সেই ছেলেবেলা থেকেই বিষণ্ণতা (Depression) জিনিসটা আমার ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে আছে। মাঝে মাঝে আসে, জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে আবার হয়তো কিছুদিন শান্ত থাকে। এমনও দিন গেছে, নিজের শরীরে নিজেই আঘাত করেছি, মাসের পর মাস ঘর থেকে বের হইনি বললেই চলে – কেবল সরকারি খাতায় সই করতে বা কোনোমতে দিন কাটানোর মতো খাবারটুকু কিনতে বেরোনো। মানসিক রোগের হাসপাতালেও (psychiatric wards) কাটাতে হয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। পুরোপুরি সেরে গেছি, তা বলব না। তবে ভালো খবর হলো, ইদানীং এই বিষণ্ণতার উৎপাত আর তার ঝাঁঝ দুটোই বেশ কমেছে। কেন কমেছে? কিছুটা হয়তো জীবনের স্রোত পাল্টানোর কারণে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ হলো, এই বিষণ্ণতা আর এর পেছনের কারণগুলো নিয়ে আমি এখন অন্যভাবে ভাবতে শিখেছি।
আমার এই নিজের দুঃখের কাহিনি শোনানোর উদ্দেশ্য নিজেকে জাহির করা নয়। আমার অভিজ্ঞতা আর দশজনের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। বরং এটা বলার কারণ হলো, অনেক ধরনের বিষণ্ণতাকেই আসলে কেবল ব্যক্তিগত ‘মনের অসুখ’ (psychological) না ভেবে, যদি একটু বড় ক্যানভাসে, সমাজের আর রাজনীতির দিক থেকে দেখি, তাহলে ব্যাপারটা হয়তো ভালোভাবে বোঝা যায়, আর এর সাথে লড়তেও সুবিধা হয়।
নিজের বিষণ্ণতা নিয়ে লিখতে বসাটা বেশ কঠিন। কারণ বিষণ্ণতার ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে ভেতরের একটা বিদ্রূপকারী কণ্ঠ (inner voice)। সে অনবরত কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে, “আরে ধুর! কিসের কী! সব বাহানা! নিজের জন্য মায়া দেখানো হচ্ছে, তাই না? উঠে দাঁড়াও তো বাপু!” আর যেই না আপনি দশজনের সামনে এ নিয়ে মুখ খুলতে যাবেন, অমনি সেই ভেতরের কণ্ঠটা যেন আরও গলা চড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করে। সত্যি বলতে কি, এই গলাটা তো ঠিক আমার ভেতরের না। এটা আসলে বাইরের দুনিয়ার নানা চাপ, নানা সামাজিক শক্তির (social forces) মনের ভেতরে গেঁথে যাওয়া প্রতিধ্বনি। আর এই শক্তিগুলোর মধ্যে কারও কারও হয়তো বিষণ্ণতা আর রাজনীতির মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ায় ঘোরতর আপত্তি আছে – নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায়।
আমার বিষণ্ণতার সাথে আঠার মতো লেপ্টে ছিল একটা বিশ্বাস – যে আমি আক্ষরিক অর্থেই কোনো কাজের না, গুড ফর নাথিং। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের সিংহভাগ সময় আমি এটাই মেনে নিয়ে কাটিয়েছি যে, আমাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কুড়ির কোঠায় জীবনটা কেটেছে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা, বেকারত্ব আর এখানে-ওখানে অস্থায়ী চাকরির চক্করে। আর যেখানেই গেছি, মনে হয়েছে আমি বেমানান। লেখাপড়ায় ছিলাম একরকম শখের পড়ুয়া (dilettante), যে কোনোমতে ফাঁকফোকর গলে টিকে আছে, আসল জ্ঞানী বা পণ্ডিত নয়; বেকার? ঠিক তাও না, যারা সত্যিই কাজ খুঁজছে তাদের মতো তো নই-ই, বরং এক ফাঁকিবাজ; আর অস্থায়ী চাকরিতেও মনে হতো কিছুই পারছি না, আর তাছাড়া এসব অফিস-কারখানার কাজ আমার জন্য নয়। ভাববেন না যে আমি সেই কাজগুলোর জন্য নিজেকে একটু বেশি উপযোগী (too good) ভাবতাম, বরং ঠিক উল্টোটা – আমি ছিলাম বেশি পড়া কিন্তু অকেজো (over-educated and useless) একজন, যে এমন কারো চাকরি দখল করে বসে আছে যার এটা আমার চেয়ে বেশি দরকার ছিল, যোগ্যতাও বেশি ছিল। এমনকি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও মনে হতো, আমি আসলে বিষণ্ণ-টিষণ্ণ কিছুই না – হয় কাজ এড়ানোর জন্য অভিনয় করছি, অথবা (বিষণ্ণতার সেই অদ্ভুত প্যাঁচালো যুক্তিতে) অভিনয় করছি এটা ঢাকার জন্য যে আমি আসলে কাজ করার ক্ষমতাই রাখি না, আর এই সমাজে আমার কোনো দামই নেই।
অনেক পরে যখন একটা ফারদার এডুকেশন কলেজে (Further Education college) লেকচারারের চাকরি পেলাম, কিছুদিন বেশ উড়ুউড়ু লেগেছিল। কিন্তু এই ফুর্তিটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল যে, ভেতরের সেই মূল্যহীনতার বোধটা যায়নি, যা কিনা কিছুদিনের মধ্যেই আবার বিষণ্ণতার কালো মেঘ ডেকে আনবে। যারা জন্ম থেকেই এসব পদের জন্য তৈরি, তাদের চেহারায় যে একটা নিশ্চিন্ত আত্মবিশ্বাস থাকে, সেটা আমার ছিল না। মনের খুব গভীরে কোথাও, আমি স্পষ্টতই বিশ্বাস করতাম না যে শিক্ষকতার মতো একটা কাজ করার মতো মানুষ আমি।
কিন্তু কোথা থেকে এল এই পোকাটা? মনশ্চিকিৎসার (psychiatry) দুনিয়ায় যারা মাতব্বর, তারা বলবেন এটা নাকি মস্তিষ্কের রাসায়নিক গড়বড়ের (malfunctioning brain chemistry) ফল, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। মনোবিশ্লেষণ (psychoanalysis) বা ওই ঘরানার থেরাপিগুলো আবার মানসিক কষ্টের শিকড় খোঁজে ছেলেবেলার গল্পে, পারিবারিক ইতিহাসে। আর কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি এইসব নেতিবাচক বিশ্বাসের উৎস খোঁজার চেয়ে সেগুলোকে কিছু মন-ভালো-করা গল্প দিয়ে চাপা দিতেই বেশি ব্যস্ত। ব্যাপারটা এমন না যে এই ব্যাখ্যাগুলো ডাহা মিথ্যে। কিন্তু আসল কারণটা তারা এড়িয়ে যায়, এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেটা হলো সামাজিক ক্ষমতা (social power)। আমার বেলাতে সেটা ছিল মূলত শ্রেণী ক্ষমতা (class power), যদিও লিঙ্গ, বর্ণ বা অন্য ধরনের চাপও (oppression) মানুষকে একইরকম অস্তিত্বের সংকটে (ontological inferiority) ফেলে দেয়। এই হীনম্মন্যতার অনুভূতিটা ঠিক কেমন? ঠিক ওই যে আগে বললাম: মনে হতে থাকে, আমি আসলে ‘সেই জাতের’ মানুষই না যে কিনা সমাজের উঁচু তলার (dominant group) জন্য রাখা কাজগুলো করতে পারে।
আমার ‘ক্যাপিটালিস্ট রিয়ালিজম’ (Capitalist Realism) বইটা পড়ার পর এক পাঠক আমাকে ডেভিড স্মেইল (David Smail) নামে একজনের লেখা পড়তে বললেন। স্মেইল একজন থেরাপিস্ট ঠিকই, কিন্তু তিনি ক্ষমতার প্রশ্নটাকে খুব গুরুত্ব দেন। তার লেখা পড়ে বুঝলাম, বিষণ্ণতা নিয়ে আমি যা যা আন্দাজ করছিলাম, তা একেবারে মিথ্যে নয়। স্মেইল তার জরুরি বই ‘দি অরিজিনস অফ আনহ্যাপিনেস’ (The Origins of Unhappiness)-এ দেখাচ্ছেন, কীভাবে শ্রেণীর ছাপগুলো (marks of class) অনেকটা জন্মের দাগের মতো হয়ে থেকে যায়। যারা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের ছোট (lesser) ভাবতে শেখে, তারা পরে যতই ডিগ্রি বা টাকা-পয়সা করুক না কেন, নিজেদের বা অন্যদের চোখে সেই প্রথম জীবনের গেঁথে যাওয়া মূল্যহীনতার (primordial sense of worthlessness) বোধটা প্রায়ই মুছতে পারে না। যদি কেউ তার জন্য ঠিক করে দেওয়া গণ্ডি (social sphere) পেরিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করে, তার লাগে ভয়, লাগে আতঙ্ক (panic), যেন পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে (vertigo): “…যেন একা, বিচ্ছিন্ন, চারিদিকে শত্রু শত্রু ভাব, কোনো অবলম্বন নেই, ধরে রাখার মতো কিছু নেই; মাথা ঝিমঝিম করা এক অবাস্তবতায় সব গুলিয়ে যায়; মনে হয় নিজের কোনো পরিচয়ই বুঝি আর থাকবে না (complete loss of identity), আদ্যোপান্ত এক জোচ্চোর বনে গেছি; এখানে থাকার, এই শরীরে থাকার, এই পোশাকে থাকার কোনো অধিকারই নেই; আপনি এক ‘কিছু না’ (nothing), আর আক্ষরিক অর্থেই অনুভব করেন যে আপনি একটা ‘কিছু না’-তেই মিলিয়ে যেতে চলেছেন।” (Smail, 1987)।
আজকাল শাসক শ্রেণীর (ruling class) একটা খুব চালু কৌশল হলো সব দায়টা ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া (responsibilisation)। সমাজের নিচু তলার (subordinate class) প্রত্যেককে এমনভাবে বোঝানো হয় যে, তাদের যত দুঃখ-কষ্ট – দারিদ্র্য, সুযোগের অভাব, বেকারত্ব – সব তাদের নিজেদের দোষ, নিজেদের ব্যর্থতা। মানুষ তখন সমাজের কাঠামোকে (social structures) দায়ী না করে নিজের ভাগ্যকেই দোষে। কারণ তাদের তো বোঝানো হয়েছে যে ওইসব কাঠামো-টাঠামো কিছু নেই, ওগুলো দুর্বলদের অজুহাত মাত্র। স্মেইল যাকে বলছেন ‘জাদুকরী ইচ্ছাশক্তি’ (magical voluntarism) – মানে এই বিশ্বাস যে, চাইলেই যে কেউ যা খুশি তাই হতে পারে – এটাই আজকের পুঁজিবাদী সমাজের মূলমন্ত্র (dominant ideology), অলিখিত ধর্ম। রিয়ালিটি টিভি ‘বিশেষজ্ঞ’ থেকে শুরু করে ব্যবসার গুরু (business gurus) আর রাজনীতিবিদ, সবাই এই মন্ত্রই জপে চলেছেন। এই জাদুকরী মন্ত্রের কারণেই সমাজে শ্রেণী চেতনা (class consciousness) আজ তলানিতে, আবার এই তলানিতে থাকার ফলেই মন্ত্রটা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। এটা বিষণ্ণতারই উল্টো পিঠ – যার ভেতরের কথাটা হলো, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দুঃখের জন্য নিজেরাই দায়ী, সুতরাং এই কষ্ট আমাদের প্রাপ্য। এই যেমন এখন ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের বেকারদের (long-term unemployed) উপর এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর চাপ তৈরি করা হয়েছে: যাদের জীবনভর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা কোনো কাজের না (good for nothing), তাদেরই আবার বলা হচ্ছে, আরে! তোমরা তো চাইলে সব পারো (it can do anything it wants to do)!
ব্যাপারটাকে শুধু ব্যক্তিগত ভাবলে চলবে না। যুক্তরাজ্যের মানুষ যে কীভাবে কৃচ্ছসাধনের (austerity) নামে সব মেনে নিচ্ছে, ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে (fatalistic submission), সেটাও আসলে এক ধরনের পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা বিষণ্ণতার (deliberately cultivated depression) ফল। এই বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে এই ধারণায় যে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে (ছোট একটা উঁচু তলার (elite) লোক বাদে সবার জন্য), চাকরি যে একটা আছে এটাই ভাগ্য (তাই বেতন বাড়ার কথা বোলো না), রাষ্ট্রের পক্ষে আর সবার জন্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা (welfare state) চালানো সম্ভব না। এই যে সমষ্টিগত বিষণ্ণতা (Collective depression), এটা শাসক শ্রেণীর আমাদের আবার অধীন বানানোর প্রকল্পের (project of resubordination) ফসল। বহুদিন ধরে আমরা এই ধারণাটা গিলেছি যে, আমরা এমন একদল মানুষ যারা কিছু করতে পারি না। এটা ইচ্ছার অভাব নয়, ঠিক যেমন একজন বিষণ্ণ মানুষ চাইলেই ‘নিজেকে সামলে’ বা ‘মোজা টেনে উঠে দাঁড়িয়ে’ ভালো হয়ে যেতে পারে না।
শ্রেণী চেতনাকে আবার জাগিয়ে তোলা নিঃসন্দেহে পাহাড়প্রমাণ কাজ। কোনো তৈরি দাওয়াই নেই। কিন্তু আমাদের ভেতরের ওই বিষণ্ণ কণ্ঠটা যাই বলুক না কেন, এটা করা সম্ভব। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার নতুন পথ খোঁজা (Inventing new forms of political involvement), পুরনো মরে যাওয়া সংগঠনগুলোকে জাগিয়ে তোলা (reviving institutions that have become decadent), ব্যক্তিগত দুঃখগুলোকে (privatised disaffection) রাজনৈতিক রাগে (politicised anger) বদলে দেওয়া – এইসবই হতে পারে। আর যখন হবে, কে জানে তখন কী না হতে পারে!
রেফারেন্স (References):
Fisher, M. (2009). Capitalist Realism: Is There No Alternative? Zero Books.
Smail, D. (1987). The Origins of Unhappiness: A New Understanding of Personal Distress. Constable.
Leave a Reply