৯ সালে জানায়, ডাইনিবিদ্যা আর জাদুবিদ্যার মামলা বাড়ছে আর “সৌদি আদালতগুলো সে দেশের ধর্মীয় পুলিশকে (religious police) দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ডাইনি শিকার করাচ্ছে” (“Saudi Arabia: Witchcraft and Sorcery Cases on the Rise”, 2009)।

২০০৬ সালে ফাওজা ফালিহ (Fawza Falih) নামে এক নিরক্ষর সৌদি মহিলাকে পুরুষত্বহীন করার মন্ত্র (impotence spell) পড়া সহ ডাইনিবিদ্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে শিরশ্ছেদের হুকুম দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, তাকে নাকি পিটিয়ে আর জোর করে একটা মিথ্যে স্বীকারোক্তিতে (false confession) টিপসই দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা তাকে পড়েও শোনানো হয়নি! (“King Abdullah urged to spare Saudi ‘witchcraft’ woman’s life”, 2008)। আপিল আদালত রায়টা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, নিচের আদালত অন্য কারণ দেখিয়ে সেই একই সাজা বহাল রাখে! (“Letter to HRH King Abdullah”, 2008)।

২০০৭ সালে মুস্তাফা ইব্রাহিম (Mustafa Ibrahim) নামে এক মিশরীয়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার অপরাধ? তিনি নাকি জাদু দিয়ে এক বিবাহিত দম্পতিকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন, আর সেই সাথে ব্যভিচার (adultery) ও কুরআন অবমাননাও (desecrating the Quran) করেছিলেন (“Saudi executes Egyptian for practising ‘witchcraft'”, 2007)।

একই বছর, আব্দুল হামিদ বিন হুসাইন বিন মুস্তাফা আল-ফাক্কি (Abdul Hamid Bin Hussain Bin Moustafa al-Fakki) নামে এক সুদানী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি নাকি এমন এক মন্ত্র (spell) তৈরি করছিলেন যা দিয়ে এক তালাকপ্রাপ্ত দম্পতির আবার মিল হয়ে যাবে! (“Sudanese man facing execution”, 2010)।

২০০৯ সালে আলী সিবাত (Ali Sibat) নামে এক লেবানিজ টিভি উপস্থাপককে সৌদি আরবে হজে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার করা হয়। টিভিতে ভাগ্য গণনা (fortune-telling) করার অপরাধে তাকে ডাইনিবিদ্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (“Lebanese TV host Ali Hussain Sibat faces execution”, 2010)। তার আপিল একবার মঞ্জুর হলেও, মদিনার অন্য এক আদালত ২০১০ সালের মার্চে আবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। যুক্তি? তিনি নাকি বহু বছর ধরে লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে টিভিতে জাদু দেখিয়েছেন! (“Lebanese PM should step in to halt Saudi Arabia ‘Sorcery’ execution”, 2010)। তবে ২০১০ এর নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় নাকচ করে দেয়, কারণ তার কাজে অন্যের ক্ষতি হয়েছে এমন যথেষ্ট প্রমাণ (insufficient evidence) ছিল না (“Saudi court rejects death sentence for TV psychic”, 2010)।

২০১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর, আমিনা বিনতে আব্দুলহালিম নাসারকে (Amina bint Abdulhalim Nassar) আল জাওফ প্রদেশে (Al Jawf Province) ডাইনিবিদ্যা আর জাদু করার দায়ে শিরশ্ছেদ করা হয় (“Saudi Arabia: Woman Is Beheaded”, 2011)। একই রকম ঘটনা ঘটে মুরি বিন আলী বিন ইসা আল-আসিরির (Muree bin Ali bin Issa al-Asiri) সাথেও, তাকে ২০১২ সালের ১৯শে জুন নাজরান প্রদেশে (Najran Province) শিরশ্ছেদ করা হয় (“Saudi man executed for ‘witchcraft and sorcery'”, 2012)।

ওশেনিয়া (Oceania)

পাপুয়া নিউগিনি (Papua New Guinea)

পাপুয়া নিউগিনিতে ভালো জাদু (white magic) – যেমন ঝাড়ফুঁক করে রোগ সারানো (faith healing) – আইনত বৈধ। কিন্তু ১৯৭৬ সালের জাদুবিদ্যা আইন (Sorcery Act) অনুযায়ী খারাপ জাদু (black magic) করলে দু’বছর পর্যন্ত জেল হতে পারত। অবশ্য ২০১৩ সালে আইনটা বাতিল করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার জানায়, ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের – বেশিরভাগই একা থাকা মহিলা – কোনো বিচার ছাড়াই অত্যাচার (extrajudicial torture) আর খুন করার ঘটনা পাহাড়ি এলাকা থেকে শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে, কারণ গ্রামের লোকেরা শহরে আসছে (migrate to urban areas) (“Unreported World”, 2009)। যেমন, ২০১৩ সালের জুনে, চারজন মহিলাকে ডাইনি বলা হলো, কারণ তাদের পরিবারের “কাঠের তৈরি একটা পাকা বাড়ি (‘permanent house’) ছিল, আর ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়েছে, সমাজে মানসম্মানও (high social standing) ছিল”! চারজনকেই অত্যাচার করা হয়, আর হেলেন রুম্বালি (Helen Rumbali) নামে একজনকে তো গলা কেটেই ফেলা হয়। মানবাধিকার কর্মী হেলেন হাকেনা (Helen Hakena) বলেছেন, এই সব অভিযোগের মূলে ছিল খনি ব্যবসার (mining boom) কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক হিংসা (economic jealousy) (McGuirk, 2013)।

জাতিসংঘ (U.N. agencies), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International), অক্সফাম (Oxfam) আর নৃতাত্ত্বিকদের রিপোর্ট বলছে, “অভিযুক্ত জাদুকর আর ডাইনিদের উপর হামলা – কখনও পুরুষ, তবে বেশিরভাগই মহিলা – প্রায়ই ঘটে, খুব নৃশংসভাবে ঘটে, আর প্রায়শই তাতে মৃত্যু হয়” (Chandler, 2017)। হিসেব বলছে, শুধু পাপুয়া নিউগিনির সিম্বু প্রদেশেই (province of Simbu) বছরে প্রায় ১৫০টা এরকম হিংসা আর খুনের ঘটনা ঘটে (Gibbs, 2012)! রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, এই ডাইনি শিকার কোথাও কোথাও যেন “আরও ভয়ঙ্কর, বিকৃত আর বীভৎস” (“something more malignant, sadistic and voyeuristic”) রূপ নিয়েছে (Chandler, 2017)। এক মহিলার ঘটনা শোনা যায়, যাকে পাশের গ্রামের কিছু যুবক আক্রমণ করেছিল। তারা নাকি “তার যৌনাঙ্গ পুড়িয়ে দিয়েছিল আর গরম লোহা (red-hot irons) বারবার ঢুকিয়ে এমন অবস্থা করেছিল যে তা আর কোনোদিন ঠিক হওয়ার নয় (fused beyond functional repair)” (Chandler, 2017)! ২০১২ সালের আইন সংস্কার কমিশন (Law Reform Commission) বলছে, এসব ঘটনার খুব কমই বাইরে আসে, আর ১৯৮০ সাল থেকে এগুলো বেড়েই চলেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশ (Indian Subcontinent)

ভারত (India)

ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে, এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন ডাইনিবিদ্যা বা কালো জাদুতে (black magic) বিরাট ক্ষমতা আছে। একদিকে যেমন শরীর খারাপ, টাকা-পয়সার টানাটানি বা বিয়ের সমস্যায় (marital problems) লোকে ওঝা বা ডাইনি ডাক্তারদের (witch doctors) কাছে ছোটে পরামর্শের জন্য (“Black Magic practices in India”, 2012), তেমনি অন্যদিকে, বিশেষ করে মহিলাদের, ডাইনি অপবাদ (witchcraft accusation) দিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করা হয়, এমনকি মেরেই ফেলা হয় (“Village ‘witches’ beaten in India”, 2009; “‘Witch’ family killed in India”, 2008)! খবর পাওয়া যায়, বেশিরভাগ সময়েই বিধবা (widows) বা তালাকপ্রাপ্তা (divorcees) মহিলাদের নিশানা করা হয়, আসল উদ্দেশ্য থাকে তাদের সহায়সম্পত্তি (property) হাতিয়ে নেওয়া (“Bengal tribesmen kill ‘witches'”, 2003)। শোনা যায়, গ্রামের মান্যিগণ্যি ওঝাদের নাকি টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয় কাউকে ‘ডায়েন’ (dayan) বলে চিহ্নিত করার জন্য, যাতে পরে তাকে মেরে ফেললে কোনো ঝামেলা না হয়! দেশের যে আইনকানুন আছে, তা এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে তেমন কার্যকর নয় (ineffective) (Schnoebelen, 2009)। ২০১৩ সালের জুন মাসে জাতীয় মহিলা কমিশন (NCW) জানায়, সরকারি হিসেব (NCRB statistics) অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ডাইনি সন্দেহে ৭৬৮ জন মহিলাকে খুন করা হয়েছে! তারা নতুন আইন আনার কথাও ঘোষণা করে (“NCW demands stringent law against witch-hunts”, 2013)।

ভেবে দেখুন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে শুধু আসাম রাজ্যেই (state of Assam) প্রায় ৩০০ জনকে খুন করা হয়েছে ডাইনি সন্দেহে! (“Killing of women, child ‘witches’ on rise, U.N. told”, 2009)। ২০০৫ থেকে ২০১০ এর মধ্যে ওড়িশার সুন্দরগড় জেলায় (Odisha’s Sundergarh district) ডাইনি সংক্রান্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩৫টি (“Witch Killings in Orissa District Cause Concern”, 2010)। ২০০৩ সালের অক্টোবরে বিহারের মুজাফফরপুর জেলার (Muzaffarpur district in Bihar) কামালপুরা গ্রামে তিনজন মহিলাকে ডাইনি বলে এমন অপমান করা হলো যে তারা তিনজনই আত্মহত্যা (committed suicide) করলেন (“Three ‘witches’ kill themselves”, 2003)। ২০১৩ সালের আগস্টে আসামের কোকরাঝাড় জেলায় (Kokrajhar district in Assam) এক দম্পতিকে একদল লোক কুপিয়ে খুন করে (“In Assam, a rising trend of murders on allegations of witchcraft”, 2013)। সেই বছরই সেপ্টেম্বরে ছত্তিশগড়ের জশপুর জেলায় (Jashpur district of Chhattisgarh) এক মহিলাকে খুন আর তার মেয়েকে ধর্ষণ (raped) করা হলো – কারণ? তারা নাকি কালো জাদু (practising black magic) করত! (“Girl raped, mom killed for her alleged indulgence in black magic in Chhattisgarh”, 2013)।

একটা হিসেব বলছে, ২০১০ সাল নাগাদ ভারতে প্রতি বছর ১৫০ থেকে ২০০ জন মহিলাকে ডাইনি অপবাদে খুন করা হয়। মানে, ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোট প্রায় আড়াই হাজার! (The Hindu, 2010; Herald Sun, 2010)। ঝাড়খণ্ড (Jharkhand), বিহার (Bihar), ছত্তিশগড়ের (Chhattisgarh) মতো গরিব রাজ্যগুলোতে এই গণপিটুনি (lynchings) খুব বেশি দেখা যায় (“Witch hunts targeted by grassroots women’s groups”, 2012)। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার (Jalpaiguri district, West Bengal) চা বাগানের শ্রমিকদের (tea garden workers) মধ্যেও এই ডাইনি শিকার চলছে (Witches, Tea Plantations, and Lives of Migrant Laborers in India)। জলপাইগুড়ির ঘটনাগুলো হয়তো কম আলোচিত, কিন্তু এর পেছনে আছে চা শিল্পের (tea industry) চাপে পিষ্ট আদিবাসী (Adivasi) শ্রমিকদের জীবনের যন্ত্রণা (stress) (Witches, Tea Plantations, and Lives of Migrant Laborers in India)।

ভারতে আসলে ব্যাপারটা কী দাঁড়িয়েছে জানেন? কাউকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দেওয়াটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জমি দখলের (grab land), পুরনো শত্রুতার শোধ (settle scores) নেওয়ার, এমনকি প্রেম বা যৌন প্রস্তাবে (sexual advances) রাজি না হওয়ায় শাস্তি দেওয়ার একটা সহজ উপায়! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যে মহিলার উপর এই অপবাদ আসে, তার পক্ষে সাহায্য পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। তাকে হয় ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে পালাতে হয়, নয়তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। আর কত ঘটনাই তো চাপা পড়ে যায়! গরিব, নিরক্ষর মহিলারা দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন কী করে? ঝাড়খণ্ডের একটা সংস্থা আছে, ফ্রি লিগ্যাল এইড কমিটি (Free Legal Aid Committee), যারা ভুক্তভোগীদের নিয়ে কাজ করে। তাদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডাইনি শিকারে অভিযুক্তদের মধ্যে সাজা হয় মাত্র ২ শতাংশেরও কম লোকের! (Womensnews.org; Bailey, 1994)। কী সাংঘাতিক অবস্থা!

নেপাল (Nepal)

নেপালেও (Nepal) ডাইনি শিকার বেশ প্রচলিত। আর সেখানেও শিকার হন মূলত নিম্নবর্ণের মহিলারা (low-caste women) (Shrestha, 2010; “Nepal – A study on violence due to witchcraft allegation and sexual violence”, 2013)। এর পেছনের কারণগুলোও প্রায় একই রকম: কুসংস্কারের (superstition) প্রতি গভীর বিশ্বাস, শিক্ষার অভাব, সচেতনতার (public awareness) অভাব, নিরক্ষরতা (illiteracy), জাতপাতের ভেদাভেদ (caste system), পুরুষতান্ত্রিকতা (male domination), আর পুরুষদের উপর মহিলাদের আর্থিক নির্ভরতা (economic dependency)। যাদের ডাইনি বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের কপালে জোটে মারধর, অত্যাচার, সবার সামনে অপমান (publicly humiliated), এমনকি মৃত্যু। কখনও কখনও অভিযুক্তের বাড়ির লোকজনকেও ছাড় দেওয়া হয় না (“Nepal – A study on violence due to witchcraft allegation and sexual violence”, 2013)। ২০১০ সালে নেপালের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী (Minister for Women and Social Welfare) সর্ব দেব প্রসাদ ওঝা (Sarwa Dev Prasad Ojha) বলেছিলেন, “কুসংস্কার আমাদের সমাজে এমনভাবে গেঁড়ে বসেছে, আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস হলো এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকগুলোর একটা” (“Witch-hunt victim recounts torture ordeal”, 2010)।

সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকা (Sub-Saharan Africa)

আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের অনেক দেশেই ডাইনি নিয়ে মানুষের মনে ভীষণ ভয়। আর এই ভয় থেকেই থেকে থেকে শুরু হয় ডাইনি শিকার। কিছু বিশেষ লোক থাকে, যারা নাকি ডাইনি চিনতে পারে (specialist witch-finders)। তারা কাউকে সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করলেই ব্যস, শুরু হয়ে যায় গণপিটুনি, যার শেষ হয় প্রায়শই মৃত্যুতে (Diwan, 2004)। দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) (Ally, 2014), ক্যামেরুন, কঙ্গো, গাম্বিয়া, ঘানা, কেনিয়া, সিয়েরা লিওন, তানজানিয়া, জাম্বিয়া – এই দেশগুলোতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে (de Waal, 2012)।

এমনকি শিশুদেরও ডাইনি অপবাদ দিয়ে অত্যাচার করা হয়! ১৯৯৯ সালে কঙ্গোতে (Congo) (“Congo witch-hunt’s child victims”, 1999) আর তানজানিয়াতে এমন খবর পাওয়া গিয়েছিল। তানজানিয়াতে তো মহিলাদের লাল চোখ (red eyes) দেখলেই ডাইনি বলে হামলা করা হতো, সরকারকে শেষে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল (“Tanzania arrests ‘witch killers'”, 2003)। ঘানাতেও ডাইনি শিকার খুব সাধারণ ঘটনা। ২০০১ সালে সেখানে একজন মহিলা, যাকে ডাইনি বলা হয়েছিল, তিনি মামলা দায়ের করেছিলেন (“Tanzania arrests ‘witch killers'”, 2003)। আফ্রিকায় অনেক সময়েই দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি (property) হাতানোর লোভে তার আত্মীয়রাই এই ডাইনি শিকারের কলকাঠি নাড়ে!

অড্রে আই রিচার্ডস (Audrey I. Richards) নামে একজন নৃতাত্ত্বিক ১৯৩৫ সালে ‘আফ্রিকা’ (Africa) জার্নালে জাম্বিয়ার বেম্বা জাতির (Bemba people of Zambia) একটা ঘটনার কথা লিখেছিলেন (Richards, 1935)। সেখানে বামুকাপি (Bamucapi) নামে এক নতুন ধরনের ডাইনি-শনাক্তকারীর দল গ্রামে গ্রামে ঘুরত। তারা পরত ইউরোপীয় পোশাক (European clothing)! গ্রামের মোড়লকে (headman) ডেকে বলত সবার জন্য ভোজের (ritual meal) আয়োজন করতে। সবাই এলে, তারা একটা আয়না (mirror) দিয়ে সবাইকে দেখত আর দাবি করত, এভাবেই নাকি ডাইনি চেনা যায়! যাদের ডাইনি বলে ধরা হতো, তাদের নাকি নিজেদের “শিং জমা দিতে” (“yield up his horns”) হতো – মানে, অভিশাপ (curses) আর খারাপ ওষুধের (evil potions) জন্য ব্যবহার করা শিংয়ের কৌটাগুলো (horn containers) তাদের দিয়ে দিতে হতো। তারপর বামুকাপিরা সবাইকে কুচাপা (kucapa) নামে একটা ওষুধ খাওয়াত। বলা হতো, কোনো ডাইনি যদি আবার এসব করার চেষ্টা করে, তাহলে এই ওষুধ খেয়ে সে মরে ফুলে উঠবে!

গ্রামের লোকেরা বলত, বামুকাপিরা নাকি ভুল করত না। কারণ তারা যাদের ধরত, তাদেরকেই তো গ্রামসুদ্ধ লোক আগে থেকে ভয় পেত! বামুকাপিরা নিজেদের ক্ষমতার ব্যাখ্যা দিত খ্রিস্টান আর স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের (Christian and native religious traditions) মিশেল দিয়ে। বলত, ঈশ্বর (God) (কোন ঈশ্বর, তা অবশ্য বলত না!) তাদের ওষুধ বানাতে সাহায্য করেন। আরও বলত, যে ডাইনিরা ধরা পড়ার ভয়ে ভোজে আসবে না, তাদের পরে তাদের ‘মাস্টার’ (master) ডাকবে – যে কিনা কবর থেকে উঠে এসেছে! মাস্টার নাকি ড্রাম বাজিয়ে (drums) ডাইনিদের কবরস্থানে (graveyard) যেতে বাধ্য করবে, আর সেখানেই তারা মরবে! রিচার্ডস খেয়াল করেছিলেন, বামুকাপিরা গ্রামের সব শিং – তা সে ডাইনি তাড়ানোর তাবিজ (anti-witchcraft charms), ওষুধ, নস্যি (snuff) রাখার জন্যই হোক, বা সত্যিই কালো জাদুর (black magic) জন্যই হোক – সব কেড়ে নিয়ে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করত।

বেম্বা জাতির লোকেরা ভাবত, যুদ্ধবিগ্রহ (wartings), ভূতের উপদ্রব (hauntings) বা দুর্ভিক্ষ (famines) – এসব হলো তাদের প্রধান দেবতা লেসার (High-God Lesa) দেওয়া শাস্তি, এর পেছনে কারণ আছে। কিন্তু বিনা কারণে ক্ষতি করতে পারে কেবল একজনই – ডাইনি! যার নাকি প্রচুর ক্ষমতা (enormous powers), আর যাকে চেনা খুব মুশকিল। আফ্রিকায় যখন শ্বেতাঙ্গ শাসন (white rule of Africa) এল, তখন জাদু আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস যেন আরও বেড়ে গেল। হয়তো নতুন ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, আইনের চাপে মানুষের মধ্যে একটা টানাপোড়েন (social strain) তৈরি হয়েছিল বলে। আবার এটাও কারণ হতে পারে যে, তখন আর আদালতে ডাইনিদের বিচার করা যেত না।

দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু উপজাতিদের (Bantu tribes of Southern Africa) মধ্যে ডাইনি চেনার কাজটা করত ‘ডাইনি গন্ধগ্রাহক’রা (witch smellers)! দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু জায়গায় ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ডাইনি শিকারে মারা গেছে (Hayes, 1995)।

ক্যামেরুন তো ১৯৬৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আবার আদালতেও ডাইনিবিদ্যা সংক্রান্ত অভিযোগ (witchcraft-accusations) শোনার ব্যবস্থা করেছে! (Levack, 2004; Fisiy, 2001; Afrik.com)।

২০০৮ সালের মে মাসে খবর এল, কেনিয়াতে (Kenya) একদল জনতা ডাইনি সন্দেহে অন্তত ১১ জনকে পুড়িয়ে মেরেছে (burnt to death)! (“Mob burns to death 11 Kenyan ‘witches'”, 2008)।

২০০৯ সালের মার্চে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানাল, গাম্বিয়াতে সরকারি মদতপুষ্ট “ডাইনি ডাক্তাররা” (“witch doctors”) প্রায় ১০০০ লোককে ডাইনি অপবাদে অপহরণ (abducted) করে আটক কেন্দ্রে (detention centers) নিয়ে গেছে আর সেখানে তাদের জোর করে বিষাক্ত জিনিস (poisonous concoctions) খাইয়েছে! (“The Gambia: Hundreds accused of ‘witchcraft'”, 2009)। সেই বছরই মে মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) রিপোর্ট করল, এই কাণ্ডটা নাকি ঘটিয়েছেন গাম্বিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহ (Yahya Jammeh) নিজে! (Nossiter, 2009)।

সিয়েরা লিওনে আবার ডাইনি শিকারটা হয়ে দাঁড়ায় নীতিশিক্ষার উপলক্ষ্য! কেমামোই (kɛmamɔi) নামে স্থানীয় মেন্ডে জাতির ডাইনি-শনাক্তকারী (native Mende witch-finder) এসে লোকজনকে বোঝায়: “ডাইনিবিদ্যা… মানুষের জীবনে তখনই ঢোকে যখন মানুষ মন খুলে মেশে না। যত খারাপ কাজ, তার মূলে আছে ঘৃণা, হিংসা, সন্দেহ বা ভয়। এই সব অনুভূতিই মানুষকে সমাজবিরোধী (act antisocially) করে তোলে” (Gittins, 1987, p. 197)। আর লোকেরা নাকি তার কথা শুনে বলত, “তারা তার কাজকে সম্মান করে এবং সামাজিক দায়িত্ব আর সহযোগিতার যে শিক্ষা তিনি দিতে এসেছেন, তা তারা শিখবে” (Gittins, 1987, p. 201)। বিচিত্র ব্যাপার!

অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘উইচ-হান্ট’ শব্দের ব্যবহার (Use of the term in other contexts)

আজকাল অবশ্য ‘উইচ-হান্ট’ শব্দটা শুধু আসল ডাইনি শিকার বোঝাতে ব্যবহার হয় না। যখন কোনো কারণ ছাড়াই হন্যে হয়ে কিছু লোককে দোষী খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, আর তারপর তাদের হেনস্তা করা হয়, তখন সেটাকেও ‘উইচ-হান্ট’ বলা হয়। যেমন ধরুন, স্ট্যালিনের আমলের অত্যাচার (Stalinist witch-hunts) (Mansky, 2017) বা আমেরিকায় ম্যাকার্থিজমের সময়কার কমিউনিস্ট খোঁজা (McCarthyite witch-hunts) (Miller, 1996)। গবেষক জেমস মোরোন (James Morone) ঠিকই বলেছেন, “একটা ঘটনাকে উইচ-হান্ট বানায় আসলে ডাইনিরা (বা কমিউনিস্ট বা শিশু নির্যাতনকারীরা) নয়। বরং যারা শিকার করছে, তাদের স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নিয়মগুলো (normal rules of justice) ছুঁড়ে ফেলার মানসিকতাই একে উইচ-হান্ট বানায়” (Morone, 2022)।

রাজনীতিতেও এই শব্দটা খুব চলে। কেউ যখন বোঝাতে চায় যে তাকে বা তার দলকে অন্যায়ভাবে কোণঠাসা (oppressed) বা একঘরে (ostracised) করা হচ্ছে, তখন তারা প্রায়ই ‘উইচ-হান্ট’ বলে চিৎকার করে। দ্য টেলিগ্রাফ (The Telegraph) পত্রিকা তো ‘ক্যানসেল কালচার’কে (cancel culture) বলেছে “আজকের দিনের ডাইনি বিচার” (“modern-day witch trials”)! (Telegraph Video, 2021)। আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) তো কথায় কথায় টুইটারে এই শব্দটা ব্যবহার করতেন – তার বিরুদ্ধে হওয়া নানা তদন্ত (investigations) (Shear, Savage, & Haberman, 2017; Al-Arshani, 2021) বা অভিশংসনের প্রক্রিয়াকে (impeachment proceedings) তিনি ‘উইচ-হান্ট’ বলতেন (“Trump calls impeachment effort ‘greatest witch hunt'”, 2021; “Trump calls impeachment case a ‘witch hunt'”, 2021; Markham-Cantor, 2019)। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি নাকি ৩৩০ বারেরও বেশি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন! (Almond, 2020)। এমনকি আমেরিকার ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনও (NRA) এই শব্দ ব্যবহার করে নিউ ইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেলের করা একটা মামলা খারিজ করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল (Gregorian, 2022)।

ডাইনি বিচারের তালিকা (List of witch trials)

  • Aberdeen witch trials of 1596–1597

  • Akershus witch trials

  • Amersfoort and Utrecht witch trials

  • Baden-Baden witch trials

  • Basque witch trials

  • Bideford witch trial

  • Bo’ness witches

  • Bredevoort witch trials

  • Bury St Edmunds witch trials

  • Channel Islands Witch Trials

  • Copenhagen witch trials

  • Derenburg witch trials

  • Doruchów witch trial

  • Eichstätt witch trials

  • Ellwangen witch trial

  • Esslingen witch trials

  • Fulda witch trials

  • Fürsteneck witch trial

  • Geneva witch trials

  • Great Scottish Witch Hunt of 1597

  • Great Scottish witch hunt of 1649–50

  • Great Scottish Witch Hunt of 1661–62

  • Islandmagee witch trial

  • Kasina Wielka witch trial

  • Kastelholm witch trials

  • Katarina witch trials

  • Kirkjuból witch trial

  • Liechtenstein witch trials

  • Lisbon witch trial

  • Lukh witch trials

  • Mergentheim witch trials

  • Mirandola witch trials

  • Mora witch trial

  • Newcastle witch trials

  • Nogaredo witch trial

  • North Berwick witch trials

  • Northamptonshire witch trials

  • Northern Moravia witch trials

  • Orkney witch trials

  • Paisley witches

  • Pappenheimer witch trial

  • Peelland witch trials

  • Pittenweem witches

  • Pendle witches

  • Põlula witch trials

  • Ramsele witch trial

  • Roermond witch trial

  • Rosborg witch trials

  • Rottenburg witch trials

  • Rottweil Witch Trials

  • Rugård witch trials

  • Salem witch trials

  • Spa witch trial

  • St Osyth Witches

  • Szeged witch trials

  • Terrassa witch trials

  • Thisted witch trial

  • Torsåker witch trials

  • Trier witch trials

  • Valais witch trials

  • Val Camonica witch trials

  • Vardø witch trials (1621)

  • Vardø witch trials (1651–1653)

  • Vardø witch trials (1662–1663) as part of the Christianization of the Sámi people

  • Wiesensteig witch trial

  • Witches of Warboys

  • Würzburg witch trials

তথ্যসূত্র (References)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.