বাংলার সাহিত্যিকগণ

(বর্ধিত হবে)

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮২২-১৯২২)

(লেখাটি অধ্যাপক মাহবুবুল আলম রচিত “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থ থেকে নেয়া)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহচ্ছায়ায় যে সব কবি কাব্যরচনায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) অন্যতম উল্লেখযােগ্য কবি। তবে তার কবিমানস বিবিধ বৈশিষ্ট্যে রবীন্দ্রকবিমানস থেকে স্বতন্ত্র প্রকৃতির। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশেষত স্বদেশী যুগের মধ্যে তার কবিপ্রতিভার বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটে। তাছাড়া, তার কাব্যে রােমান্সবিমুখ বস্তুপ্রাধান্য, তথ্য ও ইতিহাসপ্রীতি এবং জ্ঞানমুখী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রূপায়িত হয়ে উঠেছে। এই সমস্ত কারণে তাকে বাস্তববাদী কবি বলে অভিহিত করা যায়। কবি তার কবিতায় ভাবের উদ্দীপনাকে বিষয়-বিবৃতির সীমায় সংবৃত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি কবিতার রূপপ্রকৃতির প্রতি সচেতন ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ছন্দের কারুকুশলতার ওপরে তার ঝোঁক কম ছিল না। তার সম্পর্কে বলা হয় তিনি গীতিকবিতার জগতে ছিলেন জ্ঞানযােগী।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সহজ ভাষা এবং প্রসন্ন চপল ছন্দের ব্যাপারে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার কবিপ্রকৃতির মধ্যে বিজ্ঞানী বুদ্ধির অংশ যে প্রবল ছিল তার পরিচয় মেলে কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্যে। কবিতায় বাহুল্য তথ্যের প্রয়ােগ সর্বত্র লক্ষণীয়, কিন্তু তার কবিতা ভাবগম্ভীর নয়। মানবসংসারের বিস্তৃত জ্ঞানভাণ্ডারের প্রায় সকল সামগ্রীর প্রতিই কবির সজাগ কৌতূহল ছিল। প্রাচীন ইতিহাস থেকে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান কোন কিছু তিনি বাদ দেন নি। এদেশে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায়ই জ্ঞানের বিষয় ছিল প্রথম উপজীব্য। এদিক থেকে তিনি তার পিতামহ অক্ষয়কুমার দত্তের তথ্যদৃষ্টি ও জ্ঞানবিজ্ঞান প্রিয়তার সুযােগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে স্বল্প সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ বৈচিত্র্যপূণ সৃষ্টি রেখে গেছেন। কাব্যগ্রন্থের নাম : ‘সবিতা’, ‘সন্ধিক্ষণ’, ‘বেণু ও বীণা’, ‘হােমশিখা’, তীর্থসলিল’, ‘তীর্থরেণু’, ‘ফুলের ফসল’, ‘কুহু ও কেকা’, ‘তুলির লিখন’, ‘মণিমঞ্জুষা’, ‘অভ্রআবীর’, ‘হসন্তিকা’, ‘বেলাশেষের গান’, ‘বিদায় আরতি’ ইত্যাদি। সাহিত্য রচনায় সত্যেন্দ্রনাথ বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তার কাব্য বাদ দিয়েও অন্যান্য ধরনের সাহিত্যসৃষ্টি কম কৃতিত্বের পরিচায়ক ছিল না। গদ্য রচনায় তার উৎসাহ ছিল। গদ্যেপদ্যে তার বিচিত্র রচনা ‘ছন্দসরস্বতী’–এতে ছন্দের রহস্য নিয়ে ছন্দ-শিল্পী-মনের অপরূপ চিন্তা-কল্পনা বিলাস প্রকাশ পেয়েছে। ‘জন্মদুঃখী’ তার গদ্য-কাহিনি অনুবাদ। ‘রঙ্গমলী’ অনুবাদ নাটকের সংকলন। ধূপের ধোয়া কৌতুক নাটিকা। বিচিত্র সৃষ্টিমুখরতার নিদর্শন এসব রচনার মধ্যে বিদ্যমান।

সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যে যে বক্তব্য রূপায়িত হয়েছে তাতে তার মনের বিচিত্র ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন জ্ঞানের সাধক, সেজন্য তার কাব্যে বিজ্ঞানানুরাগ ও ঐতিহ্যপ্রীতির নিদর্শন বিদ্যমান। রাজনৈতিক অবস্থার বিশৃঙ্খলতা, সামাজিক অনাচার, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা—দেশের এসব দিক লক্ষ করে কবি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তার কাব্যে এই মনােভাবের প্রকাশ ঘটেছে। মানবিকতা, সমাজনীতি ও ধর্মবােধ তার কাব্যে প্রতিফলিত। মানবতাবােধের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশপ্রেমের বৈশিষ্ট্য তার কাব্যে পাওয়া যায়। কবি ‘সন্ধিক্ষণ’ কাব্যে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণা দিয়েছেন :

সুবেশ রাখাল-বেশ সকল ভুলিয়া।
              ধন্য হও স্বদেশের কাজে;
প্রতিজ্ঞা রাখিয়া স্থির স্থাণুর মতন
             মান্য হও জগতের মাঝে।
আত্মতেজে করি ভর—
              কর্মে হও অগ্রসর! 
মূর্খে শুধু বলে এ ‘হুজুক’, 
বঙ্গ ইতিহাসে আজ এল স্বর্ণযুগ।

জ্ঞানসাধকদের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। দেশের ও মানুষের কল্যাণে যারা ব্ৰতী হয়েছিলেন তাদের প্রতি বহু কবিতায় কবি ভক্তির অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন। প্রেমের কবিতা রচনায় কবি দক্ষতা দেখিয়েছেন। শিশুর প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে কতগুলাে কবিতায়। কিছু ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতাও তিনি রচনা করেছিলেন। প্রকৃতির চিত্রাঙ্কনে তার দক্ষতার নিদর্শন মেলে ‘পাল্কীর গান’ কবিতায় : 

বৈরাগী সে,।।
কণ্ঠী-বাধা,।।
ঘরের কাঁখে
লেপছে কাদা,
মট্‌কা থেকে
চাষার ছেলে
দেখছে ডাগর
চক্ষু মেলে!।।
দিচ্ছে চালে
পােয়াল গুছি;
বৈরাগীটির
মূর্তি শুচি।।

কবি এমনিভাবে বিচিত্র ধরনের বিষয় নিয়ে স্বীয় কবিপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় কল্পনার লঘু লীলাই বেশি ফুটেছে। কবি ছড়ার ঝোঁকে, ছন্দের বৈচিত্র্যময় নৃত্যহিল্লোলে, চটুল শব্দের ধ্বনিময় প্রয়ােগে, রং-তুলির হালকা টানে অপরূপ চিত্রাঙ্কনে তার কল্পনালীলা ফুটিয়ে তুলেছেন। ফলে আধুনিক যুগের রুচিবৈচিত্র্যের প্রয়ােজন মেটাতে তার কবিতা ছিল যথার্থই সক্ষম। কবিমনের অপরিসীম অনুসন্ধিৎসা তার কাব্যে প্রকাশ পেয়ে পাঠকহৃদয়কে সে দিকে আকৃষ্ট করেছে।

বাংলা অনুবাদ কবিতার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আনয়নের জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘তীর্থসলিল’, ‘তীর্থরেণু’, ‘মণিমঞ্জুষা’ তার অনুবাদ কাব্য। এই অনুবাদগুলাের মাধ্যমে বহু দেশের বহু ভাষার প্রাচীন ও নবীন গান, ছড়া ও গীতিকবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় ঘটে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ কবিতাগুলাে অনেক সময়ে অনুবাদের অনুবাদ। তিনি ইংরেজি ছাড়া বিদেশি ভাষার কবিতাগুলাে প্রায়ই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। তার ইংরেজি কবিতার কোন কোন অনুবাদে বিদেশী ছন্দের শৈলী অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা কবিতায় নতুন রূপ ও ছন্দ প্রয়ােগের জন্যও অনুবাদগুলাের গুরুত্ব আছে। অনুবাদেও কবি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তার অনুবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তােমার এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি—আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে—ইহা শিল্পকার্য নহে ইহা সৃষ্টিকার্য।’

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথের মতই সমকালীন জীবনের প্রতি আগ্রহশীল ছিলেন। স্বদেশের প্রতি আকর্ষণ তার কাব্যে রূপলাভ করেছে। সমসাময়িক ইতিহাসও তার অনুরাগের বিষয় ছিল। এই অনুরাগ তার কবিতা রচনার পেছনে কাজ করেছে। এ প্রসঙ্গে ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, রবীন্দ্র কবিতায় ইতিহাসের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা এবং ঘটনার সারোৎসার যেখানে ভাব-সুরভিভরে বিধূনিত হয়েছে—সত্যেন্দ্রনাথ সেখানে হালের বিষয়কেই প্রধানত কবিতার অবলম্বন করেছেন। কেবল বিদ্যাসাগর কিংবা গান্ধীকে নিয়ে লেখা কবিতায় নয়, ‘মেথর’ থেকে ‘আমরা’ কিংবা ‘গঙ্গাহৃদি বঙ্গভূমি’ পর্যন্ত সেই একই প্রবণতা অনবচ্ছিন্ন।’

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসম্ভারে উচ্চতর কল্পনানিষ্ঠার খুব বেশি সার্থক উদাহরণ পাওয়া যায় না। আসলে কল্পনার উচ্চশৃঙ্গে তিনি অস্খলিত পদচারণা করতে পারতেন না বলে যথার্থ কৃতিত্বের নিদর্শন তাতে অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে তত্ত্বের ভারে তার কবিতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও আবেগের প্রাবল্য পরিস্ফুট।

বাংলা ছন্দের ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথেষ্ট বৈচিত্র্য সম্পাদন করেছিলেন। ছন্দের বহুবিধ কৌশল দেখানাের জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের নিকট থেকে ছন্দের রাজা এবং ছন্দের যাদুকর আখ্যা পেয়েছিলেন। অবশ্য এই কৃতিত্বের জন্য তিনি কিছুটা নিন্দার ভাগীও হন। কারণ, ছন্দের কৌশল ফোটানাের দিকে প্রখর দৃষ্টি দিতে গিয়ে কবি কাব্যরসসৃষ্টির গুরুত্ব উপেক্ষা করেছেন। কবি সংস্কৃত থেকে এবং নানা দেশীয় ভাষার কবিতার অনুবাদ কালে লৌকিক ছন্দ নিয়ে বিচিত্র ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। অনেক সময় তার ছন্দ কবিকল্পনার বশবর্তী না হয়ে কবিকল্পনাই ছন্দের বশবর্তী হয়ে পড়েছে। শব্দসম্ভারের দিক দিয়েও সত্যেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। আরবি-ফারসি ও অনাদৃত দেশজ শব্দের প্রাচুর্যপূর্ণ ব্যবহারে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্যগুলাে এভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, তিনি খাঁটি বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, তার শব্দযােজনা যেমন গভীর ভাষাজ্ঞান ও ঐকান্তিক সাধন-সাপেক্ষ, তেমনি তা অতিশয় অর্থপূর্ণ। তৃতীয়ত, তার কবিমানসে চরিত্র ও পৌরুষ বড় বেশি প্রকট হয়ে আছে। চতুর্থত, তার ছন্দ-জ্ঞান ও ছন্দবােধ অতিশয় সুখকর; এবং সর্বোপরি, তার রচনায় একপ্রকার সুতীক্ষ্ণ রসবােধের আত্যন্তিক সদ্ভাব রয়েছে।

বাকচাতুরী ও বাগবৈদগ্ধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য সহজেই লক্ষণীয়, বাঙালি সমাজের চটুল ও মুখর রসিকতা সহজাত শক্তিতে রূপ লাভ করেছে। যেমন :

বলব আমি ‘প্রিয়া’ ‘প্রাণেশ্বরী’
                            ছেড়ে দিয়ে শুনছ’? ‘ওগাে।’ ‘হ্যাঁগাে’; 
    বলতে গিয়ে লজ্জাতে হায় মরি,
                      ও সম্বােধন ওদের মানায় নাকো।
ওসব যেন নেহাৎ থিয়েটারী,
              যাত্রাদলের গন্ধ ওতে ভারি,
‘ডিয়ার’টাও একটু ইয়ার-ঘেঁষা,
                      ‘পিয়ারা’ সে করবে ওদের খাটো,
এর তুলনায় ‘ওগাে’ আমার খাসা,
                         যদিও,—মানি—একটু ঈষৎ মাঠো।

‘বক্তব্যকে প্রাঞ্জল অথচ সুঠাম-পরিপাটি করে তােলার আগ্রহও তার তথ্যবলয়িত ছন্দ-মন্দ্রিত কাব্যকলার এক বিশেষ প্রবণতা।’

কাব্যের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে সত্যেন্দ্রনাথের প্রতিভা ব্যাপকভাবে রূপায়িত হলেও গদ্যরচনায় তার কিছু বিশিষ্টতা ছিল।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সহজ বিষয় থেকে সৌন্দর্য আহরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ‘পাল্কীর গান’, ‘ইলশে গুঁড়ি’ ইত্যাদি কবিতায় অতি সাধারণ বিষয়বস্তুকে আশ্চর্য সুন্দর রূপে রূপায়িত করে তুলেছেন। তার কবিতায় ভাবের চেয়ে ছবি বেশি ফুটে উঠেছে। অনির্বচনীয়তার চেয়ে স্পষ্টার্থক শব্দের ধ্বনি-চঞ্চলতাময় ঝঙ্কারেরই প্রাধান্য লাভ ঘটেছে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবি হিসেবে রােমান্টিক, কিন্তু সে রােমান্টিকতা ইন্দ্রিয়-চেতনা-নিহিত, অতীন্দ্রিয় নয় একেবারেই।

রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২ — ১৮৮৬)

রামনারায়ণ তর্করত্ন (২৬শে ডিসেম্বর, ১৮২২ – ১৯শে জানুয়ারি, ১৮৮৬) একজন বাঙালি নাট্যকার। তিনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার হরিনাভি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম মৌলিক নাট্যকার ও হরিনাভি বঙ্গনাট্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা (১৮৬২)। রামনারায়ণের পিতা রামধন শিরোমনি সেকালের একজন নামকরা পণ্ডিত ছিলেন। তার দাদা প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। রামনারায়ণ সংস্কৃত কলেজে ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রথমে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে প্রধান পণ্ডিত হিসেবে এবং পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। প্রায় ২৭ বছর তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৮২ সালে এই কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি নিজগ্রাম হরিনাভিতে চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনার দ্বারা বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। উলে­খ্য, তাঁর অগ্রজ প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরও সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ১৮৮৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্বগ্রামে তাঁর মৃত্যু হয়।

বাংলা মৌলিক নাটক রচয়িতা হিসেবেই রামনারায়ণের মুখ্য পরিচয়। তার রচিত কিছু নাটক হচ্ছে – স্বপ্নধন (১৮৩৩), কুলীন-কুল-সর্বস্ব (১৮৫৪), বেণী সংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তল (১৮৬০), নব নাটক (১৮৬৬), সম্বন্ধ সমাধি (১৮৬৭), মালতী মাধব (১৮৬৭), চক্ষুদান (১৮৬৯), উভয়সঙ্কট (১৮৬৯), রুক্মিণী হরণ (১৮৭১), যেমন কর্ম তেমন ফল (১৮৭২), ধর্মবিজয় (১৮৭৫), কংসবধ (১৮৭৫)। পতিব্রতোপাখ্যান (১৮৫৩) তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। এখানে যেমন কর্ম তেমনি ফল (১৮৬৩), উভয় সঙ্কট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯) হচ্ছে প্রহসন। তাঁর অধিকাংশ নাটক ও প্রহসন বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চ, কলকাতার অভিজাত ধনিকশ্রেণীর নিজস্ব মঞ্চ এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালায় বহুবার অভিনীত হয়। ‘দি বেঙ্গল ফিলহার্মোনিক আকাদেমি’ থেকে তিনি ‘কাব্যোপাধ্যায়’ উপাধি লাভ করেন।

বাংলা নাটকের ইতিহাসে অস্থিরচিত্ততা কাটিয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক সৃষ্টি হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের (১৮২২-৮৬) হাতে। নাট্যকার হিসেবে তার প্রভূত খ্যাতিলাভের পেছনে রয়েছে তার সামাজিক নাটক “কুলীনকুলসর্বস্বের” (১৮৫৪) অভিনয় সাফল্য। এই নাটকটি নাট্যকর্মের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ অনুসারী না হলেও তা তৎকালীন বাংলা নাটকের মধ্যে বৈচিত্রের পরিচায়ক বলে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিল। কুলীনকুলসর্বস্ব’ নামে নাটক রচনার জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার ঘােষণা করে রংপুরের কুণ্ডী পরগনার জমিদার কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী যে প্রতিযােগিতা আহ্বান করেছিলেন তাতে বিজয়ী হয়ে রামনারায়ণ সে পুরস্কার লাভ করেন। এতে দেখা যায় রামনারায়ণের নাটক রচনা স্বতঃস্ফুর্ত ছিল না এবং নাটকের বিষয় ও নাম পর-নির্দেশিত ছিল। তবে নাটকটির বিষয়ের প্রতি সমগ্র জাতির কৌতূহলই রামনারায়ণকে জনপ্রিয়তা দান করেছিল। এই নাটকের মাধ্যমে দর্শকদের প্রবলভাবে মাতিয়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল। সে কারণে তিনি নাটুকে রামনারায়ণ নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কৌলিন্যপ্রথার দোষ নির্দেশক এই নাটকটিতে মূলকাহিনির শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। তাতে কতকগুলাে কৌতুকপূর্ণ দৃশ্য সংযােজিত হয়েছে মাত্র। একান্ত বাস্তব সামাজিক জীবনের ঘটনা অবলম্বন করাতেই এই নাটকটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে যে কৌতুকরস স্থান পেয়েছে তা কোথাও করুণ, আবার কোথাও প্রহসনধর্মী। নাটকটির অন্য একটি বৈশিষ্ট্য এর টাইপ চরিত্রের প্রাধান্য। অমৃতাচার্য, অধর্মরুচি, বিবাহবণিক, উদারপরায়ণ, বিবাহবাতুল, অভব্যচন্দ্র এই সব নাম একদিকে যেমন ব্যঙ্গরসাত্মক, অন্যদিকে তাৎপর্যবাহী। হাস্যরসের আধিক্যের জন্য কোন কোন চরিত্র অবাস্তবতায় পরিপূর্ণ। সমস্যাপীড়িত মানবজীবনের অন্তরবেদনা, প্রথানুগত্যের পেছনে গােপন মর্মকথা, হাসির অন্তরালে অশ্রুর আভাস রামনারায়ণ তর্করত্নের এই নাটকটিকে জীবনরসােজ্জ্বল করেছে। বাঙালি শ্রোতা এ নাটকে সর্বপ্রথম নিজ সমাজপরিবেশে নিজের হাসিকান্নায়, বিরূপ সমবেদনায় দোলায়িত হয়ে আত্মপরিচয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। রাজা রামমােহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে নতুন সমাজচেতনা প্রবর্তন করেছিরেন তা-ই একটি বিশেষ সমস্যা অবলম্বনে রামনারায়ণের হাতে নাটকীয় রূপ লাভ করেছে।

সংস্কৃতে সুপণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন সংস্কৃত থেকে কতিপয় নাটক বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বেণীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০) ও মালতীমাধব (১৮৬৭)—এই চারটি নাটক সংস্কৃত থেকে অনূদিত। এদের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে স্থানে স্থানে মূলের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। ‘রত্নাবলী’ নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়াতেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের রুক্ষ্মিণীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫) ও ধর্মবিজয় (১৮৭৫)—এই কয়টি নাটক পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। তিনি কয়েকটি প্রহসনও রচনা করেছিলেন, যথা : যেমন কর্ম তেমন ফল (১২৭৯ বঙ্গাব্দ), উভয় সঙ্কট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯) প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। সামাজিক সমস্যাই এই প্রহসনগুলাের বিষয়বস্তু। স্বপ্নধন (১৮৭৩) রােমান্টিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত নাটক। বাল্যবিবাহ প্রথার দোষ দেখিয়ে রচিত সম্বন্ধসমাধি নাটক (১৮৬৭) রামনারায়ণের রচনা বলে অনুমিত হয়।

সমকালীন সামাজিক দুর্নীতির প্রতি কটাক্ষপাত করে যে সমস্ত নাটক সে সময়ে রচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে রামনারায়ণের ‘নবনাটক’ (১৮৬৬) শ্রেষ্ঠ। তার সমস্ত নাটকের মধ্যে একেই পূর্ণ নাট্যমর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা বিষয়ক ‘নবনাটক’ এই নামকরণের মাধ্যমেই নাটকটির পরিচয় ফুটে উঠেছে। এই নাটকটিও পুরস্কার প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে পর-নির্দেশিত বিষয়ে রচিত। জোড়াসাঁকো নাট্যশালার পক্ষ থেকে গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ পুরস্কার ঘােষণা করেছিলেন। রামনারায়ণ এই নাটক রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য ‘নবনাটক’ প্রকাশের আগেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। রামনারায়ণ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। নাটকের ভাষা-বিন্যাস ও পরিণতিতে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণের’ প্রভাব লক্ষ করা চলে। বহু মৃত্যুজনিত ট্র্যাজেডি সৃষ্টি নীলদর্পণের প্রভাবের ফল।

রামনারায়ণ তর্করত্ন বাংলা নাটকের ইতিহাসে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। তার ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক তৎকালীন নাট্যসাহিত্যে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সমকালীন সমাজব্যবস্থার কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলাে নাটকে রূপায়িত করতে গিয়ে আঙ্গিকগত দিক থেকে তার চূড়ান্ত সার্থকতা লাভ করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু বিষয়বস্তুর গুণে শুধু তিনি যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা নয়, বরং তার অনুবর্তী একটা নাট্যধারার সৃষ্টি সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। রামনারায়ণের নাটকের অভিনয় সাফল্যের পর থেকেই অভিনয় শিল্পে এবং বাংলা নাটক রচনায় প্রবল উদ্দীপনা দেখা দেয়। এর ফলে একদিকে যেমন অজস্র নাটক রচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অভিনয়যােগ্য নাটকের প্রয়ােজন প্রকাশ পেয়েছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)

(লেখাটি অধ্যাপক মাহবুবুল আলম রচিত “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থ থেকে নেয়া)

কবিতা

কবি হিসেবে মধুসূদন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) বাংলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। এদিক থেকে তাকে বিপ্লবী কবি হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মধ্যযুগের কাব্যে দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক কাহিনির বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে বাংলা কাব্যধারায় মানবতাবােধ সৃষ্টিপূর্বক আধুনিকতার লক্ষণ ফোটানােতেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের অতুলনীয় কীর্তি প্রকাশিত। তিনি তার সাহিত্যসৃষ্টিতে বিষয়নির্বাচনে ও প্রকাশভঙ্গিতে, ভাবে ও ভাষায়, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে এমন একটি আশ্চর্য শিল্পকুশলতা ফুটিয়ে তুলেছেন যাকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সম্পূর্ণ অভিনব বলে চিহ্নিত করা যায়। বস্তুত এই সমস্ত দিক থেকে তার অপরিসীম কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যের গতি পরিবর্তনে সহায়তা করেছিল। ড. গােলাম মুরশিদ মন্তব্য করেছেন, ‘স্বসমাজের তুলনায় তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা। আচার-আচরণে তার ঔদ্ধত্য, সনাতন মূল্যবােধের প্রতি অবজ্ঞা, জীবন এবং সাহিত্যের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি বিদ্রোহ—সবই তাকে তার চারদিকের জনতা থেকে একেবারে আসমানজমিন ফারাক করেছে।…তিনি এমন অসাধারণ ছিলেন যে, সে সময়ের লােকেরা কেউ তাকে ঘৃণা করেছেন, কেউ ভালবেসেছেন, কেউ-বা করুণা করেছেন; কিন্তু কেউই তাকে অস্বীকার করতে পারেন নি।

সমকালীন যুগের বৈশিষ্ট্য মধুসূদনের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে সম্বন্ধে যােগীন্দ্রনাথ বসু মন্তব্য করেছেন, ‘স্বদেশীয় সাহিত্যে অনাস্থা, পাশ্চাত্য সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ, স্বদেশীয় আচার ব্যবহারে উপেক্ষা এবং পাশ্চাত্য আচার ব্যবহারে পক্ষপাতিত্ব এইগুলি তখনকার ছাত্রমণ্ডলীর লক্ষণ ছিল। মধুসূদনের চরিত্রেও এই সকল দোষের প্রত্যেকটি পরিস্ফুট হইয়াছিল। তাহার সমকালবর্তী ছাত্রদিগের ন্যায় তিনিও বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিতে শিখিয়াছিলেন এবং ইংরাজি ভাষায় কবিতা রচনা দ্বারা প্রতিপত্তিলাভের আশা করিয়াছিলেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পূর্বেই তিনি স্বদেশীয় আচার ব্যবহারে ঘৃণা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং কলেজে থাকিতেই সুরাপানে ও হিন্দুধর্ম নিষিদ্ধ দ্রব্য ভক্ষণে অভ্যস্ত হইয়াছিলেন। পূর্ণ বয়সে অনেক বিষয়ে তাহার শৈশবর্জিত সংস্কার পরিবর্তিত হইয়াছিল; কিন্তু বিপ্লবকালের প্রভাব তাহার হৃদয়ে এমনই বদ্ধমূল হইয়াছিল যে, কিছুতেই তিনি তাহা উৎপাটিত করিতে পারেন নাই। একদিকে পুরুষ পরম্পরাগত প্রাচ্য ভাব ও অপরদিকে কলেজীয় শিক্ষালব্ধ পাশ্চাত্য ভাব, উভয়ের সংমিশ্রণে তাহার অনেক কার্য, সেই জন্য, পরস্পর বিসম্বাদী হইত। পূর্ণ বয়সে তিনি বাংলা ভাষায় কাব্য লিখিতে কুণ্ঠিত হন নাই কিন্তু পত্র লেখা লজ্জাজনক মনে করিতেন।…অন্তরে জাতীয় ভাব এবং বাহিরে সাহেবিয়ানা। উভয়ের সংমিশ্রণে তাহার প্রকৃতি, এইরূপে, এক বিচিত্র পদার্থে পরিণত হইয়াছিল।’

বিরাট প্রতিভা সহযােগে সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে আবির্ভূত হন। তার কৃতিত্ব যে, তিনি বাংলা কাব্যসাহিত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে সম্পূর্ণ নতুন কাব্যধারার প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সাহিত্যসাধনায় সাফল্যের মাধ্যমে এমন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন যাকে ভিত্তি হিসেবে অবলম্বন করে পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যের দ্রুত উন্নতি সাধিত হয়। পাশ্চাত্য কাব্যপুষ্ট, প্রতিবেশনিরপেক্ষ কবিকল্পনার অধিকারী ছিলেন মধুসূদন দত্ত। এই বৈশিষ্ট্য সমসাময়িক কালে একান্ত ছিল অচিন্ত্যনীয় এবং এর প্রভাবেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যুগবিভাগে ১৮০০ সাল থেকে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ধরা হয়। কিন্তু আধুনিকতার লক্ষণ বিবেচনায় মধুসূদনের আমল থেকেই এই নতুন কালের সূচনা – তার কবিকৃতির প্রকাশকাল মােটামুটি ১৮৬০ সাল থেকেই আধুনিক যুগের প্রকৃত লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সীমাহীন কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভারের মাধ্যমে। তার প্রতিভা বিকাশের প্রধান পর্ব ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর। শেষবারের মত ১৮৬৫ সালে চতুর্দশপদী কবিতাবলি রচনার মাধ্যমে তার কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদনের অবদান স্বল্প সময়ের কৃতিত্বের ফল। তার প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’র (১৮৫৯) মাধ্যমে পাশ্চাত্য রােমান্টিক নাট্যকলার আদর্শ প্রদর্শিত হওয়ায় তা বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম সার্থক নাটক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর পরে পরেই প্রকাশিত ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) নাটকদ্বয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম আধুনিক কমেডি ও ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করেন। তাছাড়া ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) এবং ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০) নামক প্রহসন দুটি নতুনত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০) রচনার মাধ্যমে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত প্রথম কাব্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘মেঘনাধবধ কাব্য’ (১৮৬১) রচনা করে বাংলা মহাকাব্যের ধারার প্রবর্তন করেন। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের (১৮৬২) পৌরাণিক নারীচরিত্রের পুনর্বিচারে এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের চরমােৎকর্ষ সাধনে মাইকেল নতুনতর বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনে সক্ষম হন। এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি বাংলা ছন্দে নতুন যুগের সৃষ্টি করেন। ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ও (১৮৬১) নতুন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এখানে পৌরাণিক রাধাকে তিনি নতুনরূপে প্রত্যক্ষ করলেন। এ সব দিক ছাড়া তার ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৮৬৫) বাংলা কাব্যধারায় সনেট জাতীয় কবিতা রচনার পথিকৃৎ হিসেবে অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী। এই সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন বিদেশী সাহিত্যাদর্শের প্রাণধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। কাহিনিনির্মাণ, চরিত্রসৃষ্টি ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে বিদেশী আদর্শ ছিল তার অনুসরণযােগ্য। সমাজ সচেতনতা, মানবপ্রীতি ও নতুনত্ব প্রকাশ করেই মধুসূদন বাংলা কাব্যে যথার্থ আধুনিকতা আনয়ন করতে সক্ষম হন।

পূর্বানুবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বাংলা সাহিত্যকে মধুসূদন আধুনিকতার খাতে প্রবাহিত করলেন। তা সম্ভবপর হয়েছিল পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে তার সুনিবিড় পরিচয়ের ফলে। যশােরের বিত্তশালী জমিদার এবং কলকাতার লব্ধ-প্রতিষ্ঠ আইনজীবী রাজনারায়ণ দত্তের একমাত্র পুত্র ছিলেন মধুসূদন। বাল্যকাল থেকেই ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং কলকাতার পরিবেশে থেকে চিন্তায় ও চলনে পাশ্চাত্যানুসারী হয়ে উঠেন। তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গল সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুগােপযােগী উচ্ছৃঙ্খলতায় অবগাহন করলেও তার মধ্যে একটি উচ্চাভিলাষী মনােবৃত্তি জাগরূক ছিল। অত্যধিক স্নেহে লালিত হয়ে ভোগলালসাপূর্ণ হৃদয়ের ভিতরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকবি হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা সঞ্জীবিত করে রেখেছিলেন। সেকালের কলকাতাকেন্দ্রিক পরিবেশ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রেরণা দিয়েছে এবং সমুদ্রপারের মহাকবিদের আদর্শ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে। তাই কলকাতা থেকে বিলাতগামী জাহাজ যাত্রা করতে দেখলে তার মনও সঙ্গে সঙ্গে সেক্সপীয়র, মিলটন প্রমুখ কবির দেশে যাত্রা আরম্ভ করত। সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি তার কোন বিতৃষ্ণা না থাকলেও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ বিলাতযাত্রার সহায়ক হবে বিবেচনা করে তিনি সাগ্রহে পরধর্ম গ্রহণ করলেন। এতে বিলাত যাওয়া সম্ভবপর হলেও বাংলা সাহিত্যের জন্য তা পরম কল্যাণজনক হয়েছিল। খ্রিস্টান হওয়ার ফলে তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ক্ল্যাসিক্যাল ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করতে পেরেছিলেন। এ সব সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে উপকরণ নিয়ে পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যকে বহুদিক দিয়ে সমৃদ্ধিশালী করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

মধুসূদনের ধর্মান্তরিত হওয়ার তাৎপর্য সম্পর্কে কাজী আবদুল ওদুদ ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘তার এই ধর্মান্তর গ্রহণ তার নিজের জন্য যতবড় দুঃখের কারণ হােক তার জাতির জন্য প্রকৃতই হয়েছে এক মহা লাভের ব্যাপার। এই ধর্মান্তর গ্রহণের ফলেই খ্রিস্টান পাদরিদের সাহায্যে গ্রীক, লাতিন, ইতালিয় প্রভৃতি ভাষায় ও সাহিত্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটে – তার নব-সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল এই সব সাহিত্যের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়ের গুণে। মধুসূদন তার সমসাময়িক কালেই দেশে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু তার মর্যাদা যে কত বড় তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে একালে। তার স্বাজাত্যবােধ সুগভীর, সেই সঙ্গে সর্বমানবের সঙ্গে তার যােগও সুনিবিড়; দেবতা বা ভাগ্যের কুটির উর্ধ্বে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের পৌরুষের মহিমা, শব্দপ্রয়ােগের নিপুণতায় বিশ্ব-শিল্পীদের সভায় তিনি একজন প্রথম শ্রেণির শিল্পী; আর হৃদয়ধর্মে তিনি রাজাধিরাজ। এই অপেক্ষাকৃত স্বল্পজীবী কবি যে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তার তুলনায় তার সৃষ্টি পর্যাপ্ত নয়; কিন্তু সেই জন্যই তিনি হয়ে রয়েছেন সহৃদয় পাঠকের চির- বিস্ময়।’

মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন ও প্রত্যক্ষ জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে মধুসূদন কয়েকজন সুধী ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং অনেকটা আকস্মিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের সাধনায় আত্মনিয়ােগ করেন। অবশ্য মাদ্রাজ প্রবাসকালে তিনি Captive Ladie এবং Visions of the past নামক দুটি কাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু গ্রন্থদ্বয় দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত যশলাভে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হন। মাদ্রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কলকাতার পুলিস আদালতে দোভাষীর চাকরিতে ১২০ টাকা বেতনে তার জীবন কাটছিল অস্বচ্ছলভাবে। এমন সময় তিনি রামনারায়ণ তর্করত্বের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা নাটকের দীনতা উপলব্ধি করলেন। এর ফলস্বরূপ তিনি রচনা করেন শর্মিষ্ঠা নাটক। তখন থেকে পাঁচ বৎসরের মধ্যে তার প্রায় সমগ্র সাহিত্যকীর্তি প্রকাশিত হয়।

মধুসূদন জীবনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় ব্যারিস্টারি পড়ায় উদ্বুদ্ধ হন এবং আজন্ম সাধের বিলাতযাত্রা করেন। সে সময়ে ফ্রান্সে থাকাকালীন ১৮৬৫ সালে তার সনেটগুলাে রচিত হয়। দেশে ফিরে ব্যারিস্টারি করে প্রচুর অর্থোপার্জন, হাইকোর্টে বিরাট অঙ্কের চাকরি প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে জীবিকার্জনে মধুসূদন সচেষ্ট হলেও অমিতব্যয়িতা ও উচ্চাভিলাষের জন্য তার জীবনে করুণ পরিণতি নেমে আসে। জীবনের কেন্দ্রস্থলে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বর্তমান ছিল এবং তার পরিতৃপ্তি সাধনে যে উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন তা-ই তার জীবনকে গ্রীক ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্যানুসারে অলঙ্ঘনীয় দৈনির্দেশে বেদনাতুর করেছিল। তার জীবনের এই বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যে নবযুগ সৃষ্টির পশ্চাতে কার্যকরী ছিল। গতানুগতিক ধারায় বাংলা কাব্যে যে স্থৈর্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করা মধুসূদনের পক্ষে সম্ভব হয় জীবনের উচ্চাভিলাষ সাধনে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের ফলে।

মধুসূদনের কবিজীবনে পাশ্চাত্য আদর্শের প্রভাব সম্পর্কে মােহিতলাল মজুমদার মন্তব্য করেছেন, ‘যে সংস্কৃতি একদা য়ুরােপে নবজাগরণ আনিয়াছিল, যাহার ফলে humanities বা মানববিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যার উপরে স্থান পাইয়াছিল; এবং মনুষ্যজীবনগত পরম রহস্যের প্রতি শ্রদ্ধা বা humanism-ই মানুষকে নবধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিল। আমাদের পক্ষেও তাহা সঞ্জীবন মন্ত্রের মত কাজ করিয়াছিল, সেই মানবতা বা মর্ত্যপ্রীতির প্রেরণাই আমাদিগকে চঞ্চল করিয়াছিল। এই যুগপ্রভাব বা যুগ প্রবৃত্তিই মধুসূদনের জীবন ও তাহার কবিপ্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়াছিল।’

বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির জাতীয় জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম। ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতার আলােকে দেশবাসীর জীবনে যখন এক নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের নবরূপায়ণ যখন একান্ত প্রয়ােজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল তখনই মধুসূদনের আবির্ভাব। অবশ্য তার জীবনের বিস্তৃত প্রস্তুতি ভিত্তি করেই তার প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল, তবু বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব আকস্মিক ভাবেই ঘটে। নিজের প্রতিভার ওপর অগাধ বিশ্বাস সহকারে প্রথমে তিনি পাশ্চাত্য কবিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। পরিণামে তিনি বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাকবি হিসেবে পরম গৌরব লাভ করেন।

কোনপ্রকার প্রস্তুতিপর্ব না রেখেই মধুসূদন বলিষ্ঠ প্রতিভার দানে যেভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তার জন্য বাঙালি পাঠক মােটেই প্রস্তুত ছিল না। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি প্রণিধানযােগ্য : ‘নবযুগের প্রাণবান সাহিত্যের স্পর্শে কল্পনাবৃত্তি যেই নবপ্রভাতে উদ্‌বােধিত হল, অমনি মধুসূদনের প্রতিভা তখনকার বাংলা ভাষার পায়ে চলা পথকে আধুনিক কালের রথযাত্রার উপযােগী করে তােলাকে দুরাশা মনে করলেন না। আপন শক্তির পরে শ্রদ্ধা ছিল বলেই বাংলা ভাষার পরে কবি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। বাংলা ভাষাকে নির্ভীকভাবে এমন আধুনিকতায় দীক্ষা দিলেন, যা তার পূর্বানুবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বঙ্গবাণীকে গম্ভীর স্বরনির্ঘোষে মন্ত্রিত করে তােলার জন্য সংস্কৃত ভাণ্ডার থেকে মধুসূদন নিঃসঙ্কোচে যেসব শব্দ আহরণ করতে লাগলেন সেও নতুন; বাংলা পয়ারের সনাতন সমবিভক্ত আল ভেঙে দিয়ে তার ওপরে অমিত্রাক্ষরের যে-বন্যা বইয়ে দিলেন সে-ও নতুন। আর মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য রচনার যে-রীতি অবলম্বন করলেন, তাও বাংলা ভাষায় নতুন। এটা ক্রমে ক্রমে পাঠকের মনকে সইয়ে সইয়ে সাবধানে ঘটল না, শাস্ত্রিক প্রথায় মঙ্গলাচরণের অপেক্ষা না রেখে কবিতাকে বহন করে নিয়ে এলেন এক মুহূর্তে ঝড়ের পীঠে প্রাচীন সিংহদ্বারের আগল ভেঙে।’

তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের কাব্যশাখায় যে অবিস্মরণীয় দান রেখে গেছেন তার মধ্যে প্রথমে উল্লেখযােগ্য তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য’। আদ্যন্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দে চার সর্গে রচিত এ কাব্যের বিষয়বস্তু ভারতীয় পুরাণকাহিনি থেকে সংগৃহীত। সুন্দ-উপসুন্দ নামে দুই দৈত্যভ্রাতার নিধন কাহিনি এর উপজীব্য। দেবদ্রোহী দৈত্যভ্রাতৃদ্বয় স্বর্গ বিজয় করেছিল। অত্যন্ত ধার্মিক হয়েও তারা অতুলনীয়া রূপলাবণ্যবতী তিলােত্তমাকে লাভ করার জন্য কিভাবে আত্মবিস্মৃত হয়ে পরস্পরকে আঘাত করে নিহত হল এবং দেবতারা স্বর্গ লাভ করল তারই কাহিনি এখানে বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যরূপায়ণে মধুসূদন দেশীবিদেশী কাব্যের ওপর ছিলেন নির্ভরশীল। ‘পদ্মাবতী’ নাটকে মাইকেল প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের সামান্য প্রয়ােগ করে তার ব্যবহারােপযােগিতা প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এই ছন্দের ক্ষমতা উপলব্ধি করে তিলােত্তমাসম্ভব কাব্যে তার ব্যবহার দেখান। অমিত্রাক্ষরের গাম্ভীর্য এই কাব্যে বিদ্যমান। কাব্যের আরম্ভ এই রূপ :

ধবল নামেতে গিরি হিমাদ্রির শিরে।।
অভ্রভেদী, দেবতাত্মা, ভীষণ দর্শন,
সতত ধবলাকৃতি, অচল, অটল,
যেন ঊর্ধ্ববাহু সদা শুভ্রবেশধারী,
নিমগ্ন তপ সাগরে ব্যোমকেশ শূলী।।
যােগীকুলধ্যেয় যােগী।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রাথমিক ব্যবহারের অপরিপক্কতা এই কাব্যে বিদ্যমান এবং রচনা হিসেবেও গ্রন্থটি গুরুত্বহীন। তবে তা পাঠকের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। দেশী কাহিনি অবলম্বনে বিদেশী প্রভাবের সমন্বয়ে রচিত এ কাব্যে গ্রীক আদর্শে কিছু সংখ্যক দেবদেবীর চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। নগণ্য কাহিনি অবলম্বনে রচিত বলে এবং যুগােপযােগী কোন প্রকার আবেদন না থাকায় কাব্যটি তেমন কোন আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে নি। ‘তিলােত্তমাসম্ভব কাব্য’ অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন এবং মহাকাব্য রচনার পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণযােগ্য।

মেঘনাদবধ কাব্য

মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরে প্রবহমানতার সঙ্গে উপমা ব্যবহারের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধিত হয়েছে। যেমন মেঘনাদবধ কাব্য থেকে :

উত্তরিলা বীরদর্পে রৌদ্র দাশরথি,।।
‘নাহি বিভাবসু আমি, দেখ নিরখিয়া,
রাবণি! লক্ষ্মণ নাম, জন্ম রঘুকুলে!
সংহারিতে, বীরসিংহ, তােমায় সংগ্রামে
আগমন হেথা মম, দেহ রণ মােরে
অবিলম্বে’। যথা পথে সহসা হেরিলে
ঊর্ধ্বফণা ফণীশ্বরে, ত্রাসে হীনগতি
পথিক, চাহিলা বলী লক্ষ্মণের পানে।
সভয় হইল আজি ভয় শূন্য হিয়া।
প্রচণ্ড উত্তাপে পিণ্ড হায় রে গলিল!
গ্রাসিল মিহিরে রাহু, সহসা আঁধারি
তেজঃপুঞ্জ! অম্বুনাথে নিদাঘ শুষিল!
পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে।’

অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তনার মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ছন্দের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। বিপ্লবী মনােবৃত্তি অবলম্বনে তিনি বাংলা ছন্দের চিরাচরিত পয়ার ছন্দকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে বিদেশি প্রভাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বাংলা ভাষার স্বরবহুলতা বিদূরিত করে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদ এবং নামধাতু প্রয়ােগে তিনি এ ছন্দে ধ্বনিগাম্ভীর্য আনয়ন করলেন। অন্ত্যমিলের জন্য ভাবের সমাপ্তি ঘটানাের বিপত্তি দূর করা হল ইংরেজি Blank verse ছন্দের অনুসরণে। সংস্কৃত ছন্দের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ত্যমিল নেই, মধুসূদন তা লক্ষ করেছিলেন। ফলে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রবহমানতার সৃষ্টি হয়। বাংলা পয়ারের নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্ৰাসংখ্যা রক্ষা করে অন্ত্যমিলহীনতা ও প্রবহমানতা আনয়ন এবং যতি স্থাপনের গতানুগতিক নিয়ম পরিত্যাগ করে মধুসূদন বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন।

মধুসূদনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। বাল্মীকির সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণ থেকে কাহিনি নিয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভাবের সম্মিলনে কবি এ কাব্য রূপায়িত করেন। মহাকাব্যের লক্ষণের মধ্যে প্রাচ্যপাশ্চাত্য মহাকাব্যিক আদর্শ এতে একত্রিত হয়েছে। নয় সর্গে কাব্যটি সমাপ্ত। রামরাবণের যুদ্ধে রাবণপুত্র মেঘনাদের হত্যাকাহিনি এর উপজীব্য। কাহিনি রামায়ণ থেকে গৃহীত হলেও উপস্থাপনারীতি মধুসূদনের নিজস্ব এবং সে ক্ষেত্রে তার সার্থক প্রতিভার পরিচয় বর্তমান। চরিত্রচিত্রণে তিনি বাল্মীকির প্রতি আনুগত্য দেখান নি, পাশ্চাত্য আদর্শ অনুসরণ করেছেন। কাব্যের পরিণতি গ্রীক ট্র্যাজেডির অনুবর্তী। উপমা অলঙ্কার ব্যবহারেও তিনি গ্রীক মহাকাব্যের সহায়তা নিয়েছেন। পরবর্তীকালে বাংলা মহাকাব্যের ধারাটি অনুসৃত হলেও মধুসূদনের শ্রেষ্ঠত্ব আজও অম্লান।

ব্রজাঙ্গনা কাব্য

‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যটি বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে আধুনিক রূপে রূপায়িত করে মেঘনাদবধ কাব্যের সমসাময়িক কালে রচিত। কবিতাগুলােতে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার আধ্যাত্মিক রূপক গ্রহণ না করে কবি রাধার বিরহের মানবিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। বৈষ্ণব সাহিত্যের ভক্তি বা রসতত্ত্ব এতে প্রতিফলিত হয় নি, বিরহ ব্যথায় আকুলা রাধার মনােবেদনা এখানে ব্যক্ত হয়েছে। ভাবে বা ভাষায় ব্রজাঙ্গনা বৈষ্ণবকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত নয় – রাধার বিরহ, হতাশা, আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলে কবি রাধাকে যথার্থ মানবী করে রূপ দিয়েছেন। এই রূপান্তরে উনিশ শতকের মানবতাবাদের পরিচয় মিলে। গীতিকাব্যের গুণ কাব্যটির মধ্যে প্রকাশমান। ব্রজাঙ্গনা কাব্যে কবির আন্তরিক কোন ভক্তিভাব পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে না। মাইকেলের প্রথম যৌবন থেকে তার মধ্যে যে গীতি-প্রবণতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল তারই প্রকাশ ঘটেছে ব্রজাঙ্গনা কাব্যে। তাছাড়া ভাষা ও ছন্দ নিয়ে কবি নিরন্তর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন তা এ কাব্যে নতুন রূপ লাভ করেছে। স্তবকবিন্যাস ও অন্ত্যমিলেও নতুনত্ব আছে। এ প্রসঙ্গে কয়টি পংক্তি উল্লেখ করা যায়:

কেন এত ফুল তুলিলি, সজনি।।
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে, পরে কি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে, কুসুম রতনে।
ব্রজের বালা?

অথবা –

কি কহিলি কহ, সই,       শুনি লাে আবার।।
মধুর বচন।
সহসা হইনু কালা       জুড়া এ প্রাণের জ্বালা
আর কি এ পােড়া প্রাণ পাবে সে রতন।।
মধু—যার মধুধ্বনি,       কহে, কেন কাঁদ ধনি
ভুলিতে কি পারে তােমা শ্রীমধুসূদন।।

বৈষ্ণব পদের মত কবি ভণিতাও ব্যবহার করেছেন। এ কাব্যের স্বরূপ সম্পর্কে বলা যায়, এগুলাে সুরের সহযােগে গেয় মহাজন পদাবলীও নয়, বিভিন্ন পালায় বিভক্ত কবি বা পাঁচালি শ্রেণির গানও নয়। কবি মধুসূদন স্বয়ং এগুলােকে Ode আখ্যা দিয়েছেন। তার অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও চতুর্দশপদী কবিতার মত বাংলায় এই শ্রেণির গীতিকবিতারও তিনি জন্মদাতা। বৈষ্ণব পদকর্তাদের ভক্তিভাব মধুসূদনের মনে কখনও ছিল না। তিনি ওড বা অসমচরণ গীতিকবিতা রচনা করতে গিয়ে যতি, পংক্তি, অন্ত্যমিল ও মাত্রাবৃত্তের ব্যবহারে স্বাধীনতা দেখিয়েছেন। কবির ভাষাপ্রয়ােগ বিষয়ানুযায়ী সহজ।

বীরাঙ্গনা কাব্য

‘বীরাঙ্গনা’ ইটালির কবি ওভিদের Heroides কাব্যের আদর্শানুসারে লিখিত পত্রকাব্য। যীশু খ্রিস্টের জন্মের অব্যবহিত পরে রচিত ওভিদের কবিতাগুলাের মূল বিষয়বস্তু প্রেম হলেও উপকরণ ছিল পুরাণের। মধুসূদনেরও তাই। তিনি অভিমান ও অনুযােগের যােগসূত্র দিয়ে বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন অবস্থানের কয়েকজন ক্ষুব্ধা ও বিরহিণী নারীকে সফলভাবে এই কাব্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

ওভিদের কাব্যের পত্রসংখ্যা ছিল একুশ। মধুসূদন এগারটি পত্র পূর্ণ করেছিলেন। আরও কয়েকটির সূত্রপাত করলেও তার পক্ষে সমাপ্ত করা সম্ভব হয় নি। ওভিদের কাব্যের নায়িকারা তাদের পতি বা প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে প্রধানত প্রেম-উদ্বোধিত চিত্তে পত্ররচনা করেছে। মধুসূদন এদেশের পৌরাণিক নারীচরিত্র উপজীব্য করে পত্ররচনা করেছেন। তবে কবি সেসব চরিত্র নিজের আদর্শের ছাঁচে ঢালাই করে নিয়েছেন। পত্রগুলাের কোন নারী নিষিদ্ধপ্রেমে উন্মাদিনী, কেউ প্রিয়সঙ্গলাভের জন্য কামাতুরা, কেউবা দুর্বল ভীরু স্বামীর প্রতি তীব্র বাক্যবাণবর্ষণে অকৃপণা। বীরাঙ্গনা কাব্যের চরিত্রগুলােতে কামনার রক্তরাগ এবং চরিত্রের সুদৃঢ় স্বাতন্ত্র প্রাধান্য পেয়েছে। চরিত্রগুলাে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কোথাও নায়িকার প্রেমানুভূতির বেদনাকাতর রূপটি ফুটে উঠেছে। যেমন দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ পত্রে বনবাসিনী শকুন্তলার আবেদন :

কিন্তু নাহি লােভে দাসী বিভব, সেবিবে
পা দু খানি—দাসীভাবে, এই লােভ মনে,
এই চির-আশা, নাথ, এ পােড়া হৃদয়ে।
বনবাসিনী আমি, বাকল-বসনা,
ফলমূলাহারী নিত্য, নিত্য কুশাসনে
শয়ন; কি কাজ, প্রভু, রাজসুখ-ভােগে?
আকাশে করেন কেলি লয়ে কলাধারে
রােহিণী; কুমুদী তারে পূজে মর্ত্য তলে!
কিংকরী করিয়া মােরে রাখ রাজপদে!

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের কবিতাগুলােকে Dramatic monologue জাতীয় কবিতা বলা যায়। কতগুলাে কবিতায় নাটকীয়তা ফুটে উঠেছে। সর্বোপরি নারীচরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় কবি তার লিরিক ক্ষমতাটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যের ভাষা সরল এবং আবেগময়।

অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত বীরাঙ্গনা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছন্দের দিক থেকে চরম সার্থকতা লাভ করেছেন। এমন কি মেঘনাদবধ কাব্যের ছন্দ থেকেও এতে অধিক কৃতিত্ব বিদ্যমান। মেঘনাদবধ কাব্যে অপ্রচলিত আভিধানিক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বনিগাম্ভীর্য সৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায়; কিন্তু বীরাঙ্গনা কাব্যে পরিচিত পরিবেশের মধ্যেই শব্দব্যবহার সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই কাব্যের ভাষা সরলতা-অভিমুখী।

চতুর্দশপদী কবিতাবলী

‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে সনেট জাতীয় কবিতা রচনার মাধ্যমে মধুসূদন বাংলা কাব্যে একটি নতুন শাখার সৃষ্টি করেছেন। বৈচিত্র্যহীন বাংলা কাব্যে নতুনত্ব সৃষ্টি করে সমৃদ্ধি আনয়ন করার জন্য কবির সনেট রচনার এই উদ্যোগ। মেঘনাদবধ কাব্যের রচনাকালে কবির মনে সনেট রচনার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলেও ব্যারিস্টারি পড়া উপলক্ষে ফ্রান্সে থাকাকালীন এই সনেটগুলাে রচিত হয়। মধুসূদন বিদেশযাত্রা করেন ১৮৬২ সালের ৯ই জুন তারিখে এবং ব্যারিস্টারি পড়ে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন ১৮৬৭ সালে। ১৮৬৫ সালের স্বল্প সময়ে রচিত ১০২টি কবিতা প্রকাশের জন্য কলকাতায় প্রেরিত হয় এবং ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশ লাভ করে। প্রকৃত পক্ষে এটিই মধুসূদনের সর্বশেষ কাব্য।

গীতিকবিতার পর্যায়ভুক্ত এই সনেটে কবিহৃদয়ের একটি সম্পূর্ণ অনুভূতি চৌদ্দ পংক্তির মধ্যে আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য সহকারে প্রকাশ পায়। সনেটে আবেগের তীব্রতা অপেক্ষা জীবন সম্বন্ধে পরিণত চিন্তা রূপ লাভ করে, প্রজ্ঞা ও মননের মাধ্যমে মুহূর্তের অনুভবের স্থায়িত্ব বিধান হয় এবং অতীত স্মৃতিচারণ অবলম্বনে কবি চেতনার গভীর স্তরে অবতরণ করেন। এক অখণ্ড ভাব ও চিন্তার রসপরিণতি এতে লক্ষণীয় এবং সনেটের অষ্টক ষটক – এই দুই অংশে বক্তব্যের বিশেষ রূপায়ণ এর বৈশিষ্ট্য। ইটালির কবি পেত্রাকের আদর্শে মধুসূদন অধিকাংশ সনেট রচনা করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পেত্রার্কের সঙ্গে মনন ও মানসের আশ্চর্য মিল ছিল। পেত্রার্ক সনেট ও খণ্ড কবিতার এমন আদর্শ স্থাপন করেছিলেন যা পরবর্তী চার-পাঁচ শতাব্দী ধরে ইউরােপীয় সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই কবি তার কাব্যকে এমন একটা পরিশীলিত ও নাগরিক রূপ দিয়েছিলেন, রেনেসাঁর সময়কার ও তার পরবর্তী কবিরা যাকে আধুনিকতার প্রথম সােপান হিসেবে গণ্য করেছিলেন। এসব কারণে মধুসূদন তাকে অনুসরণ করেছিলেন।

ইউরােপে প্রবাসকালে মাতৃভূমির স্মৃতি-উদ্ভাসিত মনে বাল্যস্মৃতি, হিন্দুদের পূজাউৎসব, পূবর্তন কবিদের স্মৃতিতর্পণ ইত্যাদি বহুবিধ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কবিতাগুলাে রচিত। ফলে এসব কবিতায় তার মানসিক অবস্থার সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে তার ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি উল্লেখযােগ্য :

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;–
তা সবে (অবােধ আমি!) অবহেলা করি,
পরধন-লােভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, বিনাহারে সঁপি কায়মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;–
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে,-
‘ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তাের আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।’
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।

পৌরাণিক আদর্শের কালােচিত রূপান্তর, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় এবং যুগােপযােগী জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিফলন তার কাব্যকে যেমন ঐতিহ্য বিরহিত করেছে, তেমনি অনাগত কালের জন্য রেখে গেছে অন্তহীন আবেদন। বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের প্রবর্তনার মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত আশ্চর্য প্রতিভার যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। গতানুগতিক সাহিত্যাদর্শে তার বলিষ্ঠ বিদ্রোহের ফলে বাংলা সাহিত্যের মুক্তিলাভ এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। একান্ত আকস্মিকতা সহকারে তার আবির্ভাব, স্বল্প সময়ে তার আশ্চর্য প্রতিভার বিকাশ এবং যুগস্রষ্টা হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পরম বিস্ময়।

মহাকাব্য

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকাব্যের ধারার সূত্রপাত করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত মেঘনাদবধ কাব্যের মাধ্যমে মহাকাব্যের পূর্ণাঙ্গ রূপের অনবদ্য প্রকাশ ঘটে এবং বাংলা সাহিত্যের তা প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মধুসূদন প্রবর্তিত পথরেখায় হেমচন্দ্র, নবীন সেন, কায়কোবাদ প্রমুখ মহাকবির পরিক্রমণ সংঘটিত হলেও অন্য কারও পক্ষে মাইকেলের মত শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা সম্ভব হয় নি।

পাশ্চাত্য শিক্ষাসভ্যতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি কাব্যসাধনায় বিখ্যাত পাশ্চাত্য কবিদের সমপর্যায়ভুক্ত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। সে উদ্দেশ্যসাধনে ব্যর্থকাম হয়ে তিনি অনেকটা আকস্মিকভাবে বাংলা ভাষার শক্তি সম্পর্কে বিশ্বাস সঞ্চয়পূর্বক প্রাচ্য-পাশ্চাত্য আদর্শের সম্মিলনে বাংলায় মহাকাব্য রচনার প্রয়াস পান। মধুসূদনের যুগে মহাকাব্য রচনাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ মর্যাদালাভের একমাত্র উপায় ও পরীক্ষাস্থল বলে বিবেচিত হত। সেজন্য মধুসূদন যখন বাংলায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মনস্থির করলেন তখন তিনি হােমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসাে প্রভৃতি বিদেশী এবং ব্যাস, বাল্মীকি প্রভৃতি দেশীয় মহাকবিদের রচনার প্রতিস্পর্ধী মহাকাব্য রচনার দুঃসাহসিক কল্পনাকেই রূপদানের কার্যে প্রবৃত্ত হলেন। এই উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে তিনি রামায়ণের রাবণকর্তৃক সীতাহরণ ও রামের উদ্ধার কাহিনির মেঘনাদবধের ঘটনা কেন্দ্র করে হােমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসাে, মিলটন, বাল্মীকি, কালিদাস প্রমুখ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য কবিগুরুর প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রভাবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামক মহাকাব্য রচনা করেন।

মধুসূদন বাল্মীকির রামায়ণ থেকে স্বল্প পরিমিত কাহিনী সংগ্রহ করেন। বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ থেকে মেঘনাদের হত্যা এবং প্রমীলার চিতারােহণ পর্যন্ত তিন দিন দু’রাত্রির ঘটনা এতে বর্ণিত হয়েছে। নয় সর্গের এই কাব্যকে মধুসূদন ঠিক মহাকাব্য বলেন নি, বলেছেন Epicling—ছােট মাপের মহাকাব্য। কাহিনির দিক থেকে রামায়ণের নিকট ঋণী হলেও তিনি প্রয়ােজন মত কাহিনী ও চরিত্রের পরিবর্তন করে নিয়েছেন। এর জন্য রাবণ-মেঘনাদ-প্রমীলা ও রাম-লক্ষ্মণকে অভিনব রূপে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।

পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে মাইকেল বাংলা সাহিত্যে মহত্তর সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধ হন। আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের মানবতার বন্দনাগীতি মধুসূদনের মনে নবপ্রেরণার সঞ্চার করেছিল। এদিক থেকে রামরাবণের সংগ্রামের মধ্যে যুগচেতনানুসারে মানবিকতার পরিচয় উপলব্ধি করেছিলেন। সংস্কৃত কবি বাল্মীকি এবং তার বাংলা অনুবাদক কবি কৃত্তিবাসের রামচন্দ্র অবতাররূপে কল্পিত হলেও মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্যে অভিনব দৃষ্টিতে এই পৌরাণিক চরিত্রটির নবমূল্যায়নে সচেষ্ট হন। মধুসূদনের মতানুসারে রাবণচরিত্র মহত্ত্ব ও গৌরবময় আদর্শের প্রতীক—পরম পরাক্রমশালী রাজা রাবণ দেশপ্রেমিক ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, পতিব্রতা প্রমীলা চরিত্র তাকে অধিকতর আকৃষ্ট করেছিল। সমসাময়িক যুগে রামের নৈতিক আদর্শ অপেক্ষা রাবণের দৈবের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রামের অধিকতর উপযােগিতা এবং প্রবলতর আবেদন আছে বলে মধুসূদন এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন।

মধুসূদনের ব্যক্তিজীবন, কবিমানস ও যুগমানসে যে বিদ্রোহ বিদ্যমান ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের ছন্দে ও ভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে এই তাৎপর্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে : “মেঘনাদবধ কাব্যের কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রামরাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন হইতে আমাদের মনে একটা যে বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহার শাসন ভাঙ্গিয়াছেন। এই কাব্যে রামলক্ষ্মণের চেয়ে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ বড় হইয়া উঠিয়াছে। যে ধর্মভীরুতা সর্বদাই কোনটা কতটুকু ভাল ও কতটুকু মন্দ তাহা কেবলই অতি সূক্ষ্মভাবে ওজন করিয়া চলে, তাহার ত্যাগ দৈন্য আত্মনিগ্রহ আধুনিক হৃদয়কে আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দবােধ করিয়াছেন। এই শক্তির চারিদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য, ইহার হৰ্মচূড়া মেঘের পথ রােধ করিয়াছে; ইহার রথ-রথী-অশ্ব-গজে পৃথিবী কম্পমান; ইহা স্পর্ধা দ্বারা দেবতাদিগকে অভিভূত করিয়া বায়ু-অগ্নি-ইন্দ্রকে আপনার দাসত্বে নিযুক্ত করিয়াছে; যাহা চায় তাহার জন্য এ শক্তি শাস্ত্রের বা অস্ত্রের বা কোনকিছুর বাধা মানিতে সম্মত নহে। এত দিনের সঞ্চিত অভ্রভেদী ঐশ্বর্য চারিদিকে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া ধূলিসাৎ হইয়া যাইতেছে, সামান্য ভিখারি রাঘবের সহিত যুদ্ধে তাহার প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্র-পৌত্র-আত্মীয় স্বজনেরা একটি একটি করিয়া সকলেই মরিতেছে। তাহাদের জননীরা ধিক্কার দিয়া কাঁদিয়া যাইতেছে, তবু যে অটল শক্তি ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনমতেই হার মানিতেছে না, কবি সেই ধর্মবিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে-শক্তি অতি সাবধানে সমস্ত মানিয়া চলে তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া, যে-শক্তি অতি সাবধানে স্পর্ধাভরে কিছু মানিতে চায় না বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।”

মেঘনাদবধ কাব্যে মাইকেলের দৃষ্টিভঙ্গি এক নতুনতর দিকের পরিস্ফুটন ঘটিয়েছে। রাক্ষসেরা এখানে সুসভ্য মানুষের মতই চিত্রিত হয়েছে। মহিমান্বিত সম্রাট, পুত্র-অনুরাগী পিতা, স্বদেশপ্রেমিক বীর প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত রাবণ মাইকেলের কল্পনাকে উজ্জীবিত করেছে।

ড. গােলাম মুরশিদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘মাইকেল বারবার পৌরাণিক কাহিনি বেছে নিয়েছেন। এ থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, তিনি পৌরাণিক জগতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেটা মােটেই ঠিক নয়। এমন কি, নতুন ভাষা ও ছন্দ এবং ভিন্নতর ভঙ্গিতে পৌরাণিক কাহিনি নতুন করে বলার লােভেও নয়। সত্যি বলতে কি, তার মনােভাব ছিল প্রাচীন জগৎ থেকে একেবারে আলাদা। কিন্তু তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যের অত্যুৎসাহী পাঠক হিসেবে পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখতে পেতেন। সেই সৌন্দর্য তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণকে পরিবেশন করতে। তিনি পৌরাণিক কাহিনি বেছে নিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে তার আধুনিক মানবিক মূল্যবােধকে প্রকাশ করার জন্য।’

মেঘনাদবধ কাব্যে গৃহীত বিষয়ের রূপায়ণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যােগীন্দ্রনাথ বসু তার ‘মাইকেল মধুসুদন দত্তের জীবনচরিত’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : ‘মেঘনাদবধ সম্বন্ধে প্রথম কথা এই যে, ইহার রাক্ষসগণ রামায়ণের বীভৎসরসের আধার নরশােণিতপ্রিয় জীব নহেন। বীরত্বে, গৌরবে, ঐশ্বর্য এবং শারীরিক সৌন্দর্যে সাধারণ মনুষ্য হইতে শ্রেষ্ঠ হইলেও তাহারা মনুষ্য। আবার, ব্যবহারেও আর্য সমাজ হইতে তাহাদিগের সমাজের কোন পার্থক্য নাই। আর্য নরনারীগণের ন্যায় তাহারাও যজ্ঞ ও দেবপূজা করেন; ধূপদীপ, নৈবেদ্য এবং গঙ্গাজলও তাহাদিগের পূজার অঙ্গ; তাহাদিগেরও কুললক্ষ্মীগণ স্বামী-পুত্রের কল্যাণের জন্য শিবসাধনা করেন এবং সতী পতির সঙ্গে সহমৃতা হন। তাহাদিগেরও গৃহে পার্থিব ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী রূপে রাজলক্ষ্মীর সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত এবং মহামায়া তাহাদিগেরও পুরাধিষ্ঠাত্রী। আর্য রামায়ণের যে নরমাংসাশী রাক্ষসরাজ, সীতাদেবীকে প্রাতরাশ রূপে ভক্ষণ করিবেন বলিয়া, মধ্যে মধ্যে ভীতি প্রদর্শন করিতেন, মেঘনাদবধের পাঠককে সর্বপ্রথমে, তাহার ও তাহার পরিজনবর্গের কথা বিস্মৃত হইতে হইবে। রাক্ষসগণের ন্যায় মেঘনাদবধের বানরগণও মানব; বৃহল্লাঙ্গুল, রােমশ পশু নহেন; সাধারণ মানব হইতে তাহাদিগের কোনও পার্থক্য নাই। মেঘনাদবধ কাব্য সম্বন্ধে দ্বিতীয় কথা এই যে, ইহার রামচন্দ্র ও সীতা দেবী। নারায়ণের ও লক্ষ্মীর অবতার নহেন; তাহারাও মানব-মানবী এবং পৃথিবীর অপর নরনারীগণের ন্যায় সুখ-দুঃখ ভাগী। সাধারণ মনুষ্য হইতে তাহাদিগের এইমাত্র বিভিন্নতা যে তপােবলে ও কর্মবলে, তাহারাও দেবগণকে প্রত্যক্ষ করিতে এমনকি, সময়ে-সময়ে আপনাদের অনুষ্ঠিত কর্মেরও অংশ গ্রহণ করাইতে পারেন। মেঘনাদবধ সম্বন্ধে শেষ কথা এই যে, ইহাতে রামায়ণে অনুল্লিখিত, এমনকি, রামায়ণ-বিরােধী, অনেক কথাও লক্ষিত হইবে। রামায়ণের ন্যায় ইলিয়াড ও ইনিয়াড প্রভৃতি পাশ্চাত্য কাব্যসমূহের অনেক ঘটনা, পরিবর্তিত আকারে, ইহার অন্তর্নিবিষ্ট হইয়াছে। রামায়ণের আদর্শ হইতে ইহার আদর্শও ভিন্ন। মহর্ষির প্রদর্শিত মার্গ পরিত্যাগ করিয়া কবি ইহাতে রামচন্দ্রের ও লক্ষ্মণের অপেক্ষা রাক্ষস পরিবারদিগের প্রতি অধিক সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়াছেন।’ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বীর রাক্ষসদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বানরদের দেখাতে কবি সংকোচ বােধ করেছেন। কারণ তাতে রাক্ষসদের বীরত্ব ম্লান হয়ে যায়। কবি বহিরাগত ও আগ্রাসী রামের চেয়ে রাক্ষসদেরই জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে সমর্থন করেছেন।

বীররসাত্মক কাব্য রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্যের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বীররসের কাহিনির ইঙ্গিত দিয়েই কাব্যের আরম্ভ :

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি।
রাঘবারি?

এই সরস্বতী-বন্দনাতেই কবি বলেছেন :

গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত; উরি, দাসে দেহ পদছায়া।
—তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী
কল্পনা। কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।

বীররসে কাব্যরচনার এই উদ্দেশ্য সার্থকভাবে রূপায়িত হয়ে ওঠে নি। বীরবাহু জননী চিত্রাঙ্গদার আর্তনাদে, অশােকবনে বন্দিনী সীতার অশ্রুবিসর্জনে, মেঘনাদপত্নী প্রমীলার চিতারােহণে, সর্বোপরি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুত্রহারা রাবণের হাহাকারে করুণ রসেরই প্রাধান্য ঘটেছে। প্রথম সর্গে রাবণের খেদ :

কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালা সম রে আছিল
এ মাের সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটী;
নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;
তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?
কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?

বেদনাকাতর এই অনুভূতি শেষ সর্গে চরম হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রাণপ্রিয় পুত্র মেঘনাদের চিতার সম্মুখে দাড়িয়ে রাবণ তার হৃদয়ের হাহাকার ব্যক্ত করেছেন :

ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয় আমি তােমার সম্মুখে,-
সঁপি রাজ্যভার, পুত্র, তােমায় করিব
মহাযাত্রা! কিন্তু বিধি—বুঝিব কেমনে
তার লীলা? ভাঁড়াইলা সে সুখ আমারে!
ছিল আশা, রক্ষঃকুল-রাজ-সিংহাসনে।
জুড়াইব আঁখি, বৎস, দেখিয়া তােমারে,
বামে রক্ষঃকুললক্ষ্মী রক্ষোরাণীরূপে
পুত্রবধূ! বৃথা আশা! পূর্বজন্মফলে
হেরি তােমা দোহে আজি এ কাল-আসনে!
কর্বুর-গৌরব-রবি চির রাহুগ্রাসে।

রাবণচরিত্রের এই হাহাকারই কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছে।

স্বদেশি ও বিদেশি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে মেঘনাদবধ কাব্য রচিত। রামায়ণ থেকে কাহিনি গ্রহণ করলেও মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনি অনেকটা পরিবর্তিত। তবে কবি অনেক স্থানে বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসকে অনুসরণ করেছেন। মধুসূদনের ওপর বাল্মীকি ও হােমারের প্রভাব সমধিক। কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে দেখা যায়, মাইকেল রামায়ণ কাহিনির মহৎ ও স্নিগ্ধ কবিত্বের ওপর হােমারের ‘ইলিয়াড’ কাহিনির কঠিন ও দীপ্ত শৌর্যের রং ফলিয়ে নতুন কবিকল্পনার ফসল মেঘনাদবধ মহাকাব্য সৃষ্টি করেছেন। গ্রিক মহাকবি হােমারকে অনুসরণ করে মেঘনাদবধের অধিকাংশ চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। মেঘনাদবধের শিব-উমা যেন হােমারের জিউস-হেরা। মহামায়াকে স্বতন্ত্র দেবী কল্পনা মধুসূদনের নিজস্ব। ইলিয়াডের আরেস মেঘনাদবধের স্কন্দ। মেঘনাদের পরিণাম হেকটরের পরিণামের মত। প্রমীলা কতকটা হেকটরের স্ত্রী আন্দ্রোমাখের এবং কতকটা ট্যাসাের কাব্যের রণরঙ্গিণী ক্লোরিন্দার মত। মেঘনাদবধ কাব্যে রামচন্দ্রের পক্ষাবলম্বন পূর্বক দেবদেবীকর্তৃক পরামর্শ প্রদান, উমাকর্তৃক শিবকে ভুলিয়ে রাবণের বিরুদ্ধে নেওয়ার চেষ্টা, দেবতাকর্তৃক রামকে অস্ত্র প্রদান ও রামের পক্ষে যােগদান, রামচন্দ্রের নরকভ্রমণ ও পরলােকে পিতৃদর্শন, ইন্দ্রজিতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রভৃতি ঘটনা হােমারের অনুসরণে সংস্থাপিত।

ভাষা, শব্দ ও উপমা ব্যবহারের দিক দিয়ে মাইকেল হােমারের মহাকাব্যের সহায়তা গ্রহণ করেছেন। কয়েকটি বিশেষণ, শব্দ ও বাক্যাংশ গ্রিক থেকে অনূদিত। সিংহ ব্যাঘ্র অগ্নি প্রভৃতি উপমা ব্যবহারের বাহুল্য গ্রীকের অনুসারী।

মধুসূদন দেশিবিদেশি উৎস থেকে উপমা-অলঙ্কার সংগ্রহ করে মহাকাব্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত উপমার কিছু নিদর্শন :

  • ১. পৌরাণিক :
    হলাহল জ্বলে কোন স্থলে;
    সাগর-মন্থনকালে সাগরে যেমতি।
  • ২. কালিদাসীয় :
    যে রমণী পতিপরায়ণা,
    সহচরীসহ সে কি যায় পতিপাশে?
    একাকী প্রত্যুষে, প্রভু; যায় চক্রবাকী
    যথা প্রাণকান্ত তার!
  • ৩. বৈষ্ণব সাহিত্য :
    চমকি রামা উঠিলা সত্বরে,-
    গােপিনী কামিনী যথা বেণুর সুরবে।
  • ৪. দেশীয় ব্রত-উৎসব :
    বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে।
  • ৫. মহাদেব :
    শূলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম।
  • ৬. অগ্নি :
    উঠিল আভা আকাশ মণ্ডলে,
    যথা বনস্থলে যবে পশে দাবানল।
  • ৭. সমুদ্র :
    ভীষণ স্বন স্বনিল সে স্থলে
    সাগর কল্লোলসম।
  • ৮. পর্বত :
    হেমকুট হৈম শিরে শৃঙ্গধর যথা তেজঃপুঞ্জ।
  • ৯. সূর্য :
    হাসিল তারাবলী-মণিকুল সৌরকরে যথা।
  • ১০. চন্দ্র :
    সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে।
  • ১১. হাতি :
    চলিলা বীর-কুঞ্জর কুঞ্জর গমনে।
  • ১২. সিংহ :
    কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
    বীতংসে?
  • ১৩. পদ্ম :
    লঙ্কার পঙ্কজ রবি গেলা অস্তাচলে।
  • ১৪. সাপ :
    বিষদন্তহীন অহি হেরিলে নকুলে
    বিষাদে লুকায় যথা।

গ্রিক মহাকাব্যের ‘নেমেসিস’ বা দৈবনির্বন্ধবাদ মেঘনাদবধ কাব্যে প্রকাশমান। সমস্ত শক্তিসামর্থ্য থাকলেও যে বিধির বিধানে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হতে হয় তা গ্রিক নিয়তির বৈশিষ্ট্য। রাবণ তার ধ্বংসের জন্য কোন কারণ খুঁজে পান নি, সীতাহরণকে পাপ বলে মনে করার যুক্তি তার ছিল না, পূর্বজন্মের অজ্ঞাত পাপ সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু এক অদৃশ্য নিয়তির নির্দেশেই যেন তাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. আবুল হাসান শামসুদ্দিন তার অভিসন্দর্ভ ‘বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য : মধুসূদন ও অনুসারিবৃন্দ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, মধুসূদন তার কাহিনি পরিকল্পনায় নিয়তির। অনিবার্য পরিণাম সম্পূর্ণ পরিস্ফুট করতে পারেন নি। রাবণের ধ্বংসের জন্য তার পাপকে তিনি দায়ী করেন নি, অথচ সমস্ত দেবকুল রাবণের ধ্বংসের জন্য সমবেত হয়েছেন, এবং এর ফলেই রাবণের ধ্বংস সাধিত হয়েছে। পাঠকদের কাছে দেবতাদের ষড়যন্ত্রই রাবণের নিয়তিরূপে প্রতিভাত হয়। এমনকি, মহাদেব ও মায়াদেবী সহায়তা না করলে দেবতারাও মেঘনাদের হত্যার ষড়যন্ত্র সফল করে তুলতে পারতেন না।’

মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে মধুসূদনকে ভাব ভাষা ও ছন্দ নতুনভাবে রূপায়িত করে তুলতে হয়েছিল। ভাবের প্রকাশের দিক থেকে যেমন তার মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি মহাকাব্যের উপযুক্ত ভাষা তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সংস্কৃত শব্দের বাহুল্যপূর্ণ ব্যবহার, অপরিচিত অথচ ধ্বনিগাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দের প্রয়ােগ, সমাসবদ্ধ শব্দের প্রাচুর্য তার কবিভাষাকে বিশিষ্ট করেছে। বাংলা ভাষার অপূর্ব শক্তির পরিচয় এই মহাকাব্যে বিধৃত। ‘যাদঃপতিরােধঃ যথা চলাের্মি-আঘাতে’-এ ধরনের দুরূহ ভাষাপ্রয়ােগও যে ভাব প্রকাশের উপযুক্ত বাহন তা সমালােচক-স্বীকৃত। প্রকৃতপক্ষে নতুন শব্দ নির্মাণকৌশলের প্রতি মনােযােগী না হয়ে কবি প্রচলিত শব্দকেই নতুন বাণীভঙ্গিতে বিন্যস্ত করেছেন। মধুসূদনের কৃতিত্ব আছে প্রতিশব্দ ব্যবহারে। মেঘনাদবধ কাব্যে প্রচুর প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একই শব্দের পুনরাবৃত্তি রােধ করার জন্য যেমন এসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি ছন্দ, ধ্বনিগাম্ভীর্য ও শ্রুতিমাধুর্যের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শব্দের অর্থসম্পর্কে কবির পাণ্ডিত্য, ছন্দ সম্পর্কে সচেতনতা, ধ্বনির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবির উপলব্ধির গভীরতার বিষয় অবহিত হওয়া যায়। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মহাকবির বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় এখানে সহজেই লাভ করা সম্ভব। কবির প্রতিশব্দ ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত : রামের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত শব্দাবলি : রাঘব, দশরথাত্মজ, দাশরথি, সীতাপতি, বৈদেহীনাথ, বৈদেহীরঞ্জন, কৌশল্যানন্দন, বৈদেহীমনােরঞ্জন, রঘুকুলমণি, রাঘবেন্দ্র, রঘুবর, রঘুনন্দন, রঘুশ্রেষ্ঠ, সীতানাথ, রবিকুল রবি, রঘুকুলনিধি, রঘুচূড়ামণি, নর-বর, রঘুপতি, রঘুনাথ, রঘুবংশ-অবতংস, সীতাকান্ত, রাঘবচন্দ্র, রঘুকুল-রাজা, বৈদেহীবিলাসী, রাঘবেশ্বর, মৈথিলীনাথ, নরপাল, বৈদেহীপতি, রক্ষোরিপু, মৈথিলীবিলাসী, রামভদ্র, মৈথিলীপতি, রঘুজ-অজ-অঙ্গজ-দশরথাত্মজ।

সুনির্বাচিত উপমা তার বক্তব্যকে সুস্পষ্ট রূপ দিয়েছে। অনুপ্রাস ব্যবহারের প্রাচুর্য মেঘনাদবধ কাব্যের সর্বত্র রয়েছে। ‘সশঙ্ক লঙ্কেশ শূর স্মরিলা শঙ্করে’–এ ধরনের অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত প্রচুর পাওয়া যেতে পারে। মহাকাব্যের উপযুক্ত ছন্দ অমিত্রাক্ষর সৃষ্টি করে মধুসূদন যে শুধু তার মহাকাব্যে সার্থকতা দেখিয়েছেন তা নয়, বরং বাংলা ছন্দের পরবর্তী সম্ভাবনাপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টির জন্য বন্ধনমুক্তি ঘটালেন। এ সমস্ত দিক থেকে মধুসূদনের সাধনা একক। এর ফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের নতুন ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং এই ধারায় শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবও তার। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু রাজনারায়ণ রায় মেঘনাদবধ কাব্যকে বাংলা ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য বিবেচনা করে মন্তব্য করেছিলেন, অসাধারণ কবির রচনার প্রকৃত লক্ষণ এই যে, তাহা কখনই পুরাতন বা অরুচিকর হয় না। বহু শতাব্দী পরে যখন গ্রন্থকার এবং তাহার সমালােচক উভয়ই অন্তর্হিত হইবেন, তখনও মনুষ্যগণ অক্লান্ত অনুরাগের সহিত মেঘনাদ পাঠ করিবে।’

মেঘনাদবধ কাব্যের ত্রুটি সম্পর্কে যেসব মন্তব্য লক্ষ করা যায়, সেগুলাে হল : কাহিনির সংক্ষিপ্ততা, কাব্যে বিধৃত নীতিধর্ম সম্পর্কে ভিন্নমত, অনার্যপ্রীতি, স্বর্গ-নরকের প্রাণহীন বর্ণনা, আখ্যানের বাইরে সীমিত ও আড়ষ্ট কবিকল্পনা, পৌরাণিক কাহিনিমূলক উপমা-অলঙ্কার প্রয়ােগ, অনুপ্রাস-যমকের বিপুল ভার, নামধাতুর আতিশয্য প্রভৃতি।

মধুসূদনের মহাকাব্যের প্রথম আলােচক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ করেছিলেন সে সম্পর্কে এ ভাবে মন্তব্য করেছেন : ‘বাক্যের জটিলতা দোষই তাহার রচনার প্রধান দোষ; অর্থাৎ যে বাক্যের সহিত যাহার অন্বয় বিশেষ্য বিশেষণ, সংজ্ঞাসর্বনাম এবং কর্তক্রিয়া সম্বন্ধ তৎপরস্পরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান; সুতরাং অনেক স্থলে অস্পষ্টার্থ দোষ জন্মিয়াছে,—অনেক পরিশ্রম না করিলে ভাষার উপলব্ধি হয় না। দ্বিতীয়ত, তিনি উপর্যুপরি রাশি রাশি উপমা একত্রিত করিয়া পাকার করিয়া থাকেন এবং সর্বত্র উপমাগুলি উপমিত বিষয়ের উপযােগী হয় না। তৃতীয় দোষ, প্রথা-বহির্ভূত নিয়মে ক্রিয়াপদ নিপাদন ও ব্যবহার করা। যথা— ‘স্তুতিলা’, ‘ধ্বনিলা’, ‘মর্মরিছে’, ‘দ্বন্দ্বিলা’, ‘সুবর্ণি’ ইত্যাদি। চতুর্থত, বিরাম যতি সংস্থাপনের দোষে স্থানে স্থানে শ্রুতিদুষ্ট হইয়াছে।’

এই ত্রুটি নির্দেশ করে হেমচন্দ্র মন্তব্য করেছেন, এ সমস্ত দোষ না থাকিলে মেঘনাদবধ গ্রন্থখানি সর্বাঙ্গ-সুন্দর হইত; কিন্তু এই রূপ দোষাশ্রিত হইয়াও কাব্যখানি এত উৎকৃষ্ট হইয়াছে যে বঙ্গভাষার ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য দৃষ্টিগােচর হয় না। মােহিতলাল মজুমদার লিখেছেন, “মেঘনাদবধের ঘটনাবস্তু জটিল বা বিস্তৃত নহে; চরিত্র সৃষ্টিতে অথবা নায়কের কীর্তিকুশলতায় মহাকাব্যোচিত মহিমা ইহার নাই—এমন একটি চরিত্রও নাই, যাহাকে দুর্ধর্ষ পুরুষ বীর বা মানুষরূপী দেবতা বলা যাইতে পারে। নায়ক মেঘনাদের হত্যা এবং যে-ভাবে সেই হত্যা সাধিত হইয়াছে, লঙ্কার সর্বনাশ ও রাবণের শােক এ সকলের কোনটিতেই মহাকাব্যোচিত বিষয় গৌরব নাই।’

মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য রচনায় যে অপরিসীম সাফল্য অর্জন করেছিলেন তার ফলে বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য রচনার প্রেরণা আসে। তবে পরবর্তীকালে কারও পক্ষেই মধুসূদনের সমকক্ষতা লাভ করা সম্ভব হয় নি। মধুসূদন মনে করতেন ‘আমাদের নাটক গদ্যে না-লিখে, অমিত্রাক্ষরে লেখা উচিত।’ এই অমিত্রাক্ষর ছন্দকেই তিনি আক্ষরিক অর্থে বাজি রেখে বাংলাকাব্যে প্রয়ােগ করলেন এবং মেঘনাদবধ কাব্যে তা বাহন হিসেবে রূপ দিয়ে মহাকাব্যের এক গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি করলেন।

নাটক ও প্রহসন

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) সগৌরব আবির্ভাব ঘটেছিল নাট্যরচনার সূত্র ধরে। বাংলা নাটকের দীনহীন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার বিস্ময়কর প্রতিভা বৈচিত্র্যমুখী হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাট্যকার হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্থান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯) বাংলা নাটকে প্রাণসঞ্চার করতে সক্ষম হয়। এই নাটকের পূর্বেকার বাংলা নাটকে কৌতুকরসের বাহুল্য, রচনার গুরুভার ইত্যাদি ত্রুটি বিদ্যমান ছিল। মধুসূদন পূর্ববর্তী প্রভাব কাটিয়ে বাংলা নাটককে উদ্দেশ্যহীন গতি থেকে মুক্তি দিয়ে কাহিনিবিন্যাস, ঘটনার সংস্থাপনা এবং কৌতুক-রসের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে এক নতুন জীবনদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি, কাহিনিতে নিরবচ্ছিন্ন গতি, নাট্যরীতিতে পাশ্চাত্য আদর্শ গ্রহণ ইত্যাদির ফলে বাংলা নাটক তার হাতেই ভাবীকালের পথের সন্ধান পেয়ে সার্থকতর সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত হয়।

কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের অভিনয়ের সংস্পর্শে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন। পুরাণকাহিনি অবলম্বনে রচিত ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক ব্যতীত মাইকেল পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) নাটক এবং সামাজিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) ও বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০) নামক প্রহসন রচনা করেছিলেন। এগুলাে ছাড়া মধুসূদন শেষজীবনে ‘মায়াকানন’ নাটক রচনা করেন এবং তা তার মৃত্যুর পর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। তবে নাটক হিসেবে তা অন্যান্য নাটকের মত সার্থকতা লাভ করতে পারে নি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে নতুন আদর্শ অবলম্বনে বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার প্রথম ফসল ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রথম সংস্করণে সংস্কৃত নাটকের আদর্শে শুরুতে প্রস্তাবনা এবং শেষে ‘উপসংহার গীত’ সংযােজিত ছিল। পরে তা পরিত্যক্ত হয়। প্রস্তাবনাটি ছিল এ রকম :

          মরি হায়, কোথা সে সুখের সময়,
যে সময় দেশময় নাট্যরস সবিশেষ ছিল রসময়।
শুন গাে ভারত ভূমি,      কত নিদ্রা যাও তুমি,
     আর নিদ্রা উচিত না হয়।
উঠ ত্যজ ঘুমঘাের,       হইল, হইল ভাের;
      দিনকর প্রাচীতে উদয়।
কোথায় বাল্মীকি, ব্যাস,         কোথা তব কালিদাস,
        কোথা ভবভূতি মহােদয়।
অলীক কুনাট্য রঙ্গে,           মজে লােক রাঢ়ে বঙ্গে
       নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। 
সুধারস অনাদরে,                      বিষবারি পান করে,
       তাহে হয় তনু মনঃ ক্ষয়।
মধু বলে জাগ মাগাে,                বিভুস্থানে এই মাগ,
সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়।

এতে পৌরাণিক কাহিনি, সংস্কৃতাশ্রয়ী ভাষণ এবং পাশ্চাত্য রােমান্টিক নাট্যকলার আদর্শ স্থান পেয়েছে। সংস্কৃত নাটকের অলংকার, অঙ্কের আদর্শ, নান্দী-প্রস্তাবনা সূত্রধার প্রভৃতি বর্জিত হয়ে এই নাটকটি প্রথম সার্থক বাংলা নাটক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তৎকালীন অপরিকল্পিত প্লট অথবা দৃশ্যহীন নাটকের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাটকটিকে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সৃষ্টি বলে ধরা যায়। এই নাটকে কাহিনির ঘনবিন্যাস এবং সংলাপ সৃষ্টিতে মাধুর্য থাকায় এতে সত্যিকার নাট্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।

গ্রিক পুরাণের আখ্যায়িকা হিন্দু পুরাণের ছাঁচে ঢেলে হিন্দু ধর্মসংস্কারানুযায়ী রূপ প্রদানপূর্বক মাইকেল মধুসূদন তার দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেন। শর্মিষ্ঠার তুলনায় দৃশ্যস্থাপনা এই নাটকে অবিন্যস্ত; তবে এতে চমকপ্রদ কাহিনির মাধ্যমে নাট্যরস সৃষ্টি হয়েছে। গল্পসর্বস্বতা, বৈশিষ্ট্যহীন চরিত্রচিত্রণ এ নাটকে লক্ষণীয়। ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই মাইকেল প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। তবে এর ভাষারীতি প্রধানত গদ্য।

মধুসূদনের পরবর্তী নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজিডি নাটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে লিখিত এটিই প্রথম বাংলা নাটক । তবে ইতিহাসের মূল কাহিনির সঙ্গে নাট্যকাহিনির সংযােগ ক্ষীণতম বলে একে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় না। এই নাটকটি সমসাময়িক ও পরবর্তী অনেকগুলাে নাটকের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। কৃষ্ণকুমারীর কাহিনি নাট্যোপযােগী ও দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং এর স্বাভাবিক পরিণতির মধ্যে কোন অসংলগ্নতাও পরিদৃষ্ট হয় না। মানবীয়তা এই নাটককে বাস্তবতার অনুসারী করেছে। প্রতীচ্য আঙ্গিকের ব্যবহারে রচিত ‘কৃষ্ণকুমারী’ মাইকেলের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। নাট্যকাহিনিটি টডের ‘রাজস্থান’ থেকে গৃহীত। কৃষ্ণকুমারী নাটক বাংলা ঐতিহাসিক রােমান্টিক ট্র্যাজেডির পথপ্রদর্শক। মাইকেলের সর্বশেষ নাটক ‘মায়াকানন’ কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘রিজিয়া’ ইসলামি বিষয়ে রচিত অসমাপ্ত নাটক।

মধুসূদনের প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রো’ বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রহসনের পর্যায়ে স্থান লাভ করতে পারে। প্রথম প্রহসনটির মধ্যে তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষাভিমানী যুবসম্প্রদায়ের উচ্ছলতা ও অনাচারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। অন্যটির মধ্যে অধৰ্মচারী লােকের ভণ্ডামি এবং চরিত্রহীনতার চিত্র বিদ্যমান। নাট্যকার প্রহসন দুটিতে টাইপ জাতীয় চরিত্র সৃষ্টি করে সমকালীন সমাজের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। এগুলাের অনুসরণে পরবর্তীকালে এই প্রকার অনেকগুলাে প্রহসনের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রহসন হিসেবে নিখুঁত এই রচনাদুটিকে বাস্তবতাপ্রধান বলে অভিহিত করা যায়। প্রহসন দুটিতে কথ্য বাগভঙ্গির সাবলীলতা, চরিত্রোপযােগী সংলাপ ও বাস্তব পরিবেশ-সচেতনতা নিঃসন্দেহে উৎকর্ষের কারণ হয়েছে। নব্যবঙ্গ সমাজ এবং প্রাচীন বকধার্মিক বৃদ্ধ সমাজ-নায়কদের নৈতিক অনাচারকে মাইকেল সমপরিমাণেই কটাক্ষের রূঢ় আঘাত করেছিলেন।

মাইকেল মধুসূদনের নাট্যরচনার কাল মাত্র দু বছর। এই স্বল্পকালের মধ্যে তার সাফল্য বিস্ময়কর। তার নাট্যরচনায় দ্বন্দ্বসংঘাতের ফলে ঘনীভূত নাট্যরসে, নাটকীয় রসপুষ্টির জন্য ঘটনাবিন্যাসে এবং চরিত্রসৃষ্টি ও মূল্যায়নে আধুনিক যুগের বাঙালির প্রাণধর্ম ও জীবননিষ্ঠতার পরিচয় সুস্পষ্ট। মধুসূদনের নাটকে একদিকে যেমন মানবজীবনের বাস্তবচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মানবমনের দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট করা হয়েছে। মধুসূদনের হাতে বাংলা নাটক রচনার ভাষা, কাহিনির পরিকল্পনা, চরিত্রসৃষ্টির আদর্শ বিশিষ্ট রূপ লাভ করে সার্থক বাংলা নাটকের অগ্রগতি সাধন করেছে।

নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)

(লেখাটি অধ্যাপক মাহবুবুল আলম রচিত “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থ থেকে নেয়া)

১৯শ শতকের মহাকাব্যের ধারায় নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) হেমচন্দ্রের সমসাময়িক কবি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের আদর্শ সম্মুখে রেখে তিনি মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন। তবে তিনি মহাকাব্যের কাহিনি নির্বাচনে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। মহাকাব্যের সুবিপুল কাহিনি নির্বাচন করে তিনি কাহিনিগত দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিশিষ্টতা অর্জন করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি গীতিকবিতা, গাথাকাব্য ও মহাকাব্য – ১৯শ শতকের রীতি অনুযায়ী এই তিন ধরনের কাব্য রচনা করেছিলেন।

নবীনচন্দ্র সেন হেমচন্দ্রের মতই জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তার কবিমানসের অভিব্যক্তি ঘটেছিল হিন্দুদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস অবলম্বনে। এই বৈশিষ্ট্যই তার জনপ্রিয়তার পশ্চাতে কার্যকরী ছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে এদেশের সাহিত্যে যে নতুন হাওয়া প্রবাহিত হয়, নবীন সেন তা উপলব্ধি করে স্বীয় কাব্যধারায় তা পরিস্ফুটনে সচেষ্ট হন। অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য নিয়ে তিনি পুরাতন ভাবধারাকে নতুন রূপদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সমসাময়িক যুগের আদর্শ তিনি বরণ করেন, তার নিদর্শন রেখেছেন জাতীয়তাবােধ নিয়ে রচিত তার মহাকাব্যে।

চট্টগ্রামের নবীন যুবক নবীন সেন এফ. এ. পড়ার জন্য কলকাতা আগমনের পরে পরেই প্রতিভাধর হিসেবে সুধীমহলে খ্যাতি অর্জন করেন। সেখানে কলেজ জীবনেই কবিখ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন এবং পত্রপত্রিকায় তার গীতিকবিতা প্রকাশিত হয়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবনে তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। কর্মজীবনে বাংলার বাইরে পুরী ও রাজগিরে থাকাকালীন সে সব স্থানের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক পটভূমিকায় আকৃষ্ট হয়ে হিন্দুধর্মগ্রন্থ ও কাব্যপাঠে মনােযােগী হন। এর পরিণতিতে তিনি পরিণত বয়সে মহাকাব্য রচনায় প্রবেশ করেন।

নবীন সেনের মহাকাব্য ‘রৈবতক’ (১৮৮৩), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) ও ‘প্রভাস’ (১৮৯৬)—এই তিনটি কাব্য ‘ত্রয়ীকাব্য’ নামে পরিচিত। তিনি মহাভারত ভাগ বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি কৃষ্ণলীলাবিষয়ক গ্রন্থ থেকে উপকরণ নিয়ে তৎকালীন ভারতের সমাজ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণচরিত্র অবলম্বনে চৌদ্দ বছরে এই মহাকাল রচনা করেন। কাব্য তিনখানির কাহিনিগত তাৎপর্যের দিক থেকে তা ‘উনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত’ নামে অভিহিত। ত্রয়ীকাব্যে একদিকে কবির ধর্মবােধ, অন্যদিকে স্বাজাত্যবােধ রূপায়িত হয়েছে। ‘রৈবতক’ কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্রে মধ্যলীলা এবং ‘প্রভাসে’ অন্ত্যলীলা স্থান পেয়েছে। এসব কাব্যের কেন্দ্রীয় ঘটনা যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যুবধ ও যদুবংশ ধ্বংস। এর মূল বক্তব্য নিষ্কাম কর্ম ও নিষ্কাম প্রেমের ডােরে আর্য-অনার্যের রাখিবন্ধন এবং অখণ্ড হিন্দুসংস্কৃতির পত্তন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থ পাঠে প্রভাবিত হয়ে মহাভারত থেকে শ্রীকৃষ্ণচরিত্র অবলম্বনে কবি মূল বক্তব্য প্রকাশ করেন। তার অনুকূলে ছিল অর্জনের শৌর্য, কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মনীষা, সুভদ্রার প্রীতি এবং শৈলজার প্রেম। প্রতিকূলে ছিল দুর্বাসার অকারণ প্রতিহিংসা ও অভিমান এবং বাসুকির সংশয়। ভারতের দ্বিধাবিভক্ত অবস্থার অবসানে এক ধর্ম ও এক জাতি প্রতিষ্ঠার কল্পনায় নবীন সেন শ্রীকৃষ্ণকে অবতার শ্রেণি থেকে স্থানচ্যুত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে অঙ্কন করেছেন। মহাভারতের অলৌকিকতা থেকে শ্রীকৃষ্ণকে উদ্ধার করে ভারতের ধর্মসংস্কারক এবং এক অখণ্ড মহাভারতের প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়েছে। সমস্ত বিরােধের অবসানে এক ভারত সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে—এই ছিল কবির কাম্য; সমগ্র ভারত জুড়ে এক ধর্মরাজ্য স্থাপন করাই তার উদ্দেশ্য। তার কৃষ্ণের আদর্শ ছিল :

এক ধর্ম এক জাতি      এক রাজ্য এক নীতি 
সকলের এক ভিত্তি সর্বভূতহিত। 
সাধনা নিষ্কাম ধর্ম      লক্ষ্য সে পরম ব্রহ্ম 
একমেবাদ্বিতীয়ম, করিব নিশ্চিত,
ওই ধর্মরাজ্য, ‘মহাভারত’ স্থাপিত।

নবীন সেন মানবমাহাত্ম্যকেই সর্বাপেক্ষা বড় বলে উল্লেখ করেছেন। তাই দেখা যায়, ভগবানের অবতার হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে যে সমস্ত অলৌকিকতার সমাবেশ ঘটেছিল তা দূর করে বিভিন্ন দিক থেকে তাকে মানবতার পরিপূর্ণ আদর্শ হিসেবে নবীন সেন স্থান দিয়েছেন। নবীনচন্দ্র সেন শিল্পসৃষ্টি অপেক্ষা আদর্শ চরিত্রসৃষ্টির ব্যাপারে বেশি মনােযােগী ছিলেন।

কাহিনিগত দিক থেকে কবির মৌলিকতা না থাকলেও কতিপয় বিষয়ে কবি মৌলিক পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। তার পরিকল্পনায় কৃষ্ণ ভগবান বা অবতার নন, তিনি শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন মহামানব। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতির আদর্শের প্রতিফলন তার কৃষ্ণজীবনে লক্ষণীয়। নবীনচন্দ্রের লেখনীতে শ্রীকৃষ্ণ পুরাণের পরিমণ্ডল ছেড়ে আধুনিক ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন। নবীন সেনের মহাকাব্যে সমকালীন ধ্যানধারণার প্রতিফলন ঘটেছে :

নবধর্ম বেদি-মূলে বসিয়া দেবগণ।।
আর্য অনার্যের ধ্যানে; বেদি-বক্ষে নিরুপম
নিষ্কামের মহামূর্তি; তদুপরি বিরাজিতা
জননী আনন্দময়ী, অতুল প্রতিভান্বিতা!
বিদগ্ধ অধর্ম-মল, রক্তবর্ণ কলেবর
অর্ধেন্দু-কিরীট শিরে, পাশাঙ্কুশ ধনুঃশর,
—সমরাস্ত্র, শাসনাস্ত্র হইয়াছে শােভমান
চারিভূজে চারিদিকে; ত্রিনেত্রে ত্রিকালজ্ঞান।
ধর্ম-সম্রাজ্ঞীর মুখ, অনন্ত মহিমা-ছবি,
ভাসিল প্রভাতকাশে যেন শান্ত-বাল-রবি,
অনন্ত মানব-ব্যাপী ভবিষ্যৎ বর্তমান,
নয়নে আনন্দ অশ্রু গাহিতেছে কৃষ্ণনাম।

নবীন সেন তার কাব্যের বিষয়বস্তু নির্বাচনে যথেষ্ট মৌলিকতা ও অনন্যসাধারণতার পরিচয় প্রদান করলেও মহাকাব্যের রচনাকারী হিসেবে সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। পরিকল্পনার বিরাটত্ব ও মহাকাব্যোচিত উপাদানের সমাবেশ ঘটালেও কাব্যটি মহাকাব্যের গৌরব অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তত্ত্বের প্রাধান্য, ঐক্যহীন ভাব, রসহীন কাব্যনিবদ্ধ প্রভৃতি অসঙ্গতির জন্য কাব্যটি সার্থকতা লাভ করতে পারে নি। ভক্তিরস ও ভাববিলাসের কবি বলে নবীন সেন কৃষ্ণভক্তির প্রচারক রূপেই প্রাধান্য লাভ করেছিলেন, কিন্তু উপাদান বিন্যাসের দৃঢ়তা এবং মূল কল্পনার কেন্দ্রিকতা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়েছে। এক মহাভারতের পরিকল্পনার মধ্যেও নবীন সেন কোন সুনির্দিষ্ট গঠন সুষমা দান করতে পারেন নি। অসংযত ভাবােচ্ছ্বাস, গম্ভীর বিষয় থেকে তুচ্ছ বিষয়ে অতর্কিতে অবতরণ, আখ্যানের অতিপল্লবিত রূপ, গীতিমূৰ্ছনা ইত্যাদি এই মহাকাব্যের ত্রুটি হিসেবে বিবেচ্য। কবি পৌরাণিক কাহিনি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন বলে তার মৌলিক পরিকল্পনা অসঙ্গত। মহাকাব্যের বিশালতা, চরিত্র পরিকল্পনার ঔদার্য এবং রচনারীতির ক্লাসিক গাম্ভীর্য ভাবপ্রবণ কবি নবীন সেন আয়ত্ত করতে সক্ষম হন নি। তাই তার কাব্যকে পুরাণকাহিনিভিত্তিক অভিনব আখ্যানকাব্য হিসেবেই বিবেচনা করা চলে। নবীন সেনের অমিত্রাক্ষর ছন্দের নমুনা :

একাকী নির্জনে এক তরুর ছায়ায়
একটি উপল খণ্ডে করিয়া শয়ন
চাহি অনন্তের শান্তদীপ্ত নীলিমায়
ভাবিতেছি,—জীবনের ভাবনা প্রথম,—
একই মানব সব; একই শরীর,
একই শােণিত মাংস ইন্দ্রিয় সকল;
জন্মমৃত্যু একরূপ ; তবে কি কারণ
নীচ গােপজাতি, আর সর্বোচ্চ ব্রাহ্মণ?
চারি বর্ণ চারি বেদ, দেবতা তেত্রিশ?
নিরমম জীবঘাতী যজ্ঞ বহুতর।

নবীন সেনের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য রচনাও রয়েছে। তার প্রথম কাজ ‘অবকাশরঞ্জিনী’ (প্রথম ভাগ ১৮৭১, দ্বিতীয় ভাগ ১৮৭৮)। ব্যক্তিগত জীবনে সুখদুঃখ, সমসাময়িক ঘটনা, স্বদেশপ্রীতি প্রভৃতি বিচিত্রভাব এই কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। তবে দুর্বল শব্দবিন্যাস, অশােভন উপমা কাব্যটিকে উন্নত পর্যায়ে স্থান দিতে পারে নি। কবির সহজাত উচ্ছ্বাস প্রবণতা ও যৌবনসুলভ আবেগের ফলে কোন বক্তব্যে বা প্রেমচিন্তায় কোন স্থির প্রত্যয়ে পৌঁছাতে না পারলেও গীতিকবিতার সকল বৈশিষ্টই ‘অবকাশরঞ্জিনী’তে লক্ষ করা যায়।

‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৬) নবীন সেনের ঐতিহাসিক গাথাকাব্য। দেশপ্রেমমূলক এই কাব্যটির মাধ্যমে তিনি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাব্যটি কবির জন্য যথেষ্ঠ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এমন কথাও বলা হয় যে, পলাশীর যুদ্ধ প্রকাশের ফলে বঙ্গ সাহিত্যজগতে একটা তােলপাড় শুরু হয়েছিল। প্রকাশের পরই কাব্যটি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাঠ্যপুস্তক রূপে নির্ধারিত হয়েছিল। পরাধীনতার বেদনাবােধ এবং স্বাধীনতা লাভের উন্মাদনায় কাব্যটি সমৃদ্ধ। এতে মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করে ইংরেজদের বিজয় দেখানাের মাধ্যমে কবি দেশপ্রেমের বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। নবাব সিরাজদ্দৌলা ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের কাহিনি কাব্যটির উপজীব্য। তবে এতে সিরাজদ্দৌলাকে গুরুত্বহীন করে সেনাপতি মােহনলালকে কাব্যের নায়ক হিসেবে স্থান দিয়েছেন এবং মােহনলালের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই কবির দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। কবি এই কাব্যে ইতিহাসের বস্তুসত্য ও কল্পনার কাব্যসত্য যথার্থরূপে মেশাতে পারেন নি, আবেগের অসংযত প্রকাশও এতে বিদ্যমান। তবু নবীন সেনের কবিখ্যাতি প্রধানত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের ওপরই নির্ভরশীল।

‘ক্লিওপেট্রা’ (১৮৭৭) নবীন সেনের ক্ষুদ্র কাব্য, প্রতিভার তেমন কোন নিদর্শন এতে নেই। ওয়াল্টার স্কটের আদর্শানুসারে তিনি ‘রঙ্গমতী’ (১৮৮০) নামে একটি কাল্পনিক, রােমান্টিক ও স্বদেশপ্রেমের আখ্যায়িকা কাব্য রচনা করেন। তার পরবর্তী কাব্যগুলাে অবতার মহাপুরুষের জীবনী অবলম্বনে রচিত। যীশুখ্রিস্টের জীবনী অবলম্বনে ‘খৃস্ট’ (১৮৯১), বুদ্ধদেবের জীবনী অবলম্বনে ‘অমিতাভ’ (১৮৯৫) এবং শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপ-লীলাকাহিনি অবলম্বনে ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯) কাব্যগুলাে রচনা করা হয়। তার ধর্মমূলক কাব্য হচ্ছে ‘গীতা’ ও ‘চণ্ডীর’ অনুবাদ। নবীন সেন ‘প্রবাসের পত্র’ ভ্রমণকাহিনি, ‘ভানুমতী’ দীর্ঘ উপন্যাস এবং ‘আমার জীবনী’ সুবৃহৎ আত্মজীবনী প্রভৃতি গদ্য গ্রন্থের রচয়িতা। পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত ‘আমার জীবনী’ বাংলা আত্মজীবনীর ইতিহাসে একটি মূল্যবান সংযােজন।

নবীন সেন অত্যধিক হৃদয়াবেগ দ্বারা পরিচালিত ছিলেন বলে কাব্যকলায় যথেষ্ট উৎকর্ষ দেখাতে পারেন নি। মহাকাব্যের চেয়ে গীতিকবিতার ক্ষেত্রে তার কবিপ্রতিভা ছিল সম্ভাবনাময়। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, ‘একটা পার্বত্য পাগলাঝােরার ধারার ন্যায় অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য লইয়া বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব হয়েছিল কবি নবীনচন্দ্রের।…প্রাচ্য প্রতীচ্যের কোন কবির সহিতই নবীনচন্দ্রের ঠিক ঠিক মিল হয় না; তাহার উন্মাদ প্রতিভা লইয়া তিনি কাব্যক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র মূর্তি। যদি তাহাকে যথার্থ কাহারও মন্ত্রশিষ্য বলা যায়—তবে তিনি সমুদ্র মেঘলা পর্বতবাসিনী চট্টলেশ্বরী।’ কবির উচ্ছাসধর্মিতা প্রশ্রয় পেয়েছিল তখনকার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নির্বিচার ভাববিলাসের মধ্যে, নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের সফল স্ফুর্তির মধ্যে, আত্মসংগঠনের নামে বিবেচনাহীন ঐতিহ্য পূজার নামে।

নবীন সেন স্বাজাত্যবােধের জন্য হেমচন্দ্রের মতই সমকালীন যুগে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাদের এই জনপ্রিয়তার মূল্যায়ন করে প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন, ‘হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের সমসাময়িক খ্যাতির কারণ নির্ণয় এখনকার পাঠকের পক্ষে দুষ্কর। তাহাদের মহাকাব্যগুলি ব্যর্থতার মরুভূমি। এখানে ওখানে যে দু চারিটি মরুদ্যান দেখা। যায় সে সব নিতান্তই লিরিক উচ্ছ্বাস। মধুসূদনের বলিবার কিছু ছিল, ইহাদের কিছু বক্তব্য ছিল না। মধুসূদনগঠিত নূতন কাব্যসংস্কার বা ট্র্যাডিশনটা মাত্র ছিল তাহাদের সম্বল। প্রাণহীন সেই সংস্কার তাহাদের পক্ষে বিড়ম্বনা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। মহাকাব্য না লিখিয়া হেমচন্দ্র যদি সমাজবিষয়ক ব্যঙ্গকাব্য ও ব্যঙ্গনাট্য রচনা করিতেন, নবীনচন্দ্র যদি মধুসূদনকে অনুসরণ করিয়া কাব্য না লিখিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করিয়া উপন্যাস লিখিতেন—হয়ত তাহাদের কীর্তি সময়ের বিচারে অধিক টেকসই হইত।’

মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩)

১৯শ শতকের প্রখ্যাত মহিলা কবি মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩) ছিলেন মহাকবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী। তার পৈত্রিক নিবাস মধুসূদন দত্তের মতই যশোরের কেশবপুরে সাগরদাঁড়ী গ্রামেই, ছিলেন মহাকবির কাকা রাধামোহন দত্তের পুত্র আনন্দ মোহন দত্তের কনিষ্ঠ কন্যা। শিশুকালে মানকুমারী বসুর বিদ্যাশিক্ষার সূচনা হয় পারিবারিক পরিবেশে পিতার নিকটে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি মহাভারত, রামায়ণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থগুলি আয়ত্ত করে ফেলেন। শৈশবকাল থেকেই লেখা-লেখির ব্যাপারে ছিল তার প্রবল আগ্রহ ও আকর্ষণ। এই অল্প বয়সেই তিনি গদ্য ও পদ্য রচনায় হাত দেন। সংগীতের প্রতিও ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। তিনি কীর্তনের আংশবিশেষ মুখস্থ করে নির্ভুলভাবে মধুর কণ্ঠে গাইতে পারতেন।

১৮৭৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বিধুবশঙ্কর বসুর সাথে মাত্র দশ বছর বয়সে তার বিবাহ হয়, শশুরবাড়ী কেশবপুর থানার বিদ্যানন্দকাটি গ্রামে। শ্বশুর রাসবিহারী বসু ছিলেন তৎকালীন বৃটিশ সরকারের একজন নামজাদা ডেপুটি ম্যজিষ্ট্রেট। ১৮৮০ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাদের একমাত্র কন্যা পিয়বালার জন্ম হয়। ১৮৮২ সালে বিধুবশঙ্কর কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এল. এম. এফ পাশ করে প্রথমে কলকাতায় পরে সাতক্ষীরায় ডাক্তারী শুরু করেন। ১৮৮২ সালে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মান কুমারী বসুর স্বামী বিধুবশঙ্কর বসু সাতক্ষীরায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। স্বামী মৃত্যু বেদনায় বিরহিনী মান কুমারী বসু স্বামীর মনোবাঞ্ছাকে স্মরণযোগ্য করে রাখার জন্যে এবং বিধবা নারীদের কর্তব্যকর্মে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে সাহিত্য সাধনায় পূর্ণোদ্যমে আত্ননিয়োগ করেন।

মানকুমারী বসুর বিবাহের পর স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কবি মান কুমারী বসুর কবিতা লেখার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কেবল মধুসূদন দত্তই কবিতা রচনা করেননি, করেছিলেন এই মানকুমারী বসুও। ১৮৭৭ সালে স্বামী বিবুধশঙ্কর বসু কলকাতায় অবস্থানকালে মান কুমারী বসু ‘পুরন্দরের প্রতি ইন্দুবালা’ নামক অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি কবিতা লিখে স্বামীকে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটির অংশবিশেষ :

দুরন্ত যবন সবে ভারত ভিতরে
পসিল আসিয়া, পুরন্দন মহাবলি
কেমনে সাজিল বনে, প্রিয়তমা তার
ইন্দুবালা কেমনে বা করিলা বিদায় ?
কৃপা করি কহ মোরে হে কল্পনা দেবী।
কেমনে বিদায় বীর হল প্রিয় কাছে।

পরবর্তীতে কবিতাটি ঈশ্বরগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মানকুমারী বসুর এটিই মুদ্রিতাকারে প্রথম প্রকাশিত কবিতা।

স্বামীর অকালমৃত্যুতে ভাবােচ্ছ্বাসপূর্ণ ‘প্রিয়প্রসঙ্গ’ ও ‘বনবাসিনী’ কাব্যগ্রন্থদুটি রচনা করেছিলেন, এর মধ্যে ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত প্রিয়প্রসঙ্গ কাব্যগ্রন্থটিই তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, বনবাসিনী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৮ সালে। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘কাব্যকুসুমাঞ্জলি’ (১৮৯৬), কনকাঞ্জলি’ প্রভৃতি। তিনি অভিমন্যুর কাহিনি নিয়ে ১৯০৪ সালে ‘বীরকুমারবধ’ নামে একটি কাহিনিকাব্য রচনা করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও তার প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘বিভূতি’ ও ‘শুভ সাধনা’, ১৯২৬ সালের ‘সোনার শাঁখা’ এবং ১৯৩৬ সালে ‘পুরাতন ছবি’। নিজের জীবনের বেদনাতুর দিকটির জন্য তার কাব্যে বেদনার সুর ফুটে উঠেছে। সমালােচকের ভাষায়, মানকুমারী বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলাে বেদনার কথা কইত এবং কান্নাভেজা প্রেমরসসিক্ত কবিতাগুলি তারই জীবনের দ্বারােন্মােচন করত। ছােটবেলা থেকে মানকুমারী বসুর কাব্যরচনার যে অভ্যাস ছিল, বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে তা সুগঠিত হয়েছিল। বিধবা হওয়ার প্রেক্ষিতে তার রচিত কবিতা নারীসুলভ অন্তরঙ্গতার সঙ্গে সহজ ভগবদ্ভক্তি ও শােকার্তির করুণায় মণ্ডিত হয়ে আছে। মানকুমারী বসুর কবিতায় হালকা কথার ভঙ্গি চমৎকার ফুটেছে :

শুনিলাম, এই মাসে
যাবে তুমি পতি-পাশে
করিতে গৃহিণীপনা—ধিক মূর্খতায়।
এত শীতে নারী কেবা
করে পতিপদ সেবা,
পৌষমাসে ঘরকন্না কে করিতে চায়?
শাস্ত্রের বচন, সতী।।
শীতকালে যার পতি
রাধেন বাড়েন নিজে প্রফুল্ল অন্তরে;
সেই ধন্যা নরকূলে,
লােকে তারে নাহি ভুলে,
চির সােহাগিনী জায়া শিবদুর্গা বরে।

ছােটগল্প রচনায়ও মানকুমারী বসু ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ছোটগল্পের জন্য তিনি পুরস্কারও পান, পরে এগুলোর কথা বলা হবে। চলমান জীবনের ছােটখাট ঘটনা, প্রেমপ্রীতি, হাসিকান্না, সুখ-দুঃখ তার গল্পের উপজীব্য। অন্তঃপুর শিক্ষার জন্য শিক্ষয়িত্রী, পল্লীগ্রামে স্ত্রীচিকিৎসক ও ধাত্রীর আবশ্যকতা বিষয়ে এবং সমাজের দুর্নীতি ও কুসংস্কার নিবারণের জন্যও তিনি কলম ধরেন। এই সব বিষয়ে যে সমস্ত প্রবন্ধ রচনা করেন কয়েকটি পাঠক সমাজে বিশেষ আদৃত ও পুরস্কৃতও হয়। তিনি ‘বামাবোধিনী’র লেখিকা শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। ১৮৯০ সালে তিনি ‘বাঙালি রমণীদের গৃহকর্ম’ ও ‘বিবাহিতা স্ত্রীলোকের কর্তব্য’ নামে দুটো গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।

মান কুমারী বসু তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ দুর্লভ সম্মান ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সমাজের বিভিন্ন সমস্যাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অন্তপুর শিক্ষার জন্য ‘শিক্ষায়িত্রী’, পল্লীগ্রামে স্ত্রী চিকিৎসক ও ধাত্রীর আবশ্যকতা বিষয়ে এবং সমাজের দুর্নীতি ও কুসংস্কার নিবারণের জন্য মূল্যবান কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে তিনি পুরস্কৃত হন। মান কুমারী বসুর গৌরবময় কৃতিত্বের সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ভারত সরকার ১৯১৯ সাল থেকে তাকে অমৃত্যু বৃত্তি প্রদান করেন। তিনি ‘রাজলক্ষ্মী’, ‘অদৃষ্টচক্র’, এবং ‘শোভা’ গল্পের জন্য হেমেন্দ্রমোহন বসু প্রবর্তিত ‘কুন্তলীন পুরস্কার ‘ লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ভুবনমোহনী সুবর্ণপদক’ এবং ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘জগত্তারিণী সুবর্ণপদক’ দানে সম্মানিত করে। মানকুমারী বসু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে চন্দননগরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ‘কাব্যসাহিত্য’ শাখার সভানেত্রী হয়েছিলেন।

বাংলা সাহিত্যের এই সুলেখিকা আজীবন সাহিত্য সাধনা করে আশি বৎসর বয়সে ১৯৪৩ সালের ২৬ ডিসেম্বরে কন্যা পিয়বালার খুলনাস্থ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন। খুলনার ভৈরব নদীর তীরে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মৃত্যুর পুর্বে মধুসূদনের সমাধিলিপির ভাব অবলম্বনে ‘অন্তিম’ শীর্ষক জীবনের শেষ কবিতাটি তিনি রচনা করেন। কবিতাটির অংশ বিশেষ –

যে কুলে জন্মিলে কবি শ্রী মধুসূদন
সে কুলে জন্ম মম বিধির আদেশ,
মাতা শান্তমনি পিতা আনন্দমোহন
বিধুব শঙ্কর বসু পতিদেব মম।
যদি প্রিয় বঙ্গবাসী ভালবাস মোরে
ক্ষণেক দাঁড়ায়ে দেখ তটিনীর তীরে,
স্নেহমতি মা জননী বসুমতি কোলে
বঙ্গের মহিলা কবি রয়েছে ঘুমায়ে।

তথ্যসূত্র

  • “যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক” – কাজী শওকত শাহী
  • “বাঙ্গলা সাহিত্যের কথা” – শ্রী সুকুমার সেন – সপ্তম সংস্করণ
  • “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস”, মাহবুবুল আলম রচিত
  • উইকিপিডিয়া

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) 

(মাহবুবুল আলম রচিত “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থ থেকে লেখাটি নেয়া হয়েছে)

বাংলা সাহিত্যে অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন। একান্ত আকস্মিকতা সহকারে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর সগৌরব আবির্ভাব এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর পক্ষে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভবপর হয়েছিল। নিষিদ্ধ সমাজ বিগর্হিত প্রেমানুভূতির বিশ্লেষণে শরৎচন্দ্র যে অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তিনি বাঙালিসুলভ সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি অতিক্রম করে আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় সংযোগসাধন করেছিলেন। সিদ্ধহস্ত জীবনরসিক হিসেবে তিনি বাঙালি জীবনের উপেক্ষিত বৈশিষ্ট্য চিত্রিত করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তাঁর প্রতিভার প্রধান শক্তি হল জীবনপ্রেম ও মানবিক অনুভূতি এবং মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা তাঁর উপন্যাসে সহজ সরল ভাবে রূপ লাভ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম।

বাল্যকাল থেকে তাঁর সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত হলেও রচনার প্রকাশ সে সময়ে হয় নি। তাঁর পূর্বপুরুষদের রক্তধারার মধ্যে বৈরাগ্যভার বর্তমান ছিল, তাঁর মধ্যেও সে সন্ন্যাসী মনোবৃত্তির পরিচয় লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর ফলে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি সন্ন্যাসীবেশে ভারতের বহুস্থান পর্যটন করেন। চাকরির উদ্দেশ্যে ১৯০৩ সালে শরৎচন্দ্র বার্মা বা বর্তমান মায়ানমার যান। সেখানে থাকাকালীন তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘মন্দির’ (১৯০৫) এক আত্মীয়ের নামে কুন্তলীন গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়। তাঁর দ্বিতীয় গল্প ‘বড়দিদি’ ভারতী নামক সে আমলের প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর কিছুকাল পর থেকে বাংলা সাহিত্যকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অজস্র দানে সমৃদ্ধ করতে থাকেন এবং অতি অল্পদিনের মধ্যে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সাধনাকেই জীবনের একমাত্র পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। লেখালেখি করার উদ্দেশ্যেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতার উপকণ্ঠে নির্মিত বাসস্থানে অকৃতদার জীবনযাপন করে কথাশিল্পী হিসেবে সৃষ্টিমুখর হয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : বড়দিদি(১৯১৩), বিরাজবৌ, (১৯১৪), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), পণ্ডিতমশাই (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫), পল্লীসমাজ (১৯১৬) চন্দ্রনাথ (১৯১৬), বৈকুণ্ঠের উইল(১৯১৬), অরক্ষণীয়া (১৯১৬), শ্রীকান্ত, (প্রথম পর্ব ১৯১৭, দ্বিতীয় পর্ব ১৯১৮, তৃতীয় পর্ব ১৯২৭, চতুর্থ পর্ব ১৯৩৩), দেবদাস (১৯১৭), নিষ্কৃতি (১৯১৭), কাশীনাথ (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), স্বামী (১৯১৮), দত্তা (১৯১৮), ছবি (১৯২০), গৃহদাহ (১৯২০), দেনাপাওনা (১৯২৩), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১), বিপ্রদাস (১৯৩৫) ইত্যাদি।

বাংলা উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চোখের বালি’ উপন্যাস, ‘নষ্টনীড়’ গল্প প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে সমাজচেতনার অভিনব রীতির যে পরিচয় দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তারই বিকাশ ঘটেছে। মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাসসৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় শরৎচন্দ্র তারই অনুসরণ করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ফুটিয়েছেন। বরং বলা যায়, উপন্যাসের ক্ষেত্রে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করে গতানুগতিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অভিনব পথের পথিকৃত হিসেবে শরৎচন্দ্রের বৈশিষ্ট্য রূপায়িত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্টিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাসের পথরেখা থেকে শরৎচন্দ্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ বর্তমানের সমস্যাজর্জর জীবনে অতীতের গৌরবকাহিনি কোন আবেদনের সৃষ্টি করতে পারে না বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসগুলোতে মানবমনকে সামাজিক আদর্শের অনুবর্তী করে রূপায়িত করেছেন; কারণ সেই বিশেষ আদর্শের প্রাণশক্তি ও কল্যাণময় প্রভাব সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস ছিল সুদৃঢ়। মানবমন থেকে অবৈধ প্রবৃত্তির দমন এবং বৃহত্তর কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন—হিন্দুধর্মের এই শ্রেষ্ঠ সাধনা বঙ্কিমচন্দ্রের বিপরীতধর্মী মতে আস্থাশীল। শরৎচন্দ্র যে নতুন সমাজনীতি অনুসরণ করেছিলেন। তাতে আত্মঘাতী পাপীর প্রতিও সহানুভূতি ছিল। তাঁর মতে পাপীর মধ্যেও যদি সদগুণ থাকে তবে তা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে, অবস্থাচক্রে যে অসতী তারও চরিত্রগৌরব ও সতীত্ব মর্যাদা স্বীকার করতে হবে। তিনি সমাজকে মনে করেছেন ব্যক্তি জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণের প্রেরণাদাতা হিসেবে। শরৎচন্দ্র এদেশের পরিবার জীবনে সাধারণ আবেগ ও বৃত্তি সম্বন্ধে এক আশ্চর্য সূক্ষ্ম সত্যানুভূতি উপলব্ধি করে তাঁর উপন্যাসে তা স্থান দিয়েছেন। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি যে বিচিত্র বৈশিষ্ট্য সহকারে প্রকাশ পেতে পারে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস তারই নিদর্শন।

রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাস শরৎচন্দ্রের ওপর যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল সে সম্বন্ধে সমালোচক মন্তব্য করেছেন, ‘যে সমস্ত নারী চরিত্রের সৃজনকর্তা হিসেবে শরৎচন্দ্রের উদ্দেশ্যে বাংলা সাহিত্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়ে থাকে তারা সকলেই হয় বিনোদিনীর ভগ্নাংশ, আর নয় বিনোদিনীর কাঠামোয় অন্য শরীরের রূপান্তর।

শরৎচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মৌলসত্তাকে আলোকিত করার জন্য নিষিদ্ধ প্রেমের চিত্র অঙ্কন করেছেন। মনে রাখা দরকার, ব্যক্তিমানসের দ্বিধাদীর্ণতাই উপন্যাসে নিষিদ্ধ প্রেমকে উপলব্ধি করার প্রধান সূত্র। প্রেমের নিবিড়তা দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে নিষিদ্ধ প্রেম আসে না। বিভিন্ন সম্পর্ক, সমস্যা, পরিবেশের চাপে ব্যক্তিমানসের যে স্বরূপ প্রকাশ পায় নিষিদ্ধ প্রেম তা পরিস্ফুটনে সহায়ক। তাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়টিকে তাঁর উপন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছেন।

প্রেমের বিচিত্র রহস্য উদ্ঘাটনে শরৎচন্দ্র যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বাঙালি জীবনের সঙ্কীর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেমের সাধারণ বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটন করা যে ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত ছিল, শরৎচন্দ্রের হাতে তা প্রকাশের অপূর্ব সুযোগ লাভ করে। তাই তাঁর উপন্যাসের প্রেমকাহিনিগুলোর মধ্যে সম্পূর্ণ রূপে স্বাভাবিকতা বর্তমান। বাঙালি সমাজের একটি অবহেলিত দিক–নারীজাতির দুঃখ দুর্দশা শরৎচন্দ্রের মনে প্রবল বেদনাবোধের সৃষ্টি করেছিল। এর ফলেই তাঁর উপন্যাসে নারীজীবনের বিবিধ বৈশিষ্ট্য পরম সার্থকতা সহকারে রূপায়িত হয়েছে। নারীহৃদয়ের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় প্রেমের ক্ষেত্রে। ভালবাসার আকর্ষণ প্রবলতর, প্রত্যাখ্যান দুর্বার—উভয়ের প্রবল দ্বন্দ্ব নারীহৃদয়ে গভীরতর ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করে। ‘দেবদাস’ উপন্যাসের পার্বতী, ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের ষোড়শী, ‘বড়দিদি’র মাধবী—প্রভৃতি নারী চরিত্রের হৃদয়ের প্রবৃত্তির সঙ্গে সমাজ ও প্রচলিত সংস্কারের দ্বন্দ্বই প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। কেবল দেহধর্মর্গত নীতিবোধ মেনে চললেই চরিত্রবান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়, শরৎচন্দ্র একথা মোটেই বিশ্বাস করতেন না। তাই তাঁর মতানুসারে দেহধর্মকে কেন্দ্র করে নীতিবোধের প্রাধান্য লাভকেই সতীত্বের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করা চলে না। তাঁর দৃষ্টিতে প্রেম সতীত্বের চেয়েও মহত্তর। শরৎচন্দ্রের কয়েকটি উপন্যাসে এই মতবাদের সমর্থন মিলে। এ ধরনের বাস্তবপ্রিয়তা, গভীর সমাজ সচেতনতা এবং ব্যাপক মনস্তত্ত্বজ্ঞান ভিত্তি করে গড়ে ওঠার জন্য তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো জীবন্ত বলে প্রতীয়মান হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্রগুলো বাঙালির চিরপরিচিত পরিবেশ থেকে সংগৃহীত বলে তা পাঠকের কাছে একান্ত আপনজন হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালি জনজীবনের নিস্তরঙ্গ অঙ্গনে কত বিপুল রহস্য যে লুকিয়ে ছিল শরৎচন্দ্র তাঁর চরিত্রচিত্রণে উপভোগ্য রূপে উপস্থাপন করেছেন।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর মধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করেছে ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’ ও ‘গৃহদাহ’ উপন্যাস তিনটি। এই উপন্যাস কয়টিতে শরৎচন্দ্র এমন এক প্রকার প্রেমের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছেন যাকে সমাজবিগর্হিত বা সমাজ অননুমোদিত বলা চলে। অবশ্য এদেশের সমাজের দৃষ্টিতে তা সমর্থনযোগ্য না হলেও মানবমানবীর হৃদয়ের প্রবৃত্তি হিসেবে তাকে নিষিদ্ধ বলা চলে কিনা তা-ই শরৎচন্দ্র এই পর্যায়ে ব্যক্ত করেছেন। মানুষের মনোবৃত্তি সকল সময়ে সমাজের বিধিনিষেধ মেনে চলে না—মানুষের বিচিত্র মন নিজস্ব পথরেখা ধরে অগ্রসর হয়ে থাকে। ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে সতীশ-সাবিত্রীর প্রেমলীলা প্রাধান্য লাভ করলেও, উপেন্দ্র-দিবাকর-কিরণময়ী প্রভৃতি চরিত্রের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও প্রকাশমান। এদের চরিত্রের মাধ্যমে সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমের চিত্রাঙ্কন করে কী অবস্থায় তা সংঘটিত হয়েছে তা নিপুণ ভাবে বিবৃত করেছেন এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পাঠকের স্বাধীন বিচারের সুযোগ দিয়েছেন। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘চরিত্রহীন বঙ্গ-উপন্যাস-সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ—ইহার পাতায় পাতায় জীবনসমস্যার যে আলোচনা, যে গভীর অভিজ্ঞতা, যে স্নিগ্ধ উদার সহানুভূতি ছড়ান রহিয়াছে, তাহা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক বিচারবুদ্ধির একটা চিরন্তন পরিবর্তন সাধন করে।

‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের মধ্যেও এমনি এক সমাজবহির্ভূত প্রেমের চিত্র চমৎকার ভাবে অঙ্কিত হয়েছে। নিজের স্বামী মহিম এবং স্বামীর বন্ধু সুরেশের প্রতি নায়িকা অচলার যে দোলাচল মনোবৃত্তি তাই এই উপন্যাসটির আলোচ্য বিষয়। অচলা স্বামীকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু সুরেশকেও দূরে ঠেলে দেওয়া তার পক্ষে মোটেই সম্ভব হয় নি। স্বামীগৃহ ত্যাগ করে সে সুরেশের সঙ্গে চলে গিয়ে গতানুগতিক সামাজিক আদর্শে চরম আঘাত হানে। দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটার মত স্ত্রীর মন অবিচলিত নিষ্ঠার সঙ্গে স্বামীর দিকেই যে ফিরে থাকতে পারে না, বাস্তব জীবনের অবস্থা বিশেষে অন্যের প্রতি মন যেমন আকৃষ্ট হতে পারে—তাই এ উপন্যাসে আলোচিত হয়েছে। শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের মধ্যেও একই বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ ঘটেছে। রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে শ্রীকান্তের যে প্রেমের সম্পর্ক তা সব সময় সামাজিক আদর্শের অনুসারী ছিল না। অসংখ্য কাহিনি ও চরিত্র এতে সন্নিবেশিত হয়েছে বলে উপন্যাসের নিবিড় ঐক্য এতে নেই। কিন্তু দৃশ্যাবলীর অসাধারণ বৈচিত্র্যে তা অনবদ্য। উপন্যাসটি লেখকের আত্মকাহিনির মত। শরৎচন্দ্রের জীবনদর্শন উপরোক্ত উপন্যাস তিনটির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের প্রেমের চিত্র সহানুভূতি সহকারে অঙ্কন করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র সমসাময়িক উপন্যাসের ক্ষেত্রে যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন তারই সাক্ষ্য বহন করছে এই সব উপন্যাস।

শরৎচন্দ্রের কতগুলো উপন্যাসে প্রেমবর্জিত পারিবারিক বিরোধের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পরিবারের অন্তর্গত কতিপয় মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধের কৌতুকপূর্ণ কাহিনি এগুলোর উপজীব্য। প্রেমবর্জিত এসব কাহিনিতে প্রধানত ভ্রাতৃবিরোধ ও মাতৃস্নেহ স্থান পেয়েছে। ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’, ‘মেজদিদি’, ‘মামলার ফল’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘একাদশী বৈরাগী’ প্রভৃতি গ্রন্থ এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

পরিবারভিত্তিক কতগুলো উপন্যাসে নরনারীর স্বাভাবিক প্রেমের চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। সম্পূর্ণ সাধারণ সামাজিক বিধিনিষেধের অনুবর্তী এই সব প্রেম শরৎচন্দ্রের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক নয়। ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’, ‘কাশীনাথ’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘স্বামী’, ‘পরিণীতা’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘শুভদা’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘দেনাপাওনা’ প্রভৃতি এই পর্যায়ভুক্ত। সাধারণ অবস্থায় মানবমনে প্রেমের বিচিত্র লীলাখেলার প্রকাশই এই উপন্যাসগুলোকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

সমাজ-সমালোচনামূলক উপন্যাস হিসেবে ‘অরক্ষণীয়া’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘পল্লী সমাজ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সমাজে অনুষ্ঠিত অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে এসব উপন্যাসে। সমাজের নিষ্ঠুরতার জন্য স্বাভাবিক প্রেমের বিকাশ ব্যাহত হওয়ার চিত্রও এগুলোতে দেখা যায়। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি রাজনৈতিক পটভূমিকায় রচিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম চাঞ্চল্যকর উপন্যাস।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ‘বস্তুতপক্ষে যখন বাংলা উপন্যাস পাঠক সমাজ পরিমাণে বিস্তৃত হয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রবল জিজ্ঞাসা সে বিস্তৃত পাঠকমণ্ডলীর অ্যাভারেজ অংশকে স্পর্শ করতে পারছে না, অথচ তখনও তিরিশের যুগে রবীন্দ্রনাথেরই উত্তরাধিকারকে নানাভাবে গ্রহণ করে বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের বিস্তার ও গভীরতার সূচনা হয় নি এই রকম ধরনের অবস্থায়, দুই অঙ্কের মাঝখানে বিরতির সময়টুকুতে শরৎচন্দ্র বাঙালি পাঠকমণ্ডলীকে অধিকার করেছিলেন। মানুষের সম্বন্ধে গভীর ভালবাসার বোধ শরৎচন্দ্রের নৈতিক সম্পদ বলে, কোন জীবনদর্শন ব্যতিরেকেই, কোন গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় না দিয়েও শরৎচন্দ্র পাঠকের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হন নি। এ ভালবাসা কতকাংশে শিল্পমূল্যের প্রতিদান কতকাংশে শরৎচন্দ্রের করুণাময় মনের মূল্যশোধ।”

বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় রচিত বলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। বাঙালি জীবনের সুখদুঃখ আনন্দ ব্যথাবেদনা এই সমস্ত উপন্যাসে চিত্রিত হয়ে বাঙালির মনের ভাবধারাকে সার্থকতা সহকারে প্রকাশ করেছে। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের উপেক্ষিত মানুষের জীবন্ত ছবি অঙ্কনে শরৎচন্দ্র দরদী শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছেন। চিরাচরিত আদর্শের মাপকাঠিতে মানবমনের ভাবধারার বিচার না করে যে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তিনি দিয়েছেন তা একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল, তেমনি মানুষের নবমূল্যায়নের দিক থেকে তা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

শরৎচন্দ্র ছিলেন সিদ্ধহস্ত জীবনরসিক। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিরাজমান। ছোট ছোট পটে ব্যক্তিচরিত্রের অসামান্যতা পরিস্ফুটনে শরৎচন্দ্রের অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। জীবনপ্রেম ও মানবিক অনুভূতি এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে। মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসাকে প্রধান উপাদান হিসেবে রূপায়িত করে শরৎচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে গৃহ ও সমাজের মধ্যে স্থাপন করেছেন। তাঁর অপরিসীম জনপ্রিয়তার পিছনে এই বৈশিষ্ট্য কাজ করেছে।

প্রাঞ্জলতা, সহজবোধ্যতা ও মাধুর্য শরৎচন্দ্রের ভাষার বৈশিষ্ট্য। গল্পরস সৃষ্টি করার একটা অপূর্ব দক্ষতা তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। রচনারীতির দিক থেকে শরৎচন্দ্রের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তাঁর স্বকীয়তা সহজে স্বীকার্য। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহজ সরল, কিন্তু আকর্ষণীয় ভাষায় তাঁর কাহিনি পরিবেশন করেছেন। রসের প্রাচুর্য থাকলে সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি যে কত আকর্ষণীয় হতে পারে তা তাঁর সমুদয় রচনায় সহজলভ্য। শরৎচন্দ্র কিছু সংখ্যক ছোটগল্পও রচনা করেছিলেন। তবে এদের অধিকাংশই উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। ‘মহেশ’ নামক ছোটগল্পটির মধ্যে তিনি যথেষ্ট সার্থকতার পরিচয় দান করেছেন।

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ – ১৯৫৪)

(লেখাটি ব্যাঙ্কার ও প্রাবন্ধিক ফারুক মঈনউদ্দীন কর্তৃক রচিত, বণিকবার্তা প্রকাশনীর “কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা” গ্রন্থে প্রকাশিত)

বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা প্রধানতম কবি জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার বয়স ৫৫ বছর। তার এই নাতিদীর্ঘ জীবনের শেষ বছরটি ছাড়া একটা ভদ্ৰোজনােচিত কর্মসংস্থানের জন্য তিনি তার শিক্ষা-পরবর্তী জীবনের বিশাল একটা অংশ পার করেছেন বেকারত্বে এবং দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। জীবদ্দশায় তার কাব্য প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হয়নি, যতটুকু মূল্যায়ন হয়েছে বুদ্ধদেব বসু প্রমুখদের দ্বারা, তার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছে বিরূপ সমালােচনা ও তাচ্ছিল্য। এই সঠিক মূল্যায়নের কিছুটা আস্বাদ তিনি লাভ করতে শুরু করেছিলেন মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে থেকে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নিয়তি তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, তিনি পেয়েছিলেন একটা ভদ্রোচিত জীবিকার সন্ধান, পাঠক ও সম্পাদক মহলে পেয়েছিলেন সমাদর ও স্বীকৃতি। নিভৃতচারী এবং নির্জনতম এই কবির যে বিপুল অপ্রকাশিত রচনা তার মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত হয়, তাতে তার প্রচারবিমুখতা প্রমাণ হয় বটে, কিন্তু তাকে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের অবকাশও পাওয়া যায় তার রচনার সমগ্রতা থেকে।

জীবনানন্দ মানসিক গঠনে মুখচোরা ও লাজুক স্বভাবের হলেও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে – তার মা কুসুমকুমারী দাশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব সামান্য সামান্য হলেও তিনি ছিলেন কবি। তার পিতা সত্যানন্দ দাশ কবি না হলেও ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও ধর্মযাজক (ব্রাহ্ম)। জীবনানন্দ তার পিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘প্রায় শেষ রাতে বিশেষত হেমন্ত ও শীতকালে উপনিষদের শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে তিনি আমাদের অপরূপ সূর্যচেতনার প্রভাতে নিয়ে আসতেন।’ মা-বাবার এ গুণের যুগলবন্ধনে জীবনানন্দের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল। তাদের পরিবারেও ছিল সাহিত্যচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। ফলে জীবনানন্দ খুব অল্প বয়স থেকেই লেখা শুরু করেছিলেন। সেসব অপক্ব কবিতা কখনই পাওয়া যায়নি। তবে ছােট ভাই অশােকানন্দ স্মৃতি থেকে তার কিশাের অগ্রজের কাব্যপ্রয়াসের প্রমাণ দিয়েছেন একটা কবিতার দুটো লাইন উদ্ধৃত করে : 

এল বুঝি বৃষ্টি এল
পায়রাগুলাে উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলােমেলাে।

কিশোর জীবনানন্দের বাগান করার শখও ছিল প্রবল। এখনকার সময়ের মত বরিশালে এত নার্সারি ছিল না হয়তাে। তাই তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে ফুলের বীজ বা চারা জোগাড় করে আনতেন। কখনাে কাউকে দিয়ে কলকাতা থেকেও বীজ আনাতেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময় তিনি যে কবিতা চর্চা করেছিলেন, সেটি কলেজে গিয়েও অব্যাহত রেখেছিলেন। সে সময় ইংরেজিতেও কবিতা লিখতেন তিনি। একই সঙ্গে কিছু গানও রচনা করেছিলেন। জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গােপালচন্দ্র রায়ের তথ্যসূত্রে জানা যায়, স্কুলের উপরের ক্লাসে থাকতেই ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন তিনি, তবে সেগুলাের সবই পেনসিল স্কেচ। এ প্রসঙ্গে তার ছােট বােন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, তার ছবি আঁকার নেশা ছিল, আলতাে পেনসিলের মৃদু চঞ্চলতার অস্ফুট আলােছায়াময় কতই না ছবি ফুটে উঠত। তার সেই সময়ের কবিতা, গান বা চিত্রকর্ম কিছুই পরবর্তী সময়ে আর পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে, ছাপার অক্ষরে তার প্রথম কবিতা ছিল ‘বর্ষ-আবাহন’, এটি ছাপা হয়েছিল বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজ থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ব্রহ্মবাদীর ১৩২৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায়। মজার বিষয়, কবিতাটি জীবনানন্দের নামে ছাপা হয়নি, রচয়িতার নামের জায়গায় কেবল ছিল ‘শ্ৰী…’। বছর শেষে সারা বছরের লেখকদের যে সূচি ছাপা হয়, তাতেই দেখা যায় কবিতাটির রচয়িতা ছিলেন ‘শ্রী জীবনানন্দ দাশ বিএ’।

জীবনানন্দের প্রকাশিত প্রথম কাব্যপ্রয়াসে ছদ্মনামের ব্যবহার আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দেয় তার লাজুক স্বভাবের কথা, কিংবা হতে পারে কবিতাটি নিয়ে তার সংশয় ছিল। এমনাে হতে পারে কবিতাটি কারাে অনুরােধ বা নির্দেশে লিখেছিলেন বলে তিনি নিজের নামটা গােপন রাখতে চেয়েছিলেন। এসব ধারণার সঙ্গে গােপালচন্দ্র রায়ের অভিমত, যেহেতু ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মদের পত্রিকা এবং জীবনানন্দ নিজে ব্রাহ্ম হলেও ব্রাহ্মদের আম অনুষ্ঠান, এমনকি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই এড়িয়ে চলতে ভালবাসতেন, সেই জন্যই হয়ত ঐ পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে চাননি।

জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতাটিতে নিজেকে অপ্রকাশ্য রাখার আমরা দেখলাম, সেটি কেবল বিভিন্নজনের ভাষ্য অনুযায়ী তার অমিশুক নিভৃতচারী স্বভাবের সঙ্গেই সমিল নয়, মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত তার বিপুল অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার লােকচক্ষুর আড়ালে রেখে দেয়ার বিষয়টিকেও তার সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়। তার গােপনে সংরক্ষিত লেখাগুলো নিয়ে কি তবে তার সংশয় ছিল কিংবা ছিল কি কোনাে অতৃপ্তি? তা না হলে তার জীবদ্দশায় সেসব প্রকাশের কোনাে ব্যবস্থা কিংবা কোনো তাগিদ তাগিদ অনুভব করেননি কেন তিনি? এসব প্রশ্নের জবাব আর কখনই পাওয়া যাবে না। 

আমরা জানি, জীবনানন্দ ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাস করেছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। এ ফলাফল নিশ্চয়ই তার কাম্য ছিল না। তবে এ উপলক্ষে সর্বানন্দ দাশের দৌহিত্র ও দৌহিত্রীরা বিএ, বিএসসি ও এমএ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে সর্বানন্দ ভবনে এক বিশেষ ব্রাহ্ম অনােনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছিল। তিনি যখন এমএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন অসুখে পড়েন, সে কারণে তার প্রস্তুতি ভালাে ছিল না। জীবনানন্দ চেয়েছিলেন সে বছর পরীক্ষাটা না দিয়ে পরের বছর আরাে ভালাে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসতে, যাতে প্রথম শ্রেণী নিশ্চিত হয়। কিন্তু তার বাবা ছেলের একটি বছর সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না, তাই ছেলেকে তিনি উপদেশ দেন, যাতে সে বছরই পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলেন। ভালাে প্রস্তুতি না থাকায় এমএ-তেও জীবনানন্দ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করেন। জীবনানন্দের চরিত্রের এদিকটি লক্ষণীয়, কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক শিক্ষাজীবনের শেষে এসেও পিতার উপদেশ শিরােধার্য করে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বদলে দিচ্ছে। পিতার উপদেশ মেনে নিতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল থেকে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে তার খেদ ছিল কিনা। আমরা জানি না, কিন্তু একটি প্রথম শ্রেণী না থাকায় তিনি কোথাও শিক্ষকতার চাকরি জোটাতে পারছিলেন না। একাধিকবার কলেজ ও সংবাদপত্রের (স্বরাজ) চাকরি থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়ছিল না। সেই দুর্বিষহ বেকার জীবনে তাকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যেকোনাে ধরনের কাজ করতে হয়েছে, এমনকি ইস্যুরেন্সের দালালির মতাে চরম অসম্মানজনক কাজও করেছিলেন তিনি। সেই বেকারত্ব, প্রথম শ্রেণী না পাওয়ার আক্ষেপ এবং অর্থকষ্ট তাকে তাড়া করে ফিরেছে আমৃত্যু। তার সে সময়কার হীনম্মন্যতা ও মানসিক অবস্থার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় অশােক মিত্রের লেখায়, “জীবনানন্দের সঙ্গেও কলকাতায় এলে নিয়মিত দেখা হতাে, তিনি ক্রমশ উদভ্রান্ত, ক্রমশ আত্মবিশ্বাসরহিত। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন… অথচ তিনি নিজে একটি ভদ্রগােছের অধ্যাপনার কাজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারছেন না। পরিচিত একে-তাকে ধরেও কোনাে ফল হচ্ছে না, আমরা যারা তার ভক্ত শুভানুধ্যায়ী, তারাও কিছু করে উঠতে পারছি না। একদিন, বর্ষার সন্ধ্যা, রাসবিহারী এভিনিউর প্রায় মােড়ে, ল্যান্সডাইন রােডের গলিতে তার একতলার ফ্ল্যাটের বহির্দুয়ার দিয়ে ঢুকেছি, হঠাৎ আমাকে টেনে এক কোণে, নিচু নিমগাছের ডালের আড়ালে নিয়ে গেলেন, কানে-কানে তার অস্ফুট প্রশ্ন : ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, বুদ্ধদেব বাবুর নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড আছে?’ ( আপিলা চাপিলা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা)।

একজন ইংরেজির অধ্যাপনা চাকরিপ্রার্থী প্রথম শ্রেণীবঞ্চিত মানুষের এই যন্ত্রণা, হতাশা ও আক্ষেপ প্রতিফলিত হয়েছে জীবনানন্দের ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসে। উল্লেখ্য, ‘মাল্যবান’ কিংবা ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসদ্বয় জীবনানন্দের আত্মজীবনীমূলক বলে সহজে চিহ্নিত করা যায়, ‘সুতীর্থ’কে শুরুতে তেমনটি মনে হলেও পরে সেই ধারণা আর থাকে না। তবে উপন্যাসটির শুরুতে পেশাগত জীবনের চাপে এবং সময়ের অভাবে এই কবি যে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, সে ইঙ্গিত আছে। এমনকি তার নিকটতম দোসর দারিদ্র্যই যে কবিতা লেখা ছেড়ে দেয়ার মূল কারণ, সে কথাও আছে এভাবে, “… নিজে অনেক দিন থেকে কিছু লিখছে না বটে কিন্তু সেটা অক্ষমতার জন্যে নয়, অবসরের অভাবে। অর্থের সচ্ছলতা নেই। এই নিরেট পৃথিবীতে টাকা রােজগার করতে গিয়ে মূর্খ ও বেকুবদের সঙ্গে দিন-রাত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মনের শান্তিসমতা যায় নষ্ট হয়ে।”

আমরা জীবনানন্দের জীবনসমগ্র যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই, কৈশােরে কবিতা লেখা, ফুলের বাগান করা, ছবি আঁকার চেষ্টা করা, তারুণ্যে ও যৌবনে কবিতার চর্চা করা একজন মানুষ কেবল পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে হীনম্মন্য হয়ে যাচ্ছেন তা নয়। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া বিভিন্নজনের ভাষ্যে জানা যায়, তিনি ছিলেন কিছুটা খাপছাড়া, যথেষ্ট মুখচোরা এবং সর্বার্থে আত্মসম্মানবােধসম্পন্ন একজন মানুষ। তার খাপছাড়া চরিত্রের আভাস মেলে সর্বশেষ কর্মস্থল হাওড়া গার্লস কলেজ থেকে আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। তার আগের কর্মস্থল থেকে নানা ছুঁতােয় অনুপস্থিত থাকার বহু কারণ ছিল, কিন্তু বহুদিন বেকার থাকার পর তার পছন্দসই একটা চাকরি জোটার পরও তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনাে ধরনের আনুষ্ঠানিক কিংবা মৌখিক অনুমােদন না নিয়ে হাওড়া থেকে দিল্লির মতাে দূরত্বে চলে যাওয়ার ঘটনায় প্রমাণ হয় যে, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে বাস্তবরহিত খাপছাড়া এক কবি। এমনকি জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গােপালচন্দ্র রায়ের মতে, হাওড়া গার্লস কলেজের চাকরির জন্য তিনি প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতেও অনিচ্ছুক ছিলেন এবং দেখা করেনওনি। পরে জীবনানন্দ প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি তাকে শুধু একটা দরখাস্ত পূরণ করতে বলে জানিয়ে দেন যে তাকে নিয়ােগ দেয়া হবে। তার কবিখ্যাতির কারণেই বােধকরি খুব দ্রুত চার-পাঁচজনকে ডিঙিয়ে বিভাগীয় প্রধান করে দেয়া হয় তাকে। ভাইস প্রিন্সিপাল করার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছিল একসময়। গােপালচন্দ্র জানান, এ প্রস্তাবে জীবনানন্দ রাজি না হয়ে বরং বলেছিলেন, ‘আর না, বেশ আছি’।

জীবনানন্দের আত্মসম্মানবােধ কেমন প্রখর ছিল, সে প্রসঙ্গে গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, জীবনানন্দ যখন বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যাপক, তখন সেখানে এসডিও হয়ে এসেছিলেন অবনীমােহন কুশারী। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের কবিতার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। অবনীমােহন একবার তার দাপ্তরিক কাজে কয়েক দিনের জন্য সরকারি বোটে যাত্রা করেছিলেন বিভিন্ন এলাকা সফরে, সঙ্গে নিয়েছিলেন জীবনানন্দ এবং তার সহকর্মী হেরম্ব চক্রবর্তীকে। সেই ভ্রমণের সুবাদে কবি উপভোগ করেছিলেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিন্তু অবনীমোহন যতই তার কবিতার অনুরাগী হন না কেন, তাদের যাত্রাবিরতির সময় স্থানীয় মানুষ স্বভাবতই এসডিওর মতো একজন উচ্চপদস্থ রাজপুরুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার ঘনিষ্ঠ হতে চাইবেন, সে সময় এসডিওর সঙ্গে থাকা মানুষদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র দেখায়। এ বিষয়ে হেরম্ব চক্রবর্তীর মনােভাব জানা না গেলেও জীবনানন্দ অবনীমােহনের তুলনায় তার খাটো অবস্থানটা মেনে নিতে পারেননি, তাই পুরাে সফরসূচি শেষ না করে ফিরতি লঞ্চে বরিশাল ফিরে এসেছিলেন তিনি।

বুদ্ধদেব বসু তার সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র।’ বুদ্ধদেব বসুর এ কথায় জীবনানন্দ একদিন তার সহকর্মী অধ্যাপক নিরঞ্জন চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘নির্জন কবি, নির্জন কবি বলে বুদ্ধদেব বসু আমার সম্বন্ধে একটা লিজেন্ড খাড়া করেছেন, যেটা আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।’ অথচ জীবনানন্দের সঙ্গে মিশেছেন এমন অনেকের ভাষ্যে জানা যায়, তিনি কোনাে অর্থেই সামাজিক ও মিশুক প্রকৃতির ছিলেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, সে যেন এই সংগ্রাম-সংকুল সংসারের জন্য নয়, সে সংসারপলাতক। …যেখানে অনাহূত ধ্বনি ও অলিখিত রং জীবনানন্দের আড্ডা সেইখানে (কল্লোল যুগ)।’ এ মন্তব্যের সূত্র ধরেই হয়তাে জীবনানন্দের ছােট বােন সুচরিতা দাশ তার মৃত্যুর পর লিখেছিলেন, ‘দাদার সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত। তিনি জীবন থেকে পালিয়েছেন। তিনি মানুষের সখ্য সহ্য করতে পারেন না। তিনি নির্জন, তিনি নিরিবিলি। সব কোলাহল থেকে দূরে। এসব বাক্য গঠনের সত্য-সত্যতা কতটুকু তা আমার বিবেচ্য নয়, যদিও এসবের অনেকগুলােই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে হয়ত এতদিন।’

সবার কাছ দূরে থাকার মনােভাবটি জীবনানন্দ পােষণ করতেন আত্মসম্মানবােধ থেকে, তার ধারণা ছিল অনেকের সঙ্গে মিশতে গেলে আত্মসম্মানের বিষয়টি কোনাে কোনাে সময় উপেক্ষা করতে হয়, এটি তিনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার থেকে স্বতন্ত্র, একাকী ও নিভৃতচারী। তার এই স্বভাব তাকে কী দিয়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু বাংলা কবিতাকে দিয়েছিল নতুন মাত্রার সন্ধান। তাই তিনি লিখতে পারেন, ‘প্রকৃতির আবিল কিছু, তবু মানুষের প্রয়ােজন মতাে তাতে নির্মলতা আছে।’

মনোজ বসু (১৯০১ – ১৯৮৭)

মনোজ বসু ( ২৫ জুলাই ১৯০১ — ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭ ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক। মনোজ বসু (১৯০১-৮৭) প্রচুর লিখেছেন। তাঁর গল্পের বই ‘বনমর্মর’, ‘নরবাঁধ’, ‘দেবী কিশোরী’, ‘পৃথিবী কাদের’, ‘একদা নিশীথ কালে’, ‘দুঃখ নিশার শেষে’, ‘উলু’, ‘খদ্যোত’, ‘কাঁচের আকাশ’, ‘দিল্লি অনেকদূর’, ‘কুসুম’, ‘কিংশুক’, ‘মায়াকান্না’, ‘গল্পপঞ্চাশৎ’, ‘কনকলতা’, ‘ওনারা’ ইত্যাদি। সমালোচকের মতে, রোমান্সপ্রিয় লেখক তিনি, কিন্তু তার রোমান্সে মিশিয়ে আছে গ্রামবাংলার একেবারে মাটি মাখানো আকৃতি; বিদেশী ফেস-পাউডারের গন্ধ জড়ানো অন্য জগতের রোমান্স। এই তার সাফল্যের চাবিকাঠি। এইখানেই তাঁর সিদ্ধি, প্রাকৃতিক পরিবেশ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। বারবার, বারবার মানবিক জগতে ফিরে আসতে, যে মানুষ মাটির মানুষ, মনোজ বসু তাদেরই কাছাকাছি লেখক। মনোজ বসুর গল্পশিল্প কালের নিরিখে কল্লোল যুগের তটবর্তী। বয়ঃসন্ধিমথিত স্বভাবকিশোর মনের আহত-স্বপ্ন অস্ফুট কান্না, ভারহীন জীবন-মমতাবোধের এক স্বভাবকরুণ যাদুস্পর্শই মনোজ বসুর গল্পরসের উৎসমূল।

মনোজ বসুর জন্ম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জুলাই বৃটিশ ভারতের বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার কেশবপুর থানার ডোঙ্গাঘাট গ্রামের এক মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে। তবে পরিবারটির বংশগৌরব ও খ্যাতি ছিল ।তার পিতার নাম রামলাল বসু। মাত্র আট বৎসর বয়সে যখন তিনি পিতৃহীন হন, তখন তিনি পাঠশালার গণ্ডি পার হননি। প্রথমে নিজ গ্রামে পরে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর খুলনার বাগেরহাট কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময়ই তিনি বিপ্লবী দল যুগান্তরের সংস্পর্শে আসেন ও স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আই.এ. পাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সাউথ সুবারবন কলেজ, বর্তমানের আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। পরবর্তীতে, আইন পড়া শুরু করলেও আর্থিক কারণে তা শেষ করতে পারেননি।

কলকাতার ভবানীপুরে সাউথ সুবারবন স্কুলে শিক্ষকতা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন এবং দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক রচনায় মনোনিবেশ করেন। প্রকাশনার জন্য পরবর্তীতে নিজের প্রকাশনা সংস্থা “বেঙ্গল পাবলিশার্স” প্রতিষ্ঠা করেন। শেষে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শিক্ষকতা পেশা পরিত্যাগ করেন।

সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই ছিল। সাত বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় সহপাঠীদের নিয়ে হাতে লিখে দেওয়াল পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখা প্রথম গল্প ছিল “গৃহহারা”। তার গল্পের সংকলন ‘বনমর্মর’ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। নিজে যখন নিয়মিত কবিতা গল্প লেখালেখা শুরু করেন, সেই সাথে অন্যান্য প্রকাশনার কাজও করে গেছেন। গুরুসদয় দত্ত রচিত ব্রতচারীদের জন্য অপরিহার্য সঙ্গী -‘ব্রতচারী সখা’ র (১৯৩৩) প্রকাশনা করেন মনোজ বসু। এছাড়াও, গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলার শক্তি'(১৯৩৬) মাসিক পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন তিনি। প্রকাশনা ও সম্পাদনা কাজের পাশাপাশি তিনি নিজে উপন্যাস রচনা শুরু করেন। তার প্রতিটি উপন্যাসে দেশ, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের মানুষের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি সমস্যা, বাংলার নিসর্গ চিত্র, গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে তার লেখায়। সেসময়ের সশস্ত্র বিপ্লবীদের ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ “ভুলি নাই”। মূলতঃ,মানুষের জীবনকথা আর তাদের জগৎ নিয়ে বিভিন্ন পটভূমিতে তার অভিজ্ঞতা পরিস্ফুট হয়েছে অসংখ্য কবিতায়, গল্পে , উপন্যাসে, নাটকে আর ভ্রমণকাহিনীতে। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি হিন্দী, ইংরেজি,গুজরাটি,মারাঠা,মালয়ালম ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণও হয়েছে। মনোজ বসু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি মণ্ডলীর অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। ভারতের বহু সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংস্থার পৌরহিত্য করেছেন ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে বহুবার বিদেশ ভ্রমণও করেছেন। মনোজ বসু ছিলেন একজন প্রথম শ্রেনীর ছোটগল্পকার।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত গ্রন্থ – ‘ভুলি নাই’ (১৯৪২), ‘সৈনিক’ (১৯৪৬), ‘আগস্ট ১৯৪২’, ‘বাঁশের কেল্লা’। গল্পগ্রন্থ- ‘বনমর্মর’ (১৯৩২), ‘নরবাঁধ’ (১৯৩৩), ‘দেবী কিশোরী'( ১৯৩৪), ‘পৃথিবী কাদের’ (১৯৪০), ‘কাঁচের আকাশ’, ‘খদ্যোত’, ‘দিল্লি অনেক দূর’, ‘দুঃখ-নিশার শেষে’, ‘উলু’, ‘কুঙ্কুম’। জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রতিফলিত উপন্যাস ও অন্যান্য গ্রন্থ- ‘আমি সম্রাট’, ‘সেই গ্রাম সেইসব মানুষ’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘এক বিহঙ্গী’, ‘কিংশুক’, ‘মায়াকন্যা’, ‘একদা নিশীথকালে’ (১৯৪২), ‘জলজঙ্গল’ (১৯৫১), ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ (১৯৫৭), ‘আমার ফাঁসি’ (১৯৫৯), ‘রক্তের বদলে রক্ত’ (১৯৫৯), ‘রূপবতী’ (১৯৬০), ‘বন কেটে বসত’ (১৯৬১), ‘নিশিকুটুম্ব’ (১৯৬৩), ‘সেতুবন্ধ’, ‘ঝিলমিল’, ‘পথ কে দেখাবে’, ‘বকুল’, ‘শত্রুপক্ষের মেয়ে’, ‘সবুজ চিঠি’, ‘মানুষ নামক জন্তু’। স্বদেশানুরাগদীপ্ত নাটক – ‘প্লাবন’, ‘নতুন প্রভাত’ (১৯৪৩), ‘রাখীবন্ধন’ (১৯৪৯)। অন্যান্য নাটক- ‘শেষলগ্ন’, ‘বিপর্যয়’, ‘বিলাসকুঞ্জ বোডিং’, ‘ডাকবাংলো’ – ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। ভ্রমণকাহিনী – ‘ভ্রমণকাহিনী’, ‘চীন দেখে এলাম’, ‘সোভিয়েতের দেশে দেশে’।

সাহিত্যকীর্তির জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিখ্যাত “নিশিকুটুম্ব” উপন্যাসটির জন্য ভারতের সাহিত্য সম্মাননা – সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ পুরস্কারে,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎচন্দ্র পদক ও পুরস্কারে’ সম্মানিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা সাহিত্যিক মনোজ বসু ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে ডিসেম্বর ৮৬ বছর বয়সে কলকাতায় পরলোক গমন করেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.