অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ, ইউরোপে কূটনৈতিক বিপ্লব, দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ ও সপ্তবর্ষ যুদ্ধ

Table of Contents

অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সাইলেশিয়া যুদ্ধ ও অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০-১৭৪৮)

প্রাশিয়ারাজ ফ্রেডারিক দি গ্রেটের বর্ণনা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামের মৃত্যুর পর ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিক প্রাশিয়ার সিংহাসন লাভ করেন। তিনি ইতিহাসে ফ্রেডারিক দি গ্রেট নামে পরিচিত। সমকালীন ইউরােপে জ্ঞানদীপ্ত শাসক, কূটনীতিবিদ, সামরিক দূরদর্শিতা অনেক গুণে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। শাসক হিসাবে তার প্রতিভা ও দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। লর্ড অ্যাক্টন তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন “He was the most consummate Practical genius that in modern times has ever inherited a throne.” ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের সময় ১৮শ শতাব্দীতে ইউরােপে অস্ট্রিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। অস্ট্রিয়া ক্যাথলিক ধর্ম অধ্যুষিত রাজ্য এবং বিভিন্ন জাতি গােষ্ঠীর লােক নিয়ে অস্ট্রিয়ার জনশক্তি তৈরি হয়েছিল। ইউরােপের পবিত্র রােমান সম্রাটের পদ লাভ করত অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ পরিবার।

অনেক জার্মান রাষ্ট্রের ওপর অস্ট্রিয়ার অপ্রতিহত আধিপত্য ছিল। কাজেই ফ্রেডারিক সিংহাসনে আরােহণ করেই সাইলেশিয়াকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। সাইলেশিয়া অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। এখানকার জনগােষ্ঠী ছিল প্রােটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে অষ্ট্রিয়ার সম্রাট ৬ষ্ট চালর্সের মৃত্যুর পর তার কন্যা মেরিয়া থেরেসা ২৪ বছর বয়সে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসেন।মেরিয়া থেরেসার পিতা সম্রাট ৬ষ্ঠ চার্লসের কোনাে পুত্র সন্তান না থাকায় মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্ব হতেই তার কন্যা মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করার পরিকল্পনা করেন। স্যালিক আইন অনুসারে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে স্ত্রীলােকের আসনের কোনাে সুযােগ ছিল না। ৬ষ্ঠ চার্লস এই আইনগত সমস্যা দূর করার জন্য ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ নামে এক স্বীকৃতিপত্র ইউরােপের রাজগণ কর্তৃক স্বাক্ষর করিয়ে মেরিয়া থেরেসাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ঘােষণা করেন। তবে ইউরােপীয় রাজগণ এই শর্তে স্বাক্ষর করেছিলেন যে, মেরিয়া থেরেসা পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবেন না। কাজেই কেবল অস্ট্রিয়ার সম্রাট হিসেবে মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসন লাভ করেন। উল্লেখ্য সে সময় অস্ট্রিয়ার সম্রাটই পবিত্র রােমান সম্রাট পদ লাভ করতেন। প্রাশিয়াকে এই সম্মতি দেওয়ার জন্য মহান ফ্রেডারিকের পিতা প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামকে ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে জুলিক ও বার্গ নামক স্থান দুটি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে এই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসলে ফ্রেডারিক তাকে রানী বলে স্বীকার করেননি। জুলিক ও বার্গ নামক স্থান দুটি প্রদান না করায় পিতার স্বাক্ষরিত ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ মানতে তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। মূলত অস্ট্রিয়ার সামরিক দুর্বলতা, মেরিয়া থেরেসার অনভিজ্ঞতা এবং প্রাশিয়ার সামরিক ঐশ্বর্য ফ্রেডারিককে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে প্ররােচিত করে। (“Tired of ruling over slaves, “he recorded towards the end of his life, but he never did anything to set them free.” John canning, too Great kings, Queens and Rulers of the world, p – 499)।

মেরিয়া থেরেসা যখন অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসেন তখন অস্ট্রিয়ার সামরিকশক্তি ছিল দুর্বল এবং কোষাগার ছিল শূন্য। তিনি অনভিজ্ঞ ও অল্প বয়স্ক ছিলেন। এছাড়া প্র্যাগম্যাটিক স্যাংকশনের কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনােযােগ দিতে পারেন নি। বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া ভূখণ্ড ছিল অসংগঠিত। দ্বিতীয় ফ্রেডারিক তাই এ দুর্বলতার সুযােগে অস্ট্রিয়ার সাইলেশিয়া অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা করেন। সাইলেশিয়া ওডার নদীর উর্বর উত্তর উপত্যকায় বিস্তৃত ছিল। এটি পূর্বে স্লাভীয় পোলদের থেকে পশ্চিমে বোহেমিয়ার স্লাভীয় চেকদেরকে পৃথক করে রেখে ছিল। এই রাজ্যের লোকসংখ্যা সবই জার্মান এবং বেশিরভাগ প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী ছিল। এর জনসংখ্যা প্রাশিয়ার রাজ্যের জনসংখ্যার সমান ছিল। এটি প্রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে প্রাশিয়া সমৃদ্ধ হবে। অপরদিকে জার্মান জনগোষ্ঠীর নিকট প্রাশিয়ার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। অস্ট্রিয়া এই অঞ্চলটি হারালে সে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আরো দুর্বল হবে। সাইলেশিয়া দখলের জন্য মহান ফ্রেডারিক একটি সেকেলে দাবি উত্থাপন করে। এখান থেকেই প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে, যার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সাইলেশিয়া অধিকার। সাইলেশিয়ার ওপর বহু প্রাচীন পারিবারিক উত্তরাধিকারের অজুহাতে সাইলেশিয়ার ওপর দাবি জানিয়ে ফ্রেডারিক মেরিয়া থেরেসাকে এক চরমপত্র পাঠালেন। এই পত্রে জানানো হল যে,

  • (১) মেরিয়া খেরেসা যদি সাইলেশিয়ার ওপর ফ্রেডারিকের অধিকার মেনে নেন, তা হলে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য রক্ষার্থে সর্বদা সাহায্য করবেন।
  • (২) আর এ দাবি অস্বীকৃত হলে ফ্রেডারিক যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হবেন।

মেরিয়া থেরেসা এই চরমপত্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে ১৭৪১ সালে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই দাবির প্রতি উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে, মেরিয়া থেরেসার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রেডারিক সাইলেশিয়া আক্রমণ করেন। এক বছরের মধ্যেই ফ্রেডারিক প্রায় সমগ্র সাইলেশিয়া দখল করে নেন। সাইলেশিয়ার রাজধানী ব্রেসল তার অধীনে আসে। কেবলমাত্র মিসি ও ব্রিগ নামক দুটি শহর তখনো অপরাজিত থাকে। ব্রিস নামক স্থানের নিকট ১৭৪১ সালে মলউইজের যুদ্ধে ফ্রেডারিক জয়লাভ করেন। প্রাশিয়ার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে স্পেন, স্যাভয়, বেভেরিয়া, সার্ডিনিয়া, স্যাক্সনি প্রভৃতি ইউরোপীয় শক্তি অস্ট্রিয়ার ভূখণ্ডের বিশেষ বিশেষ অঞ্চল দাবি করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।

হ্যাপসবার্গ রাজবংশের ষষ্ঠ চার্লসের মৃত্যুর পর ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্ট (১৭২৬-১৭৪৫) চাচ্ছিলেন পরবর্তী পবিত্র রোমান সম্রাট হতে। কিন্তু তিনি অস্ট্রিয়াকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। এদিকে ফ্রান্স ছিল অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ রাজবংশের পরম শত্রুদেশ, এতদিন পর্যন্ত দেশটি অস্ট্রিয়ার এই দুর্বলতার অপেক্ষায় ছিল। তাই এই মোক্ষম সুযোগে ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে বেভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্টের দাবিকে সমর্থন করে। এর ফলে প্যাগম্যাটিক স্যাংশনকে প্রত্যাখ্যান করা হলে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত ছিল সাইলেশিয়া যুদ্ধ। ফ্রেডারিক প্রথম দিকে অস্ট্রিয়া বিরোধী সামরিক জোটে যোগদান করেননি। প্রাশিয়া কর্তৃক সাইলেশিয়া দখল স্বীকার করে নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় ফ্রেডারিক মেরিয়া থেরেসাকে প্রস্তাব দেন এবং এর বিনিময়ে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মেরিয়া থেরেসা এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করায় দ্বিতীয় ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার বিরোধী যুদ্ধে যোগদান করেন এবং ফ্রান্স ও বেভেরিয়া ফ্রেডারিকের সাথে এক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে স্থির হল যে, প্রাশিয়া কর্তৃক সাইলেশিয়া দখল ফ্রান্স ও বেভেরিয়া মেনে নেবে। কিন্তু বেভেরিয়ার ইলেক্টর সপ্তম চার্লস (১৭৪৩-৪৫) উপাধি ধারণ করে পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ লাভ করবে, এবং ফ্রেডারিক বেভেরিয়ার ইলেক্টরকে অস্ট্রিয়ার সম্রাট পদ লাভে সাহায্য করবেন এবং রাইন অঞ্চলের দাবি ত্যাগ করবেন। এদিকে ফ্রান্স অস্ট্রিয়া-নেদারল্যান্ডস অধিকার করবে। ফ্রান্স ও বেভেরিয়া প্রাশিয়ার পক্ষে যোগদান করলে ফ্রেডারিকের সামরিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তিনি অনেকটা নিশ্চিত হলেন।

এই প্রেক্ষিতে অস্ট্রিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী সাইলেশিয়াতে পরাজিত হয়। ১৭৪১ সালে ফ্রান্স ও বেভেরিয়ার সেনাবাহিনী বোহেমিয়া আক্রমণ ও দখল করেন। ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্ট হন বোহেমিয়ার রাজা। চার্লসের লক্ষ্য বোহেমিয়ারও ঊর্ধ্বে ছিল। তিনি পবিত্র রোমান সম্রাট তো হতে চাইতেনই, সেই সাথে তিনি মারিয়া থেরেসার হ্যাপসবার্গ উত্তরাধিকারী হবার দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতেন, আর এর মাধ্যমে তিনি সমগ্র অস্ট্রিয়াই অধিকার করতে চাইতেন। যাই হোক, এরপর চার্লস আলবার্ট সপ্তম চার্লস (১৭৪২-১৭৪৫) সম্রাট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই অবস্থায় মেরিয়া থেরেসা তার অনুগত হাঙ্গেরীয় প্রজাদের সাহায্য প্রার্থনা করে। হাঙ্গেরীয় প্রজাদের সাহায্যে অস্ট্রীয় বাহিনী বেভেরিয়া দখল করে। এর ফলে নতুন পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লস হয়ে পড়েন স্বদেশবিহীন সম্রাট। কিন্তু ১৭৪২ সালে চলুসিজের যুদ্ধে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয় বাহিনীকে পরাজিত করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৭৪২ সালে ব্রেসলাউ এর সন্ধি মেরিয়া থেরেসা ফ্রেডারিকের সাথে সন্ধি করে সাইলেশিয়ার ওপর ফ্রেডারিকের অধিকার স্বীকার করে। বিনিময়ে ফ্রেডারিক নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে প্রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করে কিন্তু ফ্রান্স ও বেভেরিয়া এবং অপর দিকে অস্ট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হতে থাকে।

ব্রেসলাউ এর সন্ধির ফলে ফ্রেডারিক যুদ্ধ ত্যাগ করলে অস্ট্রিয়া অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয় এবং যুদ্ধের গতি অস্ট্রিয়ার অনুকূলে পরিবর্তিত হয়। এছাড়া ১৭৪৩ সালে ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ওয়েস্টমিনিস্টারের চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার ফলে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস অস্ট্রিয়ার পক্ষে এই যুদ্ধে যোগদান করে। ইংল্যান্ডের অস্ট্রিয়ার সাথে মৈত্রী করার কারণ ছিল। কিন্তু সেদিকে যাবার আগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছু ইতিহাস বলে নেয়া দরকার। ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সিংহাসন লাভ করেন। এরপর থেকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে। সেই সময় ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে ইংল্যান্ড লিগ অব অগসবার্গে যােগদান করে হল্যান্ডের পক্ষে চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৬৯৭ সালে রাইসুইগের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ইংল্যান্ড যেসব স্থান ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ থেকে দখল করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়। ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তৃতীয় উইলিয়ামের দাবি স্বীকার করে নেয়। কিন্তু ১৬৯৭ সালে রাইসুইকের সন্ধি ফ্রান্সের জন্য কোনাে বিশেষ সুবিধা এনে দেয়নি। ফলে পাঁচ বছর পর স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার সম্রাট এবং অন্যান্য ইউরােপীয় রাজার সাথে এক গ্রান্ড অ্যালায়েন্সে (Grand Alliance) স্বাক্ষর করে চতুর্দশ লুইয়ের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইউট্রেক্টের সন্ধি (১৭১৩-১৫) দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংল্যান্ড ফ্রান্স থেকে নােভাস্কশিয়া, হাস্টেনবে টেরিটোরি, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিটস দ্বীপগুলাে দখল করে। ফরাসি মিত্র স্পেনের নিকট থেকেও ইংল্যান্ড অনেক সুবিধা আদায় করে এবং কতিপয় স্থান দখল করে। সন্ধি হলেও দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা ছিলই।

যাই হোক, এবারকার অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ডের যোগদান নিয়ে বলা যাক। তদকালীন ইংল্যান্ডে যে রাজবংশের শাসন চলে তা হলো হ্যানোভারীয় রাজবংশ, রাজা ছিলেন রাজা দ্বিতীয় জর্জ (১৭২৭-১৭৬০)। রাজবংশের নাম হ্যানোভারীয় কারণ এই বংশের উদ্ভব জার্মানির হ্যানোভার থেকেই। এই বংশ বংশ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ও হ্যানোভারের ইলেক্টর ছিল। কাজেই ইংল্যান্ডের তদকালীন রাজা দ্বিতীয় জর্জের মনে হ্যানোভার প্রীতি ছিল, হ্যানোভারের কোন ক্ষতি হোক তা তিনি কখনই চাইতেন না। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জ হ্যনােভারের নিরাপত্তা সম্পর্কে আশঙ্কিত হয়ে হ্যানােভারের রক্ষার্থে অস্ট্রিয়ার পক্ষে অংশগ্রহণ করতে উৎসুক ছিলেন। ইংল্যান্ডের জনমতও তার অনুকূলে ছিল। কিন্তু তদকালীন ইংল্যান্ডের প্রধামন্ত্রী ওয়ালপােল এ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তার মন্ত্রিসভার পতন হয় এবং লর্ড কার্টারেট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কার্টারেট জর্জের হ্যানােভার প্রীতির সমর্থক ছিলেন। যেহেতু জার্মানির হ্যানােভার ছিল ইংল্যান্ডের হ্যানােভার বংশের জন্মস্থান, সেহেতু জার্মানিতে ফরাসি প্রাধান্য স্থাপিত হােক তা দ্বিতীয় জর্জের অভিপ্রেত ছিল না। এছাড়া, ফ্রান্স ইউট্রেকটের সন্ধির শর্তাদি ভঙ্গ করতে অগ্রসর হয়েছে, এই ভয়ও তার ছিল। এসকল কারণে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যােগদান করেন।

অস্ট্রিয়া রক্ষার যুদ্ধ হতে ক্রমে এই যুদ্ধে (ইংল্যান্ডের পক্ষে) ফ্রান্স বিরােধী যুদ্ধে পরিণত হয়। ফ্রান্স ও স্পেন উভয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্যের চুক্তিতে ১৯৪৩ সালে ‘ফন্টেনব্লা-এর সন্ধি’ সম্পাদন করেছিল, তাই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে স্পেইনও দাঁড়ায়। যাই হোক, দ্বিতীয় জর্জ স্বয়ং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তিনি সৈন্য পরিচালনা করে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে ডেটিনজেনে (Dettingen) ফরাসি বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন। এর ফলে জার্মানি হতে ফরাসি বাহিনী বহিষ্কৃত হয়। এদিকে মেরিয়া থেরেসা মিত্রদের সহায়তায় শক্তি অর্জন করে যুদ্ধে জিততে থাকেন ও দক্ষিণ জার্মানি বিধ্বস্ত করেন। এই অবস্থায় অস্ট্রিয়া জার্মানিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাশিয়ার জারিনা এলিজাবেথও (১৭৪১-১৭৬২) অস্ট্রিয়ার সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। স্যাক্সনি শুরু থেকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়ার মিত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ও অস্ট্রিয়া যুদ্ধে অর্জন করতে থাকলে স্যাক্সনি ১৭৪৩ সালে অস্ট্রিয়ার পক্ষে দল বদল করে।

কিছুকাল পর অস্ট্রিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করতে আরম্ভ করলে ফ্রেডারিক ভীত হন। এই অবস্থা ফ্রেডারিকের কাম্য ছিল না। তিনি এ আশঙ্কা করেন যে, যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলে অস্ট্রিয়া হয়তো সাইলেশিয়া দখল করতে অগ্রসর হবে। মেরিয়া থেরেসার অব্যাহত সাফল্য ভবিষ্যতে প্রাশিয়ার জন্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং একসময় মেরিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হতে পারে। এজন্য ১৭৪৪ সালে ফ্রেডারিক পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। এভাবে দ্বিতীয় সাইলেশিয়া যুদ্ধের সূচনা হয়। এ সময় থেকে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ দুই প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হয় – ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব এবং অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার দ্বন্দ্ব। নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে মেরিয়া থেরেসার বিরোধী জোটে যোগদান করে কয়েকটি যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে। ১৪৪৪ সালে অস্ট্রিয়া বোহেমিয়া পুনর্দখল করার চেষ্টা করছিল যখন তা পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লস ও তার ব্যাভেরিয়ান বাহিনীর অধীনস্ত ছিল। প্রাশিয়া এইসময় বোহেমিয়ায় অস্ট্রিয়ান বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল। এদিকে অস্ট্রিয়া ও স্যাক্সোনির বাহিনী সাইলেশিয়ায় আক্রমণ করলে ফ্রেডারিক বোহেমিয়া থেকে তার সেনাবাহিনী সরিয়ে সাইলেশিয়া ও অন্যান্য জায়গায় সরিয়ে নেয় ও বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হয়ে সাইলেশিয়াকে রক্ষা করে। কিন্তু বোহেমিয়া এতে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তা ১৭৪৪ সালে অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

১৭৪৫ সালের জানুয়ারিতে অসুস্থতার কারণে পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লসের মৃত্যু হয়। তার পুত্র তৃতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান জোসেফ (১৭৪৫-১৭৭৭) পিতার মত সংঘাত টেনে নিয়ে যেতে চাননি। ব্যাভেরিয়া অস্ট্রিয়ার দখলে ছিল। তিনি যুদ্ধ থেকে সরে আসার বিনিময়ে ব্যাভেরিয়া ফিরে পেতে চান ও ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর হয়ে ওঠেন। এজন্য তিনি ফিউসেনে অস্ট্রিয়ার সাথে এক মৈত্রি চুক্তি সম্পাদন করেন। অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি ও পোল্যান্ডের সাথে এক মিত্রতা চুক্তি স্থাপন করে প্রাশিয়াকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে এবং রাশিয়াও ঐ সময়ে অস্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে। এ সময় একমাত্র ফ্রান্সই প্রাশিয়ার মিত্র ছিল।

এডমিরাল ম্যাথু দক্ষতার সাথে ভূমধ্যসাগরে ইংরেজ স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন। ভারতবর্ষ এবং আমেরিকাতেও ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছিল। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সিংহাসনের ছােট দাবিদারের (Young Pretender) (দ্বিতীয় জেমসের (১৬৮৫-১৬৮৮) পৌত্র চার্লস এডওয়ার্ড) পক্ষ অবলম্বন করে ইংল্যান্ড আক্রমণের করে। কিন্তু প্রবল ঝড়ে ফরাসি নৌবহর ধ্বংস হওয়ায় ফ্রান্সের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর ফ্রান্স ও প্রাশিয়া যুদ্ধে পরপর কয়েকটি সাফল্য লাভ করে। এদিকে ফ্রান্স ১৭৪৫ সালে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস (বর্তমান বেলজিয়াম) দখল করতে গিয়ে ব্রিটিশ ও হল্যান্ডের এর বাহিনীকে ফন্টেনয়ের যুদ্ধে ভীষণভাবে ফন্টনয়ে পরাজিত করে ও এর মাধ্যমে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের উপর ডেন্টিনজেনের যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়। ১৯৪৫ সালের ৮ই জানুয়ারিতে ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য বিবদমান জাতিগুলাের মধ্যে ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ রক্ষা করার শর্তে ‘ওয়ার্সের সন্ধি’ হয়। সাইলেশিয়ার পুনর্দখলের জন্য অস্ট্রিয়ার সৈন্য অগ্রসর হয়ে হােহেনফ্রিডবার্গের যুদ্ধে পরাজিত হয়। ফ্রেডারিক অষ্ট্রিয়ার সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করে বােহেমিয়ার সােহরের যুদ্ধে পুনরায় তাদেরকে পরাজিত করেন। এই অবস্থায় মেরিয়া থেরেসা ১৭৪৫ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ড্রেসডেনের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী মেরিয়া থেরেসা দ্বিতীয় ফ্রেডারিককে সাইলেশিয়া ছেড়ে দেন বিনিময়ে দ্বিতীয় ফেডারিক মেরিয়া থেরেসার স্বামী, ডিউক অফ টাস্কেনি ও ডিউক অফ লোরেইন ও বার ফ্রান্সিসকে প্রথম ফ্রান্সিস (১৭৪৫-১৭৬৫) হিসেবে পবিত্র রোমান সম্রাট বলে স্বীকার করে নেন (ইতোমধ্যে মেরিয়া থেরেসার স্বামী প্রথম ফ্রান্সিস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটপদে নির্বাচিত হন)। এভাবে দ্বিতীয় সাইলেশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

ড্রেসডেনের সন্ধির পরবর্তী ইংরেজ-ফরাসি দ্বন্দ্ব

ড্রেসডেনের চুক্তির মধ্য দিয়ে অস্ট্রিয়া-প্রাশিয়ার যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল বটে, কিন্তু এদের যুদ্ধের টানে যে ঈঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল সেটা ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত চলে, তাছাড়া অস্ট্রিয়ার সাথে অস্ট্রিয়া-বিরােধী দেশগুলাের যুদ্ধও অব্যাহত থাকে। ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধ শুরু করায় এই যুদ্ধ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘর্ষ রূপ লাভ করে।

দাক্ষিণাত্যে প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮)

এখন অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে যে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের সূচনা হলো তা ভারতবর্ষে কী প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। আর তার আগে দরকার ভারতের তদকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে দুচারটি কথা বলা। ১৮শ শতকের মধ্যভাগে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় হয়ে পড়ে। ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। দুর্বল উত্তরাধিকারীদের কারণে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মুঘল কর্তৃত্ব শিথিল হতে থাকে। অল্পকালের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্য অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সকল রাজ্যের রাজারা সর্বদাই পরস্পর কলহে লিপ্ত ছিলেন। ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের (১৭৩৬-১৭৪৭) ভারত আক্রমণে মুঘল সাম্রাজ্যর দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার নিজাম-উল-মুলক প্রথম আসফ ঝা (১৭২৪-১৭৪৮) স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং হায়দ্রাবাদে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মারাঠাগণ প্রথম বাজীরাও (১৭২০-১৭৪০) এর নেতৃত্বে নিজামের প্রভুত্বকে অস্বীকার করে এর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। মারাঠা আক্রমণের চাপে এবং বার্ধক্যের ভারে নিজাম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন। তার মৃত্যুর পর দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি কোন দিকে মােড় নেবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ সময় দাক্ষিণাত্যে মহীশূর, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর, ত্রিচিনাপল্লী, মাদুরা ও তাঞ্জোর প্রভৃতি প্রধান হিন্দু রাজ্য ছিল। এসব রাজ্যগুলাের মধ্যে না ছিল কোন ঐক্য, না ছিল নিজ পায়ে দাঁড়ানাের মত কোন ক্ষমতা। এদিকে হায়দ্রাবাদ এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চৌথ আদায়ের উদ্দেশ্যে মারাঠাদের আক্রমণ দাক্ষিণাত্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তােলে। এ সময় দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের অধীনে কর্ণাটক নামে একটি প্রদেশ ছিল। এর রাজধানী ছিল আর্কট। কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলী খান (১৭৩৪-১৭৪০) হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীন হলেও নিজামের বার্ধক্য ও দুর্বলতা তাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তােলে। তিনি নিজামের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য চালাতে থাকেন।

সুতরাং দেখা যায়, ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রাক্কালে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল। ভারতীয় শক্তিগুলোর অবিরাম কলহই ইউরােপীয় বণিক সংঘগুলােকে দেশীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়। প্রথমে হয়ত তাদের বাধ্য হয়েই অরাজক ভারতবর্ষে নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু পরে সে অরাজকতার সুযােগে তারা সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করতে থাকে। ভারতবর্ষের তদকালীন কলহপূর্ণ অবস্থার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে ইংরেজ ও ফরাসী শক্তি। তারা দক্ষিণ ভারতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। উভয় জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযােগিতা শেষপর্যন্ত সাম্রাজ্য স্থাপনের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। দাক্ষিণাত্যে দেশীয় রাজন্যবর্গের অবিরাম কলহে পণ্ডিচেরীর ফরাসি গভর্নর জোসেফ ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে (Joseph François Dupleix, ১৭৪২-১৭৫৪) ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রতিপত্তি বিনষ্ট করে ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দেশীয় কলহে পক্ষাবলম্বন করতে আরম্ভ করেন। অনুরূপভাবে ইংরেজদের অন্তরেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা দেয় এবং তারা নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন বােধ করে পাল্টা ব্যবস্থাস্বরূপ প্রতিপক্ষে যােগদান করে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এই সময়ে দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত নিয়ে বলি। ১৭৪০ এর দশকে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক অঞ্চলের পরিস্থিতি ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে মারাঠারা কর্ণাটক আক্রমণ করে কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলী খানকে হত্যা করে। এর ফলে কর্ণাটকের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় হায়দ্রাবাদের নিজাম স্বয়ং কর্ণাটকে এসে তার এক বিশ্বাসভাজন আনােয়ারউদ্দীনকে ১৭৪৩ সালে নবাব পদে অধিষ্ঠিত করেন। এতে সংকটের নিরসন হয়নি। কারণ কর্ণাটকের পূর্বতন নবাব দোস্ত আলীর জামাতা চাঁদ সাহেব আনােয়ারউদ্দীনের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতায় লিপ্ত হন। কর্ণাটক অঞ্চলের রাজনৈতিক এই অনিশ্চয়তা ইংরেজ ও ফরাসী উভয় কোম্পানীকে ঐ অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনে প্রলুব্ধ করে।

ইতােমধ্যে ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে ইউরােপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব (War of Austrian Succession) শুরু হয়, আর ইংল্যান্ড তাতে যোগ দেয় ১৭৪৪ সালে। এই যুদ্ধে ইংরেজ ও ফরাসীরা পরস্পরবিরােধী পক্ষ অবলম্বন করে। এই যুদ্ধের প্রভাব ভারতেও পড়ে। ১৭৪৬ সালের গােড়ার দিকে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে খােলাখুলি শত্রুতা শুরু হয়। এ সময় বার্নেটের নেতৃত্বে ইংরেজ নৌবহর কতকগুলাে ফরাসী জাহাজ অধিকার করে। পন্ডিচেরীর ফরাসী গভর্নর ডুপ্লে তৎক্ষণাৎ মরিশাসের ফরাসী গভর্নর লা বুর্দনের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠান। লা বুৰ্দন আটটি শক্তিশালী জাহাজ নিয়ে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে করমণ্ডল উপকূলে উপস্থিত হলে ইংরেজ নৌসেনাপতি পেইটন লা বুর্দনকে কোন বাধা না দিয়ে বাংলার দিকে পালিয়ে যান। এই সুযোেগ ডুপ্লে ইংরেজদের শক্ত ঘাঁটি মাদ্রাজ দখল করে নেন। অতঃপর লা বুৰ্দন মরিশাসে ফিরে যান। এরপর ডুপ্লে পন্ডিচেরীর দক্ষিণে ইংরেজ ঘাঁটি সেন্ট ডেভিড আক্রমণ করেন। কিন্তু ইংরেজরা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। এভাবে দক্ষিণ ভারতে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়ে ডুপ্লের নেতৃত্বে ফরাসীরা সফল হয়।

এপ্রসঙ্গে ডুপ্লের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেই। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে যােশেফ ডুপ্লে-একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ফরাসী কোম্পানী কর্তৃক ভারতে প্রেরিত ফরাসীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দক্ষ কূটনীতিবিদ এবং অপূর্ব রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন একজন শাসক। তার স্বদেশপ্রেম ছিল প্রশংসনীয়। স্বীয় দেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করাই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। জোসেফ ডুপ্লে ১৭৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম কলকাতার সন্নিকটে চন্দননগরে ফরাসী শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে ভারতে আসেন। দীর্ঘ দশ বছর কৃতিত্বের সঙ্গে চন্দননগরের শাসনকার্য পরিচালনার পর ফরাসী কোম্পানী তাকে ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের পন্ডিচেরীর গভর্নর নিযুক্ত করেন। পন্ডিচেরীর শাসনভার গ্রহণের পর তিনি অনুধাবন করেন যে, দেশীয় শাসকবর্গের মর্জির উপর নির্ভর করে চললে কখনই ফরাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্য উৎকর্ষ লাভে সম্ভব হবে না। তাছাড়া তিনি ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করে এদেশে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, ইউরােপীয় পদ্ধতিতে এবং ইউরােপীয় সেনাধ্যক্ষের পরিচালনায় ভারতীয় সেনাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারা সহজে ভারতীয় রাজাদের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে। এ লক্ষ্যে তিনি অচিরেই ইউরােপীয় পদ্ধতিতে কিছুসংখ্যক ভারতীয় সেনাকে সুশিক্ষিত করে তােলেন। 

যাই হোক, দক্ষিণ ভারতে যখন ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখন কর্ণাটকের নবাব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকেননি। নবাব আনােয়ারউদ্দীন তার অনুমতি ছাড়াই রাজ্যে যুদ্ধ শুরু করায় ইংরেজ ও ফরাসীদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। সুচতুর ডুপ্লে নবাবের মনােভাব বুঝতে পেরে তাকে আশ্বাস দেন যে, ফরাসীরা ইংরেজদের থেকে মাদ্রাজ দখল করে তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু ডুপ্লে তার প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। এতে নবাব আনােয়ারউদ্দীন ক্ষুব্ধ হয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এদিকে ডুপ্লে এতদিনে ভারতীয় সৈন্যদেরকে ইউরোপীয় রনকৌশলে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। এদের সাহায্যেই ১৭৪৬ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট টোম-এর যুদ্ধে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীনের বিশাল সেনাবাহিনীকে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। প্রথমত, কর্ণাটকের যুদ্ধ ছিল ভারতে প্রথম যুদ্ধ যে যুদ্ধে কোন ইউরােপীয় শক্তি দেশীয় শক্তিকে সুনিশ্চিতভাবে পরাজিত করে। অল্প সংখ্যক কিছু ফরাসী সৈন্যের হাতে নবাব আনোয়ারউদ্দীনের বিশাল বাহিনীর পরাজয়ে ভারতীয় শক্তির দুর্বলতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এদেশের রাজাদের সামরিক শক্তি যে কতটা দুর্বল তা এর পূর্বে বিদেশী বণিকদের কাছে এত স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পীয়ারের মতে, “এর পরই ডুপ্লের দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের সাহসী প্রচেষ্টা শুরু হয়।” (“There followed Dupleix’s bold bid for South Indian Empire”- The Oxford of Modera India.)।

এই অপ্রত্যাশিত সফলতার পর ডুপ্লে ভারতে একটি ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনে অধিকতর উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন ভারতে ফরাসী প্রাধান্য স্থাপনের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ইংরেজ শক্তি। এজন্য তিনি ইংরেজদেরকে বিতাড়িত করে পর্যায়ক্রমে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে দমন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধে ডুপ্লের এই সাফল্যের ফলে ভারতীয়দের চোখে ডুপ্লের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এর পাল্টা হিসেবে ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা ফরাসীদের পণ্ডিচেরী আক্রমণ করলে ডুপ্লের কাছে পরাজয় বরণ করে। এই অবস্থায় ভারতে খবর পৌঁছায় যে, আয়-লা-শ্যাপলের চুক্তিতে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটেছে (১৭৪৮)। ফলে ইউরােপে যুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসী যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা মাদ্রাজ ফিরে পায়, বিনিময়ে আমেরিকায় তারা ফরাসিদের কাছ থেকে যে নোভাস্কোটিয়ার লুইসবার্গ দুর্গ দখল করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়। এই যুদ্ধে আপাততদৃষ্টিতে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দুটো জিনিস এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল – (১) ভারতীয় সেনাবাহিনী ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক দুর্বল, ইউরোপীয় রনকৌশলে প্রশিক্ষিত অল্পসংখ্যক সেনা নিয়েই বিশাল সংখ্যক ভারতীয় সেনাকে পরাজিত করা সম্ভব, এটাই সেই সময় ফরাসী ও ইংরেজদেরকে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনে উৎসাহিত করে, এবং (২) এই যুদ্ধে নৌশক্তির গুরুত্ব থেকে স্পষ্ট হয় যে নৌযুদ্ধে যারা অধিকতর পারদর্শিতা অর্জন করতে পারবে তারাই হবে ভবিষ্যতে ভারতের অধীশ্বর। 

আমেরিকা ও ইউরোপে ইংরেজ-ফরাসি দ্বন্দ্ব, এবং অস্ট্রিয়ার সন্ধিতে আসতে বাধ্য হওয়া

ভারতের কথা বলা হয়েছে, আমেরিকার কথা একটু বলা যাক। আমেরিকায় অস্ট্রিয়ায় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ পরিচিত ছিল রাজা জর্জের যুদ্ধ (১৭৪৫-৪৮) নামে। এটি আমেরিকাতেও সমান রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় কিন্তু তা অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। নিউ ইংল্যান্ডের যােদ্ধাদের বিশাল বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ফ্রান্সের অধীনে থাকা নোভাস্কোটিয়ার লুইসবার্গ দুর্গ দখল করেছিল। 

নেদারল্যান্ডসে আরও কয়েকটি যুদ্ধে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়। ফরাসিরা প্রায় সমগ্র নেদারল্যান্ডস দখল করে নেয়। ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে কিছুই করতে পারলনা। পক্ষান্তরে ফ্রান্সও নৌযুদ্ধে সুবিধা করতে পারছিল না। ফলে শেষে উভয় পক্ষ সন্ধির জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে এবং ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আয়-লা-শ্যাপেলের সন্ধি” (Peace of Aix-la-Chapelle) স্বাক্ষরিত হয়। অস্ট্রিয়া এতে অনিচ্ছার সাথে যােগ দেয়। কারণ এ সন্ধির শর্তানুযায়ী ফ্রান্স মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার শাসক এবং তার স্বামী লােরেনের ফ্রান্সিসকে সম্রাট হিসেবে স্বীকার করে নিলেও তাকে সাইলেশিয়া ও লম্বার্ডির কিয়দংশ হারাতে হয়। প্রাশিয়া সাইলেশিয়া দখল করে নেয়, সার্ডিনিয়া স্যাভয় ও নিস পুনরুদ্ধার করে এবং ইতালিতে লােম্বার্ডির কিছু অংশ পায়।

এই সন্ধির দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পরের অধিকৃত স্থানসমূহ প্রত্যর্পণ করতে স্বীকৃত হয়। ফরাসিরা ইংরেজদেরকে মাদ্রাজ ফিরিয়ে দেয় বিনিময়ে আমেরিকা লুইসবার্গ লাভ করে। এত কষ্ট করে নিউ ইংল্যান্ডের সৈন্যদের লুইসবার্গ দুর্গ দখল করার গর্ব হতাশায় রূপান্তরিত হল, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন দেখা গেল তা ফরাসীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরিশেষে ১৭৪৮ সালে আইল্যা-শ্যাপল এর সন্ধি (Peace of Aix-la-Chapelle) দ্বারা এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

পররাষ্ট্রক্ষেত্রে দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের শক্তিশালী নীতি তাকে ইউরােপে শ্রেষ্ঠ সম্রাটের পদ দান করে। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্যাক্সনদের ওপর তার বিজয় তার অপরিসীম সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেয় এবং ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার ফ্রেডারিককে ‘দি গ্রেট’ উপাধি দেন। 

১৭৪৮ সালের এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি

এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধির মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। নিম্নে এই-লাশ্যাপেলের সন্ধির শর্তগুলাে ছিল –

  • (১) সাইলেশিয়া ও গ্ল্যাৎসর ওপর প্রাশিয়ার আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয়। 
  • (২) ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার রাণী মেরিয়া থেরেসার স্বামী ফ্রান্সিসকে পবিত্র রােমান সম্রাট এবং দ্বিতীয় জর্জকে ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডে হল্যান্ডের সীমান্ত রক্ষার জন্য ইউট্রেক্টের সন্ধির ফলে ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে যেসব দুর্গ স্থাপিত হয়েছিল সেগুলাের যে কটি ফ্রান্স ইতােমধ্যে দখল করেছিল সেগুলাে ফ্রান্স ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ডানকার্ক বন্দরের রক্ষা প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট বংশের যারা ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বিতাড়িত করতে ফ্রান্সকে বাধ্য করা হল।
  • (৩) স্পেন ফ্রান্সিসকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেয় এবং আমেরিকায় ইংল্যান্ডকে ব্যবসাবাণিজ্যের সুযােগ দিতে বাধ্য হয়।
  • (৪) সার্ডিনিয়ার চার্লস ইমালুয়েল লােম্বার্ডি, স্যাভয় ও নিস লাভ করেন। কিন্তু তিনি ফিনেইল নামক স্থানটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

এই সন্ধির বেশ কিছু সমালােচনাও রয়েছে –

  • (১) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি আপাতত অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটালেও এই সন্ধি কোনাে পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি।
  • (২) অস্ট্রিয়ার রাণী মেরিয়া থেরেসা ইংল্যান্ডের অনুরােধে প্রাশিয়াকে সাইলেশিয়া ছেড়ে দিলেও সাইলেশিয়ার মতাে সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল ছেড়ে দেয়ার কষ্ট মেরিয়া থেরেসা ভুলে যেতে পারেন নি। তাই সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য অস্ট্রিয়া আবার তৎপরতা শুরু করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) শুরু হয়েছিল।
  • (৩) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাদের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের শত্রুতা প্রশমন করতে পারে নি। এই দুই দেশের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক শত্রুতা প্রশমনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে।
  • (৪) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধির মাধ্যমে প্রাশিয়া মধ্য ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
  • (৫) রাশিয়া অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সাইলেশিয়ার যুদ্ধে যােগদান করে এবং এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি স্থাপনে অংশগ্রহণ দাবি করে ভবিষ্যতে ইউরােপের রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছিল।
  • (৬) অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ফ্রান্স। এই সন্ধিতে ফ্রান্সকে অপমানজনকভাবে নতি স্বীকার এবং কয়েকটি স্থান ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। এ ছাড়া এই যুদ্ধে ফ্রান্সের বৈদেশিক বাণিজ্য ও নৌবাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল।
  • (৭) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি ইউরােপীয় শক্তিগুলাের মধ্যে রাজনৈতিক বিরােধ দূর করতে পারে নি। এই সন্ধি কোনাে পক্ষের স্বার্থ রক্ষা না করায় সকলে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে পুনরায় যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যার ফলে পরবর্তী পর্যায়ে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধিকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি মনে করেন।

১৭৪৮-৫৬ এর মধ্যে ইউরোপের কূটনৈতিক বিপ্লব

১৮শ শতাব্দীর ইউরােপের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল ১৭৫৬ সালে সংঘটিত কূটনৈতিক বিপ্লব। কূটনৈতিক বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া তাদের বিগত দু’শ বছরের শত্রুতা পরিহার করে পরস্পরের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয় যা পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অস্ট্রিয়া সমুদ্র তীরবর্তী দেশসমূহের সাথে তার দীর্ঘদিনের অনুসৃত মিত্রতা রক্ষার নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। অপরপক্ষে ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে সমরাভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইউরােপীয় শক্তিগুলাের পরস্পর কূটনৈতিক সম্পর্কের এ পরিবর্তনকে ইউরােপের ইতিহাসে কূটনৈতিক বিপ্লব নামে আখ্যায়িত। (A large army, a well filled treasury and a lively temperament did the rest. So with a flimsy legal Claim to only part of the territory, he marched, Purloined the whole of the province and then awaited reactions. The Austrians promptly looked up arms, were defeated in Silesia and four years of sporadic warfare followed from which Frederick emerged as a great military commander and diplomantst, unscrupulous even by the standards of that age.[John canning, too Great kings, Queens and Rulers of the world, P-498-499])

কূটনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে ১৭শ শতকে ফ্রান্সের বুরবোঁঁ রাজবংশ এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশ পরস্পরের শত্রু ছিল। ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য থাকত অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে দুর্বল করে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী রিশল্যু অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করে অস্ট্রিয়ার প্রভাব খর্ব করেছিলেন। কার্ডিনাল রিশল্যু ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান রক্ষক অস্ট্রিয়া ও স্পেনের বিরুদ্ধে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে প্রােটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যােগদান করেছিলেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়াকে হীনবল করা। ১৮শ শতকে ইউরােপের রাষ্ট্রগুলাে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থের কারণে দুটি পরস্পরবিরােধী জোটে বিভক্ত হয়। সামুদ্রিক শক্তি ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও পর্তুগাল একপক্ষে ছিল, অন্যজোটে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড, তুরস্ক ও সুইডেন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটে ১৭৫৬ সালে কূটনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। ১৭৫৬ সালে কূটনৈতিক বিপ্লবের কারণ ইউরােপের রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের গভীরে নিহিত ছিল। ১৭৪৮ সাল থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত এই বিপ্লবের পশ্চাতে যেসব কারণ বিদ্যমান ছিল সেগুলো হলো –

  • (১) এই.লা-শ্যাপেলের সন্ধির ক্রটি : কূটনৈতিক বিপ্লবের প্রধান কারণ ছিল এই লা-শ্যাপেলের সন্ধিতে স্বাক্ষরিত সকল পক্ষের অসন্তুষ্টি। (The year 1756 saw the break-up of an old system and the substitution of a new one. Austria and France laid aside the enmity of 200 years, ceased to be rivals, and formed an alliance which continued till the French Revolution, Austria broke off her long-standing connection with the maritime powers, while England found an ally in Prussia. ARTHUR HASSALL, The Balance of power. P. 208.) সন্ধিতে অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া উদ্ধার করতে পারে নি। ইংল্যান্ড তার দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ফ্রান্স যুদ্ধে প্রচুর অর্থ ও সৈন্য হারালেও তার প্রাপ্তি কিছুই ছিল না। যুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়া ইংল্যান্ডের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। সাইলেশিয়া ছাড়াও অস্ট্রিয়া ইতালিতে ভূখণ্ড হারিয়েছিল। অস্ট্রিয়া যুদ্ধে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। মেরিয়া থেরেসা ইংল্যান্ডের প্রতি ক্রদ্ধ হওয়ায় ইংল্যান্ডও বিরক্ত হয়ে মেরিয়া থেরেসাকে জানিয়েছিল যে, ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার সপক্ষে অস্ট্রিয়ার সৈন্য ছাড়া ডেটিনজেন (Dettingen) এবং ফোন্টিনয়ে (Fontenoy) যুদ্ধ চালিয়েছিল। অপরদিকে ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের পরামর্শ ছাড়াই বার্লিন ও ড্রেসডেনে সন্ধির সমালােচনা করেছিল। প্রাশিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযােগ এনেছিল।
  • (২) প্রাশিয়ার উত্থান : ১৭শ শতকে প্রাশিয়া ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে শক্তিসাম্য (Balance of power) ভেঙে পড়ে। প্রাশিয়া অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায়। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার আধিপত্য ধ্বংস করার জন্য প্রাশিয়াকে অস্টিয়ার বিরুদ্ধে মদদ দিতে শুরু করে। প্রাশিয়া অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল সাইলেশিয়া দখল করে নেয়। পূর্ব ইউরােপে তুরস্ক ও রাশিয়ার দ্বন্দ, উত্তর ইউরােপে সুইডেন ও পােল্যান্ডের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব সুইডেন ও পােল্যান্ডকে ফ্রান্সের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে যােগদানে প্ররােচিত করে। এদিকে জার্মানির হ্যানােভার অঞ্চল প্রাশিয়ার কবল থেকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সাথে ইংল্যান্ডের গােপন সমঝােতা হয়। ফলে ইউরােপে কূটনৈতিক বিপ্লবে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড ও তুরস্ক একপক্ষে আসে। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও পর্তুগাল একপক্ষভুক্ত হয়। 
  • (৩) মেরিয়া থেরেসা কর্তৃক সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের সংকল্প : অস্ট্রিয়ার শাসক মেরিয়া থেরেসা কর্তৃক সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের সংকল্প কূটনৈতিক বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল। ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দের পর অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সমঝােতার প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাশিয়ার ক্ষমতা হ্রাস ও প্রাশিয়াকে ব্যবচ্ছেদ করা। অপরদিকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে আমেরিকা ও ভারতে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব পারস্পরিক যুদ্ধের আবহ তৈরি করেছিল। মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার স্বার্থে রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রতাবদ্ধ ছিলেন। অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের নীতি অস্ট্রিয়ার মনঃপূত হয় নি। ১৭৪৯ সালে মার্চ মাসে মেরিয়া থেরেসা তার উপদেষ্টাদের লিখিতভাবে বৈদেশিক নীতির নতুন সম্পর্ক কী হওয়া উচিত তা জানাতে বলেন। প্রাচীনপন্থী উপদেষ্টারা পুরােনাে মৈত্রী নীতি অনুসরণ করতে মত দেন। কিন্তু যুবক মন্ত্রী এন্টন ওয়ানজেল ভন কৌনিজ (Anton wengel von kaunitz) মনে করেন, সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ড অপেক্ষা ফ্রান্সের সামরিক সমর্থন অপরিহার্য। এই পরামর্শ মন মত হয় মেরিয়া থেরেসার। কৌনিজের নীতি সমর্থন করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় পররাষ্ট্র দপ্তরকে।

এই কূটনৈতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি হলেন অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত কৌনিজ। কৌনিজের প্রকৃত নাম এন্টন ওয়ানজেল ভন কৌনিজ। তিনি ১৭১১ সালে ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা তাকে গির্জায় চাকরি নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। তার বয়ােজ্যেষ্ঠ চার ভ্রাতার মৃত্যু তার জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন করে দেয়। তিনি কূটনৈতিক বিষয়ে শিক্ষার জন্য ভিয়েনা, লিপজিক, লিডেন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি ষষ্ঠ চার্লসের সময় কূটনৈতিক পেশায় চাকরি নেন। তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইতালি, উত্তর জার্মানি এসব দেশ চাকরির পূর্বেই ভ্রমণ করেছিলেন। অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারী যুদ্ধের সময় তিনি রােম, তুরিন, ব্রাসেল প্রভৃতি দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। এইলা-শ্যাপেলের সন্ধির সময় তিনি অষ্ট্রিয়ার প্রতিনিধিদলে ছিলেন। তার মধ্যে খামখেয়ালি, বাবুগিরি প্রভৃতি দোষ ছিল। তার স্বাস্থ্য ভালাে ছিল না কিন্তু কূটনৈতিক জ্ঞানে তিনি শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করেছিলেন। গভীর দূরদৃষ্টি এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাকে সব সময়ের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিকে ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। মেরিয়া থেরেসার মতাে তিনিও সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য সদা ভাবতেন। এজন্য মেরিয়া থেরেসা তাকে পছন্দ করতেন।

ফ্রান্সের বংশানুক্রমিক শত্রুতা দূর করার জন্য কৌনিজ ১৭৫০ সালে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রান্সে যােগদান করেন। কিন্তু ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে সফল হন নি। ২৫০ থেকে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফ্রান্স তিনজন রাষ্ট্রদূত ভিয়েনায় প্রেরণ করে। এসব দতকে অস্ট্রিয়া সরকার আন্তরিকতার সাথে সংবর্ধনা দেয়। এসব দূত জানান যে, ফরাসি সরকার অস্ট্রিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চান। যতদিন ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার মিত্র থাকবে ততদিন ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার শত্রু প্রাশিয়ার সাথে মৈত্রী রাখতে বাধ্য হবে। কৌনিজ যদিও ফ্রান্সকে প্রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন নি তবুও ফরাসি রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সাথে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করেন এবং বোঝান যে, ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার বিশেষ কোনাে বিরােধ নেই। ইতােমধ্যে স্পেনের সাথে অস্ট্রিয়ার সম্পর্ক উন্নত হয় এবং ১৭৫২ সালে অস্ট্রিয়া ও স্পেন অরুণজুয়েজ চুক্তি স্বাক্ষর করে। অস্ট্রিয়ার ইতালীয় প্রদেশসমূহের অস্তিত্বকে গ্যারান্টি দিয়ে সার্ভিনিয়া, নেপলস ও পার্মা উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অপরদিকে রাশিয়ার এলিজাবেথ প্রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৭৫৩ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত একটি কাউন্সিলে বলেছিলেন, প্রাশিয়ার আগ্রাসী শক্তি রুদ্ধ করা এবং অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি ও ইংল্যান্ডের সহায়তায় প্রাশিয়াকে তার আদি সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। এদিকে ইংল্যান্ডের সাথে রাশিয়ার বন্ধুত্বের প্রধান কারণ ছিল জার্মানির হ্যানােভারের নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার সামরিক সহায়তা পাওয়া। কিন্তু এর জন্য রাশিয়াকে বার্ষিক দু লক্ষ পাউন্ড ও যুদ্ধের সময় আরাে অর্থ দান করতে হয়েছিল। বাণিজ্যিক কারণেও রাশিয়ার সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিল।

ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার সাম্প্রতিক সম্পর্ক এবং অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার গােপন চুক্তি সম্পর্কে ফ্রেডারিক অবহিত হন। ১৭৫৩ সালে ফ্রেডারিক মেঞ্জেল নামে একজন স্যাক্সন কেরানিকে উৎকোচ দিয়ে ১৭৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে সম্পাদিত অস্ট্রো-রুশ চুক্তির গােপন ধারাগুলাে হাত করেন। উইনগারটেন নামে বার্লিনের অষ্ট্রিয় দূতাবাসের একজন এটাশেকে ঘুষ দিয়ে ফ্রেডারিক অনেক গােপন তথ্য সম্পর্কে অবহিত হন। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া প্রাশিয়ার ধ্বংসের জন্য যে পরিকল্পনা করেছিল তার নথি হস্তগত করেন। এতে বলা হয়েছিল অস্ট্রিয়া বােহেমিয়াতে সৈন্য সমাবেশ করবে এবং প্রাশিয়ার আক্রমণে রাশিয়া সৈন্য পাঠাবে। ফ্রেডরিক এজন্য প্রয়ােজনীয় সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ায় রাশিয়া প্রাশিয়া আক্রমণ করে নি। এদিকে ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে প্রাশিয়া আক্রমণের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে। 

অপরদিকে আমেরিকা ও ভারতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বে প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক উদ্বিগ্ন হন। ফ্রান্সের নৌবাহিনী ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী অপেক্ষা দুর্বল হওয়ায় সমুদ্রে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সাথে প্রতিযােগিতায় পেরে ওঠে না, এতে ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে মহাদেশে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এ যুদ্ধ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্বে সীমিত থাকে। ফ্রেডারিক উপলব্ধি করেন যে, ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধে যােগদানের সাথে সাথে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া প্রাশিয়া আক্রমণ করবে। যদি ফ্রান্স সমুদ্রে নৌযুদ্ধে পরাজিত হয় তাহলে ইংল্যান্ড, হ্যানােভার, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও স্যাক্সনি প্রাশিয়া আক্রমণ করবে এবং তা প্রতিরােধ করা কঠিন হবে। ফ্রান্স প্রাশিয়াকে হ্যানােভার আক্রমণের পরামর্শ দিলেও তিনি হ্যানােভার আক্রমণ করেন নি এবং ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকার কৌশল নেন। ১৭৫৫ সালের জুলাই মাসে ফ্রেডারিক ফ্রান্সকে অস্ট্রিয় নেদারল্যান্ডস আক্রমণের আহ্বান জানালে ফ্রান্স দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। এদিকে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত ১৭৪১ সালের চুক্তির মেয়াদ ১৭৫৬ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার সাথে আলােচনা চালালেও ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ার চুক্তি বর্ধিত করার জন্য ফ্রান্স বার্লিনে প্রতিনিধি পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রতিনিধি পাঠাতে বিলম্ব হয়। এদিকে প্রাশিয়া উপলব্ধি করে যে, ফ্রান্স অপেক্ষা ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রতা প্রাশিয়ার জন্য নিরাপদ হবে। ফ্রেডারিক ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় ছিলেন।

ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের দ্বন্দ্বকে ফ্রেডারিক তাদের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব মনে করত। ১৭৫৫ সালে ফ্রেডারিক শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানালে ফ্রান্স এ বিষয়ে সন্তোষজনক সাড়া দেয় নি। ইতােমধ্যে প্রাশিয়া ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এজন্য ফ্রেডারিক ১৬৫৬ সালে ১৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের সাথে ওয়েস্টমিনস্টারের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধি দ্বারা ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া বিদেশী সৈন্যকে জার্মানির অভ্যন্তরে প্রবেশ অথবা জার্মানির ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে দেবে না। ইংল্যান্ড জার্মানিতে রুশ সৈন্য ব্যবহার করবে না; ফরাসি সৈন্য দ্বারা হ্যানােভার আক্রান্ত হলে ফ্রেডারিক হ্যানােভার রক্ষা করবেন। ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার এ চুক্তি অস্ট্রিয়াতে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। রাশিয়ার এলিজাবেথ ক্রুদ্ধ হন। ফ্রান্স এ চুক্তির কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়। এ অবস্থায় কৌনিজ তার পরিকল্পনাকে কাজে লাগান। তিনি ফ্রান্সের সাথে ১৭৫৬ সালের ১লা মে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল তিনটি চুক্তি – দুটি প্রকাশ্য ও একটি গােপন। প্রথম চুক্তি ছিল নিরপেক্ষ চুক্তি। এর দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্বে অস্ট্রিয়া নিরপেক্ষ থাকবে এবং ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার কোনাে ভূখণ্ড আক্রমণ করবে না। দ্বিতীয়টি ছিল প্রতিরক্ষা ও বন্ধুত্ব চুক্তি। বিদেশী শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে (ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্য চলমান যুদ্ধ ব্যতীত) একে অপরের ভূখণ্ড রক্ষা করবে। তৃতীয় চুক্তিতে পাঁচটি গােপন শর্ত ছিল। এতে বলা হয়েছিল যে, ইংল্যান্ডের যে কোনাে মিত্র দ্বারা ফ্রান্স আক্রান্ত হলে অস্ট্রিয়া তাকে সাহায্য করবে। (ARTHUR HASSALL. The Balance of power. P-208.)। পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে সেন্ট পিটার্সবুর্গে কনভেনশন দ্বারা রাশিয়া ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে পূর্বে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি গ্রহণ করে ও ১৭৫৭ সালের ১ মে স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় ভার্সাই চুক্তি সাক্ষর করে, যার দ্বারা ফ্রান্স প্রাশিয়ার ব্যবচ্ছেদে অস্ট্রিয়াকে একটি বার্ষিক সাবসিডি দিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বৃহৎ সেনাবাহিনী রাখতে সম্মত হয় ও বিনিময়ে ফ্রান্স নেদারল্যান্ডসের একাংশ পাবে। এই চুক্তি কূটনৈতিক বিপ্লবেরই একটি অংশ ছিল। (The Treaty of Westminster and the Treaties of Versailles introduced a new system into Europe ; England and Prussia, the two vigorous advancing powers, allied together against France and Austria, aided by the young pushing Russian nation.)।

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৮-৫৫)

ইউরোপে যখন নানান শক্তির পক্ষ বদলের মাধ্যকে কূটনৈতিক বিপ্লব চলছে, তখন ভারতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে শুরু হয় দাক্ষিণাত্যে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ। প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ ইংরেজ ও ফরাসী উভয় শক্তিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করে। তাঞ্জোরের ক্ষুদ্র রাজ্যে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইংরেজরা সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দে দেবীকোট্টাই অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে হায়দ্রাবাদের নিজাম আসফ ঝা মারা যান। তার মৃত্যুর পর হায়দ্রাবাদের নিজামের পদ গ্রহণ করেন তার দ্বিতীয় পুত্র নাসির জং। কিন্তু এ সময় নাসির জং-এর ভাগ্নে মুজাফফর জং হায়দ্রাবাদের সিংহাসনের দাবী উত্থাপন এবং ঘােষণা করেন যে, তিনি মুঘল সম্রাট কর্তৃক দাক্ষিণাত্যের সুবাদার পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ফলে হায়দ্রাবাদের সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। অপরদিকে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীন তার সিংহাসন সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ কর্ণাটকের প্রাক্তন নবাব দোস্ত আলীর জামাতা চাঁদ সাহেব কর্ণাটকের নবাব পদ লাভে আগ্রহী ছিলেন। শীঘ্রই উভয়ের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ডুপ্লে এই সুযােগে দাক্ষিণাত্যে প্রভাব বিস্তারের আশায় চাঁদ সাহেব এবং মুজাফফর জং-এর পক্ষ সমর্থন করেন এবং তাদের সঙ্গে একটি গােপন চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। ফলে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দের ৩ আগস্ট মুজাফফর জং, চাঁদ সাহেব এবং ফরাসী বাহিনী সম্মিলিতভাবে ভেলােরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত অম্বুরের যুদ্ধে কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীনকে পরাজিত করে হত্যা করে। এই যুদ্ধের পর আনােয়ারউদ্দীনের পুত্র মুহম্মদ আলী ত্রিচিনাপলিতে পলায়ন করেন এবং সেখানে ইংরেজদের আশ্রয় লাভ করেন। 

১৭৫০ খ্রীস্টাব্দে হায়দ্রবাদের নিজাম নাসির জং ফরাসী বাহিনীর হাতে নিহত হন। নাসির জং নিহত হলে ডুপ্লের প্রচেষ্টায় মুজাফফর জং হায়দ্রাবাদের নিজাম পদে অধিষ্ঠিত হন। কৃতজ্ঞ নিজাম ডুপ্লেকে কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে অবস্থিত যাবতীয় অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করেন। ফলে নিজামের দরবারে ফরাসী প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এভাবে ডুপ্লে চাঁদ সাহেবকে কর্ণাটকের সিংহাসনে এবং মুজাফফর জংকে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং সমরকুশলী হিসেবে স্বীয় প্রতিভার পরিচয় দেন। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে আততায়ীর হাতে মুজাফফর জং মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফরাসীরা মুজাফফর জং-এর তৃতীয় পুত্র সালবৎ জংকে হায়দ্রাবাদের নিজাম পদে অধিষ্ঠিত করেন। এ সময় চাঁদ সাহেব ফরাসী বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজ সমর্থনকারী মুহম্মদ আলীকে ত্রিচিনাপলিতে অবরােধ করেন। মুহম্মদ আলীকে সাহায্য করার জন্য একটি ইংরেজ বাহিনী ত্রিচিনাপলীতে হাজির হয়। শুরু হয় ত্রিচিনাপলী শহর দখলের জন্য দীর্ঘ ইঙ্গ-ফরাসী সংঘর্ষ। কিন্তু এ সময় দাক্ষিণাত্যে রবার্ট ক্লাইভ নামক একজন ইংরেজ বীরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি মাদ্রাজ কুঠির জনৈক অসামরিক কর্মচারী ছিলেন, যিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। 

সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে ক্লাইভ সামরিক ক্ষেত্রে তার প্রতিভা স্ফুরণের এক অপূর্ব সুযােগ পান। ক্লাইভ এ সময় (১৭৫১ খ্রীস্টাব্দেই) তড়িৎবেগে কর্ণাটকের রাজধানী আর্কট দখল করে নেন। ফলে ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলী দখলের ব্যাপারে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে পারল না। অতঃপর ক্লাইভ ত্রিচিনাপলী অবরোধ করে ফরাসী সেনাপতি জেকিস ল-কে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এভাবে ত্রিচিনাপলী দখলে ব্যর্থ ফরাসী বাহিনী শেষপর্যন্ত ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা চাঁদ সাহেবকে বন্দী করে হত্যা করে। ইংরেজদের সাহায্যে মুহম্মদ আলী কর্ণাটকের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ডুপ্লে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতেও ফরাসী গভর্নর ডুপ্লে পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। এক বছরেরও অধিককাল ধরে তিনি ইংরেজ সাফল্যকে প্রতিহত করার জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি ডুপ্লের সহায়ক ছিল না। ফ্রান্সের সরকার ক্রমশ তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছিল। সরকার তাকে ভুল বুঝে ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য থেকে অপসারণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়। ফলে তাকে স্বদেশে ফিরে যেতে হয়। ডুপ্লের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে ফরাসী প্রভাব ও ফরাসী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ডুপ্লের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর গডেহু পন্ডিচেরীর গভর্নর নিযুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তারই উদ্যোগে ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ফরাসী ও ইংরেজদের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে উভয় কোম্পানী ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে। ফরাসী কোম্পানীর আঞ্চলিক অধিকার বজায় থাকে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারতে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ডুপ্লের স্বপ্ন সফল হয়নি সত্য, কিন্তু ভারতের তার নীতি ছিল অভ্রান্ত। ডুপ্লের নীতি অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনে সফল হয়। প্রকৃতপক্ষে ডুপ্লের ব্যর্থতার জন্য তার ব্যক্তিগত ত্রুটি এবং সামরিক ভুল যে কিয়দাংশ দায়ী ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে তার ব্যর্থতার জন্য ফরাসী কর্তৃপক্ষও কম দায়ী ছিল না। ফরাসী সরকার তার পরিকল্পনা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন এবং তাকে সাহায্য না করে দেশে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে ডুপ্লে একজন ব্যর্থ নায়ক। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও তার স্বদেশ প্রীতি ও ফরাসী স্বার্থরক্ষার জন্য তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ সবাইকে মুগ্ধ করে। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা ডুপ্লের কৃতিত্বকে সব সময় খাটো করে দেখেন। কিন্তু অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিকও তার মহত্ত্ব ও অবদান অস্বীকার করতে পারেননি। P.E. Roberts ডুপ্লে সম্পর্কে বলেন, “In spite of his final failure, Duplex is a striking and brilliant figure in Indian history. For even if we give up the old uncritical estimate, we need not deny his real claims to greatness. His political conceptions were daring and imaginative. He raised the prestige of France in the East for some years to an amazing height, he won a reputation among Indian princes and leaders that has never been surpassed, and he aroused a dread in the English Contemporaries……” (History of British India, P: 118-19)।

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধও ভারতের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রথমত, এই যুদ্ধের ফলে কর্ণাটকে ফরাসী প্রাধান্যের অবসান ঘটে। দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজদের ক্ষমতা ও মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়ত, এই যুদ্ধ এটিই প্রমাণ করল যে, বিদেশীরা ভারতীয় শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং ভারতীয় শাসকশ্রেণী তাদের অস্তিত্বের জন্য ইউরােপীয়দের উপর অসহায়ভাবে নির্ভরশীল। কর্ণাটকের মুহম্মদ আলী ইংরেজদের এবং হায়দ্রাবাদের সালবৎ জং সম্পূর্ণরূপে ফরাসীদের অধীনস্তে পরিণত হয়।

ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষ-ব্যাপী সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩)

যুদ্ধের কারণ

১৮শ শতাব্দীর ইউরােপের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা ছিল সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (Seven years war)। অস্ট্রীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তিকারী এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধিতে প্রকৃতপক্ষে ইউরােপের অথবা ইউরােপের বাইরের সমস্যাসমূহের কোন সন্তোষজনক সমাধান হয়নি, কেবল যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল। এর দ্বারা ভারতবর্ষ কিংবা আমেরিকায় ইঙ্গ-ফরাসি বিরােধের মীমাংসা হয়নি। অপরদিকে, রাজ্যের কিছু অংশ হারিয়ে অস্ট্রিয়ার রানী মেরিয়া থেরেসা ইংল্যান্ডের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ফ্রেডারিক সাইলেশিয়া দখল করায় তার দুঃখের সীমা ছিল না। মেরিয়া থেরেসা এই সন্ধিকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি মনে করতেন। তিনি সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর হন ও ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার দু’শ বছরের বিরােধ মিটিয়ে মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন।

অপর পক্ষে, ফ্রেডারিক দি গ্রেট প্রাশিয়ার শক্তি ক্রমশই বৃদ্ধি করেছিলেন। প্রাশিয়ার আকস্মিক শক্তি বৃদ্ধিতে ফ্রান্স মেরিয়া থেরেসা ভীত হয়ে পড়েন। ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রাশিয়ার উথান শক্তিসাম্য বিনষ্ট করে এবং ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। ফলে অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স পুরাতন শত্রুতা ভুলে একত্রে সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মিলিত হয়। এ ছাড়া অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ফ্রেডারিকের স্বার্থপরতা ফ্রান্সের বিরক্তির কারণ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ফ্রেডারিক একাধিক বার নিজ স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মিত্রশক্তির মতামতের অপেক্ষা না করেই অস্ট্রিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ফলে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। স্পেনও তাদের সাথে যােগ দেয়। প্রাশিয়ার অভ্যুদয়ে রাশিয়াও নিজের সীমান্ত রক্ষার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাই রাশিয়ার পক্ষেও প্রাশিয়ার বিপক্ষে যােগ দেয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। তাছাড়া একদিকে রাশিয়ার রানী এলিজাবেথের ইউক্রেনের পরিবর্তে পূর্ব প্রাশিয়া দখলের ইচ্ছা ছিল, অন্যদিকে প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক রাশিয়ার জারিনা ক্যাথারিনকে উপলক্ষ করে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন, ফলে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এভাবে শক্তিশালী রাজ্যগুলাে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় ইউরােপের শক্তিসাম্য বিচলিত হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড তখন মিলিত হয় প্রাশিয়ার সঙ্গে। ছােট ছােট রাজ্যগুলাে সুবিধামত এদিকে ওদিকে যােগ দেয়। এরূপে আয়-লা-শ্যাপেলের সন্ধির পরবর্তী আট বছরের মধ্যে সমগ্র ইউরােপ মহাদেশ দুটি শত্রু শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুগপৎভাবে ইউরােপ, আমেরিকা, ভারতবর্ষ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পশ্চিম আফ্রিকা ও সমুদ্রে পুনরায় এক বিরাট রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হয়। এটাই সপ্তবর্ষের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ।

১৭৫৬ সালে ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স তাদের দু’শ বছরের বিবাদ ভুলে গিয়ে মিত্ৰতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অস্ট্রিয়া সামুদ্রিক শক্তিবর্গের সঙ্গে বহুকাল অনুসৃত মিত্রতা রক্ষার নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সঙ্গে সামুদ্রিক, বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রাধান্য আর দ্বন্দ্বের শেষ মীমাংসার জন্য প্রাশিয়ার সহিত মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইউরােপীয় শক্তিগুলাের পররাষ্ট্রনীতির এ আকস্মিক পরিবর্তনকে কূটনৈতিক বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই কূটনৈতিক বিপ্লব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ। ছিল। কূটনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে ইউরােপ দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল। ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, পর্তুগাল একপক্ষে থাকত। অপরপক্ষে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড, তুরস্ক ও সুইডেন এক শিবিরে জোটবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার মধ্যে ওয়েস্টমিনস্টারের মিত্রতা চুক্তি এবং অস্ট্রিয়া ও ফান্সের মধ্যে ভার্সাই চুক্তি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করে।

ইংল্যান্ড প্রধানত তার বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সপ্তবর্ষের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। আমেরিকা এবং ভারতবর্ষ উভয় স্থানেই ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে বাণিজ্যিক ঔপনিবেশিক স্বার্থের সংঘাত চলছিল। আমেরিকায় আটলান্টিকের তীর প্রদেশে তেরটি ইংরেজ উপনিবেশ ছিল। এদের সুনির্দিষ্ট কোন সীমান্ত ছিল না। এদের উত্তরে কানাডা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে লুইজিয়ানা ছিল ফরাসি উপনিবেশ। এই প্রসঙ্গে উত্তর আমেরিকায় তদকালীন কোন শক্তির ভাগে কোন কোন অঞ্চল ছিল তা একটু বলে নেই। বর্তমান কানাডার ম্যানিটোবা ও সাস্কাচিওয়েন এর কিছু অংশ, কুইবেক, অন্টারিও; ইউনাইটেড স্টেটস এর ডাকোটা টেরিটোরি, মিনেসোটা, আইওয়া, মিসৌরি, আরকানসাস, লুইজিয়ানা, উইসকন্সিন, মিশিগান, ইলিনয়েস, ইন্ডিয়ানা, ওহায়ো, কেন্টাকি, টেনেসির অর্ধেক, টেক্সাস ও পেনিসিলভানিয়ার কিছু অংশ, নিউ ইয়র্কের অর্ধেক ও মিসিসিপি ছিল আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ বা নিউ ফ্রান্সের অংশ। আগে কানাডার কুইবেক, ওন্টারিও, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড ও নোভাস্কোটিয়ার পুরোটাই ফ্রেঞ্চদের ছিল, কিন্তু উট্রেক্টের চুক্তির সময় ইংল্যান্ড নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের পুরোটা ও বাকি তিন অঞ্চলের কিছু একাংশ নিয়ে নিয়েছিল। স্পেইনের ভাগে দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল অঞ্চল ছিল, সেই আলোচনায় যাচ্ছিনা, উত্তর আমেরিকায় তাদের ছিল মেক্সিকো, ইউনাইটেড স্টেটসের টেক্সাসের বেশিরভাগ অংশ, ইউটাহ ও কলোরাডোর কিছু অংশ, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো, ফ্লোরিডা, সাথে আলাবামা ও জর্জিয়ার সামান্য অংশ, যা নিয়ে উত্তর আমেরিকার নিউ স্পেইন গঠিত হয়। এদিকে বর্তমান ইউনাইটেড স্টেটসের মেইন, নিউহ্যাম্পশায়ার, ভারমন্ট, ম্যাসাচুসেটস, নিউ জার্সি, রোড আইল্যান্ড, কানেক্টিকাট, ডেলাঅয়ার, মেরিল্যান্ড, ডিসি, ক্যারোলিনা (নর্থ ও সাউথ), ভার্জিনিয়া (ইস্ট ও ওয়েস্ট), জর্জিয়ার অর্ধেক, পেনিসিলভানিয়ার বেশিরভাগ অংশ ও নিউ ইয়র্কের অর্ধেক নিয়ে গঠিত ছিল ইংল্যান্ডের আমেরিকার উপনিবেশ বা নিউ ইংল্যান্ড, সাথে ইউট্রেক্টের চুক্তির ফলে বর্তমান কানাডার যে অংশগুলো তারা পেয়েছিল সেগুলোও ছিল। এই বর্ণনা থেকেই বুঝতে পারছেন উত্তর আমেরিকার কি বিশাল অঞ্চল জুড়ে ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ ছিল। এই তিন শক্তির মধ্যে ফ্রান্সই ছিল সবচেয়ে বড়, এটি এত বড় ছিল যে নিউ ফ্রান্সকে দুটো অঞ্চলে ভাগ করা হয় – কানাডা ও লুইজিয়ানা। বর্তমান কানাডায় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক অঞ্চল ছিল কানাডা আর বর্তমান ইউনাইটেড স্টেটসে এর ঔপনিবেশিক অঞ্চল ছিল লুইজিয়ানা। আয়তনের দিক দিয়ে ফ্রান্সের পর ছিল স্পেইন ও তার পর উত্তর আমেরিকার পূর্বাচঞ্চলের উপকুলীয় একটা অংশ নিয়ে ছিল নিউ ইংল্যান্ড। 

যাই হোক, এবারে ইংল্যান্ডের অধিকৃত স্থানগুলাে যাতে পশ্চিম দিকে আর বিস্তৃত হতে না পারে সে উদ্দেশ্যে ফরাসিরা ইংরেজ উপনিবেশগুলোর পশ্চাদবর্তী ও পশ্চিম অঞ্চলগুলাে দখল করে কানাডা ও লুইজিয়ানাকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করে। অ্যালেগ্যানি পর্বতমালা ও মেক্সিকো উপসাগরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে আবদ্ধ করে ইংরেজদের আমেরিকা ত্যাগ করতে বাধ্য করাই ছিল ফরাসিদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে তারা কানাডা ও লুইজিয়ানার মধ্যবর্তী স্থানে (মিসিসিপি) কতগুলাে সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের দুর্বল স্থানসমূহের দুর্গগুলােকেও সুরক্ষিত করতে আরম্ভ করে। অধিকন্তু তারা ব্রিটিশ নােভাস্কটিয়ার ফরাসি অধিবাসীদের তাদের ইংরেজ প্রভুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্য সম্ভাব্য সকল কৌশল প্রয়ােগ করে। ফান্স কর্তৃক এভাবে ইংরেজদের বাণিজ্য ও উপনিবেশ বিস্তারের পথ রুদ্ধ করার চেষ্টায় বাধা দান করা ইংল্যান্ডের পক্ষে আশু প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। এ জন্যই ইংল্যান্ডকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।

ভারতবর্ষেও একই কারণে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। এখানে দাক্ষিণাত্যে বােম্বাই ও মাদ্রাজ ছিল ইংরেজদের অধিকারে; আর বােম্বাইয়ের কাছে মাহে এবং মাদ্রাজের পাশে পণ্ডিচেরী ছিল ফরাসিদের অধিকারে। বাংলার কলকাতায় ছিল ইংরেজদের কুঠি, আর তারই সন্নিকটে চন্দননগরে ছিল ফরাসিদের কুঠি। সুতরাং ফরাসি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে দেরি হয়নি। প্রথম কর্ণাটক যুদ্ধে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে বিরোধিতার সূত্রপাত হয়েছিল আয়-লা-শ্যাপেলের সন্ধিতে এ বিরােধের প্রকৃত কোন মীমাংসা হয়নি, পরে আবার দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধও শুরু হয়। কিন্তু ১৭৫৫ সালে এদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্থাপন হলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপ ও আমেরিকায় যুদ্ধ শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ভারতবর্ষেও বিস্তৃত হয়। এরূপে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ইংল্যান্ডকে সপ্তবর্ষের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়।

এ ছাড়া ইউরােপের জার্মানীয় হেনােভার ছিল ইংরেজ রাজবংশের পিতৃভূমি। সুতরাং হেনােভারের নিরাপত্তা রক্ষা করা ইংল্যান্ডের জন্য খুব জরুরি ছিল। ইউরােপ মহাদেশে ইংরেজ রাজবংশের সম্পত্তি হ্যানােভারকে রক্ষা করাও ইংল্যান্ডের এ যুদ্ধে যােগদানের অন্যতম কারণ ছিল। সেই সাথে অস্ট্রিয়ার রানী মেবিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া উদ্ধারের আশায় প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স, রাশিয়া ও সুইডেনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করার পর ইংল্যান্ডের পক্ষে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারণ, হ্যানােভার ছিল প্রাশিয়ার প্রতিবেশী; আসন্ন যুদ্ধে তা প্রাশিয়া অথবা পশ্চিম দিকে ফ্রান্সকর্তৃক আড়াল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সুতরাং হ্যানােভারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডকে ফ্রান্স-অস্ট্রিয়ার প্রতিপক্ষ প্রাশিয়ার সঙ্গে যােগ দিয়ে সপ্তবর্ষের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইউরোপে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ

উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের পটভূমি রচিত হয় এবং ১৭৫১ সালে ফ্রেডারিক স্যাক্সনি আক্রমণ করলে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। অল্পকালের মধ্যের ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, সুইডেন ও স্যাক্সনি; অন্যদিকে পােল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধ ইউরােপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষ এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমেই ইউরােপীয় যুদ্ধ শুরু হয়। ফ্রেডারিক প্রথমে স্যাক্সনি আক্রমণ করেন এবং ১৭৫৬ সালে ড্রেসডেন দখল করেন। কিন্তু পরের বছর বােহেমিয়া আক্রমণ করতে গিয়ে কোলিনের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার নিকট পরাজিত হন। এমন সময় রাশিয়া পূর্ব প্রাশিয়া আক্রমণ করে। সুইডেন পােমেরেনিয়া নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করে। ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনী জার্মানিতে প্রবেশ করলে ফ্রেডারিক রসব্যাকের যুদ্ধে তাদের যুগ্ম বাহিনীকে পরাজিত করে। এরপর ফ্রেডারিক লিউথেনের যুদ্ধে অস্ট্রিয়া বাহিনীকে পরাজিত করে সাইলেশিয়া উদ্ধার করেন। উত্তর জার্মানিতে হ্যানােভারের ইংরেজ সৈন্য হ্যাসেনবেকের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীকে ফ্রেডারিক জর্ন ডরফের যুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু হচকাৰ্চ নামক স্থানে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার নিকট পরাজিত হন। ১৭৫৯ সালে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনীর নিকট কনসারডর নামক স্থানে ফ্রেডারিক পুনরায় পরাজিত হন। অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি দখল করে। একমাত্র হ্যানােভার অঞ্চলে প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে। ১৭৬০ সালে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনী বার্লিন দখল করে। কিন্তু ১৭৬২ সালের ৫ জানুয়ারিতে রাশিয়ার রানী এলিজাবেথের মৃত্যু হলে প্রাশিয়ার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। কারণ এরপর সিংহাসনে বসা রাশিয়ার শাসক তৃতীয় পিটার ছিলেন ফ্রেডারিকের বন্ধু। তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেই রাশিয়া প্রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ মিটিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় প্রাশিয়া বার্কাসডরফের যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে সাইলেশিয়া থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করে। ফলে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এটা গেল ইউরোপের প্রাশিয়া-অস্ট্রিয়া-রাশিয়ার দিকের যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে প্রাশিয়া কিছুতেই সফল হত না যদিনা ইংল্যান্ড তাকে সাহায্য করত। যুদ্ধের এই দিকটা জানার জন্য ইউরোপের সপ্তবর্ষের যুদ্ধের অন্য আরেকটা দিকে নজর দিতে হবে। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সপ্তবর্ষের যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের গতি প্রথম দিকে ইংরেজদের বিপক্ষে ছিল। ইংরেজদের একের পর এক পরাজয় বরণ করতে হয়। ফরাসিরা মিনর্কা অধিকার করে নেয়। প্রাশিয়া চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে পরাজয় স্বীকার করতে থাকে। সাগর পথেও বারবার ইংরেজদের পরাজয় ঘটে। ভূমধ্যসাগর ও পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফরাসি শক্তি প্রতিপত্তি লাভ করে। আমেরিকাতেও ইংরেজ শক্তি বিপর্যস্ত হয়। ইংরেজরা লুইসবার্গ, রচেফোর্ট এবং হ্যাস্টেনবেতে পরাজিত হয়। এডমিরাল বিং (Byng) মিনৰ্কা রক্ষা করার জন্য প্রেরিত হলে তিনি ফরাসি নৌ-বহরের নৈপুণ্য দেখে বিনা যুদ্ধে প্রত্যাবর্তন করেন। অপমান-ক্ষুব্ধ ইংরেজ জাতির দাবিতে বিং প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। প্রধানমন্ত্রী নিউক্যাসল পদত্যাগ করেন। দেশের এ দুর্দিনে উইলিয়াম পিট দি এল্ডার (বড় পিট) ইংরেজ জাতিকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেন।

এই প্রসঙ্গে উইলিয়াম পিটকে নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করা দরকার। উইলিয়াম পিট দি এণ্ডার বা বড় পিট ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইটনে লেখাপড়া করেন। লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি অশ্বারােহী বাহিনীতে যােগদান করেন। ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ওয়ালপোলের বিরােধী দলে যোগদান করেন। পিট ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ছিলেন। স্বাধীনচিত্ততা, নিষ্কলুষ চরিত্র, বাগ্মিতা ও অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তির প্রভাবে অল্পকালের মধ্যে তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং ক্রমে ওয়ালপােলের বিরােধী দলের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। কমন্সসভার ওপর তার অসাধারণ প্রভাব ছিল। তার বক্তৃতায় পার্লামেন্ট সদস্যগণ অভিভূত, মুগ্ধ ও সন্ত্রস্ত হতাে। তার প্রভুত্বব্যঞ্জক চেহারা ও বচন বিরােধীদের ভয়াভিভূত করত। তার সমসাময়িক জনৈক ব্যক্তি লিখেছেন, “তার কথা শুনে কখনও কখনও আমার তরুণ রক্তের চলাচল বন্ধ হয়ে যেত, আবার কখনও কখনও এটা আমার এবার মধ্য দিয়ে এত দ্রুত বেগে ধাবিত হতাে যে আমার পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ত।” এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা ছিলেন বড় পিট বা পিট দ্য এল্ডার। পেলহাম মন্ত্রিসভার আমলে রাজার বিরােধিতা সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীর বখশীর পদে নিযুক্ত হন। পেলহামের মৃত্যুর পর ১৭৫৪ সালে ডিউক অব নিউ ক্যাসল প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি বিরােধী দলে যােগদান করেন।

পিট তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সদগুণাবলির প্রভাবে তৃতীয় জর্জের রাজ্য প্রাপ্তি পর্যন্ত আপন প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রেখে স্বদেশের সেবা করে গেছেন। তার সততার জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন। তখনকার দিনে দুর্নীতির মধ্যে তিনি দুর্নীতি ও স্বার্থপরতা হতে মুক্ত থেকে সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পিটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তিনি দুর্নীতিপরায়ণ কমন্সসভার উপর নির্ভর না করে প্রত্যক্ষভাবে জাতির নিকট আবেদন করতেন বলে তাকে ‘শ্রেষ্ঠ জননেতা’ (The Great Commoner) বলে আখ্যায়িত করা হয়। পার্লামেন্ট অপেক্ষা জনসমর্থনের উপর তার শক্তি নিহিত ছিল। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ গণতান্ত্রিক মনােভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি ‘খােলা শাসন’ বা ‘সাধারণ পরােয়ানা’ (General warrant)-এর বিরােধিতা করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিডল সেক্স নির্বাচনে ভােটারদের মৌলিক অধিকার ও পার্লামেন্টের সংস্কারের পক্ষ সমর্থন করেন। এরূপে ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন প্রভৃতি কৃতিত্বপূর্ণ কার্যের জন্য বড় পিট ইংল্যান্ডের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছেন। তিনি অত্যন্ত অহঙ্কারী ছিলেন। হয়ত কখনও কখনও তার কথায় ও কাজে অসংলগ্নতা দেখা যেত, তবু তিনি সে যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। 

পিট উপলব্ধি করেছিলেন যে, কেবল ইউরােপে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করলেই ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না, সে জন্য ইউরােপের বাইরেও তার মর্যাদা ও অধিকার বৃদ্ধি করতে হবে। তাই তিনি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সপ্তবর্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হলে বৈদেশিক ব্যাপারে ইংল্যান্ডকে বিপদ ও অবমাননার সম্মুখীন হতে হয়। মিনৰ্কা ইংরেজদের হস্তচ্যুত হয়; ভূমধ্যসাগর ও পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফরাসি শক্তি প্রতিপত্তি লাভ করে। আমেরিকাতেও ইংরেজ শক্তি বিপর্যস্ত হয়। দেশেও তখন গুরুতর অশান্তি। এরূপ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নিউক্যাসল একা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে না পেরে পদত্যাগ করেন এবং ১৭৫৭ সালে পিট-নিউক্যাসল যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। নিউক্যাসল স্বরাষ্ট্র দপ্তরের যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে এবং পিট সমর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরূপে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এক দুর্যোগময় সময়ে পিট ইংল্যান্ডকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সদর্পে ঘােষণা করেন, “আমি নিশ্চিত জানি যে, আমিই দেশকে রক্ষা করতে পারি, আর কেউ পারেন না।” ১৭৫৭ সালে সমর মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে পিট উদ্যমের সাথে যুদ্ধ পরিচালনায় আত্মনিয়ােগ করেন। তার চেষ্টায় যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে যায়।

উপযুক্ত সামরিক কর্মচারী নিয়োগ, নিখুঁত সমর পরিকল্পনা রচনা করা এবং সেগুলােকে ধৈর্য সহকারে ও নিপুণভাবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে তিনি অদ্ভুত দক্ষতা প্রদর্শন করেন। আমেরিকায় প্রচুর পরিমাণে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জামাদি প্রেরণ করা, ফরাসিরা যাতে আটলান্টিকের অপর তীরে সৈন্য প্রেরণ করতে না পারে সে জন্য ফরাসি বন্দরগুলাে অবরােধ করা, ফরাসি উপকূলভাগ আক্রমণ করা, তাদের ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে হ্যানােভারে পর্যাপ্ত সৈন্য রাখা এবং প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিককে সর্বোতভাবে সাহায্য করা ইত্যাদি তার সমর নীতির ও কৌশলের প্রধান অঙ্গ ছিল। অধিকন্তু ফ্রান্সের সামরিক শক্তিকে যতদূর সম্ভব ইউরােপের মধ্যে ব্যস্ত রেখে নিঃশেষ করাই তার সমর নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাই তিনি বলেছেন, “আমরা এলব নদীর তীরে কানাডা জয় করব।” এ কারণে তিনি প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক দি গ্রেটকে প্রচুর পরিমাণ সাহায্য করেন এবং হ্যানােভার ও প্রাশিয়ার পশ্চিম ভাগ রক্ষা করার জন্য ব্রুন্সউইকের ফার্দিনান্দের অধীনে জার্মানিতে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রান্সের উপকূলে সময়ে অসময়ে সৈন্য প্রেরণ করে আক্রমণ চালানো হয়। এ সমস্ত আক্রমণ সর্বক্ষেত্রে খুব কার্যকর না হলেও এর ফলে ফরাসিদের সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকতে হতাে। পিটের হিসেব মতে ত্রিশ হাজার ফরাসি সৈন্যকে বিদেশে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের পরিবর্তে স্বদেশে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়। সেই সাথে ইংল্যান্ড থেকে যুগপৎভাবে ভারতবর্ষ ও আমেরিকায় নৌবহর প্রেরিত হয় ও ফরাসি বন্দরসমূহ অবরােধ করা হয়।

পিটের দূরদর্শী সমরনীতি ইংল্যান্ডের পক্ষে অত্যন্ত কল্যাণকর ছিল। ইংল্যান্ডের সাহায্যে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স ও সুইডেনের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে প্রাশিয়াকে রক্ষা করতে সক্ষম হন এবং সে সঙ্গে ইংল্যান্ডের হ্যানােভার রাজ্যটি রক্ষা পায়। ফরাসিরা দেশরক্ষা ও ইউরােপীয় সমরে সাফল্য অর্জনে জন্য ক্রমেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে; তারা আমেরিকায় কিংবা ভারতবর্ষে উপযুক্ত সৈন্য ও সাহায্যাদি প্রেরণ করার সুযােগ পায়নি। এ সুযােগে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালিয়ে একটার পর একটা ফরাসি উপনিবেশ দখল করে নেয়। ফ্রান্সের ভারতীয় কুঠিগুলাে এবং আফ্রিকার সেনেগাল ও গােরী ইংল্যান্ডের হস্তগত হয়। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য, ইংল্যান্ড এ যুদ্ধে ফরাসিদের কাছ থেকে কানাডা জয় করে দেয়। এভাবে যে যুদ্ধ ইংল্যান্ডের পক্ষে আশঙ্কাজনকভাবে আরম্ভ হয়েছিল, পিটের সুদক্ষ পরিচালনায় গৌরবময় বিজয়ের দ্বারা তার পরিসমাপ্তি হয়। এরূপে একমাত্র তিনিই ইংল্যান্ডকে রক্ষা করতে পারেন বলে পিট যে গর্ব করেছিলেন তার সার্থকতা প্রমাণিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি যে কলা-কৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন তার জন্য তিনি ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরমন্ত্রী বলে খ্যাতিলাভ করেছেন। এভাবে তিনি সপ্তবর্ষের যুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়া ইংল্যান্ডকে তার দুর্যোগময় সময়ে তিনি সগর্বে রক্ষা করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধের গতি ইংল্যান্ডের অনুকূলে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন।

১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংরেজদের জয়যাত্রা শুরু হয়। বসকাওয়েন কেপব্রেটনে লুইসবার্গ জয় করেন। দু’কেশন দুর্গ অধিকৃত হওয়ায় লুইজিয়ানা ও কানাডার সংযোগ ছিন্ন হয়। ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দ ছিল ইংল্যান্ডের পক্ষে বিজয়ের বছর। ঐ বছরে এডমিরাল হুক (Hauke) এক নৌ-যুদ্ধে ফরাসিদের পরাভূত করেন। লেগােস ও কুইবেরন বে’তে ব্রিটিশ নৌ-বহর ফরাসি নৌ-বহরকে পরাজিত করে। আমেরিকায় এভাবে প্রথম দিকে ফরাসিদের সাফল্য লাভ হলেও শেষের দিকে কুইবেক মন্টরিয়েলের যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের ফলে কানাডায় ফরাসিদের প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় ও কানাডা দ্রুত বিজিত হয়। এদিকে ইউরােপের রণক্ষেত্রে ফ্রেডারিক ইংল্যান্ডের অর্থ সাহায্যে সৈন্য সংগ্রহ করে স্বীয় প্রতিভা বলে একে একে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সকে পরাজিত করেন। ভারতবর্ষে রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। দাক্ষিণাত্যেও ইংরেজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে কর্ণেল কুট বন্দিবাসের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। পরের বছর ১৭৬১ খ্রি. সালে পণ্ডিচেরী ইংরেজদের হস্তগত হয়। ফলে দাক্ষিণাত্য হতে ফরাসি প্রাধান্য চিরদিনের মত বিলুপ্ত হয়। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে পিট যে কলা-কৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন সে জন্য তিনি ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর মন্ত্রী বলে খ্যাতিলাভ করেছেন। ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী ভবিষ্যতের লক্ষ্য অর্জনের পথে তার অবদান কম ছিল না। সপ্তবর্ষের সমরে ইংল্যান্ডকে জয়ী করে তিনি ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ বন্ধ করেন এবং ভারতবর্ষ ও আমেরিকা মহাদেশে ইংরেজ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। তারই সুদক্ষ নেতৃত্বে ইংরেজ শক্তি আমেরিকা, ভারতবর্ষ এবং ইউরােপ সর্বত্রই প্রাধান্য লাভ করে এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঔপনিবেশিক ও সামুদ্রিক শক্তিতে পরিণত হয়।

এদিকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ হতেই ইউরােপে সন্ধি ও শান্তি স্থাপনের চেষ্টা চলছিল। ঐ বছর রাজা দ্বিতীয় জর্জের মৃত্যু হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় জর্জ সিংহাসনে আরােহণ করতে তার সাথে পিটের মতানৈক্য হয়। তৃতীয় জর্জের অভিষেকের পরেই পিট স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু রাজা তৃতীয় জর্জ ও ক্যাবিনেটের সাথে মতানৈক্য হয়, আর তার প্রস্তাব গৃহীত হয়না, ফলে পিট ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করেন। এরপর তৃতীয় জর্জের প্রিয়পাত্র বুট প্রধানমন্ত্রী হন। তার শান্তি স্থাপনের ইচ্ছা ছিল; কিন্তু তিনি বিজয় সফলকাম হননি। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে মার্টিনিক, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট, গ্রেনেডা, কিউবার রাজধানী হাভানা এবং ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ম্যানিলা ইংরেজদের হস্তগত হয়। অতঃপর রণক্লান্ত ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলাে সন্ধির জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্যারিসের সন্ধি দ্বারা সপ্তবর্ষের যুদ্ধের অবসান হয়।

ভারতবর্ষে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ : তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩)

১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও শান্তিচুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইংরেজ ও ফরাসী কোন পক্ষই পারস্পরিক বিরােধিতা ত্যাগ করেনি। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে ইউরােপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩) শুরু হলে ভারতে পুনরায় ইংরেজ ও ফরাসীগণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, ভারতে ইঙ্গফরাসী দ্বন্দ্ব আবার নবজীবন লাভ করে। কিন্তু এবার বাংলা ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্বের প্রধান ক্ষেত্র। বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিরা দুর্গ সুরক্ষিত করতে থাকলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাদেরকে দুর্গ তৈরি করতে নিষেধ করেন। ফরাসিরা নবাবের আদেশ মানলেও ইংরেজরা অগ্রাহ্য করে। ফলে নবাব ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের নিকট থেকে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটি দখল করেন। কিন্তু ক্লাইভ ও ওয়াটসন সেটি পুনরুদ্ধার করেন। এরপর ক্লাইভ সপ্তবর্ষের যুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতে ফরাসীদের শক্তি ধ্বংস করার জন্য চন্দননগর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদেরকে তার রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু নবাবের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ক্লাইভ ও ওয়াটসন ২৩ মার্চ ফরাসী বাণিজ্য কুঠি চন্দননগর আক্রমণ করেন এবং দখল করেন। চন্দননগর আক্রমণ করলে নবাব ফরাসীদের কোন সাহায্য না করে ভুল করেন। চন্দননগরের পতনের পর সিরাজের পতনও আসন্ন হয়ে পড়ে। চন্দননগর পতনের ফলে বাংলায় ফরাসী শক্তি দুর্বল হয়ে গেলে ইংরেজদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সংঘর্ষে নবাব ফরাসীদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে পলাসীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ক্লাইভ বাংলায় ইংরেজ প্রভুত্ব স্থাপন করেন। ইংরেজরা বাংলায় প্রভূত্ব স্থাপন করলে তা তৃতীয় কর্ণাটিক যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়কে নিশ্চিত করে দেয়। কারণ বাংলা থেকে ইংরেজরা যখন খুশী অর্থ ও সৈন্য মাদ্রাজে প্রেরণ করতে পারত, এর সামরিক গুরুত্ব ছিল প্রচুর।

১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে ফরাসী কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য কাউন্ট লালিকে (Count Lally) পন্ডিচেরীর গভর্নর করে ভারতে পাঠান। ভারতে ফরাসী কোম্পানীকে শক্তিশালী করবার অভিপ্রায়ে এ সময় ফরাসী সরকার এক বিশাল বাহিনীও ভারতে প্রেরণ করেন। ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দের ২রা জুন ফরাসীরা ইংরেজদের কাছ থেকে সেন্ট ডেভিড দুর্গ দখল করে নেয়। এরপর ফরাসী সেনাপতি বুসি হায়দ্রাবাদের “উত্তর সরকারের অন্তর্গত” বিশাখাপত্তম সহ চারটি ইংরেজ ঘাটি দখল করেন। এরপর লালি মাদ্রাজ আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি সমগ্র ফরাসী বাহিনীকে একত্রিত করেন এবং বুসীকে হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন। এটি ছিল গভর্ণর লালির একটি ভুল সিদ্ধান্ত। হায়দ্রাবাদ থেকে লালির প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা বাংলা থেকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই রাজমাহেন্দ্ৰী, মসলিপট্টম প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেয়। ইংরেজ কোম্পানী হায়দ্রাবাদের নিজাম সালবৎ জং-এর সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে দাক্ষিণাত্যে ফরাসী প্রভাব হ্রাস পায়। ফরাসীরা ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে মাদ্রাজ অবরােধ করলে মাদ্রাজের ইংরেজ শাসনকর্তা পিগট ও সেনাপতি লরেন্স যুগ্মভাবে ফরাসীদের বাধা দেয়। ইতােমধ্যে একটি ব্রিটিশ নৌবহর মাদ্রাজে এসে পৌঁছলে লালি মাদ্রাজের অবরােধ তুলে নিতে বাধ্য হন। ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে ২২ জানুয়ারি ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ ‘বন্দিবাসের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। বন্দিবাসের এই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি স্যার আয়ারকুটের কাছে ফরাসী বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের তিন মাসের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ অঞ্চল ফরাসীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ইংরেজ বাহিনী পন্ডিচেরী অবরোধ করে লালিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের অপর দু’টি ফরাসী ঘাঁটি মাহে এবং জিঞ্জি ইংরেজ শক্তির হস্তগত হয়। এভাবে ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের সব স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। ভারতে উপিনবেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই শেষ হাসি হাসে। ১৭৬৩ খ্রীস্টাব্দে প্যারিস শান্তি চুক্তি দ্বারা সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটলে ভারতীয় উপমহাদেশেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তিতে ফ্রান্স ইংরেজদেরকে চন্দননগর, মাহে, পণ্ডিচেরী, কারিকল ও জিজ্ঞি – এই পাঁচটি স্থান ফিরে পেলেও ফরাসি অধিকৃত কোনাে স্থানে দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা হবে না – এই শর্ত ফ্রান্সকে দিতে হয়েছিল।

উত্তর আমেরিকায় সপ্তবর্ষ যুদ্ধ

উপনিবেশ বিস্তারের প্রতিদ্বন্দিতা সবচেয়ে সঙ্কটজনক রূপ নেয় উত্তর আমেরিকায়। সেখানে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ ফ্রেঞ্চ-ইণ্ডিয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিত ছিল। ইউরােপে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকায় ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত সবচেয়ে সঙ্গতভাবেই তা উপনিবেশ বিস্তারের মহাযুদ্ধ (দি গ্রেট ওয়ার ফর এমপায়ার) নামে অভিহিত। এই লড়াইয়ের ফলে ফরাসীরা উত্তর আমেরিকা থেকে বিতাড়িত হয়।

উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মূলত একই জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হত। ব্রিটিশরা তাদের আশ্রিত, যুদ্ধংদেহী ইরােকী ইণ্ডিয়ানদের মাধ্যমে ওহায়ো উপত্যকা এবং সেন্ট লরেন্স নদীর উজানের ভূখণ্ডের ওপর অধিকার দাবী করে। ওদিকে ফরাসীরা প্রথম আবিষ্কারের যুক্তিতে পশ্চিম নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভ্যানিয়া এবং ভার্জিনিয়ার বেশীর ভাগ এলাকার মালিকানা তাদের বলে দাবী জানায়। বিস্তীর্ণ উর্বর ভূখণ্ড এবং সেই সঙ্গে বিপুল কাঁচা চামড়ার সম্পদ ছিল এই বিবাদের কারণ। যে কোন যুদ্ধে ফরাসীদের একটা সুবিধা ছিল। তাদের সরকার এবং সামরিক কম্যান্ড পরিচালনায় ক্ষমতার ভাগাভাগি ছিল না। পশ্চিম দিকে সব কটি গুরত্বপূর্ণ যােগাযােগ পথে অবস্থিত প্রধান দগলাে ছিল তাদের দখলে। ইণ্ডিয়ানদের বেশীরভাগই ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু তাদের লােকসংখ্যা ছিল কম, বসতিগুলাে ছিল অনেক দুরে দুরে অবস্থিত এবং বাসিন্দাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল যাযাবর ধরনের, গৃহস্থ পরিবার নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলাে যেসব রাজনৈতিক ইউনিটের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে মতের কোন মিল ছিল না। এদের জোড়াতালি একতাব্দধ রেখেছিলেন একজন রাজা, যিনি বাস করতেন তিন হাজার মাইল দূরে এবং এদের সামরিক ব্যাপারে যার নিয়ন্ত্রণ ছিল শিথিল। এই উপনিবেশগুলাে অভিন্ন কোন লক্ষ্য অর্জনে পরস্পরের সহযােগিতা করেছে এমন কোন নজীর নেই এবং টাকা-কড়ি, লােকলস্কর সরবরাহের জন্যে খােসামােদ করে, মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে এদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে রাজী করাতে হত। সামরিক দিক দিয়ে কেন্দ্রায়ত্ব নিয়ন্ত্রণের এই অভাব ছিল তাদের সবচেয়ে গুরুতর দুর্বলতা, কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের এই অভিজ্ঞতার কোন দাম ছিল না তাই বা কী করে বলা যাবে? রাজকীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আর একটা সম্ভাব্য এটি ছিল এই যে, ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের মধ্যে ঔপনিবেশিক সৈনিকদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের মনােভাব পােষণ করার একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হত; যার ফলে আমেরিকানদের যেসব বৈশিষ্ট্য যুদ্ধে খুবই কাজে লাগতে পারতাে, তার পরিপূর্ণ সুযােগ তারা নিতেন না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিপুলে সংখ্যাধিক্য এসব দুর্বলতা পুষিয়ে দেয়। ফরাসী ঔপনিবেশিকদের তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশী। ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর শক্তি তখন সারা দুনিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। সেটাও ছিল একটা মহামূল্যবান সম্পদ। ফরাসী সমর্থক ইণ্ডিয়ানদের তুলনায় এদের মিত্র ইরােকী ইণ্ডিয়ানরা ছিল বহুগুণে বেশী শক্তিসম্পন্ন। এবং সবশেষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বেসামরিক নেতৃত্ব ছিল এক কথায় অতুলনীয়।

নতুন দুনিয়ায় চারটি এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভৌগােলিক অবস্থান মিলিতভাবে সেগুলােকে রণাঙ্গনে পরিণত হতে সহায়তা করে। এগুলি হচ্ছে নিউ ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত, লেক শ্যাম্পলেনের সঙ্গে সংযােগ রক্ষাকারী সরু ভূখণ্ড, ওহায়াে নদীর উৎস এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা ইউরােপের যে কোন জায়গায় এ যুদ্ধে সূচিত হতে পারতাে। কিন্তু ঘটনামে যুদ্ধের সূচনা হয় ওহায়াে নদীর উজানের ভূখণ্ডে, যখন ভার্জিনিয়ার গভর্নর তার বর্তমানের পিটসবার্গ এলাকা ছেড়ে ফরাসীদে চলে যেতে তাদের হুশিয়ার করে দেবার জন্য আধা সামরিক বাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসার জর্জ ওয়াশিংটনকে পাঠান। ফরাসীরা চলে যেতে অস্বীকার করল, একের পর এক ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমশ ঘােলাটে করে তুললাে, এবং অবশেষে পাশ্ববর্তী জঙ্গলে ছােটখাট দুটি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে লড়াই বেঁধে উঠলাে। অচিরেই সারা দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়লাে। একমাত্র ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোন জায়গাতেই ব্রিটিশরা সুবিধা করতে পারলাে না। গােড়ার দিকে ব্রিটিশ পরাজয়গালাের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমেরিকায় ব্রাডকের সেনাবাহিনীর নিধনের ঘটনা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। আমেরিকার অন্য সবখানে এবং সেই সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ও ইউরােপেও ব্রিটিশদের শােচনীয় ও  অপমানজনক পরাজয় বরণ করতে হয়।

পরাজয়ের এই নিম্নমুখী স্রোতকে বিজয়ের জোয়ারে রপান্তরিত করার জন্যে অন্য যে কোন কারণের চাইতে অধিকতর গুরত্বপূর্ণ যে কারণটি এককভাবে দায়ী তা হচ্ছে একা একজন মানুষের প্রতিভা। তার নাম উইলিয়াম পিট। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকারে প্রবেশ করার পর তিনি বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যুদ্ধ পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের হাতে গ্রহণ করেন। একা একটা লােকের পক্ষে যতটা সম্ভব, এ বিজয়ের কতিত্ব সম্পূর্ণ তার একার। সামরিক পরিচালনা ব্যবস্থাকে একক সংগঠনের অধীনস্থ করার মাধ্যমে দুনিয়া জোড়া রণাঙ্গনে সেনাপতিদের পরিচালনার ভার তিনি নিজের হাতে তুলে নেন। বিংশ শতাব্দীর পাঠক আজও তার নির্দেশাবলীর মধ্যে খুঁজে পান প্রজ্ঞা আর বলিষ্ঠতার ছাপ। তিনি বেছে নেন যােগ্যতাসম্পন্ন এমন সব তরণ সেনাপতিকে, আক্রমণ ঠেকানাের বদলে যাদের জয় করার ক্ষমতা ছিল সুবিদিত। তার এই সব ক্রিয়াকলাপ দায়িত্বশীল অফিসারদের মনােবল বহুলাংশে বর্ধিত করে। তার পরিকল্পনা, তার অনুসৃত নীতি এবং তার মেধাসম্পন্ন সুযােগ্য স্থল ও নৌ-সেনাপতিদের সমাহারের দ্বারা সূচিত হয় অসাধারণ চমকপ্রদ সামরিক জয়ের মিছিল, নেপােলিয়ানের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক ইতিহাসে যার কোন নজীর নেই। এই বিজয়েরই নিশান হয়ে বিশ্বের প্রতিটি কোণায় সগর্বে উড়তে থাকে ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক। ১৭৫৯ সালে জেনারেল উলফ আমেরিকায় কুইবেক অধিকার করেন। তিনি এ যুদ্ধে আহত হয়ে অনতিকাল পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিন্তু তার কুইবেক বিজয় কানাডায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে, আর উত্তর আমেরিকায় ফরাসি সাম্রাজ্যের সমাধি স্থাপন করে। 

১৭৬৩ সালে প্যারিসের সন্ধি এবং সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলােচনায় ব্রিটেনের এই বিজয়কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ফ্রান্স উত্তর আমেরিকার ভূখণ্ড থেকে বিদায় নেয়। ইংল্যান্ড নিউ ফ্রান্সের কানাডা নিয়ে নেয় আর স্পেইন নিয়ে নেয় নিউ ফ্রান্সের লুইজিয়ানার বেশিরভাগ অংশ। অন্যভাবে বললে মিসিসিপির পূর্বাঞ্চলে তার জমিজমা যা ছিল, তা ব্রিটেনের দখলে চলে যায়, আর ওদিকে মিসিসিপির পশ্চিমাঞ্চল লাভ করে তারই বিপর্যস্ত মিত্র এবং এই লাঞ্ছনায় তার সমভাগী স্পেইন। এই বিজয়ের ফলে ব্রিটিশ সামাজ্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।

যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ও ইংল্যান্ডের জয়ের কারণ

সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ও ইংল্যান্ডের জয়ের অন্যতম কারণ ছিল তাদের রাজনৈতিক কাঠামো। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের রাজনীতি এদের শাসনপদ্ধতির অনেক কিছুকেই নির্ধারিত করে দেয় যা সপ্তবর্ষের যুদ্ধে সরাসরি প্রভাব ফেলে। ফ্রান্স স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হত। ফ্রান্সে তৃতীয় শ্রেণী বা সাধারণ জনমতের কোন মূল্য ছিলনা। অপরপক্ষে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী ছিল, সেখানে পার্লামেন্ট ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। ইংরেজদের পার্লামেন্টে পুঁজিপতিদের একটি শক্ত অবস্থান ছিল। তাই এই পার্লামেন্ট ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্বার্থ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিল। ইংরেজ কোম্পানী ছিল একটি প্রাইভেট কোম্পানী, ফলে তা ছিল স্বায়ত্বশাসিত, এরা তাদের সিদ্ধান্তের উপর ইংল্যান্ডের সরকারের উপর নির্ভর করত না। ১৬০০ খ্রীস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে সনদ লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ভারতে আগমন করে। ভারতে তাদের প্রথম ও প্রধান পেশা যে ব্যবসা তা ইংরেজ জাতি কখনই বিস্মৃত হয়নি। কোম্পানীর কর্মচারীরা ভালভাবেই জানতেন যে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই কোম্পানীর স্থায়িত্ব সম্ভব, অন্যথায় পতন অনিবার্য। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কারণেই ইংরেজ কোম্পানী দিনে দিনে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। তারা রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং সরকারকে মােটা টাকা ধার দিত। অন্যদিকে ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল সম্পূর্ণভাবে ফরাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে কোম্পানী স্বাধীনভাবে কোন নীতি নির্ধারণে সক্ষম ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই ফরাসী সরকারের সিদ্ধান্তের উপর তাদের নির্ভর করতে হত।

১৮শ শতাব্দীতে ইংরেজরা ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল। শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পপণ্যের বাজার তৈরির জন্য ইংরেজরা সচেষ্ট ছিল। এজন্য বাণিজ্য সবসময়ই কোম্পানির কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ফ্রান্সে তখনও শিল্পবিপ্লব ঘটেনি, এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্র থাকায় সেখানে পুঁজিপতিদের ক্ষমতা ও বাণিজ্য ইংল্যান্ডের মত অত বৃদ্ধি পায়নি। ইংরেজদের মধ্যে যেরকম বাণিজ্য ও মুনাফার চেতনা ছিল তা ফরাসিদের মধ্যে ছিলনা। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখি ডুপ্লে ফরাসী কোম্পানীর আর্থিক সমৃদ্ধি উপেক্ষা করে সামরিক আদর্শ গ্রহণ করেন। এর ফলে কোম্পানীর আর্থিক স্বচ্ছলতা বিনষ্ট হয় এবং মুনাফার পরিবর্তে কোম্পানী ফরাসী সরকারের কাছে বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী সরকারের কাছ থেকে প্রয়ােজনীয় অর্থ সাহায্য না পাওয়ায় ডুপ্নে তার বিশাল পরিকল্পনা কার্যকর করতে ব্যর্থ হন। বাণিজ্যিক চেতনার দৌলতেই ইংরেজরা স্থানীয় উৎস থেকে অর্থ ও সামরিক শক্তি সংগ্রহ করে তা ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযােগ পেয়েছিল। বিশেষ করে ভারতে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইংবেজরা বাংলার অর্থসম্পদ ও সামরিক শক্তি ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযােগ পেয়েছিল। তাদের দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের সাফল্য লাভের ক্ষেত্রটি তৈরী হয় ১৭৫৭ সালে বাংলায় পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজরা সমৃদ্ধশালী বাংলায় তাদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। বাংলা থেকে ইংরেজরা যখন খুশী অর্থ ও সৈন্য মাদ্রাজে প্রেরণ করতে পারত। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধই প্রকৃতপক্ষে ভারতে ফরাসীদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিয়েছিল। “The battle of plassey may be truely said to have decided the fate of the French in India.”। অন্যদিকে ফরাসিদের মধ্যে এরকম বাণিজ্যিক ও মুনাফার চেতনা সেভাবে কাজ করেনি। তারা ভারতবর্ষ থেকেই মুনাফা অর্জন করে ভারতবর্ষে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিল। অর্থ ও সামরিক সাহায্যের জন্য তাদেরকে সব সময় নিজ দেশ ফ্রান্সের দিকে চেয়ে থাকতে হতাে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ফরাসিরা দেশীয় রাজন্যবর্গের অনিশ্চিত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল, আর এটা করেই তারা মারাত্মক ভুল করেছিল। মহীশূরের হায়দার আলী ফরাসীদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করলেও নিজ রাজ্যে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে ফরাসী শিবির থেকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। অন্যদিকে ইংরেজগণ সামরিক সাহায্যের জন্য দেশীয় নৃপতিদের ওপর মােটেই নির্ভরশীল ছিল না।

এখানে জাতীয়তাবাদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পবিপ্লব, বাণিজ্যের প্রসার ও মনন, রাজতন্ত্রের ক্ষমতা হ্রাস – এসবের কারণেই ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক স্বার্থ ছিল ইংরেজদের জাতীয় স্বার্থের দ্বারা প্রণােদিত। তাই ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে এক করে দেখত। কিন্তু ফরাসি উপনিবেশগুলাে রাজকীয় স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতীয় স্বার্থে উপনিবেশগুলাে গড়ে না ওঠায় ফরাসি বণিকরা এগুলাে রক্ষার জন্য ইংরেজদের ন্যায় নিজ উদ্যোগে অর্থ ব্যয় করত না। কোম্পানি নিশ্চিতভাবেই বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, আর বাণিজ্যে উন্নতি করার জন্য নিশ্চিতভাবেই বাণিজ্যিক যথেষ্ট স্বাধীনতা ও মুনাফালাভের মনন থাকতে হয়, ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে এগুলো তো ছিলই না, সাথে কোম্পানির কাঠামোও ছিল যথেষ্ট দুর্বল। সেই সাথে রাষ্ট্রের কাছেও এই কোম্পানির গুরুত্ব তেমন ছিলনা। এর একটি কারণ এই যে কোম্পানি থেকে ফ্রান্সের ইংল্যান্ডের মত লাভ তো হচ্ছিলই না, উল্টে খরচ হচ্ছিল। এর জন্যই সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ফরাসী সরকার আমেরিকা ও ইউরোপের যুদ্ধকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছিল, ভারতবর্ষের যুদ্ধকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ডুপ্লেও ভারতে ফরাসী সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনার কথা কোম্পানীর উর্ধ্বতম কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে জানাননি। তাছাড়া কোম্পানীর স্বার্থরক্ষা ছিল ফরাসী সরকারের কাছে গৌন বিষয়। স্যার আলফ্রেড লয়েল মন্তব্য করেছেন, “ফরাসীরাজ পঞ্চদশ লুইয়ের ভ্রান্ত বৈদেশিক নীতি, ইউরোপের যুদ্ধকে ফরাসী সরকারের অধিক গুরুত্বদান এবং পঞ্চদশ লুইয়ের উপপত্নী ও অযােগ্য মন্ত্রীদের কুমন্ত্রণার ফলেই ভারতে ফরাসীদের পরাজয় ঘটে।”

ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল তাদের নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব। ইংল্যান্ডের চতুর্দিক ছিল সমুদ্রবেষ্টিত। সমুদ্রে ইংরেজরা একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর ফলে ভারতে যে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে ইংরেজ নৌবহর সাহায্য প্রেরণ করতে পারত। সমুদ্রপথে তাদের বাধা দেওয়ার মত কোন শক্তি তখন ছিল না। জলপথে ইংরেজদের প্রাধান্যের কারণেই ডুপ্লের মত নায়কের পরাজয় অনিবার্য ছিল। নৌশক্তিতে বলীয়ান ইংল্যান্ডের মােকাবেলা করার জন্য ফ্রান্সের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল না, ফ্রান্সের নৌবাহিনীর সৈন্যরা ইংরেজদের ন্যায় সাহসী ও দুর্ধর্ষ ছিল না। তাই সমুদ্রবক্ষে যুদ্ধে ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। ফ্রান্সের নৌশক্তির এই দুর্বলতা তার পতনের কারণ ছিল। উপযুক্ত নৌবহরের অভাবে তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের ইংজেরদের হাতে ফরাসী বন্দর পন্ডিচেরীর পতন হয়েছিল। ফরাসীদের ভারত মহাসাগরের মরিশাসে একটি নৌ-ঘাঁটি ছিল সত্য, কিন্তু করমণ্ডল উপকূল হতে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় প্রয়ােজনের সময় ফরাসীরা সেখান থেকে তেমন সামরিক সাহায্য লাভ করতে পারেনি। অপরপক্ষে, ইংরেজরা উন্নত নৌশক্তির বলেই ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

ফ্রান্সের কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ফ্রান্সের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের নতুন মিত্র অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা তৈরির জন্য কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন নীতি গ্রহণ করেছিল। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার কারণে ইউরােপে প্রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে ফ্রান্স একই সঙ্গে ইউরােপ, আমেরিকা এবং ভারতে ইংরেজ ও তার মিত্রদের স্বার্থে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ফ্রান্সের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়ােজন ছিল ইউরােপে শান্তি রক্ষা করে আমেরিকা ও ভারতে ইংরেজদের মােকাবেলা করা। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংরেজরা যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ সংগঠক পেয়েছিল। পিট দি এলডারের ন্যায় যােগ্য যুদ্ধমন্ত্রী ফরাসিদের ছিল না। বড় পিট যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাপতি নিয়ােগ, যুদ্ধকৌশলে যে দূরদর্শিতা দেখিয়েছিল ফরাসিরা সে ক্ষেত্রে বড় পিটের ন্যায় যােগ্য যুদ্ধমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারে নি। বড় পিট প্রাশিয়ার ফ্রেডারিককে অর্থ সাহায্য দিয়ে প্রাশিয়াকে ইউরােপে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছিল। যার ফলে ফরাসিদের পক্ষে আমেরিকা ও ভারতে যুদ্ধ উপকরণ ও সৈন্য প্রেরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পিটের যুদ্ধকৌশল ফরাসিদের পতন ডেকে এনেছিল। ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের অপর কারণ হল সে সময় ভারতবর্ষে ইংরেজ বাহিনীতে রবার্ট ক্লাইভ, সান্ডার্স, আয়ারকুট ও আমেরিকায় ইংরেজ বাহিনীতে উলফের মতো সুদক্ষ সেনানায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল। ফরাসী সেনানায়ক ডুপ্লে, বুসী ও লালি নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান ছিলেন। কিন্তু তারা কেউই ইংরেজ সেনানায়কদের সমকক্ষ ছিলেন না।

ফরাসি নীতিনির্ধারকদের ভুল যুদ্ধকৌশল এবং যােগ্য লােককে যথাস্থানে নিয়ােগের অদূরদর্শিতা তাদের পতনের কারণ ছিল। যেমন ভারত থেকে ডুপ্লের মতাে যােগ্য গভর্নরকে প্রত্যাহার করে সে স্থলে যাদের নিয়ােগ দিয়েছিলেন তারা ডুপ্লের মতাে যােগ্য ছিলেন না। এভাবে ভারতে ফরাসী কোম্পানীর দুর্দিনে ফরাসী সরকার কর্তৃক ডুপ্লেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ ছিল একটি মারাত্মক ভুল। ডুপ্লেকে পদচ্যুত করে তদস্থলে ফরাসী সরকার গডেহুকে নিযুক্ত করলে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে বিজিত অঞ্চলগুলাে ইংরেজদের ছেড়ে দেন। এর ফলে ফরাসী কোম্পানীর মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ডুপ্লের প্রত্যাবর্তনের ফলে ভারতে ফরাসী প্রভুত্বের অবসান ঘটে। তাছাড়া তীক্ষ্ম কূটনৈতিক বুদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সত্ত্বেও ভারতে ফরাসী গভর্নর ডুপ্লের সামরিক ক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত পদক্ষেপ ফরাসীদের পরাজয়ের কাছ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের সময় কর্ণাটকের নবাব আনােয়ারউদ্দীন অম্বুরের যুদ্ধে নিহত হলে তার পুত্র মুহম্মদ আলী ত্রিচিনাপলীতে আশ্রয় নেন। যুদ্ধের পরেই যদি ডুপ্লে মুহম্মদ আলীকে ত্রিচিনাপলী দুর্গে আঘাত হানতেন তবে হয়ত ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতি ভিন্নভাবে প্রবাহিত হত। ডুপ্লের বিলম্বের সুযােগে ইংরেজ শক্তি ত্রিচিনাপলীতে মুহম্মদ আলীর রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। ডুপ্লেও তৎক্ষণাৎ জেনারেল ল নামে এক সেনাধ্যক্ষের অধীনে একটি ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলীতে পাঠায়। কিন্তু ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনাপলী দখল করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া ডুপ্লে দাক্ষিণাত্যে ফরাসী বাহিনীকে বিভক্ত করে রেখেছিলেন। তিনি হায়দ্রাবাদে সেনাধ্যক্ষ বুসীর অধীনে ফরাসী সেনাদলের একাংশ স্থাপন করে অবশিষ্ট সেনাদল দ্বারা তিনি ত্রিচিনাপলী অবরােধ করেন। এর ফলে ফরাসী সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডডওয়েল বলেন, “একটির পরিবর্তে দু’টি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা করতে গিয়ে তিনি বােকামী করেছেন।” এদিকে ভারতবর্ষে ইংরেজদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যথা-কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজ্যে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। শত্রু কর্তৃক একটি ঘাঁটির কিংবা একই সঙ্গে দু’টি ঘাঁটির পতন ঘটলে অন্যটি ইংরেজদের অধীনে থাকত। কিন্তু ফরাসীদের একমাত্র পন্ডিচেরীতে শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। পন্ডিচেরীর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ফরাসী শক্তিরও পতন ঘটে। ঐতিহাসিকেরা ভারতে ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ফরাসী শক্তির বিপর্যয়ের জন্য ফরাসী সেনাপতি কাউন্ট লালিকে দায়ী করেছেন। তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের সময় হায়দ্রাবাদ থেকে বুসীকে সরিয়ে আনা ছিল তার এক মারাত্মক ভুল। বুসীকে অপসারণের ফলে হায়দ্রাবাদে ফরাসী প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়। তাছাড়া লালির কর্কশ মেজাজ ও সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ফরাসী শিবিরে অনৈক্যের সৃষ্টি করে। ফরাসীরা অন্তর্দ্বন্দ্বে তাদের শক্তি ক্ষয় করায় ইংরেজদের জয়লাভের পথ সুগম হয়।

যুদ্ধ শেষে প্যারিস ও হিউবার্ট্‌সবার্গের সন্ধি এবং যুদ্ধের ফলাফল

সপ্তবর্ষের যুদ্ধে বিজয়ী ছিল পােল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া পক্ষ, এবং পরাজিত ছিল ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, সুইডেন ও স্যাক্সনি পর্ব। ইউরােপ-আমেরিকা-ভারতবর্ষ এই তিন যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধার অসম্ভব বলে মনে করে প্রাশিয়ার সাথে শান্তি স্থাপনে বাধ্য হয়। দুটি সন্ধির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরফলে ১৭৬৩ সালে দুটি সন্ধি সাক্ষরিত হয়েছিল – (১) প্যারিসের সন্ধিতে (Peace treaty of Paris) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন স্বাক্ষর করে। (২) হিউবার্টস্‌বার্গের সন্ধি (Peace of Hubertsburg) দ্বারা প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও স্যাক্সনি স্বাক্ষর দান করে। এই দুই সন্ধি একত্রে প্যারিসের সন্ধি  নামে পরিচিত। প্যারিস শান্তিচুক্তিতে স্পেনের ক্ষতি হয়। ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে প্যারিসের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সপ্তবর্ষ ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে স্পেন ফরাসি পক্ষ অবলম্বন করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল এবং নির্বুদ্ধিতার শাস্তিস্বরূপ

  • (১) স্পেনকে দক্ষিণ আমেরিকার হন্ডুরাসের দুর্গগুলাে ভেঙে দিতে হয়। 
  • (২) নিউফাউন্ডল্যান্ডে স্পেনের মৎস্য শিকারের অধিকার নাকচ করা হয়। 
  • (৩) যুদ্ধের সময়কালে ইংল্যান্ড কর্তৃক অধিকৃত কিউবা ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ইংল্যান্ড স্পেনকে ফিরিয়ে দিলেও তার পরিবর্তে আমেরিকায় ফ্লোরিডা ইংল্যান্ড লাভ করে।

প্যারিস শান্তিচুক্তির শর্ত মােতাবেক ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে কানাডা (সেন্ট পিয়ারী ও মিকোয়েলন নাম দুটি ক্ষুদ্র দ্বীপ বাদ দিয়ে), নােভাস্কশিয়া, কেপব্রেটন দ্বীপ, গ্রানাডা, গ্রেনেডাইন্‌স, টোবাগাে, ডমিনিকা ও সেন্ট ভিনসেন্ট দিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া লুইসিয়ানা নামক স্থানটি তারা স্পেনকে দিতে বাধ্য হয়। মার্টিনিক, সেন্ট লুসিয়া ও গােরী ফ্রান্সের অধিকারে থাকে। স্পেইনের থেকে ইংল্যান্ড ফ্লোরিডা লাভ করে। স্পেন পায় হাভানা ও ম্যানিলা। ভারতীয় উপমহাদেশে ফ্রান্স চন্দননগর, মাহে, পণ্ডিচেরী, কারিকল ও জিজ্ঞি – এই পাঁচটি স্থান ফিরে পেলেও ফরাসি অধিকৃত কোনাে স্থানে দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা হবে না – এই শর্ত ফ্রান্সকে দিতে হয়েছিল। শুধুমাত্র বাণিজ্য উদ্দেশ্যে এসব স্থান ব্যবহৃত হবে এই শর্ত সন্ধিতে রাখা হয়েছিল। ইউরােপ মহাদেশে ইংল্যান্ড মিনরকা ফিরে পায়। আফ্রিকার সেনেগাল ফরাসি উপনিবেশ হলেও ফ্রান্স সেনেগাল ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ইংল্যান্ড আমেরিকা, ইউরােপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে জয়লাভ করে বিশ্বের সর্বত্র ইংল্যান্ড বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ও বিশ্বে শ্রেষ্ঠ সামরিক ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে আমেরিকা ও ভারতে উপনিবেশ স্থাপনে ফরাসি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও স্যাক্সনির মধ্যে হিউবার্টসবার্গের সন্ধি (১৭৬৩ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত মােতাবেক প্রাশিয়া, স্যাক্সনি এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে অধিকৃত স্থানগুলাে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক অধিকৃত স্যাক্সনি পরিত্যাগ করেন কিন্তু সাইলেশিয়ায় স্থায়িভাবে প্রাশিয়ার অধিকার স্থাপিত হয়। সপ্তবর্ষ যুদ্ধ ইউরােপের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ যুদ্ধকে ইউরােপের ইতিহাসের অন্যতম নিষ্পত্তিকারী যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী –

  • (১) সপ্তবর্ষ যুদ্ধে জয়লাভ করে প্রাশিয়া ইউরােপীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। জার্মানিতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযােগিতায় অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে প্রাশিয়াই শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
  • (২) মধ্য ইউরােপে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রাশিয়া শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়।
  • (৩) সপ্তবর্ষ যুদ্ধের ফলে ফ্রান্স সকল দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ফ্রান্সের নৌবাহিনী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা শােচনীয় হয়েছিল। পরাজয়ের ফলে ফ্রান্সকে বহু স্থানের ঔপনিবেশিক অধিকার ত্যাগ করতে হয়। ইউরােপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের প্রতিপত্তি ও গৌরব ম্লান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই মর্যাদাহানি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় গােলযােগ অদূরভবিষ্যতে ফ্রান্সে এক মহাবিপ্লবের সূচনা করেছিল।
  • (৪) সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংল্যান্ড আমেরিকা ও ভারতীয় মহাদেশের সকল যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করেছিল। আমেরিকার যেসব স্থানে ইংল্যান্ড এই যুদ্ধের ফলে জয়লাভ করেছিল তাতে পশ্চিম দিকে মিসিসিপি নদী ইংরেজ উপনিবেশগুলাের সীমারেখায় পরিণত হয় এবং উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল ইংরেজদের অধীনে আসে। ভারতে ফরাসিদের পতনের ফলে ইংরেজ সাম্রাজ্য স্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংল্যান্ড বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক ক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।

সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রেডারিককে ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের প্রতিশ্রুত অর্থ সাহায্য প্রদানে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ ছাড়া প্রাশিয়া যখন চতুর্দিকে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তখন ইংল্যান্ড সাহায্যদানে বাল্টিক অঞ্চলে নৌসাহায্য প্রেরণ করেন নি। ফলে প্যারিস সন্ধির সঙ্গে সঙ্গেই প্রাশিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের মিত্রতা ভেঙ্গে যায়। প্যারিসের সন্ধিতে অনেক ত্রুটি ছিল। ফ্রেডারিককে অতিক্রম করে ফ্রান্সের সঙ্গে পৃথক সন্ধি করায় ফ্রেডারিক ইংরেজদের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ইংরেজ জাতিও এ চুক্তি সাদরে গ্রহণ করেনি। তবুও এটি অস্বীকার করা যায় না যে, এ সন্ধির দ্বারা ইংল্যান্ড পূর্বের যে কোন সন্ধি অপেক্ষা অধিক লাভবান হয়েছিল। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড আমেরিকায় অদ্বিতীয় মর্যাদার আসন লাভ করে। এর দ্বারা ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক উদ্যমের পতন হয় এবং সে স্থলে ইংরেজদের ভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় অংশেই ইংল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ আসন লাভ করে। অধিকন্তু ইংল্যান্ড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঔপনিবেশিক ও সামুদ্রিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে এ বিষয়ে প্রাধান্যের প্রশ্ন ইংল্যান্ডের পক্ষে চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়। তবে সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়ের পশ্চাতে ক্ষতির বীজও নিহিত ছিল। এ যুদ্ধের ফলে কানাডা থেকে ফরাসি প্রাধান্য এবং ফ্লোরিডায় স্পেনের প্রাধান্য বিলুপ্ত হলে আমেরিকার ঔপনিবেশিকগণ বিপদমুক্ত হয়ে অদূর ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সাহস ও অনুপ্রেরণা লাভ করে। সেই সাথে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য পরবর্তীকালে ফ্রান্স ও স্পেন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের সাহায্য ও সহযােগিতা দিয়েছিল। এদিকে এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়, যা ফরাসী বিপ্লব সংগঠনে ভূমিকা রাখে। অতএব সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিজয়ের মধ্য দিয়েই আমেরিকার বিপ্লব ও বিচ্যুতির পথ প্রশস্ত হয়েছিল।

আমেরিকার স্বাধীনতা লাভে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের ভূমিকা

তৎকালীন ইউরােপে ঔপনিবেশিক প্রাধান্য নিয়ে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক নীতি ত্রুটির মধ্যে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। তবে আমেরিকার ইংরেজদের সচেতন স্বার্থবােধ, সাহস ও বীরত্ব এ যুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়ে দিল। ১৭শ শতাব্দী হতে আরম্ভ কবে ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগর উপকূলে ইংরেজগণ ১৩টি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এ সকল উপনিবেশসমূহে একজন করে ইংরেজ গভর্নর নিয়ােগ করা হত এবং প্রত্যেকটি উপনিবেশ নিজস্ব আইন সভা ছিল। ইংরেজগণ আমেরিকার উপনিবেশগুলাের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনাে হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। ইংরেজ সরকার যুদ্ধব্যয় মেটানাের জন্য উপনিবেশগুলাের ওপর কর ধার্য করার পরিকল্পনা করে। এদিকে কানাডা থেকে ফরাসিদের বিতাড়নের পর আমেরিকা উপনিবেশসমূহে ফরাসি ভীতি দূর হয়, পাশাপাশি ইংল্যান্ডের প্রতি তাদের আনুগত্য হ্রাস পেতে থাকে। বাণিজ্য সচেতন আমেরিকান ব্যবসায়িরা তাদের পুঁজির স্বার্থে ব্রিটিশ পুঁজির খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। বিশেষ করে আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার নব্য পুঁজিবাদীদের বিদ্রোহ করার প্রেরণা দেয়।

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড আমেরিকায় আধিপত্য বজায় রাখার জন্য শক্তিশালী নৌবহর মােতায়েনের পরিকল্পনা করে। এই সামরিক ব্যয় মিটানাের জন্য ইংরেজ সরকার আমেরিকার উপনিবেশগুলাের উপর নতন কর আরােপনের পরিকল্পনা করে। ১৭৬৫ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্রেন্ডভিল স্টাম্প অ্যাক্ট (Stamp Act) নামে আইন প্রবর্তন করে উপনিবেশসমূহের সকল দলিলের ওপর কর ধার্য করে। আমেরিকানরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং ঘােষণা করে যে, যেহেতু ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে আমেরিকানদের কোনাে প্রতিনিধি নেই, তাই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট আমেরিকার উপনিবেশগুলাের উপর কোনাে কর ধার্য করতে পারে না। এই ঘটনার পূর্বে ইংরেজ সরকার নেভিগেশন অ্যাক্ট আইনের মাধ্যমে আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষতি করে ছিল কারণ এই আইন অনুসারে যে সকল পণ্য ইংল্যান্ডে উৎপন্ন হত তা উপনিবেশসমূহে প্রস্তুত করা যেত। এ ছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। নির্দিষ্ট কয়েকটি দ্রব্য ইংল্যান্ড ব্যতীত অপর কোনাে দেশে রপ্তানি করতে পারত না। এ ছাড়া মালামাল পরিবহনে ইংল্যান্ডের জাহাজ ব্যবহার করতে হত। এ সকল কারণে আমেরিকার উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণী ইংল্যান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিল। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট পাস করার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় প্রচণ্ড বিদ্রোহ হয়। ফলে ১৭৬৬ সালে ইংরেজ সরকার স্ট্যাম্প অ্যাক্ট প্রত্যাহার করে। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট রহিত হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঘােষণা করে যে আমেরিকার ওপর কর ধার্য করার অধিকার ইংল্যান্ডের আছে। এ নিয়ে উপনিবেশসমূহের সাথে ইংল্যান্ডের বিরােধ চলতে থাকে। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট রহিত করার ২ বছর পর চ্যাথাম মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য টাউন্ডসেন আমেরিকার আমদানি চা, কাগজ, বস্ত্র আরাে কতিপয় পণ্যের উপর নতুন শুল্ক ধার্য করে। ফলে আমেরিকার নানা স্থানে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়। লর্ড নর্থ ১৭৭৩ সালে একমাত্র চা ছাড়া অপর সকল দ্রব্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহার করেন কিন্তু তাতেও আমেরিকানদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। কিন্তু একদল বিদ্রোহী ছদ্মবেশে বােস্টন বন্দরে চা বােঝাই জাহাজে ওঠে ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত চায়ের বাক্স সমুদ্রে ফেলে দেয়। ইংরেজ সরকার বােস্টন বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় এবং মেসাচুসেটসের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। এতে আমেরিকানদের ক্ষোভ আরাে বৃদ্ধি পায়। উল্লেখিত অবস্থায় আমেরিকার উপনিবেশসমূহে স্বাধীনতা যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে থাকে। আর এই প্রক্রিয়ায় ১৭৭৫ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় ও ১৭৮৩ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৭৭৮ সালে ফ্রান্স সরকার আমেরিকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করেছিল। এরপর ফ্রান্স আমেরিকার পক্ষে প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামে, ফলে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আমেরিকা ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ডীয় যুদ্ধে পরিণত হয়। এ সময় ইংরেজ রাজনীতিবিদ চ্যাথাম মৃত্যুবরণ করলে আমেরিকার স্বার্থে বিরােধ মেটাবার আর কোনাে সম্ভাবনা থাকল না। ১৭৭৯ সালে স্পেন ও ১৭৮০ সালে হল্যান্ড আমেরিকানদের পক্ষ সমর্থন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে যােগ দেয়। এই যুদ্ধের সময় রাশিয়া, প্রুশিয়া, ডেনমার্ক ও সুইডেন সশস্ত্র নিরপেক্ষ সংঘ গঠন করে। এর লক্ষ্য ছিল মহাসমুদ্রে ইংরেজ কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের জাহাজ তল্লাশি বন্ধ করা। ফলে সমুদ্র বক্ষেও ইংল্যান্ডের প্রাধান্য ব্যহত হয়। এ সময় ভারতে মহীশুরের হায়দার আলী এবং দাক্ষিণাত্যে মারাঠাগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। আয়ারল্যান্ডে ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিরােধ দেখা দেয়। এই অবস্থায় ইংরেজরা বিপদগ্রস্ত হয়। ১৭৭৯ সালে ফ্রান্স ও স্পেন সম্মিলিতভাবে জিব্রাল্টার ও মিরকা অবরােধ করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত হবার ক্ষেত্রে এইসব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল। তাই বলা যায়, সপ্তবর্ষের যুদ্ধে (১) ইংল্যান্ড আমেরিকানদের উপর উচ্চমাত্রায় করারোপ, (২) এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের আমেরিকা ত্যাগ, এবং (৩) এই যুদ্ধে ফ্রান্স ও স্পেইনের বঞ্চনা আমেরিকার স্বাধীনতা লাভ ও ইংরেজদের আমেরিকা হারানোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাই এক দিক দিয়ে আমেরিকার স্বাধীনতাকে সপ্তবর্ষের যুদ্ধের পরিণতি বলা যায়।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৬২-২৮৮
  • আধুনিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস (১৪৮৫ থেকে ১৯৩৬ খ্রিঃ পর্যন্ত), তানজিমুল ইসলাম, বুক চয়েস, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২৮২-২৯৯
  • দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : ১৫২৬ খ্রী হতে ১৮৫৭ খ্রী পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা, ঢাকেশ্বরী লাইব্রেরী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ২৮৮-৯৯
  • আমেরিকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কাফি খান, বাংলাদেশ বুকস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ২৩-৩০

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.