ইউরোপে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সীমারেখা, রেনেসাঁ, ভৌগোলিক আবিষ্কার ও ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন

Table of Contents

ভূমিকা

মধ্যযুগীয় ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থা থেকে ভিন্নরূপ ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন সামন্ত কাঠামোর ওপর গড়ে উঠেছিল। সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অভাবে সামন্তরা নিজ নিজ এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বর্বর জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে ভ্যান্ডাল, গথ (ভিজিগথ), অ্যাংগল, সেক্সন প্রভৃতি জাতি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফ্র্যাংকরা পশ্চিম ইউরোপে প্রাধান্য বিস্তার করে, অস্ট্রোগথ ইতালিতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। ভিজিগথরা ফ্রান্সে ও স্পেনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ভ্যান্ডালরা স্পেনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বার্গান্ডিয়ানরা স্যাভয় ও সুইজারল্যান্ডে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বর্বর জার্মান জাতির আরেকটি গোষ্ঠী লম্বার্ডগণ উত্তর ইতালির বৃহৎ অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

ব্রিটেনে অ্যাঙ্গলস, স্যাক্সনস ও জুটস্ প্রভৃতি গোষ্ঠী কেল্টদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এংলো-স্যাক্সন নামে পরিচিত হয় এবং এরা একটি জাতিতে পরিণত হয়ে ইংল্যান্ডে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই বিভিন্ন বর্বর জাতি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে মধ্যযুগের প্রথম পর্যায়ে ইউরোপে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর পরিপ্রক্ষিতেই সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম ব্যাপকভাবে প্রসারিত হলে একটি নতুন ভাবধারায় এই নতুন বর্বর গোষ্ঠী দীক্ষিত হলে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস সামন্ত ভাবধারায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এদের মধ্যে ফ্রাংকরা ফ্রান্সে মেরুভেঞ্জীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে পশ্চিম ইউরোপে রাজনৈতিক ঐক্য অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়। মেরুভেঞ্জীয় রাজবংশকে ক্যারোলিঞ্জীয় রাজবংশ উচ্ছেদ করে পশ্চিম ইউরোপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা শার্লামেন নবম শতকে পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্টান ভাবধারাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম ইউরোপে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব ইউরোপে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য গ্রিক ভাবধারার মধ্যে খ্রিস্টধর্মকে আত্মস্থ করে খ্রিস্টীয় আধিপত্য বহাল রাখে। ক্যারোলিঞ্জীয় রাজবংশের অন্যতম প্রাণপুরুষ চার্লস দ্য মর্টেল (৭১৮-৭৪১) ফ্রান্সে মুসলিম অগ্রাভিয়ান প্রতিহত করে পশ্চিম ইউরোপকে মুসলিম অধিকার থেকে রক্ষা করেছিলেন। চার্লস মর্টেলের পুত্রদের মধ্যে কার্লম্যান, পিপিন সি শর্ট এবং গ্রিফো তার উত্তরাধিকার হলেও পিপিন দি শর্ট সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন এবং তার পুত্র শার্লামেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আদর্শ পশ্চিম ইউরোপে প্রতিষ্ঠা করেন। শার্লামেনের মৃত্যুর পর পশ্চিম ইউরোপে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং এই সুযোগে হাঙ্গেরীয় ও মুসলিম আক্রমণে ইউরোপে নিরাপত্তা বিয়ের উপক্রম হলে ক্যারোলিঞ্জীয় সামন্তরা নিজ এলাকায় দুর্গ ও নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে শাসকে পরিণত হন। এভাবে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিপূর্ণতা পায়।

সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামন্তরা ছিলেন ভূমির মালিক এবং সমাজের সাধারণ মানুষ ছিল ভূমিদাস। সামন্তরা গ্রামাঞ্চলে মেনর প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কালক্রমে ইউরোপের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবক্ষয় দেখা দেয়। শক্তিশালী সামন্তরা দুর্বল সামন্তদের ফিফ দখল করলে শক্তিশালী কম গড়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ১৪৫৩ সালে তুর্কিরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য দখল করলে কনস্টান্টিনপোলের পণ্ডিতরা ইতালি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নেন। ক্রমে ইউরোপে শিক্ষাক্ষেত্রে নবজাগরণ আসে। ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরোপে পুঁজিবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে ক্যাথলিক ভাবধারা খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে খ্রিস্টীয় ভাবধারাকে পুঁজিবাদী ভাবধারার সাথে সমন্বয় করা হয়, যাকে ইতিহাসে আমরা ধর্মসংস্কার আন্দোলন বলে থাকি।

মধ্যযুগে ইউরোপের ভাবধারা ছিল খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসকেন্দ্রিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল খ্রিস্টীয় ভাবধারাপ্রসূত পরকালমুখী। এতে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত হয়েছিল এবং বিজ্ঞান শিক্ষা ছিল উপেক্ষিত। কলা, বিজ্ঞান ও সাহিত্যে চার্চের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় যাজকগণ মানুষকে কুসংস্কারে আবদ্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে রেনেসাঁস ইউরোপীয় মানুষকে এই স্থবির অবস্থা থেকে মুক্তি দেয় এবং গড়ে ওঠে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ যা আধুনিক ইউরোপ পুনর্নাঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের এ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তার ধারাকে বিকশিত করে, যার মাধ্যমে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে।

আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য

আধুনিক বলতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝায় যা মূলত রাজনৈতিক আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিকেই বোঝানো হয়ে থাকে। তবে ইউরোপের ইতিহাসে আধুনিক (Modern) ধারণার বিষয়টি একদিনে গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আধুনিকতা ধারণাটি বিকাশ লাভ করেছিল। শিক্ষার বিকাশ, হিউমানিস্টদের প্রভাব, দার্শনিক আদর্শ, মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, মুদ্রা-অর্থনীতির বিকাশ, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি অনুষঙ্গ আধুনিক ভাবধারা বা যুগসৃষ্টিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এই তিন ভাগে বিভক্ত করেন যথা : প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। আধুনিক ও মধ্যযুগের সীমারেখা নির্ধারণ করা কঠিন : বিশেষ করে আধুনিক শব্দটি আপেক্ষিক হওয়ায় আধুনিক যুগের কোনো নির্দিষ্ট প্রারম্ভিক সময় নির্ধারণ করা ভুল হবে। এ ধরনের প্রচেষ্টা ইতিহাসের ক্রমবিকাশের ধারাকে অগ্রাহ্য করে এবং বিষয় সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা পরিবেশন করে। তবে রাজনৈতিক জীবনধারাকে মাপকাঠি ধরে ১৪৫৩ সালে তুর্কিগণ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল দখলকে আধুনিক যুগের প্রারম্ভিক সময় ধরা হয়। ইতিহাসের বিবর্তনের ধারায় যে ব্যতিক্রমধর্মী পরিবর্তন হয় সেটিকেই যুগ বিভাজনের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই ইতিহাসের কোনো কোনো পর্যায়ে এমন কতগুলো নতুনত্ব দেখা দিয়েছিল যার ফলে পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে এটাকে পৃথকভাবে বিচার করার প্রয়োজন হয়েছে। মধ্যযুগের পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে কতগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ কারণে পণ্ডিতগণ মধ্যযুগের পরবর্তী সময়কে আধুনিক যুগ বলে অভিহিত করেছেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, ১৪৫৩ সালে আধুনিক যুগের সূচনা কাল বলে ধারণা করা হয়। কারণ ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দকে কনস্টান্টিনোপল পতন ঘটলে সেখানকার পণ্ডিতগণ ইউরোপে চলে আসেন এবং তাদের চেষ্টায় ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞান এবং চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়। একে ঐতিহাসিকগণ রেনেসাঁস বলে অভিহিত করেছেন। রেনেসাঁসের ফলে মধ্যযুগ আধুনিক যুগে উত্তরণ ঘটে। তবে রেনেসাঁস ছাড়াও আরো কতকগুলো কারণ আধুনিক যুগের সূচনায় ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে আধুনিক যুগের সূচনায় ভূমিকা পালন করা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হল –

  • রেনেসাঁস : ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে মধ্যযুগ ক্রমে ক্রমে আধুনিক যুগে রূপান্তরিত হয়েছে। ঐতিহাসিক জে.ই. সোয়ান এর মতে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলোকে আধুনিক যুগের পূর্ববর্তী ধাপ বলা চলে। রেনেসাঁস যুগেই মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাধান্য হারিয়েছিল ও আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো রূপ পরিগ্রহ করেছে। আবার মধ্যযুগের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্য যেমন আধুনিক যুগের বহুদূর পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। তেমনি কোনো কোনো আধুনিক বৈশিষ্ট্যও মধ্যযুগে প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং মধ্য-আধুনিক যুগের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। রেনেসাঁস যুগের শেষ হতে আধুনিক যুগের আরম্ভ গণনা করা যেতে পারে। রেনেসাঁসের মাধ্যমেই ইউরোপীয় ইতিহাস মধ্যযুগ হতে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। রেনেসাঁসের ফলে মানুষ মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা প্রভৃতি থেকে মুক্তিলাভ করে। মানুষের মনে এক নতুন স্বাধীন সাহসপূর্ণ চেতনা এবং বলিষ্ঠ সমালোচনা ও অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি মনে নবচেতনার জন্ম লাভ করে। এর ফলে ব্যক্তি মধ্যযুগীয় গতানুগতিকতার সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ভাষ্কর্য, ললিতকলা সবক্ষেত্রেই নতুন চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়। এই নতুন চেতনা মানুষের মনে ধর্মনিরপেক্ষ জীবন ও সমাজের আকাঙ্ক্ষা জাগরিত করে। এর ফলে এক নতুন সহজ ও স্বাধীন জীবনের আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রেনেসাঁসের ফলে স্বৈরাচারী ও ঈশ্বর প্রদত্ত রাজতন্ত্রের স্থলে আধুনিক রাজনৈতিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে যা আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করে। যুক্তির উন্মেষে গির্জাকেন্দ্রিক বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে অধিক সংখ্যক গ্রন্থ রচনা সম্ভব হয়েছিল যা শিক্ষার প্রসারে সহায়ক ছিল। রেনেসাঁসের ফলে যে নবজাগরণের সূচনা হয় তাতে লুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রাচীন মূল্যবান গ্রন্থানি ও চিন্তাধারার সাথে পূর্ণ পরিচয় ঘটিয়ে আধুনিককালের নতুন আন অর্জন ও চিন্তার পথ খুলে দেয়। পিথাগোরাস, এনেক্সিমেন্ডার, খেলেস, হেরাক্লিয়াস, জেনো, প্লেটো, আরিস্টটল প্রভৃতি মনীষীর চিন্তাধারার সাথে মানুষের পূর্ণ পরিচয় ঘটে। এর দরুন মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। রেনেসাঁসের মাধ্যমেই আধুনিক সাহিত্য ও স্থানীয় ভাষার উন্নতি সাধিত হয়। এতে সাধারণ মানুষের শিক্ষার প্রসার ঘটে, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চেতনা শাণিত হয়। রেনেসাঁসের ফলে মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। রেনেসাঁসের ভাবধারা বিকাশের ফলেই সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ, সর্বক্ষেত্রে এক নতুন ভাবধারা এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করার অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়েছিল।
  • ব্যক্তিত্বের বিকাশ : ব্যক্তিত্বের বিকাশ বা ব্যক্তির স্বাধীন মনোবৃত্তি ও আত্মরতিষ্ঠা আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগীয় ব্যক্তি সমাজের প্রতি স্তরেই কতগুলো লৌহ কঠিন নিয়মশৃঙ্খলা, আচার-আচরণ, রীতিনীতির দ্বারা শৃঙ্খলিত ছিল। কৃষক, সামন্ত প্রথার নিম্নতম স্তরে ঊর্ধ্বতন ভূমি অধিকারীর আদেশাধীন। শিল্পকারও কারিগর শিল্প ও কারিগরি সংঘের কঠিন নিয়মে আবদ্ধ ছিল। মধ্য ভূম্যধিকারী মুখ্য ভূমাধিকারীর নির্দেশে যুদ্ধ চালনায় লিপ্ত, মুখ্য ভূম্যধিকারী রাজ অনুগ্রহ প্রার্থী এবং রাজাজ্ঞা পালনে বাধ্য ছিল। ধর্মাধিষ্ঠানের কর্তৃত্বাধীনে ব্যক্তির ধর্ম, ব্যক্তিগত জীবন ও চিন্তাধারা সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলিত ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের শেষ ভাগে ব্যক্তির শৃঙ্খলমুক্তির চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এ চেষ্টার ফলে ব্যক্তি মধ্যযুগের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করে নিজেকে উপলব্ধি করার ও স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করে। এর ফলে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ বা ব্যক্তির মুক্তির মাধ্যমেই আধুনিক যুগের অপরাপর বৈশিষ্ট্যের বীজ নিহিত ছিল।
  • জাতীয় রাষ্ট্র : জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগে জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আদর্শ ইউরোপের একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শ ছিল এবং প্রত্যেক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী পবিত্র রোমান সম্রাটের প্রজা ছিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ইউরোপের স্থানীয় রাজারা পবিত্র রোমান সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করত। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সামন্ত প্রথার কুফল হিসেবে প্রত্যেক দেশের অভিজাত শ্রেণী রাজশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সামন্তগণ নিজ নিজ এলাকায় একেক জন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন। তাদের নিজস্ব দূর্গ, সেনাবাহিনী, মুদ্রা, বিচারালয় ইত্যাদি ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের শেষ দিকে ইউরোপে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন ঘটে। পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে উভয়ের শক্তির অপচয় হয়। পোপের ক্ষমতা প্রসারিত হয়ে যখন রাজাগণের পদচ্যুতি ঘটাবার অধিকার দাবি আরম্ভ হয় তখন পোপের বিরুদ্ধে রাজশক্তি রুখে দাঁড়ায়। এদিকে গোলাবারুদ আবিষ্কৃত হলে আগ্নেয়াস্ত্র রাজার আয়ত্তাধীন আসে এবং এর সাহায্যে রাজা সামন্তশক্তিকে দমন করে শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন প্রভৃতি দেশে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজশক্তি অভিজাতশ্রেণীর স্থলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে নিজ সমর্থক গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে। রাজতন্ত্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষার অন্যতম উপায় এবং অভিজাত শ্রেণীর অত্যাচার থেকে মুক্তির প্রধান উপায় –এ ধারণা এবং পোপের বিরোধিতা ও সম্রাটের আধিপত্য থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে। এই জাতীয় রাষ্ট্র আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে একই আইন ও প্রথার নিয়মণে বিভিন্ন জাতি তাদের জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলে। মূলত আধুনিক যুগে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের ক্ষমতা খর্ব হলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর বিভিন্ন দেশে একই ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী একই ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী সামন্তরা জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করে। এ সকল জাতি রাষ্ট্র রোমান সম্রাটের আধিপত্য ছিল না এবং প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট রাজ্যগুলোর ওপর পোপের ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছিল।
  • ধর্মসংস্কার আন্দোলন : ধর্মসংস্কার আন্দোলন ধর্মক্ষেত্রে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকার আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রেনেসাঁর ফলে মানুষের মনে যে অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয় সেই অনুসন্ধিৎসা মানুষের ধর্মীয় জীবনকে যাচাই করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই অবস্থার ফলে যাজক শ্রেণীর ধর্মহীনতা, ধর্মের নামে কুসংস্কার ও ধর্মাধিষ্ঠানের বিভিন্ন ত্রুটি মানুষের চোখে ধরা পড়ে। এ ত্রুটি দূর করার জন্য এবং ধর্মকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষত ইংল্যান্ডে অ্যাংলিকান চার্চ, স্কটল্যান্ডে প্রেসব্যাটেলিয়ান চার্চ, সুইজারল্যান্ডে জুইংলি ও ক্যালভিনের নেতৃত্বে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মসংস্কার আন্দোলন খ্রিস্টধর্মবিশ্বাসকে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের প্রভাব থেকে মুক্ত করে ধর্মের বিশ্বাসকে মানবতাবোধ ও নীতিরোধের ওপর স্থাপন করা হয়। যার ফলে সততা, ঈশ্বর ভক্তি, ন্যায়পরায়ণতা, শ্রমের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি ধারণা ধর্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গ হয়। বিভিন্ন প্রতিবাদী ধর্মগুলো স্থানীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করলে ধর্মবিশ্বাসে ব্যক্তির উপলব্ধিবোধ বৃদ্ধি পায়। ফলে অনৈতিকতা ও কুসংস্কার- ধর্ম থেকে দূরীভূত হয়। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে মানুষের মনে ধর্ম সহিষ্ণুতার জন্ম হয় এবং নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো ধর্ম গ্রহণের স্বীকৃতি লাভ ঘটে। ধর্মসংস্কার আন্দোলন থেকেই প্রতিসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ফলে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের দুর্নীতি ও কুসংস্কার অনেকটা দূরীভূত হয়। ধর্মসংস্কার ও প্রতিসংস্কার আন্দোলন ক্রমে ইউরোপে ধর্মযুদ্ধের সূচনা করে। ১৫৫৫ সালে অগসবার্গের সন্ধির মাধ্যমে ধর্ম সমস্যার সমাধান হয় এবং রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত হলে জার্মানিতে ধর্মীয় প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ফলে ইউরোপে ধর্ম ক্ষেত্রে ধর্মীয় শক্তির সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্মসংস্কার আন্দোলন মানুষকে ধর্মীয় শোষণ থেকে অনেকটাই মুক্ত করে।
  • ভৌগোলিক আবিষ্কার : ভৌগোলিক আবিষ্কার আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটার পাশাপাশি নতুন নতুন দেশ ও বাণিজ্য পথ আবিষ্কার হয়। ভৌগোলিক আবিষ্কার মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ভৌগোলিক আবিষ্কার ইউরোপের সমৃদ্ধ সমুদ্র বাণিজ্যকে মহাসাগর বাণিজ্যে পরিণত করে। বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে তোলে। আধুনিককালের মুদ্রানীতি এবং মূলধনের সাহায্যে শ্রমিকদের কাজে খাটা ইত্যাদির সূচনা ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে হয়েছিল। আধুনিক ব্যাংকিং, যৌথ কারবার ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপে শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে। আধুনিক সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিষ্ঠা ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ : মধ্যযুগে ব্যবসাবাণিজ্যের দিকে আধুনিক যুগের প্রারম্ভে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয়েছিল। এই শ্রেণী ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত থাকায় শহরে বাস করত। দ্বাদশ শতকে ইউরোপে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসাবের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বণিক নগরকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্যের আদান-প্রদান শুরু করে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত বণিকরাই সামুদ্রিক পথে নতুন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জলপথ আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। নতুন রাজবংশগুলো অভিজাতদের চেয়ে এদেরকে নিজেদের সমর্থক তৈরী করে সরকারি চাকরি ও বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পদে নিয়োগ দেয়। ইউরোপে গ্রামাঞ্চলের উদ্যোগী মানুষেরা শহরে এসে অর্থ উপার্জন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীভূক্ত হয়। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইউরোপে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও কলকারখানা স্থাপন করে আধুনিক পুঁজিবাদের জন্ম দেয়।
  • পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভব : মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে মুদ্রা অর্থনীতি চালু হয়ে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং যৌথ বাণিজ্য ও শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ সহজ হয়। ইতালির জেনোয়া, নেপলসসহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলে ধনী বৃহৎ অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হয়। এ অবস্থায় ফ্লোরেন্স, ভেনিস ও জেনোয়ার ব্যবসায়ীরা ইউরোপের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এই মুদ্রা অর্থনীতি ক্রমে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যে পুঁজির স্ফীতি ঘটায় এবং একাদশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ইউরোপে রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় নতুন জীবনবোধ সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থার ক্রম প্রসারে ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন প্রভৃতি অনুষঙ্গ রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, যা ক্রমে আধুনিক জীবনধারাকে প্রভাবিত করে।

রেনেসাঁস

রেনেসাঁস কী?

রেনেসাঁস (Renaissance) শব্দটি দ্বারা ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে একটি সীমারেখা এঁকে এর দ্বারা মানুষের বিশেষ করে ইউরোপের মানব চেতনার ক্ষেত্রে একটি নতুন বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। এ শব্দটি অনেক ক্ষেত্রে গ্রীক ও রোমান চেতনার পুনর্জন্ম, বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, জ্ঞানের ক্ষেত্রে নবজাগরণ প্রভৃতি অর্থ করা হয়। এ মূল শব্দটি ল্যাটিন শব্দ rinascere হতে উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ হল প্রাচীন গ্রিক ও রোমের সাহিত্য, শিল্প ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের পুনরুত্থান।

আধুনিক পণ্ডিতদের অনেকেই রেনেসাঁস আন্দোলনের সীমারেখা নির্দেশ করেছেন চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত দুশত বছর। এই চেতনা প্রথম ইতালিতে আরম্ভ হয় এবং পরে জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড প্রভৃতি পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও ধর্ম ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন “ও সাহিত্য চর্চা, শিল্পকলা ও ভাস্কর্য ইত্যাদি মানব তৎপরতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়; যে নব ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি ইউরোপীয়দের সকল কর্মে, চিন্তায় ও সাধনায় মূর্ত হয়ে উঠে, সংক্ষেপে তারই নাম রেনেসাঁস। রেনেসাঁস শব্দের অর্থ পুনর্জন্ম। কিন্তু এর দ্বারা কিসের পুনর্জন্ম বোঝায়। রাজনৈতিক জাতিগত বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে নেশন (Nation) বা রাষ্ট্রের এক সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক চেতনার পুনর্জন্ম যা মধ্যযুগীয় ইউরোপের পোপতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইউরোপের সর্বত্র জাতীয়তার ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্ভব করেছিল। সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে সামন্ততন্ত্রের বা জায়গিরদারি প্রথার বিলোপ এবং তৎপরিবর্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও ক্রমে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এর প্রধান তাৎপর্য হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। আর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে বিচার করলে এর দ্বারা খ্রিস্টধর্ম বিবর্তনের ইতিহাসে রিফরমেশন বা ধর্ম-সংস্কারের ঐতিহাসিক সুদূরপ্রসারী আন্দোলনকে স্মরণ করা হবে।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রেনেসাঁস ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ বুঝাবে। শিল্পকলা বা সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে রেনেসাঁস দ্বারা জীবনধর্মী সাহিত্য এবং ভাস্কর্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ বুঝায়। এ যুগে পেত্রার্কবোক্কাসিও’র রচনার নতুন সাহিত্য সৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়। বত্তিচেলি, ডুরের, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো ও লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির অপূর্ব সৃষ্টকর্ম সমগ্র শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে যুগান্তর ঘটিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এ সাহিত্য ও শিল্পসৃষ্টির ছত্রে ছত্রে, বর্ণে বর্ণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল মানবতার জয়গান। সুদূর অতীতে গ্রিক মনীষী ও শিল্পীগণ এ মানবতার আহ্বান সাড়া দিয়েই অপূর্ব সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিল। এ অর্থে বিবেচনা করলে রেনেসাঁস অর্থে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য শিল্পকলা ও মানবতার পুনর্জন্ম বুঝায়। রেনেসাঁসের সময় হতে মানবতার পুনর্জন্মের পর ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা এবং বিভিন্ন কর্মে ইউরোপের অগ্রগতি হতে থাকে। রেনেসাঁসের মূল চেতনা ছিল অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামির স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদ এবং জীবন চেতনায় ইহলৌকিকতা ও প্রকৃতি প্রেম।

রেনেসাঁসের চেতনাগত বিষয় : রেনেসাঁস মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস এবং জীবন বিমুখী ভাবধারা এ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ছিল। সামন্তবাদ (Feudalism), গোপতন্ত্র (Papacy) একই শক্তির অনুগ্রহপুষ্ট খ্রিস্টীয় পণ্ডিত গোষ্ঠী যে জীবনদর্শন, প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের পটভূমিকায় জীবনের উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও পরিণাম সম্বন্ধে যে ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে মানুষের জীবনকে যে এক অচলায়তন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলিত করেছিল – রেনেসাঁস আন্দোলন সেই জীবনদর্শন, ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তি নিজ জীবন ও জগৎকে নতুনভাবে ভাবতে থাকে। এর থেকেই মানুষের ব্যক্তিত্বের নতুন জন্ম লাভ ঘটে। জীবন ও জগৎভাবনায় মানুষ প্রচলিত সকল শৃঙ্খলের শিকল ভেঙে এক নতুন জীবনধারার পরিচয় পায়। পুরাতনতন্ত্র, পরিচিত ব্যবস্থা, স্বীকৃত মত, বদ্ধমূল সংস্কার একে একে নতুনরূপে, নতুন সংশয়ে ও অনিশ্চয়তায় ধরা দেয়। মানুষ নিজেকে ও পৃথিবীকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

মধ্যযুগীয় জীবন ভাবনা ও রেনেসাঁস : মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জীবনভাবনা ও সামন্তবাদী সামাজিকতা ও রাজনীতি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আত্মার স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিল। মধ্যযুগীয় সমাজ ও রাজনীতিক ব্যবস্থার মূলমন্ত্র ছিল বশ্যতা ও আজ্ঞানুবর্তিতা। রাষ্ট্রে, সমাজে, ধর্মজীবনে বিনা প্রতিবাদে কর্তৃপক্ষের অনুশাসন মেনে চলা ও আদেশ পালন করাই মানুষের প্রধান গুণ বলে বিবেচনা করা হত। বিরাট প্রতিষ্ঠানের একটি নগণ্য অংশরূপে এবং কেবলমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের জন্য মানুষের জীবন ধারনের প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছিল, এর বাইরে মানুষ নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ভাবতে পারতনা। এরূপ অবস্থায় খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠান চরম স্বেচ্ছাচারিতার প্রতীক হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। ধর্মের সাথে রাজনীতি অঙ্গীভূত হওয়ায় মানুষ এক অচলায়তন প্রথায় আবদ্ধ হয়। স্বর্গদ্বারের সজাগ প্রহরী হিসেবে ধর্মাধিষ্ঠানের প্রাথমিক কর্তব্যই ছিল মানুষের প্রতিটি কর্ম ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা। ধর্মসংস্থা যা আদেশ দেবে তা পালন করতে এবং যা শিখাবে তা বিশ্বাস করতে বিশ্বাসী নর-নারীকে বাধ্য করা। এর বিরুদ্ধাচার করা ছিল প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রকে এবং ঈশ্বরকে অস্বীকার করা এই বিরুদ্ধাচারণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মহাপাপ এবং এই মহাপাপের শাস্তি ছিল সমাজচ্যুতি বা ইনকুইজিশনে মৃত্যুদণ্ড।

উল্লিখিত অচলায়তন ব্যবস্থায় মননশীলতার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় দার্শনিকগণ এই প্রচলিত জীবনধারাকে ভাঙার চেষ্টা করেন। এ অবস্থায় নতুন জ্ঞান ও নতুন আবিষ্কার সম্ভব ছিল না। এ বদ্ধ অবস্থায় ইউরোপের স্পেনে আরব পণ্ডিতেরা নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সেখানে প্রাচীন গ্রিক মনীষীদের জ্ঞানচর্চা ও প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা দিতে থাকে। এ অবস্থায় ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাচেতনায় এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আরব পণ্ডিতদের অনুকরণে ইউরোপের মধ্যযুগীর দার্শনিকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জীবনমুখী শিক্ষার ও ভাবধারা প্রচার করতে থাকে। বিশেষ করে প্লেটো অ্যারিস্টটলীয় জ্ঞান সূত্রকে কেন্দ্র করে প্রাচীন গ্রিক শিক্ষার সহিত ইউরোপীয়দের পরিচয় হতে থাকে। এক পর্যায়ে স্কলাস্টিসিজম অর্থাৎ অ্যারিস্টটলীয় জ্ঞান ইউরোপে একমাত্র গ্রহণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় খ্রিস্টান পণ্ডিতেরা অ্যারিস্টটলীয় জ্ঞান ও খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসের সমন্বয়ে এক নতুন শিক্ষাদর্শন চালু করে। এতে পাণ্ডিত্যবাদের বাহিরে সবকিছু অলৌকিক নাস্তিকতা ও খ্রিস্টীয় শিক্ষার বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।

রেনেসাঁস আন্দোলন মানুষকে মননশীলতার এই উৎপীড়ন থেকে মুক্ত করে সর্বক্ষেত্রে চিন্তা স্বাধীনতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করে। নির্দিষ্ট জ্ঞান ও ঐতিহ্যের সাজানো গর্তে যুগের পর যুগ দিন গুনতে গুনতে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। অনির্দিষ্ট পথ ও অনিশ্চিত ভাগ্যের আকর্ষণ ক্রমশ দুর্বল হয়ে উঠে। মানুষ যখন এ গণ্ডির বাধা অতিক্রম করে গতানুগতি থেকে মুক্ত হয়। তখন সে নতুন জীবন বা জগতের সাক্ষাৎ পায় যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবতাবোধ ও প্রকৃতিপ্রেম মানুষের জীবনকে নতুন অর্থ প্রদান করে।

রেনেসাঁসের ব্যাপ্তি ও তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা

রেনেসাঁসের সূচনা ও সমাপ্তিতে বিভিন্ন তারিখের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করলেও এর সঠিক সীমারেখা দেওয়া সম্ভব নয়। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দু শত বৎসর যাবৎ এ আন্দোলন ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। এ বিস্তৃত সময়ের মধ্যে কয়েকটি ঐতিহাসিক তারিখ প্রণিধানযোগ্য।

  • প্রথমতঃ ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের হাতে কনস্টানটিনোপলের পতন। রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙনের পর হতে মুসলিম প্রাধান্য বিস্তার পর্যন্ত বহু বিপর্যয় সত্ত্বেও খ্রিস্টানদের পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্য এতদিন প্রাচীন গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে বিরাজমান ছিল; অটোম্যান তুর্কিদের আক্রমণে সহসা তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘ ছয়শত বৎসর যাবৎ মধ্যযুগীয় ইউরোপে যে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের আশা মনে মনে পোষণ করত তা নির্মূল হয়ে যায়। এইসব ঘটনা স্রোতের পরিপ্রেক্ষিতে রোমের ধর্মাধিষ্ঠান নিতান্ত অসহায় ও দুর্বল মনে হতে থাকে এবং এও বোঝা যায় যে সবদিক থেকেই পুরাতন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের আয়োজন চলছে। কনস্টানটিনোপলের পতনের আরেকটি গুরুত্ব এই যে, বহু গ্রিক পণ্ডিত ও শিক্ষক এ সময় প্রাচীন পুঁথিপত্রসহ বাইজেন্টিয়াম পরিত্যাগ করে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে পলায়ন ও উদ্বাস্তু বাইজেন্টাইন গ্রিক পণ্ডিতদের আগমনে গ্রিক ভাষা চর্চার এবং মূল গ্রিক পাণ্ডুলিপি পড়বার ও তরজমা করার বিশেষ সুবধিা হয়। পেত্রার্কের (১৩০৪–৭৪) সময় হতে মূল গ্রিক পাণ্ডুলিপি হতে গ্রিক সাহিত্যের রসাস্বাদনের যে স্পৃহা জাগ্রত হয়েছিল এবং তদুদ্দেশ্যে গ্রিক পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের যে হিড়িক পড়ে, ইতালিতে ও পশ্চিম ইউরোপে বাইজেন্টাইন পণ্ডিতদের আগমনে এই সপ্তাহ কার্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
  • রেনেসাঁস সম্পর্কিত আরেকটি তারিখ উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৯২-১৫০০ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকা আবিষ্কার, স্পেনের প্রাধান্য লাভ, ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয় নাবিকদের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা যুগান্তরকারী ঘটনা এ কয়েকটি বিষয়কে স্মরণীয় করে গেছে। এসময় ইতালিতে অষ্টম চালর্সের সামরিক অভিযানের ফলে ফরাসি, জার্মান ও স্প্যানিশ জাতিদের পক্ষে এ মহামূল্য উপদ্বীপের কর্তৃত্ব লাভের পথ অনেকটা পরিষ্কার হয়। রেনেসাঁসের প্রথম ফসল ফলেছিল ইতালির মাটিতে। জ্ঞানে, কর্মে ও নতুন ভাবধারার অভিনবত্বে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইতালি ছিল ইউরোপের পুরোভাগে। এখান থেকেই পশ্চিম ইউরোপে অন্য জাতির লোকেরা এ ফসল ভোগ করার সুযোগ পায়।
  • রেনেসাঁসের তৃতীয় আরেকটি উল্লেখযোগ্য তারিখ হলো কোপার্নিকাসের জ্যোতিষীয় গ্রন্থ De revolutionizes এর ও ভেসালিয়াসের শারীস্থান সমন্ধীয় গ্রন্থ De fabrica-র প্রকাশকাল ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে প্রচলিত ভূকেন্দ্রীয় ব্ৰহ্মাণ্ড পরিকল্পনার ভিত্তিতে এতদিন জ্যোতিষীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যা চালু ছিল। কিন্তু কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রীক মতবাদ উদ্ভাবন হলে পূর্ববর্তী মতবাদের ভুল ধরা পড়ে। অনুরূপভাবে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্যালেন মানুষের দেহযন্ত্রের ও শারীরবৃত্তের যে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন শতাব্দী পর শতাব্দী কেহ এতে সন্দেহ করেনি। কিন্তু ভেলাসিয়াসের De fabrica-র সেই চিত্রের এই কয়েকটি প্রধান অসঙ্গতি দেখানো হয়। এই দুটি গ্রন্থের প্রকাশনা প্রাচীন জ্ঞানের অভ্রান্তায় বিশ্বাসী ফাটল ধরায়। তাই ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ রেনেসাঁসের একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখই শুধু নহে, কোনো একটি বিশেষ বৎসরে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে সীমারেখা যদি আদৌ টানতে হয় তবে এ বছরই টানা উচিত।

উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে রেনেসাঁসের নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মানদণ্ডকে বিবেচনায় আনা যায়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ ও কনস্টানটিনোপলের পতনকে যুগান্তরকারী সীমারেখা ধরা যেতে পারে। আবার পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা আবিষ্কার, স্পেনের প্রাধান্য লাভ, ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয় নাবিকদের আবির্ভাব পুঁজিবাদের দুয়ার খুলে নিয়েছিল, এজন্য এটি স্মরণীয় মাইলফলক ধরা যেতে পারে। আবার বৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিচার করলে ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোপার্নিকাসের রচিত De revolutionizes ও ভেলাসিয়াসের শারীরস্থান সমন্ধীয় গ্রন্থ এবং De fabrica-র সময়কালকে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল ধরা যেতে পারে। তবে অনেকেই রেনেসাঁসের প্রারম্ভিক সময়কাল নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে ত্রয়োদশ শতকে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়, নগরে শহরের উৎপত্তি এবং নগরজীবনের বিকাশ ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা এবং শিল্পকলার উন্নতি ইউরোপের ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।

রেনেসাঁসের কারণ

রেনেসাঁর বিভিন্ন কারণ অর্থাৎ বিভিন্ন, বিচিত্র ও বহু বিচিত্র অবস্থার একত্র সমাবেশ রেনেসাঁকে সম্ভব করেছিল। প্রথমদিকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরি এবং এর মধ্যে আত্মিক বিকাশ পরবর্তীতে গ্রিক সাহিত্য ও ভাষ্কর্যের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, কম্পাস, কাগজ, মুদ্রা, যান্ত্রিক ঘড়ি, বারুদ প্রভৃতি কারিগরি আবিষ্কার রেনেসাঁসের প্রধান কারণ বলা যায়। এসব কারণ আবার একটি অপরটিকে প্রভাবিত করেছিল। কম্পাসের আবিষ্কার ও জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে এর প্রয়োগ পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযানগুলোকে সম্ভব করেছিল। নতুন গোলার্ধ আবিষ্কারে ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে যুগান্তর ঘটিয়েছিল। গ্রিক সাহিত্যের পুনরুদ্ধারকে কেন্দ্র করে যে, বিদ্যোৎসাহিতার সৃষ্টি হয়েছিল তা সম্ভব করেছিল কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার

  • (১) রেনেসাঁসের বুদ্ধিবৃত্তিক কারণ : রেনেসাসকে বলা হয় গ্রিক ও রোমান শিক্ষার পুনর্জাগরণ। ইউরোপে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইটালির দক্ষিণাঞ্চলে আরব পণ্ডিতগণ গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রচার করে। সিসিলি এবং দক্ষিণ স্পেন সেসময় মুসলমান আরবের শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম পণ্ডিতগণ গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষা দিত। এ শিক্ষা ইউরোপীয় শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করে। দ্বাদশ শতাব্দীতে অনেকগুলো গ্রিক ও রোমান জ্ঞান পুস্তক উদ্ধার হয়। তবে এগুলোর সবগুলো অনুবাদ করা কঠিন ছিল। বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা (logic), পদার্থবিদ্যা (Physics), জীববিজ্ঞান (Biology), নীতিবিজ্ঞান (Ethics) এবং রাজনীতি (Politics) ইউরোপে মুসলিম পণ্ডিতদের দ্বারা পুনঃপ্রকাশিত হয়। একইভাবে প্লেটোর সাহিত্যকর্ম পুনঃপ্রকাশিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কনস্টানটিনোপলে ল্যাটিন সাম্রাজ্য স্থাপিত হলে এ অঞ্চলে গ্রিক দর্শনের নতুন ভাষা রচিত হয়ে পশ্চিম ইউরোপে প্রচারিত হয়। এই আবিষ্কার ইউরোপের শিক্ষক সমাজে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ইউরোপে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়।
  • (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব : মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব ইউরোপে রেনেসাঁসের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। ইউরোপে দশম শতাব্দীতে সেলারনো এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে ভলোনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি প্রতিষ্ঠা হয়। এসব ফ্যাকাল্টিতে পণ্ডিতরা ছাত্রদেরকে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় অবহিত করত। তাদের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। অনুরূপভাবে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, ধর্মতত্ত্ব, আইন ও চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। ছাত্ররা এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিসন্দর্ভ লেখার সময় বিভিন্ন পণ্ডিতদের রচনার সাথে পরিচয় হত। ছাত্র-শিক্ষকদের উন্নত আলোচনা এবং প্রশ্ন তাদের ভাবনায় প্রচলিত পাণ্ডিত্যবাদের অনেক ধারণা অসার মনে হত। এভাবে ইউরোপে শিক্ষারক্ষেত্রে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। আর ধর্মতত্ত্ব পড়তে গিয়ে খ্রিষ্টধর্মের মূল নীতি এবং ইহুদিধর্ম ও ইসলামি ভাবধারার সাথে পরিচিত হত। জ্ঞানের এ বহুমুখী চর্চা শিক্ষার্থীদেরকে গ্রিক রোমান শিক্ষার বিষয়বস্তু জানতে উদ্বুদ্ধ করে।
  • (৩) বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক : একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রখ্যাত পণ্ডিতগণ খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠানের অনেক প্রচলিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে। এর মধ্যে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার এবেলার্ড (১০৭৯-১১৪২) খ্রিস্টধর্মের অনেক বিতর্কিত বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সেন্ট ভার্নাড খ্রিষ্টান চার্চের দুর্নীতির সমালোচনা করে। এভাবে চার্চের দুর্নীতি, গোঁড়ামি অনেকের নিকট ধরা পড়ে। খ্রিষ্টান পণ্ডিতগণ খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসকে দার্শনিক ভিত্তি দেওয়ার জন্য এ্যারিস্টটলের দর্শনকে খ্রিস্টান বিশ্বাসের সাথে সমন্বয় করে এর থেকে স্কলাস্টিসিজম গড়ে উঠে। এ সূত্রে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের চর্চা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে উইলিয়াম ওকাম (William of Ockham) প্রচলিত স্কলাস্টিসিজম বা পাণ্ডিত্যবাদের সমালোচনা করেন এবং সবকিছুকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সত্যে উপনীত হওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন।
  • (৪) বৈজ্ঞানিক চিন্তার উৎপত্তি : ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপে দিক বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার সূত্র ধরে বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ হতে থাকে। ত্রয়োদশ শতকে রজার বেকন (Rogar Becon (1214-94)) অ্যারিস্টটলের সব মতকে বিনা যুক্তিতে মেনে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তা তুলে ধরেন। বিশেষকরে নৌবিদ্যার প্রযুক্তি, বীজ তৈরির কারিগরি কৌশল, প্রাণীদের প্রজনন প্রভৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করেন। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির প্রসারের ফলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পণ্ডিত অ্যারিষ্টটলের পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। একইভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে গ্যালেনের অনেক সিদ্ধান্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। মাইকেল সারবেটাস (Michael Servetus (1511-53) নামে একজন স্প্যানিয় ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসাবিদ গ্যালেনের রক্ত পরিবাহী সূত্রের ধারণা চ্যালেঞ্জ করেন। বেলজিয়ামের পণ্ডিত বেসালিয়াস (1514-64) ইতালি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিদ্যায় অ্যানাটমি ও শারীরবিদ্যায় (Physiology) শাস্ত্রে এক নতুন ধারণা প্রদান করেন। অনুরূপভাবে টলেমির বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত মতবাদের বিভিন্ন বিষয় মানুষের নিকট প্রশ্ন হিসাবে দেখা দেয়। নিকোলাস কোপার্নিকাস (1473-1543 ) পৃথিবীকেন্দ্রিক মতবাদ মিথ্যা প্রমাণ করেন। এসকল প্রচলিত ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মানুষের অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়।
  • (৫) মুদ্রাপ্রচলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ : রিচার্ড এরনবার্গ প্রমুখ আরো অনেক লেখক মনে করেন যে মুদ্রাপ্রচলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ মধ্যযুগে শহর ও বন্দরের পত্তন, বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসার, মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ও মূলধনের বিনিয়োগ রেনেসাঁসের প্রধান কারণ ছিল। সামন্ত শাসিত সমাজে কৃষিই ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে উৎপাদন নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তিত থাকে; ফলে সব রকমের লেনদেনেই দ্রবা বিনিময় যথেষ্ট মনে হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার প্রয়োজন সীমাবদ্ধ থাকে। এরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মূলধন বিনিয়োগে সুযোগ থাকে না। ধর্মপ্রভাবিত সমাজে সুদে অর্থলগ্নীর কারবার পাপ বলে মনে করা হয়। এ সত্ত্বেও দশম-একাদশ শতাব্দীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু কিছু প্রসার ঘটলে অনিবার্য কারণেই ব্যবসায়ীদের নিকট অর্থ সঞ্চিত হতে থাকে। সুদে অর্থ খাটানো খ্রিস্টধর্ম সংস্থা কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ায় অনেক সময় জমি, স্বর্ণদ্রব্য অথবা মূল্যবান মণিমুক্তা বন্ধক রেখে যে সামন্ত রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজনে অর্থ ধার দেওয়া হত। কিন্তু এরূপ ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় ব্যবসায়ীদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয়িত হওয়ায় সামগ্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো সুরাহা হয়নি। এ অর্থ প্রায় ক্ষেত্রে জলে গিয়েছে। রাজানুগ্রহ, প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠার আশায় এভাবে অর্থ ধার দিতে গিয়ে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর অধিকাংশ মহাজন দেউলিয়া হয়েছিল। ইহুদিদের পক্ষে সুদ গ্রহণের কোনো ধর্মীয় বাধা না থাকায় লাভজনক কারবারে অর্থ লগ্নীর ব্যাপারে ইহুদি ব্যবসায়ীরা অগ্রণী হয়েছিল। এজন্য ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা ইহুদিদের নির্যাতন করত। অর্থলগ্নীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুশাসন অপেক্ষা ও বড় সমস্যা ছিল। সামন্ত্রতন্ত্রী ব্যবস্থায় মূলধন বিনিয়োগের সুযোগের অভাব। এ সুযোগ প্রথম উপস্থিত হয় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে লিপ্ত উত্তর ইতালিয় বণিকদের নিকট। ক্রুসেডের সময় হতে ভেনিস, জেনোয়া প্রভৃতি বন্দর ভূ-মধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে ধীরে ধীরে প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকলে এসব বন্দরের বিত্তশালী বণিকরা লাভজনক আমদানি-রপ্তানির কারবারে মূলধন বিনিয়োগের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সম্বন্ধে অবহিত হয়। রপ্তানি বাণিজ্যে লাভবান হতে হলে স্থানীয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য উৎপাদন এবং গুণের দিক হতেও উৎপন্ন দ্রব্যের ক্রমোন্নতি সাধন অপরিহার্য। এটাই মূলধন বিনিয়োগের প্রধান প্রেরণা। তাই উত্তর ইতালির বাণিজ্যিক তৎপরতা শুরু হবার অল্পকালের মধ্যেই কাচ ও রেশম নির্মিত দ্রব্যাদি প্রস্তুতের ব্যাপারে ভেনিস বিবিধ ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ দক্ষতায় বস্ত্রশিল্পে ও উচ্চশ্রেণীর পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করতে ফ্লোরেন্স দক্ষতা অর্জন করে। এ ধরনের উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণ সামন্ততন্ত্রী ব্যবস্থায় অর্থাৎ যেখানে কারিগরকে স্থানীয় কাঁচামাল হতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সবকিছু একা হাতে করতে হয়, সেখানে সম্ভবপর নয়। যেমন, ফ্লোরেন্সের যে বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠেছিল তার বস্ত্র আসত ফ্লান্ডার্স থেকে, কারণ উৎকৃষ্ট বস্ত্র বয়নে ফ্লান্ডার্সের তাতিরা ছিল দক্ষ। আবার বস্ত্র রাঙাবার কাজে ফ্লোরেনটাইন কারিগররা ছিল অদ্বিতীয়। কাজেই ফ্লান্ডাস থেকে কাপড় এনে ফ্লোরেন্টাইন কারিগরদের সাহায্যে উৎকৃষ্ট রঙিন বস্ত্র প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে যে শিল্প পত্তনের প্রয়োজন তার মূলধন জোগাবার জন্য দরকার আরেক তৃতীয় পক্ষ। তারপর বিদেশের বাজারে এ মাল সরবরাহের জন্য জটিল ব্যবস্থা প্রয়োজন এখানে উল্লেখ্য যে ফ্লোরেন্টাইন মহাজনেরাই আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার প্রবর্তক এবং মধ্যযুগেই ও রেনেসাঁসের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ইউরোপে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যাপক হয়েছিল।
  • (৬) ইতালীয় শহরগুলোর অবদান : রেনেসাঁস সৃষ্টিতে ইতালীয় শহরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইউরোপে গির্জা এবং দুর্গগুলোকে কেন্দ্র করে নগরায়ন শুরু হয়েছিল। মহামারীতে ইউরোপে বহু লোক মারা গেলে ম্যানরগুলো ভেঙে পড়ে। ভূমিদাসরা ম্যানর ত্যাগ করে নগরে এসে আশ্রয় নেয়। এরা পর্যায়ক্রমে প্রতিরক্ষা, কারিগরি শিল্প এবং বিভিন্ন পেশায় আত্মনিযোগ করে। এদের ভেতর থেকে অনেক স্বনামধন্য শিল্পী ও মানবতাবাদীর আগমন ঘটে। নতুন শহরগুলো ছিল উদার এবং এগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ইতালির জেনোয়া, ভেনিস, নেপলস, মিলান, পিসা, ফ্রান্সের প্যারিস, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ছিল কসমোপলিটন নগর। এগুলোতে হিউম্যানিস্ট ও শিল্পী তাদের বিদ্যাবুদ্ধির রসদ নিয়ে এক নগর থেকে অন্য নগরে ঘুরে বেড়াতেন এবং তারা হয়ে উঠেছিলেন ‘ইউনিভার্সাল ম্যান’। নগরগুলোতে শ্রম এবং সময়ের মূল্য স্বীকৃত হয়। ফলে নিচু শ্রেণী থেকে আগত অধিকাংশ চিত্রশিল্পী, স্থপতি ও ভাস্কর নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়।
  • (৭) হিউম্যানিস্টদের প্রভাব : রেনেসাঁস সৃষ্টিতে হিউম্যানিস্টদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। হিউম্যানিস্টরা ইউরোপীয় মানবজাতির জামির জন্য প্রাচীন সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি এবং শিল্প ও স্থাপত্যের মূল্যবান বিষয় উদ্ধার করেছিলেন। তারা জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান বিতরণ প্রভৃতি মূল্যবান কাজে নিয়োজিত থেকে মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। তারা গ্রিক, রোমান এবং আরবীয় জ্ঞানের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ইউরোপীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে নিয়েছিলেন। প্রাচীন সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার, সেগুলোর অনুবাদ, প্রাচীন গ্রন্থাদির প্রতিলিপি প্রস্তুত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে মানুষের মধ্যে জীবনমুখী চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাদের চেষ্টার ফলে ইউরোপের মানুষ নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
    • পেত্রার্ক (Petrarch): হিউম্যানিস্টদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন পেত্রার্ক, বোক্কাচো, মাইকেলেঞ্জেলো প্রমুখ। ইতালীয় হিউম্যানিস্টদের মধ্যে ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪) সবচেয়ে খ্যাতিমান। তিনি সনেট নামে চৌদ্দ লাইনের ছোট কবিতার সৃষ্টিকর্তা। তিনি তার কবিতায় মানুষের জীবনধারা তুলে ধরতেন। পেত্রার্ক সারা জীবন লরা নামে এক প্রিয়তমা মহিলার প্রশংসা সংবলিত ইতালীয় ভাষায় বিভিন্ন আকারে কবিতা রচনা করেন। পেত্রার্ক লরার মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতিবিধ দেখতে পান। যার বিবরণ দিতে তিনি কখনো ক্লান্ত হন নি। পরবর্তীকালে তিনি তার প্রতিমূর্তিতে খ্রিস্টান মাত্রা যোগ করেন, যাতে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দায়িত্ব প্রতিফলিত হয়। পেত্রার্ক তার রচিত কাব্য ক্যানজোনিয়ার-এ (Canozoniere) লরার জন্য তার পছন্দ আবেগের বিবরণ দিয়েছেন। এতে আরো আছে কুমারী মেরীর প্রতি ধর্মসংগীত দ্বারা তিনি কারাটি সমাপ্ত করেছেন। এ কাব্যে মানবিক চেতনা এবং পার্থিব চেষ্টার অসার দত্ত প্রকাশ পেয়েছে। ঐশ্বরিক ও পার্থিব চেতনার মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব এবং ঐশ্বরিক ভালবাসা ও ধর্মীয় অনুভূতির বিবরণ আছে। রেনেসাঁসের পথপ্রদর্শক হিসেবে তার দান অপরিসীম। পেত্রার্ক প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে সময় ও শ্রম ব্যয় করেছিলেন। তার সংগৃহীত পাণ্ডুলিপির মধ্যে ছিল হোমারের মহাকাব্য, প্লেটো রচিত ১৬ খানি গ্রন্থ এবং সিসেরোর পত্রাবলি। আর সুনাম ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন শিক্ষার্থীরা মধ্যযুগীয় শিক্ষা (পাণ্ডিত্যবাদ বা স্কলাস্টিসিজম) ত্যাগ করে পেত্রাকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। তিনি মানুষের জন্য যে জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত করেছিলেন যা মানুষের মধ্যে মানবতাবাদ ও ইহজাগতিকতার প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।
    • বোক্কাচো (Boccaccio): চতুর্দশ শতাব্দীর ইতালির সাহিত্য জগতের অন্যতম জ্যোতিষ্করূপে পরিচিত। তিনি দান্তের একজন ভক্ত ছিলেন এবং দান্তের জীবনী তিনি রচনা করেন। এটিই ছিল দান্তের প্রথম জীবন কাহিনী। ১৩৭৩ সালে ফ্লোরেন্সবাসীর আমন্ত্রণে তিনি দান্তের ‘পবিত্র কমেডি’র (Divine Comedy) ওপর বক্তৃতা করেন। এ ধরনের বক্তৃতাও ছিল সর্বপ্রথম। দান্তে সম্বন্ধে জানার জন্য বোক্কাসিওর বয়স ছিল খুবই কম। কিন্তু পেত্রার্কের সাথে তার সম্পর্কের কারণ ছিল ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের। এ দু কবি ১৩৫০-এর শরৎকালে প্রথম মিলিত হন ফ্লোরেন্সে। বোক্কাসিও বহুদিন যাবৎ পেত্রার্কের জ্ঞান ও আদর্শকে ধারণ করেছিলেন। তাদের প্রথম পরিচয় হওয়া থেকে আমৃত্যু তিনি তা করেছিলেন। তিনি পেত্রার্কের একজন শিষ্য হিসেবেই মনে করতেন। পেত্রার্ক বোকাসিওকে তার মাতৃভাষার পরিবর্তে ল্যাটিন ভাষায় লিখতে উৎসাহিত করতেন। বোক্কাসিও গ্রিক ভাষা আয়ত্ত করে হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডেসি’ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। তার বিখ্যাত রচনা ‘ডেকামেরন’ (Decameron) ইতালীয় গদ্য সাহিত্যের উৎকৃষ্ট রচনা। ডেকামেরন শব্দের অর্থ ‘দশ দিন’। সাহিত্যের এই গ্রন্থটি ১৩৪৮ থেকে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত। বোক্কাসিওকে ইতালির গদ্য সাহিত্যের জনক বলা হয়।

রাজনীতি, শিল্প ও বিজ্ঞানের সাথে রেনেসাঁর সম্পর্ক

রেনেসাঁস ও রাজনীতি : সাহিত্যের ন্যাম রাজনীতির ইতিহাসে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ললিতকলা, বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই এক নতুন অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি হয়েছিল। রেনেসাঁসের আমলে ইতালিতে যেসব মনীষার আবির্ভাব হয়েছিল তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন মেকিয়াভেলি। তিনি ‘দি প্রিন্স’ নামক গ্রন্থ রচনা করে ইতালিকে প্রাচীন রোমের মতো সাম্রাজ্যে পরিণত করা যায় সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। মেকিয়াভেলির মতে, রাজনীতিতে নৈতিকতা বা ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। সে সময় ইতালি শতধাবিচ্ছিন্ন হয়ে একজন বিজেতার অপেক্ষায় ছিল। মেকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বা ‘হিস্ট্রি অব ফ্লোরেন্স’ গ্রন্থে স্বাধীনতা বা স্বাদেশিকতার অর্ডার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও জাতি সংগঠনের একটি স্বৈরতান্ত্রিক পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। স্বদেশ ও স্বধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের আদর্শ তুলে ধরা হয় ‘দি প্রিন্স’ গ্রন্থে। তবে মেকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’-এ যে আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে তা চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিস্ট।

রেনেসাঁস ও চিত্রশিল্প: রেনেসাঁস যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো ও টিশিয়ান। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একাধারে স্থপতি, ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, বৈজ্ঞানিক, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাকে রেনেসাঁসের প্রতীক মনে করা হয়। মানব ইতিহাসের বহু আবিষ্কারের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন তিনি। তার আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা, বিমান চালনা বিদ্যা, সামরিক প্রকৌশলসহ আরো অনেক কিছু। মিলানের সান্তা মারিয়া দেল্লা থ্রেজি গির্জার ভোজনশালায় অঙ্কন করেন। তার বিখ্যাত চিত্র শেষ ভোজ’ (The Last Supper)। চিত্রে যিশুকে খাবার টেবিলে সবার মাঝখানে দেখা যাচ্ছে। তার পিছনে উন্মুক্ত গবাক্ষ। গরাক্ষের ওপরে খিলান যেটি একটি প্রভাবমণ্ডলের কাজ করেছে এবং এটিই চিত্রের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। ছবিতে বিশ্বাসঘাতক জুডাসকে একই টেবিলে দেখানো হয়েছে—তার মুখমণ্ডল কালো ছায়ায় আবৃত। সে ডান হাত দিয়ে দৃঢ় মুষ্টিতে টাকার খলে বের করে বাম দিকে রাখছে। টেবিলের দু প্রান্তে উপবিষ্ট দুজন শিষ্য অপেক্ষাকৃত নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে আছে।

স্থাপত্য : রেনেসাঁস যুগে গথিক শিল্পের হাত ছাড়িয়ে বেনেসাসের স্থাপত্য এগিয়ে চলেছিল মিলনধর্মী মুক্তির দিকে। ব্রুনেলেস্কি, আলবের্তি, মিচেলেজ্জো, ব্রামাস্তে, পেরুজ্জি, সানসুভিনো, মাইকেল এঞ্জেলো স্থাপত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। স্তূপীকৃত পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো হত প্রাসাদগুলো। শুদ্ধ রুচি ও দৃঢ় বিচারবুদ্ধির সাথে বিজ্ঞানসম্মত অনুপাত সামঞ্জস্য আনার স্থাপত্য কলায় এসেছিল নতুন চারিত্র্য। স্থাপত্যকর্মকে দেখা হতে থাকল মানবদেহের অনুপাত সামঞ্জস্যের সমান্তরালে। একটি অট্টালিকা যেন একটি মানুষ। মধ্যযুগের গির্জাগুলো ছিল ক্রুশ চিহ্ন মাফিক। রেনেসাঁসের যুগে তা বৃত্তাকৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাথায় দেওয়া হয় গভীর গম্বুজ। গির্জার মূল অংশে, হাসে, চ্যাপেলে যাতে শোভা পেতে পারে ‘হাই রিলিফ’, ‘ফ্রেঙ্কো’ বা ‘স্টাকো’র কাজ, সে ব্যবস্থা হল। ব্রুনেলেস্কি নির্মিত ‘ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রাল’, মিচেলেজ্জো নির্মিত ‘মেদিচি প্রাসাদ’, মাইকেল এঞ্জেলো রচিত ‘লবেগীয় লাইব্রেরি, এবং বহু স্থপত্তির মেধা ও সক্রিয়তায় প্রায় দু শ বছর ধরে নির্মিত ‘সেন্ট পিটার গির্জা’ রেনেসাঁস স্থাপত্যের বিস্ময়কর ঐশ্বর্য বহন করে।

ভাস্কর্য : ভাস্কর্য হল কাঠ, পাথর এবং মাটির মধ্যে কোনো জন্তু-জানোয়ার, বা মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করে তাতে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত ভাস্কর ছিলেন ডোনাটেলো, মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি প্রমুখ। রেনেসাঁস যুগের প্রথম দিকে ভাস্কর্য আত্মপ্রকাশ করে স্থাপত্য শিল্পের অধীন ও অনুগামী শিল্প হিসেবে। প্রখ্যাত ভাস্কর ঘিবার্তির তৈরি ‘ব্যাপটিসরি ব্রোঞ্জ পেট’। মাইকেল এঞ্জেলো এটিকে বলেছেন ‘স্বর্গের প্রবেশ দ্বার’। মাইকেল এঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ একটি অনুপম ভাস্কর্য।

বিজ্ঞান : রেনেসাঁস থেকে শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) ছিলেন রেনেসাঁস যুগের বৈজ্ঞানিক। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এ তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। জার্মান বিজ্ঞানী কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) জ্যোতির্বিদ্যাকে আরো উন্নত করেন। ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও রেনেসাঁস যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি সৌরজগৎ সম্পর্কে নতুন তথ্যের অবতারণা করেন এবং উন্নত দূরবীক্ষণ যন্ত্র (টেলিস্কোপ) আবিষ্কার করে তার তত্ত্বকে সত্য হিসেবে প্রমাণ করেন। এ ছাড়া ডেনমার্কের টাইকোব্রাহে, ইংল্যান্ডের গিলবার্ট, লর্ড ভেরুলাম প্রমুখ ছিলেন রেনেসাঁস যুগের বিজ্ঞানী। তবে রেনেসাঁস যুগে বিজ্ঞানের পাশাপাশি জ্যোতিষবিদ্যা বিশেষ মর্যাদা পেত। ইতালীয় নগররাষ্ট্রের রাজদরবারের গৃহচিকিৎসকের মতো নিজস্ব জ্যোতিষী ছিল। প্রখ্যাত দার্শনিক ফিকিনো জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন। কুসংস্কার ও অপবিশ্বাস কী পরিমাণে রাজত্ব করত তার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় বুর্খহার্ডটের রেনেসাঁস সংক্রান্ত গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে।

রেনেসাঁস প্রথমে ইতালিতে শুরু হবার কারণ

ইতালিতে রেনেসাঁস প্রথম শুরু হওয়ার পেছনে ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান, ইতালিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ, ইতালীয় নগরগুলোর ভূমিকা, ইতাদির প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতালিতে মানবতাবাদীদের আবির্ভাব প্রভৃতি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

  • (১) ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান : ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান ইতালিতে রেনেসাঁস সৃষ্টির অন্যতম কারণ ছিল। ইতালি ছিল ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। মধ্যযুগ থেকে ইতালির নগরগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। দ্বাদশ শতক ছিল ‘বাণিজ্যিক বিপ্লব’-এর স্বর্ণযুগ এবং তার নেতৃত্ব দিয়েছিল ইতালি। মিলান, ভেনিস, নেপলস ও ফ্লোরেন্সে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার হওয়ায় এ নগরগুলো প্রাচীরবেষ্টিত হয়ে গড়ে ওঠে এবং শহরতলি ও সন্নিহিত জনপদের ওপর শহরগুলোর আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থানীয় ও আঞ্চলিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়। ক্রুসেডের প্রভাবে এ নগরগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রের রূপ নেয়। বাণিজ্যে বেশি লাভ হওয়ায় অধিকাংশ নাগরিক বাণিজ্য পেশা গ্রহণ করে। যার ফলে বাণিজ্য ধন এসব নগরে নতুন অভিজাত সৃষ্টি করে। এ অভিজাত শ্রেণী রেনেসাঁসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল। ফ্লোরেন্সের মেডিচি পরিবার, মিলানের ভিসকন্তি পরিবার, এমনকি ইতালির কোনো কোনো গোপ রেনেসাঁসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এদের অর্থানুকূল্য এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উন্নতি সম্ভব হয়েছিল।
  • (২) ইতালীয় রেনেসাঁসের পশ্চাতে আরব সংস্কৃতির প্রভাব : ইতালীয় শহরগুলোর সাথে আরব বণিকদের যোগাযোগ ছিল। ইতালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরব পণ্ডিতদের রচিত গ্রন্থ বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুনের গ্রন্থ পড়ানো হত। আরবরাই প্রথমে নিজেদের ঐতিহ্যের সাথে একদিকে সদ্যোত ইসলাম ধর্ম ও অন্যদিকে গ্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটানোয় উদ্যোগী হন এবং সে প্রচেষ্টা থেকে এক মহৎ ও ব্যাপক সভ্যতা গড়ে ওঠে। ইউরোপে আরবরাই আমদানি করেন ভারতের বিশিষ্ট সংখ্যাতত্ত্ব ও শূন্যের পরিকল্পনা এবং চীনের কাগজ নির্মাণের পদ্ধতি। তুলনামূলক ধর্মবিচারের প্রবর্তন করেন আলি ইবনে হাজম, ইবনে সিনার বিখ্যাত ‘বিশ্বকোষ’-এর পনেরটি ল্যাটিন সংস্করণ প্রকাশিত হয় পনের শতকের শেষ ত্রিশ বছরে; ইবনে রুশদের অ্যারিস্টটল ব্যাখ্যা ও যুক্তিবাদ ইউরোপীয় চিন্তায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দক্ষিণ ইতালির অনেকাংশ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল দীর্ঘকাল আরবদের অধীন ছিল। হিটির মতে, আরব সভ্যতার প্রভাব ছাড়া পশ্চিমি রেনেসাঁস অকল্পনীয়।
  • (৩) ইতালীয় শহরগুলোর প্রভাব : ইতালীয় শহরগুলোর প্রভাব ইতালিতে রেনেসাঁস সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত করেছিল। শহরগুলোতে ধনী বণিক শ্রেণীর উদ্ভব, শহরের সামাজিক সংকীর্ণতামুক্ত পরিবেশ শহরগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাব রেনেসাঁসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।
  • (৪) ইতালির ঐশ্বর্য : ইতালি ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। রোমকে কেন্দ্র করে একসময় রোমান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে ইতালীয়দের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় নি। তাই ইতালিতে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে সম্ভব ছিল।
  • (৫) ইতালির ধর্মাধিষ্ঠানের ভূমিকা : ইতালিতে রোমান সত্যতা পতন হলেও ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ইউরোপে খ্রিস্টানদের ঐক্য ধরে রেখেছিল। এ ছাড়া ধর্মাধিষ্ঠানগুলোতে ল্যাটিন ভাষার চর্চা হত এবং এগুলো প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের অনেক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করে রেখেছিল।
  • (৬) ইতালীয় হিউম্যানিস্টদের প্রভাব : ইতালির হিউম্যানিরা ছিলেন রেনেসাঁসের পথপ্রদর্শক। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার করে এগুলোর গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক মূল্য তারাই বুঝতে পেরেছিলেন। দান্তে, পেত্রার্ক, প্রমুখ হিউম্যানিস্ট প্রাচীন গ্রিক ও রোমান। ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পথপ্রদর্শক ছিলেন। সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি উন্নতি লাভ করেছিল ইতালীয় হিউম্যানিস্টদের প্রভাবে। রেনেসাঁস যুগে ইতালির শহরগুলোতে অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন মনীষার আবির্ভাব হয়েছিল। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, বাফাফেল, মাইকেল এঞ্জেলো প্রমুখ শিল্পীর সবাই ছিলেন ইতালীয়।
  • (৭) ইতালিতে বিভিন্ন সভ্যতার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রভাব : ইতালির বিভিন্ন শহরগুলো ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র। ৪৭৬ সালে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইতালিতে গথ, লোম্বার্ড, ফ্রাঙ্ক, নর্মান, জার্মান এবং আরব বণিকসহ প্রভৃতি জাতির মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সূত্রে রোমান সভ্যতার পৌত্তলিক সংস্কৃতি, বাইজান্টাইন সংস্কৃতির মাধ্যমে গ্রিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির মানবতাবাদ ও পবিত্রতা ইসলামি সংস্কৃতির একেশ্বরবাদ, সততা ইতালিতে এক নতুন জীবন চেতনা ও সংস্কৃতির জন্ম দেয়।
  • (৮) ইতালীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব : ইতালির বিভিন্ন শহরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সেগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষ বাস্তবজীবনের ফলপ্রপ্ত শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছিল। ইতালির রোম ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান কেন্দ্র হলেও ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ইতালিতে স্থাপিত না হয়ে ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হয়েছিল। ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা ও ব্যাকরণ, রোমান আইন, চিকিত্সাবিজ্ঞান প্রভৃতি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হত। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা মানুষের ইহজাগতিক জীবনকে সুখকর এবং সহজ ও সরল জীবনযাপনের প্রেরণা দেয়। এ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা রেনেসাঁসের বীজ তৈরি করেছিল।
  • (৯) ইতালীয় সমাজের প্রভাব : সামন্ততন্ত্র ফান্স, জার্মানি এবং উত্তর ইউরোপে শক্তিশালী হলেও ইতালির সমাজব্যবস্থায় সামন্ততন্ত্রের প্রভাব অনেকটা দুর্বল ছিল। ইতালির বাণিজ্য অর্থনীতি সামন্ততন্ত্রকে অবক্ষয় অবস্থায় রেখেছিল। সামন্ততন্ত্রের প্রভাবমুক্ত ইতালির নগরগুলোতে নবজাগরণ বা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণার বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।
  • (১০) ইতালিতে প্রাচীন রোমান ঐতিহ্যের নিদর্শনের প্রভাব : প্রাচীন রোমান সভ্যতার অনেক ঐতিহ্য বিশেষ করে রাস্তাঘাট, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি সভ্যতার চিহ্ন রোমে ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন শিল্প-সাহিত্যের চর্চা ইতালীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চর্চা হত। অনেক মঠে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। রোমানরা খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাদের রক্তে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিকতা ঐতিহ্যবোধ সক্রিয় থাকায় তাদের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ জীবন চেতনা ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল।

ইতালীয় রেনেসাঁসের স্বরূপ

রেনেসাঁসের মাতৃভূমি ইতালি। তবে এ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি ঐতিহাসিক মিশেল। তিনি তার রচিত ‘ফ্রান্সের ইতিহাস’ গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রেনেসাঁস শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে এর আগে রেনেসাঁসের অনুরূপ শব্দ ‘Rinacita’ (রিনাসিটা) ভাসারি ব্যবহার করেছিলেন ইতালীয় শিল্পীদের জীবনকাহিনীতে। ঐতিহাসিক জ্যাকব বুর্খাহার্টের তার রচিত “The Civilization of the Renaissance in Italy’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেন ক্লাসিক্যাল যুগের অবসান আর শেষ খণ্ডে মধ্যযুগের অন্ত আর আধুনিক যুগের উদয়—এ প্রসঙ্গে বুর্খাহার্ট ভাসারির রিনার্সিটাকে (যা শুধু চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের শিল্প সম্বন্ধে প্রযোজা) সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। (অবশ্য ক্লাসিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সমান জোর দিয়েছেন ইতালির বিশিষ্ট জাতীয় প্রতিভাকে। মধ্যযুগের সাম্রাজ্য, চার্চ ও গিল্ডের কঠিন শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তিত্বের মুক্তি ও পূর্ণ প্রকাশ, যশলিঙ্গা, দেশপ্রেম, যুক্তিবাদ, সুগঠিত রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, ধর্মনিরপেক্ষ সংশয়বাদ এমনকি প্রগতির ধারণাও তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রেনেসাঁসের মধ্যে। সর্বোপরি রেনেসাঁসকে মধ্যযুগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক স্বয়ম্ভ ঐতিহাসিক যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি। তিনি মরুভূমির ঊষর বালুতে হঠাৎ প্রস্ফুটিত ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন রেনেসাঁসকে। মিশেলের বিখ্যাত ঘোষণা, “discovery of man and nature’ কে কিঞ্চিৎ বদলে বলেছেন— ‘The discovery of the world and of man’ এতদিনে সম্ভব হল রাষ্ট্রসহ পার্থিব সব জিনিসকে তন্ময়ভাবে দেখা। মানুষ এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিপুরুষ। ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল (১) মানবতাবোধ, (২) ইহজাগতিকতা এবং (৩) ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ। নিম্নে ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :

  • (১) মানবতাবাদ : মানবতা বা হিউম্যানিজমকে ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রধান বিশেষ লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য বলা যায়। মানবতাবাদে মানুষকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় অর্থাৎ সবার উপরে মানুষ সত্য। প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য ছিল মানবতাবাদী। ইতালিতে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ব্যাপকভাবে চর্চা শুরু হলে প্রাচীন মানবতাবাদ ইতালীয় রেনেসাঁসে বিশেষ গুরুত্ব পায়। ইতালীয় মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, মানুষ তার আপন সত্তার নিয়ন্তা। মধ্যযুগে মানুষ অপেক্ষা ঈশ্বর এবং পারলৌকিক জীবনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। সামন্ত অর্থনীতি এবং গিল্ডের শৃঙ্খলে মানুষের গুরুত্ব বা মর্যাদা বিলুপ্ত হয়েছিল। শিক্ষা, নীতিবোধ, আত্মসচেতনতা, শ্রমের মর্যাদা, মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং প্রকৃতিকে জয় করে মানুষ নিজের ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে।
  • (২) ইহজাগতিকতা : ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইহজাগতিকতা। ইতালি ছিল প্রাচীন রোম সভ্যতার লীলাভূমি। রোমান সভ্যতার সংস্কৃতি ছিল ইহজাগতিক। খ্রিস্টান ধর্ম ইতালিতে জনপ্রিয় হলেও ইতালীয়রা রোমান সংস্কৃতির উত্তরাধিকারিত্ব ভুলে যায় নি। ইতালির নগরগুলোতে প্রচুর বিত্তবৈভব জড়ো হলে ইতালির বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে ভোগস্পৃহা এবং ইহজাগতিক সৌন্দর্যবোধ উপভোগের কৃষ্টি গড়ে ওঠে। এমনকি পোপ ও যাজক শ্রেণী এ থেকে মুক্ত ছিল না। খ্রিস্টধর্মে স্বর্গ ও নরকের চিত্র ধর্মবিশ্বাসীদের সম্মোহিত করলেও বিত্তবৈভব এবং ভোগস্পৃহা ইতালীয় নগরগুলোর বিত্তশীল মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল।
  • (৩) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ : ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি সামন্তশাসিত অঞ্চল অপেক্ষা ইতালি ছিল অনেকটা সামন্ত প্রভাবমুক্ত। ইতালির নগরগুলোতে দাসত্ব প্রথা বা ভূমিদাস প্রথা না থাকায় নগরের নির্মল পরিবেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল। শ্রমের মর্যাদা এবং মানুষের কর্মের স্বাধীনতা অনেক অখ্যাত মানুষকে বিখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক এবং মানবতাবাদী হওয়ার মতো সুযোগ দিয়েছিল। গির্জার শৃঙ্খলমুক্ত সামন্ত প্রভুর অধীনতামুক্ত, গিল্ডের প্রভাবমুক্ত থাকায় রেনেসাঁস যুগের শিল্পী, ভাস্কর, কবি বা সাহিত্যিক সবাই নিজেদের কৃতিত্ব এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। রেনেসাঁসের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকদের মূল নিহিত ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে। এ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটেছিল।

ইতালীয় রেনেসাঁস ধর্মনিরপেক্ষ জীবনের ওপর প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করলেও রেনেসাঁসের শিল্পী, ও মানবতাবাদীগণ খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেন নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থোপার্জন, সুদ (ব্যাংকিং ব্যবসার মূল ভিত্তি, অবাধ বাণিজ্য সংক্রান্ত ট্যাবুগুলো (ধর্মীয় বিধিনিষেধ) নবোদ্ভূত ধনিক-বণিকরা যেমন অস্বীকার করলেন, তেমনি সেগুলো তারা পুষিয়ে দিতে থাকলেন নতুন নতুন চার্চ, ধর্মীয় চিত্রাদির পৃষ্ঠপোষকতা করে। জোত্তোর আঁকা এক ছবিতে দেখা যায় এনরিকো স্লোভেনি এক বণিক পিতার সুদের কারবারজনিত ঐশ্বর্যের পাপস্খলনের জন্য এরিনা চ্যাপেল’ নির্মাণ করে যাজকদের তা উৎসর্গ করেছিলেন। রেনেসাঁসের আমলে কত গির্জা তৈরি হয়েছিল তার হদিস নিতে গেলে অবাক হতে হয়। ইতালীয় রেনেসাঁসের চিত্রকররা চার্চের দেওয়ালে, ছাদে, চ্যাপেলে শত শত ধর্মীয় ছবি এঁকেছিলেন। চিত্রকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল চার্চ। চিত্রের প্রধান কাজই ছিল সাধারণ মানুষের সামনে ধর্মের গল্প বিশ্বাসযোগ্য ও সুন্দর করে উপস্থাপন করা। রেনেসাঁসের চিত্রীরা এঁকেছিলেন ‘ঘোষণা’, ‘জন্ম’, ‘স্তব’, ‘উপহার’, ‘পলায়ন’, ‘রূপান্তরণ’, ‘শেষ ভোজ’, ‘ক্রুশারোহণ’, ‘সমাধিকরণ’, ‘পুনরুত্থান’, ‘স্বর্গারোহণ’, ‘শহীদ দৃশ্য’-র মতো শত শত ধর্মীয় ছবি। ভার্জিন, মেরী, দিশু রেনেসাঁসের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত রাজত্ব করে গিয়েছেন। অ্যাঞ্জেলোর ‘আদমের জন্ম’, টিশিয়ান বা রাফায়েলের ‘রূপান্তরণ’, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘ভার্জিন অব দ্য রক’ ছবি দেখলে এ কথা বলা সম্ভব নয় যে, ধর্মের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে রেনেসাঁসের শিল্প আধুনিকতার দিকে যাত্রা করেছিল।

রেনেসাঁসের নেতিবাচক দিক : ইতালীয় রেনেসাঁস ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, সৌন্দর্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষ জীবন, যুক্তিবাদ প্রভৃতি ধারণা সৃষ্টি করলেও তা ইতালিতে অনেক নেতিবাচক অবক্ষয়ের সূচনা করেছিল। বিত্তবান ধনীরা ধর্মহীন ও নাস্তিক না হলেও গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির অনেক খারাপ বিষয় ইতালীয় নগরগুলোতে দেখা দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিতে ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে খ্রিস্টধর্মের সংযম, চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রভৃতি হাস্যকর মনে করা হত। ধর্মহীনতা নগরগুলোতে ব্যভিচার, অলসতা, আরামপ্রিয়তা, নীতিজ্ঞানহীনতা প্রভৃতি অনাচার ইতালীয় সমাজ জীবনকে আচ্ছন্ন করেছিল। এমনকি পোপ ও যাজকরা এসব পাপাচার থেকে মুক্ত ছিল না।

রেনেসাঁসের বিস্তার

রেনেসাঁসের মাতৃভূমি ইতালি। কালক্রমে রেনেসাঁসের চেতনা ইতালির সীমা ছেড়ে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনসহ প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে। ইতালিতে রেনেসাঁসের পৃষ্ঠপোষক ছিল বণিক শ্রেণী এবং রোমের কয়েকজন পোপ। কিন্তু উত্তর ইউরোপে রেনেসাঁসের পৃষ্ঠ পোষক হয় রাজদরবারসমূহ। যেমন—ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের প্রথম এলিজাবেথ, জার্মানির রাইন নদীর উপত্যকাসমূহে কোনো রাজবংশ না থাকায় ধার্মিক মানবতাবাদীরা বিশেষ করে ‘ব্রেথেন অব দি কমন লাইফ’-এর (Brethren of the common life) সংগঠনগুলো রেনেসাঁসের পৃষ্ঠপোষক ছিল। ইতালিতে রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান (প্যাগান) সংস্কৃতির সাথে (জীবনবোধ) মানবতাবাদের সমন্বয় কিন্তু উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় মানবতাবাদের সাথে আদি খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের সমন্বয় সাধন। ইতালির বিভিন্ন শহরে রেনেসাঁসের শিক্ষা প্রচারিত হলে এসব শিক্ষাকেন্দ্রে উত্তর ইউরোপ থেকে শিক্ষার্থীরা ইতালিতে এসে বিভিন্ন শহরের শিক্ষাকেন্দ্রে জ্ঞান অর্জন করে এবং তারা স্বদেশে রেনেসাঁসের আদর্শ প্রচার করে। উত্তর ইউরোপে রেনেসাঁসের প্রভাবে ধর্মীয় কুসংস্কার, গির্জার দুর্নীতি ও যাজকদের অনৈতিক জীবনের প্রতি চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। নিম্নে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেনেসাঁসের বিস্তার আলোচনা করা হল –

  • ফ্রান্স : ফ্রান্সে রেনেসাঁসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা প্রথম ফ্রান্সিস। ইতালি থেকে রেনেসাঁসের প্রভাব ফ্রান্সে বিস্তার হলে ফ্রান্সের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যানুরাগের সৃষ্টি হয়। ফান্সে প্রাচীন প্যাটিন সাহিত্য প্রভাবিত কবিতা, নাটক ও গদ্য সাহিত্যের সৃষ্টি সহজতর হয়। রেনেসাঁসের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ফ্রান্সের প্রখ্যাত লেখক মনটেইন (১৫৩৩-১৫৯২), রেবেলেয়াস (১৪৯০-১৫৫৩) নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করেন। রেনেসাঁসের প্রভাবে ফরাসি ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্প উন্নত হয়। একাদশ শতাব্দী থেকে ফরাসি ভাস্কর্য শিল্প উন্নত হতে থাকে। বেনেসাঁসের প্রভাবে ভাস্কর্য শিল্পে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। রেনেসাঁস প্রভাবিত ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম দৃষ্টান্ত প্যারিসের সেন্ট গির্জায় স্থাপিত (Sainte Chapelle) দেবদূতের মূর্তিগুলো। ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রভাবে ফরাসি ভাস্কর্যে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ভাস্কর্যের রীতি গৃহীত হলে ফরাসি ভাস্কর্যের স্থানীয় রীতি তার স্বাতন্ত্র্য হারায়।
  • ইংল্যান্ড : ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রভাব ইংল্যান্ডের শিল্প-সাহিত্য ও শিল্পকলাকে প্রভাবিত করে। রানী এলিজাবেথ নিজ দরবারে রেনেসাঁসের অনুরাগী মানবতাবাদী শিক্ষক, কবি ও বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ইংল্যান্ডে রেনেসাঁসের অগ্রদূত ছিলেন রজার বেকন্ (১২১০-১২৯৩)। তিনি অক্সফোর্ডের ফ্রন্সিঙ্কান ভ্রাতৃসংঘের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘অপাস মাজুস’ (Opus Majus) ছিল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি সমকালীন স্কলাস্টিক ধারা থেকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণায় মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত ও অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী। মানুষ একসময় যন্ত্রচালিত গাড়ি, জাহাজ ও বিমান প্রভৃতি প্রস্তুত করতে পারবে এমন বিশ্বাস তিনি পোষণ করতেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে রেনেসাঁসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সাহিত্যচর্চায়। এ সময় জিওফ্রে চসারের (১৩৪০-১৪০০) ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ (Canterbury Tales) এবং ম্যালোরির ‘মার্টি ডি আর্থার’ (Morte D’ Arthur) গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। তবে ১৪৮৫ সালে গোলাপের যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে অশান্তি এবং রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে সাহিত্যক্ষেত্রে কিছুটা পশ্চাৎপদতা দেখা দেয়। তবে টিউডর রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর ইংল্যান্ডে শন্তি প্রতিষ্ঠা হলে সাহিত্যক্ষেত্রে আবার পুনর্জাগরণ দেখা দেয়। রেনেসাঁসের যুগে ইংল্যান্ডে প্রখ্যাত মানবতাবাদী জন কোলেট (১৪৬৭-১৫১৯) এবং স্যার টমাস মূর (১৪৭৮-১৫৩৫)। ইংল্যান্ডের নবজাগরণে এদের অবদান চিরস্মরণীয়। জন কোলেট বাইবেল সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করে অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৫০৫ সালে তিনি লন্ডনের সেন্ট পলের গির্জার তিন নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ধর্ম উপদেশ অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ বাইবেল ব্যাখ্যা করে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। তিনি ভালগিটের (চতুর্থ শতাব্দীতে সাধু জেরাম কর্তৃক অনূদিত ল্যাটিন বাইবেল) বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দেহ করতেন না। তবে গির্জা ও ধর্মযাজকদের আত্মশুদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিতেন।
  • সম্রাট অষ্টম হেনরির সময় ইংল্যান্ডে রেনেসাঁসের ভাবধারার প্রচারক ছিলেন টমাস মুর। তিনি ল্যাটিন ভাষায় কালজয়ী গ্রন্থ ‘ইউটোপিয়া’ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি পৃথিবীকে একটি আদর্শ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা পেশ করেন। এ গ্রন্থটিতে ইউটোপিয়া (Utopea) নামে একটি কাল্পনিক দ্বীপে বসবাসরত মানুষেরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ভোগ করত। তারা রাজা, আইনসভার সদস্য এবং স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাচিত করত। তবে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে নাগরিকরা তাদের পদচ্যুত করত। প্রত্যেক নাগরিককে লাভজনকভাবে নিয়োগ করতে হবে—এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তিনি এমন একটি সমাজের ছবি অঙ্কন করেন, যেখানে জনগণ দিনে ছয় ঘণ্টা কাজ করে এবং অবসর সময়ে তারা জ্ঞানার্জনের জন্য পড়াশোনা করে। সেখানে আইনের শাসন, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নাগরিক সুবিধাসহ একটি শহরের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয়। ইউটোপিয়া দ্বীপে সবার শিক্ষার সুযোগ রয়েছে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে চুক্তি করে শান্তি বজায় রাখা হয়েছে। সেখানে একটি ধর্ম প্রচলন করা হয়েছে। যাতে সব ধর্মবিশ্বাসের লোক অংশগ্রহণ করতে পারে। ইউটোপিয়া গ্রন্থটি মানবতাবাদের একটি উপাখ্যান। টমাস মুর ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের দুর্নীতি দূর করে ধর্মাধিষ্ঠানের সংস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন।
  • রেনেসাঁসের প্রভাবে ইংল্যান্ডে অনুবাদ সাহিত্যের প্রসার ঘটে। অনেক মূল্যবান গ্রিক ও ল্যাটিন গ্রন্থ ইংরেজিতে অনূদিত হয়। তবে ইংল্যান্ডের সাহিত্যিকরা নিজেদের মেধাকে ব্যবহার করে মৌলিক সাহিত্য রচনা করেন। এর দৃষ্টান্ত হল স্পেন্সারের ফেয়ারি কুইন (Faerie Queen)। রেনেসাঁসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় নাট্যসাহিত্যে। এ সময় খ্রিস্টফর মার্লো (১৫৬৪-১৫৯৩) এবং শেকসপিয়ার অসামান্য নাটকগুলো রচনা করেন। শেক্সপিয়ার মোট ৩৭টি নাটক রচনা করেন। ইংল্যান্ডের একজন প্রখ্যাত মানবতাবাদী সাহিত্যিক ছিলেন জন মিলটন (১৬০৮- ১৬৭৪)। তিনি প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তিনি ইতালি ভ্রমণ করে। র‍্যাফেইল এবং মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মনোরম চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হন। তিনি রেনেসাঁসের প্রভাবে বাইবেলের কাহিনীকে ভিত্তি করে প্যারাডাইজ লস্ট’ ও ‘প্যারাডাইজ রিগেইনড’ (Paradise Lost and paradise Regained) নামক অমর কাব্যদ্বয় রচনা করেন। রেনেসাসের প্রভাবে ইংল্যান্ডে সঙ্গীতশাস্ত্রের উন্নতি ঘটে। সে সময় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ট্যালিস, বার্ড অর্ল্যান্ডো গিবনস প্রমুখ।
  • স্পেন ও পর্তুগাল : স্পেন ও পর্তুগালে রেনেসাঁসের প্রভাবে সাহিত্যক্ষেত্রে জাগরণ আসে। স্পেনে প্রখ্যাত মানবতাবাদী ছিলেন সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬)। তার অমর সাহিত্যকর্ম ‘ডন কুইকজোট (Don Quixote) অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম। এ গ্রন্থে উল্লিখিত ডন কুইক্‌জোট ও স্যাঙ্কো পাঞ্জার (Sancho panza) চরিত্রটি হাস্যরসাত্মকপূর্ণ। পর্তুগালে রেনেসাঁসের প্রভাবে কবি ক্যামেনেস (১৫৪২-১৫৮০) মহাকাব্য লুসিয়াড (Lusiad) রচনা করেন। রেনেসাঁসের প্রভাব স্পেনের চিত্রশিল্পকে উৎকর্ষ দান করেছিল। স্পেনের চিত্রশিল্পী ভেলাজ কুয়েজ (Velasquez, ১৫৯৯-১৬৬০) রেনেসাঁসের প্রভাবে চিত্রশিল্পে নতুনত্ব আনেন।
  • হল্যান্ড : ওলন্দাজ রুবেন্স ও রেমব্রান্ডেট (Rembrandt) ছিলেন ঐ যুগের প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী। রুবেন্স ও রেমব্রান্ডেট তৈলচিত্র অঙ্কনে উৎকর্ষ লাভ করেন। হল্যান্ড ও জার্মানিতে রেনেসাঁসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সাহিত্য অঙ্গনে এবং ধর্মসংস্কার আন্দোলনে। হল্যান্ডের বিখ্যাত মানবতাবাদী ছিলেন ইরাসমাস। তিনি তৎকালীন রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে লেখনী চালিয়েছিলেন। ইরাসমাসের জন্ম হল্যান্ডের রটারডামে। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রটারডামের শহরের একটি বেসরকারি স্কুলে। পরে তিনি ডেভেনটারের একটি গির্জা স্কুলে ৯ বছর শিক্ষা লাভের পর সন্ন্যাসীজীবন গ্রহণ করেন। মঠ জীবনে তিনি প্রাচীন সাহিত্য ও ধর্মসংক্রান্ত সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। তিনি ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ১৪৯২ সালে তিনি ইউট্রেক্টে ধর্মযাজক নিযুক্ত হন। ধর্মশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ১৪৯৫ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৪৯৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রি লাভের পর তিনি ইংল্যান্ডে এসে অক্সফোর্ড সংস্কারক জন কোলেট ও স্যার টমাস মুরের সাথে পরিচিত হন।
    • ইরাসমাস প্রাচীন ল্যাটিন সাহিত্য অধ্যয়ন করে মূল্যবান কথামৃত সংগ্রহ করে ১৫০০ সালে Adages এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন।
    • ১৫০১ সালে সিসেরোর ডি অফিসিস (De officis) ও ১৫০৬ সালে গ্রিক গ্রন্থ ইউরোপিদেশ এবং লুসিয়ান (Europides and Lucian) ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন।
    • ১৫০৩ সালে তিনি খ্রিস্টান ধর্মের মূলনীতি বিষয়ে হ্যান্ড বুক অব দি খ্রিস্টিয়ান নাইট (Hand Book of the Christian Knight) রচনা করেন। এতে তিনি খ্রিস্টধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন উপবাস ব্রত, মুত সাধু ব্যক্তিদের সাহায্য প্রার্থনা, তীর্থ গমন এবং ইন্ডালজেন্স ক্রয়কে (মুক্তিপত্র) মূল্যহীন উল্লেখ করেন। তিনি নিরক্ষরতাকে পাপ মনে করতেন। তার মতে, শিক্ষা মানবসমাজে অনুরাগ ও ভালবাসা বৃদ্ধি করে।
    • ১৫০৫ সালে ইরাসমাস লোরেনজো ভেন্না (Lorenzo Vella) রচিত নোটস অন দি নিউ টেস্টামেন্টের (Notes on the New Testament) গ্রিক থেকে ল্যাটিন ভাষায় বাইবেলের প্রথম ভাষণ তৈরি করেন।
    • ইংল্যান্ডে প্রাপ্ত চারটি, ব্রাসেলসে প্রাপ্ত পাঁচটি এবং অন্যত্র প্রাপ্ত একটি গ্রিক ভাষায় হস্তলিখিত বাইবেলের ওপর ভিত্তি করে নোভাম ইনসট্রুমেনটাম (Novum Instrumentum) নামে প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৫১৬ সালে। তিনি মনে করতেন বাইবেলের বিশুদ্ধতা খ্রিস্টীয় জীবনে বিশুদ্ধতাকে অসামান্যভাবে প্রভাবিত করে।
    • তার বিখ্যাত রচনা ‘ফ্রেইজ অব ফোলি’ (Praise of Folly) তৎকালীন ধর্মাধিষ্ঠান ও যাজকদের শিক্ষার সমালোচনা। ফোলি এক ভদ্র ও অমায়িক মহিলা, যাকে মানুষের দুর্বলতা হিসেবে রূপায়িত করা হয়। তিনি উল্লেখ করেন যে, তাকে ঘৃণা করা উচিত নয়, বরং তার প্রশংসা করা উচিত। কেননা সে না থাকলে পুরুষ মানুষ বিয়ে করতে পারত না, সন্তান জন্ম দিতে পারত না; সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্ম হত না, সাহিত্যের বিকাশ হত না এবং গির্জা তার অনুসারী খুঁজে পেত না।
    • ১৫১৭ সালে ইরাসমাস বেনামে জুলিয়াস এক্সক্লুডেড ফ্রম হেভেন (Julius Excluded from Heaven) নামে হাস্যরসাত্মক কথোপকথনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের মৃত্যুর পর এটি লেখা হয়। এতে দেখানো হয়েছে যে, “যোদ্ধা পোপ” জুলিয়াস অহংকারের সাথে স্বর্গের দরজায় প্রবেশ করলে সেন্ট পিটার তার প্রবেশে বাধা দেন।
    • পরে তিনি ফেমিলিয়ার কনভারসেশন (Familiar Conversation) নামে অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
    • ইরাসমাস ‘এডুকেশন অব এ খ্রিস্টিয়ান প্রিন্স’ (Education of a christian prince) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করে ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন বাতিল করেন এবং তিনি প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও টমাস একুইনাসের মত অনুসরণ করে বলেন যে, রাজনীতি নীতিশাস্ত্রের একটি শাখা এবং শাসকের উচিত জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব স্বীকার করা।
    • ইরাসমাস স্বৈরাচারী শাসনকে ঘৃণা করতেন এবং প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। এ বিষয়ে বিটল (Beetle) নামে একটি গ্রন্থে মত ব্যক্ত করেন ইরাসমাস।
    • ইরাসমাস জার্মান ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন। তিনি ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের দুর্নীতি ও যাজকদের বিলাসিতার সমালোচনা করে জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন।
  • জার্মানি : জার্মানিতে মার্টিন ল্যুথার রেনেসাঁসের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ধর্ম বিষয়ে বাইবেলের প্রাধান্য, খ্রিস্টান বিশ্বাসীদের সাথে ঈশ্বরের মিলনের ক্ষেত্রে যাজকদের মধ্যস্থতা অস্বীকার করে ধর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মার্টিন ল্যুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিলেন। রেনেসাঁসের প্রভাবে জার্মানির কলোন নামক শহরে চিত্রশিল্পের উন্নতি হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালীয় চিত্রকলার প্রভাবে জার্মানিতে প্রকাশ পায় আলব্রেখট ডুরার (Albrecht Durer) এবং হানস হলবিইনের চিত্রে।

রেনেসাঁসের ফলাফল

রেনেসাঁস আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, অর্থনীতি, শিক্ষা, জীবনবোধ সব ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে আধুনিক জীবনের উত্তরণের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। রেনেসাঁসের মাধ্যমে মধ্যযুগ আধুনিক যুগে পরিবর্তিত হয়। এজন্য রেনেসাঁসকে পণ্ডিতগণ আধুনিক যুগের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

  • (১) নতুন চিন্তা ও চেতনা প্রতিষ্ঠা : রেনেসাঁস মানসিক জীবনে নতুন চিন্তা ও আদর্শের ভিত্তি তৈরি করে। মধ্যযুগে মানুষ ছিল চিন্তা-চেতনা আড়ষ্ট এবং ধর্মীয় কুসংস্কারে আবদ্ধ। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জীবনবোধ মানুষের চিন্তা ও চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ ও সৌন্দর্য চেতনার সৃষ্টি করে। মধ্যযুগের মানুষ জীবনকে আদমের আদি পাপের পরিণতি এবং এ জগতে সুখ-সমৃদ্ধিকে অলীক মনে করত। পরকালীন অনন্ত জীবনের স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য ইহলৌকিক সকল বিষয়কে ঘৃণার চোখে দেখত। রেনেসাঁস মানুষের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি করে এবং ইহকালীন জীবন ও জগতের অনন্ত সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করে জীবনকে মহিমান্বিত করার অনুপ্রেরণা দেয়। মধ্যযুগে জ্ঞান বলতে ধর্মজ্ঞান বোঝাত। রেনেসাঁস মানবীয় ও প্রাকৃতিক জ্ঞানকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মানুষের নিকট তুলে ধরে। রেনেসাঁস মানুষের চিন্তা-চেতনাকে ধর্মীয় আড়ষ্ট থেকে মুক্তি দেয়। ফলে রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, শিল্পকলা, সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে।
  • (২) মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি : রেনেসাঁস মানুষকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করে। মধ্যযুগের মানুষ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামন্ত প্রভুর, ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধর্মাধিষ্ঠান এবং পেশাগত ক্ষেত্রে গিল্ডের অধীন ছিল। রেনেসাঁস সকল প্রথা ও প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত করে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। এজন্য রেনেসাঁসকে বলা হয় ‘Discovery of man’ বা ব্যক্তির আত্ম আবিষ্কার। রেনেসাঁসের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ স্বীকৃতি লাভ করে।
  • (৩) রাজনৈতিক ফলাফল: রেনেসাস ইউরোপে জাতীয়তাবান ও জাতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্র তৈরি করে। মধ্যযুগে জাতির আলাদা কোনো স্বীকৃতি ছিল না। ইউরোপের প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজেকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের (Christendom) অন্তর্ভুক্ত মনে করত। কিন্তু রেনেসাঁসের প্রভাবে জাতীয়তাবাদের আদর্শ গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন জাতি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আদর্শ উপেক্ষা করে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলে।
  • (৪) ধর্মীয় ক্ষেত্রে : রেনেসাঁসের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে যুক্তিবাদ ও অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি হয় তা ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংস্থার অপরিহার্য করে তোলে। মানবতাবাদীরা ধর্মের অসার আচার-অনুষ্ঠানের যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মের সংস্কারের জন্য জার্মানি, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।
  • (৫) বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার প্রসার : রেনেসাঁস মানুষের চিন্তা-যুক্তিবাদের প্রসার ঘটালে তা থেকে সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ভৌগোলিক জ্ঞান, নতুন নতুন দেশের বিচিত্র মানুষ, পশু-পক্ষী ও প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা লাভে ইউরোপের মানসলোক প্রসারিত হয়। নতুন গোলার্ধ আবিষ্কারের ফলে ধর্ম সংস্থাগুলোর প্রচারিত শিক্ষা, বিশ্বাস ও কর্তৃত্বের ভিত্তিমূলে আঘাত শুরু হয়। ইউরোপের ক্ষুদ্রতা ও পৃথিবীর বিরাটত্বের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা মানুষকে আবিষ্কারের পথে প্রবুদ্ধ করে। এ সময় স্প্যানিশ মুদ্রার একপিঠে খোদিত হয় হারকিউলিসের থাম, আর তার নিচে লিখিত হয় দুটি কথা— ‘Plus ultra’, অর্থাৎ ‘সামনে আরো আছে’। থামিও না, এগিয়ে যাও, সামনে আরো আছে, এটাই হল রেনেসাঁসের মর্মকথা। এটা বিজ্ঞান সাধনারও মূলমন্ত্র। তাই রেনেসাঁসের সমুদ্রমন্থন হতে মনুষ্য সমাজ সর্বকালের জন্য অমৃতস্বরূপ আধুনিক বিজ্ঞানকে লাভ করেছিল।
  • (৬) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শক্তি উপলব্ধির চেষ্টা শুরু: রেনেসাঁসের চেতনা মানুষের মধ্যে ইহজাগতিক কথা সৃষ্টি করে। এর ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে জাগরিত করে। রেনেসাঁসের ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য শিল্পকলা বিশেষ করে চিত্রশিল্প, ভাষ্কর্য, স্থাপত্য সব ক্ষেত্রেই শিল্পীরা সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এর ফলে ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পীরা তাদের প্রতিভাকে নিয়োগ করে সৌন্দর্য সাধনাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
  • (৭) জ্ঞানের প্রসার : রেনেসাঁসের ফলে প্রাচীন গ্রিক, রোমান, বাইজান্টানীয় এবং আরব মুসলমানদের মূল্যবান জ্ঞানভাণ্ডার ইউরোপে ব্যাপকভাবে চর্চা হয়। এর ফলে ইউরোপে দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি জ্ঞান মানুষের নিকট উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি ইউরোপীয় মানবতাবাদীদের চেষ্টায় স্থানীয় ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ অনূদিত হলে সাধারণ মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পায় এবং সাহিত্য ও মূল্যবান গ্রন্থ পাঠ করে আনন্দ লাভ সহজ হয়। এর ফলে জ্ঞানের ভাণ্ডার সকলের নিকট উন্মুক্ত হয়।

ভৌগোলিক আবিষ্কার

আধুনিক যুগের শুরুতে যে সকল বিষয় মানব সভ্যতার অগ্রগতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তার মধ্যে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর ভৌগোলিক আবিষ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১৪৯২ সালে কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা মহাদেশের সন্ধান মধ্যযুগের অবসান ঘটায় এবং আধুনিক যুগের সূচনা করে। এ ভৌগোলিক আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে প্রভাবিত করে। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় এবং মানুষের ধ্যান-ধারণার ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের পটভূমি

মধ্যযুগে আরব বণিকরা প্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। আরব বণিকদের মাধ্যমে ইতালীয় শহরগুলো বিশেষ করে ভেনিস ও জেনোয়া প্রাচ্যের বিলাসপণ্য ও মশলা ইউরোপে বিপণন করত। আরব বণিকদের বাণিজ্যপথগুলো –

  • মধ্যযুগে বিশেষ করে দ্বাদশ শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত আরবরা ভারতের পশ্চিমে মালাবার উপকূলকে কেন্দ্র করে ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে আফ্রিকার উত্তর পূর্ব উপকূল দিয়ে মিশরের কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল
  • মালাবার উপকূল থেকে আরেকটি বাণিজ্যপথ ভারত মহাসাগর পার হয়ে পারস্য উপসাগরে সর্ব উত্তর প্রান্তে এবং কৃষ্ণসাগর বা ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
  • দ্বাদশ শতকে চীন থেকে গোবি মরুভূমি পার হয়ে মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের ভিতর দিয়ে কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলকে সংযুক্ত করত।
  • এখান থেকে একটি বাণিজ্যপথ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরের ভিতর দিয়ে ইউরোপের সাথে বাণিজ্য পণ্যের লেনদেন হত।
  • এ বাণিজ্য পথের আরেকটি শাখা উত্তর দিকে বিস্তৃত হয়ে কাস্পিয়ান সাগর ঘুরে কৃষ্ণসাগরের দিকে পণ্য লেনদেন করত।
  • এর একটি শাখা রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য লেনদেন করত।

এ বাণিজ্য পথগুলোতে পণ্য লেনদেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল আরব বণিকরা। আরব বণিকরা প্রাচ্য থেকে গোলমরিচ দারচিনি, জায়ফল, লবঙ্গ প্রভৃতি মশলা ইউরোপে নিয়ে যেত। অন্যান্য বাণিজ্য পণ্যের মধ্যে ছিল পারস্যের কম্বল ও গালিচা, কাশ্মিরের শাল এ ছাড়া হিরা, মুক্তা, মূল্যবান পাথর, রেশম, সুগন্ধি দ্রব্য এবং বিভিন্ন প্রকারের রঙ। স্পেনে মুর শাসনের সময় আরব বণিকরা সমুদ্র অভিযান, নৌযাত্রা, সামুদ্রিক মানচিত্র, কাঁটাকম্পাস, সামুদ্রিক বাণিজ্য, পোস্ত পরিচালনা সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। ক্রমে আরবদের এ ভৌগোলিক এবং সামুদ্রিক অভিযান সম্পর্কে জ্ঞান ইতালীয়রা ও স্পেনীয়রা শিক্ষালাভ করে। স্পেনে আরব শাসনের উচ্ছেদের পর স্পেনীয় খ্রিস্টানরা আরবদের রেখে যাওয়া নৌবিদ্যা আত্মস্থ করে তা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে অটোমান তুর্কিরা ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল দখল করলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যপথ ইতালীয় বণিকদের হাতছাড়া হয়ে যায়। প্রাচ্যের মূল্যবান বিলাস দ্রব্য ও মশলা বাণিজ্য থেকে ইতালীয় শহরগুলো বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হলে ইউরোপীয় বাণিজ্যপ্ররণ জাতি রাষ্ট্রগুলো ভারতের সাথে বাণিজ্য করার নতুন অলপথ আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পর্তুগাল ও স্পেন সমুদ্র পথে নতুন বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এ ছাড়া যিশুর বাণী অখৃষ্টানদের মধ্যে প্রচার করে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের পটভূমি তৈরি করেছিল।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ

  • (১) রেনেসাঁসের প্রভাব : ভৌগোলিক আবিষ্কারের পিছনে রেনেসাঁস প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। রেনেসাঁসের ফলে মানুষের মন মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত হয় এবং রেনেসাঁস প্রসূত অনুসন্ধিৎসা নাবিকদের মনে দুঃসাহসিকতার নতুন চেতনার জন্ম দেয়। রেনেসাঁস প্রসূত মানুষের স্বাধীন চিন্তাধারা মানুষের কর্মক্ষেত্রে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ফলে ইউরোপীয়রা ইউরোপের ভৌগোলিক গণ্ডি অতিক্রম করে অজ্ঞাত এবং স্বল্পজ্ঞাত দেশ সম্পর্কে স্পষ্টত জ্ঞান লাভে আগ্রহী হয় এবং এ আগ্রহ প্রবণতা পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের সামুদ্রিক অভিযানের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
  • (২) অর্থনৈতিক কারণ : বাণিজ্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভৌগোলিক আবিষ্কারে উদ্দীপক হিসাবে কাজ করেছিল। মধ্যযুগে মূল্যবান বাণিজ্য পণ্য হিসেবে মশলাপাতি, তুলা, সোনা, রুপা, দামি, পাথর ইউরোপে অভিজাত শ্রেণীর নিকট ব্যাপক চাহিদা ছিল। ইতালীয় শহরগুলো বিশেষ করে ভেনিস ও জেনোয়া তাদের বাণিজ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে এ সকল পণ্যের লভ্যাংশ ভোগ করত। ইতালীয় শহরগুলো একচেটিয়া মশলা বাণিজ্য কুক্ষিগত করলে অন্যান্য জাতি পূর্বদেশের সাথে (মশলার দেশ ভারতীয় উপমহাদেশ) নতুন সমুদ্র বাণিজ্য পথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য উৎসাহি হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে ১৪৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল দখল করলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য পথ ইতালি, স্পেন ও পর্তুগাল বণিকদের নিকট বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে নতুন সমুদ্র পথে বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হয়। এ থেকেই সমুদ্র পথে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়।
  • (৩) নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার : পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপীয়দের সামুদ্রিক জ্ঞান ছিল সীমিত। ভূমধ্যসাগর এবং তার দক্ষিণদিকস্থ মহাদেশ সম্বন্ধে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না এ সময়। সমুদ্র পাড়ি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু দিকদর্শন যন্ত্রের আবিষ্কার সামুদ্রিক অভিযানের ক্ষেত্র প্রশস্ততর করতে সহায়তা করেছিল। দিকদর্শন যন্ত্র ও অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সামুদ্রিক অভিযানের বিপদ অনেকটা কমে গিয়েছিল। এ সকল যন্ত্রের সাহায্যে সমুদ্রের মানচিত্র তৈরি এবং মধ্য সমুদ্রে বসেও উপকূল রেখার অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। অ্যাস্ট্রোল্যাব আবিষ্কারের ফলে যে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যেত। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞান, সময় নিরূপণ যন্ত্র আবিষ্কার, সমুদ্র অভিযান সহজ ও নিরাপদ হওয়ায় ভৌগোলিক আবিষ্কারের স্পৃহা শক্তিশালী হয়েছিল।
  • (৪) ধর্মীয় কারণ : ভৌগোলিক আবিষ্কারের পিছনে ধর্মীয় প্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন: সন্ন্যাসী, যাজক, প্রাচ্য অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পোপরা মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল রাজাদের নিকট ধর্ম যাজক প্রেরণ করত। জন অব মন্টেকর্তিনো নামে খ্রিস্টান সন্ন্যাসী পারস্যে ও ভারতের মাদ্রাজে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য চার্চ প্রতিষ্ঠা করে। চীনেও খ্রিস্টান মিশনারি প্রেরিত হয়। পোপ দূরপ্রাচ্য, ভারত, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে ধর্ম প্রচারের জন্য সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্ম প্রচারের আকাঙ্ক্ষা ভৌগোলিক আবিষ্কারের প্রেরণা যুগিয়েছিল।
  • (৫) কনস্টান্টিনোপলের পতন : ১৪৫৩ সালে তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল দখল করলে ভূমধ্যসাগরে ইতালীয় বণিকদের বাণিজ্য হুমকির সম্মুখীন হয়। তুর্কিরা কালক্রমে দক্ষিণ- পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চল দখল করে। তুর্কিরা সিরিয়া, মিশর এবং মরক্কো পর্যন্ত আধিপত্য স্থাপন করলে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করার সুবিধা হারিয়ে ফেলে। কৃষ্ণসাগর এলাকা তুর্কিদের হস্তগত হলে ইউরোপ ও প্রাচ্যের বাণিজ্যপথ তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এতে ইতালীয় বিভিন্ন শহরের বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রাচ্যের সাথে নতুন পথ বাণিজ্য করার জন্য সমুদ্রপথে বাণিজ্যপথ আবিষ্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়।
  • (৬) অ্যাডভেঞ্চারের নেশা : মধ্যযুগে সমুদ্র সম্পর্কে নাবিকদের অনেক কুসংস্কার ছিল। তারা সাগর মহাসাগরে বিভিন্ন অপশক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করত। অনেকেই সাগরগুলোতে বিভিন্ন দৈত্যদানবের অস্তিত্ব কল্পনা করত। এ থেকেই অনেকের মনে সমুদ্র অভিযানের উন্মত্ত দেখা দেয়। মার্কোপলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠ করে ইউরোপীয়রা নতুন নতুন দেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে নতুনভাবে জানার জন্য সমুদ্র অভিযানে অংশ নিতে থাকে। ইউরোপীয়দের মধ্যে ভারতবর্ষ ও ক্যাথে (চীন) সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নতুন নতুন দেশের বিপুল ঐশ্বর্য ও সম্পদের কাহিনী ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। পর্তুগালের যুবরাজ নাবিক হেনরি মার্কোপোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত “The Book of Sir Marco Polo Concerning the Kingdoms and Marvels of the East’ পাঠ করে প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে জলপথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের উৎসাহ দান করে। মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত পরবর্তীকালে সমুদ্রপথে নতুন নতুন দেশে পৌঁছাবার উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল।
  • (৭) বিলাসদ্রব্যের চাহিদা : ইউরোপে প্রাচ্যের বিলাসদ্রব্যের বিশেষ করে প্রাচ্যের সোনা, মশলা, রেশম পণ্য ইউরোপে প্রচুর চাহিদা ছিল। আরব বণিকরা প্রাচ্যের মূল্যবান পণ্য ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের বাণিজ্যপথে ইউরোপীয় বণিকদের নিকট পৌঁছে দিত। ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তী ইতালির ভেনিস, জেনোয়া, ফ্লোরেন্স ও পিসার বণিকরা এ বাণিজ্যের সিংহভাগ লভ্যাংশ ভোগ করত। ইতালীয় বণিকরা প্রাচ্যের পণ্য জার্মানির লুরেমবুর্গ, আউসবুর্গ, উম, রিজেন্সবুর্গ, কনষ্টান্সে এবং রাইন ও দানিয়ুব নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের শহরগুলোতে সরবরাহ করত। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড এবং বাল্টিক সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোতে পণ্য সরবরাহ করত ইতালীয় বণিকরা।
    • একটি পরিসংখ্যান মতে, ভেনিসীয় বণিকরা প্রতি বছর ৪,২০,০০০ পাউন্ড ওজনের পরিমাণ গোলমরিচ ইউরোপের বিভিন্ন বাজাবে বিক্রয় করত। ইতালীয় বণিকরা মিশরীয় বণিকদের কাছ থেকে এগুলো ক্রয় করত। মিশরীয় বণিকরা এসকল পণ্য আমদানি করত শ্রীলঙ্কা, ভারত ও সুমাত্রা থেকে।
    • মশলার মধ্যে দারচিনি ক্রয় করা হত সুমাত্রা ও পশ্চিম ভারত থেকে।
    • আদা আমদানি করত ভারত ও চীন থেকে।
    • মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে সংগ্রহ করত লবঙ্গ, জায়ফল।
    • ইউরোপীয় অভিজাতদের সাজসজ্জা ও ধর্মস্থানগুলোর অঙ্গসজ্জার জন্য বিভিন্ন ধরনের মণিমুক্তা, যেমন—পান্না, হিরা, চুনি, মুক্তা এসকল পাথর ক্রয় করা হত পারস্য ভারত ও শিলঙ্কা থেকে।
    • কর্পূর ও কাবাব চিনি সংগ্রহ করা হত বর্ণিও ও সুমাত্রা থেকে।
    • কস্তুরী, সুগন্ধ দ্রব্য, আমদানি করা হত চীন থেকে।
    • চিনি আমদানি করা হত পারস্য ও ভারত থেকে।
    • নীল, চন্দন কাঠ, ঘৃতকুমারী কাঠ আমদানি করা হত ভারত থেকে।
    • চীনা মাটির পাত্র চীন থেকে
    • মূল্যবান ধাতুর দ্রব্যাদি জাপান থেকে
    • ফিটকিরি এশিয়া মাইনর থেকে।
    • সিরিয়া থেকে লিলেন,
    • পারস্য থেকে কার্পেট ও কম্বল,
    • কাশ্মির থেকে শাল ইউরোপে সরবরাহ করা হতো।
  • প্রাচ্য থেকে যে পরিমাণ পণ্য ইউরোপে আমদানি হত কিন্তু রপ্তানি হত অনেক কম। এর মধ্যে কিছু পশমি বস্ত্র, তামা, দস্তা, টিন, লোহা, পারদ, ইউরোপ থেকে প্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে রপ্তানি হত। তবে এ সমস্ত বাণিজ্য ইতালীয় বণিকরা নিয়ন্ত্রণ করত। ইতালীয় বণিকদের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ইউরোপের অন্যান্য দেশের বণিকদের মনে ঈর্ষার সৃষ্টি করত। ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্য ইতালীয় বণিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় অন্য দেশের বণিকরা এতে ব্যবসা করার সুযোগ পেত না। তাই তারা অন্য পথে বাণিজ্যপথ আবিষ্কারের চেষ্টা চালায়। বণিকদের অর্থনৈতিক অনুপ্রেরণা ছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর ভৌগোলিক আবিষ্কারের অন্যতম কারণ।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্য অভিযানসমূহ : সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচ্য এ দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এ বাণিজ্য সরাসরি সমুদ্রপথে হতো না। আরব দেশের মধ্য দিয়ে জল ও স্থলপথে তখন ভারতবর্ষ ও এর নিকটবর্তী অঞ্চলের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। মধ্যযুগে আরবরা ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এ বাণিজ্যের প্রধান পণ্য ছিল মশলা। ইউরোপের মানুষ মাংসভোজী হওয়ায় মাংস সুস্বাদু করার জন্য মশলার প্রয়োজন হত। আরবরা এ মশলা পণ্য ইউরোপীয়দের নিকট বেশি দামে বিক্রয় করত। ইউরোপীয় বণিকরা এ লাভজনক মশলা ব্যবসা হস্তগত করার জন্য সচেষ্ট ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় নাবিকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের দ্বীপগুলোর সাথে জলপথে যোগাযোগ স্থাপন করা এবং তথাকার মশলা বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করা। এসব অঞ্চলের দ্বীপগুলো ‘মশলার দ্বীপ’ (Spice Islands) নামে ইউরোপীয়দের নিকট পরিচিত ছিল। ইউরোপীয় নাবিকরা এ মশলার দ্বীপে সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রার বিপদ উপেক্ষা করে বারবার চেষ্টা করে। প্রাচ্য দেশগুলোতে পৌঁছাতে গিয়েই ইউরোপীয় নাবিকরা আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ আবিষ্কার করে।

পর্তুগালের ভৌগোলিক অভিযান

ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্য পর্তুগাল প্রথম সমুদ্রপথে অভিযান শুরু করে। পর্তুগালের তিনজন নাবিক ভৌগোলিক আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা হলেন, (১) প্রিপ হেনরি দ্য নেভিগেটর, (২) বার্থলমিউ ডিয়াজ ও (৩) ভাস্কো-দা-গামা।

  • প্রিন্স হেনরি দ্য নেভিগেটর : পর্তুগালের রাজা প্রথম জন-এর পুত্র রাজকুমার হেনরি দ্য নেভিগেটর ভৌগোলিক আবিষ্কারের জন্য অভিযানসমূহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নিজে দীর্ঘ সমুদ্রপথে অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি তথাপি তার উৎসাহ উদ্যম ও সংগঠনের জন্য ইতিহাসে তাকে ‘হেনরি দ্য নেভিগেটর’ বা নাবিক হেনরি নামে অভিহিত করা হয়। প্রিন্স হেনরি ১৩৯৪ সালে পর্তুগালের পরটোতে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই সমুদ্র অভিযানে তিনি উৎসাহি ছিলেন। তিনি রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে দক্ষিণ পর্তুগালের সেন্ট ভিনসেন্ট অন্তরীপের সাগ্রেসে বসবাস করতেন। তিনি সেখানে পণ্ডিতব্যক্তি, মানচিত্র প্রস্তুতকারক ও সমুদ্র অভিযানে দক্ষ নাবিকদের সংগঠিত করেন। বিখ্যাত নাবিক নৌবিদ্যাসংক্রান্ত যন্ত্রের নির্মাতা এবং মানচিত্র নির্মাতা জেমিকে তার প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়োগ দেন। তার প্রতিষ্ঠিত সমুদ্রবিদ্যা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভৌগোলিক অভিযানে অংশ গ্রহণ করে। আফ্রিকার উপকূল আবিষ্কারের জন্য হেনরি ইতালীয় নাবিকদের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে ইউরোপের বাইরে বিভিন্ন দেশের খোঁজখবর নিতেন। তিনি সমুদ্র অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করেন। তার উৎসাহে পর্তুগিজ নাবিকরা জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে আফ্রিকার পশ্চিমে উপকূলে পৌঁছে। তারা আরো দক্ষিণ দিকে অভিযান চালানোর চেষ্টা করে। এসব অভিযানের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকা মহাদেশের আটলান্টিক উপকূলে পর্তুগিজ বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং আফ্রিকায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। এসব সামুদ্রিক অভিযানে পর্তুগিজরা মরিসাস, আজরস ও কেপভারডী দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করে। যদিও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সব উপকূল সম্পর্কে ইউরোপীয়রা জ্ঞান রাখত কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। হেনরির উৎসাহে জেনোয়ার নাবিকরা পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরালিওন এবং পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলের মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হন।
  • বার্থলমিউ ডিয়াজ : পর্তুগিজ নাবিকদের মধ্যে বার্থোলোমিও ডিয়াজ ১৪৮৮ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার করেন। তিনি স্বেচ্ছায় এ অভিযান করেন নি। প্রবল ঝড়ে তাড়িত হয়ে তার জাহাজ এ অন্তরীপের তিন দিক ঘুরে এসেছিল। এ কারণে প্রথমে এ অন্তরীপের নাম রাখা হয়েছিল ঝড়ের অন্তরীপ (Cape of storm) । কিন্তু পর্তুগালের তদানীন্তন রাজা উপলব্ধি করেছিলেন যে, এ অন্তরীপ হয়েই একদিন ইস্ট-ইন্ডিজে অর্থাৎ ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে পৌঁছা যাবে। এ কারণে তিনি এ অন্তরীপের নাম দিয়েছিলেন (Cape of good Hope)। বার্থলমিউ ডিয়াজ যতদিন পর্যন্ত না আফ্রিকা মহাদেশে দক্ষিণের বাঁকা অংশ থেকে ভারত মহাসাগরকে না দেখা যায় ততদিন সমুদ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। তিনি ভারতে পৌঁছতে পারতেন। কিন্তু তার জাহাজের নাবিক ও খালাসিরা অবস্থান ধর্মঘট করায় তিনি পর্তুগালে ফিরে যান। তবে তিনি উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার করে পর্তুগিজদের জন্য ভারতে পৌঁছার পথ সুগম করে গিয়েছিলেন। ১৫০০ সালে ডিয়াজ পেদ্রু আলভারেস ক্যাররালের জাহাজ বহরের একটি জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যান। তবে সামুদ্রিক ঝড়ে নিমজ্জিত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
  • ভাস্কো-দা-গামা : পর্তুগিজ নাবিকদের মধ্যে ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে পৌঁছেন। অবশ্য একজন আরব মুসলিম তাকে এ জলপথ দেখিয়ে ভারতে আসতে সাহায্য করেছিলেন। প্রথম হেনরি প্রথমে ভাস্কো-দা-গামার পিতাকে সমুদ্র যাত্রায় অভিযানে অংশগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু হেনরি ও ভাস্কো-দা-গামার পিতা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বেই মারা যান। পর্তুগালের নতুন রাজা ম্যানুয়েল ভাস্কো- দা-গামাকে এ সমুদ্র অভিযানের দায়িত্ব দেন। ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৭ সালে ৮ জুলাই চারটি জাহাজ নিয়ে পর্তুগাল থেকে যাত্রা শুরু করেন। ভাস্কো-দা-গামার জাহাজ বহর নভেম্বর মাসে উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে মে মাসে ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছে। কালিকটের জামুরিন (শাসক) ভাস্কো-দা-গামাকে অনিহার সাথে গ্রহণ করেন। সেখানকার আরব বণিকরা পর্তুগিজদের উপস্থিতিকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয় নি। স্থানীয় লোকজন পর্তুগিজদের অপছন্দ করত। তবে ভাস্কো-দা-গামার আবিষ্কার ইউরোপীয় নাবিকদের বহু যুগের আশা পূর্ণ করে। এরপর থেকে পর্তুগিজরা পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মালয়, মালাবার প্রভৃতি অঞ্চলে মশলার বাণিজ্য থেকে আরবদের বিতাড়িত করে নিজেরা লাভবান হয়। এ সমুদ্রপথ আবিষ্কার হওয়ার ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মধ্যে স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাস্কো-দা-গামা পর্তুগালে ফিরে গেলে তাকে পর্তুগাল রাজা অ্যাডমিরাল অব দি সি অব দি ইন্ডিস পদবিতে ভূষিত করেন। পরে রাজা তাকে কাউন্ট অফ ভিভিগোয়েরা (Count of Vindiguara) পদে নিয়োগ দেন এবং তাকে ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেন। ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ভাস্কো-দা-গামা ১৫০২ থেকে ১৫০৩ সালে আরো একবার সমুদ্রযাত্রার অভিযান করেছিলেন। এরপর তিনি অবসরে যান। ১৫২৪ সালে পর্তুগালরাজ তাকে তার ভারতীয় উপনিবেশের ভাইসরয় নিযুক্ত করেন। ১৫২৪ সালে ২৪ ডিসেম্বর কোচিনে ভাস্কো-দা-গায়া মৃত্যুবরণ করেন।

স্পেনীয় ভৌগোলিক আবিষ্কারকগণ

স্পেনীয় ভৌগোলিক আবিষ্কারকদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন (১) ক্রিস্টোফার কলম্বাস, (২) ব্যালবোয়া, (৩) ম্যাগেলান, (৪) কটেজ, (৫) ফ্রান্সিসকো পিজারো ও (৬) গনজালো পিজারো। পর্তুগিজরা আফ্রিকার উপকূল ধরে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করে। তবে স্পেনীয় নাবিকরা আটলান্টিক মহাসাগরে পাড়ি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দূরপ্রাচ্যে আসার জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করে।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস : স্পেনীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬) ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। কলম্বাস ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার করে ঐতিহাসিক ঘটনার সৃষ্টি করেন। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৫১ সালে ইতালির জেনোয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের পদবি ছিল কলম্ব। এর ল্যাটিন রূপ কলম্বাস। তার পিতা ডমেনিকো কলম্বাস একজন পশম তাতি ছিলেন। তার মাতা সুসানা ফোন্টানারোজা একজন পশম তাতির কন্যা ছিলেন। কলম্বাসরা পাঁচ ভাই। এর মধ্যে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বার্থলমিউ কলম্বাসের সামুদ্রিক অভিযানের সাথি ছিলেন। বাল্যকাল থেকে কলম্বাস সমুদ্র ভ্রমণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। জেনোয়া সে সময় একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল। জেনোয়ার নাবিকরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা করত। এ সূত্রে যৌবনকালে কলম্বাস ছোট নৌকায় জেনোয়া ও অন্যান্য উপকূলীয় শহরে যাতায়াত করতেন। এ সময় তিনি নৌবিদ্যা সম্পর্কে অভিহিত হন। তার স্কুল শিক্ষা খুব একটা বেশি ছিল না। তবে জেনোয়ার স্থানীয় ভাষায় তিনি কথাবার্তা বলতে পারতেন। পরবর্তী সময় স্পেনীয় সরকারের অধীনে চাকরি নিয়ে স্পেনীয় ভাষা শিক্ষা করেন। কালক্রমে তিনি ল্যাটিন ভাষা আয়ত্ত করেন। ল্যাটিন ভাষা আয়ত্ত করার ফলে সে সময় ল্যাটিন ভাষায় রচিত মূল্যবান ভূগোল বিষয়ে রচিত গ্রন্থগুলো পাঠ করেন। এ থেকে তিনি সমুদ্র যাত্রা ও নতুন দেশ আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হন। প্রথমে তিনি ১৯-২০ বছর বয়সে জেনোয়ার স্থানীয় যুদ্ধ জাহাজে কাজ করেন। এরপর তিনি ইজিয়ান সাগরে চিরাস দ্বীপে একাধিকবার সমুদ্র ভ্রমণে যান। সে সময় একটি নৌবহরে জেনোয়া থেকে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। এরপর বেচাল্লা নামক জাহাজে তিনি ভ্রমণ করেন কিন্তু সে জাহাজটি সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছিল। তিনি সেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে সাগর সাঁতরিয়ে একটা বৈঠাকে অবলম্বন করে ভাসতে ভাসতে একটি পর্তুগিজ জাহাজে ওঠেন এবং লিসবনে পৌঁছেন। পর্তুগিজরা ইতোপূর্বে আজাবস দ্বীপ আবিষ্কার করেছিল এবং মারিরাসে পর্তুগিজ কলোনি স্থাপন করেছিল। সে সময় পর্তুগিজরা বিষুবরেখা পর্যন্ত সামুদ্রিক অভিযান করেছিল এবং এই পথে প্রাচ্যে আসার চেষ্টা করেছিল। সে সময় প্রাচ্য বলতে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ভারত, চীন ও জাপানকে বুঝাত। পর্তুগিজরা আফ্রিকার উপকূল হয়ে এসব অঞ্চলে আসার নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু কলম্বাস আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। কলম্বাস প্রথমে পর্তুগালের রাজার সাহায্য নিয়ে সমুদ্র অভিযান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সমর্থন না পেয়ে তিনি স্পেনে আসেন। স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্দ কলম্বাসকে সমুদ্র যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ, নাবিক ও অর্থ দান করেন। কলম্বাস প্রথমে সান্তামারিয়া (The Santa Maria), পিন্টা (The Pinta). নিনা (The Nina) এ তিনটি জাহাজ নিয়ে প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। নিনাতে ছিল ৪০ জন নাবিক, সান্তামারিয়াতে ২৬ জন এবং পিণ্ঠাতে ছিল ২৫ জন নাবিক। ১৪৯২ সালে ২ আগস্ট জাহাজগুলো নিয়ে স্পেনের প্যালস বন্দর থেকে সমুদ্র অভিযান শুরু করেন। সবচেয়ে বড় জাহাজটির ভার বহন ক্ষমতা ছিল ১০০ টন। তিনি সাথে নিয়েছিলেন স্পেনের রাজা কর্তৃক ক্যাথের মহান খানের জন্য উপঢৌকন ও লিখিত পত্র। কলম্বাস ক্রমাগত পশ্চিম দিকে জাহাজ চালিয়ে গহীন সমুদ্রে পৌছেন। তার অভিযানের সময় সাথি নাবিকরা অধৈর্য হয়ে ওঠেছিল। কলম্বাস অসীম ধৈর্য ও সাহসের সাথে জাহাজ চালিয়ে ১৪৯২ সালে ১২ আগস্ট ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের স্যান সেবাস্টিনে পৌঁছেন। ৮ সেপ্টেম্বর সেখানে অবস্থান করে ৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিম দিকে ক্রমাগত জাহাজ চালিয়ে অজানা জগতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৬ সেপ্টেম্বর নাবিকরা সমুদ্রে ভাসমান ঘাস দেখে নতুন উপকূল সম্পর্কে আশ্বস্ত হন। ২৩ সেপ্টেম্বর একটি ঘুঘু পাখি দেখতে পান। ৩০ সেপ্টেম্বর জাহাজ তিন সপ্তাহের ভ্রমণ শেষ করে কিন্তু নতুন ভূখণ্ডের দেখা মিলেনি। ১০ অক্টোবর নাবিকরা বিদ্রোহ করলে কলম্বাস তাদেরকে আশ্বস্ত করে। এরপর আরো দুই দিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ১২ অক্টোবর বাহামা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেন এবং এর নাম দেন স্যান সালভেদর। তিনি তার লোকজন নিয়ে তীরে অবতরণ করেন এবং আমেরিকা আবিষ্কার করেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, এশিয়ার উপকূলের কোনো স্থানে তিনি পৌঁছেছেন। এটা ক্যাথে (চীন) বা জাপানের নিকটবর্তী দ্বীপ। তিনি পার্শ্ববর্তী দু একটি দ্বীপ ঘুরে সেখানকার আদিবাসিন্দাদের সাক্ষাত পান। তারা ছিল দেখতে ভারতীয়দের মতো তাই এই দ্বীপগুলোকে তিনি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত করেছিলেন। ১৫৯২ সালে ২৮ অক্টোবর আরো পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে কিউবা আবিষ্কার করেন। তিনি এটিকে ক্যাথের অংশ মনে করেছিলেন। তিনি কয়েকজন নাবিককে সেখানকার সম্রাটের নিকট পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু সম্রাটের সাক্ষাত পাওয়া যায়নি। ঐখানকার বাসিন্দারা সিগার পান করছিল। এখানে প্রথম ইউরোপীয়রা সিগার সম্পর্কে অভিহিত হয়। এরপর কলম্বাস হিসপানিওলা আবিষ্কার করে এর নাম দেন এসপানোলা (ক্ষুদ্র স্পেন)। এরপর জাহাজ নিয়ে তিনি হাইতি দ্বীপে যান। সেখানে সান্তামেরিয়া জাহাজটি ডুবে যায়। সেখানকার ভারতীয়দের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। তিনি সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। স্বর্ণ আবিষ্কারের জন্য ৪০ জন লোককে দুর্গে রেখে ১৫৯৩ সালে ১৬ জানুয়ারি পিন্টা ও নিনা জাহাজ নিয়ে স্পেনে রওনা হন। ৮ ফেব্রুয়ারি জাহাজগুলো সামুদ্রিক ঝড়ে আক্রান্ত হয়। ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত্রে প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঢেউ ও ঝড়ে পিন্টা ও নিনা আলাদা হয়ে যায়। ১৫৯৩ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নিনা জাহাজটি আজরসের সান্টামারিয়া দ্বীপ পৌঁছে। ১০ দিন অবস্থান করে পিন্টা জাহাজটি ছাড়ায় নিনা জাহাজ নিয়ে কলম্বাস স্পেনের দিকে রওনা হন। ১৫ই মার্চ নিনা স্পেনীয় বন্দর প্যালসে উপনীত হয়। কিছু সময় পর পিন্টাও এসে প্যালস বন্দরে পৌঁছে। রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলা কলম্বাসকে বিপুল অভ্যর্থনা দেন এবং তাকে Admiral of the Ocean sea উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ইন্ডিজের গভর্নর নিয়োগ করেন। তাকে হিসপনিগুলাতে কলোনি স্থাপন, খ্রিস্টধর্ম প্রচার, আরো দেশ আবিষ্কারের নির্দেশ দেন।

কলম্বাস ১৫৯৩ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর স্পেনে কার্ডিজ বন্দর থেকে সমুদ্রযাত্রা করেন। তিনি ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ অতিক্রম করে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেন। এখানে ম্যারিয়াগালটি আবিষ্কার করেন। হাইতিতে অবস্থিত হয়ে দেখেন যে, তার নিয়োগকৃত চল্লিশজন লোককে হত্যা করা হয়েছে। হিসপানিওলার দক্ষিণ উপকূলে একটি নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করে এর নাম দেন ইসাবেলা দ্বীপ। এরপর তিনি স্পেনে ফিরে আসেন। ১৪৯৮ সালে এসে কিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের সালুনকার বন্দর থেকে তৃতীয় বার সমুদ্রযাত্রা করেন। ৩ জুলাই তিনি ত্রিনিদাদে পৌঁছেন। এরপর তার জাহাজ পারিয়া উপদ্বীপে পৌঁছে। এটি ছিল আমেরিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড। তিনি নতুন মহাদেশের মাটিতে নেমে এর নাম দেন অন্য জগৎ (other world) এরপর কলম্বাস স্পেনে ফিরে এসে স্পেনের রাজাকে তার অভিযানের যাবতীয় তথ্য পরিবেশন করেন। এরপর চারটি জাহাজ নিয়ে চতুর্থবার সমুদ্র যাত্রার বের হন। এসময় যে চারটি জাহাজ তিনি পেয়েছিলেন এগুলোর নাম ছিল La Capitana (লা ক্যাপিটানা), The Santiago de Palos (দ্য সান্তিয়াগো ডি পালোস), The La Gallega (দা লা গেলিগা) এবং The Vizcaina (দ্য ভিজকেইনা)। ১৫০২ সালে ৯ মে কলম্বাস আটলান্টিক মহাসাগরে পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৫০৩ সালে ১ জানুয়ারি কলম্বাস আমেরিকার বর্তমান ককোসলো নামক স্থানে পৌঁছেন। এখানে স্বর্ণ আহরণের জন্য একটি উপনিবেশ স্থাপন করেন। এখানে স্থানীয় জনগণ কলম্বাসকে আক্রমণ করলে তিনি তাদেরকে পরাজিত করেন। কিন্তু সংঘর্ষে কয়েকজন স্পেনীয় নিহত হয়। ১৫০৩ সালে ১৬ এপ্রিল কলম্বাস স্পেনে যাত্রা করেন। প্রত্যাবর্তন পথে লা গেলিগা ও চিজকেইনা সমুদ্রে ডুবে যায়। তিনি জ্যামাইকা পৌঁছলে কেপিটানা ও সান্তিয়াগো সমুদ্র সৈকতে আটকে যায়। কলম্বাস এ সময় হিসপানিওলাতে ক্যাপটেন মেন্দেজকে পাঠিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেখানকার গভর্নর ওভান্ডে কোনো সাহায্য দেন নি। কারণ তিনি মনে করেছিলেন কলম্বাস স্পেনে গিয়ে হিসপানওলার গভর্নর পদ হাত করে নেবেন। কলম্বাস ও তার সঙ্গীরা খাদ্যাভাবে সংকটে পড়েন। এসময় তিনি স্থানীয় অদিবাসীদের দৈব ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেন। ঐ সময় একদিন রাতে জ্যামাইকাতে চন্দ্র গ্রহণ হচ্ছিল। রাতের আকাশ ছিল পরিষ্কার তাই চন্দ্র গ্রহণ পরিদৃষ্ট হচ্ছিল। তিনি স্থানীয় অদিবাসীদের মোহাচ্ছন্ন করার জন্য নিজেকে দেবতার বংশধর বলে পরিচয় দেন। তাই তাদেরকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ না করলে চাঁদ ঢেকে যাবে। দেবতারা রুষ্ট হবেন এবং তাদের বিরাট ক্ষতি হবে। চন্দ্র গ্রহণের সময় স্থানীয় মানুষ ভীত হত। তাই তয়ে কলম্বাসকে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করে। ইতোমধ্যে মেন্দেজ একটি জাহাজ চার্টার করতে সক্ষম হন। কলম্বাস এই জাহাজে ১০০ জন লোক নিয়ে ১৫০৪ সালে ৭ নভেম্বর স্পেনের সালুনকার বন্দরে পৌঁছেন। এসময় কলম্বাসের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। এ পর্যায়ে স্পেনের রাণী ইসাবেলা জীবিত ছিলেন না। তাকে আরো সাহায্য দিতে রাজা অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি সমুদ্র অভিযানে আর উৎসাহবোধ করেননি। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে ১৫০৬ সালে ২০ মে কলম্বাস মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যালবোয়া : কলম্বাসের সামুদ্র অভিযানে উৎসাহিত হয়ে ব্যালবোয়া (১৪৭৫-১৫১৯) প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পূর্ব উপকূলে পৌঁছেন। ১৫১৩ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর একটি পাহাড়ের চূড়াতে উঠে তিনি প্রশান্ত মহাসাগর দেখতে পান। তিন-চারদিন পর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে উপনীত হয়ে এর নাম দেন দক্ষিণ সাগর এবং এর সকল উপকূল স্পেনের জন্য দাবি করেন। রডরিগো ডে ব্যাস্টিভ্যাস নামে একজন স্পেনীয় নাবিক সমুদ্র অভিযান করেছিলেন। ১৫০১-১৫০২ সালে ব্যালবোয়া তার একটি জাহাজ চালিয়ে ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া, পানামা যোজকের পূর্ব উপকূল আবিষ্কার করেন। তিনি ড্যারিয়েন উপকূলে পানামা যোজকের একটি জায়গা ভবিষ্যত উপনিবেশের জন্য নির্বাচন করেন। এরপর তিনি কলম্বাস কর্তৃক আবিষ্কৃত হিসপানিওলা দ্বীপে বসবাস শুরু করেন। এর কিছুদিন পর মূল ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনের জন্য ১৫০৯ সালে হিসপানিওলা ত্যাগ করেন। বিপজ্জনক ভারতীয়দের জন্য নির্বাচিত উপনিবেশ খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। ‘কাজেই তিনি যোজকের একটি জায়গায় উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা করেন, যেটি প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময় তিনি দেখেছিলেন। তিনি ড্যারিয়েনে উপনিবেশ স্থাপন করে এর গভর্নর হন। ড্যারিয়েন থেকে তিনি অভিযান করে ভারতীয়দের সাথে বন্ধুত্ব করেন ও একজন ইন্ডিয়ান প্রধানের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি স্পেনের রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করেন। সেখানকার ইন্ডিয়ানরা পানামা যোজকের অন্যদিকে একটি সমুদ্রের কথা জানায়। তিনি পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যের প্রচুর স্বর্ণ ও সম্পদ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। ১৫১৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ২০০ লোক নিয়ে ড্যারিয়েন ত্যাগ করেন এবং শিগগির পর্বত চূড়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগর দেখতে পান। পেডরিয়াস জ্যাভিলা ১৫১৪ সালে ড্যারিয়ানের গভর্নর হয়ে আসেন। নতুন গভর্নর ব্যালবোয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন। তিনি ব্যালবোয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করেন। ১৫১৯ সালে অকলা উপনিবেশে চার বন্ধুসহ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

ম্যাগেলান (১৪৮০-১৫২১) : ১৫১৯ সালে ফার্ডিনান্ড ম্যাগেলান নামে একজন পর্তুগিজ নাবিক স্পেনের রাজার অধীনে চাকরি নিয়ে সমগ্র পশ্চিম দিকস্থ জলপথ সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হন। স্পেনের সেভিল বন্দর থেকে রওনা হয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে ম্যাগেলান প্রশান্ত মহাসাগরে উপনীত হন। এ মহাসাগরের শান্তরূপ দেখে তিনি এর নামদেন প্রশান্ত মহাসাগর। ম্যাগেলানের অভিযান ভৌগোলিক আবিষ্কারের মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। তাকে তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ নাবিক মনে করা হত। ম্যাগেলান উত্তর পর্তুগালের একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাল্যকালে পর্তুগালের রাণীর অধীনে ভৃত্যের চাকরি নিয়েছিলেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি ভারতের পর্তুগিজ সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন এবং অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি সে সময় সিঙ্গাপুরের নিকটবর্তী মালাক্কা পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন। মরক্কোর মূরদের সাথে যুদ্ধে আহত হয়ে আজীবনের জন্য খোঁড়া হয়ে যান। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল শ্রেষ্ঠ নাবিক হওয়া। এজন্য ভূগোল বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। তিনি প্রশান্ত মহাসাগর সম্পর্কে এবং এর আয়তন কত হবে তা না জানলেও তিনি মনে করতেন মশলা দ্বীপ মলুক্কাস, স্পেনীয় আমেরিকা থেকে খুব বেশি পশ্চিমে হবে না। পর্তুগালের রাজা প্রথম স্যামুয়েল তাকে পছন্দ না করায় তিনি স্পেনের সরকারের অধীনে ১৫১৭ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি মশলা দ্বীপে যাওয়ার জন্য একটি জলপথ আবিষ্কারের ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লস তাকে জাহাজ ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ম্যাগেলান The Conception (দ্য কনসেপশন), The San Antinio (দ্য সান এন্টিনিও), The Santiago (দা সান্তিয়াগো), The Trinidad (দ্য ত্রিনিদাদ) ও The victoria (দ্য ভিক্টোরিয়া) এই পাঁচটি জাহাজ ও ২৪০ জন জনবল নিয়ে ১৫১৯ সালে ২০ সেপ্টেম্বর স্পেনের সানলুকার বন্দর থেকে সমুদ্র অভিযানে বের হন। ১৫১৯ সালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি রিও ডে জানিরো উপসাগরে পৌঁছে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল আবিষ্কার করেন। তিনি নতুন মহাদেশের একটি প্রণালী দিয়ে ১৫২০ সালে মার্চ-অক্টোবরে দক্ষিণ আর্জেন্টিনাতে পৌঁছেন। তিনি আবার সমুদ্র অভিযান করে একটি প্রণালী আবিষ্কার করেন। যা ইতিহাসে ম্যাগেলান প্রণালী নামে পরিচিত হয়। এর অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকার শেষ দক্ষিণে। এর মধ্য দিয়ে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়া যায়। এই পথে ম্যাগেলান প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করেন। তখন তার সাথে ৩টি জাহাজ ছিল। এর মধ্যে সান্তিয়াগো সামুদ্রিক ঝড়ে ডুবে যায়। সান এন্টিনিও তাকে ফেলে গোপনে স্পেনে ফিরে যায়। তিনি নতুন মহাসাগরের নাম দেন প্রশান্ত মহাসাগর। তিনি ৯৮ দিন সমুদ্র যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এ সময় দুটি মরুদ্বীপ ছাড়া অন্যকোনো স্থান দেখেন নি। ম্যাগেলানের জাহাজে খাদ্যদ্রব্য ও জলের অভাব দেখা দেয়। এ সময় তার সঙ্গীরা করাতের গুঁড়া ও ইঁদুর খেয়ে জীবন ধারণ করেন। অনেকেই খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এই দুর্যোগ মুহূর্তে ম্যাগেলান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট থেকে বলপূর্বক খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করেন। ম্যাগেলান ক্রমাগত পশ্চিম দিকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ফিলিপাইনে সেবু দ্বীপে পৌঁছেন। তিনি হিসাব করে বের করেছিলেন যে, তিনি পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বিষুব রেখা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি ভারত মহাসাগর হয়ে স্পেনে প্রত্যাবর্তনের জলপথ আবিষ্কার করেন। ম্যাগেলান ফিলিপাইনের সেবু দ্বীপের গোত্র প্রধানকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন। এরপর তিনি সেবু দ্বীপের নিকটবর্তী ম্যাকটানের গোত্রপ্রধান সিলাপুলাপু এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ১৫২১ সালে ২৭ এপ্রিল প্রতিপক্ষের বর্শা ও খঞ্জরের আঘাতে নিহত হন। এরপর সেবু প্রধান স্পেনীয়দেরকে আক্রমণ করে অনেককে হত্যা করে। বাকিদেরকে দ্বীপ থেকে বিতাড়ন করে। মৃত ম্যাগেলানের স্পেনীয় জাহাজগুলো কয়েক মাস পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ঘোরাফেরা করে। Conception জাহাজটি অকেজো হয়ে পড়ে। ত্রিনিদাদ ও ভিক্টোরিয়া জাহাজদ্বয় মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে। প্রত্যেকটি জাহাজ লবঙ্গ দিয়ে ভর্তি করা হয়। ত্রিনিদাদ পানামা যোজকের দিকে রওনা হলে ডুবে যায়। ভিক্টোরিয়া জাহাজটি ভারত মহাসাগর ও উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ১৫২২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর স্পেনের সানলুকা বন্দরে পৌঁছে। এর নাবিক ছিলেন জুয়ান সেবাস্তিয়ান ডেল কানো। মাত্র ১৭ জন লোক নিয়ে স্পেনে ফিরে আসতে পেরেছিল। ইউরোপীয়দের মধ্যে তিনি প্রথম পৃথিবীর চতুর্দিকে ভ্রমণ করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।

কর্টেজ (১৪৮৫–১৫৪৭): কর্টেজ নামে একজন স্পেনীয় নাবিক ভৌগোলিক আবিষ্কারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি স্পেনের এস্ট্রেমাদুরাতে ১৪৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫০৪ সালে তিনি স্পেনের নাবিক হিসেবে ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করে কিউবা দখল করেন। কিউবার গভর্নর দ্বীপের পশ্চিমের ভূভাগের সম্পদ আহরণের জন্য কর্টেজকে অধিনায়ক করে পাঠান। ১৫১৯ সালে কর্টেজ ইউকাটানের উপকূল আবিষ্কার করেন। এবং মেক্সিকো দখল করে ভেরাক্রুজ উপনিবেশ স্থাপন করেন। কর্টেজ ভেরাক্রুজ রক্ষার্থে কিছু সৈন্য রেখে বাকি সৈন্য নিয়ে আজটেক সাম্রাজ্যের ইন্ডিয়ানদের রাজধানী টেনোচটিটলান (মেক্সিকো নগর) আক্রমণ করেন। আজটেক শাসক মনটেজুমা কর্টেজকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করে। কিন্তু কটেজ বিশ্বাসঘাতকতা করে মন্টেজুমাকে বন্দি করেন। ভেরাক্রুজে আরো স্পেনীয় সৈন্য উপস্থিত হলে আজটেক আধিবাসীরা স্পেনীয়দের আক্রমণ করে। স্পেনীয়রা অনেক আজটেককে হত্যা করে। আজটেকরা আটম্বা সমতল ভূমিতে স্পেনীয়দের নিকট পরাজিত হয়। কর্টেজ পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে সৈন্য আনেন। তদুপরি অনেক ইন্ডিয়ান রক্তপিপাসা ও নিষ্ঠুরতার জন্য আজটেকদেরকে অপছণ করায় কর্টেজের সাথে যোগ দেয়। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কর্টেজ ১৫২১ সালে টেনোচটিটিলান দখল করে আজটেক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। মেক্সিকোতে স্পেনীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আজটেক মেক্সিকোর গভর্নর নিযুক্ত হন। তার সামরিক সাফল্যের জন্য স্পেনের রাজা তাকে মারকুইস অব ভেমি পদবিতে ভূষিত করে। ১৫৩৬ সালে কর্টেজ একটি সামরিক অভিযান করে নিম্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই স্পেনের রাজার সাথে মতানৈক্য দেখা দিলে ১৫৪০ সালে স্পেনে ফিরে আসেন এবং সেভিলের কাছে একটি গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।

ফ্রান্সিসকো পিজারো (১৪৭৮-১৫৪১): ফ্রান্সিসকো পিজারো একজন স্পেনীয় নাবিক। তিনি স্পেনের ট্রজিল্লোতে জন্ম লাভ করেন। তিনি সমুদ্রযাত্রা করে ব্যালবোয়া কর্তৃক আবিষ্কৃত ড্যারিয়েন (পানামা) যান এবং ১৫১৩ সালে ব্যালবোয়ার সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ড্যারিয়েন (পানামায়) একটি গরুর খামার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেখান থেকে দক্ষিণ আমেরিকার সমৃদ্ধ রাজ্য ইনকা সভ্যতা সম্পর্কে অভিহিত হন। ভিয়েগো ডে আলমাসরো নামে একজন ভাগ্যান্বেষী ফেরনানডো ডে লুকু নামক একজন পাদ্রির সাথে পেরু আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। ১৫২৪ এবং ১৫২৬ সালে পরপর দু বার তিনি পেরুতে অভিযান করেন। তার সহকর্মী আলমাসরোর সহায়তায় পেরুতে অভিযান করেন। এই অভিযানের পূর্বে স্পেনীয় রাজার সম্মতি প্রয়োজন এ ধারণায় ১৫২৮ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারো স্পেনে এসে রাজার অনুমতি নেন। তিনি তার তিন ভ্রাতা ও ১৮০ জন জনবল নিয়ে ফ্রান্সিসকো পিজারো টুম্বেসের ইনকা নগর থেকে অভিযানের যাত্রা করেন। এ সময় ইনকাদের রাজ্যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছিল। ইনকা রাজা হুয়ানকারের বিরুদ্ধে তার ভ্রাতা আটাহুয়ালপা বিদ্রোহ করে সিংহাসন দখল করে ছিল। এই গৃহযুদ্ধ অবস্থায় ফ্রান্সিসকো পিজারো সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাজামার্কাতে হাজির হন। তিনি বিদ্রোহী রাজা আটাইয়ালপার অনুসারীদের হত্যা করে আটাহুয়ালপাকে বন্দি করেন। মুক্তিপণ হিসাবে আটাহুয়ালপা প্রচুর স্বর্ণ প্রদান করলেও ফ্রান্সিসকো পিজারো আটাহুয়ালপাকে হত্যা করেন। আলমাসরো কর্তৃক সরবরাহকৃত সৈন্য নিয়ে ফ্রান্সিসকো পিজারো ইনকার রাজধানী কুচকোতে এসে হুয়ানকারের এক আত্মীয়কে ক্রীড়নক হিসেবে ইনকাদের রাজপদে বসান। তিনি পেরুতে লিমা নগর প্রতিষ্ঠা করেন। পেরুতে ১৫৩৬ সালে ইনকারা বিদ্রোহ করলে ফ্রান্সিসকো পিজারো তা কঠোর হস্তে দমন করেন। ইতোমধ্যে আলমাসরো ফ্রান্সিসকো পিজারোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু ফ্রান্সিসকো পিজারো তাকে পরাজিত এবং নিহত করেন। ফ্রান্সিসকো পিজারো পেরু দখল করায় স্পেনের রাজা তাকে ‘মার্ক হুইস’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ফ্রান্সিসকো পিজারো ১৫৪১ সালে ২৬ জুন পর্যন্ত পেরু শাসন করে। কিন্তু আলমাসরোর একদল অনুসারী তাকে হত্যা করেছিল।

গোনজালো পিজারো (১৫০৬-১৫৪৮): গোনজালো পিজারো ছিলেন ফ্রান্সিসকো পিজারো-এর ভ্রাতা। তিনি তার ভ্রাতা ফ্রান্সিসকো পিজারোর সাথে ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলবর্তী অনেক অঞ্চল আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তার ভ্রাতার মৃত্যুর পর পেরুর গভর্নর হয়েছিলেন এবং তিন বছর রাজার অনুমতি ছাড়াই পেরু শাসন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজ রোষে তিনি ক্ষমতাহীন হন এবং আত্মসমর্পণ করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

ইংরেজ, ফরাসি ও ইতালীয় নাবিকদের ভৌগোলিক আবিষ্কার

পর্তুগাল ও স্পেনীয় নাবিকরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করলে ইংরেজরাও এ বিষয়ে আগ্রহী হয়। যে সকল নাবিক ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক আবিষ্কারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে জন ক্যাবট ও সেবাশ্চিয়ান ক্যাবটের নাম উল্লেখযোগ্য।

  • জন ক্যাবট: জন ক্যাবট ও সেবাশ্চিয়ান ক্যাবট জন্মগতভাবে ইতালির ভেনিসের মানুষ হলেও তারা একসময় ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের তিন বছর পর ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম হেনরির উৎসাহ ও সমর্থনে তারা মশলার জন্য পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যাবার জন্য জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু করেন। জন ক্যাবট ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল বন্দর থেকে ১৪৯৭ সালে মে মাসে সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ করেন এবং ১৪৯৭ সালে ২৪ জুন উত্তর আমেরিকায় পৌঁছেন। তারা উত্তর আমেরিকার নিউফাইন্ডল্যান্ড অথবা নোভাস্কটিয়ার ভূমিতে অবতরণ করেন। পরে উপকূল বেয়ে জাহাজ চালিয়ে আমেরিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আবিষ্কার করেন। ইতোপূর্বে পোপ পশ্চিম ও পূর্ব গোলার্ধ স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এই সমুদ্রযাত্রার ফলে ইংল্যান্ড উত্তর আমেরিকার আবিষ্কৃত ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি করে।
  • সেবাশ্চিয়ান ক্যাবট : ১৫২৭ সালে জন ক্যাবটের পুত্র সেবাশ্চিয়ান ক্যাবট উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূল প্রদক্ষিণ করেন। কিন্তু প্রচণ্ড বরফের চাড় ভেঙে তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। সেবাশ্চিয়ান ক্যাবট প্রথম জীবনে স্পেনের নাবিকের চাকরি করেন। ১৫২৬ সালে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার প্যারাগুয়ে ও রিও ডে লা প্লাটা ভ্রমণ করে ১৫৪৮ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডে এসে তিনি একটি রুশ কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে রাশিয়া যাওয়ার জন্য একটি জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড (১৫৪৭-১৫৫৩) তাকে জাহাজ ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ১৫৫৩ সালে জাহাজ চালিয়ে উত্তরপূর্ব জলপথ ধরে রাশিয়াতে পৌঁছেন। রাশিয়ার জার ইংল্যান্ডের সাথে ব্যবসা করার জন্য একটি পত্র দিলে তিনি তা নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। চ্যান্সেলর নামে আরেকজন ইংরেজ অভিযানকারী সেবাস্টিন ক্যানারির পথ অনুসরণ করে রাশিয়ার উপকূলে পৌঁছেন।
  • জন হকিন্স (১৫৩২–১৫৯৫) : জন হকিন্স ছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ ভৌগোলিক আবিষ্কারক। জন হকিন্স অনেকবার আটলান্টিক মহাসাগরে সামুদ্রিক অভিযান করে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেন। সেখানে অবস্থানকালে হিসপনিওয়ালা দ্বীপে আফ্রিকার ক্রীতদাসদের বিপুল চাহিদা সম্পর্কে অবহিত হন। এরপর তিনি আফ্রিকার গিনি উপকূলে অভিযান চালিয়ে নিগ্রোদের ধরে এনে হিসপনিওয়ালার খামার মালিকদের নিকট বিক্রয় করেন। স্পেনীয়রা তার এই অভিযানকে ভালো চোখে দেখেনি। তাই আমেরিকা থেকে ফেরার পথে স্পেনীয় নৌবহর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্পেনীয়দের আক্রমণে তার তিনটি জাহাজ ধ্বংস হয়। তিনি ও তার সহকারী ফ্রান্সিস ড্রেক কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।
  • ফ্রান্সিস ড্রেক : ফ্রান্সিস ড্রেক ছিলেন দুঃসাহসিক ইংরেজ অভিযাত্রী। তিনি এক জলদস্যু দল গঠন করেন। পানামা যোজক ও তৎসংলগ্ন এলাকায় স্পেনীয় মালবাহি জাহাজে আক্রমণ করতেন। ১৫৭৭ সালে ফ্রান্সিস ড্রেক ম্যাগেনাল প্রণালী অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া পৌঁছেন। সেখান থেকে সোজা পশ্চিম দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ পার হয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছেন। তারপর আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে ১৫৮০ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছেন। তার এ দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ তাকে নাইট উপাধি দিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস ড্রেকের এ অভিযানের ফলে ইংরেজরা পোপের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পূর্ব পশ্চিমে সমুদ্র অভিযান করেন। পশ্চিম দিকে ষোড়শ শতাব্দীর পরে উত্তর আমেরিকায় ১৩টি উপনিবেশ স্থাপন করে পূর্ব দিকে অভিযান করে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য স্থাপন করেন। ইংরেজ বণিকরা ১৫৯১ সালে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য করার জন্য জাহাজ প্রেরণ করেন। এ চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ১৫৯৯ সালে তারা দ্বিতীয়বার বাণিজ্য জাহাজ প্রেরণ করেন। এর প্রেক্ষিতে ১৬০০ সালে ৩০ ডিসেম্বর পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্যবসা করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে রাণী এলিজাবেথের সনদ নিয়ে ভারত ফিরে আসেন।

ফরাসি ভৌগোলিক আবিষ্কারকগণ : ফরাসি ভৌগোলিক আবিষ্কারকদের মধ্যে জিওভান্নি বেরাজানো (Giovanni Verazano), জ্যাকভ্যাস কার্টিয়ার (Jacqves Cartier) উল্লেখযোগ্য ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসি নাবিকগণ ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম দিকে ফ্রান্সের মৎস শিকারিরা ফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে গিয়ে মাছ শিকার করে তা প্রচুর লাভে বিক্রি করত।

  • জিওভান্নি বেরাজানো: ১৫২৪ সালে ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিস জিওভান্নি বেরাজানোকে সামুদ্রিক অভিযানে প্রেরণ করেন। জিওভান্নি বেরাজানো প্রথম অভিযানে উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি থেকে কেপ কড পর্যন্ত অঞ্চল আবিষ্কার করেন।
  • জ্যাক কার্টিয়ার : ফরাসি ভৌগোলিক আবিষ্কারের মধ্যে জ্যাক কার্টিয়ার ছিলেন বিখ্যাত। তিনি ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিসের উৎসাহে আমেরিকায় অভিযান করে নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছেন। সেখান থেকে ক্রমে লরেন্স উপসাগরে অবস্থিত বেল্লে আইন প্রণালীর ভিতর দিয়ে সাসপে উপদ্বীপে পৌঁছেন। পরে সেন্ট লরেন্স নদীর মোহনা পর্যন্ত যান। পরের বছর ১৫৪৫ সালে সেন্ট লরেন্স নদীর মধ্যে দিয়ে একটি পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছেন এবং এখানকার নামকরণ করা হয়েছিল মাউন্ট রিয়েল। সেখানে হোচেলাগা নামে একটি ইণ্ডিয়ান গ্রাম ছিল। এখানে পরে মন্ট্রিল নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এখান থেকে চীনে যাবার জলপথ আবিষ্কারের সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু সেটি কার্যকরী হয়নি। এরপর ফ্রান্সে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে তার সমুদ্র অভিযান বন্ধ থাকে। ১৫৪১ সালে কার্টিয়ার তৃতীয়বার সমুদ্রপথে আমেরিকা যান এবং কানাডা কুইবেক শহরে শীতকাল অতিবাহিত করেন। ফ্রান্স সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমেরিকার পোর্ট রয়াল ও কানাডার কুইবেককে উপনিবেশে পরিণত করে

ইতালির ভৌগোলিক আবিস্কার : ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালি ভৌগোলিক আবিষ্কারে মনোযোগী হয়। ইতালীয় ভৌগোলিক আবিষ্কারকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন আমেরিগো ভেসপুচি। আমেরিগো ভেসপুচি (১৪৫৪-১৫১২) ইতালির ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফ্লোরেন্সের মেডিচি পরিবারে স্পেনীয় ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ভূগোল ও বিশ্ব গঠনতত্ত্বে তার অগাধ পাণ্ডিত্য থাকায় তাকে স্পেন ও পর্তুগিজকে ইতঃপূর্বে পোপ যে সীমারেখার মাধ্যমে তাদের উপনিবেশ আলাদা করে দিয়েছিলেন তা বের করতে ভেসপুচিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ১৫০০-১৫০২ সালে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল বরাবর দুটি সমুদ্রযাত্রার বিবরণ দেন। তিনি ১৪৯৯-১৫০০ সালে স্পেনের জন্য প্রথম সমুদ্রযাত্রা এবং ১৫০১-১৫০২ সালে পর্তুগালের জন্য দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা শেষ করেন। এই অভিযানে তিনি এক বিরাট ভূখণ্ড যা আমেরিকা নামে পরিচিত এর উত্তর ও পূর্ব উপকূলের ৬০০০ মাইল আবিষ্কার করেন। তার নাম থেকেই পরবর্তীকালে নতুন জগতের নামকরণ করা হয় আমেরিকা। ১৫০৭ সালে লরেনের একজন ভূগোলবিদ মাল্টিন ওয়াল্ড সিমুলার নতুন মহাদেশ (বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকা) দেখিয়ে একটি মানচিত্র রচনা করেন। এর সাথে ছিল একটি পুস্তিকা যাতে তিনি এর আবিষ্কারক আমেরিকাস (আমেরিগো ভেসপুচি)-এর নাম অনুসারে এর নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, যেহেতু ইউরোপা ও এশিয়া উভয়ই মেয়েলি নাম ধারণ করে সেজন্য নতুন মহাদেশকে আমেরিকা নামকরণ করা হোক। তাৎক্ষণিকভাবে এ নামটি অনেকে সমর্থন করেছিলেন। যেহেতু কলম্বাস চারটি সমুদ্রযাত্রা করে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেছিল সেহেতু কলম্বাসের নাম অনুসারে অথবা তার প্রথম আবিষ্কৃত ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামানুসারে নাম দেওয়া যেত। ভেসপুচির প্রথম সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কে বিতর্ক আছে। কলম্বাসের দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে উপনীত হওয়ার এক বছর আগে ভেসপুচি প্রথম সমুদ্র যাত্রা করেন। আবার অনেকের মতে তাদের নগরের সম্মান বৃদ্ধির জন্য ফ্লোরেন্সের তার কোনো বন্ধু এই সমুদ্রযাত্রার কথা আবিষ্কার করতে পারে। আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে ফ্রেডারিক জে পোহল তার ‘আমেরিগো ভেসপুকচি পাইলট মেজর’ গ্রন্থে মত দেন যে, ভেসপুচি প্রথম সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করেননি। অন্যদিকে জার্মান পণ্ডিত আরসিনিগারস তার রচিত ‘আমেরিগো অ্যান্ড দা নিউওয়াল্ড’ গ্রন্থে মত দেন যে, আমেরিগো ভেসপুচি প্রথম সমুদ্রযাত্রা করেন। এ বিতর্ক একটি বিষয়কে এড়িয়ে যায়, কারণ একটি নতুন মহাদেশের অস্তিত্বের ভেসপুচির প্রমাণকে গ্রহণের দ্বারা, কলম্বাসের এক বছরের আগে ভেসপুচির সমুদ্রযাত্রার সম্ভাবনার দ্বারা নয়, ওয়ান্ড সিমুলার আমেরিকা নাম প্রস্তাব করতে প্ররোচিত হন। ওয়ার্ল্ড সিমুলারের বৃহৎ মানচিত্রে দক্ষিণের মহাদেশকে আমেরিকা নাম দেওয়া হয় নি : এটা উক্ত মানচিত্রের অভ্যন্তরে অংকিত ক্ষুদ্র একটি মানচিত্রে এটা দেওয়া হয় যা দুটি ভৌগোলিক আবিষ্কার উত্থাপন করে। যার আবিষ্কারক ছিলেন ভেসপুচি। প্রথমত যেখানে, নতুন একটি মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল ও দ্বিতীয়ত যে, এশিয়া ও নতুন মহাদেশের মধ্যে একটি মহাসাগর ছিল। ভেসপুচি প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন সেখানে, পশ্চিম দিক দিয়ে এশিয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপ থেকে সমুদ্রযাত্রা করলে একজনকে দুটি সমুদ্র অতিক্রম করতে হবে। ভূখণ্ডের অবস্থান ও পৃথিবীর একটানা জনবিস্তার সম্পর্কে তার মোটামুটি মন ছিল ও পাগনিক নৌ চলাচল সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। কোনো পশ্চিম ভূখণ্ডে পর্যবেক্ষিত একটি গ্রহের সাথে চন্দ্রের সংযোগ ও স্পেনে পর্যবেক্ষণের সময় তুলনা করে তিনি অক্ষাংশ পান। পৃথিবীর ব্যাসের সঠিক অংকের প্রায় কাছাকাছি ছিল তার হিসেব। এর ভুল ছিল কেবল ৫০ মাইল। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্পেনীয় রাজার জ্যোতির্বিদ ছিলেন। পাইলট মেজর হিসাবে তার দায়িত্ব ছিল আটলান্টিক মহাসাগর ও পশ্চিম ভূখণ্ডের মূখ্যচার্ট তৈরি ও সংশোধন করা ও নাবিকদের তার অনুলিপি সরবরাহ করা। আমেরিকা নামকরণ সম্পর্কে বলা যায় যে, জনগণ এটাকে এত পছন্দ করত যে, তারা উত্তর আমেরিকা মহাদেশ ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ উভয় ক্ষেত্রে এটিকে ব্যবহার করত।

ভৌগোলিক আবিষ্কার ও উপনিবেশিক শাসন

ভৌগোলিক আবিষ্কারের পর পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

পর্তুগাল : 

  • ভারতে ১৫০৫ সালে পর্তুগিজ নাবিক আলবুকার্ক ভারতের পশ্চিম উপকূলের গোয়াতে পর্তুগিজ ঘাঁটি স্থাপন করে।
  • পরে কোচিনে পর্তুগিজরা আরেকটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে।
  • পর্তুগিজরা পারস্য উপসাগরে অরমুজ বন্দরটি দখল করে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে।
  • ১৫১১ সালে পর্তুগিজরা মালাক্কা দখল করে।
  • পূর্ব দিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি অঞ্চল পর্তুগিজরা দখল করে।
  • ১৫১৭ সালে পর্তুগিজরা চীনের ক্যান্টন দ্বীপে বাণিজ্যবন্দর স্থাপন করে।
  • পরে চীনের ম্যাকাও দ্বীপটি দখল করে।
  • ১৫৪২ সালে পর্তুগিজরা জাপানে বাণিজ্যঘাঁটি স্থাপন করে। পর্তুগিজ ধর্মযাজক ফ্রান্সিস জেভিয়া জাপানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন।
  • এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারতবর্ষ পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পর্তুগিজরা উপনিবেশ স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের চেষ্টা করেছিল। অবশ্য পরে হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড পর্তুগিজদের পূর্ব ভারতীয় এবং ভারতীয় উপনিবেশগুলো কেড়ে নেয়।
  • পর্তুগিজরা ১৫২০ সালে মোজাম্বিক দখল করে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে।
  • আবিসিনিয়াতেও তাদের ঘাঁটি ছিল।
  • পর্তুগিজরা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রাজিলের দক্ষিণে সাওপাওলো এবং উত্তরে পার্নায়ুকে ও বাহিযাতে পর্তুগিজদের উপনিবেশ ঘাঁটি ছিল।
  • ১৫৬৭ সালে পর্তুগিজরা ফরাসিদের কাছ থেকে বায়ো-ডি জেনিরো কেড়ে নিয়ে তা ব্রাজিলের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

স্পেন :

ভৌগোলিক আবিষ্কারের সুবাদে স্পেন বিশাল উপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ অঞ্চল স্পেনের উপর নির্ভরশীল ছিল।

  • ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরু হয় তখন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানরা বাস করত। মেক্সিকো ও পেরু অঞ্চলে উন্নত নগর সভ্যতা ছিল। স্পেনীয়রা আমেরিকাতে গিয়ে স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যা করে ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে।
  • স্পেনীয়রা আমেরিকায় প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে সান ডমিঙ্গো দ্বীপে। পরে এর নামকরণ করা হয় হিস্পনিওলা।
  • এরপর ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে স্পেনীয়রা উপনিবেশ স্থাপন করে।
  • কালক্রমে ফ্লোরিডা থেকে ভেনিজুয়েলা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে স্পেনীয়রা উপনিবেশ স্থাপন করে।
  • স্পেনীয়রা ১৫১৯ সালে আমেরিকা মহাদেশের উন্নত আজটেক সভ্যতার দেশ মেক্সিকো দখল করে। স্পেনীয়রা মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ শহরটি দখল করে সেখানকার শাসক সম্রাট মন্টেজুমাকে পরাজিত করে প্রচুর সোনা ও মূল্যবান পাথর অধিকার করে। ক্রমে সমগ্র দেশটি স্পেনের কর্তৃত্বে আসে।
  • ১৫৩১ সালে পর্তুগিজরা আমেরিকার ইনকা সভ্যতার কেন্দ্র পেরু আক্রমণ করে। এরপর স্পেনীয়রা আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, চিনি ও ইকুয়েডর দখল করে।
  • আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পেড্রো ডি মেন্ডোজা স্পেন রাজের সমর্থন নিয়ে আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে দখল করেন। তিনি ১৫৩৫ সালে বুয়েন্স এয়ারিস শহরটি স্থাপন করেন।
  • পিজারোর আরেকজন সহযোগী দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের চিনির রাজ্যটি দখল করে ১৫৪১ সালে সান্টিয়াগো শহরটি স্থাপন করেন।
  • পিজারোর আরেকজন সহযোগী ইকুয়েডর দখল করে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে গোয়াই আকুইল শহরটি স্থাপন করেন।
  • ১৫৩৮ সালে স্পেনীয়রা কলম্বিয়া দখল করে।
  • এসবস্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে স্পেনীয়রা সোনা আহরণ, পশুপালন, ইক্ষু চাষ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়। আফ্রিকা থেকে নিগ্রো দাস নিয়ে সেখানে কৃষির বিকাশ ঘটায়।
  • ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনীয়রা আমেরিকাতে উপনিবেশিক শাসন কেন্দ্র স্থাপন করে নতুন স্পেন ও পেরুতে। নতুন স্পেন থেকে মেক্সিকো পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মধ্য আমেরিকা দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চল ও প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ শাসন করত। পেরু থেকে শাসন করত চিলি ইকুয়েডর ও আর্জেন্টিনা।
  • সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা খ্রিস্টধর্মের প্রচারের জন্য খ্রিস্টান যাজক ও সন্ন্যাসীকে দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠানো হয়। পাদ্রিরা দক্ষিণ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন।
  • স্পেন ১৫৫১ সালে লিমা এবং মেক্সিকো শহরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে।
  • স্পেনীয়গণ দূরপ্রাচ্যে ফিলিপাইনকে ইউরোপীয়করণ করে। স্পেনীয় নাবিক ম্যাগেলান এ দ্বীপটি দখল করেছিলেন। ১৫২১ সালে স্পেনের যুবরাজ ফিলিপের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় ফিলিপাইন। ১৫৭১ সালে ম্যানিলা শহরটি স্থাপন করা হয়। স্পেনীয়রা ফিলিপাইনে অতি সহজে স্পেনীয় ভাষা, ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়।

আফ্রিকা মহাদেশে ইউরোপীয় বিস্তারনীতি : পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয়রা আফ্রিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান আমলে ইউরোপীয়রা আফ্রিকাতে সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও মধ্যযুগে আফ্রিকা সম্পর্কে ইউরোপীয় রাজবংশগুলোর খুব একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল না। মিশরীয় ও কার্থেজীয় সভ্যতা সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব ইউরোপীয়দের জানা থাকলেও ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আফ্রিকা অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ নামে পরিচিত ছিল। কারণ আফ্রিকার উপকূল রেখা ভিন্ন অভ্যন্তরভাগের কোনো সঠিক তথ্য ইউরোপীয়দের জানা ছিল না।

  • প্রথম দিকে পর্তুগিজরা আফ্রিকাতে ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরু করে। পর্তুগিজরা আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে মোজাম্বিক বা পর্তুগিজ পূর্ব আফ্রিকা নামে উপনিবেশ স্থাপন করে। পর্তুগালের ইচ্ছা ছিল পর্তুগিজ পূর্ব আফ্রিকা ও পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের জলপথ আবিষ্কার করে।
  • আফ্রিকাতে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল আলজেরিয়া, নাইজার, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, মৌরিতানিয়া, মালি, গিনি বিসাও, চান, সেনেগাল, তিউনিশিয়া, গ্যাবন, মাদাগাস্কার, কঙ্গো, ক্যামেরুন, টোগোল্যান্ড ও সোমালিয়া।
  • আফ্রিকায় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল সিয়েরালিওন, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, বতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ড, রোডেশিয়া, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, মিশর, সুদান, টাঙ্গানাইকা, টোগো, ক্যামেরুন প্রভৃতি অঞ্চলে।
  • আফ্রিকাতে ইতালির উপনিবেশ ছিল ইথিওপিয়ায়।
  • স্পেন মরক্কোতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের গুরুত্ব ও ফলাফল

ভৌগোলিক আবিষ্কারের গুরুত্ব : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন দেশ ও সমুদ্রপথ আবিষ্কার হয়। এসব আবিষ্কারের ফলে কেবল ভৌগোলিক জ্ঞানই বৃদ্ধি পায়নি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। নিম্নে ভৌগোলিক আবিষ্কারের আলোচনা করা হলো :

  • ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়। ভৌগোলিক আবিষ্কারের পূর্বে ইউরোপীয় সামুদ্রিক বাণিজ্য কেবল ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় ব্যবসা-বাণিজ্য মহাসাগরীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে পরিণত হয়। ইউরোপীয়দের বাণিজ্য তরি আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে।
  • পুঁজিবাদের সূচনা : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কেন্দ্রীক ব্যবসা বাণিজ্য বৃহৎ আয়তন শিল্প ও কারখানায় পরিণত হয়। এর ফলে যৌথ মূলধনী ব্যবসা, মুদ্রানীতি, ব্যাংকিং ব্যবসা, শ্রমের অবাধ বিচরণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যের স্থলে বড় বড় যৌথ মূলধন কারবার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। মূলধনের চাহিদার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক নামক লগ্নী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে আমেরিকা ও এশিয়া থেকে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও মূল্যবান ধাতু ইউরোপে জমা হয়। এই সঞ্চিত সম্পদ প্রাথমিক পুঁজিবাদের সূচনা করে। এর ভিত্তিতেই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বিকাশ হয়। এই বাণিজ্যপুঁজি ক্রমে শিল্পপুঁজিতে রূপান্তরিত হয় যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সম্ভব করে। শিল্প বিপ্লবের ফলে বৃহৎ বৃহৎ কলকারখানা গড়ে ওঠে।
  • অবাধ বাণিজ্য : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে উইরোপের ব্যবসা ক্ষেত্রে গিল্ড প্রথা ভেঙে অবাধ বাণিজ্যের সূচনা হয়। অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়। এই কোম্পানিগুলো আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এর উপকূলীয় দেশগুলোতে অবাধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। এ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধ শুরু হয়। পূর্বে ইউরোপীয় বাণিজ্যে ইতালীয় শহরগুলো বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করত। ক্রমে ইতালীয় বণিকরা বাণিজ্য সুবিধা হারায়। এ স্থলে পর্তুগাল, স্পেন, হল্যান্ড ও ইংল্যান্ড বাণিজ্য পুঁজির লাভ ভোগ করতে থাকে। লিসবন, সেভিল, এন্টওয়ার্প, প্যারিস, আমস্টারডাম, লন্ডন, ইউরোপের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বণিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের বাণিজ্য কুক্ষিগত করে। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয় যে সকল বিখ্যাত কর্পোরেট বাণিজ্য কোম্পানি গড়ে ওঠেছিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাক্সভি কোম্পানি (১৫৫৪), টার্কি-লেভান্ট কোম্পানি (১৫৮), মরক্কো কোম্পানি (১৫৮৫), গায়ানা কোম্পানি (১৫৮৮), ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০) ইত্যাদি।
  • শ্রম শোষণ : পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশের ফলে শোষণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমেরিকা থেকে সোনা ও রুপার ব্যাপক আমদানি মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতিতে একটি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। মুদ্রা অর্থনীতি বিনিময়ের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জয়েন স্টক কোম্পানি ও বীমা কোম্পানি গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদী স্বার্থে গড়ে ওঠে ক্রীতদাস প্রথা। আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস ধরে নিয়ে আমেরিকায় কৃষি খামার, পশু খামার, খনি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদিতে নিয়োগ করা হয়। পর্তুগাল ও স্পেন আমেরিকাতে দাস ব্যবসাকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করে।
  • পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি : ভৌগোলিক আবিষ্কার পণ্যের প্রসার ঘটায়। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয় বণিকরা আমেরিকা থেকে সোনা, রুপা, তামাক, কোকো, কুইনাইন, ভুট্টা, আলু, শিম ইত্যাদি নিয়ে আসে। এশিয়া থেকে মশলা, তুলা, ৰবি বৃক্ষ, রেশম, হাতির দাঁত, নী, চ, লবন, চা, কফি, কার্পেট, চীনামাটির পাত্রা, কম্বল, সুগন্ধি দ্রব্য, মূল্যবান পাথর ইউরোপে নিয়ে আসে। আমেরিকাতে ইউরোপীয়রা নিয়ে গিয়েছিল ঘোড়া, গাধা, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, লেবু, কমলা, কলা, জলপাই, আঙুর ও খাদ্যশস্য। পরবর্তীকালে ইউরোপ আমেরিকায় রপ্তানি শুরু করে গম, সুতি ও পশমি বস্ত্র, বারুদ, লোহার যন্ত্রপাতি প্রভৃতি পণ্য। ইউরোপীয়রা এশিয়া ও আমেরিকা থেকে কাঁচামাল এনে তা পণ্যে রূপান্তর করে উনিবেশগুলোতে রপ্তানি করত।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল : অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও ভৌগোলিক আবিষ্কার এক যুগান্তাকরী পরিবর্তন আনে। নিম্নে এর ফলাফল আলোচনা করা যেতে পারে –

  • ১. অর্থনৈতিক : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর পূর্বে ইউরোপীয় সামুদ্রিক বাণিজ্য মহাসাগরীয় ব্যবসায় বাণিজ্যে পরিণত হল। আটলান্টিক, প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরর অতিক্রম করে সামুদ্রিক বাণিজ্যে পৃথিবীময় ছেড়ে গেল। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে কলকারখানা ও বৃহদায়তন শিল্পের শুরু হয়। আধুনিক মুদ্রা নীতি, মূলধন ও শ্রমের সম্বন্ধ সর্বত্র ছড়ে পড়ে। ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থলে বড় বড় যৌথ কারবার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল। মূলধনের চাহিদার ফলে ব্যাংক নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলো।
  • ২. রাজনৈতিক : ভৌগোলিক আবিষ্কারের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের সূত্র ধরে রাজনৈতিক অধিকার বিস্তৃত হতে লাগলো। অনুন্নত দেশের সহজ সরল বাসিন্দাগণকে পাশবিক শক্তির দ্বারা পরাভূত করে ইউরোপীয়রা সেসকল দেশে তাদের উপনিবেশ বিস্তার ও বাণিজ্যিক প্রাধান্য স্থাপন করতে শুরু করলেন। আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে তাদের দেশ ইউরোপীয়য়া কেড়ে নেন। উপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রাধান্য নিয়ে অল্পকালের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। ইউরোপে নৌবাহিনী গঠন ও নৌবলের বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে শুরু হয়েছিল।
  • ৩. ধর্মনৈতিক : ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলেই ইউরোপীয় খ্রীষ্ট ধর্ম ও যাজকগণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরেন। তাদের চেষ্টায় খ্রীষ্টান ধর্ম পৃথিবীব্যাপী বিস্তার ঘটে।
  • ৪. সামাজিক : সামাজিক ক্ষেত্রেও ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয় এবং দাস ব্যবসায়ের পত্তন হয়। মানুষকে পশু অপেক্ষা নীচু স্তর মনে করে আফ্রিকায় উপকূল হতে তাদেরকে ধরে আমেরিকায় চালান দেয়া হত। আমেরিকায় নতুন উপনিবেশ স্থাপনে দাস শ্রমিক নিযুক্ত লাভজনক ছিল। এ ক্রীতদাস কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে আমেরিকায় এক বিরাট সামাজিক সমস্যা, এমন কি রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে উপনিবেশে প্রেরণ করায় বেকার সমস্যা ও জনসংখ্যা সৃষ্ট সমস্যার সাময়িকভাবে সমাধান হয়।
  • ৫. সাংস্কৃতিক : নাবিকদের নতুন দেশ আবিষ্কার ও নতুন দেশের নতুন অভিজ্ঞতা সাহিত্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞান যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে দ্রুত যাতায়াতের প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক চাহিদার ফলে নানা প্রকার যন্ত্রপাতির আবিষ্কার আরম্ভ হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে বহু নতুন নতুন দেশ ও সমুদ্র পথ আবিষ্কৃত হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ফলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক আবিস্কারের দান অপরিসীম।

ধর্ম সংস্কার আন্দোলন

ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল ইতিহাসে তা ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত। ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্টিন ল্যুথারের নেতৃত্বে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের সৃষ্টি হয়। এর ফলে খ্রিষ্টীয় ধর্মাধিষ্ঠান বিভক্ত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন গির্জা বা ধর্মাধিষ্ঠান গড়ে ওঠে; এর মধ্যে জার্মানির সুপারিয়ান চার্চ, ইংল্যান্ডের অ্যাংলিকান চার্চ, স্কটল্যান্ডের প্রেসবেরেটিয়ান চার্চ, সুইজারল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ অন্যতম ছিল।

ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রকৃতি : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল দ্বিবিধ। (১) খ্রিস্টান জগতের নৈতিক শুদ্ধতা এবং পোপের ধর্মীয় আধিপত্য অগ্রাহ্য করে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা। (২) রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পোপের প্রভাব ও আধিপত্য উচ্ছেদ করে অভ্যন্তরীণ ও ধর্মের ক্ষেত্রে রাজশক্তির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। ধর্মীয় ক্ষেত্রে আধিপত্যের পাশাপাশি পোপ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করত। রাজ্যের খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের কাছ থেকে ধর্ম কর আদায় করত এবং গির্জায় পোপদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিত। পোপের এই কর্মকাণ্ডে প্রত্যেকটি জাতির জাতীয়তাবোধের সাথে খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠানের বিরোধ দেখা দেয়। এ পর্যায়ে পোপের আধিপত্য বিলোপ করে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন কায়েম করা হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয়ই।

ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের কারণ 

  • (১) মানবতাবাদীদের প্রভাব : বিভিন্ন কারণে ইউরোপে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। রেনেসাঁস প্রসূত অনুসন্ধিৎসা ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে মানুষের মনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করেছিল। ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের দুর্নীতি, দোষ-ত্রুটি, নৈতিক অবক্ষয় অনেক চিন্তাশীল মানুষের মনে ধর্মের প্রকৃত লক্ষ্য এবং ধর্মকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে উন্নীত করে মানবতার মঙ্গল সাধনে অনেক মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ধর্মাধিষ্ঠানের প্রতিভূ পোপগণ যখন তাদের ধর্মীয় দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভুত্ব স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ ও শত্রুতায় লিপ্ত হয় তখন স্বাভাবিক কারণেই পোপদের উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে মানুষের মনে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে স্যাভোনারোলা, ওয়াইক্লিফ, রিউক্লিন, ইরাসমাস, জন কোলেট, স্যার টমাস মুর, মার্টিন ল্যুগার, জুইংলি, ক্যালভিন প্রমুখ মনীষীগণ ধর্ম সংস্কারে এগিয়ে আসেন। এসকল মনীষীদের প্রচেষ্টায় খ্রিস্টান জগতে ধর্মীয় বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও জীবনবোধের ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা দেয় যা ধর্মের সংস্কার অনিবার্য করে তোলে। আধুনিক যুগের ইউরোপে প্রখ্যাত কয়েকজন ধর্মজ্ঞানী ও মানবতাবাদী পণ্ডিত ধর্ম ও ধর্মাধিষ্ঠানের সংস্কারের দাবি তোলেন। এদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের স্যাভোনারোলা, হল্যান্ডের ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস, ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ, থমাস মোর, জন রিউক্লিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
    • স্যাডোনারোলা (১৪৫২-১৪৯৮): স্যাভোনারোলা ছিলেন ইতালীয় পণ্ডিত। রেনেসাঁসের প্রভাবে ইতালিতে ভোগবাদিতা ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা দেখা দেয় তা খ্রিস্ট ধর্মাধিষ্ঠানকেও প্রভাবিত করে। পোপবা সম্রাট বা রাজাদের মতো বিলাসী জীবন ও রাজক্ষমতা ভোগ করতে শুরু করলে তার প্রভাবে তা সমগ্র খ্রিস্টীয় জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লোরেন্সের স্যাভোনারোলা ধর্মযাজকদের এ বিলাস ও অনৈতিক জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন। ফল ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
    • জন ওয়াইক্লিফ (১২২৪-১৩৮৪): চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ ধর্মক্ষেত্রে পোপের কর্তৃত্ব এবং যাজকদের বিলাসিতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের সমালোচনা করেছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রখ্যাত মানবতাবাদী পোপ কর্তৃক বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ শোষণ, যাজকপদে অনৈতিক নিয়োগ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন। এজন্য তাকে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত এবং ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ‘শুকতারা’ বলা হয়।
    • জন হাস (১৩৬৯–১৪১৫): ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের কুসংস্কার এবং যাজকদের লোভ ও বিলাসিতার যে সমালোচনা শুরু করেন তা বিভিন্ন মনীষীদের প্রভাবিত করে। হাঙ্গেরির বোহেমিয়ার জন হাস চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের সংস্কার দাবি করেন। কিন্তু তার এ সংস্কার আন্দোলনের জন্য তাকে ধর্মাদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
    • জন রিউক্লিন (১৪৫৫-১৫২২) : জন রিউক্লিন ছিলেন স্বনামধন্য জার্মান পণ্ডিত। তিনি হিব্রু ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের অনাচার ও যাজকদের বিলাসিতার কঠোর সমালোচনা করতেন। তার প্রধান শিষ্য হুটেনের নেতৃত্বে ধর্মযাজক ও ধর্মজ্ঞানহীন ক্যাথলিক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তারা “অজ্ঞাত ব্যক্তিদের চিঠি’ (Letters of obscure men) এ নামে বহু পত্র প্রকাশ করে সেগুলোতে যাজক ও ক্যাথলিক শিক্ষার্থীদের দোষ-ত্রুটির কঠোর সমালোচনা করতেন। এর ফলে জার্মানিতে যাজক শ্রেণীর প্রতি অনেক মানুষ বিরোধী হয়ে উঠেছিল।
    • ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস (১৪৬৬-১৫৩৬): খ্রিস্টীয় মানবতাবাদী ও সংস্কারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস। তাকে মানবতাবাদীদের রাজপুত্র বলা হত (Prince of the Humanists), ইরাসমাস হল্যান্ডের এক যাজকের অবৈধ সন্তান ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে ব্রেদেন অফ দি কমন লাইফের (Brethren of the common life) সদস্যদের তত্ত্বাবধানে স্কুল জীবনে শিক্ষালাভ করেন। তিনি ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে প্রথমে যাজক পদে চাকরি নেন এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে তার নিকট ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। তিনি ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় বাইবেলের সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তৎকালীন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত ধর্মতত্ত্বের শিক্ষার সমালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন। ইরাসমাস ১৫১১ সালে তার ‘প্রেইজ অফ ফলি’ (Praise of folly) বা ত্রুটি বিচ্যুতির প্রশংসা নামক গ্রন্থে সমসাময়িক খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠান এবং খ্রিস্টানদর নৈতিক দোষ-ত্রুটির সমালোচনা করেন। তার এ সমালোচনা ধর্মাধিষ্ঠান ও যাজকদের নীতিহীনতা ও স্বার্থপরতা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে। ইতোমধ্যে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় মানবতাবাদী পণ্ডিতরা স্থানীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করলে শিক্ষিত মানুষ বাইবেল পাঠ করে ধর্মের মূল বিশ্বাস জানতে পারে। এর ফলে যাজক শ্রেণীর স্বার্থপরতা, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয় এবং ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ও যাজকদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি ও ঘৃণার সৃষ্টি হয়, যা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে।
  • (২) চার্চের দুর্নীতি : মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপের মানুষ ছিল ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কুসংস্কার (Superstitions), ভণ্ডামি (Frauds), জাঁকজমক ধর্মীয় অনুষ্ঠান (Sacraments) প্রভৃতি চার্চ লালন করত। মানুষের বিপদ ও আত্মার মুক্তির জন্য বিভিন্ন সাধুদের মরণাপন্ন হত। কতক মানুষ ধর্মীয় ভোজের উচ্ছিষ্টকে মসিবত, ব্যাধি, অপশক্তি দূরীভূত করার জন্য ব্যবহার করত। বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তির জন্য বিভিন্ন সাধুর স্মরণাপন্ন হত। যেমন— পোড়া ও পিত্তদোষের জন্য কসমাস এবং ডেমিয়ান, চক্ষুরোগের জন্য সাধু ক্লেরি (Saint Clare) দাঁতের জন্য সাধু এপোলিনের (Saint Apolline) স্মরণাপন্ন হত। গির্জার কোনো ছাদের অংশ পবিত্র ধর্মীয় জিনিস হিসেবে রক্ষিত হত। জনগণের ধর্মীয় এ কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে যাজকরা মানুষকে শোষণ করতে শুরু করে। যাজকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পোপ অর্থ উৎকোচ নিত। পোপ ও বিশপরা রাজাদের মতো জীবনযাপন করত। নিচু স্তরের যাজকরা শুঁড়িখানা, জুয়ার আসর, প্রভৃতিতে জড়িত হত। ক্যাথলিক যাজকদের বিয়ে নিষিদ্ধ থাকলেও তারা গোপনে মিস্ট্রেস বা রক্ষিতা পোষণ করত। পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের আটটি অবৈধ সন্তান ছিল এবং তাদের মধ্যে সাতজন তার পোপপদে নিযুক্তি হওয়ার পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছিল। তিনি নিজ কন্যা লুকরেজিয়ার (Lucrezia) সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক রাখতেন বলে সন্দেহ করা হত। পোপ ও বিশপদের জীবনযাত্রা সম্রাট ও রাজাদের অনুরূপ ছিল।
  • (৩) পোপের দুর্নীতি : পোপ নিয়োগের সময় দুর্নীতির হতো। অনেক ধর্মীয় পদ নিলামে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আয় করত, যাজকরা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সেবার জন্য অর্থ আদায় করত। ধর্মীয় বিধান পালন থেকে অব্যাহতি দিয়ে যাজকরা প্রচুর অর্থ আয় করত। এ ছাড়াও যাজকরা অনেক অসংগত বিষয়কে অর্থের মাধ্যমে সংগত করত। যেমন—নিকট সম্পর্কযুক্ত ভাই-বোনের বিয়ে সংক্রান্ত ফি এক ডুকাট আদায় করত । নিষিদ্ধ সম্পর্কে বিয়ে, যেমন—মামা-ভাগ্নি বা চাচা-ভাইজি বিয়ের জন্য ফি আদায় করত সাধারণ বিয়ের ফি থেকে ত্রিশ গুণ বেশি। মধ্যযুগের রোমান ক্যাথলিক চার্চ পোপের মুক্তিপত্র (Indulgence) বিক্রি করে প্রচুর অর্থ আদায় করত। সাধারণত ক্যাথলিক চার্চ প্রচার করত পোপ যে কোনো মৃত লোকের কৃত পাপের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ পরলোকে মার্জনা দিতে পারেন। ইনডালজেন্স বা মুক্তিপত্রের এ তত্ত্বটি ত্রয়োদশ শতকে ডলাসটিক (পাণ্ডিত্যবাদী) পণ্ডিতদের দ্বারা তৈরি ট্রেজার অব মেরিট (Treasure of Merit) তত্ত্ব দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এ তত্ত্ব অনুযায়ী যিশুখ্রিস্ট ও অন্যান্য সাধুরা পৃথিবীতে তাদের অসাধারণ পুণ্যের দ্বারা স্বর্ণলোকে অনেক দৈবক্ষমতা অর্জন করেছেন। তাদের কাছ থেকে এ দৈব ক্ষমতার কিছু অংশ পোপের উপর আরোপিত হওয়ার ফলে পোপ সেটি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে। প্রথমদিকে ইন্ডালজেন্স অর্থের বিনিময়ে ক্রয়ের বিষয় জড়িত ছিল না। বিভিন্ন সৎকাজ, যেমন— ধর্মীয় উপাসনা, উপবাস, অর্থদান বা ক্রুসেডে যোগদান প্রভৃতির মাধ্যমে কোনো জীবিত ব্যক্তি তার নিজের বা তার মৃত আত্মীয়ের জন্য পোপের মুক্তিপত্র (Indulgence) লাভ করতে পারত। রেনেসাঁসের যুগে বিলাসিতা গির্জায় প্রবেশ করলে পোপরা মাত্রাতিরিক্ত ভোগ্য উপকরণ সংগ্রহ করতে ইন্ডালজেন্স বিক্রি করে অর্থ আয় করতে শুরু করেন। ক্রমে এটি অর্থ উপার্জনের লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। পোপ বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানকে কমিশন প্রদানের মাধ্যমে ইণ্ডালজেন্স বিক্রির জন্য অনুমোদন দিত। যাজকরা মূর্খ লোকদের কাছে ইন্ডালজেন্সকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি পত্র হিসেবে প্রচার করত।

(৪) ধর্মীয় অনাচার : পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকে চার্চের ধর্মযাজকদের অর্থের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।

    • ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পোপের পক্ষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘মহাবিভেদ’ (Great Schism) প্রভৃতি কারণে পোপের ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পায়। এ অবস্থায় ক্যাথলিক চার্চ জাকজমক বৃদ্ধি করে ধর্মীয় ক্ষমতা উদ্ধারের কৌশল গ্রহণ করে। এ জাঁকজমকের প্রকাশ ঘটত চার্চের সৌন্দর্য ও সৌকর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে। এর জন্য বিভিন্ন উপায়ে অর্থসংগ্রহের জন্য সম্পূর্ণ চার্চ সংগঠনকে নিয়োগ করে। পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস ও দশম লিও একটি কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী তৈরি করে এবং তারা সবাই অবৈধ উপার্জনের দ্বারা লাভবান হয়। মানুষের পারলৌকিক কল্যাণের লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তার দ্বারা পৃথিবীর ভোগ-বিলাস আকুণ্ঠভাবে ভোগ করত। রোমে যারা তীর্থদর্শনে আসত তারা পোপ ও তার সহকর্মীদের আধ্যাত্মিক শক্তিতে মোহিত হওয়া অপেক্ষা রোমান চার্চের জাঁকজমক ও বাহ্যিক সৌন্দর্যে বেশি মুগ্ধ হত। এর প্রভাব খ্রিস্টীয় সমাজে পড়েছিল। মূর্খ ও অন্ধবিশ্বাসী মানুষকে ধর্মের নামে ধোঁকা দেওয়া ও তাদের প্রভাবিত করা সহজ ছিল। সেসময় ধর্মীয় তীর্থযাত্রা আনন্দ ভ্রমণে পরিণত হয়েছিল। অনেক উগ্র ও বদ স্বভাবের তরুণরা তীর্থ যাত্রায় এসে মাতলামি ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করত।
    • মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকায় চার্চ এটিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বৃদ্ধি করে। পবিত্র বস্তু প্রদর্শন (Veneration of sacred relice) দ্বারা ধর্মবিশ্বাসীদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করা হত। ইউরোপের প্রত্যেক চার্চই যিশু, মেরি শু সাধু-সন্তদের ব্যবহৃত দ্রব্য সংরক্ষণ করছে বলে দাবি করত। এগুলো প্রদর্শন করে বা স্পর্শ করে অর্থ উপার্জন করত। প্রায় প্রত্যেক বড় বড় চার্চ দাবি করত যে, যিশুকে যে ক্রুশে বিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তার একটি কাষ্ঠখণ্ড ঐ চার্চ সংরক্ষণে রেখেছে। এজন্য ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস এ সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে বলতেন যে, এ সকল কাষ্ঠখণ্ড জোড়া দিলে একটি জাহাজ তৈরি করা যাবে।
    • মধ্যযুগে ইউরোপে সন্ন্যাসীদের বসবাসকে কেন্দ্র করে মঠ গড়ে ওঠে। কালক্রমে এ মঠগুলো প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়। ক্রমে মঠগুলোতে দুর্নীতি ও ভোগ-বিলাস ঢুকে মঠের সন্ন্যাসীদের বিলাসী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ করে তোলে। ফলে মঠগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়।
  • (৫) ধর্ম সংস্কারের আদর্শিক কারণ : খ্রিস্টধর্মের আদর্শগত মতবিরোধ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল। খ্রিস্টজগতে সেন্ট অগাস্টিনের দর্শন এবং সেন্ট একুইনাসের দর্শন একই সাথে প্রবহমান ছিল। সেন্ট অগাস্টিন মানুষের ভাগ্যের পূর্ব নির্ধারিত (Predestination) থাকার মতবাদে বিশ্বাস করতেন। এ মত অনুসারে জগতের সকল ঘটনা ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত এবং ঈশ্বরের অনুকম্পা ছাড়া মানুষের মুক্তির অন্য কোনো হেতু নেই। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রার্থনা এগুলো মূল্যহীন। পাশাপাশি সেন্ট একুইনাসের মত ছিল, গির্জা ও সৎকর্ম মানুষের জন্য ঈশ্বরের অনুকম্পা লাভে মধ্যস্থতা করতে পারে। রেনেসাঁসের যুগে মানুষের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ দেখা দিলে ধর্মক্ষেত্রে চার্চের প্রভাব কমে আসে এবং ধর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়টি শক্তিশালী হয়। অনেক পুরুষ ও মহিলা যারা “ব্ৰেদেন অফ দি কমন লাইফের’ (Brethren of the common life) সদস্য ছিল তারা ব্যক্তিগত চেষ্টায় যিশুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এক নতুন মুক্তির পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করে। এ ধর্মপন্থাকে ডেভোটিও মর্ডানা (Devoti Moderna) বলা হত। তারা বিশ্বাস করত, ব্যক্তিগত দয়া এবং নীতিবোধ ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রধান অংশ এবং মানুষ নিজেদের চেষ্টায় আত্মীক মুক্তি অর্জন করতে পারে। ঈশ্বর মানুষের আত্মার মাধ্যমে কথা বলেন এবং এ বাণী সাধু মানুষের মুখ থেকে শুনে সান্ত্বনা লাভ করে। ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের বিশ্বাসী হওয়া। এ ধরনের ভাবধারা এবং সেন্ট অগাস্টিনের দর্শন মার্টিন ল্যুথার ও অন্যান্য সংস্কারকদের প্রভাবিত করেছিল। তারা ক্যাথলিক চার্চ ও যাজকদের কর্মকাণ্ডকে খ্রিস্টধর্মের বিকৃতরূপ বলে মনে করতেন এবং যাজকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা, কুমারী মেরির উপাসনা, পারগেউরিয়াতে বিশ্বাস, পবিত্র বস্তু দর্শনে পুন্যলাভ, দেবতাদের শুভেচ্ছা আনায়ন ইত্যাদিকে কুসংস্কার বলে অভিহিত করেন।
  • (৬) সমাজতাত্ত্বিক কারণ : মধ্যযুগের শেষে সামন্ততন্ত্রের পতনে ইউরোপের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়। এর ফলে মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে ইউরোপে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। বুর্জোয়া বা ধনী বণিক শ্রেণীর উদ্ভব, নগরায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্পায়ন প্রভৃতির ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ হয়। এ অবস্থায় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনে নতুন ভাবধারার প্রয়োজন দেখা দেয়। ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাস ছিল সামন্ততন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক উপযোগী ভাবধারা। কিন্তু নতুন পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বিকাশের জন্য ক্যাথলিকতন্ত্র প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ ক্যাথলিক ধর্মে সুদপ্রথাকে ঘৃণা এবং ধনকে স্বর্গপ্রাপ্তির প্রতিবন্ধক মনে করা হত। এ অবস্থায় নতুন ভাবধারা হিসেবে সংস্কারকৃত প্রোটেস্ট্যান্টবাদ পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিল।
  • (৭) রাজনৈতিক কারণ : মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে পোপের সাথে রাজাদের ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পোপ ও যাজক শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা দাবি করলে প্রত্যেক দেশের রাজা ও রাজতন্ত্রের সমর্থকগণ নিজ নিজ দেশকে রোমান ধর্মাধিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে রাজা ও পোপের দ্বন্দ্ব প্রত্যেক দেশে জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি করে। ফলে রাজশক্তি ধর্মসংস্কারকদের সমর্থন দিতে শুরু করে। ফলে ধর্মসংস্কার আন্দোলন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়।
  • (৮) অর্থনৈতিক কারণ : ষোড়শ শতকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ক্যাথলিক চার্চ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের খ্রিস্টবিশ্বাসী জনগণের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অর্থসংগ্রহ করত। ধর্মকর, রোমে পোপের আদালতে মামলার আপিল বাবদ অনেক অর্থ রোমে চলে যেত। এ ছাড়াও ইউরোপের জনসাধারণ পোপকে নানারকম ফিউডাল কর, তীর্থ যাত্রার দক্ষিণা এবং যাজকদেরকে Assets, First fruits ইত্যাদি বাবদ পোপকে অর্থ দিতে হত। বিভিন্ন ধর্ম-কর্ম বাবদ অর্থ রোমে চলে যাওয়ায় রাজাদের অর্থের সংকট দেখা দেয়। পোপের অর্থ শোষণ বন্ধ করার জন্য রাজারা ধর্মসংস্কারকদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। মধ্যযুগে ইউরোপে গড়ে উঠা মঠগুলোর প্রচুর ভূমি সম্পদ ছিল। উদাহরণস্বরূপ সে সময়কার জার্মানির এক-তৃতীয়াংশ জমি ছিল চার্চ ও মঠগুলোর দখলে। একইভাবে ফ্রান্সের এক-পঞ্চমাংশ জমি ছিল চার্চ ও মঠগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ইংল্যান্ডেও মঠগুলো নিয়ন্ত্রণে অনেক জমি ছিল। এ সকল জমি দখলের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং রাজশক্তি তৎপর হয় এবং তারা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে সচেষ্ট হয়।
  • (৯) রেনেসাঁসের প্রভাব : ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে রেনেসাঁসের প্রত্যক্ষ ফল বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে যুক্তিবাদ ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার সূচনা করে তা মানুষকে অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে। রেনেসাঁস মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস দূর করে যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাবে মানুষের মন থেকে কুসংস্কার ও অজ্ঞানতা দূর হয়। রেনেসাঁস মানুষকে পোপতন্ত্র ও যাজকদের শিক্ষা ও ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে মানুষকে কৌতূহলী করে। শিক্ষিত, উদার খ্রিস্টানরা বাইবেলের মূল শিক্ষা পাঠ করে বুঝতে পারে যে, গির্জা পরিচালিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও শিক্ষা বাইবেলের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ উপলব্ধি তাদেরকে ধর্মের মূল শিক্ষা জানার জন্য যে প্রেরণা দেয় তা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে।
  • (১০) প্রত্যক্ষ কারণ : ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ১৫১৭ সালে জার্মানিতে পোপের মুক্তিপত্র (Indulgence) বিক্রি। টেটজেল নামক একজন ডোমিনিকান ফ্রায়ার রোমের সেন্ট পিটারের গির্জা সংস্কার ব্যয়ের টাকা সংগ্রহের জন্য জার্মানিতে এসে মুক্তিপত্র বিক্রি শুরু করলে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন ল্যুথার এর চরম প্রতিবাদ করেন। প্রথমে তিনি ধর্মাধিষ্ঠানের অনাচার ও দুর্নীতি দূর করার জন্য আবেদন জানায় কিন্তু পোপ দশম লিও এতে কর্ণপাত না করায় মার্টিন ল্যুথার প্রকাশ্যভাবে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধ ৯৫টি নিবন্ধ (95 Thesis) প্রকাশ করেন। তার এ প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে ১৫১৭ সালে জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

ধর্মসংস্কার আন্দোলন জার্মানিতে শুরু হয়েছিল কেন

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মানি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। জার্মানিতে সে সময় শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অস্ট্রিয়ার সম্রাট ও শাসকরা জার্মানি শাসন করত। জার্মানি অনেকগুলো বিশপরিক এবং ইলেকটরেটে বিভক্ত ছিল। অনেকগুলো রাজ্যের আয়তন ছিল এক বর্গমাইলের চেয়ে ছোট। বড় বড় বিশপ এবং অ্যাবটরা (Abbot) বিশাল বিশাল এলাকার প্রভু ছিলেন। অনেকগুলো নগর ছিল স্বাধীন। মোটের উপর জার্মানি প্রায় চারশ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল।

জার্মানি পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় নগরায়নে পশ্চাৎপদ ছিল। জনগণ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং বিভিন্ন নগরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। জার্মানিতে প্যারিস এবং লন্ডনের ন্যায় কোনো রাজধানী শহর ছিল না, যার মাধ্যমে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। জার্মানির এ বিকেন্দ্রীকরণ বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট রাজ্য বিভিন্ন শাসক কর্তৃক শাসিত হত। কৃষকরা এ সকল শাসক দ্বারা শোষিত হত। আগ্নেয়াস্ত্রের উন্নয়ন এবং সেনাবাহিনীর জন্য এ সকল শাসকরা তাদের ভূমিকা পালন করতে পারত না। উপরন্তু তারা ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত থেকে কৃষক ও নগরগুলোকে শোষণ করত। অনেক অপ্রয়োজনীয় সামন্ত নাইটরা ধনী যাজকদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখায় ধর্মীয় সংস্কার জার্মানিতে হয় নি।

জার্মানির চার্চগুলোর যাজকরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যথা, আর্চ বিশপ ‘অ্যাবট” এবং ফ্রায়াররা ছিল অভিজাতভুক্ত। তারা ছিল রাজপুরুষ অথবা রাজপুরুষদের সামন্ত। তারা ভূমিদাসদের শ্রমের উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করত। দ্বিতীয় শ্ৰেণীভুক্ত ছিল- “সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত স্থায়ী সৈন্য দল (The standing Armly of Monks) এবং নিচু শ্রেণীর যাজকরা। তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ছিল নগর এবং গ্রামের নিচু শ্রেণীর যাজক শ্রেণী। তারা ছিল অল্পশিক্ষিত এবং বেতন ভুক্ত। তারা শ্রমজীবী ও কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। মধ্যযুগের শেষে মঠগুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এগুলো তখন যাজকায়িত (Clericalized) করা হয়। উচ্চ শ্রেণীর যাজকরা সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের সম্পদের চাহিদা ছিল প্রচুর এবং তারা নির্লজ্জভাবে জনগণের কাছ থেকে তাদের জন্য এবং রোমের পোপের প্রয়োজনে অর্থ আদায় করত। নগরের লোকেরা যাজকদের অপ্রয়োজনীয় মনে করত। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার চার্চের একচেটিয়া শিক্ষার কর্তৃত্বও সুযোগ নষ্ট করে। সমাজে আইনবিদ এবং ধর্মীয় আইনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের উদ্ভব যাজকদের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।

জার্মানিতে সামাজিক ক্ষেত্রে অভিজাতরা সরকারি অফিসে মর্যাদাপূর্ণ পদ দখল, করধার্য এবং সরকারি সুবিধা ভোগ করত। মধ্যবিত্ত শ্রেণী নগরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত এবং তারা যাজকদের সুবিধাগুলো বিলুপ্ত করেন। সমাজের নিচু শ্রেণীতে অবস্থানকারী কৃষকরা ছিলেন, সম্পদহীন ও বেকার। জার্মানির এ অবস্থায় রেনেসাঁস কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। জনগোষ্ঠী ছিল ধার্মিক। এ অবস্থায় মার্টিন ল্যুথার জাতীয় মুক্তিদাতা হিসেবে জার্মানি থেকে বিদেশী পোপের অর্থ শোষণ বন্ধ এবং বিদেশী স্পেনের সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও পোপের শাসনমুক্ত করার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। অভিজাতরা চার্চের সম্পদ লাভ; কৃষকরা সামন্ত শোষণ থেকে মুক্তি এবং শাসকরা চার্চকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ খুঁজে পায় মার্টিন ল্যুথারের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে। এ ছাড়া জার্মানির বণিক ও ব্যাংকার শ্রেণী প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের মধ্যে পুঁজিবাদের সুরক্ষা খুঁজে পায়। তাই জার্মানির সকল শ্রেণীর মানুষ ক্যাথলিক ধর্মের বিবদ্ধে মার্টিন ল্যুথারের ধর্মমতকে সমর্থন করে।

মার্টিন ল্যুথার ও  তার সংগ্রাম

মার্টিন ল্যুথার (১৪৮৩-১৫৪৬): ষোড়শ শতকে ইউরোপে যে, ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রধান প্রাণপুরুষ (প্রধান নায়ক) ছিলেন মার্টিন ল্যুথার। মার্টিন ল্যুথার ১৪৮৩ সালে ১০ নভেম্বর জার্মানির থুরিনজিয়া (Thuringia) নামক স্থানের অন্তর্গত আইজলবেন (Eisleben) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর সেন্টমার্টিনস ডে-তে এ সাধুর নাম অনুসারে তার নামকরণ করা হয় মার্টিন ল্যুথার। মার্টিন ল্যুথারের পিতার নাম ছিল হ্যান্স ল্যুথার ও মাতার নাম ছিল মার্গারেট। কৃষক পরিবারে জন্ম হওয়ায় কৃষকসুলভ গোঁড়ামি ও সরলতা তার চরিত্রে দেখা দিয়েছিল। মার্টিন ল্যুথারের পিতা ১৪৪৪ সালে থুরিনজিয়া থেকে ম্যানসফিল্ড শহরে এসে লৌহ ও কয়লার খনির ইজারার ব্যবসা করে প্রচুর অর্থের মালিক হন। তার সুনামের জন্য তাকে ম্যানসফিল্ড শহরে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব নেওয়া হয়। হ্যান্স ল্যুথার তার পুত্র মার্টিন লুথারকে ভালো স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। চৌদ্দ বছর বয়সে শিক্ষার জন্য ম্যাগডেবার্গের চার্চ স্কুলে ভর্তি করা হলে সেখানকার ‘ব্রিদেন অব দি কমন লাইফের’ সদস্যরা তাকে শিক্ষাদান করেছিলেন। শিশুকাল থেকেই বাল্যকাল পর্যন্ত মার্টিন ল্যুথার ক্যাথলিক ভাবধারায় শিক্ষিত হন।

হ্যান্স ল্যুথার তার পুত্র মার্টিন ল্যুথারকে আইন শিক্ষা লাভের জন্য ১৫০১ সালে এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্টিন ল্যুথার স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৫০৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিতার ইচ্ছানুসারে আইনের উপর ডিগ্রি লাভের জন্য ১৫০৫ সালে আইন অনুষদে ভর্তি হন। কিন্তু ধর্মের প্রতি অধিক আগ্রহ তাকে আইন বিষয়ের চাইতে ধর্ম শিক্ষার (Theology) প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশি। ইতোমধ্যে একটি ঘটনা তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পরিবর্তন করে দেয়। ১৫০৫ সালে ২ জুলাই বাড়ি থেকে এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে বজ্রাহত হয়ে মাটিতে পড়ে ভীত হন এবং তিনি সেন্ট অ্যান এর (Saint Anne) নিকট প্রার্থনা করে বলেন যে, তাকে সাহায্য করলে এবং সুস্থ্য হলে মঠের সন্ন্যাসী হবেন। বজ্রাহত থেকে সুস্থ হয়ে মার্টিন ল্যুথার এরফোর্ট মঠে অগাস্টাইন ভ্রাতৃসংঘে যোগদান করেন।

মঠ জীবনে আত্মার মুক্তি বা আত্মার শান্তিলাভের বিষয়টি তার নিকট প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় তিনি আত্মার শান্তির জন্য কৃচ্ছ্রতা সাধন, প্রার্থনা সবই একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করলেও আত্মার শান্তি লাভ করেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বিবেকের অন্তর্দাহের সময় অপশক্তি বা শয়তানকে সত্যিকারভাবে দেখেছেন। এরপর তিনি একজন আদর্শ খ্রিস্টান হিসেবে অধ্যয়ন ও প্রার্থনায় অধিকতর মনোযোগী হন। এ সময় পর্যন্ত তিনি বিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি সত্যিকার মুক্তি লাভ করতে পারবেন না। এমনকি চার্চের আশীর্বাদ ও ভালো কাজ তার মনে কোনো শান্তি দিতে পারে নি। এরপর তিনি বাইবেল পড়ে বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বর বিশ্বাসে আত্মার মুক্তি হয়। “Just shall live by his faith” (Rom. 1:17).

ল্যুথারের পূর্ববর্তী ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান প্রচার করত যে, গির্জা মানুষের আত্মার মুক্তির পথ দেখাতে পারে। কিন্তু মার্টিন ল্যুথার সেন্ট অগাস্টিনের বিশ্বাস গ্রহণ করে প্রচার করেন যে, ঈশ্বরের একান্ত বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের বিশ্বাস ও করুণা মুক্তির একমাত্র পথ। ল্যুথার প্রচার করতে থাকেন যে, ঈশ্বর পাপীকে রক্ষা করবেন যদি কোনো খ্রিস্ট বিশ্বাসী বিনয়ের সাথে ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ করে পাপের জন্য অনুশোচনা করে। ঈশ্বর-এর নিকট আত্মসমর্পণ করায় ঈশ্বরের অনুকম্পার বদৌলতে বিশ্বাসীর নতুন জন্ম হবে এবং তার বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। ঈশ্বরের আন্তরিক বিশ্বাস বিশ্বাসীকে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে ও ভালো কাজ করতে শক্তি জোগায়। ১৫১৫ সালে উইটেনবার্গ নগরের গির্জায় ধর্মীয় বক্তৃতা প্রচারের সময় তিনি আত্মার মুক্তির বিষয়টি মানুষের নিকট সুন্দরভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি খ্রিষ্টান জীবনের সংস্কারের বিষয়টিও তুলে ধরেন। যিশুখ্রিস্ট আত্মবলিদানের মাধ্যমে খ্রিষ্টজীবনের আদর্শ সকল যুগের সকল মানুষের নিকট রেখে গেছেন। সুতরাং মানুষের মুক্তির জন্য অন্য কারো উপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। মার্টিন ল্যুথারের বিশ্বাসের এ ব্যাখ্যাকে বলা হয় “justification by faith”। মার্টিন ল্যুথার রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিপরীতে দেখাতে চেয়েছিলেন যে, মানুষ ও তার ঐহিক জীবনকে মূলতই পাপাত্মক বলে ভাবা অনুচিত। মানুষ ও ঈশ্বরের ভেতর গির্জা ও যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা, তথা ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে লোকদের ‘পাপস্খালন’ ও ‘আত্মা পরিত্রাণের’ অধিকার তিনি অস্বীকার করেছিলেন। ল্যুথারের বক্তব্য ছিল, মানুষ ‘ত্রাণ’ বা ‘মোক্ষ’ পায় গির্জা ও তার আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়, ‘বিশ্বাসে’, যা ঈশ্বরই তাকে দেন। এ বক্তব্যের মাধ্যমে যাজক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জগতে আধিপত্য করার দাবিই শুধু তিনি অস্বীকার করেন নি, গির্জার রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শীয় নিগড় থেকে বার্গার (পুঁজিপতি বণিক শ্রেণী) সম্প্রদায়ের মুক্তির প্রয়াস, জাগতিক প্রতিষ্ঠানাদি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছিলেন।

পোপের ফতোয়া, বাণী, ক্যাথিড্রালের নির্দেশাদির বদলে তিনি পবিত্র বাইবেলের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ১৫১০ সালে মার্টিন ল্যুথার রোম ভ্রমণে গিয়ে পোপতন্ত্রের দুর্নীতি এবং অনাচার নিজ চোখে অবলোকন করে মনে ব্যথা পান। এরপর তিনি নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসে সেন্ট অগাস্টিনের উপর অন্যান্য ধর্মীয় অতিন্দ্রীয় বিষয় অধ্যয়ন করে উপলব্ধি করেন যে, আত্মার মুক্তির বিষয়টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তপঃজল এবং তীর্থযাত্রার উপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে একনিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসের উপর। ইতোমধ্যে তিনি স্যাকসনের রাজধানীতে অবস্থিত উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এ সময় থেকে তার মনপ্রাণে এ সকল ধর্মীয় প্রশ্ন কাজ করেছিল। এ সময় ইন্ডালজেন্স (Indulgence)  বিক্রিকে কেন্দ্র করে তুমুল ধর্মীয় বিতর্ক শুরু করেন।

মার্টিন ল্যুথার যখন উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তখন ১৫১৭ সালে জন টেটজেল (John Tetzel) নামে একজন ডোমেনিকান সন্ন্যাসী জার্মানিতে পোপের করুণা-দানপত্র (ইন্ডালজেন্স) বিক্রি করতে জার্মানিতে আসেন। ব্র্যান্ডেনবার্গের হোহেনজোলার্ন বংশের ইলেক্টরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এলবার্ট ১৫১৩ সালে ম্যাগডেবার্গ (Magdeburg) এবং হলবেরস্টার্ড (Halberstadt) বিশপরিকসের বিশপপদ লাভের জন্য রোমের পোপ দশম লিওকে প্রচুর টাকা উৎকোচ দিয়েছিলেন, কারণ সে সময় এলবার্টের বয়স ২৩ বছর থাকায় বিশপ পদের যোগ্য ছিলেন না। এর পরের বছর ১৫১৪ সালে মেনজের (Mainz) বিশপপদ শূন্য হলে এলবার্ট মেনজের আর্চ বিশপ পদ লাভের জন্য রোমে প্রচুর টাকা দেন। এ প্রচুর টাকা সংগ্রহের জন্য এলবার্ট জার্মানির ফুগার (Fugger) ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নেন। এ সময় তিনি পোপ দশম লিওয়ের সাথে আট বছরের একটি চুক্তি করেন। পোপ লিও এলবার্টের ধর্মশাসিত অঞ্চলে ইন্ডালজেন্স বিক্রির ঘোষণা দেন। ইন্ডালজেন্স বিক্রির টাকার অর্ধেক রোমের সেন্ট পিটারের গির্জা স্থাপনের ব্যয় হবে এবং বাকি অর্ধেক টাকা এলবার্ট কর্তৃক ফুগার (Fugger) ব্যাংকের দেনা পরিশোধ হবে। মার্টিন ল্যুথার এলবার্টের সাথে পোপের চুক্তি বিষয়টি জানতেন না। তবে তিনি জানতেন যে, টেটজেল অতি শীঘ্র জার্মানিতে এসে ফুগার ব্যাংকে এজেন্ট সাথে নিয়ে ইনডালজেন্স বিক্রি করবেন এবং তা ক্রয় করার জন্য মানুষদেরকে প্রভাবিত করবেন স্বর্গের টিকিট সংগ্রহের জন্য।

ইভালজেন্সের বিশ্বাস এবং তার প্রয়োগ : ইন্ডালজেন্স চার্চের শিক্ষা থেকে উদ্ভুত যা পাপের প্রায়শ্চিত্ত ক্ষেত্রে পাপের ক্ষমার সনদ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এক্ষেত্রে (১) অনুতাপ (Contrition) এবং (২) যথাযথ শাস্তি ( Substantil punishment) এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুতাপ ছিল পাপ ক্ষমার পূর্বশর্ত। কিন্তু অচিরেই যথাযথ শাস্তির পরিবর্তে গির্জার পবিত্র উদ্দেশ্যেই অর্থ প্রদান শুরু হয়। যে পত্রে (কাগজে) পাপমোচনের সনদ দেওয়া হত তাকে ইন্ডালজেন্স (Indulgence) বলা হত। পোপের ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবস্থার অর্থ উপার্জনের একটি প্রধান খাত হিসেবে ইন্ডালজেন্স ব্যবহৃত হতে থাকে। রেনেসাঁসের সময়কালে পোপরা অসংগতভাবে এজেন্ট বা ফেরিঅলা নিয়োগ করে ইন্ডালজেন্স বিক্রি করত। জন টেটজেল ছিল এরকম ফেরিঅলা। ডোমিনিক সন্নাসী টেটজেল ইন্দালজেন্স বিক্রি করার জন্য জার্মানির জুটারবগে (Juterbog) পৌঁছেন। স্যাকসনিতে সেখানকার ইলেক্টর ফ্রেডারিক তার রাজ্যে ইন্ডালজেন্স বিক্রি নিষিদ্ধ করলে টেটজেল স্যাকসনির নিকটবর্তী জারবস্ট (Zerbst) এবং জুটারবগে (Juterbog) এসে ইন্ডালজেন্স বিক্রি শুরু করেন, যাতে স্যাকসনির খ্রিস্টানরা সেখান থেকে ইন্ডালজেন্স ক্রয় করতে পারে।

ধর্মের নামে এরূপ প্রতারণা মার্টিন ল্যুথার সহ্য করতে পারেন নি। ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের প্রধান পোপ কর্তৃক ইন্ডালজেন্স বিক্রি করাকে অন্যায় ও অধর্ম বলে তিনি ৯৫ দফা যুক্তিসংবলিত একটি প্রতিবাদপত্র তখনকার রীতি অনুসারে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে দেন। তিনি ৯৫ দফা সংবলিত কয়েকটি অভিমতে পোপের সমালোচনা করেন। ৯৫ দফা প্রতিবাদপত্রগুলো ল্যাটিন ভাষায় লেখা হয়েছিল। কিন্তু তার সমর্থকগণ এগুলো জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে বিলি করে। অবশ্য মার্টিন ল্যুথার জার্মানিতে ইন্ডালজেন্স বিক্রির সময় পোপের প্রতিনিধিদের ধর্মহীন আচরণের অভিযোগসহ থিসিসগুলোর আলাদা আলাদা কপি তিনি পাঠিয়েছিলেন ব্রান্ডেনবুর্গ ও মাইনটসের বিশপের কাছে। ল্যুথারের থিসিসগুলোতে প্রকাশ পায় বিভিন্ন শ্রেণীর, যেমন—শাসক সম্প্রদায়, নগরবাসী, সরকারি কর্মচারীদের একাংশ এবং দরিদ্র যাজকদের অসন্তোষ। মার্টিন ল্যুথারের এ প্রতিবাদে জার্মানিতে ইন্ডালজেন্স বিক্রির ভাটা পড়ে।

পোপের সাথে মার্টিন ল্যুথারের দ্বন্দ্ব : ল্যুথারের কর্মকাণ্ডে পোপ দশম লিও ক্ষুব্ধ হয়ে মার্টিন ল্যুথারকে রোমে তলব করেন। ল্যুথার পোপ দশম লিওকে একটি পত্রে জানান যে, ধর্মশাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে ধর্মবিষয়ে আলোচনা করার অধিকার তার আছে। ইতোমধ্যে ডোমিনিকান সম্প্রদায় ধর্মদ্রোহী সন্দেহে ল্যুথারকে ৬০ দিনের মধ্যে রোমে হাজির করার জন্য পোপকে রাজি করান। ১৫১৮ সালে ৭ আগস্ট মার্টিন ল্যুথার পোপের কাছ থেকে সমন পান। এ অবস্থায় মার্টিন ল্যুথার তার পৃষ্ঠপোষক স্যাকসনির ইলেক্টর ফ্রেডারিককে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য আবেদন করেন। ফ্রেডারিক পোপকে প্রতিনিধি পাঠাতে রাজি করান। পোপের প্রতিনিধি কাজেটান অগসবার্গে আসেন। কাজেটানের সাথে সাক্ষাৎ করে মার্টিন ল্যুথার তার মতের স্বপক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন। কাজেটান পোপের নিকট এক পত্রে ল্যুথারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানান। পোপ এক পত্রে মার্টিন ল্যুথারকে শয়তান, ধর্মদ্রোহী হিসেবে অভিহিত করে কাজেটানকে পত্র দেন। ল্যুথার এ পত্রের অনুলিপি স্বচক্ষে দেখে সে বিষয়টি স্যাকসনির ইলেক্টর ফ্রেডারিককে অবহিত করেন। মার্টিন ল্যুথার পোপকে অ্যান্টিক্রাইস্ট-খ্রিষ্টশত্রু হিসেবে উল্লেখ করেন।

এ অবস্থায় ১৫১৯ সালে লিপজিগে এক ধর্মবিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পোপের প্রতিনিধি ড. জন এক (Dr. John Eck) বিতর্কে মার্টিন ল্যুথারকে যুক্তিবানে জর্জরিত করেন। এ বিতর্কে মার্টিন ল্যুথার পোপের কর্তৃত্ব এবং ধর্মসভার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বাইবেলের কর্তৃত্ব তুলে ধরেন। তিনি বিতর্কে নিজমত উত্থাপন করে বলেন যে, গির্জার মধ্যস্থতা ব্যতীত খ্রিস্টবিশ্বাসী ঈশ্বরের সাথে সরাসরি আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এ পর্যায়ে তিনি রোমান চার্চের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।

রোমান ধর্মাধিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে পোপ এবং রোমান ধর্মাধিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা লেখেন। যথা-

  • (১) ‘জার্মান জাতির খ্রিস্টান অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতি’ নিবেদন। (An Address to the Nobility of the German Nation) পুস্তিকায় –
    • পোপের আত্মিক শক্তির এবং খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের পবিত্রতা অস্বীকার করেন এবং পবিত্র ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যায় একমাত্র পোপের অধিকারকে বাইবেল বিরোধী বলে অভিহিত করেন। যাজকপদে নিয়োগ বা অপসারণ হওয়া উচিত সমাজের ইচ্ছায় এবং তারা হবে ঐহিক ক্ষমতার অধীন।
    • পোপের ঐহিক দাবিকে সীমিত করা, কার্ডিনালদের সংখ্যা হ্রাস করার প্রস্তাব করেন তিনি, যাজকদের কৌমার্যব্রতকে তিনি পৈশাচিক অত্যাচার বলে তাতে আপত্তি করেন।
    • তিনি জার্মান শাসকদেরকে বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানান।
    • তিনি গির্জার সম্পদের দিকে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
  • (২) গির্জার ব্যাবিলোনীয় বন্দিত্ব’ (On the Babylolian Captivity of the Church of God) পুস্তিকায় পোপ এবং গোটা রোমক ক্যাথলিক চার্চের নিন্দা করেন। ধর্মের ব্যাপারে পোপের ও ক্যাথিড্রালের (গির্জার) অত্যন্ত কর্তৃত্ব, তথা তার আইন প্রদানের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
  • (৩) তৃতীয় পুস্তিকায় ‘খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী স্বাধীনতা’ (On the Freedom of a Christian Man)-তে মার্টিন ল্যুথার তার ধর্মমতের মূল বক্তব্য তুলে ধরে বলেন যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ভালো কাজ আত্মার মুক্তি বা উন্নতির কোনো লক্ষস্থল নয়। এটি মানুষের একটি প্রচেষ্টা যা মানুষ হতাশা থেকে করে এবং ঈশ্বরের অঙ্গীকারের উপর নিজকে সমর্পণ করে। ল্যুথারের মতে যারা বলে যে, বাক্সে টাকা ঝনঝনালেই প্রায়শ্চিত্তালয় থেকে আত্মা উদ্ধার পাবে, এভাবে তারা ভুল প্রচার করে। ল্যুথার মনে করতেন যে, ঈশ্বরের সঙ্গে পাপীর মিটমাট হয় অন্তরের অনুশোচনায়, লোকের আত্মিক পুনর্জন্মের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায়। সেটি তিনি বলেছেন ৩৬তম থিসিসে: ‘যে সত্যি করেই অনুশোচনা করেছে, কৃত পাপের জন্য মনস্তাপে ভুগছে এমন প্রতিটি খ্রিস্টানই পোপের পাপমোচন ছাড়াই ক্ষমা লাভ করবে।

মার্টিন ল্যুথার ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের অনেক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন। ক্যাথলিকদের ট্রানসাবস্টেনশিয়েশন (Transubstantiation) বা রুটি ও মদ প্রার্থনার পর খ্রিস্টের মাংস ও রক্তে পরিণত হয়—এ বিশ্বাস তিনি অস্বীকার করেন। মার্টিন ল্যুথারের এসকল ক্যাথলিক ধর্মীয় বিরোধী ভাবধারা বা অধার্মিক কার্যকলাপের জন্য পোপ তাকে সমাজচ্যুত করার (ধর্মাধিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার বা এক্সকমিউনিকেট করার) সিদ্ধান্ত নেন। এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন একটি পেপাল ডিক্রি জারি করে তাতে ধর্মীয় কাউন্সিল ও পোপ কর্তৃক ব্যাখ্যাত বাইবেলের ধর্মতত্ত্বের বিপরীত ধর্মীয় ব্যাখ্যা আবিষ্কারের জন্য ল্যুথারের নিন্দা করা হয় এবং ৬০ দিনের মধ্যে তাকে এসকল মত ত্যাগ করতে বলা হয়, নতুবা তাকে সমাজচ্যুত করা হবে। ল্যুথার পোপের নিকট নতি স্বীকার না করায় পোপ ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি আর একটি ডিক্রি জারি করে ল্যুথারকে সমাজচ্যুত করেন। মার্টিন ল্যুথার পোপকে বাইবেলের দ্বিতীয় অংশের খ্রিস্টান-বিরোধী ব্যক্তি যে সেই গির্জার অধিপতি যা “ডাকাতীদের সবচেয়ে অনুশাসনহীন আখড়া, সবচেয়ে লজ্জাহীন বারবনিতালয় এবং পাপ, মৃত্যু ও নরকের রাজ্য”-তে পরিণত হয় বলে বর্ণনা করেন। মার্টিন ল্যুথার ও তাকে সমাজচ্যুত করার পোপের ঘোষণা (Popal bull) বা Exsurge domine-এর একটি কপি তার সমর্থকদের সম্মুখে অগ্নিতে জ্বালিয়ে দেন।

ওয়ার্মসের সভা (১৫২১ সালে): মার্টিন ল্যুথার জার্মানিতে তার ধর্মমত প্রচার শুরু করলে অনেক রাজপুরুষ, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ তার মতাদর্শে আকৃষ্ট হতে থাকে। এসময় পোপ দশম লিও ল্যুথারের রাজসমর্থকদের শক্তি উপলব্ধি করে পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসকে ল্যুথারের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করে। জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ প্রসার ঘটলে পবিত্র রোমান সম্রাটের প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় সম্রাট পঞ্চম চার্লস ওয়ার্মস নামক স্থানে এক আলোচনার জন্য ওয়ার্মস অধিবেশন আহ্বান করেন। পঞ্চম চার্লস মার্টিন ল্যুথারকে ওয়ার্মসের আলোচনা সভায় হাজির হওয়ার জন্য নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। এ প্রেক্ষিতে মার্টিন ল্যুথার তার সমর্থকদের বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও ওয়ার্মসের অধিবেশনে যোগ দেন। যাজকদের কাউন্সিল, পবিত্র রোমান সম্রাট এবং জার্মান ডায়েটের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সামনে মার্টিন ল্যুথার উপস্থিত হন। ১৫২১ সালে ১৭-১৮ এপ্রিল ওয়ার্মসের অধিবেশন চলে। প্রথমেই রোমান সম্রাট ল্যুথারকে তার মতবাদ ত্যাগ করতে বলেন। ১৭ এপ্রিল বুধবার বিকালে ল্যুথার সেখানে তার বক্তব্য পেশ করেন। ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ল্যথার সম্রাটকে জানান যে, বাইবেলের উপর ভিত্তি করে কেউ যদি যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তার মত ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করতে পারে তা হলে তিনি নিশ্চয় নিজ মতবাদ ত্যাগ করবেন। তিনি আরো বলেন যে, কাউন্সিল অথবা পোপের সিদ্ধান্তে তিনি বিশ্বাস করেন না। কারণ তারা ভুল করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়ে থাকে। মার্টিন ল্যুথার ল্যাটিন এবং জার্মান ভাষায় তার বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সম্রাট তার বক্তব্যে বিরক্ত হয়ে সভা ত্যাগ করেন। ল্যুথার সভা থেকে বের হয়ে তার জন্য অপেক্ষারত তার সমর্থকদের বীরোচিত জয়সূচক চিহ্ন প্রদর্শন করে স্যাকসনিতে ফিরে আসেন। ল্যুথারের আচরণকে সম্রাট ও কাউন্সিল ধর্মদ্রোহী বলে তাকে আইন বহির্ভূত (Outlow) ঘোষণা করেন এবং তার প্রচারিত বই-পুস্তক জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। একজন আউটলকে যে কেউ হত্যা করতে পারে। ল্যুথারের জীবন আইনত বাজেয়াপ্ত হলে স্যাকসনির ইলেক্টর তাকে ওয়ার্টবার্গ দুর্গে লুকিয়ে রাখেন। ওয়ার্টবার্গ দুর্গে আত্মগোপন কালে মার্টিন ল্যুথার জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। জার্মানিতে তিনি তার ধর্মপ্রচার চালাতে থাকেন।

মার্টিন ল্যুথারের বিরুদ্ধে সম্রাট পঞ্চম চার্লসের গৃহীত পদক্ষেপ : ওয়ার্মসের সভায় ল্যুথারের বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নে সম্রাট পঞ্চম চার্লস সুযোগ পান নি। কারণ ইতালিতে আধিপত্য নিয়ে ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিসের সাথে পঞ্চম চালসের যুদ্ধ দেখা দেয়। তার সেনাবাহিনীতে ল্যুথার সমর্থক সৈন্য এবং জার্মানির অনেক রাজশক্তি ল্যুথারের সমর্থক থাকায় পঞ্চম চার্লস ল্যুথারের বিরুদ্ধে ওয়ার্মসের সভার সিদ্ধান্তগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত রাখেন। জার্মানির ক্যাথলিক সমর্থক রাজশক্তিগুলো ল্যুথারের বিরুদ্ধে শক্তি প্রযোগ করতে আগ্রহী হয় নি। এ ছাড়া পঞ্চম চার্লস স্পেন, আমেরিকা, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন সমস্যায় জড়িত হলে তার পক্ষে ল্যুথারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব ছিল না। এ সকল কারণে ল্যুথারবাদ কোনোরকম প্রতিরোধের সম্মুখীন না হওয়ায় জার্মানি ও উত্তর ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে।

জার্মানিতে ল্যুথারপন্থিদের উগ্রতা : ল্যুথারের প্রচারিত ধর্মমত জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় পরিণত হয়। অনেক উগ্র ল্যুথারপন্থী ধর্মান্ধতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানিতে বিভিন্ন গির্জায় রক্ষিত যিশু ও সাধুসন্তদের প্রতিকৃতি ভাঙতে শুরু করে। লুথারপন্থী এ উগ্রপন্থিদের কর্মকাণ্ডে মার্টিন ল্যুথার ন্যুধার তার ধর্মের ভবিষ্যৎ বিপদ অনুধাবন করে এসকল উগ্রপন্থিদের দমনের জন্য তিনি তার সমর্থকদের নির্দেশ দেন। লুথারের নির্দেশে ল্যুথারের অনুগত বিশ্বাসীরা এসকল উগ্রপন্থিদের স্যাকসনি থেকে বহিষ্কার করেন।

জার্মানিতে অভিজাতদের যুদ্ধ : মার্টিন ল্যুথারের মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে জার্মানির বিভিন্ন নাইট এবং ছোট সামন্ত অধিপতিরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য এবং জার্মানির রাজপুরুষদের ক্রমবর্ধমান স্বৈরক্ষমতা হ্রাস করার জন্য বিদ্রোহ করে। তবে জার্মানির শক্তিমান রাজপুরুষরা এসকল বিদ্রোহ দমন করে নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম রাখেন।

জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ : মার্টিন লুথারের ধর্মমত জার্মানিতে প্রচারিত হলে সেখানকার ভূমিদাস, দরিদ্র কৃষক ও কারিগররা লুথারবাদে আকৃষ্ট হয়। কারণ বাইবেলকে ভিত্তি করে মার্টিন ল্যুথার প্রচার করেছিলেন যে, ঈশ্বরের নিকট সকল মানুষই সমান। ল্যুথার কৃষকদেরকে ক্যাথলিক গির্জার সম্পত্তি দখল এবং যাজকদের আঘাত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কৃষকরা সে সময় ধর্মীয় উন্মাদনায় উৎসাহিত হয়ে সামন্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তারা ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি, মৎস্য ও পশুশিকারের অধিকার, নগদ অর্থে শ্রমের মূল্য প্রদান এবং সামন্তদের স্বেচ্ছাচারী বিচার ব্যবস্থার অবসান দাবি করেন। যতদিন কৃষকরা ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন ততদিন মার্টিন লুথার তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু ১৫২৪ সালে কৃষকবিদ্রোহ মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানিতে প্রকট আকার ধারণ করে। কৃষকরা সামন্তপ্রভু ও অভিজাতদের হত্যা করতে শুরু করলে অভিজাত ভূ-স্বামীরা কৃষকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৫২৫ সালে কৃষকরা ১২ দফায় নিজেদের দাবি সূত্রবদ্ধ করে মার্টিন ল্যুথারের সমর্থন লাভের চেষ্টা করলে ল্যুথারের তা পুরোপুরি নাচক করে দেন। যেমন—

দশমিকা, অর্থাৎ গির্জা ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রতিপালনে আয়ের দশমাংশ আদায় তুলে দেওয়ার যে দাবি কৃষকরা করে, সে প্রসঙ্গে ল্যুথার মন্তব্য করেন : “অধিকার বলেই দশমিকা তাদের প্রাপ্য’ আর ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদের দাবি তিনি নাকচ করে দেন এই বলে : ‘আব্রাহামেরও দাস ছিল’। মৃগয়া ও মৎস্য শিকারের সুবিধা, বন ব্যবহারের অধিকার, বিচার ব্যবস্থার শৃঙ্খলা, ভালো আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ল্যুথারের ধারণা যে, এগুলো আইনজীবীদের ব্যাপার, তার নয়। মার্টিন ল্যুথারের মতবাদ বিশ্বাস করে কৃষকরা দাবি করেছিল, শুধু গির্জার ব্যাপারে নয়, সামাজিক জীবনেও আদি খ্রিস্টাচারের প্রত্যাবর্তন চেয়েছিল তারা। তাদের মতে, পীড়ন ও দাসত্বের যে অবস্থায় তারা রয়েছে, সেটা বাইবেলের শিক্ষার সাথে খাপ খায় না। সে কারণে কৃষকরা নিজেদের প্রভুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কৃষকদের নেতা টসিভক্বাউয়ের ধর্মপ্রচারক টমাস মুনটসার ধর্মীয় আবরণে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বলপূর্বক উচ্ছেদ করে এমন সমাজব্যবস্থার প্রচার করেছিলেন যাতে কোনো খ্রিস্টানেরই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অধিকার না থাকে। অন্যদের উপর খ্রিস্টানদের ক্ষমতা ও জবরদস্তি, কোনো একটি সরকারি পদের অধিকার বা উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা লাভের বিরোধিতা করতেন তিনি। তার মতে, মানুষ যেহেতু সবাই ঈশ্বরের চোখে সমান, তাই অনুরূপ সমাজ পৃথিবীতে খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

কিন্তু পোপতন্ত্র ও সম্রাটের বিরুদ্ধে জার্মানির রাজন্যবর্গের সাহায্য ও সমর্থন মার্টিন ল্যুথারের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাজন্যবর্গ অভিজাতদের সমর্থন করেন। এ অবস্থায় ল্যুথার বাইবেলকে ভিত্তি করে প্রচার করেন নম্রতা ও ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার নিকট অন্ধ আনুগত্যের মতবাদ : “সরকারের উচিত ইতরজনের উপর, সমস্ত লোকের উপর প্রভুত্ব করা, তাদের প্রহার, দলন, ফাঁসি দান, অগ্নিদগ্ধ, মুণ্ডচ্ছেদ, চক্রপিস্ট করতে হবে, যাতে লোকে সরকারকে ভয় করে, জনগণকে তাদের অধীনে রাখতে পারে। মার্টিন ল্যুথার কৃষক বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রচনা করেন “ঘাতক এবং তন্ত্রর কৃষক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে” (‘এগেইনস্ট দ্য মার্ডারস অ্যান্ড থিবিং হোর্ডস অব পেজেন্টস্’) (১৫২৫)। এতে উল্লেখ করেন, “যে যেখানে পারো বিদ্রোহী কৃষকদের প্রকাশ্যে বা গোপনে আক্রমণ বা নিধন কর, কেননা বিদ্রোহের চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না…এটা করতে হবে দেশের স্বার্থে।”

মার্টিন ল্যুথার বিদ্রোহে প্ররোচনাকারী টমাস মুনটসারকে শয়তানের হাতিয়ার বলে অভিহিত করে রাজন্যবর্গকে আহ্বান করেন, দেশ থেকে হাঙ্গামার প্ররোচকদের বহিষ্কার করার জন্য। ধর্মনেতা ল্যুথারের সমর্থন পেয়ে শাসকশ্রেণী প্রায় আট হাজার কৃষকের রক্তে ভিজিয়ে দেয় জার্মানির মাটি। এভাবে নিষ্ঠুর পন্থায় কৃষক বিদ্রোহ দমন করা হয়। ফলে ল্যুথারবাদ দক্ষিণ জার্মানিতে অনেকটা জনপ্রিয়তা হারায়। ল্যুথারবাদ নিপীড়িত মানুষের নিকট রক্ষণশীল মতবাদ হিসেবে পরিগণিত হয়। কৃষক বিদ্রোহের পর জার্মানিতে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য সম্রাট পঞ্চম চার্লস ১৫২৬ সালে স্পিয়ার নামক স্থানে ডায়েটের দ্বিতীয় সভা আহ্বান করেন। ডায়েটের সদস্য জার্মান শাসকরা ল্যুথারপন্থি এবং ক্যাথলিকপন্থি এ দুভাগে বিভক্ত ছিল। ফলে সম্রাটের পক্ষে ল্যুথারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুযোগ হয়নি। ল্যুথারবাদে বিশ্বাসী ডায়েটের সদস্যরা তাদের মৌলিক ধর্মবিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। তারা একটি অস্পষ্ট ঘোষণা গ্রহণ করেন, তাতে বরা হয় যে, “প্রত্যেক শাসক এমনভাবে দেশ শাসন করবেন যাতে প্রত্যেকেই তাদের কাজের জন্য ঈশ্বর ও সম্রাটের কাছে জবাবদিহি করতে পারে।” কিন্তু ১৫২৯ সালে স্পিয়ারে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ডায়েটের সভায় সম্রাট পঞ্চম চার্লস ঘোষণা করেন যে, ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইন কার্যকর করতে হবে এবং প্রচলিত ধর্মকর নতুন ধর্মের জন্য ব্যয় করা যাবে না। ল্যুথারপন্থি শাসকরা এ অবস্থায় একটি আইনগত প্রতিবাদপত্র তৈরি করেন। তাতে ঘোষণা করা হয় যে, তারা ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের স্পিয়ারের ডায়েটের ঘোষিত আইন মান্য করতে বাধ্য নয়। এ প্রতিবাদ থেকে প্রোটেস্ট্যান্ট নামের উৎপত্তি হয়।

অগ্সবার্গের স্বীকারোক্তি : সম্রাট পঞ্চম চার্লস তার রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ল্যুথারপন্থিদের বিরুদ্ধে কঠোরনীতি গ্রহণের সুযোগ পান নি। তিনি ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসকে পরাজিত করে ১৫২৯ সালে ক্যাম্বের সন্ধি স্বাক্ষর করে জার্মানিতে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ নেন। ১৫৩০ সালে তিনি অগসবার্গ নামক স্থানে ডায়েটের সভা আহ্বান করলে সেখানে ল্যুথারপন্থি ও ক্যাথলিকপন্থি রাজাগণ উপস্থিত হন। ল্যুথারপন্থিদেরকে তাদের মতের স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। এ প্রেক্ষিতে মার্টিন ন্যুথারের সহকর্মী ও উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেলাঞ্চথোন ল্যুথারীয় ধর্মবিশ্বাসের মূল বিষয় সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করে ১৫৩০ সালে অগ্সবার্গ ডায়েটে এটি পেশ করেন। ক্যাথলিকপন্থি ডায়েটের সদস্যরা এটা গ্রহণ করেন নি; কিন্তু ল্যুথারীয় ডায়েটের সদস্যরা এটা গ্রহণ করে যা পরবর্তীকালে লুথারীয় গির্জায় এটি স্বীকৃত ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হয়। মেলাঞ্চথোন (Melanchchon) কর্তৃক লিপিবদ্ধ ধর্মবিশ্বাসকে ‘অসবার্গের ধর্মবিশ্বাস” (Confession of Augsburg) নামে অভিহিত করা হয়।

পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস প্রথমে নিরপেক্ষতার ভান করলেও পরিশেষে তিনি নিজ ধর্মবিশ্বাস ক্যাথলিক ধর্মমতের পক্ষভুক্ত হয়ে ওয়ার্মসের সভায় মার্টিন লুথারের বিরুদ্ধে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এ বিপজ্জনক অবস্থায় ল্যুথারপন্থি শাসকগণ পঞ্চম চার্লসের মোকাবেলা করার জন্য ১৫৩১ সালে স্মলক্যালডিক নামে একটি সংঘ স্থাপন করেন। এ অবস্থায় জার্মানিতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু তুর্কিরা হাঙ্গেরি আক্রমণ করে দানিযুর উপত্যকার আধিপত্য বিস্তার করে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা আক্রমণের উদ্যোগ করায় পঞ্চম চার্লস তুর্কি আক্রমণে জার্মানির ল্যুথারীয় শাসকদের সহযোগিতা লাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রযোগনীতি স্থগিত করেন। ১৫৩২ সালে নূরেমবুর্গের শান্তিচুক্তি দ্বারা চার্লস একটি ধর্মীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ধর্মীয় মতানৈক্য দূর করার চেষ্টা করেন এবং এ বিষয়ে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত সকল বিরোধ স্থগিত করতে রাজি হন।

প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে সম্রাট পঞ্চম চার্লসের যুদ্ধ ও অগসবার্গের শান্তিচুক্তি

প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে সম্রাট পঞ্চম চার্লসের যুদ্ধ : ইউরোপে দানিয়ুর উপত্যাকায় তুর্কি আক্রমণের ভয় তিরোহিত হলে সম্রাট পঞ্চম চার্লস পুনরায় জার্মানিতে ধর্মীয় সমস্যা দূর করার জন্য মনোযোগ দেন। সম্রাট পঞ্চম চার্লসের অনুরোধে পোপ দশম লিও ১৫৪৫ সালে ট্রেন্টে একটি জেনারেল কাউন্সিল আহ্বান করেন, ইতিহাসে এটা কাউন্সিল অব ট্রেন্ট (Council of Trent) নামে পরিচিত। প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে এ কাউন্সিলে প্রতিনিধি পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু পঞ্চম চার্লসের ট্রেন্টের সভা আহ্বানের পিছনে কোনো দূরভিসন্ধি আছে, এ সন্দেহে প্রোটেস্ট্যান্ট প্রতিনিধিরা এ সভায় যোগদান করেন নি। এ ছাড়া প্রোটেস্ট্যান্টরা এ ধরনের ধর্মীয় কাউন্সিল স্বীকার করেন না। তাই এতে প্রতিনিধি প্রেরণের প্রশ্ন আসে না। এ অবস্থায় ধর্মীয় সমস্যা সমাধান অসম্ভব ভেবে পঞ্চম চার্লস প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনা করে ১৫৪৬ সালে স্মলক্যালডিক লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পঞ্চম চার্লস মার্টিন লুথারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্যাকসনির ফ্রেডারিকের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেন। তিনি স্যাকসনির ফ্রেডারিকের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক কৌশলে তার এক আত্মীয় মরিসকে ইলেক্টরের পদ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নিজ পক্ষভুক্ত করেন। পঞ্চম চার্লস মরিসের সাহায্যে মুহলবার্গের যুদ্ধে (Battle of Muhlberg) প্রোটেস্ট্যান্টদের পরাজিত করেন এবং তাদের প্রধান নেতা স্যাকসনির ফ্রেডারিক ও হেসের ফিলিপকে কারারুদ্ধ করেন। মরিস স্যাকসনির ইলেক্টর পদ লাভ করেন। পঞ্চম চার্লসের নেতৃত্বে জার্মানিতে ক্যাথলিকদের জয় প্রোটেস্টান্টদের বিপদ মনে হলেও অল্পকালেই পঞ্চম চার্লস জার্মানিতে নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য পদক্ষেপ নেন। এ অবস্থায় জার্মানিতে সম্রাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পোপকে ঈর্ষান্বিত করে। ফলে পোপ ট্রেন্টে আহুত জেনারেল কাউন্সিল ভেঙে দেন। পঞ্চম চার্লস ইন্টেরিম নামে একটি ডিক্রি জারি করে জোরপূর্বক জার্মানিতে শান্তি স্থাপন করেন। এতে প্রোটেস্ট্যান্টদের কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছিল।

অগসবার্গের শান্তিচুক্তি, ১৫৫৫ (Peace of Augusburg, 1555): জার্মানিতে পঞ্চম চার্লস তার ক্ষমতা সুদৃঢ় করার কৌশল নিলে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট শাসকগণ বিক্ষুব্ধ হন। তারা পোপ পঞ্চম চার্লসের ক্ষমতাবৃদ্ধিকে সুনজরে দেখেন নি। এ অবস্থায় স্যাকসনের মরিস আবার প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষভুক্ত হয়ে গোপনে ফরাসি রাজ দ্বিতীয় হেনরির সাথে গোপন চুক্তি করে পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পঞ্চম চার্লস বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত ইতালিতে পলায়ন করেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধ এবং জার্মানির ধর্মসমস্যা পঞ্চম চার্লসকে পরিশ্রান্ত করে। (এ অবস্থায় পঞ্চম চার্লস নিজ ভ্রাতা ফার্ডিনান্ডের হাতে সম্রাটের ক্ষমতা ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। নতুন সম্রাট ফার্ডিনান্ড পশুর কনভেনশন দ্বারা প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে একটি প্রাথমিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এরপরই ১৫৫৫ সালে প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে সম্রাটের অপসবার্গের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অগসবার্গের শান্তি চুক্তি দ্বারা প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। নিম্নে অগসবার্গের শান্তিচুক্তির বিষয়বস্তু আলোচনা করা হল। অগসবার্গের সন্ধির দ্বারা—

  • (১) পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে ল্যথার প্রচারিত ধর্মমত ও প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাধিষ্ঠান আইনত স্বীকৃতি লাভ করে।
  • (২) এ সন্ধির দ্বারা স্থির হয় যে, ডায়েটের সদস্যভুক্ত যে কোনো রাজ্য, রাজপুরুষ অথবা সম্রাটের আয়ত্তাভূক্ত শহর (Imperial city) ল্যুথারবাদ গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার থাকবে এবং নিজ শাসিতদের উপর নিজ ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারবে অর্থাৎ “শাসক তার রাজ্যের প্রজাদের ধর্ম স্থির করবেন” (Cujus regjo ejus religio) এ নীতিতে প্রজাদের ধর্মীয় অধিকার বা সাধারণ ধর্ম সহিষ্ণুতার অধিকার অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রজাদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়।
  • (৩) এ সন্ধির দ্বারা স্থির হয় যে, সর্বপ্রকার ধর্মবিরোধ মীমাংসার জন্য ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টরা সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি প্রতিনিধি সভা প্রতিষ্ঠা করবে। ক্যাথলিকদের ইচ্ছানুক্রমে স্থির করা হয় যে, যদি কোনো ক্যাথলিক বিশপ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মগ্রহণ করে তা হলে তাকে নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে এবং পদত্যাগকৃত পদের সকল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করতে হবে। সে সময় বিশপ ও অ্যাবটরা নিজ নিজ এলাকায় প্রশাসনিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করতেন। এজন্য তাদেরকে যাজক রাজা (Ecclesiastical prince) বলা হত। এটিকে “ধর্মীয় সংরক্ষণ” (Ecclesiastical Reservation) বলা হত।
  • (৪) এ সন্ধির দ্বারা স্থির হয় যে, ১৫৫২ সালে পূর্বে প্রোটেস্ট্যান্টদের কর্তৃক দখলকৃত সকল সম্পত্তি তাদের দখলে থাকবে।
  • (৫) ল্যুথারীয় ধর্মমত ছাড়া অন্য কোনো প্রোটেস্ট্যান্টবাদ স্বীকার করা হবে না।
  • (৬) ক্যাথলিক শাসকদের মতো ল্যুথারীয় শাসকগণ, নাইটরা ও সাম্রাজ্যের নগরসমূহ নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং “শাশ্বত ও শর্তহীন শান্তি” বজায় রাখবে।

সমালোচনা : অগসবার্গের সন্ধি জার্মানিতে ধর্মবিরোধের সাময়িক অবসান ঘটালেও এর অনেক দুর্বলতা ছিল।

  • ১. এ সন্ধি খ্রিস্ট ধর্মাধিষ্ঠানের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে ইউরোপে খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের দুটি দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল।
  • ২. অগসবার্গের সন্ধিতে কেবল লুথারবাদকে আইনত স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু ক্যালভিনবাদকে আইনত স্বীকার না করায় ভবিষ্যতে ল্যুথারবাদ ও ক্যালভিনবাদের মধ্যে দূরত্ব এবং বিরোধের বীজ বপন করেছিল। ল্যুথারবাদ ও ক্যালভিনবাদের বিরোধের সুযোগে ক্যাথলিক শাসকগোষ্ঠী জার্মানিতে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
  • ৩. অগসবার্গের সন্ধিতে বলা হয়েছিল যদি কোনো বিশপ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করে তা হলে তাকে পদ থেকে অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করা হবে। কিন্তু এ শর্তটি প্রোটেস্ট্যান্টরা প্রথম থেকেই মেনে চলে নি। উত্তর জার্মানিতে অনেক বিশপ শাসিত এলাকা প্রোটেস্ট্যান্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সেখানে তারা অগসবার্গের সন্ধির ধারা অগ্রাহ্য করলে ধর্মীয় বিরোধের সৃষ্টি হয় যা দ্বিতীয় পর্যায়ে ধর্মযুদ্ধের সৃষ্টি করে।
  • ৪. অগসবার্গের সন্ধি রাজন্যবর্গ ও বিশপ-অ্যাবটদের হাতে তাদের প্রজার ধর্ম নির্ধারণ করার অধিকার দিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা রুদ্ধ করেছিল। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট শাসিত সকল অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দুর্দশাগ্রস্ত ও অত্যাচারিত হয়েছিল।
  • ৫. রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম এ নীতিকে ভিত্তি করে ক্যাথলিকরা মনে করেছিল যে, তারা তাদের রাজ্য প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করবে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্টরা সন্ধিতে একটি শর্ত আদায় করেছিল যে, ক্যাথলিক শাসিত অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অবলম্বন করবে এবং তাদেরকে দেশত্যাগে করতে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্টরা এরূপ সুবিধা ক্যাথলিকদের দেবে এমন শর্ত অগসবার্গের সন্ধিতে ছিল। না। এ কারণে প্রোটেস্ট্যান্টরা মনে করত যে, তারা নিজ দেশের ক্যাথলিকদের উপর নিপীড়ন করতে পারবে। এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করেছিল।
  • ৬. অগসবার্গের সন্ধি ক্যাথলিক শাসিত দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং প্রোটেস্ট্যান্ট শাসিত দেশে ক্যাথলিকদের কোনো অধিকার ছিল না। কিন্তু উভয় সম্প্রদায় খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিল। খ্রিস্টধর্মের ভ্রাতৃত্ব ও দয়া এ সন্ধিতে উপেক্ষিত হয়েছিল।

অগসবার্গের সন্ধির গুরুত্ব : অগসবার্গের সন্ধি অনেক দোষ-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ষোড়শ শতকে জার্মানিতে ধর্মীয় সংঘাত ও যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা পালন করেছিল। এ সন্ধি মধ্যযুগের খ্রিস্ট ধর্মাধিষ্টান ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আদর্শ পরিবর্তন করে নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের পথ উন্মুক্ত করেছিল। “রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম”–এ নীতি ইউরোপের অনেক দেশে জাতীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা এবং রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণে গির্জা প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেছিল। এ ছাড়া প্রত্যেক দেশে আলাদা জাতীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় প্রত্যেক দেশে ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল অর্থাৎ সেকালে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ও পোপের নিয়ষুণমুক্ত হতে জাতীয়তাবাদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পরিশেষে, অগসবার্গের সন্ধি পবিত্র রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিজয় বলা যায়। অগসবার্গের সন্ধি জার্মানিতে পবিত্র রোমান সম্রাটের ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল

  • (১) ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের ঐক্য বিনষ্ট ও বিভিন্ন দেশে জাতীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা : আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে ইউরোপের অনেক দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়। ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের এবং ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়। এ আন্দোলনের ফলে ইউরোপের জার্মানি, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ রোমের ধর্মাধিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এবং এ প্রত্যেকটি দেশে জাতীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা হয়। ঐতিহাসিক হেইজের মতে, “এক কথায় বলতে গেলে, বিচ্ছিন্নতার অর্থ হল যে জাতিগুলি পূর্বে রোমের সাথে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল সেই সম্পর্কগুলি এখন পুরোপুরি স্বাধীন বা সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হয়েছে – একেবারে স্বাধীন বা সার্বভৌম শক্তি, তাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বশাসিত।”
  • (২) নৈতিক উৎকর্ষ : ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে গির্জা এবং যাজকদের নৈতিক জীবনের উন্নতি হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টানরা নৈতিক শুদ্ধতা ও সৎকর্ম এবং ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেয়। ফলে প্রোটেস্ট্যান্টদের অনুকরণে ক্যাথলিক ধর্মেও নৈতিক শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
  • (৩) ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি : ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা দূর হয়। ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধির ফলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। মানুষ যাজকদের সাহায্য ছাড়াও যে, ঈশ্বরের সাথে আত্মিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এ বিশ্বাস স্বীকৃত হওয়ায় মানুষ বাইবেল পাঠ করে ধর্ম জ্ঞান লাভে সচেষ্ট হয়। ফলে মানুষের মনে উদারতা ও ধর্মসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়।
  • (৪) ধর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা : ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে ক্যালভিনপন্থিরা তাদের জাতীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা করে। এ সকল গির্জায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধর্মীয় নেতাদের নিয়োগ করা হত। এর ফলে ধর্মাধিষ্ঠান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।
  • (৫) বাইবেলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে ইউরোপের অনেক দেশে জাতীয় গির্জা গড়ে উঠে। এ সকল গির্জায় জাতীয় ভাষা বাইবেল মুদ্রণ করে গির্জায় পাঠ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বাইবেলের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়।
  • (৬) রাজনৈতিক ফলাফল : ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ইউরোপে জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি করে। এ জাতীয় চেতনা শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে ইউরোপের অনেক দেশে ধর্মাধিষ্ঠানের উপর রাজার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। পোপের অর্থশোষণ বন্ধ হলে অনেক দেশ আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়। ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বহু প্রোটেস্ট্যান্ট রাজার আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয় ।
  • (৭) জাতীয় চেতনার বিকাশ : ধর্মসংস্কার আন্দোলন জার্মানিতে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করেছিল। মার্টিন ল্যুথার জার্মানির অভিজাতদের বিদেশী পোপ এবং সম্রাটের শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। যা জার্মানিতে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল। এ ছাড়া অপসবার্গের সন্ধিতে ‘রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম’ এ নীতি স্বীকৃত হওয়ায় ধর্ম জাতীয় চেতনা হিসেবে কাজ করেছিল।
  • (৮) ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি : ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে সমাজ জীবনে ধর্মপরায়ণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী দেশগুলোতে স্থানীয় ভাষায় বাইবেল অনূদিত হলে সাধারণ মানুষ বাইবেল পাঠের সুযোগ পায়। এর ফলে মানুষের মধ্যে ধর্মপরায়ণতা বৃদ্ধি পায়।
  • (৯) অর্থনৈতিক ফলাফল : ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ইউরোপে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা করে। ক্যাথলিক মতবাদ সুদ ও লভ্যাংশকে নিরুৎসাহিত করত। ধন-সম্পদকে স্বর্গে পৌঁছার প্রতিবন্ধক মনে কর হত। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে পরিশ্রম, সঞ্চয়, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিকে মঙ্গলজনক এবং অলসতাকে পাপ হিসেবে উল্লেখ করায় প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলোতে পুঁজির বিকাশ হয়। এ ছাড়া পোপের অর্থশোষণ বন্ধ হলে ইউরোপের অনেক দেশে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ পুঁজিবাদকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফল মনে করে। ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসী, এজন্য ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে পুঁজিবাদের আদর্শ মনে করা হয়।

ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের বিস্তার ও সুইজারল্যান্ডের উলরিখ জুইংলির জুইংলিবাদ

ক্যালভিন, হালরিক জুইংলি ও নক্স (Calvin, Huldreich Zwingli & Knox): ধর্ম সংস্কার আন্দোলন প্রথমে জার্মানিতে শুরু হয় এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। উত্তর জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইডেনে বিস্তার লাভ করে। পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স, স্পেন এবং দক্ষিণ ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, ইতালি প্রভৃতি দেশে প্রসার লাভ করে। নেদারল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডেও প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়। ইউরোপের বাণিজ্যসমৃদ্ধ দেশগুলোতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। তবে ইতালিতে বিশেষ করে রোমান প্রভাবিত অঞ্চলে এ ধর্ম খুব বেশি প্রসার লাভ করে নি।

সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে প্রভৃতি দেশে ল্যুথারবাদের প্রসার : সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে প্রভৃতি দেশকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ বলা হয়। এসকল দেশ পূর্বে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী দেশ ছিল। চতুর্দশ শতকে সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে একই রাজশক্তির শাসনাধীনে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে এসকল দেশের ঐক্য ভেঙে যায়। সুইডেন ভ্যাসা রাজপরিবারের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে। সুইডেনের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর ভ্যাসা পরিবার ল্যুথারবাদকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে। মার্টিন ল্যুথারের প্রচারিত ধর্ম মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে এ তিনটি স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশে প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।

সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রসার এবং উলরিখ জুইংলির ভূমিকা : সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডে জুরিখ ক্যান্টনে হালরিখ জুইংলি প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচার করেন। মার্টিন ল্যুথার ১৫১৭ সালে জার্মানিতে ইনডালজেন্স (Indulgence) বিক্রির প্রতিবাদ শুরু করলে জার্মানিতে ধর্ম সংস্কারের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়। সুযোগ কাজে লাগিয়ে হালরিখ জুইংলি প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ১৫১৯ সালে জুইলি সুইজারল্যান্ডে জুরিখ মঠে যাজকপদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অকস্মাৎ ক্যাথলিকবিরোধী মতবাদে দীক্ষা নেন। আকস্মিকভাবে প্লেগরোগে আক্রান্ত হয়ে এবং মার্টিন ল্যুথারের মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

হালরিখ জুইংলি ১৪৮৪ সালে সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই জুইংলি শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ভিয়েনা ও ব্রাসেলসে পড়াশুনা করেন। তিনি ইরাসমাসের মানবতাবাদী ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তিনি প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। শিক্ষা শেষে প্রথম জীবনে কিছুদিন সৈনিক হিসেবে কাজ করেন। ১৫১৮ সালে তারে জুরিখের ক্যাথেড্রাল মঠে যাজকপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তিনি ইরাসমাসের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসে নতুন ব্যাখ্যা দেন। পোপতন্ত্রকে সমালোচনা করে ব্যাখ্যা দেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার প্রধান উৎস হল বাইবেল। তিনি উপবাস, সাধু ব্যক্তিদেরকে সম্মান করা ও ধর্মযাজকদের চিরকুমারত্ব অস্বীকার করেন। তার অনুসারীরা তার শিক্ষা জনগণের নিকট প্রচার শুরু করেন। তার অনুসারীরা ক্যাথলিক গির্জার অভ্যন্তরে মূর্তি ভেঙে ফেলে এবং প্রাচীন নিদর্শন ভেঙে ফেলেন।

হালরিখ জুইংলি খ্রিস্টান ধর্মের জনপ্রিয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ট্রানসাবসটেনসিয়েশন (transu bstantiation) উৎসবের মদ ও রুটি যিশুর রক্ত ও মাংসে পরিণত হয়, এ বিশ্বাস অস্বীকার করেন। এবং এগুলোকে তিনি প্রতীকী স্মারক অনুষ্ঠান মনে করতেন। জুইংলি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচার করেন। সুইজারল্যান্ডে ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ও যাজকরা বিভিন্ন সময় মানুষের কাছ থেকে অর্থ শোষণ করেছিল। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ও বার্ন শহরে ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি ক্ষোভ থাকায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারের অনুকূল পরিবেশ ছিল। হালরিখ জুইংলি সুইজারল্যান্ডে ক্যাথলিকবিরোধী প্রচারণায় ১৫২৮ সালে মধ্যেই সুইজারল্যান্ডের সমগ্র উত্তর অঞ্চল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণে ক্যান্টনগুলোতে ক্যাথলিক ধর্ম বজায় থাকে। এ ধর্মীয় প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ১৫২৯ সালে সুইজারল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং জুইংলি এ যুদ্ধে নিহত হন। পরিশেষে, সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা ১৫৩১ সালে ক্যাপেল-এর চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি ক্যান্টনে ধর্মবিশ্বাস সেখানকার শাসক কর্তৃক নির্ধারিত হয়।

উত্তরের ক্যান্টনগুলো থেকে জুইংলিবাদ জেনেভায় প্রচারিত হয়। জেনেভায় দুটি শাসন কর্তৃপক্ষ ছিল। একটি স্থানীয় বিশপ শাসিত, অন্যটি কাউন্ট অব স্যাভয় কর্তৃক শাসিত। এ দুজন শাসক নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ষড়যন্ত্র করলে জনগণ বিদ্রোহ করে তাদেরকে জেনেভা থেকে বিতাড়িত করে শহরটিকে ১৫৩০ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এ সময় সুইজারল্যান্ডে জুরিখ ও বার্ন থেকে প্রোটেস্ট্যান্ট প্রচারকরা জেনেভাতে এসে জুইংলিবাদ প্রচার করেন। জুইংলি সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন। তিনি সরকার ও ধর্ম বিষয়ে একটি নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন, যা পরবর্তীকালে ক্যালভিন বাস্তবায়ন করেছিলেন।

ল্যুথারবাদ ও জুইংলিবাদের পার্থক্য : ল্যুথারবাদ ও জুইংলিবাদ-এ উভয় ধর্মবিশ্বাস ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের ত্রুটি ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল। উভয় সংস্কারক পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং ইনডালজেন্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ ধর্মমত প্রচার শুরু করেছিলেন। তবে এ দুধর্ম মতের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য ছিল –

  • (১) মার্টিন ল্যুথার ইউকারিস্ট (Eucharist) নামক খ্রিষ্ট ধর্মানুষ্ঠানে প্রার্থনার পর রুটি ও মদ যা সে প্রার্থনা সভায় রাখা হত এবং যা যিশুখ্রিস্টের মাংস ও রক্তে পরিণত হত তা বিশ্বাস করতেন না। যদিও ক্যাথলিকরা এটিকে ধর্মের প্রধান সত্য হিসেবে বিশ্বাস করত। মার্টিন ল্যুথার এ সত্য বিশ্বাস না করলেও এ প্রার্থনা সভায় যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব হয় তা তিনি বিশ্বাস করতেন। জুইংলি ইউকারিস্টের প্রার্থনাকে একটি স্মৃতি উৎসব মনে করতেন।
  • (২) মার্টিন ল্যুথার আত্মার মুক্তির জন্য ঈশ্বরের বিশ্বাস এবং সৎকাজকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। কিন্তু হালরিখ জুইংলি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর যাদেরকে মুক্তির জন্য নির্বাচিত করবেন কেবল তারাই মুক্তিলাভ করবে। মানুষ নিজ ইচ্ছা বা কর্মের দ্বারা মুক্তি পেতে পারে না। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসই হল মুক্তির প্রধান পথ। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দুই মতবাদের মধ্যে মিল থাকলেও জুইংলির মত ছিল একেবারেই গোড়া।
  • (৩) মার্টিন ল্যুথার বাইবেলের যে ব্যাখ্যা করেছিলেন সে ব্যাখ্যার বিরোধী না হলে ধর্মনীতির যে কোনো ব্যাখ্যা তিনি গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু জুইংলি বাইবেলের যে ব্যাখ্যা করেছিলেন এর বাইরে তিনি কিছু গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। বাইবেলের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও জুইংলি ছিলেন গোড়া।
  • (৪) মার্টিন ল্যুথার রোমের ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের প্রতি প্রথমে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ধর্মাধিষ্ঠানের সংস্কারের চেষ্টা ব্যর্থ হলেই কেবল তিনি ধর্মাধিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। কিন্তু জুইংলি ক্ষুদ্র ধর্মাধিষ্ঠানকেও গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য স্বাধীনতাদানের পক্ষপাতী ছিলেন।
  • (৫) মার্টিন ল্যুথার ধর্মসংস্কার আন্দোলনের শুরুতে ধর্মবিশ্বাসকে রাজনীতি-মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পোপের অনমনীয় হিংসাত্মক মনোভাব এবং সম্রাটের সামরিক হুমকি মোকাবেলার জন্য রাজশক্তির সহায়তা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু জুইংলি জনগণের সহায়তায় ধর্মমতকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।

ল্যুথারবাদ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রসার লাভ করে এবং জুইংলিবাদ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের প্রসার লাভ করে। স্যামুয়েল স্মিথের মতে, “রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে লুথারের চেয়ে উলরিখ বেশি গণতান্ত্রিক ছিলেন। তদুপরি, জনগণের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে তার সমর্থন জুরিখ এবং বার্নের সুইস ক্যান্টনগুলিতে তার জন্য ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছিল।”

জন ক্যালভিন ও তার ক্যালভিনবাদ

জন ক্যালভিন (১৫০৯-১৫৬৪): ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে জন ক্যালভিন সুইজারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রচারিত ধর্মমত ক্যালভিনবাদ (Calvinism) নামে পরিচিত। ভি. এইচ. এইচ. গ্রিনের মতে, “Calvinism crystallised the Reformation. ” ল্যুথার এবং হালরিখ জুইংলি পুরোনো খ্রিস্টধর্মের পরিবর্তন করেছিলেন কিন্তু জন ক্যালভিন আরো পরিবর্তন এনে বাইবেলে ঈশ্বরের বাণীকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সংগঠিত সরকার ব্যবস্থা এবং দার্শনিক ভিত্তি দিয়েছিলেন। তিনি চিন্তা এবং কর্মের সমন্বয় করে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মকে একটি গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে পরিকল্পনা করেন। প্রথম তিনি জেনেভাতে যে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা ১৫৪১ সালে থেকে ১৫৬৪ সালে অমৃত্যু এ ধর্ম প্রশাসনের প্রধান ছিলেন এবং তার মত ইউরোপ এবং পরে আমেরিকাতেও প্রচারিত হয়েছিল।

জন ক্যালভিনের জন্ম ও শিক্ষা : জন ক্যালভিন ১৫০৯ সালের ১০ জুলাই ফ্রান্সের পিকার্ডি প্রদেশের নয়ন (Noyon) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তার পিতা একজন ধর্মীয় নোটারি এবং অর্থবিষয়ক এজেন্ট ছিলেন। তার পিতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীভূক্ত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। জন ক্যালভিন-এর পিতা আশা করতেন, তার দ্বিতীয় পুত্র জন গির্জার চাকরি নিবেন। এজন্য জন ধর্মতত্ত্বের উপর শিক্ষা লাভ করেন। এবং পরে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে, ও অর্লিয়ঁ (Orleans) বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক, হিব্রু এবং ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। তিনি বার্জেসে (At Bourges) অধ্যয়ন কালে বিখ্যাত আইনজ্ঞ এলসিয়াটির (Alciati) বক্তৃতা শুনতেন এবং সেখানকার তার সহকর্মীদের আইনশাস্ত্রের অভিজ্ঞতা তাকে প্রভাবিত করেছিল। সেখানকার আইন এবং ধ্রুপদী সাহিত্যের অধ্যয়ন তার মনে স্থায়ী রেখাপাত করে এবং সে ভিত্তিতে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর আইনি ব্যাখ্যা দেন। তার শিক্ষা তাকে গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞানদান করেছিল। ১৫৩২ সালে তিনি ল্যাটিন ভাষায় সেনেকা রচিত ‘ডি ক্লেমেনটিয়ার’ (De Clementia) উপর একটি প্রবন্ধ লেখেন।

জন ক্যালভিন কোন সময় তার পৈতৃক ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেন তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তিনি লিখেছেন ঈশ্বর নতুন ধর্মবিশ্বাস গ্রহণের জন্য তার হৃদয়কে নরম করে দিয়েছিলেন। তিনি ক্লাসিক্যাল সাহিত্য ও আইন অধ্যয়নের পর খ্রিস্টীয় সাধু এবং ধর্মপুস্তকের উপর প্রচুর পড়াশুনা করেন। সম্ভবত ইরাসমাসের গ্রিক ভাষায় অনূদিত বাইবেল এবং ল্যুথারেরর লেখা বিশ্বাস দ্বারা মুক্তি (Justification by faith) তাকে প্রভাবিত করে। তিনি ‘ডি ক্লেমেনটিয়া’ রচনার সময় ওয়ান্ডেনসিয়ায় এক কাপড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে বাস করতেন এবং সেখানে তিনি তার নিকট মার্টিন ল্যুথারের প্রশংসা শোনেন। ইরাসমাস এবং ল্যুথারের প্রভাব তার চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। ১৫৩৩ সালে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটার হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্যাথলিক ধর্মের পাদ্রি এবং কিউরেটরের পদ ত্যাগ করেন। ইরাসমাসের গ্রিক ভাষায় অনূদিত বাইবেল পড়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, খ্রিস্টান চার্চের শিক্ষা বাইবেল থেকে অনেক বিচ্যুত হয়েছে। মার্টিন ল্যুথারের রচনা তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং তার মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করে যে, মানুষ অপরাধপ্রবণ এবং ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের দয়ায় মানুষের আত্মা মুক্তি পেতে পারে। ১৫৩৪ সালে তিনি ফ্রান্স ত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় শহর বাসল-এ (Basle) আশ্রয় নেন। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পণ্ডিত ও মানবতাবাদীদের সম্মেলন ঘটেছিল। বাসলএ তিনি ল্যাটিন ভাষায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের মূলগ্রন্থ ‘ইনস্টিটিউটস অব দ্য ক্রিশিয়ান রিলিজন’ (Institutes of the Christian Religion) গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থটিতে ক্যালভিন ধর্মবিশ্বাসের মূল ধারণাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ গ্রন্থটি প্রকাশের (১৫৩৬ সালে) তেইশ বছরের মধ্যে এর মূল ছয়টি অধ্যায় বাড়িয়ে আশিটি অধ্যায় করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রকাশিত আর কোনো গ্রন্থ এর মতো প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। পরে এর কিছু অংশ ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং এর মাধ্যমে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাস প্রচার করা হয়।

জন ক্যালভিনের প্রচারিত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত সুইজারল্যান্ডের জুরিখ (Zurich), বেসল- এ (Basle), বার্ন (Berne) এবং জেনেভায় (Geneva) প্রচারিত হয়। জেনেভা শহরটি তখন স্যাভয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্য ছিল। ষোড়শ শতকে এর অধিবাসীরা তিনটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। যথা-স্যাভয়ের ডিউক, একজন বিশপ এবং স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ। জেনেভার বিশপ স্যাভয়ের ডিউকের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। জেনোভার কর্তৃত্ব নিয়ে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সাথে স্যাভয়ের ডিউকের দ্বন্দ্ব ছিল। স্যাভয়ের ডিউক ছিল সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর ভগ্নিপতি। এ অবস্থায় দেশপ্রেমিক দল (Patriot party) বেজানসন হিউজেস-এর (Bezanson Hugues) নেতৃত্বে বার্ন (Berne) এবং ফাইবার্গ-এ (Fribourg) জয় লাভ করে। তারা বিশপ পিয়েরে ডি লা বোমকে (Pierre de la Baume) বিতাড়িত করে। সেখানে একজন ফরাসি প্রচারক বার্নেস (Bernnese) এবং গুইলাম ফারেল-এর (Guillaume Farel) পৃষ্ঠপোষকতায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত প্রচার করেন। ১৫৩৫ সালে অনেক চার্চের মূর্তি ভেঙে ফেলা হয় এবং ক্যাথলিক যাজকের পরিবর্তে প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক নিয়োগ করা হয়। তবে সেখানকার অবস্থা ছিল অস্বস্তিকর। ফারেল এর সেনাবাহিনী মিলিশিয়ারা ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট যারা নগরের কর্তৃপক্ষের বিরোধী পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ক্যালভিন ফারেল-এর আমন্ত্রণে জেনেভাতে আসেন। ১৫৩৭-৪১ সালে মধ্যেই নগরের প্রোটেস্ট্যান্ট বিরোধীরা জয় লাভ করে ফারেল এবং ক্যালভিনকে নগর থেকে বহিষ্কার করে। এ সময়ে ক্যালভিন জেনেভাতে অবস্থান করে। ইতোমধ্যে ক্যালভিন-এর মতবাদ সুইজারল্যান্ডে বিস্তার লাভ করতে থাকে। ক্যালভিন সেখানে জনপ্রিয়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি জেনেভায় প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ প্রতিষ্ঠা করেই জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, আচার অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করেন। তার ধর্মনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখেই জেনেভা কর্তৃপক্ষ প্রোটেস্ট্যান্ট বিরোধী সকল বই-পুস্তক নিষিদ্ধ করেন। জন ক্যালভিন তার মত অনুসারীদের অলসতার পাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রমের উপদেশ দেন এবং সকল প্রকার বিলাসিতা ও আমোদ-প্রমোদ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ক্যালভিন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সমন্বয়ে একটি ধর্মরাজ্য (Theocracy) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৫৩৬ সালে পর্যন্ত ধর্মীয় সংগঠনকে সুগঠিত করেন। কিন্তু ১৫৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তিনি জেনেভা ত্যাগ করেন। এর কয়েক বছর পর ১৫৪১ সালে তার অনুসারীদের অনুরোধে জেনেভায় ফিরে এসে সেখানকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন নিজ আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তোলেন। তিনি ধর্মীয় বিচারালয় (consistory) গড়ে তোলেন। এ কেন্দ্রীয় ধর্মীয় সংগঠনের পরিচালনার জন্য বারো জন জ্যেষ্ঠ সদস্য (Twelve lay elders) সাধারণ বিশ্বাসীদের ভেতর থেকে নিয়োগ করা হতো এবং পাঁচজন মন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। কোনো বিষয়ে আইন প্রবর্তন করতে হলে তা মন্ত্রীদের সম্মেলনে উপস্থাপন করা হতো। ধর্মীয় বিচারালয়ের (Consistory) কাজ ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসীদের নৈতিক জীবন পর্যবেক্ষণ করা। সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো এমনকি প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ধর্মীয় সংগঠনের পরিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জেনেভাকে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয় এবং ধর্মীয় বিচারালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি কমিটি প্রত্যেকের বাড়ি পূর্ব নির্দেশ ছাড়াই পরিদর্শন করত। এমনকি আত্মকেন্দ্রিক, নির্লিপ্ত জীবন-যাত্রা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নাচ, তাস খেলা, নাট্যশালায় যাওয়া; সাবাথের দিনে (ধর্মীয় ছুটির দিনে) কাজ করা ও খেলাধুলাকে শয়তানের কাজ’ বলে মনে করা হতো। সরাইখানার মালিকদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তাদের সরাইখানায় কোনো অতিথি যেন প্রার্থনা না করে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করে। রাত্র ১টার পর খাবার গ্রহণ করা ও পান করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ আইন অমান্য করলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। খুন ও বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ব্যভিচার, ধর্মত্যাগ করা, ধর্মের বিরোধিতা করা, ডাইনিবিদ্যা বা বুজরুকির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

ক্যালভিন জেনেভাতে যে ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তিনি ছিলেন তার প্রধান ধর্মগুরু বা পোপ। তিনি জেনেভার ধর্মাধিষ্ঠান থেকে প্রত্যহ ধর্ম প্রচার করতেন। ক্যালভিন ধর্মমতের উপর অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফরাসি ভাষায় অনূদিত বাইবেল। ক্যালভিন জেনেভাতে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক ধর্মীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করত এবং এদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্যালভিনবাদ প্রচারিত হয়।

ক্যালভিন জেনেভায় গণতান্ত্রিক ধর্মীয় চার্চ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, শৃঙ্খলাবোধ ও নীতিবোধের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ছাত্রদের শিক্ষণীয় বিষয় ছিল স্থানীয় ভাষায় বাইবেল অধ্যয়ন, ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন ও গ্রিক বিষয়ে শিক্ষা, অলংকার শাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গণিত ও সংগীত বিষয়ে শিক্ষা। সংগীত মূলত চার্চের ধর্মীয় সংগীত শেখানো হতো। চার্চ শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত। চার্চ স্কুল শিক্ষকদের এবং প্রোটেস্ট্যান্ট প্রচারকদের প্রশিক্ষণ দিত।

ক্যালভিনের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা এবং প্রচারণায় ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচারিত হয়। অনেকেই ক্যালভিন-এর ধর্মীয় উপদেশ শোনার জন্য জেনেভায় আসত। শিক্ষার্থী ও আগন্তুকরা স্বদেশে গিয়ে ক্যালভিনের মতাদর্শ প্রচার করত। ক্যালভিন-এর শিষ্য জন নক্স (John knox) স্কটল্যান্ডে ক্যালভিনবাদ প্রচার করেন। অল্পকালের মধ্যেই স্কটল্যান্ড ক্যালভিনবাদে দীক্ষা নেয় এবং স্কটল্যান্ডে প্রেসবাইটাবিয়ান চার্চের প্রতিষ্ঠা হয়। ফ্রান্সে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ক্যালভিনবাদ প্রচারিত হয়। ফ্রান্সের ক্যালভিনপন্থীরা আদালত, সংসদ প্রভৃতি স্থানে প্রভাবশালী ছিল। ফ্রান্সের ক্যালভিনপন্থিদের বলা হতো হিউগেনো। ষোড়শ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় হিউগেনো ফ্রান্সের রাজশক্তির সাথে অসামরিক ধর্মীয় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

নেদারল্যান্ডে প্রথমে ল্যুথারবাদ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে নেদারল্যান্ডে ল্যুথারবাদের প্রভাব কমে আসলে সেখানে ক্যালভিনবাদ শক্তিশালী ধর্মমতে পরিণত হয়। প্রথমে নেদারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাথলিকবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল। স্পেনের সাথে নেদারল্যান্ডের ধর্মযুদ্ধ চলাকালীন উত্তরাঞ্চল অরেঞ্জ বংশীয় উইলিয়ামকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং দক্ষিণাঞ্চলের ক্যাথলিকরা দ্বিতীয় ফিলিপকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ক্রমে ওলন্দাজদের অধিকাংশ মানুষ ক্যালভিনবাদে ধর্মান্তরিত হয় এবং ক্যালভিনবাদ নেদারল্যান্ডের জাতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।

জার্মানিতে প্রথমে ল্যুথারবাদ জনপ্রিয় হলেও কৃষক বিদ্রোহে মার্টিন ল্যুথার রাজন্যবর্গের পক্ষ অবলম্বন করলে দক্ষিণ জার্মানিতে ল্যুথারবাদ অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সুযোগে ক্যালভিনবাদ জার্মানিতে প্রচারিত হয়। ওয়ারটেমবার্গ, বার্ডেন, বিনিশ অঞ্চলসমূহে অনেক সাধারণ মানুষ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্যালভিনবাদে দীক্ষা নেয়। ১৫৫৫ সালে অর্গসবার্গের সন্ধিতে ক্যালভিনবাদ স্বীকৃত না হওয়ায় এর প্রচারণা অনেকটা মন্থর হয়েছিল। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে ক্যালভিনবাদ স্বীকৃতি লাভ করলে তা অন্যতম ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ব ইউরোপে হাঙ্গেরির বোহেমিয়া ও পোল্যান্ডের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ক্যালভিনবাদ জনপ্রিয় হয়েছিল। পোল্যান্ডের জমিদার শ্রেণীর অনেকেই ক্যালভিনবাদে দীক্ষা নিয়েছিল।

স্কটল্যান্ড থেকে ক্যালভিনবাদ ইংল্যান্ডে প্রচারিত হয়রাজা অষ্টম হেনরির (১৫০৯- ১৫৪৭) রাজত্বের শেষের দিকে ইংল্যান্ডে ক্যালভিনবাদ জনপ্রিয় হতে থাকে। রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড-এর (১৫৪৭-১৫৫৩) সময় ক্যালভিনবাদ ইংল্যান্ডের এ্যাংলিকানবাদকে প্রভাবিত করে। ক্যালভিনবাদ ইংল্যান্ডে পিউরিটান ধর্মমত হিসেবে পরিচিত ছিল। রাজা প্রথম জেমস-এর সময় পিউরিটানরা অত্যাচারিত হয়ে আমেরিকায় অভিবাসী হয় এবং এদের মাধ্যমে আমেরিকা ক্যালভিনবাদ জনপ্রিয় হয়।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখ, বার্ন ও জেনেভার নগর ক্যান্টনসমূহের অধিকাংশ মানুষ ক্যালভিনবাদে দীক্ষা নিয়েছিল। জেনেভাতে ক্যালভিনবাদের প্রভাবে ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠান ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উৎখাত হয়েছিল। ক্যালভিনবাদ ইউরোপে গণতান্ত্রিক ধর্ম হিসেবে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। আধুনিক যুগে ইউরোপে গণতান্ত্রিক ভাবধারা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্যালভিনবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ক্যালভিনবাদের মূলনীতি : ক্যালভিনবাদ ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রাধান্য স্বীকার করে এবং ক্যালভিনবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, ঈশ্বরের উপর আন্তরিক বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ আত্মার মুক্তির একমাত্র উপায়। ক্যালভিন বিশ্বাস করতেন যে, সমগ্র বিশ্বের কর্মকাণ্ড ঈশ্বরের ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত এবং ঈশ্বরের মহিমার জন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। আদিমানব আদম পাপের জন্য স্বর্গচ্যুত হয়েছেন এবং সকল মানুষ সে পাপের উত্তরাধিকার বহন করছে। অর্থাৎ মানুষ স্বভাবগতভাবে পাপী। তাই কোন আত্মা ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া মুক্তিপেতে পারে না। ঈশ্বর মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুই জানেন এবং মানুষের জন্মের সময় তার মুক্তি বা শাস্তি ঈশ্বর নির্ধারণ করে দেন। নিয়তি মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কেলভিন বিশ্বাস করতেন যে, খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের মধ্যে আচরণগত ঐক্য থাকবে। এ পৃথিবীতে একই নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবে। খ্রিস্ট ধর্মাধিষ্ঠান যেহেতু সকল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রতিষ্ঠান সেহেতু তাতে সকলের অধিকার আছে। তাই ধর্মাধিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নির্বাচিত বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা এর পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। নির্বাচিতরা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাবেন। ক্যালভিন দয়া ও নীতিবোধকে প্রত্যেক খ্রিস্টানের জন্য বাধ্যতামূলক করেছিলেন। ভালো খ্রিস্ট বিশ্বাসী পৃথিবীতে ঈশ্বরের ইচ্ছা বাস্তবায়নকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবে। ক্যালভিন-এর ধর্মীয় ধারণার সক্রিয়তা প্রকাশ পায়। গির্জাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার মধ্যে ক্যালথিক চার্চ গড়ে উঠেছিল রোমান কেন্দ্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের কাঠামোকে অনুকরণ করে। ক্যালভিন তা প্রত্যাখ্যান করে ধর্মাধিষ্ঠানকে সকল খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এ ধর্ম প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতো। ক্যালভিন তার ধর্মীয় বিশ্বাসের অনেক ধারণার জন্য মার্টিন ল্যুথার-এর কাছে ঋণী থাকলেও তিনি ক্যাথলিক আচার অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব সবকিছুই প্রত্যাখ্যান করেন। ক্যালভিন-এর ধর্মীয় বিশ্বাস পুরোপুরিভাবে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম থেকে নেওয়া হয়েছিল এবং রবিবারে সারাথ দিবস সকলের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। তিনি ক্যাথলিক উপাসনার পদ্ধতি অনেক বিষয় যেমন উপাসনার বেদী, প্রার্থনার জন্য যাজকের বিশেষ পোশাক ইত্যাদি পোপতন্ত্রের ঐতিহ্য বাতিল করে দেন। ধর্ম বিষয়ে যাজকদের আধ্যাত্মিকতা বাতিল ঘোষণা করেন। ক্যালভিন তার অনুসারীদের ঈশ্বরের দ্বারা নির্বাচিত এবং ঈশ্বরের পৃথিবীতে তার মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রেরিত মানবগোষ্ঠী হিসেবে মনে করতেন।

ক্যালভিনবাদ ও ল্যুথারবাদের মধ্যে পার্থক্য : ল্যুথারবাদ ও ক্যালভিনবাদ এ উভয় মত ক্যাথলিক ধর্মধিষ্ঠানের অনাচার, কুসংস্কার, পাপাচার ও লোভের প্রতিবাদ করেছিল। এ উভয় ধর্মমত ঈশ্বরের চূড়ান্ত ক্ষমতা, ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস, বাইবেলের প্রাধান্য এগুলোকে খ্রিস্টধর্মের মূল বিশ্বাস মনে করতো। উভয় ধর্মমত পোপের কর্তৃত্ব ও যাজকদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছিল। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধর্মমতের কিছু নীতিগত পার্থক্য ছিল। নিম্নে এ পার্থক্য আলোচনা করা হলো। যথা-

  • (১) ল্যুথারবাদ প্রকৃতিগতভাবে একটি রক্ষণশীল ধর্মমত ছিল। এ আন্দোলন প্রথমে শোষণ, অনাচার এদের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরে মার্টিন লুথার রাজন্যবর্গের আশ্রয়পৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে এ আন্দোলন তার প্রগতিশীল চরিত্র হারায়। জার্মানি, স্ক্যান্ডিডেনীয়া প্রভৃতি দেশে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় লুথারবাদ জাতীয় ধর্মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ক্যালভিনের ধর্মমত ল্যুথারের ধর্মমত অপেক্ষা ভিন্ন ধরনের ছিল। ক্যালভিন ধর্মতান্ত্রিক (Theocracy) সরকার গঠন করে সেখানে প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্য সাম্য ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। ক্যালভিনবাদ গণতান্ত্রিক ধর্মমত হওয়ায় তা নেদারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনকারী শক্তি হিসেবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। ক্যালভিনবাদ এ সকল আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছিল। ল্যুথারবাদ ক্যাথলিকবাদের সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করেন। কিন্তু ক্যালভিন-এর লক্ষ্য ছিল ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ উৎখাত করা। জেনেভাতে তিনি ক্যাথলিক চার্চ ও এর ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান উৎখাত করেছিলেন। ক্যালভিনবাদ নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানুষের মনে এক আশার সঞ্চার করেছিল।
  • (২) ল্যুথারবাদ ছিল রাষ্ট্র আশ্রিত ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত একটি প্রতিবাদী ধর্ম। জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে প্রভৃতি দেশে রাজশক্তি ল্যুথারবাদের রক্ষক ছিল। যার ফলে ল্যুথারবাদ সাধারণ গণমানুষের ধর্ম হিসেবে সাফল্য অর্জন কতে পারেনি। জার্মানিতে কৃষক শ্রেণীর ল্যুথারবাদের প্রভাবিত হয়ে তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলে মার্টিন ল্যুথার কৃষকদের পক্ষাবলম্বন না করে রাজশক্তির সহায়তায় কৃষক বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। ফলে ন্যুথারবাদ রক্ষণশীল শ্রেণীর ধর্মে পরিণত হয়েছিল।
  • (৩) ল্যুথারবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সবদেশে প্রচারিত হওয়ায় সাধারণ নিপীড়িত মানুষের নিকট এটা গণমানুষের মুক্তির ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু ক্যালভিনবাদ গণতান্ত্রিক ধর্মমত হওয়ায় এটা নিপীড়িত ও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই যখন ইউরোপে প্রতিসংস্থার আন্দোলন শুরু হয়, তখন ল্যুথারবাদ অপেক্ষা ক্যালভিনবাদ আত্মরক্ষা করতে অধিক সক্ষম হয়েছিল।
  • (৪) ল্যুথারবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ নীতিকে সমর্থন করতো না কিন্তু ক্যালভিনবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক সময় বলপ্রয়োগ নীতির আশ্রয় নিত। এমনকি শুধুমাত্র ক্যাথলিক ধর্মমত নয়, ল্যুথারবাদকে প্রতিরোধ করে ক্যালভিনবাদ প্রাধান্য স্থাপন করেছিল।
  • (৫) ল্যুথারবাদ ধর্মশাস্ত্র কর্তৃক সরাসরি নিষিদ্ধ হয় নি এমনকিছু আচার-অনুষ্ঠান গির্জায় বহাল রাখার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু ক্যালভিনবাদ ধর্মশাস্ত্র কর্তৃক নিষিদ্ধ কোন আচার- অনুষ্ঠান গির্জায় রাখার পক্ষপাতী ছিল না। ক্যালভিনবাদের ভাবধারা আচার-অনুষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই হিব্রু ধর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।

ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রসার

ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানিতে মার্টিন ল্যুথার প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু করলে তা কালক্রমে ইউরোপের অপরাপর দেশের মতো ইংল্যান্ডেও প্রসার ঘটে। ইংল্যান্ডে রেনেসাঁস-এর প্রভাবে যে নতুন ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয় তা প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। ইংল্যান্ডে রেনেসাঁস-এর প্রভাবে বিস্তারে জন কোলেট (John colet), স্যার টমাস মোর (Sir Thomas more) এবং ইরাসমাস-এর (Erusmas) নাম উল্লেখযোগ্য। এ সকল মানবতাবাদীগণ ‘অক্সফোর্ড সংস্কারক’ (Oxford Reformer) নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাদের বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনের ফলে ইংল্যান্ডে খ্রিস্ট ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এছাড়া ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের জন্য নতুন ভাবধারা হিসেবে সংস্কারকৃত নতুন ধর্ম যুগোপযোগী হয়েছিল।

ইংল্যান্ডে পোপের সাথে রাজশক্তির বিরোধ : ইংল্যান্ডে ধর্ম সংস্কার শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। ইংল্যান্ডে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ইংরেজ জাতি রাজশক্তির আনুগত্য মেনে নেয়। যার ফলে জনসমর্থনপুষ্ঠ রাজশক্তি পোপ-এর আধিপত্য বিলুপ্ত করার সাহস পায়। এছাড়া টিউডর রাজা অষ্টম হেনরি অক্সফোর্ড সংস্কারকদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু তিনি মার্টিন ল্যুথার-এর ধর্মবিশ্বাস পছন্দ করতেন না। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মে অষ্টম হেনরির সমর্থনের জন্য পোপ তাকে ‘Defender of the faith’ উপাধি দিয়েছিলেন। তবে রোমান চার্চের দুর্নীতি, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, মঠের প্রচুর সম্পদ, রোমের পোপ কর্তৃক ইংল্যান্ডের অর্থ শোষণ ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। উচ্চশ্রেণীর যাজকদের ধন- রত্নের প্রাচুর্য ও বিলাসিতা, মঠবাসী সন্ন্যাসীদের লোভ ও অলসতা, চার্চের কুসংস্কারপূর্ণ শিক্ষা পোপের অপ্রতিহত ক্ষমতা ও চার্চের প্রভাব ইংল্যান্ডের অনেকের মনে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করেছিল। তৃতীয় এডওয়ার্ড-এর আমল থেকেই ইংরেজ সচেতন শ্রেণী ইংলিশ চার্চ ও ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে পোপের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে আসছিল। প্রিমুনার ও প্রোভাইজার আইন (Premonere and proviser Act) থেকে অনুমান করা যায় যে, ইংল্যান্ড পোপকে অর্থপ্রদান করতে কিংবা তার নিকট মামলার আপীল প্রেরণ করতে অনেক দিন থেকে অনিচ্ছুক ছিল। অতঃপর রেনেসাঁসের প্রভাবে পোপ ও চার্চের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ক্রমে বৃদ্ধি পায়। রেনেসাঁসের ফলে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের স্থান দখল করে যুক্তিবাদ। ফলে অনুসন্ধিৎসু ও সচেতন মানুষ জীবনের সকল বিষয় যুক্তিতর্ক দ্বারা বিচার করে সত্য নির্ণয়ের চেষ্টা শুরু করে। এ যুক্তিবাদী প্রবণতা মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে যে, এতদিন যাবৎ যাজক সম্প্রদায় ধর্মের নামে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে ধর্মের নামে তাদের নিকট পরিবেশন করেছে। ফলে চার্চ ও পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে পোপ এবং ধর্মসংস্কারের জন্য অনুকূল জনমত সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত ইরাসমাস ও স্যার টমাস মোর তাদের গ্রন্থ ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ ও ‘ইউটোপিয়ার’ মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্তারের অনুকূল পথ প্রশস্ত করেন। এছাড়া ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক যাজকদের মধ্যেও অনেকে চার্চের দুর্নীতি ও কুসংস্কার দূর করে এটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়াসী হন। এসব কারণে জনসাধারণের মধ্যে পোপ-এর প্রতি বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনি সময় মার্টিন ল্যথার ১৫১৭ সালে পোপ ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে জার্মানিতে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এ আন্দোলন ক্রমে ইংল্যান্ডের শিক্ষিত লোকদের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে প্রভাবিত করে। ইংল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় কাউন্টিসমূহের শিক্ষিত মানুষ এবং লন্ডনের জনগণকে আকৃষ্ট করে যা ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে তৈরি করেছিল। এ সংস্কার পরিবেশ যখন ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ধর্মসংস্কারের দাবি প্রবল হয়, এসময় অষ্টম হেনরি-এর সাথে রাণী ক্যাথরিন-এর বিয়ে বিচ্ছেদকে কেন্দ্র করে রাজার সাথে পোপের বিরোধ দেখা দেয়। রাণী ক্যাথারিন অষ্টম হেনরি-এর চেয়ে বয়সে বড় এবং রাণী ক্যাথারিন এ পর্যন্ত জন্মদানে অপরাগ এ অজুহাতে অষ্টম হেনরি ১৫২৭ সালে পোপ- এর নিকট তালাকের অনুমতি প্রার্থনা করেন। রাণী ক্যাথারিন ছিলেন স্পেনরাজ পঞ্চম চার্লস-এর মাসি। এ কারণে পোপ বিয়ে বিচ্ছেদের আদেশ প্রদানে কালক্ষেপণ করেন। পোপ ইংল্যান্ড তার প্রতিনিধি ও রাজা অষ্টম হেনরি-এর উপদেষ্টা টমাস উলসী এবং ক্যাম্পাস জিয়ো নামে একজন ইতালীর কার্ডিনালকে ইংল্যান্ডেই উক্ত বিষয়টি সুরাহা করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার পূর্বেই পোপ ১৫২৯ সালে নিজ হাতে বিচারকার্য গ্রহণ করেন। অষ্টম হেনরি বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমতি আদায় করতে ব্যর্থ হয়।

এ প্রেক্ষিতে রাজা অষ্টম হেনরি বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আর্চ বিশপ ক্র্যানমার এর পরামর্শে বিয়ে বিচ্ছেদের মতামত চেয়ে ইউরোপীয় প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অনুরোধ জানান। বিশ্ববিদ্যালগুলো এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দেয়। অষ্টম হেনরি বিরক্ত হয়ে ইংল্যান্ডের উপর থেকে পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্ব বিলোপের জন্য ১৫২৯ সালে ‘রিফরমেশন পার্লিমেন্ট’ (The Reformation Parliament) নামে পরিচিত পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন। এ পার্লামেন্ট আইন পাস করে ইংল্যান্ডের উপর পোপের কর্তৃত্ব হ্রাস করে। প্রথমে রাজা যাজক সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৫২৯ সালে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে চার্চের কতকগুলো লাভজনক আয় রহিত করেন। ১৫৩০ সালে উলসীকে পোপের প্রতিনিধিরূপে স্বীকার করার অভিযোগে যাজকদেরকে প্রাচীন ‘এ্যাক্ট অব প্রিমুনার’ অনুসারে অভিযুক্ত করে বিচারাধীনে আনা হয় এবং তাদের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এরপর যাজকদের ‘সাবমিশন অব ক্লার্জি’ (Submission of clergy) নামক একটি দলিলে দস্তখত করতে বাধ্য করা হয়। এর দ্বারা রাজার অনুমোদন ছাড়া চার্চ কর্তৃপক্ষের চার্চ সংক্রান্ত বিষয়ে আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা রহিত করা হয়।

যাজকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর অষ্টম হেনরী ১৫৩২ সালে পার্লামেন্টের তৃতীয় অধিবেশন আহবান করে ‘অ্যাক্ট অব এ্যানেট্স’ (Act of Annates) পাস করে পোপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। এ আইনের মাধ্যমে এ্যানেস্ ও পিটার পেন্‌স নামক কর পোপ-এর নিকট প্রেরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরিবর্তে ঐসকল করের যাবতীয় অর্থ রাজার নিকট হস্তান্তর করা হয়। ১৫৩৩ সালে ‘অ্যাক্ট অব অ্যাপীল’ (Act of Appeal) প্রণয়ন করে ইংল্যান্ডের ধর্মাধিষ্ঠান থেকে যাজকদের বিচার সংক্রান্ত আপীল পোপের দরবারে প্রেরণ নিষিদ্ধ করা হয়। উক্ত ক্ষমতা ইংল্যান্ডের যাজক সভার ‘আপার হাউজ’-এর উপর ন্যস্ত করা হয়। এ আইনের বলে আর্চ বিশপ ক্র্যানমার চার্চ বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিয়ে বিচ্ছেদের মামলা বিচার করে অষ্টম হেনরি ও ক্যাথারিন-এর বিয়ে প্রথম থেকেই অসিদ্ধ ছিল বলে রায় দেন।

১৫২৪ সালে অষ্টম হেনরি পার্লামেন্টের অধিবেশনে ‘এ্যাক্ট অব সাকসেশনস’ (Act of succession) পাস করে রানী ক্যাথারিন-এর কন্যা মেরীকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন এবং অ্যান বোলিনের সন্তানকে উত্তরাধিকার দান করেন। এরপর অষ্টম হেনরি পার্লামেন্টের ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৫৩৪ সালে অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী (Act of Supremacy) আইনটি পাস করেন। এর দ্বারা রাজাকে ইংল্যান্ডের চার্চের সর্বময় প্রভু ঘোষণা করা হয়। যারা অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসী মানতে অস্বীকার করেন তাদের রাজদ্রোহের অপরাধে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান করা হয়। এভাবে ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার করে পোপের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে ইংল্যান্ডের চার্চকে পোপ-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে রাজার অধীনে আনা হয়। ফলে ইংল্যান্ডে জাতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১-৮৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.