ফ্রান্সে ধর্মভিত্তিক গৃহযুদ্ধ, বুরবোঁ রাজবংশের উত্থান, চতুর্থ হেনরি, ত্রয়োদশ লুই, রিশল্যু, ম্যাজারিন

Table of Contents

ফ্রান্সে ধর্মভিত্তিক গৃহযুদ্ধ (১৫৬২-১৫৯৮)

ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের প্রসার

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দালন প্রসারিত হলে ফ্রান্সে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। ফ্রান্স ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে ফরাসি রাজতন্ত্র প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতি সহনশীল নীতি অনুসরণ করতে হয়েছিল। ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস (১৫১৫-১৫৪৭ সালে) তার শাসনের প্রথম পর্যায়ে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীল নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন স্পেনের বিরুদ্ধে বিশেষ করে স্পেনের শাসক ও পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি জার্মানির লুথারপন্থী প্রোটেস্ট্যান্ট রাজাদের এবং সুইজারল্যান্ডের জুইংলিপন্থি ক্যান্টনগুলোর সাহায্য লাভ করবেন। তবে এই রাজনৈতিক স্বার্থ প্রণোদিত রাজনৈতিক কূটকৌশল স্বল্পকাল স্থায়ী হয়েছিল।

ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট : ১৫১৬ সালে রোমান ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের প্রধান পোপের সাথে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের সাথে এক ধর্মীয় সমঝোতা হয়। ইতিহাস একে কনকর্ডাটা (Concordat) চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্সের রাজার উচ্চ পদস্থ বিশপদের নিযুক্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ সময় ধর্ম বিষয়ে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো রাজ্যে ধর্মসংস্কারকে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ মনে করা হত। ফরাসি রাজা ফ্রান্সিস নিজে এক রাজা, এক ধর্ম এবং এক আইন এই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজেই ফ্রান্সে কোনোরকম সংস্কারে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। দেশের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট করতে পারে এ ধরনের ধর্মীয় সংস্কার তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু রাজত্বের শেষের দিকে ফ্রান্সের প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন গতিশীল হলে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন নির্মূলের জন্য রাজকীয় আদেশ জারি করেন। এর ফলে প্রোটেস্ট্যান্টবা নির্যাতিত হতে থাকে। ১৫৪৭ সালে ফরাসি শাসকগোষ্ঠী প্রোটেস্ট্যান্টদের দমনের জন্য ইনকুইজিশনের আদলে এক ধরনের ধর্মীয় আদালত স্থাপন করে সেটিকে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের সাথে যুক্ত করা হয়। এই আদালত যে কোনো ব্যক্তিকে ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার বিধান জারি করে। প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর এই ধর্মীয় নিপীড়ন ও অত্যাচার ফ্রান্সের পরবর্তী শাসক দ্বিতীয় হেনরির (১৫৪৭-১৫৫৯) সময় পর্যন্ত বলবৎ ছিল। দ্বিতীয় হেনরি ফ্রান্সে ইনকুইজিশন আদালত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পার্লামেন্ট অব প্যারিসের বিরোধিতার কারণে তা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেন নি।

ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের প্রসার : ফরাসি রাজশক্তি প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর অকথ্য নিপীড়ন চালালেও ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টরা ছিল ক্যালভিনপন্থী এবং তাদেরকে ফরাসিরা হিউগেনো (Huguenot) বলত। স্বধর্মে নিষ্ঠাবান হিউগেনোরা সংগোপনে মিলিত হয়ে ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল আদর্শ প্রচার করত। শিক্ষিত, সচেতন ও বিত্তবান ক্যালভিনপন্থী প্রোটেস্ট্যান্ট নেতাদের তৎপরতায় এ ধর্মের লোকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৫৬০ সালে ফ্রান্সে এদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখে উন্নীত হয়। কালক্রমে তারা সংগঠিত হয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তারা সরকারের কাছে ধর্মীয় প্রচার ও ধর্মীয় উপাসনার দাবি করে এবং প্রয়োজনবোধে নিজ ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়। ক্যাথলিকরাও তাদের ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধি এবং এই হিউগেনো প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রচারণা বন্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এই দুই ধর্ম গোষ্ঠীর ধর্মীয় উন্মাদনা ফ্রান্সে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা করে।

ফরাসি রাজতন্ত্রের দুর্বলতা

ফরাসি রাজতন্ত্রের দুর্বলতা এ ধর্মযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। ১৫৫৯ সালে দ্বিতীয় হেনরি মারা যাবার পর তার তিন পুত্র দ্বিতীয় ফ্রান্সিস (১৫৫৯-১৫৬০), নবম চার্লস (১৫৬০- ১৫৭৪) এবং তৃতীয় হেনরি (১৫৭৪-১৫৮৯) একাধিক্রমে ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এরা সবাই ছিলেন দুর্বল শাসক। কিন্তু সে সময় ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রয়োজন ছিল, কেননা শক্তিশালী রাজার পক্ষেই এ ধর্মীয় উদ্দীপনা নির্মূল করে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এই দুর্বল শাসকদের আমলে ধর্মীয় বৈষম্য ও ধর্মোন্মাদনা ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ ত্বরান্বিত করে। ফরাসিরাজ দ্বিতীয় ফ্রান্সিস যখন ক্ষমতায় বসেন তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তিনি স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি স্কোয়ার্টকে বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের রাণী মেরি স্টুয়ার্ট গোড়া ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। রাজা অনভিজ্ঞ হওয়ায় তার দুই পিতৃব্য বা কাকা ডিউক অব গাইস এবং কার্ডিনাল অব লরেন রাজার অভিভাবকত্ব করতেন। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী দ্বিতীয় ফ্রান্সিস ১৭ মাস রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই নবম চার্লস মাত্র দশ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। রাজমাতা ক্যাথারিন দ্য মেডিচি ছিলেন রাজার অভিভাবক। রাজমাতা ক্যাথারিন দ্য মেডিচি ইতালির বিখ্যাত মেডিচি পরিবারের কন্যা ছিলেন। এই মহিলা ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু। তিনি ফ্রান্সের সর্বময় রাজক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কুটিল রাজনীতিজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তিনি নৈতিক নিয়মকানুনকে অগ্রাহ্য করতেন। তিনি মেকিয়াভেলি রচিত ‘প্রিন্স’ (The Prince) গ্রন্থের আদর্শ অনুসরণ করতেন। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি যে কোনো ধরনের চক্রান্ত কূটকৌশল এবং হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নিতে গড়িমসি করতেন না। তিনি ১৫৮৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজক্ষমতা কুক্ষিগত রেখেছিলেন। তিনি এ রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়ন করতে নিজ সন্তানদের মধ্যে গৃহবিবাহের সৃষ্টি করেছিলেন। ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব কোনো আদর্শ বা নীতিবোধ ছিল না। তিনি প্রয়োজনে প্রোটেস্ট্যান্ট বা ক্যাথলিক যে কোনো গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতেন। বিবাদমান প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা উভয়ই তার প্রতি সন্দিগ্ধ হলে তিনি শেষ পর্যায়ে ক্যাথলিকদের পক্ষ গ্রহণ করেন। হিউগেনোদের শক্তি বৃদ্ধি হলে তিনি তাদের দমন করতেন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণটি মুখ্য ছিল না। তিনি হিউগেনোদের রাজশক্তির প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করতেন। ক্রমে হিউগেনোদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাদের প্রতি রাজমাতা ক্যাথরিনের বিদ্বেষ ও ঘৃণা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ধর্মযুদ্ধের ঘটনাবলি

১৫৩২ সালে ফ্রান্সে ক্যাথলিক ও হিউগেনোদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন ফ্রান্সের রক্ষণশীল ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী দলের নেতা ডিউক অব গাইজের নেতৃত্বে সংঘটিত ভ্যাসির হত্যাকাণ্ড গৃহযুদ্ধের দ্বার উন্মুক্ত করে। একসময় ডিউক অব গাইজ ফ্রান্সের শ্যাম্পেন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলার সময় দেখতে পান যে, ছয়/সাত শত হিউগেনো রাজনির্দেশ অমান্য করে এক ধর্মীয় সমাবেশ করছে। তিনি তৎক্ষণাৎ হিউগেনো নেতাদের সমাবেশ ভঙ্গ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হিউগেনোরা এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করে। ডিউক অব গাইজ ও তার সৈন্যরা বলপূর্বক ধর্মীয় স্থানে প্রবেশ করতে চাইলে হিউগেনোরা ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। একটি ঢিল ডিউক অব গাইজের গায়ে আঘাত হানে। এই অবস্থায় ক্ষিপ্ত ডিউকের লোকজন হিউগেনোদের উপর আক্রমণ শুরু করে। এতে প্রায় ৫০ জন হিউগেনো নিহত ও শতাধিক আহত হয়। এ সংবাদ প্রচারিত হলে ফ্রান্সের সর্বত্র হিউগেনোরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা তাদের নেতা প্রিন্স অব কান্ড এবং অ্যাডমিরাল কলিনির (Coligny) নেতৃত্বে ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ক্যাথলিকরা হিউগেনোদের সম্পূর্ণভাবে দমন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে গৃহযুদ্ধ প্রকটরূপ ধারণ করে। এই গৃহযুদ্ধে ডিউক অব গাইজ একজন হিউগেনো আততায়ীর হাতে নিহত হন। এই অবস্থায় রাজমাতা ক্যাথারিন ক্যাথলিকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

হিউগেনোদের প্রতিরোধ : ফরাসি হিউগেনোরা গৃহযুদ্ধে অক্লান্ত সামরিক শক্তি ও সাহসিকতার পরিচয় দেয়। তারা ক্যাথলিকদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। দীর্ঘদিন এই গৃহযুদ্ধে হিউগেনোদের দমন করতে না পারায় রাজমাতা ক্যাথারিন একটি সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন। ১৫৭০ সালে তিনি সেন্ট জার্মেইনের নির্দেশ (Edict of Saint Germain) ঘোষণা করেন যা অনুসারে –

  • হিউগেনোদের ধর্মীয় উপাসনার অধিকার এবং সকল ধরনের চাকরিতে নিয়োগ লাভের অধিকার দান করা হয়।
  • তাদের নিরাপত্তার জন্য চারটি শহরকে তাদের বসবাসের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয়।
  • হিউগেনোদের নেতা অ্যাডমিরাল কলিনিকে রাজার কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে স্থান দেওয়া হয়।
  • হিউগেনোদেরকে লা’রসেল, মন্টাবান, কগনাক ও লা চ্যারিটি এই চারটি স্থানে দুই বছরের জন্য রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
  • হিউগেনো নেতা অ্যাডমিরালকে কলিনি দেশের সার্বিক স্বার্থে এই মীমাংসা মেনে নেন এবং রাজশক্তির সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজে অপর একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজা নবম চার্লসের ভগ্নি মার্গারিটের (Marguerite) সাথে প্রভাবশালী হিউগেনো নেতা হেনরি অব নেভারের বিবাহ প্রস্তাব করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানো। রাজা এতে সম্মত হলে বিবাহের প্রস্তুতি চলতে থাকে।

কিন্তু রাজা নবম চার্লসের উপর অ্যাডমিরাল কলিনির প্রভাব লক্ষ্য করে রাজমাতা ক্যাথারিন নিজের ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে আশঙ্কাগ্রস্ত হন। কারণ রাজার উপর কলিনির প্রভাব বৃদ্ধি পেলে নিজের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তাই কলিনিকে তার প্রধান শত্রু ভেবে তাকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা করেন। রাণীর পরিকল্পনায় গুপ্তঘাতক অ্যাডমিরাল কলিনিকে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাজা এ বিষয়টি জানতে পেরে কলিনিকে আশ্বস্ত করে যে, যেভাবেই হোক তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রটি উৎঘাটন করা হবে। রাজমাতা ক্যাথরিন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হন। তিনি এই অবস্থায় সকল প্রোটেস্ট্যান্ট নেতাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। এই চক্রান্তের কথা জানতে পেরে রাজা নবম চার্লস রাজমাতাকে এই ভয়ংকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মায়ের উপর্যুপরি ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও শ্লেষমিশ্রিত বাক্যে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন যে, কোনো হিউগেনো রাজার নিকট নালিশ জানাতে জীবিত না থাকে। এভাবেই নিষ্ঠুর সেন্ট বার্থোলোমিট হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়।

হিউগেনো হত্যাকাণ্ড : রাজমাতা ক্যাথারিনের পরিকল্পনা মতো মার্গারিট এবং হেনরি অব নেভারের বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য প্যারিসে সকল হিউগেনো নেতারা সমবেত হয়েছিল। ১৫৭২ সালের ২৪ আগস্ট রাত্রে গির্জায় ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে মধ্যরাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের প্রতিটি হিউগেনোর বাড়িতে আততায়ীরা হামলা শুরু করে। ঘুমন্ত অবস্থায় বৃদ্ধ, নারী, শিশু নির্বিশেষে সকল হিউগেনোকে হত্যা করা হয়। ডিউক অব গাইজ হেনরি নিজে এ হত্যাকাণ্ড ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করা হয়। অ্যাডমিরাল কলিনিসহ প্যারিসের প্রায় সকল হিউগেনো নিহত হয়। একমাত্র ডিউক অব কান্ড এবং বিয়ের পাত্র মানে যার সাথে রাজকন্যা বা রাজার বোন মার্গারিটের বিবাহ হলো সেই হেনরি অব নেভার এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পান। তবে হেনরি অফ নেভারকে জোরপূর্বক ক্যাথলিক-ধর্মান্তরিত করা হয় ও হাউজ-এরেস্টে রাখা হয়। যাই হোক, প্যারিসের এই হত্যাকাণ্ড সমগ্র ফ্রান্সে ছড়িয়ে পরে। আনুমানিক প্রায় দশ হাজার প্রোটেস্ট্যান্ট এই হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে সমগ্র ইউরোপের মানুষ শিহরিত হয়। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন। তবে স্পেন রাজ দ্বিতীয় ফিলিপ এই হত্যাকাণ্ডে খুশি হয়েছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া : ১৫৭২ সালের ২৪ আগস্টের এ হত্যাকাণ্ড ইউরোপের ইতিহাসে ধর্মীয় নৃশংসতার একটি জ্বলন্ত নজির। এই নির্মম ঘটনার দুই বছর পর নবম চার্লস ২৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা রাজাকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল। যে উদ্দেশ্যে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল তা সফল হয় নি। অ্যাডমিরাল কলিনির মৃত্যুতে হিউগেনোারা হতাশাগ্রস্ত হয় নি। তাদের মধ্যে আরো অনেক শক্তিশালী হিউগেনো নেতার আবির্ভাব হয়। এ হত্যাকাণ্ড হিউগেনোদের আরো ধৈর্যশীল ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এক বছর যুদ্ধের পর লা বয়েলের সন্ধি দ্বারা হিউগেনোদের ধর্মাধিকার দেওয়া হয়। এসময় গৃহযুদ্ধে অতিষ্ট হয়ে শান্তিকামী ক্যাথলিকগণ একটি সংঘ তৈরি করে। পরস্পর ধর্মসহিষ্ণুতার ভিত্তিতে সমগ্র ফ্রান্সকে ঐক্যবদ্ধ করা এর লক্ষ্য ছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৫৭৪ সালে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্পদিন পূর্বে নবম চার্লস মৃত্যুবরণ করেন। এরপর রাজা হন তার ভাই তৃতীয় হেনরি (১৫৭৪-১৫৮৯)। তিনি সিংহাসনে বসে কিছু দিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। এদিকে হাউজ-এরেস্টে থাকা ও জোরপূর্বক ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া তার ভগ্নিপতি হেনরি অফ নেভার ১৫৭৬ সালে পালিয়ে যান, পুনরায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হন ও হিউগেনোদের অন্যতম শক্তিশালী নেতা হয়ে ওঠেন। হিউগেনোদের বিদ্রোহ তীব্রতর হয় ও এর ফলে তৃতীয় হেনরি ১৫৭৬ সালে মসিয়ারের (Mousier) শান্তি চুক্তি দ্বারা হিউগেনোদেরকে অধিকতর ধর্মীর অধিকার দান করেন। তবে প্যারিস ও এর তিন মাইলের মধ্যে তারা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী রাজা তৃতীয় হেনরির শাসনকালে তিন হেনরির যুদ্ধ শুরু হয়।

  • (ক) একপক্ষে রাজা তৃতীয় হেনরি উদারপন্থী ক্যাথলিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন,
  • (খ) অন্যপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল ক্যাথলিক নেতা এবং হলি লীগের সংগঠক হেনরি অব গাইজ,
  • (গ) আরেকপক্ষ অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষ হেনরি অব নেভার হিউগেনোদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

তিন হেনরির যুদ্ধ : স্পেন রাজ দ্বিতীয় ফিলিপের সমর্থন নিয়ে হেনরি অব গাইজ ফ্রান্সের ক্ষমতা লাভের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার ক্ষমতা চরম বৃদ্ধি পেলে রাজা তৃতীয় হেনরির জন্য এক অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এমনকি তিনি রাজধানী প্যারিসও দখল করে নেন। তার প্রভাব ধ্বংস করার জন্য রাজা তৃতীয় হেনরি ১৫৮৮ সালে তাকে হত্যা করান। এরপর ক্যাথলিক লীগের ক্ষোভ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি হিউগেনোদের নেতা হেনরি অব নেভারের সাথে মিত্রতা করেন। তারা একত্রে ক্যাথলিক লীগের প্রধান ঘাঁটি প্যারিস অবরোধ করেন। ১৫৮৯ সালে তৃতীয় হেনরি একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসীর হাতে নিহত হন। হেনরির মৃত্যুর সাথে সাথে ফান্সে ভ্যালয় রাজবংশের অবসান ঘটে এবং বুরবোঁ রাজবংশের শাসন শুরু হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তৃতীয় হেনরি তার ভগ্নিপতি হেনরি অব নেভারকে ফ্রান্সের সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান এবং তার সভাসদকে অনুরোধ করেন হেনরি অব নেভারকে রাজা মেনে নিতে। তিনি নতুন রাজাকে তার ধর্মমত পরিবর্তন করে ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণের অনুরোধ করে গিয়েছিলেন। হেনরি অব নেভার, চতুর্থ হেনরি উপাধি ধারণ করে ১৫৮৯ সালে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তিনি ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০)

ভ্যালয় (Valois) বংশের শেষ রাজা তৃতীয় হেনরি নিহত হলে ন্যাভারের হেনরি চতুর্থ হেনরি নামধারণ করে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তার সিংহাসন প্রাপ্তির সাথে সাথে ইউরোপে এক নতুন রাজবংশের সূচনা হয়। এই রাজবংশ ইতিহাস খ্যাত বুরবোঁ রাজবংশ। এই রাজবংশ অনেক দিনব্যাপী ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

সমস্যা ও ধর্মান্তরণ

সিংহাসনে বসেই চতুর্থ হেনরি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। প্রায় ত্রিশ বছরব্যাপী ক্রমাগত গৃহযুদ্ধের ফলে ফরাসি জাতির সঙ্গে হতাশা ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল। গৃহযুদ্ধের ফলে অভিজাত সম্প্রদায় দুর্বিনীত ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছিল। স্পেনের সৈন্য ক্যাথলিক দলকে সাহায্য করার জন্য তখনো ফ্রান্সে অবস্থান করছিল। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মবিরোধ তখনো বিদ্যমান ছিল। কৃষি ও বাণিজ্যের শোচনীয় অবস্থা রাজকোষ শূন্য করেছিল। সরকারি কর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। এই অবস্থায় চতুর্থ হেনরি দৃঢ় চিত্তে ও ধৈর্যসহকারে সকল সমস্যা সমাধানের জন্য তৎপর হন। তিনি এ ব্যাপারে সফলতা অর্জন করেছিলেন। এজন্য ফরাসিগণ চতুর্থ হেনরিকে “Good King Henry” আখ্যা দিয়েছিল।

চতুর্থ হেনরি ক্ষমতা লাভ করে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে শক্তিশালী করার জন্য সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রথমেই ধর্মীয় বিষয়টি সুরাহা করার জন্য সুদূরপ্রসারি পদক্ষেপ নেন। সিংহাসন লাভের পূর্বে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট বা হিউগেনো মতাবলম্বী ছিলেন। তার ফলে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীগণ তাকে মেনে নিতে পারছিল না। চতুর্থ হেনরি উপলব্ধি করেন যে, তার পক্ষে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ও ক্যাথলিক দলের নেতা গাইজ বংশকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তাই দেশে শান্তি স্থাপন এবং ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের আনুগত্য লাভের জন্য তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। তার ধর্মান্তরের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিক দল এবং প্রতিপক্ষ গাইজগণ শান্ত ও সন্তুষ্ট হয়।

১৫৯৩ সালের ২৫ জুলাই তারিখে সেন্ট ডেনিস গির্জায় গিয়ে চতুর্থ হেনরি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট মত ত্যাগ করে ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করেন। ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের প্রত্যেকটি নগর একের পর এক তার কর্তৃত্ব মেনে নেয়। প্যারিসের জনগণ তার পক্ষে চলে আসে, ফলে নগরীর দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। চতুর্থ হেনরি বিজয়ীর বেশে প্যারিস নগরে প্রবেশ করেন। প্যারিসের জনতা তাকে গ্রহণ করলে সমগ্র ফ্রান্স তাকে রাজা হিসাবে মেনে নেয়। এই অবস্থায় প্যারিসে অবস্থানরত স্পেনীয় সেনাবাহিনী প্যারিস থেকে চলে যায়। রাজা চতুর্থ হেনরি স্পেনীয় সৈন্যবাহিনীকে নির্বিঘ্নে ফ্রান্স ত্যাগের অনুমতি দেন। ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে পরবর্তী সময় ১৫৯৮ সালে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে এই সন্ধিকে ভারবিসের চুক্তি বলা হয়ে থাকে।

ধর্মনীতি

চতুর্থ হেনরি ফরাসি হিউগেনোদেরকে ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীনতা দান করে ফরাসি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রাজনৈতিক প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি ১৫৮৯ সালে ক্ষমতা লাভ করে ফ্রান্সের জাতীয় ঐকা প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্য ধর্মসহিষ্ণু নীতি গ্রহণ করেন। ১৫৯৩ সালে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক স্বার্থে। তিনি ফরাসি হিউগেনোদের (ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্ট) ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিশেষ বিশেষ শহর ও নগরে তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেন। ১৫৯৮ সালে তিনি এডিক্ট অব নান্টস (Edict of Nantes) ঘোষণা করেন। এই এডিক্টের শর্তানুসারে হিউগেনোদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। লারসেল নামক স্থানে হিউগেনোদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল বলে সেখানে হিউগেনোদেরকে তিনি রাজনৈতিক স্বায়ত্ব শাসনের অধিকারও দিয়েছিলেন। এই ঘোষণা অনুযায়ী-

  • (১) ফ্রান্সের সর্বত্র হিউগেনোরা ধর্মীয় উপাসনা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচারণার স্বাধীনতা ভোগ করবে।
  • (২) ফ্রান্সের প্রত্যেক জেলায় নির্দিষ্ট শহর ও নগরে হিউগেনোরা উপাসনা পরিচালনা করতে পারবে।
  • (৩) হিউগেনোদের স্কুল ও কলেজের আংশিক বায় মেটানোর জন্য সরকারি অনুদান দেওয়া হবে।
  • (৪) ফ্রান্সে ক্যালভিনপন্থী প্রোটেস্ট্যান্টরা তাদের রচিত গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারবে।
  • (৫) সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অধিকার থাকবে।
  • (৬) হিউগেনোদের মামলা মোকদ্দমা বিচারের নিমিত্তে স্থানীয় পার্লামেন্টে বিশেষ কক্ষ যার বিচারকদের মধ্যে অন্তত একজন হিউগেনো বিচারক থাকবে।
  • (৭) হিউগেনোদের নিরপত্তার স্থানসমূহের অধিকার আট বছরের জন্য নিশ্চিত করা হবে এবং সরকার তাদের দুর্গসমূহের সৈন্যের ভরণপোষণ বহন করবে।
  • (৮) রাজকীয় অনুমতিক্রমে হিউগেনোরা গির্জার যাজকীয় বিচার সভা ও প্রাদেশিক রাজনৈতিক কাউন্সিল ডাকতে পারবে।
  • (৯) তবে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ক্যাথলিক ধর্ম মর্যাদা পাবে।

চতুর্থ হেনরি এডিক্ট অব নাউস দ্বারা ফ্রান্সে ধর্ম সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন জাতীয় অনৈক্যের মূল উৎপাটন করেন। প্রোটেস্ট্যান্টরা রাষ্ট্রীয় আশ্বাসের বিনিময়ে ফরাসি রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তারা তাদের নিরাপত্তার জামিনস্বরূপ লা’রসেলসহ (La Rochelle) দুইশ সুরক্ষিত শহরের পূর্ণ অধিকার লাভ করে। হেনরির ধর্মীয় উদারতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে গৃহযুদ্ধের অবসান হয় এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। তবে হিউগেনোদের লা’রসেল এবং আরো একশটি সুরক্ষিত নগরিকের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেয়াটা রাষ্ট্রের ভিতরে কার্যত আরেকটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে, আর তাতে রাজকীয় ক্ষমতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।

অর্থনৈতিক পুনর্গঠন 

চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পর অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে মন দেন। তিনি তার এককালীন সহকর্মী ডিউক অব সুলি ম্যাক্সিমিলিয়েন ডি বেথুনকে (Duke of Sully) অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন, সংক্ষেপে যিনি সুলি হিসেবে পরিচিতি। সুলির সতর্কতা আর্থিক বিষয়ে নতুন নীতি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

কৃষির উন্নতি :

  • সুলি উপলব্ধি করেন যে, সরকারি রাজকোষে অধিক অর্থ জমা করা সম্ভব যদি এর প্রাকৃতিক অর্থ উৎসগুলো কাজে লাগানো যায়। এজন্য তিনি কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নত করার ব্যবস্থা নেন। তাছাড়া সুলি মনে করতেন শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে কৃষকরা রাজার প্রতি বেশি অনুগত, ফলে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক উন্নতি এবং রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি সম্ভব করা যাবে।
  • কৃষির উন্নতি বিধানের জন্য চতুর্থ হেনরি যথেষ্ট সাহায্য ও উৎসাহ দান করেন। তিনি খাদ্যশস্যের উপর ধার্যকৃত রপ্তানি শুল্ক তুলে দিয়ে ফ্রান্সের কৃষি ও কৃষকদের উন্নতির পথ উন্মুক্ত করেন। ফলে ফরাসি কৃষকরা তাদের শস্যের ন্যায্য মূল্য পায় এবং ফ্রান্স ইউরোপের শস্য ঘাটতি দেশসমূহে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু করে।
  • কৃষি উন্নয়নের জন্য সুলি জলাবদ্ধ নিম্নভূমিতে পয়ঃপ্রণালি তৈরি করে জলনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে অনেক জলাভূমিকে কৃষি আবাদের উপযুক্ত করেন। অনেক পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা হয়।
  • সুলি সরকারি বনভূমিতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা চালু করেন, ফলে জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ এবং গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রের জন্য কাঠের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

কৃষিতে আনা এইসব সংস্কারের ফলে ফ্রান্সকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্য আর অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে হত না। সুলির কৃষি পরিকল্পনা ফ্রান্সকে ইউরোপে বৃহৎ শস্য উৎপাদক দেশে পরিণত করে।

শিল্পের উন্নতি :

  • ফ্রান্সের শিল্পের উন্নতির জন্য চতুর্থ হেনরি চেষ্টা করেছিলেন। শিল্পের উন্নতির উপর দেশের এবং সরকারের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে চতুর্থ হেনরি তা বুঝতেন। এটি ভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদিগকে হাতে রেখে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব বিবেচনা করে তিনি শিল্পের উন্নতির উৎসাহ দান করেন।
  • অর্থমন্ত্রী সুলি অবশ্য এইসব শিল্পজাত দ্রব্যের উপর শুল্ক বসিয়ে শিল্পের উন্নতির পথ কতকটা রুদ্ধ করেছিলেন।
  • সুলি সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দেশসমূহে প্রচলিত মার্কেন্টাইল নীতি নামক ভ্রান্ত অর্থনৈতিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্য তিনি ফ্রান্সে বৃহৎ শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করতেন না। তিনি শিল্পদ্রব্য আমদানি-রপ্তানির উপর কর ধার্য করেছিলেন। এই মার্কেন্টাইল নীতির জন্য সুলি স্বর্ণ রৌপ্য রপ্তানিও নিষিদ্ধ করেছিলেন।
  • তবে সুলি রাজা চতুর্থ হেনরির পরামর্শে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরবর্তী সময় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতে লিয়ন্স ও নিসমেসের নতুন রেশম শিল্প এবং প্যারিস ও নেভারসের কাচ ও মৃৎশিল্পকে উৎসাহিত করেন। এভাবে ৪র্থ হেনরির চেষ্টায় ফ্রান্সে রেশম, কাচ, মৃৎশিল্প প্রভৃতির উন্নতি ঘটেছিল।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি : শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির প্রয়োজনে চতুর্থ হেনরি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করেন।

  • ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবহনের উন্নতির জন্য নতুন রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়।
  • ৪র্থ হেনরি দেশের প্রথম খাল খনন করেন যা সিয়েন থেকে লয়ার ও থেকে সাওন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর এভাবে রাস্তা, খাল ইত্যাদি তৈরি করে ৪র্থ হেনরি বাণিজ্যের সুযোগ- সুবিধা বাড়িয়েছিলেন।

বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার : চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সের বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সক্রিয় ছিলেন।

  • চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের জন্য তুর্কি সুলতানের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করেন এবং তুর্কি বন্দরগুলোর সাথে ফ্রান্সের বাণিজ্যের সুবিধা বৃদ্ধি করেন।
  • তিনি ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের সঙ্গে সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন।
  • ফরাসি মদ দেশে চালান দিয়ে ফ্রান্স বহু পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।

উপনিবেশ স্থাপন : চতুর্থ হেনরি বৈদেশিক বাণিজ্য বিস্তারের জন্য উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

  • সরকারি অর্থ দিয়ে ফরাসি বাণিজ্যিক নৌবহর গড়ে তোলা হয়।
  • উপনিবেশিক বাণিজ্য নিরাপত্তার জন্য একটি নৌবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ফ্রান্স স্পেন, ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগীতা শুরু করে।
  • ফরাসিরা ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন।
  • ১৬০৮ সালে চ্যাপলেন (Champlain) নামে এক ব্যক্তিকে চতুর্থ হেনরি আমেরিকা উপমহাদেশে প্রেরণ করলে তিনি কানাডার কুইবেক নামক স্থানে ফরাসি উপনিবেশ স্থাপন করে। ক্রমে ফ্রান্স আমেরিকা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম হয়।

রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কার :

  • চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন করে প্রশাসন ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও কর্মক্ষম করেছিলেন। সুলি রাষ্ট্রীয় কর বিভাগে বিদ্যমান সকল দুর্নীতি ও অসঙ্গতি দূর করার জন্য কঠোর নীতি নেন। তিনি পুরাতন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে অপসারণ করে তার স্থলে নতুন কর্মচারী নিয়োগ করেন। তিনি কর আরোপের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার আশ্রয় নেন এবং সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধ করেন।
  • সুলি বেআইনীভাবে কর আদায় করা ও হিসাব পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর হওয়ায় জনগণের দুর্দশা লাঘব হয় এবং ফ্রান্স অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
  • সুলি নতুন কর আরোপের পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু অর্থনৈতিক অব্যবস্থা দূর করে অর্থের প্রাচুর্য আনার জন্য পলেট নামে এক নতুন কর স্থাপন করেন। কেমন ছিল এই কর? ফ্রান্সে রাজকর্মচারীর পদ চিরস্থায়ীভাবে কিনে নেয়ার রেওয়াজ ছিল। ঠিক এই জায়গায় সুলি একটি আইন করে ঘোষণা করেন যে, বিচার বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের কোনো কর্মচারী তার পুত্রকে ঐ পদে বসাবার পূর্বে তাদেরকে সরকারকে পলেট নামে কর দিতে হবে। এই কর পরিশোধ করে বিচার ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী তাদের উত্তরাধিকারীর নিকট তাদের পদ স্থানান্তরিত করতে পারতেন।
  • সে সময় ফ্রান্সের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল টেইলি বা তেই, গেবেলা, এইডস বা এদ, দোয়েনেস প্রভৃতি। সুলি এই প্রচলিত কর নিয়মিত আদায়ের ব্যবস্থা করেন এবং আয় ব্যয়ের যথাযথ হিসাব রাখার ব্যবস্থা করেন। এইসব কর সম্পর্কে একটু বিবরণ দেয়া যাক –
    • টেইলি ছিল সম্পদের উপর প্রত্যক্ষ কর। অভিজাত ও গির্জাকে এই কর দিতে হত না। তবে এই কর ধার্যের ক্ষেত্রে ত্রুটি ছিল। বেশ কয়েকটি শ্রেণী এই কর দেওয়া থেকে মুক্ত ছিল। যার দরুন কৃষকদেরকে এর বোঝা বহন করতে হত। এই কর অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেত যে কোনো অর্থমন্ত্রী এটা বৃদ্ধি করতে পারতেন। করের পরিমাণ নির্ধারণ ও কর আদায়ে ত্রুটি ছিল। প্রতিটি প্রদেশ কী পরিমাণ রাজস্ব দিবে তা সরকার নির্ধারণ করত। এরপর এই কর আদায়ের জন্য সুবিধাজনক শর্তে ইজাদার নিয়োগ করা হত। ইনটেনডেন্ট নামে প্রদেশে সরকারি রাজস্ব কর্মকর্তা প্রত্যেক প্রদেশের প্রকৃত কর নির্ধারণ করত। প্রধান ইজারাদার উপইজারাদারকে কর আদায়ের জন্য পুনঃইজারা দিত। পরিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর যাজক পল্লীর কোটা ধার্য করার জন্য প্রত্যেক প্রদেশের জনগণ একটি কমিটি গঠন করত। প্রত্যেক প্রদেশ, তার ইনটেনডেন্টদের সাথে মেলামেশা থাকত ও প্রত্যেক অধিবাসী যার কর নির্ধারণ কমিটির সাথে ওঠা-বসা থাকত তাদের কোটা হ্রাস করে নিত। এতে অন্যান্যদের করের পরিমাণ বেশি হত। প্রত্যেক ইজারাদার ও উপইজারাদার সহজ সরল কৃষকদের নিকট থেকে বলপূর্বক অধিক অর্থ আদায় করত। এদের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য চেম্বার দ্যা ক্যাম্পটাস থাকলেও তারা ইজারাদারদের হিসাব নিকাশ ঠিকমতো পরীক্ষা করত না। সুলী যখন এ বিষয়টি সংস্কারের জন্য মনোযোগী তখন জনগণ ২০০ মিলিয়ন ফ্রাংক কর দিয়েছিল। কিন্তু সরকারি রাজকোষে জমা হয়েছিল ৫০ মিলিয়ন ফ্রাংক। এতে তিন-চতুর্থাংশ এই কর আদায়ে ব্যয় হয়েছিল।
    • গেবেলা ছিল লবণ কর। এটিকে একইভাবে ইজারাদারকে ইজারা দেওয়া হত। এই কর নির্ধারণ পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। একজন ফরাসি কী পরিমাণ লবণ কিনবে তা সরকার নির্ধারণ করে দিত। সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারকে প্রয়োজনের অধিক লবণ ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। এতে দুর্নীতি হত। ১৭৮১ সালে এক হিসাবে দেখা যায় গেবেলা প্রতি বছর প্রাপ্য ৭২ মিলিয়ন লিভর আদায়ের জন্য ১৮ মিলিয়ন লিভর ব্যয় করা হত। এই কর আদায়ের জন্য এক চতুর্থাংশ ব্যয় হত। প্রতি বছর চোরা চালানের জন্য তিন থেকে চারজন লোককে দণ্ড দেওয়া হত।
    • এইডস ও দোয়েনেস ছিল আবগারি ও বাণিজ্য শুল্ক। এগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিরুৎসাহিত ও জনগণকে দরিদ্র করতে সাহায্য করত। ফ্রান্সের প্রত্যেক প্রদেশ ও জেলা থেকে ও সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় টোল আদায় করা হত।

উপসংহার: ফ্রান্সের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে হেনরির অবদান ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ত্রিশ বছরব্যাপী ক্রমাগত যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে ফ্রান্সে আর্থিক দুর্দশা চরমে পৌঁছে ছিল। কৃষি, শিল্প বাণিজ্য ছিল ধ্বংস প্রায়। রাজকোষে অর্থ ছিল না। এই অবস্থায় চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য ডিউক অব সুলিকে অর্থসচিব নিযুক্ত করেন। সুলি ছিলেন গভীর, দৃঢ়চেতা, ন্যায়পরায়ণ, কৃপণ স্বভাব ব্যক্তি। তার অনেক চেষ্টায় ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়। যে সকল ক্ষেত্রে সুলি হস্তক্ষেপ করেননি সে সকল ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরির কার্য ও উৎসাহের ফলে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।

রাজনৈতিক সংস্কার 

হিউগেনোদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দান ছাড়াও চতুর্থ হেনরি বেশ কিছু রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করেছিলেন। এটা ঠিক যে, হিউগেনোদের লা’রসেল এবং আরো একশটি সুরক্ষিত নগরিকের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেয়াটা রাষ্ট্রের ভিতরে কার্যত আরেকটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে, আর তাতে রাজকীয় ক্ষমতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়, যা ছিল চতুর্থ হেনরিরই কাজ। কিন্তু ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন –

  • অভিজাতদের দমন: ফ্রান্সে অভিজাত শ্রেণী ছিল ক্ষমতালোভী ও রাজতন্ত্রের প্রতিপক্ষ। সুতরাং তিনি অভিজাতদের দমন করে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করেন।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সুবিধা প্রদান : চতুর্থ হেনরি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে রাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত-শ্রেণীর সৃষ্টি করেন এবং এদেরকে নানা প্রকার খেতাব প্রদান করেন। এই অভিজাত শ্রেণী রাজার প্রতি আনুগত্য এবং নিবেদিত প্রাণ আমলাতান্ত্রিক হিসাবে গড়ে ওঠে।
  • স্পেনীয় সৈন্যদের বিতাড়ন : চতুর্থ হেনরি স্পেনীয় সৈন্যদেরকে ফ্রান্স থেকে বিতাড়ন করেন। ভারবিন নামক সন্ধি দ্বারা স্পেন কর্তৃক অধিকৃত ফরাসি স্থানগুলো তিনি দখল করেন। ফলে স্পেনের সাথে শান্তি স্থাপিত হয়।

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরি

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরির অনুসৃত নীতি ছিল ইউরোপে ফ্রান্সকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।

  • এ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি ফ্রান্সের রাজ্যসীমাকে প্রাকৃতিক সীমায় পৌঁছিয়ে সুদৃঢ় করেন এবং স্পেন ও অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • চতুর্থ হেনরির পররাষ্ট্র নীতি কার্যকরী করার জন্য ইতালির গ্র্যান্ড ডাচি অফ টাস্কেনির গ্র্যান্ডডিউক প্রথম ফ্রাঞ্চেস্কো ডি মেডিচির (১৫৭৪-১৫৮৭) কন্যা মেরি ডি-মেডিচিকে বিবাহ করেন এবং এই সূত্রে ইতালিতে নিজ প্রভাব বৃদ্ধি করে স্যাভয় আক্রমণ করেন এবং ভসজেস্ নামক গিরিপথের সম্মুখে ব্রেসি ও কর্গে নামক দুইটি স্থান অধিকার করে ঐ পথে শত্রুদের ফ্রান্সে প্রবেশ করার পথ বন্ধ করেন। উল্লেখ্য, ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত মেডিচি পরিবার ততদিনে গ্র্যান্ড ডাচি অফ টাস্কেনি নিয়ন্ত্রণ করছিল। (১৪৯৪ সালে ইতালীয় যুদ্ধের শুরুতে মেডিচি পরিবার ফ্লোরেন্সের নিয়ন্ত্রণ হারালেও লরেঞ্জো ডি মেডিচির পুত্র কার্ডিনাল জিওভানি ডি মেডিচি (পরে পোপ দশম লিও (১৫১৩-১৫২১)) ১৫১২ সালে মেডিচি পরিবার ফ্লোরেন্সের শাসনক্ষমতা দখলে নেন। পরে ১৫২৭ সালে এরা ক্ষমতা হারালেও ১৫২৯ সালে লরেঞ্জোর ভ্রাতুষ্পুত্র গুইলো ডি মেডিচি বা পোপ সপ্তম ক্লিমেন্টের (১৫২৩-১৫৩৪) সাথে পঞ্চম চার্লসের চুক্তির মাধ্যমে ফ্লোরেন্সের ক্ষমতা মেডিচি পরিবারের হাতে আসে ও ডাচি অফ ফ্লোরেন্স গঠিত হয়। এরপর প্রথম কসিমো ডি মেডিচির (১৫৩৭-১৫৬৯) শাসনকালে ১৫৬৯ সালে পোপ পঞ্চম পায়াস (১৫৬৬-১৫৭২) ডাচি অফ ফ্লোরেন্সকে গ্র্যান্ড ডাচি অফ টাস্কেনির অভিধা দান করেন।)
  • ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে জুলিক-ক্লিভস-বার্গ এই তিনটি ক্ষুদ্র অংশের ডিউকের অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু ঘটলে তার উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই স্থানগুলো ছিল অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ পরিবারের অর্থাৎ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত। চতুর্থ হেনরি হ্যাবসবার্গ পরিবারের বিপক্ষ দলের সাথে যোগদান করেন এবং ইংল্যান্ড, স্যাভয়, ভেনিস ও জার্মানির রাজন্যবর্গের কয়েকজনকে নিয়ে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে এক শক্তি সংঘ গঠন করেন। কিন্তু আততায়ীর হস্তে চতুর্থ হেনরির মৃত্যু হলে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময় চতুর্থ হেনরির অনুসৃত বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে ফ্রান্স ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে স্থান লাভ করেছিল।

ফ্রান্সের ইতিহাসে চতুর্থ হেনরির রাজত্বকালের গুরুত্ব

ইউরোপের ইতিহাসে বিশেষ করে ফ্রান্সের সমৃদ্ধির পশ্চাতে চতুর্থ হেনরির অবদান ছিল নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। চতুর্থ হেনরি অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে যে নীতির পত্তন করেছিলেন তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময় ফ্রান্স ইউরোপে শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।

  • চতুর্থ হেনরি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তখন ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটজনক। চতুর্থ হেনরি এই সংকটময় মুহূর্তে ধীরভাবে শাসন পরিচালনা করে ফ্রান্সের জাতীয় জীবনকে হতাশার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে সর্বজয়ী ও সর্বেসর্বা করে তুলেছিলেন।
  • তিনি ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নীতি অনুসরণ করেছিলেন এবং এডিক্ট অব নান্টস ঘোষণার দ্বারা ফ্রান্সের হিউগেনোদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মীয় দ্বন্দ্বের অবসান করেছিলেন।
  • দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি কৃষির উন্নতি সাধন এবং শিল্প উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে ছিলেন।
  • প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ এবং ফ্রান্স থেকে স্পেনীয় সৈন্যদের বিতাড়ন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হেনরির কৃতিত্বের পরিচায়ক।
  • পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে শক্তিশালী নীতি অনুসরণ করে তিনি ফ্রান্সের প্রাকৃতিক সীমারেখা উদ্ধার এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে স্পেন ও অস্ট্রিয়ার প্রভৃত্ব খর্ব করার জন্য দূরদর্শী বৈদেশিক নীতি অনুসরণ চতুর্থ হেনরির পররাষ্ট্রনীতির বিশিষ্ট দিক ছিল। তার অনুসৃত নীতির ফলে ইউরোপের ইতিহাসে ফ্রান্স একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে পরবর্তী সময় আবির্ভূত হয়েছিল।

আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে চতুর্থ হেনরি যে অবদান রেখে যান তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময় ফ্রান্সের রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছিল এবং ইউরোপে ফ্রান্স শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ঐতিহাসিক জে. ই সোয়ানের মতে “চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সকে সাফল্যের পথে পরিচালনা করেন। তার রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সংস্কার যুদ্ধক্ষত দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনে। কৃষির উন্নতি ঘটে, রেশম শিল্পের উন্নতি হয় এবং ফ্রান্স পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রেশম উৎপাদক দেশে পরিণত হয় এবং বাণিজ্যে উৎসাহিত হয়। ভারতে ও উত্তর আমেরিকায় বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং উপনিবেশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

চতুর্থ হেনরির পর ফ্রান্সের অবস্থা

চতুর্থ হেনরির মৃত্যুর পর কী হয় সেটা বলার আগে তার স্ত্রীদের সম্পর্কে বলা উচিত। চতুর্থ হেনরির বিবাহ হয়েছিল ফ্রান্সের তদকালীন রাজা নবম চার্লসের বোন মার্গারিটের সাথে, আর এই বৈবাহিক সূত্রের জন্যই সন্তানহীন রাজা তৃতীয় হেনরি তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। ১৫৮৯ সালে চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সের রাজা হলে মার্গারিট হন রানী, কিন্তু তিনিও ছিলেন সন্তানহীন, ফলে উত্তরাধিকার সংকট দেখা গেল। তাই ১৫৯৯ সালে বিবাহ বাতিল হলো আর ১৬০০ সালে চতুর্থ হেনরি বিবাহ করলেন টাস্কেনির গ্র্যান্ড ডিউক প্রথম ফ্রাঞ্চেস্কো ডি মেডিচির (১৫৭৪-১৫৮৭) কন্যা মেরি ডি মেডিচিকে। চতুর্থ হেনরি ও মেরির ৬ সন্তান ছিল। ১৬০১ সালে মেরির জন্ম নিল লুই, যে ১৬১০ সালে চতুর্থ হেনরির মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সে ত্রয়োদশ লুই নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করে। আর ফ্রান্সের আসল ক্ষমতা চলে যায় রাজমাতা ও রাজার অভিভাবক বা রিজেন্ট মেরি ডি মেডিচির হাতে। তাকে পরামর্শ দিত রাজকীয় কাউন্সিল। মেরির দ্বিতীয় সন্তান ছিল ১৬০২ সালে জন্ম নেয়া এলিজাবেথ, যিনি পরে স্পেনের রানী হন।

মেরি ডি মেডিচি ছিলেন একজন অজ্ঞ মহিলা কিন্তু ক্ষমতার প্রতি ছিল তার সীমাহীন লালসা। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অজ্ঞ আর উপদেষ্টারা ছিল গোড়া ক্যাথলিক। ফলে ফ্রান্সের হিউগেনোরা রাণী ও তার উপদেষ্টাদের ঘৃণা করত। সুলি প্রথমে উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন, কিন্তু ১৬১১ সালেই তিনি উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যান্য সদস্যদের সাথে বাক-বিতণ্ডা করে পদত্যাগ করেন। এই সময় ফ্রান্সের রাজক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করত মেরি ডি মেডিচির দুধভগ্নি লিউনোরা গালিগাই ও তার দুঃসাহসী স্বামী কনসিনি, যিনি নিজেই ফ্রান্সের মার্শাল ও মারকুইস ডি আংকার পদবী গ্রহণ করেন। ক্যাথলিক ধর্মযাজক ও অভিজাত শ্রেণী নিজেদের ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়। চতুর্থ হেনরির সময় অর্থ সচিব সুলি যে অর্থ জমা করেছিলেন তার অপচয় করা হয়। ফলে ফ্রান্স অচিরেই অর্থ সংকটে পরে। এ অবস্থায় রাণী মেরি ডি মেডিচি ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে এস্টেটস জেনারেলের (Estates General) অধিবেশন আহ্বান করেন। এস্টেটস্ জেনারেলের তিনটি কক্ষ ছিল। যথা: এস্টেট ধর্মযাজক, অভিজাত ও সাধারণ সদস্যরা। এই তিন শ্রেণী পৃথক পৃথক চেম্বারে বসত।

ধর্মযাজক ও অভিজাতরা কোনো প্রকার কর দিত না এবং তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদের সাথে এদের সুসম্পর্ক ছিল না। তিন সপ্তাহ স্থায়ী এস্টেট জেনারেলের অধিবেশন কোনোরকম কার্যকরি আইন পাস করা ছাড়াই সমাপ্ত হয়। রাণী বিরক্ত হয়ে অধিবেশন কক্ষে তালা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর পর থেকে স্পেনের রাষ্ট্রদূত ফরাসি বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ১৫৯৮ সালে দ্বিতীয় ফিলিপের (১৫৫৫-১৫৯৮) মৃত্যুর পর স্পেনের সিংহাসনে বসেন তৃতীয় ফিলিপ (১৫৯৮-১৬২১)। তার প্রথম সন্তান ছিলেন অ্যান অফ অস্ট্রিয়া (জন্ম ১৬০১ সালে), নামে অস্ট্রিয়া থাকলেও তার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব স্পেনেই। পরের সন্তান ১৬০৩ সালে জন্মের এক মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। তার পরের সন্তান ছিলেন ফিলিপ (জন্ম ১৬০৫ সালে) যিনি ১৬২১ সালে পিতার মৃত্যুর পর চতুর্থ ফিলিপ (১৬২১-১৬৬৫) নাম নিয়ে স্পেনের রাজা হন। যাই হোক, রাণী স্পেনের সাথে বৈরী নীতির অবসান ঘটিয়ে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ নেন। এই লক্ষ্যে তিনি ১৬১৫ সালে পুত্র ত্রয়োদশ লুইয়ের (১৬১০-১৬৪৩) সাথে তৃতীয় ফিলিপের কন্যা অ্যান অফ অস্ট্রিয়ার এবং কন্যা এলিজাবেথের সাথে তৃতীয় ফিলিপের পুত্র ও স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজা চতুর্থ ফিলিপের বিয়ে দেন। ফ্রান্সের ও স্পেনের মধ্যে ক্লিভস সমস্যা স্থগিত রাখা হয়। মেরি ডি মেডিচি পোপের প্রতিনিধি নানসিও (Nuncio) এবং জেসুইটদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। ফ্রান্সের ওপর পোপের প্রতিনিধি নানসিও (Nuncio) এর প্রভাবও সৃষ্টি হয়। এই সব কিছুর ফলে ফ্রান্সের প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্ষুব্ধ হয়। এ সময় অভিজাতরা বিদ্রোহ করলে রাণী মেরি ডি মেডিচির পরামর্শদাতা কনসিনি কিছু সরকারি পদ বণ্টন করে অভিজাতদের সন্তুষ্ট করেন। এই অবস্থায় চতুর্থ হেনরির সুহৃদ ও সমর্থকরা ফ্রান্সের এই দুর্যোগের সময় চিন্তাগ্রস্ত হন। এই অবস্থায় কার্ডিনাল রিশল্যুুু নামে একজন অভিজাত বংশীয় রাজনীতিবিদ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে ফ্রান্সকে ইউরোপের রাজনীতিতে শক্তিশালী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন।

কার্ডিনাল রিশল্যুু (১৬২৪–১৬৪২)

ফ্রান্সের রাজনীতিতে রিশল্যুর প্রবেশ ও প্রাথমিক জীবন

ফ্রান্সের ইতিহাসে সপ্তদশ শতাব্দীতে রিশল্যুুু ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ। ১৬২৪-১৬৪২ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপে ফ্রান্সকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা রিশল্যুুুর প্রধান কৃতিত্ব ছিল। চতুর্থ হেনরি ফ্রান্সকে শক্তিশালী করার জন্য যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন রিশল্যুু সে নীতি অনুসরণ করে ফ্রান্সকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিক রাইকার এজন্য মন্তব্য করেছেন, “If Henry IV was the architect of Bourbon France, Richlieu was the master mason.” রাজা ত্রয়োদশ লুই এর কম বয়স; মেরি ডি মেডিচির অজ্ঞতা; দুধভগ্নি লিওনোরা গালিগাই, তার দুঃসাহসী স্বামী কনসিনি, পোপের প্রতিনিধি নানসিও (Nuncio), স্পেনীয় রাষ্ট্রদূত, ফ্রান্সের জেসুইট প্রতিনিধির প্রভাব – সব মিলে চতুর্থ হেনরির আমলে ফ্রান্স যতটুকু এগিয়েছিল তা স্থবির করে দেয়।

চতুর্থ হেনরির অর্থসচিব সুলি যে অর্থ রাজকোষে জমিয়েছিলেন তা অপচয় হতে থাকে। ফ্রান্সের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে স্পেনীয় রাষ্ট্রদূত মেরি ডি মেডিচিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এটি অনেকের নিকট আতঙ্কের বিষয় ছিল। চতুর্থ হেনরির সময় ফ্রান্সের বৈদেশিক নীতি ছিল অস্ট্রিয়া ও স্পেনের হ্যাপসবার্গ রাজবংশের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধি করা। রাণী মেরি ডি মেডিচি এই নীতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন। স্পেনের সাথে বৈরী নীতি পরিহার করে ফ্রান্সের স্বার্থ রক্ষার নীতি গ্রহণ করেন। হ্যাপসবার্গ রাজ শক্তির সাথে ফ্রান্সের বন্ধুত্ব শক্তিশালী করার জন্য রাণী দুটি বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ফরাসি রাজকুমার ত্রয়োদশ লুইয়ের সাথে স্পেনের তৃতীয় ফিলিপের কন্যা অ্যান অফ অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের রাজকুমারী এলিজাবেথকে বিয়ে দেন স্পেনের তৃতীয় ফিলিপের পুত্রের সাথে। অন্যদিকে ক্লিভস সমস্যা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। মেরি ডি মেডিচি পোপের প্রতিনিধি জেসুইটদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন। এতে ফ্রান্সের প্রোটোস্ট্যান্টরা (হিউগেনো) আতঙ্কগ্রস্ত হয়। চতুর্থ হেনরি ছিলেন শক্তিশালী রাজা এবং তার সময় অভিজাতদের ক্ষমতা ও প্রভাব কমে গিয়েছিল। নাবালক রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের সময় অভিজাতরা তাদের পূর্ব ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হয়। নেতৃস্থানীয় অভিজাতরা রাজপরিষদকে ভিতি প্রদর্শন করলে রাজ উপদেষ্টা কনসিনি কিছু সরকারি পদ অভিজাদের মধ্যে বিতরণ করে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। ত্রয়োদশ লুইয়ের জ্ঞাতিভাই প্রিন্স অব কোল্ডে, হেনরি অব কুঁরোর নেতৃত্বে অভিজাতরা ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাস থেকে স্থগিত হয়ে যাওয়া স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য করে। কিন্তু স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে অভিজাতরা তাদের স্বার্থ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ফলে অধিবেশন স্থগিত হয়। ফ্রান্সের এ যুগ সন্ধিক্ষণে আরমন্ড জিন ডু প্লেসিস ডি বিলার আবির্ভাব ঘটে।

প্রাথমিক জীবন : ১৫৮৫ সালে রিশল্যুু ফ্রান্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন অভিজাত এবং মাতা ছিলেন আইনজীবী। পিতা-মাতা চেয়েছিলেন রিশল্যুুু যেন সেনাবিভাগে যোগদান করেন কিন্তু তার ভ্রাতার ইচ্ছায় তিনি ধর্মযাজকের পেশ গ্রহণ করে লুকোনের গির্জার ধর্মযাজক নিযুক্ত হন। রিশল্যুুু ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ১৬১৪ সালে লুকোনের বিশপ্রিকের বিশপ হিসেবে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে যোগ দেন। সেখানে তার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ততা রাণী মেরি ডি মেডিচির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাণী তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে কাউন্সিল অব স্টেটের সদস্য নিয়োগ করেন। সে সময় ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই রিশল্যুুুর মেধা এবং দক্ষতা বুঝতে পেরে তাকে ১৬২৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন এবং ১৬৪২ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন। রিশল্যুুু ক্ষমতা লাভ করেই দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন – অভিজাতদের ক্ষমতা হ্রাস এবং ফরাসি হিউগেনোদের রাজনৈতিক আধিপত্য ধ্বংস করা। কারণ অভিজাতরা শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্তরায় ছিলেন, এবং হিউগেনোরা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে শক্তিশালী হয়ে রাষ্ট্রের ভেতরে আর একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

হিউগেনোদের দমন

ফ্রান্সে হিউগেনোরা ছিল একটি শক্তিশালী ধর্মগোষ্ঠী। চতুর্থ হেনরি ১৬১০ সালের এডিক্ট অব নান্টস ( Edict of Nants) জারি করে ফরাসি হিউপেনোদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এর ফলে হিউগেনোরা লা’রসেলকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে উঠে। তারা ফ্রান্সে অশান্তি ও বিদ্রোহ সৃষ্টি করত। হিউগেনোদের এ সকল কর্মকাণ্ডের জন্য রিশল্যুু উপলব্ধি করেন যে, “যতদিন ফ্রান্সে তাদের ক্ষমতা থাকবে ততদিন রাজা তার নিজগৃহে প্রভু হতে পারবে না এবং বিদেশে বড় ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড হাতে নিতে সমর্থ হবে না।” এ সময় ফ্রান্সে ক্যাথলিক মিশনারীদের তৎপরতা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্ডিনাল রিশল্যুুুর নিয়োগে তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়। ১৬২৫ সালে হিউগেনোরা বিদ্রোহ করে। রিশল্যুুু তাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য ছয়টি যুদ্ধজাহাজ ব্রিটানীর ব্ল্যাভেট বন্দরে মোতায়েন করেন কিন্তু হিউগেনোরা সোবিনের নেতৃত্বে এ ছয়টি জাহাজ দখল করে।

তারা গোপনে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড থেকে সাহায্যের আশ্বাস পায়। কিন্তু রিশল্যুু হিউগেনোদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ১৬২৬ সালে লা’রসেলের সন্ধির পর কিছুদিন শান্তি বজায় ছিল। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের রাজার গোপন সমর্থনে হিউগেনোরা বিদ্রোহ করে। ইংল্যান্ডের তদকালীন রাজা প্রথম চার্লস (১৬২৫-১৬৪৯) তার পিতা রাজা প্রথম জেমসের (১৬০৩-১৬২৫) এর মতো যুদ্ধবিরোধী ছিলেন না। জার্মানিতে তখন প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ চলছে, আর ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট হিউগেনোদের দমন করা হচ্ছে। তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। ক্রমশ ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের অবনতি ঘটে ও ১৬২৭ সালে তা সংঘর্ষের রূপ নেয়। ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই লা-রসেল (La-Rochelle)-এ হিউগেনোদের আক্রমণ করলে মন্ত্রী ডিউক অফ বাকিংহাম জর্জ ভিলিয়ার্স (১৬১৬-১৬২৮) তাদের রক্ষার্থে একটি বাহিনী নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন। ইংরেজমন্ত্রী ডিউক অফ বাকিংহাম (সংক্ষেপে বাকিংহাম নাম পরিচিত) একটি নৌবহর নিয়ে লা- রসেলে আগমন করে রি দ্বীপ দখল করেন এবং সেন্ট মার্টিন দুর্গ অবরোধ করেন। এ অবস্থায় লা-রসেল ও দক্ষিণাঞ্চলের হিউগেনোরা বিদ্রোহ করে। কিন্তু রিশল্যুুর পাঠানো নৌবাহিনী আবার ইংরেজ নৌবাহিনীকে ঘিরে ফেললে তাদের পলায়ন করতে হয়, কিন্তু এর ফলে ইংরেজরা যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়, আর বাকিংহামের এই অভিযান ব্যর্থ হয়ে পড়ে। প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে বাকিংহাম লা-রসেলের সাহায্যার্থে আরেকটি অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, কিন্তু যাত্রার পূর্বেই তিনি ১৬২৮ সালে ফেল্টন নামে এক পিউরিটান আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর আর্ল অফ লিন্ডসের নেতৃত্বে সেই অভিযানটি প্রেরণ করা হয়, কিন্তু এটাও আগের মতো ব্যর্থ হয়। আর এর অল্পকাল পরেই ফরাসিরাজ ত্রয়োদশ লুই লা-রসেল দখল করে নেন।

দীর্ঘ চৌদ্দ মাস অবরোধের পর হিউগেনোরা আত্মসমর্পণ করেন। রিশল্যুুু লা-রসেলের হিউপেনোদের পৌরশাসনের সুযোগ বাতিল করেন এবং তাদের দুর্গ ধ্বংস করে ফরাসি সরকারি কর্মচারীর উপর এর প্রশাসনিক দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। হিউগেনোদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তবে রাজনৈতিক সুবিধা বাতিল করা হয়। আর এভাবে চার্লসের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কেননা একইভাবে স্পেইন ও ইউরোপের অন্যত্রও তিনি ব্যর্থ হন। মন্ত্রী বাকিংহামের মৃত্যুর পর তার পররাষ্ট্রনীতি অর্থাভাবে ও পার্লামেন্টের সাথে তীব্র বিরোধিতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তিনি স্পেন ও ফ্রান্সের সাথে সন্ধি করে বৈদেশিক যুদ্ধ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে পড়েন। এর ফলে তার অবশিষ্ট রাজত্বকালে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের মর্যাদাও শূন্যের কোথায় নেমে আসে। লা-রসেল দখলের পর ফরাসি সেনাবাহিনী দক্ষিণ ফ্রান্সের লংগুয়েডক ও সিভেনেস জেলায় হিউগেনোদের দমন করে তাদের দুর্গ ধ্বংস করে দেয়। ১৬২৯ সালে অ্যালে শান্তিচুক্তি দ্বারা (Edict of Alais) হিউগেনোদেরকে শুধু ধর্মীয় অধিকার দেওয়া হয় এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক সভা করার অধিকার বাতিল করা হয়। রিশল্যুুুর এ গৃহীত ব্যবস্থার ফলে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়। লা-রসেলের পতন এবং এদের চুক্তি হিউগেনোদের কেবল ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত করে। ধর্মীয় স্বাধীনতা পেয়ে তারা রিশল্যুুুর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় এবং ফরাসি রাজতন্ত্রের সমর্থকে পরিণত হয়।

অভিজাতদের দমন

হিউগেনোদের দমনের পর রিশল্যুুু ফরাসি অভিজাতদের দমন করে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেন। সে সময় ফরাসি অভিজাতরা পার্লামেন্ট, প্রাদেশিক পরিষদ, বিচারালয় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের নিজস্ব দুর্গ এবং সেনাবাহিনী ছিল। রিশল্যুুু উপলব্ধি করেন যে, অভিজাতদের শক্তি বিনষ্ট না করলে রাজতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। এজন্য তাদের শক্তি বিনষ্ট করার জন্য তাদের দুর্গ ও প্রাসাদসমূহ ধ্বংস করেন। তাদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ নিষিদ্ধ করেন কিন্তু শক্তিশালী অভিজাতরা তা অগ্রাহ্য করে। মোন্টসারেনসি বাউটেভিল মল্লযুদ্ধের আয়োজন করলে তাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রাজসভায় অভিজাতদের অনেক সমর্থক ছিল। ১৬৩০ সালে অভিজাতরা রাজমাতা মেরি ডি মেডিচির সহায়তায় রিশল্যুুুকে পদচ্যুত করার সংকল্প নিয়েছিল কিন্তু রিশল্যুুু এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সমর্থ হন। রিশল্যুু ষড়যন্ত্রের হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। ত্রয়োদশ লুই এর ভাই, রাজমাতা মেরি ডি মেদিচির পুত্র ও অর্লিন্স এর ডিউক ষড়যন্ত্রকারী গাস্টন লোরেনে পালিয়ে যান। মেরি ডি মেডিচি ব্রাসেলসে আশ্রয় নেন, মার্শাল ডি মারিলাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার ভ্রাতা চ্যান্সেলর নির্বাসনে মৃত্যুবরণ করেন; বাসোমপিয়ারকে কারাগারে বন্দি করা হয়। এলবউফ ও অরনানোর ডাচেসদ্বয়কে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের হোতা গ্যাস্টন ১৬৩২ সালে অভিজাতদের এক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তারা বিদেশী স্পেনীয় সরকারের গোপন সমর্থন আদায় করে। সেসময় স্পেইনের রাজা ত্রয়োদশ লুই এর শ্যালক চতুর্থ ফিলিপ (১৬২১-১৬৬৫)। পরিকল্পনা অনুসারে স্পেনীয় এবং লোরেনীয় বাহিনী পূর্ব নিক থেকে ফ্রান্স আক্রমণ করবে এবং লংগুয়েডকের গভর্নর মার্শাল ডি মোন্টমারেন্সী দক্ষিণ ফ্রান্সে সৈন্য সমাবেশ করবে। কিন্তু ইতোমধ্যে সুইডেনের রাজা গুস্তাভাস এডলফাসের (১৬১১-১৬৩২) অধীনে সুইডিশ সৈন্যবাহিনী স্পেনীয়দের পরাজিত করে এবং রাজা ত্রয়োদশ লুই লোরেন দখল করে সেটিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে আনেন।

ইতোমধ্যে গাস্টন এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে লংগুয়েডকে উপস্থিত হয়ে জনগণের সমর্থন কামনা করে ব্যর্থ হন। লংগুয়েডকে মার্শাল ডি মোন্টমারেন্সী ব্যক্তিগত চেষ্টায় এক সৈন্যদল সংগ্রহ করেন কিন্তু জনগণ তাকে সমর্থন করেন নি। ফরাসি রাজকীয় বাহিনী তাকে পরাজিত করে ফাঁসি দেয়। রিশল্যুু লংগুয়েডকের অনেক অভিজাতদেরকে হত্যা করেন। পাঁচজন বিশপকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। শহরের দুর্গ ধ্বংস করা হয়। এ অবস্থায় অনেক অভিজাত বাধ্য হয়ে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগদান করে।

শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

  • কেন্দ্রীভূত প্রশাসন : রিশল্যুুু শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রাজা ও মন্ত্রীর নিকট সকল সরকারি প্রশাসনের বিভাগগুলোকে কেন্দ্রীভূত করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি রাজকীয় কাউন্সিলকে ব্যবহার করেন। কাউন্সিল রাজার ইচ্ছা অথবা মন্ত্রীর নীতির প্রতীক হিসেবে কাজ করে। ফ্রান্সের পার্লামেন্টসমূহকে কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। প্রশাসনিক সমতা বিধানের জন্য বার্গান্ডি, ডাওফিন ও প্রোভেন্স প্রদেশকে অন্যান্য প্রদেশের সমপর্যায়ে আনা হয়।
  • বিদ্রোহ প্রতিরোধ : সম্ভাব্য বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্য প্রদেশের গভর্নরদের বদলির ব্যবস্থা করেন। রাজদ্রোহী প্রজাদের বিচারের জন্য বিশেষ বিচারব্যবস্থা চালু করেন।
  • আমলাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা : অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের সুবিধার জন্য আমলাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে ইনটেনডেন্ট নামে আমলা নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে রাজার অধীনে আনা হয়। ইনটেনডেন্ট আমলারা রাজা ও প্রদেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। এ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে মধ্যস্বত্বভোগী অভিজাতদের ক্ষমতা ও সুবিধা বিলুপ্ত হয়। ইজারা দেওয়া রাজস্ব ব্যতিরেকে সকল রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করত ইনটেনডেন্টরা। ফলে অভিজাত গভর্নররা অবৈতনিক কর্মকর্তায় পরিণত হয়। ফলে রাজার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
  • ধর্মাধিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের আধিপত্র প্রতিষ্ঠা : রিশল্যুু ক্যাথলিক ধর্মের একজন কার্ডিনাল হলেও তিনি ধর্মকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দেন নি। তিনি মনে করতেন চার্চের কাজ হল জনমতকে রাষ্ট্রের অনুগত রাখা এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। তিনি চার্চের বিপদেরকে রাজকীয় কর্মচারীতে পরিণত করেন।
  • গণ প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর হস্তক্ষেপ : রিশল্যুু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজতন্ত্রের শক্তির প্রধান অন্তরায় মনে করে স্টেটস জেনারেল (States General) বা ফ্রান্সের সামন্ত পার্লামেন্ট আহ্বান বন্ধ রেখেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্থানীয় সভার ক্ষমতা হ্রাস করেছিলেন, তবে বিচার বিভাগের মধ্যে এদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। প্রদেশের অন্যান্য সকল প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ অকার্যকর করে রেখেছিলেন। দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতা হ্রাস শাসন বিভাগের সবক্ষেত্রেই রাজশক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।
  • জনমত প্রভাবিতকরণ : রিশল্যুু জনমতকে রাজতন্ত্রের সমর্থনে রাখার জন্য ‘দি গেজেট’ এবং ‘মার্কারি’ নামে দুটি পত্রিকা সরকারের তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। সরকারি অর্থে লেখক নিয়োগ করে রিশল্যুুর নীতির স্বপক্ষে পুস্তক রচনায় উৎসাহিত করতেন। রিশল্যুুর গুপ্তচরেরা রাষ্ট্রের সকল বিষয় তার দৃষ্টিগোচর করতো। এভাবেই তিনি জনমত প্রভাবিত করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে পথ সুগম করেছিলেন।
  • সামরিক ক্ষেত্র, উপনিবেশায়ন ও ভাষা : রিশল্যুু ফ্রান্সে স্থায়ী সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তিনি ফ্রান্সকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। এলক্ষ্যে তিনি কতকগুলো বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশ সম্পর্কিত কোম্পানী গঠন করেছিল। রিশল্যুু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ফ্রান্সকেও একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৬৩৫ সালে ফরাসি একাডেমী (Academy of France) প্রতিষ্ঠা করেন। এরফলে ফরাসি ভাষার উন্নতি হয়েছিল।

রিশল্যুুর পররাষ্ট্রনীতি

ফ্রান্সকে ইউরোপের রাজনীতিতে শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা রিশল্যুুর পররাষ্ট্র নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্পেন ও অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। স্পেন ও অস্ট্রিয়ার রাজ্যসীমা ফ্রান্সকে পরিবেষ্ঠিত করে রেখেছিল। ফলে ফ্রান্সের প্রাকৃতিক সীমারেখা রাইন নদী পর্যাপ্ত প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এজন্য হ্যাপসবার্গ বংশ দ্বারা শাসিত স্পেন ও অস্ট্রিয়াকে দুর্বল করে ফরাসি সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমা বাইন নদী পর্যন্ত বর্ধিত করে ফ্রান্সকে দৃঢ় ও শক্তিশালী করা ছিল রিশল্যুুর প্রধান লক্ষ্য।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে রিশল্যুু অসাধারণ কূটনৈতিক কৌশল ব্যবহার করেন। তিনি সুইডেন ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বৈরীভাব বৃদ্ধি করেন এবং পোল্যান্ড ও ডেনমার্ককে সুইডেন আক্রমণ করতে বিরত রেখে ফ্রান্সের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইতালিতে স্যাভয়, মন্টুয়া ও পার্মার সাথে মৈত্রী স্থাপন করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের শক্তি বৃদ্ধি করেন। ইতোমধ্যে অস্ট্রিয়ার শক্তি হ্রাসের এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ উপস্থিত হয়। বোহেমিয়াতে ধর্মবিরোধ উপলক্ষ্য করে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য দু’ অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অস্ট্রিয়ার রাজাই ছিলেন প্রকৃত রোমান সম্রাট। তিনি ক্যাথলিকদের পক্ষ গ্রহণ করেন। ফলে ইউরোপে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। রিশল্যুু এ সুযোগে স্পেন ও অস্ট্রিয়াকে দুর্বল করার জন্য প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে ইন্ধন দিতে শুরু করেন। স্পেন যাতে বিদ্রোহী নেদারল্যান্ডসে নিজ আধিপত্য কায়েম করতে না পারে এবং ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে পবিত্র রোমান সম্রাটকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে না পারে সেজন্য স্পেনকে অন্যত্র বিব্রত রাখার কৌশল গ্রহণ করে। উত্তর ইতালিতে স্পেনকে ব্যস্ত রেখে সেখানে তার সমস্ত শক্তি ও উদ্যম নিঃশেষ করাবার এক অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করেন।

এ সময় ভল্টেলিন (Voltelline) উপত্যকাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। এ উপত্যকাটি ছিল ফ্রান্সের আশ্রিত রাজ্য সুইজারল্যান্ডের কর্তৃত্বাধীন। স্থানীয় ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের এ অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগ গ্রহণ করে স্পেন উক্ত অঞ্চলটি অধিকার করে নেয়। মিলান থেকে জার্মানিতে এবং জার্মানি থেকে নেদারল্যান্ডসে যাতায়াতের জন্য ভন্টেলিন অঞ্চলটি স্পেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ উপত্যকা থেকে স্পেনকে বহিষ্কার করে নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির সাথে স্পেনের যোগযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রিশল্যুু পরিকল্পনা নেন। তিনি সামরিক শক্তি ও কূটনীতি প্রয়োগ করে ভল্টেলিন উপত্যকা সুইজারল্যান্ডে পুনঃকর্তৃত্বাধীনে আনেন।

ইতোমধ্যে ১৮ মাস রিশল্যুু ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ এবং হিউগেনো বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকেন। এতে তিনি সাফল্য লাভ করেন। তিনি আল্পসের অপর পাড়ে মনোযোগ দেন। এ সময় মান্টুয়া ডাচির সিংহাসনে একজন ফরাসি নার্ভাসের ডিউক চার্লস আরোহণ করায় উদ্বিগ্ন হয়ে রিশল্যুুর প্রাক্তন মিত্র স্যাভয়ের ডিউক অস্ট্রিয়ার সাথে হাত মেলায়। অস্ট্রিয়া চার্লসের সিংহাসনে আরোহণ বাধা দেয়। এতে চার্লস ক্রুব্ধ হয়ে রিশল্যুুর সাহায্য প্রার্থনা করেন। রিশল্যুু কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করে স্যাভয়ের ডিউককে ফ্রান্সের সাথে মিত্রতায় আসতে বাধ্য করেন এবং চার্লসের সিংহাসনে আরোহণে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে। ১৬৩১ সালের জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত চেরাসকো সন্ধি দ্বারা স্যাভয়ের ডিউক নার্ভাসের ডাচিতে চার্লসের অধিকার মেনে নেয় এবং ফ্রান্সকে কাসাল ও পিনেরলো দুর্গ ছেড়ে দেয়।

ইউরোপের জার্মানিতে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে রিশল্যুু তার পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুযোগ পান। তিনি প্রথমে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মী রাষ্ট্রগুলোকে অস্ট্রিয়া ও স্পেনের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেন। ১৬৩০ সালে রার্টিসবনে ক্যাথলিক শাসক ও পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড (১৬১৯-১৬৩৭) কর্তৃক আহুত ডায়েটের সভায় রিশল্যুু ধর্মীয় উপদেষ্টা হিসেবে ব্লুরাট নামে একজন ঝানু কূটনীতিবিদকে প্রতিনিধি করে পাঠান। তিনি মান্টুয়া উত্তরাধিকার প্রশ্নে ফ্রন্সের অনুকূলে বন্দোবস্ত এবং সম্রাটের ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার জন্য ডায়েটের সভাকে কাজে লাগান। ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে বিশবার প্রথমে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি প্রোটেস্ট্যান্ট শক্তিকে গোপনে অর্থ ও উৎসাহ দেন। ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে জয়লাভ শুরু করলে রিশল্যুু কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধবিশারদ দুর্ধর্ষ ক্যাথলিক সেনাপতি ওয়েলিনস্টিনের (Wallenstien) পদচ্যুতি ঘটান। ডেনিশ রাজার নেতৃত্বে প্রোটেস্ট্যান্টরা পরাজিত হলে রিশল্যুু সুইডেনের গুস্টাভাস এডোলফাসকে (১৬১১-১৬৩২) ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগদানের উৎসাহ দেন এবং আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। গুস্টাভাস এডোলফাস যাতে জার্মান প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে অধিকতর সাহায্য করতে পারেন সেজন্য বিবাদমান পোল্যান্ড ও সুইডেনকে মিত্রতায় আবদ্ধ করেন। রিশল্যুু গুস্টাভাসের সাথে চুক্তির সময় প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, গুস্টাভাস ক্যাথলিকদের অত্যাচার করবেন না। এর দ্বারা তিনি ফ্রান্সের ক্যাথলিকদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গির্জার স্বার্থ নষ্ট করেন নি।

ফরাসি সাহায্যপুষ্ট হয়ে গুস্টাভাস জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে জয়লাভ করেন। এতে গুস্টাভাসের প্রভাব বৃদ্ধি পেলে রিশল্যুু আতঙ্কিত হন। ১৬৩২ সালে নভেম্বর মাসে লুটযেনের যুদ্ধে গুস্টাভাস নিহত হলে রিশল্যুু খুশি হন। সুইডিশ প্রতিনিধি অকজেনস্টিয়ানো গুস্টাভাস এডোলফাসের কার্য চালিয়ে নেন। তবে তিনি রিশল্যুুর প্রতিনিধি ফুয়েকুয়ার্সের নিকট কূটনৈতিক কৌশলে পরাভূত হয়ে পূর্বে সম্পাদিত বরওয়ালডি চুক্তি ফ্রান্সের অনুকূলে সংশোধন করেন। এর ফলে সুইডিশ বাহিনী ফরাসি ভাড়াটে সেনাবাহিনীতে পরিণত হয় এবং যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ ফ্রান্সের হাতে চলে আসে। ইতোমধ্যে ক্যাথলিক বাহিনী স্পেনীয় জেনারেল কার্ডিনাল ইনফান্টে ফার্ডিনান্ড ভ্যাল্টেলিনা উপত্যকা অতিক্রম করে সম্রাটের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে নর্ডলিনজেনের যুদ্ধে সুইডিশ বাহিনীকে পরাজিত করে স্যাক্স- ওয়েমারের বার্নাড ও তার প্রোটেস্ট্যান্ট সৈন্যদলকে রাইন অঞ্চলে তাড়িয়ে দেন। রিশল্যুু এসময় জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের উপর একটি সুবিধাজনক সন্ধি আরোপ করেন। রিশল্যুু এ শর্তে সৈন্য ও অর্থ পাঠাতে সম্মত হন যে, তারা আলসাসে অবস্থিত তাদের দখলকৃত ক্লেটস্টাড ও মেনফিল্ড দুর্গ ফ্রান্সকে ছেড়ে নিবে। জার্মানরা তাতে সম্মত হলে রিশল্যুু স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। স্পেনীয়রা ফ্রান্স আক্রমণ করে প্যারিসের প্রায় নিকটবর্তী করবি নামক স্থানে উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় রাজা ত্রয়োদশ লুই সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং ফরাসি সেনাপতি বোরডিয়াক্সের আর্চবিশপ হেনরি দি সোরডিসের অধীনে ফরাসি নৌবাহিনী ১৬৩৮ সালে স্পেনীয় নৌবাহিনীকে পরাজিত করে।

এরপর সাক্স ওয়েমারের বার্নাড রাইন অঞ্চলের শক্তিশালী দুর্গ ব্রেসাক দখল করে। ইতোমধ্যে রিশল্যুু পর্তুগাল ও কেটালোনিয়া (Catalonia) প্রদেশকে স্পেনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে স্পেনের মূল ভূখণ্ডে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে স্পেনকে সমস্যায় ফেলেন। কেটালোনিয়ার বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করে ফ্রান্স ১৬৪২ সালে পিরেনিজ পর্বতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রসিলন (Roussillion) দখল করে। রিশল্যুুর শক্তিশালী পররাষ্ট্র নীতির জন্য ফ্রান্সের প্রধান শত্রু অস্ট্রিয়া ও স্পেন বিধ্বস্ত হয়। ১৬৪২ সালে ৪ ডিসেম্বর রিশল্যুু মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তিনি তার সাফল্য দেখে যেতে পারেন নি তবুও তার যোগ্য উত্তরাধিকারী ম্যাজারিন তার নীতি অনুসরণ করে অস্ট্রিয়া ও স্পেনের শক্তিকে পঙ্গু ও হীনবল করে রিল্যুর অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করেন। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি (১৬৪৮) এবং পিরিনিজের (১৬৫৯) সন্ধি ফ্রান্সের অনুকূলে সম্পাদিত হলে ফ্রান্স ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।

রিশল্যুুর মূল্যায়ন ও সমালোচনা

রিশল্যুুর কৃতিত্ব মূল্যায়ন :

  • ফ্রান্সের ইতিহাসে রাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের জন্য রিশল্যুু অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি একজন কার্ডিনাল হলেও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে নিরপেক্ষ রেখেছিলেন। রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্র তার নিকট ধর্মের উপরে স্থান পেয়েছিল। তিনি ক্যাথলিক হয়েও ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যোগ দিয়ে ফ্রান্সের স্বার্থ উদ্ধার করেছিলেন। আবার স্বদেশে প্রোটেস্ট্যান্ট (হিউগেনোদের) কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। এজন্যই বলা হয় তাকে “Richelieu was a Catholic at home and a protestant abroad.”
  • রিশল্যুু ফ্রান্সে হিউগেনো, অভিজাত শ্রেণীকে দমন এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাহীন করে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছিলেন। জনমতকে রাজতন্ত্রের পক্ষে আনার জন্য এবং তার নীতির যথার্থতা প্রমাণের জন্য প্রচারণা শক্তিকে (পত্র-পত্রিকা) কাজে লাগিয়েছিলেন। বিদ্রোহী প্রজাদের শাস্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের প্রশাসনকে রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। গির্জাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এনে রাজশক্তিকে সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন। তার পূর্ববর্তী একাদশ লুই (১৪৬১-১৪৮৩), প্রথম ফ্রান্সিস (১৫১৫-১৫৪৭) এবং চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০) ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন রিশল্যুু তা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
  • রিশল্যুু ফ্রান্সে নিয়মিত সৈন্যবাহিনী (Standing Army) এবং ফরাসি নৌবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তার সময়েই ফ্রান্স যুদ্ধ এবং বাণিজ্যের প্রয়োজনে রণতরী ও বাণিজ্য তরী নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর চেষ্টায় টুলো, লাহাভার, ব্রেস্ট প্রভৃতি নৌবন্দরসমূহের উন্নতি হয়। তিনি ‘ফরাসি সাহিত্য পরিষদ’ (Academy of France) প্রতিষ্ঠা করে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সাধন করেন।
  • পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ফ্রান্সের প্রধান শত্রু অস্ট্রিয়া ও স্পেনের হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে কূটনৈতিক কৌশলে এবং ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে পরাজিত করে শক্তিহীন করে। স্পেন ও অস্ট্রিয়াকে দুর্বল করে ফরাসি সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলসমূহ সুরক্ষিত করে। পিনারেলো (Pinarello) অধিকার করে রিশল্যুু ইতালিতে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধি করেন। তিনি আলসাস লোরেইনের (Alsace Lorraine) উপর আধিপত্য স্থাপন করে রাইন নদীর প্রান্তসীমা পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। অপর দিকে রসিলন (Roussillon) অধিকার করে তিনি পীরেনিজ পর্বতের মধ্য দিয়ে স্পেনকে আক্রমণের সুবিধা লাভ করেন। ফলে ফ্রান্স ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে কর্তৃত্ব লাভ করে।

সমালোচনা : উল্লিখিত কৃতিত্ব সত্ত্বেও রিশল্যুুর নীতি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তিনি রাজতন্ত্র ও রাজশক্তিকে গুরুত্ব দিলেও জনগণকে গুরুত্ব দেননি। তিনি মনে করতেন জনগণ সমৃদ্ধশালী হলে তাদেরকে কাজের পরিসীমার মধ্যে রাখা অসম্ভব হয়। তারা গাধার সাথে তুলনীয়, যারা পরিশ্রম থেকে অবসরে বেশি খারাপ হয়। কিন্তু এটা গাধার পরিশ্রম, যা দেশের সম্পদ সৃষ্টি করে, যার দ্বারা সেনা সদস্যদের চেতন প্রদান করা হয় এবং যার উপর ফরাসি রাজতন্ত্রের ক্ষমতা নির্ভর করে। তার নিকট জনগণ ছিল উপেক্ষার পাত্র। তিনি জনগণের উপর অধিক কর ধার্য করেছিলেন। কৃষির উন্নতির জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতির আস্ত সম্পৰ্ক উপলব্ধি করেন নি।

রিশল্যুুর এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ফ্রান্সের ইতিহাসে তার অবদান অবিস্মরণীয়। ফ্রান্সের জনচিত্তে জাতীয় ঐক্যবোধ জাগরণে ও ফরাসি জাতির শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার দান অস্বীকার করা যায় না। ফরাসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে তার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য ছিল। এজন্য ঐতিহাসিক Perkins মন্তব্য করেছেন, “Richelieu loved France, but did little for the French people. It is doubtful whether the French people were any happier at the end of Richelieu’s administration than at its beginning, but beyond question, France was a more powerful state.” এ থেকে বলা যায়, রিশল্যুুর গৃহীত নীতি ও কর্মকাণ্ড ব্যতীত চতুর্দশ লুইয়ের সময় ফ্রান্স শক্তিশালী হতে পারত না।

কার্ডিনাল ম্যাজারিন (১৬৪২-১৬৬১)

ফ্রান্সের রাজনীতিতে ম্যাজারিনের প্রবেশ ও অভিজাতদের সাথে বিরোধ

ইউরোপের ইতিহাসে ফ্রান্সের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে কার্ডিনাল ম্যাজারিন (Cardinal Mazarin) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতিগত দিক থেকে ম্যাজারিন একজন ইতালীয় নাগরিক ছিলেন। ১৬১৮ সালে রোমে পোপের এক কার্যোপলক্ষে ম্যাজারিন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিশল্যুর সাথে পরিচিত হন। ম্যাজারিনের কর্মদক্ষতায় আকৃষ্ট হয়ে মন্ত্রী রিশল্যুু তাঁকে ফরাসিরাজ প্রযোদশ লুইয়ের অধীনে ফরাসি প্রশাসনে যোগদানের আহ্বান জানালে ম্যাজারিন ১৬৩৯ সালে ফ্রান্সের সরকারি প্রশাসনে যোগদান করেন। ১৬৪১ সালে ম্যাজারিন কার্ডিনাল পদে উন্নীত হন। ১৬৪২ সালে মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় রিশল্যুু ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে তার উত্তরাধিকার হিসেবে ত্রয়োদশ লুই-এর নিকট সুপারিশ করেন। ত্রয়োদশ লুই মন্ত্রী রিশল্যুুার মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় ত্রয়োদশ লুইয়ের পুত্র চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) ৪ বছর ৬ মাস বয়সে ফ্রান্সের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। রাজমাতা অ্যান অব অস্ট্রিয়া সে সময় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। চাতুর্য ও শালীন আচরণের দ্বারা ম্যাজারিন রাণীর উপর অসামান্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজমাতা ম্যাজারিনকে পছন্দ করেন এবং রিশল্যুু কর্তৃক সুপারিশকৃত ম্যাজারিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ম্যাজারিনের নীতি ও লক্ষ্য : রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও পরিচালনায় ম্যাজাবিন তার পূর্বসূরি রিশল্যুুর অনুকরণ করেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে রিশল্যুুর লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ পরিবারের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে ফ্রান্সের সীমারেখা প্রাকৃতিক সীমারেখায় পৌঁছান এবং পিরেনিজ, আল্প্স, রাইন ও শেল্ট পর্যন্ত রাজ্যসীমা বিস্তার করেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ম্যাজারিন রিশল্যুর মতো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নি।

ম্যাজারিনের সাথে অভিজাতদের বিরোধ : ম্যাজারিন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অভিজাতদের সাথে বিরোধ দেখা দেয়। রাজমাতা অ্যানের সাথে ত্রয়োদশ লুই ও রিশল্যুর বিরোধ হত। ত্রয়োদশ লুই তার মৃত্যুর পর নাবালক রাজার সহায়তা করার জন্য একটি রিজেন্সি কাউন্সিল নিয়োগ করেছিলেন এবং এই রিজেন্সি কাউন্সিলকে ডিঙিয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব ছিল না। রাণী অ্যান ম্যাজারিনের পরামর্শে রিজেন্সি কাউন্সিলকে বরখাস্ত এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসহ রাজমাতা অ্যানকে রিজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। এ অবস্থায় অভিজাতরা তাদের পূর্বে রিশল্যুর হাতে হারানো ক্ষমতা ফিরে আনার জন্য সচেষ্ট হয়। স্বার্থান্বেষী অভিজাত শ্রেণী রিশল্যুুর বিরুদ্ধাচারণ করতে সাহস করত না। কিন্তু তারা ম্যাজারিনকে বিদেশী নাগরিক হিসেবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং তার নামে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অপপ্রচার শুরু করে। ১৬৪৩ সালে চতুর্থ হেনরির একজন নাতি বিউফোর্টের ডিউকের নেতৃত্বে এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ম্যাজারিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। সে সময় ফ্রান্স ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় যুদ্ধব্যয় রাজকোষে অর্থ সংকট তৈরি করে। এ অবস্থায় ম্যাজারিন কতগুলো নতুন কর ধার্য করে অর্থসংকট মেটানোর চেষ্টা করেন। কর আদায়কারীদের দুর্নীতির কারণে কর প্রদানকারীদের ক্ষুব্ধ করে। ম্যাজারিন নগরে আনীত পণ্যের ওপর অক্টরয় (নগর শুল্ক) ধার্য করলে প্যারিস নগরীর অদিবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়। প্যারিস নগরীর উপকণ্ঠে গৃহ তৈরি নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু এ আইন বহুদিন থেকে কার্যকর ছিল না। ম্যাজারিন এটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং আইন অমান্যের জন্য অনেককে জরিমানা করা হয়। গৃহকর বৃদ্ধির জন্য শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ম্যাজারিনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।

ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট অব প্যারিস ও প্রথম ফ্রন্ডি আন্দোলন  

ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট অব প্যারিস যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা ইতিহাসে প্রথম ফ্রন্ডি আন্দোলন নামে পরিচিত। প্যারিসের রাস্তায় দুষ্ট ও অভদ্র গুণ্ডা ছেলেরা লোকের গায়ে চামড়ার ফালির সাহায্যে কাদামাটি বা ঢিল ছুড়ে মারত। এ যন্ত্রটির নাম ছিল ফ্রন্ড। যারা এ ফ্রন্ড ব্যবহার করত তাদেরকে ফ্রন্ডি বলা হত। তবে পার্লামেন্ট অব পারিস ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেন তাতে অভিজাত শ্রেণী এবং সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলনে বহু পেশাদার গুণ্ডা প্রকৃতির মানুষ অংশগ্রহণ করায় তা ‘ফ্রন্ডি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ম্যাজারিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের শক্তিবৃদ্ধি প্রথম ফ্রন্ডি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল।

পার্লামেন্ট অব প্যারিস ফ্রান্সের কোনো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সভা ছিল না, এটি ছিল বিচারপতি ও আইনজীবীদের একটি সম্মিলিত সভা। এ প্রতিষ্ঠানটি রাজকীয় ঘোষণা, আইন-কানুন আদেশ ইত্যাদি জারি হওয়া মাত্র লিখে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। ক্রমে এ সভা রাজার আদেশ বা কোনো নতুন আইন পূর্বেকার আইনের পরিপন্থী হলে তা লিখে রাখতে অস্বীকার করতে পারত। এ সামান্য শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের ছিল না। কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর ইন্ধনে পার্লামেন্ট অব প্যারিস ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৬৪৮ সালে প্যারিস নগরীতে বিক্ৰয়ার্থ সকল জিনিসের উপর অক্টরয় (নগর-শুল্ক) ধার্য করে রাজকীয় অধ্যাদেশ জারি করলে পার্লামেন্ট অব প্যারিস তা নিবন্ধনভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এ অবস্থায় রাজসভা (রিজেন্সি) বালক রাজাকে পার্লামেন্টে এনে একটি পুরাতন প্রথা অনুসরণ করে এডিক্ট নিবন্ধনযুক্ত করা হয়। কিন্তু একটি শাসনতান্ত্রিক সংকট সমাধান করতে নয় বছরের অনভিজ্ঞ রাজার হস্তক্ষেপকে বিজ্ঞ আইনজ্ঞরা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং ১৬৪৮ সালে ১৬ জানুযারি পার্লামেন্ট অব প্যারিস এ নিবন্ধনকরণকে বেআইনী ও অকার্যকর বলে ঘোষণা করে। এ অবস্থায় রাজসভা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের সাথে একটি সমঝোতায় আসে। রাষ্ট্রের সরকার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পার্লামেন্ট তিন কক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। ১৬৪৮ সালের ২৯ জুন চেম্বার ডি সেইন্ট লুই (Chamber de S Louis) নামে প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি একটি সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কতকগুলো বিষয়ে দাবি পেশ করে। যথা- (১) ইনটেনডেন্টদেরকে প্রত্যাহার করতে হবে, (২) টেইলি (Taille) এক চতুর্থাংশ হ্রাস করতে হবে, (৩) সরকারি নির্দেশে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থিত করতে হবে, (৪) কর ব্যবস্থার উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

ম্যাজারিন সাময়িকভাবে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের দাবি মেনে নেন, তবে মনে মনে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ অবসানের পর ফরাসি সৈন্যের দেশে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে ফরাসি সেনাপতি কন্ডি লিনসে (Lens) যে সামরিক বিজয় লাভ করেন সে সংবাদ ম্যাজারিনের নিকট পৌঁছে। এ বিজয়ের জন্য নটরডামে এক বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানে রাজসভার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দলের নেতা ব্রাউসেলকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। এ সংবাদ প্রচারিত হলে প্যারিসে চরম বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং রাজপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ব্রাউসেলের মুক্তি দাবি করে। রাজসভা এ অবস্থায় পার্লামেন্টের সাথে আপোষ করে ব্রাউসেলকে মুক্তি দেয়। ম্যাজারিন অধিকতর কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর ফরাসি সৈন্যবাহিনীর অপেক্ষায় থাকেন।

ম্যাজারিন প্যারিস নগরীর গোলযোগ অবস্থা লক্ষ্য করে নিরাপত্তার জন্য রাজসভা রুয়েলে স্থানান্তর করেন। এ কারণে প্যারিসের জনতা হট্টগোল শুরু করে। প্যারিসের বিশপ গন্ডি ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে জনগণকে প্ররোচনা নেয় এবং বিজয়ী ফরাসি সেনাপতি কন্ডিকে পার্লামেন্টের পক্ষে নিয়ে আসেন। এ অবস্থায় ম্যাজারিন রাজসতা পুনরায় প্যারিসে ফিরিয়ে আনেন এবং চেম্বার ডি সেইন্ট লুইয়ের সকল দাবি গ্রহণ ও কার্যকর করে ১৬৪৮ সালে ২৪ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি করান। এভাবে রাজসভার সাথে পার্লামেন্টের দ্বন্দ্ব সাংবিধানিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। পার্লামেন্টে ও প্যারিসের সমর্থক প্যারিস জনতা এবং পার্লামেন্ট অব প্যারিস ম্যাজারিনের দুর্নাম ও অজনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে রাজস্ব ও ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে ফ্রান্সে রাজক্ষমতাকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা করেন।

ফ্রান্সে রাজার ক্ষমতা ছিল চূড়ান্ত ক্ষমতা। রাজা স্থানীয় স্বাধীন গভর্নর দ্বারা নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। কিন্তু যখন রাজার ক্ষমতা মন্ত্রীর কর্তৃত্বে আমলাদের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হত তখন রাজার ক্ষমতার বিষয়টি নগণ্য হয়ে যেত। ফ্রান্সে সামন্ত অভিজাত বা পেশাগত শ্রেণীর শাসনকে চরম স্বৈরাচারী মনে করা হত না। কিন্তু মন্ত্রী ম্যাজারিনের সাথে পার্লামেন্টের দ্বন্দ্ব মূলত স্থানীয় কর্তৃত্বের সাথে কেন্দ্রীয় শাসনের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। রিশল্যুর সময় অভিজাতদের শাসন ও পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু ম্যাজারিনের সময় আবার অভিজাতরা কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় হয়। কিন্তু পার্লামেন্ট অব প্যারিস জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা ছিল না এবং এদের ঐতিহ্যগত কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। পার্লামেন্ট জনগণের স্বার্থের জন্য রাজসভার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় নি। ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণী পার্লামেন্ট অব প্যারিসকে সমর্থন করত না। মূলত প্যারিস নগরীর জনতা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের সমর্থক ছিল।

রাজসভার দুর্বলতা অনুধাবন করে অভিজাতরা পার্লামেন্ট ও সেনাপতি কন্ডির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য রাজধানী প্যারিসে আসেন। প্রিন্স ডি কন্টি, ডুক ডি বাউলন, ছক ডি বিওফোর্ট এবং ডুক ডি লংগুয়েভাইল ও তার স্ত্রী তাড়াতাড়ি প্যারিসে হাজির হন। লংগুয়েভাইলের ডাচি কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে দেশপ্রেমিক টুরেনি রাজসভার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ম্যাজারিন কন্ডিকে রাজসভার পক্ষে আনতে সক্ষম হন। ১৬৪১ সালের ৬ জানুয়ারি রাজসভা গোপনে সেইন্ট জারমেনে পলায়ন করেন। প্যারিসের বিদ্রোহ দমনের জন্য রাজধানীতে আনীত সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে কন্ডিকে নিয়োগ করা হয়। এ অবস্থায় দু প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে পরিণত হয় নি। পার্লামেন্টের এক কক্ষের প্রেসিডেন্ট মর্লের এবং একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পার্লামেন্ট ও রাজসভা ১৯৪৯ সালের ১ এপ্রিল রুয়েলে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর প্রায় এক বছরকাল শান্তিবজায় থাকলে পরস্পরের ঈর্ষা, কুৎসা, ষড়যন্ত্র ও আন্দোলন চলতে থাকে। কন্ডির গৌরব ও জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ১৬৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি ম্যাজারিন কন্ডি, কন্টি ও লংগুয়েভাইলকে বন্দি করেন। এ গুরুত্বপূর্ণ রাজপুরুষদের বন্দি সাধারণ মানুষের মধ্যে ম্যাজারিন সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকে যে, যতদিন ম্যাজারিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন ততদিন ফ্রান্সে শান্তি আসবে না।

নরমান্ডি, গিনি ও বারগান্ডি প্রদেশসমূহ রাজসভার বিরোধী হয়ে ওঠে এবং ফ্রন্ডিয়াররা বন্দি অভিজাতদের মুক্তি ও মন্ত্রী ম্যাজারিনের নির্বাসন দাবি করে। নরমান্ডি এবং বারগান্ডির বিদ্রোহ রাজকীয় বাহিনী অতি সহজে দমন করে। গিনির বিদ্রোহ দমন করা হয় কিন্তু বিদ্রোহের আগুন ক্রমে বিস্তার হতে থাকে। প্যারিস নগরী রাজসভার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অর্লিন্স এর ডিউক আন্দোলনে যোগদান করেন। টুরেনি একটি স্পেনীয় সেনাবাহিনী নিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করে, কিন্তু ১৬৫০ সালের ১৭ ডিসেম্বরে রয়েলে ডুপ্লেসিস (Duplessis) কর্তৃক পরাজিত হন। ম্যাজারিন এ সময় আবার আন্দোলনকারীদের সাথে আপোষ করে ১৬৫১ সালে জানুয়ারিতে গ্রেফতারকৃত অভিজাতদের মুক্তি দিয়ে গোপনে দেশত্যাগ করে কলন ইলেক্টরের ব্রহলে অবস্থান নেন এবং সেখান থেকে রাজমাতা ও মন্ত্রী লিওনি (Lionne) লেটেরিয়ার ও সারভিয়েনের সাথে যোগাযোগ রেখে দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকেন। ম্যাজাবিনের দেশত্যাগের সংবাদে ফ্রন্ডিয়াররা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে নির্বাসনের ডিক্রি জারি করে এবং তার বই-পুস্তক ও শিল্পকর্ম বিক্রি করে দেয়। প্যারিস রাজসভাকে বন্দির মতো ব্যবহার করে। ১৬৫১ সালে ফেব্রুয়ারিতে মুক্তিপ্রাপ্ত অভিজাতদের অভ্যর্থনা দেয়া হয় এবং তাদের বিজয়ী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেনাপতি কন্ডির ক্ষমতা লালসা ও উৎপীড়ন অল্পকালের মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং তিনি ফ্রন্ডি নেতাদের নিকট অসহনীয় হয়ে ওঠেন। রাজমাতা এসময় কৌশলে কন্ডিকে ফ্রন্ডিয়ারদের নিকট থেকে পৃথক করে ফেলেন। এ সময় যুবক রাজা চতুর্দশ লুইকে বয়োপ্রাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ সময় অভিজাতরা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের অর্জিত রাজনৈতিক সাফল্যকে কুক্ষিগত করার জন্য নিজেরা আন্দোলনের দায়িত্ব হাতে নেয়। ফলে পার্লামেন্ট পশ্চাদভূমিতে প্রত্যাগমন করে। আন্দোলন অভিজাতদের হাতে চলে যায়। ফলে এ পর্যায়ে আন্দোলন অভিজাত ও রাজার মধ্যে দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। এ পর্যায়ে আন্দোলনকে দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলন বলা হয়।

দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলন

অভিজাতদের সাথে রাজসভার দ্বন্দ্বে সেনাপতি কন্ডি নিমোর্স (Nemours), লি রোচিফউকন্ড (Le Rochefoucauld), লা ট্রেমোইলি (La Tremouille) ও অন্যান্য অভিজাত পরিবারের সমর্থন লাভ করেন এবং এদের সমর্থনে দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলন ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য রাজমাতা অ্যান ও রাজা তিনটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। টুরেনি রাজ আনুগত্যে ফিরিয়ে আসে। প্যারিস জনতা ম্যাজারিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর হলেও রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি ছিল না। ফলে কন্ডি সেনাবাহিনী ও জনগণের সমর্থন হারাতে থাকে। ম্যাজারিন নির্বাসন থেকে ফ্রান্সের সীমান্ত অতিক্রম করে ১৬৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পয়েটিয়াসে (Pontiers) রাজসভায় যোগদান করেন। আট মাস যাবৎ গৃহযুদ্ধ চলে এবং ফ্রান্স পরস্পর বিরোধী সেনাবাহিনীর কৃপায় পতিত হয়। এ গৃহযুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করে ফ্রান্সের চিরশত্রু স্পেন উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের কিছু এলাকা দখল করে। এ অবস্থায় রাজসভা বিরোধী দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলনে সামরিক নেতা কন্ডি জনগণের সমর্থন হারায়। ১৬৫২ সালে জুলাই মাসে ফিউবার্গ সেন্ট এন্টয়িনিতে রাজসভার পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সামরিক নেতা টুরেনি কন্ডিকে পরাজিত করে। কন্ডি ও তার সৈন্যবাহিনী যখন চূড়ান্ত ধ্বংসের সম্মুখীন অবস্থায় তখন অরলিঁওর (Orleans) গ্যাসটিনের কন্যা ম্যাডমোজেল প্যারিস নগরীর জনগণকে পরাজিত সৈন্যদের নগর প্রাকারের ভেতর প্রবেশের জন্য সুযোগ দিতে প্ররোচিত করে। কিন্তু কন্ডির জন্য প্যারিসের কোনো ভালবাসা ছিল না। তারা ফ্রন্ডিদের সমর্থন করত শুধু ম্যাজারিনের প্রতি ঘৃণার কারণে। ম্যাজারিন প্যারিস জনগণের মনোভাব বুঝতে পারেন যে, তিনি শান্তির জন্য একমাত্র প্রতিবন্ধক, তাই ১৬৫২ সালে আগস্ট মাসে স্বেচ্ছায় প্যারিস ত্যাগ করে তিনি সেডানে যান যাতে প্যারিসের জনগণ রাজার আনুগত্যে ফিরে আসে। এ সম্পর্কে একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়। জনগণ উৎসাহভরে তা গ্রহণ করে। প্যারিসের জনগণ কন্ডির পক্ষ ত্যাগ করায় কন্ডি ফ্রান্সের শত্রু স্পেনের সাথে হাত মেলান এবং আট বছরের অধিক স্পেনীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

প্রার্লামেন্টের কর স্থাপনের অধিকার ইত্যাদি কোনো কিছুই তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে নি। ফলে, আন্দোলনটি অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। অল্পকালের মধ্যেই রাজসভা যুদ্ধ প্রত্যাগত সৈনিকদের সাহায্যে দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলন দমন করা হয়। ১৬৫০ সালে দ্বিতীয় ফ্রন্ডি আন্দোলন দমন হলে ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণী রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য হয়।

রাজা চতুর্দশ লুই একটি সৈন্যবাহিনীসহ ১৬৫২ সালের ২ অক্টোবর প্যারিসে প্রবেশ করলে ফ্রন্ডি আন্দোলনের অবসান ঘটে। সে সময় থেকে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত ফ্রান্স রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শাসনতন্ত্র এবং সুবিধা স্থানীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং আইনগত অধিকার সবই রাজতন্ত্রের নিকট অসহায় হয়ে পড়ে। ফ্রন্ডি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় এবং অনেককে বিভিন্ন অজুহাতে ফাঁসি দেয়া হয়। রাষ্ট্রের যে কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা হয়। এক শতাব্দী ধরে এটি কেবল রাজকীয় অধ্যাদেশ নিবন্ধনভুক্ত করার অধিকার ভোগ করে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং স্থানীয় প্রভাব থেকে বঞ্চিত হয়ে অভিজাতরা অর্ধ-স্বাধীন সামন্ত (Half-independent feudatories) হিসেবে রাজতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত হয়। যখন রাজসভার বিজয় নিশ্চিত হয় তখন ম্যাজারিন নির্বাসন থেকে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ম্যাজারিনের পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ম্যাজারিনের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে তিনি রিশল্যুুর অনুসৃত পন্থা অনুসরণ করেছিলেন। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ম্যাজারিন ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে দূরদর্শী নীতি অনুসরণ করে দক্ষতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ফ্রন্ডি আন্দোলনের সময় স্পেন, ফ্রান্স আক্রমণ করে কিছু অঞ্চল দখল করলেও পরিশেষে ফ্রান্সের নিকট পরাজিত হয়েছিল। ম্যাজারিনের কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। ১৬৫৮ সালে লীগ অব রাইন (League of Rhine) গঠন করে পবিত্র রোমান সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং ইংল্যান্ডের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রতিষ্ঠা করে স্পেনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্পেনকে ফ্রান্সের নিকট নত করতে বাধ্য করেন।

১৬৪৮ সালে ফ্রান্স ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে সর্বত্র জয়লাভ করলে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স রাজ্যসীমা বৃদ্ধির জন্য টুলো, মেস, ভার্দুন প্রভৃতি স্থান দখল করে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর ম্যাজারিন স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। পরিশেষে স্পেন ফ্রান্সের সাথে পিরেনিজের সন্ধি করতে বাধ্য হয়। এ সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স স্পেনের অধিকার থেকে সার্ডেন এবং রুসিলন দখল করে পিরেনিজ পর্বতকে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত প্রাচীররূপে পরিণত করে।

পার্লামেন্ট অব প্যারিসের বিফলতার কারণ

পার্লামেন্ট অব প্যারিস শাসনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ১৬৪৮ সালে অনেকটা সফল হয়েছিল। কিন্তু দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে তাদের সফলতা বিফলে গিয়েছিল। পার্লামেন্টে অব প্যারিস কোনো গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ছিল না। আইন প্রণয়নের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা এর ছিল না। এর পিছনে জনসমর্থনের অভাবে এবং ঐতিহ্যগত অধিকার চেতনার অভাব এর বিফলতার কারণ ছিল। পার্লামেন্টের চূড়ান্ত সাফল্যের পর্যায়ে অভিজাত শ্রেণী পার্লামেন্টের আন্দোলনে প্রবেশ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের সচেষ্ট হয়। এ শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির স্বপ্ন এবং উশৃঙ্খল লোকদের কর্মকাও বুর্জোয়া শ্রেণীকে ভীত সন্ত্রস্ত করে। লংগুভাইলের ডিউকের পত্নীর নেতৃত্বে উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীলোকদের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে।

পার্লামেন্ট অব প্যারিসের পক্ষে যেসকল লোক সমর্থন দিয়েছিল তাদের লক্ষ্য ছিল বিদেশী মন্ত্রী ম্যাজারিনকে পদচ্যুত করা। রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক আদর্শ জনগণের উন্নতি এর মধ্যে সক্রিয় ছিল না। বিদেশী নাগরিক ম্যাজারিনের প্রতি বিদ্বেষ সকলকে সম্মিলিত করেছিল। এর পিছনে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। অভিজাত সম্প্রদায় শাসনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের পক্ষপাতি ছিল না। নাবালক রাজার দুর্বল শাসনের সুযোগে তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সক্রিয় হয়েছিল। ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ হতে প্রত্যাগত সৈন্যরা অতিসহজেই অভিজাতদের আন্দোলন নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে ফ্রান্স জয় লাভ করলে ম্যাজারিন পার্লামেন্টের আন্দোলনকারীদের নেতা ব্রাইসেলকে বন্দি করেন। ফলে প্যারিসের মধ্যবিত্ত শ্রেণী গুণ্ডা ও উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীলোকেরা ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে। স্বার্থান্বেষী অভিজাত শ্রেণী এ সুযোগে নিজেদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য পার্লামেন্টের পক্ষ গ্রহণ করে। এ আন্দোলন ইউরোপের ইতিহাসে ‘ফ্রন্ডি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ম্যাজারিন এ দুর্যোগ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৬৪৮ সালে অক্টোবর মাসে পার্লামেন্টের চারটি দাবি মেনে নেন। পার্লামেন্ট কর স্থাপন করার অধিকার লাভ করে এবং ফরাসি নাগরিকরা অন্যায়মূলক গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি লাভের আইনগত অধিকার পায়।

ম্যাজারিনের সময় পার্লামেন্ট অব প্যারিস যে আন্দোলন শুরু করেছিল তার পিছনে মধ্যবিত্ত অভিজাত সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় পার্লামেন্ট অধিকার আদায়ে অনেকটা সফল হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ের মুহূর্তেই অর্জিত সাফল্য অভিজাত শ্ৰেণী ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা তাদের কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। রাজক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা পার্লামেন্টকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করেছিল।

পার্লামেন্ট অব প্যারিস ও ফরাসি রাজতন্ত্র

ফ্রান্সে যেসকল রাজনৈতিক সংগঠন বা সভা রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট ছিল এর মধ্যে পার্লামেন্ট অব প্যারিস ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে পার্লামেন্ট অব প্যারিস ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ন্যায় শক্তিশালী ছিল না এবং এটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সভা ছিল না। ম্যাজারিন যখন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন নাবালক রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময় পার্লামেন্ট অব প্যারিস রাজক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল।

স্টেটস জেনারেল ও পার্লামেন্ট অব প্যারিস : ফ্রান্সের জাতীয় প্রতিনিধি সভাকে স্টেটস জেনারেল (State General) বলা হত। এ সভার তিনটি কক্ষ ছিল। সে যুগে ফ্রান্সের সমাজ তিন শ্রেণীর বিভক্ত ছিল। যথা— প্রথম শ্রেণী (যাজক সম্প্রদায়), দ্বিতীয় শ্রেণী (অভিজাত সম্প্রদায়) এবং তৃতীয় শ্রেণী (সাধারণ মানুষ)। স্টেটস জেনারেলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মোট প্রতিনিধি সংখ্যা থেকে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি ছিল। তবে এ তিন শ্রেণীর প্রত্যেকটির সমষ্টিগতভাবে একটি করে ভোট ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী তাদের শ্রেণী স্বার্থেই একপক্ষে থাকত। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় কক্ষের দুটি ভোট এবং অপরপক্ষে তৃতীয় কক্ষের মাত্র একটি ভোট থাকত। ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষের অভিজাত (লর্ড সভা) এবং নিম্নকক্ষের (কমন সভা) সদস্যগণ একপক্ষে ভোট দিলেও ফ্রান্সে সেরকম হত না। এ কারণে ফ্রান্সের স্টেটস জেনারেল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের মতো শক্তিশালী হতে পারে নি।

পার্লামেন্ট অব প্যারিস : ফ্রান্সের পার্লামেন্ট অব প্যারিস মূলত একটি কেন্দ্রীয় বিচারালয় হিসেবে কাজ করত। তবে এ সভার কতক পরিমাণ শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ছিল। এ সভার পদ রাজা বিক্রি করতেন এবং যারা বিচারপতির পদ ক্রয় করতেন তারা বংশানুক্রমে এ পার্লামেন্টের সদস্য হতেন। তাই এটি জনপ্রতিনিধিত্বমূল কোনো সভা ছিল। না। কালক্রমে পার্লামেন্ট অব প্যারিস বিচারপতি এবং আইনজ্ঞদের একটি শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাদেশিক পার্লামেন্ট হতে যেসকল মামলা-মোকদ্দমা আপিলের জন্য এ সভাতে আসত বিচারকরা তার আপিল শুনত। তাদের রায় বিচারের ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি হত। আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর সদস্যরা রাজাজ্ঞা (Edict) এবং নতুন আইন-কানুন লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। ক্রমান্বয়ে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের সদস্যরা কোনো নতুন আইন প্রচলিত আইনের বিরোধী হলে তা লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করতে পারতেন। এভাবে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের সদস্যরা কোনো নতুন আইন প্রচলিত আইনের বিরোধী হলে তা লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করতে পারতেন। এ পদ্ধতিতে পার্লামেন্টের অস্বীকৃতিজনিত ত্রুটি দূর করা হতো। ক্ষমতার মানদণ্ডে বিচার করলে এটিকে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের কোনো ক্ষমতা বলা যায় না। তবে স্টেটস জেনারেলের ক্ষমতাহীনতা এবং ১৬১৪ সাল হতে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন স্থগিত থাকায় একমাত্র পার্লামেন্ট অব প্যারিস গণতন্ত্রের ভরসাস্থল ছিল।

সপ্তদশ শতকের শুরুতে দুটি ঘটনা পার্লামেন্ট অব প্যারিসের ক্ষমতা কতকটা বৃদ্ধি করেছিল। ১৬১০ সালে চতুর্থ হেনরি আকস্মিকভাবে আততায়ীর হাতে খুন হলে ফ্রান্সে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। ঐ সময়ে চতুর্থ হেনরির পত্নী মেরি ডি মেডিচি নাবালক রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের অভিভাবকত্ব লাভের জন্য পার্লামেন্ট অব প্যারিসের অনুমতি নেন। ১৬৪৩ সালে ত্রয়োদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর অনুরূপ আরেকটি ঘটনা ঘটে। ত্রয়োদশ লুই তার অবর্তমানে নাবালক পুত্র চতুর্দশ লুইয়ের জন্য একটি অভিভাবক সত্য (Regency) এক উইল দ্বারা নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। তার বিধবা পত্নী রাণী অ্যান অব অস্ট্রিয়া নিজে অভিভাবকত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টকে ত্রয়োদশ লুইয়ের উইল নাকচ করতে এবং রাণীকে অভিভাবক বলে স্বীকার করতে রাজি করান। এভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে পার্লামেন্ট কোনোরকম চেষ্টা ছাড়াই কতকটা ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। এতে পার্লামেন্ট অব প্যারিসের- ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

মন্ত্রী ম্যাজাবিনের কার্যকালে নাবালক রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময় পার্লামেন্ট অব প্যারিস স্পেনের পার্লামেন্টের এবং ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ফ্রান্সের রাজসভা এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরাচারী শাসন নিয়মতান্ত্রিক করার জন্য ১৬৪৮ সালে আন্দোলন শুরু করেছিল। ঐ বছর ম্যাজারিন প্যারিসে বিক্রয়ার্থ সকল পণ্যের উপর নগর-শুল্ক (Octroy) আরোপ করলে পার্লামেন্ট তা লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করে। মন্ত্রী ম্যাজারিন নাবালক রাজা চতুর্দশ লুইকে নিয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করে পার্লামেন্টের অস্বীকার-জনিত জটিলতা দূর করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পার্লামেন্টের বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারকরা নগর-শুল্ক আরোপ করা বে-আইনি হিসেবে উল্লেখ করে তা নিবন্ধন করতে অস্বীকার করেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল ভেবে ম্যাজারিন পার্লামেন্টের সাথে আপোষ করেন। কিন্তু পার্লামেন্ট এ সুযোগে রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের সচেষ্ট হয়। সেন্ট লুই নামক স্থানে পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে পার্লামেন্ট রাজসভার নিকট চারটি দাবি উত্থাপন করে। যথা –

  • (ক) টেইলি (Taille) নামক কর এক-চতুর্থাংশ কমাতে হবে,
  • (খ) মন্ত্রী রিশল্যুু কর্তৃক নিয়োগকৃত ইনটেনডেন্ট (Intendent) নামক কর্মচারীদেরকে পদচ্যূত করতে হবে,
  • (গ) বিনা বিচারে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখা যাবে না এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে।
  • (ঘ) পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়া কোনোরকম কর আরোপ করা যাবে না। এ সকল শর্ত মেনে নিলে জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক সরকার নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার স্বীকৃত হত।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৩৫-১৬৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.