অ্যারিস্টোটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.)

(সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

অ্যারিস্টটলের জীবন

শৈশবকাল : থ্রেস প্রদেশের অন্তর্গত গ্রীক উপনিবেশ স্ট্রাগিরিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে অ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক পাঠক হয়ত বিস্মিত হবেন এই ভেবে যে, এথেন্স বা গ্রীসের কোন প্রসিদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নয়, একটা সম্পূর্ণ অখ্যাত নগরে অ্যারিস্টটলের জন্ম হয়েছিল। তিনি ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা দ্বিতীয় অ্যামিনটাস-এর চিকিৎসক নিকোম্যাকাসের পুত্র। শৈশব অবস্থাতেই অ্যারিস্টটলের পিতা অ্যারিস্টটলকে চিকিৎসাশাস্ত্রবিষয়ক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন; যার জন্য শৈশব থেকেই অ্যারিস্টটলের মন অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক কার্যের দিকে ধাবিত হয়। পিতামাতার মৃত্যুর পর অ্যারিস্টটলের শিক্ষা তার অভিভাবক প্রক্সিনাস-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। যখন অ্যারিস্টটলের সপ্তদশ বছর বয়স তখন তার অভিভাবক প্রক্সিনাস (Proxenus) তাঁকে শিক্ষা লাভের জন্য এথেন্সে প্রেরণ করেন। এথেন্সে তিনি অ্যাকাডেমির সদস্য হন এবং প্লেটোর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। প্লেটোর শিষ্যরূপে প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি প্লেটোর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত (৩৪৮-৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্লেটোর অধীনে থেকে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন এবং তাঁর সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনায় নিজেকে নিযুক্ত রাখেন।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সম্পর্ক : একটা কথা বলা হয়ে থাকে যে, প্লেটোর মৃত্যুর পূর্বে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে একটা তিক্ততার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর জন্য অ্যারিস্টটলের দলাদলীর মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু এ ধরনের অভিযোগের মূলে সত্যতা আছে বলে অনেকে স্বীকার করেন না। প্লেটোর মৃত্যুর সময়ে অ্যারিস্টটল অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছিলেন এবং গুরুর শিক্ষাকে কেন্দ্র করে অনেক বিষয়ে তিনি তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিন্তু সেই কারণে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে কোন ছেদ দেখা দিয়েছিল, বিশেষ করে যতদিন প্লেটো জীবিত ছিলেন, এমন মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। স্টেইস-এর মন্তব্য – তা ছাড়া, অ্যারিস্টটল-এর রচনাতে প্লেটো প্রসঙ্গে জাতীয় কোন বিষয় আলোচিত হয়নি। এ ছাড়া বেশ বোঝা যায়, ভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, গুরুর প্রতি তিক্ত মনোভাব নিয়ে সুদীর্ঘ কুড়ি বছরকাল অ্যাকাডেমিতে টিকে থাকা অ্যারিস্টটলের পক্ষে কোনদিন সম্ভব হতো না। তা ছাড়া অ্যারিস্টটল তাঁর রচনাতে প্লেটোর শিক্ষার সমালোচনা করলেও সেই সমালোচনাতে কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ভাব ছিল না। জি. ই. আর. লয়েড (G. E. R. LIoyd) বলেন, “গুরুর শিক্ষার প্রতি তার মনোভাবের প্রশ্নটি বেশ বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে … কিন্তু এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, অ্যারিস্টটল-এর চিন্তাধারার ওপর প্লেটোর গঠনমূলক প্রভাব ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” (G. E. R. Lloyd: Aristotle: The Growth and Structure of His Thought; Page 4)। অ্যারিস্টটল অ্যাকাডেমিতে প্লেটোর বিরোধী পক্ষ ছিলেন, এই জাতীয় ধারণাকে সমর্থন করা চলে না। অ্যারিস্টটল প্লেটোকে যথার্থ বন্ধু বলেই মনে করতেন। প্লেটোর মধ্যে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন যথার্থ নেতা বা পথপ্রদর্শকের। প্লেটোর প্রতি তার ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং যদিও অ্যারিস্টটলের পরিণত জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগ দৃঢ়ভাবে দেখা দিয়েছিল, প্লেটোর আধিবিদ্যক এবং ধর্ম সম্পর্কীয় শিক্ষার একটা স্থায়ী প্রভাব তার ওপর ছিল এবং অ্যারিস্টটলের নিজস্ব দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ তার মধ্যে ধীরে ধীরে দেখা দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে গ্রীক দর্শনের লেখক স্টেইস মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, প্লেটোর প্রতি সাধারণের মধ্যে যে বীরপূজার ভাব ছিল এবং যে রকম অন্ধভাবে তারা তার প্রশংসা করেছেন, অ্যারিস্টটলের মত এক স্বাধীনচেতনা, মৌলিক চিন্তাধারার অধিকারী সৃজনশীল প্রতিভার কাছ থেকে সেই অন্ধ প্রশংসা তিনি যদি না পেয়ে থাকেন তাতে বলার এমন কিছু নেই।

অ্যারিস্টটলের এথেন্স ত্যাগ : প্লেটোর মৃত্যুর পর অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষরূপে কে তার স্থানে নির্বাচিত হবেন, এই প্রশ্ন দেখা দিল। সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন তিনজন। অ্যারিস্টটল, জেনোক্রেটিস এবং প্লেটোর ভাইপাে স্পিউসিপাস। এই তিন জনের মধ্যে ভাইপাে স্পিউসিপাস (Speusippus) অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। অ্যারিস্টটল জেনোক্রেটিস-কে সঙ্গে নিয়ে এথেন্স ত্যাগ করলেন এবং অ্যাসস শহরে অ্যাকডেমির একটি শাখা স্থাপন করলেন। এখানে বাস করার সময় তিনি অ্যাটারনিরাসের রাজা হারমিয়াসের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং তার পালিত কন্যা পিথিয়াসকে বিয়ে করেন। কথিত আছে যে, পরবর্তীকালে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন।

থিয়োফ্রেসটাসের সঙ্গে পরিচয় : দ্বিতীয় পত্নীর নাম ছিল হারপিলিস এবং এই পত্নীর গর্ভে নিকোমেকাস নামে তার এক পুত্র জন্মে। অ্যাসস শহরে নিজ কার্যে নিযুক্ত থাকাকালীন অ্যারিস্টটল তাঁর স্বাধীন মত প্রচার করতে থাকেন। তিন বছর পরে লেসবস্ (Lesbos)-এ মাইটিলিন নামক একটি স্থানে তিনি গেলেন। সেখানেই থিয়োফ্রেসটাস (Theophrastus)-এর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যিনি পরবর্তী সময়ে অ্যারিস্টটলের একজন খ্যাতনামা শিষ্য হয়েছিলেন।

অ্যারিস্টটল ও আলেকজান্ডার : ৩৪৩ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপ তার পুত্র আলেকজান্ডারকে শিক্ষা দানের জন্য অ্যারিস্টটলকে আমন্ত্রণ জানান। আলেকজান্ডারের তখন তেরো বছর বয়স। এই আলেকজান্ডারই পরবর্তীকালে বীরের খ্যাতিলাভ করেছিলেন। অ্যারিস্টটল এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। পাঁচ বছর ধরে আলেকজান্ডারকে শিক্ষাদান করেছিলেন। অ্যারিস্টটলে আলেকজান্ডারের সম্বন্ধ ঠিক কিরূপ ছিল তা নিরূপণ করা কঠিন। কেউ কেউ করেন যে, অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, অনেক লেখক, যেমন, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস প্রণেতা বার্ট্রান্ড রাসেল এস. আর. লয়েড মনে করেন যে, আলেকজান্ডারের ওপর অ্যারিস্টটলের কোন প্রভাব কার্যকর হয়নি। (B. Russell : A History of Western Philosophy; Page 160) কথিত আছে রাজা ফিলিপ এবং আলেকজান্ডার উভয়েই অ্যারিস প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পােষণ করতেন।

লাইসিয়ামে চতুম্পাঠী স্থাপন : ফিলিপের মৃত্যুর পর তার পুত্র আলেকজান্ডার সিংহাসনে আরোহণ করলে, আলেকজান্ডারের শিক্ষা সমাপ্ত হল এবং ৩৩৫ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে অ্যারিস্টটল এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করলেন। এথেন্সে ফিরে এসে তিনি দেখলেন জেনোক্রেটিসের তত্ত্বাবধানে প্লেটোর শিক্ষায়তনটি ভালই চলছে এবং প্লেটোর দার্শনিক মতবাদই এথেন্সে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তিনি তখন লাইসিয়াম (Lyseum) নামক স্থানে তাঁর শিক্ষায়তন বা চুতম্পাঠী স্থাপন করেন। শিক্ষাদান ব্যাপার ছাড়াও লাইসিয়ামের এই চতুম্পাঠীর খ্যাতি অ্যাকাডেমির থেকে অনেক বেশি ছিল। শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত এখানে বক্তৃতা দিতেন, গবেষকবৃন্দ পাঠ এবং গবেষণা কার্যে নিযুক্ত থাকতেন। জি. ই. আর. লয়েড এই চতুম্পাঠী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, অ্যারিস্টটলের কাছে এই চুতম্পাঠীর গুরুত্ব ছিল অনেকখানি, যেহেতু এই চতুম্পাঠী তাকে অনেক দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক রচনার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে এবং অনুসন্ধানের বহু বিচিত্র ক্ষেত্রে এক নজিরহীন উদ্দীপনামূলক কর্মপরিকল্পনার প্রবর্তন করতে সমর্থ করেছিল। তাছাড়া এখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও ছিল। (G. E. R. Lloyd. Aristotle: The Growth and Structure of His Thought; Page ৪)

অ্যারিস্টটল এথেন্সে তেরো বছর অতিবাহিত করেন : অ্যারিস্টটল তার শিষ্যদের শিক্ষা দেবার সময় এদিক-ওদিক পদচারণা করতেন। এজন্য তার দর্শনকে ‘ভ্রাম্যমাণ দর্শন’ (Peripatetics) নামে অভিহিত করা হতো। এথেন্সে অ্যারিস্টটল তেরো বছর অতিবাহিত করেন। এই সময় তিনি তার প্রতিষ্ঠিত চতুম্পাঠীটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এবং সাহিত্য ও দর্শন আলোচনায় ব্যাপৃত থাকেন। তার জীবনের এই সময়ই ছিল সকল দিক থেকে ফলপ্রসূ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ থেকে ৩২৩ অব্দ তার দার্শনিক ক্রিয়াকলাপের তৃতীয় এবং শেষ যুগ, যাকে লাইসিয়ামের যুগ বা দ্বিতীয় এথেন্সের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। তার সব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থই এই সময় রচিত হয়। কিন্তু এই সময়ের পরে তার ভাগ্যবিড়ম্বনা শুরু হয়।

অ্যারিস্টটলের ভাগ্য বিড়ম্বনা : ৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে ব্যাবিলনে আকস্মিকভাবে আলেকজান্ডারের মৃত্যু ঘটে। এথেন্সবাসীরা ম্যাসিডােনিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আলেকজান্ডারের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হেতু তাঁকে নানাভাবে পীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। অ্যারিস্টটলের বিরুদ্ধে ধর্মহীনতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অ্যারিস্টটল তখন ইউবোয়িয়ার (Euboea) অন্তর্গত চালসিসে (Chalcis) পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। হয়ত কিছুদিন পরে এথেন্সে ফিরে আসার একটি সংকল্প তার। ছিল কিন্তু চালসিসে বসবাস করার প্রথম বছরেই তিনি পীড়িত হন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দে ৬৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। অ্যারিস্টটল ছিলেন দায়িত্বশীল, মহানুভব এবং উদার। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যে উইল করে গিয়েছিলেন, সেই উইলই প্রমাণ করে যে, তিনি উপরিউক্ত সদগুণের অধিকারী ছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, দার্শনিক হিসাবে অ্যারিস্টটল নানা দিক থেকে তার সব পূর্বসূরি থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন। তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দার্শনিকের মত লিখে গেছেন; তার রচনাগুলো ছিল সুবিন্যস্ত। তার আলোচনাগুলো শিরোনামায় শ্রেণীবিভক্ত। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার শিক্ষক, তিনি প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম প্রবর্তক মহাপুরুষ ছিলেন না। তাঁর রচনা সমালোচনামূলক, যত্নকৃত, নীরস। তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন না, বা কোন সুগভীর অর্থে তাকে ধর্মপরায়ণও বলা চলে না। তার পূর্বসূরিদের ভ্রান্তি হল যৌবনের গৌরবময় ভ্রান্তি, অসম্ভবকে নিয়ে যার প্রয়াস, তার ভ্রান্তি হল যুগের ভ্রান্তি যা অভ্যাসগত কুসংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। বিশদ বিবরণ ও সমালোচনার ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতা লক্ষণীয়। কিন্তু মৌলিক স্পষ্টতার অভাবের জন্য বৃহৎ সংগঠনের ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ। স্টেইসের মতানুসারে আধুনিককালে যে সীমিত অর্থে আমরা দার্শনিক শব্দটিকে বুঝে থাকি সেই অর্থে অ্যারিস্টটল যে শুধুমাত্র একজন দার্শনিক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন এক বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি। এমন কোন জ্ঞানের শাখা ছিল না যা তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেনি এবং একমাত্র গণিত ছাড়া তাঁর সময়ে এমন বিষয় ছিল না, যার সম্পর্কে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলে অভিহিত করা যেত না। অমূর্ত চিন্তনের তুলনায় ভৌতিক বিজ্ঞানের প্রতিই তার আগ্রহ ছিল বেশি। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল সমগ্র জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ করা। যে-সব বিজ্ঞানের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলো পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষণে ব্রতী হওয়া, পূর্বসূরিদের রচনায় যা মিথ্যা তাকে বর্জন করে, যা অবশিষ্ট তাকে বিকশিত করা এবং তার সঙ্গে নিজের ধারণাকে যুক্ত করে দেওয়া। নতুন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করাও তার পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্ততঃপক্ষে দুটি বিজ্ঞানের তিনি প্রবর্তক ছিলেন। একটি হল যুক্তিবিজ্ঞান, অপরটি প্রাণিবিজ্ঞান। তাই তিনি প্রায়। সব জ্ঞানের শাখাতেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন যা বর্তমান যুগে কোন একজন ব্যক্তির পক্ষে এক অসম্ভব ব্যাপার।

অ্যারিস্টটলের রচনাবলি 

অ্যারিস্টটল প্রায় চারশ’র মত গ্রন্থ রচনা করেছেন, এমন কথা শােনা যায়। তবে এতে বিস্ময়ের বিশেষ কোন কারণ নেই, কারণ যাকে অ্যারিস্টটল প্রণীত গ্রন্থ বলে অভিহিত করা হচ্ছে সেগুলো হয়ত আধুনিক যেকোন গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদের সঙ্গে তুল্য।

অ্যারিস্টটলের রচনার অধিকাংশ অংশ বিনষ্ট : এসব রচনার চার ভাগের তিন ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে যেটুকু পাওয়া গেছে সেটুকু খুবই গুরুত্বপর্ণ। কেননা এই অংশ থেকে অ্যারিস্টটলের দর্শন সম্পর্কে মােটামুটি একটি পরিপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। কপলস্টোন অ্যারিস্টটলের রচনাবলিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত সেসব রচনা, যেগুলো প্লেটোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রচিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হল সেসব গ্রন্থ, অ্যাসসে এবং মিটিলিনে বসবাস করার সময় যেসব গ্রন্থ তিনি রচনা করেন এবং তৃতীয় পর্যায়ের যুগ হল লাইসিয়ামে তার যুগ, যখন তার পাণ্ডিত্যসূচক গ্রন্থগুলো রচিত হয়। কপলস্টোনের মতানুসারে অ্যারিস্টটলের রচনাগুলোকে আরও দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে (১) যেগুলো কথােপকথনের ভঙ্গিতে লিখিত এবং সাধারণের পাঠ্য। (২) যেগুলো লাইসিয়ামে অ্যারিস্টটলের প্রদত্ত বক্তৃতার ভিত্তিতে রচিত। শিক্ষাদানই এই গ্রন্থগুলোর উদ্দেশ্য। প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলোর অধিকাংশ অংশই পাওয়া গেছে। এই শ্রেণীর অন্তর্গত গ্রন্থগুলোর সাহিত্যিক প্রসাদ গুণ নেই বললেই চলে। বেশ বোঝা যায়, এই গ্রন্থগুলো রচনাকালে রচনাশৈলীর প্রতি তিনি বিশেষভাবে উদাসীন ছিলেন, কিন্তু দর্শনের বিষয়বস্তু আলোচনা করতে গিয়ে তিনি উপমা বা অলীক কাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ না করে বিচারবুদ্ধির সাহায্যে বিষয়বস্তুর আলোচনাতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তার প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত গ্রন্থগুলোর সাহিত্যিক সুষমা ও রচনাশৈলীর প্রাঞ্জলতা লক্ষণীয়। প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত গ্রন্থগুলোতে প্লেটোর প্রভাবও সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। অ্যারিস্টটলের সাহিত্যিক ক্রিয়াকর্মের প্রথম যুগে অ্যারিস্টটল তার সাহিত্যের বিষয়বস্তু এবং আকারের ব্যাপারে গুরু প্লেটোরই অভিমত বিশেষ করে সমর্থন করেন। ‘ইউডিমাসের কথােপকথন’ (The Dialogue of Eudemus) অথবা ‘আত্মা সম্পর্কে (On The Soul) গ্রন্থগুলো এই যুগে রচিত হয়। প্লেটোর স্মরণ সম্পর্কে মতবাদ এবং জন্ম-পূর্ব অবস্থায় ধারণাগুলোর উপলব্ধি সম্পর্কীয় মতবাদ যে অ্যারিস্টটলও সমর্থন করতেন, এই গ্রন্থ থেকে তা জানা যায়।

অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় অভিমত : প্লেটোর ফিডডা (Pheado) গ্রন্থের অনুসরণে এই গ্রন্থে অ্যারিস্টটল আত্মার অমরত্বের পক্ষে যুক্তি প্রদান করেছেন। আত্মা দেহের সঙ্গতি’-প্লেটোর এই অভিমত খণ্ডন করে অ্যারিস্টটল প্লেটোর আত্মা সম্পর্কীয় চিন্তার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সূচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন, সেই যুক্তিটি হল, সঙ্গতির একটা বিপরীত অবস্থা আছে যেটা হল অসঙ্গতি। কিন্তু আত্মার কোন বিপরীত অবস্থা নেই। তাই আত্মা দেহের সঙ্গতি নয়। সঙ্গতি হল একটা গুণ এবং আত্মা হল একটা দ্রব্য। তাই দুটি ভিন্ন বিষয়। আত্মা যখন এই জাবণে প্রবেশ করে তখন জন্ম-পূর্ব অস্তিত্বের কথা বিস্মৃত হয়। আত্মা মৃত্যুর পরে জীবনের কথা স্মরণ করে। দেহবিযুক্ত যে জীবন তাই হল আত্মার স্বাভাবিক অবস্থা। আত্মার দেহে অবস্থান এক কঠিন ব্যাধির অবস্থা ছাড়া কিছুই নয়। ‘ পরবর্তীকালে প্লেটোর প্রভাবমুক্ত হয়ে অ্যারিস্টটল এ বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিজ অভিমত উপস্থাপিত করেন।

প্রােট্রিপটিকাস গ্রন্থের পরিচয় : ‘দি প্রােট্রিপটিকাস’ (The Protrepticus) গ্রন্থটিও এই সময়কার গ্রন্থ। এটি কোন ‘ডায়ালগ’ নয়, এটি পত্রের আকারে লিখিত। এই গ্রন্থে প্লেটোর ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ আলোচিত হয়েছে। তাকেই দার্শনিক গণ্য করা হয় যিনি এই আকার বা ধারণাগুলোকে, তাদের অনুলিপি বা অনুকরণকে নয়, অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এই গ্রন্থে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, জাগতিক সম্পদ মূল্যহীন এবং এই জীবন হচ্ছে আত্মার মৃত্যু বা কবর; দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মার প্রকৃত এবং উন্নততর জীবনে উত্তরণ ঘটে। অ্যারিস্টটলের এই মতবাদের ওপর প্লেটোর প্রভাব সুস্পষ্ট। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘ফিজিকস্’ (Physics)-এর কয়েকটি খণ্ড অ্যারিস্টটলের প্রথম পর্যায়ভুক্ত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

অ্যারিস্টটলের রচনার দ্বিতীয় পর্যায় : অ্যারিস্টটলের রচনার দ্বিতীয় যুগটি হল পরিবর্তনের যুগ (The Transition Period) : এই যুগে অ্যারিস্টটল প্লেটোর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নন, কিন্তু অ্যাকাডেমির বিভিন্ন মতবাদের প্রতি তিনি সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং কোন কোন মতের তিনি সংশােধন করেন। ‘দর্শন বিষয়ে কথােপকথন’ (Dialogue on Philosophy) এই সময়ে রচিত। এই গ্রন্থের তিনটি খণ্ড (১) ঐতিহাসিক, (২) সমালোচনামূলক এবং (৩) মননবিষয়ক (Speculative)। প্রথম খণ্ডে আছে দর্শনের বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের সমালোচনা। আর তৃতীয় খণ্ডে আছে অ্যারিস্টটলের নিজের জগৎ-বিষয়ক এবং ধর্ম বিষয়ক দার্শনিক আলোচনা। এই গ্রন্থে অ্যারিস্টটল তাঁর অধিবিদ্যার মূল ধারণা, বিশ্বজগতের সব পরিবর্তনের অপ্রবর্তিত প্রবর্তক (The Unmoved Mover)-এর ধারণা ব্যক্ত করেন। পূর্ণতার ক্রমবিন্যাসের ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি এই ডায়ালগেই দৃষ্ট হয়। মনে হয় অধিবিদ্যার (Metaphysics) মােটামুটি একটা না এই সময়েই রচিত হয়েছিল। অধিবিদ্যার প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষ খণ্ডগুলো এই সময়ের রচনা। এই সময় অ্যারিস্টটল নীতিবিদ্যাও রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, অতীন্দ্রিয় অপরোক্ষ অনুভূতির দ্বারাই জানা যায় যে, ঈশ্বরই পরম কল্যাণ এবং তারই আলোকে মানুষের নৈতিক চরিত্র নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। অ্যারিস্টটল কল্যাণবাদ প্রচার করেন। প্লেটো তাঁর ‘ফিলিবাস এবং লস-এ যে নৈতিক মতবাদ প্রচার করেছেন তার সঙ্গে এই মতবাদের সংযোগ খুবই সুস্পষ্ট। অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের (Politics) কয়েকটি খণ্ডও এই সময়ে রচিত হয় (“To this early Politics belongs Book II and III, VI and VIII of the Politics
as they now stand”)। এই সব খণ্ডে একটি আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা আছে এবং প্লেটোর ‘রিপাবলিক’এ বর্ণিত এবং পূর্ববর্তী অন্যান্য লেখকদের কাল্পনিক আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনাও এতে আছে। প্রকৃত রাষ্ট্রকে বর্জন না করার জন্যই অ্যারিস্টটল প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রকে বর্জন করেছিলেন। জেলার (Zeller)-এর অভিমতানুসারে অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় এবং জগততত্ত্ব বিষয়ক মৌলিক মতবাদগুলো এই সময়েই রচিত হয়।

অ্যারিস্টটলের রচনার তৃতীয় পর্যায় : অ্যারিস্টটলের রচনার তৃতীয় যুগ হল লাইসিয়ামে তার ক্রিয়াকলাপ। অ্যারিস্টটলের জীবনের শেষ তেরো বছর প্রকৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ গবেষণাকার্যে অতিবাহিত হয়। তিনি ছাত্রদের এই গবেষণাকার্য চালান। প্রকৃতিকে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করার এক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে এই সময়ে জাগ্রত হয়েছিল। তিনি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দর্শনের সৌধকে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতির ঘটনা এবং ইতিহাস সম্পর্কে যথাযথ গবেষণাকার্য পরিচালনার মনোভাব, যা অ্যারিস্টটলের মধ্যে এই সময়ে দেখা গিয়েছিল, তা গ্রীক জগতে এক অভিনব ঘটনা এবং এর কৃতিত্ব অ্যারিস্টটলের প্রাপ্য। তবে কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে যা বলেছেন তাও মনে রাখা দরকার। যথাযথ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকার্যে আগ্রহ দেখাবার জন্য অ্যারিস্টটলকে তার শেষজীবনে একজন প্রত্যক্ষবাদী (Positivist) রূপে চিত্রিত করা সমীচীন হবে না, কেননা এমন কোন প্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, তিনি অধিবিদ্যাকে বর্জন করেছিলেন। অ্যারিস্টটলের পাণ্ডিত্যসূচক (Pedagogical Works) গ্রন্থগুলোর অধিকাংশই এই সময়ে রচিত। অবশ্য এসব গ্রন্থের কিছু কিছু অংশ যে ইতোপূর্বে রচিত হয়েছে সেকথা পূর্বেই বলা হয়েছে। অ্যারিস্টটলের পাণ্ডিত্যসূচক গ্রন্থের মূলে ছিল অ্যারিস্টটলের চতুম্পাঠীতে প্রদত্ত তার বক্তৃতা। অ্যারিস্টটলের এই গ্রন্থগুলো যথাযথভাবে অনুধাবন করতে গিয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিরা খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই গ্রন্থগুলোর বিভিন্ন খণ্ডের মধ্যে সংযোগ সকল ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি, পরিচ্ছেদগুলোর মধ্যে চিন্তার যৌক্তিক ধারাবাহিকতা বা পারস্পর্য বজায় থাকেনি। এ ছাড়াও রয়েছে আরও নানা ধরনের ত্রুটি, তার ফলেই অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল।

অ্যারিস্টটলের তৃতীয় পর্যায়ের রচনাগুলোর শ্রেণীবিভাগ : অ্যারিস্টোটলের রচনাগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় –

  • (১) যুক্তিশাস্ত্র সম্পর্কিত রচনা : অরগ্যানন (Organon) এই শিরোনামার অধীনে যুক্তিশাস্ত্রবিষয়ক রচনাগুলো প্রকাশিত হয়। এতে রয়েছে বচন, অনুমান, প্রমাণ পদ্ধতি, ডায়েলেকটিক বা সম্ভাব্যতার প্রমাণ (The Proof of Probability) এবং সােফিস্টদের অনুপপত্তি (Fallacies) সম্পর্কে আলোচনা।
  • (২) অধিবিদ্যা বিষয়ক রচনা : বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বক্তৃতার সমষ্টি হল এই রচনাবলি। অ্যারিস্টটল এই রচনার বিষয়বস্তু নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন যে, এ হল ‘জগৎ বিষয়ক প্রথম নীতির বিজ্ঞান’ বা ‘যে বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা অনুসন্ধান করি। এই রচনার প্রথম এবং শেষ অংশের মধ্যে পার্থক্য হল যে, প্রথমাংশে অধিবিদ্যাকে অতীন্দ্রিয় বিষয় সম্পর্কীয় মতবাদরূপে অভিহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের আলোচনায় অধিবিদ্যার পরিসরকে আরও বিস্তৃত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে সমস্ত জগতকে নিয়ে সত্তা সম্পর্কীয় একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়।
  • (৩) প্রাকৃতিক দর্শন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে রচনাবলি : এই রচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল পদার্থবিদ্যা (Physics)। এই গ্রন্থটির আটটি খণ্ড, যার প্রথম দুটি খণ্ড অ্যারিস্টটলের প্লেটোনিক পর্যায়ের রচনা। সপ্তম খণ্ডটি মনে হয় পরবর্তীকালের সংযোজন। খণ্ডগুলোতে গতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ‘মিটিয়্যারোলোজি’ (The Meteorology) প্রথা এই সময়ের রচনা। এর চারটি খণ্ড। এই সময় ‘প্রাণীদের ইতিহাস’ (The Histories of Animals) গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। এটি তুলনামূলক অঙ্গবিচ্ছেদ বা গঠন সংক্রান্ত বিদ্যা এবং শারীরবৃত্তি সম্পর্কীয় একটি গ্রন্থ। এর দশটি খণ্ড, তবে শেষের খণ্ডটি অ্যারিস্টটলের পরবর্তী রচনা বলে মনে করা হয়। মনোবিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ ‘ডি অ্যানিমা’ (De Anima) এবং ‘পার্ভা নেচুরেলিয়া’ (Parva Naturalia) এই সময়েরই রচনা। শেষােক্ত গ্রন্থটিতে প্রত্যক্ষণ, স্মৃতি, নিদ্রা এবং জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন, দীর্ঘ। জীবন এবং সংক্ষিপ্ত জীবন, জীবন এবং মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। দি প্রবলেমাটা (The Problemata) গ্রন্থটিও এই সময়ে প্রকাশিত হয়, যেটিতে কতকগুলো সমস্যা সমষ্টিগতভাবে আলোচিত হয়েছে।
  • (৪) নীতিবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক রচনাবলি : এই রচনাবলির অন্তর্ভুক্ত হল ‘দি মেগনা মােরেলিয়া’ (The Magna Moralia)। এই গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে রচিত এবং বিষয়বস্তু দেখে মনে হয় অ্যারিস্টটল প্রকৃতই এর রচয়িতা। ‘দি নিকোমেকিয়ান এথিকস’ (The Nicomachean Ethics) গ্রন্থটিও এই পর্যায়ের রচনা। গ্রন্থটির দশটি খণ্ড, অ্যারিস্টটলের মৃত্যুর পর তার পুত্র নিকোমেকাস-এর নামানুসারে গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়। তা ছাড়া, এই সময়ে রচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান (The Politics) গ্রন্থের দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম ও অষ্টম খণ্ড অ্যারিস্টটলের দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই খণ্ডগুলোর প্রধান আলোচ্য বিষয় হল অ-রাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি এবং তাদের অস্তিত্বের শর্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান অংশ প্রস্তুত করার জন্য ১৫৮টি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের সংগ্রহ এই গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়।
  • (৫) সৌন্দর্যবিদ্যা বা কান্তিবিদ্যা, ইতিহাস এবং সাহিত্যবিষয়ক রচনাবলি : এই রচনাবলির অন্তর্ভুক্ত হল ‘দি রেটোরিক’ (The Rhetoric) যার তিনটি খণ্ড এই সময়ে রচিত ‘দি পয়েটিক্স’ (The Poetics) একটি অসম্পূর্ণ গ্রন্থ। এগুলো ছাড়াও প্রাচীন নিদর্শন সংক্রান্ত তত্ত্বমূলক গবেষণার উল্লেখ করা যেতে পারে যার মাধ্যমে অ্যারিস্টটল তাঁর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস এবং সাহিত্যের কালানুক্রমিক ভিত্তি উপস্থাপনের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। ডিডাস, সেলিয়ার রচনা সংগ্রহ এর অন্তর্ভুক্ত। এতে রয়েছে অ্যাথেন্সের নাট্যানুষ্ঠানের বিবরণ এবং অলিম্পিক ও পাইথিয়ান ক্রীড়ায় বিজয়ীদের নামের সঙ্কলন। তা ছাড়া আছে ছাত্রদেরও নামের সঙ্কলন। ছাত্রদের সহায়তায় অ্যারিস্টটল বিভিন্ন বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনায় প্রণােদিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তাঁরই নির্দেশে থিয়োফ্রেসটাস প্রাকৃতিক দর্শনের রোডস্-এর ইউডিমাস (Eudumus of Rodes); গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের এবং মেনো (Meno) ভেষজের ইতিহাস রচনা করেন। রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অধিকার সম্পর্কেও তিনি একটি নিবন্ধ রচনা করেন। বস্তুত, এইসব রচনাই প্রমাণ করে, তার রচনার পরিসর কত বিস্তৃত এবং ভিন্নধর্মী। এই অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং ঐতিহাসিক গবেষণার জন্যই অ্যারিস্টটল তাঁর গুরু প্লেটো যেখান। থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাকে অতিক্রম করে অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতাভিত্তিক বা প্রকৃতি নির্ভর গবেষণা কার্য এবং মননশীল দর্শন আলোচনা, উভয়েতেই তিনি সমান আগ্রহী ছিলেন।

জেলার-এর মন্তব্য – জেলার বলেন, “দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি, তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং তাঁর সময়ের সবচেয়ে মহান ব্যাখ্যাকার ছিলেন।” যদিও অ্যারিস্টটল দর্শনকে সুসঙ্গতভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শ্রেণীবিভক্ত করেছেন, কপলস্টোনের মতে, এ ব্যাপারে তার সুচিন্তিত অভিমত হল – 

  • (১) তাত্ত্বিক দর্শন (Theoretical Philosophy) : যেখানে জ্ঞানই হল লক্ষ, কোন ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি নয়। এই তাত্ত্বিক দর্শন দুভাগে বিভক্ত
    (ক) পদার্থবিদ্যা বা প্রাকৃতিক দর্শন, যার কাজ জড় বস্তুকে নিয়ে যারা গতির অধীন
    (খ) গণিত, যার কাজ যা গতিহীন তাকে নিয়ে, কিন্তু জড় থেকে যা অবিচ্ছিন্ন। তাছাড়া অধিবিদ্যা, যার কাজ যা বিচ্ছিন্ন (অতীন্দ্রিয়) এবং গতিহীনকে নিয়ে।
  • (২) ব্যবহারিক দর্শন (Practical Philosophy) : প্রধানত রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে, ব্যাপক অর্থে নৈতিক ক্রিয়ার আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত,
  • (৩) কাব্যিক দর্শন (Poetical Philosophy) : যার কাজ উৎপাদন নিয়ে, গতি নিয়ে নয়, এর কাজ কলার তত্ত্ব (Theory of Arts) নিয়ে।

অ্যারিস্টটলের রচনাবলির সঙ্গে প্লেটোর রচনাবলির ভাবগত পার্থক্য

অ্যারিস্টটলের গ্রন্থের তালিকা দেখলেই যেন মনে হয় গুরুর সঙ্গে তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অ্যারিস্টটল অভিজ্ঞতায় প্রদত্ত ঘটনা এবং তথ্যের ওপর নির্ভর করার ব্যাপারেই ছিলেন সমধিক আগ্রহী। তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক সংগঠনকর্তা। আর, জন্ম থেকেই কবি প্লেটোর ছিল এক কল্পনাপ্রবণ মন, এর ওপর পিথাগোরাস দর্শনের প্রভাবে অতীন্দ্রিয়তার প্রতি ছিল তার প্রবল ঝোঁক। অ্যারিস্টটল প্লেটোর ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ এবং তার দ্বৈতবাদী মনোবিজ্ঞান (Dualistic Psychology)-এর বিরোধিতা করেছিলেন। প্লেটোর মতে, জাগতিক বস্তু জ্ঞানের বিষয় হবার উপযোগী নয় কিন্তু অ্যারিস্টটল এই জগতকে অর্ধসত্য বা প্লেটোর উপরিউক্ত সিদ্ধান্তকে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারেননি।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতই ঘটনার জগৎ। অ্যারিস্টটল ঘটনা ভালবাসতেন। তিনি সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভেই আগ্রহী ছিলেন। প্লেটো ঘটনা ভালবাসতেন না। ভৌতিক তথ্য অনুসন্ধানে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জ্ঞানকে মূল্যহীন আখ্যাত করাই ছিল প্লেটোর বিশেষত্ব। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি প্লেটোর এ উদাসীনতা অ্যারিস্টটলকে পীড়া দিয়েছিল। প্লেটো বুদ্ধিবাদী হওয়া সত্ত্বেও রূপকথা এবং কাব্যকে চিন্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল ছিলেন সুনির্দিষ্ট জ্ঞানলাতে আগ্রহী। বিচারবুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যার পরিবর্তে কাব্যসুলভ উপমার ব্যবহার অ্যারিস্টটল মনকে পীড়িত করত। প্লেটো রচনাশৈলীর সুষমাতে মনোযোগী ছিলেন, আর অ্যারিস্টটলের, শব্দ যে সত্য, যে গৃঢ় প্রকাশ করে, তাতে আগ্রহী ছিলেন।

স্টেইস্-এর মন্তব্য : তাই উভয় দার্শনিকের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু সাধারণের মনে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, উভয় দর্শন পরস্পরের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাধারণের এই ধারণা যথার্থ নয়। উভয় দর্শনের মধ্যে কোন কোন মতবাদের ব্যাপারে বিরোধিতা লক্ষ করা গেলেও একের দর্শন অপরের দর্শনের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ, এই ধরনের সিদ্ধান্ত হবে বিরোধিতার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই কথা বলাই সমীচীন হবে যে, অ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতবাদ প্লেটোর মতবাদের বিরোধী মতবাদ নয়, বরং বলা যেতে পারে তার ক্রমবিকাশ বা পরিণতি। অ্যারিস্টটল প্লেটোর কোন কোন মতবাদের যেমন ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ বা প্লেটোর দ্বৈতবাদী মনোবিজ্ঞানের সংশােধন করেছেন এবং ভৌতিক ঘটনার সুদৃঢ় ভিত্তি যুগিয়ে দিয়েছেন। দুই দর্শনকে পরস্পরের বিরোধী গণ্য না করে এককে অপরের পরিপূরক গণ্য করাই যুক্তিসঙ্গত। অ্যারিস্টটলের দর্শন ভালভাবে অনুধাবন করলে এই অভিমত ব্যক্ত করা যাবে না যে, তার দর্শন প্লেটোর দর্শনের বিরোধী দর্শন। বরং স্টেইসের কথা উদ্ধৃত করে বলা যেতে পারে যে, প্লেটো অনুরাগীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন মহত্তম ব্যক্তি, কেননা তার দার্শনিক মতবাদ ‘ধারণা’ (Idea)-র উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি প্লেটোর ভাববাদের ত্রুটি সংশােধনের চেষ্টা করে ভাববাদকে এক নতুন ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। নানা বিষয়ে উভয় দর্শনের মধ্যে বিরূপতা থাকলেও, এদের মধ্যে ছিল এক মৌলিক সাদৃশ্য, যা পার্থক্যের তুলনায় অনেক গভীরতর। প্লেটোর ভাববাদকে ত্রুটিমুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি তার ত্রুটিগুলো নির্দেশ করেছিলেন। সেই কারণেই প্লেটোর দর্শনের প্রতি তিনি বিতর্কমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল ধারণাকে (Idea) জগতের সর্বনিরপেক্ষ ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছিলেন, প্লেটোর ধারণাবাদকে তিনি পরিহার করেননি।

কপলস্টোনের মন্তব্য : অ্যারিস্টটলের ছিল ঘটনার প্রতি গভীর আকর্ষণ কিন্তু সেই কারণে এটা সিদ্ধান্ত করলে ভুল হবে যে, ঘটনার প্রতি অনুরাগ এবং দর্শনের একটা অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যুগিয়ে দেবার অত্যধিক আগ্রহে তিনি তার অধিবিদ্যার প্রতি আগ্রহকে পরিহার করেছিলেন। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েরই দর্শনের উৎকর্ষ কিন্তু অধিবিদ্যাতে। কপলস্টোনের মতে, অ্যারিস্টটলের চিন্তার গতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, প্রথম দিকে প্লেটোর যে দার্শনিক চিন্তাকে তিনি সমর্থন করেছিলেন, ক্রমশ তা থেকে তিনি দূরে সরে গেছেন। আবার প্লেটোর যে-সব অভিমতগুলোকে তিনি শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে সেই সব অভিমতগুলোর সংযোগ সকলক্ষেত্রে সুসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান 

ভূমিকা ও যুক্তিবিজ্ঞান বিষয়ক রচনা

যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের কৃতিত্ব ও জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের প্রভাব লক্ষ করা গেলেও, যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই প্রভাব যে সর্বাধিক, সে-কথা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীনকালে যখন অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে প্লেটোর প্রভাবের কথা বিশেষভাবে সুবিদিত, তখন কিন্তু যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলেরই সর্বাধিক নাম। বস্তুত মধ্যযুগ পর্যন্ত তিনি এই সর্বোচ্চ পদের অধিকারী ছিলেন। অধিবিদ্যার ক্ষেত্রেও তিনি তার সুস্পষ্ট পরিচয় রেখে গেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিস্টান দার্শনিকবৃন্দ অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের প্রাধান্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের পরে তার এই প্রাধান্য নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তখনও পর্যন্ত তার প্রাধান্য বজায় থাকে। বস্তুত, আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার সত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞানের মর্যাদা হ্রাস পায়নি। অনেকের মতে, আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞানের সম্প্রসারণ, পরিবর্ধিত ও পরিণত রূপ। অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞান যে যুক্তিবিজ্ঞানের প্রথমাবস্থা, আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান তারই পরবর্তী পরিণত অবস্থা।

যুক্তিবিজ্ঞান বিষয়ক অ্যারিস্টটলের রচনা : 

  • ১। অর্গানন (Organon) : যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলের রচনা সমগ্র অর্গানন (Organon) নামে পরিচিত। যেহেতু এই স্বল্প পরিসরে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কিত সকল সমস্যার আলোচনা এখানে। সম্ভব নয়, তাই, অর্গাননে আলোচিত কয়েকটি বিশেষ বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করে। অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচ্য বিষয়ের পরিসর আমরা নির্দেশ করতে পারি। তার থেকেই অ্যারিস্টটলের যৌক্তিক বিশ্লেষণের বিস্তৃত পরিসরের কথা জানা যাবে।
  • ২। কেটাগরিস (Categories) : এই গ্রন্থে অ্যারিস্টটল উদ্দেশ্য এবং বিধেয়র ভিন্নতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ডি. ইন্টারপ্রিটেশন (De Intepretation) গ্রন্থে তিনি বচনের বিরোধিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রায়র এনালিটিকস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি বিভিন্ন ধরনের বচন নিয়ে, ন্যায়-অনুমানের সংস্থান নিয়ে, ন্যায় অনুমানের গঠন নিয়ে এবং আরও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে অ্যারিস্টটল আশ্রয়বাক্য এবং সিদ্ধান্তের সত্যতামিথ্যাত্ব, ন্যায় অনুমানের ত্রুটি, আরোহ অনুমান অর্থাৎ পূর্ণ গণনামূলক আরোহ অনুমান, সংক্ষিপ্ত ন্যায় অনুমান প্রভৃতি আলোচনা করেছেন।
  • ৩। পোস্টিরিয়ার এনালিটিক্স গ্রন্থে প্রথম খণ্ডে অবরোহ বিজ্ঞানের গঠন এবং তার যৌক্তিক শুরুর বিষয়টি, বিজ্ঞানের যৌক্তিক ক্ৰম (Logical Ranking), হেত্বাভাস, অবৈধতা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে সংজ্ঞার্থ, সংজ্ঞাথের সঙ্গে প্রমাণের পার্থক্য, কিভাবে মূল সত্যকে জানা যায় প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ‘দি টপিকস’ (The Topics) গ্রন্থে বিধেয়ক (Predicables), সংজ্ঞার্থ, প্রমাণের প্রণালী, কৌশল বা ডায়ালেকটিক-এর অনুশীলন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। “দি সােফিস্টটিক এলেনকিস’ (De Sophistic Elenchis) গ্রন্থে অনুপত্তি বা হেত্বাভাসের শ্রেণীবিভাগ এবং সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
  • ৪। দি প্রায়র এনালিটিকক্স গ্রন্থে অ্যারিস্টটল ন্যায় অনুমান নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘কেটিগরিস’ (Categories) এবং ‘টপিক্স’ (Topics) গ্রন্থে তিনি বিধেয়ক সম্পৰ্কীয় তার মতবাদ আলোচনা করেছেন। কেটিগরির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, এমন উক্তি যা কোন মতেই যৌগিক কিছু নির্দেশ করে না’ (Expressions which are in no way composite signify)। এর অর্থ হল—প্রতিটি শব্দ এমন, যার অর্থ অন্য শব্দের অর্থের মিশ্রণ নয় (every word of which the meaning is not compounded of the meanings of other words)।

আকারমূলক যুক্তিবিজ্ঞান

অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞানকে প্রায়ই আকারমূলক যুক্তিবিজ্ঞান (Formal Logic) বলে আখ্যাত করা হয়। এর কারণ হল অ্যারিস্টটল চিন্তার বা যুক্তির আকার বিশ্লেষণ করেছেন। অবশ্য এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় স্মরণে রাখা উচিত হবে যে, অ্যারিস্টটল তার যুক্তিবিজ্ঞানে চিন্তার আকার নিয়ে আলোচনা করলেও এ কথা মনে করা সমীচীন হবে না যে, তার চিন্তার আকারের সঙ্গে বাহ্য জগতের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বিশেষ করে প্রমাণের আকার নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং তিনি ধারণা করেছেন যে, কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সিদ্ধান্ত, সত্তা (Reality) সম্পর্কে আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সকল মানুষ হয় মরণশীল’, সক্রেটিস হয় একজন মানুষ’, সুতরাং সক্রেটিস হয় মরণশীল’, এই ন্যায় অনুমানে শুধুমাত্র সিদ্ধান্তই যুক্তিবিজ্ঞানের আকারমূলক সূত্র বা নিয়মানুসারে যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয় না, উপরন্তু সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাস্তবের মিলও প্রমাণিত হয়।

যুক্তিবিজ্ঞান অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কীয় চিন্তার আকারের বিশ্লেষণ : সেই কারণে অ্যারিস্টটল অনুমান করেন যে, যুক্তিবিজ্ঞান যদিও চিন্তার আকারের বিশ্লেষণ, তবু এ হল সেই চিন্তার বিশ্লেষণ, যে চিন্তা অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করে, প্রত্যয়ের মাধ্যমে তাকে মনের মধ্যে উপস্থাপিত করে এবং যথাযথ অবধারণের ক্ষেত্রে, সেই অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কে এমন বিবৃতি দেয়, বাস্তব জগতে যার প্রমাণ মেলে। তাই যুক্তিবিজ্ঞান হল অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কে মানুষের যে চিন্তন, সেই চিন্তনের বিশ্লেষণ। এই বিষয়টি সম্পর্কে পরে আরও আলোচনা করা হবে।

ন্যায় অনুমান : যুক্তিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের উল্লেখযোগ্য অবদান হল ন্যায় অনুমান (Syllogism)। ‘প্ৰায়র অ্যানালিটিকস’ (Prior Analytics) গ্রন্থে অ্যারিস্টটল অনুমানের বা যুক্তির আকার নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং ন্যায় অনুমানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, এ হল “এমন আলোচনা, যার ক্ষেত্রে, কিছু বিষয় উক্ত বা বিবৃত হলে, কিছু বিষয় যা উক্ত বা বিবৃত হয়নি, তারা, তাই হওয়ার জন্য, উক্ত বিষয় থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়।” (“…discourse in which certain things being stated, something other than what is stated follows of necessity from their being so”.-Analytics Prior 11. 24b.)। দৃষ্টান্ত – সকল মানুষ হয় মরণশীল; সক্রেটিস হয় একজন মানুষ, সক্রেটিস হয় মরণশীল।

সাধ্যপদ, পক্ষপদ ও হেতুপদ : এবার ন্যায় অনুমান (Syllogism) কাকে বলে বুঝে নেওয়া যাক। এই ধরনের অনুমান বা যুক্তির তিনটি অংশ, সাধ্য আশ্রয়বাক্য (Major Premise), পক্ষ আশ্রয়বাক্য (Minor Premise) এবং সিদ্ধান্ত (Conclusion)। সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য পদকে পক্ষপদ (Minor Term), বিধেয় পদকে সাধ্যপদ (Major Term) এবং যে পদটি পক্ষপদ ও সাধ্য পদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করে তাকে হেতুপদ (Middle Term) বলে। উপরে ন্যায় অনুমানের যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে ‘সক্রেটিস’ পক্ষপদ, ‘মরণশীল’ সাধ্যপদ এবং ‘মানুষ’ হেতুপদ। হেতুপদ দুটি যুক্তিবাক্যকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। দুটি আশ্রয় বাক্যেরও দুটি ভিন্ন নাম আছে।

প্রধান আশ্রয় বাক্য, অপ্রধান আশ্রয় বাক্য : যে আশ্রয় বাক্যে সাধ্যপদ ও হেতু পদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রকাশ করা হয় তাকে বলা হয় সাধ্য আশ্রয় বাক্য বা প্রধান আশ্রয় বাক্য। যে আশ্রয় বাক্যে পক্ষপদ ও হেতুপদের মধ্যে সম্বন্ধ প্রকাশ করা হয় তাকে বলা হয় পক্ষ আশ্রয় বাক্য বা অপ্রধান আশ্রয় বাক্য। উপরের দৃষ্টান্তে ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’ – এই যুক্তিবাক্যটি প্রধান আশ্রয়বাক্য; সক্রেটিস হয় একজন মানুষ’ – এই যুক্তিবাক্যটি অপ্রধান আশ্রয় বাক্য। … সক্রেটিস হয় মরণশীল—এ যুক্তিবাক্যটি সিদ্ধান্ত। সাধারণত পক্ষপদ, হেতুপদ এবং সাধ্যপদকে যথাক্রমে ‘S’ ‘M’ এবং ‘P’ এই তিনটি প্রতীক বর্ণের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।

ন্যায় অনুমানের আশ্রয় বাক্য এবং সিদ্ধান্ত-এর তিনদিক থেকে পার্থক্য করা হয় পরিমাণ, গুণ এবং নিশ্চয়তা। পরিমাণ অনুসারে বচন তিন ধরনের সার্বিক, বিশেষ এবং অনির্দিষ্ট (Indefinite) বা অনুক্ত পরিমাণ বচন। ‘সব মানুষ হয় প্রাণী’, ‘কোন কোন লোক হয় জ্ঞানী এবং ‘সুখ হয় ভাল’ হল যথাক্রমে তিন ধরনের বচনের উদাহরণ। গুণানুসারে বচন দুই প্রকার-সদর্থক এবং নঞর্থক। ‘ক সকল খ-এর অন্তর্ভুক্ত’, ‘ক নয় কোন খ’ এর অন্তর্ভুক্ত হল অ্যারিস্টটলের দেওয়া দুধরনের বচনের উদাহরণ।

গুণ ও পরিমাণের সংযুক্ত ভিত্তিতে A, E, I, O চার ধরনের বচনের কথা তিনি বলেছেন।
সার্বিক সদর্থক – ‘ক সকল খ-এর অন্তর্ভুক্ত।
সার্বিক নঞর্থক – ‘ক নয় কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষ সদর্থক – ‘ক হয় কোন কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।’
বিশেষ নঞর্থক – ‘ক নয় কোন কোন খ-এর অন্তর্ভুক্ত।’

নিশ্চয়তা অনুসারে বচন তিন প্রকার ঘােষক (Assertoric), অনিবার্য (Apodetic) এবং সম্ভাব্য (Problematic)। ‘ক হয় খ’, ‘ক অবশ্যই খ’ এবং ‘ক খ হলেও হতে পারে’ – এগুলো পূর্বোক্ত তিন প্রকার বচনের উদাহরণ।

‘প্রায়র এনালিটিকস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম দিকের পরিচ্ছেদগুলোতে বিভিন্ন ধরনের আশ্রয় বাক্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর অ্যারিস্টটল চতুর্থ পরিচ্ছেদে কিভাবে ন্যায় অনুমান গঠন করা হয় সেই সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেকোন ধরনের দুটি আশ্রয় বাক্য থেকেই সিদ্ধান্ত টানা যায়।

অ্যারিস্টটল যুক্তিবাক্য দুটিতে হেতুপদের অবস্থান অনুযায়ী অনুমানের তিনটি সংস্থান (Figures)-এর আলোচনা করেছেন।

১। প্রথম সংস্থানে হেতুপদটি প্রধান যুক্তিবাক্যে উদ্দেশ্য এবং অপ্রধান যুক্তিবাক্যে বিধেয়র স্থান অধিকার করে। প্রতীক বর্ণের সাহায্যে প্রথম সংস্থানের দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ : M হয় P. – প্রত্যেক মানুষ হয় মরণশীল।
S হয় M. – প্রত্যেক দার্শনিক হয় মানুষ।
S হয় P – সুতরাং, প্রত্যেক দার্শনিক হয় মরণশীল।

২। দ্বিতীয় সংস্থানে হেতুপদটি প্রধান যুক্তিবাক্যে ও অপ্রধান যুক্তিবাক্য উভয় ক্ষেত্রেই বিধেয়ের স্থান অধিকার করে :
P হয় M – প্রতিটি মানুষ হয় দ্বিপদ জীব।
S হয় না M – কোন ঘােড়া নয় দ্বিপদ জীব।
S হয় না P – কোন ঘােড়া নয় মানুষ।

৩। তৃতীয় সংস্থানে হেতুপদটি প্রধান যুক্তিবাক্য ও অপ্রধান যুক্তিবাক্য উভয় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যের স্থান অধিকার করে।
M হয় P – প্রত্যেক মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি।
M হয় S – প্রত্যেক মানুষ হয় প্রাণী।
S হয় P – সুতরাং, কোন কোন প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি।

প্রথম সংস্থান বিশুদ্ধ সংস্থান : অ্যারিস্টটল তিনটি সংস্থানের কথা বলেছেন। অন্যান্য যুক্তিবিজ্ঞানীরা একটি চতুর্থ সংস্থানের কথা বলেছেন। চতুর্থ সংস্থানে হেতুপদটি প্রধান যুক্তিবাক্যে বিধেয় এবং অপ্রধান যুক্তিবাক্যে উদ্দেশ্যের স্থান অধিকার করে। সব P হয় M. কোন M হয় না S. সুতরাং কোন S হয় নয়-P। অ্যারিস্টটল তার তিনটি সংস্থানের মধ্যে প্রথম সংস্থানকেই বিশুদ্ধ সংস্থান (Perfect Figure) বলেছেন। অবশিষ্ট সংস্থানগুলোকে, অ্যারিস্টটলের মতে, প্রধান সংস্থানে রূপান্তরিত করে তাদের শুদ্ধতা নিরূপণ করা যায়।

প্রতিটি সংস্থানের ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি (Moods) আছে। আশ্রয় বাক্যের গুণ ও পরিমাণের ওপর এই মূর্তিগুলো নির্ভর। প্রায়র এনালিটিকস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ন্যায় অনুমানের এই তিনটি সংস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টটল প্রথম সংস্থানের চারটি শুদ্ধ মূর্তির কথা বলেছেন –

(১) সকল মানুষ হয় মরণশীল, সকল গ্রীক হয় মানুষ, অতএব, সকল গ্রীক হয় মরণশীল। এই মূর্তিটির নাম BARBARA.
(২) কোন মাছ নয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, সব তিমি হয় মাছ, সুতরাং কোন তিমি নয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। এই মূর্তিটির নাম CELARENT
(৩) সব মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, কোন কোন প্রাণী হয় মানুষ, সুতরাং কোন কোন প্রাণী হয়। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। এই মূর্তিটির নাম DARII.
(৪) কোন গ্রীক নয় কৃষ্ণাঙ্গ, কোন কোন মানুষ হয় গ্রীক, সুতরাং কোন কোন মানুষ নয় কৃষ্ণাঙ্গ। এই মূর্তিটির নাম হল FERIO.

ন্যায় অনুমানের মূর্তিগুলো যথার্থ কিনা বিচার করার জন্য অ্যারিস্টটল একটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এই সূত্রটির নাম Dictum De Omni Et Nullo, এই সূত্রটির অর্থ- “কোন শ্রেণী সম্পর্কে যা স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়, সেই শ্রেণীর অন্তর্গত সকল কিছু সম্পর্কেই তা স্বীকার বা অস্বীকার করা যায়।”

পূর্বের উদাহরণটিই নেওয়া যাক ? “সব মানুষ হয় মরণশীল, সক্রেটিস হয় একজন মানুষ, সুতরাং সক্রেটিস হয় মরণশীল।” এখানে প্রধান আশ্রয় বাক্যে মরণশীলতা সব মানুষ সম্পর্কে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং ‘মরণশীলতা’ সক্রেটিস সম্পর্কেও স্বীকার করা যেতে পারে। এই উদাহরণটিতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান যুক্তিবাক্যটি সার্বিক এবং অপ্রধান যুক্তিবাক্যটি সদর্থক। সুতরাং অ্যারিস্টটল এর সূত্রটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, (১) প্রধান যুক্তিবাক্যটি অবশ্যই সার্বিক হবে, (২) অপ্রধান যুক্তিবাক্যটি সদর্থক হবে— এই দুটি নিয়ম প্রথম সংস্থানের নিয়ম। সুতরাং অ্যারিস্টটলের সূত্রটি প্রথম সংস্থানের ওপর সােজাসুজি প্রযোজ্য। সেই কারণে Aristotle-এর মতে, প্রথম সংস্থানকে শুদ্ধ সংস্থান (Perfect Figure) বলে গণ্য করা উচিত। অশুদ্ধ সংস্থানের শুদ্ধ মূর্তিগুলোকে রূপান্তরের সাহায্যে প্রথম সংস্থানের মূর্তিতে রূপান্তরিত করে তার শুদ্ধতা বিচার করা যায়।

একটিমাত্র হেতুবাক্য থেকেও সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব। কোন কোন অনুমানের ক্ষেত্রে একটিমাত্র হেতুবাক্য থেকেও সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে। যেমন, কোন কোন মানুষ হয় মরণশীল’, এই হেতুবাক্য থেকে আমরা সিদ্ধান্ত টানতে পারি, কোন কোন মরণশীল জীব হয় মানুষ। এই সিদ্ধান্তটি আমরা সকল মানুষ হয় মরণশীল’ থেকেও পেতে পারি—কোন দেবতা নয় মরণশীল’ থেকে অনুমান করতে পারি ‘কোন মরণশীল জীব নয় দেবতা। তবে কোন কোন মানুষ নয় চালাক’ থেকে সিদ্ধান্ত করা যাবে না যে, কোন কোন চালাক ব্যক্তি নয় মানুষ।

উপরে যে অনুমানের কথা বলা হল, তা হল অমাধ্যম অনুমান। এগুলো ছাড়া অ্যারিস্টটল এবং তার সমর্থকবৃন্দ মনে করতেন যে, সব অবরোহ অনুমানকে তার যথাযথরূপে প্রকাশ করলে তা ন্যায় অনুমানের রূপ গ্রহণ করবে। সব ধরনের বৈধ ন্যায়। অনুমানের রূপগুলো যদি নিরূপণ করা যায়, এবং কোন আলোচ্য যুক্তিকে যদি ন্যায়। অনুমানের আকারে প্রকাশ করা যায়, তাহলে ন্যায় অনুমানের নিয়মলঙ্ঘনজনিত সব রকম দোষ বা অনুপপত্তি (Fallacies)-কে এড়ানো যেতে পারে।

অ্যারিস্টটলের ন্যায় অনুমানের বৈশিষ্ট্য : অ্যারিস্টটলের ন্যায় অনুমানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তার মৌলিকতা। যুক্তির আকারের সুসংহত বিশ্লেষণ অ্যারিস্টটলের পূর্বে আর কেউ করেননি। তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি পদের (Term) জন্য প্রতীক ব্যবহার করার কথা বলেছেন। তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বৈধতার শর্ত সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন এবং প্রসক্তি- এর নিয়মাবলি (Rules of Implication) প্রণয়ন করেছেন।

জি. ই. আর. লয়েড-এর মন্তব্য : জি. ই. আর, লয়েড (G. E. R. Lloyd) বলেন, “ন্যায় অনুমান সম্পর্কে তার মতবাদ, যতদূর পর্যন্ত তা প্রযুক্ত হতে পারে, সংসনীয়ভাবে স্পষ্ট, ব্যাপক এবং বিচক্ষণভাবে ব্যবহৃত।” কিন্তু ন্যায় অনুমানের বিস্তৃতি বেশি দূর পর্যন্ত প্রসারিত নয়। তিনি ভ্রান্তভাবেই দাবি করেছেন যে, সব ধরনের যুক্তিকেই ন্যায় অনুমান রূপান্তরিত করা যায়। চতুর্থ সংস্থানকে তিনি স্বীকার করেননি। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল , A, E, I, O এই চার ধরনের বচন সম্পর্কে তার আলোচনা যেমন ব্যাপক, অন্য ধরনের বচন সম্পর্কে তার আলোচনা তেমন পরিপূর্ণ ও ব্যাপক নয়। ন্যায় অনুমানমূলক যুক্তির (Syllogistic Argument) বিশ্লেষণে তিনি বিশেষ করে সেই সব বচনের আলোচনাতে আগ্রহী। যেগুলো দুটি পদের মধ্যে শ্রেণী অন্তর্ভুক্তি (Class-Inclusion) এবং শ্রেণী-বিযুক্তি (Class-Exclusion)-এর সম্বন্ধ নির্দেশ করে। কিন্তু তিনি সুসংহতভাবে সেই সব বচন নিয়ে আলোচনা করেননি যেগুলো ‘বৃহত্তর’, ‘ক্ষুদ্রতর’, ‘সম’ বা ‘যুগপৎ’ প্রভৃতি সম্বন্ধের নির্দেশক। কেননা এই সম্বন্ধ প্রকাশক বচনের দ্বারাও ন্যায় অনুমান গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা যায় যে, ‘A হয় B-এর থেকে বৃহত্তর’ এবং ‘B হয় Cএর থেকে বৃহত্তর’, তাহলে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, A হয় C-এর থেকে বৃহত্তর। অ্যারিস্টটল পদের জন্য প্রতীকের প্রবর্তন করেছেন। কিন্তু বচনের জন্য প্রতীক ব্যবহারের মূল্য সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন না। বস্তুতপক্ষে পরবর্তীকালে যুক্তিবিজ্ঞানীরা এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সঠিকভাবে সমাধান করেছিলেন।

অভিযোগ

আকারমূলক যুক্তিবিজ্ঞানের শুরু হিসেবে যে ন্যায় অনুমানের কথা অ্যারিস্টটল বলেছেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আকারমূলক যুক্তিবিজ্ঞানের শুরু হিসেবে না দেখে পরিণতি হিসেবে বিচার করলে, এর বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেলকে অনুসরণ করে আমরা সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করব :
(১) ন্যায় অনুমানের অন্তর্নিহিত আকারমূলক ত্রুটি (Formal Defects)।
(২) অন্য ধরনের অবরোহমূলক যুক্তির তুলনায় ন্যায় অনুমানের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ।
(৩) যুক্তির আকার হিসেবে অবরোহের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ।

(১) আকারমূলক ত্রুটি (Formal Defects) : ‘সক্রেটিস হয় একজন মানুষ’ এবং ‘সকল গ্রীক হয় মানুষ’-এই দুটি বচনের মধ্যে পার্থক্য করা দরকার, যা অ্যারিস্টটল করেননি। সব বাংলাদেশী হয় মানুষ এই বচনটিকে সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এইভাবে যে, বাংলাদেশীরা হয় অস্তিত্বশীল। যদি এভাবে ব্যাখ্যা করা না হয় তাহলে অ্যারিস্টটলের কোন কোন ন্যায় অনুমান বৈধ হবে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক :

‘সব বাংলাদেশী হয় মানুষ’, ‘সব বাংলাদেশী হয় শ্বেতাঙ্গ, সুতরাং কোন কোন মানুষ হয় শ্বেতাঙ্গ’ – এই অনুমানটি বৈধ হবে যদি ‘বাংলাদেশী’ বলে কেউ থাকে। তাই ‘সব বাংলাদেশী হয় মানুষ’– এই বচনটিকে দুটি বচনে বিভক্ত করতে হবে। এইভাবে ‘বাংলাদেশীরা হয় অস্তিত্বশীল’, এবং ‘যদি কোন কিছু বাংলাদেশী হয়, তবে তা হবে একটি মানুষ’। শেষের বচনটি একটি প্রাকল্পিক বচন এবং এই বচনটি এই কথা বলে না যে, ‘বাংলাদেশীরা অস্তিত্বশীল’।

তাই ‘সক্রেটিস হয় একজন মানুষ’–এই বচনটির তুলনায় ‘সব বাংলাদেশী হয় মানুষ’ বচন আকারের দিক থেকে অনেক জটিল। ‘সক্রেটিস হয় মানুষ’ বচনটিতে সক্রেটিস হল উদ্দেশ্য, কিন্তু ‘সব বাংলাদেশী হয় মানুষ’ বচনটিতে উদ্দেশ্য ‘সব বাংলাদেশী’ নয়, কেননা ‘বাংলাদেশীরা হয় অস্তিত্বশীল’ বা ‘কোন কিছু যদি বাংলাদেশী হয়, তাহলে তা হবে মানুষ’—এই দুই বচনের কোনটিতেই ‘সব বাংলাদেশী’ সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। এই বিশুদ্ধ আকারমূলক ভ্রান্তি, অধিবিদ্যা এবং জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদের ক্ষেত্রে নানা ভ্রান্তির উৎস হয়ে দাড়ায়।

রাসেলকে অনুসরণ করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক্‌—‘সক্রেটিস হয় মরণশীল’ এবং সকল মানুষ হয় মরণশীল—এই দুই বচনের ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানের অবস্থার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ‘সক্রেটিস হয় মরণশীল’–এই বচনের ক্ষেত্রে আমাদের আপ্তবাক্যের ওপর নির্ভর করতে হয় এবং তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’– বচনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের ব্যাপারটি ভিন্ন— এই ধরনের সার্বিক বচনের জ্ঞানের প্রশ্নটি জটিল। যেমন ‘সব বাংলাদেশী হয় মানুষ’ – এই বচনটি আমরা স্বীকার করি, কেননা মানুষ না হলে আমরা তাকে বাংলাদেশী বলি না। অভিধান থেকেও বিষয়টি জেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’—এই ধরনের বচন নয়। অমরণশীল মানুষের ধারণার মধ্যে কোন যৌক্তিক আত্ম-বিরোধিতা নেই। আমরা আরোহের ওপর ভিত্তি করে বচনটিতে আস্থা স্থাপন করি কেননা, ধরা যাক দেড়শ বছরের বেশি কোন ব্যক্তি জীবিত রয়েছে, এমন কোন খবর আমাদের জানা নেই। ফলে বচনটি হয়ে পড়ে সম্ভাব্য, সুনিশ্চিত নয়। যতদিন জীবিত ব্যক্তি অস্তিত্বশীল থাকবে, ততদিন এই বচনটি সুনিশ্চিত হবে না।

আধিবিদ্যক বা তাত্ত্বিক ভ্রান্তি দেখা দেয় যখন আমরা মনে করি ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’ বচনটির উদ্দেশ্য হল ‘সকল মানুষ’; যেমন আমরা মনে করি ‘সক্রেটিস হয় মরণশীল’ বচনের উদ্দেশ্য হল ‘সক্রেটিস’। কিন্তু সক্রেটিসকে যেমন আমরা একটা পদার্থ (Entity) বলে ভাবতে পারি, সকল মানুষকে কি সেই অর্থে পদার্থ ভাবা যায়?

বিশেষ এবং সার্বিকের মধ্যে পার্থক্য ন্যায় অনুমান উপেক্ষা করে : আরও একটি ভ্রান্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল বিধেয়র বিধেয়কে মূল উদ্দেশ্যের বিধেয় বলে গণ্য করেছেন। যদি বলা হয় ‘সক্রেটিস হয় গ্রীক’, ‘সব গ্রীক হয় মানুষ’, তাহলে অ্যারিস্টটল মনে করবেন, ‘মানুষ’ হল গ্রীকের বিধেয়, যেহেতু গ্রীক হল সক্রেটিসের বিধেয়। স্পষ্টতই ‘মানুষ’ হল সক্রেটিসের বিধেয়। কিন্তু মানুষ’ গ্রীকের বিধেয় নয় – এইরূপ মনে করা হলে নাম (Name) এবং বিধেয়র (Predicate) মধ্যে পার্থক্য; বা অধিবিদ্যার ভাষায়, বিশেষ এবং সার্বিক (Universal)-এর পার্থক্য মুছে যায় এবং ফলে দর্শনের দিক থেকে এর ফলাফল হয়ে পড়ে ভয়াবহ। এই ধরনের ভুলবশত যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তাহল, যে কোন শ্রেণী যার সভ্য একজন মাত্র, সেই শ্রেণী সেই একজন সভ্যের সঙ্গে অভিন্ন হয়। এর ফলে ‘এক’ (One) এই সংখ্যার সম্পর্কে নির্ভুল মতবাদ গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং একত্ব (Unity) সম্পর্কে অযৌক্তিক অধিবিদ্যার শেষ থাকে না।

(২) ন্যায় অনুমানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ : ন্যায় অনুমান হল এক ধরনের অবরোহমূলক অনুমান। গাণিতিক যুক্তি পুরোপুরি অবরোহমূলক। কিন্তু সেখানে ন্যায় অনুমান কদাচিৎ দেখা যায়। আর গাণিতিক যুক্তিকে ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ করবার বিষয়টি হবে একান্তভাবে কৃত্রিম এবং যুক্তির দিক থেকেও খুব অকাট্য হবে না। যেমন, আমি যদি ৪০ টাকার জিনিস কিনি, ৩২ টাকা দাম দিই। আমি কত টাকা ফেরত পাব? এই সাধারণ অঙ্কটিকে ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ করা হবে এক অসম্ভব ব্যাপার এবং যুক্তিটির আসল রূপটিই ঢাকা পড়ে যাবে। তা ছাড়া যুক্তিবিজ্ঞানে ন্যায় অনুমান ছাড়াও অন্য অনুমান রয়েছে, যেমন, ‘গরু হয় একটি প্রাণী; সুতরাং ‘গরুর লেজ হল একটি প্রাণীর লেজ’। বৈধ ন্যায় অনুমান বৈধ অবরোহানুমানের বিভিন্ন রূপের মধ্যে একটি রূপ। অন্য ধরনের অনুমানের তুলনায় তার কোন যৌক্তিক অগ্রাধিকারের বা পূর্ববর্তিতার বিষয়টি (Logical Priority) মেনে নেওয়া যায় না। অবরোহ ন্যায়-অনুমানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার জন্য, গাণিতিক যুক্তির প্রকৃতি নিরূপণের ব্যাপারে দার্শনিকবৃন্দ অনেক ক্ষেত্রে ভুল পথে চালিত হয়েছেন।

(৩) অবরোহের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ : অ্যারিস্টটল আরোহের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। কেননা, যার থেকে অবরোহ শুরু হয়, সেই প্রথম হেতুবাক্যগুলো আমরা কিভাবে জানি—এই প্রশ্নের আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেছেন। তাহলেও এ কথা বলা যেতে পারে যে, তিনি তার জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদে অবরোহের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ‘রাম মরণশীল’—এটা আমরা মেনে নিতে পারি এবং আমরা এমন কথাও বলতে পারি যে, এটা আমরা জানি যে, আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে, সেটি হল ‘সব মানুষ হয় মরণশীল’। কিন্তু এটি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কেননা আসলে যা আমরা জানি তা হল, দেড়শ বছর আগে যে সব লোকেরা জন্মেছে তারা হল মরণশীল এবং তার ভিত্তিতেই আমরা বলছি ‘রাম হল মরণশীল। কিন্তু এই যুক্তিটি অবরোহ নয়, আরোহ। অবরোহের তুলনায় এর অকাট্যতা। কম। এটি সম্ভাব্য কিন্তু এটি আমাদের নতুন খবর দেয়, যা অবরোহ দেয় না। যুক্তিবিজ্ঞান এবং শুদ্ধ গণিতের পরিসর বহির্ভূত সব গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিই হল আরোহ। অবশ্য আইনশাস্ত্র এবং ধর্মবিজ্ঞান হল ব্যতিক্রম।

‘টপিকস’ গ্রন্থে তিন ধরনের যুক্তির আলোচনা

প্রমাণমূলক যুক্তি : টপিকস্ (Topics) গ্রন্থে অ্যারিস্টটল প্রমাণমূলক যুক্তি (Demonstrative Reasoning), সাধারণত স্বীকৃত মতামতের ভিত্তিতে যুক্তি (Dialectical Reasoning) এবং সাধারণভাবে স্বীকৃত নয় এমন মতামতের ভিত্তিকে যুক্তি (Contentious Reasoning)-এই তিন ধরনের যুক্তির মধ্যে পার্থক্য করেছেন। প্রথম ধরনের যুক্তি বা অনুমানের ক্ষেত্রে সব আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়। সেগুলো সত্য এবং প্রাথমিক (Primary)। দ্বিতীয় ধরনের অনুমানের ক্ষেত্রে আশ্রয়বাক্য হয় সকলের দ্বারা বা অধিকাংশের দ্বারা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা অর্থাৎ কিনা, সাধারণভাবে স্বীকৃত। তৃতীয় ধরনের অনুমানে আশ্রয়বাক্যে সাধারণভাবে স্বীকৃত মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। অ্যারিস্টটল ন্যায় অনুমানের বিভিন্ন ধরনের অনুপপত্তি বা হেত্বাভাস (Fallacies) নিয়েও আলোচনা করেছেন।

এমন সূত্র আছে যাদের প্রমাণ ছাড়াই জানা যায় : অ্যারিস্টটল বুঝতে পেরেছিলেন যে, অবরোহ অনুমানের আশ্রয়বাক্যেরও প্রমাণের প্রয়োজন আছে। আবার প্রতিটি বচন বা সূত্রের প্রমাণ চাওয়া হলে অনবস্থা প্রক্রিয়া (Processus in Infinitum) দেখা দেবে এবং কোন কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। তাই অ্যারিস্টটল ধারণা করলেন যে, এমন কিছু সূত্র আছে যেগুলোকে কোন প্রমাণ ছাড়াই আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সাক্ষাৎভাবে জানি। এই সূত্রগুলোর মধ্যে বিরোধবাধক নিয়ম বা সূত্রটি (The Principle of Contradiction) সর্বপ্রধান। নিয়মটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল, একই সময়ে একই বস্তু সম্পর্কে দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ গুণ কখনও সত্য হতে পারে না। সব চিন্তাই এই নিয়মটির অন্তর্ভুক্ত। চিন্তা করতে গেলে এই সূত্র বা নীতিটির সত্যতা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে। কোন ব্যক্তি যিনি চিন্তা করছেন, তিনি এই নীতির সত্যতা সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন তুলতে পারেন না।

অ্যারিস্টটল-এর মতে আরোহ অনুমানের স্বরূপ

আরোহ অনুমান : অ্যারিস্টটল অবরোহ নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, আরোহ নিয়েও তেমনি আলোচনা করেছেন। বৈজ্ঞানিক আরোহানুমান বলতে তিনি বোঝেন পূর্ণ গণনামূলক আরোহানুমান (Induction by Complete Enumeration)। কেননা, তার মতে, সব দৃষ্টান্তের গণনার ভিত্তিতেই আরোহানুমান প্রতিষ্ঠিত হয়। অপূর্ণ গণনামূলক আরোহ অনুমান (Induction by Incomplete Enumeration) প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হওয়াতে শুধুমাত্র বক্তাদেরই কাজে লাগে। অ্যারিস্টটল আরোহের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। আরোহের মাধ্যমেই, সার্বিককে আমরা জানি এবং এই আরোহের মাধ্যমেই আমরা অপরোক্ষ আশ্রয়বাক্য-স্বতঃসিদ্ধ সত্য (Axioms), সংজ্ঞার্থ (Definition) এবং প্রকল্প (Hypothesis)-কে জানি যার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত। এ কথা সত্য যে, ‘প্রসটিরিয়ার এনালিটিক্স’-এর একটিমাত্র পরিচ্ছেদে (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-১৯) তিনি এই বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন এবং ‘অর্গানন’ (Organon) গ্রন্থের এখানে ওখানে ছড়ানো আরোহ অনুমান সম্পর্কে তার মন্তব্য নানা দিক থেকেই অসন্তোষজনক। ‘প্রায়র এনালিটিক্স’ গ্রন্থে তিনি আরোহকে অবরোহের আকারে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ সন্দেহ করেন যে, এর পেছনে যে উদ্দেশ্যটি নিহিত আছে, সেটি হল, ন্যায় অনুমান যে আরোহ অনুমানের অগ্রগামী এবং আরোহ অনুমানের থেকে শ্রেষ্ঠ, সেই বিষয়টি প্রমাণ করা।

আরোহ অনুমানকে ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ : তিনি দেখিয়েছেন যে, যখন আরোহ অনুমান নির্দোষ (Perfect) বা পূর্ণ গণনামূলক (Complete Enumeration) আরোহ অনুমান হয় অর্থাৎ যখন কোন শ্রেণীর প্রতিটি সভ্যকেই গণনা করে নেওয়া হয়, তখন আরোহ অনুমানকে ন্যায় অনুমানের আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটলের উদাহরণ হল, যদি মানুষ, অশ্ব, অশ্বতর ইত্যাদি প্রাণী (গ) দীর্ঘজীবি (ক) হয়, এবং মানুষ, অশ্ব, অশ্বতর প্রভৃতি (গ) পিত্তহীন (খ) হয় তাহলে, যদি ‘খ’ শ্রেণীটি ‘গ’ শ্রেণী–এর থেকে বৃহত্তর না হয় তাহলে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, সব পিত্তহীন প্রাণী (খ) হল দীর্ঘজীবি (ক)।

আরোহ সম্পৰ্কীয় আলোচনার ত্রুটি : ‘প্রসটিরিয়ার এনালিটিক্স’ গ্রন্থে আরোহ সম্পর্কে অ্যারিস্টটল যে সব মন্তব্য করেছেন তার থেকে জানা যায় যে, আরোহ অনুমানের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি কোনভাবেই উপেক্ষা করেননি কিন্তু আরোহ অনুমানের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু কিছু প্রশ্নের সমাধান করার জন্য তিনি সচেষ্ট হননি। যেমন তিনি বলেছেন যে, আমরা বিশেষ (Particular)-কে জানতে পারি না, কেবলমাত্র সার্বিককে জানতে পারি। কিন্তু আবার অনেক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, বিশেষের পরীক্ষার ভিত্তিতেই আমরা সার্বিককে জানতে পারি। তিনি বলেন যে, প্রমাণমূলক যুক্তির আশ্রয়বাক্যগুলোর জ্ঞান সহজাত নয়, সেগুলোর জ্ঞান আরোহ অনুমানের মাধ্যমে লব্ধ হয়। কিন্তু তিনি তাঁর বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদনে সচেষ্ট না হয়ে শুধুমাত্র এর উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘প্রসটিরিয়ার এনালিটিক্স’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল, জ্ঞান এবং প্রমাণের শর্তগুলো গণিতশাত্রে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের আলোচনার অনেকাংশই অবরোহ যুক্তিকে নিয়ে। আরোহ সম্পর্কে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদের ক্ষেত্রে এর একটা মৌলিক ভূমিকা আছে। কেননা আরোহের সাহায্যেই আমরা সার্বিক এবং প্রাথমিক আশ্রয়বাক্যগুলো জানতে পারি যার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত। আরোহের বৈধতা (Validity of Induction) বিষয়ে তার তেমন বিশেষ কিছু অবদান নেই। কারণ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা সার্বিককে জানি সেই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার কোন চেষ্টাই তিনি করেননি। কেবলমাত্র প্রক্রিয়াটি ঘটে, এই বিষয়টিই তিনি ঘােষণা করেছেন।

কপলস্টোন-এর মন্তব্য : তাই দেখা যাচ্ছে যে, অবরোহ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণে তিনি যতখানি মনোযোগ দিয়েছেন, আরোহ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তা দেননি। কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, প্রাচীন জগতে এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কারণ তখন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তুলনায় গণিতশাস্ত্র ছিল খুবই উন্নত। গাণিতিক যুক্তি অবরোহমূলক, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে আরোহ অনুমানের প্রয়োগই সমধিক।

কেটিগরিস (Categories) বা বিধেয়ক

সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ : অ্যারিস্টটলের মতে, যখন আমরা কোন বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করি তখন কোন একটা বিধেয়কে ঐ বিষয় সম্বন্ধে প্রয়োগ করি। যে ধরনের পদকে বিধেয় রূপে ব্যবহার করা হয় তাকে বিধেয়ক বলে। কপলস্টোন বলেন যে, যুক্তিবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ‘কেটিগরিস’, যেভাবে আমরা বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করি তা নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ দ্রব্যে গুণ বিশেষিত করা। কিন্তু এছাড়াও তারা বস্তু বাস্তবে যেভাবে অস্তিত্বশীল তাও নির্দেশ করে। এ বস্তু হল দ্রব্য এবং বাস্তবিকই দ্রব্যের আপতিক গুণ আছে। সেই কারণে কেটিগরিস-এর শুধুমাত্র যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত নয়, আধিবিদ্যক বা তাত্ত্বিক আলোচনারও প্রয়োজন আছে। ‘কেটিগরিস’ গ্রন্থে এবং ‘টপিকস্’ গ্রন্থে বিধেয়ক-এর সংখ্যা দশটি বলে নির্দেশ করা হয়েছে – ১. দ্রব্য (মানুষ, অশ্ব), ২. পরিমাণ (তিন হাত দীর্ঘ), ৩. গুণ (সাদা, লাল), ৪. সম্বন্ধ (দ্বিগুণ, অর্ধেক, বৃহত্তর), ৫. স্থান (Place)- (হাটে, বাজারে, প্রাসাদে), ৬. কাল (গতকাল, গত বছর), ৭. অবস্থান (Position)-(শােয়া, বসা), ৮. অবস্থা (State)(জুতো পায়ে, অস্ত্র সাজে), ৯. ক্রিয়া (Action)-(কাটা, পােড়া), ১০. প্রভাবিত হওয়া বা প্রতিক্রিয়া (Affection)-(কেটে যাওয়া, দগ্ধ হওয়া)।

বিভিন্ন মন্তব্য : 

  • কপলস্টোন – ‘প্রসিটিরিয়ার এনালিটিক্স’ গ্রন্থে বিধেয়ক-এর সংখ্যা আট বলা হয়েছে। দশই হােক, আর আটই হােক এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, তিনি তার বিধেয়কের তালিকাটি এলোমেলোভাবে তৈরি করেছিলেন, এর কোন গঠনমূলক বিন্যাস ছিল না। দশটি কেটিগরির যে তালিকা অ্যারিস্টটল নির্দেশ করেছেন, যে নীতির ভিত্তিতে তা করা হয়েছে তার কোন ইঙ্গিত অ্যারিস্টটল দেননি। কপলস্টোন বলেন যে, ‘কেটিগরির তালিকায় একটা শৃঙ্খলা ও বিন্যাস রয়েছে, এ হল প্রত্যয়ের একটা শ্রেণীবিভাগ (Classification of Concepts), মৌলিক প্রত্যয়ের শ্রেণীবিভাগ যেগুলো আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রিত করে।’ ‘কেটিগরি’ শব্দটির অর্থ হল বিধেয় আরোপ করা এবং টপিকস্-এর অ্যারিস্টটল কেটিগরি বলতে বিধেয়র শ্রেণীবিভাগ বুঝিয়েছেন, যে উপায়ে কোন সত্তা বা অস্তিত্বশীল বস্তু নিজেকে প্রকাশ করে; যেমন, আমরা কোন বস্তুকে দ্রব্যরূপে চিন্তা করতে পারি বা দ্রব্য ছাড়া অন্য নটি বিধেয়কের যে কোন একটির অধীনস্থ করেও দেখতে পারি। বিধেয়ক দ্রব্য কিভাবে নির্দিষ্ট হয় তাই প্রকাশ করে।
  • জি. ই. আর. লয়েড-এর মন্তব্য – জি. ই. আর. লয়েড-এই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন তা হল এই যে, কেটিগরির বা বিধেয়কের যে শ্রেণীবিভাগ তা কি বস্তুর বা পদের শ্রেণীবিভাগ? এটি কি আধিবিদ্যক বা যৌক্তিক শ্রেণীবিভাগ? তিনি তার উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন যে, কেটিগরির শ্রেণীবিভাগ হল মূলত সত্তার শ্রেণীবিভাগ (Classification of Reality); পদ যা নির্দেশ করছে সেই পদের শ্রেণীবিভাগ নয়, পদের দ্বারা নির্দেশিত বিষয়ের শ্রেণীবিভাগ। (“…the categories are primarily intended as a classification of reality of the things signified by terms, rather than of the signifyings terms themselves.” – G.E.R. Lloyd : Aristotle : The Growth and Structure of His Thought; Page 113.) ‘কেটিগরির’ গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদের শুরুতে এভাবেই শ্রেণীবিভাগটি উপস্থাপিত হয়েছে।
  • কপলস্টোনেরও অভিমত হল যে, কেটিগরি মনোগত বিষয় বা প্রত্যয় মাত্র নয়, বাইরের জগতে তারা বাস্তব অস্তিত্বের প্রকারের সূচক, অর্থাৎ চিন্তা এবং চিন্তার বিষয় উভয়ের ক্ষেত্রেই তারা প্রযোজ্য। তারা যুক্তিবিজ্ঞান এবং অধিবিদ্যার মধ্যে সেতু রচনা করে। চিন্তার বিষয় কতরকম ভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে কেটিগরি তাও নির্দেশ
    করে।

কেটিগরি মনোগত বিষয় নয় : তাই কেটিগরির একটি আধিবিদ্যক বা তত্ত্ববিদ্যাগত দিক এবং একটা যৌক্তিক দিকও আছে। আধিবিদ্যক দিক থেকে দেখলেই তাদের গঠনমূলক বিন্যাসটা স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়। সত্তাকে অস্তিত্বশীল হতে হলে দ্রব্যকে অস্তিত্বশীল হতেই হবে। অর্থাৎ কিনা দ্রব্য নিয়েই শুরু করতে হবে। মনের বাইরে যাদের অস্তিত্বশীল দেখি তারা হল বিশিষ্ট (Singular) বস্তু বিশিষ্ট বস্তুকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল হতে হলে তাকে অবশ্যই দ্রব্য হতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র দ্রব্য হিসেবে এটি অস্তিত্বশীল হতে পারে না। এর কোন একটা আপতিক রূপ (Accidental Form) থাকবেই। যেমন কোন অশ্ব অস্তিত্বশীল হতে পারে না যদি এর কোন বর্ণ না থাকে। আবার বর্ণ থাকতে পারে না যদি এর কোন পরিমাণ অর্থাৎ বিস্তৃতি না থাকে। আবার অশ্বটি অন্য অশ্বের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না হয়ে থাকতে পারে না। কারণ অশ্বটি অন্য অশ্ব থেকে আকারে ছােট বা বড় হবে। আবার এটি ভৌতিক দ্রব্য হিসেবে কোন দেশে, কোন কালে, কোন বিশেষ অবস্থায় অবস্থান করবে। আবার একটি অশ্ব যেমন অপরের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই কোন কোন কেটিগরি বা বিধেয়ক যেন বস্তুর মধ্যে থেকে তাকে নিরূপণ করে। আবার কোন কোন কেটিগরি যেন বাইরে থেকে তাকে নিরুপণ করে, অর্থাৎ অন্য জড়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাকে নিরূপণ করে। এই আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যে নীতির উপর ভিত্তি করে কেটিগরিগুলোকে নিঃসৃত করা হয়েছে, সেই নীতি মােটেও এলোমেলো বিশৃঙ্খল নীতি নয়। কেটিগরি হল প্রাথমিক শ্রেণী, যা কিছু অস্তিত্বশীল বা বাস্তব তা তার অন্তর্ভুক্ত হবেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, অ্যারিস্টটলের কেটিগরি সম্পর্কীয় মতবাদের মূল্য কি? অ্যারিস্টটল তার কেটিগরিস গ্রন্থে সাধারণভাবে এই সম্পর্কে কিছু বলেননি। এই মতবাদের উপযোগিতা এবং মূল্য কেবলমাত্র তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন অন্য আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি বস্তুর শ্ৰেণী বা পদের অর্থের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে মতবাদটিকে প্রয়োগ করেছেন। বিধেয়ক কাকে বলে? ‘প্রসিটিরিয়ার এনালিটি’ গ্রন্থে সংজ্ঞার্থের আলোচনা প্রসঙ্গে এবং ‘টপিকস্ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল বিধেয়ক (Predicable) সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। বিধেয়ক হল বিধেয়র সঙ্গে উদ্দেশ্যের বিভিন্ন ধরনের সম্বন্ধ সম্পর্কের এই প্রকারভেদ অনুসারে বিধেয়ককে পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে : জাতি। (Genus), প্ৰজাতি (Species), বিভেদক লক্ষণ (Differentia), উপলক্ষণ (Proprium), এবং আপতিক লক্ষণ (Accidents)। বিধেয়র সঙ্গে উদ্দেশ্যের সম্বন্ধ যদি এমন হয় যে, বিধেয় উদ্দেশ্যের সমব্যাপক, তাহলে হয় আমরা বিধেয় মারফত উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থকে পাই বা উপলক্ষণকে পাই। যেমন, ‘মানুষ হয় বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জীব’ (সংজ্ঞার্থ), ‘মানুষ হয় জীব যে তর্ক করতে পারে’ (উপলক্ষণ)। আর যদি বিধেয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে সমব্যাপক না হয়, তাহলে উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থের অন্তর্ভুক্ত গুণাবলির অংশবিশেষকে পাই। সেক্ষেত্রে বিধেয় পদটি হবে উদ্দেশ্যের সম্বন্ধে জাতি, না হয় তার বিভেদক। যেমন, ‘মানুষ হয় প্রাণী’ (জাতি), ‘মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন (বিভেদক)। আর যদি বিধেয় উদ্দেশ্যের সমব্যাপক না হয় এবং বিধেয় যদি উদ্দেশ্যের সংজ্ঞার্থের অন্তর্ভূক্ত গুণাবলিকে নির্দেশ না করে, তাহলে বিধেয় হবে আপতিক গুণ। যেমন— ‘মানুষ হয় হাস্যপ্রিয় জীব।

বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিচয়

অ্যারিস্টটলের মতে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হল সার্বিকী থেকে বিশেষকে, আপেক্ষিক ঘটনাকে তার কারণ থেকে অবরোহের আকারে নিঃসৃত করা, যার ফলে আমরা, যে কারণটির ওপর ঘটনা নির্ভর, তাকে এবং ঘটনা ও কারণের মধ্যে যে অনিবার্য সম্পর্ক তাকে জানি। অর্থাৎ কিনা, আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান লাভ করি যখন আমরা কারণকে, যার ওপর ঘটনা নির্ভর, ঘটনার কারণ হিসাবে জানি এবং এও জানি যে ঘটনাটি অন্য রকম হতে পারত না। | এই জ্ঞান আসে প্রতিপাদনের (Demonstration) মাধ্যমে যার একটা ন্যায় অনুমানের বা অবরোহের আকার আছে। কিন্তু যেহেতু ন্যায় অনুমানমূলক (Syllogistic) এই প্রতিপাদন শুরু হবে আশ্রয়বাক্যকে নিয়ে, এই আশ্রয়বাক্যগুলোর অবশ্যই কতকগুলো অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য থাকবে। এগুলো হবে সত্য, মৌলিক, অপ্রতিপাদক এবং অমাধ্যম, এই অর্থে যে, হেতুপদ ছাড়াও বিধেয় সরাসরি উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সব বচনই প্রতিপাদ্য এবং কোন বচনই প্রতিপাদ্য নয়। অ্যারিস্টটল এই দুইকেই অস্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন, কোন কোন সিদ্ধান্ত আশ্রয়বাক্য থেকে প্রতিপাদিত করা যেতে পারে, যে আশ্রয়বাক্যগুলো অপ্রতিপাদ্য, কিন্তু সত্য বলে জ্ঞাত। আশ্রয়বাক্যের মধ্যে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিহিত থাকবে। অ্যারিস্টটল তিন প্রকার মৌলিক আশ্রয়বাক্যের কথা বলেছেন, স্বতঃসিদ্ধ সত্য (Axioms), সংজ্ঞার্থ (definitions) এবং প্রকল্প (Hypothesis)।

যদিও যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে বিচার করলে আশ্রয়বাক্যগুলো সিদ্ধান্তের পূর্বগামী, অ্যারিস্টটল সুস্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছেন যে, যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত পূর্বগামিতা এবং জ্ঞানগত পূর্বগামিতা এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। জ্ঞানগত দিক থেকে বিচার করলে মানুষের কাছে যে বস্তু তার ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থিত সেই বস্তুগুলোই পূর্বগামী। মানুষের জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান দিয়েই শুরু অর্থাৎ বিশেষকে নিয়ে শুরু এবং এ বিশেষ থেকে আমরা সার্বিকে উপনীত হই। তাই প্রাথমিক আশ্রয়বাক্যগুলোকে আমাদের আরোহের মাধ্যমেই জানতে হয়। যে পদ্ধতির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ সার্বিককে প্রতিষ্ঠা করে তাও আরোহ, সেই কারণে অ্যারিস্টটলকে অবরোহ ছাড়া আরোহের আলোচনাও করতে হয়। সব মানুষ হয় মরণশীল। সক্রেটিস হয় মানুষ’, সুতরাং সক্রেটিস হয় মরণশীল। এই অবরোহ অনুমানে প্রধান আশ্রয়বাক্য ‘সব মানুষ হয় মরণশীল। এই বচনটি ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অবশ্য স্মৃতিও এর সঙ্গে জড়িত। এটি প্রাথমিক নিয়ম নয়, যাকে স্বতঃসিদ্ধ বা প্রমাণ ব্যতিরেকে অপরোক্ষভাবে জানা যায়। এটি অবরোহ নির্ভর। অ্যারিস্টটলের মতে, ইন্দ্রিয় কখনও ভুল করে না। আমাদের অবধারণই সত্য বা মিথ্যা হয়। উদাহরণস্বরূপ সূর্যকে পৃথিবীর থেকে ছােট দেখাবার ব্যাপারে ইন্দ্রিয়ের কোন ভুল নেই, ভুল হয় যখন অবধারণ করা হয় যে সূর্য পৃথিবীর থেকে ছােট।

বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হল বিষয়ের জ্ঞান, অর্থাৎ কিনা, যে বিষয় যেমন, তার থেকে অন্যরকম হতে পারে না এই জ্ঞান। এটি সেই সম্পর্ক প্রমাণ করে যেগুলো সার্বিক। ‘প্রাসটিরিয়ার এনালিটিক্স’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ পরিচ্ছেদে অ্যারিস্টটল বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমত, গুণটি (Attribute) কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই উদ্দেশ্যের প্রতিটি দৃষ্টান্তের অন্তর্ভুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, এই গুণটির উদ্দেশ্যের সম্পর্কে আকস্মিকভাবে নয় , অপরিহার্যভাবে সত্য। তৃতীয়ত, এটি সুনির্দিষ্টভাবে উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাহলে উদ্দেশ্য এবং গুণের মধ্যে সার্বিক সম্পর্ক আছে বলা যায় যখন—(১) গুণটি উদ্দেশ্যের যে কোন দৃষ্টান্ত সম্পর্কে সত্য হয়। (২) উদ্দেশ্য হল ব্যাপকতম শ্রেণী যার সম্পর্কে এটি সত্য প্রমাণিত হয়। যেমন, দুটি সমকোণের সমান কোণের অধিকারী হওয়া হল ত্রিভুজের একটি সার্বিক গুণ, কোন ক্ষেত্রের (Figure) গুণ নয় বা কোন সমদ্বিবাহু ত্রিভুজেরও নয়। এটি ক্ষেত্রের কোন সার্বিক গুণ নয় কেননা এটি কোন কোন ক্ষেত্র সম্পর্কে সত্য হলেও, যে কোন ক্ষেত্র সম্পর্কে সত্য নয়। আবার এটি কোন সমদ্বিবাহু ত্রিভুজেরও সার্বিক গুণ নয়, কেননা এটি সব সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ সম্পর্কে প্রমাণ করা গেলেও খেয়াল রাখতে হবে, এটি ত্রিভুজ বলেই বিষয়টি প্রমাণ করা যাচ্ছে, সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ বলে নয়। বস্তুত ‘ত্রিভুজ’ হল ব্যাপকতম শ্রেণী যার সম্পর্কে গুণটি সত্য প্রমাণিত হয়।

সুনিশ্চিত জ্ঞানের শর্ত এবং প্রমাণ : প্রসিটিরিয়ার এনালিটিকস্’-এ সুনিশ্চিত জ্ঞানের শর্ত এবং প্রমাণ নিরূপণ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যথাযথভাবে বলতে গেলে জ্ঞান এবং প্রমাণের সম্পর্ক হল অনিবার্য সার্বিক সম্পর্ক নিয়ে। গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডে অ্যারিস্টটলের দেওয়া সব উদাহরণই গণিত অথবা গণিতের সমগোত্রীয় শাস্ত্র থেকে গৃহীত। তবে গণিত থেকে উদাহরণ সংগৃহীত হলেও, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর জ্ঞানের শর্তগুলোর বিশ্লেষণ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞানের সমালোচনা

লয়েড বলেন যে, যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের রচনা বিশেষভাবে ব্যাপক, যথেষ্ট মৌলিক এবং অনেকাংশে প্রাঞ্জল। বার্ট্রান্ড রাসেল ও তার দর্শনের ইতিহাসে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদগুলো আলোচনা করার পর মন্তব্য করেছেন যে, তার মতবাদগুলো সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত। তিনি বলেন যে, বর্তমানকালে কোন ব্যক্তি যুক্তিবিজ্ঞান পাঠের ইচ্ছা করে যদি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান পাঠ করেন, তাহলে তিনি তার সময়ের অযথা অপচয় করবেন। তবে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কিত রচনা তার মহান দক্ষতার পরিচায়ক।

যুক্তিবিজ্ঞানের সমালোচনা ও কপলস্টোন বলেন যে, অ্যারিস্টটল সব ধরনের অনুমান সম্পর্কে আলোচনা করেননি এবং মানবীয় চিন্তার আকার সম্পর্কে সকল রকম প্রশ্ন উত্থাপন করে তার সমাধান করেননি বলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তিনি যা সম্পাদন করবেন বলে ইচ্ছা করেছিলেন, তা ভালভাবেই সম্পাদন করেছিলেন এবং তার যুক্তিবিজ্ঞান রচনা সমগ্র, যার পরবর্তীকালে নাম হয় অর্গানন (Organon), নিঃসন্দেহে একটি মহৎ রচনা। যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কীয় বিশ্লেষণ এবং যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কীয় চিন্তার সংহতি (System) রচনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন পুরোধা।
প্রায়ই বলতে শােনা যায় যে, আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান সাবেকী যুক্তিবিজ্ঞান অর্থাৎ অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞানকে পিছনে ফেলে এতদূর উন্নত হয়েছে যে, অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞানের বর্তমানে কোন মূল্য আছে বলে মনে করা যেতে পারে না। অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞানের অপরিপূর্ণতার কথা স্বীকার করে নিলেও তার কোন মূল্য নেই, এ কথা বলা যেতে পারে না। কারও কারও মতে, অ্যারিস্টটলের ‘অর্গানন’ যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনার এক সুন্দর এবং শিক্ষাপ্রদ ভূমিকা। আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান ও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধিতা নেই। আসলে আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞান অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, তার পরিপূরক।

অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যা

ভূমিকা, অর্থ ও আলোচ্য বিষয়

অ্যারিস্টটলের যে রচনাকে বর্তমানে অধিবিদ্যা (Metaphysics) নামে অভিহিত করা হয়, মূলত কিন্তু গ্রন্থের সেই নাম ছিল না। অ্যারিস্টটল তাঁর এই রচনার নাম দিয়েছিলেন প্রথম দর্শন (First Philosophy), যার দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই রচনা হল প্রথম, পরম বা বিশ্বজগৎ সম্পৰ্কীয় সবচেয়ে ব্যাপক নীতি বা সূত্রের জ্ঞান। জ্ঞানের অন্যান্য শাখা এই আলোচনার অধীনস্থ, এই অর্থে নয় যে, এই শাখাগুলো এই আলোচনার মূল্যের তুলনায় নিকৃষ্ট। অধীনস্থ বলার কারণ হল—এই আলোচনার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে যে, অন্যান্য জ্ঞানের শাখা যে নীতি বা সূত্র নিয়ে আলোচনা করেছে, এই সূত্রগুলো অধিবিদ্যা সম্পর্কীয় আলোচনায় যে সূত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার তুলনায় কম ব্যাপক এবং তাই যৌক্তিক পারপর্যের দিক থেকে তাদের স্থান সর্বব্যাপক সূত্রের আলোচনার পরে। সব প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সত্তা (Being)-র কোন একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে কিন্তু প্রথম দর্শনের আলোচনার বিষয়বস্তু সত্তাকেই নিয়ে (Being as such)। এই আলোচনার বিষয়বস্তু সত্তার কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়, এই আলোচনার বিষয়বস্তু হল সেই সূত্রগুলো যেগুলো সব সত্তা সম্পর্কেই সমভাবে সত্য। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক—প্রাণীবিদ্যার সূত্রগুলো কেবলমাত্র প্রাণীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু প্রথম দর্শনের সূত্রগুলো সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

অধিবিদ্যার অর্থ : ‘অধিবিদ্যা’ নামটি খ্রিস্টের জন্মের পঞ্চাশ বছর পূর্ব থেকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এনড্রোনিকাশ (Andronicus) অ্যারিস্টটলের সব পরিচিত রচনার একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। এই সংস্করণের ‘প্রথম দর্শন’ সম্পর্কীয় গ্রন্থটিকে পদার্থবিদ্যার পরে রাখা হয় এবং অধিবিদ্যার (Metaphysics) অর্থ হল সেই আলোচনা যা পদার্থবিদ্যার পর আসে (meta = after; Physika = physics) | তাই অধিবিদ্যা শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘যা পদার্থবিদ্যার পরে আসে’। ‘Physics’ পদার্থবিদ্যা এবং Meta অর্থাৎ যা পরে আসে। তাই Metaphysics বা অধিবিদ্যা বলতে বোঝায় যে আলোচনা ভৌতিক জগতের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় যা অ-প্রাকৃতিক, যা অ-ভৌতিক, যা ইন্দ্রিয়-উর্ধ্ব—এই ধরনের অর্থ মেটাফিজিকস্ কথাটি সুচিত করতে চাইছে কিনা, বলা সন্দেহজনক। বস্তুতঃ গ্রীক দর্শনের লেখক স্টেইস এই ধরনের সংশয় প্রকাশ করেছেন।

অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় : সত্তার প্রকৃতি (Nature of Being) বা পরমতত্ত্বের মূল সূত্র বা নীতি (First Principle of Reality)-ই অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। সব মানুষই স্বভাবত জানতে চায়। জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা মানুষের মধ্যে স্বভাবতঃই বিদ্যমান; কিন্তু মানুষ কোন কিছু জানলেই তাকে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলে অভিহিত করা চলে না। যে জ্ঞানের লক্ষ কোন ফল উৎপাদন করা বা ব্যবহারিক জীবনের কোন উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করা তা প্রজ্ঞা (Wisdom) পদবাচ্য নয়। প্রজ্ঞা হল কতকগুলো মূল বিষয় এবং সূত্রের বিচারবুদ্ধিসম্মত জ্ঞান। অ্যারিস্টটলের মতে, জানার জন্য জানা বা উদ্দেশ্যবর্জিত কৌতুক পরিতৃপ্তির জন্য জানাই হল শ্রেষ্ঠ জানা। যে শাস্ত্র শুধুমাত্র উদ্দেশ্য নিবৃত্তির জন্য কোন কিছু জানতে প্রয়াসী হয় না, শুধুমাত্র জানার জন্যই জানতে চায়, বা জ্ঞানলাভের জন্যই জ্ঞান লাভ করতে চায় অর্থাৎ যে শাস্ত্রের উদ্দেশ্য পরমতত্ত্বের মূল নীতিগুলোর জ্ঞান লাভ করা, সেই শাস্ত্রই হল শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা (Wisdom per Excellence), তাই হল অধিবিদ্যা। তিনি যথার্থ প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বা দার্শনিক যিনি সত্তার প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হতে চান বা সত্তার মূল কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধানে আগ্রহী। বিস্ময় থেকেই এই জাতীয় শাস্ত্রের উৎপত্তি। বিস্ময় থেকেই উদ্ভূত হয় জানার ইচ্ছা, বস্তুর বা ঘটনার ব্যাখ্যা লাভের ইচ্ছা, ঘটনার হেতু আবিষ্কারের ইচ্ছা। এই জানা থেকেই অধিবিদ্যার বা দর্শনের উদ্ভব। তাই এই শাস্ত্র স্ব-নির্ভর এই অর্থে যে, অন্য শাস্ত্রের ওপর এই শাত্র নির্ভর নয়। অধিবিদ্যা বস্তুর কারণ বা মূল সূত্র নিয়ে আলোচনা করে এবং তাই এই জ্ঞান হল সার্বিক জ্ঞান, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান; তাই এই শাস্ত্র ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ। করার কথা বলে না, এই শাস্ত্র মননের (Reflection) দ্বারা পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করার কথা বলে। অবশ্য আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নিয়ে শুরু করে, তারপর মননের সাহায্যে পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করতে হয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য এই শাস্ত্র হল সবচেয়ে অমূর্ত বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন যেহেতু কঠিন মননের প্রয়োজন। অন্য শাস্ত্রের তুলনায় সবচেয়ে অমূর্ত হলেও অ্যারিস্টটলের মতে অন্য বিদ্যা বা শাস্ত্রের তুলনায় অধিবিদ্যাই হল যথার্থ শাস্ত্র (The most exact of the sciences)।

কার্যকারণ তত্ত্ব (Doctrine of Causation)

অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যা তার কার্যকারণ তত্ত্বের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর। কার্যকরণতত্ত্ব বলতে বর্তমানে যা বোঝায়, অ্যারিস্টটলের ধারণা তার তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপক। কোন ঘটনার নিছক কারণ নির্দেশ করা হলে তার হেতু (Reason) সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না এবং তার ফলে ঘটনাটির যথাযথ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা, হেতু নিরুপণের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। মৃত্যু ব্যাধির জন্য ঘটেছে, জানা গেলেও এই বিশ্বজগতে মৃত্যু-রূপ ঘটনার অস্তিত্ব রয়েছে কেন, মৃত্যুর কারণ ব্যাধি—এর থেকে তা জানা যায় না। কারণ ও হেতুর এই পার্থক্যের বিষয়টি যদি স্বীকার করে নেওয়া যায় তাহলে বলা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ বিষয়ক তত্ত্বে কারণ ও হেতু উভয়েরই অন্তর্ভুক্তি লক্ষ করা যায়। অ্যারিস্টটলের কার্যকারণতত্ত্ব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারে; কারণ হেতু, ঘটনা এবং সূত্র সকল কিছুরই নির্দেশ করে।

কারণের শ্রেণীবিভাগ : কারণকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে অ্যারিস্টটল চার ধরনের কারণের কথা বলেছেন। উপাদান কারণ (Material Cause), নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause), আকারগত কারণ (Formal Cause), পরিণতি কারণ (Final Cause)। যে কোন বস্তুর অস্তিত্বের বা উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই চারটি কারণকেই যুগপৎভাবে ক্রিয়া করতে দেখা যায়। কি মানুষের গড়া বস্তু বা প্রকৃতির গড়া বস্তু, যে কোনটিতেই এই চারটি কারণের ক্রিয়া লক্ষ করা যেতে পারে। মানুষের গড়া একটি মূতির উদাহরণের সাহায্যে এই চারটি কারণের স্বরূপ বুঝে নেওয়া যেতে পারে। এই মূর্তিটির উপাদান কারণ হল ব্রোঞ্জ (Bronze) ধাতুর সাহায্যে মূতির রূপ দিয়েছেন। আকারগত কারণ হল বস্তুটির দ্রব্য বা স্বরূপধর্ম (The substance and essence of a thing)। আসলে এটি হল বস্তুর ধারণা (idea of a thing)। স্টেইস বলেন, “প্লেটোর ধারণাগুলোই অ্যারিস্টটলের আকারগত কারণ রূপে (Formal Cause) আবির্ভূত হয়েছে।” উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতি কারণ হল, যে লক্ষ বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাস্কর মূর্তিটি গঠন করলেন। যখন একটি মূর্তি গঠন করা হয়, তখন এই গঠন রূপ ক্রিয়ার যেটি লক্ষ, সেটিই হল মূর্তিটির সম্পূর্ণতা। যে কোন বস্তুর পরিণতি কারণ হল সাধারণভাবে সেই বস্তুটিই, বস্তুটির সম্পূর্ণ সত্তা।

পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দের কারণের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা এবং সেই সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মন্তব্য : নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, কারণের এই ব্যাখ্যা আধুনিক ব্যাখ্যার তুলনায় অনেক ব্যাপক। কারণের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে মিল (Mill) বলেছেন, কারণ হল কার্যের অপরিবর্তনীয় এবং শর্তান্তরহীন অগ্রবর্তী ঘটনা। এই সংজ্ঞাতে পরিণতি কারণ এবং আকারগত কারণের কোন স্থান নেই। অ্যারিস্টটল তার ‘মেটাফিজিক্স’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তার পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দ চারটি কারণের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন কিনা, এবং এই চারটি কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণের অস্তিত্ব নির্দেশ করেছেন কিনা, তাই নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি তার অনুসন্ধানের ফল ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মধ্যে কেউ, তিনি যে চারটি কারণ নির্দেশ করেছেন, তার অতিরিক্ত কোন কারণের অস্তিত্ব নির্দেশ করেননি। এমন কি তার দ্বারা আবিষ্কৃত চারটি কারণের কথাও কেউ সন্তোষজনকভাবে ব্যক্ত করেননি। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মধ্যে থেলিস্ (Thales), অ্যানাক্সিমিনিস্ (Anaximenes), হেরাক্লিটাস উপাদান কারণের কথা স্বীকার করেছেন, যদিও এই উপাদান কারণের স্বরূপ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিভেদ দেখা যায়। কিন্তু তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মধ্যেই কয়েকজন লক্ষ করলেন যে, শুধুমাত্র উপাদান কারণের সাহায্যেই বস্তুর আবির্ভাব ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ উপাদান নিজেই গতি উৎপন্ন করতে পারে না। দার্শনিক এমপিডক্লিজ (Empendocles) এবং অ্যানাকসাগোরাস (Anaxogoras) এই ব্যাখ্যা দেবার প্রয়াসী হয়ে নিমিত্ত কারণকে স্বীকার করে নিলেন। সঙ্গতি এবং অসঙ্গতি, অনুরাগ এবং ঘৃণা প্রভৃতি গতিশক্তির উল্লেখ করে এমপিডক্লিজ নিমিত্ত কারণকে স্বীকার করে নিলেন। অ্যানাকসাগোরাস দেখলেন যে, বস্তুর সৌন্দর্য ও গঠন-নৈপুণ্য কেবলমাত্র জড় উপাদানের সাহায্যে ব্যাখ্যাত হতে পারে না। তাই অ্যানাকসাগোরাস গতিশীল ক্রিয়াশক্তি রূপে ‘নাউস’ (Nous) বা মনের ক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে নিমিত্ত কারণকে স্বীকার করে নিলেন। এই দুই দার্শনিক উপাদান, কারণ ও নিমিত্ত কারণের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন সত্য, কিন্তু সুসঙ্গতভাবে এবং বিশদভাবে এই নিয়ে আলোচনা করেননি। বস্তুত অ্যানাকসাগোরাসের বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটলের অভিযোগ হল যে, অ্যানাকসাগোরাস নিজের অজ্ঞতাকে ঢাকবার জন্যই মনের প্রবর্তন করেছিলেন। এমপিডক্লিজ দুটি সক্রিয় নীতির উল্লেখ করে নিমিত্ত কারণকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই দুটি নীতিকে পর্যাপ্তভাবে এবং সুসঙ্গতভাবে তিনি ব্যবহার করেননি।

প্লেটো আকারগত ও উপাদানগত কারণকে স্বীকার করেছিলেন : পিথাগোরীয় সম্প্রদায় সংখ্যাকে আকার বলে অভিহিত করাতে আকারগত উপাদানকে স্বীকার করেছেন এমন কথা কিন্তু বলা চলে না। কেননা সংখ্যাকে বস্তুর উপাদান কারণরূপে নির্দেশ করে তারা আকারগত উপাদানকে জড় উপাদানের পর্যায়ে নিয়ে এলেন। দার্শনিক প্লেটোই কেবলমাত্র আকারগত কারণের ধারণা দেন, সেই কারণ আর প্লেটোর ধারণা (Idea) অভিন্ন। কিন্তু প্লেটো অ্যারিস্টটলের চারটি কারণের মধ্যে কেবলমাত্র দুটি উপাদান কারণ এবং আকারগত কারণকে স্বীকার করেছিলেন কিন্তু কোন নিমিত্ত কারণ স্বীকার করেননি। পরিণতি কারণ (Final Cause) প্লেটো স্বীকার করেছেন খুব স্পষ্টভাবে নয়, কেননা যদিও তিনি বলেছেন যে, কল্যাণের (Good) জন্যই সব কিছুর অস্তিত্ত্ব, তবু তিনি সেই ধারণার বিশেষ বিকাশ-সাধন করেননি। এই প্রসঙ্গে সমালোচনা করতে গিয়ে কপলস্টোন বলেছেন যে, প্লেটোর প্রতি অ্যারিস্টটল সুবিচার করেননি, কারণ ‘টাইম্যায়িয়ুসে’ জগৎ নিয়ন্ত্রণ কর্তার প্রবর্তন করে তিনি নিমিত্তকারণকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এছাড়াও প্লেটো নক্ষত্র দেবতা (Star-Gods)-র কথা বলেছেন এবং পরিণতি সম্পৰ্কীয় মতবাদ (Doctrine of Finality)-এর কথাও উল্লেখ করেছেন, কারণ, ভবনের (Becoming) পরিণতি কারণ হল কল্যাণের উপলব্ধি, অবশ্য অনুকরণ অর্থে। (“…for the final cause of becoming is the realisation in the sense of imitation of the Good.”)

সত্তা (Being)

সত্তাই অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় : পূর্বেই বলা হয়েছে যে, অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল সত্তা। অধিবিদ্যায় সত্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো সত্তার একটি বিশেষ দিককে আলোচনার বিষয়রূপে নির্বাচন করে এবং সত্তার ঐ বিশেষ দিকটির গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু অধিবিদ্যার সত্তার কোন একটি বিশেষ দিক দিয়ে আলোচনা করা হয় না। অর্থাৎ কিনা, এই বস্তুর বা ঐ বস্তুর সত্তা নিয়ে আলোচনা না করে অধিবিদ্যায় সাধারণ সত্তা বা সত্তা নিজে কি (Being itself), তাই নিয়ে এবং সত্তা হওয়ার জন্য তার যে গুণ, তাই নিয়ে আলোচনা করা হয়। অ্যারিস্টটলের মতানুসারে কোন কিছু সত্তাবান বলার অর্থই হল এটি এক। তাই একত্ব (Unity) হল সত্তার একটি অনিবার্য গুণ এবং যেহেতু সব বিধেয়ক (Categories)-এর সত্তা রয়েছে তাই একত্ব সব বিধেয়কেই পাওয়া যায়। অ্যারিস্টটল তাঁর নীতিবিদ্যাতেও বলেছেন যে, কল্যাণও সব বিধেয়কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ‘একত্ব’ এবং ‘কল্যাণ’ হল সত্তার অতীন্দ্রিয় গুণ। যেহেতু তারা সব বিধেয়কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কোন একটিমাত্র বিধেয়কেই তারা সীমাবদ্ধ থাকে না এবং তারা পরাজাতি নয়। মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়, মানুষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী।

প্রাণী হল পরাজাতি (Genus), ‘বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হল বিভেদক লক্ষ (Differentia) : ‘বিচারবুদ্ধি’ সম্পর্কে ‘প্রাণিত্ব’ বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হতে পারে না। অর্থাৎ বিভেদক লক্ষণ সম্পর্কে ‘পরাজাতি’ বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু ‘বিচারবুদ্ধি’ এবং ‘প্রাণিত্ব’ ‘উভয়ের সম্পর্কেই সত্তা বিধেয় রূপে প্রয়োগ করা যায়। তাই সত্তা পরাজাতি হতে পারে না।

অধিবিদ্যা দ্রব্যের সত্তা নিয়ে আলোচনা করে : সব অস্তিত্বশীল বস্তু সম্বন্ধে ‘সত্তা’ শব্দটি একই অর্থে বিধেয়রূপে আরোপিত হতে পারে না। দ্রব্য (Substance) এর সত্তা এবং দ্রব্যে যে গুণ থাকে, সেই গুণের সত্তা, এক নয়। অধিবিদ্যা কোন্ সত্তা নিয়ে আলোচনা করে—এই প্রশ্নের উত্তরে অ্যারিস্টটল বলেন, যে অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল দ্রব্যের সত্তা। কেননা দ্রব্যের সত্তা হল মূল বা প্রাথমিক সত্তা। কারণ সব বস্তুই হয় দ্রব্য বা দ্রব্যের কোন প্রকার (Affection)। কিন্তু দ্রব্য যেহেতু নানা ধরনের হতে পারে, অধিবিদ্যা কোন্ দ্রব্য নিয়ে আলোচনা করবে—এই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। অ্যারিস্টটলের মতে, অধিবিদ্যা অপরিণামী দ্রব্য নিয়ে আলোচনা করবে। যেহেতু অধিবিদ্যার কাজ হল সত্তার যথার্থ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা এবং যেহেতু সত্তার যথার্থ প্রকৃতি তাতেই প্রকাশিত হয় যা অপরিণামী এবং স্ব-নির্ভর, তাই অপরিণামী বা নিত্য দ্রব্য যদি কিছু থাকে তাই নিয়ে অধিবিদ্যা আলোচনা করবে। প্রশ্ন হল, এইরকম কোন অপরিণামী নিত্য বস্তু আছে কী? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, কমপক্ষে এই রকম একটি অপরিণামী নিত্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করে পারা যায় না। যুক্তিটা এই রকম : একটি গতিশীল বস্তুর কারণ অপর একটি বস্তু যা তাকে গতিশীল করে। তার কারণ আবার অপর একটি বস্তু—এইভাবে চলতে থাকলে অনবস্থা দোষ দেখা দেবে। তাই সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, এমন একটি সত্তা আছে, যা অন্যকে গতিশীল করলেও নিজে অগতিশীল। এই সত্তাই হল অপরিণামী বা অনিত্য। এই সত্তার প্রকৃতি হবে আধ্যাত্মিক। এই নিত্য সত্তা বা দ্রব্য তবে অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। গণিতশাস্ত্র হল তাত্ত্বিক বিজ্ঞান এবং গণিতশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় হল অপরিণামী বা অপরিবর্তনশীল বস্তু। কিন্তু এই বস্তুগুলোকে উপাদান থেকে পৃথকভাবে আলোচনা করা হলেও এরা উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। পদার্থবিদ্যা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সেগুলো উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না এবং সেগুলো গতিশীল। কেবলমাত্র অধিবিদ্যাই অপরিণামী নিত্যসত্তা নিয়ে আলোচনা করে। অধিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হল তাই, যা উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে এবং যা গতিহীন। অ্যারিস্টটল কখনও দ্রব্যকে পরিণামী এবং কখনও অপরিণামী—এই দুই শ্রেণীতে। ভাগ করেছেন। আবার তিনি তিন ধরনের দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করেছেন- (১) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং নশ্বর, (২) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং নিত্য, যেমন— সৌরজগতের গ্রহতারকা; (৩) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এবং নিত্য।

প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের খণ্ডন 

অ্যারিস্টটলের মতে, অধিবিদ্যা অতীন্দ্রিয় ও নিত্যদ্রব্য নিয়ে আলোচনা করে। প্রশ্ন হল এই নিত্যদ্রব্যের স্বরূপ বা প্রকৃতি কি? এই নিত্যদ্রব্য কি প্লেটোর ধারণা? অ্যারিস্টটল এর উত্তর হল ‘না’। তাই অ্যারিস্টটল প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ খণ্ডন করার জন্য নিম্নলিখিত যুক্তিগুলো উপস্থাপিত করেছেন – 

  • ১. প্লেটোর ধারণা বা আকার বস্তুর অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কেন এই জগতকে আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি, অর্থাৎ কেন এটি এখানে অস্তিত্বশীল—এটিই দর্শনের প্রধান সমস্যা। কিন্তু প্লেটোর ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ এই সমস্যার কোন সমাধান করতে পারে না। যদি মেনেও নেওয়া যায় যে, শ্বেতত্ত্বের ধারণা বা আকারের অস্তিত্ব রয়েছে, আমরা বুঝে উঠতে পারি না তা কিভাবে শ্বেতবস্তু উৎপন্ন করে।
  • ২. প্লেটোর ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে। এই মতবাদ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে। অ্যারিস্টটল বলেন তার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ধারণা বা আকার কাল্পনিক বিষয় নয়। কিন্তু তার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু (Individual) থেকে পৃথকভাবে ধারণা বা আকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে। প্লেটোর ধারণাবাদ যখন সব কিছুরই ধারণা বা আকার স্বীকার করে তখন অভাব (Negation) বা সম্বন্ধের (Relations) ধারণা বা আকার স্বীকার করতে হয়। কিন্তু অভাব বা সম্বন্ধের ধারণার বা আকারের কথা চিন্তা করা যায় কি?
  • ৩. ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদ অপ্রয়োজনীয়। এই জগতে বহুসংখ্যক বস্তু আছে। জগতের এই বহুত্ব ব্যাখ্যা করা দর্শনের কাজ। প্লেটো এই বহুত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য বহুসংখ্যক ধারণার বা আকারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই অ্যারিস্টটলের মতে, প্লেটোর আকারগুলো প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুর প্রয়োজনহীন দ্বিত্বকরণ (Doubling) ছাড়া কিছুই নয়। অ্যারিস্টটল প্লেটোকে সেই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন যিনি অল্প সংখ্যা নিয়ে গণনা করতে অসমর্থ হয়ে মনে করেছেন যে, সেই সংখ্যা দ্বিগুণ করলে তার গণনার কাজটি সহজতর হবে।
  • ৪. অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, বস্তুর জ্ঞানের পক্ষেও ধারণা বা আকার অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু ধারণা বা আকার বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে থাকে না, বিশেষ বস্তুর জ্ঞান লাভে তারা প্রয়োজনহীন। কপলস্টোন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, অ্যারিস্টটলের এই ধরনের যুক্তি প্রমাণ করে যে, অ্যারিস্টটল প্রত্যক্ষগ্রাহ্য জগতেই অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর আগ্রহ ছিল ধারণা বা আকারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ এই আকার বা ধারণাকে জানার মাধ্যম। ধারণা বা আকারকে জানলেই বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তিতে তার রূপায়ণ কতটা মাত্রায় ঘটেছে জানা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্রের আদর্শরূপের কথা জানা থাকলে, বাস্তবে অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রগুলো, যেগুলো কম বা বেশি মাত্রায় তাকে রূপায়িত করেছে, তাদের উন্নতিসাধনের জন্য সচেষ্ট হওয়া যায়।
  • ৫. যদি স্বীকার করে নেওয়াও যায় যে, বস্তুর অস্তিত্ব, ধারণার বা আকারের সাহায্যে ব্যাখ্যাত হয়, তবু বস্তুর গতি ব্যাখ্যার ব্যাপারেও ধারণা বা আকার অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু ধারণাগুলো অপরিণামী এবং গতিহীন, তাই এই বিশ্বজগত, ধারণার অনুকরণ প্রতিলিপি (Copy) হওয়াতে অবশ্যই গতিহীন হবে। কিন্তু আমরা দেখি যে, এই জগতে পরিবর্তন, গতি, বস্তুর আবির্ভাব, তিরোভাব লেগেই রয়েছে। প্রেটো এই পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য সচেষ্ট হননি। ধারণা বা আকারের মধ্যেই গতির কোন সূত্র বা নীতি থাকা দরকার, কিন্তু প্লেটো এই রকম কোন নীতি স্বীকার
    করেননি। কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, অ্যারিস্টটল প্লেটোর ধারণাবাদের বা আকারবাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করে, তার প্রতি সুবিচার করেননি। কেননা ধারণা যে গতির ব্যাখ্যা দিতে অসমর্থ, সেই বিষয়ে প্লেটো সচেতন ছিলেন এবং এই কারণেই গতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি জগৎ নিয়ন্ত্রণকর্তা বা ডেমিয়ার্জ (Demiurge)-এর বিষয়টির অবতারণা করেছিলেন, হতে পারে ডেমিয়ার্জের ধারণা পৌরাণিক ধারণা। তবু এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, তিনি ধারণা বা আকারকে কখনও গতির নীতি বলে গণ্য করেননি এবং অন্যভাবে গতির ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন।
  • ৬. অ্যারিস্টটল-এর মতে, যেহেতু ধারণা বা আকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে ব্যাখ্যা করে, তাই ধারণা বা আকারও হয়ে পড়বে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আদর্শ মানুষ (Ideal man) বা আকার মানুষ, সক্রেটিসের মতই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে। ধারণা বা আকারগুলো হবে নররূপী দেবতার সদৃশ, দেবতারা হল অবিনশ্বর, মানুষ; আকার বা ধারণা হল অবিনশ্বর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়। এই অভিযোগও খুব যুক্তিযুক্ত নয়। যদি আদর্শ মানুষকে বাস্তব মানুষের এক নিখুঁত রূপ বলে মনে করা হয়, আদর্শ বলতে সাধারণ অর্থে যা আমরা বুঝে থাকি, তাহলে আদর্শ মানুষ অবশ্যই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে। কিন্তু ‘আদর্শ মানুষ’ বলতে প্লেটো সাধারণভাবে যা বোঝায়, তা বোঝেননি। প্লেটোর মতে, আদর্শ মানুষ হল মানুষ (Universal Man) যা হল একটি আকার বা ধারণা (Idea)। তাই ধারণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে কিভাবে? আদর্শ মানুষ যদি হয় একটা ধারণা, তাহলে তার দেহধারী হওয়ার বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
  • ৭. অ্যারিস্টটলের মতে, ধারণা বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদের সম্ভাব্যতা স্বীকার করা চলে না। প্লেটোর মতে, আকার হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর স্বরূপ ধর্ম (Essence) এবং আকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে। অ্যারিস্টটল বলেন যে, আকার যদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকে তাহলে সেই আকারে বস্তুর স্বরূপধর্ম কিভাবে থাকতে পারে? সােজা কথা, উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি? প্লেটো এই সম্পর্ক প্রকাশ করার জন্য “অংশগ্রহণ” (Participation), ‘অনুকরণ’ (Imitation) প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, আকার ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সম্পর্ক বোঝাবার জন্য এই সব শব্দ ব্যবহার করে প্লেটো এই সম্পর্কের যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি কতকগুলো শূন্যগর্ভ পদ এবং কাব্যিক উপমা ব্যবহার করেছেন মাত্র। অ্যারিস্টটলের এই অভিযোগ সত্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে যদি অ্যারিস্টটল ধারণা বা আকার ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর স্বতন্ত্র হয়ে অবস্থান করার বিষয়টি স্থানগত দিক থেকে বুঝে থাকেন। কিন্তু প্লেটো তা মনে করেননি। প্লেটোর আসল বক্তব্য হল আকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর ওপর নির্ভর নয়।
  • ৮. আকার থেকেই বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির (Individual) উদ্ভব, প্লেটোর এই হল অভিমতকে অ্যারিস্টটল সমালোচনা করে বলেন, ‘আকার’ (Form) বলতে সাধারণত যা বোঝায় সেই অর্থে আকার থেকে বস্তু আসতে পারে না। বস্তুতপক্ষে অ্যারিস্টটল সেই একই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, আকারের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক কি? এই সম্পর্ক যথাযথভাবে প্লেটো ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, অ্যারিস্টটল প্লেটো যে জগৎ নিয়ন্ত্রণকর্তা বা ডেমিয়ার্জ-এর কথা বলেছেন, সেটিকে অগ্রাহ্য করেছেন।
  • ৯. স্টেইস-এর মন্তব্য – প্লেটো আকারের স্বরূপ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে আকারও অন্যান্য বস্তুর মত বিশেষ বস্তু হয়ে পড়েছে। কিন্তু আসলে আকার হচ্ছে সার্বিক (Universal)। আদর্শ মানুষ সক্রেটিসের মতই হয়ে উঠবে ব্যক্তি মানুষ (Individua Man) বা বিশেষ (Particular), কেননা সক্রেটিস বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে যেমন অন্যান্য ব্যক্তি থেকে ভিন্ন, তেমনি সার্বিক মানুষ’ অন্যান্য, সার্বিক থেকে ভিন্ন হওয়ার জন্য বিশেষ হয়ে পড়বে। আকার যেহেতু সার্বিক তাই কেবলমাত্র বিশেষেই তা থাকতে পারে। সব ঘােড়ার মধ্যে রয়েছে সার্বিক ঘােড়ার অস্তিত্ব, সার্বিক ঘােড়া বিশেষ বিশেষ ঘােড়া থেকে স্বতন্ত্র হয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না। কিন্তু প্লেটো মনে করেন যে, বিশেষ বিশেষ ঘােড়া ছাড়াও এক সার্বিক ঘােড়ার অস্তিত্ব আছে, যেমন বিশেষ বিশেষ শ্বেতবস্তু ছাড়াও শ্বেতত্ব বলে এক বস্তু অছে এবং এইখানেই প্লেটোর মতবাদ স্ব-বিরোধী। প্লেটো মনে করেছেন সার্বিক হচ্ছে বাস্তব, বিশেষ হচ্ছে অলীক। কিন্তু আবার সার্বিককেই তিনি বিশেষের স্তরে নামিয়ে নিয়ে এলেন। স্টেইস্ (Stace) বলেন, “প্লেটোর ভুল হল, তিনি প্রথমে যথার্থভাবেই অনুধাবন করলেন যে অস্তিত্বশীলতাই বাস্তবতা নয়। কিন্তু তারপর তিনি ভ্রান্তভাবেই কল্পনা করলেন যে, বাস্তবতা হল অস্তিত্বশীলতা।” এই সমালোচনার উত্তরে বলা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটলের সমালোচনা প্লেটোর অভিমতের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হবে যদি প্লেটো মনে করেন আকার হল বস্তু, কিন্তু তিনি কি তা মনে করেছেন? তিনি যদি আকারকে প্রত্যয় বা সার্বিক বলে মনে করেন যাদের দেশ-কালে অস্তিত্ব নেই, কিন্তু অবস্থিতি (Subsistence) আছে, তাহলে সক্রেটিস যে অর্থে বিশিষ্ট ব্যক্তি, আকার বা ধারণা সেই অর্থে বিশিষ্ট বস্তুতে পরিণত হয় না। অবশ্য তারা বিশেষ বিশেষ প্রত্যয় বা সার্বিক ধারণা, কিন্তু প্লেটো যে সমগ্র প্রত্যয় বা ধারণার জগতকে সুবিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
  • ১০. এরপর হল তৃতীয় মানুষের যুক্তি (the argument of the third man) – অ্যারিস্টটল প্রদত্ত উদাহরণ থেকেই এই যুক্তির এরূপ নামকরণ হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল প্লেটোর আকারবাদের বিরুদ্ধে অ্যারিস্টটল প্রদত্ত এই যুক্তিটিকেই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে করেছেন। সব মানুষের মধ্যে যেদিক থেকে মিল রয়েছে তা হল তারা মানুষের ধারণার বা সার্বিকের অনুকরণ। কিন্তু বিশেষ বিশেষ মানুষ আর মানুষের ধারণা (Idea of Man)-র মধ্যে একটা সাধারণ উপাদানের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে গেলে একটি তৃতীয় ধারণা অর্থাৎ কিনা, তৃতীয় মানুষের কথা ভাবতে হয়। আবার এই ‘তৃতীয় মানুষের ধারণাও ব্যক্তি মানুষ-এর মধ্যে সাধারণ উপাদান। হিসেবে অন্য আর একটি সাধারণ ধারণার কথা ভাবতে হবে, যার ফলে অবস্থা দোষ (Infinite Regress) দেখা দেবে।
  • ১১. প্লেটো ধারণাগুলোকে অতীন্দ্রিয় বলেছেন। ঘােড়া এবং ঘােড়ার ধারণার পার্থক্য প্লেটো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হননি। ঘােড়া আসলে যা (initself) বা সাধারণ ঘােড়া (horse in-general) প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার এই পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ধারণা বা আকারগুলোকে প্লেটো লৌকিক ধর্মের, মানবিক গুণসম্পন্ন দেবতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন “এরা হল ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন মানুষ”। তাই ধারণা হল প্রকৃতিরই বস্তু যা নিত্যতা লাভ করেছে। বস্তুকে বলা হয়েছে ধারণার নকল কিন্তু বস্তুতপক্ষে দেখা যাচ্ছে যে, ধারণাই হল বস্তুর নকল।
  • ১২. ‘আকার হল, সংখ্যা’—প্লেটোর এই অভিমতের বিরুদ্ধেও অ্যারিস্টটল অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। অ্যারিস্টটলের প্রশ্ন হল, আকার যদি সংখ্যা হয় তাহলে তারা কারণ (Cause) কিভাবে হতে পারে? যদি বলা হয় যে, আকার হল কারণ, যেহেতু অস্তিত্বশীল বস্তু হল অন্যান্য সংখ্যা (যেমন একটা সংখ্যা হচ্ছে ‘মানুষ’, আর একটি সংখ্যা হচ্ছে সক্রেটিস) তাহলে কেন একদল সংখ্যা অন্যদল সংখ্যার কারণ হচ্ছে? তা ছাড়া দু’ধরনের সংখ্যা কিভাবে থাকতে পারে। আকার সংখ্যা (form numbers) ছাড়াও যদি অন্য সংখ্যা (গাণিতিক বস্তু) স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে দুই ধরনের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তিটা কি? অ্যারিস্টটলের বক্তব্য হল, আমরা মাত্র এক ধরনের সংখ্যার কথা জানি, যে সংখ্যা নিয়ে গণিতবিদরা আলোচনা করেন।

অ্যারিস্টটল এই সম্পর্কে প্লেটোর মতবাদের বিরুদ্ধে আরও নানাধরনের অভিযোগ উথাপন করেছেন। যেহেতু ‘আকার হল সংখ্যা’—প্লেটোর এই অভিমত আমরা ইতোপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করিনি, তাই অ্যারিস্টটল এই সম্পর্কে যে বিভিন্ন অভিযোেগ উত্থাপন করেছেন সেগুলো এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তবে এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন অ্যারিস্টটলের এই মতবাদের সমালোচনা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা যেতে পারে। কপলস্টোন মন্তব্য করেছেন যে, অ্যারিস্টটল প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে তার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। কপলস্টোন বলেন যে, অ্যারিস্টটলের সমালোচনা থেকে এমন মনে হয় যে, প্লেটো বুঝি গাণিতিক বস্তু বা আকারকে বস্তু বলে মনে করেছেন। আসলে তিনি তা মনে করেননি। কপলস্টোন আরও বলেন যে, অ্যারিস্টটল প্লেটোর আকারবাদ বা ধারণাবাদের যে সমালোচনা করেছেন তার মূল্য স্বীকার করে নিলেও এমন কথা ভাবা যুক্তিসঙ্গত হবে যে, প্লেটোর আকার সম্পর্কীয় মতবাদ এক দুর্বোধ্য মতবাদ, যাকে ইচ্ছা করলেই বাতিল করা যায়। তার অভিমত হল যে, আমাদের পক্ষে প্লেটো বা অ্যারিস্টটল, এই দুজনের মধ্যে কোন একজনের মতবাদকেই বাতিল করা সম্ভব নয়; উভয়ের মতবাদে যে সত্যতা রয়েছে তাকে একত্র সংযুক্ত করতে হবে। সার্বিক এবং বিশেষকে নিয়ে যে সমস্যার উদ্ভব, সে সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক মতবাদ গঠন করতে হলে, তার মতে, আমাদের প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল, উভয়ের মতবাদেরই প্রয়োজন আছে।

সার্বিক (Universal)

প্লেটোর সার্বিক বা আকার সম্পর্কীয় মতবাদের সমালোচনা থেকেই অ্যারিস্টটল সার্বিক সম্পর্কে তার নিজস্ব মতবাদ গঠন করেছেন। অ্যারিস্টটল প্লেটোর সঙ্গে একমত যে, সার্বিক নিছক মনোগত প্রত্যয় নয়, কেননা মনে যে সার্বিকের অস্তিত্ব রয়েছে বস্তুতে সেই সার্বিকের অনুরূপ বিশেষ স্বরূপধর্ম (Specific Essence) রয়েছে, যদিও কোন অবস্থাতেই এই স্বরূপধর্ম বস্তু থেকে স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না। কেবলমাত্র মনের ক্রিয়ার দ্বারা মনেতেই তাকে পৃথক করা যায়। সামান্যই যে বিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তু, প্লেটোর এই সিদ্ধান্তে অ্যারিস্টটলেরও বিশ্বাস ছিল। তাই সার্বিক-এর যদি কোনভাবে সত্যতা না থাকে, এর যদি বস্তুগত সত্যতা (Objective Realities) মেনে নেওয়া না যায়, তাহলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সত্যতাকেও স্বীকার করে নেওয়া যাবে না। কেননা এ কথা তো ঠিক যে, বিজ্ঞান বিশেষকেই তার আলোচনার বস্তু করে না। তাই সার্বিকের সত্যতা (Reality) বা অস্তিত্ব আছে; শুধুমাত্র মানুষের মনে নয়, বস্তুতেও এর অস্তিত্ব আছে। তবে বস্তুতে এর অস্তিত্ব মনেতে এর যে আকারগত সার্বিকতা (Formal Universality) আছে, তাকে অনুসৃত করে না। একই উপজাতির অন্তর্ভুক্তি বিশিষ্ট বস্তু হল অস্তিত্বশীল দ্রব্য। (“The universal is real, it has reality not only in the mind but also in the things, though the existence in the thing does not entail that formal universality that it has in the mind.”-Copleston.)। কিন্তু শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুতে সংখ্যাগতভাবে অভিন্নরূপে বর্তমান এমন কোন বস্তুগত সার্বিকের তারা অংশীদার নয়। এই বিশেষ স্বরূপধর্ম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্তমান। অপরপক্ষে এটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্যের মধ্যে বিশেষভাবে একই।

অমূর্ত সার্বিক : অ্যারিস্টটলের মতে, এই বস্তুগত সাদৃশ্য অমূর্ত সার্বিক (Abstract Universal)-এর যথার্থ ভিত্তি। বিজ্ঞানের কাজ বস্তুর সার্বিক উপাদানকে নিয়ে। এই বিষয়টি প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই স্বীকার করেছেন। যেমন বিজ্ঞানী বিশেষ বিশেষ স্বর্ণখণ্ডে আগ্রহী নয়, তিনি আগ্রহী স্বর্ণের স্বরূপধর্ম নিয়ে অথাৎ কিনা সেই বিশেষ সাদৃশ্য নিয়ে, যা প্রতিটি বিশেষ বিশেষ স্বর্ণখণ্ডে দৃষ্ট হয়।

মূর্ত সার্বিক : প্লেটোর সার্বিক সম্পর্কীয় মতবাদের গোড়া পত্তন করেছিলেন সক্রেটিস তার সংজ্ঞার্থ (Definition) সম্পর্কীয় মতবাদের মাধ্যমে। কিন্তু সক্রেটিস বিশেষকে সার্বিক থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করেননি এবং তাঁর এই চিন্তা কপলস্টোনের মতে, যথাযথ হয়েছিল। কেননা সার্বিক ছাড়া জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়; কিন্তু সার্বিককে বিশেষ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে, প্লেটোর ধারণার (Ideas) বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল সেগুলো এক্ষেত্রেও দেখা দেবে। অ্যারিস্টটলের মতে, সার্বিক বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তির (Individulity) মধ্যে মূর্ত এবং সার্বিক বিশেষের অতিবর্তী নয়, বিশেষের মধ্যে অস্তঃস্যুত। প্লেটোর মতে, সার্বিক হল অমূর্ত (Abstract), অ্যারিস্টটলের মতে মূর্ত (Concrete)। অ্যারিস্টটলের মতে, সার্বিক অশ্ব বিশেষ বিশেষ অশ্বের মধ্যেই অন্তঃস্যুত।

প্লেটোর সার্বিক যথার্থ দ্রব্য নয় : অ্যারিস্টটলের মতে, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুই হল যথার্থ দ্রব্য (Substance)। প্রশ্ন হল, দ্রব্য কাকে বলে? দ্রব্য হল তাই, যা স্বনির্ভর, যার সত্তার উৎস অন্য সত্তা নয়। প্রশ্ন হল, প্লেটোর সার্বিক কি দ্রব্য? অ্যারিস্টটলের মতে, তাদের যথার্থ দ্রব্য বলা যায় না, তারা গৌণ অর্থে দ্রব্য। বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তিই কেবলমাত্র উদ্দেশ্য যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়, বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তি অপর কোন কিছু সম্পর্কে বিধেয় রূপে ব্যবহৃত হয় না। সার্বিক দ্রব্য নয়, তার কারণ প্লেটোর সার্বিক হল একটি সাধারণ বিধেয় যা একটি শ্রেণীর বহু বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। যেমন মানুষ এই ধারণা বলতে আমরা বুঝি বহু ব্যক্তির মধ্যে যা সাধারণভাবে উপস্থিত। আসলে এই মানুষ হল মনুষ্যত্ব (Humanness)। মনুষ্যত্ব মানুষ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না। তাই সার্বিক দ্রব্য রূপে গণ্য হতে পারে কিভাবে? আবার নিছক বিশেষও (Absolutely Particular) দ্রব্য নয়। নিছক বিশেষের কোন অস্তিত্ব নেই। মনুষ্যত্ব যেমন বিশেষ বিশেষ মানুষ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না, তেমনি মানুষও মনুষ্যত্ব ছাড়া থাকতে পারে না। তাই সার্বিক দ্রব্য নয়, আবার নিছক বিশেষও দ্রব্য নয়, কেননা এদের কেউ একে অপরকে ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না। দ্রব্য হল এই দুই-এর সমন্বয়। দ্রব্য সার্বিক আবার বিশেষ, এর অর্থ, দ্রব্য হল বিশিষ্ট বস্তু (Individual Object) অর্থাৎ মানুষ যাতে মনুষ্যত্ব রয়েছে।

দ্রব্যের তুলনায় সার্বিকের শ্রেষ্ঠতার স্বীকৃতি—ফলে বিরোধিতা : কিন্তু অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের মধ্যে বিরোধিতা দোষ রয়েছে। কেননা তিনি প্রথমে বলেছেন যে, বিশিষ্ট বস্তু যা সার্বিক এবং বিশেষের সমন্বয় হল দ্রব্য, কিন্তু পরে তিনি ‘সার্বিক বা যাকে আকার (Form) নামে অভিহিত করেছেন, তাকে অপরটির চেয়ে শ্ৰেষ্ঠতা দান করেছেন। অর্থাৎ অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, বিজ্ঞানের সম্পর্ক দ্রব্য নিয়ে এবং বিশিষ্ট বস্তুই হল দ্রব্য। কিন্তু অপরপক্ষে তিনি সার্বিককে উচ্চতর গুণের আধকারী মনে করে তাকেই বিজ্ঞানের যথার্থ বস্তু বলে অভিহিত করেছেন। তাহলে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য কি পরস্পরবিরোধী হওয়ার জন্য বিরোধিতা দোষে দুষ্ট হচ্ছে না? কিন্তু স্টেইস্, কপলস্টোন প্রমুখ লেখক মনে করেন যে, প্রকৃতপক্ষে অ্যারিস্টটলের উক্তি বিরোধিতা দোষে দুষ্ট নয়, যদি অ্যারিস্টটল যা বলেছেন তার যথাযথ অর্থ করা হয়। অ্যারিস্টটল যখন বলছেন যে, বিশিষ্ট বস্তুই হল যথার্থ দ্রব্য এবং এই হল একমাত্র যথাযথ দ্রব্য তখন তিনি প্লেটোর সেই মতবাদকে অস্বীকার করতে চাইছেন, যে মতবাদ অনুসারে সার্বিকের স্ব-নির্ভর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু বস্তুর মধ্যে আকারগত উপাদান হিসেবে যে সার্বিকের অস্তিত্ব আছে তাকে তিনি অস্বীকার করতে চাননি। বিশিষ্ট বস্তুই যথার্থ দ্রব্য কিন্তু যা তাকে দ্রব্যে পরিণত করে এবং বিজ্ঞানের বস্তুতে পরিণত করে তা হল সার্বিকগত উপাদান, বস্তুর আকার, যাকে মন বস্তু থেকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে আকারগত সার্বিকের মধ্য দিয়ে চিন্তা করতে পারে। তাই যখন অ্যারিস্টটল এ কথা বলেন যে, সার্বিক হল বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু, তখন তার উক্তি বিরোধিতা দোষে দুষ্ট নয়, কারণ তিনি অস্বীকার করেননি যে, সার্বিকের বস্তুগত সত্যতা আছে। তিনি শুধুমাত্র তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

সার্বিক বিশিষ্ট বস্তুর অতিবর্তী নয়, তার মধ্যে অন্তঃস্যুত : আসলে সার্বিক বিশিষ্ট বস্তুর অতিবর্তী নয়, অন্তর্বর্তী, বিশেষের মধ্যে সার্বিক অন্তঃস্যুত। এটি হল মূর্ত সার্বিক (Concrete Universal)। বিশিষ্ট বস্তুই কেবলমাত্র যথার্থ দ্রব্য, কিন্তু বিজ্ঞান সার্বিক নিয়ে আলোচনা করার সময় বিশিষ্ট বস্তুতে, যে সার্বিক তার উপাদান (Element) হিসেবে সেখানে রয়েছে, তাকেই সরাসরি আলোচনার বিষয়বস্তু করে তোলে। তাছাড়া ভাষার দিক থেকেও অ্যারিস্টটলের উক্তি বিরোধীতা দোষে দুষ্ট নয়, কেননা তিনি দ্রব্যের দুটি অর্থ-এর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য করেছেন। প্রাথমিক অর্থে দ্রব্য বলতে বিশিষ্ট বস্তুকে বুঝতে হবে, যা উপাদান এবং আকার-এর দ্বারা গঠিত। কিন্তু গৌণ অর্থে দ্রব্য হল আকারগত উপাদান (Formal Element) বা বিশেষ বা বিশিষ্ট স্বরূপধর্ম (Specific Essence), যা সার্বিক প্রত্যয়ের অনুরূপ। তাছাড়া অ্যারিস্টটল প্রাথমিক ও গৌণ বলতে প্রকৃতির দিক থেকে, কালের দিক থেকে, মর্যাদার দিক থেকে এই বিভেদ করেননি, আমাদের দিক থেকে তাকে প্রাথমিক ও গৌণ বলেছেন।

গণিতের বস্তু এবং সার্বিক দ্রব্য নয় : তাই অ্যারিস্টটল গণিতের বস্তু এবং সার্বিককে দ্রব্য বলে স্বীকার করতে রাজি নন। অ্যারিস্টটল তার ‘Metaphysics’ গ্রন্থে, যেখানে প্লেটোর সার্বিক সম্পর্কীয় মতবাদ খণ্ডন করেছেন, সেখানে সার্বিককে দ্রব্য বলে অভিহিত করেননি, যদিও ‘Categories’ গ্রন্থে তিনি সার্বিককে গৌণ অর্থে দ্রব্য বলেছেন। যাই হােক না কেন, অ্যারিস্টটলের মতে, যা বিশিষ্ট তাই যথার্থ দ্রব্য (it is the individual that is truly substance) কেবলমাত্র বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তিই দ্রব্য।

শুদ্ধ আকারই যথার্থ দ্রব্য : অ্যারিস্টটলের মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশিষ্ট বস্তুর সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় না, কেননা তাদের মধ্যে উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে। এই উপাদানের উপস্থিতির জন্য তারা নশ্বর এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও দুর্বোধ্য। অপরপক্ষে, দ্রব্য হল মূলত স্বরূপধর্ম যার সংজ্ঞা দেওয়া যায় বা বস্তুর আকার, যার জন্য এ উপাদান কোন একটি নির্দিষ্ট মূর্ত বস্তু হয়ে ওঠে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, দ্রব্য হল মুখ্যত আকার বা নিজে উপাদান বর্জিত। তাই যদিও অ্যারিস্টটলের অভিমত হল বিশিষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুই হল দ্রব্য, তার চিন্তার গতিধারা লক্ষ করলে দেখা যায় যে ‘শুধু আকার-ই যথার্থ এবং প্রাথমিক দ্রব্য’–এই অভিমতের দিকেই সেই চিন্তাধারা অগ্রসর হতে চায়। কিন্তু উপাদানের ওপর বাস্তবিকপক্ষে নির্ভর নয় এমন আকার হল কেবলমাত্র ঈশ্বর, জ্যোতিষ্কমণ্ডলে বিরাজ করে যে বুদ্ধি (The Intelligences of the Spheres) এবং মানুষের মধ্যে সক্রিয় বুদ্ধি। এ আকারগুলোই হল প্রাথমিক দ্রব্য। যদি অধিবিদ্যা দ্রব্যের আলোচনা করে, তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এটি ধর্মতত্ত্বের সমতুল্য।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সার্বিকের জ্ঞানের কি প্রয়োজন আছে? : এ প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, বিজ্ঞানের জন্য সার্বিকের (Universals) প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হল, সত্যই কি প্রয়োজন আছে? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে বিজ্ঞান বলতে আমরা কি বুঝি? যদি বিজ্ঞান বলতে সার্বিকের জ্ঞান বোঝায়, তাহলে প্রয়োজনের ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান বলতে যদি বিজ্ঞতা বোঝায়, যে অর্থে অ্যারিস্টটল তাকে বুঝেছেন, তাহলে বলা যেতে পারে যে, দার্শনিক বিশেষকে বিশেষ হিসেবে গ্রহণ করেন না, কেননা, দার্শনিক যদিও কোন আপেক্ষিক সত্তা নিয়ে আলোচনা করেন, তিনি বিশেষ কোন আপেক্ষিক সত্তার কথা চিন্তা না করে, আপেক্ষিক সত্তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন। আপেক্ষিক সত্তা সম্পর্কে দার্শনিক এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান যা সব আপেক্ষিক সত্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। আর বিজ্ঞান বলতে আধুনিককালে আমরা যা বুঝি তাকে যদি বোঝায় তাহলে বলতে হয় কোন শ্রেণীর যথার্থ সার্বিক স্বরূপ-ধর্মের জ্ঞানের তেমন প্রয়োজন নেই। উদ্ভিদের শ্রেণীবিভাগ করার সময় সেই সব উদ্ভিদের সংজ্ঞার্থের জ্ঞান ছাড়াও উদ্ভিদবিদ শ্রেণীবিভাগের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োজন না হলেও, একে একেবারে বাতিল করা চলে না, কেননা আপতিক (Accidental) বৈশিষ্ট্যের সহায়তায় যখন কোন কিছুর শ্রেণীবিভাগ করা হয় বা বর্ণনা দেওয়া হয়, তখনও কোন না কোনভাবে সার্বিক নিরূপণের প্রয়োজন দেখা দেয়, কেননা সঠিকভাবে সংজ্ঞা দিতে না পারলেও, যে বর্ণনা দিচ্ছে বা শ্রেণীবিভাগ করছে, তাকে জাতিরূপ (Type) নিরূপণ করতে হয়। এ যেন অস্পষ্টভাবে সার্বিককে উপলব্ধি করা, যদিও সঠিকভাবে তার সংজ্ঞা নিরূপণ করা যাচ্ছে না। তাই বাস্তব স্বরূপধর্মগত সংজ্ঞার্থ (Real Essential Definition) অর্থে সার্বিক সংজ্ঞার্থ আদর্শ হিসেবে সবসময়ই থাকছে, যদিও অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিজ্ঞানগুলো এ আদর্শকে বাদ দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে পারে। অ্যারিস্টটল বিজ্ঞান বলতে এ আদর্শের দিক থেকেই বিজ্ঞানের কথা বুঝেছেন।

উপাদান এবং আকার (Matter and Form)

অ্যারিস্টটল চার ধরনের কারণ স্বীকার করেছেন—(১) উপাদান কারণ, (২) নিমিত্ত কারণ, (৩) আকারগত কারণ। (৪) পরিণতি কারণ। কিন্তু এ কারণের আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে যে, শেষ পর্যন্ত আকারগত কারণ, নিমিত্ত কারণ এবং পরিণতি কারণ সবগুলোই একটিমাত্র কারণের রূপ গ্রহণ করেছে যা হল আকার (Form)। কেবলমাত্র উপাদানগত কারণকেই আকারে রূপান্তরিত করা যায় না। তাই উপাদান এবং আকারের বৈপরীত্যই টিকে থাকে।

উপাদানের স্বরূপ : এখন প্রশ্ন হল অ্যারিস্টটল উপাদান (Matter) বলতে কি বুঝেছেন? যদি এ রকম মনে করা হয় যে, অ্যারিস্টটল উপাদান বলতে ভৌত দ্রব্য, কাঠ, লোহা বুঝেছেন এবং আকার বলতে কোন বস্তুর আকার বুঝেছেন, তা হলে ভুল হবে। তাই অ্যারিস্টটল উপাদান বলতে কি বুঝেছেন দেখা যাক : পারমিনাইডিস পরিবর্তন বা পরিণামের সত্যতা অস্বীকার করলেও, অ্যারিস্টটল করেননি। পরিবর্তনকে স্বীকার করলে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, কোন কিছু কিছুতে পরিবর্তিত হচ্ছে। বীজ পরিবর্তিত হয়ে চারা গাছে পরিণত হয়। কাষ্ঠ থেকে শয্যা তৈরি হয়। এ কোন কিছুর মধ্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিহিত থাকে, তারপর কোন নিমিত্ত কারণের তত্ত্বাবধানে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়।

মূল আধার : অ্যারিস্টটলের বক্তব্য হল, কোন কিছু যে কোন কিছুতে পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু তার একটা মূল আধার (Ultimate Substratum) আছে, যার নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এটা হল শুধু সম্ভাবনা বা অব্যক্ততা (Potentiality) ছাড়া কিছুই নয়। এটাকেই অ্যারিস্টটল বলেছেন প্রাথমিক উপাদান (Prime Matter), যা সব জড় বস্তুতেই দেখা যায় এবং যা হল পরিবর্তনের মূল ভিত্তি। প্রাথমিক উপাদান হল রূপ-গুণ বর্জিত উপাদান। নিমিত্ত কারণ (Efficient Cause) প্রত্যক্ষভাবে প্রাথমিক উপাদানের ওপর ক্রিয়া করে না। এটি সর্বদাই কোন নির্দিষ্ট বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে, যে নির্দিষ্ট বস্তু হল আধারের বাস্তবায়িত রূপ। যেমন, ভাস্কর যখন মার্বেল পাথরকে একটি মূর্তিতে পরিণত করে তখন এ মার্বেল পাথরই হল উপাদান। যেমন, ভাস্কর যখন মার্বেল পাথরকে একটি মূর্তিতে পরিণত করে তখন এ মার্বেল পাথরই হল উপাদান। তিনি মার্বেল পাথরে যে পরিবর্তন সংঘটিত করেন সেই পরিবর্তনের আধার হল প্রাথমিক উপাদান, মার্বেল পাথর নয়।

উপাদান হল সকল কিছুর সভাবনা বা অব্যক্ততা : প্রাথমিক উপাদান হল আকারবিহীন। এটি হল সব বস্তুর মূল ভিত্তি। এর নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এটি অনির্দিষ্ট, এর কোন গুণ নেই। যা কিছু কোন কিছুতে নির্দিষ্টতা, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, গুণ আরোপ করে তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট বস্তুতে পরিণত করে, তা হল আকার। বস্তুর সঙ্গে বস্তুর গুণগত পার্থক্য এবং যেহেতু উপাদান গুণহীন, এর কোন পার্থক্য নেই। তাই দেখা যাচ্ছে যে, অ্যারিস্টটলের উপাদানের ধারণা আমাদের ভৌতিক দ্রব্যের ধারণা থেকে পৃথক। উপাদানে আকার আরোপিত হলে, উপাদান যে কোন কিছুতে পরিণত হতে পারে। তাই উপাদান হল সব কিছুর সম্ভাবনা, যদিও আসলে এটি কিছু নয়, তাই আকার লাভ করেই এটি কোন কিছু বলে পরিগণিত হয়। এখান থেকে একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে যে, প্রাথমিক উপাদান কখনও প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, সব সময়ই আকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অস্তিত্বশীল হয়। এ আকার হল তাই যা বস্তুকে বৈশিষ্ট্য দান করে। তাই উপাদান ও আকার হল অবিচ্ছেদ্য। বাস্তবে এদের বিচ্ছিন্ন করা চলে না। আমরা চিন্তাতেই এদের পৃথক করতে পারি।

আকার নিজে নিজে অস্তিত্বশীল হতে পারে না : তাই উপাদানকে আকার থেকে যৌক্তিকভাবেই (Logically) পৃথক করা যেতে পারে। তবে প্রাথমিক উপাদান হল জড় বস্তুর একটি বাস্তব উপাদান এবং জড় বস্তুর যে পরিবর্তন ঘটে তার প্রাথমিক ভিত্তি। সেই হিসেবে আকার থেকে তাকে পৃথকভাবে ভাবা যেতে পারে। প্রাথমিক উপাদান জড় জগতের সরলতম পদার্থ নয়। এটি কোন পদার্থ নয়, এটি পদার্থের, এমন কি সরলতম পদার্থের উপাদান। তাই আকার ছাড়া উপাদান এবং উপাদান ছাড়া আকার থাকতে পারে না। প্রতিটি অস্তিত্বশীল বস্তু, প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তু হল উপাদান এবং আকারের সমাবেশ। উপাদান এবং আকার কখনও পৃথকভাবে থাকতে পারে না। তাই কি উপাদান, কি আকার হল এক অমূর্ত বিষয়। এর কোন অস্তিত্ব নেই। আকার নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হতে পারে , প্লেটোর এ ভুলের সংশােধন করতে চেয়েছেন অ্যারিস্টটল। আকারই হল ধারণা এবং প্লেটো মনে করতেন যে, ধারণাগুলো তাদের নিজস্ব জগতে অস্তিত্বশীল।

আকার, উপাদান এবং অভাব : আগেই আমরা দেখেছি যে, পরিবর্তন হল সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ণ, অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। সম্ভাবনার কথা বললে বাস্তব একটা কোন কিছুকে স্বীকার করে নিতে হয়—যা, যা এটি হতে পারে, তা এখনও হয়নি। তাই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় রয়েছে। দুটি ভাবাত্মক বিষয় অর্থাৎ আকার ও উপাদান এবং তৃতীয় বিষয়টি হল—অভাব (Privation)। অভাব কোন ভাবাত্মক বিষয় নয়, তবু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিলে অভাবকে স্বীকার করে নিতে হয়।

বহুত্ব নির্ভর করে উপাদানের ওপর, আকারের ওপর নয় : মূর্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দ্রব্য (Concrete Sensible Substance) হল একটি বিশিষ্ট সত্তা যা উপাদান এবং আকারের দ্বারা গঠিত। এ সত্তার আকারগত দিক, যেটি তাকে একটি নির্দিষ্ট বিষয় করে তোলে, হয় এমন কিছু যা একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্যের মধ্যে এক। যেমন সক্রেটিস, এবং প্লেটোর মধ্যে মানুষের স্বরূপ ধর্ম (Essence) এক। তাই এ স্বরূপ ধর্মের জন্য মূর্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুবিশিষ্ট সূত্র হতে পারে না। উপাদানের জন্যই সক্রেটিস প্লেটোর থেকে পৃথক। তাই কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে একটি মাত্র শুদ্ধ আকার থাকতে পারে। বহুত্ব নির্ভর করে উপাদানের ওপর, আকারের ওপর নয়।

বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর সংজ্ঞা দেওয়া যায় না : অ্যারিস্টটলের মতে, উপাদানই হল বিশিষ্ট সত্তার বিশিষ্টতা নির্দেশক সূত্র এবং তা নিজে অজ্ঞেয় থেকে এ সিদ্ধান্ত নিঃসৃত হয় যে, বিশিষ্ট মূর্ত বস্তুকে পরিপূর্ণভাবে জানা যায় অ্যারিস্টটল বলছেন, যে, বিশিষ্টের (Individual) সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানের সম্পর্ক সংজ্ঞা নিয়ে, স্বরূপ- ধর্ম নিয়ে; তাই বিশিষ্ট ব্যক্তি যা বস্তু বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয় এবং একে পুরোপুরি জানা যায় না। তারা অপরোক্ষ অনুভূতি বা স্বজ্ঞার (Intuition) সাহায্যে জ্ঞেয়-এমন ইঙ্গিত অ্যারিস্টটল দিয়ে থাকলেও, বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে তিনি আলোচনা করেননি। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, স্বরূপধর্মের জ্ঞান যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশিষ্ট বস্তুর জ্ঞানের থেকে শ্রেষ্ঠ, এমন অভিমত ব্যক্ত করে অ্যারিস্টটল তার ওপর প্লেটোর প্রভাবকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।

অব্যক্ততা এবং ব্যক্ততা (Potentiality and Actuality)

অব্যক্ততার অর্থ : ‘মেটাফিজিক্স’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল অব্যক্ততা এবং ব্যক্ততা বা বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। গ্রীক দর্শনে মেগারিক সম্প্রদায় অব্যক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এ সম্প্রদায়ের মতে, যে বাস্তবে কোন কিছু তৈরি করছে না, সে তৈরি করতে পারে না। কিন্তু অ্যারিস্টটল অব্যক্ততাকে অস্বীকার করেননি। অ্যারিস্টটলের মতে অব্যক্ততা অভাব মাত্র নয়। একখণ্ড প্রস্তর বাস্তবে চিন্তা করছে না এবং তার চিন্তার কোন ক্ষমতাই নেই। কিন্তু কোন ব্যক্তি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকাকালীন চিন্তা করছে না সত্য, কিন্তু তাই বলে তার চিন্তা করার ক্ষমতা নেই—এমন কথা কি বলা যায়? অ্যারিস্টটলের মতে, অব্যক্ততা অলীক নয়, বাস্তব। একটা চারা গাছের মধ্যে তার পরিপূর্ণরূপ লাভ করার অর্থাৎ কিনা একটা মহীরূহে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এ অব্যক্ততা অন্য বস্তুতে পরিবর্তন সংঘটিত করার শক্তিও হতে পারে বা নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করার শক্তিও হতে পারে। একটা চারাগাছ যখন মহীরূহে পরিণত হয় তখনই সে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করে। অব্যক্ততা হল অস্তিত্বহীনতা এবং ব্যক্ততা বা বাস্তবতার মধ্যবর্তী। উপাদান এবং আকারকে ব্যক্ত এবং অব্যক্ত রূপে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। অব্যক্ততা উপাদানের সঙ্গে অভিন্ন, ব্যক্ততা আকারের সঙ্গে অভিন্ন; উপাদান হল নিছক অব্যক্ততা। কেননা উপাদানের সব কিছুতেই ব্যক্ত হবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু যা তাকে ব্যক্ত করে তা হল তার আকার। কালগত পারম্পর্যের দিক থেকে অর্থাৎ কালের দিক থেকে কোনটি আগে কোনটি পরে, প্রশ্ন তোলা হলে , বলতে হয়, অব্যক্ততা পূর্ববর্তী এবং ব্যক্ততা পরবর্তী, যেমন কে বৃক্ষের বীজ পূর্ববর্তী এবং ওক বৃক্ষ পরবর্তী , কিন্তু যৌক্তিক দিক থেকে (Logically) ব্যক্ত ওক বৃক্ষ বীজের পূর্ববর্তী। কেননা ওক বৃক্ষের বীজে ওক বৃক্ষ অব্যক্ত হয়ে না থাকলে, সেই বীজ থেকে ওক বৃক্ষ কি জন্মাতে পারে? অ্যারিস্টটলের মতে, ব্যক্ত অব্যক্তের পূর্ববর্তী। ব্যক্ত বা বাস্তব তা সব সময়ই অব্যক্ত থেকে উৎপন্ন হয়। কিন্তু বাস্তব বা ব্যক্তই সর্বদা অব্যক্ত বা সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করে, যেমন মানুষের দ্বারা মানুষের উৎপত্তি। এ অর্থে কালিক পারস্পর্যের দিক থেকে ব্যক্তকে অব্যক্তের পূর্ববর্তী বলা চলে। আবার ব্যক্ত যৌক্তিক দিক থেকেও অব্যক্তের পূর্ববর্তী। অবশ্য নীতির দিক থেকে এ কথা বলা হচ্ছে। ব্যক্ত হচ্ছে পরিণতি, যার জন্য অব্যক্ত অস্তিত্বশীল। একটি বালক মানুষে পরিণত হয়। কালের দিক থেকে বালক মানুষের পূর্ববর্তী কিন্তু যৌক্তিক দিক থেকে তার মানুষ হওয়ার অবস্থাটি তার বালক অবস্থার পূর্ববর্তী। কেননা মানুষ হবার জন্যই তার বালক অবস্থার অস্তিত্ব। অ্যারিস্টটল বলেন, যা নিত্য তা অনিত্যের পূর্ববর্তী এবং যা নিত্য ও অবিনশ্বর তা পরম অর্থে ব্যক্ত বা বাস্তব।

পারমিনাইডিসের মতবাদ খণ্ডন : ব্যক্ত এবং অব্যক্তের পার্থক্যের মধ্য দিয়েই অ্যারিস্টটল পারমিনাইডিসের পরিবর্তন সম্পর্কীয় মতবাদের উত্তর দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। পারমিনাইডিসের মতে, পরিবর্তন অসম্ভব। কেননা নিছক শূন্যতা থেকে কোন কিছুর উৎপত্তি যেহেতু সম্ভব নয়, তাই অসত্তা থেকে সত্তার উদ্ভব সম্ভব নয়। আবার সত্তা, সত্তা থেকে উৎপন্ন এ কথা বলা অর্থহীন, কেননা সত্তা তো-পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল। বাতাস থেকে আগুন হতে পারে না কেননা বাতাস বাতাস, আগুন নয়। অ্যারিস্টটল এর উত্তরে বলবেন যে, যে বাতাস বাতাস, তার থেকে আগুন উৎপন্ন হতে পারে না; যে বাতাস এখনও আগুন হয়নি সেই বাতাস থেকে আগুন উৎপন্ন হতে পারে, যে বাতাসের আগুন হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই বাতাসই আগুন হতে পারে। অর্থাৎ একটি বস্তু তার অভাব থেকেই উৎপন্ন হয়। যদি পারমিনাইডিস বলেন যে, তাহলে মেনে নেওয়া হচ্ছে যে, অসৎ থেকে সৎ-এর উৎপত্তি হচ্ছে, অ্যারিস্টটল বলবেন নিছক অভাব থেকে নয়, কোন বস্তুতে কোন কিছুর অভাব থেকেই সৎ-এর উৎপত্তি। পারমিনাইডিস হয়ত প্রতিবাদের সুরে বলে উঠতে পারেন যে, তাহলে এক্ষেত্রে একটি বস্তু সৎ থেকে সৎ-এ উত্তীর্ণ হচ্ছে, যা বিরোধিতা দোষে দুষ্ট। অ্যারিস্টটল তার উত্তরে বলবেন যে, এটি ঠিক সৎ থেকে সৎ-এ উত্তীর্ণ হওয়া নয়, এটি সেই সৎ থেকে উৎপন্ন হচ্ছে, যে সৎ আবার অসৎ, অর্থাৎ কিনা এটি যা হচ্ছে সেই বস্তু নয়। (not the thing which it comes to be)। তাই অ্যারিস্টটলের মতে, একে সৎ থেকে সৎ-এর উৎপত্তি বলা যেতে পারে না। আসলে তিনটি বিষয় স্বীকার করতে হবে—উপাদান , আকার এবং অভাব (privation) বা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে—ক্রিয়া, অব্যক্ততা এবং অভাব।

অব্যক্ত চরম অসত্তা নয় : অব্যক্ত এবং ব্যক্তের মধ্যে যে বৈপরীত্য রয়েছে তার মাধ্যমে এলিয়ার দার্শনিকদের উদ্ভাবিত ভবন (Becoming)-এর সমস্যাটির সমাধান করতে পেরেছেন বলে অ্যারিস্টটল দাবি করেন। ভবন বা অসৎ (Becoming) কিভাবে সম্ভব হয়? সত্তা থেকে সত্তার উদ্ভব, ভবন নয়। কেননা এক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন নেই। আবার অসত্তা থেকে সত্তায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়—এমন কথা কখনও বলা যে পারে না, কেননা নিছক শূন্য থেকে কোন কিছুর উদ্ভব হতে পারে না। অ্যারিস্টটলের মতে, অ-সত্তা এবং সত্তার পার্থক্যের কোন অস্তিত্ব নেই। তিনি এ দুটি নিরপেক্ষ পদের পরিবর্তে অব্যক্ত এবং ব্যক্ত পদ দুটি ব্যবহার করেছেন। অ্যারিস্টটলের দর্শনে অব্যক্ত-ই অ-সত্তার জায়গাটি দখল করেছে। এটি সমস্যার সমাধান করেছে কেননা, এটি চরম অ-সত্তা নয়। যেহেতু এটা কিছুই নয় তাই এটি অ-সত্তা, কিন্তু এটির মধ্যে সত্তার সম্ভাবনা বিদ্যমান। এটি হল অব্যক্ত সত্তা। তাই ভবন হল শূন্যতা থেকে কোন কিছুতে উপনীত হওয়া নয়। এটি হল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। সব পরিবর্তন, সব গতি অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া, উপাদানের আকারে উত্তীর্ণ হওয়া।

ঈশ্বর (God)

ঈশ্বর সর্বনিরপেক্ষ ব্যক্ত সত্তা : বিশ্বের যাবতীয় বস্তু যে বিশেষ ক্ৰমে বিন্যস্ত তার সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে ঈশ্বর। ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ আকার। যেহেতু আকার হল ব্যক্ততা, ঈশ্বরই সর্বনিরপেক্ষ ব্যক্ত সত্তা। ঈশ্বরই একমাত্র বাস্তব। অন্যান্য সব অস্তিত্বশীল বস্তু কম-বেশি অবাস্তব। ক্রমের যত উপরের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, ততই অধিকতর বাস্তবতা, কেননা আকারের অধিকতর মাত্রায় উপস্থিতি। তাই সত্তার ক্রম বাস্তবতারও ক্রম। সর্বনিরপেক্ষ বাস্তবতা অর্থাৎ ঈশ্বর এবং আকারহীন উপাদান বা আদিম উপাদান যা পুরোপুরি অবাস্তব, এ দুই-এর মাঝে অসীম ক্ৰমের (Infinite Gradations) অবস্থিতি।

ঈশ্বর হলেন পরম পূর্ণতা : দ্বিতীয়ত, যেহেতু আকার হল আকার, নিমিত্ত এবং পরিণতি কারণ (Final Cause) ঈশ্বর হলেন এ সকল কিছুই। আকারগত কারণ হিসেবে ঈশ্বর হলেন ধারণা (Idea)। ঈশ্বর হলেন বিশেষ করে চিন্তন, বুদ্ধি বা ধী-শক্তি। পরিণতি কারণ হিসেবে তিনি হলেন পরম লক্ষ। প্রতি সত্তারই নিজস্ব লক্ষ ব উদ্দেশ্য আছে, কিন্তু পরম উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যরূপে ঈশ্বর সব নিম্নতর লক্ষ্যকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন এবং যেহেতু প্রতিটি বস্তুর উদ্দেশ্য বা লক্ষ হল সেই বস্তুর সমগ্র পরিপূর্ণতা, তাই পরম লক্ষ হিসেবে ঈশ্বর হলেন পরম পূর্ণতা। সর্বশেষে নিমিত্ত কারণ হিসেবে ঈশ্বর সব গতি এবং ভবন (Becoming)-এর চরম অন্তিম কারণ। ঈশ্বর হলেন প্রথম প্রবর্তক। কিন্তু তিনি নিজে অপ্রবর্তিত থাকেন।

ঈশ্বর হলেন অপ্রবর্তিত প্রবর্তক : ঈশ্বর হলেন অপ্রবর্তিত প্রবর্তক (Unmoved Mover)। প্রথম প্রবর্তক যে অপ্রবর্তিত (Unmoval) থাকবেন, অ্যারিস্টটলের পরিণতি কারণ থেকে তা অনিবার্যভাবে নিসৃত হয়। গতি বলতে বোঝায় কোন বস্তুর তার লক্ষ্যের দিকে উত্তরণ। পরম লক্ষ্যের নিজ ছাড়া অন্য কোন লক্ষ থাকতে পারে না। তাই পরম লক্ষ্যের গতির কথা বলা যেতে পারে না। তা ছাড়া গতি বলতে বোঝায় উপাদানের আকারে উত্তরণ। সবনিরপেক্ষ বা অন্তিম আকারের কোন উচ্চতর আকারের দিকে অগ্রগতি লক্ষ করা যেতে পারে না। তাই সেই হিসেবে তা হবে গতিহীন।

আদি প্রবর্তক-এর অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি : অ্যারিস্টটল আদি প্রবর্তক যে গতিহীন বা অপ্রবর্তিত তা প্রমাণ করার জন্য যুক্তি উপস্থাপিত করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, প্রতিটি গতির গতিশীল হবার অবস্থার, প্রতিটি অব্যক্তের ব্যক্ত হবার অবস্থার, ব্যাখ্যার জন্য একটি ক্রিয়াশীল সূত্রের প্রয়োজন। এখন প্রতিটি পরিবর্তনকে, প্রতিটি গতিশীল বস্তুকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি একটি বাস্তব গতিশীল কারণকে স্বীকার করে নিতে হয়, তাহলে এ বিশ্বজগতেরও একটি আদি প্রবর্তকের (First Mover) প্রয়োজন আছে। অ্যারিস্টটলের যুক্তি হল, একটি গতিশীল বস্তু আর একটি গতিশীল বস্তুর দ্বারা গতি লাভ করে। এখন প্রথম গতিশীল বস্তুও অপর আর একটি গতিশীল বস্তুর দ্বারা গতিশীল হয়ে থাকে। এভাবে একটি গতির সাহায্যে এবং তাকে অপর একটি গতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে গেলে এ ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া শেষ হবে না, অনবস্থা দোষ দেখা দেবে; প্রথম গতির কারণটি অব্যাখ্যাত থেকে যাবে এবং তার কোন যথার্থ কারণও নির্দেশ করা যাবে না। তাই আদি কারণ বা আদি প্রবর্তককে অপ্রবর্তিত বা গতিহীন হতে হবে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার। অ্যারিস্টটল যখন ঈশ্বরকে আদি প্রবর্তক বলে অভিহিত করেছেন, তখন ‘আদি’ (First) কথাটিকে কালগত পারপর্যের দিক থেকে চিন্তা করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কালের শুরুতে আদি প্রবর্তক, বস্তুতে গতি আরোপ করেছিলেন—এভাবে চিন্তা করলে ভুল হবে। কেননা অ্যারিস্টটল তা মনে করেন না। অ্যারিস্টটলের মতে, ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ এবং যথার্থ নিমিত্ত কারণ হল পরিণতি কারণ (Final Cause)। ঈশ্বর পরিণতি কারণ হিসেবেই আদি প্রবর্তক। অ্যারিস্টটলের মতে, এ বিশ্বজগৎ এবং তার মধ্যে অবস্থিত গতি, কোনটিরই কোন আকার নেই। গতি নিত্য, কেননা গতিকে প্রবর্তিত করতে গেলে বা তাকে তিরোহিত করতে গেলে গতির প্রয়োজন হবে। তাই ‘আদি’ (First) শব্দটিকে প্রধান (Supreme) অর্থে গ্রহণ করতে হবে। আদি প্রবর্তক বা প্রথম প্রবর্তক হলেন নিত্য গতির নিত্য উৎস। মনে রাখতে হবে, আদি প্রবর্তক কোন স্রষ্টা-ঈশ্বর নন। কেননা জগৎ নিত্য, অনন্তকাল ধরে জগৎ অস্তিত্বশীল।

ঈশ্বর যান্ত্রিক কারণ নয়, পরিণতি কারণ : ঈশ্বর জগতের প্রথম কারণ বা আদি কারণ বলতে তিনি কোন যান্ত্রিক কারণ (Mechanical Cause) নন, যা জগতের সৃষ্টির পূর্বে অস্তিত্বশীল হয়ে জগতকে সৃষ্টি করেছে। ঈশ্বর হলেন উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতি কারণ (Teleological Cause), যিনি লক্ষ বা উদ্দেশ্যের দিক থেকে ক্রিয়া করছেন। সেই হিসেবে সব প্রারম্ভের বা শুরুর, তিনি যান্ত্রিক দিক থেকে (Logically) পূর্ববর্তী এবং আদি প্রবর্তক। কালের দিক থেকে কিন্তু জগতের কোন শুরু নেই, কোন শেষ নেই। বিশ্বজগতের পরিণতি হল চূড়ান্ত আকার (Absolute Form)। কিন্তু তাতে উপনীত হওয়া বিশ্বজগতের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, আকার উপাদান ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না। অ্যারিস্টটলের মতে, ঈশ্বর যদি গতি সংঘটিত করতেন তাহলে ঈশ্বর অপ্রবর্তিত না থেকে প্রবর্তিত বা গতিশীল হয়ে যেতেন। কেননা গতির কর্তার ওপর গতির প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। তাই পরিণতি কারণ হিসেবে ঈশ্বর তার দিকে জগতকে আকর্ষণ করবেন। ঈশ্বর হলেন পরিণতি কারণ বা লক্ষ যার দিকে জগতের গতি।

ঈশ্বর পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত : অ্যারিস্টটলের মতে, এ আদি প্রবর্তক বা ঈশ্বর হবেন পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত। তিনি অব্যক্ত হবেন না। তিনি যদি অব্যক্ত হন তবে তার আবার পরিবর্তন থাকবে এবং তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আবার এ প্রবর্তক যদি শুদ্ধ আকার না হয়ে উপাদানযুক্ত হয়, তবে তাও পরিবর্তিত হবে এবং সেই পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। ফলে অনবস্থা দোষ দেখা দেবে। সেই কারণে অ্যারিস্টটল এক আদি কারণ স্বীকার করেছেন যা নিত্য, পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত, শুদ্ধ আকার এবং আদি কারণ প্রবর্তক হয়েও অপ্রবর্তিত। এ আদি-প্রবর্তক পরিবর্তন ঘটান। কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকেন। এ আদি কারণই ঈশ্বর। এ আদি কারণই বিশ্বের পরিণতি কারণ। এ আদি কারণ পরিপূর্ণভাবে ব্যক্ত (Pure Act) হওয়াতে উপাদানহীন (Immaterial) হবে। কেননা উপাদানযুক্ত হলে পরিবর্তিত হবার এবং উপাদানের উপর অন্য ক্রিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল অপ্রবর্তিত প্রবর্তক এর কথা বলতে গিয়ে কখনও তাকে এক আবার কখনও বহু বলেছেন। আদি প্রবর্তক যদি উপাদানবিহীন হন তাহলে তিনি একের অধিক হতে পারেন না। কেননা, কোন কিছুর বিশিষ্ট (Individual) বা বহু হওয়ার মূলে হল উপাদানের অস্তিত্ব। তাই আদি প্রবর্তক এক, বহু নয়-এভাবে চিন্তা করলে কোন সমস্যার উদ্ভব ঘটে না। অ্যারিস্টটল হয়ত শেষ পর্যন্ত এক অপ্রবর্তিত প্রবর্তকের কথাই চিন্তা করেছেন।

আদি প্রবর্তক অধ্যাত্মিক : আদি প্রবর্তক উপাদানবিহীন হওয়ার জন্য কোন শারীরিক কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন না। তার কাজ হবে শুদ্ধ আধ্যাত্মিক কাজ এবং তাই বৌদ্ধিক। ঈশ্বরের কাজ হবে চিন্তন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কিসের চিন্তা, চিন্তার বিষয়বস্তু কি? সেই বিষয়বস্তু নিশ্চয়ই এমন কিছু নয়, যা পরিবর্তনের বা অভিনবত্বের সঙ্গে সংযুক্ত। ঈশ্বরের চিন্তা ঈশ্বর নিজেই। ঈশ্বর নিজেই চিন্তার কর্তা এবং চিন্তার বিষয়। এক অনন্ত আত্ম-সচেতনতারূপ ক্রিয়ার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে জানেন। ঈশ্বর হলেন আত্ম-সচেতনতা, সর্বনিরপেক্ষ বিষয়-বিষয়ী। ঈশ্বর যেহেতু পরম লক্ষ, তার লক্ষ্যের বাইরে কোন কিছু থাকতে পারে না। তাই ঈশ্বর নিজেকে ছাড়া অন্য কোন কিছুকে চিন্তা করতে পারেন না। সেইজন্যই অ্যারিস্টটল ঈশ্বরের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর হলেন ‘চিন্তার চিন্তা’ (Thought of Thought)। ঈশ্বরের চিন্তার বাইরে কোন চিন্তার বিষয় থাকতে পারে না, যদি থাকে তাহলে যে ঈশ্বর। পরম লক্ষ, তার বাইরে লক্ষ্যের অস্তিত্বের কথা ভাবতে হয়। কিন্তু তা যেহেতু সম্ভব নয়, ঈশ্বর তাই শুধু নিজেকে জানেন।

প্রশ্ন হল, অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর কি পুরুষ (Person)? : প্লেটোর মত অ্যারিস্টটল এ প্রশ্নের আলোচনা করেননি, এটি একটি আধুনিক প্রশ্ন। স্টেইস্, কপলস্টোন প্রমুখ দার্শনিকবৃন্দ এ প্রশ্নের আলোচনা করেছেন। কথা হল, এ প্রশ্ন উত্থাপিতই বা হচ্ছে কেন? স্টেইস্-এর বক্তব্য হল, অ্যারিস্টটল এ প্রসঙ্গে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেই ভাষাই এ প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ। প্রথমত, অ্যারিস্টটল পরম সত্তা শব্দটি ব্যবহার না করে ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আবার অ্যারিস্টটল যখন বলেছেন যে, ঈশ্বর অনন্ত প্রশান্তির মধ্যে বসবাস করেন এবং তার প্রশান্তি হল তার নিজের পূর্ণতার চিরস্থায়ী অনুধ্যান (everlasting contemplation of his own perfection). তখন এ উক্তির গভীরতর অর্থ মেনে নিতে গেলে ঈশ্বরকে চেতন পুরুষ রূপে স্বীকার করে নিতে হয়। প্রশ্ন হল, ‘পুরুষ’ বলতে কি বোঝাচ্ছে? স্টেইস–এর বক্তব্য হল, পুরুষ বলতে বোঝায় এক ব্যক্তি (Individual) যা অস্তিত্বশীল চেতনা; কিন্তু ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ আকার। আকার হল সার্বিক; যা সার্বিক এবং উপাদান-বর্জিত, তা ব্যক্তি হতে পারে না। সুতরাং ঈশ্বর ব্যক্তি হতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আকার উপাদান ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না, তাই ঈশ্বরকে অস্তিত্বশীল বলা চলে না, যদিও ঈশ্বর পরম ব্যক্ততা বা বাস্তবতা। তাই ঈশ্বর পুরুষ নন। স্টেইস্-এর বক্তব্য হল যে, অ্যারিস্টটল ঈশ্বর প্রসঙ্গে আলঙ্কারিক ভাষা ব্যবহার করলেও, ঈশ্বরকে পুরুষ রূপে গণ্য করা তাঁর অভিপ্রেত নয়। ঈশ্বর চিন্তন, কোন বিশেষ মনের চিন্তন নয়। ঈশ্বর হলেন বস্তুগত চিন্তন, প্লেটোর ধারণার মত তার নিজস্ব বাস্তবতা আছে, কেউ তাকে চিন্তা করল বা করল না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্লেটো মনে করেছিলেন যে, চিন্তন যেহেতু বাস্তব এবং বস্তুগত, এর অস্তিত্ব মেনে নিতে হবেই। অ্যারিস্টটল এ ভ্রম পরিহার করার চেষ্টা করেছেন। পরম চিন্তন সর্বনিরপেক্ষভাবে বাস্তব, কিন্তু এ অস্তিত্বশীল নয়। কপলস্টোনের বক্তব্য হল, পুরুষ বলতে যদি ঈশ্বরকে মানবিক গুণসম্পন্ন সত্তা মনে করতে হয় তাহলে অ্যারিস্টটল আদি প্রবর্তককে পুরুষ বলতে চাননি কিন্তু যেহেতু আদি প্রবর্তক বুদ্ধি বা চিন্তন তাই তিনি দার্শনিক অর্থে পুরুষ। আদি প্রবর্তক উপাসনার বিষয়বস্তু এমনভাবে অ্যারিস্টটল কখনও চিন্তা করেননি। কেননা অ্যারিস্টটল তাঁর রচনার এক জায়গায় বলেছেন যে (Magna Moralia), যারা মনে করেন ঈশ্বরের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়, তারা ভ্রান্ত ধারণা করেন, কেননা ঈশ্বর আমাদের ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারে না এবং আমরাও ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারি না।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অন্যান্য যুক্তি : ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে আরও কিছু কিছু যুক্তি অ্যারিস্টটলের রচনায় দেখা যায়। একটা যুক্তি হল পৃথিবী, পর্বত, আকাশ এগুলোর যে সৌন্দর্য ও মহিমা আছে তার হেতু কি? সাধারণ মানুষ এর হেতু হতে পারে না। তাই এগুলো ঈশ্বরের সৃষ্টি। এ হল পরিণাম বা উদ্দেশ্য সম্পর্কীয় যত (Teleological Argument)-র অস্পষ্ট আভাস। অপর একটি যুক্তি হল, যদি ভাল বলে কিছু থাকে, আরও ভাল বা সবচেয়ে ভাল-র অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। সেক্ষেত্রে কার্যকারণ তত্ত্বের প্রবর্তন করে সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, সব সীমিত পূর্ণতা এক সর্বনিরপেক্ষ পূর্ণতা থেকে উদ্ভূত যা সব সীমিত পূর্ণতার উৎস। অবশ, অ্যারিস্টটল এ জাতীয় যুক্তির অবতারণা করেছেন তাঁর প্রথম দিকের রচনাতে, যখন তিনি প্লেটোর প্রভাবের অধীন। তার পরবর্তীকালের রচনাতে অর্থাৎ ‘মেটাফিজিকস গ্রন্থে তিনি এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপিত করেননি।

সমালোচনা : পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, ঈশ্বর সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা মােটেও সন্তোষজনক নয়। প্লেটোর ঈশ্বর সম্পর্কে যে ধারণা তার তুলনায় অ্যারিস্টটলের ধারণা সুস্পষ্ট। কিন্তু জগতের ওপর ঐশ্বরিক ক্রিয়ার যে বর্ণনা প্লেটোর গ্রন্থে দেখা যায় এবং বিচারবুদ্ধিসম্মত ঈশ্বরতত্ত্বে যে বিষয়ের আলোচনার প্রয়োজন, অ্যারিস্টটলের রচনায় সেই আলোচনার অভাব। অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর নিমিত্ত কারণ যেহেতু ঈশ্বর পরিণতি কারণ। অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর জগতকে জানে না এবং ঈশ্বরের কোন পরিকল্পনা এ জগতে সিদ্ধ হয় না। তাই প্রকৃতির মধ্যে যে উদ্দেশ্য তা হল সচেতন উদ্দেশ্য। কেননা অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিক্স’ গ্রন্থে প্রদত্ত ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনা থেকে আমাদের এ জাতীয় ধারণা হয়। এ দিক থেকে বিচার করলে অ্যারিস্টটলের আধিবিদ্যক আলোচনা প্লেটোর আলোচনার তুলনায় নিকৃষ্ট। অপরপক্ষে, অ্যারিস্টটলের কিছু কিছু মতবাদের উৎস প্লেটোর মতবাদ হলেও, অ্যারিস্টটল তার অন্তঃস্যুত উদ্দেশ্যবাদের সাহায্যে দেখাতে পেরেছেন যে, সব মূর্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর গতি হল। তাদের অব্যক্ত ক্ষমতার পরিপূর্ণ উপলদ্ধির দিকে। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্লেটোর তুলনায় তাকে তিনি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং পরিবর্তন ও জ্ঞানের যথার্থ অর্থ এবং উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছিলেন, যদিও প্লেটোর চিন্তার বহু মূল্যবান বিষয় তিনি বর্জন করেছিলেন।

আত্মা (Soul)

অ্যারিস্টটল ‘De Anima’ এবং ‘On The Soul’ গ্রন্থে আত্মার স্বরূপ এবং দেহের সঙ্গে আত্মার সম্বন্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

আত্মা দেহের সংগঠনী শক্তি : অ্যারিস্টটলের মতে, দেহ আত্মা হতে পারে না, কারণ দেহ প্রাণ নয়। অ্যারিস্টটল , প্লেটোর মত, দেহ ও আত্মার দ্বৈত স্বীকার করেননি। তা ছাড়া, তিনি দেহ ও আত্মাকে দুটি পৃথক দ্রব্য রূপে স্বীকার করেননি। তিনি আত্মাকে দেহের ‘Entelechy’ বা দেহের সংগঠনী শক্তি রূপে অভিহিত করেছেন। দেহ ও আত্মা মিলে এক দ্রব্য। ‘On the Soul’ গ্রন্থে তিনি আত্মাকে দেহের সঙ্গে যুক্ত বলে গণ্য করেছেন। পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের জন্মান্তরবাদকে তিনি উপহাস করেছেন। তিনি মনে করতেন, দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মার বিকতিক তাই যদি হয় তাহলে আত্মা দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য। তাঁর মতে, দেহ ও আত্মার বিনাশ ঘটে। তাই যদি হয় তাহলে আত্মা দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য। তাঁর মতে, দেহ ও আত্মার সম্পর্ক হল উপাদানের সঙ্গে আকারের সম্পর্ক।

আত্মা দেহের পরিণতি কারণ : দেহ হল আত্মার উপাদান আর আত্মা হল দেহের আকার। জড়দেহের আকার হিসেবে আত্মা অবশ্যই একটি দ্রব্য, যে জড়দেহের মধ্যে প্রাণ অব্যক্তভাবে বিদ্যমান। কিন্তু দ্রব্য হল বাস্তব এবং আত্মা হল, যেভাবে দেহের বৈশিষ্ট্যের কথা উপরে বলা হল, সেই অর্থে দেহের বাস্তবতা বা ব্যক্ততা। যে দেহ প্রাণযুক্ত তার স্বরূপধর্ম (Essence) হিসেবে আত্মা দ্রব্য। দেহ ও আত্মা অভিন্ন কিনা, এ প্রশ্ন তেমনই অবান্তর যেমন মােম এবং মােমের ওপর যে ছাপ অঙ্কিত করা হয়েছে, এ দুটি পৃথক কিনা, এ প্রশ্ন যেমন অবান্তর। আত্মা দেহের পরিণতি কারণ (Final Cause)। গতির উৎস হিসেবে, পরিণতি কারণ হিসেবে এবং প্রাণসমন্বিত বাস্তব দ্রব্য (অর্থাৎ আকারগত কারণ) হিসেবে আত্মা প্রাণ সমন্বিত দেহের কারণ এবং সূত্র।

মন ও আত্মার পার্থক্য : অ্যারিস্টটল আত্মা ও মনের মধ্যে পার্থক্য করেছেন (On the Soul)। তিনি মনে করেন, মন আত্মা থেকে উচ্চস্তরের এবং দেহের সঙ্গে তার সংযোগ অপেক্ষাকৃত কম। মন একটা স্বাধীন দ্রব্য যা আত্মার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট এবং যা অবিনশ্বর। আত্মার বিভিন্ন অংশ আত্মা থেকে স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না। মনই কেবলমাত্র আত্মার অন্যান্য শক্তি থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে। মন আমাদের সেই অংশ যা গণিত এবং দর্শন অনুধাবন করতে পারে। মনের বিষয় হল কালাতীত, তাই মনকেও কালাতীত গণ্য করা হয়। আত্মা হল তাই যা দেহকে চালিত করে। আত্মা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু প্রত্যক্ষ করে। মনের কাজ হল চিন্তন। মনের সঙ্গে দেহ বা ইন্দ্রিয়ের কোন সম্পর্ক নেই। তাই মন অবিনশ্বর হতে পারে যদিও আত্মার অবশিষ্ট অংশগুলো তা হতে পারে না। অ্যারিস্টটলের মতে, যা কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীতে দ্রব্যত্ব আরোপ করে তাই হল আত্মা। কিন্তু মন হল অন্য কিছু। মন দেহের সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সম্ভবত এটি আত্মার অংশ কিন্তু অল্পসংখ্যক জীবিত সত্তাই এর অধিকারী।

আত্মার দুটি দিক—বৌদ্ধিক এবং অ-বৌদ্ধিক : অ্যারিস্টটল অন্য একটি গ্রন্থে (Nicomachean Ethics) আত্মার দুটি দিকের কথা বলেছেন বৌদ্ধিক (Rational) এবং অ-বৌদ্ধিক (Irrational)। অ-বৌদ্ধিক দিকের দুটি অংশ বর্ধনমূলক (Vegetative) যা প্রতিটি জীবিত প্রাণীতে, এমনকি উদ্ভিদে বর্তমান এবং ক্ষুধামূলক (Appetitive) যা সব প্রাণীতে উপস্থিত। বৌদ্ধিক আত্মা দুই ভাবে সক্রিয়—এর বৈজ্ঞানিক চিন্তনের ক্ষমতা আছে এবং সুপরিকল্পিত চিন্তনের ক্ষমতা আছে। প্রথমটির উদ্দেশ্য হল সত্যতাকে সত্যতার জন্য লাভ করা। দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল সত্যতাকে সত্যতার জন্য নয়, ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য লাভ করা। অ্যারিস্টটলের মতে, আত্মার সব ক্রিয়াই দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য এবং নশ্বর, কিন্তু বৌদ্ধিক আত্মা দেহের পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল এবং অবিনশ্বর। বৌদ্ধিক আত্মায় জীবন হল চিন্তনের জীবন, যা হল মানুষের পরিপুর্ণ সুখ, যাকে সম্পূর্ণভাবে লাভ করা যায় না। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যে পার্থক্য সেই পার্থক্য হল ব্যক্তির দেহ এবং অ-বৌদ্ধিক আত্মার জন্য। বৌদ্ধিক আত্মা হল ঐশ্বরিক এবং নৈব্যক্তিক। রাসেলের মন্তব্য – কামনা-বাসনার দিক থেকে মানুষ পৃথক। কিন্তু শুদ্ধভাবে যখন মানুষ চিন্তা করে, তখন শুধু চিন্তনের দিক থেকে মানুষ এক। ব্যক্তির অ-বৌদ্ধিক আত্মা তাকে অন্য ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র করে। বৌদ্ধিক আত্মা তাকে অন্য মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে। তাই মন বা বিচারবুদ্ধির অবিনশ্বরতা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত অবিনশ্বরতা নয়; এ হল ঈশ্বরের অবিনশ্বরতার অংশগ্রহণ। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “প্লেটো এবং পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্ম যে ব্যক্তিগত অমরত্বের শিক্ষা দিয়েছেন সেই অর্থে অ্যারিস্টটল ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। তিনি শুধুমাত্র বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ যতটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন, ততটা সে ঐশ্বরিক ভাবের অধিকারী, যা অমর। নিজ প্রকৃতিতে ঐশ্বরিক উপাদানের অধিকতর বিকাশ সাধন করার সুযোগ মানুষের রয়েছে এবং সেটা সম্পাদন করাই হল শ্রেষ্ঠ সততা।” (B. Russel; A History of Western Philosophy; Page 172)

অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যা বা প্রাকৃতিক দর্শন

ভূমিকা

বর্তমানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অ্যারিস্টটলের সময়ে ছিল প্রাকৃতিক দর্শন ও গ্রীকরা যাকে ‘Phusis বা Physics বলতেন অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যা হল তারই বিজ্ঞান। ‘Phusis’ শব্দটির অর্থ হল ‘প্রকৃতি’ (Nature)। প্রকৃতি’ শব্দটির সাধারণত যে অর্থ আমরা করে থাকি অ্যারিস্টটল Nature বা প্রকৃতির সে-অর্থ করেননি। আমরা এখনও ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’ বা ‘প্রাকৃতিক ইতিহাস’-এর কথা বলে থাকি। কিন্তু প্রকৃতি শব্দটি, যদিও একটি দুর্বোধ্য শব্দ Phusis বলতে যা বোঝায়, তাকে বোঝায় না। আজকাল যাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয় অ্যারিস্টটলের সময়ে তা দর্শনের অন্তর্গত ছিল এবং তাকে বলা হতো প্রাকৃতিক দর্শন (Natural Philosophy)। আধুনিককালের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং সে যুগের প্রাকৃতিক দর্শন নিয়ে অ্যারিস্টটল আলোচনা করেছেন।

বার্ট্রান্ড রাসেলের মন্তব্য – এক হিসেবে বলা যেতে পারে যে, পাশ্চাত্য দেশে প্রাণীবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোচনা যারা করেছেন, তাদের মধ্যে অ্যারিস্টটলের একটা বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনিই এ আলোচনার পথিকৃৎ। অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা পদার্থবিদ্যা সম্পকে আলোচনার জন্য অ্যারিস্টটলের দুইখানি গ্রন্থ ‘Physics’ এবং On The Heavens’ অনুসরণ করা দরকার। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, “আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যারিস্টটল প্রণীত গ্রন্থ দুটির অনেক আলোচনাই গ্রহণযোগ্য মনে না হতে পারে, তম দর্শনের ইতিহাস রচয়িতাদের গ্রন্থ দুই খানি পাঠ করে দেখা দরকার।”

প্রাকৃতিক দর্শনের আলোচ্য বিষয়

অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যা বা প্রাকৃতিক দর্শনের আলোচ্য বিষয়টি কি? জেলার (Zeller) বলেন, “প্রথম দর্শন (First philosophy) আলোচনা করে যা গতিহীন এবং অ-ভৌতিক, তাকে নিয়ে ; পদার্থবিদ্যার আলোচনা হল যা গতিশীল এবং ভৌতিক তাকে নিয়ে; সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে তাকে নিয়ে, যার গতির কারণ তার নিজের মধ্যেই নিহিত।” গতি এবং স্থিরতা যার মৌলিক গুণ, তারই গতি ও স্থিরতার কারণ হল ‘প্রকৃতি’ (“Nature’ is the cause of motion and rest in that in which motion and rest are original qualities.” -Physics;11. 1926, 20.)। স্টেইস (Stace)-ও অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যা বা প্রাকৃতিক দর্শনের উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, এ অস্তিত্বশীল বিশ্বজগৎ, আকারবিহীন উপাদান এবং উপাদানবিহীন আকার, এ দুই চরমসীমার মধ্যে অবস্থিত সত্তার একটি ক্রম বা মাত্রা (a scale of being)। অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শনের উদ্দেশ্য হল প্রকৃতি জগতে বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে উপাদান (Matter)-এর আকারে (Form) উত্তরণ। (Passage)-এর বিষয়টি দেখান।

বার্ট্রান্ড রাসেলের মন্তব্য – বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত বুঝে নিতে হলে, সেই অভিমতের পেছনে তার যে কল্পনা ক্রিয়া করেছে, তাকে বুঝে নেওয়া দরকার। তিনি বলেন যে, একটা শিশু জীবন্ত প্রাণীদের অন্য বস্তু থেকে যে বিষয়টির ভিত্তিতে পৃথক করে, তা হল জীবন্ত প্রাণীরা নিজে নিজেই গতিশীল। অনেক গ্রীক চিন্তাবিদ, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের কাছে এ বিশেষত্বই পদার্থবিদ্যার একটি সাধারণ মতবাদের ভিত্তি যুগিয়ে দিয়েছে।

স্টেইস্ বলেন যে, অ্যারিস্টটলের প্রকৃতিকে বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটি সাধারণ বিষয়কে স্মরণে রাখতে হবে। উদ্দেশ্য বা লক্ষ আকারের অন্তর্ভুক্ত। তাই সমগ্ৰ জগৎ প্রক্রিয়া, উপাদান থেকে আকারে উত্তরণের প্রক্রিয়া রূপে উদ্দেশ্যের বা লক্ষের অভিমুখে গতিশীল। প্রকৃতির সর্বত্রই উদ্দেশ্য বা লক্ষ, বিচারবুদ্ধিভিত্তিক পরিকল্পনা দৃষ্ট হয়। যা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ তা যদি সম্ভাব্য হয়, প্রকৃতি তাকে লাভ করতে চায়। অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শন হল পরিণতি বা উদ্দেশ্যমূলক (Teleological), অবশ্য অ্যারিস্টটলের প্রাকৃতিক দর্শন যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক বর্জন করে না। তবে যান্ত্রিক কারণ শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক কারণে রূপান্তরিত হয়, কারণ প্রকৃত নিমিত্ত কারণ হল পরিণতি কারণ (Final Case)। তবে অ্যারিস্টটল এ কথা বোঝাতে চাইছেন না যে, প্রকৃতিতে সব কিছুরই অস্তিত্ব মানুষের প্রয়োজনের জন্য, যদিও অ্যারিস্টটল মনে করেন প্রকৃতির মূল লক্ষ মনুষ্য সৃষ্টি। তবে মনুষ্যেতর প্রাণীরও নিজ নিজ লক্ষ আছে। তারা মানুষের জন্য নয়, তারা তাদের নিজেদের জন্যই অস্তিত্বশীল।

জগৎ-বহির্ভূত কোন অস্তিত্বশীল চেতনা নেই

প্রকৃতির মধ্যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ বর্তমান থাকলেও, প্রকৃতি তার উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন অথবা জগৎবহির্ভূত কোন অস্তিত্বশীল চেতনা জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এমন সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত হবে না। এর কারণ হল, ঈশ্বর কোন অস্তিত্বশীল চেতন ব্যক্তি নন আর প্রকৃতির পক্ষে নিজ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া সম্ভব নয়। এ পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই হল একমাত্র সত্তা যে তার লক্ষ সম্পর্কে সচেতন। মনুষ্যেতর প্রাণী বুদ্ধিসম্মতভাবে ক্রিয়া করলেও আসলে তারা সহজাত প্রবৃত্তিবশতই তাদের লক্ষ্যকে লাভ করে। অজীব জড় এর অনেক গতিই উদ্দেশ্যমূলক, কিন্তু কোনমতেই সেগুলোকে সচেতন ক্রিয়া বলা যেতে পারে না। আসল কথা, প্রকৃতি বুদ্ধিসম্মত ক্রিয়া সম্পাদন করলেও সেই ক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন নয়। উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ হয়ে এবং সহজাতভাবেই প্রকৃতি ক্রিয়া করে চলে।

আকারের জড়কে গঠন করার প্রচেষ্টা : প্রকৃতির এ প্রক্রিয়ায় সব সময় আকার (Form) সম্মুখে চালিত করে। উপাদান বিলম্বিত করায় বাধা প্রদান করে। সমগ্র জগৎ প্রক্রিয়া হল আকারের উপাদানকে গঠন করার প্রচেষ্টা। কিন্তু উপাদানের মধ্যেই যেহেতু প্রতিরোধের ক্ষমতা নিহিত, জগৎ প্রক্রিয়ার কাজে বাধা দেখা দেয়। এ কারণেই অ্যারিস্টটলের মতে, আকার উপাদান থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে না, কারণ উপাদানের ক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করে যাওয়া আকারের পক্ষে সম্ভব হয়।

এবং সেই কারণে উপাদানও সম্পূর্ণভাবে কখনও আকারে রূপ লাভ করে না। বিশ্বজগতে অস্বাভাবিক ঘটনা সেই কারণেই ঘটে। তাই স্বাভাবিক, যা তার নিজ উদ্দেশ্যকে লাভ করে। তাই স্বাভাবিক (Natural), যেখানে আকার উপাদানের ওপরে। কর্তৃত্ব করে।

প্রকৃতি, গতি, দেশ, কাল

প্রকৃতি : যে সব বস্তু জড়াত্মক (Material) এবং গতির অধীন সেই সব বস্তুর সমগ্রতাই (Totality) হল প্রকৃতি। অ্যারিস্টটল তার ‘Physics’ গ্রন্থে প্রকৃতির কোন সংজ্ঞার্থ বা লক্ষণ নির্দেশ করেননি। তবে তাঁর রচনা পাঠ করলে মনে হবে প্রকৃতি বলতে তিনি তাই বুঝেছেন। প্রকৃতি বলতে অ্যারিস্টটল মনে করেন সেই সব বস্তু যারা পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে এবং তাদের একটা লক্ষে উপনীত করতে পারে। তার অর্থ হল, প্রকৃতি বলতে সেই সব বস্তু বুঝতে হবে যাদের মধ্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিহিত। একটা শয্যা নিজে নিজে গতিশীল হতে পারে না। শয্যা-বহির্ভূত কোন বাহ্য-কৰ্তাই তাকে গতিশীল করে। অর্থাৎ প্রাণহীন জড়বস্তুকে গতিশীল করার পিছনে থাকে সেই বস্তু বহির্ভূত কোন বাহ্য কর্তার ক্রিয়া। অ্যারিস্টটল বিষয়টাকে বোঝাবার জন্য তাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন। অজীব বস্তুর মধ্যে গতিশীল হবার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু। গতি সংগঠিত করার সম্ভাবনা নেই।

গতি : পদার্থবিদ্যা সম্পর্কীয় কোন আলোচনাই গতি, দেশ এবং কাল প্রভৃতি মৌলিক ধারণাগুলোর আলোচনাকে উপেক্ষা করতে পারে না, সেই কারণে অ্যারিস্টটল এগুলোর আলোচনা করেছেন। সাধারণভাবে গতি হল প্রতিটি পরিবর্তন, যে কোন সম্ভাব্য পরিবর্তনের বাস্তব রূপায়ন বা অব্যক্ত শক্তির ব্যক্ত হওয়া। গতি হল উপাদানের আকারে উত্তরণ (Passage of Matter into Form)। গতি চার প্রকার – (১) দ্রব্যগত (Substantial)-এ গতি কোন বস্তুর দ্রব্যকে প্রভাবিত করে, এ হল উৎপত্তি এবং তিরোভাব। (২) পরিমাণগত—দ্রব্যের বৃদ্ধি এবং হাস; (৩) গুণগত—একটি দ্রব্যের অন্য দ্রব্যতে রূপান্তর এবং (৪) স্থানীয় গতি (Locomotion) অর্থাৎ স্থান পরিবর্তন। প্রথম ধরনের গতিকে তিনি ব্যাপক অর্থে গতি বলেছেন এবং শেষের তিন ধরনের গতিকে তিনি সংকীর্ণ অর্থে গতি বলেছেন। অন্য সব ধরনের গতি স্থানীয় গতির দ্বারাই নির্ধারিত হয়।

দেশের প্রকৃতি : সব ধরনের গতির জন্যই দেশ (Space) এবং কালকে (Time) পূর্ব থেকে স্বীকার করে নিতে হয়। দুটি বিষয় দেশের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, প্রথমত, স্থানান্তরকরণ; দেশ আছে। বলেই বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ-এর নিজ নিজ স্থানে অবস্থিতি। দেশ না থাকলে এ চারটি ভূতের অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। দেশ হচ্ছে শূন্যতা (Void)-অ্যারিস্টটল দেশের এ সংজ্ঞা অস্বীকার করেন। কারণ শূন্য দেশ সম্ভব নয়। একই কারণে তিনি প্লেটো এবং পিথাগোরাসএর অভিমত মেনে নিতে রাজি নন যে ভূত, জ্যামিতিক ক্ষেত্রের দ্বারা গঠিত। যন্ত্রবাদীদের প্রকল্প,-সব গুণের ভিত্তি হল পরিমাণ, অ্যারিস্টটল মেনে নিতে পারেননি। গুণের নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। 

দেশ কোন ভৌতিক বস্তু নয়। যদি তাই হত তাহলে একই সময়ে একই স্থানে দুটি বস্তুর অর্থাৎ বস্তু ও দেশ, যেটি অপর একটি বস্তু, প্রত্যক্ষিত হতো। তাই দেশকে সীমা (Limit) ছাড়া অন্য কোনভাবে ধারণা করা যায় না। তাই অ্যারিস্টটল দেশের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছেন যে, দেশ হল একটি বস্তুর সীমা অর্থাৎ যে সীমার দ্বারা একটি বস্তু সীমিত হয়ে থাকে (as the limit of the surrounding body towards what is surrounded)। অ্যারিস্টটল দেশকে অসীম বলে গণ্য করেননি।

বিশ্বজগতের বাইরে কোন দেশ নেই : দেশের এ সংজ্ঞা স্বীকার করলে কোন শূন্য দেশের বা বিশ্বজগতের বাইরে কোন দেশের কথা বলা যেতে পারে না, কারণ দেশ হল দেশে যে বস্তু রয়েছে তার সীমা। অ্যারিস্টটল একটা বস্তুর আধার (Container) এবং দেশ এর মধ্যে প্রভেদ করেছেন। একটা স্রোতস্বিনীর ওপর দিয়ে নৌকা চলেছে। এক্ষেত্রে গতিশীল স্রোতস্বিনী হল আধার। নৌকাটি হল সেই আধারে অবস্থিত বস্তু, স্রোতস্বিনীকে দেশ বলে গণ্য করলে ভূল হবে। সমগ্র নদী, যেটি স্থির, সেটিই হল দেশ, যাতে নৌকা রয়েছে। তাই দেশ হল যেটি আধার তার অগতিশীল সীমা (unmoved limit of the container)। তাই বিশ্বজগতের সব কিছু দেশে রয়েছে। কিন্তু বিশ্বজগতে কোন দেশ নেই। সুতরাং গতি যেহেতু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া বোঝায় এবং তা যেহেতু দেশেই সম্ভব তাই বিশ্বের সম্মুখ গতির কথা বলা চলে না। বিশ্বজগতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন গতির কথা বলা যেতে পারে কিন্তু বিশ্বের বহির্গতির কথা বলা চলে না।

কাল-এর স্বরুপ : কালের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, কোন্‌টা আগে, কোটা পরে, সে সম্পর্কে। গতির পরিমাপ হল কাল’ (“The number of motion in respect of before and after.”)। তাই কাল তার অস্তিত্বের জন্য গতির ওপর নির্ভর। এ বিশ্বজগতে কোন পরিবর্তন না ঘটলে, কালের কথা বলা যেত না। যেহেতু কাল হল গতির গণনা বা পরিমাপ, কাল গণনা মনের ওপর নির্ভর। গণনা করার জন্য কোন মনের অস্তিত্ব না থাকলে, কালের গণনার কথা বলা যেতে পারত না। কোন মনের অস্তিত্ব যখন ছিল না, তখন কালের অস্তিত্ব কিভাবে থাকতে পারে?—এ প্রশ্ন অ্যারিস্টটলের মনে দেখা দেয়নি, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অনন্তকাল ধরে মানুষ ও প্রাণী অস্তিত্বশীল। কিন্তু কাল মনের ওপর নির্ভর না করেও অস্তিত্বশীল। কালের বিভিন্ন অংশগুলোর পরিমাপ মনের দ্বারাই হয়ে থাকে, কিন্তু তা বলে মনবহির্ভূত কোন অস্তিত্ব তাদের নেই, এমন কথা বলা যেতে পারে না। অ্যারিস্টটলের কাল সম্পর্কিত ধারণা কান্টের অভিমত থেকে স্বতন্ত্র। 

যা নিত্য তা কালে থাকে না : কাল গতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে অভিন্ন নয়, কারণ গতি অনেক প্রকার। কিন্তু কাল এক। কাল গতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। কাল গতির মত অবিচ্ছিন্ন। কাল বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের দ্বারা গঠিত নয়। যেসব বস্তু গতিশীল বা যাদের মধ্যে গতির সম্ভাবনা রয়েছে তারাই কালে থাকে। যা নিত্য এবং গতির সম্ভাবনা যাতে নেই তা কালে থাকে না। গতি নিত্য কিন্তু স্থির না হওয়ার জন্য কালে থাকে। কালও নিত্য কারণ কালের শুরু বা শেষ নেই।

কাল পরিমাপের মানদণ্ড : কাল পরিমাপ করতে হলে, আমাদের কাল পরিমাপের একটা মানদণ্ডের (Standard) প্রয়োজন। অ্যারিস্টটলের মতে, যে গতি স্বাভাবিক এবং একরূপ তাই কাল পরিমাপের মানদণ্ড গণ্য হতে পারে। অ্যারিস্টটলের মতে, স্থান সম্পর্কীয় গতি (Spatial Motion) এবং স্থান সম্পর্কীয় গতির মধ্যে বিশেষ করে বৃত্তাকার গতি (Circular Motion) হল স্বাভাবিক ও একরূপ গতি যার প্রারম্ভ বা শেষ নেই। তাই কাল পরিমাপের মানদণ্ড হতে পারে সূর্যের গতির ভিত্তিতে কাল পরিমাপই কাল পরিমাপের যথাযথ ভিত্তি।

অসীমের প্রকৃতি 

অসীমের সম্ভাবনার প্রশ্নটি অ্যারিস্টটল আলোচনা করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, অসীম বস্তু সম্ভব নয়, কেননা প্রতিটি বস্তুই সীমিত। কোন বস্তুর অবস্থানের কথা ভাবতে গেলে ‘উপর নিচ’ এ জাতীয় অবস্থানের কথা চিন্তা করতে হয়। কোন অসীম বস্তর ক্ষেত্রে এ জাতীয় অবস্থানের কথা ভাবা যেতে পারে না। তার মতে, কোন অসীম সংখ্যারও অস্তিত্ব নেই। কেননা সংখ্যা গণনা করা যায় এবং অসীম সংখ্যা গণনা করা যায় না।

অব্যক্ত রূপে অসীম অস্তিত্বশীল : অ্যারিস্টটল যদিও বাস্তবে অস্তিত্বশীল কোন অসীম বস্তু বা সংখ্যার কথা স্বীকার করেননি, তিনি অন্য অর্থে ‘অসীম’কে স্বীকার করেছেন। অব্যক্তরূপে বা সম্ভাবনা রূপে অসীম অস্তিত্বশীল (infinite exists potentially), বাস্তবে নয়। অর্থাৎ দৈশিক বিস্তৃতি বাস্তবে অসীম নয়, তবে অসীম ভাগে বিভাজ্য। একটি সরলরেখা বাস্তবে অস্তিত্বশীল অসীম সংখ্যক বিন্দুর একত্র সমাবেশ নয়, কিন্তু অসীম ভাগে বিভাজ্য হওয়ার সম্ভাবনা তার মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ অসীম ভাগে বিভাজ্য হবার অবস্থাটি তার মধ্যে অব্যক্তভাবে বর্তমান। এলিয়ার দার্শনিক জেনো (Zeno) দেশ-কালের অসীম বিভাজ্যতাকে কেন্দ্র করে যে হেঁয়ালির সৃষ্টি করেছিলেন অ্যারিস্টটল এ ভাবেই তার সমাধান করার জন্য চেষ্টা করেছেন।

অ্যারিস্টটলের মতে, কালও বাস্তবে অস্তিত্বশীল অসীম নয়। কিন্তু অসীমতা কালের মধ্যে অব্যক্ত। কাল আনুক্রমিক আধার, এর অংশগুলো কখনও একসঙ্গে অবস্থান করে না। কিন্তু কাল অব্যক্তভাবে অসীম (Potentially Infinite), কারণ অনন্তকাল ধরে কালের সঙ্গে কাল যোগ করা যেতে পারে। সংখ্যা কালের মত অব্যক্তভাবে অসীম, কারণ সংখ্যার যোগ অনন্তকাল ধরে চলতে পারে। কিন্তু দেশ ও কালের সঙ্গে সংখ্যার পার্থক্য হল সংখ্যা অসীম ভাগে বিভাজ্য নয়, কারণ সংখ্যার একটা নিম্নতম একক (Unit) আছে।

প্রকৃতি সম্পর্কে যান্ত্রিকতাবাদী মতবাদের তুলনায় উদ্দেশ্যমূলক মতবাদের প্রাধান্য লাভ

অ্যারিস্টটলের মতে, সব স্বাভাবিক গতিই উদ্দেশ্যমূলক। প্রকৃতিতে এই উদ্দেশ্যের স্বরূপ কি? এ উদ্দেশ্য হল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া উপাদানের আকারে রূপান্তরিত হওয়া। প্লেটোর ক্ষেত্রে যেমন অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রেও প্রকৃতি সম্পর্কে যান্ত্রিকতাবাদী মতবাদের তুলনায় উদ্দেশ্যমূলক মতবাদ প্রাধান্য লাভ করেছে। তবে অ্যারিস্টটলের পক্ষে যৌক্তিক দিক থেকে (Logically) কোন সচেতন উদ্দেশ্যবাদ স্বীকার করা সম্ভব নয়। প্লেটো জগৎ-আত্মা এবং জগৎ-নিয়ন্তা হিসেবে ডেমিয়ার্জকে স্বীকার করেছিলেন বলে জগতে লক্ষ বা উদ্দেশ্যের অস্তিত্বের কথা বলতে পেরেছেন।

কপলস্টোনের মন্তব্য – কিন্তু অ্যারিস্টটল প্রকৃতির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক বিষয়ে কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি যেন বলতে চেয়েছেন যে, প্রকৃতির মধ্যে উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া নিহিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কপলস্টোন মন্তব্য করেছেন যে, অ্যারিস্টটল যে প্রকৃতিকে একটি সচেতন সক্রিয় সুসংবদ্ধ ক্রিয়াশীল নীতিরূপে মাঝে মাঝে বর্ণনা করেছেন, অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যা এবং ধর্মবিদ্যা থেকে তার যে উপযুক্ত সমর্থন মেলে না, এটা আমরা স্বীকার করতে বাধ্য।

অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যার প্রধান বিষয় হল সত্তার ক্রম (the scale of Being)। এটি সত্তার ক্রম শুধুমাত্র নয়, স্টেইস্ একে মূল্যের ক্রম (Scale of Values) হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। সত্তার ক্রম যার স্থান উপরের দিকে তার মূল্য অধিক, কেননা তার মধ্যে আকারের নীতি বা সূত্রটি অনেক উন্নত।

সত্তার ক্রম

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটা ক্রমবিকাশের মতবাদ, একটা বিবর্তন সম্পকীয় দর্শন। যা নিম্ন তা উচ্চতরে বিবর্তিত বা বিকশিত হয়। এটি কালগত ক্রমবিকাশ নয়, কোন কালগত প্রক্রিয়া নয়, এটি যৌক্তিক (Logical) প্রক্রিয়া। তাই এক্ষেত্রে ক্রমবিকাশ হল যৌক্তিক ক্রমবিকাশ, কারণ নিম্নতর অবস্থার মধ্যেই উচ্চতর অবস্থা অব্যক্তভাবে বিদ্যমান। আবার যা উচ্চতর তার মধ্যে নিম্নতর বাস্তব দিক থেকে বিদ্যমান। নিম্নতর অবস্থার মধ্যে যা প্রচ্ছন্ন তা উচ্চতর অবস্থার মধ্যে প্রকট। নিম্নতর অবস্থার মধ্যে যে আকার (Form) থাকে তা উচ্চতর অবস্থার মধ্যে নিজেকে উপলদ্ধি করে। নিম্নতর অবস্থা উচ্চতর অবস্থার ভিত্তিস্বরূপ, উচ্চতর হল আকার, নিম্নতর হল যার উপাদান। (“The higher is the form of which the lower is the matter’.)। তাই সমগ্র জগৎ প্রক্রিয়া, কোন কালিক প্রক্রিয়া নয়। এক পরম তত্ত্ব, ঈশ্বর, বুদ্ধি, সর্বনিরপেক্ষ আকার, ক্রমবিকাশের প্রতিটি ক্রমেই অনন্তকাল ধরে নিজেকেই প্রকাশ করে চলেছে। কোন বস্তুর আকার হল তার সংগঠন (Organization), তাই ক্ৰমের উচ্চস্তরে অবস্থিত হওয়ার অর্থ হল অধিকতর সংগঠিত হওয়া।

সুতরাং ক্রমের সর্বনিম্ন রয়েছে প্রাণহীন উপাদান (Inorganic Matter)। প্রাণহীন উপাদানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তার অতিবর্তী। প্রাণহীন উপাদানের দৈশিক গতি ছাড়া কোন কাজ নেই, সপ্রাণ উপাদানের রয়েছে বৃদ্ধি। এ বৃদ্ধির অর্থ হল, যা অন্তর্নিহিত, তাকে বাহ্যত প্রকট করে তোলা, যা অব্যক্ত তাকে ব্যক্ত করে তোলা। প্রাণহীন উপাদানের স্তরে সপ্রাণ উপাদান (Organic Matter), যার লক্ষ তার অন্তর্বর্তী। সপ্রাণ উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্তরে হল উদ্ভিদ, তার উপরের স্তরে প্রাণী, তার উপরের স্তরে মানুষ।

পুষ্টিসাধক আত্মা

সপ্রাণ উপাদানের ক্ষেত্রে আকারের সূত্রটি বাস্তব এবং সুনির্দিষ্ট, যেহেতু সেটি তার অভ্যন্তরীণ সংগঠন। এ অভ্যন্তরীণ সংগঠন হল সপ্রাণ উপাদানের প্রাণ, যাকে আমরা বলি আত্মা। বস্তুত মানুষের আত্মা তার দেহের সংগঠন। আকারের সঙ্গে উপাদানের যে সম্পর্ক দেহের সঙ্গে আত্মার সেই সম্পর্ক, সপ্রাণ উপাদানের ক্ষেত্রেই আমরা সজীব আত্মার ধারণাতে উপনীত হই, কিন্তু এ সজীব আত্মার ক্ষেত্রে সত্তার উচ্চতর এবং নিম্নতর ক্রম (lower and higher grades of being) বর্তমান। উচ্চতর সত্তার ক্ষেত্রে আকারের সূত্র বা তত্ত্বটির অধিকতর মাত্রায় রূপায়ণের বিষয়টি নিহিত রয়েছে। প্রাণী বা সজীব উপাদান নিজেকে উপলব্ধি করতে চায় এবং এ আত্মোপলদ্ধির বিষয়টির প্রকাশ ঘটে আত্মরক্ষার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়ত হল, প্রজাতির আত্মরক্ষা (Preservation of the Species)। তাই সপ্রাণ উপাদানের সর্বনিম্ন স্তরে আমরা পাই সেইসব প্রাণ উপাদান যার একমাত্র কাজ হল নিজেদের পুষ্টি বিধান, বুদ্ধি এবং বংশবৃদ্ধি। এরাই হল উদ্ভিদ। উদ্ভিদের রয়েছে পুষ্টিসাধক আত্মা (Nutritive Soul), সত্তার ক্রমে উদ্ভিদের পরে আসে প্রাণী যেহেতু সত্তার ক্রমে। যা উচ্চতর তা নিম্নতরকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।

পুষ্টিসাধক এবং সংবেদনশীল আত্মা : প্রাণীদের উদ্ভিদের মতই রয়েছে পুষ্টিবিধানের এবং বংশবৃদ্ধির ক্রিয়া। প্রাণীরা উদ্ভিদের থেকে শ্রেষ্ঠ, কারণ প্রাণীদের রয়েছে সংবেদনশীল আত্মা। সংবেদন সুখকর বা অসুখকর হতে পারে। উদ্ভিদের পক্ষে সংবেদনের কোন প্রয়োজন নেই, কেননা তারা নিজে নিজে পুষ্ট হয়। পুষ্টির জন্য তাদের গতিশীল হবার প্রয়োজন দেখা দেয় না। গতিশীল প্রাণীদের সংবেদন একান্ত প্রয়োজন। কারণ তারা সুখ-দুঃখের প্রতি সংবেদনশীল। সত্তার ক্রমে প্রাণীর পরে আসে মানুষ।

মানুষের তিন ধরনের আত্মা : মানুষের ক্ষেত্রে পুষ্টিবিধানের, গতিশীল হবার, বংশবৃদ্ধি করার, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অর্থাৎ নিম্নতর সত্তার সব বৈশিষ্ট্যই বর্তমান, কিন্তু এ ছাড়াও রয়েছে মানুষের মধ্যে বিচারবুদ্ধি, তাই আত্মা হল পুষ্টিসাধক, সংবেদনশীল এবং বৌদ্ধিক (Rational)। মানুষের মধ্যে বিশ্ব ধীশক্তি তার যথাযথ আকারে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

সত্তার ক্রম অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, প্রথমে প্রাণহীন উপাদান, তারপর উদ্ভিদ, তারপর প্রাণী এবং তারপর মানুষ। প্রশ্ন হল, এর পরের স্তরে কি? অ্যারিস্টটল স্পষ্ট করে এর পরে অন্য কোন সত্তার কথা না বলে, এ পৃথিবীর বাইরে যে গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান তাদের কথা বলেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হয়েছে যে, সত্তার ক্রমের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মানুষ। কিন্তু কেউ কেউ এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সত্তার ক্রম মানুষেতেই থেমে যায়নি, গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে। একেবারে ঈশ্বরের সত্তায় গিয়ে সমাপ্তি লাভ করেছে। আর তা ছাড়া গ্রহ-নক্ষত্র অ্যারিস্টটলের মতে ঐশ্বরিক সত্তা, এ রকম ধারণা করার সপক্ষে যুক্তি কি? যুক্তি হল, প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যেই এ যুক্তি নিহিত আছে। কেননা, সত্তার সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে আকারহীন উপাদান এবং একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে উপাদানহীন আকার, তাই সত্তার ক্রম প্রথমটি থেকে শুরু করলে শেষেরটিতে সাক্ষাতভাবে উপনীত হতে হবে। অ্যারিস্টটলের দর্শনে বিশ্বজগৎ এক নিরবচ্ছিন্ন শৃঙ্খল। তাই সত্তার ক্রমে মানুষ এসে থেমে গেলে যেন একটা ছেদ পড়ে যায়।

লোক-অতিচান্দ্রলোক এবং অধঃচান্দ্রলোক

অ্যারিস্টটলের মতে, এ বিশ্ব দুটি লোকে বিভক্ত—(১) অতি চান্দ্রলোক (The Superlunary) এবং অধঃচান্দ্রলোক (The Sublunary)। অতি চান্দ্রলোক অবিনশ্বর নক্ষত্রের অবস্থান। স্থানীয় গতি ভিন্ন অন্য কোন গতি নক্ষত্রের নেই, যে গতি হল বৃত্তাকার। অ্যারিস্টটলের মতে, ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ—এ চারটি উপাদান থেকে পৃথক এবং তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ অপর একটি উপাদান ব্যোম (Ether) দ্বারা নক্ষত্রগুলো গঠিত।

অ্যারিস্টটলের মতে, পৃথিবী বর্তুলাকার। বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থলে পৃথিবী স্থির হয়ে বর্তমান। চতুর্দিকে জল, বাতাস ও আগুনের বিভিন্ন স্তর। এগুলোকে অতিক্রম করে যেতে হবে স্বর্গলোকে (Heavenly Sphere)। স্বর্গলোকের বহির্ভাগ হল স্থির নক্ষত্রের লোক, যা আদি প্রবর্তক থেকেই তার গতি লাভ করে। স্বর্গলোকের যে বস্তু (Heavenly Bodies), তাদের ছাপান্নটি লোক আছে। নক্ষত্রগুলো গ্রহের বাইরে অবস্থিত। এখানে লক্ষ করার বিষয় যে, এখানেও একটা যৌক্তিক নিরবচ্ছিন্নতা বর্তমান। অর্থাৎ কিনা, বিবর্তনের যে শৃঙখল তাতে কোন ছেদ নেই।

তাই আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, সত্তার ক্রমে সর্বোচ্চ স্তরে মানুষ অবস্থিত নয়। মানুষের পরে আসছে স্বর্গলোকের বস্তু। অর্থাৎ গ্রহাদি, সূর্য, চন্দ্র যার অন্তর্ভুক্ত, যারা পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। তারপর আসছে নক্ষত্র। নক্ষত্র এবং গ্রহ হল ঐশ্বরিক সত্তা। মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন বা প্রজ্ঞাবান হওয়াতে ঐশ্বরিক, কিন্তু স্বর্গলোকের বস্তুরা আরও বেশি ঐশ্বরিক। তারা মানুষের তুলনায় আরও অধিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তাই সত্তার ক্রমে আরও উচ্চতর স্তরে অবস্থিত। এরা হল অনন্ত এবং অবিনশ্বর। কারণ অনন্ত ধী-শক্তির পরম উপলব্ধি তাদের মধ্যে ঘটেছে।

ঈশ্বর দেশে অবস্থিত নয়

নক্ষত্রের পরে আমরা উপনীত হই সত্তার সর্বশেষ স্তরে অর্থাৎ উপাদানহীন আকারে। এ স্তর হল সর্বনিরপেক্ষ বা পরম আকার-এর স্তর অর্থাৎ ঈশ্বর। যেহেতু আকারহীন উপাদান এবং উপাদানহীন আকার কোন অস্তিত্বশীল বস্তু নয়, যেহেতু ঈশ্বর দেশ-কালের জগতে অবস্থিত নয়। সবচেয়ে বাইরের যে লোক (Outermost Sphere) তার বাইরে ঈশ্বর অবস্থিত। তাই ঈশ্বর দেশে অবস্থিত নয়। সব দেশ এবং কাল এ বিশ্বজগতের মধ্যে। তাই দেশ হল সীমিত। ঈশ্বর যেহেতু পরম সত্তা, সবচেয়ে যে বাইরের লোক (Sphere) তার বাইরেই তিনি অবস্থিত হবেন।

অ্যারিস্টটল এ বিবর্তনের সম্পূর্ণ ক্রমটি অনুধাবন করলে, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমাদের কাছে ধরা পড়বে। সর্বনিরপেক্ষ সত্তা হল ধী-শক্তি বা বিচারশক্তি, উপাদানহীন আকার। তাই এ জগতের প্রতিটি বস্তুই হল মূলত বিচারবুদ্ধি (Reason)। অবশ্য অ্যারিস্টটল বিষয়টি নিয়ে যতখানি আলোচনা করা দরকার তা করেননি। তার একটা কারণ হল, তিনি উপাদানকে আকার থেকে পৃথক একটি তত্ত্বরূপে স্বীকার করেছেন যাকে আকারে পরিণত করা যাবে না।

বিবর্তনবাদের মূল্যায়ন

প্রশ্ন হল অ্যারিস্টটলের বিবর্তনবাদের মূল্য কতখানি? স্টেইস্ প্রমুখ লেখক এর অপরিসীম মূল্যের কথা স্বীকার করেছেন। আসলে বিবর্তন সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ যা অ্যারিস্টটল দিয়েছেন, তার কথা চিন্তা না করে আমাদের চিন্তা করতে হবে তিনি যে সূত্রের সাহায্যে তাকে ব্যাখ্যা করেছেন। এ সূত্রেরই অপরিসীম মূল্য রয়েছে। বিবর্তন সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদের সঙ্গে স্টেইস অ্যারিস্টটলের বিবর্তনবাদের তুলনা করেছেন। আধুনিক লেখক হার্বার্ট স্পেন্সার বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন যে, বিবর্তন প্রক্রিয়া সব সময়ই সহজ থেকে জটিল অবস্থায়, সদৃশ ও সমসাত্ত্বিক অবস্থা থেকে অসদৃশ বা বিষমসাত্ত্বিক অবথায়, অনির্দিষ্ট ও অসংবদ্ধ অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ও সুসংবদ্ধ অবস্থায় চালিত হয়। অ্যারিস্টটলের বিবর্তনে বিবর্তনের উপরিউক্ত সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে তবে ভিন্ন ভাষায় তাকে ব্যক্ত করেছেন।

কোন বস্তুর আকারই তার সংগঠন

তিনি বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, এ হল উপাদানের আকারের দিকে গতি। যা বস্তুতে সুনির্দিষ্টতা আরোপ করে তাই হল আকার। উপাদান হল অনির্দিষ্ট আধার। আকার তাকে সুনির্দিষ্টতা দান করে। অ্যারিস্টটলের মতে, উচ্চতর সত্তার মধ্যে অধিকতর আকার থাকার জন্য তা অধিকতর সুনির্দিষ্ট। তাই উপাদান হল সম-সাত্ত্বিক এবং আকার হল বিষমসাত্ত্বিক। আকারই সদৃশ অবস্থায় বিসদৃশ অবস্থা প্রবর্তন করে। সুসংবদ্ধ অবস্থাই হল সংগঠন, উভয়ই অভিন্ন। অ্যারিস্টটল নিজেই কোন বস্তুর আকারকে তার সংগঠন রূপে বর্ণনা করেছেন। স্পেন্সারের ক্ষেত্রে যেমন, অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রেও উচ্চতর সত্তা হল তাই যা অধিকতর সংগঠিত। বিবর্তন সম্পর্কীয় যে কোন মতবাদ সজীব প্রাণীর ধারণার উপরে মূলত নির্ভর। অ্যারিস্টটল এ ধারণার এবং সজীব প্রাণী (Organism) শব্দটির আবিষ্কর্তা।

অ্যারিস্টটলের মতবাদের সঙ্গে আধুনিক বিবর্তনবাদীদের মতবাদের পার্থক্য

তবে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে আধুনিক বিবর্তনবাদীদের পার্থক্যও রয়েছে। আধুনিক বির্তনবাদীদের মতে বিবর্তন প্রক্রিয়া শুধুমাত্র যৌক্তিক প্রক্রিয়া (Logical Process) নয়, এটি একটি কালিক প্রক্রিয়াও বটে। অ্যারিস্টটল এ বিষয়টি অনুমান করতে সক্ষম হয়নি। অ্যারিস্টটল ধারণা করতে পারেননি যে কালের গতিতে নিম্নতর জীব উচ্চতর জীবে বিবর্তিত হয়। কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে, আধুনিক বিবর্তনবাদীরা বিবর্তন সম্পর্কে যে মতবাদ উপস্থাপিত করেছেন তাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অ্যারিস্টটল দেবার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, অ্যারিস্টটল বিবর্তনের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, যা হার্বার্ট সেন্সরের মত আধুনিক লেখকরা হননি। প্রশ্নটা হল, বিবর্তন পরিবর্তন সূচনা করে, কিন্তু কেন এ পরিবর্তন? উচ্চতর সত্তা আর নিম্নতর সত্তা, অর্থাৎ উচ্চতর জীব, আর নিম্নতর জীব, কিসের ভিত্তিতে এ প্রভেদকরণ? যদি বলা হয়, যা উচ্চতর তা অধিকতর সংগঠিত, তাহলে প্রশ্ন হল, অধিকতর সংগঠিত হওয়া ভাল কেন? স্পেন্সার এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। অ্যারিস্টটল এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন যে, একটা লক্ষ্যের কথা চিন্তা না করলে এবং সেই লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হলে ক্রমবিকাশ, অগ্রগতি উচ্চতর নিম্নতর এসবগুলো অর্থহীন শব্দে পর্যবসিত হয়। কোন কিছুর দিকে অগ্রগতি না হলে অগ্রগতি কথাটির কোন মানে হয় না। সােজা কথায়, বিবর্তন সম্পর্কে দার্শনিক চিন্তাকে উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণামী (Teleological) হতে হবে। কোন লক্ষ্যের দিকে প্রকৃতি অগ্রসর না হলে, কোন্ ক্রমবিকাশ উচ্চতর এবং কোন্‌টি নিম্নতর, এ প্রভেদের কথা বলা চলে না। তাহলে লক্ষ্যটা কি? অ্যারিস্টটলের মতে, তা হল বিচারবুদ্ধির বাস্তবায়িত হওয়া (Actulisation of Reason)। আদিম সত্তা হল অন্তহীন বিচারবুদ্ধি। কিন্তু এ বিচারবুদ্ধি অস্তিত্বশীল নয়। একে অস্তিত্বশীল হবার জন্য অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে।

স্টেইস্-এর মন্তব্য – প্রশ্ন হল, বিশ্বজগৎ তার লক্ষে উপনীত হলে তার মাত্রা তো শেষ হয়ে যাবে, তাই নয় কি? কিন্তু, সেই প্রশ্ন ওঠে না, কেননা পরম লক্ষ, যা হল সর্বনিরপেক্ষ বা শুদ্ধ আকার (Absolute Form), তাতে কখনও উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। সেকারণে যা উচ্চতর তা অধিকতর বৌদ্ধিক, যা নিম্নতর তা কম বৌদ্ধিক। অধিকতর বৌদ্ধিক হওয়া ভাল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। যা হেতু, তার হেত সন্ধান করা চলে না। সেই কারণে স্টেইস মন্তব্য করেছেন, “আধুনিক বিজ্ঞানের বিবর্তন বিষয়ে কোন দর্শন নেই কিন্তু অ্যারিস্টটলের আছে।”

অ্যারিস্টটলের মনোবিজ্ঞান

ভূমিকা

অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদ তার সমগ্র দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার। করে আছে। বস্তুত তার আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদ তার প্রকৃতি সম্বন্ধীয় দর্শনের (Philosophy of Nature) মূল বিষয় এবং এ মতবাদ তার পদার্থবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র। এবং ধর্মবিজ্ঞানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের কাজ করে।

অ্যারিস্টটলের দর্শনে ‘আত্মা’ শব্দটির ব্যাপকতর অর্থ ও অ্যারিস্টটলের দর্শনে ‘আত্মা’ পদটি ইংরেজি ভাষায় ‘আত্মা’ বা ‘মন’ শব্দটির যে অর্থ, তার তুলনায় অনেক ব্যাপক। কারণ প্রতিটি সজীব ক্রিয়া যেমন—বংশরক্ষা, সংবেদন, স্থানীয় গতি, বিচারবুদ্ধি—সবই এর আওতায় এসে পড়ে। ‘De Anima’ গ্রন্থটি এবং ‘Parva Naturalia’ শিরোনামায় যে কয়েকটি অপ্রধান রচনা প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোতে সাধারণত মনোবিজ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝি তার তুলনায় অনেক বেশি কিছু বর্ণিত হয়েছে। সেখানে রয়েছে জ্ঞানমূলক বৃত্তির, সংবেদন, বিচারবুদ্ধি প্রভৃতির আলোচনা, কিন্তু ‘Parva Naturalia’-তে শারীরবৃত্ত-বিষয়ক অনেক প্রশ্নের যেমন নিদ্রা, জাগ্রত অবস্থা, এমনকি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের আলোচনাও করা হয়েছে। তবে মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বক্তব্য প্রধানত ‘ডি.আনিমা’ গ্রন্থ অনুসরণ করেই আমাদের জানতে হবে।

পূর্ববর্তী লেখকদের মতবাদ বিচার ও অ্যারিস্টটলের পক্ষে আলোচনার যেটি রীতি, সেই রীতি অনুযায়ী ‘ডি.আনিমা’ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে অ্যারিস্টটল তার পূর্ববর্তী লেখকদের মতবাদ বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তিনি মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তার বিচারের কাজ শুধুমাত্র তার পূর্ববর্তী মতবাদগুলোর ঐতিহাসিক আলোচনাতে সীমাবদ্ধ থাকাতে, তিনি এ প্রসঙ্গে যে প্রধান প্রধান। সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন সেগুলোকেও সুনির্দিষ্ট করে নিলেন। তিনি তার পূর্ববর্তী অভিমতগুলোর সমালোচনা করলেন এবং কয়েক ক্ষেত্রে মনোগ্রাহী ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি দেখালেন যে প্রাচীন লেখকদের মতে, আত্মার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল গতি (Movement) এবং জ্ঞান (Cognition)।

পূর্ববর্তী দার্শনিকবৃন্দ সজীব ও অজীব-এর মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বিশেষ করে সমালোচনা করলেন তাদের, যারা প্রাণহীন দ্রব্য এবং সজীব দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, যদি আত্মাকে জল বা অগ্নির সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করা হয়—যেমন, সক্রেটিস-পূর্ব কোন কোন দার্শনিক করেছেন, তাহলে এ উপাদানগুলো, যে যেখানে অস্তিত্বশীল, সজীব প্রাণীর রূপ গ্রহণ করেনি কেন? আত্মাকে আগুনের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলে আত্মা কিসের দ্বারা গঠিত তা হয়ত জানা যায় কিন্তু এর দ্বারা সজীব এবং অজীৰ-এর পার্থক্যের কোন জ্ঞান আমাদের হয় না। জড়বাদী লিউকিপ্লাস (Leucippus) এবং ডেমােক্রিটাস (Democritus) আত্মা সম্পর্কে যে জড়বাদী অভিমত পােষণ করতেন, অ্যারিস্টটল স্পষ্টই উল্লেখ করেছেন, যে, আত্মা সম্পর্কে তার অভিমত এঁদের অভিমত থেকে ভিন্ন।

আত্মা সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদের ব্যাখ্যার জন্য সেই সময়কার দুটি বিতর্কমূলক প্রশ্নের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রশ্নটি হল আত্মার কোন অংশ আছে কিনা, যদি থাকে কি অর্থে, এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল, আত্মা ও দেহের সম্পর্ক, বিশেষ করে আত্মার দেহ বহির্ভূত স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রশ্নটি। এ দুটি প্রশ্ন নিয়ে চতুর্থ শতাব্দীতে যথেষ্ট আলোচনা হয় এবং প্লেটো দুটি প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন এবং তাই নিয়ে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিক’ গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদে আত্মার তিনটি অংশের কথা বলার পর সক্রেটিস ডায়ালগের’ শেষে বলেছেন, যা বহু অংশের দ্বারা গঠিত তার পক্ষে অবিনশ্বর হওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেছেন, মানুষের ক্ষেত্রেই আত্মার ঐ ত্রিধা রূপ পরিলক্ষিত হয় এবং আত্মার প্রকৃত স্বরূপ তার থেকে অনেক পৃথক। আত্মা এক না বহু, পরবর্তী ডায়ালগে তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। তবে মানুষের আত্মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘টাইম্যায়িয়ুস’-এ বলা হয়েছে যে আত্মার তিনটি অংশ দেহের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত এবং কেবলমাত্র বিচার বুদ্ধির অংশই অবিনশ্বর।

তবে দেহ ও আত্মার সম্পর্ক বিষয়ে প্লেটোর মতবাদ সুস্পষ্ট। আত্মার সঙ্গে দেহের গুণগত পার্থক্য আছে। আত্মা অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং অজড়াত্মক; দেহ প্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং জড়াত্মক, তা ছাড়া আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে অবস্থান করতে পারে এবং আত্মা অবিনশ্বর। কিন্তু প্লেটো আত্মার অবিনশ্বরতা এবং অজড়াত্মক প্রকৃতি স্বীকার করে নেওয়াতে দুটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। আত্মা যদি অজড়াত্মক হয় তাহলে দেহকে কিভাবে গতিশীল করে তোলে, প্লেটো এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর কোথাও দেননি। আর দ্বিতীয়ত, আত্মা কেন দেহ ধারণ করে?

আত্মার প্রকৃতি বর্ণনা

এ সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদকে বিচার করতে হবে। অ্যারিস্টটল কখনও কখনও আত্মাকে কিছু ক্ষমতা রূপে চিন্তা করেছেন, যেমন, পুষ্টি সাধনের (The capacity for Nutrition), ক্ষমতা, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের ক্ষমতা, চিন্তনের ক্ষমতা, এসব ক্ষমতাগুলো নিছক কিছু ক্ষমতার সমাবেশ মাত্র নয়, তারা ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সবচেয়ে নিম্নতর ক্ষমতা (পুষ্টি সাধন) উচ্চতর ক্ষমতা ব্যতিরেকে অস্তিত্বশীল হতে পারে, কিন্তু বিপরীত কথা সত্য নয় (Physics; Page 43.)। ‘ডি. আনিমা’ গ্রন্থের শুরুতে যেখানে তিনি আত্মা সম্পর্কে সদর্থক অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সেখানে তিনি বলেছেন, আত্মা হল, যার মধ্যে প্রাণ অব্যক্তভাবে বর্তমান, এমন একটা স্বাভাবিক দেহের প্রথম বাস্তবায়িত বা ব্যক্ত হওয়া (The first actuality of a natural body that potentially has life)। এর অর্থ কি ? আত্মা হল ব্যক্ততা (Actuality)-এ মতবাদের প্রবর্তন তিনি করেছেন। তিনি জীবিত প্রাণীর ক্ষেত্রে আকার এবং উপাদানের পার্থক্য করার পর, একটি জীবিত প্রাণীকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, জীব হল যৌগিক সমগ্রতা। জীব উপাদান এবং আকার উভয়েরই অধিকারী, দেহ হল উপাদান এবং আত্মা হল আকার। উপাদান হল অব্যক্ত, আকার হল ব্যক্ত। ব্যক্ততা দুধরনের হতে পারে, যেমন কোন জ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং বাস্তবে সেই জ্ঞানকে ব্যবহার করা। অ্যারিস্টটলের মতে, আত্মা হল প্রথম ধরনের ব্যক্ততা-কারণ নিদ্রা, জাগরণ এসব ক্রিয়া আত্মার অস্তিত্ব নির্দেশ করে।

জনৈক লেখক বলেন, ‘আত্মা’ শব্দটি কোন কোন আধুনিকের কাছে সেকেলে মনে হতে পারে এবং লোকেরা হয়ত তার পরিবর্তে ‘মন শব্দটি বসাতে প্রলুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা আত্মার ক্রিয়াকে, যাকে আমরা মানসিক ক্রিয়া বলি, তাতে সীমায়িত রাখবে এবং এর ফলে অ্যারিস্টটলের মতে, পুষ্টিবিধান প্রক্রিয়াও মূলত আত্মার ক্রিয়া (Richard Sorabji: ‘Body and Soul in Aristotle’; Page. 44 (in Articles on Aristotle edited by Barnes, Schofield & Sorabji)

প্লেটো এবং আরও অনেকে উদ্ভিদের আত্মার কথা বলেছেন। প্লেটো মনে করতেন উদ্ভিদের সংবেদন এবং কামনা আছে। অ্যারিস্টটলের মতে, উদ্ভিদের আত্মা আছে, কিন্তু উদ্ভিদরা সংবেদন এবং কামনার অধিকারী, এ অভিমত তিনি বর্জন করেছিলেন। বরং তাঁর মতে, সংবেদন হল প্রাণীদের স্বাতন্ত্রসূচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে তিনি উদ্ভিদে যে আত্মা আরোপ করলেন তাকে কিভাবে সমর্থন করা যেতে পারে? তিনি আত্মার ধারণাকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলেন, যাতে পুষ্টিবিধান ও বৃদ্ধি—এ অ-চেতন প্রক্রিয়াগুলো আত্মার ক্রিয়া রূপে গণ্য হতে পারে। অ্যারিস্টটলের আত্মাকে এমন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার বিষয়টি আমাদের কাছে বিস্ময়জনক মনে হতে পারে। কিন্তু অ্যারিস্টটলের মতে, একটি উদ্ভিদের বৃদ্ধি লক্ষহীনভাবে সংঘটিত হয় না, একটি সুনির্দিষ্ট সংগঠনে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। আত্মার এ ধরনের ধারণা তাকে জীবনের সঙ্গে অর্থাৎ কিনা, সব জীবনের সঙ্গে সমব্যাপক করে তোলে (Coextensive with life)। আত্মার এ ধরনের ধারণা হল জীববিদ্যা-সম্বন্ধীয় ধারণা।

দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ

দেহ ও আত্মার সম্বন্ধ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের মতবাদকে দুটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যদি কোন কুঠার একটি জীবিত প্রাণী হতো – তাহলে যা তাকে কুঠার করেছে অর্থাৎ তার কর্তন করার ক্ষমতা হবে এর আত্মা; আর যে উপাদান দিয়ে কুঠারটি তৈরি, অর্থাৎ সেই নির্দিষ্ট ধাতুটি হবে তার দেহ। যদি চক্ষু হতো একটা জীবন্ত প্রাণী, তাহলে দৃষ্টিশক্তি হতো তার আত্মা, কারণ দৃষ্টিশক্তিই হল তার সারবস্তু।

আত্মাকে দেহ থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়

অ্যারিস্টটল প্লেটোর মত দেহ ও আত্মার নিবিড় সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন না। তবে প্লেটোর মতে, আত্মা দেহ কে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং আত্মা ও দেহ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা। কিন্তু অ্যারিস্টটলের মতে, একটি যৌগিক সমগ্রের (a composite whole) আকার হল আত্মা, দেহ যার উপাদান। আত্মাকে দেহ থেকে পৃথক করা অসম্ভব, যেমন অসম্ভব একটি কুঠার যে উপাদানের দ্বারা গঠিত সেই উপাদান থেকে তার তীক্ষ্ণতাকে স্বতন্ত্র করা বা চক্ষু থেকে তার দৃষ্টিশক্তিকে পৃথক করা। সুতরাং অ্যারিস্টটল বলেন যে, “আত্মা এবং দেহ এক কিনা, এটা অনুসন্ধান করার কোন প্রয়োজন নেই; যেমন, একখণ্ড মােমকে এবং তাকে যে আকার দেওয়া হয়েছে, তারা পৃথক কিনা, এটা অনুসন্ধান করা যেমন প্রয়োজনহীন।”

এ মতবাদের মৌলিকতা এবং গুরুত্ব হল একটি জীবন্ত প্রাণীকে একটি মাত্র জটিল সমগ্রতা (a single complex whole) বলে ধারণা করা। আত্মা কোন স্বতন্ত্র সত্তা নয়, যা কোন প্রাণীর জীবদ্দশায় তার মধ্যে বসবাস করে। আত্মা হল দেহের ব্যক্ততা (actuality of the body), যা একটি জীবিত প্রাণীকে একটি জীবিত প্রাণীতে পরিণত করে। দেহ ও আত্মা সম্পর্কে দ্বৈতবাদের একজন প্রধান সমর্থক হলেন প্লেটো, আর অ্যারিস্টটল হলেন অদ্বৈতবাদী। অ্যারিস্টটলের মতবাদ অনুসারে দেহ ও মন দুটি স্বতন্ত্র সত্তা নয় বরং একটি মাত্র জটিল সত্তার বিভিন্ন দিক।

অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় সংজ্ঞা স্বীকার করে নিলে, আত্মা ও দেহের সম্পর্ক এবং আত্মার অবিনশ্বরতার প্রশ্নটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আত্মা সম্পর্কে তার মতবাদ স্বীকার করে নিলে, আত্মা এক স্বতন্ত্র অবিনাশী সত্তা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, আত্মা যদি দেহের ব্যক্ততা হয়, তাহলে সুস্পষ্ট ভাবে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, যে দেহের আত্মা হল ব্যক্ততা, সেই দেহ থেকে বিযুক্ত হয়ে তার পক্ষে অবস্থান করা সম্ভব নয়। তবে তিনি একটা ব্যতিক্রম করেছেন। সেই ব্যতিক্রম হল যে, আত্মার বিচার-বুদ্ধির অংশ অবিনশ্বর এবং আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে।

আত্মার বিভিন্ন বৃত্তি

‘ডি. আনিমা’ গ্রন্থের শুরুতে আত্মার একটা বিবরণ দেবার পর অ্যারিস্টটল তার বিভিন্ন বৃত্তি (Faculties) নিয়ে আলোচনা করেছেন। অ্যারিস্টটল মানুষের চেতনার বিভিন্ন স্তরগুলোকে সাধারণত বৃত্তি নামে অভিহিত করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, এ বৃত্তিকে আত্মার বিভিন্ন অংশ রূপে গণ্য করা সমীচীন হবে না। স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে তারা কোন অংশ নয়। এ কথা সত্য যে, তিনি মাঝে মাঝে ‘অংশ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু আসলে তিনি তাদের চেতনার স্তর রূপেই বুঝে নিতে চান। অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, মানুষের চেতনার নিম্নতর এবং উচ্চতর ক্রম আছে এবং তিনি সেগুলো দেখাবার চেষ্টা করেছেন। আত্মা এক অবিভাজ্য সত্তা, তাই তার কোন অংশ নেই। আত্মার ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি, একই অভিন্ন সত্তার ক্রিয়ার বিভিন্ন দিক।

অ্যারিস্টটলের রচনায় এমন কোন একটি প্রামাণ্য অংশ নেই, যার থেকে, যে বৃত্তিগুলোকে বা চেতনার স্তরকে তিনি স্বীকার করেছেন, সেগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়। অ্যারিস্টটল প্রদত্ত বিভিন্ন বিবরণ থেকে আমরা নিম্নলিখিত প্রধান বৃত্তিগুলোর কথা জানতে পারি। এ বৃত্তিগুলো হল পুষ্টিসাধন ও বংশরক্ষা, সংবেদন, কামনা, স্থানীয় গতি, কল্পনা, স্মৃতি এবং বিচারবুদ্ধি।

সব জীবিত প্রাণীই নিজের পুষ্টিসাধন করতে পারে এবং বংশরক্ষা করতে পারে। আত্মার এ পুষ্টিসাধক বৃত্তি প্রাণী এবং উদ্ভিদ সকলের মধ্যেই দেখা যায়। তবে অ্যারিস্টটলের মতে, উদ্ভিদরা আত্মার এ একটিমাত্র বৃত্তিরই অধিকারী। প্রাণীদের আরও একটি বৃত্তি আছে সেটি হল সংবেদন। কিন্তু সব প্রাণীই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অধিকারী নয়।

কামনা : কামনা, স্থানীয় গতি (Locomotion) এবং কল্পনা, আত্মার এ তিনটি বৃত্তি পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কামনার বৃত্তি সংবেদনকে অনুসরণ করে অর্থাৎ কিনা, যার সংবেদন আছে, তারই কামনা আছে। যার সংবেদন আছে সে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে এবং যে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করে তার ক্ষুধারও অভিজ্ঞতা হয়। কেননা ক্ষুধা হল যা মনোরম বা প্রীতিকর তার জন্য কামনা। সব প্রাণী, যাদের স্পর্শেন্দ্রিয় আছে তারা খাদ্য এবং পানীয় প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং খাদ্য ও পানীয়ের জন্য কামনাকেই যথাক্রমে, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা নাম দেওয়া হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, কামনা আত্মার অন্যান্য অংশ থেকে পৃথক, তাই কামনাকে একটি স্বতন্ত্র বৃত্তি হিসেবে গণ্য করতেই হবে।

স্থানীয় গতি : এরপর হল স্থানীয় গতি। অ্যারিস্টটলের মতে, অন্যান্য বৃত্তি থেকে এটি একটি স্বতন্ত্র বৃত্তি। কিন্তু তিনি যেমন কামনার ও কল্পনার সঙ্গে তেমনি আবার বিচারবুদ্ধির সঙ্গেও এর গভীর সম্পর্ক স্বীকার করেছেন। সব প্রাণী এ বৃত্তির অধিকারী নয়। কোন প্রাণী নিজেকে গতিশীল করে তুলতে সমর্থ যেহেতু তার কামনার বৃত্তি রয়েছে। কিন্তু কামনা কল্পনাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে নেয় এবং কল্পনা বৌদ্ধিক হতে পারে বা সংবেদনমূলক হতে পারে।

কল্পনা : কল্পনা হল আর একটি বৃত্তি। অ্যারিস্টটল কল্পনা বলতে সৃষ্টিমূলক কল্পনা বোঝেননি। কল্পনা হল সেই শক্তি যার দ্বারা প্রতিটি ব্যক্তি মানসিক প্রতিরূপগুলো সৃষ্টি করে। কোন বস্তু ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করার পর যখন ইন্দ্রিয়ে সেই উত্তেজনা চলতে থাকে, তখন এটি ঘটে। সব প্রাণীই যেমন পিপীলিকা, মৌমাছি ইত্যাদি কল্পনার অধিকারী নয়। কল্পনা পূর্ব থেকেই সংবেদনকে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু কল্পনা সংবেদন থেকে পৃথক, দুকারণে। প্রথমত, আমরা কোন কিছু প্রত্যক্ষ না করেও কল্পনা করতে পারি এবং দ্বিতীয়ত, কল্পনা হল ভ্রমপ্রবণ, কিন্তু সংবেদন নয়।

অ্যারিস্টটল বলেন যে, যখন আমাদের শ্বেতবর্ণের সংবেদন হয়, তখন তার ক্ষেত্রে ভ্রম দেখা দেয় না। ভ্রম তখনই দেখা দেয় যখন আমরা যা প্রত্যক্ষ করি, সেই সম্পর্কে অবধারণ গঠন করি (Form Judgments)। তিনি বলেন যে, কল্পনা হল একটা গতি যা সংবেদনের দ্বারা উৎপন্ন হয়, যা সংবেদনেরই সদৃশ (“Imagination is a movement produced by sensation, similar to the sensation itself.”) সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, কল্পনা সংবেদন থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু সংবেদনের সঙ্গে এর পার্থক্য হল, কল্পনা সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। কল্পনার দুটি প্রয়োজনীয় ভূমিকা আছে। কল্পনা স্মৃতির ভিত্তি, কেননা মানসিক প্রতিরূপ ছাড়া স্মৃতি ঘটতে পারে না এবং ক্রিয়া ও গতির ক্ষেত্রে কল্পনা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। কারণ আমরা আগেই দেখেছি কামনা কল্পনাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে নেয়।

স্মৃতি : স্মৃতি কল্পনার সঙ্গে অভিন্ন, কেবলমাত্র এটুকু পার্থক্য যে, প্রতিরূপের সঙ্গে এক্ষেত্রে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়। সেটি হল প্রতিরূপটিকে একটি অতীত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার প্রতিলিপি বা নকল বলে চিনতে পারা। স্মরণ (Recollection) স্মৃতির তুলনায় উচ্চতর স্তরে অবস্থিত। স্মৃতিপ্রতিরূপ উদ্দেশ্যহীনভাবে মনে ঘােরাফেরা করে। স্মরণ হল ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতি প্রতিরূপগুলোকে মনে জাগিয়ে তোলা।

সংবেদন : আত্মার দুটি জ্ঞানমূলক বৃত্তি হল সংবেদন এবং বিচারবুদ্ধি। সংবেদনের আলোচনার সময় তিনি আবার আকার এবং উপাদানের মধ্যে যে পার্থক্য তার আলোচনা করেছেন। যখন সংবেদন ঘটে, তখন অ্যারিস্টটলের ভাষায় ইন্দ্রিয় ‘প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার’ (Perceptible Form) গ্রহণ করে, দৃষ্ট বস্তুর উপাদানকে গ্রহণ করে না। তিনি এক টুকরো মােমের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। যখন এক টুকরো মােমের ওপর একটা আংটির ছাপ দিয়ে দেওয়া হয় তখন মােমের টুকরো শুধু আংটির ছাপটাই গ্রহণ করে, যে সােনা দিয়ে আংটিটা তৈরি সেই সােনা গ্রহণ করতে পারে না। তাই যখন আমরা কোন কিছু প্রত্যক্ষ করি তখন চক্ষু, বস্তুটির প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকারটি গ্রহণ করে, তার উপাদান গ্রহণ করে না। কিন্তু প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার বলতে অ্যারিস্টটল কি বোঝাতে চেয়েছেন? অ্যারিস্টটলের মতে, সংবেদনের প্রাথমিক বস্তু হল বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি। প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই তার নিজস্ব প্রত্যক্ষ করার বস্তু রয়েছে, যেমন চক্ষুর বর্ণ। যখন আমরা কোন শ্বেতবস্তু প্রত্যক্ষ করি, চক্ষু, শ্বেতবর্ণের প্রত্যক্ষ গ্রাহ্য আকারটি গ্রহণ করতে পারে। বস্তুত, প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার এবং গ্রাহক-ইন্দ্রিয় একাঙ্গীভূত হয় এবং প্রত্যক্ষ করার সময় এক হয়ে যায়। ইন্দ্রিয় উপাত্তের (Sense Data) একটা মাত্রার মধ্যেই ইন্দ্রিয়টি ক্রিয়া করতে পারে। এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তীব্র আলোর ছটায় চক্ষু সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। |

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর শ্রেণীভেদ

সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, সংবেদন হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারের দ্বারা ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তা লাভ। এ প্রসঙ্গে তিনি তিন ধরনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর কথা বলেছেন। প্রথমত, প্রাথমিকভাবে যা আমরা প্রত্যক্ষ করি তা হল কোন বর্ণ, গন্ধ, শব্দ। ইন্দ্রিয়ের এসব বিশেষ বস্তুর সংবেদন সাধারণত ভ্ৰমমুক্ত হয়ে থাকে। সংবেদনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেই ভুল হয়ে থাকে। যেমন, পাখির কণ্ঠস্বরকে কোন বাদ্যযন্ত্র নির্গত শব্দ বলে মনে করা। দ্বিতীয়ত, কতকগুলো সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় (Common Sensibles) আছে, যেমন-গতি, আকার, সংখ্যা। এগুলো কোন একটি মাত্র বিশেষ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষিত হয় না, একাধিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষিত হয়। যেমন—গতি দৃষ্টি ও স্পর্শ এ উভয় ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষিত হয়। এ সকল ক্ষেত্রে কতকগুলো ইন্দ্রিয় একত্রে ক্রিয়া করে অর্থাৎ কিনা, ইন্দ্রিয় রূপ বৃত্তি (Faculty of Sense) সমগ্রভাবে ক্রিয়া করে এ প্রত্যক্ষণকে সম্ভব করে তোলে। তৃতীয় ধরনের হন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হল যাকে আকস্মিকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় (what is perceptible accidentally)। একটা টেবিল প্রত্যক্ষ করার সময় আমরা দেখি কিছু বর্ণ (Colour) বা বর্ণসমষ্টি কিন্তু আমরা আরও যা দেখি তাহল একটা বিশেষ টেবিল।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কোন বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার সময় আমরা বস্তুর বিভিন্ন গুণ প্রত্যক্ষ করি। গুণগুলোকে ধারণ করে রয়েছে যে অজ্ঞাত আধার তা আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে ধরা পড়ে না। অর্থাৎ কিনা, উপাদান অজ্ঞাত থেকে যায়। আমরা শুধু আকারকে জানি, কেননা গুণগুলো হল আকারের অংশ। তাই ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ তখনই ঘটে যখন বস্তু তার আকারটি আত্মায় মুদ্রিত করে দেয়। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটল বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দ্রিয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চেয়েছেন।

অ্যারিস্টটলের আত্ম-সম্পর্কীয় মতবাদের আলোচনায় বিচারবুদ্ধির আলোচনা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। অ্যারিস্টটলের মতে, আত্মার বৃত্তিগুলো দেহ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি এর ব্যতিক্রম স্বীকার করেছেন।

বিচারবুদ্ধি বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারটিকে গ্রহণ করে

তিনি বিচারবুদ্ধিকে সংবেদনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সংবেদনের ক্ষেত্রে উপাদানকে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকারটিকে গ্রহণ করা হয়। বিচারবুদ্ধি উপাদানকে বাদ দিয়ে বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার (Intelligible Form) গ্রহণ করে। তবে সংবেদনের ক্ষেত্রে তীব্র উত্তেজক যেমন ইন্দ্রিয়কে ধ্বংস বা বিনষ্ট করতে পারে, বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না।

যখন মন ‘পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাতব্য’ (knowable in the fullest sense) কোন বস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন মনের কোন বিনাশ ঘটে না বা পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাতব্য নয়’ এমন বিষয়কে অনুধাবন করতে মন কোন অসুবিধা বোধ করে না। বরং মন তাদের আরও ভালভাবে জানতে পারে। আমরা দেখেছি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য আকার হল বর্ণ, গন্ধ, শব্দ ইত্যাদি। বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার হল কোন বস্তুর সারধর্ম বা স্বরূপধর্ম (Essence)। এ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল জীবদেহের মাংসের উদাহরণ দিয়েছেন। সংবেদন জীবদেহে উষ্ণতা ও শীতলতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে কিন্তু আমরা বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই জীবদেহের মাংস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। মানুষের সংজ্ঞা-‘মানুষ হল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী’, বিচারবুদ্ধির বস্তুর উদাহরণ যা হল বিচারবুদ্ধির আকার।

ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রেও, বিচারবুদ্ধির তার বস্তুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা রয়েছে। বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে, বিচারবুদ্ধি বস্তুর সঙ্গে এক হয়ে যায় যেমন প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারের সঙ্গে এক হয়ে যায়। কিন্তু দুই-এর মধ্যে পার্থক্য হল, সংবেদন দেহের একটা অংশের ওপর নির্ভর করে যেমন, দৃষ্টির ক্ষেত্রে চক্ষুর ওপর। কিন্তু বিচারবুদ্ধি দেহের কোন ইন্দ্রিয় নয়।

বিচারবুদ্ধি এক ভিন্ন ধরনের আত্মা

অ্যারিস্টটল মনে করেন ইন্দ্রিয়ের বৃত্তির আবাসস্থল হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কিন্তু মানসিক কাজের আবাসস্থল মস্তিষ্ক, তা অ্যারিস্টটল বলেননি। তাই বিচারবুদ্ধির কাজ দেহের উপর নির্ভর না করেই চলতে থাকে। যেহেতু অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করেন যে, বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে দেহের কোন প্রসঙ্গই নেই, সেই কারণে তিনি বিচারবুদ্ধিকে এক ভিন্ন ধরনের আত্মা বলে অভিহিত করেছেন, যাকে দেহ থেকে পৃথক করা চলে। শুধুমাত্র বিচার-বুদ্ধিই দেহের কোন অংশের ব্যক্ততা নয়।

বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সংবেদনের সাদৃশ্য যেমন রয়েছে তেমনি বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। বিচারবুদ্ধি সংবেদনের মতই উপাদানকে বাদ দিয়ে আকারকে গ্রহণ করে। অবশ্য এক্ষেত্রে বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারকে বুঝতে হবে। বৈসাদৃশ্য হল, সংবেদন দেহের একটা অংশের ওপর নির্ভর, বিচারবুদ্ধি নয়।

বিচারবুদ্ধির দুটি স্তর—সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় ও অ্যারিস্টটল দুই ধরনের বিচারবুদ্ধির বা বিচারবুদ্ধির দুটি স্তরের কথা বলেছেন—নিষ্ক্রিয় (Passive) এবং সক্রিয় (Active)। এ পার্থক্য বুঝতে হলে সংবেদনের সঙ্গে তুলনা করেই একে বুঝতে হবে। দৃষ্টির ক্ষেত্রে বস্তুগুলো হল প্রত্যক্ষগোচর আকার, চক্ষু আকারের গ্রহণ কর্তা। কিন্তু ‘আলোক’ ভিন্ন প্রত্যক্ষগোচর আকারগুলো প্রত্যক্ষিত হবে না। তাই আলোক হল প্রয়োজনীয় সাহায্যকারী অবস্থা বা প্রাক শর্ত। বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রেও বস্তু হল বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার। তাদের অনুধাবন করে নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি। কিন্তু এখানেও একটি তৃতীয় বিষয়ের প্রয়োজন, সেটি হল সক্রিয় বিচারবুদ্ধি। এটি ছাড়া বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারগুলো জ্ঞাত হবে না। বাস্তবে চিন্তা না করলেও মনের চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। মনের চিন্তা করার এ শক্তি, যা মনে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, তাকে নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি বলে। এক্ষেত্রে মন হল এক টুকরো পালিশ করা মােম, যার ছাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কিন্তু যে এখনও পর্যন্ত ছাপ গ্রহণ করেনি। বাস্তব চিন্তনের ক্রিয়াই হল সক্রিয় বিচারবুদ্ধি। নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি হল বিনাশশীল। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি নিত্য এবং অবিনশ্বর। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে এর বিনাশ ঘটে না। এর আদি-অন্ত নেই। বাইরে থেকে এটা দেহে আসে এবং মৃত্যুর পর দেহ থেকে বহির্গত হয়ে যায়। একটা প্রশ্ন হল, সক্রিয় বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের যথার্থ মতবাদটি কি?

এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের যথার্থ মতবাদটি কি জানা যায় না। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি বুদ্ধিগ্রাহ্য আকারগুলোকে বাস্তবায়িত বা ব্যক্ত করে তোলে। যার মধ্যে বুদ্ধিগ্রাহ্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে তাকে বাস্তবে বৃদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলা হল এর কাজ। এ কথাই অ্যারিস্টটল বলতে চেয়েছেন, যখন সক্রিয় বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন যে, এটি সব কিছুকে তৈরি করে (it makes all things)।

সক্রিয় বিচারবুদ্ধির প্রকৃতি নিয়ে মতভেদ

সক্রিয় বিচারবুদ্ধি প্রকৃতি কি, তাই নিয়ে অ্যারিস্টটলের ভাষ্যকারদের মতে, মতবিভেদ লক্ষ করা যায়। অধিবিদ্যায় ঈশ্বর বা অপ্রবর্তিত প্রবর্তককে বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞা হিসেবে অভিহিত করাতে কেউ কেউ মনে করেন যে সক্রিয় বিচারবুদ্ধি মানবীয় নয় , ঐশ্বরিক। আবার এমন ধারণা করার পক্ষেও যুক্তি আছে যে, সক্রিয় বিচারবুদ্ধি প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের (individual man) মধ্যে বর্তমান। সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করলে, ঈশ্বর হয়ে পড়বেন মানুষের অন্তর্বর্তী। কিন্ত অ্যারিস্টটলের অপ্রবর্তিত প্রবর্তক জগৎ-অতিবর্তী সত্তা। তাই একটা অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়। সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে যেহেতু মানুষের থেকে স্বতন্ত্র করা যায়, তাই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, এটা ব্যক্তি মানুষের মধ্যে অস্তিত্বশীল হতে পারে। যেহেতু সক্রিয় বিচারবুদ্ধি নিষ্ক্রিয় নয়, এবং যেহেতু নিষ্ক্রিয় বিচারবুদ্ধি বিনাশশীল, তার থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ব্যক্তি হিসেবে আমরা সক্রিয় বিচারবুদ্ধির অংশীদার।

কোন কোন লেখক মনে করেন যে, এ দুই অভিমতের মধ্যে যথার্থ কোন বিরোধিতা নেই। সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে পুরোপুরি ঐশ্বরিক বা আমাদের মধ্যে এক ঐশ্বরিক অংশ যা-ই বলা হােক না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় বিচারবুদ্ধিকে, যা বুদ্ধিগ্রাহ্য আকার, তাকে বাস্তবে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলে, এ সিদ্ধান্তের কোন হেরফের হয় না। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি সুনিশ্চিতভাবে নৈর্ব্যক্তিক এ অর্থে যে, এটি ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর নয়। আর সক্রিয় বিচারবুদ্ধি যেহেতু অজড়াত্মক তাই আমাদের মধ্যে অবস্থিত, না আমাদের বাইরে অবস্থিত, এ প্রশ্ন অবান্তর। সক্রিয় বিচারবুদ্ধি অবিনাশশীল বলা হলে এটা বুঝতে হবে যে এখানে ব্যক্তিগত অমরত্বের প্রশ্ন ওঠে না।

কপলস্টোনের মন্তব্য : সক্রিয় বিচারবুদ্ধি প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে অবস্থিত হওয়ার জন্য কি ব্যক্তিভেদে পৃথক বা এটি সকল মানুষের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার জন্য এক অভিন্ন তত্ত্ব? কপলস্টোন মনে করেন যে, সক্রিয় বিচারবুদ্ধি হল একটা নীতি বা তত্ত্ব যা সব মানুষের মধ্যে অভিন্ন। এ হল এমন একটা বিচারবুদ্ধি যা মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে তার মধ্যে ক্রিয়া করে এবং মৃত্যুর পরেও যার বিনাশ ঘটে না।

অ্যারিস্টটলের আত্ম-সম্পর্কীয় মতবাদের মূল্য

অ্যারিস্টটলের আত্মসম্পৰ্কীয় মতবাদ সম্পর্কে কি মন্তব্য করা যেতে পারে? অ্যারিস্টটল আত্মা সম্পর্কে এক নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ ধারণা উপস্থাপিত করেছেন। যখন তিনি বলেন যে, যে স্বাভাবিক দেহের মধ্যে প্রাণ অব্যক্তভাবে আছে তার প্রথম ব্যক্ততা হল আত্মা, তখন তিনি দেহ এবং আত্মার সম্পর্কের এক মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলতে হবে এবং প্লেটোর দ্বৈতবাদের সঙ্গে তার পার্থক্য লক্ষণীয়। ‘ডি.আনিমা’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটলের আত্মা সম্পর্কীয় আলোচনার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, তিনি ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, একজন প্রকৃতিবাদী (Naturalist)-র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

তিনি সংবেদন সম্পর্কে কতকগুলো সাধারণ নিয়ম বিচার না করেই আমাদের কাছে উপস্থাপিত করেননি। কোন্ কোন্ প্রাণী কি কি ইন্দ্রিয়ের অধিকারী এসব নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্লেটোর আত্মা সম্পর্কীয় মতবাদের অনেক কিছুই তিনি বর্জন করেছিলেন সত্য, তবে প্লেটো এবং প্রাচীন কিছু গ্রীক লেখকের সঙ্গে তিনি একমত যে, আত্মার অংশবিশেষ অবিনশ্বর, এবং বিচারবুদ্ধি বা প্রজ্ঞা ঐশ্বরিক।

অ্যারিস্টটলের নীতিশাত্র (Aristotle’s Ethics)

অ্যারিস্টটলের নীতিদর্শনের প্রধান উৎস ‘দি নাইকোমেকিয়ান এথিকস্

অ্যারিস্টটলের রচনা সঙ্কলনে তিনটি স্বতন্ত্র নীতিশাত্ৰ সম্পৰ্কীয় রচনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ তিনটি রচনা হল ‘The Magna Moralia’, ‘The Eudemian Ethics’ এবং The Nichomachean Ethics’। গ্রীক দর্শনের লেখকবৃন্দের মধ্যে অনেকেই প্রথম দুটি রচনাকে প্রামাণ্য বলে মনে করেন না। তাদের মতে, অ্যারিস্টটলের নীতিদর্শনের প্রধান উৎস হল ‘দি নাইকোমেকিয়্যান এথিকস্’। তাই বিশেষ করে এ গ্রন্থের ওপর নির্ভর করেই আমরা অ্যারিস্টটলের নৈতিক অভিমতগুলোর সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য সচেষ্ট হব। নিকোমেকিয়্যান এথিকস্’ গ্রন্থটি অ্যারিস্টটলের রচনার মধ্যে সবচেয়ে সুবিন্যস্ত এবং সুসংহত রচনা। অ্যারিস্টটলের অন্য রচনার তুলনায় এ রচনাটিতে প্লেটোর ডায়ালগের গুণ লক্ষ করা যায়।

নীতিশাত্রের আলোচনার ক্ষেত্রে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মধ্যে পার্থক্য

নীতিশাত্রের প্রকৃতি, লক্ষ এবং নৈতিক প্রশ্নের আলোচনায় যে পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার, এ সব বিষয় সম্পর্কে প্লেটোর অভিমতের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের অভিমতের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উভয় দার্শনিকের নৈতিক অভিমত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে উভয়ের নৈতিক অভিমতের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন যাতে আমরা একের অভিমতকে অপরের অভিমত বলে ভুল না করি।
নীতিশাত্রে গাণিতিক সুনিশ্চয়তা লাভ সম্ভব নয়। উভয়ের মধ্যে নীতিদর্শন বিষয়ে নিম্নলিখিত পার্থক্য লক্ষ করা যায় –

(ক) নীতিশাস্ত্রকে যথার্থ বিজ্ঞান ভাবা ও এতে গাণিতিক নিশ্চয়তা থাকা নিয়ে পার্থক্য : অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, নীতিশাস্ত্র কোন যথার্থ বিজ্ঞান নয়। প্লেটোর মতে, কি নীতিশাস্ত্রে, কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গাণিতিক নিশ্চয়তাই হল মানদণ্ড। অ্যারিস্টটল গণিতের উদাহরণ দিয়েছেন কেবলমাত্র গাণিতিক এবং নীতিশাস্ত্র বিষয়ক অনুসন্ধান কার্যের মধ্যে যে মূল পার্থক্য তাকে সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য। অ্যারিস্টটলের মতে, প্রমাণ এবং সুনিশ্চয়তা গণিতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে উপযোগী। কিন্তু নীতিশাস্ত্র এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কোন স্থান নেই। শেষােক্ত দুটি শাত্রে আমরা যতখানি সুনির্দিষ্টতা লাভ করা সম্ভব ততখানি সুনির্দিষ্টতা লাভ করার জন্য সচেষ্ট হব। অর্থাৎ কিনা, এ দুই শাত্রের আলোচ্য বিষয় আমাদের যতখানি সুনির্দিষ্টতা লাভে সক্ষম করবে, আমরা তাই লাভ করতে চাইব। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে তোলার জন্য অ্যারিস্টটল নৈতিকতা প্রথাগত (Morality is Conventional), এ মতবাদের উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল দেখনো যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে মতভেদের বিষয়টি খুবই ব্যাপক। তিনি নিজে অবশ্য এ মতবাদে বিশ্বাসী নন। উচিত এবং অনুচিত-এর পার্থক্য প্রথাগত এবং তাদের প্রমাণের বিষয় করা যেতে পারে, এ উভয় বিষয়ই তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, উচিত এবং অনুচিতের পার্থক্য হল স্বাভাবিক (Natural) পার্থক্য। তবে নীতিশাস্ত্র চিকিৎসাশাস্ত্রের মত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি নিয়ে আলোচনা করে। ব্যাধি সম্পর্কে যেমন সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, নৈতিক প্রশ্ন সম্পর্কেও করা যায়।

তবে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাকে বাতিল করা যেতে পারে না। সােজা কথা হল, নৈতিক অনুসন্ধান কার্যে যতখানি নির্দিষ্টতা লাভ করা সম্ভব ততখানি নির্দিষ্টতা লাভের জন্যই আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।

(খ) অনুসন্ধান কার্যের পদ্ধতি সম্পর্কে পার্থক্য : দ্নৈতিক অনুসন্ধান কার্যের পদ্ধতি সম্পর্কেও প্লেটোর, সঙ্গে অ্যারিস্টটলের পার্থক্য রয়েছে। অ্যারিস্টটলের মতে, নৈতিক সততা অর্জন করা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে নয়। প্লেটো মনে করেন যে, নৈতিক সততা অর্জন সাধারণ মানুষের ক্ষমতা বহির্ভুত। তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে নৈতিক প্রশ্নের বিচার করার সময় অ্যারিস্টটল সাধারণ মানুষের অভিমতকে অগ্রাহ্য করার পক্ষপাতী নন। অর্থাৎ অ্যারিস্টটলের মতে, সুখ অথবা সততা সম্পর্কীয় প্রচলিত অভিমতগুলোর পরীক্ষণ বা বিচারকার্য দিয়েই নৈতিক অনুসন্ধান কার্য শুরু হওয়া উচিত। প্লেটো সক্রেটিসের মত সততা সম্পর্কে সাধারণ লোকের ধারণাকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন না এবং প্রায়শই তাদের অসঙ্গত এবং অর্থহীন গণ্য করতেন।

অ্যারিস্টটল কিন্তু নৈতিকতা সম্পর্কে লৌকিক ধারণাকে অসঙ্গত জেনেও অগ্রাহ্য করতে চান না। কারণ সত্য আবিষ্কারের জন্য সেগুলোর বিচারের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করতেন। অ্যারিস্টটল মনে করতেন তার কাজ হল যতদূর সম্ভব, সাধারণভাবে স্বীকৃত নৈতিক অভিমতগুলোকে অগ্রাহ্য না করে, তার মধ্যেই সত্যের সন্ধান করা। তাই নৈতিকতা সম্পর্কে সাধারণ অভিমতের প্রতি প্লেটোর তুলনায় অ্যারিস্টটল অনেক বেশি মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু আর এক বিষয়ে উভয়ের পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য আছে। অ্যারিস্টটল মনে করেন, যা আমরা জানি তাকে নিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করতে হবে। তবে এর দুটো অর্থ আছে-যেমন, যা আমাদের জানা। আছে আর যাকে পরিপূর্ণভাবে আমরা জেনেছি (What is known Absolutely)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, যে বিশেষ বা আমাদের সংবেদনের কাছাকাছি তাকেই আমরা ভাল করে জানি। অ্যারিস্টটলের মতে, নৈতিক অনুসন্ধানকার্য প্রথমটি নিয়েই শুরু হবে। প্লেটোর পদ্ধতির ক্ষেত্রে ‘অবরোহ বা আরোহবিরোধী’ (Counter-Inductive) কোন্ পদটি যথাযথভাবে প্রযোজ্য বলা কঠিন হলেও এটা স্পষ্ট যে, অ্যারিস্টটল আরোহ পদ্ধতিকেই নীতিশাস্ত্রের যথার্থ পদ্ধতি বলে গণ্য করতেন। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হল, অভিজ্ঞতায় যা এলোমেলোভাবে দেওয়া আছে তাকে গ্রহণ করে, যুক্তির সাহায্যে, নীতি সম্পর্কিত বচন প্রতিষ্ঠা করা।

(গ) লক্ষ বা উদ্দেশ্যের দিক থেকে পার্থক্য : নৈতিক প্রশ্নের আলোচনায় লক্ষ বা উদ্দেশ্যের দিক থেকেও উভয় দার্শনিকের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এ পার্থক্য হল, উভয়ের রচনাতে কি অনুপাতে বর্ণনা, নির্দেশন (Prescription) বা বিশ্লেষণ এবং অনুমােদনের (Recommendation) ব্যাপার রয়েছে। প্লেটোর ডায়ালগে নৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্লেটোর আসল অভিপ্রায় হল অনুমােদন বা নির্দিষ্ট কোন অভিমত মেনে নিতে বলা। অ্যারিস্টটলও বর্ণনা ও নির্দেশ করা—এ দুই বিষয় নৈতিক সম্যসার ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন, কিন্তু বিভিন্ন মাত্রায়। সাধারণ অভিমত তিনি বর্জন করবেন কেবল যদি তা বর্জন করতে হয়। অ্যারিস্টটল মানুষের প্রকৃতিকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবে গ্রহণ করেছেন এবং মানুষের কিভাবে আচরণ করা উচিত তা ব্যক্ত করেছেন। তবে অ্যারিস্টটলও প্লেটোর মত কোন নির্দিষ্ট অভিমত মেনে নেবার কথা বলেছেন। তিনিও প্লেটোর মত নিজ অভিমত বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপিত করেছেন। তার গ্রন্থ ‘Nicomachean Ethics’-এ, যেখানে তিনি পরম আনন্দময় জীবনের আদর্শ নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেটি পাঠ করলে অ্যারিস্টটলের উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা প্রমাণিত হবে।

নীতিশাস্ত্রে প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের ধারণার পার্থক্য নিয়ে মন্তব্য : স্টেইস্-এর মন্তব্য – প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কীয় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য করতে গিয়ে স্টেইস্ মন্তব্য করেছেন যে, প্লেটোর তুলনায় অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহারিক। প্লেটো তার নীতিশাস্ত্র বিষয়ক শিক্ষা প্রচার করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের সীমারেখা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন এবং যার ফলে তা হয়ে উঠেছে এক আদর্শ কাল্পনিক জগতের কথা। কিন্তু অ্যারিস্টটলের নীতিশিক্ষা বাস্তব জগতের প্রতি উদাসীন নয়। তিনি যে কল্যাণের কথা তার নীতিশাত্রে আলোচনা করেছেন সেই কল্যাণের কথা বলতে গিয়ে তিনি এমন কোন আদর্শ কল্যাণ বোঝেননি যা মানুষ সেই পৃথিবীতে লাভ করতে পারে না। বরং তিনি যে কল্যাণের কথা বলেছেন তার প্রকৃতি এমন যে, মানুষ নিজেকে যে অবস্থাতেই প্রতিষ্ঠিত দেখুন না কেন, সেই কল্যাণ লাভ করা উচিত বলে মনে করতে পারে। প্লেটো চেয়েছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের উর্ধ্বে বিচরণ করতে। অ্যারিস্টটল বাস্তব অভিজ্ঞতার জগতের সীমারেখা অতিক্রম করতে চাননি।

জি.ই. আর. লয়েডের মন্তব্য – জি.ই.আর. লয়েড বলেন, অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞান প্লেটোর নীতিবিজ্ঞানের তুলনায় অধিকতর শুদ্ধভাবে আরোহমূলক এবং বর্ণনামূলক”। (G.E.R. Lioyd : Aristotle : The Growth and Structure of his Thought.)।

রাসেলের মন্তব্য – বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মতবাদগুলো প্রধানত তার সময়কার শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রচলিত অভিমতগুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে। প্লেটোর মতবাদগুলোর মত অ্যারিস্টটলের মতবাদগুলো রহস্যময় ধর্মের ভাবে পূর্ণ নয় এবং রিপাবলিকের সম্পত্তি ও পরিবার সম্পৰ্কীয় যে সব নৈতিক মতবাদ সেগুলোও সূচিত করে না। ভদ্র সৎ আচরণবিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ তার নীতিশাত্রে তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা যেতে পারে এমন নীতিগুলোর সুসঙ্গত বিবরণ দেখতে পাবেন। (B. Russell: A History of Western Philosophy; Page 173.)

পরম কল্যাণ (The Highest Good)

অ্যারিস্টটলের মতে, নীতিশাত্রের আলোচ্য বিষয় হল মানুষের পরম কল্যাণ। অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানই মানুষের কল্যাণ (Good for Man) নিয়ে আলোচনা করে।

রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির কল্যাণ অভিন্ন : রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির কল্যাণ অভিন্ন। তবে ব্যক্তির কল্যাণের তুলনায় রাষ্ট্রের কল্যাণ ব্যাপকতর এবং মহত্তর। প্লেটো রিপাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের আলোচনায় এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্লেটোর মতানুসারে ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতার তুলনায় আদর্শ রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণতা ব্যাপকতর। অ্যারিস্টটল নীতিশাস্ত্রকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানের শাখা রূপে গণ্য করেছেন। তার পলিটিক্স’ গ্রন্থে তিনি প্রথমে ব্যক্তি সম্পর্কিত নীতিশাত্র (Individual Ethical Science) ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত নীতিশাস্ত্র (Political Ethical Science) নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কপলস্টোনের বক্তব্য – অ্যারিস্টটলের নীতিশাস্ত্রবিষয়ক আলোচনার সূচনাতে। কপলস্টোন বলেন, ‘অ্যারিস্টটলের নীতিশাস্ত্র স্পষ্টতই উদ্দেশ্যমূলক। তার মতে, মানুষের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত হয় এমন কোন কর্ম নিজে নিজেই উচিত গণ্য হতে পারে না। যে কর্ম মানুষের পক্ষে কল্যাণকর বা মানুষের কল্যাণ সাধন করে তাই উচিত বা সৎ কর্ম এবং যে কর্ম মানুষের পক্ষে কল্যাণকর নয় বা মানুষের কল্যাণ সাধন করে না, তা অনুচিত বা অসৎ কর্ম।

আগেই বলা হয়েছে যে, অ্যারিস্টটল তাঁর নীতিশাস্ত্র পরম কল্যাণের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিষয়টা কি বুঝে নেওয়া যাক্, অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষের প্রতিটি কাজের, প্রতিটি অনুসন্ধান ক্রিয়ার, প্রতিটি নির্বাচনের লক্ষ হল কল্যাণ লাভ করা।

পরম কল্যাণের সংজ্ঞা : পরম কল্যাণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেন, ‘পরম কল্যাণ হল কোন কার্যের লক্ষ যাকে তার নিজের জন্যই কামনা করা হয়, যখন সব কিছুকে এর জন্যই কামনা করা হয়। (“an end of action which is desired for its own sake, while everything else is desired for the sake of it.” (En. 1094a 19))। তাই কল্যাণের সংজ্ঞায় আমরা দেখতে পাই যে, ‘কল্যাণ হল তাই, যার দিকে সকল কিছুর লক্ষ। তাই বোঝা যাচ্ছে যে, অ্যারিস্টটল কল্যাণ বলতে বুঝেছেন কর্মের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে।

সুতরাং উদ্দেশ্যের ভিন্নতা অনুসারে কল্যাণও হয়ে পড়ে বহু ধরনের। যেমন চিকিৎসকের লক্ষ হল রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষা, সুতরাং তাই হল চিকিৎসকের কল্যাণ। নাবিকের লক্ষ নিরাপদ সমুদ্রযাত্রা, ব্যবসায়ীর লক্ষ সম্পদ আহরণ, তা-ই তাদের কাছে কল্যাণ। আবার কোন কোন কল্যাণ ব্যাপকতর কোন কল্যাণের অধীনস্থ হতে পারে। যেমন, কোন ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য অর্থ লাভ, কিন্তু এ সামর্থ লাভ অন্য বৃহত্তর উদ্দেশ্যের অধীন। সেটি হল অর্থের সাহায্যে জীবনে সুখপ্রদ বস্তু আহরণ। তাই স্বাস্থ্য, শক্তি, খ্যাতি ইত্যাদি অনেক উদ্দেশ্যই ব্যাপকতর উদ্দেশ্যের অধীন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এমন কোন উদ্দেশ্য বা কল্যাণের কথা বলা যেতে পারে কি, যা অন্য কোন উদ্দেশ্য লাভের উপায়রূপে নয়, যাকে তার নিজের জন্যই কামনা করা হয়, বা সব উদ্দেশ্য যার অন্তর্ভুক্ত? সেই রকম কোন উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব যদি থাকে তাহলে তা হবে পরম কল্যাণ (The highest good), মানুষের চরম অভীষ্ট বা লক্ষ, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু। অ্যারিস্টটল এ পরম কল্যাণের স্বরূপ আবিষ্কার করতে চান, এবং দেখতে চান এমন কোন শাস্ত্র আছে কি-না যা এ পরম কল্যাণের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করে।

প্লেটোর কল্যাণের আকারের সমালোচনা ও অ্যারিস্টটল প্লেটোর কল্যাণের আকার (Form of the Good)-এর সমালোচনা করেছেন। তাঁর প্রথম বক্তব্য হল, ‘কল্যাণ’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কল্যাণ’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। সব কল্যাণের সাধারণ রূপ হিসেবে একটিমাত্র আকার থাকতে পারে না। (There cannot be a single form common to all ‘goods’) I অ্যারিস্টটলের দ্বিতীয় বক্তব্য হল কল্যাণের কোন আকার থাকলে এর জ্ঞান হতো নিরর্থক।

আনন্দ (Happiness)

আনন্দের বিভিন্ন অর্থ : আগেই বলা হয়েছে অ্যারিস্টটল-এর মতে, নীতিশাস্ত্রের অনুসন্ধানের বিষয়টি হল মানুষের কল্যাণ কি, বা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ কি? অ্যারিস্টটল বলেন যে, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রায় সব মানুষই একই উত্তর দেবে যে, তা হল আনন্দ (Happiness)। কিন্তু অ্যারিস্টটল বলেন যে, মানুষের পরম কাম্যবস্তুটির নাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন মতভেদ পরিলক্ষিত না হলেও, আনন্দ বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা নিয়ে মানুষে মানুষে মতভেদের অন্ত নেই। কেউ মনে করেন, আনন্দ হল সুখ (Pleasure), আবার কেউ মনে করেন আনন্দ হল অর্থ বা খ্যাতি। এ ছাড়াও একই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে আনন্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেন। ব্যক্তি পীড়িত হলে মনে করে স্বাস্থ্যই হল আনন্দ। আবার যখন সে অভাবগ্রস্ত তখন সে মনে করে অর্থই হল আনন্দ। কিন্তু প্রকৃতই কি এরা আনন্দ বলে গণ্য হতে পারে? খ্যাতি জীবনের লক্ষ হতে পারে না, কারণ খ্যাতি আমরা অপরের কাছ থেকে লাভ করি, খ্যাতি আমাদের নিজস্ব বিষয় নয়। ইন্দ্রিয়সুখ মানুষের পরম কাম্যবস্তু হতে পারে না, ইতর প্রাণীদের হতে পারে। কেননা সংবেদন হল প্রাণীদের বিশেষ ক্রিয়া, মানুষের নয়। মানুষের বিশেষ ক্রিয়া হল বিচারবুদ্ধি। নৈতিক সততা (Moral Virtue)-ও জীবনের পরম কাম্যবস্তু হতে পারে না। কেননা, নৈতিক সততার সঙ্গে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুঃখ জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু আনন্দ, যা হল জীবনের পরম কাম্যবস্তু, অবশ্যই হবে সক্রিয়তা এবং তা দুঃখকে দূরে রাখে।

মানুষের ক্রিয়া : অ্যারিস্টটলের মতে, আনন্দের ধারণাকে ভাল করে বুঝে নিতে হলে আমাদের মানুষের ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। প্রতিটি জীবের কল্যাণ হল তার বিশেষ ক্রিয়ার যথাযথ সম্পাদন। কোন ভাস্করের, কল্যাণ তার ভাস্কর্যের কাজে নিহিত। তবে ভাস্করের কাজে বললে ভুল হবে, ভালভাবে ভাস্করের কার্য সম্পাদনে নিহিত। অ্যারিস্টটলের মতে, সামগ্রিকভাবে মানুষের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রশ্ন হল, এমনিতে মানুষের ক্রিয়া কি? নিশ্চয়ই এ ক্রিয়া পুষ্টিবিধান এবং বংশরক্ষা বা সংবেদন হতে পারে না। কেননা এ সব কাজ মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীও সম্পাদন করে।

তাই মানুষের ক্রিয়া বললে বুঝতে হবে তার এমন ক্রিয়া যার দ্বারা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র করে দেখা যায়। সেই ক্রিয়া হল বিচারবুদ্ধির ক্রিয়া বা বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী ক্রিয়া (activity in accordance with reason)। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের আর একটি বিষয়কে যোগ করে দিতে হবে সেটি হল এ ক্রিয়াকে হতে হবে সততা অনুযায়ী ক্রিয়া, সৎ ক্রিয়া (Virtuous Activity)। সততা বলতে তিনি বুদ্ধিগত এবং নৈতিক, এ উভয় প্রকার সততাকে বুঝেছেন।

বিষয়টা ভাল করে বুঝে নেওয়া যাক : মানুষ শুধুমাত্র বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব নয়, উদ্ভিদের মত তার ক্ষুধা আছে, প্রাণীদের মত সংবেদন আছে। ক্ষুধা এবং অন্যান্য রিপু, কামনা ও আবেগ তাঁর প্রকৃতির অংশবিশেষ। তাই সততা দুই প্রকার—বুদ্ধিগত ও নৈতিক। বুদ্ধিগত সততা হল বিচারবুদ্ধির জীবন, চিন্তার বা দর্শনের জীবন যাপন করা। এ বুদ্ধিগত সততাকে অ্যারিস্টটল ‘Dianoetic’ নাম দিয়েছেন। নৈতিক সততা হল আবেগ, কামনাবাসনাকে বিচারবুদ্ধির অধীনস্থ করা। বুদ্ধিগত সততাই হল শ্রেষ্ঠ সততা।

আনন্দ সম্পর্কীয় অন্যান্য মতবাদ বিচার : ‘আনন্দ’ সম্পর্কে অন্যান্য ব্যক্তিরা যে সব মতবাদ পােষণ করেন সেগুলোর সঙ্গে তাঁর নিজের মতবাদের মিল আছে কিনা, অ্যারিস্টটল তা বিচার করে দেখতে চান। তিনি দাবী করেন যে, তাঁর মতবাদের মধ্যে অন্য মতবাদগুলো অন্তর্ভুক্ত। অ্যারিস্টটল বলতে চান যে, যখন তিনি মনে করেন আনন্দ হল সততা অনুসারে কর্মসম্পাদন, তখন আনন্দ সম্পর্কে সাধারণ অভিমতগুলোকে তিনি বর্জন করেননি। যেমন, আনন্দ থেকে সুখকে (Pleasure) বর্জন করার প্রশ্ন ওঠে না, কেননা, সৎ কার্য সম্পাদিত হলে স্বাভাবিকভাবে সুখ তাকে অনুসরণ করে। পরিপূর্ণ আনন্দের জন্য শুধুমাত্র আত্মার কল্যাণ নয়, দেহের কল্যাণও দরকার। যেমন-সৌন্দর্য; স্বাস্থ্য; বাহ্য কল্যাণ যেমন পরিমিত অর্থ এগুলোর প্রয়োজন আছে। Cynic সম্প্রদায় বাহ্য কল্যাণকে সততা বহির্ভূত মনে করেছিলেন, কিন্তু, অ্যারিস্টটল তাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি।

বাহ্য-কল্যাণ সততা লাভে সহায়তা করে : এখানে বিষয়টাকে ভাল করে বুঝে নিতে হবে। বাহ্য ধন সম্পদ বা অন্যান্য বস্তুর যে নিজস্ব মূল্য আছে অ্যারিস্টটটল তা মনে করেন না। অথচ যা নিজে নিজে কল্যাণপ্রদ তা হল সততা। কিন্তু বাহ্য কল্যাণ সততার অনুসন্ধানে বা সততার অধিকারী হবার জন্য মানুষকে সাহায্য করে। দারিদ্র্য, ব্যাধি, দুর্ভাগ্য মানুষের সৎ হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বাহ্য কল্যাণ, কল্যাণ লাভের উপায়; তাই তাদের বর্জন করার প্রশ্ন ওঠে না। অর্থ, বন্ধু, মাথ্য, সৌভাগ্য আনন্দ নয় কিন্তু তারা আনন্দের অভাবাত্মক (Negative) শর্ত। এদের বাদ দিয়ে আনন্দ লাভ করা কঠিন, এরা থাকলে আনন্দ লাভ সহজতর হয়। তাই সেভাবেই তাদের মূল্য বিচার হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

সুতরাং আনন্দের প্রকৃতি হল ক্রিয়া, যে ক্রিয়া মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক। এ ক্রিয়ার জন্য সুখ বা বাহ্য উন্নতিকে বর্জন করার কোন প্রয়োজন নেই। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অ্যারিস্টটলের নীতিবিষয়ক চিন্তা এ সাধারণ জগতের প্রতি উদাসীন নয়।

আনন্দ হল ক্রিয়া : কোন কোন বাহ্য কল্যাণ আনন্দের বা আনন্দ লাভের প্রাকশর্ত এবং এগুলো কিছুটা দৈবের ওপর নির্ভর। কিন্তু আনন্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, যেহেতু এটি আত্মার ক্রিয়া, তাই এটি দৈব-নির্ভর নয়, মানুষের প্রচেষ্টা নির্ভর। শিশু বা নিম্নতর প্রাণীরা আনন্দ লাভ করতে পারে না, কেননা তারা সততা অনুসারে আত্মার ক্রিয়া সম্পাদনে সমর্থ নয়। মানুষ আনন্দ লাভ করে, যখন মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়—এ গ্রীক ধারণা অ্যারিস্টটল বর্জন করেছেন। আনন্দ হল ক্রিয়া, এটি মনের কোন অবস্থা নয়। তাছাড়া আনন্দের জীবন সুখের জীবন। অ্যারিস্টটল বলেন, আনন্দ হল সবচেয়ে ভাল, সবচেয়ে মহৎ এবং সবচেয়ে সুখের বিষয়। আনন্দের জীবন হল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সততা ও সুখ উভয়ই এর অন্তর্গত। আনন্দের প্রকৃতিই হল ক্রিয়া। অ্যারিস্টটলের এ অভিমতের সমালোচনা করেছেন। জনৈক লেখক (Anthony kenny : Aristotle on Happiness, Page 31 in Atricles on Aristotle, Edited by Barnes, Schofield & Sorabji.)। তিনি বলেন, এ আমাদের কাছে ভাবতে অদ্ভুত লাগে যে, অ্যারিস্টটল আনন্দকে শুধুমাত্র ক্রিয়া বলেই গণ্য করবেন।

আনন্দ ও সততা আলাদা : অ্যারিস্টটল যুক্তি হিসেবে দেখান যে, আনন্দ ও সততা আলাদা, কারণ এটিও সম্ভব হতে পারে যে কোন ব্যক্তি, যার সততা আছে, সে তার সমস্ত জীবনটা ঘুমিয়ে বা আলস্যে কাটাল বা তাকে খুব দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হল। এমন লোককে কেউ সুখী বলবে না। আবার এ কথাও নিশ্চয় সত্য যে, কোন লোক যদি সারা জীবনটা বিছানাতেই শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয় এবং কখনও কোন সৎ কাজ করে না, তাহলে তাকে সৎ ব্যক্তি বলাও অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সততা হচ্ছে বিশেষ ক্রিয়া বা পেশা, কিন্তু আনন্দ একটা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা, সততা দুর্ভাগ্যের দ্বারা পীড়িত হতে পারেনা, কিন্তু আনন্দ দুর্ভাগ্যের দ্বারা পীড়িত হতে পারে।

সব লোক আনন্দ চায়না : এ কথা কি সত্য যে, সব লোক আনন্দ চায়? এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমতই বা কি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হার্ডি (Hardie) যে দুটি লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য করেছেন, কর্তৃত্বমূলক (Dominant) এবং অন্তর্ভুক্তিকর (Inclusive) লক্ষ, তার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রশ্নটির উত্তর করা যেতে পারে। যদি আনন্দকে কর্তৃত্বমূলক লক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে এটি হবে একটিমাত্র প্রধান কামনার বস্তু; ধরা যাক্, অর্থ বা দর্শন। আর যদি এটিকে অন্তর্ভুক্তিকর লক্ষ রূপে গণ্য করা হয়, তাহলে আনন্দ হবে স্বনির্ভর একাধিক কামনার শৃঙ্খলাপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত পরিতৃপ্তি। এটা খুবই স্পষ্ট বিষয় যে, প্রত্যেকেরই জীবনে একটিমাত্র কর্তৃত্বমূলক লক্ষ নেই। কারণ সমান গুরুত্বপূর্ণ অথচ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কবর্জিত একাধিক লক্ষ্যকে পরপর অনুসরণ করা জীবনে সম্ভব। যদি আনন্দ বলতে আমরা একটিমাত্র কর্তৃত্বমূলক লক্ষ্যের কথা চিন্তা করি, তাহলে বলা ঠিক না যে, সব মানুষ আনন্দ কামনা করে।

যদি আনন্দকে অন্তর্ভুক্তিকর লক্ষ হিসেবে গণ্য করা যায় তাহলে কি হয়? এ ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, জীবনে প্রতিটি অন্তর্ভুক্তিকর পরিকল্পনা আনন্দকে অনুসরণ করার পরিকল্পনা। কোন ব্যক্তি অপরের আনন্দের জন্য তার জীবনকে উৎসর্গ করার লক্ষ গ্রহণ করতে পারে বা এমন কোন লক্ষ লাভ করার কথা ভাবতে পারে বা তার মৃত্যুর পরে লভ্য হতে পারে। এ কথা ঠিক যে স্বার্থবর্জিত সেবাব্রতের মধ্যেও মানুষ আনন্দ পেতে পারে, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। আনন্দকে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ হিসেবে গণ্য করলে, সেটি নানা ধরনের উপাদানকে তার অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে। কিন্তু প্রতিটি দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যকে সুসঙ্গতভাবে অনুসরণ করলে যে তা আনন্দের আদর্শের উপযোগী হবে তা নয়।

অ্যারিস্টটল, যিনি আনন্দকে কর্তৃত্বমূলক অর্থে গ্রহণ করেছেন, কখনও দাবি করেন না যে, প্রতিটি লোক আনন্দ চায়। তিনি মনে করেন আনন্দই সব ব্যবহারিক লক্ষ্যের মধ্যে পরম লক্ষ, কিন্তু তাই বলে এ কথা বলার পিছনে কোন যুক্তি নেই যে, প্রতিটি লোক আনন্দকে অনুসরণ করতে চায়।

অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, আনন্দ দার্শনিক মনন (Philosophic Contemplation)-এর সঙ্গে অভিন্ন। জনৈক সমালোচকের মতে, অ্যারিস্টটলের উপরিউক্ত অভিমত সত্য হলেও, তার থেকে এমন সিদ্ধান্ত করা চলে না যে, যারা আনন্দ কামনা করে তারা দার্শনিক মননের বাসনা করে।

সৎ চরিত্র ও সৎ কর্ম

আনন্দের স্বরূপ আলোচনা করার পর অ্যারিস্টটল প্রথমে সৎ চরিত্রের ও সৎ কর্মের সাধারণ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারপর তিনি আলোচনা করেছেন প্রধান প্রধান নৈতিক সৎ গুণ নিয়ে এবং বুদ্ধিগত সৎ গুণ নিয়ে। নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস্ গ্রন্থের শেষাংশে তিনি আদর্শ জীবন, বা সৎ কর্মের আদর্শ জীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন, যে জীবন হল মানুষের পক্ষে প্রকৃত আনন্দময় জীবন।

সৎ কার্য সম্পাদনের দ্বারা সৎ চরিত্র লাভ : সাধারণভাবে চরিত্রের সততার কথা বলতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেন যে, সৎ চরিত্র লাভের শক্তি আমাদের মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু অভ্যাস বা অনুশীলনের দ্বারা তাকে বিকশিত করে তুলতে হবে। সৎ কার্য সম্পাদনের দ্বারাই সৎ চরিত্র লাভের শক্তিকে বিকশিত করে তুলতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, অ্যারিস্টটলের বিবৃতিগুলো এক চক্রক দোষের সৃষ্টি করেছে। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, সৎ কর্মসম্পাদন করে সৎ হওয়া যায় কিন্তু মানুষ সৎ না হলে সৎ কর্মের অনুষ্ঠান কিভাবে সম্ভব হবে? অ্যারিস্টটল বলেন যে, আমরা সৎকার্যকে সৎকার্য বলে না জেনে, বা সেভাবে তাদের নির্বাচিত না করে, সম্পাদন করি। পরে এই সৎ কাজ দিনের পর দিন সম্পাদন করতে করতে আমাদের মধ্যে সৎ কার্য সম্পাদনের অভ্যাস গড়ে ওঠে। তখন আমরা সৎ কর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হই এবং স্বেচ্ছায় সৎ কর্ম সম্পাদন করে থাকি। উদাহরণ দিতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন, কোন মাতাপিতা তাদের শিশু সন্তানকে মিথ্যা কথা বলতে নিষেধ করলেন। সত্য কথা বলা সৎ, সেই সম্পর্কে অবহিত না হয়ে সে তার মাতাপিতার আদেশ মত সত্য বলা কথা বলে যায়। এভাবে সত্য কথা বলার অভ্যাস তার মধ্যে গড়ে ওঠে এবং কালক্রমে সে বুঝে উঠতে পারে যে, সত্য বলার জন্যই সত্য কথা বলা উচিত। তখনই সে সত্য কথা বলার ঔচিত্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে সত্য কথা বলতে থাকে। তাই এদিক থেকে কাজটিকে সৎ কাজ বলা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল দুই ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য করে চক্ৰকদোষ পরিহার করলেন। তার মতে, সৎ কাজ দিনের পর দিন সম্পাদনের ফলে ব্যক্তির মধ্যে সৎ কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং এভাবে সৃষ্ট অভ্যাসবশত মানুষ স্বেচ্ছায় সৎ কাজ করতে থাকে। সততা এক ধরনের অভ্যাস, যে অভ্যাস এক বিশেষ ধরনের কাজ করার অনুশীলন থেকেই সৃষ্ট হয়।

মধ্যপন্থা সম্পর্কীয় মতবাদ (The Doctrine of the Mean)

অ্যারিস্টটল সততা (Virtue)-র সঙ্গে অসততা (Vice)-র সম্বন্ধ নিয়ে আলোচনা। করেছেন।

সততা হল দুই চরম অবস্থাকে এড়িয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ : অ্যারিস্টটলের মতে, সততা হল একাধারে আতিশয্য (Excess) এবং অপরদিকে অভাব (Defect), এ দুই চরম অবস্থাকে এড়িয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ করা। তাই অ্যারিস্টটলের মতে, সততা হল, মাঝামাঝি পথ বেছে নেবার অভ্যাস। অবশ্য কোন ব্যক্তির পক্ষে কোটি মাঝামাঝি পথ তা নির্ভর করছে ব্যক্তির সামর্থ্য এবং ব্যক্তি কোন বিশেষ অবস্থায় রয়েছে তার ওপর। সুতরাং সততা হল মাঝামাঝি পথ বা মধ্যপন্থা বেছে নেবার অভ্যাস। এ মধ্যপন্থা হল আপেক্ষিক অর্থাৎ অবস্থাবিশেষের এবং মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর। সমাজ জীবনের সাধারণ উন্নয়নের পক্ষে এ মধ্যপন্থা কতখানি উপযোগী তারই প্রেক্ষিতে এ মধ্যপন্থা সকল সময় নির্ধারণ করতে হবে। সততা হল দুই চরমের মধ্যবর্তী পন্থা (virtue is a mean between two extremes.)। একদিকে আতিশয্য বা অতিরিক্ততা এবং অপরদিকে স্বল্পতা বা অভাব—এ দুই চরমের মাঝামাঝি বহু সৎ গুণের উপস্থিতি। যেমন, ‘সাহসিকতা’ এ সৎ গুণটি একদিকে ‘হঠকারিতা এবং অপরদিকে ‘ভীরুতা’–এ চরমের মধ্যবর্তী। অনুরূপভাবে বদান্যতা’–এ সৎ গুণটিও একদিকে ‘অমিতব্যয়িতা’ এবং অপরদিকে ‘ব্যয়কুণ্ঠতা’—এ দুই চরমের মধ্যবর্তী। তবে অ্যারিস্টটলের মতে, এ মধ্যপন্থা সকল লোকের পক্ষে এক ধরনের নয়। এ মধ্যপন্থা ব্যক্তির সামর্থ্য এবং অবস্থাবিশেষের ওপর নির্ভর। এ মধ্যপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধি এবং অন্তদৃষ্টির কাছে এক সমস্যার বিষয়। যদিও সাহসিকতা ‘হঠকারিতা’ এবং ‘ভীরুতা’—এ দুই চরমের মধ্যপন্থা, তবুও কোন সৈনিকের ক্ষেত্রে এ সাহসিকতার ঝোক ভীরুতার তুলনায় হঠকারিতার দিকে বেশি হতে পারে।

সততার সংজ্ঞা : সততা হল মিতাচার। কিন্তু এ মিতাচার সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়। এটি বিচারবুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয়। যা কোন ব্যক্তির পক্ষে মধ্যপন্থা, তা অপর ব্যক্তির পক্ষে হয়ত আতিশয্য বা কোন বিশেষ অবস্থায় যা মধ্যপন্থা তা ভিন্ন অবস্থায় চরম পন্থা। তাই সততা বা সৎ গুণকে অবস্থানিরপেক্ষভাবে নির্ধারণ করা চলে না। সেই কারণেই অ্যারিস্টটল বলেন, “সততা হল মধ্যপন্থা নির্বাচনের অভ্যাস, যে মধ্যপন্থা আপেক্ষিক এবং বিচার-বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় বা ব্যবহারিক বুদ্ধিসম্পন্ন। ব্যক্তি যেভাবে একে নির্ধারণ করে। (“Virtue is a disposition to choose consisting essentially in a mean relative to us determined by a rule, i.e. the rule by which a practically wise man would determine it.”)। অ্যারিস্টটলের মতে, এ মধ্যপন্থা নির্বাচনের জন্য প্রকৃত সৎ ব্যক্তির ব্যবহারিক বিজ্ঞতার প্রয়োজন, তাত্ত্বিক জ্ঞান এ ব্যাপারে খুব কার্যকর নয়।

অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে মধ্যপন্থা নিরূপণ : যখন অ্যারিস্টটল বলেন যে, সত্যতা হল মধ্যপন্থা তখন তিনি বলতে চান না যে, এ মধ্যপন্থা গাণিতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিরূপণ করতে হবে। সেই কারণেই তিনি সততার সংজ্ঞাতে ‘আপেক্ষিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তি তার ব্যবহারিক বিজ্ঞতা বা অন্তদৃষ্টির সাহায্যে সেটি নিরূপণ করবেন।

সততা দুটি বিপরীত অবস্থার সুষম সমন্বয় ও অ্যারিস্টটল-এর মতে সততা বা সৎগুণ হল দুটি বিপরীত অবস্থার এক সুষম সমন্বয়। অভাব এবং আতিশয্য দুই-ই মন্দ, মধ্যপন্থায় এ দুটিকে এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যেমন, সাহসিকতা, দুঃসাহসিকতা বা নিষ্ক্রিয় দূরদর্শিতা বোঝায় না, দুই-এর এক সাম্যাবস্থা বোঝায়, যার জন্য সাহসিকতা হঠকারিতায় বা ভীরুতায় পর্যবসিত হয় না।

কপলস্টোন মন্তব্য করেছেন, যে, সততা সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের আলোচনা নির্দেশ করে যে, গ্রীকদের মানুষের আচরণের প্রতি যে সৌন্দর্যমূলক মনোভাব (Aesthetic Attitude) ছিল অ্যারিস্টটল তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

সমালোচনা : সততা মধ্যপথ অনুসরণের অভ্যাস, অ্যারিস্টটলের এ অভিমতের মধ্যে যথেষ্ট সত্যতা নিহিত আছে। তবে অবস্থাবিশেষে এর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। সব সময়ই যে মধ্যপন্থা অনুসরণ করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কোন বিপন্ন ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি কোন ব্যক্তি সাহসিকতার নামে কিছুটা হঠকারিতার পরিচয় দেয় বা দেশ যখন বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত, তখন যদি দেশের জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশ প্রেমের আতিশয্য দেখা দেয়, তা মোেটও নিন্দনীয় নয়। পরম কল্যাণের ধারণা থেকে বিযুক্ত করে সততা বা সৎ গুণকে কখনও নির্ধারণ করা যায় না।

সমালোচনার উত্তর : মধ্যপন্থা সম্পর্কীয় মতবাদের অনেক রকম সমালোচনা হয়েছে, তবে অধিকাংশ সমালোচনাই আসলে মতবাদটির উদ্দেশ্য কি, সেই সম্পর্কে ভ্রান্ত অভিমত ছাড়া কিছুই নয়। এ মতবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, মতবাদকে একটি চরম নীতিরূপে প্রয়োগ করাই অ্যারিস্টটলের উদ্দেশ্য। তিনি নির্বিচারে এ নীতিকে প্রয়োগ করতে চান; কিন্তু এটা সত্য নয়। কেননা অ্যারিস্টটল নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এমন কোন কোন অসৎ গুণ আছে যার আনুষঙ্গিক সৎ কোন গুণ নেই, যেমন—’ব্যভিচার’, ‘চৌর্য’, ‘হত্যা’। এগুলো আতিশয্যও নয়, অভাবও নয়। এ সব ব্যাপারে সঠিক ব্যক্তির সঙ্গে, সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ক্রিয়া করার মধ্যে কোন ভাল-মন্দ নেই। শুধুমাত্র এগুলো করা হলে অর্থাৎ সঠিকভাবে করা না হলে এসব ক্রিয়া নিশ্চয়ই মন্দ। তাই সততা আতিশয্য এবং অভাব—এ দুই চরমের মধ্যবর্তী, এর ব্যতিক্রম আছে। অ্যারিস্টটল এমন কোন নীতির কথা বলছেন, যা ব্যতিক্রম ছাড়াই সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা ছাড়া তিনি এমন কথা বলেছেন যে, এ মধ্যপন্থা অনুসরণের ব্যাপারটি আপেক্ষিক।

লয়েডের মন্তব্য – এ প্রসঙ্গে জি. ই. আর. লয়েড বলেন, “তিনি এমন কথা বলেননি যে, মধ্যপন্থার মতবাদটি নিজেই কোথায় সততা নিহিত সেটি নিরূপণের সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ সাধারণ মতবাদটি যা করতে পারে তা হল সততার অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা কোথায় তার খোঁজ করব। আমরা বলতে পারি যে, কিছু সীমার বা মাত্রার মধ্যে তাকে পাওয়া যেতে পারে।”

এ নীতিটি একটি সাধারণ সূত্র মাত্র : এ মতবাদের বিরুদ্ধে আর একটি সমালোচনা হল যে, এ মতবাদ যেখানে গুণগত পার্থক্য রয়েছে সেখানে পরিমাণগত তুলাদণ্ডও প্রয়োগ করে এবং তা করা অসঙ্গত এবং অস্বাভাবিক। এ সমালোচনায় কিছুটা সত্যতা রয়েছে। বদান্যতা এবং কৃপণতা, যার মধ্যে পরিমাণগত উপাদান নিহিত, সেখানে অ্যারিস্টটলের নীতির প্রয়োগ সার্থক নাও হতে পারে। কিন্তু কথা হল সামগ্রিকভাবে সততার ক্ষেত্রেই এ সমালোচনা হতে পারে কি? আসল কথা হল, এ নীতিটি, কোন নির্বিচারে মেনে নেওয়া নীতি (Dogmatic Rule) নয় যার থেকে কোন বিশেষ সততার প্রকৃতিকে অবরোহ প্রক্রিয়ায় নিঃসৃত করা যায়। অধিকাংশ সৎ গুণের ক্ষেত্রে যা সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাকে প্রকাশ করার জন্য এটি একটি সাধারণ সূত্র রচনার প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। বহুসংখ্যক ক্ষেত্রে যে এ নীতিকে প্রয়োগ করা যেতে পারে তা কোনমতে অস্বীকার করা যায় না। লয়েড বলেন, “অ্যারিস্টটলের আলোচনার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা মতবাদটি বিশেষ বিশেষ সততা ও অসততা সম্পর্কে একটি সাধারণ কাঠামাে যুগিয়ে দেয়।”

ইচ্ছার স্বাধীনতা 

অজ্ঞানতাবশত কার্য করলে কর্মচারীর কোন নৈতিক দায়িত্ব থাকে না ও ব্যক্তির ঐচ্ছিক ক্রিয়াই হল নৈতিক কর্ম, এ অর্থে যে, নৈতিক গুণ তাতে উপস্থিত থাকে, যার জন্য ব্যক্তির ওপর নৈতিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিক বিচারের প্রাকশর্ত, অর্থাৎ ইচ্ছার স্বাধীনতাকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে না নিলে নৈতিক বিচার সম্ভব হয় না। যদি কোন ব্যক্তি কোন কাজ করতে বাধ্য হয় বা অজ্ঞানতাবশত সে কার্যটি করে, তাহলে তার কোন নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে মনে করা যাবে না। তবে অজ্ঞানতাবশত কথাটির অর্থ ঠিকভাবে বুঝে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি ক্রোধবশত মদ্য পান করার পর যদি কোন কার্য করে তাহলে সে অজ্ঞানতাবশত কার্যটি করেছে এ কথা বলা হয়। কিন্তু তা বলা যেতে পারে না, কেননা সেই অজ্ঞানতা, ক্রোধ বা মদ্য পানের দ্বারা সৃষ্ট। অ্যারিস্টটলের বক্তব্য হল অজ্ঞানতাবশত কোন কার্য করার পর ব্যক্তি যদি অনুতপ্ত হয় তাহলে তার কাজটি অনৈচ্ছিক।

অ্যারিস্টটল চার ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য করেছেন—
(১) কর্মকর্তা জেনে শুনে কাজের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত হয়ে যে কাজ করেন,
(২) কর্মকর্তা সংকল্প করেই কোন কাজ করেন কিন্তু কাজের ফলাফল সম্পর্কে পূর্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে অবহিত থাকেন না। যেমন, কোন এক ব্যক্তিকে একটি পানীয় পান করতে দেওয়া হল যেটা পান করে ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ল। কিন্তু কর্মকর্তা পূর্ব থেকে বুঝে উঠতে পারেননি যে, ব্যক্তিটি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
(৩) কর্মকর্তা যে কাজ করার পরে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হন।
(৪) কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় যে কাজ করেন না, যে কাজ করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ এ ধরনের কাজ বাধ্যতামূলক, কর্মকর্তার উদ্দেশ্য নিঃসৃত নয়। যেমন, কোন অত্যাচারীর অপর ব্যক্তিকে কোন কর্ম করতে বাধ্য করা।

অ্যারিস্টটলের মতে, সব ঐচ্ছিক ক্রিয়ার কর্মকর্তার নির্বাচন (Choice)-এর ফল নয়। কারণ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিবেচনা (Deliberation) এবং নির্বাচন নৈতিক চরিত্র নির্দেশ করে। এখানেই আমরা অ্যারিস্টটলের নৈতিক দায়িত্বের মূল কথাটিকে জানতে পারি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের ব্যক্তিগত কাজের জন্যই যে শুধু দায়ী তা নয়; তাদের নৈতিক চরিত্র বা মানসিক প্রবণতা যা আমাদের লক্ষ্যের জন্য কামনা বা ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রিত করে, তার জন্যও দায়ী। কেননা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি থেকেই মানসিক প্রবণতার সৃষ্টি।

অ্যারিস্টটলের বিভিন্ন মন্তব্য : অ্যারিস্টটল বলেন, সততা এবং অসততা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে। জেনে শুনে কেউ অসৎ কাজ করতে পারে না—সক্রেটিসের এ বক্তব্য সম্পর্কে অ্যারিস্টটল বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। কখনও অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, মানুষের মনে নৈতিক দ্বন্দ্ব যে মাঝে মাঝে দেখা দেয় তা অস্বীকার করা চলে না এবং কখনও কখনও মানুষ জ্ঞাতসারে অসৎ কর্ম সম্পাদন করে। তাই সক্রেটিসের অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সংযম ও অসংযমের দিক থেকে প্রশ্নটি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, যে ব্যক্তি অন্যায় করছে, অন্যায় করার সময় তিনি সেই কার্যের অসততা সম্পর্কে সচেতন থাকেন না বা তাকে অন্যায় বলে জানেন না। কিন্তু অ্যারিস্টটল কি অস্বীকার করতে পারেন যে, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায়কে অন্যায় জেনেও সম্পাদন করে? অসংযত লোক জেনেশুনে অন্যায় কাজ করছে। এরূপ দৃষ্টান্তের কি অভাব আছে? কপলস্টোন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের মতবাদ বর্জনের চেষ্টা করলেও কিছুমাত্রায় যে তার মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তা অস্বীকার করা চলে না। কতব্য সম্পর্কে আরিস্টটলের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। একটি কাজ ভাল হতে পারে এবং সেটি কর্তব্য নাও হতে পারে, এ দুইয়ের মধ্যে অ্যারিস্টটল কোন পার্থক্য করেননি।

নৈতিক সৎ গুণ (Moral virtues)

অ্যারিস্টটলের নৈতিক সততার মান খুবই উচ্চ : অ্যারিস্টটল দু’ধরনের সৎ গুণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন; যেমন, বুদ্ধিগত সৎ গুণ (Intellectual Virtues) যেমন, বিজ্ঞতা (Wisdom) ও ব্যবহারিক বুদ্ধি (Practical Intelligence) এবং নৈতিক সৎ গুণ, যেমন বদান্যতা এবং মিতাচার। শিক্ষাদান থেকে বুদ্ধিগত সৎ গুণগুলোর এবং অভ্যাস থেকে নৈতিক সৎ গুণগুলোর উদ্ভব। দৃষ্টিশক্তি মানুষের মধ্যে যে অর্থে সহজাত, কোন সৎ গুণ সেই অর্থে সহজাত নয়। কিন্তু নৈতিক গুণগুলো সহজাত না হলেও তারা প্রকৃতির বিরোধী নয়। আমাদের মধ্যে তাদের আবির্ভাব হয় কেননা প্রকৃতি তাদের গ্রহণ করার জন্য আমাদের উপযোগী করে তুলেছে। কিন্তু অনুশীলন এবং অভ্যাসের দ্বারা তারা নিখুঁত হয়ে ওঠে। আমরা সৎ কার্য সম্পাদন করে সততা অর্জন করি বা সৎ গুণের অধিকারী হই। সাহসের কার্য সম্পাদন করতে করতে আমরা সাহসী হই। অ্যারিস্টটলের নৈতিক সততার মান খুবই উচ্চ। কিছু সাহসের কাজ সম্পাদন করাই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে –
(১) কর্মকর্তাকে অবশ্যই তার কাজের গুণ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। তা না হলে নিম্নতর প্রাণীদেরও সাহসী বলতে হবে, কিন্তু অ্যারিস্টটল তাতে রাজি নন।
(২) কার্যটি কর্মকর্তার নির্বাচনের ফলস্বরূপ হওয়া উচিত।
(৩) এটি এমন একটা কাজ হওয়া উচিত যেটি কর্মকর্তার একটি সুদৃঢ় এবং স্থায়ী মানসিক প্রবণতা নির্দেশ করে।

কামনা-বাসনাকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রশ্ন ওঠে না : অ্যারিস্টটলের মতে, নৈতিক সততা হল আবেগকে বিচারবুদ্ধির অধীনস্থ করা। কিন্তু কিভাবে তা করা সম্ভব? বিচারবুদ্ধি কিভাবে কামনা-বাসনার ওপর নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করবে? অ্যারিস্টটলের মতে, কেবলমাত্র অনুশীলনের মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে। নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, আত্মনিয়ন্ত্রণের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনের দ্বারাই রিপুগুলোকে বিচারবুদ্ধির নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাই সততার দুটি উপাদান, বিচারবুদ্ধি এবং কামনা-বাসনা, উভয়েরই উপস্থিতি প্রয়োজন। রিপুকে বশীভূত করতে হলে তাদের অস্তিত্বকে বাতিল করা চলে না। তাই কামনা-বাসনাকে পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করে যে কৃচ্ছ্ববাদের আদর্শের কথা বলা হয় তা ভ্রান্ত। কামনা-বাসনা সততার উপাদান। বিচারবুদ্ধি সততার আকার। সততা বলতে কামনা-বাসনার নিয়ন্ত্রণ বোঝায়, তাদের নির্মূল করার কথা বোঝায় না। তাই দুটি চরম অবস্থাকে পরিহার করতে হবে – এক হল কামনা-বাসনা যা আবেগের উজ্জ্বলতা এবং অপরদিকে তাদের নির্মূলকরণ। এ দুই চরম অবস্থাকে পরিহার করে মধ্য পথ গ্রহণ করতে হবে। সততা হল পরিমিতি (Moderation)। এর থেকেই অ্যারিস্টটলের মধ্যপন্থার নীতিটি অনুসৃত হয়েছে।

নৈতিক সৎ গুণের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা অ্যারিস্টটল দেননি, যেমন-প্লেটো দিয়েছেন। অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে যে ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান তাই তাকে এ রকম কোন তালিকা প্রণয়ন থেকে নিবৃত্ত করেছে। যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা বিভিন্ন , তাই জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অনুসারে সৎ গুণও অসংখ্য। তবে নৈতিক সৎ গুণ অসংখ্য হলেও কিছু কিছু নৈতিক সৎ গুণ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেমন সাহসিকতা, বদান্যতা, নম্রতা, মিতাচার, বিনয়, ভাল মেজাজ ইত্যাদি।

কপলস্টোনের মন্তব্য : কপলস্টোন বলেন, ‘নৈতিক গুণ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের আলোচনা অ্যারিস্টটলের সাধারণ পরিমিতিবোধ এবং নির্ভুল বিচারের পরিচায়ক। বস্তুত সাহসিকতার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে যখন তিনি বলেন যে, সাহসিকতা হল হঠকারিতা এবং ভীরুতা, এ দুই চরমের মধ্যপন্থা, তখন মনে হয় তিনি সাহসিকতার প্রকৃত স্বরূপটি ব্যক্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে সাহসিকতাকে, যা সাহসিকতা নয়, তার থেকে পৃথক করেছেন।’

ন্যায়পরায়ণতা (Justice)

স্টেইস মনে করেন যে, নৈতিক সৎ গুণের আলোচনায় ন্যায়পরায়ণতার আলোচনা অ্যারিস্টটলের পরিকল্পনাতে আসবার কথা নয়। কেননা ন্যায়পরায়ণতা ব্যক্তির তুলনায় রাষ্ট্রের সৎ গুণ এবং সেই কারণে অনেকে মনে করেন নীতিশাস্ত্রের যে খণ্ডে এ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে তা ভুলবশত নীতিশাস্ত্রে স্থান লাভ করেছে।

সার্বিক ন্যায়পরায়ণতা : ন্যায়পরায়ণতা বলতে অ্যারিস্টোটল মনে করেন যা আইনসম্মত এবং যা পক্ষপাতহীন এবং সমান। প্রথম ধরনের ন্যায়পরায়ণতা, যাকে সার্বিক বা সাধারণ ন্যায়পরায়ণতা (Universal Justice) নামে অভিহিত করা হয়, তা আইনের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে সমার্থক। তবে অ্যারিস্টটল মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের আইন মানুষের সমগ্র জীবনের ওপর বাস্তব অর্থে, বাস্তব আদর্শের দিক থেকে নয়, কার্যকর। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সৎকার্য সম্পাদনে প্রণােদিত করে, অবশ্য সৎকার্য বলতে জাগতিক দিক থেকে যাকে সৎ কার্য বলে অভিহিত করা যায়। সার্বিক ন্যায়পরায়ণতা সামাজিক দিক থেকে বিচার করা হলে, সততার থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়, উভয়কে সমার্থকই গণ্য করা যেতে পারে।

বিশেষ ন্যায়পরায়ণতা : অ্যারিস্টটলের মতে, বিশেষ ন্যায়পরায়ণতা (Particular Justice) দুধরনের-

  • (ক) বণ্টনমূলক ন্যায়পরায়ণতা (Distributive Justice) – এ ন্যায়পরায়ণতা হল ব্যক্তির যোগ্যতা (Merit) অনুসারে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুবিধা এবং অসুবিধা প্রদান করা। ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিকে সম্মান এবং পুরস্কার প্রদান হল বণ্টনমূলক ন্যায়পরায়ণতা।
  • (খ) প্রতিকারমূলক ন্যায়পরায়ণতা (Remedial Justice) – শাস্তি দেওয়ার সঙ্গে এ ন্যায়পরায়ণতার সম্পর্ক। কোন ব্যক্তি যদি অসঙ্গতভাবে কোন সুবিধা গ্রহণ করে, তাহলে আনুষঙ্গিক একটা অসুবিধা তার ওপর আরোপ করে অর্থাৎ তাকে শাস্তি প্রদান করে, বিষয় দুটির মধ্যে সমতা আনতে হবে।

ন্যায়পরায়ণতা হল একটা সাধারণ নীতি এবং কোন সাধারণ নীতিই জীবনের জটিলতার সমান হতে পারে না।

ন্যায়পরায়ণতার সংজ্ঞা : অ্যারিস্টটলের মতে, ন্যায়পরায়ণতা হল অন্যায় আচরণ করা এবং অন্যায় ব্যবহার পাওয়া—এ দুই চরম অবস্থার মধ্যবর্তী পন্থা। কিন্তু অনেকেই অ্যারিস্টটলের ন্যায়পরায়ণতার এ সংজ্ঞা গ্রহণে সম্মত নন। কপলস্টোন বলেন যে, অন্যান্য সৎ গুণ যেগুলো অ্যারিস্টটল ইতোপূর্বে আলোচনা করেছেন, তাদের সঙ্গে সমপর্যায়ভুক্ত করার জন্যই অ্যারিস্টটল ন্যায়পরায়ণতার এ জাতীয় সংজ্ঞা দিয়েছেন। এ সংজ্ঞা কেন গ্রহণযোগ্য নয় একটা উদাহরণের সাহায্যে বুঝে নেওয়া যাক—যে ব্যবসায়ী ন্যায়পরায়ণ সেই ব্যক্তি হল এমন ব্যক্তি যে অপর ব্যক্তিকে তার যতটুকু প্রাপ্য তার কম না দিয়ে এবং নিজের যতটুকু প্রাপ্য তার বেশি না নিয়ে, অপরকে তার যা প্রাপ্য তা দিতে চায় এবং নিজের যতটুকু প্রাপ্য তার বেশি গ্রহণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোন ব্যবসায়ী যদি অপর ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অংশের অধিক দেয়। এবং নিজের যতটুকু প্রাপ্য তার কম গ্রহণ করে, তাহলে কি বলা যেতে পারে, সেই ব্যবসায়ী ন্যায়পরায়ণ নয়? অ্যারিস্টটল বলেন যে, অন্যান্য সৎ গুণ যে হিসেবে দুই চরম অবস্থার মধ্যবর্তী অবস্থা, ন্যায়পরায়ণতা তা নয়। এটি এ অর্থে মধ্যবর্তী অবস্থা যে, এটি এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করে যেটি হল দুটি অবস্থার মধ্যবর্তী।

দুধরনের অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য : অ্যারিস্টটল এ প্রসঙ্গে, জাগতিক দিক থেকে অন্যায়, এমন দুধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। এমন অন্যায় কাজ করা হল যাতে অপরের ক্ষতি হল কিন্তু ক্ষতির কথা পূর্ব থেকে চিন্তা করা হয়নি বা তা অভিপ্রেত নয় এবং সাধারণ ঐ ধরনের কাজ করলে ক্ষতি হবার কথা নয়। আবার এমন অন্যায় কাজ করা হল যেখানে অপরের ক্ষতি হল, যে ক্ষতির কথা পূর্ব থেকে চিন্তা করা হয়েছে এবং যা কর্মকর্তার অভিপ্রেত এবং এ ধরনের কাজ করলে স্বাভাবিকভাবে ক্ষতি হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটলের মতে, এ দুই ধরনের কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে।

এ পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে, ন্যায়পরায়ণতা হিসেবে সমদর্শিতা, আইনগত ন্যায়পরায়ণতার তুলনার উৎকৃষ্ট বলা যেতে পারে। আইনগত ন্যায়পরায়ণতা প্রতিটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যেতে পারে, সেই হিসেবে সমদর্শিতার তুলনায় তা ব্যাপকতর।

বুদ্ধিগত সৎ গুণ (Intellectual virtues)

৫টি বুদ্ধিগত সৎগুণ : অ্যারিস্টটল পাঁচ ধরনের বুদ্ধিগত সৎ গুণের কথা বলেছেন, যথা –

  • (১) কলা (Art) – কলা হল কোন কিছু করার সামর্থ্যের তুলনায় কোন কিছু তৈরি করার সামর্থ্য। কিন্তু এটি একটি বুদ্ধিগত সৎ গুণ, যেহেতু এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি যথার্থ যুক্তি প্রক্রিয়া। কলা হল মানসিক প্রবণতা যার দ্বারা একটি যথার্থ নিয়মের সাহায্যে আমরা কিছু তৈরি করি। (“…art alone is related to a capacity for making rather than one for acting or doing…” G.E.R. Lloyd: Aristotle, The Growth and Structure of his Thought.)।
  • (২) বৈজ্ঞানিক জ্ঞান (Scientific Knowledge) – বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্পর্ক হল যা অপরিবর্তনীয় তাকে নিয়ে। এটা হল সেই মানসিক প্রবণতা যার দ্বারা আমরা অপরিবর্তনীয় ঘটনার রাজ্যে বিষয়বস্তুর মধ্যে সম্বন্ধ প্রমাণ করি।
  • (৩) বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা (Rational Intuition) – বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা হল সেই বৃত্তি যার দ্বারা আমরা কতকগুলো বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে একটি সার্বিক সত্যের জ্ঞান লাভ করি এবং তারপর বুঝতে পারি যে, সার্বিক সত্যটি স্বতঃসিদ্ধ। বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা হল সেই বৃত্তি যার সাহায্যে আমরা মৌলিক নীতিগুলোর (First Principles) বা যেগুলো থেকে শুরু করে প্রমাণের কাজ শুরু হয় তার জ্ঞান লাভ করি। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা— এ দুইকে একত্রিত করে পাওয়া যায়।
  • (৪) তত্ত্বীয় বিজ্ঞতা (Theoretical wisdom) – তত্ত্বীয় বিজ্ঞতা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তু। শুধুমাত্র অধিবিদ্যার বস্তু নয়, গণিতের এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুও এ তত্ত্বীয় বিজ্ঞতার অনুধাবনের বিষয়। এ সব বস্তুর মনন মানুষের আদর্শ জীবনের অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞতা বা দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয় যে, এ হল বৌদ্ধিক স্বজ্ঞা এবং বিজ্ঞানের সংযোগ (combination of intutive reason and science), সৃষ্ট মহৎ বস্তুর অনুধাবনের দিকেই এর লক্ষ।
  • (৫) ব্যবহারিক বুদ্ধি (Practical Intelligence) – ব্যবহারিক বুদ্ধি ও ব্যবহারিক বুদ্ধি হল তাই যা আমাদের যথাযথ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যটি লাভ করার জন্য যথাযথ উপায় গ্রহণ করতে বলে। অ্যারিস্টটল বলেন, ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ‘আত্মার চক্ষু’ (The Eye of the Soul)।

সততার সংজ্ঞা : উপরিউক্ত পাঁচটি বুদ্ধিসংক্রান্ত সৎ গুণের মধ্যে ব্যবহারিক বুদ্ধি এবং বিজ্ঞতা অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। সততার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সততা হল মধ্যপন্থা নির্বাচনে অভ্যাস, যে মধ্যপন্থা আপেক্ষিক এবং বিচার-বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় বা ব্যবহারিক বিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি যেভাবে একে নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সাহস হল দৃঢ় বিশ্বাস বা আস্থার যথাযথ অনুভূতির অধিকারী হওয়া কিন্তু যথাযথ বস্তু সম্পর্কে, যথাযথ উদ্দেশ্যের দ্বারা চালিত হয়ে, যথাযথভাবে এবং যথাযথ সময়ে তার অধিকারী হতে হবে। কিন্তু এ সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিবেচনা, কি অবস্থায় ব্যক্তিকে কাজ করতে হবে, সবই ব্যবহারিক বুদ্ধির অন্তর্গত। নৈতিক গুণ হল তাই যা আমাদের যথাযথ উদ্দেশ্য বা লক্ষটির দিকে দৃষ্টি দিতে বলে।

নৈতিক সৎ গুণ এবং ব্যবহারিক বুদ্ধির মধ্যে সংযোগ : অ্যারিস্টটল নৈতিক সৎ গুণ এবং ব্যবহারিক বুদ্ধি, এ দুইয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন। নৈতির সৎ গুণ যদি যথাযথ লক্ষ যুগিয়ে না দেয়, তাহলে তাকে বাদ দিয়ে ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ধূর্ততার শামিল। আবার ব্যবহারিক বুদ্ধিকে বাদ দিয়ে নৈতিক সৎ গুণ হল খুব জোর ‘স্বাভাবিক সৎ গুণ’, একটা স্বাভাবিক স্বভাব বা মানসিক প্রবণতা, যার অধিকারী শিশু এবং নিম্নতর প্রাণীরাও হতে পারে, কিন্তু যাকে প্রকৃত সৎ গুণে বিকশিত করার জন্য শিক্ষা এবং যুক্তির প্রয়োজন। অ্যারিস্টটল একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। স্বাস্থ্য হল আমাদের একটি কাম্যবস্তু , কিন্তু সুস্বাস্থ্য লাভ কল্যাণপ্রদ, এ সম্পর্কে আমরা অবহিত হলেও, সেই অবহিতি কিভাবে সুস্বাথ্যের অধিকারী হওয়া যায় বা তাকে রক্ষা করা যায়, তা আমাদের নিরূপণে সাহায্য করে না। আমাদের জানা প্রয়োজন সেই উপায়গুলো যার দ্বারা নিরূপণ করা যাবে এবং ব্যবহারিক বুদ্ধির দ্বারাই তা নিরূপণ করতে হবে।
অ্যারিস্টটল বলেন, ব্যবহারিক বুদ্ধি হল ব্যবহারিক ন্যায় অনুমান (Practical syllogism), যেমন- ক হল লক্ষ্য, খ হল উপায়, সুতরাং ‘খ’ করা উচিত। কিন্তু অ্যারিস্টটল বলেন যে, অনেক লোক তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারেন, কোনটি যথার্থ কার্য যেটি সম্পাদন করা উচিত, যদিও সাধারণ নীতিগুলো সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট জ্ঞান তাদের নেই। তাই ব্যবহারিক ন্যায় অনুমানের। সিদ্ধান্তকে না জেনে সাধ্য আশ্রয়বাক্যকে জানার তুলনায়, সাধ্য আশ্রয়বাক্যকে না জেনে সিদ্ধান্তকে জানা ভাল।

সততা ও বিচক্ষণতা (virtue and Prudence)

সব সততাই বিচক্ষণতা নয় : সক্রেটিসের মতে, সততাই হল এক ধরনের বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতা। অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, সক্রেটিসের এ অভিমত আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যা। অংশত সত্য এ কারণে যে, তিনি যথার্থই বলেছেন যে, বিচক্ষণতা ছাড়া সততার কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কিন্তু সব সততাই হল এক ধরনের বিচক্ষণতা— সক্রেটিসের এ বক্তব্যকে যথার্থ বলে স্বীকার করা চলে না। অ্যারিস্টটলের মতে, সততাতে বিচক্ষণতা থাকে তবে সব সততাই বিচক্ষণতা নয়, সততাই যথাযথ মনোভাব নয়। সততা হল সেই মানসিক প্রবণতা যা মানুষকে যথাযথ এবং যুক্তিসঙ্গত নির্বাচনের দিকে চালিত করে। যথার্থ সৎ ব্যক্তির পক্ষে বিচক্ষণতা প্রয়োজন। তবে মনে রাখতে হবে, বিচক্ষণতা এবং চতুরতা অভিন্ন বিষয় নয়। চতুরতা হল সেই বৃত্তি যার দ্বারা মানুষ যেকোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য যথাযথ উপায় নিরূপণ করতে পারে। একজন দুবৃত্ত তার অসৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য যথাযথ উপায় নিরূপণ করতে পারে, সে চতুর হতে পারে কিন্তু তাকে বিচক্ষণ ব্যক্তি বলা চলে না।

বিচক্ষণতা ও চাতুর্য অভিন্ন নয় : নিছক চাতুর্য বিচক্ষণতা থেকে স্বতন্ত্র বিষয়। বিচক্ষণতার সঙ্গে সততা সম্পর্কযুক্ত এবং বিচক্ষণতা হল নৈতিক অন্তদৃষ্টি। বিচক্ষণতা চাতুর্য ছাড়া অস্তিত্বশীল হতে পারে না। কিন্তু দুটোকে এক করে দেখা সমীচীন নয় কেননা বিচক্ষণতা হল নৈতিক গুণ। বিচক্ষণতা হল সেই চতুরতা যা মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্যই উপায় নিরূপণ করে, যেকোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার উপায় নিরূপণ করে না। নৈতিক সততাই মানুষকে যথার্থ লক্ষ্যটি নির্বাচন করতে সহায়তা করে। কোন মানুষ সৎ বা ভাল না হয়েও, যা তার করা উচিত তা করতে পারে। কিন্তু একটা লোককে সৎ বা ভাল বলা হবে যদি সে কাজটি ভাল জেনেই তা সম্পাদন করে বা তার ক্ৰিয়া নৈতিক নির্বাচন প্রসূত হয়। এর জন্য বিচক্ষণতা প্রয়োজন।

বিচক্ষণতাকে বাদ দিয়ে নৈতিক গুণের অধিকারী হওয়া যায় না : কোন মানুষকে নৈতিক সৎ গুণের অধিকারী হতে হলে অবশ্যই বিচক্ষণ হতে হবে। কিন্তু কোন শিশু সাহসী হয়েও অশান্ত হতে পারে। অর্থাৎ স্বাভাবিক গুণের ক্ষেত্রে একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির অধিকারী হওয়া যায় কিন্তু নৈতিক গুণের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতাকে বাদ দিয়ে নৈতিক গুণের অধিকারী হওয়া চলে না। বিচক্ষণতা থেকে অন্যান্য সৎ গুণ অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়।

সততা ও জ্ঞান (virtue and Knowledge)

‘ইউডিমিয়্যান এথিকস’ – এ অ্যারিস্টটল মন্তব্য করেছেন যে, সক্রেটিসের মতে, সব সততাই কোন কোন ধরনের জ্ঞান। তাঁর মতে, ন্যায়পরায়ণতা কি, সেই সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা আর ন্যায়পরায়ণ হওয়া একই বিষয়। কিন্তু অ্যারিস্টটল সক্রেটিসের এ বক্তব্য স্বীকার করে নিতে চান না। তার মতে, আমরা সাহসী হতে চাই, সাহস কি তা জানতে চাই না। আমরা ন্যায়পরায়ণ হতে চাই, ন্যায়পরায়ণতা কি, জানতে চাই না। ‘ম্যাগনা মােরালিয়া’ গ্রন্থে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, কোন ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণতা কি, তা জানলেই সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ হয় না। চিকিৎসকের নির্দেশ জেনেও অনেকে তা পালন করে না, তেমনি ন্যায়পরায়ণতা কি তা জেনেও অনেকে ন্যায়পরায়ণ হবার চেষ্টা করে না।

সততা হল এমন একটি মানসিক প্রবণতা যা অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত হয়। এ হল কর্তব্য সম্পাদন করার অভ্যাস। কিন্তু কর্তব্য সম্পর্কে যদি কোন জ্ঞান না থাকে তাহলে কর্তব্য করার অভ্যাস গঠিত হবে কিভাবে? তাই সক্রেটিসের মতে সততা হল জ্ঞান।

সমালোচনা : আমাদের মনে হয় এ দুটি মতকে জুড়ে দিলেই প্রকৃত সত্য জানা যায়। সততা হল জ্ঞান এবং অভ্যাস দুই-ই। কাজ করতে গেলেই জ্ঞানের প্রয়োজন হয় এবং জ্ঞান যদি কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ না করে তা হল শূন্যগর্ভ। কর্তব্যের জ্ঞান যেমন প্রয়োজন, নিয়মিত কর্তব্য করার অভ্যাসও ততোধিক প্রয়োজন, যার ফলে সততা অর্জন করা সম্ভব হয়।

সুখ (Pleasure)

নৈতিক সততা এবং অসততার সঙ্গে সুখ-দুঃখের সম্পর্ক রয়েছে। এ সুখ-দুঃখের জন্যই আমরা অনেক সময় কোন কিছুকে ভাল জেনেও তার বিরুদ্ধাচরণ করি এবং সৎ শিক্ষার কাজ হল যা আমাদের ভােগ করা উচিত তাকে ভােগ করতে এবং যা আমাদের ভােগ করা অনুচিত তাকে অপছন্দ করতে শিক্ষা দেওয়া। এ কারণে অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানে আনন্দের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রিস্টটলের মতে, সুখ (Pleasure) আনন্দের (Happiness) থেকে পৃথক, যদিও সুখ ছাড়া কোন আনন্দ হতে পারে না।

সুখ সম্পর্কে তিনটি অভিমত : সুখ সম্পর্কে তিনটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন –
(১) কোন সুখই ভাল নয়।
(২) কোন কোন সুখ ভাল কিন্তু অধিকাংশ সুখই খারাপ।
(৩) যদিও কোন কোন সুখ ভাল বা কল্যাণপ্রদ, সুখ মানুয়ের জীবনের পরম কল্যাণ বা পরম কাম্যবস্তু নয়।

সমগ্র আলোচনাটি অ্যাকাডেমিতে সমসাময়িক বিতর্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্পিউসিপ্পাস (Speusippus)-এর মতে, কোন সুখই ভাল বা কল্যাণপ্রদ নয় এবং ইউডােক্সাস (Eudoxus)-এর মতে, সুখই হচ্ছে পরম কাম্যবস্তু। আমাদের একটা বিষয় এ প্রসঙ্গে খেয়ালে রাখতে হবে। আমাদের অনুমান করে নেওয়া উচিত হবে না যে, একটা বিশেষ অভিমত খণ্ডন করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বুঝি তার বিপরীত মতটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অ্যারিস্টটল বিশেষ করে দেখাতে চেয়েছেন, যে-কোন একটি অভিমতের সপক্ষে যে যুক্তি উপস্থাপিত করা হয়েছে তা সমর্থনযোগ্য নয়।

উপরিউক্তি তিনটি অভিমতের মধ্যে অ্যারিস্টটল প্রথমটিকে অস্বীকার করেন। কষ্ট (Pain) সুনিশ্চিতভাবে মন্দ, তাই আনন্দ অবশ্যই ভাল। অ্যারিস্টটল স্বীকার করতে চান না যে, সুখ মাত্রই খারাপ। সুখ অবশ্য ভাল হতে পারে না যেমন, ইউডােক্সাস মনে করেছিলেন, কেননা কোন কার্য বিনা বাধায় সম্পাদিত হলে সুখ তাকে স্বাভাবিকভাবে অনুসরণ করে। তাই মানুষের লক্ষ হওয়া উচিত কাজ; কাজ থেকে যে সুখ হয়, সেই সুখ নয়। এমন অনেক কাজ আছে, যার থেকে সুখ হয় না, তবু আমাদের সেইসব কাজ সম্পাদন করা লক্ষ হওয়া উচিত। আবার সুখ মানুষের কাম্য হতে পারে না, কেননা, সুখ এমন অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত যেসব কাজ একান্তভাবেই কলঙ্কজনক।

মানুষের যথাযথ সুখ তার বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত : কোন কোন সুখ কলঙ্কজনক বলে সব সুখই খারাপ, এ সিদ্ধান্তও যুক্তিযুক্ত নয়। ভাল কাজ করলে যে সুখ পাওয়া যায় তা ভাল, আবার মন্দ কাজ করলে যে সুখ পাওয়া যায় তা মন্দ। তাই কর্ম অনুযায়ী সুখের পার্থক্য ঘটে। অ্যারিস্টটলের মতে, মন্দ সুখ (Bad Pleasure)-এর অস্তিত্ব আছে, যেগুলো ভাল লোকের কাছে সুখ নয়। এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলোকে সুখের থেকেও মূল্যবান মনে করা হয়। সুখজনক হলেও শিশুর বুদ্ধি নিয়ে কেউ সারা জীবন চলতে চাইবে না। প্রত্যেক প্রাণীরই তার যথাযথ সুখ রয়েছে এবং মানুষের যথাযথ সুখ তার বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

সুখ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের নিজস্ব বক্তব্য : সুখই মানুষের পরম কল্যাণ, ইউডােকসাস (Eudoxus)-এর এ অভিমত অ্যারিস্টোটল গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু মানুষ এবং প্রাণী যাকে স্বাভাবিকভাবে সুখপ্রদ মনে করে তার প্রতি প্লেটো যেমন বিতৃষ্ণা জানিয়েছেন তার বিরোধিতা করে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, সব প্রাণীই যেহেতু সুখ অনুসন্ধান করে, তাই স্বীকার করা যায় এটি অন্ততঃপক্ষে একটি কল্যাণকর বস্তু।

অ্যারিস্টটলের মতে, সুখ স্বাভাবিক ক্রিয়াকে পরিপূর্ণতা বা সমপূর্ণতা দান করে। এর অর্থ এই নয় যে, ক্রিয়াটিই অসম্পূর্ণ। সুখ অতিরিক্তভাবে এসে পড়ে। সুখ স্বাভাবিক কাজে সম্পূর্ণতা আনে, এ মতবাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিণতিকে স্বীকার করেছেন অ্যারিস্টটল। ক্রিয়া নৈতিক গুণের দিক থেকে নীতিগতভাবে ভাল, মন্দ এবং নীতি নিরপেক্ষ। সুখের নৈতিক গুণের তারতম্য ঘটে। যেহেতু কি ধরনের কাজ কর্মকর্তা সম্পাদন করছে সেই কাজের ধরনের ওপর এ তারতম্য নির্ভর করে, অর্থাৎ যে কাজ করে সুখ হয় সেই কাজের প্রকৃতির দ্বারাই নির্ধারিত হয় সুখের নৈতিক গুণ , অর্থাৎ সুখ ভাল নাকি মন্দ সেটা।

ভাল লোকই কোটি যথার্থ সুখ বিচার করতে পারে : অ্যারিস্টটলের মতে, ভাল লোকই কোনটি যথার্থ সুখ, তার বিচার করতে পারে। রুগ্ন ব্যক্তি, কোন্‌টি মিষ্টি, কোটি টক্, কোন্‌টি উষ্ণ, কোটি শীতল—এ সম্পর্কে ভ্রান্ত অভিমত ব্যক্ত করতে পারে। একমাত্র সুস্থ ব্যক্তি এগুলো সঠিকভাবে বিচার করতে পারে। অ্যারিস্টটলের মতে, নৈতিক দিক থেকে যিনি সাচ্চা লোক তিনিই কোটি যথার্থ সুখকর, কোনটি নয়, তার মানদণ্ড যুগিয়ে দিতে পারেন। অন্যান্য সুখ, সুখ বলে প্রতিভাত হয় এবং সেই কারণেই অ্যারিস্টটল আপাতঃবিরোধী সিদ্ধান্ত করেছেন যে, কোন কোন সুখ যা মন্দ বা কলঙ্কজনক বলে স্বীকৃত, যথার্থ সুখ নয়; এগুলো যারা দুশ্চরিত্র বা নৈতিক দিক থেকে অধঃপতিত তাদের কাছেই সুখ। তাই কাজের গুণানুসারেই সুখ ভাল, মন্দ বা নিরপেক্ষ। কাজের এবং সুখের—এ দুইয়ের বিচারের সময় আমরা কোনটি প্রকৃত ভাল এবং যথার্থ সুখপ্রদ তার জন্য ভাল লোককে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করব।

সুখ, দুঃখের অভাব নয় : অ্যারিস্টটলের মতে, সুখ, দুঃখের অভাব (Negation) নয়। দুঃখ, স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে যে অভাব সৃষ্টি করে, সুখ সেই অভাব পূরণ করে দেয়। অ্যারিস্টটল এ মতবাদে বিশ্বাসী নয়। এ কথা সত্যি, অভাব পূরণ হলে সুখ হয়। যেমন- ক্লান্তি দুঃখজনক, ক্লান্তি তিরোহিত হলে সুখ আসে। কিন্তু তাই বলে এ সিদ্ধান্ত করা চলে না যে, পূর্ববর্তী কোন অভাবের পূরণই হল সুখ। গণিত পাঠ করে বা আলোচনা করে সুখ হয়, এক্ষেত্রে কোন পূর্ববতী অভাবের বা দুঃখের প্রশ্ন ওঠে কি? সুগন্ধ সুখ দেয়, এখানেও পূর্ববতী কোন দুঃখের কথা ভাবা যায় কি? প্রত্যাশা এবং স্মৃতি সুখজনক এবং এদের সঙ্গে কোন পূর্ববর্তী দুঃখ জড়িত নয়।

তাই সুখ কোন অভাবাত্মক অবস্থা নয়, ভাবাত্মক অবস্থা। যে কাজের সঙ্গে সুখ জড়িত, সেই কাজের পার্থক্য অনুযায়ী সুখও পৃথক হয়। ভাল মানুষ যাকে সুখ বলে তাই যথার্থ সুখ, মন্দ ব্যক্তির সুখ যথার্থ সুখ নয়। সব সুখই দৈহিক সুখ—এ অভিমত অ্যারিস্টটল স্বীকার করেন না। সব বস্তুই আংশিকভাবে ঐশ্বরিক এবং তাই তার উচ্চতর সুখ প্রদানের ক্ষমতা আছে।

কপলস্টোনের মন্তব্য – কপলস্টোন বলেন যে, সুখের আলোচনায় অ্যারিস্টটলের সৎ বুদ্ধি ও মনস্তত্ত্বসুলভ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে, বুদ্ধিসংক্রান্ত ক্রিয়া থেকে যে সুখ হয় তাকেই তিনি প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি সবরকম চরম পন্থাকে বর্জন করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি ইউডােক্সাস-এর সঙ্গে একমত হয়ে সুখকেই ভাল বলেননি আবার। স্পিউসিপ্পাস (Speusippus)-এর সঙ্গে একমত হয়ে সব সুখকেই খারাপ বলেননি।

বন্ধুত্ব (Friendship)

বন্ধুত্ব হল নিজেকে ভালবাসা : অ্যারিস্টটল তার নীতিশাস্ত্রের অষ্টম এবং নবম খণ্ডে বন্ধুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার মতে, বন্ধুত্ব একটি সৎ গুণ। এটি জীবনের অনিবার্য বস্তুগুলোর মধ্যে অন্যতম। অ্যারিস্টটলের মতে, বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকেই ভালবাসে। তবে নিজেকে ভালবাসা বা ‘আত্ম-ভালবাসা’র তিনি বিভিন্ন রকম অর্থ করেছেন। কোন কোন লোক নিজেদের জন্য যতদূর সম্ভব ইন্দ্রিয়সুখ, অর্থ, খ্যাতি ইত্যাদি কামনা করে। এরা নিজেদের ভালবাসে এ কথা যখন আমরা বলি, তখন নিন্দাসূচক অর্থে তা বলে থাকি। আবার ভাল মানুষ মহৎ কর্ম করে, সৎ গুণ অর্জন করে নিজের শ্রেষ্ঠতা দেখাতে উৎসুক। এও নিজেকে ভালবাসা, তবে একে আমরা দোষের বলে মনে করি না। ভাল লোক বন্ধুকে অর্থ দান করে যাতে বন্ধুর অনেক অর্থ হয়। এতে বন্ধুর ধনপ্রাপ্তি ঘটে। কিন্তু ধনদাতা সৎকর্মের অধিকারী হয়। তিনি সততা অর্জন করেন। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা এ সম্পর্কেও উপরিউক্ত বক্তব্য সত্য। কোন ব্যক্তি অপরকে সম্মানিত করেছেন। তাকে খ্যাতির অধিকারী করে, তাকে জগতে প্রতিষ্ঠিত করে নিজে অর্জন করেছেন মহত্ত্ব। এ কথা ঠিক যে, নিজে মহত্ত্ব অর্জন করার জন্য বন্ধুকে অর্থ দেওয়া মােটেও সমর্থনযোগ্য নয়। অ্যারিস্টটল আসলে যেটা দেখাতে চেয়েছেন সেটা হল, নিজেকে ভালবাসার ধরণ ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে।

বন্ধুত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত আত্মকেন্দ্রিক নয় : অ্যারিস্টটল বলেন যে, কোন ব্যক্তির তার বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক তার নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের অনুরূপ, কেননা বন্ধু হল তার নিজ আত্মারই এক দ্বিতীয় রূপ। অর্থাৎ কিনা, নিজের আত্মাকে এমনভাবে বিস্তৃত করা সম্ভব যাতে বন্ধুরাও নিজের আত্মার অংশ হয়ে ওঠে, যাতে বন্ধুর সুখ, দুঃখ, জয়, পরাজয় নিজের সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয় বলে মনে হয়। তা ছাড়া অ্যারিস্টটল যখন বলেন যে, ভালবাসা পাওয়ার থেকে ভালবাসা দেওয়াতেই বন্ধুত্ব নিহিত বা ‘মানুষ বন্ধুদের ভালর জন্যই বন্ধুদের কল্যাণ চায়’ তখন এ সমস্ত বিবৃতি থেকে মনে হয় যে অ্যারিস্টটলের বন্ধুত্ব সম্পর্কে অভিমত যতখানি আত্মকেন্দ্রিক মনে হয়, ততখানি আত্মকেন্দ্রিক নয়।

সৎ ব্যক্তির মধ্যেই নিখুঁত বন্ধুত্ব সত্তা : অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, সৎ ব্যক্তির মধ্যেই নিখুঁত বন্ধুত্ব সম্ভব এবং একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। নিজের থেকে উচ্চতর অবস্থায় অধিষ্ঠিত এমন ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়। কারণ যদি তিনি উচ্চতর সততার অধিকারী না হন, তাহলে তাকে যে শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে তার সমর্থন খুঁজে পাওয়া যাবে না। অসম সম্বন্ধের ক্ষেত্রে, যেমন-স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, পদমর্যাদায় যিনি উচ্চতর, তাকেই বেশি ভালবাসা উচিত। ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয় কেননা ঈশ্বর আমাদের ভালবাসতে পারেন না। মানুষ কি নিজে নিজের বন্ধু হতে পারে? অ্যারিস্টটলের মতে, হতে পারে, যদি তিনি সৎ ব্যক্তি হন। দুষ্ট ব্যক্তি প্রায়ই নিজেকে ঘৃণা করে। সৎ ব্যক্তির নিজেকে ভালবাসা উচিত, তবে তিনি মহৎভাবে নিজেকে ভালবাসবেন। বন্ধুরা দুর্ভাগ্যের সময় সান্ত্বনাস্বরূপ। কিন্তু তাদের সহানুভূতি কামনা করেও তাদের অসুখী করা উচিত নয়, যেমন স্ত্রীলোকেরা করে থাকেন বা নারী প্রকৃতির পুরুষেরা করে থাকেন। বন্ধু সকল অবস্থাতেই কাম্য, শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের সময় নয়, কেননা সুখী মানুষ বন্ধু কামনা করে যাতে সে তার সুখ, বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে।

বন্ধুত্বের শ্রেণীবিভাগ : অ্যারিস্টটলের বন্ধুত্বের ধারণা বেশ ব্যাপক এবং এ ব্যাপকতার বিষয়টি বোঝা যায় যখন দেখি অ্যারিস্টটল বন্ধুত্বের নানারকম শ্রেণীবিভাগ করেছেন –

  • (১) প্রয়োজনভিত্তিক বন্ধুত্ব – এ ধরনের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এ ধরনের বন্ধুত্ব মানুষের পক্ষে অনিবার্য, কেননা আর্থিক দিক থেকে মানুষ স্ব-নির্ভর নয়। ব্যবহারিক বন্ধুত্ব এ শ্রেণীর অন্তর্গত।
  • (২) সুখ লাভের জন্য বন্ধুত্ব – মানুষ সমাজে অপরের সঙ্গ কামনা করে এবং অপরের সঙ্গ কামনা থেকেই এ জাতীয় বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অ্যারিস্টটলের মতে, উপরিউক্ত দুই শ্রেণীর বন্ধুত্বই স্বল্পকাল স্থায়ী। কারণ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বা সুখলাভের ইচ্ছা যখন ক্ষীণ হয়ে যায় তখন বন্ধুত্বও ভেঙ্গে যায়।
  • (৩) সৎ লোকের বন্ধুত্ব – অ্যারিস্টটলের মতে, এ জাতীয় বন্ধুত্বই শ্রেষ্ঠ এবং স্থায়ী হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, বন্ধুত্ব অনুভূতি নয়, কেননা বন্ধুত্ব হল একটা মানসিক অভ্যাস যা অনুশীলনের দ্বারা আয়ত্ত হয়।

অ্যারিস্টটলের বন্ধুত্ব সম্পর্কীয় অভিমত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বার্ট্রান্ড, রাসেল বলেন, বন্ধুত্ব সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে সবই বোধগম্য। তবে সাধারণ জ্ঞানের বাড়তি একটি শব্দও সেখানে নেই। (B. Russell : A History of Western Philosophy; Page 180.)

আনন্দ এবং পরম জীবন

অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় হল আনন্দ। তিনি তার নীতিবিজ্ঞানের প্রথম খণ্ডে আনন্দের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আনন্দের স্বরূপ নিরূপণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, আনন্দ মানুষের কাজের ওপর নির্ভর করে এবং আনন্দ হল মানুষের আত্মার সততা অনুসারে কার্য সম্পাদন। কিন্তু অ্যারিস্টটল তাঁর নীতিবিজ্ঞানের শেষ পরিচ্ছেদে আবার সততা এবং পরম জীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন।

পরম সততা হল মনন : অ্যারিস্টাটল বলেন, আনন্দ যদি হয় সততা অনুসারে কার্য সম্পাদন, তাহলে এটা যুক্তিযুক্ত যে, আনন্দ হবে পরম সততা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন। কিন্তু পরম সততা হল আত্মার শ্রেষ্ঠ অংশ অর্থাৎ কিনা, বিচার-বুদ্ধি যার কার্যকে এখানে মনন (Contemplation) বলে অভিহিত করা হয়েছে। মানুষের পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন হল মননমূলক জীবন (Contemplative Life) বা দার্শনিকের জীবন (Life of the Philosopher)। অ্যারিস্টটলের মতে, এটি শুধু যে পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন তা নয়, এটি হল পরম আনন্দের এবং সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন।

অ্যারিস্টটলের পরম বা শ্রেষ্ঠ জীবন সম্পর্কে ধারণা মানুষের নিম্নতর বৃত্তিকে অগ্রাহ্য করে না। আত্মার বৃত্তি অনুসারে উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ এমনকি দেবতারা সকলেই একটি নিরবচ্ছিন্ন ক্রমে বিন্যস্ত। উদ্ভিদের রয়েছে পুষ্টিগত এবং বংশরক্ষামূলক আত্মা। প্রাণীদের সংবেদন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরও অতিরিক্ত কিছু, যেমন স্থানীয় গতি কামনা, কল্পনা ইত্যাদি। মানুষের এসব নিম্নতর বৃত্তি রয়েছে, তা ছাড়া রয়েছে বিচারবুদ্ধি। দেবতাদের সঙ্গে মানুষ এ বিচারবুদ্ধির অংশীদার। মানুষের পরম জীবন নির্ভর করে কিছু পরিমাণে আত্মার এ নিম্নতর বৃত্তির ক্রিয়া করার ওপর। যেমন, অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, মননশীল জীবন কাটাবার জন্য, অনুশীলন করার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য ভাল হওয়া দরকার। কিন্তু তবু যখন তিনি শ্রেষ্ঠ জীবনের কথা বলেছেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই সেই বৃত্তির উল্লেখ করেছেন। যে বৃত্তির জন্য মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক।

বিচারবুদ্ধির অনুশীলন হল শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া, কিন্তু বিচারবুদ্ধি, অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষের তুলনায় ঐশ্বরিক (divine in comparison with man)। মানুষ বলেই যে মানুষ বিচারবুদ্ধির জীবন যাপন করবে, তা নয়। মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক উপাদান রয়েছে বলেই মানুষ তা করবে না।

বিচারবুদ্ধির অনুশীলন শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া : প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই মননের জীবনকে ক্রিয়া জীবন (Life of Action) থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল ক্রিয়ায় জীবনের সঙ্গে যুক্ত সৎ গুণগুলোকে মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক ধর্ম বলেই গণ্য করেছেন; কিন্তু বিচারবুদ্ধির জীবনকে তিনি অতিমানবিক গণ্য করেছেন।

পরিপূর্ণ আনন্দ মননমূলক : পরিপূর্ণ আনন্দ মননমূলক। মনন, যুদ্ধ অথবা রাজনীতি বা অন্য কোন ব্যবহারিক কর্মজীবনের থেকে শ্রেয়, কেননা, মননের ক্ষেত্রে অবকাশ (Leisure) রয়েছে। ব্যবহারিক সৎ গুণ এবং আনন্দের জন্য এ অবকাশ প্রয়োজন। ব্যবহারিক সৎ গুণ এক গৌণ ধরণের আনন্দ, মানুষের পরম আনন্দ বিচারবুদ্ধির অনুশীলনে নিহিত। মানুষ পরিপূর্ণভাবে মননশীল হতে পারে না কিন্তু যতখানি পারে তাতেই সে ঐশ্বরিক জীবনের অংশীদার হয়। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে অন্য ক্রিয়ার কথা বলা যেতে পারে না, তাই ঈশ্বরের ক্রিয়া হচ্ছে মননমূলক। দার্শনিক কাজ ঈশ্বরের মত মননমূলক এবং তাই দার্শনিক সবচেয়ে আনন্দের অধিকারী।

অ্যারিস্টটল বলেন যে, ব্যক্তি তার বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ করে এবং তার অনুশীলন করে। মনে হয়, সে সবচেয়ে ভাল মানসিক অবস্থায় থাকে এবং দেবতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়। দার্শনিকও তা করে থাকেন, তাই দার্শনিক দেবতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং যে ব্যক্তি এরূপ, সে সবচেয়ে আনন্দ লাভের অধিকারী এমন মনে করা যেতে পারে। তাই এদিক থেকেও দেখা যাচ্ছে, দার্শনিক অন্যের তুলনায় বেশি আনন্দের অধিকারী।

শ্রেষ্ঠ আনন্দ বা মননের ওপর নির্ভরতার সপক্ষে যুক্তি : মানুষের শ্রেষ্ঠ আনন্দ যে বিচারবুদ্ধির ক্রিয়া এবং তাই মননের ওপর নির্ভর, অ্যারিস্টটল তার সপক্ষে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন –

(১) বিচারবুদ্ধি মানুষের শ্রেষ্ঠ বৃত্তি এবং তত্ত্বীয় মননকার্য (Theoretic Contemplation) বিচারবুদ্ধির শ্রেষ্ঠ ক্রিয়া।
(২) দৈহিক ক্রিয়ার তুলনায় বিচারবুদ্ধির ক্রিয়াকে অধিককাল স্থায়ী করা যায়।
(৩) সুখ আনন্দের একটা উপাদান এবং দর্শনের মধ্যে এ সুখের চরম প্রকাশ ঘটে।
(৪) দার্শনিক অন্যান্য ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি স্ব-নির্ভর। জাগতিক প্রয়োজনকে একেবারে বর্জন করা সম্ভব না হলেও তিনি নির্জনে তার মননক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারেন এবং অপরের সহায়তা ছাড়াও তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম, যদিও অপরের সহযোগিতা তার পক্ষে অভিপ্রেত বিষয়।
(৫) দর্শনের প্রতি অনুরাগ দর্শনের জন্যই, দর্শন থেকে কোন ফল লাভ ঘটে তার জন্য নয়। দর্শন কোন লক্ষ লাভের উপায় নয়। তাই দার্শনিক, মননক্রিয়ার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ আনন্দের অধিকারী হন।

মহৎ বস্তুকে কেন্দ্র করে বিচারবুদ্ধির অনুশীলন : তাই মহৎ বস্তুকে কেন্দ্র করে বিচারবুদ্ধির অনুশীলনের মধ্যেই মানুষের পরিপূর্ণ আনন্দকে পাওয়া যায়। তবে এ অনুশীলন যেন স্বল্পকাল স্থায়ী না হয়ে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। এ ধরনের জীবনই, মানুষের মধ্যে যে ঐশ্বরিক উপাদান আছে, তাকে প্রকাশ করে ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করে আমাদের উচিত বিচারবুদ্ধির জীবন যাপন করায়, যেহেতু বিচারবুদ্ধিই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপাদান। বিচারবুদ্ধি মানুষের আত্মার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও এর মূল্য এবং ক্ষমতা অপরিসীম। বস্তুত বিচারবুদ্ধিই মানুষের প্রকৃত আত্মারূপে গণ্য হতে পারে যেহেতু এটি সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং সকলের ওপরই এর প্রভুত্ব। তাই মানুষের উচিত তার প্রকৃত আত্মার জীবনকেই বেছে নেওয়া।

তত্ত্বীয় মননের বিষয়বস্তু হিসেবে কাকে অ্যারিস্টটল অন্তর্ভুক্ত করেছেন : তিনি গণিতের এবং অধিবিদ্যার অপরিবর্তনীয় বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে যে সব বস্তু অপরিবর্তনীয়, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পদার্থবিদ্যা মননের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যদি পদার্থবিদ্যার আলোচ্য বিষয় যে পরিবর্তনশীল বস্তু, সেই পরিবর্তনশীল বস্তুর মধ্যে অপরিবর্তনীয় এবং অনিবার্য উপাদানগুলো নিয়ে পদার্থবিদ্যা আলোচনা করে।

অধিবিদ্যার পরম বস্তু হল ঈশ্বর। ‘ইউডিমিয়ান এথিকস্’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ঈশ্বরের পূজা ও মনন আদর্শ জীবনের পক্ষে অপরিহার্য, তাই এ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল নীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কের কথা বলেছেন কিন্তু ‘নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস’-এ এই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অ্যারিস্টটল মননের ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তা পরবর্তীকালের দার্শনিকদের উপর, বিশেষ করে খ্রিস্টান দার্শনিদের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

নীতিবিজ্ঞানের যুক্তির মূল্য

দশম খণ্ডের ৬-৮ পরিচ্ছেদে অ্যারিস্টটল মননশীল জীবনের স্তুতিবাদ করেছেন। তারপর ‘নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস’-এর শেষ পরিচ্ছেদে অ্যারিস্টটল নীতিবিজ্ঞানে যুক্তির মূল্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

নীতিবিজ্ঞান পাঠে মানুষ সৎ হয় না : অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, নীতিবিজ্ঞান পাঠে মানুষ সৎ হয় না। মানুষকে সৎ করার ব্যাপারে স্বভাব, অভ্যাস এবং যুক্তি প্রকৃতির কিছু না কিছু অবদান আছে। কিন্তু স্বভাব আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। যারা স্বভাবত সৎ এবং সৎ অভ্যাসের দ্বারা যাদের চরিত্রের সততা আরও বিকশিত, তাদের ক্ষেত্রেই যুক্তি বা শিক্ষা কার্যকর। কিন্তু অধিকাংশ লোকই নীতির ব্যাপারে কোন যুক্তিতে কর্ণপাত করতে চান না। এ জাতীয় লোকদের যুক্তির দ্বারা বশ করা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগই একমাত্র যুক্তিযুক্ত পন্থা। অবশ্য এ বল প্রয়োগ হল রাষ্ট্র প্রণীত আইনের প্রয়োগ। এ আইনই তাদের সৎ হতে বাধ্য করবে বা মন্দ আচরণ থেকে তাদের নিবৃত্ত করবে। যারা সম্ভাবাপন্ন, আইন তাদের সৎ কার্য সম্পাদনে প্রেরণা যোগাবে, যারা সততার নিয়ম লঙ্ঘন করতে চায় তাদের শাস্তি প্রদান করবে এবং যারা সংশােধনের অতীত তাদের নির্বাসিত করবে। তাই নীতিবিজ্ঞানের আলোচনা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার দিকে চালিত করে। ব্যক্তির জীবনে সমগ্র সমাজ জীবনের, তার আইন, আচার-ব্যবহার, তার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, ভাল আইন প্রণয়ন করেই রাষ্ট্রে নাগরিকদের সৎ আচরণে প্রণােদিত করা যেতে পারে। নীতিবিজ্ঞানের কাজ হল মানুষের কল্যাণ কি তা নিরূপণ করা এবং মানুষের লক্ষ কি হওয়া উচিত তা আমাদের সামনে তুলে ধরা, যাতে জীবনে, কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা অগ্রসর হতে সচেষ্ট হই।

অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের গুণ এবং দোষ

বার্ট্রান্ড রাসেলের তিনটি প্রশ্ন : বার্ট্রান্ড রাসেল তার দর্শনের ইতিহাসে অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের গুণ ও দোষের আলোচনা করতে গিয়ে তিনটি প্রশ্ন উথাপন করেছেন। অবশ্য এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করার জন্য আমরা অ্যারিস্টটলের ‘নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস্’-এর ওপরই বিশেষ করে নির্ভর করব –

(১) অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সঙ্গতি আছে কি? এই উত্তরে বলা যেতে পারে যে, নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস-এর আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঙ্গতি বর্তমান, কেবলমাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে এ সঙ্গতি লক্ষ করা যায় না, যদিও সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; যেমন, অ্যারিস্টটলের মধ্যপন্থা সম্পর্কীয় মতবাদ কেবলমাত্র ব্যবহারিক সৎ গুণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বুদ্ধিগত সৎ গুণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

(২) অ্যারিস্টটলের অন্যান্য অভিমতের সঙ্গে তাঁর নীতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন অভিমত কি সঙ্গতিপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে তার অধিবিদ্যার সঙ্গতি বর্তমান।

(৩) নীতিবিজ্ঞানের সমস্যা সম্পর্কে অ্যারিস্টটল যে সব উত্তর দিয়েছেন সেগুলো কি আমাদের নৈতিক অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, অ্যারিস্টটলের অনেক নৈতিক সিদ্ধান্ত আমাদের নৈতিক অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন, ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে তিনি কোন অভিযোগ উত্থাপন করেননি। যা শ্রেয় বা সবচেয়ে কল্যাণপ্রদ, তা স্বল্প কয়েকজনের জন্য অর্থাৎ অহঙ্কারী ব্যক্তি এবং দার্শনিকদের জন্য, অ্যারিস্টটলের এ অভিমত স্বীকার করে নেওয়া যায় না। এ অভিমত স্বীকার করে নিলে বহু লোককে অপর ব্যক্তির উপায়রূপে গণ্য করতে হবে। কান্ট বলেছেন, প্রতি মানুষই নিজে নিজের লক্ষ, কোন লক্ষ লাভের উপায় নয়। অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানে মহানুভবতার কোন স্থান নেই। মানুষের দুঃখকে তিনি আবেগের দিক থেকে না দেখে বুদ্ধিগত দিক থেকে অকল্যাণ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু মানুষের দুঃখ যে তাকে অসুখী করে তোলে তার কোন প্রমাণ তার নীতিবিজ্ঞান গ্রন্থে নেই। বাৰ্টান্ড রাসেল বলেন যে, অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞ্যনে আবেগের অভাব (Emotional poverty) পরিলক্ষিত হয় যা তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মধ্যে দৃষ্ট হয় না। নৈতিক জীবনের গভীরতর দিকগুলো তার অজানা ছিল। মানুষের অভিজ্ঞতার সেই ক্ষেত্রটি যেটি ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাকে তিনি আলোচনা থেকে বর্জন করেছেন। রাসেল বলেন, “আমার অভিমতানুসারে তাঁর নীতিবিজ্ঞানের খ্যাতি সত্ত্বেও তার মধ্যে স্বকীয় গুরুত্বের অভাব।” (“… in my judgment, his Ethics, inspite of its fame, is lacking in intrinsic importance.” B. Russell : ‘A History of Western Philosophy”; Page 184.)

জি. ই. আর. লয়েডের মন্তব্য : জি.ই. আর. লয়েড অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানের সমালোচনায় বলেন যে, অ্যারিস্টটলের নীতিবিজ্ঞানে যে বিশেষ নৈতিক মতবাদগুলোর কথা বলা হয়েছে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কিন্তু নৈতিক অনুসন্ধান কার্যের প্রকৃতি সম্পর্কে তার ধারণা তার মতবাদগুলোর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অ্যারিস্টটল প্রচার করাকে তার কর্তব্য বলে মনে করেননি। তাঁর কাজ হল বিশ্লেষণ করা এবং মানুষ সাধারণত উচিত- অনুচিত সম্পর্কে যা বিশ্বাস করে তার পরীক্ষণ নিয়েই তার পদ্ধতি শুরু হয়েছে। ‘নাইকোম্যাকিয়ান এথিকস’ সাহিত্য হিসেবে মােটেও আকর্ষণীয় নয়। তবে অ্যারিস্টটলের গ্রন্থটি একটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে। এ গ্রন্থের লক্ষ মূলত মানুষকে অসৎ পথ থেকে সৎ পথে আনা নয়, বরং মানুষের আচরণের সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা। নৈতিক প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে গেলে কি অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো আলোচনা করা এবং সমস্যার সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধানে উপনীত হওয়া। আর যদি সিদ্ধান্তগুলোতে গাণিতিক অনিবার্যতার অভাব পরিলক্ষিত হয়, তাহলে মনে করতে হবে যে, নৈতিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গাণিতিক নিশ্চয়তা লাভ করা যায় না। তার আলোচনার উদ্দেশ্য নৈতিক সমস্যার উপর আলোকপাত করা।

জনৈক সমালোচক বলেন, “এটা মন্তব্য করা প্রয়োজনীয় যে যদিও অ্যারিস্টোটলের নৈতিক সৎ গুণের সাধারণ বিবরণ সরল এবং পরিকল্পনামূলক, তাঁর ব্যক্তিগত সৎগুণের আলোচনা মানুষ যে বহু বিচিত্র ক্ষমতা ও দুর্বলতার অধিকারী এবং যে বহু বিচিত্র পরিপ্রেক্ষিতে তাদের চরিত্র পরীক্ষিত ও প্রকাশিত হয়, তা প্রকাশ করে।” (J.L. Aclcvill : Aristotle’s Ethics, Page 23.)

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রনীতি

ভূমিকা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিবিজ্ঞান বা নীতিশাস্ত্র থেকে কোন স্বতন্ত্র নয়, এটি হল একই বিষয়ের অপর একটি বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের নীতিবিজ্ঞান, ব্যক্তির নয়। শুধু এ কারণেই যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতি-বিজ্ঞানের বিভাগ তা নয়, এ ছাড়াও অপর কারণ হল ব্যক্তির নৈতিকতা রাষ্ট্রের মধ্যেই তার লক্ষ্যকে খুঁজে পায় এবং রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তির নৈতিকতা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র কি তাই নিয়ে তিনি তাঁর আলোচনা শুরু করেছেন। পরে রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের পার্থক্য, পূর্ববর্তী লেখকদের আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে বক্তব্য, শাসনতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ, নাগরিকের অধিকার এবং কর্তব্য, কারা নাগরিক হবার উপযুক্ত, বিপ্লব কেন সংঘটিত হয়, বিপ্লব নিবারণের উপায়, ক্রীতদাসত্ব, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র সম্পর্কে তার অভিমতও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিবৃত করেছেন। জি.ই. আর এ লয়েড বলেন, “অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যে আলোচনা করেছেন, তা, আজকে যাকে আমরা সমাজবিজ্ঞান বলি , তার সমগ্র আলোচনার ক্ষেত্র যতদূর ব্যাপক, ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।”

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পূর্ব থেকে পরিলক্ষিত কোন রচনা নয়। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রচনার একত্র সংযোজন। প্রথম খণ্ডটি তার রচনা নয়। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রচনার একত্র সংযোজন। প্রথম খণ্ডটি তার রচনার শেষের দিকের অংশ। এটিকে সমগ্র রচনার ভূমিকাস্বরূপ গণ্য করা যেতে পারে। ধারাবাহিকভাবে প্রদত্ত বক্তৃতামালা থেকেই এ রচনার উৎপত্তি এবং এর অনেক অংশ অসম্পূর্ণ।

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন আকর্ষণীয় তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। আকর্ষণীয় এ কারণে যে, তার সময়কার শিক্ষিত গ্রীকদের সাধারণ সংস্কারের কথা এটি প্রকাশ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এটি অনেক নীতির বা তত্ত্বের উৎস, মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত যাদের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল।”

রাষ্ট্র (state)

মানুষের পরমকল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনার শুরু। রাষ্ট্র বলতে অ্যারিস্টটল গ্রীক নগর রাষ্ট্র বুঝেছেন। রাষ্ট্র হল বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন এবং মানুষের পরমকল্যাণই রাষ্ট্রের লক্ষ। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মত; রাষ্ট্রের একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ আছে। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের লক্ষ যেমন কোন না কোন কল্যাণ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ লক্ষ হল মানুষের পরম কল্যাণ, মানুষের নৈতিক এবং বুদ্ধিময় জীবন।

অ্যারিস্টটল, প্লেটোর সঙ্গে একমত যে, নাগরিকের সৎ জীবনযাপন এবং আনন্দই হল রাষ্ট্রের লক্ষ, রাষ্ট্র ভিন্ন যেগুলো অন্য কোথাও নাগরিকদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়। মানুষ স্বভাবত এক রাজনৈতিক জীব। এটি প্রমাণিত হয় যে বিষয়টির দ্বারা সেটি হল, মানুষ কথা বলার অধিকারী। কোন জীব সামাজিক না হলে তার এ অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। স্বভাবত (by nature) রাজনৈতিক জীব বলতে বোঝায়, মানুষ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে তার জীবনের প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদন করতে পারে না। রাষ্ট্র হল আকার, ব্যক্তি হল উপাদান। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সততা শিক্ষা দেয় এবং সততার অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগের ব্যবস্থা করে দেয়। রাষ্ট্র ছাড়া মানুষ মানুষই হতো না সে হতো একটি বন্য পশু।

রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা : রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক উৎপত্তি নিরূপণ করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল পরিবারের মধ্যেই তা খুঁজে পেলেন। আদিম সামাজিক সংগঠন হল পরিবার। পুরুষ এবং নারী, প্রভু এবং ক্রীতদাস- এ দুই মৌলিক সম্বন্ধের ওপর ভিত্তি করেই পরিবারের উদ্ভব। উভয় সম্বন্ধই স্বাভাবিক সম্বন্ধ। জীবনের জন্যই, মানুষের প্রাত্যাহিক অভাব মেটাবার জন্যই পরিবারের অস্তিত্ব। যখন অনেকগুলো পরিবার একত্র যুক্ত হয় এবং নিছক দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও অন্য লক্ষ্যের প্রশ্ন এসে পড়ে, তখন গ্রামের আবির্ভাব ঘটে। যখন অনেকগুলো গ্রাম একত্রিত হয়ে একটি সামাজিক সংগঠনের সৃষ্টি হয় তখন নগর বা রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। রাষ্ট্র পরিবার বা গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। জীবনের নিছক প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি কিন্তু কল্যাণময় জীবন যাপনের জন্যই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব। অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র পরিবার এবং গ্রাম থেকে শুধুমাত্র পরিমাণগত দিক থেকে নয়, গুণগত দিক থেকে এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রেই কেবলমাত্র মানুষ পরিপূর্ণ অর্থে অকল্যাণময় জীবন-যাপন করতে পারে এবং কল্যাণময় জীবন যাপনই মানুষের স্বাভাবিক লক্ষ। রাষ্ট্র হল একটি স্বাভাবিক সমাজ। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক অগ্রগতি রাষ্ট্রেই ঘটা সম্ভব, কেননা এ লক্ষ্যের উপযোগী অবস্থাগুলো রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে।

রাষ্ট্র ব্যক্তি এবং পরিবারের অগ্রবর্তী : অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র পরিবার এবং গ্রামের নিছক যান্ত্রিক সমষ্টি নয়। কারণ কালের দিক থেকে যদিও রাষ্ট্র ব্যক্তি এবং পরিবারের পরে আসে, চিন্তার দিক থেকে এবং বাস্তবতার দিক থেকে রাষ্ট্র, ব্যক্তি এবং পরিবারের আগে আসে। রাষ্ট্র হল লক্ষ এবং লক্ষ যার লক্ষ, সব সময়ই তার পুর্ববতী। প্রকৃতিগত দিক থেকেও রাষ্ট্র পরিবার এবং ব্যক্তির পূর্ববতী। কারণ, কোন কিছু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলেই আমরা তাকে তার প্রকৃতি (Nature) বলি। মনুষ্য সমাজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলেই রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং সমগ্র যে অংশের পূর্ববর্তী এ কথা অস্বীকার করা চলে না। রাষ্ট্র হল সমগ্র যা অবশ্যম্ভাবীভাবে অংশের পূর্ববর্তী, অংশ হল পরিবার এবং ব্যক্তি। রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাই ব্যক্তি হল সমগ্রের সম্পর্কে একটি অংশের মত। লক্ষ্যের সাহায্যে প্রারম্ভ বা শুরুকে ব্যাখ্যা করা যায়, তাই রাষ্ট্রের সাহায্যেই পরিবারের ব্যাখ্যা হতে পারে। রাষ্ট্র পরিবারের তুলনায় পরিপূর্ণভাবে বিকশিত।

রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক সামাজিক সংগঠন : রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক সামাজিক সংগঠন, কেননা একটি পরিপূর্ণতা সভ্য জীবনের সম্ভাবনা রাষ্ট্রে নিহিত। যে মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী, এ সভ্য জীবন তারই লক্ষ্য। যে মানুষ রাষ্ট্র ছাড়া বসবাস করতে পারে সে হয় একজন পশু কিংবা ঈশ্বর। মানুষ তার কথা বলার ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী। এ ক্ষমতার জন্যই মানুষ ভাল এবং মন্দ, অন্যায় এবং ন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং মানুষের এ বোধই তাকে পরিবার এবং রাষ্ট্র গঠন করায়। এ কথা বলার ক্ষমতা আরও প্রমাণ করে যে, মানুষ অন্যান্য জীব থেকে অনেক বেশি সামাজিক।

রাষ্ট্র ব্যক্তির যান্ত্রিক সমষ্টি নয় : রাষ্ট্রের প্রকৃতি যান্ত্রিক নয় আঙ্গিক, এটি ব্যক্তির যান্ত্রিক সমষ্টি নয়। রাষ্ট্র একটি জীবদেহ, যেখানে বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে আঙ্গিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি হাত যদি দেহের সঙ্গে যুক্ত না থাকে, তাকে হাত বলা যেতে পারে না। আসল তাৎপর্য হল, একটি হাতের সংজ্ঞা দিতে গেলে তার উদ্দেশ্যের দ্বারাই সেই সংজ্ঞা দিতে হবে। সেই উদ্দেশ্য হল কিছু ধরা এবং এ কার্যটি হাতের পক্ষে করা সম্ভব যদি কোন সজীব দেহের সঙ্গে হাতটি যুক্ত থাকে। অনুরূপভাবে, কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের অংশ না হলে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। অ্যারিস্টটল বলেন, যে ব্যক্তি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি পরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ আইন ছাড়া মানুষ প্রাণীদের মধ্যে নিকৃষ্ট এবং আইন, তার অস্তিত্বের জন্য, রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে। পণ্য বিনিময় এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্র নিছক একটা সমাজ নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ হল কল্যাণপ্রদ জীবন। শুধুমাত্র সাহচর্যের জন্য নয়, মহৎ কাজের জন্য রাজনৈতিক সমাজের অস্তিত্ব। অঞ্চল বা জনসংখ্যার দ্বারা রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় শাসনতন্ত্রের দ্বারা। শাসনতন্ত্র পরিবর্তিত হলেই রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়।

দুটি বিরোধী মতের সমালোচনা : যারা রাষ্ট্রের সত্তা স্বীকার করেন, ব্যক্তির সত্তা স্বীকার করেন না, আবার যারা ব্যক্তির সত্তা স্বীকার করেন, রাষ্ট্রের সত্তা স্বীকার করেন না, এ দুই অভিমতেরই অ্যারিস্টটল বিরোধিতা করেছেন। রাষ্ট্র সম্পর্কে যান্ত্রিক মতবাদ অ্যারিস্টটল সমর্থন করেন না। এ মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র ব্যক্তির নিছক যান্ত্রিক সমষ্টিমাত্র। এ মতবাদ অংশের অর্থাৎ কিনা, ব্যক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং সমগ্রের অর্থাৎ রাষ্ট্রের সত্তা অস্বীকার করে। অ্যারিস্টটলের মতে, এ মতবাদ ভ্রান্ত। আবার প্লেটো তার রিপাবলিক’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের সত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং যে ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র গঠিত তাদের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, এ অভিমতও ভ্রমাত্মক।

রাষ্ট্রের আনন্দের কথা কখন বলা যেতে পারে? রাষ্ট্রের আনন্দের কথা তখনই বলা যেতে পারে যখন রাষ্ট্র আনন্দে রয়েছে এমন লোকের দ্বারা গঠিত হয়। আনন্দ ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়েরই লক্ষ। (Maurice Defourmy : The Aim of the State : Peace; Page 195 (in Atricles on Aristotle Edited by Barnes, Schofield and Sorabji.)

মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে কল্যাণময় জীবন যাপন করতে পারে বা আনন্দ লাভ করতে পারে এবং রাষ্ট্র কালগত না হলেও বাস্তব দিক থেকে ব্যক্তির ও পরিবারের অগ্রবর্তী। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের এ অভিমত পরবর্তীকালের রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। একথা সত্য যে, অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের চিন্তা করতে গিয়ে গ্রীক নগর রাষ্ট্রের পরিধির বাইরে তার চিন্তাকে বিস্তৃত করতে পারেননি, তবু রাষ্ট্রের যথার্থ প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য যে পরবর্তীকালের অনেক দার্শনিকের তুলনায় তিনিই যথাযথভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, তা আজও একান্তভাবে স্বীকৃত।

ক্রীতদাসত্ব (Slavery)

ক্রীতদাসত্ব স্বাভাবিক। রাষ্ট্র যেহেতু পরিবার দিয়ে গঠিত তাই অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আলোচনা পরিবার দিয়েই শুরু হওয়া উচিত। কিন্তু প্রভু-ক্রীতদাস সম্পর্কের এবং সম্পত্তি অর্জনের আলোচনাতেই পরিবারের আলোচনার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে। অ্যারিস্টটল ক্রীতদাসত্ব সমর্থন করেছেন এবং তাকে স্বাভাবিক গণ্য করেছেন পুরুষ। এবং স্ত্রী, পিতা এবং সন্তানের মধ্যে যেমন স্বাভাবিক পার্থক্য আছে, তেমনি প্রভু এবং ক্রীতদাসের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। তার মতে, ক্রীতদাস হল প্রভুর জীবনের সাহায্যকারী একটি সজীব ক্রিয়াশীল যন্ত্রমাত্র। ক্রীতদাস প্রথার উপযোগিতা আছে এবং এটি সমর্থনযোগ্য। স্বাভাবিকভাবে ক্রীতদাস তার প্রভুর থেকে নিকৃষ্ট। জন্ম থেকেই কিছু লোক শাসিত হওয়ার জন্য চিহ্নিত হয় এবং কিছু লোক শাসন বা প্রভুত্ব করে। তিনি মনে করেন যে, শাসক এবং শাসিতের মধ্যে পার্থক্য প্রকৃতির সর্বত্রই দৃষ্ট হয়।

ব্যক্তি মানুষের মধ্যেও এ বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যেখানে আত্মা শাসন করে এবং দেহ শাসিত হয়। এটা সুস্পষ্ট যে, কিছু লোক স্বভাবতই স্বাধীন এবং কিছু লোক পরাধীন এবং শেষােক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে ক্রীতদাসত্ব সুবিধাজনক এবং সঙ্গত।

ক্রীতদাস নির্বাচন : যে মানুষ স্বভাবতই তার নিজের নয়, অন্য ব্যক্তির, স্বভাবতই সে একজন ক্রীতদাস। যে সব প্রাণী পােষ মানে, তারা ভাল থাকে যখন মানুষ তাদের ওপর প্রভুত্ব করে। ঠিক তেমনি, যারা স্বাভাবিকভাবে নিকৃষ্ট, তারা ভাল থাকে যখন তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাদের ওপর প্রভুত্ব করে। একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস তৈরি করা সমর্থনযোগ্য প্রথা কিনা? এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, যেসব ব্যক্তিকে স্বাভাবিকভাবে শাসিত হওয়ার কথা তারা যখন তাতে অসম্মতি জানায় তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা সমর্থনযোগ্য এবং কেবলমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই অর্থাৎ বিজিতদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস নির্বাচন করা যুক্তিসঙ্গত।

অ্যারিস্টটলের অভিমতের সমালোচনা : কেউ কেউ ক্রীতদাস হবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে, অ্যারিস্টটলের এ মতবাদ কোনমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কপলস্টোন বলেন অ্যারিস্টটলের মতবাদের সার কথা হল যে, বুদ্ধিগত এবং শারীরিক ক্ষমতার দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং তাই সমাজে তাদের স্থানও হবে ভিন্ন ভিন্ন। অবশ্য অ্যারিস্টটল যদি স্বীকার করে থাকেন যে, মানুষের যোগ্যতা এবং মানিয়ে চলার দিক থেকে পার্থক্য আছে তাহলে তা এমন কিছু নিন্দনীয় নয়। কিন্তু কিছু লোক প্রভুত্ব করবে এবং কিছু লোক ক্রীতদাস হবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে, এ চুলচেরা বিভাগকে সমর্থন করা চলে না। তাছাড়া কি অবস্থায় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে ক্রীতদাস সংগ্রহ করা চলে, এ সম্পর্কে তাঁর অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তার অভিমত, যেকোন যুদ্ধ ঘােষণাকারীকে তার কার্যের সমর্থন যুগিয়ে দেবে। কোন জাতিই স্বীকার করবে না যে সে শাসিত হবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে এবং প্রকৃতির যথার্থ অভিপ্রায় কি, সেটি যুদ্ধের ফলাফল দেখেই নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে বলতে হবে, প্রতিটি যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিজেতা যথাযথ কাজ করেছে এবং বিজিতরা তাদের ওপর প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না দিয়ে অন্যায় করেছে। কিন্তু এ জাতীয় সিদ্ধান্তকে কি গ্রহণ করা যেতে পারে?

অ্যারিস্টটল ক্রীতদাস প্রথা সমর্থন করলেও এ কথা ব্যক্ত করেছেন যে, প্রভুর উচিত হবে না তার ক্রীতদাসের ওপর অত্যাচার করা। ক্রীতদাসের সন্তানও যে স্বাভাবিকভাবে ক্রীতদাস হবে, এমন কোন কথা নেই। তবে অ্যারিস্টটল যাই বলুন না কেন, ক্রীতদাস প্রথাকে তিনি যে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন তা নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক এবং এটি তার ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

জনৈক দার্শনিক সমালোচক অ্যারিস্টটলের ক্রীতদাস প্রথা সম্পর্কে আলোচনা করার পর মন্তব্য করেছেন, “আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, ক্রীতদাসত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে মূর্খতার পরিচায়ক নয় নৈতিক দিক থেকে বীভৎস নয়। অবশ্য এটা সত্য যে, জগতে কোন স্বাভাবিক ক্রীতদাস নেই, তাই অভিমতটি তাত্ত্বিক। তবে মতবাদ হিসাবে এর গুণ হল প্লেটো লস (Laws) – এ যে পরস্পর বিরুদ্ধ অভিমত ব্যক্ত করেছেন এটি তার মাঝে একটি মধ্যপথ অনুসরণ করেছে।” (W. W . Fortenbamgh : Aristotle on Slaves and Women ; page 135 (in Articles on Aristotle. edited by Barnes, Schofield and Soradji.)

ধন বা সম্পত্তি অর্জন 

অ্যারিস্টটল ধন উপার্জন বা সম্পত্তি সংগ্রহ করার কয়েকটি পদ্ধতির কথা বলেছেন। ধন অর্জন বা সম্পত্তি লাভের স্বাভাবিক উপায় হল পশুচারণ, মৃগয়া, কৃষিকর্ম প্রভৃতি উপায়ের দ্বারা জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করা।

বিনিয়োগ পদ্ধতি : দ্বিতীয় পদ্ধতি হল বস্তু ক্রয় করার জন্য অর্থ বিনিয়োগ পদ্ধতি। তিনি এ পদ্ধতিকে অস্বাভাবিক বলে বর্ণনা করেছেন এবং নিন্দা করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, কোন বস্তুর দুই রকম ব্যবহার আছে, একটি উপযুক্ত এবং অপরটি অনুপযুক্ত। যখন জুতো পরিধান করা হয় তখন জুতোর যথাযথ বা উপযুক্ত ব্যবহার হয়। কিন্তু যখন জুতোর বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করা হয় তখন তার অনুপযুক্ত ব্যবহার হয়। যে মুচি জুতো তৈরি করে, জীবিকার জন্য অর্থের বিনিময়ে তা বিক্রি করে, তার কার্য নিন্দনীয়। অর্থ সংগ্রহ বা সম্পত্তি লাভের ব্যাপারে খুচরা বিক্রয় পদ্ধতি স্বাভাবিক পদ্ধতি নয়। কৃষিকর্ম, পশুচারণ প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন স্বাভাবিক পদ্ধতি এবং এভাবে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটা সীমা আছে। কিন্তু ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন সীমা নেই। তাই ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন ঘৃণ্য পদ্ধতি; কারণ এটা অস্বাভাবিক। গ্রীকদের ব্যবসার প্রতি যে মনোভাব তাই প্রকাশ পেয়েছে। অ্যারিস্টটলের খুচরা বিক্রয় পদ্ধতির যখন নিন্দা করেছেন।

তেজারতি কারবার নিন্দনীয় : তেজারতি কারবার বা সুদে টাকা ধার দেওয়ান পদ্ধতি, তাঁর মতে হল টাকা থেকেই লাভ করা; টাকার যেটা স্বাভাবিক উদ্দেশ্য অর্থ কোন বস্তু ক্রয় করার জন্য অর্থের ব্যবহার, তার থেকে নয়। বিনিময়ের জন্যই অর্থের ব্যবহার সুপ্রযুক্ত, সুদে তার বৃদ্ধি অভিপ্রেত বিষয় নয়। যত রকমভাবে অর্থ রোজগার করা যায় এটি হল তার মধ্যে সবচেয়ে অস্বাভাবিক। গরু, ভেড়া এরা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অর্থ এভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে না। কোন বস্তু ক্রয় করলে তার বিনিময়ে অর্থ প্রদান, এ ছাড়া অর্থের কোন ব্যবহার নেই। বিনিময়ের মাধ্যমরুপে ব্যবহৃত হওয়াই অর্থের স্বাভাবিক উদ্দেশ্য। অর্থের বিনিময়ে কোন বস্তু গ্রহণ না করে এবং কোন রকম পরিশ্রম না করে, মানুষ যখন তার অর্থ বাড়াতে থাকে তখন তাকে অস্বাভাবিক পদ্ধতি বলতেই হয়। তাই এ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে ঘৃণ্য।

বিনিময় পদ্ধতি : পূর্বোক্ত দুটি পদ্ধতির মাঝামাঝি পদ্ধতি হল বিনিময় (Barter) পদ্ধতি। বিনিময় পদ্ধতিতে একটি বস্তুর যথাযথ বা উপযুক্ত ব্যবহার হয় না, তার থেকে পৃথক ধরনের ব্যবহার হয়। কিন্তু যেহেতু বিনিময় পদ্ধতির সাহায্যে আমরা আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করতে পারি তাই অ্যারিস্টটলের মতে, বিনিময় পদ্ধতিকে অর্থ উপার্জনের স্বাভাবিক উপায়রূপে গণ্য করা যেতে পারে।

প্লেটোর কাল্পনিক রাষ্ট্রের সমালোচনা (Criticism of Plato’s Utopia)

নানা দিক থেকে অ্যারিস্টটল প্লেটোর কাল্পনিক রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। প্লেটো রাষ্ট্রের ঐক্যের ওপর এত অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন যে ব্যক্তির বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটল প্লেটোর এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করতে পারেননি, কেননা রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির আঙ্গিক সম্পর্ক। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে নানা ব্যাপারে নানা ধরনের পরিবর্তনের কথা বলেছেন, যা অ্যারিস্টটল সমর্থন করতে পারেননি। প্লেটো যেসব আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন, অ্যারিস্টটল সেগুলোকে আবশ্যক বলে মনে করেননি। তা ছাড়া সেগুলোকে কার্যকর করা হলেও সেগুলো বাঞ্চিত নয়।

অভিভাবকবৃন্দকে পারিবারিক জীবনযাপন করা থেকে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। উদাহরণস্বরূপ, প্লেটো অভিভাবকবৃন্দের ক্ষেত্রে পরিবার প্রথা বর্জনের অনুমােদন করেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের মতে, পরিবার একটি স্বাভাবিক সংগঠন, অভিভাবকবৃন্দকে তার থেকে বঞ্চিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্লেটো অভিভাবক শ্রেণীর সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে রক্ষণাগার (Creche)-এর কথা বলেছেন, অ্যারিস্টটল তা সমর্থন করেননি যে, যে সন্তান সকলের সন্তান সে কারোর সন্তান নয়। অ্যারিস্টটলের মতে, সেই সন্তান অবহেলিত হতে বাধ্য। তিনি বলেন, প্লেটো যে অর্থে সন্তানের কথা বলেছেন, সেই অর্থে সন্তান হওয়ার চেয়ে বাস্তবে খুড়তুতো বা জ্যাঠতুতো ভাই হওয়া ভাল। সন্তান তার স্বাভাবিক মাতাপিতার স্নেহ ভালবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ হবে—এ বিষয়টিই অভিপ্রেত, কারণ তাতেই শিশুর প্রকৃত কল্যাণ হয়।

সমভােগবাদের সমালোচনা : প্লেটোর সমভােগবাদের আদর্শ অ্যারিস্টটলের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়েছে। আরিস্টটল বলেন, এর ফলে অলস ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাধের সঞ্চার হবে এবং নানা ধরনের কলহ, বিতর্ক প্রভৃতির সৃষ্টি হবে। বরং ত্যেকেই যে যার কাজের প্রতি মনোযোগী হবে এটাই ভাল। প্লেটোর মতে, অভিভাবকবৃন্দ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না। অ্যারিস্টটলের মতে, সম্পত্তি ভােগের মধ্যে সুখ নিহিত, এ সুখভােগ থেকে অভিভাবক শ্রেণীকে বঞ্চিত করা যক্তিসঙ্গত নয়। অভিভাবক শ্রেণীকে সম্পত্তি ভােগ করা থেকে বঞ্চিত করলে রাষ্ট্র সুখী হবে, অ্যারিস্টটলের মতে, এ যুক্তি অর্থহীন, কেননা ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের পৃথক সুখের কথা বলা চলে না। সব সম্পত্তিকে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে সম্পত্তির সমতা বিধানের পক্ষপাতী অ্যারিস্টটল ছিলেন না। কেননা এ ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন আছে বলে অ্যারিস্টটল মনে করেননি। তাঁর মতে, ব্যক্তির নিজ নিজ সম্পত্তি ভােগের অধিকার থাকা উচিত, কিন্তু তাদের এমনভাবে শিক্ষিত করা উচিত হবে, যাতে সমষ্টিগত কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে তারা তাদের সম্পত্তি ভােগ করে। আর যদি শিক্ষার সাহায্যে তাদের মহানুভব করে তোলা না যায়, তা হলে রাষ্ট্রের উচিত, তাদের অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহে বাধা দান করা।

শাসনতন্ত্র এবং সরকার (Constitution and Government)

নানা ধরনের শাসনতন্ত্র আলোচনা করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল সরকারকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন— ভাল এবং মন্দ। সেই সরকারকে ভাল বলা যেতে পারে যে সরকারের লক্ষ সমাজের সমষ্টিগত কল্যাণ। সেই সরকার মন্দ, যে সরকার কেবল নিজের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী। তিন ধরনের সরকার আছে যাদের ভাল বলা যেতে পারে : রাজতন্ত্র (Monarchy), অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) এবং জনতন্ত্র (Polity)। তিন ধরনের মন্দ সরকার হল স্বৈরতন্ত্র (Tyrrany), ধনিকতন্ত্র (Oligarchy) এবং গণতন্ত্র (Democracy)।

বিভিন্ন সরকারের প্রকৃতি বর্ণনা : শাসন ক্ষমতা যখন একজন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত থাকে, যে ব্যক্তি অন্যান্য ব্যক্তির থেকে জ্ঞানে এমন উচ্চতর যে, তিনি স্বাভাবিকভাবেই শাসন করেন, তখন তা হল রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রের বিকৃত রূপ হল স্বৈরতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্র একজন মাত্র ব্যক্তির শাসন; কিন্তু ব্যক্তি তার বিজ্ঞতা এবং শাসন ক্ষমতার দিক থেকে অপরের থেকে শ্রেষ্ঠ বলে শাসন পরিচালনা করে না, বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে। দ্বিতীয় ভাল সরকার হল অভিজাততন্ত্র। এ সরকারের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে স্বল্প কিছু জ্ঞানী এবং সৎ ব্যক্তির হাতে। এর বিকৃত রূপ হল ধনিকতন্ত্র; এক্ষেত্রে শাসনকার্য পরিচালনা করেন স্বল্প কয়েক জন ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তৃতীয় ভাল সরকার হল জনতন্ত্র। জনতন্ত্রে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে বহুজনের হাতে। এক্ষেত্রে সব নাগরিকই প্রায় সমান ক্ষমতার অধিকারী। এখানে বিশেষ কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর উপরে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে না, যার ফলে প্রায় সবাই বা অধিকাংশ ব্যক্তি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে। এরই বিকৃত রুপ হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে শাসনকার্য বহুজনের ওপর ন্যস্ত থাকলেও, এটি হল মূলত দরিদ্র ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত সরকার।

জনতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ সরকার : অ্যারিস্টটলের মতে, অভিজাততন্ত্র রাজতন্ত্রের তুলনায় এবং জনতন্ত্র অভিজাততন্ত্রের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তার মতে, কোন রাষ্ট্রে এমন একজন ব্যক্তি যদি থাকেন যিনি সকল বিষয়ে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাহলে তিনিই হবেন স্বাভাবিক রাজা ও শাসক, এবং সেক্ষেত্রে রাজতন্ত্রই হবে আদর্শ সরকার। কিন্তু বাস্তবে সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ এমন ব্যক্তির দেখা পাওয়া কঠিন। তাই অ্যারিস্টটল মনে করেন রাজতন্ত্রের তুলনায় অভিজাততন্ত্র শ্রেষ্ঠ। অভিজাততন্ত্রে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা নিজেদের যোগ্যতাবলে অপরকে শাসন করেন এবং শাসন করার সময় অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, সমসাময়িক রাষ্ট্রের পক্ষে অভিজাততন্ত্রের আদর্শ খুবই উচ্চ আদর্শ। সেই কারণে তিনি জনতন্ত্রকে অভিজাততন্ত্রের তুলনায় শ্রেয় মনে করেন। এ হল মধ্যবিত্তের শাসন এবং এ সরকার হল ধনিকতন্ত্র এবং জনতন্ত্রের মধ্যবর্তী সরকার। ধনীরা দরিদ্রদের এবং দরিদ্ররা ধনীদের বিশ্বাস করতে পারে না, কিন্তু উভয় শ্রেণীই মধ্যবিত্তদের বিশ্বাস করতে পারে। সে কারণে তিনি ধনী বা দরিদ্রদের শাসনের তুলনায় মধ্যবিত্তের শাসনকে ভাল মনে করেন।

শাসকের মধ্যে নৈতিক গুণের উপস্থিতিই, ভাল এবং মন্দ সরকারের পার্থক্য নিরূপণ করে

ভাল এবং মন্দ সরকারের যে পার্থক্য অ্যারিস্টটল করেছেন সেটি শাসনতন্ত্রের আকারের দ্বারা নিরূপিত হবে না, সেটি নিরূপিত হবে যাদের হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত তাদের নৈতিক গুণের দ্বারা। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন যে, এটি আংশিকভাবে সত্য। অভিজাততন্ত্র হল সৎ ব্যক্তির শাসন এবং ধনিকতন্ত্র হল ধনী ব্যক্তিদের শাসন এবং অ্যারিস্টটল সততা ও ধনকে কখনও অভিন্ন গণ্য করেননি। তিনি তার মধ্যপন্থা সম্পকীয় মতবাদ অনুসারে যে অভিমত পােষণ করেন তা হল, সততার সঙ্গে কিছু মাত্রায় যোগ্যতা যুক্ত হওয়া দরকার। তাই অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে ধনিকতন্ত্রের পার্থক্য আছে, কেননা যারা শ্রেষ্ঠ তাদের ঐশ্বর্য হবে পরিমিত। জনতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে, কেননা উভয়ের মধ্যে নৈতিক পার্থক্য ছাড়াও অ্যারিস্টটল যাকে জনতন্ত্র বলেছেন তার মধ্যে কিছু ধনিকতন্ত্রের উপাদান আছে। কিন্তু রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্য শুধুমাত্র নৈতিক পার্থক্য।

ধনিকতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ভর করছে শাসনকার্য যাদের ওপরে ন্যস্ত তাদের অর্থনৈতিক মর্যাদার ওপরে। ধনিকতন্ত্রের সরকার হল সেই সরকার যে সরকারে ধনীরা দরিদ্রের কথা চিন্তা না করে শাসনকার্য চালায়। গণতন্ত্রের বেলায় যারা অভাবগ্রস্ত তাদের হাতেই শাসনকার্য ন্যস্ত থাকে এবং তারা ধনীর স্বার্থের প্রতি উদাসীন হয়।

যা সবচেয়ে ভাল সরকার তার বিকৃত রূপ হল সবচেয়ে খারাপ। সুতরাং স্বৈরতন্ত্রের থেকে ধনিকতন্ত্রের নিকৃষ্ট এবং ধনিকতন্ত্রের থেকে গণতন্ত্র নিকৃষ্ট। অ্যারিস্টটলের মতে, বাস্তবে অস্তিত্বশীল অধিকাংশ সরকার খারাপ এবং তাই বাস্তব সরকারের মধ্যে গণতন্ত্র হল সবচেয়ে ভাল।

বিপ্লব (Revolution)

বিভিন্ন শাসনতন্ত্রে কি রকম ধরনের বিপ্লব দেখা টতে পারে, এ বিপ্লব কতখানি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে, বিপ্লবের বিভিন্ন কারণ, এবং বিপ্লব কিভাবে নিবারিত হতে পারে-এ সব বিষয় নিয়ে অ্যারিস্টটল তার রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। গ্রীসে বিপ্লব প্রায়ই দেখা দিত। তাই বিপ্লব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল এবং এ ঐতিহাসিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই তিনি বিপ্লব সম্পর্কে তার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গঠন করেছিলেন।

বিপ্লবের ধারণা : অ্যারিস্টটলের মতে, বিপ্লবের কারণ হল ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে একদেশদর্শী ধারণা। যারা গণতন্ত্রী তারা মনে করেন যে মানুষ যেহেতু সমানভাবে স্বাধীন, তাই তারা সকল বিষয়েই সমান হবে। ধনতন্ত্রীরা মনে করে যে, যেহেতু ধনের দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য, তাই তারা সব দিকে পৃথক হবে। উভয়েরই ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে এক বিশেষ ধরণের ধারণা রয়েছে, যে ধারণাকে যথার্থ ধারণা বলা চলে না। তাই উভয় দলই যখন কোন সরকার গঠনে অংশীদার হয়, তখন ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধারণার জন্য বিপ্লব দেখা দেয়। ধনিকতন্ত্রের তুলনায় গণতন্ত্রে বিপ্লব দেখা দেবার সম্ভাবনা কম, কেননা ধনিকতন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হতে পারে।

বিপ্লব নিবারণের উপায় : অ্যারিস্টটলের মতে, বিপ্লব নিবারণের তিনটি প্রকৃষ্ট উপায় হল— শিক্ষাগত, সরকারি প্রচার, খুব ছােটখাটো বিষয়েও আইনের প্রতি আনুগত্য এবং আইন ও প্রশাসনের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা। অর্থাৎ কিনা “অনুপাত অনুযায়ী সমতা এবং প্রতিটি ব্যক্তির নিজ বিষয় ভােগ করা”, (equality according to proportion and for every man to enjoy his own property) ‘অনুপাত অনুযায়ী সমতা’– এ নীতির ক্ষেত্রে কি অসুবিধা দেখা দিতে পারে অ্যারিস্টটল তা ভেবে দেখেননি। কারণ একেই যদি যথার্থ ন্যায়পরায়ণতা বলে অভিহিত করতে হয় তাহলে সততার অনুপাতের কথা বলতে হয়। কিন্তু সততার পরিমাপ অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।

আনুপাতিক সমতা : রাজনীতির ক্ষেত্রে এ সততার পরিমাপ করা হয় আয়ের দ্বারা। সব সামাজিক অসমতা হল আয় সম্পর্কীয় অসমতা। গণতন্ত্রীরা মনে করেন, অর্থ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ‘আনুপাতিক ন্যায়পরায়ণতার’ প্রশ্নের কখনও কোনও সমাধান মিলতে পারে না। ধনিকতন্ত্রের সমর্থকবৃন্দও মনে করেন যে, আয় সততার আনুপাতিক (Income is proportional to virtue)। অ্যারিস্টটলও মনে করেন যে, সৎ লোকেরা তার নিজের যতটুকু আয় করা প্রয়োজন তাই করেন, তার বেশিও নয়, কমও নয়। কিন্তু এ ধরনের ধারণা যুক্তিসঙ্গত নয় বলে অনেকে মনে করেন। ন্যায়পরায়ণতা পরিপূর্ণ সমতা নির্দেশ করে, যে ন্যায়পরায়ণতা সততা ছাড়া অন্য কোন ধরণের গুণকে প্রাধান্য দেয় তা নিন্দনীয়।

অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, শাসনকর্তাদের পদাধিকার বলে নিজেদের জন্য অর্থ রোজগারের কোন সুযোগ না থাকা উচিত। শাসনযন্ত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য থাকা প্রয়োজন, তারা অবশ্যই প্রশাসন কার্যে দক্ষ হবেন এবং তাদের চরিত্রের সততা থাকা প্রয়োজন। কোন সরকারের উচিত নয় চরম সীমায় উপনীত হওয়া। কারণ গণতন্ত্র বা ধনতন্ত্র যদি চরম সীমায় উপনীত হয় তাহলে দলের মধ্যে অসন্তোয় পুঞ্জীভূত হয় এবং তার পরে বিপ্লব ঘটে।

আনুপাতিক সমতা (Proportional Equality)

যে সাধারণ নীতির দ্বারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার, সেই নীতিটি হল ‘আনুপাতিক সমতার নীতি’। অ্যারিস্টটল গণতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক উভয় ধরনের ন্যায়পরায়ণতার সমালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিকরা সব নাগরিককে সমান মনে করেন। যেহেতু তারা জন্মসূত্রে স্বাধীন। ধনতান্ত্রিকরা অপরপক্ষে মনে করেন যে, নাগরিকদের মধ্যে কোন সমতা নেই তাই অর্থের দিক থেকে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, উভয় ধারণাই ভ্রান্ত কেননা, উভয় অভিমতই সমতা এবং অসমতা সম্পর্কে অত্যন্ত সংকীর্ণ ধারণাতে বিশ্বাসী। স্বাধীন জন্ম এবং ধনের দ্বারাই বিচার করা যেতে পারে না, দুটি মানুষ সমান কিনা। কেননা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সমতা ও অসমতার বিচার করতে গেলে আমাদের জন্ম এবং অর্থ ছাড়াও অন্য গুণাবলি, বিশেষ করে মানুষের নৈতিক এবং বুদ্ধিগত গুণগুলো বিচার করে দেখা প্রয়োজন।

প্রতিটি মানুষের যা প্রাপ্য তাকে তাই দেওয়াই হল ন্যায়পরায়ণতা। কিন্তু যা তার প্রাপ্য, তা সকল ক্ষেত্রেই এক রকম হতে পারে না। অ্যারিস্টটল মনে করেন, সমগুণবিশিষ্ট লোক সমান অংশীদার হবেন কিন্তু যাদের গুণগত শ্ৰেষ্ঠতা রয়েছে তাদেরকে তাদের থেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এক করে দেখা যুক্তিসঙ্গত নয়। যা সরকারের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করে তা হল আনুপাতিক সমতা (Proportional Equality)।

সম্ভাব্য রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত 

প্লেটো এবং অন্যান্য লেখকের আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা করার পর অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র কি হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্রের লক্ষ সমগ্র সমাজের কল্যাণ করা। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র হল সেটি যেখানে প্রতিটি লোক, সে যেই হােক না কেন, সবচেয়ে ভালভাবে কাজ করতে পারে এবং আনন্দে বসবাস করতে পারে। কিন্তু আনন্দ সৎ কাজের ওপর নির্ভর। তাই কতখানি আনন্দ মানুষ লাভ করবে তা নির্ভর করছে কতখানি সততা সে অনুশীলন করতে সক্ষম। নাগরিকই কেবলমাত্র রাজনীতিবিদ এবং দার্শনিকদের সৎ গুণগুলো অনুশীলন করতে পারে এবং সেই কারণে সে একাই পরিপূর্ণ আনন্দ লাভে সক্ষম। কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের লক্ষ হল তার সভ্যদের সততা অনুশীলনের জন্য তাদের বিভিন্ন ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সমর্থ করা।

রাষ্ট্র কতটা বৃহৎ হওয়া উচিত : অ্যারিস্টটলের মতে, বড় রাষ্ট্র কখনও সুশাসিত হয় না। কেননা একটা বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য রাষ্ট্রের যতখানি বড় হওয়া দরকার, ততখানি বড় হওয়া উচিত, কিন্তু এতখানি বড় হওয়া উচিত নয় যাতে সুশাসন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সােজা কথায়, রাষ্ট্র ততখানি বৃহৎ হওয়া উচিত যাতে রাষ্ট্রের যেটি লক্ষ সেটি লাভ করা যেতে পারে। রাষ্ট্র ছােট হওয়া দরকার যাতে নাগরিকরা পরস্পরকে জানতে পারে, তা না হলে নির্বাচন এবং মামলা-মােকদ্দমার ক্ষেত্রে সুবিচার সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের জনসংখ্যা সীমিত হওয়া দরকার।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, যা পরিণতিতে বিপ্লব ঘটায়। প্লেটোর মত তিনি বিশ্বাস করেন যে , নাগরিকরা কখন বিবাহ করবে এবং তাদের সন্তান হবে সেই সম্পর্কে আইন সাধারণ সীমা নির্ধারণ করে দেবে। অতিরিক্ত শিশু সন্তান সম্পর্কে তার বক্তব্য হল যে, যে শিশুর দেহ বিকৃত, এমন শিশুকে বাচিয়ে রাখা সমীচীন নয় এবং প্রয়োজনে গর্ভপাত সমর্থনযোগ্য।

রাষ্ট্রের আয়তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, রাষ্ট্র ছােট হওয়া দরকার যাতে পর্বতের উপর থেকে তাকে নিরীক্ষণ করা যায়। অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কীয় এ ধরনের অভিমত আধুনিক কালের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কতখানি অসঙ্গতিপূর্ণ তা সহজেই বোঝা যায়।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত অভিমতের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি : রাষ্ট্র আয়তনে এত ছােট হবে না যাতে রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক জীবন অসম্ভব হয়ে দাড়ায় এবং এত বড় হওয়া উচিত নয়। যাতে বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অর্থই রাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ হবে না। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয় বস্তু আমদানি করবে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু রপ্তানি করবে। অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্য আমদানি-রপ্তানি করবে, এও এক অসঙ্গতিপূর্ণ অভিমত।

নাগরিকতার অধিকার : রাষ্ট্রের নাগরিক সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের অভিমত হল, যেসব ব্যক্তি জীবিকার জন্য কাজ করে তাদের নাগরিকতায় কোন অধিকার থাকবে না। রাষ্ট্রে কৃষক, কারিগর প্রভৃতির প্রয়োজন আছে কিন্তু নাগরিকত্বে তাদের অধিকার থাকবে না। নাগরিকেরা মিস্ত্রি, কারিগরের পেশা গ্রহণ করবে না। কেননা এ ধরনের জীবন অসম্মানজনক এবং সৎ জীবন যাপনের পক্ষে ক্ষতিকর। নাগরিকেরা কৃষক হবে না, কেননা, তাদের অবসরের প্রয়োজন। যোদ্ধারাই হল পরিপূর্ণ অর্থে নাগরিক। এরা যৌবনে যোদ্ধা হবে, মধ্যবয়সে শাসনকর্তা এবং বৃদ্ধ বয়সে পুরোহিত হবে। নাগরিকের একখণ্ড জমি থাকবে নগরের কাছে এবং আর একখণ্ড জমি থাকবে রাষ্ট্রের সীমান্তে। এর ফলে সকলেরই রাষ্ট্রকে রক্ষা করার ব্যাপারে আগ্রহ জাগবে। এই জমির কাজ করবে এমন কোন ব্যক্তি যে নাগরিক নয়।

শিক্ষা

প্লেটোর মত অ্যারিস্টোটলও শিক্ষার ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং প্লেটোর মতই তিনি মনে করেন এটি রাষ্ট্রের কাজ। শিক্ষা শুরু হবে দেহকে কেন্দ্র করে এবং দেহের কামনা-বাসনা নিয়ে, কেননা আত্মার তুলনায় দেহ এবং তার কামনা-বাসনা বহু পূর্বে বিকশিত হয়। তবে আত্মার জন্যই দেহের এবং বিচারবুদ্ধির জন্যই কামনা-বাসনার শিক্ষণ প্রয়োজন।

তাই শিক্ষা হল মূলত নৈতিক শিক্ষা, কেননা নাগরিক কখনও , কারিগরের বৃত্তি গ্রহণ করে তার জীবিকা নির্বাহ করবে না। তাকে শিক্ষা লাভ হবে ভাল সৈনিক বা ভাল শাসনকর্তা হবার জন্য। শিশুদের কথা ভেবেই অ্যারিস্টোটল নৈতিক শিক্ষার ওপরে এতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ শিশুরাই ভবিগত নাগরিক হবে। যারা ক্রীতদাস, তাদের হয়ত রন্ধনকার্য বা অন্যান্য কাজ শেখানো যেতে পারে। কিন্তু এগুলো শিক্ষার কোন অঙ্গ নয়।

শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি : যে শাসনতন্ত্রের অধীনে শিশুরা থাকবে, সেই শাসনতন্ত্রের দিকে লক্ষ রেখেই তাদের শিক্ষিত করতে হবে। শাসনব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক, সেই অনুসারে শিক্ষারও হেরফের হবে। অ্যারিস্টোটল মনে করেন নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকার থাকবে। শিশুরা তাদের পক্ষে যা প্রয়োজনীয় তা শিক্ষা করবে কিন্তু এমন কোন কিছু শিক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হবে না যা তাদের দেহকে বিকৃত করে বা তাদের শুধু অর্থ রোজগারের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। তারা মল্লক্রীড়া অভ্যাস করবে তবে তার মাত্রা থাকবে। পেশাদারী দক্ষতা অর্জনে তাদের আগ্রহী হওয়া উচিত হবে না। শিশুরা চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করবে, ভাস্কর হবে, তবে তাদের এমন চিত্রাঙ্কন এবং ভাস্কর্য শিক্ষা করা উচিত, যা নৈতিক ধারণার প্রকাশক। তারা গান-বাজনা শিক্ষা করবে এমনভাবে, যাতে তারা সঙ্গীতের সমালোচক হতে পারে, কিন্তু খুব বেশি দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হওয়া সমীচীন হবে না। তারা অবশ্যই লিখতে ও পড়তে শিখবে যদিও চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, সঙ্গীত প্রভৃতির ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য সততা অর্জন, উপযোগিতা নয়।

বৃত্তি শিক্ষার প্রতি অনীহা : অ্যারিস্টোটলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অসম্পূর্ণ হওয়াতে নাগরিকদের উচ্চতর শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, দর্শন শিক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে অ্যারিস্টোটলের সঠিক অভিমত কি জান যায় না। তবে কপলস্টোন প্রমুখ বিভিন্ন সমালোচক যে কথা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটল, উভয়েই শিক্ষার লক্ষ এবং নাগরিকদের আদর্শ সম্পর্কে উচ্চ এবং মহৎ ধারণা পােষণ করতেন। যে শিক্ষা, প্রয়োজনমূলক বৃত্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, সেই শিক্ষার প্রতি তাদের কোন সমর্থন ছিল না। কেননা এই জাতীয় শিক্ষা আত্মার উচ্চতর বৃত্তির বিকাশ সাধনে ব্যর্থ। হয় এবং শিক্ষার যেটি প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে তার প্রকৃত লক্ষ লাভের জন্য উপযুক্ত করে তোলা, সেটিকে কার্যকর করে না। অ্যারিস্টোটল শুধুমাত্র রাষ্ট্রের জন্যই ব্যক্তিকে শিক্ষিত করে তোলার বিষয়টি সমর্থন করেননি। রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির লক্ষ্যের মধ্যে এক হিসেবে অভিন্নতা বর্তমান। কেননা, ব্যক্তি নাগরিক (Individual citizen) যদি সৎ হয় এবং নিজের প্রকৃত লক্ষকে লাভ করতে পারে, তখনই রাষ্ট্র উন্নত হয়। রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে যদি নৈতিকতা বোধ এবং চারিত্রিক সততা না থাকে তাহলে রাষ্ট্র স্থায়ী এবং উন্নতিশীল হতে পারে না। আবার অপরপক্ষে, রাষ্ট্র যদি ভাল না হয় এবং তার শিক্ষা ব্যবস্থা নৈতিক দিক থেকে সৎ বিচারবুদ্ধিসম্মত না হয়, নাগরিকের কখনও ভাল হতে পারে না। ব্যক্তির বিকাশ এবং উন্নতি রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই সম্ভব। সে রাষ্ট্র তার অভীষ্ট লক্ষে উপনীত হতে পারে যদি তার সভ্যরা সৎ হয়।

যুদ্ধ রাষ্ট্রের লক্ষ হতে পারে না

যুদ্ধ এবং অপরের ওপর প্রাধান্য স্থাপন রাষ্ট্রের লক্ষ হতে পারে না। সৎ জীবনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিকে যে নৈতিক নিয়ম মেনে চলতে হয়, রাষ্ট্রকেও একই নৈতিক নিয়ম মেনে চলতে হয়। অ্যারিস্টোটলের ভাষায়, একই বিষয় ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়ের পক্ষে শ্রেয়। আইনপ্রণেতা শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যেই তার সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাবে। একমাত্র যুদ্ধের সময়ই সামরিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্থায়ী হয়, যুদ্ধ শেষ হলে তার পতন অনিবার্য। অ্যারিস্টোটল সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিলাষকে সমর্থন করেননি।

সমালোচনা

জনৈক সমালোচকের মতে, অ্যারিস্টোটলের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অব্দের গ্রীক নগর রাষ্ট্রের ঘটনা, বিশ্বাস এবং অভিমতকেই রূপায়িত করেছে। অ্যারিস্টোটল ক্রীতদাস প্রথাকে একটি স্বাভাবিক প্রথা রূপে গ্রহণ করেছেন। এটি শুধু তাঁরই অভিমত নয়, তার সময়কার অসংখ্য শিক্ষত গ্রীকদেরই অভিমত। অবশ্য অনেক লোককেই যে অন্যায়ভাবে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়, তিনি তাও ব্যক্ত করেছেন। অ্যারিস্টোটলের মতে, কৃষক, কারিগর বা ব্যবসায়ীর জীবনের সঙ্গে নাগরিকের জীবনের কোন সঙ্গতি নেই। এক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়, তিনি অধিকাংশ গ্রীকদের রাষ্ট্রনীতিবিদের অভিমতেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই দেখা যাচ্ছে, উপরিউক্ত দুটি ক্ষেত্রেই অ্যারিস্টোটল তাঁর সময়কার চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতির সূচনা করতে পারেনি। বরং সত্যি কথা বলতে গেলে এই কথাই বলতে হয় যে, কতকগুলো বদ্ধমূল গ্রীক কুসংস্কারের বা ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিচার-বুদ্ধিসম্মত সমর্থন যোগানই যেন তার কাজ। তিনি শাসক এবং শাসিত, উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট, এদের পার্থক্যকে স্বাভাবিক পার্থক্য বলেই গণ্য করেছেন। আত্মা কি ধরনের বৃত্তির অধিকারী, সেদিক থেকে জীবিত প্রাণীদের তিনি ক্রমবিন্যস্ত করতে গিয়ে বলেছেন যে, প্রাণীদের জন্যই উদ্ভিদের অস্তিত্ব এবং মানুষের জন্যই প্রাণীদের অস্তিত্ব।

অনুরূপ পার্থক্য অ্যারিস্টোটল করতে চেয়েছেন মানুষের মধ্যে। তিনি শাসক এবং শাসিতের মধ্যে পার্থক্য করেছেন, প্রথমে তাদের মধ্যে পুরুষ এবং স্ত্রী , তারপর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও শিশু এবং তৃতীয়ত, স্বাধীন মানুষ এবং ক্রীতদাসের মধ্যে তিনি পার্থক্য করেছেন। তিনি প্রথমে ক্রীতদাসকে একটি যন্ত্রের সঙ্গে এবং পরে একটি পােষা জন্তুর সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছেন, কেননা, ক্রীতদাস এবং গৃহপালিত জন্তু উভয়েই তাদের শরীর দিয়ে মানুষের প্রয়োজন মেটায়। অ্যারিস্টোটলের মতে সমগুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতি সমান আচরণ করা উচিত। কিন্তু তার এই বিশ্বাসের পিছনে রয়েছে এই ধারণা যে, বিভিন্ন মানুষের মধ্যে গুণের দিক থেকে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। অ্যারিস্টোটলের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম অব্দের গ্রীক নগর-রাষ্ট্রই আদর্শরূপে ক্রিয়া করেছে। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন তিনি রাষ্ট্রের

নাগরিকদের সংখ্যার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, এই সংখ্যা এমন হওয়া উচিত যাতে একটিমাত্র সমাবেশেই তাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা যেতে পারে। অ্যারিস্টোটলের সৎ জীবনের ধারণা তার নগর রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

অ্যারিস্টোটল তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কয়েক জায়গায় ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে তার চেতনাকে প্রকাশ করেছেন। গ্রাম কিভাবে রাষ্ট্রে পরিণত হল তার চিত্র তিনি অঙ্কিত করেছেন, বিষয়টি খুবই সহজ ও সরল। কিন্তু গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের বর্তমান বিবর্তন দেখাতে গিয়ে যখন তিনি রাজতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিকাশের কথা বলেছেন তখন তার যে কিছুটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, তা অস্বীকার করা চলে। প্রাচীন পণ্য বিনিময় প্রথা পরিবর্তিত হয়ে কিভাবে জটিল ব্যবসা বাণিজ্যে রূপান্তর লাভ করেছে তার আকর্ষণীয় বিবরণ তিনি দিয়েছেন এবং অনেক জায়গায় তিনি মানুষের আবিষ্কার ও মানুষের কারিগরি বিদ্যার বিকাশ সাধনের ফলে মানুষের যে উপকার সাধিত হয়েছে তার কথাও বলেছেন। কিন্তু এই বিকাশের ভবিষ্যত যথাযথভাবে চিত্রিত করতে তিনি পারেননি, বা এসব ক্ষেত্রে কতখানি প্রগতি সাধিত হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি কল্পনা করতে পারেননি যে, তার সময়কার যে নগর-রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরবর্তীকালে আরও কত না বিকাশ সাধিত হবে।

অ্যারিস্টোটল তাঁর সময়কার বিশেষ কতগুলো গ্রীক কুসংস্কারের অংশীদার ছিলেন। এবং আজকালকার দিনে উন্নতি বা প্রগতি বলতে যা বোঝায়, সেই সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। এই কারণে আধুনিক পাঠকের কাছে অ্যারিস্টোটলের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার মূল্য সীমিত। অ্যারিস্টোটল প্রায়ই রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন ব্যাখ্যার জন্য মনস্তত্ত্বমূলক এবং নৈতিক উপাদানের নির্দেশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব শাসনতন্ত্রবিষয়ক বা অর্থনৈতিক উপাদানের তুলনায়, নাগরিকের চরিত্রের ওপরই অধিকতর মাত্রায় নির্ভর। উদাহরণস্বরূপ, যে-সব ব্যক্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার মধ্যেই অকল্যাণের বীজ নিহিত আছে বলে মনে করেন, তিনি তাদের সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, অকল্যাণের মূল নিহিত মানুষের অসততায়, তবে নৈর্ব্যক্তিক উপাদান যেমন-অর্থনৈতিক, শাসনতন্ত্র সম্পর্কীয় এবং ভৌগোলিক উপাদানগুলোকে তিনি একেবারে অবহেলা করেননি। বিপ্লবের কারণ নিরূপণ করতে গিয়ে তিনি তাদের কথা উল্লেখ করেছেন।

অ্যারিস্টোটল মনে করেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র বিষয়ক নিরাপত্তা রক্ষিত হয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের সততার ওপর। অ্যারিস্টোটলের এই রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ সম্পর্কে আমাদের মনে যথেষ্ট সংশয়ের সৃষ্টি হয়, কেননা অ্যারিস্টোটল নিজেই বলেছেন যে, সাধারণ রাষ্ট্রে প্রতিটি শ্রেণী নিজের স্বার্থেই কাজ করে। তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, রাষ্ট্রে যে সব ব্যক্তি উচ্চ পদ অধিকার করে, তাদের শাসনতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য থাকা উচিত, তাদের নিজেদের সৎ এবং দক্ষ হওয়া উচিত, কিন্তু এতসব গুণের সংমিশ্রণ কদাচিৎ দেখা যায়। তা ছাড়া কোন শাসনতন্ত্রের ভাগ্য ও সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র সম্পর্কে অ্যারিস্টোটলের বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে। অ্যারিস্টোটল বলেছেন যে, শাসনতন্ত্রের ক্রিয়া কতকগুলো গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে নাগরিকের সততা এবং আত্মসংযমের ওপর নির্ভর করে। সমালোচকদের মতে, শুধুমাত্র নাগরিকের নৈতিক সৎ গুণের ওপর নয়, যারা অ-নাগরিক তাদের ওপর যে কার্যের দায়িত্ব চাপানো হয়, সেই কার্য করতে তারা উচ্ছুক কিনা, তার ওপরও শাসনতন্ত্রের ক্রিয়া নির্ভর করে। অ্যারিস্টটলের অনেক রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ আমাদের কাছে অতিরিক্ত ভাববাদী (Over-idealistic) বলে মনে হয়। তবু তার রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার সদর্থক দিকগুলোকে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়।

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্কীয় অভিমত সম্পর্কে দুচার কথা বলা যেতে পারে। অ্যারিস্টটল বাস্তবে অস্তিত্বশীল নগর রাষ্ট্রগুলো পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের বিশ্লেষণ করে যে সমস্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন সেগুলো আধুনিক আঞ্চলিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপযোগী মনে করা যেতে পারে না। এ প্রসঙ্গে বেনজামিন জোয়েট অনূদিত অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভূমিকায় এইচ. ডর. সি. ডেভিসের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, নগর-রাষ্ট্র সম্পর্কে তার বিবরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা যেতে পারে বা সংশােধন করা যেতে পারে কিন্তু তাকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না। তিনি আরও বলেছেন যে, “রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের ধারায় ধারাবাহিকভাবে সংযুক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার হলেন অ্যারিস্টটল। সমাজের উৎপত্তি এবং মৌলিক আয়তন, সামাজিক জীবনের লক্ষ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির পারস্পরিক দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কীয় অ্যারিস্টটলের অভিমতগুলোর এমন এক মূল্য আছে যা ঐতিহাসিক অবস্থার ওপর নির্ভর নয়। ”

প্রথমত, তার রাষ্ট্র সম্পকীয় মতবাদের অনেক মূল্য রয়েছে। তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই ব্যক্ত করেছেন যে, সমষ্টিগত স্বার্থরক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। অর্থাৎ সমগ্রের কল্যাণের জন্য, কোন একটি বিশেষ অংশের জন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নয়, যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে, বিভিন্ন মাত্রায় রাষ্ট্রের অংশীদার হয়। আমরা অ্যারিস্টটলের সঙ্গে একমত হতে পারি যখন তিনি রাজনৈতিক সংঘগুলোকে (Political Parties) লক্ষ লাভের উপায়রূপে গণ্য করেন; নিছক উপায় বলে গণ্য করেন না। তার মতে , সেই লক্ষ্যই ব্যক্তির আনন্দ।

অ্যারিস্টটলের প্রধান গুণ হল এই যে, তিনি দেখাতে পেরেছেন , অভিজ্ঞতাভিত্তিক আলোচনার দ্বারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনুসন্ধানকার্য কিভাবে সম্পাদিত হতে পারে। তিনি নীতিবিজ্ঞানে যে নীতি প্রয়োগ করেছিলেন, সেগুলো তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন। অর্থাৎ আমাদের আলোচনা শুরু হবে যা আমাদের ভালমত জানা আছে তাকে নিয়ে এবং বিশেষ দৃষ্টান্ত নিয়ে। রাষ্ট্রনীতিবিদরা দুটি কাজ করেন— একটি হল বিশ্লেষণ, আর একটি হল অনুমােদন। তার শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র সম্পর্কীয় মতবাদ তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুটি খণ্ডে আলোচিত হয়েছে এবং রাষ্ট্র কি ভূমিকা গ্রহণ করবে এ সম্পর্কে তার অভিমত অন্য আলোচনাকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের শাসনতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ করতে গিয়ে এবং কি কি উপাদান তাদের স্থায়িত্ব ও অস্থায়িত্ব নিরূপণ করে তার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই বিশেষ বিশেষ বাস্তব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক অংশ অস্তিত্বশীল রাষ্ট্রের ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছে। অ্যারিস্টটলের বিশেষ বিশেষ শাসনতন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার এ প্রচেষ্টা নির্দেশ করে যে, প্রাচীন লেখকদের তুলনায় তিনি সুসঙ্গতভাবে ঐতিহাসিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করার মূল্য উপলব্ধি করেছিলেন। বিভিন্ন আলোচনার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের বিশেষ বিশেষ অভিমতের যে সমালোচনাই আমরা করি না কেন, তিনি সমস্যাগুলোর আলোচনায় যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক এবং স্থায়ী অবদান বলে স্বীকার করা যেতে পারে।

কান্তিবিদ্যা বা ললিতকলা বিষয়ক মতবাদ (Aesthetics or The Theory of Fine Arts)

সৌন্দর্য (Beauty)

যা ইন্দ্রিয়সুখপ্রদ তাই সুন্দর নয় : অ্যারিস্টটল মনে করেন যা নিছক ইন্দ্রিয় সুখপ্রদ তার সঙ্গে সৌন্দর্যের পার্থক্য রয়েছে। ‘প্রবলেম্যাটা’ গ্রন্থে তিনি কাম-সুখের জন্য কোন বিষয়কে যখন নির্বাচন করা হয় এবং সৌন্দর্যের জন্য যখন কোন বিষয়কে নির্বাচন করা হয়— এ দুই ধরনের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি মনে করেন মানুষ তার কামনাকে পরিতৃপ্তি করতে যা উপযোগী তাকে সুন্দর দেখে, কিন্তু এ সুন্দরের সঙ্গে, যা প্রকৃত বস্তুগত সুন্দর, তার পার্থক্য আছে। তাই যা শুধুমাত্র মানুষের ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে সেই নিছক সুখপ্রদ বিষয় কখনও সুন্দর বলে আখ্যাত হতে পারে না।

সুন্দর ও কল্যাণ অভিন্ন নয় : অ্যারিস্টটল সুন্দরের সঙ্গে কল্যাণের সম্পর্ক নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোন সুস্পষ্ট অভিমত উপস্থাপিত করতে পারেননি। ‘রেটরিক’ (Rhetoric) গ্রন্থে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, ‘সুন্দর হল সেই কল্যাণ যা সুখপ্রদ, কারণ এটি কল্যাণকর (the beautiful is that good which is pleasant because it is good)। সুন্দরের সংজ্ঞা থেকে যা সুন্দর এবং যা নীতিসম্মত, এ দুই-এর পার্থক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে না। মেটাফিজিকস’ (Metaphysics) গ্রন্থে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, সুন্দর এবং কল্যাণ অভিন্ন নয়। এটা গতিহীন বস্তু, যেমন একটা টেবিলও সুন্দর হতে পারে, কিন্তু কল্যাণ বা ভালত্বের সম্পর্ক শুধুমাত্র মানুষের আচরণের সঙ্গে। এ মতবাদ, সুন্দর এবং কল্যাণের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করেছে এবং এ কথা বলতে চাইছে যে, কোন কিছু নিছক সুন্দর বলেই কামনার বস্তু নয়।

সৌন্দর্য হল আকার ও শৃঙ্খলার বিষয় : ‘মেটাফিজিকস’ গ্রন্থে সুন্দরের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি অপর একটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন যেটি অধিকতর সন্তোষজনক মনে হয়। তিনি বলেন যে শৃঙ্খলা, সঙ্গতি এবং সুনির্দিষ্টতা— এ তিনটি বৈশিষ্ট্যই কোন বস্তুতে সৌন্দর্য আরোপ করে। পােয়েটিকস (Poetics) গ্রন্থে অ্যারিস্টটল বলেছেন, সৌন্দর্য হল আকার এবং শৃঙ্খলার বিষয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, একটি জীবনকে তখনই সুন্দর বলা যাবে যখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিণ্যাসের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা (a certain order in its arragement of parts) থাকে এবং যখন তার আকারের মধ্যেও একটা সঙ্গতি থাকে, অর্থাৎ আকারটি খুব ছােটও নয়, আবার খুব বড়ও নয়। অ্যারিস্টটলের মতে, যা সুন্দর তা মননের বস্তু, কামনার বস্তু নয়। সুন্দরের কুৎসিতের সম্পর্ক নিয়ে অ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবে কোন আলোচনা করেননি।”

ললিতকলা (Fine Arts)

অ্যারিস্টটল সাধারণভাবে ললিতকলা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ললিতকলা সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক আলোচনা সুসঙ্গত নয়। এখানে ওখানে তার যে সব অভিমত ছড়ানো রয়েছে সেগুলো থেকেই তার অভিমত সংগ্রহ করতে হবে। সৌন্দর্যবিদ্যা বা ললিতকলা সম্পর্কে আমরা অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে যা পেয়েছি তাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে –(১) সাধারণভাবে ললিতকলার প্রকৃতি এবং তাৎপর্য সম্পর্কে অভিমত এবং (২) ললিতকলা সম্পর্কীয় নীতি বা তত্ত্বগুলোর কাব্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ।

ললিতকলা এবং যা ললিতকলা নয় : ললিতকলা কি, তা জানতে হলে আমাদের ললিতকলা যা নয় তার থেকে আমাদের তাকে পৃথক করতে হবে। ললিতকলার সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এবং অন্যান্য ক্রিয়া থেকে তাকে পৃথক করতে হবে। প্রথমত, নৈতিকতার সঙ্গে ললিতকলার পার্থক্য নিরূপণ করতে হবে। নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্ক মানুষের আচরণের। মানুষের আচরণই নীতিসম্মত বা নীতিবিগর্হিত হয়। ললিতকলার কাজ কোন কিছু সৃষ্টি করা। কি সৃষ্টি করা হল, ললিতকলার ক্ষেত্রে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ, সৃষ্টি করার ক্রিয়াটি নয়।

ললিতকলা ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য : নৈতিকতা কাজের মধ্যেই নিহিত থাকে। ললিতকলা তার ক্রিয়ার মাধ্যমে যেটি সৃষ্টি করে, সেই বস্তুতেই নিহিত থাকে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কর্মকর্তার উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, অনুভূতি এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এগুলো নৈতিক ক্রিয়ারই অঙ্গ। কিন্তু ললিতকলার ক্ষেত্রে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৃষ্ট বস্তুটি কিভাবে সৃষ্ট হল ললিতকলার ক্ষেত্রে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যা সৃষ্ট হল , তার উৎকর্ষ থাকা প্রয়োজন, কেননা তার দ্বারাই ললিতকলার উৎকর্ষ নির্ধারিত হয়।

ললিতকলা ও প্রকৃতির ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য : দ্বিতীয়ত, ললিতকলাকে প্রকৃতির ক্রিয়া থেকেও পৃথক করা হয়, যার সঙ্গে তার অনেক বিষয়ে মিল আছে। সজীব প্রাণী সন্তান-সন্ততির জন্ম দেয়। তাই, যেহেতু এখানেও সৃষ্টির ব্যাপার রয়েছে , তাই ললিতকলার সঙ্গে সৃষ্টির ব্যাপারে এর মিল রয়েছে। কিন্তু সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে জীব কেবল নিজেকেই সৃষ্টি করে। মানুষ মানুষ সৃষ্টি করে, নিম্নতর প্রাণী নিম্নতর প্রাণীর জন্ম দেয়, উদ্ভিদ উদ্ভিদ সৃষ্টি করে। কিন্তু ললিতকলার ক্ষেত্রে কলাবিদ নিজের থেকে পৃথক কিছু সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে কোন কাব্য, কোন চিত্র, বা কোন মূর্তি।

কলার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য : অ্যারিস্টটল-এর মতে সাধারণভাবে কলা হল দুপ্রকার। এক ধরনের কলার উদ্দেশ্য প্রকৃতির কাজকে সম্পূর্ণ করা। আর এক ধরনের কলার উদ্দেশ নতুন কিছু সৃষ্টি করা। প্রথম ধরনের কলার উদাহরণ হল চিকিৎসাবিদ্যা। যেসব ক্ষেত্রে প্রকৃতি নীরোগ দেহ সৃষ্টি করতে পারেনি, চিকিৎসার দ্বারা রুগ্ন দেহকে নীরোগ করে তুলতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ চিকিৎসক প্রকৃতি যে কাজ শুরু করেছে তাকে সম্পূর্ণ করতে চায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা যে কলা পাই, আধুনিককালে, তাকেই ললিতকলা নামে অভিহিত করা হয়। এগুলোকে অ্যারিস্টটল অনুকরণমূলক কলা নামে অভিহিত করেছেন। এক্ষেত্রে কলাবিদ একটি কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টি করে, যা বাস্তব জগতের অনুকরণ।

প্লেটোও সব কলাকে অনুকরণমূলক মনে করেছিলেন। অ্যারিস্টটল কলাকে অনুকরণমূলক মনে করলেও, প্লেটো যে অর্থে তাকে অনুকরণমূলক মনে করেছেন, অ্যারিস্টটল সেই অর্থে তাকে মনে করেননি।

কলার কাজ বিশেষের মধ্যে যে সার্বিকের প্রকাশ তাকে নিয়ে : প্লেটোর মত অ্যারিস্টটল কোন অতীন্দ্রিয় প্রত্যয়ের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই প্লেটোর মত অ্যারিস্টটল মনে করেন না যে, কলা হল নকলের নকল (Copy of a Copy)। অ্যারিস্টটল মনে করেন, কলা হল মূলেরই অনুকরণ নকল (Copy of Original)। কলার বিষয়বস্তু কোন বিশেষ বস্তু নয়, বিশেষের মধ্য দিয়ে যে সার্বিকের প্রকাশ ঘটে, তাই কলার বিষয়বস্তু। বস্তুর আদর্শরূপকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হন কলাবিদ। বিশেষ বস্তুর একটা আদর্শরূপ শিল্পীর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। ভাস্কর কোন ব্যক্তি মানুষকে (Individual Man) মূর্তির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন না। তিনি তাকে এক চিরন্তন অস্থায়ী রূপায়ণ হিসেবে গ্রহণ করেন (as the fleeting embodiment of an eternal thought)। অর্থাৎ শিল্পীর কাজ বিশেষের মধ্যে সার্বিককে প্রত্যক্ষ করা। প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তু হল আকার এবং উপাদানের, বিশেষ এবং সার্বিকের সংমিশ্রণ। কলার কাজ হল তার মধ্যে যে সার্বিক আছে তাকে প্রদর্শিত করা।

অ্যারিস্টটলের মতে, অনুকরণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক এবং অনুকরণ ক্রিয়া থেকে আনন্দ পাওয়াও মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কোন কিছু শিল্পসুলভ হলে, তা দুঃখজনক হলেও, আমরা তা দেখে আনন্দ পাই।

অ্যারিস্টটল বলেন, কাব্য ইতিহাসের তুলনায় গভীরতর অর্থবহ এবং দার্শনিক ভাবসম্পন্ন। এর কারণ, কাব্যের কাজ সার্বিক বিবৃতি নিয়ে, ইতিহাসের কাজ বিশেষ বিবৃতি নিয়ে। সার্বিক বিবৃতি বলতে অ্যারিস্টটল বুঝেছেন এক ধরনের লোক স্বভাবত যা বলে বা অনিবার্যভাবে যা বলে থাকে। বিশেষ বিবৃতি বলতে কোন বিশেষ লোক কি বলে বা করে। কাব্য ও ইতিহাসে এখানেই পার্থক্য, বিষয়বস্তু কবিতায় লেখা হয়েছে বা গদ্যে লেখা হয়েছে – এটাই পার্থক্য নয়।

শিল্পীর কাজ হল টাইপ (Type) নিয়ে, যা আদর্শের সমজাতীয়। ইতিহাসের কাজ বিশেষ ঘটনা লিপিবদ্ধ করা আর কাব্যের কাজ সার্বিক সত্য নিয়ে। কবি ইতিহাস থেকে কোন ঘটনা নির্বাচন করতে পারেন কিন্তু তিনি যদি যা সম্ভব এবং সম্ভাব্য তারই বর্ণনা করেন, তাহলে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হলেও তিনি কবি বলে আখ্যাত হবেন।

ইতিহাস, দর্শন ও ললিতকলার পার্থক্য ও ক্রম : সােজা কথায়, ইতিহাস বিশেষকে বিশেষ হিসেবেই প্রত্যক্ষ করে। এর কাজ যা ঘটেছে অর্থাৎ শুধু তথ্য নিয়ে। এর সত্যতা হল নির্ভুল হওয়া, সুনির্দিষ্ট হওয়া। এখানে কোন শাশ্বত সত্যের স্থান নেই, যা অস্থায়ী এবং নশ্বর তার স্থান আছে। কিন্তু কলার বিষয় হল বস্তু এবং ঘটনার মধ্যে নিহিত আন্তর সারধর্ম যার কোন বিকাশ নেই। তাই দর্শন, কলা এবং ইতিহাসের মধ্যে মহত্ত্ব এবং সত্য প্রকাশের দিক থেকে স্থান নিরূপণ করতে গেলে দর্শনের স্থান প্রথম, কলার স্থান দ্বিতীয় এবং ইতিহাসের স্থান তৃতীয়।

কেননা, দর্শনের কাজ শুধু সার্বিককে নিয়ে।। কলার স্থান দ্বিতীয় কেননা, কলার কাজ হল বিশেষের মধ্যে যে সার্বিক আছে তাকে নিয়ে। আর ইতিহাসের স্থান সর্বশেষে, কারণ তার কাজ শুধু বিশেষকে নিয়ে।

কাব্য দর্শন নয় : অ্যারিস্টটলের মতে, কাব্যের বিবৃতি বিশুদ্ধ প্রত্যয় নিয়ে নয়, কাব্য দর্শন নয়। অ্যারিস্টটলের মতে, কলার দর্শনকে অনুকরণ করা উচিত নয়, কারণ এ জগতে প্রত্যেকেরই তার যথাযোগ্য ক্রিয়া আছে যা সে সম্পাদন করবে। কবির উচিত হবে না তার কাব্যকে অমূর্ত চিন্তনের বাহন করে তোলা। কাব্যের কাজ বিশেষের মধ্যে যে সার্বিকের প্রকাশ তাকে নিয়ে, শুদ্ধ সার্বিক নিয়ে নয়। দর্শনকে কাব্যের আকারে প্রকাশ করেছিলেন এমপিডক্লিস। কিন্তু তা প্রকৃত কাব্য নয়। তাই দর্শন কলার থেকে শ্রেষ্ঠ।

দর্শন ও কলা : পরমতত্ত্ব হল চিন্তন (Thought), বিচারবুদ্ধি (Reason) ও সার্বিক (Universal)। এ পরমতত্ত্বের মনন হল দর্শন এবং কলার বিষয়বস্তু। কলা পরমতত্ত্বের স্বরূপ যেমন, সেই ভাবেই তাকে প্রত্যক্ষ করে না, দর্শন (philosophy) কিন্তু তা করে। তাই দর্শন হল পরিপূর্ণ সত্য। তবে দর্শন কলার থেকে উচ্চতর বা শ্রেষ্ঠ হলেও, দর্শনের জন্য কলার অবদমন সমর্থনযোগ্য নয়। অ্যারিস্টটলের দর্শনের একটা বৈশিষ্ট্য হল উচ্চতর নিম্নতরকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং সমগ্রের ক্ষতি না করে নিম্নতরকে বাতিল করা চলে না। তাই দর্শন মানুষের আধ্যাত্মিক ক্রিয়ার পরম অবদান হলেও, কলার নিজ অধিকার রয়েছে এবং কলা নিজেই তার পরম লক্ষ। এ সত্যই প্লেটোর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।

কপলস্টোনের মন্তব্য – ‘পোয়েটিকস্’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল মহাকাব্য, ট্রাজেডি এবং কমেডি নিয়ে আলোচনা করেছেন। চিত্র, ভাস্কর্য এবং সঙ্গীতশিল্প নিয়ে তিনি নামমাত্র আলোচনা করেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, সব কলার মধ্যে সঙ্গীতই সবচেয়ে বেশি অনুকরণমূলক। তার মতে, যুবকদের শিক্ষার ব্যাপারে চিত্রাঙ্কনের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ শিল্পীদের কাজের যথাযথ বিচার করতে যুবকদের শিক্ষায় সঙ্গীতকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কপলস্টোন বলেন, “তাহলে মনে হতে পারে যে, ললিতকলায় অ্যারিস্টটলের আগ্রহ প্রধানত শিক্ষাগত এবং নৈতিক।” কিন্তু বোসাঙ্কয়েট মন্তব্য করেছেন যে, “শিক্ষার মধ্যে সৌন্দর্যবিদ্যা সম্পর্কীয় আগ্রহের প্রবর্তন, সৌন্দর্যবিদ্যার মধ্যে শিক্ষাগত আগ্রহ প্রবর্তন , দুটি কিন্তু অভিন্ন বিষয় নয়। ”

অ্যারিস্টটল সঙ্গীত এবং নাটকের বিভিন্ন কার্যের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাদানের বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার থেকে এ সিদ্ধান্ত করা সমীচীন হবে না যে, নৈতিক প্রভাব বিস্তার করা কলার একটা বৈশিষ্ট্য। অ্যারিস্টটল কলার শিক্ষাগত এবং নৈতিক প্রভাবের কথা স্বীকার করলেও তিনি কলার আনন্দদানের বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করেননি।

বিয়োগান্তক নাটক (Tragedy)

কাব্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বিশেষ করে নাটক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, নাটকের কাহিনী ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ কলার যেটি উদ্দেশ্য, সার্বিক (Universal) -কে প্রদর্শিত করা, সেই কাজটি বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেমন, কাল্পনিক ঘটনার মধ্য দিয়েও সম্পন্ন হতে পারে।

বিয়োগান্তক নাটকের লক্ষণ : নাটক দুধরনের বিয়োগান্তক (Tragedy) এবং মিলনান্তক (Comedy)। অ্যারিস্টটল বিয়োগান্তক নাটকের লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, বিয়োগান্তক নাটক হল এমন কাজের অনুকরণ যা গুরুত্বপূর্ণ, যার বিশালতা বা বিরাটত্ব আছে এবং যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিয়োগান্তক নাটকের অনুষঙ্গ হল সুখ। এটি বিবৃতিমূলক হবে না, নাটকের আকারে উপস্থাপিত হবে। এতে এমন ঘটনা সন্নিবিষ্ট হবে যা করুণা এবং ভয়ের উদ্রেক করে। বিয়োগান্তক নাটকে এ ধরনের আবেগের বিশােধন হয়। বিয়োগান্তক নাটকের বিষয় হবে গুরুত্বপূর্ণ, মহৎ, কল্যাণকর। বিয়োগান্তক নাটকের কাজ নয় যা বাস্তবে ঘটেছে তাকে বর্ণনা করা, যা ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা যায় তাকে বর্ণনা করা। তার অর্থ, এ নাটক যিনি রচনা করবেন তিনি বাস্তব অতীত ঘটনা বা নিজের মনের এলোমেলো কাল্পনিক ঘটনাকেও বিবৃত করবেন না। তিনি এমন ঘটনা বিবৃত করবেন যার ঘটবার সম্ভাবনা আছে। মহাকাব্যের সঙ্গে বিয়োগান্তক নাটকের এ দিক থেকে সাদৃশ্য আছে। মিলনান্তক নাটক এবং বিদ্রুপাত্মক রচনা (Satire)-র বিষয়বস্তু হল, কুৎসিত, নিকৃষ্ট এবং হাস্যকর বিষয়। তাই বিয়োগান্তক নাটকের সঙ্গে মিলনান্তক নাটক এবং বিদ্রূপাত্মক রচনার পার্থক্য আছে। বিয়োগান্তক নাটক হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর অর্থ হল, এর কাহিনীর মধ্যে থাকবে একটা ঐক্য এবং এর গঠনে থাকবে একটা আঙ্গিক ঐক্য। স্থান, কাল ও ক্রিয়া— এ তিনের ঐক্য থাকবে নাটকে। বিয়োগান্তক নাটকের অনুষঙ্গ সুখ, এর অর্থ হল বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে ছন্দ, ঐকতান (Harmony) এবং সঙ্গীত। বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে ছন্দবদ্ধ কথােপকথন এবং সঙ্গীত। বিয়োগান্তক নাটক বিবৃতিমূলক হবে না, হবে নাটকীয়। এখানেই মহাকাব্যের সঙ্গে বিয়োগান্তক নাটকের পার্থক্য।

বিয়োগান্তক নাটকের উপাদান : অ্যারিস্টটল বিয়োগান্তক নাটকের ছটি আকারমূলক উপাদানের কথা বলেছেন– কাহিনী, চরিত্র, ভাষা, চিন্তা, দৃশ্য এবং সুর। অ্যারিস্টটলের মতে, এ উপাদানগুলোর মধ্যে কাহিনীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা নাটকে কাহিনীর স্বার্থেই চরিত্র চিত্রণ। বিয়োগান্তক নাটক প্রধানত ব্যক্তির অনুকরণ নয়, কর্ম এবং জীবনের, সুখ এবং দুঃখের অনুকরণ। কাহিনীর পরেই চরিত্রের স্থান। বিয়োগান্তক নাটকে চিন্তা থাকবে। অর্থাৎ নাটকের বিভিন্ন চরিত্র যা বলছে তার একটা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থাকবে। বিয়োগান্তক নাটকের ভাষা হবে গদ্য এবং পদ্য, এবং এতে সুর বা সঙ্গীত থাকবে। দৃশ্যপট বিয়োগান্তক নাটকের সর্বশেষ উপাদান। মানুষের মনকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা দৃশ্যপটের রয়েছে। তবে দৃশ্যপটের তুলনায় নাটকের কাহিনী এবং চরিত্র চিত্রণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিয়োগান্তক নাটকের সাফল্য নির্ভর করে আকর্ষণীয় কাহিনী ও সার্থক চরিত্র চিত্রণের ওপর।

কাহিনীর ঐক্য : অ্যারিস্টটল কাহিনীর ঐক্যের কথা বলেছেন, কাহিনী খুব বড় হবে না, কারণ বেশি বড় হলে তাকে স্মৃতিতে ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। আবার এমন ছােট হবে না যাতে তাকে ক্ষুদ্র এবং অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। কাহিনীর ঐক্য বলতে কোন একজন ব্যক্তির কাহিনী বোঝায় না বা নায়কের জীবনের সব ঘটনার বিবৃতি বোঝায় না। কাহিনীর ঐক্য বলতে বোঝায়, ঘটনাগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে, একটিমাত্র ঘটনাকেও যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সমগ্রের সংযোগ ব্যাহত হবে। বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকবে এবং সম্ভাব্যতা বা অনিবার্যতার সঙ্গে একে অপরকে অনুসরণ করবে। বিয়োগান্তক নাটকের যে ঐক্য, তা হল কাহিনীর মধ্যে নিহিত যে ক্রিয়া তার ঐক্য, চরিত্রের ঐক্য নয়। কাহিনীর ঐক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’- তে এ ঐক্য দেখা যায় কারণ হােমার এমন কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা এক অখণ্ড সমগ্রতা এবং কোন ক্ষেত্রেই তিনি প্রধান চরিত্র একিলিস্ বা ওডিসিয়াস-এর সমগ্র ইতিহাসকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেননি।

বিয়োগান্তক নাটকে যে কর্মের কথা চিত্রিত হবে তা হবে এক সমগ্র- এর একটা শুরু থাকবে, একটা মধ্য থাকবে এবং একটা অন্ত থাকবে। শুরুর অর্থ হল এমন কিছু বা অন্য কিছুর অনিবার্য পরিণতি নয় বরং যাকে অন্য কিছু অনুসরণ করে। আর অন্ত বা শেষ হল যা অন্য কিছুকে অনুসরণ করে, কিন্তু যাকে আর কিছু অনুসরণ করে না। সুগঠিত কাহিনী খেয়ালখুশি মত শুরু বা শেষ হবে না। এটি হবে এক অখণ্ড সমগ্রতা। কাহিনী সরল এবং জটিল হতে পারে, জটিল কাহিনী সরল কাহিনীর থেকে শ্রেষ্ঠ। বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনীর প্রকৃতি ও অ্যারিস্টটলের মতে, যে কাজ করুণা এবং ভয় উদ্রেক করে বিয়োগান্তক নাটক তার অনুকরণ। সেই কারণে তিন ধরনের কাহিনী বা আখ্যায়িকা বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনী হতে পারে না।

  • প্রথমত, সৎ ব্যক্তি সুখের অবস্থা থেকে দুঃখের অবস্থায় পতিত হচ্ছে, এমন ঘটনা বিয়োগান্তক নাটকের কাহিনীতে স্থান পাবে না, কেননা এ জাতীয় ঘটনা আমাদের বিরক্তি এবং ভীতির সঞ্চার করবে যার ফলে মনে করুণা জাগবে না.
  • দ্বিতীয়ত, একজন অসৎ ব্যক্তি দুঃখের অবস্থা থেকে সুখের অবস্থায় উপনীত হচ্ছে, এমন ঘটনাও বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে না, কেননা এ জাতীয় ঘটনা আমাদের মনে করুণা বা ভীতি কোন আবেগই সৃষ্টি করে না।
  • তৃতীয়ত, একজন অত্যন্ত অসৎ ব্যক্তি সুখের অবস্থা থেকে দুঃখের অবস্থায় উপনীত হতে চলেছে, এমন ঘটনাও বিয়োগান্তক নাটকে থাকবে না, এ জাতীয় ঘটনা মানুষের মনে অনুভূতি জাগিয়ে তুললেও করুণা বা ভয় কোনটিই সৃষ্টি করবে না। কারণ যার দুঃখ পাওয়ার কথা নয়, সে দুঃখ পেলে আমাদের মনে করুণা জাগে বা আমাদের মত ব্যক্তি দুর্ভাগ্যে পতিত হলে মনে ভয় জাগে।

বিয়োগান্তক নাটকের চরিত্র ও বিয়োগান্তক নাটকে এমন চরিত্র চিত্রিত হবে দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে যার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তির দুর্ভাগ্য তার চরিত্রের অসততা বা নৈতিক চরিত্র কলুষিত হওয়ার জন্য নয়, তার কোন ভুলের জন্য। বিয়োগান্তক নাটক যে করুণা এবং ভয় মানুষের মনে জাগাবে, তা নাটকের ঘটনার দ্বারাই মানুষের মনে জাগাতে হবে। কোন ভয়ঙ্কর ঘটনার দ্বারা নয়, অর্থাৎ কিনা, রঙ্গমঞ্চে কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তা করা চলবে না।

রেচন : বিয়োগান্তক নাটকের মনস্তাত্ত্বিক লক্ষ হল মানুষের মনে করুণা এবং ভয় জাগানো। তিনি এ দুই আবেগের রেচন (Catharsis) এর কথা বলেছেন। ‘রেচন’ শব্দটির দুপ্রকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে – (১) রেচন হল করুণা এবং ভীতি নামক আবেগের বিশুদ্ধিকরণ (Purification)। (২) রেচন হল করুণা এবং ভীতির সাময়িক অপসারণ। দ্বিতীয় অভিমতই বর্তমানে গৃহীত। এ মতানুসারে বিয়োগান্তক নাটকের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য করুণা এবং ভীতি মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা। নায়কের অতীত এবং বর্তমান দুঃখের জন্য করুণা এবং ভবিষ্যতে নায়কের যে সব দুঃখ ভােগের সম্ভাবনা আছে, তার জন্য ভীতি। বিয়োগান্তক নাটকের পরোক্ষ উদ্দেশ্য হল শিল্পকলার মাধ্যমে মন থেকে এই আবেগের নির্দোষ এবং সুখদায়ক বহির্গমন। বিষয়টি ভাল করে বুঝে নেওয়া যাক্ : করুণা এবং ভীতি এ আবেগ বা প্রক্ষোভগুলোর যখন আধিক্য ঘটে তখন তারা অবাঞ্চিত, কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তিই এ দুই আবেগের অধীন। তাই সময়ে সময়ে এ আবেগের উত্তেজনা এবং শিল্পকলার মধ্য দিয়ে তাকে স্তিমিত করার যে ব্যবস্থা তা ব্যক্তির পক্ষে স্বাস্থ্যকর এবং হিতকর। প্লেটো ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বিয়োগান্তক নাটকের নীতিবিগর্হিত প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু অ্যারিস্টটল তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর মতে, বিয়োগান্তক নাটকের কোন নীতিবিগর্হিত প্রভাব নেই, বরং এ হল এক নির্দোষ শিল্পকর্ম যা মানুষের আনন্দ বিধান করে।

সঙ্গীতের তিনটি উদ্দেশ : অ্যারিস্টটল সঙ্গীতের তিনটি উদ্দেশের কথা বলেছেন যার জন্য সঙ্গীত শিক্ষা করা দরকার। (১) শিক্ষা, (২) বিশুদ্ধিকরণ এবং (৩) বুদ্ধিগত আনন্দ উপভােগ, অবকাশ বিনোদন এবং পরিশ্রমের পর আমােদ-প্রমােদের দ্বারা চিত্ত বিনোদন। প্রশ্ন হল, এখানে বিশুদ্ধিকরণ বলতে কি বোঝাচ্ছে? বিশুদ্ধিকরণ হল মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে মনকে হাল্কা করা। সঙ্গীতের সাহায্যে যে আনন্দ লাভ করা যায় তা মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে সাহায্য করে। এখানে ‘বিশুদ্ধিকরণ’ কথাটির কোন নৈতিক তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না।

ইতোপূর্বে বিয়োগান্তক নাটকের প্রসঙ্গে ‘রেচন’ নামক শব্দটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাহল করুণা এবং ভীতি নামক আবেগের বিশুদ্ধিকরণ। ইতোপূর্বে সঙ্গীতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেল যে, বিশুদ্ধিকরনের কোন নৈতিক তাৎপর্য নাও থাকতে পারে। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, অ্যারিস্টটল আবেগ ও ভীতি এ দুই আবেগের রেচন, ‘নির্দোষ আনন্দ-বিধান’ অর্থেই বুঝেছেন; এর সঙ্গে কোন নৈতিক তাৎপর্য যুক্ত নয়। রেচন হল করুণা ও ভীতি – এই দুই আবেগের মন থেকে সাময়িক অপসারণ।

স্টেইসের অভিমত – কিন্তু অনেকে এ অভিমত মেনে নিতে রাজি নয়। যেমন স্টেইস মনে করেন যে, বিয়োগান্তক নাটক করুণা ও ভীতি— এ দুই আবেগের মাধ্যমে আত্মার বিশুদ্ধি সাধন করে। হীন, জঘন্য, ভয়ঙ্কর বিষয় আমাদের মহৎ করে না। প্রকৃত মহান এবং করুণা দুঃখের রূপায়ণ দর্শকের মনে করুণা এবং ভীতি জাগিয়ে তার আত্মাকে বিশােধিত করে, তাকে শান্ত এবং বিশুদ্ধ করে। স্টেইস্ বলেন যে, যারা মনে করেন যে বিয়োগান্তক নাটক শুধুমাত্র দর্শকের মনকে করুণা এবং ভীতি রূপ, অপ্রীতিকর আবেগ থেকে মুক্ত করে মাত্র এবং দর্শককে সুখী করে, বিয়োগান্তক নাটকের কোন নৈতিক প্রভাব নেই, তারা অ্যারিস্টটলের সমালোচনা করতে গিয়ে তার প্রতি সুবিচার করেন না। কপলস্টোন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বিয়োগান্তক নাটক সম্পর্কে যথাযথ অভিমত কোনটি সেটি আসল প্রশ্ন নয়।

বিয়োগান্তক নাটকের কাজ অতিরিক্ত আবেগের প্রশমন : প্রশ্ন হল; অ্যারিস্টটলের অভিমত কোনটি। তবে যেসব সমালোচক মনে করেন যে, বিয়োগান্তক নাটকের কোন নৈতিক প্রভাব নেই, তারা অ্যারিস্টটল কি বলতে চেয়েছেন, সে সম্পর্কে স্টেইসের প্রদত্ত ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে পারেন। অবশ্য স্টেইস যে বলেছেন, বিয়োগান্তক নাটক দর্শকের মনকে শান্ত এবং শুদ্ধ করে, এ শুদ্ধ কথাটির কোন নৈতিক অর্থ তারা না করলেই ভাল করবেন।

কাব্য সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের আলোচনা হল রসহীন এবং বিশ্লেষণমূলক, এবং এ আলোচনার স্পষ্টতই কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। তার বিশ্লেষণ সময় সময় কৃত্রিম বলে মনে হয়, যখন তিনি বিয়োগান্তক নাটককে মিলনান্তক নাটক থেকে পৃথক করতে গিয়ে বলেছেন যে, যে ব্যক্তিদের চিত্রিত করা হচ্ছে তাদের নৈতিক গুণের জন্যই তাদের মধ্যে পার্থক্য। এ কৃত্রিমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন কোন ধরনের কাহিনী শ্রেষ্ঠ বলতে গিয়ে তিনি ভাগ্যবিড়ম্বনার রকমফেরের কথা বলেন। কাহিনী গঠনের কলাকৌশল সম্পর্কে তার যে আলোচনা তা এ ধরনের বিষয় সম্পর্কে তাঁর সংকীর্ণ অভিমতের পরিপােষক। বিয়োগান্তক নাটক বা মহাকাব্যের স্বাভাবিক আয়তনের কথা বলতে গিয়ে, তিনি জীবিত প্রাণীর যে উপমা দিয়েছেন তা কোন কোন সমালোচকের মতে বিপজ্জনক। কিন্তু তার বিশ্লেষণ শুষ্ক বা রসহীন হলেও, সাধারণ বুদ্ধির কাছে তার আবেদন রয়েছে এবং এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন কাব্যের ঐক্যের কথা, বা কাহিনী যে চরিত্রের থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তার এসব অভিমত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, প্লেটো কাব্যের প্রতি যে উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন, তার থেকে রক্ষা করা। তিনি প্লেটোর বিরোধিতা করে কাব্যের গুরুত্ব এবং নৈতিক মূল্যের কথা বলেছেন, এ কথা বলে যে, কবি সার্বিক (Universal)-কেই কাব্যে রূপায়িত করেন যদিওবা তা বিশেষের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় এবং প্লেটোর অভিমতের বিরোধিতা করে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, কাব্য থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর নয়, বরং নির্দোষ এবং হিতকর আনন্দ।

অ্যারিস্টটলের দর্শনের বিচার 

পূর্ববর্তী দার্শনিকদের অভিমতের আলোচনা ও অ্যারিস্টটল তার দার্শনিক চিন্তার প্রায় সব শাখার ক্ষেত্রে একটা সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। এ পদ্ধতির প্রথম লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল যে, কোন একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি নিজে তার সমাধান দেবার পূর্বে সেই সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ অভিমত এবং তার পূর্ববর্তী চিন্তাবিদৃদের অভিমতগুলো আলোচনা করেছেন। অধিবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্র সম্পর্কীয় অ্যারিস্টটলের রচনাবলি পাঠ করলেই উপরিউক্ত বিষয়টির সমর্থন খুঁজে পাওয়া যাবে। কোন একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তিনি যেমন যুক্তির সহায়তা গ্রহণ করেছেন, তেমন বাস্তব সাক্ষ্য-প্রমাণের এবং বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। আবার কোন তথ্য নিরূপণের জন্য প্রয়োজনে বিশদ গবেষণায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। একটা সাধারণ পদ্ধতি যেমন তার বিভিন্ন রচনার মধ্যে। সংযোগ সাধন করেছে তেমনি কতকগুলো সাধারণ মতবাদ তার চিন্তার বিভিন্ন দিকের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করেছে। পরস্পর সংযুক্ত এ গুরুত্বপূর্ণ মতবাদগুলো হল- (১) আকার এবং উপাদানের মধ্যে বিরোধিতা, (২) সম্ভাব্যতা এবং বাস্তবতার মধ্যে বৈপরীত্য এবং পরিণতি কারণ সম্পর্কীয় মতবাদ (the doctrine of final causes)।

সার্বিক-এর এ জগৎ ছাড়া অন্য কোন জগতের অস্তিত্ব নেই

প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল দুজনেই ভাববাদী দার্শনিক। চিন্তন, সার্বিক, ধারণা, আকার, যে নামেই অভিহিত করা হােক না কেন, পরম সত্তা হল এ জগতের ভিত্তি। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই পরম সত্তাকে এভাবে চিন্তা করেছেন কিন্তু প্লেটোর মতে সার্বিক (universal) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতিরিক্ত এক নিজ জগতে অস্তিত্বশীল। কিন্তু অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, এভাবে চিন্তা করলে চিন্তনকে আবার বস্তুতে পরিণত করা হবে। তার মতে সার্বিক বাস্তব হলেও, এ জগৎ ছাড়া অন্য কোন জগতে তার অস্তিত্ব নেই। সার্বিক হল বিশেষ বস্তুর আকারমূলক নীতি। অ্যারিস্টটলের দর্শনের এ হল মূল কথা। তাই অ্যারিস্টটলের দর্শন প্লেটোর দর্শনের এক উন্নত রূপ। গ্রীক ভাববাদের পরিপূর্ণ রূপ অ্যারিস্টটলের দর্শনে দেখা যায়।

বিবর্তন সম্পর্কীয় মতবাদের মৌলিকতা

অ্যারিস্টটলের বিবর্তন সম্পর্কীয় মতবাদও চিন্তনের ক্ষেত্রে এক মৌলিক অবদান। তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের কাছ থেকে এ সমস্যার উপাদান তিনি গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনিই এ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন। যেমন, ভবন (Becoming) কিভাবে সম্ভব হতে পারে, এ সম্পর্কে তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মধ্যে হিরাক্লিটাস এবং আরও অনেকে আলোচনা করেছিলেন কিন্তু ভবনের যথার্থ অর্থ তারা আবিষ্কার করতে পারেননি। অ্যারিস্টটল দেখিয়েছিলেন যে, ভবনের অর্থ আছে এবং জগৎ প্রক্রিয়া একটি বৌদ্ধিক লক্ষ্যের অভিমুখী। জগৎ প্রক্রিয়া একটি বিচারবুদ্ধিসম্মত শৃঙ্খলাপূর্ণ বিকাশ।

অ্যারিস্টটলের দর্শনের ব্যাপকতা

অ্যারিস্টটলের দর্শনের ব্যাপকতা সর্বজনস্বীকৃত। জি, ই, আর, লয়েড বলেন, “কোন গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের তুলনায় অধিকতর মৌলিকতার অধিকারী ছিলেন না। যুক্তিবিজ্ঞান, জীববিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, গতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি হয়ত একাই বিজ্ঞান বা শত্রটির প্রতিষ্ঠা করেছেন বা সেটি তার কোন একটি মৌলিক অবদানে সমৃদ্ধ।”

মূলতত্ত্ব সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন ও অ্যারিস্টটলের রচনার বা চিন্তার ব্যাপকতা অস্বীকার করা না গেলেও, এর অনেক ত্রুটি আছে। প্রথম কথা, তাঁর দর্শনের যেটি তত্ত্ব সেটি কি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, তা কি জগতকে ব্যাখ্যা করতে পারে। প্লেটোর দর্শনের ত্রুটি তার দ্বৈতবাদ-ইন্দ্রিয় এবং চিন্তন, উপাদান এবং আকারের দ্বৈত। জগতকে আকার বা ধারণা (Idea) থেকে অবরোহের আকারে নিঃসৃত করা যেতে পারে।

কেননা প্লেটোর দর্শনে ধারণাকে এ জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করা হয়েছিল। অ্যারিস্টটল প্লেটোর এ দ্বৈতকে দূর করার জন্য সচেষ্ট হলেন। তিনি বললেন, ‘সার্বিক এবং বিশেষ, উপাদান এবং আকার হল অবিচ্ছেদ্য। এদের সম্পর্ক যান্ত্রিক, আঙ্গিক। কিন্তু অ্যারিস্টটল কি এর সাহায্যে তার দর্শনকে প্লেটোর দ্বৈতবাদের ত্রুটি থেকে মুক্ত করতে পারলেন?

‘আকার’, জগতের উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে পারে

পরমতত্ত্ব যদি আকার হয়, তাহলে অ্যারিস্টটলকে দেখাতে হবে যে, উপাদানকে তার থেকে নিঃসৃত করা যেতে পারে। তাকে দেখাতে হবে যে, আকার উপাদানকে সৃষ্টি করে অর্থাৎ উপাদানকে আকার থেকেই পাওয়া যায়। যদি দেখাতে না পারেন তাহলে আকার এবং উপাদান হয়ে পড়বে দুই মৌলিক সত্তা, যাদের কাউকে অপরটি থেকে নিঃসৃত করা যায় না। বাস্তবে হয়েছেও তাই। অ্যারিস্টটল উপাদানকে আকার থেকে নিঃসৃত করেননি, করার কোন প্রয়োজন আছে বলেও তিনি মনে করেননি। তাই ইন্দ্রিয় (Sense) এবং চিন্তন (Thought), উপাদান (Matter) এবং আকার (Form)-এর দ্বৈতবাদ অ্যারিস্টটলের দর্শনে রয়েই গেছে। প্লেটোর দ্বৈতবাদ খণ্ডিত হয়নি, জগতের ব্যাখ্যাও মেলেনি। কারণ কোন একটি মাত্র তত্ত্ব থেকে তাকে নিঃসৃত করা হয়নি। যদি আকার হয় পরমতত্ত্ব তাহলে সমগ্র জগতকে তার থেকে অবরোহের আকারে নিঃসৃত করা দরকার। কিন্তু অ্যারিস্টটলের দর্শনে আমরা তা দেখি না।

আকার-এর তত্ত্ব নিজেকে নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে না

দ্বিতীয় প্রশ্ন, আকার-এর তত্ত্বটি কি নিজেকে নিজে ব্যাখ্যা করতে পারে? অ্যারিস্টটলের আকার একটি বৌদ্ধিক তত্ত্ব (Rational Principle)। অ্যারিস্টটলের দেখা প্রয়োজন যে, এ তত্ত্বকে অস্তিত্বশীল মনে করার পিছনে কি অনিবার্যতা রয়েছে অ্যারিস্টটলকে তা দেখাতে হবে। কিন্তু তিনি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

অ্যারিস্টটলের বিবর্তন সম্পর্কীয় মতবাদেরও ত্রুটি লক্ষ করা যায়। তার মতে, বিবর্তন এক লক্ষ্যের দিকে গতিশীল। এ লক্ষ্যের দিকে বিবর্তনের অগ্রগতির বিভিন্ন স্তরের কথা তিনি বলেছেন কিন্তু মতবাদটিকে স্তরে স্তরে বিচারবুদ্ধির দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এসব ত্রুটি সত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের দর্শন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন। ‘অ্যারিস্টটল ছিলেন এক মননশীল চরিত্র, একজন পর্যবেক্ষক এবং একজন আবিষ্কারক।’ জনৈক সমালোচকের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা যেতে পারে যে, ‘যদিও তাঁর (অ্যারিস্টটলের) দর্শন সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, এ দর্শন এ জগৎ আমাদের কাছে পূর্বে যতটা না বোধগম্য ছিল, তার চেয়ে তাকে অধিকতর বোধগম্য করে তোলে।’ (W.T. Stace : A Critical History of Greek Philosophy; Page 338)।

বিশিষ্ট সমালোচকের মন্তব্য

অপর একজন সমালোচকের ভাষায়, “দর্শনে নিছক ঐতিহাসিক আগ্রহ সৃষ্টি করা ছাড়াও তাঁর (অ্যারিস্টটলের) অধিকতর গুরুত্ব রয়েছে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের যেকোন আলোচনার ক্ষেত্রেই তার সমালোচনা যে অনিবার্য, শুধুমাত্র তাই নয়, তা ছাড়াও, নীতিদর্শন এবং অধিবিদ্যা উভয় ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তিনি যা বলতে চান, অনুশীলনরত দার্শনিকদের কাছে তার এক নিরবচ্ছিন্ন গুরুত্ব আছে। তাঁর রচনার বিভিন্ন দিকের নানাবিধ আকর্ষণ রয়েছে। তা ছাড়াও তিনি যার জন্য আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন তা হল যে, চিন্তার বিভিন্ন শাখায় যে বহুবিধ মূল্যবান অবদান রয়েছে, একজন এবং একই ব্যক্তি তার জন্য দায়ী। মানুষের বুদ্ধিপ্রসূত রচনাবলিতে যারা আগ্রহী, চিন্তনের ক্ষমতা, বিস্তৃতি এবং মৌলিকতার জন্য অ্যারিস্টটলের আলোচনা তাদের মনকে নিবিষ্ট করে রাখে এবং আলোচনা সার্থক মনে হয়। (G.E.R. Loyd, Aristotle : The Growth and Structure of His Thought; Page 315.)

জেলার-এর মতে, অ্যারিস্টটলের দর্শন প্লেটোর মতবাদ থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছিল এবং প্লেটোর মতবাদকে অতিক্রম করেও তার অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। জেলার প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের দর্শনের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন , দার্শনিক মননের সঙ্গে সুস্থ অভিজ্ঞতাবাদের এ সংযোগ, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের দর্শনের বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়েই প্লেটোর দর্শনের সঙ্গে তার পার্থক্য। (E. Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy; Page 200-20.)

তনি আরও বলেন যে, অ্যারিস্টটলের প্রভাবের একটা শুরু আছে এবং একটা শেষ আছে। গ্রীক দর্শনের এবং বিজ্ঞানের পূর্ববর্তী সমগ্র বিকাশের পরিণতিরূপে অ্যারিস্টটলের দর্শনকে গণ্য করা চলে।

জেলার বলেন, আধুনিককালের লাইবনিজই হলেন একমাত্র দার্শনিক, মনের সার্বিকতার দিক থেকে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে যার তুলনা চলে, যিনি তার নিজের দর্শনকে অ্যারিস্টটলের দর্শনের সংস্কার (Reformation) রূপে অভিহিত করেছিলেন। শুধুমাত্র লাইবনিজের মনাদের মধ্যেই যে অ্যারিস্টটলের প্রাণশক্তির (Entelechy) ধারণা টিকে ছিল তা নয়, গ্যেটের প্রকৃতি বিষয়ক দর্শনেও তার স্থান ছিল এবং বর্তমান যুগের নব্য প্রাণবাদে এর এক বিস্ময়কর ও চমৎকার পুনরুজ্জীবন বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

জনৈক সমালোচকের মতে, আমরা অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্তগুলো অপছন্দ করতে পারি কিন্তু তার চিন্তার সঙ্গতিকে প্রশংসা না করে আমাদের উপায় নেই। (“We may dislike the conclusions to which Aristotle was led, but we can hardly help admiring the consistency of his thought.” – W.K.C. Guthric : The Greek Philosophers (From Thales to Aristotle) : Page 140)

অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনৈক সমালোচক বলেন যে, অ্যারিস্টটলের দর্শন খুবই জটিল কিন্তু এ দর্শন সরাসরি, কখনও বা নীরস, কিন্তু সকল বিচারবুদ্ধিসম্মত এবং আক্ষরিক গদ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু প্লেটোর ডায়ালগগুলো এর থেকে পৃথক। সেগুলো যতখানি দর্শন ততখানি সাহিত্য এবং যতখানি সাহিত্য, ততখানি নাটক। প্লেটোকে কেউ বুঝে উঠতে পারে না যদি সে ডায়ালগগুলোতে দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে কাব্য এবং ধর্মের উপাদানকে বুঝে উঠতে না পারে। এ ধরনের রচনার মূল্যকে অপরকে বলে জানানো যায় না। পাঠকের ওপর তারা যে প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টি করে তাতেই এদের মূল্য নিহিত। (W.K.C. Guthric : The Greek Philosophers (From Thales to Aristotle) : Pages 119-120.)

প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল মানুষের জীবনের সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা না করেও, উভয়েই যে জগতে আমরা বাস করি সেই সম্পর্কে মননক্রিয়ার আগ্রহী ছিলেন। প্লেটোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রে ছিল মানুষের আত্মা। কিন্তু অ্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে প্রকৃতিতে তার নিজের জন্য স্বার্থবর্জিত অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল। (W.K.C. Guthric; The Greek Philosophers (From Thales to Aristotle))।

প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দর্শনের মধ্যে কোন্‌টি শ্রেষ্ঠ? এ বিতর্কে প্রবৃত্ত না হয়ে কপলস্টোনের বক্তব্য অনুসরণ করাই যুক্তিসঙ্গত কাজ। তিনি বলেন যে, উভয় দর্শনের যে কোন একটিকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ না করে, উভয় দর্শনের মূল্যবান এবং সত্য উপাদানগুলোর অধিকতর পরিপূর্ণ এবং পর্যাপ্ত এবং সংহতিতে সুসামঞ্জস্যভাবে বিকশিত হবার প্রয়োজন রয়েছে।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ২৮২-৪০৮

3 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. পশ্চিম ইউরোপে ১৬শ-১৭শ শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব – বিবর্তনপথ
  3. এরিজেনা ও খ্রিস্টীয় মরমিবাদ – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.