প্রতিসংস্কার আন্দোলন

ষোড়শ শতকে ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রচারণা শ্লথ করার জন্য এবং ক্যাথলিক গির্জার সংস্কার ও ধর্মাধিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে প্রতিসংস্কার আন্দোলন বলা হয়। ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা করে ক্যাথলিক ধর্মকে পুনরায় মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য এ আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। লুথারীয় প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রচারে ভীত হয়ে যেসব স্পষ্ট ত্রুটি ও অনিয়ম রোমান গির্জার ক্ষমতা নষ্ট করেছিল, সেগুলো দূরীভূত করার জন্য কতগুলো সংস্কার পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছিল। এদিক থেকে বিবেচনা করলে প্রতিসংস্কার আন্দোলনকে ক্যাথলিক চার্চের পুনর্গঠন আন্দোলনও বলা যেতে পারে।

প্রতিসংস্কার আন্দোলনের কারণ

প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের গতিবেগ স্তব্ধ করা, ক্যাথলিক ধর্মকে আবার মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করা এ সকল লক্ষ্যে প্রতিসংস্কার আন্দোলন শুরু হলেও ষোড়শ শতকে কতগুলো বিষয় এ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এ সময় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত লুথারপন্থী, জুইংলিপন্থি এবং ক্যালভিনপন্থী প্রভৃতি দলে বিভক্ত হওয়ায় প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন অনেকটা দুর্বল হয়েছিল। এ সময় যারা পোপ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বিশেষ করে পোপ তৃতীয় পল (১৫৩৪-১৫৪৯) পোপ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে পোপতন্ত্রের নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং ধর্মযাজকদের জীবনধারাকে আদর্শমণ্ডিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। এ ছাড়া ক্যাথলিক ধর্মের অনেক অনুসারী ক্যাথলিক ধর্মের সংস্কার, যাজকদের জীবনযাত্রার উন্নতি প্রভৃতি বিষয়ে তাদের ধারণা প্রচার করতে থাকে। যার ফলে ক্যাথলিক ধর্মের মৌলিক ধারণাগুলো পরিবর্তন না করে এগুলোর সংস্কার করে চার্চের সংগঠনকে শক্তিশালী এবং প্রশ্নবিদ্ধ বিশ্বাসগুলোকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মত দিতে থাকে।

ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের অবনতির ফলেই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের সূত্রপাত হয়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রচারণা, ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা যুগের চাহিদা ছিল। পোপ ষষ্ঠ এড্রিয়ান (১৫২২-১৫২৩) যখন পোপ ছিলেন তখন রোমের ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল। কিন্তু ঐ সময় স্পেনে রাজা ফার্ডিনান্ড (১৪৫২-১৫১৬) স্পেনে ধর্মাধিষ্ঠানের সংস্কার করেছিলেন। স্পেনীয় গির্জায় আত্মশুদ্ধির আন্দোলন পার্শ্ববর্তী দেশ ইতালিতে বিস্তার লাভ করে এবং রোমের পোপ ষষ্ঠ এড্রিয়ান এর দ্বারা প্রভাবিত হন। যদিও এ সংস্কারের গতি ছিল মন্থর তবুও এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। ক্যারাফফা, ইগ্নেশিয়াস লায়লা, লেইনেজ, জেভিয়ার প্রমুখ ধার্মিক সাধুদের প্রচেষ্টায় ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের আত্মশুদ্ধি ও পুনরুদ্ধান সম্ভব হয়েছিল।

১৫৪৫-১৫৩৬ সালে টেন্টের ধর্মসভায় ক্যাথলিক ধর্মমতের অনেকগুলো সমালোচিত বিষয় সংস্কার করে চার্চের একতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। এ সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়েছিল –

  • (১) ক্যাথলিক ধর্মের মূলনীতি নির্দিষ্ট করা।
  • (২) প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্যাথলিক ধর্মে পুনঃদীক্ষিতকরণ।
  • (৩) ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানে ধর্মজ্ঞান বৃদ্ধি করা।
  • (৪) ক্যাথলিক ধর্মের একর প্রাধন্য প্রতিষ্ঠা করে পোপের মর্যাদা ও ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি।

ট্রেন্টের সভার প্রতিনিধিগণ ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের মূল বিষয়ে ঐকমত সমর্থন করলেও চার্চের চাকরির পদ বিক্রির সমালোচনা করে এবং যাজকদের কর্তব্যে একনিষ্ঠ হওয়ার জন্য দাবি করা হয়, ইনডালজেন্স বিক্রি রহিত করা হয়। এ ছাড়া ট্রেন্টের ধর্মসভায় The papal index অর্থাৎ চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ ধর্মবিরোধী পুস্তক নিষিদ্ধ করা হয় এবং ধর্মীয় অপরাধের বিচারের জন্যে ইনকুইজিশন আদালত পুনঃস্থাপন করা হয়। প্রতিসংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং যাজক শ্রেণির নৈতিক জীবনের শুদ্ধি, অক্যাথলিকদের বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে পুনরায় ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করা। এ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্যাথলিক ধর্মকে পুনরায় সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করা, ক্যাথলিকদের ধর্মান্তর রোধ এবং প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের গতিবেগ অনেকটা দমন করা সম্ভব হয়েছিল। একটি দল ক্যাথলিক চার্চের অনুগত ছিলেন এবং তারা মরমীবাদ ও দয়ার উপর অধিক গুরুত্ব দিতেন। অর্থাৎ তারা ঈশ্বর-এর দয়ার প্রত্যাশী ছিলেন। অন্য একদল রোমান ধর্মাধিষ্ঠানের সমালোচনা করতেন। আর একদল ছিল রোমান ধর্মাধিষ্ঠানের বিরোধী।

ট্রেন্টের ধর্মসভা ছাড়াও প্রতিসংস্কার আন্দোলন অনেকখানি জেসুইট সংঘের মাধ্যমে পরিণতি লাভ করেছিল। এর মধ্যে কারাফ্ফা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত থিয়েটাইন নামক সংঘ আত্মশুদ্ধি আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া কেপোচিন (The Capuchine) নামক সংঘ ছিল ফ্রান্সিসক্যান আধ্যাত্মিক সংঘের একটি প্রতিষ্ঠান। এরা আধ্যাত্মিক ধ্যানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করতেন।

জেসুইট সংঘ 

জেসুইট সংঘ (The Society of the Jesuits) প্রতিসংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইগ্নেশিয়াস লায়লা। ১৪৯১ সালে স্পেনের গুইপুজকোয়াতে ইগ্নেশিয়াস লায়লা জন্মগ্রহণ করেন। যৌবনে সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলেন। একটি যুদ্ধে কামানের গোলা লেগে তার একটি পা নষ্ট হয়। তিনি বহুদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় বীরত্ব সম্বলিত সাহিত্য পড়তেন। তিনি লুডলফ স্যাকসোনির ‘লাইফ অফ ক্রাইস্ট’ ও ‘ফ্লাওয়ারস অব দ্য সেইন্টস’ পাঠ করে এক নতুন জীবনের সন্ধান পান। সুস্থ হয়ে তিনি খ্রিস্টধর্মের সেবায় আত্মনিয়োগের পরিকল্পনা করেন। গৃহত্যাগ করে তিনি মোন্টসেরাট মঠে রক্ষিত কুমারী মেরির মূর্তি দেখতে পান এরপর তিনি মানরেসার বাইরে একটি গুহায় অবস্থান করেন। এখানে তিনি নয় মাস কাটান। এ সময়ের শেষের দিকে তিনি ঈশ্বর ত্রিত্বের দর্শন পান। এটি তার সংবেদনশীল মনে গভীর দাগ কাটে। জীবনের প্রথম দিকে তার জীবনধারা ছিল কঠোরতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু তিনি কখনো সন্ন্যাসীর জীবন গ্রহণ করেননি। পরে তিনি মধ্যপন্থা গ্রহণ করেন। অন্যের আত্মাকে সাহায্য করা এবং ধর্মকর্ম ফলপ্রসূ হওয়ায় তিনি এ সময় থেকে কঠোরতা পরিত্যাগ করেন। ইগ্নেশিয়াস লায়লা স্পিরিচুয়াল এক্সারসাইজেস নামে একটি গ্রন্থ রচনা ইশিয়া করেন। এটি ১৫৪৮ সালে তা প্রকাশিত হয়। এটি ছিল ধর্মে বিশ্বাসী লোকের জন্য একটি ভক্তি ও প্রশিক্ষণের গ্রন্থ। ধ্যানের প্রথম সপ্তাহে মানুষের মন নিষ্ক্রিয় হয়, তবে দ্বিতীয় সপ্তাহে সে সৃষ্টিকর্তা ও তার কাজে আত্মনিয়োগ করার গৌরব অনুভ করে। তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে সে যিশুর জীবন ও অনুভূতি এবং মানুষের পাপের গভীরতা নিয়ে ধ্যান করে। শেষে সে স্বর্গের আনন্দ পায়। এজন্য সে তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পরিত্যাগ করে। ১৫২৩ সালে ইগ্নেশিয়াস লায়লা মানরেসা থেকে জেরুজালেমে যান সেখান থেকে যান রোমে ও ভেনিসে এবং শেষে বার্সিলোনায়। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নেন এবং সেখানেই সোসাইটি অফ জেসাসের গঠন প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন। ১৫৩৪ সালে তার ছয় অনুসারী এবং তিনি বিধর্মীদেরকে ধর্মান্তরিত করতে বা পক্ষে সাহায্য করতে জেরুজালেমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেন্টডেনিস চ্যাপেলে দারিদ্র ও কৌমার্যের শপথ গ্রহণ করেন। ইয়েশিয়াস লায়লা যিশুর জন্যভূমি জেরুজালেমে যাওয়ার জন্য নৌকার জন্যে ভেনিসে যান।

নৌকা পেতে বিলম্ব হওয়ায় তারা দুটি ভেনিসীয় হাসপাতালে সেবামূলক কাজ শুরু করেন। তারা রোগীর শুশ্রূষা, মেঝে পরিষ্কার, ময়লা উৎপাটন, পাত্র পরিষ্কার সমাধি খনন, গির্জায় প্রার্থনা পরিচালনা ও মৃত ব্যক্তিকে সমাহিত করার কাজে ব্যাপৃত থাকেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন যে, গির্জার বেশি জরুরি কাজ হলো ধর্মদ্রোহীতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যা ইউরোপে করা যায়। ইতোমধ্যে সহকর্মী ফ্রান্সিস জেভিয়ার ও লায়লা নিজেদেরকে পোপের অধীনে স্থাপন করেন। পোপ তৃতীয় পল একটি পেপাল বুল (Papal bull) দ্বারা ১৫৪০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর জেসুইট সংঘকে অনুমোদন দেন। জেসুইট সংঘ প্রতিষ্ঠার পর প্রতিসংস্কার আন্দোলন নতুন উদ্দীপনা পায়, পোপ প্ৰদত্ত পেপাল বোলে বলা হয়-

সংঘের সদস্যরা পোপ ও সংঘের জেনারেলের নিকট অনুগত থাকবে। ইগ্লেশিয়াস লায়লা জেনারেল নির্বাচিত হন। লায়লা বিশ্বাস করতেন যে, আজ্ঞানুবর্তিতা হলো সংঘের সদস্যের একটি সংজ্ঞা। এটি সংঘকে দৃঢ়তা ও শক্তি দেয় কিন্তু আজ্ঞানুবর্তিতা জাতীয় আনুগত্যের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করে। ফলে এটিকে ইউরোপের জাতীয় শাসকরা অপছন্দ করত। জেসুইট সংঘ ছিল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, এর উপর জাতীয় শাসকের কোনো আধিপত্য ছিল না। পোপ এটাকে পরিচালনা করতেন। জেসুইটরা মঠবাসী সন্ন্যাসী ছিলেন না। তারা মঠে ধর্মসঙ্গীত গাইতেন না এবং মঠবাসীদের বিশেষ পোশাক পরিধান করতেন না। এজন্য অনেক সংগঠন তাদের সন্দেহ করত। পোপ চতুর্থ পল (১৫৫৫-১৫৫৯) সংঘের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করেছিলেন। প্যারিসের বিশপ ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব অনুষদ এদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল। ১৫৬৩ সালে জেসুইট সংঘের গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়।

জেসুইট সংঘের কার্যক্রম : জেসুইট সংঘের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ছিল। দু বছর শিক্ষানবিশ থাকার পর কোনো ব্যক্তি সংঘের ধর্ম বহির্ভূত পার্থিব কাজ গ্রহণ করতে পারত। অথবা জাগতিক যুগ্ম মীমাংসাকারী হতে পারত। অথবা ধর্মযাজক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারত। আরো কিছু বছর প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর একজন জেসুইট একজন ঐশ্বরিক যুগ্ম মীমাংসাকারী হতে পারত। এদের মধ্য হতে অল্প কয়েকজন সদস্য আরেকটা গ্রেড পায়—চার শপথে পারদর্শী কমিটি। জেনারেলের প্রচুর ক্ষমতা ছিল; তবে প্রাদেশিক সভা, সাধারণ সভা ও কনসালটরগণ দ্বারা সীমিতভাবে তার ক্ষমতাকে বাধা প্রদান করতে পারত। এ দীর্ঘ ও সতর্ক প্রশিক্ষণ একজন জেসুইটকে তার সংঘের অনুগত ও যোগ্য সদস্য হতে সাহায্য করত।

জেসুইটদের দায়িত্ব : ১৫৪০ সাথের পোপের ভুলধারা জেসুইটদের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এগুলো হলো: (১) পাপ স্বীকারোক্তি গ্রহণ; (২) শিক্ষা দান; (৩) ধর্ম প্রচার। রাজা বা শাসকদের পাপ স্বীকারোক্তির পুরোহিত হিসাবে তারা রাজনীতি ও কূটনীতির উপর এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী এবং কোনো কোনো সময় ভীতিকর প্রভাব ব্যবহার করতেন।

ধর্ম ও শিক্ষা প্রচারের ভূমিকা : জেসুইটরা শিক্ষা ও ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইগ্লেশিয়াস লায়লা প্রথম দিকে পরিকল্পনা করেছিলেন যে, সংঘ কেবল এর সদস্যকে শিক্ষাদান করবে, ফলে ১৫৪২ সালে কইমব্রাতে বিখ্যাত জেসুইট কলেজ স্থাপন করেন। পরে পড়ুয়া, ভ্যালেন্সিয়া, আলকালা ও সালামানকা সহ বিভিন্ন ইতালীয় ও স্পেনীয় শহরে ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়। কিন্তু স্যানডিয়ার ডিউক সেন্ট ফ্রান্সিস বর্গিয়া প্যানডিয়াতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় সংঘের প্রাথমিক পরিকল্পনার সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে সাধারণ উপাসককে শিক্ষাদানের জন্য জেসুইটরা শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষক ও প্রভাষক হিসেবে পদ গ্রহণ করতে আরম্ভ করেন। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, ক্যাথলিকরাদের স্বপক্ষে যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারে। অচিরেই ক্যাথলিক বিশ্বে সর্বত্র জেসুইট কলেজ স্থাপন করা হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেসব যুবক শিক্ষা লাভ করে যারা পরবর্তীকালে শক্তিধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হবেন। এরপর রোমে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রেগরিয়ান কলেজ। অস্ট্রিয়া ও ব্যাভেরিয়ার শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিয়েনা, ইনগলস্টার্ড ও কলনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো সহযোগী শিক্ষায়তন গঠনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। পরের গুলোর দায়িত্ব হলো ধর্মদ্রোহীদের ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত করার শিক্ষা দান করা। প্রাগে অভিজাতদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য একটি স্কুল গড়ে ওঠে। পোল্যান্ড ও ফ্রান্সেও জেসুইট বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপিত হয়। উল্লিখিত প্রক্রিয়ার তিনটি তাৎপর্য ছিল –

  • প্রথমত, এটা সুশিক্ষিত ও উদ্যোগী ধর্মপ্রচারক সরবরাহ করে। তারা তাদের বসবাসের এলাকায় প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করে ও নিজেদের ধর্মাবলম্বীদেরকে উপদেশ দেওয়ার কাজ করতেন।
  • দ্বিতীয়ত, এটা অভিজাত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের উপর জেসুইটদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হতো মানসিকভাবে ধারণক্ষম বয়সে। ফলে জেসুইটদের জীবন দর্শনের দীক্ষিত হওয়ার পর তাদের সাহসী রোমান্টিক হিসেবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
  • তৃতীয়ত, এটা উল্লেখযোগ্যভাবে উৎকৃষ্ট শিক্ষাদান করে। ধর্মের ক্ষেত্রে তাদের অস্তিত্বের সম্মিলিত দর্শন বা ধর্মতত্ত্ব ছিল। কিন্তু পার্থিব বিষয়ে বিশেষ করে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও জাহাজ চলাচল বিদ্যার শিক্ষা একইরকমভাবে উৎকৃষ্ট ছিল। জেসুইটরা স্কুলের সংগঠন দেখাশুনা করতেন। এর প্রতি তাদের সযত্ব মনযোগ ছিল। তারা নিম্নস্তরের স্কুলে উচ্চস্তরের স্কুলের মতো দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে সচেষ্ট হন।

জেসুইটদের ধর্মপ্রচারণ: জেসুইটরা ছিলেন একাধারে ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষক। তাদের একনিষ্ঠতার জন্য ধর্ম সম্মেলনে বহুলোকের সমাগম হত। ধর্মপ্রচারক হিসেবে ফ্রান্সে ছিলেন এডমুন্ড অগের। তিনি একটি প্রশ্নোত্তরিকা রচনা করেন। কেবল প্যারিসে এর ৩৮১ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতনামা ধর্মপ্রচারক হলেন সেন্ট পিটার ক্যানিসিয়াস, যিনি ইনগলস্টার্ডে ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে অনেক কাজ করেছিলেন। পরে তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব অনুসারীদের ডীন ও একটি প্রশ্নোত্তরিকা হিসেবে গির্জার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। একজন ক্যাথলিক ঐতিহাসিক তার প্রশ্নোত্তরিকাকে সমগ্র প্রতিসংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে খ্যাতনামা গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করেন। ক্যানসিয়াস সম্পর্কে সম্রাট প্রথম ফার্ডিনান্ডের (১৫৫৬-১৫৬৪) উচ্চ ধারণা ছিল। তিনি ক্যানিসিয়াসের প্রশ্নোত্তরিকা জার্মান ভাষায় ভাষান্তরিত করার নির্দেশ দেন এবং সাম্রাজ্যের সকল ল্যাটিন ও জার্মানি স্কুলে এর পঠনপাঠন বাধ্যতামূলক করেন।

উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল সংঘের ধর্ম প্রচার সম্পর্কে কার্যকলাপ। তৃতীয় শপথের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পোপের প্রতি জেসুইটদের আজ্ঞানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তার কথা ছিল। প্রথমে জেসুইটরা ভারত ও চীনে এবং পরে দক্ষিণ আমেরিকা, কুইবেকের ফরাসি উপনিবেশ এবং আবিসিনিয়ায় ধর্ম প্রচার করেন। ধর্ম প্রচারের ইতিহাসে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতনামা জেসুইট। ১৫৪১ সালে তিনি গোয়ার পর্তুগিজ উপনিবেশ যান। গোয়াবাসীদের নৈতিক চরিত্র খুবই খারাপ ছিল। সেখানে তাদের মধ্যে উচ্চমানে চরিত্র গঠনে কিছু করার পর তিনি কমরিন উপকূলে মুক্তা আহরণকারীদের মালয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের এবং জাপানের জনগণের মধ্যে ধর্ম প্রচার আত্মনিয়োগ করেন। জেসুইট ধর্মপ্রচারক সম্পর্কে প্রচারকদের উদ্যম প্রশ্নাতীত ছিল।

১৫৬০ সালে ফাদার মাৰ্টিয়েজ লিখেছেন, আমার স্বাস্থ্য ভালো আমার অনেক শক্তি আছে। আমি উভয়কে যিশুর কাজে ব্যবহার করতে আগ্রহী। এতে আমার রক্ত ও জীবন দিতে রাজি আছি। ওরান অভিযানের সাথে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে অনেক কষ্ট হয়েছিল। এর থেকে অনেক খারাপ অবস্থায় আমি কাজ করতে চাই। সেজন্য আমাকে চীনে যেতে দেওয়া হোক। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জেসুইটরা পৃথিবীর চতুর্দিকে বৃত্ত তৈরি করেন।

জেসুইটদের সমালোচনা : সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অনেকেই তাদের কাজকর্মে সন্দেহ করত। রোমের পোপ এবং পোপের কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক নীতির সাথে তাদের সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে জাতীয় সরকার তাদের প্রতি বিরূপ হয়। গির্জার নিয়ন্ত্রণ ও মঠ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি অনেক বিশপ ও অন্যান্য মঠ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদের প্রতি ক্রোধের উদ্রেগ করে। নৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা কূটতর্ক সৃষ্টি করে। এটা সত্য যে, অনেক জেসুইট নৈতিক প্রশ্নে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন। একজন আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী এ সম্পর্কে লিখেছেন, ইগ্নেশিয়াস লায়লা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গির্জার সকল শিক্ষা, শৃঙ্খলা, এমনকি আমোদ-প্রমোদ বিষয়ক অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে । এটা জাঁকজমক ও সাংসারিকতা এর ব্যবহার্যে প্রযোগ করতে হবে। এসব বিষয়ে লায়লা ক্যালভিন ও লুথারের থেকে বেশি বিপ্লবী ছিলেন। কারণ যেখানে তারা তাদের নিকট বিকশিত হওয়া নতুন বিশ্বকে পেছনে নিয়ে যান, লায়লা আলংকারিকভাবে ও প্রকৃতপক্ষে এটাকে আলিঙ্গন করেন।

পোপের প্রতি জেসুইটদের প্রশ্নাতীত বিশ্বস্ততা তাদেরকে শাসকদের কাছে অপছন্দনীয় করে। জেসুইট বেল্লারমাইন দাবি করেন যে, খ্রিস্টান বিশ্ব তার অস্তিত্বের জন্য পোপের ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার নিকট ঋণী যার উপর পার্থিব ক্ষমতা নির্ভরশীল। এ মত পার্থিব শাসকদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করে। স্পেনীয় জেসুইট লুই মোলিনা ঘোষণা করেন যে, একজন ধর্মদ্রোহী শাসককে উৎখাত করার ক্ষমতা জনগণের ছিল। জেসুইট ম্যারিয়ানার বক্তব্য ছিল আরো বিস্ময়কর। তিনি অত্যাচারতন্ত্রকে ন্যায়সঙ্গত বলে অভিহিত করেন। কাজেই জেসুইটরা ছিলেন প্রতিসংস্কার আন্দোলনের মুখ্য কারিগর। ক্যাথলিক পুনরুজ্জীবনে তাদের প্রকৃত অবদান আসে তাদের শিক্ষাদান, ধর্ম প্রচার, লেখনী ও পাণ্ডিত্য ধর্মপ্রচার সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড এবং ধর্মবিশ্বাসের জীবনীশক্তির গতিশীলতা হতে।

ট্রেন্টের ধর্মসভা

ট্রেন্টের কাউন্সিল ছিল প্রতিসংস্কার আন্দোলনের আর একটি এজেন্সি। ১৫৪৫ – ৪৯, ১৫৫১-৫২ ও ১৫৬২-৬৩ সালে ট্রেন্টে কাউন্সিলের তিনটি সভা বসে। সভায় গির্জা, যেসব সমস্যা একে বিভক্ত করে এবং একে ধ্বংস করার হুমকি দেয়, যেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের সাথে সম্পর্ক নিজ গৃহের সংস্কার এবং তার ধর্মমতকে আরো পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা। এটি শীঘ্রই প্রতীয়মান হয় যে, প্রোটেস্ট্যান্টবাদের সাথে সমঝোতা সম্ভব। কেবল আত্মসমর্পণের শর্তে ধর্মদ্রোহীরা ক্যাথলিক ধর্মে ফিরে আসতে পারে।

ট্রেন্টের কাউন্সিলের পটভূমি : অনেক দিন আগে থেকেই বিশপদের একটি জেনারেল কাউন্সিল ডাকার জন্য দাবি করা হচ্ছিল। ১৫২৩ সালে নুরেমবুর্গ ডায়েট গির্জার বিভক্তি দূরীকরণের জন্য একটি জেনারেল কাউন্সেলের অধিবেশনের নির্দেশ দেয়। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় সম্প্রদায় একটি কাউন্সিল চাইলেও পোপ এতে কান দেন নি। এর দ্বারা পোপ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত ছিলেন। তা ছাড়া যেসব ত্রুটিতে তাদের কায়েমি স্বার্থ ছিল সে সব ত্রুটি দূর করতে পোপেরা মোটেই আগ্রহী ছিলেন না এবং পোপের ক্ষমতার ক্ষতি করে সম্রাটের ক্ষমতা বাড়ানোর যে কোনো সংস্কারের তারা বিরোধী ছিলেন। কিন্তু পোপের পার্থিব স্বার্থ কাউন্সিল ডাকা বিলম্ব করলেও ধর্মে ধর্মীয় ত্রুটির বিরুদ্ধে জনগণ এত বেশি সোচ্চার হচ্ছিল যে, কোনো পোপ কাউন্সিল ডাকা বন্ধ করতে পারেন না। কার্ডিনাল ফারনেসে গির্জা সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন। এ কারণে তিনি সহজে পোপ নির্বাচিত হন। তিনি তৃতীয় পল উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫৩৬ সালে মান্টুয়াতে কাউন্সিল ডাকা হয়। কিন্তু পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যে যুদ্ধের কারণে এটা স্থগিত করা হয়। ১৯৩৫ সালে ১৩ ডিসেম্বর ট্রেন্টে কাউন্সিল এর প্রথম অধিবেশন বসে।

কাউন্সিলের আলোচনার বিষয় : ট্রেন্টের কাউন্সিলে আগে সংস্কার না ধর্ম বিষয়ে আলোচনা হবে এ নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। সম্রাটের প্রতিনিধি কার্ডিনাল মাডরুজ্জো ও স্পেনীয় বিশপরা সংস্কারকে অগ্রাধিকারকে দেওয়ার দাবি করে। পোপের প্রতিনিধিরা উপলব্ধি করে যে, এ ধরনের সংস্কার পোপকে সাংঘাতিকভাবে বিব্রত করবে। তাই তারা একই সাথে সংস্কার ও ধর্ম বিশ্বাস আলোচনার করার ফেলটারের বিশপের সংকারের প্রস্তাব গ্রহণ করে।

কাউন্সিলের কর্মকাণ্ড : ট্রেন্টের কাউন্সিল এর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে কোনো সমঝোতা অসম্ভব করে। কিন্তু এটা ক্যাথলিক অবস্থান পরিষ্কারভাবে নির্ধারণে সাহায্য করে। এটা বলা হয় যে, বাইবেল ও যিশুর বাণী সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল বাইবেলের উপর প্রোটেস্ট্যান্টদের জোর দেওয়ার বিপরীত। পরে এটি আদি পাপ ও জাস্টিফিকেশান বাই ফেইথকে (যিশু খ্রিস্টের বিশ্বাস দ্বারা মানুষের সততা প্রমাণ) বর্জন করে। শেষে কাউন্সিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। জাস্টিফিকেশানের উপর কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একজন ক্যাথলিক ইতিহাসবিদ বলেন, এটি ধর্মতত্ত্বের উপর একটি প্রখ্যাত সিদ্ধান্ত। এটা পরিষ্কারভাবে ও নির্দিষ্টভাবে ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসের মান নির্ধারণ করে। এটা ক্যাথলিক বিশ্বাস এবং একদিকে পিলেজীয় ভুল অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট ত্রুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। ট্রেন্টের কাউন্সিলে ক্যাথলিক গির্জার সংস্কারের প্রশ্নে অনেক দ্বন্দ্ব হয়। তবে কাউন্সিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলো ছিল : বিশপদেরকে সঠিকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে এবং তাদেরকে তাদের এলাকায় বসবাস করতে হবে। গির্জা মেরামত ও অন্যান্য ব্যাপারে গির্জা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও পোপ তৃতীয় পলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পোপের প্রতিনিধিরা প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সুযোগ নিয়ে কাউন্সিল সভা ট্রেন্ট থেকে বলোগনাতে স্থানান্তরিত করার সুপারিশ করে। এটি পোপের ভূখণ্ডে ছিল। সম্রাট তার বিশপদেরকে ট্রেন্টে থাকতে নির্দেশ দেন। এ বিভক্তির মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়।

কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন : সম্রাট পঞ্চম চার্লসের ভাগ্যের অবনতি এবং বৃদ্ধ পোপ তৃতীয় পলের স্থলে সমঝোতাপন্থী তৃতীয় জুলিয়াস (১৫৫০-১৫৫৫) পোপ নির্বাচিত হওয়ায় দ্বিতীয় কাউন্সিল ডাকা হয়। এ অধিবেশন সংক্ষিপ্ত সময়ে তবুও এ সম্মেলনে যিশুর ভোজ, প্রায়শ্চিত্ত ও ধর্মানুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে তৈল লেপন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রথমটি প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জাসমূহের সাথে সমঝোতা অসম্ভব বলে উল্লেখ করে। এটা পরিচর্চার ভাষায় যিশুর ভোজের ক্ষেত্রে লুথার, জুইংলি ও ক্যালভিনের মতের নিন্দা করে এবং ট্রান্স-সাবস্ট্যান্টসিয়েশন তত্ত্বকে পুনঃনিশ্চিত করে। এটি এ ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারেনি। সম্রাট খুব ক্লান্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আবার বিদেশী শাসকরা একটি সংগঠন করে যাদের সাথে সাফল্যের সাথে যুদ্ধ করা কঠিন ছিল। অবস্থার প্রেক্ষিতে কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয়।

তৃতীয় সম্মেলন ও এতে পোপের সুবিধা : পরবর্তী দশকে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে – সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগ, তার মধ্যপন্থি ও সুবুদ্ধিসম্পন্ন ভ্রাতা প্রথম ফার্ডিনান্ড-এর সম্রাট পদ অধিষ্ঠা, প্রোটেস্ট্যান্টবাদের অব্যাহত সম্প্রসারণ ও উদার মনোবৃত্তির পোপ গোষ্ঠীর অবসান। কাজেই একটি পরিবর্তিত বিশ্বে ট্রেন্টে কাউন্সিলের তৃতীয় অধিবেশন বসে। এটি ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কারের উপর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। যিশুর ভোজ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য নতুন যাজক সভাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আত্মার পাপ স্খলনের জায়গায়, সাধু ব্যক্তিদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা এবং সাধু ব্যক্তির দেহাবশেষ ও মূর্তিকে সম্মান করা সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ধর্ম যাজকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রত্যেক বিশপ জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেন্টের কাউন্সিলে পোপ লাভবান হন। তিনি তার বিরোধীদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কাউন্সিলের ঘোষণা বৈধতার জন্য তার সম্মতির প্রয়োজন হতো। পোপ ১৫৬৪ সালে নভেম্বর মাসে ‘ক্রিড অব পোপ পিয়াস দ্য ফোর্থ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশনা করে। এই গ্রন্থে ক্যাথলিক ধর্ম-বিশ্বাসের প্রধান তত্ত্ব উল্লেখ করেন। কাউন্সিল সভায় পোপের একনায়কতন্ত্র সীমিত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ট্রেন্টের সভার পর আর কোনো সুযোগ থাকল না। তথাপি যদিও ট্রেন্টের কাউন্সিল ধর্মে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভঙ্গের জন্য অনেক কিছু করে। তবে এটি রোমান ক্যাথলিক ধর্মের তত্ত্বকে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং গির্জার ধর্মযাজক ও সাধারণ উপাসকের মধ্যে ঐশ্বরিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করে।

ইনকুইজিশন ও পেপাল ইনডেক্স : ইনকুইজিশন প্রথম স্পেনে প্রতিষ্ঠা হয় মূলত স্পেনীয় মুসলমান ধর্ম বিশ্বাসীদেরকে এবং ইহুদিদেরকে ধর্মদ্রোহের দায়ে ইনকুইজিশনে বিচার করার জন্যে। স্পেনে ইনকুইজিশান সাফল্যের সাথে কাজ করেছিল। এ সাফল্য দ্বারা স্পেনে পোপের প্রতিনিধি কার্ডিনাল কারাফ্ফা এত প্রভাবিত হন যে, তিনি পোপ তৃতীয় পলকে এরকম আদালত প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইতালির শহরে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের বিস্তৃতির দ্বারা ভীত হয়ে ১৫৪২ সালে ২১ জুলাই জারিকৃত একটি বুল দ্বারা পোপ রোমান ইনকুইজিশন গঠন করেন।

ইনকুইজিশনে বিচার : রোমান ইনকুইজিশন ছিল অমানবিক। এর বিচার পদ্ধতি ছিল খারাপ। অভিযুক্তদের জন্য বিচার ছিল কষ্টকর, পরিবেশ ছিল গোপন, ফৌজদারি কার্যপ্রণালী ছিল অন্যায়। এর চূড়ান্ত রায় ছিল আগুনে পুড়িয়ে মারা। ইনকুইজিশন ধর্মদ্রোহকে বাধা প্রদান করে কিন্তু এটি স্পেনের ইনকুইজিশনের ন্যায় জনপ্রিয় ছিল না। ইনকুইজিশনে বিচারকরা সপ্তম শতাব্দীতে গ্যালিলিওকে ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্যাসানোভাকে গ্রেপ্তার করেছিল।

পেপাল ইনডেক্স : ইনকুইজিশনের সাথে পেপাল ইনডেক্স নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। অনেক গ্রন্থ ধর্মদ্রোহিতা সৃষ্টি করত। জেনেভা ও ফ্রাঙ্কফুটের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো আনা হতো। সুতরাং এ ব্যাপারে ধর্মদ্রোহিতামূলক গ্রন্থ নিষিদ্ধকরণ একটা প্রতিবন্ধক হতে পারে। ১৫৪৩ সালে ইনকুইজিটর জেনারেল জোর দিয়ে বলত যে, পোপের অনুমতি ব্যতীত কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করা যাবে না। ষোল বছর পর ১৫৫৯ সালে পোপ চতুর্থ পল (১৫৫৫-১৫৫৯) ইনডেক্স ইস্যু করেন, যা এখনো বই পড়ার ব্যাপারে রোমান ক্যাথলিকদের পথ নির্দেশক। ইনডেক্স হলো একটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ তালিকা। এটাকে তিন অংশে ভাগ করা হয়। এক অংশে ছিল ইরাসমাসের মতো লেখকের লেখনী। তাদের গ্রন্থ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ পোপের মতে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যাথলিক ধর্মের অপব্যাখ্যা করে। যেসব লেখকের লেখনী মানুষকে ধর্মদ্রোহী করতে পারত তাদের গ্রন্থের অন্য একটি তালিকা ছিল। শেষত অনিষ্টকর তথ্য ছিল এমন বইয়ের ছিল তৃতীয় একটি তালিকা। এগুলো ছিল নিশ্চিতভাবে অত্যাচারমূলক পন্থা। তা সত্ত্বেও ইনকুইজিশন ও পেপাল ইনডেক্স উভয়ই ধর্মদ্রোহিতার অগ্রগতিকে বাধা দিতে সহায়তা করে এবং প্রতিসংস্কার আন্দোলনে অবদান রাখে।

প্রতি সংস্কার আন্দোলনের ফলাফল

(১) ক্যাথলিক ধর্মের পুনঃজীবন : প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ফলে ধর্মীয় দায়িত্ব একটি সম্মিলিত দায়িত্ব হিসেবে গুরুত্ব পায়, যা ব্যক্তিজীবন ও গির্জায় মানবজীবনের মান উন্নয়নে অবদান রাখে। কখনো কখনো জেসুইটদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ধর্মযাজক ও সাধারণ উপাসকের প্রশিক্ষণ উন্নত করা হয়। ১৫৬৬ সালে একটি নতুন প্রশ্নোত্তরিকা প্রকাশনা সাধারণ উপাসকদেরকে ধর্ম বিশ্বাসের একটি পরিষ্কার ও প্রমাণিত বিবরণ সরবরাহ করে। প্রার্থনাপুস্তক ও বাক্য সংক্ষেপের সংস্কার সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সর্বোপরি পেশার অর্থ সম্পর্কে জোড়ালো উপলব্ধিতে নিহিত ছিল ধর্মীয় পুনঃজীবনের শিকড়।

(২) প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত এলাকায় ক্যাথলিক ধর্মের বিস্তার : প্রোটেস্ট্যান্টবাদে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ও অঞ্চলকে পুনঃদখলের একটি সর্বব্যাপি প্রচেষ্টা হলো ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফলাফল। এ প্রচেষ্টাকে সময় সময় সামরিক বাহিনীর সদস্য ও নির্যাতনের কঠোরতার সহায়তা করে। ক্যাথলিক ধর্মের দিকে পোল্যান্ডকে ফিরিয়ে আনা হয়। সাম্রাজ্যের ভিতর পূর্ণ ধর্মান্তরকরণ দৃঢ়ভাবে চলতে থাকে। প্ররোচনা ও নির্যাতন উভয়ের সাহায্যে বিশপরা ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রচেষ্টা চালায়। জেসুইটদেরকে আনা হয়, ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করা হয়, গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সাধারণ জনগণকে যিশুর ভোজে বিশ্বাস অথবা দেশান্তরের মতো স্থূল বিকল্প দেওয়া হয়। ক্যাথলিক শাসকরা এরকম উদ্যম পোষণ করে। তাদের মধ্যে কেবল সম্রাটের পরিবার বেশি সংযম দেখায়। পঞ্চম চার্লস-এর অবস্থা দেখে তার ভ্রাতা প্রথম ফার্ডিনান্ড অগসবার্গের ধর্মীয় শান্তি চুক্তি আনয়ন করেন। দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ানকে (১৫৬৪-১৫৭৬) প্রায় প্রোটেস্ট্যান্ট হিসেবে সমালোচনা করা হয়। তার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় রুডলফ (১৫৭৬-১৬১২) রাজ্যশাসন থেকে জ্যোতির্বিদ ও পরশ পাথর অনুসন্ধানে বেশি মনোযোগী ছিলেন।

(৩) ক্যাথলিক ধর্মের প্রসার : প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ফলে ইতালি ধর্মদ্রোহ থেকে মুক্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের কারণে ফ্রান্স বিভক্ত ছিল। ১৫৮৯ সালে চতুর্থ হেনরি (১৫৮৯-১৬১০) নামে একজন হিউগেনোকে রাজা হিসেবে স্বীকার করে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। ক্যাথলিক পত্নীক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুইডেনের রাজা তৃতীয় জন (১৫৩৭-১৫৯২) রোমান গির্জার সাথে সমঝোতা করেন। এদিকে প্রতিসংস্কার আন্দোলন ইউরোপের অনেকদেশে পার্থিব উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় ফিলিপ (১৫৫৬-১৫৯৮) প্রতিসংস্কার আন্দোলনকে স্পেনীয় স্বার্থ ও ইউরোপে স্পেনীয় কর্তৃত্ব স্থাপনে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। হ্যাপসবার্গ বংশে কঠোর ক্যাথলিক সম্রাট দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড (১৬১৯-১৬৩৭) দ্বিমুখী উদ্দেশ্যের উপর কাজ করেছিলেন। (১) ক্যাথলিক ধর্মের জন্য আত্মার পুনরুদ্ধার; (২) বংশানুক্রমিক অঞ্চলে হ্যাপসবার্গ নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আত্ম স্বার্থবাদী শাসকরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে ঢেকে দেওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করত। পরে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ছিল সমাজের উপর ধর্ম ও রাজনীতির কর্তৃত্বপূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রতিসংস্কারে আন্দোলনের ফলে ক্যাথলিক চার্চ পূনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী হয়েছিল। চার্চের মধ্যে যে অরাজকতা অনাচার ও কলুষতা ছিল তা দূরীভূত হয়েছিল এবং ক্যাথলিক মতবাদ স্পষ্টভাবে পুনঃনির্ধারিত হয়েছিল।

(৪) পোপতন্ত্রের উপর প্রভাব : পরিবর্তীত প্রকৃতির পোপতন্ত্র প্রতিসংস্কার আন্দোলনের একটি ফসল। রেনেসাঁসের ফলে পোপের স্বজনপ্রীতি অদৃশ্য হওয়া আরম্ভ করে যদিও প্রিয়তোষণ থেকে যায়। তখনকার পোপেরা যেটিকে গির্জার প্রকৃত স্বার্থ মনে করতেন সেটিতে পার্থিব ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসে যোগ হয়। জ্ঞানী কারাফফার চতুর্থ পল হিসেবে পোপ নির্বাচনের সাথে সাথে প্রতি সংস্কার আন্দোলন পিটারের সিংহাসন দখল করে। তার উত্তরাধিকারী চতুর্থ পিয়াস (১৫৫৯-১৫৬৫) বেশি সমঝোতাপন্থি ও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ট্রেন্টের কাউন্সিল ডাকেন এবং এর পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন। পঞ্চম পিয়াস (১৫৬৬-১৫৭২) তার উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন প্রতিসংস্কার আন্দোলন পোপতন্ত্রের জীবন্ত আদর্শ। তিনি পোপের রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। তিনি প্রথম এলিজাবেথকে (১৫৫৮-১৬০৩) একঘরে করেন। তিনি স্পেন ও ভেনিসের সাথে বন্ধুত্ব করে তুর্কিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে লেপনটোর নৌযুদ্ধে জয় লাভ করেন। তার উত্তরাধিকারী ত্রয়োদশ গ্রেগরি (১৫৭২-১৫৮৫) একই রকম উদ্যোগী ছিলেন। তিনি এলিজাবেথের বিরুদ্ধে আইরিশ বিদ্রোহীদেরকেও ফরাসি হিউগোনীদের বিরুদ্ধে ক্যাথলিককে সমর্থন করেন। পরবর্তী পোপ পঞ্চম সিক্সটাস (১৫৮৫-১৫৯০) পোপ-এর রাষ্ট্রের সংস্কার করেন। প্রতিসংস্কার আন্দোলনের তিনি যোগ্য পোপ ছিলেন। পোপের নির্বাচনে রাজনীতির প্রবেশ, পোপ-এর নীতি গ্রহণে আবার অবদান রাখতে আরম্ভ করে। তবে প্রথা প্রবর্তন হয় এবং জনমত দাবিও স্বীকার করে যে, পিটারের উত্তরাধিকারী হিসাবে পোপ গির্জার প্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত হবেন, ব্যক্তিগত খামখেয়ালী বা পার্থিব আকাঙ্ক্ষা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হবেন না।

অনেক পোপকে সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেখানো হয় যে, কীভাবে ধর্মীয় পুনঃজীবন ভ্যাটিকানে প্রবেশ করে। কিন্তু এ সময়ে পোপ ছাড়াও কিছু সাধু ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তারা মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কঠোরতার সাথে পার্থিব বিষয়ের সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। অভিলার সেন্ট থেরেসা একদিকে যেমন ছিলেন উচ্চস্তরের মরমী অন্যদিকে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী কর্মদক্ষ মহিলা। তিনি ভিসক্যালসের কারমেলাইট নামে একটি সংস্কারকৃত সন্ন্যাসিনীর সম্প্রদায় গঠন করেন। কঠোরতার দিক দিয়ে এটা ছিল মধ্যযুগীয় কিন্তু এর ব্যবহারিক ভক্তিতে এটা ছিল উপযোগবাদ সম্বন্ধীয়। ধর্মীয় ভক্তির উপযোগী দিক ছিল প্রতিসংস্কার আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য। এ সময় অনেক সাধু ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, সামাজিক কাজেও তাদের সময় দেওয়া উচিত।

এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী দু’জন ইতালীয় সাধু ছিলেন। তারা হলেন সেন্ট কারলো বারোমিও ও সেন্ট ফিলিপনেরী। প্রথম ব্যক্তির প্রবল দায়িত্ববোধ ছিল। তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি রোমান প্রশ্নোত্তরিকা সম্পাদনা করেন। বাইবেলের ল্যাটিন অনুবাদ, প্রার্থনা পুস্তক ও বাক্য সংক্ষেপে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৫৭০ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে যান এবং সেখানে ক্যাথলিক ধর্মের জন্য তিনি অনেক কিছু করেন। তার উদ্যোগে সেখানে জেসুইট ও কাপুচিনরা যান। ১৫৭৯ সালে তিনি মিলানে একটি হেলভেসীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার মিলানের আর্চবিশপ এলাকায় অনেক সংস্কার কাজ করেন। তার সমসাময়িক সেন্ট ফিলিপ নেরী ছিলেন এ ধরনের আরেকজন সাধু ব্যক্তি। তিনি অরেটরীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাধারণ ধর্ম যাজকদের ধর্মীয় জীবন উন্নয়নে অনেক কিছু করেছিলেন। সক্রিয় খ্রিস্টান ধর্মের মূল সুর ছিল প্রতিসংস্কার আন্দোলন। গির্জার দু জন ফরাসি প্রতিনিধি তারা হলেন ফ্রান্সিস ও সেন্ট ভিনসেন্ট দা পল। প্রথম ব্যক্তি একজন সুশিক্ষিত ও ভদ্র ধর্ম যাজক ছিলেন। ১৬০২ সালে তাকে জেনেভার বিশপ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি শত্রুভাবাপন্ন ক্যালভিনপন্থিদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করেন। ক্যাথলিক ধর্মের ভক্তির উপর তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন এগুলো হলো— লাভ অব গড ও ইনট্রোডাকশান অব এ ডিভাইড লাইফ। ভিনসেন্ট দা পল গির্জার সামাজিক শিক্ষাদানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ধর্ম যাজক হওয়ার পর জলদস্যুরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা তাকে তাদের জাহাজের রন্ধনশালার দাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে। পালিয়ে যাবার পর তিনি জাহাজে রন্ধনশালার ভৃত্যদের অবস্থার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। এরজন্য তিনি বরডিয়াক্স ও মাসাইয়ের জাহাজে সময় কাটান। ফরাসি শহরগুলোতে ধর্মান্তর করনের কাজ করার নিমিত্তে ধর্মপ্রচারকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তিনি চাট্রেসে কংগ্রিগেশন অব মিশনস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সিস্টার্স অব চ্যারিটি নামে একটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায় গঠন করেন, যা নার্স পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

(৫) শিল্পকলার উপর প্রভাব : প্রতিসংস্কার আন্দোলন ক্যাথলিক গির্জার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। বারোক স্থাপত্য শিল্প (গির্জায় ব্যবহৃত স্থাপত্য শিল্প) ছিল ক্যাথলিক পুনরুজ্জীবনের একটি ফসল। এর জাঁকজমকপূর্ণ উপকরণ কারলো ম্যাডেরনার গির্জার বেশি লোক সমাগমের জায়গায় ও রোমের সেন্ট পিটারের গির্জার সম্মুখভাগে ব্যবহৃত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল গির্জার অনুষ্ঠানাদি আড়ম্বরে পূর্ণ করা। যদি বারোকের অভ্যন্তরীণ ভূষণ হালকা পীতবর্ণ, ও সোনালি পলস্তার এবং বঞ্চিত কাঠ ও অতীব রঙিন মূর্তি প্রধানত যিশুর সম্মানের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, সন্দেহবাদী ও ধর্মদ্রোহীদেরকে ক্যাথলিক বিশ্বাসে ধর্মান্তরিত করাও ছিল এদের ইচ্ছা। রোমের জেসুইট গির্জা হলো বারোক স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নমুনা। পিটার ক্যানিসিয়াস বলেন, উদ্ভাবনকারীরা গির্জা অলংকরণে আমাদের বিরুদ্ধে অমিতব্যয়িতার অভিযোগ আনে; এটা জুডাস কর্তৃক মেরি ম্যাগডালেনের যিশুকে মূল্যবান মলম ব্যবহারের নিন্দা করার মতো দেখায়। একই রকমভাবে সাহিত্যও প্রভাবিত হয়। টরকুয়াটো টাস্সো তার জেরুজালেম নামক মহাকাবো নায়ক হিসেবে গডফ্রে বাউলন নামক একজন খ্রিস্টানকে নির্বাচন করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের গভীরতা এল- গ্রেফোর চিত্রশিল্পে ও প্যালেস্ট্রিনার সঙ্গীতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তার যিশুর ভোজ অনুষ্ঠানের সঙ্গীত হল ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা সঙ্গীতের একটি উৎকৃষ্ট নমুনা।

তথ্যসূত্র

আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১০৯-১২০

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.