ফ্রাঙ্কদের রাজকীয় বৃত্তান্ত : সম্রাট শার্লমানের অধ্যায় 

ফ্রাঙ্কদের ক্ষমতায় আরোহন থেকে শার্লমানের আগ পর্যন্ত

ফ্রাঙ্কদের পরিচয় : মধ্যযুগে ইউরােপীয় সভ্যতার সৃষ্টিকর্মে অন্যান্য জার্মান গােষ্ঠীগুলোর তুলনায় ফ্রাঙ্করা অংশ নিয়েছিল কিছু দেরীতে। কিন্তু আবির্ভাবের পর থেকেই রােমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপর যে নতুন ইউরােপ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল তার মধ্যে তাদের প্রবল অস্তিত্ব অনুভূত হতে থাকে। প্রাচীন গলের যে অংশে তারা বসতি স্থাপন করে সেই ফ্রাঙ্কিয়া (Frankia, এই শব্দটি থেকেই পরবর্তীকালে ফ্রান্স নামটি জাত হয়েছে) তাদের উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতার জন্য মধ্যযুগীয় ইউরােপের প্রাণপ্রবাহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং তাদের অন্যতম শাসক শার্লমানই আপন যােগ্যতায় সুবিস্তীর্ণ এক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের উপর আপন নামটি অঙ্কিত করে দেন। অ্যাংলো-স্যাক্সনদের মতো ফ্রাঙ্করাও ছিল পশ্চিমা-জার্মান গােষ্ঠী থেকে উদ্ভূত এবং ৫ম শতকের মধ্যেই গলদেশে—বেলজিয়াম অঞ্চলে স্যালিয়ান ফ্লাঙ্করা এবং মধ্য রাইন এলাকায় রিপুয়ারিয়ান ফ্রাঙ্কগণ নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে নেয়। কিন্তু অন্যান্য জার্মান গােষ্ঠীগুলোর মতো তারা আদি বাসভূমির সঙ্গে সংযােগ বিচ্ছিন্ন হতে দেয় নি এবং তার জন্যেই জার্মান সংস্কৃতির বহু মূল্যবান সম্পদ এবং জাতীয় চরিত্রের বলিষ্ঠতা সংরক্ষণে তারা সফল হয়েছিল। আর ক্ষমতার একটি স্থির ভিত্তিভূমি থাকায় তাদের সম্প্রসারণও সহজতর হয়ে যায়। স্বর্ণাভ কেশ, প্যাগান, ও দুদ্ধর্ষ ফ্রাঙ্করা একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তােলার ব্যাপারেও যথেষ্ট সংগঠনশক্তির পরিচয় দিতে পেরেছিল। এই ফ্রাঙ্কদের উত্তরপুরুষগণই ফ্রান্স এবং জার্মানী শাসন করে যথাক্রমে ৯৮৭ এবং ৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। 

ফ্রাঙ্কদের রাজনৈতিক অবস্থা : ফ্রাঙ্কদের যে গােষ্ঠী প্রথমে শাসন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল তারা অন্যতম আদি পুরুষ মেরেভিয়াসের (Merovius) নামানুসারে মেরেভিঞ্জীয় রূপে খ্যাত, আর এরাই ফ্রাঙ্কিয়ায় অধিষ্ঠিত ছিলেন ৪৮২ খ্রি. থেকে ৭৫১ খ্রি. পর্যন্ত। শাসনের ব্যাপারে মেরােভিঞ্জীয়গণ দক্ষিণাঞ্চলে রোমান ঐতিহ্যের অবশেষ গ্রহণ করেছিলেন, এবং অভিজাত রােমক-গলদের সাহায্য নিতেও তাদের আপত্তি হয়নি। এদের তুলনায় কিছুটা অপরিশীলিত ক্যারােলিঞ্জীয়গণ (৭৫১-৮৯১ খ্রি.) জার্মান জাতির সহজাত বলিষ্ঠতা এবং মৌলিকতা রক্ষায় বেশী আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়। মেয়েভিঞ্জীয় রাজ্য সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যের প্রধান উৎস তুর-এর গ্রেগরীর রচনা (Gregory of Tours)। রাজ্যকে নৈর্ব্যুক্তিক, অবিভাজ্য একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যুক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল ফ্রাঙ্করা। সুতরাং একজন শাসকের দেহবসানের পর, ফ্রাঙ্ক প্রথানুযায়ী রাজ্যটি প্রয়াতের পুত্রগণের মধ্যে সমভাবে বন্টিত হতো। তা ছাড়া ফ্রাঙ্ক ব্রাজ্য নিদিষ্ট একটি ভৌগােলিক সীমানার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গড়ে ওঠেনি। ক্লভিস এবং তার বংশধরগণ গল অথবা ফ্রাঙ্কিয়ার রাজারূপে যতটা পরিচিত ছিলেন তার থেকে বেশি খ্যাত দিলেন ফ্রাঙ্কদের রাজা হিসেবে। তবে ফ্রাঙ্কদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতনতার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যেতো রাজউপস্থিতি-ধন্য সাধারণ সভা বা Marchfield-এ সশস্ত্র, অভিজাত গণ্যমান্যদের উপস্থিতির মধ্যে। দেশ শাসনের প্রধান কর্তব্যগুলো সাধিত হতো রাজার প্রাসাদে যেটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় না বলে রাজার বাসগৃহ বলা উচিত। রাজকর্মীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন Major Domus বা Mayor of the Palace যার উপর শাসকের খাস-সম্পত্তির তত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। একে বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য করতেন স্টিওয়ার্ড, সেনেশ্যল, বাটলার, চেম্বারলেন, কনস্টেবল এবং মার্শালগণ। ফ্রাঙ্কদের আমলে কোনও একটি বিশেষ জনপদেরই রাজধানী হবার সৌভাগ্য হয় নি, তা ছিল শাসকের সঙ্গে সদাপরিভ্রমণরত। আর রাজকোষ স্ফীততর করা ছাড়া মহত্তর কোনও লক্ষ্যের প্রমাণ ফ্রাঙ্ক শাসন ব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাষ্ট্রের মঙ্গল অমঙ্গলের প্রশ্নে গুরুত্ব না দিয়ে রাজ্যের পরাক্রান্ত দলপতিদের বিশেষ অধিকার দানেও (immunity) ফ্রাঙ্ক রাজাদের কোনও আপত্তি ছিল না যদি এই প্রথার মাধ্যমে তাদের কিছু অর্থাগমের সম্ভাবনা থাকতো। 

ক্লভিসের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কদের জয়যাত্রা : মেরােভিঞ্জীয় শাসকদের মধ্যে বহুবিধ কারণে বিশিষ্ট হয়ে আছেন। Childeric-এর পুত্র Chlodowech (“battle of glory”) বা ক্লভিস (ফরাসী ভাষায় লুই) ৪৮১ সালে সিংহাসন লাভ করে অতি অল্পকালের মধ্যে নিজ রাজ্যসীমা বহুগুণ বৃদ্ধি ছাড়াও তিনি এমন কিছু কীর্তির নায়ক হয়ে আছেন যার ফলে উত্তর-রােমান পর্বে এবং প্রাক-শার্লমান মধ্যায়ের ইতিহাসে তাকে জয়সিদ্ধ এক শাসকের মর্যাদা দান করেছেন একাধিক ঐতিহাসিক । ক্লভিসকে কেন্দ্র করে ফ্রাঙ্কদের যে তিরিশ বছরের ইতিহাস গড়ে উঠেছিল তা গুণগত কারণে অন্যান্য ‘বর্বরদের’ কাহিনী থেকে সর্ব অর্থে স্বতন্ত্র। ৪৮৬ সালে প্রতিবেশী শাসক সায়াগ্রিয়াসের (সমসাময়িক জার্মানগণ যাকে ‘রােমানদের রাজা’ হিসেবে গণ্য করতেন) নাশ করে পারী (Paris) ও আর্লিয়ঁ (Orleans) সহ তার সমস্ত রাজ্য গ্রাস করলেন এবং মিউস (Meuse) ও সেইন (Seine) এবং সেইন ও লয়্যর (Loire) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের স্যালিয়ান ফ্রাঙ্কদের আপন প্রভুত্বাধীন করতে সমর্থ হন। গথদের রাজা থিওডোরিক তার পরাক্রমের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে। এরপর ক্লভিস রাইন ও ভসজেস (Vosges) অঞ্চলের অ্যালিমানি বা অলিমানসদের (Alemans) পদানত করে রিপুয়ারিয়ান ফ্রাঙ্কদেরও স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আনতে সক্ষম হন। ক্লভিস অবশ্য তার সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠ প্রমাণ রেখেছিলেন ৫০৭ সালে ভিসিগথদের পরাজিত করে। এই প্রশংসনীয় রণজয়গুলোকে পরিকল্পনাহীন, ক্ষাত্রশক্তির আস্ফালনমাত্র রূপে বিচার করলে তাদের গুরুত্ব অন্যায়ভাবে হ্রাস করা হবে, কেননা এই সাফল্যের ফলেই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও রােন (Rhone) উপত্যক৷ বাদে সমস্ত গলে ফ্রাঙ্কদের নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব স্থাপিত হয় এবং ফ্রাঙ্কদের দুই গােষ্ঠী—রিপুয়ারিয়ান ও স্যালিয়ানদের এক রাজচ্ছত্ৰতলে আনা সম্ভব হয়।   

ক্লভিসের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ও এর ফলে আসা পরিবর্তন : কিন্তু এই ঈর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও ক্লভিস হয়তাে পৌরাণিক যুগের অন্যতম পরাক্রান্ত বীর অথবা শত্রুর শােণিতসিক্ত ও রত্নলুব্ধ একজন অজেয় যােদ্ধাই থেকে যেতেন যদি না ইতিমধ্যে রাজমহিষী ক্লোটিলডার (বার্গান্ডির রাজকন্যা) প্রভাবে তিনি সানুচর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতেন। ৪৯৬ সালের ১১ই নভেম্বর র‍্যাঁস (Rheims)-এ বিশপ রেমিজিয়াস কর্তৃক ধর্মান্তরিত হলেন ক্লভিস এবং রাজার দৃষ্টান্তে তার তিন সহস্রাধিক প্যাগান যােদ্ধাও খ্রিস্টের শরণাগত হন। অবশ্য এর ফলে রাজা বা তার অনুচরদের নৈতিক জীবনের সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি কিন্তু সমসাময়িক জগতে সফলতম বর্বর শাসকের খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হবার ঘটনা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ক্লভিসের সমসাময়িক শাসকগণ প্রায় সকলেই ছিলেন প্যাগান অথবা আরিয়ান মতাবলম্বী (খ্রিস্টধর্মের একটি শাখা যা মূলধারার খ্রিস্টধর্মের কাছে হেরেটিক ছিল), সুতরাং এই ফ্রাঙ্ক বীর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় তিনিই হয়ে ওঠেন চার্চের প্রধান পৃষ্ঠপােষক। পােপতন্ত্রের স্বীকৃতিও আসে অবিলম্বে। ফলে ফ্রাঙ্করাজ্যের বাইরে, ভিসিগথ অথবা বার্গান্ডিয়ানদের রাজ্যেও বিশপগণ ক্লভিসের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন। বাইজান্টাইন সম্রাটও ক্লভিসকে ‘প্যাট্রিসিয়ান’ ও ‘কনসাল’ রূপে স্বীকৃতি দেয়ায় রােমান প্ৰজাপুঞ্জের চোখে তার শাসনের বৈধতা স্পষ্ট হয়ে যায়। ক্রমে রােমান সভ্যতা সংস্কৃতির ধারক গলের যাজক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ফ্রাঙ্ক রাজশক্তির মিত্রতার ভিত্তি হয়ে ওঠে সুদৃঢ়, এবং সেখানকার অ-জার্মান প্রজাপুঞ্জের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য লাভ করতেও ক্লভিসের আর অসুবিধে হয়নি। অনাগত দিনের বহু সম্ভাবনার সূত্রপাত এভাবেই ক্লভিসের শাসনকালে হয়েছিল, আর এ সমস্ত কিছুই মামগ্রিক ভাবে ফ্রাঙ্ক ইতিহাসকে এক অসামান্য মর্যাদা ভূষিত করে দেয়। এরপর ৫১১ খ্রি. ক্লভিস যখন ভিসিগথ শাসক, অ্যারিয়ান-ধর্মাবলম্বী দ্বিতীয় আলারিখের বিরুদ্ধে অভিযান করেন তা আর শুধুমাত্র একজন বর্বর শাসকের বিরুদ্ধে অপর এক বিধর্মীর সমরাভিযান থাকেনি। ক্লভিসের পেছনে চার্চের শুভকামনা থাকায় তা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সম্প্রসারণ হিসেবেও চিত্রিত হয়। ৫১১ সালে তার মৃত্যুর আগে ব্রিটানী, প্রভাঁস ও সেপ্টিমানিয়া ছাড়া রাইনের উভয় তীরেই ফ্রাঙ্ক শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। চার্চের আশীর্বাদপুষ্ট, জাতীয় সংহতিতে বলীয়ান ফ্রাঙ্করা এভাবেই অনাগত দিনে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ক্লভিস সম্পর্কে ফরাসী ঐতিহাসিক লেভিসে (Livisse) লিখেছেন, “From being simply a Frankish king, he became the king of the Franks. It was not a nation that he created but a historic force.” 

মেরোভিঞ্জীয়দের পতন : কিন্তু ক্লভিসের এই সাফল্যদীপ্ত শাসনের অবসান হবার পরেই ফ্রাঙ্কিয়াতে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা প্রবল হয়ে ওঠে। প্রয়াত শাসকের পুত্রদের মধ্যে রাজ্যবণ্টনের সর্বনাশা রীতিই এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। মেরোভিঞ্জীয়দের শেষ উল্লেখযােগ্য এবং সৌভাগ্যবান (কেননা পিতার রাজ্য তিনি অখণ্ডিত অবস্থায় লাভ করেছিলেন) শাসক ছিলেন ডাগােবার্ট (৬২৯-৬৩৯ খ্রি.)। এই সময়েই ফ্রাঙ্ক শাসন বিভাগের মুখ্য কর্মচারী ‘মেয়র অফ দ্য প্যালেস’ লান্ডিন-এর পিপিনের পুত্র গ্রিমওয়াল্ড রাজাকে অপসারিত করার যে ব্যর্থ চেষ্টা করেন শত বছর পরে তা ভিন্নভাবে সফল হয়ে ফ্রাঙ্কদের ইতিহাসের ধারাকে পরিবর্তিত করে দেয়। গ্রিমওয়াল্ডের প্রচেষ্টা অসফল হলেও মেরেভিঞ্জীয়দের অবক্ষয় রােধ করা যায় নি। ডাগােবার্টের মৃত্যুর পরেই ফ্রাঙ্করাজ্য বিচ্ছিন্ন হতে আরম্ভ করে। অস্ট্রেসিয়া, নিউসট্রিয়া ও বার্গান্ডির উপর মেরেভিঞ্জীয়রাজের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রভাঁসও (Provence) প্রায় স্বাধীন রাজ্যের মতো আচরণ করতে শুরু করে। রাজা এই সময়ে পরাক্রান্ত ও পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী অভিজাতদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন আর শাসন ক্ষমতা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে মেয়র অফ দ্য প্যালেসের হাতে। ইতিমধ্যে এই ঈর্ষণীয় পদটি মেজ্‌ (Metz)-এর বিশপ আর্নুল্‌ফ-এর বংশধরগণ আর্নুল্‌ফিংসদের কুক্ষীগত হয়ে গিয়েছিল। এদেরই অন্যতম পিপিন দ্য ইয়ং (হার্সট্ল‌-এর পিপিন) নিউস্ট্রিয়া, বার্গান্ডি এবং অস্ট্রেসিয়ার শাসনভার ৭ম শতকের শেষের দিকে নিজের হাতে তুলে নেন। পিপিন-তনয় চার্লস মার্টেল (চার্লস দ্য হ্যামার) ৭১৪ সালের সমগ্র রাজ্যের প্রকৃত অধীশ্বর হয়ে ওঠেন এবং পােয়াতিয়ের (বা তুর) (Poitiers or Tours)-এর যুদ্ধে স্পেনাগত এক মুসলমান সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন। কিন্তু মৃত্যুর সময় পর্যন্ত চার্লস মার্টেল রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি (৭৪১ খ্রি.)। তবে অতুলনীয় এবং ইতিহাসের গতিনিয়ন্ত্রক অন্যতম ঘটনার নায়কের নামানুসারেই তার উত্তরসূরীগণ ক্যারােলিঞ্জীয় নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। 

ক্যারোলিঞ্জীয়দের উত্থান ও চার্চ ও রাজার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা : মেয়র অফ দ্য প্যালেসের পদ থেকে বৈধ রাজারূপে সিংহাসনে আরােহণের সৌভাগ্য হয়েছিল চার্লস মার্টেলের বংশধর তৃতীয় পিপিনের (পিপিন দ্য শর্ট)। ইতিমধ্যে মেরোভিঞ্জীয় শাসকের অপদার্থতা ও অক্ষমতার কথা আর কারােই অগোচর ছিল না। সমসাময়িক পােপেরও মত ছিল শক্তিহীন রাজার থেকে প্রকৃত ক্ষমতার অধীশ্বরেরই রাজমুকুট ধারণ করা উচিত। ফলে ফ্রাঙ্কদের ইতিহাসে আবার দৃশ্যান্তর ঘটলো। ৭৫১ সালে সােয়াসোঁ (Soissons)-তে পোপের সম্মতি পেয়ে সেন্ট বােনিফেস আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ মেরােভিঞ্জীয় শাসক তৃতীয় চিল্ডারিককে সিংহাসনচ্যুত করে তৃতীয় পিপিনকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। (“Samuel had anointed David King in the place of Saul, and so the Church, aware of the parallel, an ointed Pepin and his successors. The Franks were the chosen of the Lord and their armies the columns of Israel.”) পিপিনের এই রাজক্ষমতা অধিগ্রহণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্মতি ও সহযােগিতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলেই তা আর অবৈধ থাকে নি, চার্চের হস্তক্ষেপে এই ঘটনা ঈশ্বরের অভিপ্রেত বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। তিন বছর পরে সদ্যোস্থাপিত ক্যারােলিঞ্জীয় রাজবংশ স্মরণীয়তার সমর্থন পেয়েছিলেন যখন পােপ দ্বিতীয় স্টিফেন স্বয়ং তৃতীয় পিপিনকে রাজারূপে অভিষিক্ত করেন এবং রাজপুত্রদ্বয় চার্লস ও কার্লোমানকেও সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরূপে স্বীকার করে নেন। বলা বাহুল্য সমসাময়িক ইউরােপীয় সমাজে এই ঘটনাগুলো অন্তঃসারহীন, চিত্তাকৰ্ষক ও আলােড়ন সৃষ্টিকারী অনুষ্ঠান মাত্র ছিল না, খ্রিস্টান জগতের ধর্মগুরুর আশীর্বাদপূত হয়ে ফ্রাঙ্ক রাজা আর শুধুমাত্র একজন পরাক্রান্ত সমরনায়কই রইলেন না, তার ভূমিকারও আদ্যন্ত পরিবর্তন ঘটলো। পবিত্র তৈলসিঞ্চিত হয়ে, পুণ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি যে ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহেই সিংহাসন লাভ করলেন তা ঘোষিত হলো অতি স্পষ্টভাবে। ফ্রাঙ্কনৃপতি এরপর থেকে হয়ে উঠলেন চার্চ ও খ্রিস্টধর্মের প্রধান রক্ষক, একাধারে শাসক ও পুরােহিত rex et sacerdos, প্রজাপুঞ্জের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক-উভয় জীবনের নিয়ন্ত্রক। ভূলোকে ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে (Vicar of God) সম্মানিত করা হলো ফ্রাঙ্ক রাজাকে সফলতম ও সক্ষমতমকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করার যে প্রথা ফ্রাঙ্কদের মধ্যে চালু ছিল তারও অবসান হলো, কেননা পােপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার পিপিনের দুই পুংকে ‘পবিত্র আত্মার’ (Holy Ghost) নামে আশীর্বাদপূত করে প্রকারান্তরে ভিন্ন কোনও রাজবংশের সন্তানকে রাজমুকুট দান অবৈধ ও অশাস্ত্রীয় বলে ঘােষণা করেছিলেন। চার্চ ও সিংহাসনের মধ্যে এই সুদৃঢ় এবং প্রাথিত মৈত্রী সম্পাদিত হবার পর নব-অধিষ্ঠিত রাজা পিপিনকে ৭৫৫ সাল এবং পুনরায় ৭৫৬ সালে সসৈন্যে ইতালীতে উপস্থিত হয়ে লোম্বার্ডদের বিরুদ্ধে পোপকে সাহায্য করতে দেখা গিয়েছিল। ঐ সময়েই মধ্য ইতালীতে পােপের মর্যাদা অনুযায়ী একটি শক্তির ভিত্তি-ভূমি (পরবর্তীকালে যা পােপের শাসনাধীন রাজ্যে পরিণত হয়েছিল) স্থাপনেও উদ্যোগী হয়েছিলেন পিপিন (Donation of Pepin)। এরপর থেকে পৃষ্ঠপােষকতার জন্য পােপতন্ত্র আর বাইজান্টাইন সম্রাটের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেনি। সর্বপ্রকার সঙ্কটত্রাণের জন্য ফ্রাঙ্করাই তার প্রধান সহায় হয়ে ওঠে, আর ফ্রাঙ্কশাসক হয়ে ওঠেন পােপের পার্থিব অপার্থিব—সকল বিষয়ে প্রধান অবলম্বন। ৭৫১ সালে ক্যারােলিঞ্জীয় বংশের প্রথম রাজা পিপিনের মৃত্যুর পর পশ্চিম ইউরােপের ইতিহাসে সংযোজিত হলাে পিপিন-তনয় শার্লমানের নামাঙ্কিত এক দীর্ঘ, সুদীপ্ত অধ্যায়। 

শার্লমান (৭৬৮-৮১৪ খ্রি.) ও তার বীরত্ব

ভূমিকা : মধ্যযুগের রাজকীয় বৃত্তান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে সম্রাট শার্লমানের অধিষ্ঠান। এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বড়ো অংশ যে এই ফ্রাঙ্ক শাসকের বিস্ময়কর ব্যুক্তিত্ব ও বহু বিচিত্র কীর্তিকলাপকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত। জয়স্ফীত বিশাল একটি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, অক্লান্তকর্মা এই শাসকের দ্বারা লাতিন খ্রিস্টান জগতের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস প্রভাবিত হয়েছিল প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে। ব্রিটীশ দ্বীপপুঞ্জ সহ প্রায় সমস্ত পশ্চিম ইউরোপ বহু শতক পরে এক রাজচ্ছত্র তলে এসেছিল। শাসন বিভাগের সর্বস্তরে অনুভূত হয়েছিল সম্রাটের প্রেরণা সঞ্জাত এক তৎপরতা। তাছাড়া রণদীর্ণ ও হতাশা সমাচ্ছন্ন মেরোভিঞ্জীয় গলদেশের হানাহানি এবং আদর্শবর্জিত স্থূল শাসনের পরিবর্তে খ্রিস্টীয় আদর্শকে আপন রীতিনীতির মধ্যে উদ্ভাবিত করার চেষ্টা, প্রায়-অশিক্ষিত এক শাসকের প্রগাঢ় বিদ্যানুরাগ এবং ৮০০ সালে খ্রিস্ট-জন্মোৎসবের পুণ্যলগ্নে পােপ কতৃক সম্রাটরূপে তার অভিযেক এবং পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন – এই সমস্ত ঘটনা এবং বৈশিষ্ট্য তার রাজত্বকালকে অনন্যসাধারণ এক গুরুত্ব দিয়েছে। 

চার্লস দ্য গ্রেট বা শার্লমানের ক্ষমতায় আরোহন : নিউস্ট্রিয়ার (Neustria) মেয়র অফ দ্য প্যালেস এর পদ থেকে রাজপদে উন্নীত তৃতীয় পিপিন (পিপিন দ্য শর্ট)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস ৭৬৮ সালে ইহলােক ত্যাগ করার আগেই ফ্রাঙ্ক প্রথানুযায়ী রাজা পিপিন দুই পুত্র—চার্লস এবং কার্লোমানের মধ্যে রাজ্য বণ্টন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চার্লস-এর ভাগে পড়েছিল ফ্রান্সের প্রায় সমস্ত উপকূলভাগ, হলান্ড ও বেলজিয়াম এবং জার্মান সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত সমস্যাজর্জর এক ভূখণ্ড যাকে বশে রাখার জন্য অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়ােজন ছিল। তুলনায় কনিষ্ঠ কার্লোমান এক অখণ্ড রাজ্যাংশ পেয়েছিলেন। তার রাজ্য উত্তরে পারী থেকে দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের উপকূল পর্যন্ত, পূর্বে সুইজারল্যাণ্ড এবং দক্ষিণ জার্মানীর বেশ কিছু এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উভয় ভ্রাতার মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা তিরােহিত হয় ৭৭১ সালে কার্লোমানের অকালমৃত্যুতে। প্রয়াত ভ্রাতার সমস্ত রাজ্য চার্লস অধিকার করে নেন প্রায় বিনা আয়াসে। এর পর থেকে শুরু হয় চার্লস-এর দীপ্ত, ঘটনাবহুল এবং অফুরন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ সুদীর্ঘ শাসনকাল। ৮ম ও ৯ম শতাব্দীর মাপকাঠিতে ‘দ্য গ্রেট’ বিশেষণে ভূষিত হবার মতো যােগ্যতা চার্লস-এর প্রয়োজনের অতিরিক্তই ছিল। উদ্যমী, অপ্রতিরােধ্য এই যোদ্ধা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা ছাড়াও তার কালের মানুষের চোখে মহৎ একটি আদর্শ-খ্রিস্টধর্ম প্রসারের জন্য প্রার নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করেছেন এবং সফল হয়েছেন প্রায় সর্বত্র। যুদ্ধ এবং দূরদূরান্তে প্রবাসজীবনযাপনের মধ্যে প্রাণোচ্ছল, কর্মনিষ্ঠ এই লােকনায়ক অকৃত্রিম আবেগে ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার ও উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন, দেশ এবং দূর দেশের মনীষীদের উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনায় আহ্বান করেছেন আপন প্রজাপুঞ্জের নৈতিক এবং মানসিক জীবনের মান উন্নততর করার জন্য। অকৃপণ পৃষ্ঠপােষকতায় বিদ্যাচর্চার এক অনুকূল পরিবেশ রচনা করেছেন আপন রাজসভায়। ক্ষাত্ৰতেজের সঙ্গে বিদ্যানুরাগের, অব্যবহিত জাগতিক প্রয়ােজন সাধনের দক্ষতার সঙ্গে ধর্মানুশীলন অবস্থিতি রাখার সামর্থ্যের বহু নিশ্চিত প্রমাণ তিনি রাখতে পেরেছিলেন বলে কাল চিহ্নিত হয়ে আছে তারই নামে। 

বীরত্ব, সমরাভিযান ও জয় : শার্লমানের সামরিক দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। উত্তরাধিকারসূত্রে এবং সহােদরের মৃত্যুর পর শত্ৰুবেষ্টিত যে রাজ্য তিনি লাভ করেছিলেন তা বারবার আক্রান্ত হয়েছিল প্রতিবেশীদের দ্বারা। অনেক সময়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন রণাঙ্গনে সামরিক বাহিনী পাঠাতেও বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। রাজ্যসীমা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা বিধান এবং বিধর্মীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার দৃঢ় সঙ্কল্প বার বার এই ফ্রাঙ্ক বীরকে যুদ্ধে প্রণােদিত করেছে। সর্বসমেত তার ৫৪টি সমরাভিযানের কথা জানা যায়। ৫টি লােম্বার্ডদের বিরুদ্ধে, ১৮টি স্যাক্সনদের দমন করার জন্য, ৩টি ফ্রিসিয়ান ও ডেনদের বিরুদ্ধে, থুরিঞ্জিয়া ও ব্যাভেরিয়ায় ১টি করে, গ্যাস্কনদের বিরুদ্ধে ২টি, আভার ও স্লাভদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার জন্য ৮টি, ৭টি মুসলমান কবলিত স্পেনের বিরুদ্ধে, ৫টি দক্ষিণ ইতালীর মুসলমান শক্তি ধ্বংস করার জন্য, ২টি ব্রিটন ও ২টি বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে। “৭৯০ সালে একটি যুদ্ধও হয় নি”–সমসাময়িক কালের একজন লেখকের বিস্ময়-জড়িত এই উক্তি থেকে বােঝা যায় কি নিরবচ্ছিন্ন, সুদীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহে অতিবাহিত হয়েছিল শার্লমানের দীর্ঘ শাসনকাল। অস্ত্র চালনায় সদা অভ্যস্ত তার কালের মানুষের চোখেও অমিতবীর্য এই যোদ্ধার কীর্তি বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছিল এবং চার্লসের নামের সঙ্গে ‘দ্য গ্রেট’ এই বিশেষণের সংযুক্তি এই কারণেই (Charles the Great-Charl emagne)। 

লোম্বার্ডদের বিরুদ্ধে জয় : শার্লমানের পূর্ববর্তী ফ্রাঙ্ক শাসকগণ উত্তর ইতালীতে সুপরিকল্পিতভাবে সমরাভিযান পরিচালনা না করায় লােম্বার্ডরা নিবিঘ্নেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। সিংহাসন আরোহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শার্লমান ইতালীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দিগ্বিজয়ের বাসনা ছাড়াও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দুটি উপাধি-প্যাট্রিসিয়াস (Patricious-Protector of the People) এবং লোম্বার্ডদের উর্ধ্বতম প্রভু তাকে ইতালীর আভ্যন্তরীণ রাজ নীতিতে হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিঃসংশয় করেছিল বলে মনে হয়। ৭৭৩ সালে পােপ প্রথম হাড্রিয়ানের অনুরোধে সেনিস পর্বত (Mt. Cenis) পার হয়ে শার্লমান সসৈন্যে উপস্থিত হলেন উত্তর ইতালীতে। লােম্বার্ড রাজধানী পেভিয়া নয় মাস অবরুদ্ধ থাকার পর আত্মসমর্পণ করল। ফ্রাঙ্ক শাসক লােম্বার্ডদের পরাভূত করেই সন্তুষ্ট হলেন না, তাদের রাজ্যও গ্রাস করলেন। ফ্রাঙ্করাজ এখন থেকে লোম্বার্ডদের রাজারূপেও পরিগণিত হলেন। ফ্রাঙ্কবাহিনী এপর ভেনিস, ইস্‌ট্রিয়া, ডালমেশিয়া উপত্যকা এবং কর্সিকা দ্বীপ অধিকার করে নেয়।

স্যাক্সনদের বিরুদ্ধে জয় এবং উত্তর জার্মানি ও স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলে খ্রিস্টীয়করণের সূচনা : চার্লস-এর দীর্ঘতম, দুরূহতম এবং নৃশংসতম যুদ্ধ হয়েছিল স্যাক্সনদের সঙ্গে। একাধিক জার্মান ঐতিহাসিক ফ্রাঙ্কদের এই অভিযানের তুলনা করেছেন সীজারের গল আক্রমণের সঙ্গে। ৭৭২ সালে শুরু হয়েছিল দুর্ধর্ষ এই বিধর্মীদের দমন করার প্রচেষ্টা, সাফল্য এসেছিল সুদীর্ঘ তিরিশ বছর পরে অগণিত লােকক্ষয় এবং অপরিসীম কষ্টবরণের মধ্য দিয়ে। এই জয়ের ফলে ফ্রাঙ্ক রাজ্য পূর্বদিকে এল্ব পর্যন্ত শুধু বিস্তৃতই হয়নি, স্যাক্সনী অধিকৃত হওয়ায় খ্রিস্টান জগতের সীমান্তও অখ্রিস্টান এলাকায় প্রসারিত হবার সুযােগ লাভ করল। যুদ্ধান্তে বিধর্মী স্যাক্সনদের জোর করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন শার্লমান এবং এ কাজে বাধা দেয়ায় কুদ্ধ ফ্রাঙ্কনৃপতি ভারডেনে (Verden) প্রায় ৪৫০০ ‘প্যাগান স্যাক্সনকে’ নির্মমভাবে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হন নি। এই নৃশংসতার জন্য শার্লমান নিন্দিত হয়েছিলেন আলকুইনের কাছে। বিদেশী এই পণ্ডিত তার পৃষ্ঠপােষককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে শক্তি প্রয়ােগ করে মানুষের মনে কোনও ধর্মবিশ্বাস জাগানো যায় না, তা সৃষ্টি হতে পারে কেবলমাত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে। স্যাক্সনী বিজয়ের পর শান্তিরক্ষার উপায় হিসেবে বহু স্যাক্সনকে ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেখানে স্থাপিত হয় বহু ফ্রাঙ্ক উপনিবেশ। নবার্জিত এই প্রদেশে একটি বিশপাধীন অঞ্চল গড়ে উঠল ব্ৰিমেন শহরটিকে কেন্দ্র করে। ইংরেজ বিশপ উইলিহ্যাডকে (Willehad) ওয়ার্মস থেকে স্থানান্তরিত করে নতুন এই বিশপরিকের (bishopric) দায়িত্ব দেয়া হল। এখান থেকেই ক্রমশ উত্তরে স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর জার্মানীতে ভারডেন (Verden), মিডেন (Minden), হ্যালবারস্ট্যাড (Halberstadt), প্যাডারবর্ন (Pederborn), অস্‌নাব্রুক (Osnabruck) প্রভৃতি স্থানকে কেন্দ্র করে নতুন বিশপশাসিত অঞ্চলের পত্তন হলো। অ্যাংলাে-স্যাক্সন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ছাড়া জার্মান গােষ্ঠীর অন্তর্গত জাতিগুলো ফ্রাঙ্কদের স্যাক্সনী জয়ের ফলে এক রাজছত্ৰতলে সম্মিলিত হবার সুযােগ পেয়েছিল। 

ব্যাভেরিয়ার সাম্রাজ্য অন্তর্ভূক্তি : ফ্রাঙ্কদের কর্তৃত্ব নীতিগতভাবে সমর্থন করলেও ব্যাভেরিয়া ছিল কার্যত স্বাধীন এবং ব্যাভেরিয়ান চার্চও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ভােগ করেছিল বহুদিন ধরে। ফ্রাঙ্ক শাসকের মতো পােপের চোখেও এ অবস্থা ছিল অনাচারেরই নামান্তর। বাভেরিয়ার ডিউক ট্যাসিলো (Tassilo) আনুষ্ঠানিকভাবে শার্লমানকে উর্ধ্বতন প্রভু (Overford) রূপে স্বীকার করতে বাধ্য হন, কিন্তু ৭৭৮ সালে অবাধ্যতার অভিযোগে তাকে পদচ্যুত করা হয় এবং ব্যাভেরিয়া ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পরবর্তী দশ বছরে দানিয়ুব তীরবর্তী অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয় অ্যাভাররা চার্লস পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ (মার্ক বা মার্চ) গড়ে তুললেন ব্যাভেরিয়াকে কেন্দ্র করে (ভবিষ্যতে তা পরিণত হয়েছিল অস্ট্রিয়াতে (Ostmark)।

মুসলমান অধিকৃত স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : শার্লমানের সর্ববৃহৎ এবং তাৎক্ষণিক সাফল্যবর্জিত যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়েছিল মুসলমান অধিকৃত স্পেনের বিরুদ্ধে। কর্ডোভার উমাইয়া আমীরকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল তার সুযােগ গ্রহণ করবার জন্য শার্লমান পীরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে স্পেনে প্রবেশ করলেন, কিন্তু ফ্রাঙ্করা কিছুতেই এব্রো (Ebro) নদীর তীরবর্তী সারাগোসা দখল করতে পারল না। ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের এই অভিযান শুধু ব্যর্থই হয়নি পীরেনিজ পর্বত অতিক্রম করে স্বদেশে ফেরার সময় ফ্রাঙ্ক সেনাবাহিনী রন্‌সিভক্স (Ronce vaux)-এ শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। শার্লমানের জীবনীকার এইনহার্ড স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নিহতদের মধ্যে ছিলেন সুখ্যাত ব্রিটন মার্চের কাউন্ট রোলান্ড। লােকান্তরিত এই বীরকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল পরবর্তীকালের পরম সুন্দর কাব্য ‘সঙ অফ রোলান্ড’ (Chanson de Roland)। স্পেন জয় করতে না পারলেও শার্লমান পীরেনিজ পর্বতমালার দক্ষিণে স্প্যানিশ মার্চ (স্পেনীয় সীমান্ত প্রদেশ) গঠন করতে পেরেছিলেন। হয়তো এই সাফল্যই ভবিষ্যতে ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের স্পেন পূনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপ। অতি প্রতিকূল অবস্থায় এই কাজ সুসম্পন্ন করে শার্লমান তার সমরকুশলতার একটি অভ্রান্ত প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন। 

পশ্চিম ইউরোপে শার্লমানের রোমান সম্রাট হয়ে ওঠা ও এর ফলশ্রুতি

রোমে পোপের সাহায্যার্থে আগমন এবং শার্লমানের কাছে পোপ : ৭৭৩ সালে পেভিয়া অবরােধের সময়ে ইস্টার উৎসব পালনের জন্য শার্লমান রােমে উপনীত হন এবং লােম্বার্ড আক্রমণে বিপর্যস্ত ও পলাতক পােপ প্রথম হ্যাড্রিয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। পুনরায় রােমে অবিষ্ঠিত পােপ কর্তৃক উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনায় সম্বদ্ধিত হলেন শত্রুসূদন শার্লমান। এই সময়েই তিনি ‘কনস্টানটাইন এর শ্রদ্ধার্ঘ’ (Donation of Constantinc) সমর্থন করলেন। অবশ্য মধ্য ইতালীতে পােপের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিলেও শার্লমান এ তত্ত্ব ঘােষণা করতে দ্বিধা করেন নি যে রােমানদের প্যাট্রিসিয়াস (Patricius Romanorum) এবং পবিত্র চার্চের সম্পত্তির (Holy Sce) রক্ষক হিসেবে তিনি স্বয়ং এই ভূখণ্ডের অধীশ্বর এবং পােপ তার প্রতিটি নির্দেশ মেনেই এ রাজ্য শাসন করছেন। শার্লমানের চোখে পোপ ছিলেন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতা ও অপার্থিবতার প্রতীক। সে কারণে পার্থিব শক্তি অর্জনে আগ্রহী পোপের পক্ষে শার্লমানের এ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অতন্ত অস্থির। কনস্টান্টিনোপলের পৃষ্ঠপোষককে ত্যাগ করে গলদেশের নবোদিত এই শক্তির উপর নির্ভর করে শুধুমাত্র একজন শক্তিশালী সমর্থক লাভের বাসনাই তারা পোষণ করতেন। কিন্তু ইতালীর রাজনৈতিক সংকট বারবার সেখানে শার্লমানের হস্তক্ষেপ অনিবার্য করে তুলেছিল। ৭৭৫ থেকে ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পােপ এবং তার ভূসম্পত্তি রক্ষার জন্য শর্লমানকে অন্তত চারবার সসৈন্যে ইতালীতে প্রবেশ করতে হয়েছিল।

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সমস্যা ও ষড়যন্ত্র, পোপকে তার পদে বহাল করা ও শার্লমানের পবিত্র রোমান সম্রাটের অভিধা লাভ : এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে রোমান সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড রোমের উপর পূর্ব রোমান সম্রাটের কর্তৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল প্রায় স্মরণাতীত কালে। তা ছাড়া এ সময়েই ঘটেছিল কনস্টান্টিনোপল-এর সেই মর্মান্তিক ঘটনা যার ফলে সম্রাট ষষ্ঠ কনস্টানটাইন রাজমাতা আইরীন কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হয়ে অন্ধের জীবন কাটাচ্ছিলেন। খ্রিস্টান জগতের সবচেয়ে পূত সিংহাসনে দুশ্চরিত্রা (যাকে রাজহন্তাও বলা যায়) এক স্ত্রীলোকের অধীষ্ঠান সহ্য করতে অনেকেই রাজী ছিলেন না। অবিলম্বে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বহু ইতালীয়ানের মনে আসাটাও স্বাভাবিক ঘটনা। আর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমান শক্তির বিপজ্জনক বিস্তার যে রোম, সমগ্র ইতালি এবং পােপতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে সে সম্ভাবনাও তুচ্ছ করা সম্ভব হয় নি। ৮ম শতকের শেষের দিকে পশ্চিম ইউরােপে ঘনীভূত এই সঙ্কটের ত্রাতা হিসেবে শার্লমান ছাড়া অন্য কোনও শাসককে ভাবা যেত না। খ্রিস্টধর্ম প্রসারে, ধর্মগুরু পোপের রক্ষক রূপে শার্লমানের দীপ্ত ভূমিকা সমগ্র ঘটনাস্রোত তার পক্ষে অনুকূল একটি পরিবেশ রচনা করে দিয়েছিল। সুতরাং শার্লমানের মতো অনাক্রমনীয় প্রতিষ্ঠা লাভে সফল এক শাসকের পক্ষে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা করা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক ছিল না। ইতিমধ্যে পােপ হ্যাড্রিয়ানের দেহাবসান ঘটেছিল ৭৯৫ সালে এবং নবনিযুক্ত পােপ তৃতীয় লিও তার পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশী সৌভাগ্যবান ছিলেন না। সদ্যোপ্রয়াত পােপের আত্মীয়গণ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে পণ এবং সম্মান রক্ষার জন্য তিনি আল্পস পার হয়ে প্যাডারবর্ন-এর কাছে ফ্রাঙ্ক নৃপতির শরণাপন্ন হলেন। তার শত্রূপক্ষও নিশ্চেষ্ট হয়ে ছিলেন না। তাদের প্রতিনিধিরাও শার্লমানের কাছে ‘দুশ্চরিত্র’ এবং অবৈধ বহ দুষ্কর্মের নায়ক ‘লিও’কে পদচ্যুত করার আবেদন নিয়ে উপস্থিত হলেন। ৭১৯ সালে শার্লমানের জীবনে এক সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হলো বলা যায়। এই সময়েই তার প্রধান পরামর্শদাতা পণ্ডিত আলকুইন তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ছিলেন যে সসাগরা পৃথিবীর তিন প্রধানের মধ্যে মহামহিম পােপ শত্রুবেষ্টিত হয়ে হতগৌরব পূর্ব রােমান সম্রাট রাজপ্রাসাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে বিধ্বস্ত, কেবলমাত্র ফ্রাঙ্ক নৃপতিই পূর্ণ গৌরবে সুদীপ্ত হয়ে আছেন। একমাত্র তিনিই পারেন চার্চের পবিত্রতা রক্ষা করতে, দুষ্কৃতকারীর শাস্তি বিধান করতে, বিপথগামীকে পথ নির্দেশ করতে, শােকাহতকে সান্ত্বনা দিয়ে পুণ্যের জয় ঘােষণা করতে। ৮০০ সালে শার্লমান আবার পূর্ব পরিচিত পথে ইতালীতে উপস্থিত হলেন শুধুমাত্র লিওকে সাহায্য করতে নয়, পােপতন্ত্রকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেও। পােপ লিওর বিরুদ্ধে সব অভিযােগই অসত্য বলে প্রমাণিত হল। ধর্মগুরুও শপথ নিয়ে ঘােষণা করলেন যে তিনি নির্দোষ। সেন্ট পিটারের পবিত্র আসন তাকে ফিরিয়ে দেয়া হল। আর ৮০০ সালে খ্রিস্টজন্মােৎসব উপলক্ষে সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রালে উপাসনারত ফ্রাঙ্কনৃপতির নত মস্তকে অকস্মাৎ সাম্রাজ্যিক কর্তৃত্বের প্রতীক মণিমুক্তা খচিত একটি মুকুট পরিয়ে দিলেন কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত পােপ তৃতীয় লিও। ক্যাথিড্রালে সমবেত জনতা তুমুল হর্ষধ্বনি করে নব অভিষিক্ত সম্রাটের বিজয় কামনা জানাল। ইতিহাসের অনির্ণেয় ঘটনাচক্রে অমিতবীর্য শার্লমান অভাবনীয় এবং সুদুর্লভ এক মর্যাদার অধিকারী হলেন। 

শার্লমানের পবিত্র রোমান সম্রাট – অভিধা লাভের ফল ও এসম্পর্কিত বিশ্লেষণ : ঘটনাস্রোতের এই ক্ষিপ্র, অভাবনীয় দিক পরিবর্তনে বিস্ময়-বিহ্বল শার্লমান অবশ্য প্রকাশ্যে ঘােষণা করেছিলেন যে পূর্বাহ্নে পােপের অভিপ্রায় জানতে পারলে তিনি সেন্ট পিটার্স ভজনালয়ে প্রবেশ করতেন না। সদ্য অভিষিক্ত সম্রাটের বিস্ময় বা বিরক্তির আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলেও এ তথ্য স্বীকার করে নিতে হয় যে তৃতীয় লিওর এই অনুষ্ঠানের ফলে ঘটনাস্রোতের নিয়ন্ত্রণাধিকার শার্লমানের হস্তচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া অভিষেক অনুষ্ঠানের তাৎপর্য ৯ম শতাব্দীতেই আবদ্ধ না থেকে অনাগত কালে বহুবিধ অতি জটিল সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। রাজা থেকে সম্রাটের মর্যাদায় উন্নীত হবার বাসনা শার্লমানের ছিল এবং তার পারিষদবর্গ বহুকাল থেকেই তাকে উৎসাহিত করেছেন এই গােপন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এবং প্রক্রিয়ায় তিনি সম্রাটের পদাভিষিক্ত হয়েছিলেন তার বহুবিধ অশুভ এবং অস্বস্তিকর পরিণতি সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। ৮০০ সালে অভিষেক অনুষ্ঠান কনস্টান্টিনােপলের বিচারে অবৈধ বলে বিবেচিত হয়েছিল যদিও অভিষেকের পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোতে বাইজান্টাইন প্রথা প্রকরণ বিশ্বস্তভাবে অনুসৃত হয় এবং পূর্ব রােমান সম্রাটের স্বীকৃতি লাভের জন্য শার্লমানের চেস্টারও কোন বিরাম ছিল না। ঐতিহাসিক Previte Orton এ বিষয়ে নিঃসংশয় যে বৈধতার সীমা লঙ্ঘন করে, একজন ‘বর্বর’ কর্তৃক অন্যের মর্যাদা ‘অপহরণের’ দৃষ্টান্ত স্থাপনে শার্লমানের ঘােরতর আপত্তি ছিল। প্রচলিত বিধি অনুসারে সিনেট কর্তৃক নির্বাচন, প্রজাপুঞ্জের সমর্থন এবং অন কোনও সম্রাট তখন ক্ষমতাসীন থাকলে তার দ্বারা সমমর্যাদাসম্পন্ন শাসকবৃপে স্বীকৃতি লাভ ছিল ফ্রাঙ্কনৃপতির অভিপ্রায়। কৃতার্থ এবং কৃতজ্ঞ পোপের আবেগতাড়িত কার্যকলাপ, রােমান সম্রাটের দীর্ঘ জীবন এবং নিরবচ্ছিন্ন জয় কামনা করে সমবেত জনতার উল্লসিত অভিনন্দনে শার্লমানের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রায় দুই দশক পরে শার্লমানের জীবনীকার এইনহার্ডও এই মত সমর্থন করেছেন। ৮০০ সালের কিছু পরে ফ্রাঙ্কদের যে রাজকীয় বৃত্তান্ত রচিত হয় তাতে ঘটনাটিকে অনন্য সাধারণরূপে বর্ণনা করা হয়নি। পােপের উদ্যোগ প্রসূত অনুষ্ঠানটি একজন সুযােগ্য এবং অনাক্রমনীয় প্রতিষ্ঠা লাভে সফল নৃপতিকে অর্ঘ্যদানরূপে বিবেচিত হয়েছিল। পােপ লিও রাজা শার্লমানকে সম্রাটে রূপান্তরিত করেন নি, আপন প্রতিভায় এবং সাফল্যে তিনি সম্রাট হয়েছিলেন, চার্চ সাধারণ্যে সে সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য ঘােষণা করেছিল মাত্র। আধুনিক কালের একজন ইতিহাস রচয়িতা C. D. Burns কিন্তু স্পষ্টই এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে জয়গর্বী ফ্রাঙ্ক বীর স্বয়ং এই অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। তার বিচারে শার্লমান ‘Play Emperor’ ছাড়া বেশি কিছু ছিলেন না। ৮০০ সালে খ্রিস্টজন্মোৎসবের ঘটনা সম্পর্কে বেলজিয়ান ঐতিহাসিক হেনরী পিরেনের (আঁরি পিরেন) মন্তব্যই বােধ হয় সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী এবং বিতর্কিত। তার মতে ক্যারােলিঞ্জীয় অধ্যায়ের উল্লেখযােগ্য সমস্ত ঘটনাই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মুসলমান শক্তির বিস্তারের প্রতিক্রিয়া মাত্র। বর্বর জার্মান আক্রমণ শুরু হবার দুই শতাব্দী ধরে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু ৮ম শতাব্দীর মধ্যেই মুসলমান শক্তির অভিঘাতে এই ভূখণ্ডের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়, রােমান সভ্যতার ক্ষীণ স্পন্দনটুকুও স্তব্ধ হতে শুরু করে। এই শূন্যতা এবং ক্ষতিপূরণের জন্য, জার্মান সমাজব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখার জন্য নতুন কোন উপায়ের সন্ধান করতে হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্ট হয়েছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য যা ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রাচীনতর পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের প্রভাবমুক্ত। সুতরাং পরোক্ষভাবে মুসলমানগণই ছিল ফ্রাঙ্করাজ শার্লমানের সম্রাটের মর্যাদায় ভূষিত হবার মূলে – “মহম্মদই সৃষ্টি করেছিলেন সম্রাট শার্লমানকে”। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিম ইউরােপের যােগসূত্র যখন সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তখনই পশ্চিমী সভ্যতার হৃতাবশিষ্টটুকুকে কেন্দ্র করে, রােমে নতুন এক সাম্রাজ্যের জন্ম হলো।

শার্লমানের সম্রাট হবার গুরুত্ব সম্পর্কে বিতর্ক :

শার্লমানের অভিষেক অনুষ্ঠান এবং পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের গরত্ব মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসে সযত্নে বিশ্লেষিত হবার মতো একটি বিষয়। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বিচারে ৮০০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা যুগান্তকারী এবং তা সমগ্র মধ্যযুগের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। আবার কারো লেখায় চিত্তাকর্ষক এই অনুষ্ঠানটির বর্ণনায় ব্যঙ্গবিদ্রূপ প্রচ্ছন্ন থাকেনি। এপ্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মত –

  • লর্ড ব্রাইসের চোখে অসামান্য গুরুত্ব : শার্লমানের সম্রাটরূপে অভিষিক্ত হবার ঘটনাটির মধ্যে অসামান্য, তুলনারহিত তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহ্যসিক লর্ড ব্রাইস। ১৯শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে (১৮৬৪) প্রকাশিত, বহু সম্মানিত তার গ্রন্থটির “দ্য হােলি রোমান এম্পায়ার*-নামকরণের মধ্যেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে শার্লমানের সম্রাটরূপে বৃত হবার ঘটনা তাকে কী পরিমাণে অভিভূত করেছিল (এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে বিষয়াস্তরে অগ্রহান্বিত হওয়ায় ১৯০৪ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হবার কালে ঐতিহাসিক ব্রাইস তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অবকাশ পাননি)। তার বিচারে ৮০০ সালে খ্রিস্টজন্মােৎসবের শুভদিনেই জন্ম হয়েছিল এক সহস্রবৎসর স্থায়ী (৮০০-১৬০৬ খ্রি.) পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের এবং শার্লমান কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত সাম্রাজ্যের মধ্যেই তিনি ‘ইউনিভার্সাল মনার্কি’ এবং মানবসমাজসৃষ্ট শাসনতন্ত্রের সর্বোত্তম আদর্শ প্রতিফলিত হতে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান শুধুমাত্র মধ্যযুগের কেন্দ্রাবস্থিত নয়, তা ছিল অতিবিরল সেই সমস্ত ঘটনার অন্যতম যা সংঘটিত না হলে মানবেতিহাস ভিন্ন পথবাহী হত। মধ্যযুগের তমসাবৃত পর্বে সমাজে দুটি পরস্পরবিরােধী প্রবাহ এবং প্রবণতা সক্রিয় ছিল – একটি বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা ও অজ্ঞানতাপ্রসূত দুপ্রবৃত্তির প্রতীক, অপরটি সুস্থতর জীবনের প্রতি, রাষ্ট্রিক সংহতির (যার ভিত্তি ছিল প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যের মধ্যে এবং রােমান চার্চের প্রতি আন্তরিক ও সুগভীর আনুগত্যের মধ্যে ছিল যার নিরন্তর প্রকাশ) জন্য, মানব কল্যাণের জন্য বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের আকুলতা। শার্লমানের অভিষেক এই দ্বিতীয় প্রবণতার জয় সূচিত করেছিল, আর শুভপ্রসূ এই ঘটনার প্রভাব হয়ে উঠেছিল অন্তহীন।
  • ফার্ডিন্যান্ড লটের চোখে এর গুরুত্বহীনতা : প্রখ্যাত ফরাসী ঐতিহাসিক ফার্ডিন্যান্ড লট (Ferdinand Lot) লর্ড ব্রাইসের এই উচ্ছ্বসিত এবং আবেগতপ্ত ব্যাখ্যার প্রতি বিরূপ। তীক্ষ বিদ্রূপ ঝলসে উঠেছে তার রচনায়। তিনি লিখেছেন, “৮০০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাটি বাতিল হয়ে যাওয়া ধ্যানধারণায় অনুরক্ত কয়েকজন যাজকের যেমন তেমন করে উপস্থাপিত শূন্যগর্ভ প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।” তার সিদ্ধান্ত এই যে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে সাময়িক শূন্যতার সুযােগে ফ্রাঙ্ক ও লােম্বার্ডদের রাজাকে অকস্মাৎ সম্রাটের অভিধায় ভূষিত করা হাস্যকর এবং অন্তঃসারহীন একটি প্রচেষ্টা। বাইজান্টাইনদের পক্ষে শার্লমানকে সম্রাটরূপে স্বীকার করা ছিল প্রশ্নাতীত কেননা তাদের চোখে ফ্রাঙ্করা তখনও বর্বর; অমিতবীর্য শার্লমানের পক্ষেও তা অর্জন করা ছিল দুঃসাধ্য। ফার্ডিন্যান্ড লট এ বিশ্বাসে অটল যে শার্লমানের অভিষেক ইতিহাসের কালতরঙ্গে উৎক্ষিপ্ত চিত্তাকর্ষক একটি ঘটনামাত্র।
  • রোমান সাম্রাজ্য গঠনে জেফ্রে ব্যারাক্লর অস্বীকার : মধ্যযুগীয় ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ জেফ্রে ব্যারাক্ল ঐ যুগের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে এইমত প্রকাশ করেছেন যে শার্লমানের অভিষেকের মধ্য দিয়ে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের জন্ম হয়নি, এমনকি প্রথম অটোর সময়েও এই সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটেনি। শার্লমানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার সাম্রাজ্যের প্রকৃত সমাধি হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ৮০০ থেকে ১৮০৬ খ্রি. পর্যন্ত পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক ইতিহাসের অস্তিত্ব কল্পনা অনৈতিহাসিক। পােপ তৃতীয় লিও যে অনুষ্ঠান করেছিলেন তা ধর্মীয় আচরণসপৃক্ত বলে মনােগ্রাহী হলেও বৈধ ছিল না, তা ছিল সম্পূর্ণরূপেই তার অধিকার বহিভূত। আর সেন্ট পিটার্স ভজনালয়ে সমবেত জনতা কর্তৃক শার্লমানের সম্রাট-পদ প্রাপ্তি অনুমােদিত হলেও এই পদটি বংশানুক্রমিক হয়ে যায়নি, কোনও কালে তা ছিলও না। 

যুগের প্রয়োজনেই খ্রিস্টধর্ম রক্ষায় নতুন রোমান সাম্রাজ্যের উদ্ভব : সামগ্রিক বিচারে বােধহয় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনাে যায় যে লর্ড ব্রাইস এবং ফার্ডিন্যান্ড লটের দুই বিপরীত মেরুতে স্থিত মতের মধ্যস্থলেই ৮০০ খ্রি. অভিষেক অনুষ্ঠানের যথার্থ মূল্যায়ণের সন্ধান পাওয়া যাবে। সম্রাটরূপে বৃত হবার পরে শার্লমান ব্যবহৃত একটি শীলমােহরে Renovatio Romani imperli-(রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন) এই শব্দগুলো উৎকীর্ণ আছে। কিন্তু শাসনাধীন ভূখণ্ডের সীমানার কথা বাদ দিলেও শার্লমানের সাম্রাজ্যকে প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবিত সংস্করণ আখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। কেননা বৈধতা এবং বাস্তব অবস্থার বিচারে এ তথ্য স্বীকার করতেই হয় যে অবয়ব এবং সজীব অস্তিত্ব নিয়ে বােমান সাম্রাজ্য রাজধানী কনস্টান্টিনােপল কেন্দ্র করে তখনো সগৌরবে অধিষ্ঠিত। আবার এ তথ্যও স্মর্তব্য যে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যও কখনো সরকারী এবং সুনিশ্চিতভাবে বিলুপ্ত হয়নি। ৮ম ও ৯ম শতকের অসংখ্য সচেতন মানুষের মনে শৃঙ্খলা, প্রজ্ঞা ও ধর্মের প্রতীকরূপে তার অধিষ্ঠান ছিল অম্লেয়। চার্লসকে লেখা সুপণ্ডিত আলকুইনের একটি পত্রে কনস্টান্টিনোপল এর (দ্বিতীয় রােমকূপে বর্ণিত) সাম্রাজ্যিক কর্তৃত্বের উল্লেখ আছে এবং সেইসঙ্গে আছে লাতিন জগতের প্রতি পবিত্র এবং অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব পালনে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত অক্ষমতার ইঙ্গিত। এই পত্রটিতে সমসাময়িক কালের অসংখ্য মানুষের এই অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে যে শার্লমান স্বয়ং খ্রিস্টের অনুগ্রহেই সমস্ত খ্রিস্টান জাতিগুলোর অধীশ্বর হয়েছেন এবং মর্যাদায়, সামর্থ্যে, বৈভবে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্রিস্টান জগতের সংহতি ও ধর্ম রক্ষায় একমাত্র তিনিই সক্ষম। আলকুইনের এই পত্রে ৮ম শতকের শেষার্ধে পশ্চিম ইউরােপের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণের যে নির্যাসটুকু আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ৮00 সালের ঘটনাটিকে কালাদিষ্ট বললে অসমীচীন হবে না।

ল্যাতিন জগতের সাথে ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের অভিন্নতা : ৮00 খ্রিস্টাব্দে সৃষ্ট ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্য কালক্রমে লাতিন জগতের সঙ্গে অভিন্ন হয় উঠল। ইউরোপে রােমান চার্চের প্রভাবাধীন সমস্ত জাতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই তার পথ চলা শুরু হলাে। এই সাম্রাজ্যের কোনও অঞ্চলের প্রজাদের পক্ষে পূর্ব সাম্রাজ্যকে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক – কোনও দৃষ্টিকোণ থেকেই রােমান সাম্রাজ্যরূপে আর স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। এই অর্থে শার্লমানের সাম্রাজ্যকে প্রাচীন প্যাগান রােমান সাম্রাজ্যের নব কলেবরে পুনর্জন্ম (পুনরুজ্জীবন নয়) হিসেবে বর্ণনা করা যায়। এই “নব রূপের” সবচেয়ে বিশিষ্ট অভিজ্ঞান হলো যে তা ছিল লাতিন-খ্রিস্টান এবং ৮ম শতকের শেষার্ধ এবং ৯ম শতাব্দীর মানুষ যাকে ইউরােপ বলে গ্রহণ করেছিল, তার সঙ্গে অভিন্ন।

লাতিন খ্রিস্টান জগতের নিজ স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা এবং পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে দুটো সাম্রাজ্যের উদ্ভব : শার্লমানের অভিষেকের পর থেকে স্বাভাবিক কারণে পশ্চিম ইউরােপ বা লাতিন খ্রিস্টান জগৎ আপন স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে, ইউরােপের পশ্চিম ও পূর্ব অর্ধের ব্যবধানও অনতিক্রম হয়ে উঠতে থাকে। পূর্বদিকে শার্লমানের সাম্রাজ্যের সীমান্ত রােমান চার্চের প্রভাবাধীন সীমানার সঙ্গে ছিল অভিন্ন। এর অপর পারেই ছিল গ্রীক বা অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী জাতি অধ্যুষিত অ-রােমান এলাকা। ভবিষ্যৎ ইউরোপের রাষ্ট্রনৈতিক বিন্যাস এভাবেই গড়ে ওঠে এবং পৃথক দুই ধারায়, ঐশ্লামিক জগৎকে পাশে নিয়ে ইউরােপের দুই স্বতন্ত্র অঙ্গের পথপরিক্রমা শুরু হয় সুনিশ্চিতভাবে ৮০০ সালের পর থেকে। ঐতিহাসিক জেফ্রে ব্যারাক্ল এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে শার্লমানের সম্রাটপদপ্রাপ্তির অন্যতম প্রধান গুরুত্ব তার বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রেই নিহিত আছে। বাইজান্টাইন সম্রাটগণ প্রাচীন রােমান সম্রাটদের অধীনস্থ সমস্ত ভূখণ্ডের উপর তাদের দাবীর বৈধতা সম্পর্কে অটল ছিলেন যদিও বাস্তবে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী সঙ্কীর্ণ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের অধিকার। ৮০০ সালের পর পশ্চিম সাম্রাজ্য সৃষ্ট হলে এই দাবীর অসারতা এবং অযৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হলো। ফ্রাঙ্ক সম্রাটও নিজেদের পূর্ব রােমান সম্রাটের সমমর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে দাবী করলেন। দীর্ঘ আলোচনা, উত্তপ্ত বাদানুবাদ, কখনো বা সামরিক শক্তি প্রয়ােগের ভয় দেখিয়ে এ সমস্যার মীমাংসার চেষ্টার পরে ৮১২ সালে বাইজান্টাইন সম্রাট শার্লমানকে পশ্চিম সাম্রাজ্যের অধীশ্বরবৃপে স্বীকৃতি দান করলেন। এর পরে এক অখণ্ড রোমান সান্তাজ্যের পরিবর্তে, বৈধতা অবৈধতার প্রশ্ন সঙ্গে করে ইউরােপ মহাদেশে দুটি সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বাস্তব ঘটনা হয়ে উঠল।

রােমান ও জার্মান উপাদানের সংমিশ্রণ, জার্মান প্রভাবের আধিক্য ও রোমান উপাদানের অভাব : অনেক ঐতিহাসিক ৮০০ সালে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য সৃষ্টির মধ্যে খ্রিস্টান, রােমান ও জার্মান উপাদানের সংমিশ্রণ দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু শার্লমান এবং তার উত্তরসূরী অটো এবং অপর জার্মান সম্রাটগণ ইতালীর বৃহৎ এ অংশের অধীশ্বর হলেও পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ক্রমশ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে দূরে সরে গিয়ে আল্পস পার হয়ে জার্মানীতে স্থিত হয়। সময়ের পরিবর্তে সূচিত হয় জার্মান প্রভাবের আধিক্য। শার্লমানকে সম্রাট করে যে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের নবজন্ম হলাে তার আকৃতি ও প্রকৃতির মধ্যে নাম এবং বিধ্বস্ত ঐতিহ্যের কিছু ক্ষীণ অনুসরণ ছাড়া রােমান উপাদান প্রায় কিছুই ছিল না। প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বহু স্থানই ছিল ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে। ইংল্যান্ড, স্পেন এবং স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে ফ্রাঙ্ক শাসনের ছায়াও পড়েনি। সম্রাটের মর্যাদা লাভের পরেও শার্লমান মূলত একজন ফ্রাঙ্ক শাসকই রয়ে গিয়েছিলেন, ফ্রাঙ্ক শাসকের খাস ভূ-সম্পত্তি থেকেই সংগৃহীত হত তার রাজস্বের মুখ্য অংশ, ফ্রাঙ্করাজের ভ্যসালদের মধ্য থেকে মনােনীত হতেন তার মন্ত্রী এবং রাজকর্মচারীবৃন্দ, আর, রাইন, মিউস এবং মােসেল নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খণ্ডই ছিল তার শক্তি সামর্থ্যের প্রধান উৎস। এমনকি রাজধানী হিসেবে কোনও নগরীকে চূড়ান্ত এবং স্থায়ীভাবে বেছে না নিলেও, রোম নয়, আখেনই ছিল তার সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। কিন্তু অ-রােমান হলেও সমাজ ও যুগের প্রয়ােজন সাধনে পশ্চিম সাম্রাজ্যের অপরিহার্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সুদীর্ঘ অস্তিত্বে। নিরবচ্ছিন্ন না হলেও ১৮০৬ সাল পর্যন্ত ছিল এই সাম্রাজ্যের আয়ু। বিধ্বস্ত হলেও, বারবার, হয়তো কিছুটা রূপান্তরিত হয়ে এই সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান এই সত্যই উদঘাটিত করে যে ৮০০ সাল অভিষেক অনুষ্ঠান শুধুমাত্র কৌতূহল উদ্দীপক, অন্তঃসারহীন একটি ঘটনা ছিল না। 

সম্রাট হওয়ায় শার্লমানের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যে প্রভাব : সম্রাটরূপে অভিষিক্ত হবার ফলে শার্লমানের রাজ্যসীমা বা বৈভবের সামান্যতম বৃদ্ধিও ঘটেনি। কিন্তু একজন বর্বর শাসকের অসামান্য পরাক্রম ও অতুলনীয় দক্ষতার পক্ষেও যে সম্মান লাভ ছিল অসম্ভব, ৮০০ খ্রিস্টাব্দের অভিষেক অনুষ্ঠান তা দিয়েই তাকে ভূষিত করেছিল। অভূতপূর্ব এই ঘটনার পর থেকে তিনি শুধু ফ্রাঙ্কদের নির্বাচিত রাজাই রইলেন না, ঈশ্বরের মনােনীত রূপে সুদুর্লভ মর্যাদা ও গৌরবস্নাতও হলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট শার্লমান খ্রিস্টান জগতের পার্থিব অপার্থিব – সকল বিষয়েই নিজেকে সর্বশক্তিমান রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়েছিলেন। তার রূপান্তরিত এই সত্তার অবিরল প্রতিফলন ঘটেছিল চার্চের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গীতে, প্রজাপুঞ্জের নৈতিক জীবনের মান উন্নয়নের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং ধর্মীয় সংস্কারের অন্তহীন উদ্যমে।

ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের চিন্ময় জগতে প্রেরণা : ৮০০ খ্রিস্টাব্দে শার্লমানের মহামর্যাদাপূর্ণ সম্রাটের পদে বৃত হবার ঘটনাটির শুভ প্রভাব ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের চিন্ময় জগতেও অপরিসীম প্রেরণার সঞ্চার করেছিল। সম্রাটকে লেখা পণ্ডিত আলকুইনের একটি পত্রে এই বিশ্বাস আভাসিত হয়েছিল যে এই অসামান্য ঘটনার পর ফ্রান্সে এক নতুন অ্যাথেন্স এর অভ্যুদয় ঘটবে। খ্রিস্টধর্মের পুণ্যস্পর্শে এই “নতুন অ্যাথেন্স” গ্রীক সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র পুরােনো অ্যাথেন্স এর থেকেও মোহনীয় হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া ফ্রাঙ্ক শাসকের এই মহিমাবৃদ্ধি ফ্রাঙ্কদের এই বিশ্বাস দৃঢ়তর করতে থাকে যে তারাই “ঈশ্বরের অনুগ্রহভাজন” (Populus Dei-The people of God) এবং “প্রকৃত খ্রিস্টান” (Populus Christianus)। এই বােধ এবং উপলব্ধি নিঃসন্দেহে তাদের নবাৰ্জিত ভূমিকার উপযুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ক্যারােলিঞ্জীয় রেনেসাঁসের সূচনার উপর না হলেও এর সম্প্রসারণ ও বেগবতী হবার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ রচনার উপর পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্রাট লােকান্তরিত হবার পরেও পশ্চিম ইউরােপীয়দের পুরােনো জীবনাদর্শ ত্যাগ করে খ্রিস্টীয় ধ্যান ধারণায় প্রভাবিত নতুন এক সাংস্কৃতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত হতে দেখা গিয়েছিল এই কারণেই।

মধ্যযুগের কেন্দ্রস্থ ঘটনা নয় : কিন্তু শুধু এই কারণেই লর্ড ব্রাইসের মতের প্রতিধ্বনি করে ৮০০ সালের অভিষেক অনুষ্ঠানকে মধ্যযুগের কেন্দ্রস্থ ঘটনার আসনে বসানো অযৌক্তিক। মধ্যযুগের সামগ্রিক জীবনের উপর যে সমস্ত ঘটনা ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ছিল দূর বিস্তৃত এবং অনুক্ষণ অনুভূত তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্পর্শ করেনি পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পুনরুত্থানের অনুষ্ঠান। সামন্ততন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, দুশো বছর স্থায়ী ক্রুশেড, নাগরিক জীবন ও বাণিজ্যের বিস্ময়াবহ বিস্তার, মঠজীবনবাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ আবির্ভাব। প্রায় সমগ্র মধ্যযুগ ধরে মহাদেশের প্রতিটি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত করেছিল এবং ইউরোপীয় সমাজে এনে দিয়েলি প্রাণচাঞ্চল্য এবং গতি-তাদের সঙ্গে শার্লমানের সম্রাটপদ প্রাপ্তি, ক্ষীণতম যোগসূত্র স্থাপন করাও দুরূহ। 

এর ফলে পরবর্তীতে পোপদের ক্ষমতাবৃদ্ধি ও জার্মানদের রাষ্ট্রিক বিকাশে সংকট : শার্লমানের অভিষেক অনুষ্ঠানের অপর এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব, ঘটনার সময়ের পর্যবেকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও, কালের অগ্রগতির সঙ্গে তা স্পষ্ট ও প্রবল হয়ে ওঠে। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে কৃতজ্ঞ পোপ তৃতীয় লিও, বিব্রত শার্লমানের মস্তকে রাজমুকুট স্থাপন করেছিলেন (বলা বাহুল্য ফ্রাঙ্ক শাসকের বিরক্তি এবং উষ্মার কারণ ঘটিয়ে)। শার্লমানের জীবনীকার এইনহার্ড লিখেছেন যে পোপের এ জাতীয় আচরণের সামান্যতম পূর্বাভাস পেলে ফ্রাঙ্কনৃপতি সেন্ট পিটার্স ভজনালয়ে প্রবেশ করতেন না। এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তির কোনও সুযোগ না দিয়ে ৮১৩ সালে সম্রাট স্বয়ং আখেনের রাজপ্রাসাদে আত্মজ এবং উত্তরাধিকারী লুই দ্য পায়াসকে ভাবী সম্রাটরূপে অভিষিক্ত করেন। তিনি যে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য মহামহিম সম্রাট এবং পােপ যে কেবলমাত্র তার মুখ্য বিশপ – যার প্রধান কর্তব্য প্রতিনিয়ত সম্রাটের সুখ ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা জানানো – এ তত্ত্ব ঘােষণায় শার্লমান ছিলেন অকুণ্ঠ ও ক্লান্তিহীন। কিন্তু লিও আচরিত কর্মের সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা এবং মূল্যায়ণের সম্ভাবনা থেকেই গিয়েছিল। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ, ক্ষমতাশালী পরবর্তী পােপগণ এই মতপ্রকাশে অটল থাকেন যে ৮০০ সালে প্রকৃতপক্ষে পােপ লিও একজন ফ্রাঙ্ক শাসককে সম্রাটের মর্যাদা দান করেছিলেন, এবং এ জাতীয় কাজের অধিকার আছে একমাত্র পােপেরই। তারাই সম্রাট-স্রষ্টা সাম্রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা। খ্রিস্টীয় সমাজে ‘বিহিতক্রম’ অনুযায়ী (Right Order) পােপের স্থান সুনিশ্চিতভাবে সম্রাটের আসনের বহু ঊর্ধ্বে। পোপতন্ত্রের মুখপাত্র Liber Pontificalis এর এই দাবী এবং সম্রাটপক্ষীয়দের তার তীব্র প্রতিবাদ ১১শ শতকে তীক্ষ্ণ সংঘাত ও সংঘর্ষের রূপ নিয়ে মধ্যযুগের অবশিষ্ট কালের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, জার্মানীর স্বাভাবিক রাষ্ট্রিক বিকাশের সম্ভাবনা হয়ে গিয়েছিল সুদূরপরাহত, এবং ইউরােপের বাকি বহু অঞ্চলেও পড়েছিল সঙ্কীর্ণ ক্ষমতাদ্বন্দ্বের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার প্রভাব। 

শার্লমানের শেষদিনগুলো ও কৃতিত্ব

শেষ দিনগুলো : সম্রাট শার্লমানের জীবনের শেষ বছরগুলো প্রিয়জনের বিচ্ছেদে শােকদগ্ধ হয়ে উঠেছিল। তার শুদ্ধশীল সহােদরা গিসেলা এবং পুত্র পিপিন (দ্য হাঞ্চবাক) পরপর মৃত্যুমুখে পতিত হন (৮১০ খ্রি.)। আরো গভীর একটি শােক তাকে বিহ্বল করে দেয় যখন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস এর দেহাবসান হয় (৮১১ খ্রি.)। এই পুত্রটিই ছিলেন তার আশাভরসার প্রধান অবলম্বন, সাম্রাজ্যের ভাবী শাসকরূপে চিহ্নিত। অবশ্য এই বিষাদাক্রান্ত দিনগুলো কিছুটা বিশিষ্ট এবং উল্লেখযােগ্য হয়ে গিয়েছিল ৮১২ সালে বাইজান্টাইন সম্রাট কর্তৃক তার স্বীকৃতিতে। কনস্টানটাইন-আগত রাজদূতবৃন্দ কর্তৃক ‘ব্যাসিলিয়াস’ এবং ‘ইমপারেটর’ (Basileus and Imperator) অভিধায় ভূষিত হলেন পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। ইউরােপের পূর্ব ও পশ্চিম অর্ধের দুটি সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথে আর কোনও অন্তরায় রইলো না। এই সময়েই বাগদাদের সুখ্যাত খলিফা হারুণ অল রসিদ ফ্রাঙ্ক সম্রাটের সখ্যের অভিলাষী হয়ে স্পেনের বিদ্রোহী স্যারাসেন প্রজাদের বিরুদ্ধে তার সাহায্য প্রার্থনা করে পাঠান। দেহাবসানের আগে সম্রাট আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পাদন করে গিয়েছিলেন। ৮১৩ সালে পুত্র লুইকে সহশাসক রূপে ঘােষণা করে স্বয়ং তাকে আখেন এ রাজপদে অভিষিক্ত করেন। সম্রাট আয়ােজিত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই তত্ত্বই ঘােষিত হলো যে শার্লমানের অতুলনীয় প্রতিষ্ঠা তার স্বােপার্জিত, তার সাম্রাজ্যিক মহিমার জন্য তিনি ঋণী নন কারো কাছে, তার সম্রাটপদ প্রাপ্তি পােপের উদ্যোগপ্রসূত কোনও অনুষ্ঠান বা রােমান প্রজাপুঞ্জের সমর্থনের ফলে ঘটেনি। তাৎপর্যপূর্ণ এই ঘটনার অল্প কিছু পরেই সম্রাট শার্লমান লােকান্তরিত হন আখেনএ ৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী।

পরবর্তী ইউরোপীয় শাসকদের কাছে সম্রাটের অসামান্য কৃতিত্ব : পরবর্তী কালের ইউরােপের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও অসামান্য কৃতিত্ব যে কি পরিমাণে গভীর ও ব্যাপক ছিল তা বােঝা যায় তাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য ও বিচিত্র উপকথা ও উপাখ্যান সৃষ্টির মধ্যে। মধ্যযুগের নৃপতিদের মধ্যে শার্লমান হয়ে ওঠেন সর্বোত্তম রাজকীয় মহিমার প্রতীক। ইউরােপের গণমানসে তিনি প্রতিভাত হয়েছেন একজন লােকোত্তর পুরুষরূপে। দূরদেশবাসী স্লাভগণও প্রকৃত অর্থে রাজা ও সাধারণ শাসকের মধ্যে পার্থক্য বােঝাতে প্রথমােক্তকে চিহ্নিত করতে ‘কার্ল’ (Krol) শব্দটি ব্যবহার করতো। যে সমস্ত ভূখণ্ড ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের সীমানায় কোনও দিনই অন্তর্ভুক্ত হয়নি – আয়ার্ল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া সেখানেও তিনি বন্দিত হয়েছেন অসংখ্য কবিতা ও লােকগীতিতে। শার্লমানের বংশের সঙ্গে রক্তের সুদূরতম সম্পর্ক থাকাও মধ্যযুগের রাজপরিবারগুলোর কাছে শুধু ঈর্ষনীয় সৌভাগ্য বলেই বিবেচিত হতো না, তা রাজরংশের বৈধ তা স্বীকৃতিরও প্রধান নিরিখ হয়ে উঠেছিল। ফরাসীরাজ ফিলিপ অগাস্টাসের মাতার সঙ্গে শার্লমানের পরিবারের ক্ষীণ একটি সম্বন্ধ থাকায় তিনি ক্যারোলাইড (Karolide) অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। ঐ সময়কার রাজকীয় বৃত্তান্ত রচয়িতা সেণ্ট ডেনিস লিখেছেন যে, ফিলিপ অগাষ্টাসের রাজ্যাভিষেকের ফলে সম্রাট ও ফরাসীরাজ চার্লস দ্য গ্রেটের বংশ সাতটি প্রজন্মের পরে পুনরুজ্জীবিত হলো। আর যে সম্রাট শার্লমান রাজশক্তির শ্রেষ্ঠ প্রতীকরূপে পরবতীকালে পরমাদৃত হয়েছিলেন তাকে তার সমসাময়িক কালের বিশপগণ ‘খ্রিস্টান’, সুবিচারক ও অসাধারণ আইনজ্ঞরূপে ডেভিড এবং মেল্চি‌সেডেক্‌ এর সঙ্গে একাসনে বসাতে দ্বিধা করেন নি। 

তথ্যসূত্র

  • মধ্যযুগের ইউরোপ – ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, ৩য় সংস্করণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ – ২৮-৪৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.