সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তা : জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ

মানুষ সামাজিক জীব। আর সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত থেকে জীবনাচরণ পরিচালনা করে। তবে মানুষ তার জীবনে যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশি যুক্ত থাকে সেটি হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ব্যতীত কোনো মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ও দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করতে পারে না। কেননা রাষ্ট্রেই মানুষ অনুগ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তাই মানুষ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে সব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন রয়েছে তার সাথে পরিচিত হয় এবং সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যে চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা পোষণ করে তাই রাষ্ট্রচিন্তা (Political Thought) হিসেবে পরিচিত। তবে রাষ্ট্র ও এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদ আলাসা বা ভিন্ন ধরনের ধারণা পোষণ করতেন বলে এটি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছে।

Table of Contents

রাষ্ট্রচিন্তা (Political Thought)

মানব সমাজ বিকাশের সাথে যেসব প্রতিষ্ঠানের জন্ম ও বিকাশ সাধিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সর্বদা মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) ও এরিস্টটল (Aristotle) রাষ্ট্র সম্পর্কে অনুরূপ ধারণা পোষণ করেছেন। বাস্তবেও লক্ষ করা যায় যে, রাষ্ট্র মানব জীবনের রাজনৈতিক (Political), সামাজিক (Social) ও অর্থনৈতিক (Economical) দিক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে আসছে। এরূপ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র নিয়ে মনীষীদের ভাবনার কোনো অন্ত নেই। তাই মনীষীগণ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। রাষ্ট্রকে কীভাবে আরো কল্যাণকর ও গণমুখী করে তোলা যায় সে সম্পর্কে তাদের ভাবনাকে প্রসারিত করেছেন। তাদের এ চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ বা সমষ্টি হলো রাষ্ট্রচিন্তা (Political Thought)। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীন গ্রিক (Greek), রোমান (Roman), মিশরীয় (Egyptian) ও ব্যবলনীয় (Babilonian) সভ্যতার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ঘটলেও গ্রিকদের হাতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), এরিস্টটল ( Aristotle) প্রমুখের চিন্তাধারার মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে বলে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেতেন।

রাষ্ট্রচিন্তার সংজ্ঞা

রাষ্ট্রচিন্তার ধারণাটি অতি প্রাচীন এবং এটি একটি জটিল বিষয়। মূলত রাষ্ট্রচিন্তা বলতে রাষ্ট্র সম্পর্কে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বা দার্শনিকগণ কর্তৃক প্রণীত সুচিন্তিত মতামতকে বোঝায়। বিভিন্ন যুগে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে যে ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়েছে তাই রাষ্ট্রচিন্তা (Political Thought) নামে অভিহিত। তবে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ (Political Thinkers) অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, গ্রিক চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তৎকালীন গ্রিসের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কার্যকলাপের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। অনুরূপভাবে রোমান চিন্তাবিদরা তৎকালীন রোমান সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ব্যস্ত করেছেন। এভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রচিন্তার সংজ্ঞা প্রদান করার প্রয়াস পেয়েছেন। নিম্নে এসব সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :-

  • অধ্যাপক আর. জি, গ্যাটে (Professor Gettell) বলেন, “Political thought represents a high type of intellectual achievement and like other forms of philosophic thought, has an interest and a value entirely apart from any practical application of its principles. Intelligent men naturally wish to understand the authority under which they live, to analyse its organization and its activities and speculate concerning the best form of political existence.”
  • অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার (Prof. Ernest Barker) রাষ্ট্রচিন্তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “Political theory is the speculation of particular thinkers which may be remote from actual fact of the time, political thought is the imminent philosophy of the whole age.” অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মতবাদ বিভিন্ন চিন্তাবিদদের চিন্তা-চেতনা ও গবেষণার ফলস্বরূপ। অনেকাংশেই এটা তাদের সমসাময়িক কালের বাস্তব ঘটনাবলি থেকে দূরে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রদর্শন একটি যুগের বাস্তব ঘটনাবলির স্থায়ী দর্শন।
  • হেনরী বি, মেগরো (Henry B. Magro) বলেছেন যে, “রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোনো বিশেষ সময়ে কোনো বিশেষ জনসমাজের ভাবধারা ও বিশ্বাসসমূহের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। যেসব রাজনৈতিক ধারণা নিয়ে কোনো জনসমাজ বেঁচে থাকে, তাই রাজনৈতিক চিন্তাধারা। অর্থাৎ রাষ্ট্রচিন্তা হলো কোনো কালের বা যুগের রাজনৈতিক ধারণার সমষ্টি।”
  • অধ্যাপক ওয়েপার (Prof. Wayper) বলেন, “রাষ্ট্রচিন্তা বলতে বুঝায় সেই মতবাদকে যা রাষ্ট্রের গঠন, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করে।”
  • অধ্যাপক ফিলিপ ডোয়েল (Prof. Philiph Doyle) রাষ্ট্রচিন্তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,“রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। যথা-মানব প্রকৃতি (Human Nature) ও তার কার্যকলাপ, জীবনের সমগ্র অনুভূতির জন্য পৃথিবীর অপরাপর বিষয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক।”
  • অধ্যাপক হেরম্যান হেলাল (Prof. H Helal) বলেন, “রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রের স্থিতিশীল পর্যায়গুলো আলোচনা করে। “

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তা হলো এমন একটি বিষয় যাতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ যাবতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সমাজস্থিত মানুষের সম্পর্ক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক ও এর অতীত কার্যাবলি সম্পর্কে ব্যাপক পর্যালোচনা হয়।

রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ

যে কোনো দার্শনিক চিন্তাধারা সাধারণত কালের বিবর্তন অনুযায়ী আলোচিত হয়ে থাকে। কালের পরিক্রমায় এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে বলে দার্শনিকগণ অনুরূপ পদ্ধতিতে আলোচনার পক্ষপাতি। তাই রাষ্ট্রচিন্তার দার্শনিকগণও কালের বিভাজন অনুসারে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে বিভক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন :

  • ক. প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা (Oriental Political Thought), এবং
  • খ. পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা (Western Political Thought)

ক. প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা (Oriental Political Thought) : প্রাচ্য দেশীয় তথা ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয়, ব্যবলনীয়, এসিরীয়, পারস্য এলাকার রাষ্ট্রচিন্তা মূলত প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা হিসেবে পরিচিত। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় উপরিউক্ত অঞ্চলসমূহের রাজনৈতিক চিন্তা স্থান পেয়েছে।

খ. পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা (Western Political Thought) : গ্রিক, রোম, ইতালি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসমূহের রাষ্ট্রচিন্তা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার আওতাভুক্ত। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা (European Political Thought) নামেও অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব। গ্রিক সভ্যতা ও নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্যদিয়ে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি হয়েছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অভিমত পোষণ করেছেন। আলোচনা ও অধ্যয়নের সুবিধার্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো :

  • ক. প্রাচীন যুগ (Ancient Age)
  • খ. মধ্যযুগ (Mediaeval Age )
  • গ. আধুনিক যুগ (Modern Age)

নিম্নে— রাষ্ট্রচিন্তার তিনটি যুগের বর্ণনা করা হলো :

ক. প্রাচীন যুগ (Ancient Age) : পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্রাচীন যুগ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ হতে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগের পরিব্যাপ্তি। এ সময়ে গ্রিক, রোমসহ ইউরোপীয় অনেক দেশে রাষ্ট্রচিন্তার উৎপত্তি ঘটে। তবে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে (Greek Political Thought) রাষ্ট্রচিন্তার সূতিকাগার (Birthplace) বলে অভিহিত করা হয়। সে সময়ে গ্রিক চিন্তাবিদদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দ্বারা অন্যান্য দেশের চিন্তাবিদের রাজনৈতিক চিন্তা প্রভাবিত হয়েছে। অধ্যাপক বার্কার (Prof. Ernest Barker) বলেন, “গ্রিকদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা ও সমৃদ্ধি ঘটে।”

গ্রিক সভ্যতার ছোঁয়া সমসাময়িককালীন অনেক দেশেই পরিলক্ষিত হয়। ফলে দিকে দিকে গ্রিস সভ্যতার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য গ্রিসের শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে আসতেন এবং গ্রিক পণ্ডিতদের সাহচর্য লাভ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পেতেন। তাছাড় প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রের (City State) ধারণা তৎকালীন রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। নগররাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রচিন্তার যাত্রাকে সুসংহত করে তুলেছিল। গ্রিক পণ্ডিতদের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তায় যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তারা হলেন । সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), এরিস্টটল (Aristotle) প্রমুখ। গ্রিসের এসব জ্ঞানীদের পদচারণা প্রাচীনযুগের রাষ্ট্রচিন্তা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিল।

খ. মধ্যযুগ (Mediaeval Age) : পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ (Age of ignorance) বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), এরিস্টটল ( Aristotle) প্রে পর প্রাচীন যুগে আর কোনো উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের আবির্ভাব না ঘটায় প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। গ্রিক নগররাষ্ট্রের পতন এবং আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাব অর্থাৎ ম্যাকিয়াভেলীর 1 (Machiavelli) আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কাল রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ (Mediaeval Age) হিসেবে খ্যাত। এ সুদীর্ঘ সময়ে প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ন্যায়নীতির অবসান এবং ধর্মীয় রাজনীতি প্রবর্তিত হবার ফলে রাষ্ট্রচিন্তায় স্থবিরতা বিরাজ করে। তাছাড়া এ সময়ে “জোর যার মুল্লুক তার” (Might is right) নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীি ধর্মীয় যাতাকলে আবর্তিত হবার ফলে রাষ্ট্রচিন্তা প্রসারের পরিবর্তে বরং সংকুচিত হয়। আলাদা

মধ্যযুগের রাজনীতিতে কতিপয় বৈশিষ্ট্য ছিল লক্ষণীয়। এ সময়ে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধে সংঘাত, রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি, পোপতন্ত্র, সামন্তবাদ, বিশ্বজনীনতাবাদ এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে ডব্লিউ. এ. ডানিং (W. A. Dunning) এর একটি মন্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “The Middle age was unpolitical, aspirations and ideals centred about the form and content and religious belief.” এছাড়াও মধ্যযুগে যেসব দার্শনিক রাষ্ট্রচিন্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তারা হলেন সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine), সেই টমাস একুইনাস (St. Thomas Acquinas), এলিমেয়েরী দান্তে (Dante) এবং মার্সিলিও অব পাদুয়া (Marsilio of Padua) প্রমুখ ।

গ. আধুনিক যুগ (Modern Age) : রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়কাল হলো আধুনিক যুগ। মূলত পঞ্চদশ শতাব্দিতে পরিষদ আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। গির্জা ও রাষ্ট্রের সীমিত শাসনের ফলে পরিষদ আন্দোলন যে সামান্য উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করে, ষোড়শ শতাব্দির শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রি তাকে স্রোতের ন্যায় জানিয়ে নিয়ে যায়। এসময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক নানা আন্দোলন সূচিত হয়। এ সব আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে মানুষের চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। ঠিক এমনি সময়ে যুগ পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলীর আবির্ভাব ঘটে এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার ফলে রাষ্ট্রের উপর গির্জার প্রভাব সম্পূর্ণরূপে হ্রাস পায়। তার চিন্তাধারা ও লেখনীতে ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। পোপতন্ত্র ও রাজার ক্ষমতার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তি দেখা দেয়। তার এ চেতনা শুধুমাত্র ইতালিতে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল যা ইতিহাসে রেনেসাঁ (Renaissance) বা পুনর্জাগরণ হিসেবে খ্যাত। যেসব দার্শনিকদের চিন্তাচেতনা ও লেখনী মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটায় তারা হলেন নিকলো ম্যাকিয়াভেলী (Nicalo Machiavelli), টমাস হবন (Thomas Hobbes), জন লক (John Locke), মন্টেস্কু (Montesquieu), রুশো (Rousseau) প্রমুখ ।

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে উপরিউক্ত তিনটি যুগ ছাড়াও দার্শনিকগণ আরো একটি যুগের প্রবর্তন করেন। এ যুগটি রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এটি হলো সাম্প্রতিক কাল (Recent Period)। নিম্নে এ যুগ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :

ঘ. সাম্প্রতিককাল (Recent Period) : রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সাম্প্রতিককালের উদ্ভব ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) শেষ দিকে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট থেকে। দার্শনিকগণ মনে করেন যে, যেদিন জাপানের হিরোশিমায় আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় সেদিন থেকে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সাম্প্রতিককালের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি তথা উপনিবেশবাদের পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীতে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা সূচিত হয়, কমিউনিজমের পতন ঘটে এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। গণতন্ত্র সমগ্র পৃথিবীতে প্রতীক্ষিত শাসনব্যবস্থায় রূপ লাভ করে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে “মুক্তবাজার অর্থনীতি” (Free Market Economy) রাষ্ট্রচিন্তার গতিধারাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে এবং বিশ্ব রাজনীতি বর্তমানে জাতীয়তাবাদের গতি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে অগ্রসরমান।

পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমানে আমরা রাষ্ট্রচিন্তার যে বিশাল অবয়ব লক্ষ করি তা একদিনে তৈরি হয়নি; বহু দার্শনিক ও পণ্ডিতবর্গের চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়ে আজ রাষ্ট্রচিন্তা মহীরূহে পরিণত হয়েছে। তবে এর পেছনে রয়েছে বহু মনীষীর ত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে তাদেরকে কখনো স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে হয়েছে; কখনো দেশান্তরী হতে হয়েছে, আবার কখনো তাদের জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাদের এ চিন্তাচেতনা মানুষের জীবনধারাকে গতিসঞ্চার করেছে। তাদের চিন্তাধারাকে পুঁজি করে রাষ্ট্রের শাসকসহ নাগরিকগণ তাদের চলার পথের সন্ধান করেছেন। আজকের পৃথিবীতে আমরা যে রাজনীতির পদচারণা লক্ষ করি এর পিছনেও রাষ্ট্রচিন্তার অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য একজন শাসকের যে জ্ঞান প্রয়োজন তা কেবল রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।

সমকালীন বা সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তা

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বিস্তৃত সমকালীন রাষ্ট্রদর্শন। আধুনিক কালের রাষ্ট্রদর্শনসমূহ সাম্প্রতিককালে অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে রাষ্ট্রচিন্তাকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে হার্বার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদ, জৈব মতবাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাস্তি, শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের প্রচারক হলেন কান্টফিকটেহেগেল হলেন নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত রাষ্ট্রের প্রবক্তা এবং এক স্বশাসিত জনসমাজের ধারণাকে প্রচার করার ক্ষেত্রে হামবোল্ট (Humboldt) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রদর্শনের ঐতিহাসিক শক্তিশালী ভিত্তি গড়তে হেগেল ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠিত করে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রচলন করে সর্বগ্রাসিতা ও অতি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জার্মান উদারনৈতিক আদর্শবাদের সূচনা করেন। গ্রীন বলেন, রাষ্ট্র গঠনের পিছনে মানবিক চেতনা ও সামাজিক মঙ্গলই প্রধান। দমন পীড়ন নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের তিরি, ব্যক্তির নৈতিক ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করাই রাষ্ট্রের কাজ। ব্রাডলে ছিলেন সমাজ রাষ্ট্রের প্রবক্তা। হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদের সূত্র ধরে কার্ল মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক জড়বাদের মাধ্যমে শ্রেণিহীন বৈষম্যহীন সমাজতন্ত্রের রূপরেখা প্রদান করেন। বিশ্ব নতুন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কমিউনিজমের পতনের পর গণতন্ত্রের চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সময় উদারনৈতিক গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে, সমকালীন দর্শনকে আন্তর্জাতিকতা ও মানবতার দর্শনও বলা হয়। কেননা, বিশ্ব আজ আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমকালীন রাষ্ট্রচিন্তা বলতে আমরা বুঝি, চলমান রাষ্ট্রদর্শন যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক উদারনৈতিক ও নিয়মতান্ত্রিক ধারণা, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্ক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, বৈজ্ঞানিক মেথোলজি, উপযোগবাদ, স্থান্দ্বিক পদ্ধতিতে সমাজ বিশ্লেষণ সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রভৃতি নতুন নতুন চিন্তাধারার বিকাশ সাধন করে এবং জনগণকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সচেতন করে এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করে।

আধুনিক ও সমকালীন রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য

সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যা মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে তার সকল কিছুই রাষ্ট্রটির পর্যায়ভুক্ত। রাষ্ট্রচিন্তা সমাজের কথা বলে, সমাজ মানুষের কথা বলে। মানুষের জীবনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, অধিকার ও তার দায়িত্ব-কর্তব্য সব কিছুই রাষ্ট্রচিন্তার অন্তর্ভুক্ত। আর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা স্থবির নয়, গতিশীল। ফলে গতিশীল সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হয়। এই গতিশীল সমাজের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রচিন্তা প্রাচীন যুগ পেরিয়ে মধ্যযুগ এবং মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। মূলত রেনেসাঁ আন্দোলন পরবর্তী যুগের রাষ্ট্রচিন্তাকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা বলা হয়। আর আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার বিগত দেড় শতকের রাষ্ট্রচিন্তাকে সমকালীন রাষ্ট্রচিন্তা বলে অভিহিত করা হয়। এতে রাজনৈতিক ভাবধারার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়।

যে সমস্ত উপাদান বা বৈশিষ্ট্যসমূহ আধুনিক ও সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছে এবং নাগরিকের আইনগত অধিকারের উপর সরকারি অন্যায় হস্তক্ষেপে আধুনিক চিন্তাধারাকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে স্বাতন্ত্র্যতা দান করেছে সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :

  • ১. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। “জনগণই রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার উৎস”-ব্যক্তি সম্পর্কে এই ধারণা আধুনিক সভ্যতার দর্শন তত্ত্বেরও ভিত্তি স্থাপন করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সরকারি অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এক দার্শনিক প্রতিবাদ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা মিল এর মতে, ব্যক্তির সুখ বিধান রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। সরকার এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অন্য কোনো সমাজব্যবস্থার অনুকূলে পথ ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
  • ২. রেনেসাঁ আন্দোলন : আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ও গতিধারা নির্ধারণে রেনেসাঁ আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রেনেসাঁ অর্থ পুনর্জাগরণ শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, ভাস্কর্য ও সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ইউরোপে যে নব জাগরণ সূচিত হয় তাকে রেনেসাঁ বলা হয়। রেনেসাঁর প্রভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা প্রসারিত হয় এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন রূপ লাভ করে।
  • ৩. ধর্মসংস্কার আন্দোলন : সংস্কার আন্দোলন আধুনিক তথা সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রেনেসাঁর পাশাপাশি এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মযাজকদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করা এবং খ্রিস্টধর্মের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করা। ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই আন্দোলনের নাম সংস্কার আন্দোলন (Movement of Reformation)। মার্টিন লুথার কিং, ক্যালভিন প্রমুখ সংস্কারবাদী চিন্তাবিদগণ রাষ্ট্র ও গির্জার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। ফলে মধ্যযুগীয় গির্জার একছের আধিপত্যের পরিবর্তে লোকায়তবাদী চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটে। সমগ্র ইউরোপে এ আন্দোলন বিরাট রূপ ধারণ করে এবং পুরাতন চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাস মুছে ফেলে নতুন চিন্তা চেতনায় আত্মনিয়োগ করে। সংস্কারবাদীদের উদারবাদী ধ্যান-ধারণা সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
  • ৪. নিয়মতান্ত্রিক সরকার: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো দার্শনিক শাসকের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতাকে ন্যস্ত করে ব্যক্তির সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস জনগণ। অর্থাৎ, এ নীতির দ্বারা তারা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের ধারণা সমর্থন করেন। তারা গণতন্ত্রের জয়গান করেন এবং প্রাকৃতিক আইনকে যদি কুসংস্কার মনে করেন তবে উপযোগবাদ নীতির ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করতে হবে বলে মনে করেন। অর্থাৎ, অধিক লোকের মতামতের উপর আইনের গুণাগুণ নির্ভর করবে।
  • ৫. উপযোগবাদ: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে উপযোগবাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপযোগবাদ হলো মানব আচরণের প্রকৃতি এবং অভিপ্রায়ের মতবাদ, যার মাধ্যমে লাভ ও ক্ষতির মাপকাঠি নির্ণয় করা যায়। সরকার কতটুকু মানবকল্যাণে ইচ্ছুক এ নীতির মাধ্যমে তা বুঝা যায়। উপযোগবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন বেন্থাম। বেন্থাম এর মতে, প্রকৃতি মানব জাতিকে “আনন্দ ও বেদনা” নামক দুই সার্বভৌম প্রভুর শাসনাধীনে স্থাপন করেছে। আমাদের কী করা উচিত তা নির্দেশ করে দেয়া এবং আমরা যথার্থই কী করব তা স্থির করে দেয়া একান্তই এই দুই প্রভুর কাজ। এই দুই প্রভুর সিংহাসনে বাধা রয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের বিজয় বৈজয়ন্তী এবং কার্যকরণের দাসত্ব শৃঙ্খল।
  • ৬. উদারতাবাদ: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উদারতাবাদ। আর উদারতাবাদ এমন এক ধরনের মতবাদ যেখানে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণকে মহামূল্যবান মনে করা হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে অশুভ বলে গণ্য করা হয়। ব্যক্তির জন্য সমাজ, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির উন্নতিই উদারতাবাদের মূল লক্ষ্য।
  • ৭. জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা: জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে জাতিবাদ বা জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা প্রবল ও ব্যাপকতর হতে থাকে। ম্যাকিয়াভেলী আধুনিক ইউরোপের রাষ্ট্রচিন্তার অবকা হিসেবে এই পরিবর্তনের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখেন। তিনি রাষ্ট্রশক্তিকে ধর্মনীতিবোধের প্রভাবমুক্ত করে স্বতন্ত্র লোকায়িত শক্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যাকিয়াভেলীর এই আদর্শ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে বিশেষভাবে সহায়ক।
  • ৮. জাতীয় চেতনাবোধ সৃষ্টি : জাতীয় চেতনাবোধ জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এই জাতীয়তাবাদী চেতনার রূপান্তর ঘটে আঠারো শতক থেকে। রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিক এ নতুন চেতনার দিশারি। রাজশক্তি নয়, রাষ্ট্রের জনশক্তিই সার্বভৌম ক্ষমতার ধারক। এ ধারণা রুশোর লেখনিতে সোচ্চার। তাঁর মতে, জাতিভিত্তিক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের গণ্ডিতেই জনশক্তি সুষ্ঠুভাবে সার্বভৌম ধারণা প্রয়োগে সক্ষম। রুশোর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসি বিপ্লবীরা রাজকবল থেকে জনশক্তির হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলে এবং দাবি বাস্তবায়নের জন্য বিপ্লবের পথ বেছে নেয়।
  • ৯. আদর্শগত বুনিয়াদ সৃষ্টি : সনাতন চেতনার পতনের ফলে অসংখ্য মানুষের ধর্মীয় আনুগত্যের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার ফলে এর প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায়। প্রায় সকল আধুনিক রাষ্ট্রেই আদর্শগত বুনিয়াদ জাতীয়তাবাদের প্রভাবকে আরো বৃদ্ধি করে। প্রকার কৃষ্টি, আচার আচরণ, অনুষ্ঠান, যেমন- জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, শহিদ মিনার ইত্যাদির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ প্রভাবিত হয়েছে।
  • ১০. যুক্তিময়তা: আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ধারার যুগকে আমরা যুক্তির যুগ বলতে পারি। যুক্তির কষ্টি পাথরে বিচার বিশ্লেষণ করে এ যুগে রাজনৈতিক চিন্তাধারা নবতর রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ যুগে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা পেল এবং জানতে পারল কোনটা ভালো এবং কোনটা মন্দ। এর পূর্বে এই স্বাধীন বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল না।
  • ১১. একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের আবির্ভাব : আধুনিক যুগে অর্থনৈতিক পরিবর্তন সীমিত রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের জয়গানে মত্ত হয়ে ওঠে এবং এই সময় পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র যেমন : স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রে কেন্দ্রিভূত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। রাজাই ঈশ্বরের একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। সুতরাং তার প্রতি শর্তহীন আনুগত্যই নাগরিকের কর্তব্য।
  • ১২. গৌরবময় বিপ্লব : ১৬৮৮ সালে ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লব সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে। এই বিপ্লবের ফলে শক্তিশালী রাজশক্তির বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের বিজয় সূচিত হয় এবং জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই বিপ্লবের মাধ্যমে একটি উদারবাদী চিন্তার প্রসার ঘটে। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে গৌরবময় বিপ্লবের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  • ১৩. আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন : ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ব্রিটিশ শাসন থেকে আমেরিকার ১৩টি অঙ্গরাজ্যের মুক্তি এনে দেয়, যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে। এই বিপ্লবের ভাবধারা অন্যদেরকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
  • ১৪. ফরাসি বিপ্লব : ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র “সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা” সমগ্র বিশ্বে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মানুষের চিন্তা-চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নতুন ভাবধারার সৃষ্টি হয়।
  • ১৫. শিল্প বিপ্লব : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শিল্প বিপ্লব ইউরোপের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজনের ভিত্তি রচনা করেছিল।
  • ১৬. ধর্মনিরপেক্ষতা : আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যদানের ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এই মতবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে মধ্যযুগীয় গির্জাকেন্দ্রিক ভাবধারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূলকথা হলো ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রচিন্তাকে আধুনিক ভাবধারায় গড়ে উঠতে সহায়তা করে।
  • ১৭. পুঁজিবাদ : শিল্প বিপ্লবের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসেবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার আগমন ঘটে। পুঁজিবাদের আবির্ভাবের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন অবকাঠানো গড়ে ওঠে। মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদ নতুন মাত্রা যোগ করে। তাই বলা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে পুঁজিবাদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
  • ১৮. সাম্রাজ্যবাদ : সাম্রাজ্যবাদ মূলত পুঁজিবাদের স্বাভাবিক পরিণতি। পুঁজিবাদী দেশসমূহ তাদের উৎপাদিত সামগ্রী বাজারজাতকরণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে উপনিবেশ সৃষ্টি করতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়। এভাবে পুঁজিবাদী দেশসমূহ উপনিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বে তাদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। এর ফলে জন্মলাভ করে সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণা। তাই বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
  • ১৯. সমাজতন্ত্রবাদ : সমাজতন্ত্র সমগ্র বিশ্বে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। বিখ্যাত মনীষী কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের মূল প্রবক্তা। সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে সমাজ কাঠামোর মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। উৎপাদনের পদ্ধতি এবং উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। মোট কথা সমাজতন্ত্র মানুষের জীবনধারাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এভাবে সমাজতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • ২০. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ: ইতালিতে ফ্যাসিবাদ এবং জার্মানিতে নাৎসিবাদের উদ্ভব আধুনিক বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ কোনো দীর্ঘস্থায়ী আদর্শ না হলেও এদুটি আদর্শ সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের আবির্ভাব আধুনিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
  • ২১. ভৌগোলিক আবিষ্কার : বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক আবিষ্কার রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কারের ফলে মানুষের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান।
    হয়েছে এবং একে অন্যের জানার ও বুঝার সুযোগ হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে যোগাযোগ ও সংযোগের ফলে নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশকে প্রভাবিত করেছে।
  • ২২. সামাজিক ধ্যান ধারণা: শিল্প বিপ্লবের পর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদির ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে গড়ে ওঠে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি। ফলে উদ্ভব ঘটে পুঁজিপতি শ্রেণির। পুঁজির অসম বিন্যাসের ফলে সমাজে কুফলের সৃষ্টি হয় এবং তা দূর করার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দিতে সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদের। কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস এ মতবাদের প্রবক্তা। তাদের বৈজ্ঞানিক ধারণা লোকায়তবাদকে বিশেষভাবের প্রভাবিত করে।
  • ২৩. সামাজিক জীবন : সামাজিক ক্ষেত্রে অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রাধান্যও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিলুপ্ত হওয়ায় সমাজ জীবনে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য রইল না। আইনের চোখে সকলেই সমান বলে বিবেচিত হয়। বিপ্লবের সময় ভূমিদাসরা ভাবত তারা সামন্তবাদের চিরদাস। কিন্তু বিপ্লবোত্তরকালে যেভাবে ভূসম্পত্তি বণ্টন করা হয়েছিল তার ফলে স্বাধীন কৃষক সমাজের জন্ম হয়। ফরাসি বিপ্লবের ফলে তাদের মনে এক নতুন ভাবধারার উদয় হলো এবং তারা বুঝতে পারল যে, তাদেরও স্বাধীনভাবে বাস করার অধিকার আছে।
  • ২৪. আমলা শ্রেণির উত্থান : শিল্পবাদী সমাজের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একটি আমলা শ্রেণির। তারা কলকারখানার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়াও শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ সমন্বয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রযুক্তির কেন্দ্রায়নের সাথে শাসন ক্ষমতাও কেন্দ্রিভূত হয় মুষ্টিমেয় আমলার হাতে। এ পটভূমি কেবল গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় বাঁধা সৃষ্টি করেছে তা নয় বরং একনায়কতন্ত্র ও সর্বাত্মক রাষ্ট্রের উত্থানেও সহায়তা করেছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ কখনো থেমে থাকে না। সময় ও পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ধারাও এগিয়ে যাবে এবং এভাবেই রাষ্ট্রচিন্তা নতুন রূপ পরিগ্রহ করবে। যে কারণে বলা যায় আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশও একদিনেও হয়নি। আধুনিক রাষ্ট্রীচিকা রেনেসাঁ যুগের অনেক পূর্বেই অন্তর্নিহিত ছিল। পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন, জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা এবং ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রভৃতি ভাবধারার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশ লাভ করেছে।

আধুনিক ও সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশে ফরাসি বিপ্লবের অবদান

সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যা মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে তার সকল কিছুই রাষ্ট্রচিন্তার পর্যায়ভুক্ত। রাষ্ট্রচিন্তা সমাজের কথা বলে, সমাজবদ্ধ মানুষের কথা বলে। গতিশীল সমাজের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রচিন্তা প্রাচীন যুগ পেরিয়ে মধ্যযুগ এবং মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা সমগ্র বিশ্বে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মানুষের চিন্তা-চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নতুন ভাবধারার সৃষ্টি হয়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ফরাসি বিপ্লব ব্যাপক অবদান রাখে। নিম্নে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

  • ১. স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অবসান : ফরাসি বিপ্লবের অনবদ্য অবদান হিসেবে স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ফ্রান্সে সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্যমান স্বৈরতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধিত হয়। বুরবোঁ রাজা ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২)– এর পতনের পর ফ্রান্সে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এরই সূত্র ধরে পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপে রাজতন্ত্রের বিবর্তন লক্ষ করা যায়।
  • ২. গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: ফ্রান্সের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের বিশেষ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। রাজার স্বেচ্ছাচারিতার পরিবর্তে প্রবর্তিত হয় জনগণের সার্বভৌমত্ব। বিশেষ করে এ পরিবর্তন ইউরোপীয় রাষ্ট্র কাঠামোয় অধিক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। কেননা, ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থার বিলোপ সাধিত হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার।
  • ৩. সাংবিধানিক পরিবর্তন: সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার অমোঘ বাণী নিয়ে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রে, সরকার, নাগরিক, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রভৃতি বিষয় ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় স্থান পায়।
  • ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্যদানের ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হলো ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এই মতবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে মধ্যযুগীয় গির্জা কেন্দ্রিক ভাবধারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রচিন্তাকে আধুনিক ভাবধারায় গড়ে উঠতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের অবদান অনস্বীকার্য। কেননা, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম বিষয় ছিল চার্চের সাথে রাজার দ্বন্দ্ব।
  • ৫. জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা : ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা ফরাসি বিপ্লবের অনেক পূর্বে হালেও ফ্রান্সে এর তেমন কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। অর্থাৎ, জাতি ও জাতীয় রাষ্ট্র প্রভৃতি ধারণাগুলো রাজতন্ত্রের সাথে জড়িয়ে ছিল। একমাত্র অভিজাত সম্প্রদায় যাজক ও পাদ্রিরা জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পরে এক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ইউরোপের জাতীয় রাষ্ট্রের এই ধারণা পরবর্তীকালে এশিয়ার প্রসার লাভ করে।
  • ৬. পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবর্তন : যদিও ফরাসি বিপ্লবের সময় সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের বিষয়টির উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল, তথাপি ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের পর বুর্জোয়া শ্রেণির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসেবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার আগমন ঘটে। পুঁজিবাদের আবির্ভাবের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন অবকাঠামো গড়ে ওঠে। মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদ নতুন মাত্রা যোগ করে। তাই বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে পুঁজিবাদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
  • ৭. সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রসার: ফরাসি বিপ্লবের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দিতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। কেননা, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলস্বরূপ অষ্টাদশ শতাব্দিতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শ্রমভিত্তিক নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়। ফলে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়, যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে।
  • ৮. ক্ষমতাবিভাজন নীতি : ফরাসি বিপ্লবের ফলে শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা বিভাজন নীতি গ্রহণ করা হয় এবং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের উপর অর্পণ করা হয়। এই বিভাজন নীতি ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • ৯. উগ্র জাতীয়তাবাদ: ফরাসি বিপ্লবের পর জাতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা গেলেও ইউরোপে জাতীয়তাবাদ উগ্র রূপ ধারণ করে। যে কারণে সমগ্র মানবসভ্যতা বিপদের সম্মুখীন হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
  • ১০. সামাজিক বৈষম্যের অবসান: ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এক্ষেত্রে পুঁজিপতি, ধর্মযাজক, রাজবংশ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সাথে সাধারণ জনগণের বৈষম্যমূলক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বিপ্লব পরবর্তীতে এধরনের বৈষম্য হ্রাস পায়। যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে প্রভাবিত করে।
  • ১১. শিল্প বিপ্লব : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শিল্প বিপ্লব ইউরোপের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজনের ভিত্তি রচনা করেছিল। আর এক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব সংগঠনের ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের অবদান অনস্বীকার্য।
  • ১২. উদারতাবাদ: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উদারতাবাদ। আর উদারতাবাদ এমন এক ধরনের মতবাদ যেখানে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও কল্যাণকে মহামূল্যবান মনে করা হয়। আর এই উদারতাবাদের উৎপত্তি ঘটেছে মূলত ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যম। কেননা, ফরাসি বিপ্লবের মূল দর্শন সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা যারা আলোড়িত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জার্মানিতে সনাতন সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরম্ভ হয়।
  • ১৩. ব্যক্তিস্বাস্থ্যবান: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। “জনগণই রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার উৎস”- ব্যক্তি সম্পর্কে এই ধারণা আধুনিক সভ্যতার দর্শন তত্ত্বেরও ভিত্তি স্থাপন করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্যবাদ সরকারি অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এক দার্শনিক প্রতিবাদ। আর এক্ষেত্রে বলা যায় যে, মন্টেস্কু ও ভলতেয়ারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার দ্বারা যে ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হয় তা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে বিকশিত করেছে।
  • ১৪. নিয়মতান্ত্রিক সরকার : ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বক্ষমতার অধিকারী রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো দার্শনিক শাসকের হাতেই সার্বভৌম ক্ষমতাকে ন্যস্ত করে ব্যক্তির সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও কেউ কেউ বলেছেন সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস জনগণ। অর্থাৎ এ নীতির দ্বারা তারা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের ধারণা সমর্থন করেন।
  • ১৫. সংস্কার আন্দোলন : ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কেননা, বিপ্লবকালীন সময়ে রাজতন্ত্রের অবসানের পাশাপাশি এধরনের সংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম যাজকদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করা। আবার রেনেসাঁর সময়ও Reformation বা সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়। মার্টিন লুথার কিং ক্যালভিন প্রমুখ সংস্কারবাদী চিন্তাবিদ রাষ্ট্র ও গির্জার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। ফলে মধ্যযুগীয় গির্জার একছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে লোকায়তবাদী চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটে। ইউরোপে এই আন্দোলন বিরাটরূপ ধারণ করে এবং পুরাতন চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাস মুছে ফেলে নতুন চিন্তাচেতনায় আত্মনিয়োগ করে।
  • ১৬. উপযোগবাদ : আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে উপযোগবাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপযোগবাদ হলো মানব আচরণের প্রকৃতি এবং অভিপ্রায়ের মতবাদ, যার মাধ্যমে লাভ ও ক্ষতির মাপকাঠি নির্ণয় করা যায়। সরকার কতটুকু মানবকল্যাণে ইচ্ছুক এ নীতির মাধ্যমে তা বোঝা যায়। উপযোগবাদী নীতি প্রবর্তনে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব রয়েছে।
  • ১৭. আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ফরাসি বিপ্লবের অন্যান্য প্রভাব: ক. যুক্তিময়তা, খ. সম্রাজ্যবাদ, গ. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ প্রভৃতি।

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ কখনো থেমে থাকে না। সময় ও পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ধারাও এগিয়ে যাবে এবং এভাবেই রাষ্ট্রচিন্তা নতুন রূপ পরিগ্রহ করবে। যে কারণে বলা যায় আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ একদিনে হয়নি। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা রেনেসাঁ যুগের অনেক পূর্বেই অন্তর্নিহিত ছিল। পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন, জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা এবং ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাকে বিকশিত করে।

জাতীয়তাবাদ (Nationalism)

জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ। আধুনিককালের রাজনীতির প্রধা চালিকা শক্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলো জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার ফসল। মূলত জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর উদ্ভবের সাথে সাথে এ আদর্শ মানব ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছে। জাতীয়তাবাদ একদিকে বহু নির্যাতিত জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছে; অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের সংহার মূর্তি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বহু-যুদ্ধ বিগ্রহ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পিছনে উগ্র জাতীয়তাবাদকে দায়ী করা হয়। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জাতীয়তাবাদ প্রবল বিতর্কের সূচনা করেছে।

জাতীয়তাবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা

বিশেষ্য পদ “জাতি” (Nation) থেকে এর বিশেষণ পদ “জাতীয়তা” (Nationality)-এর উৎপত্তি এবং এ থেকে রাষ্ট্রদর্শনে যে মতবাদের জন্ম হয়েছে তাকে জাতীয়তাবাদ (Nationality) নামে অভিহিত করা হয়। সুতরাং জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ বা মতাদর্শের নাম।

জাতীয়তাবাদ মূলত একটি আত্মিক ধারণা, একটি মানসিক অনুভূতি। ঐ আত্মিক ধারণা এবং মানসিক অনুভূতির মাধ্যমে কোনো জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস, অতীতের স্মৃতি, উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারণা আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয়তাবান হলো জনসমাজের মধ্যে এক গভীর ঐক্য সাধনকারী ধারণা। এ ধারণা এক মানবগোষ্ঠী থেকে অন্য মানব গোষ্ঠীকে স্বতন্ত্র বলে বিবেচনা করে। সুতরাং জাতীয়তাবোধের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য বর্তমান। যথা : ১. নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ এবং ২. পৃথিবীর অন্যান্য জনসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ। সুতরাং কোনো জাতি যখন স্বজাত্যবোধ এবং স্বকীয়তার ফলে নিজেদের অন্য জাতি থেকে পৃথক বলে মনে করে এবং স্বকীয়তাকে কেন্দ্র করে একটা আবেগ, অনুভূতি ও আত্মিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করে, সেই মানসিক অবস্থা এবং চেতনাকেই জাতীয়তাবাদ বলে।

  • ১. অধ্যাপক হ্যান্স কোহন (Hons Kohn) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ প্রথমত এবং চূড়ান্তভাবে একটি মানসিক অবস্থা এবং একটি চেতনা বিশেষ।” (Nationalism is first and foremost a state of mind and an act of conciousness.)
  • ২. বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস (Hayes)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তা এবং স্বদেশপ্রেম নামক দুটি প্রাচীন উপাদানের আধুনিক আবেগমতি ও সমন্বয় এবং অতিরঞ্জন।” (Nationalism consists of a modern fusion of emotional and exaggeration of two very old phenomena.)
  • ৩. আরনল্ড জে. টয়েনবী (Amold J. Toynbee) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ কোনোরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক অনুভূতি নয় বরং এক প্রকার আত্মিক মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি।” (Nationalism is nothing material or mechnical, but a subjective, psychological feeling in a living people.)
  • ৪. অধ্যাপক পাডেলফোর্ড ও লিংকন (Prof. Padelford and Lincoln) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ দুটি উপাদানের সংমিশ্রণ বিশেষ। এর একটি উপাদান হচ্ছে জাতীয়তার ধারণা সম্পর্কিত কোনো আদর্শবাদ এবং অপরটি হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের ভেতর ঐ আদর্শবাদকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপদান।” (Nationalism is an amalgam of two elements, an idealogy embroidered about the idea of nationality and the political institutionalization of that ideology into national states.)
  • ৫. অধ্যাপক স্নাইডার (L. Snyder) বলেন, “জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিগত উপাদানের ফল। এটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের একটি মানসিকতা, অনুভূতি ও আবেগ।” (Nationalism is a product of political, economic, social and intellectual factors at a certain stage in history, is a condition of mind, feeling or sentiment of a group of people living in a well defined geographical area.)
  • ৬. বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো একটি সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি (a sentiment of similarity and solidarity.) যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়।”
  • ৭. অধ্যাপক লয়েড (Prof. Lioyd) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদকে একটি ধর্ম বলে অভিহিত করা যায়, কারণ এর উৎস মানুষের গূঢ়তম প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত আছে।” (Nationalism may called a religion because it is rooted in the deepest instincts of man.)
  • ৮.অ্যালফ্রেড ডি মেজিয়া (Alfred D. Gragia)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিদেশিদের প্রতি সন্দেহপরায়ণতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা একই ধরনের মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত হয় এবং বিদেশিদের সন্দেহ করার প্রবণতা উৎসারিত হয় এই ধারণা থেকে যে তারা একই মূল্যবোধের ধারক ও বাহক নয়।” (Nationalism combines love of country and suspiciousness of foreigners. Love of country comes from shared values and suspiciousness of foreigners comes from the belief that foreigners do not share such values in the same strength.)
  • ৯. অধ্যাপক লিপসন (Leslie Lipson) বলেছেন, “রাষ্ট্র পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ও সমৃদ্ধি সাধন করতে সক্ষম হলে নাগরিকদের কাছ থেকে একটি আনুগত্যবোধ দাবি করতে পারে। এই আনুগত্যবোধ সকল শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপ্ত হলে এবং বিভিন্ন ব্যাপারে বহিঃপ্রকাশ ঘটলে তাকে জাতীয়তাবোধ নামে আখ্যা দেয়া যায়। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের আবেগ ও অনুভূতি, মনোভাব, আশা, সহানুভূতি, ঘৃণা এবং আত্মিক বন্ধনের মানসিকতা প্রকাশ পায়। “
  • ১০. অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাস্কি (Harold J. Laski) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ মূলত প্রত্যেক জাতীয় গোষ্ঠীর নিজ বাসভূমি নিজেদের সাদৃশ্য, অন্যের সাথে নিজেদের বৈসাদৃশ্য,বংশগত বন্ধন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।”

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ হলো একটি মানসিক চেতনা যা অনুভূতি যা কোনো জনগোষ্ঠীকে নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, জীবনযাত্রা ও গৌরব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং নিজেদের অন্যান মানবগোষ্ঠী থেকে পৃথক ভাবতে শেখায় ।

জাতীয়তাবাদের উপাদান বা জাতি গঠনের উপাদান

যে সব উপাদান সম্মিলিতভাবে কোনো জনসমষ্টিকে জাতীয়তায় রূপান্তরিত করে, সেগুলোকে জাতীয়তার উপাদান বলে। অধ্যাপক লাস্কি (Laski)-এর মতে, “জাতীয়তার ধারণা সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ কোনো বিশেষ উপাদানের মধ্যে তার উৎস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।” (The idea of nationality is not easy to define, for there is no measurable factor to which it can be traced.)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ জাতীয়তার উপাদানসমূহকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা : ক. মাহ্যিক উপাদান ও ভাবগত বা মানসিক উপাদান। বংশ, ভাষা, ভৌগোলিক, ইতিহাস, ধর্ম প্রভৃতি উপাদান বাহ্যিক দিক থেকে জাতীয়তা গঠনে সহায়তা করে। আর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক সমস্বার্থ, অতীত এবং বর্তমানের ঐতিহ্য সম্পর্কে সমচিন্তা, অতীতের গৌরব, বীরত্ব, সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে অভিন্ন অনুভূতি নিয়ে জাতীয়তার মানসিক বা ভাবগত উপাদান গঠিত হয়।

  • ১. বংশগত বা কুলগত ঐক্য (Racial Unity) : যখন কোনো জনসমষ্টি মনে করে যে, তাদের দেহের শিরা ও ধমনীতে একই রক্তধারা প্রবাহিত এবং তারা একই পূর্বপুরুষের বংশধর তখন তাদের মধ্যে একাত্মবোধের ধারণা জন্মে। তারা অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক মনে করে, এভাবে বংশগত ঐক্য জাতীয়তা সৃষ্টি করে। অধ্যাপক বার্জেস ও পীকক বংশগত বা কুলগত ঐক্যকে জাতীয়তার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য করেছেন। অধ্যাপক জিম্মার্ন (Zimmern) – অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, “Every nationality enjoys the feeling of group institution which is primarily determined by racial unity and the purity of blood.” তবে বংশগত ঐক্যকে জাতীয়তা গঠনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা যায় না। যেমন- ইংরেজ, জার্মান ও ডাচদের মধ্যে বংশগত ঐক্য থাকলেও তারা আলাদা জাতীয়তায় পরিণত হয়েছে। আবার আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, কানাডা, ভারত প্রভৃতি দেশের জনসমষ্টির মধ্যে বংশগত ঐক্য না থাকা সত্ত্বেও তারা এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchirst) তাই বলেছেন, “A nationality can not be regarded as a pure family descent.”
  • ২. ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য (Community of language, literature and culture) : ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন বা মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করে এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। ভাষার মাধ্যমে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশিত হয়। একই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জনসমাজের মধ্যে একাত্মবোধ সৃষ্টি করে। যেমন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে সহায়তা করেছিল। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir)- এর মতে, “জাতীয়তা সংগঠনের ক্ষেত্রে ভাষাগত ঐক্য বংশগত ঐক্য অপেক্ষা অধিক সহায়ক।” তাঁর ভাষায়, “There is nothing that will give unity to divergent races as the use of common tongue and in very many causes unity of language and community of ideas which it brings have proved the nation building force in a nation.” ভাষা কোনো জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতি গঠনে সহায়তা করে। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেন, “Community of language is the most important factor in moulding a people into a nationality. তবে সাংস্কৃতিক ঐক্যও কোনো জনগোষ্ঠীকে অন্যান্য মানবগোষ্ঠী থেকে পৃথক করে।তবে ভাষাগত ঐক্য জাতীয়তার একমাত্র উপাদান নয়। সুইজারল্যান্ডে তিনটি ভাষাভাষীর মানুষ বাস করা সত্ত্বেও তারা এক জাতি। বহু ভাষা-ভাষী ভারতবাসীরা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। আবার ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার জনগণ ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও তারা ভিন্ন জাতি।
  • ৩. আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য (Community of behaviour, manners and customs) : জাতীয়তার একটি অপরিহার্য উপাদান হলো-আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য। একটি জনসমষ্টির মধ্যে একই ধরনের আচরণ ও রীতি-নীতি গড়ে উঠলে তারা নিজেদেরকে অন্য জনসমষ্টি থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। ফলে আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য জনসমষ্টিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে। বাংলাদেশের জনসমষ্টি তাদের আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্যের কারণে যুক্ত পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য না থাকায় উত্তর আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সুতরাং আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। আচরণ ও রীতি-নীতিগত মিল না থাকলে জাতীয়তা গড়ে ওঠে না।
  • ৪. ধর্মগত ঐক্য (Religious Unity) : ধর্মগত ঐক্য জাতীয়তা গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। সম-ধর্মমতাবলম্বী জনসমষ্টির মধ্যে খুব সহজে ঐক্যের মানসিকতা গড়ে ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে অনেক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। আধুনিক কালেও ধর্মের গুরুত্ব একেবারে হ্রাস পায়নি। ধর্মের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেন, “Community of religion was once regarded as a mark of nationality and in earlier times it played an important part in the process of national consolidation.”তবে জাতীয়তাবাদ গঠনে ধর্মগত ঐক্য অত্যাবশ্যক উপাদান নয়। যেমন- ধর্মগত ঐক্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবার মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর জনসমষ্টি একই ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তারা আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু আধুনিককালে জাতি গঠনে ধর্মের ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে।
  • ৫. ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical Unity) : একই ভূখণ্ডে বহুদিন ধরে যদি কোনো জনসমষ্টি বাস করতে থাকে, তবে তাদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। একই ভৌগোলিক সীমায় বসবাসের দরুন আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসমষ্টির মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে পরস্পর একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “একটি স্বতন্ত্র জাতি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করে। দীর্ঘদিন যাবৎ একটি ভূখণ্ডে বাস করার ফলে একটি জনসমাজ তাদের মতপার্থক্য দূর করে এক এবং অভিন্ন ভাবধারায় গড়ে ওঠে। তাঁর ভাষায়, “Undoubtedly the most clearly marked nations have enjoyed a geographical unity and have owned their nationhood is part to this facts.” ভৌগোলিক দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা জাতি গঠনে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। যেমন ভৌগোলিক অবাস্তবতার কারণে ১৯৭১ সালে যুক্ত পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু জাতীয়তা গঠনে ভৌগোলিক ঐক্য অপরিহার্য উপাদান নয়। যেমন- ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করত। কিন্তু তারা নিজেদের একই জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করত।
  • ৬. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য (Common history and heritage): কোনো ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী যদি মনে করে যে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অভিন্ন এবং তারা সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, গৌরব-গ্লানির সমান অংশীদার তখন সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তা জাগ্রত হয়। প্রত্যেক জাতি তাঁর অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখে। এভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভিন্নতা জাতীয়তা গঠনে সাহায্য করে। জন স্টুয়ার্ট মিল ও রামজে ম্যুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্যকে জাতীয়তার আবশ্যক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “Heroic achievements, agonies, heorically endured, these are the sublime food by which the spirit of nationhood is nourished.” ইতিহাসের উপকথা, ঘটনাপঞ্জি, বীরত্বগাঁথা মানুষকে প্রেরণা দেয় এবং তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে। কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য জাতীয়তা গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। যেমন— ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে বাঙালি জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে নিজেদের পৃথক বলে মনে করে এবং এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
  • ৭. রাজনৈতিক ঐক্য (Political unity): কোনো জনসমষ্টি দীর্ঘদিন ধরে একই সরকারের অধীনে থাকলে এবং অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হলে তাদের মধ্যে একাত্মবোধ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে বংশ, ভাষা, ধর্মগত পার্থক্য কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। রাজনৈতিক ঐক্য একই বংশ, ভাষা ও ধর্মগত উপাদানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক জাতি রাজনৈতিক উপাদানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তবে জনসমষ্টির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারে না। আর জাতীয়তা রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে জাতিতে পরিণত হয়। জার্মানরা ঊনবিংশ শতাব্দিতে অস্ট্রিয়ার অধীনে বসবাস করে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জার্মান রাষ্ট্র গঠন করে। দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটিশ সরকারের শাসনাধীনে থাকায় ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের জনসমষ্টি একই জাতীয়তায় পরিণত হয়েছে। ডুর্খেইম (Durkheim) বলেছেন, “A nationality is a group of which the members.- wish to live under the same laws and form of a state.” সুতরাং রাজনৈতিক ঐক্য জাতীয়তা গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অধ্যাপক অরণ্যানস্কি (Organski) তাই বলেন, “It is hard to over estimate the importance of political ties in binding a group of individuals into a nation.” তবে রাজনৈতিক ঐক্যও জাতীয়তা গঠনের অত্যাবশ্যক উপাদান নয়। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে ইহুদিরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের অধীনে বসবাস করত। রাজনৈতিক ঐক্য তাদের মধ্যে ছিল না। তথাপি তারা নিজেদের পৃথক জাতি বলে গণ্য করত।
  • ৮. অর্থনৈতিক ঐক্য (Economic Unity): কোনো জনসমষ্টির মধ্যে একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন জাতীয়তা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কোনো জনসমষ্টি সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে একই ধরনের অর্থনৈতিক বন্ধন থাকায় তারা এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা পাকিস্তানের কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। তার পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
  • ৯. একই স্বার্থ (Common interests): জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে একই স্বার্থ। একই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কৃষ্টিগত স্বার্থ কোনো অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার প্রেরণা যোগায়। জনগণের স্বার্থ অভিন্ন হলে তারা একত্রে কাজ করতে উৎসাহ ও আনন্দ পায়। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchirst) বলেন, “Common interests are rather aids towards strengtheing union than fundamental agents of union.” একই সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ইংলিশ ও স্কচদের একতাবদ্ধ করেছিল। তবে একই স্বার্থও জাতীয়তা গঠনের অপরিহার্য উপাদান নয়। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু মুসলিমদের অভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও ১৯৪৭ সালে ভারত দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
  • ১০. ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য (Spiritual Unity) : জাতীয়তা গঠনের ক্ষেত্রে ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য মুখ ও প্রধান ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেছেন, “আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যের ভিত্তি বাহ্যিক নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক। ” (The basis of unit in modern state is psychological rather than physical). ফরাসি অধ্যাপক রেনান (Renan) যথার্থই বলেছেন, “জাতীয়তা সম্পর্কে ধারণা মূলত ভাবগত। “(The idea of nationality is essentially spiritual in character) জাতীয়তার বাহ্যিক উপাদানের সব কয়টি ছাড়াও কোনো জনসমষ্টির মধ্যে জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারে যদি তারা নিজেদের এক মনে করে এবং অন্য জন ও অভিন্ন সমষ্টি থেকে পৃথক ভাবতে শেখে। তাই জিম্মার্ন (Zimmern) বলেন, “যদি কোনো জনসমষ্টি নিজেদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে সেটাই জাতীয়তা।” (If a people feels itself to be a nationality, it is a nationality.)

জাতীয়তা মূলত একটি মানসিক অবস্থা। জিম্মার্ন (Zimmern)-এর মতে, অনুভূতি, চিন্তা এবং জীবনধারণের পদ্ধতি নিয়ে ঐ মানসিক অবস্থা তৈরি হয়। অধ্যাপক গেটেল ( Gettell) বলেছেন, “জাতীয়তা আসলে একটি ভাবগত ব্যাপার। একটি মানসিক অবস্থা, জীবন-যাপন চিন্তা এবং অনুভূতির একটি পদ্ধতি।” (Nationality, therefore, is largely a matter of sentiment, it is a state of mind, a way of living, thinking and feeling.)

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তা গঠনে সকল উপাদান সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে জাতীয়তার কোনো না কোনো উপাদান মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক। পরবর্তীকালে তার সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাবি যুক্ত হয়। সুতরাং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা গড়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

জাতীয়তাবাদ কি আধুনিক সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ?

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ জাতীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিটি জাতির স্বকীয় সত্তা এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশে অকুণ্ঠ অনুপ্রেরণার সঞ্চার ঘটিয়ে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অপরদিকে, অন্ধ স্বদেশপ্রেম, জাতিগত সংকীর্ণতা, অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ, জাত্যাভিমান, জাতিগত প্রাধান্য বিস্তারের লোলুপতা, জাতির শৌর্য-বীর্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য রাষ্ট্র দখল প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ বারবার সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখেও ফেলেছে। জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একদিকে যেমন প্রত্যেক জাতি পরাধীনতা এবং শোষণের শৃঙ্খল ভেদ করে স্বাধীন হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রকট জাতি বিদ্বেষের মাধ্যমে, সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ সিদ্ধির সাহায্যে মানবজাতির বিকাশের ধারাকে ব্যাহত করেছে। এসব কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচিত জাতীয়তাবাদে আমরা দুটি রূপ দেখতে পাই। একটি হলো জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ যার ফলে একটি জাতি মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সত্তাকে উপভোগ করার সুযোগ পায়। আরেকটি হলো জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ যার দংশনে একটি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ধারণ করে। আর তখনই জাতীয়তাবাদ সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলা হয়ে থাকে “Nationalism is a menance to civilization.” অর্থাৎ “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পথে একটি হুমকি। অধ্যাপক লাস্কির (Laski) মতে, “When nationalism demands political autonomy. that is, sovereign state, the needs of civilization begin to emerge.” প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পথে হুমকি কি-না সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ : জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ সভ্যতার প্রতি হুমকি নয় বরং আশীর্বাদ। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের সুসভ্য জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :

  • ১. জাতির সার্বিক বিকাশের সহায়ক : জীবনে জাতীয়তাবাদ একটি সুমহান আদর্শ। এটি জাতিকে ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে এবং দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। এই আদর্শ দেশ ও জাতির স্বার্থে জনগণকে আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে জাতির সার্বিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
  • ২. ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে: জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা এবং একটি আত্মিক অনুভূতি। জাতীয়তাবাদের চেতনা জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে। এই আদর্শ জাতিকে আত্মপ্রীতি এবং আত্মপ্রত্যয়ের শিক্ষা দেয়। এটি একটি জনসমাজকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যোগায়।
  • ৩. মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে : জাতীয়তাবাদের জনক ইতালির দার্শনিক ম্যাৎসিনি (Mazzini)-এর মতে, বিভিন্ন গুণ ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে। বিশ্বের প্রত্যেক জাতির কোনো না কোনো নিজস্ব কিছু গুণ থাকে। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এসব গুণের বিকাশ ঘটে। এভাবে প্রত্যেক জাতির গুণাবলির বিকাশের মাধ্যমে মানবসভ্যতা সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়। ম্যাৎসিনি সম্পর্কে লয়েড (Lioyd) বলেছেন, “He thought each nation possessed certain talents, which taken together formed the wealth of the human race.”
  • ৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপক : পরাধীন জাতির কাছে জাতীয়তাবাদ আশীর্বাদস্বরূপ, জাতীয়তাবাদের সুমহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন ও দুর্বল জাতি মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা যায়। জাতীয়তাবাদ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার জাতিসমূহকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করেছে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদ এবং প্যান-আফ্রিকানিজম সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামে ইন্ধন যুগিয়েছে।
  • ৫. পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয় : জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ও সংঘর্ষের আশংকা দূর করে এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ কোনো জাতির বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব রক্ষার পরিবর্তে অন্যান্য জাতির সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে প্রত্যেকের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। জাতীয়তাবাদের মূল কথাই হলো, “নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও।” (Live and let others live)
  • ৬. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক : জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক চেতনা ও অধিকারের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজ ইচ্ছানুযায়ী আত্মবিকাশের অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জনগণ সম অংশীদারিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
  • ৭. দেশপ্রেম জাগ্রত করে : জাতীয়তাবাদের আদর্শ জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে। এটা বীরত্ব ও আত্মত্যাগ সৃষ্টি করে। প্রকৃত জাতীয়তাবান মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা দূর করে জাতীয় স্বার্থে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায়। এটি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশ মাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহী করে ।
  • ৮. অভ্যন্তরীণ স্থায়িত্বের সহায়ক : জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব ও শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে জনগণ অতি সহজেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি দূরীভূত হয়। ফলে রাষ্ট্রকে তারা নিজের বলে ভাবতে শেখে ।
  • ৯. বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় : জাতীয়তাবাদ অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের সাথে সাথে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জনগণকে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয়তাবাদ উদারতাবাদ ও মানবতাবাদী দর্শন বিকাশে সহায়তা করে। বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত করে। শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলতে জাতীয়তাবাদী আদর্শের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
  • ১০. শাসক ও শাসিতের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক : প্রকৃত জাতীয়তাবান রাষ্ট্রের মধ্যে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক করে। এটি শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। অধ্যাপক বার্জেস (Burgess)-এর মতে, জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বকে দৃঢ় করে এবং সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে সংহতি স্থাপন করে।
  • ১১. সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাস রোধ : জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদকে প্রতিহত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ সকল দেশ সাম্রাজ্যবাদের শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
  • ১২. আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক : জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের সহায়ক ও পরিপূরক। এটি জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি সমুন্নত রেখে বিশ্ব সভ্যতার প্রসারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রথম সোপান। এ প্রসঙ্গে জিম্মার্ন (Zimmern) বলেছেন, “Nationalism is a high way to internationalism.”

জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ : জাতীয়তাবাদ একটি সুমহান রাজনৈতিক আদর্শ সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এর বিকৃত রূপ মানবসভ্যতার জন্য খুবই ভয়ংকর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “Nationalism” গ্রন্থে জাতীয়তাবাদকে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, “Nationalism is a menance to civilization” নিম্নে জাতীয়তাবাদের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাসমূহ আলোচনা করা হলো :

  • ১. সভ্যতার সংকট : স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি গভীর অনুরাগের ফলে জাতীয়তাবাদ জাত্যাভিমানে পরিণত হয়। তারা নিজেদের সকল কিছুকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং অন্য জাতির সকল কিছুকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এক সময় গ্রিকগণ মনে করত তারাই পৃথিবীতে সভ্য জাতি। অপর জাতিগুলো হলো দাস। জার্মানরা নিজেদেরকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত। সুতরাং অন্যান্য জাতির উপর প্রভুত্ব করার অধিকার তাদের আছে। এভাবে জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়। ফলে জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ বাধে এবং দেখা দেয় সভ্যতার সংকট। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতে, “এই সংকট দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন হলো জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত সমগ্র ধারণাকে পরিহার করা।”
  • ২. সাম্রাজ্যবাদের আশংকা : উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসারের ফলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের পথে অগ্রসর হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের তাড়নায় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল জাতিগুলোকে পদানত করতে প্রয়াসী হয়। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে। কালক্রমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়। অধ্যাপক লাস্কির (Laski) মতে, “ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়” (As power extends, nationalism becomes transformed into imperialism)। পুঁজিবাদের প্রসারের সাথে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। এভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দুর্বল ও অনুন্নত জাতিগুলো শোষণের শিকারে পরিণত হয়। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ লেনিন (Lenin) তাঁর “সাম্রাজ্যবাদ” গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে দেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকরূপে ব্যবহার করে।
  • ৩. জাতি বিদ্বেষের সৃষ্টি : বিকৃত জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধনকে ছিন্ন করে জাতি বিদ্বেষের সৃষ্টি করে। অন্ধ স্বদেশপ্রেম অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসার ইন্ধন যুগিয়েছে। বিকৃত জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নিজ জাতি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এবং অন্য জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব বারবার আত্মপ্রকাশ করেছে। ফিকটে প্রচার করেছিলেন জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা। তিনি প্রচার করেন যে, জার্মান জাতিই মানব জাতির পথ প্রদর্শক ও আদর্শ। ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর “শ্বেতাঙ্গের বোঝা” (Whitemen’s burden) কিংবা “নরডিক বংশের শ্রেষ্ঠত্ব” (Superiority of the Nordic Race)-এর কথা প্রচার করে হিটলার তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করেছিলেন’।
  • ৪. যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে : উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে । চরম জাতীয়তাবাদের পরিণতি হলো যুদ্ধ। যেমন- জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে বিশ্বযুদ্ধ বাধে। তাই জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ কোনো অর্থে জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। এডলফ হিটলার বলতেন, “যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই শাশ্বত” (War is life, war is eternal)। ইতালির একনায়ক মুসোলিনী বলতেন, “নারী জাতির নিকট মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক, পুরুষের নিকট যুদ্ধও তেমনি স্বাভাবিক।” আধুনিক যুগে যুদ্ধের অর্থই সামগ্রিক ধ্বংসকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bartrand Russell)-এর বক্তব্য হলো, “হয় মানুষ যুদ্ধকে ধ্বংস করবে, নয়তো যুদ্ধই মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে” (Either man will abolish war, or war will abolish man)। অধ্যাপক হায়েস (Hayes) বলেছেন, “আধুনিক জাতীয়তাবাদ একটি অভিনব ধর্মে পরিণত হয়েছে। ব্যাপকভাবে মধ্যযুগের চারশ বছরের ক্রুসেড থেকে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বর্তমান প্রথমার্ধের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে” (Modern nationalism has indeed been a peculiar bloody religon. Vastly more persons have been slained in the nationalist wars of the first half of the present century than in the four centuries of medicaval crusading)
  • ৫. অন্যায়-অবিচারের উৎস : বিকৃত জাতীয়তাবাদকে অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। অধ্যাপক হায়েস (Hayes) মন্তব্য করেছেন যে, আমাদের যুগে জাতীয়তাবোধ, জাতীয় রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের সংমিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা চরম, অন্যায় ও অমঙ্গলের প্রধান উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাতীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধভাবে কাজ করে চলে। “অসভ্য বর্বর” ভারতীয়দের শিক্ষিত ও সুসভ্য করার মহান দায়িত্বের কথা ইংরেজরা প্রচার করেছে। অন্যায় ও অমঙ্গল প্রতিষ্ঠাকারী ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে বঙ্কিমচন্দ্র “ঘোরতর পৈশাচিক পাপ” বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন।
  • ৬. অগণতান্ত্রিক : জাতীয়তাবাদের উগ্র হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও মানবিক চেতনার পরিপন্থী। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো “সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা” গণতন্ত্রের এই সুমহান নীতিগুলোকে ধ্বংস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ” (Nationalism is a menance to Civilization)। অধ্যাপক ইবেনস্টাইন (Ebenstain)-এর মতে, “ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে জাতীয়তাবাস, অভ্যন্তরীণ, সাম্রাজ্যবাদী ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
  • ৭. বিশ্ব শান্তির বিরোধী : উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে ক্ষতিকর। স্বদেশ প্রীতি খারাপ কিছু নয়। কিন্তু অপর দেশকে ঘৃণা করা বা অপর দেশের স্বার্থ নষ্ট করার কাজ জাতীয়তাবাদ হতে পারে না। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তির পরিপন্থী। ফরাসি ও জার্মানিদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণাবোধ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ। উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা মুসোলিনী বলেছেন, “আন্তর্জাতিক শান্তি কাপুরুষের স্বপ্ন” (International peace is a cowards dream)।
  • ৮. সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে : বিকৃত জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতির মধ্যে সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্যান্য জাতির জ্ঞান- বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার মানসিকতা বিনষ্ট করে দেয়। একটি জাতির নিজস্ব যা কিছু আছে তার বাইরে তারা কিছুই শিখতে বা জানতে পারে না।
  • ৯. অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে : জাতীয়তাবাদ বিশ্ব জুড়ে অনৈক্য ও বিভেদের সৃষ্টি করে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের এবং জাতিতে জাতিতে বিষেষ ও কলহের জন্য দেয়। জাতীয়তাবাদী চেতনা বড় বড় রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি করে। যেসব রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে। ভারত, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ অনেক দেশে এ ধরনের সমস্যা বিদ্যমান।
  • ১০. অনৈতিহাসিক : অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। জোসেফ বলেছেন, “It is dangerous in principle and constituted chief obstacle to world progress. ” গর্ড অ্যাকটন বলেছেন, “এটা জাতির অধিকার ও ইচ্ছাকে পদদলিত করে।” (It over-rules the rights and wishes of the inhabitants.) সুতরাং জাতীয়তাবাদ জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করে তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
  • ১১. সুস্থ মানবিক সংস্কৃতি বিকাশের বিরোধী : উগ্র জাতীয়তাবাদ সমর্থ মানব জাতির মানবিক গুণাবলি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের সৃজনশীল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এরূপ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠী নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজেদের দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায়। অপরদিকে অন্য জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অসত্য ও বিকৃত ধারণা গড়ে তোলে। এভাবে সুস্থ ও সাবলীল সংস্কৃতির বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ফলে মানবসভ্যতা সংকটের আবর্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে ।
  • ১২. মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা : উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একদিকে ক্ষুধার তাড়নায় জর্জরিত, অন্যদিকে চলছে মারণাস্ত্রের তীব্র প্রতিযোগিতা। এভাবে মানবিক মূল্যবোধ ও মানতা পদদলিত হয়।
  • ১৩. অর্থনৈতিক শোষণ : জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ অর্থনৈতিক শোষণের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। বর্তমানে বিত্তশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর শাসক শ্রেণি বিভিন্ন দুর্বল ও অনগ্রসর জাতিকে অর্থ সাহায্যের নামে তাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষণ করতে থাকে। এসব রাষ্ট্র বৃহৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর উপর অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এরপ অর্থনৈতিক শোষণকে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (Economic Imperialism) বলে। অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল জাতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে।
  • ১৪. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব : জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করলে প্রতিটি বড় রাষ্ট্রই শতধাবিভক্ত রাষ্ট্র হতে বাধ্য। যেমন- ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডেই আরও ক্ষুদ্রাকৃতির তিনটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। যুক্তরাজ্য চার ভাগে বিভক্ত হবে। তাহলে বিশ্ব জুড়ে জটিল রাজনৈতিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়ে মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ যদি সত্যিকার দেশপ্রেম থেকে আসে, তবে তা মানব সভ্যতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় না। জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতা ও বিশ্ব শান্তির সহায়ক। অধ্যাপক হায়েস (Hayes) বলেন, “জাতীয়তাবাস যদি দেশপ্রেমের সাথে সম্পৃক্ত হয় তা হলে তা মানব জাতি ও বিশ্বের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে” (Nationalism when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessing to humanity to the world)।

আন্তর্জাতিকতাবাদ (Internationalism)

বিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীতে দুটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এ দুটি বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ হতাহত হয়েছে। বহু শহর, নগর, গ্রাম ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে। জাতীয়তাবাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতি লক্ষ করে অনেক মনীষী রাজনীতিবিদসহ বিশ্ববাসী আতঙ্কিত হয়েছেন। নিজেদেরকে সমগ্র মানবজাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে অনেক স্মরণীয় কবি-শিল্পী-নেতা সমগ্র মানুষের মহাসভা এবং বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে প্রত্যেক জাতি সংকীর্ণতা এবং হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে নিজেকে সমগ্র মানবজাতির অংশ হিসেবে গণ্য করবে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ এই মহান আদর্শকে বারবার পদদলিত করেছে। তাই পৃথিবীর সভ্য মানুষ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, মানুষ উপলব্ধি করছে যে, আন্তর্জাতিকতা ছাড়া মানবসভ্যতাকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব।

আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে ধারণা নতুন কিছু নয়। প্রাচীন যুগেও এ সম্পর্কিত ধারণার পরিচয় পাওয়া গেছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মৃত্যুর পর নব-হেলেনীয় (Hellenistic) রাষ্ট্রচিন্তা বিকশিত হয়। এ ধরনের রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদের আভাস পাওয়া যায়। সমসাময়িক আরও কিছু মনীষীর লেখনীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদী চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটে।

এ সকল চিন্তাবিদের মধ্যে সিসেরো, জেনো, ক্রিসিপাস (Chrysippus) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এরা নগর- রাষ্ট্রের (City-State) স্থলে বিশ্ব নগরীর (City of the world) ধারণা প্রদান করেন। মধ্যযুগের মহাকবি দান্তে বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যের আদর্শের কথা বলেন। মধ্যযুগের শেষ দিকে রাষ্ট্র ও গির্জার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য পরিষদীয় আন্দোলনকারীগণ (Conciliarists) আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থার কথা বলেন।

আন্তর্জাতিকতার বক্তব্য : আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী ধ্বংস সাধনের ক্ষমতা আন্তর্জাতিকতার উদ্ভবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতির ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে। বর্তমানে কোনো জাতিই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিটি জাতি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকায় বিশ্ববাসী উচিৎ। মানব সভ্যতার এই চরম সঙ্কটে আন্তর্জাতিকতার বিকল্প হলো বিশ্বসভ্যতার ধ্বংস। অধ্যাপক হ্যারল্ড জে লাস্কি (Harold J. Laski) মন্তব্য করেছেন, বিশ্ব এখন এমনভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, কোনো রাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছা অন্যান্য রাষ্ট্রের শাস্তির পক্ষে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই বিশ্ব সমাজের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য করে তোলে।

আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের ন্যায় একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্য ব্যক্তির মনে নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকতার সাথে আন্তর্জাতিক নাগরিকতার ধারণা জনায়। আন্তর্জাতিকতায় উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিকে সংকীর্ণ জাতীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তিনি নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গণ্য করেন। সুতরাং আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো বিশ্বের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি ও মিলনের অনুভূতি। আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন একটি রাজনৈতিক দর্শন যা রাষ্ট্রের সংহতি, বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার এবং বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে।

  • ১. বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-এর মতে, “জাতির সীমানা এবং রাষ্ট্রের সীমানা প্রায় এক না হলে প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা গড়ে ওঠে না” (There can be no good international system until the boundaries of states coincide as nearly as possible with the boundaries of nations ) । তিনি আরও বলেছেন, “Internationalism is the completion of nationalism.”
  • ২. জিম্মার্ন (Zimmern) বলেছেন, “জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাই আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি (Nationalism is the highway to Internationalism)
  • ৩. অধ্যাপক গোল্ডস্মিথ (Goldsmith) বলেছেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন এক ধরনের অনুভূতি, যা ব্যক্তিকে কেবল তার নিজ রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবেই নয়, বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবেই ভাবতে শেখায়।” (Internationalism is the feeling that the individual is not only member of his state, but a citizen of the world.)
  • ৪. অধ্যাপক এল. এল. লরউইন (L. L. Lorwin)-এর মতে, “আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি আদর্শ, একটি নীতি, একটি পদ্ধতি। সকল ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সকল জাতির অভিন্ন স্বার্থ এবং এদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এতে বিভিন্ন জাতির মধ্যকার যুদ্ধ ও সংঘর্ষের বিরোধিতা করা হয় এবং তার পরিবর্তে তাদের মধ্যকার সদিচ্ছা ও সহযোগিতাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। “
  • ৫. পণ্ডিত ভিশু শর্মা (Pandit Vishu Sharma) বলেছেন, “আন্তর্জাতিকভাবান হলো এমন একটি মানসিক ধারণা যা সংকীর্ণমনা মানুষকে বৃহন্মনা করে এবং গোটা বিশ্বকে তাদের পরিবার হিসেবে ভাবতে শেখায়” (Internationalism is the concept of mind and it prevails among the narrow minded people, the broad minded people Considered the world as their family)”
  • ৬. অধ্যাপক হ্যান্স কোহন (Hans Kohn)-এর মতে, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বিশ্বের সকল জনগণ ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে ওঠে সকল জাতিকে একত্রিত করে। “
  • ৭. Dictionary of Social Science-এর ভাষায় “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো একটি মানসিক অনুভূতি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা যা মানব জাতির মধ্যে ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।”

সুতরাং বলা যায় যে, আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন এক ধরনের মানসিকতা ও চেতনা যা জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে ওঠে বিশ্বের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের বিশ্বজনীন কল্যাণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিকতা মানে জাতীয় রাষ্ট্রের বিলুপ্তি নয়। জাতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলোপ সম্ভব নয়। জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখেই আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

জাতীয়তাবাদ কি আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী? 

আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাজগতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো দুটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। জাতীয়তাবাদ হলো একটি মানসিক অনুভূতি, যা কোনো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং একত্রে বসবাস করার অনুপ্রেরণা যোগায়। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। আর আন্তর্জাতিকতাবাদও একটি মানসিক অনুভূতি যা মানুষকে নিশ ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ ও উদ্দীপ্ত করে। আন্তর্জাতিকতা মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ন্যায়বিচার এবং শান্তির আদর্শে বিশ্বাসী। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, জাতীয়তাবাদ সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরোধী। যে কারণে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। এ মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে ম্যাৎসিনি (Mazzini), জিম্মার্ন (Zimmer), হ্যারল্ড জে. লাস্কি (Harold J. Laski), গার্নার (Gamer) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আবার অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ পরস্পরের পরিপূরক। এরা একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। সুতরাং জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে এদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই রয়েছে। নিম্নের যুক্তিসমূহের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করা হলো :

ক. স্বপক্ষে যুক্তি : অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ পরস্পরের পরিপূরক। নিম্নে তাদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহ পেশ করা হলো :

  • ১. অসম্পূর্ণ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের সহায়ক : আদর্শ জাতীয়তাবাদের সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনো বিরোধ নেই। উগ্র জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী প্রকৃত জাতীয়তাবান নয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ বস্তুত একটি মহান আদর্শ। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা উদ্রেক করে। দেশের স্বার্থে দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে, আত্মত্যাগে অনুপ্রেরণা যোগায়। দেশের ও জাতির প্রতি ভালোবাসাই ক্রমান্বয়ে বিশ্ববাসীর প্রতি ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। যে ব্যক্তির স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি ভালোবাসা থাকে না, তার পক্ষে বিশ্ববাসীকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। দেশবাসীর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা মানুষের মনে বিশ্ববাসীর প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি করে। জিম্মার্ন (Zimmern) যথার্থ বলেছেন, The read to internationalism lies throughs nationalism.
  • ২. অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। উত্তরের লক্ষ্য হলো মানব জাতির মধ্যে ঐক্য, সংহতি, বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধন দৃঢ় করা। মাৎসিনি (Mazzini) বলেছেন, প্রত্যেক জাতির স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভার যথার্থ বিকাশ তার নিজস্ব পদ্ধতিতেই সম্ভব। এটিই জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য। বস্তুতপক্ষে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল বক্তব্য হলো, নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও” (Live and let others live)।
  • ৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি : বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। বর্তমান বিশ্বে কোনো জাতিই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধন গড়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জনসমষ্টির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে।
  • ৪. দ্বন্দ্ব সংঘাত অবসান : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে জাতীয়তাবাদ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে, জাতীয়তাবাদের বন্ধনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করতে পছন্দ করে। একাত্মতা ও সম্প্রীতির ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশংকা হ্রাস পায়। আদর্শ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ জাতিসমূহের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করে। ম্যাৎসিনি (Mazzini) বলেন, “আদর্শ জাতীয়তাবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত জাতিসমূহের মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা থাকে না।”
  • ৫. প্রকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদকে শক্তিশালী করে : প্রকৃত জাতীয়তাবাদ অন্য জাতিকে পদানত এবং শোষণ করার শিক্ষা দেয় না। সুস্থ জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক জাতির স্বাতন্ত্র্য এবং তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তি, মৈত্রী, সম্প্রীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি প্রচার করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ হিংসা-বিদ্বেষ দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর।
  • ৬. জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল : আদর্শ জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে। জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। এই চেতনা আন্তর্জাতিকতাবাদের মহতী চিন্তা-চেতনায় রূপান্তরিত হলে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়। সুতরাং যিনি দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভাবতে পারেন, তিনিই বিশ্ব মানবের কল্যাণের কথা ভাবতে পারেন। বস্তুত, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার সার্থক সমন্বয়ের উপর মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
  • ৭. স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার সুযোগ বিদ্যমান : আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হয় না। আন্তর্জাতিকতা সকল জাতির স্বকীয়তা বজায় রেখে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ যখন সঠিক পথে পরিচালিত হয় তখন একে অপরের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদকে বিসর্জন দেয়ার প্রয়োজন নেই।
  • ৮. আদর্শ জাতীয়তাবাদ একটি প্রগতিশীল শক্তি এবং আন্তর্জাতিকতার সহায়ক : আত্মপ্রীতি ও আত্মপ্রত্যয় হলো ব্যক্তি মানুষের দুটি বিশেষ গুণ। কিন্তু আত্মপ্রীতি মানেই কখনোই অন্যের প্রতি ঘৃণা বোঝায় না। তেমনি আত্মপ্রত্যয় মানেই কখনোই অন্যকে অবিশ্বাস করা বোঝায় না। আন্তর্জাতিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেক জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক পরিবেশে সকল জাতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদ হলো একটি প্রগতিশীল শক্তি। এই শক্তি সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতিকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
  • ৯. আন্তর্জাতিকতার প্রসারে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা : বর্তমানকালে জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে আন্তর্জাতিকতাবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ভাবধারার উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ (UNO) আন্তর্জাতিকতা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
  • ১০. সহযোগিতা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা : জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার মাধ্যমে জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়াসী। আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে। আর আন্তর্জাতিকতাবাদ সকল জাতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সুতরাং বলা যায় আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হয় না বরং সম্প্রসারণ ঘটে।

খ. বিপক্ষে যুক্তি : কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী। তারা তাদের বক্তব্যের সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তির অবতারণা করেন।

  • ১. বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট করে : জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট করে। জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার জন্য পৃথিবীতে যুদ্ধের আবহাওয়া ও মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদ জাতি বিদ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, বৈরিতা এবং পররাজ্য গ্রাসের বাসনা জাগ্রত করে। ফলে আন্তর্জাতিকতা প্রসারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।
  • ২. জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টি : উগ্রজাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বদলে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ নিজ জাতির প্রতি গর্ব, দাম্ভিকতা সৃষ্টি করে এবং অন্যান্য জাতির প্রতি ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষের মানসিকতা সৃষ্টি করে, যা সত্যিকার অর্থে আস্ত জাতিকতাবাদের পরিপন্থী ।
  • ৩. আগ্রাসী মনোভাব : উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি করে। উগ্র জাতীয়তাবাদের তাড়নায় সবল রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর উপর আক্রমণ চালাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না তারা বিভিন্ন দুর্বল জাতিকে শোষণ করে।
  • ৪. সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা : শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন অজুহাতে অনেক সময় অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। ক্রমে ক্রমে সে রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে। অধ্যাপক লাস্কির (Laski) মতে, “পৃথিবীতে যতদিন পরস্পর বিবদমান ও প্রতিযোগী জাতীয় রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। আবার জাতীয়তাবাদ যখন উগ্র ও বিকৃত রূপ ধারণ করে তখনই সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়।” লাস্কি (Laski) আরও বলেছেন, “ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়।” এটা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী।
  • ৫. গণতন্ত্রের পরিপন্থী : জাতীয়তাবাদের হিংস্র ও বীভৎস রূপ গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা গণতন্ত্রের এই সুমহান আদর্শকে ধ্বংস করতেও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রসমূহ একটুও সংকোচ করে না। সরকার বিরোধী সমালোচনাকে এসব জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রসমূহ কঠোর হাতে দমন করে, নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিবাদি ইতালি হলো গণতন্ত্রের পরিপন্থী জাতীয়তাবাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
  • ৬.  মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা : উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবাদ তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে সময় বিশ্বব্যাপী মারণাস্ত্রের অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করে। ফলে বিশ্ব সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে এডলফ হিটলার ও মুসোলিনী বিশ্বের বুকে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করেছিল।
  • ৭. বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট :  জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করে। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার ফলে জাতিতে জাতিতে সমর সজ্জার প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়। ফলে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
  • ৮. বিশ্ব সভ্যতার প্রতি হুমকি : উন্ন জাতীয়তাবাদকে বিশ্ব সভ্যতার প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করা হয়। এটি শুধু মানব সমাজের সৃজনশীল বিকাশের বিরোধী নয় বরং তা মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার “Nationalism” গ্রন্থে বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ” (Nationalism is a menance to civilization)। তিনি আরও বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ একটি বড় হুমকি, কারণ এটি শক্তি ও দক্ষতা অর্জনের জন্য কঠোর প্রয়াস চালায়। ফলে তা মানুষের ত্যাগী ও সৃজনশীল চরিত্র হতে কর্মপ্রয়াস নস্যাৎ হয়ে যায়” (Nationalism is a great menance because it calls for a strenuous effort after strength and efficiency and thereby drains mans energy from his high nature where he is self sacrificing and creative)
  • ৯. নব্য উপনিবেশবাদ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। এর ফলে ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটলেও নব্য-উপনিবেশবাদের জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ, বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, সামরিক জোট গঠন, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক উপজাতীয় কোন্দল সৃষ্টি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কৌশল পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো এভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পরনির্ভরশীল করে রাখে। মূলত সাম্রাজ্যবাদের আধুনিকতম রূপ নব্য উপনিবেশবাদ, যা আন্তর্জাতিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী।
  • ১০. সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে: উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতির মনে সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ নির্দিষ্ট কোনো জাতির কল্যাণ, মর্যাদা ও সুখ সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করে। অপরদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদ সমগ্র বিশ্বব্যাপী মানবজাতির কল্যাণ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ সব সময় নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্যদের অবহেলা করে। ফলে প্রকৃত আস্ত জাতিকতাবাদ গড়ে ওঠে। উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা সারা বিশ্বে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো যুদ্ধ।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সমন্বয় সাধন দুরূহ ব্যাপার। সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে জাতীয় রাষ্ট্রগুলো উদারচিত্তে আন্তর্জাতিকতাবাদকে গ্রহণ করতে পারছে না। তবে আদর্শ জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই । প্রকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের সোপান, জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ নিজ নিজ রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে অন্যান্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে ওঠে সকল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্বশান্তি ও সম্প্রীতি বন্ধন গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যখন চরম আকার ধারণ করে এবং সম্প্রসারণবাদী হয়ে ওঠে তখন তা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদের উগ্র ও সম্প্রসারণবাদী মনোভাব বিশ্ব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।

গণতন্ত্র (Democracy)

গণতন্ত্র প্রত্যয়টি যুগ যুগ ধরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়ে আসছে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তাজগতকে তুমুলভাবে আলোড়িত করছে। সুপ্রাচীনকালে বিশেষত প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রদর্শনের উৎপত্তি লক্ষ করা যায়। গণতন্ত্র জনগণের সর্বসম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার এবং জনগণের অধিকার রক্ষাসহ সার্বিক বিকাশে একান্ত সহায়ক। কাজেই আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের জয়জয়কার সর্বত্র লক্ষণীয়। যে কারণে বর্তমান যুগকে গণতান্ত্রিক যুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। ফলে জে. এস. মিল (JS. Mill) গণতন্ত্রকে “Great discovery of modern times” বলে অভিহিত করেছেন।

গণতন্ত্রের অর্থ ও সংজ্ঞা

গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “Democracy” যা গ্রিক শব্দ Demos এবং Kratia / Kratos থেকে এসেছে। Demos শব্দের অর্থ জনগণ, আর Kratia / Kratos শব্দের অর্থ “ক্ষমতা”। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায় “জনগণের ক্ষমতা”। কিন্তু পারিভাষিক দিক থেকে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় তা একবাক্যে বলা মুশকিল। কেননা, গণতন্ত্রের রূপ, প্রকৃতি ও ধরন স্থানকাল পাত্র ভেদে এতই ভিন্ন যে, এর সংজ্ঞাও বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। যেমন:

  • ১৯৬৫ সালে গেটিসবার্গের বক্তৃতায় প্রদেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন (Abraham Lincoln) এর গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি বেশ জনপ্রিয়, তাঁর মতে, “Democracy is a government of the people by the people and for the people.”
  • ফরাসি দার্শনিক রুশোর সংজ্ঞায় আইনের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। রুশোর মতে, “গণতন্ত্র তাকেই বলা হয়, যা আইনের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত।”
  • অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Prof. Maclver) তাঁর “Web of Government” গ্রন্থে গণতন্ত্রের একটি চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, “গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা অন্য কারো দ্বারা পরিচালিত পদ্ধতি নয় বরং কে শাসন করবে এবং কোন উদ্দেশ্যে শাসন করবে তা নির্ধারণের উপায় মাত্র।”
  • গণতন্ত্রের আধুনিক পিতা বলে খ্যাত জন লক (John Locke ) গণতন্ত্রের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, “Consent is the basis of modern Democracy.”
  • অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettel) বলেন, “যেখানে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।”
  • সি.এফ.স্ট্রং (C. F. Strong) বলেন, “যেখানে শাসন ব্যবস্থা শাসিতের সক্রিয় সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত তাই গণতন্ত্র।”
  • অধ্যাপক ডাইসী এর মতে, “গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসকবর্গ তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ।”
  • অধ্যাপক শিলি (Prof. Seely) এর মতে, “Democracy is a form of government in which everyone has a share”.
  • লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “Democracy is a government in which the will of the majority of the qualified citizen rules… say at least three-fourths so that physical force of the citizen coincides with their voting power.”
  • সমাজবিজ্ঞানী Giddings এর মতানুসারে, “Democracy may either be a form of government, a form of state, a form of society of a combination of all the three.”

সুতরাং বলা যায় যে, গণতন্ত্র এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যাতে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং ক্ষমতার উৎস, এর স্থায়িত্বকরণ এবং দেশ পরিচালনায় জনগণ ও তাদের সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

গণতন্ত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র একদিনে বিকশিত হয়নি। এটি যুগের পর যুগ ধরে বিকশিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এটি এমন এক মতাদর্শ যা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষ নিরস্তন সংগ্রাম করে চলেছে। যে কারণে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার মন্তব্য করেছেন, “Democracy is a form of government that is never completely achieved… democracy grows into its being.”

  • প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে পরীক্ষামূলকভাবে গণতন্ত্রের প্রবর্তন হয় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। মহামতি প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনে এবং গ্রিক ঐতিহাসিক থুসাইডিডিস তাঁর ‘History of the Peloponnesian War’ গ্রন্থে Democracy শব্দ ব্যবহার করেন। তবে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এরিস্টটল গণতন্ত্রকে সুনজরে দেখেননি। ৫ম শতাব্দিতে ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডিটাস এ শব্দকে বেশ সমৃদ্ধ করেছেন। দার্শনিক পেরিক্লিস এথেন্সকে আদর্শ গণতন্ত্র বলে আখ্যা দেন।
  • গ্রিসের পাশাপাশি রোমেও গণতন্ত্র চর্চা শুরু হয়। রোমে রাজতন্ত্র অবসানের পর প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান মধ্যে সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে সূচনা হয়, তাকে প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের সূত্রপাত বলা যায়। গণতন্ত্র বিকাশের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষেও এর শুভ সূচনা হয়। মহাভারত, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি থেকে বৈদিক যুগেগৌতম বুদ্ধের সময়ে গণতন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র” হতেও জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতের কয়েকটি স্থানে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল।
  • গণতান্ত্রিক ধারা বিকাশে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন মনীষী ব্যাপক অবদান রেখেছেন। অন্যধ্যে গ্রিক, স্টোয়িক ও রোমান আইনবিদদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, দায়িত্ববোধ, নির্বাচন, জনমত প্রভৃতি গণতন্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তথাপিও অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র দুর্বলভাবেই বিরাজমান ছিল।
  • মধ্যযুগে গির্জা ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব, সামন্তবাদ প্রভৃতির প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। তবে ১২১৫ সালে ইংল্যাণ্ডে ঘোষিত ম্যাগনাকার্টা গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করে। এটি সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বীজ বপন করে।
  • অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে থাকে। বিশেষত ইংল্যাণ্ডের গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা, ফরাসি বিপ্লব প্রভৃতি এতে ইন্ধন যোগায়। এসময়কার উল্লেখযোগ্য দিক হলো সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও উদারতাবাদ রূপে পরিগণিত হয়।
  • উনবিংশ শতকে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়। মহান দার্শনিকত্রয় হবস্, লক রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ গণতন্ত্রকে শাণিত করে। বিংশ শতাব্দির আইনের শাসন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, অধিকারের সনদ প্রভৃতি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটায় ও গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি রচনা করে। এক্ষেত্রে মনীষী হার্বার্ট স্পেন্সার, হবহাউস, বার্কার, গ্রিন, ম্যাকাইভার, লাস্কি প্রমুখ এবং বলশেভিক বিপ্লবসহ অন্যান্য বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রভৃতি গণতন্ত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে । এভাবে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা ও বিশ্বের সর্বত্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান সময়ে এই মতবাদ তৃতীয় সহস্রাব্দের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম।

গণতন্ত্র কেবল সরকার ব্যবস্থাই নয়, সমাজব্যবস্থাও বটে

বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র একটি সর্বজনগৃহীত উপযোগী শাসন পদ্ধতি। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেখানে বিগত কয়েক শতাব্দি যাবৎ রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য একটি অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল সেখানেও বর্তমানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য গণতন্ত্র আজ হয়েছে সর্বাধিক আলোচনা ও গবেষণার বিষয়। A. D. Lindsay আবার মনে করেন, “Democracy is a theory of society as well as a theory of government.” অর্থাৎ, গণতন্ত্র যেমন একটি সামাজিক তত্ত্ব, তেমনি সরকার তত্ত্বও বটে। তিনি বলেন, যদি রাষ্ট্রের লক্ষ্য হয় সমাজ ও সম্প্রদায়ের সেবা করা এবং আরো উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ ঘটানো তবে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক জীবনের কতগুলো নীতিমালা অবশ্যই মেনে চলবে। তিনি আরো বলেন, “গণতান্ত্রিক শাসনের লক্ষ হচ্ছে সমাজের সাধারণ জনগণের জীবন যাত্রায় সহায়তা করা এবং এরূপ জীবনযাত্রার ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী সকল অসংগতি দূর করা।” গণতন্ত্র সম্পর্কে লিওনের ধারণাসমূহের বিশ্লেষণে দু’ধরনের অর্থ বেরিয়ে আসে। প্রথমত, গণতন্ত্র একটি সামাজিক তত্ত্ব এবং দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র একটি সরকার তত্ত্ব।

সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে গণতন্ত্র :

  • ১. সাম্যভিত্তিক অংশগ্রহণ : একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে সকল নাগরিক কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে। এই অংশগ্রহণ সাম্যভিত্তিক। এখানে সকল মানুষেরই গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সমান। সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে সকলেই সমান অংশীদার।
  • ২. স্বাধীনতা : গণতান্ত্রিক সমাজ অবাধ ও মুক্ত সমাজ, তবে স্বেচ্ছাচারী নয়। এখানে ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার পাশাপাশি কাজ করার ও কাজ পাবার স্বাধীনতাও রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের এসকল অধিকার রক্ষায় আগ্রহী।
  • ৩. কল্যাণমূলক সরকার : কল্যাণমূলক সরকারের ধারণা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিভূ। কেননা, গণতান্ত্রিক সমাজই কেবল পারে কল্যাণকামী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে।
  • ৪. আইনের শাসন : গণতান্ত্রিক সমাজ সকলের প্রতি সমান ব্যবহার করবে এবং নৈর্বক্তিকতার মধ্য দিয়েও এ আইন কার্যকর হবে। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিই অনুসৃত। “Due process of law” অর্থাৎ আইনের যথাযথ বিধান ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকেই বিনা কারণে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত করা যাবে না-এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
  • ৫. সহিষ্ণুতা : সহিঞ্চুতা গণতন্ত্রের একটি অন্যতম উজ্জ্বলতম আদর্শ। গণতন্ত্রের যে মহাত্যতা তাঁর সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। মতামত প্রকাশে এখানে সকলেই সংযত ও সহিষ্ণু হবে। এখানে Argument of force নয়, বরং Force of Argument হবে প্রধান নিয়ামক শক্তি। অস্ত্র বা ক্ষমতার দাপট গণতন্ত্রের এ মূল্যবোধকে শুধুই পর্যুদস্ত করে। সরকার পরিবর্তনে বুলেট নয়, ব্যালটই একমাত্র কাম্য ।
  • ৬. সার্বজনীনতা : গণতান্ত্রিক সমাজ সার্বজনীন সমাজ। গণতন্ত্রে আইনের চোখে সকলেই সমান। ধন সম্পদ নয় বরং মানুষ হিসেবে মানুষের মূল্যায়ন ও প্রতিপালনই সার্বজনীন আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত থাকবে।
  • ৭. সৌহার্দ্য : “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম সামাজিক মূল্যবোধ। একের প্রতি অন্যের দরদ, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে যা কেবল গণতান্ত্রিক সমাজ থেকেই আশা করা যায়।
  • ৮. ন্যায়বিচার : প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরোপিত গুণ নয়, বরং অর্জিত যোগ্যতাই মানুষের কর্ম ও সাফল্যের শর্ত হিসেবেবিবেচিত হয়।
  • ৯. যুক্তিবাদ : মানুষ মাত্রই বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব। মানুষের যুক্তিযুক্ত ও সংযত আলাপ-আলোচনা ও সম্মতিই গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি।

সরকার তত্ত্ব হিসেবে গণতন্ত্র :

  • ১. সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব : শাসনব্যবস্থায় সকল প্রকার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা গোষ্ঠির সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মানুষের মাঝে বিরাজমান সকল প্রকার ব্যবধানের বিলোপ সাধন করে থাকে।
  • ২. নিয়মতান্ত্রিক সরকার : আইন ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ এবং জনগণ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট জবাবদিহিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নিয়মতান্ত্রিক সরকার কেবলমাত্র গণতন্ত্রেই সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এর ব্যর্থতাই সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
  • ৩. সংবিধানের প্রাধান্য : গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে জাতীয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় কিংবা আন্ত:আঞ্চলিক সমস্য সমাধানে সংবিধানই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ। সাংবিধানিক আইন অলঙ্ঘনীয় ও পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
  • ৪. সংসদীয় সার্বভৌমত্ব : সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার সংসদের মাধ্যমে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকে। আইন বিভাগের প্রতি নির্ভরশীলতা সরকারকে দায়িত্বশীল হবার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু স্বৈরতন্ত্র ঠিক এর বিপরীত।
  • ৫. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ : সাধারণ অবস্থায় সরকারের তিনটি বিভাগ একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করা এবং প্রয়োজনে জনস্বার্থ রক্ষার্থে ভারসাম্য রক্ষা করার নীতি গণতান্ত্রিক সরকার তত্ত্বের অন্যতম দিক।
  • ৬. শক্তিশালী বিরোধী দল : গণতান্ত্রিক সমাজ কিংবা সরকার উভয়ের সফলতার ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। সরকার তাঁর সাফল্যের প্রয়োজনে বিরোধী দলকে প্রতিপালন করে থাকে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রে এ প্রমাণ মেলে না।
  • ৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : জনগণের অধিকার এবং মানব প্রগতি নিশ্চিতকরণের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যরত থাকবে।
  • ৮. সার্বজনীন ভোটাধিকার : আধুনিক গণতন্ত্রে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হয়ে আসেন।

উপরের আলোচনায় তত্ত্ব হিসেবে আমরা গণতন্ত্রকে সরকার ও সমাজব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখতে পাই। তাই এ পর্যায়ে দ্বিধাহীন চিত্তেই আমরা লিওসের উক্তিকে স্মরণ করে গণতন্ত্রকে যুগপৎভাবে সরকার ও সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি। তবে অনগ্রসর ও অশিক্ষিত সমাজে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে গণতন্ত্রের এ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

“জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য ও জনগণের শাসনই হলো গণতন্ত্র”- আব্রাহাম লিংকন

গণতন্ত্র হলো জনগণ কর্তৃক পরিচালিত একটি উত্তম শাসনব্যবস্থা। এধরনের শাসনের মূল মন্ত্র হলো “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস”। আর এ সত্যটিই উপলব্ধি করেছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। যে কারণে ১৯৬৫ সালে প্রদত্ত তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ উচ্চারণ করেছেন, “জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য ও জনগণের শাসনই হলো গণতন্ত্র” বক্তৃতায় তিনি (Democracy is a government of the people by the people and for the people)।  তাঁর এ ধারণাকে বিশ্লেষণ করলে গণতন্ত্রের কতিপয় মৌলিক দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলো নিম্নরূপ :

  • ১. জনসম্মতি : আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বপ্রথমে জনসম্মতির ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লর্ড ব্রাইস এক্ষেত্রে একমত পোষণ করে বলেন, “The yerm public opinion is community used to denote the aggregate of views men hold regarding matters that affect or interest the community.” গণতন্ত্রে সরকার জনমতের ভিত্তিতে কাজ করে। অন্যথায় পরবর্তীতে নির্বাচনে সরকারের পরিবর্তন সূচিত হয়।
  • ২. জনগণের সরকার : আব্রাহাম লিঙ্কনের মতে, এটি স্বতঃসিদ্ধ যে গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার। এটি জনগণের সাথে অবস্থান করে জনগণের স্বার্থে কাজ করে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এ সরকার পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ রয়েছে। আর এ সত্যটি উপলব্ধি করে অধ্যাপক শেলী বলেন, “Democracy is a form of government in which everyone has a share”
  • ৩. যুক্তিপ্রসূত শাসনব্যবস্থা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনগণের যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রে সরকার ও জনগণ নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিমিয়ের সুযোগ পায়। ফলে যুক্তিপ্রসূত সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ হয়।
  • ৪. দায়িত্বশীলতা : অন্যান্য শাসনব্যবস্থার তুলনায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অধিকতর দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা। এধরনের শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিগণ তাদের প্রত্যেকের কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। তাঁরা পার্লামেন্টে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সরকারের এ ধরনের দায়িত্বশীলতা জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে।
  • ৫. জনকল্যাণ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনকল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। সরকার সর্বদা জনস্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে। আব্রাহাম লিঙ্কনও গণতন্ত্রের এই দিকটির উপর জোর দিয়ে বলেন, “Democracy is a system in which the government works for the people “
  • ৬. সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক : আব্রাহাম লিঙ্কনের মতে, সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটি উত্তম শাসনব্যবস্থা ।
  • ৭. স্বাধীনতা সংরক্ষণ : আব্রাহাম লিঙ্কন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্বাধীনতা বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। তাঁর প্রদত্ত সংজ্ঞায় স্বাধীনতার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা ব্যাহত হয় তা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হতে পারে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
  • ৮. শিক্ষা বিস্তার : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাই জনগণের সার্বিক মুক্তি আনে। আর জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
  • ৯. ব্যক্তিত্বের বিকাশ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যক্তিত্ব বিকাশের উৎকৃষ্ট পরিবেশ বজায় থাকে। কারণ জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে জনগণের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।
  • ১০. নারী উন্নয়ন : নারী সমাজ জনগণের একটি বিরাট অংশ। যে কারণে নারী সমাজকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। গণতান্ত্রিক সরকার এ সত্যটি উপলব্ধি করে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে।

উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ আব্রাহাম লিঙ্কন প্রদত্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞার মৌলিক দিক। এসকল বিষয় জনগণের অধিকার ও প্রত্যাশার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ তিনি এগুলোকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছেন।

একনায়কতন্ত্র (Dictatorship)

প্রাচীন রোমে ‘একনায়ক’ শব্দটির প্রচলন লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংকটজনক অবস্থা মোকাবেলার জন্যই রোমানগণ কোনো ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করত। এ ব্যবস্থা রোমে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার প্রাচীনকালে কোনো কোনো দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকেও একনায়কতন্ত্র বলে মনে করা হতো। তবে একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে বর্তমানের ধারণা ভিন্ন প্রকৃতির। সাধারণত যে শাসনব্যবস্থায় একজন রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করে তাকেই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। একনায়কের নির্দেশেই রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

  • আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) এর মতে, “যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে কেন্দ্রিভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।”
  • গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল (Aristotle) এর মতে, “যখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সে যদি নিজের স্বার্থের জন্য শাসন করে তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।”
  • রজার ইসক্রুটন (Roser Escruton) তাঁর A Dictationary of political thought গ্রন্থে বলেন, “একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি বা দল সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সকল জনসাধারণের নিকট থেকে আনুগত্য আদায় করে।”
  • অস্টিন রেনি (Austin Ranney) এর ভাষায়, “একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে প্রশাসনিক চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয় একজন ব্যক্তি বা বাছাই করা কয়েকজনের হাতে।”
  • রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিউম্যান (Newman) এর মতে, “By dictatorship we understand the rule of a person or group of persons who arrogate to themselves and monopolize power of the state, exercising it without restraint.”
  • বিশিষ্ট দার্শনিক ফোর্ড (Ford) বলেন, “Dictatorship is the assumptions of extra- legal authority by the head of the state.”
  • Alfred এর ভাষায়, “Dictatorship is the government of one man who has not obtained his position by inheritance but either by force or by consent and normally by a combination of both, he must posse’s absolute sovereignty. Finally it must not be incompatible with absolute rule.
  • ইটালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনি (Mussolini) এর মতে, “একনায়কতন্ত্র হচ্ছে ঐ শাসনব্যবস্থা যেখানে সকল কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থে করা হয়। কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, আর রাষ্ট্রের বাইরেও কোনো কিছু নয়।”

সুতরাং বলা যায়, একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যাতে সরকার গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে একজন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা শ্রেণির ব্যাপক ক্ষমতা বিদ্যমান। ঐ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, ভোগ ও প্রয়োগ করে।

একনায়কতন্ত্রের উৎপত্তি 

একনায়কতন্ত্র একটি প্রচলিত প্রাচীন মতবাদ। প্রাচীনকালে যতগুলো মতবাদ প্রচলিত ছিল তন্মধ্যে একনায়কতন্ত্র অন্যতম। তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের ন্যায় একনায়কতন্ত্রের উৎপত্তিও প্রাচীন গ্রিক ও রোমে। তৎকালীন গ্রিসে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। এধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা প্রায়ই একজনের কর্তৃত্বে ব্যবহৃত হতো, যাতে একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়।

কিন্তু আধুনিক একনায়কতন্ত্রের বিকাশ ঘটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ গড়ে ওঠে। ফলে এ সময় জার্মানি ও ইতালিসহ কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের পুনর্জন ঘটে। বিশেষ করে জার্মানি ও ইতালির একনায়করা যুদ্ধপরবর্তী দুর্দশা কাটিয়ে উঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এধরনের প্রতিশ্রুতি একনায়কতন্ত্রকে স্বাগত জানায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ১৯২২ সালে ইতালির বলিষ্ঠ নেতা মুসোলিনীর। নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদি (Facism) নামে একটি দলের উত্থান ঘটে। ১৯৩৩ সালে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের নেতৃত্বে জন্ম নেয় নাৎসিবাদ (Nazism) নামে আর একটি দল বা মতবাদ। এ দুই মতবাদই একনায়কতন্ত্রকে তত্ত্বগতভাবে সমর্থন করে। একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সামরিক শক্তি, যেকারণে একনায়কতন্ত্র যুদ্ধকে প্রশ্রয় দেয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক বিশ্বেও বিভিন্ন নামে ও ছদ্মবেশে অনেক রাষ্ট্রে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে।

ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, বিরোধী মত ও পথকে রুদ্ধকরণ, সামরিকীকরণ প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি। একনায়কতন্ত্রে সামরিক শক্তির উপস্থিতি লক্ষ করে মনীষী নিৎসে (Nietzsche) বলেন, “Live dangerously effect your cities beside Visuvius send out your ships to unexpected seas, live in a state of war.”

একনায়কতন্ত্রের প্রকারভেদ

একনায়কতন্ত্র এমন বিশেষ এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যাতে একক ব্যক্তির ও ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসনব্যবস্থার মূল মন্ত্র হলো One man, one state and to believe, to obey and to fight. একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক ফোর্ড বলেন, “Though there is sometime similiarity among the military, the facist and the communist dictatorship, yet they are different in certain ways.” প্রকৃত বিচারে একনায়কতন্ত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

  • ১. ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র (Individual Dictatorship) : ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে দেশের যাবতীয় ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা সামরিক নেতার হাতে ন্যস্ত থাকে। সাধারণত সংবিধান বহির্ভূতভাবে ও সম্পূর্ণ অতর্কিতে আইনানুমোদিত সরকারকে উচ্ছেদ করে বা হটিয়ে ক্ষমতা দখল করা হয় এবং একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়। এধরনের ব্যবস্থায় কখনো কখনো সামরিক বাহিনীর সমর্থনে সামরিক প্রধান শাসন ক্ষমতা দখল করেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় শাসন ক্ষমতা দখল করলে তাকে সামরিক একনায়কতন্ত্র (Military Dictatorship) বলা হয়। একনায়কের ক্ষমতাকে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। স্পেনের সেনানায়ক ফ্রাঙ্কো, পাকিস্তানের আইয়ুব খান এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ।
  • ২. দলগত একনায়কতন্ত্র (Party Dictatorship): যে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি মাত্র রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করে তাকে দলগত একনায়কতন্ত্র বলে। এই বিশিষ্ট দল ব্যতীত অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব এই ব্যবস্থায় স্বীকৃত নয়। তবে দল নেতার প্রভাব ও প্রাধান্য এখানে মুখ্য। যেমন: জার্মানির হিটলারের নাৎসি দল এবং ইতালির মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের কথা বলা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এরূপ দল গঠিত হয়। এরা প্রথমে আইনানুমোদিতভাবে ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন। করে। C. D. Burns এর ভাষায়, “In 1933 Hitler established the Nazi party on his dictatorship in Germany and he remained in power till 1944,”
  • ৩. শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র (Class Dictatorship) : একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করলে আর এক ধরনের একনায়কতন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র। শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র হলো এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে একটি বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এধরনের একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ফলে এধরনের ব্যবস্থায় শ্রেণি শোষণ ও শাসন স্বীকৃত হয়। বিশেষ করে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় ধনিক-বণিক শ্রেণির নেতৃত্বে এবং সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে এধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চীনের সমাজতান্ত্রিক দল

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য 

একনায়কতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা হতে পারে এক ব্যক্তির, এক দলের বা এক শ্রেণির অথবা তাদের সমর্থিত শাসনব্যবস্থা। একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা, স্বরূপ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফাইনার একনায়কতন্ত্রের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা :

  • ১. প্রচারণার ব্যাপক প্রয়োগ;
  • ২. একদলীয় ব্যবস্থা;
  • ৩. নামমাত্র ও নিয়ন্ত্রিত আইনসভা; এবং
  • ৪. ক্ষমতার ব্যাপক কেন্দ্রিকরণ।

অটো স্ট্যামার একনায়কতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা : স্বৈরাচারী ও একচেটিয়া ক্ষমতার প্রয়োগ, সাংবিধানিক ব্যবস্থার অবলুপ্তি, নাগরিকদের পৌর ও অন্যান্য অধিকারের অবলুপ্তি, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আবেগতাড়িত ও অন্যান্য মনোভাবের প্রাধান্য এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে স্বৈরাচারী পদ্ধতি। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রেক্ষিতে একনায়কতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :

  • ১. একদলীয় শাসন : একনায়কতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একদলীয় শাসনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের প্রাধান্য থাকে এবং দেশের সার্বিক ক্ষমতা এককভাবে করায়ত্ত করে। এ ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। জার্মানিতে হিটলারের Nazist Party এবং ইটালির মুসোলিনীর Facist Party একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
  • ২. এক ব্যক্তির শাসন : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মূল ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী শাসনক্ষমতা পরিচালিত হয়। তিনি অপরিসীম ক্ষমতার মালিক। তাঁর সম্পাদিত কাজের জন্য তিনি কারো নিকট দায়ী থাকেন না। তাঁর আদেশ ও নির্দেশই হলো সার্বভৌম নির্দেশ। তাকে কেন্দ্র করে পুরো শাসনব্যবস্থা আবর্তিত হয়।
  • ৩. একদলীয় ব্যবস্থা : আধুনিক একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুষ্টিমেয় লোক সমন্বয়ে একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। তারা অন্য কোনো পক্ষ, দল, বিরোধী দল, মত, পথ নির্মূল করে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে। কেন্দ্রিয় কতিপয় নেতার মাধ্যমে এ দল হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, “Dictatorship is the one paty government”। জার্মানিতে হিটলারের Nazist Party ও ইটালির মুসোলিনীর Facist Party একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
  • ৪. সর্বাত্মকবাদ : সর্বাত্মকবাদ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক। এধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র হলো সর্বশক্তিধর ও সর্বাত্মক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রই নাগরিক জীবনের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করে। ইটালীয় একনায়ক মুসোলিনীর ভাষায়, “All within the state none outside the state “। হেগেলীয় দর্শন মতে, “রাষ্ট্র হলো সর্বাত্মক ও সর্বশক্তিমান, কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।”
  • ৫. রাষ্ট্র ও সরকার অভিন্ন : একনায়কতন্ত্রের বিশেষ দিক হচ্ছে যে, এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সরকার এক ও অভিন্ন। বিশ্বের সেরা একনায়করা নিজেদের সাথে রাষ্ট্রকে অভিন্ন ও একাত্ম করে। দেখতেন। যেমন: ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই, হিটলার, মুসোলিনি প্রমুখ। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই বলতেন, “I am the state”।
  • ৬. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। এ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ স্বীকৃত। সকল ক্ষমতা এক ব্যক্তি ও কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশ মোতাবেক সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। ফলে কেন্দ্রে একক আধিপত্য বিস্তৃত হয়। যদিও বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আদৌ কাম্য নয়।
  • ৭. ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম দিক হলো এধরনের ব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। কেননা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারকে এখানে রাষ্ট্রের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ফলে ব্যক্তি জীবনের সকল নিকই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সংবিধান, সংসদ ও অন্যান্য সংস্থার অস্তিত্ব থাকলেও এগুলো মেকীরূপ ধারণ করে। প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেল এর ভাষায়, “A man is what he is bacause of the state and he is not what he is without the state.”
  • ৮. দায়িত্বহীনতা : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা, একনায়কতন্ত্রে সরকার জনগণের উপর কর্তৃত্ব খাটায় এবং তারা জনগণের নিকট কোনোভাবেই জবাবদিহিতা করতে চায় না। এমনকি বলপ্রয়োগের মাধ্যমেও একনায়কতান্ত্রিক সরকার জনগণের উপর প্রভাব খাটায়। এক্ষেত্রে সংবিধানের বিধি-নিষেধকেও পুরোপুরি অনুসরণ করা হয় না। ফলে এটি মূলত একটি দায়িত্বহীন শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়।
  • ৯. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ: একনায়কতন্ত্রে সবকিছুতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন : কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামরিক অস্ত্রের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব, প্রচারযন্ত্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, সংগঠন ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের প্রধান প্রধান দিক।
  • ১০. বিরোধী মতামত উপেক্ষা : একনায়কতন্ত্রের একটি অন্যতম দিক হলো বিরোধী মতামত উপেক্ষা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সকল প্রকার বিরোধিতার অবসানকল্পে ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। শাসকদল মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বিরোধী সমালোচনাকে প্রতিহত করে। প্রয়োজনে বিরোধী ও বিদ্রোহী নেতাদেরকে কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
  • ১১. প্রচারযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ : প্রচারযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ একনায়কতন্ত্রের অন্যতম দিক। কেননা, এধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর সরকারের একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র একনায়কদের গুণকীর্তন ও সফলতা প্রচারে ব্যস্ত থাকে। এসকল মাধ্যম সরকার বিরোধী কোনো তথ্য ও মতামত প্রচার করতে চায় না। সংবাদপত্রের কোনো বাকস্বাধীনতা থাকে না।
  • ১২. দুর্বল আইন ও বিচার বিভাগ: একনায়কতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, এধরনের শাসনব্যবস্থা আইন ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানই হলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর নির্দেশই হলো আইন। এপ্রসঙ্গে অস্টি বলেছেন, “Law is the command of soveriegn”। অর্থাৎ, এধরনের শাসনব্যবস্থার আইন ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয় বিধায় রাষ্ট্রের এ দুটি বিভাগ দুর্বল হয়ে থাকে।
  • ১৩. বল ও শক্তি প্রয়োগ : একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র বল ও শক্তি প্রয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব রাষ্ট্র শান্তি ও সৌহার্দো বিশ্বাস করে না। সুযোগ পেলে তারা প্রতিবেশী ও দুর্বল রাষ্ট্রের ভূখণ্ড জোর করে দখল করে নেয়। হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, পোল্যাণ্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখল করেছিল। মুসোলিনিও ইথিওপিয়া দখল করেছিল।
  • ১৪. নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য : একনায়কতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য। এ ব্যবস্থায় নেতার মাহাত্ম্য জোর গলায় প্রচার করা হয় এবং নেতাকে সর্বশক্তিমান বলে গণ্য করা হয়। নেতাকে বিভিন্ন টাইটেল ও গুণে ভূষিত করা হয়। নেতার যে কোনো প্রকার বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতা বলে গণ্য করা হয়।
  • ১৫. উগ্র জাতীয়তাবাদ : একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একনায়কগণ জ্বালাময়ী ভাষায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করে জনগণকে অন্য জাতির উপর আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের ফসল হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ।
  • ১৬. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের অনুপস্থিতি : একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় অপরিসীম ক্ষমতাধর শাসন বিভাগ একক দলের নেতাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফলে বিচারবিভাগ ও আইন বিভাগ অকেজো হয়ে পড়ে। লোক দেখানো ও ক্ষমতাহীন আইনসভা থাকলেও সেখানে শাসকগোষ্ঠির ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণীত হয়।
  • ১৭. গুপ্তচর বাহিনী : ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য একনায়কতন্ত্রে গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর কাজ হচ্ছে জনগণ ও দলের মধ্যে বিরোধিতা ও চক্রান্তের খবর সংগ্রহ এবং হিংসাত্মক পন্থায় তা রোধ করা। যেমন: হিটলারের গেস্টাপো, মুসোলিনীর কালো কোর্তা ইত্যাদি।
  • ১৮. মিথ্যা প্রচারণা : একনায়ক নিজের মত ও পথ চাপিয়ে দিয়ে এবং নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে ব্যাপক মিথ্যা প্রচার চালায়। বিরোধী ভাবমূর্তি নষ্টের জন্যও এরূপ প্রচারণা চালানো হয়। যেমন: হিটলার আইনসভায় অগ্নিসংযোগ করে কমিউনিস্টদের দোষ দেয়।
  • ১৯. আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলো আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী একটি শাসনব্যবস্থা। একনায়কতন্ত্রে আন্তর্জাতিকতাকে স্বীকার করা হয় না। এই শাসনব্যবস্থায় আন্তর্জাতিকতার সহযোগী কোনো কার্যক্রমকে সহজে অনুমোদন দেয়া হয় না। Dictionary of Political Science এর ভাষায়, “The dictator do not care for the international opinion and the give priority to their own selfish motives.”
  • ২০. অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আরও যেসকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিবিরোধিতা, অতি মানবীয় নেতৃত্ব, নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠোরতা এবং ইউটোপিয়াজিন ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায় যে, একনায়কতন্ত্রের মূল সূর হলো “One man, one state and to believe, to obey and to fight” এই শাসনব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, যে কারণে বিশ্বের কোথাও একনায়কতন্ত্র তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ।

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে তুলনা বা পার্থক্য

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র বর্তমানে প্রচলিত বিশ্বের দুটি বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা। যার প্রথমটি জনগণকে প্রাধান্য দেয় এবং অন্যটি জনগণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ফলে শাসন প্রণালী, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, সংগঠন ও বৈশিষ্ট্যভেদে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

  • ১. তত্ত্বগত দিক: তত্ত্বগত দিক থেকে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্র মানবতাবাদ ও আদর্শবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থা। অর্থাৎ, মানবতার মহান আদর্শ, হিতবাদী তত্ত্ব এবং মিলের আদর্শবাদী তত্ত্বের উপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে, একনায়কতন্ত্রে এধরনের কোনো মানবতাবাদী মতবাদ দেখা যায় না। একনায়কতন্ত্রের মূলে রয়েছে হেগেলের আদর্শবাদী তত্ত্ব। Hegel এর ভাষায় “A man is what he is because of the state and he is not what he is without the state”.
  • ২. সার্বভৌম ক্ষমতা : গণতন্ত্র এমন এক শাসন পদ্ধতি, যাতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। জনগণের ইচ্ছা অনুসারে সরকার পরিচালিত হয়। অপরদিকে, একনায়কতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা একনায়কের হাতে ন্যস্ত থাকে। সরকার গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর খেয়াল-খুশিমতো অনেকটা নির্বিচারে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
  • ৩. জনসম্মতি : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যবস্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ শাসকদের বাছাই করতে পারে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস নির্বাচনি ব্যালট নয়, বরং বুলেট। যে কারণে একনায়কতান্ত্রিক সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
  • ৪. আইনের শাসন : গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র হচ্ছে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্রে আইনের চোখে সকলেই সমান। আইন কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করবে না। আইন তার আপন গতিতে চলবে। পক্ষান্তরে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসনের কোনো অস্তিত্ব নেই। সংবিধান এবং আইনের পরিবর্তে একনায়কের আদেশই আইন হিসেবে গণ্য, যা সকলেই মেনে চলতে বাধ্য।
  • ৫. সংবিধান : গণতান্ত্রিক সরকারের একটি নিজস্ব সংবিধান তথা শাসনকার্য পরিচালনার মৌল নীতি থাকে। সংবিধানের অধীনেই এ সরকার পরিচালিত হয়। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক সরকার সংবিধানের তোয়াক্কা করে না।
  • ৬. ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে: ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া হয় বিধায় ব্যক্তির মতামত ও ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী একটি মতবাদ। এ ব্যবস্থায় বলা হয়। রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায়, “Everything is for state nothing out of state nothing for individual.
  • ৭. সমতার নীতির ক্ষেত্রে: সাম্যনীতির ভিত্তিতে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রে সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, যেখানে সকল শ্রেণির মানুষ সমান সুযোগ সুবিধা লাভে সক্ষম হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সমতার উপর তেমন গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। এব্যবস্থায় ধরে নেয়া হয় যে, মানুষে মানুষে কোনো সমতা নেই, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই এখানে মুখ্য বিষয়।
  • ৮. অধিকারের ক্ষেত্রে পার্থক্য : জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। কেননা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়। যে কোনো মূল্যে এধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়। কেননা, এ শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রনায়কের নির্দেশে পরিচালিত হয়।
  • ৯. দল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে: গণতন্ত্র একটি বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থা, যেখানে অনেকের মত ও আদর্শের অস্তিত্ব বিদ্যমান। দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ব্যবস্থায় মানুষ যেমন স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়, তেমনি একাধিক দলের অস্তিত্বের কারণে বিরোধী দল সরকারি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একটি মাত্র দল থাকে, যেটি সরকারের কর্মকাণ্ডের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। এই ব্যবস্থায় জনগণ তাদের মতামত প্রকাশেরও সুযোগ পায় না।
  • ১০. রাষ্ট্র ও সরকার : গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকার একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- ইংল্যাণ্ডের স্টুয়ার্ট রাজারা রাষ্ট্র ও সরকারকে একই দৃষ্টিতে দেখত। তেমনি জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনী রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করতেন না।
  • ১১. সংখ্যালঘুর স্বার্থ : গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যবস্থায় সকলের জন্য সমান অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার প্রায় ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়।
  • ১২. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে। অপরদিকে, একনায়কতন্ত্রে সকল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে। অর্থাৎ, শাসন সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা একনায়কের হাতে ন্যস্ত হয়।
  • ১৩. মৌলিক অধিকার : গণতন্ত্রে নাগরিকদের বিভিন্ন প্রকার মৌলিক অধিকার শাসনতন্ত্রে লিপিবন্ধ থাকে। ফলে কোনোভাবে মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে যে কেউ সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না।
  • ১৪. প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে প্রচার মাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয় বিধায় এগুলো স্বাধীনভাবে দেশের সংবাদ তুলে ধরতে পারে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে প্রচার মাধ্যমগুলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় বিধায় কেবলমাত্র সরকারের পক্ষে এসব মাধ্যমের প্রচারণা সীমাবদ্ধ থাকে।
  • ১৫. স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে: গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও একনায়কতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করা হয় না। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সুশাসন যতই ত্রুটিমুক্ত হোক না কেন ত স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হতে পারে না। ব্যানারম্যান বলেছেন, “Better bad government under self government than good government under dictatorship”.
  • ১৬. বিপ্লবের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হয় বিধায় পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। ফলে জনগণের মধ্যে তেমন কোনো ক্ষোভ না থাকায় গণতন্ত্র বিপ্লব বা বিদ্রোহের আশংকা থেকে মুক্ত। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র প্রভাব ব্যক্তিজীবনকে গ্রাস করে। ফলে জনমনে ক্ষোভ ও তিতিক্ষা জমতে থাকে। আর এতে করে একনায়কতন্ত্রে বিপ্লবের আশংকা সর্বদা বর্তমান থাকে।
  • ১৭. স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে : স্থায়িত্বের দিক থেকে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রে পরস্পর বিরোধী স্বার্থের সংঘাত, দলত্যাগ, জনমতের পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে ঘন ঘন সরকারের পরিবর্তন হয়। যে কারণে সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকে। পক্ষান্তরে একনায়কতন্ত্রে একনায়কের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বিধায় এধরনের শাসনব্যবস্থা স্বার্থের দ্বন্দ্ব, দলত্যাগ প্রভৃতি ত্রুটি থেকে মুক্ত। ফলে একনায়কতন্ত্রে স্থায়িত্বের ব্যাপারে কোনো অনিশ্চয়তা থাকে না।
  • ১৮. ব্যয়ের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্র একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। কেননা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কার্য সম্পাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের ন্যায় ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা নয়। এধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের একনায়কের হাতে সরকার পরিচালনার সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে বিধায় তিনি নিজে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
  • ১৯. উপযোগিতার ক্ষেত্রে পার্থক্য : উপযোগিতার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। গণতন্ত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি বৃহদায়তন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ বৃহদায়তন রাষ্ট্রে ক্ষমতা সাধারণত বিকেন্দ্রীকৃত থাকে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে তা সম্ভব নয়। এধরনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে। এখানে ক্ষমতা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় না। যে কারণে বৃহৎ রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্রের উপযোগিতা কম।
  • ২০. আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিশ্বশান্তির অনুকূলে। এ শাসনব্যবস্থা সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। যে কোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু একনায়কতন্ত্র বিশ্বশান্তির জন্য এতটা সহায়ক নয়। একনায়কতন্ত্রের প্রবক্তা মুসোলিনী ও হিটলার বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি। কেননা, এধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রনায়কলণ বিশ্বস্বার্থ অপেক্ষা নিজেদের স্বার্থকে অধিক প্রাধান্য প্রদান করেন।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান এবং এক্ষেত্রে গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্র অপেক্ষা অধিক উপযোগী শাসনব্যবস্থা। কেননা, গণতন্ত্রে জনমতের ভিত্তিতে যেমন সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জনগণের অধিকার যথার্থভাবে রক্ষিত হয়। তাছাড়া কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই স্বায়ত্তশাসনের সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়। অপরদিকে একনায়কতন্ত্রে সুশাসন কদাচিৎ পাওয়া সম্ভব হলেও এতে কখনোও স্বায়ত্তশাসন লাভ করা যায় না।

নৈরাজ্যবাদ (Anarchism)

নৈরাজ্যবাদ ঊনিশ শতকের রাষ্ট্রচিন্তায় সর্বাধিক প্রাধান্য বিস্তার করলেও এ তত্ত্বটি ইতিহাসে অনেক প্রাচীন। ফ্রান্সিস বেকন মন্তব্য করেছেন, প্রাচীন গ্রিসের কতিপয় স্টোইক দার্শনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গুরুত্বকে ছোট করে দেখেছেন এবং তারা শিক্ষা নিয়েছেন যে উত্তম জীবনের পথ রাষ্ট্রের মধ্যে নিহিত নয়, বরং এমন এক সামাজিক অবস্থার মধ্যে নিহিত যেখানে মানুষ তার সমাজপ্রিয়তা ও ন্যায়বোধের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে সক্ষম। তারা আরো মনে করেন, হিতবাদী ও যুক্তিবাদী মানুষকে তাদের চেয়ে হীনতর মানুষদেরকে নিয়ে গঠিত শাসকমণ্ডলীর অধীনে আবদ্ধ করে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মধ্যযুগের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী চিন্তা লক্ষ করা যায়। আধুনিক যুগে কয়েকজন কবি ও দার্শনিক রাষ্ট্রে। বলপ্রয়োগকারী ক্ষমতাকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে নিন্দা করেন। তারা যুক্তি দেন যে, মানুষের স্বাভাবিক যুক্তিবাদিতা ও সমাজপ্রিয়তা ন্যায়ভিত্তিক ও সুখী সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।

নৈরাজ্যবাদের প্রবক্তা

রাষ্ট্রহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি নিয়ে নৈরাজ্যবাদীগণ সুস্পষ্ট দু’টি ধারায় বিভক্ত। এ দুটি ধারা হলো বিবর্তনপন্থী ও বিপ্লবপন্থী। বিবর্তনপন্থী নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন যে বিবর্তনের পথ ধরেই একদিন স্বাভাবিক ও শাস্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রের তিরোধান হবে-এ লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না। এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত চিন্তাবিদগণ হলেন উইলিয়াম গডউইন, জোশেফ প্রুধো, লিও টলস্টয়, টমাস হপকিন, জোসিয়া ওয়ারেন প্রমুখ। অপরদিকে, বিপ্লবপন্থী নৈরাজ্যবাদ হিংগ্রেতা ও বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে নিজেদের পরিকল্পিত সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে। এ ধারার চিত্ত বিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন মাইকেল বাকুনিন, পেটার রূপটিন, বাট্রান্ড রাসেল প্রমুখ।

নৈরাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য

নৈরাজ্যবাদ হচ্ছে এমন এক ধরনের রাজনৈতিক মতবাদ যা মানুষের কর্তৃত্বসহ সকল ধরনের কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে। এটি রাষ্ট্রহীন এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে যা মানুষের স্বেচ্ছামূলক সংগঠনগুলোর দ্বারা গঠিত হবে। নৈরাজ্যবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ :

  • ১. রাষ্ট্রবিরোধী: নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্রবিরোধী মতবাদ। এই মতবাদ মনে করে, রাষ্ট্র কৃত্রিম, অনাকঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয়। রাষ্ট্র সমাজের সকল প্রকার অন্যায়কে রক্ষা করে। এমনকি রাষ্ট্র শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার হিসেবেও ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের সকল নিবর্তনমূলক সংস্থা আধিপত্য বিস্তারকারী শ্রেণির স্বার্থে সাধারণ মানুষকে দমন করে। কাজেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে বলে নৈরাজ্যবাদীরা মনে করেন।
  • ২. রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় : নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন, নৈরাজ্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয়। কেননা, নৈরাজ্যবাদী সমাজের মূল ভিত্তি হলো ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিতা। এরূপ সমাজের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য আইনকানুন ও রাষ্ট্রের নিবর্তনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে না। মানুষের সহজাত প্রবণতা ও সদগুণাবলি সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
  • ৩. রাষ্ট্র ও শ্রেণিহীন সমাজের পক্ষে : নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্রহীন ও শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে। এ লক্ষ্যে নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদগণ নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও শ্রেণিহীন নতুন সমাজব্যবস্থা কল্পনা করেছেন। তাদের মতে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও সদগুণাবলি নির্ভর সমাজেই কেবল মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে।
  • ৪. কর্তৃত্ব বিরোধী মতবাদ : নৈরাজ্যবাদ যে কোনো ধরনের কর্তৃত্বের বিরোধী। বিশেষ করে রাষ্ট্র ধর্ম ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আক্রমণ করে এবং এগুলোর উচ্ছেদের জন্য সুপারিশ করে। তারা স্বেচ্ছাভিত্তিক সংগঠিত সমাজব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি প্রদান করে। নৈরাজ্যবাদ মনে করে, সকল ধরনের কর্তৃত্ব ব্যবস্থাই খারাপ এবং সমাজের অনিষ্টের মূল।
  • ৫. ধর্মের বিরোধিতা: নৈরাজ্যবাদ ধর্ম বিরোধী এক মতবাদ। নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন, ধর্ম সকল অন্যায়ের মূল। এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রকে সমর্থন দেয়। মানুষকে আনুগত্য ও বশ্যতা শিক্ষা দিয়ে তার মর্যাদাকে হেয় করে।
  • ৬. ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী: নৈরাজ্যবান ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধিতা করে এবং তা উচ্ছেদের সুপারিশ করে। প্রধোর মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হচ্ছে চৌর্যবৃত্তির ফল। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের শোষণের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে ওঠে। এটা সমাজের সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অনিষ্ট, দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের কারণ। এমনকি তা মানুষের আত্মিক ও সামাজিক উন্নতির অন্তরায়। কাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী বলে নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন।
  • ৭. প্রতিনিধিত্বের বিরোধী: নৈরাজ্যবাদ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থার বিরোধী। নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন, এ ধরনের সরকার চতুরমাত্র এবং তা বাস্তবসম্মত নয়। তাদের মতে, এরূপ সরকার দুর্বল ও অদক্ষ এবং বাস্তবে একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে
  • ৮. বিবর্তন ও বিপ্লবকে সমর্থন: নৈরাজ্যবাদীগণ বিবর্তন ও বিপ্লব উভয় ধারাতেই বিভক্ত। বিবর্তনপন্থীরা মনে করেন, বিবর্তনের পথ ধরে একদিন অনিবার্যভাবে নৈরাজ্যিক সমাজ গঠিত হবে। অপরদিকে, বিপ্লবপন্থীরা বিপ্লব ও সহিংস পন্থায় নৈরাজ্যিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। তবে কোনো কোনো নৈরাজ্যবাদী মনে করেন যে, বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী শক্তিগুলোকে অপসারণের জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন ।

নৈরাজ্যবাদের সমালোচনা

রাষ্ট্রধীন ও শ্রেণিহীন অবস্থায় এক ধরনের উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ নৈরাজ্যবাদ করেছে যাতে ব্যক্তি প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। কেননা, রাষ্ট্র, ধর্ম ও পুঁজিবাদের শাসন-শোষণে ব্যক্তির স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়। এরূপ মহতি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নৈরাজ্যবাদ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে :

  • ১. নৈরাজ্যবাদীগণ মনে করেন, কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যকার সম্পর্ক বিরোধিতামূলক। এই ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, রাষ্ট্র ও সরকারের অনুপস্থিতিতে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে সকল মানুষের স্বাধীনতা থাকে না। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বই মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে।
  • ২. নৈরাজ্যবাদীগণ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ধ্বংসের পক্ষে যা বাস্তবসম্মত নয় এবং কাঙ্ক্ষিতও নয়। নৈরাজ্যবাদীদের সুপারিশকৃত স্বেচ্ছামূলক সংগঠন রাষ্ট্রের বিকল্প হতে পারে না। কেননা, রাষ্ট্র এত বেশি সংখ্যক কাজ করে যেগুলো এসব সংগঠনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সমাজের বিভিন্নমুখী কার্য সম্পন্ন করতে হলে কোনো না কোনো ধরনের কর্তৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে।
  • ৩. “মানুষের নৈতিকতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিকশিত হয়”-এ কথা সত্য। কিন্তু তা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্র মানুষের নৈতিকতা বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র ও পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কাজেই ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ রাষ্ট্র ব্যতীত সম্ভব নয় ।
  • ৪. “মানুষের প্রবৃত্তি খুব উত্তম”—এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে নৈরাজ্যবাদীরা তাদের নৈরাজ্যিক সমাজের কল্পনা করেছেন। কিন্তু মানুষ তো স্বার্থপরও বটে। কাজেই স্বার্থপর মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের অনুরূপ কর্তৃত্ব প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমানে মানব সমাজ এত বেশি জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল হয়েছে যেগুলো সমাধানের জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
  • ৫. “রাষ্ট্র নিছকই একটি বলপ্রয়োগকারী কর্তৃত্ব”-নৈরাজ্যবাদীদের এরূপ ধারণা একপেশে ও অতিরঞ্জিত। বাস্তবে রাষ্ট্র বাধ্যবাধকতা ও সহযোগিতা উভয় পদ্ধতিতেই কাজ করে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সেবামূলক খাতগুলো বলপ্রয়োগের বাইরে থাকে। “রাষ্ট্র দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য বলপ্রয়োগ করে”-নৈরাজ্যবাদীরা এই সত্যকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন নি।
  • ৬. নৈরাজ্যবাদ মানুষের সামাজিকতা, যুক্তিবাদিতা ও সহযোগিতার ওপর প্রয়োজনে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে। কিন্তু বাস্তবে এসবের বিপরীত প্রবণতাগুলোও মানব আচরণকে ভীষণভাবে প্রভাবিত ও নির্ধারিত করে। কাজেই নৈরাজ্যবাদের একমুখী বিশ্লেষণ বাস্তবতাবর্জিত।
  • ৭. সমাজের যা কিছু খারাপ তা “রাষ্ট্র, ধর্ম ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের সাথে উচ্ছেদ হয়ে যাবে”-নৈরাজ্যবাদীদের এরূপ ধারণা সঠিক নয়। কেননা, এসবের মূলে রয়েছে অনেক উপাদান এবং বাতির স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, ক্ষমতা স্পৃহা, দৈহিক চাহিদা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। কাজেই কেবল রাষ্ট্র, ধর্ম ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদ করে সমাজের সকল খারাপ উচ্ছেদ করা যাবে না।
  • ৮. নৈরাজ্যবাদীগণ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় যে সমাজের কল্পনা করেছেন তা নিছকই কল্পনা মাত্র বাস্তবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের কল্পিত সমাজ ন্যায়বিচার, যুক্তিবাদিতা ও উচ্চতর মানবিক গুণাবলির ওপর ভিত্তিশীল যেগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রায়ই অনুপস্থিত। কাজেই স্বার্থপরতা, লোভ- লালসা ইত্যাদি মানবিক প্রবৃত্তিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ নিয়ে কীভাবে নৈরাজ্যিক সমাজ গঠন করা সম্ভব সে উত্তর নৈরাজ্যবাদে নেই।
  • ৯. ইতিহাস হতে দেখা যায় যে, মানুষের সভ্যতার গতি ও রাষ্ট্রের উপস্থিতি পাশাপাশি চলেছে। রাষ্ট্র ব্যতীত শাস্তি ও অগ্রগতি থাকতে পারে না। রাষ্ট্র এমন পরিবেশের সৃষ্টি করে যাতে সভ্যতা বিকশিত হতে পারে। সভ্য মানব সমাজে সরকার বা অনুরূপ কর্তৃপক্ষ থাকবে বা সভ্যতার অগ্রগতিতে সহায়তা করবে। বাস্তবে নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উচ্ছে করলেও সেখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ন্যায় অনুরূপ কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটবে।
  • ১০. সমালোচকগণ নৈরাজ্যবাদকে ধ্বংসের দর্শন বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবে তারা সহিংস, ধ্বংস ও হত্যার পথ অনুসরণ করে ন্যায়, ভালোবাসা ও সহযোগিতাভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। বাস্তবে এটা সম্ভব নয়।

ফ্যাসিবাদ (Fascism)

ফ্যাসিবাদ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Fascism, যা ল্যাটিন শব্দ Fascia থেকে এসেছে। Fascia শব্দের অর্থ হলো ‘একবোঝা লাঠির সাথে একটি কুঠার”। Fascia শব্দটি ছিল ঐক্য, সংহতি ও কর্তৃত্বের উৎস। প্রাচীন রোমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীকরূপে একবোঝা লাঠির সাথে একটি কুঠার বাধা থাকত। সাধারণ ভাষায় নৈতিকতা বিরোধী একনায়কতান্ত্রিক শাসনই হলো ফ্যাসিবাদ। তবে বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকজন দার্শনিকের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :

  • অধ্যাপক স্যাবাইন এর মতে, “ফ্যাসিবাদ হলো পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুসারে বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ভাবধারার সমন্বয়।”
  • মরিস ক্রানসটন এর মতে, “হেগেলের অধিবিদ্যামূলক চিন্তাধারা এবং সোরেলের সক্রিয়তাবাদী মতবাদের সমন্বয়ে ফ্যাসিবাদ এর জন্ম।”
  • ইবেনস্টান এর মতে, “ফ্যাসিবাদ হলো অন্ধ জাতীয়তাবাদী, জাভি-বিধ্বংসী আগ্রাসী এবং সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একদলীয় সরকার এবং সমাজের এক সামগ্রিকতাবাদী বা সর্বগ্রাসী মতবাদ”
  • রজনী পাম দত্ত ফ্যাসিবাদকে ‘শোধনবাদের সন্তান’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, “ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের বিকল্প এবং স্বতন্ত্র পথ নয়। পুঁজিবাদের বিরোধিতা থেকেও ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটে নি। উপরন্ত ফ্যাসিবাদ হলো পুঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি এবং পূর্ণতা।”

পরিশেষে বলা যায় যে, ফ্যাসিবাদ হলো এমন এক মতবাদ যেখানে রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মতপ্রকাশ, চিন্তা, বিশ্বাস, সংগঠনের অধিকার নেই ।

ফ্যাসিবাদের পটভূমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই মানুষের মনে জাতীয়তাবাদ এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তিবাদী মতাদর্শ বিকাশ লাভ করতে পারে নি। ফলে সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথ প্রশস্ত হয়েছে, যা থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্য। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক মতাদর্শরূপে বিগত শতাব্দিতে ধূমকেতুর মতো ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হয়। ফ্যাসিবাদ কোনো দার্শনিক তত্ত্ব নয়, বরং বর্বরতার এক বাহ্যিক প্রকাশ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে ইতালির রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সংকট ফ্যাসিবাদকে ত্বরান্বিত করে। তৎকালীন ইতালির একনায়ক বেনিটো মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের তত্ত্বগত কাঠামো নির্মাণ করে মতাদর্শটিকে বাস্তবে রূপদান করেন। তরুণ বয়সে মুসোলিনি সমাজবাদী দলের সাথে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি সমাজবাদী দলের মুখপাত্র এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমাজবাদী দল ইতালির অংশগ্রহণের বিরোধিতা করায় তিনি দল থেকে পদত্যাগ করে। কেননা, তাঁর ইচ্ছা ছিল ইতালি বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করবে। যুদ্ধের বাস্তব অবস্থা মুসোলিনির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেয়। যুদ্ধ শেষে তিনি দেশে ফিরে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাছাড়া তিনি ম্যাকিয়াভেলির দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি ম্যাকিয়াভেলির ‘দি প্রিন্স’ (The Prince) গ্রন্থ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বৈরাচারী কলাকৌশল শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি সুইজারল্যাণ্ডে অবস্থানকালে প্যারেটোর সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁর এলিট তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনাচার ও অবিচারের দরুন ইতালিতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তখন মুসোলিনি ইতালির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ফ্যাসিবাদী আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নেন। তিনি ইতালির নেতৃত্ব গ্রহণের পর সর্বশ্রেণির লোকদের নিয়ে একটি ‘সংগ্রামী বাহিনী’ গঠন করেন। সংগ্রামী বাহিনী গঠনের পর তিনি ১৯২১ সালে রোমে এক অধিবেশনে ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্য বর্ণনাকালে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলো শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও স্তরভিত্তিক।

তৎকালীন রাজা তৃতীয় ভিক্টোরিও মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান। মুসোলিনি ভিট্টোরিওর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইতালির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সকল বাধা অতিক্রম করেন এবং সর্বাত্মকবাদী পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কথা হলো “Every thing for the state, nothing against the state, nothing outside of the state.” তাঁর মতে, রাষ্ট্রই সব, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। রাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ব্যক্তিকে তাঁর নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হবে। কেননা, মানুষের সকল কল্যাণের উৎস হলো রাষ্ট্র। যে কারণে রাষ্ট্র মানুষের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করবে। মুসোলিনি নিজেই বলেন, মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদ ম্যাকিয়াভেলির সুবিধাবাদী তত্ত্ব, হেগেলের রাজনৈতিক চরমতাবাদ, সোরেলের হিংসার তত্ত্ব, উইলিয়াম জেমসের অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।

ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য

ফ্যাসিবাসের তাত্ত্বিকতা বিচার করলে ফ্যাসিবাদের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়:

  • ১. মৌলিক অধিকার অস্বীকৃতি: ফ্যাসিবাদ মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় না। স্বাধীনতার বিরোধিতাই ফ্যাসিবাদের নীতি। ব্যক্তির প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী রূপে গণ্য করা হয়। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তিত্বকে সর্বশক্তিমান শাসকের পদতলে বিসর্জন দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদী শাসনে ব্যক্তির একমাত্র অধিকার হলো ফ্যাসিবাদের প্রতি দ্বিধাহীন ও নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশের অধিকার।
  • ২. উগ্র জাতীয়তাবাদ: ফ্যাসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়। সাময়িকতাবাদ, পররাজ্য গ্রাস, আক্রমণমুখী নীতি এবং কার্যকলাপকেই ফ্যাসিবাদী সরকার জাতির মেরুদণ্ড রূপে গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা জনগণকে মোহগ্রস্ত করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়। আবার সাম্রাজ্যবাদ গণতন্ত্র ও বিশ্বমৈত্রীর প্রধান শত্রু।
  • ৩. গণতন্ত্র বিরোধী: ফ্যাসিবাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক সরকারকে ফ্যাসিস্টগণ অবাস্তব বলে মনে করেন। গণতন্ত্রের বিরোধী বলে ফ্যাসিবাদ জনগণের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী নয়। তাদের মতে, স্বাধীনতা কোনো অধিকার নয়, কর্তব্য মাত্র। রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য থেকেই মানুষ স্বাধীন হতে পারে। এখানে জনগণের মত প্রকাশ, চিন্তা ও সংগঠনকে অধীকার করা হয়।
  • ৪. স্বায়ত্তশাসন বিরোধী: ফ্যাসিবাদ যে কোনো প্রকার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরোধী। সামগ্রিক জীবনের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ইতিহাসের গতিকে নিয়ন্ত্রিত করতে উৎসুক। ফ্যাসিবাদ মানবজীবনের অগ্রগতির বিরোধী। ফ্যাসিবাদ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর স্বার্থে পরিচালিত হয়।
  • ৫. জনসাধারণের কন্ঠরোধ: রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনা প্রসারের ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ফ্যাসিবাদী শাসনে মতপ্রকাশ, সভা-সমিতি গঠন এবং সমাবেশের অধিকারের উপর বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণার মাধ্যমে এই শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণ এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের কন্ঠরোধ করে। ফ্যাসিবাদ শিক্ষা ব্যবস্থায়ও তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
  • ৬. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব: ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রেই সর্বেসর্বা। এ ব্যবস্থায় জনমতের কোনো মূল্য নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অর্থাৎ, ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে রাষ্ট্র সকলের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন প্রত্যেকের কর্তব্য। এখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না।
  • ৭. উদারতাবাদের বিরোধী: ফ্যাসিবাদ উদারতাবাদকে স্বীকার করে না। এ মতবাদ উদারনৈতিক মতবাদ ও মূল্যবোধের বিরোধী। ফ্যাসিবাদে গণতন্ত্রের সকল নীতি, জনগণের সার্বভৌমিকতা, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সাম্য, মৌলিক স্বাধীনতা, জনগণের সম্মতি, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণসহ উদারতাবাদের সকল নীতির বিরোধিতা করে।
  • ৮. একদলীয় ব্যবস্থা: ফ্যাসিবাদ একদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কেননা, সকল প্রকার বিরোধিতা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কঠোরভাবে দমন করাই তার লক্ষ্য। একমাত্র ফ্যাসিস্ট পার্টিই জনগণের বিবেক ও বুদ্ধির অভিভাবক। এই দলের মাধ্যমে এবং নেতৃত্বেই জাতির বিকাশ ও অগ্রগতি সম্ভব।
  • ৯. পাশবিক শক্তি প্রতিষ্ঠা: ফ্যাসিবাদ পাশবিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ভীতি প্রদর্শন, দৈহিক বলপ্রয়োগ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যবস্থা যুক্তির পরিবর্তে বলপ্রয়োগকে প্রশ্রয় দেয়। ফ্যাসিবাদ মানুষকে চরম যুক্তিহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
  • ১০. জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী: ফ্যাসিবাদ জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। ফ্যাসিবাদ আঞ্চলিকতা এবং ধর্মীয় মতান্ধতার আশ্রয় গ্রহণ করে। যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চল, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং উপজাতির মধ্যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
  • ১১. আন্তর্জাতিকতা বিরোধী: ফ্যাসিবাদ শান্তি, সংহতি, মানবজাতির ঐক্য এবং আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। এটা আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী নয়। ফ্যাসিবাদ জাতি-বিরোধী। জাতি বিদ্বেষের মাধ্যমে মানবজাতির সম্পদ ও উত্তরাধিকারের ভাণ্ডারকে দরিদ্র করেছে।

গণতন্ত্র, উদারনৈতিকতা, সমাজতন্ত্র, যুক্তি নিষ্ঠাসহ সকল বিষয়ের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ আদিম বর্বর জীবনের সূচনা করেছিল। বিদ্বেষ ও হিংসার আগুনে সভ্যতাকে বিনাশ করেছিল। সভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ ছিল এক দুঃস্বপ্ন। তবে এটাও বলা যায় যে, এমন এক সময়ে ফ্যাসিবাদের সূচনা ঘটেছিল যখন ইতালির জনজীবন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার দরুন সংকটাপন্ন এবং মানুষ আশ্রয় খুঁজেছিল শক্তিশালী নেতৃত্বের। এমন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মুসোলিনির ইতালির হাল ধরা ছিল একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ এবং ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে স্বজাতিকে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মুসোলিনি কৃতিত্বের দাবিদার।

নাৎসিবাদ (Nazism)

সাধারণ ভাষায় বলা যায় যে, মতবাদ মানুষের অধিকার হরণ করে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তাকেই নাৎসিবাদ বলা হয়। অধ্যাপক গণি এর মতে, “সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনসহ সম ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করাই নাৎসিবাদের উদ্দেশ্য। এখানে রাষ্ট্রের মাধ্যমেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রাষ্ট্রের বাইরে কিছুই থাকে না।” সুতরাং বলা যায় যে, উদারতাবাদ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী মতবাদ হলো নাৎসিবাদ। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না। রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রতি অনুগত থেকেই ব্যক্তিকে স্বাধীন থাকতে হয়। এখানে মতপ্রকাশ, চিন্তা, বিশ্বাস ও সংগঠনের অধিকার স্বীকার করা হয় না। এ মতবাদ জাতি বিদ্বেষী মতবাদ। এখানে পুঁজিবাদের নগ্ন রূপকে প্রতিফলিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

নাৎসিবাদের পটভূমি

বিংশ শতাব্দিতে যে কয়েকটি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক তত্ত্ব দানাবেঁধে উঠেছি নাৎসিবাদ তাদের অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। উভয়েই সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রবিরোধী মতবান এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে। জার্মানির হিটলার নাৎসিবাদের প্রতিষ্ঠাতা। জার্মানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষিতে হিটলার নাৎসিবাদের সূচনা করেন।

১৮৭১ সালে জার্মানিতে রাইখ শাসন শুরু হয়। তখন জার্মানিতে শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও সম্রাট কাইজার প্রথম উইলহেমই (১৮৭১-১৮৮৮) ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তারা একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যায় জার্মানিকে শাসন করতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৮৯০ সালে বিসমার্ক জার্মানিতে চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তিনি জনহিতকর কাজ করার চেষ্টা করলেও তার শাসনতন্ত্র ছিল কাইজারের ন্যায় একনায়কতান্ত্রিক। তবে একথা সত্য যে, বিসমার্কের শাসনকাল থেকেই জার্মানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বেঁধে ওঠে। আর তখন থেকেই জার্মানরা নিজেদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলে জার্মানির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ফলে সেনাবাহিনী, সাধারণ মানুষ, শ্রমিক শ্রেণি ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অপরদিকে, যুদ্ধত্তোর নীতির প্রশ্নে জার্মান সমাজবাদী দল দু’টি উপদলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথমটি স্পার্টাসিস্ট, যা শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাসহ সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিল। অপরটি ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’, যা জার্মানির অবাধ নির্বাচন ও সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে ছিল। অর্থাৎ ‘স্পার্টাসিস্ট’ দল চেয়েছিল সমাজতন্ত্র কায়েম করতে এবং ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’ চেয়েছিল সংসদীয় তথা সমাজ সংস্কারের পক্ষে। এ অবস্থায় দল দুটির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখা দেয়। সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে স্পার্টানিস্টনের সুজন ঊর্ধ্বতন নেতা নিহত হলে দলটি দুর্বল হয়ে যায় এবং ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’ দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ফলে ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক দল জার্মানির নেতৃত্বে চলে আসে এবং এই দলটির প্রচেষ্টায় ১৯১৯ সালে ওয়াইমার সংবিধান প্রবর্তিত হয়। যেহেতু পূর্ব থেকেই দলটি সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে ছিল সেহেতু এ সংবিধানে গণতন্ত্র সহ জনগণের মৌলিক অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়।

‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক’ দলটি জার্মানিকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে গেলেও দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কোন্দল ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। স্বার্থবাদী মহল সরকারের বিরুদ্ধে ওঠে পড়ে লাগে এবং সরকারের উন্নয়নমূলক পদক্ষেপগুলোকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অসহযোগিতা দেখা দেয়। অপরদিকে বিশ্বব্যাপী দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। জার্মানিও এ অবস্থার হাত থেকে রেহাই পায় নি। এই নাজুক পরিস্থিতিতে জার্মানিতে National Socialist Party নামে একটি পার্টির উত্থান ঘটে। আর এ পার্টির নেতৃত্ব দেন এডলফ হিটলার। হিটলার দেশের বিরাজমান সমস্যাসমূহকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে এবং শ্রমিক শ্রেণিকে তার ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন। ফলে ১৯৩৩ সালে হিটলারের National Socialist Party বা নাৎসি পার্টি একটি বৃহৎ পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নাৎসি পার্টি আত্মপ্রকাশের পর তাদের নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

হিটলারের পরিচয় ও রাজনৈতিক জীবন

এডলফ হিটলার ১৮৮৯ সালের ২০শে এপ্রিল অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের কয়েকটি বছর কাটে ভিয়েনায়, যেখানে তিনি রাজনীতিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। একই সাথে তার মধ্যে তীব্র মার্কস বিরোধী ও ইহুদি বিরোধী বিদ্বেষ গড়ে উঠতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পূর্বে তিনি জার্মানির মিউনিখ যান এবং সেই যুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে ব্যাভেরিয়ার পক্ষে অংশ নিয়ে কর্পোরাল পদে উন্নীত হন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের পর শান্তিচুক্তির মাধ্যমে জার্মানির প্রতি যে কঠোর শর্তাবলি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাতে অন্যান্য জার্মানবাসীর ন্যায় হিটলারও মর্মাহত হন। যুদ্ধ পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি জার্মানিতে রাজনৈতিক ভবঘুরে জীবন কাটান এবং অতঃপর নাৎসি পার্টি গঠনের প্রয়াস পান। আর এই প্রয়াসই তাকে জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার সুযোগ এনে দেয় ।

নাৎসিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

নাৎসিবাদের যেসকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

  • ১. উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসার : নাৎসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়। সামরিকতাবাদ, পররাজ্য গ্রাস, আক্রমণমুখী নীতি এবং কার্যকলাপকেই এই সরকার জাতির মেরুদণ্ডরূপে গণ্য করে। নাৎসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদ দ্বারা জনসাধারণকে মোহগ্রস্ত করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। সাম্রাজ্যবাদ গণতন্ত্র এবং বিশ্বমৈত্রীর প্রধান শত্রু।
  • ২. নাগরিকের মৌলিক অধিকার অস্বীকৃত: নাৎসিবাদ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় না। স্বাধীনতার বিরোধিতাই নাৎসিবাদের নীতি। ব্যক্তির প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী রূপে গণ্য করা হয়। নাৎসিবাদে ব্যক্তিত্বকে সর্বশক্তিমান শাসকের পদতলে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই শাসনে ব্যক্তির একমাত্র অধিকার হলো নাৎসিবাদের প্রতি দ্বিধাহীন ও নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশের হাতিয়ার।
  • ৩. মত প্রকাশে বাধা : নাৎসিবাদ জনসাধারণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনা প্রসারে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে। এই শাসনে মত প্রকাশ, সভা-সমিতি গঠন, সমাবেশের অধিকারের ওপর বাধা- নিষেধ আরোপিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণার মাধ্যমে এই শাসনে জনসাধারণ এবং নাৎসিবাদ বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে।
  • ৪. একদলীয় ব্যবস্থা : নাৎসিবাদ একদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কেননা, সকল প্রকার বিরোধিতা ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে কঠোরভাবে দমন করাই তার লক্ষ্য। একমাত্র নাৎসি পার্টিই জনগণের বিবেক ও বুদ্ধির অভিভাবক। এই দলের মাধ্যমে এবং নেতৃত্বেই জাতির বিকাশ ও অগ্রগতি সম্ভব।
  • ৫. জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী : নাৎসিবাদ জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। নাৎসিবাদ আঞ্চলিকতা এবং ধর্মীয় মতান্ধতার আশ্রয় গ্রহণ করে। যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চল, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং উপজাতির মধ্যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
  • ৬. একক শক্তির প্রতিষ্ঠা: নাৎসিবাদ পাশবিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ভীতি প্রদর্শন, দৈহিক বলপ্রয়োগ এই শাসনব্যবস্থার স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থা মুক্তির পরিবর্তে বলপ্রয়োগে প্রশ্রয় দেয় । নাৎসিবাদ মানুষকে চরম যুক্তিহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
  • ৭. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব : নাৎসিবাদী শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা। এ ব্যবস্থায় জনমতের কোনো মূল্য নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অর্থাৎ, নাৎসিবাদী মতাদর্শে রাষ্ট্র সকলের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন প্রত্যেকের কর্তব্য ! এখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না।
  • ৮. উদারতাবাদের বিরোধী : নাৎসিবাদ উদারতাবাদকে স্বীকার করে না। এ মতবাদ উদারনৈতিক মতবাদ ও মূল্যবোধের বিরোধী। নাৎসিবাদে গণতন্ত্রের সকল নীতি, জনগণের সার্বভৌমিকতা, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সাম্য, মৌলিক স্বাধীনতা, জনগণের সম্মতি, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণসহ উদারতাবাদের সকল নীতির বিরোধিতা করে।
  • ৯. অর্থনৈতিক বৈষম্য: নাৎসিবাদের অর্থনৈতিক নীতির সাথে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রবাদের পার্থক্য আছে। নাৎসিবাদ উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর জাতীয়করণে বিশ্বাসী নয়। ব্যক্তিগত পুঁজির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। নাৎসিবাদ ছিল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী।
  • ১০. বিপ্লবের সম্ভাবনা : নাৎসিবাদে জনসাধারণের সকল দাবি ও অধিকার পদদলিত হয়। নির্যাতন, দমন পীড়ন, সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক শোষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। জনসাধারণ এই শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে না। ফলে নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ বিপ্লবের রূপ ধারণ করে ।

জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদের উত্থানের কারণসমূহ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির ইতিহাসকে “উইমার প্রজাতন্ত্র” ও “ডিক্টেটরশীপ”-এই দুইভাগে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ, জার্মান সম্রাট কাইজার উইলহেমের (১৮৮৮-১৯১৮) পলায়ন ও সিংহাসনচ্যূতির পর ১৯১৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধিরা জার্মানির ভাইমার নামক স্থানে জাতীয় সংবিধান সভার অধিবেশনে মিলিত হয়ে জার্মানির জন্য যে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান ও কোয়ালিশন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তা ভাইমার প্রজাতন্ত্র নামে খ্যাত। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগে শেষ পর্যন্ত উইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে এবং জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এডলফ হিটলার ও তার নাৎসি দলের আবির্ভাব ঘটে। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে হিটলার জার্মানিতে ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠা করেন। যে সমস্ত ঘটনা বা কারণ হিটলার ও তার নাৎসি দলের জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

  • ১. অবমাননাকর ভার্সাই সন্ধি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর বিজয়ী ও মিত্রশক্তিবর্গ ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে জার্মানির উপর এক অবমাননাকর সন্ধি বা চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে জার্মানির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে পদলিত করে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দেয়ার প্রয়াস চালায়। কেননা এই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সীমানা সংকুচিত করার পাশাপাশি উপনিবেশগুলোও কেড়ে নেয়া হয়, সামরিক শক্তি হ্রাস করা হয়, বিশাল পরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, এমনকি মিত্রশক্তির সৈন্যবাহিনীকে জার্মানির খরচে জার্মানিতে মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের ঘৃণ্য ও অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য হিটলারের মনে ব্যাপক উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল, যা তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় ।
  • ২. রাজতন্ত্রের অবসান ও হিটলার কর্তৃক নাৎসিদল গঠন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সংকটময় আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জার্মান সম্রাট কাইজার উইলহেম জার্মানি ত্যাগ করে হল্যাণ্ডে আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে জার্মানিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং এটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। “কাউন্সিল অব পিপলস্ কমিসার” নামে একটি কার্যনির্বাহক সমিতির উপর প্রজাতান্ত্রিক জার্মান সরকারের শাসনভার সাময়িকভাবে ন্যস্ত হলেও নতুন সরকার জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এসময় জনসাধারণের চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশার সুযোগ নিয়ে এডলফ হিটলার ও তাঁর অনুচরবর্গ “National Socialist” বা নাৎসি (Nazi) নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এ নাৎসি দল হিটলার কর্তৃক জার্মানির ক্ষমতা দখলের ভিত্তিই শুধু তৈরি করেনি বরং ইউরোপীয় ইতিহাসের গতিধারাকেও প্রভাবিত করে।
  • ৩. হিটলারের ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টায় কারাদণ্ড ও “Mein Kampf” গ্রন্থ রচনা : ১৯২৩ সালে হিটলার জেনারেল লডেনডর্ফ ও অন্যান্য অনুচরদের সহায়তায় জার্মানির ভাইমার সরকারকে উৎখাতের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালান। আর এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ তাকে কিছুদিনের জন্য কারাভোগ করতে হয়। কারাভোগের সময় হিটলার নাৎসিদলের বাইবেল খ্যাত Mein Kamp গ্রন্থের অধিকাংশ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি যেসমস্ত কর্মসূচি তুলে ধরেন তা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। যার ফলশ্রুতিতে হিটলারের কারাদণ্ড ও বিচারের বিরুদ্ধে সমগ্র জার্মানিতে গভীর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কেননা, হিটলার ও নাৎসিদলের কর্মসূচি জার্মান জাতিকে মুক্তির সন্ধান দিয়েছিল।
  • ৪. হিটলারের ঘোষণা ও নাৎসি দলের কর্মসূচি: হিটলার তার মেইন ক্যাম্প গ্রন্থে সর্বপ্রথম ভার্সাই সন্ধিকে বাতিল করে জার্মানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মাধ্যমে একটি বৃহত্তর জার্মান রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি তার উপনিবেশিক অঞ্চল বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, হিটলার তথা নাৎসি দলের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল, যে কোনো পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ভার্সাই সন্ধিকে বাতিল করে জার্মানদেরকে উগ্র জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর এক্ষেত্রে দুর্দশাগ্রস্ত জার্মানরা মুক্তির আশায় হিটলারের যে কোনো প্রচারকার্যে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল বিধায় হিটলার ও নাৎসি দলের পক্ষে সাফল্য লাভ করা সম্ভব ছিল।
  • ৫. নেতৃত্ব ও জনসমর্থন আদায় : নাৎসি দল গঠনের পর হিটলার বিভিন্ন জনসভায় ধনতন্ত্র, ইহুদি, ফরাসি, ভার্সাই সন্ধি ও ভাইমার প্রজাতন্ত্রের নিন্দা করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে থাকেন। তাঁর স্পষ্টবাদিতা ও প্রতিভাময়ী বক্তব্য জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিক্ষিত, বেকার যুবক, বণিক ও কৃষক সম্প্রদায় তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর ও নাৎসি দলের প্রতি জনগণের সমর্থন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা হিটলারকে আরো উদ্দীপ্ত করে তুলে ।
  • ৬. জার্মান জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি : ভাইমার প্রজাতন্ত্রের শাসকবর্গ, বিশেষত স্ট্রেসম্যান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় স্বীকার করে বিজয়ীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ শুরু হয়। অপরদিকে, যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার এবং জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করে হিটলার জার্মানবাসীর সমর্থন লাভে সক্ষম হন। হিটলারের এসকল প্রচারণা মূলত জার্মানদেরকে উত্তেজনাকর জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত করে।
  • ৭. আধা-সামরিক বা ঝটিকা বাহিনী গঠন : নাৎসি দলের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য হিটলার বেকার যুবক ও যুদ্ধ ফেরত সেনাদল নিয়ে আধাসামরিক ও ঝটিকা বাহিনী নামে এক গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন। নাৎসি দলের সভা সমিতি রক্ষা করা এবং অন্যান্য দলের সভা- সমিতি ভেঙে দেওয়াই ছিল এই বাহিনীর কাজ। অর্থাৎ এই বাহিনী হিটলারের উত্থান এবং ক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়তা করে।
  • ৮. গণতান্ত্রিক সরকারের দুর্বলতা : ভাইমার শাসনতন্ত্রের অধীনে গণতান্ত্রিক সরকারের দুর্বলতা জনগণকে একজন লৌহমানবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ফলে হিটলার সে সুযোগে অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বহির্বিশ্বে মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দানের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে একজন লৌহমানব হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চালান।
  • ৯. হিটলারের সর্বাত্মক ক্ষমতা লাভ : ১৯৩১ সালের সাধারণ নির্বাচনে হিটলারের নাৎসি দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে হিটলার চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। ১৯৩৪ সালে হিণ্ডেনবুর্গের মৃত্যুর পর হিটলার একইসাথে প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর পদ গ্রহণ করেন এবং পার্লামেন্টকে যাবতীয় ক্ষমতা তার নিজ হাতে সমর্পণ করাতে রাজি করান। আর এভাবেই হিটলার সমগ্র জার্মানিতে এক অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেন।
  • ১০. ইহুদি ও কমিউনিস্ট দলন : হিটলার ছিলেন ইহুদি ও কমিউনিস্ট বিরোধী। তার অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে বহু ইহুদি জার্মানি ত্যাগ করে। কমিউনিস্টনের দমন করার জন্যও তিনি একই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার আদেশে জার্মানিতে মার্কসবাদের প্রচার বন্ধ করা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয় এবং কমিউনিস্টদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এভাবে দমনপীড়নের মাধ্যমে নাৎসি বিরোধী সকল দলকে পঙ্গু করে তিনি জার্মানিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
  • ১১. শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ ও অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন : দেশের সমগ্র শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করে হিটলার জার্মানির অর্থনৈতিক উন্নতি ও অপরাপর সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন। তিনি আমদানির বিপরীতে রপ্তানি বৃদ্ধি করেন, জমির খণ্ডিতকরণ হ্রাস করার জন্য উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করেন, কৃত্রিম উপায়ে পেট্রোল, পশম, রাবার, কাপড় প্রভৃি প্রস্তুতের বৈজ্ঞানিক প্রণালী তারই পৃষ্ঠপোষকতায় আবিষ্কৃত হয়। পরিত্যক্ত লোহা পরিশোধন এবং পুরাতন লোহা খনি হতে যথাসম্ভব উত্তোলন করে উন্নয়নের কাজে লাগানো হলো। হিটলারের এই সমস্ত অর্থনৈতিক নীতি জনগণ গ্রহণ করেন।
  • ১২. সামরিক শক্তি বৃদ্ধি : পদাতিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে হিটলার একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন, তেমনি অপরদিকে দেশের বেকার সমস্যাও বহুল পরিমাণে লাঘব করেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করে হিটলার ক্রমান্বয়ে ভার্সাই সন্ধির শর্তসমূহ অমান্য করতে থাকেন।
  • ১৩. নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বর্জন ও লীগ অব নেশনস্ ত্যাগ : ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষর করায় জার্মানিকে লীগ অব নেশনস্ এর সদস্য করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৩ সালে সামরিক শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হিটলার নিরস্ত্রীকরণ বৈঠক হতে বের হয়ে আসেন এবং লীগ অব নেশনস্ এর সদস্যপদ ত্যাগ করেন। ফলে হিটলার ও জার্মানির ভবিষ্যৎ পন্থা কী হবে তা সহজেই ধারণা করা যায়।
  • ১৪. হিটলার কর্তৃক রাইন অঞ্চল দখল : ১৯৩৬ সালে হিটলার ভার্সাই সন্ধির শর্তাদি ভঙ্গ করে রাইন অঞ্চলটি দখল করার পরও ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের নিকট হতে কোনো তীব্র প্রতিবাদ করা না হলে হিটলার তার আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করে চলেন।
  • ১৫. ফ্রান্স ও বৃটেনের জার্মান ভীতি : হিটলার ইউরোপীয় শক্তিসমূহের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা করা মাত্র বৃটেন ও ফ্রান্স জার্মানির সাথে অতি নম্র নীতি অনুসরণ করতে থাকে। কারণ তৎকালীন সময়ে জার্মানি ইউরোপের যে কোনো শক্তিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখেন-হিটলারের অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে সেই পরোক্ষ ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ছিল।
  • ১৬. হিটলার ও মুসোলিনীর মিত্রতা : হিটলারের উত্থান আরো সুসংহত হয় এক সময়কার হিটলার বিরোধী নেতা ইটালির মুসোলিনী কর্তৃক হিটলারের সাথে মিত্রতা স্থাপনের মাধ্যমে। এই মিত্রতার পথ ধরে জার্মানি ও ইটালি কর্তৃক জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সাহায্যদান এবং সুদূর প্রাচ্যে জাপানের সাথে মিত্রতা স্থাপন প্রভৃতি দ্বারা ইউরোপ তথা পৃথিবীর রাজনীতির ক্ষেত্রে হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি যে শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল তা অনুমান করা যায়।
  • ১৭. স্পেনের মিত্রতা লাভ : ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি জার্মানির সহায়তায় স্পেনের কমিউনিস্ট বিরোধী বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রী জেনারেল ফ্রাঙ্কো স্পেনের ক্ষমতায় আসীন হলে হিটলার ও মুসোলিনীর সমর্থক আরো একটি তৃতীয় শক্তির সৃষ্টি হয়, যা হিটলারের উত্থানে সহায়তা করে।
  • ১৮. হিটলার কর্তৃক অস্ট্রিয়া দখল : ১৯৩৮ সালে হিটলার জার্মানির সামরিক সর্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করে তার ইচ্ছেমতো রাজ্যগ্রাস নীতি অনুসরণ করে চলেন এবং স্বল্পকালের মধ্যে সৈন্য প্রেরণ করে অস্ট্রিয়া দখল করেন।
  • ১৯. চেকোস্লাভাকিয়ার উপর প্রাধান্য বিস্তার : ১৯৩৮ সালে স্বাক্ষরিত মিউনিখ চুক্তির আওতায় হিটলার চেকোস্লাভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চলটি লাভ করলেও পরবর্তীতে যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে চেকোস্লাভাকিয়ার অন্য দুটি প্রদেশ বোহেমিয়া ও মোরাভিয়াকেও জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করেন।
  • ২০. পোল্যান্ডের উপর হিটলারের দাবি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা : হিটলার পোল্যান্ডের নিকট ডানজিগ বন্দর এবং পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে পূর্ব-প্রাশিয়া ও জার্মানির অবশিষ্টাংশের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য আরও একখণ্ড জমি দাবি করেন। পোল্যাণ্ড হিটলারের এ দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ৩ সেপ্টেম্বর ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। আর এই সময়টাই ছিল হিটলারের উত্থানের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত পর্যায়।

তাছাড়াও হিটলারের উত্থানে তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলিও বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও একজন গণবক্তা। তিনি তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে তরুণ ও বেকার যুব সমাজসহ সকল শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন।

জার্মানির এক সংকটাপন্ন সময়ে হিটলারের রাজনীতির সর্বোচ্চ চূড়ায় আগমন। এই সময়ে হিটলার তার জনপ্রিয় নীতি ও কর্মসূচির পাশাপাশি দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধের পরিচয়দানের মাধ্যমে জার্মান জনগণের সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদ নীতি ও আগ্রাসনমূলক মনোভাব যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করে, তেমনি তাঁর পতনকেও ত্বরান্বিত করে।

নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে পার্থক্য

মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দল ইতালির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের এক দশক পরে হিটলারের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল জার্মানিতে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কারণে অনেকে মনে করেন যে নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদেরই নব সংস্করণ এবং ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব না হলে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উদ্ভব হতো না। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। নাৎসিবাদের ওপর ফ্যাসিবাদের প্রভাবের কথা অস্বীকার না করলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব না হলেও জার্মানিতে নাৎসিবাদের উদ্ভব হতে পারত। কেননা, যে অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে মাৎসিবাসের উদ্ভব হয় সে অবস্থা ও পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে জার্মানির স্বকীয় অবস্থা ও পরিস্থিতি ছিল। এর সাথে ইতালির ফ্যাসিবাদের মোটেই কোনো সম্পর্ক ছিল না। ইতালির ফ্যাসিবাদ ও জার্মানির নাৎসিবাদের মধ্যে বহু দিক থেকে সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকলেও এই দুটি মতবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও কম ছিল না। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

  • ১. ফ্যাসিস্ট দল ইতালিতে ক্ষমতা লাভ করার বেশ কয়েক বছর পরে ফ্যাসিবাদের দার্শনিক ভিত্তি রচিত হয়। কিন্তু জার্মানিতে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বে থেকে নাৎসি আদর্শবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে। গটফ্রেড ফেডার ১৯২০ সালে ‘দি পলিটিক্যাল এর ইকনমিক প্রগ্রাম অব দি ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নামে যে পুস্তক রচনা করেন তার মধ্যেই সর্বপ্রথম নাৎসিবাদের দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এর সাথে পরে হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্প’, রোজেনবার্গের “দি স্মিথ অব দি টুয়েন্টয়েথ সেঞ্চুরি’ (১৯৩০) সংযুক্ত হওয়ায় হিটলার ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বেই নাৎসিবাদ সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠত হয়।
  • ২. যদিও উভয় মতবাদ অযুক্তিবাদ (Irrationalism), সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism), ঐতিহ্যবাদ (Traditionalsim)আদর্শবাদের (Idealism) দ্বারা প্রভাবিত হয় তথাপি শেষোক্ত দুটি ‘বাদ’ ফ্যাসিবাদকে যতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করে নাৎসিবাদকে তা করতে পারে নি। ইতালিতে যে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ঐতিহ্যবান ও আদর্শবাদ ফ্যাসিবাদকে প্রভাবিত করে, জার্মানিতে সেরূপ কোনো পরিস্থিতি না থাকায় এ দুটি “মতবাদ’ এর প্রভাব অনেকাংশে গৌণ হয়ে পড়ে এবং নাৎসিবাদ মূলত অযুক্তিবাদ ও সামাজিক ডারউইনবাদের সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত হয়। বস্তুত অযুক্তিবাদ ও সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবলতর প্রভাবের কারণেই নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদ অপেক্ষা অনেক বেশি হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক স্বৈরশাসনের সৃষ্টি করে। ফলে হিটলার দ্বারা জার্মানিতে সাম্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অনেক বেশি লাঞ্ছিত ও পদদলিত হয়।
  • ৩. ফ্যাসিবাদ অপেক্ষা নাৎসিবাদ বংশগত পবিত্রতা ও অখণ্ডতার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। যদিও মুসোলিনি ও হিটলার উভয়েই জাতিকে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেন তথাপি একথা সত্য যে, মুসোলিনির জাতি ও হিটলারে জাতির মধ্যে পার্থক্য ছিল – মুসোলিনির জাতি এককভাবে নির্দিষ্ট কোনো বংশের লোক নিয়ে গঠিত নয়, এর মধ্যে আর্থ অনার্য, টিউটন বর্বর সব রকমের লোককে দেখা যায়। কিন্তু হিটলার যে জাতির কথা কল্পনা করেন তা কেবল আর্য বংশের লোকদের নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে অন্য কোনো বংশের লোকদের মোটেই কোনো স্থান নেই। হিটলারের মতে, জার্মান জাতি হচ্ছে বিধাতার একমাত্র মনোনীত জাতি এবং বিশ্বকে শাসন করার মহান দায়িত্ব দিয়েই বিধাতা তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং জার্মান জাতির পবিত্রতা রক্ষা করাকেই হিটলার তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে গণ্য করেন এবং জার্মান জাতির পবিত্রতা, অখণ্ডতা ও বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য তিনি দুটি সুস্পষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেন। প্রথমত জার্মান জাতিকে দোষ থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি ইহুদিদেরকে নিঃশেষে ধ্বংস করার কথা ঘোষণা করেন; এবং দ্বিতীয়ত, জার্মান জাতির স্বাস্থ্য, শৌর্য ও সাহসিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য “সুপ্রজন্ম” পদ্ধতি চালু করেন। শেষোক্ত কর্মসূচি অনুযায়ী যারা পঙ্গু, ভীরু ও দুর্বল তাদের সন্তান প্রজনন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং যারা স্বাস্থ্য ও শৌর্যবীর্যের অধিকারী তাদেরকে অধিক সংখ্যায় সন্তান প্রজনন করতে উৎসাহিত করা হয়। এই একই উদ্দেশ্যে তিনি দেশের সকল পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ শিশুকে হত্যা করে ফেলার নির্দেশ দেন। সুতরাং মুসোলিনি যেখানে ‘জাতির কল্পকথা’ (Myth of the nation) প্রচার করেন সেখানে হিটলার প্রচার করেন ‘বংশের কল্পকথা ‘(Myth of the race)।’
  • ৪. নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদের নিকটর থেকে তার ‘নেতৃত্ব তত্ত্ব’ (Cult of Leadership) লাভ করলেও এ তত্ত্বে নাৎসিবাদ সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা সংযোজন করে এবং তার ফলে ইতালির ‘ইল ডিউশ’ (II duce) অপেক্ষা জার্মানির ‘ফুহেরার প্রিনজিপ’ (Fuehere prinsip) অনেক বেশি ক্ষমতা, ব্যাপকতা ও মাহাত্ম্য অর্জন করে। ইতালিতে নেতা কেবল এলিট পার্টির প্রধান এবং সরকারের প্রধান হিসেবে কাজ করে, রাষ্ট্রের প্রধান নয়। আইনগতভাবে রাজাই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান। কিন্তু নাৎসি জার্মানিতে যিনি নেতা তিনি যুগপৎ পার্টির প্রধান, সরকারের প্রধান, রাষ্ট্রের প্রধান এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে বংশ, তারও প্রধান। নাৎসি জার্মানিতে নেতৃত্ব নিছক উপর থেকে প্রাপ্ত কর্তৃত্ব কিংবা নিচ থেকে প্রাপ্ত আস্থার চেয়ে বড় একটা কিছু। এখানকার নেতৃত্ব হচ্ছে এমন একটি যান্ত্রিকতা যার মধ্যে, রাষ্ট্রে এবং সব ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সংমিশ্রিত হয়ে একটি অখণ্ড এককের সৃষ্টি হয়েছে।

নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে সাদৃশ্য

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে পার্থক্যের কথা উল্লেখ করা হলেও এসব পার্থক্য মূলত পদ্ধতিগত, প্রকৃতিগত নয়। প্রকৃতিগত দিক থেকে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। অংশত যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খলার গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতার কারণে এবং অংশত রুশ বলশেভিকদের আগ্রাসী তৎপরতার ফলে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ ও জার্মানিতে নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছে। পটভূমির এই অভিন্নতার কারণে এই দুটি মতবাদের মধ্যে একাধিক অভিন্ন উপাদান পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

  • ১. উভয় মতবাদই সর্বাত্মবাদ ও স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং এই বিশ্বাসের মূলে নিহিত রয়েছে অযুক্তিবাদ ও সামাজিক ডারউইনবাদের অভিন্ন নীতি।
  • ২. রাজনৈতিক কীর্তিকলাপের সর্বোচ্চ পদ্ধতি হিসেবে উভয় মতবাদ হিংস্রতা ও জবরদস্তির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে এবং প্রচার কৌশলের সাহায্যে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রমাণ করতে প্রয়াস পায় ।
  • ৩. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ উভয়েই সর্বাত্মক বাসে সমান বিশ্বাসী এবং এই সর্বাত্মকবাদ উভয়- মতবাদের গণতন্ত্র বিরোধী চরিত্রের জন্য দায়ী।
  • ৪. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদীদের মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কোনো জিনিস নেই। সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য নিজেকে নিঃশেষে উৎসর্গ করে দেয়ার মধ্যেই ব্যক্তিজীবনের সার্থকতা নিহিত। রাষ্ট্রই ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়— তা ধর্ম, শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত।
  • ৫. ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ উভয়ই বিশ্বাস করে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তি বা প্রজ্ঞা বলে কোনো জিনিস নেই এবং যুক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের অতীত। তাদের মতে, অধিকাংশ মানুষ নির্বোধ এবং তারা প্রবৃদ্ধি ও আবেগের দ্বারা পরিচালিত। গণতন্ত্রের নীতি অনুসারে জনগণের হাতে যদি সরকার পরিচালনার ভার ছেড়ে দেয়া হয় তবে যে ফল দাঁড়াবে তা গণতন্ত্র নয়, তা হবে ‘ধোঁকাবাজতন্ত্র’। যুক্তিবাদ বিবর্জিত সাধারণ জনগণের জন্য একমাত্র উপযুক্ত শাসন হচ্ছে কতিপয় প্রজ্ঞাবান এলিটের শাসন কিংবা একনায়কের শাসন। ফ্যসিস্ট ও নাৎসিবাদীদের মতে, গণতন্ত্র মূর্খ, নির্বোধ ও অযোগ্যদের শাসন এবং এই শাসনে মানুষের যথার্থ মুক্তি সম্ভব হয়।
  • ৬. দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ উভয়ই অযুক্তিবাদ, সামাজিক ডারউইনবাদ, ঐতিহ্যবাদ ও আদর্শবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে ফ্যাসিবাদ যেখানে চারটি উপাদানের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করে সেখানে নাৎসিবাদ প্রথম দুটি উপাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
  • ৭. উভয় মতবাদই যুদ্ধের প্রশংসা কীর্তন করে এবং শান্তিকে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য করেন। তাদের মতে, “নারীর জন্য মাতৃত্ব যেমন, পুরুষের জন্য যুদ্ধ তেমন।”
  • ৮. উভয় মতবাদই সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর নীতি বিসর্জন নিয়ে বৈষম্য, কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলার নীতিকে স্বাগত জানায়।

তথ্যসূত্র 

  • সাম্প্রতিক রাষ্ট্রচিন্তা, সালাম, নাসির, নজরুল, এন. এস. পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ১-৫৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.