পশ্চিম ইউরোপে ১৫শ থেকে ১৭শ শতকের মুদ্রণ বিপ্লব, সামরিক বিপ্লব ও কৃষি বিপ্লব

Table of Contents

১৫শ শতকের মধ্যভাগ – একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা

ইউরােপের ইতিহাসে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। আলােচ্য পর্বের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি আবিষ্কার শুধু সমকালকে নয়, আগামী প্রজন্মকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে মালাবার উপকূলে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী অর্ধশতকে ইউরােপ সর্বপ্রথম মুদ্রিত পুস্তক পাঠ করেছিল। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে কোপারনিকাস শাশ্বত নগরী রােমে গণিতশাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন যে, পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর আবর্তন করছে এবং একাধারে সূর্যকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট পথে প্রদক্ষিণ করছে। বলাবাহুল্য, তার এই আবিষ্কার ছিল চাঞ্চল্যকর, বৈপ্লবিক এবং যুগান্তকারী। ১৪৫০ থেকে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্র এক নতুন ও প্রলয়ঙ্করী রণনীতি উদ্ভাবনে সহায়তা করেছিল। বলাবাহুল্য, উপরােক্ত আবিষ্কার, উদ্ভাবন এবং পুনরাবিষ্কারসমূহ সমকালীন এবং পরবর্তীকালীন ইউরােপ তথা বিশ্ব ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। শুধু তাই নয়, এর ফলে ইউরােপের সঙ্গে ইউরােপ বহির্ভূত অঞ্চল এমনকি অতীত ইউরােপের সঙ্গে সমকালীন ইউরােপের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। ষােড়শ শতক পর্যন্ত ইউরােপ ছিল গ্রিকো-রােমান অতীত এবং দূর ও নিকট প্রাচোর সভ্যতা-সংস্কৃতির ভাবশিষ্য ও ছাত্র। কলম্বাস ও ভাস্কো-ডা-গামার অভিযান সেই সংস্কৃতির যােগসূত্রের অবসানের সূচনা করেছিল। অতঃপর ইউরােপ অর্জন করেছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং বৈজ্ঞানিক কারিগরি নেতৃত্ব। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে ইউরােপ ভাবাদর্শ ও কারিগরি জ্ঞান আমদানি করত। কিন্তু ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে সে উন্নততর সংস্কৃতির ঋণদাতার মর্যাদা অর্জন করল (Anthony Grafton-এর ভাষায়, “…after 1500, Europeans were cultural creditors”, (The Foundations of Early Modern Europe)).

মুদ্রণ বিপ্লব

১৫শ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব

আধুনিক ইউরােপের আদি পর্বের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মুদ্রণ বিপ্লব। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মেনজে ধাতব টাইপের সাহায্যে ছাপা শিল্পের উন্নতি সাধন করা হয়েছিল। ১৫শ শতকের মধ্যভাগে ইউরােপের প্রায় সব শহরে ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল। ১৫শ শতকের শেষদিকে ইউরােপের দুশাের বেশি শহরে এবং মফস্বলে ছাপাখানা ছিল। এই শিল্পের প্রথম যুগের উদ্ভাবন ও উন্নতির সঙ্গে তিনটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, যথা—জোহান ফাস্ট (১৪০০-১৪৬৫), পিটার শােয়েফার (১৪২৫১৫০২) (ইনি সম্পর্কে ফাস্টের জামাতা) এবং জোহান গুটেনবার্গ (১৩৯৫-১৪৬৮)। ছাপাখানার উন্নতিতে এদের সঠিক অবদান কী ছিল তা বলা কঠিন এবং এবিষয়ে ইতিহাসের উপাদানগুলি কিছুটা অস্পষ্ট ও অনির্ভরযােগ্য। তবে বেশিরভাগ পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন যে ১৪৩৮ খ্রি. নাগাদ জার্মানির মেন্‌জ শহরে জোহানস্ গুটেনবার্গ নামক এক ব্যক্তি প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করেন। গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য হল এটি ছিল সচল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার আকস্মিকভাবে হয়নি, এটি একজন ব্যক্তির মস্তিষ্ক প্রসূত নয়, বহুদিন ধরে মুদ্রণ যন্ত্রের ক্রমােন্নতির প্রক্রিয়া চলেছিল। মুদ্রণশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ও বাণিজ্যিকীকরণে কোনাে ব্যক্তি বিশেষের অবদান ছিল কিনা তা সঠিক বলা যায় না। যাইহােক, এ বিষয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবনসমূহ শুধুমাত্র ব্যক্তি বিশেষের প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি নয়, এর মূলে আছে সম্মিলিত প্রয়াস এবং সামাজিক পরিস্থিতি। এখানেই কবিতা বা চিত্রশিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানের মূল পার্থক্য। স্টিম ইঞ্জিন বা টেলিগ্রাফের মত নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ফলেই মুদ্রণশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। অবশেষে এর প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপ লক্ষ করা গিয়েছিল মেন্‌জে।

মুদ্রণশিল্পের উন্নতি পর্যালােচনা করলে অনিবার্যভাবে দুটি চিনা উদ্ভাবনের প্রসঙ্গ এসে যায়। প্রথম হল block printing এবং দ্বিতীয়টি কাগজ। ৮ম শতকের প্রথমভাগে চীন দেশে প্রথম block printing (বা xylography) উদ্ভাবিত হয়েছিল। যদিও চীন দেশের এই ব্লক নির্মাণ সংক্রান্ত ব্যবহারিক জ্ঞান ছিল অনুন্নত, সময়সাপেক্ষ এবং অপচয়ী, তথাপি এই কারিগরি জ্ঞান আগামী দিনের কারিগরি উদ্ভাবনসমূহকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ব্লকগুলি ছিল কাষ্ঠনির্মিত। ১২৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই ব্লক নির্মাণের কৌশল ইউরােপে আমদানি করা হয়েছিল চিনদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুবাদে। ব্লকের মতাে কাগজও ছিল একান্ত প্রয়ােজনীয় একটি উপাদান। কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে parchment (লেখার উপযােগী পশুচর্ম) বা vellum-এর (পাতলা parchment বা চর্মপত্র বিশেষ) ওপর বই লেখা হত। এগুলিকে manuscript books আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অলংকরণই ছিল এহেন পুস্তক রচনার মূল উদ্দেশ্য। এর উপযােগিতা তেমন ছিল না। বই-এর একাধিক copy নির্মাণের কাজ ছিল প্রায় দুঃসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। বাইবেলের একটি বৃহৎ সংস্করণের জন্য প্রয়ােজন হত প্রায় ১৭০টি বাছুরের ছাল অথবা ৩০০টি ভেড়ার ছাল। (পার্চমেন্টের জন্য প্রয়ােজন হত ভেড়ার চামড়া এবং vellum-এর জন্য দরকার হত বাছুরের চামড়া)। ১২শ শতকে স্পেনে সর্বপ্রথম আরবরা কাগজ নির্মাণ শুরু করে। (আইবেরীয় উপদ্বীপ তখন আরব-মুসলমান শাসনাধীন)। আরবরা এই বিদ্যা আত্মস্থ করেছিল চিন দেশে। ধীরে ধীরে প্রায় দুই শতক ধরে এই কাগজ নির্মাণ কৌশল ছড়িয়ে পড়ে ইউরােপের অন্যত্র—ইতালি (১২৭০), ফ্রান্স (১৩৪০), জার্মানি (১৩৯০) এবং সুইজারল্যান্ডে (১৪১১)।

প্রথম যুগে ইউরােপে কাগজ শিল্পে ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল ছিল পুরােনাে, শতচ্ছিন্ন পােশাক এবং ন্যাকড়া। কাগজ নির্মাতাগণ জলশক্তি চালিত একটি যন্ত্রে (stamping mill) কাঁচামাল প্রথমে কাটতেন এবং তারপর কাপড়ের টুকরােগুলি জলে মিশিয়ে নরম করতেন। সেগুলি তরল পিণ্ডের রূপ ধারণ করত। একটি বৃহৎআকৃতি কাঠের ফ্রেম যুক্ত জালের ওপর ওই তরল পিণ্ড ফেলে তার থেকে জল নিষ্কাশন করা হত। অতঃপর পিণ্ডগুলি থাকে থাকে সাজানাে পশমি বস্ত্রের ফাকে রেখে সেগুলিকে শুকোনাে হত। সবশেষে শুষ্ক কাগজগুলি নির্দিষ্ট মাপে কাটা হত। এটাই ছিল আদি কাগজ নির্মাণ পদ্ধতি। মুচি-কবি এবং হ্বাগনেরের কাব্যের নায়ক হ্যান্স স্যাক্স (Hans Sachs, 1494-1576) তাঁর একটি কবিতায় এই কাগজ নির্মাণ পদ্ধতির একটি জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন। কবিতার শেষে তিনি লিখছে কীভাবে দড়ির ওপর কাগজ শুকোনাে হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে তা উজ্জ্বল ও তুষার-শুভ্র রূপ ধারণ করছে। কাগজের ঐরূপ যে-কোনাে মানুষকে মুগ্ধ করবে। কবির ভাষায় – “I hang them up to let them dry, Snow-white and glossy, a treat for every eye.” (মূল জার্মান থেকে ইংরাজিতে অনুদিত)।

চীনা লিপির সঙ্গে ইউরােপীয় লিপির মৌল পার্থক্য রয়েছে, ইউরােপে শব্দ বিভাজন থাকার জন্য চীনা পদ্ধতিতে ছাপার কাজ চালানাে ছিল অসুবিধাজনক। যাইহোক, প্রথম যুগের ইউরােপীয় মুদ্রণশিল্প শুধুমাত্র চিনের কাছে ঋণী ছিল এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। মুদ্রণ বিপ্লবের ক্ষেত্রে আধুনিক ইউরােপ চীনের কাছে অবশ্যই ঋণী, তবে সচল অক্ষর সম্পন্ন ছাপাখানা ইউরােপের নিজস্ব সৃষ্টি। এক্ষেত্রে ইউরােপের নিজস্ব কারিগরি জ্ঞানের একটা ভূমিকা ছিল। ১৫শ শতকের পূর্বেই এই বিশেষ কারিগরি জ্ঞান নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছিল। জার্মানরাই ছাপার কালি তৈলাক্ত করার প্রক্রিয়া রপ্ত করেছিলেন। মেন্‌জে গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং শােফারের বিশিষ্ট মুদ্রণ রীতির জন্য একান্ত প্রয়ােজন ছিল উপযুক্ত কালি, মুদ্রণ (press) এবং ধাতব টাইপ। কালির ছাপাটি যাতে যথাযথভাবে কাগজের ওপর পড়ে, তার জন্য একান্ত প্রয়ােজন ছিল সেই কালিতে উপযুক্ত তেলের উপাদান বা মিশ্রণ (oil base)। কাগজ তৈরির কাজে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হত তা আবার ছাপার কাজেও ব্যবহার করা হত। ধাতু দিয়ে টাইপ তৈরি করে ছাপার জন্য ব্যবহার করা হত। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে ইউরােপে ধাতুবিদ্যার জ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছিল, তা না হলে ধাতু দিয়ে টাইপ তৈরি করা সম্ভব হত না। মুদ্রণযন্ত্র, কাগজ, টাইপ ও কালি তৈরির প্রযুক্তি যৌথভাবে মুদ্রণ বিপ্লব ঘটিয়েছিল। ১৫শ শতকের সূচনা থেকেই নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলির উৎকর্ষ সাধন করা হচ্ছিল। বলাবাহুল্য, এর জন্য প্রয়ােজন ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের mechanical বা technological brain। ইউরােপে অনুরূপ brain বা মস্তিষ্কের অভাব ছিল না। আলােচ্য পর্বে যে ধাতব print-গুলি তৈরি হচ্ছিল, সেগুলি নির্মাতাদের শিল্পরুচিবােধ ও ধাতুবিজ্ঞানের ওপর অসামান্য দখলের পরিচায়ক। ফ্লেমিশ শিল্পীরা যথােপযুক্ত কালিও (printer’s ink) ব্যবহার করছিলেন। এতে প্রয়ােজনীয় রঞ্জক পদার্থ (pigment) এবং উজ্জ্বল রূপদানের জন্য মসিনার তেলের বার্নিসের (linseed oil varnish) উপযুক্ত মিশ্রণ থাকত। মেন্‌জ শহর থেকে প্রথম ছাপার অক্ষরে বই বেরিয়েছিল, এখানকার কারিগররা হল মুদ্রণ প্রযুক্তির আবিষ্কর্তা। পরবর্তী তিরিশ বছর ধরে ইউরােপের মুদ্রণ শিল্পীরা গুটেনবার্গের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল।

প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ইউরােপে সঠিক কবে আবির্ভূত হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু সংশয়ের অবকাশ থাকলেও এটা অনস্বীকার্য যে মেন্‌জে আদিযুগের বইয়ের নিদর্শন বা নমুনা পাওয়া গেছে এবং এগুলি একাধারে শিল্পোৎকর্ষ তথা, কারিগরি জ্ঞানের পরিচায়ক, পূর্ববর্তী যুগের উদ্ভাবনসমূহ এই জ্ঞানকে গভীরভাবে প্রভাবিত ও প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেছিল। ১৪৫৫-৫৬ সালে নতুন প্রযুক্তি প্রয়ােগ করে বাইবেল ছাপা হয়। গুটেনবার্গের লাতিন বাইবেল প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল ৪২ পঙক্তি বিশিষ্ট গ্রন্থ (প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ৪২টি পঙক্তি, ইতিপূর্বে প্রকাশিত Mainz Bible ছিল ৩৬ পঙক্তি বিশিষ্ট)। ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে আর একটি স্মরণীয় দিবস। ঐদিন গুটেনবার্গের এক সহকর্মী ফাস্ট এবং শােয়েফার বাইবেলের অন্তর্গত প্রার্থনা সংগীত (psalms) প্রকাশ করেছিলেন। এটি পাতলা পার্চমেন্ট কাগজের (vellum) উপর মুদ্রিত হয়েছিল। এতে কালাে এবং লাল টাইপ ব্যবহৃত হয়েছিল। নিউ কেম্ব্রিজ মডার্ন হিষ্ট্রি-তে মুদ্রণ বিপ্লবের পরিচয় প্রসঙ্গে হয়েছে যে প্রথম ছাপা বইখানি ছিল অত্যন্ত সুন্দর। পাতার প্রথম অক্ষরে নানারকম কারুকাজ ছিল, মার্জিনেও কারুকাজ দিয়ে শােভন করা হয়। হাতে লেখা গ্রন্থের সঙ্গে এর অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। গ্রন্থটির অলংকরণ মূলত ক্ষুদ্রাকৃতি জীবজন্তুর প্রতিকৃতি এবং পুষ্পের শােভা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। ইউরােপে আজও যেসব স্বাক্ষরিত ও সন-তারিখ উল্লিখিত গ্রন্থ (signed and dated books) তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করছে। তাদের মধ্যেই এই Psalms প্রাচীনতম। প্রথম যুগের মুদ্রিত গ্রন্থগুলির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটি হল ছাপা অক্ষরগুলির সঙ্গে মূল হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির অক্ষরের সাদৃশ্য। বইয়ে ছাপা অক্ষরগুলি যেন হস্তলিখিত মূল পাণ্ডুলিপিরই অক্ষরগুলির প্রতিবিম্ব। সে যুগের কারিগররা মুদ্রিত গ্রন্থকে হস্তলিখিত গ্রন্থেরই অন্যতম সংস্করণ মনে করতেন। শােফারের মতে মুদ্রণ ছিল কলম ছাড়া সৃষ্ট লিপির শৈল্পিক এবং কৃত্রিম রূপ। তার ভাষায়, “…the art of writing artificially without reed or pen.” এহেন পুস্তক বিক্রয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যে আরও বেশি সংখ্যায় manuscripts বিক্রয়।

অতএব মুদ্রণশিল্পীৱা এক্ষেত্রে চিরাচরিত ধ্যানধারণার প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। নানা বিষয়ে ব্যাপক পুস্তক প্রকাশনার চেয়েও তারা অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন সুন্দর ও শােভন পাণ্ডুলিপি প্রকাশের ওপর। যদিও মুদ্রণশিল্প ছিল রেনেসাঁর অন্যতম উদ্ভাবন, তথাপি প্রথম যুগে এর উন্নতির মূলে ছিল ধর্মীয় প্রয়ােজন এবং চাহিদা এবং এর ভৌগােলিক উৎপত্তি ছিল রেনেসাঁর প্রাণকেন্দ্র ইতালি থেকে বহুদূরে অবস্থিত। ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে ছাপাখানাগুলি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল ছােটো মফস্সল শহরগুলিতে যেখানে জনসংখ্যা ছিল গড়ে প্রায় তিন হাজার। এখানকার মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ তেমন উল্লেখযােগ্য ছিল না এবং মূলত ধর্মীয় প্রয়ােজনেই ছাপাখানাগুলি ব্যবহৃত হত। মুদ্রিত গ্রন্থের মধ্যে লাতিন বাইবেল, সাধুসন্তদের জীবনী, সেন্ট টমাস আকুইনাসের গ্রন্থাবলি, ক্ষমাপত্র (indulgence) বিক্রয়ের জন্য প্রয়ােজনীয় form ছিল অন্যতম। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল বীরত্বব্যঞ্জক রােমান্স (romances of chivalry)। অবশ্য, পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ও বিষয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আরও বেশি সংখ্যায় নবগঠিত শহর ও নগরকেন্দ্রগুলিতে উদীয়মান বুর্জোয়া, বণিক, শিক্ষক, আইনজীবী, কারিগর, চিকিৎসক, সরকারি কর্মচারী প্রভৃতি শ্রেণির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানাের জন্য নানাবিষয়ে অসংখ্য পুস্তক প্রকাশিত হতে থাকে। ধর্মশাস্ত্রের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে অতঃপর গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইন, আঞ্চলিক ও বিশ্বের (ইউরােপের) ইতিহাস, লাতিন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য, ব্যাকরণ প্রভৃতি অসংখ্য পুস্তক আলােচ্য পর্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এইযুগে যেসব জনপ্রিয় লাতিন classics প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল—ভার্জিলের ইনিদ’ (Virgil’s Aenid) ও সিসেরাের ‘দ্য অফিসিস’ (De Officis)। এছাড়া টেরেন্স, সেনেকা ও প্লিনির গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল।

মুদ্রণযন্ত্র উদ্ভাবনের পূর্বে হস্তলিখিত পুস্তকই প্রচলিত ছিল। এই ধরনের বইয়ের প্রকাশকগণ ‘স্টেশনারগণ’ (Stationers) নামে পরিচিত ছিলেন। ফরমায়েস অনুযায়ী এরা অসংখ্য লেখক’ নিয়ােগ করে নানা বইয়ের সুদৃশ্য, সুশােভিত ও কারুকার্য শােভিত হস্তলিখিত কপি সৃষ্টি করতেন। ভ্যাটিকান থেকে অক্সফোর্ড ও ইউরােপের অন্যান্য বর্ধিষ্ণু বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আলমারিতে আজও শােভা পাচ্ছে সেইসব সুন্দর বইগুলি। এখন সেইসব custom made books on demand-এর জায়গায় এল অসংখ্য ছাপানাে বই। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন ইউরােপীয় ছাপাখানা থেকে প্রায় ষাট লক্ষাধিক পুস্তকের চল্লিশ হাজার সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এত বই ইতিপূর্বে কখনােই প্রকাশিত হয়নি।

ইউরোপে বইয়ের চাহিদা, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষিতের সংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সম্পর্ক

মুদ্রণ বিপ্লব সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য হল যে ইউরােপে বইয়ের চাহিদা বেড়েছিল, আগে বইয়ের চাহিদা ছিল কম। শুধু যাজকদের গ্রন্থের প্রয়ােজন হত, হাতে লেখা পুঁথি সেই প্রয়ােজন মেটাতে পারত। ১৫শ শতক থেকে ক্রমবর্ধমান বইয়ের চাহিদা হাতে লেখা পুঁথি মেটাতে পারেনি। হাতে লেখা পুঁথির দামও পড়ত বেশি, এই সময় থেকে বই শুধু ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। রেনেসাঁ সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা সৃষ্টি করেছিল, ভদ্রলােক ও শহুরে বুর্জোয়া শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ার ফলে হিসেব-পত্র রাখার দরকার হয়, এসব কারণে ইউরােপে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল। প্রয়ােজন হল আবিষ্কারের জননী। নিউ কেম্ব্রিজ মডার্ন হিস্ট্রি-তে বলা হয়েছে যে ১৫শ শতকে শিক্ষার মানে অবনতি ঘটলেও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল। শুধু পেশাগত কারণে বইয়ের চাহিদা বেড়েছিল তা নয়, সময় কাটানাের জন্য মানুষ পড়াশােনার দিকে ঝুঁকেছিল। শুধু বাইবেল ও ধর্মসংক্রান্ত গ্রন্থ নয়, স্থানীয় ভাষায় গ্রন্থ রচনা অবশ্যই বেড়েছিল। স্টিভেন ওজমেন্ট জানিয়েছেন যে এই পর্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল (This was a period of expanding lay education), নতুন নতুন বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

১৩০০-১৫০০ খ্রি. মধ্যে ইউরােপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ থেকে সত্তর, কলেজের সংখ্যাও বেড়েছিল। ফ্রান্সে ছিল ৬৩টি কলেজ, ইংল্যান্ডে ২১, ইতালিতে ১৬, এবং জার্মানিতে ১৬। ১৫০০ খ্রি. নাগাদ ইউরােপে সাক্ষর মানুষের সংখ্যা অবশ্যই বেড়েছিল। তবে ইউজিন রাইস জানিয়েছেন যে ইউরােপে কৃষকরা বহুকাল নিরক্ষর ছিল। বণিক, বড়াে কারিগর, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী, চিকিৎসক, শিক্ষক ইত্যাদি সামাজিক গােষ্ঠিগুলির সম্প্রসারণ ঘটেছিল, এজন্য বইয়ের চাহিদাও বেড়েছিল, বইয়ের বিষয়-বস্তুতে বৈচিত্র্য এসেছিল। ইতিহাস, ব্যাকরণ, শব্দকোষ, বিশ্বকোষ, অঙ্ক ইত্যাদির ওপর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এসব বিষয়ের বইয়ের চাহিদা বেড়েছিল। ক্রমবর্ধমান বইয়ের চাহিদা মেটাতে পারেনি হাতে লেখা বই। নকলনবিশরা অতিরিক্ত সময় কাজ করেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বজায় রাখতে পারেনি। এই চাহিদা হল মুদ্রণ বিপ্লবের জননী (Necessity is the mother of invention)! তবে ছাপা বইয়ের যে বিরােধিতা একেবারে ছিল না তা নয়। শিল্প বিপ্লবের শুরুতে বস্ত্রশিল্পে যা ঘটেছিল মুদ্রণ শিল্পেও তাই হল। উৎপন্ন পণ্য ছিল গুণগত মানে উন্নত অথচ দামে সস্তা। বিরােধিতা সত্ত্বেও মে থেকে ছাপাখানা ছড়িয়ে পড়ল স্ট্রাসবুর্গ, কোলন, অগস্তুর্গ, লাইপজি প্রভৃতি শহরে। ১৫০০ খ্রি. নাগাদ এই সব ছাপাখানা থেকে চল্লিশ হাজার বই ছেপে বেরিয়েছে। বইয়ের প্রচার ছিল ব্যাপক, চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে যায়, সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ধর্মসংস্কারান্দোলনে মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব ও সেন্সরশিপ

মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব ছিল ব্যাপক বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। ইতিপূর্বে হস্তলিখিত পুস্তকে কিছু ভুল-ত্রুটি রয়ে যেত। proof reading-এর অনুপস্থিতিতে সেই ত্রুটি কখনােই সংশােধিত হত না। এখন সেই ত্রুটি দূর করা সম্ভব হয়েছে। হস্তলিখিত পুস্তক ছিল একক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি কিন্তু মুদ্রিত পুস্তকের সঙ্গে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের সমবেত সারস্বত সাধনা যুক্ত হয়েছিল। কোপারনিকাসের পুস্তক ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হওয়ার পর একাধিক শিক্ষিত মানুষ তার বৈপ্লবিক ধ্যানধারণা পর্যালােচনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একে সমৃদ্ধতর করেছিলেন। ভাবের আদানপ্রদান এর ফলে সহজতর হয়েছিল। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার কম্পিউটার আবিষ্কারের তুলনায় কোনাে অংশে কম যুগান্তকারী ছিল না।

পুস্তক সংগ্রহের কাজটি তখন সহজতর হয়েছিল। ইতিপূর্বে পুস্তক ছিল সীমিত সংখ্যক লাইব্রেরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা মুষ্টিমেয় সম্পদশালী মানুষের সম্পদ। অধিক সংখ্যায় পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার ফলে তা আরও বেশি সংখ্যক মানুষের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব হয়েছিল। মধ্যযুগের ছাত্র শ্রেণিকক্ষে dictated note লেখার পিছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় (অপব্যয়) করত। মূল পুস্তক থেকে তাকে শিক্ষক বা অধ্যাপক পাঠ করে শােনাতেন। কিন্তু ১৬শ শতকে সে পাঠ্যপুস্তক বাড়ি নিয়ে গিয়ে অধ্যয়ন করতে পারত। ইতিপূর্বে মুখস্থ বিদ্যার ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করা হত এখন এই অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বিষয়টি গৌণ হয়ে আসে, কারণ ছাপা বইটি র‍্যাকে, শেলফে বা আলমারিতে সহজেই পাওয়া যায়।

ছাপা বই শিক্ষার বিস্তার অত সহায়ক হয়েছিল, সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়েছিল বিজ্ঞানচর্চা। বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ, গ্রিক পাঠ্যপুস্তক, কথ্য ভাষায় লেখা বই, অঙ্ক, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যায় জনপ্রিয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার অবশ্যই সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। মানুষের নতুন চিন্তা তগতিতে ইউরােপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতি আর যাজকদের কুক্ষিগত চল না। সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশে দেশে মাতৃভাষায় সাহিত্য সাধনার কাজ শুরু হয়েছিল, মধ্যযুগে লাটিন ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাষা। সাধারণ মানুষ লাটিন বুঝত না। ইতালিতে পেত্রার্ক, দান্তে ও বােক্কাচিও মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ইংল্যান্ডে চসার ইংরাজি ভাষাকে সাধারণের বােধগম্য করে তােলেন। জার্মানিতে মার্টিন লুথার তার বক্তব্য স্থানীয় ভাষায় জনগণের কাছে পৌঁছে দেন। সংস্কার আন্দোলন মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে শক্তিশালী হতে পেরেছিল। স্পেনে সার্ভেন্টস (Cerventes) ডন কুইকজোট লিখে কথ্য ভাষাকে শক্তিশালী করেন। ফ্রান্সে র‍্যাবেলা ফরাসি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন, ইউরােপের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে ল্যাটিনের যে একাধিপত্য ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়।

অধ্যাপক হেস (Hayes) জানিয়েছেন যে মুদ্রণ বিপ্লবের প্রধান তাৎপর্য হল বহু গ্রন্থের প্রকাশ। সমাজের সব মানুষের কাছে সংস্কৃতির দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়, চিন্তা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে অভিজাত ও যাজকদের একচেটিয়া অধিকারের অবসান ঘটে। নতুন চিন্তা জীবনের অন্ধকার দিকগুলিকে আলােকিত করে তুলেছিল, অসংস্কৃত জীবনে সংস্কৃতির আলাে প্রবেশ করেছিল। (The invention of the press multiplied the books and made culture accessible to every common man in society. Ideas, hitherto the exclusive right of the nobility and clergy, now began to throw light into the dark and uncivilized lives of the many.)। বৈজ্ঞানিক ও ভৌগােলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নতুন কিছু আবিষ্কৃত হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ছাপিয়ে প্রকাশ করা হত, ইউরােপের সব মানুষ তা জেনে যেত। মুদ্রণ বিপ্লব এশিয়া ও আমেরিকা আবিষ্কারের কথা ইউরােপের মানুষকে জানিয়েছিল। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ব্রাহে, উইলিয়াম হার্ভে প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করেন গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ তা জেনেছিল। জীববিদ্যাকে চিত্রশােভিত করার কাজ করেছিল মুদ্রণ যন্ত্র। মুদ্রণ শিল্পের জন্য গ্লোবের আবিষ্কার হয়েছিল, হাতে আঁকা মানচিত্রের পরিবর্তে মানুষ মুদ্রিত মানচিত্রের ব্যবহার শিখেছিল।

নিউ কেম্ব্রিজ মডার্ন হিস্ট্রি-তে মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব বিস্তারিতভাবে আলােচনা কর হয়েছে। ল্যাটিন ও স্থানীয় ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। মুদ্রণ মানুষের চিন্তার জগতকে উন্মােচিত করেছিল, সূক্ষ্ম বৌদ্ধিক আলােচনার স্থান নিয়েছিল মানবতাবাদী সাহিত্য। গদ্যে প্রবন্ধ রচনার কাজ শুরু হয়েছিল। ইউজিন রাইস মনে করেন যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড়াে কমের পরিবর্তন ঘটেছিল। হাতে লেখা পুঁথিতে যেসব ভুল ছিল ছাপার অক্ষরে সেগুলির শােধন হয়ে যায়, ছাপা বই ছিল তুলনামূলকভাবে নিঃখুত ও নির্ভুল। ইউরােপের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ছাপা বইয়ে ফুটনােট দিয়ে সূত্র নির্দেশ করা সহজ হয়। মুদ্রণকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। বৌদ্ধিক কাজকর্ম আর একটি গােষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্টীম ইঞ্জিন যেমন মানুষের শ্রম ক্ষমতা বাড়িয়েছিল তেমনি মুদ্রণ মানুষের মনন ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। কোপারনিকাসের আবিষ্কারের কথা পড়ে ইউরােপের মানুষের মননের পরিবর্তন ঘটেছিল। রাইস পঞ্চদশ শতকের মুদ্রণ বিপ্লবের সঙ্গে আধুনিক কালের কমপিউটার বিপ্লবের তুলনা করেছেন। মানুষের মনের ওপর চাপ কমেছিল, বহু জিনিস আর মনে রাখার দরকার হত না, মুদ্রিত গ্রন্থে পাওয়া যেত। শিক্ষা আর মুখস্থ বিদ্যা-নির্ভর ছিল না, অন্য মাত্রা পেয়েছিল। মানুষের ভাব ও কল্পনার জগৎ উন্মােচিত হয়েছিল (Printing accelerated the diffusion of images and ideas)। মুদ্রণ বিপ্লবের জন্য প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরােধিতা করা সম্ভব হয়।

শুধু ভাবের আদানপ্রদান নয়, ভাবধারা প্রচারের কাজটিও সহজতর হয়েছিল। রটারডামের এরাসমাসের ধর্মীয় চিন্তা বা মাইকেলেঞ্জেলাের শিল্পকীর্তি মুদ্রণ যন্ত্রের ফলেই ব্যাপক প্রচার সম্ভব হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এত বেশি সংখ্যায় বই প্রকাশিত হওয়ায় সমকালীন সাংস্কৃতিক জগৎ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল ধর্মসংস্কার বা Reformation আন্দোলনের উথালপাতাল ঝােড়াে হাওয়ার দিনগুলিতে। প্রতিবাদী ধর্মীয় বক্তব্যের অন্যতম ধারক ও বাহক ছিল সেই যুগের মুদ্রিত বইগুলি। প্রােটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের ওপর মুদ্রণ বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল। ছাপাখানা ছিল ক্যাথলিকবাদ বিরােধিতার এক প্রধান অস্ত্র। ছাপাখানার সাহায্য নিয়ে লুথার ১৫১৭-২০ খ্রি. এর মধ্যে তিরিশখানি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তার “Address to Christian Nobility’ প্রবন্ধটির এক বছরে যােলটি সংস্করণ হয়েছিল। লুথারের লেখাগুলির তিন লক্ষ কপি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশে বিক্রি করা হয়। বাইবেলের প্রচারে মুদ্রণ যন্ত্রের বিশিষ্ট ভূমিকার কথা সকলে স্বীকার করেছেন। সাধারণ মানুষ স্থানীয় ভাষায় লেখা বাইবেল পড়ে পােপতন্ত্রের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল, ক্যাথলিক চার্চের গুরুত্ব ও মর্যাদা কমেছিল। গ্রন্থ প্রকাশনা একটি নতুন পেশা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল, পুরনাে প্রচারক শ্রেণীর অবসান ঘটে। গ্রন্থের প্রকাশ আঞ্চলিক ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। এভাবে মুদ্রিত পুস্তিকা ও গ্রন্থ মার্টিন লুথারের পােপতন্ত্রবিরােধী প্রচারকে আরও ব্যাপক ও বিপ্লবাত্মক রূপদান করেছিল। শুধু ধর্মপ্রচারকরা নন, রাজারাও মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে লাভবান হন (Printing served the designs of Kings as readily as those religious reformers)। অন্যদিকে মুদ্রণ শিল্প রাষ্ট্রীয় প্রচারের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। বৈদ্যুতিক মাধ্যমের আবির্ভাবের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মুদ্রণশিল্প ছিল রাষ্ট্রীয় প্রচারের সর্বাধিক কার্যকরী মাধ্যম। অষ্টম হেনরির পরামর্শদাতা টমাস ক্রমওয়েল মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে রাজার পক্ষে বক্তব্য রাখেন, চার্চের ওপর রাজার কর্তৃত্ব দাবি করেন।

ছাপাখানার ও ছাপা বইয়ের গুরুত্ব এতটা বৃদ্ধি পাওয়াতে ১৬শ শতক ও তার পরবর্তীকালে এর সম্প্রসারণকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কঠোর censorship চালু হয়েছিল। বিরােধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে স্থিতাবস্থার প্রতীকসমূহ, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্যাথলিক চার্চ ও রক্ষণশীল রাষ্ট্রযন্ত্র। লুথারবাদের মােকাবেলা করার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় ‘Roman Index of Prohibited Books’। ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরি প্রায় অনুরূপ একটি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। পােপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার মুদ্রাঙ্কিত একটি অনুশাসনে (Papal Bull of 1501) ঘােষণা করেন – “একান্ত প্রয়ােজনীয় পুস্তক সম্প্রচারের জন্য মুদ্রণ শিল্পের উপােযােগিতা অনস্বীকার্য কিন্তু ধ্বংসাত্মক ধ্যানধারণা ও কার্যকলাপ বৃদ্ধিতে মদত জোগালে এই শিল্পই ক্ষতিকারক (বা অনৈতিক) রূপধারণ করতে পারে।” তার ভাষায়, “…it can be very harmful if it is permitted to widen the influence of pernicious works.” এই রক্ষণশীল চার্চ ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্র আরোপিত সেন্সরশিপ থেকেই বোঝা যায় সেসময় মুদ্রণ বিপ্লব মধ্যযুগের সাংস্কৃতিক জীবনকে কতটা পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিল, বলা যায় আধুনিক যুগের প্রতিষ্ঠায় এর অবদান হল সর্বাধিক।

সামরিক বিপ্লব

মধ্যযুগের অবস্থা

১৫শ ও ১৬শ শতক হল ইউরােপে সামরিক বিপ্লবের যুগ। সব যুগে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটে। সৈন্যবাহিনীর গঠন, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ, রণকৌশল ও নেতৃত্ব সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগে ভূমিদাস ও কৃষক সামন্তপ্রভুদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করত। শিরস্ত্রাণ পরিহিত, বর্মাবৃত, অস্ত্রসজ্জিত অশ্বারােহী নাইটের ছবি আমাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক প্রয়ােজন দেখা দিলে শহরের নাগরিকরা অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াইয়ে যােগ দিত। ইউরােপের বিভিন্ন দেশের সামরিক ব্যবস্থায় কিছু মিল আবার কিছু অমিলও দেখা যায়। সমুদ্রের উপকূলবর্তী দেশগুলি সাধারণত নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়, এরা প্রতিরক্ষার জন্য স্থলবাহিনী নয় নৌবহরের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইংল্যান্ড মধ্যযুগ থেকে তার প্রতিরক্ষার জন্য নৌবহরের ওপর নির্ভর করেছিল, স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের নৌবহর ছিল। দেশের ভৌগােলিক অবস্থান, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকখানি নির্ভর করে। ইংল্যান্ডের টিউডর ও স্টুয়ার্ট রাজাদের স্থায়ী বেতনভুক সৈন্যবাহিনী ছিল না। রাজাদের শুধু একটি ক্ষুদ্র আয়তনের সৈন্যবাহিনী ছিল, এরা রাজার প্রাসাদ পাহারা দিত, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের কাজ করত। বৈদেশিক আক্রমণের সময় রাজারা বন্দরগুলির কাছ থেকে জাহাজ নিতেন, ভূস্বামীরা তাদের অনুচরবাহিনী নিয়ে রাজার সঙ্গে যােগ দিতেন। ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানির রাজারা প্রতিরক্ষার জন্য স্থলবাহিনীর ওপর নির্ভর করতেন। স্থলবাহিনী পদাতিক ও অশ্বারােহী এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধের সময় বাণিজ্য জাহাজগুলোকে এরা যুদ্ধের কাজে লাগাত।

রেনেসাঁর সময় থেকে যুদ্ধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধির ফলে রাজাদের নতুন যুদ্ধাস্ত্রের সন্ধান

কিন্তু রেনেসাঁর সময় থেকে যুদ্ধ পদ্ধতিতে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। ১৪৫০ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরােপে কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও অগ্রগতির প্রতিক্রিয়া সমরাস্ত্র ও রণনীতির ওপর অনুভূত হয়েছিল। এই সময় ছিল নতুন সমরাস্ত্র (বা মারণাস্ত্র) এবং অত্যন্ত কার্যকরী রণনীতির উদ্ভাবনের যুগ। এই যুগে বারুদের সাহায্যে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের বিশেষ দক্ষতা রণনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। মুদ্রণশিল্প যেভাবে বৌদ্ধিক জীবনকে পরিবর্তিত করেছিল, ঠিক অনুরূপভাবে নতুন রণনীতি ইউরােপীয় সমাজ ও রাজনীতিকে রূপান্তরিত করেছিল। এ সময় যুদ্ধ বিগ্রহ বেড়েও গিয়েছিল। ১৬শ শতকে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হয়েছিল। স্পেন ও নেদারল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ চলেছিল, ইতালির রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধ ছিল। যুদ্ধ শুধু রাজাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সামন্ত রাজারা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতেন। তুর্কিরা কনস্ট্যানন্টিনােপল অধিকার করলে ইউরােপের দেশগুলি সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরােপের রাজারা নতুন যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ ও সামরিক সন্ধান করেছিল। ফ্রান্সের রাজা নতুন যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের জন্য লিওনার্ডোকে ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করেছিলেন। নিজেদের সুরক্ষিত করার জন্য রাজারা দুর্গ বানিয়েছিলেন, দুর্গ নির্মাণ কৌশলে পরিবর্তন ঘটেছিল। ইউরােপীয়রা ধর্মযুদ্ধের সময় প্রাচ্যের দুর্গ দেখেছিল, ইউরোপের দুর্গ নির্মাণ পদ্ধতির ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। শক্ত পাথর দিয়ে, দুর্গ প্রাকারে গম্বুজ নির্মাণ করে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট পরিখা পরিবেষ্টিত দুর্গ গড়ে তােলা হয়। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা দুর্গ নির্মিত হয় তার নাম হল ‘ট্রেস ইতালিয়েন’ (Trace Italienne)। এই দুর্গ কামান দেগে ধ্বংস করা যেত না, এই সব দুর্গে সৈন্য রাখা হত, যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম মজুদ থাকত। প্রাকারের ওপর সারি সারি কামান বসানাে হত।

ভৌগােলিক আবিষ্কার শুরু হলে নৌবহরের প্রয়ােজন

১৫শ শতকে ভৌগােলিক আবিষ্কার শুরু হলে নৌবহরের প্রয়ােজন দেখা দেয়। ১৬শ শতকে উপনিবেশ ও বাণিজ্য বেড়েছিল, এজন্য অনেক দেশ নৌবহর গঠনে মন দিয়েছিল। আগেকার দাঁড়টানা, পালতােলা জাহাজ নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যেত না। ইউরােপে মজবুত কগ, ক্যারাভেল, ক্যারাক এবং ভাসা মডেলের জাহাজ তৈরি হয়েছিল। ইংল্যান্ড মজবুত জাহাজ বনিয়েছিল। নৌ-সৈনিক ও নাবিকরা নতুন মানচিত্র, কম্পাস ও এস্ট্রোল্যাবের ব্যবহার শিখেছিল। এসব জাহাজে অনেক মাস্তুল ও পাল খাটানাে হত, সেজন্য দাঁড় টানার দরকার হত। ভাইকিং জলদস্যুদের মন্থর গতি জাহাজের দিন শেষ হয়েছিল। জাহাজের ওপর সারি সারি কামান বসিয়ে জলদস্যুদের প্রতিহত করা হয়। গােলন্দাজ বাহিনী তৈরি হলে স্থলযুদ্ধে পদাতিক সৈন্যের গুরুত্ব বেড়ে ছিল, অশ্বারােহী সৈন্য প্রাধান্য হারিয়েছিল, তবে অশ্বারােহী বাহিনী একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি। ১৬শ শতকের গােড়ার দিকে স্পেনের নাবিক করটেজ মেক্সিকোতে যে অভিযান পরিচালনা করেন তাতে ছিল ইস্পাতের তরবারিধারী পদাতিক সৈন্য, অশ্বারােহী বাহিনী, কয়েকটি কামান ও তেরােটি মাস্কেট, এই বাহিনী নিয়ে তিনি অজটেকদের পরাস্ত করেন।

বারুদ, বন্দুক ও কামান আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন যুদ্ধ পদ্ধতি

মধ্যযুগের সমরবিদ্যায় পদাতিক বাহিনীর চেয়ে অশ্বারােহী বাহিনী প্রাধান্য পেয়েছিল। অশ্বারােহী বাহিনী তীর, ধনুক, বর্শা, তরবারি, হাতুড়ি ও কুঠার নিয়ে লড়াই করত। ভূমিদাস, কৃষক, ভাড়াটিয়া সৈন্য নিয়ে পদাতিক বাহিনী গঠন করা হত। এই বাহিনীর নিয়মিত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল না। রেনেসাঁর সময় থেকে সৈন্যবাহিনীর গঠন, যুদ্ধাস্ত্র ও রণকৌশল পাল্টে যায়। এই সময় থেকে নতুন ধরণের যুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বারুদের আবিষ্কার সভ্যতার ইতিহাসে আধুনিক যুগের পত্তন করেছে। বারুদের আবিষ্কারের সঙ্গে রজার বেকনের নাম যুক্ত হয়ে আছে। পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে Gunpowder বা বারুদের পরিচয় হয়েছিল ১৩শ শতকের মধ্যভাগে। ফ্রান্সিস্কান বৈজ্ঞানিক রজার বেকন (১২১৪-১২৯২) এটি বহুল প্রচলিত বলেই উল্লেখ করেছিলেন। তিনি একটি firecracker বা আগ্নেয়াস্ত্রের অনেকটা এইরকম বর্ণনা দিয়েছিলেন – “…পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তীব্র আওয়াজ ও আগুনযুক্ত একটি শিশুদের খেলনাসদৃশ (ছােট্ট ?) আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হচ্ছে। এই আগুন ও আওয়াজের উৎস একপ্রকার powder (বারুদ) যা মূলত saltpetre (potassium nitrate) বা সােরা, sulphur (brimstone) বা গন্ধক এবং hazelwood বৃক্ষের কাঠ পুড়িয়ে বানানাে কাঠ কয়লার মিশ্রণ। মিশ্রণটি ভরা হয় একটা আঙ্গুলাকৃতি ছােট্ট কার্তুজের ভিতর। বলাবাহুল্য, এর থেকে কার্তুজ নিক্ষিপ্ত হলে এর তীব্র আওয়াজ অসতর্ক মানুষের কর্ণপটহ বিদীর্ণ করতে পারে এবং এর মারাত্মক আগুনের ঝলকানি অত্যন্ত ভয়ংকর। …আর কোনাে শক্তপােক্ত দ্রব্য নির্মিত হলে অস্ত্রটির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেত।” স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে যে বেকনের কাছে বারুদ অজানা ছিল না। তিনি অবশ্য এর আবিষ্কারক ছিলেন না। ১১শ শতকে চিন দেশে বারুদ আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রিন্টিং-এর মতাে বারুদ নির্মাণের কলাকৌশল চিন দেশ থেকে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইউরােপে প্রসারিত হয়েছিল। ১৩শ শতকে ইউরােপ বারুদের ব্যবহার শিখেছিল, তার আগে সম্ভবত চীনদেশে বারুদের ব্যবহার হয়েছিল। ১৪শ শতকে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয়, ১৫শ শতকে এর ব্যবহার বেড়েছিল। গাদাবন্দুক (মাস্কেট), পিস্তল, কামান তৈরি হলে যুদ্ধের চেহারা পাল্টে যায়, হাতাহাতি যুদ্ধের যুগ শেষ হয়ে যায়, যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছিল। সৈন্যবাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্রে শিক্ষিত করে তােলার প্রয়ােজন দেখা দেয়। সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির লােকেরা কামানের ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছিল, বিভিন্ন দেশের সৈন্যবাহিনীতে গােলন্দাজ সৈনিক হিসেবে এরা কাজ করত।

১৪শ শতকের সূচনায় ইউরােপ ও চিনে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও বন্দুক নির্মাণ শুরু হয়েছিল। ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সের একটি নথিতে প্রথম বন্দুকের উল্লেখ পাওয়া যায়। যে দুইজন সরকারি কর্মচারী লৌহাস্ত্রটি নির্মাণ করেছিলেন তাদের নাম এখানে উল্লেখিত আছে। এছাড়া ফ্লোরেন্সে প্রজাতন্ত্রের দুর্গ ও গ্রাম রক্ষার্থে যে ধাতু নির্মিত কামান এরা নির্মাণ করেছিলেন তারও উল্লেখ এতে পাওয়া যায়। ওই বছরে লিখিত একটি ইংরাজি নথিতে প্রথম বন্দুক জাতীয় একটি অস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। অপটু হাতে তৈরি এই অস্ত্রটির দ্বারা তীর নিক্ষিপ্ত হত। কিন্তু ১৪শ শতকের অন্তিম লগ্ন থেকে ইউরােপে প্রায় সর্বত্র ব্যাপকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদিত হতে থাকে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ২৪ পাউন্ড ওজনের বন্দুক যার থেকে সিসার গুলি নিক্ষেপ করা হত, ৩৪ পাউন্ড ওজনের বন্দুক (যার থেকে তির নিক্ষেপ করা হত) এবং প্রায় ১ টন ওজনের বন্দুক (যা নির্মাণ করতে প্রায় একমাস সময় লাগত)। ১৫শ শতকের মধ্যভাগের মধ্যে রণক্ষেত্রে কামানের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক হয়ে ওঠে। প্রায় দুর্ভেদ্য সামন্তপ্রভুর দুর্গ বা নগরের প্রাকারকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এই কামানের ছিল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কস্টানটিনোপলের অবরােধের সময় তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ (১৪৫১-১৪৮১) অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার গােলন্দাজ বাহিনীকে নিয়ােগ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার সহায়ক ছিলেন জার্মান ও হাঙ্গেরিয়ান গােলন্দাজরা এবং তাদের ব্যবহৃত ভারী বন্দুক ও কামান। এই কামানগুলির মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বিশালাকৃতি এই কামানদুটি থেকে যে পাথরের বল নিক্ষিপ্ত হত তার ব্যাস ছিল প্রায় ৩ ফুট এবং এগুলির ওজন ছিল প্রায় আটশাে পাউন্ড। কামান দুটি টেনে আনার জন্য প্রয়ােজন হত প্রায় ৭০টি তার এবং এক হাজারের বেশি মানুষ। ওই কামান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে সামান্য কয়েকদিনের মধ্যে তুর্কি বাহিনী কস্টানটিনােপলের প্রতিরােধ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। ফ্রান্সেও শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অন্তিম পর্বে অবরােধের রণক্ষেত্রে গােলন্দাজ বাহিনীর কার্যকারিতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই পর্বে ফরাসিরা ইংরেজদের দখল থেকে নরমাঁদি (Normandy) আবার ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল। ইতিপূর্বে ১২শ শতকে ফরাসি রাজগণ কোনাে বিদ্রোহী সামন্তকে বশীভূত করতে এবং তাকে অবরুদ্ধ দুর্গের বাইরে আনতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি একাধিক বছর কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তীকালে ফরাসিরাজ সপ্তম চার্লস মাত্র এক বছরের মধ্যে ষাটটি অবরােধ অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন। এই অবরােধ সামন্তশ্রেণিকে এতই ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত যে রাজকীয় বাহিনী কামান সাজানাের সঙ্গে সঙ্গেই তারা আত্মসমর্পণ করত। এইভাবে পুরােনাে দুর্গের ওপর আধুনিক কামানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অশ্বারোহীর বদলে পদাতিক বাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি

যাইহােক, উপরােক্ত সাফল্যের প্রায় দেড় শতাধিক বছর পর্যন্ত কামান ছিল মূলত অবরােধের সময় ব্যবহৃত সমরাস্ত্র (primarily a siege weapon’)। কামান বা গােলন্দাজ বাহিনীর নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল সীমিত। রেনেসাঁর যুগে সৃষ্ট কামানের গােলা মাঝে মাঝেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হত। কিন্তু পদাতিক বাহিনী (infantry) কর্তৃক বহনযােগ্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কামানের চেয়েও এইগুলি আরও কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন, পদাতিক বাহিনীই সৈন্যবাহিনীর সারভাগ এবং প্রধান অবলম্বন (তার ভাষায় substance and sinew of armies)। মধ্যযুগীয় সশস্ত্র বাহিনীতে পদাতিকের তুলনায় অশ্বারােহী বাহিনীর (cavalry) গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বাহিনীর এক-একাদশাংশ ছিল পদাতিক বাহিনী আর স্পেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর এক-দ্বাদশাংশ ছিল পদাতিকরা, অবশ্য পরবর্তীকালে পদাতিকদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একাধিক ইউরােপীয় রণাঙ্গনে পদাতিক বাহিনী হয়ে ওঠে তুলনামূলক বিচারে আরও বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন। উভয় বাহিনীর সামাজিক ভিত্তিও ছিল অনেকটা পৃথক। অশ্বারােহী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন অভিজাততান্ত্রিক। অন্যদিকে পদাতিকরা ছিলেন plebian বা সাধারণ শ্রেণিভুক্ত। অভিজাতদের চোখে এরা ছিলেন ঘৃণিত। কিন্তু এই বাহিনীকে আর উপেক্ষা করা যাচ্ছিল না। এই পদাতিকরাই হালকা এবং উন্নততর আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার পর আরও দুর্বারগতি সম্পন্ন এবং প্রায় অপরাজিত বাহিনী রূপে ইউরােপের রণাঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছিল। এদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল আর্কেবাস (arquebus)। এটি একপ্রকার হাত বন্দুক। পরবর্তীকালে এটি আরও উন্নত বন্দুক মাস্কেটে (musket)-এ রূপান্তরিত হয়। সমসাময়িক কয়েকটি চিত্রে এবং অন্যান্য বৃত্তান্তে এটি বর্ণিত হয়েছে। এর barrel বা নল (বা চুঙ্গি) ছিল লৌহ-নির্মিত, এর butt বা কুঁদো ছিল কাঠের। দৈর্ঘ্যে এটি ছিল প্রায় ৬ ফুট। এর ওজন ১৫ পাউন্ড। এর থেকে সিসার বুলেটগুলি প্রায় দুইশত গজ দূরে নিক্ষিপ্ত হত। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পর পদাতিকরা অনেকেই ছিল আর্কেবুস বা মাস্কেটের অধিকারী। অবশ্য এদের পাশাপাশি মধ্যযুগীয় pikemen বা দীর্ঘ বল্লমধারীরাও থাকতেন। বন্দুক এবং বল্লমধারীরা ছিলেন রণক্ষেত্রে একে অন্যের পরিপূরক। ধেয়ে আসা অশ্বারােহীর হাত থেকে বাঁচানাের অন্য বন্দুকধারীর প্রয়ােজন ছিল বল্লমধারীর আর রণক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার পথটিকে প্রশস্ততর করার জন্য (অর্থাৎ বিপক্ষের সৈন্যদের হঠানাের জন্য) বল্লমধারীর প্রয়ােজন ছিল বন্দুকবাজের (এবং তার নিক্ষিপ্ত গুলির ওপর)। বল্লম ও বন্দুকের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার রণকৌশলের উদ্ভাবক ছিলেন বিশিষ্ট স্পেনীয় সেনাপতি ফার্নান্দো ফ্রান্সিসকো দ্য আভালােস মার্শেসে দি পেসকারা (১৪৮৯-১৫২৬)। তাকে আধুনিক পদাতিক বাহিনীর জনক (father of modern infantry) বলা হয়েছে। ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দের পাভিয়ার যুদ্ধে ইনি চরম নৈপুণ্যের সঙ্গে এই নীতি প্রয়ােগ করে ফরাসি বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন। স্বয়ং ফরাসিরাজ প্রথম ফ্রান্সিস এই রণক্ষেত্রে পরাজয় স্বীকার করে বন্দি হয়েছিলেন।

খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও কারিগরি উদ্ভাবনে এবং বারুদের ভিন্ন ব্যবহার

আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরােপের খনিজ পদার্থের উৎপাদনও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল, কারণ কামান, বন্দুক প্রভৃতি নির্মাণের জন্য লােহা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতির প্রয়ােজন ছিল। শুধু কামান বন্দুক নয়, তরবারি, বল্লম, ছােরা, তির প্রভৃতির জন্য ধাতুর প্রয়ােজন ছিল। নানাপ্রকার কারিগরি উদ্ভাবন খনিজ উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়তা করেছিল। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল খনি থেকে জল বার করার উন্নত পদ্ধতি ও মেশিন, ব্লাস্ট ফার্নেস প্রভৃতি। এতে ১৪৬০ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খনিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় পাঁচ গুণ। খনিজ তামা থেকে রূপা সরানাের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে তামার উৎপাদন ও জোগানও উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬শ শতকে লােহার কামান নির্মাণের আগে পর্যন্ত তামাই ছিল কামানের অন্যতম উপাদান। Gunpowder বা বারুদ শুধু ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে ব্যবহৃত হত এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। শান্তিপূর্ণ বা আর্থিক ক্রিয়াকলাপে এর ভূমিকা নেহাত উপেক্ষণীয় ছিল না। বুলেট ব্যবহৃত হওয়ার আগেই খনিতে blasting বা বিস্ফোরণ ঘটানাের জন্য বারুদ ব্যবহৃত হত। Blasting ছাড়া খনির সম্প্রসারণ বা উৎপাদন বৃদ্ধি অসম্ভব। এছাড়া উৎসবের দিনে firecracker বা পটকা ফাটানাের জন্য বারুদ ব্যবহৃত হত। চিনদেশে পশ্চিমের তুলনায় বারুদের সামরিক ব্যবহার অনেক কম ছিল। পাশ্চাত্য দুনিয়ার শাসকশ্রেণি সাম্রাজ্য বা দেশের সংহতি সাধন বা সাম্রাজ্য বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার রূপে বারুদকে দেখেছিলেন। বিচ্ছিন্নতাকামী সামন্তশ্রেণির ওপর রাজার আধিপত্য বিস্তার এবং কেন্দ্রীকরণের অন্যতম অস্ত্র ছিল বারুদ এবং আগ্নেয়াস্ত্র।

স্থায়ী, শিক্ষিত সৈন্যবাহিনী ও এলিট বাহিনী গঠন এবং কৌশলভিত্তিক আক্রমণাত্মক যুদ্ধরীতি

আগ্নেয়াস্ত্রের আবিষ্কার, নতুন দুর্গ ও জাহাজ নির্মাণ ও নতুন রণকৌশল ইউরােপের উদীয়মান রাষ্ট্র ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি ও ইতালিকে স্থায়ী, বেতনভুক, শিক্ষিত সৈন্যবাহিনী গঠনে উৎসাহ দিয়েছিল। ইউরােপে ভাড়াটে, ভাগ্যান্বেষী, ভূমিদাস সৈনিকের দিন শেষ হয়েছিল। তাদের নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানাের অসুবিধা ছিল, সুযোগ পেলে বা দুর্গতির মধ্যে পড়লে তারা সমদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেত, দেশ বা রাজার প্রতি এদের আনুগত্য তৈরি হত না। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও স্পেনের রাজারা স্থায়ী, বেতুনভুক, শিক্ষিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। অভিজাতদের পরিবার থেকে অফিসারদের নিয়ােগ করা হত, বুর্জোয়াদের অফিসার হিসেবে নিয়ােগ করায় কোনাে বাধা ছিল না। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই রাষ্ট্রীয় আয়ের ৫০-৭৫ শতাংশ সৈন্যবাহিনীর জন্য ব্যয় করতেন। ভঁবা (Vauban) লিখেছেন যে সামরিক বিপ্লবের ফলে জনগণের ওপর করের বােঝা চেপেছিল, ডাইম রয়েল (Dime Royale) নামক গ্রন্থে তিনি ফ্রান্সের জনগণের দুর্দশার কথা উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের ব্যয় বেড়েছিল, রাজারা রাষ্ট্রের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বাড়তি ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করতেন। অটোমান সুলতানরা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। যুদ্ধ হল নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। যুদ্ধ ছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। বৃহৎ সামরিক শক্তি হল অস্ট্রিয়া, স্পেন ও ফ্রান্স, ১৭শ শতকে এদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিল সুইডেন ও হল্যান্ড। এদের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্র। অনেক দেশে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে একটি সেরা বাহিনী গঠন করা হত। ক্রমওয়েলের ছিল আইরনসাইডস (Ironsides), তুরস্কের সুলতানের জ্যানিসারি সৈন্যদল, এরা অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে কাজ করত, শত্রুর ওপর প্রথম আঘাত হানত।

ইউরােপে আগেকার যুদ্ধরীতি ছিল অনেকটা রক্ষণাত্মক, নতুন রীতি হল আক্রমণাত্মক। শত্রুকে আঘাত হানার জন্য সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। নতুন যুদ্ধ রীতিতে নৈতিকতার কোনাে স্থান ছিল না, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন ছিল না। চার্চ যুদ্ধের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত, অনেক সময় চার্চের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হত। ছলে, বলে, কৌশলে যুদ্ধ জেতার চেষ্টা হত। ব্যাক্তিগত নৈপুণ্যের চেয়ে কৌশলের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। সারা বছর ধরে সৈন্যবাহিনী কাজ করত, সাজ সজ্জার পরিবর্তন হয়েছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা দেখা যায়, সুইডেনের সৈন্যবাহিনী জার্মানিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, ক্রমওয়েল দ্রোঘেদার (Drogheda) যুদ্ধে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন। প্রচণ্ড শীতে সামরিক অভিযান বন্ধ থাকত।

১৭শ শতকে যুদ্ধকৌশল, সৈন্যবাহিনীর গঠনে পরিবর্তন ও দুর্গকে ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

১৭শ শতকে যুদ্ধকৌশলের আরও পরিবর্তন হয়। রাজারা বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। ফ্রান্সের রাজার আড়াই লক্ষ সৈন্য ছিল, জনসংখ্যার ১.৫ শতাংশ। অস্ট্রিয়ার সম্রাটের প্রধান শত্রু ছিল তুরস্কের সুলতান। প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে নতুন অস্ত্র শস্ত্র বানানাে হয়। এ যুগের সামরিক বিশেষজ্ঞরা হলেন মন্টিকুক্কোলি (Montecuccoli), লােরেনের চার্লস, স্যাভয়ের হভাজন, সুইডেনের গুস্তাভাস এডলফাস ও একাদশ চার্লস। তুরিন (Turenne) ও নাসাওয়ের মরিস (Maurice of Nassau) সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়ােগে ছিলেন অগ্রগামী। মরিস (১৫৬৬-১৬২৫ খ্রি.) দুর্গ নির্মাণে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মরিস ও গুস্তাভাস নতুন সামরিক কৌশল (strategy) অনুসরণ করেন। সৈন্য ও সেনাপতিরা ছিলেন শিক্ষিত ও পেশাদার। সম্মান, জীবিকা ও লুটের জন্য সৈনিকরা সৈন্যবাহিনীতে যােগ দিত। ১৭শ শতকের সৈন্যবাহিনীতে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ছিল, সৈন্যরা যুদ্ধের চেয়ে অফিসারদের বেশি ভয় পেত। ক্রমওয়েলের আইরনসাইডস ও গুস্তাভাসের লুথারপন্থী সৈন্যদের মধ্যে আদর্শবাদ ছিল। গান ও উপদেশ দিয়ে (Psalm and sermon) সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করা হত। ফরাসি যুদ্ধ মন্ত্রী লে টেলিয়ের ও তার পুত্র লাভােয়া (Le Tellier and Louvois) সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়েছিল, সৈনিকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা ছিল। মিলিশিয়া (Militia) নামে সংরক্ষিত বাহিনী গড়ে তােলা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে অস্ত্র কারখানা গড়ে তােলা হয়, এতে অবশ্যই অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সুইজারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সার্বিয়া ও ফিনল্যান্ডের লােকেরা ইউরােপের বিভিন্ন দেশে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক হিসেবে কাজ করত। বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য সংগ্রহ করা হত (conscription)। সৈন্যবাহিনীতে পদাতিক বাহিনী প্রাধান্য পেয়েছিল, এদের সঙ্গে থাকতো গােলন্দাজ বাহিনী। গুস্তাভাস প্রত্যেক ব্যাটালিয়নের সঙ্গে কামান রেখেছিলেন। গাদা বন্দুকের উন্নতি হয়েছিল, বড়াে বর্শার ব্যবহার (Pike) কমেছিল। অশ্বারােহী বাহিনীর হাত থেকে গাদা বন্দুকধারীদের রক্ষা করত বর্শাধারী পাইকম্যানরা, বর্শার স্থলে বেয়নেটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। বন্দুকের ব্যবহার বাড়লে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য সমাবেশ করা হত তিন সারিতে। প্রথম সারিতে হাঁটু মুড়ে বসত পদাতিকরা, দ্বিতীয় সারির কাঁধের ওপর দিয়ে বন্দুক চালাত বন্দুকধারীরা। গােলন্দাজ বাহিনী ঘােড়ার গাড়িতে কামান বসিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেত। ১৬৭২ খ্রি. চতুর্দশ লুই যখন নেদারল্যান্ড আক্রমণ করেন তার সঙ্গে ছিল ১২০,০০০ সৈন্য, এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ ছিল পুদাতিক বাহিনীর লোক। আবার ম্যাক্স (Max) ও ইউজিনের নেতৃত্বে অস্ট্রিয়ার যে সৈন্যবাহিনী ছিল তার সেরা অংশ ছিল অশ্বারােহী বাহিনী। অস্ট্রিয়ার সেনাপতিরা হাল্কা অশ্বারােহী হুসার বাহিনী ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন রণক্ষেত্রের অবস্থান অনুযায়ী রণকৌশল পাল্টাত। অস্ট্রিয়া অশ্বারােহী ও পদাতিক বাহিনীকে পরপর সাজাত, সুইডেন ও ইংল্যান্ড দ্রুত, আকস্মিক আঘাত হানার জন্য অশ্বারােহী বাহিনী ব্যবহার করত।

১৭শ শতকে দুর্গ ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। মনে করা হত দুর্গ হল সৈন্যবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়। ফ্রান্স সীমান্ত বরাবর তেত্রিশটি দুর্গ বানিয়েছিল, গ্রান, মান্টুয়া ও ব্রেদাতে শক্তিশালী দুর্গ ছিল। প্যাগান, স্পিনােলা ও ভঁবা (Pagan, Spinola and Vauban) সামরিকক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাকে প্রয়ােগ করেন। সৈন্যবাহিনীর বেতন, নিয়ােগ, শিক্ষা ইত্যাদির কিছুটা উন্নতি হলেও বাসস্থান, খাওয়া দাওয়া তেমন উন্নতমানের ছিল না। এজন্য সৈন্যবাহিনীতে যােগ দিয়েও অনেকে পালিয়ে যেত। এযুগে নৌ-বাহিনীর গুরুত্ব বেড়েছিল। ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের মধ্যে নৌ-যুদ্ধ (১৬৫২-৭৪ খ্রি.) নৌ-বাহিনীর ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল। শক্তিশালী জাহাজ, কামান ও দক্ষ নৌ-সৈনিক নৌবহর গঠনের জন্য প্রয়ােজন হয়। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্স নৌবহরের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, নৌপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল। পল হােস্ট (Paul Hoste) নৌবিদ্যার ওপর গ্রন্থ রচনা করেন (L’Art des armees navales, 1697)।

বারুদের ফলে যুদ্ধের রাজকীয়করণ ও রাজার ক্ষমতা-বৃদ্ধি

উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধের রাজকীয়করণে সহায়তা করেছিল, কারণ কামানবন্দুক এখন থেকে রাজার অস্ত্রে (অর্থাৎ রাজার প্রাধান্য বিস্তারের অস্ত্রে) পরিণত হয়েছিল। আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকার রাজার ক্ষমতা ও গৌরব বৃদ্ধির অন্যতম উৎস ছিল। যদিও ইউরােপে সর্বত্র রাজক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ও সময় ভিন্ন ছিল, তথাপি এটা লক্ষ করা মরেছিল যে বারুদ নির্মাণ সংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞান (এর ওপর রাজার একচেটিয়া অধিকার) অভিজাতদের স্বাতন্ত্র্য, বিচ্ছিন্নতাকামী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সমান্তরাল রাজনৈতিক-সামরিক ক্ষমতাকে প্রথমে নিয়ন্ত্রিত এবং পরবর্তীকালে সমূলে উৎপাটিত করেছিল। একমাত্র বড়াে রাজ্যের রাজাই পারতেন একটি বিশাল সেন্যবাহিনী এবং তার আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে। শুধু ভূমি রাজস্ব বা বাণিজ্য শুল্ক নয়, দেশের প্রায় সর্বপ্রকার সম্পদের ওপর তার ছিল সীমাহীন অধিকার। private army এবং private war-এর যুগ অবশেষে অস্তমিত হয়েছিল। এখন থেকে কেন্দ্রীকরণ, সুস্থিতি, শান্তিশৃঙ্খলা, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রতীক রাজশক্তি, আর অন্ধকার, অনগ্রসরতা, বিচ্ছিন্নতা ও নিশ্চলতার প্রতীক সামন্তপ্রভু। ইতিহাসে অনিবার্য-অমােঘ নিয়মে রাজশক্তির ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ ও সামন্তের প্রস্থান ঘটেছিল।

বারুদের ও সমরাস্ত্রের সাংস্কৃতিক মূল্যায়ন এবং যুদ্ধসংক্রান্ত মতাদর্শে পরিবর্তন

অবশ্য কিছুটা ভিন্ন অর্থে আগ্নেয়াস্ত্র সর্বহারার অস্ত্র ছিল। Eugene F. Rice-এর ভাষায় : “If in one perspective the effect of firearms was to royalize warefare, in another perspective the effect was to proletarianize it.” (The Foundations of Early Modern Europe, 1460-1559)। সমসাময়িকগণ এবিষয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। পাভিয়ার যুদ্ধে জনৈক ফরাসি অভিজাতকে বন্দি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি লিখছেনঃ “ঈশ্বর এই অস্ত্রটি (arquebus) আবিষ্কারে সাহায্য না করলেই ভালাে করতেন। এটাই আমার অ-সুখের কারণ (অস্ত্রটিকে ইনি unhappy weapon আখ্যা দিয়েছেন)। এটি আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করেছে। শুধু তাই নয়, আরও লজ্জা ও পরিশ্রমের বিষয় হল এই যে আলােচ্য অস্ত্রটির অধিকারীরা অত্যন্ত ভীরু, কাপুরুষ এবং পলাতক (cowards and shirkers)। এরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হয়ে দূর থেকে বিশ্রী বুলেট ছুঁড়ে শত্রুকে ধরাশায়ী করতে চেষ্টা করে।” গােলাবারুদের আবিষ্কারের পিছনে উন্নত কারিগরি জ্ঞান মধ্যযুগীয় অভিজাতদের যত না বিপন্ন বিস্ময়ে অভিভূত করেছিল, তার চেয়ে বেশি তাদের কাছে গাত্রদাহের কারণ ছিল বন্দুকবাজরা; এরা ছিল নীচ বংশজাত এবং নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি ছুঁড়ে এরা বীর যােদ্ধা নাইটদের ধরাশায়ী করত। এই যুগের এক বিশিষ্ট কবি ছিলেন লােডােভিসাে অ্যারিওস্টো (Ludovico Ariosto, 1473-1533)। ইনি ছিলেন ফেরারায় ইস্টের ডিউকের সভায় শিভাল্‌রি ধারক এবং বাহক এবং ইনি নারী, নাইট, অস্ত্র এবং প্রেমের গান গাইতেন। বলাবাহুল্য, বন্দুক একে ব্যথিত করেছিল। এর রচিত একটি গীতে তিনি লিখছেন – “কী ঘৃণ্য, অপবিত্র এই উদ্ভাবন! মানব হৃদয়ে এর স্থান হল কীভাবে? সৈনিকের অহংকারকে তুমি (বন্দুক) ভূলুণ্ঠিত করেছ, তােমার অশুভ স্পর্শে অস্ত্রের গৌরব আজ অস্তমিত।” নিকলাে ম্যাকিয়াভলি তার Discourses-এ লিখছেন, “জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে শঠতা-প্রবঞ্চনার আশ্রয় নেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কিন্তু যুদ্ধে বন্দুকের ব্যবহার গৌরবময় এবং প্রশংসনীয়।” রেনেসাঁসের নতুন মানুষ, বিশিষ্ট রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ ম্যাকিয়াভেলি বন্দুককে স্বাগত জানাতে দ্বিধাবােধ করেননি। অবশেষে যুদ্ধে নীতিবহির্ভূত (amoral) রাষ্ট্র নাইটের গৌরবকে উৎখাত করেছিল। শিভাল্‌রির অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছিল gunpowder।

সমরাস্ত্র উৎপাদনের আর একটি ফলশ্রুতি এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আগ্নেয়াস্ত্রের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা একদিকে যেমন এযুগে শান্তি আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি বিশেষ প্রয়াজনে (অর্থাৎ প্রতিরক্ষা, শান্তিস্থাপন, অবিচারের প্রতিকার প্রভৃতি কারণে) যুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তাকে চিন্তাশীল মানুষের একাংশ যুদ্ধকে স্বাগত জানিয়েছিল। অ্যানাব্যাপটিস্টরা ওল্ড টেস্টামেন্টের মোজেস বা মুসা প্রদত্ত দশটি বাণী বা অনুজ্ঞার একটিকে বার বার স্মরণ করে বলেছিলেন ‘অবশ্যই হত্যা করবে না’ (Thou shalt not kill)। কিন্তু অন্যদিকে যুদ্ধকেও নতুন করে গৌরবান্বিত করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য এই দুই পরস্পরবিরােধী আদর্শের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে মানুষ এই সিদ্ধান্তে এসেছিল যে যুদ্ধ ও শান্তি দুটিই সমানভাবে প্রয়ােজনীয়। এই প্রসঙ্গে প্রায় সমকালীন একটি রেনেসাঁস চিত্রের উল্লেখ করতে হয়। সেখানে প্রেম এবং মিলনের গ্রিক দেবী বিবসনা-সুন্দরী ভেনাস মতভেদ ও যুদ্ধের দেবতা মার্সকে বশীভূত করেছে তার প্রেমালিঙ্গনের দ্বারা। অবশেষে উভয়ের মিলনের ফলে Harmony বা ঐক্য নামক একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হচ্ছে। দৃশ্যটির প্রতীকী ব্যঞ্জনা বিশেষভাবে উল্লেখযোেগ্য।

১৬শ শতকের কৃষি বিপ্লব এবং ১৭শ শতকের অর্থনৈতিক সংকট ও পরিণাম

অধ্যাপক রােস্টো (Rostow) জানিয়েছেন যে শিল্প বিপ্লবের আবশ্যিক শর্ত হল কৃষি বিপ্লব –

  • কৃষি বিপ্লব বর্ধিত খাদ্যশস্য, কাচামাল বাজার ও পুঁজির ব্যবস্থা করে দেয়।
  • বিচ্ছিন্ন, মুক্ত জোতের জায়গায় সংহত, বৃহৎ কৃষি খামার গড়ে ওঠে, চাষ জমির পরিমাণ বাড়ে, চাষের সঙ্গে পশু পালন যুক্ত হয়।
  • খােরাকি-নির্ভর কৃষক সমাজের পরিবর্তে মজুরির উপর নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিকের আবির্ভাব হয়।
  • এরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য উৎপাদন করে এবং কৃষিতে মাথাপিছু উৎপাদন বেড়ে যায়।
  • উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটে যায় এবং উৎপাদকের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে।

১৬শ শতকে ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে উন্নতি ঘটেছিল। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবভৌগােলিক আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে ইউরােপীয় আধিপত্যের সূচনা করেছিল। পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ হল এ যুগের বৈশিষ্ট্য। লােকসংখ্যা বেড়েছিল, ইউরােপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়েছিল আর সেই সঙ্গে চাহিদাও বেড়েছিল। বাজারের এই চাহিদার দিকে তাকিয়ে পুঁজি ও মজুর নিয়ােগ করে মুনাফার জন্য কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু সামন্ত প্রভু নন, মাঝারি ও ছােটো ভূস্বামী, বুর্জোয়া শ্রেণীর মানুষ কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, ইংল্যান্ডে জেন্ট্রি শ্রেণী কৃষিতে নানা বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

১৬শ শতকে ইউরােপের কৃষিতে সম্প্রসারণ ঘটেছিল। ইউরােপে কৃষির সম্প্রসারণের কতকগুলি কারণ ছিল –

  • ১৬শ শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাড়তি চাহিদা ও আমেরিকা থেকে সােনা-রূপাে আমদানির জন্য এ বিপ্লব ঘটেছিল, খাদ্য-শস্য ও কৃষিজ পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছিল।
  • সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার পতন ঘটে, ইউরােপে বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়। পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে সামন্ত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। এই অঞ্চল থেকে পশ্চিম ইউরােপে খাদ্যশস্য ও গবাদি পশু রপ্তানি করা হত। এসব কারণে এই অঞ্চলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তন বিলম্বিত হয়েছিল। অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপে কৃষিতে বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছিল, পশম, রেশম, শণ, তুলাে ইত্যাদি পণ্য বাজারের বিক্রির জন্য উৎপন্ন হত। এসব পণ্যের বাজার গড়ে উঠেছিল। ভূমি মূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। কৃষি পণ্যের বাজার তৈরি হয়েছিল।
  • ১৬শ শতকে ইউরােপে পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ ঘটেছিল, পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ পুঁজিবাদের অগ্রগতি সম্ভব করে তুলেছিল। ১৬শ শতকে যুদ্ধ ও প্লেগ মহামারীর প্রকোপ কমেছিল, এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে নতুন জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়, অরণ্য, জলাভূমি এবং চারণভূমিতে চাষ বসানাে হয়েছিল। উত্তর সাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে জলনিষ্কাশন ও বাঁধ দেবার ব্যবস্থা করে কৃষিক্ষেত্রগুলি রক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। এই সব অঞ্চলে ৪৪ হাজার হেক্টর নতুন জমিতে চাষ বসেছিল, নেদারল্যান্ডে ৩০ শতাংশ বাড়তি জমি কৃষির আওতায় এসেছিল।
  • ইউরােপে শুধু কৃষি জমির সম্প্রসারণ ঘটানাে হয়নি, নিবিড় চাষ শুরু হয়েছিল। চাষবাসে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জন্য উৎপাদন বেড়েছিল। চাষের নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়, চাষ জমি ব্যবহারের নতুন ধারণা গড়ে ওঠে। চক্রাকার চাষের মাধ্যমে (crop rotation) একই জমিতে একবছরে একাধিক শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ভালাে জমিতে পরপর চার বছর চাষ করে এক বছর পতিত রাখা হত। দু’বছর চাষ করে এক বছর পতিত রাখা এবং তিন থেকে ছয় বছর চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হত জমি। চক্রাকার চাষ করে পতিত বছরে জমিতে পশু খাদ্য উৎপন্ন করা হত। ইংল্যান্ডে পশুখাদ্য টার্নিপ চাষ করে গবাদি পশু বাড়ানাে হয়েছিল। চাষের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • ১৬শ শতকে নিবিড় চাষ শুরু হলে দুরকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সামন্ততান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে উৎপাদন পদ্ধতির বড়াে রকমের পরিবর্তন না ঘটিয়ে উৎপাদন বাড়ানাে সম্ভব হয়। নিবিড় চাষের জন্য বিশেষ ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়ােজন হয়। কৃষি খামারের পরিচালনগত কৌশলের দরকার হয়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষি উৎপাদন ও খামার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন।
  • প্রত্যেক ইউরােপীয় দেশ কৃষি উৎপাদন বাড়ানাের জন্য দুধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল – চাষের সম্প্রসারণ অথবা নিবিড় চাষ। বেশিরভাগ দেশে নতুন জমিতে চাষ বসিয়ে উৎপাদন বাড়ানাে হয়। নেদারল্যান্ড, ইতালির পো উপত্যকা এবং ইংল্যান্ডে নিবিড় চাষ শুরু হয়েছিল। এসব দেশে শিল্পের কাঁচামাল কৃষিতে উৎপন্ন হত, এসব অঞ্চলে চাষ আবাদ বাড়ানাের জন্য বাড়তি জমি ছিল না। অন্যান্য অঞ্চলে যেমন স্পেন, জার্মানি ও ফ্রান্সে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানাের জন্য পশুপালন কমানাে হয়। এসব দেশের পশম উৎপাদনকারীরা খাদ্যশস্যের চাষ করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন দেশ নিজেদের পছন্দমতাে উৎপাদন পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল। ইংল্যান্ডে ভূস্বামীরা জমি ঘিরে মেষ পালন করতে শুরু করে দেন (enclosure)। এতে বহুলােক কর্মচ্যুত হন, গ্রামাঞ্চলে অশান্তি দেখা দেয়। কৃষি কাজে নতুন লাঙল ব্যবহার শুরু হয়েছিল, কৃষি ব্যবস্থায় নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারও শুরু হয়েছিল।
  • ১৬শ শতকের মূল্য বিপ্লব খাদ্যশস্যের মূল্য বিপ্লব, মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। এই সময় থেকে কৃষির বাণিজ্যীকরণ হয়, পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ ঘটে। কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে গােপালনকে যুক্ত করা হয়েছিল, এই ধরনের কৃষি ব্যবস্থায় জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

এই কৃষিবিপ্লবের ফলে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে পরিবর্তন ও শিল্পবিপ্লব ভূমিকা –

  • ইংল্যান্ড ইউরােপের বাজারে পশম ও মাংস সরবরাহ করত। পশমের চাহিদা বৃদ্ধি ইংল্যান্ডের কৃষিতে বাণিজ্যীকরণ নিয়ে এসেছিল। পশম বিক্রি করে ইংল্যান্ডের গ্রামীণ সমাজ পুঁজি গড়ে তুলেছিল। এই পুঁজি শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়। ফিলিস ডীন মনে করেন ইংল্যান্ডের কৃষি বিপ্লব শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়। কৃষি দিয়েছিল খাদ্যশস্য, কাঁচামাল, বাজার, পুঁজি ও শ্রমিক। কৃষি লাভজনক হলে সম্পন্ন কৃষক, ফটকাবাজ, বণিক ও অর্থলগ্নিকারী সকলে কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। চারণ ভূমিতে ঘেরা দিয়ে মেষ পালন শুরু হয়, কৃষকের পশুচারণভূমির অভাব দেখা দিয়েছিল।
  • ইউরােপে কৃষির বাণিজ্যীকরণ শুরু হলে সমাজ বিন্যাসেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ সমাজে তিন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে – ভূস্বামী, সম্পন্ন কৃষক ও স্বাধীন কৃষক। ভূমি সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিল, বুর্জোয়ারা লাভের আশায় শহুরে মূলধন জমিতে লগ্নি করেছিল। ভূমি-নির্ভর পুরনাে সামাজিক শ্রেণী সরে যায়, নতুন ভূমি-নির্ভর সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। ইংল্যান্ডে রাজা অষ্টম হেনরি চার্চের ভূসম্পত্তি বিক্রি করলে এই শ্রেণী লাভবান হয়। এদের অধীনে চলে এসেছিল চাষযােগ্য জমির একটি বড় অংশ। ভূমিদাসরা ভূমি হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়, এদের জন্য টিউডর শাসকদের ‘দরিদ্র আইন’ (Poor law) পাশ করতে হয়েছিল।

ইংল্যান্ডের মতো ফ্রান্সের কৃষিতে বিপ্লব হয়নি, কারণ –

  • এজন্য ফ্রান্সের ভূমি ব্যবস্থা অনেকখানি দায়ী ছিল।
  • ফ্রান্সের কৃষক ছিল অশিক্ষিত, রক্ষণশীল ও দরিদ্র, এজন্য কৃষিতে বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
  • ফ্রান্সের কৃষকেরা ছিল দরিদ্র, এজন্য কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার তারা করতে পারেনি। ফ্রান্সের কৃষকেরা ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানসম্মত কৃষি যন্ত্রপাতির কথা জেনেছিল, জেথরো টুলের (Jethro Tull) প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছিল, কয়েকজন অভিজাত কৃষিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কৃষির উন্নতি হয়নি, উৎপাদন তেমন বাড়েনি, জলসেচের ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়নি। পাশের দেশ হল্যান্ডে কৃষি কাজকর্মের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো বা চক্রাকার চাষের ব্যবস্থা হয়েছিল।
  • কৃষকের রক্ষণশীলতা কৃষি সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করত। কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনের জন্যে যে ব্যাপক হারে পুঁজি বিনিয়োগের দরকার ছিল বেসরকারি বা সরকারি কোনো পক্ষই তা লগ্নি করতে রাজি ছিল না।
  • সরকার বার্টিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে অনেকগুলি কৃষি সমিতি গড়ে তুলেছিল। পতিত জমি চাষের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছিল কিন্তু কৃষকেরা তাতে উৎসাহ দেখায়নি।
  • গ্রামীণ অভিজাতরা কৃষি সংস্কারের বিরোধিতা করত কারণ তারা ধরে নিয়েছিল সংস্কার তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ধ্বংস করবে।
  • ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে দ্রব্যমূল্য ও মজুরি নিয়ে গবেষণা করেছেন সি. ই. লাব্রুস। তিনি দেখিয়েছেন যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষকেরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দরিদ্র কৃষকের খাদ্য ভুট্টা, রাই ও নিম্নমানের গমের দাম ভালো গমের চেয়ে বেশি বেড়েছিল।

কিন্তু ১৬শ শতকের কৃষি বিপ্লব ১৭শ শতকে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। ১৭শ শতকে সামগ্রিকভাবে ইউরোপে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সংকট দেখা যায়, কারণ –

  • ইউরােপের সব দেশে যুদ্ধের কারণে কম বেশি লােকসংখ্যা কমেছিল। এই শতকে মাত্র চার বছর যুদ্ধ ছিল না।
  • পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ ঘটলেও সামন্ততান্ত্রিক কাঠামাে রয়ে যায়, এটি কৃষির সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭শ শতকে সমান্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছিল।
  • অনেকে মনে করেন যে ১৬শ শতকে কৃষি ব্যবস্থার অস্বাভাবিক সম্প্রসারণ থেকে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। ম্যালথাসের অনুগামীরা হলেন এই মতের সমর্থক।
  • ভূমির ওপর পরীক্ষানীরিক্ষা উৎপাদিকা শক্তি কমিয়েছিল।

এই সংকটের ফলে ইউরোপের অর্থনীতিতে বেশ কিছু পরিণাম দেখা যায়, যেগুলোর অধিকাংশই বাজে –

  • ১৬শ শতকের মতাে ১৭শ শতকে কৃষিজ পণ্যের দাম বাড়েনি, জমির দাম কমেছিল; জমিতে যারা বিনিয়ােগ করেছিল তারা লােকসানের মুখে পড়েছিল। জমির খাজনা কমেছিল, তবে ভূস্বামীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। জমির সামাজিক মর্যাদা আগের মতাে ছিল না।
  • বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে খাদ্যশস্যের দাম কমেছিল কিন্তু ইংল্যান্ডে খাদ্যশস্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়ে যায়, খাজনা বেশি ছিল, ঘেরাও চলেছিল। ১৭শ শতকের শেষে ইংল্যান্ড থেকে পশম রপ্তানি কমেছিল।
  • বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে কৃষি সংকট মােকাবেলার চেষ্টা করেছিল। নিবিড় চাষের পাশাপাশি চাষ জমি বাড়ানাের প্রয়াস অব্যাহত ছিল। খাদ্য শস্যের জমিতে পশু পালন করা হয়।
  • ১৭শ শতকের কৃষি সংকটের ফলে গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা বেড়েছিল, ভবঘুরেদের সংখ্যা বেড়ে যায়। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন ও জার্মানির গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
  • বুর্জোয়া শ্রেণী সামাজিক গতিশীলতার সুযােগ নিয়ে (social mobility) অভিজাততন্ত্রের সামিল হয়েছিল, গ্রেগরি কিং (Gregory King) এদের কথা উল্লেখ করেছেন।
  • ফ্রান্সে ভূস্বামীরা খাজনা বাড়িয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছিল, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ খাজনা বৃদ্ধি ঘটেছিল।
  • অবিরাম যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য রাষ্ট্রের অর্থের প্রয়ােজন বেড়েছিল, এজন্য কৃষকের ওপর বাড়তি করের বােঝা চেপেছিল।
  • পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে সামন্ত প্রভুরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছিলেন, তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়। শস্যের দাম কমলে কৃষক দুর্গতির মধ্যে পড়েছিল, ভূমিদাসদের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছিল, পূর্ব ইউরােপে ভূমিদাস প্রথার সম্প্রসারণ ঘটেছিল। পােল্যান্ড ও রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা নতুন করে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০-১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ২৪৩-২৪৮, ২৫৩-২৫৮
  • আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন : মধ্য পঞ্চদশ থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতক, বাসবেন্দ্র বসু, মিত্রম প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ৬০-৬৯

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.