ইউরোপ, জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার, ফরাসি বিপ্লবের কারণ

Table of Contents

১৮শ-১৯শ শতকে ইউরােপে পরিবর্তন

আধুনিক কালে ইউরােপের ধারণা সারা বিশ্বজুড়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের মধ্যে ইউরােপ হল আয়তনে সবচেয়ে ছােটো কিন্তু সবচেয়ে অগ্রসর। উত্তরে উত্তরমেরু, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর, পশ্চিমে আটলান্টিক ও পূর্বে এশিয়ার মধ্যে হল ইউরােপের অবস্থান। মােট আয়তন ৪ মিলিয়ন বর্গমাইল, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে লােকসংখ্যা ছিল ৫৪ কোটি। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইউরােপের জুড়ি নেই। ইউরােপের বস্তুগত সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি, বৌদ্ধিক অগ্রগতি ও মননশীলতা। ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে ইউরােপ বিশ্বে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল –

  • পৃথিবী জুড়ে ছিল তার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরােপীয়দের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল।
  • মহাদেশের মধ্যে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র একাধিপত্য স্থাপন করেছিল। 
  • অভিজাততন্ত্র ও যাজকরা ছিল শক্তিশালী সামাজিক শ্রেণি, রাজতন্ত্র এদের দমন করে সহযােগী শ্রেণিতে পরিণত করেছিল। ইংল্যান্ড ছাড়া আর কোনাে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না। ইংল্যান্ডের নির্বাচন পদ্ধতিতে নানা ত্রুটি ছিল, অভিজাত ও ধনীরা রাজনীতিতে প্রাধান্য স্থাপন করেছিল।

ডেভিড টমসন জানিয়েছেন যে এই পর্বের ইউরােপ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়েছিল। পরিবর্তনশীলতা হল এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই পরিবর্তনশীলতার ব্যাখ্যা করা হল ঐতিহাসিকদের কাজ। ইউরােপের ইতিহাসে এই পর্বে একটি ধরন গড়ে উঠেছে। এই ধরনটির সাধারণ প্রবণতাগুলোকে বুঝে নিলে ইউরােপের ইতিহাসের মূল ধারাকে বােঝা যায়।

  • বলা হয় ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে সমগ্র ইউরােপ একই জীবন প্রবাহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কোনাে দেশের আর স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল না। তা সত্ত্বেও ইউরােপের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বৃহৎ দেশের স্বতন্ত্র ইতিহাসের ধারাকে তুলে ধরেছেন। ইউরােপের প্রধান প্রধান পরিবর্তনের ধারাগুলি হল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক। এই পর্বের ইউরােপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়াে রাজনৈতিক ধারাটির উদ্ভব হয় ফরাসি বিপ্লব থেকে।
  • রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, চার্চ ও যাজকতন্ত্র ছিল বিপ্লবের শত্রু। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে রাজতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, ১৮৩০ ও ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল, ইউরােপে উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণার বিস্তার ঘটেছিল।
  • গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি নিয়ে উদারনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠেছিল তবে উদারনীতিবাদীরা সব বিষয়ে একমত ছিলেন না।
  • ফরাসি বিপ্লবের আর এক অবদান হল জাতীয়তাবাদ। জাতিরাষ্ট্রের ধারণা জনপ্রিয় হয়, বহুজাতিক রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির লােকেরা মুক্তি কামনা করেছিল।
  • পর্বের অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে শিল্প উৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটানাে হয়। আধুনিক যন্ত্রশিল্প ইউরােপের প্রায় সবদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শিল্পপণ্যের বাজারের খোঁজে ইউরােপের দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল। শুরু হয়েছিল আগ্রাসী নব সাম্রাজ্যবাদের যুগ। ইউরােপের বহু দেশে নতুন নতুন শহর, বন্দর, পােতাশ্রয়, রাস্তাঘাট, রেলপথ, জলপথ ইত্যাদি নির্মিত হয়। ইউরােপের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপুল পরিবর্তন ঘটে যায়। নতুন যুগে জমি নয়, শিল্প, মূলধন ইত্যাদি হয় সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি।
  • ইউরােপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছিল, ১৭৫০-১৮৫০ মধ্যে প্রায় জনবিপ্লব ঘটে যায়। ১৮০০-১৮৫০ মধ্যে ইউরােপের জনসংখ্যা বেড়েছিল ৪০ শতাংশ, ১৮৮ মিলিয়ন থেকে ২৬৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার এই বিস্ফোরণ নতুন যন্ত্রশিল্পের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিকের সরবরাহ বজায় রেখেছিল, কিন্তু নানাধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। বহু গ্রামের মানুষ শহরে চলে এসেছিল কাজের আশায়, কিন্তু যে হারে শ্রমিকের সরবরাহ বেড়েছিল সে হারে যন্ত্রশিল্পের বিস্তার ঘটেনি, নগরের সম্প্রসারণ হয়নি। শহরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছিল, এদের মধ্যে নতুন সমাজতান্ত্রিক ধারণা জনপ্রিয় হয়।
  • ইউরােপের শহরতলিতে ১৯শ শতকের মধ্যভাগে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়, পুরােনাে ভূস্বামী ও কৃষকদের স্থান নিয়েছিল এই দুই সামাজিক শ্রেণি, পুঁজিপতি শ্রেণি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ওপর এরা প্রভাব বিস্তার করেছিল। অপরদিকে সদ্যোজাত শিল্প শ্রমিক সমাজে পরিবর্তনকামী শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল, কৃষকেরা ছিল মানসিকতায় অনেকখানি রক্ষণশীল।
  • ইউরােপের চার্চ ও ধর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে যায়, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর তখনও চার্চের যথেষ্ট প্রভাব ছিল, তবে সাধারণ মানুষ ধর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। 
  • দেশের রাষ্ট্রনেতারা জনমত তৈরির জন্য চার্চের সহায়তা নিতেন। এই দেড়শো বছরে ইউরােপের মানুষের মনােজগতে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছিল –
    • ১৮শ শতকে ভাববাদী দার্শনিকদের প্রাধান্য ছিল, এই শতকের শেষদিক থেকে যুক্তিবাদের বিরােধিতা দেখা দেয়। রুশাে রােমান্টিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন, ডেভিড হিউম যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেননি।
    • ১৯শ শতকে রােমান্টিকতা প্রাধান্য পেয়েছিল, শিল্প ও সাহিত্যে এর প্রতিফলন ঘটেছিল। শাতােব্রিয়া, কোলরিজ, মেন্ডেলসােন, পুশকিন, মানজোনি ও ডেলাক্রয় হলেন এযুগের শ্রেষ্ঠ রােমান্টিক বুদ্ধিজীবী। ইতিহাস চর্চা এদের প্রভাবে উৎসাহিত হয়।
    • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই যুগ হল মানুষের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময়কাল।

১৮শ শতকের ইউরােপে জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার : ফ্রেডারিখ, ক্যাথরিন ও জোসেফ

জ্ঞানদীপ্তি, জ্ঞানদীপ্ত দার্শনিকগণ ও জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার

১৮শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বৌদ্ধিক বিপ্লবের কথা ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন –

  • মধ্যযুগের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল খ্রিস্টধর্ম। রেনেসাঁরিফরমেশন এই ধর্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে দিয়ে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছিল।
  • যুক্তিনির্ভর বৈজ্ঞানিক চিন্তা রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনৈতিক জীবন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।
  • জ্ঞানদীপ্তির যুগে প্রকৃতিবিজ্ঞানচর্চা নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। সমাজ বিজ্ঞানচর্চার ওপর বিজ্ঞানের প্রভাব পড়েছিল।
  • দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবতাবাদ সামাজিক মূল্যবােধ নির্ধারণ করেছিল।
  • শিল্প ও সংস্কৃতির যে ঐতিহ্যগত রূপ ছিল সমালােচনার আলােকে তারও রূপান্তর ঘটে।
  • রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ওপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।
  • যুক্তিকে দেবীর আসনে বসিয়ে নতুন জ্ঞানের সন্ধান চলেছিল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্ম, সমাজ, আইন, অর্থনীতি, শাসনে যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা শুরু হয়েছিল। এসবের ফলে বহু কুসংস্কার দূর হয়ে যায়। মানসলােক উদ্ভাসিত হল যুক্তির আলােকে।
  • ধর্ম শাস্ত্র ও ঈশ্বরের বাণীতে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। মানুষের সম্ভাবনা ও মর্যাদায় নতুন করে আস্থা তৈরি হয়েছিল। বুদ্ধিবিভাসা মানুষকে অতিপ্রাকৃতে আস্থা না রাখার পরামর্শ দিয়েছিল, ধর্মশাস্ত্রচর্চার স্থলে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল।
  • যুক্তিবাদীরা ধরে নেন জগৎ ও মানব সমাজের পেছনে সক্রিয় রয়েছে প্রাকৃতিক বিধান। যুক্তিবাদকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করা হয়। এ যুগের পণ্ডিতরা মনে করেন জীবন ও জগতের সব রহস্যের সমাধান রয়েছে যুক্তিবাদে। ধরে নেওয়া হয় মানব সভ্যতার অগ্রগতি ঘটে যুক্তিবাদের পথ ধরে।

জ্ঞানদীপ্তির যুগে বুদ্ধিজীবীরা সভ্যতার অগ্রগতি ও মানুষের ক্ষমতায় আস্থা রেখেছিলেন। মানুষের প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী সামাজিক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে ধরে নেয়া হয়।

ফ্রান্সে জ্ঞানদীপ্তির ধারা ছিল সজীব। নতুন দর্শনের দৃষ্টি ছিল বিশ্বজনীন, তবে রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল। বুদ্ধিবিভাসা আন্দোলন ছিল বিশ্বজনীন ও মানবতাবাদী। যুক্তিবাদীরা ধর্ম ও চার্চের বিরােধিতা করেন। ফরাসি দার্শনিকরা সমাজ, রাষ্ট্র ও অন্যান্য মানবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। ফরাসি যুক্তিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন মঁতেস্কু, ভলতেয়ার ও রুশাে

  • অভিজাত পরিবারের সন্তান মঁতেস্কু ইংরেজ ও মার্কিন শাসনব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার ওপর জোর দেন। তিনি মনে করেন ক্ষমতার বিভাজন ঘটিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষা করা যায়। তার বিখ্যাত রচনা দ্য স্পিরিট অব লস গ্রন্থে তিনি ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি সংস্কারের মাধ্যমে ফাসি রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।
  • ভলতেয়ার ছিলেন চার্চ বিরােধী এবং অভিজাততন্ত্র বিরােধী। তিনি ব্যঙ্গাত্মক রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত তবে সমকালের স্বৈরাচারী রাজাদের তিনি আক্রমণ করেননি। প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক রাশিয়ার রানি দ্বিতীয় ক্যাথারিনের সঙ্গে তার পত্রালাপ ছিল।
  • রােমান্টিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত রুশাে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যাখ্যা দিলেন এমনভাবে যে সমকালের মানুষ এর মধ্যে বৈপ্লবিক উপাদানের সন্ধান পেয়েছিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থ সােসাল কন্ট্রাক্ট-এ তিনি বলেছেন যে, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু সর্বত্র সে বহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তার সামাজিক চুক্তি মতবাদের মধ্যে রয়েছে স্বৈরাচার বিরােধিতা, আবার জেনারেল উইল ধারণাটিকে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে দেখেছিলেন।
  • অন্যান্য চিন্তাবিদদের মধ্যে ছিলেন ফিজিওক্র্যাটরা। এদের নেতা কুয়েসনে Laissez faire নীতিকে সমর্থন করে বললেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হবে ন্যূনতম। এদের মতে, ভূমি ও কৃষি হল সম্পদের উৎস।
  • ডেনিস দিদেরাে ও বিশ্বকোষ গােষ্ঠীর লােকেরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলােচনা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন। কন্দরসে প্রগতির ধারণায় আস্থা রেখেছিলেন, হেলভেটিয়াস সমাজের বিবর্তনে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকার কথা বলেন। দ্য এলেমবার্ট জ্ঞানচর্চার ওপর জোর দেন। হলবাক সমাজের ব্যাখ্যায় বস্তুবাদের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন বিজ্ঞানের জয় অনিবার্য, মরেলি ও মাবলি একটি আদর্শ সমাজের কথা বলেছিলেন। সবমিলিয়ে ফ্রান্সে একটি বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল।

বুদ্ধিবিভাসা ইউরােপের অন্যান্য দেশেও সমানভাবে সক্রিয় ছিল। ফ্রান্সের বাইরে লক, ডেভিড হিউম, উইলিয় রবার্টসন, এডওয়ার্ড গিবন, কান্ট, লেসিং, শিলার, গ্যেটেবেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন জ্ঞানদীপ্তির অগ্রগামী চিন্তানায়ক হিসেবে কাজ করেছিলেন।

  • ইংল্যান্ডের অ্যাডাম স্মিথ শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে অবাধ নীতির কথা বলেন তার ওয়েলথ অব নেশনস গ্রন্থে।
  • ডেভিড হিউমএডওয়ার্ড গিবন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের বিশ্লেষণ করেন।
  • ইতালিতে ভিকো একই ধারায় কাজ করেছিলেন।

জ্ঞানদীপ্তির দর্শন সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৌদ্ধিক আলােচনাকে প্রভাবিত করেছিল। তবে দর্শনের প্রবক্তাদের মধ্যে পরস্পরবিরােধিতা ছিল, চিন্তার ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা ছিল। ভলতেয়ার চার্চের কঠোর সমালােচক ছিলেন, তিনি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে আক্রমণ করেননি, বরং প্রশংসা করেন। মঁতেস্কু স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন কিন্তু বুরবোঁ স্বৈরাচারী কর্তৃত্বকে আক্রমণ করেননি। এই দর্শন সংস্কারের মাধ্যমে প্রগতির কথা বলেছিল।

ইংল্যান্ড বাদে ইউরােপের অন্যসব দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ছিল। এই স্বৈরাচারী শাসকরা জনগণকে তাদের শাসনের সঙ্গে যুক্ত করেননি। পূর্বসূরিদের সঙ্গে এদের দুটি বিষয়ে অমিল ছিল। প্রথমত, জ্ঞানদীপ্তির দর্শনে এরা আস্থা স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, জনগণের মঙ্গলজনক কাজকর্মের সঙ্গে তারা নিজেদের যুক্ত করেছিলেন। এরা শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, সমাজ, ভূমি, আইন, বিচারব্যবস্থায় সংস্কার প্রবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। এজন্য এধরনের শাসকদের বলা হয়েছে প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচার অথবা জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার। জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারকে আবার আখ্যা দেওয়া হয়েছে অনুতপ্ত রাজতন্ত্র কারণ এসব শাসক তাদের পূর্বসূরিদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে স্বীকার করে নেন। অনুতাপে দগ্ধ হয়ে তারা সংস্কারের পথ ধরেন।

প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক (১৭৪০-৮৬)

এযুগের একজন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক হলেন প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। ১৭৪০-৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই রাজ্যের শাসক ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তিনি সফল হন। ফ্রেডারিক ছিলেন স্বৈরাচারী এবং সামরিকতন্ত্রে বিশ্বাসী। ১৮শ শতকের এই স্বৈরাচারী শাসক মনে করেন তিনি হলেন রাষ্ট্রের একজন সেবক মাত্র। রাজতন্ত্র সম্পর্কে এমন ধারণা ছিল নতুন। লর্ড অ্যাকটন, হ্যাসাল ও হর্ন তাকে একজন আদর্শ শাসক রূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়াকে ইউরােপের একটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি রাজনীতি, দর্শন ও আইনের ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি যে রাজতন্ত্রের কথা বলেন তা হল প্রজাহিতৈষী ও উপযােগবাদী। সেযুগের বিখ্যাত দার্শনিকদের সঙ্গে তার যােগাযােগ ছিল, ভলতেয়ারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি রাজতন্ত্রের কর্তৃত্বে আস্থা স্থাপন করেও বলেছেন যে এই কর্তৃত্ব প্রজাসাধারণের মঙ্গলজনক কাজে ব্যবহার করা উচিত। তার কাছে রাজশক্তির অর্থ হল ভিন্ন, জনগণের সেবা হল রাজশক্তির প্রধান দায়িত্ব। তবে রাজকর্তৃত্ব অটুট রেখে তিনি সেবার কাজ চালিয়ে যাবেন। একবার তিনি বলেছেন তিনি হলেন রাষ্ট্রের প্রথম সেবক, আবার তিনি বলেছেন রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা তার মধ্যে কেন্দ্রীভূত।

প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক জ্ঞানদীপ্তির প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, রাষ্ট্র হল একটি পার্থিব প্রতিষ্ঠান, এর আইন-কানুন নথিবদ্ধ হওয়া প্রয়ােজন, অত্যাচারমূলক আইনগুলির অবসান ঘটানাে দরকার। তবে রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়ােজন থাকতে পারে, এই প্রয়ােজন হল রাজনৈতিক ও সামরিক। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি প্রাশিয়া রাজ্যটিকে শক্তিশালী করে গড়ে তােলার দিকে বেশি নজর দেন, জনহিতৈষণা ছিল অনেকখানি গৌণ। প্রাত্যতিত শাসনের ব্যাপারে তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছিলেন। ফ্রেডারিকের শাসনের মধ্যে এক দ্বিচারিতা লক্ষ করা যায়। তিনি নতুন দর্শনের কথা বলেন আবার স্বৈরাচার ও বাস্তব রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। তবে ফ্রেডারিক যে সংস্কারক ছিলেন তাতে কোনাে সন্দেহ নেই –

  • সমকালীন ইউরােপীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে তিনি হলেন একমাত্র রাজা যার উদ্বৃত্ত রাজস্ব ছিল, তিনি তা প্রায় পাঁচগুণ বাড়িয়েছিলেন।
  • সামরিক খাতে তার ব্যয় বেড়েছিল, তা সত্ত্বেও রাজকোষে উদ্বৃত্ত ছিল।
  • প্রাশিয়ার অনগ্রসরতা দূর করে তিনি একে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত করেন।
  • তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বড়াে ভূস্বামী। তিনি নতুন জমিতে চাষ বসিয়েছিলেন, কৃষির উৎপাদন বেড়েছিল, পশু সম্পদ বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া হয়, কৃষিতে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির চলন হয়।
  • দেশে ভূমিদাস প্রথা ছিল, জনসংখ্যা তেমন বেশি ছিল না, সেজন্য ভূমিদাস নিয়ে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়নি। দেশে খাদ্যাভাব ছিল না, ভূমিদাসদের মধ্যে বড়াে ধরনের বিক্ষোভ ছিল না। সৈন্যবাহিনী দিয়ে ভূমিদাসদের দমন করার প্রয়ােজন হয়নি। ফ্রেডারিক সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলেন, দেশের সর্বত্র তিনি শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করে দেন। এসবের ফলে গ্রামাঞ্চলে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব হয়।
  • অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফ্রেডারিক সংরক্ষণ শুল্কনীতি অনুসরণ করেন, শস্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি এই নীতির প্রয়ােগ করেন। তিনি অবাধ বাণিজ্য নীতিকে সমর্থন করেননি। কৃষিজ পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা হয়।
  • দেশের জনবিরল অঞ্চলে ফ্রেডারিক নতুন জনবসতি গঠন করেন। পমিরানিয়া, পূর্ব প্রাশিয়া, কুরমার্ক ও সাইলেশিয়া অঞ্চলে নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হয়। ফ্রেডারিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে খুব গুরুত্ব দেন কারণ জনসংখ্যাকে তিনি জাতীয় সম্পদ রূপে গণ্য করেন।
  • ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে পরােক্ষ করের ক্ষেত্রে ইজারাদার নিয়ােগ করেন। ইজারাদাররা রাজাকে বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিত। পরবর্তীকালে রাজা ইজারাদারদের কাজকর্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। ডাক ও তার বিভাগের ওপর এদের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তার অবসান ঘটানাে হয়।
  • রাজার আইন ও বিচার সংক্রান্ত সংস্কারের পেছনে ছিল হেনরিখ ভন কক্কেজির অনুপ্রেরণা। তিনি সারাদেশের জন্য একই ধরনের আইন ও বিচার ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। বিচারকদের যােগ্যতার মান নিদিষ্ট করে দেওয়া হয়। বিচারপ্রার্থীর ব্যয়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়, সারাদেশের জন্য এ ধরনের আইনবিধি রচিত হয়। কক্কেজির মৃত্যুর পর সংস্কারের কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়, পরে একটি সাধারণ আইন সংহিতা প্রবর্তন করা সম্ভব হয় (a general common law)। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ফ্রেডারিকের জ্ঞানদীপ্ত সংস্কার কার্যাবলির মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে সফল ও স্থায়ী।
  • ফ্রেডারিকের ধর্মীয় সহনশীলতার ওপর বুদ্ধিবিভাসা যুগের প্রভাব পড়েছিল। ইহুদিদের তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা দেন, কয়েকজন জেসুইট নেতাকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেন কারণ তারা প্রচার করেছিল যে সৈন্যবাহিনীর কাজ ছেড়ে চলে যাওয়া ধর্মদ্রোহিতার কাজ নয়।
  • রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুরাগী পৃষ্ঠপােষক। তিনি বার্লিনে অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স স্থাপন করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মেনে নেন।
  • সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর রাজা নতুন নতুন প্রশাসনিক বিভাগ স্থাপন করেন, এগুলি হল খনি, অরণ্য, চার্চ প্রভৃতি। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের পর তিনি উচ্চপদের জন্য প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। প্রাশিয়া রাজ্যে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছিল তবে পূর্ব প্রাশিয়ার জাঙ্কার ভূস্বামীদের অনেকগুলি পুরােনাে অধিকার তিনি ফিরিয়ে দেন।

রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে অনেকগুলি সংস্কার প্রবর্তন করেছিলেন তবে সমকালীন জার্মান দার্শনিক লেসিংগ্যেটে সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন ছিলেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি সহনশীল নীতি অনুসরণ করেছিলেন কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি উদারতা দেখাননি। পশ্চিমের সঙ্গে তুলনায় প্রাশিয়া ছিল সাংবিধানিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর। অনেক কাজ করা সম্ভব হয়নি কারণ সব ক্ষমতা ছিল রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত। রক্ষণশীল অভিজাতরা ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা। সমগ্র প্রশাসনের ওপর সামরিকতন্ত্রের প্রভাব ছিল, সেজন্য বুদ্ধিবিভাসার তেমন প্রসার ঘটেনি। বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ফ্রেডারিক ছিলেন আগ্রাসী সম্প্রসারণশীল, আন্তর্জাতিক আইন তিনি মানতেন না, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি নীতিহীন কাজ করেছেন। এসব সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০-৪৮) এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬-৬৩) তিনি সাফল্য লাভ করেন। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি জার্মান রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠা দেন। তিনি সাইলেশিয়া অধিকার করে আর্থিকভাবে লাভবান হননি। ফ্রেডারিক চরিত্রে দেখা যায় বুদ্ধিবিভাসা ও ঐতিহ্যের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তার রাজনীতি ছিল প্রয়ােজনভিত্তিক, তার সমালােচক রিট্টার, গুচ ও পারেট বলেছেন যে পরবর্তী প্রজন্ম তাকে মনে রেখেছে কারণ তিনি নতুন যুগের নতুন ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

রাশিয়ার রানি দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬৩-৯৬)

রাশিয়ার রানি দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬৩-৯৬) হলেন এরকম আর একজন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক। তিনি ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার, দিদেরাে ও অন্যান্যদের ভক্ত হলেন। ফ্রেডারিক ও দ্বিতীয় জোসেফের মতাে সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন। জনগণের মঙ্গলসাধন করা ছিল তার রাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য। পিটার দ্য গ্রেটের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্যাথারিন রাশিয়াকে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। এধরনের রাষ্ট্রনীতির জন্য রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দরকার ছিল। জ্ঞানদীপ্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকা সত্ত্বেও ক্যাথারিন স্বৈরাচারী শাসক রয়ে যান। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস ছিলেন রানি স্বয়ং। তার মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষরা তার আদেশ কার্যকর করত।

  • রানি একটি আইন কমিশন গঠন করে তাকে রাশিয়ার জন্য সংবিধান রচনার নির্দেশ দেন। তিনি কমিশনকে যে নির্দেশ দেন (নাকাজ) তাতে তিনি মঁতেস্কু, ভলতেয়ার ও অন্যান্য দার্শনিকদের মতামত উল্লেখ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে রাশিয়ার রাজতন্ত্রের চরিত্র পালটে যেত। কিন্তু এই আইন কমিশনের কাজ শেষ হবার আগে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যায়।
  • ক্যাথারিন রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। পুগাচেভের নেতৃত্বে পরিচালিত কসাকদের বিদ্রোহ দমন করে রানি প্রশাসনিক ও গ্রামীণ অর্থনীতির সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সুবিধাভােগী ভূস্বামীরা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে রানি ভূস্বামীদের কতকগুলি বিশেষ সুযােগ-সুবিধা দেন, বস্তুত রানির শাসন অভিজাত ভূস্বামীদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে রুশ সাম্রাজ্যকে পঞ্চাশটি প্রদেশে ভাগ করা হয় (গুবার নাই), স্থানীয় অভিজাতরা এগুলি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পেয়েছিল। এগুলিকে ঘিরে স্থানীয় শাসন আবর্তিত হত।
  • প্রদেশগুলিকে জেলাতে ভাগ করা হয়। প্রদেশগুলিতে রানি তার অনুগত গভর্নরদের নিয়ােগ করেন। জেলা শাসনের জন্য তিনি নিয়ােগ করেন আমলাতন্ত্রকে, এদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়, বেতন ও কাজের শর্তাবলি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব বিভাগ গঠন করা হয়, ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার প্রথম বাজেট তৈরি হয়।
  • ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে নােবল চার্টার (Noble Charter) জারি করে রানি ভূস্বামীদের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেন। বংশানুক্রমিক অভিজাত ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করা হয়। অভিজাতদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তা দেওয়া হয়, ভূমিদাসদের ওপর তাদের আধিপত্য মেনে নেওয়া হয়, কর ও দৈহিক শাস্তি থেকে অভিজাতদের রেহাই দেওয়া হয়। তিনি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলােচনা করে ভূমিদাস প্রথার বিকল্প খুঁজেছিলেন কিন্তু পাননি।
  • ঐতিহ্যশালী সামন্ত সমাজব্যবস্থা টিকে ছিল, টিকে ছিল সামাজিক বৈষম্য। ইভান বাটস্কির সহায়তা নিয়ে ক্যাথারিন শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার প্রবর্তনের পরিকল্পনা করেন। অভিজাতদের সন্তানদের জন্য পৃথক স্কুল স্থাপন করা হয়, অন্যান্যদের জন্য জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তােলা হয়।

রানি যেসব বিক্ষিপ্ত সংস্কার প্রবর্তন করেন তাতে রাশিয়ার সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড়াে ধরনের পরিবর্তন আসেনি। রাশিয়ার স্বৈরাচারী ব্যবস্থা অটুট ছিল, সমাজে বৈষম্য ছিল, এজন্য ঐতিহাসিক রায়েফ (Raeff) তার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে, রানির জ্ঞানদীপ্তি বা প্রজা হিতৈষণা ছিল অনেকটা বাইরের জিনিস, বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়ােগ হয়নি। তত্ত্ব ও তার প্রয়ােগের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান ছিল। ফলে কৃষকের দুর্দশার অবসান হয়নি। তার শাসন অভিজাত নির্ভর ছিল, ভূমিদাস প্রথা শক্তিশালী হয়েছিল, নতুন অঞ্চল যেমন ইউক্রেনে এর সম্প্রসারণ ঘটে। শাসন কাঠামাের বিন্যাস আগেই শুরু হয়েছিল, পূর্ববর্তী শাসকদের কাছ থেকে তিনি সংস্কারের ঐতিহ্য পেয়েছিলেন। রানির পক্ষে রক্ষণশীল সুবিধাভােগী সমাজে সংস্কার প্রবর্তন করা সম্ভব ছিল না। মৌলিক পরিবর্তন ঘটানাে সম্ভব হয়নি, সেই ইচ্ছাও রানির ছিলনা। ক্যাথারিনের শাসনের অন্যতম সুফল হল নগরায়ণের বিস্তার এবং বিদেশে শিক্ষালাভের জন্য ছাত্র পাঠানাের নীতি। মূলত রানি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক, মাঝে মাঝে জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে কিছু বিক্ষিপ্ত সংস্কার প্রবর্তন করেন।

অস্ট্রিয়ার রাজা এবং পবিত্র রােমান সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফ (১৭৬৫-৯০)

১৮শ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানদীপ্ত শাসক হলেন অস্ট্রিয়ার রাজা এবং পবিত্র রােমান সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফ (১৭৬৫-৯০)। বার্নার্ড লিখেছেন তার মধ্যে জ্ঞানদীপ্তির সব লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছিল, তার শাসন ছিল নিঃসন্দেহে জ্ঞানদীপ্ত। স্বৈরাচার জোসেফ নাকি বলেছিলেন ‘আমি দর্শনকে সাম্রাজ্যের আইন প্রণয়নকারী করেছি’। দর্শনের প্রভাবে অস্ট্রিয়ার পরিবর্তন ঘটবে বলে তিনি আশা করেন। একথা ঠিক তিনি অনেকগুলি প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন করেন যেগুলির অনেকগুলি ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে, এটি হল তার শাসনের সবচেয়ে বড়াে শক্তি ও একই সঙ্গে বড়াে দুর্বলতা। ১৭৬৫-৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় জোসেফ তার মাতা মারিয়া টেরেসার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রক্ষণশীল মাতার সঙ্গে এই দার্শনিক রাজার পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। 

  • এই পর্বে জোসেফ সৈন্যবাহিনীর সংস্কার করে একে শক্তিশালী করে গড়ে তােলেন। দেশের মধ্যে তিনি আধা বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যােগদানের নীতি প্রবর্তন করেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে মাতা মারিয়া টেরেসার মৃত্যুর পর জোসেফ একজন পরিপূর্ণ সংস্কারক রাজা হয়ে বসেন। তিনি মনে করেন তার মায়ের শাসন ছিল অপূর্ণ। জ্ঞানদীপ্তির দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও জোসেফ সামরিক শক্তির গুরুত্ব এবং আঞ্চলিক সম্প্রসারণের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তবে তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন যার অভাবে অন্য সব সংস্কার অর্থহীন হয়ে যায়।
  • রাজত্বের শুরু থেকে জোসেফ ব্যয় সংকোচের নীতি অনুসরণ করেন, নিজে আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় কমিয়ে তিনি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেন তবে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ব্যয় কমানাে হয়নি।
  • তিনি জনগণের ওপর করভার সমতার ভিত্তিতে চাপাতে চেয়েছিলেন যাতে দরিদ্রদের ওপর বাড়তি করের চাপ সৃষ্টি না হয়। তার আগেকার কর ব্যবস্থা ছিল বৈষম্যমূলক। জোসেফ দেশের সামন্তপ্রভুদের সমস্ত জমির হিসেব করে সমতার ভিত্তিতে কর স্থাপন করেন।
  • তিনি ফিজিওক্র্যাটদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জমি ও কৃষির ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি হাঙ্গেরিতে আদমশুমারির নির্দেশ দিলে সেখানে বিরােধিতা দেখা দেয়। জোসেফ এই বিরােধিতা দমন করে সেখানে তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করেন। এর ওপর ভিত্তি করে তিনি কৃষি অর্থনীতির সংস্কারের কাজে হাত দেন। কৃষকদের দেয় কর তিনি ১৭ শতাংশ কমিয়ে দেন। জমি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের কাজ শেষ হলে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্দেশ দেন যে যারা ১২ শতাংশের বেশি রাজস্ব দেন তারা সমহারে রাজস্ব দেবেন, কৃষক ও ভূস্বামীর ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রয়ােগ করা হয়। কৃষকদের মােট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ কর হিসেবে দিতে হত। বাকি ৭০ শতাংশ দিয়ে কৃষক তার সব দায়িত্ব মেটাতেন। ভূস্বামীরা এই সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে জোসেফ তা অগ্রাহ্য করেন। তার উত্তরাধিকারী লিওপােল্ড এই আদেশ বাতিল করেন।
  • ১৭৮১ ও ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে দুটি আদেশ জারি করে তিনি ভূমিদাস প্রথা তুলে দেন। তিনি মনে করেন এই সংস্কারের ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তিনি গিল্ডগুলির কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষণ শুল্ক নীতি প্রবর্তন করেন। অস্ট্রিয়াতে যেসব শিল্পপণ্য উৎপন্ন হয় সেগুলির তিনি আমদানি বন্ধ করে দেন।
  • তিনি অস্ট্রিয়ার বাণিজ্যকে উৎসাহ দিয়ে যান, দানিয়ুব অঞ্চলে তিনি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ চেয়েছিলেন।
  • তার ধর্মনীতির ওপর বুদ্ধিবিভাসা যুগের প্রভাব পড়েছিল। জোসেফ অস্ট্রিয়ার চার্চকে পােপের প্রভাবমুক্ত করে জাতীয় চার্চ গঠন করেছিলেন। এটি হল তার জ্ঞানদীপ্ত সংস্কারগুলির অন্যতম। পােপের অস্ট্রিয়ার যাজক পদে নিয়ােগের অধিকার তিনি বাতিল করে দেন।
  • তিনি মঠের সম্পত্তির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে রাষ্ট্রের স্বার্থে তা ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন। তিনি অধিগৃহীত সম্পত্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টন করতে চেয়েছিলেন। তিনি চার্চের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন, যাজক নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা রাষ্ট্রের হাতে তুলে নেওয়া হয়, জেনারেল সেমিনারিতে যাজকদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
  • অস্ট্রিয়ার মতাে বহুজাতিক রাষ্ট্রে জোসেফ কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করে গড়ে তােলার কথা ভেবেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক সভাগুলির ক্ষমতা বাতিল করে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেন। সমগ্র সাম্রাজ্যকে তেরােটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেক অঞ্চলে একজন করে সামরিক গভর্নর নিয়ােগ করেন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলির পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছিল। জার্মান ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
  • দৈহিক শাস্তি এবং মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয়। দেশে ছটি আপিল আদালত স্থাপন করা হয়েছিল।

জোসেফের কাজকর্ম গােড়ারদিকে সাফল্য লাভ করেছিল। নিম্ন অস্ট্রিয়া, স্টাইরিয়া, টাইরল ও বােহেমিয়াতে বস্ত্র ও ধাতু শিল্পের উন্নতি হয়। এইসব অঞ্চলে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল, বল্কান অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। সরকারের রাজস্ব খাতে আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু জোসেফের সংস্কারের বিরুদ্ধে বিরােধিতা ছিল। বিরাট আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হলেও জনগণ তার সংস্কারে সন্তুষ্ট হননি, বরং আশাভঙ্গের বেদনা দেখা দিয়েছিল। তার সংস্কারগুলি অগ্রগামী চিন্তানির্ভর ছিল না, আবার এগুলিকে রক্ষণশীল বলা যায় না। অভিজাত ও সাধারণ মানুষ সকলে ক্ষুন্ন হয়।

  • জোসেফ নিজেই বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে গোঁড়া ক্যাথলিক মতবাদ প্রবর্তন করেন।
  • ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কঠোর সেন্সরশিপ প্রবর্তন করে নিজের সংস্কার কর্মসূচির বিরােধী কাজ করেন।
  • বিদেশ নীতিতে সংকট দেখা দিলে জোসেফ তার অনেকগুলি দমনমূলক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। ঐবছর জোসেফ বেলজিয়ামের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। বিদেশ নীতিতে তিনি প্রাশিয়ার কাছে বিধ্বস্ত হন।
  • রক্ষণশীল বহুজাতিক রাষ্ট্রে সংস্কার প্রবর্তন করে জোসেফ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণবিক্ষোভ ডেকে আনেন। জার্মান ভাষা চাপানাে হলে অজার্মানরা আপত্তি করেছিল, নেদারল্যান্ডে জার্মান ভাষার বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছিল।
  • রক্ষণশীল গোঁড়া ক্যাথলিকরা তার চার্চ নীতির সমালােচনা করেছিল।
  • হাঙ্গেরি তার কর নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।

বিপদ এগিয়ে এলে জোসেফ ও তার সংস্কারের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলেছিল। শেষ পর্যন্ত দুটি সংস্কার তিনি বজায় রেখেছিলেন – ভূমিদাসদের মুক্তি ও ধর্মীয় সহনশীলতা। তার উত্তরাধিকারী লিওপােল্ড অনেকগুলি গ্রামীণ সংস্কার বাতিল করে দেন। হ্যাপসবার্গ রাজবংশের প্রথা অনুযায়ী তিনি ঐতিহ্যনির্ভর সংস্কার প্রবর্তন করেননি। দ্রুত সংস্কার কার্যাবলি গ্রহণ করে তিনি সমস্যার সৃষ্টি করেন। তিনি শেষঅবধি স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন, ক্ষমতার ভাগ কাউকে দেননি, উদীয়মান মধ্যবিত্তকে তিনি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দেননি। জোসেফ ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, বাস্তববাদী রাষ্ট্রনেতা নন। সমসাময়িক ফ্রেডারিক ছিলেন অনেকবেশি বাস্তববাদী, তত্ত্বের ওপর তিনি তেমন নির্ভর করেননি। তার সমাধির জন্য তিনি যে বাণী রেখে যান তা তার সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন। শ্রেষ্ঠতম লক্ষ্য ও ইচ্ছা নিয়েও তিনি কিছু করে উঠতে পারেননি (Here lies a man who, with the best intentions, never succeded in anything)। অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় জোসেফ ছিলেন জ্ঞানদীপ্তির এক প্রতিমূর্তি যদিও তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও তাদের শাসকগণ

ইউরােপের অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও তাদের শাসকরা জ্ঞানদীপ্তির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এসব দেশের শাসকরা নিজ নিজ দেশে সংস্কার প্রবর্তন করেন –

  • ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্টের শাসক চার্লস দ্বিতীয় ইমানুয়েল তার দেশের ভূমিদাসদের মুক্তি দেন, সামন্তপ্রভুদের নিয়ন্ত্রণ থেকে এদের মুক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে এসব সংস্কার পূর্ণ সাফল্য লাভ করেনি।
  • পর্তুগালের রাজা প্রথম জোসেফের মন্ত্রী পােম্বাল বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়িয়েছিলেন, অভিজাতদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং জেসুইটদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তবে ধর্মদ্রোহীদের শাস্তিদানের জন্য তিনি ইনকুইজিশন বজায় রাখেন।
  • স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস (১৭৫৯-৮৮) তার মন্ত্রী ক্যাম্পােমানেসির সহায়তা নিয়ে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় সংস্কার প্রবর্তন করেন।
  • টাসকেনির গ্রান্ড ডিউক দ্বিতীয় লিওপােল্ড (১৮২৪-১৮৫৯) ছিলেন ১৮শ শতকের এক মডেল শাসক। তিনি চার্চের কর্তৃত্ব খর্ব করেন, শস্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। গিল্ড ব্যবস্থার ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছিলেন, ভূস্বামীদের জমি জরিপ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় আইন সংসদকে পুনর্গঠিত করে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেন।
  • সংস্কারে উৎসাহী অন্যান্য শাসকরা হলেন সুইডেনের তৃতীয় গুস্তাভাস, ফ্রান্সের তুর্গো, স্পেনের দ্য এরান্ড এবং ইতালির তানুচ্চি

উপসংহার

ইউরােপের জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসকরা অনেক সংস্কার প্রবর্তন করেন। তবে দেশের শাসন ব্যবস্থা ও সমাজের মৌল পরিবর্তন হয়নি। জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার স্বৈরাচারী নীতি থেকে সরে দাঁড়ায়নি। রাজপুরুষ বা জনগণের হাতে এরা ক্ষমতা তুলে দেননি, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এজন্য জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। সংস্কারের উদ্দীপনা একটি ক্ষুদ্র শাসক গােষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শাসকরা ওপরতলা থেকে সংস্কার চাপিয়েছিলেন জনগণের ওপর। সামন্ত প্রথা ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি অটুট ছিল। কায়েমি স্বার্থপুষ্ট ব্যক্তিরা সংস্কারে বাধা দিয়েছিল। শাসকরা বাইরের দিকে ছিলেন বুদ্ধিবিভাসার অনুগামী, ভেতরে তারা উদীয়মান শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে পারেননি।

  • ফ্রেডারিক তার মন্ত্রীদের ইচ্ছামতাে নির্দেশ দিতেন, দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক তার সংস্কারের সুফল পায়নি।
  • দ্বিতীয় জোসেফ তার রাষ্ট্রের বহুজাতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তিনি চার্চের সংস্কার করতে গিয়ে ক্যাথলিকদের বিরাগভাজন হন, বেলজিয়াম বিদ্রোহ করেছিল। তার প্রশাসনিক সংস্কার উচ্চ রাজপুরুষ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান কেউ পছন্দ করেনি। তার সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হলে তিনি অনেকগুলি সংস্কার বাতিল করে দেন, শুধু ধর্মীয় সহনশীলতা ও ভূমিদাসদের মুক্তি বজায় ছিল।
  • রাশিয়ার রানি ক্যাথারিন ভূমিদাসদের মুক্তিদানের ব্যাপারে কিছুই করেননি। মধ্যযুগীয় শাসকদের মতাে রাশিয়ার শাসকরা স্বৈরাচারী রয়ে যান।

জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার ইউরােপীয় রাজনীতিতে বড়াে ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। যেসব পরিবর্তন ঘটানাে হয়েছিল সেগুলি ছিল গৌণ, অগভীর। ইউরােপীয় জ্ঞানদীপ্ত শাসকদের ব্যর্থতা বিপ্লবের দুয়ার উন্মুক্ত করেছিল, বিপ্লবের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

ফরাসি বিপ্লব

অষ্টাদশ শতকের প্রেক্ষাপট : সমাজ

ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবের আধুনিক ঐতিহাসিকরা যেমন আর. আর. পামার ও জে. গােদেসাে (Golechot) একে ইউরােপীয় বিপ্লবের প্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন। অষ্টাদশ শতকে ইউরােপের অনেক দেশে বিপ্লব হয়েছিল – জেনিভা, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, পােল্যান্ড হাঙ্গেরির বিপ্লবের কথা ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। আটলান্টিকের অপর পারে আমেরিকাতেও বিপ্লব হয়েছিল। ইউরােপীয় বিপ্লবের কতকগুলি সাধারণ কারণ ছিল – অষ্টাদশ শতকে ইউরােপের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল (১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপের জনসংখ্যা ছিল ১০ কোটি, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ কোটি)। অষ্টাদশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে ইউরােপের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরে দেখা দিয়েছিল এই মন্দা। মন্দার ফলে জমির চাহিদা বেড়েছিল, বেকারত্ব বেড়েছিল, ভােগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছিল কিন্তু উৎপাদন তেমন বাড়েনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে মজুরি বাড়েনি, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল। সরকারের ব্যয় বেড়েছিল, আয় বাড়েনি। এই সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের পটভূমিকায় ইউরােপের দেশগুলিতে বিপ্লব ঘটে যায়। এইসব বিপ্লব নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়, ফ্রান্সে সফল হয় কারণ সেখানে একটি বড়াে বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল আর এই তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত কৃষক, শ্রমিক ও সাঁকুলােৎরা প্রাক্-বিপ্লবযুগের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত যে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি বুর্জোয়া ছিল, এবং প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে সর্বাধিক অসন্তোষ ছিল, সেখানেই মৌলিক পরিবর্তনের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল।

যাজক

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স ছিল একটি বিশাল, ঘনজনবসতিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ সেই সময়ের মান অনুযায়ী ফ্রান্স একটি খুব বড়, জনবহুল, ধনী এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল)। ফ্রান্সের রাজারা সমাজকে তিনভাগে ভাগ করেছিলেন – যাজক, অভিজাত ও সাধারণ মানুষ, এবং এদের যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এস্টেট বলা হত। সম্ভবত খ্রিস্টধর্মে ত্রিত্বের যে ধারণা ছিল তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজের বিভাজন হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা এদের আবার দু’ভাবে ভাগ করেছেন – সুবিধাভােগী যাজক ও অভিজাত এবং সুবিধাহীন সাধারণ মানুষ। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, এই এস্টেটগুলি ঐক্যবদ্ধ ও সংহতিপূর্ণ ছিল না। প্রত্যেক এস্টেটের মধ্যে আবার ছোট ছােট গােষ্ঠী ছিল এবং গােষ্ঠীগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব ছিল। ভলতেয়ার লিখেছেন যে একটি জাতির অভ্যন্তরে তিনটি জাতির অস্তিত্ব ছিল। 

এই তিনটি শ্রেণির প্রথমটি হল যাজক, ফ্রান্সের সুবিধাভােগী শ্রেণি –

  • এরা ছিল ফ্রান্সের জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ, ফ্রান্সের মােট আড়াই কোটি লােকের মধ্যে এরা ছিল ১,২০,০০০ থেকে ১,০০,০০০।
  • যাজকরা ছিল একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গােষ্ঠী; শাসন, বিচার ও রাজস্ব সংক্রান্ত এদের নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল। এজন্য চার্চ ও যাজক সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে এরা ছিল রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র। চার্চের নিজস্ব আইন প্রণয়নকারী সভা ছিল, ছিল বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থা।
  • দেশের সকল মানুষের কাছ থেকে এরা ধর্মীয় কর টাইথ (Tithe) আদায় করত।
  • দেশের ২০ শতাংশ চাষযােগ্য জমির মালিকানা ছিল এদের হাতে, শহরের অনেক সম্পত্তির ওপর চার্চের মালিকানা ছিল।
  • ভলতেয়ার জানিয়েছেন যে ভূসম্পত্তি থেকে চার্চের বার্ষিক আয় ছিল নয় কোটি লিভর, নেকারের হিসেব অনুযায়ী তেরাে কোটি লিভর। টাইথ থেকেও অনুরূপ পরিমাণ আয় হত। চার্চ ও যাজক সম্প্রদায়ের আয়ের পরিমাণ ছিল বিশাল।
  • রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য চার্চ রাজাকে স্বেচ্ছাকর (Dongratuit) দিত, এর পরিমাণ কখনও ৩৫ লক্ষ লিভরের বেশি ছিল না। আয়ের তুলনায় করের পরিমাণ ছিল অতি সামান্য।
  • চার্চের কিছু দায়-দায়িত্ব ছিল – জনকল্যাণমূলক কিছু কাজ চার্চকে করতে হত। শিক্ষাদান, আর্তের সেবা, রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখা, পানীয় জলের সরবরাহ বজায় রাখা, দীক্ষাদান, বিবাহ, প্রার্থনা ইত্যাদি কাজ চার্চকে পরিচালনা করতে হত।

ফ্রান্সের সমাজ অনেক ক্ষেত্রে ছিল চার্চের ওপর নির্ভরশীল এবং সমাজের ওপর ছিল যাজকদের অপরিসীম প্রভাব। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে যাজকদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছিল –

  • উচ্চশ্রেণির যাজকরা বিলাস-ব্যসনের মধ্যে থাকত, নিম্নশ্রেণির যাজকরা ছিল অশিক্ষিত ও দরিদ্র।
  • উচ্চশ্রেণির যাজকদের পদগুলি – বিশপ, আর্চবিশপ, মঠাধ্যক্ষ ইত্যাদি অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষরা অধিকার করে নিয়েছিল। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ১৩৯ জন উচ্চ যাজকের সকলেই ছিলেন অভিজাত শ্রেণির মানুষ। নিজেদের অধীনস্থ অঞ্চলের ধর্মীয় কাজকর্ম নিয়ে এরা মাথা ঘামাতেন না।
  • দেশের নিম্নশ্রেণির যাজকরা দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিল, এরা ছিল সাধারণ পরিবারের লােক, জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ, ধর্মীয় কাজকর্ম এরাই পরিচালনা করত। কিন্তু এদের শিক্ষাদানের ভাল ব্যবস্থা ছিল না, আর আয় ছিল বার্ষিক ৩০০-৭৫০ লিভর। এরা বিদ্রোহী হয়ে তৃতীয় এস্টেটের মানুষদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্টেটস-জেনারেলকে জাতীয় সভায় পরিণত করেছিল।
  • নিম্নশ্রেণির যাজকদের মধ্যে ছিল গ্রামের পাদরি ও স্থানীয় যাজকেরা। উচ্চশ্রেণির যাজকরা এদের অবজ্ঞার চোখে দেখতাে, অজ্ঞ ও রক্ষণশীল মনে করত। এদের মধ্যে মানসিক ব্যবধান গড়ে উঠেছিল।
  • নিম্নশ্রেণির যাজকরা উচ্চশ্রেণীর যাজকদের বিলাসবহুল জীবন দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছিল।

এসব কারণে অষ্টাদশ শতকের মানুষ চার্চ ও যাজকদের সম্পর্কে শ্রদ্ধার মনােভাব হারিয়ে ফেলেছিল, চার্চ মানুষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শান্তির সন্ধান দিতে পারেনি। চার্চ পার্থিব জীবন, অর্থ, সম্পদ, প্রতিপত্তি নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে প্রাক্-বিপ্লব যুগের অধঃপতিত জীবনের জন্য তাকেই দায়ী করা হত। অষ্টাদশ শতকের যুক্তিবাদী মানুষ যাজকদের সম্পদ, বিলাসবহুল জীবন, নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদিকে সমর্থন করেনি। ভলতেয়ার চার্চ ও যাজকতন্ত্রের বহু দুর্নীতি প্রকাশ করে দেন, চার্চের প্রতি সাধারণ মানুষের আনুগত্য শিথিল হয়ে পড়েছিল।

অভিজাত

উচ্চশ্রেণীর যাজক ও অভিজাতরা ছিল ফ্রান্সের সুবিধাভােগী শ্রেণি। আবে সিয়েসের হিসেব অনুযায়ী এদের সংখ্যা হল ১,১০,০০০, ডেভিড টমসন বলেছেন যে এদের সংখ্যা ছিল ৫,০০,০০০ (২৪ বা ২৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে তাদের সংখ্যা মাত্র অর্ধ মিলিয়ন), অর্থাৎ জনসংখ্যার দুই শতাংশ। ফ্রান্সের সমাজব্যবস্থায় এরা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী গােষ্ঠী। ফ্রান্সের সামন্তযুগে অভিজাত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়, রাজতন্ত্রের সঙ্গে এদের সংঘাত ঘটেছিল (ফ্রঁঁদে), তারপর রাজতন্ত্রের সঙ্গে এদের সমঝােতা হয়। এদের মধ্যে ছিল দুটি শ্রেণি – নীলরক্তের অভিজাত (aristocracy of the sword) এবং পােশাকি অভিজাত (aristocracy of the robe) । রাজা সম্পদশালী বুর্জোয়া পরিবারের লােককে অভিজাত হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। এরা হল পােশাকি অভিজাত, ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর এই সামাজিক গতিশীলতার পথ বন্ধ হয়েছিল। এটি ছিল বুর্জোয়াদের ক্ষোভের একটি কারণ। ফ্রান্সের অভিজাতরা নানা ধরনের সুযােগ-সুবিধা ভােগ করত –

  • অভিজাতরা শাসন, সৈন্যবাহিনী ও চার্চে উচ্চপদগুলি অধিকার করেছিল, পার্লেমাের পদগুলি এরা বংশানুক্রমিকভাবে ভােগ করত। পার্লেমাে ছিল একটি সংস্থা যেখানে বিচারকরা বংশানুক্রমিকভাবে শাসন ও বিচারের ক্ষমতা ভােগ করত (hereditary legal corporations)।
  • তাদের ভূমিকর তেই দিতে হত না, বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে অব্যাহতি ছিল, সম্পদকর ভাতিয়েম ও কাপিতাসিওঁ থেকে রেহাই ছিল, অস্ত্র বহনের অধিকার ছিল, শিকারের অধিকার, মাছ ধরার অধিকার, সামরিক, রাজকীয় ও প্রশাসনিক উচ্চপদে নিয়ােগের অধিকার ইত্যাদি তারা একচেটিয়াভাবে ভােগ করত।
  • অভিজাতরা ফ্রান্সের মােট চাষযােগ্য জমির ৬০ শতাংশ ভােগ করত।
  • এদের কিছু সামন্ততান্ত্রিক অধিকার ছিল, সামন্ত ব্যবস্থার কিছু অবশেষ তখনও ফ্রান্সে টিকে ছিল। অভিজাতরা ভূমিকর আদায় করত, মদকর, শস্য পেষাই কর ইত্যাদি তারা আদায় করত। বিপ্লবের প্রাক্কালে তারা কয়েকটি নতুন সামন্তকর স্থাপন করে, পতিত জমিগুলি অধিকার করতে থাকে। এজন্য কৃষকদের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। অভিজাতদের বিচার করার ক্ষমতা ছিল, এজন্য তারা বিচারালয় (manor court) গঠন করে অধীনস্থ কৃষকদের বিচার করে শাস্তি দিত।
  • অভিজাতদের মধ্যে প্রায় দশ হাজার ব্যক্তি ভার্সাই শহরে রাজপ্রাসাদের পাশে প্রাসাদ বানিয়ে বাস করত। এরা হল রাজকীয় সভাসদ অভিজাত, মহাসমারোহে ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকের মধ্যে এরা থাকতে ভালোবাসত। এদের মধ্যে থেকে রাজা মন্ত্রীদের নিয়ােগ করতেন, এদের পুত্ররা রাজার শিকারের সঙ্গী হত। ব্যবসা ও বাণিজ্যকে এরা নিজেদের মর্যাদা হানিকর বলে গণ্য করত, দেশের বাইরে যেতে পছন্দ করত না, শাসন, কূটনীতি ও সামরিক কাজকর্ম নিয়ে এরা ব্যস্ত থাকত। অসংখ্য ভৃত্য, ব্যয়বহুল পােশাক, জুয়া, নানা উৎসব, আমােদ-প্রমােদ, শিকার ইত্যাদি নিয়ে এরা জীবন কাটাত।

এই অভিজাতদের পরিস্থিতি বোঝার জন্য তাদের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা দরকার –

  • অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। অভিজাতদের যে হারে ব্যয় বেড়েছিল সে হারে আয় বাড়েনি। ফলে ইনফ্লেশন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ক্রমাগত ঋণ করে অনেক অভিজাত পরিবার ঘাটতি মেটানাের চেষ্টা করত, বেশি করে কর আদায়ের চেষ্টা করত।
  • অভিজাতদের সকলের অবস্থা সমান ছিল না, অল্পসংখ্যক পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৫০,০০০ লিভরের ওপর, বেশিরভাগের আয় ছিল ৪,০০০ লিভরের কম। বিশ শতাংশ অভিজাতের বার্ষিক আয় ছিল ১,০০০ লিভরের কম। এই ধন বৈষম্য অভিজাতদের মধ্যে ঈর্ষা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিল, তাদের মধ্যে শ্রেণিগত ঐক্য ও সংহতি ছিল না।
  • অভিজাতদের একটি অংশ গ্রামে বাস করত, এদের জীবনযাত্রা ছিল অনেকটা গ্রামীণ সম্পন্ন কৃষকদের মতাে, নাগরিক জীবনের প্রভাব এদের ওপর কমই পড়েছিল। মাতিয়ে এদের দরিদ্র অভিজাত বলেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য বা কায়িক শ্রমে এদের অনীহা ছিল, এরা কৃষক শােষণ করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করত। এদের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রচণ্ড আক্রোশ গড়ে উঠেছিল, অন্যদিকে ভার্সাই-এর রাজকীয় অভিজাতরা এদের অবজ্ঞা ও করুণার চোখে দেখত। গ্রামীণ অভিজাতরা নতুন করে বিলুপ্ত সামন্ততান্ত্রিক অধিকারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছিল।
  • অভিজাতদের মধ্যে বিত্তশালীরা ভারী শিল্পে মূলধন বিনিয়ােগ করেছিল, ব্যাংকিং কাজকর্মের সঙ্গেও এরা কিছুটা যুক্ত ছিল। রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে তারা খানিকটা সংহত করে রেখেছিল।
  • শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তাদের আগ্রহ ছিল, কিন্তু অভিজাতরা ঐক্যবদ্ধ ছিল না, ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভবও ছিল না।
    • অভিজাতদের মধ্যে মঁতেস্কু, কন্দরসে, লাফায়েত ও মিরাবাের মতাে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন।
    • সভাসদ অভিজাত ও গ্রামীণ অভিজাতদের মধ্যে স্বার্থদ্বন্দ্ব ছিল।
    • গ্রামীণ অভিজাতরা রাজকীয় অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত ছিল।
    • শহুরে অভিজাতরা রাজকীয় স্বৈরাচারের বিরােধিতায় নেমেছিল।
    • মুক্তপন্থী অভিজাতরা প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাষ্ট্র ও সমাজের সমালােচনা করেছিল।
    • পােশাকি অভিজাতদের মধ্যে নানাধরনের ক্ষোভ ছিল, তাদের যথেষ্ট সামাজিক মর্যাদা ছিল না।
    • বিক্ষুব্ধ অভিজাতরা তাদেরই রক্ষক স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সংস্কারের দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছিল।

বুর্জোয়া

প্রাক্-বিপ্লব যুগে ফ্রান্সের আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে দু’কোটি চল্লিশ লক্ষ লােক ছিল তৃতীয় এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত। আবে সিয়েস তার ‘তৃতীয় এস্টেট কী’ পুস্তিকায় বলেছেন যে তৃতীয় এস্টেট হল ফরাসি জাতি। মুষ্টিমেয় মানুষ হল অভিজাত, তারা সুবিধাভােগী, তাদের বাদ দিয়ে জাতি গঠিত হলে কোনাে ক্ষতি হবে না। তৃতীয় এস্টেট একটি সুগঠিত, ঐক্যবদ্ধ, সংহতিপূর্ণ সামাজিক শ্রেণি ছিল না। এদের মধ্যে চারটি সামাজিক শ্রেণিকে পাওয়া যায় – বুর্জোয়া, কৃষক, শ্রমিক ও সাঁকুলোৎ। গ্রাম ও শহরের অনভিজাত সকলকে নিয়ে গঠিত হয় তৃতীয় এস্টেট, আবার এদের মধ্যে বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ও সামাজিক মর্যাদায় বুর্জোয়ারা ছিল অগ্রগণ্য। বার্গার শব্দ থেকে বুর্জোয়া শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। বার্গার শব্দের অর্থ হল শহরবাসী, কিন্তু বুর্জোয়ারা সকলে শহরবাসী ছিলেন না, বহু বুর্জোয়া গ্রামে বাস করতেন। বুর্জোয়াদের মধ্যে ছিল বণিক, শিল্পপতি, ব্যাংকার, পেশাদারি মানুষ, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, কারিগর ও কর্মশালার মালিক। কৃষক শ্রেণি থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স ছিল কৃষিনির্ভর দেশ। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে মেসাঁস বুর্জোয়াদের উদ্ভব এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : “কোনাে গ্রামের মানুষ হয়তাে শহরে গিয়ে শ্রমিক, কারিগর, শিল্পদ্রব্য নির্মাতা অথবা ব্যবসায়ী হল। যদি সে উদ্যমী, বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান হয়। তাহলে সে অল্পকালের মধ্যে বিত্তশালী হবে। এভাবেই ফ্রান্সে কৃষককুল থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব।”

লাব্রুস বুর্জোয়াদের মধ্যে রাজকর্মচারী, খাজনার ওপর নির্ভরশীল সম্পন্ন গ্রামীণ ভূস্বামী, স্বাধীন বৃত্তিজীবী, পুঁজিপতি পাইকারি ব্যবসায়ী, নির্মাতা, বণিক এমনকি ছােটো দোকানদার, কর্মশালার মালিক ও স্বাধীন কারিগরদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শহরবাসী বুর্জোয়ারা কয়েকটি সুযােগ-সুবিধা পেত, প্যারিস, তুর ও বাের্দোর বুর্জোয়াদের তেই (Taille) দিত হত না। প্যারিসের বুর্জোয়ারা বাণিজ্য শুল্ক অ্যাদ দিত না। প্যারিসের বুর্জোয়ারা অভিজাতদের মতাে অস্ত্র বহনের অধিকার পেয়েছিল। বিপ্লবের প্রাক্কালে বুর্জোয়াদের সংখ্যা কত সঠিকভাবে বলা যায় না। অনুমান করা হয়েছে পঁচিশ মিলিয়ন লােকের মধ্যে এদের সংখ্যা ছিল দু’মিলিয়নের একটু বেশি, জনসংখ্যার ৮ – ৯ শতাংশ। বুজোয়াদের সম্পর্কে যা নিশ্চিত করে জানা যায় তাহল বিপ্লবের আগে ফ্রান্সে এদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছিল, ব্যাংকিং, শিল্প, পেশা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল।

আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পার্থক্যের জন্য বুর্জোয়াদের মধ্যে অন্তত তিনটি স্তর গড়ে উঠেছিল – উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন বুর্জোয়া –

  • উচ্চ বুর্জোয়ারা ছিল অতিধনী, তারা অভিজাতদের জীবনযাত্রার নকল করত, ধনী হয়ে প্রাসাদ বানাত, জমিদারি কিনত, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরে দাঁড়াত। এরা সরকারি পদ কিনে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াত, রাজস্বের ঠিকাদারি করে অর্থবান হয়ে উঠত। শিল্পপতি, ব্যাংকার ও জাহাজ মালিকরা ছিল এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
  • উচ্চ বুর্জোয়াদের পরবর্তীস্তরে ছিল মধ্য বুর্জোয়ারা। এদের মধ্যে ছিল আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, অভিনেতা, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। মাঝারি দোকানদার, কর্মশালার মালিক ও স্বাধীন কারিগর এই শ্রেণির মধ্যে ছিল। উচ্চ শ্রেণির বুর্জোয়াদের ছিল বিত্ত ও পদমর্যাদা আর মধ্য বুর্জোয়াদের ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এদের ওপর বিপ্লবী দার্শনিকদের প্রভাব পড়েছিল খুব বেশি। এরা দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
  • মধ্য বুর্জোয়াদের নীচে ছিল নিম্ন বুর্জোয়ারা। এদের অর্থনৈতিক কৌলীন্য ছিল না, ছিল না তেমন বিদ্যাবুদ্ধি, ছােটোখাটো কারিগরি কাজ ও পেশাদারি কাজ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করত। ঐতিহাসিকরা বুর্জোয়াদের মধ্যেকার তিনটি গােষ্ঠীর কথা উল্লেখ করলেও কোনাে বাঁধা-ধরা বিভাজন রেখা ছিল না। এক অঞ্চলের মধ্য বুর্জোয়া অন্য অঞ্চলে গিয়ে স্বচ্ছন্দে নিম্ন বুর্জোয়া হতে পারত।

বুর্জোয়াদের সাথে অভিজাতদের দ্বন্দ্ব দেখা যায় –

  • আলেক্সি দ্য তকভিল বুর্জোয়াদের মধ্যেকার গতিশীলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তকভিল লিখেছেন যে কিছু সম্পত্তি থাকলেই কৃষক তার ছেলেকে শহরে পাঠাত, একটি দোকান বা রাজপদ কিনে দিত। বুর্জোয়াদের মধ্যে যেমন গতিশীলতা ছিল, তেমনি উচ্চ বুর্জোয়ারা অভিজাত শ্রেণিতে উন্নীত হত। রাজারা উচ্চ বুর্জোয়াদের অভিজাত শ্রেণিতে স্থান করে দিতেন। কিন্তু পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) এর আমলে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চ বুর্জোয়াদের অর্থ, সম্পদ, শিক্ষা, সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও তারা অভিজাত শ্রেণিতে প্রবেশাধিকার পেত না। এতে তাদের আত্মাভিমান আহত হয়েছিল।
  • পুরােনাে ব্যবস্থার স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, যাজকতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এদের ক্ষোভের আরও কারণ ছিল, বুরবোঁঁ রাজাদের হয়ে শাসন পরিচালনা করত অভিজাতরা, তারা দেশের বাইরে যেত না, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। বুর্জোয়াদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য তারা কোনাে ব্যবস্থা নেয়নি।
  • বিদেশের বাণিজ্য যেমন অবহেলিত হয় তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অভ্যন্তরীণ শুল্কের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, গিল্ডের নিয়ম-কানুনের জন্য অন্তর্বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হত। বুর্জোয়ারা এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা চেয়েছিল যেখানে তারা কর্মের স্বাধীনতা পাবে, সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যায় ও অসাম্যের অবসান ঘটবে।
  • ফ্রান্সের বন্দর শহরগুলিতে এই বুর্জোয়া শ্রেণির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর্থার ইয়াং নান্তে শহরে বুর্জোয়াদের মধ্যে বিপ্লবী মনােভাব লক্ষ করেছিলেন।
  • তবে বিপ্লবের শুরুতে তারা অভিজাতদের বিরােধিতা করেনি, ১৭৮৭ থেকে ১৭৮৮ আগস্ট পর্যন্ত বুর্জোয়ারা অভিজাতদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিল। অভিজাত ও বুর্জোয়ারা এই সময়ে ফরাসি স্বৈরতন্ত্রের বিরােধিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
  • ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে বুর্জোয়ারা নিজেদের শ্রেণিচেতনা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিল, অভিজাততন্ত্র ও তাদের স্বার্থ যে এক নয় তা বুঝতে তাদের দেরি হয়নি। বিপ্লবে বুর্জোয়ারা দার্শনিকদের পৃষ্ঠপােষকতা দিয়েছিল, কৃষকদের বিপ্লবে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল, কিন্তু কৃষকরা কর সংগ্রাহক হিসেবে এদের ভূমিকা বিস্মৃত হয়নি।

কৃষক 

অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্স ছিল কৃষি-নির্ভর দেশ, দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি ছিল কৃষক। একটি হিসেবে দেখা যায় ২৫ মিলিয়ন লােকের মধ্যে ২২ মিলিয়ন ছিল কৃষক। ইউরােপের প্রথাগত সমাজে কৃষকদের কাজ ছিল দুটো – উৎপাদন করা এবং কর দেওয়া। ফ্রান্সে সামন্ত ব্যবস্থার অবশেষ তখনও টিকে ছিল, কৃষকদের মধ্যে পাঁচ শতাংশ বা প্রায় দশ লক্ষ ছিল ভূমিদাস (serf)। ফ্রান্সে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল, কৃষকদের সংখ্যা বেড়েছিল। আলেক্সি দ্য তর্কভিল জানিয়েছেন যে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের কৃষক ছিল জমির মালিক, স্বাধীন এবং লেখাপড়া শিখছিল। তার আঁকা এই চিত্রটি অনেকের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়নি। ফ্রান্সের মােট চাষযােগ্য জমির মাত্র ৩৩ শতাংশ ছিল কৃষকের মালিকানায়, বাকি ৬৭ শতাংশ জমির মালিক ছিল চার্চ ও ভূস্বামীরা।

  • ভূমিবান কৃষক : কৃষকদের মধ্যে একটি সম্পন্ন স্তর অবশ্যই ছিল, তবে ভূমিবান কৃষকদের সকলে আবার সম্পন্ন ছিল না। ফ্রান্সের কৃষি ও কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে ইংরেজ কৃষিবিজ্ঞানী আর্থার ইয়াং-এর ডায়েরি বহু তথ্য সরবরাহ করেছে। ইয়াং লিখেছেন যে ভূমিবান কৃষকদের সকলে সচ্ছল ছিলেন না, তিনি দুটি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন এই ভূমিবান কৃষকদের অনেকে ছিল দরিদ্র, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি। একজন ভূমিবান কৃষক তাকে একটি গাছ দেখিয়ে বলেছিল যে ঐ গাছের তলাটুকু হল তার কৃষিক্ষেত্র, উত্তর-পশ্চিমের এক কৃষক রমণী তাকে বলেছিল যে সামান্য একটু জমি তাদের আছে ঠিকই কিন্তু তাদের স্বামী-স্ত্রীকে অন্যান্য কাজ করে, হাঁস, মুরগি, শুয়াের ইত্যাদি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আর্থার ইয়াং-এর ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, সম্পত্তিবান কৃষকদের সকলে সচ্ছল ছিল না বা তাদের একই স্তরভুক্ত করা যায় না।
  • ভাগচাষি : ফ্রান্সের কৃষকদের পঞ্চাশ শতাংশ ছিল ভাগচাষি বা বর্গাদার (share croppers)। এরা চার্চ বা জমিদারের জমি ভাগ চাষি হিসেবে চাষ করত, উৎপন্ন ফসলের পঞ্চাশ শতাংশ পারিশ্রমিক হিসেবে পেত। জমিতে এদের কোনাে অধিকার জন্মাত না, তাদের অধীনস্থ জমি বন্ধক দেওয়া বা বিক্রি করার অধিকার তাদের ছিল না। কৃষকদের মধ্যে এরা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায়, ফসল বসানাের জন্য তাদের অর্থলগ্নি করতে হত, ফসল নষ্ট হলে এরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ত। ফ্রান্সে গ্রামীণ ঋণ সরবরাহের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না, ভূস্বামী, বণিক, মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে কৃষকদের ঋণ নিতে হত।
  • ভূমিহীন কৃষক: বাকি পঁচিশ শতাংশ কৃষক ছিল ভূমিহী। এরা কৃষি মজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত। কোনাে কারণে চাষের ক্ষতি হলে এরা দলে দলে শহরে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করত, ভবঘুরে ও ভিক্ষুক হিসেবে এদের অনেকে জীবন কাটাতে বাধ্য হত।

ফ্রান্স কৃষকদের দুঃসহ অবস্থা –

  • ফ্রান্সে চাষবাসের ভালাে ব্যবস্থা ছিল না, বুরবোঁঁ রাজাদের কৃষি বিভাগ ছিল না। জলসেচের ভালাে ব্যবস্থা ছিল না। ইংল্যান্ডে কৃষি বিপ্লব হয়েছিল, হল্যান্ডে নতুন ধরনের চাষবাস শুরু হয়েছিল, ফ্রান্সে তার প্রভাব পড়েনি। ইংল্যান্ডের সরকার বড়াে বড়াে জোত তৈরি করে দিয়েছিল, জলসেচের ব্যবস্থা করেছিল, নতুন শস্য চাষে উৎসাহ দিয়েছিল। ফ্রান্সের কৃষি ছিল প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।
  • জনসংখ্যা বৃদ্ধির অভিঘাতে কৃষি জোতের খণ্ডীকরণ চলেছিল, তাতে প্রান্তিক কৃষকের আয় কমেছিল, তাকে শ্রমিক বা কারিগর হিসেবে কাজ করে আয় বাড়াতে হত।
  • সমকালীন পর্যবেক্ষকরা বলেছেন যে ফ্রান্সের কৃষিতে সব সময় ভালাে ফসল হত না, দশ বছর ভালাে ফসল হলে পরের দশ বছর ভালাে ফসল হত না (agricultural cycle) । বিপ্লবের প্রাক্কালে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, পঙ্গপালের আক্রমণ, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদির জন্য ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফ্রান্সের কৃষি উৎপাদন ব্যহত হয়, কৃষি অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়েছিল।
  • ফ্রান্সের কৃষকের সংকটের দুটি দিক হল ভূমিহীনতা ও অতিরিক্ত করভার। কৃষকদের মধ্যে ভূমি বণ্টনের দাবি জোরালাে হতে থাকে, এরা জমিদার ও মহাজনের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিল, এই ঋণ থেকে তারা মুক্তি পেতে চেয়েছিল। তবে এর চেয়েও দুঃসহ ছিল তাদের করভার, তাদের বহু ধরনের কর দিতে হত।
  • কৃষকদের সমস্যা হল উপরতলার মানুষ অভিজাত ও যাজকরা রাষ্ট্রকে কর দিত না। রাজার আয়ের বেশিরভাগ সরবরাহ করত কৃষকরা, বাকিটা আসত বণিকদের কাছ থেকে। যাদের কর দেবার ক্ষমতা ছিল না তাদের কর দিতে হত, যাদের দেবার ক্ষমতা ছিল না তারা রাজাকে কর দিত না। কৃষকদেরকে দিতে হতো বিভিন্ন রকমের কর –
    • কৃষকরা রাজাকে দিত ভূমিকর তেই (Taille), চার্চকে দিত টাইথ (Tithe) ও জমিদারদের দিত নানাধরনের সামন্তকর (বানালিতে)। 
    • জমিদারদের ছিল শিকার ও মাছ ধরার অধিকার, জমিদার পথ সেতু ও খেয়াঘাটের ওপর কর বসাতেন।
    • সামন্তপ্রভুর কারখানায় রুটি, মদ ও গম ভাঙানাের জন্য কর দিতে হত।
    • সরকারি কাজ বিনা পারিশ্রমিকে করতে হত, বেগার শ্রম প্রথা কর্ভি (Corvee) নামে পরিচিত ছিল।
    • কাপিতাসিওঁ ও ভাতিয়েম (Capitation and Vinstiemes) ছিল আয়কর ও সম্পত্তিকর, গাবেল (Gabelle) ছিল লবণ কর।
    • কৃষকদের পশুখাদ্যের সঙ্গে লবণ মেশাতে হয়, এজন্য পরােক্ষ করের বােঝা তাদের ওপর বেশি ছিল।
    • ভােগ্যপণ্য তামাক, মদ ইত্যাদির ওপর ছিল বাণিজ্য শুল্ক অ্যাদ (Aides)। কৃষকেরা এই পরােক্ষ করটিকেও পছন্দ করত না।
  • বিপ্লবের প্রাক্কালে সামন্তকর নিয়ে কৃষকদের ক্ষোভ বেড়েছিল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল, ভূস্বামীদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল, এই পরিস্থিতিতে অভিজাত ভূস্বামীরা পুরােনাে দলিলপত্র ঘেঁটে নতুন নতুন সামন্তকর স্থাপন করেছিল, পতিত পশুচারণভূমি চাষের আওতায় এনেছিল। এতে কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভ অবশ্যই বেড়েছিল।

ফ্রান্সের বুরবোঁঁ সরকার কৃষকদের মৌল সমস্যাগুলির সমাধানের চেষ্টা করেনি; কৃষকদের ভূমি বণ্টনের দাবি, ঋণ থেকে মুক্তি ও করভার থেকে অব্যাহতির মতাে গুরুতর সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা হয়নি। সামন্ততান্ত্রিক করভার থেকে কৃষক মুক্তি চেয়েছিল, কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস হল বিপ্লবের প্রাক্কালে এই করভার তাে কমেনি বরং বেড়ে চলেছিল, কৃষকের অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছিল। তবে এটা মনে করা ভুল হবে কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের মধ্যে স্তরভেদ ছিল না, তাদের মধ্যে স্ববিরােধিতা ছিল না। এসব সত্ত্বেও ফ্রান্সের কৃষকের সমস্যা সবচেয়ে বড়াে সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছিল।

শ্রমজীবী

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অর্থনৈতিক উন্নতির প্রায়ই একই স্তরে ছিল, এই অবস্থা থেকে ইংল্যান্ড দ্রুত উন্নতি করতে থাকে, ফ্রান্স পিছিয়ে পড়ে। ফ্রান্সে শিল্পের অবস্থা –

  • ফ্রান্সে বস্ত্র, কয়লা, লােহা ও ইস্পাত শিল্পে আধুনিক যন্ত্রশিল্পের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু এর অগ্রগতির হার ছিল মন্থর। ফ্রান্সের অভিজাত ও বুর্জোয়াশ্রেণি শিল্পস্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফ্রান্সের শ্রমজীবী মানুষের বেশিরভাগ ছিল কুটির ও হস্তশিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক ও কারিগর, এরা আধুনিক যন্ত্রশিল্পের শ্রমিক নয়।
  • যন্ত্রশিল্পের মধ্যে বস্ত্র ছিল প্রধান, ইংল্যান্ডের মতাে ফ্রান্সের বস্ত্র শিল্পে প্রথম যন্ত্রের ব্যবহার হয়, তবে বেশিরভাগ উৎপাদন হত প্রথাগত শিল্পে। স্পিনিং জেনি, ওয়াটার ফ্রেম, মিউল ও ফ্লাইং শাটল ইত্যাদি ফ্রান্সের বস্ত্রশিল্পে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। উত্তরের শহর রাইম, রুয়েন ও লিওঁতে বস্ত্রশিল্প ছিল। ভ্যানরােবাই বস্ত্রকলে বহু শ্রমিক কাজ করত।
  • ইংরেজ প্রযুক্তিবিদরা ফ্রান্সের শিল্পের আধুনিকীকরণে সহায়তা দিয়েছিল। লােহা ও ইস্পাত শিল্পের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি ঘটেছিল। তবে কয়লার চুল্লি প্রবর্তিত হলেও কাঠের চুল্লিও পাশাপাশি চালু ছিল। আলসাস, লােরেন ও অন্যত্র লােহা ও ইস্পাত কারখানা ছিল। লৌহ শিল্পের প্রধান হলেন দিত্রিস (Dietrich), জেগেরতাল, নিডেরব্রন, রাইখসােফেল ও রােথাওয়েতে তার লােহার কারখানা ছিল। নিডেরব্রন কারখানায় আটশাে শ্রমিক কাজ করত। ক্রেউজার কারখানার লগ্নিকৃত মূলধনের পরিমাণ ছিল এককোটি লিভর।
  • কয়লা শিল্পেও একই অবস্থা লক্ষ করা যায়, পুরােনাে ব্যবস্থার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তবে খনির অভ্যন্তরস্থ জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা হয়নি। আনজিন (Anzin) কয়লা খনিটি ছিল বিশাল আকারের, এখানে একহাজারের বেশি লােক কাজ করত। এধরনের খনি শিল্প আর্লে ও কর্মোতেও ছিল।
  • ন্ত্রশিল্প ফ্রান্সে নতুন সামাজিক শ্রেণি গঠনের সূচনা করেছিল – শিল্প শ্রমিক পুঁজিপতিদের উত্থান শুরু হয়েছিল তবে এদের মধ্যে ঐক্যবােধ ও সংগঠন গড়ে ওঠেনি। পুরােনাে পদ্ধতিতে যে ভােগ্য ও শিল্পপণ্য উৎপাদিত হত তা দেশের প্রয়ােজন মেটাত। লাব্রুস মনে করেন পুরােনাে পদ্ধতিতে অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল।

সাঁকুলোৎ

শহরের দরিদ্র মানুষদের বলা হয়েছে সাঁকুলোৎ। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ শহরে বাস করত, বেশিরভাগ ছিল ছোটো বা মাঝারি শহর, সবচেয়ে বড়ো শহর ছিল প্যারিস। পাঁচ থেকে ছ’লক্ষ লোক সেখানে বাস করত, লিওঁ ছিল তারপর বড়ো শহর, প্রায় একলক্ষ লোক বাস করত। মার্সেই, বর্দো, লিল, নান্তে, তুলজ প্রভৃতি শহরে লোকসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের বেশি। অষ্টাদশ শতকে শাসনের জন্য শহরগুলির সম্প্রসারণ ঘটে, রাস্তাঘাট, জলনিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। নানা কর্ম উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিশেষ করে গ্রাম থেকে, বহু লোক শহরে এসে হাজির হত। এদের মধ্যে ছিল দিনমজুর, দোকান কর্মচারী, শিক্ষানবিশ, মুটে, ভিত্তি, মালি, ভৃত্য, সদ্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পের শ্রমিক, মিস্ত্রি ইত্যাদি। অনেক ভবঘুরে ও ভিক্ষুকও ছিল। শহরের বেশিরভাগ মানুষ ছিল এই সাঁকুলোৎরা। এদের অবস্থা –

  • এদের নির্দিষ্ট জীবিকা ছিল না, ভালো বাসস্থান ছিল না। শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এরা বাস করত, লেখাপড়া শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। মার্কস কথিত প্রলিতারিয়েতের এরা হল পূর্বসূরি, সবুল এদের শহুরে জনতা বলে উল্লেখ করেছেন।
  • লাব্রুস দেখিয়েছেন ১৭৩০-১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছিল ৬০ শতাংশ। সেই সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই দরিদ্রশ্রেণির মজুরি বৃদ্ধি পায়নি, এদের মজুরি বেড়েছিল মাত্র ২২ শতাংশ। শহরে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছিল, উৎপাদন বেড়েছিল, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি তেমন বাড়েনি।
  • সাঁকুলোৎদের মৌল সমস্যা হল মধান ভোগ্যপণ্য খাদ্যশস্য, বস্ত্র, মাংস, চিনি ইত্যাদির এমন মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল যে তাদের প্রকৃত মজুরি হ্রাস পেয়েছিল। একজন দিন মজুরের প্রতিদিনের মজুরির ৭৫ শতাংশ রুটি কিনতে ব্যয় হয়ে যেত। এই শ্রেণি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল এই অসহনীয় দুঃসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে।
  • এদের সামাজিক সম্মান ছিল না, অভিজাত ও বুর্জোয়ারা এদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত।

অবমানিত, লাঞ্ছিত, দরিদ্র, অশিক্ষিত এই হতভাগ্যের দল বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বিপ্লবে তারা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল –

  • শ্রমিকদের দাবি নিয়ে ২৮ এপ্রিল (১৭৮৯) প্যারিসে বিক্ষোভ ও দাঙ্গা হয়েছিল, বলা যায়, শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষদের সেটাই ছিল প্রথম বিপ্লবী দিবস।
  • বাস্তিল দুর্গের পতনে, ভার্সাই শহরের ভুখা মিছিলে বা রাজতন্ত্রের পতনে এদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
  • বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে খাদ্যাভাব চলেছিল, খাদ্য বাজার থেকে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেত, সাঁকুলোৎরা খাদ্যদাঙ্গা করে প্রতিবাদ জানাত, খাদ্যগাড়ি লুট করত বা ব্যবসায়ীদের ন্যায্য দামে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধ্য করত।
  • বিপ্লব শুরু হলে এই সাঁকুলোৎরা মূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি তুলেছিল, কর্মসংস্থানের কথা বলেছিল।

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা

অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে ফ্রান্স দরিদ্র বা অনুন্নত দেশ ছিল না। জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিজ সম্পদ, শিল্প ও বাণিজ্যে ফ্রান্স বেশ অগ্রসর দেশ ছিল। রাস্তাঘাট, যাতায়াত ব্যবস্থা খুব অনুন্নত ছিল না, তবে পরিবহনের ভালো বন্দোবস্ত গড়ে ওঠেনি। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের পরেই ছিল ফ্রান্সের স্থান। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংল্যান্ড ক্রমশ এগোতে থাকে, ফ্রান্স পিছিয়ে পড়তে থাকে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে কৃষির উৎপাদন তাল মিলিয়ে বাড়েনি : ফ্রান্স অবশ্যই ছিল কৃষিনির্ভর দেশ, লোকসংখ্যার ৮০ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। শতকের গোড়ার দিকে ফ্রান্সের জনসংখ্যা ছিল ১৫ মিলিয়ন, শতকের শেষদিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫-২৬ মিলিয়ন। ফ্রান্সের কৃষিতে উৎপাদন যে একেবারে বাড়েনি তা নয়। জনসংখ্যার চাপে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা হয়, তাতে একর পিছু উৎপাদন হার কমেছিল। সরকার যে কৃষির ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল তা নয় –

  • সরকারি কৃষিসংস্থা কৃষকদের নতুন শস্য চাষ করার জন্য উৎসাহ দিত।
  • গবাদি পশু বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
  • অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ হত, ফসল নষ্ট হয়ে যেত। এজন্য কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়, এমনকি পুঁজিবাদী কৃষির কথা অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন।

ফ্রান্সের কৃষিতে বিপ্লব না আসার কারণ : ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সের কৃষিতে বিপ্লব হয়নি, কারণ –

  • এজন্য ফ্রান্সের ভূমি ব্যবস্থা অনেকখানি দায়ী ছিল।
  • ফ্রান্সের কৃষক ছিল অশিক্ষিত, রক্ষণশীল ও দরিদ্র, এজন্য কৃষিতে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
  • ফ্রান্সের কৃষকেরা ছিল দরিদ্র, এজন্য কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার তারা করতে পারেনি। ফ্রান্সের কৃষকেরা ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানসম্মত কৃষি যন্ত্রপাতির কথা জেনেছিল, জেথরো টুলের (Jethro Tull) প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছিল, কয়েকজন অভিজাত কৃষিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কৃষির উন্নতি হয়নি, উৎপাদন তেমন বাড়েনি, জলসেচের ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়নি। পাশের দেশ হল্যান্ডে কৃষি কাজকর্মের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো বা চক্রাকার চাষের ব্যবস্থা হয়েছিল।
  • কৃষকের রক্ষণশীলতা কৃষি সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করত। কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনের জন্যে যে ব্যাপক হারে পুঁজি বিনিয়োগের দরকার ছিল বেসরকারি বা সরকারি কোনো পক্ষই তা লগ্নি করতে রাজি ছিল না।
  • সরকার বার্টিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে অনেকগুলি কৃষি সমিতি গড়ে তুলেছিল। পতিত জমি চাষের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছিল কিন্তু কৃষকেরা তাতে উৎসাহ দেখায়নি।
  • গ্রামীণ অভিজাতরা কৃষি সংস্কারের বিরোধিতা করত কারণ তারা ধরে নিয়েছিল সংস্কার তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ধ্বংস করবে।
  • বিপ্লবের প্রাক্কালে দ্রব্যমূল্য ও মজুরি নিয়ে গবেষণা করেছেন সি. ই. লাব্রুস। তিনি দেখিয়েছেন যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষকেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দরিদ্র কৃষকের খাদ্য ভুট্টা, রাই ও নিম্নমানের গমের দাম ভালো গমের চেয়ে বেশি বেড়েছিল।

ফ্রান্স  শিল্পের অবস্থা :

  • ফ্রান্সের তুলনামূলকভাবে অনুন্নত কৃষি তার শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করত। তুলো, আখ, রেশম, পশম, শণ ইত্যাদি কৃষকেরা উৎপন্ন করত, এগুলি শিল্পে ব্যবহার করা হত। ফ্রান্সের কুটির শিল্প মদের কাঁচামাল আঙুর ছিল কৃষিজ ফসল।
  • ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব না হলেও ফ্রান্স শিল্পে ছিল একটি অগ্রসর দেশ। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের শিল্পের উৎপাদন প্রায় দু-গুণ বেড়েছিল। ফ্রান্সে নগরায়ণ চলেছিল, প্যারিস, লিয়ো, রেনে, বোর্দো প্রভৃতি শহরের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। নগরবাসী মানুষের ভোগ্য পণ্যের সরবরাহ করত ফরাসি শিল্প।
  • রাজারা নিজেদের ব্যবহারের জন্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করেছিলেন, সরকারি কারখানায় যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম উৎপন্ন হত।
  • ফ্রান্সে একটি ধনী বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। এরা রাজা ও অভিজাতদের ঋণ দিত, বাণিজ্য ঋণ সরবরাহ করত এবং ঋণ সরবরাহকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করত। এরা সরকারের হয়ে দেশ থেকে কর সংগ্রহ করত (farmier general) ।
  • ফ্রান্সের প্রধান শিল্প হল চিনি, রেশম, পশম, সুতিবস্ত্র, লোহা, কয়লা, মদ প্রভৃতি। বাণিজ্যিক পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ করা হত, বণিকেরা নিজেদের উদ্যোগে শিল্প উৎপাদনের ব্যবস্থা করতেন।
    • লিঁয়ো ছিল রেশম শিল্পের জন্য বিখ্যাত, এর একাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যেত।
    • বোর্দোতে চিনি, মদ ও জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল।
    • ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে লিনেন, পশম ও সূতি বস্ত্র তৈরি হত।
    • মেন, ব্রিটানি ও ক্যাস্ত্রোসিসে বস্ত্র তৈরির কারখানা ছিল।
    • ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল বস্ত্রশিল্পের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল, এখানকার লিল, লিয়ো, রাইম, রুয়েন প্রভৃতি শহরে বস্ত্রকল ছিল।
    • ধাতু শিল্পের মধ্যে কয়লা ও লোহার উন্নতি হয়েছিল। আলসাস-লোরেন ও আনজিনে খনিশিল্প গড়ে উঠেছিল।
  • ফ্রান্সে বহু শিল্পপণ্য উৎপাদিত হলেও উৎপাদন পদ্ধতিতে তেমন পরিবর্তন হয়নি। কোনো কোনো শিল্পে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার শুরু হলেও ব্যাপকভাবে তার ব্যবহার হয়নি। বস্ত্রশিল্পে কিছু কিছু যন্ত্রপাতির ব্যবহার হয়েছিল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই শিল্প মধ্যযুগীয় উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছিল।
  • ফ্রান্সের অধিকাংশ শিল্পে গিল্ড ছিল, গিল্ড উৎপাদন, সরবরাহ, মূল্য মজুরি ইত্যাদি নির্ধারণ করত।
  • শ্রমিক-মালিক স্বার্থের সংঘাত অজানা ছিল না। বণিকেরা নিজেদের পুঁজি, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল দিয়ে শ্রমিক-কারিগর লাগিয়ে উৎপাদনের ব্যবস্থা করত (Putting out system) ।

ফরাসি শিল্পের অনগ্রসরতার কারণ :

  • মূল কারণ হল পুঁজির অভাব, উদ্যোগী বণিক বা বুর্জোয়া কিছু পুঁজির বিনিয়োগ অবশ্যই করেছিল, কয়েকজন অভিজাত শিল্পে মূলধন নিয়োগ করেন, কিন্তু বড়ো বড়ো শিল্পগুলি যথেষ্ট মূলধন সংগ্রহ করতে পারত না। তাদের সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হত। সরকার অনেক সময় বড়ো বড়ো শিল্পগুলিকে অনুদান, ঋণ, ভর্তুকি এমনকি একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগও করে দিত।
  • অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে উন্নত ব্যাংক পরিষেবা বা স্টক এক্সচেঞ্জ ছিল না। বিদেশিরা ফ্রান্সে ব্যাংকিং কারবার করত, কিন্তু শিল্প ঋণ পাওয়া সহজ ছিল না।
  • ফ্রান্স অর্থনীতিতে মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসরণ করত। এই মতবাদের অর্থ হল সরকারি নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, নেভিগেশন আইন, উপনিবেশ ও নৌবহর গঠন ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় রপ্তানিকে উৎসাহ দেওয়া হত, আমদানি কমাতে বলা হয়, সোনা-রুপোর রপ্তানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল।
  • সরকারের সুনির্দিষ্ট শিল্পনীতি ছিল না, শিল্প যে, সম্পদের উৎস এই ধারণা শাসকদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। ফ্রান্সের বেশিরভাগ শিল্প ছিল কুটির ও হস্তশিল্প, অল্প পুঁজি নিয়ে মালিক নিজেই তার গৃহে পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করত।

বৈদেশিক বাণিজ্য :

  • বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের বাণিজ্য বেড়েছিল, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল কমপক্ষে চারগুণ।
  • অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে শান্তি ছিল, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমেছিল, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক কাজকর্ম বেড়েছিল। ঔপনিবেশিক কার্যাদির মধ্যে উল্লেখ্য –
    • আমেরিকা, কানাডা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ভারতে ফরাসিদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল।
    • আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিক্রি করা হত।
    • আটলান্টিক ছাড়াও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ফরাসিদের বাণিজ্য ছিল। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে লেভান্ট অঞ্চলে ফরাসি বণিকেরা বাণিজ্য করতে যেত।
  • এই শতকে ফ্রান্সের বন্দরগুলি সর্বদা কর্মব্যস্ত থাকত। মার্সেই, বর্দো, লা রোচেল, নান্তে, ডানকার্ক দিয়ে পণ্য আমদানি- রপ্তানি চলত। বাল্টিক সাগরের বন্দরগুলির সঙ্গে ফরাসি বণিকেরা বাণিজ্য করত। ইংরেজ পর্যটক আর্থার ইয়াং বোর্দোর সঙ্গে ইংল্যান্ডের লিভারপুলের তুলনা করেছেন।
  • অষ্টাদশ শতকে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফ্রান্স ইংল্যান্ডের কাছে পরাস্ত হলেও তার বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য :

বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে তার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আশানুরূপভাবে বাড়েনি, ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সে বাণিজ্য বিপ্লব হয়নি। কারণ –

  • ফ্রান্সের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না।
  • অন্তর্বাণিজ্য বিকাশের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল এই যে, অসংখ্য শুল্ক প্রাচীর পণ্য চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি করত, আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিত। প্রত্যেক ভূস্বামী তার এলাকার প্রান্তে শুল্ক চৌকি বসিয়েছিল।
  • ওজন, পরিমাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ঐক্য ছিল না।
  • তাছাড়া ফ্রান্সে ছিল অসংখ্য বাণিজ্য ও শিল্প ও গিল্ড। এগুলি উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল, ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ এগুলিকে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিল, বিপ্লবের প্রথম ধাক্কায় জনতা এই শুল্ক চৌকিগুলি ও তাদের কাগজপত্র নষ্ট করে দিয়েছিল।

সার্বিক অবস্থা :

  • অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ফ্রান্স ইউরোপের মধ্যে একটি সচ্ছল দেশ ছিল। অভিজাত ও বুর্জোয়ারা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ছিল, চার্চের হাতে অঢেল সম্পদ ছিল, সাধারণ মানুষ চার্চের সম্পত্তি সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠে ছিল। উচ্চ যাজকেরা বিলাস-ব্যসনের মধ্যে থাকতেন। ভার্সাই শহরে প্রায় দশ হাজার অভিজাত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা বানিয়ে প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করতেন, জাঁকজমক ও আড়ম্বরের অভাব ছিল না।
  • অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে নির্মাণ শিল্প উৎসাহিত হয়েছিল, বহু রাজমিস্ত্রি ও কারিগর এই নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মিস্ত্রি ও কারিগরদের পৃথক গিল্ড ছিল।
  • সম্পন্ন লোকেরা শহর জীবনকে পছন্দ করেছিল, সেজন্য শহরের সম্প্রসারণ ঘটে, শহরবাসী লোকের সংখ্যা বেড়ে যায়।
  • ফরাসি অর্থনীতির মৌল সমস্যা হল মুষ্টিমেয় মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর ও গ্রামের মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল। ভিখারি ও ভবঘুরেদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল, গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধ বেড়ে চলেছিল।
  • শাসকগোষ্ঠী এসব আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধানের কথা ভাবেনি, কৃষি ও শিল্পবিপ্লব ঘটিয়ে ফ্রান্সের ক্রমবর্ধমান জনগণের খাদ্য, ভোগ্যপণ্য ও কর্মসংস্থানের দাবি মেটানো সম্ভব ছিল। শাসকগোষ্ঠী এব্যাপারে ব্যর্থ হলে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট

বিপ্লবের কারণ নিয়ে মতানৈক্য : ফরাসি বিপ্লবের সমকালীন ও আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিপ্লবের কারণ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ এর রাজনৈতিক কারণকে, আবার অনেকে এর আর্থ-সামাজিক কারণকে বিপ্লবের জন্য দায়ী করেছেন। ফরাসি বিপ্লবের আধুনিক ঐতিহাসিকরা প্রাক্- বিপ্লব যুগের অর্থনৈতিক সংকটের ওপর জোর দিয়েছেন। সমকালীন ও আধুনিক ঐতিহাসিকরা এসম্পর্কে একমত হতে পারেননি।

  • প্রায় সমকালীন আলেক্সি দ্য তর্কভিল বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক কারণকে গুরুত্ব দেননি। তার মতে, বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে থাকে, বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছিল, শিল্পের উন্নতি হয়, কৃষকেরা সামন্তব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও শিক্ষিত হয়ে উঠেছিল, জমির মালিকানা পেয়েছিল।
  • আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে জারেস (Jaures) বিপ্লবের প্রাক্কালে ফরাসিদেশের সমৃদ্ধি লক্ষ করেছিলেন।
  • মিশলে (Michelet) দেখেছিলেন দেশটির দুঃসহ শোষণ ও দারিদ্র্য।
  • আধুনিককালে জর্ড লেভের. সি. ই. লাকস ও রিচার্ড কব বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করেছেন। এই সংকটের ফলে ফ্রান্সের কৃষক, শ্রমিক ও সাকুলোত্রা ভয়ংকর দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। এদের মতে, বিপ্লবের প্রাক্কালে রাজার অর্থনৈতিক সংকট, কৃষি অর্থনীতিতে অবক্ষয়, শিল্প-বাণিজ্যের মন্দা, জিনিসপত্রের অসাধারণ মূল্যবৃদ্ধি এবং সেইসঙ্গে জীবন ধারণের সংকট বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল।

রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে সংকট : বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে (Public finance) সংকট দেখা দিয়েছিল –

  • ঋণ : বুরবোঁঁ রাজাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি ছিল। চতুর্দশ লুইয়ের সময় থেকে রাজারা ঋণ নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতেন, এতে রাজার ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল, আয়ের পঞ্চাশ শতাংশ ব্যাংকারদের সুদ হিসেবে দিতে হত। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজার আয় ছিল ৫০০ মিলিয়ন লিভর, ব্যয় হয়েছিল ৬২১ মিলিয়ন, ঘাটতি ছিল ১২৬ মিলিয়ন। বুরবোঁ রাজাদের অর্থনীতি একটি ‘দুষ্ট চক্রের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, তা থেকে মুক্তি মেলেনি।
  • কর না আসা : বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অভিজাত সম্প্রদায়। বুরবোঁ রাজাদের সাধারণত গড়ে বার্ষিক ৫০০ মিলিয়ন লিভর আয় হত। এই আয়ের অর্ধেক আসত ভূমিরাজস্ব তেই থেকে, বাকি অর্ধেক আদায় করা হত সম্পদ কর কাপিতাসিও, আয়কর ভাতিয়েম, শুল্ক অ্যাদ ও লবণ কর গাবেল থেকে। ফ্রান্সের কর ব্যবস্থা ছিল বৈষম্যমূলক, রাজাদের নিজস্ব কর বিভাগ ছিল না। কর স্থাপন ও সংগ্রহের কাজ করত ফারমিয়ের জেনারেলরা। ফ্রান্সের উচ্চযাজক ও অভিজাতরা রাজাকে কর দিত না, যাজকরা মাঝে মাঝে রাজাকে থোক টাকা কর হিসেবে নিত, কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। অভিজাতদের কর দেবার কথা ছিল কিন্তু নানা কৌশলে কর ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি তারা আদায় করে নিত। ফ্রান্সের কৃষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হত। ফ্রান্সের কর সংগ্রহ পদ্ধতি ছিল উৎপীড়নমূলক। ফারমিয়ের জেনারেলরা করের ইজারা নিয়ে ঠিকাদার ও ফাটকাবাজদের সঙ্গে কর আদায়ের বন্দোবস্ত করত। এরা কৃষকদের কাছ থেকে নানা অবৈধ ও বেআইনি কর আদায় করত।
  • যুদ্ধ : ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি বড়ো অংশ যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য ব্যয় হয়ে যেত। আয়ের ৫০ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হত কারণ সারা অষ্টাদশ শতক ধরে যুদ্ধবিগ্রহ চলেছিল। রাজার ঋণ এজন্য বেড়ে চলেছিল, ষোড়শ লুইয়ের আমলে রাজার গুণ বেড়েছিল তিনগুণ। বিপ্লবের প্রাক্কালে রাজার ঋণ ছিল প্রায় ৫০০ কোটি লিভর অর্থাৎ রাজার দশ বছরের আয়ের সমান। এই বিরাট অঙ্কের ঋণের জন্য শতাব্দী ব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ দায়ী ছিল। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স চারটি বড়ো বড়ো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, যেগুলোতে ফ্রান্সের মোট ব্যয় হয়েছিল চারশো কোটি লিভর –
    • চতুর্দশ লুইয়ের আমলে স্পেনের উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলে ফ্রান্স তাতে যোগ দিয়েছিল ( ১৭০২-১৭১৩)।
    • ১৭৪০-১৭৪৮ পর্যন্ত পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে যোগ দিয়ে বিরাট ঋণের জালে জড়িয়েছিল।
    • ১৭৫৬-১৭৬৩ পর্যন্ত চলেছিল সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মহাদেশীয় ইউরোপে আধিপত্য লাভ ছিল এর কারণ। এই যুদ্ধেও ফ্রান্সের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় কিন্তু লাভ তেমন হয়নি। আমেরিকা ও ভারতেও ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করেছিল।
    • ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্স আমেরিকার স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রশ্নে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং পাঁচ বছর ধরে যুদ্ধ করেছিল (১৭৭৮-১৭৮৩)। এই যুদ্ধে ফ্রান্সের ১৮০ থেকে ২০০ কোটি লিভর ব্যয় হয়েছিল। আমেরিকা স্বাধীনতা পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু ফরাসি বিপ্লব প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কোবান লিখেছেন যে আমেরিকার স্বাধীনতার মূল্য হল ফরাসি বিপ্লব’ (the price to be paid for American independence was a French Revolution) ।
  • প্রাসাদ ও কর্মচারীদের খরচ : বুরবোঁ রাজারা সৈন্যবাহিনী ছাড়াও প্রাসাদ ও কর্মচারীদের জন্য বাজেটের ২৫ শতাংশ ব্যয় করত। রাজা পঞ্চদশ লুই বিলাস-ব্যসনে থাকতেন, শিকার করতে ভালোবাসতেন, রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা মারি আতোয়ানেতের পাঁচশো দাস-দাসী ছিল। রাজপরিবারের মহিলারা বিলাস-ব্যসনের জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করতেন। পঞ্চদশ লুইয়ের স্ত্রী মাদাম পম্পাদ্যুর প্রচুর মণিমুক্তো কিনতেন। রাষ্ট্রীয় আয়ের ১২ শতাংশ শুধু প্রাসাদের জন্য ব্যয় হত। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ রাজাকে বাজেটের ১২ শতাংশ ব্যয় করতে হত। রাজারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণমূলক কাজে বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় করতেন। এসব কাজের বেশিরভাগ করত চার্চ ও যাজকেরা।
  • করের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করতে গিয়ে বিপ্লব : রাজার অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির পথ ছিল বায় কমানো অথবা আয় বাড়ানো। ব্যয় কমানো সম্ভব ছিল না, আর আয় বাড়ানোর জন্য ষোড়শ লুইয়ের চারজন অর্থমন্ত্রী ভূগো, কালোন, ব্রিয়েন ও নেকার করব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব দেন। ফ্রান্সের কৃষকদের কর দেবার ক্ষমতা ছিল না, অভিজাত ও যাজকরা রাজাকে কর দিতে পারত। কিন্তু অভিজাত শ্রেণি ও পার্লেমো রাজার ভূমি কর ও স্ট্যাম্প কর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। এই শ্রেণির মানুষ সম্পত্তিকে পবিত্র অধিকার বলে গণ্য করতে থাকে, করকে তারা সম্পত্তির ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করেছিল। তারা রাজাকে জাতীয় পরিষদ স্টেট্স-জেনারেল আহ্বান করার পরামর্শ দিয়েছিল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় রাজা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্টেটস-জেনারেল আহ্বান করলে বিপ্লব শুরু হয়ে যায়।

কৃষি অর্থনীতিতে সংকট : বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। ফ্রান্সের মোট আড়াই কোটি লোকের মধ্যে দু’কোটি বিশ লক্ষ লোক ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত মধ্যযুগীয় ও অনগ্রসর। হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের নতুন কৃষি ব্যবস্থার প্রভাব এখানে পড়েনি। জর্জ লেফেভর ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতির সংকটকে বিপ্লবের আসল কারণ বলে ধরে নিয়েছেন, কৃষি সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

  • তার মতে, বিপ্লবের আগে দশ বছর ধরে (১৭৭৮-১৭৮৮) এই সংকট চলেছিল। গোড়ার দিকে ছিল মন্দা, কৃষিজ পণ্যের দাম কমেছিল, এতে কৃষক ও ভূস্বামী উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
  • বিপ্লবের আগের তিনবছর ধরে (১৭৮৬-৮৮) অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, শস্যহানি, পঙ্গপালের আক্রমণ ইত্যাদির জন্য কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, খাদ্যাভাব দেখা দেয়, খাদ্য শস্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।
  • কৃষকেরাও দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিল। ফ্রান্সের বেশিরভাগ কৃষক ছিল দরিদ্র বর্গাদার, ২৫ শতাংশ ছিল ভূমিহীন আর মাত্র ২৫ শতাংশ কৃষক ছিল সম্পত্তিবান। আর্থার ইয়াং-এর বর্ণনা থেকে দেখা যায় এই সম্পত্তিবান কৃষকদের অনেকে ছিল ক্ষুদ্র, দরিদ্র, প্রান্তিক চাষি। এই কৃষক সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয় আয়ের বেশিরভাগ জোগাতে হত। রাষ্ট্র, চার্চ, সামন্তপ্রভু সকলকে কর দিতে হয়, বেগার শ্রম কর্তি দিতে হত।
  • লেফেভর জানিয়েছেন যে বিপ্লবের প্রাক্কালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, দরিদ্র কৃষক দলে দলে শহরে গিয়ে ভিড় করতে থাকে। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
  • তিনি আরও জানিয়েছেন যে কৃষকদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে আত্মরক্ষার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। ভূস্বামীদের আক্রমণের আশঙ্কায় কৃষকেরা দলবদ্ধভাবে ভূস্বামীদের প্রাসাদ (শাটো) আক্রমণ করে দলিল-পত্র পুড়িয়ে দেয়, শস্যগোলা লুট করেছিল, তবে প্রাণহানির ঘটনা ছিল খুব কম। লেফেভর জানিয়েছেন গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে দুটি প্রবণতা সক্রিয় ছিল—একটি হল ‘বিষম ভীতি’ (great fear), অপরটি হল ‘বিরাট আশা’ (great hope) । কৃষকেরা ন্যায় ও সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তারা আশা করেছিল ওপর তলার মানুষেরা দুর্বিষহ অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দিতে এগিয়ে আসবেন। ইয়াং-এর পরিচিত কৃষক রমণী তার কাছে এমন আশা ব্যক্ত করেছিলেন।

শিল্প ও বাণিজ্যে সংকট : বিপ্লবের প্রাক্কালে শিল্প ও বাণিজ্যে সংকট দেখা দিয়েছিল। ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব হয়নি, তবে কোনো কোনো শিল্পে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লবের উপযোগী পরিকাঠামো তৈরি হয়নি, বেশিরভাগ শিল্প ছিল কুটির ও হস্তশিল্প, শিল্প পুঁজির অভাব ছিল। তবে ফ্রান্সে কয়েকটি বড়ো শিল্প অবশ্যই ছিল। বস্ত্র, রেশম, পশম, চিনি, জাহাজ এবং লোহা ও ইস্পাত শিল্প ছিল। ফ্রান্সের ভোগ্যপণ্য দেশে উৎপন্ন হত, কিছু পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হত। ফ্রান্সে বড়ো বড়ো বন্দর ছিল, বুর্জোয়ারা আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা ও লেভান্টের সঙ্গে বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল। বাল্টিক সাগরের বন্দরগুলিতে ফরাসি বণিকদের যাতায়াত ছিল। ফ্রান্সের সবচেয়ে বড়ো শিল্প হল বস্ত্র শিল্প, উত্তরের শহরগুলিতে এই শিল্প প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভ্যানরোবাই টেক্সটাইল মিলে বারো হাজার শ্রমিক কাজ করত, আনজিন খনি অঞ্চলে কর্মরত ছিল নয় হাজার শ্রমিক। সমস্যা হল বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের শিল্প-বাণিজ্যে মন্দা চলেছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয় বাজার গড়ে ওঠেনি, দেশের মধ্যে অসংখ্য শুল্ক চৌকি ছিল, শিল্প ও বাণিজ্যের সংগঠন গিল্ডগুলি উৎপাদন, সরবরাহ, পণ্যমূল্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করত। ফ্রান্সের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মন্দার কারণ –

  • অনেকে ফ্রান্সের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মন্দার জন্য ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অবাধ বাণিজ্য চুক্তিকে দায়ী করে থাকেন। এদের মতে, এই চুক্তির ফলে ইংল্যান্ড থেকে অবাধে উন্নতমানের সস্তা ভোগ্যপণ্য ফ্রান্সে আমদানি করা সম্ভব হয়। ফ্রান্সের কারখানায় উৎপন্ন পণ্য ইংল্যান্ডের যন্ত্রশিল্পে প্রস্তুত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরাস্ত হয়। ফলে ফ্রান্সের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংকট দেখা দিয়েছিল। উৎপাদন হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ফ্রান্সের শিল্প শহরগুলিতে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিল। লিওঁ, ট্রয়, রুয়েন, রাইমস প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত শহরগুলিতে এই সংকট দেখা দিয়েছিল, ইংল্যান্ডের উন্নতমানের সস্তা বস্ত্র ফ্রান্সে প্রবেশ করেছিল। এই সংকট গ্রামের শিল্প কারখানাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
  • জর্জ লেফেভর ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের অবাধ বাণিজ্য চুক্তিকে বিপ্লবের জন্য দায়ী করেননি। তার মতে, ফ্রান্সের অনগ্রসর শিল্প ও বাণিজ্য এই সংকটের জন্য দায়ী ছিল। তবে এই অবাধ বাণিজ্য চুক্তি যে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকটকে সাময়িকভাবে তীব্রতর করে তুলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
  • ফ্রান্সের মার্কেন্টাইল অর্থনীতির জন্য আমদানি-রপ্তানি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র রপ্তানিকে উৎসাহ দিত, আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ চাপানো হয়। এর ফলে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় চারগুণ বেড়েছিল, এই বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এজন্য জারেস মন্তব্য করেছেন যে সমৃদ্ধির মধ্যে বিপ্লব এসেছিল। তবে এই বক্তব্য অধিকাংশ ঐতিহাসিক মেনে নেননি। জর্জ লেফেভর মনে করেন যে বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে লাভবান হয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণি। ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক এর ফলে লাভবান হয়নি। এই বাণিজ্যের বেশিরভাগ ছিল পুনঃরপ্তানি বাণিজ্য (re-export trade)। বিদেশ থেকে পণ্য কিনে ফরাসি বণিকেরা নিজেদের দেশে গুদামজাত করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করত। এই পণ্য ফ্রান্সে উৎপন্ন হত না, সেজন্য শ্রমিক ও কৃষক এই সমৃদ্ধির ভাগ পায়নি। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মন্দা চলেছিল, বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতি সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হয়নি, শিল্পে এর বাজে প্রভাব পড়েছিল।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : বিপ্লবের সময় ইউরোপের সবদেশে জিনিসপত্রের দাম অল্পবিস্তর বেড়েছিল। কারণ –

  • এর প্রধান কারণ হল ইউরোপে মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছিল, উৎপাদন বাড়েনি। এজন্য বলা হয়েছে মেক্সিকোর রুপোর খনিতে ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। শুধু মেক্সিকো নয়, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে সোনা ও রুপোর উৎপাদন বেড়েছিল, ইউরোপের বাজারে সোনা ও রুপোর সরবরাহ বেড়েছিল। উৎপাদন না বাড়িয়ে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়ালে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে।
  • বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার আরও দুটি কারণ লক্ষ করা যায়। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অন্য যে-কোনো দেশের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ছিল। ফ্রান্সের বুরবোঁ সরকার দেশে খাদ্যশস্য ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।
  • অপর কারণটি হল ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা ধনশালী হয়ে উঠেছিল, আর ভূমি-নির্ভর অভিজাতরা দীর্ঘস্থায়ী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে খাজনা বাড়িয়ে আয় বাড়িয়ে নিয়েছিল। এদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি থাকায় মূল্যস্তরের ওপর চাপ পড়েছিল।

সি ই লাব্রুস বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত সংকটের বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ঐ সময়কার সমস্ত ভোগ্যপণ্যের পরিসংখ্যান দিয়ে সংকট ব্যাখ্যা করেছেন –

  • লারুস দেখিয়েছেন যে খাদ্য, বস্ত্র ও মাংসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল, বিপ্লবের আগের তিরিশ বছর এই তিনটি পণ্যের গড় মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল ১০০-১৩০ শতাংশ। চিনি, কফি, মাখন সহ সব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছিল ৬০ শতাংশ, সাধারণ মানুষ দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। এই হারে কিন্তু ভোগ্যপণ্য মদের দাম বাড়েনি, মদের দাম বাড়লে কৃষক উপকৃত হত কারণ মদ ছিল ফ্রান্সের কুটির শিল্প। সরকারি শুল্ক নীতির জন্য জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল, শুল্কচৌকি ও গিল্ডের নিয়ন্ত্রণের জন্য দাম বেড়েছিল।
  • এর পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে অত্যন্ত কম। গত তিরিশ বছরে গড়ে মজুরদের বেতন বেড়েছিল মাত্র ২২ শতাংশ।
  • দ্রব্যমূল্য ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে এই অসঙ্গতি দেশের বেশিরভাগ মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। লেফেভর জানিয়েছেন যে বেশ কিছুকাল ধরে ফ্রান্সের মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটে চলেছিল। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সাধারণ মানুষ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়।
  • বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে মজুতদারি, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজি চলেছিল, এসব কাজকর্মের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরাও যুক্ত ছিলেন।
  • লাব্রুস জানিয়েছেন যে একজন শ্রমিক দৈনিক যা রোজগার করত তার ৫০-৭৫ শতাংশ শুধু রুটি কিনতে ব্যয় হয়ে যেত, অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য তার আয়ের সামান্য অংশই থাকত। এই পটভূমিকায় ফ্রান্সের সর্বত্র খাদ্যদাঙ্গা দেখা দিয়েছিল। খাদ্যের দোকান লুট হয়, খাদ্য গাড়ি থামিয়ে ক্ষুধার্ত জনতা ন্যায্য দামে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধ্য করত।

উপসংহার : একথা ঠিক ফরাসি বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক সংকট সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল। বুরবোঁ রাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারেনি। বিপ্লবের প্রাক্কালে বিপুল ক্ষণভারে রাজতন্ত্র দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষি-নির্ভর, বিপ্লবের প্রাক্কালে কৃষিতে অজন্মা চলেছিল। বেশিরভাগ কৃষক (প্রায় ৭৫ শতাংশ) ছিল ভূমিহীন, এদের ক্রয়ক্ষমতা ছিল না, অত্যধিক করভাবে ফ্রান্সের কৃষক ছিল জর্জরিত, দুর্দশাগ্রস্ত। কৃষি অর্থনীতি থেকে মন্দা শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। সমস্ত ভোগ্যপণ্য দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল, অসাধু বণিক ও সরকারি কর্মচারীরা মজুতদারি বাড়িয়ে দিয়েছিল। অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, ভয়াবহ বেকারত্ব ও মজুরি হ্রাস সর্বশ্রেণীর জনগণকে বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

রাজনৈতিক কাঠামো বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে কেন্দ্রীভূত, নিরঙ্কুশ, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ছিল। এই রাজতন্ত্র ছিল দৈবানুগৃহীত, রাজারা নিজেদের অমিত শক্তিশালী সূর্যরাজ বলে (roi soleil-sun king) পরিচয় দিতেন। ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫)। রাজতন্ত্রকে ক্ষমতার কেন্দ্রে স্থাপন করলেও তিনি একটি সুসংহত শাসনযন্ত্র গড়ে তুলতে পারেননি। এজন্য বলা হয় ফ্রান্সে স্বৈরাচারের উপস্থিতি ছিল সর্বত্র, আবার শাসকের অনুপস্থিতি ছিল সর্বত্র। এই যুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও পোল্যান্ডে কিছুটা স্বতন্ত্র ধরনের ব্যবস্থা ছিল। ইংল্যান্ডে ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, হল্যান্ডে ছিল প্রজাতন্ত্র আর পোল্যান্ডে ছিল নির্বাচিত রাজতন্ত্রপ্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মতো ফ্রান্সে ছিল স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা।

রাজা ছিলেন সব ক্ষমতার উৎস –

  • তিনি ছিলেন শাসন, বিচার ও আইন প্রণয়ন বিভাগের প্রধান।
  • রাজকীয় অনুশাসন আইনের মর্যাদা পেত।
  • রাজা মন্ত্রীদের নিয়ে শাসন করতেন, রাজার ছ’জন মন্ত্রী ছিলেন, এরা নিজ নিজ কাজের জন্য রাজার কাছে দায়বদ্ধ ছিল, যৌথ দায়িত্ব ছিল না।
  • রাজার মন্ত্রীরা ছিলেন কার্যত তার সচিব।
  • মন্ত্রীদের কাজকর্মের মধ্যে সংহতি ছিল না, এতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হত, বিশৃঙ্খলা দেখা দিত।
  • রাজার কয়েকটি কাউন্সিল ছিল, শাসন ক্ষেত্রে এই কাউন্সিলগুলি ছিল সর্বেসর্বা।
    • সবচেয়ে ক্ষমতাশালী কাউন্সিলটি হল কনসিল দ্য এস্টেট (Conseil d’estat), রাজা এই কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করতেন, রাজ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিত।
    • কনসিল দ্য ডেপিডেস (Conseil de depeches) ছিল অভ্যন্তরীণ শাসন ও বিচার সংক্রান্ত কাজের ভারপ্রাপ্ত।
    • অর্থ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত কাউন্সিল ছিল।
    • একটি গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিল কনসিল দ্য এন হট (Conseil d’en haute) ছিল শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রস্থিত সংগঠন, এখানে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণের ব্যবস্থা ছিল।
  • রাজা কাউন্সিলের সদস্যদের নিযুক্ত করতেন, আবার তাদের পদচ্যুত করার অধিকারও তার ছিল।
  • রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন চ্যান্সেলর, তিনি ছিলেন বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত, রাজার বিচারালয়গুলির তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক।
  • রাজার চারজন সচিব পররাষ্ট্র, যুদ্ধ, নৌবহর ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়গুলির তদারকি করতেন।
  • কন্ট্রোলার অব ফাইন্যান্স ছিলেন অর্থ সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান।

ফ্রান্সে আইনের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছিল –

  • উত্তরদিকে ছিল প্রথাগত আইন, দক্ষিণে ছিল কঠোর রোমান আইন, ৩৬০টি স্থানীয় আইনবিধি ছিল।
  • বেশিরভাগ বিচারক ছিল বংশানুক্রমিক, দেশের তেরোটি পার্লেমো আপিল আদালত হিসেবে কাজ করত।
  • রাজার যে-কোনো ব্যক্তিকে বন্দি করে বিনাবিচারে আটক করে রাখার অধিকার ছিল।
  • এই লেটার দ্য ক্যাশে (Lettre de cachet) রাজার পক্ষে অভিজাতরা ব্যবহার করতেন।
  • আবার লেটার দ্য গ্রেস (Lettre de grace) জারি করে যে-কোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া যেত।
  • অভিজাত ও যাজকদের নিজস্ব আইন ছিল, যাজকেরা নিজেদের আইন নিজেরা প্রণয়ন করতেন। এদের বিচারের অধিকার ছিল, কর স্থাপন ও আদায়ের অধিকার ভোগ করত।

বুরবোঁ রাজারা ঐক্যবদ্ধ সংহত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি –

  • প্রদেশগুলি ছিল দুভাগে বিভক্ত — সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলি ছিল অনেক বেশি অধিকারসম্পন্ন (pays d’etat)।
  • বিভিন্ন প্রদেশের সীমানা সুচিহ্নিত ছিল না; এখানে প্রাদেশিক সভাগুলি শাসনের ক্ষমতা ভোগ করত।
  • জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ, পরিবহন, পরিষেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সভাগুলির বিশেষ ক্ষমতা ছিল, কর ধার্যের ক্ষেত্রে এদের সঙ্গে সরকারকে পরামর্শ করতে হত।
  • ফ্রান্সে এধরনের পাঁচটি প্রাদেশিক প্রতিনিধিত্বমূলক সভা ছিল। এখানে রাজকীয় কর্মচারী ইনটেনড্যান্টের ক্ষমতা সংকুচিত ছিল। দেশের মধ্যবর্তী প্রদেশগুলিতে (pays d’elections) ইনটেনড্যান্টরা (Intendant) অনেকবেশি ক্ষমতা ভোগ করতেন।
  • প্রাদেশিক গভর্নররা শাসন ও বিচারের ক্ষেত্রে অধিকার ভোগ করতেন।

বুরবো রাজাদের সুনির্দিষ্ট রাজস্বনীতি ছিল না –

  • বাজেট তৈরি হত না, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।
  • করভার সকলের ওপর বা সব অঞ্চলের ওপর সমান ছিল না। সম্পদ অনুযায়ী কর ধার্য হলে করভার সহনীয় হয়, কিন্তু ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ করের বোঝা দরিদ্র মানুষকে বেশি বহন করতে হত।
  • ফ্রান্সের যাজক সম্প্রদায় রাজাকে কোনো কর দিত না। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে পোয়েন্সির (Poissey) চুক্তি অনুযায়ী যাজকেরা ইচ্ছামতো রাজাকে কর দিত, রাজা তাদের ওপর কর ধার্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ছিলেন।
  • অভিজাতদের কর দেবার কথা ছিল, কিন্তু যেহেতু তারা রাজকীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল তারা রাজাকে কোনো কর দিত না।
  • তেই, কাপিতাসিও, ভাতিয়েম প্রভৃতি কর দরিদ্র মানুষকে দিতে হত।
  • সমস্যা হল রাজার করের ক্ষেত্র শুধু সংকুচিত হয়েছিল তা নয়, জরুরি অবস্থায় অর্থের প্রয়োজন হলে রাজা কর ধার্য করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারতেন না। তাকে ঋণ করে অর্থ সংগ্রহ করতে হত।
  • কর আদায় ব্যবস্থাও ছিল উৎপীড়নমূলক, রাজা নিজে কর্মচারীদের মাধ্যমে কর ধার্য ও সংগ্রহের ব্যবস্থা করতেন না, কর আদায়ের জন্য তিনি কন্ট্রাকটর নিয়োগ করতেন, এদের নাম ছিল ফারমিয়ের জেনারেল। নিলামের মাধ্যমে কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হত, নিলামদাররা আবার ঠিকাদারদের কর আদায়ের অধিকার দিত। এতে রাজস্বপ্রদানকারীর ওপর উৎপীড়ন হত।
  • পরোক্ষ কর যেমন লবণ কর গাবেল, শুল্ক ট্রেইটস বা অ্যাদ থেকে রাজাদের আয়ের অর্ধেক আসত, কিন্তু এসব পরোক্ষ করের বোঝা দরিদ্র মানুষদের ওপর বেশি ছিল। এই পরোক্ষ কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
  • প্রশাসনে ছিল দুর্নীতি, তার সুযোগ নিয়ে কর আদায়ের জন্য নিযুক্ত কন্ট্রাকটররা সরকারকে ফাঁকি দিত।
  • ফ্রান্সের শিল্প ও বাণিজ্য বাড়লেও সরকার তার ভাগ পেত না।

চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর ফ্রান্সের রাজতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে –

  • পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) তার প্রথম জীবনে রিজেন্সির অধীনে ছিলেন, ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে তুলে নিলেও তিনি শাসন ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন না, আগ্রহীও ছিলেন না।
  • তিনি শিকার ও বিলাস-বাসন নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। অভিজাতরা এর সুযোগ নিয়ে সব উচ্চপদ অধিকার করেছিল, শাসন, চার্চ ও সৈন্য বাহিনীর সব উচ্চপদ ছিল এদের দখলে।
  • ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে পার্লমোকে চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) বলেছিলেন : ‘আমার মধ্যে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, আইন প্রণয়নের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও আমার, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা আমার মধ্য থেকে উদ্ভূত। জাতির সব আইন ও স্বার্থ আমার মধ্যে একীভূত এবং একমাত্র আমার হাতে ন্যস্ত।’ রাজা ছিল সৈন্যবাহিনীর প্রধান, যুদ্ধ ও শান্তির সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত ছিল রাজার হাতে। এসব সত্ত্বেও বাস্তবক্ষেত্রে রাজার ক্ষমতা ছিল অনেকাংশে সীমিত।
  • ফ্রান্সে রাজক্ষমতার ওপর অভিজাত ও চার্চের নিয়ন্ত্রণ ছিল। রাজা অভিজাতদের দমন করে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুইয়ের আমলে অভিজাতরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
  • ফ্রান্সের চার্চ ছিল স্বয়ংশাসিত, রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র। চার্চের নিজস্ব আইনসভা, কর ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা ছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য রাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করত চার্চ। রাজার আইন চার্চের ওপর প্রয়োগ করা যেত না।
  • ফ্রান্সের শহরগুলিতে ছিল পার্লেমো (Parlemont), প্যারিসের পার্লেমো ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। এই পার্লেমোগুলি রাজার ক্ষমতা খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করত, এগুলিকে বলা হয়েছে বংশানুক্রমিক আইন ও বিচার সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান (hereditary legal corporations)। এদের পদগুলি ছিল বংশানুক্রমিক, বুর্জোয়ারা এসব পদ কিনে অভিজাত হয়ে বসেছিল। এদের অনেক রকমের কাজ ছিল, রাজার আদেশ নথিবদ্ধ করে জনগণের মধ্যে প্রচার করত, বিচার করার ক্ষমতা ছিল, ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও এরা কাজ করত।
  • পার্লেমো রাজকীয় আইন নথিবদ্ধ করতে অস্বীকার করলে রাজা বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে (lit de justice) আইন প্রবর্তন করতে পারতেন।
  • রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরোধী হয়ে উঠেছিল ফ্রান্সের তেরোটি পার্লেমো। রাজার সঙ্গে নানা কারণে এদের বিরোধ বেধেছিল। পার্লেমোর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভয় পেয়ে পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে পার্লেমোগুলি ভেঙে দেন, দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল, ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে এদের আবার ফিরিয়ে আনেন।
  • ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রাদেশিক সত্তাগুলি রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারকে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছিল, এদের বিশেষ অধিকারগুলি রাজারা মেনে নিয়েছিলেন। কর ধার্য, শাসন, জনহিতকর কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এদের বিশেষ অধিকার ছিল। রাজকর্মচারী ইনটেনড্যান্টরা এদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতেন।
  • ফ্রান্সে একটি কেন্দ্রীয় আইনসভা ছিল যার নাম হল স্টেটস জেনারেল। এই স্টেট্স জেনারেল প্রতিষ্ঠা করেন ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপ দ্য ফেয়ার। এই কেন্দ্রীয় আইনসভায় তিনটি সামাজিক শ্রেণির জন্য তিনটি কক্ষ ছিল, কক্ষ অনুযায়ী ভোট হত। রাজা এই সভার অধিবেশন ডাকতেন, আবার ইচ্ছামতো অধিবেশন ভেঙে দিতেন। রাজাকে কর ধার্যের ব্যাপারে এই সভা পরামর্শ দিতে পারত কিন্তু সেই পরামর্শ রাজার পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিল না। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু কাগজপত্রে টিকে ছিল, ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের পর এর অধিবেশন ডাকা হয়নি।

অষ্টাদশ শতকে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের প্রশাসনিক ব্যর্থতা প্রকট হয়ে পড়েছিল –

  • শাসনত সচল ছিল না, ছিল দুর্নীতি ও অপদার্থতা, অভিজাতরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
  • রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল, পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) এই সংস্কার প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হন। (The system of government devised by Louis XIV had, under his successors, lost a great deal of its vigour and its ability to maintain the loyalty and respect of their subjects. This was due in part to the indolence and personal failings of Louis XV and, in part, to the tendency of the bureaucracy, staffed by privileged office-holders, to become almost a law unto itself)  তিনি সম্ভবত রাজনৈতিক কাঠামোর অবক্ষয় লক্ষ করে বলেছিলেন ‘আমার পরেই ধস নামবে’ (after me deluge) ।
  • ষোড়শ লুই দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, প্রজা মঙ্গলের ইচ্ছা তার ছিল, কয়েকটি সংস্কারের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। কর, শাসন ও বিচারব্যবস্থায় কয়েকটি সংস্কার প্রবর্তিত হয়, কিন্তু আরও মৌল সংস্কারের প্রয়োজন ছিল।
  • রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করেনি। জনগণের অধিকারহীনতা, অসাম্য ও শাসনক্ষেত্রে নৈরাজ্য বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবী দার্শনিকরা জনগণকে অধিকার সচেতন করে তুলেছিলেন, জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার ধারণা জনমনে স্থায়ী আসন নিয়েছিল।

জ্ঞানদীপ্তির যুগে ফরাসি চিন্তানায়কগণ

মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫)

ইউরোপের আলোকিত যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি বিভাসিত যুক্তিবাদী দার্শনিক হলেন চার্লস লুই দ্য সেকেন্ডাত, ব্যারন দ্য মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫)। তাকে বলা হয়েছে অষ্টাদশ শতকের অগ্রগামী চিন্তানায়ক, বিপ্লবী ও মানবতাবাদী। বলা হয়েছে তিনি হলেন এডমন্ড বার্করোবসপিয়েরের পূর্বসূরি। অভিজাত পরিবারের সন্তান মঁতেস্কু বোর্দোর কাছে ব্রেদের প্রাসাদে জীবন কাটিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে তিনি সেখানকার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার স্বাধীনতা দেখে বিস্মিত হন কারণ তার নিজের দেশ ফ্রান্সে এধরনের স্বাধীন, মুক্ত, অবাধ ব্যবস্থা ছিল না। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি বন্ধু চেস্টারফিল্ডের সঙ্গে বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। বোর্দোর পার্লেমোতে তিনি বেশ কিছুকাল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছিলেন। অভিজাত মঁতেস্কুর গডফাদার ছিলেন একজন ভিখারি।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তিনি তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। প্রথম জীবনে শারীর বিজ্ঞান নিয়ে তিনি কিছুকাল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন। জীবনে আর কখনো বিজ্ঞান নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করেননি। তার পড়াশোনা ছিল বিশাল, তবে এর বেশিরভাগটা ছিল গ্রন্থনির্ভর। বাস্তব অবস্থা নিয়ে তিনি কখনো সমীক্ষা চালাননি যদিও তার সময়ে অনেকে এধরনের কাজ করেছিলেন। তার প্রবল রসবোধ ছিল, ব্যঙ্গাত্মক লেখায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন, এধরনের লেখায় তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য পার্সিয়ান লেটার্স (Les Letters Persanes)। এর মূল বক্তব্য হল দুজন পারস্যদেশীয় ভদ্রলোক পশ্চিমি সভ্যতা দেখে বিস্মৃত, হতবাক। ইউরোপ এপর্বে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে, মঁতেস্কুর লেখার ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। তার শ্রেষ্ঠ রচনা হল দ্য স্পিরিট অব লজ (de L. Espirit des Lois)। এই গ্রন্থে তার প্রধান বক্তব্য হল বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলি হল বিভিন্ন ধরনের, স্বতন্ত্র, সভ্য হবার নানা পদ্ধতি আছে। বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু, পরিবেশ, ঐতিহ্য ও আচার- আচরণ আইনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা ঘটায়। প্রকৃতি ও যুক্তি সবদেশের আইনের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারে না। মঁতেস্কু প্রকৃতিবাদযুক্তিবাদকে আশ্রয় করেছিলেন, বিশ্বজনীন ঐক্যের সূত্র এদের মধ্যে পাওয়া যায়। মঁতেস্কু মনে করেন মানব বিজ্ঞান প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি মনে করেন মনুষ্যসৃষ্ট কোনো ব্যবস্থার বিশ্বজনীন প্রয়োগ হয় না। সামাজিক সমস্যাগুলির সহজ সমাধান হয় না কারণ এগুলি হল জটিলতায় পরিপূর্ণ। সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থাগুলির উপযোগিতা বা গুরুত্ব সর্বদা আপেক্ষিক, কোনো ব্যবস্থাকে ত্রুটিহীন বলা যায় না। তিনি তত্ত্ববাগীশ ছিলেন না, আবার কোনো কিছুকে কোনো সমস্যাকে অতিসরলীকরণের প্রবণতাও তার ছিল না। মঁতেস্কু বাস্তব ও তত্ত্বের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়েছেন, সাধারণ ও বিশেষ অবস্থার মধ্যে বিচরণ করেছেন।

তার মতে, মানুষ স্বাধীন ও যুক্তিবাদী হয়ে জন্মায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজ হল সেই স্বাধীনতা বজায় রাখা (Man is infact born free and reasonable, therefore we ought to see that he remains so)। তিনি মনে করেন ব্যক্তি মানুষ মন্দ হতে পারে কিন্তু যূথবদ্ধ মানুষ সৎ ও আন্তরিক। মঁতেস্কু বলেছেন যে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য হল জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করা। জনগণের খাদ্য, পোশাক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি জোগানোর দায়িত্ব হল রাষ্ট্রের। তিনি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন। তিনি মানুষকে স্বাধীনতা দিতে বলেছেন, ক্যাথলিক চার্চের ইনকুইজিশনকে তিনি বলেছেন বর্বরতা। এই বর্বরতা তিনি বন্ধ করতে বলেছেন।

মঁতেস্কুর মতে, সমাজ হল জৈবিক প্রতিষ্ঠান, জীবনের মতো পরিবর্তনশীল (Societies were natural biological organisms)। সমাজে পরিবর্তন হল অনিবার্য, এই পরিবর্তনের হার সবসময় দ্রুত নাও হতে পারে। মানুষের সমাজ গঠনে প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সাধারণ সূত্র নির্ধারণে তিনি উদ্যোগী হন। তিনি সাধারণ সূত্রের সন্ধান করেছেন কারণ তিনি মনে করেন এভাবে সামাজিক সূত্র আবিষ্কার করে সমাজকে স্থিতিশীল রাখা যায়। মঁতেস্কু দাবি করেছেন যে রাজনীতির বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি তিনি রচনা করেছেন। মানুষের পরিবর্তনশীল জীবনধারা তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন কিন্তু ভিকোর মতো ঐতিহাসিক দৃষ্টি তার ছিল না।

তার কাছে সরকার হল তিন ধরনের, এক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের বিশ্লেষণের সঙ্গে তিনি সহমত হতে পারেননি। স্বৈরাচার, রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র হল তিন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ফ্রান্সের ইতিহাসে তিনি সামস্ত যুগের আইনের উৎস সন্ধান করেছেন। স্বৈরাচারের ভিত্তি হল ভয়, রাজতন্ত্রের সম্মান, আর প্রজাতন্ত্রের ভারচু। মঁতেস্কু মনে করেন ন্যায় ও স্বাধীনতা মানুষের কাম্য কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর কোনো নির্দিষ্ট পথ নেই। ভিন্ন ভিন্ন পথে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে স্বৈরাচার হল সবচেয়ে সহজ পথ, কিন্তু বিপজ্জনক। স্বৈরাচার জ্ঞানদীপ্ত বা জনকল্যাণকামী হতে পারে কিন্তু তাতেও কিছু আসে যায় না। কেননা এই পথ বিপজ্জনক। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে কিন্তু স্বাধীনতায় পৌঁছনোর পথ যে দুর্গম তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। মঁতেস্কুর প্রজাতন্ত্র গণতান্ত্রিক নয়, কারণ প্রাচীনকালের লোকজনের মধ্যে শুধু এসব গুণাবলি পাওয়া যেত। আধুনিক কালে এসব গুণাবলির (ভারচু) সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। না। তিনি মনে করেন সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হল সবচেয়ে ভালো সরকার কারণ এই সরকারের ওপর শক্তিশালী অভিজাততন্ত্রের প্রভাব থাকে এবং আইনের শাসনের ওপর এই সরকার প্রতিষ্ঠিত (The most viable government is now monarchy tempered by a robust honourable and responsible nobility, and tempered also by the rule of law)।

তার মতে, সমাজের উৎপত্তি ও লক্ষ্য স্বতঃসিদ্ধের মতো। সমাজের উৎপত্তি হয় সাধারণভাবে, এর ভিত্তি হল বাস্তব অবস্থা। ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশের জন্য এদের মধ্যে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দেখা দেয়। সমাজবিজ্ঞানী এদের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করবেন। নৈতিকতাও ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ভিন্ন ধরনের আইনের প্রয়োজন হয়। সমাজ কাঠামো গঠিত হবার পর প্রয়োজন হয় মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক বিধি-বিধান। তিনি বিচার ব্যবস্থায় আইনের শাসন চেয়েছিলেন। অত্যধিক, অমানবিক শাস্তিদানের তিনি বিরোধী ছিলেন (Brutal purnishments will brutalize the public)। এতে সমাজ জীবনের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে।

ইংল্যান্ড পরিভ্রমণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে এখানে নৈতিকতা হল উচ্চস্তরের। এখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রয়েছে। এর কারণ হল ইংল্যান্ডের সংবিধান। এই সংবিধানে ক্ষমতা বিভাজন রয়েছে – শাসন, বিচার ও আইন প্রণয়ন বিভাগ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে। সমালোচকরা মনে করেন মঁতেস্কু ইংল্যান্ডের সংবিধানের চরিত্র সঠিকভাবে ধরতে পারেননি। ওয়ালপোলের সরকার আইনসভার ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন, পূর্ণ ক্ষমতা বিভাজন ইংল্যান্ডে ছিল না। ফ্রান্সের বিপ্লবী আইনসভার ওপর মঁতেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বের প্রভাব পড়েছিল। তিনি মনে করেন ক্ষমতা বিভাজন না থাকলে আধিপত্যবাদ জনগণের স্বাধীনতা ধ্বংস করে দিতে পারে।

রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অস্ত্র প্রতিযোগিতার তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। মঁতেস্কুর অন্তর্দৃষ্টি ছিল, তিনি বুঝেছিলেন যুদ্ধ আনে ধ্বংস, হতাশা, জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপে। তিনি বলেছেন যে এমন অস্ত্র আবিষ্কৃত হতে পারে যাতে সমগ্র মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি আণবিক অস্ত্র দেখেননি, তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

রাষ্ট্র দর্শনের ক্ষেত্রে মঁতেস্কুর স্থায়ী অবদান নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। দ্য এলেমবার্ট তার প্রশংসা করেছেন, কন্দরসে তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। মঁতেস্কুকে বলা হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যদিও ডার্কহাইম তা মানেননি। তার মতে, মঁতেস্কুর সমাজ চিন্তায় পারম্পর্য ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার অভাব রয়েছে। সামাজিক সূত্রগুলির প্রণয়নে তিনি গভীরতার পরিচয় দিতে পারেননি। প্রাচ্যদেশগুলির ইতিহাস ও সমাজ থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি তার বক্তব্যের সমর্থন খুঁজেছেন। এসব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় মঁতেস্কু হলেন জ্ঞানদীপ্তির যুগের একজন প্রতিভাবান, সৃজনশীল লেখক । পুরোনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আক্রমণ করে তিনি পরিবর্তনের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনশীলতার তিনি হলেন একজন শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা।

ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)

অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ ফরাসি দার্শনিক ফ্রাঙ্কয়েজ মারি আরুয়েত তার ছদ্মনাম ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) নামে পরিচিত। তার পিতা ছিলেন একজন নোটারি, মাতা ছিলেন অভিজাত পরিবারের কন্যা। শৈশবে ভলতেয়ার তার মাকে হারিয়েছিলেন। পিতার কাছ থেকে তেমন উৎসাহ পাননি, তার আদর্শ ছিলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা আর্মান্দ। অল্পবয়সে তিনি তর্কশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যদিও তার পিতা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা তেমন পছন্দ করতেন না। ভলতেয়ারের ওপর সমকালের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। সমকালের বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের আলোকিত যুগে ভলতেয়ার ছিলেন সবচেয়ে আলোকিত মানুষ, ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। ইতালিবাসী তাদের রেনেসাঁস নিয়ে গর্ববোধ করত, জার্মানরা রিফরমেশনের জন্য কৃতিত্ব দাবি করত, আর ফরাসিরা ভলতেয়ারকে নিয়ে গর্ব করত। যুগের ধর্ম অনুযায়ী ভলতেয়ার যুক্তিবাদকে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিচার- বিশ্লেষণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি হিসেবে দেখেছিলেন। তার জেসুইট শিক্ষকরা তাকে সবকিছুকে সন্দেহ বা প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন (His later educators, the Jesuits, gave him the very instrument of scepticism by teaching him dialectic-the art of proving anything, and therefore at last the habit of believing nothing) I

অষ্টাদশ শতকের আলোকিত যুগের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত, পরিহাসপ্রিয়, গভীর জ্ঞানের অধিকারী হলেন ভলতেয়ার। ফ্রান্সের রাজতন্ত্র ও রাজসভা নিয়ে ব্যঙ্গ করে তিনি দুবার বাস্তিল দুর্গে বন্দি ছিলেন। রাজানুগ্রহ লাভের কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। তিনি লিখেছেন অজস্র উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দার্শনিক গ্রন্থ ও প্রহসন। তার বিখ্যাত উপন্যাস হল কাঁদিদ, বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ হল ডিকশনারি ফিলজফিক, আর বিখ্যাত প্রহসন হল আইরিন। ইতিহাস সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। দিদেরো সম্পাদিত বিশ্বকোষে তিনি ইতিহাসের ওপর একখানি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ঐ প্রবন্ধে তিনি আধুনিক ইতিহাসচর্চার মূল সুরটি তুলে ধরেন। তার বক্তব্য হল আধুনিক ইতিহাসে পাওয়া যায় শুধু দস্যু-তস্করের লুটপাটের কাহিনি। মানুষের মননের ইতিহাস হল আসল ইতিহাস। পরিবর্তন হল সভ্যতার ইতিহাসের স্বাভাবিক পরিণতি, আর এই পরিবর্তনের কথা তুলে ধরা হল ঐতিহাসিকদের কাজ। ঐতিহাসিক রাজ-রাজড়ার কাহিনি না লিখে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা লিখবেন। ভলতেয়ার বলেছেন যে দার্শনিকরা ভালো ঐতিহাসিক হতে পারেন কারণ পরিস্থিতিকে বোঝার সূক্ষ্ম অন্তদৃষ্টি তাদের রয়েছে। মধ্য বয়সে ভলতেয়ার ইংল্যান্ড পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেখানে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুটি বিষয় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল – নিউটনের পদার্থবিদ্যা এবং জন লকের মনোবিদ্যা। নিউটনের তত্ত্ব যেমন বিশ্বজনীন, তেমনি লকের মনোবিজ্ঞান তত্ত্বও বিশ্বজনীন। মনস্তত্ত্ব দিয়ে সামাজিক অগ্রগতির ধারা বা প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাখ্যা করা যায় বলে তিনি মনে করেন।

ফ্রান্সে তখনো ধর্মযুদ্ধের জের চলেছিল। রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) এডিক্ট অব নান্তে প্রত্যাহার করে নিলে প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্ষুব্ধ হয়। সেখানে ধর্মীয় সহনশীলতার পরিমণ্ডল ছিল না, কিন্তু ইংল্যান্ডে ছিল। ইংল্যান্ডের মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারত, স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরার অধিকারও তার ছিল। ফ্রান্সের মানুষের সেই স্বাধীনতা ছিল না। ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চকে তিনি দুর্নীতি, অপশাসন, অত্যাচার ও শোষণের জন্য দায়ী করেন। সারাজীবন তিনি ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের আপসহীন শত্রু। যাজকতন্ত্রের লোভ ও ভোগবিলাসকে তিনি ফ্রান্সের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেছিলেন। শতাধিক রচনায় ঘুরেফিরে তিনি চার্চ ও যাজকতন্ত্রকে আক্রমণ করেছেন। এজন্য ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চ তাকে অখ্রিস্টান বলে মনে করত যদিও ভলতেয়ার ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাননি। ভলতেয়ার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু নিয়ে আলোচনা করেছেন। রুশোর সোসাল কন্ট্রাক্ট পাঠ করে তার ধারণা হয়েছিল প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। জন লক প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। এইখানে ভলতেয়ারের সঙ্গে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়। ভলতেয়ার প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি কারণ এধরনের ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে, এদের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনাও থাকে। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে ভলতেয়ার চতুর্দিকে রাজতন্ত্র দেখেছিলেন, দেখেছিলেন অভিজাতরা রাজার হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করছে। প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিকরাশিয়ার রানি দ্বিতীয় ক্যাথারিনের সঙ্গে তার পত্রালাপ ছিল। তার ধারণা হয়েছিল জ্ঞানদীপ্ত যুক্তিবাদী শাসক জনগণের মঙ্গলসাধন করতে পারেন। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা তিনি পছন্দ করেননি কারণ জনগণের ওপর তার আস্থা ছিল না। জনগণকে তিনি নির্বোধ ও নিষ্ঠুর বলে উল্লেখ করেছেন (No interest at all in the masses of men, whom he regarded as cruel and stupid)।

লেটারস অন দ্য ইংলিশ প্রবন্ধাবলীতে ভলতেয়ার সাম্য ও স্বাধীনতার প্রশ্ন দুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ কারণ অসাম্যের শিকড় রয়েছে সমাজের গভীরে। তবে আইনের চোখে সকলের সমতা প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা নেই। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকলে আইনের চোখে সমান বলে গণ্য হবেন। কর, চাকরি ও বিচারের ক্ষেত্রে সকলের সমতা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

সামাজিক অগ্রগতির জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়। এখানে ভলতেয়ারের চিন্তার মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার চান না, অথচ জনগণের জন্য নাগরিক স্বাধীনতা চান। রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত না হলে জনগণ নাগরিক স্বাধীনতা কীভাবে পাবেন ভলতেয়ারের চিন্তা-ভাবনায় তা স্পষ্ট নয়। তিনি নাগরিক অধিকারের পক্ষ নিয়েছেন কিন্তু কীভাবে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিবর্তন আসবে তার ইঙ্গিত দেননি।

ভলতেয়ার বিপ্লবের কথা বলেননি, তবে রাষ্ট্র, ধর্ম, আইন, বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যেসব ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেগুলি যথেষ্ট বৈপ্লবিক সম্ভাবনাপূর্ণ ছিল। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতা ও স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সকলের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলেছিলেন। তিনি স্থিতাবস্থার বিরোধিতা করেন, পরিবর্তনের কথা বলেন। স্বয়ং ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) মন্তব্য করেছিলেন যে দুজন ব্যক্তি ভলতেয়ার ও রুশো তার রাজবংশের পতন ঘটাবে।

সারাজীবন ধরে ভলতেয়ার যুদ্ধের বিরোধিতা করে যান। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস ও হতাশা নিয়ে আসে, এতে মনুষ্যজাতির সর্বনাশ হয় (War is the greatest of all crimes)। তিনি জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের বিরোধী ছিলেন কারণ জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম সংকীর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে, অন্যদেশ ও জাতি সম্পর্কে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। মনে রাখা দরকার এই সময়টা ছিল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিস্তারের যুগ। ভলতেয়ারের অনুগামী তুর্গো, কন্দরসে মিরাবো শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন ঘটানোর কথা বলেছিলেন, সাম্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বিপ্লবের অভিঘাতে এদের স্বপ্নভঙ্গ হয়, রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণ সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, এমনকি স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেও তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। বিপ্লবের তাণ্ডবে ভলতেয়ারের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধ্যানধারণা নষ্ট হয়ে যায়। তবে তার চিহ্নিত প্রধান সামাজিক শত্রু ক্যাথলিক চার্চ ও যাজকতন্ত্র বিপ্লবের ফলে প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছিল।

রুশো (১৭১২- ১৭৭৮)

ফরাসি জ্ঞানদীপ্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হলেন জ্যঁ জ্যাক রুশো (১৭১২- ১৭৭৮)। বিপ্লবের ওপর তার প্রভাব ছিল সর্বাধিক। জেনিভার এক ঘড়ি ব্যবসায়ীর পুত্র রুশো ওখানকার ক্যালভিনিস্ট আবহাওয়ার মধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। জীবনে কয়েকবার তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘কনফেশনস’ থেকে জানা যায় ধর্ম ও যৌনতা বারবার তার জীবনকে বিড়ম্বিত করেছে (His confessions gives a clear picture of a deeply divided personality, in which morbidities both of sex and religion played a large part)। শুভ-অশুভ, আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে তিনি সর্বদা দোদুল্যমান থেকেছেন। জীবনে লাভ করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অনেক সময় তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করে। প্যারিসে অবস্থানকালে বারো বছর তিনি বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন (১৭৪৪-১৭৫৬)। দিদেরো বা ভলতেয়ার কেউ তাকে পছন্দ করতেন না। ফ্রান্সের সেই আলোকিত যুগের দার্শনিকদের সঙ্গে তিনি অনেক বিষয়ে সহমত হতে পারেননি। রুশোর চরিত্র, জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার নীতিবোধ ও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সবই ছিল আলোকিত যুগের চিন্তাধারা বিরোধী (His character, his outlook on life, his scale of values, his instinctive reactions, all differed essentially from what the enlightenment regarded as admirable)। রুশো এযুগের দার্শনিকদের মতো যুক্তিবাদী নন, তিনি রোমান্টিক বিপ্লবী, গণতন্ত্র ও সমতায় বিশ্বাসী। তিনি হলেন গণসার্বভৌমত্বের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। দার্শনিক মহলে রাজার সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রুশো গণসার্বভৌমত্বের যে ধারণা দেন পরবর্তীকালে তা দেশে দেশে গৃহীত হয়।

রুশো যুক্তির কাছে আবেদন রাখেননি (Rousseau did not appeal to reason)। ভবঘুরের জীবনযাপন করেছেন, দুঃখ, দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহ ছিল না, রুচি, আচার-আচরণ, সাধারণ নীতিবোধ এসব তিনি পছন্দ করেননি। তার কাছে অনুভূতি হল সবচেয়ে মূল্যবান, মধ্যবিত্তের মানসিকতা তার চিন্তার জগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার মনে হয়েছে বুদ্ধি ও মেধা হল বিপজ্জনক কারণ এতে শ্রদ্ধা কমে যায়। বিজ্ঞান ধ্বংসকারী কারণ বিশ্বাসের জগতের মৃত্যু ঘটে যায়। যুক্তি মন্দ কারণ যুক্তি দিয়ে মানুষ অনুভবের পতন ঘটায়। শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও নৈতিক অনুভূতি ছাড়া চরিত্র ও সমাজ কোনোটাই টেকে না (Intelligence is dangerous because it undermines reverence, science is destructive because it takes away faith; reason is bad because it sets prudence against moral intuition. Without reverence, faith and moral intuition there is neither character nor society)। রুশোর মতে, সাধারণ মানুষজন নিয়ে মানবজাতি গড়ে উঠেছে (It is the common people who compose the human race)। সে যুগের বিখ্যাত দার্শনিক ও যুক্তিবাদী দিদেরোর সঙ্গে তিনি সহমত হতে পারেননি। রুশোর মতে, যুক্তি নয়, অনুভূতি হল মানবিক কর্মকাণ্ডের উৎস। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে রুশো লিখলেন, ‘ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অব ইনইকুয়ালিটি’। তার মতে, প্রথম ব্যক্তি যিনি একখণ্ড জমি ঘিরে নিয়ে বললেন এটি আমার এবং অন্যরা তা মেনে নিল তিনি হলেন সিভিল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা (The first man who, having enclosed a piece of ground, bethought himself of saying this is mine, and found people simple enough to believe him, was the real founder of civil society) ।

সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার আগে মানুষ ছিল প্রকৃতির মধ্যে, তার অনেকগুলি স্বাভাবিক অধিকার ছিল। প্রকৃতির মধ্যে মানুষ সুখী ও সন্তুষ্ট ছিল। ঈশ্বর সবকিছু সুন্দর করে সৃষ্টি করেন – মানুষ, আইন, পরিবেশ ; প্রকৃতিগতভাবে মানুষ ভালো, পরিবেশ, অন্যায় আইন-কানুন ও স্বৈরাচারী সরকার তাকে অন্যায় পথে নিয়ে যায় (It is bad social arrangements, unjust laws, despotic governments that cause evil) । ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রুশো লিখলেন দুখানি বিখ্যাত গ্রন্থ— এমিল ও সোসাল কন্ট্রাক্ট। এমিল তার শিক্ষা দর্শনের পরিচয় দেয়। তিনি মনে করেন মানুষ শিক্ষার মধ্যে দিয়ে সর্ববিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ওঠে। সমাজ তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে না। সোসাল কন্ট্রাক্টে রুশো তার রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেন। রাষ্ট্রের নাগরিকরা সকলে হবেন স্বাধীন। সোসাল কন্ট্রাক্টের প্রথম বাক্যে তিনি লিখলেন ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’ (Man is born free but everywhere he is in chains) । নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র জনগণের অধিকারের স্বীকৃতি দেয় না, আবার জনগণের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। রুশো এমন একটি রাষ্ট্রের কথা ভেবেছেন যেখানে জনগণের অধিকার বজায় থাকবে। রাষ্ট্র হবে একটি নৈতিক সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, রুশো এর নাম দেন ‘জেনারেল উইল’। জেনারেল উইল সাধারণের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করবে (General Will must be general in its object as well as its essence)। রুশো দাবি করেছেন এই সাধারণ ইচ্ছা হল সার্বভৌম। সমগ্র জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হল এই সাধারণ ইচ্ছা (Rousseau calims that the general will in action is sovereign, and since the general will emanates from the community as a whole, so sovereignty must reside in the community as a whole)। সাধারণ ইচ্ছাকে তিনি এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে একে সকলের ইচ্ছা বলে ধরা যাবে না। সাধারণ ইচ্ছা একটি স্বতন্ত্র সত্তা, সকলের ইচ্ছার যোগফল নয়। সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা ও জনগণের মাঝখানে কোনো সংগঠন, সংস্থা ও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেননি। এই সার্বভৌমত্ব অন্যের কাছে হস্তান্তর করা যায় না (Sovereignty can not be surrendered, or delegated to any one person or group of people)। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই সার্বভৌত্বের প্রয়োগ হয় না। রুশোর মতে, রাষ্ট্রের সব নাগরিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশীদার হবেন। সম্ভবত তিনি গ্রিক নগররাষ্ট্র বা তার জন্মভূমি জেনিভার মতো ছোটো রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার পছন্দ ছিল।

রুশোর লেখার মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতার কথা আছে। তবে তিনি নাগরিক ধর্মের কথা বলেছেন, স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তার ধর্মচিন্তার মধ্যে স্ববিরোধিতা অনেকে লক্ষ করেছেন। তার ধর্মচিন্তায় স্বাধীন ধর্মমত ও নাগরিক ধর্মের সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। তিনি বলছেন নাগরিকরা ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবেন যদি তাদের ধর্ম অন্যকে আঘাত না করে। ধর্মের সঙ্গে নাগরিক ধর্মের বিরোধ হলে ধর্মকে পথ ছেড়ে দিতে হবে। এরকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধর্মদ্রোহীকে বহিষ্কার করবে কারণ সে সমাজ বিরোধী (Toleration should be granted to all religions so long as they tolerate others and so long as their own dogmas contain nothing contrary to the duties of citizenship. Banishment of unbelievers, in true Lutheran style, will not be for impiety, but for being anti-social)। ধর্মের কথা যেমন রুশো উল্লেখ করেছেন তেমনি জাতীয়তাবাদের উপাদানও তার লেখার মধ্যে পাওয়া যায়। তিনি পোল্যান্ডের অবস্থা সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তাতে সেখানকার জাতীয়তাবাদ উৎসাহিত হয়। রুশো নিজে জাতীয়তাবাদী ছিলেন একথা বলা যায় না। তবে পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদীরা তার লেখার মধ্যে জাতীয়তাবাদের অনেক উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।

রুশোর দর্শনের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে। কোনো মহান লেখক এই ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। তার সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে (The development of the theory of general will in social contract was involved in paradoxes)। তার সাধারণ ইচ্ছা ও নাগরিক অধিকারের মধ্যেকার সম্পর্ক স্পষ্ট নয়। তার স্বাধীনতার ধারণাটির মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। এটিও অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন। রুশোর লেখার মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের উপাদান পাওয়া যায়। ফরাসি বিপ্লবের জ্যাকোবিন নেতা রুশোকে অনুসরণ করে বলছেন : ‘আমাদের ইচ্ছা হল সাধারণ ইচ্ছা’ (Our will is the general will)। রুশো সাধারণ ইচ্ছার এধরনের ব্যাখ্যা করেননি। রুশো মানুষের স্বাভাবিক বিশুদ্ধতার কথা বলেছেন যার সঙ্গে খ্রিস্টান মৌল পাপতত্ত্বের বিরোধ রয়েছে। আধুনিক মনস্তত্ববিদরা বলছেন মানুষ ভালো নয়, মন্দ নয়, মানুষ যখন জন্মায় এসব নিরপেক্ষ থাকে। তার শিক্ষা, পরিবেশ ও পার্থিব অবস্থা তার মনন গঠনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। এসব কারণে অনেকে তাকে আধুনিক সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রবর্তক বলে গ্রহণ করেছেন। তিনি সমতার কথা বলেছেন, অতি ধনী ও অতি দ্ররিদ্রের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছেন। যুগে যুগে রাষ্ট্রনেতারা তার চিন্তাভাবনার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সম্ভবত তিনি এমন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন যেখানে দারিদ্র্য থাকবে না, বা সম্পদ পুঞ্জীভূত হবে না। ডিসকোর্স অন পলিটিক্যাল ইকনমিতে, তিনি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সমঝোতার কথা বলেছেন। সাধারণ ইচ্ছা হল সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। রুশো স্বভাবত রোমান্টিক, সাহিত্য ও শিল্পে তিনি রোমান্টিক আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। রুশো বিপ্লবী কারণ তিনি সম্পন্ন মানুষজন নিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন যেখানে থাকবে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। গণসার্বভৌমত্ব তত্ত্বের তিনি হলেন একজন শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। এই তত্ত্ব দুশো বছরের অধিককাল ধরে আধুনিক পৃথিবীর রাজনৈতিক চিন্তাকে আলোড়িত করেছে।

ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠী ও কুয়েসনে (১৬৯৪-১৭৭৪)

ফ্রান্সের একটি অর্থনীতিবিদ গোষ্ঠীর নাম হল ফিজিওক্র্যাট। কুয়েসনে ছিলেন এই গোষ্ঠীর নেতা। সদস্যরা হলেন তুর্গো, ল রিভিয়ের, মিরাবো, নেমুর ও গুনে। কুয়েসনে তার ট্যাবলো ইকনমিক (Tableau Economique) গ্রন্থে এই গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন। ফিজিওক্র্যাটরা জাগতিক বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, বৌদ্ধিক বিষয় তাদের চিন্তায় প্রাধান্যলাভ করেনি। তবে সমকালীন চিন্তাধারা থেকে তারা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। হেলভিটিয়াসের মতো এরা বিশ্বাস করতেন মানুষের অন্বেষা হল সুখ, দুঃখ এড়িয়ে চলা হল মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। মানুষ স্বভাবত আত্মসুখপরায়ণ, নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে মানুষ তার কার্যক্রম ঠিক করে নেয়। ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠী উৎপাদক শ্রেণি কৃষক, কারিগর ও বণিকদের কাজকর্ম, সম্পর্ক ও সমৃদ্ধি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এদের বিষয় ছিল অর্থনীতি, সেযুগে একে পলিটিকাল ইকনমি বলা হত। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও গিল্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল, এর সমকালীন নাম হল মার্কেন্টাইল মতবাদ। ফিজিওক্র্যাট গোষ্ঠী এই ধরনের অর্থনীতির বিরোধিতা করে। রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস নিয়ে এরা আলোচনা করেছেন। জাতীয় আয়ের একটি অংশের দাবিদার হল রাষ্ট্র। তবে সম্পদের উৎস, বণ্টন, জনগণের মঙ্গল ইত্যাদির সঙ্গে করের নিকট সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রকে কর ধার্যের সময় এসব বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে হয়। এই গোষ্ঠীর অর্থনীতিবিদরা একটিমাত্র কর ভূমিকরের কথা বলেছিলেন যা রাষ্ট্রের সব অধিবাসীরা দেবেন। এরা অভ্যন্তরীণ সব শুল্ক তুলে দিতে বলেছিলেন কারণ এজন্য জিনিপত্রের দাম বাড়ে।

কুয়েসনে ও তার সহযোগী রিভিয়ের এই তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সমাজের ভিত্তি হল ন্যায়, আর এই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষার প্রয়োজন হয়। প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার আছে, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের অধিকার আছে। এগুলি সব প্রকৃতিদত্ত অধিকার। প্রাকৃতিক নিয়মে সমাজবদ্ধ মানুষ এসব অধিকার লাভ করে। এর অন্য নাম হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। এই ঐশ্বরিক বিধান কার্যকর করার দায়িত্ব হল রাজার। রাজা আইন প্রণেতা নন, তিনি আইনের প্রয়োগকারী। স্বৈরাচারী নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রে তাদের আপত্তি নেই তবে রাজাকে প্রজার অধিকার রক্ষা করতে হবে। রাজা বিচারক নন, শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিচারক হিসেবে কাজ করবেন কারণ বিচারকার্য সম্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ফিজিওক্র্যাটরা অবাধ, মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। গুর্নে হলেন ফ্রান্সে এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। এই গোষ্ঠী ফরাসি শিল্প-বাণিজ্যের ওপর অনাবশ্যক নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে। শ্রমিক স্বাধীনভাবে শ্রম বিক্রি করবে, বণিক স্বাধীনভাবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করবে, কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না (Laissez faire might be depended upon to bring about the best good of men and nations if governments kept their hands off)। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজতন্ত্র হস্তক্ষেপ করবে, সকলকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক সম্পর্ক ও নিয়মকানুন বুঝতে হলে বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, নাগরিক সকলকে শিক্ষিত হতে হবে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তুর্গো ফিজিওক্র্যাট দর্শন বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করেন। তিনি তার প্রতিবেদনে জনগণকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে বলেছিলেন। অ্যাডাম স্মিথ তার ওয়েলথ অব নেশনস (১৭৭৬) গ্রন্থে ফিজিওক্র্যাটদের অর্থনৈতিক চিন্তার অনেকখানি গ্রহণ করেন। স্মিথ ও তার অনুগামীরা এই চিন্তাধারাকে প্রসারিত করে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দেন। মার্কেন্টাইল মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব হিসেবে অবাধ অর্থনৈতিক তত্ত্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

আলোকিত ফ্রান্স – দার্শনিকদের অবদান

ইউরোপের সমগ্র অষ্টাদশ শতক হল আলোকিত যুগ, জ্ঞানদীপ্তির যুগ। সপ্তদশ শতকের ইউরোপে এই আলোকিত যুগের সূচনা করেন লক, লিবনিজ, পাসকাল (Pascal), দেকার্ত ও নিউটন। এই আন্দোলন ছিল বৌদ্ধিক, চিন্তার জগতে নতুনের আবাহন। ইংল্যান্ডে হিউম, গিবন, বরার্টসন, জার্মানিতে লেসিং, কান্ট, গ্যেটে, শিলার ও আমেরিকায় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এদের চিন্তার বৈশিষ্ট্য হল বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, প্রকৃতিকে জানার অদম্য ইচ্ছা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বৈরাচারের বিরোধিতা, দুর্নীতিগ্রস্ত চার্চের বিরোধিতা ইত্যাদি। রোবসপিয়ের এই দর্শনের মূল বক্তব্য তুলে ধরেন : ‘প্রকৃতির অন্তর্লীন প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা, মানবজাতির ভাগ্যজয়, অপরাধ ও স্বৈরাচারের দীর্ঘ রাজত্ব থেকে নিয়তির মুক্তি এবং সর্বজনীন সুখের নতুন ঊষার আলোকের উপলব্ধি হল এর সারমর্ম। এই আলোকিত শতকের মৌল ঐক্য সত্ত্বেও চিন্তার রাজ্যে বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা যায় না। বুদ্ধি দিয়ে অন্ধকার দূর করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন একদল দার্শনিক—’অবশেষে সব অন্ধকার দূর হল, সর্বত্র এক উজ্জ্বল আলো। আলোকিত যুগের বুদ্ধি বিভাসিত মানুষেরা জগৎ ও জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজেদের মতো করে এসবের ব্যাখ্যা দেন। ফ্রান্সের অভিজাতরা স্বৈরাচারের বিরোধিতায় নেমেছিলেন, দার্শনিকদের রচনা তাদের সহায়ক হয়েছিল। এযুগে বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটে, ফ্রান্সে বুফো (Buffon) প্রকৃতির ইতিহাসে এই চেতনার প্রসার ঘটিয়েছিলেন। দেকার্ত ও ফ্রান্সিস বেকন বিজ্ঞানের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন, নিউটন বিজ্ঞান চর্চাকে সংহত রূপ দেন।

ফেনেলো (Fenelon) থেকে ফ্রান্সে যুক্তিবাদের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্র ও ধর্মের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দার্শনিকরা তাদের বক্তব্য রাখেন। ফরাসি বিপ্লবী দার্শনিকদের বিখ্যাত ত্রয়ী হলেন মঁতেস্কু, ভলতেয়ার ও রুশো। মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) ছিলেন অভিজাত পরিবারের লোক, অথচ উদারনৈতিক দর্শনের সমর্থক। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি ঐ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার অনুরাগী হয়ে পড়েন। তার পার্সিয়ান লেটারস (Letters Persanes) গ্রন্থে (১৭২১) তিনি সমকালীন ফ্রান্সের স্বৈরাচার, দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্রের স্বার্থপরতা ও চার্চের গোঁড়ামি প্রকাশ করে দেন। তিনি লিখেছেন ফ্রান্সের রাজার সোনার খনি নেই, জনগণকে শোষণ করে তিনি অর্থ সংগ্রহ করেন। গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেকাডেন্স অব দ্য রোমানস গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন। যে ভৌগোলিক পরিবেশ, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি একটি দেশের জীবনযাত্রা, আইন, শাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। রোমান আইনের তিনি। প্রশংসা করেছেন কারণ রোমান শাসকেরা দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিলেন। মঁতেস্কুর শ্রেষ্ঠ রচনা হল স্পিরিট অব দ্য লস (Spirit of the laws)। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থে মঁতেস্কু তার বিখ্যাত ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে তার ধারণা হয়েছিল যে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে—শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার ক্ষমতা বিভক্ত হলে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা পায়। ফ্রান্সে তার এই ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, বিপ্লব শুরু হলে বিপ্লবীরা নতুন সংবিধান রচনার সময় মঁতেস্কুকে অনুসরণ করেছিল। মঁতেস্কু গণতন্ত্রের কথা বলেননি, অভিজাততন্ত্র ও চার্চের সুযোগ-সুবিধা বিলোপ করতে বলেননি, তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র স্থাপনের কথা বলেছিলেন।

ফ্রান্সের আলোকিত বুদ্ধিজীবীরা সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা করেছেন। তুঁসা, লা মেত্রি ও কঁদিলাক মানুষের জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই যুগের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও লেখক হলেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। তিনি ছিলেন দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও লেখক। প্রহসন লিখে তিনি খ্যাতিলাভ করেন, তিনি মঁতেস্কুর মতো ইংল্যান্ড পরিভ্রমণ করেন, তার মুক্ত পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের গৃহশিক্ষক ছিলেন, রাশিয়ার রানি দ্বিতীয় ক্যাথারিনের সঙ্গে তার পত্রালাপ ছিল। তিনি দর্শনের ওপর অনেকগুলি প্রবন্ধ লেখেন (দিকসিয়নের ফিলজফিক পোরতাতিফ), ইতিহাসের ওপর প্রবন্ধ লিখে তিনি সাধারণ মানুষকে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরেন। কাঁদিদ হল তার লেখা উপন্যাস। ফ্রান্সের চার্চের দুর্গতি ও ভ্রষ্টাচারকে ভলতেয়ার তীব্রভাবে আক্রমণ করেন, তিনি বলেছেন চার্চ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে। তার মনে হয়েছিল ফ্রান্সের দুর্নীতিগ্রস্ত উৎপীড়ক চার্চ ব্যবস্থা ভেঙে দিলে দেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভলতেয়ার চার্চকে আক্রমণ করলেও নাস্তিক ছিলেন না, বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানে তিনি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন (Deist)। ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রিটিশ দার্শনিক লকের মতো তিনি উদারনীতিবাদী ছিলেন, কিন্তু গণতন্ত্রের কথা বলেননি, বিপ্লব প্রচার করেননি, তিনি জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা তার রচনায় স্থান পায়নি যদিও তিনি স্বৈরাচারের বিরোধিতা করেন।

এই বিখ্যাত ত্রয়ীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন জ্যঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮)। ফরাসি দার্শনিকদের দর্শন ব্যবহারিক—মানুষের মর্যাদা ও ঐহিক সুখের চাবিকাঠি, ফলিত বিজ্ঞানের দ্বারা বশীভূত প্রকৃতি মানুষকে নতুন মহিমায় ভূষিত করে কেবলমাত্র ঐহিক সুখই এনে দেবে না ; রহস্যের অবগুণ্ঠনমুক্ত প্রকৃতির রত্নভাণ্ডার মানুষকে এক মহা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সিংহদ্বারে পৌঁছে দেবে।’ রুশোর জীবন ছিল বিচিত্র ধরনের, বহু অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছিলেন। তিনি শুধু যুক্তিবাদী নন, মানুষের অনুভূতি, চেতনা ও উপলব্ধির ওপর তিনি জোর দেন। তার মধ্যে বহু বৈচিত্র্যের সমাবেশ লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছেন তার আত্মজীবনী (confessions), ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অব ইনইকুয়ালিটি, সোস্যাল কন্ট্রাক্ট, ডিসকোর্স অন পলিটিক্যাল ইকোনমি ও এমিল। স্যোসাল কন্ট্রাক্ট হল তার শ্রেষ্ঠ রচনা—এই গ্রন্থে তার রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত হয়েছে। স্বভাবত সৎ ও সুখী মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির ফলে অসুখী ও অসৎ হয়ে যায়। রুশো বলেছেন সভ্যতার জন্মলগ্নে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজ ছিল সাম্যবাদী। (As soon as in a democracy the few outstrip the many in the matter of wealth, the state must either perish or cease being a democracy. No citizen should be rich enough to purchase another or so poor as to be forced to sell himself)। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব হলে সমাজ প্রশাসন, আইন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে তোলে সামাজিক ক্তির মাধ্যমে (The first man who enclosed a piece of land and said to nimself this is mine is the originator of civil society)। মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, পরে সমাজ তাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে (Man is born free but every where he is in chains) |

রুশোর মতে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। শাসিত শ্রেণি হল সার্বভৌমত্বের অধিকারী, রাজা সার্বভৌম নন। জনগণের ইচ্ছা হল আইন (general will), এবং জনগণের অধিকার আছে। রাজা শাসন ব্যাপারে অপদার্থতার পরিচয় দিলে জনগণ রাজাকে পদচ্যুত করতে পারে। রুশো দৈবানুগৃহীত রাজতন্ত্রের ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন, সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলেছেন, রুশোর প্রভাব পড়েছে সমকালীন মানুষের ওপর। রুশো বিপ্লবের কথা বলেননি, তবে তার চিন্তাধারার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত ছিল। বিপ্লবীদের কাছে রুশো ছিলেন খুবই জনপ্রিয়, তার সামাজিক চুক্তি মতবাদকে তারা পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিল।

স্বৈরাচার বিরোধী ফরাসি দার্শনিকদের কাছে স্বাধীনতা মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিন্তা, কাজ, লেখা সর্বক্ষেত্রে দার্শনিকরা স্বাধীনতা দাবি করেন (freedom in all shapes, freedom to think, to speak to write, to act)। এই বিখ্যাত ত্রয়ী ছাড়া ফ্রান্সে দুটি দার্শনিক গোষ্ঠী ছিল — বিশ্বকোষ ও ফিজিওক্র্যাট। বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ডেনিস দিদেরো, অন্য সদস্যরা হলেন দ্য এলেমবার্ট, হলবাক (Holbach)হেলভেটিয়াস (Helvetius)। এদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় কয়েকখণ্ডে বিভক্ত বিশ্বকোষ, অঙ্ক, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য সবকিছু ছিল এর বিষয়। এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন জড়বাদী ও নাস্তিক, স্বৈরাচার ও রক্ষণশীল চার্চ বিরোধী। দিদেরো নিজেই নাস্তিক ছিলেন, বিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান নিয়ে নতুন চিন্তা গড়ে উঠেছিল। এই শতকের মানুষ অনেক স্বনির্ভর, স্বীয় শক্তি সম্পর্কে অবহিত এবং দুরন্ত আশার দ্বারা উজ্জীবিত। এই নব মানবতাবাদের প্রবক্তা হলেন দিদেরো। বিশ্বকোষ চার্চের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। এই বিশ্বকোষে প্রকৃতি বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও মনন নিয়েও প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল।

হেলভেটিয়াসের গবেষণার বিষয় ছিল নীতিবোধ ও মনন। বিশ্বকোষের রচয়িতারা মানুষের ভোগের ইচ্ছাকে নিন্দা করেননি, বরং একে স্বাভাবিক বলে গণ্য করেন। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গোষ্ঠীর নাম হল ফিজিওক্র্যাট। অর্থনীতিবিদ কুয়েসনে (Quesnay) ছিলেন এদের নেতা, অন্য সদস্যরা হলেন তুর্গো, মিরাবো, নেমুর ও গুর্নে। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত “ইয়াবলো ইকনমিক” গ্রন্থে কুয়েসনে তার অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের চিন্তাভাবনা এদের প্রভাবিত করেছিল। ফিজিওক্র্যাট শব্দটির উদ্ভাবক হলেন নেমুর (Nemours), এরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন (Laissez Faire)। তারা সমকালীন মার্কেন্টাইল মতবাদের বিরোধিতা করে অবাধ, মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলেন। ফ্রান্সের শুষ্ক প্রাচীর ভেঙে দিয়ে বাণিজ্যকে উন্মুক্ত করতে বলেন। এদের মতে, সম্পদের একমাত্র উৎস হল ভূমি, ভূমিকর ছাড়া আর সব কর তারা তুলে দিতে বলেছিলেন। এরা সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করতে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সর্বজনীন শিক্ষার প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন। রাজাকে তারা অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে বলেন। শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়নের সহায়ক পরিমণ্ডল গঠনের ওপরে তারা জোর দেন।

অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে আরও বেশ কয়েকজন দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী জনমত গঠন করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলি হল বুফো, মাবলি, কন্দরসে, মেসলিয়ে, মরেলি ও লিঙ্গুয়ে (Linguet)। দার্শনিকরা স্বৈরাচার, অভিজাততন্ত্র ও চার্চ বিরোধী যে মতাদর্শ গড়ে তুলেছিলেন এসব দার্শনিকরা তার অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন। বুফো বিত্তশালী ব্যক্তিদের দরিদ্র মানুষের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেন, তিনি সাম্যের কথা বলেছিলেন, তিনি গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আবেদন রেখেছিলেন। কন্দরসে ছিলেন বিজ্ঞানী, তিনি রাজনৈতিক অসাম্যের বিরোধিতা করেন, জনগণের অধিকারের কথা বলেন। ধর্মযাজক মেসলিয়ে সব ধরনের স্বৈরাচারের বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তিনি মনে করেন যে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে অধিকার আদায় করে নিতে পারে। মরেলি ও লিঙ্গুয়ে সমাজবাদের কথা বলেছিলেন, মরেলি মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল সব অনর্থের কারণ। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি তুলে দিতে বলেছিলেন।

লিঙ্গুয়ে তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, তিনিও ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী ছিলেন। বিপ্লবের জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে দার্শনিকদের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একদল মনে করেন বিপ্লবের সঙ্গে দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক যা ছিল তা দূরবর্তী ও পরোক্ষ। বিপ্লব শুরু হলে এর ওপর দার্শনিকদের প্রভাব পড়েছিল। দার্শনিকরা ছিলেন অভিজাত, বুর্জোয়া, বণিক, আইনজীবী, পুরোনো ব্যবস্থায় তারা ছিলেন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, এই ব্যবস্থা ভেঙে দেবার সুপারিশ তারা করেননি (The connexion between their (philosophers’) ideas and the outbreak of revolution in 1789 is somewhat remote and indirect)। জর্জ রুদে বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। তার মতে, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ক্ষোভ, রাজনৈতিক ও সামাজিক উচ্চাশার ব্যর্থতা শুধু বিপ্লব নিয়ে আসে না। জনগণের ক্ষোভ, আশা-আকাঙ্ক্ষার সমন্বিত প্রকাশ ও মনোলোক গঠনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থাকে। তারাই সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দেন। সাধারণ বিপ্লবী চেতনা ও কর্মসূচি গঠনে বুদ্ধিজীবীরা অবদান জুগিয়ে থাকেন। মনে রাখা দরকার সেযুগে রাজনৈতিক দল ও কর্মসূচি ছিল না, দার্শনিকরা সেই অভাব পূরণ করেছিল। তারাই জনগণকে সচেতন করে পরিবর্তনের দাবিগুলি তুলে ধরেছিল, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রয়োজন তা চিহ্নিত করে দিয়েছিল (It needed more than economic hardship, social discontent, and the frustration of political and social ambitions to make a revolution. To give cohesion to the discontents and aspirations of widely varying social classes there had to be some unifying body of ideas, a common vocabulary of hope and protest, something in short, like a common revolutionary psychology)।

ইংরেজ বাগ্মী, রাষ্ট্রনেতা ও দার্শনিক এডমন্ড বার্ক ফরাসি বিপ্লবের ওপর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন (Reflections on the Revolution in France, 1790)। এই গ্রন্থে বার্ক বলেছেন যে বিপ্লবের কারণ হল নব্য ধনী ও দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র। (The revolution, therefore, could not in his opinion be the outcome of a genuine and widespread feeling for reform, but rather of the evil machinations of selfish and socially disruptive groups. He instanced in particular, the clique of literary men and philosophes, who had long been sniping at the established church, and the jumped-up moneyed interest, eager to settle accounts with the traditional aristocracy. In the wake of these sinister influences, he argued, followed the poor benighted mob or swinish multitude, owning litle or no property and incapable of political thinking or discernment. Thus the Revolution, having no roots in legitimate dissatisfaction, was the child of the conspiracy of a few.) ফ্রান্সের মতো অবস্থা অনেক দেশেই ছিল, সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের ক্ষোভ দূর করা যেত। ফ্রান্সের দার্শনিকরা সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। বার্ককে অনুসরণ করে বারুয়েল, তেন, তকভিল, রুস্তাও, মাদলা, শাতোব্রিয়া প্রভৃতি লেখকেরা বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের দায়ী করেছেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিপ্লবের জন্য যারা দার্শনিকদের দায়ী করেছেন তাদের মধ্যেও মতভেদ আছে। বার্কের চক্রান্ততত্ত্ব তারা স্বীকার করেননি, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অসন্তোষকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। একদল ঐতিহাসিক আবার দার্শনিকদের অবদানকে একেবারেই স্বীকার করতে চান না। মুনিয়ে (Mounier) জানিয়েছেন যে বিপ্লবের সঙ্গে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই।

মুনিয়ে, জ্যরেস, মাতিয়ে, তিয়ের, মিন্যে (Mignet), মিশলে ও আধুনিককালে জর্জ লেভের ও তার ছাত্ররা (জর্জ রুদে, রিচার্ড কব ও লাক্রস) ফরাসি বিপ্লবের জন্য জনগণের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষোভকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন (The causes of the movement were chiefly economical and political, not philosophical, or social)। জর্জ লেভের ও অন্যান্যরা মনে করেন যে বিপ্লবের আসল কারণ হল অর্থনৈতিক (The condition of the peasants was undoubtedly a prime cause of the revolution)। মর্নে দেখিয়েছেন যে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, আর এই অসন্তোষ সৃষ্টিতে দার্শনিকদের একটি বিশিষ্ট অবদান ছিল। বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল বুর্জোয়ারা, আর এই বুর্জোয়াদের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল দার্শনিকরা। কোবান লিখেছেন যে দার্শনিকদের চিন্তা- ভাবনা ছিল পরস্পরবিরোধী, এদের কোন সাধারণ কর্মসূচি ছিল না।

ডেভিড টমসন মনে করেন যে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের সামগ্রিক বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বিপ্লবের জন্য দায়ী ছিল। দার্শনিকদের রচনা পুরোনো ব্যবস্থার প্রতি বিরূপ মনোভাব ও অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছিল, পুরোনো ব্যবস্থার ভিত শিথিল করে দিয়েছিল, দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জনগণ পুরোনো ব্যবস্থার সমালোচনা করতে থাকে বিপ্লব শুরু হলে দার্শনিকদের প্রভাবে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দার্শনিকদের বিশেষ অবদান ছিল বলে ডেভিড টমসন স্বীকার করেননি। ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন যে দার্শনিকরা বিপ্লব প্রচার করেননি। মঁতেস্কু ছিলেন রক্ষণশীল, ভলতেয়ার জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের কথা বলেছিলেন, রুশো বিপ্লবের কথা বলেননি। দার্শনিকদের মতাদর্শের মধ্যে ঐক্য ছিল না, তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা ছিল, এসব স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে দার্শনিকরা ফ্রান্সের ঐতিহ্যগত রাষ্ট্র ও সমাজের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। দার্শনিকদের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধীরা বলেছেন যে এদের পাঠক ছিল শিক্ষিত বুর্জোয়ারা, ফ্রান্সের অধিকাংশ মানুষ ছিল অশিক্ষিত। বলা হয় বিপ্লবের সূতিকাগৃহ ছিল সালো (Salon), বসার ঘর, কাফে, রেস্তোরাঁতে দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা হত। সাধারণ মানুষ এসব আলোচনা শুনে অনেক কিছু জেনেছিল। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই সময় ফ্রান্সের প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা হল ১৬৯। হাটে, বাজারে, অফিস, আদালত, সভা-সমিতি, থিয়েটার, অ্যাকাডেমিতে এসব নিয়ে আলোচনা হত। পার্লেমো বিদ্রোহ করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছিল। ফ্রান্সে এসময় অনেক সাময়িক পত্র ও প্রচার পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এসব পত্র-পত্রিকা সব সময় সুরুচির পরিচয় দিত না, কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে এগুলি লেখা হত কিন্তু জনসাধারণ সচেতন হয়ে উঠেছিল।

জর্জ লেফেভর বলেছেন যে ফ্রান্সের ইতিহাসের গভীরে নিহিত ছিল বিপ্লবের উৎস (The origins of the revolution of 1789 lie deep in French history)। মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক দুর্গতির জন্য ফ্রান্সের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। আধুনিককালের বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় একটি রাজনৈতিক দল, অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে রাজনৈতিক দল ছিল না। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিক্ষোভকে সংহত রূপ ও ভাষা দিয়েছিলেন দার্শনিকরা। সংস্কার ও স্বাধীনতার যে আশা এতদিন অনুচ্চারিত ছিল দার্শনিকদের রচনায় তা ভাষা পেয়েছিল। মানুষের মানসলোকের অস্পষ্ট চিন্তা-ভাবনা স্পষ্ট রূপ লাভ করেছিল, বিপ্লবী মানসিকতা গঠনে দার্শনিকদের অবদান অবশ্যই ছিল। পরিবর্তনমুখী মানসিকতা তারা গঠন করে দিয়েছিলেন, কিন্তু দার্শনিকদের জন্যই বিপ্লব হয়েছিল এই ধারণা ঠিক নয়। সামগ্রিক বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বিপ্লবের জন্য দায়ী ছিল। বিপ্লবের বস্তুগত পরিস্থিতি (objective situation) তৈরি না হলে শুধু জ্ঞানদীপ্তি বা দার্শনিকদের প্রচার বিপ্লব ঘটাতে পারে না। ফ্রান্সের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে দার্শনিকদের রচনা বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, পরিবর্তনের দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।

ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বিপ্লব না হয়ে ফ্রান্সে হল কেন?

ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ইউরোপের প্রায় সবদেশে প্রায় একই ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা ছিল। দৈবানুগৃহীত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অধীনে মুষ্টিমেয় অভিজাত সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করেছিল। স্বৈরাচারের প্রকৃতিতে কিছুটা হেরফের অবশ্যই ছিল। ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কারণ পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুই শাসক হিসেবে দুর্বল ছিলেন। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়ার শাসকেরা জ্ঞানদীপ্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংস্কারের কাজে হাতে দিয়েছিলেন, জনগণের মঙ্গল সাধনের কথা ভেবেছিলেন। ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের সর্বত্র অভিজাতশ্রেণি ক্ষমতা হস্তগত করেছিল, জনগণের রাজনৈতিক, নাগরিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। ইউরোপের সর্বত্র অভিজাতরা ছিল ভূমির মালিক, বেশিরভাগ কৃষক ছিল ভূমিহীন, অধিকারহীন ভূমিদাস। ভূমিদাস প্রথা পূর্ব ইউরোপের সর্বত্র অটুট ছিল, ইউরোপের অর্থনীতি ছিল কৃষি-নির্ভর, মার্কেন্টাইল মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এধরনের অর্থনীতিতে আমদানি নয়, রপ্তানির ওপর জোর দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ছিল ব্যতিক্রম, সেখানে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল, অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অবাধ মুক্ত অর্থনীতির কথা বলেছিলেন কিন্তু বেশিরভাগ দেশ মুক্ত অর্থনীতিতে আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চ ছিল সম্পদশালী, প্রভাবশালী কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চও রক্ষণশীল পথ ধরেছিল, পরিবর্তনের বিরোধিতা করত। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড ও পোল্যান্ডে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আটলান্টিকের অপর পারে আমেরিকায় বিপ্লব হয়েছিল কিন্তু ইউরোপের কোথাও বিপ্লব হয়নি।

ফরাসি বিপ্লবের প্রথম ব্যাখ্যা দেন এডমন্ড বার্ক। তার মতে, বিপুল পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লব ঘটানো হয়নি, এই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্র। তিনি মনে করেন ফরাসি বিপ্লব হল একটি ষড়যন্ত্রের ফল, ষড়যন্ত্র করেছিল দার্শনিক ও নব্য ধনীরা (philosophes and money clique)। উনিশ শতকে তিয়ের (Thiers) ও মিন্যে (Mignet) ফরাসি বিপ্লবকে দেখেছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে। এদের ব্যাখ্যায় অত্যাচার ও অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের আশায় ফ্রান্সের মানুষ বিপ্লব করেছিল। উনিশ শতকে এসে বিপ্লব পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল, এর রাজনৈতিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ ছিল। জুল্স মিশলে (Jules Michelet) মনে করেন ফরাসি বিপ্লব হল স্বৈরাচার, অসহনীয় দারিদ্র্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। মিশলের মতে, জনগণ হল বিপ্লবের আসল নায়ক, রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল নয়। ফ্রান্সের কৃষক ও সাঁকুলোতরা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও অভিজাতন্ত্রের অত্যাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আলেক্সি দ্য তকভিল ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া, পোল্যান্ড ও বোহেমিয়ার কৃষক ও সাধারণ মানুষ অনেকবেশি দুর্দশা ও দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়েছিল। ফ্রান্সের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে, তারা ছিল মুক্ত, স্বাধীন, জমির মালিক ও শিক্ষিত। এসত্ত্বেও ফ্রান্সে বিপ্লব হয়েছিল কারণ স্বৈরাচারী শাসক ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) ব্যাপকভাবে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রশাসন, বিচার, আইন, কর ব্যবস্থা সংস্কার করতে শুরু করে দেন। স্বৈরাচারী শাসক যখন সংস্কার করতে শুরু করেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, বিপ্লব আসন্ন হয়ে ওঠে (The most dangerous moment for a despotic government is that when it sets about reform)। ইংরেজ ঐতিহাসিক মোরস স্টিফেনস তকভিলের বক্তব্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ফ্রান্সের কৃষক ছিল ধনী ও স্বাধীন, সেজন্য সে ভূস্বামীর বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও করের বিরোধিতা করেছিল। জার্মান ভূমিদাসরা নীরবে বন্ধন মেনে চলেছিল (It was because the French peasant was more independent, more wealthy and better educated than the German serfs that he resented the political and social privileges of his landlord and the payment of rent more than the serf objected to his bondage)। তকভিল মনে করেন যে শুধু অধিকারহীন মানুষ বিপ্লব করে না, অধিকার ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে মানুষ বিপ্লবের পথে পা বাড়ায় (It is not always by going from bad to worse that a society falls into revolution)।

তকভিলের ব্যাখ্যা অভিনব ও বুদ্ধিদীপ্ত সন্দেহ নেই, কিন্তু এই বিশ্লেষণের মধ্যে বিপ্লবের পুরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্র জনগণের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হারিয়েছিল। ফ্রান্সের পরাক্রান্ত স্বৈরাচারী শাসক চতুর্দশ লুই যে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র স্থাপন করেছিলেন পঞ্চদশ লুইয়ের (১৭১৫-১৭৭৪) শাসনকালে তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এজন্য তার রিজেন্সি কাউন্সিল, তার নিজের দুর্বলতা ও আমলাতন্ত্র দায়ী ছিল। অতিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করলেও রাজা শাসনকার্যে নজর দেননি, শিকার ও বিলাস-ব্যসন নিয়ে মগ্ন ছিলেন। আমলাতন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল, শাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছিল। ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা রাজার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাত কিন্তু এই অপদার্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তারা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করেছিল, ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) প্রশাসন, বিচার, করব্যবস্থা, প্রাদেশিক শাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। তার মন্ত্রী তুর্গো, কালোন, ব্রিয়েন ও নেকার নতুন কর স্থাপনের প্রস্তাব দেন। অভিজাততন্ত্র মনে করে রাজার কর প্রস্তাব হল তাদের সম্পত্তি ও অধিকারের ওপর আক্রমণ। তারা প্রবলভাবে সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। রাজা এই প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সংস্কার প্রবর্তন করতে পারেননি, বিপ্লব অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ডেভিড টমসন জানিয়েছেন একজন বিপ্লবী রাজাই শুধু বিপ্লব থেকে দেশকে বাঁচাতে পারত।

ঐতিহাসিকরা সমকালীন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছিল। এই বর্ধিত বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য দেশের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু বর্ধিত সম্পদের ভাগ কৃষক, শ্রমিক ও কারিগররা পায়নি কারণ এই বাণিজ্যের বেশিরভাগ ছিল পুনঃরপ্তানি বাণিজ্য (re- export trade)। এজন্য জর্জ লেভের মনে করেন সমৃদ্ধির মধ্যে বিপ্লব এসেছিল এই ধারণা ঠিক নয়, তবে সমৃদ্ধ বাণিজ্য থেকে ফ্রান্সের বুর্জোয়ারা লাভবান হয়েছিল। এই ধনশালী বুর্জোয়াদের সামনে সামাজিক প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পর বুর্জোয়ারা উচ্চ পদ কিনে অভিজাত হতে পারত না, বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। দেশের প্রচলিত শিল্প-বাণিজ্য আইন-কানুন সদ্যোজাত সম্প্রসারণশীল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী বুর্জোয়াদের উত্থানের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। তারা পুরোনো ব্যবস্থার সংস্কার দাবি করেছিল। অভিজাতরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে ধনী বুর্জোয়া সাম্য ও স্বাধীনতার দাবি নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।

তকভিল ও জ্যরেস বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের সমৃদ্ধির কথা বলেছেন। কিন্তু লেভের, জর্জ রুদে ও লাব্রুস মনে করেন যে এই সমৃদ্ধি সকলের জন্য ছিল না। ফ্রান্সের মাত্র ২৫ শতাংশ কৃষকের জমি ছিল, আবার সম্পত্তিবান কৃষকদের মধ্যে ছিল দরিদ্র প্রান্তিক চাষি। আর্থার ইয়াং একজন দরিদ্র চাষি এবং হত দরিদ্র এক কৃষক রমণীর কথা বলেছেন যাদের অল্প জমি ছিল। ফ্রান্সের ৫০ শতাংশ কৃষক ছিল। ভাগচাষি, উৎপন্ন ফসলের ৫০ শতাংশের বিনিময়ে তারা ভূস্বামীর জমি চাষ করত, জমিতে তাদের কোনো অধিকার ছিল না, ২৫ শতাংশ কৃষক ছিল ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। বিপ্লবের আগে দশ বছর ধরে ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতিতে মন্দা চলেছিল, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। এরা নিজেদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করতে পারত না। এদের একাংশ জীবিকার খোঁজে শহরে গিয়ে ভিড় করেছিল, কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি নিয়েছিল, অনেকে দস্যুবৃত্তি করতে থাকে, এই দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের কর দিতে হত রাষ্ট্র, ভূস্বামী ও চার্চকে। বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে ভূস্বামী পতিত জমি দখল করেছিল, নতুন কর বসিয়েছিল কারণ তার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল। কৃষির মন্দা শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। সরকার ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করে বস্ত্রশিল্পের সংকট ডেকে এনেছিল। প্যারিস, লিল, ট্রয়, সেডান, রুয়েন, রাইমসের বস্ত্র কলের শ্রমিকরা কর্মচ্যুত হয়ে পড়েছিল। মার্কেন্টাইল অর্থনীতির জন্য ফ্রান্সের অর্থনেতিক উন্নতি ব্যাহত হয়। সি. ই. লাক্রস দেখিয়েছেন যে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল সেহারে মজুরি বাড়েনি। শ্রমিকদের আয়ের ৮০ শতাংশ শুধু খাদ্য কিনতে ব্যয় হয়ে যেত। গড় দাম বেড়েছিল ৬০ শতাংশ, গড় মজুরি বেড়েছিল মাত্র ২২ শতাংশ। প্রকৃত মজুরি কমেছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে। সমৃদ্ধি নয়, দারিদ্র্য ও হতাশার মধ্যে বিপ্লব এসেছিল। তকভিল বা জ্যরেস নয়, মিশলের ব্যাখ্যা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় ।

আধুনিককালের বিপ্লবে একটি রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দেয়। সেযুগে রাজনৈতিক দল ছিল না, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করেছিল ফরাসি বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরা। এরা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এরকম শক্তিশালী বৌদ্ধিক আন্দোলন ইউরোপের অন্য কোনো দেশে ছিল না। এরা জনগণের মনকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, পরির্তনের কর্মসূচি তৈরি করে দেন, বৈপ্লবিক মানসিকতার জন্ম হয়েছিল। ফ্রান্সে বহু পুস্তক, পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হত। কাফে, রেস্তোরাঁ ও সালোতে দার্শনিকদের মতবাদ নিয়ে আলোচনা হত, সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ ও তার মর্মার্থ বুঝেছিল। এদের প্রচারের ফলে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও যাজকতন্ত্র জনগণের শ্রদ্ধা হারিয়েছিল, এসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি শিথিল হয়েছিল। ফ্রান্সের চার্চ ছিল চারটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত— গলিক্যান, জেসুইট, রিচারিস্ট ও জ্যানসেনিস্ট। ফ্রান্সের মানুষ চার্চের দুর্নীতি ও নৈতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিল। অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দার্শনিকদের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষার কথা বলেছিল। জাতি, নাগরিক, সামাজিক চুক্তি, সাধারণের ইচ্ছা ইত্যাদি শব্দগুলির বহুল ব্যবহার হয়। জনমনে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছিল, ফ্রান্সের সচেতন জনমত বিপ্লবের জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল।

জর্জ রুদে মনে করেন বিভিন্ন কারণে ফ্রান্সে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। লেভেরের মতে, “বিশাল আশা’ ও ‘বিরাট ভয়’ এই পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। শুধু কৃষকেরা নয়, সর্বস্তরের মানুষ পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে শোষক ভূস্বামী ও শোষিত কৃষকের মধ্যে আতঙ্ক ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে রাজার অর্থনৈতিক দেউলিয়া অবস্থা বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে রাজা দেউলিয়া হন, আর লাফায়েত, লামেথ ও ডুমারা স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে বিপ্লবী অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। রাজার নতুন কর প্রস্তাব অভিজাতরা বাতিল করেছিল, স্টেট্স-জেনারেল ডাকা ছাড়া রাজার অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্টেট্স জেনারেলের অধিবেশন বসার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অভিযোগ প্রবল বন্যার ন্যায় প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম ব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছিল। অভিজাতরা এই বিপ্লব শুরু করেছিল, অল্পকাল পরে বুর্জোয়াদের হাতে এর নেতৃত্ব চলে যায়। রাজতন্ত্রের ব্যর্থতা, অভিজাততন্ত্রের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, বুর্জোয়াদের সামাজিক উচ্চাশা, কৃষক, শ্রমিক ও সাঁকুলোংদের দারিদ্র্য ও হতাশা ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ইউরোপের অন্য কোনো দেশে এধরনের বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ : ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ১৭৮৯-১৯৪৫, সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা – ১১-৫৭, ৫৬৫-৫৭৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.