Table of Contents
ভূমিকা
আচ্ছা, আপনার কখনো এমন মনে হয়েছে, যে কাজটা আপনি করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, দিনের পর দিন, সেটা আসলে আপনার কাজই না? কেমন যেন একটা যন্ত্রের মতো করে যাচ্ছেন। কাজের শেষে ক্লান্তি আসছে, মাস শেষে মাইনে পাচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা গভীর শূন্যতা। মনে হচ্ছে, জীবনটা ঠিক যেমন হওয়ার কথা ছিল, তেমন নেই। কেমন যেন সুর কেটে গেছে। অথবা ধরুন, চারপাশের মানুষজনের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, সবাই কেমন একা, বিচ্ছিন্ন। নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে আছে। পাশের ফ্ল্যাটের মানুষটাকে হয়তো আপনি চেনেনই না, যদিও একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর বাস করছেন। এই যে একটা অচেনা লাগা, একটা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি—এটা কি শুধু আপনার একার? নাকি আমাদের সবারই কমবেশি এই অভিজ্ঞতা হয়?
যদি এমনটা মনে হয়ে থাকে, তাহলে আপনি একা নন। প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে, কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) নামে এক জার্মান দার্শনিক ঠিক এই ব্যাপারগুলো নিয়েই গভীরভাবে ভেবেছিলেন। তিনি এর একটা নামও দিয়েছিলেন—বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation বা Estrangement)। তিনি শুধু এই অনুভূতির বর্ণনা দিয়েই থেমে থাকেননি, এর পেছনের কারণগুলোও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। আর সেই কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি মানুষের এক মৌলিক ধারণার কথা বলেছিলেন—প্রজাতি-সত্তা (Species-Being বা Gattungswesen)।
আজকের এই লম্বা আলাপে আমরা মার্ক্সের এই দুটো ধারণাকে একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করব। চেষ্টা করব সহজ ভাষায়, যেন বিষয়টা ধরতে সুবিধা হয়। অনেকটা গল্পের মতো করে এগোনো যাক, কেমন? মার্ক্স সাহেব ভারী ভারী জার্মান শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু তার ভেতরের কথাগুলো ছিল খুব মানবিক, খুব জীবনঘনিষ্ঠ। চলুন, সেই মানবিক গল্পটাই শোনার চেষ্টা করি। কেন আমরা কাজ থেকে, নিজেদের থেকে, এমনকি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি? কোথায় আমাদের সেই ‘প্রজাতি-সত্তা’ হারিয়ে যায়? এই বিশাল জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার পথে মার্ক্স আমাদের কোথায় নিয়ে যান, সেটাই দেখার বিষয়।
মানুষ আসলে কী? মার্ক্সের চোখে ‘প্রজাতি-সত্তা’ (Species-Being)
মার্ক্স যখন মানুষ নিয়ে ভাবছিলেন, তখন তিনি শুধু ভাবেননি যে মানুষ দুটো হাত-পা ওয়ালা একটা প্রাণী যে খায়-দায়, ঘুমায় আর বংশবৃদ্ধি করে। তিনি তার চেয়েও গভীরে যেতে চেয়েছিলেন। মানুষ হিসেবে আমাদের আসল পরিচয়টা কী? কী সেই জিনিস যা আমাদের অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি ‘প্রজাতি-সত্তা’ (Gattungswesen) ধারণাটির অবতারণা করেন, বিশেষ করে তার বিখ্যাত ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানাস্ক্রিপ্টস অফ ১৮৪৪ (Economic and Philosophic Manuscripts of 1844) বইটিতে (Marx, 1959)।
‘প্রজাতি-সত্তা’ শব্দটা শুনলে প্রথমে একটু খটমট লাগতে পারে। মনে হতে পারে, এটা বুঝি বায়োলজির কোনো ব্যাপার। কিন্তু মার্ক্সের কাছে এটা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটা হলো মানুষের সেই সারসত্য (essence), সেই সম্ভাবনা (potential), যা তাকে অনন্য করে তুলেছে। আসুন, একটু ভেঙে ভেঙে বোঝার চেষ্টা করি, মার্ক্স ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।
১. মানুষ শুধু বাঁচে না, জীবন নিয়ে ভাবেও (Conscious Life-Activity):
মার্ক্স বলছেন, পশু আর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো—পশু তার জীবন আর তার কার্যকলাপকে আলাদা করে দেখে না। একটা পাখি বাসা বাঁধে, একটা মাকড়সা জাল বোনে—এটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি (instinct)। তারা এটা করে বেঁচে থাকার তাগিদে, কোনো পরিকল্পনা করে বা এর ফলাফল নিয়ে চিন্তা করে নয়। তাদের কাজ তাদের জীবনের সাথেই মিশে থাকে।
কিন্তু মানুষ? মার্ক্সের মতে, মানুষ তার জীবন-যাপন প্রক্রিয়া (life-activity) থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারে। সে তার কাজ নিয়ে চিন্তা করতে পারে, পরিকল্পনা করতে পারে, এমনকি তার কাজের ফলাফল নিয়েও ভাবতে পারে। সে শুধু বাঁচার জন্য কাজ করে না, বরং তার কাজটাই তার জীবনকে অর্থ দেয়। মার্ক্স বলছেন, মানুষের জীবন-যাপন প্রক্রিয়া হলো সচেতন (conscious) এবং স্বাধীন (free)। অর্থাৎ, আমরা জেনে-বুঝে কাজ করি, কেন করছি, কীভাবে করছি, তার একটা ধারণা আমাদের থাকে। এই সচেতন জীবন-যাপনই (conscious life-activity) হলো আমাদের প্রজাতি-সত্তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ (Marx, 1959, p. 76)।
ধরুন, একটা কাঠঠোকরা পাখি গাছের ডালে ঠোকর দিয়ে গর্ত করে। এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি। সে জানে না কেন করছে, হয়তো খাবারের জন্য বা বাসার জন্য, কিন্তু এর পেছনে তার কোনো সচেতন পরিকল্পনা নেই। কিন্তু একজন কাঠমিস্ত্রি যখন কাঠ কেটে একটা চেয়ার বানান, তখন তার মাথায় একটা নকশা থাকে, তিনি জানেন কেন বানাচ্ছেন, কীভাবে বানাচ্ছেন। তিনি প্রয়োজন ছাড়াও সৌন্দর্যবোধ দিয়ে, নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে জিনিসটা তৈরি করতে পারেন। এই যে সচেতনতা, এই যে কাজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ—এটাই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে।
২. মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য ভাবে (Universality):
পশুরা সাধারণত বাঁচে শুধু নিজেদের আর নিজেদের প্রজাতির তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য। তাদের জগৎটা সীমিত। কিন্তু মার্ক্স বলছেন, মানুষ স্বভাবগতভাবেই সার্বজনীন (universal)। সে শুধু নিজের প্রয়োজন নিয়ে ভাবে না, সে গোটা প্রকৃতিকে, গোটা বিশ্বকে নিজের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। সে প্রকৃতির নিয়ম বোঝে, তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে, আবার তার সৌন্দর্যও উপভোগ করে। শুধু তাই নয়, সে অন্যান্য মানুষের সাথেও নিজেকে যুক্ত মনে করে, একটা বৃহত্তর মানব সমাজের অংশ হিসেবে নিজেকে দেখে।
এই সার্বজনীনতা (universality) মানে হলো, মানুষ প্রকৃতির যেকোনো অংশ নিয়ে কাজ করতে পারে, যেকোনো কিছু তৈরি করতে পারে, শুধু তার তাৎক্ষণিক জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য নয়। সে শিল্পের জন্য শিল্প তৈরি করতে পারে, জ্ঞানের জন্য জ্ঞান অন্বেষণ করতে পারে। সে নিজেকে প্রকৃতির অংশ মনে করে, আবার প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছামতো বদলেও দিতে পারে। এই ক্ষমতা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। মানুষ চাঁদে পর্যন্ত চলে গেছে, ভাবা যায়! একটা পিঁপড়া কি কখনো ভাবে মঙ্গল গ্রহে বাসা বানানোর কথা? হয়তো ভাবে না। কারণ তার জগৎটা তার নিজের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানুষের এই সীমাহীন সম্ভাবনাই তার প্রজাতি-সত্তার আরেকটা দিক। সে শুধু এখানে এবং এখন-এর মধ্যে বাঁচে না, সে অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে, সে দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যেতে চায়।
৩. মানুষ প্রয়োজনের বাইরেও সৃষ্টি করে (Freedom and Creativity):
মার্ক্সের মতে, পশুরা উৎপাদন করে কেবল তখনই, যখন তাদের শারীরিক প্রয়োজন (physical need) দেখা দেয়। খিদে পেলে খাবার খোঁজে, বিপদের আশঙ্কা দেখলে আশ্রয় খোঁজে। তাদের উৎপাদন সবসময় প্রয়োজনের শৃঙ্খলে বাঁধা।
কিন্তু মানুষ? মানুষ প্রয়োজনের বাইরে গিয়েও সৃষ্টি করতে পারে। সে সৌন্দর্যবোধ (laws of beauty) দিয়ে জিনিস তৈরি করতে পারে। একজন কবি কবিতা লেখেন, একজন শিল্পী ছবি আঁকেন—এগুলো সবসময় পেটের দায়ে হয় না। এর মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ থাকে, একটা সৃজনশীলতার (creativity) প্রকাশ থাকে। মার্ক্স বলছেন, মানুষ তখনই সত্যিকার অর্থে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে, যখন সে এই জৈবিক প্রয়োজনের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কিছু সৃষ্টি করতে পারে (Marx, 1959, p. 76)। এই স্বাধীন সৃজনশীলতাই (free, conscious activity) তার প্রজাতি-সত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
যখন একজন মানুষ নিজের আনন্দে, নিজের ভেতরের তাগিদে কোনো কাজ করে, তখন সেই কাজের মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পায়। তার কাজের মধ্যে তার সত্তার প্রতিফলন ঘটে। ধরুন, গ্রামের একজন কুমোর যখন আপন মনে মাটির হাঁড়ি বানাচ্ছেন, তখন তিনি শুধু একটা ব্যবহার্য বস্তু তৈরি করছেন না, তিনি তার বংশপরম্পরায় পাওয়া জ্ঞান, তার নিজের দক্ষতা আর সৌন্দর্যবোধকেও সেই মাটির পাত্রে মিশিয়ে দিচ্ছেন। এই কাজটা তার কাছে শুধু জীবিকা নয়, তার আত্মপ্রকাশেরও মাধ্যম। এখানেই মানুষের মুক্তি, তার প্রজাতি-সত্তার জয়।
৪. মানুষ সামাজিক জীব (Social Being):
মার্ক্স খুব জোর দিয়ে বলেছেন, মানুষ একা একা ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে না। সে জন্মায় একটা সমাজে, বেড়ে ওঠে অন্য মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার (interaction) মাধ্যমে। আমাদের ভাষা, চিন্তা, জ্ঞান, সংস্কৃতি—সবকিছুই আমরা সমাজ থেকে পাই। আমরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রজাতি-সত্তা বিকশিত হয় অন্যদের সাথে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।
মার্ক্স মনে করতেন, মানুষ কেবল তখনই পূর্ণাঙ্গ ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে, যখন সে নিজেকে সমাজের একজন অংশ হিসেবে দেখে এবং সমাজের কল্যাণে নিজের সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করে। তার ভাষায়, “মানুষের সারসত্য কোনো ব্যক্তির মধ্যে নিহিত বিমূর্তন নয়। তার আসল রূপে, এটি হলো সামাজিক সম্পর্কের সমষ্টি” (Marx, Theses on Feuerbach, VI)। অর্থাৎ, আমাদের মানবীয় গুণাবলী—যেমন ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহযোগিতা—এগুলো সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই জন্মায় এবং বিকশিত হয়। আমাদের ‘প্রজাতি-সত্তা’ তাই একটি সামাজিক সত্তা (social being)।
তাহলে সংক্ষেপে ‘প্রজাতি-সত্তা’ মানে কী দাঁড়াল?
মার্ক্সের চোখে, প্রজাতি-সত্তা হলো মানুষের সেই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও বৈশিষ্ট্য যা তাকে পশু থেকে আলাদা করে। এটা হলো:
-
সচেতনভাবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা।
-
গোটা প্রকৃতি ও মানব সমাজকে নিজের জগৎ হিসেবে দেখার সার্বজনীনতা।
-
প্রয়োজনের বাইরে গিয়েও সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতার তাড়নায় কিছু তৈরি করার ক্ষমতা।
-
এবং একটি সামাজিক জীব হিসেবে অন্যদের সাথে মিলেমিশে বিকশিত হওয়ার ক্ষমতা।
এইসব মিলিয়েই হলো মানুষের আসল পরিচয়, তার ‘প্রজাতি-সত্তা’। এটা হলো সেই আদর্শ অবস্থা, যেখানে মানুষ তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচতে পারে, যেখানে তার কাজ তার কাছে আনন্দের উৎস, যেখানে সে প্রকৃতি ও সমাজের সাথে একাত্ম বোধ করে।
কিন্তু মার্ক্স দেখলেন, তার সময়ের শিল্পবিপ্লবোত্তর পুঁজিবাদী সমাজে (capitalist society) মানুষ যেন এই আদর্শ অবস্থা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সে যেন তার নিজের সত্তা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এই অবস্থাকেই তিনি নাম দিলেন ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ বা Alienation।
এবার চলুন, সেই বিচ্ছিন্নতার জগতে প্রবেশ করি। দেখি, কেন এবং কীভাবে মানুষ তার প্রজাতি-সত্তা থেকে দূরে সরে যায়।
বিচ্ছিন্নতার গোলকধাঁধা—মার্ক্সের Alienation তত্ত্ব
‘Alienation’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো কোনো কিছু থেকে দূরে সরে যাওয়া, পর হয়ে যাওয়া, অচেনা হয়ে যাওয়া। মার্ক্স এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের দুরবস্থা বর্ণনা করতে। তিনি তার ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি-তে (1844 Manuscripts) দেখিয়েছেন, কীভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা (capitalist mode of production) মানুষকে তার নিজের কাজ থেকে, কাজের ফল থেকে, তার মানবীয় সত্তা থেকে, এমনকি অন্য মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
মার্ক্সের মতে, এই বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ হলো ব্যক্তিগত মালিকানা (private property) এবং শ্রম বিভাজন (division of labour), বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেভাবে তা প্রয়োগ করা হয়। এখানে উৎপাদনের উপায়গুলো (means of production) – যেমন কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, জমি – থাকে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির (capitalists) হাতে। আর বাকি বিশাল সংখ্যক মানুষ, যাদের এসব কিছুই নেই, তারা বাধ্য হয় তাদের শ্রমশক্তি (labour power) পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করতে। তারা পরিণত হয় মজুরি শ্রমিকে (wage labourer)। এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে বিচ্ছিন্নতার বীজ।
মার্ক্স চার ধরনের বিচ্ছিন্নতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন (Marx, 1959, pp. 70-81)। আসুন, এগুলো একটু বিস্তারিতভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
১. শ্রমের ফল বা উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the Product of Labour):
এটা বুঝতে পারাটা হয়তো সবচেয়ে সহজ। ধরুন, একজন শ্রমিক কারখানায় জুতা তৈরি করছেন। তিনি সারাদিন ধরে শত শত জুতা বানাচ্ছেন। কিন্তু সেই জুতা গুলোর একটাও তার নিজের নয়। সেগুলো কারখানার মালিকের সম্পত্তি। শ্রমিক যত বেশি জুতা বানাচ্ছেন, মালিক তত বেশি ধনী হচ্ছেন। কিন্তু শ্রমিকের নিজের অবস্থা হয়তো একই থাকছে, অথবা তুলনামূলকভাবে আরও খারাপ হচ্ছে। যে জিনিসটা তিনি নিজের হাতে তৈরি করলেন, সেটাই তার কাছে একটা অচেনা, বাইরের বস্তু (alien object) হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই বস্তুটি (জুতা) বাজারে গিয়ে এমন এক শক্তি হয়ে উঠছে যা শ্রমিকের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জুতার দাম বাড়লে বা কমলে, চাহিদা বাড়লে বা কমলে, তার চাকরির নিশ্চয়তা, তার মাইনে—সবকিছু প্রভাবিত হচ্ছে।
মার্ক্স বলছেন, শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে যে বস্তু তৈরি করে, সেই বস্তুটিই তার বিরুদ্ধে একটা স্বাধীন শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। “শ্রমিক যত বেশি সম্পদ উৎপাদন করে, যত বেশি তার উৎপাদনের শক্তি ও পরিধি বাড়ে, সে তত বেশি দরিদ্র হয়। শ্রমিক যত বেশি পণ্য তৈরি করে, সে তত সস্তা পণ্যে পরিণত হয়” (Marx, 1959, p. 71)। অর্থাৎ, নিজের তৈরি বস্তুই যেন তাকে গ্রাস করে ফেলে। যে সৃষ্টিশীলতা দিয়ে সে বস্তুটি তৈরি করেছিল, সেই সৃষ্টির আনন্দ সে পায় না। বস্তুটি তার কাছে আনন্দের উৎস না হয়ে, তার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভাবুন তো, একজন কৃষক যদি নিজের জমিতে ফসল ফলান, সেই ফসলের ওপর তার একটা অধিকার থাকে, একটা মায়া থাকে। তিনি জানেন, এই ফসল তার নিজের, তার পরিবারের। কিন্তু একজন কারখানার শ্রমিক যে হাজার হাজার মোবাইল ফোন বানাচ্ছেন, সেই ফোনগুলোর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনো মায়া জন্মানোরও সুযোগ নেই। ফোনগুলো তার কাছে শুধুই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। এই যে নিজের সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া—এটাই হলো উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতা।
২. উৎপাদন প্রক্রিয়া বা শ্রম-কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the Act of Production / Labour Process):
এটা হয়তো আরও গভীর এক বিচ্ছিন্নতা। মার্ক্স বলছেন, শুধু উৎপাদিত বস্তুটিই নয়, খোদ উৎপাদন প্রক্রিয়াটাই (process of production) শ্রমিকের কাছে একটা বাইরের জিনিস হয়ে যায়। কাজটা তার কাছে নিজের বলে মনে হয় না। এটা যেন তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজ তাকে আনন্দ দেয় না, বরং তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ করে ফেলে।
কেন এমন হয়? কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকের কাজের ধরন, কাজের গতি, কাজের সময়—কোনো কিছুই তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সবকিছু ঠিক করে দেয় মালিক বা ম্যানেজার। শ্রমিককে একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে দেওয়া হয়। তাকে হয়তো দিনের পর দিন একই কাজ করতে হয়—ধরা যাক, একটা স্ক্রু লাগানো বা একটা বোতাম টেপা। এই একঘেয়ে, পুনরাবৃত্তিমূলক (repetitive) কাজ তার সৃজনশীলতাকে মেরে ফেলে। কাজটা তার কাছে জীবনের অংশ মনে হয় না, বরং মনে হয় জীবন থেকে কিছু সময় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
মার্ক্স বলছেন, এই ধরনের শ্রমে শ্রমিক নিজেকে খুঁজে পায় না, বরং নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সে কাজে শান্তি পায় না, বরং অসুখী হয়। সে তার শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে বিকশিত করতে পারে না, বরং তা ক্ষয় করে। ফলে, শ্রমিক কেবল কাজের বাইরে—অর্থাৎ যখন সে খায়, ঘুমায় বা বিশ্রাম করে—তখনই নিজেকে ‘নিজের’ বলে মনে করে। আর কাজের সময় নিজেকে মনে হয় ‘অন্য কারো’। “ফলে, শ্রমিক কেবল তার কাজের বাইরে নিজেকে অনুভব করে, এবং কাজের মধ্যে নিজেকে বাইরের কেউ বলে অনুভব করে। সে যখন কাজ করে না তখন সে ঘরে থাকে, আর যখন কাজ করে তখন সে ঘরে থাকে না” (Marx, 1959, p. 74)।
কাজ যদি হতো মানুষের সৃজনশীলতার প্রকাশ, তার আত্ম-আবিষ্কারের পথ, তাহলে মানুষ কাজের মাধ্যমেই নিজেকে বিকশিত করত। কিন্তু যখন কাজটা হয়ে দাঁড়ায় একটা যন্ত্রের মতো অংশ হয়ে যাওয়া, যখন তাতে কোনো আনন্দ থাকে না, থাকে শুধু ক্লান্তি আর বাধ্যবাধকতা—তখন মানুষ তার নিজের কার্যকলাপ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে কাজ করে শুধু বেঁচে থাকার জন্য, মাস শেষে মাইনে পাওয়ার জন্য। কাজটা তার জীবনের লক্ষ্য থাকে না, থাকে শুধু উপায়। এই অবস্থাই হলো উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা।
৩. প্রজাতি-সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from Species-Being):
এই বিচ্ছিন্নতা আগের দুটি বিচ্ছিন্নতার সরাসরি ফলাফল। মার্ক্স বলছেন, মানুষের ‘প্রজাতি-সত্তা’র মূল কথাই হলো তার স্বাধীন, সচেতন ও সৃজনশীল কার্যকলাপ (free, conscious activity), বিশেষ করে তার শ্রম। শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃতিকে নিজের মতো করে গড়ে তোলে, নিজের সত্তাকে প্রকাশ করে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যখন শ্রম নিজেই একটা বিচ্ছিন্ন, যন্ত্রণাদায়ক আর অমানবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ তার আসল সত্তা, তার ‘প্রজাতি-সত্তা’ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
যেহেতু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ—অর্থাৎ শ্রম—তার কাছে বাইরের, চাপিয়ে দেওয়া এবং অর্থহীন মনে হয়, তাই সে তার মানবীয় সম্ভাবনাকে আর বিকশিত করতে পারে না। তার সচেতন এবং সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তার কাজ পশুর মতো কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে (means of subsistence) পর্যবসিত হয়। মার্ক্সের ভাষায়, “বিচ্ছিন্ন শ্রম মানুষের কাছ থেকে তার প্রজাতি-জীবনকে (species-life) ছিনিয়ে নেয়” (Marx, 1959, p. 77)।
কীভাবে ছিনিয়ে নেয়? মানুষ যখন তার কাজের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, যখন তার কাজটা হয়ে যায় নিছক পেটের দায়ে করা একটা যন্ত্ররূপ প্রক্রিয়া, তখন সে তার মানবীয় গুণাবলী—সৃজনশীলতা, সার্বজনীনতা, স্বাধীনতা—থেকে দূরে সরে যায়। তার জীবন তখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটা হলো কাজের সময়, যা কষ্টকর ও অর্থহীন। আরেকটা হলো কাজের বাইরের সময়, যেখানে সে কেবল তার জৈবিক চাহিদাগুলো (খাওয়া, ঘুম, বংশবৃদ্ধি) পূরণ করে। মার্ক্স খানিকটা শ্লেষের সাথেই বলেছেন যে, মানুষ তখন তার ‘পশুসুলভ’ কাজগুলোতেই (eating, drinking, procreating) কেবল স্বাধীনতা অনুভব করে, আর তার ‘মানবীয়’ কাজগুলোতে (শ্রম, সৃষ্টি) নিজেকে পশুর মতো মনে করে (Marx, 1959, p. 74)।
এইভাবে, যে শ্রম হওয়ার কথা ছিল মানুষের আত্ম-উপলব্ধির পথ, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তার আত্ম-বিসর্জনের কারণ। মানুষ তার নিজের সম্ভাবনা থেকে, তার আসল পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে আর প্রকৃতির সাথে, নিজের কাজের সাথে, নিজের সত্তার সাথে একাত্ম বোধ করতে পারে না। সে পরিণত হয় একটা খণ্ডিত, অপূর্ণাঙ্গ জীবে। এটাই হলো প্রজাতি-সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা।
৪. অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from Other Human Beings / Man from Man):
যখন একজন মানুষ তার নিজের কাজ থেকে, নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে অনিবার্যভাবে অন্য মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মার্ক্স বলছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে একে অপরের প্রতিযোগী (competitor) করে তোলে। শ্রমিককে লড়তে হয় অন্য শ্রমিকের সাথে—কাজের জন্য, সামান্য বেশি মজুরির জন্য। আবার শ্রমিক আর মালিকের সম্পর্ক তো শুরু থেকেই একটা সংঘাতের সম্পর্ক (antagonistic relationship)।
যেহেতু শ্রমিকের শ্রম এবং তার উৎপাদিত পণ্য মালিকের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, তাই মালিককে শ্রমিকের কাছে একজন বাইরের, এমনকি শত্রুভাবাপন্ন (hostile) শক্তি বলে মনে হয়। অন্যদিকে, মালিকও শ্রমিককে দেখে কেবল উৎপাদনের একটা উপায় (means) হিসেবে, মুনাফা তৈরির যন্ত্র হিসেবে, মানুষ হিসেবে নয়।
এই ব্যবস্থায় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আর স্বাভাবিক, মানবিক থাকে না। সম্পর্কগুলো নির্ধারিত হয় অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে, বাজারের নিয়মে। কে কার থেকে কতটা লাভ আদায় করতে পারবে, সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সহানুভূতি, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব—এইসব মানবিক অনুভূতিগুলো গৌণ হয়ে যায়। মানুষ মানুষকে দেখে হয় প্রতিযোগী হিসেবে, নয়তো ব্যবহারের বস্তু হিসেবে।
মার্ক্সের মতে, “মানুষের তার শ্রমের ফল থেকে, তার জীবন-যাপন প্রক্রিয়া থেকে, তার প্রজাতি-সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতার তাৎক্ষণিক পরিণতি হলো মানুষের কাছ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা” (Marx, 1959, p. 78)। যখন একজন শ্রমিক তার নিজের কাজেই নিজেকে খুঁজে পায় না, তখন সে অন্য শ্রমিকের মধ্যেও নিজেকে বা নিজের সাথীকে খুঁজে পায় না। তারা সবাই একই বিচ্ছিন্নতার শিকার, একই ব্যবস্থার দ্বারা শোষিত, কিন্তু তারা এক হতে পারে না। সমাজটা হয়ে ওঠে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমষ্টি। প্রত্যেকে একা, প্রত্যেকে নিজের জগতে বন্দী।
এই চার ধরনের বিচ্ছিন্নতা একে অপরের সাথে যুক্ত। একটি আরেকটিকে জন্ম দেয় এবং শক্তিশালী করে। সব মিলিয়ে পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ এক গভীর অস্তিত্বের সংকটে (existential crisis) ভোগে। সে তার কাজকে ভালোবাসতে পারে না, নিজের জীবনকে অর্থপূর্ণ মনে করতে পারে না, প্রকৃতির সাথে একাত্ম বোধ করতে পারে না, এবং অন্য মানুষের সাথে সত্যিকার মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। সে যেন নিজের ঘরেই পরবাসী।
প্রজাতি-সত্তা আর বিচ্ছিন্নতা—একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
এতক্ষণ আমরা মার্ক্সের দুটো মূল ধারণা—প্রজাতি-সত্তা (Species-Being) আর বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation)—আলাদাভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম। এবার একটু দেখি, এই দুটো ধারণা কীভাবে একে অপরের সাথে জুড়ে আছে। সত্যি বলতে কি, মার্ক্সের কাছে এই দুটো ধারণাকে আলাদা করে ভাবাই মুশকিল। বিচ্ছিন্নতাবোধকে বুঝতে হলে প্রজাতি-সত্তাকে জানতেই হবে, আবার প্রজাতি-সত্তার মর্মার্থ বোঝা যায় বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতার বৈপরীত্যে।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: ধরুন, আপনার কাছে একটা নিখুঁত সুর জানা আছে। কিন্তু আপনি শুনছেন একটা বেসুরো গান। ওই বেসুরো গানটা শুনেই আপনি বুঝতে পারছেন যে, সুরটা ঠিক নেই, কোথাও একটা গোলমাল আছে। কেন বুঝতে পারছেন? কারণ আপনার মনের মধ্যে ওই নিখুঁত সুরটার ধারণা আছে। মার্ক্সের ‘প্রজাতি-সত্তা’ হলো সেই নিখুঁত সুর—মানুষের আদর্শ অবস্থা, তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। আর ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ হলো সেই বেসুরো গান—পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের বাস্তব অবস্থা, তার সম্ভাবনার বিকৃতি।
মার্ক্স যখন বিচ্ছিন্নতার কথা বলছেন, তখন তিনি আসলে বলছেন যে, মানুষ তার ‘প্রজাতি-সত্তা’ অনুযায়ী বাঁচতে পারছে না। তার মানবীয় সারসত্য (human essence) বিকশিত হওয়ার বদলে অবদমিত (suppressed) হচ্ছে। আসুন, মিলিয়ে দেখি:
-
প্রজাতি-সত্তার বৈশিষ্ট্য: সচেতন ও স্বাধীন শ্রম (Conscious and free labour)।
বিচ্ছিন্নতার রূপ: উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the act of production)।
ফলাফল: শ্রম আর স্বাধীন ও সচেতন থাকে না, হয়ে যায় বাধ্যবাধকতা, একঘেয়েমি আর যন্ত্রণা। মানুষ তার কাজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় না। -
প্রজাতি-সত্তার বৈশিষ্ট্য: সৃজনশীলতা ও প্রকৃতির সাথে একাত্মতা (Creativity and unity with nature)।
বিচ্ছিন্নতার রূপ: উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from the product of labour)।
ফলাফল: নিজের সৃষ্টিই নিজের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য করে বটে, কিন্তু তার সাথে একাত্ম বোধ করে না, বরং তাকে কেবল ব্যবহারের বস্তু মনে করে। সৃজনশীলতার বদলে তৈরি হয় পণ্যের পাহাড়, যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। -
প্রজাতি-সত্তার বৈশিষ্ট্য: সার্বজনীনতা ও আত্ম-উপলব্ধি (Universality and self-realization)।
বিচ্ছিন্নতার রূপ: প্রজাতি-সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from species-being)।
ফলাফল: মানুষ তার সার্বিক সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে পারে না। তার জীবন খণ্ডিত হয়ে যায়। সে কেবল জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেই মুক্তি খোঁজে। তার মানবীয় সত্তা অপূর্ণ থেকে যায়। -
প্রজাতি-সত্তার বৈশিষ্ট্য: সামাজিকতা ও সহযোগিতা (Sociality and cooperation)।
বিচ্ছিন্নতার রূপ: অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা (Alienation from other human beings)।
ফলাফল: সমাজ পরিণত হয় প্রতিযোগিতার রণক্ষেত্রে। মানুষের মধ্যে মানবিক সম্পর্কের বদলে তৈরি হয় স্বার্থের সম্পর্ক। সহযোগিতা ও সহানুভূতির জায়গা নেয় বিচ্ছিন্নতা ও সংঘাত।
দেখতেই পাচ্ছেন, বিচ্ছিন্নতার প্রতিটি রূপই আসলে প্রজাতি-সত্তার কোনো না কোনো গুণের সরাসরি লঙ্ঘন বা বিকৃতি। মার্ক্স বলতে চাইছেন, পুঁজিবাদী সমাজ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে মানুষের পক্ষে তার আসল সত্তা অনুযায়ী বাঁচাটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সমাজব্যবস্থা মানুষকে তার মানবতা থেকেই দূরে ঠেলে দেয়।
বিচ্ছিন্নতার উৎস কোথায়?
মার্ক্সের কাছে এই বিচ্ছিন্নতা কোনো বিমূর্ত ধারণা বা মানসিক সমস্যা মাত্র নয়। এর একটা বাস্তব, বস্তুগত ভিত্তি (material basis) আছে। আর সেই ভিত্তিটা হলো পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক (capitalist relations of production)। বিশেষ করে দুটি জিনিসকে তিনি দায়ী করেছেন:
১. ব্যক্তিগত মালিকানা (Private Property): উৎপাদনের উপায়গুলো (কলকারখানা, জমি, পুঁজি) যখন ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে, তখন অনিবার্যভাবে সমাজে দুটো শ্রেণি তৈরি হয়—মালিক শ্রেণি (বুর্জোয়া) আর শ্রমিক শ্রেণি (প্রোলেতারিয়েত)। মালিক শ্রেণি শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে মুনাফা অর্জন করে। শ্রমিকের নিজের শ্রমের ওপর বা তার ফলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটাই বিচ্ছিন্নতার মূল উৎস। যতক্ষণ ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে, ততক্ষণ এই বিচ্ছিন্নতাও থাকবে।
২. শ্রম বিভাজন (Division of Labour): পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা হয়। প্রত্যেক শ্রমিককে একটা নির্দিষ্ট, ক্ষুদ্র কাজ বারবার করতে হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে বটে, কিন্তু শ্রমিক একটা সম্পূর্ণ জিনিস তৈরি করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। সে পরিণত হয় একটা যন্ত্রাংশের মতো। তার সার্বিক দক্ষতা বা সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ পায় না। এই শ্রম বিভাজনও মানুষকে তার কাজ থেকে এবং তার সামগ্রিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
মার্ক্স মনে করতেন, এই বিচ্ছিন্ন অবস্থা মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা নয়। এটা একটা ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, যা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ফল। সুতরাং, এই ব্যবস্থা বদলালে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটালে, মানুষ আবার তার প্রজাতি-সত্তাকে ফিরে পেতে পারে। তখন শ্রম আবার হয়ে উঠবে আনন্দের, সৃজনশীলতার এবং আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যম। মানুষ আবার প্রকৃতি ও সমাজের সাথে একাত্ম বোধ করবে। এটাই ছিল মার্ক্সের স্বপ্ন—এক বিচ্ছিন্নতামুক্ত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে মানুষ তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচতে পারবে।
আজকের দিনে মার্ক্সের ভাবনা—আমরা কি এখনো বিচ্ছিন্ন?
মার্ক্স এই কথাগুলো লিখেছিলেন প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে, শিল্পবিপ্লবের সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে। সময় অনেক বদলে গেছে। পুঁজিবাদও তার রূপ পাল্টেছে। এখনকার কারখানায় হয়তো সেকালের মতো অমানবিক পরিস্থিতি সবসময় দেখা যায় না। শ্রমিকদের অধিকার বেড়েছে, কাজের পরিবেশ উন্নত হয়েছে। তাহলে কি মার্ক্সের বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা আজকের দিনে আর প্রাসঙ্গিক নয়?
একটু ভাবলেই বোঝা যায়, মার্ক্সের মূল কথাগুলো কিন্তু এখনো আশ্চর্যরকমভাবে সত্যি। হয়তো বিচ্ছিন্নতার রূপ কিছুটা বদলেছে, কিন্তু তার অস্তিত্ব এখনো প্রবলভাবেই অনুভূত হয়।
-
কাজের প্রতি অনীহা: আজকের দিনেও কত মানুষ তাদের কাজ নিয়ে অসুখী! চাকরিটা হয়তো মাস শেষে একটা মোটা মাইনে এনে দেয়, সামাজিক মর্যাদা (social status) দেয়, কিন্তু কাজটা করতে ভালো লাগে না। সেই একঘেয়েমি, সেই যান্ত্রিকতা, সেই ওপরওয়ালার চাপ—এগুলো এখনো খুব পরিচিত অনুভূতি। অনেকেই চাকরি করেন শুধু টাকার জন্য, সপ্তাহ শেষের ছুটির আশায়। কাজের মাধ্যমে আত্ম-উপলব্ধি বা সৃজনশীলতার বিকাশ—এসব ধারণা যেন অনেকের কাছেই বিলাসিতা। এটা কি সেই উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতারই আধুনিক রূপ নয়?
-
পণ্যের মোহ আর শূন্যতা: আমরা এক চরম ভোগবাদী (consumerist) সমাজে বাস করি। বাজার ভর্তি নিত্যনতুন পণ্য। বিজ্ঞাপন আমাদের শেখায়, এই পণ্য কিনলেই আমরা সুখী হব। আমরা কিনছিও। গাড়ি, মোবাইল, পোশাক, গ্যাজেট—আমাদের ঘর ভর্তি জিনিস। কিন্তু এই বস্তুগুলো কি আমাদের সত্যিকার আনন্দ দেয়? নাকি কেনার পরের দিনই আবার নতুন কিছুর জন্য মন ছটফট করে? মার্ক্স যেমন বলেছিলেন, উৎপাদিত বস্তু শ্রমিকের কাছে বাইরের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়—আজকের দিনেও কি এই পণ্যগুলো আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে না? আমরা জিনিসের মালিক হচ্ছি, নাকি জিনিসই আমাদের মালিক হয়ে বসছে? এই যে বস্তুর পাহাড়ের নিচে চাপা পড়া এক ধরনের শূন্যতা—এটা কি উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতারই অন্য চেহারা নয়?
-
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের অনেক কাছাকাছি এনেছে—অন্তত ভার্চুয়ালি। আমরা ফেসবুকে হাজার হাজার বন্ধু বানাই, টুইটারে মত প্রকাশ করি, ইনস্টাগ্রামে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো শেয়ার করি। কিন্তু এই ভার্চুয়াল সংযোগ কি আমাদের আসল একাকিত্ব ঘোচাতে পারছে? পাশের বাড়ির মানুষটার সাথে কথা হয় না, অথচ আমরা দূর দেশের অচেনা মানুষের পোস্টে লাইক দিই। পরিবারে এক ছাদের নিচে থেকেও প্রত্যেকে নিজের মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকি। সম্পর্কগুলো কেমন যেন ঠুনকো, তাৎক্ষণিক হয়ে গেছে। প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে। চাকরির বাজারে, ব্যবসার জগতে, এমনকি সামাজিক জীবনেও—সবখানেই যেন এক ইঁদুর দৌড়। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। এই গভীর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কি মার্ক্সের বলা ‘মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা’রই প্রতিধ্বনি নয়?
-
পরিচয়ের সংকট: আজকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেকেই এক ধরনের পরিচয়ের সংকটে (identity crisis) ভোগেন। ‘আমি কে?’, ‘আমার জীবনের মানে কী?’, ‘আমি কী করতে চাই?’—এই প্রশ্নগুলো তাদের তাড়া করে ফেরে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বা চাকরির জগৎ তাদের হয়তো একটা পেশা দেয়, কিন্তু জীবনের দিশা দিতে পারে না। অনেকেই প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে নিজের সত্তাকে খুঁজে বেড়ায়—ভ্রমণে, শিল্পে, সামাজিক কাজে। এই যে একটা গভীর অতৃপ্তি, একটা দিশাহীনতা—এটা কি সেই ‘প্রজাতি-সত্তা’ থেকে বিচ্ছিন্নতারই বহিঃপ্রকাশ নয়? মানুষ তার আসল সম্ভাবনাকে খুঁজে পাচ্ছে না, তাই সে অস্থির, অতৃপ্ত।
সুতরাং, মার্ক্সের বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা আজকের দিনেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। হয়তো এর চেহারা কিছুটা বদলেছে, জটিলতা বেড়েছে। এখন শুধু কলকারখানার শ্রমিক নয়, তথাকথিত হোয়াইট কলার কর্মী, এমনকি সৃজনশীল পেশার মানুষেরাও এই বিচ্ছিন্নতার শিকার হতে পারেন। পুঁজিবাদী যুক্তি (logic of capitalism) এখন আমাদের জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঢুকে পড়েছে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, অবসর—সবকিছুই যেন বাজারের পণ্য হয়ে উঠছে।
মার্ক্সের বিশ্লেষণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটা সেই ব্যবস্থার ফল যার মধ্যে আমরা বাস করি। এটা আমাদের ভাবতে শেখায়, আমরা কি কেবল এই ব্যবস্থার শিকার হয়েই থাকব, নাকি একে পরিবর্তনের চেষ্টা করব?
শেষ কথা: হারানো সুর খুঁজে পাওয়ার আশা
মার্ক্স শুধু সমস্যার কথাই বলেননি, সমাধানের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ এই বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। তার জন্য দরকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান এবং এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে উৎপাদনের উপায়গুলো থাকবে সমাজের সমষ্টিগত মালিকানায় (collective ownership)। সেই সমাজে শ্রম আর শোষণের হাতিয়ার থাকবে না, হয়ে উঠবে মানুষের মুক্ত ও সৃজনশীল আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। মানুষ ফিরে পাবে তার হারানো ‘প্রজাতি-সত্তা’।
এই স্বপ্ন কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। মার্ক্সের প্রস্তাবিত পথে চলে যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল, তারাও মানুষের মুক্তি আনতে পেরেছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কিন্তু মার্ক্সের মূল বিশ্লেষণ—পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের বিচ্ছিন্নতার বিশ্লেষণ—তার গুরুত্ব হারায়নি।
মার্ক্সের ভাবনাগুলো আমাদের সাহায্য করতে পারে নিজেদের অবস্থাটা বুঝতে। কেন আমরা অসুখী? কেন আমাদের কাজে আনন্দ নেই? কেন আমরা এত একা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য মার্ক্সের ‘প্রজাতি-সত্তা’ আর ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’-এর ধারণা এক শক্তিশালী চশমার মতো কাজ করে।
এটা আমাদের সচেতন করে তোলে যে, আমাদের ভেতরের শূন্যতা বা অতৃপ্তি শুধু আমাদের একার সমস্যা নয়। এটা একটা বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ফল। আর এই সচেতনতাই হয়তো পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
হয়তো আমরা এখনই সমাজ বদলাতে পারব না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতে পারি নিজেদের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন আনতে। আমরা চেষ্টা করতে পারি এমন কাজ খুঁজে নিতে, যা আমাদের আনন্দ দেয়, যাতে আমাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে। আমরা চেষ্টা করতে পারি পণ্যের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সাথে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আমরা চেষ্টা করতে পারি প্রকৃতিকে ভালোবাসতে, তার সাথে একাত্ম হতে। আমরা চেষ্টা করতে পারি আমাদের সন্তানদের শেখাতে, জীবনের মানে শুধু টাকা উপার্জন বা জিনিস কেনা নয়, তার চেয়েও বড় কিছু আছে।
মার্ক্সের লেখা আমাদের সেই বড় কিছুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, মানুষ আসলে কেমন হতে পারত, তার সম্ভাবনা কতটা বিশাল। হয়তো আমরা সেই ‘প্রজাতি-সত্তা’র আদর্শ অবস্থায় পৌঁছাতে পারব না, কিন্তু সেই আদর্শের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে তো চলবে না। সেই হারানো সুরটাকে মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ, সেই সুরটাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা যন্ত্র নই, আমরা মানুষ। আমাদের জন্ম হয়েছে সৃষ্টি করার জন্য, ভালোবাসার জন্য, একসাথে বাঁচার জন্য।
এই দীর্ঘ আলাপের শেষে, হয়তো আপনার মনেও কিছু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। হয়তো আপনি ভাবছেন, আপনার নিজের জীবনে এই বিচ্ছিন্নতার ছায়া কতটা পড়েছে? কীভাবে এর থেকে বেরোনো যায়? এই প্রশ্নগুলো যদি আপনার মনে এসে থাকে, তাহলেই হয়তো এই আলোচনার কিছুটা সার্থকতা আছে। কারণ প্রশ্ন জাগলেই উত্তর খোঁজার শুরু হয়। আর সেই খোঁজাই হয়তো একদিন আমাদের নিয়ে যাবে এক কম-বিচ্ছিন্ন, বেশি-মানবিক পৃথিবীর দিকে। কে জানে!
রেফারেন্স (References)
-
Marx, K. (1959). Economic and philosophic manuscripts of 1844 (M. Milligan, Trans.). Progress Publishers. (Original work published 1844)
Leave a Reply