সম্রাট পঞ্চম চার্লস (১৫১৬-১৫৫৫)

ষোড়শ শতকের ইউরোপে ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন সম্রাট পঞ্চম চার্লস (১৫১৬-১৫৫৫)। ১৫১৬ থেকে ১৫৫৫ ফ্রান্সে রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল পঞ্চম চার্লসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৫১৯ সালে তার পদবির তালিকা ছিল নিম্নরূপ : রোমানদের রাজা, সদ্য নির্বাচিত সম্রাট; সেমপারা অগাস্টাস, স্পেন, সিসিলি, জেরুজালেম, ব্যালিরিক দ্বীপপুঞ্জ, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আটলান্টিকের অপর পারের মূল ভূখণ্ডের রাজা; অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক, বার্গান্ডি, ব্রারান্ট, স্টিরিয়া, ক্যারিনথিয়া, কারনিওলা, লুক্সেমবার্গ, লিমবার্গ, এথেন্স ও পাট্রান্সের ডিউক হ্যাপবার্গ, ফ্লান্ডার্স ও টাইরলের কাউন্ট, বার্গান্ডি, হৈনন্ট, এশিয়া ও আফ্রিকার লর্ড।

শৈশব ও  রাজক্ষমতা লাভ

পঞ্চম চার্লসের জন্ম ও শৈশব : পঞ্চম চার্লস ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডস রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চার্লস লেখাপড়ায় পারদর্শী ছিলেন না। তবে তিনি স্বল্পভাষী এবং অশ্বরোহী বিদ্যার পারদর্শী ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চল তার সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও তিনি কোনো ভাষাই ভালো করে জানতেন না। তার জন্মগত ভাষা ছিল ফরাসি, কিন্তু এ ভাষায়ও তিনি অনরগল কথা বলতে পারতেন না। ল্যাটিনও জার্মান ভাষায়ও তার দক্ষতা ছিল না। স্পেনের রাজা হওয়ার দুই বছর পরেও তিনি স্পেনীয় ভাষা আয়ত্ত করতে পারেন নি। ধর্মতত্ত্বে তার জ্ঞান ছিল অগভীর। ত্রিশ বছর বয়সের পর তিনি গণিত শিক্ষা আরম্ভ করেছিলেন। ছোটকালে তিনি ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন এবং এ ভাষাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে কথাবার্তা বলতে পারতেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও ফরাসিদের ন্যায় মার্জিত ফরাসি ভাষা তিনি কখনও আয়ত্ত করতে পারেন নি। পঞ্চম চার্লস সম্রাট হওয়ার পূর্বে প্রথম চার্লস নামে পরিচিত ছিলেন। যুবককালে তার চারিত্রিক বল ও বুদ্ধিমত্তা বেশি ছিল না। তবে অনভিজ্ঞ যুবক ক্রমান্বয়ে একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বাসী ব্যক্তিতে পরিনত হয়েছিলেন। ১৫১২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তাকে উদ্ধত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে দেখা যায়। ক্রমে তার চরিত্র থেকে ঔদ্ধত্য চলে যায়। তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তার গর্ব ছিল সরলতা সংবলিত। শেষে তিনি পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন। বিদ্যাশিক্ষায় আগ্রহ না থাকলেও ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার খেলা, কুস্তি করা এবং বন্দুক চালনায় চার্লস দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

পঞ্চম চার্লসের রাজক্ষমতা লাভ : পঞ্চম চার্লস নেদারল্যান্ডসের শাসকের পুত্র ছিলেন। এ রাজ্যটি বিবাহসূত্রে হ্যাপসবুর্গ রাজবংশের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চম চার্লস মায়ের সূত্রে স্পেন, নেপলস ও সিসিলির রাজা হন এবং আফ্রিকা ও আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশগুলোর শাসক হন। পিতার মাধ্যমে তিনি হ্যাপসবুর্গ রাজবংশের অধীনস্থ জার্মানির এবং বার্গান্ডির রাজ্যসমূহের রাজা হন। ১৫০৬ সালে ফিলিপ দি ফেয়ার মারা গেলে ছয় বছর বয়স্ক চার্লস বার্গান্ডির রাজবংশের অধীনস্থ রাজ্যগুলোর রাজা হয়েছিলেন। বার্গান্ডির রাজবংশ অধিকৃত রাজ্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল ফ্ল্যান্ডার্স ও আর্টয়, ফ্রাঙ্কেফঁতে (বার্গান্ডির প্রদেশ), লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডসের প্রদেশসমূহ। চার্লসের প্রপিতামহ প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান বার্গান্ডির মেরীকে বিবাহ করেছিলেন বলে বার্গান্ডির রাজ্যসমূহ অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবুর্গ রাজবংশের অধীনস্থ হয়েছিল। চার্লসের বয়স ১৬ বছর হলে তিনি ১৫১৬ সালে স্পেনের রাজা হন। একই সাথে স্পেনের অধীনস্থ নেপলস সিসিলি, আফ্রিকা ও আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশসমূহ তার রাজ্যভুক্ত হয়।

সমস্যা, কার্যাবলি ও নীতি

পঞ্চম চার্লসের সমস্যা : পঞ্চম চার্লস যখন সম্রাটপদ লাভ করেন তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ১৫১৯ সালে জার্মানির ইলেক্টররা তাকে পবিত্র রোমান সম্রাট মনোনীত করলে তখন ক্যাথলিক ধর্মের ঐক্য বজায় রাখা তার দায়িত্ব হিসেবে দেখা দেয়। পঞ্চম চার্লস ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী এবং ক্যাথলিক ধর্ম রক্ষা করা ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব হিসেবে মনে করতেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তুর্কিরা ইউরোপে আক্রমণ করলে ক্যাথলিক ধর্মের রক্ষক হিসেবে ইউরোপকে তুর্কী আক্রমণ থেকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব হিসেবে দেখা দেয়। ইতালিতে রাজনৈতিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের সাথে বিরোধ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ফ্রান্সকে দমন করে ইতালিতে স্পেনের আধিপত্য বজায় রাখা তার নীতি হিসেবে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও বৃহৎ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাও তার দায়িত্ব ছিল। কেননা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত জার্মানিতে বহু সংখ্যক স্বাধীন রাজ্য ছিল। এবং এগুলোর শাসকগণ পরস্পর বিবাদবিসংবাদে লিপ্ত ছিল। মার্টিন লুথার জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচার করলে জার্মানির অনেক শাসক প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। তাই জার্মানিতে প্রভাব বজায় রাখা পঞ্চম চার্লসের জন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল।

পঞ্চম চালর্সের কার্যাবলি : উল্লিখিত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চম চার্লস সুচিন্তিত কোনো নীতি অনুসরণ করেন নি। এক্ষেত্রে ক্যাথলিক ধর্ম এবং হ্যাপসবার্গ রাজবংশের প্রভাব হয়তো তার এই সমস্যা সমাধানে অনেকটা সহায়তা করত যদিও তিনি কৌশলে এ নীতিকে কাজে লাগাতেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ক্যাথলিক ধর্মের বিষয়টি ছিল আবেগের। আবেগ হলেও তার নিকট এটি ছিল বাস্তবতা। কিন্তু ধর্মানুরাগ তার অন্যান্য সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধক ছিল। তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে সম্রাটের দায়িত্ব পালন করছেন এরূপ বিশ্বাস তার ছিল। তার মতে, ঈশ্বরের ইচ্ছা ও হ্যাপসবার্গ নীতি ছিল অভিন্ন। ক্যাথলিক গির্জার প্রতি তার অকৃত্রিম বিশ্বাস ছিল। কিন্তু পোপকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সমগ্র ক্যাথলিক বিশ্বাসী মানুষদেরকে আনুগত্যে রাখার মতো কৌশল তার জানা ছিল না। এ ছাড়া পোপরাও তাকে পুরোপুরি সহযোগিতা করে নি। তবে হ্যাপসবার্গ রাজবংশের ঐতিহ্য বা স্বার্থ তার সাম্রাজ্যের ঐক্যকে অটুট রাখতে অনেকটা সহায়তা করত। বিশেষ করে হ্যাপসবার্গ রাজবংশের ঐতিহ্য এবং ক্যাথলিক বিশ্বাস তার সাম্রাজ্যে ঐক্যের সুযোগ এনে দিয়েছিল। তার ভ্রাতা ফার্ডিনান্ড ছিলেন হাঙ্গেরির রাজা, তার এক ভগ্নির স্বামী ছিলেন ডেনমার্কের রাজা ক্রিশিয়ান, তার আর এক ভগ্নি ছিলেন পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনের স্ত্রী। তার তৃতীয় ভগ্নি এলিনরের বিয়ে হয়েছিল প্রথম ফ্রান্সিসের সাথে। চতুর্থ ভগ্নি ছিলেন হাঙ্গেরির সাবেক রাণী, যিনি নেদারল্যান্ড অভিভাবক ছিলেন। তার পরিবারের সাথে বিভিন্ন রাজবংশের আত্মীয়তার জন্য একটি কূটনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছিল। তবে তিনি ধর্ম ও বংশানুক্রমিক আত্মীয়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন নি। তার অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য বৃহৎ কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ক্যাথলিক বিশ্বের মঙ্গল সাধন তার লক্ষ্য ছিল। এজন্য ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিনি ধর্মদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে, বিশ্ব শান্তির শত্রু হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল তার নীতির লক্ষ্য ছিল। তবে রাজনৈতিক কারণে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা এবং তুর্কিদের প্রতিহত করা তার দায়িত্ব হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তবে এসব সমস্যার মধ্যেও একজন বিশ্বাসী খ্রিস্টান যার দৈহিক ত্রুটি এবং নৈতিকতাবিবর্জিত প্রবণতা ও রাজনৈতিক অসাধ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। (পঞ্চম চার্লসের খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসে কোনো শৈথিল্য না থাকলেও তার অনেক উপপত্নী ছিল। যাদের সন্তানদের মানুষ করতে তার একধরনের আগ্রহ ছিল।)

স্পেনে চার্লসের নীতি :

  • পঞ্চম চার্লস স্পেনকে ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তা করতে গিয়ে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এতে স্পেনের রাজকোষের অর্থ নিঃশেষ হয়। সে সময় স্পেন তার আমেরিকা মহাদেশের মেক্সিকো ও পেরু থেকে বিপুল সোনা পেয়েছিল, তাও যুদ্ধ খরচে নষ্ট হয়। তিনি যুদ্ধ ব্যয়ের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে তিনি অতিরিক্ত কর আদায় করতেন। স্পেনীয় সৈন্য ও অর্থ তিনি নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চম চার্লসের সাম্রাজ্যের স্বার্থ ও স্পেনের স্বার্থ এক ছিল না। পঞ্চম চার্লসের পূর্ববর্তী রাজারা অভিজাত সম্প্রদায়কে দমন করে রাজশক্তি ও জনগণের স্বার্থরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চম চার্লসের সময় জনগণের উপর সামরিক কর ও অভিজাতদের আধিপত্য বৃদ্ধি করায় জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। পূর্ববর্তী রাজত্বকালে ক্যাস্টাইলের বিভিন্ন শহর স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত কিন্তু পঞ্চম চার্লস তাদের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিহ্ন করেন। ক্যাস্টাইলের পার্লামেন্ট করটেস ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ন্যায় শক্তিশালী ছিল। কিন্তু পঞ্চম চার্লস করটেসের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন।
  • স্পেনীয় সৈন্যরা পঞ্চম চার্লসের রাজনৈতিক স্বার্থে ইতালি নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও আফ্রিকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়। অজস্র সৈন্য আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশসমুহের স্বার্থে দেশ পরিত্যাগ করেছিল। এতে স্পেনের ভবিষ্যতে সামরিক শক্তি নষ্ট হয়েছিল।
  • পঞ্চম চার্লস স্পেনের ‘মূর’ অর্থ মুসলমান ও ইহুদীদের নির্যাতন করতেন। ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে ইনকুইজিশন (Inquisition) আদালত স্থাপন করে অখ্রিস্টান অনেক মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। এতে স্পেন অনেক দক্ষ জনশক্তি হারায়। তবে পঞ্চম চার্লসের রাজত্বকালে স্পেন, আমেরিকা, মেক্সিকো মধ্য আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা, নিউ, গ্রানাডা, পেরু, বলিভিয়া, চিলি প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও আমেরিকায় স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপন তার কৃতিত্ব বলা যেতে পারে।

স্পেনের বিদ্রোহ বা কমুনারোসের বিদ্রোহ

১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্দ মারা গেলে তার মেয়ে জোয়ানার স্পেনের রানী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জোয়ানা মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় তার বড় ছেলে চার্লস (পঞ্চম চার্লস) স্পেনের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। স্পেনীয়রা চার্লসকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। এসময় স্পেনে অভিভাবক বৃদ্ধ ফার্ডিনান্ড জিমেনেজ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপারগ হন। পুরাতন মিলেশিয়া পুনঃপ্রবর্তন করায় তার প্রচেষ্টাকে স্পেনের নগরগুলো বাধা প্রদান করে এবং অভিজাতরা শহর পুনরায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফ্লেমীয় প্রভাবের জন্য অভিজাতরা ভীত হয়ে চার্লসের ভ্রাতা ফার্ডিনান্ডকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র করে। এই অবস্থায় চার্লসের জন্য নেদারল্যান্ডস থেকে শীঘ্রই স্পেনে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। স্পেনে যাওয়ার সময় তিনি বহুসংখ্যক সহচর নিয়ে যান এবং তাদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। এতে স্পেনীয় অভিজাতরা বিক্ষুব্ধ হন। চার্লস ১৫১৭ সালে ৩০শে অক্টোবর ক্যাসটাইলের কনষ্টাপোলের সাথে যোগাযোগ করেন। টরডেসিপ্লাসের মাতা জোয়ানার সাথে সাক্ষাতের পর তিনি ভায়াদোলিদের দিকে যাত্রা করেন। সেখানে করটেস (স্পেনীয় পার্লামেন্ট) চার্লসকে শর্ত সাপেক্ষে রাজা হিসাবে মেনে নেয়। চার্লস স্পেনে আসলে অভিযোগের ক্রমবর্ধমান তালিকা এবং আগত গোলযোগের দৃষ্টিগোচর লক্ষণ প্রদর্শিত হয়। চার্লস সাক্ষাত করার পূর্বেই স্পেনের রাজ অভিভাবক জিমেনসের মৃত্যু হয়। ১৫৭৮ সালে ২রা ফেব্রুয়ারি স্পেনের প্রতিনিধি পরিষদের (করটেস) অধিবেশন শুরু হয়। চার্লস শপথ করেন যে, তিনি দেশের প্রথা ও ঐতিহ্যকে মেনে চলবেন এবং কেবল স্পেনীয়দেরকে চাকরিতে নিয়োগ দিবেন। এ প্রেক্ষিতে করটেস চার্লসকে মায়ের সাথে দ্বৈতশাসক মনোনীত করা হয় এবং তিন বছরের জন্য তাকে সাবসিডয়ারি মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু এ সময় তার সহযোগী ফ্লেমীয় উপদেষ্টাদের কারণে গোলযোগ শুরু হয়।

সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ন ১৫১৯ সালে মৃত্যুবরণ করলে স্পেনের পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। চার্লস সম্রাটের পদ গ্রহণ করার জন্য স্পেন ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হলে ক্যাস্টিলীয়দের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ চার্লসের দেশত্যাগ করে জার্মানিতে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ক্যাস্টাইল ভ্রমণ করার অপারগতা, একজন ফ্লেমীয় ইউট্রেক্টের এড্রিয়ানকে প্রকৃত অবিভাবক নিয়োগ, আরো সাবসিডি দাবি এবং দূরবর্তী ও আপেক্ষিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ শহর গ্যালিসিয়ার সান্টিয়াগোতে কারটেস এর অধিবেশন আহ্বান চার্লসের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। স্পেনীয় বিক্ষুব্ধরা টলেডোতে বিদ্রোহ আরম্ভ করে। ক্যাস্টাইলের “কুমুনারোস” এর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল রাজার বিরুদ্ধে দুটি শক্তিশালী সামাজিক শক্তি—জুয়ান পাড়িয়া ও টিলেডোতে পেড়ো লাসো কর্তৃক পরিচালিত শহরসমূহ ও পেদ্রোদা গিরনের নেতৃত্বে অভিজাতগণ অনেক জায়গায় গির্জা বিদ্রোহ সমর্থন করে। এর নেতা ছিল জামোবার বিশপ এন্টিনিও ডা একুনা। বিদ্রোহীরা জয়লাভ করে ১৫১৯ সালে ২০শে অগাস্ট সান্তাজান্তা নামে একটি সরকার গঠন করে। জান্তার দাবি ছিল সমসাময়িক অভিযোগ নিরসন ও ভবিষ্যৎ সংবিধানের জন্য আবেদন। অভিযোগ ছিল বিদেশী কর্মচারী ও বণিক উভয়ের মধ্যে ঈর্ষা, স্পেন থেকে মূল্যবান ধাতু পাচার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। শহরগুলো কেরটেসের আমুল সংস্কার দাবি করে। অভিজাতরা চাকরি ও কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দাবি করে। কিন্তু বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভক্তি থাকায় এবং বিদ্রোহীরা অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করলে অভিজাতরা একজোট হয়ে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। চার্লস বিদ্রোহীদের প্রতি বিশেষ করে অভিজাতদের প্রতি সমঝোতার নীতি গ্রহণ করলে অভিজাতরা চার্লসের পক্ষে কাজ শুরু করে। গৃহযুদ্ধের কেন্দ্র ছিল ভায়াদোলিদ ও টলেডো সেখানে জনগণ বিশপ একুনাকে আর্চবিশপ হিসেবে ঘোষণা করে।

উত্তরাঞ্চলে পাডিয়া বিদ্রোহ পরিচালনা করছিল। ভিয়ালারের যুদ্ধে (Battle of Villalar) তার অনুসারীরা পরাজিত হয়। ভায়াদোলিদও আত্মসমর্পণ করে টলেডো ১৫২০ সালে অক্টোবর পর্যন্ত পরাজিত থাকে। পরে নাভারের সীমান্তে বিশপ গ্রেফতার হন। বিদ্রোহের অপরাধে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই দুই স্থানের বিদ্রোহ দমনের পর ক্যাস্টাইলের বিদ্রোহ শেষ হয়। ভ্যালেনসিয়ার বিদ্রোহ তখনো শেষ হয়নি। এখানে জনগণ অভিজাতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। উভয়ে সরকারের বিদ্রোহ দমনের প্রচেষ্টা অবজ্ঞা করে। ভ্যালেনসীয়রা পরিশেষে পরাজিত হয়। সুতরাং চার্লস যখন জার্মান সৈন্য ও ৭৪টি কামান নিয়ে স্পেনে প্রত্যাবর্তন করেন তখন পরিস্থিতি শান্ত হয়। তিনি স্পেনে বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে ৩০০ বিদ্রোহীকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়নি। “কমুনারোস” এর ব্যর্থতা স্পেনে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান ঘটায়। ক্যাস্টাইল ও এ্যারগোনে করটেস বলবৎ থাকে। রাজা বিদেশীদের অর্থাৎ ফ্লেমিশ বা অন্যান্যদের নিয়োগ না দিয়ে স্পেনীয়দের উচ্চ রাজপদে নিয়োগের আশ্বাস দেন এমনকি প্রজাদের ইচ্ছানুসারে পর্তুগালের রাজার ভগ্নী ইসাবেলাকে বিয়ে করেন।

জার্মান সমস্যা

পঞ্চম চার্লস একজন গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ১৫১৯ সালে রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান (১৫০৮-১৫১৯) মারা গেলে পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সম্রাট পদপ্রার্থী হন। সে সময় জার্মানির সাত জন ইলেক্টর পবিত্র রোমান সম্রাট নির্বাচনে ভোট দিত। ষোড়শ শতকে প্রথাগতভাবে অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবুর্গ রাজবংশের শাসকরাই পবিত্র রোমান সম্রাটপদে নির্বাচিত হতেন।

পবিত্র সম্রাট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা : পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ নিয়ে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এবং স্পেনের রাজা চার্লসের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। দুজনেই নির্বাচকদের প্রচুর অর্থ ঘুষ দিয়ে সম্রাট পদ লাভে সচেষ্ট হন। কারণ সে সময় পবিত্র রোমান সম্রাট উপাধিটা ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানজনক উপাধি ছিল। চার্লস পূর্ববর্তী সম্রাট প্রথম ম্যাক্সি মিলিয়ানের পৌত্র এবং সে সূত্রে হ্যাপসবার্গ রাজবংশের সন্তান ছিলেন। চার্লস পরিশেষে পোপের সমর্থন লাভ করে সর্বসম্মত ভোটে পবিত্র রোমান সম্রাট নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি সম্রাট পঞ্চম চার্লস নামে পরিচিত হন। কারণ তিনি ছিলেন চার্লস নামধারী পঞ্চম সম্রাট। সম্রাট নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর তিনি জার্মানিতে যান এবং ১৫২০ সালে তার অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। স্পেনে প্রত্যাবর্তনের আগে চার্লস জার্মানির ওয়ার্মস নামক স্থানে ১৫২১ সালে জার্মানির ডায়েট বা পার্লামেন্টের এক সভা আহবান করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য ও অর্থ সংগ্রহ করা। জার্মান ডায়েট তাকে ২৪ হাজার সৈন্য ও কিছু অর্থের অনুমোদন দেন, যা ছিল চার্লসের প্রত্যাশার চেয়ে কম।

নাইটদের বিদ্রোহ : চার্লস জার্মানির সম্রাট হলেও সাম্রাজ্যের সংবিধানিক বিষয় নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছিল। কাউন্টিস অব রিজেন্সী (রাইখস রেজিমেন্ট) কে সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারক করা উচিত ছিল। কিন্তু চার্লস এ ধরনের সাংবিধানিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। কাজেই সেখানে যে কাউন্সিল গঠিত হয় তা ছিল ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে সম্রাটের অনুপস্থিতির সময় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। সম্রাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি না হওয়ায় জার্মান শাসকদের হাতেই অধিকতর ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। জার্মানিতে অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখাও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নাইটরা বা সামন্ত সম্প্রদায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দুর্দশগ্রস্ত হয়েছিল। শাসকদের ক্ষমতাবৃদ্ধি, সামন্ত আইনকে রোমান আইন দ্বারা প্রতিস্থাপন এবং ব্যক্তিগত যুদ্ধ ও লুণ্ঠন নিষিদ্ধ করার সামন্ত স্বাধীনতা সীমিত হয়েছিল। এর ফলে ফ্রান ভন সিকিনজেনের নেতৃত্বে রাইন অঞ্চলের নাইটরা ওয়ার্মসের ডায়েটে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বকে অগ্রাহ্য করে। এর কিছু দিন পর ট্রিয়ার নগরে আক্রমণ করে তারা গীর্জার সম্পত্তি দখল করে। সিকিনজেন ও তার সহকর্মী উলরিচ ভন হুটেন লুথারীয় ধর্ম বিশ্বাসে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু সে সময়- নাইটদের সম্মানজনক কোন অবস্থান ছিল না। সিকিনজেন তার নিজের ক্যাসলে ১৫২৩ সালে মে মাসে অবরোধে নিহত হন। হুটেন সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান। এ বিদ্রোহ দমনে চার্লস অপেক্ষা স্থানীয় শাসকদের অবদান ছিল বেশি।

জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহ: সে সময় জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় শ্রমমূল্য বৃদ্ধিতে কৃষকরা লাভবান হন। সামন্তদের শিকার, আইন ও টাইথের মত অভিযোগ সম্পর্কে তা স্বচ্ছ হয়। কৃষকরা জমিদার কর্তৃক সামন্তকর পুনঃধার্য করার বিরোধিতা করে। সে সময় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সামন্তদের ভূমি রাজস্ব হ্রাস পায়। ফলে তারা সামন্ত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। কৃষকরা জমিদারদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে ১৫২৫ সালে মার্চ মাসে কৃষকরা টুয়েলভ আরটিকেলস উত্থাপন করে জমিদার কর্তৃক বনজমি দখল ও অপ্রচলিত কাজ করে নেয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। মার্টিন লুথারের নতুন ধর্মমত মানব ভ্রাতৃত্বের উপর জোর দেয় এবং গীর্জার সম্পত্তি দখলে নিষেধ করে না। মার্টিন লুথারের অনুসারী জুইকাও-এর টমাস মুনজার থুরিনজিয়াতে বিদ্রোহের আহ্বান জানায় এবং স্যাক্সনির মহল হুউসনে একটি আধা সাম্যবাদী উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করে। কাউন্ট ভন লুপথেনের জমিদারিতে বিদ্রোহ আরম্ভ হয় এবং তা দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে বিস্তার লাভ করে অস্ট্রিয়া ও স্যাক্সনির দিকে অগ্রসর হয়। মঠ, ব্যারনদের ক্যাসল ও আত্মরক্ষামূলক প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্ঠিত শহর কৃষক বিদ্রোহের স্বীকার হয়। এসব শহরের শ্রমিকরা যাজক ও সামন্তদের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু জার্মান ক্যাথলিক ও লুথারিয় শাসকরা নিষ্ঠুরভাবে কৃষক বিদ্রোহ দমন করে। এসময় মার্টিন লুথার প্রচারপত্রের মাধ্যমে শাসকদেরকে বিদ্রোহী কৃষকদের দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। হেসের ফিলিপ ও স্যাক্সনির ইলেক্টর জোন ১৫২৫ সালের মে মাসে ফ্রাঙ্কেইউসেনে কৃষক বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন। এক্ষেত্রেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার অব্যাহত রাখার বিনিময়ে শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ সময়ে এনাবাপটিস্টরা বিদ্রোহ করেছিল। এরা ছিল আধা সাম্যবাদী মতাদর্শী। প্রোটেস্ট্যান্টদের অবস্থা শক্তিশালী করার নিমিত্তে তাদের বামঘেঁষা নেতা বোথম্যান কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে হারলেমের ব্যাংকার জ্যান ম্যাথিস ও লিজেনের জ্যামের নেতৃত্বে ১৫৩৫ সালে একদল ওলন্দাজ এনাব্যাপটিস্ট মুনস্টার নগরে এসে সেখানকার শাসনব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে নগরটিকে একটি নতুন জেরুজালেমে পরিণত করার চেষ্টা করেন। শাসক দ্বারা সামরিক সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে মুনস্টারের বিশপ বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করে নগরপূর্ণ দখল করেন এবং এনাব্যাপটিস্ট নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলান।

পঞ্চম চার্লস ও মার্টিন লুথার

পঞ্চম চার্লস- এর রাজত্বকালে জার্মানিতে মার্টিন লুথার প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচার করেন। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রচার জার্মান শাসকদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবাদী ভাবধারা তৈরি হলে পবিত্র রোমান সম্রাটের ক্ষমতা হ্রাস এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। চার্লস ক্যাথলিক গির্জার সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু ক্যাথলিক ধর্ম ত্যাগ করা বা প্ৰটেস্ট্যান্ট ধর্মকে সমর্থন করা তার পক্ষে ছিল অকল্পনীয়। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটা জেনারেল কাউন্সিল, জেক এ ধর্মীয় সমস্যাটি আলোচনা করা যেতে পারে এবং মার্টিন লুথারের অভিযোগ দূর করতে পারলে ক্যাথলিক গির্জার প্রতি জার্মান প্রোটেস্ট্যান্টদের আনুগত্য ফিরে আসতে পারে। কিন্তু এটি করার জন্য পোপের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। মার্টিন লুথারের প্রচারিত ধর্মমত একটি পৃথক খ্রিষ্টধর্মে পরিণত হয়েছিল এবং এর বিশেষ অঞ্চলভিত্তিক এবং রাজনৈতিক শক্তিও তৈরি হয়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্টবাদ জার্মান শাসকদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যদান করেছিল। প্রোটেস্ট্যান্টবাদে বিশ্বাসী জার্মান শাসকরা গির্জার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আর্থিকভাবে লাভবান হয় এবং গির্জার উপর ধর্মগুরুর প্রভাবের চাইতে শাসকদের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হয় এবং তারা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পায়। এ ধর্মীয় সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে পঞ্চম চার্লস প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী স্যাক্সনির জন ফ্রেডারিক এবং হেসের ফিলিপের ন্যায় অনেক জার্মান শাসক কর্তৃক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এবং কিছু নগরের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৫২১ সালের ওয়ার্মসের ডায়েটে কাউন্সিল অব এজেন্সি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা কার্যকর করা চার্লসের পক্ষে কঠিন ছিল। ওয়ার্মসের ডিগ্রি দ্বারা মার্টিন লুথারকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে গ্রেফতার ও সম্রাটের নিকট হস্তান্তরের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ফ্রান্স ও তুরষ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করায় সম্রাটের পক্ষে মার্টিন লুথারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।

বৈদেশিক সমস্যার কারণে তাকে প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের সুবিধার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। আবার যখন বৈদেশিক সমস্যা মোকাবেলা করে চার্লস শক্তিশালী হন তখন প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। কিন্তু তার বিবেচনায় প্রোটেস্ট্যান্ট পক্ষ শক্তিশালী মনে হওয়ায় এবং নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব তাকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কম বাধা সৃষ্টি করে। জার্মানিতে ওয়ার্মসের ডায়েটের পর জার্মানিতে দুটি গোষ্ঠী তৈরি হয়। একদশ পঞ্চম চার্লসকে সমর্থন দেয় এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫২৩ সালের জানুযারি মাসে নুরেমবার্গ ডায়েটের অধিবেশনে পোপের প্রতিনিধি প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মদ্রোহিতার বিষয়ে বক্তৃতা দিলে ডায়েরির সদস্যরা একটি জেনারেল কাউন্সিল ডাকার পরামর্শ দেয় এবং পোপকে জার্মান এ্যানেট ছেড়ে দেয়ার দাবি তোলে। ১৫২৪ সালের নুরেমবুর্গ ডায়েটের ধর্ম সমস্যার বিষয়ে কোন ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। এটি একটি জেনারেল কাউন্সিল আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে জার্মান ন্যাশনাল কাউন্সিল ডাকার আহ্বান জানায় কিন্তু পোপ ও পঞ্চম চার্লস এটি সমর্থন করে নি। ১৫২৪ সালে জুন মাসে পোপের প্রতিনিধি কর্তৃক আয়োজিত রাটিসরোমে ক্যাথলিক শাসকদের একটি সভা বসে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে হেসের ফিলিপ ও অন্যান্য প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকরা ১৫২৫ সালে অক্টোবর মাসে টরগাউতে একটি লুথারীয় লিগ গঠন করে।

১৫২৫ সালে পঞ্চম চার্লস ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিসকে (১৫১৫-১৫৪৭) পরাজিত করলে পঞ্চম চার্লসের শক্তি বৃদ্ধি পায় এর প্রেক্ষিতে ১৫২৫ সালে স্পিয়ারে ডায়েট অধিবেশনে তিনি তার ভ্রাতা ফার্ডিনান্ডকে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের বিশ্বাসীদের দমনের জন্য ওয়ার্মসের ঘোষণাকে কার্যকর করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অটোমান তুর্কিরা মোহাক্‌সে হাঙ্গেরীয়দের বিরুদ্ধে জয়লাভ এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রযোগ কঠিন হয়ে ওঠে। তিনি জার্মান সাম্রাজ্যের সভাগুলিকে আবার একটি জার্মান ন্যাশনাল কাউন্সিল ডাকার আহবান জানান। ডায়েটে শাসকরা ঘোষণা করে যে, ধর্মীয় ব্যাপারে প্রতিটি শাসক এমনভাবে কাজ করবে যে সে তার আচরণের জন্য পোপ ও সম্রাটের নিকট জবাবদিহি করবে। স্পিয়ারের ডায়েট দুই দলে বিভক্ত হয় ও প্রোটেস্ট্যানটদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি পায়। ১৫২৯ সালে স্পিয়ারে আরেকটি ডায়েট অধিবেশন বসে। এ সময় পঞ্চম চার্লস তুর্কিদের পরাজিত করলে তার ক্ষমতা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্সের সাথে ক্যামব্রাই চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে ব্রাসেলস চুক্তি দ্বারা পোপ সম্রাটের আধিপত্য স্বীকার করে। এ ডায়েটের বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন ক্যাথলিক। প্রথমে তারা স্বাধীন মনোভাব পোষণ করলেও পরে সম্রাটের নির্দেশ মেনে নেয়। এর প্রেক্ষিতে সম্রাট ১৫২৬ সালের স্পিয়ারের ডায়েট অধিবেশনের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। ডায়েটে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রে ক্যাথলিকদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাবে কিন্তু ক্যাথলিক রাষ্ট্রে লুথারপন্থীদের গ্রহণ করা হবে না এবং জুইংলি ও এনাব্যাপটিস্টদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো যাবে না।

জার্মানির ৬ জন শাসক ও চৌদ্দটি শহরের সমন্বয়ে গঠিত লুথারপন্থীরা নতুন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিখ্যাত প্রোটেষ্ট ইস্যু করে, যা থেকে পরে প্রোটেস্ট্যান্ট শব্দটি নেয়া হয়। লুথারীয় শাসকদের বিরোধিতার জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য মনে হলেও কোন পক্ষই যুদ্ধের জন্য উৎসাহী ছিলেন না। বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে সম্রাটের অনেক অর্থ নষ্ট হয়েছিল। এছাড়া যুদ্ধের কারণে জার্মান শাসকদের বিভক্তি সম্রাট মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। সম্রাট আশা করতেন যে, ক্যাথলিক বিরোধীরা হতে জাতীয় ঐক্যে ফিরে আসবে। তাই ধর্মীয় বিভেদ পরিহার করার স্বার্থে সম্রাট অগসবার্গে ডায়েটের অধিবেশন ডাকেন এবং সেখানে লুথারপন্থীদের তাদের মত প্রকাশের জন্য নির্দেশ দেন। ইতোমধ্যে মেলাঞ্চথোন খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের উপর একটি দলিল তৈরি করেন যা ইতিহাসে অগসবার্গের ধর্ম বিশ্বাস নামে পরিচিত। এটি ছিল একটি মধ্যপন্থী বিশ্বাসের দলিল, যাতে লুথারপন্থীগণ কর্তৃক ক্যাথলিকদের কিছু প্রচলিত আচার ও বিশ্বাসকে সমান করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে সমঝোতার কোন সম্ভাবনা ছিল না। মীমাংসা অসম্ভব বুঝতে পেরে লুথারপন্থী শাসকরা ডায়েটের সভা থেকে চলে যায়। ডায়েটে ওয়ার্মসের ঘোষণা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়। ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তনের জন্য লুথারপন্থীদের ছয় মাসের সময় দেয়া হয়। এই সংকট মোকাবেলার জন্য বিশেষ করে আত্মরক্ষার জন্য লুথারপন্থী শাসকরা ১৫৩০ সালে ডিসেম্বর মাসে স্যাকসনীর শহর স্মলক্যালডেনতে মিলিত হয়ে ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক সামরিক লীগ গঠন করেন। ইতিহাসে ইহা স্মলক্যালডিক লীগ নামে পরিচিত।

১৫৩০-৩১ সালে পঞ্চম চার্লস প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের দমন করতে পারতেন। এ সময় লুথারপন্থীরা বিভক্ত ছিল। কিন্তু সে সময় ক্যাথলিক শাসকরাও ঐক্যবদ্ধ ছিল না। বিশেষ করে আর্থিক দুরবস্থা এবং তুর্কী আক্রমণের সম্ভাবনা পঞ্চম চার্লসকে লুথারীয় শাসকদের সাথে একটি মীমাংসা আসতে বাধ্য করে। ১৫৩২ সালে জুলাই মাসে নুরেমবার্গ ডায়েটে সম্রাট প্রতিশ্রুতি দেন যে, গীর্জার জেনারেল কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি লুথারপন্থীদের বিরুদ্ধে গৃহীত সকল ব্যবস্থা বাতিল করবেন। পোপ যদি কাউন্সিল আহ্বান না করেন তাহলে সম্রাট ৬ মাসের মধ্যে একটি সাম্রাজ্যের কাউন্সিল ডাকারও প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ইতালিতে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সম্রাটের পক্ষে নয় বছর জার্মানিতে আসা সম্ভব হয় নি।

ক্রেপি চুক্তি দ্বারা ভ্যালয় হ্যাপসবার্গ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান হলে চার্লস পররাষ্ট্রীয় সংকট থেকে মুক্ত হন। ইতিমধ্যে পোপ তৃতীয় পল ১৫৪৫ সালে ১৫ মার্চ ট্রেন্টে একটি জেনারেল কাউন্সিল ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। চার্লসের খ্রিস্টান ধর্ম সংস্কারের নিজস্ব পরিকল্পনা বাদ দেয়া, লুথারপন্থীদেরকে অবদমনে ফিরে যাওয়ার বিনিময়ে তিনি এটি করেছিলেন। ১৫৪৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে মার্টিন লুথার মৃত্যুবরণ করেন। এরপর স্মলক্যালডিক লীগে অন্তঃবিরোধে সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় ১৫৪৬ সালে জুলাই মাসে বাটিসবনে ভায়েটের অধিবেশন বসলে চার্লস ওয়ার্মসের ঘোষণা কার্যকর করার প্রস্তুতি নেন। চার্লস প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৫৪৭ সালে ২৪ এপ্রিল মুহলবার্গের যুদ্ধে জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকদের পরাজিত করেন। জয় লাভের পর পঞ্চম চার্লস শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। জার্মানরা হেসের ফিলিপ ও স্যাক্সনির জন ফ্রেডারিকের প্রতি সম্রাটের দুর্ব্যবহারকে নিষ্ঠুর হিসাবে মনে করেন। ইতোমধ্যে পোপ তৃতীয় পল ট্রেন্টে অনুষ্ঠিত জেনারেল কাউন্সিলের অধিবেশন স্থগিত করার পরিকল্পনা করলে সম্রাট পোপের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাথলিক ও লুথারপন্থীদের মধ্যে সমঝোতা করেন। তিনি মনে করতেন ধর্মীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে। সকল দলকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি অগসবার্গের ঘোষণার সংশোধন করেন। কিন্তু ক্যাথলিক ও লুথারপন্থীরা কেউ এটি পছন্দ করেনি। ফলে চার্লস সামরিক শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এতে অনেক ক্যাথলিক শাসক সম্রাটের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে।

ইতোমধ্যে ক্যাথলিকপন্থীরা ফরাসি রাজ দ্বিতীয় হেনবির (১৫৪৭-১৫৫৯) সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ১৫৫২ সালে চামবের্দও-এ একটি চুক্তি করে। সামরিক শক্তি ব্যবহার করে উদ্দেশ্য সিদ্ধি হাসিল না হওয়ায় সম্রাট দুই প্রোটেস্ট্যান্ট নেতাকে মুক্তি দেন এবং তাদের স্বাধীনভাবে লুথারের ধর্ম পালনের অনুমতি দেন। ফ্রান্সের সাথে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বের কারণে সম্রাট কাহিল হয়ে পড়েন। তার পক্ষে জার্মানিতে ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে তিনি অসুস্থতার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তা করার পূর্বেই ১৫৫৫ সালে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে অগসবার্গের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই শান্তি চুক্তির ধারাগুলো ছিল নিম্নরূপ :

  • (১) লুথার স্থাপিত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। জার্মান শাসকরা ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের মধ্যে যে কোন ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে এতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
  • (২) শাসকরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রজাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে। অর্থাৎ যিনি দেশ শাসন করবেন তিনি প্রজাধর্ম ঠিক করবেন (Cujus regio ejus religio)।
  • (৩) এখন হতে সর্বপ্রকার ধর্ম বিরোধ বিনা যুদ্ধে মীমাংসা করা হবে এবং সে উদ্দেশ্যে সমান সংখ্যক ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট প্রতিনিধি নিয়ে নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে।
  • (৪) যদি কোন ধর্মযাজক লুথারীয় ধর্মগ্রহণ করে তবে সেটা সম্পত্তি ও পদ হারাবে।
  • (৫) তখনকার দিনে বিশপ ও এ্যাবটরা নিজ নিজ এলাকার শাসন কার্য চালাতেন। এজন্য তাদেরকে যাজক রাজা বলা হত (Ecclesiastical Prince)। এই বিশপ ও এ্যাবটদের অধীন প্রোটেস্ট্যান্ট প্রজাবর্গের উপর কোন অত্যাচার করা হবে না এবং পরবর্তীকালে যে সকল ক্যাথলিক প্রজা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম অবলম্বন করবে তাদেরকে নিজ নিজ সম্পত্তি সহ দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

অপসবার্গের সন্ধি ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেনি। এ সন্ধি সম্রাট পঞ্চম চার্লসের খ্রিস্ট ধর্মাধিষ্ঠানের ঐক্য স্থাপনের আদর্শ বিনষ্ট করে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের চিরকালের জন্য দুই দলে বিভক্ত করে। এ সন্ধিতে কেবলমাত্র লুধারপন্থীদের আইনত স্বীকার করা হয়েছিল। এতে ক্যালভিনপন্থী প্রোটেস্ট্যান্টদের কথা উল্লেখ না থাকায় ভবিষ্যতে দু দলের মধ্যে বিরোধের বীজ বাপন করা হয়েছিল। কারণ জার্মানিতেও ক্যালভিনবাদ প্রবেশ করেছিল এর ফলে ক্যালভিনপন্থীরা গুরুতরভাবে ক্যাথলিক বিরোধী হয়ে ওঠে। ক্যালভিনবাদ বিপ্লবী মতবাদ প্রচার করে। ফলে নেদারল্যান্ডস এর ক্যালভিনপন্থীরা, ফ্রান্সের হিউগেনোরা, ইংল্যান্ডের পিউরিটান এবং স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান ক্যালভিনপন্থীরা বিদ্রোহ করে।

পঞ্চম চার্লস ও হ্যাপসবার্গ-ভ্যালয় দ্বন্দ্ব

পঞ্চম চার্লস ও ফরাসি রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যে সম্রাটের পদ নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। এছাড়া উভয়েই ইতালিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ছিল। এ ছাড়া হ্যাপসবার্গ রাজবংশের রাজ্য অস্ট্রিয়া থেকে শুরু করে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ফ্রান্সের জন্য নিরাপত্তার শংকা সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া পঞ্চম চার্লস ও ফ্রান্সিস উভয়েই অন্যের অধিকৃত ভূখণ্ডের উপর উত্তরাধিকার দাবি করত। পঞ্চম চার্লস দাবি করেন যে, ডাচি অব বার্গান্ডি ভূ-খণ্ডকে স্পেনের কাছে ফেরত দিতে হবে। কারণ একাদশ লুই স্পেনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। তাছাড়া ফ্রান্সিস সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইতালির মিলান ভূখণ্ড দখল করেছিলেন। চার্লস সেটিকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চল হিসাবে ফেরত চান। স্পেন ও ফ্রান্সের রাজবংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলে আসছিল। আবার অস্ট্রিয়ার রাজবংশ ও ফ্রান্সের রাজবংশের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। এ সকল বিবাদ চার্লস ও ফ্রান্সিসের মধ্যে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথম ফ্রান্স পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এ সময় স্পেনে পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে সান্টা জুন্টার বিদ্রোহ চলছিল এবং জার্মানিতে লুথারপন্থী শাসকরা চার্লসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে পঞ্চম চার্লস সংকটে পড়েন। এ রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগে ফ্রান্সিস ১৫২১ সালে স্পেনের অধীনস্থ ন্যাভারে আক্রমণ চালায়। পঞ্চম চার্লস পোপ ও ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির সাথে ঐক্যজোট গঠন করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধ ৪ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৫২৫ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সিসকে প্যান্ডিয়াতে পরাজিত ও বন্দি করেন। ১৫২৬ সালে ১৩ জানুয়ারি তাদের মধ্যে মাদ্রিদের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ফ্রান্সিস ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করে মাদ্রিদের সন্ধি অগ্রাহ্য করেন। প্যাডিয়ায় পঞ্চম চার্লসের বিজয় ইউরোপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, এর প্রেক্ষিতে চার্লসের বিরুদ্ধে ফ্রান্স, পোপ, ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান ও ইংল্যান্ড ১৫২৬ সালে ২২ মে কগন্যাক সংঘ গঠন করেন। এর ফলে আবার যুদ্ধ শুরু হয় পঞ্চম চার্লসের সেনাপতি রোমে প্রবেশ করে লুটতরাজ শুরু করে। ফরাসী বাহিনী পরাজিত হয়। পোপকে সেন্ট এঞ্জেলো দুর্গে বন্দি করা হয়। রোম দখলের সংবাদ পেয়ে ফরাসিরাজ ফ্রান্সিস ইতালিতে সৈন্য প্রেরণ করেন। ফরাসি বাহিনী মিলান ছাড়া সমস্ত লোম্বার্ডি দখল করে। পোপ ক্লেমেন্টকে বন্দি করায় স্পেন ও ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকরা পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়। ফরাসীরা জয় লাভ করায় পঞ্চম চার্লস পোপকে মুক্ত করে দেয় তবে ফ্রান্স ও পঞ্চম চার্লসের দ্বন্দ্বে পোপকে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল। এরপর পঞ্চম চার্লস ফরাসি সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন। ইতোমধ্যেই জার্মানিতে লুথারপন্থী শাসকরা গোলযোগ শুরু করলে এবং তুর্কীরা দানিয়ুব উপত্যকায় আগ্রাসন শুরু করলে পঞ্চম চার্লস ১৫২৯ সালে ২ আগস্ট ফ্রান্সের সাথে ক্যাম্বাই সন্ধি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এই সন্ধি পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফ্রান্সিসের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায় নি। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন ও জার্মানির লুধারপন্থী শাসকদের নিয়ে একটি জোট গঠন করেন। প্রথম ফ্রান্সিস তুরস্কের সাথেও মৈত্রী স্থাপন করেন। তুর্কীদের সাথে ফ্রান্সের মিত্রতা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ভালো চোখে দেখেনি, যার ফলে জার্মানির রাজারা ফ্রান্সের পক্ষ ত্যাগ করে। ফরাসী রাজ ফ্রান্সিস যুদ্ধ প্রস্তুতি এগিয়ে নেন। ১৫৪৫ সালে মিলানের ডিউক মারা গেলে প্রথম ফ্রান্সিস দ্বিতীয় যুবরাজের নামে মিলান দখলের জন্য সৈন্য পাঠান। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর পঞ্চম চার্লসের সাথে ফ্রান্সের ক্রেপী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে আবার পঞ্চম চার্লস এবং ফ্রান্সের নতুন রাজা দ্বিতীয় হেনরির মধ্যে যুদ্ধ চলে কিন্তু কোন পক্ষই বিজয় অর্জন করতে পারেনি। ১৫৪৭ সালে প্রথম ফ্রান্সিস মৃত্যুবরণ করেন। ১৫৫৬ সালে পঞ্চম চার্লস ও দ্বিতীয় হেনরির (১৫৪৭-১৫৫৯) মধ্যে যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষরিত হয়। এর পরেও ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। ১৫৫৯ সালে সম্পাদিত ক্যাটুক্যাব্রেসিস চুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় ফিলিপ ও দ্বিতীয় হেনরির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

তুর্কি ও মুর সমস্যা

পঞ্চম চার্লস ও তুর্কি সমস্যা : পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সম্রাট হওয়ার পর তুর্কিরা দানিয়ুব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। তুর্কী সুলতান সোলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের সেনাপতিত্বে তুর্কীরা ১৫২১ সালে বেলগ্রেড দখল করে। এর ফলে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্য বিপদের সম্মুখীন হয়। ১৫২২ সালে সোলায়মান ভূমধ্যসাগরের রুডস্ দখল করে। এর ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তুর্কি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর সোলায়মান হাঙ্গেরী আক্রমণ করে এর অর্ধাংশ দখল করে নেয়। ১৫২৬ সালে অটোমান তুর্কিরা হাঙ্গেরীয় রাজাকে পরাজিত করে। রাজা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় জলে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। হাঙ্গেরী বাজার শ্বশুরবাড়ি অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশ হওয়ায় মৃত রাজার শ্যালক অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্ডিনান্ড হাঙ্গেরী আক্রমণ করে বুদাপেস্ট দখল করে তুর্কীদের বিতাড়িত করে। সোলায়মান হাঙ্গেরী পুনঃদখল করেন এবং ১৫২৯ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা অবরোধ করেন। পঞ্চম চার্লস তুর্কীদের প্রতিরোধ করলেও পরের বছর তুর্কীরা আবার ভিয়েনা আক্রমণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে পঞ্চম চার্লস তুর্কি সুলতান সোলায়মানের সাথে ১৫৩৩ সালে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুসারে হাঙ্গেরীকে ফার্ডিনান্ড ও তুর্কি সুলতানদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ফার্ডিনান্ড (১৫৫৬-১৫৬৪) চুক্তি ভঙ্গ করে ১৫৪০ সালে সমগ্র হাঙ্গেরী দখল করার চেষ্টা করেন। ১৫৪১ সালে সোলায়মান পুনরায় হাঙ্গেরী আক্রমণ করে হাঙ্গেরীর অধিকাংশ অঞ্চল দখল করেন। ১৫৪৭ সালে দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পঞ্চম চার্লস ও মুর সমস্যা : অটোমান তুর্কি সুলতান সোলায়মানের সমর্থনপুষ্ট খায়েরুদ্দীন বারবারোসা আফ্রিকার উপকূলে আলজিয়ার্স ও তিউনিসে ঘাঁটি স্থাপন করে ইউরোপীয় খ্রিস্টান বণিকদের জাহাজ লুটতরাজ করে। বারবারোসা এক নৌবাহিনী গঠন করে ভূমধ্যসাগর উপকূলে ইউরোপীয় দেশগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। ইউরোপীয়রা বারবোরাসাকে জলদস্যুর নেতা হিসাবে অভিহিত করত। তার আক্রমণে ইতালি ও স্পেনের উপকূলভাগের খ্রিস্টানদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পঞ্চম চার্লস ১৫৩৫ সালে এক বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে বারবোরাসাকে আক্রমণ করেন এবং তার আশ্রয়কেন্দ্র তিউনিস অধিকার করে ২২ হাজার খ্রিস্টানকে মুক্ত করেন। এ কাজের জন্য তিনি খ্রিস্টানদের ত্রাতা হিসেবে সম্মানীত হন। ১৫৩৬ সালে তিনি আলজিয়ার্স আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ফ্রান্সের সাথে নতুন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি আলজিয়ার্স আক্রমণ স্থগিত রাখেন। ১৫৪১ সালে তিনি আলজিয়ার্স দখলের জন্য নৌবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সামুদ্রিক ঝড়ে অনেক জাহাজ ও সৈন্য মৃত্যুবরণ করায় তার অভিযান পরিত্যক্ত হয়। তবে তার সামরিক তৎপরতার জন্য মুসলমান জলদস্যুদের আক্রমণকে অনেকটা দমন করা গিয়েছিল।

শেষ জীবন ও মূল্যায়ন

পঞ্চম চার্লসের শেষ জীবন : পঞ্চম চার্লস দীর্ঘদিন রাজত্ব করার পর জার্মান লুথারীয় শাসকদের বিরোধিতা এবং ফ্রান্সের শত্রুতার জন্য নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে পারেননি। তুর্কি সৈন্যরা ইউরোপ সামরিক অভিযান করে তাকে আশংকাগ্রস্ত করেছিল। এ সকল কারণে তার স্বাস্থ্য ও মনোবল ভেঙ্গে যায়। এরপর তিনি সমস্ত রকম দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৫৫৫ সালে তার পুত্র ফিলিপের হস্তে নেদারলেন্ডস এর শাসনভার অর্পণ করেন। পরের বছর ১৫৫৬ সালে তিনি স্পেনের রাজপদ এবং তার অধীনস্থ ইতালির অঞ্চলসমূহের শাসনভার ফিলিপকে প্রদান করেন। তার ভাই ফার্ডিনান্ডকে পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ অর্পণ করেন এবং অস্ট্রিয় শাসনভার প্রদান করেন। ১৫৫৮ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর পঞ্চম চার্লস মৃত্যুবরণ করেন।

পঞ্চম চার্লস-এর মূল্যায়ন : পঞ্চম চার্লস-এর শাসনকাল ইউরোপের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। তিনি পরিস্থিতির সুযোগে ইউরোপে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছিলেন। কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রাখার যোগ্যতার যথেষ্ট অভাব ছিল। তা সত্ত্বেও শার্লামেনের যুগের পর তার সাম্রাজ্য ছিল বৃহৎ সাম্রাজ্য। তিনি ইউরোপের অনেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। স্পেন, ইতালি, আফ্রিকা, জার্মানি ও নেদারল্যান্ড বিশেষ বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো সমাধানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দক্ষতা তার ছিল না। বিপুল সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল উচ্চমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। কিন্তু চার্লস-এর অধিকারী ছিলেন না। তার সীমিত দক্ষতা দিয়ে তাকে অনেক কাজ করতে হয়েছিল। ফলে কোন কাজই তিনি সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারেন নি। তাঁর বড় সমস্যা ছিল জার্মানিতে। জার্মানিতে লুথারবাদ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে স করেছিল। কিন্তু তিনি লুথারবাদকে ধ্বংস করতে পারেন নি। তিনি লুথারবাদকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছিলেন। কিন্তু এর ধর্মীয় সমস্যা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। তিনি স্পেনীয় আমেরিকায় দক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। এর পেছনে স্পেনীয় অর্থ ও দক্ষ জনশক্তির ভূমিকা ছিল। কিন্তু পঞ্চম চার্লসের রাজত্বে স্পেন উপকৃত হয়নি। স্পেনের অর্থ ও লোকবল পঞ্চম চার্লসের সাম্রাজ্য রক্ষায় ব্যয়িত হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকার উপকূল মূর জলদস্যুদের তিনি দমন করেছিলেন এর দ্বারা ইতালীর ও স্পেনীয় বণিকরা লাভবান হয়েছিল। তিনি নেদারল্যান্ডসের ভূখণ্ডকে একত্র করে সফলতা দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু তুর্কি শক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেন নি। তা সত্ত্বেও তার শাসনকাল ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তার নেতৃত্বেই স্পেন বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৯৬-১০৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.