ডারউইনের বিগলের দ্বিতীয় অভিযানের পটভূমি

সমুদ্রাভিযানের লক্ষ্য

দীর্ঘ বারোটি বছর ইউরোপ জুড়ে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞর পর ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সমাপ্তি হল। এরপর দেখা গেল পুনরায় সমুদ্রচারী রাষ্ট্রগুলো ঔপনিবেশায়ন ও দ্রুত শিল্পায়নের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর এই শিল্পায়নের জন্য চাই উন্নত বাণিজ্য ও টেকশই সাপ্লাই লাইন। আর তার জন্য দরকার সমুদ্রপথ সংক্রান্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য। ১৮০৮ থেকে ১৮৩৩ – এই ২৫ বছর ধরে চলে স্প্যানিশ আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও আর্জেন্টিনা পর্যন্ত ল্যাতিন আমেরিকা স্প্যানিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, আমেরিকায় স্পেনীয় শাসনের অবসান ঘটে। এর ফলে বাণিজ্যে যে এতকাল ধরে আমেরিকায় স্প্যানিশ মনোপলি চলছিল তার সমাপ্তি ঘটে। এদিকে যুক্তরাজ্য ১৮২৫ সালেই আর্জেন্টিনার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দান করে তাদের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করে ফেলেছে, যার ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চলে নৌ ও বাণিজ্যিক গুরুত্বও প্রচণ্ড রকমে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ব্রিটিশ নৌসেনাবিভাগ তদকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট চতুর্থ জর্জকে রিপোর্ট করল তাদের দক্ষিণ আমেরিয়ায় একেবারে রিভার প্লাটার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রবেশপথ থেকে শুরু করে, চিলয় ও তিয়েরা দেল ফুয়েগো ঘুরে দক্ষিণ আমেরিকার পুরো দক্ষিণাঞ্চলীয় তীরবর্তী অঞ্চলের নিখুঁৎ হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে করা দরকার। কিরকম জরিপের দরকার ছিল তা সেই সময় এই জরিপাভিযানে যাওয়া এক ছোকড়ার ডায়েরিতেই পাওয়া যাচ্ছে। এই চার্লস রবার্ট ডারউইন লিখছেন, “তার অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ১৮২৬ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ক্যাপ্টেন কিং এর অধীনে পাতাগোনিয়া ও তিয়েরা দেল ফুয়েগো এর সারভের (অসম্পূর্ণ) কাজটিকে সমাপ্ত করা; চিলি, পেরু ও আশেপাশের কিছু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের উপকূলবর্তী অঞ্চলে জরিপ করা; এবং পৃথিবীর চারদিকে একের পর এক ক্রোনোমেট্রিকাল পরিমাপ সম্পাদন করা”।

নৌবাহিনীর একটি মেমোরেন্ডামে এই সার্ভের ডিটেইল্ড ইনস্ট্রাকশন দেয়া হলো। প্রথম রিকয়ারমেন্ট ছিল রিও ডি জেনিরো এর লংগিচুড নিয়ে পূর্ববর্তী সার্ভেগুলোতে যে অসঙ্গতিগুলো দেখা যাচ্ছিল তার সমাধান করা, এই স্থানটি মেরিডিয়ান দূরত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় বেস পয়েন্ট বলে এর সমাধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা করার জন্য যে নিখুঁৎ ক্রোনোমিটারের প্রয়োজন তা ইংল্যান্ডের রয়াল নেভির কাছে ১৮২৫ এর আগে প্রচলিত ছিলনা। স্কুল-কলেজে যারা পদার্থবিজ্ঞান পড়ে থাকবেন তারা হাইগেনস প্রিন্সিপল, হুকস ল পড়ে থাকবেন। এই হাইগেল ও হুকই ১৬৭৫ সালে তাদের খুব পরিচিত তাত্ত্বিক নীতি দিয়েই একরকম প্রাথমিক ক্রোনোমিটার ডেভলপ করেছিলেন। তবে এর আধুনিক ডেভলপমেন্ট হয় আরও অনেক পরে ১৭৮০ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী পিয়েরে লে রয় এর হাত ধরে। এরপর এর ইংল্যান্ডের রয়াল নেভির ব্যবহার্য যন্ত্রে পরিণত হতে হতে ১৮২৫ সাল লেগে গেল। এবারে তাদের পক্ষে রিও ডি জেনিরোর নিখুঁৎ লংগিচুড মাপাটা সম্ভব, সুতরাং দেরি না করে কাজে লেগে পড়ো… অভিযানের দায়িত্ব যে জাহাজের উপর পড়েছিল, মানে এইচএমএস বিগল, সেই জাহাজটি রিও ডি জেনিরোর লংগিচুড সংশোধন করার জন্য ২২ খানা ক্রোনোমিটার বহন করেছিল। এই কাজটির জন্য জাহাজটিকে একটি সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে চার দিনের জন্য থামতে হবে। এই চারদিন যাবত ক্রোনোমিটারের রেটিং দেখতে হবে আর জ্যোতির্বিজ্ঞানগত পর্যবেক্ষণের সাথে মেলাতে হবে। পোর্তো প্রায়া ও ফারনান্দো দি নরনহাতে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানগত পর্যবেক্ষন করার দরকার ছিল পূর্ববর্তী উইলিয়াম ফিৎজউইলাম ওয়েন ও হেনরী ফস্টারের জরিপের মানের সাথে বর্তমানের মানগুলোকে ক্যালিব্রেট করার জন্য। আবরোলহস আর্কিপেলাগো রিফের এক্সটেন্ট অঞ্চলেও সার্ভে করা দরকার, সেখানেই পূর্বে আলবিন রোউসিনের সার্ভেতে ভুল হয়েছিল। এরপর যেতে হবে রিও ডি জেনেইরোতে ভিলেগাগনন দ্বীপের এক্স্যাক্ট লংগিচুডটা জানার জন্য।

এরপর সার্ভের আসল কাজটা শুরু হবে রিও দে লা প্লাতা এর দক্ষিণে, সেই সাথে সাপ্লাই এর জন্য মোন্টেভিডিওতে রিটার্ন ট্রিপও দিতে হবে। এর মধ্যে তিয়েরা দেল ফুয়েগো ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের জরিপের কাজও আছে। এরপর সময় ও সম্পদে যতটা কুলোয় ততটা পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর, অর্থাৎ চিলির উপকূল বরাবর উত্তর দিকে যেতে হবে। এরপর জাহাজের কমান্ডার পশ্চিম দিকে তার নিজের পথ নিজেই দেখে নেবেন। যদি আবহাওয়া অনুকূল হয় তাহলে তিনি গেলাপেগোস দ্বীপপুঞ্জে জরিপ করতে পারেন। এরপর বিগলকে এর পয়েন্ট ভেন্যুগুলো, অর্থাৎ তাহিতি ও অস্ট্রেলিয়ার পোর্ট জ্যাকসনে আসতে হবে যেগুলো ক্রোনোমিটারের পাঠ ভেরিফাই করার জন্য জ্ঞাত বিন্দু। ইনস্ট্রাকশনে বলা হয়, এই জরিপকার্যে বিস্তৃত পরিসরের চিত্রাঙ্কন করে সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই, কেবল চার্ট ও প্ল্যানের মধ্যে নোট রাখতে হবে, তাতে সমুদ্র থেকে উপকূলের ভূমি সংক্রান্ত সরল দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে যেখনে উপকূল থেকে যে পাহাড়গুলো দেখা যায় তাদের উচ্চতার উল্লেখ থাকবে। সেই সাথে জোয়ার-ভাটা ও আবহাওয়াগত অবস্থার ধারাবাহিক রেকর্ডও প্রয়োজন। সেই সাথে একটি অতিরিক্ত সাজেশন ছিল যে, প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বৃত্তাকার কোরাল এটল (উপহ্রদ পরিবেষ্টক বলয়াকার প্রবাল-প্রাচীর) এর জিওগ্রাফিক সার্ভে করতে হবে, সেই সাথে এর টাইডাল ফ্লো এরও প্রোফাইল নিতে হবে। এরকম কোরাল রিফের ফরমেশনের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যই এইসব ডেটার প্রয়োজন।

এইচএমএস বিগল ও এর প্রথম সমুদ্রাভিযান

এই প্রসঙ্গে যে জাহাজটিতে করে অভিযানটি পরিচালিত হবে সেই বিগল জাহাজটি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। এইচএমএস বিগল (HMS Beagle) ছিল যুক্তরাজ্যের রয়াল নেভির চেরোকি ক্লাসের (Cherokee-class) একটি ১০-গান ব্রিগ স্লুপ (10-gun brig-sloop) জাহাজ। জাহাজটি তৈরিতে লেগেছিল ৭,৮০৩ পাউন্ড (আজকের মুদ্রায় ৬২৮,০০০ পাউন্ড)। ১৮১৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে জাহাজটি তৈরির অর্ডার দেয়া হয়, আর ১৮২০ সালের ১১ই মে-তে টেমস নদীর উলউইচ ডকইয়ার্ড থেকে জাহাজটি চালু করা হয়। পরে রিপোর্ট বলছে যে জাহাজটি যুক্তরাজ্যের রাজা চতুর্থ জর্জের রাজ্যাভিষেক উদযাপনে অংশগ্রহণ করে, যা পুরাতন লন্ডন সেতু দিয়ে যায়। বিগলের কোন তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ছিল না তাই এটি পড়েই ছিল, কে জানতো এই জাহাজটিই পুরো পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তন করতে যাচ্ছে… যাই হোক, পরে জাহাজটিকে সার্ভে করার জরিপ জাহাজে পরিণত করা হয় এবং এটি দিয়ে ৩টি জরিপ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই জাহাজের দ্বিতীয় অভিযানটি ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন সবে মাত্র গ্র্যাজুয়েট করা প্রকৃতিবাদী চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২), যিনি এই অভিযানের মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রমণ করেন। এই অভিযানের সময় যখন জরিপ-কার্য চলছিল, তখন ডারউইন তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে ভূতত্ত্ব, প্রাকৃতিক ইতিহাস ও জাতিতত্ত্ব (ethnology) বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি তার ডায়েরি জার্নাল প্রকাশ করে খ্যাতি অর্জন করেন, যা দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল নামে সর্বাধিক পরিচিত। আর তার এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলই বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ডারউইন নিয়ে আলোচনা পরে হবে, এখন আলোচনার বিষয় হলো এইচএমএস বিগল। ক্যাপ্টেন প্রিঙ্গল স্টোকসকে (Pringle Stokes) ১৮২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে বিগলের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করা হয়, এবং জাহাজটিকে হাইড্রোগ্রাফিক অফিসের জরিপ বিভাগে বরাদ্দ করা হয়। ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিগলকে উলউইচের বন্দরে মেরামত করে একে এর জরিপকার্যের জন্য ফিট করা হয়। এর কামানের সংখ্যা ছিল ১০টি, কমিয়ে ৬টি করা হয়, এদিকে হ্যান্ডলিং উন্নত করার জন্য মিজেন মাস্তুল যোগ করা হয়। এভাবে একে একটি ব্রিগ জাহাজ (brig) থেকে বার্ক জাহাজে (barque) পরিণত করা হয়। এই জাহাজের প্রথম অভিযানটি ছিল ১৮২৬ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। ১৮২৬ এর ২২শে মে-তে এটি ক্যাপ্টেন স্টোকসের নেতৃত্বে প্রথম প্লিমাউথ থেকে যাত্রা করে। এর লক্ষ্য ছিল কমান্ডার এবং সার্ভেয়ার অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন ফিলিপ পার্কার কিং-এর সামগ্রিক নেতৃত্বে পাতাগোনিয়া (Patagonia) এবং তিয়েরা ডেল ফুয়েগোর (Tierra del Fuego) একটি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপে এর চেয়েও বড় জাহাজ এইচএমএস অ্যাডভেঞ্চারের (৩৮০ টন) সাথে জরিপ-কার্যে অভিযান করা। সমগ্র অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ছিলেন অস্ট্রেলীয় ক্যাপ্টেন ফিলিপ পার্কার কিং, যিনি একজন সার্ভেয়র বা জরিপকারীও ছিলেন।

তিয়েরা ডেল ফুয়েগোর নির্জন জলে জরিপের আরো কঠিন অংশের মুখোমুখি হয়ে ক্যাপ্টেন স্টোকস গভীর বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। ম্যাগেলান প্রণালীর পোর্ট ফেমিনে তিনি নিজেকে ১৪ দিনের জন্য তার কেবিনে আটকে রাখেন, তারপর অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পরবর্তী ক্রুজের প্রস্তুতির কথা বলার পর, ১৮২৮ সালের ২রা আগস্ট নিজেকে গুলি করেন। চার দিন প্রলাপ বকে যাওয়ার পর স্টোকস সামান্য সুস্থ হয়ে উঠলেও তার অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ১৮২৮ সালের ১২ আগস্ট তিনি মারা যান। ক্যাপ্টেন পার্কার কিং তারপর বিগলের ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট, লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম জর্জ স্কাইরিংকে বিগলের কমান্ডার হিসেবে স্টোকসের স্থলাভিষিক্ত করেন। এরপর উভয় জাহাজ মন্টেভিডিওতে যাত্রা করে। ১৩ অক্টোবর পার্কার কিং তার জাহাজ অ্যাডভেঞ্চারকে পুনর্মেরামতের জন্য রিও ডি জেনেইরোতে নোঙ্গর করেন। এই কাজের সময় সাউদ আমেরিকান স্টেশনের কমান্ডার ইন চিফ রিয়ার অ্যাডমিরাল স্যার রবার্ট ওটওয়ে এইচএমএস গ্যাঙ্গেসে করে সেখানে পৌঁছান। এসে তিনি জানান, তিনি বিগল জাহাজটিকেও মেরামতের জন্য মন্টেভিডিওতে আনতে এবং স্কাইরিং পদচ্যুত করতে চান। বিগল মন্টেভিডিওতে এসে পৌঁছলে তিনি তার সহযোগী ফ্ল্যাগ লেফটেনেন্ট রবার্ট ফিট্জ‌রয়কে (Robert FitzRoy) বিগলের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। রবার্ট ফিট্‌জরয় ছিলেন ইংল্যান্ডের অভিজাত বংশের ছেলে, ছিলেন গ্রাফটনের ৪র্থ ডিউক জর্জ ফিট্‌জরয়ের নেফিউ।

২৩ বছর বয়সী অভিজাত ফিটজরয় একজন সক্ষম কমান্ডার এবং সতর্ক জরিপকারী হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছেন। একটি ঘটনায় ফুয়েজিয়ান আদিবাসীরা বিগল জাহাজের একটি নৌকা চুরি করেছিল। এর জন্য ফিট্জ‌রয় ফুয়েজিয়ান আদিবাসীদের অনেককে জিম্মি হিসেবে জাহাজে তুলে নেন। অবশেষে তিনি দুইজন ফুয়েজিয়ান পুরুষ, একজন নারী এবং একটি বালককে ধরে নিয়ে ১৮৩০ সালের ১৪ই অক্টোবরে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। পুরুষ দুজনের নাম দেয়া হয় ইয়র্ক মিনস্টার ও বোট মেমরি, নারীর নাম দেয়া হয় ফুয়েজিয়া বাস্কেট। বালকটির নাম দেয়া হয় জেমি বাটন। বালকটিকে ফিট্জ‌রয় একটি মুক্তার বোতাম দিয়ে কিনেছিলেন বলে তার এই নাম দেয়া হয়েছিল। অবশ্য আসলেই জেমিকে বাবামার সমতে বোতামের বিনিময়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, নাকি জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ফিট্জ‌রয় ভেবেছিলেন এদেরকে ওয়েস্টার্নাইজ ও ক্রিশ্চিয়ানাইজ করে ইংরেজি শিখিয়ে দেয়া গেলে, পরে এদের মাধ্যমে ফুয়েজিয়ানদের সাথে যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদান করতে সুবিধা হবে, আর এদেরকে মিশনারি হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। এরা ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছলে রাতারাতি সেলিব্রিটি বনে যায়। ইংল্যান্ডের রাজা-রাণীও এদের সাথে দেখা করেন। যাই হোক, এই চারজনের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছিল বোট মেমরি, কিন্তু ইংল্যান্ডে পৌঁছবার পর বোট মেমরি স্মল পক্সে মারা যায়। এরপর বিগলের ২য় অভিযানে জেমি বাটন সহ বেঁচে থাকা তিনজন ফুয়েজিয়ান আদিবাসীকে পাতাগোনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। জেমি বাটনের নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে সেখানকার ভাষা ও প্রথা মনে করতে প্রথম দিকে কষ্ট হয়। কিন্তু কয়েক দিন যাবার পর জেমি বাটন নিজের ইউরোপীয় পোশাক ও অভ্যাস পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলে ফুয়েজিয়ান জীবনধারায় ফিরে আসে। তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার কথা বলা হলেও সে আর তাতে রাজি হয়নি। এই দ্বিতীয় অভিযানে ডারউইনও ছিলেন। তিনি বলেছিলেন জেমি তার সুন্দরী ও তরুণী স্ত্রীর জন্যই সেখানে থেকে গিয়েছিল। যাই হোক, আবার ১ম জরিপাভিযানে ফিরে আসি। দক্ষিণ আমেরিকার চরম দক্ষিণ প্রান্তে চিলি ও আর্জেন্টিনার দক্ষিণাঞ্চলে একটি প্রণালী রয়েছে। ১ম অভিযানের সময় এই প্রণালীটির নামকরণ করা হয় বিগল প্রণালী, নামকরণ হয় এই জাহাজের নামেই। ক্যাপ্টেন ফিট্জ‌রয়ের হাতের লেখায় প্রথম যাত্রার লগ বইটি আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আয়ার্স প্রদেশের টাইগ্রেতে অবস্থিত মিউজিও নেভাল ডে লা নাসিওন (আর্জেন্টিনার নৌবাহিনীরপ্রশাসনের অধীনে) নিলামে অধিগ্রহণ করা হয়। ১৮৩০ সালের ১৪ অক্টোবরে বিগল ডেভনপোর্ট বন্দরে পৌঁছলে ক্যাপ্টেন কিং অবসর গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় অভিযানের প্রস্তুতি

২৭ বছর বয়সী ফিট্জ‌রয় আশা করেছিলেন যে তিনি আবার দক্ষিণ আমেরিকায় সার্ভে করার জন্য যাবার সুযোগ পাবেন। তার এই আশা করার জন্য যথেষ্ট কারণও ছিল, তাকে এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৌবাহিনীর লর্ডরা এই পরিকল্পনা বাতিল করে। কিন্তু এর মধ্যে ফিট্‌জরয়ের মাথায় ভুত চেপে বসেছে, তিনি যে করেই হোক ফুয়েজিয়ান আদিবাসীদের সাথে পুনরায় দেখা করবেনই। তিনি একটি ছোট বাণিজ্য-জাহাজের মালিকের সাথে একটি চুক্তি করেন, যাতে তাকে সহ আরও ৫ জনকে দক্ষিণ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তার এক সদয় আংকল এই ব্যাপারে জানতে পেরে নৌবাহিনীর সাথে যোগযোগ করেন। ফিট্‌জরয় অভিজাত বংশীয় ছিলেন আগেই বলেছি। তার এক আংকেলের সাথে এডমিরাল্টি বা নৌবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের লোকেদের সাথে খাতির ছিল, তিনি ফিট্‌জরয়ের দুঃখ দেখে উপর মহলে কিছু কলকাঠি নাড়েন, অমনি দেখা গেল ফিট্‌জরয়কে এইচএমএস চ্যান্টিক্লিয়ার (HMS Chanticleer) এর কমান্ডার নিয়োগ করে তিয়েরা ডেল ফুয়েগোতে যাবার আদেশ দেয়া হয়েছে। ফিট্‌জরয়ও আনন্দে আটখানা। কিন্তু সমস্যা হলো, দেখা গেল এই নতুন জাহাজ চ্যান্টিক্লিয়ারের অবস্থা খুব একটা ভালো না, এটা নিয়ে যাত্রা করা যাবেনা। অবশেষে সেই পুরনো জাহাজ এইচএমএস বিগল নিয়েই শুরু যাত্রা হবে বলে ঠিক হলো। ১৮৩১ সালের ২৭ জুনে ফিট্‌জরয়কে কমান্ডার হিসেবে পুনরায় নিয়োগ করা হলো, এবং বিগল কমিশন পেলো ১৮৩১ সালের ৪ঠা জুলাইতে। ফিট্‌জরয়ের সাথে যোগদান করেন লেফটেনেন্ট জন ক্লিমেন্টস উইকহ্যাম এবং বার্থোলোমিও জেমস সালিভান।

বিগলকে অবিলম্বে ব্যাপক পুনর্নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণের জন্য ডেভনপোর্টের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এবারে বিগলের গঠন অনেকটাই পাল্টে দিয়ে তাকে সমুদ্রযাত্রার জন্য আরও উপযুক্ত করা হলো। বিগল ছিল চেরোকি ক্লাসের জাহাজ, এই ক্লাসের জাহাজগুলো ‘কফিন’ ব্রিগ নামে পরিচিত ছিল, কেননা এগুলো ডুবে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। এটা আটকাবার জন্য ফিট্‌জরয় জাহাজটির উপরের ডেক ৮ ইঞ্চি উপরে আর ১২ ইঞ্চি সামনের দিকে সরিয়ে আনলেন, যাতে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় ডেকের ওপর কম জল জমে ও দ্রুত জল নিষ্কাসিত হয়ে যায়, এছাড়া এর ফলে জাহাজের উপরের দিকের ভর কমে আসে, এতে জাহাজডুবির সম্ভাবনা কমে আসে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন করা হলো, হালে অতিরিক্ত শিদিং যোগ করা হয়েছি। জাহাজটিকে উইলিয়াম স্নো হ্যারিস দ্বারা আবিষ্কৃত লাইটনিং কনডাক্টারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এটাই ছিল প্রথম জাহাজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যেখানে এই পরিবাহী যুক্ত করা হয়েছিল, উদ্দেশ্য ছিল জাহাজে এই পরিবাহীটি কেমন কাজ করে তা টেস্ট করে দেখা। ফিট্‌জরয় এই জাহাজে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার জন্য আরও অনেক খরচ করলেন। তিনি জাহাজটিতে ২২টি ক্রোনোমিটার নিয়ে আসেন। আরও ঢোকান ৫টি সিম্পিসোমিটার, এগুলো হলো আলেকজান্ডার এডির আবিষ্কৃত পারদহীন ব্যারোমিটার, ফিট্‌জরয় এই রকম ব্যারোমিটার পছন্দ করতেন কারণ এগুলো নিখুঁৎ মান দিত, নৌবাহিনীও এটাই ব্যবহার করতো। এখন জাহাজের নেভিগেশনাল ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর দেয়া মান যাতে ম্যাগনেটিক ইনটারফেয়ারেন্স এর কারণে পরিবর্তিত না হয়ে যায় তাই তিনি লোহার বন্দুক-কামানের জায়গায় জাহাজে পিতলের বন্দুক-কামান বসানোর প্রস্তাব করেন। তবে এডমিরাল্টি তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু ফিট্‌জরয় দমার পাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন পারফেকশনিস্ট। ১৮৩২ সালে রিও ডি জেনিরোতে পৌঁছে তিনি নিজের টাকা খরচ করে জাহাজে পিতলের কামান লাগিয়ে নেন। বুঝতেই পারছেন, ফিট্‌জরয় যতটা পারা যায় বিগলকে উন্নত প্রযুক্তিমণ্ডিত ও কার্যকরী সমুদ্রযাত্রার জন্য বিগল জাহাজকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। এজন্য নিজের গাট থেকে টাকা খরচ করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি।

অফিসার ও ক্রু ছাড়া বিগলে কোন অফিশিয়াল পজিশন ছাড়াই অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। ফিট্‌জরয় তার কেবিনে রাখা ২২টি মেরিন ক্রোনোমিটার মেইন্টেইন করার জন্য একজন ম্যাথমেটিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট মেকারকে নিয়োগ দেন, সেই সাথে তিনি ব্যক্তিগত খরচেই অগাস্টাস আর্ল নামে একজন আর্টিস্ট বা ড্রাফটসম্যান। এছাড়া যে তিনজন ফুয়েজিয়ানকে তিনি এর আগের অভিযানে ধরে এনেছিলেন তাদেরকেও তিয়েরা দেল ফুয়েগোতে পৌঁছে দিতে হবে, এদের সাথে ছিলেন মিশনারি রিচার্ড ম্যাথিউস।

প্রকৃতিবিজ্ঞানী বা ভূতাত্ত্বিক এর তলব 

এই প্রসঙ্গে আসার আগে তদকালীন প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে দুচারটে কথা বলে নেই। বিউফোর্ট ও কেম্ব্রিজের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় “জেন্টলমেন অফ সায়েন্স” এর জন্য বিগলের এই দ্বিতীয় অভিযানটি ছিল বিজ্ঞান নিয়ে সরকারের নীতিকে পুনরুজ্জীবিতকরার একটা মাধ্যম। এই এলিট বিজ্ঞানীগণ পয়সার জন্য গবেষণাকে অবজ্ঞা করতেন, তারা মনে করতেন নেচারাল ফিলোসফি বা বিজ্ঞান ব্যাপারটা ট্রেডসম্যানদের জন্য নয়, জেন্টলম্যানদের জন্য। আর তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চরিতার্থ করার একটা অন্যতম মাধ্যম ছিল সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী। কারণ এদের সাথে কাজ করলে গবেষণাগুলো হয় তার পয়সা বা সাপোর্টগুলো সরকারের থেকেই আসে, বিজ্ঞান থাকে পুঁজিপতিদের লভ্যাংশ লাভের চিন্তা থেকে মুক্ত। এরকম সরকারী উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাধারণত জাহাজের সার্জনরাই অভিযানের সময় বিভিন্ন বিজ্ঞনাসংক্রান্ত স্পেসিমেন বা নিদর্শন সংগ্রহ করে থাকেন। বিগলের সার্জনের দায়িত্ব পান রবার্ট ম্যাককরমিক। তিনি এর আগের অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ন্যাচারাল হিস্টোরি নিয়ে গবেষণাও করেছিলেন। যথেষ্ট পরিমাণ স্পেসিমেন কালেকশনের একটা ভাল সোশ্যাল ভেল্যুও ছিল সে সময়, এগুলো জনসাধারণকে আকৃষ্ট করত, আর অভিযানে অংশ নিয়ে নিয়ে ম্যাককরমিক একজন এক্সপ্লোরিং ন্যাচারালিস্ট বা অনুসন্ধানী প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময়ই অভিযানের দ্বারা যেসব বিজ্ঞানসংক্রান্ত স্পেসিমেন সংগৃহীত হত সেগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো, ও এগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মত জাদুঘরে স্থানান্তরিত হতো। কিন্তু সবসময়ই তা ছিলনা। এই যেমন, বিগলের প্রথম অভিযানের ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়া ছিল যে, অভিযানের ক্ষেত্রে নাবিকদেরকে সর্বোচ্চ পরিমাণে স্পেসিমেন কালেকশনের প্রচেষ্টা করতে হবে, এবং এগুলোর সবই সরকারের অধীনে থাকবে। কিন্তু বিগলের এই দ্বিতীয় অভিযানের বেলায় এই নির্দেশ তুলে দেয়া হয়, এই অভিযানে অফিসাররা সকল স্পেসিমেনকেই অফিসারদের নিজেদের গ্রহণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়।

ফিট্জ‌রয় ও তার অফিসাররা ছিলেন হাইড্রোগ্রাফিতে দক্ষ। হাইড্রোগ্রাফি মানে বোঝেন তো? পৃথিবীর জলভাগ সম্বন্ধে গবেষণা, জলভাগের মানচিত্রাঙ্কন, জলভাগের গভীরতা নির্ণয় সংক্রান্ত বিজ্ঞানকেই বলা হয় হাইড্রোগ্রাফি। কিন্তু হাইড্রোগ্রাফিতে তারা দক্ষ হলেও প্রকৃতিবিজ্ঞানে তাদের দক্ষতা ছিলনা। ফিট্‌জরয় বিগলের প্রথম অভিযানে একজন ভূতাত্ত্বিকের খুব অভাববোধ করেছিলেন। প্রথম অভিযানের সময় ফিট্‌জরয় যে জার্নাল লিখেছিলেন, সেখানে লেখা আছে, বারবারা চ্যানেলের নিকট ম্যাগনেটিক রক নিয়ে তদন্ত করার সময় তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, “জাহাজে একজন ব্যক্তিও নেই যিনি মিনারোলজিতে, বা অন্তত ভূতত্ত্বে দক্ষ, যে এই মাটি ও পাথরের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার সুযোগ নেবেন”। ফিট্‌জরয় তখনই ঠিক করেন, এরপর একই রকম কোন অভিযানে এলে তিনি তার সাথে এমন কাউকে নিয়ে আসবেন যিনি এই ভূমি পরীক্ষা করতে সক্ষম, ফিট্‌জরয় ও তার অফিসাররা যখন হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে চালাবেন তিনি তখন এই মাটি, পাথর, অর্থাৎ ভূপ্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। ম্যাককরমিক স্পেসিমেন সংগ্রহে ও নেচারাল হিস্টোরি নিয়ে গবেষণায় দক্ষ হলেও ভূতত্ত্ব নিয়ে তার ভাল এক্সপারটিজ ছিলনা, সেই সাথে জাহাজেও তার তার ডিউটি ছিল। তাই বিগলের দ্বিতীয় অভিযানে ফিট্‌জরয়ের প্রয়োজন ছিল একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী যিনি ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন, সেই সাথে জাহাজ থেকে বের হয়ে উপকূলবর্তী এলাকায় যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সময় অতিবাহিত করতে পারেন। 

আর শুধু ভূতাত্ত্বিকের অভাবটাই ফিট্‌জরয়ের প্রধান সমস্যা ছিলনা। ফিট্‌জরয় জানতেন জাহাজ পরিচালনা করায় কতটা মানসিক চাপ ও একাকিত্ব কাজ করে। সেই সময়ের অভিযানের কমান্ডাররা উত্তাল মহাসমুদ্রের মাঝে একাকী জাহাজ নিয়ে বেশ স্ট্রেস ও একাকিত্বের মধ্যে পড়ে যেতেন। বিগলের প্রথম অভিযানে ক্যাপ্টেন স্টোক্সের আত্মহত্যা তাকে এটা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া তার আংকল ভাইকাউন্ট ক্যাসালরিঘও অতিরিক্ত কাজের চাপে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই প্রথমবারের মতো ফিট্‌জরয় জাহাজের পুর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন যার অধীনে কোন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কোন কমান্ডিং অফিসার বা সেকন্ড ক্যাপ্টেন নেই। তাই তার একজন জেন্টলম্যান সহযাত্রীর দরকার ছিল যার মধ্যে তার মতই বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে, এবং তার সাথে তিনি সমানে সমান হিসেবে একসাথে নৈশভোজ করতে পারেন। হেনস্লো বলেছেন, ফিট্‌জরয়ের একজন নিছক সংগ্রহকারীর চেয়ে সাথীরই বেশি দরকার ছিল। অবশ্য এই ব্যাপারটাই বিশেষত্বের কিছু ছিলনা। সেই সময় এরকম অনেক জাহাজ অভিযানেই প্রকৃতিবিজ্ঞানীদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে নিয়ে যাওয়া হতো।

আগস্টের শুরুতে ফিট্‌জরয় তার বন্ধু ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস বিউফোর্টকে তার এই ইচ্ছার কথা জানালেন। তিনি তাকে বললেন একজন নেচারালিস্ট বা প্রকৃতিবাদী ভদ্রলোককে খুঁজে দিতে, যিনি নিজের টাকায় এই অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন এবং ফিট্‌জরয়ের সঙ্গী হবেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিউফোর্টের অনেক জানাশোনা ছিল, তার একটা সাইন্টিফিক নেটওয়ার্কও ছিল কেমব্রিজভিত্তিক, তাই তার পক্ষেই বিগলের দ্বিতীয় অভিযানের জন্য উপযুক্ত কাউকে জোগাড় করে দেয়াটা সম্ভব ছিল। বিউফোর্টের অনুরোধে গণিতের লেকচারার জর্জ পিকক লন্ডন থেকে প্রফেসর জন স্টিভেনস হেনস্লোকে লিখলেন, একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানীর জন্য এই বিরল সুযোগটির কথা। বিশিষ্ট ইংলিশ ক্লার্জিম্যান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী রেভারেন্ড লিওনার্ড জেনিনের নাম সাজেস্ট করা হলো। তিনি নিজের ব্যাগও গুছিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো একজন ভাইকার বা বিশপের প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়বদ্ধতা ও তার স্বাস্থ্যগত সমস্যায়। তাই আর তার অভিযানে যাওয়া হলো না। হেনস্লোও একবার যেতে চাইলেন, কিন্তু তিনি যেতে পারলেন না তার স্ত্রীর জন্য। বললেন তার স্ত্রী এই কথা জেনে এতটাই “করুণ” হয়ে গেলেন যে তিনি তার অভিযানের পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন। তবে এরা দুজনেই ২২ বছর বয়সী এক তরুণ চার্লস ডারউইনকে এই অভিযানে যাবার জন্য রিকমেন্ড করলেন। তিনি এই সম্প্রতি একটি সাধারণ ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী গ্রহণ করে কেরিয়ার গড়ার কথা ভাবছেন, সেই সাথে তিনি অ্যাডাম সেজউইকের সাথে একটি জিওলজি ফিল্ড ট্রিপেও ছিলেন।

ডারউইনকে নেবার প্রস্তাব

একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানীর থেকে যা যা আশা করা হয়, সবই ছিল ডারউইনের। সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন সুপ্রশিক্ষিত প্রকৃতিবিদ।এডিনবার্গে দ্বিতীয় বর্ষে তিনি যখন ভূতত্ত্ব পাঠ করেছিলেন, তখন ভূতত্ত্ব তার কাছে বোরিং লেগেছিল। কিন্তু ১৮৩১ সালের ইস্টারের সময় থেকে অ্যাডাম সেজউইকের কাছ থেকে ভূতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শেখেন, এবং সেই জিওলজিকাল ফিল্ড ট্রিপ থেকে ভূতত্ত্ব সম্পর্কে অনেক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ২৪ আগস্টে হেনস্লো ডারউইনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “… আমি মনে করি এরকম পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তুমিই সব থেকে বেশি যোগ্য। আর এটা এজন্য মনে করিনা যে তুমি একজন প্রশিক্ষিত প্রকৃতিবাদী, বরং এই কারণে মনে করি যে, তুমি সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যা কিছু থাকে সবকিছুই নোট করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারদর্শী। পিকক এই নিয়োগের ভার নিচ্ছেন, আর যদি তিনি উপযুক্ত কাউকে না খুঁজে পান তবে এই সুযোগ হয়তো আর কখনোই পাওয়া যাবেনা। আমার জানা মতে ক্যাপ্টেন ফিট্‌জরয়ের একজন নিছক সংগ্রাহকের চেয়ে একজন সাথীরই বেশ দরকার, আর তাকে কেবল ভাল প্রকৃতিবিজ্ঞানী হলেই চলবে না একজন জেন্টলম্যান বা ভদ্রলোকও হতে হবে… অভিযানটি দুই বছর চলবে, আর যদি তুমি সাথে যথেষ্ট পরিমাণে বই নিয়ে যাও তবে তুমি যাই চাও তাই হয়তো করা সম্ভব হবে… একজন উৎসাহী ব্যক্তির পক্ষে এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর হয়না… নিজের অক্ষমতার ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ বা ভীতিও রেখো না, আমি তোমাকে এই নিশ্চয়তা দান করছি যে, আমার মতে তুমিই এই কাজের জন্য সবথেকে উপযুক্ত।”

চিঠিটি প্রথমে জন পিককের কাছে যায়, আর সাথে সাথেই তিনি তা ডারউইনকে আরও ডিটেইল সমেত ফরোয়ার্ড করে দেন, আর তাকে নিশ্চিত করেন যে সেপ্টেম্বরের শেষের জাহাজটি যাত্রা করবে। পিকক এই অফারটি নিয়ে বিউফোর্টের সাথে আলোচনা করেন। তিনি এর পুরোপুরি অনুমোদন দেন। ডারউইন ২৯ আগস্টে চিঠিটি পান। ২২ বছর বয়সী তরুণ গ্র্যাজুয়েট চার্লস ডারউইন চাইতেন “মানুষ” হবার পূর্বেই ট্রপিক ভ্রমণ করতে। কিন্তু তার বাবা তার এই অভিযানকে একেবারেই মেনে নেননি, ফলে ডারউইন অফারটি ত্যাগ করেন ও তার আংকল দ্বিতীয় জোশিয়াহ ওয়েজউডের কাছে চলে যান। আংকলের সহায়তায় তিনি তার বাবাকে তার অভিযানের ফান্ডিং করাতে রাজি করান। ১লা সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ডারউইন লেখেন তিনি পিককের অফার গ্রহণ করেছেন। সেইদিনই বিউফোর্ট ফিট্‌জরয়কে চিঠিতে লেখেন যে তার বন্ধু পিকক তোমার জন্য একজন “সারভেন্ট” ম্যানেজ করতে পেরেছে, তিনি হলেন মি. ডারউইন, সনামধন্য দার্শনিক ও কবি এরাসমাস ডারউইনের নাতি, যে দক্ষিণ আমেরিকায় নিজের অভিযানের উৎসাহ ও উদ্যমে পরিপূর্ণ। শুক্রবারে ডারউইন কেমব্রিজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, সেখানে শনিবারটা হেনস্লোর সাথে কাটান আর প্রস্তুতির ব্যাপারে উপদেশ ও এক্সপার্টদের রেফারেন্স গ্রহণ করেন।

পিককের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র আলেকজান্ডার চার্লস উড ছিলেন ফিট্‌জরয়ের কাজিন। তিনিও ডারউইনকে রিকমেন্ড করেন। রবিবার ৪ঠা সেপ্টেম্বরে উড ফিট্‌জরয়ের জবাব পান। ফিট্‌জরয়ের জবাবটা খোলাখুলি তবে ভদ্রোচিত ছিল, তিনি ডারউইনকে অভিযানে নিতে চাননা। এতে ডারউইন ও হেনস্লো দুজনই এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। তবুও ডারউইন লন্ডনে যান, এবং পরের দিন সকালেই তিনি ফিট্‌জরয়ের সাথে সাক্ষাত করেন। ফিট্‌জরয় তাকে বলেন যে তিনি তার বন্ধ মি. চেস্টারকে নেবেন বলে প্রমিস করেছেন (সম্ভবত ঔপন্যাসিক হ্যারি চেস্টারের কথা বলছেন), কিন্তু ডারউইনের আসার ৫ মিনিট আগেই চেস্টারের চিঠি তার কাছে এসেছে, তিনি এই অভিযানে যোগ দিতে পারবেন না জানিয়েছেন। ফিট্‌জরয় ডারউইনকে তাদের কার্যস্থলের বাজে পরিবেশগত অবস্থা ও সাধারণ খাদ্যের কথা বলেন, এই দিকগুলোতেই তিনি বেশি জোর দেন। কিন্তু এই প্রতিকূলতার কথাগুলো ডারউইনের ইচ্ছাশক্তিকে দমাতে পারেনি। ফিট্‌জরয় তাকে বলেন ডারউইনের নাম এডমিরাল্টি বা নৌবাহিনীর বইতে থাকবে তিনি প্রতি বছর ৪০ পাউন্ডের প্রোভিশন পাবেন। সেই সাথে জাহাজের অফিসার ও ক্যাপ্টেনদের মতই তাকে বছরে ৩০ পাউন্ড পরিশোধ করতে হবে। আর সাজসজ্জা সহ তার খরচ ৫০০ পাউন্ড ছাড়াবে না। জাহাজটি ১০ অক্টোবরে যাত্রা করবে, আর সম্ভবত তিন বছরের জন্য বাইরেই থাকবে। তারা একসাথেই নৈশভোজ সম্পন্ন করেন, আর শীঘ্রই নিজেদেরকে একে অপরের সাথে খুব মানিয়ে নেন। ফিট্‌জরয় ছিলেন একজন টোরি, অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজনীতিতে তিনি টোরিবাদকে সমর্থন করতেন, টোরিবাদ হলো ট্রেডিশনালিজম ও কনজারভেটিজমের ব্রিটিশ ভারশন। অন্যদিকে ডারউইনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল হুইগ। হুইগবাদ ছিল লিবারালিজম বা উদারতাবাদের ব্রিটিশ ভার্শন। ফিট্‌জরয় ডারউইনকে জানান, তার সাথে হুইগ ব্যাকগ্রাউন্ডের যে এক অপরিচিত তরুণ এত বছর ধরে জাহাজে কাটাবেন সেই লোকের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, পাছে এমনই হয় কিনা যে এমন একজনের সাথে এতটা বছর চলছেন যাকে তিনি পছন্দই করেন না… এই সব সাত-পাঁচ ভেবেই তিনি ডারউইনকে প্রত্যাখ্যান করে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু ডারউইনের সাথে কথা বলে ও নৈশভোজ করে তার এই দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ফিট্‌জরয় ডারউইনকে অভিযানের সঙ্গী হিসেবে নিলেন।

ফিট্‌জরয় ডারুইনকে হাফ-সিরিয়াসলি বললেন, তিনি জোহান ক্যাস্পার ল্যাভাটারের একনিষ্ঠ শিষ্য। ল্যাভাটারের ফিজিওনমির ভিত্তিতে তিনি ডারউইনের নাকের আকৃতি দেখেই তাকে প্রায় বাতিল করে দিয়েছিলেন, ল্যাভাটার তত্ত্ব অনুয়ায়ী ডারউইনের নাকের মত নাকওয়ালাদের একাগ্রতার অভাব থাকে! ফিজিওনমি মানে হলো গিয়ে ব্যক্তির বাইরের রূপ, বিশেষ করে চেহারে দেখে তার পারসোনালিটি বা ব্যক্তিত্বকে শনাক্ত করার বিদ্যা। আজকের যুগে একে অপবিজ্ঞান ধরা হয়, কিন্তু সেকালে এর অনেক প্রভাব ছিল। ফিট্‌জরয় ছিলেন এর প্রভাবে প্রভাবিত। ডারউইন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ফিট্‌জরয় তাকে অভিযানের সঙ্গী হিসেবে নেবার প্রস্তাব প্রায় প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছিলেন, আর এর কারণ ছিল ডারউইনের নাকের গঠন। ফিট্‌জরয় সন্দেহ করছিলেন, ডারউইনের যে নাক তাতে তার মধ্যে সমুদ্রযাত্রা করার মত শক্তি ও সংকল্প থাকতে পারেনা। ফিট্‌জরয় কি আর তখন বুঝতে পেরেছিলেন, এই ডারউইনই তার “সামান্য” জরিপের অভিযানকে পরিণত করতে চলেছেন এক গ্রাউন্ড-ব্রেকিং সাইন্টিফিক এক্সপেডিশনে!?!

ডারউইনের প্রস্তুতি

ফিট্‌জরয় কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে ডারউইন তার সাথে যাত্রার সাপ্লাই ও ইকুইপমেন্ট সংক্রান্ত শপিং শুরু করেন। সেই সাথে তাকে বিভিন্ন এক্সপার্টদের এডভাইসের জন্যও ছুটতে হয়। তিনি জুলজিকাল সোসাইটি অফ লন্ডনের স্পেসিমেন সংগ্রহ সংক্রান্ত এক্সপার্ট যেমন উইলিয়াম ইয়ারেল, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রবার্ট ব্রাউন, প্রথম অভিযান এর পরিচালক ক্যাপ্টেন ফিলিপ পারকার কিং, ও এডিনবার্গে ডারউইনের শিক্ষক ইনভারটেব্রেট (অমেরুদণ্ডী) অ্যানাটমিস্ট রবার্ট এডমন্ড গ্রান্ট এর উপদেশ গ্রহণ করেন। ইয়ারেল তাকে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন, এবং তিনি দোকানদের সাথে দামাদামি করে দেন যার ফলে দুটো পিস্তল ও একটা রাইফেলের জন্য ডারউইনকে মাত্র ৫০ পাউন্ড পরিশোধ করতে হয়, যেখানে ফিট্‌জরয় তার ফায়ার-আর্মের জন্য ৪০০ পাউন্ড খরচ করেছিলেন। ১১ই সেপ্টেম্বর রবিবার ফিট্‌জরয় ও ডারউইন পোর্টসমাউথের উদ্দেশ্যে স্টিম প্যাকেটে (নিয়মিত শিডিউল করা কারগো) চড়ে রওনা হন। ডারউইনের সি সিকনেস ছিলনা। এই তিনদিনের জাহাজযাত্রা তাদের ভালই কাটল। এই প্রথমবার তিনি খুব ছোট ক্র্যাম্পড শিপ দেখলেন ও অফিসারদের সাথে সাক্ষাত করলেন। তার জন্য একটা বড় কেবিন দেখে তিনি খুশিই হলেন, কেবিনটি তাকে তার এসিস্টেন্ট সার্ভেয়র জন লর্ট স্টোক্সের সাথে শেয়ার করতে হবে। শুক্রবার ডারউইন লন্ডনে ফিরে যান এবং কেমব্রিজ হয়ে তিনি ২২ সেপ্টেম্বরে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দেখা যাত্রার আগে দেখা করবার জন্য স্র্যুসবেরিতে যান, এবং ২ অক্টোবরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বিগলের যাত্রা শুরু করার কথা ছিল ১৮৩১ সালের ২৪ অক্টোবর। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে নিতে দেরি হয়ে যাওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। বিগলের যাত্রা ডিলে হওয়ায় ডারউইন এক্সপার্টদের এডভাইস নেবার জন্য ও তার ব্যাগেজ প্যাক করার জন্য অতিরিক্ত সময় পান। স্টিম প্যাকেটে করে তার ভারি জিনিসপত্র পাঠানোর অর তিনি কোচে অগাস্টাস আর্ল সমেত ২৪ অক্টোবরে ডেভনপোর্টে পৌঁছান।

ভূতাত্ত্বিক চার্লস লিয়েল ফিট্‌জরয়কে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ফিচার যেমন ইরেটিক বোল্ডার সম্পর্কে পর্যবেক্ষণগুলোর রেকর্ড করতে অনুরোধ করেন। ইংল্যান্ড ত্যাগ করার পূর্বে ফিট্‌জরয় ডারউইনকে লিয়েলের প্রিন্সিপল অফ জিওলিজি বইটার প্রথম ভলিউমের একটা কপি দেন। লক্ষ-কটি বছর ধরে ধীরে ধীরে যে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটছে তার ফলস্বরূপ ভূতত্ত্বের ফিচারগুলো কেমন হচ্ছে সেই ব্যাপারে বইটিতে ব্যাখ্যা দেয়া ছিল। হেনস্লো তার অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেন তিনি ডারউইনকে বইটি জোগার করে পড়ে নিতে বলেছিলেন।

অভিযানটিতে ডারউইনের অবস্থান ছিল একজন নিজ-খরচে যাওয়া ও বিনা অফিশিয়াল এপয়েন্টমেন্টে কাজ করা একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে, তাই তিনি যখন চাইবেন তখনই অভিযান ত্যাগ করতে পারতেন। অভিযান শুরুর আগে আগে জর্জ পিকক ডারউইনকে বলেছিলেন, “নৌবাহিনী বা এডমিরাল্টি তোমাকে বেতন দেবে না, কিন্তু তারা তোমাকে অফিশিয়াল এপয়েন্টমেন্ট ও সবরকম একোমডেশন দান করবে। যদি স্যালারির প্রয়োজন হয় তাহলে আমার মনে হয় তা গ্রান্টেড হবে।” কিন্তু ডারউইনের মধ্যে এই বিষয়ে কোন উদ্বিগ্নতা ছিলনা। তার একমাত্র উদ্বিগ্নতা ছিল তার সংগৃহীত স্পেসিমেনগুলোর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। এমনকি এজন্য তিনি এডমিরালটির বইএ তার নাম তোলার ব্যাপারেও অনিচ্ছুক ছিলেন, পাছে যদি সরকার তার স্পেসিমেনগুলোর নিয়ন্ত্রণের অধিকারে ভাগ বসায়। শেষে ফিট্‌জরয় ও বিউফোর্টের নিশ্চয়তা দানের পর তিনি এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলেন, তারা বললেন এতে তার স্পেসিমেনের নিয়ন্ত্রণের অধিকারে কোন হেরফের হবেনা। ডারউইন চাননি যে তার সংগ্রহ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাক, কারণ তিনি শুনেছিলেন প্রথম অভিযানে যে স্পেসিমেনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো এখনও ডেসক্রাইব করা হয়নি, সেগুলো পড়েই আছে। বিউফোর্ট তাকে নিশ্চিত করেন, তিনি যদি তার স্পেসিমেনকে জুলজিকাল বা জিওলজিকাল সোসাইটির মত কোন পাবলিক বডিতে ইপস্থাপন করেন তাহলে এই ব্যাপারে কোন সমস্যা হবেনা। হেনস্লো কেমব্রিজে ফিলোসফিকাল সোসাইটি অফ মিউজিয়াম নামে একটা সংগ্রহশালা স্থাপন করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ডারউইন সেটায় তার স্পেসিমেনগুলো দিতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার স্পেসিমেনগুলো “সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে কেন্দ্রীয় সংগ্রহশালায়” যাক। কিন্তু স্পেসিমেনগুলোর চালানের ডেলিভারির ব্যাপারে হেনস্লো এর উইলিং এগ্রিমেন্ট পাবার পর ডারউইন তাকে জানান তিনি কেমব্রিক মিউজিয়ামকে তার কিছু স্পেসিমেন দান করবেন।

অভিযানে ডারউইনের কাজ

১০ই ডিসেম্বরে জাহাজটি ডেভনপোর্ট বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করল। খারাপ আবহাওয়ার কারণে জাহাজটিকে কিছু দূর গিয়ে প্লিমাউথ সাউন্ডের পশ্চিম পাশে বার্ন পুলে প্রথম নোঙ্গর করতে হলো। অবশেষে ২৭শে ডিসম্বরে বিগল বার্ন পুল থেকে যাত্রা শুরু করে প্লিমাউথ শহর অতিক্রম করলো। বিগল আটলান্টিক মহাসাগর জুড়ে যাত্রা করে এবং দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল বরাবর এটি ব্যাপকভাবে ডিটেইলড হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে করে। এরপর জাহাজটি নিউজিল্যান্ড, তাহিতি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, হোবার্ট টাউন (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬), ফালমাউথ, করনওয়েল হয়ে, অর্থাৎ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ১৮৩৬ সালের ২রা অক্টোবরে ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। পরিকল্পনা ছিল এই অভিযানটি চলবে মাত্র দুই বছরের জন্য, কিন্তু এটি সমাপ্ত হতে হতে ৫টা বছর লেগে যায়। সামুদ্রিক অভিযান হলেও ডারউইন এই অভিযানের বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন ভূমিতে। সমগ্র সমুদ্রযাত্রার মধ্যে তিন বছর তিন মাস বা ৩৯ মাস তিনি কাটান ভূমিতে, আর বাকি ১৮ মাস তিনি কাটান সমুদ্রে।

ডারউইন এই অভিযানের সময় চার্লস লিয়েলের (Charles Lyell) পিন্সিপলস অফ জিওলজি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হন। অভিযানের শেষে ডারউইন একজন জিওলজিস্ট এবং ফসিল কালেক্টর হিসেবে নিজের পরিচিতি ঠিক করে নেন। যাত্রার শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি ভূতত্ত্ব নিয়ে একটি বই লিখতে পারেন, এবং তার ভূতত্ত্বের ব্যাপারে তার যথেষ্ট প্রতিভাও ছিল। আর্জেন্টিনার পুন্টা আল্টায় তিনি বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিশাল জীবাশ্ম বা ফসিল খুঁজে পান, সেই সময় এই বিলুপ্ত প্রজাতির খুব কম সংখ্যক ফসিল স্পেসিমেনই পাওয়া গিয়েছিল। তিনি এই অভিযানে উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের নিয়ে যা যা পর্যবেক্ষণ করেছিল তা বিস্তারিত আকারে লিখে রাখেন। আর এখান থেকে যা বেরিয়ে আসে তা ডারউইনকে চমকে দিল। এতদিন মানুষ জানত প্রজাতিরা স্থির, কিন্তু তার এই পর্যবেক্ষণ অন্য কিছু ইঙ্গিত করছে।

এই অভিযানে ক্যাপ্টেনকে তার সারভে নিয়ে প্রচুর পেপারওয়ার্কের কাজ করতে হয়। সেই সাথে ডারউইনও তার কাজের ডেইলি লগ রাখতেন, তার ফাইন্ডিং ও স্পেকুলেশনগুলোর বিস্তারিত তার নোটবুকগুলোতে লিখতেন, সেই সাথে তিনি ডায়রিও লেখেন যা তার জার্নালে পরিণত হয়। ডারউইনের নোটবুকে দেখা যায় তার পূর্ণাঙ্গ পেশাদারিত্ব। এই পেশাদারিত্ব তিনি অর্জন করেছিলেন সম্ভবত তার এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এই ছাত্রজীবনে তিনি ১৮২৬ সালে তার ভাই ইরাসমাসের সাথে ফার্থ অফ ফোর্থ এর উপকূল এক্সপ্লোর করার সময় ও ১৮২৭ সালে রবার্ট এডমান্ড গ্রান্টের কাছে কয়েক মাস সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের নিয়ে পড়াশোনার সময় নেচারাল হিস্টোরির নোট কিভাবে নিতে হয় তা শিখেছিলেন। ডারউইন কেমব্রিজে গুবরে পোকা সংগ্রহও করেছিলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক ইতিহাসের অন্যান্য এরিয়াতে তিনি দক্ষ ছিলেন না। এই অভিযানের সময়েই ডারউইন অন্যান্য স্পেসিমেনগুলো সংগ্রহ করার সময় ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের নিয়ে ইনভেস্টিগেট করেন। ইংল্যান্ডে ফিরে এক্সপার্টদেরকে এইসব বিষয়ে বর্ণনা করবেন ও এগুলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন এই আশায় তিনি এই কাজগুলো করেছিলেন। তিনি যত্নের সাথে যে জুলজি নোটগুলো তৈরি করেছিলেন সেগুলোর অর্ধেকেরও বেশি ছিল সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের নিয়েই। তিনি এই অমেরুদণ্ডী প্রাণী স্পেসিমেনদেরকে উপর কিছু পরীক্ষা করেন, দেখেন কোন উদ্দীপনায় এরা কেমন সাড়া দিচ্ছে। এরপর এদেরকে তিনি ব্যবচ্ছেদ করে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে এদের অঙ্গানুগুলো দেখেন। তারপর এদের কমপ্লেক্স ইন্টারনাল অ্যানাটমি নিয়ে যা যা পেলেন সেগুলো যৌক্তিক ও বিস্তারিত বর্ণনা সহ নোট করেন। তার উপকূলীয় পর্যবেক্ষণে তার দেখা প্রাণীগুলোর আচরণ, ডিস্ট্রিবিউশন ও পরিবেশের সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়ে গভীর ও বিশ্লেষণী মতামতের উল্লেখ ছিল। জাহাজটিতে প্রাকৃতিক ইতিহাসের বই এর একটি অসাধারণ ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল। ডারউইন সেই লাইব্রেরিটির সদ্ব্যবহার করেন। কিন্তু বারবার তিনি সেই বইগুলোতে যা লেখা হয়েছে তার সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন।

এই অভিযানে ডারউইনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভূতত্ত্ব। আর ভূতত্ত্ব নিয়ে তার নোট ছিল জুলজি নিয়ে তার নোট এর প্রায় চারগুণ। অবশ্য তিনি ভূতত্ত্ব ও প্রাণীবিজ্ঞান – উভয় বিষয়েই ব্যাপক আকারে নোট রাখেন। এই অভিযানের সময় তিনি তার বোনকে লেখেন, “ভূতত্ত্বের মত কোন জিনিস হয়না; প্রথমবার পাখি শিকারের আনন্দ বা প্রথম বারের শিকার আনন্দকে কোনভাবেই এক গুচ্ছ সুন্দর ফসিল হাড় আবিষ্কারের আনন্দের মত হতে পারেনা, এটি যেন বর্তমানের জিভ দিয়ে অতীতের গল্পের বর্ণনা”। এই ইনভেস্টিগেটিভ জিওলজিই ডারউইনকে তার তত্ত্বের বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিল। ডারউইন এই পর্যবেক্ষণ থেকে যা যা লিখে রাখেন তাই তার ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তি প্রদান করেছিল। ডারউইন এই অভিযানে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে ডায়রি লিখেছিলেন, এবং পরে তিনি এটাকে “জার্নাল এন্ড রিমার্ক্‌স” নামে পুনরায় লেখেন এবং ১৮৩৯ সালে এটিকে এই অভিযানের অফিশিয়াল নথির ৩য় খণ্ড হিসেবে প্রকাশ করেন। এই ট্রাভেলগ ও সাইন্টিফিক জার্নালটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে, আর বিভিন্ন ভাষায় এই লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়, তবে এটি “দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল” নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে। ডারউইন উল্লেখ করেন, এটাই ছিল প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে তার প্রথম সত্যিকারের ট্রেইনিং।

তথ্যসূত্র

1. Browne, E. Janet; Neve, Michael (1989), “Introduction”, in Darwin, Charles (ed.), Voyage of the Beagle: Charles Darwin’s Journal of researches, London: Penguin Books, ISBN 9780140432688
2. Taylor, James (2008), The Voyage of the Beagle: Darwin’s Extraordinary Adventure in Fitzroy’s Famous Survey Ship, Conway, ISBN 978-1-84486-066-1
3. King, P. P. (1839), FitzRoy, Robert (ed.), Narrative of the surveying voyages of His Majesty’s Ships Adventure and Beagle between the years 1826 and 1836, describing their examination of the southern shores of South America, and the Beagle’s circumnavigation of the globe. Proceedings of the first expedition, 1826–30, under the command of Captain P. Parker King, R.N., F.R.S., I, London: Henry Colburn, retrieved 27 January 2009
4. Darwin, Charles (1845), Journal of Researches into the natural history and geology of the countries visited during the voyage of H.M.S. Beagle round the world, under the Command of Capt. Fitz Roy, R.N. 2d edition, London: John Murray
5. FitzRoy, Robert (1839), Narrative of the surveying voyages of His Majesty’s Ships Adventure and Beagle between the years 1826 and 1836, describing their examination of the southern shores of South America, and the Beagle’s circumnavigation of the globe. Proceedings of the second expedition, 1831–36, under the command of Captain Robert Fitz-Roy, R.N., II, London: Henry Colburn, retrieved 27 January 2009
6. Browne, E. Janet (1995), Charles Darwin: vol. 1 Voyaging, London: Jonathan Cape, ISBN 1-84413-314-1
7. van Wyhe, John (2013), “”My appointment received the sanction of the Admiralty”: Why Charles Darwin really was the naturalist on HMS Beagle” (PDF), Studies in History and Philosophy of Science Part C: Studies in History and Philosophy of Biological and Biomedical Sciences, Elsevier BV, 44 (3): 316–326, doi:10.1016/j.shpsc.2013.03.022, PMID 23664568
8. Keynes, Richard (2001), Charles Darwin’s Beagle Diary, Cambridge University Press, retrieved 27 January 2009
9. van Wyhe, John (2013), “”My appointment received the sanction of the Admiralty”: Why Charles Darwin really was the naturalist on HMS Beagle” (PDF), Studies in History and Philosophy of Science Part C: Studies in History and Philosophy of Biological and Biomedical Sciences, Elsevier BV, 44 (3): 316–326, doi:10.1016/j.shpsc.2013.03.022, PMID 23664568
10. https://www.darwinproject.ac.uk/

উইকিপিডিয়া নিবন্ধ – HMS Beagle, Jemmy Button, Second voyage of HMS Beagle

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.