দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৮-১৫৯৮) এবং নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা

ষোড়শ শতকের ইউরোপের ইতিহাসে দ্বিতীয় ফিলিপ অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকে ইউরোপের ইতিহাসে দ্বিতীয় ফিলিপের যুগ বলা যায়। সম্রাট পঞ্চম চার্লস (১৫১৯-১৫৫৬) স্বেচ্ছায় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পদ এবং অস্ট্রিয়ার অধ্যুষিত সাম্রাজ্যের পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলে তার পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮) স্পেনের সিংহাসন লাভ করেন। ফিলিপ স্পেন, স্পেনের অধ্যুষিত ইতালীয় রাজ্যগুলো, নেদারল্যান্ডসস ও স্পেনীয় আমেরিকার আধিপত্য লাভ করেছিলেন। পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ না পেলেও তিনি তার সময়কালে ইউরোপে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন।

দ্বিতীয় ফিলিপ সিংহাসনে বসেই প্রধান দুইটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী এবং ক্যাথলিক বিরোধী প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মকে সমূলে উৎপাটিত করে ক্যাথলিক ধর্মকে তার সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। যদি কখনো স্পেনের অগ্রাধিকার ও ক্যাথলিক গির্জার স্বার্থের স্বপ্ন দেখা দিত, সে ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে গির্জার স্বার্থে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তার সাম্রাজ্যের সকল শ্রেণী ও প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে সার্বভৌম ও সর্বশক্তিমান রাজতন্ত্র স্থাপনের নীতি বাস্তবায়ন করতেন। তিনি স্পেনকে ইউরোপের শ্রৈষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ফিলিপ যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তা বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে কিছু নীতি ও আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন।

দ্বিতীয় ফিলিপের অভ্যন্তরীণ নীতি

দ্বিতীয় ফিলিপ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন –

  • (১) তিনি রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য স্পেনের পার্লামেন্টকে (cortes) উপেক্ষা করে চলতেন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেনেন্টের কোনো পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না।
  • (২) তিনি স্বেচ্ছাচারী শাসন অব্যাহত রাখার জন্য সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেছিলেন এবং সামরিক বাহিনীর আকার বড় করেছিলেন। তিনি স্পেনে স্থায়ী সেনাবাহিনী নিয়োগ করেন। পূর্বে যুদ্ধের সময় সৈন্য সরবরাহের জন্য সামন্তদের উপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু এ স্থলে বেতনভোগী স্থায়ী সৈন্য রাজশক্তিকে অপ্রতিহত করে তুলেছিল।
  • (৩) তিনি স্পেনের অভিজাত শ্রেণীকে রাজ্য শাসনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দিতেন না এবং তাদেরকে শাসন কর্তৃত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ছিলেন।
  • (৪) প্রজাদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ রাজ্যের ক্ষতি হতে পারে, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে অক্যাথলিকদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছিলেন। তার এই ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য স্পেনীয় সাম্রাজ্যে বসবাসকারী দক্ষ শিল্পী ও শ্রমিকরা দেশত্যাগ করেছিল।
  • (৫) দ্বিতীয় ফিলিপ ইনকুইজিশন বিচারালয়ের মাধ্যমে অক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসী এবং রাজতন্ত্রের বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতেন। তার এই স্বৈরাচারী নিষ্ঠুরতার জন্য স্পেনীয় নাগরিকদের অনেকেরই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার বিনষ্ট হয়েছিল। এর ফলে স্পেনের জাতীয় জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
  • (৬) দ্বিতীয় ফিলিপ তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। তিনি তার প্রথম বিবাহের সন্তান ডন কার্লোসকে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কারাগারে আটক করেছিলেন এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল।
  • (৭) দ্বিতীয় ফিলিপ তার রাজ্যভুক্ত ইতালীয় রাজ্য ন্যাপলস্, মিলান ও সিসিলিতে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। তিনি নেদারল্যান্ডসে স্বৈরাচারী শাসন স্থাপনের জন্য স্পেনীয় গভর্নর নিয়োগ করলে নেদারল্যান্ডসে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ক্রমে এ বিদ্রোহ স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
  • (৮) দ্বিতীয় ফিলিপ স্পেনের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য মার্কেন্টাইল অর্থনীতি অনুসরণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে বিশ্বাস করা হত যে, বিদেশ হতে পণ্য আমদানি করলে মূল্যবান অর্থ বাইরে চলে যায় কিন্তু আমদানি না করে কেবল বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারলে দেশে মূল্যবান সোনা রুপার সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। এতে দেশ সমৃদ্ধশালী হয়। স্পেন সে সময় আমেরিকাস্থ উপনিবেশ থেকে প্রচুর সোনা-রুপার জোগান পেত। কাজেই সোনা-রুপার জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানি স্পেনের জন্য প্রয়োজন ছিল না। আমেরিকার উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত সোনা ও অর্থ বিনিয়োগ করে স্পেনে নানা শিল্প গড়ে ওঠে। সেই সাথে স্পেন আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু স্পেনীয় নাগরিকরা আলস্য ও আরামপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতে দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব দেখা দেয়। স্পেনীয়দের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। দ্বিতীয় ফিলিপ পণ্যের মূল্যস্তর আয়ত্বে রাখার জন্য বিদেশে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দেন। এই অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের কারণে কৃষিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। স্পেনের বৈদেশিক বাণিজ্য বিদেশীদের হাতে চলে যায়। বাণিজ্যের এই অচল অবস্থার জন্য দ্বিতীয় ফিলিপ কৃষকদের উপর অতিরিক্ত রাজস্ব কর আরোপ করেন। ফলে কৃষক শ্রেণী আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফিলিপের উৎপীড়নমূলক শাসননীতির জন্য মুর ও ইহুদিরা স্পেন ত্যাগ করে। ফলে স্পেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দ্বিতীয় ফিলিপ স্পেনকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করার জন্য এবং বিভিন্ন খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসীদেরকে ক্যাথলিক মতে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু এই ধর্মীয় আদর্শের জন্য রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করেছিলেন। বিশেষ করে তার এই নীতির জন্য অক্যাথলিক নাগরিকরা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল, যা জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল। দ্বিতীয় ফিলিপের অভ্যন্তর নীতি ছিল তার স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসনের নামান্তর। তার শাসনকালে আমলাতন্ত্র দুর্নীতিংন্ত ছিল এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঈর্ষা ও ষড়যন্ত্র-প্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্পেনীয় নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। তার সময়ে ধর্মীয় নিপীড়ন সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল। তার এ অসহিষ্ণু নীতির জন্য স্পেনের জাতীয় সংহতি বিপন্ন হয়েছিল। বিশেষ করে স্পেনীয়দের জাতীয় চরিত্রের সকল ত্রুটি যেমন পরধর্ম বিদ্বেষ, একদেশদর্শিতা, আদর্শ ও অহংকার চরমে পৌঁছেছিল। তিনি যখন রাজত্ব শুরু করেছিলেন তখন স্পেন ছিল ইউরোপের গৌরবান্বিত দেশ কিন্তু তার রাজত্বের শেষে স্পেন পতনোন্মুখ ছিল।

দ্বিতীয় ফিলিপের পররাষ্ট্রনীতি

ইউরোপের ক্যাথলিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকরূপে ইউরোপের স্পেনের প্রাধান্য স্থাপন করা দ্বিতীয় ফিলিপের লক্ষ্য ছিল। তিনি পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে কতকগুলো লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। তার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল পর্তুগালকে স্পেনীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা; এ ছাড়া একটি বিশাল উপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন করা। তার এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন জটিল ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন কাজে হাত দিয়েছিলেন। তার রাজত্বে নেদারল্যান্ডসসে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ইংল্যান্ডফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রসার ঘটলে তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ক্যাথলিক পক্ষকে সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করেন। এ ছাড়া তুর্কি আগ্রাসন থেকে ইউরোপকে রক্ষা তার পররাষ্ট্র নীতির প্রধান লক্ষ্য হয়েছিল।

ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ : দ্বিতীয় ফিলিপ উত্তরাধিকার সূত্রে ফ্রান্সের শত্রুতা মোকাবেলা করেন। ফরাসি রাজ দ্বিতীয় হেনরি (১৫৪৭-১৫৫৯) ফ্রান্সের পূর্বেকার নীতি অনুসরণ করে ইতালি ও নেদারল্যান্ডসস থেকে স্পেনের প্রাধান্য খর্ব করার পদক্ষেপ নেন। এতে দ্বিতীয় ফিলিপের সাথে দ্বিতীয় হেনরির যুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিতীয় ফিলিপ ক্রমাগত তিন বছর যুদ্ধ করে ইতালিতে স্পেনের আধিপত্য বলবৎ রাখেন। ১৫৫৯ সালে ফ্রান্স ক্যাটুক্যাম্ব্রোসিস সন্ধির দ্বারা ইতালীয় অঞ্চল দ্বিতীয় ফিলিপকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফ্রান্স সিসিলি, মিলান ও ন্যাপলসে স্পেনের আধিপত্য স্বীকার করে। ফ্রান্স ক্যামে বন্দর, মেস, টুল ও ভার্দুন ফিরে পায়। এর ফলে ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু রাজাদের মধ্যে সখ্য স্থাপিত হলেও আসলে উভয় দেশের শত্রুতার অবসান ঘটে নি। ফ্রান্সে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিবাদ আরম্ভ হয়। ফরাসিরাজ তৃতীয় হেনরির মৃত্যুর পর ফ্রান্সের সিংহাসন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী হেনরি অব ন্যাভারের (পরে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০)) নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এই আশঙ্কায় ফ্রান্সের ক্যাথলিকরা একটি সংঘ স্থাপন করে। দ্বিতীয় ফিলিপ ক্যাথলিক সংঘকে গোপনে সমর্থন দেন। হেনরি অব গাইজ দ্বিতীয় ফিলিপের সমর্থন নিয়ে হেনরি অব ন্যাভারের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে হেনরি অব ন্যাভারে (বুরবোঁ) ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিয়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলে ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৫৯৮ সালে ভারবিনস্ এর সন্ধি অনুসারে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। চুক্তি অনুসারে দ্বিতীয় ফিলিপ ফ্রান্স থেকে স্পেনীয় সৈন্য সরিয়ে আনেন।

তুর্কি শক্তি দমন : দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকালে ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান তুর্কিবা দানিয়ুব উপত্যকায় তুর্কি সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। তুর্কি সুলতান সোলায়মান দি ম্যাগ্লিফিসেন্ট হাঙ্গেরি পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করলে স্পেন ও অস্ট্রিয়ার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন হয়েছিল। সোলায়মানের মৃত্যুর পর তার পুত্র সেলিম পিতার নীতি অনুসরণ করে অস্ট্রিয়া আক্রমণ করে। এ সময় দ্বিতীয় ফিলিপ রোমান পোপ ও অস্ট্রিয়ার সামরিক বাহিনী একযোগে তুর্কিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তুর্কি আগ্রাসন প্রতিহত করে স্পেনের বাণিজ্য স্বার্থ ও স্পেনীয় উপকূলের নিরাপত্তা রক্ষা দ্বিতীয় ফিলিপের প্রধান লক্ষ্য ছিল। দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭১ সালে তুর্কি নৌবহরকে লেপান্টোর যুদ্ধে পরাজিত করেন। ফলে তুর্কিদের পশ্চিম ইউরোপে আগ্রাসন প্রতিহত হয়। দ্বিতীয় ফিলিপের বৈমাত্রিয় ভ্রাতা ডন জন অব অস্ট্রিয়া এই যুদ্ধে অসাধারণ সামরিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন।

পর্তুগাল অধিকার : দ্বিতীয় ফিলিপ পর্তুগালকে স্পেনীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। ১৫৪০ সালে পর্তুগালের রাজা মৃত্যুবরণ করলে ফিলিপের মাতা (যিনি ছিলেন পর্তুগাল রাজবংশের দুহিতা) ও স্ত্রীর (পর্তুগাল রাজকন্যা) দাবির সমর্থনে দ্বিতীয় ফিলিপ পর্তুগাল আক্রমণ ও দখল করে। ফিলিপের মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর ১৬৪০ সালে পর্তুগাল স্পেনের দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতা লাভ করেছিল

ইংল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক : পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিতীয় ফিলিপের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ইংল্যান্ডের রানী মেরি ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপের স্ত্রী। ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্ম প্রবর্তনের জন্য তিনি ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু মেরির মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে আবার প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রানী এলিজাবেথ ইংল্যান্ডে অ্যাংলিকান চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকরা দ্বিতীয় ফিলিপের স্মরণাপন্ন হন। দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ডের শাসক এলিজাবেথকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু রানী এলিজাবেথ তা প্রত্যাখান করলে তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু আমার্ডার যুদ্ধে স্পেনীয় নৌবাহিনী ইংল্যান্ডের নিকট পরাজিত হয়। ফলে সমুদ্রে স্পেনের প্রাধান্য চিরতরে নষ্ট হয়।

নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ : নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ ছিল দ্বিতীয় ফিলিপের শাসনকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ

দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল নেদারল্যান্ডসস এর বিদ্রোহ। ষোড়শ শতাব্দীতে সতেরটি প্রদেশ নিয়ে নেদারল্যান্ডস গঠিত ছিল। নেদারল্যান্ডসে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লোক বাস করত। দেশের অধিকাংশ অঞ্চল ছিল জার্মান ভাষাভাষী অধ্যুষিত, ওয়ালন প্রদেশসমূহ ছিল ফরাসি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। কিন্তু সেখানে কোনো এককেন্দ্রিক সরকার গড়ে ওঠে নি। মধ্যযুগে নেদারল্যান্ডসে চারজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন –

  • (i) কাউন্ট অব ফ্ল্যান্ডার্স,
  • (ii) ডিউক অব ব্রাবান্ট,
  • (iii) ডিউক অব গেলডারল্যান্ড,
  • (iv) কাউন্ট অব হল্যান্ড ও জিল্যান্ড।

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও শহরগুলো ডিউক অব বার্গান্ডি নামে একজন শাসক দ্বারা শাসিত হত। এ পরিবারের ডিউক ফিলিপ দা গুড (১৪১৯-১৪৬৭) একজন দূরদর্শী শাসক ছিলেন। তিনি বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলো নিয়ে একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। তিনি নেদারল্যান্ডসে ছিলেন বহিরাগত। এজন্য স্থানীয় জনগণের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। ১৪৭৭ সালে তার বংশধর ডিউক চার্লস দ্য বোল্ডের (১৪৬৭-১৪৭৭) মৃত্যুর পর নেদারল্যান্ডসের শাসনভার তার মেয়ে মেরির (১৪৭৭-১৪৮২) ও তার স্বামী সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ানের হাতে চলে যায়, আর মেরির মৃত্যু হলে নেদারল্যান্ডস মেরি ও সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের পুত্র ফিলিপ দ্য হ্যান্ডসামের (১৪৮২-১৫০৬) এর হাতে, ও ১৫০৬ সালে তার মৃত্যুর পর তা ফিলিপ ও তার স্প্যানিশ স্ত্রী জোয়ানার পুত্র সম্রাট পঞ্চম চার্লস (১৫১৬-১৫৫৬) নেদারল্যান্ডসের শাসনভার প্রাপ্ত হন।

নেদারল্যান্ডসে বিদ্রোহের কারণ

১৫০৬ সালে ফিলিপের মৃত্যুর পর পঞ্চম চার্লস বার্গান্ডির শাসন লাভ করে। চার্লস তার কর্তৃক নিয়োগকৃত স্ট্যাডহোল্ডার ও পেনশনারীর মাধ্যমে প্রদেশসমূহ শাসন করতেন। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে স্ট্যাডহোল্ডারের অনেক ক্ষমতা ছিল। তিনি প্রধান বিচারপতি ও প্রাদেশিক সভার কনভেনর ছিলেন। চার্লস নিজে ফ্লেমিং হিসেবে লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং ফ্লেমিয় উপদেষ্টার দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। তিনি যদিও কিছু সময় নেদারল্যান্ডসের বাহিরে ছিলেন। তবুও নেদারল্যান্ডসের জনগণ তাকে নিজেদের শাসক মনে করত। কিন্তু তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রদেশগুলোকে কেন্দ্রীভূত শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন নি। তার সময় নগরীর বাসিন্দা গ্রামের অভিজাতগণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও রাজস্ব হ্রাসের কারণে ক্ষুব্ধ ছিল। সাধারণ জনগণ চার্লসের রাজ প্রতিনিধি অস্ট্রিয়ার মার্গারেট ও হাঙ্গেরির মেরির প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। তারা স্থানীয় ব্যবসা- বাণিজ্যে উৎসাহ দিত ও দক্ষ প্রশাসন বহাল রেখে ছিল। চার্লসের রাজত্বকাল পর্যন্ত বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত।

কিন্তু পঞ্চম চার্লসের শাসনকালে বিচ্ছিন্নমুখী মনোভাব থাকলেও তা প্রকট হয় নি। বিশেষ করে আর্থিকভাবে নেদারল্যান্ডস সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। নেদারল্যান্ডসের ব্রুগেস, ঘেন্ট ও ইপরেস অক্ষোকৃত কম সমৃদ্ধ ছিল। পরে এগুলো বস্ত্রশিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। লিয়েগ, নামুর ও হেনন্টের কয়লা ও লৌহখনি নেদারল্যান্ডসের শিল্প বিকাশের অনুকুল ছিল। নেদাল্যান্ডের উত্তরের প্রদেশগুলো কৃষিসমৃদ্ধ ছিল। সমুদ্র তীরবর্তী হল্যান্ড ও জিল্যান্ড মৎস্য শিকার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিল। সেকালে উত্তর নেদারল্যান্ডসের প্রধান নগর আমস্টারডাম খাদ্যশস্যের ব্যবসার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল। ব্র্যান্টেওয়ার্প বিশেষ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। এটি ছিল ব্যাংক ব্যবসার প্রধানকেন্দ্র। এই নগরটি দক্ষ জনগোষ্ঠী, রাজনৈতিকভাবে উদার ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ছিল। ১৫৪০ সালে ঘেন্ট চার্লসের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং নেদারল্যান্ডসে স্পেনীয় নীতির বিরোধিতা প্রকাশ করে। নেদারল্যান্ডস ছিল ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্টদের জন্য বসবাসের উপযোগী স্থান। এখানকার ক্যাথলিক গির্জা দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ায় এনাব্যাপটিজমের উন্মেষ হয় এবং লুথার প্রচারিত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের বিস্তার লাভ করে। পঞ্চম চার্লস নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ দমনের পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু ইনকুইজিশন প্রতিষ্ঠা এবং এর নিষ্ঠুরতা ১৫৫০ সালে এক চরম অশান্তি সৃষ্টি করে। ফরাসি শাসকরা গোপনে নেদারল্যান্ডসের প্রোটেস্ট্যান্টদের গোপন সমর্থন দিতে থাকে। এ সময় পঞ্চম চার্ল ও ফ্রান্সের যুদ্ধের ব্যয় নেদারল্যান্ডসের অধিবাসীদের ক্ষুব্ধ করে যুদ্ধের ব্যয়ের জন্য কর আরোপের কারণে। এই প্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডসে স্পেনীয় বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়।

পঞ্চম চার্লসের অবসর গ্রহণের পর দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮) ১৫৫৬ সালে স্পেনীয় নেদারল্যান্ডসে শাসনপ্রাপ্ত হলে প্রথম দিকে নেদারল্যান্ডসের অভিজাত শ্রেণী ও সাধারণ জনগণ অনুগত ছিল। কিন্তু তার স্বৈরাচারি ও ধর্ম অসহিষ্ণুতার কারণে শীঘ্রই নেদারল্যান্ডসে বিদ্রোহ দেখা দেয়। নিম্নে এ বিদ্রোহের কারণগুলো আলোচনা করা হল –

রাজনৈতিক কারণ : দ্বিতীয় ফিলিপ ছিলেন স্বৈরাচারি শাসক তিনি শাসন ক্ষেত্রে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেন। তিনি নেদারল্যান্ডসে শাসনক্ষেত্রে অভিজাতদের বঞ্চিত করেন। দ্বিতীয় ফিলিপ তার বৈমাত্রীয় ভগ্নী মার্গারেটকে (Margaret of Parma) নেদাল্যান্ডের গভর্নর নিযুক্ত করেন। নেদারল্যান্ডস ১৭টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত একটি কনফেডারেশন রাষ্ট্র ছিল। কাউন্সিল অব স্টেটস নিয়ন্ত্রণ করত অভিজাতরা। শাসনক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্পেনীয়দেরকে। স্পেনীয় গভর্নর মার্গারেটের উপদেষ্টা ছিল স্পেনীয়। এ ছাড়া কার্ডিনাল গ্রানভেলা ছিলেন মার্গারেটের প্রধানমন্ত্রী। গ্রানভেলাকে সাহায্য করার জন্য কনসালটা নামে একটি গোপন সমিতি ছিল। দেশের শাসনকার্যের ব্যাপারে গ্রানভেলা এবং কনসান্টাই ছিল দ্বিতীয় ফিলিপের প্রকৃত প্রতিনিধি। মার্গারেট নেদারল্যান্ডসের কাউন্সিল অব স্টেটস এর পরামর্শ ছাড়াই গ্রানভেলা এবং কনসান্টার পরামর্শে শাসনকার্যের পরিচালনা করতেন। স্থানীয় নেদারল্যান্ডসবাসী স্পেনীয় শাসনে বিরক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডসে স্পেনীয় সৈন্য নিয়োগ করায় নেদারল্যান্ডসবাসী ক্ষুব্ধ হয়। যার প্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডসে দ্বিতীয় ফিলিপের শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। ইনকুইজিশন নামক বিচারালয় নেদারল্যান্ডসে অক্যাথলিক ও রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিপীড়ন শুরু করলে গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। এই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ফিলিপ নেদারল্যান্ডস থেকে স্পেনীয় বাহিনী প্রত্যাহার করে। তা সত্ত্বেও নেদারল্যান্ডসবাসীর মন থেকে দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রশমিত হয় নি।

অর্থনৈতিক কারণ : নেদারল্যান্ডস ষোড়শ শতকে মৎস্য, তাঁত এবং জাহাজ শিল্পে খুবই উন্নত ছিল। নেদারল্যান্ডসের অধিবাসীগণ পরিশ্রমী এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী হওয়ায় নেদারল্যান্ডসের আর্থিক অবস্থা উন্নত ছিল। সমুদ্রের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করে সমুদ্র থেকে প্রচুর জমি তারা উদ্ধার করে। এ ভূমিকে কৃষিভূমিতে পরিণত করে। নেদারল্যান্ডসের বস্ত্র শিল্প খুবই উন্নত ছিল। দ্বিতীয় ফিলিপ ক্ষমতা লাভ করেই বাণিজ্যক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণ করেন তা নেদারল্যান্ডসের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি কর বৃদ্ধি করেন এবং স্পেনীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য নেদারল্যান্ডসের ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর নানারূপ বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এর ফলে নেদারল্যান্ডস অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

ধর্মীয় কারণ : দ্বিতীয় ফিলিপের অসহিষ্ণু ধর্মনীতি নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল। নেদারল্যান্ডসে ক্যাথলিক গির্জা ছিল দুর্নীতিপূর্ণ। এর নিম্নপদস্থ ধর্মযাজকরা ছিল নীতিহীন মূর্খ ও অলস। নেদারল্যান্ডসের ক্যাথলিক অভিজাতরা গির্জার সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করত। গির্জার বৃহৎ অংশ বিদেশী বিশপের জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় ফিলিপ গির্জার দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য সংস্কারগত পদক্ষেপ নেন এবং একই সময়ে ক্যাথলিক বিরোধী প্রোটেস্ট্যান্টদের দমন করার জন্য নিষ্ঠুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে নেদারল্যান্ডসের নিম্ন প্রদেশে বিভিন্ন জেসুইট সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কিছুকাল পর পোপের নির্দেশে (Papal bull) নেদারল্যান্ডসের গির্জার অনুমোদন করা হয়। এতে বলা হয় ভবিষ্যতে নেদারল্যান্ডসে আর্চ বিশপ্রিকসহ ১৮টি বিশগ্রিক থাকবে। পেপাল বুল Papal bull-এর অন্যান্য ধারায় উল্লেখ করা হয় যে, ভবিষ্যতে বিশপ মনোনয়নের ক্ষমতা রাজার হাতে থাকবে। যারা গির্জার উচ্চপদ লাভ করবেন, তাদেরকে অভিজ্ঞ ধর্মতত্ত্ববিদ ও চরিত্রবান হতে হবে। দ্বিতীয় ফিলিপের এই সংস্কার পদক্ষেপে নেদারল্যান্ডসের নিম্ন প্রদেশসমূহের লোভী বিশপরা ক্ষুব্ধ হন। এ ছাড়া সমৃদ্ধ বৃহৎ মঠের রাজস্ব দ্বারা নতুন বিশপ্রিকের খরচ মেঠানো হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্বিতীয় ফিলিপের এই ধর্মীয় সংস্কার নীতি বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। প্রভাবশালী ও অভিজাতরা গির্জার পৃষ্ঠপোষকতা হারানো পছন্দ করত না। কারণ এটা তাদের সম্পত্তি ও প্রভাব বৃদ্ধির অবদান রাখত। ক্ষমতা ও অর্থ হারানোর জন্য অ্যাবোটরা অসন্তুষ্ট হয়। কারণ নতুন বিশপ্রিকের খরচ মেটানো হবে মঠের আদর্শ দ্বারা। এই নির্দেশ তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে। বণিক শ্রেণী তাদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুপ্রবেশ পছন্দ করে নি। তাই তারা এর সমালোচনা করতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতি নীপিড়ন তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ইনকুইজিশন বিচারালয়ের সাহায্যে দ্বিতীয় ফিলিপ প্রোটেস্ট্যান্ট, ইহুদি ও মুর প্রভৃতি অক্যাথলিকদের অত্যাচার শুরু করলে প্রোটেস্ট্যান্টরা নতুন ধর্মনীতিকে তাদের অস্থিতের জন্য হুমকি হিসাবে মনে করতে থাকে। দ্বিতীয় ফিলিপ পিতা পঞ্চম চার্লস প্রবর্তিত ঘোষণা পুনরায় জারি করেন। এ ঘোষণার দ্বারা ক্যাথলিক বিরোধী ধর্মদ্রোহিদের আগুনে পুড়িয়ে গর্তে ফেলে বা তলোয়ার দ্বারা হত্যা করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। যারা বিধর্মীদের কোনো আশ্রয় দিবে এবং লুথার বা ক্যালভিনের ধর্মমত সংক্রান্ত কোনো পুস্তক রাখবে বা বিক্রয় করবে তাদেরকেও অনুরূপ শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৫৫ সালে ঘোষণা পুনরায় জারি করলে নেদারল্যান্ডসের অক্যাথলিক জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

নেদারল্যান্ডসের গণবিদ্রোহের স্বরূপ : নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহ প্রথম দিকে গণবিদ্রোহ বা জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ ছিল না। দ্বিতীয় ফিলিপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় ফিলিপ নেদারল্যান্ডসে এককেন্দ্রীক শাসন প্রতিষ্ঠা, অভিজাতদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত, গির্জার কর্মচারী ও বণিকদের শ্রেণীগত স্বার্থ না করলে এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহরূপ লাভ করে। শহরে বসবাসকারী শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ তার নীতি ও আদর্শের জন্য ক্ষুব্ধ হয়। স্পেনে অবস্থানকারী দ্বিতীয় ফিলিপের পক্ষে নেদারল্যান্ডসের রাজনৈতিক অস্থিরতা সঠিক প্রকৃতি উপলব্ধি করা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় ফিলিপের অসাবধানতা এবং খারাপভাবে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা ক্রমে জনগণকে ক্ষুব্ধ করে এবং তা প্রকাশ্য বিদ্রোহের রূপ লাভ করে। ক্রমে স্বার্থান্বেষী শ্রেণী স্বার্থের ক্ষোভ এক দেশপ্রেমিক জাতীয়তারূপ লাভ করে।

বিদ্রোহের গতিপথ

নেদারল্যান্ডসে বিদ্রোহের আসন্ন কারণ

দ্বিতীয় ফিলিপের এককেন্দ্রীক শাসননীতি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে তা ফিলিপের রাজপুষ্ঠনীতি ডাসেস অব পার্মার জন্য সংকট সৃষ্টি করে। তিনি বিজ্ঞতার সাহায্যে রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে ব্যর্থ হন। নেদারল্যান্ডসে অভিজাত শ্রেণী ক্রমে রাজপুষ্ঠ নীতির সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে উইলিয়াম অব অরেঞ্জ, কাউন্ট এগমন্ট এবং এডমিরাল হর্ন এ তিন জন নিজেদের সুখসুবিধা বৃদ্ধির জন্য রাজপৃষ্ঠনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করে। উইলিয়াম অব অরেঞ্জ অভিজাতদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে একটি সংঘ স্থাপন করেন। এবং প্রধানমন্ত্রী প্রানভেলার পদচ্যুতি দাবি করেন। তারা দ্বিতীয় ফিলিপের নিকট দাবি জানায় যে, তাদের দাবি না আনলে কাউন্সিল অব স্টেটস থেকে পদত্যাগ করবেন। তাদের পদত্যাগ সরকারের উপর জনগণের আস্থা হ্রাস করবে, এই আশঙ্কায় রাজপুষ্ঠনীতির প্রধান পরামর্শদাতা গ্রানভেল স্পেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন।

ফিলিপ অভিজাতদের দাবি অনুযায়ী স্পেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে তারা রাজপুষ্ঠনীতি গ্রানবেলার উপশম দাবি করেন। দ্বিতীয় ফিলিপের গির্জা পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত অভিজাতদের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাই তারা দ্বিতীয় ফিলিপের ধর্মীয় নীতির সংশোধনের আশা করছিল। কিন্তু রাজার ধর্মনীতির উপর সশরীরে আক্রমণ তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে। কারণ সকল অভিজাত যিশুর ভোজে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ক্যালভিনবাদ তখনো তাদের মধ্যে পুরাপুরি প্রবেশ করে নি। তারা নেদারল্যান্ডসের রাজার প্রধান প্রতিনিধি গ্রানভেলাকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। ফিলিপ তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে গ্রেনভেলাকে প্রত্যাহার করে নি। অভিজাতদের প্রধান প্রতিনিধি উইলিয়াম অব অরেঞ্জ প্রভাবশালী অভিজাতদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজপ্রতিনিধির সাক্ষাত করেন। তারা রাজপ্রতিনিধিকে বলে যে, প্রানভেলকে অপসারণ না করলে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। এ বিষয়টি দ্বিতীয় ফিলিপকে অবহিত করা হলে দ্বিতীয় ফিলিপ গ্রানভেলাকে ছুটি নিতে বলেন। ১৫৬৪ সালের ১৮ মার্চ গ্রানভেলা নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করেন। উল্লিখিত দু একটি দাবি আদায়ে অভিজাতরা উৎফুল্ল হলেও রাজা তার ধর্মনীতির কোনো পরিবর্তন করেন নি। তিনি নেদারল্যান্ডসের রাজপুষ্ঠনীতিকে কাউন্সিল অব ট্রেন্টের ডিক্রি প্রয়োগ করার নির্দেশ দেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য অভিজাতরা কাউন্ট এগমেন্টকে দ্বিতীয় ফিলিপের নিকট তাদের প্রতিনিধি হিসাবে মাদ্রিদে পাঠান। দ্বিতীয় ফিলিপ কাউন্ট এগমেন্টকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেও শাসননীতির কঠোরতা দূর করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন। উপরন্তু কয়েকটি নতুন ঘোষণা জারি করে তিনি অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করেন। এ প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজাতরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেয়। শক্তিশালী অভিজাতরা বিভক্ত ছিল এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। ক্ষুদ্র অভিজাতদের মধ্যে ব্রেডারড ও লুই অব নাসা নেতৃত্ব গ্রহণ করে দ্বিতীয় ফিলিপের সাথে প্রকাশ্য বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। তারা কম্প্রমাইজ নামে একটি দলিল প্রণয়ন করেন। এতে দাবি করা হয় যে, ফিলিপের ধর্মীয় নীতি পরিবর্তন হওয়া উচিত। তারা রাজপ্রতিনিধির নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এই অবস্থায় রাজপ্রতিনিধির সিদ্ধান্তহীনতা সংকট সৃষ্টি করে।

এ সময় নেদারল্যান্ডসের নগরগুলোতে অনেক শ্রমিক ছিল। যারা খণ্ডকালীন চাকরির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হত। ক্যালভিনপন্থী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারের কারণে অনেক লোক প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। এরূপ বিস্ফোরক অবস্থায় রাজপ্রতিনিধির সিদ্ধান্তহীনতা সংকট সৃষ্টি করে। ১৫৫৬ সালের ১৯ আগস্ট বিভিন্ন শহরে গির্জা আক্রমণ করে ধর্মযাজকদের লাঞ্চিত করে এবং গির্জার অত্যন্তরস্থ যিশু ও মেরির মূর্তি ও গির্জার কাচ ভেঙে ফেলে। ইতিহাস এই আন্দোলনকে মূর্তি ভঙের দাঙ্গা বা আন্দোলন (Iconoclastic riot) নামে পরিচিত। এই অবস্থায় মার্গারেট ইনকুজিশন উঠিয়ে দেন। উইলিয়াম, এগমন্ট প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ দেশে শান্তি স্থাপনে সচেষ্ট হন। দ্বিতীয় ফিলিপ এই সংবাদ পেয়ে ইনকুইজিশন বিচারালয় পুনঃস্থাপন করেন এবং দাঙ্গাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ডিউক অব আলবাকে সৈন্যবাহিনীসহ নেদারল্যান্ডসে প্রেরণ করেন। ১৫৬৭ সালের ২২ আগস্ট ডিউক অফ আলবা ব্রাসেলসে পৌঁছেন। ৮ সেপ্টেম্বর মার্গারেট পদত্যাগ করেন। ডিউক অব আলবা নেদারল্যান্ডসে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করেন। এগমেন্ট ও হর্নকে হত্যা করা হয়। এভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সাহায্যে দাঙ্গা দমন করা হয়। দাঙ্গাকারীদের বিচারের জন্য একটি কাউন্সিল স্থাপন করা হয়। এ কাউন্সিল নিয়ে যাদের বিচার করা হয়েছিল তাদের সবারই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এজন্য এ কাউন্সিলকে কাউন্সিল অব ব্লাড বলা হত। ডিউক অব আলবা অনেক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেন এবং ধর্মদ্রোহীদের ফাঁসি দেন।

১৫৬৮ সালে উইলিয়াম অব অরেঞ্জ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। তার সহযোগী হিসাবে তার ভ্রাতা লুই অব নাসা অরেঞ্জ অব উইলিয়ামের সাথে যোগ দেন। উইলিয়াম অরেঞ্জ হেইলিগাবলিতে স্পেনীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত কারণ। ডিউক অব আলবা বিদ্রোহীদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করার জন্য কাউন্ট এগমেন্ট ও হর্নকে ফাঁসি দেন। ডিউক অব আলবা জেমিং জেনের যুদ্ধে লুইয়ের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং নেদারল্যান্ডসে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। আলবার অত্যাচারে বহু নেদারল্যান্ডসবাসী দেশ ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। ফলে নেদারল্যান্ডসের শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলবা নেদারল্যান্ডসবাসীদের করভারে জর্জারিত করেন। ব্যবসায়ীদের উপর এক শতাংশ মূলধন কর, পাঁচ শতাংশ দ্রব্য কর ও দশ শতাংশ ক্রয় কর ধার্য করন। ধর্মীয় অসন্তোষের সাথে অর্থনৈতিক অব্যবস্থা নেদারল্যান্ডসে গোলযোগ আরো ব্যাপক হয়।

ইতোমধ্যে নেদারল্যান্ডসবাসীরা আলবাকে প্রতিরোধ করার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৫৭২ সালে পলাতক নেদারল্যান্ডসবাসী সম্মিলিতভাবে ব্রিল শহরটি আক্রমণ করে দখল করে। এদেরকে সামুদ্রিক ভিক্ষুক (Sea Beggars) বলা হত। কারণ নেদারল্যান্ডস থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন তারা ইংল্যান্ডের উপকূলে বাস করত, তখন তাদের পেশা ছিল জলদস্যুতা। ব্রিল শহরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র উত্তর নেদারল্যান্ডসে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে। ব্রিল শহরের দেওয়ালের উপর অরেঞ্জ তিন রঙবিশিষ্ট পতাকা উত্তোলন অন্যান্য শহর অনুসরণ করে। ব্রিল দখলের পর লিউস নামক একজন নেতা মনস নামক স্থানটি দখল করে। এরপর সমুদ্রের ভিক্ষুকরা হল্যান্ড ও জিল্যান্ড দখল করে। তারা নগরের পাহারাদারদেরকে শক্তি প্রয়োগ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতারণার মাধ্যমে স্বপক্ষে আনেন। শহর কাউন্সিলে ক্যালভিনপন্থী প্রতিনিধি শহরে প্রবেশ করে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর ক্যালভিনপন্থীরা শহরের কারিগর ও মর্সিকারীদের সমর্থন পায়। এরপর তারা অবশিষ্ট জনগণকে সংস্কারকৃত ধর্মকে গ্রহণ করতে বাধ্য করে। লুই মনস নামক শহরটি দখল করে। নেদারল্যান্ডসের উত্তরে বিদ্রোহী শহরসমূহ অরেঞ্জ পরিবারের উইলিয়ামকে তাদের স্টেট হোল্ডার ও প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করে। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠলে আলবা বিদ্রোহী শহরগুলো দখল করে। কিন্তু ফিলিপ আলবার যোগ্যতা সম্পর্কে সন্ধিহান হয়ে তাকে পদচ্যুত করেন এবং ডন লুই দ্যা রিকুয়েন্সকে গভর্নর হিসাবে নেদারল্যান্ডসে প্রেরণ করেন।

বিদ্রোহ প্রশমনের চেষ্টা

ডন রিকুয়েন্স ছিলেন সমঝোতা পন্থী। তিনি দশ শতাংশ কর বাতিল করেন ও ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী অভিজাতদের পক্ষে আনার জন্য তাদের কিছু সুবিধা দেন। তিনি আলবার শাসনকালে কঠোরতা অনেকটা হ্রাস করেন। তিনি কাউন্সিল অব ব্লাড তুলে দেন এবং বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এ সময় উইলিয়াম অব অরেঞ্জ ডন দ্যা রিকুয়েন্সের নিকট তিনটি দাবি উপস্থাপন করেন –

  • (ক) নেদারল্যান্ডস থেকে স্পেনীয় বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।
  • (খ) নেদারল্যান্ডসের পূর্বেকার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন করতে হবে।
  • (গ) ধর্মীয় ব্যাপারে স্বাধীনতা দিতে হবে।

এ তিনটি শর্তে নেদারল্যান্ডসবাসীরা বিদ্রোহ ত্যাগ করবে এ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ফিলিপ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে যুদ্ধ চলতে থাকে। এ সময় লিডেন নামক স্থানটি স্পেনীয় সৈন্যবাহিনী অবরোধ করে। দীর্ঘ সাত মাস এখানকার জনগণ স্পেনীয় বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। ১৫৭৪ সালে অক্টোবর মাসে উইলিয়াম অব অরেঞ্জ সসৈন্যে এসে শহরটি দখল করেন। ঐ শহরবাসীদের বীরত্বের স্মারক হিসাবে উইলিয়ামের আদর্শে লিডেন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

স্পেনীয় উন্মত্ততা

১৫৭৬ সালে ডন রিকুয়েন্স মৃত্যুবরণ করলে অ্যান্টওয়ার্পে স্পেনীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করে অনেক মানুষকে হত্যা করে। সে সময় স্পেনীয় সৈন্যদের পর্যাপ্ত রসদ ছিল না। দীর্ঘদিন তাদের বেতন পাওনা ছিল। সৈন্যরা সামরিক নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করে। তারা লুটতরাজ, হত্যার মাধ্যমে এক অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। নেদারল্যান্ডসের অর্থশালী ব্যক্তিদের সম্পত্তি ও শহর লুট করে, ফলে জনগণের দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছে। সৈনিকদের এই কর্মকাণ্ডকে ইতিহাসে স্পেনীয় উন্মত্ততা বলা হয়। স্পেনীয় উন্মত্ততা নেদাল্যান্ডের ১৭টির মধ্যে ১৬টি প্রদেশের ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় সম্প্রদায়কে স্পেনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে। জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার জন্য উইলিয়াম অব অরেঞ্জ উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের নিয়ে ঘেন্টের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনৈক্য দূর করা হয়। ধর্ম ব্যাপারে সহিষ্ণুতা, হল্যান্ড ও জিল্যান্ডের ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণু নীতি অনুসরণ এবং দেশের জন্য একটি জাতীয় সভা আহ্বান করা ঘেন্টের শান্তি চুক্তিতে স্বীকৃত হয়।

চিরস্থায়ী ঘোষণা

জন ডি রিকুয়েন্সের পর দ্বিতীয় ফিলিপ জন অফ অস্ট্রিয়া বা ডন খুয়ানকে (Don Juan) নেদারল্যান্ডসের গভর্নর নিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপের বৈমাত্রীয় ভ্রাতা (পঞ্চম চার্লসের অবৈধ পুত্র)। জন পেসিফিকেশন অব ঘেন্টের দাবিসমূহ গ্রহণ করেন এবং ১৫৭৬ সালে নভেম্বর মাসে ঘোষণা আকারে তা প্রচার করেন। তিনি ধর্মদ্রোহীতার বিরুদ্ধে সকল এডিক্ট বাতিল করেন। জন উপলব্ধি করেন যে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা উত্তর দক্ষিণ প্রদেশসমূহের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করে। উত্তর প্রদেশসমূহ ছিল ক্যালভিনপন্থী এবং দক্ষিণ প্রদেশসমূহ ছিল ক্যাথলিক পন্থী। দক্ষিণের ক্যাথলিক অভিজাতরা ডিউক অব আরস কোটের নেতৃত্বে উইলিয়াম অরেঞ্জকে ঈর্ষা করত। জন ক্যাথলিকদের স্বপক্ষে এনে বিদ্রোহীদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করেন। ১৫৭৭ সালে তিনি নামুর দুর্গ দখল করেন এবং উইলিয়াম অব অরেঞ্জের শাস্তি দাবি করেন। কিন্তু এ সময় তার পদক্ষেপ ছিল ভ্রান্ত। কাজেই নেদারল্যান্ডসে স্বপক্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা ক্ষেত্র তৈরি হয়। জন ১৫৭৮ সালে গেমরাউজে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন কিন্তু ১৫৮০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

জনের মৃত্যুর পর ডিউক অব পার্মা আলেকজান্ডার নেদারল্যান্ডসের গভর্নর হন। ডিউক অব পার্মা দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের ক্যাথলিকদের সমর্থন লাভ করেন। এর ফলে ঘেন্টের চুক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নষ্ট হয়। উইলিয়াম অফ অরেঞ্জ এ সময় ফরাসি এবং হল্যান্ডের সাহায্যের উপর নির্ভলশীল হয়ে পড়েন। তিনি ফ্রান্সের সমর্থন লাভের জন্য ফরাসি যুবরাজ ডিউক অব আঞ্জুকে বিদ্রোহী উত্তরপ্রদেশের শাসক হিসাবে স্বীকার করেন। তিনি অ্যান্টেওয়ার্প বলপূর্বক দখলের চেষ্টা করেন। ফরাসি উন্মত্ততা নেদারল্যান্ডসে ডিউকের অবস্থা খারাপ করে। তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান এবং ১৫৮৪ সালের ১০ জুন মৃত্যুবরণ করেন। ১৫৮৪ সালের ১০ জুলাই নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় ফিলিপের এজেন্ট ব্যালথাসার জেরারড পিস্তলের গুলিতে উইলিয়াম অব অরেঞ্জকে হত্যা করেন। নেদারল্যান্ডসের জনগণ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ হয়। (নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণাংশের ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরা ঘেন্টের চুক্তি প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ১৫৮৯ সালে নেদারল্যান্ডসের উত্তরাংশের হল্যান্ড, জিল্যান্ড, ইউট্রেট, গিভারল্যান্ড, ফ্রিসল্যান্ড, ওভেরিসেল, এনিংজেন এ কয়টি প্রোটেস্ট্যান্ট অঞ্চল নিয়ে ইউট্রেক্টের ইউনিয়ন নামে এক রাজ্য স্থাপন করেন। এই ইউনিয়নেই পরবর্তীকালে হল্যান্ড নামে পরিচিত হয়। যে সকল শর্তের উপর এ ইউনিয়ন স্থাপিত হয়েছিল সেগুলো পরবর্তী ডাচ রিপাবলিকের শাসনতন্ত্রের শর্ত হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।)

উইলিয়াম অব অরেঞ্জের মৃত্যুর পর নেদারল্যান্ডসবাসী তার পুত্র মরিসকে স্টাটহোল্ডার (Studtholder) নির্বাচিত করেন। তিনি স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ডিউক অব পার্মা ক্যাথলিকদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে উত্তর নেদারল্যান্ডসের রাজ্যগুলো একের পর এক দখল করতে থাকে। কেবল হল্যান্ড ও জিল্যান্ড স্পেনীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। এ দুর্যোগের সময় ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ (১৫৫৮-১৬০৩) নেদাল্যান্ডসের বিদ্রোহীদের সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করে। ইতোমধ্যে স্পেনীয় নৌবাহিনী সামুদ্রিক যুদ্ধে ইংল্যান্ডের নিকট পরাজিত হয়। ইতোমধ্যে ফ্রান্সের সিংহাসন নিয়ে ক্যাথলিক ও হিউগনোদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে দ্বিতীয় ফিলিপ বুরবোঁ পরিবারের হেনরির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০) ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলে দ্বিতীয় ফিলিপ বেকায়দায় পরেন। তিনি ফ্রান্সের সাথে সন্ধি স্থাপন করে স্পেনীয় সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হন। এ সকল নানা সমস্যার কারণে স্পেনের পক্ষে হল্যান্ড ও জিল্যান্ডের বিদ্রোহীদের দমন করা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় ফিলিপ বেকায়দায় পরে ১৬০৯ সালে “দ্বাদশ” বছরের যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষর করেন। ১৬০১ সাল থেকেই নেদারল্যান্ডসস কার্যত স্বাধীন হয়ে পরে। নেদারল্যান্ডসের উত্তরাংশে স্বাধীনতা একরকম স্বীকৃত বলা যেতে পারে। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়া হয়। উত্তর নেদারল্যান্ডসের প্রদেশগুলো নিয়ে হল্যান্ডের প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছিল। ফলে একে যুক্তপ্রদেশ নামে অভিহিত করা হত।

স্বাধীনতার পর

নেদারল্যান্ডসের স্বাধীনতা লাভ হলেও এর অনেক অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল। তবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তীকালে নেদারল্যান্ডস শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছিল। প্রথম দিকে নেদারল্যান্ডসের সাতটি যুক্তপ্রদেশ একটি ফ্রেডারেন্স গঠন করে। প্রতিটি প্রদেশের জন্য স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট ও সরকার ছিল। এভাবে একজন প্রশাসকের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সাতটি প্রদেশ। অরেঞ্জ পরিবার বংশ পরিক্রমায় এ শাসন ক্ষমতা লাভ করত। তবে পুরো সপ্তদশ শতাব্দীব্যাপী আইন পরিষদ ও গভর্নরের মধ্যে মতানৈক্য হত। আইন পরিষদের পক্ষ নিয়েছিল ধনীক বণিক শ্রেণী। তারা নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি পরিচালিত (oligarcy) ফেডারেশনের পক্ষপাতি ছিলেন। অপরপক্ষে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অরেঞ্জ পরিবারের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র গড়ে তোলার পক্ষপাতি ছিল।

নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণের ক্যাথলিক অধ্যুষিত প্রদেশগুলো পরবর্তীকালে বেলজিয়াম নামে পরিচিত হয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীব্যাপী এ অঞ্চলটি অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অনেক সময় এটিকে স্পেনীয় নেদারল্যান্ডস বা অস্ট্রিয় নেদারল্যান্ডস বলা হত। যুদ্ধে হল্যান্ড বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরবর্তীকালে তা বেলজিয়াম অপেক্ষা আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ওলন্দাজরা ঘেন্ট  নদী ও তার আশপাশের সমুদ্রে ঢোকার পথ বন্ধ করে দিলে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প বাণিজ্য কেন্দ্রটি তার ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলে। এর ফলে ওলন্দাজরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র প্রধান শহর আমস্টার্ডামে স্থানান্তরিত করে। এই আমস্টার্ডাম পরবর্তীকালে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ব্যাংক ব্যবসা এবং জাহাজ তৈরি শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

নেদারল্যান্ডস স্বাধীনতা লাভের পর ক্রমে ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। ওলন্দাজরা এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলে। ওলন্দাজগণ বিজ্ঞান, শিল্প, ও চিত্রকলায় উন্নতি সাধন করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনের প্রণেতা হিউগো গ্লোটিয়াস, ইহুদি দার্শনিক স্পিনোজা, বিশ্বের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রেমব্র্যান্ট ফ্রান্স হাল্স নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ওলন্দাজদের সাফল্য ও দ্বিতীয় ফিলিপের ব্যর্থতার কারণ

ওলন্দাজদের সাফল্যের কারণ : নেদারল্যান্ডসবাসী দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে স্পেনীয় আধিপত্য থেকে যুক্ত হয়। তাদের সাফল্যের কতগুলো কারণ ছিল।

  • ওলন্দাজদের জাতীয় নেতা উইলিয়াম ও মরিসের দক্ষ নেতৃত্ব ওলন্দাজদের সাফল্যের কারণ ছিল। তাদের দেশপ্রেম ও অধ্যবসায় বিদেশী সৈনিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রেরণা যুগিয়েছিল।
  • নেদাল্যান্ডের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তাদের সাফল্যের কারণ ছিল। দেশটি অসংখ্য নদী ও খাল দ্বারা বেষ্টিত থাকায় স্পেনীয় বাহিনীর পক্ষে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। শত্রুর প্রবেশমুখে বাঁধগুলো ভেঙে দিয়ে তাদের অভিযান প্রতিহত করা হত।
  • নেদারল্যান্ডসের যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য নিযুক্ত থাকার ফলে তারা নিজ দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ পেত। দেশের অভ্যন্তরভাগ নিরুপদ্রব থাকায় সাধারণ মানুষ কাজ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়ে তুলতো। পরে আর্থিক বিপর্যয়ের সময়ও দেশে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে নি।
  • যুদ্ধের সময় বিদ্রোহী নেদারল্যান্ডসবাসী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ও জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্টদের সাহায্য লাভ করেছিল। স্পেন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তার পক্ষে নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না। এটা ওলন্দাজদের সাফল্যের কারণ ছিল।

দ্বিতীয় ফিলিপের ব্যর্থতার কারণ : দ্বিতীয় ফিলিপ ইউরোপের শ্রেষ্ঠ এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েও কেন নেদারান্ডের বিদ্রোহ দমন করতে পারেন নি তা ইতিহাসের একটি প্রধান জিজ্ঞাসা।

  • দ্বিতীয় ফিলিপ ছিলেন স্বৈরাচারী ও ধর্মীয় অসহিষ্ণু শাসক। তিনি নেদারল্যান্ডসের বিদ্রোহের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
  • নেদারল্যান্ডসবাসী স্পেনীয় শাসনকে বিদেশী শাসন এবং ফিলিপকে বিদেশী শাসক মনে করতেন।
  • তার ধর্মনীতি অক্যাথলিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তার ধর্মসংস্কার ক্যাথলিকদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
  • নেদারল্যান্ডসের শাসনে স্থানীয় অভিজাতদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে তিনি সেখানে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিলেন।
  • দ্বিতীয় ফিলিপের ভুল আর্থিকনীতি নেদারল্যান্ডসের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষতি করেছিল।
  • রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বঞ্চনায় সেখানে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল তা জাতীয় আন্দোলনের রূপ লাভ করেছিল। জাতীয় আন্দোলন যে শক্তি প্রযোগ করে দমন করা যায় না তা উপলব্ধি করার মতো দূরদর্শিতা দ্বিতীয় ফিলিপের ছিল না।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১২১-১৩৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.