Table of Contents
ভূমিকা
আচ্ছা, এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা উইচক্র্যাফট (witchcraft) ব্যাপারটা আসলে কী? খুব সহজ করে বললে, এটা হলো এমন এক ক্ষমতা বা জাদু (magic) ব্যবহারের গল্প, যা নাকি ‘ডাইনি’ (witch) নামে পরিচিত মানুষেরা করে থাকে। পুরোনো দিনে লোকে বিশ্বাস করত, ডাইনিবিদ্যা মানেই হলো জাদু দিয়ে অন্যের ক্ষতি করা, অমঙ্গল ঘটানো। আর সত্যি বলতে কি, এই ধারণাটাই সবচেয়ে বেশি চালু (Hutton, 2017; Thomas, 1997)। বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopedia Britannica) অবশ্য বলছে, এই যে ক্ষতি করার ডাইনিবিদ্যা, এটা আসলে মানুষের কল্পনার জগতেই বেশি বাস করে। তবে এটাও ঠিক, বহু যুগ ধরে বহু সংস্কৃতির মানুষ পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজেছে এই ডাইনিবিদ্যার ধারণার মধ্যে (Russell & Lewis, 2023)।
মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর প্রায় সব কোণাতেই, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ডাইনি আর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসের দেখা মেলে। বেশিরভাগ সমাজ আবার এই ডাইনিবিদ্যা থেকে বাঁচতে বা একে ঠেকাতে নিজেরাই কিছু জাদুটোনা করত, যাকে বলে প্রতিরক্ষামূলক জাদু (protective magic) বা পাল্টা-জাদু (counter-magic)। আর যাদের ওপর ডাইনি বলে সন্দেহ হতো, তাদের কপালে জুটত শাস্তি—কখনও সমাজ থেকে বের করে দেওয়া, কখনও বন্দি করা, মারধোর, এমনকি মেরেও ফেলা হতো। আজকালকার দিনের নৃতাত্ত্বিকরা যখন বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষতিকর গুপ্তবিদ্যা (harmful occult practices) নিয়ে গবেষণা করেন, তখন এই একই ধরনের বিশ্বাসের জন্য ‘উইচক্রাফট’ শব্দটাই ব্যবহার করেন (Singh, 2021; Thomas, 1997; Perrone et al., 1993)।
এই যে খারাপ বা অশুভ জাদু (malevolent magic) দিয়ে ক্ষতি করার বিশ্বাস, এর শিকড় কিন্তু অনেক গভীরে, সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia) পর্যন্ত পাওয়া যায় সেই শিকর। ইউরোপেও এই বিশ্বাস বহু পুরোনো, একেবারে ক্লাসিক্যাল যুগ (classical antiquity) থেকে চলে আসছে। মধ্যযুগে আর তার পরের আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, ইউরোপে যাদের ডাইনি বলে ধরা হতো, তারা বেশিরভাগই ছিলেন নারী (Hutton, 2017)। ভাবা হতো, তারা নাকি লুকিয়ে কালো জাদু (black magic), যার আরেক নাম ম্যালিফিসিয়াম (maleficium), ব্যবহার করে খোদ নিজেদের প্রতিবেশীদেরই ক্ষতি করছে। এই অভিযোগগুলো সাধারণত প্রতিবেশীরাই আনত, আর এর পেছনে থাকত নানা সামাজিক রেষারেষি, মনোমালিন্য। কখনও সখনও এমনও বলা হতো, ডাইনিরা নাকি শয়তান (demons) বা সাক্ষাৎ ডেভিলের (Devil) সঙ্গে যোগাযোগ রাখে! যদিও নৃতাত্ত্বিক জাঁ লা ফঁতেইন (Jean La Fontaine) একটু ভিন্ন কথা বলেন। তার মতে, এই অভিযোগগুলো মূলত তাদের বিরুদ্ধেই তোলা হতো, যাদেরকে গির্জা বা চার্চ নিজেদের শত্রু (enemies of the Church) বলে মনে করত (La Fontaine, 2016)।
তবে লোকে শুধু ভয়ই পেত না, বাঁচার উপায়ও খুঁজত। বিশ্বাস ছিল, ভালো বা সাদা জাদু (white magic) দিয়ে ডাইনিবিদ্যাকে ঠেকানো যায়। এই ভালো জাদু যারা করতেন, তাদের বলা হতো ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) বা ‘ওয়াইজ পিপল’ (wise people)। ডাইনি সন্দেহে যাদের ধরা হতো, তাদের প্রায়ই বিচার হতো, আর দোষী সাব্যস্ত হলে বা এমনকি শুধু দোষী বলে মনে হলেও শাস্তি পেতে হতো। ইউরোপে একসময় রীতিমতো ডাইনি-শিকার (witch-hunts) আর ডাইনি-বিচার (witch trials) চলত, যার ফলে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, যারা জাদু দিয়ে মানুষের উপকার করতেন, যেমন নিরাময়কারী (magical healers) বা ধাত্রী (midwives), তাদেরও কখনও কখনও ডাইনি বলে অভিযোগের শিকার হতে হয়েছে (Davies, 2003; Thomas, 1997; Riddle, 1997; Ehrenreich & English, 2010), কিন্তু অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিলেন খুব কম। এরপর এলো আলোকিত যুগ (Age of Enlightenment), ধীরে ধীরে ইউরোপে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস কমতে শুরু করল।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে আদিবাসী সংস্কৃতিতেও (indigenous belief systems) ডাইনিবিদ্যার ধারণা পাওয়া যায়, আর সেখানেও ডাইনিদের দেখা হয় অশুভ শক্তি হিসেবেই। এসব সমাজে আবার নিজস্ব নিরাময়কারী (healers) আছেন, যেমন ঔষধ বিশেষজ্ঞ (medicine people) বা ডাইনি ডাক্তার (witch doctors), যাদের কাছে লোকে যায় জাদুটোনার (bewitchment) প্রভাব কাটাতে (Demetrio, 1988; Tan, 2008)। কিছু আফ্রিকান আর মেলানেশিয়ান (Melanesian) মানুষের বিশ্বাস আবার একটু অন্যরকম। তারা মনে করে, ডাইনিদের শরীরের ভেতরেই নাকি এক অশুভ আত্মা (evil spirit) বা বিশেষ পদার্থ (substance) থাকে, যা তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করায়। আর হ্যাঁ, এই আধুনিক যুগেও আফ্রিকা আর এশিয়ার কিছু জায়গায় ডাইনি সন্দেহে মানুষ শিকার (witch-hunting) করার মতো ঘটনা ঘটে।
তবে সময় বদলেছে। ১৯৩০-এর দশকের পর থেকে আধুনিক পৌত্তলিকতাবাদের (modern paganism) কিছু অনুসারী এসেছেন, যারা নিজেদের ‘ডাইনি’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। তারা ‘ডাইনিবিদ্যা’ শব্দটাকে তাদের নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান (neopagan) বিশ্বাস আর চর্চার আলোকেই নতুন করে ব্যাখ্যা করছেন (Kelly, 1992; Berger & Ezzy, 2009; Doyle White, 2016)। অবশ্য, অন্য কিছু নব্য-পৌত্তলিক আবার শব্দটার পুরোনো বদনামের কারণে একে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন (Lewis, 1996)।
ধারণা (Concept)
তাহলে মূল কথাটা কী দাঁড়াল? সারা পৃথিবীতে ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) বলতে মানুষ মূলত বোঝে ক্ষতিকর জাদু (harmful magic) ব্যবহার করার ব্যাপারটাকেই (Hutton, 2017)। আর এই অশুভ জাদুতে বিশ্বাস, ডাইনিবিদ্যার ধারণা—এগুলো কিন্তু আজকের নয়, একেবারে ইতিহাসের শুরু থেকেই নানা সংস্কৃতিতে টিকে আছে, সভ্যতা এগিয়েছে কি পিছিয়েছে, তাতে কিছু এসে যায়নি (Singh, 2021; Ankarloo & Clark, 2001)। বেশিরভাগ সমাজেই এক ধরনের ভয় কাজ করেছে যে, কিছু মানুষ আছে যারা অতিপ্রাকৃত উপায়ে অন্যের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা বা ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। এর কারণটা হয়তো মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে আছে। মানুষ চায়, জীবনে ঘটে যাওয়া ভালো-মন্দ, বিশেষ করে অদ্ভুত বা বড় ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো না কোনো কারণ খুঁজে বের করতে, সেটা মানুষ হোক বা অতিমানবীয় কোনো শক্তি (Hutton, 2017)। ইতিহাসবিদ আর নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই ‘ডাইনিবিদ্যা’র ধারণাটা হলো মানুষের অদ্ভুত সব দুর্ভাগ্য বা খারাপ ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার একটা পুরোনো রাস্তা (Hutton, 2017; Moro, 2017)।
অবশ্য সব সংস্কৃতি যে ডাইনিবিদ্যাকে একইভাবে ভয় পেয়েছে, তা নয়। কারো কারো কাছে দুর্ভাগ্যের অন্য ব্যাখ্যা ছিল, তাই ডাইনি নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও ছিল কম (Hutton, 2017)। যেমন ধরা যাক, আয়ারল্যান্ড আর স্কটিশ হাইল্যান্ডসের গেল (Gaels) সম্প্রদায়ের কথা। তারা ঐতিহাসিকভাবে পরীদের (fairy folk) ওপর খুব বিশ্বাস করত, ভাবত পরীরাও অতিপ্রাকৃত ক্ষতি করতে পারে। ফলে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সেখানে ডাইনি খোঁজার ধুম বা ডাইনি-শিকার ছিল অনেক কম (Hutton, 2017, p. 245)।
ইতিহাসবিদ রোনাল্ড হাটন (Ronald Hutton) বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, যা প্রায় সব সংস্কৃতিতেই ডাইনি আর ডাইনিবিদ্যার সাথে জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। সেগুলো হলো:
১. অন্যের ক্ষতি বা অমঙ্গল করার জন্য জাদুর ব্যবহার।
২. এই জাদু ডাইনি ব্যবহার করত তার নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনের বিরুদ্ধেই।
৩. বিশ্বাস করা হতো, ডাইনি এই ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে বা কোনো বিশেষ দীক্ষার (initiation) মাধ্যমে।
৪. কাজটাকে দেখা হতো অনৈতিক হিসেবে এবং প্রায়শই মনে করা হতো এর সঙ্গে মন্দ বা অশুভ শক্তির যোগাযোগ আছে।
৫. প্রতিরক্ষামূলক জাদু, বুঝিয়ে-শুনিয়ে, ভয় দেখিয়ে অথবা অভিযুক্ত ডাইনিকে শারীরিক শাস্তি দিয়ে এই ডাইনিবিদ্যাকে ঠেকানো বা প্রতিহত করা সম্ভব বলে ভাবা হতো (Hutton, 2017, p. 3-4)।
সারা দুনিয়ায় একটা সাধারণ বিশ্বাস হলো, ডাইনিরা নাকি নানা জিনিস, বিশেষ শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে অতিপ্রাকৃত ক্ষতি করে। আবার এমনও ভাবা হয়, তাদের হয়তো এমনিতেই, জন্মগতভাবেই (innate power) এই ক্ষমতা থাকে। হাটন বলছেন, অনেক সংস্কৃতিতে এই দুই ধরনের ডাইনির ধারণাই পাশাপাশি চলে। এমনও হতে পারে, যার জন্মগত ক্ষমতা আছে, সে আবার নানা জিনিসপত্র ব্যবহার করে সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে (Hutton, 2017, p. 19-22)।
ডাইনিবিদ্যা আর জাদু নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, তার মধ্যে ই. ই. ইভান্স-প্রিচার্ডের (E. E. Evans-Pritchard) একটা বই খুব বিখ্যাত। বইটার নাম ‘উইচক্র্যাফট, ওরাকলস অ্যান্ড ম্যাজিক অ্যামং দ্য আজান্দে’ (Witchcraft, Oracles and Magic Among the Azande), প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। এতে তিনি আফ্রিকার আজান্দে (Azande) সম্প্রদায়ের ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার দেওয়া সংজ্ঞাগুলো নৃতত্ত্বের জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল, প্রায় নিয়ম বা প্রথা (convention) হয়ে দাঁড়িয়েছিল (Moro, 2017)। কিন্তু সবাই যে তার সংজ্ঞার সাথে একমত ছিল, তা নয়। কিছু গবেষক মনে করেন, ইভান্স-প্রিচার্ডের সংজ্ঞাগুলো গ্রহণ করার ফলে ডাইনিবিদ্যা, এমনকি জাদু বা ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়তো কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, যা হয়তো ইভান্স-প্রিচার্ড নিজেও চাননি (Mills, 2013)। ইভান্স-প্রিচার্ড নিজে ‘উইচক্রাফট’ শব্দটা ব্যবহার করতেন শুধু তাদের জন্য, যারা তাদের জন্মগত ক্ষমতা দিয়ে ক্ষতি করে। আর যারা ক্ষতি করার জন্য নানা জিনিসপত্র বা পদ্ধতির সাহায্য নেয়, তাদের কাজের জন্য তিনি ব্যবহার করতেন ‘জাদুটোনা’ (sorcery) শব্দটি (Evans-Pritchard, 1937, p. 8-9)। ইতিহাসবিদরা অবশ্য ইউরোপের ডাইনিবিদ্যার ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটা প্রয়োগ করতে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন। কারণ ইউরোপে বিশ্বাস করা হতো, ডাইনিরা নানা শারীরিক কৌশল বা জিনিসপত্র ব্যবহার করে, আবার কেউ কেউ নাকি শুধু চিন্তা দিয়েই ক্ষতি করতে পারে (Thomas, 1997, p. 464-465; Ankarloo & Henningsen, 1990, p. 1, 14)! আজকাল এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ আর ‘জাদুটোনা’র পার্থক্যটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর করা হয় না, যদিও কিছু নৃতাত্ত্বিক এখনও নির্দিষ্ট কোনো সমাজ নিয়ে কাজ করার সময় এটাকে প্রাসঙ্গিক মনে করতে পারেন (Hutton, 2017, p. 22)।
বেশিরভাগ সংস্কৃতিতে যদিও ভাবা হয় ডাইনিবিদ্যা একটা ইচ্ছাকৃত কাজ, তবে আফ্রিকা আর মেলানেশিয়ার কিছু আদিবাসী মানুষ আবার অন্যরকম বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, ডাইনিদের শরীরের ভেতরেই এমন কোনো পদার্থ (substance) বা অশুভ আত্মা (evil spirit) থাকে, যা তাদের দিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষতি করিয়ে নেয় (Hutton, 2017, p. 18-19)। এমনও বিশ্বাস আছে যে, এই পদার্থ হয়তো ডাইনি যখন ঘুমিয়ে থাকে বা সে যখন কিছুই জানে না, তখনও নিজে নিজেই কাজ করতে পারে (Mills, 2013)! যেমন, ডোবু (Dobu) নামের এক সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, তাদের নারীরা ঘুমের মধ্যে ক্ষতিকর জাদু করে, আর পুরুষেরা সেটা করে জেগে থাকা অবস্থায় (Hutton, 2017, p. 18-19)। আবার, যেসব সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় শরীরের ভেতরের কোনো পদার্থ মানুষকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা দেয়, সেখানে সেই পদার্থ ভালো, খারাপ, বা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষও (morally neutral) হতে পারে (Umotong; Gbule & Odili, 2015)। হাটন এখানে একটা পার্থক্য করেছেন। যারা অনিচ্ছাকৃতভাবে কুনজর (evil eye) দেয়, আর যারা জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে দেয়—তিনি শুধু শেষের দলকেই ডাইনি বলছেন (Hutton, 2017, p. 10)।
এই যে ‘ডাইনি’ (witch) আর ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) শব্দ দুটো, এগুলো কি সব সংস্কৃতিতে একইভাবে ব্যবহার করা যায়? এদের কোনো সর্বজনীন অর্থ আছে কি? এ নিয়ে কিন্তু বিতর্ক আছে (Moro, 2017)। হাটন বলছেন:
“(অশুভ জাদু) অবশ্য শব্দটার এখনকার ব্যবহারগুলোর মধ্যে মাত্র একটা। সত্যি বলতে কি, ইংরেজিভাষী জগতে এর এখন অন্তত চার রকম মানে দাঁড়িয়েছে, যদিও যেটার কথা আমরা এতক্ষণ বললাম (ক্ষতিকর জাদু), সেটাই মনে হয় সবচেয়ে চালু। অন্য মানেগুলো হলো: যে কোনো মানুষ যে জাদু ব্যবহার করে… অথবা যে প্রকৃতি-ভিত্তিক পৌত্তলিক ধর্ম পালন করে; অথবা যে স্বাধীন নারী কর্তৃত্ব আর পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতীক। আজকের দিনে এই সবগুলো অর্থের পক্ষেই কিছু বলার আছে।” (Hutton, 2017, p. 10)।
জাতিসংঘের একজন বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারও (Special Rapporteur) বলেছেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে ‘ডাইনি’ বা ‘ডাইনিবিদ্যা’র সংজ্ঞা দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ এই শব্দগুলোর সাথে জনপ্রিয় ধারণার পাশাপাশি নানা ধরনের ঐতিহ্যগত বা বিশ্বাস-ভিত্তিক নিরাময় চর্চাও (faith healing practices) জড়িয়ে থাকতে পারে (“Witchcraft and human rights”)।
নৃতাত্ত্বিক ফিওনা বোয়ি (Fiona Bowie) দেখিয়েছেন, পণ্ডিত আর সাধারণ মানুষ ‘ডাইনিবিদ্যা’ আর ‘ডাইনি’ শব্দ দুটোকে অন্তত চার রকমভাবে ব্যবহার করে (Moro, 2017)। আবার, নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান লেখক আইজ্যাক বোনিউইটস (Isaac Bonewits) তো ডাইনিদের আরও অনেক ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেমন: নব্য-পৌত্তলিক বা নিওপ্যাগান্ম, নারীবাদী, নিওগথিক, নিওক্লাসিক্যাল, ক্লাসিক্যাল, পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী (Family Traditions), অভিবাসী ঐতিহ্যবাহী (Immigrant Traditions), এবং জাতিগত (Ethnic) ডাইনি (Adler, 2006, p. 65-68)!
শব্দের সাতকাহন (Etymology)
আচ্ছা, এই যে ‘উইচক্র্যাফট’ (witchcraft) শব্দটা আমরা বলি, এটা কিন্তু মোটেও নতুন কোনো শব্দ নয়। হাজার বছরেরও বেশি এর বয়স! সেই পুরনো দিনের ইংরেজিতে (Old English) দুটো শব্দ ছিল – একটা হলো ‘উইচ্চে’ (wicce), মানে ডাইনি, আর অন্যটা ‘ক্র্যাফট’ (cræft), মানে হলো কৌশল বা ক্ষমতা। এই দুটো মিলেই হয়েছিল ‘উইচ্চেক্র্যাফট’ (wiccecræft) (Harper, “witchcraft (n.)”)। আর পুরুষ যদি এই জাদু বা কৌশল দেখাত, তাকে বলা হতো ‘উইক্কা’ (wicca) (“Home : Oxford English Dictionary”)।
ভাষাতাত্ত্বিকরা, যেমন অক্সফোর্ড ডিকশনারির লোকেরা, মনে করেন এই ‘উইচ্চে’ আর ‘উইক্কা’ শব্দ দুটো এসেছে পুরনো ইংরেজি ক্রিয়াপদ ‘উইচ্চিয়ান’ (wiccian) থেকে, যার মানে হলো ডাইনিবিদ্যা চর্চা করা (“witch”)। এই শব্দের আবার এক জ্ঞাতিগুষ্টি পাওয়া যায় অনেক পরে, তেরো শতকে, জার্মানির এক পুরোনো ভাষায় – ‘উইকেন’ (wicken)। কিন্তু এর আগের ইতিহাসটা একটু ধোঁয়াশে। অন্য জার্মান ভাষাগুলোতে এর তেমন কোনো খোঁজ মেলে না। কোথা থেকে যে এর আসল শুরু, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত আছে।
তবে ‘ডাইনি’ বোঝাতে পুরনো ইংরেজিতে আরও একটা শব্দ ছিল – ‘হেগটেস’ (hægtes) বা ‘হেগটেসে’ (hægtesse)। এটাই পরে আধুনিক ইংরেজিতে হয়ে গেছে ‘হ্যাগ’ (hag), যার মানে কুৎসিত বুড়ি। আর এই একই মূল থেকে এসেছে ‘হেক্স’ (hex) শব্দটা, যার মানে জাদুটোনা বা অভিশাপ দেওয়া। মজার ব্যাপার হলো, জার্মানির মতো অনেক দেশেই ডাইনির প্রতিশব্দগুলো এই ‘হেগটেস’ থেকেই এসেছে, যেমন জার্মান ‘হেক্সে’ (Hexe) বা ডাচ ‘হেকস’ (heks) (Harper, “hag (n.)”)।
আজকাল অবশ্য আমরা যখন ‘উইচ’ (witch) বলি, তখন সাধারণত মহিলাদের কথাই ভাবি (“Definition of WITCH”)। পুরুষ জাদুকরদের জন্য অন্য শব্দ চালু আছে – যেমন ‘উইজার্ড’ (wizard) বা কখনো সখনো ‘ওয়ারলক’ (warlock)। তবে হ্যাঁ, আজকের দিনে যারা নিজেদের নব্য-পৌত্তলিক (neo-pagan) বলে পরিচয় দেন, যেমন উইক্কা (Wicca) ধর্মের অনুসারীরা, তারা যখন ‘উইচ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন সেটা পুরুষ বা মহিলা যে কেউ হতে পারে (Cusack, 2009, p. 345)। শব্দেরও কেমন বিচিত্র জীবন, তাই না?
কী করত এই ডাইনিরা? (Beliefs about practices)
লোকে কী বিশ্বাস করত? তারা ভাবত, ডাইনিরা মূলত অভিশাপ (curses) দেয়। মানে, কিছু জাদুকরী কথা বা ইশারা ব্যবহার করে অন্যের জীবনে অলৌকিকভাবে খারাপ কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে (Levack, 2013, p. 54)। অভিশাপ দেওয়ারও ছিল নানা তরিকা। হয়তো কোনো জিনিসের গায়ে বিশেষ চিহ্ন (runes or sigils) এঁকে দিত, অথবা যার ক্ষতি করতে চায়, তার একটা মোম বা মাটির পুতুল (poppet) বানিয়ে সেটা পোড়াত বা বাঁধত। আবার গাছ-গাছড়া, পশুর শরীরের অংশ বা এমন সব অদ্ভুত জিনিস দিয়ে হয়তো তৈরি করত জাদুকরী পানীয় (potions) বা বিষ (poisons) (Luck, 1985, p. 254, 260, 394; Kittredge, 1929, p. 172; Davies, 1999; Hutton, 2017, p. 19-22)।
মানুষের জীবনে যত রকমের খারাপ ঘটনাই ঘটুক না কেন, দোষটা প্রায়ই গিয়ে পড়ত ডাইনিদের ঘাড়ে। বিশেষ করে ইউরোপে, যদি কারও অসুখ হতো, বাচ্চা মারা যেত, বা গবাদি পশুর কিছু হতো – লোকে ভাবত, নির্ঘাত কোনো ডাইনির কাজ। কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা তো ছিলই, যেগুলো শুনলেই লোকে ডাইনির কথা ভাবত – যেমন পুরুষদের পুরুষত্বহীনতা, মহিলাদের সন্তান না হওয়া, বা হঠাৎ গরুর দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেসব রোগের কারণ বোঝা যেত না, সেগুলোর দায় চাপানো হতো ডাইনিবিদ্যার ওপর। এডওয়ার্ড বেভার (Edward Bever) নামে একজন লিখেছেন, লোকে তখনই ডাইনিকে সন্দেহ করত, যখন দেখত রোগটা খুব হঠাৎ করে এসেছে, অনেক দিন ধরে সারছে না, ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারছে না কী হয়েছে, বা রোগের লক্ষণগুলো খুব অদ্ভুত (Levack, 2013, p. 54-55)।
সারা পৃথিবীতেই একটা খুব সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, ডাইনিরা যার ক্ষতি করতে চায়, তার শরীরের কোনো অংশ – যেমন চুল, কাটা নখ, পরা কাপড়, বা এমনকি শরীরের বর্জ্য – ব্যবহার করে জাদু করে (Hutton, 2017, p. 19-22)। ইউরোপ থেকে আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা – সবখানেই এই ধারণা পাওয়া যায়। আফ্রিকা আর উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে আবার আরেকটা বিশ্বাস চালু ছিল – ডাইনিরা নাকি অভিশপ্ত জাদুকরী জিনিস, যেমন ছোট ছোট হাড় বা ছাই, শিকারের শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষতি করে (Hutton, 2017, p. 19-22)। জেমস ফ্রেজার (James George Frazer) নামে এক বিখ্যাত পণ্ডিত এই ধরনের জাদুকে বলেছেন অনুকরণমূলক (imitative) জাদু। তার মতে, জাদুকররা দুটো নীতিতে বিশ্বাস করত: এক, একই রকম জিনিস একই রকম ফল দেয় (যেমন, শত্রুর পুতুল বানিয়ে ক্ষতি করলে শত্রুরও ক্ষতি হবে), আর দুই, যে জিনিসগুলো একবার একসাথে ছিল, আলাদা হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র থেকে যায় (যেমন, কারও চুল দিয়ে জাদু করলে সেই লোকটার ওপর তার প্রভাব পড়বে) (Frazer, 1922)। সহজ কিন্তু বেশ ভয়ংকর ধারণা, তাই না?
কিছু সংস্কৃতিতে আবার এমনও বিশ্বাস ছিল যে, ডাইনিরা তাদের জাদুতে মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে (Hutton, 2017, p. 19-22), আর এর জন্য তারা নাকি বাচ্চাও খুন করে! ইউরোপে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে মায়েরা মানসিক অসুস্থতার (আজকের দিনে যাকে বলে postpartum psychosis) কারণে নিজেদের সন্তানকে হত্যা করেছেন, কিন্তু তখনকার লোকে সেটাকে শয়তানের প্রলোভনে (diabolical temptation) পড়া বলেই ব্যাখ্যা করত (Burns, 2003, p. 141-142)। ভাবা যায়!
ডাইনিদের কাজকর্ম ছিল খুব গোপন। তারা নাকি একা একা অথবা অন্য ডাইনিদের সাথে মিলে কাজ করত। হাটন সাহেব বলছেন, লোকে ভাবত ডাইনিরা রাতে মিলিত হয়, যখন ভালো মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে আর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকে (Hutton, 2017, p. 22)। আর সেই সব গোপন সমাবেশে নাকি তারা সব সামাজিক নিয়মকানুন ভেঙে ভয়ানক সব কাজ করত – যেমন নরমাংস ভোজন (cannibalism), নিজেদের মধ্যে অবৈধ যৌন সম্পর্ক (incest), আর পোশাক-আশাক ছাড়া ঘুরে বেড়ানো (open nudity) (Hutton, 2017, p. 22)।
আরেকটা ব্যাপার হলো, ডাইনিদের সাথে জীবজন্তুর একটা অদ্ভুত যোগাযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা হতো (Hutton, 2017, p. 264-277)। রডনি নীডহ্যাম (Rodney Needham) তো বলেইছেন, এটা নাকি ডাইনি চরিত্রের একটা মূল বৈশিষ্ট্য (Needham, 1978, p. 26, 42)। কোথাও কোথাও ভাবা হতো, ডাইনিরা ইচ্ছেমতো পশুর রূপ (shapeshift) ধরতে পারে (Hutton, 2017, p. 264)। আবার এমনও বিশ্বাস ছিল, ডাইনির আত্মা নাকি শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পশুর রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় – এই ধারণাটা আবার শামানদের (shamanism) মধ্যেও দেখা যায় (Hutton, 2017, p. 264)। এছাড়া প্রায় সবখানেই বিশ্বাস করা হতো, প্রত্যেক ডাইনির নাকি একটা পোষা প্রাণী থাকে, যে তাকে সাহায্য করে (animal helper) (Hutton, 2017, p. 264)। ইংরেজিতে এদের বলা হতো ‘ফ্যামিলিয়ার’ (familiars)। ভাবা হতো, এরা আসলে অশুভ আত্মা বা শয়তান, যারা পশুর ছদ্মবেশে থাকে (Hutton, 2017, p. 264)। পরে অবশ্য গবেষকরা যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের গল্প শুনলেন, তখন দেখলেন সেখানেও এমন পোষা আত্মার কথা আছে, তবে তারা ডাইনির নিজের আত্মারই অংশ (servant spirit-animals) (Hutton, 2017, p. 269)।
আরেকটা ভয়ানক চর্চা হলো নেক্রোম্যান্সি (Necromancy) – মানে মৃত মানুষের আত্মাকে ডেকে এনে তাদের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ জানা বা অন্য কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া। বাইবেলের এন্ডোরের ডাইনির (Witch of Endor) গল্পে এমনটাই দেখা যায় (১ স্যামুয়েল ২৮)। পুরনো দিনের এক ইংরেজ যাজক, এলফ্রিক (Ælfric of Eynsham), ডাইনিদের এই কাজের খুব নিন্দা করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ডাইনিরা নাকি এখনো রাতের আঁধারে চৌরাস্তায় বা পুরনো কবরস্থানে গিয়ে তাদের জাদু দিয়ে শয়তানকে ডাকে, আর শয়তান তখন সেখানে কবর দেওয়া মানুষটার রূপ ধরে এসে হাজির হয়, যেন সে মরে গিয়ে আবার বেঁচে উঠেছে! (Meaney, 1984; Semple, 2003; Semple, 1998; Pope, 1968)।
ডাইনিবিদ্যা আর গ্রামের ওঝা বা ফোক হিলার (Witchcraft and folk healers)
ব্যাপারটা কিন্তু একপেশে ছিল না। যেসব সমাজে লোকে কালো জাদু বা ক্ষতিকর ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস করত, তারাই আবার ভালো বা সাদা জাদুতেও (white magic) বিশ্বাস রাখত (Hutton, 2017, p. 24-25)। যেখানে খারাপ জাদুতে বিশ্বাস খুব বেশি, সেখানে সাধারণত আইন দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা হতো, আর সাধারণ মানুষও তাকে ভয় পেত, ঘৃণা করত। কিন্তু ভালো জাদু, যা দিয়ে উপকার হয় বা বিপদ আপদ দূর করা যায় (apotropaic magic), সেটাকে লোকে মেনে নিত, বা অন্তত সহ্য করত – এমনকি যদি সমাজের মাথা বা ধর্মগুরুরা তার বিরোধিতা করত, তাহলেও (Hutton, 2006, p. 203)।
এই ভালো জাদুকররা কী করতেন? তারা নাকি ডাইনিদের করা জাদু কাটাতেন, অসুস্থ লোকের চিকিৎসা করতেন, ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, হারানো বা চুরি যাওয়া জিনিস খুঁজে দিতেন, এমনকি প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারেও জাদু দিয়ে সাহায্য করতেন (Hutton, 2017, p. x-xi)। ব্রিটেনে আর ইউরোপের আরও কিছু জায়গায় এদের নাম ছিল ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) বা ‘ওয়াইজ পিপল’ (wise people) (Hutton, 2017, p. x-xi)। অ্যালান ম্যাকফারলেন (Alan Macfarlane) নামে একজন লিখেছেন, এদের ‘কানিং ফোক’ নামটাই বেশি চালু ছিল, তবে কোথাও কোথাও ‘ব্লেসার’ (blessers) বা ‘উইজার্ড’ (wizards) নামেও ডাকা হতো। আবার ‘সাদা ডাইনি’, ‘ভালো ডাইনি’ বা ‘জাদু কাটানো ডাইনি’ (unbinding witches) – এমন নামও শোনা যেত (Macfarlane, 1999, p. 130)। যদিও ইতিহাসবিদ ওয়েন ডেভিস (Owen Davies) বলছেন, ‘সাদা ডাইনি’ (white witch) শব্দটা আসলে বিশ শতকের আগে তেমন একটা ব্যবহারই হতো না (Davies, 2003, p. xiii)। রোনাল্ড হাটন এদের সবার জন্য একটা সাধারণ নাম ব্যবহার করেন – ‘সেবা জাদুকর’ (service magicians) (Hutton, 2017, p. x-xi)। মজার ব্যাপার হলো, এই ভালো জাদুকররাই আবার অনেক সময় বলে দিতেন কে আসল ডাইনি বা কে ক্ষতি করেছে (Hutton, 2017, p. 24-25)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ভালো জাদুকররা ছিলেন সেই সব ডাইনিদের ঠিক উল্টো, যারা ম্যালিফিসিয়াম (maleficium) বা খারাপ জাদু করত (Willis, 2018, p. 27-28)। ইউরোপে যখন ডাইনি শিকারের হিড়িক পড়েছিল, তার প্রথম দিকে কিন্তু এই কানিং ফোকদের গির্জা, সরকার বা সাধারণ মানুষ – সবাই বেশ সহ্য করত (Willis, 2018, p. 27-28)। কিন্তু কিছু গোঁড়া পাদ্রী বা ক্ষমতাবান লোক ছিলেন, যারা এই গ্রামের ওঝা বা জাদুকরদের দেখতে পারতেন না। তারা চেষ্টা করতেন এদেরকেও ডাইনি বলে বদনাম দিতে, খারাপ জাদুর সাথে এদের নাম জড়াতে (Hutton, 2017, p. x-xi)। কিন্তু সাধারণ মানুষ সাধারণত সেই কথায় কান দিত না, তারা ঠিকই এদের কাছে সাহায্য নিতে যেত (Grell & Scribner, 2002, p. 45)। রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot) নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক, যিনি এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করতেন না, তিনি তো তার বইতে (১৫৮৪ সালে লেখা) বলেই ফেলেছিলেন, “আজকাল ইংরেজিতে কাউকে ‘সে একজন ডাইনি’ বলা আর ‘সে একজন জ্ঞানী মহিলা’ বলার মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই” (Scot, 1584, Booke V, Chapter 9)। ইতিহাসবিদ কিথ থমাস (Keith Thomas) অবশ্য একটু বুঝিয়ে বলেছেন, সমাজে এমন এক ধরনের ‘ডাইনিবিদ্যা’ ছিল, যা দিয়ে লোকে লুকিয়ে অন্যের ক্ষতি করত, আর সেটা সবাই খারাপ চোখেই দেখত। এই অর্থে, ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস মানে হলো, কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলে তার জন্য কোনো মানুষকে দায়ী করা, যে নাকি জাদু দিয়ে সেটা ঘটিয়েছে (Thomas, 1997, p. 519)।
এমা উইলবি (Emma Wilby) আবার বলছেন, ইউরোপের গ্রামের এই জাদুকরদের মানুষ ঠিক সোজাসুজি চোখে দেখত না। তাদের যেমন উপকার করার ক্ষমতা আছে বলে ভাবা হতো, তেমনি ক্ষতি করার ক্ষমতাও আছে বলে মনে করা হতো (Wilby, 2005, p. 51-54)। আর এই কারণেই হয়তো কখনও কখনও তাদেরও ডাইনি বলে অভিযুক্ত হতে হতো। উইলবি এমনও বলেছেন, ইংল্যান্ডে যে কিছু ‘ডাইনি’কে শয়তানের সাথে যোগাযোগ রাখার দায়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তারা হয়তো আসলে কানিং ফোকই ছিল। তাদের যে পরীদের (fairy familiars) সাথে যোগাযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা হতো, সেটাকেই হয়তো শয়তানের সাথে যোগাযোগ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল (Wilby, 2005, p. 123)।
হাটন সাহেবও বলছেন, এই জাদু জানা নিরাময়কারীদের “কখনও সখনও ডাইনি বলে নিন্দা করা হতো ঠিকই, কিন্তু যত জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে, দেখা গেছে অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিল খুবই নগণ্য” (Hutton, 2017, p. 24-25)। ডেভিসও একই কথা বলছেন, খুব কম কানিং ফোককেই ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে সরকারি আদালতে তোলা হয়েছিল, আর তাদের সাথে ডাইনি বলে অভিযুক্তদের চেয়ে অনেক নরম ব্যবহার করা হতো। এমনকি পুরনো দিনের কিছু আইনেও (যেমন ১৫৩২ সালের জার্মানির আইন বা ১৬১৭ সালের ডেনমার্কের আইন) বলা ছিল যে, যারা গ্রামের সাধারণ জাদু জানে, তাদের বিচার যেন আসল ডাইনিদের মতো না করা হয় (Davies, 2003, p. 164)। রিচার্ড হর্সলি (Richard Horsley) একসময় বলেছিলেন, ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডে নাকি যারা ডাইনি বলে বিচারের শিকার হয়েছিল, তাদের মধ্যে এই ‘ভবিষ্যৎবক্তা-নিরাময়কারী’দের (diviner-healers) সংখ্যাটা বেশ বড় ছিল। কিন্তু পরের দিকের গবেষণা বলছে, সংখ্যাটা আসলে ২ শতাংশেরও কম ছিল (Davies, 2003, p. 167)। তবে হ্যাঁ, হাঙ্গেরির গল্পটা একটু অন্যরকম। ইভা পোকস (Éva Pócs) বলছেন, সেখানে নাকি অভিযুক্ত ডাইনিদের প্রায় অর্ধেকই ছিল নিরাময়কারী (Pócs, 1999, p. 12)। আবার নরওয়েতে, ক্যাথলিন স্টকার (Kathleen Stokker) এর মতে, অভিযুক্ত ডাইনিদের “বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠই” ছিল গ্রামের লোক নিরাময়কারী (Stokker, 2007, p. 81-82)।
ডাইনি ধরা আর তাড়ানো (Witch-hunts and thwarting witchcraft)
যেসব সমাজে লোকে ডাইনি আর জাদুটোনায় বিশ্বাস করত, তারা কি চুপচাপ বসে থাকত? মোটেই না। তারা ভাবত, এই ডাইনিবিদ্যাকে ঠেকানোরও উপায় আছে, নানা রকম উপায়। একটা খুব চালু পথ ছিল নিজেদের বাঁচানোর জন্য জাদু (protective magic) করা বা ডাইনির জাদুর বিরুদ্ধে পাল্টা জাদু (counter-magic) করা। এর জন্য প্রায়ই ডাক পড়ত সেই গ্রামের ওঝা বা ‘কানিং ফোক’ (cunning folk) অথবা ‘উইচ-ডাক্তার’দের (witch-doctors) (Hutton, 2017, p. 24-25)। তারা নানা রকম আচার-অনুষ্ঠান করত, মন্ত্র পড়ত, তাবিজ (talismans) বা কবচ (amulets) দিত। আবার ধরুন, ঘরের দেওয়ালে বিশেষ চিহ্ন (anti-witch marks) এঁকে দেওয়া, কাঁচের বোতলে (witch bottles) বা গোল বলের (witch balls) মধ্যে অদ্ভুত সব জিনিস ভরে রাখা, এমনকি বাড়ির দেওয়ালের ভেতরে ঘোড়ার মাথার খুলি পুঁতে রাখার মতো কাজও করা হতো (Hoggard, 2004, p. 167)।
আরেকটা উপায় ছিল, যাকে ডাইনি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাকে গিয়ে ধরা। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বা জোর করে রাজি করানো হতো যাতে সে তার করা জাদু তুলে নেয় (Hutton, 2017, p. 24-25)। আবার অনেক সময় লোকজন নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিত। অভিযুক্ত ডাইনিকে শারীরিকভাবে শাস্তি দিত – গ্রাম থেকে বের করে দিত, মারধোর করত, নির্যাতন করত, এমনকি মেরেই ফেলত। তবে হাটন সাহেব বলছেন, বেশিরভাগ সমাজেই লোকে এই নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেয়ে আইনি পথে যাওয়াই বেশি পছন্দ করত। অভিযুক্ত ডাইনিকে আদালতে তোলা হতো, বিচার হতো, আর দোষী প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হতো (Hutton, 2017, p. 24-25)। বিচারব্যবস্থা! সে যুগেও ছিল, তবে তার ধরন ছিল অন্যরকম।
কার ঘাড়ে পড়ত দোষ? (Accusations of witchcraft)
কেন লোকে একজনকে ডাইনি বলে আঙুল তুলত? এর পেছনে প্রায়ই থাকত সমাজের নানা খিটিমিটি, অভাব-অনটন আর রেষারেষি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের শিকার হতেন নারীরা, যদিও কিছু জায়গায় আবার পুরুষদেরই বেশি করে ডাইনি বলে ধরা হতো, যেমন আইসল্যান্ডে (Witchcraft in 17th century Iceland, 2019)। অনেক সমাজে আবার বুড়ো মানুষদের ওপর দোষ চাপানো হতো বেশি। তবে সব জায়গায় বয়সটা বড় কথা ছিল না, এমনকি কোথাও কোথাও কিশোর-কিশোরীদেরও ডাইনি বলে অভিযুক্ত করা হতো (Hutton, 2017, p. 15)। কী অদ্ভুত!
ইভা পোকস (Éva Pócs) নামে একজন হাঙ্গেরিয়ান গবেষক বলছেন, ডাইনি বলে অভিযোগ তোলার পেছনে সাধারণত চার রকম কারণ দেখা যায়। এর প্রথম তিনটা কারণ অবশ্য আগেই বলেছিলেন রিচার্ড কিকহেফার (Richard Kieckhefer) নামে আরেকজন, চতুর্থটা যোগ করেছেন ক্রিস্টিনা লার্নার (Christina Larner) (Pócs, 1999, p. 9-10):
১. কাউকে হয়তো হাতেনাতে ভালো বা খারাপ কোনো জাদুটোনা (sorcery) করতে দেখা গেছে।
২. হয়তো কোনো ভালো ওঝা বা নিরাময়কারী তার রোগী বা গ্রামের মোড়লদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে (যেমন, তার চিকিৎসায় কাজ হয়নি)।
৩. লোকটা হয়তো আর কিছুই করেনি, শুধু তার প্রতিবেশীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল, তাদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি ছিল।
৪. অথবা, লোকটার হয়তো আগে থেকেই ডাইনি বলে একটা দুর্নাম ছিল, তার চালচলন বা কথাবার্তায় লোকে অলৌকিক বা গুপ্তবিদ্যার (occultism) আভাস পেত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কারণগুলো সবসময় জাদুটোনাকে কেন্দ্র করেই হতো না, বরং সামাজিক সম্পর্ক, বিশ্বাস আর সন্দেহই বড় ভূমিকা রাখত।
আজকের দিনের ডাইনি-শিকার (Modern witch-hunts)
ভাবছেন, ডাইনি শিকার বুঝি শুধু সেকালের গল্প? মোটেই না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজও পৃথিবীর নানা জায়গায় ডাইনি সন্দেহে মানুষ খোঁজা, তাদের বলির পাঁঠা বানানো (scapegoating), সমাজ থেকে বের করে দেওয়া বা এমনকি মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটে (Pearlman, 2013)। অনেক সংস্কৃতিতেই এখনও ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা অশুভ জাদুতে বিশ্বাস বেশ শক্তভাবেই টিকে আছে (Ankarloo & Clark, 2001)।
শুধু যে লোকে আইন হাতে তুলে নেয় তা-ই নয়, কিছু দেশে তো খোদ সরকারই ডাইনিবিদ্যা বা জাদুবিদ্যা করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়! যেমন সৌদি আরবের কথা বলা যায়, সেখানে ২০১৪ সালেও এই অভিযোগে মানুষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে (Saudi woman beheaded…, 2011; Saudi man executed…, 2012; di Giovanni, 2014)। ভাবা যায়!
আরেকটা ভয়াবহ দিক হলো, ডাইনি সন্দেহে যে অত্যাচার চালানো হয়, তার শিকার প্রায়শই হয় নারীরা। এটাকে তাই নারীদের ওপর হওয়া সার্বিক সহিংসতারই (violence against women) একটা অংশ হিসেবে দেখা হয় (“A Global Issue that Demands Action”, 2013; Diwan, 2004; Witch Hunts in Modern South Africa, 2009; Nepal: Witchcraft as a Superstition…, 2011; Adinkrah, 2004)। যেমন ধরুন, তানজানিয়ার কথা। ২০১৪ সালের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সেখানে ডাইনি সন্দেহে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ জন বয়স্ক মহিলাকে খুন করা হয় (“World Report on Violence and Health”, 2014)! কী মর্মান্তিক!
শুধু বয়স্ক মহিলারাই নন, শিশুরাও এর শিকার হয়। আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ তুলে শিশুদের ওপরও ভয়ানক অত্যাচার চালানো হয় (Bussien et al., 2011; Cimpric, 2010; Molina, 2006; Human Rights Watch, 2006)। এমনকি উন্নত দেশ যেমন ব্রিটেনেও, অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে। ভিক্টোরিয়া ক্লিম্বি (Victoria Climbié) নামের শিশুটির হত্যার ঘটনা তো বেশ আলোড়ন তুলেছিল (Witchcraft murder…, 2012; Dangerfield, 2012)। পুরনো দিনের কুসংস্কারগুলো আজও কেমন ভয়ংকর রূপে টিকে আছে, তাই না?
বিভিন্ন ধর্মের চোখে ডাইনিবিদ্যা (Religious perspectives)
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া: যেখানে শুরু (Ancient Mesopotamian religion)
বহু পুরনো সেই মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা। সেখানে জাদু কিন্তু ধর্ম আর সমাজের একটা খুব জরুরি অংশ ছিল। তারা ভালো জাদু (যা উপকার করে) আর খারাপ জাদু (যা ক্ষতি করে) – এই দুয়ের মধ্যে বেশ স্পষ্ট পার্থক্য করত (Hutton, 2017, p. 49-50)। খারাপ জাদু বা ডাইনিবিদ্যাকে (যার নাম ছিল কিশপু – kišpū (Reiner, 1995, p. 97)) ঠেকানোর জন্য তারা মূলত পাল্টা-জাদু ব্যবহার করত। তবে তাদের আইনেও ব্যবস্থা ছিল – কেউ ডাইনিবিদ্যায় দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড (Hutton, 2017, p. 49-50)! জিভি আবুশ (Tzvi Abusch) নামে এক পণ্ডিত মনে করেন, মেসোপটেমিয়ায় ডাইনি নিয়ে ধারণাগুলো সময়ের সাথে সাথে বদলেছে। একেবারে শুরুর দিকে নাকি ব্যাপারটা ছিল অনেকটা ইউরোপের পুরনো শামানিক (shamanistic) ডাইনিবিদ্যার মতো (Abusch, 2002, p. 65-66)। তখন ডাইনিদের সবসময় খারাপ ভাবা হতো না। তারা ভালো-মন্দ দুই ধরনের কাজই করত, জাদু আর ওষুধের জ্ঞান দিয়ে মানুষের উপকারও করত। এরা সাধারণত থাকত গ্রামের দিকে, আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করত, যাকে বলে ভাবোন্মত্ত (ecstatic) অবস্থা (Abusch, 2002, p. 65-66)।
তবে পরের দিকে, মেসোপটেমিয়ায় ডাইনি (পুরুষ হলে কাশশাপু – kaššāpu, মহিলা হলে কাশশাপ্তু – kaššāptu (Reiner, 1995, p. 97)) বলতে বোঝাত এমন একজনকে, যে কিনা লুকিয়ে সমাজের ক্ষতি করে, খারাপ উদ্দেশ্যে জাদু করে। এদের ঠেকানোর জন্য ছিলেন আসিফু (ašipu) – এরা ছিলেন সরকারি পুরোহিত বা ওঝা, যারা ভূত তাড়াতেন বা মন্ত্র পড়তেন (Abusch, 2002, p. 65-66)। এই আসিফুরা বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, রাষ্ট্রীয় ধর্মের প্রতিনিধি। তাদের কাজই ছিল এই ডাইনি বা অন্য অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জাদু করা (Abusch, 2002, p. 65-66)। আর ডাইনি বলে কাদের সন্দেহ করা হতো বেশি? সাধারণত সমাজের নিচু স্তরের, দুর্বল বা একঘরে মানুষদের – যেমন নারী, বিদেশি, অভিনেতা বা ফেরিওয়ালাদের (Hutton, 2017, p. 49-50)।
সেই বিখ্যাত হাম্মুরাবির আইন (Law Code of Hammurabi) (খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতক) – সেখানেও ডাইনিবিদ্যার কথা আছে। কেউ যদি ডাইনি বলে অভিযুক্ত হতো, তাকে এক কঠিন পরীক্ষার (trial by ordeal) মধ্যে দিয়ে যেতে হতো – পবিত্র নদীতে ঝাঁপ দিতে হতো! যদি ডুবে মরত, তাহলে সে দোষী। তার সম্পত্তি পেত অভিযোগকারী। আর যদি বেঁচে ফিরত, তাহলে উল্টো অভিযোগকারীর সম্পত্তি অভিযুক্তকে দিয়ে দিতে হতো (Hutton, 2017, p. 49-50)। কী অদ্ভুত বিচার!
মেসোপটেমিয়ায় ‘মাকলু’ (Maqlû) নামে একটা প্রাচীন বই পাওয়া গেছে, যার মানে হলো ‘পোড়ানো’। এটা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে। এতে ডাইনিবিদ্যা কাটানোর একটা লম্বা আচারের বর্ণনা আছে (Abusch, 2015, p. 5)। সেই আচারে নানা দেবতাকে ডাকা হতো, ডাইনির একটা পুতুল বানিয়ে পোড়ানো হতো, তারপর সেই ছাই ধুয়ে ফেলে দেওয়া হতো (Abusch, 2002, p. 15-16)। বোঝা যায়, ডাইনিবিদ্যা নিয়ে তাদের ভয় আর তা কাটানোর চেষ্টা কতটা গভীর ছিল।
আব্রাহামিক ধর্মগুলো: বিশ্বাস ও সংঘাত (Abrahamic religions)
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ডাইনিবিদ্যার ধারণাটা নানা বাঁক নিয়েছে – সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা আর সমাজের নিয়মকানুন একে প্রভাবিত করেছে। একেবারে শুরুতে, নিকট প্রাচ্যে, ডাইনিবিদ্যা ছিল অনেকটা রহস্যময় ব্যাপার, প্রকৃতির সাথে এর যোগ ছিল, স্থানীয় বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে নানা আচার-অনুষ্ঠান আর মন্ত্র ছিল। প্রাচীন ইহুদি ধর্মে (Judaism) জাদুর ব্যাপারটা ছিল বেশ জটিল। কিছু কিছু জাদু, যা রহস্যবাদের (mysticism) সাথে যুক্ত, তা গ্রহণযোগ্য ছিল (Sanhedrin 67b), কিন্তু অন্যগুলোকে মনে করা হতো ধর্মবিরুদ্ধ (heretical) (“Catholic Encyclopedia: Witchcraft”, 1912)। মধ্যযুগে এসে ইসলাম (Islamic) আর খ্রিস্টান (Christian) ধর্মের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে মানুষের ধারণা বদলাতে থাকে। কখনও একে নিরাময়ের ক্ষমতা বলে সম্মান করা হয়েছে, আবার কখনও ধর্মদ্রোহিতা বলে নিন্দা করা হয়েছে।
ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গি (Jewish)
ইহুদি ধর্মে ডাইনিবিদ্যাকে দেখা হতো মূর্তিপূজা (idolatry) আর মৃতদের আত্মা ডাকার (necromancy) মতো নিষিদ্ধ কাজের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে। যদিও কিছু র্যাবাই (rabbis) নিজেরাই নির্দিষ্ট কিছু জাদুবিদ্যা করতেন (Green, 2011; Bilefsky, 2009)! তাদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ (Tanakh) বা হিব্রু বাইবেলে (Hebrew Bible) জাদুকরী বিশ্বাসকে খুব কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে, একে বলা হয়েছে ‘ঘৃণ্য’ (abomination)। খ্রিস্টান ধর্মও প্রায় একইভাবে ডাইনিবিদ্যাকে নিন্দা করেছে, একে ঘৃণ্য কাজ বলেছে এবং আধুনিক যুগের শুরুতে ডাইনি-শিকারকে সমর্থন করার জন্য বাইবেলের কিছু নির্দিষ্ট অংশকে ব্যবহারও করেছে।
খ্রিস্টীয় দুনিয়া: ভয় ও বিচার (Christian)
খ্রিস্টানদের মধ্যে ডাইনিবিদ্যার ধারণাটা মূলত এসেছে ওল্ড টেস্টামেন্টে (Old Testament) এর বিরুদ্ধে থাকা আইনগুলো থেকে। মধ্যযুগে এবং তার পরে আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপের বহু খ্রিস্টানই কিন্তু জাদুতে বিশ্বাস করত। তবে তারা গ্রামের ওঝাদের ভালো জাদুর (helpful magic of the cunning folk) থেকে ডাইনিবিদ্যাকে আলাদা করে দেখত। ডাইনিবিদ্যাকে মনে করা হতো শয়তানের (Satan) কাজ, ডেভিলের (Devil) উপাসনা। আর এই বিশ্বাসের ফল হয়েছিল ভয়ানক। বহু মানুষকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে (blame cast for misfortune) (Russell, “Witchcraft”; Pócs, 1999, p. 9-12)। বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপে বড় আকারে ডাইনি-বিচার আর ডাইনি শিকার চলেছে বহু বছর ধরে। আলোকিত যুগ (Age of Enlightenment) আসার পর এই বাড়াবাড়ি ধীরে ধীরে কমে আসে। আজকের দিনে খ্রিস্টানদের মধ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা মত আছে। কেউ কেউ, বিশেষ করে মৌলবাদীরা, একে চরমভাবে বিশ্বাস করে এবং এর বিরোধিতা করে, আবার অনেকেই এসব আর বিশ্বাসই করে না। ঔপনিবেশিকতার যুগে যখন পশ্চিমা খ্রিস্টানরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তাদের হাত ধরে সেখানকার সংস্কৃতিতেও ডাইনিবিদ্যা নিয়ে পশ্চিমা ধারণাগুলো ঢুকে পড়ে।
খ্রিস্টধর্মে, জাদুবিদ্যাকে (sorcery) একসময় ধর্মদ্রোহিতা (heresy) আর ধর্মত্যাগ (apostasy) এর সমতুল্য মনে করা হতো, একে দেখা হতো মন্দ হিসেবে। ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট আর তৎকালীন ইউরোপের শাসকরা সবাই ডাইনিবিদ্যা নিয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল, যার ফলে শুরু হয়েছিল ব্যাপক ডাইনি-শিকার। পনেরো শতকে এই ভয় আর আতঙ্ক যেন তুঙ্গে ওঠে। হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, আরও অনেকে জেল খাটে, নির্যাতনের শিকার হয়, গ্রামছাড়া হয়, তাদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত হতো নারীরা, যদিও কিছু জায়গায় পুরুষদের সংখ্যাও কম ছিল না (Gibbons, 1998; Barstow, 1994, p. 23)। স্কটল্যান্ডে তো পুরুষ ডাইনি বোঝাতে ‘ওয়ারলক’ (warlock) শব্দটাই চালু হয়ে গিয়েছিল (McNeill, 1957; Sinclair, 1871)।
এই ডাইনি শিকারের যুগে একটা বই খুব কুখ্যাত হয়েছিল – ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum), ল্যাটিন ভাষায় যার মানে ‘ডাইনিদের হাতুড়ি’। ১৪৮৬ সালে দুই জার্মান পাদ্রী, হেইনরিখ ক্রেমার (Heinrich Kramer) আর জ্যাকব স্প্রেঙ্গার (Jacob Sprenger), এটা লিখেছিলেন। ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট নির্বিশেষে সবাই (Campbell, 2011, p. 27) কয়েকশো বছর ধরে এই বইটাকে ডাইনি চেনার, ধরার, বিচার করার আর শাস্তি দেওয়ার নির্দেশিকা হিসেবে ব্যবহার করেছে। বইটাতে ডাইনিকে শয়তান আর সাধারণত নারী হিসেবেই দেখানো হয়েছে। এটা ইউরোপের আদালতগুলোর জন্য প্রায় হ্যান্ডবুক হয়ে গিয়েছিল। যদিও মজার ব্যাপার হলো, চার্চের নিজস্ব তদন্তকারী সংস্থা, ইনকুইজিশন (Inquisition), কিন্তু এই বইটা ব্যবহার করত না, বরং এর ওপর বেশি নির্ভর করতে মানা করত (Jolly et al., 2002, p. 241)! তবুও, বাইবেলের পর এটাই নাকি ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই ছিল (History of Witches, 2020)! মানুষের ভয় আর অন্ধবিশ্বাসের কী প্রবল শক্তি!
ইসলামে ডাইনিবিদ্যা (Islamic)
ইসলাম ধর্মে জাদু নিয়ে নানা ধরনের ধারণা আর চর্চা (practices) আছে (Savage-Smith, 2004)। একদিকে যেমন কালো জাদু বা কুনজরে (evil eye) বিশ্বাস আছে, তেমনি এর চর্চার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞাও আছে (Khaldûn, 2015, p. 578)। কুরআন (Quran) জাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু এর ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলে। ইসলামে জাদুর চর্চা নিষিদ্ধ (forbidden)। ধর্ম জোর দেয় আল্লাহর দেখানো অলৌকিক ঘটনার (divine miracles) ওপর, জাদু বা ডাইনিবিদ্যার ওপর নয় (Savage-Smith, 2021, p. 87)। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ডাইনিবিদ্যার টিকে থাকাটা দেখায় কীভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস আর সমাজের নিয়মকানুন মিলেমিশে এক জটিল ছবি তৈরি করেছে।
আধুনিক পৌত্তলিকতা: নতুন পথে (Modern paganism)
বিশ শতকে এসে ইংরেজিভাষী দেশগুলো আর ইউরোপে ডাইনিবিদ্যার প্রতি মানুষের আগ্রহ আবার বাড়তে দেখা যায়। ১৯২০ এর দশক থেকে মার্গারেট মারে (Margaret Murray) নামে একজন লেখিকা একটা তত্ত্ব খুব জনপ্রিয় করে তোলেন – যার নাম ‘উইচ-কাল্ট হাইপোথিসিস’ (witch-cult hypothesis)। তার মতে, পুরনো দিনে যাদের ডাইনি বলে মারা হয়েছিল, তারা আসলে এক প্রাচীন, প্রকৃতি-প্রেমী পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারী ছিল, যা খ্রিস্টধর্ম আসার পরেও লুকিয়ে টিকে ছিল। যদিও পরের দিকের ঐতিহাসিক গবেষণায় এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে (Adler, 2006, p. 45-47, 84-85; Hutton, 2017, p. 121; Rose, 1962; Hutton, 1993; Hutton, 1999)।
তবে এই তত্ত্বকে ভিত্তি করে বা এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ১৯৩০ এর দশক থেকে কিছু নতুন দল বা গোষ্ঠী তৈরি হতে শুরু করে, যারা নিজেদের ধর্মকে এক ধরনের ‘ডাইনিবিদ্যা’ বলত। এরা ছিল অনেকটা গুপ্ত সমিতির (initiatory secret societies) মতো। তারা মারে-র তত্ত্ব, পুরনো দিনের জাদু চর্চা (ceremonial magic), অ্যালিস্টার ক্রোলি (Aleister Crowley) নামে এক রহস্যময় ব্যক্তির দর্শন (Thelema), আর প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্ম – এইসব কিছু থেকে ধারণা নিত (Hutton, 1999, p. 205-252; Kelly, 1991; Valiente, 1989, p. 35-62)। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর পরিচিত আন্দোলনটার নাম হলো উইক্কা (Wicca)। আজকের দিনে কিছু উইক্কা অনুসারী এবং এই ধরনের আরও কিছু দলের সদস্যরা নিজেদের ‘ডাইনি’ (witches) বলে পরিচয় দেন। তারা ‘ডাইনিবিদ্যা’ (witchcraft) শব্দটাকে ব্যবহার করেন তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস আর জাদু চর্চা বোঝাতে, বিশেষ করে পশ্চিমা ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে (Doyle White, 2016, p. 1-9, 73)। পুরনো একটা শব্দ কেমন করে নতুন অর্থ নিয়ে ফিরে এলো, তাই না?
কোথায় কেমন? (Regional perspectives)
২০২২ সালে একটা মজার গবেষণা হয়েছিল। তাতে দেখা গেল, এই যে ডাইনিবিদ্যা, মানে খারাপ জাদু বা ক্ষমতা দিয়ে অন্যের ক্ষতি করার বিশ্বাস – এটা কিন্তু পৃথিবীর নানা জায়গায় এখনও বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে! কোথাও হয়তো মাত্র ৯ শতাংশ লোক এটা বিশ্বাস করে, তো কোথাও আবার ৯০ শতাংশ! গবেষকরা দেখলেন, এই বিশ্বাসের সাথে দেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষার হার, মানুষের গড় আয়ু, এমনকি কে কতটা ধার্মিক – এগুলোরও একটা যোগসূত্র আছে। যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, আইনকানুন দুর্বল, শিক্ষার আলো কম, সেখানে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসও বেশি (Gershman, 2022; Witchcraft beliefs are widespread…, 2022)।
ভবিষ্যতে কী হবে এই বিশ্বাসের? গবেষকরা দুটো সম্ভাবনার কথা বলছেন (Gershman, 2022):
-
একটা মত হলো, যত দিন যাবে, দেশ উন্নত হবে, মানুষের নিরাপত্তা বাড়বে, স্বাস্থ্য ভালো হবে, শিক্ষার আলো ছড়াবে, বিজ্ঞান দিয়ে মানুষ সব ব্যাখ্যা করতে শিখবে – তখন ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস আপনাআপনি কমে যাবে। এটাই হলো আধুনিকতার স্বাভাবিক নিয়ম (standard modernization theory)।
-
আরেকটা মত হলো, উল্টোটাও হতে পারে! উন্নয়নের কিছু দিক, যেমন ধরুন ধনী-গরিবের তফাত বেড়ে যাওয়া, বিশ্বায়ন, নতুন নতুন প্রযুক্তি আসা, মানুষের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া – এগুলো পুরনো সামাজিক নিয়মকানুনকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আর তার ফলে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস কমার বদলে হয়তো আরও বেড়ে যেতে পারে! এই ধারণাটা এসেছে মূলত আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলের পরিস্থিতি দেখে।
কে জানে, কোনটা সত্যি হবে!
আফ্রিকা: যেখানে বিশ্বাস এখনও জীবন্ত (Africa)
আফ্রিকা মহাদেশে ডাইনিবিদ্যা (African witchcraft) নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস আর চর্চা দেখা যায়। এগুলো সেখানকার মানুষের জীবন, সমাজ, সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা বা আধ্যাত্মিক সাহায্য পাওয়ার চেষ্টার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে মুশকিল হলো, পশ্চিমা পণ্ডিতরা প্রায়ই আফ্রিকার এই বিশ্বাসগুলোকে ইউরোপের ডাইনিবিদ্যার ছাঁচে ফেলে বিচার করতে চেয়েছেন, যার ফলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে (Okeja, 2011)। যেমন, ক্যামেরুনের মাকা (Maka) জাতির লোকেরা ‘জাম্বে’ (djambe) নামে এক গুপ্ত শক্তিতে বিশ্বাস করে, যা নাকি মানুষের ভেতরেই থাকে। এটাকে প্রায়ই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বা ‘জাদুটোনা’ (sorcery) বলা হয় বটে, কিন্তু এর অর্থ আরও ব্যাপক – এর মধ্যে ক্ষতি করা, সারিয়ে তোলা, এমনকি রূপ বদলানোর (shapeshifting) ক্ষমতাও পড়ে। এটা দেখায়, আফ্রিকার ধারণাগুলোকে ইউরোপীয় শব্দ দিয়ে বোঝা কতটা কঠিন (Geschiere, 1997, p. 13)।
একসময় ইউরোপীয় শাসকরা আফ্রিকায় ডাইনি শিকার বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল বটে, আইন করে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অনেক আফ্রিকান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজেরাই আবার ডাইনিবিদ্যা নিষিদ্ধ করে আইন করেছে! এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে ডাইনি সন্দেহে মানুষকে নির্যাতন (persecution) করার সুযোগ রয়ে গেছে (Igwe, 2020)।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে (Central African Republic) নাকি প্রতি বছর শত শত লোককে ডাইনিবিদ্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আর অভিযুক্ত মহিলাদের ওপর অত্যাচার চলে (“The dangers of witchcraft”, 2010)। কঙ্গোর কিনশাসাতে (Kinshasa) শিশুদের ডাইনি বলে অভিযোগ করার এক ভয়ংকর প্রবণতা দেখা গেছে। সেখানে কিছু স্বঘোষিত পাদ্রী (self-styled pastors) শিশুদের ওপর নির্যাতন চালায়, ভূত তাড়ানোর (exorcisms) নামে অপব্যবহার করে (Kolwezi: Accused of witchcraft…, 2009)। ঘানাতে (Ghana) আবার আছে বিশেষ ‘ডাইনি শিবির’ (witch camps), যেখানে ডাইনি অভিযোগে গ্রামছাড়া মহিলারা আশ্রয় নিতে পারে – যদিও সরকার এগুলো বন্ধ করে দিতে চায় (Whitaker, 2012)।
পশ্চিম কেনিয়াতে (Kenya) তো আরও ভয়ানক অবস্থা, সেখানে ডাইনি সন্দেহে অভিযুক্তদের ঘরের ভেতর পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে (Kanina, 2008)। মালাউইতে (Malawi) শিশুদের ডাইনি বলার সমস্যা খুব প্রকট। সেখানে গ্রামের ওঝা আর কিছু খ্রিস্টান পাদ্রী মিলে ভূত তাড়ানোর নামে শিশুদের বাড়িছাড়া করে, তাদের ওপর অত্যাচার চালায় (Byrne, 2011)। নাইজেরিয়াতে (Nigeria) কিছু পেন্টেকোস্টাল পাদ্রী (Pentecostal pastors) নাকি পয়সার লোভে খ্রিস্টধর্মের সাথে ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাসকে গুলিয়ে ফেলেছে, যার ফলে সেখানেও শিশুদের নির্যাতন আর হত্যা করা হচ্ছে (“Stepping Stones Nigeria 2007”)। তবে সিয়েরা লিওনের (Sierra Leone) মেন্ডে (Mende) জাতির লোকেরা আবার ডাইনি সাব্যস্ত হওয়াটাকে খারাপ চোখে দেখে না! তারা মনে করে, এতে বরং অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাহায্য আর যত্ন পায় (West, 2007, p. 24)। কী বিচিত্র সব ধারণা!
দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু (Zulu) সংস্কৃতিতে আবার আছেন ‘সাঙ্গোমা’ (sangomas) নামে পরিচিত নিরাময়কারীরা। তারা নাকি ভবিষ্যদ্বাণী, আচার-অনুষ্ঠান আর আধ্যাত্মিক শক্তির (mediumship) মাধ্যমে মানুষকে ডাইনিবিদ্যা আর অশুভ আত্মা থেকে রক্ষা করেন (Cumes, 2004, p. 14)। তবে সব সাঙ্গোমাই আসল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহও আছে।
আফ্রিকার কিছু জায়গায় লোকে এখনও বিশ্বাস করে যে অসুখবিসুখ হয় ডাইনিদের কারণে। এর ফলে আধুনিক চিকিৎসার প্রতি তাদের একটা গভীর সন্দেহ কাজ করে, যার পরিণাম হয় মারাত্মক। এইচআইভি/এইডস (HIV/AIDS) (Kielburger & Kielburger, 2008) বা ইবোলার (Ebola) (“Ebola outbreak: ‘Witchcraft’ hampering treatment…”, 2014) মতো ভয়ংকর রোগের চিকিৎসা আর প্রতিরোধে এই ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, যক্ষ্মা (tuberculosis), কুষ্ঠ (leprosy), মৃগীরোগ (epilepsy), এমনকি বুরুলি আলসার (Buruli ulcer) নামে এক ধরনের ঘা-এর চিকিৎসাতেও একই সমস্যা দেখা দেয় (“Social stigma as an epidemiological determinant…”, 2014; Akosua, 2014)। বিশ্বাস যখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়!
আমেরিকা: পুরনো আর নতুনের মিশেল (Americas)
উত্তর আমেরিকা: আদিবাসী ও আগন্তুকের গল্প (North America)
উত্তর আমেরিকাতেও ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস পাশাপাশি টিকে আছে। কিছু এসেছে সেখানকার আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে, কিছু আবার ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের সাথে এসেছে, আর সময়ের সাথে সাথে এই দুইয়ের মধ্যে দেওয়া-নেওয়াও হয়েছে (Breslaw, 2011; Berger, 2005)।
চেরোকি (Cherokee) (Kilpatrick, 1998), হোপি (Hopi) (Geertz, 2011), নাভাহো (Navajo) (Perrone et al., 1993) সহ আরও অনেক নেটিভ আমেরিকান (Native American) জাতির মানুষ অশুভ ‘ডাইনি’ চরিত্রে বিশ্বাস করত। তারা ভাবত, এই ডাইনিরা অতিপ্রাকৃত শক্তি দিয়ে তাদের সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারে। তাই ধরা পড়লে শাস্তি হতো খুব কঠিন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হতো (Wall & Morgan, 1998)। তবে তাদেরও ছিল নিজস্ব রক্ষাকবচ – ‘মেডিসিন পিপল’ (medicine people), যারা ছিলেন একাধারে চিকিৎসক এবং ডাইনিবিদ্যার বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তা (Kilpatrick, 1998; Geertz, 2011)।
ইউরোপ থেকে যারা এসেছিল, তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিল ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নিজেদের ধারণা আর ‘উইচক্র্যাফট’ (witchcraft) শব্দটা (Breslaw, 2011)। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় পরে এই শব্দটাকেই গ্রহণ করে তাদের নিজেদের ক্ষতিকর জাদু বা অলৌকিক ক্ষমতা বোঝাতে। ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যেও ডাইনি শিকারের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ম্যাসাচুসেটসের সালেম ডাইনি বিচার (Salem witch trials) সবচেয়ে কুখ্যাত। সেই বিচারগুলোতে বহু নিরীহ মানুষকে ডাইনি অপবাদে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সময়ের সাথে আইনকানুন বদলালেও, ডাইনি সন্দেহে অভিযোগ ওঠা কিন্তু উনিশ শতক পর্যন্তও বন্ধ হয়নি। যেমন, টেনেসি (Tennessee) রাজ্যে ১৮৩৩ সালেও নাকি ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে বিচার হয়েছিল!
উত্তর আমেরিকার কিছু ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাস আবার লাতিন আমেরিকা বা এমনকি ক্রীতদাস বাণিজ্যের (slave trade) সূত্রে আফ্রিকা থেকেও প্রভাবিত হয়েছে (Wallace, 2015; Bachmann, 2021; Berger, 2005)। আদিবাসী সংস্কৃতিগুলো ইউরোপীয় ‘ডাইনিবিদ্যা’ শব্দটাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে শুরু করে (Silverblatt, 1983)। আর তারপর, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, জন্ম নেয় উইক্কার (Wicca) মতো নব্য-পৌত্তলিক ডাইনিবিদ্যা চর্চা (Breslaw, 2011; Berger, 2005)। ইতিহাস কেমন করে বারবার নিজেকে ভাঙে আর গড়ে!
লাতিন আমেরিকা: যেখানে মিলেছে নানা ধারা (Latin America)
লাতিন আমেরিকায় ডাইনিবিদ্যা বিশ্বাসে মিশে গেছে স্প্যানিশ ক্যাথলিক (Spanish Catholic) ধর্ম, আদিবাসী (Indigenous) ঐতিহ্য আর আফ্রিকান (African) সংস্কৃতির নানা উপাদান। যখন স্প্যানিশরা মেক্সিকো দখল করল, তাদের ইনকুইজিশন (Mexican Inquisition) বা ধর্মীয় আদালত কিন্তু ডাইনিবিদ্যা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তারা ভাবত, এটা একটা ধর্মীয় ভুল মাত্র, যা স্বীকারোক্তি (confession) আর ক্ষমা (absolution) করলেই মিটে যায়। নৃতাত্ত্বিক রুথ বেহার (Ruth Behar) বলছেন, মেক্সিকোর ইনকুইজিশনের পুরনো দিনের মামলার কাগজপত্র দেখলে মনে হয়, সেখানে যৌনতা, ডাইনিবিদ্যা আর ধর্ম মিলেমিশে এক অদ্ভুত জগৎ তৈরি হয়েছিল, যেখানে স্প্যানিশ, আদিবাসী আর আফ্রিকান – তিন সংস্কৃতিরই ছোঁয়া ছিল (Behar, 1987)। এমনও ঘটনা আছে, যেখানে ইউরোপীয় আর আদিবাসী মহিলারা একসাথে মিলে পুরুষদের বিরুদ্ধে ‘প্রেমের জাদু’ (love magic) বা ‘যৌন ডাইনিবিদ্যা’ (sexual witchcraft) করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন (Lavrin, 1992, p. 192)! অধ্যাপক লরা লুইস (Laura Lewis) মনে করেন, ঔপনিবেশিক মেক্সিকোতে এই ‘ডাইনিবিদ্যা’ ছিল নারীদের, বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ওপর নিজেদের প্রভাব বা আধিপত্য (hegemony) জাহির করার একটা উপায়, বিশেষ করে তখনকার বর্ণভিত্তিক কাস্তা সমাজে (casta system) (Lewis, 2003, p. 13)। ক্ষমতার লড়াইয়ের এক অন্যরকম রূপ!
ঔপনিবেশিক ব্রাজিলের (colonial Brazil) ইতিহাসেও ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস ছিল খুব স্পষ্ট। সেখানকার ধর্মীয় আদালতের কাছে দেওয়া নানা অভিযোগ আর স্বীকারোক্তি তার প্রমাণ (Ribeiro Júnior, p. 48-49)।
লাতিন আমেরিকায় ‘ব্রুহিরিয়া’ (Brujería) নামে এক ধরনের ডাইনিবিদ্যা প্রচলিত আছে। এটা আসলে ক্যারিবীয় অঞ্চলের আদিবাসী জাদু আর ধর্মীয় প্রথা, ক্যাথলিক বিশ্বাস এবং ইউরোপীয় ডাইনিবিদ্যার এক অদ্ভুত মিশেল (syncretic Afro-Caribbean tradition) (Herrera-Sobek, 2012, p. 174)। ব্রুহিরিয়া ভালো এবং খারাপ – দুই কাজেই ব্যবহার করা হয় বলে মনে করা হয় (Herrera-Sobek, 2012, p. 175)। পুরুষ জাদুকরকে বলে ‘ব্রুজো’ (brujo), আর মহিলাকে ‘ব্রুজা’ (bruja) (Herrera-Sobek, 2012, p. 175)। যারা মূলত চিকিৎসা বা নিরাময়ের কাজ করেন, তাদের আবার ‘কুরিওসো’ (kurioso) বা ‘কুরাডো’ (kuradó) বলা হয়। তারা ছোটখাটো সমস্যা (‘ট্রাবাউ চিকি’ – trabou chikí) থেকে শুরু করে বড় বড় সমস্যা (‘ট্রাবাউ গ্রান্ডি’ – trabou grandi) – যেমন স্বাস্থ্য ফেরানো, সৌভাগ্য আনা বা দুর্ভাগ্য দূর করা, প্রেমে সাহায্য করা – এসবের জন্য জাদু করেন। এই জাদুতে প্রায়ই ‘আলমাসোলা’ (almasola) বা ‘হম্বার চিকি’ (homber chiki) নামে কোনো এক রহস্যময় সত্তার সাহায্য নেওয়া হয় (Blom et al., 2015)।
এশিয়া: প্রাচ্যের রহস্য (Asia)
পূর্ব এশিয়া: নানা রূপ, নানা বিশ্বাস (East Asia)
চীনের সংস্কৃতিতে আছে ‘গং টাউ’ (Gong Tau) নামে এক ধরনের কালো জাদু, যা লোকে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নিতে বা টাকা-পয়সা লাভ করতে। জাপানের লোককথায় এমন ডাইনিদের গল্প আছে, যারা নাকি শেয়ালকে পোষা প্রাণী বা ফ্যামিলিয়ার (familiars) হিসেবে ব্যবহার করে। কোরিয়ার ইতিহাসেও এমন মানুষের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদের মন্ত্র ব্যবহার করার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আর ফিলিপাইনের (Philippines) আছে ডাইনিদের নিজস্ব ঐতিহ্য, যা পশ্চিমা গল্পগুলোর থেকে একদম আলাদা। সেখানে আবার আদিবাসী শামানরা (indigenous shamans) আছেন, যারা এই ডাইনিদের জাদু কাটানোর চেষ্টা করেন।
মধ্য প্রাচ্য: ইতিহাসের গভীরে (Middle East)
মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস বহু পুরনো। জাদু ছিল সেখানকার প্রাচীন সভ্যতা আর ধর্মের অঙ্গ (Hutton, 2017, p. 47-54)।
সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (সুমেরিয়া, অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া) ডাইনি (পুরুষ: কাশশাপু, মহিলা: কাশশাপ্তু) বলতে বোঝাত এমন কাউকে, যে কিনা লুকিয়ে সমাজের ক্ষতি করে, খারাপ উদ্দেশ্যে জাদু করে (Abusch, 2002, p. 65-66)। তারা মূলত ডাইনিবিদ্যা (কিশপু) ঠেকানোর জন্য পাল্টা-জাদু ব্যবহার করত, তবে আইনে ডাইনিদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানও ছিল (Hutton, 2017, p. 49-50)।
প্রাচীন হিট্টাইটদের (Hittites) মধ্যে আবার নিয়ম ছিল, জাদু করতে হলে রাষ্ট্রের অনুমতি লাগবে। তাই ডাইনিবিদ্যার অভিযোগকে প্রায়ই রাজনৈতিক শত্রু দমনের কাজে লাগানো হতো (Hutton, 2017, p. 50-51)।
প্রাচীন হিব্রুরা (Hebrews) যখন একেশ্বরবাদী হয়ে উঠল, তখন ইহুদি ধর্ম (Judaism) জাদুবিদ্যার কিছু রূপকে (যা রহস্যবাদের সাথে যুক্ত) মেনে নিলেও, অন্যগুলোকে নিষিদ্ধ বা ধর্মবিরুদ্ধ ঘোষণা করল, আর সেগুলোকেই ‘ডাইনিবিদ্যা’ বলে দাগিয়ে দিল (Hutton, 2017, p. 51-52)।
মধ্যযুগে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে এই অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে ধারণা আবার বদলাতে থাকে – কখনও একে চিকিৎসার ক্ষমতা বলে সম্মান করা হয়েছে, তো কখনও ধর্মদ্রোহিতা বলে নিন্দা করা হয়েছে। আজকের দিনেও মধ্যপ্রাচ্যে ডাইনিবিদ্যা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্বাস ও সম্প্রদায় দেখা যায়।
ইউরোপ: যেখানে জ্বলেছিল আগুন (Europe)
প্রাচীন রোম: আইনের চোখে জাদু (Ancient Roman world)
ইউরোপে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসের শিকড় খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ক্লাসিক্যাল যুগে (classical antiquity)। তখন জাদু আর ধর্ম প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে চলত। প্রাচীন রোমের (ancient Rome) পৌত্তলিক যুগেও কিন্তু ক্ষতিকর জাদুর বিরুদ্ধে আইন ছিল (Dickie, 2003, p. 138-142)। বিখ্যাত লেখক প্লিনি (Pliny) জানিয়েছেন, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই রোমের আইনে (Twelve Tables) ক্ষতিকর মন্ত্র বলার জন্য বা জাদু দিয়ে অন্যের জমির ফসল নষ্ট করার জন্য শাস্তির বিধান ছিল (Dickie, 2003, p. 138-142)। গাইউস ফিউরিয়াস ক্রেসিমাস (Gaius Furius Cresimus) নামে এক ব্যক্তির বিচারের ঘটনাই শুধু এই আইনের অধীনে নথিভুক্ত আছে (Dickie, 2003, p. 138-142)।
ল্যাটিন ভাষায় ‘ভেনেফিসিয়াম’ (veneficium) শব্দটার দুটো মানে ছিল – বিষ দেওয়া এবং জাদু দিয়ে ক্ষতি করা (যেমন জাদুকরী পানীয় তৈরি), যদিও সেকালের লোকেরা হয়তো এই দুটোর মধ্যে খুব একটা তফাত করত না (Hutton, 2017, p. 59-66)। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে এক ভয়ংকর মহামারী দেখা দিলে কমপক্ষে ১৭০ জন মহিলাকে এই ‘ভেনেফিসিয়াম’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়! আবার ১৮৪-১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইতালিতে আরেক মহামারীর সময় প্রায় ৫,০০০ জনকে একই অভিযোগে মারা হয়েছিল (Hutton, 2017, p. 59-66)! হাটন সাহেব বলছেন, এই রিপোর্টগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে রিপাবলিকান রোমানরা যে মাত্রায় ডাইনি শিকার করেছিল, তেমনটা প্রাচীন বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায়নি (Hutton, 2017, p. 59-66)।
৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেক্স কর্নেলিয়া (Lex Cornelia) নামে এক আইন পাশ হয়, যাতে ভেনেফিসিয়ামের মাধ্যমে হত্যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। পরে, সাম্রাজ্যের যুগে, এই আইনটাকেই আরও নানা ধরনের জাদুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে থাকে (Hutton, 2017, p. 59-66), যেমন খারাপ উদ্দেশ্যে পশুবলি দেওয়া। ধরা পড়লে জাদুকরদের নাকি জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো (Dickie, 2003, p. 138-142)!
প্রাচীন রোমান সাহিত্যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই, আমরা ভয়ংকর সব ডাইনি চরিত্রের দেখা পাই। এরা সাধারণত কুৎসিত বুড়ি, যারা খারাপ মন্ত্র পড়ে, গাছপালা বা পশুপাখি আর মানুষের শরীরের অংশ দিয়ে বিষাক্ত পানীয় বানায়, বাচ্চাদের বলি দেয়, মরা মানুষ বাঁচিয়ে তোলে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের বা অন্যকে পশু বানিয়ে ফেলতে পারে, আর পাতালের দেবতা বা আত্মাদের ডেকে আনে! লুকানের (Lucan) এরিকথো, হোরেসের (Horace) ক্যানিডিয়া, অভিডের (Ovid) ডিপসাস বা অ্যাপুলিয়াসের (Apuleius) মেরো – এরা হলো সেইসব ভয়ংকর ডাইনির উদাহরণ (Hutton, 2017, p. 59-66)। সাহিত্যের পাতাতেও কেমন জীবন্ত হয়ে আছে মানুষের ভয়!
আধুনিক ইউরোপ: উন্মাদনা থেকে নতুন ভাবনা (Early modern and contemporary Europe)
এরপর এলো ইউরোপের আধুনিক যুগ। আর তার সাথেই শুরু হলো বড় আকারে ডাইনি শিকার আর ডাইনি বিচার। এর পেছনে ছিল নানা কারণ – ধর্মীয় রেষারেষি, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সমস্যা। এই সময়ে ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) (১৪৮৬) নামের বইটি যেন আগুনে ঘি ঢালল। ডাইনিদের তখন দেখা হতো এমন মানুষ হিসেবে, যারা কালো জাদু দিয়ে ক্ষতি করে, আর প্রায়ই ভাবা হতো তারা শয়তানের সাথে চুক্তি (pact with the Devil) করেছে (Ehrenreich & English, 2010, p. 29, 54)। অভিযোগগুলো আসত মূলত প্রতিবেশীদের কাছ থেকে, আর তার মূলে থাকত সামাজিক টানাপোড়েন। অভিযোগের শিকার হতো প্রায়শই সমাজের দুর্বল মানুষজন – নারী, বুড়ো, বা যারা একটু অন্যরকম ছিল। নারীরা যেমন অভিযোগ করত, পুরুষরাও করত। সাধারণ মানুষ অবশ্য বিশ্বাস করত গ্রামের ওঝা বা ‘কানিং ফোক’রা জাদুবিদ্যা কাটাতে পারে। হাটন বলছেন, এই ওঝাদেরও কখনও কখনও ডাইনি বলে নিন্দা করা হতো, কিন্তু অভিযুক্তদের মধ্যে তারা ছিল সংখ্যালঘু (Hutton, 2017, p. 24-25)। এই ডাইনি-উন্মাদনা (witch-craze) সবচেয়ে বেশি চরমে উঠেছিল ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল! ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টা আমাদের দেখায়, কীভাবে কুসংস্কার, ভয় আর ক্ষমতা মিলেমিশে জটিল সমস্যার জন্য সহজ বলির পাঁঠা খুঁজে বের করে। নারীবাদীরা (feminist interpretation) আবার বলেন, এর পেছনে ছিল নারীবিদ্বেষী (misogynist) মনোভাব, যা নারীদেরকেই অশুভ ডাইনিবিদ্যার সাথে জুড়ে দিয়েছিল (Ehrenreich & English, 2010, p. 29, 54)।
স্কটল্যান্ডে (Scotland) এই ডাইনি শিকার ছিল ভয়াবহ। ১৬ শতক থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে নাকি ৪০০০ থেকে ৬০০০ লোককে ডাইনি অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, যা ইউরোপের অন্য জায়গার চেয়ে অনেক বেশি (The Oxford companion to Scottish history, p. 644-645; Cartwright, 2010, p. 32)।
রাশিয়াতেও (Russia) ১৭ শতকে ডাইনি বিচারের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ডাইনিদের প্রায়ই জাদুবিদ্যা আর অলৌকিক কাজ করার দায়ে অভিযুক্ত করে সমাজচ্যুত (excommunication) বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। রাশিয়ার বিচার পদ্ধতিতে গির্জা আর রাষ্ট্র হাত ধরাধরি করে চলত, যা দেখায় ধর্ম আর রাজনীতির ক্ষমতা কীভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, ডাইনি নিয়ে ভয়টা নিছক কুসংস্কার থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। যারা শাসকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠত, তাদেরকেই ডাইনি অপবাদ দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো (Zguta, 1977)।
তবে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপে আবার নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে। নব্য-পৌত্তলিক (neopagan) ডাইনিবিদ্যা আন্দোলন শুরু হয়, যারা পুরনো দিনের পৌত্তলিক আর রহস্যময় প্রথাগুলোকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এর মধ্যে জেরাল্ড গার্ডনারের (Gerald Gardner) হাত ধরে শুরু হওয়া উইক্কা (Wicca) আন্দোলনটিই সবচেয়ে প্রভাবশালী। এরা পুরনো দিনের জাদু, পৌত্তলিক বিশ্বাস আর মার্গারেট মারের (যদিও ভুল প্রমাণিত) উইচ-কাল্ট তত্ত্ব থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। উইক্কা জোর দেয় প্রকৃতি, ঈশ্বরত্ব আর ব্যক্তিগত উন্নতির ওপর। ইতালিতেও ‘স্ট্রেঘেরিয়া’ (Stregheria) নামে একই রকম একটা আন্দোলন দেশের পৌত্তলিক অতীতের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। এই নতুন আন্দোলনের অনেকেই নিজেদের ‘ডাইনি’ বলে পরিচয় দেন। ইউরোপের নব্য-পৌত্তলিক ডাইনিবিদ্যা এখন নানা রূপে, নানা ঐতিহ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওশেনিয়া: দ্বীপপুঞ্জের জাদু (Oceania)
প্রশান্ত মহাসাগরের কুক দ্বীপপুঞ্জের (Cook Islands) মাওরি (Māori) ভাষায় কালো জাদুকে বলে ‘পুরেপুরে’ (purepure) (Buse, 1995, p. 372)। আর তাদের পুরোহিত বা ওঝাদের নাম হলো ‘তা’উঙ্গা’ (ta’unga) (Buse, 1995, p. 471)।
পাপুয়া নিউ গিনিতে (Papua New Guinea) ডাইনি সন্দেহে মানুষ হত্যার ঘটনা আজও ঘটে। অনুমান করা হয়, সেখানে প্রতি বছর ৫০ থেকে ১৫০ জন অভিযুক্ত ডাইনিকে মেরে ফেলা হয় (“Papua New Guinea’s ‘Sorcery Refugees’…”, 2015)! ২০০৮ সালে তো সেখানকার দুটো প্রদেশেই পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষকে ডাইনিবিদ্যা করার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছিল (“Woman suspected of witchcraft burned alive”, 2009)।
পাপুয়া নিউ গিনির মিলনে বে প্রদেশে (Milne Bay Province) ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাস আর তার চর্চা দুটোই খুব চালু আছে (Lawrence, 2015)। তবে মজার ব্যাপার হলো, দেশের অন্য জায়গার তুলনায় এই প্রদেশে আর পাশের সামারাই দ্বীপপুঞ্জে (Samarai Islands) ডাইনি অভিযোগে বা সাধারণভাবে মহিলাদের ওপর অত্যাচার অনেক কম হয় (Lawrence, 2015)। কেউ কেউ মনে করেন, এই অঞ্চলে ডাইনিবিদ্যার দীর্ঘ ইতিহাস হয়তো সেখানকার সমাজে মহিলাদের মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করেছে (Lawrence, 2015)। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য!
শিল্প আর সাহিত্যে ডাইনি (Witches in art and literature)
ডাইনিরা কি শুধু মানুষের মুখে মুখে ফেরে? না, তারা শিল্পীর তুলিতে, লেখকের কলমেও বারবার ফিরে এসেছে। যদিও তাদের সবচেয়ে পুরনো ছবিগুলো পাওয়া যায় ইউরোপের আধুনিক যুগের শুরুর দিকে, বিশেষ করে মধ্যযুগ আর রেনেসাঁসের সময়ে। পণ্ডিতরা মনে করেন, ক্যানন এপিস্কোপি (Canon Episcopi) নামে পুরনো এক বই, যেখানে শয়তান আর ভূতপ্রেতের কথা ছিল, আর সেই কুখ্যাত ‘ম্যালিয়াস ম্যালেফিকারাম’ (Malleus Maleficarum) (১৪৮৭) – এইগুলোই নাকি শিল্পীদের ডাইনি আঁকতে বা লেখকদের ডাইনি নিয়ে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল (Simons, 2014)। গল্প-উপন্যাসে ডাইনিরা নানা রূপে এসেছে। বেশিরভাগ সময়ই তারা মহিলা, তবে সবসময় নয়। কখনও তারা ভয়ংকর খলনায়িকা (villains), আবার কখনও বা শক্তিশালী নায়িকা (heroines) (Hutton, 2018)। ডাইনিরা যেন মানুষের কল্পনা আর ভয়ের এক চিরন্তন প্রতিচ্ছবি।
রেফারেন্স
-
Abusch, T. (2002). Mesopotamian Witchcraft: Toward a History and Understanding of Babylonian Witchcraft Beliefs and Literature. Brill Styx.
-
Abusch, T. (2015). The Witchcraft Series Maqlû. (Writings from the Ancient World, Vol. 37). SBL Press.
-
Adinkrah, M. (2004). Witchcraft Accusations and Female Homicide Victimization in Contemporary Ghana. Violence Against Women, 10(4), 325–356. https://doi.org/10.1177/1077801204263419
-
Adler, M. (2006). Drawing Down the Moon: Witches, Druids, Goddess-Worshippers, and Other Pagans in America Today. Penguin Books.
-
Akosua, A. (2014, September 3). Ebola: Human Rights Group Warns Disease Is Not Caused By Witchcraft. The Ghana-Italy News. Archived from the original on September 3, 2014. Retrieved October 31, 2017.
-
Ankarloo, B., & Clark, S. (Eds.). (2001). Witchcraft and Magic in Europe: Biblical and Pagan Societies. University of Philadelphia Press.
-
Ankarloo, B., & Henningsen, G. (Eds.). (1990). Early Modern European Witchcraft: Centres and Peripheries. Oxford University Press.
-
Bachmann, J. (2021). African Witchcraft and Religion among the Yoruba: Translation as Demarcation Practice within a Global Religious History. Method & Theory in the Study of Religion, 33(3–4), 381–409. https://doi.org/10.1163/15700682-12341522
-
Barstow, A. L. (1994). Witchcraze: A New History of the European Witch Hunts. Pandora.
-
Behar, R. (1987). Sex and Sin, Witchcraft and the Devil in Late-Colonial Mexico. American Ethnologist, 14(1), 34–54. https://doi.org/10.1525/ae.1987.14.1.02a00030
-
Berger, H. A. (Ed.). (2005). Witchcraft and Magic: Contemporary North America. University of Pennsylvania Press.
-
Berger, H. A., & Ezzy, D. (2009). Mass Media and Religious Identity: A Case Study of Young Witches. Journal for the Scientific Study of Religion, 48(3), 501–514. https://doi.org/10.1111/j.1468-5906.2009.01462.x
-
Bilefsky, D. (2009, May 10). Hard Times Give New Life to Prague’s Golem. The New York Times. Archived from the original on May 9, 2013. Retrieved March 19, 2013.
-
Blom, J. D., Poulina, I. T., van Gellecum, T. L., & Hoek, H. W. (2015). Traditional healing practices originating in Aruba, Bonaire, and Curaçao: A review of the literature on psychiatry and Brua. Transcultural Psychiatry, 52(6), 840–860. https://doi.org/10.1177/1363461515589709
-
Breslaw, E. G. (2011). Witchcraft in Early North America. Journal of American History, 98(2), 504. https://doi.org/10.1093/jahist/jar254 (Corrected reference; original OCR had page 504 but referenced jar254 which points to a different article. Assuming intent was a general article on the topic). Note: Original reference [134] might be mistaken.
-
Burns, W. (2003). Witch Hunts in Europe and America: An Encyclopedia. Bloomsbury Publishing.
-
Buse, J. (Ed.). (1995). Cook Islands Maori Dictionary. Cook Islands Ministry of Education.
-
Bussien, N., et al. (2011). Breaking the spell: Responding to witchcraft accusations against children. (New Issues in Refugee Research, 197). UNHCR.
-
Byrne, C. (2011, June 16). Hunting the vulnerable: Witchcraft and the law in Malawi. Consultancy Africa Intelligence.
-
Campbell, H. M. (Ed.). (2011). The Emergence of Modern Europe: c. 1500 to 1788. Britannica Educational Publishing.
-
Cartwright, K. (2010). Witchcraft in Tudor and Stuart Scotland. Wiley.
-
Catholic Encyclopedia: Witchcraft. (1912, October 1). New Advent. Archived from the original on February 11, 2021. Retrieved October 31, 2013.
-
Cimpric, A. (2010). Children accused of witchcraft, An anthropological study of contemporary practices in Africa. UNICEF WCARO.
-
Cumes, D. (2004). Africa in my bones. New Africa Books.
-
Cusack, C. M. (2009). The Return of the Goddess: Mythology, Witchcraft and Feminist Spirituality. In M. Pizza & J. Lewis (Eds.), Handbook of Contemporary Paganism. Brill.
-
Dangerfield, A. (2012, March 1). Government urged to tackle ‘witchcraft belief’ child abuse. BBC News. Archived from the original on October 8, 2014. Retrieved June 8, 2014.
-
Davies, O. (1999). Witchcraft, Magic and Culture, 1736–1951. Manchester University Press.
-
Davies, O. (2003). Cunning-Folk: Popular Magic in English History. Hambledon Continuum.
-
Definition of WITCH. (n.d.). Merriam-Webster.com. Retrieved October 12, 2023.
-
Demetrio, F. R. (1988). Shamans, Witches and Philippine Society. Philippine Studies, 36(3), 372–380.
-
Dickie, M. (2003). Magic and Magicians in the Greco-Roman World. Routledge.
-
di Giovanni, J. (2014, October 14). When It Comes to Beheadings, ISIS Has Nothing Over Saudi Arabia. Newsweek. Archived from the original on October 16, 2014. Retrieved October 17, 2014.
-
Diwan, M. (2004). Conflict between State Legal Norms and Norms Underlying Popular Beliefs: Witchcraft in Africa as a Case Study. Duke Journal of Comparative & International Law, 14(2), 351–388. Archived from the original on February 25, 2021.
-
Doyle White, E. (2016). Wicca: History, Belief, and Community in Modern Pagan Witchcraft. Liverpool University Press.
-
Ebola outbreak: ‘Witchcraft’ hampering treatment, says doctor. (2014, August 2). BBC News. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved June 22, 2018.
-
Ehrenreich, B., & English, D. (2010). Witches, Midwives & Nurses: A History of Women Healers (2nd ed.). Feminist Press at CUNY.
-
Evans-Pritchard, E. E. (1937). Witchcraft, Oracles and Magic Among the Azande. Oxford University Press.
-
Frazer, J. G. (1922). The Golden Bough. Bartleby.com. (Original work published 1890)
-
Gbule, N. J., & Odili, J. U. (2015). Socio-Missiological Significance of Witchcraft Belief and Practice in Africa. African Research Review, 9(3), 99. https://doi.org/10.4314/afrrev.v9i3.9
-
Geertz, A. W. (2011). Hopi Indian Witchcraft and Healing: On Good, Evil, and Gossip. American Indian Quarterly, 35(3), 372–393. https://doi.org/10.1353/aiq.2011.a447052
-
Gershman, B. (2022). Witchcraft beliefs around the world: An exploratory analysis. PLOS ONE, 17(11), e0276872. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0276872
-
Geschiere, P. (1997). The Modernity of Witchcraft: Politics and the Occult in Postcolonial Africa (P. Geschiere & J. Roitman, Trans.). University of Virginia Press.
-
Gibbons, J. (1998). Recent Developments in the Study of the Great European Witch Hunt. The Pomegranate, 5. Archived from the original on January 26, 2009.
-
A Global Issue that Demands Action. (2013). Academic Council on the United Nations System (ACUNS) Vienna Liaison Office. Archived from the original on June 30, 2014. Retrieved June 7, 2014.
-
Green, K. (2011, February 1). The Golem in the Attic. Moment Magazine. Archived from the original on August 25, 2017. Retrieved August 25, 2017.
-
Grell, O. P., & Scribner, R. W. (Eds.). (2002). Tolerance and Intolerance in the European Reformation. Cambridge University Press.
-
Harper, D. (n.d.-a). hag (n.). Online Etymology Dictionary. Retrieved from https://www.etymonline.com/word/hag
-
Harper, D. (n.d.-b). witchcraft (n.). Online Etymology Dictionary. Archived from the original on November 5, 2013. Retrieved October 29, 2013.
-
Herrera-Sobek, M. (Ed.). (2012). Celebrating Latino Folklore: An Encyclopedia of Cultural Traditions. ABC-CLIO.
-
History of Witches. (2020, October 20). History.com. Retrieved October 26, 2021.
-
Hoggard, B. (2004). The archaeology of counter-witchcraft and popular magic. In Beyond the Witch Trials: Witchcraft and Magic in Enlightenment Europe. Manchester University Press.
-
Home : Oxford English Dictionary. (n.d.). Oed.com. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved July 18, 2021.
-
Human Rights Watch. (2006). Children in the DRC. (Human Rights Watch report, 18(2)).
-
Hutton, R. (1993). The Pagan Religions of the Ancient British Isles. Blackwell Publishers.
-
Hutton, R. (1999). The Triumph of the Moon: A History of Modern Pagan Witchcraft. Oxford University Press.
-
Hutton, R. (2006). Witches, Druids and King Arthur. A&C Black. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved November 22, 2020.
-
Hutton, R. (2017). The Witch: A History of Fear, from Ancient Times to the Present. Yale University Press.
-
Hutton, R. (2018). Witches and Cunning Folk in British Literature 1800–1940. Preternature: Critical and Historical Studies on the Preternatural, 7(1), 27. https://doi.org/10.5325/preternature.7.1.0027
-
Igwe, L. (2020). Accused Witches Burned, Killed in Nigeria. Skeptical Inquirer, 44(5).
-
Jolly, K., Raudvere, C., & Peters, E. (Eds.). (2002). Witchcraft and Magic in Europe: The Middle Ages. A&C Black.
-
Kanina, W. (2008, May 21). Mob burns to death 11 Kenyan ‘witches’. Reuters. Archived from the original on June 20, 2017. Retrieved September 15, 2016.
-
Kelly, A. A. (1991). Crafting the Art of Magic, Book I: a History of Modern Witchcraft, 1939–1964. Llewellyn Publications.
-
Kelly, A. A. (1992). An Update on Neopagan Witchcraft in America. In J. R. Lewis & J. G. Melton (Eds.), Perspectives on the New Age (pp. 136–151). State University of New York Press.
-
Khaldûn, I. (2015). The Muqaddimah: An Introduction to History (Abridged ed.). Princeton University Press. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved May 4, 2021.
-
Kielburger, C., & Kielburger, M. (2008, February 18). HIV in Africa: Distinguishing disease from witchcraft. Toronto Star. Archived from the original on October 19, 2017. Retrieved September 18, 2017.
-
Kilpatrick, A. (1998). The Night Has a Naked Soul – Witchcraft and Sorcery Among the Western Cherokee. Syracuse University Press.
-
Kittredge, G. L. (1929). Witchcraft in Old and New England. Russell & Russell.
-
Kolwezi: Accused of witchcraft by parents and churches, children in the Democratic Republic of Congo are being rescued by Christian activists. (2009, September). Christianity Today. Archived from the original on November 14, 2011. Retrieved October 14, 2011.
-
La Fontaine, J. (2016). Witches and Demons: A Comparative Perspective on Witchcraft and Satanism. Berghahn Books.
-
Lavrin, A. (Ed.). (1992). Sexuality and Marriage in Colonial Latin America (Reprint ed.). University of Nebraska Press.
-
Lawrence, S. E. (2015). Witchcraft, Sorcery, Violence: Matrilineal and Decolonial Reflections. In M. Forsyth & R. Eves (Eds.), Talking it Through: Responses to Sorcery and Witchcraft Beliefs and Practices in Melanesia. ANU Press.
-
Levack, B. P. (Ed.). (2013). The Oxford Handbook of Witchcraft in Early Modern Europe and Colonial America. Oxford University Press.
-
Lewis, J. R. (Ed.). (1996). Magical Religion and Modern Witchcraft. SUNY Press.
-
Lewis, L. A. (2003). Hall of mirrors: power, witchcraft, and caste in colonial Mexico. Duke University Press.
-
Luck, G. (1985). Arcana Mundi: Magic and the Occult in the Greek and Roman Worlds; a Collection of Ancient Texts. Johns Hopkins University Press.
-
Macfarlane, A. (1999). Witchcraft in Tudor and Stuart England: A Regional and Comparative Study. Psychology Press.
-
McNeill, F. M. (1957). The Silver Bough: A Four Volume Study of the National and Local Festivals of Scotland (Vol. 1). Canongate Books.
-
Meaney, A. L. (1984). Æfric and Idolatry. Journal of Religious History, 13(2), 119–135. https://doi.org/10.1111/j.1467-9809.1984.tb00191.x
-
Mills, M. A. (2013). The opposite of witchcraft: Evans-Pritchard and the problem of the person. The Journal of the Royal Anthropological Institute, 19(1), 18–33. https://doi.org/10.1111/1467-9655.12001
-
Molina, J. A. (2006). The Invention of Child Witches in the Democratic Republic of Congo. Save the Children.
-
Moro, P. A. (2017). Witchcraft, Sorcery, and Magic. In The International Encyclopedia of Anthropology. https://doi.org/10.1002/9781118924396.wbiea1915
-
Needham, R. (1978). Primordial Characters. University of Virginia Press.
-
Nepal: Witchcraft as a Superstition and a form of violence against women in Nepal. (2011). Asian Human Rights Commission. Archived from the original on June 25, 2014. Retrieved June 7, 2014.
-
Okeja, U. (2011). An African Context of the Belief in Witchcraft and Magic. In Rational Magic. Fisher Imprints.
-
The Oxford companion to Scottish history. (2001). Oxford University Press.
-
Papua New Guinea’s ‘Sorcery Refugees’: Women Accused of Witchcraft Flee Homes to Escape Violence. (2015, January 6). Vice News. Archived from the original on March 20, 2017.
-
Pearlman, J. (2013, April 11). Papua New Guinea urged to halt witchcraft violence after latest ‘sorcery’ case. The Telegraph. Archived from the original on February 11, 2018. Retrieved April 5, 2018.
-
Perrone, B., Stockel, H. H., & Krueger, V. (1993). Medicine women, curanderas, and women doctors. University of Oklahoma Press. Archived from the original on April 23, 2017. Retrieved October 8, 2010.
-
Pócs, É. (1999). Between the Living and the Dead: A Perspective on Witches and Seers in the Early Modern Age. Central European University Press.
-
Pope, J. C. (Ed.). (1968). Homilies of Aelfric: a supplementary collection (Vol. II). (Early English Text Society 260). Oxford University Press.
-
Reiner, E. (1995). Astral Magic in Babylonia. American Philosophical Society.
-
Ribeiro Júnior, J. (n.d.). O Que é Magia. Abril Cultural.
-
Riddle, J. M. (1997). Eve’s Herbs: A History of Contraception and Abortion in the West. Harvard University Press.
-
Rose, E. (1962). A Razor for a Goat. University of Toronto Press.
-
Russell, J. B. (n.d.). Witchcraft. Britannica.com. Archived from the original on May 10, 2013. Retrieved June 29, 2013.
-
Russell, J. B., & Lewis, I. M. (2023, July 28). Witchcraft. Encyclopedia Britannica. Archived from the original on June 28, 2023. Retrieved July 28, 2023.
-
Saudi man executed for ‘witchcraft and sorcery’. (2012, June 19). BBC News. Archived from the original on May 30, 2019. Retrieved June 7, 2014.
-
Saudi woman beheaded for ‘witchcraft and sorcery’. (2011, December 13). CNN. Archived from the original on May 21, 2020. Retrieved June 7, 2014.
-
Savage-Smith, E. (Ed.). (2004). Magic and Divination in Early Islam. Ashgate/Variorum. Archived from the original on July 18, 2021. Retrieved August 25, 2020.
-
Savage-Smith, E. (Ed.). (2021). Magic and divination in early Islam. Routledge.
-
Scot, R. (1584). The Discoverie of Witchcraft.
-
Semple, S. (1998). A fear of the past: The place of the prehistoric burial mound in the ideology of middle and later Anglo-Saxon England. World Archaeology, 30(1), 109–126. https://doi.org/10.1080/00438243.1998.9980400
-
Semple, S. (2003). Illustrations of damnation in late Anglo-Saxon manuscripts. Anglo-Saxon England, 32, 231–245. https://doi.org/10.1017/S0263675103000115
-
Silverblatt, I. (1983). The evolution of witchcraft and the meaning of healing in colonial Andean society. Culture, Medicine and Psychiatry, 7(4), 413–427. https://doi.org/10.1007/BF00052240
-
Simons, P. (2014). The Incubus and Italian Renaissance art. Notes in the History of Art, 34(1), 1–8. https://doi.org/10.1086/sou.34.1.23882368
-
Sinclair, G. (1871). Satan’s Invisible World Discovered. Edinburgh.
-
Singh, M. (2021). Magic, Explanations, and Evil: The Origins and Design of Witches and Sorcerers. Current Anthropology, 62(1), 2–29. https://doi.org/10.1086/713111
-
Social stigma as an epidemiological determinant for leprosy elimination in Cameroon. (2011). Journal of Public Health in Africa, 2(1), e10. Archived from the original on July 31, 2017. Retrieved August 27, 2014.
-
Stepping Stones Nigeria 2007. Supporting Victims of Witchcraft Abuse and Street Children in Nigeria. (2007). Humantrafficking.org. Archived from the original on October 17, 2012.
-
Stokker, K. (2007). Remedies and Rituals: Folk Medicine in Norway and the New Land. Minnesota Historical Society Press.
-
Tan, M. L. (2008). Revisiting Usog, Pasma, Kulam. University of the Philippines Press. Archived from the original on January 26, 2021. Retrieved September 17, 2020.
-
The dangers of witchcraft. (2010, February 4). Reuters Blogs. Archived from the original on March 12, 2010. Retrieved March 26, 2010.
-
Thomas, K. (1997). Religion and the Decline of Magic. Oxford University Press. (Original work published 1971)
-
Umotong, I. D. (n.d.). Witchcraft in Africa: malignant or developmental? Nigerian Journals Online. Retrieved from https://www.nigerianjournalsonline.com/index.php/najp/article/download/1925/1881
-
Valiente, D. (1989). The Rebirth of Witchcraft. Robert Hale.
-
Wallace, D. L. (2015). Rethinking religion, magic and witchcraft in South Africa: From colonial coherence to postcolonial conundrum. Journal for the Study of Religion, 28(1), 23–51. Retrieved September 15, 2023, from Academia.edu.
-
Wall, L., & Morgan, W. (1998). Navajo-English Dictionary. Hippocrene Books. (Original work published 1958)
-
West, H. G. (2007). Ethnographic Sorcery. The University of Chicago Press.
-
Whitaker, K. (2012, September 1). Ghana witch camps: Widows’ lives in exile. BBC News. Archived from the original on October 20, 2018. Retrieved September 1, 2012.
-
Wilby, E. (2005). Cunning Folk and Familiar Spirits: Shamanistic Visionary Traditions in Early Modern British Witchcraft and Magic. Sussex Academic Press.
-
Willis, D. (2018). Malevolent Nurture: Witch-Hunting and Maternal Power in Early Modern England. Cornell University Press.
-
Witchcraft accusations were an ‘occupational hazard’ for female workers in early modern England. (2023, September 19). University of Cambridge. Retrieved from https://www.cam.ac.uk/stories/witchcraft-work-women
-
Witchcraft and human rights. (n.d.). Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights. Retrieved from https://www.ohchr.org/en/special-procedures/ie-albinism/witchcraft-and-human-rights
-
Witchcraft beliefs are widespread, highly variable around the world. (2022, November 23). Phys.org. Retrieved December 17, 2022.
-
Witchcraft in 17th century Iceland. (2019, February 2). Penguin.co.uk. Retrieved from https://www.penguin.co.uk/articles/2019/02/witchcraft-in-17th-century-iceland-caroline-lea
-
Witchcraft murder: Couple jailed for Kristy Bamu killing. (2012, March 5). BBC News. Archived from the original on April 8, 2014. Retrieved June 8, 2014.
-
Witch Hunts in Modern South Africa: An Under-represented Facet of Gender-based Violence. (2009). MRC-UNISA Crime, Violence and Injury Lead Programm. Archived from the original on April 25, 2012. Retrieved June 7, 2014.
-
Woman suspected of witchcraft burned alive. (2009, January 8). CNN.com. Archived from the original on April 29, 2009.
-
World Report on Violence and Health. (2014). World Health Organization. Archived from the original on January 24, 2014. Retrieved June 7, 2014.
-
Zguta, R. (1977). Witchcraft Trials in Seventeenth-Century Russia. The American Historical Review, 82(5), 1187–1207. https://doi.org/10.2307/1856344
Leave a Reply