রেনেসাঁ শিল্প

Table of Contents

রেনেসাঁ শিল্পের পটভূমি ও কারণ

রেনেসাঁ শব্দের অর্থ, এর সময়কাল ও পর্বসমূহ

রেনেসাঁ শব্দের অর্থ পুনর্জন্ম অথবা পুনর্জাগরণ। কথাটি ইউরােপের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে এসেছে। এর সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতিও জড়িত। শিল্পকলায় বাস্তবের প্রতিফলনের আলােচনায় সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো, অর্থাৎ শিল্পকলার চর্চা, তার পটভূমি এবং শৈলী সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা প্রাধান্য পায়। ইউরােপে, বিশেষ করে ইতালিতে যখন ১৫শ শতকের শুরুতে রেনেসাঁ পর্বের সূচনা হয় সেই সময় পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ বলতে প্রাচীন গ্রিস ও রােমের সংস্কৃতির কথাই মনে করা হয়েছে। এই পুনর্জাগরণের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিসে ব্যক্তির ওপর যে গুরুত্ব আরােপ করা হয় এবং মানুষ ও প্রকৃতির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি যে মনােযােগ দেওয়া হয় এবং শিল্পে যে আদর্শ রূপের চর্চা করা হয়েছিল সে সবের পুনঃচর্চা প্রাধান্য পায়।

সংস্কৃতির সীমিত পরিসর (শিল্পকলা) থেকে তার প্রসারিত পরিধিতে দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং রাজনীতিও রেনেসাঁর অন্তর্গত। ইউরােপে ১৪০০ থেকে ১৬০০ শতকের ইতিহাসে যেসব উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে এবং তার ফলে যে পরিবর্তন আসে সেসবের মধ্যে রয়েছে ভৌগােলিক আবিষ্কারের জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা ও নতুন মহাদেশ আবিষ্কার, জ্ঞানের চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের প্রসার, বিজ্ঞানের অনুশীলন, অর্থনীতিতে মুদ্রা ও বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা, ধর্মচিন্তা ও চর্চায় সংস্কার এবং শিল্পকলার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। পরিবর্তনের এই সব ক্ষেত্রে নতুনত্বের আভাস ইউরােপে ১২শ শতক থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্রুসেড যুদ্ধের ফলে অন্য দেশ ও অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান, দর্শন ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচয় ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, মধ্যযুগে সামন্ত প্রথার শেষ পর্বে ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতিষ্ঠা, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রসার লাভ, রাজা ও ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বহু স্বাধীন ক্ষুদ্র নগরীর প্রতিষ্ঠা, জ্ঞানচর্চার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা, গথিক পর্বে প্রকৃতি (বাস্তব) ও প্রাচীন শিল্পের (অ্যান্টিক) প্রতি আকর্ষণ এবং শিল্পকলার চর্চায় তাদের ব্যবহার, এই সব পরিবর্তন ক্রমবর্ধমান নতুন চিন্তা-ভাবনা ও ধারণার পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশেষ করে শিল্পকলায় রেনেসাঁর বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটে ১৭শ শতকে, অর্থাৎ রেনেসাঁ-পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর। তাই রেনেসাঁর শুরু ১৪০০ শতকে এবং সমাপ্তি ১৬০০ শতকে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। রেনেসাঁ শুরু হয়েছে ১৪০০ শতকের আগেই এবং শেষ হয়েছে ১৬০০ শতকের বেশ পরে। বলা যায় ইতিহাসে অনেক অধ্যায়ের সময়কাল হিসাবের ক্ষেত্রে যে যথেচ্ছ বা খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রেনেসাঁর সময় নির্ধারণও তেমন একটি। ইতিহাসের বহমান স্রোতে কোনাে ঘটনা বা দৃশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং স্থির নয় যার জন্য তার সূচনা ও শেষ নির্ধারণ গাণিতিক হিসাবে করা যায় না।

সমকালীন মানুষ মনে করেছিল এটা হল প্রত্যাবর্তন, ক্ল্যাসিক আদর্শে প্রত্যাবর্তন, প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন। বুখার্ট অতীতের পুনরুজ্জীবন (revival of antiquity) ও জগৎ আবিষ্কার (discovery of the world) শব্দ দিয়ে এই প্রত্যাবর্তন বােঝাতে চেয়েছেন। রেনেসাঁ শিল্পের আরও দুটি বৈশিষ্ট্য হল শিল্পীর বহুমুখী দক্ষতা ও ধনীদের পৃষ্ঠপােষকতা। কারুশিল্পীর মর্যাদাহীন অবস্থান থেকে শিল্পীরা সামাজিক সুযােগ সুবিধা ও সম্মানের অধিকারী হন। বুখাট রেনােসাঁ শিল্পকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেছেন, এই অভিমত গ্রাহ্য নয়। রেনে শিল্পীরা বহু মাদোনা, পিয়েতা, ক্রুশারােহণ, সন্তদের প্রতিমূর্তি এঁকেছেন বা তৈরি করেছেন। বুখার্ট আরও বলেছেন যে রেনেসাঁ শিল্প ক্ল্যাসিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতি অনুসরণ করেছিল, এই বক্তব্যও ঠিক নয়, তিনি ক্ল্যাসিক চিত্রকলার কথা তােলেননি কারণ রেনেসাঁ শিল্পীরা তার নিদর্শন দেখেননি। রেনেসাঁ যুগের মুখ্য স্থপতি ব্রুনেল্লেস্কি ক্ল্যাসিক স্থাপত্য শৈলী অন্ধভাবে অনুকরণ করেননি। রেনেসাঁ স্থাপত্যের ওপর স্থানীয় রােমানেস্ক স্থাপত্য রীতির প্রভাব পড়েছিল।

রেনেসাঁ যুগের ভাস্কররা আসল গ্রিক মূর্তিগুলি দেখেননি, দেখেছিলেন তাদের রােমান নকল। ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে মিকেল্যাঞ্জেলো প্রথম গ্রিক ভাস্কর্য (লাওকুন) দেখেছিলেন। গথিক ভাস্কর্যের বাস্তবতা রেনেসাঁ ভাস্করদের প্রভাবিত করেছিল। ফ্রান্সের ক্যাথিড্রালে যেসব সন্তমূর্তি দেখা যায় তাতে শরীর সংস্থান জ্ঞানের অভাব আছে, কিন্তু মুখগুলি খুব বাস্তব, এতে বাইজানটাইন শিল্পের জড়ত্ব নেই। রেনেসাঁর কৃতিত্ব হল কুলুঙ্গি ও ফ্রেম থেকে শিল্পীরা মূর্তিকে স্বাধীন করে দিয়েছিল।

রেনেসাঁ পর্বকে শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তিন পর্বে বিভক্ত করা হয়েছে যেখানে ইতালি ছাড়াও বাইরের নগরীর ভূমিকা ছিল। পর্বগুলাে হলাে : (১) সূচনাকালের রেনেসা বা আর্লি রেনেসা (১৪০০-১৫০০); (২) রেনেসার শীর্ষকাল বা হাই রেনেসাঁ (১৫০০-১৫২০) ও (৩) রেনেসাঁর অন্তিম পর্ব বা লেট রেনেসাঁ (১৫২০-১৬০০)।

রেনেসাঁর উদ্ভবের স্থান ও ব্যাপ্তি এবং ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর উদ্ভবের কারণ

শিল্পকলার চর্চায় রেনেসাঁর প্রধান চারণভূমি ইতালি। এই দেশেই কয়েকটি শহরে রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাের চর্চা ও বিকাশ দেখা গিয়েছিল এবং তার নিদর্শন থেকে গিয়েছে। শহরগুলাের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা নেয় ফ্লোরেন্স। এর পাশাপাশি রােম সহ মিলান, ভেনিস এবং ইতালির অন্যান্য শহরে রেনেসাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।

শিল্প-ঐতিহাসিক ডেল ক্লিভার জোর দিয়ে বলেছেন, গথিক পর্বে যে দ্রুত নগরায়ণ হয় এবং নগরগুলাে বিত্তের ও ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয় তার ফলেই শিল্পকলার পৃষ্ঠপােষকতায় নগরের ভূমিকা প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় (ডেল ক্লিভার, আর্ট, ১৯৬৬)। পূর্বে শিল্পীদের চর্চাকে অব্যাহত রাখার জন্য তাদের ভূস্বামীদের ও রাজরাজড়ার দরবারের অনুগ্রহের দরকার হতো, কিন্তু এই সময়ে নগরীর বিত্তবান শিল্পপতি ও ধনী পরিবারের অর্থানুকূল্য লাভের ফলে শিল্পীরা কেবল তাদের চর্চা অব্যাহত রাখতেই সক্ষম হননি, সেই সাথে তারা প্রাচীন শৈলীর পুনর্ব্যবহার সহ নতুন শৈলীর উদ্ভাবন করে জীবিকা অর্জন করতে ও নিজেদের সৃজনশীলতাকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন, যা পূর্বে সম্ভব ছিলনা।

১৫শ শতাব্দীতে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের বিত্তবান পরিবারগুলাে এই পৃষ্ঠপােষকতা দান করে নগরীটিকে রেনেসাঁর প্রধান পীঠস্থানে পরিণত করে। পরবর্তী সময়ে ১৬শ শতকে রােম ও ভেনিস নগরী ফ্লোরেন্সের এই ভূমিকা গ্রহণ করে। ইতালির বাইরে ১৫শ শতকে ইউরােপের যেসব অঞ্চলে বা নগরীতে রেনেসাঁর শিল্পচর্চা সবচেয়ে উল্লেখযােগ্যভাবে ছিল সেগুলাে ছিল বর্তমান বেলজিয়ামের ভৌগােলিক এলাকায় অবস্থিত টুনাই, ব্রুজেস, ঘেন্ট, ব্রুসেলস, লৌভেইন এবং অ্যান্টয়ার্প। ফ্রান্সের বার্গান্ডি এলাকার দিজো নগরী ১৪২০ পর্যন্ত রেনেসাঁ শিল্পচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। ১৬শ শতকে প্যারিস এবং ফতেব্র নগরী রেনেসাঁ শিল্পচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। রেনেসাঁ কর্মকাণ্ডে জার্মানি অঞ্চলে কোলন, ন্যুরেমবার্গ, ভিয়েনা এবং ক্যাসল নগরীর ভূমিকাও উল্লেখযােগ্য। খুব দেরিতে হলেও ১৬শ শতকের শেষে ইংল্যান্ডেও শিল্পকলার চর্চায় রেনেসাঁর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল।

১৫শ শতকে রেনেসাঁর প্রাথমিক পর্বে ফ্লোরেন্স ছিল চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যের ক্ষেত্রে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। অবশ্য এই সময়ে ইতালির আরেজ্জো এবং সিয়েনা নগরীতেও শিল্পীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন। কিন্তু ফ্লোরেন্স নগরীকেই রেনেসাঁর সূতিকাগার হিসেবে মনে করা হয়েছে। ১৪শ শতকে প্লেগ মহামারির বিধ্বংসী ঘটনার পরও ফ্লোরেন্স ইতালির সবচেয়ে উন্নত ও সম্পদশালী নগরীর মর্যাদায় ও গুরুত্বে চিহ্নিত হয়। রাজনীতিবিদ, স্থপতি, শিল্পী, ভাস্কর এবং পণ্ডিতদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকায় এবং ভাবের আদান-প্রদান ঘটায় এখানেই বিজ্ঞান, দর্শন, স্থাপত্য, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য উৎকর্ষের শীর্ষে উন্নীত হয়। প্রজাতন্ত্র হলেও ১৫শ শতকে ফ্লোরেন্স নগরীর কর্তৃত্ব ছিল মেডেচি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। এই পরিবারটির আয়ের উৎস ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যাংকিং। পরিবারটির প্রধান, বিশেষ করে লরেঞ্জো মেডিচি (১৪৪৯-১৪৯২), ছিলেন একাধারে ব্যবসায়ী-ব্যাংকার, কূটনীতিবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচীন শিল্পকলার সংগ্রাহক। তারই পৃষ্ঠপােষকতায় ফ্লোরেন্স নগরী রেনেসাঁর প্রথম পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আধুনিক কালে মধ্যযুগের গথিক ‘আন্তর্জাতিক শৈলীর’ অবসান ও রেনেসাঁর পূর্বেই বিভিন্ন স্কুলের উদ্ভব

১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরােপের সর্বত্র শিল্পকলা একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। সেই সময়ে গথিক চিত্রকর ও ভাস্করদের শৈলী ‘আন্তর্জাতিক শৈলী’ (ইন্টারন্যাশনাল স্টাইল) হিসেবে পরিচিত হয়েছে। কেননা, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও বার্গান্ডির (বর্তমান ফ্রান্সে অবস্থিত) শিল্পীদের উদ্দেশ্য একই ছিল। অবশ্য মধ্যযুগে দেশে দেশে কিছু পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়েছে (যেমন, ১৩শ শতকে ফ্রান্স ও ইতালির শিল্পে), কিন্তু এই পার্থক্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই বিষয়টি শুধু শিল্পের ক্ষেত্রে নয়, রাজনীতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে।

মধ্যযুগের শেষে শহরের উত্থান ও সেখানে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাব বৃদ্ধির ফলে শিল্পকলার চর্চায় আর আগের মতো ‘আন্তর্জাতিকতা’ ও শিল্পীদের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত ও কাজ করার অবাধ সুযােগ থাকলো না। শহরে প্রত্যেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যে গিল্ড বা সংগঠন গড়ে তােলা হয় তার উদ্দেশ্য ছিল বাইরের ব্যবসায়ী, কারুশিল্পী, কারিগর এবং অন্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে নিজ শহরের পেশাজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এভাবে আধুনিক যুগের প্রথম পর্যায়ে মধ্যযুগের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। শিল্পের ওপর এই পরিবর্তনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে রেনেসাঁর কিছুকাল পূর্ব থেকে গথিক পর্বের অর্থাৎ মধ্যযুগের আন্তর্জাতিক শৈলীর স্থলে দেশে দেশে শিল্পের আবির্ভূত হয় বিভিন্ন স্কুল বা সংঘবদ্ধ শিল্পচর্চার প্রতিষ্ঠান। ইতালি, জার্মানি ও ফ্লান্ডার্সের (আসল ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ ফ্লাঁদর, বর্তমান বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের অংশ) প্রতিটি নগর এবং ছােট শহরেই চিত্রকরদের নিজস্ব স্কুল বা সংগঠন গড়ে তােলা হয়। এই স্কুল আধুনিক অর্থে কোনাে প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং এর দ্বারা একজন গুরু বা শিক্ষক-শিল্পীর অধীনে শিক্ষানবিশি করে কাজ শেখার পদ্ধতিকে বোঝানো হতো। মধ্যযুগে শিল্পের এই স্কুলের ধারণা ছিল না, রেনেসাঁ পর্বের কিছুকাল পূর্বেই এর এর যাত্রা শুরু।

আর্লি রেনেসাঁ

ব্রুনেল্লেস্কি ও আলবের্তির পারস্পেক্টিভের ধারণা, মধ্যযুগের মডেলের জায়গায় বাস্তবতার মায়া

শিক্ষক-শিল্পী, শিক্ষানবিশ শিল্পীর কাজ এবং শিল্পচর্চায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার দৃষ্টান্ত দেখার জন্য ১৫শ শতকের ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর প্রাথমিক পর্বে যখন শিল্পচর্চা নতুন খাতে বইতে শুরু করেছে, তখন সেই অবস্থাতেই শিল্পকর্মে (স্থাপত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য) নতুন পদ্ধতির ও শৈলীর ব্যবহার করে রেনেসাঁর সূচনা করা হয়। এর পথিকৃৎ ছিলেন ব্রুনেল্লেস্কি, আলবের্তি, দোনাতেল্লো এবং মাসাচ্চো।

স্থাপত্য, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যে রেনেসাঁর স্থায়ী অবদান হলাে পারসপেকটিভের ব্যবহার যা ফ্লোরেন্স নগরীতেই শুরু হয়। এই শৈলীর উদ্ভাবনে বিজ্ঞান, বিশেষ করে গণিত এবং শিল্প, উভয়েরই সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ক্যানভাসে কিংবা কাগজের সরল (ফ্লাট) সমতলে ত্রিমাত্রিক স্পেস বা জমিন সৃষ্টির জন্য গণিতের সূত্রের ব্যবহার করে সরলরৈখিক পারসপেকটিভের উদ্ভাবন করা হয়। এই পারস্পেক্টিভের আবিষ্কর্তা হলেন ফ্লোরেন্সের স্থপতি ফিলিপ্পো ব্রুনেল্লেস্কি (Filippo Brunelleschi) এবং স্থপতি ও লেখক লিওন বাত্তিস্তা আলবের্তি (Leon Battista Alberti)। সরলরৈখিক পারসপেকটিভের ভিত্তি গাণিতিক সূত্র হলেও এই গাণিতিক সূত্রে ১৫শ শতকের চিত্রকলায় সৌন্দর্যের আদর্শের সমর্থনও ছিল। প্রাচীন গ্রিসে এবং পরবর্তী সময়ে প্রাচীন রােমের চিত্রকলায় যে স্বর্গীয় বা মহাজাগতিক মাত্রার (প্রপােরশন) ধারণা প্রতিফলিত হয়েছিল তার পুনঃপ্রচলন ও ব্যবহার হয় এই সময়ের সুষমামণ্ডিত চিত্রকলায়। এসময় অনেকেই মনে করেছিলেন, মানবদেহের ওপর ভিত্তি করে স্থাপত্যে ও চিত্রকলায় মাত্রার যে গাণিতিক অনুপাত ব্যবহার করা হয় তার মাধ্যমে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট মহাজগতের জ্যামিতিক শৃঙ্খলার প্রতিফলন ঘটে। ১৫শ শতকের চিত্রশিল্পী পাওলাে উচ্চেল্লো (Paolo Uccello) এবং পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেসকা (Piero della Francesca) পারসপেকটিভ এবং বৃষ্টিপাতের বিজ্ঞান (অপটিক্স) বিষয়ে গবেষণা করে এই বিষয়ে লেখেন। পারসপেকটিভের নিয়ম ও পদ্ধতি সম্বন্ধে স্থপতি-লেখক লিওন বাত্তিস্তা আলবের্তি ‘অন পেইন্টিং’ (১৪৩৫) (ইতালীয় ভাষায় De pictura) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তার একটি নির্দেশনা ছিল চিত্রশিল্পী ছবিতে প্রকৃত স্বর্ণ ব্যবহার না করে নির্ভর করবে সােনালি রঙের ঔজ্জ্বল্যের ওপর। অপটিক্স নিয়ে পরবর্তিতে ফ্রান্সে দার্শনিক দেকার্ত (René Descartes (১৫৯৬-১৬৫০), ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ অনেকটা “ঘ্‌‌হ্‌নে দেকা‌ঘ্‌হ্‌ত্‌”) তার মূল্যবান মতামত দেন। কারও কারও মতে পারস্পেক্টিভের আবিষ্কারের কৃতিত্ব কেবলই ব্রুনেল্লেস্কির। গ্রিক চিত্রশিল্পীরা এবং হেলেনিস্টিক পর্বের চিত্রকরগণ মানুষের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সামনে ছােট করে এঁকে (ফোরশর্টেনিং) স্পেসে গভীরতার মায়া সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তারা গাণিতিক সূত্র অনুযায়ী দূরবর্তী বিষয়বস্তু যে ক্ষুদ্রাকার দেখায় সে সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না। এই গাণিতিক সূত্র আবিষ্কার করে ব্রুনেল্লেস্কি শিল্পচর্চা শুধু বিজ্ঞানসম্মত করেননি, বাস্তববাদী করে তােলার পথও সুগম করেন।

রেনেসাঁর প্রথম পর্বের শিল্পীরা মধ্যযুগের শিল্প আদর্শ ও শৈলী থেকে সরে এসেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ও রােমান শিল্পীদের মতাে তারা নৈর্ব্যক্তিক মডেল নয়, প্রকৃত মানুষের ফিগার দেখে ভাস্কর্য নির্মাণ ও ছবি এঁকেছেন। কিন্তু পারসপেকটিভের নতুন ব্যবহার বাস্তবের মায়ার সৃষ্টি করে। গমব্রিখ এই প্রসঙ্গে বলেন, রেনেসাঁ শিল্পীরা প্রাচীন গ্রিক ও রােমান শিল্পের আদর্শ গ্রহণ করে এবং সেই অনুসারে অগ্রসর হয়েছেন বলে মনে করলে ভুল হবে। তার মতে, রেনেসাঁর প্রথম পর্বের শিল্পীরা (ব্রুনেল্লেস্কির দলের) শিল্পে নবজাগরণের জন্য প্রাচীন (ক্লাসিক্যাল) শিল্প শৈলী যেমন মনে রেখেছেন একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন প্রকৃতির প্রতিফলন এবং গণিতের (পারস্পেকটিভ) ব্যবহার। গাণিতিক সূত্র আয়ত্তে এনে এবং ক্লাসিক্যাল পর্বের শিল্প ঐতিহ্য ও শৈলী স্মরণে রেখে প্রথম পর্বের (১৫শ শতকের) রেনেসাঁ শিল্পীরা কাজ করলেও এটা শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ইতালির উত্তরাঞ্চলের দেশগুলিতেও একই সময়ের শিল্পীদের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

১৫শ শতকের প্রথমদিকে ইতালি এবং তার উত্তরাঞ্চলের দেশে শিল্পকলায়, বিশেষ করে চিত্রকলার ক্ষেত্রে যে নতুন ধারণা, পদ্ধতি ও শৈলীর উদ্ভাবন হয় তার প্রভাব সমস্ত ইউরােপে বিস্তৃত হয়। রেনেসাঁর আবির্ভাবে ইতালির উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোতে এক নতুন প্রত্যয়ের জন্ম হয়েছিল, যা অনুসারে শিল্প শুধু ধর্মীয় পবিত্র বিষয়কে আন্তরিকতার সঙ্গে সংবেদনশীলতার মাত্রা যােগ করে উপস্থাপিত করবে না, সেই সাথে তা বাস্তব জগতের দৃশ্যও বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রতিফলিত করবে। এর ফলে শিল্পীরা নতুন এবং চমকপ্রদ সৃষ্টির সন্ধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। এই নতুনের অনুসন্ধান এবং রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অনুশীলন মধ্যযুগের শিল্পকলা থেকে ইতালির উত্তরাঞ্চলের দেশে ১৫শ শতকের অথবা রেনেসাঁর প্রথম পর্বের শিল্পকে আলাদা করে।

ইতালির শিল্পকলার ইতিহামসে শৈলীর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাঁক ফেরার পরিবর্তনে নতুন যুগ এসেছে বলে মনে করা যায়। এর একটি ছিল ১৪শ শতকে বিখ্যাত লেট গথিক ও প্রোটো-রেনেসাঁস চিত্রকর ও স্থপতি জত্তোর (Giotto, ১২৬৭-১৩৩৭ খ্রি.) নতুন শৈলী উদ্ভাবন। দ্বিতীয়টি সূচিত হয় ১৫শ শতকে ব্রুনেলেস্কির কাজের মাধ্যমে। কিন্তু দুই শতকব্যাপী এই সব পরিবর্তনের ঢেউ বয়ে গেলেও যে পরিবর্তনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা ঘটেছে এই দুই শতকেই। গমব্রিচ বলেছেন, এই পরিবর্তন যেমন অনুভব করা যায়, একইভাবে বর্ণনা করা সম্ভব না। এই পরিবর্তনের মেজাজ বা বৈশিষ্ট্যের আভাস পাওয়া যেতে পারে মধ্যযুগে কোনাে ধর্মগ্রন্থের সচিত্রকরণের সঙ্গে ১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেই ধরনের কাজের সঙ্গে তুলনা করা হলে। রেনেসাঁ পর্বে ফ্লোরেন্সের শিল্পী ধর্মগ্রন্থ সচিত্র করতে গিয়ে ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা অভিভূত হয়ে কাহিনির অর্থ বর্ণনার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। ধর্মভাবাপন্ন হলেও শিল্পী তার নবলব্ধ ক্ষমতার মাধ্যমে এই ধরনের শিল্পকর্মে সমকালের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন ও পরিবেশকে ধারণ করতে চেয়েছে। শিল্পের ভূমিকা যে জীবনের সৌন্দর্য ও সুষমার সংযােজন, রেনেসাঁ পর্বের শিল্পে সে বিশ্বাস ফিরে এসেছিল বলেই একে পুনর্জাগরণ বলা হয়।

মাসাচ্চো ও দোনাতেল্লোর শিল্পে বাস্তবতার আগমন

চিত্রশিল্পী মাসাচ্চো (Masaccio) (১৪০১ – ১৪২৮ খ্রি.) ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নোভেল্লা চার্চে ‘দ্য হলি ট্রিনিটি’ (ইতালীয় ভাষায় Santa Trinità) নামে ১৪২৭-২৮ সালে একটি ফ্রেস্কো এঁকেছিলেন। সেখানেই প্রথম পারসপেকটিভের এই গাণিতিক সূত্রের ব্যবহার করা হয়। মাসাচ্চোর আঁকা ছবিতে এই পারসপেকটিভের গাণিতিক রীতি ব্যবহার দৃষ্টিনন্দন না হলেও তা ছিল আন্তরিক এবং সেই কারণে দর্শকের কাছে আবেদন রাখতে সফল। মাসাচ্চো তার পূর্বসূরি জত্তোর (Giotto) (১২৬৭ – ১৩৩৭ খ্রি.) চিত্রকলার জাঁকজমকপূর্ণ নাটকীয়তার প্রশংসা করলেও তার অনুকরণ করেননি। ‘দ্য হলি ট্রিনিটি’ ছবিতে ভার্জিনকে খুব সরল ভঙ্গিতে হাত তুলে পুত্র যিশুর মৃতদেহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখানাে হয়েছে। সরল এই ভঙ্গিটি বক্তব্যে খুবই সােচ্চার এবং দৃষ্টি আকর্ষণকারী, কেননা ছবিতে এই ফিগারটিই একমাত্র গতিশীলতার পরিচায়ক। এই ছবির অন্য সব ফিগারকেই মনে হয় ভাস্কর্যের মতাে স্থির ও অনড়। পারস্পেকটিভের গাণিতিক সূত্র ব্যবহার করে মাসাচ্চো ছবিটিতে ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রিকতার মায়া সৃষ্টি করেছেন। পারস্পেকটিভের এই শৈলী এবং অন্যান্য নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে মাসাচ্চোর মতাে রেনেসাঁর অন্য শিল্পীরা শুধু নতুনত্বের চমক দিতে চাননি, বিষয়ের অর্থ ও তাৎপর্যকে দর্শকের কাছে প্রাঞ্জল করে তুলতে চেয়েছেন। এটি করতে গিয়ে তারা এক নতুন সমস্যার সম্মুখীনও হয়েছিলেন।

ব্রুনেল্লেস্কি গােষ্ঠীর অন্যতম সদস্য দোনাতেল্লো (Donatello) (১৩৮৬ – ১৪৬৬ খ্রি.) ছিলেন ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর। তিনি তার কর্মজীবনের প্রথম দিকে ১৪১৫ – ১৬ সালে ফ্লোরেন্সের ওরসানমিকেলে চার্চে “সেইন্ট জর্জ” নামে একটি ভাষ্কর্য তৈরি করেছিলেন (ওরসানমিকেলে শব্দটির অর্থ হল সেইন্ট মাইকেলের কিচেন গার্ডেন)। এই ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে দোনাতেল্লোর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রাণবন্ত এবং গতিশীলতার পরিচিতি দেওয়া ছাড়াও এই ভাস্কর্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর প্রস্তরখণ্ডসম স্থিরতা এবং সুস্পষ্ট বাহ্যিক সীমারেখা (আউটলাইন)। মাসাচ্চোর পূর্ববর্ণিত ছবিটির মতাে দোনাতেল্লো তার ভাস্কর্যে পূর্বসূরিদের সূক্ষ্ম ও মসৃণ সৌন্দর্যের স্থানে দেখাতে চেয়েছেন প্রকৃতির (বাস্তবের) গভীর পর্যবেক্ষণ, যা নতুন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিল। দোনাতেল্লো তার “সেইন্ট জর্জ” ভাস্কর্যটির ফিগারের হাত, পা এবং চোখের নির্মাণে তার পূর্বসূরিদের ব্যবহৃত প্রথাগত মডেলকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই ভাস্কর্যে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য দেখানাের উদ্দেশ্যে আদর্শ কোনাে ফিগার নয়, বরং বাস্তবের প্রতিফলন ঘটেছে।

গিবের্তির গেটস অফ প্যারাডাইস

ফ্লোরেন্সের কেথিড্রাল ডুয়ােমাের সঙ্গে ছােট একটি আটকোনা ব্যাপ্টিস্টেরি (Florence Baptistery) আছে, যার মধ্যে শিশুদের এমনকি বড়দেরও মাথায় জর্ডান নদীর জল দিয়ে বাপ্টাইজ করা হয়। এই ছােট মন্দিরটির চারটি দরজা আছে। তার একটি দরজায় ছিল ভাষ্কর আন্দ্রেয়া পিজানাের নির্মিত অতি সুন্দর ব্রোঞ্জের রিলিফ ভাস্কর্য। ঐরকম আরাে একজোড়া দরজা তৈরি করতে হবে। আন্দ্রেয়া পিজানাে ১৩৪৮ সালে মারা যান। তার মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পরে ফ্লোরেন্সবাসীরা ঠিক করেন যে এই বাপ্টিস্টেরির উত্তর দিকে আর এক জোড়া দরজা চাই এবং তার জন্য এক প্রতিযােগিতা ডাকা দরকার। ফ্লোরেন্সে তখন বেশ কয়েকজন নামকরা ভাস্কর রয়েছেন। প্রত্যেকেই এই দায়িত্ব নিতে চাইলেন। এদের মধ্যে কাকে দায়িত্বটি দেয়া হবে তা ঠিক করার জন্য ১৪০১ সালে প্রতিযোগিতা ডাকা হয়। প্রতিযােগিতার নিয়ম ছিল –
১। প্রত্যেক প্রতিযােগীকে নকশা দিতে হবে এবং একটি ব্রোঞ্জের রিলিফ কাজ করে দেখাতে হবে তিনি কি ধরনের কাজ করতে চান।
২। প্রতিযােগিতার রিলিফের বিষয় হবে আব্রাহাম এবং আইজাক।
৩। প্রত্যেক প্রতিযােগীকে এক বছর সময় দেয়া হবে। তাদের কাজ দেখবেন চৌত্রিশজন পরীক্ষক, তারা ঠিক করবেন কে জিতেছে। যিনি জিতবেন তিনি দুটি দরজাই করবেন।

ফ্লোরেন্সের ভাস্কররা তাদের রিলিফ নির্মাণ করা শুরু করলেন। তারা কে কী কাজ করছেন তা একবছর কারােকে দেখালেন না, দেখাতে চাইলেন না। কেবল লোরেনৎসো গিবের্তি (১৩৭৮-১৪৫৫ খ্রি.) সবাইকে তার কাজ অন্যদের দেখাচ্ছিলেন। বন্ধুরা দেখতে চাইলে দেখাচ্ছিলেন, এমনকি ডেকে ডেকে তাদের দেখাচ্ছিলেন, মত চাইছিলেন কিভাবে ভালাে কাজ করা যায়। এই করতে করতে তিনি এমন এক নমুনা তৈরি করলেন, যা ছিল সত্যিই অপূর্ব। এরপর সময় এলে প্রত্যেক প্রতিযােগী নিজের নিজের কাজ চৌত্রিশ জন পরীক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন। তারা মহা ফাঁপরে পড়লেন। এদের মধ্যে দুজনের কাজ খুবই ভাল ছিল, একজন গিবের্তি, অন্যজন ব্রুনেলেস্কি। কিন্তু ব্রুনেলেস্কি নিজের থেকে বললেন, গিবের্তির কাজ তার কাজের চেয়ে অনেক ভাল, তাই কাজ গিবের্তিকেই দেয়া হােক। নিজের থেকে হার স্বীকার করে তিনি নিজের নাম সরিয়ে নেন, ফলে গিবের্তি জয়ী হন। এই প্রতিযােগিতার রিলিফের বিষয় হচ্ছে আব্রাহাম এবং আইজাক। এখন তা ফ্লোরেন্সের বার্জেলাে সংগ্রহালয়ে আছে। গিবের্তিকে উত্তর দেউড়িতে এক জোড়া দরজার কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আন্দ্রেয়া পিজানাে কাজ করেছিলেন গথিক অলঙ্কারবহুল চার খােপের ফ্রেমে, পিজানাের কাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাকে রিলিফ করতে হল। বিষয় ছিল খ্রীষ্টের জীবন, তার শিষ্যদের জীবন এবং চার্চের আদি পুরুষদের কাহিনী। গিবের্তি ১৪০৩ সালে কাজ শুরু করেন। সেই কাজ শেষ হয় ২১ বছর পর ১৪২৪ সালে। এভাবে অবশেষে সেই দরজা দুটোর কাজ শেষ হবার পর তা ব্যাপ্টিস্টেরির উত্তর দেউড়ি বা ডোরওয়েতে লাগানাে হয়। দরজার দুটো কবাটের প্রত্যেকটিতে ১৪টি করে মোট ২৮টি প্যানেল বা রিলিফের দৃশ্য ছিল, যেগুলোর অধিকাংশই খ্রীষ্টের জীবন অবলম্বনে আঁকা। প্রত্যেকটি রিলিফ আলাদা আলাদা করে ব্রোঞ্জে তৈরি করে, শেষ সব একসঙ্গে একে একে লাগিয়ে দরজা জোড়া লাগানাে হয়। তারি এই কাজটি খুব প্রশংসিত হয়। সারা ফ্লরেন্সের লােকের এটা এত ভাল লাগে যে তারা সমস্বরে সকলে চাইল গিবের্তি পূর্ব দেউড়িতে আরেক জোড়া দরজা করুন। উল্লেখ্য, এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি যে ওয়ার্কশপ তৈরি করেছিলেন তাতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান দোনাতেল্লো, মোসালেনো, মিকেলোৎসো, উচ্চেল্লো, পোল্লাইওলো প্রমুখ।

যাই হোক, নতুন দরজার কাজ শুরু করার আগে গিবের্তি এক বছর ছুটি নেন ও ভেনিসে ঘুরে আসেন। ও সেইসাথে চারিদিকে শিল্পজগতে কোথায় কি হচ্ছে খোঁজখবর নিয়ে আসেন। এবার তিনি অনেক বেশী কাজ করার স্বাধীনতা পান, অর্থাৎ তিনি নিজের ইচ্ছেমত বিষয় ও নক্সা করতে পারবেন। ইতিমধ্যে তিনি শিল্পজগতে যে নতুন হাওয়া উঠেছে অথাৎ পরিপ্রেক্ষিত বা পারস্পেকটিভের, তার সম্বন্ধে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছেন। ইতালীয় চিত্রে পারস্পেকটিভের ব্যবহারে যারা মহান শিল্পকর্মগুলো তৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ মাসাচ্চো, পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেস্কা, উচ্চেলাে – তখন তারা সকলে সবে মাত্র বিশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে। পারস্পেকটিভ বলতে সেই কৌশল বা হিসাবকে বোঝানো হয় যার মাধ্যমে চিত্রের বা রিলিফের মধ্যে সম্মুখ, মাঝামাঝি, দূর ও বহুদূরের আভাস আনা যায়। বিশেষ করে আইজাক, যােজেফ আর সলােমন – এই তিনটি প্যানেলের রিলিফে গিবের্তি পারস্পেক্টিভের অসাধারণ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই পারস্পেকটিভের চেয়ে দোনাতেল্লোর সেন্ট জর্জ ও ড্রাগন রিলিফটিতে পারস্পেকটিভ আরাে ভাল ছিল।

যাইহোক, ১৪২৫ গিবের্তি নতুন দরজার জন্য কাজ শুরু করলেন। এবারে ২৭ বছর পর ১৪৫২ সালে সেই কাজ শেষ হল। এই দরজায় ছিল ১০টি প্যানেল, যাদের মধ্যে ছিল ওল্ড টেস্টামেন্টের বিষয় থেকে বানানো ১০টি রিলিফ। পূর্বদিকের এই দরজা দেখে ফ্লোরেন্সবাসী অনেক প্রফুল্ল হয়েছিল, বলেছিল এর চেয়ে নিখুঁৎ কাজ আর হয়না। পরবর্তী জমানার ভাষ্কর ও চিত্রকর মিকেল্যাঞ্জেলো এই ১০ প্যানেলের দরজার দ্বিতীয় জোড়া দেখে মুগ্ধ হয়ে তার নাম দিয়েছিলেন “দ্য গেটস অফ প্যারাডাইস”। ১৪৫৫ সালে তিনি মারা যান। সব মিলে ৭৭ বছরের জীবনের ৪৮ বছর তিনি দুই জোড়া দরজা তৈরি করতে গিয়েই শেষ করেন। কিন্তু সেই দরজাগুলোই তাকে অমর করে রেখেছে। 

ব্রুনেল্লেস্কির ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রালের ডোম

ফিলিপ্পো বুনেল্লেস্কি (১৩৭৭-১৪৪৬ খ্রি.) ছিলেন একাধারে স্থপতি, ভাস্কর এবং স্বর্ণকার। লােরেঞ্জো গিবের্তি আর দোনাতেমল্লা ছিলেন ভাস্কর। ব্রুনেলেস্কির অন্যান্য বিখ্যাত কাজ তো আছেই, কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি যে কাজের জন্য বিখ্যাত, তা হচ্ছে ফ্লোরেন্সের ডুয়ােমাে কেথিড্রালের (যেটি জত্তোর ডুয়ােমাে বলে খ্যাত) আটকোনা ডােমটি তৈরি। ডােমের প্রত্যেক কোণ থেকে একটি করে পাথরের মােটা শির এসে শীর্ষে মিশেছে।

ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রাল বা ফ্লোরেন্সের ডুয়োমো যাকে আমরা চিনি তার আসল নাম সান্তা মারিয়া ডেল ফিওরে। ফ্লোরেন্সের এই ক্যাথিড্রালটি হচ্ছে ফ্লোরেন্স নগরেরই প্রতীক, ১২৯৬ সালে এর কাজ শুরু হয়েছিল। ১৩০০ বা ১৩১০ সালে এর প্রথম স্থপতি আর্নোলফো ডি ক্যাম্বিওর (Arnolfo di Cambio) মৃত্যুর পর ৫০ বছর ধরে এর নির্মাণকার্য আটকে ছিল। ১৩৩০ সালে বিখ্যাত প্রোটো-রেনেসাঁস বা লেইট গথিক চিত্রকর ও স্থপতি জত্তো (Giotto) এর ক্যাম্পানিলে বা বেল টাওয়ার অংশটি সমাপ্ত করেন। তাই এই ক্যাথেড্রালটিকে জত্তোর ডুওমাও বলা হয়। যাই হোক, ক্যাম্পানিলে তৈরি হলেও এর ডোম তৈরির জায়গাটি খালিই পড়েছিল। ১৩৩৪ থেকে ১৩৬৬ সালের মধ্যে স্থপতি ও চিত্রশিল্পীদের একটি কমিটি মিলে এখানে একটি ডোম বা গম্বুজ তৈরির পরিকল্পনা করে। প্রস্তাবিত গম্বুজটি বেস থেকে উপরে লণ্ঠন পর্যন্ত ছিল আশি মিটারেরও বেশি উঁচু, এবং অষ্টভুজাকৃতির বেস ছিল প্রায় ৪২ মিটার ব্যাসের। এটি প্রাচীন প্যান্থিয়নের গম্বুজ বা ইউরোপের অন্য কোন গম্বুজের চেয়ে বড় ছিল, এবং প্রাচীন যুগের পর থেকে এই আকারের কোন গম্বুজ আর নির্মিত হয়নি।

এই ডোমের স্থপতি কে হবে তা নির্বাচন করার জন্য ১৪১৮ সালে একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪০১ সালে এই ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রালেরই বাপ্টিস্ট্রির দরজার রিলিফ তৈরির জন্য প্রতিযোগিতায় ব্রুনেল্লেস্কি গিবের্তির কাছে পরাজিত হয়ে রানার আপ হয়েছিলেন। এবারে তিনি তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী গিবের্তিকে হারিয়ে এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেন। এজন্য তিনি তার বন্ধু ভাস্কর দোনাতেল্লোর দ্বারা নির্মিত গম্বুজের একটি ইট মাপের মডেল ব্যবহার করেছিলেন। ফ্লোরেন্সের ফাদাররা স্থাপত্যের জন্য বাট্রেসের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, কারণ বাট্রেসের ক্ষেত্রে স্ক্যাফোল্ডিং এর জন্য যথেষ্ট লম্বা এবং শক্তিশালী (এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে) র‍্যাফটার লাগে যা তখন পাওয়া সম্ভব ছিলনা। কিভাবে এত বড় আকারের ডোম নির্মাণ করা যাবে যাতে এটি নিজের ভরের কারণেই ভেঙ্গে না পড়ে, তা নিয়ে তখন কারও স্পষ্ট ধারণা ছিলনা, কমপ্রেশন স্ট্রেস বা সংকোচন চাপ কতো হবে তা পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছিল না, আর মর্টারগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই বসে যেত, এর ফলে তার উপর স্ক্যাফোল্ডিং এর স্থায়ী দাগ তৈরি হতো।

ব্রুনেল্লেস্কির সাফল্যের পেছনে ছিল তার প্রযুক্তিগত এবং গাণিতিক প্রতিভা। ব্রুনেলেস্কি অষ্টভুজাকৃতি গম্বুজ নির্মাণে চার মিলিয়নেরও বেশি ইট ব্যবহার করেন। লক্ষণীয়, ব্রুনেলেস্কি সেই গম্বুজের কাঠামোর বিস্তারিত কোন বিল্ডিং পরিকল্পনা বা নকশা রেখে যাননি, পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে তিনি গম্বুজটি এমন ভাবে নির্মাণ করেছিলেন যেন এটি হেমিস্ফেরিকাল বা অর্ধগোলকাকার, যার ফলে ডোমটি নিজেকে সাপোর্ট দিতে সক্ষম হয়। ব্রুনেল্লেস্কি দুটো ডোম তৈরি করেন। একটির ভেতরে আরেকটি ছিল। পরবর্তীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডোম বা গম্বুজ নির্মাণে একই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল প্যারিসে লেস ইনভ্যালিডেস এবং ওয়াশিংটনে ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটল। বাইরের ডোমটি ভেতরের ডোমটিকে বৃষ্টির থেকে রক্ষা করে এবং একটি রাজকীয় আকৃতি দান করে। ডোমটির ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে ২৮টি হরাইজন্টাল লো ভার্টিকাল মারবেল রিব বা এপেরোনি দিয়ে, যাদের মধ্যে ৮টিকে বাইরে থেকে দেখা যায়। বাইরে থেকে যেগুলো দেখা যায় সেগুলো মূলত নান্দনিকতার জন্য, কেননা বাইরের ডোমটিকে এগুলো সাপোর্ট দেয়না, বরং ভেতরের ডোমটিই বাইরের ডোমটিকে সাপোর্ট দেয়। দুটো ডোমের মধ্যে একটি সরু সিঁড়ি আছে যা উপরের শিখরের ল্যান্টার্ন পর্যন্ত যায়।

ব্রুনেল্লেস্কি গম্বুজের জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাসনরির সরঞ্জাম ও মেটারিয়ালগুলো উত্তোলনের জন্য একটি নতুন উত্তোলন মেশিন বা হয়েস্ট মেশিন আবিষ্কার করেন। এটি ছিল ভিট্রুভিয়াস ডে আর্কিটেকচুরা দ্বারা অনুপ্রাণিত, যে মেশিন দিয়ে রোমানরা প্যানথিওন ও বাথস অফ ডায়োক্লেশিয়ানের মত বিশাল ভবনগুলো তৈরি করেছিল। অনেক পরে দা ভিঞ্চি এই মেশিনের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। ব্রুনেলেস্কি দ্বারা আবিষ্কৃত কাঠ এবং বেলেপাথরের শিকল দ্বারা গম্বুজের শক্তি বাড়ানো হয়, যা গম্বুজের ভিত্তির চারপাশে উত্তেজনাকর আংটির মত কাজ করে এবং ফ্লাইং বাট্রেসের চাহিদার হ্রাস করে। এই ফ্লাইং বাট্রেসের ব্যবহার গথিক স্থাপত্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু রেনেসাঁস স্থাপত্যের সময় থেকে এর ব্যবহার কমতে থাকে। এছাড়া ব্রুনেল্লেস্কি রোমে হ্যারিংবোন ব্রিক প্যাটার্ন দেখে থাকতে পারে। এই ডোমে এই প্যাটার্ন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ডোমটি নির্মাণের পূর্বে এই ব্রিক প্যাটার্ন ইউরোপে বিস্মৃত হয়েছিল। ব্রুনেল্লেস্কি এই বিস্মৃত ব্রিক প্যাটার্নকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ব্রুনেল্লেস্কি তার নির্মাণকর্মী বা রাজমিস্ত্রীদেরকে তাদের বিরতির সময় সেই ভবনেই রাখতেন, তাদেরকে নিচে নামতে দিতেন না। কেননা তারা শত শত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবার উঠলে তারা ক্লান্ত হয়ে যাবে, তাতে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। তাদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য তিনি বাইরে থেকে খাবার আনাতেন। সেই সাথে তিনি তাদের জন্য কেবল ডায়াল্যুটেড ওয়াইন বা পাতলা মদ নিয়ে আসতেন, যা সেসময় প্রেগনেন্ট নারীদেরকেই কেবল দেয়া হতো।

১৪৩৬ সালে গম্বুজ সম্পন্ন হওয়ার পর আবার একটি নতুন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, আবার তাকে তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী গিবের্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়। এবারও ব্রুনেল্লেস্কি বিজয়ী হন, এবং তিনি এর ফলে ল্যান্টার্নকে ডিজাইন করার ও এর বেজ তৈরি করার করার কমিশন পান। কিন্তু তিনি ডোমটির উপর ল্যান্টার্নটির চূড়ান্ত ইনস্টলেশন দেখা অব্দি জীবিত থাকেননি। ১৪৪৬ সালেই তিনি মারা যান। এই ডোম, এর ল্যান্টার্ন ও এর এক্সেড্রার কাজ করতে করতেই তার জীবনের বেশিরভাগ সময় চলে যায়। তিনি নতুন কমিশন অনুযায়ী ল্যান্টার্ন ও এক্সেড্রা ডিজাইন করেন। আর তার জীবদ্দশায় ল্যান্টার্ন নির্মিত না হলেও এক্সেড্রা নির্মিত হয়েছিল। ১৪৩৮ সালে ব্রুনেল্লেস্কি ক্যাথিড্রালে তার শেষ অবদানের নকশা করেন; এটি ছিল চারটি হেমিস্ফেরিকাল বা অর্ধগোলাকার এক্সেড্রা,অথবা ছোট অর্ধ গম্বুজ। একটি রোমান মডেল উপর ভিত্তি করে তিনি এটি ডিজাইন করেছিলেন। প্রধান গম্বুজের গোড়ায় ড্রামের বিপরীতে এটিকে সেট করা হয়েছে। এগুলো মূল গম্বুজের চারপাশে সাজানো চারটি ছোট গম্বুজের বিকল্প তৈরি করে এবং উপরের দিকে যাওয়া গম্বুজের একটি সিঁড়ির আবির্ভাব ঘটায়। তারা বিশুদ্ধভাবে সাজানো ছিল, এবং সমৃদ্ধভাবে হরাইজন্টাল এনট্যাব্লেচার, ভার্টিকাল আর্চ, পিলাস্টার ও ডাবল কলাম দ্বারা সজ্জিত ছিল। এগুলো স্থাপত্য বিষয়াবলি হাই রেনেসাঁ স্থাপত্যকে অনুপ্রাণিত করে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৫০২ সালে ব্রামান্টের দ্বারা মন্তোরিওতে নির্মিত তেম্পিয়েত্ততো অফ সেইন্ট পিটার। একইরকম স্ট্রাকচার দেখা যায় উরবিনোতে প্রায় ১৪৭৫ সালে পিয়েরো দেল্লা ফ্রাঞ্চেস্কার আইডিয়াল সিটি বা আদর্শ নগরের চিত্রকর্মেও। ১৪৩৮ সালে এক্সেড্রাটির নকশা করার পর ১৪৩৯ সালে এটির নির্মাণকার্য শুরু হয় ও ১৪৪৫ সালে তা শেষ হয়। ১৪৪৬ সালে যে বছর তিনি মারা যান সেই বছরেই তার নকশা অনুযায়ী ক্যাথেড্রালটির ল্যান্টার্ন বানানো শুরু হয় ও ১৪৬১ সালে এটি বানানো সমাপ্ত হলে ডোম বা গম্বুজটির উপর এটি স্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। এই ডোমটি নির্মাণ করতে গিয়ে ব্রুনেল্লেস্কি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন বিখ্যাত ইতালীয় ব্যাঙ্কার ও পলিটিশিয়ান কসিমো দে মেডিচি (১৩৮৯-১৪৬৪ খ্রি.), তিনি লোরেঞ্জো দে মেডিচির পিতামত ছিলেন। 

দোনাতেল্লোর কীর্তিসমূহ

দোনাতেল্লো (১৩৮৬-১৪৬৬ খ্রি.) রােমান ভাস্কর্য ও মূর্তি সম্বন্ধে খুব ভাল করে পড়াশুনা করে ক্লাসিকাল ভাষ্কর্যের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি ফ্লোরেন্স থাকতেন। যখন ব্রুনেলেস্কি গিবেৰ্তির কাছে হার মেনে রােম রওনা দিলেন, তখন ব্রুনেলেস্কির বয়স তেইশ বা চব্বিশ আর দোনাতেল্লোর বয়স তাঁর চেয়ে ন’ বছর কম, অর্থাৎ চোদ্দ কি পনেরাে। রােমে পৌঁছে এই দুজন পুরনাে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন ও সুন্দর প্রাচীন রােমান কীর্তি খুঁজতেন। ব্রুনেলেস্কি ছিলেন স্থপতি, তাই তিনি সব পুরনাে বাড়ি মেপে মেপে বেড়াতেন। অন্যদিকে দোনাতেল্লো খুঁজতেন ভাস্কর্য। ওদের যারা জানতাে তারা ওদের নাম রেখেছিল গুপ্তধন শিকারী। 

এই দুজন ফ্লোরেন্সে ফিরে আসার পর, দোনাতেল্লো প্রথম বড় যে কাজ পেলেন সে হচ্ছে ব্রোঞ্জ দিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের বীর ডেভিডের মূর্তির নির্মাণ, যা থাকবে ফ্লরেন্সের জাতীয় মিউজিয়াম বার্জেলাে প্রাসাদে। ডেভিড ছােট ছেলে, বিরাট দৈত্য গােলিয়াথকে গুলতি ছুঁড়ে মেরে তার মুণ্ডু কাটছেন এমন ভাষ্কর্য বানাতে হবে। এতদিন কেউ বাইবলের কোন বীরকে নগ্ন শরীরে দেখাতে সাহস করেনি। ১৪৪০ এর দশকে দোনাতেল্লো গ্রীকনীতি স্মরণ করে ডেভিডকে সম্পূর্ণ নগ্ন এক যুবা হিসেবে দেখান। ডেভিড এখানে দৃপ্ত, বিজয়ের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন, বাঁ হাতটি মুড়ে কোমরে লাগিয়ে দাঁড়ানাে, ডান পায়ের উপর সমস্ত শরীরের ভার, বাঁ পাটি আলগা করে হাঁটুভাঙ্গা অবস্থায় মাটিতে ছোঁয়ানাে, ডান হাতে বড় তরােয়াল, গােলিয়াথের মুণ্ড পায়ের সমুখে পড়ে, তাতে তরােয়ালের ডগা ঠেকানাে, মুখটা নামানাে, সারা শরীর জয়ের আনন্দে শিথিল, আর ভাবখানা যেন, “এবার মজাটা টের পেয়েছাে?”। এই ভাষ্কর্যের পর বাইলের বীরদেরও নগ্ন শরীরে দেখাতে পারা যায় কিনা সেই দ্বিধা কেটে যায়।

এরপর তিনি আবার একটি অবাক কাণ্ড ঘটান। ফ্লোরেন্সের কেথিড্রালে (মুজেও দেলােপেরা দেল ডুয়ােমােতে) ক্যান্টোরিয়াতে (অর্থাৎ যেখানে ছেলেরা বেদীর দু’দিকে বসে ধর্মসঙ্গীত বা কোরাল গায়) সেখানে মাৰ্বলে এবং রিলিফ ভাস্কর্যে সঙ্গীতরত ছেলেদের একটি ভাস্কর্যের ফ্রিজ করার কমিশন আসে তার উপর। একে বলা হলো সিঙ্গিং গ্যালারি। দুটি গ্যালারির ভেতরে একটিতে দোনাতেল্লো করলেন মাৰ্বলের ফ্রিজ, অন্যটিতে একই মার্বেল ভাস্কর্য নির্মাণ করেন লুকা দেল্লা রব্বিয়া (Luca della Robbia)। এটুকুতেও কমিশনদাতারা সন্তুষ্ট হননি বলে দোনাতেল্লো গ্যালারির বাইরের দেয়ালে আবার রিলিফ ভাস্কর্য খােদাই করেন। এর বিষয় ছিল নৃত্যরত দেবদূত, যাকে ইটালীয় ভাষায় বলে পুতি। রিলিফটিতে বাচ্চা পুতিরা যেন মনের আনন্দে নাচছে, গাইছে; এরা যেমন প্রাণােচ্ছল, তেমনি স্বর্গীয় ও নির্মল। 

দোনাতেল্লোর পরের কাজ ছিল তার তৈরি সেইন্ট জর্জের এক জগদ্বিখ্যাত মূর্তি। প্রথমে ঠিক হয়েছিল সেটি আরেকটি চার্চের সামনে থাকবে, কিন্তু এখন সেটি আছে বার্জেলােতে। সেইন্ট জর্জ ও ড্রাগন নামে তিনি একটি ব্রোঞ্জের পাত্রে আরেকটি রিলিফও বানিয়েছিলেন। সেইন্ট জর্জ ছিলেন রােমান সৈন্যদলের একজন সৈনিক। তখন রােমান সৈন্যদলে কোন খ্রীষ্টানকে ভর্তি করা হত না। যদি কেউ লুকিয়ে ভর্তি হত তাহলে তার পক্ষে সেটা খুবই বিপজ্জনক হত। কিন্তু সেন্ট জর্জ লুকোবার পাত্র নয়, বরং তিনি যে খ্রীষ্টান বলে তার অসীম গর্ব ছিল, ফলে তার ঢালের সাদা জমির উপর তিনি এঁকেছিলেন একটি টকটকে লাল ক্রস। সেই থেকে এটিকে সেইন্ট জর্জের ক্রস বলা হয় যা এখন ইংল্যাণ্ডের জাতীয় পতাকার সামিল, কারণ সেইন্ট জর্জ হলেন ইংলণ্ডের একান্ত প্রিয় সেইন্ট। তিনি অসমসাহসী ছিলেন। ফলে রােমান সম্রাট খ্রীষ্টানদের উপর অত্যাচার শুরু করলে তিনি গিয়ে তাঁকে অত্যাচার বন্ধ করতে বলেন। এই স্পর্ধা দেখানোর জন্য সম্রাট তাকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন। 

কয়েকশো বছর পূর্বে মারা যাওয়া সেইন্ট জর্জের কোন ছবি ছিলনা বলে দোনাতেল্লোর পক্ষে তাকে কেমন দেখতে ছিল তা জানা সম্ভব ছিলনা। তাই তিনি সেইন্ট জর্জের যে মূর্তিটি নির্মাণ করলেন তা কোন আসল প্রতিকৃতি নয়। দোনাতেল্লো এই মূর্তির মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলেন, রােমান সৈন্যদলের একজন অসমসাহসী বীর খ্রীষ্টান যুবক অফিসারের কি রকম চেহারা হওয়া উচিত। মূর্তিটি তৈরি হয়ে গেলে যারা সেটা দেখেলেন তারাও বললেন, হ্যাঁ, সেউন্ট জর্জকে ঠিক এরকমই দেখতে হওয়া উচিৎ। ফলে মূর্তিটির অসম্ভব খ্যাতি রটে গেল। দেখলে যেন মনে হয় সশরীরে সেন্ট জর্জ দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে রােমান সৈন্যের উর্দি, হাতে বর্ম, সহজ সরল ভাবে মাথা তুলে, নির্ভীকভাবে সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, পা দুটি ফাঁক করা (স্ট্যাণ্ড এট ঈজ), বাঁ হাত খুলে দাঁড় করানাে ঢালের উপর রাখা ডান হাতটি মুঠি করে শরীরের পাশে ঝােলানাে। ঢালটিতে ক্রস আঁকা। দেখতে নির্ভীক কিন্তু বিনয়ী যুবা, নিতান্তই অল্প বয়স। দর্শকদের মধ্যে একজন দোনাতেল্লোকে বলেছিলেন, এই ভাষ্কর্যে একটাই ত্রুটি আছে, তা হল মূর্তিটি কথা বলতে পারেনা!

তবে দোনাতেল্লো সবচেয়ে বেশি  বিখ্যাত হয়ে আছেন ১৪৫৩ সালে তার বানানো ঘােড়ায় চড়া একটি যােদ্ধার মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে, যা ইকুয়েস্ট্রিয়ান স্ট্যাচু অফ গাত্তেমেলাতা নামে পরিচিত। পৃথিবীর প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ ভাস্কর ফিডিয়াসের তৈরি পার্থেননের ফ্রিজের জন্য ঘােড়া ও ঘােড়সওয়ার তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি উৎকীর্ণ ভাস্কর্য ছিল, রিলিফ, সুডােল ভাস্কর্য ছিলনা। রিলিফে ঘােড়া বা অন্য কোন জন্তু খােদাই করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু সেগুলো জীবন্ত, সুডােল করা অনেক কঠিন, কারণ রিলিফের ঘােড়া পশ্চাদপটের জমির সঙ্গে অভিন্ন থাকে, তার ওজন লেগে থাকে তার পিছনের জমিতে। রিলিফের ঘােড়াকে তার চারপায়ে সমস্ত ওজন ফেলে দাঁড়াতে হয় না। ঘােড়ার পিঠে মানুষের মূর্তিকে ঘােড়সওয়ার মূর্তি বা ইকোয়েস্ট্রিয়ান মূর্তি বলে। রােমানরা গ্রীকদের চেয়ে ঘােড়সওয়ার মূর্তি ভাল তৈরি করতে পারতেন, কারণ কি করে মূর্তিতে ওজন ঠিকমত ছড়িয়ে দিতে হয় সে বিষয়ে তাদের ধারণা আরাে ভাল ছিল। তারপরে হাজার দেড়েক বছর ধরে ভাল ঘােড়সওয়ার মূর্তি আর তৈরি হয়নি। 

১৫০০ বছর পরে যিনি আবার একটি অতি উৎকৃষ্ট ঘােড়সওয়ার মূর্তি তৈরি করেছিলেন, তিনি হলেন দোনাতেল্লো। এই মূর্তির নাম গাট্টেমেলাটা। এটি ইটালির পাড়ুয়া শহরে আছে। গাট্টেমেলাটা ছিলেন একজন কণ্ডোটিয়েরে, অর্থাৎ ভাড়াটে সৈন্য, এরা তাদের জন্য লড়ত যারা তাদেরকে টাকা পয়সা দিয়ে পুষতো। গার্টেমেলাটা খুব বড় মূর্তি, এমনকি প্রমাণ সাইজের চেয়ে বড়। মূতিটি করতে দোনাতেল্লোর দশ বছরের বেশী সময় লেগেছিল, করার পর আবার সেটিকে পাডুয়ায় স্থাপন করা ছিল আরেক বড় কাজ। এটি এত ভাল কাজ, যে অনেকের মতে এটি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভাল ঘােড়সওয়ার মূর্তিগুলির মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে। সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াসের ঘােড়ার সঙ্গে গাট্টেমেলাটার ঘােড়ার তফাৎ আছে। সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াসের ঘােড়া উচু, দোহারা চেহারা, খুব অভিজাত, কিছুটা সুখে পালিত মনে হয়। গাট্টেমেলাটার ঘােড়া বিরাট বড় মােটা, ভীষণ জোর বা বলিষ্ঠ, তেজী মনে হয়। তার কারণ কণ্ডোটিয়েরেরা খুব ভারী বর্ম পরতেন, আর ভাড়াটে সৈন্য বলে খুব বেশী বলিষ্ঠ হতেন। ঘােড়ার ওজন, সওয়ারের ওজন, বর্মের ওজন, বর্শার দৈর্ঘ্য ও ওজন সবই বেশী হওয়া দরকার। কারণ যত বেশী ওজন হবে এবং যত বেগে সেই ওজন নিয়ে তেড়ে আক্রমণ করবে, ততই শত্রুকে ফেলে দেবার সম্ভাবনা বেশী হবে। দোনাতেল্লোর ঘােড়সওয়ার এত ওজনে ভারী যে ঘােড়া যে পা তুলে আছে, অর্থাৎ সমুখের বাঁ পাতার তলায় দোনাতেল্লোকে একটি বল লাগাতে হয়, তা না হলে ঘােড়াটি সওয়ারসুদ্ধ কাত হয়ে পড়ে যেতে পারে। ভাষ্কর্যটিতে ঘােড়ার মুখে লাগাম দিয়ে সােজা করে টানা, ঘােড়ার চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে, নাক দিয়ে যেন ফর ফর করে শব্দ হচ্ছে। ল্যাজটি সুন্দর বিনুনি করে শেষের দিকে গিট দেয়া। সম্রাট অরিলিয়াসের ঘােড়া রেসের ঘােড়ার মত, সারা শরীরটি ছিমছাম, কিন্তু এ ঘােড়াটি বেজায় মােটা। আরেকটা তফাৎ হল গাট্টেমেলাটা স্টিরাপ বা রেকাবে পা ঢুকিয়ে সমুখের দিকে পা উঁচু করে আছেন, জুতাের পিছনে একটা শিক, শিকের শেষে একটা কাঁটা কাঁটা পাঁচমুখী তারা। এই তারাকে বলে স্পার। ঘােড়া ছােটাতে গেলে গােড়ালি দিয়ে এই স্পার দিয়ে ঘােড়ার পেটে খোঁচা মারলে ঘােড়া ছুটবে।

লুকা দেল্লা রব্বিয়ার সিক্রেট

লুকা দেল্লা রব্বিয়া (Luca della Robbia, ১৪০০-১৪৮৭ খ্রি.) দোনাতেল্লোর বন্ধু ছিলেন। দোনাতেল্লোর মত তিনিও ফ্লোরেন্সে থাকতেন। বয়সে দোনাতেল্লোর চেয়ে একটু ছােট (১৪০০-১৪৮৭)। লুকা ভাস্কর্য করতেন মাৰ্বল পাথরে আর ব্রোঞ্জে। তাঁর তৈরি ফ্লোরেন্স কেথিড্রালের সিঙ্গিং গ্যালারির ফ্রিজটি দোনাতেল্লোর ফ্রিজের মুখােমুখি ছিল। দোনাতেল্লো আর লুকার ফ্রিজ দুটি এমন প্রাণবন্ত, জীবন্ত যে আসল জীবন্ত ছেলেরা যদি সেখানে নাও থাকে তবুও মনে হবে দু দল ছেলে যেন মুখােমুখি দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের বা যীশুর স্তবগান করছে। দোনাতেল্লো বিরাট ভাস্কর হলেও লুকার কাজ এত ভাল যে যদি কাছে দাঁড়িয়ে দু’জনের কাজ দেখলে মনে হবে লুকার কাজই বােধ হয় বেশী ভাল। তার কারণ দোনাতেলোর কাজ লুকার কাজের মত অত মসৃণ, অত নিখুঁতভাবে শেষ করা নয়, বরং একটু এবড়াে খেবড়াে, অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। দেখে মনে হয় দোনাতেল্লো শেষ পালিশটুকু করতে পারেননি বা বাদ দিয়ে গেছেন। কিন্তু সিঙ্গিং গ্যালারি দুটি একটু দূর থেকে দেখলে (যেমনটা সাধারণত লােকে কেথিড্রালে নিজের নিজের আসন থেকে দেখে, কারণ সচরাচর কোয়ারের গ্যালারিতে শুধু গান করা ছেলেরাই যায়, উপাসকদের যখন তখন ইচ্ছামত যাবার অধিকার থাকেনা) তখন দোনাতেল্লোর ফ্রিজই বেশী ভাল দেখায়, কারণ তার ভাস্কর্যের গায়ে যে অমসৃণতা আছে তাতে নরম আলাে আরাে ভাল করে ঠিকরিয়ে প্রতিফলিত হয়, তাই শরীরগুলো খুব ভাল করে, আরাে প্রাণবন্ত দেখায়, মসৃণ মােমের পুতুল মনে নয় না। তাই বলা যায় দুজনের, অর্থাৎ দোনাতেল্লো আর লুকার দুটি ফ্রিজই আজ সাড়ে পাঁচশ বছর পরে এত মহামূল্য হয়ে গেছে যে দুটিকেই এখন সরিয়ে নিয়ে কেথিড্রালের মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।

লুকা দেল্লা রব্বিয়া চিন্তা করে দেখলেন যে মার্বেল কাটতে (তিনি ব্রোঞ্জ বেশী করতেন না) বড্ড বেশী সময় ও পরিশ্রম যায়। তাছাড়া ভাল রকম মার্বেল কিনতেও বেশ পয়সা লাগে। মার্বেল কিনে মূর্তি খােদাই করে অত পরিশ্রম করে যন্ত্রপাতি কাজ করতে গিয়ে ভোঁতা করে, এত সব করে যখন মূর্তিটি তৈরি হল তখন প্রায়ই দেখেন প্রথমে যে দরে কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন, তাতে পােশায় না, হয় লােকসান হয়, না হলে লাভ খুব কম থাকে। ব্রোঞ্জের বেলাতেও প্রায় একই দশা। তাই তিনি এমন এক কাঁচামালের কথা ভাবলেন, যাতে সহজেই মূর্তি গড়া যায় এবং পয়সাও কম খরচ হয়। বস্তুটি হল মাটি। লুকা দেল্লা রব্বিয়া মাটি ব্যবহার করতেন ঠিকই, কিন্তু মাটির মূর্তি শেষ করার পর তার উপরে এক প্রস্থ চীনামাটির আস্তর লাগাতেন, যেগুলো খানিকটা কাঁচের মত ছিল। কাঁচের মত চীনামাটির আস্তর লাগিয়ে তিনি আগুনের ভাঁটিতে দিয়ে দিতেন, এবং ঠিক যতক্ষণ দরকার হিসাব করে ততক্ষণ ভাঁটিতে রাখতেন। তার এই উপায়ের সিক্রেট ছিল গ্লেজটি ঠিকমত তৈরি করার মধ্যে। ঠিকমত গ্লেজটি আর পােড়ামাটি তৈরি হলে সেটি ঠিক মার্বেলের মতই রােদ, জল সহ্য করবে, নষ্ট হবে না, যা নাকি শুধু পােড়ামাটি বা টেরাকোটায় সম্ভব নয়। গ্লেজবিহীন টেরাকোটা রােদে জলে থাকলে ভেঙ্গে গলে যায়। তার দেখাদেখি অন্য ভাস্কররা এই ফন্দিতে কাজ করার চেষ্টা করেন কিন্তু কেউই লুকা দেল্লা রব্বিয়ার মত গ্লেজ করতে পারেননি। গ্লেজ-করা টেরাকোটায় লুকা যেসব ভাস্কর্য করেন তার অধিকাংশই রিলিফের কাজ। সুডােল কাজ হলে হাত থেকে পড়ে গিয়ে বা ধাক্কাধাক্কি খেয়ে চটা ওঠার আশঙ্কা থাকে। রিলিফ অর্থাৎ ভাস্কর্যের উচ্চকিত ভাগ যেটুকু সেটুকু সাদা মার্বলের মত দেখাতাে, কিন্তু পশ্চাদ্ভাগ বা জমিটি হত অতি সুন্দর এক নয়নতৃপ্তিকর নীল রং। লুকা তার এই গোপন কৌশল তার পালিত পুত্রকে জানান। সেই পালিত পুত্রের আবার নিজের পাঁচটি ছেলে ছিল। তারা আবার যখন বড় হল তখন তাদের বাবা তাদের সেই গােপনীয় ব্যাপারটি জানান। এভাবে এটি পারিবারিক গোপন কথা হয়েই রয়ে যায়। 

লুকা নিজের ভ্রাতুস্পুত্রকে পােয্যপুত্র করেছিলেন, নাম ছিল আন্দ্রেয়া। তাকে তাঁ একান্ত গােপন প্লেজের কাজ শেখালেন। আন্দ্রেয়ার তিন ছেলে ছিল – দ্বিতীয় লুকা, জোভান্নি আর জিরােলামাে। এরা সকলে মিলে গ্লেজকরা টেরাকোটার একটি পারিবারিক ফ্যাক্টরি বা কারখানা করে ফেললেন। সেখানে অন্য সকলের প্রবেশ নিষেধ ছিল। ভাইয়ের ছেলে আন্দ্রেয়া আরাে উন্নতি করলেন, তিনি প্রায় সব কাজই টেরাকোটা করতেন এবং তার কাজে আরাে অনেক রঙের গ্লেজ উদ্ভব করে লাগাতেন, যদিও যেখানে ত্বক বা গায়ের চামড়া দেখাতে হবে সেখানটা তিনি মূর্তিতে সাদা রেখে দিতেন। আন্দ্রেয়ার শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল তার ম্যাডােনা এবং শিশু যীশুর মূর্তিগুলিতে। বড় লুকা ছিলেন তার মূর্তিতে পবিত্র, নির্মল,ধর্মীয় বা ঐশ্বরিক ভাব আনতে সিদ্ধহস্ত। এদের পারিবারিক কারখানা খুব ভালভাবে প্রায় ১৬শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছিল। ফ্লোরেন্সের একটি শিশু হাসপাতালের বাইরের দেয়ালের জন্য আন্দ্রেয়া সারি সারি অনেকগুলি টেরাকোটা রিলিফের মূর্তি করেন-কাঁথা দিয়ে জড়ানাে সদ্যোজাত শিশুদের মূর্তি করেন। কিন্তু প্রত্যেকটি মূর্তি তার নিজস্ব গােল উচু করা ফ্রেমের মধ্যে সমান জমিতে শােয়ানাে। 

ভেরােক্কিওর দুটি ভাষ্কর্য

ভেরোক্কিও (Andrea del Verrocchio, ১৪৩৫-১৪৮৮ খ্রি.) ছিলেন একাধারে চিত্রকলার দিকপাল ও অন্যদিকে ভাস্কর্যের দিকপাল। চিত্রকলায় যারা আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত আনেন, যেমন পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেস্কা, মাসাচ্চো প্রভৃতি, তাদের মধ্যে ভেরােক্কিও অন্যতম প্রধান। পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠতম বহুধারার প্রতিভা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির উপর ভেরােক্কিওর প্রভাব অপরিমেয় বলা যায়। প্রবাদ আছে ভেরােক্কিও নিজে দোনাতেল্লোর কাছে এবং বােধ হয় গিবের্তির কাছেও কাজ শেখেন। ভেরোক্কিওও দোনাতেল্লোর মতো আরেকটি ডেভিডের মূর্তি গড়েছিলেন, এটিও ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। এতে তিনি গুরুকে অতিক্রম করেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। এটি অনুমান ১৪৭৬ সালে তৈরি, যাকে রেনেসাঁর প্রতীক বলা যায়। ভেরােক্কিও ডেভিডকে যথাসম্ভব সহজসরল, স্বাভাবিক, মরলােকের সাধারণ, অথচ অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ, যুবার মত গড়েছেন। তার চেহারা চেহারা, কিন্তু রােগার দিকেই বলা যায়। এর ভাবখানা বা ভঙ্গীটা প্রায় দোনাতেল্লোর ডেভিডের মত। সেই ডান পায়ে ভর দিয়ে বাঁ পা শিথিল করে দাঁড়ানাে, বাঁ হাত মুঠো করে বাঁ কোমরে রাখা, ডান হাত সােজা করে বেপরােয়া ভাবে, পায়ের কাছে কাটা মুণ্ড ফেলে, তরােয়াল পাশ দিকে সরিয়ে রাখা, যেন কাজ সেরেছেন এই ভাব। মাথায় বারি চুল, গলায় হারে ঝােলানাে তক্তি, খালি গা। অল্পবয়স্ক বিজয়ী যুবা ডেভিডের হাবেভাবে এতই ছেলেমানুষি গর্ব আর অসীম আত্মগরিমা ফুটে উঠেছে যেন দর্শককে তিনি চোখের চাউনি মাথা হেলানোের ভঙ্গিতে স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি অসাধ্যসাধন করেছেন। এই মনস্তত্ত্বর ব্যাপারে ভেরােক্কিও যেন দোনাতেল্লোকেও হারিয়ে দিয়েছেন।

প্রশ্ন হল দোনাতেল্লোর ঘোড়সওয়ারের মূর্তি ২য় সর্বোত্তম হলে সর্বোত্তম মূর্তিটি কোনটি। এর উত্তর হল ভেরোক্কিওর ঘোড়সওয়ার মূর্তি। তার আসল নাম অন্য ছিল, ভেরোক্কিও নামটি তার গুরু দিয়েছিলেন, যার থেকে তিনি স্বর্ণকারের কাজ শিখেছিলেন। ইতালীয় ভাষায় ভেরোক্কিও মানে হচ্ছে অভ্রান্ত-চোখ। তার বানানো মূর্তিটি হল এক ঘােড়সওয়ার যােদ্ধার, যিনি ভেনিসের সৈন্যদলের সবচেয়ে বড় সেনাপতি ছিলেন। নাম ছিল কলেওনি। ১৪৮০ থেকে ১৪৮৮ সালের মধ্যে তার তৈরি মূর্তিটির নাম হচ্ছে ইকুয়েস্ট্রিয়ান স্ট্যাচু অফ বার্তোলোমেও কলেওনি। কলেওনি ছিলেন অতি সুযােগ্য সেনাপতি। যেমন সৈন্যদের যুদ্ধ চালাতে পারতেন তেমনি যুদ্ধ করতে পারতেন। গায়ে ছিল অসীম শক্তি, মনে ছিল দুর্ধর্ষ সাহস। সারা গায়ে অত ভারী বর্ম পরেও ঘােড়দৌড়ে সবাইকে হারিয়ে দিতে পারতেন। আবার তিনি ছিলেন একজন সুপণ্ডিত। সেনানিবাসে যারা শিল্পী বা ছাত্র ছিল তাদের খুব উৎসাহ দিতেন। তেমনি ছিলেন নম্র, বিনয়ী, ভদ্র। কখনও বেশী খেতেন না বা পান করতেন না, ভীষণ মিতাহারী ছিলেন। সেইসাথে ছিলেন অত্যন্ত সৎ। কলেওনির মৃত্যুর পর তিনি তার সব সম্পত্তি এই শর্তে ভেনিসের প্রজাতন্ত্রকে দিয়ে যান যে, ভেনিস সরকার সেন্টমার্কের চকে তার একটি ঘােড়সওয়ার মূর্তি স্থাপন করবে। সেন্টমার্কের চকে কোন মূর্তি স্থাপনা করা আইনবিরুদ্ধ ছিল, তাই ভেনেশীয়রা ধরে নেয় যে কলেওনির টাকাপয়সা কিছুই ভেনিস পাবে না। তারপর এদের মনে পড়ল যে সেন্টমার্ক বিদ্যালয়ের সামনে একটি ছােট চক আছে। সেই চককে সেন্টমার্কের চক বললেই হয়ে যায়। এরপর সেখানে ঘোরসাওয়ারের মূর্তি তৈরির কাজ ভেরোক্কিওকে দেয়া হলো। এই সিদ্ধান্তের ফলে কলেওনির টাকাপয়সাও ভেনিসের হস্তগত হল।

ভেরোক্কিও এত সুন্দরভাবে সওয়ারসুদ্ধ ঘােড়ার ভারসাম্য রাখলেন যে এই ঘােড়ার সমুখের শূন্যে ভােলা বাঁ পায়ের তলায় গার্টেমেলাটার মত বল রাখতে হল না। ভেরােক্কিও মূর্তিটি গাট্টেমেলাটার চেয়ে অনেক উঁচু বেদীর উপর রাখার ফলে ভেরােক্কো কলেওনির সমস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ এমন একটু বাড়িয়ে বা উঁচিয়ে দিয়েছিলেন যে, মাটি থেকে দেখলে কলেওনিকে সত্যিই অত্যন্ত তেজস্বী, বীর, নির্ভীক, ধর্মভীরু, সৎ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অজেয় দেখায়। এর পাগুলি অনেক লম্বা, কলেওনি টান করে স্টিরাপে ভর দিয়ে ঘােড়ার উপর উঠে দাঁড়িয়েছেন, তার ভঙ্গী দৃপ্ত, পৃথিবীতে কারাের তােয়াক্কা করেন না। ঘােড়াটিও সেরকম অত্যাশ্চর্য, অপূর্ব। ১৪৭৯ সালে ভেনিসে ঘােড়াটি ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয় এবং ভেরােক্কিও মারা যাবার পর ১৪৮৮ সালে মূর্তিটি স্থাপিত হয়। এই হল ভেরােক্কিওর কলেওনি, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, অত্যাশ্চর্য, ঘােড়সওয়ার মূর্তি।

১৫শ শতকে দোনাতেল্লো আর ভেরােক্কিও শুধু যে ভাল ভাস্কর ছিলেন তা নয়, অত্যন্ত ভাল গুরুও ছিলেন। তাই দেশ দেশান্তর থেকে অনেকে তাদের কাছে ভাস্কর্য সম্বন্ধে শিক্ষা নিয়ে গেছে এবং তার ফলে ১৬শ শতকে চারিদিকে ভাস্কর্যের মানও অনেক বেড়ে যায়।

ট্রেডিশনাল শিল্পের প্রভাবের কারণে আর্লি রেনেসাঁয় সমস্যা ও গথিক শৈলীর মিশ্রণ

পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা যখন শিল্পকর্মের নতুন শৈলীর জনক ও পথপ্রদর্শক ব্রুনেল্লেস্কি, আলবের্তি, দোনাতেল্লো ও মাসাচ্চোর অনুসরণ করতে যায় তখন তাদের সামনে একটা সমস্যা দেখা দেয়। ধনী বা অভিজাত শ্রেণির যেসব পৃষ্ঠপােষক তাদেরকে কাজের জন্য কমিশন দিতো, অর্থাৎ চুক্তি করতো তারা ট্র্যাডিশনাল বা প্রচলিত পদ্ধতি ও শৈলীর মাধ্যমে সৃষ্ট কাজই বেশি পছন্দ করত। এতে শিল্পীদের পক্ষে নতুন এবং নিরীক্ষাপ্রধান শৈলীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে নতুন শৈলীর সঙ্গে কমিশনের মাধ্যমে পাওয়া প্রস্তাবিত কাজের বিরােধ ছিল। প্রাচীন গ্রিস ও রােমের ক্লাসিক্যাল শৈলী, যার পুনর্ব্যবহার দিয়ে রেনেসাঁ শিল্পের শুরু, তার সঙ্গে পরবর্তীকালের প্রচলিত ট্রেডিশনাল পদ্ধতির মেলবন্ধন সহজ ছিল না। স্থপতিদের মতাে ফ্লোরেন্সে ১৫শ শতকের প্রথম পর্বের (আর্লি রেনেসাঁ) চিত্রকর ও ভাস্করদেরও নতুন পদ্ধতিকে প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ব্যবহার করতে হয়েছে। নতুন এবং প্রচলিত পদ্ধতি অর্থাৎ আধুনিক শৈলী ও গথিক শৈলীর সংমিশ্রণ করে ১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শিল্পীদের কাজ করতে হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যই রেনেসাঁর প্রাথমিক পর্বের শিল্পকলার প্রধান প্রবণতা ছিল।

গিবের্তি, অ্যাঞ্জেলিকোর ও উচ্চেল্লোর শিল্পকর্মে নতুন ও পুরনো শৈলীর মিশ্রণ

১৫শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নতুন ও প্রচলিত শৈলীর সফল সংমিশ্রণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ দোনাতেল্লোর প্রজন্মের স্থপতি লোরেন্‌ৎসো গিবের্তি (Lorenzo Ghiberti) (১৩৭৮-১৪৫৫ খ্রি.)। দোনাতেল্লোর কাজে যেমন সবই নতুন দেখা যায়, গিবের্তির ভাস্কর্যে তেমন দেখা যায় না, বরং সেখানে পুরাতন অর্থাৎ মধ্যযুগের শিল্পরীতির অনুসরণ দেখা যায়। কিন্তু গিবের্তি গথিক শিল্পের প্রতি আনুগত্য দেখালেও সূক্ষ্মভাবে রেনেসাঁর আধুনিক শিল্পপদ্ধতি ও শৈলীর ব্যবহার করেন। তিনি দোনাতেল্লোর মতাে বলিষ্ঠভাবে এবং স্পষ্টরূপে স্পেসের ধারণা দেন না, কিন্তু তার রিলিফ ভাস্কর্যে গভীরতার আভাস থাকে এবং মূল ফিগারগুলাে নিরপেক্ষ পটভূমিতে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

গিবের্তি যেমন গথিক শিল্পশৈলীর ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে না এসেও সূক্ষ্মভাবে রেনেসাঁ শিল্পশৈলীর ব্যবহার করেছেন, ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোও (Fra Angelico) (১৩৯৫-১৪৫৫ খ্রি.) তেমন কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি ধর্মীয় বিষয়ের চিত্রায়নে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মাসাচ্চোর নতুন পদ্ধতির সংমিশ্রণ করে ব্যবহার করেছিলেন। ফ্লোরেন্সের সান মার্কো মঠের দেয়ালে তিনি “সান মার্কো অল্টারপিস” নামে যে ফ্রেসকো আঁকেন (১৪৩৮-১৪৪৩ খ্রি.) তা ছিল তার সর্বোৎকৃষ্ট কাজের অন্যতম।

ফ্লোরেন্সের আর একজন প্রথম পর্বের রেনেসাঁ শিল্পী পাওলাে উচ্চেল্লোর (Paolo Uccello) (১৩৯৭-১৪৭৫ খ্রি.) কাজেও ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর অনুসৃত সংমিশ্রণ পদ্ধতি দেখা যায়। মেডিচি পরিবারের প্রাসাদের জন্য তার তৈরি কাঠের ওপর তেল রঙের চিত্র “দ্য ব্যাটল অফ সান রোমানো“-তে (১৪৩৫-১৪৬০ খ্রি.) তিনি যুদ্ধের যে তিনটি দৃশ্য আঁকেন তার শৈলী আপাতদৃষ্টিতে মধ্যযুগীয় মনে হবে। কিন্তু ভালাে করে দেখলেই বােঝা যাবে মধ্যযুগের (গথিক) শিল্পরীতির প্রতি তার আনুগত্য ছিল বাহ্যিক, প্রকৃতপক্ষে তিনি পারস্পেকটিভের আধুনিক সূত্রকেই অবলম্বন করেছেন, যার জন্য ছবির ফিগারগুলাে স্পেসের ভেতর স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যেন তারা খােদাই করা, আঁকা বা পেইন্ট করা নয়। কিন্তু গাণিতিক পদ্ধতির নিখুঁত অনুসরণ করতে গিয়ে তার ছবিতে যুদ্ধের দৃশ্যে ক্ষেত্র অর্থাৎ মঞ্চ হয়ে গিয়েছে কৃত্রিম বা অলীক (আর্টিফিশিয়াল)। এর কারণ উচ্চেল্লো পারস্পেকটিভের ব্যবহার জানলেও আলাে, ছায়া এবং বাতাসের (অ্যাটমসফিয়ার) ব্যবহার করে পারস্পেকটিভের ভিত্তিতে তৈরি দৃশ্যের কঠোর বাহ্যিক সীমারেখা (আউটলাইন) মসৃণ করার কৌশল রপ্ত করেননি। উচ্চেল্লোর এই ব্যবহারিক জ্যামিতিপ্রীতি সত্ত্বেও তার শিল্পকর্মের উৎকৰ্ষ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন ওঠে না।

গথিক শৈলীতে গৎসোলি, মানতেঞা ও ফ্রাঞ্চেস্কার আনুগত্যহীনতা

ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর মতাে শিল্পীরা প্রচলিত গথিক শিল্পপদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিহার না করেও আধুনিক রেনেসাঁ পদ্ধতির ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু উচ্চেল্লো প্রচলিত পদ্ধতি ত্যাগ না করে আধুনিক পদ্ধতির দিকেই বেশি ঝুঁকেছিলেন। যেসব শিল্পী প্রচলিত পদ্ধতির প্রতি কম আনুগত্যবােধ করেছেন এবং খুব একটা নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন না, যারা নির্দ্বিধায় এবং মুক্তচিত্তে আধুনিক পদ্ধতি ও শৈলীর ব্যবহার করেছিলেন, তাদেরই একজন ছিলেন বেনৎসো গৎসোলি (Benozzo Gozzoli) (১৪২১-১৪৯৭)। তিনি ফ্লোরেন্সে মেডিচি পরিবারের প্রার্থনা কক্ষের দেয়ালচিত্র আঁকার কমিশন লাভ করেন। ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর শিষ্য হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন ছিল। প্রার্থনাকক্ষের দেয়ালে তিনি ‘জার্নি অব দ্য মাজাই’ (১৪৫৯ – ১৪৬২ খ্রি.) নামে যে ফ্রেস্কো আঁকেন তার মাধ্যমে যেন প্রমাণ করতে চেয়েছেন সমকালীন জীবনের উৎসবমুখরিত দৃশ্যের উপস্থাপনায় নতুন শৈলী খুব কার্যকর। ছবিটিতে সামনে অশ্বারােহী এবং পেছনে ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠা পাহাড়ি পথের শেষে চূড়ায় দুর্গ-প্রাসাদ যেন পারস্পেকটিভের ‘ভ্যানিশিং পয়েন্ট’ সূত্রের বাস্তব উপস্থাপন।

ফ্লোরেন্সের উত্তরে এবং দক্ষিণে বেশ কিছু শিল্পী দোনাতেল্লো এবং মাসাচ্চোর নতুন শিল্পরীতি ও পদ্ধতির প্রতি অনুরক্ত হন, ও তাদের চেয়েও এই ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে একজন হলেন চিত্রকর আন্দ্রেয়া মানতেঞা (Andrea Mantegna) (১৪৩১ – ১৫০৬ খ্রি.)। তিনি প্রথমে ইউনিভার্সিটি শহর পাদুয়াতে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি উত্তর ইতালিতে মানতোভার (Mantua) শাসকের দরবারে নিয়ােজিত হন। পাদুয়ার চার্চে জত্তোর (Giotto) ফ্রেসকোর কাছেই মানতেঞা কয়েকটি দেয়ালচিত্র আঁকেন যেখানে সেইন্ট জেমসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে (এদের মধ্যে ১৪৫৫ সালে আঁকা “সেইন্ট জেমস লেড টু হিস এক্সেকিউশন” একটি)। জত্তো এবং দোনাতেল্লোর মতাে মানতেঞা বাস্তবে কোনাে দৃশ্য কেমন দেখায় তা কল্পনা করে নিতেন। কিন্তু এই বাস্তবের বৈশিষ্ট্য ও মান জত্তোর সময় যেমন ছিল তার তুলনায় ছিল কঠোর এবং উচ্চতর পর্যায়ের। জত্তোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিষয়ের অন্তর্গত অর্থ বা তাৎপর্য। যেমন, কোনাে বিশেষ পরিস্থিতিতে নর-নারী কীভাবে চলাফেরা বা ব্যবহার করে থাকে, এই বিষয়। তার মতাে মানতেঞা বাইরের রূপের প্রতি মনােযােগ দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি গথিক শৈলীর প্রতি কোনাে আনুগত্যই দেখাননি বরং মাসাচ্চিওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছবির ফিগারগুলােকে তৈরি করেছেন ভাস্কর্যের মতাে সরল ও সুঠাম ভঙ্গিতে। মাসাচ্চোর মতাে তিনিও পারস্পেকটিভের গাণিতিক পদ্ধতি ও সূত্র ব্যবহার করেন কিন্তু উচ্চেল্লোর মতাে এই সূত্র বা পদ্ধতিকে মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করে তার ফলাফল দেখতে জাদুকরের মতাে আগ্রহী হননি। তিনি পাস্পেকটিভ ব্যবহার করেছেন ছবিতে মঞ্চ তৈরি করার উদ্দেশ্যে যার ওপর ফিগারগুলাে দাঁড়াবে এবং রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে চলাফেরা করছে, এমন দেখাবে। একজন দক্ষ নাট্য পরিচালকের মতাে তিনি এই মঞ্চে ফিগারগুলােকে দাঁড় করান এবং বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেখান যেন নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট মুহূর্তের তাৎপর্য ফুটে ওঠে এবং কাহিনির গতি-প্রকৃতি বােঝা যায়।

ইতালির উত্তরাঞ্চলে মানতেঞা যখন রেনেসাঁর প্রথম পর্বে এই নতুন পদ্ধতির শিল্পরীতি প্রয়ােগ করছিলেন, ফ্লোরেন্সের দক্ষিণে পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেস্কা (Piero della Francesca) (১৪১৫ – ১৪৯২ খ্রি.) সেই সময় আরেৎসো (Arezzo) এবং উর্বিনো (Urbino) শহরে একই ধরনের কাজ করছিলেন। গৎসোলি এবং মানতেঞার ফ্রেসকোর মতাে পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেস্কার ফ্রেস্কোও ১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কিছু পর আঁকা হয়েছিল। এই বিবেচনায় তিনি রেনেসাঁর প্রথম পর্বের পরবর্তী পর্বের অর্থাৎ হাই রেনেসাঁর রেনেসাঁ শিল্পী। ১৪৬৪ সালে তার আঁকা ‘দ্য ড্রিম অফ কনস্ট্যান্টাইন’ ফ্রেসকোতে সম্রাট কনস্টান্টিনকে যুদ্ধের আগে তাঁর তাঁবুতে নিদ্রিত অবস্থায় দেখা যায়। নিদ্রায় তিনি স্বপ্নে দেবদূতকে দেখেন এবং খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে যুদ্ধে জয়ী হবেন বলে তার কাছে শােনেন। শয্যার পাশে দেখা যায় তার ভৃত্য বসে আছে এবং সামনে রয়েছে দুই প্রহরীর দণ্ডায়মান ফিগার। এই ফ্রেসকো আঁকতে গিয়ে ফ্রাঞ্চেস্কা পারস্পেকটিভের ব্যবহার করে তাঁবুর অভ্যন্তর এবং পটভূমির দূরত্ব সূচিত করেছেন। এর চেয়েও উল্লেখযােগ্য হলাে এই ছবিতে আলাের ব্যবহার। ছবির দৃশ্য এবং ফিগারের উপস্থাপনে পারস্পেকটিভ ব্যবহার এবং ফিগারের সামনের অংশ ফোরশর্টেনিং করার পদ্ধতি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, আলােছায়ার খেলা দিয়েও বিষয়ের বিভিন্ন ডিটেইলস স্পষ্ট এবং বাস্তবানুগ করে তােলা হয়েছে। সরল এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি বাস্তবের মায়া সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। 

কম্পোজিশনের সামঞ্জস্যময়তা ও ফিগারের সন্নিবেশনের সমস্যা এবং পোল্লাইওলো ও বত্তিচেল্লির সমাধান প্রচেষ্টা

রেনেসাঁর প্রথম পর্বের শিল্পকর্মে নতুন পদ্ধতি ও শৈলীর ব্যবহার অনেক শিল্পীকে আকৃষ্ট করে কিন্তু এই শৈলী ব্যবহারের ফলে তাদের অন্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পারস্পেকটিভ এবং প্রকৃতির অনুশীলন এই সমস্যার সমাধানে খুব একটা কার্যকর হয় নি। সমস্যাটি ছিল ছবিতে বাস্তবের প্রতিফলন করতে গিয়ে ফিগারগুলোকে কীভাবে ফ্রেমের ভেতর কম্পােজিশনে সন্নিবেশিত করা হবে? বাস্তবে কোন দৃশ্যে ফিগারগুলো সামঞ্জস্যময়তার সঙ্গে দাঁড়ায় কিংবা বসে না, তারা ভিড় করে দাঁড়ায় অথবা এমনভাবে বসে যে সবাইকে দেখা যায় না। এই সমস্যার সমাধানে মধ্যযুগের শিল্পীরা ইচ্ছেমতাে ফিগারগুলোকে সাজিয়ে দেখিয়েছে যেন প্রত্যেককে স্পষ্টরূপে দেখা যায়। এমনকি ১৪শ শতকের শিল্পী সিমোনে মারতিনি (Simone Martini) (১২৮৪ – ১৩৪৪ খ্রি.) ছবির ফিগারগুলোকে সুন্দর ডিজাইনের ভেতর এঁকেছেন। ১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ হাই রেনেসাঁর সময় ফ্লোরেন্সের শিল্পী অ্যান্তনিও দেল পােল্লাইওলাে (Antonio del Pollaiuolo) (১৪৩৩ – ১৪৯৮ খ্রি.) ছবির ফিগার নিখুঁতভাবে আঁকা এবং সেগুলি সামঞ্জস্যময় কম্পােজিশনের ভেতর সাজানাের উপায় খুঁজে বের করেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে শুধু বুদ্ধি কিংবা সহজাত অনুভূতি নয়, নির্দিষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তার এই প্রচেষ্টা খুব সফল বলা যাবে না এবং এর ফলে সুন্দর ছবিও তৈরি হয়নি, কিন্তু ফ্লোরেন্সের শিল্পীরা উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে কীভাবে অগ্রসর হয়েছিল – এখানে তার একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। কম্পােজিশনের কঠোর সামঞ্জস্যময়তার সঙ্গে শিল্পসৌন্দর্যের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন এবং প্রাকৃতিক বা বাস্তবিক, এর জন্যই ছবির ভেতর গতিশীলতা দেখানাের প্রয়ােজন অনুভূত হয়। পােল্লাইওলাের ছবিতে সচেতনভাবে এই গতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা থাকলেও তিনি এর জন্য প্রকৃতি বা বাস্তবের দৃশ্য নয়, বরং মডেল ব্যবহার করেছেন বলেই মনে হয়। তার সমসাময়িক ফ্লোরেন্সের অন্য চিত্রকররাও একই কৌশলের ব্যবহার করে ভ্রমের শিকার হয়েছিলেন। এক প্রজন্মের পর এই সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান বের করে রেনেসাঁ শিল্প তার শীর্ষে পৌছায়।

ছবিতে কম্পােজিশনের, বিশেষ করে ফিগার সন্নিবেশের সমস্যাকে রেনেসাঁর প্রথম পর্বের (আর্লি রেনেসাঁ) যে চিত্রশিল্পীরা সমাধানের চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন সান্দ্রো বত্তিচ্চেল্লি (Sandro Botticelli) (১৪৪৫ – ১৫১০ খ্রি.)। তার একটি বিখ্যাত ছবির আছে, যার বিষয় খ্রিষ্টধর্মভিত্তিক নয়, বরং ক্লাসিক্যাল মিথ – ভেনাসের জন্ম। ১৪৮৪ থেকে ১৪৮৬ সালে আঁকা এই চিত্রকর্মটির নাম “দ্য বার্থ অফ ভেনাস“। মধ্যযুগে শিল্পীদের কাছে এই মিথ এবং ক্লাসিক্যাল কবিদের কবিতায় ব্যবহৃত অন্য মিথের কথা জানা থাকলেও রেনেসাঁ পর্বেই ক্লাসিক্যাল মিথগুলো শিল্পের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। শুধু সৌন্দর্যের জন্য মিথের দৃশ্য এবং ফিগারগুলোর প্রতি শিল্পীদের আকর্ষণ জন্মায়নি, তাদের ভেতর যে গভীর ও রহস্যময় সত্য নিহিত, সেই বিষয়টিও তাদের আকৃষ্ট করেছে। ভেনাসের জন্ম সম্পর্কিত যে কাহিনি মিথে বলা হয়েছে তার মাধ্যমে শুধু রহস্যময়তা আর সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্যের পেছনে ঐশ্বরিক বাণীরও সন্ধান পেয়েছে রেনেসাঁর উদারচেতা ও শিক্ষিত শিল্পী এবং শিল্প-রসিকগণ। পােল্লাইওলাে যেখানে মধ্যযুগের গথিক শিল্পরীতি ও রেনেসাঁর শিল্পরীতির সমন্বয়ে ব্যর্থ হন, সেখানে এই ছবি আঁকতে গিয়ে বত্তিচেল্লি সফল হন। তিনি ছবির মধ্যে সন্তোষজনকভাবে কম্পােজিশনের সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বতেচেল্লির ছবিতে ফিগারগুলোকে খুব অনমনীয় মনে হয় না যার ফলে জীবন্ত রূপের সৃষ্টি হয়েছে। মাসাচ্চো বা পােল্লাইওলাের ছবির ফিগারের মতাে বতেচেল্লির আঁকা ‘দ্য বার্থ অফ ভেনাস’ ছবিতে ফিগারগুলাে নিখুঁতভাবে আঁকা হয়নি। কিন্তু কম্পােজিশনের ছন্দময়তা এবং ফিগারগুলাের সুষমামণ্ডিত গতিভঙ্গি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ছবিটি দেখে গিবের্তি এবং ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো অনুসৃত গথিক পদ্ধতি ও ঐতিহ্যের কথা মনে হতে পারে এমনকি ১৪শ শতকের শিল্পের কথাও মনে আসবে অথবা এই সময়ের ফরাসি স্বর্ণকারদের অলংকরণের কাজও মনে আসতে পারে। বত্তিচেল্লির ছবিতে বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নেই, যেমন ভেনাসের গলা দেখা যায় বেশ লম্বা, বা কাঁধ হঠাৎ যেন ওপর থেকে নিচে নেমে গিয়েছে, বাম হাত অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিচে নামানাে এবং সেটি মাথার চুলের প্রান্ত ধরে রাখা অবস্থায় দেখানাে হয়েছে। বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে বত্তিচেল্লি সুষমামণ্ডিত এবং পবিত্র সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য ডিজাইনের সামঞ্জস্যময়তা ব্যবহার করেছেন যার ফলে সূক্ষ্ম, ভঙ্গুর এবং সীমাহীনভাবে স্পর্শকাতর এক নারী সৃষ্টি হয়েছে যাকে রক্ত-মাংসের হলেও অপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়। বত্তিচেল্লি স্টাইলাইজেশনের সঙ্গে সমন্বয় করেছেন আদর্শায়নের, অর্থাৎ তাঁর ছবিতে ক্লাসিক্যাল পর্বের ছবি এবং রেনেসাঁ শৈলীর সংমিশ্রণ ঘটেছে। ছবিতে ফিগার সন্নিবেশের সমস্যার সমাধানের অন্য দৃষ্টান্ত বতেচেল্লির ১৪৭০ এর দশকের শেষের দিক থেকে ১৪৮০ এর দশকের প্রথম দিকে আঁকা “প্রিমাভেরা‘ বা বসন্ত নামক তেলরং ছবিটি। এখানেও মিথের ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মিথের সঙ্গে কবির কল্পনাও মেশানাে যার জন্য ছবিটির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া বেশ দুরূহ। এই ছবিতে বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নয়, বরং প্রভাব ফেলেছে কল্পনা এবং আদর্শায়ন।

ফিলিপ্পা লিপ্পি ও পেরুজিনোর শিল্পকর্ম

রেনেসাঁর প্রথম পর্বের আর একজন শিল্পী হলেন ফিলিপ্পো লিপ্পি (Filippo Lippi) (১৪০৬ – ১৪৬৯) যিনি মাসাচ্চিওর মতাে নিরেট (সলিড) এবং বড় আকারের ফর্ম (ফিগার) তৈরি করেছেন তার ছবিতে, যদিও এই সব বিশালাকার (মনুমেন্টাল) ছিল না। তিনি ডিটেইলের ব্যবহার করে বিশাল আকারের অভাব পূরণ করেছিলেন। তার ছবিতে সরলরৈখিকতার যে প্রবণতা দেখা যায় তার উৎস ছিল দোনাতেল্লোর ভাস্কর্য কর্মে। উফ্‌ফিৎসি (Uffizi) সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত ১৪৫০ থেকে ১৪৬৫ সালের মধ্যে আঁকা লিপ্পির ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড‘ এবং সান লরেঞ্জোতে সংরক্ষিত ১৪৪০ সালে আঁকা তার ‘মারতেল্লি অ্যানানসিয়েশন’ ছবি দুটিতে লিপ্পির ব্যবহৃত শৈলী রেনেসাঁর প্রথম পর্বের শৈলীর পরিচায়ক।

এই সময়ের আরেক শিল্পী পিয়েত্রো পেরুজিনাে (Pietro Perugino) (১৪৪৬ – ১৫২৩ খ্রি.) উমব্রিয়া (Umbria) অঞ্চলের পেরুজা (Perugia) শহরে তার শিল্পী জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। তিনি তার ছবির কম্পােজিশনে ব্যবহার করেন সরল ফর্ম এবং সরল ভঙ্গি। তার আঁকা ল্যান্ডস্কেপগুলাে সিগ্ধ, ফিগার ও পােশাক ছন্দময় রেখায় সমৃদ্ধ এবং মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। এই সব আদর্শায়িত (আইডিয়ালাইজড) ছবি পরবর্তী সময়ে শিল্পী রাফ্ফা‌য়েল্লো (Raffaello বা Raphael) (১৪৮৩ – ১৫২০ খ্রি.) এর ওপর প্রভাব ফেলেছিল। পেরুজিনাে ফ্লোরেন্স এবং রােমেও কিছুকাল কাজ করেন। তার ছবির মধ্যে ১৪৮৩ থেকে ১৪৯৩ সালের মধ্যে আঁকা ‘পিয়েত্তা (Pietà)’ এবং লুকা সিনিওরেল্লির (Luca Signorelli) সাথে মিলে ১৪৮৩ থেকে ১৪৯৫ সালের মধ্যে আঁকা ‘ক্রোচিফিস্‌সিওনে (Crocifissione)‘ (ইংরেজিতে কুসিফিকশন (Crucifixion)) উল্লেখযােগ্য।

আর্লি রেনেসাঁর অন্য দুই ভাষ্কর

এই চার দিকপাল ছাড়াও আরাে অনেক ভাস্কর নানা ভাবে কাজ করে ১৫শ শতকে ইটালীয় ভাষ্কর্যকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিলেন। এই শতকেই নানান চার্চ, প্রাসাদে, বড়লােকের বাড়িতে বহু ভাস্কর্যের কমিশন আসে। ফলে ১৫শ শতকের শেষে ইটালিতে ভাস্কর্যের মান এত বেড়ে গেল যে ইওরােপের দূর দূর দেশ থেকে ছাত্ররা এসে দোনাতেল্লো, ভেরােক্কিও, লুকার মত লােকের কাছে কাজ শেখার জন্য ব্যাকুল হতে লাগলো। অন্য দিকে জার্মানীর গেরহার্টের প্রভাব ইটালীয় ভাস্কর্যের পরবর্তী যুগে কিছু কম ছিলনা। ব্রুনেলেস্কি, গিবের্তি, দোনাতেল্লো, লুকা ও ভেরোক্কিও ছাড়া এই সময়ের আরও দুজন ভাষ্কর উল্লেখযোগ্য। এদের প্রথম জন হচ্ছেন আগোস্তিনো দি দুচ্চো (Agostino di Duccio) (১৪১৮-৮১)। এর কাজ রিমিনি শহরের চার্চে বেশী আছে। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন দেসিনিয়ানো দে সেত্তিঞানো (Desiderio da Settignano, আনু. ১৪৩০-১৪৬৪), তিনি দোনাতেল্লোর ছাত্র ছিলেন। ফ্লোরেন্সের বার্জেলােতে তার তৈরি একজন নারীর একটি আবক্ষ মূর্তি আছে। এত অপরূপ, কমনীয় সূক্ষ্ম কাজ খুব কম আছে, মহিলা খুবই সুন্দরী, কিন্তু শিল্পী তাকে আরাে সুন্দর মায়াময় বা লাস্যভাবময় করার কোন চেষ্টা করেননি। চিত্রকর পােলাইউলাে বা ভেরােক্তিও বা পিয়েরাে দেল্লা ফ্রাঞ্চেকার মেয়েদের ছবির মতই এই মূর্তিটি উৎকৃষ্ট।

ইতালির হাই রেনেসাঁ

সময়কাল, প্রধান শিল্পীগণ ও বৈশিষ্ট্য

১৫শ শতকে নয়, ১৬শ শতকের ইতালিতে ১৫০০-১৫৩০ সালের সময়কালেই ইতালিতে রেনেসাঁ শিল্প তার শীর্ষস্থানে পৌছায় যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হাই রেনেসাঁ’। ১৬শ শতকের শুরু ছিল ইতালির শিল্পের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়েই ইতালিতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci, ১৪৫২-১৫১৯ খ্রি.), মিকেল্যাঞ্জেলো (Michelangelo, ১৪৭৫-১৫৬৪ খ্রি.), রাফ্‌ফায়েল্লো (Raphael বা Raffaello, ১৪৮৩-১৫২০ খ্রি.), তিৎসিয়ানো (Titian বা Tiziano, ১৪৮৮/৯০-১৫৭৬ খ্রি.), কোরেজিও (Antonio da Correggio, ১৪৮৯-১৫৩৪ খ্রি.) এবং জোর্জোনে (Giorgione) এবং উত্তরাঞ্চলের ইউরােপে আলব্রেশট ডুরার ও হােলবেইনের মতাে শিল্পীর আবির্ভাব হয়। তিৎসিয়ানো, কোরেজিও এবং জোর্জোনে ভেনিসে ইতালিয়ান রেনেসার সূচনা করেন।

রেনেসাঁর শীর্ষবিন্দু ১৬শ শতকের যে সময়ে চিহ্নিত (১৫০০-১৫৩০) তখন ইতালির শিল্পকলার ক্ষেত্রে তিনজন প্রতিভাবান শিল্পী দোর্দণ্ডপ্রতাপে এবং অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে শিল্প সৃষ্টি করেছেন। এরা হলেন দা ভিঞ্চি, মিকেল্যাঞ্জেলো এবং রাফ্‌ফায়েল্লো। ইতালির শিল্পী এবং শিল্প-ঐতিহাসিক জোর্জো ভাজারি (Giorgio Vasari, ১৫১১-১৫৭৪) তার লাইভস অব আর্টিস্ট বইতে এদের জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে, এই তিন শিল্পীদের সময়েই রেনেসাঁ শিল্পের স্বর্ণযুগ সূচিত হয়। হাই রেনেসাঁর শিল্পীদের কৃতিত্ব ছিল এই যে তারা কল্পনা ও ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে যেমন শিল্প সৃষ্টি করেছেন, তেমনি প্রাচীন গ্রিক ও রােমক ভাস্কর্য দেখে মানবদেহের জটিল ভঙ্গির অনুকরণে আদর্শায়িত বাস্তবের প্রতিফলনও করেছেন। রেনেসাঁর প্রথম পর্বের (আর্লি রেনেসা, ১৪০০-১৫০০) শিল্পীরা যেখানে প্রকৃতির (বাস্তবের) শৃঙ্খলাবদ্ধ কিন্তু প্রাঞ্জল প্রতিফলন করেছেন, হাই রেনেসাঁ পর্বের শিল্পে প্রকৃতির (বাস্তব) পর্যবেক্ষণ থাকলেও তা ছিল পরিশীলিত এবং আদর্শায়িত।

ফ্লোরেন্স ছিল হাই রেনেসাঁ পর্বের সূতিকাগার। দা ভিঞ্চি সেখানে থেকে তাঁর প্রধান শিল্পকর্মগুলাে শুরু ও শেষ করেন, শুধু সেই কারণে এ কথা বলা হয় না। হাই রেনেসাঁর শিল্পী মিকেল্যাঞ্জেলো এবং রাফ্‌ফায়েল্লোও ওই শহরে তাদের প্রথম পর্বের কাজগুলাে করেন বলে ফ্লোরেন্সের এই খ্যাতি হয়েছে। কিন্তু হাই রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ মিকেল্যাঞ্জেলো ও রাফ্‌ফায়েল্লো যেসব কাজের জন্য খ্যাত হয়েছিলেন সেইসব বড় ধরনের কাজগুলি তারা রােম শহরেই করেছিলেন।

হাই রেনেসাঁ বা রেনেসাঁর শীর্ষপর্বে ইতালির শিল্প আর্লি রেনেসাঁর তুলনায় ভিন্ন উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। তাই এই পর্বে শিল্পচর্চাকে আর্লি রেনেসাঁরই সম্প্রসারণ বা পরিণতির দিকে যাত্রা মনে করা যায় না। আর্লি রেনেসাঁয় লক্ষ্য ছিল বাস্তব জগতের দৃশ্য এবং মানবদেহের বহিরাঙ্গের নিখুঁত আবিষ্কার। অন্যদিকে হাই রেনেসাঁ পর্বের শিল্পীদের লক্ষ্য ছিল বাইরের বাস্তবতা উপেক্ষা না করে তার ঊর্ধ্বে ওঠা অথবা তাকে কিছুটা রূপান্তরিত করা। এই সময়ের শিল্পীরা শিল্পের আদর্শ সম্বন্ধে তাদের ধারণার ভিত্তিতে প্রকৃতির বাস্তবকে প্রতিফলিত করতে চেয়েছে। এই সময়ে মানুষের মুখের সাধারণ বৈশিষ্ট্য মনে রেখে তাদের বিভিন্ন রূপ আঁকার ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ছবিতে আঁকা পোশাক আগের মতো সমসাময়িক পোশাকের মতো বাহুল্যময় করে না দেখিয়ে শিল্পীরা ভাঁজ এবং দৈর্ঘ্যকে সরল করে এঁকেছেন। ১৫শ শতকে আর্লি রেনেসাঁর শিল্পীদের কাজে যে সরলরৈখিকতার ব্যবহার ছিল হাই রেনেসাঁয় তার স্থান গ্রহণ করেছে পরিপূর্ণ ওজন (ম্যাস) ও মৃদু আলাে। অবয়বের আউটলাইনে মৃদু আলাের নমনীয় প্রান্তভাগ অস্পষ্ট আবহ সৃষ্টি করেছে যাকে দা ভিঞ্চি নাম দিয়েছিলেন স্ফুমাতো বা ধোঁয়াশা। এর সঙ্গে ১৫শ শতকের প্রথম দিকের আর্লি রেনেসাঁ শিল্পের আবদ্ধ স্পেসের কাঠিন্য ও তীক্ষ্ণতার পার্থক্য রয়েছে। ফিগারগুলির কাজ করার ভঙ্গিতে প্রদর্শিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ ও ছন্দময় সামঞ্জস্যময়তা; আলােছায়ার বলিষ্ঠ খেলায় পরিস্ফুট হয়েছে নাটকীয়তার ব্যঞ্জনা। এই সবই ছিল শিল্পে একটি উচ্চপর্যায়ের শৈলী সৃষ্টির পন্থা যার দ্বারা শিল্পীরা প্রকৃতির বাস্তবতাকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল। শিল্পীকে এই পর্বে নেহাত একজন কারিগর মনে না করার যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রবণতা দেখা দেয় তার ফলে শিল্পী তার অন্তর্নিহিত অভিজ্ঞতার সাহায্যে আদর্শরূপের অভিব্যক্তি হিসেবে শিল্প সৃষ্টি করার সুযােগ লাভ করে।

ক্ল্যাসিক্স দিয়েছিল সুসমঞ্জস শরীর বিন্যাসের ধারণা, প্রকৃতিকে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রেনেসাঁ শিল্প পূর্ণতা লাভ করেছিল। স্থাপত্যের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের আয়তনগত সম্পর্ক ঠিক করত গাণিতিক অনুপাত। ভাস্কর্যের সাধারণ নিয়ম ছিল সব অঙ্গ বিস্তৃত করলে তা যেন এক বৃত্তের পরিধি স্পর্শ করে। জ্যামিতির বিশুদ্ধ রূপ বৃত্ত ভাস্করদের পছন্দ ছিল। লিওনার্দো ও মিকেল্যাঞ্জেলো দেহ ব্যবচ্ছেদ করে সত্যিকারের শরীর সংস্থান বুঝে নেন। গাছপালা, পশুপাখি সব কিছু নিয়ে তারা প্রেক্ষিত গড়ে তুলেছেন। শিল্পে স্থানগত (space) ধারণা তারা পাল্টে দিয়েছেন। তারা বিজ্ঞানবাদী ছিলেন কিন্তু ফর্মকে (form) তারা ছােটো করেননি। রেনেশাস শিল্পের ওপর ঐতিহ্যের প্রভাব ছিল, ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের ওপর ঐতিহ্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

এখানে দা ভিঞ্চির শিল্পকর্ম নিয়ে লেখা হয়েছে, তার শিল্প দর্শন সম্পর্কে জানতে চাইলে “শিল্প দর্শন” নিবন্ধটির লিওনার্দো দা ভিঞ্চি অংশটি পড়ুন।

১৫শ শতকের শেষ দিকে দা ভিঞ্চির শিল্পকর্মগুলোতে হাই রেনেসাঁ পর্বের উপরে আলোচিত বৈশিষ্ট্যেগুলোর সূচনা হয়। দা ভিঞ্চির অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ১৫শ শতকে সম্পূর্ণ হলেও তাকে এই কারণে হাই রেনেসাঁর শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকেই মনে করা হয় এই দুই পর্বের বা শতাব্দীর শিল্পকর্মের ভেতর সেতুবন্ধ হিসেবে।

মানুষের সৃজনশীলতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম হল লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)। ফ্লোরেন্সের কাছে ভিঞ্চি হল তার জন্মস্থান। ভেরােক্কিও ছিলেন তার শিল্পগুরু, তার কারখানায় তার শিক্ষানবিশী শুরু হয়, ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষানবিশীর কাজ শেষ করে তিনি শিল্প গিল্ডের সদস্য হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। সে যুগের মানুষ বিশ্বাস করত লিওনার্দো সাধারণ মানুষ নন, ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য। বুখার্ট রেনেসাঁ যুগের শিল্প নিয়ে দুটি অতিকথা বা মিথ তৈরি করেছেন – একটি হল রেনেসাঁ শিল্প ধর্ম নিরপেক্ষ, দ্বিতীয় মিথ হল এযুগের শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য হল ক্ল্যাসিক্যাল রীতির অনুকরণ। এগুলো পণ্ডিতরা মেনে নেননি। লিওনার্দো বা মিকেল্যাঞ্জেলো ক্ল্যাসিকাল যুগের আসল নিদর্শন দেখেননি, দেখেছিলেন রােমান নকল। লিওনার্দো গ্রিক ও রােমান যুগের অনুকরণ করে শিল্প সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি সত্যের নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, যে জলের উৎসের কাছে পৌঁছুতে পারে ঘড়ার জলে তার কী প্রয়োজন (he who has access to the fountain does not go to the water pot)। সামনে, পেছনে, চতুর্দিকে প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য ভাণ্ডার, তার মধ্যে মধ্যে রয়েছে কত রকমের প্রকৃতি ও আকৃতির জৰি ও উদ্ভিদ জগৎ। এজন্য তিনি অতিন্দ্রিয়বাদ বা অ্যারিস্টটলের সীমিত বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে চাননি। আশ্চর্য ছিল তার চোখ, তার দেখার দষ্টি। একজন সমালােচক তার চোখকে রঞ্জন রশ্মির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে এই দৃষ্টি এত তীব্র ও গতিশীল যে উড্ডীয়মান পাখির গতিবেগও ধরতে পারে। তিনি বাস্তবকে তার প্রেক্ষিতে যথাযথভাবে ধরতে চেয়েছিলেন, এজন্য তিনি অংকশাস্ত্রের সহায়তা নেন। বাস্তবকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য লিওনার্দো বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, অনেক ছবি বা স্কেচ শেষ করেননি (His passion for the exact turned him towards mathematics; his passion for the actual urged him to experiement.)। লিওনার্দো মানষের শরীর সংস্থান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, অন্তত তিরিশটি শব ব্যবচ্ছেদ করে মানুষের শরীর সংস্থান নিজের চোখে দেখেছিলেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন বিশ্বকোষ সদৃশ জ্ঞানের অধিকারী, সম্ভবত তার যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি। প্রকৃতি তাকে দিয়েছিল অনন্য প্রতিভা, কল্পনা শক্তি, তিনি এমন সব কল্পনা করেছেন যা বিস্ময়কর বলে মনে হয়, এসব কল্পনাকে তিনি বাস্তব রূপ দিয়েছেন। চিত্রকলায় তিনি এমন সব সৃষ্টি এঁকেছেন যা সজীব ও সুষমামণ্ডিত। তিনি বহু বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন, এদের মধ্যে উল্লেখৰ্গে হল শরীরবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, গতিতত্ত্ব ও বীক্ষণতত্ত্ব। এগুলোর মধ্যে তিনি চিত্রকলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি এত বিষয় জানতেন যে পণ্ডিত ব্যক্তিরা তার সঙ্গে আলােচনা করে বিস্মিত হতেন, ভাজারি একথা তার শিল্পীদের ইতিহাসে লিখেছেন। তিনি কল্পনায় এমন সব চিত্রকল্প নির্মাণ করেন যে অতিসূক্ষ্ম তুলির অধিকারী হয়েও তিনি সেগুলি বাস্তবায়িত করতে পারেননি। এজন্য তার অনেক প্রকল্প ও ছবি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তার ছবির নকশা বা কার্টুন দেখার জন্য শিল্পীরা ভিড় করতেন। শিক্ষক ভেরোক্কিও ছাত্রদের প্রেক্ষিতের মধ্যে চিত্রকে স্থাপন করার পরামর্শ দেন, পুরুষ ও নারীর নগ্ন ছবি আঁকার পরামর্শ দেন, প্রকৃতিকে ভালাে করে বুঝে নিয়ে ছবি বা ভাস্কর্যের বিষয় নির্বাচিত করতে বলেন। লিওনার্দো তার গুরুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নারীর কেশ বিন্যাসকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তার চিত্রকলায় প্রকাশ করেন। তিনি লেদার নগ্নমূর্তি এঁকেছিলেন কিন্তু ছবিটি পাওয়া যায়নি। লিওনার্দো ছবিতে নিয়ে এলেন প্রেক্ষিত এবং এরিয়াল প্রেক্ষিতের ধারণা। ছবিগুলি তাদের তিনমাত্রার প্রেক্ষিতসহ জীবন্ত ও অপূর্ব সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছিল।

হাই রেনেসাঁর শিল্পকর্মে উচ্চকিত প্রকৃতিবাদ অবদমিত হয়েছিল, প্রকৃতিবাদের সুর নরম হয়ে এসেছিল এবং তার পরিবর্তে গুরুত্ব পেয়েছিল সৌষ্ঠব এবং মাধুর্য (গ্রেস)। ফর্ম ও রঙের ব্যবহারে সূক্ষ্মতার মাত্রা এনে এর বাস্তবায়ন হয়েছে। এই শৈলীর উদ্ভাবন করেন দা ভিঞ্চি যিনি তার নাম দেন ‘স্ফুমাতো’ (Sfumato) যার অর্থ ‘ধোঁয়ার মতাে’ অথবা ‘ধোয়াশা’। এর মাধ্যমে এক রঙ থেকে আরেক রঙে স্থানান্তরনকে কোমলতর করা হয় ও তার মাধ্যমে আমরা চোখ দিয়ে যে অঞ্চলকে ফোকাস করি তার বাইরের আউট অফ ফোকাসের ধোঁয়াশার মত স্থানের মিকিকিং করা হয়, অর্থাৎ চোখের দৃষ্টির সেই আউট অফ ফোকাস অঞ্চলের সেই বৈশিষ্ট্যকে দা ভিঞ্চি তার ছবিতে নিয়ে আসেন স্ফুমাতোর সাহায্যে। এর ফলে ছবিতে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটলেও তা যেন থেকে যায় অধরা। দা ভিঞ্চি বিশেষ পদ্ধতিতে ফর্ম ও রং ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিকৃতি ও দৃশ্যের বাহ্যিক সীমারেখা (আউটলাইন) এবং দৃশ্য পরিচায়ক রঙিন নকশা (কন্টুর) কিছুটা অস্পষ্ট করে এই ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেন। এর প্রকৃষ্ট নিদর্শন ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ বা ১৫১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর আঁকা বিখ্যাত মােনালিসা (Mona Lisa) চিত্রে দেখা যায়।

লিওনার্ডোর অন্য সেরা সৃষ্টি হল এই মােনালিসা, প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ব্যালকনিতে এই অপূর্ব রহস্যময়ী নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে যুগে প্রতিকৃতি আঁকার চল ছিল, ধনী লােকেরা যিশু ও মেরির ছবি ও মূর্তি তৈরি করাতেন, নিজের পরিবারের লােকজনের ছবি আঁকিয়ে নিতেন। অনেকে মনে করেন এই বিশ্ববিখ্যাত ছবিতে শিল্পীর নিজের মায়ের আদল ধরা পড়েছে। সম্ভবত এটি হল ইতালির সম্ভবত ফ্লোরেন্সের কোনাে ধনীর স্ত্রীর প্রতিক এই ছবির সৌন্দর্য হল এর রহস্যময়তা এবং নারীর মুখের বিস্ময়কর হাসি। মুখের হাসি, বিষন্নতা, আনন্দের না আবেশের সমালােচকরা হদিশ করতে পারেননি। অনুপম সৌন্দতে অধিকারিণী এই নারী তার স্রষ্টার মতাে রহস্যের আধার হয়ে আছেন।

আর্লি রেনেসাঁ শিল্পে জ্যামিতিক সূত্র অনুযায়ী সরলরৈখিক পারসপেকটিভের ব্যবহার করা হয়েছিল। এবারে হাই রেনেসাঁয় ওপর থেকে দেখা (এরিয়াল) পারসপেকটিভের উদ্ভাবন ও ব্যবহার জনপ্রিয় হল। এই ধরনের পারসপেকটিভের ব্যবহার দূরবর্তী দৃশ্য বা ফিগারকে অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তােলে এবং দিগন্তে গিয়ে তা নীল রঙে পর্যবসিত হয়। এই পদ্ধতি ও কৌশল শিল্পীরা দীর্ঘকাল ধরে অনুসরণ করলেও দা ভিঞ্চিই প্রথম ওপর থেকে দেখা পারসপেকটিভের সূত্র বর্ণনা করেন এবং নিজের পেইন্টিংয়ে তার পূর্ণ ব্যবহার করেন। তিনি শুধু শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ এবং তাত্ত্বিক। দা ভিঞ্চির কর্মজীবনের প্রথমদিকে ১৪৮৩ থেকে ১৪৮৬ সালে আঁকা একটি মাস্টারপিস ভার্জিন অব দ্য রকস-এ (Virgin of the Rocks) পিরামিডের মতাে কম্পােজিশন ব্যবহার করা হয়েছে যা হাই রেনেসাঁ পর্বের সব শিল্পীর কাছে মডেল হয়ে যায়। এই পেইন্টিংয়ে ভার্জিন মেরিকে শিশু যিশু, সেইন্ট জন এবং একজন উপবিষ্ট দেবদূতের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে একটি গুহাসিদৃশ গোপন স্থানের ভেতর যার পটভূমিতে নীলাভ ফ্যাকাশে রাঙর ভেতর বিলীয়মান রূপে পাহাড়ের ভগ্নাংশ দেখা যায়। ছবিটিতে একটি লিরিকাল বা কাব্যিক দ্যোতনা রয়েছে যা কিছুটা রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে, এতে মনে হয় ছবিটি এই মর্তের হয়েও অপার্থিব। শিল্পী এখানে আলাে-আঁধারির আবহ সৃষ্টি করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন যা রহস্যে ঘেরা অলৌকিক জগতের আভাস দেয়। শিশু যিশু হাত তুলে জনকে আশীর্বাদ করছেন।

১৫শ শতকে প্রথম পর্বের রেনেসাঁ চিত্রকরদের প্রাঞ্জলতা ও নিদিষ্টতার যে শৈলী তার পরিবর্তে দা ভিঞ্চি তার ছবির ফিগারগুলােকে দেখিয়েছেন ছায়াছন্ন অবস্থায় অর্থাৎ স্ফুমাতো আঙ্গিক ব্যবহার করে। দা ভিঞ্চির এই ছবিতে ধােঁয়াশার ভেতর প্রাকৃতিক দৃশ্যের, প্ৰস্তরের এবং ফিগারের বৈশিষ্ট্য ও বর্ণময় নকশা (কন্টোউর বা contour) দেখা যায়। ছবিটিতে দেবদূত যেভাবে তাকিয়ে আছে তা দেখে মনে হয় যেন তিনি এখনি কিছু বলবেন। এমন জীবনসদৃশ ফিগার এর আগে কেউ আঁকেনি। দা ভিঞ্চির ট্রেডমার্ক শৈলী হলাে আলোছায়ার সন্নিবেশ, যার দ্বারা তিনি তার ছবিতে বাস্তকে ধোঁয়াশার ভেতর রহস্যময়ভাবে ধারণ করতেন। তার লেখা ‘ট্রিটিজ অন পেইন্টিং’ বইতে তিনি লিখেছেন, আলােছায়ার নিখুঁত ব্যবহার করা হলে মুখের প্রতিকৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে … এতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রকৃতির নিবিষ্ট পর্যবেক্ষক ছিলেন এবং পূর্বসূরি শিল্পীদের তুলনায় আরাে বিশদভাবে কিন্তু শিল্পিত ভঙ্গিতে প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করেন। গাছপালা, লতাগুল্ম, মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা, তরঙ্গের ওঠানামা, পৰ্বতশৈলীর রুক্ষ আকার, পাখির উড্ডয়ন সবই দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি প্রতিফলিত করেছেন। তার ছবিতে বাস্তবের শিল্পিত প্রতিফলনের আর একটি দৃষ্টান্ত হল মিলানের চার্চের উদ্দেশ্যে ১৪৯৫-৯৬ সালে তার আঁকা দ্য লাস্ট সাপার (The Last Supper) ছবিটি। চিত্রাঙ্কনে তিনি জ্যামিতির ব্যবহার করেছেন। জ্যামিতিক অংকনের প্রয়ােগ ঘটেছে তার এই বিখ্যাত ছবিতে। তার আগে গিরলানদাইও শেষ ভােজের ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু তা রসােত্তীর্ণ হয়নি, এতে সংহতির অভাব দেখা দিয়েছিল। এখানে যিশুর তার বারাে জন শিষ্যকে নিয়ে নৈশভােজ করার দৃশ্যটি এমনভাবে দেখানাে হয়েছে যে দর্শকের মনে হবে যেন তিনি একটি সচল চলচ্চিত্র দেখছেন। বাস্তবসদৃশ এবং নাটকীয় ভঙ্গি ছবিটির ফিগারগুলােকে প্রাণবন্ত এবং প্রায় সচল করে তুলেছে। কিন্তু নাটকীয়তা এখানেই যে এই প্রাণবন্ত ফিগারগুলোর সত্তা বিনােদনে পর্যবসিত না হয়ে একরকম ভাবগাম্ভীর্যের সৃষ্টি করেছে যার ভেতর নিহিত রয়েছে ট্র্যাজেডির আভাস। দা ভিঞ্চির সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মােনালিসা পেইন্টিংয়ে নাম চরিত্রের জাদুকরী দৃষ্টি ও বদ্ধ ওষ্ঠদ্বয়ে পরিস্ফুট স্মিত হাসি একরকম রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছিল, যা এখনাে সবার কাছে নতুন। ছবিটির পেছনের পটভূমিতে দেখা যায় তার ট্রেডমার্ক স্ফুমাতো, যার ভেতর দূরের প্রাকৃতিক দৃশ্য হয়ে উঠেছে মায়াময়। বাস্তবের এমন মায়া সৃষ্টিতে দা ভিঞ্চির মতাে সমকালে এবং পরবর্তী সময়ে আর কেউ এমন সফল ছিলেন না এবং হননি। বাস্তবকে ভিত্তি করেই তিনি এই মায়ার সৃষ্টি করেছিলেন। লিওনার্দোর এই দ্য লাস্ট সাপারে নাটকীয় সংহতি আশ্চর্য রকমের। তিনজন করে শিষ্যের চারটি দল পিরামিডের আকার নিয়েছে, যার শীর্ষ বিন্দুতে যিশু স্বয়ং। চিত্রকরের সমস্যা কম ছিল না, সব চরিত্র পুরুষ, খাবার টেবিল ছাড়া কোনাে আসবাব ছিল না। নেই প্রেক্ষিত বা গতির সম্ভাবনা। শুধু একটি উদ্বেগভরা মুহূর্ত এবং বারােজন শিষ্যের উদ্দেশ্যে যিশু ঘােষণা করলেন বারােজন শিষ্যের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ধরিয়ে দেবে, শিষ্যদের প্রতিক্রিয়া বারােজনের বারােরকম।

জেথসিমানি উদ্যানে করুণায় বিষন্ন ঈশ্বর পুত্রের মুখ তিনি শেষ করতে পারেননি। শৈশবে দেখা এক লােভী নিষ্ঠুর যাজকের মুখটি তিনি জুডাসের মুখে বসিয়ে দেন। ভার্জিন অব দ্য রকস ছবিতে লিওনার্ডো দেখিয়েছেন উদ্ভিদ জগতকে তিনি নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করে তার ছবির পটভূমিকায় রেখেছেন। ফুলগুলি বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে, তাদের অন্তরের আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে। লিওনার্দোর সৃষ্টিতে রয়েছ তার অসামান্য নকশাগুলি। তার নােটবুকসে পাওয়া যায় প্রায় পাঁচ হাজারের মতাে। যন্ত্র, পশু ও মানুষের অ্যানাটমি, ফুলের রেখাচিত্র, এতে পাওয়া যায় কাপড়ের ভাজ, হাতের। মুদ্রা, মস্তিষ্কের নকশা, ঘােড়ার নানাভঙ্গি, মুখের আদরা। তার চিত্রে রয়েছে স্মােকি টেকনিক, রেখাগুলি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, ছায়া আলাে-আঁধারি তৈরি করেছে, মুখের দিকটি স্পষ্ট। হয়েছে, তার আলােয় পেইন্টিং-এর রেখা প্রায় দেখা যায় না, রঙের মায়াজাল তা আড়াল করে ফেলেছে। লিওনার্দো সঙ্গীতের যন্ত্র তৈরি করে নিয়েছেন, মানুষের অন্তরীক্ষে ওড়ার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করে নকশা তৈরি করেছেন। টেলিস্কোপ, সেতু, বাঁধ, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি নিয়েও তিনি ভেবেছেন, নক্শা বানিয়েছেন। ফ্লোরেন্সের চার্চ শহর ও বড়াে রাস্তার জন্য প্রকল্প তৈরি করেছেন। তিনি শুধু চিত্রকর ও স্থপতি নন, তিনি ভাস্কর্যও ভালােভাবে আরও করেছিলেন। লুডােভিকে ফোর্জার জন্য তিনি একটি ব্রোঞ্চের আশ্বমূর্তির নকশা বানিয়েছিলেন। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিলিটারি মেশিনের নক্শা বানিয়েছিলেন, তার নােটবুকে এই নকশা রয়েছে।

মিকেল্যাঞ্জেলো

দা ভিঞ্চির চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ যে দুজন শিল্পী দ্য ভিঞ্চির সঙ্গে হাই রেনেসাঁ পর্বের শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা মিকেল্যাঞ্জেলো এবং রাফ্‌ফায়েল্লো। তাঁরা কিছুকাল ফ্লোরেন্সে কাজ করলেও তাদের প্রধান কর্মস্থল ছিল রােম। প্লেটোর দার্শনিকতত্ত্ব আত্মার অমরত্বের প্রভাব পড়েছিল তার চিন্তাভাবনার ওপর। মিকেল্যাঞ্জেলো নিও-প্লেটোনিক ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তিনি শুধু গ্রিক রীতি অনুসরণ করেননি, তিনি প্যাগান রীতি ও বলিষ্ঠতাকে এর সঙ্গে মিশিয়েছেন। তিনি শরীর সংস্থানবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন, তার ডেভিডের হাতের শিরাগুলি স্পষ্ট দেখা যায়। রােমা বঁলা মিকেল্যাঞ্জেলোর জীবনীতে লিখেছেন যে তিনি বাস্তবকে তুলে ধরতে চেয়েছেন (See men and life as they are)।

মিকেল্যাঞ্জেলোর (১৪৭৫-১৫৬৪ খ্রি.) মতো প্রতিভা পৃথিবীতে অতি কমই জন্মিয়েছে, তিনি একাধারে স্থপতি, ভাস্কর, চিত্রকর এবং কবি ছিলেন এবং এই চার বিদ্যাতেই ছিলেন অতুলনীয়। তাকে ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে বাদ দিয়ে রনেসাঁসের কথা ভাবা যায় না। মিকেল্যাঞ্জেলাের শিক্ষা হয় মার্বেল পাথরে খােদাই করা ভাস্কর হিসাবে, এবং ভাস্কর হিসাবেই তিনি সবসময় নিজের পরিচয় দিতেন। তবে নিজেকে ভাষ্কর দাবি করলেও তিনিই সেই চিত্রকর যিনি তার ছবি দিয়ে রােমের পােপের প্রাসাদে ভ্যাটিকানের নিজস্ব চার্চ সিস্টিন চ্যাপেলে এঁকে চার্চের সারা ছাদ এবং সারা দেওয়াল ভরে দিয়েছিলেন। বাচ্চা ছেলে হিসাবে তিনি শীতকালে মাঠে পড়া বরফ কেটে একটি মূর্তি গড়েছিলেন। তা দেখে ফ্লরেন্সের বিখ্যাত মেডিচি পরিবারের কর্তা লােরেঞ্জো দি ম্যাগনিফিসেন্ট বা ডিউক অভ ফ্লরেন্স একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। লোরেঞ্জো এতই খুশি হয়েছিলেন যে তিনি ছেলেটিকে নিজের ছেলে বলে উল্লেখ করতেন এবং তার নিজের সংগ্রহের সমস্ত পুরনাে গ্রীক ও রােমান মূর্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেন, যাতে তার থেকে ছেলেটি শেখে। তারপর ছেলেটি একটু বড় হলে লোরেঞ্জো তাকে ভাস্কর্যের কাজও দিলেন। 

১৪৯৬ সালে মিকেল্যাঞ্জেলাে রােমে যান এবং ১৪৯৮ সালের আগস্ট মাসে ২৩ বছর বয়সী মিকেল্যাঞ্জেলো রােমের সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকায় রক্ষিত তার জগদ্বিখ্যাত ভাষ্কর্য “পিয়েটা” খােদাই করার জন্য চুক্তি লিখে দেন, তাতে তিনি লেখেন, “রােমে যে সব ভাস্কর্য আছে তার মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে সুন্দর, এরকম ভাস্কর্য আজকের দিনে কোন জীবিত ওস্তাদ গড়তে পারবেন না।” সেই ভাস্কর্য পুরাে দুই বছর ধরে খােদাই করে ১৫০১ সালের শুরুতে শেষ করে তিনি ফ্লোরেন্সে ফিরে যান। মূর্তিটি ৬৮.৫ ইঞ্চি উঁচু, নিচে বেদীর কাছে সবচেয়ে চওড়া অংশ ৭৭ ইঞ্চি, এবং সবচেয়ে পুরু অংশে ২৭ ইঞ্চি। কাটার আগে পাথরটি ছিল একটি অর্ধবৃত্তাকার সুডােল পাথর। মূর্তিটিতে মাতা মেরী পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, কোলে আড়াআড়ি ক্রুশবিদ্ধ হবার পর তার ছেলে যীশুর মৃতদেহ। তার ডান কোলে যীশুর মাথা। যীশুর ঘাড়ের তলায় যীশুর পিঠে মেরীর ডান হাত, যীশুর ডান বগলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে বুকের পাঁজরে ঠেকেছে। যীশুর হাঁটু মেরীর কোল পেরিয়ে মেরীর বাঁ উরুর উপর দিয়ে মেরীর বাঁ দিকে ঝােলানাে। যীশুর বাঁ হাঁটুর উপর হতাশভাবে মেরীর বাঁ হাত উপরের দিকে খােলা। যীশুর দেহ এমনভাবে নেতিয়ে পড়েছে যে মনে হয় প্রাণহীন শ্লথ শরীরের সমস্ত ভার মেরীর কোলে। যীশুর ডান হাত মেরীর ডান হাঁটুর সমুখ দিয়ে ঝুলে পড়েছে। বাঁ হাত নিজের কোমর বরাবর এসে তাঁর কোমরের পাশ দিয়ে মেরীর কোলে উঠে মেরীর শরীরের বাঁ দিকে পড়ে আছে। মেরী তগত, তন্ময়, পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভুলে যীশুর দিকে মুখ নত করে চোখ আধবােজা অবস্থায় ভাবছেন। হয়তো যীশুর জীবন, তাঁর মাতৃত্বের স্মৃতি, যীশুর মৃত্যু এরকম হবে বহু আগে তার ভবিষ্যদ্বাণী এসবই ভাবছেন। এরকম মহান, শােকাচ্ছন্ন অথচ স্তব্ধ, আত্মসমাহিত, সংযত শান্ত মূর্তি কেউ বােধহয় আর কখনাে করেননি।

পিয়েটা সম্পূর্ণ হবার পর ফ্লোরেন্সে ফিরে তিনি অন্যান্য ভাস্কর্যে হাত দিলেন। ইতিমধ্যে ফ্লোরেন্সে ডেভিডের দুটি বিখ্যাত মূর্তি হয়ে গেছে। দোনাতেল্লো ১৪৪০ এর দশকে এবং এবং ভেরোক্কিও (Andrea del Verrocchio, ১৪৩৫-১৪৮৮ খ্রি.) ১৪৭৩-৭৫ সালে ডেভিড নামে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি ব্রোঞ্জের। ফ্লোরেন্সে নানা সাইজের মার্বেলের মধ্যে তিনি দেখেন একটি প্রকাণ্ড মার্বলের চাঁই পড়ে আছে। আরেকজন ভাস্কর আগোস্তিনো দুচ্চো বরাত দিয়ে পাথরটি আনিয়ে ছিলেন কিন্তু সেটি অত্যন্ত লম্বা আর সরু বলে তিনি সে-পাথরে কিছু করতে পারেননি। মিকেলাঞ্জেলাে পাথরটি দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, তিনি এতে একটি মূর্তি করবেন। ইতিমধ্যে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বলে কারও কোন আপত্তি হয়নি। পাথরটি অনেক কষ্টে দাঁড় করানাে হয় ও মিকেল্যাঞ্জেলাে যাতে আপন মনে কাজ করতে পারেন তাই তার চারধারে বড় করে বেড়া দেয়া হয়। ১৫০১ সালের ১৬ই আগস্ট কাজটি শুরু হয়, কথা দিলেন দুবছরের মধ্যে শেষ করবেন, মূর্তির নাম হবে ডেভিড, তাতে তিনি মাস মাইনে পাবেন ৬টি স্বর্ণমুদ্রা। ১৫০৪ সালের জানুয়ারি মাসে মিকেল্যাঞ্জেলোর ডেভিড কোথায় স্থাপন করা হবে সেই জায়গাটি ঠিক করতে ত্রিশ জন বিখ্যাত শিল্পীর একটি কমিটি বসেছিল, এদের মধ্যে ছিলেন আন্দ্রেয়া দেল্লা রব্বিয়া, ঘিয়েরলান্দায়য়া, ফিলিপ্পো লিপ্পি, বতিচেল্লি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, পেরুজিনো, সানসাভিনাের মতো লিজেন্ডরা, এ থেকেই বোঝা যায় তিনি ততদিনে তার কাজ দিয়ে সকলকে কিরকম অভিভুত করেছিলেন এবং কিরকম শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। ১৫০৪ সালের এপ্রিলে ডেভিড মূর্তি শেষ হয় আর ৮ই জুন সেটি স্থাপিত হয় পালাৎসাে ভেকিওর প্রবেশদ্বারের সমুখের আঙ্গিনায়। কিন্তু সেটি একেবারে রাস্তার উপরে হওয়ায় মূর্তিটির উপর অনেক অত্যাচার হয়। ১৫২৭ সালে পালাৎসাে ভেল্কিও থেকে একটা বেঞ্চি ছুঁড়ে বাইরে ফেলায় বাঁ হাতটি ভেঙে তিন টুকরাে হয়ে যায়। দু তিন জায়গায় সরিয়ে নড়িয়ে অবশেষে ১৮৭৩ সালে মূর্তিটি ফ্লোরেন্সের আকাডেমিয়া দি বেলে আর্টের লম্বা গ্যালারির এক প্রান্তে রাখা হয়। সেদিন থেকে এটি সেখানেই আছে। শুধু ফ্লোরেন্সে নয়, দূর দূর থেকে ভীড় করে লোকে মিকেল্যাঞ্জেলাের এই নতুন মূর্তিটি দেখতে এসেছিল। এটি এক অতিকায় মূর্তি, বেদী বাদে মূর্তিটি একাই প্রায় সাড়ে তেরাে ফিট উচু, বেদীর প্রস্থ ১ ফুট ৫ ইঞ্চি, উচতা ১ ফুট ৩ ইঞ্চি, বেদীসুদ্ধ ডেভিড ১৮ ফুট উচু। ডান পায়ে শরীরের ভার রেখে বাঁ হাঁটু আলগা করে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে, বাঁ হাত বুকের কাছে উপর দিকে মুড়ে, কাঁধের উপর গুলতি ফেলা, ডান হাত ডান উরু বরাবর সােজা করে ফেলা, ডান হাতে গুলতির পাথর। একেবারে গ্রীক পুরুষােচিত সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা, শরীরের প্রত্যেকটি মাপ আদর্শ পুরুষের দেহের। যে দেখল সেই বলল দৈত্য, এর ওজন হলো নয় টন।

মিকেল্যাঞ্জেলাের ডেভিডের সঙ্গে দোনাতেল্লোর বা ভেরােক্কিওর ডেভিডের কোন মিল নেই। তাঁরা দেখিয়েছিলেন রােগা, ছােট, অল্পবয়স্ক ছেলে, গায়ে জামাকাপড়, বর্ম। আর মিকেল্যাঞ্জেলোর ডেভিড সম্পূর্ণ নগ্ন, বিরাট শক্তিমান যুবা। দোনাতেল্লো আর ভেরােক্কিও দুজনেই গােলিয়াথের কাটা মাথা পায়ের তলায় দেখিয়ে বুঝিয়েছেন ডেভিড গােলিয়াথের তুলনায় কত বাচ্চা। আর মিকেলাঞ্জেলাের ডেভিড গুলতিটিও এমনভাবে কাঁধে রেখেছেন যে বােঝা যায় গুলতি ছুঁড়তেও সময় লাগবে। আসলে তিনি তার নিজের দেহের শক্তি এবং মনের সাহসের উপরেই বেশী নির্ভর করেছেন। মূর্তি দেখে মনে হয় তিনি ফ্লোরেন্সবাসীকে জানাতে চেয়েছিলেন যে এই যুবাই হবে ফ্লোরেন্সের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। তিনি এক চিরন্তন মুহূর্ত, মানুষের পক্ষে এক চিরন্তন আদর্শ গড়তে চেয়েছিলেন। গ্রীক বা রােমান ক্ল্যাসিকাল সৌন্দর্যের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে মিল থাকলেও, এ মূর্তি এক নতুন আদর্শ আনে, যা হল রেনেসাঁর আদর্শ। সে আদর্শ শুধু ক্লাসিকাল সৌন্দর্যের দেহের অস্থিরতা ও পেশীর বা দাঁড়াবার অন্তরস্থ উদ্বেগ, দ্বন্দ্ব বা টানভাবের নয়, এর মধ্যে নতুন কিছু আছে। মূর্তিটির মাথা, হাত, পা প্রমাণ মানুষের মত বড় এবং সেভাবেই তৈরি। তবুও শরীরটা দেখলে মনে হয় এটি একটি বাড়ন্ত যুবার। শরীরটি খুব শক্ত, সমর্থ, মেদহীন। দাঁড়াবার ভঙ্গী, শরীরের অভিব্যক্তি, কটমট করে বিস্ফারিত নেত্রে তাকানো, কোঁচকানাে ভুরু, কপালে কুঞ্চিত রেখা, সবেই মনে হয় শরীরে ও মনে বেশ আলােড়ন উঠেছে। এই ডেভিড ক্ল্যাসিকাল গ্রীক বা রােমান মূর্তির মত শান্ত, সমাহিত, সংযত নয়। স্ফুরিত ঠোঁট দুটি একদিকে একটু বেশী খােলা, বাঁ চোখ ডান চোখের চেয়ে ওপর দিকে একটু ওঠা, নাকটি মুখের দুপাশে অসমভাবে কোঁচকানাে, ভারী ভুরুদুটি বড় লােমে ভর্তি, ঠিক যেন পরিণত বয়সের লােক, অথচ মুখটি কাঁচা। হাত, পা বয়স্ক লােকের মত। এই সব লক্ষণের ফলেই ক্ল্যাসিকাল নৈর্ব্যক্তিক সৌম্যভাবের চেয়ে ডেভিড মূর্তিটি আমাদের মন বেশি জয় করে। এভাবে গ্রিক বা রােমান ক্লাসিক্যাল সৌন্দর্যের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে মিল থাকলেও ডেভিডের এই মূর্তি এক নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে যাকে বলা যায় রেনেসাঁর আদর্শ।মিকেল্যাঞ্জেলো যে মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ তবে তার পেশি ও অস্থির গঠন এবং বিন্যাস পাঠ করেছিলেন তার ভিত্তিতে চিত্রকলার মতো ভাস্কর্য মূর্তিকেও বাস্তবসম্মত করেছেন, এটা তিনি ক্লাসিক্যাল শৈলীর মতাে নৈর্ব্যক্তিকভাবে করেননি।

মিকেল্যাঞ্জেলাে মানুষের শরীরের অস্থি ও পেশী বিন্যাস খুব ভাল করে জানতেন। তিনি স্ত্রী-পুরুষের দেহ খুব ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, এমন কি বহুবার শবব্যবচ্ছেদ করে অ্যানাটমির ছাত্রদের মত হাড়, পেশীর সংস্থান খুজে খুঁজে বের করতেন। সেগুলো ত্বকের তলায় কিরকমভাবে থাকে, তিনি এসব বিষয় এত নিখুঁতভাবে জানতেন যে এগুলো শরীরের নানা অবস্থায় ও অস্বাভাবিক ভঙ্গীতে কোন কোন হাড়, কোন কোন পেশী কী ভাবে বেঁকে যায়, বেরিয়ে আসে বা দুমড়ে যায় বা বেশী ফুলে যায় – এসব দেখাতে তিনি অনেক মূর্তি গড়েন ও ছবি আঁকেন। মায়ের স্নেহ ও মায়ের শােক, এই দুটি ভাব মিকেল্যাঞ্জেলােকে যেন আজীবন তাড়া করেছে। পৃথিবীর যত কিছু সন্তানশােক ১৫০১ সালে রােমের সেন্ট পীটরের পিয়েটাতে দেখানাের পরই তিনি যখন ডেভিডের উপর কাজ করছেন, সেই সময়েই তিনি ১৫০১-৪ সালে ব্রুজ কেথিড্রালের জন্যে “ম্যাডােনা অ্যান্ড চাইল্ড” নামে একটি মূর্তি তৈরি করেন। ১৫০৪-১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন ট্যাডেই টন্ডো। এটি গােলাকার পাথরের উপর রিলিফ, এখন লণ্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমিতে আছে (ইতালীয় ভাষায় টন্ডো মানে গোলাকার)। এই ভাষ্কর্যটি অপূর্ব। চার ফুট উচু সুডােল ভাস্কর্য, মেরী চেয়ারে বসে, যীশু তাঁর বাঁ হাঁটু ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, যীশুর হাত ম্যাডােনার বাঁ হাতের মধ্যে, শিশুর ছােট্ট পা দুটি দেখলেই একজন সদ্ধার্মিক খ্রিস্টানের চুমু খেতে ইচ্ছে করবে। মেরীর ডান হাতে উরুর উপর রাখা ধর্মগ্রন্থ। তাছাড়া ঐ সময়ে আরেকটি ১৫০৬ সালে করা ‘টন্ডো পিত্তি’ নামে গােলাকার টণ্ডো পাথরের রিলিফে ম্যাডােনা ও শিশু যিশুর প্রতিকৃতি তিনি তৈরি করেন যা এখন বার্জেলাে মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

ভাস্কর্যের উপরেই মিকেল্যাঞ্জেলাের আগ্রহ বেশি ছিল। কিন্তু পােপের পৃষ্ঠপােষকতা এবং আর্থিক কারণে তাকে চিত্রশিল্পের দিকে ঝুঁকতে হয়েছে। ফ্লোরেন্সে তার উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে কেবল তার ১৫০৭ সালে আঁকা দনি তন্দো (Doni Tondo) বা দ্য হলি ফ্যামিলি নামক তেল রঙের চিত্রকর্মটি শেষ করেন যা বর্তমান ফ্লোরেন্সের উফ্‌ফিজি গ্যালারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। তার বাকি সব চিত্রকর্ম ফ্রেসকোর মাধ্যমে আঁকা এবং সেসব রােমে ভ্যাটিকানে স্থান পেয়েছে। মিকেল্যাঞ্জেলাের কাজে মানুষের ফিগার এত গুরুত্ব পেয়েছে যে সেখানে পরিপার্শ্ব প্রায় উপেক্ষিত বলে মনে হয়। মানুষের ফিগার বলতে তাঁর মনে আদর্শরূপের যে ভাবনা ছিল তার ভিত্তিতে তিনি বিস্ময়কর আকারের পেশিবহুল মানুষ এঁকেছেন কর্মব্যস্ত রূপে বা অস্থির চঞ্চল ভঙ্গিতে দেখিয়ে। ভ্যাটিকানে সিস্টিন চ্যাপেলে আঁকা ফ্রেসকোতে যেন উওেজিত এবং ভীষণ চঞ্চল ও ব্যস্ত সব দানবের মতো মানুষকে দেখা যায় মহাবিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্ত উপস্থাপনায়, মানুষের স্বর্গ থেকে পতনের ঘটনা চিত্রণে, নুহ নবির প্লাবনের সময় পরিত্রাতার ভূমিকা প্রদর্শনে এবং অসংখ্য গৌণ কাহিনি ও কথামালার বর্ণনায়। এই সবই সন্নিবেশিত হয়েছে ভ্যাটিকানের স্থাপত্যের, বিশেষ করে ছাদ এবং দেয়ালের নিদিষ্ট কাঠামাে ও ফ্রেমের ভেতর।

ভ্যাটিক্যানের সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে ১৫০৮ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত তার আঁকা মিকেল্যাঞ্জেলোর বিশাল শিল্পকর্মকে শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং সফল কাজ হিসেবে মনে করা হয়। আর এই বিশাল এবং দুরূহ কাজটি করেছেন তিনি একাই, কোনাে সার্বক্ষণিক সহকর্মীর সাহায্য ছাড়া। এই কাজে যে অতিমানবের শক্তি ও বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে তার জন্য তাকে বলা হয়েছে ‘স্বর্গীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত মিকেল্যাঞ্জেলো’। বলা যায়, সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে এবং দেয়ালে আঁকা ফ্রেসকোটিই তাকে এই খ্যাতি এনে দেয়। ১৫০৮ খ্রি. পােপ দ্বিতীয় জুলিয়াস তাকে এই চার্চের ছাদে বারােজন সন্তর ছবি আঁকার কথা বলেন। বিশাল মাপের (৩৬০ X ৩৮০ সে.মি.) এই ফ্রেসকোতে রয়েছে সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা, সন্ত ও সন্ন্যাসিনীরা, রয়েছে ঈশ্বর ও আদম। ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনি, সন্তদের বাণী, সন্ন্যাসিনীদের কথা সব এখানে মেলানাে হয়েছে ঐতিহ্য অনুযায়ী। ডেলফির দেবীরা এখানে পেয়েছে পুরুষের মতাে দেহ, মুখ নারীর। এমন সব রঙ তিনি এখানে ব্যবহার করেছেন যে চরিত্রগুলি পেয়েছে গাম্ভীর্য ও শক্তি। পােপ তাকে ঘন ঘন তাগিদ দিতে থাকায় তিনি অনেক কিছু বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করেন।

উল্লেখ্য, এর অন্তর্গত সব ফিগার একই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়। যেমন, কর্মব্যস্ত, চঞ্চল, অস্থির এবং প্রায় উত্তেজিত ফিগারের পাশেই দেখা যায় অ্যাডামের ফিগার যাকে দেখানাে হয়েছে শান্ত ভঙ্গিতে ঈশ্বরের প্রসারিত হাত থেকে জীবনীশক্তি গ্রহণ করতে। শান্ত ভঙ্গিতে হলেও অ্যাডামের রক্ত-মাংসের শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বিপুল শক্তির আভাস। মিকেল্যাঞ্জেলো তার অনুসৃত শৈলী অনুযায়ী অ্যাডামকে ভাগ করেছেন দুই অংশে যেখানে বিভিন্ন দৃশ্য এবং ফিগারগুলি সন্নিবেশিত রয়েছে। এক অংশে রয়েছে অ্যাডাম ও পৃথিবীর মৃত্তিকাময় দৃশ্য, অন্য অংশে রয়েছে ঈশ্বর এবং তার চারপাশের দেবদূতদের ফিগার যাদের পরনে উড্ডীয়মান পােশাকের হিল্লোল। এই দৃশ্যের দুটি অংশ এসে মিলেছে ঈশ্বর এবং অ্যাডামের হাতের আঙুল যেখানে প্রায় স্পর্শ করছে সেখানে, সেই নাটকীয় মুহূর্তের ভঙ্গিতে, ১৫১২ সালের দিকে আঁকা এই চিত্রকর্মটি দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম (The Creation of Adam) নামে পরিচিত। ফ্রেসকোটির অন্য সব দৃশ্যে মুখের অচঞ্চল অভিব্যক্তির দ্বারা ফিগারের শারীরিক শক্তির প্রাবল্য অবদমিত হয়েছে, এই মুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে বিরক্তি থেকে ক্রোধ এবং গভীর মনােনিবেশের বিভিন্ন মুহূর্ত। ১৫১২ খ্রি. সাড়ে চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি এই বিশাল শিল্পকর্ম শেষ করেন। সিসটাইনের শিল্পকর্ম হল শিল্পীর অমর সৃষ্টি, বহু পণ্ডিত ও গুণীজন, শিল্প সমালােচক এই শিল্পকর্ম দেখে নিন প্রকাশ করেছেন। এদের একজন হলেন মহাকবি গ্যেটে।

সিস্টিন চ্যাপেলের শেষ প্রান্তের দেয়ালে ১৫৩৬-৪১ সালে তার আঁকা ফ্রেসকোর দ্য লাস্ট জাজমেন্ট (The Last Judgment) নামক অংশে এই সব মুখের অভিব্যক্তি আরাে ব্যাপকতা পেয়েছে এবং শাস্তিপ্রাপ্তদের যন্ত্রণাকাতর মুখের মাধ্যমে সেই অভিব্যক্তি বিশদ হয়েছে। মিকেল্যাঞ্জেলো শুধু বিশাল আকারের ফিগার আঁকেননি, তাদের অন্তর্নিহিত মানবিক অনুভূতির বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের উপস্থাপনেও ছিলেন তিনি বিস্ময়করভাবে সফল।

শিল্প-ঐতিহাসিক ডেল ক্লিভারের মতে মিকেল্যাঞ্জেলোর ছবি থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, তিনি মানুষের শারীরিক সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে হতাশ হয়েছিলেন। তার ছবির স্কেল এবং ফিগারের সচল ভঙ্গি ১৭শ শতকের ‘ব্যারােক’ শিল্পশৈলীর আভাস দেয় বলেও তিনি মনে করেন। ভাজারি বলেছেন, মিকেল্যাঞ্জেলোর চিত্রকর্মে ডিজাইন নিখুঁত করে আঁকার কৌশল দেখা যায়, যা তিনি সঠিকভাবে ড্রইং করে এবং কন্টুর ও আলােছায়ার ব্যবহারের মাধ্যমে আয়ত্তে এনেছিলেন। মিকেল্যাঞ্জেলাের ফ্রেসকোর ছবিতে মানুষের ফিগার দৈত্যের মতাে অতিকায় হলেও তার গঠন, পেশির বিন্যাস এবং মুখভঙ্গি ছিল বাস্তবানুগ, যার জন্য তাকে বিশ্লেষণ করতে হয়েছে মানবদেহের, বিশেষ করে পেশির নির্মাণ ও বিন্যাসকে। তার স্কেচবুকে মানবদেহের জটিল পেশিসমূহের এই পাঠ ও বিশ্লেষণ দেখা যায়। এই দিক দিয়ে তিনি দ্য ভিঞ্চি এবং গ্রিক ক্লাসিক্যাল শিল্পীদের সঙ্গে তুলনীয়। এই অনুশীলনের ফলে অতিকায় দৈত্যসদৃশ ফিগার আঁকলেও সেগুলো শারীরিক গঠনের মাপকাঠিতে বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠে। মুখের অভিব্যক্তিতেও তিনি মানবিক অনুভূতিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রতীকের ব্যবহার বা ইঙ্গিতময়তার সাহায্য নেননি।

সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেসকোর কাজ শেষ হওয়ার পর পােপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (Julius II) মিকেল্যাঞ্জেলোকে নিজের সমাধিসৌধের ভাস্কর্যের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। তিনি রােমান স্মৃতিসৌধের মতাে এখানেও কিছু বন্দির মূর্তি সংস্থাপন করার জন্য তৈরি করেন ডাইং স্লেভ (Dying Slave) বা মরণাপন্ন দাস নামে মার্বেলে দণ্ডায়মান এক মূর্তি। সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেসকোতে অ্যাডামের ফিগারের চিত্রে তিনি মূর্ত করেছেন প্রাণ সঞ্চারের মুহূর্ত, আর মরণাপন্ন দাসের মার্বেল মূর্তিতে তিনি ব্যক্ত করেছেন প্রাণ নিঃশেষিত হওয়ার যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর আগের এই মুহূর্তে শুধু যন্ত্রণা নয়, জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক ধরনের প্রশান্তি ও সমর্পণের আকুতিও রয়েছে মূর্তিটির অসহায় ভঙ্গিতে। মূর্তিটি দেখে পাথরের তৈরি অনড়-অচল বলে মনে হয় না, এটি প্রতিভাত হয় সচল এবং ছন্দময় ভঙ্গিতে। গমব্রিচের মতে, মিকেল্যাঞ্জেলাের শিল্পকর্মের একটি গােপন সূত্র হলাে ফিগারগুলােতে যতই দৈহিক আঘাতের দরুন আলােড়ন থাকুক না কেন, তাদের আউটলাইনে থাকে সরলতা এবং আত্মসমর্পণের শান্ত সমাহিত ভাব। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, মিকেল্যাঞ্জেলাে সবসময় ভাস্কর্যের মূর্তিগুলােকে নির্মাণের আগেই অখণ্ড মার্বেলের ভেতর নিহিত রয়েছে বলে কল্পনায় দেখেছেন। ভাস্কর হিসেবে তিনি যেন শুধু সেই অদৃশ্য মূর্তিটি বের করে এনেছেন। এই কারণে মূর্তি যতই সচল ভঙ্গিতে দেখানাে হােক না কেন তার আউটলাইনে থেকেছে মার্বেল খণ্ডের আকারের (শেপ) প্রতিফলন।

পােপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধিস্থলের জন্য, রােমের সান পিয়েত্রো ইন ভিনকোলি চার্চে মিকেল্যাঞ্জেলাে ১৫১৩-১৫ সালে মোজেসের (Moses) একটি ভাষ্কর্য খােদাই করেন। কেউই জানতেন না যে মােজেসের ঐতিহাসিকতা থেকে থাকলে তিনি কিরকম দেখতে ছিলেন। তাই তিনি নিজের মনগড়া মােজেসের মূর্তি গড়লেন। মােজেসের মাথার উপর তিনি কপালের দুপাশে দুটি শিং বের করে দিলেন। বাইবলে লেখা আছে মােজেস যখন তপস্যার পর সাইনাই পাহাড় থেকে নেমে আসেন, তখন তার মাথার থেকে দুটি আলাের রেখা বেরিয়েছিল। এই বই যখন প্রথম ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ হয় তখন আলাের রশ্মির বদলে লেখা হয়েছিল দুটি শিং। তাই মিকেল্যাঞ্জেলাের সময়ে লােকে ভাবত মােজেসের দুটি শিং ছিল। মূর্তিটি অত্যন্ত শক্তিব্যঞ্জক, মনে হয় কোন সম্রাট বসে আছেন। এখনই ইচ্ছা করলে পৃথিবী ধ্বংস করতে পারেন। মােজসের ডান হাতে দুটি পাথরের খাতা বা ট্যাবলেট, এতে মােজেসের আইন লেখা ছিল। মােজেসের মতই শক্তিশালী মূর্তি মিকেলাঞ্জেলাে খােদাই করেন মেডিচি পরিবারের দুটি ব্যক্তির সমাধির জন্য। এই সমাধিগুলি ফ্লরেন্সের সান লরেঞ্জো চার্চের মেডিচিদের নিজস্ব প্রার্থনা চার্চ বা চ্যাপেলে আছে। দুটি সমাধির উপর মিকেল্যাঞ্জেলাে দুটি মূর্তি স্থাপনা করেন। একটির উপর একটি পুরুষ; অন্যটির উপর একটি নারী। এদের দুজনের উপর দেয়ালের কুলুঙ্গিতে তিনি দেন আরাে দুটি মূর্তি। একটির নাম হল থিঙ্কার বা চিন্তাশীল লােক (দার্শনিক বলা যায়); অন্যটির নাম যােদ্ধা। অন্য যে দুটি, অর্থাৎ পুরুষ আর নারীর মূর্তি ছিল তাদের নাম হল দিন আর রাত্রি। এই কাজেও তিনি ক্লাসিক্যাল নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মানবদেহের প্রতিনিধিত্ব এবং মুখের অভিব্যক্তিতে এই ভাস্কর্যও বাস্তবানুগ।

১৫৪৭ সালে মিকেল্যাঞ্জেলো দ্য ডেপোসিশন বা দ্য ফ্লোরেন্টাইন পিয়েটা (ফ্লোরেন্সের পিয়েটা) নামে একটি ভাষ্কর্য নির্মাণ করা শুরু করেন। ১৫৫০ সালে ভাসারি লিখেছেন যে এই ‘পিয়েটা’ তখনও অসম্পূর্ণ। ১৫৪৭ সালে মিকেল্যাঞ্জেলাের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিট্টোরিয়া কলােনা মারা যান। সেই শােকে বােধহয় শিল্পী মূর্তিটি আরম্ভ করেছিলেন। ১৫৫২ সালেও মূর্তিটি অসম্পূর্ণ ছিল। ভাসারি বলেন তাঁর ভৃত্য,সহকারী এবং যুগপৎ বন্ধু উর্বিনো এবং আরেকটি ভৃত্য আন্টোনিও তাকে মূর্তিটি শেষ করার জন্য পীড়াপীড়ি করায় তিনি একদিন রেগে মেগে হাতুড়ি ঠুকে মূর্তিটি ভাঙতে আরম্ভ করেন। ফলে যীশুর বাঁ পাটি ভেঙে যায়। মূর্তিটিতে যীশুর বাঁ পা নেই। কিন্তু মূর্তিটির আকর্ষণ এতো বেশি যে না দেখিয়ে দিলে তা দর্শকের চোখে পড়ে না। মূর্তিটি বড়, সাড়ে সাত ফুট উঁচু, পিরামিডের আকারে বানানো। এখানে যীশুর মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছেন যােসেফ অভ অ্যারিম্যাথিয়া, যীশুর বাঁ দিকে মাতা মেরী, যীশুর ডান দিকে তার শরীরের ভার তুলে ধরে মেরী ম্যাগডালেন (যীশু তাঁকে উদ্ধার করেন, তিনি যীশুর ধুইয়ে দেন)। মিলানে কাস্তেলাে স্ফোর্জেস্কোতে গিয়ে মাটির তলায় বেসমেন্টে দেখি তার অসম্পূর্ণ ভাষ্কর্য রয়েছে, যা রান্দানিনি পিয়েতা নামে পরিচিত। এটির কাজ শুরু হয় ১৫৫২ সালে, এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্কার হয় ১৫৬৩ এবং মারা যাবার সাল ১৫৬৪ সালে। এর উচ্চতা ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি। এখানে দুটি ফিগার আছে – মাতা মেরী আর তার সম্মুখে কোন রকমে ক্রস থেকে নামানাে, তখনাে দাঁড়ানাে অবস্থায় যীশু। সারা শরীরের পাথর এবড়ােখেবড়াে, মেরীর মুখে নাক চোখ সদ্য ফোটানাে মাত্র, যীশুর শরীরের রেখা দেখানো। সম্মুখ দিকে গােলাকার আকারে নোয়ানাে দুটি মূর্তি, মনে হয় একই নােয়ানাে গাছের দুটি সরু গুড়ি ফুড়ে উঠেছে।

মিকেলাঞ্জেলাে ৮৯ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। মিকেলাঞ্জেলাের পর তার চেয়েও ভাল ভাস্কর্য করা মুশকিল হল, কারণ তার মতো সব শাস্ত্রে মহান হয়ে ওঠা খুব কষ্টকর ছিল। তার পরে ভাস্কর্য তত উঁচু মানে আর উঠল না, বরং এর মান নেমেই গেল। আবার খানিকটা ভাল হতে অনেক বছর লাগলো।

রাফ্‌ফায়েল্লো

হাই রেনেসাঁ পর্বের শিল্পী রাফ্‌ফায়েল্লো দা ভিঞ্চি এবং মিকেল্যাঞ্জেলোর তুলনায় বয়সে ছোট ছিলেন, তাই তিনি সমসাময়িকদের তুলনায় একটু বেশি মাত্রায় এই অগ্রজ দুই শিল্পীর শিল্পশৈলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে শিল্পকর্মগুলো তৈরি করেন সেগুলো তাদের সৌষ্ঠব এবং মােহনীয়তার কারণে একান্ত তার নিজেরই বলে চিহ্নিত হয়। তার শিল্পজীবনের প্রাথমিক পর্বে অবশ্য পেরুজিনাের শিল্পের মধুর সৌন্দর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তাকে উৎসাহ দিয়েছে। রাফ্‌ফায়েল্লো সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভাজারি লিখেছেন, তার মতাে বহু গুণে গুণান্বিত একজন শিল্পীকে সাধারণ মানুষ বলে মনে হয় না। তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলতে হয় তিনি একজন মরণশীল ঈশ্বরের মতাে।

রাফ্‌ফায়েল্লো পেরুজিয়া (Perugia) এবং ফ্লোরেন্সে পেরুজিনাের শৈলীর প্রভাবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফ্লোরেন্সে তিনি মাসাচ্চো, দা ভিঞ্চি ও মিকেল্যাঞ্জেলাের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন এবং নিজস্ব শৈলী নির্মাণের পথে অগ্রসর হন। তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাকে রােমে ভ্যাটিকানে পােপের শয়নকক্ষের পাশে নির্মীয়মাণ নতুন কক্ষের দেয়ালে ফ্রেসকো আঁকার সম্ভাবনার কথা জানালে তিনি রােম যাত্রা করেন। ইতােমধ্যে তিনি যেসব কাজ করেছেন সেগুলোতে ডিটেইলের নিখুঁত উপস্থাপনা তার শিল্পশৈলীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সব কাজ দেখেই তার আত্মীয়টি তাকে রােমে কাজের সুযােগের উল্লেখ করেন।

রাফ্‌ফায়েল্লোর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলাে এত সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে করা বলে মনে হয়, যে সেসবের পেছনে থাকা কঠোর পরিশ্রম বা সাধনার ভূমিকা সঙ্গে সঙ্গেই উপলব্ধ হয় না। রাফ্‌ফায়েল্লো বলতে অনেকের মনে আসে ম্যাডোনা নাম দিয়ে তার আঁকা মাধুর্যপূর্ণ ছবিগুলোর কথা। এই ছবির বিষয় এত সর্বজনীন ও জনপ্রিয় যে এধরনের বহু ছবি আঁকা হয়েছে। তিনি নিজেই ম্যাডোনা নাম দিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন, যেগুলোর মধ্যে ১৫১৪ সালে তার আঁকা সিস্টিন ম্যাডোনা (Sistine Madonna) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ১৫০৫ সালে তার আঁকা ম্যাডােনা দেল গ্রান্দুসা (Madonna del Granduca) দেখতে এতই সরল এবং স্বয়ংব্যাখ্যিক যে এর কোনাে বিষদ ব্যাখ্যার প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু গ্রিক ভাস্কর ফিডিয়াস অথবা প্রাক্সিটেলেসের কাজের মতাে তার এই শিল্পকর্মটিও নিখুঁত হওয়ার কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিল্পীদের এবং অন্যদের কাছে আদর্শ ছবির দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়েছে। এই একই বিষয়ে অন্যেরা যেসব ছবি এঁকেছে সেসবের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে রাফ্‌ফায়েল্লো এই ছবিতে যে সরলতা প্রদর্শন করেছেন তারা মরিয়া হয়ে তার অনুসরণ করেছে। পেরুজিনার ছবির শান্ত সৌন্দর্যের কাছে রাফ্‌ফায়েল্লোর এই চিত্রকর্মটি ঋণী মনে হলেও একটু ভালাে করে দেখলে বােঝা যাবে যে পেরুজিনাের প্রায় অর্থহীন নিয়মিত শৃঙ্খলার স্থানে রাফ্‌ফায়েল্লোর চিত্রে প্রাণবন্ত ও সতেজ অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। আরাে বােঝা যায় ছবিটির কম্পােজিশন এতই স্বতঃস্ফূর্ত যে সামান্য পরিবর্তন হলেই এখানে যে সামঞ্জস্যময়তা রয়েছে তা হারিয়ে যাবে। কম্পােজিশনের ক্ষেত্রে রাফ্‌ফায়েল্লোর দক্ষতার উল্লেখ করে ভাজারি তার বইতে লিখেছেন, এই ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ, এমন শিল্পীর সংখ্যা কম।

ফ্লোরেন্সে বেশকিছু কাজ করার পর রাফ্‌ফায়েল্লো ভ্যাটিকান প্রাসাদে নবনির্মিত কক্ষের দেয়ালে ছবি আঁকার আশ্বাস পেয়ে রােমে চলে আসেন। পােপের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে এবং চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি এই সব ঘরের দেয়ালে এবং ছাদে যেসব ফ্রেসকো আঁকেন সেখানে নিখুঁত ডিজাইন এবং ভারসাম্যপূর্ণ কম্পােজিশনের ওপর তার দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণের স্বাক্ষর রাখেন। বৈচিত্র্যের মধ্যে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করে তিনি এক স্থানের গতিশীলতার সঙ্গে অন্য স্থানের গতিশীলতা এবং একটি ফর্মের সঙ্গে অন্য ফর্মের মিল নিশ্চিত করেছেন। যে নবনির্মিত ঘরগুলোর দেয়ালে ও ছাদে তিনি ছবি এঁকেছিলেন সেই ঘরটি আজ রাফ্‌ফায়েল্লোর ঘর (Raphael Rooms) নামে পরিচিত। ১৫১৪ সালে এক ধনী ব্যাংকারের জন্য তার আঁকা ফ্রেস্কো দ্য ট্রায়াম্ফ অফ গ্যালাটিয়া (The Triumph of Galatea) নিখুঁত এবং সামঞ্জস্যময় কম্পােজিশনের এক বিখ্যাত দৃষ্টান্ত। গমব্রিচের মতে, গতিশীল ফিগারের মধ্যে সামঞ্জস্যময়তা বিধানের এমন দক্ষতা রাফায়েলের পূর্বসূরিরা আয়ত্তে আনতে হিমশিম খেয়েছেন। 

রাফফায়েল্লোর ছবিতে দ্বিতীয় যে বিধানের বৈশিষ্ট্য তার সমসাময়িক শিল্পীরা প্রশংসা করেছেন তা হলাে ফিগারের সৌন্দর্য। গ্যালাটিয়া ছবিতে একই নামের জলপরীর সৌন্দর্য দেখে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি এমন মডেল কোথায় পেলেন। উত্তরে রাফফায়েল্লো জানিয়েছেন, তিনি কোনাে মডেলের কপি করেননি, সৌন্দর্য সম্বন্ধে তার নিজস্ব ধারণার অনুসরণে ছবিটি এঁকেছেন। তাঁর গুরু পেরুজিনাের মতাে তিনিও প্রকৃতির (বাস্তব) হুবহু অনুকরণ করেননি, যা ১৬শ শতকের অনেক শিল্পীই করেছেন। সৌন্দর্যের একটা সাধারণ ধারণা কল্পনায় এনে তিনি তার ভিত্তিতে ছবির ফিগারের মুখ এঁকেছেন। প্রাচীন গ্রিসে প্রাক্সিটেলেসের মতাে ভাস্কররা পরিকল্পিত ফর্মকে প্রকৃতিনির্ভর করে আদর্শ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিলেন। রাফফায়েল্লো এই পদ্ধতি উল্টে দিয়ে ক্লাসিক্যাল ভাস্কর্য দেখে ‘আদর্শ’ সৌন্দর্যের ধারণা করেছিলেন, এবং তার ভিত্তিতে প্রকৃতির (বাস্তব) রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। বাস্তব এখানে হুবহু প্রতিফলিত না হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্লাসিক্যাল শিল্পীরা প্রকৃতিকে আদর্শায়িত করে প্রতিফলিত করেছিলেন। সচেতনভাবে প্রকৃতিকে শুধরে বা পরিশীলিত করে রূপান্তরিত করার মধ্যে একটি ঝুঁকি ছিল, তা হচ্ছে তার ভিত্তিতে তৈরি শিল্প কষ্টকল্পিত কিংবা আকর্ষণহীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু রাফফায়েল্লোর শিল্পকর্ম দেখে বােঝা যায় তিনি প্রকৃতির আদর্শায়ন করতেই কেবল সক্ষম হননি, তার শিল্পকর্মের সজীবতা এবং প্রাণপ্রাচুর্য না হারিয়ে প্রকৃতির রূপান্তরও করতে পেরেছিলেন। গ্যালাটিয়া ছবিটিতে যে সৌন্দর্য সেখানে কষ্টকল্পিত কিংবা কঠোরভাবে হিসাব করার কিছু নেই। ১৬শ শতকের ক্লাসিক সৌন্দর্যের ভক্তরা এমন বাস্তবের ব্যাখ্যাই খুঁজেছে। রাফফায়েল্লো এই কারণেই বিখ্যাত হয়েছেন। রাফ্‌ফায়েল্লোর ১৫১৮-১৯ সালে আঁকা পোট্রেইট অফ লিও দ্য টেন্থ (Portrait of Leo X) ছবিটিতে পোপ ১০ম লিওকে তার দুই কার্ডিনালের সাথে দেখানো হয়েছে। যারা রাফফায়েল্লোর শিল্পখ্যাতিকে ম্যাডােনার সরল সৌন্দর্যের এবং ক্লাসিক্যাল পর্বের আদর্শায়িত রূপের অনুসরণের জন্য প্রশংসা করে তারা এই চিত্রকর্মটি দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে, কারণ পােপের এই প্রতিকৃতিতে কিংবা ভঙ্গিতে আদর্শায়িত রূপ বলে কিছুই নেই।

ভ্যাটিকানে ১৫০৯-১১ সালে রাফফায়েল্লোর আঁকা দ্য স্কুল অব এথেন্স (The School of Athens) হচ্ছে তার আঁকা সব ফ্রেসকোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এই ছবিতে বিশাল স্কেলে রােমান স্থাপত্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আঁকা হয়েছে মানুষের আদর্শায়িত ফিগারভিত্তিক বিভিন্ন যুগের পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণীজনের প্রতিকৃতি। এখান রাফফায়েল্লো ক্লাসিক্যাল শিল্প-আদর্শ কিছুটা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু যা ছবিটিকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে তা হলাে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে ফিগারগুলােকে বিভিন্ন দলে সাজানাে। তরঙ্গায়িত রেখা, ত্রিভুজ এবং আনুভূমিক ও উলম্ব রেখার জ্যামিতিক পদ্ধতি কম্পােজিশনের জটিলতাকে সরল করেছে যা রাফায়েলের ট্রেডমার্ক বলে পরিচিত হয়েছে। ছবিটিতে ফিগারগুলাের অবদমিত আবেগ, স্পষ্টভাবে প্রকাশিত পূত-পবিত্র আবহ এবং তৃপ্তিদায়ক প্রশস্ততা মহিমা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। মনে হয় যেন মানুষকে এই ছবিতে ঐশ্বরিক মহিমায় উন্নীত করা হয়েছে। ছবির অন্তর্ভুক্ত সচল দলগুলাের বিভিন্ন ফিগারের মধ্যে সামঞ্জস্যময় ছন্দ কম্পােজিশনের শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামাের ভেতর গতিশীলতা সৃষ্টি করেছে বিস্ময়কর ভাবে। শুধু এই একটি ছবির জয় রাফফায়েল্লো অমরত্বের দাবি করতে পারেন। এই চিত্রকর্মটিতে আছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ঈস্কিনিস, সক্রেটিস, হেরাক্লিটাস, ডায়োজেনিস অফ সিনোপি, প্লোটিনাস, আলকিবিয়াডিস/আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জেনো অফ সাইটিয়াম, পারমিনাইডিস, ইবনে রুশদ, পিথাগোরাস, এপিকিউরাস, আপেল্লেস, জোরোয়াস্টার বা স্ট্র্যাবো, টলেমি, প্রোটোজেনেস, ইউক্লিড, হাইপেশিয়া (?) ও সেই সাথে চিত্রটির মধ্যমণি হিসেবে কেন্দ্রে আছেন বৃদ্ধ প্লেটো ও কিংবদন্তী দর্শন-গ্রন্থ নিকোমেনিয়ান এথিক্স হাতে তার যুবক শিষ্য এরিস্টোটল। এই মহান লিজেন্ডদের ছবি আঁকার জন্য তিনি কল্পনা করেছিলেন তদকালীন লিজেন্ডদের চেহারাকেই। এই ছবিতে প্লেটো হিসেবে যাকে দেখা যাচ্ছে তার চেহারাটা আসলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির, একই ভাবে ইউক্লিডের ভূমিকায় আছেন রেনেসাঁ স্থপতি দোনাতো ব্রামান্তে (Donato Bramante, ১৪৪৪-১৫১৪ খ্রি.), প্রোটোজেনেসের ভূমিকায় আছে চিত্রকর পেরুজিনো বা তিমোতিও ভিতি, হেরাক্লিটাসের ভূমিকায় আছে মিকেল্যাঞ্জেলো, জোরোয়াস্টার বা স্ট্র্যাবোর ভূমিকায় আছেন সম্ভবত রেনেসাঁস মানবতাবাদী কার্ডিনাল পিয়েত্রো বেম্বো, আর আপেল্লেসের ভূমিকায় আছেন রাফ্‌ফায়েল্লো নিজেই।

ভেনিসীয় ও উত্তর ইতালীয় রেনেসাঁ

ভেনিসীয় রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য

মধ্য ইতালিতে (রােম ও ফ্লোরেন্স) রেনেসাঁ শিল্পীদের শিল্পকর্মের সাথে একই সময়ের ভেনিস নগরের শিল্পীদের কাজে বেশ পার্থক্য ছিল। ফ্লোরেন্সের বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্রকলার ভিত্তি ছিল রেখা। ভেনিসে তার স্থানে প্রাধান্য পেয়েছিল রঙের ইন্দ্রিয়ভিত্তিক সৌন্দর্য। তাদের উপর উল্লেখযােগ্যভাবে সূর্যের আলাে এবং উন্মুক্ত আকাশের প্রভাবও পড়েছিল। ভেনিসের সঙ্গে সমুদ্রের জলের নিকট সম্পর্কও বিভিন্নভাবে শিল্পকর্মে ভূমিকা রেখেছিল। জলের মাধ্যমেই ভেনিসের শিল্পীরা রঙ এবং সূর্যের প্রতিফলিত আলাের ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। সূর্যের আলােয় ভেনিসের রঙিন দালানগুলাে যেভাবে দিনের প্রতি প্রহরে রঙ বদলায় তা থেকেও তারা প্রেরণা পেয়েছেন। প্রাচ্যের দেশগুলাের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ছবি আঁকার রঙও ছিল যা শিল্পীরা উৎসাহের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন। ভেনিসের ভেজা জলবায়ু ফ্রেসকো আঁকার অনুকূল ছিল না যার জন্য ভেনিসের শিল্পীরা ক্যানভাসে তেল রং দিয়ে ছবি এঁকেছেন। এই মাধ্যমেই তারা নিজেদের বিশেষ ধরনের শৈলী উদ্ভাবন করেন। ব্রিটিশ শিল্প-ঐতিহাসিক জন স্টিয়ার বলেছেন, ভেনিসের চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য হলাে তার রঙ, আলাের খেলা এবং স্পেসের ব্যবহার। এই শিল্পকর্মে ফর্মের ভূমিকা ছিল গৌণ (ইলাস্ট্রেটেড স্টোরি অব আর্ট : ডি কে পাবলিকেশন, ২০১৩ বইতে উল্লিখিত)।

জোভান্নি বেল্লিনি

১৫শ শতকের প্রথম দিকে ভেনিসের শিল্পকলা ফ্লোরেন্সের রেনেসাঁ পর্বের উদ্ভাবনীমূলক শিল্পকর্মের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। এই নগরীর শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য তখন পর্যন্ত ছিল গথিক পদ্ধতির এবং অলংকারধর্মী। ভেনিসের নিজস্ব শিল্পশৈলীর সূচনা হয় জোভান্নি বেল্লিনির (Giovanni Bellini, ১৪৩০-১৫১৬ খ্রি.) কাজের মাধ্যমে। তার বাবা জ্যাকোপাে বেল্লিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন গথিক শিল্পগুরু ফেব্রিয়ানের কাছে। জোভান্নি বেল্লিনির প্রথম দিকের কাজে তার বাবার প্রভাব ছিল। এই সময়ে আঁকা তার ম্যাডােনার চিত্রে রৈখিক ফর্ম নমনীয় করে তিনি একই সঙ্গে বাস্তবতা এবং মহিমা সৃষ্টির দিকে ঝুঁকেছিলেন। পাদুয়ায় শিল্প বিষয়ে শিক্ষিত তার আত্মীয় শিল্পী মনতেঞার প্রভাবে বেল্লিনি ছবিতে স্পেসের নতুন ব্যবহার করেন যেখানে পারসপেকটিভ প্রাধান্য পায়। কিন্তু মনতেঞার নৈসর্গিক দৃশ্যের তুলনায় বেল্লিনির ছবিতে আকাশ এবং রঙের কাব্যিকতা গুরুত্ব পেয়েছে। ১৪৭৫-৭৬ সালে অ্যান্টোনেল্লো দা মেসিনা (Antonello da Messina, ১৪৩০-১৪৭৯ খ্রি.) ভেনিসে এসে তেল রঙের চিত্রকর্ম আঁকায় তার অভিজ্ঞতা সেখানকার শিল্পীদের অবহিত করেন এবং তাদেরকে তার কাজের কিছু নমুনা দেখান। বেল্লিনি তার অনুসরণে তেল রঙের ছবি আঁকার প্রতি মনােযােগ দেন। টেম্পেরার ব্যবহার করে রঙিন এবং পরিবেশের রূপ ফুটিয়ে তােলা এর আগে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখন তেল রঙে তা সম্ভব হলাে। কেনেথ ক্লার্ক বলেছেন, আর কোনাে শিল্পী বেল্লিনির মতাে একটি স্কুল বা শিল্পধারা এককভাবে পত্তন করেননি। ভেনিসের প্রায় অধিকাংশ চিত্রকলাই ছিল ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক। কিন্তু বেল্লিনি মিথলজি বিষয়েও বড় ছবি এবং পােট্রেট এঁকেছেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কাজ অবশ্য ল্যান্ডস্কেপের দৃশ্য যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া মিলে অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। তার হাতেই পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী জোর্জোনে (Giorgione) এবং তিৎসিয়ানো (Titian) প্রশিক্ষিত হন।

জোর্জোনে

ক্লাসিক্যাল পদ্ধতিতে নিখুঁত ডিজাইন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কম্পােজিশনের সাহায্যে মধ্য ইতালির শিল্পীরা ছবি এঁকে রেনেসাঁ পর্বের সূচনা করেছিলেন, কিন্তু ভেনিসে রেনেসাঁ পর্বের চিত্রকলা চর্চার শুরু হয়েছিল বেল্লিনির রং ও আলাের ব্যবহারের মাধ্যমে। এই পদ্ধতি ও মাধ্যমে কাজ করে তার শিষ্য জোর্জোনে আরাে বেশি সাফল্য লাভ করেন। তার আঁকা মাত্র পাঁচটি ছবি পাওয়া গেলেও এদের মাধ্যমেই তার শিল্প কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং বেল্লিনি নতুন যে পদ্ধতি ও ধারার সূত্রপাত করেন সেটি অব্যাহত থাকে। জোর্জোনের সামান্য কয়েকটি ছবির মধ্যেই যে রহস্যময়তা রয়েছে শিল্পসমালােচকের কাছে তার অর্থ খুঁজে বের করা কঠিন হয়েছে, যেমন ১৫০৮ সালে আঁকা তার বিখ্যাত দ্য টেমপেস্ট (The Tempest) তৈলচিত্রটির দ্বারা কি বােঝানাে হয়েছে তা সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট হয় না। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, এটি যেন ক্লাসিক্যাল পর্বের কোনাে শিল্পীর আঁকা ছবি যার বিষয়বস্তু কবিতায় বর্ণিত কোনাে কাহিনি। ছবিটিতে দেখা যায় অরণ্যে এক পরিত্যক্ত মা এক শিশুকে নিয়ে বসে আছে নিরুপায় ভঙ্গিতে। দূরে পটভূমিতে দেখা যায় নগরীর সৌধমালা, নদীর ওপর সেতু এবং বাঁ-দিকে দাঁড়ানাে এক মেষপালক, যে মা ও শিশুর দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এই দৃশ্যে শিল্পী কি বলতে চেয়েছেন সে সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই এখন পর্যন্ত। কিন্তু শিল্পের দিক দিয়ে যা আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ তা হলাে রং ও আলাের ব্যবহারে দৃশ্যের সব অংশকে ঐক্যের সূত্রে গেঁথে এনে পূর্ণাঙ্গ এক চিত্রের সৃষ্টি। এগুলােই ছিল জোর্জোনের চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ফিগারগুলাে নিখুঁত না হলেও এবং কম্পােজিশনে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও রং ও আলাের ব্যবহারের জন্য যে পূর্ণাঙ্গতার সৃষ্টি হয়েছে তাই এই শিল্পীর মূল পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায়। আকাশের আলাে, অরণ্যের ও নগরীর সৌধের দৃশ্য এবং পটভূমিতে সেতুসহ নদী, এই সব যেন পটভূমি নয়, বরং এরা তাদের নিজেদের দাবিতেই দৃশ্যমান হওয়ার জন্য উপস্থাপিত। প্রকৃতি, আকাশ, নগরীর সৌধরাজি, মৃত্তিকা এবং কয়েকটি মানুষের ফিগার দিয়ে একটি বিশাল দৃশ্যের অংশ হিসেবে ছবিটি তৈরি হয়েছে যার জন্য এই সব ভিন্ন চরিত্রের অংশগুলাে ছবির মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। জোর্জোনের পূর্বসূরিদের সঙ্গে এমনকি মধ্য ইতালির শিল্পীদের সঙ্গে এখানে তার শিল্পের প্রধান পার্থক্য। পারস্পেক্টিভের গাণিতিক সূত্রের সাথে দৃশ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঐক্যসাধন এবং সংমিশ্রণ করা ছিল একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গমব্ৰিচ এসম্পর্কে বলেছেন, এখন থেকে চিত্রকলা, ড্রইং আকা আর রং লাগানাে নয়, তার বেশি কিছু বলে প্রতিষ্ঠিত হলাে। জোর্জোনে যেন শিল্পকলার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি ও গােপন এক সূত্র উদ্ভাবন করলেন। 

তিৎসিয়ানো

জোর্জোনে তার উদ্ভাবিত শৈলী ও পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার করার আগেই অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ত্রিশ কি বত্রিশ বছর। তার পদ্ধতি ও শৈলীর পূর্ণ ব্যবহার করেন ভেনিসের আর একজন রেনেসাঁ শিল্পী তিৎসিয়ানো (Tiziano বা Titian, ১৪৮৮/৯০-১৫৭৬ খ্রি.) যার চিত্রকলা ভেনিসের রেনেসাঁকে আরাে স্পষ্ট এবং সমৃদ্ধ করে তােলে। তিনি দা ভিঞ্চির মতাে বহু বিষয়ে পণ্ডিত বা মিকেল্যাঞ্জেলাের মতাে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বা রাফফায়েল্লোর মতাে সামাজিকভাবে চৌকসও ছিলেন না, কিন্তু চিত্রকর হিসেবে তার দক্ষতা যে মিকেল্যাঞ্জেলাের সমান ছিল তা সর্বস্বীকৃত। তারও ছিল ড্রইংয়ে মিকেল্যাঞ্জেলাের নৈপুণ্য। মিকেল্যাঞ্জেলাের সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল এখানে যে তিনি কম্পােজিশনের রীতিনীতি নিয়ে মাথা ঘামাননি। রঙের ব্যবহারই ছিল তার চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ও শক্তির জায়গা। ভেনিসের রেনেসাঁ পর্বের শিল্পে এই প্রবণতা ও শক্তির জায়গা তিনি যেমন সমৃদ্ধ করেছেন আর কেউ অতটা করেননি। ১৫১৯ থেকে ১৫২৬ সালের মধ্যে তার আঁকা পেসারো ম্যাডোনা (Pesaro Madonna) তৈলচিত্রে তিনি হােলি ভার্জিনকে মাঝখানে না রেখে এক পাশে দেখিয়েছেন যা এর আগে আর কেউ করতে সাহস করেনি। ছবির মাঝখানে দেখানাে হয়েছে উপবিষ্ট সেন্ট পিটারকে, তার সামনে সােপানে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ভেনিসের এক অভিজাত ব্যক্তি, তার পাশে বর্ম পরিহিত সৈন্যকে বন্দি এক তুর্কি সেনাকে টেনে আনতে দেখা যাচ্ছে। প্রথাগতভাবে কম্পােজিশন না করে তিৎসিয়ানো এখানে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিগারগুলােকে সন্নিবেশিত করেছেন যা দেখে সমসাময়িক অনেকে চমকে উঠেছে। কম্পােজিশনে অপ্রচলিত পদ্ধতি ও রীতি ব্যবহার করলেও ছবিটি তিৎসিয়ানোর রঙের ব্যবহারের কারণে ভারসাম্যহীন বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। রং, আলাে এবং বাতাস দিয়ে তিনি ছবিটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক অভূতপূর্ব একতা এবং অখণ্ডতার সৃষ্টি করেছেন।

তিৎসিয়ানো নিসর্গের দৃশ্য বা ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক ছবি আঁকার পাশাপাশি যেসব পােট্রেট এঁকেছেন সেগুলােও তাঁর খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ভেনিসে রেনেসাঁ শিল্পের ঐতিহ্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৫৪০-৪৫ সালে তার আঁকা পোট্রেইট অফ এ ইয়ং ইংলিশম্যান (Portrait of a Young Englishman) ছবিতে তিনি অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ যুবকের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন, যা প্রথম দৃষ্টিতে খুবই সরল এবং অনায়াস ভঙ্গির ছবি বলে মনে হয়। এখানে দা ভিঞ্চির মােনালিসার মতাে কোনাে বিশদ মডেলিংয়ের প্রভাব নেই। কিন্তু ছবির এই যুবকের দৃষ্টি দা ভিঞ্চির মােনালিসার মতােই রহস্যময় এবং জীবন্ত। তার দৃষ্টি এত গভীর এবং মর্মস্পর্শী যে রঙের সৃষ্টি না বলে জীবন্ত মানুষের চোখ বলেই মনে হয়। এই মায়া সৃষ্টিতেও তিৎসিয়ানো রঙের জাদুকরী ব্যবহার করেছেন। তিনি প্রথাগতভাবে সুন্দর প্রতিকৃতি আঁকেননি, এঁকেছেন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য।

ভেনিসের রেনেসাঁ শিল্পীদের মধ্যে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হচ্ছেন তিনতোরেত্তো। কিন্তু তার কথা রেনেসাঁর শেষ পর্ব ম্যানারিজমের আলোচনায় আলোচিত হবে।

ফ্লোরেন্সীয় ও ভেনেশীয় শৈলীর মধ্যে বিতর্ক

ভেনিসের পর ১৬শ শতকের ইতালিতে শিল্পীদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের বা ভেনিসের শিল্প ঐতিহ্য ও পদ্ধতির কোনটি শ্রেষ্ঠ, এই নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তর্কের বিষয় শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এই প্রশ্নে যে, মিকেল্যাঞ্জেলো আর তিৎসিয়ানোর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের এবং মধ্য ইতালির অন্য শিল্পীদের কাছে যে রীতি বা সূত্র গুরুত্ব পেয়েছে তার নাম ছিল ‘ডিসেপনাে’ যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ডিজাইন’। এর দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে ড্রইংয়ের মাধ্যমে ডিজাইন উদ্ভাবন প্রক্রিয়াকে বােঝানাে হয়েছে। এর বিপরীতে ভেনিসের চিত্রকলার পদ্ধতিতে রঙের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যার ফলে রঙের ব্যবহার ও প্রয়ােগের পদ্ধতি গুরুত্ব পেয়েছে। দুই পদ্ধতিই প্রকৃতিবাদের ওপর আনুগত্য রেখে অগ্রসর হয়েছে কিন্তু প্রকৃতিবাদ প্রকাশের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র হয়েছে ভিন্ন।

উত্তর ইতালির রেনেসাঁ

১৬শ শতকে হাই রেনেসাঁ পর্বে শুধু ভেনিসে নয়, ইতালির উত্তরের কয়েকটি শহরেও শিল্পীরা নতুন সম্ভাবনা ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের চিত্রকররা ১৬শ শতকের এই সব শিল্পীর মধ্যে যাকে সবচেয়ে প্রগতিশীল এবং দুঃসাহসী উদ্ভাবক মনে করেছেন তিনি পার্মা নগরীর শিল্পী কোরেজ্জো (Antonio da Correggio, ১৪৮৯-১৫৩৪ খ্রি.)। তিনি যখন চিত্রকলার চর্চা শুরু করেন সেই সময় দা ভিঞ্চি এবং রাফায়েল মৃত্যুবরণ করেছেন। ভেনিসে তিৎসিয়ানো তখন খ্যাতির চূড়ায়, কিন্তু কোরেজ্জো এদের কিংবা সমকালীন অন্যান্য শিল্পীর চিত্রকলা সম্বন্ধে খুব একটা অবহিত ছিলেন না। পার্মার কাছাকাছি উত্তরের কয়েকটি শহরে গিয়ে দা ভিঞ্চির শিষ্যদের আঁকা ছবি দেখার সুযােগ হয়তাে তার হয়েছিল। তাদের কাজ দেখে তিনি হয়তাে ছবিতে আলােছায়ার ব্যবহার সম্বন্ধে জেনেছেন। কোরেজ্জিও চিত্রকলার চর্চায় আলােছায়ার ব্যবহারে নতুনত্ব এনে শুধু খ্যাতি অর্জন করেননি, পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও অনুকরণীয় হয়ে থেকেছেন। তার আঁকা তৈলচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত তার ১৫২৯-৩০ সালে আঁকা নেটিভিটি (Nativity)। এখানে দেখা যায় দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় মেষপালক মাঠ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় উন্মুক্ত স্বর্গের দৃশ্যে দেবদূতদের দেখে এসেছে এবং গােশালায় প্রবেশ করে সে দেখতে পাচ্ছে ভার্জিন মেরির কোলে চারিদিক করে রেখে শুয়ে আছে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু। গােশালার ভেতরের দৃশ্য দেখে মেষপালক মাথার টুপি ঠিক করার চেষ্টা করছে, তার মাথার ওপরে কল্পনায় দেখা দেবশিশুরা ‘গ্লোরি টু গড’ গান গাইছে, পাশে উপবিষ্ট দুই নারীর উল্লসিত মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে এবং দরজার বাইরে প্রায় অন্ধকারে সেন্ট জোসেফকে দেখা যাচ্ছে গাধা সামলাতে ব্যস্ত। বায়ের দৃশ্য বেশ ভিড়াক্রান্ত, তুলনায় ডানে অন্ধকার আর ছায়া ব্যতীত প্রায় কিছুই নেই। ডান আর বাঁ-দিকের দৃশ্য ভারসাম্যহীন হতে পারত, অসামঞ্জস্যময়তাও স্পষ্ট হয়ে যেত, কিন্তু হয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ছবিতে বিভিন্ন অংশে আলােছায়ার দক্ষ ব্যবহারের জন্য।

ভেনিসের রেনেসাঁ শিল্পীরা যদি রঙের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাদের নিজস্ব শৈলী উদ্ভাবন করে থাকেন, কোরেজ্জো সেই লক্ষ্য অর্জন করেছেন আলােছায়া ব্যবহারের মাধ্যমে। ফর্মকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে ছবির বিভিন্ন অংশে ভারসাম্য আনার জন্য আলােছায়ার ব্যবহারে তিনি তিৎসিয়ানোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন বলে মনে হয়। আলােছায়া দিয়েই তার ছবিতে চিহ্নিত হয়েছে প্রধান সব রেখা যা দর্শকের দৃষ্টিকে নিয়ে যায় দৃশ্যের ভেতর, যেমন টর্চের আলাে দেখে অন্ধকারে অগ্রসর হয় কেউ। কোরেজ্জোর আরাে একটি শিল্প বৈশিষ্ট্য পরবর্তী শতকে অনুসৃত এবং অনুকৃত হয়েছে। এটি হলাে চার্চ বা উঁচু ভবনের ছাদ ও গম্বুজের ভেতরের দিকে ছবি আঁকার পদ্ধতি। তার এ ধরনের ছবি দেখে দর্শকের মনে হবে যে তারা যেন উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যেখানে রয়েছে রঙিন সব ফিগার এবং তাদের উড়ন্ত পােশাক। ভক্তদের কাছে এই দৃশ্য দেখে মনে হবে আকাশ নয়, স্বর্গের দৃশ্য দেখছে তারা। এখানেও কোরেজ্জোর শিল্প-নৈপুণ্যের পেছনে কাজ করেছে আলােছায়ার ব্যবহার।

শেষ কথা

ভেনিস এবং ইতালির উত্তরাঞ্চলের শহরে যেসব শিল্পী হাই রেনেসাঁ পর্বে অর্থাৎ ১৬শ শতকে কাজ করেছেন তাদের শৈলীতে বাস্তবানুগতার পরিচয় পাওয়া যায়। রং এবং আলােছায়ার ব্যবহারের মাধ্যমে এই বাস্তবানুগতা সৃষ্টি হয়েছে। আরাে উল্লেখ্য যে তারা মধ্য ইতালির (রােম, ফ্লোরেন্স) শিল্পীদের মতাে বাস্তবের আদর্শায়ন করেননি (মিকেল্যাঞ্জেলাে), অথবা বত্তিচেল্লির মতাে স্টাইলাইজেশনেরও আশ্রয় নেননি। রং এবং আলােছায়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এবং কম্পােজিশনের ক্ষেত্রে নতুনত্ব এনে তারা মধ্য ইতালির রেনেসাঁ শিল্পীদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য সূচিত করেন। বলা যায়, তারা তুলনামূলকভাবে ক্লাসিক্যাল গ্রিস ও রােমের শিল্প আদর্শ দ্বারা কমই প্রভাবান্বিত হয়েছেন। যেহেতু ১৬শ শতকে ভেনিসে এবং পার্মার মতাে শহরে নতুন ধারার চিত্রকলা সৃষ্টি হয়েছে সেজন্য এই সৃষ্টিকে রেনেসাঁ পর্বের মতাে নতুন বলেই ধরা হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁ 

উত্তরাঞ্চলীয় ইউরোপের শিল্পে পরিবর্তন, প্রকৃতিবাদ ও ইতালীয় শিল্পীদের সাথে পার্থক্য

উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁ বলতে উত্তর ইউরােপে কয়েকটি দেশে ১৪০০ থেকে ১৫৮০ শতক পর্যন্ত যে শিল্পকলার চর্চা করা হয়েছে সেগুলোকে বােঝানাে হয়। ১৫শ শতকে রেনেসাঁর প্রথম পর্বে ইতালির উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি দেশে, যেমন ফ্রান্স, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য বা হলি রোমান এম্পায়ার (মোটামুটিভাবে বর্তমান জার্মানি), ফ্রেন্ডার্স (বর্তমান বেলজিয়াম), নেদারল্যান্ডসে শিল্পীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রায় একই ছিল। কিন্তু লক্ষ্য এক থাকলেও সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা যে উপায় ব্যবহার করেছিল, অর্থাৎ যাকে স্টাইল বা শৈলী বলা হয় তা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। স্থাপত্যে এই পার্থক্য ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্রুনেলেস্কি ফ্লোরেন্সে ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের মােটিফ ব্যবহার করে গথিক স্থাপত্যের ইতি টানেন। ইতালির উত্তরাঞ্চলের দেশগুলির স্থপতিরা ভবন নির্মাণের জন্য আরাে একশ বছর ধরে গথিক শৈলী অনুসরণ করেছিল। কিন্তু গথিক শৈলী অনুসরণ করা হলেও ১৫শ শতকে উত্তরাঞ্চলের স্থাপত্যে ধীরে ধীরে সরলতার আভাস দেখা গিয়েছিল। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের প্রধান কয়েকটি চার্চ নির্মাণে (কেমব্রিজের কিংস কলেজ চ্যাপেল দ্রষ্টব্য) এর প্রমাণ পাওয়া যায় ।

স্থাপত্যের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালভাবে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যেও উত্তরাঞ্চলের দেশের শিল্পীরা ১৫শ শতকে গথিক শৈলী অনুসরণ করেছে। শৈলীতে ফন এইখ ভ্রাতৃদ্বয়ের উদ্ভাবন সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলের চিত্রকলায় মধ্যযুগের ঐতিহ্য ও শিল্পরীতি অনুসৃত হয়েছে। পারস্পেক্টিভের জ্যামিতিক সূত্র, মানবদেহের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, গ্রিক ও রােমান শিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতিদের কাজ নিয়ে উত্তরাঞ্চলের শিল্পীরা মাথা ঘামায়নি, তারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে মধ্যযুগেই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু রেনেসাঁ পর্বে ইতালির শিল্পীরা যে সমস্যার মুখােমুখি হয়, একই সমস্যা ছিল উত্তরের শিল্পীদের সামনে। ইয়ান ফন এইখ (Jan van Eyck, ১৩৯০/৯৫ – ১৪৪১ খ্রি.) উত্তরের শিল্পীদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ডিটেইল ব্যবহার করে প্রকৃতির প্রতিফলন ঘটানাে যায়। কিন্তু ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকো এবং বেনৎসো গৎসোলি যেমন ১৪শ শতকের মেজাজ ও অনুভূতি নিয়ে ১৫শ শতকে মাসাচ্চোর উদ্ভাবিত শৈলী নিয়ে কাজ করেছিলেন, সেই স্থানে উত্তরের শিল্পীদের অনেকেই প্রচলিত বিষয় (মধ্যযুগীয়) নিয়ে ছবি আঁকতে গিয়ে ফন এইখের উদ্ভাবিত পদ্ধতি (প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ ও ডিটেইল) ব্যবহার করেছিলেন। তাই তাদের কাজে রেনেসাঁ শিল্পের প্রথম পর্বের ইতালির শিল্পীদের মতাে আদর্শায়িত সৌন্দর্য ও বিভিন্ন অনুপাতের মধ্যে সামঞ্জস্যময়তা বিধান অনুসরণ বা প্রতিফলন নেই। তারা পুরােনাে (মধ্যযুগীয়) বিষয়ে প্রকৃতির ডিটেইল (বাস্তব) ব্যবহার করেছেন এবং সেখানে মানবিক অনুভূতির (হাস্যরস, কৌতুক) মাত্রা যােগ করেছে। এই সব পরিবর্তন যুগান্তকারী না হলেও উত্তরের শিল্পীদের জন্য ছিল ১৪শ শতকের তুলনায় ভিন্ন ধরনের শিল্পচর্চা। এ থেকে বােঝা যায় উত্তরের এই সব দেশে ১৫শ শতকের প্রথমদিকে রেনেসাঁ পর্বে পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যেতে শুরু করেছিল। এভাবে ফন এইখের শিল্পরীতি ও শৈলীর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের দেশে বিপ্লবাত্মকভাবে না হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে আগের তুলনায় পরিবর্তন এসেছিল। এই পরিবর্তনের নাম দেওয়া হয়েছিল উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁ।

উত্তরের রেনেসাঁর সময়কাল ১৪০০ থেকে ১৫৮০ পর্যন্ত ধরা হয়। এই সময়কালে ফ্লাঁদর বা ফ্রান্ডার্সে (বর্তমানের বেলজিয়াম) ব্রুজ (Bruges, ডাচ উচ্চারণ ব্রোঘ) শহরে ফন এইখ, জার্মানির ন্যুরেমবার্গে আলব্রেশট ডুরার (Albrecht Dürer, জার্মান উচ্চারণ আলবেঘ্হ্‌শ্‌‌ট ডুঘ্‌হা, ১৪৭১-১৫২৮ খ্রি.‌) এবং সুইজারল্যান্ডে হান্স হোলবাইন (Hans Holbein, ১৪৯৭-১৫৪৩ খ্রি.) শৈলীতে পরিবর্তন এনে খ্যাতি অর্জন করেন। হােলবাইন ইংল্যান্ডে গিয়েও শিল্পচর্চা করেন। ইতালির প্রথম পর্বের রেনেসাঁ শিল্পীদের মতাে তারাও প্রকৃতিবাদের (ন্যাচারালিজম) দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু এর প্রতিফলনের জন্য তারা বেশি করে ব্যবহার করেন ডিটেইল যা তারা প্রকৃতি ও মানবদেহ দেখেই সংগ্রহ করেন, প্রাচীন গ্রিক বা রােমান শিল্প দেখে নয়। এইখানেই তাদের সঙ্গে মধ্য ইতালির শিল্পীদের প্রধান পার্থক্য। তাদের চিত্রকর্মে বাস্তবের যে প্রতিফলন দেখা যায় তার উৎসে ছিল ১৫শ শতকে তেল রং মাধ্যমের অগ্রগতি। কাঠ খােদাই এবং এনগ্রেভিংয়ের পদ্ধতি ও কৌশল উদ্ভাবনের পর উত্তরাঞ্চলের শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন আরাে গতিশীল হয়। পেট্রাস ক্রিস্টাসের (Petrus Christus, ১৪১০/২০-১৪৭৫/৭৬) ১৪৪৯ সালে আঁকা আ গােল্ডস্মিথ ইন হিস শপ (A Goldsmith in His Shop) ছবিতে বাস্তবের যে মায়া সৃষ্টি হয়েছে সেটি সম্ভব করেছে তেল রঙের নতুন ব্যবহার পদ্ধতি। ইতালির শিল্পীদের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের দেশের শিল্পীদের শিল্পচিন্তা এবং শৈলী চর্চার ক্ষেত্রে আদান-প্রদান হয়েছে কিন্তু উত্তরাঞ্চলের শিল্পীরা ইতালির শিল্পীদের মতাে ক্লাসিক্যাল আর্টের তেমন অনুসরণ করেনি।

উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁয় গথিক শৈলীর প্রভাব

১৫শ শতকে ইতালিতে যখন রেনেসাঁর জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সেই সময় উত্তরাঞ্চলের দেশগুলির শিল্পকলার চর্চায় ফন এইখের মতাে শিল্পী কিছু নতুনত্ব আনলেও শিল্পধারা মূলত মধ্যযুগের, বিশেষ করে গথিক পর্বের ঐতিহ্যই ধারণ করেছিল। ফন এইখের সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীর মধ্যে ফ্লাঁদরের রবার্ট ক্যাম্পিন (Robert Campin, ১৩৭৫-১৪৪৪ খ্রি.), একই শহরের ভ্যান ডার ওয়েইডেন (Rogier van der Weyden, ১৩৯৯/১৪০০-১৪৬৪ খ্রি.) ও ভ্যান ডার গােয়েস (Hugo van der Goes, ১৪৩০/৪০-১৪৮২ খ্রি.), ফ্রান্সের জঁ ফুকে (Jean Fouquet, ১৪২০-১৪৮১ খ্রি.) এবং নেদারল্যান্ডসের হিয়েরোনিমাস বসের (Hieronymus Bosch, ১৪৫০-১৫১৬ খ্রি.) নাম উল্লেখ করা যায়। এদের কারাে কারাে কাজে মধ্যযুগের শিল্পরীতির প্রভাবের সাথে রেনেসাঁ শিল্পের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, ভ্যান ডার গােয়েসের ধর্মবিষয়ক ছবিতে বাস্তবের প্রতিফলন উপেক্ষা করা হলেও গভীর স্পেস আর ডিটেইলের ব্যবহারে তার ছবি রেনেসাঁ শৈলীর কাছাকাছি। ফ্লোরেন্সে সান্তা মারিয়া নুওভা হাসপাতালের চার্চের জন্য ১৪৭৫ সালে তিনি যে পোর্টিনারি অল্টারপিস (Portinari Altarpiece) আঁকেন, তার সেন্ট্রাল প্যানেলে তার আঁকা মাতা মেরি, শিশু যিশু ও মেষপালকের তৈলচিত্র এরই দৃষ্টান্ত। কেউ আবার সময়ের তুলনায় বেশ অগ্রগামী ছিলেন। যেমন, বসের ছবিতে পরাবাস্তববাদের আভাস দেখা যায়। তার ১৪৯০ থেকে ১৫১০ এর মধ্যে আঁকা দ্য গার্ডেন অব আর্থলি ডিলাইটস (The Garden of Earthly Delights) ছবির তিনটি প্যানেলে ফ্যান্টাসি ও বাস্তবের মিশ্রণ রয়েছে। ক্যামপিনের ছবিতে গভীর স্পেস এবং সরলরৈখিক পারসপেকটিভের প্রভাব দেখা গেলেও বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে মধ্যযুগের প্রধান ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক অর্থ ব্যক্ত করার প্রয়াস রয়েছে। ১৪২৫ থেকে ১৪২৮ সালের মধ্যে তার আঁকা তিন প্যানেলের দ্য মেরােড অল্টারপিস (Mérode Altarpiece) ছবিটি এর দৃষ্টান্ত। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ‘দ্য মাস্টার অব ফ্ল্যামেন’ নামে যে অজ্ঞাতনামা শিল্পী অনেকগুলাে ছবি আঁকেন তিনিই রবার্ট ক্যাম্পিন।

সম্পূর্ণভাবে রেনেসাঁর শিল্পপদ্ধতি ও শৈলী ব্যবহার না করার জন্য উত্তরাঞ্চলের শিল্পীদের অনেককেই মধ্যযুগের শেষপর্বের শিল্পপদ্ধতির (গথিক) অনুসারী বলে বিবেচনা করা হয়। তারা প্রাচীন গ্রিস ও রােমের শিল্পের প্রতি কমই আগ্রহ দেখিয়েছে যদিও যাতায়াতের ফলে ইতালির বিভিন্ন শহরে রেনেসাঁর দর্শন, শিল্পচেতনা ও চর্চার বিষয়ে তারা অবহিত ছিলেন। তারা মানুষকে ইতালির রেনেসাঁ শিল্পীদের মতাে বীরােচিত রূপে বড় করে দেখেননি যার জন্য তাদের ছবিতে মানুষের প্রতিকৃতি স্কেলে, অনুপাতে এবং কাজের মাধ্যমে আগের মতােই (মধ্যযুগ) সাধারণভাবেই দেখানাে হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে ১৫শ শতকের শিল্পে গভীর স্পেস, ওজন (ম্যাস), বিশ্বাসযােগ্য মায়া সৃষ্টি, বাস্তবঘনিষ্ঠভাবে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখানাে এবং ডিটেইলের ব্যবহার থাকলেও সেসব গথিক পর্বের শেষে প্রকৃতির দৃশ্য অনুশীলনের যে প্রবণতা দেখা দেয় তারই সম্প্রসারিত বাস্তবায়ন বলে মনে করেন শিল্প ঐতিহাসিক জন ক্লিভার। এর সপক্ষে তিনি উল্লেখ করেছেন যে উত্তরাঞ্চলের শিল্পীদের ছবিতে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুপাত এবং পােশাক দেখানাে হয়েছে প্রচলিত (গথিক) পদ্ধতিতে। এই সব শিল্পীর প্রায় সব ছবিতেই ফিগারের শীর্ণ শরীর, বেঢপ রকমের বড় মাথা, অপ্রশস্ত কাধ, কৌণিকভাবে আঁকা পােশাকের ভাজ এবং ভিড়াক্রান্ত নিসর্গ দৃশ্য অথবা স্থাপত্যকম ১৫শ শতকের উত্তরাঞ্চলের চিত্রকলাকে মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের বৈশিষ্ট্য দিয়েছে, আকারে ছবিগুলাে যেমনই হােক, বিশদ আধ্যাত্রিক চেতনার অভিব্যক্তির ফলে রেনেসাঁ শিল্পের অবয়বের ডিটেইল অতিক্রান্ত হয়েছে মধ্যযুগের ট্রেডমার্ক ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে।

ছবি ছাপানোর প্রযুক্তির উদ্ভব ও প্রয়োগ

রেনেসাঁ পর্বে, ১৫শ ও ১৬শ শতকে উত্তর ইউরােপ ও ইতালির নগরগুলির মধ্যে যােগাযােগ বৃদ্ধি পায় এবং শিল্পকলা সহ সব বিষয়ে ভাবে ও অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান ঘটে। এই সময়ে শুধু ব্যবসায়ী নয়, শিল্পীরাও এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করেছে এবং সরেজমিনে নতুন পদ্ধতি ও শৈলীর ব্যবহার দেখেছে। সবই যে তারা গ্রহণ করেছে তা নয়, কিন্তু পরিবর্তনের ঢেউ সব জায়গায়ই লেগেছে। উত্তর ইউরােপ থেকে ইতালিতে যে প্রভাব বিস্তার হয় সেটি ছিল কাঠ খােদাই এবং এনগ্রেভিংয়ের মাধ্যমে।

১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানিতে একটি কারিগরির উদ্ভাবন হয়, শিল্পকর্মের ওপর যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী সময়ে মুদ্রণের বিকাশের ক্ষেত্রেও এই কারিগরি উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বই ছাপার কয়েক দশক আগে ছবি তৈরি এবং ছাপা শুরু হয়, যা সম্ভব হয়েছিল কাঠ খােদাই উদ্ভাবনের ফলে। এই উদ্ভাবনের ফলে কাঠ খােদাই করে মানুষের মুখ ও দেহ থেকে, জীবজন্তু, গাছপালা, গির্জা – প্রায় সবকিছুর প্রতিকৃতি তৈরি ও পরবর্তী সময়ে ছাপা সম্ভব হয়েছিল, ইংরেজিতে যার নাম উডকাট এবং বাংলায় কাঠ খােদাই। খুবই সস্তা এবং সহজ ছিল কাঠ খােদাই পদ্ধতি। প্রথমে সন্তদের প্রতিকৃতি এবং লেখা যােগ করে ধর্ম বিষয়ে অনেক প্রচারপত্র তৈরি করা হয় যা তীর্থযাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে এবং বাজারে সুলভ মূল্যে পাওয়া যেত। গুটেনবার্গ যখন জার্মানিতে কাঠের হরফ তৈরি করে ছাপাখানায় পুস্তিকা ও বই ছাপানাে শুরু করলেন সেই সময় থেকে মুদ্রণপদ্ধতি প্রচলিত হলাে। ছাপা ছবির সঙ্গে অক্ষরে লেখা বর্ণনা যুক্ত হলাে। ১৫শ শতকের শেষ পর্বে উত্তরাঞ্চলের শিল্পীরা তাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আরাে বিশদ করে ছবি ছাপাতে আগ্রহী হয়ে কাঠের পরিবর্তে তামার পাত ব্যবহার করলেন যেখানে সূক্ষ্মভাবে ধারালাে ছােট অস্ত্র দিয়ে দাগ কাটা হলাে। এভাবে এনগ্রেভিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হলাে। কাঠ খােদাই এবং এনগ্রেভিংয়ের পদ্ধতি ও কৌশল উত্তরাঞ্চলের দেশ থেকে অনতিবিলম্বে সমগ্র ইউরােপে ছড়িয়ে পড়ল।

এই মাধ্যম সঙ্গে সঙ্গেই ইতালিতে শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রেখেছে। ইতালিতে মনতেঞা এবং বত্তিচেল্লি এনগ্রেভিং করে ছবি তৈরি করলেন। এগুলোর প্রিন্টের মাধ্যমে ইউরােপের সব দেশের শিল্পীরা একে অন্যের ছবির বিষয় ও শৈলী সম্বন্ধে খুব সহজে এবং দ্রুত পরিচিত হলেন। ছবির প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে ইতালির রেনেসাঁ পর্বের চিত্রকলা সমস্ত ইউরােপে শুধু পরিচিত না, জনপ্রিয়ও হয়ে উঠল। এর ফলে পরবর্তী সময়ে ছাপাখানা উদ্ভাবনের পর শিল্পীর ছবি সাধারণ মানুষে কাছে পৌছানাে সম্ভব হলো, ১৫শ শতকের শেষ দিকে উত্তর ইউরােপের মধ্যযুগীয় শিল্পধারা ও পদ্ধতির ওপর নেমে এলাে যবনিকা। সেইসব দেশের শিল্পীদের সামনে দেখা দিল রেনেসাঁ পর্বের নতুন শৈলী ব্যবহার করে ছবি আঁকার চ্যালেঞ্জ। বলাবাহুল্য, কাঠ খােদাই ও এনগ্রেভিং পদ্ধতিতে তৈরি শিল্পকর্মের অধিকাংশই ছিল বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ মধ্য ইতালির শিল্পীদের কাছে প্রকৃতিবাদের যে আদর্শ ছিল উত্তর ইউরােপে ছিল সেটি সেই ধারার সম্পূরক।

ফন এইখ ও ক্যাম্পিনের হাতে প্রকৃতিবাদভিত্তিক ফ্লেমিশ শৈলী ও তার বিবর্তনে হাই রেনেসাঁ

১৫শ শতকে উত্তর ইউরােপের ফ্ল্যান্ডার্স বা ফ্লাঁদর অঞ্চলে নতুন ধরনের চিত্রকলার চর্চা শুরু হয়। এই অঞ্চলের ফ্লেমিশ শিল্পীরা অলঙ্কারবহুল আন্তর্জাতিক গথিক শিল্পধারা থেকে সরে এসে প্রকৃতিবাদভিত্তিক শৈলীর উদ্ভাবন করে যেখানে বাস্তবতার ডিটেইল এবং ধর্মভিত্তিক প্রতীকময়তার মিশ্রণ ঘটে। ফ্লেমিশ (নেদারল্যান্ডিশও বলা হয়) স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘ফ্লিমেনের মাস্টার’ নামে পরিচিত রবার্ট ক্যাম্পিন ও ইয়ান ফন এইখ। রবার্ট ক্যাম্পিনের ছবিতে অধিক মাত্রায় শারীরিক বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন হয়েছে। অন্যদিকে ফন এইখের ছবিতে দেখা যায় তার রপ্ত তেল রং পদ্ধতির বহুল ব্যবহার যার মাধ্যমে তিনি আধুনিক যুগের হাই ডেফিনেশন ইমেজ সৃষ্টি করেছেন। ব্রুজে ফন এইখের উত্তরসূরি ছিলেন পেট্রাস ক্রিস্টাস। কিন্তু নেদারল্যান্ডিশ শিল্পে সবচেয়ে বড় প্রভাব রাখে শিল্পী ভ্যান ডার ওয়েইডেনের গভীর পর্যবেক্ষণভিত্তিক ন্যাচারালিজম এবং আবেগভিত্তিক অনুভূতির সংমিশ্রণ। এর ফলে হুবহু বাস্তবের প্রতিফলন নয়, বরং তার সৃজনশীল উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৫শ শতকে এই পরিবর্তন আসে।

১৬শ শতকে হাই রেনেসাঁ পর্বে এসে ফ্লেমিশ শিল্পপদ্ধতি শৈলী বিবর্তিত হয়ে সূচিত করে উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁ পর্বের শীর্ষবিন্দু বা উত্তরাঞ্চলীয় হাই রেনেসাঁর শিল্পচর্চা। নেদারল্যান্ডিশ শিল্পের আওতায় নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা যেমন নতুন বিষয় বেছে নিয়েছে (ল্যান্ডস্কেপ, দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য), তেমনি তারা উদ্ভাবন করেছে কিছুটা ভিন্ন এবং তরতাজা নতুন শৈলীও।

উত্তরাঞ্চলীয় হাই রেনেসাঁয় সংকট ও একজন হোলবাইন

হাই রেনেসাঁ পর্বে উত্তর ইউরােপের দেশগুলোর শিল্পীদের সামনে দুটি কারণে শিল্পচর্চায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমটি ছিল ছাপাখানার মাধ্যমে কাঠ খােদাই ও এনগ্রেভিংয়ের ছবি মুদ্রিত হওয়ার ফলে এই মাধ্যমে কাজ করার জন্য পৃষ্ঠপােষকদের কাছ থেকে চাপ। এদের অধিকাংশই ছিল ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা সস্তায় ছবি কেনার সুযােগ পেয়ে দামি তৈলচিত্রের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করে। দ্বিতীয় কারণ ছিল আরাে গুরুতর। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের নেতারা বিশেষ করে ক্যালভিনিস্টদের মতাে আরাে গোঁড়া সদস্যরা চার্চে যিশু কিংবা সেইন্টদের ছবি পৌত্তলিকতার প্রতিনিধিত্বকারী মনে করায় তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হয়। শুধু চার্চে নয়, বসতবাড়িতেও এমন চিত্র থাকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া উত্তরের দেশের বাড়িঘরের দেয়াল ফ্রেসকো আঁকার অনুকূল ছিল না। শিল্পীদের তখন বই সচিত্রকরণ এবং পােট্রেট পেইন্টিংয়ের দিকে ঝুঁকতে হয়। জার্মান শিল্পী হােলবাইনের শিল্পচর্চায় এই সমস্যার প্রভাবে কি দাঁড়ায় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণে অন্য শিল্পীদের সংকটের চিত্রও পাওয়া যাবে। তিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের বাসেল (Basel) শহরে চার্চের জন্য দ্য ভার্জিন অ্যান্ড দ্য চাইল্ড (The Virgin and The Child) ছবিটি আঁকেন। এই ধরনের ছবির শৈলী সব দেশে প্রায় একই ছিল। কিন্তু হােলবাইন এই চবিতে নিজের মতাে করে ফিগারগুলাে সাজিয়েছেন এবং ক্লাসিক্যাল শিল্পপদ্ধতির কম্পােজিশনের সাহায্যে ভার্জিন মেরির প্রশান্ত ও মােহনীয় প্রতিকৃতি স্থাপন করেছেন। সামঞ্জস্যময় কম্পােজিশনে রেনেসাঁ ইতালির রাফফায়েল্লো ও বেল্লিনির প্রভাব থাকলেও ডিটেইলের মনােযােগী ব্যবহার এবং সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণা পরিহার করার ফলে উত্তরের শিল্পীদের অনুসৃত ঐতিহ্যের অনুসরণও দেখা যায়।

এই তৈলচিত্র আঁকার পর তার যে খ্যাতি হয় তার ভিত্তিতে জার্মান ভাষাভাষী দেশে আরাে এমন কাজের কমিশন পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু তখনই রিফর্মেশনের প্রতিক্রিয়াশীল পরিবেশ আরাে কঠোর হয়ে যাওয়ার ফলে তাকে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়। সেখানে তিনি প্রধানত পােট্রেট ছবি আঁকার কমিশন পান। পরবর্তী সময়ে রাজদরবারের শিল্পী হিসেবে পােট্রেট ছাড়াও আসবাব, অলংকার, পােশাক ইত্যাদির জন্য তাকে কাজ করতে হয়। এই সময়ের একটি পােট্রেট হলো ১৫৩৬ সালে তার আঁকা পোট্রেইট অফ সার রিচার্ড সাউথওয়েল (Portrait of Sir Richard Southwell) যেখানে বিষয়ের চারিত্রিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের আভাস রয়েছে। এই ধরনের প্রতিফলনে তিনি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না নিয়ে নিজের চিন্তা ও অনুভূতির সাহায্যই নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ম্যানারিজমের আবির্ভাবে হােলবাইন যেমন সরলভাবে পােট্রেট এঁকেছেন তার স্থানে দেখা দেয় রাজপরিবারের জাঁকজমক ও রুচি। ইংল্যান্ডের শিল্পী নিকোলাস হিলিয়ার্ড (Nicholas Hilliard, ১৫৪৭-১৬১৯ খ্রি.) ১৫৮৫-৯৫ সালের মধ্যে ইয়াংম্যান অ্যামং রােজেস (Young Man Among Roses) নামে যে ছবি আঁকেন তাতে এই পার্থক্য দেখা যায়।

প্রোটেস্ট্যান্ট সমস্যার সমাধান ও ব্রোয়েঘল

ইউরােপে একমাত্র নেদারল্যান্ডসেই শিল্পচর্চার ওপর প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের নিষেধাজ্ঞা তেমন কঠোর বা ব্যাপক ছিল না। তাছাড়া সেখানে শিল্পের চর্চা এত দীর্ঘকাল হয়েছে যে শিল্পীরা সহজেই উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে নতুন পথ খুঁজে বের করেছে। পােট্রেট পেইন্টিং ছাড়াও ডাচ শিল্পীরা সেইসব বিষয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন যার ওপর প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের কোনাে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ইয়ান ফন এইখের সময় থেকেই ডাচ শিল্পীরা অনুকরণে ছিল সিদ্ধহস্ত। ইতালির রেনেসাঁ শিল্পীরা যেখানে মানুষের প্রতিকৃতি আঁকায় উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছান ডাচ শিল্পীরা গাছ, লতাপাতা এবং অন্য সব বিষয়ে ছবি আঁকায় পারদর্শির্তায় দক্ষিণের (ইতালির) শিল্পীদের অতিক্রম করে যান। কেনেথ ক্লার্ক অবশ্য আলব্রেশট ডুরারের লতাগুল্ম বিষয়ক ছবির সঙ্গে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির একই বিষয়ে আঁকা ড্রইংয়ের তুলনা করে বলেছেন যে ডুরারের ছবিতে প্রাণ নেই এবং সেগুলি উদ্দেশ্যবিহীন বলে মনে হয়। ডাচ শিল্পীদের জন্য শিল্পের কোনাে শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন যে কঠিন ছিল না তার দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন হিয়েরোনিমাস বস যিনি প্রোটেস্ট্যান্ট নিষেধাজ্ঞা আরােপের আগে বাইবেলে বর্ণিত নরক ও দানবদের একাধিক ছবি এঁকে সেই দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন।

সমস্যার মুখােমুখি হয়ে ডাচ শিল্পীরা মধ্যযুগে ধর্মীয় পুস্তক সচিত্রকরণের এবং ১৫শ শতকে বাস্তব জীবনভিত্তিক যেসব ছবি এঁকেছেন সেই ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। এভাবে শুরু হয় দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার দৃশ্য নিয়ে বিশেষ শাখা বা জাঁরের শিল্পচর্চা। এদের মধ্য সবচেয়ে প্রতিভাবান ছিলেন পিটার ব্রোয়ঘল (Pieter Bruegel, ১৫২৫-৩০ – ১৫৬৯ খ্রি.) যিনি রােমে কিছু সময় থাকার পর অ্যান্টোয়ার্পে এসে কাজ করতে শুরু করেন। ১৫৬০-এর পর থেকে তিনি সাধারণ কৃষকদের জীবন ও মাঠের দৃশ্য নিয়ে ছবি আকতে থাকেন। বেশ হালকা মেজাজে কৃষকদের কাজ ছাড়াও আনন্দ-ফুর্তি করার মুহূর্তের ছবি এমনভাবে আঁকেন তিনি যে তাকে কৃষক অথবা তাদের নিকট বন্ধু বলেই মনে হয়। সেই সময়ে গ্রামের কৃষকদের ভাঁড়ের মতাে হাস্য-কৌতুকপ্রিয় ও খােশ মেজাজে দেখানােই প্রচলিত রীতি ছিল যার জন্য ব্রোয়ঘলের ছবিতে চিত্রিত কৃষকের জীবনের দৃশ্যে একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ১৫৬৭ সালে তার আঁকা একটি উল্লেখযােগ্য ছবি দ্য পিজেন্ট ওয়েডিং-এ (The Peasant Wedding) গ্রামের মানুষেরা বিয়ের মতাে অনুষ্ঠানে কেমন আচরণ করে সেই দৃশ্য তিনি ডিটেইলের সাহায্যে এঁকেছিলেন। গমব্রিচের মতে, তিনতোরেত্তোও এত সুন্দর করে ঘরভর্তি মানুষের কম্পােজিশন সাজাতে পারতেন না। তিনি এরপর মন্তব্য করেছেন এই বলে যে এ ধরনের ছবি এঁকে ব্রোয়ঘল শিল্পের এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেন যেখানে পরবর্তী প্রজন্মের ডাচ শিল্পীরা আরও স্বচ্ছন্দে বিচরণ ও কাজ করার সুযােগ পান। ব্রোয়ঘলের আরেকটি বিখ্যাত ছবি হল ১৫৬৫ সালে তার আঁকা দ্য হান্টার্স ইন দ্য স্নাে (The Hunters in the Snow) ছবিটি। এখানে কৃষক জীবনের লঘু দিক প্রতিফলিত না করে আঁকা হয়েছে একটি গুরুতর বিষয়ের ছবি, যদিও পটভূমি গ্রামের এবং বিষয় সেকুলার। ছবিটির কম্পােজিশনের জটিলতা ব্রোয়ঘলের শিল্প-কুশলতার পরিচয় দেয়।

ফ্রান্সের শিল্পীরা উত্তরের দেশ এবং ইতালির মাঝখানে থেকে উভয় সংকটে পড়েছিলেন। ইতালির রেনেসাঁ পর্বে শিল্পশৈলীর প্রভাবে ফ্রান্সের মধ্যযুগের শিল্প ঐতিহ্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ফরাসি শিল্পীরা রেনেসাঁ ইতালির শৈলীকে নিজেদের মতাে করে খাপ খাইয়ে নিয়ে নতুন শৈলী উদ্ভাবন করেন। ভাস্কর জঁ গুজোঁর (Jean Goujon, ১৫১০-১৫৬৫ খ্রি.) রিলিফ ভাস্কর্যে এই নতুন শৈলীর দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তার ‘জ্যাক ক্যানাে’ নামের কাজে তিনি পিটার ব্রোয়েঘলের শিল্প-ভাবনার সঙ্গে তিনতোরেত্তোর শৈলীকে মেশান। এল গ্রেকোর (El Greco, ১৫৪১-১৬১৪ খ্রি.) মতাে শীর্ণ ও দীর্ঘ দেহের মানুষের ফিগারগুলােকে নানা ভঙ্গিতে দেখিয়ে তিনি ব্রোয়েঘলের মতােই হালকা মেজাজের আবহ সৃষ্টি করেছেন। 

আলব্রেশট ডুরার

জার্মানির আলব্রেশট ডুরার উত্তরের রেনেসাঁর একজন প্রধান শিল্পী। ১৪৯৮ সালে তার আঁকা সেলফ পােট্রেইট অ্যাট ২৬ (Self-portrait at 26) ছবিতে তিনি শিল্পীর মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি প্রকৃতির উদ্ভিদ ও লতাগুল্মের ছবি আঁকায় হয়তাে প্রাণসঞ্চার করতে পারেননি কিন্তু মানুষের আত্মার রহস্য সন্ধানে তার একাগ্রতা ও সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেনেথ ক্লার্ক স্বীকার করেছেন যে তার নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ডুরার যেভাবে মগ্ন থাকতেন সেটি ছিল মানুষের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তার সার্বিক আগ্রহের অংশ। এই মগ্নতা এবং অনুশীলনের ভিত্তিতে তিনি ১৫১৪ সালে তিনি মেলেনকোলিয়া ১ (Melencolia I) নামে বিখ্যাত এনগ্রেভিং ছবিটি তৈরি করেন। ছবিটির বিষয় সেকুলার এবং মধ্যযুগে অশিক্ষিত সমাজে আলস্য, একঘেয়েমি ও হতাশার সংমিশ্রণে যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা অনেকের সাধারণ অভিজ্ঞতার বিষয় হয়েছিল, সেই পরিচিত সমস্যাটি ডুরার এই ছবিতে প্রতিফলিত করেছেন। এখানে শুধু ডিটেইলের কুশলতা নয়, জটিল কম্পােজিশনের দক্ষ ব্যবস্থাপনাও অসাধারণ। সেই সাথে এখানে ডুরারের মানব চরিত্র সম্পর্কে বক্তব্যও বিশেষভাবে মনােযােগ আকর্ষণ করে। তিনি মানসিক বৈকল্য ও অস্থিরতার চিত্র এঁকে বলতে চেয়েছেন সভ্যতার সংকট শুধু বাইরের কারণে নয়, মানস জগতের চিন্তা-ভাবনার অসচ্ছতার জন্য হতে পারে। ক্লার্ক বলেছেন ডুরােরের গুরুত্ব এইখানেই যে তিনি প্রিন্ট মেকিংয়ের উদ্ভাবন বাস্তবের পরিস্থিতি প্রতিফলনের জন্য সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন। বাস্তবের প্রতিফলনে তিনি আরাে সার্থকভাবে ব্যবহার করেন রেনেসা ইতালির শিল্পীদের উদ্ভাবিত পারস্পেক্টিভের ধারণা। তার উডকাট ও এনগ্রেভিং মাধ্যমের ছবিগুলাে ছিল বাস্তবকে প্রতিফলনের নতুন এক পদ্ধতি ও কৌশল যেখানে ঐন্দ্রজালিক কিছু ছিল না, প্রতীকীও নয়। ক্লার্কের মতে, নির্ভুল এবং বস্তুনিষ্ঠ বিষয় প্রতিফলনে তার ছাপচিত্র মােক্ষম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। রেনেসাঁ ইতালির সঙ্গে প্রতিযােগিতায় এটাই ছিল উত্তরের দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন।

উত্তরাঞ্চলীয় রেনেসাঁ ভাষ্কর্য

১৫শ শতকে পােলান্ডের ক্র্যাকো (Kraków) কেথিড্রালের প্রধান বেদীতে ভেইট স্টস (Veit Stoss, ১৪৫০-১৫৩৩ খ্রি) ১৪৭৭-৮৯ সালের মধ্যে যীশুখ্রীষ্টের জীবনের নানা উপাখ্যান থেকে শুরু করে তাঁর স্বর্গারােহণ পর্যন্ত বিষয়ের ভাষ্কর্য নির্মাণ করে এক অপূর্ব কাজ করেছিলেন, যা ভেইট স্টস অল্টারপিস নামে পরিচিত। এই ভাস্কর্য থেকে বােঝা যায় যে বাইজান্টাইন আমলে সে অঞ্চলের মূর্তির লক্ষণ সম্বন্ধে ধ্যানধারণা পশ্চিম ইওরােপের থেকে এগিয়ে ছিল। জার্মানিতে ভাষ্কর নিকোলাস গেরহাট (Nikolaus Gerhaert, ১৪২০-১৪৭৩ খ্রি.) ১৪৬৭ সালে বেলেপাথরে নিজের একটি মূর্তি নির্মাণ করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। এটি ছিল এক আশ্চর্য স্বাভাবিক মূর্তি যার চোখ-মুখ থেকে হতাশা ও বিষাদ ঝরে পড়ছে। এর জামার খােদাই, চুল, হাত, হাতের আঙ্গুল সবই অসাধারণ ছিল। বুক অবধি খােদাই করা ও একটি বড় চৌকো পাথর কেটে এরকম মূর্তিকে একমাত্র রােদ্যাঁর (Auguste Rodin) ব্যালজাকের সঙ্গে তুলনা চলে, যাকে বলা যায় অত্যন্ত “আধুনিক”। ভাষ্কর্যটি ম্যান মেডিটেটিং (Man Meditating) নামে পরিচিত। অন্যদিকে সুদূর ইংলণ্ডের সেলবি কেথিড্রালেও খ্রীষ্টের ক্রুশ থেকে অবতরণ বা তার রেজারেকশন বিষয়ে অ্যালাবাস্টারে (Nottingham alabaster) ১৪৫০-৯০ সালের নির্মিত একটি অসাধারণ ভাস্কর্য আছে যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রিলিফ। এটির ভাষ্কর কে ছিলেন তা জানা যায়না। ভাষ্কর্যটি রেজারেকশন নামে পরিচিত।

শেষ কথা

ইউরােপের উত্তরের দেশে রেনেসাঁ পর্বে ডাচ শিল্পীরা রেনেসাঁ ইতালির শিল্পীদের মতাে তৈলচিত্রের মাধ্যম ব্যবহার শুরু করে, কিন্তু তাদের শিল্পকর্মে চার্চের নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে ধর্মীয় বিষয়ের পরিবর্তে সেকুলার বিষয়ই প্রাধান্য পায়, আর এই সেক্যুলার বিষয়গুলোর মধ্যে প্রাধান্য পায় নীতিকথার প্রচার। ছাপচিত্র ও ছাপাখানার প্রসারের ফলে উত্তরের রেনেসাঁয় বিভিন্ন শ্রেণির ছাপচিত্রের কাজ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তা বিস্তৃত হয়। পােট্রেইট এবং ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যও চিত্রকলার বিষয় হয়। গ্রামীণ দৃশ্য ও কৃষকের জীবন এই প্রথম শিল্পকর্মে গুরুত্ব লাভ করে।

ম্যানারিজম

ইতালীয় ম্যানারিজম

রেনেসাঁ শিল্পীদের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন সম্রাট, পােপ, সামন্তপ্রভু ও ধনী বণিকরা। ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলি এদের নানা ধরনের কাজ দিয়েছিল, এদের পতন ঘটলে শিল্পীদের ক্ষতি হয়। সাধারণতন্ত্রের পতন ঘটলে শিল্পীদের পৃষ্ঠপােষকতা করেন স্বৈরাচারী শাসকেরা। সাভোনারােলার (Girolamo Savonarola, ১৪৫২-১৪৯৮ খ্রি.) ধর্মীয় গণ-আন্দোলন, শিল্প-বিদ্বেষ ও ক্যাথলিক চার্চের ওপর আক্রমণ, মেকিয়াভেলির আভনব রাজনৈতিক মূল্যবোধ রেনেসাঁর পরিবেশ পাল্টে দিয়েছিল। শিল্পীরা আর আগের মতাে স্বাধীন ছিল না। ক্ল্যাসিক্যাল শৈলীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে ওঠে বারোক ও ম্যানারিজম। মিকেল্যাঞ্জেলোর লাস্ট জাজমেন্টের নগ্ন চিত্রকে পরানাে হয় পােশাক, তাত্ত্বিক কারণে তাকে পাল্টাতে হয় সেন্ট পিটারের নক্শা।

রেনেসাঁর তিনটি পর্বের মধ্যে শেষেরটিকে বলা হয়েছে লেট রেনেসাঁ যার সময়কাল ধরা হয়েছে ১৫৩০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ। এই পর্বে এবং সময়কালে যে শিল্পশৈলী চিহ্নিত হয়েছে তার নাম দেওয়া হয় ম্যানারিজম (Mannerism)। ইতালীয় ম্যানারিজম বা এই স্টাইলের শৈলী বলতে বােঝানাে হয়েছে ১৬শ শতকে (১৫৩০-১৬৬০) হাই রেনেসাঁর শেষ এবং ব্যারােক (Baroque) শৈলীর মাঝখানে যে শিল্পশৈলীর চর্চা ইতালিতে বিস্তৃতি লাভ করে সেটি। এই শৈলীকে মনে করা হয় হাই রেনেসাঁ শিল্পশৈলীর প্রত্যাখ্যান হিসেবে এবং একই সঙ্গে সেই শৈলীর পরিমার্জন ও পরিশীলনরূপে। এই শিরােনাম এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘ম্যানিয়েরা’ থেকে যার অর্থ স্টাইল অথবা স্টাইলিশনেস। ভাজারি এই শব্দটি তার সময়ের (হাই রেনেসাঁ) পরিশীলিত ও মাধুর্যপূর্ণ শিল্পকলা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী সময়ে ম্যানারিজম কথাটি নিন্দার্থে ব্যবহার করে শিল্পের অধােগতি ও দুর্গতি (ডেকাডেন্স) এবং আরােপিত রূপের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। হাই রেনেসাঁ পর্বের মহিমান্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ শিল্পের তুলনায় বাহুল্য অতিরঞ্জনের ফলে যে শিল্প স্টাইল অধঃপতিত হয় তার ওপর জোর দিয়ে অনেকে ম্যানারিজম কথাটি ব্যবহার করেছেন। মিকেল্যাঞ্জেলো এবং রাফফায়েল্লোর শেষ জীবনের শিল্পকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালির ম্যানারিস্ট শিল্পীরা হাই রেনেসাঁর আনুষ্ঠানিক শৈলী ও পদ্ধতির বিকৃতি ঘটিয়ে একটি অন্তঃসারশূন্য (আর্টিফিশিয়াল) শৈলী উদ্ভাবন করে, যেখানে অস্বাভাবিক আকারের ফিগার, অলঙ্করণ প্রবণতা, অপ্রাকৃতিক রং এবং কঠিন ও আঁকাবাঁকা দেহভঙ্গি স্থান পায়, ফলে মিকেল্যাঞ্জেলো ও রাফফায়েল্লোর ক্লাসিক্যাল শিল্পশৈলী ও তাঁদের শিল্প আদর্শ প্রকৃত অর্থে ম্যানারিস্টদের শিল্পে স্থান পায় না। মিকেল্যাঞ্জেলো ও রাফফায়েল্লোর শিল্পকর্মে যে শান্ত সমাহিত ভাব ও সামঞ্জস্যময়তা সেসব ম্যানারিস্টের শিল্পে থাকে না। তার পরিবর্তে দেখা যায় নাটকীয়তা ও অতিরঞ্জিত দেহভঙ্গি। ১৫২০ শতক থেকে ইতালির যেসব শিল্পী এই ধরনের ম্যানারিজম বা স্টাইলিশ স্টাইল ব্যবহার করে ছবি আঁকেন সেখানে পরিশীলন ও অতিরঞ্জন প্রক্রিয়ায় সিগ্ধ উৎকর্ষ (এলিগেন্স) দেখা দিলেও অতিরঞ্জনের জন্য অর্থহীন হয়ে যায়। যেমন, বীরােচিত দেহভঙ্গি পর্যবসিত হয় শূন্যগর্ভ এবং অলীক রূপের সৃষ্টিতে। ১৬শ শতকের শেষে অবশ্য শিল্পীদের কাজে আবেগের প্রত্যক্ষ এবং শক্তিশালী প্রকাশ ঘটে।

এই পর্বের শিল্পীরা যখন জানতে পারেন যে শিল্পকর্মে সব পদ্ধতি আর শৈলীর উদ্ভাবন কিংবা পুনঃসৃষ্টি রেনেসাঁ পর্বের শিল্পীরা করে গিয়েছেন তখন তারা তাদের কাজে সেসব অনুসরণ করলেও কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়, বিশেষ করে ন্যুড ছবি আঁকার ক্ষেত্রে। কিন্তু কেউ কেউ তা না করে ওল্ড মাস্টারদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক কিছু করার উদ্যোগ নেয়। তারা তাৎপর্যময় যে ছবি তৈরি করে তার সারবত্তা রেনেসাঁ শিল্প বিষয়ে পণ্ডিত ছাড়া অন্যদের বুঝতে কষ্ট হয়। রেনেসাঁর মাস্টার শিল্পীদের ক্লাসিক্যাল পদ্ধতিভিত্তিক শিল্প অতিক্রম করে যাওয়ার এই প্রয়াস খুব বিশ্বাসযােগ্য না হলেও বেশকিছু বিচিত্র এবং পরিশীলিত নিরীক্ষাধর্মী ছবির সৃষ্টি হয়। ওল্ড মাস্টার্সরা, বিশেষ করে মিকেল্যাঞ্জেলো অবশ্য মাঝে মাঝেই নিজের খেয়ালখুশিকে প্রাধান্য দিয়ে ক্লাসিক্যাল ঐতিহ্যবিরােধী কাজ করেছিলেন। তিনি নিখুঁত কাজে সন্তুষ্ট না হয়ে যেভাবে নতুন শৈলীর উদ্ভাবনে অগ্রসর হয়েছিলেন, ম্যানারিস্ট স্কুলের শিল্পীরা তা-ই করার চেষ্টা করেছে। এই সব শিল্পীর মধ্যে যেমন ছিল স্থপতিরা, তেমনি ছিল ভাস্কর ও চিত্রকররাও।

তিনতোরেত্তোর ম্যানারিস্ট চিত্রকর্ম

ভেনিসের রেনেসা পর্বের শিল্পীদের মধ্যে তিনতোরেত্তোর (Tintoretto, ১৫১৮-১৫৯৪ খ্রি.) নাম উল্লেখযােগ্য। সত্যজিত রায়ের ফেলুদাভিত্তিক গোয়েন্দা উপন্যাস ও তার উপর ভিত্তি করে সন্দীপ রায়ের চলচিত্র “টিনটোরেটোর যীশু” এর টিনটোরেটো হলেন এই তিনতোরেত্তো। যাই হোক, তিনতোরেত্তোর চিত্রকলায় তিৎসিয়ানোর প্রভাব বেশ স্পষ্ট। মিকেল্যাঞ্জেলােও যে তার কাছে আদর্শ চিত্রকর ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার বিখ্যাত তেল রং ছবির মধ্যে রয়েছে যিশুর জীবনীর সঙ্গে সম্পর্কিত সেন্ট মার্কের জীবনীভিত্তিক এবং মিথলজির বিষয়কেন্দ্রিক দৃশ্য। এই সব ছবিই ভেনিসে সংরক্ষিত। তার দক্ষতা এবং বিশেষত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ১৫৯২-৯৪ সালে জীবনের শেষ পর্বে তার আঁকা লাস্ট সাপার (Last Supper) ছবিটিতে। একই নামে মিলানের গির্জায় দা ভিঞ্চির আঁকা বিখ্যাত ছবিটি রয়েছে। তিনতোরেত্তো এই ছবি আঁকতে গিয়ে ভিন্ন কম্পােজিশন এবং রং ও আলােছায়ার ব্যবহার করেছেন। তিনি খাবারের টেবিলটি সামনাসামনি না দেখিয়ে ঘরের ভেতরের দিকে প্রসারিত করেছেন যার একদিকে যিশু এবং তার শিষ্যরা উপবিষ্ট, অন্যদিকে পারিচারক ও পরিচারিকাদের খাবার পরিবেশন করতে দেখা যায়। শিষ্যদের মধ্যে যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, জুডাস অন্যদের বিপরীতে বসে আছে দেখা যায়। টেবিলের মাঝখানে উপবিষ্ট যিশুর মাথার চারপাশে আলাের বড় বৃত্ত ঘরটির অন্ধকার দূর করার ভূমিকা নিয়েছে। জুডাস ছাড়া অন্যান্য শিষ্যের মাথার ওপরে ছােট আকারের বলয় দেখা যায় যার সাহায্যে ওপরের অন্ধকার কিছুটা দূর হয়েছে। সিলিং থেকে ঝুলন্ত বাতি থেকেও আলাে বিচ্ছুরিত হয়েছে নিচের দিকে। স্বচ্ছভাবে আলাে ব্যবহার করে ওপর থেকে উড়ে আসা দেবদূতদের শরীর দেখানাে হয়েছে। তিনতোরেত্তো এইভাবে যে ছবি এঁকেছেন সেখানে কম্পােজিশন ব্যবহারে শুধু নতুনত্ব নয়, আলাের ব্যবহারেরও বৈচিত্র্য এসেছে। ভেনিসের রেনেসাঁ শিল্পের এটাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য যা বাস্তবতার প্রতিফলনে রহস্যময়তার মাত্রা যােগ করেছে।

তিনতোরেত্তোই ছিলেন ইতালিতে ১৬শ শতকের শেষ দিকের ম্যানারিস্ট পর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী। ভাজারির মতে, তিনি যদি পূর্বসূরিদের ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুসরণ করতেন তাহলে ভেনিসের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী হতে পারতেন। কিন্তু তিনতোরেত্তো পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করে বিষয়কে নতুন দৃষ্টিতে দেখে নির্বাচন এবং তার উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তার শিল্পকর্মে আগের তুলনায় বেশ নতুন ভঙ্গিতে উপকথা ও মিথ সৃষ্টি হয়েছে। একটি মিথলজিক্যাল বিষয় যেভাবে কল্পনা করেছেন তিনি সেই অনুযায়ী ছবিতে দেখাতে চেষ্টা করেছেন এবং তা যখন করতে পেরেছেন তখন নিজেকে সফল মনে করেছেন। সচেষ্ট হয়ে মসৃণ পদ্ধতির ছবি তৈরি তার পছন্দের ছিল না। বলা যায় তিনি বিষয়ের আদর্শায়ন করেছেন এবং ছবি তৈরিতে পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করলেও প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করেছেন।

চেল্লিনির ম্যানারিস্ট ভাষ্কর্য

ফ্লোরেন্সে জনপ্রিয় স্বর্ণকার বেম্ভেনুতো চেল্লিনি (Benvenuto Cellini, ১৫০০-১৫৭১ খ্রি.) ছােট আকারের যে ভাস্কর্য সৃষ্টি করেন সেখানে পূর্বসূরিদের তুলনায় নতুন কিছু করার প্রতি তার গুরুত্ব ছিল বেশি। তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ১৫৪৩ সালে তার তৈরি চেল্লিনি সল্ট সেলার (Cellini Salt Cellar) এবং ফ্লোরেন্স শহরের কেন্দ্রে উন্মুক্ত স্থানে স্থাপিত পারসিয়াস উইথ দ্য হেড অফ মেডুসা নামে ভাস্কর্যকর্ম উল্লেখযােগ্য। আগেরটি ছােট আকারের হলেও দ্বিতীয়টি ছিল প্রায় লাইফ সাইজ এবং এখানে পার্সিউসকে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে মেডুসাকে বধ করে এক হাতে তার ছিন্ন মুণ্ডু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুটি শিল্পকর্মই বাস্তবভিত্তিক যদিও স্বর্ণকার হিসেবে এই কাজে তিনি অলঙ্করণের মাত্রা যােগ করেছেন। শেষােক্ত বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাকে ম্যানারিস্ট স্কুলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বেম্ভেনুতো চেল্লিনির ছেলেবেলার প্রায় সবটাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে, লােকজনের সঙ্গে মারামারি করে কেটেছে। তিনি অসম্ভব ভাল সােনার কাজ করতেন। তার বিখ্যাত বিখ্যাত সােনা-রূপার কাজের সংখ্যা প্রচুর। তার সােনা রূপা আর হীরে জহরতের কাজ এত প্রসিদ্ধ যে পৃথিবীর বিশেষত ইওরােপের সব মিউজিয়ামে তার অন্তত একটি কাজ থাকেই। চেল্লিনি স্বর্ণকার হলেও তিনি ভালো ভাষ্করও ছিলেন। তার ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলো অসাধারণ ছিল। 

ফ্লোরেন্সের ডিউক তাকে বললেন পার্সিয়ুস মেডুসাকে বধ করেছেন এই বিষয়ে এক ব্রোঞ্জ মূর্তি করে দেবার কমিশন দেন। চেল্লিনি কাজ শুরু করেন। এখন মূর্তিটি প্রমাণ মানুষের চেয়ে বড় সাইজের হতে হবে। ফ্লোরেন্সের অনেক শিল্পীই মনে করলেন, স্বর্ণকার চেলিনির পক্ষে সেটি অসম্ভব হবে, কারণ তিনি তো সােনার ছােট ছােট জিনিস তৈরি করেন মাত্র। এমনকি ফ্লোরেন্সের ডিউক ১ম কসিমো ডে মেডিচি নিজে শেষ পর্যন্ত চেল্লিনিকে বললেন, তুমি অতি ছােট ছােট হীরে মােতি নিয়ে কাজ কর, এত বড়, ঢালাইয়ের কাজ কি পারবে? ভেবে দেখ।.. যাই হোক, ব্রোঞ্জের মূর্তি নির্মাণের জন্য আগে মাটির মূর্তি তৈরি করতে হয়, তারপর তার উপর ব্রোঞ্জ গলিয়ে ঢালাই করতে হয়, তারপর তা পালিশ করতে হয়। এখনকার ভাষ্কররা খালি মাটির মডেল তৈরি করে তা কারখানায় ঢালাই এর জন্য পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু চেল্লিনির সময় এর সব কাজ ভাষ্করকেই করতে হতো। ব্রোঞ্জ গলানোর জন্য তিনি একটি বিরাট চুল্লি তৈরি করেন। তারপর তিনি মাটিতে একটি গর্ত খুঁড়ে মূর্তির ছাঁচটি বসালেন। তার সঙ্গে ছােট ছােট অনেক নল লাগিয়ে দিলেন যার মধ্যে দিয়ে গলিত ব্রোঞ্জ জলের মত নেমে এসে ছাচের চারধারে ঘুরে জমে যাবে। ছাঁচটি হল একেবারে মূর্তির মাপের। কাজের পরীক্ষা হিসাবে তিনি প্রথমে মেডুসার কাটা মুণ্ডটি ঢালাই করলেন। এতে অসাধারণ একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি হলো। 

তখন সাহস পেয়ে চেল্লিনি খােদ পার্সিয়ুস মূর্তিটি ঢালাই করতে প্রস্তুত হলেন। এটা অনেক শক্ত কাজ। প্রথমত মূর্তিটি বেজায় বড়, তার পরে তার খুঁটিনাটি কাজও অত্যন্ত জটিল। যে চুল্লিতে ঢালাইয়ের জন্য ব্রোঞ্জ গলানাে হচ্ছিল সেটি এত গরম হয়ে গেল যে আগুন চুল্লির মাথা দিয়ে উঠে চেল্লিনির বাড়ির ছাদে আগুন ধরিয়ে দিল। ওদিকে চেল্লিনি নিজে অমানুষিক পরিশ্রম করছেন, যাতে চুল্লিতে আগুন না কমে, তাহলে গলা ব্রোঞ্জ আবার শক্ত হতে আরম্ভ করবে। শেষে চেল্লিনি এই সব করে এত ক্লান্ত হয়ে গড়লেন, যে বেশ অসুস্থ হলেন ও তার ভৃত্যদের নির্দেশ দিয়ে শয্যা নিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভৃত্যরা আর সাকরেদরা ঘরে এসে বলল যে ব্রোঞ্জটি চুল্লিতে ঠিকমত না গলায় সব নষ্ট হয়ে গেছে। অত অসুস্থতা সত্ত্বেও চেল্লিনি দৌড়ে চুল্লির কাছে গেলেন। ইতিমধ্যে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি পড়ে চুল্লি নিভে যাচ্ছিলো। চেল্লিনি দুজন লােককে পাঠালেন আরাে কাঠ আনতে। কাঠ ঢুকিয়ে চুল্লি আবার উস্কে দিতেই আগুন লাফিয়ে উঠে আবার হাতে ধরে গেল। ওদিকে চেল্লিনি হুকুম দিলেন চুল্লির উপর কাঠের তক্তা আর কার্পেট চাপা দিতে, যাতে বৃষ্টির জল চুল্লির ভেতরে না ঢােকে। তারপর সকলে মিলে লম্বা লম্বা শিক নিয়ে গলানো ব্রোঞ্জ ঘুটতে আরম্ভ করে দিলেন। আস্তে আস্তে সব ব্রোঞ্জটুকু গলে ঠিকমত তরল হয়ে যায়। ঠিক এইসময় হঠাৎ এক প্রকাণ্ড চোখ ধাঁধানাে আলাের ঝিলিক এলো ও সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। তারপর সম্বিত এলে চেল্লিনি মুখ তুলে দেখেন যে চুল্লি টগবগ করে গলে মাথার টাকনা উড়ে গেছে, আর চুল্লির মাথা দিয়ে ব্রোঞ্জ টগবগ করে গলে গলে পড়ছে। চেল্লিনি তাড়াতাড়ি নলের মুখগুলি খুলে দিলেন, যাতে গলা ধাতুর স্রোত নলগুলি দিয়ে নিচের ছাঁচে ঠিকমত যায়। কিন্তু তাতেও ব্রোঞ্জ ঠিকমত সহজে নামেনি। চেল্লিনি ভাবলেন ঐ ভীষণ আগুনের তেজে তামার সঙ্গে অন্য যে ধাতুটি থাকে যার জন্য তামাটি ঠিকমত গড়ায় সেটি নিশ্চয় আগুনের তেজে বাষ্প হয়ে উবে গেছে। তাই তিনি বাড়িতে যত পিউটারের থালা, বাটি, গামলা, চামচ, বাসন ছিল সব তিনি একে একে গলা ব্রোঞ্জের মধ্যে ঢালতে আরম্ভ করলেন। পিউটার হচ্ছে টিনের নরম মিশ্র ধাতু এবং তামার সঙ্গে খুব সহজে মেশে। ফলে ব্রোঞ্জ আবার চলতে শুরু করল, এবং আস্তে আস্তে ছাঁচটি ভরে গেল। 

ফ্লোরেন্সবাসী এই মূর্তি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে ছিল, সবার মধ্যে কৌতূহল ছিল যে স্যাকরা চেল্লিনি কিকরে অতবড় ব্রোঞ্জের ভাষ্কর্য তৈরি করেন। তাছাড়া, মূর্তি লােজিয়াতে রাখার আগেই সারা ফ্লোরেন্সবাসী শুনেছে তা তৈরি করতে গিয়ে চেল্লিনির কী দশা হয়েছিল। এই অসাধারণ মূর্তিটি দেখার পর ফ্লোরেন্সবাসী যে প্রচণ্ড বিমোহিত হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই মূর্তিটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ রেনেসাঁ ভাষ্কর্যের স্থান দখল করেছে। মূর্তিটি ফ্লরেন্সের লেজিয়া ডেই লাৎজিতে রক্ষিত আছে। মার্বেল বেদীর উপর পায়ের তলায় অনেক ছােট ঘােট মূর্তি আছে পাথরের। মূর্তিটি বানানোর জন্য চেল্লিনির এত কষ্ট বৃথা যায়নি। পার্সিয়ুস মাথা নিচু করে আছেন, পাছে মেডুসার মুখে তাঁর চোখ পড়ে, তাহলেই তো পাথর হয়ে যাবেন। মেডুসার মুখ সামনের দিকে ঘােরানাে, মেডুসার মাথার পেছনটা পার্সিয়ুসের মুখের সামনে। পার্সিয়ুসের মাথায় দুটি পাখাওলা এক শিরস্ত্রাণ। বাঁ হাতে কাটামুণ্ড তুলে দেখাচ্ছেন বিজয়ীর ভঙ্গীতে, ডান হাতে খাড়ার মত আকারের তরােয়াল। শরীর খুবই বলিষ্ঠ অথচ কোন মেদ নেই।

অন্যান্য ইতালীয় ম্যানারিস্ট ভাষ্কর

প্রথমত ইটালিতে বার্তোলোমেও আম্মান্নাতির (Bartolomeo Ammannati, ১৫১১-৯২ খ্রি.) কথা বলতে হয়। মিকেলাঞ্জেলাের মত দিক্‌পাল থাকতেও তাকে বলা হয় ফ্লোরেন্সের পিয়াজা দেল্লা সিনিয়ােরিয়ার মত প্রসিদ্ধ জায়গায় নেপচুন ফোয়ারা তৈরি করতে। ইনি চারদিকে নেপচুনের ফোয়ারা তৈরি করে তার উপরে স্থাপনা করলেন নেপচুনের মূর্তি। ১৫৬৩-৭৭ সালের মধ্যে তিনি এই মূর্তিটি তৈরি করেন। ঐ পিয়াজাতেই আবার অন্যতম ইতালীয় ম্যানারিস্ট বার্তোলোম্মেও বান্দিনেল্লির (Bartolommeo Bandinelli, ১৪৯৩-১৫৬০ খ্রি) করা হারকিউলিস এবং ক্যাকোর মূর্তি রয়েছে। ভিঞ্চেনজো দান্তি (Vincenzo Danti, ১৫৩০-৭৬ খ্রি.) ছিলেন মিকেলাঞ্জেলাের শিষ্য। তিনি সাৎসােভিনাের কাজ করতেন ফ্লোরেন্সের ব্যাপ্টিস্টেরিতে এবং সেখানে দি ডিকলেশন অভ সেন্ট জন দি ব্যাপ্টিস্ট (সেন্ট জনের মুণ্ডচ্ছেদ) বলে অতি প্রসিদ্ধ ও গম্ভীর তিনমূর্তির একটি গ্রুপ খােদাই করেন।

উত্তরাঞ্চলীয় বা নর্দার্ন ম্যানারিজম

১৬শ শতকে ম্যানারিজম ইতালির বাইরেও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়। ফ্রান্সের রাজদরবারে ম্যানারিজমের পরিশীলিত রূপের চর্চা হয়। ফঁতেন্‌ব্লু স্কুল (School of Fontainebleau) নামে পরিচিত শিল্পীদের হাতে এই ধরনের শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়। এর একটি সফল উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত অ্যালেগরি অব লাভ বা অ্যালেগরি অফ ওয়াটার। এই সময়ের অনেক শিল্পকর্মের মতাে এই কাজটিও ক্লাসিক্যাল পর্বের ইন্দ্রিয়প্রধান শিল্পের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে কিন্তু এর পরিশীলিত সৌন্দর্য রাজদরবারের ম্যানারিস্ট শিল্পের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলন করে। ফরাসি রাজদরবারের বাইরে ম্যানারিস্ট স্কুলের শিল্পচর্চা দেখা যায় নেদারল্যান্ডসের রােমানিস্ট স্কুলের শিল্পীদের মধ্যে যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ইয়ান ফন স্করেল (Jan van Scorel), মার্টেন ফন হেইমষ্কের্ক (Maarten van Heemskerck) এবং ফ্রান্স ফ্লোরিস (Frans Floris)। এঁরা সবাই রােমে যান এবং সেখানকার শিল্পকর্ম দেখার পর হাই রেনেসাঁ রীতির সঙ্গে নিজেদের ফ্লেমিশ ধারার শিল্পের সংমিশ্রণ করে ছবি আঁকেন যার ফলে সৃষ্টি হয় ম্যানারিস্ট শৈলীর। জার্মান শিল্পী লুকাস ক্র্যানাক (Lucas Cranach) পরিশীলিত রূপে ইন্দ্রিয়প্রধান এক শিল্প-শৈলী উদ্ভাবন করেন যার সঙ্গে ইতালিয়ান ম্যানারিজমের বেশ মিল ছিল।

এল গ্রেকো, গোসার্ত ও হিলিয়ার্ডের নর্দার্ন ম্যানারিস্ট চিত্রকর্ম

কিন্তু মৌলিক ধরনের ম্যানারিজম পদ্ধতির শিল্পচর্চা হয় স্পেনে যার শক্তিশালী প্রকাশ ঘটে এল গ্রেকোর (El Greco, ১৫৪১-১৬১৪ খ্রি.) কাজে। তিনি গ্রিসে জন্মগ্রহণ করে ইতালির ভেনিসে কিছুকাল শিল্পচর্চা করে স্পেনের টলেডাে শহরে গিয়ে বসবাস ও কাজ করেন। তিনি বেশিরভাগ ধর্মভিত্তিক ছবি এঁকেছেন। তার ছবির বৈশিষ্ট্য ফিগারের দীর্ঘ ও শীর্ণ দেহ এবং কিছুটা বাঁকা ভঙ্গি। রঙের ব্যবহারেও তিনি উজ্জ্বলতা পরিহার করেছেন। তার ছবিকে স্টাইলাইজড ধারার বলা যায় যেখানে কিছুটা কল্পিত উপায়ে বাস্তব উপস্থাপিত হয়েছে। এল গ্রেকো সম্বন্ধে আরাে কিছু বলা প্রয়ােজন কেননা তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী যার শিল্পশৈলী নতুনত্বের জন্য বিশিষ্ট এবং খ্যাত হয়ে আছে। তিনি বাইজেন্টিয়ান শিল্পশৈলীর পদ্ধতি সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিল্পচর্চা শুরু করেন। তার প্রথমদিকের কাজ ছিল ধর্মবিষয়ক এবং ছােট আকারের যেগুলাে আইকন শ্রেণিভুক্ত। ১৫৬৮ সালে নিজ জন্মভূমি গ্রিসের ক্রিট দ্বীপ ত্যাগ করে ভেনিসে আসেন। সেখানে এসে তিনি তিৎসিয়ানোর কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বলে মনে করা হয়, কিন্তু তার ওপর অপর প্রধান শিল্পী তিনতোরেত্তোর প্রভাবই ছিল বেশি। কিছুদিন রােমে থাকার পর তিনি ১৫৭৭ সালে স্পেনের টলেডাে শহরে গিয়ে বসবাস করেন এবং শিল্পসৃষ্টির সুযােগ পান। তাকে স্প্যানিশ ম্যানারিস্ট স্কুলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী বলে বিবেচনা করা হয়। তার নিজস্ব শৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল লম্বা আকারের স্টাইলাইজড ফিগার যার অবয়বের আকার ছিল অগ্নিশিখার মতাে নৃত্যপর এবং পােশাক ফোলানাে। আগেই বলা হয়েছে তিনি অনুজ্জ্বল রং ব্যবহার করেছেন ছবিতে যার ফলে এক ধরনের বিষন্নতার সৃষ্টি হয়েছে। ম্যানারিজমের ব্যক্তিগত এবং গভীর ব্যঞ্জনাময় শিল্পকর্মের দৃষ্টান্ত তার ছবি। তিনিই প্রথম ম্যানারিস্ট শিল্পী যিনি বাস্তবের হুবহু অনুকরণ না করে সেখানে সৃজনশীলতা প্রয়ােগ করে স্টাইলাইজেশনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার ১৬০০ সালে আঁকা ‘ক্রাইস্ট ড্রাইভিং দ্য ট্রেডার্স ফ্রম দ্য টেম্পল’ বাইবেলভিত্তিক ঘটনার একটি নাটকীয় প্রতিফলন। এই বিষয়ে এল গ্রেকো আরাে কয়েকটি ছবি আঁকেন। স্প্যানিশ ধর্মপুরুষ এবং লেখক এলেনসাে ডি ভিলেগাস তার সম্বন্ধে বলেছেন, এল গ্রেকোর ছবি দেখতে টলেডাের মানুষ সবসময়ই উদগ্রীব।

নেদারল্যান্ডসের শিল্পী ইয়ান গােসার্ত (Jan Gossaert, ১৪৭৮-১৫৩২ খ্রি, ইয়ান মাবিউস (Jan Mabuse) নামেও পরিচিত) অ্যান্টোআৰ্প শহরে ম্যানারিজম শৈলীর প্রধান বক্তা ছিলেন। এই শৈলী ১৬শ শতকের প্রথম কয়েকটি দশকে প্রসার লাভ করে। এর বৈশিষ্ট্য ছিল কারিগরি উৎকর্ষের সঙ্গে গথিক ও রেনেসাঁ পদ্ধতির সংমিশ্রণ। রােম ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার শিল্পকর্ম দেখার পর তার শৈলীতে বিশাল পরিবর্তন আসে যা স্থায়ীভাবে অন্য শিল্পীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। ভাজারি তার প্রশংসা করে বলেন, ‘ন্যুড ফিগার ও মিথলজির বিষয় এবং এর প্রকৃত পদ্ধতি ইতালি থেকে নেদারল্যান্ডসে নিয়ে আসার কৃতিত্ব এই শিল্পীর।’ রােমানিস্ট স্কুলের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের ওপর এই শিল্পীর প্রভাব ছিল স্থায়ী ও গভীর। এই সব শিল্পীর মধ্যে ছিলেন ইয়ান ফন স্করেল এবং তার শিষ্য মার্টেন ফন হেইমষ্কের্ক (Maarten van Heemskerck, ১৪৯৮-১৫৭৪ খ্রি.)। ব্রিটিশ শিল্প-ঐতিহাসিক অ্যালান স্টেয়ার স্মার্ট লিখেছেন, হেইমষ্কের্ক প্রাচীন রােমান শিল্প ঐতিহ্যকে উত্তর ইউরােপে নিয়ে আসতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন।

ইংল্যান্ডেও ম্যানারিজমের শৈলী ও ধারণা সীমিতভাবে হলেও শিল্পকর্মে প্রভাব ফেলেছিল। যে শিল্পী এই স্কুলের অনুসরণে কাজ করেন এবং খ্যাতি অর্জন করেন তিনি নিকোলাস হিলিয়ার্ড (Nicholas Hilliard, ১৫৪৭-১৬১৯ খ্রি.)। তার ১৫৮৫-৯৫ সালের মধ্যে আঁকা ইয়াংম্যান অ্যামং রােজেস (Young Man Among Roses) নামক শিল্পকর্মটি সব ব্রিটিশ মিনিয়েচার কাজের মধ্যে প্রসিদ্ধ। এলিজাবেথান পর্বের কবিতা, চিত্রকলা এবং রাজদরবারের সুরুচির পরিচায়ক যে শৈলী তার প্রতিফলন ঘটেছে এই ছবিতে। জল রঙে করা এই মিনিয়েচার কাজটিতে ফ্রান্সের ফঁতেনব্লু স্কুলের ম্যানারিজমের প্রভাব দেখা যায়। ফ্রান্সে যাওয়ার আগেই হিলিয়ার্ড সেখানকার রাজদরবারের চিত্রকলার বিষয় ও শৈলী সম্বন্ধে অবহিত হয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ফঁতেনব্লু স্কুলের ম্যানারিজমধর্মী কাজ দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। তার ছবিতে যুবকের যে ফিগার রয়েছে সেটির ভঙ্গি এবং পরিহিত পােশাক ও বাগানের ফুল লতাপাতার অলংকরণের সঙ্গে ফঁতেনব্লু ম্যানারিস্টধর্মী ছবির সাদৃশ্য রয়েছে। ফিগারের অবয়ব, মুখের অভিব্যক্তি, পােশাকে নমিত আভিজাত্য এবং ফুল ও লতাপাতার বিন্যাসে অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পেলেও তার ভিত্তি বাস্তবানুগতা। রেনেসাঁ পর্বের কয়েকজন শিল্পীর আদর্শায়িত ও স্টাইলাইজড কাজ ছাড়া রেনেসাঁ শিল্পে গুরুত্বপ্রাপ্ত প্রকৃতিবাদের সঙ্গে ম্যানারিস্ট স্কুলের শিল্পীদের কাজ ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ।

জামবোলঞে, বেরুগেতি ও জঁ গুজোঁর নর্দার্ন ম্যানারিস্ট ভাষ্কর্য

ওদিকে ফরাসী ফ্লান্ডার্স বা ফ্লাঁদরের ডুয়ে থেকে শিখতে এসে জঁ দে বোলঞা (Jean de Boulogne, ১৫২০-১৬০৮) ফ্লোরেন্সের বাসিন্দা হয়ে যান ও সেখানেই সারা জীবন কাটিয়ে দেন। তার যত কিছু ভাল কাজ আছে, সবই ইতালিতে। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ভাস্কর্য বার্সেলােতে আছে, সেটি হচ্ছে দেবতা হার্মিস বা ইটালির মার্কিউরি। তার দুপায়ে দুটি পাখা আছে। বােলােঞাতেও তার একটি নেপচুন ফোয়ারা আছে। বােলােঞা শহরে থাকার সময়ে তিনি সেই শহরের জন্য এই অতি সুন্দর ফোয়ারাটি নির্মাণ করেছিলেন। সেই থেকে লোকে বলতে লাগল জোভান্নি দা বােলােঞা বা জামবোলঞে (Giambologna)।

বােলােঞা ১৫৮০ একটি মূর্তি তৈরি করেন যেটি হাওয়ায় উটছে! এর নাম উড়ন্ত মারকিউরি (গ্ৰীক হার্মিস), যা বোলোঞার শ্রেষ্ঠ কাজ। যদি মারকিউরিকে শূন্যে ওড়াতে হয় তবে তার পায়ের তলায় হাওয়া বওয়া দরকার, যা তাকে উপরে তুলবে। তাই জোভান্নি মূর্তির পায়ের তলায় ব্রোঞ্জের হাওয়া খােদাই করলেন এবং সে হাওয়া আসছে পবনদেবের মুখ থেকে। মারকিউরি ঠিক যেন হাওয়ার উপর দৌড়চ্ছেন, না দৌড়চ্ছেন না, উড়ছেন, মাথায় পাখাওলা টুপি, পায়ের জুতােতেও পাখা, হাতে ক্যাডুসিয়ুস। ক্যাডুসিউস হচ্ছে মারকিউরির লাঠি বা দণ্ড, তাতে দুটি সাপ পরম্পরকে জড়িয়ে উঠছে। দণ্ডের মাথায় জোড়া পাখা। মারকিউরি ছিলেন দেবগণের অর্থাৎ স্বর্গের দূত। তিনি আরাে অনেক কিছুর দেবতা, যেমন বাণিজ্য এবং আতিথেয়তা, গরুবাছুরের পালের, বক্তৃতাবাজির, লােক ঠকানাের ধূর্ততা আর স্বপ্নের দেবতা, ভ্রমণের দেবতা, ওদিকে আবার স্বাস্থ্য আর ঐশ্বর্যের দেবতা। গ্রীকদের বিশ্বাস ছিল হার্মিস বর্ণমালা আবিষ্কার করেন, তার সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যোতিষ, সঙ্গীত, বক্সিং, ওজন ও দৈর্ঘ্য মাপার প্রবর্তক, সেই সাথে তিনি ব্যায়ামের এবং তার সঙ্গে জলপাই ক্ষেতের দেবতা। তার ক্যাডুসিয়ুস চিকিৎসকদের পতাকা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংসদের চিহ, কারণ তিনি স্বাস্থ্যের দবতা। যখন কেউ ঝগড়া করে, ক্যাডুসিয়ুস ঝগড়া জমিয়ে দেয়। মারকিউরি একবার দেখলেন, দুটি সাপ ঝগড়া করছে। তার দণ্ডটি তাদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সাপ দুটি ঝগড়া ফেলে লাঠিটিকে শান্তভাবে জড়িয়ে উঠে পড়ল। আজও সেই শান্তিতে আছে। মারকিউরিও তাদের রেখে দিলেন, লােকে তার ক্ষমতা বুঝবে বলে।

মূর্তিটি দেখে মনে হয় যেন সত্যিই মূর্তিটি উড়তে যাচ্ছে। পবনদেবের মুখ থেকে হাওয়া উঠছে, পায়ের পাখাটি উর্ধমুখী, পায়ের বাঁকটি পায়ের পাখার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে উল্টোদিকে বেঁকে শরীরটিকে তুলছে। হাঁটুর থেকে বাঁ উরুর বাঁকটি ডানপায়ের মােড়া পা আর পায়ের পাতার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে শরীরটিকে আরাে তুলে দিচ্ছে। বাঁ হাত বেয়ে একটি রেখা উপরে উঠে দুটি কাঁধ বেয়ে, ডান হাত বেয়ে, তর্জনী বেয়ে হার্মিসকে একেবারে উঠিয়ে দিয়েছে। ওদিকে হার্মিসের ভােলা মুখ, মুকুটের দুটি পাখা, ক্যাডিসিয়ুসের সাপ আর ডানা জোড়া হুড়হড় করে তাকে টেনে নিয়ে আকাশে উঠছে।

আরেকজন ফরাসী ভাস্কর ছিলেন জঁ গুজোঁ (Jean Goujon, ১৫১০-১৫৬৫ খ্রি.)। তিনি চেল্লিনির ছাত্র ছিলেন। প্যারিসের লুভরে তার কিছু কাজ আছে। স্পেন থেকে শিখতে এসেছিলেন অ্যালােঞ্জো বেরুগেতি (Alonso Berruguete, ১৪৮০-১৫৬১ খ্রি.)। তার দুটি প্রসিদ্ধ কাজ আছে। একটি আছে স্পেনের ভ্যালাডােলিড মিউজিয়ামে, সেখানে তিনি সান বেনিটো এল রিয়ালে চার্চের বেদীর জন্য একটি পাথরে খােদাই পর্দা করেন। অন্যটি আছে টলেডাে কেথিড্রালে। সেখানে তিনি মাৰ্বল পাথরে ১৫৩৯-৪৩ সালে ছেলেদের কোয়ারের স্টল দুটি তৈরি করেন।

গুজোঁ সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন তার খুব লাে-রিলিফে কতকগুলি জলপরীর মূর্তি খােদাই-কার্যের মাধ্যমে, যা ফন্তেইন দেস ইনোসেন্টস বা ফাউন্টেইন অফ দ্য নিম্ফস নামে পরিচিত। জলপরীরা জলের পরী জলেই থাকে, তাই তাদের কোন ডানা নেই পরীদের মত। গুজোঁ অতি কমনীয়, সুন্দর পেলব করে জলপরীদের খােদাই করেন। তাদের গায়ের রেখা জলের লতার মত, গায়ের বসনও যেন ছােট নদীর জলের রেখার মত, কোথাও আটকে গেছে, কোথাও নেমে পড়েছে, কোথাও ধাক্কা খেয়ে উছলে পড়ছে। প্রতিটি পরী একটি আলাদা সরু কিন্তু বেশ লম্বা মার্বেলের পাটার উপরে খােদাই করা। পাটাগুলি লম্বা আর সরু হওয়ায় গুজোঁর নিশ্চই সেগুলি খােদাই করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ প্রতিটি পরী অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে, অলাদা ঢঙে, আলাদা ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে, অথচ প্রতিটি পরীই অত্যন্ত কমনীয়, পেলব, লাবণ্যময়। প্রত্যেক পরীর হাতে একটি করে ঘড়া, যার থেকে তারা জল ঢালছে, কারাে ঘড়া ঘাড়ে, করাে বুকে, কারও কাঁখে, কারাের পেটের কাছে, কারাের পায়ের কাছে পড়া। বহু বছর ধরে পাথরগুলো প্যারিসের একটি ফোয়ারার গায়ে লাগানাে ছিল, ফোয়ারাটির নাম ছিল ফাউন্টেন অভ দি ইনােসেন্টস। এখন এটি রক্ষিত আছে প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে।

হাই রেনেসাঁ ভাস্কর্য ও ম্যানারিজম

হাই রেনেসাঁ পর্বে ভাস্কর্য সেই সময়ের চিত্রকলার মতােই আদর্শরূপ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, অর্থাৎ সেগুলো হুবহু বাস্তবের অনুকরণ ছিলনা। এই পদ্ধতি বা শৈলীকে ক্লাসিক্যাল পর্বের শিল্পের মতাে গ্র্যান্ড ম্যানার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যার ভিত্তিতে স্কেল, আদর্শরূপ, বিভিন্ন অংশের অনুপাত এবং অনুভূতির গভীরতা ব্যক্ত হয়েছে। এক শ্রেণির ভাস্কর তাদের শিল্পকর্মে রাফ্‌ফায়েল্লোর ছবির মতাে মসৃণ ভারসাম্য এবং প্রশান্ত মেজাজের সামঞ্জস্যময়তার প্রয়ােগ করেছে। আবার কেউ মিকেল্যাঞ্জেলোর চিত্রকলায় যেমন তরঙ্গায়িত, পেশিবহুল এবং মল্লযােদ্ধার মতাে শরীর বাঁকানাের ভঙ্গি ছিল তাকেই অনুসরণ করেছে। এই দুটি প্রবণতাই রেনেসাঁর শেষ পর্বে ম্যানারিজমের ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য।

ম্যানারিজম পর্বের ভাস্কর্যে যে সচেতন বিদগ্ধতা বা সুচারু ভঙ্গি এবং সর্পিল রেখাসমন্বিত মানবদেহ দেখা যায় তার উৎসে রয়েছে রাফ্‌ফায়েল্লোর শিল্পের মসৃণ সামঞ্জস্যময়তা এবং বীরােচিত মানুষের ফিগারের অবদমিত কিংবা নমিত প্রকাশ। ১৫শ শতকের ভাস্কর্যের তুলনায় ১৬শ শতকের ভাস্কর্য ছিল আরাে বৃহদাকার এবং জটিল, কেননা যে স্থাপত্যের মধ্যে এই সব ভাস্কর্য অবস্থিত ছিল সেখানে ইতােমধ্যে স্পেসের বৈচিত্র্য এসেছে। হাই রেনেসাঁ পর্বে ভাস্কর্য-সংলগ্ন স্থাপত্য, বিশেষ করে সমাধিসৌধে ফিগার এবং স্থাপনার মধ্যে মসৃণভাবে মিশ্রণ ঘটেছিল। কিন্তু রেনেসাঁর শেষ পর্বে স্থাপত্যে, বিশেষ করে সমাধিসৌধে পরস্পরবিরোধী আকারের ফিগার ও স্থাপনা পাশাপাশি থেকেছে। এই ভাস্কর্যের অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য রেনেসাঁর শেষ পর্বের ভাস্কররা ফিগার এবং স্থাপনার মধ্যে রং, আকার অথবা স্কেলের সাহায্যে পার্থক্য দেখিয়েছে। তারা ম্যানারিজমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছুটা জাঁকজমকপূর্ণ ফিগার তৈরি করেছে। ভাস্কর্যে রেনেসাঁর শেষ পর্বের সমাধিসৌধে যে স্থাপত্য আদর্শ জনপ্রিয় হয় এবং যা ভাস্কর্য নির্মাণে প্রভাব ফেলে তা হলাে হাই রেনেসাঁ পর্বে মিকেল্যাঞ্জেলোর করা মেডিচির সমাধিসৌধের ডিজাইন ও সেখানে সংলগ্ন ভাস্কর্য। রেনেসাঁর শেষ পর্বেই ফোয়ারার সৃষ্টি হয় যেখানে ফ্রি স্ট্যান্ডিং অর্থাৎ পটভূমিহীন ভাস্কর্য এবং ছড়িয়ে পড়া জলের সংমিশ্রণ ঘটে। রিলিফ ভাস্কর্য অনেকটাই পেছনে চলে যায় আর তার স্থান করে নেয় দাড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যরা। ফলে ম্যাস বা ওজন হয় সুস্পষ্ট এবং আলােছায়ার খেলা মুক্তভাবে দেখানাে সম্ভব হয়। ১৬শ শতকে রেনেসাঁর শেষ পর্বে হাই রেনেসাঁ পর্বের মতােই রােম আর ফ্লোরেন্স ছিল ভাস্কর্যের প্রধান কেন্দ্র। ভেনিস, মিলান এবং নেপলস ছিল এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সারির নগরী। ভাস্কররা অবশ্য এক শহর থেকে অন্য শহরে স্বচ্ছন্দে কাজের জন্য যাতায়াত করেছে। হাই রেনেসাঁর ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য যদি হয় আদর্শায়ন, রেনেসাঁর শেষ পর্বে এবং ম্যানারিজমের সময় তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অলঙ্করণের প্রতি প্রবণতা।

রেনেসাঁ শিল্পীদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা ও পৃষ্ঠপােষকতা

ইউরােপীয় রেনেশাসের পীঠস্থান হল ইতালি, রেনেসাঁ পর্বে এখানে কমপক্ষে দুশাে চিত্রকর, ভাস্কর, স্থপতি, সঙ্গীত, মানবতাবাদী, বিজ্ঞানী ও লেখকের আবির্ভাব হয়। এদের মধ্যে মাত্র তিনজন ছিলেন মহিলা। শিল্পী ও লেখকদের ২৬ শতাংশ জুগিয়েছিল টাসকেনি, ২৩ শতাংশ ছিল ভেনিসের লােক, পােপের রাজ্য থেকে এসেছিল ১৮ শতাংশ, লম্বার্ডি জুগিয়েছিল ১১ শতাংশ, দক্ষিণ ইতালি থেকে এসেছিল ৭ শতাংশ, পিডমন্ট থেকে এসেচ ১.৫ শতাংশ, লিগুরিয়া দিয়েছিল ১ শতাংশ, ৭ শতাংশ এসেছিল ইতালির বাইরে থেকে আর ৫.৫. শতাংশের পরিচয় পাওয়া যায় না। রেনেসাঁয় ইতালির চারটি অঞ্চলের বিশেষ অবদান ছিল – মিলান, ভেনিস, টাসকেনি ও পােপের রাজ্য, এরা জুগিয়েছিল ৭৮ শতাংশ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী। দক্ষিণ ইতালি মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের তুলনায় ছিল অনগ্রসর। অগ্রসর অঞ্চলের মানুষজনের মধ্য থেকে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব হয়, এরা ছিলেন শহরকেন্দ্রিক মানুষ, রােম শহর ছিল ব্যতিক্রম। এখানকার মাত্র ৪ জন শিল্পী ও লেখক রেনেসাঁয় অবদান রেখেছিল। ছােটো শহর ফেরারা ও উরবিনাে জুগিয়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও ৭ জন শিল্পী ও লেখক। ভাস্কর ও স্থপতিরা এসেছিল সেই সব অঞ্চল থেকে যেখানে ভালাে পাথর পাওয়া যেত, নির্মাণের কাজ হত। বিদেশি ৪১ জন শিল্পী ও লেখকের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার, মানবতাবাদী ও কবি। মাত্র দু-একজন বিদেশি শিল্পী রেনেসাঁ ইতালিতে এসেছিলেন। রেনেসাঁর সময় ইতালীয় সমাজ ছিল পাঁচভাগে বিভক্ত – যাজক, অভিজাত, বণিক-পেশাদার, কারিগর-দোকানদার এবং কৃষক। শিল্পী ও লেখকদের মধ্যে মাত্র দুজন এসেছিল যাজক সম্প্রদায় থেকে, ১১৪ জন ছিলেন কারিগর-দোকানদার পরিবারের, ৮৪ জন অভিজাত বংশের, ৪৮ জন বণিক-পেশাদার এবং মাত্র ৭ জন ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। ৩৪৫ জন শিল্পী ও লেখকের সামাজিক পরিচয় জানা যায় না। চিত্রকর, ভাস্কর ও স্থপতিদের বেশিরভাগ এসেছিল বণিক ও কারিগরদের মধ্য থেকে। লেখক, বিজ্ঞানী, মানবতাবাদীদের বেশিরভাগ এসেছিল অভিজাত, বণিক ও পেশাদার পরিবার থেকে। চিত্রকর, ভাস্কর ও স্থপতিরা এমন সব পরিবার থেকে এসেছিল যেখানে শিল্প ও কারিগরি বিদ্যার ঐতিহ্য ছিল। ইতালির চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের গিল্ডগুলি শিল্পী ও ভাস্করদের পুত্রদের নানা সুযােগ-সুবিধা দিত।

যেখানে সামাজিক অবস্থা অনুকূল এবং শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিভা স্বীকৃতি পায় সেখানে এসবের উন্নতি হয়। সে সময়কার ইতালিতে অনেক অভিজাত ও সম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানদের চিত্রশিল্পী বা ভাস্করের জীবন পছন্দ করেনি, তা সত্ত্বেও এসব পরিবারের অনেকে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী শিল্পীর জীবন বেছে নিয়েছিল। মিকেল্যাঞ্জেলোর পিতা তাকে ভাস্করের বৃত্তি গ্রহণে বাধা দেন, তিনি এই বাধা অতিক্রম করে শিল্পী হন। কৃষক পরিবারের কারাে পক্ষে শিল্পী হওয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। এদের স্বাভাবিক প্রতিভা অন্যের চোখে পড়লে এরা শিক্ষানবিশীর সুযােগ পেত। সাধারণত অভিজাত ও পেশাদার পরিবারের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লেখক, বিজ্ঞানী বা মানবতাবাদী হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল ব্যয়সাপেক্ষ, নিম্নবর্গের সামাজিক গােষ্ঠীর লােকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিতে সাহস পেত না। ইতালির বুদ্ধিজীবীরা দুভাগে বিভক্ত হন পড়েছিল – শিল্পী, ভাস্কর ও স্থপতিরা ছিল কারিগর গােষ্ঠীর লােক, লেখক, বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদীরা ছিল উচ্চবর্গের মানুষ। রেনেশাস ইতালিতে তিন ধরনের বিদ্যায়তন ছিল বেশিরভাগ স্কুল শেখাত লেখা ও পড়া, অংক শেখার জন্য ছাত্রদের অ্যাবাকাস (Abacus) স্কুলে যেতে হত, ল্যাটিন শেখানাে হত গ্রামার স্কুলে। এখানে ধ্রুপদি সাহিত্য শিক্ষাদান ব্যবস্থা ছিল। চিত্রশিল্পী ও ভাস্কররা কোনাে শিল্পীর কার্যালয়ে (Workshop) বারাে-তেরাে বছর ধরে শিক্ষানবিশী করত। পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে শিল্পীর প্রশিক্ষণ চলত। এই সময়ে তার শিক্ষক ছাত্রকে চিত্রবিদ্যা ও ভাস্কর্যের সমস্ত পদ্ধতি, আঙ্গিক, অনুষঙ্গ সব শিখিয়ে পটু করে তলত। জিওভান্নির দুজন বিখ্যাত ছাত্র হলেন বিখ্যাত শিল্পী জোর্জোনে ও তিৎসিয়ানো।

বিজ্ঞানী, মনবতাবাদী ও লেখকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিত। এসময় ইতালিতে তেরােটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, বিখ্যাত নামগুলি হল পাদুয়া, বােলন্যা ও ফেরারা। ছাত্ররা খুব অল্প বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যেত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়া হত ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, অলংকার, অংক, জ্যামিতি, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, কাব্য ও নীতিশাস্ত্র। ছাত্ররা শিক্ষা সমাপ্ত করে ধর্মশাস্ত্র, আইন ও চিকিৎসা বিদ্যায় ডিগ্রি নিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন; শিল্পী, ভাস্কর ও স্থপতিরা ইতালিয়ান ভাষায় শিক্ষা নিত। স্থাপত্যকে স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসেবে স্বীকার করা হত না, বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিরা শিল্পীদের শিক্ষা দিতেন। ব্রামান্টের (Bramante) কার্যালয়ে স্থাপত্য বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানাের ব্যবস্থা ছিল তবে বেশিরভাগ সঙ্গীতকার চার্চের কয়ার স্কুলে (Choir school) সঙ্গীত শিখত। নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে শিক্ষা নিয়ে অনেকে ইতালিতে চলে আসতেন। রেনেশাঁস ইতালিতে শিল্পী ও লেখকদের শিক্ষার পথে সবচেয়ে বড়াে বাধা ছিল গ্রন্থের অভাব। পাণ্ডুলিপি নকল করে শিক্ষকরা মাত্র কয়েকখানি গ্রন্থ সংগ্রহ করতে পারতেন। জার্মানিতে মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলে গ্রন্থের অভাব মিটেছিল। রেনেসাঁ বিশ্বজনীন মানুষের ধারণা প্রচার করেছিল, এ যুগের শিল্পীরা একটিমাত্র বিষয় আয়ত্ত করে সন্তুষ্ট হত না। আলবের্তি, মিকেল্যাঞ্জেলো ও দা ভিঞ্চি কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে সমান দক্ষতা অর্জন করেন, ইতালিতে এরকম আরও আঠারােজন শিল্পী ও লেখক ছিলেন। এ যুগে শিল্পীদের কার্যালয় ছিল, অনেকের পারিবারিক শিল্প কারখানা ছিল (workshop)। অনেক সময় শিল্পী ও ভাস্কররা যৌথভাবে কোম্পানি গঠন করে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করত। স্থপতিদের বড়াে সংগঠন ছিল, এতে বহু ধরনের শিল্পী, কারিগর ও শ্রমিক অন্তর্ভুক্ত হত। চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও গৃহনির্মাণ শিল্পীদের গিল্ড ছিল। এই গিল্ডগুলি অনেক কাজ করত, নিয়ােগকর্তা, কারিগর, শিল্পী ও শিক্ষানবিশীদের মধ্যেকার সম্পর্ক এরা নিয়ন্ত্রণ করত। গিল্ড উৎপাদনের গুণগত মান যেমন বজায় রাখত তেমনি গিল্ড সদস্যদের প্রয়ােজনে অর্থ সরবরাহ করত। এরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত, দরিদ্র ও আর্ত মানুষদের সাহায্য দিত। গিল্ড দরিদ্র শিল্পীর শিল্পকর্ম কিনে নিয়ে বেশি দামে বিক্রির ব্যবস্থা করত। লেখক, মানবতাবাদী, বিজ্ঞানী ও সঙ্গীতজ্ঞদের কোনাে গিল্ড ছিল না, ওয়ার্কশপও ছিল না। এদের গিল্ড হল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সংগঠন হিসেবে গণ্য করত। এইসব বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্র ও চার্চে চাকরি করত, সৈনিক, কূটনীতিবিদ ও বিশপ হিসেবেও কাজ করত। চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য ও সঙ্গীত ছিল পুরাে সময়ের পেশাদারি বৃত্তি, বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদীদের বৃত্তি ছিল আংশিক সময়ের, এদের পেশাদার বলা যায় না।

মধ্যযুগের সমাজে যাজক, শাসক ও কৃষকের নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা ছিল। ইতালির সমাজ ছিল পরিবর্তনশীল, গতিশীল, এই সমাজ সাদরে বণিকদের গ্রহণ করেছিল। এই সমাজে শিল্পীদের বিশিষ্ট স্থান ছিল। শিল্পীদের মধ্যে চিত্রশিল্পী বেশি সমাদর পেতেন, এরা। সামাজিক সম্মান ও অর্থ লাভ করেন। ভাস্কর ও স্থপতিরাও সম্মান পেয়েছিলেন, সঙ্গীতশিল্পী, বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদীদেরও যথেষ্ট সম্মান ছিল। ইতালি শিল্পীদের সম্মান দিয়েছিল বলে সেখানে রেনেসাঁ সম্ভব হয়, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি হয়। একথা ঠিক সেযুগে অনেকে শিল্পকে ভালাে চোখে দেখত না, এর কারণ হল ব্যবসায়ী মনােবৃত্তি, অশিক্ষা ও দৈহিক শ্রম। ইতালির ছশাে জন শিল্পীর সকলে ধনী হননি, সামাজিক সম্মান পাননি, অনেকে বেশ দরিদ্র ছিলেন। শিল্পী, লেখক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির লােকেরা বেশি সম্মান পেত। শিল্পীদের অনেকে ছিল কল্পলােকের বাসিন্দা, পার্থিব বিষয়ে আগ্রহ ছিল না। শহরবাসী বুর্জোয়াদের মতাে এরা হিসেবি মানুষ ছিলেন না, এরা ছিলেন সমাজের প্রতিভা, অনন্য, অসাধারণ।

বুখার্ট বলেছেন যে রেনেসাঁ হল অতীতের পুনরুজ্জীবন ও জগৎ আবিষ্কার। এর অন্য দুটি বৈশিষ্ট্য হল শিল্পীর বহুমুখী দক্ষতা এবং ধনীদের পৃষ্ঠপােষকতা। লিওনার্দো একাধারে স্থপতি, ভাস্কর ও চিত্রকর, মিকেল্যাঞ্জেলো চিত্রকর ও ভাস্কর। রেনেসাঁ যুগে শিল্পীরা মর্যাদা পেয়েছিলেন, ধনী বণিক, অভিজাত, রাজা, বিশপ, পােপ ও সামন্তপ্রভুরা শিল্পীদের পৃষ্ঠপােষণ করেন। শিল্পীরা সামাজিক সুযােগ-সুবিধা পান, সম্মানের অধিকারী হন। ওয়ার্নার গুন্ডের শেমার (Gunder Sheimer) মনে করেন প্রাক-শিল্প বিপ্লব যুগের ইউরােপের সংস্কৃতি জগতের এটি হল স্থায়ী, অনন্য বৈশিষ্ট্য। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন ঐ যুগের সম্পন্ন প্রভাবশালী মানুষরা রেনেসাঁ শিল্পকে উৎসাহ দেন, পৃষ্ঠপােষকতা করেন। এই পৃষ্ঠপােষকরা সকলে এক গােষ্ঠীর লােক ছিলেন না, এদের পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, একজন ধনী ব্যক্তি শিল্পীকে দিয়ে তার বাড়িতে পছন্দমত শিল্পকাজ করিয়ে নিত। (household system)। দ্বিতীয়ত, শিল্পীকে দিয়ে অস্থায়ীভাবে একটি বিশেষ কাজ করিয়ে নেওয়া হত, যেমন মিকেল্যাঞ্জেলোকে দিয়ে পােপ সিসটাইন চ্যাপেলের ভিতরের ছবি আঁকিয়ে নেন (made to measure)। তৃতীয়টি ছিল অবশ্যই বাজার ব্যবস্থা (market system), শিল্পী বাজারের চাহিদার দিকে তাকিয়ে শিল্পকর্ম করতেন। বণিক বা ক্রেতা তা কিনে নিত। চতুর্থটি ছিল সরকারি ব্যবস্থা বা অ্যাকাডেমি সিস্টেম (Academy system)। সরকার শিল্পী সংগঠনের মাধ্যমে উৎপাদনের ব্যবস্থা করত। পঞ্চমটি ছিল অনুদান প্রথা (subvention systen), বিশ্ববিদ্যালয় বা শিল্পসংস্থা অনুদান দিয়ে শিল্পকর্মে উৎসাহ জোগাত, কিন্তু শিল্পকর্মের ওপর তার কোনাে অধিকার থাকত না। রেনেসাঁ যুগে ইতালিতে ঘরােয়া বা অস্থায়ী নির্দেশমূলক ব্যবস্থা চালু ছিল, শিল্পকর্মের বাজার ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে।

রেনেশাসের শিল্পকর্মের পাঁচ রকমের উৎপাদন পদ্ধতি যেমন ছিল পৃষ্ঠপােষকরাও তেমনি নানাভাবে বিভক্ত ছিল। প্রথমভাগে ছিল যাজক ও গৃহী মানুষরা। ইউরােপের চার্চ ছিল শিল্পের বড়াে পৃষ্ঠপােষক। চতুর্থ শতক থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই ধারা চলে এসেছিল। এজন্য ইউরােপের শিল্পকলার ওপর ধর্মের প্রভাব ছিল গভীর। সাধারণ গৃহী মানুষ তার উপাসনালয়ের জন্য ধর্মীয় চিত্র আঁকিয়ে নিত, গৃহের সজ্জার জন্য শিল্পীকে দিয়ে চিত্র আঁকিয়ে নেবার প্রথা ছিল। আবার যাজকরা শিল্পীদের দিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ চিত্র আঁকিয়ে নিত। দ্বিতীয়ত, শিল্পীদের সংস্থার একজন পৃষ্ঠপােষক থাকত, সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপােষক থাকত। ফ্লোরেন্সের পশম ও বস্ত্র গিল্ড শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিল। ধময় সম্প্রদায়গুলি যৌথভাবে শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করত। ভেনিসের গিল্ড শিল্পী ভিত্তোর করপাচ্চিওকে দিয়ে উরসুলা চিত্রাবলি আঁকিয়ে নিয়েছিল। এ ধরনের গিল্ডের জন্য তিনতোরেত্তো, ডায়ানা ও বেলেনি ছবি এঁকেছিলেন। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুরােধে লিওনার্দো ‘ভার্জিন অব দ্য রক’ ছবিটি এঁকেছিলেন।

পৃষ্ঠপােষক অন্য সংস্থা ছিল রাষ্ট্র। ফ্লোরেন্সের সরকার মিকেল্যাঞ্জেলোকে দিয়ে ডেভিডের ব্রোঞ্জ মূর্তিটি বানিয়ে নেন। ভেনিসের প্রজাতন্ত্রী সরকার বেলেনিকে চিত্রকর হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। ভেনিসের চাকরি করত একদল স্থপতি। ভেনিসের কাউন্সিল হলের চিত্রগুলি এঁকেছিলেন একদল চিত্রশিল্পী, এদের মধ্যে বেল্লিনি ও তিৎসিয়ানো ছিলেন। রাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রাজা শিল্পীদের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। রাজার পৃষ্ঠপােষকতা শিল্পীদের সামাজিক সম্মান বাড়িয়ে দিত, তবে পােষকরা সকলে শিল্পীদের স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করতেন না। পােষকরা ছিল দুই শ্রেণির স্থায়ী ও অস্থায়ী। স্থায়ীরা হলপৃষ্ঠপােষক, অস্থায়ীরা মক্কেল। শিল্পীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায় স্থায়ী ও অস্থায়ী ব্যবহার সুবিধা-অসুবিধা দুইই ছিল। স্থায়ী কাজ দিত আর্থিক নিরাপত্তা খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা ও সামাজিক সম্মান। অস্থায়ী কাজে এসব সুবিধা ছিল না, তবে স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। তুরা, মনতেঞা ও স্প্যানজোত্তি ছিলেন দরবারি শিল্পী। এখানে তাদের নানা ধরনের কাজ করতে হত, তবে দোকান সাজিয়ে শিল্পকর্ম বিক্র করার চেয়ে এটি ছিল অনেক নিরাপদ। পােষকদের সকলে ধনী ছিলেন না। মেডিচি, স্ট্রোজিজ, পাৎজি, পিটি, রুচেলাইদের মতাে ধনী পরিবারগুলি এদের পােষক ছিল। উরবিননা, মান্টুয়া, ফেরারা, ভেনিস, মিলান ও ফ্লোরেন্স সরকারিভাবে শিল্পীদের পােষকতা করত। সাধারণ সম্পন্ন মানুষজনও শিল্পের সমজদার ছিল, শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিত।

শিল্প সমালােচক পণ্ডিত মানুষরা রেনেশাস শিল্পের চারটি উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছেন। এই চারটি লক্ষ্য হল পুণ্যসঞ্চয় করা, সম্মান অর্জন করা, আনন্দ লাভ করা এবং লগ্নিকরা (piety, prestige, pleasure and investment)। চার্চ, যাজক ও ধর্মপ্রাণ মানুষরা ঈশ্বরের গৌরব প্রচার এবং আত্মার মুক্তির জন্য ছবি আঁকিয়ে নিতেন। বেদির ছবি, ফ্রেসকো, ম্যাডােনা ও ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি সব পুন্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে আঁকানাে হয়। মক্কেল তার নিজের পরিবারের বা শহরের গৌরব বৃদ্ধির জন্য ছবি আঁকিয়ে নিতেন, মূর্তিও বানাতেন। রাজনৈতিক গৌরব বৃদ্ধির জন্য সব বিশাল বিশাল সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণ করা হত। ম্যাকিয়াভেলি রাজাদের শিল্পীদের পৃষ্ঠপােষকতা দিতে বলেন। তার বক্তব্য হল সুদৃশ্য বৃহৎ অট্টালিকা, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা রাজার মহিমা ও গৌরব বৃদ্ধি করে। শিল্পের তৃতীয় লক্ষ্য ছিল আনন্দ দান করা। বিশাল অট্টালিকা বানিয়ে ভাস্কর্য ও চিত্র দিয়ে সাজিয়ে মানুষ আনন্দ পেত। উরবিনাের ফ্রেডেরিকো ও ফ্লোরেন্সের কসিমাে দ্য মেদিচি সুষমামণ্ডিত ভাস্কর্য ও স্থাপত্য দেখে আনন্দ পেতেন। ইসাবেলা ছবি দেখে বিমল আনন্দ লাভ করতেন। শিল্পের চতুর্থ লক্ষ্য ছিল বিক্রির জন্য শিল্পকর্ম তৈরি করা। এভাবে শিল্পকর্ম খুব কম হত। মানবতাবাদী শিক্ষা ইতালিতে শিল্পের কদর সৃষ্টি করেছিল, অভিজাত পরিবারের সন্তানরা শিক্ষালাভের সঙ্গে শিল্পকর্ম বােঝার ক্ষমতা অর্জন করত। এরাই পরবর্তীকালে শিল্পের পৃষ্ঠপােষক হয়ে যেত।

সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে পৃষ্ঠপােষক হল রেনেসাঁ শিল্পের আসল স্রষ্টা। তারাই ঠিক করে দিত কী ধরনের শিল্প সৃষ্টি হবে। ইতালির অভিজাত, রাজা, শাসক, পোপ শিল্পকর্মের জন্য শিল্পীদের আহ্বান করত। শিল্পের জন্য পৃষ্ঠপােষক ও শিল্পীর মধ্যে একটি হত। চুক্তির আগে ঠিক নিলামের মতাে করে শিল্পী ঠিক করা হত। সাধারণত যে শিল্পী সবচেয়ে কমদামে শিল্পকর্মটি করতে রাজি হত তার সঙ্গে চুক্তি হত। শিল্পী ফিলারেট মনে করেন স্থপতি যে অট্টালিকা বানায় তার আসল স্রষ্টা হল পৃষ্ঠপােষক। শিল্পকর্মের পিতা পৃষ্ঠপােষক, মাতা শিল্পী। তিৎসিয়ানো ফেরারার শাসককে শিল্পের আত্মা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেন। পৃষ্ঠপােষক এ শিল্পীর মধ্যে যে চুক্তি হত তাতে শিল্পের মাল-মশলা, কাজের মূল্য, সময়কাল, সরবরাহ তারিখ সব উল্লেখ করা হত। শিল্পকর্মের আকার কেমন হবে তাও চুক্তিতে উল্লেখিত হত। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে মিকেল্যাঞ্জেলো ফ্লোরেন্সের সঙ্গে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হন তাতে যিশুর পূর্ণাবয়ব মূর্তির কথা বলা হয়েছিল। স্কেচ করে, মডেল করে বা ভাষায় বর্ণনা করে শিল্প চুক্তি হত।

পৃষ্ঠপােষক ও শিল্পীর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড়াে প্রশ্ন হল শিল্পী কী শিল্প সৃষ্টিতে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন। তুরা, পেরুজিনাে ও রাফ্‌ফায়েল্লোর চুক্তিগুলি থেকে অনুমান করা যায় পােষক তার কাজের ছক করে দিতেন। অনেক সময় একসঙ্গে বহু শিল্পীর সঙ্গে চুক্তি হত। শিল্পকর্মের স্থায়িত্বের গ্যারান্টি দিতে হত শিল্পীকে। ভার্জিন অব দ্য রক ছবির দশ বছরের গ্যারান্টি ছিল। শিল্পীর প্রাপ্য অর্থ এবং শিল্পের গুণগতমান নিয়ে পােষক ও শিল্পীর মধ্যে বিরােধ দেখা দিত। পােষক অনেক সময় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ দিত না, শিল্পীর সৃষ্টি তার পছন্দ হত না। এ নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হত। তিক্ততার জন্য শিল্পকর্ম ধ্বংস করা হয়েছে এমন ঘটনাও আছে। রেনেসাঁ পর্বে শিল্পীর সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান বেড়েছিল, পােষক অনেকক্ষেত্রে শিল্পীকে শিল্প সৃষ্টির ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন। পােষকের ভূমিকা প্রধান ছিল না, শিল্পীরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী শিল্প সৃষ্টি করত। অনেক সময় একজন বুদ্ধিজীবী শিল্পী ও মক্কেলের মধ্যে যােগসূত্র হিসেবে কাজ করত। তিনি শিল্পকর্মের সবদিক শিল্পীকে বুঝিয়ে দিতেন। রেনেসাঁ পর্বে পােষক ও শিল্পীর মধ্যে ভারসাম্য শিল্পীর দিকে ছিল। ধনী, অভিজাত, রাজসভা, যাজক ও রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য শিল্পের বিকাশ হয়। এদের জন্য রেনেশাস শিল্পের ক্ষতি হয়নি, শিল্পী ও শিল্পের স্বাতন্ত্র্য ও সত্তা অক্ষুন্ন ছিল।

তথ্যঋণ

  • শিল্পকলার নান্দনিকতা, হাসনাত আবদুল হাই, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, পৃ – ১৫৯-১৯৬
  • ইউরোপের ভাষ্কর্য, অশোক মিত্র, আনন্দ প্রকাশনী, কলকাতা, জুন ২০১৭, পৃ – ১৫৬-১৮৫
  • আধুনিক ইউরোপ: আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০-১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০১৪, পৃ – ৬৩-৯৮
  • কেনেথ ক্লার্ক, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, ১৯৩৯
  • ই এইচ গমব্রিচ, নর্ম অ্যান্ড ফর্ম: স্টাডিজ ইন দি আর্ট অফ রেনেসাঁ, ১৯৬৬
  • জি ভাজারি, দা লাইভস অফ আর্টিস্টস, প্রথম খণ্ড জজ বুন অনুদিত, ১৯৬৩
  • ই এইচ গমব্রিচ, স্টোরি অফ আর্ট ১৯৫৩


2 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. পশ্চিম ইউরোপে ১৫শ থেকে ১৭শ শতকের মুদ্রণ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও সামরিক বিপ্লব –

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.