মঁতেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)

যখন বিধানিক ক্ষমতা (আইন প্রণয়নের ক্ষমতা) এবং নির্বাহী ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না… আবার যদি বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিধানিক এবং নির্বাহী থেকে পৃথক না করা হয় তাহলেও কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। – স্পিরিট অফ দ্য লজ

সম্ভবত রুশোকে বাদ দিলে আলোকায়নের যুগে ফ্রান্সে জন্মানো সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দার্শনিক ছিলেন মঁতেস্কু। – হলোয়েল, পৃ. ১৪০

মঁতেস্কুর আবির্ভাবকালে ফ্রান্সের রাষ্ট্রচিন্তা

ফ্রান্সের আবির্ভাব : লকের পর থেকে ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদের স্রোত প্রবল আকার ধারণ করে। কিন্তু লক-উত্তর ইংল্যান্ডে দীর্ঘ অর্ধশতককাল ধরে কোন সৃজনশীল লেখা বের হয় নি। ১৮শ শতকের মাঝামাঝি আবির্ভাব ঘটল হিউমের। ১৭৪৮ সালে তার Inquiry Concerning Human Understanding প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড কোন নতুন চিন্তা সংযােজন করতে না পারলেও চিন্তার স্রোত স্তব্ধ হয়ে যায় নি। স্রোতের বহমানতা বজায় রেখেছিল অন্য একটা দেশ এবং তার নাম ফ্রান্স। রাজনীতিক চিন্তা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ফ্রান্স তার একটা নিজস্ব আসন তৈরী করে নিয়েছিল। শিক্ষিত মহলের দৃষ্টি ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের প্রতি নিবন্ধ হতে শুরু করেছিল। কিন্তু শিক্ষা জগতে নিজ আসন প্রস্তুত করতে গিয়ে ফ্রান্সকে নানাপ্রকায় বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। ফ্রান্সে তখন চলছিল স্বৈরাচারী শাসন। চতুর্দশ লুই ক্ষমতার শীর্ষে। ১৭শ শতকের শেষ থেকে স্বৈরাচারী শাসনের তীব্রতা কমতে থাকে এবং ১৭১৫ সালে চতুর্দশ লুই-এর মত্যুর পর এই স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে।

ফ্রান্সের রাষ্ট্রচিন্তা ও লক : ফ্রান্সের রাজনীতিক আকাশে নতুন বাতাস বইতে শুরু করে। স্বৈরাচারের পতন হওয়ায় জনগণ রাজনীতিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভােগ করতে শুরু করে। একে বলা হয় আলােকপ্রাপ্ত অবস্থা বা জ্ঞানালোক বা Enlightenment. এই জ্ঞানালোক প্রভাবিত হয়েছিল লকের রাষ্ট্রচিন্তার দ্বারা। সেবাইন বলছেন, লকের দর্শন ফরাসি জ্ঞানালোকের ভিত্তিস্বরূপ বলে প্রতীয়মান হয়, এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাই ফরাসি মুক্তির চাবিকাঠিতে পরিণত হয়।” (সেবাইন, পৃ. ৫৪৬)। লকের স্বাধীনতা, সম্মতিতত্ব, জনপ্রিয় সার্বভৌমতা ও প্রাকৃত অধিকার ফরাসী জনগণের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। ফরাসী নাগরিকরা ব্রিটিশ নাগরিকদের স্বাধীনতার ঈর্ষা করতে দ্বিধাবােধ করে নি। তারা ভাবতে শিখল সরকারের কাজ জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে সুনিশ্চিত করা। এভাবে শুরু হলো ফরাসী রাষ্ট্রচিন্তার।

ফরাসী রাষ্ট্রচিন্তার স্বাতন্ত্র্য : ফরাসী উদারনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা লকের কাছে ঋণী হলেও পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পর্যায়ে এর স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হয়ে পড়েছিল। এর কারণ অনুসন্ধান আদৌ কষ্টসাধ্য নয়। ফ্রান্সের প্রথম সারির চিন্তকদের কোন প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল না। স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে থেকে তারা স্বাধীনতার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছিলেন। স্যাবাইন বলছেন, “এটি মুক্তির নীতি হলেও তা স্বৈরাচারের মধ্যেই লিখিত হয়েছিল, আর এর বেশিরভাগই তাদের দ্বারাই লিখিত হয়েছিল যাদের সরকার নিয়ে কোন অভিজ্ঞতাই ছিলনা।” (স্যাবাইন, পৃ. ৫৪৮)। ফলে রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শন কোনটাই তথ্য-নির্ভর হয়ে উঠতে পারে নি। আমলারা শাসনকার্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। রাষ্ট্রচিন্তায় সময় ব্যয় করার মানসিকতা তাদের ছিল না। এইজন্য ১৮শ শতকের ফরাসী রাষ্ট্রদর্শন পুরােপুরি সাহিত্যঘেষা ও পুঁথিগত বিদ্যায় ভরপুর হয়ে পড়েছিল। স্যাবাইন বলছেন, “১৮শ শতকের ফরাসি দর্শন ছিল… একরকম সাহিত্যিক দর্শন, যা সেলন ও শিক্ষিত বুর্জোয়াদের জন্য লিখিত হয়েছিল, আর এদের সামনেই কেবল এই লেখকেগণ নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারতেন।” (স্যাবাইন, পৃ. ৫৪৮)। সুতরাং যারা লিখতেন তারা সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য লিখতেন না। শিক্ষার ব্যাপক প্রসার তখনও হয় নি। আর রাষ্ট্রচিন্তা বােঝার মত রাজনীতিক সচেতনতা পুরােপুরি গড়ে ওঠে নি। লকের আমলে ইংল্যান্ডে যাজকগােষ্ঠীর প্রভাব বহুলাংশে কমে গিয়েছিল, কিন্তু যদিও ফ্রান্সে তখনও যাজকদের বেশ আধিপত্য ছিল। ফ্রান্সের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা মােটামুটি শিক্ষিত ও শহরবাসী ছিলেন এবং রাষ্ট্রচিন্তা এদের ধ্যানধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। একই ব্যক্তির চিন্তা দুই দেশে ভিন্ন ফল প্রসব করেছিল। লকের প্রভাবে ইংল্যান্ডের জনগণ রাজনীতিক স্বাধীনতা ও প্রাকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেছিল। অপর দিকে ফ্রান্সে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণ আন্দোলনে নেমেছিল। স্যাবাইন বলছেন, “ইংরেজ বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব ছিলনা, কিন্তু ফরাসী বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব ছিল।… এছাড়া ইংল্যান্ডের লক ছিলেন ১৭শ শতকের, অন্যদিকে ফ্রান্সের “লক” ছিলেন ১৮শ শতকের। এই কালের ব্যবধানের ব্যাপারটাই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছিল।” (স্যাবাইন, পৃ. ৫৪৯)।

মঁতেস্কুর জন্ম ও রচনা : ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লবের ঠিক এক বছর পরে ফ্রান্সে মঁতেস্কুর (Montesquieu, ১৬৮৯-১৭৫৫) জন্ম হয়। ছােটবেলা থেকেই মঁতেস্কু সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তদানীন্তন ফ্রান্সের বুদ্ধিবাদী (intellectual) আন্দোলনের প্রতি তার বেশ সহানুভূতি ছিল। ১৭২১ সালে Persian Letters নামে তিনি একটা ব্যাঙ্গাত্মক রচনা বের করেন। এই বইতে তিনি সমাজনীতি, ধর্ম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরদ্ধে কটাক্ষ করেন। মঁতেস্কু ইংল্যান্ড, রােম সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন এবং এই সমস্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসেন। তাছাড়া তিনি প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। দীর্ঘ ১৯ বছর পরিশ্রম করার পর তিনি তার বিখ্যাত বই Spirit of the Laws লেখেন। এটা ১৭৪৮ সালের ঘটনা। ফ্রান্সের রাষ্ট্রচিন্তার জগতে Spirit of the Laws বিরাট আলােড়ন তােলে। প্রশংসা ও সমালােচনা দুইই মঁতেস্কুর কপালে জোটে। ১৭৫০ সালে তিনি ইহলােক ত্যাগ করেন।

মঁতেস্কুর পদ্ধতি : মঁতেস্কু এক জায়গায় বলেছেন যে তিনি কোন সংস্কার থেকে সিদ্ধান্ত নেন নি। ঘটনা বা পরিস্থিতির প্রকৃতি থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণ করতেন। এই মন্তব্য থেকে বােঝা যায় যে তিনি অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে মঁতেস্কুর পদ্ধতি সমাজতাত্ত্বিক (sociological) পদ্ধতি বলে থাকেন। একজন সমালােচক বলেছেন যে এই সমাজতাত্তিক পদ্ধতি মঁতেস্কুকে রাজনীতিক চিন্তার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। (হলোয়েল, পৃ. ১৪১)। সমাজতাত্তিক পদ্ধতির ব্যাপারে কিছু কথা বলা যাক। তিনি মনে করতেন সমাজের গঠন ও কাজ জনসাধারণ যে পরিবেশের মধ্যে বাস করে সেই পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ বলতে তিনি জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক পরিবেশকে বুঝিয়েছেন। একটা জাতির মানসিকতার ওপর এদের সুস্পষ্ট প্রভাব আছে। এ ছাড়া পরিবেশের মধ্যে আছে ব্যবসা, বাণিজ্য, উৎপাদন পদ্ধতি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও জনসাধারণের অভ্যাস ইত্যাদি। মঁতেস্কু বলতে চেয়েছেন যে সরকারের কাজকর্ম ও গঠনকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করা চলেনা। সামাজিক মানুষের প্রয়ােজনেই সরকার। সুতরাং সরকার সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব এড়াতে পারে না। প্রাকৃতিক জগতে অসংখ্য বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আছে এবং এই ঐক্য আবার সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। সমাজের ক্ষেত্রেও তেমনি কতকগুলাে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে এবং এই নিয়মগুলােকে জানাই সমাজবিজ্ঞানীর প্রধান কাজ। মঁতেস্কু প্লেটোঅ্যারিস্টটলের মত আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেন নি। বাস্তবে যা সম্ভব সেই পথেই চিন্তাধারাকে প্রবাহিত করেছেন।

আইন সম্পর্কে মঁতেস্কুর ধারণা

প্রকৃতির রাজ্য ও প্রকৃতির‌ ‌আইন‌ : রাষ্ট্রীয় সংগঠন সৃষ্টি হবার আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির রাজ্যের একেবারে সেই আদিম অবস্থায় মানুষের জ্ঞান বলতে কিছু ছিল না। তবে তাদের জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রকৃতির খেয়ালীপনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য মানুষ সর্বদা চিন্তা করত। শান্তিতে বসবাস করাই ছিল মানুষের একমাত্র কাম্য। মঁতেস্কু বলেছেন যে শান্তি হবে প্রকৃতির আইন (law of nature)। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষ তখনও পর্যন্ত সাব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তারা বেশ অসহায় বােধ করত। শান্তি তাদের প্রধান কামনার বস্তু ছিল। মঁতেস্কুর মতে প্রকৃতির রাজ্যের দ্বিতীয় আইন হল চাহিদার পরিতৃপ্তি কি কি উপায়ে হতে পারে। মানুষ প্রথমে পরস্পরকে সন্দেহ করত। এই সন্দেহ দূর হলে তারা অনেকটা কাছাকাছি এসে গেল। সহযােগিতা বৃদ্ধি পেল। তৃতীয়ত সম্পর্ক প্রথম পর্যায়ে গড়ে উঠেছিল স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে। পরে সেটার বিস্তৃতি ঘটে। চতুর্থত মানুষ কেবল আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিল তা নয়, প্রয়ােজনীয়তাও অনুভব করেছিল।

সমাজ গঠন ও আইনের উদ্ভব : মঁতেস্কু মনে করতেন মানুষ প্রয়ােজনের দ্বারা তাড়িত হয়ে সমাজ গঠন করেছিল। সামাজিক-চুক্তিবাদীরা যেমন বলেছেন যে সমাজ গঠনের মূলে আছে চুক্তি, মঁতেস্কু সেই পথে যান নি। তিনি কোথাও বলেন নি মানুষ চুক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরী করেছিল। সমাজবদ্ধ হওয়ায় মানুষের লাভই হয়েছিল। প্রকৃতির অনিশ্চয়তার হাত থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল। প্রকৃতির রাজ্যের অনিশ্চয়তা দূর হলেও মানুষ সম্পূর্ণরূপে নিজেকে নিরাপদ মনে করে নি। ভয় ও সন্দেহ দূর হয়ে যাওয়ায় মানুষের অহংবােধ বেড়ে গেল। এই অহংবােধ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ। সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে দেখা দিতে লাগল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে এই সংঘর্ষই ইতিবাচক আইনের জন্মদাতা। ম্যাক্সে বলছেন, “যুদ্ধের এই দুটো পক্ষই ইতিবাচক আইনের জন্ম দেয়” (পৃ. ৩১০)।

আইনের সংজ্ঞা : মঁতেস্কু Spirit of Law শুরু করেছেন আইনের সংজ্ঞা দিয়ে। তিনি বলেছেন যে বস্তুর প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত প্রয়ােজনীয় সম্পর্কই আইন। (… আইন হলো বস্তুসমূহের প্রকৃতি থেকে উদ্ভুত প্রয়োজনীয় সম্পর্ক – মঁতেস্কু)। জড়বাদী জগৎ যেমন কতকগুলাে সুনির্দিষ্ট আইনের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং কোথাও আইনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না, মনুষ্য সমাজও তেমনি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। হঠকারিতা বা খামখেয়ালীর স্থান কোথাও নেই। মঁতেস্কু বলছেন, “সাধারণভাবে আইন হচ্ছে মানুষের যুক্তিবাদিতা”। আইনকে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশ স্বীকার করে নেওয়া যায় না। মানুষের আচরণের নিয়মগুলো হলো আইন। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব বলে নিজেদের মধ্যে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেখানেই সম্পর্ক সেখানেই আইন। আইন সম্পর্ককে পরিচালিত করে।

সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা : মঁতেস্কু আইনের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সমাজের সর্বত্র আইন একই রকম হতে পারে না। কারণ সমাজের গঠন মানুষের প্রকৃতি এবং আচরণ সর্বত্র এক নয়। এই বিভিন্নতাই আইনের বৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ। জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, জনগণের পেশা, সরকারের প্রকারভেদ ইত্যাদি আইনের চরিত্র নির্ধারণে সাহায্য করে। মঁতেস্কু বলেছেন যে এই সমস্ত জড়বাদী পরিবেশ আইনের মূলনীতি (spirit of law) স্থির করে। একেই আইনের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নামে অভিহিত করা হয়। মােট কথা, আইনের উদ্ভব সমাজ থেকে এবং লক্ষ্য সামাজিক মানুষের চাহিদা মেটানাে।

আইনের প্রকারভেদ : মঁতেস্কু তিন প্রকার আইনের কথা বলেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক যে আইনের দ্বারা স্থির হয় তাকে তিনি আন্তর্জাতিক আইন বলেছেন। একটা বিশেষ সমাজের শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক যে আইনের দ্বারা স্থির হয় তাকে রাজনীতিক আইন বলে। আর নাগরিকরা যে আইনের দ্বারা আইনের প্রকারভেদ পরিচালিত হয় তাকে পৌর আইন বলে। প্রতিটি রাষ্ট্র যদি নিষ্ঠাসহকারে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে তাহলে সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং ক্ষতির পরিমাণ ন্যুনতম হয়। আবার রাজনীতিক ও পৌর আইন সর্বত্র এক নয়। কারণ, সামাজিক কাঠামাে ও আচরণ পৃথক।

সমালোচনা : মঁতেস্কুর আইন সম্পকীয় ধারণাকে অনেকে সমালােচনা করেছেন। স্যাবাইন বলেছেন যে আইনের সংজ্ঞার মধ্যে যে অস্পষ্টতা আছে তা দূর করার জন্য মঁতেস্কু কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নি। (পৃ. ৫৫৩)। হার্মন অবশ্য মঁতেস্কুর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। তিনি বলছেন, প্রতিকুল পরিবেশে অনিচ্ছুক জনগণের ওপর জোর সমালােচনা করে আইন চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং মঁতেস্কুর পূর্বানুমান ঠিকই। (পৃ. ২৭৪)। গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য রাজনীতিক শিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা খুবই প্রয়ােজন। তিনি সরাসরি এই কথাগুলাে না বললেও এগুলাে যে বলতে চেয়েছেন তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। ডানিং বলেছেন যে আইন সম্বন্ধে মতের ধারণা কতখানি ত্রুটিহীন সে বিষয়ে না গিয়ে এ কথা বলা চলে যে, তিনি আইনকে স্বৈরাচারিতা ও খামখেয়ালীর গণ্ডী থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন এবং এখানেই তার কৃতিত্ব।

স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বিভাজন

স্বাধীনতার প্রকৃতি : The Spirit of Laws গ্রন্থের একাদশ অধ্যায় মঁতেস্কু ক্ষমতা বিভাজন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের নাম of the Laws which Establish Political Liberty with Regard to the Constitution. মঁতেস্কুর আমলে ফরাসী দেশের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাত না। বরং নানারকম পীড়নমূলক উপায় অবলম্বন করে স্বাধীনতা হরণ করতে তৎপর হত। মঁতেস্কু ছিলেন স্বাধীনতার একনিষ্ঠ ভক্ত। কিভাবে জনগণ স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে তা নিয়ে এই অধ্যায়ে মঁতেস্কু বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। নথিপত্র থেকে জানা যায় ইংল্যান্ড ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে তিনি এই অধ্যায় লিখেছিলেন। ইংল্যান্ডের জনগণের স্বাধীনতা দেখে তিনি রীতিমত অভিভূত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ শুরু করেছেন রাজনীতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য টেনে। যা খুশি তাই করাকে মতে কখনও স্বাধীনতার পর্যায়ভুক্ত করেন নি। খেয়ালখুশি মত কাজ হ’ল স্বৈরাচারের নামান্তর। স্বৈরাচার ও বিশৃঙ্খলা থেকে আসে নৈরাজ্য। স্বাধীনতা, স্বৈরাচারিতা কখনও সহাবস্থানে অভ্যস্ত নয়। আইনের বিধান অনুযায়ী কাজ করাকে তিনি স্বাধীনতা বলেছেন। তিনি বলছেন, “রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানে সীমাহীন স্বাধীনতা নয়, বরং এর মানে হলো আইন যাই অনুমতি দেয় তাই করার অধিকার”। রাজনীতিক স্বাধীনতা একমাত্র সংবিধান থেকে আসে। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের তেমন কোন প্রয়ােজন নেই বলে তিনি মনে করতেন। ব্যক্তির আচার, আচরণ ইত্যাদির ওপর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নির্ভর করে। প্রকৃত আইন জনগণের রাজনীতিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে পারে। একমাত্র সংবিধানের সাহায্যে এই জাতীয় আইন প্রণয়ন সম্ভব। প্রকৃত আইনের লক্ষ্য ব্যক্তির কাজ করার সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে প্রতিকুল আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ : এইআলােচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্য একটা সত্যিকারের সরকার অবশ্যই দরকার। এ-ধরনের সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্য অবস্থায় থাকবে। ইংল্যান্ড ভ্রমণের পর তার এই প্রত্যয় সৃষ্ট হয়েছিল যে সেখানে একটা প্রকৃত সরকার আছে। ক্ষমতা সেখানে অ-ভারসাম্য অবস্থায় নেই। একমাত্র এই কারণেই ব্রিটিশ নাগরিকরা সর্বাধিক স্বাধীনতা ভােগ করে থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্বাধীনতার জন্য প্রয়ােজন নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য এবং একে সুনিশ্চিত করতে হলে সরকারী ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ফেলা দরকার। এই তিনটি বিভাগ হ’ল—আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আইন বিভাগের কাজ আইন প্রণয়ন করা, শাসন বিভাগের কাজ কূটনীতিক ও সামরিক কার্যাদি সহ আভ্যন্তরীণ কাজকর্ম পরিচালনা করা ও বিচার বিভাগের কাজ অপরাধীর শাস্তিবিধান ও বিরােধের মীমাংসা করা। প্রতিটি কাজের দায়িত্ব থাকবে স্বতন্ত্র বিভাগের ওপর। তার আশঙ্কা এই যে, যদি এই তিন প্রকার কাজ কোন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিগােষ্ঠীর ওপর ন্যস্ত থাকে তাহলে স্বাধীনতা বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে। এখানেই তিনি বলেন, “যখন বিধানিক ক্ষমতা (আইন প্রণয়নের ক্ষমতা) এবং নির্বাহী ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না… আবার যদি বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিধানিক এবং নির্বাহী থেকে পৃথক না করা হয় তাহলেও কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। বিধানিক ও নির্বাহী ক্ষমতা একে অপরের সাথে যুক্ত হলে অধীনস্ত ব্যক্তির জীবন ও স্বাধীনতা যাদৃচ্ছিক চুক্তিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে (would be exposed to arbitrary conract. অর্থাৎ তার সাথে শাসক যা খুশি তাই করতে পারবে)। … যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একই সাথে এই তিনটি ক্ষমতার চর্চা করবে তার সমাপ্তি ঘটবে।” 

মঁতেস্কু ও লক : লকের Two Treatises বের হবার ৬০ বছর পরে মঁতেস্কু The Spirit of Law লেখেন। মঁতেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে লককে অনুসরণ করেছেন। বিশেষ পার্থক্য হল লক বিচার বিভাগের কথা বলেন নি, কিন্তু মঁতেস্কু তা বলেছেন। অন্য একটা পার্থক্য হ’ল লক ক্ষমতা ভাগ করে ফেলাকে স্বাধীনতার একমাত্র শর্ত বলেন নি। কিন্তু উভয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নিমিত্ত বিভিন্ন বিভাগকে আলাদা করে দেয়ার গুরত্ব অকপটে স্বীকার করেছেন। তবে লক জনগণের স্বাধীনতার ব্যাপারে বেশ সতর্ক ছিলেন। মঁতেস্কু লকের এই সতকতার অংশীদার হয়ে আর একটু এগিয়ে গেছেন। অর্ধশতকের অধিককাল সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের রাজনীতিক জগতের ওপর দিয়ে বিরাট পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেছে। সুতরাং মঁতেস্কুর পক্ষে লকের ধারণাকে বিস্তৃততর করা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।

সমালোচনা : মঁতেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও স্বাধীনতার সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে আজ পর্যন্ত বিস্তর সমালােচনা হয়েছে। সমালােচকরা তার সঙ্গে এক মত হতে পারেন নি যে ক্ষমতা ভাগ করে দিলেই স্বাধীনতা পুরােমাত্রায় সংরক্ষিত হবে। কিন্তু একথা সত্যি যে মঁতেস্কুর আমলে ফরাসী দেশে যে ভাবে স্বৈরাচারী সমালোচনা শাসন চলছিল তার প্রেক্ষাপটে বলা চলে যে তিনি ভুল করেন নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি এত বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন যে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিকরা ইউরােপের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা যে ভােগ করত সেটা একটা বাস্তব ঘটনা। এই দিকে লক্ষ্য রেখে ম্যাক্সে বলেছেন যে মঁতেস্কু মূল নীতির দিক থেকে ভুল করেন নি, যদিও তথ্যের দিক থেকে তিনি ভুল করেছিলেন। ব্রিটেনে ক্যাবিনেট শাসন কায়েম হবার সাথে সাথে ক্ষমতা বিভাজন নীতির কোন নামগন্ধ ছিল না। তাছাড়া ব্রিটেনের মন্ত্রিসভা কিভাবে কাজকর্ম করছে সে বিষয়ে তিনি সম্যকরূপে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। অবশ্য মঁতেস্কুর ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল এমন কথা বলা যায় না। কারণ তিনি যখন ইংল্যান্ড ভ্রমণে যান তখন সেখানকার বিচার বিভাগ মােটামুটি স্বাধীন কাজকর্ম করতে পারত। পার্লামেন্ট সার্বভৌম না হয়ে উঠলেও রাজার স্বৈরাচারিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ যেমন চোরকে দিয়ে চোর ধরার কৌশল অবলম্বন করে, তেমনি একমাত্র ক্ষমতাই ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। সরকারের এক বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রিত করবে। ভারসাম্য বজায় রাখার এটাই সর্বোৎকৃষ্ণ উপায়।

মঁতেস্কুর স্থান

রুশোর পর মঁতেস্কুর স্থান : রুশাে নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারার দ্বারা ফরাসী রাষ্ট্রচিন্তাকে যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিলেন এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু রুশাের পর মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রে একমাত্র মঁতেস্কুর নাম করতে হয়। এই দুই মনীষীর কাছে স্বাধীনতা অত্যন্ত প্রিয় ছিল এবং কিভাবে তা অর্জন করা যায় তার জন্য পথ বাতলে দেয়ার কাজে তারা ব্যস্ত ছিলেন। রশাের পর মঁতেস্কু হলেন একমাত্র রাষ্ট্রদার্শনিক যিনি সমাজদর্শনের জটিলতা সম্যকরূপে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন।

সমাজতাত্তিক পদ্ধতি : রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার জন্য মঁতেস্কু সমাজতাত্তিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন এখানেই তার বিশেষ কৃতিত্ব। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন আইন প্রয়ােজন এই উপলদ্ধি মঁতেস্কুর হয়েছিল। আজও আমরা বাস্তব পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখতে পাই যে সর্বত্র একই আইন কার্যকর হয় না। অথবা কোন আইন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। মানুষের অভ্যাস, রুচি ও দষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে সাথে আইনেরও পরিবর্তন হতে বাধ্য। রাষ্ট্রতত্ত্বের বিজ্ঞ ব্যাখ্যাকারদের মতে মঁতেস্কুর আগে কোন রাষ্ট্রদার্শনিক এ নিয়ে এত সুন্দর ব্যাখ্যা করেন নি। ম্যাক্সে বলছেন, “সমস্ত পরিবেশের পক্ষে উপযােগী করে কোন একটা সর্বজনগ্রাহ্য ফর্মুলা তৈরি করা বা সত্য আবিষ্কার করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ নয়, বরং প্রতিটি স্বতন্ত্র পরিস্থিতির চরিত্র বিশ্লেষণ করে কি জাতীয় সরকার ও আইন প্রয়ােজন তা আবিষ্কার করাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ।” (পৃ. ৩১১)

The Spirit of Law-এর প্রভাব : মঁতেস্কুর The Spirit of Law-এর প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক। বইটা বের হবার দু’বছরের মধ্যে ২২টি সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইউরােপের প্রায় সব ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছিল। বইটার ভাগ্যে সমালােচনা ও প্রশংসা দুইই জুটেছিল। অনেকে প্রায়ােগিক ক্ষেত্রে The Spirit of Law-কে হবহু নকল করেছিলেন। মরিস বলছেন, “The Spirit of Law ছিল ১৮শ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ও সফল গ্রন্থ।” (Morris’s article in Folitical Ideas, p. 92).

মঁতেস্কু ও সমকালীন রাষ্ট্রচিন্তা : দুর্ভাগ্যের বিষয় মতে ১৮শ শতকের রাষ্ট্রচিন্তাকে নিজের পক্ষে আনতে পারেন নি। সমকালীন ফরাসী রাষ্ট্রচিন্তা তার প্রভাব থেকে বহুলাংশে মুক্ত ছিল। সমালােচকরা অবশ্য বলেন যে এর জন্য মঁতেস্কুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার রাজনীতিক দর্শন প্রয়ােগ করার মত মানসিকতা তদানীন্তন মতে ও সমকালীন জনগণের ছিল না। মঁতেস্কুর সমসাময়িকরা The Spirit of the Laws পড়লেও বিষয়বস্তু বুঝতে পারেন নি। (ম্যাক্সে পৃ. ২২৫)। কিন্তু মঁতেস্কুর রাষ্ট্রদর্শনের এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে ও বিংশ শতকের একেবারে প্রথমে তার রাষ্ট্রতত্ত্বের ব্যাপক প্রচার হয় এবং জনগণ এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। ম্যাক্সে বলেছেন, “তিনি তার দিনে বিখ্যাত ছিলেন, কিন্তু লোকে তাকে বুঝতো না, তিনি আজও বিখ্যাত, কিন্তু এখন লোকে তাকে বোঝে, কারণ ১৯শ ও ২০শ শতকের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ঐতিহাসিক বিবর্তন ছিল তার কাজের পূর্ণতা।” (পৃ. ৩২৬)। 

আমেরিকা সংবিধান ও মঁতেস্কু : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের রচয়িতারা মঁতেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতির দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবাবিত হয়েছিলেন। মঁতেস্কুকে অনুসরণ করে তারা ক্ষমতা বিভাজন নীতিকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছিলেন। মঁতেস্কুর প্রভাব কতখানি সংবিধান-রচয়িতাদের ওপর পড়েছিল তার প্রমাণ The Federalist Papers-এর বহু জায়গায় পাই। (The Federalist Papers-Introduction by Clinton Rossiter)। বিশেষ করে ৪৭ নং প্রবন্ধে ম্যাডিসন যা বলতে চেয়েছেন তা মঁতেস্কুর ভাষার নকল ছাড়া কিছু নয়। অন্য একজন সমালােচক জি. সি. মরিস বলেছেন, “এমনকি আমেরিকানরা মঁতেস্কুর টিউটোনিক মিথও গিলে খেয়েছে”। (G. C. Morris’s article in Political Ideas, p. 90)। কীভাবে জনগণের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত না করে একটা দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলা যায় সে ব্যাপারে সংবিধানপ্রণেতাগণ রীতিমত ভাবিত ছিলেন। তারা দেখলেন যে মঁতেস্কু প্রবতিত নীতি অনুসরণ করলে লক্ষ্যে উপস্থিত হওয়া যেতে পারে। তাই তারা মঁতেস্কুকে অনুসরণ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবত্ত করেছিলেন। এখনও অনেকে মনে করেন যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ক্ষমতা বিভাজন নীতির প্রয়ােগের জন্যই সেখানে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার জন্মগ্রহণ করতে পারে নি। এই সিদ্ধান্ত কতখানি গ্রহণযােগ্য সে ব্যাপারে বিস্তর বির্তকের অবকাশ আচ্ছ, তবে আমেরিকার প্রশাসনিক মহল ও নাগরিকরা ক্ষমতা বিভাজন নীতিকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করে থাকেন। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সরকারী কাজকর্মে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয়েছে। মনে হয় এই দিকে লক্ষ্য রেখে বার্কি বলেছেন যে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে মঁতেস্কুর বিশেষ অবদান হলো ক্ষমতা বিভাজন নীতি। (বার্কি, পৃ. ১৫১-২৬২)।

তথ্যসূত্র

  • The Spirit of the Laws, Montesquieu, 1748
  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, জুলাই ২০১৩, পৃ.
  • Main Currents in Modern Political Thought, John H. Hallowell, Henry Holt and Company (January 1, 1950)
  • Political philosophies, Chester C Maxey, The Macmillan Company (January 1, 1938)
  • A history of political theory, George Holland Sabine, Holt, Rinehart and Winston; 3rd edition (January 1, 1961)
  • Political Thought: From Plato to the Present, Harmon, M. Judd, McGraw Hill (January 1, 1964)
  • The History of Political Thought, Robert Nandor Berki, Everyman University, 1985

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.