ফরাসি শিক্ষক সামুয়েল পাটি হত্যাকাণ্ড

ভূমিকা

২০২০ সালের ১৬ অক্টোবরে প্যারিসের শহরতলী কনফ্লান্স-সেইন্তে-অনরিনে-তে (Conflans-Sainte-Honorine) ফরাসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সামুয়েল পাটির (Samuel Paty) হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ইসলামী সন্ত্রাসবাদ কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে পাটিকে ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয় এবং শিরচ্ছেদ করা হয়। অপরাধী, আব্দুল্লাখ আবুয়েদোভিচ আনজোরভ (Abdoullakh Abouyedovich Anzorov) একজন চেচেন বংশোদ্ভূত ১৮ বছর বয়সী মুসলিম রাশিয়ায় জাত (জন্মগ্রহণ রাশিয়ায়) ফ্রান্সে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী। হত্যার কয়েক মিনিট পরে পুলিশ আনজোরভকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের কারণ হচ্ছে, পাটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর একটি ক্লাসে তার শিক্ষার্থীদের সামনে ইসলামের নবী মুহাম্মদ অঙ্কিত শার্লি হেবদোর কার্টুন প্রদর্শন করেছিলেন। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ (Emmanuel Macron) বলেছেন, এই ঘটনা “একটি সাধারণ ইসলামী সন্ত্রাসী হামলা”, এবং “শিশুদের বাক স্বাধীনতা শেখানোর জন্য আমাদের স্বদেশীকে হত্যা করা হয়েছে”। এই হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্সে বেশ কয়েকটি হামলার একটি, এবং এটি ফরাসি সমাজ এবং রাজনীতিতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

প্রেক্ষাপট

অপরাধের শিকার

সামুয়েল পাটি ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্য প্যারিসের ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে ফ্রান্সের কনফ্লান্স-সেইন্তে-অনরিনে-তে (Conflans-Sainte-Honorine) অবস্থিত কোলেজ বোয়েস-ডি’আউলনে (Collège Bois-d’Aulne) ৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ইতিহাস, ভূতত্ত্ব ও পৌরনীতি শেখাতেন। তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দশ মিনিট দূরে, ভাল-ডি’ওইসের (Val-d’Oise) ছোট শহর এরাগনিতে (Éragny) বাস করতেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন, এবং তার পাঁচ বছরের একটি পুত্রসন্তান আছে।

হত্যাকাণ্ডের দিকে নিয়ে যাওয়া ঘটনাসমূহ

পাটি ২০২০ সালের অক্টোবরের শুরুতে তার নৈতিক এবং পৌরনীতি শিক্ষার ক্লাসে ফরাসি জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। ক্লাস চলাকালীন সময়ে তিনি তার কিছু কিশোর ছাত্রকে ব্যাঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন চার্লি হেবদো থেকে মুহাম্মদের একটি ব্যঙ্গচিত্র দেখান। ব্যঙ্গচিত্র দেখানোর আগে, পাটি মুসলিম ছাত্রদের চাইলে শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তাব জানিয়েছিলেন। একজন ছাত্রের মতে, ২০১৫ সালে চার্লি হেবদোকে গুলি করার পর থেকে প্রতি বছর তিনি এই কার্টুনগুলো দেখিয়েছিলেন। অনেক মুসলমানের কাছে মুহাম্মদের যে কোন রকম চিত্রায়ন নিন্দনীয়।

কিছু সূত্র অনুসারে, পাটি তার ছাত্রদের দুটি কার্টুন দেখিয়েছেন, যার মধ্যে একটিতে মুহাম্মদকে নগ্ন অবস্থায় জননাঙ্গকে প্রকাশিত করে দেখানো হয়েছে, যদিও শ্রেণীকক্ষে ঠিক কি উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। ব্রাহিম চ্‌নিনা (Brahim Chnina) নামে একজন ছাত্রীর পিতা পাটির বিরুদ্ধে ছাত্রদের কাছে পর্নোগ্রাফি ছড়ানোর অভিযোগ আনেন এবং পুলিশের কাছে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন। পাটি মানহানির অভিযোগ দায়ের করে এর বিরুদ্ধে সাড়া দেন। চ্‌নিনা ইউটিউব এবং ফেসবুকে দাবি করেছেন যে পাটি মুহাম্মদের নগ্ন একটি ছবি প্রদর্শন করেছিলেন, তিনি পাটির নাম উল্লেখ করেন এবং স্কুলের ঠিকানা দেন। তিনি তার সাথে যোগ দিতে এবং শিক্ষকের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে অন্যান্য অভিভাবকদের উৎসাহিত করেন, এবং পাটিকে একজন দুর্বৃত্ত (ফরাসীতে voyou, ইংরেজিতে thug) হিসেবে বর্ণনা করেন।

গ্র্যান্ড মসজিদ ডি প্যান্টিন (Grande Mosque de Pantin) পাটিকে হুমকি দিয়ে খুনের এক সপ্তাহ আগে তার ফেসবুক পাতায় একটি ভিডিও প্রকাশ করে। মুহম্মদের ব্যঙ্গচিত্র দেখানোয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে এবং স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করার দাবিতে অভিভাবকগণ স্কুলের সামনে প্রতিবাদ করছিলেন। গ্র্যান্ড মসজিদ ডি প্যান্টিন মসজিদের ইমাম এবং ফ্রান্সের ইমামদের কাউন্সিলের (Conseil des imams de France) একজন সদস্য আব্দেলহাকিম সেফ্রিউয়ি (Abdelhakim Sefrioui) এই প্রতিবাদে অভিভাবকদের সাথে ছিলেন। সেফ্রিউয়ি একটি ভিডিওতে কলেজের প্রশাসনের নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং সামুয়েল পাটিকে “দুর্বৃত্ত” (voyou) বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি স্কুল থেকে সামুয়েল পাটির বহিষ্কার দাবি করেন। এর আগে অভিভাবক ব্রাহিম চ্‌নানি বারবার “voyou” (দুর্বৃত্ত) শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর ভিডিওগুলো সরিয়ে নেয়া হয়।

ব্রাহিম চ্‌নিনা স্কুলের বিরুদ্ধেও একটি অভিযোগ দায়ের করেন এবং জনগণকে স্কুলে এসে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক সামুয়েল পাটি এবং ফ্রান্সের শিক্ষা কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তার মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়াও চ্‌নিনা পাটির পাঠ্যসূচী সম্পর্কে একটি আইনি অভিযোগ দায়ের করেন, যার ফলে শিক্ষক সামুয়েল পাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে মিলে স্থানীয় থানায় যান। পাটি তদন্তকারীদের বলেন যে তিনি অভিযোগটি বুঝতে পারছেন না কারণ পাটি যেদিন কার্টুনটি দেখিয়েছিল সেদিন ব্রাহিম চ্‌নিনার মেয়ে ক্লাসেই ছিল না।

অপরাধী

অপরাধী আবদুল্লাখ আবুয়েদোভিচ আনজোরভ (Abdoullakh Abouyedovich Anzorov) একজন ১৮ বছর বয়সী তরুণ। তিনি একজন চেচেন জাতির লোক, তিনি রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন, এবং ফ্রান্সে শরণার্থী হিসেবে আসেন। চেচনিয়া হল রাশিয়ান ফেডারেশনের অধীনে থাকা একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাতন্ত্র। আবদুল্লাখ আনজোরভ ১২ বছর আগে একজন ৬ বছরের বালক হিসেবে শরণার্থী মর্যাদা নিয়ে ফ্রান্সে এসেছিলেন। তিনি খুনের ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দূরে নরমাঁদির (Normandy) ম্যাডেলিন (Madeleine) জেলায় এভঘ (Évreux) শহরে বাস করতেন, এবং শিক্ষক বা স্কুলের সাথে তার কোন আপাত সম্পর্ক ছিল না। আনজোরভের পরিবার চেচনিয়ার শালাঝি (Shalazhi) গ্রাম থেকে এসেছে। আব্দুল্লাখের বাবা আবুজেজিদ (Abuezid) প্রথমে মস্কো এবং পরে প্যারিসে চলে আসেন। তার সৎ বোন ২০১৪ সালে সিরিয়ায় আইএসআইএস-এ যোগ দান করেছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে পরিবারটি ফ্রান্সে শরণার্থীর মর্যাদা এবং ১০ বছরের রেসিডেন্সি কার্ড পায়। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আব্দুল্লাখকে লক্ষ্য করেনি, যদিও তাকে এর আগে ছোটখাটো অসদাচরণের অভিযোগে আদালতে হাজির করা হয়েছিল।

হামলার আগে তিনি সিরিয়ার দুই অজ্ঞাত পরিচয় জিহাদির সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন, যার মধ্যে একজন রুশভাষী ছিলেন, আইপি এড্রেস দিয়ে এই লোকের অবস্থান জানা গেছে, তার অবস্থান ছিল ইদলিবে (Idlib), যা হাই’আত তাহরির আল-শাম (Hay’at Tahrir al-Sham) নামক সন্তাসবাদী সংগঠনের শেষ জিহাদি ঘাঁটি ছিল। তিনি রুশ ভাষায় একটি অডিও বার্তায় এই হামলার দায় স্বীকার করেন, যেখানে তিনি বলেন যে তিনি একজন শহীদ হতে প্রস্তুত এবং তিনি সামুয়েল পাটির নবীকে অপমানজনক হিসেবে দেখানোর “প্রতিশোধ” নিয়েছেন। ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত একটি ভিডিওতে তিনি ইসলামিক স্টেটের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

মূল ঘটনা

হত্যা ও শিরোশ্ছেদ

২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর পাটির বাকস্বাধীনতা ক্লাসের দেড় সপ্তাহ পরে, আনজোরভ পাটির স্কুলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করেন এবং বেশ কয়েকজন ছাত্রকে পাটিকে চিনিয়ে দিতে বলেন। এরপর স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় তিনি পাটিকে অনুসরণ করেন। বিকাল ৫টার দিকে আনজোরভ পাটি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই স্কুলের কাছাকাছি একটি রাস্তায় তাকে ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইন) মাপের একটি ছুরি দিয়ে হত্যা করেন এবং তাকে শিরচ্ছেদ করেন। শিরোশ্ছেদ ছাড়াও আনজোরভ পাটির মাথা, তলপেট ও হাতে অনেকগুলো ক্ষতের সৃষ্টি করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছে, হামলার সময় তারা হত্যাকারী “আল্লাহু আকবর” বলে চিৎকার করছিল।

তাৎক্ষণিক পরবর্তী ঘটনা

হত্যাকাণ্ডের কয়েক মিনিট পরে, “@Tchetchene_270″ ছদ্মনাম থেকে টুইটারে পাটির কাটা মস্তকের ছবি পোস্ট করা হয়। (সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনজীবী জাঁ-ফ্রাঁসোয়া রিকার্ড @Tchetchene_270 আইডিটিকে আব্দুললাখ আনজোরভের বলে সনাক্ত করেছেন)। তিনি টুইটারে পাটির কাটা মাথার একটি ছবি পোস্ট করেছেন। ছবিটি এই বার্তাসহ পোস্ট করা হয়েছে:”পরম দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল আল্লাহর নামে…. (বিসমিল্লাহ্‌)। কাফেরদের নেতা ম্যাক্রোঁর উদ্দেশ্যে (বলছি), আমি তোমাদের নরকের কুকুরগুলোর (hellhounds) একজনকে হত্যা করেছি যারা মুহাম্মদকে ছোট করার সাহস দেখায়, তোমাদের উপর আল্লাহ্‌র কঠোর শাস্তি বর্ষিত হবার আগে এদেরকে শান্ত করুন।” কয়েক মিনিট পরে, কনফলান্স-সেন্ট-অনারের (Conflans-Sainte-Honorine) কাছে এরাগনিতে (Éragny) ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৬০০ মিটার (৬৬০ গজ) দূরে আনজোরভকে পুলিশের মুখোমুখি হন, এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। আনজোরভ একটি এয়ার রাইফেল দিয়ে পুলিশকে গুলি করেন এবং ছুরি দিয়ে তাদেরকে বিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এর জবাবে পুলিশ তাকে নয় বার গুলি করে হত্যা করে। আনজোরভের ফোনে তারা তার দায়বদ্ধতার দাবি করা একটি লেখা এবং পাটির মৃতদেহের ছবি খুঁজে পায়।

তদন্ত এবং গ্রেফতার

এরপর তদন্তের জন্য ১৬ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন আনজোরভের পিতামহ-পিতামহী, পিতামাতা এবং ১৭ বছর বয়সী ভাই। এছাড়াও ফরাসি সন্ত্রাস বিরোধী পুলিশের কাছে একজন ইসলামপন্থী জঙ্গি হিসেবে পরিচিত আব্দেলহাকিম সেফ্রিউয়িকে, পাটির ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীর পিতা ও পাটির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন সন্দেহে ব্রাহিম চ্‌নিনাকে, এবং অর্থের বিনিময়ে হত্যাকারীকে পাটিকে চিনিয়ে দেয়ার সন্দেহে চারজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়।

প্রতিক্রিয়া

ফরাসি প্রতিক্রিয়া

পাটির পরিবারের সাথে পরামর্শ করে ২১শে অক্টোবর একটি বিদায় অনুষ্ঠান ঠিক করা হয়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron) যে স্কুলে পাটি কাজ করতেন সেখানে পরিদর্শন করেন এবং বলেন যে ঘটনাটি “একটি সাধারণ ইসলামী সন্ত্রাসবাদী হামলা”। তিনি আরও বলেন, “শিশুদের বাক স্বাধীনতা শেখানোর জন্য আমাদের স্বদেশীকে হত্যা করা হয়েছে”। ফরাসী শিক্ষামন্ত্রী জঁ-মিশেল ব্লাঙ্কের (Jean-Michel Blanquer) এই হত্যাকাণ্ডকে “সামগ্রিকভাবে ফরাসি জাতির উপর হামলা” বলে অভিহিত করেছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি জঁ-রেমি গিরাড (Jean-Rémi Girard) বলেছেন যে শিক্ষকরা “বিধ্বস্ত” হয়েছেন, কিন্তু তারা ভীত হবেন না। ফ্রান্সের সন্ত্রাস বিরোধী প্রসিকিউটর বলেছেন যে শিক্ষককে “শিক্ষকতার জন্য হত্যা করা হয়েছে” এবং এই হামলা ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার নীতির উপর হামলা। শার্লি হেবদো তার “আতঙ্ক এবং বিদ্রোহ” (“horror and revolt”) প্রকাশ করে একটি বিবৃতি জারি করেন এবং পাটির পরিবার এবং বন্ধুদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রদান করেন। ফ্রান্সের অনেক মুসলমান ও ইসলাম ধর্মীয় নেতা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।

ফরাসী পুলিশ ঘোষণা করেছে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ৮০টিরও বেশি বার্তা রয়েছে যারা হামলাকারীকে সমর্থন করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেরাল্ড দারমাইন (Gérald Darmanin) আদেশ দিয়েছেন যে গ্রান্ড মসজিদ দে প্যান্টিন ছয় মাসের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। প্যারিসের ঠিক উত্তরে অবস্থিত প্রায় ১,৫০০ জন মসজিদগামী উপাসক রয়েছে। সামুয়েল পাটির বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ভিডিও প্রকাশ করার কারণে মসজিদটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইমাম আব্দেলহাকিম সেফ্রিউয়ির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মসজিদটি হত্যাকাণ্ডের পর এর পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলে এবং ভিডিও প্রকাশের জন্য “অনুতাপ” প্রকাশ করে এবং এর পরিবর্তে শিক্ষক হত্যার নিন্দা জানিয়ে একটি ঘোষণা প্রকাশ করে। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর প্রতিরক্ষা কাউন্সিল (defence council) ২৩১ জন বিদেশী নাগরিককে বহিষ্কারের আদেশ দেয়, যারা ফিচে এস রেজিস্টারে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পরিচিত ছিল (Fiche S বা এস কার্ড হল আইন রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আরোপিত একটি চিহ্ন যার দ্বারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি, এমন ব্যক্তিদেরকে নির্দেশ করা হয়)। এদের মধ্যে ১৮০ জন কারাগারে ছিল এবং বাকিদের গ্রেফতার করা হয়।

২৩শে অক্টোবরে ফরাসি কাউন্সিল অফ দ্য মুসলিম ফেইথ (সিএফসিএম) ফ্রান্সের ইমামদেরকে একটি লেখা পাঠায় ও বলে যে তারা চাইলে এই লেখাটিকে তাদের শুক্রবারের প্রার্থনার সময় মসজিদে প্রার্থনা করতে আসা লোকদেরকে এই লেখাটা পড়ে শোনাতে পারে। এতে সিএফসিএম উল্লেখ করেছে যে “ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড… আমাদেরকে সেই আঘাতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আমাদের বাস্তবতারই অংশ: আমাদের দেশে ইসলামের নামে যে মৌলবাদ, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদের বিপর্যয় রয়েছে তার শিকার সব বয়সের লোক, সব পরিস্থিতির লোক, এমনকি সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও। … না, আমরা মুসলমানরা ফ্রান্সে নির্যাতিত নই।… আমরা কখনও কখনও মুসলিম-বিরোধী কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে থাকি।… (কিন্তু) অন্যরাও প্রতিকূল কর্মকাণ্ডের শিকার। এই প্ররোচনা (বা ক্রোধোদ্দীপনার) মুখে, আমাদের অবশ্যই ভদ্র, শান্ত এবং স্পষ্ট দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকতে হবে।”

ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানিন (Gérald Darmanin) দুটি ইসলামিক এনজিও সংস্থার বিলুপ্তি দাবি করেছেন। এদের একটি হলো সিসিআইএফ (কালেক্টিভ এগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ইন ফ্রান্স) এবং বারাকা সিটিকে রাষ্ট্রের “শত্রু” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। উভয় এনজিওর বিরুদ্ধে শিক্ষকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রচার মাধ্যম প্রচারাভিযানে অংশ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে, যা তার এক ছাত্রের বাবা চালু করেছেন।

বিদেশী প্রতিক্রিয়া

ইউনাইটেড নেশনস অ্যালায়েন্স অফ সিভিলাইজেশনস এর উচ্চ প্রতিনিধি মিগুয়েল মোরাটিনোস (Miguel Moratinos) এই শিরশ্ছেদের নিন্দা জানিয়েছেন। মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাটির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের মহাসচিব শেখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল করিম ইঁসা বলেন, “সহিংসতা ও সন্ত্রাস সব ধর্মেই অপরাধ ছিল”। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফরাসি জনগণের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। জর্ডানের পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয় এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করা এবং একে টারগেট করা বা ধর্মীয় প্রতীককে অপমান করা থেকে বিরত থাকার কথা উল্লেখ করেছে। চেচেন প্রজাতন্ত্রের প্রধান রমজান কাদিরভ এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, “আমরা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই”। চেচনিয়া বংশোদ্ভূত রুশ মিশ্র মার্শাল-আর্টিস্ট জেলিম ইমাদায়েভ ইনস্টাগ্রামে “আনজোরভ একজন সত্যিকারের বীর” লিখে পোস্ট করেন। এর ফলে মিশ্র মার্শাল-আর্ট প্রোমোশন কোম্পানি আলটিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপে (UFC) থেকে তার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।

র‍্যালি এবং গণ বিক্ষোভ

এই ঘটনার শিকার ব্যক্তির সমর্থনে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সমর্থনে #Je Suis Prof এবং #Je Suis Enseignant (“আমি একজন শিক্ষক”) হ্যাশট্যাগ চালু করা হয়েছে। এই প্রচারণাটি #JeSuisCharlie হ্যাশট্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শার্লি হেবদোর পত্রিকা থেকে মুহাম্মদের কার্টুন প্রকাশ করার কারণে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট ও কর্মীদের নিয়ে মোট ১২ জনকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদী হামলায় হত্যা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে #JeSuisCharlie হ্যাশট্যাগ চালু করা হয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং চরমপন্থী ইসলামের প্রতি সরকারের অকার্যকর প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে প্যারিসের প্লেস ডে লা রিপুব্লিক (Place de la République) এবং ফ্রান্সের অন্যান্য শহরে র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩৭ লক্ষ বিক্ষোভকারী পাটির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে ফ্রান্স জুড়ে সমাবেশ করে। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন বিবৃতি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নেয়, যেমন “জে সুইস সামুয়েল” (আমি সামুয়েল) এবং “স্কুলস ইন মোউর্নিং” (বিদ্যালয়সমূহ শোকগ্রস্ত) ইত্যাদি। বিক্ষোভকারীরা “Freedom of expression, freedom to teach” (মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষকতার স্বাধীনতা) বা ফরাসি জাতীয় সঙ্গীত “লা মার্সেইয়েজ” (La Marseillaise) এর স্লোগান দেয়। রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং রাষ্ট্রদূতগণ ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুসারে, প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ প্যারিসে জড়ো হয়েছে। লিওঁতে (Lyon) প্রায় ১২,০০০ জন বিক্ষোভে যোগ দেয়, তুলুজে (Toulouse) প্রায় ৫,০০০ জন বিক্ষোভ করে এবং নিস-এ (Nice) আরো শত শত মানুষ জড়ো হয়। প্রতিবেশী জার্মানিতে বার্লিনের ব্রান্ডেনবার্গ গেটে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার সন্ধ্যায় পাটির সম্মানে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের আয়োজন করা হয়। তুলুজ (Toulouse) এবং মোঁপেলিয়ের (Montpellier) আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের বিল্ডিংগুলোতে (ফরাসি: Hôtels de région) শার্লি হেবদোর ব্যঙ্গচিত্রগুলো প্রদর্শিত হয়।

তথ্যঋণ
উইকিপিডিয়া নিবন্ধ “Murder of Samuel Paty”

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.