তৃতীয় ফ্রেডরিক, হ্যাবসবার্গ রাজবংশ, আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইউরোপে রাজনৈতিক অবস্থা ও ইতালীয় যুদ্ধ

Table of Contents

সম্রাট হিসেবে হাবসবার্গ রাজবংশকে প্রতিষ্ঠাকারী পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪৫২-১৪৯৩)

তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪১৫ – ১৪৯৩) ছিলেন ১৪৫২ সাল থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পবিত্র রোমান সম্রাট। তিনি ছিলেন হাবসবার্গ রাজবংশের চতুর্থ রাজা এবং প্রথম সম্রাট। তিনি ছিলেন পোপ কর্তৃক মুকুট প্রাপ্ত সর্বশেষ সম্রাট এবং রোমে মুকুট পরা সর্বশেষ সম্রাট।

তার সাম্রাজ্যগত রাজ্যাভিষেকের আগে, তিনি ১৪২৪ সাল থেকে স্টাইরিয়া, ক্যারিন্থিয়া এবং কার্নিওলা নিয়ে গঠিত অভ্যন্তরীণ অস্ট্রিয়ার ডিউক ছিলেন এবং ১৪৩৯ সাল থেকে অস্ট্রিয়ার ডাচির রিজেন্ট হিসাবেও কাজ করেছিলেন। তিনি ১৪৪০ সালে জার্মানির রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার ৫৩ বছরের রাজত্ব পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য বা জার্মান রাজতন্ত্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম। ১৪৪০ সালে তার মৃত্যুর পরে তার পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ান তার স্থলাভিষিক্ত হন।

রাজত্বকালে ফ্রেডরিক অস্ট্রিয়ার হাবসবার্গ “বংশগত ভূমি” পুনরায় একত্রিত করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন এবং ইম্পেরিয়াল বিষয়গুলিতে তিনি কম আগ্রহী ছিলেন। তবুও, হাঙ্গেরির সাথে তার রাজবংশীয় অধিকারের পাশাপাশি বার্গান্ডিয়ান উত্তরাধিকার দ্বারা তিনি পরবর্তী হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় তাকে “পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের আর্চ-স্লিপহেড” (জার্মান: এরজশ্লাফমুটজে) হিসাবে উপহাস করা সত্ত্বেও, তাকে আজ একজন কার্যকর শাসক হিসাবে দেখা হয়।

ইতিহাসবিদ থমাস এ ব্র্যাডি জুনিয়র ফ্রেডরিককে সাম্রাজ্যবাদী উপাধির উপর বিশ্বাসযোগ্য দাবি এবং অস্ট্রিয়ান ভূমিতে একটি সুরক্ষিত দখল রেখে যাওয়ার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, যার ফলে তার পুত্র ও বংশধরেরা এই অঞ্চলকে একটি একক রাষ্ট্র হিসাবে সংগঠিত করতে পারে। এই সাম্রাজ্যবাদী পুনরুজ্জীবন (পাশাপাশি আঞ্চলিক রাষ্ট্রের উত্থান) ফ্রেডরিকের রাজত্বকালে শুরু হয়েছিল।

প্রারম্ভিক জীবন

১৪১৫ সালে ইন্সব্রুকের টাইরোলিয়ান বাসভবনে জন্মগ্রহণকারী ফ্রেডরিক ছিলেন ইনার অস্ট্রিয়ান ডিউক ও হাবসবার্গ রাজবংশের লিওপোল্ডিয়ান লাইনের সদস্য আর্নেস্ট দ্য আয়রন এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী মাসোভিয়ার সিমবুর্গিস জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৪১৫ সালের নিউবার্গের চুক্তি অনুসারে, লিওপোল্ডিনিয়ান শাখা স্টাইরিয়া, ক্যারিনথিয়া এবং কার্নিওলার ডাচিগুলির উপর শাসন করেছিল, যা অভ্যন্তরীণ বা ইনার অস্ট্রিয়া হিসাবে পরিচিত ছিল। ফ্রেডরিকের আট ভাইবোনের মধ্যে মাত্র তিনজন শৈশবে বেঁচে ছিলেন: যারা ছিলেন তার ছোট ভাই অ্যালবার্ট (পরে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ষষ্ঠ অ্যালবার্ট), তার বোন মার্গারেট (পরে স্যাক্সনির ইলেক্ট্রেস) এবং ক্যাথরিন। ১৩৭৯ সালে নয় বছর বয়সী ফ্রেডরিকের বাবা মারা যান, ফলে ফ্রেডরিক পঞ্চম ফ্রেডরিক হিসাবে ইনার অস্ট্রিয়ার ডিউক হন, তার কাকা টাইরোলের ডিউক চতুর্থ ফ্রেডরিক তার রিজেন্ট হিসাবে কাজ করেছিলেন।

১৪৩১ সাল থেকে, ফ্রেডরিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন (“প্রাপ্তবয়স্ক” হিসাবে ঘোষিত হতে এবং এর মাধ্যমে শাসন করার অনুমতি লাভ করতে) তবে বেশ কয়েক বছর ধরে তার আত্মীয়রা তা প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে, ১৪৩৫ সালে, অস্ট্রিয়ার ডিউক পঞ্চম আলবার্ট (পরে জার্মানির রাজা দ্বিতীয় অ্যালবার্ট) তাকে তার ইনার অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকারের ওপর শাসন ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। প্রায় শুরু থেকেই ফ্রেডরিকের ছোট ভাই অ্যালবার্ট  সহ-শাসক হিসাবে তার অধিকার দাবি করেছিলেন, যাথেকে এক দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু হয়। ইতিমধ্যে এই বছরগুলিতে, ফ্রেডরিক প্রতীকী এ.ই.আই.ও.ইউ. সিগনেচারকে বিভিন্ন অর্থের সাথে এক ধরণের নীতিবাক্য হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ১৪৩৬ সালে তিনি পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রা করেছিলেন, অসংখ্য অভিজাতদের সাথে অর্ডার অফ দ্য হলি সেপুলচার দ্বারা নাইট উপাধি পেয়েছিলেন, যা তাকে দুর্দান্ত খ্যাতি প্রদান করেছিল।

১৪৩৯ সালে তার কাকা ডিউক চতুর্থ ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পরে, ফ্রেডরিক ডিউকের উত্তরাধিকারী সিগিসমান্ডের জন্য টাইরোল এবং ফার্দার অস্ট্রিয়ার রাজত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আবার তাকে তার ভাই ষষ্ঠ অ্যালবার্ট দ্বারা উত্থাপিত দাবিগুলি নস্যাৎ করতে হয়েছিল; তিনি টাইরোলিয়ান অভিজাতদের সমর্থনে জয়ী হয়েছিলেন। একইভাবে তিনি অস্ট্রিয়ার (ফার্দার অস্ট্রিয়া) ডাচিতে প্রয়াত রাজা দ্বিতীয় অ্যালবার্ট এবং তার স্ত্রী এলিজাবেথ অফ লুক্সেমবার্গের পুত্র ও তার ভাগ্নে লাডিসলাস দ্য পোস্টহিউমাসের রিজেন্ট হিসাবে কাজ করেছিলেন। (লাডিসলাস প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই মারা যায় বলে তার এই নাম)। এই অবস্থায় ফ্রেডরিক হাবসবার্গ রাজবংশের অবিসংবাদিত প্রধান ছিলেন, যদিও আলবার্টিনিয়ান লাইনের (ফার্দার অস্ট্রিয়া) ভূমিতে তার রাজত্বকে তখনও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত।

প্রয়াত রাজা দ্বিতীয় অ্যালবার্টের কাজিন ভাই হিসাবে, ফ্রেডরিক ১৪৪০ সালের সাম্রাজ্যগত বা ইম্পেরিয়াল নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৪৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, প্রিন্স-ইলেক্টররা ফ্রাঙ্কফুর্টে একত্রিত হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তাকে চতুর্থ ফ্রেডরিক হিসাবে রোমানদের রাজা নির্বাচিত করেন; তার শাসন তখনও স্টাইরিয়া, ক্যারিন্থিয়া এবং কার্নিওলা বা ইনার অস্ট্রিয়ার বংশগত ভূমি-ভিত্তিকই ছিল।

১৪৪২ সালে, ফ্রেডরিক নিজেকে জুরিখের বার্গোমাস্টার রুডলফ স্টাসির সাথে ওল্ড সুইস কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে ওল্ড জুরিখ যুদ্ধে (অল্টার জুরিখক্রিগ) অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হন। ১৪৪৮ সালে, তিনি হলি সি এর সাথে ভিয়েনার কনকর্ডে প্রবেশ করেছিলেন, যা ১৮০৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল এবং হাবসবার্গ রাজবংশ এবং হলি সি এর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করেছিল।

১৪৫২ সালে, ৩৭ বছর বয়সে, তৃতীয় ফ্রেডরিক তার নববধূকে গ্রহণ করতে এবং পবিত্র রোমান সম্রাটের মুকুট পেতে ইতালি ভ্রমণ করেছিলেন। তার বাগদত্তা পর্তুগালের রাজা এডওয়ার্ডের কন্যা ১৭ বছর বয়সী ইনফান্টা এলিয়েনর ১০৪ দিনের ভ্রমণ শেষে লিভর্নোতে (লেগহর্ন) অবতরণ করেন। বিয়ের জন্য ফ্রেডরিক কে যৌতুক লাভ করেন, তা তাকে তার ঋণ প্রশমিত করতে এবং তার ক্ষমতা দৃঢ় করতে সহায়তা করবে। এই দম্পতি ২৪শে ফেব্রুয়ারি সিয়েনায় মিলিত হন এবং রোমে একসাথে চলে যান। ঐতিহ্য মেনে তারা ৯ মার্চ শহরে প্রবেশের আগে রোমের দেয়ালের বাইরে একটি রাত কাটিয়েছিলেন, যেখানে ফ্রেডরিক এবং পোপ পঞ্চম নিকোলাস বন্ধুত্বপূর্ণ শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন। যেহেতু সম্রাট মোনজার ক্যাথেড্রাল থেকে লোম্বার্ডির লোহার মুকুট পুনরুদ্ধার করতে অক্ষম ছিলেন, বা মিলানের আর্চবিশপ কর্তৃক ইতালির রাজা হতে পারেননি (মিলানের শাসক ফ্রান্সেসকো স্ফোরজার সাথে ফ্রেডেরিকের বিরোধের কারণে), তিনি পোপকে জার্মান মুকুট দিয়ে মুকুট পরতে রাজি করিয়েছিলেন, যা এই উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল। মিলানের রাষ্ট্রদূতদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৬ই মার্চ সকালে এই রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিকেলে ফ্রেডরিক এবং এলিয়েনর পোপ দ্বারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অবশেষে, ১৯ মার্চ, ফ্রেডরিক এবং এলিয়েনরকে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় পবিত্র রোমান চার্চের ভাইস চ্যান্সেলর কার্ডিনাল ফ্রান্সেসকো কন্ডুলার দ্বারা অভিষিক্ত করা হয়েছিল এবং ফ্রেডরিককে পোপ কর্তৃক ইম্পেরিয়াল মুকুট দিয়ে রাজ্যাভিষেক করা হয়েছিল। ফ্রেডরিক ছিলেন শেষ পবিত্র রোমান সম্রাট যিনি রোমে মুকুট পরেছিলেন। তার প্রপৌত্র পঞ্চম চার্লস ছিলেন শেষ সম্রাট যিনি মুকুট পেয়েছিলেন, তবে এটি বোলোনিয়ায় করা হয়েছিল।

সম্রাট-জীবন

ফ্রেডরিকের রাজনৈতিক উদ্যোগগুলি খুব কমই সাহসী ছিল, তবে সেগুলো সফলও ছিল। তৃতীয় ফ্রেডরিক ১৪৫২ সালে পবিত্র রোমান সম্রাটের মুকুট লাভ করেন, পূর্ববর্তী সম্রাট সিগিসমান্ডের মৃত্যুর পর। সম্রাটের ভূমিকায় তার আরোহণ এর সাথে এই শর্ত ছিল যে, বোহেমিয়ার পূর্ববর্তী রানী (আলবার্টাইন লাইনের পঞ্চম অ্যালবার্টের স্ত্রী) যদি কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারীর জন্ম দেন তবে ফ্রেডরিক তার অভিভাবক হবেন। রানী যখন লাডিসলাস দ্য পোস্টহিউমাসের জন্ম দেন, শর্ত অনুসারে, ফ্রেডরিক তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে ফ্রেডরিক এবং রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আভিজাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তার প্রথম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তার ভাই ষষ্ঠ অ্যালবার্ট, যিনি তার শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে একটিও সংঘাত জিততে সক্ষম হননি এবং এইভাবে আরও সূক্ষ্ম উপায় অবলম্বন করেছিলেন। তিনি তার সেকন্ড কাজিন ভাই অর্থাৎ অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এবং বোহেমিয়ার আর্চডাচির শাসক লাডিসলাস দ্য পোস্টহিউমাসকে বন্দী করেছিলেন, ( তিনি ১৪৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন) এবং নিম্ন অস্ট্রিয়ার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য তার উপর চিরতরে তার অভিভাবকত্ব প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিলেন। লাডিসলাস ১৪৫২ সালে নিম্ন অস্ট্রিয়ান এস্টেট এর দ্বারা মুক্ত হয়েছিল। ফ্রেডরিক হাবসবার্গ পরিবারের টাইরোলিয়ান লাইনের তার ফার্স্ট কাজিন ভাই সিগিসমান্ডের প্রতি একইভাবে আচরণ করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত, ফ্রেডরিক তার বিরোধীদের পরাজিত করে এবং কখনও কখনও তাদের ভূমির উত্তরাধিকারী হয়ে এই সমস্ত দ্বন্দ্বে জয়লাভ করেছিলেন, যেমনটি হয়েছিল লাডিসলাউসের ক্ষেত্রে, যার কাছ থেকে তিনি ১৪৫৭ সালে নিম্ন অস্ট্রিয়া অর্জন করেছিলেন এবং তার ভাই ষষ্ঠ অ্যালবার্ট এর সাথে, যার সাথে তিনি আপার অস্ট্রিয়ায় সফল হয়েছিলেন। ১৪৬১ সালে, তার ভাই অ্যালবার্ট ভিয়েনায় তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উত্থাপন করেছিলেন এবং সম্রাটকে বিদ্রোহী প্রজাদের দ্বারা তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। ভাইদের মধ্যে এই যুদ্ধে ফ্রেডরিক বোহেমিয়ার রাজা, পোডিব্রাডির জর্জের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিলেন। এই দ্বন্দ্বগুলির কারণে তাকে বারবার তার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ১৪৬৯ সালে ফ্রেডরিখ অর্ডার অফ সেন্ট জর্জ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজও বিদ্যমান, রোমের ল্যাটারন বেসিলিকায় এর প্রথম ইনভেস্টিচারটি তিনি এবং পোপ দ্বিতীয় পল দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল।

ধনী বার্গান্ডিয়ান রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী মেরি, তার পিতা চার্লস দ্য বোল্ডের মৃত্যুর পরে, শীঘ্রই তৃতীয় ফ্রেডেরিকের পুত্র ও অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ম্যাক্সিমিলিয়ানকে (ভবিষ্যত পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান) বিয়ে করেন যিনি তার সহ-শাসক হয়েছিলেন। বার্গান্ডির উত্তরাধিকারের সাথে, হাবসবার্গ হাউস ইউরোপে প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এটি এই প্রবাদটির জন্ম দেয় “Let others wage wars, but you, happy Austria, shall marry”, যা রাজবংশের একটি নীতিবাক্য হয়ে ওঠে।

ফ্রেডরিক ১৪৮৬ সালে তার নিজের জীবদ্দশায় পুত্রের উত্তরাধিকার নিরাপদ করেছিলেন। ১৪৮৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ম্যাক্সিমিলিয়ান ফ্রাঙ্কফুর্ট রাইখস্ট্যাগে উপস্থিত ছয় জন নির্বাচকের দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে রোমান-জার্মান রাজা নির্বাচিত হন। বোহেমিয়ার ইলেক্টরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি কারণ হাঙ্গেরিয়ান রাজা কর্ভিনাস বোহেমিয়ান স্পা আইনটির আশ্রয় নিতে পারতেন। ফ্রেডরিক সক্রিয়ভাবে তার ছেলের নির্বাচনের উদ্যোগ দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। ফ্রেডরিকের একমাত্র বেঁচে থাকা পুরুষ উত্তরাধিকারী হিসাবে, ম্যাক্সিমিলিয়ান হাঙ্গেরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোকাবেলায় ফ্রেডরিক এবং এস্টেটের জন্য একটি স্বাভাবিক পছন্দ ছিল। ম্যাক্সিমিলিয়ানের নির্বাচন উপলক্ষে, দশ বছরের ভূমি শান্তি বা ল্যান্ড পিসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফ্রেডরিকের ধারণার ভিত্তিতে, ১৪৮৮ সালে সোয়াবিয়ার অনেক সাম্রাজ্য-সম্পর্কিত রাজ্য সোয়াবিয়ান লীগ গঠনের জন্য একত্রিত হয়। শান্তি বজায় রাখতে এবং হাউস অফ উইটেলসবাখকে তার অঞ্চল সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখতে এটি করা হয়েছিল। ফ্রেডরিক তার পুত্রকে আচেনে নিয়ে যান, যেখানে ম্যাক্সিমিলিয়ানকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ১৪৮৬ সালের ৯ই এপ্রিল তাঁকে মুকুট পরানো হয়। বাবা ও ছেলের মধ্যে সমস্যা ছিল কারণ তারা আলাদা মানুষ ছিলেন এবং আলাদা উপায়ে নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু ফ্রেডরিক ম্যাক্সিমিলিয়ানের মূল্য বুঝেছিলেন যখন তিনি এস্টেটের সাথে আলোচনা করছিলেন। এভাবে তিনি ম্যাক্সিমিলিয়ানের সাম্রাজ্যিক ক্ষমতা হারানোর বিষয়ে চিন্তিত থাকলেও ম্যাক্সিমিলিয়ান দ্রুত সাম্রাজ্যিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেন।

১৪৮৭ সালে, তার কন্যা কুনিগুন্ডে বাভারিয়ার ডিউক চতুর্থ অ্যালবার্টকে বিয়ে করেছিলেন। অ্যালবার্ট অবৈধভাবে কিছু ইম্পেরিয়াল ফিফের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন এবং তারপর কুনিগুন্ডেকে তাঁকে বিয়ে করতে বলেছিলেন (যিনি তার বাবার থেকে অনেক দূরে ইন্সব্রুকে বাস করতেন), এবং তাকে যৌতুক হিসাবে ফিফ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফ্রেডরিক প্রথমে রাজি হয়েছিলেন, তবে অ্যালবার্ট আরেকটি ফিফ, রেগেনসবার্গের দায়িত্ব নেওয়ার পরে ফ্রেডরিক তার সম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ১৪৮৭ সালের ২ জানুয়ারী, ফ্রেডরিকের সিদ্ধান্তের পরিবর্তনের বিষয়টি তার কন্যাকে জানানোর আগে কুনিগুন্ডে অ্যালবার্টকে বিয়ে করেছিলেন। সম্রাটের পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ানের মধ্যস্থতার মাধ্যমেই একটি যুদ্ধ প্রতিরোধ করা হয়েছিল।

কিছু ছোট বিষয়ে, ফ্রেডরিক বেশ সফল ছিলেন: ১৪৬৯ সালে তিনি ভিয়েনা এবং উইনার নিউস্টাডে বিশপরিক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এটা এমন একটি পদক্ষেপ ছিল যা অস্ট্রিয়ার কোনও পূর্ববর্তী ডিউক অর্জন করতে সক্ষম হননি।

ফ্রেডরিক বোহেমিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান যুদ্ধে (১৪৬৮-৭৮) হাঙ্গেরি এবং বোহেমিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে ব্যর্থ হন। ফ্রেডরিক ১৪৫৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিজেকে হাঙ্গেরির রাজা ঘোষণা করেছিলেন, তবে এটি ম্যাথিয়াস কর্ভিনাসকে ভীত করেনি। ফ্রেডরিক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তবে তার সেনাবাহিনী কখনই বেশি দূর যেতে পারেনি, কারণ তিনি কোনও জেনারেল ছিলেন না। মান্টুয়ার দ্বিতীয় পিয়াস (যিনি ফ্রেডেরিকের প্রাক্তন সচিবও ছিলেন) সম্রাটকে ম্যাথিয়াসকে একা ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “হাঙ্গেরি হল সমস্ত খ্রীষ্টীয় জগতের ঢাল, যার আড়ালে আমরা এখন পর্যন্ত নিরাপদ ছিলাম। […] এভাবে যদি রাস্তাটি বর্বরদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, তাহলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং যারা এটি করবে তাদেকে ঈশ্বর এই ধরনের দুর্যোগের পরিণতি চাপিয়ে দেবেন।” ফ্রেডরিক অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান যুদ্ধে (১৪৭৭-৮৮) ১৪৮৫ সালে ম্যাথিয়াস করভিনাসের কাছে পরাজিত হন, যিনি ভিয়েনা অবরোধে পাঁচ বছর পরে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভিয়েনায় বসবাস বজায় রাখতে সক্ষম হন। সম্রাট ফ্রেডরিক প্রিন্স-ইলেক্টরস এবং ইম্পেরিয়াল স্টেটগুলির কাছ থেকে সহায়তা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। ১৪৮৩ সালে তাকে ভিয়েনায় তার হফবার্গের বাসভবন ত্যাগ করতে হয়েছিল এবং উইনার নিউস্টাডে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, যেখানে ১৪৮৭ সালে দুর্গটি দখল না হওয়া পর্যন্ত তিনি ১৮ মাস ধরে ম্যাথিয়াসের সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিলেন। অপমানিত হয়ে ফ্রেডরিক গ্রাজে পালিয়ে যান এবং পরে আপার অস্ট্রিয়ার লিঞ্জে চলে যান।

ফ্রেডরিকের ব্যক্তিগত নীতিবাক্য ছিল রহস্যময় স্ট্রিং এ.ই.আই.ও.ইউ, যা তিনি তার সমস্ত জিনিসপত্রে ছাপিয়েছিলেন। তিনি কখনই এর অর্থ ব্যাখ্যা করেননি, যার ফলে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছিল, যদিও দাবি করা হয়েছে যে তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন যে এটি অস্ট্রিয়া ইস্ট ইমপেরারে অরবি ইউনিভার্সালি বা অ্যালেস এরড্রিখ ইস্ট ওস্টাররিচ আনটারটান (“সমস্ত বিশ্ব অস্ট্রিয়ার অধীন”)। এটি তার শাসনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং অর্থ এবং ইম্পেরিয়াল উপাধির প্রাথমিক অর্জন সম্পর্কে তার নিজস্ব বোধের প্রতীক হতে পারে।

ফ্রেডরিক সাম্রাজ্যের সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে খুব সতর্ক ছিলেন। তার রাজত্বের বেশিরভাগ সময়, তিনি সংস্কারকে তার সাম্রায়িক বিশেষাধিকারের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে গিয়েছিলেন, যা রাজারা যদি তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে তাহলে তা তার অপমানের কারণ হতে পারে। ১৪৪০ এর পরে, সাম্রাজ্য এবং চার্চের সংস্কার বজায় ছিল এবং স্থানীয় এবং আঞ্চলিক শক্তি, বিশেষত আঞ্চলিক রাজাদের দ্বারা তা পরিচালিত হয়েছিল। তবে তার শেষ বছরগুলিতে, উচ্চস্তর থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তার উপর আরও চাপ ছিল। মেইনজের আর্চবিশপ বার্থল্ড ভন হেনবার্গ, যিনি সংস্কারমনস্ক রাজাদের পক্ষে কথা বলেছিলেন (যারা সাম্রাজ্যের হাতকে শক্তিশালী না করে সাম্রাজ্য সংস্কার করতে চেয়েছিলেন), ম্যাক্সিমিলিয়ানের জন্য সাম্রাজ্যবাদী নির্বাচন সুরক্ষিত করার ফ্রেডরিকের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করেছিলেন। সুতরাং তার শেষ বছরগুলিতে, তিনি ইম্পেরিয়াল সংস্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে সভাপতিত্ব করেছিলেন, যা মূলত তার পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ানের অধীনে প্রসারিত হবে। ম্যাক্সিমিলিয়ান নিজে সংস্কারের জন্য আরও উন্মুক্ত ছিলেন, যদিও স্বাভাবিকভাবেই তিনি সাম্রাজ্যবাদী বিশেষাধিকার সংরক্ষণ এবং বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। ১৪৮৮ সালে ফ্রেডরিক লিঞ্জে অবসর নেওয়ার পরে, একটি সমঝোতা হিসাবে, ম্যাক্সিমিলিয়ান রাজাদের সাথে তার পিতার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন। ফ্রেডরিকের মৃত্যুর পরে যখন তিনি একক শাসন অর্জন করেছিলেন, তখন তিনি এই নীতিটি অব্যাহত রেখেছিলেন, রাজাদের প্রস্তাবিত বিকল্পগুলির মধ্যে নিরপেক্ষ বিচারক হিসাবে কাজ করেছিলেন।

লেগেসি

জার্মান ইতিহাসবিদরা অস্ট্রিয়ানদের ইতিহাসবিদদের চেয়ে ফ্রেডরিকের বেশি সমালোচনা করেন। অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ অ্যাডাম ওয়ান্ড্রুস্কা মনে করেন যে তৃতীয় ফ্রেডরিক একজন চিত্তাকর্ষক সম্রাট ছিলেন না, তবে তিনি তার পরিবারের রাজবংশীয় স্বার্থ রক্ষা এবং সম্প্রসারণে কার্যকর ছিলেন। ওয়ান্ড্রুস্কা তাকে “হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা” বলে অভিহিত করেছেন। জার্মান ইতিহাসবিদ পল-জোয়াকিম হেইনিগ লিখেছেন যে ম্যাক্সিমিলান একজন দৈত্যের কাঁধে দাঁড়িয়েছিলেন, তবুও ফ্রেডরিক এমন কাঁধ সরবরাহ করেছিলেন যা ছাড়া ম্যাক্সিমিলিয়ান নিজেই দৈত্য হতে পারতেন না।

ফ্রেডরিক ইহুদিদের জন্য একজন মহান উপকারকারী ছিলেন – তার শত্রুরা তাকে “পবিত্র রোমান সম্রাটের চেয়ে ইহুদি” হিসাবে বর্ণনা করেছিল। তিনি জ্যাকব বেন জেহিল লোনস এর মতো ইহুদি পণ্ডিতদের পক্ষে ছিলেন, যিনি হেব্রাইস্ট জোহান রিউচলিনের শিক্ষক ছিলেন। তার সম্রাজ্ঞী এলিয়েনরও ইহুদিদের পক্ষে ছিলেন। অজানা কারণে, তাদের পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ান ছোটবেলায় ইহুদিদের প্রতি অপছন্দ গড়ে তোলে। ইহুদিদের সাথে তার নিজস্ব সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে বিকশিত হয়েছিল। শ্যাটনার-রিসার মনে করেন যে আধুনিক ইহুদিধর্মের ভিত্তি ফ্রেডরিক এবং ম্যাক্সিমিলিয়ান যুগে উদ্ভূত হয়েছিল, যা “মানবতাবাদের নীতির সাথে জড়িত ছিল”।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে স্পেইন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও হাঙ্গেরিতে হাবসবার্গ শাসনের বিস্তার

স্পেইনের ফার্দিনান্দ-ইজাবেলা ও জোয়ানা সহ তাদের সন্তানেরা

স্পেইনের রাজকীয় ইতিহাস ও তার সাথে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের কাহিনী শুরু করতে হলে স্পেইনে এরাগনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফার্দিনান্দকে (রা. ১৪৭৯-১৫১৬) দিয়েই শুরু করা যাক। পূর্ববর্তী এরাগনের রাজা দ্বিতীয় জনের (১৪৫৮-১৪৭৯) এর মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় আসেন। তবে ১৪৭৯ সালে এরাগনে রাজ্যাভিষেকের আগেই তিনি রাজা হন, এরাগনের রাজা নন, একটু অন্যরকম রাজা। ফার্দিনান্দের বিয়ে হয়েছিল ১৪৬৯ সালে ক্যাস্টাইল ও লিওন এর রাজকুমারী ইজাবেলার সাথে। তখন ক্যাস্টাইল ও লিওন শাসন করছেন ইজাবেলার বড় ভাই চতুর্থ হেনরি। ১৪৭৪ সালে সেই চতুর্থ হেনরির মৃত্যু হলো। চতুর্থ হেনরির একটি মাত্র কন্যা সন্তান ছিল, কিন্তু সেই কন্যার পিতা যে চতুর্থ হেনরিই তার নিশ্চয়তা ছিলোনা। বেশ কিছু কারণে, যেমন রাজার পূর্ববর্তী স্ত্রী এর নিঃসন্তান থাকা ও বিবাবিচ্ছেদের পরও তাকে ভার্জিন হিসেবে আবিষ্কার করা, রাজার সমকামী বা যৌনতায় অক্ষম হবার সম্ভাবনা। পরবর্তী রানীর পরকীয়া সম্পর্ক ও অন্যের দ্বারা দুটো সন্তানের প্রসব ইত্যাদি কারণেই সেই কন্যা সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তার এক ছোট ভাই ছিল, আলফন্সো, কিন্তু ১৪৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার অকালমৃত্যু হয়। তাই শেষ পর্যন্ত ক্যাস্টাইল ও লিওন এর সিংহাসন চলে যায় চতুর্থ হেনরির বোন ইজাবেলার কাছে। ইজাবেলা প্রথম ইজাবেলা নাম নিয়ে ১৪৭৪ সালে সিংহাসনে বসেন। আর তার স্বামী যেহেতু এরাগনের রাজপুত্র ফার্দিনান্দ, তাই ফার্দিনান্দ পঞ্চম ফার্দিনান্দ নাম নিয়ে ক্যাস্টাইল ও লিওন এর জুরে উক্সরিস রাজা হন, এবং প্রথম ইজাবেলার সাথে ক্যাস্টাইল ও লিওন এর সহশাসক হন। (উল্লেখ্য, জুরে উক্সরিস রাজা ও কিং কনসর্ট এক না। কিং কনসর্ট এর কোন শাসন ক্ষমতা থাকেনা, তিনি কেবলই স্বামী হওয়ায় তার রানীর কনসর্ট, শাসনে তার কোন এখতিয়ার নেই। কিন্তু জুরে উক্সরিস রাজা তার স্ত্রী এর সাথে একজন সহ-শাসক। রানী ও তার স্বামী হিসেবে জুরে উক্সরিস রাজার ক্ষমতা সমান। কিন্তু তার ক্ষমতার ভিত্তি যেহেতু তার স্ত্রী, তাই স্ত্রী এর মৃত্যু হলে তার ক্ষমতাও বিলুপ্ত হবে।) যাই হোক, এভাবেই ফার্দিনান্দ নিজ রাজ্যে রাজা হবার পাঁচ বছর পূর্বেই ক্যাস্টাইল ও লিওন এর রাজা হয়ে গেছিলেন।

বর্তমান আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় তখন তিনটি রাজ্যই – পর্তুগাল; ক্যাস্টাইল ও লিওন বা ক্যাস্টাইল রাজ্য, এরাগন ও মুসলিম শাসিত গ্রানাডা। বর্তমান স্পেইন ছিল তখনকার ক্যাস্টাইল, এরাগন ও গ্রানাডার রাজ্যের সমষ্টি। ১৪৭৯ সালে ফার্দিনান্দ দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ হিসেবে এরাগনের সিংহাসনে বসেন। এভাবে তিনি কার্যত এরাগন ও ক্যাস্টাইলের শাসক হন। গ্রানাডা যুদ্ধ (১৪৮২-১৪৯২) শাসনকালেই হয়, এবং ১৪৯২ সালে গ্রানাডা বিজয়ের পর তিনি হন আধুনিক স্পেইন যে অঞ্চল নিয়ে গঠিত তার পুরোটার শাসক, মানে গোটা স্পেইনের শাসক। আর আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে গেলে তার ও ইজাবেলার বংশধরের হাতেই গোটা স্পেইনের শাসন চলে যাবে। ঠিক এই ক্ষেত্রেই ইজাবেলা ও ফার্দিনান্দের সন্তানদের নিয়ে আলোচনায় যেতে হয়।

ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার বিয়ের এক বছর পর ১৪৭০ সালে তাদের ইজাবেলা নামে এক কন্যা সন্তান হয়। ১৪৯০ সালে তার সাথে পর্তুগালের রাজকুমার ও ভাবি রাজা আলফনসোর সাথে বিয়ে হয়, কিন্তু পরের বছর ১৪৯১ সালেই আলফোন্সোর মৃত্যু হয়। পরে ১৪৯৫ সালে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জনের মৃত্যুর পর পর্তুগালের শাসন চলে যায় ম্যানুয়েলের কাছে যিনি প্রথম ম্যানুয়েল (১৪৯৫-১৫২১) নামে পর্তুগালের সিংহাসনে আরোহন করেন। এর সাথেই পরে আবার ১৪৯৫ সালে ইজাবেলার বিয়ে হয়। তবে ইজাবেলা বেশিদিন বাঁচেনি, ১৪৯৮ সালেই তার মৃত্যু হয়। ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্তান ছিল যথাক্রমে ১৪৭৮ সালে জন্ম নেয়া পুত্র সন্তান জন, ও ১৪৭৯ সালে জন্ম নেয়া কন্যা সন্তান জোয়ানা। ঠিক এদের উপর ভিত্তি করেই স্পেইনের সাথে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রপাত।

হাবসবার্গের ম্যাক্সিমিলিয়ান, বার্গান্ডির মেরি ও  সন্তান ফিলিপের সাথে জোয়ানার বিবাহ

হাবসবার্গ রাজবংশের পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডরিক সম্রাট ছিল ১৪৯৩ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ানের পরবর্তী সম্রাট-পদ নিশ্চিত করে যান। ১৪৮৬ সাল থেকেই পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ান প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান নাম নিয়ে জার্মানি ও ইতালির সহ-শাসক হন। সেই সময় বার্গান্ডির ডাচি খুব শক্তিশালী ছিল, যা বর্তমান নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ও ফ্রান্সের একাংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই ডাচির একাংশ ছিল ফ্রান্সের অধীনে, আরেকাংশ ছিল পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। ফ্রান্সের শাসনক্ষমতায় বার্গান্ডির বেশ প্রভাব ছিল। যাই হোক, বার্গান্ডির ডিউক চার্লস দ্য বোল্ডের (১৪৬৭-১৪৭৭) মৃত্যুর পর তার একমাত্র কন্যা মেরি হন বার্গান্ডির শাসক। তবে পিতার সমস্ত ভূমির উত্তরাধিকারী মেরি হতে পারেননি। ১৪৭৪-১৪৭৭ সালে ডাচি অফ বার্গান্ডি ও সুইস কনফেডারেসির মধ্যে বার্গান্ডিয়ান যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বার্গান্ডি পরাজিত হয় ও ১৪৭৭ সালে চার্লস দ্য বোল্ড নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে বার্গান্ডি ভাগ হয়ে যায়, ফ্রেঞ্চ বার্গান্ডিকে ফ্রান্স দখল করে নেয়। ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডি চার্লস দ্য বোল্ডের কন্যা মেরির দখলে ছিল। ১৪৭৭ সালে মেরি তার স্বামী হিসেবে রাজকুমার ম্যাক্সিমিলিয়ানোকে বেছে নেন, আর তার মাধ্যমে ১৪৭৭ সালে ম্যাক্সিমিলিয়ান হন ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডির জুরে উক্সরিস ডিউক ও সহ-শাসক। পরের বছর ১৪৭৮ সালে ম্যাক্সিমিলিয়ান ও মেরির পুত্র সন্তান ফিলিপের জন্ম হয়। দেখতে সুন্দর ছিলেন বলে তিনি ফিলিপ দ্য হ্যান্ডসাম নাম পরিচিতি লাভ করেন। এর দুই বছর পর ১৪৮০ সালে মেরি ও ম্যাক্সিমিলিয়ানের মার্গারেট নাম এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যাই হোক, এর মাত্র দুই বছর পরই ১৪৮২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মেরির মৃত্যু হয়। এই অবস্থায় ম্যাক্সিমিলিয়ান আর ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডির শাসক থাকতে পারেননা। তিনি পুত্র ফিলিপের কাছে বার্গান্ডির আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তখন ফিলিপ লর্ড অফ নেদারল্যান্ডস ও ডিউক অফ বার্গান্ডি অভিধা লাভ করে ফিলিপ বার্গান্ডির ডিউক হন ও তার মা মেরির সাথে বার্গান্ডির সহ-শাসক হন। ম্যাক্সিমিলিয়ান পুত্রের রিজেন্ট হিসেবে বার্গান্ডি শাসন করতেন। এভাবে ১৪৮২ সাল থেকে ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডির ক্ষমতা হাবসবার্গ রাজবংশের হাতে চলে আসে, এভাবে এই অঞ্চল হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডস নাম পরিচিত হতে শুরু করে, যার সাথে পরে আরো কিছু অঞ্চল যুক্ত হয়।

এরপর ১৪৮৬ সালে ম্যাক্সিমিলিয়ান জার্মানি ও ইতালির সহ-শাসক ও ১৪৯৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর তিনি হলেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট, সেই সাথে অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক বা শাসকও। ১৪৯৬ সালে ম্যাক্সিমিলিয়ান স্পেইনের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরিতে জোর দেন। ১৪৯৬ সালে তার পুত্র বার্গান্ডির ডিউক ফিলিপের সাথে স্পেইনের শাসক ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার কন্যা জোয়ানার বিবাহ হয়। এর এক বছর পর ১৪৯৭ সালে ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার পুত্র জনের সাথে ম্যাক্সিমিলকিয়ান ও মেরির কন্যা মার্গারেটের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এভাবে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সাথে স্পেইনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। তবে বিয়ের বছর ১৪৯৭ সালেই ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার একমাত্র পুত্র জনের মৃত্যু হয়েছিল।

ক্যাথরিন ও ৮ম হেনরির বিবাহ ও বিচ্ছেদ

ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার আরো দুই সন্তান জন্ম নিয়েছিল। দুজনই কন্যা সন্তান ছিল। ১৪৮২ সালে মারিয়ার জন্ম হয়। ১৪৯৮ সালে তার বড় বোন ও পর্তুগালের রানী ইজাবেলার মৃত্যু হয়। এরপর ১৫০০ সালে তার সাথে পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের (১৪৯৫-১৫২১) বিবাহ হয়েছিল। ১৫১৭ সালে তার মৃত্যু হয়। ১৪৮৫ সালে ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার আরেক কন্যা সন্তান ক্যাথেরিনের জন্ম হয়। ১৫০১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ৭ম হেনরির (১৪৮৫-১৫০৯) বড় পুত্র ও ভাবি রাজা আর্থারের সাথে তার বিয়ে হয়, কিন্তু ১৫০২ সালেই আর্থার মারা যান। এরপর ১৫০৯ সালে ৭ম হেনরির মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন তার আরেক পুত্র ৮ম হেনরি (১৫০৯-১৫৪৭)। ১৫০৯ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির (১৫০৯-১৫৪৭) সাথে তার বিয়ে হয়েছিল ও ১৫৩৩ সাল পর্যন্ত তার বিবাহ টিকেছিল। ১৫১৬ সালে মেরি  নামে তাদের এক কন্যা সন্তানও হয়েছিল। ক্যাথেরিনের সাথে বিবাহবিচ্ছেদের জন্যই হেনরি ইংল্যান্ডে ধর্ম-সংস্কার এনেছিলেন।

রেনেসাঁ ও লুথারীয় মতবাদের প্রভাবে ইংল্যান্ড যখন ব্যাপক সুদূরপ্রসারী সংস্কারের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে রানী ক্যাথারিনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রশ্নে পােপের সাথে অষ্টম হেনরীর বিরােধ সৃষ্টি হয়। এটাই রােমের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশু কারণ ছিল। ক্যাথারিনের সাথে দীর্ঘকাল ঘর করে অষ্টম হেনরী ক্রমে তার ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন। পুত্রহীনা ক্যাথারিন ছিলেন অকাল বার্ধক্যপীড়িত। তার সন্তানদের মধ্যে একমাত্র কন্যা মেরী ছাড়া আর কেউ জীবিত ছিল না। হেনরী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে পুত্রের জন্যে লালায়িত ছিলেন এবং সেজন্য আবার বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এ ছাড়া ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে হেনরী স্পেনের সাথে মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করলে স্পেনরাজ দুহিতা ক্যাথারিনের সাথে তার মতান্তর হয়। এতে পত্নীর ওপর হেনরীর বিতৃষ্ণা আরাে বেড়ে যায়। সর্বোপরি, হেনরী অ্যানবােলিন নামে জনৈকা সুন্দরী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করতে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় ধর্মমতে প্রথমা পত্নী ক্যাথারিনকে আইনত ত্যাগ করার পূর্বে এ বিয়ে সম্ভব ছিল না। এ সকল কারণে অষ্টম হেনরী ক্যাথারিনকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেজন্য অজুহাতের অভাব হলাে না। তিনি যুক্তি দেখালেন যে, ক্যাথারিন তার চেয়ে পাঁচ বছরেরও অধিক বয়স্কা; ক্যাথারিন পূর্বে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ ছিলেন বলে তার সাথে বিবাহ ধর্মের চোখে অগ্রাহ্য এবং সেহেতু অভিশপ্ত ছিল। অভিশপ্ত বিবাহ বলেই ক্যাথারিন হেনরীকে কোন পুত্র সন্তান দান করতে পারেননি। এ সকল যুক্তি দেখিয়ে হেনরী ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে পােপের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এরূপ সম্মতি দান ও প্রত্যাহার করার প্রথা সেকালে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে পােপ সমস্যায় পড়লেন। কারণ, একদিকে ক্যাথারিন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের মাতৃম্বসা বা মাসি; অন্যদিকে চার্লস অষ্টম হেনরীর মতই একজন দুর্ধর্ষ রাজা। এ কারণে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ সমর্থন করতে সাহসী হলেন না; অথচ হেনরীকে অসন্তুষ্ট করতেও দ্বিধাবােধ করতে লাগলেন। সুতরাং বৃথা সময় হরণ করার উদ্দেশ্যে তিনি তার ইংল্যান্ডস্থ প্রতিনিধি ও হেনরীর উপদেষ্টা থমাস উল্‌সী এবং ক্যাম্পাগ্‌জিয়াে নামে একজন ইতালির কার্ডিনালকে ইংল্যান্ডেই উক্ত অভিযােগের বিচার করতে আদেশ দেন। কিন্তু তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই পােপ ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ হাতে বিচারকার্য গ্রহণ করেন এবং হেনরী বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি আদায় করতে ব্যর্থ হন। এটাই ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের তথা পােপের সাথে ইংল্যান্ডীয় চার্চের সম্পর্কচ্ছেদের প্রত্যক্ষ কারণ।

ফিলিপ ও ফার্দিনান্দের মৃত্যু ও পঞ্চম চার্লসের ক্ষমতায় আসা

যাই হোক, ১৫০৪ সালে রানী ইজাবেলার মৃত্যু হয়। ক্যাস্টাইল ও লিওন রাজ্যে ফার্দিনান্দের শাসনের ভিত্তি তার স্ত্রী হওয়ায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেই রাজ্যে তার আর ক্ষমতা থাকেনা, ক্ষমতা চলে যায় তার উত্তরাধিকারীর হাতে। এখন এদের একমাত্র পুত্র সন্তান জন ১৪৯৭ সালে মারা গেছে। প্রথম কন্যা ইজাবেলাও ১৪৯৫ সালে মারা গেছে। তাই ক্ষমতা চলে যায় তৃতীয় সন্তান রাজকন্যা জোয়ানা ও তার স্বামী বার্গান্ডির ডিউক ফিলিপ দ্য হ্যান্ডসামের হাতে। দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ রিজেন্ট হিসেবে শাসন করতে চাইলেও তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। ১৫০৬ সালে বার্গান্ডি থেকে জোয়ানা (১৫০৪-১৫৫৫) ও ফিলিপ (১৫০৬) স্পেইনে এসে ক্যাস্টাইলের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ফিলিপ প্রথম ফিলিপ (১৫০৬) নাম নিয়ে ক্যাস্টাইল রাজ্যের জুরে উক্সরিস রাজা হন ও সহ-শাসক হয়ে শাসন করেন। তবে তিনি বেশি দিন শাসন করতে পারেননি। সেই বছর ১৫০৬ সালেই টাইফয়েড জ্বরে তিনি মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর জোয়ানা পাগল হয়ে যান, শাসন করার অবস্থা তার ছিলোনা, তাই তার পিতা ফার্দিনান্দই তার রিজেন্ট হিসেবে ক্যাস্টাইল শাসন করতেন।

তবে ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনে ফিলিপ ও জোয়ানা ৬ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। ১৪৯৮ সালে বড় মেয়ে এলিয়ানরের জন্ম হয়। জোয়ানার বোন মারিয়া ১৫১৭ সালে মারা যায়। জোয়ানা তখন ক্যাস্টাইলের সাথে এরাগনেরও শাসিকা। তিনি পর্তুগালের সাথে বরাবরই ভালো সম্পর্ক রাখতে চেয়েছেন। বোন মারিয়ার মৃত্যু হলে তিনি তার বড় মেয়ে এলিয়ানরের সাথেই পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের (১৪৯৫-১৫২১) বিয়ে দেন। ১৫২১ সালে ৫২ বছর বয়সী রাজা ম্যানুয়েলের মৃত্যু হলে এলিয়ানোর বিধবা হয়ে যায়। পরে ১৫৩০ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের (১৫৩০-১৫৪৭) এর সাথে তার বিয়ে হয়। দ্বিতীয় সন্তান চার্লস এর জন্ম হয় ১৫০০ সালে। ১৫০৬ সালে বার্গান্ডির ডিউক ফিলিপের মৃত্যু হলে ৬ বছর বয়সে তিনিই চার্লস বার্গান্ডির ডিউক হন (পরে এই চার্লসই ১৫১৬ সালে স্পেইনের রাজা ও ১৫১৯ সালে পবিত্র রোমান সম্রাট হন)। ১৫০১ সালে ফিলিপ ও জোয়ানার তৃতীয় সন্তান ইজাবেলার জন্ম হয়, ১৫১৪ সালে ডেনমার্ক ও নরওয়ে এর রাজা দ্বিতীয় ক্রিশ্চিয়ানের (১৫১৩-১৫২৩) সাথে তার বিয়ে হয়। ১৫০৩ সালে চতুর্থ সন্তান ফার্দিনান্দের জন্ম হয় (পরে এই ফার্দিনান্দই ১৫২১ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক, ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, বোহেমিয়ার রাজা, ১৫৩১ সালে জার্মানি ও রোমানদের রাজা, ও ১৫৫৬ সালে পবিত্র রোমান সম্রাট হন)। ১৫০৫ সালে পঞ্চম সন্তান মেরির জন্ম হয়, ১৫১৫ সালে হাঙ্গেরির রাজপুত্র লুইসের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়, যিনি এক বছর পর দ্বিতীয় লুইস (১৫১৬-১৫২৬) নাম নিয়ে হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া ও বোহেমিয়ার রাজা হন। ১৫০৭ সালে জোয়ানা ও ফিলিপের শেষ ও ষষ্ঠ সন্তান ক্যাথেরিনের জন্ম হয়। ১৫২১ সালে পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের মৃত্যুর পর সেখানকার রাজা হন ম্যানুয়েল ও মারিয়ার (জোয়ানার বোন) পুত্র তৃতীয় জন (১৫২১-১৫৫৭)। স্পেইন আগের মতো এবারও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে পর্তুগালের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করে। জোয়ানা তার শেষ কন্যা ক্যাথেরিনের সাথে তৃতীয় জনের বিবাহ দেন।

যাই হোক, ১৫১৬ সালে জোয়ানার পিতা ও এরাগনের রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের মৃত্যু হয়। ১৫০৪ সালে ইজাবেলার মৃত্যু হলে ফার্দিনান্দ ১৫০৬ সালে ফ্রান্সের ফোয়া (Foix) কাউন্টির অভিজাত জার্মেইন অফ ফোয়াকে বিয়ে করেন। ১৫০৯ সালে জন নামে তাদের এক পুত্র সন্তান হয়েছিল, কিন্তু মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তাদের আর সন্তান ছিলোনা। তাই ১৫১৬ সালে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের মৃত্যুর পর এরাগনের সিংসাসনও তার কন্যা জোয়ানার হাতে চলে যায় ও তিনি স্পেইনের রানী হয়ে ওঠেন। কিন্তু জোয়ানার মানসিক ভারসাম্য নেই। কাজেই স্পেইন শাসনের ভার নিতে হলো তার ১৬ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লসকে। ১৫১৬ সালেই তার জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস প্রথম চার্লস নাম নিয়ে স্পেইনের রাজা ও মা জোয়ানার সাথে সহ-সম্রাট হন। উল্লেখ্য, পিতার মৃত্যুর পর ১৫০৬ সাল থেকে ইতিমধ্যেই তিনি ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডি বা হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডসের ডিউক ছিলেন।

পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফার্ডিনান্ড ও দ্বিতীয় ফিলিপের মধ্যে ক্ষমতা-বিভাজন

এদিকে পবিত্র রোমান সম্রাট, জার্মানি-ইতালির রাজা, অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান ১৫১৯ সালে মারা যান। ১৪৮২ সালে প্রথম স্ত্রী বার্গান্ডির ডাচেস মেরির মৃত্যুর পর ১৪৯০ সালে তিনি ব্রিটানির ডাচেস অ্যানকে বিয়ে করেন, কিন্তু ১৪৯২ সালেই বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ১৫৯৪ সালে তিনি মিলানের রাজপরিবারের বিয়াংকা মারিয়া স্ফোর্জাকে বিয়ে করেছিলেন যিনি পরে ১৫১০ সালে মারা যান। এই পরবর্তী স্ত্রীদের সাথে ম্যাক্সিমিলিয়ানের সন্তান হয়নি। তার দুই সন্তানই ছিল, যার একজন ফিলিপ তার মৃত্যুর আগেই মারা গেছেন। আরেক সন্তান ছিলেন মার্গারেট। ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার পুত্র জনের সাথে তার বিয়ে হয়, কিন্তু ১৪৯৭ সালে জন মারা যায়। এরপর ১৫০২ সালে স্যাভয় এর ডিউক দ্বিতীয় ফিলবার্টের (১৪৯৭-১৫০৪) সাথে তার বিয়ে হয়, কিন্তু দু বছর পর ফিলবার্টও মারা যান। এদিকে ১৫০৬ সালে বার্গান্ডি ও নেদারল্যান্ডস এর শাসক ফিলিপের মৃত্যু হলে এর শাসক হয় তার ছয় বছরের পুত্র চার্লস। কিন্তু শাসনের বয়স চার্লসের ছিলোনা। তাই ম্যাক্সিমিলিয়ান তার বিধবা কন্যা মার্গারেটকে পাঠান হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডস বা ইম্পেরিয়াল বার্গান্ডির গভর্নর ও ছয় বছর বয়সী পৌত্র চালর্সের গার্ডিয়ান করে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার স্যালিক আইন অনুসারে ঠিক হতো, যা অনুসারে কন্যা সন্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়না। ফলে প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ানের পর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ও অস্ট্রিয়ার আর্চডাচির ক্ষমতা কন্যা মার্গারেটের বদলে পুত্রের পুত্র চার্লসের কাছেই যায়। তাই ১৫১৯ সালে প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ানের মৃত্যুর পর চার্লস পঞ্চম চার্লস (১৫১৯-১৫৫৬) নাম নিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হন। এভাবে ১৫৫৬ সালে তিনি হয়ে যান একই সাথে স্পেইনের রাজা, হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডসের ডিউক, অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক, এবং জার্মানি-ইতালির রাজা ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট। এত বিশাল অঞ্চল শাসন করা পঞ্চম চার্লসের জন্য কঠিন ছিল। তাই তিনি দুই বছর পর ১৫২১ সালে তার ভাই প্রথম ফার্দিনান্দ এর হাতে অস্ট্রিয়ার আর্চডাচির ক্ষমতা ছেড়ে দেন, যিনি চার্লসের ১৫৫৬ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তার নামে ও ১৫৬৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এককভাবে শাসন করতেন। (এই ফার্দিনান্দই ১৫৫৬ সালে পঞ্চম চার্লসের অবসর গ্রহণের পর পবিত্র রোমান সম্রাট হন, তবে ১৫৩০ সালেই তাকে পরবর্তী সম্রাট মনোনীত করা হয়েছিল, যেখানে পঞ্চম চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপ পেয়েছিলেন স্পেইন ও নেদারল্যান্ডস এর ক্ষমতা।)

প্রথম ফার্দিনান্দের হাঙ্গেরির ক্ষমতা গ্রহণ

হাবসবার্গ রাজবংশ বরাবরের মতো বৈবাহিক সূত্রে অন্যান্য রাজ্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। ১৫১৫ সালে ফিলিপ ও জোয়ানার মেয়ে বা পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফার্দিনান্দের বোন মেরির সাথে হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া ও বোহেমিয়ার রাজপুত্র দ্বিতীয় লুইসের বিয়ে হয়, যার এক বছর পর দ্বিতীয় লুইস (১৫১৬-১৫২৬) ক্ষমতায় বসেন। এরপর ১৫২১ সালে প্রথম ফার্দিনান্দের সাথে হাঙ্গেরির দ্বিতীয় লুইসের বোন অ্যান এর বিয়ে হয়। দ্বিতীয় লুইসের কোন বৈধ সন্তান না থাকায় অটোমানদের বিরুদ্ধে মোহাচের যুদ্ধে তার মৃত্যুর পর ১৫২৬ সালে প্রথম ফার্দিনান্দই হন হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া ও বোহেমিয়ার রাজা। সত্যি বলতে তিনি নাম রাজা থাকেন, অটোমানদের কাছে মোহাচের যুদ্ধে পরাজয়ের পর হাঙ্গেরিতে আসলে এনার্কি শুরু হয়। অটোমানরা তাদের প্রথম নির্ণায়ক বিজয় অর্জনের পরে, তাদের বাহিনী হাঙ্গেরি রাজ্যের বড় অংশ জয় করে এবং ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত তাদের সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে। এই সময়টি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। হাঙ্গেরিয়ান অভিজাতরা বিভক্ত হয়ে যায়। বিভক্ত অভিজাতরা একই সাথে দুটি রাজা নির্বাচিত করেছিল, জাপোলিয়াই এবং হাবসবার্গ অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফার্দিনান্দকে। এই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজাদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত দেশকে আরও দুর্বল করে তোলে। ১৫৪১ সালে তুর্কিরা বুদা বিজয় করলে সাথে সাথে হাঙ্গেরি তিনটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল। যাই হোক, ১৫৫২ সালে সিজ অফ এগারে অটোমানদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। হাঙ্গেরির পুরানো রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম অংশ (বর্তমান স্লোভাকিয়া, পশ্চিম ট্রান্সদানুবিয়া এবং বার্গেনল্যান্ড, পাশাপাশি পশ্চিম ক্রোয়েশিয়া এবং বর্তমান উত্তর-পূর্ব হাঙ্গেরির কিছু অংশ) রাজা ফার্দিনান্দের রাজ্য হিসাবে হাবসবার্গ শাসনের অধীনে ছিল। প্রাথমিকভাবে স্বাধীন হলেও পরে এটি অনানুষ্ঠানিক নাম রয়্যাল হাঙ্গেরির অধীনে হাবসবার্গ রাজতন্ত্রের একটি অংশ হয়ে ওঠে। হাবসবার্গ সম্রাটরা তখন থেকে হাঙ্গেরির রাজা হিসাবেও মুকুট পরেছিলেন। তুর্কিরা হাঙ্গেরির উত্তর ও পশ্চিম অংশ জয় করতে অক্ষম ছিল।

দ্বিতীয় ফিলিপের সময় নেদারল্যান্ডসের স্বাধীনতা

১৫২৬ সালে পঞ্চম চার্লসের মাসি মারিয়ার সাথে পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের কন্যা ইজাবেলার সাথে পঞ্চম চার্লসের বিবাহ হয়। পরের বছর ১৫২৭ সালে তাদের প্রথম সন্তান ফিলিপের জন্ম হয় (এই ফিলিপই পিতা পঞ্চম চার্লসের অবসরের পর ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ নাম নিয়ে স্পেইনের রাজা ও ১৫৮০ সালে পর্তুগালের রাজা হন। বৈবাহিক সূত্রে ১৫৫৪ থেকে ১৫৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডেরও জুরে উক্সরিস রাজা ছিলেন।)। ১৫৩১ সালে ফার্দিনান্দকে কিং অফ রোমান ঘোষণা করা হয়, অর্থাৎ পঞ্চম চার্লসের পর তিনিই হবেন পবিত্র রোমান সম্রাট। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক হিসেবে তিনিই স্বাভাবিকভাবে পবিত্র রোমান সম্রাটের পরবর্তী শাসক ছিলেন, আর তাছাড়া পঞ্চম চার্লস এতো বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব কোন একজন রাজার হাতে, অর্থাৎ তার পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপের হাতে তুলে দিতে চাননি। তাই ১৫৫৫ ও ১৫৫৬ সালে ক্লান্ত হয়ে তিনি একে একে নিজের সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা ত্যাগ করে অবসর নেবার পর পঞ্চম চার্লস হাবসবার্গ রাজবংশকে দুটি শাখায় বিভক্ত করেন (১৫৫৫ সালে তার মা জোয়ানারও মৃত্যু হয়)। ভাই প্রথম ফার্দিনান্দের অধীনে অস্ট্রিয়ান-জার্মান শাখা এবং পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপের অধীনে স্প্যানিশ শাখা। তার ভাই প্রথম ফার্দিনান্দ অস্ট্রিয়া, বোহেমিয়া এবং হাঙ্গেরিতে স্বতঃপ্রণোদিত রাজা হন, পাশাপাশি নতুন পবিত্র রোমান সম্রাট হন। চার্লসের পুত্র স্পেনের দ্বিতীয় ফিলিপ হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডস (সতেরোটি প্রদেশ) উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এবং সেগুলোকে স্প্যানিশ মুকুটের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যেগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ইতালি এবং আমেরিকান অধিকারগুলোও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এভাবে হাবসবার্গ নেদারল্যান্ডসও হয়ে যায় স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস।

স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডসে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ তার স্বৈরাচারের জন্য কুখ্যাত হয়ে ছিলেন এবং ক্যাথলিক নিপীড়নের ফলে ডাচ বিদ্রোহ এবং আশি বছরের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিতে স্প্যানিশদের দখল আরও দুর্বল ছিল। ১৫৭৯ সালে উত্তরের প্রদেশগুলি ইউট্রেখটের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেখানে তারা ১৫৮১ সালের অ্যাক্ট অফ অ্যাবজুরেশন দ্বারা নিজেকে সাতটি সংযুক্ত প্রদেশ হিসাবে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। ১৫৮১ সালের বিচ্ছিন্নতার পরে, দক্ষিণ প্রদেশগুলি, যা “‘t Hof van Brabant” নামে পরিচিত (ফ্ল্যান্ড্রিয়া, আর্টোইস, টুরনাইসিস, ক্যামব্রাই, লুক্সেমবার্গ, লিমবার্গ, হাইনাউট, নামুর, মেচেলেন, ব্রাবান্ট এবং আপার গুয়েল্ডার্স) ফরাসি বিপ্লবী যুদ্ধের আগ পর্যন্ত হাবসবার্গ হাউসের সাথেই ছিল। ১৭০০ সালে নিঃসন্তান দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যু এবং স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (১৭০০-১৭১৪) এর সাথে স্প্যানিশ হাবসবার্গ লাইনের বিলুপ্তির পরে, দক্ষিণ প্রদেশগুলি ১৭১৫ সাল থেকে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস নামেও পরিচিত ছিল।

দ্বিতীয় ফিলিপের পর্তুগালের ক্ষমতা দখল

যাই হোক, ১৫২৫ সালে ফিলিপ ও জোয়ানার কন্যা ক্যাথেরিনের সাথে পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনের (১৫২১-১৫৫৭) বিবাহ দেয়া হয়েছিল। ১৫২৬ সালে তাদের প্রথম পুত্র আলফোন্সোর জন্ম হয়, কিন্তু সেই বছরেই আলফনসো মারা যায়। এর পরের বছর ১৫২৭ সালে মারিয়া ম্যানুয়েলা নামে তাদের এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ১৪৪৩ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ স্পেইনের অস্তুরিয়ার প্রিন্সের অভিধায় ছিলেন, তার সাথে মারিয়া ম্যানুয়েলার সাথে ফিলিপের বিয়ে হয়। কিন্তু দুই বছর পরই মারিয়া মারিয়ার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে ১৫৪৫ সালে ডন কার্লোস নামে তার এক পুত্র সন্তান হয়েছিল। ১৫৩১ সালে ক্যাথরিনের তৃতীয় সন্তান ম্যানুয়েলের জন্ম হয়েছিল, কিন্তু ১৫৩৭ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে তারও মৃত্যু হয়। এরপর ১৫৩৩ সালে ফিলিপ নাম তাদের চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়েছিল, কিন্তু ১৫৩৯ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে তারও মৃত্যু হয়। ১৫৩৭ সালে তাদের শেষ পুত্র জোয়াও ম্যানুয়েলের জন্ম হয়। অন্য ভাইদের মতোই তিনি হন তার পিতার উত্তরাধিকারী। সম্রাট পঞ্চম চার্লস ও তার স্ত্রী ইজাবেলার তিন সন্তান ছিল। বড় জন দ্বিতীয় ফিলিপ (জন্ম ১৫২৭) ও তার পর দুই মেয়ে – ১৫২৮ সালে মারিয়া ও ১৫৩৫ সালে জোয়ানার জন্ম হয়। ১৫৪৮ সালে মারিয়ার সাথে পঞ্চম চার্লসের ভাই প্রথম ফার্দিনান্দের পুত্র ম্যাক্সিমিলিয়ানের বিবাহ হয় যিনি দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান (১৫৬৪-১৫৭৬) নাম পিতার পর পবিত্র রোমান সম্রাট হন, ও এভাবে মারিয়াও পবিত্র রোমান সম্রাজ্ঞী হন। অন্যদিকে ১৫৫২ সালে পর্তুগালের হবু রাজা জোয়াও ম্যানুয়েলের সাথে পঞ্চম চার্লসের তৃতীয় সন্তান জোয়ানার বিয়ে দেয়া হয়। দু’ বছর পর তাদের সন্তান সেবাশ্চিয়ানের জন্ম হয়। আর সেই বছরেই জোয়ানার স্বামী জোয়াও ম্যানুয়েলের মৃত্যু হয়। তখনও পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনের মৃত্যু হয়নি। ১৫৫৭ সালে তৃতীয় জনের মৃত্যু হলে মাত্র ৩ বছর বয়সে প্রথম সেবাশ্চিয়ান (১৫৫৭-১৫৭৮) পর্তুগালের রাজা হন। পিতামহী ক্যাথরিন ১৫৬২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার রিজেন্ট ছিলেন। এরপর ১৫৬২ থেকে ১৫৬৮ সাল পর্যন্ত তার রিজেন্সির দ্বায়িত্ব নেন কার্ডিনাল হেনরি। ১৫৬৮ সালে তিনি বয়োপ্রাপ্ত হন ও একই রাজ্য শাসন করতে থাকেন। ১৫৭৮ সালে যিনি মরোক্কে মুরদের বিরুদ্ধে আল কাসেরের যুদ্ধে পরাজিত ও হারিয়ে যান (সম্ভবত নিহত হন)। সেবাশ্চিয়ানের বিয়ে করা হয়নি। ১৫৭৮ সালে কার্ডিনাল হেনরিই পর্তুগালের শাসক হয়ে বসেন। তবে দুই বছর পর ১৫৮০ সালেই তিনি মারা যান। স্পেইনের দ্বিতীয় ফিলিপ সেবাশ্চিয়ানের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় ছিলেন, তাই তিনিই ১৫৮০ সালে পর্তুগালের রাজা হন। এভাবে পর্তুগালও হাবসবার্গ শাসনের অধীনে আসে, এবং স্পেইন ও পর্তুগাল নিয়ে আইবেরিয়ান ইউনিয়ন গঠিত হয়।

ইংল্যান্ডে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম মেরি ও প্রথম এলিজাবেথের ক্ষমতা গ্রহণ

১৫৩৩ সালে ক্যাথেরিনের সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর অষ্টম হেনরি প্রেমিকা অ্যান বোলেইনকে বিবাহ করেন, যদিও ১৫৩৬ সালে তার সাথেও তার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। ১৫৩৩ সালে অ্যান বোলেইনের গর্ভে এলিজাবেথের জন্ম হয়েছিল যিনি পরবর্তীতে প্রথম এলিজাবেথ (১৫৫৮-১৬০৩) নাম নিয়ে ইংল্যান্ডের রানী হন। অ্যানের সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর অষ্টম হেনরি ১৫৩৬ সালে জেন সিমৌরকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু পরের বছর ১৫৩৭ সালে তিনি মারা যান। মরার আগে ১৫৩৭ সালে তিনি এডওয়ার্ড নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে যান, যে অষ্টম হেনরির পর ষষ্ঠ এডওয়ার্ড (১৫৪৭-১৫৫৩) নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন, তবে ৫ বছর পর মাত্র ১৫ বছর বয়সেই অবিবাহিত অবস্থায় ফুসফুসের সংক্রমণে মারা যান।

তিনি চাননি যে মুকুটটি মেরির কাছে চলে যাক কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম পুনরুদ্ধার করবেন এবং তার এবং তাদের পিতার সংস্কারগুলি বাতিল করবেন এবং তাই তিনি তাকে উত্তরাধিকারের লাইন থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তার উপদেষ্টারা তাকে বলেছিলেন যে তিনি তার সৎ-বোনদের মধ্যে কেবল একজনকেই উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না: তাকে এলিজাবেথকেও উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, যদিও তিনি একজন প্রোটেস্ট্যান্ট ছিলেন। নর্থম্বারল্যান্ডের প্রথম ডিউক জন ডাডলি ও সম্ভবত অন্যান্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এডওয়ার্ড শেষ পর্যন্ত উভয়কেই উত্তরাধিকারের লাইন থেকে বাদ দিয়েছিলেন। এভাবে ১৫৪৪ সালের উত্তরাধিকার আইনের বিপরীতে (যা মেরি এবং এলিজাবেথকে উত্তরাধিকারের লাইনে এনে দেয়) এডওয়ার্ড নর্থম্বারল্যান্ডের পুত্রবধূ লেডি জেন গ্রেকে তার উত্তরসূরি হিসাবে মনোনীত করেছিলেন, যিনি অষ্টম হেনরির ছোট বোন মেরির নাতনি ছিলেন। লেডি জেনের মা ছিলেন ফ্রান্সেস ব্র্যান্ডন, মেরির কাজিন এবং গডডটার। এডওয়ার্ডের মৃত্যুর ঠিক আগে, মেরিকে তার মৃত ভাই এডওয়ার্ডের সাথে দেখা করার জন্য লন্ডনে তলব করা হয়েছিল, তবে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল যে সমনটি একটি অজুহাত ছিল যার ভিত্তিতে তাকে ধরে রাখা যায় এবং এর ফলে জেনের সিংহাসনে আরোহণ সহজতর হয়। তাই হুনসডনে তার বাসভবন থেকে লন্ডনে যাওয়ার পরিবর্তে, মেরি পূর্ব অ্যাংলিয়ায় পালিয়ে যান, যেখানে তিনি বিস্তৃত এস্টেটের মালিক ছিলেন। নর্থম্বারল্যান্ড নির্মমভাবে কেটের বিদ্রোহকে দমন করেছিল, যেই কেটে ক্যাথলিক ধর্মের অনেক অনুসারী ও নর্থম্বারল্যান্ডের বিরোধীরা বাস করত। ৯ জুলাই নরফোক থেকে তিনি এডওয়ার্ডের উত্তরসূরি হিসাবে তার ঘোষণার আদেশ সহ প্রিভি কাউন্সিলকে লিখেছিলেন। ১৫৫৩ সালের ১০ জুলাইতে লেডি জেনকে নর্থম্বারল্যান্ড এবং তার সমর্থকরা রানী ঘোষণা করেছিলেন এবং একই দিনে কাউন্সিলের কাছে মেরির চিঠি লন্ডনে পৌঁছেছিল। ১২ জুলাইয়ের মধ্যে, মেরি এবং তার সমর্থকরা সাফোকের ফ্রামলিংহাম ক্যাসলে একটি সামরিক বাহিনী জড়ো করেছিলেন। নর্থম্বারল্যান্ডের সমর্থন ভেঙে পড়ে, এবং জেনকে ১৯ জুলাই পদচ্যুত করা হয়। তিনি এবং নর্থম্বারল্যান্ড লন্ডনের টাওয়ারে বন্দী ছিলেন। মেরি ১৫৫৩ সালের ৩ আগস্ট জনসমর্থনের ঢেউয়ে বিজয়ী হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। তার সাথে তার সৎ বোন এলিজাবেথ এবং ৮০০ এরও বেশি অভিজাত ও ভদ্রলোকের একটি শোভাযাত্রা ছিল। এভাবে মেরি প্রথম মেরি (১৫৫৩-১৫৫৮) হিসেবে ইংল্যান্ডের রানী হলেন। ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় বসার পর মেরির স্বামী ও উত্তরসূরির দরকার ছিল। মারিয়া ম্যানুয়েলার মৃত্যুর পর স্পেইনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ কাউকে বিয়ে করেননি। তার সাথেই মেরির বিয়ে হলো, আর এভাবে দ্বিতীয় ফিলিপ ইংল্যান্ডের জুরে উক্সরিস রাজা (১৫৫৪-১৫৫৮) হলেন। কিন্তু কোন সন্তানের জন্ম হয়নি, আর এর ফলে অসুস্থ মেরি বাধ্য হন এলিজাবেথকে তার উত্তরসুরি মনোনীত করতে। ১৫৫৮ সালে তার মৃত্যু হলে এলিজাবেথ প্রথম এলিজাবেথ (১৫৫৮-১৬০৩) ইংল্যান্ডের রানী হন।

দ্বিতীয় ফিলিপের সন্তানেরা, তৃতীয় ও চতুর্থ ফিলিপের শাসন, পর্তুগালের স্বাধীনতা ও স্পেইনের জাতিবাদ

মেরির মৃত্যুর পর দ্বিতীয় ফিলিপ আরো দুবার বিবাহ করেছিলেন। ১৫৫৯ সালে তিনি ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরির (১৫৪৭-১৫৫৯) এর কন্যা এলিজাবেথকে বিয়ে করেছিলেন। ১৫৬৮ সালে তিনি মারা যান, তার গর্ভে ইজাবেলা ও কাতালানা নাম দুই কন্যার জন্ম হয়। ১৫৬৮ সালে মারিয়া ম্যানুয়েলার গর্ভে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ফিলিপের পুত্র ডন কার্লোসের মৃত্যু হয়, যখন তার বয়স ছিল ২৩। তার মানসিক অবস্থা ভাল ছিলোনা বলে দ্বিতীয় ফিলিপ তাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। ১৫৭০ সালে তিনি ফার্দিনান্দের পুত্র ও পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ানের (১৫৬৪-১৫৭৪) এর কন্যা অ্যানাকে বিয়ে করেন। ১৫৮০ সালে মৃত্যুর আগে তিনি তিনজন পুত্র সন্তান প্রসব করেছিলেন – ফার্দিনান্দ, ডিয়েগো ও ফিলিপ। ফার্দিনান্দ ১৫৭১ সালে জন্মে ৬ বছর পর ১৫৭৮ সালে মারা যায়, ডিয়েগো ১৫৭৫ সালে জন্মে ৭ বছর বয়সে ১৫৮২ সালে মারা যায়। ফিলিপ ১৫৭৮ সালে জন্মলাভ করে ও ১৫৯৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর তৃতীয় ফিলিপ (১৫৯৮-১৬২১) নাম নিয়ে স্পেইন ও পর্তুগালের রাজা হন। তিনি ১৫৯৯ সালে সম্রাট প্রথম ফার্দিনান্দের আরেক পুত্র দ্বিতীয় চার্লসের কন্যা মার্গারেটকে বিবাহ করেন, যিনি ১৬১১ সালে মারা যান। ১৬০১ সালে প্রথম সন্তান অ্যান এর জন্ম হয়, যার সাথে ১৬১৫ সালে ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই (১৬১০-১৬৪৩) এর বিবাহ হয়েছিল, এবং যিনি চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) এর জননী হয়েছিলেন। ১৬০৫ সালে পরবর্তী সন্তান ফিলিপের জন্ম হয়, যিনি ১৬২১ সালে পিতার মৃত্যুর পর চতুর্থ ফিলিপ নাম নিয়ে স্পেইন (১৬২১-১৬৬৫) ও পর্তুগালের (১৬২১-১৬৪০) রাজা হন।

পর্তুগালের প্রথম দুই স্প্যানিশ রাজা, দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তৃতীয় ফিলিপের অধীনে পর্তুগালের অবস্থা শান্ত এবং নির্মল ছিল। তারা পর্তুগালের মর্যাদা বজায় রেখেছিল, স্প্যানিশ রাজসভায় পর্তুগিজ অভিজাতদের চমৎকার অবস্থান দিয়েছিল এবং পর্তুগাল একটি স্বাধীন আইন, মুদ্রা এবং সরকার বজায় রেখেছিল। এমনকি স্পেনের রাজধানী লিসবনে স্থানান্তরের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। পরে, চতুর্থ ফিলিপ পর্তুগালকে একটি স্প্যানিশ প্রদেশ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং পর্তুগিজ অভিজাতরা ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। এই কারণে, ও সেই সাথে ত্রিশ বছরের যুদ্ধের (১৬১৮-১৬৪৮) ফলস্বরূপ স্পেইনের রাজকোষে টান পড়ার কারণে ব্রাগানজার ডিউক এবং রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের বংশধর ১৬৪০ সালের ১লা ডিসেম্বর নিজেকে চতুর্থ জন (১৬৪০-১৬৫৬) হিসাবে পর্তুগালের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন ও স্পেনের বিরুদ্ধে পর্তুগিজ রিস্টোরেশন ওয়ার বা পর্তুগিজ স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৬৪০-১৬৬৮) শুরু করেন। সিউটার গভর্নররা নতুন রাজাকে গ্রহণ করেননি; পরিবর্তে, তারা চতুর্থ ফিলিপ এবং স্পেনের প্রতি তাদের আনুগত্য বজায় রেখেছিল। ১৬৬৫ সালে চতুর্থ ফিলিপের মৃত্যুর পর তার পুত্র চার্লস দ্বিতীয় চার্লস (১৬৬৫-১৭০০) ক্ষমতায় আসেন। তার শারীরিক সমস্যা ছিল এবং কোন সন্তান ছিলোনা।

১৭০০ সালে দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যুর সাথে সাথে হাবসবার্গ রাজবংশ স্পেনে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (১৭০১-১৭১৫) শুরু হয় যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলি স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই শেষ পর্যন্ত স্প্যানিশ উত্তরাধিকার যুদ্ধে পরাজিত হন। বিজয়ী ছিল ব্রিটেন, ডাচ প্রজাতন্ত্র এবং অস্ট্রিয়া। তারা স্পেনের মুকুট বোরবন রাজবংশের কাছে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল, তবে স্পেন এবং ফ্রান্স কখনই একীভূত হয়নি। স্প্যানিশ উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরে, নুয়েভা প্ল্যান্টা ডিক্রিগুলির মাধ্যমে ক্যাস্টিলিয়ান মুকুট কর্তৃক আরাগনের মুকুটের সংমিশ্রণ ছিল স্প্যানিশ জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। এবং গঠনে অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের মতো এটি একটি অভিন্ন জাতিগত ভিত্তিতে হয়নি, বরং হয়েছিল প্রভাবশালী জাতিগত গোষ্ঠীর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ক্যাস্টিলিয়ানরা অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর উপর নিজেদের সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিয়েছিল, তাই অন্যান্য জাতিগুলো জাতীয়তাবাদী নীতির মাধ্যমে একীভূত হওয়ার জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু তে পরিণত হয়েছিল। এই জাতীয়তাবাদী নীতিগুলি, কখনও কখনও খুব আক্রমণাত্মক হয়, এবং এখনও কার্যকরী, এগুলো স্পেইনের অভ্যন্তরে বারবার আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের বীজে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে।

প্রথম ফার্দিনান্দের পর অস্ট্রিয়ার হাবসবার্গরা, প্রথম লিওপোল্ড ও ফ্রান্সের সাথে দ্বন্দ্ব

এদিকে পবিত্র রোমান প্রথম ফার্দিনান্দ (১৫৫৬-১৫৬৪) এর মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান (১৫৬৪-১৫৭৬) পবিত্র রোমান সম্রাট; হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া ও বোহেমিয়ার রাজা হলেও সমগ্র অস্ট্রিয়া লাভ করেননি। তিনি অস্ট্রিয়া প্রোপার লাভ করেছিলেন। ইনার অস্ট্রিয়া ও ফারদার অস্ট্রিয়া গিয়েছিল যথাক্রমে তার ভাই দ্বিতীয় চার্লস ও দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের কাছে। ১৫৪৮ সালে তিনি খুড়তুতো বোন বা পঞ্চম চার্লসের মেয়ে মারিয়াকে বিয়ে করেছিলেন। এদের কন্যা অ্যানার (জন্ম ১৫৪৯) সাথে ১৫৭০ সালে স্পেইনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের (১৫৫৬-১৫৯৮) বিবাহ হয়েছিল। কন্যা এলিজাবেথের (জন্ম ১৫৫৪) সাথে ফ্রান্সের রাজা নবম চার্লসের (১৫৬০-১৫৭৪) বিবাহ হয়েছিল। পুত্র রুডলফ (জন্ম ১৫৫২) পিতার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় রুডলফ (১৫৭৬-১৬১২) নাম নিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হয়েছিলেন। দ্বিতীয় রুডল্ফের বৈধ সন্তান না থাকায় তার মৃত্যুর পর তার ভাই ম্যাথিয়াস (১৬১২-১৬১৯) পবিত্র রোমান সম্রাট হন। ম্যাথিয়াসেরও সন্তান ছিলোনা। ফলে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য চলে যায় প্রথম ফার্দিনান্দের আরেক পুত্র দ্বিতীয় চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের (১৬১৯-১৬৩৭) হাতে। তার মৃত্যুর পর পবিত্র রোমান সম্রাট হয়েছিলেন তার পুত্র তৃতীয় ফার্দিনান্দ (১৬৩৭-১৬৫৭)। তিনি প্রথম ফার্দিনান্দের পর সমগ্র অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক হন। তার মৃত্যুর পর পবিত্র রোমান সম্রাট হয়েছিলেন বিখ্যাত সম্রাট প্রথম লিওপোল্ড (১৬৫৮-১৭০৫) যিনি অটোমানদের পরাজিত করে হাঙ্গেরি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

তার সময় ফরাসি সম্প্রসারণ বিশেষত ১৬৭০ সালে কৌশলগত ডাচি অফ লরেন দখল, তারপরে ১৬৭২ সালের ফ্রাঙ্কো-ডাচ যুদ্ধ সাম্রাজ্যকে ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ফেলেছিল। জুনের মাঝামাঝি সময়ে, ডাচ প্রজাতন্ত্র ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, যার ফলে লিওপোল্ড ২৫ শে জুন ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া এবং প্রজাতন্ত্রের সাথে জোটে সম্মত হন। তবে, তিনি হাঙ্গেরিতে বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং ডাচদের সহায়তা করার চেয়ে রাইনল্যান্ডে ফরাসি বিজয়কে উচ্চতর অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তার কমান্ডার, রাইমন্ডো মন্টেকুকোলিকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে এবং সরাসরি সংঘাত এড়ানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশৃঙ্খল লজিস্টিকস সৈন্যদের বজায় রাখা অসম্ভব করে তোলে এবং ব্রান্ডেনবার্গ ভোসেমের চুক্তির অধীনে ১৬৭৩ সালের জুনে যুদ্ধ ছেড়ে চলে যান। আগস্টে ডাচ প্রজাতন্ত্র, স্পেন, সম্রাট লিওপোল্ড এবং ডিউক অফ লরেনের সমন্বয়ে একটি ফরাসি বিরোধী চতুর্ভুজ জোট গঠিত হয়েছিল, যখন ১৬৭৪ সালের মে মাসে ইম্পেরিয়াল ডায়েট এটিকে একটি ইম্পেরিয়াল যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ১৬৭৮ সালের নিজমেগেন চুক্তিকে সাধারণত ফরাসি বিজয় হিসাবে দেখা হয়, যদিও জোট তাদের লাভ সীমিত করতে সফল হয়েছিল। শান্তি সমাপ্তির প্রায় অবিলম্বে লুই রিইউনিয়নস নীতির মাধ্যমে জার্মান সীমান্তে তার আগ্রাসন পুনর্নবীকরণ করেছিলেন। সম্রাট অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে গুরুতর সংগ্রামে জড়িত থাকার কারণে ফ্রান্সের দিকে এগিয়ে যেতে আবার ধীর ছিলেন এবং তিনি ১৬৮২ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অ্যাসোসিয়েশন লীগে যোগ দিলেও দুই বছর পরে তিনি রেগেনসবার্গে যুদ্ধবিরতি করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। সমগ্র ইউরোপীয় অবস্থান এখন ইংল্যান্ডের ঘটনাগুলির সাথে আবদ্ধ ছিল এবং উত্তেজনাটি ১৬৮৮ সালে অরেঞ্জের তৃতীয় উইলিয়াম গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজ মুকুট বিজয় এবং লুই জার্মানি আক্রমণ করা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। ১৬৮৯ সালের মে মাসে সম্রাট, ইংল্যান্ড, স্পেন ও ডেনমার্কের রাজা, ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টর এবং অন্যান্যদের নিয়ে মহাজোট গঠিত হয় এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রায় পুরো পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে তীব্র সংগ্রাম শুরু হয়। সাধারণভাবে বেশ কয়েকটি অভিযান মিত্রদের পক্ষে অনুকূল ছিল এবং ১৬৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ড, স্পেন এবং ইউনাইটেড প্রভিন্স রিজসুইজকের চুক্তিতে ফ্রান্সের সাথে শান্তি স্থাপন করেছিল। লিওপোল্ড চুক্তিতে সম্মতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে তার মিত্ররা তার স্বার্থকে কিছুটা অবহেলা করেছে, তবে পরের মাসে তিনি শর্তাবলীতে এসেছিলেন এবং বেশ কয়েকটি স্থান ফ্রান্স থেকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ফ্রান্সের সাথে শান্তি প্রায় চার বছর স্থায়ী হয়েছিল, কেননা তারপরে ইউরোপ স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধে (১৭০১-১৭১৫) জড়িত ছিল।

স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ ও স্পেইনে হাবসবার্গ রাজবংশের বিলুপ্তি

স্পেনের রাজা, দ্বিতীয় চার্লস হাবসবার্গ বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং অস্ট্রিয়ান শাখার সাথে বিবাহের মাধ্যমে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন, কিন্তু অনুরূপ বন্ধন তাকে ফ্রান্সের রাজপরিবারের সাথেও তাকে আবদ্ধ করেছিল। তিনি দুর্বল এবং নিঃসন্তান ছিলেন এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলি তার বিস্তৃত রাজ্যের একটি শান্তিপূর্ণ বিভাজনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিল। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত সংঘাতের কারণে স্পেন দুর্বল হয়ে পড়লেও স্পেন একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসাবে রয়ে গিয়েছিল যার অঞ্চলগুলির মধ্যে স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস, ইতালির বড় অংশ, ফিলিপাইন এবং আমেরিকার বেশিরভাগ অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই ফ্রান্স বা অস্ট্রিয়া যেই এটি দখল করুক, ইউরোপীয় শক্তির ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ছিল। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) এবং ইংল্যান্ডের তৃতীয় উইলিয়ামের (১৬৮৯-১৭০২) কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের প্রচেষ্টা স্প্যানিশরা প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং স্পেইন রাজ দ্বিতীয় চার্লস লুই এর নাতি, অ্যাঞ্জোর ফিলিপকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। ১৭০০ সালের ১লা নভেম্বরে নিঃসন্তান দ্বিতীয় চার্লসের (১৬৬৫-১৭০০) মৃত্যুর পর ১৬ নভেম্বর অবিভক্ত স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের রাজা হিসাবে অ্যাঞ্জোর ফিলিপের ঘোষণার ফলে তার উত্তরাধিকার নিয়ে একদিকে ফ্রান্স এবং স্পেন এবং অন্যদিকে মহাজোটের সাথে স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (১৭০১-১৭১৫) শুরু হয়। অ্যাঞ্জোর ফিলিপ এবং অস্ট্রিয়ার চার্লস এবং তাদের নিজ নিজ সমর্থক স্পেন, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ডাচ প্রজাতন্ত্র, স্যাভয়, গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতির মধ্যে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই শুরু হয়েছিল। সম্পর্কিত দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে রয়েছে ১৭০০-১৭২১সালের গ্রেট নর্দার্ন ওয়ার, হাঙ্গেরিতে রাকোজির স্বাধীনতা যুদ্ধ, দক্ষিণ ফ্রান্সে ক্যামিসার্ড বিদ্রোহ, উত্তর আমেরিকায় রানী অ্যানের যুদ্ধ এবং ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকার ছোটখাটো বাণিজ্য যুদ্ধ।

সম্রাট প্রথম লিওপোল্ড কোনও দেশভাগে সম্মতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং ১৭০০ সালের নভেম্বরে চার্লস মারা গেলে চতুর্দশ লুইয়ের নাতি অ্যাঞ্জোর ডিউক ফিলিপকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। একটি শান্তিপূর্ণ বন্দোবস্তের সমস্ত আশা অদৃশ্য হয়ে যায়। তৃতীয় উইলিয়ামের নির্দেশনায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী লীগ, একটি নতুন গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছিল; এর মধ্যে সম্রাট প্রথম লিওপোল্ড একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন এবং ১৭০০ সালে তিনি দাবি করেন, স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের অধিকার যাবে তার দ্বিতীয় পুত্র অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক চার্লসের কাছে (পরে পবিত্র রোমান সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০))। যুদ্ধের প্রাথমিক গতিপথ সম্রাটের পক্ষে অনুকূল ছিল না, তবে ১৭০৫ সালের ৫মে লিওপোল্ড মারা যাওয়ার আগে ব্লেনহাইমের মহান বিজয়ের মাধ্যমে পরাজয়ের ধারা ঘুরে গেছিল। প্রথম লিওপোল্ডের মৃত্যুর পর তিনি ও তার তৃতীয় স্ত্রী নিউবার্গের ইলিওনর ম্যাগডালিনের জ্যেষ্ঠ পুত্র জোসেফ সেই বছর প্রথম জোসেফ (১৭০৫-১৭১১) নাম নিয়ে পবিত্র রোমান সম্রাট হন। জোসেফ ১৬৮৭ সালে নয় বছর বয়সে হাঙ্গেরির রাজা এবং ১৬৯০ সালে এগারো বছর বয়সে রোমানদের রাজা, অর্থাৎ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হয়েছিলেন। জোসেফ তার পিতার দাবি অনুযায়ী ছোট ভাই চার্লসকে স্পেনের রাজা করার প্রয়াসে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের (১৬৪৩-১৭১৫) বিরুদ্ধে তার বাবার দ্বারা শুরু হওয়া স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ চালিয়ে যান। এই প্রক্রিয়ায়, তার সামরিক কমান্ডার, স্যাভয়ের প্রিন্স ইউজিনের বিজয়ের কারণে, তিনি ইতালির উপর অস্ট্রিয়ান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন। জোসেফকে হাঙ্গেরিতে দীর্ঘায়িত বিদ্রোহের সাথেও লড়াই করতে হয়েছিল, যা চতুর্দশ লুই প্ররোচিত করেছিলেন। তার মৃত্যুর পরে ইউট্রেখট চুক্তির (১৭১৩-১৫) আগ পর্যন্ত কোনও দ্বন্দ্বের সমাধান হয়নি।

ফরাসিরা প্রাথমিক পর্যায়ে সুবিধা ধরে রেখেছিল, তবে ১৭০৬ সালের পরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছিল; তবে ১৭১০ সালের মধ্যে মিত্ররা কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়েছিল, এদিকে স্পেনে বুরবোঁ বিজয়গুলি অ্যাঞ্জোর ফিলিপের রাজা হিসাবে অবস্থান নিশ্চিত করেছিল। ১৭১১ সালে সম্রাট প্রথম জোসেফ মারা গেলে, আর্কডিউক চার্লস ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০) নাম নিয়ে সম্রাট হিসাবে তার ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হন এবং নতুন ব্রিটিশ সরকার শান্তি আলোচনা শুরু করে। শুধুমাত্র ব্রিটিশ ভর্তুকি যুদ্ধে তাদের মিত্রদের ধরে রেখেছিল বলে ১৭১১-১৭১৩ ইউট্রেখট শান্তি চুক্তি হয়েছিল , তারপরে ১৭১৪ সালে রাস্টাট এবং বাডেনের চুক্তি হয়েছিল। এগুলো অনুযায়ী অ্যাঞ্জোর ফিলিপকে স্পেনের রাজা হিসাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল, কিন্তু বিনিময়ে ফরাসি সিংহাসনকে তার বা তার বংশধরদেরকে স্পেইনের সিংহাসন বা তার উত্তরাধিকারী হবার অধিকার ত্যাগ করতে হয়েছিল। স্প্যানিশ সাম্রাজ্য মূলত অক্ষত ছিল, তবে ইতালি এবং নিম্ন দেশগুলির অঞ্চলগুলি স্যাভয় এবং অস্ট্রিয়ার কাছে হস্তান্তর করেছিল। ব্রিটেন যুদ্ধের সময় জিব্রাল্টার এবং মেনোরকা দখল করেছিল, স্প্যানিশ আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ছাড় অর্জন করেছিল এবং নেতৃস্থানীয় সামুদ্রিক এবং বাণিজ্যিক ইউরোপীয় শক্তি হিসাবে ডাচদের প্রতিস্থাপন করেছিল। ডাচরা বর্তমানে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন অর্জন করেছিল; তারা একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে রয়ে গেলেও যুদ্ধের ব্যয় স্থায়ীভাবে তাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফ্রান্স নির্বাসিত জ্যাকোবাইটদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং হ্যানোভারীয়দের ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়; একটি বন্ধুত্বপূর্ণ স্পেন নিশ্চিত করা একটি বড় অর্জন ছিল, তবে তারা আর্থিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বিকেন্দ্রীকরণ অব্যাহত ছিল, প্রুশিয়া, বাভারিয়া এবং স্যাক্সনি ক্রমবর্ধমান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে কাজ করছিল। অস্ট্রিয়া অটোমানদের উপর বিজয় লাভ করেছিল, এরপর অস্ট্রিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে দক্ষিণ ইউরোপের দিকে মনোনিবেশ করে। স্পেইনে এভাবে বুরবোঁ-অ্যাঞ্জো রাজবংশের সূচনা হয়।

আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইউরোপে রাজনৈতিক অবস্থা

জার্মানি : পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য

আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ছিল ধর্ম প্রভাবিত। প্রাচীন যুগে ইউরোপ পৌত্তলিকতা (Paganism) এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল এবং রোমানরা এ পৌত্তলিকতার ধারক ও বাহক ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রচার হলে পৌত্তলিকতার ভিত্তি ভেঙে পড়ে এবং জার্মানরা রোমানদের পরাজিত করে পশ্চিম ইউরোপ দখল করে। রোমের খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠানের প্রভাবে জার্মানরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে জার্মান অধ্যুষিত ইউরোপ এবং ইতালিকে কেন্দ্র করে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেঅস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডরিকের (১৪৫২-১৪৯৩) পুত্র ও  প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান (১৪৯৩-১৫১৯) প্রথম রোমান পবিত্র সম্রাট হিসাবে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা লাভ করেন। পবিত্র রোমান সম্রাট নির্বাচনের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত হতেন। জার্মানির প্রধান সাতজন ইলেক্টর সম্রাট নির্বাচনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। সম্রাট জার্মানির ডিউক, ইলেক্টর, বিশপ প্রভৃতি অভিজাত ব্যক্তিগণের সভা ডায়েটের (Diet) সহায়তায় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য শাসন করতেন।

মধ্যযুগের জার্মানি ও ইতালি নিয়ে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গঠিত হওয়ায় ইতালি ও জার্মানিতে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠে নি। ধর্মীয় ভাবাদর্শের কারণে জার্মানদের মধ্যে পৃথক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় নি। তাই আধুনিক যুগের প্রারম্ভে পবিত্র রোমান সম্রাটের আধিপত্য শিথিল হলে জার্মানি বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন সামন্ত শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। অনেক ইলেক্টর, ডিউক, স্থানীয় রাজপরিবার, বিশপ প্রভৃতি নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এর ফলে পবিত্র রোমান সম্রাটের মর্যাদা ও ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে। পবিত্র রোমান সম্রাটের অর্থ ও সামরিক বল না থাকায় তার পক্ষে স্থানীয় শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল না। বরং তিনি নিজেই স্থানীয় শাসকদের সহায়তার ওপর নির্ভর ছিলেন। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের এই দুরবস্থার সময় প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান ১৫০৮ সালে রোমান পবিত্র সাম্রাজ্যের সম্রাটপদ লাভ করেন। তিনি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের শক্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় জার্মানির কোনো কোনো অঞ্চলে জাতীয়তাবোধ উন্মেষের ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে ভাঙনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান ১৪৯৫ সালে ওয়ার্মস নামক স্থানে এক জাতীয় সভার আহ্বান করেন এবং সেখানে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর আরো কয়েকটি সভায় জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংস্কারের বিষয় আলোচনা হয়। কিন্তু এতে পবিত্র রোমান সম্রাটের বা সাম্রাজ্যের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। তবে সম্রাট পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য স্থানীয় শাসকদের ক্ষমতা বজায় রাখা হয় এবং কিছু রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গৃহীত হয়। জার্মানির সামন্তদের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অটুট থাকে। জার্মান সামন্তদের সামরিক শক্তি অটুট থাকায় তারা তাদের স্বার্থরক্ষায় একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এই যুদ্ধবিগ্রহ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের শান্তি ব্যাহত করে। তাই সম্রাট এ ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ করেন এবং শান্তি ভঙ্গের জন্য শাস্তির ঘোষণা জারি করা হয়। বিভিন্ন স্থানীয় শাসকদের পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার জন্য ‘ইম্পিরিয়াল চেম্বার’ নামে একটি বিচারালয় স্থাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন সংস্কার স্থানীয় শাসকবর্গের ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন করে নি। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

পবিত্র রোমান সম্রাট কর্তৃক জার্মানির ঐক্য প্রচেষ্টা : পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ান পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশ ও জাতির বিরাগভাজন হন। এ সময় কনস্টান্টিনোপলের তুর্কিরা পূর্ব ইউরোপে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট থাকায় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য তুর্কি আক্রমণের হুমকিতে ছিল। ম্যাক্সিমিলিয়ান তুর্কিদের রাজ্য বিস্তার রোধ করার জন্য সমগ্র ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু তার পক্ষে তার অধীনস্থ জার্মানি জাতি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন নি। তিনি পবিত্র রোমান সম্রাটের মর্যাদা ও অধিকার সমগ্র ইতালির ওপর বিস্তৃত করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে তার এই ঐক্য প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে তার বৈবাহিক নীতি দ্বারা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি বার্গান্ডির মেরীকে বিবাহ করেন। মেরী ছিলেন নেদারল্যান্ডের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। তিনি তার পুত্র ফিলিপকে স্পেনের ক্যাস্টাইল পরিবারের জোয়ানার সঙ্গে বিবাহ দেন। জোয়ানা ছিলেন স্পেনরাজ ফার্নিনান্দের উত্তরাধিকারিণী, এই দুই বিবাহসূত্রে ম্যাক্সিমিলিয়নের পৌত্র ফিলিপের পুত্র চার্লস নেদারল্যান্ড ও স্পেনের সিংহাসন লাভ করেন। যিনি পরবর্তীকালে পঞ্চম চার্লস (১৫১৯-১৫৫৬) হিসেবে পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ লাভ করেছিলেন। পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদের সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের সিংহাসন ও নেদারল্যান্ড লাভ করার ফলে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হন।

ইতালি : পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য

ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের ভিত্তিতে যে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ইতালি এ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ধর্মীয় ভাবধারার কারণে ইতালিতে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে নি। ইতালি বিচ্ছিন্ন বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ভেনিস, মিলান, ফ্লোরেন্স, পোপের অধীন রাজ্যসমূহ, নেপস্‌ প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এ পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনের রাজারা নিজেদের মধ্যে ইতালি ভাগাভাগি শুরু করলে ইতালির দুরবস্থা দেখা দেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে স্পেন সার্ডিনিয়া ও সিসিলি নামক দ্বীপ দুটি দখল করে। নেপলসের রাজপরিবারের সঙ্গে স্পেনের রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় সেখানেও স্পেনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্পেন ইতালিতে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে।

ইতালিতে স্পেনের প্রাধান্য : ফ্রান্সের অ্যাঞ্জো পরিবারের ফরাসি ভ্যালয় রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই পরিবার নেপলসের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিল। অ্যাঞ্জো পরিবারের শেষ বংশধর মৃত্যুকালে তার উত্তরাধিকার স্বত্ব ফরাসিরাজকে দিয়ে যান। এই সূত্রে ফরাসি রাজ অষ্টম চার্লস (১৪৮৩-১৪৯৮) নেপলস দখল করার জন্য ১৪৯৪ সালে ইতালি আক্রমণ করেন। ইতালিতে স্পেনের স্বার্থ থাকায় স্পেনীয় সেনাবাহিনী ইতালিতে প্রবেশ করে। এর ফলে ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ১৪৯৪ থেকে ১৫৫৯ সাল পর্যন্ত এক দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধে স্পেন জয়লাভ করে। তবে এই যুদ্ধ এতদিন ধরে টানা চলেনি, তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রকালীন ছোট ছোট যুদ্ধের সমন্বয় ছিল। এর মধ্যে ১৪৯৯-১৫০৪ সালের যুদ্ধে নেপলস স্পেনের অধিকারে চলে যায়, যুদ্ধের শেষে ১৫০৪ সালে ফ্রান্স স্পেনের নিকট নেপলসের দাবি ত্যাগ করে। ধীরে ধীরে ইতালিতে স্পেইনের ও সম্রাটের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

মিলান (Milan): ইতালির মিলান পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্ফোর্জা পরিবার মিলানে স্বাধীনভাবে শাসন করত। তবে ফরাসি রাজ অষ্টম চার্লসের মৃত্যুর পর দ্বাদশ লুই (১৪৯৮-১৫১৫) ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে মিলানের ওপর আধিপত্য দাবি করেন। দ্বাদশ লুইয়ের দাবি ছিল এই যে, স্ফোর্জা পরিবারের পূর্বে যে ভিসকন্টি পরিবার মিলানের শাসক ছিলেন দ্বাদশ লুই সেই রাজপরিবারের বংশধর। কাজেই দ্বাদশ লুই মিলানের ওপর স্ফোর্জা পরিবারের আধিপত্য স্বীকার করতেন না। তিনি ১৪৯৯ সালে মিলান আক্রমণ ও দখল করেন এবং ১৫১২ সাল পর্যন্ত মিলান ফ্রান্সের অধিকারে ছিল। কিন্তু রোমের পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩) ১৫১২ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, স্পেন, ভেনিস এসব দেশকে নিয়ে একটি পবিত্র মিত্র সংঘ (Holy league) গঠন করেন এবং ইতালি থেকে ফরাসি সৈন্যদের বিতাড়িত করেন। ১৫১৫ সালে দ্বাদশ লুই মৃত্যুবরণ করলেও মিলানের আধিপত্য নিয়ে পোপ দশম লিও (১৫১৩-১৫২১) ও স্পেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। পরবর্তী ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিস (১৫১৫-১৫৪৭) মিলান দখলের জন্য ১৫১৫ সালে সামরিক অভিযান চালান। ১৫১৫সালে ম্যারিগ্নানো নামক স্থানের যুদ্ধে মিলানের সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করে সেখানে আধিপত্য স্থাপন করেন তিনি। এ জয়ের পর কিছুকাল ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু ইতালিতে ফরাসি আধিপত্য বিস্তার হলে স্পেন ঈর্ষান্বিত হয়। স্পেনরাজ পঞ্চম চার্লস (১৫১৬-১৫৫৬) পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হলে স্পেনীয়রা ইতালিতে ফরাসি প্রভাব প্রতিহত করার সুযোগ লাভ করে। পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মিলানের ওপর আধিপত্য দাবি করেন এবং মিলান থেকে ফরাসি অধিকার বিলুপ্ত করে সেখানে নিজ আধিপত্য স্থাপনের পদক্ষেপ নিলে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।

ভেনিস (Venice): ইতালি দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল ভেনিস। ক্যান্ডিয়া, মোরিয়া, সাইপ্রাস এবং ইজিয়ান সাগরের অনেকগুলো দ্বীপ ভেনিসের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভেনিসের রাজ্যভুক্ত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ভেনিসীয়রা অনেক বিত্ত অর্জন করেছিল। কিন্তু তুর্কিরা ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগরে আধিপত্য বিস্তার করলে ভেনিসের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ভেনিসের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো তুর্কিরা দখল করে নিলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভেনিসীয়রা পিছিয়ে পড়ে। এ ছাড়া পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার করলে ভেনিসীয়দের বাণিজ্যিক স্বার্থ আরো ক্ষুণ্ণ হয়। পূর্বে ভেনিসীয় ব্যবসায়ীরা আরব বণিকদের কাছ থেকে মশলা ও নানা মূল্যবান দ্রব্য ক্রয় করে ইতালি ও সমগ্র ইউরোপে উচ্চমূল্যে বিক্রি করত। কিন্তু উত্তমাশা অন্তরীপে পর্তুগিজদের আধিপত্য স্থাপন হলে ভেনিসীয়রা মশলা বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার হারায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফরাসিরা ভেনিস দখল করলে ভেনিসের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত হয়।

ফ্লোরেন্স (Florence) : ইতালি উপদ্বীপের আরেকটি প্রজাতান্ত্রিক নগররাষ্ট্র ছিল ফ্লোরেন্স। এই ফ্লোরেন্সেই রেনেসাঁস যুগে অধিক সংখ্যক সাহিত্যিক, মানবতাবাদী ও শিল্পীদের আবির্ভাব হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সে মেডিচি পরিবার আধিপত্য স্থাপন করলে প্রজাতান্ত্রিক শাসন বিলুপ্ত হয়। ১৪৯৪ সালে ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লস ইতালি আক্রমণ করলে ফ্লোরেন্সবাসী মেডিচি পরিবারকে বিতাড়িত করে প্রজাতান্ত্রিক শাসন কায়েম করে। স্যাভেনারোলা ছিলেন এই প্রজাতন্ত্রের নেতা। তিনি প্রথম রোমের ধর্মাধিষ্ঠান ও ধর্ম যাজকদের নীতিজ্ঞানহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। স্যাভেনারোলা চার বৎসর ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের নেতা ছিলেন। কিন্তু ১৪৯৮ সালে তার শত্রুরা তাকে ধর্মহীনতার অভিযোগে হত্যা করে। এর পর থেকে প্রজাতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে। ১৫১২ সালে মেডিচি পরিবার পুনরায় ফ্লোরেন্সের শাসন ক্ষমতা লাভ করে। তবে কিছুকাল পর ফ্লোরেন্সবাসী মেডিচি পরিবারকে উৎখাত করে কিন্তু পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সহায়তায় মেডিচি পরিবার ফ্লোরেন্সের সিংহাসন লাভ করে। মেডিচি পরিবারে রাজা আলেকজান্ডার ডিউক হিসেবে ফ্লোরেন্স শাসন করতে থাকেন।

পোপের অধীন রাজ্য (The Papal states): ইতালির মধ্যবর্তী অঞ্চল পোপের রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পোপের রাজ্য বিভিন্ন অত্যাচারী সামন্তরা শাসন করত। পোপ ৬ষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৯২-১৫০৩) হত্যা, কূটকৌশল ও নানাবিধ অত্যাচারের মাধ্যমে স্থানীয় সামন্তদের ধ্বংস করে সমস্ত এলাকা পোপের শাসনাধীনে আনেন। পরবর্তী পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩) ও দশম লিও (১৫১৫-১৫২১) সুষ্ঠু শাসনের মাধ্যমে পেপাল শাসিত রাজ্য শক্তিশালী করেন। তারা ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। পোপ দশম লিও-এর শাসনকালে জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

স্যাভয় (Savoy): ইতালির উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে স্যাভয় রাজাটি অবস্থিত ছিল। এখানে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। এখানকার রাজপরিবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইতালির ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের রাজা হয়েছিল।

ফ্রান্স, স্পেইন ও ইংল্যান্ডের শক্তিশালী রাজতন্ত্র

ফ্রান্স (France): আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ফ্রান্সে শক্তিশালী রাজতন্ত্র বলবৎ ছিল। ফরাসিরাজ সপ্তম চার্লস (১৪২২-১৪৬১)একাদশ লুই (১৪৬১-১৪৮৩) ছিলেন খুব শক্তিশালী রাজা। তারা সামন্তদের দমন করে শক্তিশালী রাজশক্তি গড়ে তুলেছিলেন। একাদশ লুইয়ের পুত্র অষ্টম চার্লস (১৪৮৩-১৪৯৮) ব্রিটানি নামে ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমের দেশটি দখল করে সমগ্র ফরাসি দেশ ও ফরাসি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। অষ্টম চার্লস মিলান দখলের জন্য ১৪৯৪ সালে ইতালি আক্রমণ করেছিলেন। মিলানের আধিপত্য নিয়ে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধ বলবৎ ছিল। এই যুদ্ধে ফ্রান্স সাময়িকভাবে সফলতা পেলেও পরে স্পেন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী রাজা দ্বাদশ লুই (১৪৯৮-১৫১৫) ইতালির মিলান আক্রমণ করে তা দখল করে। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে ফ্রান্সকে মিলান ত্যাগ করতে হয়েছিল। পরবর্তী রাজা পঞ্চম ফ্রান্সিস (১৫১৫-১৫৪৭) ১৫১৫ সালে মিলান আক্রমণ করে ম্যারিগ্নানোর যুদ্ধে জয়লাভ করে মিলান অধিকার করেন।

স্পেন (Spain): মধ্যযুগে স্পেন ছিল মুসলিম শাসিত দেশ। পঞ্চদশ শতকে ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দ স্পেন থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করেন। ক্রমে স্পেন খ্রিস্টান অধ্যুষিত ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্পেনে এরাগন পরিবারের ফার্দিনান্দ ও ক্যাস্টাইল পরিবারের ইসাবেলার বিবাহসূত্রে স্পেনের দুই রাজবংশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৪৯২ সালে ফার্দিনান্দ মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডা রাজ্য দখল করে স্পেন থেকে মুসলমান শক্তিকে চিরতরে বিতাড়ন করেন। আধুনিক যুগের প্রারম্ভে স্পেন অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন ইতালিতে রাজ্য বিস্তার করে এবং ভৌগোলিক আবিষ্কারে নেতৃত্ব দিয়ে সমুদ্রপথে অনেক নতুন দেশ আবিষ্কার করে। ইতালিতে স্পেন নেপস এবং ফরাসি সীমান্তে ন্যাভার দখল করে। ফার্দিনান্দের মৃত্যুর পর তার প্রপৌত্র চার্লস ১৫১৬ সালে স্পেইনের রাজা হন, এবং ১৫১৯ সালে জার্মানির ইলেক্টরগণ তাকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ঘোষণা করলে তিনি পঞ্চম চার্লস (১৫১৯-১৫৫৬) হিসেবে পবিত্র রোমান সম্রাট পদ লাভ করেন। তিনি স্পেন, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড, নেপস ইত্যাদি দেশের আধিপত্য লাভ করেন। ফলে স্পেন ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে শক্তিশালী ও বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

ইংল্যান্ড (England): আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশ শাসন করত। সপ্তম হেনরি (১৪৮৫-১৫০৯) গোলাপের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসে অন্তযুদ্ধের অবসান ঘটান। ফলে ইংল্যান্ডে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সামন্তদের দমন করে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নানা সুবিধা দিয়ে ইংল্যান্ডে নতুন শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। সামন্তশক্তির দমন ও পার্লামেন্টকে রাজতন্ত্রের আজ্ঞাধীনকরণের মাধ্যমে সপ্তম হেনরি রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করেন। টিউডর আমলে ইংরেজ বণিকরা নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড নৌশক্তি ও সামুদ্রিক বাণিজ্যে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অষ্টম হেনরি (১৫০৯-১৫৪৭) ইংল্যান্ডে পোপের ক্ষমতা বিলুপ্ত করেন। ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের (১৫৪৭-১৫৫৩) সময় ইংল্যান্ডে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম শক্তিশালী হয়। রানী এলিজাবেথ (১৫৫৮-১৬০৩) ইংল্যান্ডের ধর্ম সমস্যার সমাধান করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। এলিজাবেথের সময় ইংল্যান্ডে অ্যাংলিকান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতালিতে ফ্রান্স ও স্পেনের দ্বন্দ্ব 

আধুনিক যুগের প্রারম্ভে ইতালি নামে কোন রাষ্ট্র ছিল না। ইতালি অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ইতালিতে আধিপত্য নিয়ে ফ্রান্স ও স্পেন দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই দ্বন্দ্ব থেকে যুদ্ধ এবং প্রায় ৬৫ বছর এই যুদ্ধ অব্যাহত ছিল।

ইতালিতে ফ্রান্স ও স্পেনের দ্বন্দ্বের কারণ

ইতালির রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা ও দুর্বলতা : মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠলে ইতালি ও জার্মানি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ইতালির ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান, স্যাভয়, নেপলস ও পোপের রাজ্য পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও এগুলো ছিল স্বাধীন। এ রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার জন্য কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তি ইতালিতে আধিপত্য বিস্তার করত না। এ সময় ইউরোপে ফ্রান্স ও স্পেন ছিল শক্তিশালী রাষ্ট্র। ইতালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরা রক্ষা করত। তবে শক্তিশালী বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি তাদের ছিল না। এ সময় ফ্রান্স ও স্পেনে শক্তিশালী রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ইতালিতে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এ নিয়ে স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

দানিয়ুব অঞ্চলে তুর্কি শক্তির আধিপত্য : পঞ্চদশ শতাব্দীতে অটোমান তুর্কিরা ইউরোপের দানিয়ুব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এ সময় ফ্রান্স ও স্পেন মনে করে যে, দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন ইতালি তুর্কি কর্তৃক অধিকৃত হলে স্পেন ও ফ্রান্সের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হবে। তাই ইতালিতে তাদের আধিপত্য বিস্তার প্রয়োজন।

ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের দাবি : পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে স্পেন সার্ডিনিয়া ও সিসিলি দখল করে। নেপলসের রাজবংশের সঙ্গে স্পেনের রাজবংশের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। এই সূত্রে স্পেন ইতালির রাজনীতিতে নিঃস্বার্থ জড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে ফ্রান্সের অ্যাঞ্জো পরিবারে ন্যাপলসের সিংহাসনের ওপর দাবি ছিল। অ্যাঞ্জো পরিবারের শেষ বংশধর মৃত্যুর পূর্বে ফরাসি রাজকে তার উত্তরাধিকার স্বত্ব দান করে গিয়েছিলেন। ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লস (১৪৮৩-১৪৯৮) অ্যাঞ্জো পরিবার থেকে প্রাপ্ত অধিকার বলে নেপলসের সিংহাসন দাবি করেন। এ সময় নেপলসের অভিজাত শ্রেণী ন্যাপলসের রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে ভেনিসীয়রা তাদেরকে ফ্রান্সের গোপন সামরিক সাহায্য নিতে পরামর্শ দেয়। নেপলসের সামন্তগণ ফরাসিরাজ অষ্টম চার্লসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। মিলানের ডিউকের পিতৃব্য লুডোভিকো অষ্টম চার্লসের সহায়তায় ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডিউক পদ থেকে সরিয়ে নিজে ডিউক হওয়ার পরিকল্পনা করেন এবং অষ্টম চার্লসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এভাবে রাজনৈতিক কারণে অষ্টম চার্লস নেপলসের সিংহাসন দখলের জন্য ইতালি আক্রমণ করেন।

স্পেন ও ফ্রান্সের স্বার্থপরতা : ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে তার সাম্রাজ্যস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। স্পেনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্পেন ইতালিতে রাজ্য বিস্তারে প্রলুব্ধ হয়। ইতালির নেপলস, সিসিলি, সার্ডিনিয়া, মিলান প্রভৃতি স্থানে স্পেনের রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল। সুতরাং ফ্রান্সকে ইতালিতে নির্বিবাদে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া স্পেনের কাম্য ছিল না। তাই স্পেন ইতালিতে ফ্রান্সের রাজ্য বিস্তারে বাধা দেয়। ফলে ইতালিতে আধিপত্য নিয়ে স্পেন ও ফ্রান্স যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

যুদ্ধের ঘটনা

ফরাসি রাজা অষ্টম চার্লস নেপলসের অভিজাতদের আমন্ত্রণে ১৪৯৪ সালে আল্পস পর্বত অতিক্রম করে সসৈন্যে ইতালিতে হাজির হন। এ সময় মিলান অষ্টম চার্লসের পক্ষে ছিল এবং ভেনিস ছিল নিরপেক্ষ। তাই উত্তর ইতালিতে ফরাসি সৈন্য বাহিনীকে কোনো বাধা পেতে হয় নি। ফ্লোরেন্সে এ সময় রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল। রোমের পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৯২-১৫০৩) অষ্টম চার্লসের শক্তিতে ভীত হয়ে নিরপেক্ষ হন। সুতরাং অন্য কোনো অংশেও তাকে বাধা প্রদান করে নি। এ সময় মিলানের ডিউক গ্যালেজো হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। লুডোভিকো মিলানের ডিউক পদ লাভ করলে, মিলান ফ্রান্সের তাঁবেদার রাজ্যে পরিণত হয়। এই অবস্থায় অষ্টম চার্লস বিনা বাধায় নেপলসের নিকটবর্তী হলে নেপলসের রাজা দ্বিতীয় অ্যালফেনসো প্রাণভয়ে রাজ্য ত্যাগ করেন। অষ্টম চার্লস বিনা বাধায় নেপলস দখল করেন। অষ্টম চার্লস রোমে প্রবেশ করে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের নিকট থেকে চারটি শহর কেড়ে নেন।

স্পেনের রণপ্রস্তুতি : অষ্টম চার্লসের রাজ্য বিস্তার এবং নেপলসে ফরাসি আধিপত্য স্পেনের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফ্রান্স, ইতালিতে আধিপত্য স্থাপন করলে স্পেনের স্বার্থ বিপন্ন হবে এই আশঙ্কা দেখা দেয়। স্পেন রাজ ফার্দিনান্দ দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ (১৪৭৯-১৫১৬) হিসেবে এরাগনের রাজা  ছিলেন, এবং ১৪৬৯ সালে ক্যাস্টাইল ও লিওন এর রাণী প্রথম ইজাবেলাকে বিয়ে করার ফলে পঞ্চম ফার্দিনান্দ হিসেবে ক্যাস্টাইল ও লিওন এর রাজা (১৪৭৫-১৫০৪) ছিলেন, এবং প্রথম ইজাবেলার পাশাপাশি তিনিও এই অঞ্চলগুলো শাসন করতেন। ফ্রান্স ইতালিতে আধিপত্য স্থাপন করলে স্পেনের স্বার্থ বিপন্ন হবে এই আশংকা দেখা দেয়। স্পেনরাজ ফার্দিনান্দ ফরাসি রাজ অষ্টম চার্লসকে প্রতিরোধ করার জন্য এক শক্তিশালী সামরিক জোট গঠন করেন। অস্ট্রিয়া, স্পেন এবং পোপ সমন্বয়ে গঠিত সামরিক শক্তি ফরাসি রাজ অষ্টম চার্লসকে প্রতিরোধ করে। অষ্টম চার্লস এই শক্তি সংঘের সামরিক বাধা মোকাবেলা করে নির্বিঘ্নে ফ্রান্সে পৌঁছেন। কিন্তু ফরাসি বাহিনী ইতালি থেকে চলে যাওয়ায় সেখানে ফ্রান্সের বিজয়ের কোনো চিহ্ন থাকল না।

দ্বাদশ লুইয়ের ইতালি অভিযান : অষ্টম চার্লস মৃত্যুবরণ করলে দ্বাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রাচীন ডিউক পরিবারের সন্তান ছিলেন। এ পরিবারকে বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করে পরবর্তী স্ফো‍‍রজা বংশ মিলানের শাসন ক্ষমতা লাভ করেছিল। কাজেই সিংহাসন লাভের পর দ্বাদশ লুই মিলানের ওপর তার আইনগত অধিকার স্থাপনে স্থির প্রতিজ্ঞ হন। পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার দ্বাদশ লুইয়ের দাবি সমর্থন করেন। পোপের উদ্দেশ্য ছিল দ্বাদশ লুইকে সমর্থন দিয়ে তার সহায়তায় পোপের পুত্র সিজার বর্জার জন্য ইতালির কিয়দংশ লাভ করা।

দ্বাদশ লুই তার সেনাবাহিনী নিয়ে মিলান দখল করে সেখানকার ডিউক লুডোভিকোকে বন্দি করেন। মিলান দখলের পর দ্বাদশ লুই নেপলসের দিকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। নেপলসের সিংহাসনের ওপর স্পেনের রাজপরিবারের দাবি ছিল। কাজেই লুই একা নেপলস দখল করা সম্ভব নয় বিবেচনা করে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দের সাথে এক চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী নেপলস রাজ্য স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্য ভাগ করা হয়। কিন্তু এ ভাগাভাগি নিয়ে ফার্দিনান্দ ও দ্বাদশ লুইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এই বিবাদ ক্রমে যুদ্ধে পরিণত হয়। যুদ্ধে ফ্রান্স স্পেনের নিকট পরাজিত হয়ে নেপলস অধিকারের আশা ত্যাগ করে। সেমিনারা ও সেরিগ্রোলার যুদ্ধে (১৫০৩) পরাজিত হয়ে দ্বাদশ লুই স্পেনের নিকট নেপলস ছেড়ে দেয়। ১৫০৪ সালে দ্বাদশ লুই পুনরায় নেপলস অধিকারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ঐ সময়ে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার নিজ স্বার্থে দ্বাদশ লুইয়ের সাহায্য কামনা করেন। দ্বাদশ লুই নিজ সৈন্য দ্বারা ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের পুত্র সিজার বর্জাকে মধ্য ইতালির রোমানা নামক স্থান দখল করতে সাহায্য করেন। কূটকৌশলী পোপ আলেকজান্ডার ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের বিরোধের সুযোগে নিজ পরিবারের জন্য মধ্য ইতালিতে একটি রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু তার মৃত্যুতে সিজার বর্জার মধ্যে সংকট দেখা দেয়। পরবর্তী পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩) ছিলেন পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের বিরোধী পক্ষের লোক। তিনি সিজার বর্জাকে মধ্য ইতালির অঞ্চলগুলো পোপের নিকট ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। রাজ্যচ্যুত সিজার বর্জা পিরেনিজ পর্বতের নিকটস্থ ন্যাভারে নামক স্থানে এক অন্তঃবিপ্লবে প্রাণ হারান।

পবিত্র সংঘ (Holy league) : সিজার বর্জাকে বিতাড়িত করে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস ইতালিতে পোপের রাজ্য প্রতিষ্ঠায় কুটকৌশল শুরু করেন। তিনি ভেনিসকে পরাজিত করে ভেনিস অধিকৃত পোপের রাজ্যাংশ পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা করেন। তিনি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তিশালী রাষ্ট্র নিয়ে ক্যাম্বের শক্তি সংঘ (League of Cambray) গঠন করে। পরে অস্ট্রিয়া এই সংঘে যোগদান করে। ফরাসি রাজ দ্বাদশ লুই পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের পক্ষে ভেনিস আক্রমণ করে ভেনিসের নিকট থেকে পোপের রাজ্যাংশ উদ্ধার করেন। ফ্রান্সের মাধ্যমে নিজ স্বার্থ উদ্ধার করে পরে ইতালি থেকে ফ্রান্সকে বিতাড়নের জন্য ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র নিয়ে পবিত্র সংঘ (Holy league) গঠন করেন। স্পেন, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, ভেনিস এবং রোমের পোপ এই পবিত্র সংঘের সভ্য ছিলেন। এই সম্মিলিত পবিত্র সংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইতালিতে কোনো স্থান অধিকারে রাখা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দ্বাদশ লুই মিলান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পিরেনিজ পর্বতের পূর্বে ফ্রান্সের সীমানায় ন্যাভারে নামক স্থান স্পেন দখল করে নেয়। ইংল্যান্ড ফ্রান্স আক্রমণ করে গিনিগেট নামক যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করে। ফলে ফ্রান্সের ইতালিতে আধিপত্য বিস্তার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল।

প্রথম ফ্রান্সিস ও পঞ্চম চার্লসের দ্বন্দ্ব : ফরাসি রাজ দ্বাদশ লুই ১৫১৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে প্রথম ফ্রান্সিস (১৫১৫-১৫৪৭) ফ্রান্সের সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভ করেই তিনি ইতালিতে অভিযান পরিচালনা করেন। ম্যারিগ্নানোর যুদ্ধে মিলান ও সুইজারল্যান্ডের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে ১৫১৫ সালে তিনি মিলান দখল করেন। এ সময় ফ্রান্সের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী স্পেনীয় রাজ ফার্দিনান্দের মৃত্যু হওয়ায় ফ্রান্স স্পেনের পক্ষ থেকে কোনো বাধা পায়নি। কিন্তু ফার্দিনান্দের মৃত্যুর পর তার পৌত্র পঞ্চম চার্লস (১৫১৭-১৫৫৬) পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে প্রার্থী হন। ফরাসি রাজ প্রথম ফ্রান্সিসও পবিত্র রোমান সম্রাটের পদপ্রার্থী হন। ১৫১৯ সালে পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সম্রাট পদ লাভ করলে স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। পঞ্চম চার্লস ইতালির মিলান থেকে ফরাসিদের বিতাড়নের জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। ইংল্যান্ড রাজ অষ্টম হেনরি (১৫০৯-১৫৪৭) এবং রোমের পোপকে নিজ পক্ষে টেনে পঞ্চম চার্লস মিলান থেকে ফরাসিদের বিতাড়িত করেন। প্রথম ফ্রান্সিস পুনরায় মিলান দখলের জন্য সামরিক অভিযান চালান কিন্তু প্যাডিয়া নামক স্থানে পঞ্চম চার্লসের নিকট পরজিত ও বন্দি হন। প্রথম ফ্রান্সিস বন্দি অবস্থায় মাদ্রিদের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী প্রথম ফ্রান্সিস আর্টয়েস, বার্গান্ডি ও ফ্ল্যান্ডার্স স্পেনকে ছেড়ে দেন এবং মিলান, নেপলস ও জেনোয়ার ওপর ফ্রান্সের দাবি প্রত্যাহার করেন। প্রথম ফ্রান্সিস বেকায়দায় পড়ে ফরাসি রাজ্যের অংশ ছেড়ে দিয়ে ইতালির ওপর দাবি ত্যাগ করে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু তিনি এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হন। এ সময় কূটনীতিবিদ উইলসি পঞ্চম চার্লসের অপ্রতিহত ক্ষমতা বৃদ্ধিকে ইংল্যান্ডের জন্য বিরূপ এবং ইউরোপে স্পেনের একক আধিপত্য স্থাপন হিসেবে দেখতে থাকেন। তিনি ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরিকে ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে পঞ্চম চার্লসকে প্রতিরোধের জন্য পরামর্শ দেন। এই পরামর্শে অষ্টম হেনরি ফরাসিরাজ ফ্রান্সিসের পক্ষে যোগদান করেন। কিন্তু পঞ্চম চার্লস ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের যুগ্ম শক্তিকে পরাজিত করেন। ১৫২৯ সালে ক্যাম্ব্রের সন্ধিতে প্রথম ফ্রান্সিস পুনরায় মাদ্রিদের চুক্তি সমর্থন করেন। কেবলমাত্র বার্গান্ডি নামক স্থানটি স্পেনের নিকট থেকে ফেরত পান। এরপর ফ্রান্সিস তুরস্ক কর্তৃক অস্ট্রিয়া আক্রমণের সুযোগে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। কিন্তু ক্রেসপির সন্ধি দ্বারা (১৫৪৪) ক্যাম্ব্রের সন্ধির শর্ত পুনরায় দুই পক্ষ মেনে নেয়। এভাবে প্রথম ফ্রান্সিস ও পঞ্চম চার্লসের মধ্যে ইতালি নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটে।

ক্যাম্ব্রোসিসের সন্ধি : প্রথম ফ্রান্সিস ও পঞ্চম চার্লসের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি হলেও ফ্রান্স ও স্পেনের বিরোধ তিরোহিত হয় নি। পঞ্চম চার্লস ও প্রথম ফ্রান্সিসের উত্তরাধিকারীগণ পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তী ফরাসি রাজ দ্বিতীয় হেনরি (১৫৪৭-১৫৫৯) এবং পরবর্তী স্পেন রাজ দ্বিতীয় ফিলিপের (১৫৫৫-১৫৯৮) মধ্যে ইতালি নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ফরাসি রাজ সেন্ট কুয়েন্টিন এবং গ্রেভেলিন্স নামক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কাটো ক্যাম্ব্রোসিস নামক সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফরাসি রাজকে ইতালিতে আধিপত্য বিস্তার কিংবা রাজ্য দখলের আশা ত্যাগ করতে হয়। এভাবে ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের বিরোধের অবসান ঘটে এবং স্পেন ইতালিতে আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

ইতালিতে ফ্রান্স ও স্পেনের দ্বন্দ্বের ফলাফল

  • ইতালিতে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স ও স্পেনের বিরোধ ইতালীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ইতালির রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মে যে, ইতালির রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং পারস্পরিক বিরোধের কারণে বিদেশী শক্তি ইতালিতে আধিপত্যের সুযোগ পাচ্ছে।
  • ইতালিতে ফ্রান্স ও স্পেনের বিরোধ ইউরোপের অন্যান্য শক্তিকেও জড়িত করে। ফলে ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের বিরোধ শুধু ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হয়।
  • ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের বিরোধে স্পেন শক্তিশালী হলে ইংল্যান্ডের কূটনীতিবিদ উইলসি শক্তিসাম্য নীতি প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে এই শক্তিসাম্য নীতি ইউরোপের রাজনৈতিক নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। কোনো এক শক্তিকে অধিক শক্তিশালী হতে না দেওয়ার নীতির প্রয়োজন ও উপকারিতা অন্য দেশগুলো বুঝতে সক্ষম হয়।
  • ইতালিতে ফ্রান্স ও স্পেনের বিরোধের সুযোগে তুর্কি শক্তির পক্ষে ইউরোপের দানিয়ুব অঞ্চলে রাজ্য বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট বা মহান সুলেমানের রাজত্বকালে তুরস্ক সাম্রাজ্য কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চল থেকে মরক্কো এবং টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস অঞ্চল থেকে আরম্ভ করে দানিয়ুব নদী উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তুর্কিরা হাঙ্গেরির অর্ধাংশ দখল করে।
  • পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস ছিলেন খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মের রক্ষক। ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন শুরু হলে তিনি লুথারপন্থী প্রোটেস্ট্যান্টদের দমনের জন্য সচেষ্ট হন। কিন্তু ফ্রান্সের সাথে রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধের কারণে তার পক্ষে লুথারপন্থীদের দমন করা সম্ভব হয় নি। এই সুযোগে জার্মানিতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের প্রসার সহজ হয়েছিল।
  • পঞ্চম চার্লস ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন। ফ্রান্সের সাথে বিরোধ না হলে সমগ্র ইউরোপে স্পেনের প্রভাব বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা ছিল। প্রথম ফ্রান্সিস পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেন। তিনি পোপ ও ইংল্যান্ডকে নিজ পক্ষভুক্ত করে শক্তিশালী স্পেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্পেনের শক্তিকে প্রতিরোধ করেছিলেন। যার ফলে স্পেনের পক্ষে সমগ্র ইতালি গ্রাস করা সম্ভব হয় নি।
  • ইতালিতে স্পেন ও ফ্রান্সের বিরোধের সূত্র ধরে ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশ এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশের মধ্যে স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীকালে ইউরোপের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৮৬-৯৫
  • Frederick III, Holy Roman Emperor ইত্যাদি উইকিপিডিয়া আর্টিকেল

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.