উদ্বেগজনিত ভীতি বা এনজাইটি ডিজঅর্ডার

Table of Contents

ভূমিকা

অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত মানসিক রোগ হল উদ্বেগজনিত বিকৃতি (Anxiety Disorder)। বহুসংখ্যক ব্যক্তি এরোগে আক্রান্ত হয়। উদ্বেগ হল একধরনের ভয় এবং আশঙ্কা। ভয় বলতে বুঝায় একটি বিপজ্জনক উদ্দীপকের সম্মুখীন হওয়া— যে বিপদ বর্তমানে উপস্থিত আছে। কিন্তু এ ভয় যদি ভবিষ্যতের কোন বিপদের প্রত্যাশা থেকে হয়, তাহলে তাকে বলে আশঙ্কা (apprehension)। উদ্বেগ বহু ধরনের মনোবিকৃতিতে দেখা দিতে পারে। স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। তবে তা ক্ষণস্থায়ী এবং দৈনন্দিন জীবনের কার্যাবলীতে বিঘ্ন ঘটায় না। তাছাড়া, স্বাভাবিক ব্যক্তির উদ্বেগ উচ্চমাত্রায় পৌঁছায় না। এখানে যেসব মানসিক ব্যাধির কথা আলোচনা করা হয়েছে— যেমন অমূলকভীতি, আতঙ্ক (Panic), সাধারণীকৃত উদ্বেগ, বাধ্যতাধর্মী আচরণ ও চিন্তা, আঘাতের পরবর্তী মানসিক পীড়নজনিত বিকৃতি – এগুলোকে পূর্বে নিউরোসিস (Neurosis) বা নিউরোটিক প্রতিক্রিয়া বলে শ্রেণীবিভাগ বা শনাক্ত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এগুলোকে উদ্বেগজনিত বিকৃতি বলা হয়। এই বিকৃতিগুলোর প্রধান লক্ষণ হল অবাস্তব উদ্বেগ (unrealistic anxiety), ও অন্যান্য সমস্যা।

এ ধরনের সমস্যাগুলোকে ফ্রয়েড নিউরোসিস বলে অভিহিত করেছিলেন। সুতরাং নিউরোসিস নিদানটির সঙ্গে মনোসমীক্ষণ তত্ত্বটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরবর্তীকালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সমিতির নিদানিক নির্দেশিকায় (Diagnostic manual) যাকে সংক্ষেপে DSM II বলা হতো, তাতে বহু ধরনের লক্ষণকে নিউরোসিসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন অমূলকভীতি ও তার থেকে সৃষ্ট বর্জনমূলক আচরণ, কোন কাজের বাধ্যতামূলক পুনরাবৃত্তি, পক্ষাঘাত বা অবশাঙ্গতা (Paralysis) ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ব্যাধি- যেগুলোকে রূপান্তরমূলক প্রতিক্রিয়া বলা হতো-এসব ব্যাধিকে একত্রে নিউরোসিস বলে আখ্যায়িত করা হতো। কিন্তু আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সমিতি মনে করেন এসব বাধির মধ্যে সামান্য মিল আছে, সেজন্য উক্ত শ্রেণীবিন্যাস বা নিদান (Diagnosis) তারা বাতিল করেছেন। DSM-IV অনুসারে কোন মানসিক ব্যাধিকে উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া (Anxiety Disorder) বলতে হলে তার প্রধান লক্ষণ হবে উদ্বেগের আত্মগত অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট উপস্থিতি। “Anxiety disorders are diagnosed when subjectively experienced feelings of anxiety are clearly present.” (Davison & Neale 1998)। DSM—IV অনুসারে উদ্বেগজনিত বিকৃতিগুলোকে ৬টি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ

  • (১) অমূলক ভীতি (Phobias)
  • (২) আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া (Panic disorder)
  • (৩) সাধারণীকৃত উদ্বেগ জনিত প্রতিক্রিয়া (Generalized Anxiety disorder)
  • (৪) বাধ্যতাধর্মী কাজ ও চিন্তা (Obsessive compulsive disorder)
  • (৫) আঘাত পরবর্তী পীড়নজনিত বিকৃতি (Posttraumatic stress disorder)
  • (৬) স্বল্পস্থায়ী পীড়নমূলক প্রতিক্রিয়া (Acute stress disorder)

এগুলোর প্রত্যেকটিতেই উদ্বেগের আত্মগত অভিজ্ঞতা একটি সাধারণ লক্ষণ। কিন্তু উদ্বেগ ছাড়া অন্যান্য বিশেষ ধরনের লক্ষণের জন্য এগুলোকে আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি রোগের নির্ণায়ক লক্ষণ (diagnostic criteria) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে দুটি রোগের জন্য নির্ণায়ক লক্ষণ উপস্থিত থাকে তাহলে এই অবস্থাকে কো-মরবিডিটি (comorbidity) বলে। উদ্বেগজনক বিকৃতির রোগীদের মধ্যে কোমরবিডিটি বা যৌথ রোগলক্ষণ থাকার জন্য দুটি কারণকে দায়ী করা হয় – 

  • (১) বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগজনক বিকৃতির শ্রেণী বিভাগ সম্পূর্ণরূপে বিশেষ লক্ষণ ভিত্তিক নয়। যেমন উদ্বেগের শারীরিক লক্ষণগুলো (যথা ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া) আতঙ্ক জনিত বিকৃতি (Panic disorder), সাধারণীকৃত উদ্বেগজনিত প্রতিক্রিয়া এবং আঘাত পরবর্তী পীড়নজনিত বিকৃতিতেও (PTSD) উপস্থিত থাকে।
  • (২) উদ্বেগজনিত বিকৃতির জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হয়, সেগুলো আরো অনেক ধরনের বিকৃতিতে বর্তমান থাকে। যেমন একটি কারণ হল এই যে, ব্যক্তি মনে করে “সে পীড়নের উৎসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না” এই কারণটি অমূলকর্তীতি এবং সাধারণীকৃত উদ্বেগ (generalized anxiety disorder) এই উভয় ব্যাধিতেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং এ ধরনের একটি সাধারণ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতার জন্যই একজন ব্যক্তির মধ্যে দুটো উদ্বেগজনিত বিকৃতি শনাক্ত করা যেতে পারে। এবারে আমরা উদ্বেগজনিত বিকৃতির প্রত্যেকটি প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য, কারণ এবং চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

অমূলকভীতি (Phobias)

বিবরণ

মানসিক রোগের নিদান-বিশেষজ্ঞদের (Psychopathologists) মতে অমূলকভীতি (Phobia) হল রোগী যে সব বস্তু বা পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক মনে করে সেগুলোর প্রতি অত্যন্ত বেশি ভীতি সৃষ্টি হয় এবং সে এগুলোকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে— যার ফলশ্রুতিতে তার জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। অথচ ব্যক্তি বুঝতে পারে যে এসব বস্তু বা পরিস্থিতিকে ভয় করার বাস্তব সম্মত কোন ভিত্তি নেই। যেমন কেউ কেউ উঁচুস্থানে উঠতে ভয় পায় (উচ্চতা ভীতি), কেউ কেউ বদ্ধস্থানের ভয় করে, কেউ কেউ সাপ বা অন্য কোন প্রাণীকে মাত্রাতিরিক্ত ভয় করে, কেউ বা মাকড়সাকে ভয় পায়। তবে শর্ত হলো যে, এসব বস্তু বা পরিস্থিতিকে বাস্তবিকপক্ষে ভয় করার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই এবং এসব ভয় ব্যক্তির মধ্যে যন্ত্রণা বা অস্থিরতা সৃষ্টি করে (distress) এবং তার জীবন যাত্রা ব্যাহত করে। প্রত্যেকটি অমূলক ভীতির জন্য বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি অমূলকভীতি হলো –

  • বদ্ধ স্থানের ভয় (Claustrophobia)
  • উচ্চ স্থানের ভয় (Acrophobia)
  • জনতার ভয়/উন্মুক্ত স্থানের ভয়/প্রকাশ্য জনাকীর্ণ স্থানের ভয় (Agoraphobia)
  • আগুনের ভয় (Pyrophobia)
  • লিখনের ভয় (Ergasiophobia)
  • শ্বাস রোধের ভয় (Pnigophobia)
  • জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার ভয় (Taphephobia)

অনেক সময় কোন একটি বস্তু বা পরিস্থিতির অমূলক ভীতি খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে না এবং ব্যক্তি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসে না। যেমন যে ব্যক্তি শহরে থাকে তার যদি প্রচণ্ড সর্প ভয় থাকে, তাহলেও সে হয়ত এটাকে একটা গুরুতর সমস্যা বলে মনে করবে না, কারণ শহরে বসবাস করলে সাপের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু অমূলকভীতির অর্থ হল এই বস্তুটি/পরিস্থিতিটি তার মধ্যে উদ্বেগ এবং তীব্র যাতনা (distress) সৃষ্টি করে যা তার সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মনোবিজ্ঞানীরা অমূলকভীতির বিভিন্ন দিক বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ দেন। এজন্য অমূলকভীতিটি কি করে সৃষ্টি হল এবং কিভাবে তা দূর করা যাবে সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,

  • মনোসমীক্ষণবাদীরা (Psychoanalysts) অমূলক ভীতির বিষয়বস্তু বা আধেয় (content) কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তারা মনে করেন ভীতিজনক বস্তুটির একটি বিরাট প্রতীকধর্মী তাৎপর্য (Symbolic meaning) রয়েছে। তারা মনে করেন ভীতিজনক বস্তুটি একটি অবচেতন ভয়ের প্রতীক। ফ্রয়েডের একটি ব্যক্তি ইতিহাসে ছোট্ট হ্যানস (Little Hans) নামের একটি ছেলের ঘোড়ার প্রতি অমূলক ভয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। বাড়ির বাইরে গেলেই এই ভয় তাকে পেয়ে বসত। রোগীর সাথে কথা বলে ফ্রয়েড জানতে পারেন যে হ্যানস ঘোড়ার মুখের চারপাশের কালো জিনিস এবং ঘোড়ার চোখের চারপাশের কালো রঙকে বেশি ভয় পেত। মনোসমীক্ষণ করে ফ্রয়েড আবিষ্কার করেন যে ঘোড়াটি প্রকৃত পক্ষে ছেলেটির পিতার একটি প্রতীক হিসাবে কাজ করছে যার গোফ ছিল এবং যিনি চশমা পরতেন। ফ্রয়েড মনে করেন যে, ছেলেটি তার পিতাকে ভয় করত এবং এই ভয় ঘোড়ার প্রতিকৃতিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। তারপর থেকে ছেলেটি ঘোড়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এমনিভাবে অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে যেসব ক্ষেত্রে অমূলকভীতির একটি প্রতীকী তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
  • কিন্তু শিক্ষণ তত্ত্বের সমর্থকগণ কোন ভীতির বিষয়বস্তু বা আধেয় নিয়ে মাথা ঘামান না। বরং তারা ভীতিটি ব্যক্তির জীবনে কি প্রয়োজন সাধন করে অর্থাৎ এর কাজ (function) নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের মতে সাপের ভয় আর ঘোড়ার ভয় কিংবা উচ্চস্থানের ভয় একই প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়, এবং এগুলোর চিকিৎসাও একই পদ্ধতিতে করা যায়।

এখানে দু’ধরনের অমূলক ভীতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে :

বিশেষ বস্তুর ভীতি (Specific phobias) এবং সামাজিক পরিস্থিতির ভীতি বা সামাজিক ভীতি (Social phobias)

বিশেষ (বস্তুর) ভীতি (Specific Phobias)

বিশেষ বস্তুর প্রতি অমূলক ভীতি হল বিশেষ কোন বস্তু বা পরিস্থিতির উপস্থিতিতে ভয় অথবা ভবিষ্যতে উক্ত বস্তুর বিপদের অযৌক্তিক আশঙ্কা। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শতকরা ৭ জন পুরুষ এবং ১৬ জন মহিলা সারা জীবনে কোন একবার বিশেষ বস্তুর অমূলক ভীতিতে আক্রান্ত হয়। এ ধরনের অমূলক ভীতিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কোন কোন সাংস্কৃতিক বা সামাজিক দলে অন্যান্য দল বা গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি। যেমন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আফ্রিকান আমেরিকানদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি (Kessler et al., 1994 Magee et al. 1996)। DSM-IV অনুসারে বিশেষ বস্তুর প্রতি অমূলক ভীতিকে এর উৎস অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমন, রক্ত ও ইনজেকশানের ভীতি, বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রতি ভীতি (যেমন এরোপ্লেনের ভীতি, এলিভেটর বা লিফট এর ভীতি, বদ্ধ ঘরের ভীতি ইত্যাদি), বিভিন্ন প্রাণীর ভীতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের ভীতি – যেমন উচ্চতা, পানি ইত্যাদি)। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের মধ্যে ভীতির বস্তুর দিক থেকে পার্থক্য থাকে। এসব অমূলক ভয়ের সঙ্গে সামাজিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সম্পর্ক রয়েছে।

সামাজিক ভীতি (Social Phobias)

সামাজিক ভীতিকে অনেক সময় সামাজিক উদ্বেগজনক বিকৃতি (Social anxiety disorder) বলা হয়। সামাজিক ভীতিতে আক্রান্ত হলে একজন ব্যক্তিকে একটি সামাজিক পরিস্থিতির অযৌক্তিক ভয় ব্যক্তিকে পেয়ে বসে। এর ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামাজিক ও পেশাগত জীবন ব্যাহত হয়। ব্যক্তির কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হবে, বা তার ক্ষমতা যাচাই করা হবে এমন ধরনের পরিস্থিতি সে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে এবং সে উদ্বেগের লক্ষণ প্রকাশ করে, অস্বস্তি বোধ করে এবং লজ্জিত আচরণ করে। কেউ কেউ জনসভায় বক্তৃতা করতে অতিরিক্ত ভয় পায়, কেউ কেউ জন সমক্ষে নাচ্ গান বা অন্যকোন কাজ করতে অযৌক্তিক ভয় পায়, অনেকের সঙ্গে খাদ্যগ্রহণ, সাধারণ শৌচাগার ব্যবহার করতে অথবা অন্যলোকের উপস্থিতিতে যেকোন ধরনের কাজ করতে মাত্রারিক্ত ভয় ও উদ্বেগে আক্রান্ত হয়। সামাজিক ভীতি সাধারণ (generalized) অথবা, বিশেষ পরিস্থিতি সম্বন্ধে হতে পারে। যখন ব্যক্তি একটি পরিস্থিতিকে ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলে তখন তাকে বিশেষ সমাজিক ভীতি বলা হয়, আর যখন কোন ব্যক্তি অনেকগুলো সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ও ভীত হয়, তখন তাকে সাধারণ সামাজিক ভীতির রোগী বলা হয়। যারা সাধারণ সামাজিক ভীতিতে ভুগে তাদের বেশির ভাগ রোগীর মধ্যে রোগটি অল্প বয়সে শুরু হয়, অপেক্ষাকৃত বেশি মাত্রায় বিষণ্ণতা থাকে এবং তারা বেশি মাত্রায় মদ্যপান করে (Mannuzza et al., 1995)। অমেরিকায় শতকরা ১১ জন পুরুষ এবং ১৫ জন মহিলা জীবনের কোন না কোন সময় এ রোগে আক্রান্ত হয় (Kessler et al., 1994) যাদের সামাজিক ভীতি থাকে তারা অনেক সময় সাধারণীকৃত উদ্বেগ অথবা বিশেষ বস্তু/পরিস্থিতির ভয় অথবা পলায়ন পর ব্যক্তিত্বের গোলযোগে ভুগতে পারে। অর্থাৎ এ রোগটি অন্য আরেকটি অমূলকভীতির সঙ্গে, অথবা ব্যক্তিত্বের গোলযোগের সঙ্গে একত্রে উপস্থিত থাকতে পারে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বয়ঃসন্ধিতে (adolescence)— যখন ব্যক্তির জীবনে সামাজিক সচেতনতা এবং অন্যের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ধরনের সামাজিকভীতি শিশুদের মধ্যেও দেখা যায়। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে এ রোগের উৎস সম্পর্কে পার্থক্য ঘটে। যেমন জাপানে কাউকে আহত বা অপমানিত করার অমূলক ভীতিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি, আবার আমেরিকায় একজনের ঋণাত্মক বা নেতিবাচক মূল্যায়নের অযৌক্তিক ভীতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

অমূলক ভীতির কারণ (Etiology of Phobias)

অন্যান্য সব মানসিক রোগের বেলায় যেমন, অমূলকভীতির বেলায়ও ঠিক তেমনি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মনোবিজ্ঞানীরা অমূলকভীতির বিভিন্ন ধরনের কারণ নির্দেশ করেছেন। এখানে মনোসমীক্ষণমূলক, আচরণবাদী, জ্ঞানীয় এবং জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি (Paradigm) অনুসারে অমূলকভীতির কারণ আলোচনা করা হল।

মনোসমীক্ষণমূলক তত্ত্ব (Psycho analytic Theories)

ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব অনুসারে অমূলক ভীতির কারণগুলো নিম্নরূপ :

  • (১) অবদমিত কামনার দ্বারা সৃষ্ট উদ্বেগের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে অমূলকভীতি দেখা দিতে পারে। উদ্বেগ অথবা ভীতিজনক আদিম জৈবিক তাড়না ( Id impulse) যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে তা স্থানচ্যুত হয়ে একটি বস্তু বা পরিস্থিতির উপরে স্থানান্তরিত হয়— যে বস্তুর সঙ্গে উক্ত কামনার প্রতীকধর্মী সম্পর্ক রয়েছে। এসব বস্তু যেমন লিফট (lift) বা বদ্ধঘর, পরবর্তীকালে অমূলকভীতি সৃষ্টি করে। এসব বস্তু/পরিস্থিতির প্রতি ভীতি সৃষ্টি করে ব্যক্তি তার সচেতন মনে লুক্কায়িত (অবদমিত) দ্বন্দ্বের মুখোমুখী হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। অমূলক ভীতি হল একটি বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হওয়া থেকে দূরে থাকার অথবা শৈশব কালীন একটি অবদমিত দ্বন্দ্ব (Conflict) থেকে দূরে থাকার একটি আত্মরক্ষামূলক কৌশল। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের ছোট্ট হ্যানস শৈশবে স্বার্থকভাবে ইডিপাস কমপ্লেক্সটি (Oedipus complex) মীমাংসা করতে পারেনি বলে পিতার সম্বন্ধে তার তীব্র ভয় পিতার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘোড়ার উপরে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং ঘোড়াকে অযৌক্তিকভাবে ভয় পেতে শুরু করেছে।
  • (২) আরেকটি মনোসমীক্ষণ তত্ত্বে এরিয়েটি (Arieti 1979) বলেছেন যে অমূলক ভীতি আদিম কামনার অবদমনের ফলে তৈরি হয় না বরং এটা শৈশবের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের কোন সমস্যাকে অবদমন করার ফলে সৃষ্টি হয়। এরিয়েটি বলেছেন যে আজকে যারা অমূলক ভীতিতে ভুগছে, শৈশবে তারা যখন নিষ্পাপ ও সরল ছিল তখন তারা তাদের আশেপাশের সবাইকে বিশ্বাস করত যে তারা বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করবে কিন্তু পরে তারা বয়স্ক লোকদের ভয় পেতে শুরু করে। বিশেষ করে তারা পিতা-মাতাদের ভয় করে, কারণ তারা নির্ভরযোগ্যভাবে আচরণ করেনি। তারপর ব্যক্তির পরিণত বয়সে যখন পীড়ন সৃষ্টি হয় তখনই অবদমিত ভীতিটি বাইরে বেরিয়ে অমূলক ভীতির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।

আচরণবাদী তত্ত্ব (Behaviouristic theory)

আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অন্যান্য সব আচরণের মতই অমূলকভীতি এক ধরনের শিক্ষণের ফল বা সাপেক্ষণের ফল (conditoning)। তবে ঠিক কোন ধরনের শিক্ষণ প্রক্রিয়া অমূলকভীতির প্রতিক্রিয়াগুলো সৃষ্টির জন্য দায়ী সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে অন্ততঃ তিনটি মতপার্থক্য বিবেচনা করা উচিত :

  • (১) পরিহারমূলক সাপেক্ষণ মডেল (Avoidance conditioning model)
  • (২) অনুকরণমূলক শিক্ষণ (modeling) এবং
  • (৩) করণ সাপেক্ষণ (operant conditioning)।

পরিহারমূলক সাপেক্ষণ মডেল : এই মডেল অনুসারে একটি আপাত নিরপেক্ষ বস্তুকে একটি স্বাভাবিক ভীতি সৃষ্টিকারী উদ্দীপকের সঙ্গে একত্রে উপস্থিত করা হলে নিরপেক্ষ বস্তুটিও ভয় উৎপন্ন করবে। এ প্রসঙ্গে ওয়াটসন ও রায়েনার (Watson and Rayner. 1920)-এর একটি গবেষণা উল্লেখ্য। উক্ত গবেষণায় ১১ মাসের শিশু এলবার্ট কিভাবে একটি খরগোশ এবং অন্যান্য সাদা বস্তুকে ভয় পেতে শেখে তা পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এলবার্ট প্রথমে খরগোসকে ভয় পেতো না, কিন্তু উচ্চশব্দকে ভয় পেতো। উচ্চ শব্দটি ভয়ের একটি স্বাভাবিক উদ্দীপক (Unconditional stimulus)। খরগোস একটি সাপেক্ষ উদ্দীপক (conditional stimulus)। এখন প্রতিবার খরগোস দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে বা একটু পরে যদি উচ্চশব্দ করা হয়, তাহলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই শিশুটি শুধুমাত্র খরগোস দেখলেই ভীতিজনক প্রতিক্রিয়া করতে শুরু করে। চিৎকার করে, চোখ বন্ধ করে, ভয়ের স্থান থেকে পালাতে চায়। এভাবে একটি নিরপেক্ষ উদ্দীপক (যেমন খরগোস) ভয় উৎপাদন করতে শুরু করে। শিশু প্রথমে খরগোসকে ভয় করে পরে সেই ভয় অন্যান্য সাদা জিনিসের প্রতি ছড়িয়ে পরে। একে বলে সামান্যীকরণ। পরবর্তী পর্যায়ে এই ভীতি থেকে বা উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শিশুটি অন্যান্য বর্জনমূলক প্রতিক্রিয়া শেখে। যেমন পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়া বা সাপেক্ষ উদ্দীপকটিকে (যেমন খরগোশ বা সাদা বস্তু— যেমন তুলা) এড়িয়ে যাওয়া। এ ধরনের শিক্ষণের প্রথম প্রক্রিয়াটি অর্থাৎ শব্দের সঙ্গে খরগোসের সম্পর্ক স্থাপন হল চিরায়ত সাপেক্ষণ (Classical conditioning) এবং দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি হল করণ শিক্ষণ (Operant conditioning)। ভয়ের বস্তুটি এড়িয়ে যেতে পারলে ব্যক্তির বর্জনমূলক আচরণটির বলবৃদ্ধি ঘটে। অনেক ধরনের ভীতিকে এই মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন মোটর দুর্ঘটনার পর একজনের মোটর গাড়ীর প্রতি ভীতি সৃষ্টি হতে পারে।

উপরে থেকে পড়ে আহত হলে পড়ে উঁচু স্থানের অমূলকভীতি পেয়ে বসতে পারে। কোন সামাজিক পরিস্থিতিতে আঘাত পেলে (শারীরিক বা মানসিক) সামাজিক পরিস্থিতির— যেমন জনতা বা অন্যানা লোকের উপস্থিতির প্রতি অমূলক ভীতি সৃষ্টি হতে পারে। এসব তথ্য মুনজাক (Munjak, 1984) স্টেন বার্জার ও অন্যান্য (Stenberger et al., 1995) দের গবেষণায় পাওয়া গেছে। তবে সব ধরনের অমূলকভীতিকে পরিহারমূলক শিক্ষণের মডেলের মাধ্যমে বাখ্যা কার যায় না। অনেকেই বলেছেন, ভীতিজনক প্রতিক্রিয়া শিক্ষা করা হলে, অন্য কথায়, সাপেক্ষণ করা হলেও অন্যান্য মানুষ সেটি দ্রুত গতিতে ভুলে যায়। কিন্তু অমূলক ভয়ের রোগীরা সহজে তা ভোলে না। কারণ ব্যক্তি ভীতিজনক পরিস্থিতি সব সময় এড়িয়ে চলে এবং ব্যাপক সংখ্যক উদ্দীপকের সঙ্গে ভীতির সাপেক্ষণ ঘটে।

অনুকরণ (Modeling) : বান্দুরা এবং রোজেনথাল (Bandura and Rosenthal, 1966) এর পরীক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, ব্যক্তি অন্যকে অনুকরণ করে কোন বস্তু বা উদ্দীপকের প্রতি অমূলক ভীতি আয়ত্ত করতে পারে। গবেষকদ্বয় কয়েকজন পর্যবেক্ষককে বললেন একটি মডেল কে দেখার জন্য। মডেল যিনি হয়েছিলেন তিনি গবেষকদের দ্বারা নিযুক্ত গবেষণা সহকারী। মনোহরণ বৈদ্যুতিক সাজ সরঞ্জামে সজ্জিত একটি চেয়ারের সঙ্গে মডেলকে বাঁধা হয়েছিল। একটি ঝুনঝুনির আকস্মিক শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মডেল চেয়ারের হাতল থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং ব্যাথা পেয়েছে বলে ভান করে। যারা এ দৃশ্যটি দেখছিলেন সেই সময়ে তাদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল। মডেলটিকে বেশ কয়েকবার বৈদ্যুতিক আঘাতের মাধ্যমে কষ্ট পেতে দেখে ক্রমাগতই ঝুনঝুনীর আওয়াজ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষককের আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার মাত্রা (যা শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়েছিল) বেড়ে গিয়েছিল। সুতরাং দেখা গেল. সরাসরি একটি ক্ষতিকারক উদ্দীপকের সংস্পর্শে না আসলেও (সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ না করা সত্ত্বেও) শুধুমাত্র অন্যের প্রতিক্রিয়া দেখে একজন ব্যক্তি নির্দোষ একটি উদ্দীপকের প্রতি— যেমন ঝুনঝুনির আওয়াজ-আবেগীয় প্রতিক্রিয়া — (যেমন ভীতি) শিখতে পারে। ঠিক এমনি আরেকটি পরীক্ষণের মাধ্যমে মিনেকা ও তার সঙ্গীরা (Mineka and others, 1984) দেখেছিলেন যে, বানরের বাচ্চারা তাদের মায়েদের একটি সাপকে ভয় পেতে দেখে নিজেরা সাপটিকে ভয় পেতে শিখেছিল। এমনকি ওই বাচ্চারা খেলনা সাপকেও ভয় পেতে শিখেছিল। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, বানরের বাচ্চারা তাদের পিতা/মাতাদের দেখে সাপ, খেলনা সাপ, কুমীর, খেলনা কুমীর ইত্যাদিকে ভয় পেতে শেখে, কিন্তু অন্য কতকগুলোর প্রতি ভয় শেখেনা, যেমন ফুল বা খেলনা খরগোশ। অর্থাৎ সব ধরনের উদ্দীপকের প্রতি ভীতি অর্জিত হয় না, তবে অনেকগুলোর প্রতি হয়।

জ্ঞানীয় তত্ত্ব (Cognitive theories)

জ্ঞানীয় তত্ত্ব অনুসারে সাধারণভাবে উদ্বেগ এবং বিশেষভাবে অমূলক ভীতির জন্য ব্যক্তির নেতিবাচক উদ্দীপকের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা এবং ভবিষ্যতে নেতিবাচক ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি বলে ব্যক্তির বিশ্বাসকে দায়ী করা হয়। অন্য কথায়, যারা একটি ঘটনার শুধু খারাপ দিকই বেশি দেখে এবং যারা মনে করে ভবিষ্যতে ভাল ঘটনা বা ভাল ফলাফল না ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি, তারাই অমূলকভীতির শিকার হয় (Mathews and Me Leod, 1994)। অনেক গবেষক বলেছেন, যারা নিজেদের মূল্যায়ন সম্পর্কে চিন্তিত, অন্যের নিকট নিজেদের ইমেজ বা ভাবমূর্তি সম্পর্কে সচেতন, তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্বেগ এবং অমূলক ভীতিতে ভোগেন। ডেভিসন ও জিগহেলবোইম (Davison and Zighelboim 1987) তাদের গবেষণার মাধ্যমে উক্ত মতামত সমর্থন করেছেন। যারা নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রাখা নিয়ে চিন্তিত, অন্যেরা তার সমালোচনা করছে এটা জানলে তারা নিম্নলিখিত ধরনের মন্তব্য করে।

  • “আমি এসব লোকদ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছি।”
  • “আমি বিষণ্ন অনুভব করছি, প্রত্যাখ্যাত ভাবছি।”
  • “আমার ভেতরে যে অনুভূতি হচ্ছে তা দূর করার কোন উপায় নেই”।
  • “আমার মনে হয় আমি যখন অন্যের সঙ্গে কথা বলি তখন আমি খুব একঘেয়ে হয়ে যাই।
  • “আমি অনেক সময় মনে করি আমার কথা বলাই উচিত নয়” ইত্যাদি।

অনেকে মনে করেন, অমূলক ভীতির উৎসগুলো মনের অবচেতন স্তরে থাকে সেজন্য এগুলো সম্বন্ধে সচেতন মন চিন্তা করার জন্য তথ্য পায়না বলে উক্ত বস্তুর ভীতিটাকে অযৌক্তিক বলে তার নিজের কাছেই মনে হয়।

সামাজিক দক্ষতার অভাব (Lack of social skills) : সামাজিক পরিস্থিতির প্রতি অমূলকভীতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ সামাজিক দক্ষতার অভাবকে দায়ী করেন। তারা মনে করেন কোন সামাজিক পরিস্থিতির বিষয়ে কারো উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে রয়েছে ব্যক্তির অনুপযুক্ত আচরণ অথবা সামাজিক দক্ষতার অভাব (deficit)। তাদের অভিমত হল এই যে, এসব ব্যক্তি সামাজিক পরিস্থিতিতে কিভাবে উপযুক্ত আচরণ করতে হবে তা শেখেনি, সেজন্য তারা অন্যের সাহচর্যে স্বস্তিবোধ করে না, বারংবার ইতস্তত করে, সামাজিকভাবে অদক্ষ, এবং তারা তাদের সঙ্গী-সাথীদের দ্বারা সমালোচিত হয়। টুয়েন্টিম্যান ও ম্যাক ফল (Twentyman and Mec Fall. 1975) তাদের গবেষণার ফলাফল থেকে বলেছেন যে, সামাজিকভাবে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিরা সামাজিক দক্ষতার পরিমাপে কম নম্বর পায়। আবার ফিসেটি ও অন্যান্যরা (Fischetti, Curran and Wessberg. 1977) বলেছেন, এরূপ ব্যক্তিরা স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী সঠিক সামাজিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে না।যেমন তারা ঠিকসময়মত একজন ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিতে পারে না।

প্রবণতা সৃষ্টিকারী জৈবিক শর্তসমূহ (Predisposing Biological Factors)

আমরা ইতোপূর্বে যেসব তত্ত্ব আলোচনা করেছি, সেগুলোতে অমূলক ভীতির উৎপত্তি এবং তা বজায় রাখার জন্য পরিবেশগত ও সামাজিক শর্তাবলীর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, একই ধরনের পরিবেশ এবং শিক্ষণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন একজন অমূলক ভীতি অর্জন করে, আরেকজন করে না? পরিপার্শ্বিক অবস্থার পীড়নের দ্বারা যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রভাবিত হয়, সম্ভবত তাদের জৈবিক কার্যাবলীর কিছু ত্রুটি থাকে যাকে বলা হয় ডায়াথেসিস (Diathesis)— যার জন্য তাদের মধ্যে পীড়ন মূলক ঘটনার – পরে অমূলকভীতিতে পীড়িত হওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। দুটি ক্ষেত্রের গবেষণা এ ধরনের শর্তের প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দেয় একটি হল স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র সম্বন্ধীয় গবেষণা, আরেকটি হল বংশগতি এবং জিন সম্বন্ধীয় গবেষণা (genetic research)।

  • স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র (Autonomic Nervous system) : সব মানুষের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র পীড়নের প্রতি এক রকমভাবে সাড়া দেয় না। (Lacey, 1967) লক্ষা করেছেন যে বিভিন্ন মানুষের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে দৃঢ়তা (stability) এবং নমনীয়তা (lability)-র দিক থেকে পার্থক্য থাকে। যাদের স্নায়ুতন্ত্র বেশি নমনীয় তারা বহু ধরনের উদ্দীপক দ্বারা দ্রুত উত্তেজিত হয়। এবং তাদের অভ্যন্তরীণ যন্ত্র মন্ডলীর ক্রিয়া বেড়ে যায়। যেহেতু ভয় একটি আবেগীয় প্রতিক্রিয়া এবং আবেগীয় প্রতিক্রিয়ায় স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা রয়েছে, সেজন্য অমূলক ভীতিতেও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের নমনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ঘটনাটি প্যাভলভ বহু পূর্বেই আবিষ্কার করেছিলেন। প্যাভলভ বলেছিলেন যে, স্নায়ুতন্ত্রের নমনীয়তাই কোন কোন ব্যক্তির সাইকোসিস (Psychosis) ধরনের মানসিক বিকৃতির জন্য দায়ী।
  • বংশগতি (Genetics) : কিন্তু অনেকেই বলেছেন যে স্নায়ুতন্ত্রের নমনীয়তা (Lability) র জন্য বংশগতির প্রভাব দায়ী। ওস্ট (১৯৯২) এবং ফাইয়ার প্রভৃতি (১৯৯৫) গবেষক বলেছেন যে তারা অমূলক ভীতির রোগীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিকট আত্মীয়দের এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখেছেন। বাইডারম্যান ও অন্যান্য (Biderman et al, 1990) একটি গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন যে, যেসব শিশু “অবদমিত” (Inhibited) অর্থাৎ যারা লাজুক এবং সহজে প্রতিক্রিয়া করে না— তাদের মধ্যে অমূলকভীতির সম্ভাবনা যারা অবদমিত নয় তাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। তবে এসব গবেষণা থেকে কখনই অমূলকভীতিতে বংশগতির প্রভাব সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ এসব শিশু তাদের পিতা মাতা বা আত্মীয় স্বজনদের নিকট থেকেও এসব আচরণ শিখতে পারে।

অমূলকভীতির চিকিৎসা (Therapies for Phobias)

মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা (Psychoanalytic approaches)

এ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে নিম্নলিখিত কৌশলগুলো অবলম্বন করা হয়।

  • (১) অবচেতন দ্বন্দ্বগুলো আবিষ্কারকরণ ও উন্মোচিত করণ (uncovering the unconscious conflicts) : অনেকে মনে করেন ব্যক্তিকে সরাসরি ভীতিজনিত বৰ্জনমূলক প্রতিক্রিয়া কমাতে চেষ্টা করতে দেয়ায় বিপদ হতে পারে। কারণ এসব অমূলকভীতির মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে অবদমিত দ্বন্দ্বের পীড়ন থেকে রক্ষা করে। সেজন্য ব্যক্তির অবদমিত দ্বন্দ্বগুলোর উন্মোচন করা উচিত। এ উদ্দেশ্যে মুক্ত অনুষঙ্গ পদ্ধতি, স্বপ্ন বিশ্লেষণ, স্মৃতিচারণ, ইত্যাদি কৌশল অবলম্বন করা হয়।
  • (২) এরিয়েটি (Arieti)-র পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হলে ব্যক্তিকে সমাজের অন্যান্য দের সাধারণীকৃত উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া বা ভীতিগুলোকে পরীক্ষা পর্যালোচনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
  • (৩) আধুনিক কালের মনোসমীক্ষকগণ বিশেষতঃ যাদের অহং তত্ত্বের সমর্থক (Ego psychologist) বলা হয়, তাদের মতে ব্যক্তির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টির উন্মেষ ঘটানোর চেয়ে বরং ব্যক্তিকে ভীতিমূলক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উৎসাহ দেওয়া উচিত।
  • (৪) আলেকজাণ্ডার এবং ফ্রেঞ্চ (১৯৪৬) মনে করেন, রোগীদের সংশোধনমূলক আবেগীয় অভিজ্ঞতার (corrective emotional experience) সুযোগ দেওয়া উচিত।
  • (৫) ওয়াচটেল (Wachtel, 1977) আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে আচরণ চিকিৎসার কৌশল – যেমন প্রণালীবদ্ধভাবে সংবেদনশীলতা হ্রাস করণ প্রয়োগের মাধ্যমে অমূলকভীতির চিকিৎসা করতে বলেন।

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Behavioral Approaches)

আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা নিম্নলিখিত কৌশলগুলোর মাধ্যমে অমূলকভীতির চিকিৎসা করেন – 

  • (১) প্রণালী বদ্ধভাবে সংবেদনশীলতা হ্রাসকরণ (Systematic Desensitization) : এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে শ্লথনের উপদেশ দেওয়া হয়। শ্লথনরত অবস্থায় তাকে ক্রমশঃ কম ভয় সৃষ্টিকারী উদ্দীপক থেকে শুরু করে বেশি ভয়সৃষ্টিকারী উদ্দীপকসমূহ কল্পনা করতে বলা হয়। তারপর ক্রমশঃ তাকে বাস্তব উদ্দীপকের সম্মুখীন করা হয়, এবং সে এসব উদ্দীপককে সহজে গ্রহণ করতে শেখে। তবে ইনজেকশনের ভয় ও রক্ত সম্পর্কে ভয়ের চিকিৎসার সময় তাদের মাংস পেশী শ্লথ করার কথা বলা হয় না। বরং তাদের মাংসপেশী টান করতে বলা হয় এবং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।
  • (২) সামাজিক পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার কৌশল অর্জন করা : অনেক আচরণমূলক চিকিৎসক রোগীদের ভূমিকা পালন এবং রিহার্সেলের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে কিভাবে অন্যের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে হবে তা শিখিয়ে দেন। এতে তাদের অমূলকভীতি হ্রাস পায়।
  • (৩) মডেলিং বা অনুকরণ এর মাধ্যমে শিক্ষণ : যে সাপ দেখে ভয় পায়, চিকিৎসক নিজে সাপ ধরে তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন এবং অথবা সাপুড়ের দ্বারা প্রদর্শন করতে পারেন এবং রোগীকে ক্রমশঃ এর কাছে আসা ও ধরার জন্য উৎসাহ দিতে পারেন।
  • (৪) ফ্লাডিং (Flooding) : ইংরেজি ফ্লাড (flood) অর্থ বন্যা। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হলে, ব্যক্তিকে ভয়ের উৎসের সম্মুখীন করা হয় যাতে ব্যক্তি সর্বোচ্চ মাত্রায় ভয় বা উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রোগীর যে পরিমাণে কষ্ট ও যাতনা ভোগ করতে হয় সেদিকে লক্ষ্য করে অনেকেই এ পদ্ধতি প্রয়োগের বিরোধিতা করেছেন। এটা শুধু তখনই করা উচিত যখন প্রণালীবদ্ধভাবে সংবেদনশীলতা হ্রাসকরণ পদ্ধতিতে কোন উপকার হয়নি।
  • (৫) করণ শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ (Operant conditioning) : ব্যক্তিকে ক্রমে ক্রমে ভয়ের উৎসের প্রতি সহজে প্রতিক্রিয়া করার অভ্যাস করানো হয়। প্রথমে বস্তুটির একটি ছবি দেখানো যায় এবং সেটা যখন ধরে বা সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তখন পুরস্কৃত করা হয়, তার পর ভয়ের বস্তুটির কাছে গেলে পুরস্কৃত করা হয়, এভাবে ক্রমশঃ ভয়ের বস্তুটিকে ধরতে বা এটিকে সরাসরি মোকাবেলা করতে শেখানো হয়। অর্থাৎ ভয়ের বস্তুর প্রতি ধনাত্মক আচরণগুলোকে পুরস্কৃত করা ও নেতিবাচক বা বর্জন মূলক আচরণগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়।

জ্ঞানীয় দৃষ্টিভঙ্গি (Cognitive approach)

জ্ঞানীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ মনে করেন, ভীতির উৎস/কারণ সম্পর্কে ব্যক্তির জ্ঞান ও বিশ্বাস পরিবর্তন করতে চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু অনেকেই বলেন শুধু মাত্র জ্ঞান বা বিশ্বাসের পরিবর্তন করা হলেই ভয় দূরীভূত হয় না, সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিকে ভয়ের উৎসের সম্মুখীন করানো উচিত এবং আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগ করা উচিত। তবে সামাজিক পরিস্থিতির ভীতিতে জ্ঞানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি এবং সামাজিক কৌশল প্রশিক্ষণের যৌথ প্রয়োগে ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে (Heimberg et al., 1993. Marks, 1995, Mattick and Andrews, 1994)। সর্বশেষে বলা যায়, ভয়কে এড়িয়ে না চলে মোকাবেলা করাই সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা পদ্ধতি। ডেভিসন ও অন্যান্য (১৯৯৮) একটি চীনা প্রবাদ উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, বিপদের অভ্যন্তরে প্রবেশ কর, কারণ সেখানেই তুমি নিরাপদ আশ্রয় পাবে (“Go straight into the heart of danger, for there you will find safety.”)

জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি (Biological approach)

ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা (Drug therapy) : যেসব ঔষধ উদ্বেগের প্রশমন ঘটায় সেগুলোকে নিদ্রাকারক (sedatives), প্রশান্তিকর (tranquilizers) অথবা উদ্বেগনাশক (anxiolytics) ঔষধ বলা হয়। পূর্বে বারবিচ্যুরেট (barbiturate) জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হতো কিন্তু এগুলোতে আসক্তি সৃষ্টি হয় বলে বর্তমানে এগুলো অপ্রচলিত। ১৯৫০ সনের দিকে উদ্বেগ নাশক দুটি ঔষধ আবিষ্কৃত হয় : প্রোপেনেডিয়ল ( propanediols), যেমন মিলটাউন (miltown), এবং বেনজোডায়াজাপাইনস (Benzodiezapines) যেমন ভ্যালিয়াম (vallium), জানার (zanax) ইত্যাদি। শেষোক্ত ঔষধগুলো এখনও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো উদ্বেগনাশক হিসাবে কাজ করে, কিন্তু ভীতির জন্য নয়। সামাজিক ভীতি এবং বিষণ্ণতা এ উভয় লক্ষণের জন্য বেনজোডায়ঙ্গাপাইনস-এর তুলনায় মনোএমাইন অক্সাইডেজ ইনহিবিটরস্ (Monoamine Oxidase Inhibitors) বেশি ফল দেয়। তবে এগুলো আসক্তি সৃষ্টি করে এবং সম্পূর্ণ বাদ দিতে গেলে গুরুতর প্রত্যাহার জনিত লক্ষণ (withdrawal syndrome) প্রকাশ পায়।

শিশুদের অমূলক ভীতি ও সামাজিক অপসারণ (Childhood Fears and Social withdrawal)

বেশীর ভাগ শিশু বিকাশের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বিভিন্ন ধরনের অমূলক ভীতি এবং দুশ্চিন্তায় ভোগে। কিন্তু এগুলো যখন তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে ব্যাহত করে তখনই এগুলোকে অস্বাভাবিক আচরণ বা মানসিক বিকৃতি বলা যায়। উল্লিখিত সংজ্ঞা অনুসারে অনুমান করা হয় যে আমেরিকার শিশু ও কিশোরদের ১০% থেকে ১৫% শিশু এবং কিশোর অমূলক ভীতি ও সামাজিক অপসারণ মূলক বিকৃতিতে আক্রান্ত (Cohen et al., 1993, Kashani et al, 1989)। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যেসব বিষয়ে ভীতি দেখা যায় সেগুলো হল :

  • (১) স্কুল সম্পর্কে ভীতি (School Phobia)
  • (২) সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীতি (Social Phobia).
  • (৩) অন্যান্য ভীতি- যেগুলো বয়স্ক মানুষদের মধ্যেও হতে পারে।

এখানে শিশু-কিশোরদের দুটি প্রধান অমূলক ভীতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

স্কুল-ভীতি (School Phobia)

শিশুরা যখন স্কুল ভীতিতে ভোগে, তখন তার সামাজিক ও শিক্ষাগত জীবনে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এই ভীতি শিশুকে অকর্মন্য করে দিতে পারে। দু’ধরনের স্কুল ভীতি শনাক্ত করা হয়েছে : একটি হলো বিচ্ছিন্নতার ভীতির সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত। এটি সবচেয়ে বেশী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। শিশুরা সব সময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে যে, তারা যদি পিতা মাতার থেকে দূরে সরে যায় তাহলে তাদের অথবা তাদের পিতামাতার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চায়, এমনকি রাতে বাবা-মার সঙ্গে ছাড়া ঘুমাতে পারে না।

শিশুকে যখন স্কুলে ভর্তি করা হয় তখনই শিশুকে সর্ব প্রথম প্রায়ই পিতা-মাতার থেকে দীর্ঘক্ষণের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। সুতরাং শিশুরা যে স্কুলে যেতে চায়না বা স্কুলে যেতে ভয় পায় এর প্রধান কারণ হল বিচ্ছিন্ন হওয়ার উদ্বেগ (separation anxiety)। একটি গবেষণায় দেখাগেছে যে, বিচ্ছিন্নতার উদ্বেগের জন্য যেসব শিশু স্কুলে যেতে ভয় পায় তাদের ৭৫% শিশুর ক্ষেত্রেই তাদের মায়েরাও শৈশব কালে স্কুল প্রত্যাখ্যান করেছিল (Last and Strauss, 1990)। অনুমান করা হয়েছে যে, শিশুদের স্কুল প্রত্যাখ্যান করা বা স্কুলে যাবার বিরুদ্ধে তীব্র অনীহার কারণ নিহিত রয়েছে মায়ের সঙ্গে শিশুর অস্বাভাবিক বা ত্রুটিপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে। খুব সম্ভবতঃ মা তার নিজের বিচ্ছিন্নতার উদ্বেগকে শিশুর মধ্যে সংক্রমিত করেন, এবং নিজের অজান্তে শিশুর নির্ভরশীল এবং পরিহার মূলক আচরণকে বলবৃদ্ধি করেন।

দ্বিতীয় ধরনের স্কুল-প্রত্যাখ্যান হলো সত্যিকার স্কুল-ভীতির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। এক্ষেত্রে শিশু স্কুলকে সত্যি সত্যি ভয় পায়, অথবা একটি সাধারণ সামাজিক ভীতির অংশ হিসাবে স্কুলের প্রতি ভীতি তৈরী হয়। এসব শিশু একটু বেশী বয়সে স্কুলকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে এবং স্কুলের প্রতি ব্যাপক পরিহার মূলক প্রতিক্রিয়া করে থাকে। এদের ভীতি স্কুলের পরিবেশের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে— যেমন পরীক্ষায় ফেল করার ভয়, অথবা সমবয়সীদের বা ক্লাসের ছাত্রদের, কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষকের সঙ্গে কষ্টদায়ক সম্পর্ক।

সামাজিক ভীতি (Social phobia)

অনেক শ্রেণী কক্ষেই কমপক্ষে এক বা দুজন ছাত্র পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত শান্ত এবং লাজুক। এসব শিশু শুধুমাত্র অতি পরিচিত সঙ্গীদের সাথে এবং নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সাথে খেলা করে, ছোট বড় অন্য যেকোন অপরিচিত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলে। তাদের লজ্জা এত বেশি যে, তারা অন্যের সাথে মিশতে পারে না এবং অনেক সামাজিক দক্ষতা বা কৌশল শিখতে পারে না। অন্য ছেলেমেয়েরা যেখানে বহু ধরনের কাজ কর্মে অংশ গ্রহণ করে আনন্দ পায়, সেসব কাজ কর্মে তারা অংশ গ্রহণ করে না। পাড়া প্রতিবেশী ছেলে মেয়েরা যেখানে মাঠের খেলায় অংশ নেয়, সেসব খেলা তারা এড়িয়ে চলে। অনেক লাজুক ছেলেমেয়ে লজ্জা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও যারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে (withdrawn) তারা কখনও অপরিচিত ব্যক্তির সাথে বহুদিন থাকলেও তাদের সাথে মিশতে পারে না। চরম লাজুক শিশুরা অনেক সময় অপরিচিত পরিবেশে কথা বলতে চায় না। এটাকে বলা হয় ‘elective mutism’ বা নির্বাচিত মৌনতা বা মূকতা। যে ঘরে অনেক লোক জড়ো হয়— যেমন কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানের সময় তখন তারা বাবা-মার সাথে লেপ্টে থাকে এবং তাদের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে, আসবাব পত্রের পেছনে লুকিয়ে থাকে, ঘরের কোণে মুখ লুকায়, অনেক সময় হাত-পা ছোড়ে কান্না জুড়ে দেয়। যখন ঘরে থাকে, তখন তারা যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত বা উদ্বেগ বোধ করে সেগুলো সম্পর্কে বাবা মাকে অসংখ্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। যারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে (withdrawn) তারা সাধারণত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এবং পরিবারের বন্ধুদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরী করে এবং তারা স্নেহ, ভালবাসা ও সমর্থন পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত লাজুকতা ঠিক কতটুকু বেশী হলে তা একটি সমস্যা হিসাবে পরিগণিত হয় তা নির্দিষ্ট নয় বলে কতজন শিশু এ ধরনের সমস্যায় ভোগে তার কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই।

কোন কোন শিশু বিশেষ ধরনের সামাজিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত উদ্বেগ প্রদর্শন করে। এ ধরনের সামাজিক ভীতি বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায়। এ সম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে। যে সব শিশু সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বোধ করে তাদের কিছু কিছু পরিস্থিতিতে উদ্বেগ উপস্থিত হলে ডাইরীতে বিবরণ রাখতে বলা হয়েছে। এসব পরিস্থিতিগুলো ছিল : একদল লোকের সামনে একাকী কোন বই বা পত্রিকা পড়া, বোর্ডে লেখা, অন্য লোকের সম্মুখে অভিনয় করা বা গান গাওয়া। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক ভীতিগ্রস্ত শিশুরা সাধারণ শিশুদের চেয়ে তিনগুন বেশী উদ্বেগ বোধ করে। এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তারা কাঁদে, পরিস্থিতি থেকে সরে যায় অথবা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

শিশুদের মধ্যে সামাজিক ভীতি কেন দেখা দেয় তা ভাল ভাবে জানা যায়নি। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন যে, উদ্বেগ শিশুর সামাজিক পারিবারিক ক্রিয়াকে বাধা দেয়, সেজন্য শিশু সামাজিক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে এবং সেজন্য সে সামাজিক কৌশলগুলো অনুশীলন করতে পারে না। আবার অনেকে বলেছেন যে, অমিশুক এবং গুটানো শিশুরা অন্য শিশুদের সাথে কি ভাবে মিশবে বা কিভাবে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করবে তা জানে না। একাকী বা অমিশুক শিশুরা বন্ধুত্ব করতে খুব কম চেষ্টা করে এবং খেলাধূলায় কম কল্পনার অধিকারী হয়, সেজন্য মনে হয় যে তাদের সামাজিক দক্ষতার অভাব রয়েছে। এমন ও হতে পারে যে ঐসব শিশুরা অতীতে বেশীর ভাগ সময় বড়দের সাথে থেকেছে বলে তারা অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে শিখেনা। এসব শিশু অন্য শিশুদের চেয়ে বরং বয়স্কদের সঙ্গে মিশতে বা পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করতে পছন্দ করে।

শৈশবের ভীতির চিকিৎসা (Treatment of childhood phobias)

শিশুদের ভীতি কিভাবে দূর করা যায়? অনেক শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে লজ্জা-ভয়/ভীতি ঝেড়ে ফেলে সামাজিক হয়ে উঠে। আর বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের চিকিৎসাও বয়স্কদের মত। তবে বয়স্কদের জন্য যেসব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় অনেক সময় শিশুদের বেলায় প্রয়োগ করতে হলে সেসব পদ্ধতি একটু বদলাতে হয়। সম্ভবতঃ সবচেয়ে বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলো শিশুরা যেসব বস্তু বা পরিস্থিতিকে ভয় পায় সেগুলোর সম্মুখে শিশুকে ধীরে ধীরে উপস্থিত করা। এই পদ্ধতিটি লক্ষ লক্ষ পিতামাতা বহুদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন। অনেক সময় শিশুকে ভয়ের বস্তুটির সম্মুখীন করানোর সময় উদ্বেগ অবদমন করার চেষ্টা করা হয়। একটি ছোট মেয়ে যদি অপরিচিত লোক দেখলে ভয় পায় তাহলে বাবা-মা শিশুটির হাত ধরে আস্তে আস্তে অপরিচিত লোকটির সম্মুখে যেতে পারেন। সর্ব প্রথম এই প্রাচীন পদ্ধতিটি কিভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করেছিলেন মেরি কোভার জোনস (Mary Cover Jories. 1924)। (একটি ছোট্ট শিশু খরগোস দেখলে ভয় পেত। মেরি জোনস্ খরগোসের কাছে বসে শিশুটিকে খাওয়াতেন। তারপর খরগোসের প্রতি শিশুটির ভয় দূর হয়ে যায়। অর্থাৎ খরগোস (S) যে ভয় সৃষ্টি করতো খাদ্য গ্রহণের (R2) সংগে সংশ্লিষ্ট অপেক্ষাকৃত বেশী শক্তিশালী ধাতুপ্নক আবেগ দ্বারা সেটিকে মন থেকে বের করে দেওয়া হয়।) মেরি জোনসের পদ্ধতিটি হল একটি বিপরীত সাপেক্ষণ পদ্ধতি (Counter conditioning)

আধুনিক কালের সব চিকিৎসকই একমত যে, অমূলক ভীতি এবং পরিহার মূলক প্রতিক্রিয়া দূর করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হল ভীতিজনক বস্তুটির সম্মুখীন করা (exposure)। মডেলিং বা অনুকরণ ও খুবই কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। বান্ডুরা, গ্রুসেক এবং মেনলাভ (Bandura, Grusce & Menlove, 1969) দেখেছেন যে শিশুদের সম্মুখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলে তারা অনুকরণের মাধ্যমে ভয়ের বস্তুটির প্রতি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করতে শেখে। পরীক্ষাগারে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি শিশু যদি মাকড়সাকে ভয়পায়, আরেকটি শিশু যদি মাকড়সাকে ভয় না পায় এবং মাকড়সাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে, তাহলে দ্বিতীয় শিশুটিকে দেখে প্রথম শিশুটি মাকড়সার প্রতি অগ্রসর হবে। একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন কিশোর কিভাবে ক্রমশঃ পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে এবং যৌথ ভাবে খেলার অংশ গ্রহণ করে, তা দেখে অন্য কিশোররাও উৎসাহ বোধ করে এবং তারা যৌথ খেলায় অংশ গ্রহণ করে ( O’Connor 1969)। এলেন (Allen et al, 1976) ও তার সঙ্গীদের একটি গবেষণা চমৎকার। তারা কয়েকটি কিশোরকে চিহ্নিত করেন যারা একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং যৌথ খেলায় অংশ গ্রহণ করে না। যেমন:  মাঠে বল খেলতে যায় না। তারা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী কে ঐসব ছেলেদের সঙ্গে জোড়া তৈরী করে দেন এবং স্কুলের অবসরের ঘন্টায় একত্রে খেলতে বলেন। উদ্দেশ্য ছিল দলগত খেলায় ঐসব লাজুক ছেলেদের অন্তর্ভুক্ত করা। স্বেচ্ছাসেবী ছেলেরা লাজুক ছেলেদের সাহায্য করত কি ধরনের আচরণ করলে অন্যের সাথে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া জোরদার হবে, আর কি করলে পারস্পরিক ক্রিয়া অবদমিত হবে। ছয় মাসের মধ্যেই দেখা গেল লাজুক এবং ভীতু ছেলেরা মাঠে অন্যান্য সমবয়সীদের সাথে খেলছে আর স্বেচ্ছাসেবীরা মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে।

অনেক সময় ভয়ের বস্তুটির কাছাকাছি আসলে যদি শিশুটিকে পুরস্কৃত করা যায়, তাহলেও শিশুটি ভীতিকর বস্তু বা পরিস্থিতিটিকে আয়ত্ত করতে শেখে। মডেলিং বা অনুকরণ এবং কার্যকরী সাপেক্ষণ এই উভয় পদ্ধতিতেই শিশুটিকে ভয়ের বস্তুটির সম্মুখীন করা হয়। যখন একটি শিশুর স্কুল-ভীতি খুব প্রবল এবং সে স্কুল পরিহার করে এবং এটা যদি দীর্ঘদিন চলে, তাহলে তাদের সরাসরি এবং আস্তে আস্তে স্কুলের পরিবেশের সম্মুখীন করা এবং কার্যকরী সাপেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সংবেদনশীলতা হ্রাস করার প্রয়োজন হতে পারে।

স্কুল-ভীতিতে আক্রান্ত একটি শিশুর চিকিৎসার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ল্যাজারাস, ভেভিসন ও পোলেফকা (Lazarus, Davison and Polefka, 1965)। চিকিৎসক নয় বছর বয়সী পলকে নিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন। তারপর ক্রমশঃ চিকিৎসক ছাড়াই পলকে বেশী সময় স্কুলে থাকতে দেওয়া হতো। ক্রমশঃ চিকিৎসকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ কমিয়ে দেওয়া হতে থাকে। পরবর্তী কালে পল প্রথমে নিজে স্কুলের আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। তার পর স্কুল ছুটির পরে একটি শূন্য শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করে। তারপর কিছুদিন শুধু সকালের প্যারেড এবং ব্যায়াম করেই বাড়ি ফিরে আসে। পরবর্তী কালে সে ডেস্কে বসে এবং বেশি সময় স্কুলে কাটায়। প্রথম প্রথম চিকিৎসককে তার পাশে বসে থাকতে হতো তারপর চিকিৎসক আশেপাশেই থাকতেন তবে দৃষ্টির আড়ালে। শেষ ধাপ ছিল যখন উদ্বেগ অনেকটা কমে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছিল তখন চিকিৎসক পলকে ক্লাসে থাকতে উৎসাহিত করার জন্য নানা রকম পুরুস্কার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। যেমন রাতে তাকে গীটার বাজিয়ে শোনাবেন, কৌতুকের বই দেবেন, টোকেন দেবেন— যে টোকেনগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যায় জমা হলে তাকে বেসবল খেলার গ্লাভস কিনে দেওয়া হবে।

বয়স্কদের বেলায় যেমন হয়, তেমনি নূতন পরিস্থিতিতে শিশুরা ভয় পায়, কারণ ঐসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা থাকে না। যেমন শিশুরা জল দেখে ভয় পায়, এবং এই ভয়ের ভিত্তি হলো তার যৌক্তিক বিচারে জলে বিপদ আছে, কারণ সে সাঁতার জানে না। কোন কোন শিশুর অন্য শিশুদের সাথে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করার বিশেষ দক্ষতা থাকে না। যেমন সমবয়সীদের কিভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হয়, কিভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়, এবং কিভাবে আলাপ পরিচয় শুরু করতে হয়, তা সে জানে না। শিশুদের নিয়ে ছোট ছোট দল গঠন করে এসব সামাজিক দক্ষতা শেখানো যায়। এগুলো ভিত্তিও টেপে ধারণ করা যায়, যাতে পরবর্তী কালে চিকিৎসক ও শিশু উভয়ে একসঙ্গে দেখে নূতন আচরণগুলো কিভাবে আরো সুন্দর শোভন করা যায় তা আলোচনা করা যায়।

চিকিৎসার ফলাফল নির্ণয় করার জন্য যেসব গবেষণা হয়েছে সেগুলোতে দেখা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য পরিকল্পনা করা হলে শিশুদের ভীতি কার্যকরী ভাবে দূর করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ হেমপে ও অন্যান্য (Hampe et al.. 1973) ৬৭ জন ভীতিগ্রস্ত শিশুকে আট সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা করেছিলেন। তারা দু ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। কারো বেলায় আচরণমূলক চিকিৎসা এবং কারো বেলায় অন্তর্দৃষ্টি মূলক চিকিৎসা। যেসব শিশুর চিকিৎসা করা হয়েছিল তাদের ৬০% আট সপ্তাহ চিকিৎসার পরে সম্পূর্ণ ভীতিমুক্ত হয়েছিল। চিকিৎসার পরবর্তী দুই বৎসর পর্যন্ত তাদের ভীতির পুনরাগমন ঘটেনি অথবা অন্য কোন আবেগীয় সমস্যাও দেখা দেয়নি। উক্ত নমুনার শতকরা ৮০ জন শিশুর (পূর্বে যে ৬০% জনের কথা বলা হয়েছে তাদের সাথে আরো যোগ করতে হবে। যারা অন্য যায়গায় আরো বেশী দিন চিকিৎসা করিয়েছিল) পরবর্তী দুই বৎসর কোন সমস্যা হয়নি, তবে ৭% তীব্ৰ ভীতিতে ভুগছিল। চিকিৎসকগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, চিকিৎসা ছাড়া অনেক শিশুর ভীতি দূর হলেও চিকিৎসায় দ্রুতগতিতে আরোগ্য লাভ করে।

আতঙ্কজনিত বিকৃতি (Panic Disorder)

বিবরণ

আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতির প্রধান লক্ষণ হল হঠাৎ করে এবং বারংবার কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই আতঙ্ক গ্রস্ত হওয়া। যখন আতঙ্ক উপস্থিত হয় তখন কতকগুলো পীড়াদায়ক লক্ষণ থাকে, যেমন শ্বাসকষ্ট হওয়া, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব দেখাদেয়া, কণ্ঠরোধ হয়ে আসা, বা দম বন্ধ হয়ে আসা, বুকে ব্যাখ্যা হওয়া, মাথা ঘোরানো, শরীর কাঁপতে থাকা, উৎকণ্ঠা বা কি যেন বিপদ হবে এ ধরনের তীব্র অনুভূতি (apprehension), আতঙ্ক (terror) এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে— এধরনের অনুভূতি। অনেকের মধ্যে নিজের শরীরের বাইরে থাকার অনুভূতি বা ডিপারসনালাইজেশন (Depersonalization) এবং পৃথিবীর বাস্তব অস্তিত্ব নেই— এধরনের অনুভূতি (Derealization) তৈরি হয়। এবং একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়, মানসিক ভারসাম্য হারানোর ভয়, এবং অনেক সময় মৃত্যুভয় তাকে পেয়ে বসে। আতঙ্কের আক্রমণ বেশ ঘন ঘন হতে পারে— যেমন সপ্তাহে একবার বা দুবার, এবং প্রত্যেকবার কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়, তবে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয় না। এবং কখনো কখনো কোন একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সূত্র ধরে শুরু হয়, যেমন মোটর গাড়ি চালানোর সময়। একটি ঘটনা যখন আতঙ্ক উপস্থিত হওয়ার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে তখন তাকে সংকেতবদ্ধ (cued) আতঙ্ক বলে (cued panic attacks)। যদি একটি উদ্দীপক ও আতঙ্কের আক্রমণের মধ্যে সংযোগ উপস্থিত থাকে অথচ বেশি শক্তিশালী থাকে না তখন তাকে পরিস্থিতি প্রবণ (situationally predisposed) আতঙ্ক বলে। তবে আতঙ্কের আকস্মিক আক্রমণ কোন বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াই বিশ্রামরত অবস্থায় ঘটতে পারে এবং কোন সংকেত না দিয়েই আসতে পারে। যখন কোন সংকেত ছাড়াই ব্যক্তি মাঝে মাঝে আতঙ্কগ্রস্ত হয়, তখন তাকে আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতি বলা হয়, আর যদি সব সময়ই একটি বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতির উপস্থিতিতে আতঙ্ক হয়, তখন একটি অমূলক ভীতির উপস্থিতি রয়েছে বলে মনে করা হয়। আমেরিকায় এ ধরনের রোগীর সংখ্যা পুরুষদের মধ্যে ২% এবং মেয়েদের মধ্যে ৫%। সাধারণতঃ রোগটি বয়ঃসন্ধিতে প্রথম দেখা দেয় এবং এর জন্য জীবনের পীড়নমূলক অভিজ্ঞতাগুলোই বেশি দায়ী। (Pollard, Pollard and Corn, 1989)।

DSM-IV অনুসারে আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (১) জনতার ভীতিসহ আতঙ্ক (Panic disorder with agoraphobia) এবং (২) জনতার ভীতি ছাড়া আতঙ্কে গ্রস্ততা (Panic Disorder without agoraphobia)। অর্থাৎ আতকগ্রস্তদের মধ্যে অনেক সময় জনতা, দোকানে যাওয়া, বাজার করতে যাওয়া এগুলোর প্রতি ভীতি থাকে। যাদের মধ্যে জনতার ভয়সহ আতঙ্কজনিত বিকৃতি রয়েছে তারা বাড়ীর বাইরে যেতে ভয় পায়। অথবা খুব কষ্টে বাইরে যেতে পারে। যে সব ব্যক্তির আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতি থাকে তারা যেসব স্থানে আতঙ্কের আক্রমণ হলে বিপদ হতে পারে বা অপমানজনক হতে পারে (embarassing) সেসব স্থান এড়িয়ে চলে। এবং এই এড়িয়ে চলার ঘটনাগুলো যদি ব্যাপক হয়, তাহলেই ব্যক্তির মধ্যে জনতার ভীতিসহ আতঙ্কজনিত বিকৃতি দেখা দেয়। জনতার ভয়সহ আতঙ্ক এবং জনতার ভয় ছাড়া আতঙ্ক – উভয়টিই পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের বেশি হয়। অনেক দেশে এটাকে মহিলাদের সামাজিক ভূমিকার একটি বর্ধিত রূপ হিসেবে দেখা যায়। যাদের উদ্বেগজনিত প্রতিক্রিয়ার রোগী বলে শনাক্ত করা যায় তাদের ৮০% এর মধ্যেই আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতির লক্ষণ উপস্থিত হয়। অর্থাৎ তারা আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া করে। তবে এধরনের আক্রমণের সংখ্যা খুব বেশি হয় না। সেজন্য তাদের আতঙ্কজনিত বিকৃতির রোগী বলা হয় না।

আতঙ্ক জনিত বিকৃতির কারণ (Etiology of Panic Disorders)

আতঙ্ক জনিত মনোবিকৃতির জন্য নিম্নলিখিত কারণগুলোকে কম বেশি দায়ী করা হয়েছে –

  • (১) নর এড্রিনালিন বা এপিনেফ্রিন চালিত বা সংশ্লিষ্ট স্নায়ুতন্ত্রের অতিসক্রিয়তা (over activity of the noradrenergic system) : বিশেষ করে পনস্ (Pons)-এর মধ্যে অবস্থিত একটি স্নায়ুকেন্দ্র যার নাম লোকাস সেরুলিয়াস (Locus coeruleus) -এর অধিক উত্তেজনা বা সক্রিয়তাকে আতঙ্কের আক্রমণের জন্য দায়ী করা হয়েছে (Redmond, 1977)। কিন্তু এ তথ্য সমর্থিত হয়নি।
  • (২) কোন কোন স্নায়ুতত্ত্ববিদ আতঙ্কজনিত বিকৃতির জন্য অতিরিক্ত শ্বাসগ্রহণ (hyperventilation) কে দায়ী করেছেন। অনেকে বলেন বাতাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ (CO2) কার্বন-ডাই অক্সাইড, থাকলে শ্বাস প্রশ্বাসের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু এর ফলে কদাচিৎ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
  • (৩) অতিরিক্ত শারীরিক উত্তেজনা এবং এর প্রতি ভীতি : কোন কোন ব্যক্তি নিজেদের শারীরিক অনুভূতি এবং উত্তেজিত অবস্থা সম্বন্ধে ভয় পায়। তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হলে আতঙ্কজনক বিকৃতি দেখা দিতে পারে।
  • (৪) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয় (Fear of loosing control) : যারা আতঙ্কজনিত বিকৃতিতে ভোগে তারা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে বলে ভয় করে। এ ভয়টা তাদের মধ্যে খুব তীব্র হয়, বিশেষ করে যদি তারা মনে করে, পরিস্থিতির উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

আতঙ্ক জনিত বিকৃতির চিকিৎসা

(১) ভেষজ চিকিৎসা : বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধ এবং উদ্বেগনাশক ঔষধে সাফল্য পাওয়া যায়। বালোঙ্গারের (Balleger et al., 1988) গবেষণায় দেখা গেছে এসব রোগীদের alprazolam অথবা জেনাক্স (xanax) সেবন করিয়ে ভালো করা যায়। তবে ঔষধ দীর্ঘদিন যাবৎ চালিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া xanax একটি বেনজোডায়জাপাইন থেকে তৈরি করা ঔষধ। এই ঔষধটির আসক্তি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে। সেজন্য এই ওষধগুলো ব্যবস্থা করার পূর্বে এগুলোর আসক্তিসৃষ্টি করার সম্ভাবনা সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত।

(২) মোকাবেলা করতে শেখানো : জনতার ভীতির চিকিৎসায় রোগীকে জনতা বা অন্যান্য সামাজিক পরিস্থিতির সম্মুখীন করে তাদের সেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শেখানো হয়।

(৩) শ্লথন অভ্যাস করানো (Relaxation Training) : যেহেতু আতঙ্কগ্রস্ত রোগীদের তাদের শারীরিক উত্তেজনা সম্পর্কে ভীতি গ্রস্ত হতে দেখা যায়, সেজন্য তাদের শ্লথন অভ্যাস করালে সে ধরনের ভয় কমে যাবে। তার সঙ্গে জ্ঞানীয় পরিবর্তন, মনোভাব পরিবর্তনমূলক চিকিৎসক একযোগে চালালে ভালো ফল পাওয়া যায় (বার্লো ও অন্যান্য, ১৯৮৯)।

(৪) যেহেতু জনতা-ভীতি (agoraphobia)’র চিকিৎসায় বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন করানো হলে সব ক্ষেত্রে আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া (Panic attack) হ্রাস পায় না— সেজন্য এ ধরনের রোগীদের মনোচিকিৎসা করতে হলে একটি তথ্যের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে যে, কিছুকিছু আতঙ্কগ্রস্ত রোগী তাদের শরীরের ভেতর থেকে উত্তেজনার যে সংবেদন লাভ করে তাতে তারা সতর্ক হয়ে পড়ে বা অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সুতরাং ফলপ্রসূভাবে তাদের চিকিৎসা করতে হলে বারলো ও তার সহকর্মীদের (Barlow, 1988, Barlow et al., 1989. Klosko et al., 1990 ) নির্দেশিত তিন মুখী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ এসব রোগীদের জন্য :

  • (১) শ্লথন প্রশিক্ষণ দিতে হবে (Relaxation training)
  • (২) এলিস ও বেক নির্দেশিত জ্ঞানীয়-আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে (Cognitive-Behavioural interventions) এবং
  • (৩) তাদের শরীরের ভেতর থেকে আসা সংকেতের সঙ্গে মোকাবেলা করতে শিখাতে হবে।

তৃতীয় ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিটি অভিনব। শরীরের ভেতর থেকে সৃষ্ট যেসব সংবেদন আতঙ্ক সৃষ্টি করার সংকেত হিসেবে কাজ করে, ব্যক্তিকে সেগুলোর সম্মুখীন করা হয় এর জন্য চিকিৎসক তার চিকিৎসা কেন্দ্রে কৃক্রিম ভাবে এসব শারীরিক সংকেত সৃষ্টি করেন। যেমন, অতিরিক্ত শ্বাস গ্রহণের ফলে (Hyperventilation) যাদের আতঙ্কের আক্রমণ হয়, তাদের চিকিৎসকের কক্ষে প্রথমে তিন মিনিট দ্রুতগতিতে শ্বাস নিতে বলা হয়। আবার আতঙ্কের আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে যাদের মাথা ঘোরায়, তাদের ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের আসনটিকে দ্রুত গতিতে ঘুরানো হয়। এসব প্রতিক্রিয়ার ফলে যখন ব্যক্তির মধ্যে মাথা ঘোরানো, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং আতঙ্কের অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়— তখন ব্যক্তি এগুলোর সঙ্গে মোকাবেলা করতে শেখে। অর্থাৎ-

  • (১) ব্যক্তি নিরাপদ অবস্থায় আতঙ্কের পূর্ব লক্ষণগুলোর অনুভূতি লাভ করে। এবং
  • (২) সে জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলো প্রয়োগ করতে পারে— যেগুলো পূর্বে সে শিখেছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্লথন অভ্যাস করে গভীরভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে শিখতে পারে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার আতকে জনিত প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।

ডেভিসন ও নীয়েল (১৯৯৮) বলেছেন যে, উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করা হলে দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এসব রোগীদের ইমিপ্রামিন (Imipramin)- বা টোফ্রানিল (Tofranil ) — যা একটি ত্রি- চক্রবিশিষ্ট ঔষধ, অথবা অন্য কোন বিষণ্নতা-বিরোধী ঔষধের মাধ্যমে অথবা বেনজোডায়জাপাইনস্ এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা হলে ফলাফল স্বল্পস্থায়ী হয় এবং রক্তে বিষক্রিয়া (toxicity) ঘটায়। বিশেষত গর্ভবর্তী মহিলাদের চিকিৎসায় এসব ঔষধ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। আবার ঔষধে সবার জন্য ভাল ফল দেয়না বা কার্যকরী হয় না। সেজন্য গভবর্তী মহিলাদের জন্য জ্ঞানীয়-আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল।

সাধারণীকৃত উদ্বেগ জনিত বিকৃতি (Generalized Anxiety Disorder)

বিবরণ

যারা সাধারণীকৃত উদ্বেগজনিত বিকৃতিতে ভোগে তারা তুচ্ছ বিষয় বা ঘটনা নিয়ে ক্রমাগত, পুনঃপুনঃ উদ্বিগ্ন বোধ করে। যেকোন বিষয় নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়, দুশ্চিন্তা অনুভব করে এবং ইচ্ছে করলেও তারা তা বন্ধ করতে পারে না। যেমন একজন ক্রমাগত ভয় পেতে থাকে যে তার ছেলে একটি দুর্ঘটনায় পড়বে। এই উৎকণ্ঠা এত প্রবল হয় যে তাকে ভাসমান উদ্বেগ বলে (Freefloating anxiety)। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন শারীরিক কষ্ট দেখা দেয়। যেমন— ঘাম হওয়া, মুখ লাল হওয়া (blushing), হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাওয়া, পাকস্থলীর গোলযোগ, ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, ডায়ারিয়া বা পাতলা পায়খানা হওয়া, সর্দি লাগা, হাত ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, গলায় টিউমার অনুভব করা, শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি। এসব লক্ষণ স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের অতিসক্রিয়তা নির্দেশ করে। নাড়ী এবং শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও বেড়ে যেতে পারে। রোগী অনেক সময় পেশীর টানভাব, পেশীর ব্যাথা (বিশেষ করে ঘাড়ে ও কাঁধে) কম্পন, সহজে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া চোখের পাতার অনৈচ্ছিক মিটমিট করা, এবং নিজেকে শ্লথ করার অক্ষমতা ইত্যাদি শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ করে। সে সহজেই চমকে ওঠে, অস্থিরভাবে চলাফেরা করে, ছটফট করে, এবং অস্থির বা চঞ্চল থাকে। ব্যক্তি সাধারণভাবে শঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত বোধ করে, অনেক সময় মনে করে কি যেন একটা দুর্ঘটনা ঘটবে, সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে, তার হৃদকম্পন থেমে যাবে। অথবা কেউ মনে করে সহসাই তার মত্যু ঘটবে। ব্যক্তি সব সময় তটস্থ থাকে, ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। অধৈর্য থাকে, ক্রুদ্ধ চিৎকার করে, অনিদ্রায় ভুগে সহজে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটে। কারণ ব্যক্তি সব সময় অতিসতর্ক ও উৎকণ্ঠিত থাকে। আমেরিকার জনগণের ৫% জীবনের কোন না কোন সময় এ ব্যধিতে ভুগে (Wittchen et al., 1994), বয়ঃ সন্ধির শেষ প্রান্তে যাদের অবস্থান তাদের মধ্যে এটা প্রথম দেখা দেয়। পীড়নপূর্ণ ঘটনার পরেই এটা সৃষ্টি হয়। এ বিকৃতিটি পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি অন্যান্য উদ্বেগমূলক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অথবা মেজাজের বিকৃতির সঙ্গে একত্রে দেখা দিতে পারে।

সাধারণীকৃত উদ্বেগের কারণ (Etiology of Generalized Anxiety Disorder)

মনোসমীক্ষণবাদীদের ধারণা (Psychoanalytic view)

মনোসমীক্ষণবাদীরা মনে করেন, সাধারণীকৃত উদ্বেগ হল আদিম কামনা ও অহং সত্তার মধ্যে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। “Source of generalized anxiety is the conflict between the ego and id Impulses” (Davison & Neale, 1998). এসব আদিম কামনা আক্রমণাত্মক এবং সব সময় বহিঃপ্রকাশের পথ খোঁজে, কিন্তু অহং এগুলোকে বাইরে আসতে দেয় না, কারণ অবচেতনভাবে সে ভয় করে যে শাস্তি পাবে। কিন্তু যেহেতু উদ্বেগের উৎসটি অবচেতনে থাকে, সেজন্য ব্যক্তি আশঙ্কা (apprehension) এবং যাতনা (distress)-য় ভোগে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না কেন আশংঙ্ক্ষা হচ্ছে। ব্যক্তির অবচেতন মনে উৎকণ্ঠার একটি চিরস্থায়ী উৎস লুকিয়ে থাকে অর্থাৎ পূর্বে যেসব আদিম কামনা বা চিত্তাবেগ (impulse) শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল— সেগুলো প্রকাশিত হওয়ার ভয়। এ অর্থে ব্যক্তির এ ধরনের উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা থেকে কোন দিনই মুক্তি পায় না। যে ব্যক্তির একটি অমূলক ভীতি থাকে সে অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান; কারণ সে তার উদ্বেগকে বিশেষ একটি বস্তু পরিস্থিতির উপর স্থানান্তরিত করেছে, কিন্তু সাধারণীকৃত উদ্বেগের রোগী তা পারেনি। সেজন্য সে সব সময় উদ্বেগে ভোগে, কিন্তু তার কারণ জানে না।

জ্ঞানীয় আচরণবাদীদের ধারণা (Cognitive behavioural views)

  • (১) জ্ঞানীয় আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীরা সাধারণীকৃত উদ্বেগকে পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপকের সে ব্যক্তির উদ্বেগজনিত প্রতিক্রিয়ার সামান্যীকরণ বলে মনে করেন। যেমন কোন ব্যক্তি যদি জাগ্রত অবস্থায় প্রায় সব সময়ই উদ্বেগে ভোগে, তাহলে বুঝতে হবে সে সামাজিক পরিস্থিতি অর্থাৎ যেকোন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভয় পায়। কিন্তু ব্যক্তি যদি অন্য লোকের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটায়, তাহলে ব্যক্তির উদ্বেগের জন্য অভ্যন্তরীণ কারণকে দায়ী না করে ঐসব পরিস্থিতিকে দায়ী করা সুবিধাজনক। এই সূত্র অনুসারে সাধারণীকৃত উদ্বেগকে ভয়ের সাপেক্ষীকরণের মত একটি প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকৃত একটি ঘটনা বলে মনে হয়। অর্থাৎ উদ্বেগজনিত প্রতিক্রিয়াটি কতকগুলো বাহ্যিক উদ্দীপকের সঙ্গে সাপেক্ষণকৃত হয়ে পড়েছে, যদিও এসব উদ্দীপকের সংখ্যা অনেক বেশি।জ্ঞানীয় ও আচরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উভয়েই মনে করে যে কোন ব্যক্তি যদি এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতি বা উদ্দীপকের মুখোমুখী হয় যে এর উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তাহলে তার মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। জ্ঞানীয় তত্ত্বে ব্যক্তি যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষম— এই প্রত্যক্ষণমূলক ঘটনাটির উপর জোর দেওয়া হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি প্রত্যক্ষণ করে যে, সে ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা; সুতরাং সে অক্ষম এবং অসহায়। সুতরাং উভয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সাধারণীকৃত উদ্বেগের প্রধান কারণ হল ব্যক্তি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা এবং অসহায়ত্ব। কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2)-এর মাধ্যমে আতঙ্কসৃষ্টি করে যেসব গবেষণা করা হয়েছে, সেগুলোতেও দেখা গেছে যে ব্যক্তি যখন পরিস্থিতিটি নিজের খুশীমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অর্থাৎ অন্ততঃ কিছু প্রচেষ্টা নিতে পারে, তখন তার মধ্যে যতটুকু আতঙ্ক হয়, তার চেয়ে বেশি হয় যখন সে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এমন কি ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র প্রত্যক্ষণ করে যে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বা তার নিয়ন্ত্রণ আছে তাহলেও বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও তার আতঙ্ক জনিত প্রতিক্রিয়া কম হয় (Geer et al.. 1970)।
  • (২) নিয়ন্ত্রণের মতই আরেকটি ঘটনা হল কোন বিপজ্জনক ঘটনা যদি পূর্বানুমান সাপেক্ষ হয় (predictable), তাহলে উদ্বেগ কম হয়, আর পূর্বানুমান সাপেক্ষ না হলে উদ্বেগ বেশি হয়। উদাহরণ স্বরূপ, একটি সংকেতের পর বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়া হলে প্রাণীরা যত বেশি ভয়ার্ত বা বর্জন মূলক প্রতিক্রিয়া করে, সংকেত না দিলে তার চেয়ে বেশি করে। কারণ সংকেত না আসলে তারা তড়িৎ আঘাত না আসার সংকেত পায়। “অর্থাৎ বিপদ আসছে না, তাই চিন্তার কিছু নেই।” সংকেত ছাড়া এবং পূর্বাভাষ না দিয়ে বর্জন মূলক উদ্দীপক উপস্থিত করা হলে (অর্থাৎ প্রাণীদের বিদ্যুতাঘাত দেয়া হলে) তাদের মধ্যে সদা সতর্কতা (vigilance), ও ভয় দেখা দেয়। মানুষের বেলায় আমরা এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকেই বলি “দুশ্চিন্তা” (worry)।
  • (৩) জ্ঞানীয় আচরণবাদীরা সাধারণীকৃত উদ্বেগের জন্য আরো কয়েকটি জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াকে দায়ী করেছেন। যেমন :
    • (ক) রোগীরা অনেক সময় নির্দোষ ঘটনাকেও অপব্যাখ্যা করে— যেমন রাস্তা পার হওয়াকেও বিপজ্জনক মনে করে।
    • (খ) এসব রোগীদের মনোযোগ সহজেই সেইসব উদ্দীপকের প্রতি ধাবিত হয় যেগুলো শারীরিক ভাবে বিপজ্জনক অথবা সামাজিকভাবে অনাকাঙিত। যেমন— সমালোচনা, প্রত্যাখ্যান, বা লজ্জাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া।
    • (গ) এসব রোগী অস্পষ্ট পরিস্থিতিগুলোকে বিপজ্জনক হিসেবে মূল্যায়ন করে।
    • (ঘ) উদ্বেগের দ্বারা ব্যক্তি নিজেকে আরো বেশি বেদনা দায়ক আবেগ থেকে রক্ষা করে (Borkovec et al., 1995)।

জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি (Biological viewpoints)

  • (১) কোন কোন গবেষণা থেকে সাধারণীকৃত উদ্বেগের জন্য বংশগতির অবদান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এ রোগটি যাদের মধ্যে আছে তাদের নিকট-আত্মীয়দের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায় (Noyes et al., 1992)। যদিও অন্যান্য গবেষণায় ঋণাত্মক ফলাফল পাওয়া গেছে তবু নিউরোটিসিজম (Neurotcism) বা উদ্বেগ-প্রবণতা যেহেতু বংশগত, সেজন্য সাধারণীকৃত উদ্বেগে বংশগতির ভূমিকা থাকতে পারে।
  • (২) বেনজোডায়জাপাইনস এর মাধ্যমে যেহেতু সাধারণীকৃত উদ্বেগের চিকিৎসা করা যায়, সেজন্য মস্তিষ্কের ক্রিয়ার সঙ্গে এই রোগটির সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। গবেষকগণ বলেছেন যে, যে নিউরোট্রান্সমিটার পদার্থকে বেনজোডায়জাপাইন্স গ্রহণ করে সেটির সঙ্গে অবদমনকারী নিউরোট্রান্সমিটার পদার্থ Gamma amino butyric acid বা GABA র সম্পর্কে রয়েছে। সাধারণ বা স্বাভাবিক নীতিতে মস্তিষ্কের নিউরণগুলো সব সময় বিচ্ছুরণ ঘটাতে থাকে এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে, কিন্তু এই স্নায়বিক বিচ্ছুরণ (firing), GABA-র রাসায়নিক প্রণালীকে উত্তেজিত করে— যা এই ক্রিয়াকে অবদমন করে এবং উদ্বেগ কমায়। এখন মনে হয়, GABA প্রণালীর কোন ত্রুটির জন্য এই প্রণালীটি উদ্বেগকে প্রশমিত করতে পারে না। বেনজোডায়পাইনস্ GABA পদার্থের অবমুক্তি বাড়িয়ে দিয়ে উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে যেসব ঔষধ GABA প্রণালীকে অবদমন করে বা বাধা দেয়, সেগুলো উদ্বেগ বৃদ্ধি করে (Insell, 1986)।

সাধারণীকৃত উদ্বেগের চিকিৎসা

  • (১) রোগী যদি উদ্বেগের কারণ হিসেবে কোন বস্তু বা পরিস্থিতিকে শনাক্ত করতে পারে, তাহলে মুক্ত ভাসমান উদ্বেগকে পুনরায় সংগঠিত করে বিশেষ ধরনের ভীতি বা অমূলক ভীতিতে পরিবর্তন করা যায় এবং সহজে চিকিৎসা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, চিকিৎসক যদি জানতে পারেন যে রোগীটি সমালোচনা শুনতে এবং করতে ভয় পায়, তাহলে বোঝা গেল যে ব্যক্তিটিকে যেহেতু সারাদিন অন্য লোকের সাথে কাজ করতে হয়, সেজন্য তার উদ্বেগটিকে ভাসমান মনে হয়। সুতরাং সে যাতে সমালোচনার ভয় থেকে মুক্তি পায় তার জন্য প্রণালীভাবে সংবেদনশীলতা হ্রাস করণ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।
  • (২) যেহেতু এ রোগে নির্দিষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টিকারী উদ্দীপক শনাক্ত করা যায় না, সেজন্য সাধারণ কতকগুলো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন—
    • (ক) ব্যাপকভাবে শ্লথন প্রশিক্ষণ প্রদান (Intensive relaxation training) 
    • (খ) সামান্যতম টানভাব বা উত্তেজনা দূরকরার জন্য শ্লথন ব্যবহার করতে উপদেশ দেওয়া।
    • (গ) উদ্বেগ জনক পরিস্থিতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেই নিজেকে শ্লথ করতে পরামর্শ দেওয়া এবং আতঙ্কিত হতে কিংবা উত্তেজিত হতে নিষেধ করা।
  • (৩) জ্ঞানীয় পদ্ধতির ব্যবহারে ব্যক্তির সামাজিক ক্ষমতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা যাতে তার সক্ষমতা বোধ ক্ষুণ্ণ না হতে পারে। এসব কৌশলের মধ্যে আছে :
    • (ক)আত্ম প্রতিষ্ঠামূলক প্রশিক্ষণ (Assertive Training)
    • (গ) ভাষাগত বা মৌখিক নির্দেশ
    • (গ) করণ সাপেক্ষণের মাধ্যমে আচরণ শিক্ষণ ও রূপায়ন।
    • (ঘ) রিহার্সেল এবং এসবগুলোর সমন্বয়।
  • (৪) জ্ঞানীয় সংগঠনের পরিবর্তন : এসব রোগী অস্পষ্ট পরিস্থিতিকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করে এবং ঋণাত্মক ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেখে। সেজন্য তাদের এসব পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করতে সাহায্য করা উচিত। এতে সাধারণীকৃত উদ্বেগ কমে যায়।
  • (৫) জৈবিক চিকিৎসা : উদ্বেগ প্রশমনকারী ঔষধ সাময়িকভাবে উদ্বেগের উপশম করতে পারে। তবে এগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট। যেমন নিদ্রালুতাব, বিষণ্ণতা, শারীরিক ক্ষতি, আসক্তি সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি। সেজন্য ট্রাঙ্কুইলাইজার (tranquilizer) বা নিদ্রাকারী ঔষধ না দেওয়া ভাল।

বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি (Obsessive Compulsive Disorder)

বিবরণ

বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি (Obsessive Compulsive disorder) হল একটি উদ্বেগ জনিত বিকৃতি যাতে ব্যক্তির মনে একটি চিন্তা বরবার উপস্থিত হয়ে থাকে এবং ব্যক্তি এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবার অনেক সময় ব্যক্তি একটি কাজ বারবার করতে বাধ্য হয়, যার ফলে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে বিঘ্ন ঘটে এবং ব্যক্তি অসুখীবোধ করে বা কষ্ট বোধ করে।

আমেরিকায় ২% থেকে ৩% ব্যক্তি এ অসুখ ভোগে এবং ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে এরোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি (Karno and Golding. 1991)। যৌবনের শেষ প্রান্তে এ রোগটি প্রথম দেখা দেয় এবং কোন একটি পীড়নমূলক ঘটনার পর থেকে শুরু হয়। পীড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাটি হতে পারে গর্ভধারণ, সন্তানের জন্মদান, পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা কর্মক্ষেত্রে কোন গোলযোগ। নসিরভানি (Noshirvani et al., 1991) এর একটি গবেষণায় দেখা যায়, ছেলেদের মধ্যে এ রোগটি মেয়েদের চেয়ে কম বয়সে দেখা দেয় এবং প্রথম শুরু হয় কোনকিছু ঠিক আছে কিনা তা বারবার বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করে দেখার (checking compulsion) মধ্যদিয়ে। আর মহিলাদের একটু বেশি বয়সে শুরু হয়, বাধ্যতামূলক শুচিবাই যস্ততা বা বারবার ধৌতকরণের মধ্য দিয়ে (cleaning compulsion)।

বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা অবস্থায়ই রোগী প্রথম বাধ্যতাধর্মী বিকৃতিতে আক্রান্ত হয়, এবং বাধ্যতাধর্মী রোগীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ বিষণ্নতা দেখা যায় (Rachman and Hodgson, 1980)। তাছাড়া, একজন একই সঙ্গে বাধ্যতাধর্মী বিকৃতিসহ অন্যান্য উদ্বেগ জনিত বিকৃতিতে ভুগতে পারে। বিশেষতঃ বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীদের মধ্যে অমূলক ভীতি ও আতঙ্ক জনিত বিকৃতির লক্ষণ বেশি দেখা যায়। আবার অনেক বাধ্যতা ধর্মী বিকৃতির রোগীর বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিও দেখা গেছে (Baer et al. 1990)। বাধ্যতাধর্মী চিন্তা (Obsession) হল যেসব চিন্তা, কর্মপ্রবণতা বা চিত্তাবেগ (impulses), এবং চিত্র (image) বা ভাব মনের মধ্যে পুনঃপুন উদিত হয়, এগুলো তার কাছে অযোক্তিক মনে হলেও সে ইচ্ছাকরে এগুলোর পুনঃপুন আগমনকে থামাতে পারে না। এই চিন্তা বা ধারণাগুলো যেন ব্যক্তিকে পেয়ে বসে। আমাদের মত স্বাভাবিক ব্যক্তিদের মনেও এধরনের চিন্তা বারবার আসতে পারে, কিন্তু এগুলো চলে যায় এবং আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে পারি।

কিন্তু বাধ্যতাধর্মী চিন্তার রোগীদের বেলায় এই চিন্তাগুলো এত বেশি জোরালো এবং পৌনঃপুনিক হয়, যে এগুলো তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। প্রধানতঃ যেসব বাধ্যতাধর্মী চিন্তা মানুষকে পেয়ে বসে সেগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধান :

  • রোগ সংক্রমনের ভয় বা জীবাণুদ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়। রোগী সব সময় মনে করে, সে রোগ জীবাণুদ্বারা আক্রান্ত হবে।
  • কোন অবৈধ যৌন ক্রিয়া বা আক্রমণাত্মক কাজ করে ফেলবে
  • শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নষ্ট বা ব্যাধিগ্রস্ত হবে, ইত্যাদি।

বাধ্যতাধর্মী চিন্তা (obsession) অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতা, তীব্র সন্দেহপরায়নতা, এবং সিদ্ধান্তহীনতার রূপ নিতে পারে।

বাধ্যতাধর্মী কাজ (compulsion) হল বাধ্যতাধর্মী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ ব্যক্তির মনে বাধ্যতাধর্মী চিন্তার জন্য যে পীড়ন বা চাপ সৃষ্টি হয় তা লাঘব করার জন্য অথবা কোন কাল্পনিক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য ব্যক্তি পৌনঃপুনিকভাবে যেসব আচরণ করে সেগুলোকে বলে বাধ্যতাধর্মী কাজ। ব্যক্তি পৌনঃপুনিক আচরণটির মাধ্যমে যে উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়, প্রকৃত পক্ষে সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাজটির কোন সম্পর্ক থাকে না। অথবা কাজটির পুনরাবৃত্তিটি একটি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে উপস্থিত হয়। যেমন এক ব্যক্তির বাতিক ছিল সে প্রত্যেকটি খাবার গেলার পূর্বে ৩০০ বার চিবুত। আরেকজনের ছিল এমন বাতিক যে সে (মহিলা) নূতন ধোয়া কাপড়ে লাল রঙ (যেমন আলতা) না ঢেলে ঘুমাতে পারত না। প্রায়শঃ এধনের ব্যক্তিরা মনে করে যে, পৌনঃপুনিক কাজটি বা বাধ্যতামূলক কাজটি না করলে তার পরিনতি হবে ভয়ঙ্কর। সাধারণতঃ এসব কাজ এত বেশি পুনরাবৃত্তিমূলক হয় যে তার হিসেব করলে অবাক হতে হয়। একজন শুচিবায়ু গ্রস্ত মহিলা দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে থালা বাসন বা আসবাবপত্র শতশতবার ধৌত করে। এগুলো না করে সে যস্তি পায় না। সাধারণত যেসব বাধ্যতাধর্মী আচরণ মানুষের মধ্যে দেখা যায় সেগুলো হলঃ-

  • বারংবার হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বাতিক— যেমন বাইরে থেকে ঘরে আনা প্রত্যেকটি জিনিষ ধোয়া।
  • কোন বিশেষ জিনিস এড়িয়ে চলা, যেমন বাদামী রঙ এড়িয়ে চলা।
  • কোন যাদুমন্ত্র আউড়ানো তাবিজ/কবচ স্পর্শকরা।
  • কোন জিনিস সঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা তা বারবার পরীক্ষা করে দেখা।

একজন তার অফিস ঘর তালাবদ্ধ করে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করে “তালাটা লাগিয়েছি তো?” সে আবার তা পরীক্ষা করতে যায়। এভাবে একনাগারে সে বারবার একই কাজের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। সেক্সপীয়ারের উপন্যাসের চরিত্র ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করার পর কেবল ভাবত তার হাতে রক্ত লেগে রয়েছে, তার পর থেকে সে দিনরাত হাত ধৌত করত। কেউ কেউ আছে যে প্রায় সারাদিন কাটিয়ে দেয় আলনায় জামাকাপড় গোছাতে। একটি বিশেষভাবে গোছানো না হওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পায় না। কোন কোন সময় এ ধরনের বাধ্যতামূলক ক্রিয়া কোন কোন কাজকে অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন করে তোলে— যেমন খেতে গেলে অনেক ঘণ্টা লেগে যায়।

আমরা অনেক সময় এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পাই যারা জুয়া না খেলে পারে না মদপান না করে পারে না, বেশি খাবার না খেয়ে পারে না (compulsive eating) কিন্তু তবু এধরনের আচরণকে বাধ্যতাধর্মী আচরণ বলা হয় না। কারণ এগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তি আনন্দ পায়। সত্যিকারের বাধ্যতাধর্মী কাজগুলোকে ব্যক্তি তার “নিজস্ব” বলে মনে করে না, তারা মনে করে, একাজটি তাদের ব্যক্তিত্বের অঙ্গ নয়। স্টার্ন এবং কব (Stern and Cobb, 1978) একটি গবেষণায় দেখেন যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীদের মধ্য ৭৮% মনে করে তারা বাধ্যতামূলকভাবে যে কাজটি বা অনুষ্ঠানটি করে সেটা হাস্যকর, বা অর্থহীন, কিন্তু তবু সে তা বারবার না করে পারে না।

বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির কারণ (Etiology of Obsessive Compulsive Disorder)

মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psychoanalytic theory)

মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব অনুসারে বাধ্যতাধর্মী চিন্তা (obsession) এবং কাজ (compulsion) একই ধরনের প্রতিক্রিয়া। এগুলো যৌন অথবা আক্রমনাত্মক আদিম শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় এবং শৌচ-ক্রিয়ার শিক্ষণের সময় কঠোর শাস্তি দেওয়ার ফলে এগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না। এজন্য ব্যক্তি পায়ু পর্যায়ে সংবন্ধিত বা স্থির হয়ে যায় (fixated)। বাধ্যতামূলক বিকৃতির রোগীদের মধ্যে আমরা যেসব লক্ষণ দেখি সেগুলো ব্যক্তির আদিম সত্তা ( Id) এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। কখনও আদিম সত্তার আক্রমণাত্মক শক্তিগুলো জয়ী হয়। আবার কখনো আত্মরক্ষা মূলক ব্যবস্থাগুলো জয়ী হয়। যেমন যখন হত্যা করার জন্য বাধ্যতাধর্মী চিন্তার উদয় হয়, তখন অহং সত্তার শক্তি জয়ী হয়। অনেক সময়, একটি লক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মরক্ষা ব্যবস্থার আংশিক সাফল্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, যে ব্যক্তি পায়ু পর্যায়ে সংবন্ধিত হয়েছে, সে মলত্যাগ করার প্রবণতা রোধ করতে গিয়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়া গঠন করতে পারে এবং বাধ্যতামূলকভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। আলফ্রেড এডলার (Alfred Adler) যিনি ফ্রয়েডের তত্ত্ব থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন, তিনি মনে করতেন বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়ার কারণ হল অক্ষমতা বা অদক্ষতা বোধ (feeling of incompetence)। অত্যন্ত প্রাধান্য বিস্তারকারী বা কর্তৃত্বপরায়ণ বাবা বা মা যদি তাদের সন্তানদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেন যে তারা নিজেদের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে শেখে না এবং নিজেদের অদক্ষ (incompetent) বলে ভাবতে শিখে, তাহলেই তাদের মধ্যে হীনমন্যতা বোধ দেখা দেয় এবং তারা একটি বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নিজেদের একটি ভুবন গড়ে তোলে – যেখানে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং নিজেদের সক্ষম ভাবতে পারে। এডলার প্রস্তাব করেছেন যে, বাধ্যতামূলক আচরণ ব্যক্তিকে “কোন একটি কাজে” দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেয়, এমন কি সেটা শুধুমাত্র টেবিলের উপরে লেখার সরঞ্জাম সাজানোও হতে পারে।” “Compulsive act allows a person mastery of some thing, even it is only the positioning of writing Implements on a desk”- Adler as narrated by Davison et al., 1998. এডলারের ব্যাখ্যাটি অনেক ধরনের বাধ্যতাধর্মী আচরণের বেলায় প্রয়োগ করা যায়।।

বাধ্যতামূলক বিকৃতির একটি সাধারণ পরিনতি হল পরিবার বা কর্মস্থলের অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া। কেউ যদি তার আত্মীয়কে দেখে যে সে প্রতি দশ মিনিট পরপর হাত ধুতে যায় অথবা স্নানের ঘরের মেঝের প্রতিটি টালি গণনা করে অথবা রাস্তাদিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিটি গাছে লাথি না মেরে চলতে পারে না, তাহলে চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক। ব্যক্তির স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, বন্ধুবান্ধব, কর্মস্থলের সহকর্মী সবাই তাদের আপন জনের এ ধরনের বাধ্যতাধর্মী কাজ দেখে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেক সময় তারা রোগীকে একাজটি থেকে বিরত রাখার জন্য বাধা দেয়। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারে যে ব্যক্তি এই নিরর্থক কাজগুলো না করে থাকতে পারে না। তখন তাদের মধ্যে অপরাধ বোধ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের অনভিপ্রেত ফলাফলের জন্য পারিবারের লোকজনের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক আরো খারাপ হয়, এবং রোগীর মধ্যে বিষণ্নতা এবং সাধারণীকৃত উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। এভাবে ক্রমশঃ ব্যক্তির মানসিক অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে এবং সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। এসব কারণে কোন কোন বাধ্যতাধর্মী রোগীর অসুস্থতার কারণ নিহিত থাকে বিবাহিত সম্পর্কের জটিলতার মধ্যে। সেজন্য এসব রোগীদের চিকিৎসা করার সময় স্বামী-স্ত্রীর একত্রে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখতে হয়।

আচরণবাদী ও জ্ঞানীয়তত্ত্ব (Behavioural and Cognitive Theories)

আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীরা বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও কাজ উভয়টিকেই শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তারা মনে করেন এসব আচরণ বলবৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ, বা পুরস্কৃত হওয়ার দরুণ, অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এক ধরনের বলবৃদ্ধি হল ভয়ের লাঘব হওয়া (reduction of fear)। যেমন, যে ব্যক্তি রোগ সংক্রমণের ভয়ে ভীত অর্থাৎ যার মন থেকে রোগাক্রান্ত হওয়ার চিন্তা দূর হয় না, সে এই চিন্তাটি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বারবার হাত ধৌত করে। সুতরাং হাত ধোয়ার কাজটি দ্বারা সে রোগাক্রমণের ভয় বা চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। এই মুক্তি পাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়াটা হল বলবৃদ্ধি (reinforcement)। ঠিক তেমনিভাবে যে ব্যক্তি একটি কাজ ঠিক হল কিনা (যেমন ঘরের দরজায় তালা লাগানো হয়েছে কিনা) তা বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করে, তখন উক্ত কাজটি ঠিকমত সম্পন্ন না হলে যে বিপদ ঘটতে পারত, বাধ্যতামূলক কাজটি তার চিন্তা বা উদ্বেগ থেকে তাকে মুক্তি দেয়। তবে এ ধরনের বাধ্যতাধর্মী কাজের মাধ্যমে সব ধরনের রোগীর উদ্বেগ সমান ভাবে হ্রাস পায় না। অনেকে বলেন যে, এসব রোগী বরং তাদের বাধ্যতাধর্মী কাজের জন্য উদ্বেগ বোধ করে। শের, ফ্রষ্ট এবং অটো (Sher, Frost and Otto. 1983) একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখেছেন যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীরা একটু আগে যে কাজটি করেছে তা ভুলে যায়। কিন্তু তারা স্মৃতি ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এতো গেল বাধ্যতা ধর্মী কাজের কথা।

বাধ্যতাধর্মী চিন্তা কেন হয়? আমরা জানি যে, আমাদের মনে অনেক সময়ই নেতিবাচক চিন্তা উদয় হয়— যেমন গাড়ী চলানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটবে বলে চিন্তা হয়। বাধ্যতাধর্মী চিন্তাও ঠিক এমনি ধরনের অবাঞ্ছিত চিন্তা। অনেক গবেষক বলেছেন যে, মানুষ যখন পীড়ন বা চাপের সম্মুখীন হয়, তখন এ ধরনের চিন্তা বেড়ে যায়। সাধারণ লোকেরা এসব চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন কিন্তু বাধ্যতাধর্মী চিন্তার রোগীদের বেলায় এসব চিন্তা খুব প্রবল হয়ে উঠে এবং ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এটা সম্ভবতঃ শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে তারা শেখে যে, কোন কোন চিন্তা বিপজ্জনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। বাধ্যতাধর্মী চিন্তার রোগীরা সম্ভবতঃ এসব কষ্ট দায়ক বা যন্ত্রণাদায়ক চিন্তাগুলোকে সক্রিয়ভাবে অবদমন করে যার ফল হয় দুর্ভাগ্য জনক। কিছু কিছু গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন চিন্তাকে অবদমিত করতে চেষ্টা করা হলে তা ঐ চিন্তাটির বাধ্যতামূলকভাবে ফিরে আসার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

জৈবিক কারণ (Biological factors)

এনসেফেলাইটিস (encephalitis) বা মস্তিষ্ক প্রদাহ, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অর্বুদ (Brain tumour) ইত্যাদি অসুস্থতার সঙ্গে বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও কাজের সম্পর্ক পাওয়া গেছে (Jenike, 1986 ) । এসব আঘাতের ফলে মস্তিষ্কের যে দুটি অঞ্চলে ক্ষতি হতে পারে এবং বাধ্যতাধর্মী আচরণ সৃষ্টি হতে পারে সেদুটি অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণা করা হয়েছে। এগুলোর একটি হল কর্টেক্স-এর সম্মুখভাগ (frontal lobe) এবং ব্যাসেল গ্যাংলিয়া (এগুলো হলো কর্টেক্স এর অধস্তন অঞ্চলের কতকগুলো স্নায়ুকেন্দ্র, যেমন কডেট নিউক্লিয়াস (caudate nucleus), পুটামেন (Putamen), গ্লবিউলাস প্যালিডাস (globulus Pallidus) এবং এমিগডালা (amygdala)}। পজিট্রন এমিশন স্ক্যানিং (PET scanning) পদ্ধতিতে ছবি তোলে দেখা গেছে যে বাধ্যতাধর্মী আচরণের রোগীদের কর্টেক্সের সম্মুখভাগে অধিকতর সক্রিয়তা ঘটে। এর ফলে বোঝা যায় যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীরা নিজেদের চিন্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে। ব্যাসেল গ্যাংলিয়া প্রধানতঃ মাংস পেশীর সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে এবং চিন্তাকে কাজে পরিণত করে। তাছাড়া ব্যাসেল গ্যাংলিয়া অকেজো হয়ে গেলে টাউরেট এর লক্ষণ (Tourett’s syndrome) দেখা দেয়। এই ব্যাধির লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে মাংসপেশীর অনৈচ্ছিক সঞ্চালন (Motor tics) এবং কণ্ঠস্বরের অনৈচ্ছিক স্পন্দন। সেজন্য বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়ায় ব্যাসেল গ্যাংলিয়ার ভূমিকা থাকা স্বাভাবিক।

তাছাড়া যাদের টাউরেটের লক্ষণ আছে তাদের মধ্যে বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়াও বিদ্যমান থাকে। রাউচ ও অন্যান্য (Rauch et al., 1994) পরীক্ষণ করে দেখেছেন যে, বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়ার রোগীদের কিছু নির্বাচিত জিনিস দেখানো হলে— যেমন ডাস্টবিনের কিছু ময়লাসহ গ্লাভস (gloves) দেখানো হলে, অথবা একটি দরজা খোলা অবস্থায় আছে এটা দেখানো হলে বাধ্যতাধর্মী আচরণের লক্ষণ প্রকাশ প্রায় এবং তাদের কর্টেক্স এর সম্মুখভাগে এবং ব্যাসেল গ্যাংলিয়াতে বেশি পরিমাণে রক্ত প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ এই দুটি অঞ্চলে অধিক সক্রিয়তা সৃষ্টি হয়।

সেরোটনিন (serotonin) নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটার বা স্নায়ু প্রবাহ পরিবহনকারী পদার্থ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। পিগো ও অন্যান্যরা (Pigott et al., 1990) গবেষণা করে দেখেছেন যে, যেসব বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধ মস্তিষ্কের কোষগুলোতে সেরোটোনিনের গ্রহণের হার কমিয়ে দেয় সেসব ঔষধ বাধ্যতধর্মী বিকৃতির চিকিৎসায় ভাল কাজ দেয়। এ থেকে মনে হয়েছিল যে সেরোটনিনের অভাব বা নীচুমাত্রা অথবা সেরোটনিন গ্রাহক কোষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াই বাধ্যতা ধর্মী বিকৃতির জন্য দায়ী। কিন্তু এ ধরনের অনুমান পরীক্ষণের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। বরং দেখা গেছে যে ঔষধের সাহায্যে সেরোটনিন সংগ্রাহক কোষকে উদ্দীপিত (stimulation) করা হলে বাধ্যতাধর্মী আচরণ হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পায় (Bastani et al., 1990)। অনেকেই বলেছেন যে ডোপামিন এবং এসিটিলকোলিন ( acetylcholine) সেরোটনিনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাধ্যতাধর্মী আচরণ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিছু কিছু গবেষণায় বাধ্যতাধর্মী বিকৃতিতে বংশগতির প্রভাব সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। ম্যাককিওন ও মারে (Mo Keon and Marray. 1987) গবেষণার ফলাফল থেকে বলেছেন যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীদের নিকট- আত্মীয়দের মধ্যে উদ্বেগজনিত বিকৃতি বেশি দেখা যায়। লিনেন ও তার সঙ্গীরা (Lenane et al. 1990) গবেষণা করে বলেছেন যে, যাদের বাধ্যতাধর্মী বিকৃতি আছে তাদের নিকট-আত্মীয়দের ৩০% জনের মধ্যে এই বিকৃতি দেখা দেয়। তবে এই বিকৃতিতে বংশগতির প্রভাব সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির চিকিৎসা (Therapies For Obsessive Compulsive Disorder)

এই রোগটির চিকিৎসা করা সবচেয়ে কঠিন। মনোসমীক্ষণ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হলে অমূলকভীতি এবং সাধারণীকৃত উদ্বেগের চিকিৎসার মতই ব্যক্তির অবদমনগুলোকে যুক্ত করতে হয়, এবং ব্যক্তি যে প্রেষণাটির বাস্তবায়নকে ভয় করে অর্থাৎ ব্যক্তি যে অবদমিত আকাঙ্খা বা কর্ম প্রবণতাটির বহিঃপ্রকাশকে ভয় করে, তার সম্মুখীন করা হয় এবং সেই আকাঙ্খাটির মোকাবেলা করতে দেওয়া হয়। যেহেতু পৌনঃপুনিক চিন্তা এবং বাধ্যতামূলক কাজটি ব্যক্তিকে তার অবদমিত দ্বন্দ্বগুলো থেকে রক্ষা করে, সেজন্য এসব চিন্তা বা কাজ থেকে তাকে মুক্ত করা কষ্টসাধ্য এবং মনোসমীক্ষণ পদ্ধতিতে এর চিকিৎসা সফল হয় না।

কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন যে, বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির রোগীদের আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে একযোগে মনোমসীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা ভাল। কারণ মনোসমীক্ষণের মাধ্যমে রোগী তার অসুবিধার কারণগুলো বলতে পারে এবং আচরণমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি সহজে অনুসরণ করতে পারে।

অনেক মনোসমীক্ষণবাদী মনে করেন যে, যেহেতু এই রোগীরা অনিশ্চয়তা থেকে ভোগে এবং এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় তাদের কাজ শুরু করার আগেই ১০০% নির্ভুল হওয়ার চাহিদা থেকে। সেজন্য মনোচিকিৎসার একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে তারা বুঝতে শেখে যে বাস্তব জীবনে কোন কিছুই ১০০% নিশ্চিত নয় এবং সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং এই বোধ জাগ্রত করার সাথে সাথে ব্যক্তিকে কিছু পরিমাণ অনিশ্চয়তাকে গ্রহণ করার এবং উদ্বেগ সহ্যকরার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে বাস্তব জীবনে সে এধরনের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হবে না। যাই হোক, মনোসমীক্ষণ পদ্ধতির সর্বশেষ লক্ষ্য হল ব্যক্তির লক্ষণগুলোর পেছনে যে অবচেতন মনে লুক্কায়িত আকাঙ্ক্ষা বা বিপরীতধর্মী আকাঙ্ক্ষাসমূহের দ্বন্দ্বগুলো লুকিয়ে থাকে সেগুলোকে গ্রহণ করতে রোগীকে সাহায্য করা। “The ultimate focus of trearment remains insight into the unconscious detrminants of symptoms” (Davison et al., 1998)। অর্থাৎ “চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হল বাধ্যতাধর্মী বিকৃতির লক্ষণগুলোর অবচেতন নির্ধারকগুলো সম্মন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা” (ডেভিসন ও অন্যান্য ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৪৫)।

বাধ্যতাধর্মী আচার বা অনুষ্ঠানের (rituals) চিকিৎসা করার জন্য ইংল্যাণ্ডের ভিক্টর মেয়ার (Victor Meyer, 1966) যে পদ্ধতির ব্যবহার করেন তা সকলেই সমর্থন করেন। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে উন্মুক্তকরণ (exposure) এবং প্রতিরোধ (prevention)- এ দুয়ের মিশ্রণ বা যৌথ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে, যে সব পরিস্থিতিতে ব্যক্তির বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়াটি সৃষ্টি হয়, সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হয়— যেমন একটি ময়লা থালা হাত দিয়ে ধরা, তার পর সে যে বাধ্যতাধর্মী ব্যক্তিকে কাজটি করার কথা (যেমন হাত ধোয়া) তার থেকে বিরত রাখা। এ ধরনের চিকিৎসার যৌক্তিকতা হল এই যে, এই পদ্ধতিতে ব্যক্তির বাধ্যতামূলক আচরণটির ঋণাত্মক বলবৃদ্ধি ঘটে এবং আচরণটি দুর্বল বা অবলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ যে উদ্দীপকটি ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে যেমন চেয়ারে ধুলিকনা, সেটির প্রতি উদ্বেগ কমে যায়। এবং ব্যক্তিকে বাধ্যতাধর্মী ক্রিয়াটি করতে না দিলে সে উক্ত উদ্দীপকটির সম্মুখীন হয় এবং এটির প্রতি তার বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়ার বিলুপ্তি ঘটে। ডুগান ও তার সঙ্গীরা (Duggan et al., 1993) পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণা করে দেখেছেন যে, এ পদ্ধতিতে প্রায় ৫০% রোগী ভাল হয়ে যায়। এটি শিশু ও কিশোরদের মধ্যেও সমান কার্যকরী। এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হলে হাসপাতালে স্টাফ (stall)-দের শিক্ষা দিতে হবে কিভাবে ব্যক্তিকে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী পরিস্থিতিতে বা যে উদ্দীপকের উপস্থিতিতে বাধ্যতাধর্মী আচরণটি ঘটে তা থেকে রোগীকে বিরত রাখা যায়। অর্থাৎ রোগী যাতে আচরণটি করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতে হলে পরিবারের সদস্যদের সাহায্য প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় রোগীকে বাধ্যতাধর্মী আচরণটি করতে না দিলে রোগী বিরক্ত হয় এবং চিকিৎসা ছেড়ে দেয়। চিকিৎসার জন্য না আসাও এই ব্যাধির একটি সমস্যা। রোগীরা দীর্ঘসসূত্রিতা করে আসতে চায় না, তারা অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চায় না এবং মনে করে তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। সে জন্য এসব সমস্যা মোকাবেলা করেই চিকিৎসা করতে হয়।

যে সব ঔষধ মস্তিষ্কে সেরোটনিনের পুনরায় গ্রহণকে অবদমিত করে (serotonin reuptake inhibitors) সে সব ঔষধ এবং ত্রি-চক্রবিশিষ্ট ঔষধ (যেমন ইলাভিল বা টোফানিল) – যেগুলো বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধ, সেগুলো ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গেছে (Jenike, 1986)। একটি গবেষণায় দেখা গেছে বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধ ইমিপ্রামিন বিষণ্ণতা দূর করলেও বাধ্যতাধর্মী আচরণের কোন উন্নতি ঘটে না। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্লোমিপ্রামিণ (clomipramin ) বাধ্যতাধর্মী আচরণকে সাময়িকভাবে বিলুপ্ত করতে পারে কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে আচরণটির পুনরাগমন ঘটে। এই ঔষধের পর বাধ্যতাধর্মী আচরণের পুনরাগমনের হার প্রতিক্রিয়াটিকে বাধা দিয়ে চিকিৎসা করার পর পুনরাগমনের হারের তুলনায় বেশি। যে সব ঔষধ মস্তিষ্কে সেরোটনিনের ব্যবহার অবদমন করে যেমন, ফ্লোওক্সেটিন (fluoxetin)- সেগুলোর মাধ্যমে চিকিৎসা করে মোটামুটি ভাল ফল পাওয়া যায়, তবে ঔষধ ছেড়ে দিলেই বাধ্যতাধর্মী আচরণটি ফিরে আসে (Mc Dougle et al., 1994)।

আরেকটি জৈবিক চিকিৎসা পদ্ধতি হল মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার (Psychosurgery)। বাধ্যতাধর্মী আচরণের চিকিৎসার জন্য মস্তিষ্কের করপাস কেলোসাম এর সন্নিকটবর্তী সিঙ্গুলাম (cingulum) নামক একটি সংগঠন থেকে দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার পরিমাণ অংশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এতে অনেকটা সুফল পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে এ চিকিৎসা হয় না। যেকোন পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করা হোক না কেন এ রোগে আরোগ্যের হার খুব আশাব্যঞ্জক নয়। তবে এসব চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়।

মানসিক আঘাতের পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতি (Post traumatic Stress Disorder)

বিবরণ

মানসিক আঘাতের পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতি (Posttraumatic Stress Disorder সংক্ষেপে PTSD) কে ১৯৮০ সাল থেকে DSM-III তে একটি স্বতন্ত্র রোগ হিসেবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। “মানসিক আঘাতের পরবর্তী পীড়নমূলক প্রতিক্রিয়া বা PTSD হল একটি গুরুতর পীড়নমূলক ঘটনার (stress) প্রতি ব্যক্তির চরম প্রতিক্রিয়া যার অন্তর্ভুক্ত হল অতিরিক্ত উদ্বেগ, আঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপকসমূহ বর্জন করা, এবং আবেগীয় আচরণের জড়তা বা অনুভূতি শূন্যতা।” (ডেভিসন ও নীয়েল ১৯৯৮)। “Posttraumatic Stress Disorder (PTSD) entails extreme response to a severe stressor, Including increased anxiety, avoidace of stimull associated with the trauma and a numbing of the emotional responses.” (Davison et al. 1998). কোন বিকৃতি বা মানসিক ব্যাধিকে PTSD হিসেবে শনাক্ত করতে হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো এক মাসের বেশি স্থায়ী হতে হবে :

  • (ক) ব্যক্তি একটি দুঃখজনক / বেদনাদায়ক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে
    • (১) ব্যক্তি নিজে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, দুর্ঘটনাটি প্রত্যেক্ষ করেছে, বা সম্মুখীন হয়েছে যার ফলে তার মৃত্যু হতে পারত, গুরুতর জখম হয়েছে (বা হতে পারত), এবং নিজের বা অন্য কারো শারীরিক অখণ্ডতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
  • (খ) বেদনাদায়ক ঘটনাটির অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটছে (অন্ততঃ এক বা একাধিক উপায়ে) 
    • (১) ঘটনাটির দুঃসহ স্মৃতি বারবার ফিরে আসছে যেমন ঘটনার মানসিক ছবি, ঘটনার চিন্তা, ঘটনার প্রত্যক্ষণ বা স্মৃতি মনের মধ্যে বারবার উদিত হচ্ছে।
    • (২) ব্যক্তি পুনঃপুনঃ ঘটনার বেদনাদায়ক স্বপ্ন দেখছে (পৌনঃপুনিক দুঃস্বপ্ন)
    • (৩) ব্যক্তি ঘটনাটি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেনা অর্থাৎ তার আচরণ ও অনুভূতিগুলো এমন যেন বেদনাদায়ক ঘটনাটি বারবার ঘটে চলেছে। ঘটনাটি ঘটনা সময়ে ব্যক্তির মধ্যে যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার বহুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটছে, বা উক্ত ঘটনার অধ্যাস ও অলীক প্রত্যক্ষণ ঘটছে এবং ঘটনার স্মৃতি পুনরায় জীবন্ত রূপ ধারণ করছে (flash back)।
    • (৪) ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক সংকেত উপস্থিত হলেই ব্যক্তির মধ্যে মানসিক পীড়ন বা যন্ত্রণা হয়।
    • (৫) ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক সংকেতের সম্মুখীন হলে ব্যক্তির শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সূচিত হয়।
  • (গ) ব্যক্তি বেদনাদায়ক ঘটনাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপকগুলোকে সব সময় এড়িয়ে যায় এবং তার আবেগীয় প্রতিক্রিয়া অসাড় হয়ে গেছে— যার পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর মাধ্যমে। (যেকোন তিনটি লক্ষণ থাকতে হবে) :
    • (১) ব্যক্তি বেদনাদায়ক ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিন্তা, অনুভূতি, বা কথাবার্তা এড়িয়ে চলতে চায়।
    • (২) যেসব ব্যক্তি, স্থান, বা কাজ বেদনাদায়ক ঘটনার স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে, ব্যক্তি সেগুলো এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে।
    • (৩) বেদনাদায়ক ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ কোন দিক/ বৈশিষ্ট্য স্মরণ করতে পারে না।
    • (৪) গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে না বা আগ্রহ দেখায় না
    • (৫) অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, অনুভূতি বা বিচ্ছিন্নতা বোধ দেখা দেয়।
    • (৬) আবেগের সংকীর্ণতা (যেমন ভালবাসার অনুভূতি লাভের অক্ষমতা)।
    • (৭) ভবিষ্যতের লক্ষ্যহীনতা (যেমন তার পেশা, বা জীবিকা, বিবাহ, সন্তান, বা কতদিন বাঁচবে এসব বিষয়ে কোন প্রত্যাশা থাকে না)।।
  • (ঘ) ব্যক্তি সব সময় অভ্যন্তরীণভাবে উত্তেজিত অবস্থায় থাকে— যার লক্ষণগুলো হতে পারে …নিম্নলিখিতগুলোর যেকোন দুটি বা বেশি) :
    • (১) ব্যক্তি সহজে ঘুমাতে পারে না, বা বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না।
    • (২) খিটখিটে মেজাজ বা মেজাজের তীব্র বহিঃ প্রকাশ।
    • (৩) মনোযোগের অসুবিধা, (মনোনিবেশ করতে না পারা)
    • (৪) অতিসতর্কতা (hypervigilance)
    • (৫) অতিরিক্ত চমকে উঠা।

এই লক্ষণগুলো ব্যক্তির সামাজিক, বৃত্তিমূলক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যাসৃষ্টি করে।

উল্লিখিত লক্ষণগুলো ছাড়াও PTSD’র রোগীদের মধ্যে অন্যান্য সমস্যাও দেখা যায়। যেমন উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ক্রোধ, মাদকের অপব্যবহার (substance abuse)— অর্থাৎ তারা মানসিক যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে। অনেকেরই বিবাহিত জীবনে সমস্যা দেখা দেয় (স্ত্রীর সঙ্গে বা স্বামীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না।) এবং পেশাগত জীবনে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক রোগী আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে, আবার কেউ কেউ ক্রোধের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ ঘটায় (যাকে আমরা বলি ক্রোধে ফেটে পড়ে)। পীড়নের প্রভাব হিসেবে সাধারণত মনোদৈহিক সমস্যা দেখা দেয়— যেমন কোমরের পেছন দিকে ব্যাথা (Low backpain), মাথাধরা এবং পাকস্থলী এবং অস্ত্রের সমস্যা— যেমন পেপটিক আলসার ইত্যাদি।

এ রোগটি প্রচণ্ড বেদনাদায়ক ঘটনার পরে (যেমন ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বলাৎকার, এসিড নিক্ষেপ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন খারাপী) এসব ঘটনা যেই প্রত্যক্ষ করুক না কেন, হতে পারে। এটি শিশুদের মাধ্যেও হতে পারে— যারা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়। শিশুদের লক্ষণ বয়স্কদের লক্ষণ থেকে কিছুটা আলাদা হয়। যেমন শিশুরা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে। দুঃস্বপ্নে তারা দৈত্য দানব (Monster) দেখে এবং কতকগুলো আচরণমূলক পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন যে শিশুটি আগে হাসিখুশি ছিল, সে হঠাৎ শান্ত বা গম্ভীর হয়ে যায়, যে শিশুটি আগে শান্ত শিষ্ট ছিল সে হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। অনেকে মনে করে তারা বড় হওয়ার আগেই মারা যাবে ইত্যাদি। শিশুরা যে সব কৌশল বা দক্ষতা অর্জন করেছিল সেগুলো ভুলে যেতে পারে। যেমন যে শিশুটি কথা বলতে শিখেছিল, সে কথা বলা ভুলে যায়, যে শৌচাগার ব্যবহার করতে শিখেছিল, সে তা ভুলে যায়। তাছাড়া শিশুরা তাদের মানসিক বিপর্যয় বা দুর্ঘটনার কথা সহজে বর্ণনা করতে পারে না, যত সহজে বয়স্করা পারে। এ বিষয়টি বিশেষ করে যারা ধর্ষণ বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের বেলায় সত্য।

আমেরিকায় PTSD- রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ১% থেকে ৩%। অর্থাৎ প্রায় ২ মিলিয়ন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যারা শরীক হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এ রোগের হার ২০%, এবং অন্যান্য নাগরিকদের— যারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৩.৫% এ রোগে ভুগছে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ডেট্রয়েট শহরের ৩৯% লোক কোন না কোন সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং তাদের মধ্যে ২৪% PTSD লক্ষণে আক্রান্ত হয়।

মানসিক আঘাতের পরবর্তী-পীড়নমূলক মনোবিকৃতির কারণ (Etiology of PTSD)

দুর্ঘটনা, বেদনাদায়ক ঘটনা বা মানসিক আঘাতের পর সবাই PTSD তে আক্রান্ত হয় না। আমরা অনেকেই দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতি সহজেই ভুলে যেতে পারি এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক আচরণ করতে পারি। কিন্তু অনেকেই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ায়, উত্তেজিত, বিষণ্ণ অবস্থায় থাকে এবং দুঃস্বপ্ন দেখে। PTSD’র জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

  • (১) ঝুঁকিপূর্ণ শর্ত (Risk factors) : দুর্ঘটনার শিকার হলে মহিলাদের মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের তুলনায় বেশি। তাছাড়া, যারা ছোট বেলায় পিতা/মাতা হারিয়েছে, যাদের পরিবারে এ ধরনের রোগের ইতিহাস রয়েছে, এবং দুর্ঘটনার আগে থেকেই যারা আতঙ্ক জনিত বিকৃতি (Panic disorder), বাধ্যতাধর্মী বিকৃতিতে (Obsessive Compulsive Disorder = OCD) ভুগছে তাদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি (Breslau et al., 1991)।
  • (২) দুর্ঘটনার তীব্রতা (Intensity of the traumatic event) : ব্যক্তি যে দুর্ঘটনার শিকার হয়, বা প্রত্যক্ষ করে তার তীব্রতা যত বেশি হয়, পীড়নমূলক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যায়। যেমন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যে সৈনিকরা যত বেশি দিন থাকে, এ রোগের সম্ভাবনা তত বেশি বেড়ে যায়।
  • (৩) প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ধরণ : দুর্ঘটনার শিকার হলে কোন ব্যক্তির মধ্যে PTSD ঘটবে কিনা তা বেদনাদায়ক ঘটনার প্রতি তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া থেকে পুর্বানুমান (prediction) করা যায়। সালেভ ও তার সঙ্গীদের (Shalev et al, 1996) গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, কোন বেদনাদায়ক ঘটনার প্রতি যারা অন্যান্য লোকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এবং বিচ্ছিন্নতামূলক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সাড়া দেয়, পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে PTSD দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

PTSD-র মনোবৈজ্ঞানিক কারণ (Psychological factors)

মানসিক আঘাতের পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতি (PTSD) কিভাবে সৃষ্টি হয়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক ও জীববিজ্ঞানসম্মত তত্ত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিক্ষণ তত্ত্ব: শিক্ষণ তত্ত্ব অনুসারে আঘাতের পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতি ভয়ের চিরায়ত সাপেক্ষণ থেকে সৃষ্টি হয়। ফেয়ারব্যাংক ও ব্রাউন (Fairbank and Brown, 1987), কিয়েন, জিমারিং ও ক্যাডেল (Keane. Zimering and Caddel, 1985) প্রভৃতি গবেষকগণ PTSD কে ভয়ের চিরায়ত সাপেক্ষণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মনে করা যাক, একজন মহিলা তার বাড়ীর আশেপাশের একটি এলাকায় ধর্ষণের শিকার হলেন। এর পর থেকে ঐ মহিলা উক্ত স্থানে বেড়াতে যেতে ভয় পাবেন, কারণ তিনি ঐস্থানে ধর্ষিতা হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ধর্ষণ হল অসাপেক্ষ উদ্দীপক (UCS) এবং ঐ স্থানটি হল সাপেক্ষ উদ্দীপক (CS)। এখন সাপেক্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী ঐ স্থানটি (CS) মহিলার মধ্যে ভয় সৃষ্টি করবে এবং তিনি ভয় থেকে মুক্ত থাকার জন্য বা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঐ স্থানটি এড়িয়ে যাবেন। এভাবে বর্জনমূলক প্রতিক্রিয়াটির বলবৃদ্ধি ঘটবে। এক অর্থে PTSD হল পরিহারমূলক শিক্ষণ বা বর্জন মূলক শিক্ষণের (Avoidance learning) এর একটি দৃষ্টান্ত। আমরা সবাই জানি যে পরিহার শিক্ষণ দুটি পর্যায়ে ঘটে বলে মাওরার (Mowrer, 1947) যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাকে পরিহার শিক্ষণের দ্বি উপাদান তত্ত্ব (Two factor theory) বলে। জ্ঞানীয় তত্ত্বের সমর্থকগণ (cognitive theory) মনে করেন PTSD তে আক্রান্ত রোগীরা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে অসহায় বোধ করে। তারা মনে করে পরিস্থিতির উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং কি ঘটতে যাচ্ছে তা তারা জানে না।

সাইকোডাইনামিক তত্ত্ব (Psychodynamic theory): PTSD কিভাবে বিকাশ লাভ করে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হরোইজ (Horowitz, 1986, 1990) যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাকে সাইকোডাইনামিক তত্ত্ব (Psychodynamic theory) বলা হয়। এটি অনেকটা মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের মতই। হরোইজ বলেছেন যে, বেদনাদায়ক ঘটনাটির স্মৃতি ব্যক্তির মনে সব সময় উদিত হয়, এবং এই স্মৃতি এত বেশি বেদনাদায়ক যে এগুলোকে ব্যক্তি হয়ত সচেতনভাবে দমিয়ে রাখে (যেমন অন্য কোন ঘটনার দিকে মনোযোগের মাধ্যমে) অথবা অবচেতন মনের গভীরে অদমন করে। এই তত্ত্ব অনুসারে মনে করা হয় যে, ব্যক্তি দুঃখজনক ঘটনাটিকে তার নিজের সম্বন্ধে এবং সমস্ত জগত সম্বন্ধে তার বিদ্যমান বিশ্বাসের সঙ্গে সমন্বিত করার জন্য সংগ্রাম করছে— যাতে সে এই ঘটনাটির একটি অর্থ খুঁজে পায়, বা এটিকে গ্রহণ করতে পারে। “The person is believed to engage in a kind of internal struggle to integrate the trauma into his or her existing beliefs about himself and the world to make some sense out of it.” (Davison & Neale, 1998).” তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, সাইকোডাইনামিক তত্ত্বে মনে করা হয় যে, PTSD’র লক্ষণগুলো হলো দুঃখজনক ঘটনাটিকে ব্যক্তির বিদ্যমান বিশ্বাসের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার প্রচেষ্টা।

জৈবিক শর্ত (Biological factors): কতকগুলো গবেষণা থেকে PTSD সৃষ্টি হওয়ার জন্য জৈবিক শর্তের প্রভাব সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। যমজ সন্তানদের একজনের এ রোগ হলে আরেকজনের মধ্যে এটা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া, বেদনাদায়ক ঘটনা বা আঘাত শরীরের নর-এড্ৰিনার্জিক প্রণালীকে সক্রিয় করে তুলতে পারে যার ফলে নর-এপিনেফ্রিনের ক্ষরণ বেড়ে যায় এবং ব্যক্তি চমকে ওঠে এবং অন্যান্য লোকের চেয়ে সহজে আবেগ প্রকাশ করে (Krystal et al., 1980, van der Kolk et al., 1985) । এই মতের স্বপক্ষে আরেকটি প্রমাণ হল এই যে, স্কিজোফ্রেনিয়া অথবা আবেগের গোলযোগের রোগীদের চেয়ে হাসপাতালে অবস্থানরত PTSD’র রোগীদের শরীরে নর-এপিন্যাফ্রিনের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে (Kosten et al., 1987)। তদুপরি পরীক্ষণমূলকভাবে নর-এড্ৰিনার্জিক প্রণালীকে উত্তেজিত করে দেখা গেছে যে, PTSD রোগীদের ৭০% এর মধ্যে আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং ৪০% রোগীর মধ্যে দুঃসহ স্মৃতির হুবহু পুনরাবির্ভাব (Flashback) ঘটে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ পাত্রদের বেলায় এসব প্রতিক্রিয়া ঘটে না। কোন কোন মনোবিজ্ঞানী মনে করেন যে, দুঃখজনক বা বেদনাদায়ক ঘটনার পর সবারই PTSD-তে আক্রান্ত না হওয়ার কারণ হলো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য। অনেকে মনে করেন যে কোন ব্যক্তির কতকগুলো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য (Diathesis) তাকে এ রোগের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ করে তোলে। অর্থাৎ কতকগুলো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই কোন কোন লোকের মধ্যে আঘাতের পর এ রোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধিপায়। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে : বেদনা দায়ক ঘটনার পূর্ব থেকেই কোন মানসিক রোগের উপস্থিতি, পরিবারের কোন সদস্যের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ইতিহাস এবং শৈশবে পিতা-মাতার মৃত্যু বা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব ইসরাইলী সৈন্য ১৯৮২ সনের লেবাননের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছিলেন তাদের নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, যারা তাদের ব্যর্থতার জন্য নিজেদেরকে দায়ী করে এবং পীড়নের মোকাবেলা করার জন্য আবেগের উপর গুরুত্বদেয়, কিন্তু বাস্তব সমস্যার উপর গুরুত্ব দেয় না— তাদের মধ্যে PTSD-র রোগীর সংখ্যা বেশি (Solomon ও অন্যান্য, ১৯৮৮)। গবেষণায় দেখা যায়, যাদের মধ্যে দৃঢ়সংকল্প ও উদ্দেশ্যমুখিতা থাকে তাদের এ রোগ হয় না। সামাজিক সমর্থন বা সাহায্য সহযোগিতা থাকলেও এ রোগের সম্ভাবনা কমে যায়। এনডু (Andrew) ঘুর্ণিঝড়ে যে সব শিশু ক্ষতিগ্রস্ত ও আহত হয়েছিল তাদের মধ্যে যারা সামাজিক সমর্থন সহযোগিতা পেয়েছিল তাদের মধ্যে PTSD-তে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা যারা এ ধরনের সাহায্য পায়নি তাদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যার চেয়ে কম ছিল (Vernberg et al., 1996)।

PTSD’র চিকিৎসা (Therapies for Post Traumatic stress Disorder)

উদ্বেগ ও অমূলক ভীতির চিকিৎসায় যেমন রোগীকে উদ্বেগজনক বা ভীতি সৃষ্টিকারী উদ্দীপক (পরিস্থিতির) সম্মুখীন করে ভাল ফল পাওয়া গেছে, ঠিক তেমনি PTSD-এর চিকিৎসায় ও রোগীকে বেদনাদায়ক/আঘাত সৃষ্টিকারী পরিস্থিতির সম্মুখীন করানো হয়, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন না করিয়ে পরিস্থিতির একটি কাল্পনিক চিত্রের (Imagery) সম্মুখীন করানো হয়। তাছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন করানোর সময় সব সময় বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পরে কি ঘটতে পারে সে বিষয়ে চিকিৎসককে সচেতন থাকতে হবে। বেদনাদায়ক পরিস্থিতির কথা রোগীকে আবার স্মরণ করতে বললে, বা পরিস্থিতির একটি স্মৃতিচিত্র (Image) উপস্থিত করা হলে রোগীরা যেসব প্রতিক্রিয়া করে সেগুলো হল বিশ্বাসহীনতা (lack of trust) ও পৃথিবীকে একটি বিপজ্জনক স্থান হিসাবে বিশ্বাস করা, তীব্র পীড়নের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য মাদক দ্রব্যের ব্যবহার (substance use) । রোগীদের বুঝিয়ে দিতে হয়, এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয় PTSD কি ধরনের সমস্যা। বিশেষ করে, বেশির ভাগ লোকেরা কিভাবে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মোকাবেলা করে (যেমন, অনিদ্রা সহজে চমকে উঠা, বিষণ্ণতা, ভালবাসার পাত্রদের কাছে থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা, বন্ধুবান্ধবদের থেকে সরে আসা বা তাদের প্রতি আগ্রহের অভাব ইত্যাদি)। এসব বিষয়ে রোগীদের শিক্ষিত করলে সুফল পাওয়া যায়। এসব জ্ঞান থেকে রোগী কি ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে তা প্রত্যাশা করা যায় এবং রোগী যে “পাগল” হয়ে যাচ্ছে না বা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেনা সে বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করা যায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকদের চিকিৎসা করার জন্য প্রথমে তাদের শিরায় সোডিয়াম পেনটোথল (sodium pentothal) ইনজেকশনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে নিদ্রাবেশ (hypnosis) তৈরি করা হতো তারপর তাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে বলা হতো। রোগীরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতি পুনরায় স্মরণ করতো এবং চিকিৎসকের নিকট বর্ণনা করতো, তখন তারা বিভিন্ন ধরনের আবেগ প্রকাশ করতো- যেগুলো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ঘটে ছিল। অনেক ঘটনা যেগুলো তারা ভুলে গিয়েছিল সেগুলোও তাদের স্মরণে আসত এবং হুবহু পূর্বের মতই তীব্র আবেগ সহ প্রকাশ পেত। তারপর ক্রমশ তাদের ঔষধের প্রভাব কেটে গেলে রোগীরা বুঝতে পারত যে এসব ঘটনা অতীত হয়ে গেছে, এখন আর ভয়ের কিছু নেই। এভাবে চিকিৎসকরা রোগীদের অতীতের দুঃস্বপ্নকে সহজভাবে প্রকাশ করতে দিয়ে অতীতের বেদনা লাঘব করতে পারতেন, এবং অতীতের ঘটনাগুলোর সঙ্গে বর্তমান অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করতেন।

১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকরা ইয়েলের মনোচিকিৎসক রবার্ট জে লিফটনের সহায়তায় র‍্যাপ গ্রুপ (Rap group) প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গ্রুপের উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যাদের PTSD- জনিত মানসিক বিকৃতি দেখা দিয়েছিল তাদের পরামর্শ ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া। এই গ্রুপ নিউইয়র্ক শহর থেকে ক্রমশ বাইরে শাখা প্রশাখা গঠন করে এবং ১৯৭৯ সালে আমেরিকান সরকার থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পায়। তখন তারা শহরের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদেরও সাহায্য করেন। এসব গ্রুপে যুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা যেসব অপরাধবোধ থেকে ভুগতো (যেমন নিরস্ত্র শিশু বা নাগরিক কে হত্যা করার স্মৃতি, ধর্ষণের স্মৃতি, এমনি ধরনের স্মৃতি- থেকে জাগ্রত অপরাধবোধ- অনেক সময় বন্ধুকে মেরে ফেলা হত, কারণ গেরিলা যুদ্ধে কে শত্রু কে মিত্র চেনা সম্ভব ছিলনা)— এসব অপরাধবোধ এবং ক্রোধ, বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি থেকে মুক্ত করার জন্য আলোচনা করা হত। ক্রমশঃ এসব আলোচনায় বর্তমান জীবনের সমস্যাও স্থান করে নিল। যেমন এসব গ্রুপে, বর্তমান জীবনের সমস্যা (যেমন যৌন জীবন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, মহিলাদের সম্পর্কে অনুভূতি এবং পুরুষালী স্বভাব সম্পর্কে সৈনিকদের অনুভূতি বা ধারণা) ইত্যাদি বিষয়ে পরস্পর মতামত প্রকাশ করত। এই ব্যবস্থার ফলে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের মানসিক সমস্যা (PTSD) অনেক কমে গিয়েছিল। কখনো কখনো তাদের বিষণ্ণতা-বিরোধী ঔষধের সাহায্যেও চিকিৎসা করার হত। কিন্তু এতে সব সময় সুফল পাওয়া যেত না।

আমেরিকার ইএমডিআর ইনস্টিটিউটের (EMDR institute) মনোবিজ্ঞানী ডঃ ফ্রান্সিন শাপিরো (১৯৯৬) PTSD-এর রোগীদের জন্য যে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন তা খুবই ফলপ্রসূ। এ পদ্ধতিটিতে মনোসমীক্ষণ পদ্ধতি ও আচরণমূলক এবং জ্ঞানীয় পদ্ধতির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। শাপিরোর পদ্ধতিটিকে বলা হয় চক্ষুসঞ্চালনের মাধ্যমে সংবেদনশীলতা হ্রাসকরণ এবং পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ (Eye Movement Desnsitization and Reprocessing সংক্ষেপে EMDR) পদ্ধতি। অনুমান করা হয় যে, নেতিবাচক জীবন অভিজ্ঞতা অথবা মানসিক আঘাত মস্তিষ্কের জৈববাসয়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় এবং এতে তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ (information processing) বাধাপ্রাপ্ত হয়। তার ফলে বেদনাদায়ক ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহ (অভিজ্ঞতা)– যেমন প্রত্যক্ষণ, অনুভূতি, বিশ্বাস, ইত্যাদি স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে আটকে থাকে এবং প্রক্রিয়াজাত হয় না। প্রক্রিয়াকরণের অর্থ হলো বর্তমানে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতামূলক তথ্য সমূহকে অতীতের ঘটনাবলীর স্মৃতির সঙ্গে মেলানো এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়ার প্রোগ্রামিং-করণ।

ইএমডিআর (EMDR) পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিকে ত্বরান্বিত করা হয়। এটি বিভিন্ন উপায়ে মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াজাত করণের প্রণালীকে খুলে দেয় বলে দাবী করা হয়। পদ্ধতির কার্যপ্রণালী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এটি অনেকটা ঘুমের মধ্যে যে চক্ষুসঞ্চালন ঘটে যেখানে শিক্ষণ ও স্মৃতির প্রক্রিয়াকরণ ঘটে, তারই অনুরূপ। মস্তিষ্কের দুটি গোলার্শ্বের মধ্যে যে সব তথ্য আটকা পড়ে ছিল, দুই গোলার্শ্বের উত্তেজনার স্তরের পার্থক্যের জন্য প্রক্রিয়াজাত হতে পারেনি, চক্ষুসঞ্চালনের ফলে দুই গোলার্শ্বের যোগাযোগবৃদ্ধি পায় এবং আটকে পড়া অভিজ্ঞতাগুলো শেষ পর্যন্ত প্রক্রিয়াজাত হতে পারে (Nicosla, 1994)। অন্যদিকে চক্ষুসঞ্চালন সম্ভবতঃ স্নায়ুশারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে একটি ঔৎসুক্য প্রতিবর্তী (Orientation reflex)-এর পরিবর্তন ঘটায় যা বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর প্রতি সংবেদনশীলতা হ্রাস করে। ইএমডি আর পদ্ধতির আরেকটি কৌশল হল জ্ঞানীয় তথ্যসমূহ সংঘবদ্ধ করে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়ানো এবং ইতিবাচক আচরণে উৎসাহিত করা। এই কৌশলটিকে বলা হয় জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার আন্তঃসম্পর্ক স্থাপন (cognitive interweave) ।

দলগত চিকিৎসা (Group therapy): PTSD-র রোগীদের দলগতভাবে চিকিৎসা করে ভাল ফল পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যাগত আমেরিকান সৈনিকদের র‍্যাপ গ্রুপ (পূর্বোল্লিখিত) ও দলীয় পদ্ধতিতে ১৭২টি প্রাক্তন সৈনিকদের পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। এসব রোগীদের নিয়ে দলগত চিকিৎসা সফল হওয়ার পেছনে নিম্নলিখিত শর্তগুলো কাজ করেছে বলে মনে হয় :

  • (১) এসব সৈনিক সহতীর্থদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পায় এবং পরস্পরের কাছে থেকে মানসিক সমর্থন পায়, যাতে তারা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার বোঝা লাঘব করতে পারে।
  • (২) যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধকালে সংঘটিত যেসব ঘটনাবলীর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞাতাগুলো তারা এতদিন অবদমন করে রেখেছিল সেগুলো আবেগ সহকারে আলোচিত হওয়ার ফলে তারা এগুলোর মুখোমুখী হয়, এগুলোকে পরীক্ষা করতে পারে এবং এগুলোকে গ্রহণ করতে পারে।

গবেষণার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আঘাতের পরবর্তী পীড়নজনিত মনোবিকৃতির (PTSD) চিকিৎসার প্রধান স্বীকার্য হচ্ছে যে, কোন উপায়ে ব্যক্তিকে ভীতিসৃষ্টিকারী বা বেদনাদায়ক পরিস্থিতিটির মুখোমুখি হতে দিলে সে এতদিন যে পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছিল, তার প্রতি ভয় দূর হয়ে যায়। বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, একটি নিরাপদ চিকিৎসামূলক পরিবেশে অথবা একটি সমর্থনমূলক পরিস্থিতিতে ব্যক্তিকে প্রণালীবদ্ধভাবে সুসংগঠিতভাবে (structured) বেদনাদায়ক পরিস্থিতিটির এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোর মুখোমুখি করা হলে ব্যক্তির পীড়ন-জনিত বিকৃতিগুলো হ্রাস পায়। একটি পরীক্ষণে একদল রোগীকে বেদনাময়/মানসিক আঘাত সৃষ্টিকারী ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট দৃশ্যাবলী দীর্ঘ সময় ধরে কল্পনা করতে দেওয়া হয়েছিল (এটাকে বলা হয় imaginal flooding condition)। অন্য দলকে কোন চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। দেখা গেল, যে দলকে পরিস্থিতির মুখোমুখি করে অর্থাৎ দৃশ্যের স্মৃতি পুনরুদ্রেক করে চিকিৎসা করা হয়েছিল তাদের বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও দুঃস্বপ্ন অনেক কমে গেছে এবং খিটখিটে মেজাজ ও চমকে উঠার ঘটনা কমে গেছে (Keane ও অন্যান্য ১৯৮৯)। কিন্তু যাদের চিকিৎসা করা হয়নি তাদের এসব লক্ষণের কোন উন্নতি ঘটেনি।

ফেয়ারব্যাংক, ডিগুড, ও অন্যান্য (১৯৮১)-দের কতকগুলো ব্যক্তি ইতিহাসমূলক বিবরণ থেকে প্রণালীবদ্ধভাবে সংবেদনশীলতা হ্রাসকরণ কৌশলের (systematic desensitization) কার্যকারিতার স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেলেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা অসুবিধাজনক। যেসব রোগী গাড়ী চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তাদের উপর এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির আদ্যোপান্ত বিবরণ সংগ্রহ করতে হয়। এসব পরিস্থিতির মুখোমুখী করা হলে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে। চিকিৎসক নিজেও এসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রোগীকে পীড়ন ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হল –

  • (ক) শ্লথন প্রশিক্ষণ, 
  • (খ) যৌক্তিক আবেগীয় পদ্ধতি (rational emotive therapy)
  • (গ) সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ার প্রশিক্ষণ (training in problem solving)
  • (ঘ) আত্ম-প্রতিষ্ঠামূলক আচরণের প্রশিক্ষণ (Assertive training)

ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমেও অনেক সময় সুফল পাওয়া গেছে। PTSD রোগীদের বিষণ্ণতা-বিরোধী ঔষধ (anti-depressant drugs) এবং উত্তেজনা প্রশমনকারী ঔষধ (Tranquilizers) ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। বিশেষতঃ প্রথমোক্ত ঔষধের মধ্যে থেকে যেসব ঔষধ সেরোটনিনের পুনরায় গ্রহণকে অবদমন করে (serotonin reuptake inhibitors) সেগুলো ব্যবহার করে মোটামুটি ভাল ফল পেয়েছিলেন ভেনডার কলক ও অন্যান্য (Van der Kolk et al. 1994)। তবে যেকোন চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যবহার করা হোক না কেন, এসব রোগীদের আরোগ্য লাভের জন্য সামাজিক সমর্থন অত্যাবশ্যক। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বা অন্য যেকোন গোষ্ঠী এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

স্বল্পস্থায়ী পীড়নজনিত বিকৃতি (Acute stress Disorder)

বিবরণ ও লক্ষণ

অনেক সময় দেখা যায়, কোন ব্যক্তি আকস্মিক দুর্ঘটনা আঘাত বা তীব্রপীড়নের সম্মুখীন হলে সাময়িকভাবে কয়েকদিনের জন্য হতবিহ্বল এবং শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার পর পীড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাটি অতীত হয়ে গেলে অথবা মাসখানেক পর ব্যক্তি আবার স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে শুরু করে। এধরনের মানসিক বিকৃতিকে বলে একিউট ট্রেস ডিসঅরডার (Acute stress disorder) বা স্বল্পস্থায়ী পীড়ন জনিত বিকৃতি।

এই বিকৃতির নির্ণায়ক লক্ষণ সমূহ নিম্মরূপ :

  • ১। ব্যক্তি একটি বেদনাদায়ক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে— যেখানে নীচের দুটি পরিস্থিতি উপস্থিত ছিল –
    • (ক) ব্যক্তি নিজে এমন একটি ঘটনার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, দেখেছে, অথবা সম্মুখীন হয়েছে যেখানে তার শারীরিক ক্ষতি হয়েছে অথবা মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে অথবা তার নিজেকে বা অন্যকে মেরে ফেলার হুমকী সৃষ্টি হয়েছে।
    • (খ) ব্যক্তি অত্যন্ত ভয় পেয়েছে, অসহায় বোধ করেছে এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে।
  • ২। তীব্ৰ পীড়নমূলক ঘটনাটি ঘটবার সময় অথবা এই ঘটনার অভিজ্ঞতার পর ব্যক্তি নিম্নলিখিত বিচ্ছিন্নতামূলক লক্ষণগুলোর মধ্যে তিনটি লক্ষণ উপস্থিত করেছে –
    • (ক) অসারতার মানসিক অনুভূতি, বিচ্ছিন্নতা বোধ বা কোন কিছুর প্রতি আসক্তি অনুভব না করা (detachment) অথবা আবেগীয় প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি
    • (খ) ব্যক্তির চারপাশে কি ঘটছে সে সম্পর্কে অবহিতির হ্রাস পাওয়া (চতুর্দিকে ঘটনাবলীর প্রতি উদাসীনতা) বা “being in a dazet
    • (গ) বুদ্ধিনাশ (derealization) বা বেঘোরে অবস্থা সৃষ্টি হওয়া
    • (ঘ) ব্যক্তিত্বনাশ (depersonalization)
    • (ঙ) বিচ্ছিন্নতামূলক বিস্মৃতি (অর্থাৎ বেদনাদায়ক ঘটনাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভুলে যাওয়া)
  • ৩। ঘটনাটির অভিজ্ঞতা বার বার ফিরে আসে। যেমন স্মৃতিতে কতকগুলো ভয়ংকর দৃশ্য উপস্থিত হয় (Image), চিন্তা, স্বপ্ন, মায়া, ফাসব্রাক উপাখ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে ঘটনাটি স্মৃতিতে বার বার হানা দেয়।
  • ৪। যেসব উদ্দীপক বেদনাদায়ক ঘটনাটিকে (যেমন-চিন্তা, কথাবার্তা, স্থান, লোকজন) স্মরণ করিয়ে দেয় ব্যক্তি সেসব উদ্দীপক এড়িয়ে চলে।
  • ৫। ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শারীরীক উত্তেজনার লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- ব্যক্তি ঘুমাতে পারেনা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কোন কাজে মানোনিবেশ করতে পারেনা, অতিশয় সচেতন থাকে (hypervigilance), হঠাৎ চমকে উঠে, পেশীর চালতা সৃষ্টি হয়।
  • ৬। ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয় তার পেশাগত বা বৃত্তিমূলক ও সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তি মানসিক কষ্টে ভোগে।
  • ৭। বিকৃতিটি দুর্ঘটনা ঘটার পর কমপক্ষে দুইদিন থেকে সর্বোচ্চ চার সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
  • ৮। বিকৃতিটির জন্য মদ্যপান বা অন্যকোন মাদকদ্রব্যকে দায়ী করা যায় না।

স্বল্পস্থায়ী পীড়নজনিত বিকৃতির চিকিৎসা

  • (১) প্রাথমিক চিকিৎসা হল ব্যক্তিকে দুর্ঘটনা বা পীড়নমূলক ঘটনা থেকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া এবং বিশ্রামে রাখা।
  • (২) কয়েকদিনের বিশ্রামে রোগী সেরে যায়। অবশ্যই তার শারীরিক আঘাতের চিকিৎসা করতে হবে এবং মানসিক সান্ত্বনা দিতে হবে।
  • (৩) সমস্যা বেশী দিন স্থায়ী হলে আঘাত পরবর্তী পীড়নজনিত বিকৃতির চিকিৎসা করতে হবে।

তথ্যসূত্র 

  • অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান : মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, অধ্যাপক নিহাররঞ্জন সরকার, ডাঃ তনুজা সরকার, পৃষ্ঠা ২৩৪-২৭০

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.