ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা

(সম্প্রসারিত হবে)

প্লেগ মহামারী ইঁদুর নয়, বরং জলবায়ুর কারণে সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে

ইউরোপে ব্ল্যাকডেথের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার একাধিকবার পুনরাগমন ঘটেছিল, আর সম্ভবত একাধিকবার ইউরোপে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই এটা হয়েছিল। যাকে মহামারীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তা হয়তো আদতে একটি মিথ্যা অভিযোগ মাত্র। দীর্ঘ দিন যাবৎ ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞগণ ইঁদুরকেই প্লেগ রোগের জন্য দায়ী করে আসছেন, কিন্ত ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন প্রমাণ দেখাচ্ছে যে এই রোগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইঁদুরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল না। বরং, সম্ভবত এশীয় জলবায়ু ঘটনাসমূহের (Asian climate events) পরপরই ইউরোপে এই রোগের একাধিকবার পুনরাগমন ঘটেছে।

১৩৪৭ থেকে ১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ জুড়ে ব্ল্যাক ডেথ ছড়িয়ে পড়ে, ইউরোপে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, এশিয়া ও আফ্রিকায় আরও ২৫ মিলিয়ন লোক মারা যায়। এটি দ্বিতীয় প্লেগ মহামারী নামে পরিচিত, যা ইউরোপে শত শত বছর ধরে চলতে থাকা প্লেগ মহামারীর ধারাবাহিকতার একটি অংশ ছিল। কিন্তু ইউরোপে প্রাকৃতিকভাবে প্লেগ হয়না। এই রোগটি আসলে এশিয়ার এনডেমিক রোগ, যেখানে ব্যাকটেরিয়া Yersinia pestis কে সকল ছোট প্রাণী এবং এদের শরীরের ফ্লি এর মধ্যে পাওয়া যায় (ফ্লি হচ্ছে একরকম ক্ষুদ্র সাইফনেপ্টেরা বর্গের পতঙ্গ, এটি স্তন্যপায়ী ও পাখির শরীরে পরজীবী হিসেবে বাস করে)। প্রচলিত কাহিনীটি হচ্ছে যে ১৪শ শতকে এই রোগটি ইউরোপে প্রবেশ করার পর Y. pestis ব্যাক্টেরিয়াটি ইউরোপ মহাদেশের ইঁদুর বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পায়, আর এই প্রাণীগুলোর দ্বারাই মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে।

ইঁদুরকে প্লেগ রোগের কারণ ধরলে একটা সমস্যা আছে। ইঁদুর সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী ইউরোপ থেকে বিলুপ্ত হয়নি, ১৯শ শতকে তো অবশ্যই হয়নি। তাদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু তারপরও ততদিনে ককেশাসের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ছাড়া ইউরোপে আর কোথাও মহামারী ছিলনা। ইঁদুর যদি মহামারির কারণ হয় তাহলে ইঁদুরের উপস্থিতির পরেও পরবর্তীতে এই মহামারী কেন অদৃশ্য হয়ে গেল? চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতি এর একটা উত্তর হতে পারে। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার কাজ রোগ হবার পর রোগীকে সুস্থ করা। পশু থেকে মানুষের মধ্যে প্রাথমিকভাবে রোগের বিস্তার ঘটার পর চিকিৎসাটা হবে। চিকিৎসাবিদ্যা পশু থেকে মানুষের মধ্যে রোগের প্রাথমিক বিস্তারটাকে আটকাতে পারবে না। বর্তমানে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের নগর বা গ্রামগুলোতে ইঁদুরের মত প্রাণীরা যাতে রোগ ছড়াতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া গেছে। কিন্তু ১৪শ শতক ও ১৯শ শতকে মানুষ ও ইঁদুরের মত প্রাণীগুলোর সম্পর্ক বলতে গেলে একই রকম ছিল। ১৪শ শতকে ইঁদুরেরা যেরকম মানুষের মধ্যে রোগের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম ছিল, ১৯শ শতকেও তাই ছিল। তাহলে প্রশ্ন আসেই যে, কেন ইঁদুরের কারণে ১৪শ শতকেই মহামারী হল, কিন্তু পরে আর মহামারী হল না, আর ১৯শ শতকে ককেশাস ছাড়া এই মহামারী ইউরোপ থেকে উঠে গেল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি বা অন্যান্য কোন কারণ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। অবশ্যই এর পেছনে ইঁদুর ভিন্ন অন্য কোন ফ্যাক্টর লুকিয়ে আছে।

আর শুধু ইঁদুর বা বন্যপ্রাণীর দ্বারাই যে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। ইঁদুরের তত্ত্ব ছাড়া অন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্রে অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিল্‌স স্টেনসেথ বলছেন, “মহামারী মানুষের দ্বারাও ছড়িয়ে থাকতে পারে, এবং ড্রপলেটের দ্বারা একজনের থেকে অন্যের উপর সংক্রমন ঘটে থাকতে পারে। আবার এটি এটা মানুষের কাপড়ে লুকিয়ে থাকা ফ্লি এর দ্বারাও ছড়িয়ে থাকতে পারে।”

যেখানে প্রাকৃতিকভাবে প্লেগের আগমন ঘটে, সেখানকার বন্য রোডেন্টদের মধ্যে, যেমন গারবিলের মধ্যে ইয়েরসেনিয়া পেস্টিস নামক প্লেগের জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া খুব পাওয়া যায় (রোডেনশিয়া নামক বর্গের প্রাণীগুলোকে রোডেন্ট বলে, এরা সবাই ইঁদুর জাতীয়)। বেশিরভাগ সময়, ইঁদুর ও তার শরীরে থাকা ফ্লিদেরকে পোষক দেহ হিসেবে পেতে এই ব্যাক্টেরিয়ার কোন সমস্যা হয়না। কিন্তু জলবায়ু তুলনামূলকভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র হয়ে গেলে ইঁদুরের সংখ্যা কমে যায়, তাই তার শরীরের পরজীবী ফ্লিগুলো একটি বিকল্প পোষক দেহকে বেছে নেয়, যা হচ্ছে গৃহপালিত পশু ও মানুষ। আজও এই উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এশিয়ায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়।

২০১৫ সালে গবেষক স্টেনসেথ ও তার কলিগেরা প্রোসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশ করেন। সেখানে তারা ট্রি রিং ডেটা এর সাহায্যে ইউরোপ ও এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনকে পরীক্ষা করেন, এবং এর সাথে ৭,৭০০ এরও বেশি ঐতিহাসিক প্লেগ প্রাদুর্ভাবের ডেটাসমূহের সমন্বয় করেন।

তারা ইউরোপীয় জলবায়ু এবং প্লেগ রোগের মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাননি, কিন্তু ১২৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে উত্তর পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালার জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ইউরোপীয় বন্দর শহরে প্লেগ মহামারীর মধ্যে কিছু কৌতূহলজনক সম্পর্ক খুঁজে পান। যেবারই এই পর্বতের পাহাড়ী ইঁদুরগুলোর জন্য জলবায়ু প্রতিকূল হয়ে যায়, ঠিক প্রায় ১৫ বছর পর পর ইউরোপীয় বন্দরগুলোতে প্লেগ এসে হাজির হয়।

১৫ বছরকে অনেক দীর্ঘ সময় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক সমাজের কথা বিবেচনায় নিলেই এই সময়টা আসলে দীর্ঘ। কিন্তু অতীত কালের মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ধীর স্থানান্তর বিবেচনায় ১৫ বছর সময়কাল মোটেও খুব একটা দীর্ঘ নয়। শুষ্ক পর্যায়ের পর ইঁদুরের সংখ্যা কমে যেতে ও তার শরীরের ফ্লিগুলোর এশিয়ার জনসংখ্যার সংস্পর্শে আসতে আসতে এক থেকে দুই বছর লেগে যাবে। এরপর এশিয়া থেকে ইউরোপে যেতে এই রোগকে প্রায় ২,৫০০ মাইল অতিক্রম করতে হবে, যেখানে প্রতি বছর এটি ২০০ থেকে ২৫০ মাইল অব্দি অতিক্রম করতে পারবে।

প্লেগ রোগের এশিয়া থেকে ইউরোপে যাবার গতিবেগ অতীতের মহামারীগুলোর সময়কার প্লেগের ছড়িয়ে পড়া গতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি চীনে সংঘটিত ৩য় মহামারীর চেয়ে দ্রুত গতির, কিন্তু ব্ল্যাক ডেথের সময়কার ইউরোপে প্লেগের ছড়িয়ে পড়ার গতির চেয়ে ধীর। গবেষকদের দলটি জানাচ্ছে, এশিয়া জুড়ে বাণিজ্য পথ বরাবর ভ্রমণকারী কাফেলাগুলো প্লেগ পরিবহন করে থাকতে পারে, যার ফলে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ জনবসতিহীন অঞ্চল থাকার পরও এশিয়ার রোগ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়া থেকে ইউরোপে ভ্রমণের সময়ের শেষ বছরটিতে ইউরোপের বন্দর শহরগুলোতে প্লেগ এসে পৌঁছয়, এবং তারপর সমগ্র ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে।

ইউরোপে প্লেগের পুনঃপ্রবর্তনের জন্য এশিয়ার জলবায়ুই দায়ী তা প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীদের আরও তথ্যের প্রয়োজন হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে বিভিন্ন সময়ে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লোকেদের থেকে নেয়া প্লেগ ডিএনএ-কে বিশ্লেষণ এই রোগের প্রাদুর্ভাব ও জলবায়ুর মধ্যকার সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে পারে। স্টেনসেথ বলেন, “যদি আমাদের এই জলভায়ু ভিত্তিক প্লেগের পুনঃপ্রবর্তনের তত্ত্বটি সঠিক হয়, তাহলে আমরা বিভিন্ন সময়ের প্লেগে মৃত ব্যক্তির মধ্যকার প্লেগ ডিএনএগুলোতে জেনেটিক ব্যাক্টেরিয়াল ভেরিয়েশন বা বৈচিত্র পাব। যদি এই ব্যাক্টেরিয়া একটি একক উৎস্য থেকে আসে, তাহলে প্লেগে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থান ও সময়ের হলেও তাদের প্যাথোজেনের ডিএনএ-তে জিনগত বৈচিত্র্য কম হবে।”

এই নতুন তত্ত্বটি প্লেগের কাহিনী থেকে ইঁদুরকে বাদ দিয়ে দেয়না। গবেষকগণ বলছেন, ইঁদুরেরা সম্ভবত সমুদ্রের জাহাজে এবং বন্দরে বন্দরে প্লেগ ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। ১৪শ শতকের ব্ল্যাকডেথের প্রতিক্রিয়ায় জাহাজকে কোয়ারেন্টাইন করার রীতি শুরু হয়। এটা যদি ব্ল্যাকডেথের সময় করা হত তাহলে অন্তত কিছু বন্ধর নগরকে এই সময়ে বাঁচানো সম্ভব হত।

তথ্যসূত্র

https://www.pnas.org/content/early/2015/02/20/1412887112

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.