ভারতীয় দর্শনে শব্দপ্রমাণ ও প্রত্যাদেশভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্ব বা প্রাধিকারবাদ

ন্যায় ও নব্যন্যায়ে শব্দপ্রমাণ

শব্দ ও শাব্দজ্ঞানের স্বরূপ, শব্দপ্রমাণের শর্ত

ন্যায়দর্শন স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে চতুর্থ প্রমাণ হলো শব্দপ্রমাণ। শাব্দ জ্ঞানের করণকে ‘শব্দ’ বলা হয়। ভারতীয় সকল শাস্ত্রই গুরু পরম্পরায় শ্রবণের মাধ্যমে এসেছে, তাই বেদের আরেক নাম শ্রুতি। ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষকে প্রধান প্রমাণ বলা হলেও এই দর্শনে অতি সূক্ষ্ম পর্যায়ের শব্দের বিচারও আছে। এই প্রেক্ষিতে জগদীশ, গদাধর প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক শব্দের ওপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন। আধুনিককালে পাশ্চাত্যে শাব্দবোধ ও বাক্যার্থবোধ নিয়ে যে আলোচনা দেখা যায়, ন্যায় দর্শন তথা ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও শাব্দিক সম্পদায় খ্রিস্টপূর্বযুগেই তা আলোচনা করে গেছেন। শব্দের আলোচনা ভারতবর্ষে ঋগ্বেদের যুগেই শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়। .যথার্থ জ্ঞান লাভের জন্য শব্দ একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ। ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতম শব্দের লক্ষণে বলেছেন, “আপ্তব্যক্তির উপদেশবাক্যই শব্দ প্রমাণ।” (ন্যায়সূত্র-১/১/৭)। আর নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তার তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে শব্দ প্রমাণের লক্ষণ দিয়েছেন, “আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলে।”

ন্যায়মতে, ভ্রম (একটি বস্তুকে অন্যরূপে জানা), প্রমাদ (অসাবধানতা), বিপ্রলিপ্সা (বঞ্চনা করার ইচ্ছা) ও করণাপাটব (ইন্দ্রিয়ের ত্রুটি)- এই চারটি দোষশূন্য যথার্থ বক্তাই আপ্তব্যক্তি। অন্নংভট্টের মতে, “আপ্তব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি যথার্থ বক্তা।” (তর্কসংগ্রহ)। যিনি পদার্থের যথাযথ ধর্মসাক্ষাৎ বা তত্ত্বসাক্ষাৎ করেছেন এবং যিনি নিজে যেরূপ সাক্ষাৎ করেছেন, অপরকে জানানোর অভিপ্রায়ে ঠিক সেইরূপ উপদেশই দেন তিনি আপ্তব্যক্তি। এরূপ আপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকে যথার্থ শাব্দজ্ঞান হয়। তাই এরূপ আপ্তব্যক্তির উচ্চারিত বাক্য শ্রবণ করে শ্রোতার যে জ্ঞান হয় তাই শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ এবং ঐ আপ্তবাক্যই শব্দপ্রমাণ। ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব- এই চারটি দোষের কোন একটি থাকলে কোন ব্যক্তিকে আপ্ত বলা হয় না, এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি অনাপ্ত। সাধারণভাবে শব্দ থেকে উৎপন্ন যেকোনো জ্ঞানই শাব্দজ্ঞান হলেও সব শাব্দজ্ঞান যথার্থ শাব্দজ্ঞান নয়, আপ্তের মতো অনাপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকেও শাব্দজ্ঞান হতে পারে, কিন্তু সেই শাব্দজ্ঞান যথার্থ নয় বলে অনাপ্ত ব্যক্তির বাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয় না।

শব্দপ্রমাণের বিভাগ

ন্যায়মতে শব্দ প্রমাণ নানা প্রকার। জ্ঞানের বিষয় অনুসারে এবং বাৎস্যায়নের মতে শব্দ প্রমাণ দুই প্রকার- দৃষ্টার্থ এবং অদৃষ্টার্থ। ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে, “দৃষ্টার্থক ও অদৃষ্টার্থক ভেদে তা (শব্দপ্রমাণ) দুই প্রকার।” (ন্যায়সূত্র-১/১/৮)। ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন দৃষ্টাথর্ক ও অদৃষ্টার্থক শব্দপ্রমাণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ন্যায়ভাষ্যে বলেছেন, “ইহলোকে যার অর্থ (প্রতিপাদ্য) দৃষ্ট হয়, তা ‘দৃষ্টার্থ’। পরলোকে যার অর্থ প্রতীত হয় অর্থাৎ যে বাক্যের প্রতিপাদ্য ইহলোকে দৃষ্ট হয় না, তা ‘অদৃষ্টার্থ’। এভাবে ঋষিবাক্য ও লৌকিকবাক্যসমূহের বিভাগ।”

জাগতিক বিষয় সম্পর্কে আপ্তব্যক্তির বচনগুলো হলো দৃষ্টার্থ শব্দ-প্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ প্রত্যক্ষযোগ্য বা ইহলোকে দৃষ্ট হতে পারে, তাদের দৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আদালতে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর সাক্ষ্য, বিশ্বাসযোগ্য কৃষকের বৃষ্টি অথবা ভূমি সম্পর্কে জ্ঞান, উদ্ভিদের গুণাবলি সংক্রান্ত আয়ুর্বেদের উক্তি, শাস্ত্র বা আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির দেয় নির্দেশ ইত্যাদি দৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোনো বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির যে বচন তাই হলো অদৃষ্টার্থ শব্দপ্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ ইহলোকে প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, তাদের অদৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আত্মা, পরমাত্মা, পাপ, পুণ্য, পরলোক সম্বন্ধে শ্রুতিবাক্য, পরমাণু সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও বৈজ্ঞানিকদের উক্তি অদৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত।

আরেকটি শ্রেণীবিভাগ অনুসারে শব্দ বৈদিক ও লৌকিক ভেদে দুই প্রকার। বেদোক্ত বাক্য হলো বৈদিক শব্দ। বেদে যারা বিশ্বাস করেন, তারা বেদকে অভ্রান্ত বলে মনে করেন, কেননা তাদের মতে বেদের বাক্য ঈশ্বরের বাক্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বাক্য হলো লৌকিক শব্দ, এ বাক্য সত্যও হতে পারে ভ্রান্তও হতে পারে। লৌকিক শব্দের মধ্যে কেবল আপ্তব্যক্তির বাক্যই শব্দপ্রমাণ। অনাপ্তব্যক্তির বাক্য শব্দপ্রমাণ নয়। ন্যায়মতে বৈদিক ও লৌকিক সকল প্রকার শব্দই পৌরুষেয় বলে আপ্ত পুরুষের বাক্য লৌকিক বা বৈদিক যাই হোক না কেন তা শব্দপ্রমাণ বলে বিবেচিত।

পদ ও শব্দার্থজ্ঞান

‘শাব্দ’ শব্দটি ন্যায় দর্শনে শুধু উপদেশ (আপ্ত বা অনাপ্ত) অর্থে ব্যবহৃত হয়না। শব্দকারণক যে কোন জ্ঞানকেই কেউ কেউ শাব্দ বলেছেন। অনেকে আবার শব্দবিষয়ক জ্ঞানকেও শাব্দ বলেছেন। জগদীশ প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক আবার পদের অন্বয়বোধ বা বাক্যার্থবোধকে শাব্দবোধ বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে শব্দের আলোচনা প্রধানত বাক্যার্থ ও শব্দার্থ কেন্দ্রিক। ন্যায়মতে ‘শব্দ’ ও ‘পদ’ সাধারণত অভিন্নার্থেই ব্যবহৃত হয়। .নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বাক্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “বাক্য হলো কতকগুলি পদের সমষ্টি।” একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তি হলো বাক্য। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। যেমন, ‘গরুটি আনো’ একটি বাক্য। এই বাক্য ‘গরু’ ও ‘আনো’ এই দুটি পদের সমষ্টি। তাহলে প্রশ্ন হল পদ কাকে বলে। এর উত্তরে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রদীপিকায় বলেছেন, “যা শক্তি বিশিষ্ট তাই পদ।”

ন্যায়মতে, যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কোন পদার্থকে নির্দেশ করার বা সংকেত করার শক্তিসম্পন্ন, তাকে পদ বলে। পদ বা শব্দের অর্থ হলো শব্দার্থ। অর্থাৎ একটি পদ শুনলে একটি পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদ শুনলে ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘পট’ পদ শুনলে পট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদের দ্বারা পটের বা ‘পট’ পদের দ্বারা ঘটের জ্ঞান হয় না। যে কোন পদের দ্বারা যে কোন পদার্থের জ্ঞান হয় না। একটি পদের দ্বারা একটি বিশেষ পদার্থেরই জ্ঞান হয়। পদের এই জ্ঞানোৎপাদন সামর্থ্যই শক্তি। এরকম শক্তি যার আছে তাই পদ। ন্যায়মতে, পদের যোগ (অবয়বশক্তি) ও রূঢ়ি (সামগ্রিকশক্তি) শক্তি অনুসারে পদকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে- যোগরূঢ়, যৌগিক, রূঢ় ও যৌগিকরূঢ়।

পদের বৃত্তি – শক্তি ও লক্ষণা

যার দ্বারা একটি পদ একটি পদার্থকে বোঝায় তাকে পদের বৃত্তি বলে। একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের এই সম্বন্ধরূপ বৃত্তি দুই প্রকার- শক্তি ও লক্ষণা।

শক্তি : একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের অর্থাৎ ঐ পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর সম্বন্ধ আছে। যে পদের সঙ্গে যে পদার্থের সম্বন্ধ আছে, সেই পদ সেই পদার্থকেই বোঝায়। পদ ও পদার্থের সম্বন্ধই শক্তি। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় শক্তির লক্ষণ দিয়েছেন, “শক্তি হলো পদ ও পদার্থের সম্বন্ধ যা পদার্থের স্মরণের সহায়ক।” এর তাৎপর্য হলো, একটি পদ যে অর্থ বা বস্তুকে বোঝায় তার সঙ্গে সেই পদের একটি সম্বন্ধ আছে। কিন্তু পদ ও পদার্থের এই সম্বন্ধকেই শক্তি বলে না। একটি পদ শুনলে যখন শ্রোতা একটি বস্তুকে বোঝে, তখন তার পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকে এবং এই জ্ঞানের দ্বারাই সেই ব্যক্তি ঐ পদ নির্দেশিত বস্তুকে বোঝে। অর্থাৎ পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকার ফলেই কোন ব্যক্তি ‘ঘট’ পদটি শুনলে ঘট বস্তুকে স্মরণ করে এবং তার ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। একেই শাব্দবোধ বলে।

লক্ষণা : শক্তির দ্বারা যেখানে পদের অর্থ নির্ধারিত হয় না সেখানে লক্ষণা করতে হয়। ন্যায়মতে শক্তির মতো লক্ষণাও শব্দ বা পদের একটি বৃত্তি। একটি পদ তার শক্তির দ্বারা যেমন একটি পদার্থের বোধক হয়, তেমনি লক্ষণার দ্বারাও একটি পদার্থের বোধক হয়ে থাকে। তবে শক্তি ও লক্ষণার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি পদ শক্তির দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় প্রত্যক্ষভাবে (directly), কিন্তু একটি পদ লক্ষণার দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় পরোক্ষভাবে (indirectly)। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন, “একটি পদের শক্তির দ্বারা যা বোধিত হয় তাই শক্য, সেই শক্যের সঙ্গে সম্বন্ধই লক্ষণা।” যেমন গঙ্গা শব্দের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ। গঙ্গার অতি নিকটে, গঙ্গার তীরে ঘোষপল্লী আছে- এটি বোঝানোর জন্য কেউ বললেন ‘গঙ্গার ঘোষেরা’। এখানে গঙ্গা পদের মূখ্যার্থ বা শক্যার্থ গ্রহণ করলে বাক্যটির অর্থের উপপত্তি হবে না। গঙ্গার পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং জলপ্রবাহে ঘোষপল্লী থাকতে পারে না। ‘গঙ্গার ঘোষেরা’ বাক্যটির অর্থের উপপত্তির জন্য গঙ্গা পদের শক্যার্থ বাদ দিয়ে গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীরকে বুঝতে হবে। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহের অতি নিকটে তীর থাকায় গঙ্গা পদের শক্যের সঙ্গে তীরের নৈকট্য সম্বন্ধ আছে এবং এই নৈকট্য সম্বন্ধের দ্বারাই গঙ্গা পদ পরোক্ষভাবে তীরকে বোঝায়। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং তার সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধে যুক্ত তীর লক্ষণার্থ। তাই অন্নংভট্ট দীপিকায় বলেছেন, ‘শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা’।

বাক্যার্থজ্ঞান

ন্যায়মতে আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয়েছে এবং আপ্তবাক্য শ্রবণের ফলে শ্রোতার যে জ্ঞান হয়, তাকে শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ বলা হয়। এই শাব্দবোধই অর্থান্তরে বাক্যার্থজ্ঞান। একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তিকে বাক্য বলে। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় সম্বন্ধ প্রকাশক বলে যে কোন পদসমষ্টিই বাক্য নয়, অর্থপূর্ণ পদসমূহের উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবেশই বাক্য। একটি বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবিষ্ট হওয়ার জন্য কতকগুলি শর্তের উপর নির্ভর করে। নৈয়ায়িকেরা এ প্রেক্ষিতে বাক্যার্থ-নির্ধারক ৪টি শর্তের উল্লেখ করেছেন – (১) আকাঙ্ক্ষা, (২) যোগ্যতা, (৩) সন্নিধি বা আসত্তি ও (৪) তাৎপর্য।

১। আকাঙ্ক্ষা : আকাঙ্ক্ষা হলো একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের অন্বয়ের প্রয়োজনবোধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ দিয়েছেন, “অন্য পদ ছাড়া একটি পদ যদি ঐ দুটি পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর অন্বয় বা সম্বন্ধের জনক না হয় তাহলে বলা যায় ঐ দুটি পদ পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত।” যেমন, ‘জল আনো’ বাক্যটির অন্তর্গত পদগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো অন্বয়। এখন ‘জল’, ‘আনো’ পদ দুটির একটি অন্যটি ছাড়া বাক্যের সামগ্রিক অর্থ অর্থাৎ অন্বয়ের জনক হয় না। এই অন্বয়ের জনক না হওয়াই ‘আকাঙ্ক্ষা’ পদের অর্থ। আকাঙ্ক্ষা হলো ‘শব্দবিন্যাসগত অপেক্ষা’। ‘জল আনো’ এই দুটি পদ আকাঙ্ক্ষাযুক্ত। ‘আনো’ পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয়- কী আনতে হবে। এই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন ‘জল’ পদটি। আবার ‘জল’ এই পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয় ‘জল নিয়ে কী করতে হবে’। এই আকাক্সার নিবৃত্তি হয় ‘আনো’ এই পদের দ্বারা। এখন যদি বলা হয়- ‘জল অশ্ব পুরুষ হস্তী’, এই পদগুলো পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত না হওয়ায় এই পদগুলির দ্বারা বাক্যার্থবোধ জন্মে না। অর্থাৎ বাক্যের ভাব বা বাক্যার্থ পরিস্ফুট করার জন্য পদগুলোর মধ্যে একটি অন্বয়বোধ থাকা প্রয়োজন, যেটা ছাড়া কয়েকটি পদ পর পর বসালেই একটি বাক্য হয় না। কর্তা অনুসারে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, তেমনি বিশেষ্য অনুযায়ী বিশেষণ ব্যবহৃত হয়, ব্যাকরণ অনুযায়ী কারকপদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধ থাকে।

২। যোগ্যতা : যোগ্যতা হলো পদসমূহের পারস্পরিক অবিরোধ সম্বন্ধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে যোগ্যতার লক্ষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, “বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের বাধ না থাকাই যোগ্যতা।” একটি বাক্যের অর্থবোধের ক্ষেত্রে ঐ বাক্যস্থিত পদগুলোর দ্বারা বোধিত পদার্থগুলোর মধ্যে অবিরোধ সম্বন্ধ থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ বাক্যস্থিত পদগুলোর দ্বারা বোধিত পদার্থগুলোর সম্বন্ধের ক্ষেত্রে বাস্তবিক কোন বাধ থাকবে না। বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের এই বাধ না থাকাই যোগ্যতা। যেমন, ‘জলে’র সঙ্গে ‘তাপে’র এবং ‘বহ্নি’র সঙ্গে ‘শীতলতা’র অবিরোধ সম্বন্ধ নেই। ‘বহ্নি শীতল’ একথা হাস্যকর, কেননা এস্থলে অর্থ-বাধ হয়। সুতরাং অর্থপূর্ণ বাক্যের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পদসমূহই পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে পারে।

৩। সন্নিধি বা আসত্তি : সন্নিধি বা আসত্তি হলো বাক্যে ব্যবহৃত পদসমূহের মধ্যস্থিত নৈকট্য। সন্নিধির লক্ষণ দিতে গিয়ে তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন, “একটি বাক্যস্থিত পদসমূহের অবিলম্বে অর্থাৎ সময়ের অব্যবধানে উচ্চারণই সন্নিধি।” একটি বাক্য অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য পদগুলোকে দেশ ও কালের সান্নিধ্যে ব্যবহৃত হতে হয়। সকালে ‘জল’ পদ উচ্চারণ করার পর বিকালে যদি ‘আনো’ পদ উচ্চারণ করা হয়, তাহলে এই শব্দদ্বয় কোনো বাক্যার্থবোধ উৎপন্ন করতে পারে না।

৪। তাৎপর্য : তাৎপর্য হলো কোনো পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তার ঈপ্সিত অর্থ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও সন্নিধি এই তিনটিকে শাব্দবোধের হেতু হিসেবে উল্লেখ করলেও টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বাক্যার্থ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘তাৎপর্যজ্ঞান কারণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।.যে সকল পদের একাধিক অর্থ আছে, সেই সকল পদের ক্ষেত্রে তাৎপর্য অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন। বক্তা পদটি কোন্ অর্থে ব্যবহার করেছেন তা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করা না হয় তাহলে সে বাক্য বক্তার মনের যথার্থ ভাব প্রকাশ করতে পারে না। যেমন, ‘সৈন্ধব’ পদের ব্যাকরণগত অর্থ দ্বিবিধ- অশ্ব এবং লবণ। এই দুই অর্থের কোন্ অর্থে বক্তা শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা অনুধাবন না করলে বাক্য যথার্থ হবে না। পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গ বিচার করেই বাক্যের তাৎপর্য গ্রহণ করতে হয়।

মীমাংসা দর্শনে শব্দপ্রমাণ

প্রত্যক্ষপ্রমাণের অক্ষমতা ও শব্দপ্রমাণের গুরুত্ব

মীমাংসাদর্শনের মূল উদ্দেশ্য হলো বৈদিক ক্রিয়াকান্ডের যাথার্থ্য ও উপযোগিতা ব্যাখ্যা করা এবং বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা হলেই তা সম্ভব। তাই মীমাংসকরা স্বীকৃত অন্যান্য প্রমানের চাইতে শব্দ-প্রমানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বেদ যাগযজ্ঞাদি কর্মের বিধানে ভর্তি। মীমাংসকদের মতে এই কর্মের বিধানই বেদবাক্যের প্রকৃত তাৎপর্য। বেদে সিদ্ধার্থ বাক্যও আছে, কিন্তু সেগুলোরও উদ্দেশ্য হলো ঐ সকল বাক্য দ্বারা প্রকাশিত তত্ত্বগুলির অস্তিত্ব ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করে মানুষকে কর্মে প্রণোদিত করা। 

মীমাংসা দর্শনের এই ধর্মীয় প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর করতে হলে বেদবাক্যের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক। যেমন, বেদে বলা হলো- যজ্ঞ করলে স্বর্গলাভ হবে। পুরো বিষয়টাই ধর্ম; তাকে কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞান এক্ষেত্রে ধর্মজ্ঞানের নিমিত্ত বা উপায় হতে পারেনা কারণ জৈমিনির মতে, “ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের ‘সম্প্রয়োগ’ অর্থাৎ সন্নিকর্ষ বা সম্বন্ধের বশে যে বুদ্ধি বা জ্ঞান জন্মায় তাই প্রত্যক্ষ। সে কেবল তাকেই জানাতে পারে যা বিদ্যমান বা বর্তমান।” (মীমাংসাসূত্র: ১/১/৪)। যজ্ঞ থেকে প্রাপ্তব্য ফল ভবিষ্যতের গর্ভে অর্থাৎ বর্তমান না হওয়ায় বেদপ্রতিপাদিত বিষয় অবশ্যই অপ্রত্যক্ষ। তাছাড়া স্বর্গাদি বিষয়টা পুরোপুরি অতীন্দ্রিয়, নিত্যপরোক্ষ হওয়ায় প্রত্যক্ষের প্রশ্ন ওঠে না। সেইসাথে অন্যান্য অনুমানাদি প্রমাণও প্রত্যক্ষনির্ভর বলে তাদের দ্বারাও ধর্মের স্বরূপ জানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে শবরস্বামীর বক্তব্য, “প্রত্যক্ষাতিরিক্ত অনুমান, উপমান এবং অর্থাপত্তিও অনিমিত্ত, অর্থাৎ ধর্মকে জানাতে অপারগ, যেহেতু তারা সকলেই প্রত্যক্ষপূর্বক। প্রত্যক্ষ যার নাগাল পায় না তারাও সেখানে ব্যর্থ।” (শাবরভাষ্য)।

একারণেই ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষকে প্রমাণজ্যেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও মীমাংসকরা তাকে শ্রেষ্ঠ মানতে নারাজ। কারণ, প্রত্যক্ষপ্রমাণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষাত্মক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রমা জন্মায়, ইন্দ্রীয় কেবল বিদ্যমান বিষয়কেই গ্রহণ করতে পারে, যা অবর্তমান তা তার অধিগম্য নয়। তাই প্রত্যক্ষপ্রমাণ ইন্দ্রিয়ের অনস্বীকার্য সীমাবদ্ধতা। ইন্দ্রিয়ের এই সীমিত ক্ষমতা সম্পর্কে ‘ন্যায়রত্নাকরব্যাখ্যা’য় পার্থসারথিমিশ্রও স্পষ্ট করে বলেন, “প্রত্যক্ষ কেবল বর্তমান বিষয়কেই জানাতে পারে এই হলো নিয়ম। এজন্য ‘ভবিষ্যৎ’ ধর্মকে জানাবার সামর্থ্য তার নেই। বিষয়কে জানানো তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব।” ফলে এই সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে থাকা প্রত্যক্ষনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও এমন একটি প্রমাণকে কোন কোন দর্শনে স্বীকার করা হয়, তা হলো শব্দ প্রমাণ। মীমাংসাদর্শনে যা শাস্ত্র বা আগম বলেও পরিচিত। শব্দপ্রাধান্যবাদের এই অন্যতম উৎস হলো মীমাংসক শবরস্বামীর ভাষ্য, “চোদনা অর্থাৎ প্রবর্তক বা বিধায়ক বাক্য অতীত, বর্তমান, ভাবী, সূক্ষ্ম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগম্য, ব্যবহিত অর্থাৎ স্থান এবং কালের দিক থেকে যার সঙ্গে ব্যবধান, দূরবর্তী এবং এজাতীয় অন্য অর্থকেও জানাতে পারে; যা অন্য কিছু করতে পারে না; এমনকি ইন্দ্রিয়ও নয়।” (শাবরভাষ্য)। সোজা কথায় এর মর্মার্থ দাঁড়াচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে শব্দই শুধু অসন্নিকৃষ্ট বা অবর্তমানকে জানাতে সমর্থ। আর এই শব্দের উৎস বা প্রমাণ হলো বেদ। যজ্ঞের ফললাভ বর্তমান নয়, বরং ভবিষ্যতের ব্যাপার বলে বিধিবাক্য কেবল সেই অনাগতেরই নির্দেশ দিতে পারে। তাই কুমারিল ভট্টের মতে, “অতীত কিংবা বর্তমান বিধির বিষয় হতে পারে না।” (শ্লোকবার্ত্তিক: চোদনা-৭)।

শব্দ, শাব্দজ্ঞান ও শব্দপ্রমাণের স্বরূপ

এই যে বিধি বা বিধায়ক বাক্য, তা মূলত বচন বা শব্দ এবং এই বচনের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ হয় তাকে শব্দজ্ঞান বলা হয়। মীমাংসা মতে বিশ্বাসযোগ্য বচন শব্দ প্রমাণ। অন্যভাবে বললে, শব্দপ্রমাণ হলো আপ্ত বা বিশ্বাসযোগ্য যথার্থবক্তার বাক্য বা উক্তি। আপ্তবাক্য থেকে যে বাক্যার্থজ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে শাব্দবোধ বা শাব্দজ্ঞান বলে। শাবরভাষ্যে শাস্ত্র বা শব্দপ্রমাণের লক্ষণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “শাস্ত্র বা শব্দ-প্রমাণ হলো শব্দজ্ঞান থেকে সঞ্জাত, সন্নিকৃষ্ট বা ইন্দ্রিয়সংযুক্ত নয় এমন বিষয়ের জ্ঞান।” শব্দবিজ্ঞান বা বাক্যজ্ঞান না হলে বাক্যার্থজ্ঞান হতে পারে না। শাবরভাষ্যের শাস্ত্রলক্ষণে ‘অসন্নিকৃষ্ট’ এই ‘অর্থ’-বিশেষণটি সবিশেষ তাৎপর্যের বাহক। যে ঘট আমার সন্নিকৃষ্ট অর্থাৎ সন্নিহিত বা ইন্দ্রিয়সংবদ্ধ তাকে ঘট বলে বোঝাবার মধ্যে শব্দের কোন মহিমা নেই। প্রত্যক্ষ হতে ঘটের বাধা নেই। তাহলে শব্দের স্বকীয়ত্ব এখানেই যে সে অবিদ্যমানেরও প্রকাশে সমর্থ। কিন্তু কেবল শব্দপ্রমাণ নয়, অনুমানাদি প্রমাণও অসন্নিকৃষ্টবিষয়ের প্রকাশক, তাহলে প্রশ্ন হল শব্দ কেন প্রধান হবে। এর উত্তরে বলা হয়, অনুমানাদি ভূত, ভাবী, ব্যবহিত ও দূরস্থকে প্রকাশ করে ঠিকই, তবে অনুমানাদি প্রমাণসমূহ প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষপূর্বক। কারণ এরা কোন না কোন দেশে বা কালে কারোর না কারোর কাছে বিদ্যমান। কিন্তু একেবারে অবিদ্যমান অলীক বিষয় সম্বন্ধে অনুমানাদি উৎপন্ন হয় না। কেবল শাব্দজ্ঞানই উৎপন্ন হতে পারে। এ বিষয়ে কুমারিলভট্টের ভাষ্য হলো, “যা অত্যন্ত অসৎ অর্থাৎ অলীক ( কোন দেশকালে যার অস্তিত্ব নেই) তার সম্বন্ধেও শব্দজ্ঞান জন্মায়।” (শ্লোকবার্ত্তিক: চোদনা-৬)।উদ্ধৃত কুমারিলভাষ্যের ব্যাখ্যাকালে পার্থসারথিমিশ্র অলীক বা অত্যন্তাসতের উদাহরণ দিলেন- ‘শশবিষাণাদি’, অর্থাৎ শশশৃঙ্গ (খরগোশের শিং, যার অস্তিত্ব থাকতেই পারেনা) প্রভৃতি।

‘অত্যন্তাসত্’-কে শব্দ প্রকাশ করতে পারে কিনা এ বিষয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য উভয় দার্শনিকমহলে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। উদয়ানাচার্য প্রভৃতি নৈয়ায়িকদের বক্তব্য হলো- শৃঙ্গের সঙ্গে শশের অবয়ব-অবয়বি-ভাবরূপ সম্বন্ধ বাস্তবে অসম্ভব বলে যোগ্যতা বা মানানসহতার অভাববশত ‘শশশৃঙ্গম অস্তি’ বা ‘শশশৃঙ্গং নাস্তি’- কোনটিকেই বাক্য বলা চলে না, অর্থাৎ এ জাতীয় উক্তির অর্থবোধকত্ব নেই। কিন্তু পাণিনীয় প্রস্থান ও বৌদ্ধরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত দিয়েছেন। তাদের মতে কোন বচনই অর্থহীন হতে পারে না। কারণ শব্দার্থ আসলে বুদ্ধিস্থ, কেবল ভাবনা। কোন বস্তু শব্দের অর্থ নয়। এজন্য ‘বহ্নিনা সিঞ্চতি’ (‘আগুন দিয়ে ভিজিয়ে দেয়’) শুনে আমরা অজানা বিদেশী ভাষা শুনে যেরকম হতবুদ্ধি হই সেরকমটা হইনা, বরং বক্তাকে পাগল বলে উপহাস করি। তাছাড়া, বিরোধীদের শাস্ত্রকে ভ্রান্ত বললেও তা থেকে নিশ্চয় কোন অর্থ প্রতীত হয়। ‘শব্দ নিত্য’ এবং ‘শব্দ অনিত্য’- এই দুটো বাস্তবে সত্য হতে পারে না। এরা পরস্পর বিরুদ্ধ। একটা সত্য, অন্যটা মিথ্যা। তবুও এটা ঘটনা যে ‘বাদে’ বা তর্কে দুটি উক্তিই নিজ-নিজ অর্থের প্রকাশক। আর কবিরা যখন সুন্দর মুখ দেখে মন্তব্য করেন ‘চাঁদের টুকরো দেখলাম’, অথবা কাউকে গাধা, গরু বলে গালি দেয়া হয়, তখন রূপক কোন অর্থ বোঝায় নিশ্চয়ই। না হলে কবির কাব্য শুনে চমৎকৃত কিংবা গালি শুনে ক্ষুব্ধ হবার অবকাশ থাকত না।’ (সূত্র: হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-১৬)। এসব কারণে বৈয়াকরণরা অভিমত ব্যক্ত করলেন- ‘শশবিষাণ’ ইত্যাদির বহিঃসত্তা না থাকলেও বুদ্ধিসত্তা অর্থাৎ উপচরিত বা আরোপিত সত্তা আছে। বৌদ্ধদর্শনে এর নাম হলো- ‘অভিধেয়সত্তা’। তাই জগদীশ তর্কালঙ্কার-এর মতো নব্য নৈয়ায়িকরাও আপোষে এসে বললেন, “বহ্নিনা সিঞ্চতি’ (‘আগুন দিয়ে ভিজিয়ে দেয়’) ইত্যাদিও সার্থক অর্থাৎ অর্থবহ বচন। কিন্তু যোগ্যতার অভাব থাকায় অপ্রমাণ।” (শব্দশক্তিপ্রকাশিকা)।

অনুমান সহ অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে শব্দের আরেকটা বড় পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য প্রমাণ হিসাবে নয়, বরং প্রমাণাভাস হিসাবে। প্রমাণ হল প্রমা বা যথার্থ অনুভবের সাধন। অন্যদিকে প্রমাণাভাস যথার্থ অনুভবের সাধন না হয়ে অপ্রমা বা অযথার্থ অনুভবকেই সাধিত করে। শ্রবণযোগ্যতার দিক থেকে শব্দপ্রমাণের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও যা বস্তুবিরোধী তা শব্দপ্রমাণ নয়; সে শব্দপ্রমাণাভাস, সংক্ষেপে শব্দাভাস। যা প্রমাণ নয় কিন্তু প্রমাণরূপে প্রতিভাত বা আভাসমান তাই প্রমাণাভাস। অনুরূপভাবে অনুমানাভাস ইত্যাদিকেও দেখানো যায়। অনুমানাভাস প্রভৃতির সঙ্গে শব্দাভাসের পার্থক্য প্রবল। ১৪শ শতকের ভাট্ট মীমাংসক চিদানন্দ পন্ডিত এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মতে, কেউ ধূলিসমূহকে ধূম ভেবে তা থেকে বহ্নির অনুমান করতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে জানবে বস্তুটা আসলে ধূম নয়, ধূলি, তখন আর তার ভ্রান্ত অনুমান জন্মাবে না। শুক্তিকে কেউ রজত বলে ভুল করতে পারে। কিন্তু একবার যদি সে জানে যে সামনের বস্তুটা আদৌ রজত নয়, তাহলে পরবর্তী জ্ঞানটা বাধকরূপে কাজ করায় তার আর রজতভ্রম হয় না। শব্দের বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম। ‘নদীর তীরে ফল নেই’ এই বিরোধী বা বাধের জ্ঞান হবার পরেও এই বাক্য পূর্বের মতই অর্থবোধ উৎপাদন করে। কেবল জ্ঞানান্তরের দ্বারা বাধিত এবং বস্তুও অসদৃশ হওয়ায় ওই বাক্যার্থজ্ঞান তখন অযথার্থ বলে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে বাক্যটিকে শব্দপ্রমাণ না বলে বলা হয় শব্দাভাস।’- (সূত্র: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-১৯)।

বৈদিক বাক্য যে কখনো শব্দাভাস নয় এ ব্যাপারে মীমাংসকদের মধ্যে কোন মতদ্বৈধ নেই। তাই বেদবাক্য বাধিত না হওয়ায় স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে মীমাংসামতে বেদই শব্দ প্রমাণ। মীমাংসক কুমারিল ভট্ট অবশ্য লৌকিক অভিজ্ঞ ব্যক্তির বচনকেও আপ্তবাক্য হিসেবে শব্দ প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। তার মতে মিথ্যাবাদী বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তির বচন বা অনাপ্তবাক্য ছাড়া সমস্ত বাক্যই জ্ঞানোৎপাদন করতে পারে এবং সেজন্যেই তা শব্দ-প্রমাণ বলে গৃহীত হওয়ার যোগ্য। তাই কুমারিল ভট্টের মতে শব্দ-প্রমাণ দুই প্রকার- পৌরুষেয় ও অপৌরুষেয়। কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তির বচন থেকে কোন বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের প্রমাণ হলো পৌরুষেয় শব্দপ্রমাণ, আর বেদবাক্য অপৌরুষেয় শব্দ প্রমাণ। স্মৃতি, পুরাণ ও পুরুষরচিত দর্শনগ্রন্থাদিও পৌরুষেয় শব্দ-প্রমাণ।

কিন্তু প্রাভাকর মীমাংসকরা অপৌরুষেয় বেদবাক্যই কেবল শব্দপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন। তাদের মতে, পৌরুষেয় লোকবাক্যের প্রায়শ বাধিত বা অযথার্থ হবার সম্ভাবনা থাকায় তা শব্দপ্রমাণ হতে পারে না। শাবরভাষ্যের করা লক্ষণে শব্দপ্রমাণ বোঝাতে ‘শাস্ত্র’ শব্দের ব্যবহারও প্রাভাকরসমর্থিত শাস্ত্র বা বেদের ব্যতিরিক্ত শব্দগুলির অপ্রামাণ্য সূচিত করে। লৌকিক বক্তা প্রায়ই অনাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে লৌকিক কথার অযথার্থ বা অর্থশূন্য অর্থাৎ অর্থব্যভিচারী হবার সম্ভাবনা রয়ে যায়। প্রাভাকর মীমাংস শালিকনাথ মিশ্র তাই প্রকরণপঞ্চিকায় বলেন, “লৌকিক বাক্যদ্বারা উৎপন্ন যথার্থ জ্ঞান শাস্ত্র বা শব্দজাত জ্ঞান নয় বলে স্বীকৃতির অযোগ্য। লৌকিক বাক্য থেকে প্রথমে বক্তার জ্ঞান বা অভিপ্রায় অনুমিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে লৌকিক বাক্যের দ্বারা জ্ঞাপিত ওই বক্তার জ্ঞান বা অভিপ্রায় অর্থকে জ্ঞাপিত করে। জ্ঞাপিত বিষয়টি বস্তুত না থাকলে ওই বাক্যটি হয়ে ওঠে লিঙ্গাভাস। শব্দাভাস সে নয়।” প্রাভাকর মীমাংসকরা তাই পৌরুষেয় শব্দ বা লোকবাক্যকে অনুমানের অন্তর্গত মনে করেন। কোন বচন সত্য কি অসত্য তা অনুমান করে নিতে হয় বক্তার চরিত্রের এবং জ্ঞানের সত্যতার উপর নির্ভর করে। বক্তা যদি বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হয় তাহলে তার বচন শব্দপ্রমাণ হবে। পৌরুষেয় শব্দ অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। তাই প্রাভাকররা লোকবাক্যকে প্রকৃত প্রমাণ বলে গ্রহণ করেন না। কিন্তু লৌকিক ব্যবহারের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ ভাট্টরা নৈয়ায়িকদের মতোই মেনে নিতে পারেন নি। শাস্ত্র তো মুখ্যত লোকের জন্য অর্থাৎ লোককে বোঝাবার জন্য। লোকব্যবহারের সেখানে প্রাধান্য হওয়া উচিত অলৌকিকের তুলনায়। ভাট্টরা তাই বলেন, “বাক্যার্থ যদি লোকে অনুমানলভ্য হয় তাহলে বেদেও তাই হোক। আর বেদে যদি শব্দের দ্বারা অর্থ অভিহিত হয় তাহলে লোকেও শব্দদ্বারা অর্থাভিধান হবে না কেন ?” (নীতিতত্ত্বাবির্ভাব)। তাছাড়া লৌকিক বাক্যের শব্দত্বের বিরুদ্ধে যে সব দোষ আবিষ্কার করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেককে চেষ্টা করলে বৈদিক বাক্যের ক্ষেত্রেও দেখানো যায়। অনেক সময় বেদের অর্থবাদকেও শব্দাভাস বলতে হয়। ভাট্টমতে শব্দপ্রমাণ লোক-বেদ-নির্বিশেষে অনুমানের অতিরিক্ত।

নৈয়ায়িকদের মতে বেদ পৌরুষেয়

মীমাংসাদর্শনে বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়েছে। বেদের অপৌরুষেয়ত্ব মীমাংসার একটি অতিপ্রসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। ‘অপৌরুষেয়’ শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো যা পুরুষকৃত নয়। কিন্তু এখানে ‘অপৌরুষেয়’ শব্দটির অর্থ হলো যা ঈশ্বরকৃত নয়। মীমাংসামতে কেবল শব্দরূপ ছাড়া দেবতার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। যার কোন বাস্তব অস্তিত্বই নেই সে শাস্ত্র রচনা করতে পারেনা। বাকি থাকে মানুষ আর ঈশ্বর। বেদ হলো অলঙ্ঘনীয় সত্য ও অবিসংবাদী জ্ঞানের অপরিমেয় ভান্ডার। মানুষ যতো বড়ো প্রতিভাধরই হোক না কেন তার জ্ঞানবুদ্ধি সীমিত, তার পক্ষে কি অনন্ত সত্যজ্ঞানের আকরস্বরূপ বিপুল বেদরাশি রচনা করা সম্ভব নয়। বাকি রইলেন এক সম্ভাব্য সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। এ পর্যায়ে নৈয়ায়িকরা বলেন- বেদের রচয়িতা ঈশ্বর। ঈশ্বরই প্রথম বেদবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। প্রাচীন ঋষিরা তা শুনেছিলেন, তারপর পুরুষানুক্রমে ও সম্প্রদায়-পরম্পরায় সেই স্মরণাতীত কাল থেকে মুখে মুখে বেদ ঋষিসমাজে প্রচলিত হয়ে এসেছে। ন্যায় ও যোগদর্শনে পুরুষবিশেষরূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়েছে। তাই তাদের মতে বেদ অপৌরুষেয় নয়, পৌরুষেয়। নৈয়ায়িকেরা এই বেদকেই ঈশ্বরের অস্তিত্বেও পক্ষে একটি প্রমাণরূপে উপস্থিত করেছেন।

তাদের যুক্তির নমুনাটি হলো- ঈশ্বর না থাকলে বেদ রচনা করার আর কেউ থাকেনা। তাই বেদ রচনার জন্য একজন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর থাকা প্রয়োজন। বাক্য-মাত্রেরই সৃষ্টিকর্তা রূপে একজন বুদ্ধিমান চেতন ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি সর্বপ্রথম উচ্চারণের দ্বারা ঐ বাক্যটি সৃষ্টি করেছেন। বেদ হলো বিপুল বাক্যরাশি। তাই সর্বপ্রথম কোন বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তি নিশ্চয়ই বৈদিক বাক্যগুলি উচ্চারণ করেছিলেন। তাকে অসীম শক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী এক সর্বজ্ঞ পুরুষ হতে হবে। সে মানুষ হতে পারে না। তাই ‘অমানুষ’ এক সর্বজ্ঞ পুরুষ সর্বপ্রথম বেদবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বরের শরীর আছে কী নেই, উচ্চারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ফুসফুস-শ্বাসনালী-জিহ্বা-মাড়ি-দাঁত-ঠোঁট-প্রভৃতি আছে কী নেই, এ প্রশ্ন অবান্তর। অসীম জ্ঞানবিধি বেদ বলে একটা কিছু যখন আছে তখন এর স্রষ্টা ঈশ্বর বলেও একটা কিছু থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে অলৌকিক মহিমা বলে তিনি শরীর ধারণও করতে পারেন। এসবই মানতে হবে, নইলে বেদ কোথা থেকে এলো সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে না। ঈশ্বর না থাকলে বেদ হয় না। যদিও বৌদ্ধ বা জৈনদের মতো নাস্তিকদের ধর্মগ্রন্থের জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়নি।

মীমাংসামতে বেদের অপৌরুষেয়ত্ব ও শব্দের নিত্যতা

কিন্তু মীমাংসাদর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়নি। বেদের উৎপত্তির প্রশ্নে মীমাংসামত হলো বেদ ঈশ্বররচিত নয়, ঋষিদের ধ্যানে প্রতিভাত সত্য, মন্ত্রদ্রষ্টাকেই ঋষি বলা হয়। তাদের মতে, নিত্য বেদবাক্যের প্রামাণ্য সন্দেহাতীত। ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা হলেও বেদের মন্ত্রের সৃষ্টিকর্তা নন। বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদনের জন্য মীমাংসকরা বলেছেন যে, বেদ ঈশ্বররচিত হলে বেদের রচনাকাররূপে ঈশ্বরের নাম থাকতো। বেদ ও বেদজ্ঞের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু বেদের রচয়িতার নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বস্তুত মীমাংসামতে বেদ নিত্য। বেদের উপদেশ গুরু-শিষ্যের পরম্পরায় চলে এসেছে।

বেদের নিত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মীমাংসকরা বর্ণাত্মক বা অক্ষরবাচক শব্দমাত্রকেই নিত্য বলে প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন। তাই মীমাংসকদেরকে বর্ণ-রূপ শব্দের নিত্যতা প্রতিপাদনের জন্য কঠোর পরিশ্রমে বিস্তৃত তর্কজাল রচনা করতে হয়েছে। কুমারিলকে এজন্য শাবর-ভাষ্যের ব্যাখ্যারূপে ৪৪৪টি শ্লোকের আশ্রয় নিতে হয়েছে। বেদ অপৌরুষেয় নিত্য বলেই এতে লেশমাত্র ভ্রান্তির সম্ভাবনা নেই। তাহলে বৈদিক বাক্যরাশির অন্তর্গত বর্ণগুলো নিত্য না হলে বেদ নিত্য হয় কী করে। এ ব্যাপারে তাই কুমারিল ভট্ট বলছেন, “বেদের প্রামাণ্য সিদ্ধির জন্যই বর্ণের নিত্যতা সিদ্ধির প্রয়োজন।” (শ্লোকবার্ত্তিক: শব্দনিত্যতা শ্লোক-৭)।

নৈয়ায়িক মতে ‘বেদ অপৌরুষেয় নয়, কিন্তু পৌরুষেয় এবং ঈশ্বরনামক সর্বজ্ঞ পুরুষের সৃষ্টি’- এই মতের অনুষঙ্গ হিসেবে নৈয়ায়িকদের আরেকটি সুবিদিত সিদ্ধান্ত হলো- শব্দ, শব্দার্থ এবং শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধও ঈশ্বরই সৃষ্টি করেছেন। কর্তা ছাড়া যেমন কার্য হয় না, তাই বিশ্বের মূলে রয়েছেন এক অনাদি বিশ্বস্রষ্টা। শব্দও কার্য, তাই শব্দের মূলেও একজন শব্দস্রষ্টা থাকতে হয়। শব্দগুলির প্রথম স্রষ্টা ঈশ্বর, যিনি বিশ্বস্রষ্টা তিনিই শব্দস্রষ্টা।
ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসরণ করেই আমরা ‘জল’ বলতে জল বুঝি, ‘অগ্নি’ বলতে আগুন বুঝি, উল্টোটা বুঝি না। ন্যায়মতে শব্দের সঙ্গে অর্থের প্রাসঙ্গিক সম্বন্ধ-নির্দেশিকা এই ঈশ্বরেচ্ছাকেই বলে শব্দের ‘শক্তি’। ন্যায়মতে এর অপর নাম ‘সংকেত’।
তাই ‘ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা’য় বাচস্পতি মিশ্রের ন্যায়সম্মত বক্তব্য হলো, “সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর যে শব্দ দ্বারা যে অর্থ বুঝতে হবে বলে ‘সংকেত’ করেছিলেন (যেমন গো-শব্দের গরু অর্থে সংকেত করেছিলেন), এখন বৃদ্ধব্যবহার-পরম্পরায় বালকও সেই শব্দের দ্বারা সেই অর্থ বুঝতে পারে। এজন্য বালকের পক্ষে একথা স্মরণ করার প্রয়োজন পড়ে না যে একদিন ঈশ্বরই শব্দের সঙ্গে অর্থের মিলন ঘটিয়েছিলেন।… এখন বৃদ্ধব্যবহার অর্থাৎ সমাজ ও পরিবারে বড়োদের কথাবার্তাই শব্দার্থের পরস্পর সম্বন্ধ নিরূপণের উপায়। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে যে মহর্ষি বা দেবতারা ছিলেন তারা জ্ঞান, বৈরাগ্য ও অলৌকিক শক্তির উৎকর্ষবশত পরমেশ্বরের অনুগ্রহে সাক্ষাৎভাবে তাঁরই কাছ থেকে সহজেই কোন শব্দের কী অর্থ তা জেনেছিলেন। তাই আমরাও এখন পুরুষানুক্রমিক বৃদ্ধ-ব্যবহারের মাধ্যমে কোন বস্তুকে কী বলে তা সহজেই বুঝে নিতে পারছি।”

কিন্তু শব্দার্থ-সম্বন্ধের এই ঐশ্বরিক বিধানের বিরুদ্ধে বাধ সাধলেন নিরীশ্বরবাদী মীমাংসকরা। তাদের মতে শব্দ, অর্থ ও শব্দার্থসম্বন্ধ কোনো ঈশ্বরের বিধান নয়। আবার তা কোন মানুষেরও বিধান নয়; ঋষি সম্প্রদায় কোন এক প্রাচীন যুগে সভায় বসে ঠিক করেন নি যে, এখন থেকে অমুক অমুক শব্দের অর্থ হোক, অমুক বস্তুর অমুক নাম হোক। পিতামাতা যেমন পুত্রকন্যার নামকরণ করে তেমনিভাবে মানুষের পক্ষে সামাজিক বিধানের দ্বারা আমাদের পরিচিত বা ব্যবহার্য জাগতিক বস্তুসমূহের নামকরণ করা সম্ভব নয়। মীমাংসদের মতে শব্দার্থসম্বন্ধ স্বাভাবিক, অর্থাৎ ঈশ্বর বা মানুষের অনুশাসনের দ্বারা স্থির হয়নি। স্মরণাতীত কাল থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় চিরকাল ধরে মানুষের সমাজে শব্দার্থ প্রচলিত রয়েছে। কোন মানুষটি কবে প্রথম জলকে ‘জল’ বলতে শিখেছিলো তা বলা যায় না। যার আদি খুঁজে পাওয়া যায় না, অথচ অবিচ্ছিন্ন ধারায় মানুষের ব্যবহারে সচল রয়েছে তাকেই এরা বলেছেন ‘স্বাভাবিক’, ‘নিত্য’ বা ‘অপৌরুষেয়’। এজন্য ঈশ্বর নিষ্প্রয়োজন। পাণিনিদর্শন অনুসারী বৈয়াকরণরা যদিও মীমাংসকদের মতো নিরীশ্বরবাদী নন, তবুও এ ব্যাপারে এরা একমত যে, শব্দের সাথে অর্থের সম্বন্ধ অনাদিকাল থেকে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে চলে এসেছে। এর নাম ‘প্রবাহনিত্যতা’। অসাধু শব্দগুলি সাধুশব্দের অপভ্রংশ।

বেদের নিত্যতার অনুষঙ্গরূপে মীমাংসকরা শব্দের নিত্যতা প্রতিপাদন করার আগে এভাবে শব্দার্থ-সম্বন্ধের নিত্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধটা যদি নিত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে অনুষঙ্গ হিসেবে শব্দ ও অর্থের নিত্যতাও স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে। এটা ‘অর্থাপত্তি’-প্রমাণলভ্য। শব্দ ও অর্থের নিত্যতা কল্পনা না করলে এদের সম্বন্ধনিত্যতা উপপন্ন হয় না। তাই শাবরভাষ্যের তর্কপাদে শবরস্বামীর উপভোগ্য যুক্তিটি হলো, “বৃদ্ধদের কথাবার্তা ও ব্যবহার লক্ষ্য করে শিশু শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধ নির্ণয় করে। ঐ বৃদ্ধরাও যখন শিশু ছিলো তখন তারাও ওভাবেই শব্দের অর্থ শিখেছে। এভাবে যত পেছনেই যাই না কেন শিশুরা সবসময়ই সমকালীন বৃদ্ধদের কাছ থেকেই শব্দের অর্থ শিখেছে। এরূপ কল্পনা করা সম্ভব নয় যে কোনো মানবগোষ্ঠির প্রথম শিশুরা প্রথম বৃদ্ধদের কাছে প্রথম শব্দার্থ শিখেছিলো। কারণ, তখনও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে ঐ কল্পিত প্রথম বৃদ্ধরাও কি একদিন শিশু ছিলো না ? তারা কার কাছে শিখেছিলো? সুতরাং কোনো মানবগোষ্ঠির প্রথম শিশু, প্রথম বৃদ্ধ ও প্রথম ভাষাশিক্ষা কল্পনা করা যায় না। তাই শব্দ ও শব্দার্থসম্বন্ধ অনাদি। ঐ একই কারণে একথাও বলা যাবে না যে কোনো এক পুরাকালে কোন একদিন বৃদ্ধের দল সভা করে সাব্যস্ত করলো এখন থেকে এই শব্দের এই অর্থ হোক। তারা শব্দগুলি পেলো কোথায় ? সভায় বসে সিদ্ধান্ত নিতে হলে কথাবার্তা চালানোর জন্য যে শব্দগুলির প্রয়োজন সেই শব্দগুলির সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধ কে ঠিক করেছিলো ? সুতরাং এমন কিছু শব্দ ও শব্দার্থসম্বন্ধ সমাজে নিশ্চয়ই ছিলো যা কোনো মানুষ নতুন টেবিল-চেয়ার তৈরি করার মতো নতুন করে তৈরি করেনি। একথার অর্থ হলো মানবসমাজে এমন কোনো আদিম কাল ছিলো না যখন শব্দ ও শব্দার্থসম্বন্ধ বর্তমান ছিলো না। এরূপ অনাদিব্যবহার প্রসিদ্ধিবোধে কেউ বলে শব্দ ও শব্দার্থ সম্বন্ধের নিত্যতা।”’ (সূত্র: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-১০১)

এখানে উল্লেখ্য যে, এই অনাদিব্যবহার যুক্তির কারণেই মীমাংসকদের মতে পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মান্ড কেউ সৃষ্টি করেনি, পৃথিবী সহ বিশ্বেও জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। তাই মানবজাতিও কেউ সৃষ্টি করেনি, জাতি হিসেবে চিরকাল ছিলো, বংশপরম্পরায় চিরকাল থাকবে। কোন মূল সৃষ্টিকর্তা নিষ্প্রয়োজন। মীমাংসকদের মতে, কোন ভাষাগোষ্ঠির মানুষ কোনদিন সমবেত হয়ে স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে আইন পাশ করে নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেনি, কোন মোড়লের ফরমান দিয়েও সৃষ্টি হয়নি। ‘গরু’ শব্দটির দ্বারা এই রকমের আকৃতিবিশিষ্ট প্রাণী বুঝতে হবে- এহেন আইন বা ফরমানের ভাষা বা শব্দরাশি তো তাহলে আগে থেকেই থাকা দরকার, এই শব্দগুলির সঙ্গে নির্দিষ্ট অর্থের সম্বন্ধটাও নিশ্চয়ই আগে থেকেই ছিলো। না হলে এগুলি কোথা থেকে এলো?

যারা মনে করেন বেদ অপৌরুষেয় নয়, তাদের দিক থেকে শব্দের নিত্যতা সম্পর্কে নানারূপ আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। যেমন, শব্দ সৃষ্ট তাই শব্দ অনিত্য, শব্দ অনিত্য হলে অসংখ্য শব্দ ও বাক্যের সমষ্টি বেদকেও অনিত্য বলতে হয়। এসব আপত্তি খন্ডন করতে গিয়ে মীমাংসকরা বলেন যে, উচ্চারণ দ্বারা শব্দের প্রত্যক্ষ হয়, সৃষ্টি হয় না। যে ধ্বনির মাধ্যমে শব্দ প্রকাশ করা হয় তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। শব্দের বিনাশ হতে পারে না। এসব ব্যাখ্যাকল্পে মীমাংসকরা দু’প্রকার শব্দ স্বীকার করেন- বর্ণাত্মক ও ধ্বন্যাত্মক শব্দ। ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’ প্রভৃতি বর্ণাত্মক শব্দ। এগুলির সাহায্যে পদ বা শব্দ, ধাতু প্রভৃতি গঠিত হয়। যে শব্দ কেবল ধ্বনিমাত্র তাকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে, যেমন ঝড়ের শব্দ, শঙ্খের শব্দ, ভেরীর শব্দ। এই ধ্বনিগুলির পেছনে কোন নিত্য শব্দদ্রব্য নেই। মীমাংসামতে এসব ধ্বন্যাত্মক শব্দ বায়ুর গুণ এবং তা অনিত্য। কিন্তু অর্থবহ ভাষায় প্রযুক্ত ভাষার সংঘটক বর্ণাত্মক শব্দ কোনো দ্রব্যের গুণ নয়। সে নিজেই দ্রব্য এবং নিত্য। বর্ণাত্মক শব্দ বায়বীয় নয়, সেহেতু তার নাশ হয় না। বৈদিক শব্দ বর্ণাত্মক শব্দ তাই বেদও নিত্য। ধ্বনি অনিত্য। ‘ম’ এই বর্ণটি বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন কালে বিভিন্ন ব্যক্তি উচ্চারণ করলে বিভিন্ন ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই বিভিন্ন ধ্বনি একই ‘ম’ বর্ণের প্রকাশ। উচ্চারণের দ্বারা ‘ম’ বর্ণ সৃষ্ট হয় না, প্রকাশ হয় মাত্র। এর ধ্বনি বিভিন্ন। যে ধ্বনির মাধ্যমে শব্দ প্রকাশ করা হয় তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। শব্দের বিনাশ হতে পারে না। তাই ধ্বনি অনিত্য, শব্দ নিত্য। শুধু তাই নয়, শব্দের নিত্যতা প্রসঙ্গে মীমাংসকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো- ধ্বন্যাত্মক শব্দকে অর্থবহ শব্দ বলা যায় না। কোন ভাষাগোষ্ঠিতে প্রচলিত কোন শব্দকে যদি সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে হয়, তাহলে সমাজের সকল মানুষকেই একটি নির্দিষ্ট শব্দের দ্বারা একটি সমান নির্দিষ্ট অর্থ বুঝতে হবে। কেউ যদি ‘গরু’ বলতে ছাগল বোঝে, আর কেউ যদি ঘোড়া বোঝে, অন্য কেউ যদি গরু বোঝে, তাহলে মানুষের ভাষা সামাজিক বিপর্যয়ের বাহন হয়ে দাঁড়াবে, কেউ কারো কথার অর্থ বুঝবে না, মানুষের জীবনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্যই ধ্বন্যাত্মক শব্দকে অর্থবহ শব্দ বলা যায় না।

আমরা যখন কোনো অর্থ বোঝাবার জন্য কোন শব্দ উচ্চারণ করতে ইচ্ছা করি তখন আমাদের নিঃশ্বাসবায়ু কণ্ঠ ও জিহ্বামূল থেকে ঠোঁট ও নাক পর্যন্ত বিভিন্ন উচ্চারণ স্থানগুলিতে আঘাত করে নির্গত হয়, তারই ফলে বিভিন্ন ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়। এখন এই ধ্বনিগুলিকেই যদি অর্থবহ শব্দ বলি তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াবে- যত লোকে যতবার ‘গরু’ শব্দটি উচ্চারণ করছে ততটা ‘গরু’ শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে বলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। যদি দশবার উচ্চারিত হয়, দশবারে ধ্বনি দশটি হলেও বোল কিন্তু একই। অর্থাৎ ধ্বনি অসংখ্য হলেও শব্দ একটি ‘গরু’। এর অর্থ হলো অসংখ্যবার অনুরূপ ধ্বনির দ্বারা একই ‘গরু’ শব্দ প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্যেই দশখানা অভিধানে দশবার ‘গরু’ শব্দটি ছাপা হলেও আমরা বলি ‘গরু’। শব্দ একটাই, শব্দচিত্রের আকৃতিও একটাই। কিন্তু শব্দচিত্র সংখ্যায় দশটি। এক সংখ্যার ‘১’ এরূপ সংখ্যা-চিত্রটি লক্ষবার লক্ষ জায়গায় ছাপা হলেও আমরা বলি এক এই সংখ্যা একটাই। এর প্রতীকী চিত্রাকৃতিও একটাই, যদিও লক্ষবার ছাপায় আঁকা হয়েছে বলে ‘১’ সংখ্যাটির ছবি সংখ্যায় লক্ষ হয়ে গেছে। কারো বাবার ছবি দশখানা থাকলেও বাবা দশজন হয় না। দশখানা ছবি একই ব্যক্তিকে দশবার প্রকাশ করেছে মাত্র। এভাবেই অসংখ্য ধ্বনি অসংখ্যবার একই শব্দকে প্রকাশ করে বা অভিব্যক্তি করে। উচ্চারিত ধ্বনি তাই শব্দের অভিব্যঞ্জক, শব্দ হলো অভিব্যঙ্গ্য। তাই শাস্ত্রদীপিকা’য় ভাট্টমীমাংসক পার্থসারথি মিশ্র বলেন, “ধ্বনি শব্দের কারণ নয়; ধ্বনি দ্বারা শব্দ উৎপাদিত হয় না, প্রকাশিত হয়।”

আবার ধ্বনি উচ্চ হয়, নীচ হয়, দ্রুত হয়, বিলম্বিত হয়, কোমল হয়, কর্কশ হয়। ধ্বনিগুলি আলাদা, অথচ অর্থবোধক শব্দ কিন্তু একটাই। ‘গরু’ শব্দটি উচ্চ নীচ, দ্রুত বিলম্বিত, কোমল কর্কশ যেভাবেই উচ্চারিত হোক না কেন, এতো ধ্বনিভেদ সত্ত্বেও ঐ একটি ‘গরু’ শব্দ চিনে নিতে ভুল হয় না। শব্দের অভিব্যঞ্জক ধ্বনিগুলির দ্রুত-বিলম্বিত প্রভৃতি গুণ অভিব্যঙ্গ্য শব্দটিতে আরোপ করে আমরা বলে থাকি শব্দটা দ্রুত বা বিলম্বিত। আসলে কিন্তু তা নয়। ঐ গুণগুলি প্রকাশক ধ্বনির, প্রকাশ্য শব্দের নয়। ধ্বনিগুলিকে অর্থবহ শব্দ বলে মেনে নিলে প্রকৃতপক্ষেই বিপত্তি দেখা দেবে। তাই ধ্বন্যাত্মক শব্দকে অর্থবহ শব্দ বলা যায় না। ক্ষণস্থায়ী শব্দধ্বনিগুলিকে অর্থবহ শব্দ বলে মেনে নিলে তখন কোন বক্তার পক্ষে কোন শ্রোতাকে কোন শব্দ দ্বারা কোন অর্থ বোঝানো সম্ভব হবে না। একদিকে ধ্বনিভেদে শব্দ আলাদা হয়ে যাবে, আবার অন্যদিকে ব্যক্তিভেদে অর্থও আলাদা হয়ে যাবে। একটি ‘মানুষ’ শব্দের দ্বারা যে কোনো মানুষকে যে আমরা বুঝতে পারি, এবং এভাবে নিয়ন্ত্রিত শব্দার্থ-সম্বন্ধের দ্বারাই একই ভাষাগোষ্ঠির মানুষ যে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজজীবন এগিয়ে নিয়ে যায়- এই বাস্তব ঘটনাটাই অবাস্তব হয়ে পড়বে। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এহেন আত্মবিলুপ্তি আর সমাজবিলুপ্তি একই কথা। তাই শব্দধ্বনি যতোই আলাদা হোক, ব্যক্তি যতোই বিভিন্ন হোক, আমরা অসংখ্য ধ্বনির পেছনে একটি সাধারণ সমান শব্দ আবিষ্কার করি, অসংখ্য ব্যক্তির পেছনে একটি সমান সাধারণ অর্থের প্রতিভাস অনুভব করি। তাই ‘মানুষ’ এই একটি শব্দের দ্বারা যে কোনো মানুষকে বুঝতে পারি।

আমরা যখন ‘মানুষ’ বলতে যে কোনো মানুষ বুঝি, ‘গরু’ বলতে যে কোনো গরু বুঝি তখনও ব্যক্তির সাধারণ রূপটিকে বুদ্ধির দ্বারা বিশ্লিষ্ট করি। এই বিশ্লেষণকে বলে সাধারণীকরণ। শব্দার্থেও সাধারণীকরণ প্রায় সব দার্শনিকই স্বীকার করেন। তাই নৈয়ায়িকরা বলেন, শব্দের অর্থ হলো জাতিবিশ্লিষ্ট ব্যক্তি। ‘জাতি’ মানে একজাতীয় সকল ব্যক্তির (particulars) সাধারণ ধর্ম বা স্বভাব যার দ্বারা অন্যজাতীয় ব্যক্তিসমুদয় থেকে কোনো একজাতীয় ব্যক্তিসমুদয়কে আমরা পৃথক করতে পারি। সকল মানুষের সাধারণ ধর্মকেই বলে মনুষ্যত্ব, সকল গরুর সাধারণ ধর্মকে বলে ‘গোত্ব’। বৌদ্ধমতে ব্যক্তির এই সাধারণ রূপটিকে বলে ‘সামান্য’। বৌদ্ধমতে সামান্য বা জাতি বাস্তব নয়, কাল্পনিক। কিন্তু এ জাতীয় কল্পনা ছাড়া লোকব্যবহার বা সামাজিক জীবনযাত্রা অসম্ভব। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শুদ্ধ ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ এবং কল্পনাগ্রাহ্য ‘সামান্য’ এই দুয়ের মিশ্রণেই লোকব্যবহার সম্ভব হয়।

মীমাংসকদের মতে, শব্দের প্রাথমিক অর্থ হলো একজাতীয় সকল ব্যক্তিতে নিহিত একটি সাধারণ রূপ, যার অপর নাম ‘আকৃতি’। এই জাতি বা আকৃতি বিষয়ে শবরস্বামী বলেছেন, “দ্রব্যগুণ বা কর্মের সামান্যমাত্রকে আকৃতি বলে।” (শাবরভাষ্য)। তবে শ্লোকবার্ত্তিকে কুমারিলভট্ট আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, “যার দ্বারা ব্যক্তি আকৃত বা নিরূপিত হয়, তাই আকৃতি।” (শ্লোকবার্ত্তিক)। কিন্তু বুদ্ধিবিশ্লিষ্ট আকৃতির দ্বারা ব্যবহারিক জীবনের উপযোগী কাজকারবার চালানো যায় না। ব্যবহারিক কার্যসাধকতাকে বৌদ্ধ দার্শনিক পরিভাষায় বলা হয় ‘অর্থক্রিয়াকারিত্ব’। কার্যসাধন হয় ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা। গরুমাত্রের সাধারণ ‘আকৃতি’ বা গোত্ব থেকে দুধ পাওয়া যায় না, দুধ দেয় গো-ব্যক্তি, একটি বিশেষ গরু। ব্যবহারিক মূল্যটা গো-ব্যক্তির, ‘গো-সামান্য’ বা ‘গবাকৃতির’ নয়। সুতরাং শব্দের প্রাথমিক অর্থটি ‘সামান্যাকারে ভাসমান’ হলেও, শব্দ উচ্চারণ করা মাত্র অর্থটি সাধারণভাবে উপস্থিত হলেও, কান টানলে মাথাটাও চলে আসার মতোই ‘গরু-সাধারণে’র সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক মূল্যের বাহক গরু-ব্যক্তিটিও চলে আসে। কারণ গো-জাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা (গোত্ব) ঘাস খায় না, ঘাস খায় একটি গরু-ব্যক্তি। সামান্য (universal) ও বিশেষ (particular) এই দুই মিলিয়েই বস্তুর সত্তা। তাই কুমারিল বলেছেন- ‘বস্তু দ্ব্যাত্মক’। দুটিই সমান সত্য। দুই মিলে পূর্ণ সত্য। এভাবে সামান্যের মাধ্যমে বিশেষের উপস্থিতিকে, একের অবিচ্ছেদ্য আনুষঙ্গিক রূপে অপরের প্রতিভাস বা জ্ঞানকে বলে ‘আক্ষেপ’ (immediate implication)। সামান্যের দ্বারা বিশেষ আক্ষিপ্ত হয়।

শব্দের শক্তি

ভাট্টমীমাংসা মতে শব্দ প্রাথমিক স্তরে সোজাসুজি জাতি বা সামান্যকে বোঝায়, দ্বিতীয় স্তরে বোঝায় ব্যক্তিকে। শব্দের এই প্রাথমিক স্তরের অর্থবোধ সামর্থ্যকে বলে ‘অভিধা বৃত্তি’, সংক্ষেপে ‘শক্তি’। দ্বিতীয় স্তরের অর্থবোধ সামর্থ্যকে বলে ‘লক্ষণা বৃত্তি’। এরূপ সামর্থ্যই হলো শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধ। ‘বৃত্তি’ মানে সম্বন্ধ। প্রাথমিক স্তরের অর্থকে বলে মুখ্যার্থ, ‘অভিধেয়’ বা ‘শক্যার্থ’ এবং দ্বিতীয় স্তরের অর্থকে বলে ‘লক্ষ্যার্থ’। যেমন ‘গরু ঘাস খায়’ বললে প্রথমে গো-জাতির কথাই মনে হবে, কারণ রামের গরু বা রহিমের গরু, কালো গরু বা সাদা গরুর কথা বলা হয়নি, যে কোনো গরুর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং গো-জাতিই মুখ্যার্থ বা শক্যার্থ। কিন্তু গো-জাতিটা ঘাস খায় না, ঘাস খায় একটি নির্দিষ্ট গো-ব্যক্তি। তাই আমরা দ্বিতীয় স্তরে গো-জাতি থেকে গো-ব্যক্তিতে অর্থাৎ লক্ষ্যার্থে পৌঁছে যাই।

কিন্তু অনেকে এমত স্বীকার করেন না। গরু বললে প্রথমে ‘গো-জাতি’ বুঝি, পরে ‘গো-জাতি’র ‘অর্থ-ক্রিয়াকারিত্ব’ নেই বলে (অর্থাৎ গো-জাতিটা ঘাস খায় না, বা গো-জাতিটাকে বেঁধে রাখা যায় না, এভাবে গো-জাতিটার সঙ্গে সরাসরি কোনো ক্রিয়ার সম্বন্ধ নেই বলে) আমরা গো-জাতির মাধ্যমে গো-ব্যক্তিকে বুঝি, যার সাক্ষাৎ অর্থক্রিয়াকারিত্ব রয়েছে। এরূপ ধারণার অর্থ হলো, ‘গরু’ শব্দটির পরিপূর্ণ অর্থ বুঝতে আমাদের দুটি ক্রমিক স্তর দরকার হয়। একটি আগে আর একটি পরে। কিন্তু এরকম ‘পৌর্বাপর্য’ বা আগ-পর আমাদের অনুভবসিদ্ধ নয়। বোধের এই ক্রমিকত্ব আমাদের বুদ্ধিতে ধরা পড়ে না। আমরা জাতি ও ব্যক্তি একই সঙ্গে বুঝি, জাতি আগে উপস্থিত হচ্ছে, ব্যক্তি পরে উপস্থিত হচ্ছে – এরকম খণ্ডিত বোধ আমাদের অভিজ্ঞতায় আসেনা। সামগ্রিকভাবে জাতি ও ব্যক্তি মিলিয়ে একই মুহূর্তে আমাদের একটা সামগ্রিক বোধ হয়।

এই প্রেক্ষিতে জাতি ও ব্যক্তির (সামান্য ও বিশেষের) পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শাবরভাষ্যের কুমারিলকৃত ‘তন্ত্রবার্তিক’ নামক টীকার প্রামাণিক ব্যাখ্যাকার ভট্টসোমেশ্বর তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ন্যায়সুধা’য় কুমারিল মতের ব্যাখ্যায় বলেন, “জাতি ও ব্যক্তির সম্বন্ধ হলো ভেদাভেদ। অর্থাৎ ভেদ-অভেদ। জাতি ও ব্যক্তির মধ্যে ঐকান্তিক ভেদ নেই। জাতি হলো বিশেষণ, ব্যক্তি হলো বিশেষ্য। বিশেষণরূপে জাতি বিশেষ্যরূপ ব্যক্তিতে আশ্রিত। জাতি ও ব্যক্তির বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধটি একটি বিশেষ ধরনের সম্বন্ধ, যে সম্বন্ধের কখনো ছেদ হয় না। কুল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে, পাকলে লাল হয়, সবুজ রঙ ছেড়ে লাল রঙ গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যক্তি এক জাতিকে ছেড়ে অন্য জাতি গ্রহণ করে না। গরুটা ঘোড়া হয়ে যায় না, গোত্ব ছেড়ে দিয়ে অশ্বত্ব গ্রহণ করে না। যারা পরস্পর একান্তই ভিন্ন তাদের একটি আরেকটিকে ছেড়ে থাকতে পারে। যদি বিশেষণরূপ জাতি বিশেষ্যরূপ ব্যক্তি হতে একান্তই ভিন্ন হবে, তা হলে ব্যক্তির জ্ঞানটা সবসময়েই জাতি দ্বারা অনুরঞ্জিত হয়ে প্রকাশ পায় কেন? কালো গরু, সাদা গরু, যে কোন গো-ব্যক্তিই গরু বলে শনাক্ত হয় কেন? গোত্ব হলো সকল ব্যক্তির সাধারণ চারিত্রিক ধর্ম বা স্বভাব (essence)। তাই জাতি ও ব্যক্তি অত্যন্ত ভিন্ন হতে পারে না। আবার এরা সম্পূর্ণ একও নয়। কারণ ব্যক্তি বহু, কিন্তু জাতি একই। জাতি ও ব্যক্তি একান্ত অভিন্ন হলে জাতির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে গিয়ে ব্যক্তিও একটাই হতো। অথবা ব্যক্তির সঙ্গে মিলে গিয়ে জাতিও বহু হয়ে যেতো। এজন্যই জাতি ও ব্যক্তির সম্পর্কটা ঐকান্তিক ভেদও নয়, ঐকান্তিক অভেদও নয়, কিন্তু ভেদাভেদ। এই আপেক্ষিক অভেদের জন্যই, কোনো শব্দের দ্বারা জাতির জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে (অর্থাৎ একই সঙ্গে) ব্যক্তিরও জ্ঞান হয়।’ (সূত্র: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৬)।

এখানে কিছু প্রশ্ন ওঠে। শব্দ দ্বারা যখন জাতি-ব্যক্তি দুটোকেই বোঝা যাচ্ছে, তখন কি আমরা শুদ্ধ বা নিছক ব্যক্তি হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে, একই বোধের ভেতরে দুটোকে আলাদা করে বুঝতে পারি? একই সঙ্গে দুটো মানুষকে যেমন আলাদা করে দেখি, একই সামগ্রিক জ্ঞানে দুটো মানুষ যেমন পৃথকভাবে ভাসমান হয় জাতি ও ব্যক্তির ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা সেরকমের? তা যদি না হয় (এবং হতে পারে না, কারণ জাতি ও ব্যক্তির মধ্যে আপেক্ষিকভাবে অভেদ রয়েছে) তবে কোনটি অপেক্ষাকৃত প্রধান, কোনটি অপ্রধান? সিদ্ধান্ত হলো জাতিই প্রধান, ব্যক্তি অপ্রধান। কারণ ব্যক্তির বোধটাও জাতিরূপে বা সামান্যাকারেই হয়ে থাকে। যেমন ‘সকল মানুষই মরণশীল’ বললে পৃথিবীর অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যাবতীয় মানুষের অনন্ত কোটি সম্ভাব্য চিত্র আমাদের মগজের দৃষ্টিকেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়। আমরা সাধারণভাবে বুঝি যে-কোন মানুষই মরণশীল। মরে মানুষ ব্যক্তিটি, মনুষ্যত্ব নামক জাতি বা সামান্যটা মরে না। ‘মনুষ্যত্বের কবর’ সাহিত্যের আলংকারিক ভাষায় হলেও বাস্তবে হয় না। মনুষ্যত্বটা কবরে বা চিতায় শুয়ে পড়ে না। অর্থাৎ আমরা বুঝি যে-কোনো মানুষ মরে, রাম বা রহিম কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝি না। তেমনি গরু ঘাস খায় বললে রামের কালো রঙের মঙ্গলা গাইটি নির্দিষ্ট করে বুঝি না। বুঝি যেকোনো গরু। এভাবে কোনো ব্যক্তি বিশেষকে নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট না করে ব্যক্তিমাত্রকে বোঝাকে সোমেশ্বর বলেছেন ‘অনির্ধারিতবিশেষা’ ব্যক্তির বোধ। একেই বলে সামান্যাকারে ব্যক্তিবোধ। এভাবে শব্দের দ্বারা সামান্যাকারে অনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তি জ্ঞানে প্রতিভাসিত হয় বলেই জাতি ও ব্যক্তির যুগপৎ বোধ জন্মালেও আকৃতি বা জাতিরই প্রাধান্য স্বীকার করতে হবে।

শব্দনিত্যতা মূলত বর্ণনিত্যতা

মীমাংসকদের শব্দনিত্যতা মূলত বর্ণনিত্যতা। তারা শব্দের অর্থকে আকৃতি বা জাতি বললেও শব্দকে অনুরূপভাবে জাতি বলতে রাজি নন। তাদের মতে অর্থবহ শব্দ উচ্চারিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ হতে পারে না, ধ্বনি বা নাদ থেকে তা স্বতন্ত্র। এ প্রসঙ্গে মীমাংসকদের যুক্তি হলো, ক, খ, গ প্রভৃতি প্রত্যেকটি বর্ণ নিত্য। যখন বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নবার ‘গ-কার’ উচ্চারণ করে তখন বর্ণধ্বনিগুলি আলাদা আলাদা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন ‘গ’ ধ্বনিগুলি একটা ‘গ’ বর্ণকে প্রকাশ করছে যার জন্য আমরা বলি- সবাই একই ‘গ’ বলছে। এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্নাকারে উচ্চারিত ‘গ’ ধ্বনি দ্বারা অনাদি-কালস্থিত ‘গ’ শব্দ অবিব্যক্ত হচ্ছে। আমরা ধ্বনিগুলিকে এক বলতে পারি না। কারণ তা হলে একজন ‘গ’ উচ্চারণ করলে সবার মুখ দিয়ে ‘গ’ ধ্বনি বেরিয়ে আসতো। অথবা একজন উচ্চারণ বন্ধ করলে সবার মুখের ‘গ’ ধ্বনি থেমে যেতো। যেমন সকল মানুষ ব্যক্তি হিসেবে এক হলে একজন মারা গেলে সবাই মারা যেতো, একজন জন্মালে সবাই জন্মাতো। শঙ্খের শব্দ, ভেরীর শব্দ এদের বেলা কী হবে? সিদ্ধান্ত হলো, এই ধ্বনিগুলির পেছনে কোন নিত্য শব্দদ্রব্য নেই, এই ধ্বনিগুলি বায়ুর গুণ। কেবল অর্থবহ ভাষায় প্রযুক্ত, ভাষার সংঘটক বর্ণরূপ শব্দগুলিই নিত্য।

কিন্তু বর্ণ নিত্য হলেই কি বেদবাক্যের নিত্যত্ব সিদ্ধ হয়? বাক্য নিত্য হতে হলে বাক্যের অন্তর্গত শব্দগুলিও নিত্য হতে হবে। কিন্তু বর্ণ ও শব্দ নিত্য হলেও বাক্য নিত্য হবে এমন কোনো কথা নেই। বাক্য রচনা বক্তার ইচ্ছাধীন, একটা সমগ্র অর্থপ্রকাশের প্রয়োজনে বক্তা শব্দগুলিকে নানাভাবে সাজিয়ে বাক্য রচনা করে।  বাক্যের অন্তর্গত শব্দগুলি ‘পদ’ বলে পরিচিত। মীমাংসকদেরকে প্রথম ধাপে বর্ণের নিত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করতে হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আসে পদনিত্যতার প্রশ্ন। মীমাংসামতে বর্ণগুলি নিত্য। কিন্তু বর্ণগুলি স্বতন্ত্রভাবে কোনো অর্থপ্রকাশ করে না। ক, খ বা গ-এর কোনো অর্থ নেই। শব্দের অর্থ পেতে হলে বর্ণগুলিকে বিভিন্ন ক্রমে সাজাতে হয়। এভাবে বর্ণের বিভিন্ন ক্রমিক সন্নিবেশ, সংস্থান বা পরিপাটিকেই সাধারণভাবে অর্থবহ শব্দ বা পদ বলা হয়। ক্রমের আরেক নাম ‘আনুপূর্বী’। একই বর্ণসমষ্টি বিভিন্ন ক্রমে সাজালে বিভিন্ন অর্থের বাহক বিভিন্ন পদ পাওয়া যায়। যেমন, ‘বন’ (ব্-অ-ন্-অ) এবং ‘নব’ (ন্-অ-ব্-অ)। বর্ণসমষ্টি একই, কিন্তু ক্রমভেদে শব্দ আলাদা হলো, অর্থও আলাদা হলো।

এ প্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন মীমাংসকদের সংকটে ফেলেছে তা হলো, বর্ণগুলির এই বিভিন্ন ধরনের ক্রমিক সন্নিবেশ যা অর্থবহ শব্দরূপে সমাজে পরিচিত, এই সন্নিবেশগুলি কি নিত্য, অর্থাৎ পদগুলি কি নিত্য? কেননা, পদগুলিকে নিত্য বলে স্বীকার না করলে বেদবাক্যকে নিত্য অপৌরুষেয় বলা চলে না। আবার পদগুলিকে নিত্য বললে, আলাদা করে বর্ণগুলিকে নিত্য বলার কোনো মানে হয় না। সমাজে ব্যবহৃত অর্থবহ শব্দগুলি যদি নিত্য ও অনাদি হয় তার মানে দাঁড়াচ্ছে- ক্রমানুপাতী বর্ণসমষ্টি-রূপ শব্দ থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে বর্ণগুলির পৃথক অস্তিত্বের কোনোদিন কোনো অবকাশ ছিলো না। পদ বা শব্দগুলি নিত্য হলে একথা আর বলা চলবে না যে বিভিন্ন বর্ণগুলিকে বিভিন্ন ক্রমানুসারে জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন পদ তৈরি হয়েছে। অংশগুলি জোড়া লাগিয়ে যা তৈরি হয় তা আবার নিত্য হয় কী করে?

বর্ণনিত্যতাবাদী মীমাংসকরা এ প্রশ্নের প্রাথমিক উত্তরে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বলেন, পদগুলি বিভিন্ন ক্রমসন্নিবিষ্ট বর্ণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ক্রমবিশিষ্ট বর্ণসমূহকেই পদ বলে। তাই ক্রমবিশিষ্ট বর্ণই অর্থের বাচক। সুতরাং বর্ণ নিত্য হলে পদও নিত্য হবে, ক্রম এবং ক্রমিকভাবে সাজানো বর্ণ এই দুয়ের মধ্যে বর্ণই হলো প্রধান এবং বিশেষ্য, ক্রম হলো অপ্রধান এবং বিশেষণ। তাই বর্ণবিশিষ্ট ক্রমকে অর্থবোধক পদ না বলে ক্রমবিশিষ্ট বর্ণকে অর্থবোধক পদ বলা উচিত। কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা হলো, ক্রমবিশিষ্ট বর্ণকে পদ বলা হবে, না বর্ণবিশিষ্ট ক্রমকে পদ বলা হবে, কোনটা বিশেষ্য আর কোনটা বিশেষণ, তার বিধিগমনা বা ক্রাইটেরিয়া কী। বরং ক্রমের প্রাধান্যটাই তো স্বাভাবিক। ইতস্তত ছড়ানো ক, খ, গ বর্ণগুলি নিত্যই হোক আর অনিত্যই হোক, ওগুলির দ্বারা কোনো অর্থই বোঝা যায় না, পৃথকভাবে এদের কোনো অর্থ নেই। বিভিন্ন ক্রমে সাজালেই সেই ক্রমিক সন্নিবেশ বা সংস্থান থেকেই অর্থটা পাওয়া যায়। তাই ক্রমিক বর্ণকে অর্থবহ শব্দ না বলে বর্ণক্রমটাকেই অর্থের বাচক বলা অধিক সংগত। বর্ণ নিত্য হলেও, ক্রমটাও যে নিত্য হবে তার কোনো যুক্তি নেই। কোনো আদিম যুগের মানুষ হয়তো বর্ণগুলিকে বিভিন্ন ক্রমে সন্নিবিষ্ট করে বিভিন্ন শব্দের সৃষ্টি করেছে।

এসব বিবেচনা করে অগত্যা কুমারিলকে পদনিত্যতার ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে আলোচিত ব্যবহারিক নিত্যতা বা প্রবাহনিত্যতার আশ্রয় নিতে হয়েছে, “অর্থবহ শব্দগুলি মনুষ্যসমাজে অনাদি-ব্যবহার সিদ্ধ। পূর্ব-পূর্বপুরুষ-পরম্পরাগত শব্দগুলি পরপর পুরুষানুক্রমে ব্যবহৃত হয়ে এসছে। কে বা কারা শব্দগুলি সৃষ্টি করেছিলো, বিভিন্ন ক্রমানুসারে বর্ণগুলি সাজিয়েছিলো তা কেউ বলতে পারে না, এর কোনো মূল আরম্ভ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই পদগুলিও অনাদি নিত্য।” (শ্লোকবার্ত্তিক: শব্দনিত্যতা শ্লোক-২৮৭-৮৯)।

ব্যবহারিক নিত্যতা বোঝাতে ভাট্টমীমাংসক পার্থসারথিমিশ্র একটি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, ‘অনিদংপ্রথমত্ব’- অর্থাৎ এটাই কোন শব্দের প্রথম ব্যবহার একথা বলা যায় না। মীমাংসামতে ক, খ, গ প্রভৃতি বর্ণগুলো কূটস্থ নিত্য, অর্থাৎ অবিকৃত, সর্বব্যাপী, নিত্য পদার্থ, যার কোন পরিবর্তন নেই। এই কূটস্থ নিত্য বর্ণগুলো বিভিন্ন ক্রমানুসারে সন্নিবিষ্ট হয়ে ক্রমিক উচ্চারণ ধ্বনির দ্বারা অভিব্যক্ত হয়। কিন্তু ভাষার ইতিহাসে কোন সর্বপ্রথম মূল উচ্চারণ বা উচ্চারয়িতা নিরূপণ করা অসম্ভব। ক্রমসন্নিবেশের পূর্বেও বর্ণগুলি ছিলো, না হলে ক্রমটা হবে কাদের নিয়ে ? কুমারিলের ভাষ্য অনুযায়ী কেবল আদি জানা যায় না বা জানার উপায় নেই বলে অর্থবহ পদগুলোকে অনাদি নিত্য বলা হয়েছে। বেদ বাক্যগুলোও এভাবে নিত্য।

মানুষ যে বাক্যগুলো রচনা করে, তা অভ্রান্ত নয়। কিন্তু বেদবাক্য অভ্রান্ত বলে মীমাংসকরা স্বীকার করেন। বেদবাক্যের কোনো রচয়িতা আছে বলে কেউ স্মরণ করতে পারে না, ঋষি-পরম্পরায় অনাদি স্মরণাতীত কাল থেকে চলে এসেছে। তাই মানুষের বাক্য অনিত্য হলেও বেদবাক্য নিত্য অপৌরুষেয়। মীমাংসকদের এই যুক্তি অনুসারে বেদনিত্যতা কিন্তু বিশুদ্ধ নিত্যতা নয়। বিশুদ্ধ নিত্যতা হলো বিকারহীন অপরিবর্তনীয় নিত্যতা যাকে বলা হয় ‘কূটস্থ’ নিত্যতা। বেদবাক্য কূটস্থ নিত্য নয়। এদের ব্যবহারিক নিত্যতা বা প্রবাহনিত্যতাই স্বীকার্য। বর্ণগুলি যে আগে থেকে চিরকালই ছিলো, ক্রমটা অর্থাৎ বর্ণক্রমরূপ শব্দগুলি পরে এসেছে তা শ্লোকবার্ত্তিকে কুমারিল অন্যভাবে বলে দিয়েছেন, “নিত্য পরমাণুগুলি বরাবর আগে থেকে রয়েছে বলেই তো ঘটপ্রভৃতি বস্তু তৈরি করা সম্ভব। উপাদানগুলি আগে থেকে না থাকলে বস্তুরচনা হবে কী দিয়ে ? তাই বর্ণগুলির কূটস্থ নিত্যতাই স্বীকার করতে হবে, ব্যবহারিক নিত্যতামাত্র নয়।” (শ্লোকবার্ত্তিক: ২৯০-৯২)

পরে এসেছে মানেই হলো কোনো এক সময় উৎপন্ন হয়েছে, শুধু কবে প্রথম শুরু হয়েছে বলা যায় না, অর্থাৎ ‘অনিদংপ্রথমত্ব’। এরই নাম ব্যবহারিক নিত্যতা। কুমারিল প্রদত্ত পরমাণু ও ঘটের দৃষ্টান্ত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শেষপর্যন্ত বৈদিক বাক্যেরও মূল আছে, এবং এই মূল হলো নিত্য উপাদানস্বরূপ বর্ণসমূহ। কেননা, উপাদানকে নিশ্চয়ই ‘উপাদেয়’ ক্রমরচনার পূর্বে থাকতে হবে। পদ যদি ব্যবহারিক নিত্য হয় তবে পদ-সমষ্টিরূপ বেদবাক্যও ব্যবহারিক নিত্যই হবে। সুতরাং বর্ণগুলো যে অর্থে কূটস্থ নিত্য বা বৈশেষিকের পরমাণু যে অর্থে নিত্য, বেদবাক্যকে সে অর্থে নিত্য বলা যাবে না। তাছাড়া বৈদিক পদ ও তার অর্থ যে লৌকিক সংস্কৃত পদ ও তার অর্থ থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়, একথা স্বয়ং শবরস্বামী স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “বৈদিক পদ ও তার অর্থ লৌকিক সংস্কৃত পদ ও তার অর্থ থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়।” (শাবরভাষ্য: মীমাংসাসূত্র-১/৩/৩০)। তার মানে, বেদের নিত্যতাও অর্থবহ পদ বা শব্দের মতো ব্যবহারপ্রসিদ্ধ। নিত্য বর্ণগুলি হলো পদ ও বাক্যের মৌলিক উপাদান, ফলে এরা বেদবাক্যেরও উপাদান, বৈদিক শব্দার্থ ও লৌকিক শব্দার্থ অভিন্ন।

তাহলে লৌকিক বাক্য থেকে বেদবাক্যের প্রভেদ কোথায় তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রভেদটা এখানে যে, লৌকিক বাক্যে লোকে খুশিমতো পদগুলির পরিপাটি রচনা করে, নতুন নতুন বাক্য রচনা করতে পারে, কিন্তু বৈদিক বাক্যের পদক্রম পরিবর্তন করার কোন স্বাধীনতা আমাদের নেই। কারণ কুমারিল বলছেন, “বৈদিক বাক্যের ক্রম অথবা ব্যবহার্য শব্দের ক্রমের কেউ যদি যথেচ্ছভাবে পরিবর্তন করতে, অর্থাৎ ওলটপালট করে পদ বা বর্ণগুলি সাজাতে চান আমরা তার তীব্র বিরোধিতা করবো।” (শ্লোকবার্ত্তিক: শব্দনিত্যতা শ্লোক-২৯০)। সুতরাং শবরস্বামী ও কুমারিলের এসব কথা মনে রাখলে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে, বেদের নিত্যতা আসলে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহনিত্যতামাত্র। নিত্যবর্ণের মতো তা বেদবাক্য কূটস্থ নিত্য নয়। এবং বেদের কাল ও রচয়িতা নিরূপণ করা যায় না, তাই বেদ নিত্য অপৌরুষেয়।

অভিহিতান্বয় ও অন্বিতাভিধান

শব্দপ্রমাণ বা বেদবাক্যের নিত্যতা সিদ্ধ করতে গিয়ে শব্দ, বর্ণ, পদ ও শব্দার্থ বিচারের পর মীমাংসকদেরকে বাক্যার্থের বিচারে উপনীত হতে হয়। ভাট্ট-মীমাংসামতে শব্দপ্রমাণ হলো বাক্যার্থজ্ঞান। একাধিক শব্দ বা পদ পরস্পর বাক্যার্থজ্ঞানে অন্বিত হয়ে যে সামগ্রিক অর্থ প্রকাশ করে তাই বাক্যার্থ। শব্দার্থকে বলা হয় অভিধান। কোন শব্দের দ্বারা যে বস্তু বা ধারণাকে বোঝায় তা হলো ঐ শব্দের অভিধেয়। পদের এই অভিধার প্রকাশ এবং অন্বয় সম্পর্কে ভাট্ট ও প্রাভাকর সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শব্দের অর্থ কীভাবে প্রকাশিত হয় – এর উত্তরে ভাট্টসম্মত শাব্দজ্ঞানের লক্ষণ দিতে গিয়ে নারায়ণ ভট্ট বলেছেন, “প্রথমে পদগুলি জ্ঞানের বিষয় হয়। সেই পদগুলি জ্ঞাত হলে পদের অর্থের স্মরণ হয়। পদার্থের স্মরণের পর অসন্নিকৃষ্ট বাক্যার্থের যে জ্ঞান হয়, তাকেই শাব্দপ্রমা বলে।” (মানমেয়োদয়)

শব্দপ্রমাণ হলো বাক্যার্থজ্ঞান। একাধিক পদ পরস্পর বাক্যার্থজ্ঞানে অন্বিত হয়ে যে সামগ্রিক অর্থ প্রকাশ করে, তাই বাক্যার্থ। যে বাক্যের অর্থ পূর্বে জানা ছিলো না বা যে বাক্যার্থের বাধজ্ঞান থাকে না, সেরূপ বাক্যার্থকে অসন্নিকৃষ্ট বাক্যার্থ বলে, ঐরূপ বাক্যার্থজ্ঞানই শাব্দপ্রমা। যে বাক্যার্থ পূর্বে জ্ঞাত হয়েছিলো (সন্নিকৃষ্টার্থ) সেরূপ বাক্যার্থজ্ঞান অনুবাদস্বরূপ হওয়ায় তা আর প্রমা হয় না। আর যে বাক্যার্থের জ্ঞান বাধিত হয়, সেই বাক্যার্থজ্ঞান ভ্রমাত্মক হয় বলে তা প্রমা হয় না। এজন্য অসন্নিকৃষ্টার্থ বাক্যার্থজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে।

ভাট্টমতে শব্দার্থের জ্ঞান না হলে বাক্যার্থজ্ঞান হতে পারে না। বাক্য হচ্ছে- পদসমষ্টি। পদসমূহের অর্থজ্ঞান বাক্যার্থজ্ঞানের হেতু, শুধু পদ বা বাক্য বাক্যার্থজ্ঞানের হেতু নয়। আবার বাক্য না শুনেও অনেক সময় বাক্যার্থের জ্ঞান হতে পারে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে কুমারিল বলেন, “এক ব্যক্তি দূর থেকে শাদা রং-এর কোনও প্রাণী দেখে প্রাণীটিকে চিনতে পারলো না। তার শুধু শ্বেতগুণরূপ পদার্থের জ্ঞান হলো। এরপর সেইদিকেই হ্রেষাশব্দ শুনতে পেয়ে শ্বেতবর্ণ প্রাণীটিকে ঘোড়া বলে অনুমান করলো। পরে খুরনিক্ষেপের শব্দ শুনতে পেয়ে লোকটি বুঝলো- (ঘোড়াটি) দৌড়াচ্ছে। তখন লোকটি তিনটি পদার্থের সম্বন্ধকে অর্থাপত্তিপ্রমাণের দ্বারা গ্রহণ করে বুঝলো যে, শাদা ঘোড়াটি দৌড়াচ্ছে। এই জ্ঞানের মূলে কোন বাক্য না থাকলেও তা বাক্যার্থজ্ঞান।” (শ্লোকবার্ত্তিক)। তাই তার মতে বাক্য বা পদ বাক্যার্থজ্ঞানের হেতু নয়, বরং পদার্থজ্ঞানই বাক্যার্থবোধের হেতু। পদসমূহ আপন আপন অর্থ বুঝিয়ে নিবৃত্ত হয়ে যায়। অন্য কিছু বোঝাতে তাদের সামর্থ্য থাকে না। তাই বলা হয়, শব্দ, বুদ্ধি এবং ক্রিয়া তাদের ব্যাপার অর্থাৎ কার্য একবার নিবৃত্ত হলে আর ব্যাপার হয় না। আর তাই নিজের অর্থ বুঝিয়ে শব্দের অভিধার কার্য নিবৃত্ত হয়ে যায়, এজন্য তা আর বাক্যার্থের বোধক হতে পারে না। এ কারণেই পদ বা বাক্য বাক্যার্থের বাচক হতে পারে না। মীমাংসক কুমারিলের মতে, কি লৌকিক কি বৈদিক সকল পদই অন্য পদের অপেক্ষা না রেখেই একটি অর্থ প্রকাশ করে। সে অর্থ অভিধাবৃত্তি থেকে লাভ করা যায়, আর অভিধা থেকে পদের যে অর্থজ্ঞান হয় সেই জ্ঞানই অভিধান। এভাবে একাধিক পদ শুনলে প্রথমতঃ প্রত্যেক পদের অর্থের জ্ঞান হয়। পরে পদার্থগুলি (বিভিন্ন পদের অর্থগুলি) বিশেষ্য-বিশেষণভাবে পরস্পরের সাথে অন্বয় সম্বন্ধ হয়। পদের দ্বারা অভিহিত পদার্থগুলি পরে জ্ঞানের বিষয় হয়ে বাক্যার্থ জ্ঞান জন্মায়। বাক্যের প্রত্যেক পদের অর্থের সাথে অপর পদের অর্থের যে পারস্পরিক অন্বয় হয়, তার নামই অভিহিতান্বয়। পরস্পরের এই অন্বয় সম্ভব হয় বিশেষ্য-বিশেষণ ভাবের দ্বারা। কুমারিলের এই মতবাদ অভিহিতান্বয়বাদ নামে পরিচিত। মোটকথা, কুমারিলের অভিহিতান্বয়বাদ হলো- প্রত্যেকটি শব্দের পৃথক পৃথক অর্থ পূর্বে নির্ধারণ করে পরে স্বতন্ত্র অর্থযুক্ত শব্দগুলি সাজিয়ে বাক্য রচনা করা হয়। স্বয়ং ভাষ্যকার শবরস্বামীর ঝোঁকও মনে হয় অভিহিতান্বয়বাদেরই পক্ষে। কেননা তিনি তাঁর শাবরভাষ্যে এ বিষয়ে বলেছেন, “স্বতন্ত্র অর্থযুক্ত পদগুলির পাস্পরিক অন্বয়েই বাক্যার্থের জ্ঞান জন্মায়, যার সাথে লৌকিক ও বৈদিক পদ এবং পদার্থের মধ্যে কোন ভেদ নেই।… শব্দের দ্বারা বাক্যরচনার পূর্বে স্বতন্ত্রভাবে ‘অভিহিত’ বা বোধিত অর্থগুলি ‘অন্বিত’ বা পরস্পরসম্বন্ধ হয়ে বাক্যার্থ সংঘটিত হয়। “(মুক্ততর্জমা)

অন্যদিকে মীমাংসক প্রভাকর অভিহিতান্বয়বাদ সমর্থন করেন নি। তিনি অন্বিতাভিধানবাদী। তার মতে, শব্দগুলি কোন-না-কোন বাক্যের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত বা সম্বন্ধ হয়েই নিজ নিজ অর্থ প্রকাশ করতে পারে, অসম্বন্ধ বা অনন্বিত অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে কোন অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থাৎ, পদার্থের জ্ঞানের জন্য পদকে পদের ক্রিয়ার সঙ্গে আগে অন্বিত হতে হয়। অন্বিত শব্দেরই শক্তিগ্রহ হয়। প্রথমে পদসমূহের দ্বারা পদার্থসমূহের পৃথক পৃথক অন্বয় হয়। এভাবে পদার্থের (পদের অর্থের) জ্ঞান হয়। পদার্থের জ্ঞান তাই অন্বয়সাপেক্ষ। গুরু প্রভাকর স্বীকৃত অন্বিতাভিধানবাদ মতে, ক্রিয়ার সাথে অন্বিত না হলে কোন পদেরই অর্থজ্ঞান হয় না। অন্বয়শক্তিও পদসমূহে অবস্থিত। ক্রিয়ার সাথে অন্বিত পদেরই অর্থজ্ঞান হয় বলে এই মতের নাম অন্বিতাভিধান। এই মতে একাধিক পদের দ্বারা পরস্পর নিরপেক্ষভাবে একাধিক পদার্থের জ্ঞান হতে পারে না। বিভক্ত্যন্ত একটি পদের অর্থের সাথে অন্বিত অর্থাৎ বিশেষ্য-বিশেষণরূপ সম্বন্ধে অন্য একটি পদার্থই অনুভবের বিষয়ীভূত হয়। দুটি পদের দ্বারা স্বতন্ত্ররূপে দুটি পদার্থের অনুভব হয় না। পরস্পর অন্বিতের অভিধানকেই অন্বিতাভিধান বলা হয়েছে। প্রভাকর অন্বিতাভিধানকে বলেছেন- ‘ব্যতিষক্তার্থাভিধান’। ব্যতিষক্ত হলো- ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পর সম্বন্ধ শব্দার্থ। যারা অন্বিতাভিধানের তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম, প্রভাকর তাদের বিদ্রূপ করে বলেছেন, “মাতৃস্নেহের অতিরিক্ত আকর্ষণে আপনি বেশিদিন গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাভ্যাস করতে পারেন নি, তাই পদ ও পদার্থের তত্ত্ব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ রয়ে গেছেন।” (বৃহতী-মীমাংসাসূত্র-১/১/২৫)।

প্রাভাকর-মতাবলম্বীরা তাদের এই অন্বিতাভিধান সিদ্ধান্তের সমর্থনে শব্দার্থবিষয়ে অজ্ঞ শিশুর প্রাথমিক শব্দার্থবোধের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন (সূত্র: সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-৩২), “কোন ব্যক্তি তাঁর ভৃত্যকে আদেশ করলেন- ‘গরুটি আন’। এখানে শব্দার্থ বিষয়ে যার জ্ঞান নেই, সেই নিকটস্থ শিশু বাক্যটি শুনলো এবং আদেষ্টা ও আদিষ্ট ব্যক্তিকে দেখলো। সে গরুর আনয়নরূপ কর্মটিও প্রত্যক্ষ করলো। এই বাক্যটি শুনেই যে আদিষ্ট ব্যক্তি আদেষ্টার অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছে, তাও শিশুটি আদিষ্ট কর্তৃক গরুটি আনয়নরূপ শারীরিক চেষ্টা দেখে অনুমান করলো। আদেষ্টার বাক্যের সাথে গরুর আনয়নরূপ কর্মের যে বাচ্যবাচকত্ব সম্বন্ধ রয়েছে, তাও শিশুটি অর্থাপত্তি-প্রমাণের দ্বারা বুঝতে পারলো। (যেহেতু এই বাক্যের বাচকতা না থাকলে আদিষ্ট কর্তৃক গরুটি আনয়নরূপ অর্থের জ্ঞান হতো না।) পরে এই প্রত্যক্ষ, অনুমান ও অর্থাপত্তি প্রমাণের বলে এবং গরুশব্দসত্ত্বে এই প্রাণীর সত্তা এবং আনয়নশব্দসত্ত্বে সমীপীকরণের সত্তা প্রভৃতি অন্বয়ব্যতিরেকবলে শব্দগুলির সঙ্কেত বা শক্তি শিশুটি জানতে পারলো।” এতে বোঝা যাচ্ছে, অন্বিত পদার্থের দ্বারাই প্রাথমিক শব্দার্থজ্ঞান হয়ে থাকে। একটি পদের অর্থমাত্রের দ্বারা লোকব্যবহার নিষ্পন্ন হয় না। বাক্যস্থিত পদসমূহের অর্থ সর্বদাই অপর পদার্থে অন্বিত। কিন্তু অভিহিতান্বয়বাদী ভাট্ট-মীমাংসকরা, এবং সাধারণভাবে আমাদেরও মনে হয় যে, শিশুকাল থেকে আমরা এক একটি বিচ্ছিন্ন শব্দের ‘বিশুদ্ধ’ বিচ্ছিন্ন অর্থ শিখি (যেমন একে গাছ বলে, একে ফুল বলে ইত্যাদি), তারপর এগুলি মিশিয়ে বাক্যরচনা শিখি। দু-চারটি শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্বন্ধ এভাবে শিশু শেখে বটে। কিন্তু শিশুকাল থেকে আমরা যে শত শত শব্দের শত শত অর্থ শিখি তার কটা এভাবে শেখানো সম্ভব? অথচ আমাদের অজান্তে শিশু যে কয়েক ডজন শব্দ কখোন ব্যবহার করতে শিখলো, তা ভেবে আমরা অবাক হয়ে যাই। অথচ শিশু কিন্তু এসব শিখে পরিবার-পরিজনের কথাবার্তা শুনে, বিশেষত বড়োদের বাক্যাকারে কথাবার্তার সঙ্গে কোনো-না-কোনো কাজের যোগাযোগ লক্ষ্য করে। প্রভাকরপন্থী মীমাংসকরা এ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন প্রাচীন লোকায়ত কৃষিসমাজের উপযোগী কোন প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের দ্যোতক কার্যকলাপ থেকে। ‘ধরুন বাবা বড়ো ছেলেকে বলল- ‘গাম্ আনয়’ (গরুটাকে নিয়ে এস)। পাশের ছোটো খোকা দেখল বাক্যটি বলার সঙ্গে সঙ্গে দাদা একটা শিংওয়ালা চারপেয়ে প্রাণী নিয়ে এল। শিশু সম্পূর্ণ বাক্যটির একটা সম্পূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পর্ক আন্দাজ করল। বাক্যের অন্তর্গত শব্দগুলির পৃথক অর্থ এখনও সে বোঝেনি, অর্থাৎ ‘গাম্’ মানে ‘গরুটাকে’ এবং ‘আনয়’ মানে ‘নিয়ে এস’ এরকম ধারণা তার এখনও হল না। এখন ধরুন বাবা বলল- ‘গাম্ বধান’ (গরুটাকে বেঁধে রাখ), ‘অশ্বম্ আনয়’ (ঘোড়াটাকে নিয়ে এস)। বড়ো ছেলে বাবার আদেশ পালন করল। কয়েকবার এরকম কথা ও কাজের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে শিশু লক্ষ করল বাক্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দাদার কাজের পরিবর্তন ঘটছে, আরও লক্ষ করল, প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যের মধ্যে ‘গাম্’ শব্দটি একই থাকছে, কিন্তু ‘আনয়’-এর স্থানে ‘বধান’ এসে যাচ্ছে, একই বস্তুর (প্রাণীর) সম্বন্ধে দুরকম কাজ হচ্ছে। আবার তৃতীয় বাক্যটিতে ‘গাম্’-এর স্থানে ‘অশ্বম্’ এসে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বাক্যের ‘বধান’ চলে যাচ্ছে, তার জায়গায় প্রথম বাক্যের ‘আনয়’ আবার ফিরে আসছে, তৃতীয় কাজটা প্রথম কাজের অনুরূপ হচ্ছে। এভাবে বাক্যের অন্তর্গত শব্দের যোগবিয়োগ (আবাপ-উদ্বাপ) এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কাজের পরিবর্তন বার বার লক্ষ করে পাশের শিশুটি ‘গাম্, অশ্বম্, আনয়, বধান’ প্রভৃতি পদের পৃথক অর্থ বুদ্ধির দ্বারা বিশ্লিষ্ট করে একরকম আন্দাজ করে নিল, পরে নিজেও অনুরূপ পরিস্থিতিতে অনুরূপ বাক্য ব্যবহার করতে শিখল- ‘দাদা, গোরুটাকে নিয়ে এস, গোরুটাকে বেঁধে রাখ, ঘোড়াটাকে নিয়ে এস।’ বলা বাহুল্য, শিশুর এই বিশ্লেষণী বুদ্ধি ন্যায়শাস্ত্র পাঠ করে হয়নি। শিশুর এটা ‘স্বভাব ন্যায়’ বা instructive logic। কিন্তু শাস্ত্রকাররা শিশুর এ জাতীয় বুদ্ধিবিকাশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন ভাষা প্রয়োগ করেন যাতে মনে হতে পারে শিশুও বোধ হয় বড়োদের মতো ‘অনুমান’ করছে, যেন সচেতনভাবে ন্যায়বুদ্ধির প্রয়োগ করছে।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৩০)।

এখানে আরেকটা বিষয়ও লক্ষ্য করতে হয়, শিশু যখন এরূপ ‘বৃদ্ধব্যবহার’ শোনে বা দেখে, তখন কিন্তু বাক্যবিযুক্ত বা শব্দান্তরের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি ‘বিশুদ্ধ’ ‘গো’-শব্দ এবং তার অর্থরূপে অন্য বস্তু বা ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য একটি বিশুদ্ধ ‘গরু’, যে গরু শোয় না, বসে না, হাঁটে না, দৌড়ায় না, খায় না, যে গরু কেবল নিছক গরু মাত্র, এমন একটি নিঃসঙ্গ গোশব্দ এবং নিঃসঙ্গ গো-পদার্থ শিশু কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। বরং শিশুর মনে স্বাভাবিকভাবে এ ধারণাই জন্মে যে কোনো শব্দ অন্য কোনো শব্দের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই আত্মপ্রকাশ করে এবং শব্দার্থও অন্য কোনো শব্দার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়েই প্রকাশিত হয়- এক কথায়, পরস্পরসম্বন্ধ শব্দ পরস্পরসম্বন্ধ অর্থ প্রকাশ করে। জগতের বস্তুসমূহ পরস্পর-সম্বন্ধ বলেই মানুষের ভাষাতেও শব্দগুলি পরস্পরসম্বন্ধভাবে বাক্যাকারে উচ্চারিত হয়। এখনকার শিশুরাও এভাবেই শেখে। পরিবার পরিজনের মধ্যে শিশু অনবরত কথার সঙ্গে কজের সম্বন্ধ লক্ষ্য করে, শব্দ-পরিবর্তনের আনুষঙ্গিকরূপে কার্যপরিবর্তন লক্ষ্য করে। এভাবে কার্যান্বিতরূপে শব্দার্থের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। এই লোকব্যবহারের সাথে অন্বিতাভিধানবাদী প্রভাকর-মতের সংগতি পরিলক্ষিত হয়। লোকব্যবহারে কোন শব্দার্থ যেহেতু বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞানে প্রতিভাসিত হয় না, অন্য কোন শব্দার্থের সঙ্গে অন্বিত রূপেই প্রতিভাসিত হয়, সেহেতু পরস্পরসম্বন্ধ শব্দার্থসমূহই বাক্য, তৎ-অতিরিক্ত বাক্য বলে কিছু নেই। এ পর্যায়ে এসে যে অনিবার্য প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো, ভাষার ব্যাকরণশাস্ত্রের নিয়মগুলি তাহলে কোন প্রক্রিয়া মেনে চলে? ব্যাকরণের নিয়মে অর্থবহ শব্দ বলতে কী বোঝায় তার বিচারও আবশ্যক মনে হয়।

অর্থবহ শব্দ নিয়ে ভর্তৃহরির মত

প্রচলিত ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব পড়ে স্বাভাবিকভাবেই একটা ধারণা জন্মে যে, বর্ণগুলি যোগ করে শব্দগুলি তৈরি হয়েছে, যেমন- আম = আ + ম্ + অ, কিংবা বক = ব্ + অ + ক্ + অ, ইত্যাদি। কিন্তু- ‘এ ধারণা ভ্রান্ত। শব্দের মূল যদি বর্ণ হয়, বর্ণ থেকেই যদি অর্থবহ শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকে, তাহলে এর তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে- মানুষের ভাষার এমন একটা আদিম অবস্থা ছিল যখন মানুষ জাগতিক বস্তু বোঝাবার জন্য বা মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য শুধু অ, আ, ক, খ জাতীয় পৃথক পৃথক বর্ণগুলিই ব্যবহার করত, এই বর্ণগুলির প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র অর্থ ছিল এবং কালক্রমে এই বর্ণগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে বিভিন্ন অর্থবহ শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থবহ শব্দের আদিমতম রূপ হল এক একটি স্বতন্ত্র বর্ণ। যে কোন ভাষার শব্দসম্পদের তুলনায় বর্ণসম্পদ অতি সীমিত। তাহলে আদিম মানুষকে একটি বর্ণের দ্বারা অসংখ্য বস্তু বুঝতে ও বোঝাতে হত। কিন্তু ভাষার আদিমতম ইতিহাসে অর্থবহ শব্দরূপে কেবল এক একটি স্বতন্ত্র বর্ণমাত্র ব্যবহার করা হত, সমগ্র একটি শব্দের ব্যবহার হত না, এহেন বিচিত্র কল্পনা খুবই কষ্টকর।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৩)।

দার্শনিক জগতের পরম বিস্ময় ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থের প্রণেতা ব্যাকরণ দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রামাণিক প্রবক্তা মহাবৈয়াকরণ ভর্ত্তৃহরি বলেন যে, মানুষ চিরদিন অর্থ বোঝাতে একটা গোটা শব্দই ব্যবহার করতো, শব্দ থেকে বিশ্লিষ্টরূপে এক একটা বর্ণমাত্র ব্যবহার করতো না। এই মতকে মীমাংসক ও নৈয়ায়িকরাও স্বীকার করেন। তাহলে এর তাৎপর্য দাঁড়াচ্ছে, মানুষের ব্যবহারসিদ্ধ শব্দরূপের উপস্থিতির পূর্বে শব্দের অবয়বরূপে পরিকল্পিত বর্ণগুলির কোনদিন বাস্তব উপস্থিতি ছিলো না। অর্থাৎ প্রাকসিদ্ধ স্বতন্ত্র বর্ণগুলির যোগ-বিয়োগ বা ক্রম পরিবর্তন করে ব্যবহারযোগ্য অর্থবোধক শব্দরাশি সৃষ্টি করা হয়নি। কাজেই আম = আ + ম্ + অ নয়, কিংবা বক = ব্ + অ + ক্ + অ নয়। তার মানে, পরবর্তীকালে ভাষাতাত্ত্বিক বৈয়াকরণ ও শিক্ষাকারগণ ভাষায় ব্যবহৃত মূল শব্দ থেকে বিশ্লেষণী বুদ্ধির দ্বারা বর্ণগুলিকে পৃথক করে বোঝার চেষ্টা করেছেন- এভাবে এক একটি ভাষার ‘বর্ণমালা’ সৃষ্ট হয়েছে। সুতরাং শব্দ থেকেই বর্নের উৎপত্তি হয়েছে। বর্ণ থেকে শব্দের উৎপত্তি হয়নি। অর্থ বোঝাবার জন্য মানুষ যদি চিরকাল ধরে একটা সমগ্র শব্দই ব্যবহার করে এসে থাকে, কোনদিন স্বতন্ত্রভাবে পৃথক পৃথক এক একটি বর্ণ ব্যবহার না-করে থাকে, তাহলে ভর্ত্তৃহরির এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে উপায় নেই যে- ‘শব্দ অখণ্ড’। তাই শব্দ একটি পূর্ণরূপ যার বৌদ্ধিক বিশ্লেষণের দ্বারা বৈয়াকরণ ও শিক্ষাকারগণ অংশাকারে বর্ণগুলি কল্পনা করেছে। পূর্ণই বাস্তব, পূর্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ বুদ্ধি-পরিকল্পিত। ‘বৌদ্ধ বিশ্লেষণের দ্বারা সমগ্র থেকে অংশকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র বস্তুরূপে কল্পনা করাকে ভর্ত্তৃহরি বলেছেন ‘অপোদ্ধার’। ভর্ত্তৃহরির অপোদ্ধার-তত্ত্ব ব্যাকরণ দর্শনের একটি মূল স্তম্ভ। ভর্ত্তৃহরি বিভিন্ন আলোচনা প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে বারবার এই তত্ত্বে উপনীত হয়েছেন। যে সমগ্র শব্দরূপের বৌদ্ধবিশ্লেষণের দ্বারা আমরা কাল্পনিক অংশে উপনীত হই ভর্ত্তৃহরি সেই সমগ্রকে বলেছেন ‘অন্বাখ্যেয়’ শব্দ (অনু-আখ্যেয় = পরে যাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা হয়)। ভর্ত্তৃহরি অপোদ্ধার তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে অন্বাখ্যেয় শব্দের উদাহরণ দিয়েছেন-  ‘ভবতি’। আমরা শিখে এসেছি ভূ ধাতুর সঙ্গে তি (তিপ্) প্রত্যয় (তিঙ্ বিভক্তি) যোগ করে ‘ভবতি’ ক্রিয়াপদটি গঠিত হয়েছে। তি বিভক্তির অব্যবহিত পূর্বে একটি অতিরিক্ত ‘অ’-কার এসেছে। ভূধাতুর দীর্ঘ ‘ঊ’টি ‘ও’-কারে পরিণত হয়েছে। ‘ও’-কারটির ‘অব্’ এ পরিণত হয়েছে। এত কান্ডের পর ‘ভূ’ ও ‘তি’ মিলে ‘ভবতি’ হয়েছে। (ভূ-তি > ভূ-অ-তি > ভো-অ-তি > ভ্-অব্-অ-তি > ভবতি)। বাস্তবে এ জাতীয় কোনোকিছুই ঘটেনি। কারণ, সংস্কৃত ভাষাভাষী আদিপুরুষরাও প্রথম থেকে ‘ভবতি’ পদটিই বলে এসেছে। মানুষ যা বলে তাই তো ভাষা। ভাষায় কোনোদিন শুধু ‘ভূ’ বা শুধু ‘তি’ বলে কিছু ছিল না। কাজেই ওদের প্রথম মিলন বলে কোনোকিছু ঘটেনি, ওরা চিরদিন মিলিতই ছিল। কেবল ‘ভূ’ বা কেবল ‘তি’ এর কোনো অর্থ নেই। ‘ভূ’ মানে হওয়া, আর ‘তি’ মানে কর্তৃকারক একবচন ও প্রথম পুরুষ, এসব কথা বৈয়াকরণের বৈঠকখানায় পরিশীলিত বিশ্লেষণী বুদ্ধির বস্তুহীন নিপুণ কল্পনা।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৫)।

এ প্রসঙ্গে অর্থবোধকতা সম্পর্কে স্বয়ং কুমারিলের একটি সর্ববাদীসম্মত বিখ্যাত সাধারণ নীতিবাক্য রয়েছে, “প্রকৃতি এবং প্রত্যয় মিলিতভাবে অর্থ প্রকাশ করে, স্বতন্ত্র বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ করে না।” এ প্রেক্ষিতে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন যে, এরই অনুষঙ্গ হিসেবে আরেকটি নীতিও এসে যায়, তা হলো- শুধু প্রকৃতি বা শুধু প্রত্যয় ভাষায় ব্যবহৃত হয় না। শব্দ ও শব্দার্থের নিরিখ হলো ভাষাগত সামাজিক ব্যবহার। তাহলে মেনে নেয়া হচ্ছে- মানুষের ভাষায় ‘ভূ’ এবং ‘তি’ কোনোদিন পৃথক সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি, পৃথক অর্থও কোনোদিন প্রকাশ করেনি। তাহলে এটাও মেনে নিতে হচ্ছে- ‘ভূ’ এবং ‘তি’ জোড়া লেগে ‘ভবতি’-রূপে পরিণত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ভাষার ইতিহাসে কোনোদিন ঘটেনি, মানুষের ব্যবহারিক বুদ্ধিগ্রাহ্য কোন পৃথক অর্থও এদের কোনোদিন ছিলো না। সুতরাং ‘ভবতি’ এই সমগ্র রূপটি এবং এর সমগ্র অর্থটি ব্যবহারসিদ্ধ অখন্ড সামাজিক সত্য। তাই মহাবৈয়াকরণ ভর্তৃহরি তার বাক্যপদীয় গ্রন্থে বলেন, “অকল্পিত সমগ্র শব্দরূপটি হলো ‘অন্বাখ্যেয়’; শাস্ত্রকারদের দ্বারা কল্পিত খণ্ডিত শব্দাংশ হলো ‘প্রতিপাদক’। সমগ্র শব্দের সমগ্র অর্থ হলো ‘স্থিতলক্ষণ’ (বস্তুত যা অবিভক্ত রূপে স্থিত, স্বরূপ থেকে অপ্রচ্যুত, লোকব্যবহারসিদ্ধ); কল্পিত খণ্ডিত অর্থাংশ হলো ‘অপোদ্ধার’।” (বাক্যপদীয়-১/২৪)

অপোদ্ধার শব্দের সাধারণ অর্থ কল্পিত বিভাগ। সমগ্র থেকে কল্পনায় খণ্ডিত করে যে অংশকে বের করে দেখানো হয় তাকেও অপোদ্ধার বলে; এখানে অপোদ্ধার মানে অপোদ্ধৃত। বস্তুত শব্দাংশ ও অর্থাংশ উভয়ই অপোদ্ধৃত। তাই ভর্ত্তৃহরির মতে ‘ভবতি’ হলো শব্দের ব্যবহারানুগত বাস্তব রূপ (অন্বাখ্যেয়)। ভূ-তি প্রভৃতি খন্ডিত রূপ হলো কল্পিত, ‘প্রতিপাদক’। তেমনি ‘ভবতি’ শব্দের সামগ্রিক অর্থটিই সত্য (স্থিতলক্ষণ)। ‘ভূ’-ধাতু মানে ‘হওয়া’, তি মানে ‘কর্তৃবাচ্যে প্রথম পুরুষ একবচন’ এরূপ বিভক্ত অর্থ অসত্য, কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় প্রয়োজনে শাস্ত্রকারদের দ্বারা পরিকল্পিত (অপোদ্ধার)। তাই ভর্ত্তৃহরির স্পষ্ট ঘোষণা, “ব্যাকরণ শাস্ত্রের প্রক্রিয়াগুলি অসত্য কাল্পনিক। পূর্বপদ, উত্তরপদ, প্রতিপদিক, ধাতু, প্রত্যয় এবং এদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক অর্থ- এ জাতীয় বহুপ্রকার বিভাগগুলি অসত্য, শাস্ত্রকারদের বিকল্পবুদ্ধিপ্রসূত অপোদ্ধার মাত্র। এজাতীয় বিভাগপ্রক্রিয়ার প্রদর্শন এব ধরনের প্রতারণা। তবু এ-জাতীয় মিথ্যা উপায়ের মাধ্যমেই ভাষাশিক্ষার্থী বালক উপেয় সত্যে উপনীত হয়।- (তর্জমা : হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-১২৭)। অসত্য কাল্পনিক উপায়ে সত্যে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হলো গাণিতিক চিহ্ন ও গানের স্বরলিপি। ১ ২ ৩ প্রভৃতি রেখাচিহ্নগুলি সংখ্যা নয়, সংখ্যার সঙ্গে চিহ্নগুলির সম্পর্ক অবাস্তব ও কাল্পনিক। কিন্তু ঐ রেখাচিহ্নগুলি ব্যবহার করে আমরা গণিত শিখে থাকি। গানের স্বরলিপি যেমন স্বর নয়, সুর নয়, তাল নয়; কিছু কাল্পনিক চিহ্নমাত্র। তবু ওগুলির মাধ্যমে গানের শুদ্ধ ধারণা জন্মে। তেমনি কোন ভাষা সম্পর্কে ধারণা করার জন্য বর্ণমালা, প্রকৃতি, প্রত্যয় প্রভৃতি কাল্পনিক বিভাগের সাহায্য নিতে হয়। ব্যাকরণ শাস্ত্র এই সাহায্যটুকু করে থাকে।

ভর্ত্তৃহরি কেবলমাত্র পদ ও পদার্থের অখণ্ডতার মধ্যেই তাঁর দার্শনিক সিদ্ধান্ত সীমাবদ্ধ রাখেন নি, তিনি আরও অগ্রসর হয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করেছেন- বাক্য ও বাক্যার্থের অখণ্ডতা। এ সিদ্ধান্তেরও প্রধান ভিত্তি হলো সামাজিক ব্যবহার। ভাষা মানুষের সামাজিক আত্মপ্রকাশ, যেখানে ব্যক্তির সামাজিক সত্তা সমাজের কাছে প্রকাশিত হয়, প্রমাণিত হয়। সমাজ-মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন নিছক বিশুদ্ধ ব্যক্তিসত্তা কোনদিন ছিলো না, আজও নেই। অনুরূপভাবে শব্দেরও একটা ‘সমাজ’ আছে। মানুষের পারিবারিক সমাজের মতো শব্দের প্রাথমিক সমাজ হলো বাক্য। বাক্যের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া কোন শব্দের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বাক্যার্থের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া স্বতন্ত্র অর্থও নেই। কারণ, মানুষের ভাষাগত সামাজিক ব্যবহার বাক্যের দ্বারা সম্পন্ন হয়, স্বতন্ত্র শব্দের দ্বারা নয়। তাই বাক্যসত্তার অতিরিক্ত শব্দসত্তা নেই। একথাই ভর্ত্তৃহরি একটি প্রসিদ্ধ শ্লোকের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন, “পদের মধ্যে কোন (পৃথক) বর্ণ নেই; বর্ণের কোন অবয়ব (অংশ) নেই; বাক্য থেকে পদগুলির কোন ঐকান্তিক ভেদ নেই।” (বাক্যপদীয়-১/৭৩)  

বাক্যের মতো বাক্যার্থও অখণ্ড। বাক্যার্থের অন্তর্গত পদার্থসমূহকে ভর্ত্তৃহরি বলেছেন ‘অত্যন্তসংসৃষ্ট’ (পরস্পর সর্বদাই অবিভক্ত)।  লোকব্যবহারের দিকে সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বাক্যার্থের মৌলিক চরিত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে ভর্ত্তৃহরি যে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ উক্তিটি করেন, তা হলো, “ক্রিয়াই হলো বাক্যার্থের আত্মা। ক্রিয়াই বাক্যার্থের ঐক্য ও বৈশিষ্ট্যের ধারক।” (স্বোপজ্ঞ বৃত্তি, বাক্যপদীয়-১/২৬)

সবদিক মিলিয়ে বিচার করলে মনে হয়, মীমাংসকদের বাক্যার্থসম্পর্কিত আলোচনার ন্যায়সংগত পরিণতি ঘটা উচিত ছিলো বৈয়াকরণসম্মত অখণ্ড বাক্যার্থবাদে। কিন্তু-
‘ভর্তৃহরির মত অনুসরণ করে একথা বোধ হয় বলা যায় যে- বর্ণসমষ্টিকে পদ বলে এবং পদসমষ্টিকে বাক্য বলে- এই মীমাংসক মত মূলত ভ্রান্ত, যদিও এজাতীয় কল্পনা দ্বারা ভাষা শেখার কাজটা চলে যায়, কারণ ব্যাকরণ-বিশ্লেষণ-পদ্ধতি কাল্পনিক হলেও অসত্য কল্পনার দ্বারা আমরা অনেক সময় সত্যে উপনীত হই। মীমাংসকদের পক্ষে বেদের প্রামাণ্যসিদ্ধির জন্য অপৌরুষেয়ত্ব সিদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে; আবার অপৌরুষেয়-নিত্যত্ব সিদ্ধির জন্য বর্ণের নিত্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে। কিন্তু শুধু বর্ণ-নিত্যতার দ্বারা বেদ-নিত্যতা প্রমাণিত হয় না, এজন্য পদ (শব্দ) ও বাক্যের নিত্যতা সাধন করা প্রয়োজন। তাই ক্রমসন্নিবিষ্ট বর্ণসমষ্টি ছাড়া অতিরিক্ত কোন পদ নেই, এ সিদ্ধান্ত বহাল রেখেও শব্দের ব্যবহারিক বা প্রবাহনিত্যতা স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু বাক্যের বেলা প্রবাহনিত্যতাও স্বীকার করা দুরূহ, কারণ বাক্যের ক্রম-ব্যতিক্রম ও আগম-নিগমের (আবাগ-উদ্বাগ) দ্বারা নতুন নতুন বাক্য রচনা করা সম্ভব। অগত্যা তাই মীমাংসককে কেবল বেদবাক্যের প্রবাহনিত্যতা স্বীকার করতে হয়েছে। বেদ বাক্যগুলি স্মরণাতীত কাল থেকে অবিকৃত রয়ে গেছে। বেদবাক্যের কোনো কর্তা বা রচনাকাল স্মরণ করা যায় না। তাই বেদ অপৌরুষেয় বলেই অভ্রান্ত। মানুষের দ্বারা তৈরি হলেই তো ভ্রান্তির সম্ভাবনা। যে বাক্যরাশি কোনো মানুষ রচনা করেনি অথচ চিরকাল ধরে আছে তাতে আর ভ্রান্তির সম্ভাবনা আসবে কোথা থেকে।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়/ বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৯)।

সাংখ্য দর্শনে শব্দপ্রমাণ

সাংখ্যসম্মত তৃতীয় প্রকার প্রমাণ হলো শব্দ, আগম বা আপ্তবাক্য। যে সমস্ত বিষয় বা বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা অনুমানের সাহায্যে জানা যায় না, তাদেরকে শব্দ প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ ষষ্ঠ কারিকায় বলেন, “সামান্যতোদৃষ্ট অনুমানের দ্বারা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অতীত (প্রকৃতি, পুরুষাদি) তত্ত্বের জ্ঞান হয়। সামান্যতোদৃষ্ট এবং শেষবৎ অনুমানের দ্বারা অতীন্দ্রিয় কোন তত্ত্ব অসিদ্ধ হলে সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আপ্তবচনরূপ আগম বা শব্দ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৬)

যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে হলে শব্দ বা আপ্তবাক্যের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আপ্তবাক্য হলো বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপদেশ। যে ব্যক্তি ভ্রম–বিপ্রলিপ্সাদি দোষমুক্ত, তিনিই আপ্ত। এরকম আপ্তব্যক্তির উপদেশ হলো শব্দ প্রমাণ। উপদেশ থেকে তৈরি হওয়া জ্ঞানের পক্ষে একদিকে বাক্যের পদজ্ঞান এবং অপরদিকে আকাক্সক্ষা, যোগ্যতা, সন্নিধি ও তাৎপর্য, বাক্যান্তর্গত এই চার প্রকার সম্বন্ধের জ্ঞান প্রয়োজন। তাই যে বুদ্ধিবৃত্তি এই সকল জ্ঞানসাপেক্ষ প্রমার করণ হয়, তাই শব্দ প্রমাণ।

ন্যায় সম্প্রদায়ের মতো সাংখ্যমতেও শব্দ প্রমাণ দুই প্রকার– লৌকিক ও বৈদিক। লৌকিক শব্দ হলো বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বাসযোগ্য লোকের বচন। লৌকিক শব্দ প্রত্যক্ষণ ও অনুমানের সাহায্যেও লাভ করা যায়। সাংখ্য দার্শনিকরা লৌকিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন না, কিন্তু বৈদিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ মানেন। বৈদিক শব্দ হলো বেদের বচন। বেদ, দেবতা, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষের অতীত এবং অনুমানের অগম্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। বৈদিক শব্দ কোন মানুষের কৃত নয়। মানুষের কৃত নয় বলে মানুষ যে জাতীয় ভুল করে সে জাতীয় ভুল বেদে থাকতে পারে না। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদেও অভিজ্ঞতাকেই বেদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই বৈদিক শব্দ অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ।

জৈন দর্শনে শব্দপ্রমাণ

ন্যায় ও মীমাংসা দর্শনের মতো জৈনদর্শনে আগম নামে শব্দ প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। জৈন দার্শনিক মানিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বলা হয়েছে, “আপ্তবাক্য হস্তসঙ্কেত প্রভৃতি হতে উৎপন্ন বিষয়ের জ্ঞান হচ্ছে আগম।” (পরীক্ষামুখসূত্র-৩/৯৯)।

জৈনরা বেদকে অপৌরুষেয় বলে স্বীকার করেন না, তাই বেদবাক্যের প্রামাণ্যও স্বীকার করেন না। তবে তারা তীর্থঙ্করদের উপদেশে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে শব্দ ও অঙ্গের মধ্যে প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদকভাব নাম স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকায় স্পষ্টতই শব্দ প্রভৃতি বস্তুর প্রতিপাদক হেতু। জৈনরা অন্বিতাভিধানবাদ বা অভিহিতান্বয়বাদ স্বীকার করেন। তাদের মতে, প্রকৃতি প্রভৃতির অন্বিতাভিধানে কিংবা অভিহিত পদগুলির অন্বয়ে পদার্থের প্রতিপত্তি (=জ্ঞান) হয়ে থাকে। জৈনমতে আগম দুই প্রকার- লৌকিক ও অলৌকিক।

তথ্যঋণ
রণদীপম বসুর লেখা চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শন সিরিজের বইগুলো

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.