গ্রিকদের ইতিহাস

Table of Contents

গ্রিক সভ্যতায় মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় লেগেসি

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মিশরে লিখন পদ্ধতির কৌশল আবিষ্কৃত হয়। মেসােপটেমিয়াতে খুব দেরিতে এটি শুরু হয় নি। প্রতিটি দেশেই লক্ষিত বস্তুর ছবি দিয়ে লিখন পদ্ধতি শুরু হয়। এসব ছবি খুব দ্রুত পরিচিতি লাভ করে এবং চলিত রীতিসম্মত হয়। এর ফলে লিখিত বা মুদ্রিত লিপি শব্দের প্রতীক হয়ে ওঠে। চিন দেশে আজো এই পদ্ধতি বিদ্যমান। হাজার হাজার বছর ধরে এই দুর্বহ ও ঝঞ্ঝাটপূর্ণ পদ্ধতি বর্ণমালার লিখন পদ্ধতিতে বিকশিত হয়। মিশর ও মেসােপটেমিয়াতে সভ্যতার প্রাথমিক বিকাশের কারণ হচ্ছে নীল, টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী। এই তিনটি নদী এই এলাকার কৃষিকাজকে খুবই সহজ এবং উৎপাদনশীল করে তোলে। স্পেনবাসীগণ মেক্সিকো এবং পেরুতে যে সভ্যতা দেখতে পেয়েছিলেন এই সভ্যতা বিভিন্ন দিক থেকে তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। সেখানে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাসহ একজন ঐশ্বরিক রাজা ছিলেন; মিশরে তিনি সমস্ত জমির মালিক ছিলেন। সেখানে একজন পরম বা সর্বোচ্চ দেবতার ধারণাসহ বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম ছিল এবং এই পরম ঈশ্বরের সঙ্গে রাজার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেখানে সামরিক অভিজাততন্ত্র এবং যাজকীয় অভিজাততন্ত্র ছিল। রাজা দুর্বল হলে বা কোনো কঠিন যুদ্ধে ব্যাপ্ত থাকলে যাজকীয় অভিজাতরা অনভিপ্রেতভাবেই রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন। কৃষকেরা ছিল দায়বদ্ধ ক্রীতদাস। এদের মালিক ছিলেন রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় বা যাজকমণ্ডল। মিশরিয় এবং ব্যবিলনিয় ধর্মতত্ত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। মিশরিয়গণ মৃত্যুচিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তারা বিশ্বাস করে যে, মৃতব্যক্তির আত্মা পাতালপুরীতে যাবে। পৃথিবীতে জীবিতকালের কর্ম অনুসারে ওসিরিস (Osiris) তাদের বিচার করবেন। (ওসিরিস মিশরীয় পুরাণের অন্যতম প্রধান দেবতা। পৃথিবী দেবতা গেব এবং আকাশদেবী ন্যুটের পুত্র। দেবতা আমনের মৃত্যুর পর ওসিরিস তার স্থলাভিষিক্ত হন। মিশরিয়দেরকে তিনি কৃষিকাজ শিখিয়েছিলেন। দেবী আইসিস তার যমজ বোন এবং আইসিসকে তিনি বিয়েও করেন। ওসিরিস পৃথিবীর মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ছিলেন। এই জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে তার ছােট ভাই সেট তাকে হত্যা করে। আইসিস পায় পুত্র হােরসের সাহায্যে সেটকে নিধন করেন। পরবর্তীকালে মিশরিয় পুরাণে ওসিরিস মৃত্যুদেবতারূপে পরিগণিত হন।) তারা মনে করে মৃত ব্যক্তির আত্মা অবশ্যই পূর্ব দেহে ফিরে আসবে। তাদের এই ধারণার ফলস্বরূপ মমিকরণ এবং চমৎকার সমাধিশিলা তৈরি শুরু হয়।

খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ সহস্রাব্দের শেষ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম পর্যন্ত বিভিন্ন রাজা পিরামিড তৈরি করেন। এরপর থেকে মিশরিয় সভ্যতা ক্রমেই অধিকতররূপে নতুনত্বহীন হয়ে পড়ে, এবং ধর্মীয় রক্ষণশীলতা সমাজবিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। খ্রিস্টপূর্ব আঠার শতকে সেমিটিস (Semites) জাতিভুক্ত হিকসোস (Hyksos) মিশর বিজয় করেন এবং তারা প্রায় দুই শতক ধরে দেশ শাসন করেন। (সেমাইত (Semite) হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত শেম হতে উৎপন্ন যেকোনো জাতির লোক। যেমন – হিব্রু, আরব, আসিনিয়, ফিনিসিয় প্রভৃতি।) মিশরিয় সভ্যতায় তারা কোনো স্থায়ী অবদান রাখতে পারেন নি, কিন্তু তাদের শাসনকালীন মিশরিয় সভ্যতা সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে বিস্তারলাভে অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। মিশরের চেয়ে ব্যবিলনিয়াতে অধিকতর সামরিক বিকাশ ছিল। প্রথমে শাসক গোষ্ঠী সেমেটিস জাতিভুক্ত ছিল না, তারা ছিল সুমেরিয় জাতি। এই জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তারা কীলকাকার লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে যা বিজয়ী সেমেটিস জাতি গ্রহণ করে। (প্রাচীন পারসিক ও এশিরীয় হস্তলিপিতে ব্যবহৃত পদ্ধতি।) এমন এক সময় ছিল যখন বিভিন্ন স্বাধীন শহর ছিল। এই স্বাধীন শহরগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, কিন্তু পরিশেষে ব্যবিলন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে এবং একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অন্যান্য শহরের দেবতারা তাদের প্রাধান্য হারিয়ে ব্যবিলনের প্রধান দেবতা মারডুকের (Marduk) অধীনস্থ হয়। পরবর্তীকালে গ্রিক সর্বদেবতার মন্দিরে জিউস যেমন প্রধান স্থান লাভ ভেৱেন মারডুকও তেমন স্থান লাভ করেন। মিশরেও প্রথম দিকেই অনুরূপ ঘটনা ঘটে।

অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের ন্যায় মিশর ও ব্যবিলনিয়ার ধর্মসমূহ ছিল মূলত উর্বরতাশক্তির পজাভিত্তিক ধর্ম। পৃথিবীকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক এবং সূর্যকে পুংলিঙ্গবাচক বলে গণ্য করা হতো। ষাঁড়কে পুরুষ উর্বরতার মূর্ত প্রকাশ বলে মনে করা হতো, এবং ষণ্ডদেবতা (Bull-gods) বা ষাঁড় দেবতারা ছিলেন উভয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ব্যবিলনে স্ত্রী-দেবীদের মধ্যে পৃথিবীর দেবী ইসতার (Ishtar) ছিলেন সর্বপ্রধান। সমগ্র পশ্চিম এশিয়াতে মহামাতা (Great Mother) বিভিন্ন নামে পূজিত হতেন। এশিয়া মাইনরে গ্রিক উপনিবেশবাদীরা এই মহামাতার মন্দির দেখে এর নাম রাখেন আর্টিমিস (Artemis) এবং তারা সেখানকার বিদ্যমান ধর্মীয় পূজা পদ্ধতিই গ্রহণ করেন। আর এভাবেই ‘ডায়ানা অব এফিসিয়াস’-এর উৎপত্তি হয়। (ডায়ানা ছিল আর্টিমিসের ল্যাটিন শব্দের সমার্থক। গ্রিক টেস্টামেন্টে উল্লিখিত আর্টেমিস মূলত এই ডায়ানা।) খ্রিষ্টধর্মে একেই কুমারী মাতা (Virgin Mary) হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়, এবং এই কুমারী মাতাকে আমরা যেমন ‘ঈশ্বরের মাতা হিসেবে উল্লেখ করি, তেমনি এফিসাসের কাউন্সিলে আর্টিমিসকে ‘ঈশ্বরের মাতা’ উপাধিকেই বৈধতা প্রদান করা হয়।

যেখানে কোনো সাম্রাজ্যের সরকারের সঙ্গে ধর্ম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকে সেখানে ধর্মের আদি বৈশিষ্ট্যসমূহ রূপান্তরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের সঙ্গে দেবতা বা দেবী সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থই হচ্ছে শুধু শস্যের প্রাচুর্য প্রদান নয়, যুদ্ধে বিজয় অর্জনেও নিশ্চয়তা প্রদান করা। একটি ধনিক যাজকীয় সম্প্রদায় ধর্মীয় রীতিনীতি এবং ধর্মতত্ত্বকে বিশদভাবে প্রণয়ন করেন এবং সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন দেব-দেবীকে একত্র করে একটি দেবমণ্ডলী গঠন করতেন। সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে দেবতারা নৈতিকতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতেন। আইন প্রণেতাগণ দেবতার কাছ থেকেই তাদের আইনের বিধিবিধান বা দণ্ডবিধি লাভ করতেন; আইন ভঙ্গ করা মানেই হতো অধর্মাচার করা। এ পর্যন্ত জানা দণ্ডবিধির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন দণ্ডবিধিটি হচ্ছে হাম্মুরাবির (Hammurabi) দণ্ডবিধি। হাম্মুরাবি ছিলেন ব্যবিলনের রাজা (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬৭-২০২৫)। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘােষণা করেন যে, দেবতা মারডুকই তাকে এই দণ্ডবিধি প্রদান করেন। সমগ্র প্রাচীনকালে ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয়।

ব্যবিলনিয়ার ধর্ম মিশরের ধর্মের মতো ছিল না। পরকালের সুখের চেয়ে ইহজগতের উন্নতিসাধনের বিষয়টি ছিল ব্যবিলনিয়ার ধর্মের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিক। জাদুবিদ্যা, ভবিষ্যৎ কথন এবং জ্যোতির্বিদ্যা ব্যবিলনিয়াতে কোনো নতুন বিষয় ছিল না, কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় অধিকতর উন্নত ছিল। মূলত ব্যবিলনের মাধ্যমেই এগুলো পরবর্তীকালে প্রাধান্যলাভ করে। ব্যাবিলন থেকে প্রাপ্ত কিছু কিছু বিষয় বিজ্ঞানের অন্তর্গত ছিল: যেমন, দিবা রাত্রির ২৪ ঘণ্টার বিভাজন এবং বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে বিভক্তিকরণ। এ ছাড়াও ব্যবিলনে আবিষ্কৃত হয় গ্রহণের কালচক্র, যার ফলে চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী এবং সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে সম্ভাব্য ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়। এই ব্যবিলনের জ্ঞান থেলিস অর্জন করেছিলেন। মাইলেসীয় দার্শনিক সম্রদায়ের দার্শনিক তিনজন – থেলিস, অ্যানেক্সিমেন্ডারঅ্যানেক্সিমিনিস। এই তিন দার্শনিকই মিলেটাস নগরের বাসীন্দা ছিলেন বলে তাদের মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায় বলা হয়, আবার তারা আয়োনিয়া অঞ্চলের লোক ছিলেন বলে তাদেরকে আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এর বিবেচনায় এদের সাথেও খ্রি.পূ. ৫ম শতকের ৩ জন আয়োনিয় দার্শনিক হেরাক্লিটাস, এনাক্সাগোরাস ও আর্কেলাওসকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এদের দর্শনই ইউরোপের দর্শনের আদি পর্যায়, গ্রীক দর্শন, এমনকি পাশ্চাত্য দর্শনের উদ্ভবের সূচনাও এদের থেকেই।

পৃথিবীর ইতিহাসে গ্রিস দেশে সভ্যতার আকস্মিক উথান অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন তা মিশর এবং মেসােপটেমিয়াতে হাজার হাজার বছর ধরেই বিদ্যমান ছিল, এবং তখন থেকেই এসব উপাদান প্রতিবেশী দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশেষ কিছু উপাদান এই দুই সভ্যতায় অনুপস্থিত ছিল। গ্রিকরাই সেই উপাদানসমূহ তাদের প্রদান করে। শিল্পকলা এবং সাহিত্যে তাদের অর্জনের বিষয়টি সকলের জানা থাকলেও বিশুদ্ধ বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে তাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ব্যতিক্রমী। তারা গণিত, বিজ্ঞান এবং দর্শন আবিষ্কার করেন; বর্ষভিত্তিক ঘটনাবলির বিবরণী লেখার পরিবর্তে তারাই প্রথম ইতিহাস লেখা শুরু করেন; জগতের প্রকৃতি এবং জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে তারাই মুক্ত ও স্বাধীনভাবে অনুধ্যানমূলক চিন্তা করেন। (পাটিগণিত এবং এক ধরনের জ্যামিতির ধারণা মিশরিয় এবং ব্যবিলনিয়দের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ ধারণাসমূহ ছিল মূলত অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলনের ওপর নির্ভরশীল পদ্ধতি। সামান্য বা সার্বিক আশ্রয়বাক্য থেকে অববোহাত্মক যুক্তি প্রণয়নে গ্রিকরাই নব প্রবর্তক।) উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রচলিত বিশ্বাস বা গোঁড়ামি এসব মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নি। তাই গ্রিস দেশে যা ঘটেছিল তা ছিল এতই আশ্চর্যজনক যে, বর্তমান সময়ের মানুষ গ্রিক প্রতিভা নিষ্পলক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে এবং এক ধরনের মরমিভাব ব্যক্ত করেই সন্তুষ্ট থাকে। অবশ্য গ্রিসের ক্রমবিকাশ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপলব্ধি করা সম্ভব, এবং তা করাই হয়তো যথােচিত হবে। থেলিসের দর্শন দিয়েই দর্শনের যাত্রা শুরু। আমরা সৌভাগ্যবান যে তার সময়কাল নির্ধারণ করতে পেরেছি। জ্যোতির্বিদদের মতানুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দে একটি সূর্যগ্রহণ হয়। থেলিসই এই সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মূলত শুরু থেকেই দর্শন ও বিজ্ঞান পরস্পর থেকে পৃথক ছিল না। তাই আমরা বলতে পারি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শুরুতে দর্শন এবং বিজ্ঞানের একত্রেই জন্ম হয়। গ্রিস দেশে এবং প্রতিবেশী দেশসমূহে এর পূর্বে কী ঘটেছিল? এর যেকোনো উত্তর হবে অংশত অনুমানমূলক, কিন্তু বর্তমানকালের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা আমাদের পিতামহের তুলনায় অধিকতর জ্ঞান প্রদান করেছে।

প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে এখানে যান

মিনোয়ান সভ্যতা (আনু. খ্রি.পূ. ২৭০০ -১৪৫০ অব্দ)

প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে গ্রীক ভাষাভাষী লোকেরা বলকান উপত্যকার উত্তর পশ্চিম প্রান্ত থেকে দক্ষিণ দিকে সরে আসতে থাকে যা পরে গ্রীস নামে পরিচিত হয়। তখন গ্রীক ট্রাইবগুলো পাথরের হাতিয়ার দিয়ে কাজ করত, ধাতুর ব্যবহার তখনও শেখেনি। এই উপদ্বীপের দক্ষিণে ছিল ক্রিট দ্বীপপুঞ্জ (Crete)। সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে এর লোকজন কপার ব্যবহার করতে ও কার্যকরী জাহাজ নির্মাণ করতে শেখে। সমুদ্র দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ায় ক্রিটের শহরগুলোকে জাহাজ নির্মাণ শিখতে হয় যাতে তারা মহাদেশীয় উপকূল, দক্ষিণ ও পূর্বের দেশগুলোর সাহে বাণিজ্য করতে পারে। সেগুলোর সুরক্ষার জন্য নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। ক্রিট ছিল ইতিহাসের সর্বপ্রথম নৌশক্তি। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ সালে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের অধীনে ক্রিট দ্বীপটি ঐক্যবদ্ধ হয়। তারপর শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের নৌবাহিনী তাদের বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে। দ্বীপগুলোর শহরগুলো খুব সমৃদ্ধভাবে গড়ে ওঠে ও নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদের কোন দেয়াল ওঠানো লাগেনি। তাদের শাসকরা বিলাশবহুল সব প্রাসাদ নির্মাণ করে, আয়োজিত হয় বিরাট সব উৎসব, তারা সৃষ্টি করেছিল আকর্ষণীয় সব শিল্প। মিশর এবং মেসােপটেমিয়ার সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক এবং পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের সভ্যতা ছিল মেষপালক ও পল্লীজীবনভিত্তিক। ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এতে নতুন এক উপাদান যুক্ত হয়। প্রথমদিকে এটি ছিল প্রায় সমুদ্রভিত্তিক বলে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ পর্যন্ত ব্রোঞ্জ দ্বারাই অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো এবং যে সমস্ত দেশে অস্ত্রশস্ত্র তৈরির জন্য নিজস্ব প্রয়োজনীয় ধাতব দ্রব্য ছিল না তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করতো। জলদস্যুতা ছিল একটি অস্থায়ী তৎপরতা বা অভিযান যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা মােটামুটি সুস্থিত বা দৃঢ় ছিল সেখানে বাণিজ্য অধিকতর লাভজনক ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রিট (Crete) দ্বীপ অগ্রগণ্য চিল মনে হয়। মােটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ১৪০০ অব্দ পর্যন্ত এগার শতক ধরে তিনি মিনোয়ান (Minoan) নামে প্রাগ্রসর শৈল্পিক সংস্কৃতি ছিল। ক্রিটয়ার শিল্পকলার বিদায় অংশ থেকে আমরা এক ধরনের মনোরম এবং প্রায়-ক্ষয়িষ্ণু বিলাসিতার ছাপ লক্ষ করি। এটি ছিল মিশরিয় মন্দিরসমূহের আতঙ্কিত বিষাদ ও হতাশার ভাব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

স্যার আর্থার ইভান্স (Sir Arthur Evans) এবং অন্যদের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের পূর্ব পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সভ্যতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় নি। মিশরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এই সভ্যতা ছিল একটি উপকূলীয় সভ্যতা (হাইকসোসের শাসনকাল ব্যতীত)। মিশরের ব্যবসা-বাণিজ্যের চিত্র থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, মিশর এবং ক্রিটের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেন ক্রিটের নাবিকদের দ্বারাই পরিচালিত হতো। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় পনের শতকে এই ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে। সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের ধর্মের সঙ্গে ক্রিটবাসীর ধর্মের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যদিও ক্রিটের শিল্পকলা অত্যন্ত মৌলিক এবং বিস্ময়করভাবে জীবনঘনিষ্ঠ, তথাপি শিল্পকলার ক্ষেত্রে মিশরের শিল্পকলার সঙ্গে ক্রিটের শিল্পকলার অধিকতর সাদৃশ্য রয়েছে। ক্রিটের সভ্যতার কেন্দ্র ছিল নোসাসে (Knossos) অবস্থিত তথাকথিত ‘মাইনোসের প্রাসাদ’ (Palace of Minos)। এই সভ্যতার স্মৃতির রেশ চিরায়ত গ্রিসের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্রিটের রাজপ্রাসাদসমূহ অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকের শেষ দিকে খুব সম্ভবত গ্রিস থেকে আগত আক্রমণকারীরা এগুলো ধ্বংস করে ফেলে। ক্রিটে প্রাপ্ত মিশরিয় দ্রব্যাদি এবং মিশরে প্রাপ্ত ক্রিটের দ্রব্যাদি থেকে ক্রিটের ইতিহাসের একটি কালানুক্রমিক ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে এ সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞান মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপরই নির্ভরশীল।

ক্রিটের অধিবাসীরা একজন অথবা সম্ভবত কয়েকজন দেবীর পূজা করতো। এই দেবীদের মধ্যে সবচেয়ে সন্দেহাতীত দেবী ছিলেন ‘মানবেতর প্রাণীর রানী’ (Mistress of Animals)। এই রানী ছিলেন একজন শিকারি, এবং সম্ভবত তিনি ছিলেন চিরায়ত আর্টিমিসের উৎস। তিনি দৃশ্যত একজন মাতাও ছিলেন। (এই রানীর ‘মানবেতর প্রাণীর প্রভু’ (Master of Animals) নামে একজন যমজ স্বামী বা স্বামী ছিল, কিন্তু তিনি কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। পরবর্তীকালে এশিয়া মাইনরে আর্টিমিসকে মহামাতার সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়।) মানবেতর প্রাণীর প্রভূ’ ব্যতীত তার যুবক সন্তানই ছিলেন একজন পুরুষ দেবতা। এখানে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে বিশ্বাসের কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরিয়দের মতো তারাও বিশ্বাস করতেন যে, এই পৃথিবীর কৃতকর্মের জন্য তারা পুরস্কৃত হবে বা শাস্তি পাবে। সামগ্রিকভাবেই ক্রিটের শিল্পকলা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা প্রফুল্ল চিত্তের অধিকারী ছিল, বিষন্ন কুসংস্কার দ্বারা পীড়িত ছিল না। তারা যাড়ের সঙ্গে লড়াই* পছন্দ করতো। এই লড়াইয়ে লড়াইকারী স্ত্রী-পুরুষ উভয় ষাড়ই বিশ্বয়কর শারীরিক শিল্প নৈপুণ্য প্রদর্শন করতো। স্যার আর্থার ইভান্স মনে করেন, ষাঁড় লড়াই এক প্রকার ধর্মীয় উৎসব ছিল, এবং শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শনকারীগণ অত্যন্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের লোক ছিল। কিন্তু তার এই মত সর্বজন স্বীকৃত হয় নি। সে সময়ের টিকে যাওয়া ছবিগুলো গতিশীল এবং বাস্তবানুগ ছিল। ক্রিটবাসীদের একটি রৈখিক হস্তলিপি বা বর্ণমালা ছিল, কিন্তু এর অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। স্বদেশে তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছিল, এবং তাদের নগরীর চারদিকে কোনো প্রাচীর ছিল না। কিন্তু একথা সত্য যে, তারা সমুদ্রশক্তি দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।

পরবর্তী গ্রীকদের কাছে এই প্রাচীন ভূমির অস্পষ্ট স্মৃতি টিকে থাকে যারা একসময় সাগরসমূহে রাজত্ব করত। তাদের বিভিন্ন উপকথায় মিনোস (Minos) নামে একটা শক্তিশালী রাজার কথা বলা আছে যিনি ক্রিটে রাজত্ব করেছিলেন। অনেক দিন ধরেই ইতিহাসবিদরা মনে করত এটা কেবলই কিংবদন্তী। তবে ১৮৯৩ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট আর্থার জন ইভান্স ক্রিটে ধারাবাহিক কয়েকটি খননকার্য পরিচালনা করে হাজার বছর আগের এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। তিনি সেখানে প্রাচীন শহর নসসের স্থানে এক রাজকীয় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পান, যেখানে রাজা মিনোসের রাজত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। সেই সময়ে ক্রিটরা সর্বেসর্বা ছিল বলে রাজা মিনোসের নাম অনুসারে তাই এই যুগকে বলা হয় মিনোয়ান যুগ। এর স্থায়িত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে ১৪০০ অব্দ পর্যন্ত। ক্রিটান ভাষার অর্থোদ্ধার করা হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালে তাদের ভাষায় চিত্রালেখ্য বা পিক্টোগ্রামের ব্যবহার ছিল, পরে তারা আঁকাবাঁকা লাইনের রেখে ব্যবহার করে। প্রথম ধরণের লেখা লিনিয়ার এ নামে পরিচিত ছিল, আর নসস ধ্বংসের সময়ে প্রচলিত ছিল লিনিয়ার বি। ১৯৫৩ সালে ইংরেজ আর্কিওলোজিস্ট লিনিয়ার বি এর পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হলেন। এখানে গ্রিক বর্ণমালা না থাকলেও শব্দগুলো গ্রীক ছিল। এই উদ্ধার হওয়া নথির মধ্যে পণ্যদ্রব্য, রশিদ, কাজের নির্দেশ সহ বিভিন্ন জিনিস ছিল। শিল্প, ইতিহাস বা বিজ্ঞানের কোন অসাধারণ কাজের বর্ণনা ছিল না। এখান থেকে বোঝা যায়, নসসেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েও এখানে গ্রিসের ব্যাপক প্রভাব ছিল, সম্ভবত গ্রিক বণিকদের দ্বারা জায়গাটি পরিপূর্ণ ছিল। গ্রিক জাহাজগুলো বাণিজ্যে অগ্রসর ছিল, আর ক্রিটানরা ধীরে ধীরে তাদের ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

ক্রিটান সভ্যতা ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে দক্ষিণে যা মূল ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ক্রিটানদের থেকে সভ্যতার শিক্ষা নিয়ে গ্রিক ট্রাইবগুলো অধিকতর ক্ষমতাশালী হয়, প্রসারমান শহর প্রতিষ্ঠা করে ও প্রতিবেশীদের সাথে বাণিজ্যের কাজ আরম্ভ করে। কিন্তু গ্রিকদেরকে দক্ষিণের অসভ্য ট্রাইবগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হত। তাই তারা শহরগুলোকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছিল। ক্রিটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল এর নিকটে গ্রিসের সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চলে, এই অংশ ছিল গ্রিসের অবশিষ্টাংশের সাথে ভূমধ্যসাগরের একটি অপ্রশস্ত অংশ দ্বারা বিচ্ছিন্ন। গ্রিসের অবশিষ্টাংশের সাথে একে সংযোগ করে রাখে একটি ২০ মাইল লম্বা, ৪ মাইল চওড়া সরু যোজক। গ্রিসের এই দক্ষিণ উপদ্বীপ প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল পেলোপনেসাস নামে, যার অর্থ হল পেলপ দ্বীপ, কারণ সেখানে প্রাচীনকালে পেলপস নামে এক রাজার শাসন ছিল। এই উপদ্বীপের উত্তরপূর্বে ছিল তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র – মাইসিনিয়া, টাইরনজ আর আর্গোস। এদের ৪০ মাইল দক্ষিণে ছিল স্পার্টা আর ২০ মাইল উত্তরে কোরিন্থ। পেলোপনেসাসের পশ্চিম উপকুলে ছিল পিলোস শহর। করিন্থ ছিল যোজকের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে, যেটা কোরিন্থের যোজক নামে পরিচিত ছিল। সাগরের এক প্রান্ত থেকে পেলোপনেসাসের দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল কোরিন্থ উপসাগর। যোজকের উত্তর-পূর্বে ছিল এথেন্স ও থিব্‌স, কিন্তু প্রথম দিকে পেলোপনেসাসের ঠিক বাইরে অবস্থিত এই শহর দুটো ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট ও কম উল্লেখযোগ্য। ক্রিটের শাসনাধীন মূলভূমির গ্রিকরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছিল, একসময় তারা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের বিশদ জানা যায় না, কিন্তু থিসিয়াস নামে এক এথেনীয় বীরের কাহিনী গ্রিকবাসীদের কাছে জানা ছিল যে ক্রিটের থেকে এথেন্সকে স্বাধীন করে। গ্রীকরা ক্রিটান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে মূলভমির উপর ক্রিটান আধিপত্যের অবসান ঘটায়। এই ব্যাপারে কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালে ঘটে যাওয়া নসসের ভূমিকম্প হয়তো তাদের সহায়তা করে। শেষ পর্যন্ত ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিকরা ক্রিট আক্রমণ করে, প্রাসাদ ধ্বংস করে নসস দখল করে। পরে প্রাসাদ পুনর্নিমিত হলেও ক্রিটরা ক্ষমতা আর ফিরে পায়নি।

মাইসিনীয় সভ্যতা (আনু. খ্রি.পূ. ১৬০০-১১০০ অব্দ)

মাইসিনীয় সভ্যতার ভূমিকা : মূল ভূখণ্ডের গ্রিকরা তাদের প্রভাব বাড়িয়েই চলছিল। সেসময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর ছিল মাইসিনিয়া, তাই মোটামুটি ১৬০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে মাইসিনিয়ান যুগ বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ষােল শতকে মিনোেয়ান সংস্কৃতি ধ্বংসের পূর্বে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে এই সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব নয় শতকের পূর্ব পর্যন্ত এই সংস্কৃতি ধীর পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে সেখানে টিকে থাকে। এই মূল ভূখণ্ডের সভ্যতাকে মিকোনায়েন (Mycenaean) নামে অভিহিত করা হয়। রাজার সমাধিস্থল পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত দুর্গ থেকে এই সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। ক্রিটে যে পরিমাণ যুদ্ধভীতি ছিল তার চেয়েও বেশি যুদ্ধভীতি তাদের ছিল বলে এ থেকে প্রমাণিত হয়। সমাধিস্থল এবং পাহাড়ের চূড়া উভয়ই চিরায়ত গ্রিসের কল্পনায় রেখাপাত করে। রাজপ্রাসাদে বিদ্যমান প্রাচীনতর শিল্পসামগ্ৰী হয় ক্রিটের প্রকৃত শিল্পীদের কর্ম আর না হয় ক্রিটের সমগোত্রীয় শিল্পীদের কর্ম। নানা উপকথা ও কল্পকাহিনীর মধ্য দিয়ে আমরা মিকোনায়েন সভ্যতার কথা জানতে পারি। হােমারের (Homer) কাব্যে এই সভ্যতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বাণিজ্যের সন্ধানে মাইসিনিয়ান নৌবাহিনী ঈজিয়ান সাগরে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও কখনও দখল ও বলপ্রয়োগ করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে তারা উপনিবেশ স্থাপনকারী বা যোদ্ধাদেরকে সাথে নিয়ে যেত। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের মধ্যেই তাআ পুরোপুরি ক্রিটের দখল নিয়ে নেয়। ক্রিটের পূর্বে তারা ভূমধ্যসাগরের উত্তরপূর্বে সাইপ্রাস দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এমনকি তারা ঈজিয়ানের উত্তর-পূর্বে কৃষ্ণসাগরেও প্রবেশ করে। মিকোনায়েন বা মাইসিনীয়দের সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। ক্রিট নগরবাসীদের দ্বারা বিজিত সভ্যতাই কি মিকোনায়েনদের ছিল? তারা কি গ্রিক ভাষায় কথা বলতো, কিংবা তারা কি আরো প্রথম দিকের স্বদেশজাত ছিল? এসব প্রশ্নের কোনো নিশ্চিন্ত উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রমাণ আছে যার দ্বারা এমন কথা বলা সম্ভব যে, তারা বিজয়ী জাতি ছিল এবং গ্রিক ভাষায় কথা বলতো, এবং উত্তর থেকে আগত সােনালি রংয়ের চুলের অভিজাত সম্প্রদায়ই গ্রিক ভাষা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। (The Minoan-Mycenaean Religion and Its Survival in Greek Religion, p. II ff by Martin P. Nilsson.) গ্রিসে গ্রিকদের আগমন ঘটে তিনটি আনুক্রমিক ধারায় : প্রথমে আগমন ঘটে আয়োনীয়দের (Ionians), এরপর আখেয়ানদের (Achaeans), এবং সর্বশেষ আগমন ঘটে ডােরিয়ানদের (Dorians)। আয়োনীয়রা বিজয়ী হলেও অত্যন্ত ভালোভাবে ক্রিটের সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিল বলে মনে হয়, যেমন বলা যায় পরবর্তীকালে রোমানরা গ্রিসের সভ্যতা গ্রহণ করে নিয়েছিল। কিন্তু আয়োনীয়দের উত্তরাধিকারী আখেয়ানরা তাদের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করে, এবং তাদের প্রায় অধিকারচ্যুত করে। বোগহাজ কিউই (Boghaz-Keui) থেকে প্রাপ্ত হিট্টিটি (Hittite) ফলক থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব চৌদ্দ শতকে আখেয়ানদের একটি সুবিশাল সুসংগঠিত সাম্রাজ্য ছিল। আইওনিয় এবং আখেয়ানদের যুদ্ধের ফলে মিকোনায়েন সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং সর্বশেষ গ্রিক আগ্রাসী ডােরিয়ানদের দ্বারা এই সভ্যতা বলতে গেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অথচ পূর্ববর্তী আগ্রাসীরা মিনোয়ান ধর্মকে অনেকাংশে গ্রহণ করেছিল আর ডােরিয়ানরা তাদের পূর্বপুরুষদের আদি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ধর্মই পালন করছিল। অবশ্য মিকোনায়েনদের ধর্ম বিশেষ করে নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকে ছিল, এবং চিরায়ত গ্রিসের ধর্ম এই দুই ধর্মের সমন্বয় ছিল। প্রকৃতপক্ষে চিরায়ত দেবীদের মধ্যে অনেকেরই উৎসস্থল ছিল মিকোনায়েন।

মাইসিনিয়ানদের কৃষ্ণসাগর যাত্রা ও সম্পর্কিত পুরাণ : উত্তরকালীন গ্রীকরা এই মাইসিনিয়ান যুগকে দেখে বীরত্বের যুগ হিসেবে যেখানে অসাধারণ সব মানুষেরা (সম্ভবত ঈশ্বরপুত্রেরা) তাদের সাহসী ভূমিকা প্রদর্শন করেছিল। গ্রীকদের প্রথম কৃষ্ণসাগরে অনুপ্রবেশের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে জেসনের গল্প হিসেবে, যে তার জাহাজ আর্গোতে করে উত্তর-পূর্বদিকে পঞ্চাশ আরগন্টাস পাড়ি দিয়েছিল। বিপুল বাধাবিঘ্নতা পেরিয়ে এই জাহাজটি কৃষ্ণসাগরের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছেছিল ‘গোল্ডেন ফ্লিস’ বা সোনালি ভেড়ার লোমসম্ভার ফিরিয়ে আনতে। ‘গোল্ডেন ফ্লিস’ গল্পের বইয়ের সংস্ক্রণে স্থান করে তিন্তে পেরেছিল, যার পেছনে আরগন্টসরা লেগেছিল ও সম্পদটি তাদের হস্তগত হয় সফল বাণিজ্যিক অভিযাত্রার মাধ্যমে। কৃষ্ণসাগরে যাবার জন্য মাইসিনিয়ান জাহাজগুলোকে অতিক্রম করতে হয়েছিল সংকীর্ণ প্রণালিগুলোকে। প্রথমে সেখানে ছিল হেলেসপন্ট, যা আধুনিক কালে দারদানেলিস নামে পরিচিত। নিজ অবশানে এটি এক মাইলেরও কম প্রশস্ত। হেলেসপন্ট পড়েছিল প্রপন্টিসে, যেটি ছিল ছোট একটি জলাধার। এর নামের অর্থ হল সাগরের আগেম কারণ এর মধ্যে দিয়ে ভরমন করলে যে কেউই উভয় দিক দিয়ে সাগরে অনুপ্রবেশ করতে পারত। প্রপন্টিস সরু হয়ে বসফরাস নামে দ্বিতীয় এক প্রণালিতে পরিণথয় যা এর অবস্থানে মাত্র এক মেইল প্রশস্ত। শুধু বসফরাস পার হয়েই কেউ কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ করতে পারে।

ট্রয়ের সাথে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কিত পুরাণ : যারাই হেলেসপন্ট আর বসফরাসের সরু জলরাশি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল তারাই কৃষ্ণসাগরের সমৃদ্ধ বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্র করার অবস্থানে চলে যেতে পেরেছিল। তারা পারাপার আর মালামাল পরিবহনের জন্য ফি ধার্য করতে সক্ষম হয়েছিল।  মাইসিনিয়ানদের আমলে এলাকাটি ছিল ট্রয়ের শাসনাধীনে, যা হেলেসপন্টের দক্ষিন-পশ্চিম প্রান্তের এশিয়ান উপকূলে অবস্থিত ছিল। কৃষ্ণসাগরে বাণিজ্য করার মাধ্যমে ট্রোজানরা সম্পদশালী আর শক্তিশালী হতে পেরেছিল, এবং এই ব্যাপারে মাইসিনিয়ান গ্রিকরা ছিল খুবই উদ্বিগ্ন।  এরই ধারাবাহিকতায়, তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রণালিগুলোর দখল নিতে চায় ও খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে (খ্রিস্টপুর্ব ১১৮৪ সাল ছিল একটি ঐতিহাসিক তারিখ যা পরবর্তী গ্রিকরা হিসাব করে বের করেছিল) একদল গ্রিক সেনা ট্রয় অবরোধ করে সেটা ধ্বংস করে দিল। ঐতিহ্য অনুসারে গ্রিক সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল আগামেমনন, যিনি ছিলেন মাইসিনিয়ার রাজা ও পেলপসের নাতি, যার নামে পেলোপনেসাসের নামকরণ করা হয়েছিল।

হোমার ও তার রচিত পুরাণ : অবরোধের অংশটুকু গল্প একজন কবি বর্ণনা করেছিলেন, যার ঐতিহাসিক নাম হোমার, বাস করতেন এবং সাহিত্য রচনা করতেন খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ অব্দে। ইলিয়াড নামে লম্বা মহাকাব্যটি স্বাগতিকদের নেতা আগামেমনন ও তার নেতৃত্বাধীন সেরা যোদ্ধা আকিলিস এর বিবাদের গল্প বর্ণনা করে। দ্বিতীয় কাব্যটি হল ওডিসিয়াস, যা হোমারেরই রচিত বলে ধারণা করা হয়। সেখানে ওডিসিয়াস নামে গ্রিক বীরের অভিযাত্রার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, যেটায় যুদ্ধ শেষে তার দশ বছরের যাত্রার সময় ঘটে। হোমারের কবিতাবলির মাহাত্ম এটাই যে সেগুলো আজও বেঁচে আছে ও হোমারের পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের কাছে পঠিত ও আদৃত হয়েছে। সেগুলো শুধু গ্রিক সাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি নয়, সেরা সৃষ্টিও বটে। হোমারের গল্পগুলো অধিভৌতিক ঘটনায় পরিপূর্ন ছিল। সেখানে দেবতারা নিয়মিত যুদ্ধের অগ্রগতি এমনকি যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতেন। এক শতাব্দী আগ পর্যন্ত আধুনিক পণ্ডিতেরা পুরো ব্যাপারটিকে উপকথা বলেই মনে করতেন। তারা নিশ্চিত ছিলেন যে, ট্রয় নামে কোন শহর ছিল না, এই অবরোধ বলতেও কিছু ছিলনা। এগুলো সবই গল্পগাঁথা ও উপকথা।

খননের সাহায্যে ট্রয় ও ট্রোজান যুদ্ধের ঐতিহাসিকতার প্রমাণ : ১৮২২ সালে জন্ম নেয়া হাইনরিখ স্লিম্যান নামে এক তরুণ হোমারের কবিতাগুলো পড়ে মুগ্ধ হন, আর তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, দেবতাদের ব্যাপারগুলো ছাড়া এই ব্যাপারে প্রকৃত ইতিহাস রয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ খনন করা (যেখানে একসময় ট্রয়ের রাজত্ব ছিল) ও হোমারের বর্ণিত নগরটি খুঁজে বের করা।  তিনি বাণিজ্য শুরু করলেন ও অনুসন্ধার কার্য পরিচালনা করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা করার জন্য প্রচুর পরিশ্রমও করেছিলেন। আর সাথে সাথে তিনি প্রত্নতত্ত্ব বা আর্কিওলজি অধ্যয়ন করেন যাতে এই ব্যাপারে তার প্রয়োজনীয় দখল থাকে। সবকিছু তার পরিকল্পনামাফিক হয়। তিনি ধনী হন, প্রত্নতত্ত্ব আর গ্রিক ভাষা শেখেন, আর ১৮৭০ সালে তিনি তুরস্কে পাড়ি জমালেন। দেশটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল স্লিম্যানের লক্ষ্য, যেখানে তার নিরীক্ষা তাকে নিশ্চিত করায় যে নিকটবর্তী মাটির ঢিবির আড়ালেই প্রাচীন শহরতির পড়পড় ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে। তিনি খনন শুরু করেন, এবং এর মাধ্যমে কেবল একটি শহরের ধ্বংসাবশেশই নয়, বরং একতির উপর আরেকটি শহরকে আবিষ্কার করলেন। ইলিয়াডে বর্ণত শহরের সাথে তিনি একতি শহরের সামঞ্জস্য মিলিয়ে নিলেন এবং আজ কেউই আর সন্দেহ করেনা যে ট্রয়ের অস্তিত্ব আসলেই বিদ্যমান ছিল । ১৮৭৬ সালে তিনি মাইসিনিয়ার একতি অংশে একইরকম খনঙ্কার্য শুরু করলেন আর মোটা দেয়াল ঘেরা একতি শক্তিশালী নগরের সন্ধান পেলেন। তার কাজের ফলশ্রুতিতেই ট্রোজান যুদ্ধ তার আগের প্রয়োজনীয় আধুনিক তথ্যাবলি আলোর মুখ দেখল।

আর্গিভস আর আকিয়ান : হোমার তার কবিতায় গ্রিকদের বর্ণনা করতে গিয়ে দুটো শব্দ ব্যবহার করেছিলেন – আর্গিভস আর আকিয়ানস। এই নামগুলো গোত্রীয় নাম ছিল। আগামেমননের শাসন মাইসিনিয়া, টাইরিনজ আর আর্গোস শহরে কেন্দ্রীভূত ছিল। হোমারের সময়ে এই তিনের ভেতর আর্গোসরা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল, যার কারণে তার পক্ষে আগামেমননকে আর্গিভস মনে করাই স্বাভাবিক ছিল। যদিও আগামেমনন মূল গ্রিকদের শাসন করতেন, অন্যান্য অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা থাকায় তিনি একক রাজা হিসেবে গ্রিকদের সবাইকে শাসন করেননি। কিন্তু বিশেষ করে পেলোপনেসাসের অন্য রাজারা প্রথম স্থানে আগামেমননকে রাখার ব্যাপারে স্বিমত ছিলেন। স্পার্টা নগরের শাসক ছিলেন আগামেমননের ভাই মেনেলাউস। অধিকন্তু, আগামেমনন পেলোপনেসাসের ভেতরের নগরগুলোর জন্য জাহাজ সরবরাহ করেছিলেন, যাদের সাগরের সাথে যোগাযোগ ছিলনা, এমনকি নিজেদের কোনও জাহাজও। সুতরাং আর্গিভস শব্দটি দিয়ে হয়তো পেলোপনেসাসের সব মানুষকে বোঝানো হত। আর, আকিয়ানরা কেমন ছিল? কোরিন্থ উপসাগরের প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে ঈজিয়ান উপকূলের একটা অংশ আছে যা একটি সমতলভূমির সবচেয়ে দক্ষিণের অংশ সৃষ্টি করেছিল, সেখানে একসময় আকিয়ান নামের একদল লোকের বসবাস ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী জেসন ছিলেন একজন আকিয়ান, যেমন ছিলেন আকিলিসও। আকিয়ানরা আগামেমননের অধীনে ছিলনা, ছিলনা পেলোপনেসাসের আর্গিভরাও। আকিলিস আগামেমননের সাথে বিবাদে জড়িয়েছিলেন এবং নিজেকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার অধিকারের পর্যাপ্ত সম্মান জানানো হয়নি। তিই এমন ভাব দেখালেন যেন তিনি কারও অধীনে নন, বরং ছিলেন স্বাধীন সত্তা। আকিয়ানরা আর্গিভদের থেকে অনেক উত্তরে বাস করার কারণে ক্রিটের সভ্যতার ছোঁয়া কমই পেয়েছিল, এবং একটু বেশি বন্য ছিল। আকিলিস অত্যন্ত রাগী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যার মিত্রদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে কোন দ্বিধা ছিলনা। যখন আবার তার শত্রুরা তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলত, তখন তিনি অত্যন্ত হিংস্ররূপে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। আকিয়ানদের একটি গোত্র নিজেদের হেলেনরূপে পরিচয় দিত এবং তারা হেল্লাস অঞ্চলে বসবাস করত। যদিও তাদের কথা সাধারণভাবে ইলিয়াডের একটি পংক্তিতে উল্লেখ আছে, এটা ছিল আকিয়ানদের প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণতার একটি নিদর্শন যে, এই নামগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা গ্রিসের সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করেছিল। ইতিহাসে দেখা যায়, মাইসিনিয়ান সময়কাল থেকে গ্রিকরা তাদের ভূখণ্ডকে হেল্লাস এবং নিজেদেরকে হেলেন বলত। এমনকি বর্তমানেও, আধুনিক গ্রিসের অফিশিয়াল নামও হেল্লাস। গ্রিস ও গ্রিক শব্দদ্বয় রোমান থেকে নেয়া হয়েছে। মাইসিনিয়ান যুগের কিছু সময় পর হেলেনদের একটি দল ইতালিতে পাড়ি জমাল। (ইতালির সবচেয়ে দক্ষিণ প্রান্তের অংশটি উত্তর-পশ্চিম গ্রিস থেকে তিরিশ মাইল দীর্ঘ একটি সরু সাগর দ্বারা পৃথক ছিল)। ইতালীতে পাড়ি জমানো গোত্রটি নিজেদের ‘গ্রেকই’ নামে পরিচয় দিত। রোমানদের ল্যাটিন ভাষায় এটি হত “গ্রেসেই”। গ্রাইকোর গোত্রে অন্তর্ভূক্ত হোক বা না হোক, রোমানরা এই নাম সব হেলেনের জন্য প্রয়োগ করতে লাগল। এইভাবে এটা ইংরেজিতে ‘গ্রিক’-এ পরিণত হল। গ্রিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী পণ্ডিতেরা পুরনো শব্দও ব্যবহার করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, ট্রোজান যুদ্ধ ও তার কিছু পরের গ্রিকের প্রাথমিক দিককার সময়কালকে বলা হয় ‘হেলাডিক যুগ’। সুতরাং মাইসিনিয়ান যুগকে পরবর্তী হেলাডিক যুগ বলা যায়।

লৌহ যুগ

গ্রিক ভাষা

প্রথম দিককার গ্রিকেরা বিভিন্ন গোত্রের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারছিল যে, গ্রিক ভাষাভাষী সব গোত্রের মধ্যেই একটা সম্পর্ক বিদ্যমান। দলবদ্ধ মানুষদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যখন তারা সবাই একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলে। এটা তাদেরকে একটা সাধারণ সাহিত্যধারা আর স্বীয় এতিহ্যকে বোঝার ক্ষমতা উপহার দেয়। এক কথায়, তারা একই রকম একটি সংস্কৃতি ভাগ করে নেয় আর স্বাভাবিক আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করে। তাইতো, গ্রিকদের সকল মানুষকে দুইভাগে ভাগ করার প্রবণতা বিদ্যমান ছিল: তারা এবং বিদেশিরা, যারা গ্রিক ভাষায় কথা বলে না। গ্রিকদের কাছে মনে হত বিদেশিরা অর্থহীন বাক্যাংশে কথা বলে, যেটা শুনে তাদের কাছে “বার-বার-বার-বার”-এর মতো মনে হত। তাই, গ্রিকরা সব অ-প্রিককে “বারবারোই” নামে অভিহিত করতো যার মানে হলো “ঝগড়াটে ভঙ্গিতে কথা বলা মানুষ”। আমাদের কাছে শব্দটির সংস্করণ হলো “বারবারিয়ান’। প্রথমেই এই শব্দটা দ্বারা ‘অসভ্য’ বোঝাতো না; শুধু “অ-গ্রিক” বোঝাতো। কখনোই অসভ্য ছিল না। পরবরতী শতাব্দিগুলোতে গ্রিক সভ্যতা অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছাল এবং দার্শনিক আর সাহিত্যিকদের মহান চিন্তাগুলো গ্রিক ভাষায় প্রকাশিত হতে লাগল। গ্রিকরা পুরাতন পদ্ধতির বদলে, বিশাল সব জটিল শব্দসম্ভার আর নতুন শব্দ তৈরি করার উদার মাধ্যম তৈরি করতে পেরেছিল। প্রকৃতপক্ষে, আমরা এখনো একটি সাধারণ প্রবাদ ব্যবহার করি. “এটার জন্য গ্রিকদের একটা শব্দ আছে,” যার মানে হলো, তোমার কাছে নতুন যে চিন্তাই থাকুক না কেন, সেটাকে প্রকাশ করার জন্য গ্রিক ভাষায় তুমি একটি শব্দ বা বাক্যাংশ খুঁজে পাবেই। গ্রিক ভাষার সাথে তুলনা করলে অন্য ভাষাগুলো  ধারণভাবে নীরিহ আর নিরস বলেই মনে হয়। গ্রিক সভ্যতার সাথে তুলনা করলে অন্য লোকদের পশ্চাদপদ বলে মনে হয়। যুগপৎভাবে, শতাব্দিজুড়ে, একজন বারবারিয়ানকে (যে গ্রিক ভাষায় কথা বলে না) সবদিক দিয়ে বিবেচনা করে অসভ্য বলে মনে করা হত। অসভ্য জাতিরা নিষ্ঠুর আর বর্বর হত বলে তাদের অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে ‘বারবারিক’ বা “বারবারিয়াস”। নিজেদের মধ্যে একটা সাধারণ ভাষা চিহিতকরণের পাশাপাশি তারা বুঝতে পারল এই ভাষার কিছু উপভাষা আছে। সব গ্রিকরাই একইরকমভাবে গ্রিক ভাষায় কথা বলত না। মাইসিনিয়ান যুগে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রিক উপভাষা ছিল: আয়োনীয় ও এওলিয়ান। সম্ভবত, আগামেমননের সময়ে আর্গিভরা আয়োনীয় ভাষায় আর একিয়ানরা একপ্রকার এওলিয়ান ভাষায় কথা বলত। মাইসিনিয়ান যুগে, সেখানে একদল গ্রিকের অস্তিত্ব ছিল, যারা তৃতীয় উপভাষায় কথা বলত – দ্য ডোরিয়ান। যখন আয়োনীয় আগামেমনন, আর এওলিয়ান আকিলিস ট্রয়কে ধ্বংস করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ডোরিয়ানরা উত্তর-পশ্চিম থেকে অনেক দূরে বাস করত। অগ্রবর্তী দক্ষিণের প্রভাব থেকে অনেক দূরে থাকায় তারা ছিল পশ্চাদপদ আর অসভ্য।

সাগরের মানুষেরা ও ডোরিয়ান আক্রমণ

মাইসিনিয়ান যুগের স্বর্ণশিখরেও এর পথে ছিল সমূহ বাধা; সভ্যতার পিলারের আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা লোকেরা এটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। ইতিহাসে যুগে যুগে এসব হয়ে এসেছে। মধ্য এশিয়ার কোনো এক জায়গায় পশুর সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। টানা কয়েক বছরের খরা এটাকে অনুসরণ করে, যেখানে বেড়ে যাওয়া জনসংখ্যা অনাহারে ভুগতে শুরু করে। তখন তাদের সামনে গবাদি পশুর খাদ্য আর নিজেদের অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনের জন্য বহিরাগমন ছাড়া পথ খোলা থাকে না। যে গোত্রগুলো বহিঃশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাদের বাইরে পালিয়ে যেতে হয়: এবং সেটি তখন নতুন একদল লোককে পটভূমিকায় নিয়ে আসে । এইভাবে, বিরাট অঞ্চল অভিবাসী মানুষজনে পূর্ণ হয়ে যায়। মাইসিনিয়ান যুগে এটাই ঘটেছিল। ডোরিয়ান, যারা গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলে ছিল, তারা এই ধরনের চাপ প্রথম অনুভব করেছিল। তারা দক্ষিণে গিয়ে সেখানে বসবাসকারী এওলিয়ান ভাষাভাষী গোত্রদের আরও দক্ষিণে সরিয়ে দিয়েছিল। একটি এওলিয়ান গোত্র থেসালিয়ান নামে পরিচিত ছিল। ট্রোজান যুদ্ধের অল্প কিছুকাল পরেই তারা দক্ষিণ দিকে ঝাঁকে ঝাকে চলে এসেছিল যেখানে একিয়ানরা বাস করত এবং যার একটি অংশ থিওটিসরা গঠন করেছিল। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে আস্তানা গেড়েছিল, যার কারণে তখন থেকে অঞ্চলটিকে থেসালী নামে ডাকা হয়। প্রায় খিস্টপূর্ব ১১২০ সালে, বিওটিয়ান নামে আরেকটি এওলিয়ান গোত্র আরও দক্ষিণ অভিমুখে অগ্রসর হয়ে থিব্‌স নগরীতে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদে সমভূমির দিকে যেতে লাগল। এই অঞ্চলের নাম হয়ে গেল বিওটিয়া। সঙ্গী এওলিয়ানদের থেকে প্রাপ্ত এই চাপের কারণে একিয়ানরা দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বাধ্য হলো। তারা পেলোপনেসাস আক্রমণ করে সেখান থেকে আয়োনীয় লোকদের বিতাড়িত করে তাদের এথেন্সের কাছাকাছি যেতে বাধ্য করল, যেটির অবস্থান একটি উপদ্বীপে, যা মধ্য গ্রিসের বাইরে গিয়ে দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে (আসলে এটি মনে হয় ট্রোজান যুদ্ধের আগে ঘটেছিল এবং আগামেমননের সেনাদল মনে হয় স্বয়ং গ্রিসের উদ্থান-পতনের চাপে এশিয়ায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছিল) কোরিন্থ উপসাগরের সীমানা ছুঁয়ে পেলোপনেসাসের দক্ষিণ উপকূলে একটি অঞ্চল আছে, যেটি এই আক্রমণের ফলাফলে একিয়া নামে পরিচিত হতে লাগল। উত্তর থেকে প্রাপ্ত বিরতিহীন চাপের কারণে আয়োনীয় আর একিয়ান উভয়েই সাগরের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হলো। তারা পূর্বে আর দক্ষিণের দ্বীপগুলোতে এবং এশিয়া আর আফ্রিকা ঘিরে থাকা উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল, সেখানের আবাস-গড়া জীবনকে ধ্বংস আর বিপর্যস্ত করে। তাদেররকে “সাগরের লোক” বলে আখ্যায়িত করল। মিশর তাদের আগমণের ধাক্কা সামলে উঠেছিল, কিন্তু এই বহিঃআক্রমণ একটি বিরাট মিশরীয় সভ্যতার পতন ত্বরান্বিত করল, যা এরই মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পড়েছিল (হোমারের ইলিয়াডে আকিলিস অত্যন্ত সম্মানের সাথে এই সাম্রাজ্যের রাজধানীকে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম শহর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন)। এশিয়া মাইনরে অভিবাসী একিয়ানদের আগমন ছিল আরও ধ্বংসাত্মক। সেখানে, ইতিমধ্যে যথেষ্ট ক্ষয়প্রাপ্ত বিশাল হিট্টাইট সাম্রাজ্য বহিরাক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গ্রিসে একিয়ানদের পর তখনো বন্য ডোরিয়ানদের আগমণে পরিস্থিতি মন্দ থেকে মন্দতর রূপ ধারণ করল। তারা কোরিন্থ উপসাগরের পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে মধ্য গ্রিসের এক অঞ্চলে কয়েক বছরের জন্য থামল। ডোরিস শহর ছিল তাদের প্রতিষ্ঠিত।

আপনি ভাবতে পারেন, সুসংগঠিত মাইসিনিয়ান সেনাদল, যাদেরকে হোমারের যুদ্ধবাজদের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু, ব্যাপারটা সেরকম কিছু ছিল না। উাল্লেখ করার মত ব্যাপার হল ডোরিয়ানদের কাছে নতুন ধরণের যুদ্ধাত্র ছিল। মাইসিনিয়ান যুগে, অস্ত্রপাতি কপার আর টিনের মিশ্রণে তৈরি হত, যাকে আমরা বলি ব্রোঞ্জ। ইলিয়াডের বীরেরা ব্রোঞ্জের তৈরি ঢালের বিরুদ্ধে ব্রোঞ্জ-নির্মিত বর্শা শানাতেন, ব্রোঞ্জের তৈরি তরবারি চমকাতেন, যার বর্ণনা হোমার অত্যন্ত সার্থকতার সাথে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে ব্রোঞ্জ ছিল গ্রিকদের কাছে সহজলভ্য সবচাইতে কঠিন ধাতু এবং যে সময়ে এটির ব্যবহার হত, সেই সময়কাল ব্রোঞ্জ যুগ বলে পরিচিত। লোহা সেইসময় মানুষজনের কাছে পরিচিত ছিল এবং তারা বুঝতে পারল ব্রোঞ্জের চেয়েও শক্ত ধাতু হিসেবে এর ব্যবহার সম্ভব। কিন্তু, খনি থেকে লোহা আহরণের কোনো পদ্ধতি তখনো আবিষ্কৃত হয়নি, এবং শুধু যে লোহা তখন পাওয়া যেত, তা ছিল মিটিওরাইট থেকে মাঝে-মধ্যে খুজে পাওয়া ধাতব লৌহ। তাই মাইসিনিয়ানদের কাছে এটা ছিল একটা অতি মুল্যবান ধাতু। যাই হোক, মাইসিনিয়ান যুগে, গ্রিসের ৭৫০ মাইল পূর্বের হিট্টাইট শাসনাধীন লোকেরা লোহার আকরিক গলানোর এবং অস্ত্র বানানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে লোহা আহরণের উপায় বের করে ফেলল। এই জ্ঞান তাদেরকে এক নতুন যুদ্ধান্ত্র উপহার দিল। লোহার তলোয়ার সরাসরি ব্রোঞ্জের ঢাল ছিদ্র করতে পারত। ব্রোঞ্জের ফলার বর্শা আর তলোয়ার লোহার বর্মে লেগে জট-পাকিয়ে, ভোতা ও নিষ্ক্রীয় হয়ে যেত। এই জাতীয় অস্ত্র যদিও-বা অল্প সংখ্যায় পাওয়া যেত, তখন সেটা হিট্রাইটদের তাদের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল। ১১০০ সালে লোহার অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ডোরিয়ান যুদ্ধবাজ দল ব্রোঞ্জ-অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের পরাজিত করে তাদেরকে কোরিন্থের উপসাগর পেরিয়ে আরও দক্ষিণে ক্ষুদ্রপ্রান্তে সরিয়ে দিল এবং তারা একসময় খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে পেলোপনেসাসও আক্রমণ করেছিল। ডোরিয়ানরা পেলোপনেসাসের দক্ষিণ আর পূর্বদিকে নিজেদেরকে স্থায়ী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। স্পার্টা, এবং তার পাশাপাশি আগেমেমননের পুরাতন রাজ্যও তাদের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। মাইসিনিয়া আর টাইরিনজ পুড়িয়ে দেওয়া হলো এবং সেটা অখ্যাত গ্রাম ছাড়া আর কিছুতেই পরিণত হয়নি। এভাবেই মাইসিনিয়ান যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এই সভ্যতার অবসান এমন এক সময় হয় ব্রোঞ্জযুগের স্থলে লৌহযুগ প্রাধান্যলাভ করে এবং স্বল্প কিছু সময়ের জন্য এই শ্রেষ্ঠত্বও সমভাবে ফিনিশীয়দের (Phoenicians) হাতে চলে যায়। মাইসিনীয় যুগের শেষ পর্যায়ে এবং এর অবসানের পর কিছু কিছু বিজেতা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে কৃষিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে। অপরদিকে কিছু অংশ প্রথমে দ্বীপসমূহে ও এশিয়া মাইনরে এবং পরবর্তীকালে সিসিলি এবং দক্ষিণ ইতালির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এসব স্থানে তারা নগর প্রতিষ্ঠা করে সমুদ্র উপকূলীয় ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। এসব উপকূলবর্তী নগরীতে গ্রিকরাই প্রথম সভ্যতার ক্ষেত্রে গুণগত দিক থেকে নতুন অবদান রাখে। এথেন্সের শ্রেষ্ঠত্ব পরবর্তীকালের এবং এই শ্রেষ্ঠত্বও সমভাবে নৌশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

দ্বীপগুলো আর এশিয়া মাইনোর

গ্রিসের মূল ভূখণ্ড ছিল পর্বতময় এবং অনেকাংশে অনুর্বর। অবশ্য তখন অনেক উর্বর উপত্যকা ছিল যেখান থেকে সহজেই সমুদ্রে যাতায়াত করা যেতো। কিন্তু এক এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকার সহজ স্থলপথের যাতায়াত ব্যবস্থা পাহাড়ের কারণে বিচ্ছিন্ন ছিল। এসব উপত্যকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, তারা কৃষিভিত্তিক ও নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা শুরু করে আর এই নগরগুলো ছিল সাধারণত সমুদ্রের নিকটবর্তী। ঠিক এরূপ অবস্থায় যখনই কোনো সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা তার অভ্যন্তরীণ সম্পদের তুলনায় অত্যন্ত বেশি হয়ে পড়তো, যারা ভূসম্পদের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে না পারতো তারাই সমুদ্রবক্ষে কাজ সংগ্রহের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তো, এবং এটাই ছিল স্বাভাবিক। মূল ভূখণ্ডের শহরগুলো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে এবং এসব উপনিবেশ প্রায়ই এমন জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হতো যেখানে জীবিকানির্বাহ মূল ভূখণ্ডের তুলনায় অধিকতর সহজ ছিল। এভাবে ইতিহাসের প্রাচীনতম যুগে এশিয়া মাইনর, সিসিলি এবং ইতালি ও গ্রিসবাসীরা মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের তুলনায় অধিকতর ধনী ছিল। আয়োনীয়রা শুধু গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের একটি অংশই ধরে রাখতে পেরেছিল। এটা হলো অ্যাটিকা নামের ব্রিভুজাকৃতির উপদ্বীপ, যার উপর এথেন্স দাড়িয়ে আছে। এওলিয়ানরা পেলোপনেসাসের অংশটুকুই শুধু ধরে রাখেনি, তার সাথে ছিল কোরিন্থ উপসাগরের দক্ষিণে গ্রিসের বেশিরভাগ জায়গা।

সময়টি সবার জন্যই কমবেশি কঠিন ছিল। বন্য ডোরিয়ানরা সমৃদ্ধ সব শহর ধ্বংস করেছিল, উচ্ছেদ করেছিল স্থায়ী বসতিগুলোকেও। মাইসিনিয়ান যুগে গ্রিক সভ্যতা যে জায়গায় পৌছেছিল, সেখান থেকে পিছনের দিকে যাত্রা শুরু করল এবং লৌহ-যুগের অন্ধকার টানা তিন শতাব্দী ধরে ভূখণ্ডের উপর স্থায়ী হলো। নতুন অস্ত্রের পেছনে ছিল লোহার অবদান আর লোহাই ছিল ভুখন্ডে দুঃখ আর দারিদ্রের কারণ। বিপুল সংখ্যক আয়োনীয় আর এওলিয়ান বিপদ সন্থুল মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে গেল আর ঈজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে পাড়ি জমাল। ইতোমধ্যে যদি নাও হয়ে থাকে, এই দ্বীপের বেশিরভাগই ভাষার দিক থেকে আয়োনিয়ান হয়ে গেল। এদের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী ছিল ইউবিয়া। এটা মুলভূমির অত্যন্ত নিকটবর্তী ছিল, এবং একস্থানে এক মাইলের চেয়ে কম একটি প্রণালি বিয়োটিয়া আর ইউবিয়াকে পৃথক করেছে। এই স্থানেই, ‘কালসিস’ শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ব্রোঞ্জের গ্রিক প্রতিশব্দ, এবং “কালসিস’ সম্ভবত বোঞ্জের কর্মযজ্ঞের একটি কেন্দ্র ছিল। অন্য গুরুত্বপূর্ণ ইউবিয়ান শহরটি ছিল কালসিসের পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত ইরিত্রিয়া।

খিস্টপূর্ব ১০০০ সালের মধ্যে, আয়োনীয়রা স্থানীয় জনসংখ্যাকে হটিয়ে দিয়ে বা শেষ করে ধীরে ধীরে ঈজিয়ানের পূর্ব তীরে পৌছাল এবং উপকূলে বসতি স্থাপন শুরু করল। গ্রিকরা আনাতোলিয়ার পূর্বে এই জায়গাকে তাদের ভাষায় উদিত সূর্য বলে ডাকত, কেন না প্রকৃতপক্ষেই, গ্রিস থেকে কেউ আসলে সূর্যোদয়ের স্থানেই তারা এটাকে দেখতে পেত। এটা আরেকটা নামও পেয়েছিল, যেটা সম্ভবত আরও প্রাচীন কোনো প্রাচ্যের শব্দ থেকে উদ্ভত। কিছু মানুষ মনে করত যে শব্দগুলো ঈজিয়ান সাগরের পশ্চিমের আর পূর্বের কোনো ভূখণ্ডকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হত, তা ছিল এরেব (পশ্চিম) আর আসু (পূর্ব)। এই শব্দগুলো ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে পূর্বপ্রান্তের উপকূলের সেমেটিক ভাষা থেকে আগত। এই সেমেটিক অধিবাসীরা ক্রিটের সাথে বাণিজ্য করত যা ঈজিয়ানের দক্ষিণে অবস্থিত। ক্রিটানদের কাছে মহাদেশীয় উপকূল ছিল পূর্ব আর পশ্চিম এবং সেমেটিক শব্দসমূহ এশিয়ান আর ইউরোপিয়ানে পরিণত হত (গ্রিকে একটি উপকথা প্রচলিত আছে যে, ক্রিটে আসা প্রথম মানুষ ছিল ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে পুবের তীর থেকে আসা এক রাজকুমারী। তার নাম ছিল ইউরোপা এবং মিনোস ছিল তার ছেলে)।

প্রথমে, শুধু ঈজিয়ানের পূর্বদিকের ভূখণ্ডের বেলায়ই “এশিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। গ্রিকরা যতই পূর্বদিকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল এলাকা সম্মন্ধে জানতে থাকল, ততই শব্দটি ছড়িয়ে পরল। আজকে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাদেশকে এই নাম দেয়া হয়েছে। ঈজিয়ানের পূর্বের উপদ্বীপ বিশাল মহাদেশটি থেকে যে অংশ দ্বারা পৃথক হয়েছে, যার কিছু অংশ দ্বারা সেটি গঠিতও বটে, তা এশিয়া মাইনর নামে অভিহিত. যে নামটি আজকের দিনে খুবই পরিচিত এক নাম। ইউরোপ” শব্দটি পুরো মহাদেশকে বোঝাতে ছড়িয়ে পড়েছিল, যার একটি অংশ গ্রিস দিয়ে গঠিত। পরবর্তীকালে এটা আবিষ্কৃত হয়েছে যে, যদিও এশিয়া আর ইউরোপ ঈজিয়ান সাগর আর কৃষ্ণসাগর দ্বারা পৃথক, আরও উত্তরে সেটা আর পৃথক না থেকে একটি অবিচ্ছিন্ন বিশাল ভূখণ্ড গঠন করেছে, যেটিকে কখনো কখনো ইউরেশিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়োনীয়, যারা কিওস আর সেমোস দ্বীপের পূর্বে এশিয়া মাইনরের উপকূলে অবতরণ করেছিল, তারা বারোটি গুরুত্বপূর্ণ শহর প্রতিষ্ঠিত করেছিল, এবং উপকূলের এই অংশটি আইওনিয়া নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আয়োনীয় নগরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মেলিটাস। এটির অবস্থান ছিল মিন্ডার নদীর মুখে এক উপসাগরের আড়াআড়ি, যে জলধারাটি তার সঞ্চরণশীল বাযুপ্রবাহের কারণে এত বিখ্যাত ছিল যে, সদা দিক পরিবর্তনশীল অনিয়মিত গতি বোঝাতে মিন্ডার’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকল।

নগররাষ্ট্র

ডোরিয়ানদের আক্রমণ মাইসিনিয়ান সাম্রাজ্যের কাঠামো ভেঙে দিয়েছিল। মাইসিনিয়ান যুগে গ্রিস রাজা-শাসিত ছিল, যাদের প্রত্যেকেই প্রমাণ আকারের এলাকা শাসন করত, বিচারক আর উচ্চপদধারী পাদ্রি দুই ভূমিকাতেই। ডোরিয়ান আগ্রাসনের পরবর্তী বিশৃঙ্খলার সময়ে, যেভাবেই হোক, পুরাতন মাইসিনিয়ান সাম্রাজ্যসমূহ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গ্রিসের অসম ভূখণ্ডের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র উপত্যকার মানুষেরা নিজেদের রক্ষার জন্য এক্যবদ্ধ হয়েছিল। যখন তারা হামলার শিকার হত, তখন তারা স্থানীয় দেয়ালের নিকটবর্তী জায়গায় দলবদ্ধ হত. এবং হয়ত তারা, যদি সুযোগ মিলত, সেই শহর থেকে সামনে এগিয়ে কোনো নিকটবর্তী উপত্যকায় চলে যেত। ধীরে ধীরে. গ্রিকদের ভিতর ‘পোলিস’-এর ধারণা গড়ে উঠল, যেটি ছিল চারিপাশে ক্ষুদ্র কৃষিজমি সহযোগে একটি প্রধান শহর নিয়ে গড়ে ওঠা স্বায়ত্তশাসিত সম্প্রদায়। আমাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, এটি একটি স্বাধীন নগর ছাড়া তার চেয়ে বড় কিছুই নয়, যে কারণে আমরা এটিকে নগর রাষ্ট্র বলি (রাষ্ট্র বলতে বহিঃনিয়ন্ত্রণমুক্ত কোনো অঞ্চলকে বোঝায়)। আজকের বিরাট সব জাতির ভিতর বসবাসকারী আধুনিক মানুষদের জন্য গ্রিক পোলিসের ক্ষুদ্র আকার সম্মন্ধে ধারণা পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। মাঝারি আকারের নগর-রাষ্ট্র ছিল সম্ভবত আয়তনে পঞ্চাশ মাইলের মতো। প্রতিটি নগর রাষ্ট্রের লোকেরাই নিজেদের আলাদা জাতি হিসেবে দেখত, আর অন্য নগর রাষ্ট্রের লোকেদেরকে বিদেশী ভাবত। প্রতিটিরই ছিল আলাদা সরকার, আলাদা উৎসব আর আলাদা এতিহ্য।নগরগুলো, এমনকি, পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধও পরিচালনা করত। এই অবস্থার গ্রিসকে দেখা মানেই মিনিয়েচার আকারে পুরো বিশ্বকে দেখা।

এটা নিশ্চিত যে, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নগর রাষ্ট্রগুলো একসাথে যুক্ত হয়ে বড় রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা করত। বিয়োটিয়ার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়াটা থিব্‌সের জন্য প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু, থিব্‌সের বিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমের বিয়োটিয়ান নগর অরকোমিনাস মাইসিনিয়ান যুগে শক্তিশালী ছিল এবং সেটা তারা ভুলেও যায়নি। সুতরাং, তারা বিয়োটিয়ার প্রভুত্ব অর্জন নিয়ে থিব্‌সের সাথে স্থায়ী শত্রুতা লাগিয়ে রাখল। থিব্‌সের নয় মাইল দক্ষিণে বিয়োটিয়ান শহর প্লাটিয়াও থিব্‌সের প্রতি সবসময় শক্রভাবাপন্ন ছিল। থিব্‌স বিয়োটিয়ায় তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পেরেছিল, এইসব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দে তাদের শক্তি বিভাজিত হয়ে পড়ছিল এবং থিব্‌স আক্রমণের হুমকিদাতা যে কোনো সেনাদল এইসব প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত শহরগুলোর সাহায্যের ওপর নির্ভর করত। ফলাফলম্বরূপ, থিব্‌স পুরো গ্রিসে কখনোই সত্যিকার অর্থে তাদের শক্তি বোঝাতে পারেনি, শুধু একটি সংক্ষিপ্ত সময়কাল ছাড়া। অন্য এলাকাগুলোতেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। প্রতিটি নগর-রাষ্ট্রের শক্তি, ব্যাপক আকারে, পাশ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল এবং প্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শুধু যে দুইটি নগররাষ্ট্র মোটামুটি আকারের অঞ্চল শাসন করতে পেরেছিল, তারা ছিল স্পার্টা আর এথেন্স, এবং তারা ছিল গ্রিক দুনিয়ার “পরাশক্তি’। যদিও এমনকি তারা ছিল খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির । এথেন্সের এলাকা ছিল ইউনিয়নের হলো রোড আইল্যান্ড আর দেলওয়ার, যাদের এলাকা যোগ করলে যা হয়, স্পার্টার এলাকা ছিল তার সমান । এদের জনসংখ্যাও খুব একটা বেশি ছিল না। এথেন্সের সুবর্ণসময়ে এর জনসংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ৪৩,০০০ সমর্থ পুরুষ এবং সেটা ছিল গ্রিস নগরটির জন্য অসাধারণ একটা ব্যাপার অবশ্যই, এথেন্সে নারী, শিশু, বিদেশি আর দাসেরা ছিল, তারপরও তা ২,৫০,০০০-এর বেশি ছিল না।

এমনকি এটা পরবর্তী-যুগের গ্রিকদের কাছে অনেক বিশাল মনে হত. যারা কিভাবে একটি নগর-রাষ্ট্র ভালোভাবে চলতে পারে তার তত্ত্ব বের করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। এটা হিসাব করে বের করা হয়েছিল যে, এর জন্য ১০০০ নাগরিক হত আদর্শ, এবং বাস্তবে, বেশিরভাগ নগর-রাষ্ট্রেই ৫০০০ বা তার কম নাগরিক ছিল। বিশাল স্পার্টাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার জনসংখ্যার খুব অল্প অংশকেই নাগরিক হতে দেয়া হত। যাই হোক, এই নগর-রাষ্ট্রগুলো সরকার পদ্ধতি বের করে ফেলল যেটি তটাই উপযোগিতাপূর্ণ ছিল যে, গ্রিসকে ঘিরে থাকা বিশাল সব সাধারণ, কর্তৃত্বপরায়ণ প্রাচ্য সাম্রাজ্যের চেয়ে এই নগর-রাষ্ট্রগুলোর নিয়মকানুনই আধুনিক সময়ে গ্রহণ করার জন্য বেশি মানানসই ছিল। এমনকি আজকের দিনেও আমরা রাজনৈতিক কলাকৌশলকে ‘পলিটিকস’ বলি যা ‘পলিস’ শব্দ থেকে এসেছে, আর শাসনকার্ধে লিপ্ত থাকা কোনো লোককে বলি ‘পলিটিসিয়ান’| “পলিস’ শব্দটি, এমনকি গ্রিসের বাইরেও আধুনিক সময়ে নগর শব্দটির অনুসর্গ হিসেবে, মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর তিনটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো এনাপলিস, মেরিল্যান্ড, ইন্ডিয়ানাপোলিস, ইন্ডিয়ানা এবং মিনিয়াপোলিস, মিনেসোটা| এবং এটাকে একরকম স্বাধীনতা মনে করেছে, যদিও আসলে পোলিস শাসনে থাকত অল্প কিছু মানুষ, কেন না তাদের জনসংখ্যার অর্ধেকাংশই ছিল দাস। তাদের সময়কার একমাত্র মানুষ হিসেবে গ্রিকরা তাদের স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু লড়াই করত এবং যদিও তাদের মধ্যে প্রচলিত স্বাধীনতার অর্থ আমাদের কাছে তেমন ব্যাপক কিছু বলে মনে হয় না, এটা আসলে ধীরে ধীরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে; আর স্বাধীনতার আদর্শরূপ, যা আজকের আধুনিক দুনিয়ার কাছে অনেক কিছু, সেটি আসলে গ্রিক স্বাধীনতারই বিকশিত ও উন্নতরূপ। নিজেদের মতো করে চলা শতশত ভিন্ন নগর-রাষ্ট্র নিয়ে গ্রিক সংস্কৃতি একটি বর্ণিল আর বৈচিত্র্যে ভরা সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছিল। এথেন্স নগর এই সংস্কৃতিকে দারুণ এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যা কিছু দিক দিয়ে বাকি গ্রিসের সম্মিলিত অবদানের চেয়ে বেশি মূল্যবান ছিল। আর, এখন পর্যন্ত মনে হয় যে, এথেন্স সেরকম একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারত না যদি না তারা নিকতটবর্তী শতশত ভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা আলোড়িত না হত।

পোলিসের বিকাশের সাথে সাথে রাজার কার্যালয়ের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। একটি বড় আকারের সাম্রাজ্যে, বিলাসিতার সরবরাহ আর রাজকীয় অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট সম্পদ থাকে এবং কার্যকরী আদালত যেখানে গঠন করা সম্ভব। এসবই একজন রাজাকে অন্যদের থেকে, এমনকি সাধারণ ভূমির মালিকদের থেকে আলাদা করে দেয় (এবং ভূমির মালিকেরা সাধারণত প্রজাই ছিল ভূমিহীন লোকদের সাথে তুলনা করলে)। এইরূপ বিলাসিতা আর আনুষ্ঠানিকতা জনগণকে খুশি রাখে, যারা এসবকে জাতীয় শক্তির এবং সেই সাথে নিজেদের শক্তি সামর্থের প্রতিচ্ছবি মনে করে। একটা নগরে, খুব কম সম্পদ থাকত বলে রাজা তার প্রজাদের থেকে খুব বেশি ধনী হন না। তিনি নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না এবং তার প্রজাদের কাছ থেকে খুব বেশি সম্ভ্রম পাওয়ার প্রত্যাশাও করেন না। তাইতো, পলিসে রাজার প্রয়োজানীয়তা ফুরিয়েও যায়। কোনো বিশাল রাজ্যে একজন মানুষের প্রয়োজন হয়, যে পুরো জাতির পক্ষে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু, একটি পোলিস এতই ছোট যে, এখানে প্রত্যেকেই একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে, অথবা কমপক্ষে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ জানাতে পারে । তারা একজন শাসককে বেছে নিতে পারে যে তাদের সিদ্ধান্তসমূহ নে নেয়, আবার তাকে সরিয়েও দিতে পারে যদি সে তাদের সিদ্ধান্তের বিপরীতে যাওয়া শুরু করে। অথবা তারা, নীতি হিসেবে, একবারে নতুন কাউকে বেছে নিতে পারে, পুরাতন একজন শাসককে অতি ক্ষমতাবান হওয়া থেকে বিরত রাখতে। যেহেতু, শাসক রাজ্যের প্রথম ব্যক্তি, তাই শাসক শব্দের সাধারণ গ্রিক ছিল ‘আরখোস’, যার অর্থ হলো প্রথম’। একজন একক শাসক হতে পারতেন মনার্ক বা সম্রাট’ (একক শাসক)। ইতিহাসের বেশিরভাগ জায়গায় একক শাসকেরা সাধারণত ছিলেন রাজা, তাইতো “মনার্ক’ বা স্ম্বাট শব্দটি ছিল “রাজার” সমার্থক, যদিও একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টও একজন একক শাসক । সাম্রাজ্যকেও তাই বলা হয় “মনার্কি’ |

যদি মূল ক্ষমতা গুটিকয়েক প্রজা ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিমালিক পরিবারের প্রধানদের হাতে সীমাবদ্ধ থাকে, আমরা যা পাই তাকে বলে ওলিগার্কি’ (গোষ্ঠীশাসন)। যদিও, এইভাবে গ্রিস অল্প সংখ্যক বড় আকারের মনার্কির শ্রেণি হিসেবে ডোরিয়ান আগ্রাসনের যুগে ঢুকে পড়ে, বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র ওলিগার্কি হিসেবে এর উত্থান ঘটেছিল। এমনকি যে নগররাষ্ট্রগুলো রাজাদের ধরে রেখেছিল, তারা তাদের রাজাদের ক্ষমতা হুট করেই কমিয়ে দিয়েছিল এবং সেগুলো আসলে একটি গোষ্ঠীশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হত। বেশিরভাগ লোক, যারা গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নতুন শাসকের কথা ভাবত, যদিও এটা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন আর ইচ্ছার বিপরীতেও যেত। সেই কারণে, গোরষ্ঠীতান্ত্রিক শাসনকে আমাদের কাছে খারাপ মনে হয়। যাই হোক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসকেরা নিজেরা স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। তারা ভাবত, সামর্থ্যবান আর সেরা মানুষ বলেই তারা ক্ষমতায় আছে। তাই, নিজেদেরকে তারা “এরিস্টোক্র্যাট’ বা “অভিজাত’ ভাবত, আর তাদের পরিচালিত সরকারকে ভাবত “এরিস্টোক্র্যাসি” বা ‘অভিজাততন্ত্র।

হোমার ও হেসিয়ডের সাহিত্য ও গ্রিকদের ধর্মচিন্তা

গোষ্ঠীশাসনে এক শ্রেণির শ্রোতাদের জন্যই হোমার ইলিয়াড লিখেছিলেন। তবে সময়কালের অনেক পরে আবিষ্কৃত ইতিহাস ছাড়া, হোমার সম্পর্কে আর তেমন কিছুই জানা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ইতিহাসের উল্লেখমতে, সে অন্ধ ছিল। ভিন্ন ভিন্ন শহরকে তার জন্মস্থান হিসেবে দাবি করা হয়েছিল, কিন্তু ঈজিয়ান দ্বীপের কিওসের গ্রহণযোগ্যতা এই ক্ষেত্রে অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। তার জীবনকাল সম্মন্ধে মতবিরোধ আছে, যেখানে পাচশত বছরের মতো পার্থক্য দেখা দেয়, কিন্তু সেরা অনুমান হলো খিস্টপূর্ব ৮০০ সাল। (প্রকৃতপক্ষে হোমারের অস্তিত্বের ব্যাপারে সত্যিকার কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু এটাও সত্য যে, কেউ না কেউ তো ইলিয়াড আর ওডিসি লিখেছিলই।)

খিস্টপূর্ব ৮৫০ সালের সংস্কারগুলোই ইলিয়াডে প্রতিফলিত হয়েছে। বীরেরা সবাই ছিল ভালো মানুষ৷ সেখানে রাজাদের বর্ণনা ছিল, কিন্তু তারা হলেন সেই শ্রেণির রাজা যাদের উত্থান হয়েছিল ডোরিয়ান আগ্রাসনের সময়ে এবং তারা আসলে মাইসিনিয়ান রাজা ছিলেন না। মোটকথা হলো, তারা ছিলেন সাধারণ জীবনযাপন করা “জনগণের পিতা”, যারা নিজেরাই নিজেদের চাষবাস করতেন, কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রজাদের সাথে পরামর্শ করতেন, এবং তারা ছিলেন ‘বালকদের একজন’। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণকে সুনজরে দেখা হত না। ইলিয়াডে কেবল একটি দৃশ্যকল্প ছিল, যেখানে সাধারণ মানুষ বক্তব্য রেখেছে । তিনি ছিলেন থারসাইটিস এবং তিনি আগামেমননের নীতির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন। তিনি যা করেছিলেন তার যৌক্তিকতা আছে, কিন্তু হোমার তাকে স্থলিত এবং বিদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন এবং তাকে ভালোমানুষ ওডিসিউসের হাতে বেদমভাবে মার খেতে দিয়েছিলেন, যখন তার সৈন্যরা সেটা দেখে হেসে উঠেছিল। সন্দেহ নেই যে, গোষ্ঠীতান্ত্রিক শ্রোতামণ্ডলীও বিদ্রূপের হাসিই হেসেছিল।

পরবর্তী নমনীয় কাব্য ওডিসিতে ইউমিয়াস নামে এক দাস আর নিচু জাতের লোকের কাহিনী রয়েছে, যে কিন্তু ছিল কাব্যটির অন্যতম সুপুরুষ আর গ্রহণযোগ্য চরিত্র। আর পেনিলোপির পাণিপ্রার্থী, যাদেরকে ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়েছে, তারা সবাই ছিল ভদ্র সমাজের লোক। সাধারণ মানুষদের ভূমিকা এই যুগের আরেকটি সাহিত্য-চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল। তিনি ছিলেন হেসিওড, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ সালে বসবাস করতেন। তার পিতামাতা এশিয়া মাইনরের ইউলিয়া থেকে বিয়োটিয়াতে অভিবাসন করেছিলেন আর জন্মগতভাবে হেসিওড ছিলেন বিয়োটিয়ান। হেসিওড ছিলেন একজন কঠোর পরিশ্রমী কৃষক এবং তার প্রধান সাহিত্যকর্ম হলো “ওয়ার্কস ত্যান্ড ডেজ’। এই বইয়ে তিনি কৃষি খামারের সঠিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং এই বইয়ে কাজ আর শ্রমের মর্যাদাই ছিল মূল নীতিকথা। হেসিওডের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো “থিওগনি’। নামটির অর্থ ছিল দেবতাদের জন্ম’, এবং হেসিওডের চেষ্টা ছিল সেইসময়ে গ্রিকদের মাঝে ছড়িয়ে থাকা উপকথাগুলোকে সংগঠিত করা। হেসিওডের লেখা জিউস এবং অন্যান্য দেবতাদের গল্পগুলো (হোমারের কিছুটা সেমেটিক দেবতাদের গল্লের সাথে মিলে) পরবরর্তী গ্রিকদের কাছে আনুষ্ঠানিক ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

হেলেনিক সভ্যতার প্রথম অবিস্মরণীয় সৃষ্টি হােমার। হােমার সম্পর্কে আমাদের জানা। সব তথ্যই অনুমানমূলক। তবে তার সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ধারণা হলো যে, তিনি একক কোনো ব্যক্তি ছিলেন না, তার নামে বেশ কয়েকজন কবি ছিলেন। এই অভিমত পােষণকারীদের মতে, ইলিয়ড (Iliad) ও ওডিসি (Odyssey) পূর্ণাঙ্গ কাব্য রচনার ব্যবধান প্রায় দুইশত বছর। কারো কারো মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ অব্দ থেকে ৫৫০ অব্দ পর্যন্ত (Beloch, Griechische Geschichte, Chap. xii.), আবার কারো কারো মতে, অষ্টম শতকের শেষের দিকেই ‘হােমার’ কাব্য রচনা হয়েছিল। বর্তমান আকারে প্রাপ্ত হােমারের কবিতাগুলো পিসিস্ট্রাটুস (Peisistratus) এথেন্সে এনেছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ অব্দ থেকে ৫২৭ অব্দ পর্যন্ত এথেন্স শাসন করেন (মধ্যে বিরতিসহ)। তার সময় থেকেই এথেন্সের যুবকরা হােমার কণ্ঠস্থ করা শুরু করে এবং এটি ছিল তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু গ্রিসের কোনো কোন স্থানে, বিশেষ করে স্পার্টাতে হােমার কাব্যের এই গুরুত্ব না থাকলেও পরবর্তীকালে তা লাভ করে।

মধ্যযুগের শেষের দিকে প্রণয়মূলক রোমান্সধর্মী কবিতার মতো হােমারের কবিতায় সভ্য অভিজাত সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। তাঁর কবিতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বহু দিনের প্রচলিত থেকে যাওয়া বিভিন্ন কুসংস্কারকে প্রাকৃতজন বা নিম্নশ্রেণীর মানুষের কুসংস্কারই জনসাধারণের মধ্যে পুনরায় লক্ষ করা যায়। নৃতত্ত্বের নীতি নির্দেশিত পথ দ্বারা পরিচালিত অনেক আধুনিক লেখকই মনে করেন যে, হােমার আদৌ প্রাচীনপন্থী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সংস্কারবাদী। তিনি ছিলেন আঠার শতকের যুক্তিবাদীদের মতো যারা প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীসমূহকে যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করেছিলেন। তিনি তার কাব্যে উচ্চ শ্রেণীর মার্জিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শ তুলে ধরেছিলেন। হােমারের কাছে অলিম্পিয় দেবতারাই ধর্মের প্রতীক, কিন্তু তার সময়ে বা পরবর্তীকালে গ্রিকদের মধ্যে এসব দেবতাই একমাত্র উপাস্য ছিলেন না। লৌকিক ধর্মে অন্যান্য রহস্যময় এবং অধিকতর বর্বর উপাদান ছিল যেগুলোকে গ্রিক বুদ্ধিজীবীরা যতদূর সম্ভব প্রকাশিত হতে দেন নি। কিন্তু জমে থাকা এসব বিষয় কোনো এক দুর্বল বা আতঙ্কের মুহূর্তে প্রকাশ হয়ে পড়ে। অধঃপতনের যুগে লক্ষ করা গেছে যে, হােমারের বর্জনীয় বিশ্বাসসমূহ চিরায়ত যুগে অর্ধবিলুপ্ত অবস্থায় হলেও টিকে আছে। এসব ঘটনার বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা হতে পারে যা অন্যভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বিস্ময়কর হবে।

পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম ধর্ম ব্যক্তিক হওয়ার চেয়ে বরং গোষ্ঠীভিত্তিক ছিল। কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান সহানুভূতিপূর্ণ জাদু দ্বারা পালন করা হতো। এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্য ছিল গোষ্ঠীর স্বার্থ, বিশেষ করে ফলন, উদ্ভিদ, মানবেতর প্রাণী এবং মানুষের স্বার্থ বৃদ্ধি করা। সূর্যের তেজশক্তি যাতে আর কমে না যায় সেজন্য দক্ষিণায়নের (২২ ডিসেম্বরের কাছাকাছি) সূর্যকে নানা অনুসন্ধানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা হতো। বসন্তকাল আর ফসল কাটার সময়কে সুনির্দিষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে বরণ করা হতো। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায়ই সমষ্টি উত্তেজনার সৃষ্টি হতো, আর ব্যক্তি তার বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র গোষ্ঠীচেতনায় নিজেকে একাত্ম করে নিতো। ধর্মীয় বিবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট স্তরে সারা পৃথিবীতে পবিত্র মানবেতর প্রাণী এবং মানুষকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে হত্যা করা হতো এবং তাদের মাংস খাওয়া হতো। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের এই স্তরের আবির্ভাব বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়। নরমাংস ভােজনের চেয়ে নরবলি প্রথা দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক যুগের সূচনালগ্নেও গ্রিস দেশে সেই প্রথার বিলুপ্তি ঘটে নি। এ ধরনের ধর্মীয় নিষ্ঠুরতা ছাড়া উর্বরতামূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান সমগ্র গ্রিস দেশেই সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে এলিউসিনীয় (Eleusian)-এর মতো রহস্যমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের প্রতীকীত্বের দিক থেকে মূলত কৃষিভিত্তিক ছিল। (Rostovtseff, History of The Ancient World, vol, 1, p. 399.)

একথা স্বীকার করতে হবে যে, হােমারের ধর্মবিষয়ক চিন্তা খুব একটা ধর্মনিষ্ঠ ছিল না। তার দেবতারা পূর্ণ মানবিক গুণসম্পন্ন। বেতাদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হচ্ছে, দেবতারা অমর এবং অতি মানবিক ক্ষমতাসম্পন্ন। নৈতিক দিক থেকে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলার নেই, তারা কীভাবে মানুষের মনে ভয় ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত সম্মানবোধ জাগিয়ে তুলেছিল, তা বলা কঠিন। তার কিছু কিছু উদ্ধৃতিতে দেবতা সম্পর্কে ভলতেরীয় শ্রদ্ধাহীনতা প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করা হয়। অবশ্য এসব উদ্ধৃতি পরবর্তীকালের রচনা বলেই অনুমান করা হয়। হােমারের মধ্যে বিশুদ্ধ ধর্মীয় অনুভূতি যতটুকু না অলিম্পিয় দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত তার চেয়েও বেশি সম্পর্কিত ভাগ্য বা মানবজীবনের নিয়ন্তা প্রাকৃতিক নিয়ম বা নিয়তির মতো অস্পষ্ট বা রহস্যময় বিষয়ের সঙ্গে। তার মতে জিউসও (Jeus) এসবের অধীন। সমগ্র এক চিন্তায় ভাগ্য একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞান যেসব উৎস থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে বিশ্বাস অর্জন করেছে সম্ভবত ভাগ্য সেই উৎসের একটি।

হােমারের দেবতারা ছিলেন বিজয়ী অভিজাত দেবতা, তারা প্রকৃত ভূমিচাষীদের প্রয়োজনীয় উর্বরতার দেবতা ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে গিলবার্ট মূরে বলেন (Five Stages of Religion, p.67), ‘অধিকাংশ জাতির দেবতারাই দাবি করেন যে, তারা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু অলিম্পিয়ান দেবতারা এরূপ দাবি করেন নি। তারা শুধু বিশ্বজগৎ জয় করেছেন বলে দাবি করেছেন… এবং রাজ্য জয় করার পর তারা কী করেন? তারা কি সরকারি কার্যে অংশগ্রহণ করেন? তারা কি কৃষির উন্নতিসাধনে সহায়তা করেন? তারা কি ব্যবসা ও শিল্প কলকারখানা পরিচালনা করেন? তারা এগুলো কোনোটিই করেন না। কেন তারা সৎ কাজ করবেন? তাঁরা রাজস্ব আয়ের উপর জীবিকা নির্বাহকে সহজতর বলে মনে করেছেন এবং যারা রাজস্ব বা খাজনা প্রদান করে না তাদের নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছেন। তারা বিজয়ী দলপ্রধান, রাজকীয় বেপরোয়া দস্যু। তারা যুদ্ধ করেন, আনন্দ উৎসব করেন, খেলাধুলা করেন এবং সঙ্গীত রচনা করে উপভােগ করেন। তারা আকণ্ঠ মদপান করেন, এবং তাঁদের জন্য অপেক্ষমাণ খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী পঙ্গু ব্যক্তিদের প্রতি অট্টহাসি হাসেন। তাদের নিজস্ব রাজা ব্যতীত তারা আর কাউকে কখনো ভয় পান না। প্রেম এবং যুদ্ধক্ষেত্র ব্যতীত তারা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না।’

একইভাবে হােমারের মানব বীরগণের আচরণও খুব একটা ভালো ছিল না। তাদের নেতৃস্থানীয় পরিবার ছিল হাউজ অব পেলোপস (House of Pelops)। কিন্তু এই পরিবার একটি সুখী পারিবারিক জীবনাদর্শ স্থাপন করতে সফল হয় নি। এশীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা টানটালোস (Tantalos) দেবতাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ক্ষতি করে তার কর্মজীবন শুরু করেন। কেউ কেউ বলেন, মানুষের মাংস খাইয়ে তিনি তাদের প্রতারিত করার চেষ্টা করেন, শুধু তাই নয় ঐ মাংস ছিল তার নিজ পুত্ৰ পেলোপসের মাংস। পেলোপস অলৌকিক উপায়ে জীবন ফিরে পেলে প্রতিশােধ গ্রহণ করেন। তিনি পিসার (Pisa) রাজা ওআইনোমাওসের (Oinomaos) বিরুদ্ধে বিখ্যাত রথ প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভ করেন। এ বিজয়ে ওআইনোমাওসের সারথি মাইয়ারটিলোস (Myrtilos) তাঁকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। আর এভাবে দুষ্কর্মের সহযোগীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তাকে প্রতিশ্রুত পুরস্কারের পরিবর্তে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান করেন। এই কাজের ফলস্বরূপ অভিশাপ, তার পুত্র আট্রেউস (Atreus) এবং থিয়েসটেসের (Thyestes) উপর বর্ষিত হয়। গ্রিক ভাষায় এই অভিশাপকে এট (Ate) নামে অভিহিত করা হয় যার অর্থ বাস্তবে দুর্নিবার না হলেও অপরাধের প্রতি শক্তিশালী প্রণােদনা বা তাড়না। থিয়েস্টেস তার ভাইয়ের স্ত্রীকে কলুষিত করে পরিবারের ‘ভাগ্যের প্রতীক বিখ্যাত সােনালি লোমযুক্ত মেষটি চুরি করতে সমর্থ হন। এর প্রতিশােধস্বরূপ আট্রেউস দেশ থেকে তার ভাইয়ের নির্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। কিন্তু বিরোধ মিটিয়ে ফেলার অজুহাতে তিনি তাকে ফিরিয়ে আনে। এবং তার নিজ সন্তানদের মাংস দ্বারা তাকে ভােজ খাওয়ান। এই অভিশাপ উত্তরাধিকারস আট্রেউসের পুত্র আগামেমননের (Agamemnon) উপর বর্ষিত হয়। তিনি একটি পবিত্র পুরুষ হরিণ হত্যা করে আর্টিমিসকে অসন্তুষ্ট করেন, দেবীদের শান্ত করতে গিয়ে নিজ কন্যা ইফিজেনিয়াকে (Iphigenia) উৎসর্গ করেন এবং নৌবহর নিয়ে নিরাপদে ট্রয়ে (Troy) পৌছার রাস্তা পান। এভাবে পালাক্রমে তার অবিশ্বাসী স্ত্রী ক্লিটেইমনেস্ত্রা (KIytaimnestra) ও তার প্রেমিক আইগিসথােস (Aigisthos) তাকে হত্যা করে। এই আইগিসয়োস ছিলেন থিয়েসটিসের একমাত্র জীবিত পুত্র। পুনরায় আগামেমননের পুত্র অরেসটিস তার মা এবং আইগিসথােসকে হত্যা করে পিতার হত্যার প্রতিশােধ নেন। (Primitive Culture in Greece, H.J. Rose, 1925, p. 193)

হােমারের পূর্ণ কৃতিত্ব আইওনিয়ারই (Ionia) সৃষ্টি, অর্থাৎ আইওনিয়া ছিল হেলেনিক এশিয়া মাইনরের এবং এর নিকটবর্তী দ্বীপসমূহের অংশবিশেষ। সর্বশেষ ষষ্ঠ শতকের কোনো এক সময়ে হােমারের কবিতাসমূহ বর্তমান রূপ লাভ করে। এই শতাব্দীতেই গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শন এবং গণিতচর্চা শুরু হয়। একই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ ঘটে। যদি কনফুসিয়াস (Confusias), বুদ্ধ (Buddha) এবং জরাথুস্ত্রের (Zoroaster) নামে কোনো ব্যক্তি থেকে থাকেন, তাহলে তারা সম্ভবত এই শতাব্দীর। (অবশ্য জরাথুষ্ট্রের সময়কাল খুবই অনুমানভিত্তিক। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের সময়কালের। দেখুন, Cambridge Ancient History, vol. iv, p. 207.) এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সাইরাস (Cyrus) পারস্য সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই শতাব্দীর শেষের দিকে পারসিকরা আইওনিয়ার গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহে সীমিত স্বায়ত্তশাসন অনুমােদন করে। এ সময় এই নগররাষ্ট্রসমূহ একটি নিস্ফল বিদ্রোহ করে, এবং দারিউস (Darius) এই বিদ্রোহ দমন করে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নির্বাসিত করে। এই সময়ের বেশ কিছু দার্শনিক শরণার্থী ছিলেন। তারা হেলেনিক জগতের তখন পর্যন্ত স্বাধীন নগররাষ্ট্রসমূহে ঘুরে ঘুরে আইওনিয়ায় সীমাবদ্ধ সভ্যতার বিস্তার ঘটান। এই দীর্ঘ ভ্রাম্যমাণ জীবনে তারা সব স্থান থেকেই সদয় আচরণলাভ করেন। ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকে জেনোফ্যানিসের (Xenophanes) আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন এই শরণার্থীদের একজন। তিনি বলেন : “শীতকালে উনানের পাশে নরম গদিতে শুয়ে সুস্বাদু মদ এবং মটরদানা চিবুতে চিবুতে আমাদের এভাবে বলা উচিত : ‘আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন, জনাব আপনার বয়স কত? মিডির (Mede) আবির্ভাবের সময় আপনার বয়স কত ছিল?” সালামিস (Salamis) প্লটেয়া (Plataea) যুদ্ধে গ্রিসের অবশিষ্ট অংশ স্বাধীনতা রক্ষা করতে সফল হয়। এরপর আইওনিয়া কিছু সময়ের জন্য মুক্ত হয়। (স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয়ের ফলে পারসিকরা এশিয়া মাইনরের সমগ্র উপকূল পুনর্দখল করে। আন্টালসিসের শান্তিচুক্তিতে (Peace of Antalcidas) তাদের অধিকার স্বীকৃত হয় (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭-৬)। এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর এই এলাকাসমূহ আলেকজাণ্ডারের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।) অনেক ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে গ্রিক বিভক্ত ছিল। প্রতিটি রাষ্ট্র চারদিকে কৃষি জমি পরিবেষ্টিত একেকটি নগর নিয়ে গথিত ছিল। গ্রিক নগররাষ্ট্রের বিভিন্নংশে সভ্যতার স্তর বিভিন্ন ছিল, এবং খুব সামান্য সংখ্যক নগররাষ্ট্রই সমগ্র হেলেনিক কৃতিত্বে অবদান রেখেছিল। স্পার্টা সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়, সামরিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। করিন্থ (Corinth) ছিল ধনী সমৃদ্ধিশালী বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেন নি।

গ্রিকদের বাণিজ্য ও লিখনকৌশল

গ্রিকদের নিকট ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জলদস্যুতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হচ্ছে লিখন কৌশল আয়ত্ত লাভ করা। অবশ্য প্রথম দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জলদস্যুতার মধ্যে খুব সামান্যই পার্থক্য করা যেতো। মিশর এবং ব্যবিলনিয়াতে হাজার হাজার বছর ধরেই লিখন পদ্ধতি বিদ্যমান ছিল। মিনোয়ান ক্রিটদেরও নিজস্ব বর্ণমালা ছিল যা বর্তমানে এক ধরনের গ্রিক বর্ণমালা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, কিন্তু গ্রিকদের বর্ণমালা দ্বারা লিখন পদ্ধতি অর্জনের সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় নি। গ্রিকরা বর্ণমালা দ্বারা লিখন পদ্ধতি শিখেছিল ফিনিসিয়দের কাছ থেকে। সিরিয়ার অন্যান্য অধিবাসীর মতো ফিনিসিয়রাও মিশরিয় এবং ব্যবিলনিয়দের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। গ্রিক নগর আইওনিয়া, ইতালি এবং সিসিলির উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত ফিনিসিয়দের সামুদ্রিক বাণিজ্যে প্রাধান্য ছিল। চৌদ্দ শতকের ইখনাতনের (Ikhnaton) (মিশরের প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ মতাবলম্বী রাজা) লিখিত চিঠিপত্রেও সিরিয়রা ব্যবিলনিয়ার কীলকাকার বর্ণমালা ব্যবহার করে। (উদাহরণস্বরূপ হিব্রু বর্ণমালার তৃতীয় অক্ষর হচ্ছে ‘Gimel’ যার দ্বারা বোঝায় ‘Camel’ (উট) এবং এর জন্য প্রচলিত একটি উটের ছবির প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।)

কিন্তু টায়ারের হিরাম (Hiram of Tyre) ফিনিসিয়দের বর্ণমালা ব্যবহার করে যা সম্ভবত মিশরিয়দের বর্ণমালা থেকে বিকাশলাভ করে। মিশরীয়রা সর্ব প্রথমে বিশুদ্ধ চিত্রলিপি ব্যবহার করে। ধীরে ধীরে এই চিত্রলিপি বেশ ভালোভাবে প্রচলিত হয়ে ওঠে এবং লিখিত ভাষার অক্ষরের প্রতিরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয় (চিত্রিত বা অঙ্কিত বস্তুর নামের প্রথম অক্ষর)। এভাবে সর্বশেষে প্রতিটি চিত্র একেকটি অক্ষরে পরিণত হয়। প্রতিটি চিত্র একেকটি অক্ষরে পরিণত হওয়ার নিয়ম ছিল এরূপ : A একজন Archer ছিল (তীরন্দাজ) যে একটি ব্যাঙ তীরবিদ্ধ করেছিল। মিশরিয়গণ বর্ণমালার এই সর্বশেষ স্তরটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারে নি। ফিনিসিয়রাই এর পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদান করে, যার ফলে বর্ণমালা ব্যবহারের সকল সুবিধা আজ পাওয়া যাচ্ছে। ফিনিসিয়দের নিকট থেকে গ্রিকরা বর্ণমালা ধার করে তাদের ভাষাকে উপযোগী করার জন্য বর্ণমালার পরিবর্তন সাধন করে। এভাবে তারা লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহারের পরিবর্তে স্বরবর্ণ ব্যবহার উদ্ভাবন করে। বর্ণমালার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তাই লিখন পদ্ধতির এই সুবিধা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে গ্রিক সভ্যতার উথানকে ত্বরান্বিত করে।

ভাষা, পুরাণ ও ধর্মে ঐক্য: ডেলফি

নগরের উত্থান আর গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলা চিরকালীন যুদ্ধ-বিগ্রহও গ্রিক জনগণকে তাদের সাধারণ উৎস্যমূল সম্পর্কে বিস্মৃত করেনি। সেখানে এমন কিছু ব্যাপার ছিল যা সবচেয়ে খারাপ যুদ্ধবিগ্রহের পরেও তাদেরকে একসাথে ধরে রেখেছিল। তারা সবাই গ্রিক ভাষায় কথা বলত, তাইতো তারা সবসময় নিজেদেরকে ‘হেলেন’ হিসেবে ভাবত, যারা অগ্রীকভাষী বারবারিয়ানদের থেকে আলাদা। সেনাদল হিসেবে লড়াই করেছিল; এবং সেটা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য তাদের কাছে হোমারের চমৎকার কাব্যগুলোও ছিল।

তাদের পূজনীয় দেবতাদের মধ্যেও মিল ছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সবকিছুতে নগর থেকে নগরে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা সবাই জিউসকে প্রধান দেবতা হিসেবে মানত এবং অন্য দেবতাদেরও সম্মান দেখাত। সেখানে অবস্থিত ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো পুরো গ্রিক দুনিয়ার কাছেই সর্বজনীন সম্পত্তি বলে মনে হত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল বিউটেনিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত ফসিস অঞ্চলে। মাইসিনিয়ান যুগে পাইথো নামে এক শহর ছিল, যেটা কোরিন্থ উপসাগরের ষাট মাইল উত্তরে পারনাসুস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। সেখানে ধরণী-দেবীর উদ্দেশ্যে স্থাপিত একটি সুপরিচিত উপাসনালয়ের অবস্থান ছিল, আর এটা পিথিয়া নামের এক মহিলা-পাদ্রীর মাধ্যমে চালিত হত। তিনি দেবতাদের অভিরুচি আর প্রজ্ঞা সবার কাছে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতেন। তিনি ছিলেন একজন “ওরাকল’। পাইথোর ওরাকলের বর্ণনা ওডিসিতে রয়েছে।

ডোরিয়ান যুদ্ধবাজরা ফসিস ধ্বংস করে দিয়েছিল, আর যখন তারা পেলোপনেসাসের দিকে আসলো, পাইথোর নাম পরিবর্তিত হয়ে হলো ডেলফি এবং এটা নিজেকে একটা স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রে পরিণত করল। এটা এখন তারুণ্য, সৌন্দর্য, কবিতা আর সংগীতের দেবতা আপোলো এবং নয়জন দেবীর একটি দল- মিউজ, যারা উপকথা অনুসারে শিল্প ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করত, তাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত (মিউজিক বা সংগীত শব্দটিও মিউজ থেকে এসেছে)। শতাব্দীর পরিক্রমায়, ডেলফির ওরাকলের কদর বাড়তে থাকল । সকল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রসমুহ, এমনকি অগ্রীক সরকারগুলোও, ডেলফিতে প্রতিনিধি প্রেরণ করত অ্যাপোলোর পরামর্শ নেওয়ার জন্য। প্রতিনিধি দলগুলো বিপুল উপহারাদি নিয়ে আসত বলে মন্দিরটি সমৃদ্ধ হতে লাগল। পবিত্র অঞ্চল ছিল বলে লোকজন এখানে আক্রমণ বা ডাকাতি করতে সাহস পেত না, আর শহরগুলো এবং সেগুলোর লোকজনেরা মুল্যবান সম্পদের নিরাপত্তার জন্য সেগুলো সেখানে জমা রাখত।

ডেলফিকে হারিয়ে ফোসিয়ান নগরগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে এটা রাজস্বের বিস্ময়কর উৎস বলে বিবেচিত হওয়ায়, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওরাকলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ফোসিয়ানদের প্রচেষ্টার কারণে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে বেশ কছু “পবিত্র যুদ্ধ” সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত সবগুলোই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর কারণ ছিল ডেলফি তার নিজের আত্মরক্ষার জন্য সব নগর-রাষ্ট্রকে আহ্বান জানাত। এভাবে সেটি, প্রকৃতপক্ষে, আন্তর্জাতিক এলাকার আদালতে পরিণত হয়েছিল, যেটি এক ডজনের মতো পার্শ্ববর্তী দেশের নিয়মিত সুরক্ষায় ছিল।

খেলায় ঐক্য: অলিম্পিক ও অন্যান্য

অন্য যে কাজে গ্রিকরা সবাই জড়িত থাকত সেগুলো ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের উৎসবসমূহ। শরীরবিদ্যার আয়োজনের মাধ্যমে এই উৎসবগুলো মনে হয় জোরদার হতো। আর যেহেতু গ্রিকরা মনোজাত উপাদানগুলোকেও মুল্যায়ন করত, সংগীত আর সাহিত্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হত। এই   যোগিতাগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল অলিম্পিক গেমস, যা প্রতি চার ছর পর পর অনুষ্ঠিত হত। ঐতিহ্য অনুসারে গেমসটি পেলপসের পরিচালিত একটি দৌড় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুরু হত, যেটি একজন রাজকুমারীর মন জয় করার জন্য অনুষ্ঠিত হত। এটার ভিতর দিয়ে একটি মাইসিনিয়ান প্রতিযোগিতার শুরু হত, এবং সম্ভবত সেটা ছিলও বটে। যাই হোক, জয়ীদের আনুষ্ঠানিক তালিকাভুক্তিকরণ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ সাল থেকে এবং সেই সাল থেকেই অলিম্পিক গেমস শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই গেমস গ্রিকদের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তারা চার-বছর বিরতিকে ‘অলিম্পিয়াড’ হিসেবে গণনা করত, যার মধ্যে খিস্টপূর্ব ৭৭৬ সালও ছিল, যেটি ছিল প্রথম অলিম্পিয়াডের প্রথম বছর। সেই পদ্ধতিতে, উদাহরণম্বরুপ বলা যায়, খিস্টপূর্ব ৫৬৫ সাল হত আঠারোতম অলিম্পিয়াডের তৃতীয় বছর। পেলোপনেসাসের পশ্চিম-মধ্য অংশে অলিম্পিয়া শহরে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হত। যদিও বা, শহরটির নাম অনুসারে গেমসের নামকরণ হয়নি । শহর যার বসবাস মনে করা হত অলিম্পাস পর্বতে। এই পর্বতটি ছিল দুই মাইলের মতো উচ্চতাবিশিষ্ট যা গ্রিসের সর্বোচ্চ পর্বত। এর অবস্থান ছিল ঈজিয়ান সাগরের দশ মাইল দূরের থেসালীর দক্ষিণ প্রান্তসীমায়। উচ্চতার কারণে (এবং যেহেতু দক্ষিণে সরে যাওয়ার আগে প্রথমদিকের গ্রিক গোত্রগুলো এর নিকটে উপাসনা করত) পর্বতটিকে দেবতাদের সুনির্দিষ্ট আবাসভূমি মনে করা হত। এই সেই কারণ যার জন্য হোমার আর হেসিওডের গল্পকে পটভূমি হিসেবে নেয়া ধর্মকে ‘অলিম্পিয়ান ধর্ম’ বা ‘অলিম্পিয়ানিস্তা’ বলা হয়।

গেমস এবং গেমসের সাথে জড়িত ধর্মীয় আচারের কারণে অলিম্পিয়াও পবিত্র স্থান ছিল, যেখানে ডেলফির মতো ধনসম্পদ জমা রাখা যেত। যুদ্ধাবস্থায় থাকার পরেও নগর-রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা সেখানে দেখা করতে পারত, যে কারণে এটা একটা আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ আদালত হিসেবে কাজ করত। বাস্তবে, অলিম্পিক গেমস এবং এর কিছু সময় আগে আর পরে যুদ্ধগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যেত, যাতে করে গ্রিকরা শান্তিপূর্ণভাবে অলিম্পিয়ায় যাতায়াত করতে পারে। গেমসটি সব গ্রিকের জন্যই উন্মুক্ত ছিল, আর গ্রিকরা সব জায়গা থেকেই খেলা দেখতে এবং প্রতিদ্বন্বিতা করতে সেখানে আসত। প্রকৃতপক্ষে, একটি নগরকে এখানে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া মানেই বিষয়টা ছিল যে তাদেরকেও আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রিক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। অলিম্পিয়ান গেমস গুরুত্ব পাওয়া ও জনপ্রিয় হওয়া শুরু করলে এবং অলিম্পিয়া ধনসম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশি শহরদের মধ্যে গেমস আয়োজন আর পরিচালনা করার অধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। খিস্টপূর্ব ৭০০ সালের দিকে এই সম্মান অলিম্পিয়ার পঁচিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমের ইলিসের কাছে চলে আসলো । তারা পুরো অঞ্চল তাদের নামে নামকরণ করিয়েছিল, কিন্তু গ্রিসের পুরো ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিল শুধু অলিম্পিয়ান গেমসকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে। সংক্ষিপ্ত বিরতিসহ তারা এটা করেছিল যতদিন পর্যন্ত গেমস চলেছিল।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গেমসও সাধারণভাবে গ্রিকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু এগুলো সবই শুরু হয়েছিল প্রথম অলিম্পিয়াডের দুই শতাব্দী পরে। যেমন, পিথিয়ান গেমস, যা প্রতি অলিম্পিকের মধ্যবর্তী সময়ে চার বছর অন্তর অন্তর ডেলফিতে অনুষ্ঠিত হত; যোতাকে গেমস যা কোরিন্থের যোজকে অনুষ্ঠিত হত; এবং নেমিয়ান গেমস যা যোজকের দশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অনুষ্ঠিত হত। ইস্থমিয়ান আর নেমিয়ান গেমস, দুটোই দুই বছর অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত হত। গেমসের বিজয়ীরা অর্থ বা মূল্যবান কোনো পুরস্কার পেতেন না, কিন্তু অবশ্যই তারা ব্যাপক সম্মান আর খ্যাতি লাভ করতেন। এই সম্মানের প্রতীক ছিল মাথাকে ঘিরে রাখা পাতার বন্ধনী। অলিম্পিক গেমসের বিজয়ীরা গ্রহণ করত জলপাই পাতার বন্ধনী, আর পিথিয়ান গেমসের বিজয়ীরা গ্রহণ করত লরেলের বন্ধনী। লরেল অ্যাপোলোর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ছিল আর সেইরকম মস্তক-বন্ধনীগুলো মানবিক অভিযাত্রার উৎকর্ষতার দিকে থেকে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ পুরষ্কার ছিল। এমনকি আজও কেউ গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন করলে আমরা বলি যে, “তিনি লরেল জিতেছেন”। যদি, পরবর্তীকালে সে ডুবে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাও করে, আমরা বলি যে, “তিনি লরেলের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছেন।’

উপনিবেশ স্থাপনের যুগ

পূর্বাভিমুখে অগ্রযাত্রা

ঔপনিবেশিকতার সূচনা ও প্রতিযোগিতা : খ্রিস্টপূর্ব ১১শ শতকে ডোরিয়ান আগ্রাসনের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক অঞ্চলের মাইসিনীয় সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এর তিন শতক পরেই গ্রিকরা তার সুসময় পুনরুদ্ধার করল। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে এসে তারা বিপুলভাবে বহিরাক্রমণ শুরু করে, এবং মাইসিনিয়ানরা যে পর্যন্ত গিয়েছিল তারা তার থেকেও সভ্যতার উচ্চ নিক্তিতে আরোহণের জন্য প্রস্তুত হয়। ইতিহাসবিদেরা অলিম্পিয়াড শুরু হওয়ার বছরকে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৭৭৬ সালকে একটি গ্রহণযোগ্য সময়কাল হিসেবে ধরে নেয়া হয়, যখন গ্রিকগণ অন্ধকার যুগ পার করে এসে একটি নতুন আলোকিত যুগের সূচনা করে। একে গ্রিক ইতিহাসের হেলেনিক যুগের প্রারম্ভ হিসেবে ধরা হয়। এই হেলেনিক যুগ পরবর্তী সাড়ে চার শতক ধরে চলেছিল, আর এই হেলেনিক যুগটিই হলো গ্রিক সভ্যতার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অংশ। কিন্তু হেলেনিক যুগের এই প্রারম্ভিক সময়টা ছিল খুবই ঝামেলার। ইতিপূর্বে গ্রিসে প্রচুর জনসংখ্যা হয়ে গেছে, যাদের জন্য খাদ্যের জোগান দেয়া ভূখণ্ড যথেষ্ট ছিলনা। এই অবস্থায়, অতিরিক্ত ভূখণ্ডের দখল নিতে কোন নগররাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক সমাধান ছিল তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু কেবল স্পার্টার মতো ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো নগররাষ্ট্রই সেটা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। কোন নগররাষ্ট্র যে একটি সমরাভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গ্রিসের একটি বিপুল অঞ্চল দখল করে নেবে এই অবস্থা কোন নগররাষ্ট্রেরই ছিলনা। সেসময়ের এমন অনেক যুদ্ধ আছে যেগুলো পারস্পরিক শান্তিচুক্তি বা ছোট কিছু জয়লাভের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

ঔপনিবেশিকতা প্রকৃতি ও স্বার্থ : এই অবস্থায় প্রায় সব নগর-রাষ্ট্রের জন্য জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের সরবরাহের জন্য একটিই উপায় ছিল, আর তা হলো বিদেশী ভূমিতে নতুন নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অতিরিক্ত জনসমষ্টিকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া। এটা আসলেই একটি কার্যকরী সমাধান ছিল। কেননা নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার বারংবার যুদ্ধবিগ্রহ গ্রিকদেরকে বানিয়েছিল সমরপটু ও কুশলী। মিশর সহ অন্যান্য অঞ্চলের দুর্বলভাবে সংগঠিত জনগোষ্ঠীরা এই সমরপটু গ্রিকদের জয়যাত্রা ও উপনিবেশায়নকে প্রতিহত করতে পারেনি। তাছাড়াও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হিসেবে গ্রিকরা ইতিমধ্যেই ভূমধ্যসাগরের বেশিরভাগ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো আবিষ্কার করে ফেলেছিল ও স্থানীয়দের সাথে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এই উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে গ্রিক উপনিবেশকারীরা জাহাজ নির্মাণ, বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদনের কাজে লিপ্ত ছিল, এদিকে এরা কৃষিজ উৎপাদন ও খনির কাজগুলোকে সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছেড়ে দেয়। এই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর থেকে গ্রিকরা খাদ্যদ্রব্য, কাঠ, খনিজ ক্রয় করতো, আর বিনিময়ে তাদের কাছে প্রক্রিয়াজাত শিল্পদ্রব্যসমূহ বিক্রি করতো। এই ব্যবস্থাটির মাধ্যমে গ্রিক ঔপনিবেশিকগণ ও স্থানীয় অধিবাসীগণ উভয়ই লাভবান হতো, আর এই উপনিবেশসমূহ সাধারণত শান্তিতেই ছিল।

কালসিডিসি : হেলেনিক সময়ের সৃচনাকালেই, ঈজিয়ান সাগরের পূর্ব উপকূলসমূহে উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল, এবং সেখানটা সমৃদ্ধ শহরে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, উত্তর দিক তখনো উন্মুক্তই ছিল। বিশেষ করে, সেখানে ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পশ্চিম কোণে বেরিয়ে থাকা তিনদিকে বিস্তৃত এক উপদ্বীপ রয়েছে। এটি উপনিবেশ স্থাপনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী ছিল। এর অবস্থান ছিল ইউবিয়ার সবচেয়ে দক্ষিণের প্রান্ত থেকে মাত্র ৬৫ মাইল উত্তরে, আর খিস্টপূর্বাব্দ সাতের শতকে এ দ্বীপের কালসিস আর ইরিত্রিয়ার শহরগুলো উপদ্বীপটিকে পুরোপুরি উপনিবেশ বানিয়ে নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, কালসিস উপদ্বীপে কমপক্ষে ৩০টি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল; সংখ্যায় তা এত ব্যাপক ছিল যে পুরো উপদ্বীপই এটির সম্মানে ‘কালসিডিসি’ নামে অভিহিত হলো।

হেলিসপন্ট, প্রপন্টিস, বসফরাস : খিস্টপূর্ব ৬৮৫ সালে, গ্রিক বসতি স্থাপনকারীরা হেলেসপন্ট আর প্রপন্টিসে অভিযান চালিয়েছিল, আর বসফরাসের এশিয়ান অংশে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল। নিকটবর্তী কপারের খনির নাম অনুসারে তারা শহরটিকে ‘কালসাডন’ নামে ডাকত। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে, গ্রিকবাসী আরেকটি দল (ইতিহাস অনুসারে বেজাস নামে এক নেতার নেতৃত্বে) কালসাডনের ঠিক বিপরীতে, বসফরাসের ইউরোপিয়ান অংশে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল। নেতার নামানুসারে এর নাম ছিল বাইজেনসিয়াম। ট্রয় যেখানে ছিল, বাইজেনসিয়ামের অবস্থান ঠিক সেইখানেই ছিল। এই গ্রিকরাই এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী প্রণালিগুলো নিয়ন্ত্রণ করত, যার মধ্য দিয়ে বণিকরা যাতায়াত করত। নিজ যোগ্যতাবলেই এই বণিকরা সেখানে ধনী হতে পেরেছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে প্রায়ই এদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হত, কিন্তু তারা সবসময়ই ঘুরে দাঁড়াতো এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতো। অচিরেই সেই সময় এসে গিয়েছিল, যখন এশিয়া মাইনোরের নগরগুলোই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গ্রিক-ভাষা চর্চাকারী নগরে পরিণত হয়।

কৃষ্ণসাগর ও সাইপ্রাস : কিন্তু, এখন গ্রিকরা, প্রণালিগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করে, কৃষ্ণ সাগরের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা অত্যন্ত আগ্রহের সাথেই জেসন আর আরগোনটদের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছিল, যেখানে নেতৃত্ব দিয়েছিল মিলেটাস ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে, কৃষ্ণ সাগরের পুরো অঞ্চলই গ্রিক বসতিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারা ঈজিয়ান সাগরের থেকে উত্থিত হয়ে দক্ষিণ অভিমুখে বিশাল ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করল। মাইসিনিয়ান যুগের সময়কালে, সাইপ্রাস দ্বীপপুঞ্জে গ্রিক বসতি স্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু এখন অন্য বসতিগুলোও এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ উপকূলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আয়োনীয়রা, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালে, সাইপ্রাস দ্বীপের ঠিক উত্তরে তারসুস শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল।

সোলি ও তাদের ভাষা নিয়ে হাসিঠাট্টা : তারসুসের দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোলি শহর। এর ভাগ্যে অদ্ভুত কিছু লেখা ছিল। গ্রিকদের মধ্যে যারা বারবারিয়ানদের মধ্যে শহর গড়ে তুলেছিল, এবং দেশের জনগণের প্রধান অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাদের ভাষায় অনিবার্যভাবেই অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ছিল। যখন গ্রিসের বৃহত্তর আর সংস্কৃতিবান শহরগুলোর গ্রিকরা এই উপনিবেশ স্থাপনকারীদের দর্শন পেত, তখন তারা অদ্ভুত শব্দ, উচ্চারণ আর ব্যাকরণগত ব্যবহার শুনে আমোদিত হত। এইরকম কিছু কারণে, সোলির জন্য এতটাই বিখ্যাত ছিল যে, আজকের দিনে বাজে ব্যাকরণের উদাহরণকে ‘সোলেসিজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

পশ্চিমমুখে অথযাত্রা

আয়োনীয় দ্বিপপুঞ্জ ও ইতালিতে উপনিবেশ স্থাপন : পূর্বের মতো পশ্চিমেও গ্রিকরা উপনিবেশ স্থাপনে সাফল্যলাভ করেছিল। গ্রিসের পশ্চিমে অবস্থিত সাগরকে আয়োনীয় সাগর বলা হয়। আয়োনীয়-বলা গ্রিকদের সাথে যোগসূত্রের কারণে এটা হয়নি, বরং নিম্ফ আইও-এর সাথে যুক্ত উপকথার কারণে এটা হয়েছে। এ সাগরের যে দ্বীপটি গ্রিক মুলভূমির ঠিক বাইরে কোরিন্থ উপসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত, তাকে আয়োনীয় দ্বীপপুঞ্জ বলে। মাইসিনিয়ান যুগেও উপসাগরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি দূরত্বে পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জগুলোও ছিল গ্রিক। ক্ষুদ্র দ্বীপগুলোর একটি ছিল ইথাকা, ওডিসির বীর ওডিসিউসের কিংবদন্তি জন্মভূমি। ইথাকার সত্তর মাইল উত্তরে, আয়োনীয় দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ হলো করসিয়া। এটা কোনো গ্রিক দ্বীপ ছিল না, যতক্ষণ পর্যন্ত না, ইতিহাস অনুযায়ী, খিস্টপূর্ব ৭৩৪ সালে কোরিন্থ থেকে একদল বসতি স্থাপনকারী সেখানে পৌঁছল। আয়োনীয় সাগরকে ঘিরে রয়েছে বুট-আকৃতির ইতালি উপদ্বীপের দক্ষিণপরান্ত। উপদ্বীপের পাদদেশেই ত্রিভূজাকৃতির দ্বীপ অবস্থিত, যেটি দেখলে মনে হয় কেউ যেন পা দিয়ে একটি ফুটবলকে লাথি মারছে। এটা প্রকৃতপক্ষে, ভূমধ্যসাগরের সর্ববৃহৎ দ্বীপ। গ্রিক ভাষায় কখনও ট্রিনাক্রিয়া দ্বীপ নামে অভিহিত করা হয় যার মানে হলে তিনমিখী। যাই হোক, এখানে বাস করত কিছু গোত্র, যারা “সাইকানস” আর “সিসেলস” নামে পরিচয় দিত, আর এভাবেই তা থেকে “সিসিলি” শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। উপনিবেশীকতার যুগে গ্রিকরা ঝাকে ঝাকে সিসিলি আর দক্ষিণ ইতালিতে এসে জড়ো হত, আর সেইসব স্থানকে অন্য একটি গ্রিসে পরিণত করতে লাগল । বাস্তবে, সেই সময়ে কিছু শহর গ্রিসের শহরগুলোর থেকেও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে, ইতালির দক্ষিণ অংশকে কখনো কখনো ‘ম্যাগনা গ্রেসিয়া” বা “বৃহত্তর গ্রিস” নামে অভিহিত করা হয়। সিসিলিতে উপনিবেশকারীদের মধ্যে কোরিন্থিয়ানরাই মনে হয় সর্বপ্রথম ছিল। খিস্টপূর্ব ৭৩৫ সালে, কোরিন্থিয়ান উপনিবেশকারীরা সিসিলির পূর্ব উপকূলে সিরাকুজ শহরটি প্রতিষ্ঠা করতে লাগল।

সাইমি, সিবারিস ও ক্রোটন : ইতালিতে, প্রথম প্রতিষ্ঠিত গ্রিক শহর ছিল সাইমি, যেটি তার ল্যাটিন সংস্করণ কিউমি’তেই বেশি সুপরিচিত ছিল। এটা ছিল ইতালির পশ্চিম উপকূলের এক- তৃতীয়াংশ যা গ্রিকদের সবচাইতে উত্তরদিকের অনুপ্রবেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। ইতিহাস অনুসারে, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালেরও আগে, কিন্তু এটা একেবারেই অসম্ভব এবং সাইমির প্রাচীনত্বের দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করে। সম্ভবত, খিস্টপূর্ব ৭৬০ সালে কালসিসের সৈন্যরা এটা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইতালিয়ান বুটের ভেতরের ধাপে, খ্রিস্টপূর্ব ৭২১ সালে একিয়ার বসতি স্থাপনকারীরা সিবারিস শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই বিন্দুতে দক্ষিণ উপকূলে ইতালিয়ান বুটের ৩০০ মাইল গভীরের এলাকা ঘিরে সিবারিসের পরিধি বিস্তৃত মধ্যে সুবিখ্যাত ছিল। খুব সুপরিচিত গল্প আছে সিবারিসের এক ব্যক্তিকে নিয়ে যার গদিতে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিল, কিন্তু তিনি বোঝালেন যে গোলাপের কিছু পাপড়ি মলিন হয়ে যাওয়ায় তিনি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন। সেই কারণে আজকের দিনে ‘সিবারাইট’ শব্দটির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে আসক্ত মানুষকে বোঝানো হয়। আরেক দল এক, পূর্ব ৭১০ সালে ক্রোটন প্রতিষ্ঠা করে। এটার ছিল ইতালিয়ান বুটের উপরে, সিবারিসের উপকূল হতে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। যদিও উৎপত্তির দিক থেকে শহরদুটি ছিল সহোদরা, ক্রোটন আর সিবারিসের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবেই কিছু বৈসাদৃশ্য ছিল, যা প্রতিবেশী গ্রিক নগর-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যেত। সেই অল্পকিছু ব্যাপারের মধ্যে একটি ছিল সেখানে একটি নগর-রাষ্ট্র আরেকটির ওপর পুরোপুরি ধ্বংসাত্মকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বিজয়ী পক্ষ ছিল ক্রোটন, আর কাহিনী মতে, এর বিজয় ছিল সিবারাইটের আভিজাত্যের মূল্যে। সিবারাইটরা মনে হয় তাদের ঘোড়াগুলোকে গানের তালে তালে নাচতে শিখিয়েছিল, যাতে করে তাদের কুচকাওয়াজ আরও চমৎকার হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫১০ সালে, তারা ক্রোটেনিয়ানদের সাথে একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা সিবারিসের ঘোড়াদের ব্যাপারটা জেনে সংগীতকারদের বাদ্য সহকারে লড়াইয়ে অগ্রসর হয়েছিল৷ সিবারাইট ঘোড়াগুলো নাচতে শুরু করল আর সিবারাইট সৈন্যদল দ্বিধায় পড়ে গেল। ক্রোটেনিয়ানরা জয়লাভ করল, আর তারা পুরো সিবারাইট শহরকে এমনভাবে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল যে পরবর্তী শতকে শহরটির সত্যিকার অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল।

নেপলস, মার্সেই ও স্পার্টান প্রতিষ্ঠিত তরাস : ৭০৭ খ্রিস্টপুর্বাব্দে, ইতালিয়ান গোড়ালি’র ভেতরের দিকে, স্পার্টানরা তরাসের প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেটি পরবর্তীতে ইতালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল। এটি তার ল্যাটিন নামেই বেশি পরিচিত ছিল। স্পার্টানরা তাদের নিজভূমে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে, দেশের বাইরে তাদের প্রতিষ্ঠিত একমাত্র শহর ছিল এটিই। খিস্টপূর্ব ৬০৬ সালে, সাইমির বসতি স্থাপনকারীরা উপকূল ধরে কয়েক মাইল দক্ষিণে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করে সাধারণভাবেই সেটিকে নতুন শহর’ বলেই ডাকত। অবশ্যই, তারা গ্রিক ব্যবহার করত, যেটাতে এর নাম হলো ‘নিয়াপলিস’। ইংরেজিতে তা হয়ে যায় নেপলস, যদিও আজও আমরা নেপলসের কোনো অধিবাসীকে একজন নিয়াপলিটানই বলে থাকি। গ্রীক উপনিবেশকারীরা ইতালির থেকেও আরও পশ্চিমে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফোসিয়া ছিল এশিয়া মাইনরের আয়োনীয় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তর দিকের, আর ফোসিয়ান বসতি স্থাপনকারীরা সাইমির ৪০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলে বসতি স্থাপন করে মাসালিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে। এটাই আজকের আধুনিক দিনের মার্সেই নগরী।

মিশর

ঔপনিবেশিকতার পূর্বে মিশর সম্পর্কে গ্রিকদের ধারণা ও পটভূমি : শুধু ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলই গ্রিক উপনিবেশকারীদের কাছে উন্মুক্ত ছিল। অন্য উপকূলগুলো দখলে চলে গিয়েছিল, আধুনিক নতুনদের আগমনে সাবধানে পিছিয়ে আসা পশ্চাৎগামী গোত্রবাসীদের দ্বারা নয়, বরং গ্রিসের থেকেও পুরনো কোনো সভ্যতার মাধ্যমে। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণে, ভূমধ্যসাগরের ৩৫০ মাইলের মধ্যে রূপকথার মিশরীয় ভূমির অবস্থান, যা মাইসিনিয়ান যুগেও ছিল যথেষ্ট প্রাচীন। মাইসিনিয়ান যুগে, মিশর ছিল দারুণ সামরিক শক্তিতে ভরপুর, এবং নিকটর্তী এশিয়ার বিরাট অংশ নিয়ে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। গ্রিসদের কাছে এর ক্ষীণ স্মৃতিই জমা ছিল, আর পরবর্তী শতাব্দীতে তারা সিসোট্রিস নামে এক দিগ্বিজয়ী রাজার কথা বলত যিনি এক বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটা ছিল, অবশ্যই অতিরঞ্জিত একটা ব্যাপার। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের পরে, একিয়ান জলদস্যু দলগুলো মিশরীয় উপকূল তছনছ করে দিয়েছিল। এই বহিরাক্রমণও গ্রিক উপকথায় বর্ণিত আছে, কারণ স্পার্টার মেনেলাউসের ট্রয় থেকে দেশে ফেরার সময়ে মিশরে অবতরণের আর সেখানে সাত বছর অবস্থান করার কথা ছিল৷ এই আগ্রাসন ইতোমধ্যেই ক্ষয়প্রাপ্ত মিশরকে দুর্বল করে এমন এক বিন্দুতে নিয়ে ফেলল, যেখানে আর কোনো বৃহৎ সামরিক শক্তি গড়ে উঠতে পারেনি । এটা গ্রিসের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনলো, অর্থাৎ মিশরের মতো দেশ শক্তিশালী আর ক্ষমতাশালী হলে যা হত, অন্ধকার শতাব্দীতে ডোরিয়ান আগ্রাসনের পরবর্তী সময়কালে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো সেই রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া মুক্তভাবে চলতে পারছিল।

আসিরীয় আগ্রাসন ও গ্রিকদের প্রাথমিক উপনিবেশ : এদিকে, এশিয়ায়, মিশরের প্রায় হাজার মাইল পূর্বে, এক যুদ্ধবাজ নেতা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে পড়েছিল। ডোরিয়ানদের মতোই সে লোহার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তার চারপাশের লোকদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, আর খিস্টপূর্ব ৯০০ সালের দিকে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। তারা নিজেদেরকে তাদের প্রধান দেবতার নামানুসারে “আশুর” বলে ডাকত, কিন্তু তারা আমাদের কাছে নামটির গ্রিক সংস্করণ “আসিরিয়া” নামেই বেশি পরিচিত। এই ভীতিকর কিন্তু দূরবর্তী জাতির মৃদু ফিসফিসানিই শুধু গ্রিকদের কানে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, পরবর্তী সময়ে, তারা কল্পনা করত যে, প্রথম নামেই নামকরণ করা হয়েছিল। তারা এটাও ভাবত যে, তার সুন্দরী, অনৈতিক আর সামর্থ্যবান রাণী সেমিরামিস তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, যার আসিরিয়ান সাম্রাজ্য জয় করার কথা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, এসব কিংবদন্তী ছিল মূল্যহীন, কিন্তু এর সারকথা ছিল এই যে, আসিরিয়া একটা সময় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, আর সত্যই তা ছিল। খিস্টপূর্ব ৭৫০ সালের ভেতরে, গ্রিক বসতি স্থাপনকারীরা ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলে অনুসন্ধান চালাতে আর বসতি স্থাপন করতে শুরু করল বলে আসিরিয়া সাগরের পূর্ব উপকূলের দিকে সরে যেতে লাগল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালের মধ্যে, তারা সেখানে পৌঁছে গেল। মিশরীয়রা আসিরিয়ার এই অগ্রগমনকে ভয় পেত আর তাই আসিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের জন্য অর্থায়ন করত। কিন্তু যার সবগুলোই পরাজিত হয়ে গেল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৭১ সালে আসিরিয়া সমস্যার মূলে আঘাত করতে সিদ্ধান্ত নিল আর মিশর আক্রমণ করল। প্রতিরোধ হওয়ার কারণে মিশর আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। এই অবস্থায় গ্রিসও বিপদে পড়তে পারত কিন্তু তার ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। আসিরিয়া তাদের আগ্রাসন যতদূর পর্যন্ত পেরেছিল, ততদূর ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারা শত্রুদের প্রতি ভয়ানক নিষ্ঠুর ছিল, তাই তাদের শাসনকৃত সব মানুষের কাছে তারা ছিল এক ঘৃণিত নাম। সেখানে নিয়মিত বিদ্রোহ সংঘটিত হচ্ছিল; আজ এক জায়গায়. তো কাল আরেক জায়গায়। কয়েক বছরের মধ্যেই সব বিদ্রোহ অবদমিত হয়ে গেল, কিন্তু এসব আসিরিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল, আর গ্রিস ছিল নিরাপদ।

সাইটিক মিশরে গ্রিক উপনিবেশ ও গ্রিকদের দক্ষ সেনা হোপলাইট : মিশর নিজেই বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে বসেছিল (পরবর্তী শতকগুলিতে মিশরীয়রা তাদের শাসন করা জাতিসমূহের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে বিদ্রোহ করেছিল, যাদের মধ্যে মাঝে-মধ্যে গ্রিসও অন্তর্ভুক্ত থাকত)। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫২ সালে, মিশরীয়রা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, এবং স্বাধীনতার শেষ পর্বে প্রবেশ করেছিল। মিশরীয় রাজধানী, তখন তার ইতিহাসের এই সময়কালকে “সাইটিক মিশর” নামে অভিহিত করা হয়। সাইটিক মিশর গ্রিসের প্রতি ছিল বন্ধু-বৎসল, কারণ তারা গ্রিসকে পূর্ব দিক থেকে আগত নতুন বিপদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে দেখত। প্রাচ্যের বিশাল সাম্রাজ্যগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিয়ে গঠিত বিশাল সেনাবাহিনী ছিল, কিন্তু তারা ছিল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। সতর্কভাবে নেয়া কর্ম-পরিকল্পনার বদলে তারা সংখ্যাগত ওজনের ওপর নির্ভরশীল ছিল, আর তার সাথে ঘোড়ায় বা রথে চড়া সৈন্যদের ওপর নির্ভর করত। সহজেই বদলে নেওয়া যেত বলে পদাতিক সৈন্যদের আহত হওয়া তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাদের কাছে; সুতরাং, পদাতিক বাহিনী হালকা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকত। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত গ্রিকরা নিজেদের মধ্যে যেন চিরস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। নগর-রাষ্ট্রগুলোর ছিল ক্ষুদ্র সেনাদল, যেটি ছিল পুরোপুরি পদাতিক সৈন্য নিয়ে গড়া, আর এক্ষেত্রে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হত প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব যুদ্ধ-কৌশলের ওপর। প্রায় প্রতিটি গ্রিককেই ছোটবেলা থেকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হত, আর অল্প সংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন সৈন্যদের থেকে সেরাটা বের করে আনার জন্য প্রত্যককে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হত। পদাতিক সৈন্যরা বহন করত ভালোমানের বর্শা আর অন্যাংশে থাকত ধাতুর ব্যবহার, আর সবার কাছেই থাকত নিজেদের রক্ষা করার জন্য ভারী ঢাল। এইরকম ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের বলা হত “হোপলাইট” যা ছিল “অস্ত্র”-এর গ্রিক প্রতিশব্দ। হোপলাইটদের একটি দল সহজেই দুর্বলভাবে সংগঠিত, হালকা অস্ত্রধারী এশিয়ান দলগুলোকে হারিয়ে দিত, যার কারণে গ্রিকদের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে সবসময়ই চাহিদা ছিল; যে সৈন্যরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিদেশি সরকারকে সেবা দিত। গ্রিকদের প্রায়ই এই ধরনের কাজের জন্য পাওয়া যেত, যখন এক নগর-রাষ্ট্র দেশে কঠিন সময় পার করার চাইতে দেশের বাইরে চাকুরি খুঁজত। এর পাশাপাশি, দেশের বাইরে ভাড়াটে সৈন্যদল পাঠানো ছিল নিজেদের দেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে মোকাবিলা করার একটি উপায়। এভাবে পাঁচ শতাব্দী ধরে, গ্রিক ভাড়াটে সৈন্যদের ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের যুদ্ধগুলোতে একটা ভালো ভূমিকা রাখতে হয়েছিল। সাইটিক (Saitic) সময়কালে, মিশরীয়রা গ্রিক হোপলাইটদের সহযোগিতা পূর্ণরূপে খুঁজে পেয়েছিল। গ্রিক বাণিজ্যকেও তারা উৎসাহ প্রদান করত, এমনকি তারা নীলনদের মুখে গ্রিকদের একটি বাণিজ্য-ঘর প্রতিষ্ঠা করতেও দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ সালে, নোহক্রাটিস (Naucratis) শহরে গড়ে ওঠা মিলেটাসের বসতি স্থাপনকারীরা এই স্থাপনা নির্মাণ করেছিল, যে শহরের নামের মানে ছিল “সাগরের শাসক”। এর মাধ্যমে মিশরে গ্রিক অনুপ্রবেশ সূচিত হলো, যে অনুপ্রবেশ তিন শতক পরে চরম পরিণতিতে পৌঁছাল। যে জিনিসই গ্রিকরা দেখতে পেত, সেখানেই তারা নিজেদের নাম ব্যবহার করত, তাইতো পরবর্তী বছরগুলোতে গ্রিক ভাষাকেই বোঝা যেত, আসল মিশরীয় ভাষা নয়; এভাবেই গ্রিক নামগুলোই টিকেছিল৷ এটি মিশরীয় সভ্যতাকে কৌতুহল উদ্রেককারী চেহারা প্রদান করল।

মিশরে উপনিবেশ স্থাপন ও সাংস্কৃতিক গ্রহণ : মাইসিনীয় যুগে মিশরীয়দের কাছে কিছু কারণে মিশরীয় রাজধানী ছিল “নো”, কিন্তু গ্রিকদের কাছে কিছু কারণে তা ছিল “থিব্‌স”, যদিও বিয়োটিয়ান শহরের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তী শতকে এটি “ডিসপোলিস” অথবা “দেবতাদের শহর”-এ পরিণত হলো, এখানে অনেক মন্দির ছিল বলে। মিশরীয় থিব্‌স (Thebes) ছিল নীলনদের চারশ মাইল ভেতরে অবস্থিত। নদের মুখেই, যেখানে নদটি একটি বদ্বীপের দিকে গিয়েছে, মিশরীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল, যাকে গ্রিকরা “মেম্ফিস’-এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। নামটির অন্য আরেকটি রূপ থেকে গ্রিকরা ‘আইজিপ্টোস’ শব্দটি পেয়েছিল, যে নামটি তারা পুরো জাতির ক্ষেত্রেই ব্যবহার করত। নিকটবর্তী অন্য শহরটি, পরবর্তীকালে “হেলিওপলিস’ বা ‘সূর্যের শহর’-এ পরিণত হলো, সূর্য দেবতার মন্দির সেখানে অবস্থিত ছিল বলে। প্রথম দিককার সম্রাটদের নির্মাণ করা দানবাকৃতির সমাধিসৌধগুলোকে মিশরীয়রা ‘পি-মার’ বলত, কিন্তু গ্রিকরা সেগুলো বেশি পরিমাণে গ্রিকদের বোধগম্য ‘পিরামিড’-এ পরিবর্তন করে নিল। গ্রিকরা এই দানবীয় গঠনের প্রতি বিমুদ্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল, এবং পরবর্তীকালে এগুলোকে বিশ্বের প্রথম সপ্তমাশ্চর্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করল (এদেরকে সাধারণত বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্য বলা হয়)। পিরামিডের কাছেই সিংহের আকৃতির বিশাল ভাষ্কর্য ছিল, যার মুখ ছিল মানুষের। গ্রিকদের উপকথার দানবদের তালিকায় ছিল নারী মাথাযুক্ত সিংহ, যাকে তারা ‘স্ফিংস’ নামে ডাকত। এই নাম তারা মিশরীয় ভাষ্কর্যটিকেও দিয়েছিল, যেটিকে তখন থেকে “গ্রেট স্ফিংস” নামে ডাকা হয়। মিশরীয়রা লম্বা, সরু কাঠামোও নির্মাণ করেছিল, যেটাতে তাদের বিজয়ী সম্রাটদের প্রশংসাবাণী উৎকীর্ণ ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণটি স্থাপন করা হয়েছিল খিস্টপূর্ব ১৪৫০ সালে, যখন মিশরীয় সভ্যতা তার শীর্ষবিন্দুতে ছিল। গ্রিকরা এগুলোকে ‘হোট কাটের টুকরো’ (ওবেলিসকোস) বলত। ধারা পরিক্রমায়, আমরা এখনো সেগুলোকে “ওবেলিস্ক’ বলি। ওবেলিস্ক আর অন্যান্য স্থানে উৎকীর্ণ লেখাগুলো ছিল প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি। গ্রিকরা, যারা এগুলো পড়তে সক্ষম ছিল না, তাদের কাছে এসব ছিল রহস্যময় ও শক্তিশালী ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণতার প্রতীক। তারা এই লেখাগুলোকে বলত ‘হায়রোগ্লিফিকস’ (পবিত্র লেখা), আর আমরাও আজ তাই করে থাকি।

ফিনিশিয়া

মিশরীয়রা কখনোই সমুদ্র অভিযাত্রী ছিল না। তারা হয়তো শুধু নিজেদের ভূখণ্ডকেই রক্ষা করতে পারত, কিন্তু তারা গ্রিকদের সাথে সাগরে যুদ্ধ করতে বা উপনিবেশকারী পাঠাতে পারত না। ভূমধ্যসাগরে সাগরের আরেকদল মানুষের বেলায় এটি সত্য ছিল না। সাগরের সবচেয়ে পূর্বে অংশ বিধৌত ভূমিটিতে একদল ক্রান্তিক মানুষরা অভিবাসন করেছিল, বাইবেলে যাদেরকে বলা হত “ক্যানানাইটস’। তারা সমুদ্র-বিহারের ক্ষেত্রে ছিল অনেক পুরনো আর তাদের জাহাজগুলো সমুদ্রের অচেনা, অজানা অংশগুলোতে গ্রিকদের চেয়েও সাহসীভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল। গ্রিক সময়কালে, এই পূর্বদিকের উপকূলের প্রধান শহরকে এতে বসবাসকারীরা ‘সার’ (Sur) নামে ডাকত, কারণ খিস্টপূর্ব ১৪৫০ সালের দিকে এই শহর উপকূলের পাথুরে দ্বীপের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই নামটির গ্রিক সংস্করণ আমাদের কাছে এসেছে ‘টায়ার’ (Tyre) নামে। টায়ারের উন্নতির প্রধান উত্স ছিল রংয়ের কাজ। উপকুলে প্রাপ্ত শেল মাছের থেকে তারা গোপনে রাখা একটি প্রক্রিয়ায় লাল-পার্পল রঙ আহরণ করেছিল। সেই সময়ে, ভালো রঙ, যেগুলো সহজে মলিন হয়ে বা উঠে যেত না, তা খুবই কম পরিমাণে পাওয়া যেত বলে এই টাইরিয়ান পার্পল’, যাকে আজও এই একই নামে ডাকা হয়, তা ছিল দারুণ আকাঙ্ক্ষিত। এর ভালো দাম পেয়ে টাইরিয়ান বণিকদের প্রসার বাড়তে লাগল।

গ্রিকরা যখন যখন টায়ারের বণিক আর নাবিকদের দেখা পেল, তারা তাদের পরিহিত বর্ণিল পোশাক দেখে খুবই মুগ্ধ হলো। তারা তাদের একটি শব্দানুসারে ‘ফিনিসিয়ান’ বলে ডাকত, যার অর্থ হলো “রক্ত লাল’, আর টাইরান ভূখণ্ডকে তারা বলত ‘ফিনিসিয়া’ ফিনিসিয়ানদের গ্রিক উপকথায় খুজে পাওয়া যেত। উপকথা অনুসারে, ক্রিটের প্রাটান রাজা মিনোস ছিলেন ফিনিসিয়ার রাজকুমারী ইউরোপার পুত্র। ইউরোপার ভাই ক্যাডমাস সম্ভবত গ্রিক মূল ভূখণ্ডতে পৌঁছেছিলেন এবং থিব্‌স নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটা মাইসিনিয়ান যুগে ফিনিসিয়ান অভিযাত্রাকে ভালোভাবে চিহ্নিত করতে পারে। ডোরিয়ান আগ্রাসন পরবর্তী অস্থির যুগে, ফিনিসিয়ানরা টায়ারের ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সাইপ্রাসে বসতি স্থাপন করেছিল। মাইসিনিয়ান যুগে, গ্রিকরা ইতোমধ্যেই সেখানে বসতি গেড়েছিল, আর হেলেনিক সময়কালে সাইপ্রাসে গ্রিক আর ফিনিসিয়ান উভয় শহরই খুঁজে পাওয়া যেত। ফিনিসিয়ানরা গ্রিক বসতি স্থাপনের জন্য শুধু ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তই নয়, পশ্চিম প্রান্তও বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি, গ্রিক উপনিবেশিকতার বন্যার সময়কালেও, ফিনিসিয়ান উপনিবেশকারীরা নীল নদের এক হাজার মাইল পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে পৌঁছেছিল। তারা দুটি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল, যাদের একটি, কয়েক শতাব্দী পরে, রোমানদের কাছে ইউটিকা (Utica) নামে পরিচিত ছিল; আর দ্বিতীয়টি, যেটি খিস্টপূর্ব ৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি পরিচিত ছিল কার্থেজ (Carthage) নামে। কার্থেজ প্রসার লাভ করেছিল। এটা পুরো উপকূলের প্রভু হয়ে উঠেছিল, এবং প্রকৃতপক্ষেই, টায়ারের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ সময় ধরে, তারা ছিল পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে ধনী শহর, আর কোন জাহাজই সাগরের সেই অংশে কার্থেজের অনুমতি ব্যাতিরেকে প্রবেশ করতে পারত না। এর উপর, কার্থেজ গ্রিকদের সাথে সরাসরি পাল্লা দিয়ে কর্তৃত্বের অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করল। শহরটি সিসিলির পশ্চিম প্রান্ত থেকে সাগরের নব্বই মাইল সাগরাঞ্চল দিয়ে পৃথক ছিল। এটাতে কোনো বিস্ময় ছিল না যে, কার্থেজিয়ানরা পশ্চিম সিসিলিতে পাড়ি জমাল আর গ্রিকরা দ্বীপের পূর্বাংশে চলে গেল। হেলেনিক সময়কালে কার্থেজিয়ান আর গ্রিকরা সিসিলিতে পরষ্পরের বিরুদ্ধে শেষ স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কোনো পক্ষই একে অন্যকে দ্বীপ থেকে পুরোপুরি তাড়িয়ে দিতে পারেনি, যদিও কখনো কখনো তারা এর কাছাকাছি গিয়েছিল বটে।

গ্রিকরা ইতালি উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে গিয়ে থামল আর তাদের প্রথম উপনিবেশ সাইমি ছাড়িয়ে আর অগ্রসর হয়নি। সাইমির উত্তর-পশ্চিমে ছিল ইত্রুস্কানদের অবস্থান। ইত্রুস্কানদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তারা সম্ভবত এশিয়া মাইনর থেকে ইতালিতে পৌঁছেছিল, কিন্তু তাও নিশ্চিত নয়। তাদের ভাষা বোঝা সম্ভব হয়নি, আর অনুসন্ধানের জন্য তাদের সংস্কৃতির খুব কমই অবশিষ্ট আছে। তারা পরবর্তীকালে রোমানদের সাথে মিশে গেল, এবং এভাবে তাদের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যখন গ্রিকরা ইতালিতে বসতি স্থাপন করা শুরু করল, ইত্রুস্কানরা কিন্তু তখন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। যখন গ্রিকরা ইতালি আর মাসালিয়ার গ্রিক বসতির মাঝে অবস্থিত সারদিনিয়ার বিশাল ভূখণ্ডের দিকে হাত বাড়াল, তখন তারা প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিল। ফিনিশিয়ান, যারা মাসালিয়ায় বসতি গড়ে তুলেছিল, তারা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে দ্বীপটিতে বসতি স্থাপনের কর্তৃত্ব নিল। যাই হোক, খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সালে ইট্রুস্কানরা কার্থেজিয়ানদের সাথে মিলে সারদিনিয়ার কাছে এক নৌযুদ্ধে ফিনিসিয়ান রণতরীকে পরাভূত করল। এর ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক, এবং গ্রিক বসতি স্থাপনকারীদের হয় মেরে ফেলা হলো অথবা দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করা হলো। কার্থেজ সারদিনিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে নিল, আর করসিকা চলে আসলো ইত্রুস্কানদের হাতে। সেই যুদ্ধ গ্রিক উপনিবেশিকতার যুগের সমাপ্তি চিহিত করল। বসতি স্থাপনের সন্তাব্য সব স্থানই পুরণ হয়ে গিয়েছিল বলে গ্রিকরা কোথাও ছড়িয়ে যেতে পারল না।

যদিও বা ফিনিসিয়ান আর তাদের উপনিবেশকারীরা এইক্ষেত্রে গ্রিকদের হতাশ করেছিল, অন্যভাবে তারা গ্রিকদের অন্য উপায়ে সাহায্যও করেছিল। তারা কয়েকটি প্রতীকের সাহায্যে শব্দসমূহকে প্রকাশের উপায় আবিষ্কার করেছিল। বিভিন্ন শব্দ বা বিভিন্ন শব্দাংশের জন্য শতশত এমনকি হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করত (চীনারা আজও তা করে থাকে)। ফিনিসিয়ানরাই সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিল যে প্রতিটি প্রতীক দিয়েই একটি করে স্বরবর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব, এবং এভাবে কেউ মাত্র দুই ডজন অক্ষর দিয়ে এই কাজটুকু সারতে পারে যেখানে প্রতিটি শব্দই হবে কয়েকটি অক্ষরের সমাহার। ফিনিসিয়ান আবিষ্কার মনে হয় একেবারেই আলাদা গোছের কিছু ছিল। অন্যসব মানুষেরা, যারা এই উপায়ে লিখতে শিখল, তারা মনে হয় ফিনিসিয়ান অক্ষরগুলিকেই গ্রহণ করল, যদিও-বা সেই প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল ছিল৷ গ্রিকরা ফিনিসিয়ানদের কাছ থেকেই তাদের বর্ণমালা পেয়েছিল, যার স্বীকারোক্তি তাদের উপকথাতে রয়েছে। থিব্‌সের প্রতিষ্ঠাতা রাজপুত্র ক্যাডমাস, উপকথা অনুসারে, অক্ষর দিয়ে লেখার পদ্ধতিটি গ্রিকদের মধ্যে চালু করেছিলেন। গ্রিকরা শুধু একটি পরিবর্তন এনেছিল। তারা স্বরবর্ণ প্রকাশের জন্য কিছু অক্ষর গ্রহণ করেছিলেন যাতে করে ক্যাট, কট, কাট, কিউট আর একিউট-এর মতো শব্দের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য পুরো ব্যাপারটি আরও সহজ আর স্বচ্ছ হয়।

স্পার্টার উত্থান

ল্যাকনিয়া

ডোরিয়ান শহরগুলোর অবস্থান : গ্রিক ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় অংশ বহন করেছিল ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ আর এশিয়া মাইনরের আয়োনীয় লোকজন। ডোরিয়ান শহরগুলোর মধ্যে শুধু কোরিন্থই গভীরভাবে ঔপনিবেশিকতায় যুক্ত ছিল। কোরিন্থের অবস্থান ছিল প্রণালির ওপর এশিয়া মাইনরের পূর্বদিকে আর সিসিলির দিকে পশ্চিমে মুখ করে। বাণিজ্যের জন্য এর অবস্থান ছিল ভালো, আর পুরো হেলেনিক সময়কাল আর তার পরে এটি ছিল এক উন্নত শহর যার নৌবহর ছিল খুবই শক্তিশালী। এই ব্যাপারগুলো ডোরিয়ান শহরগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্নতর ছিল। তারা ভূমি দখলের এতিহ্য ধরে রেখেছিল, এবং সাগরাভিমুখে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাদের সবার ভেতরে, ভূমিতে যুদ্ধনৈপূণ্য দেখানোর আর সাগরে দুর্বলতার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ছিল স্পার্টা।

স্পার্টার অবস্থান, ডোরিয়ান বিজয় ও দাসপ্রথা : স্পার্টা, যাকে উপকথার প্রতিষ্ঠাতার নামে লেসিডিমন নামেও ডাকা হত, তার অবস্থান ছিল সাগর থেকে পঁচিশ মাইল দূরে ইউরোটাস নদীতে। এভাবেই এটি ছিল এক অন্তর্ভূখণ্ডের শহর। মাইসিনিয়ান যুগে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ শহর, কিন্তু খিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে তা ডোরিয়ানদের অধীনে চলে যাওয়ার পর এর গুরুত্ব কিছু সময়ের জন্য কমে যায়। পরবর্তী তিন শতাব্দীতে, তারা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে ফিরে পেল আর খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালের মধ্যে, প্রতিবেশী শহরগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করল। স্পার্টা ছিল ইউরোটাসের উপত্যকায়, ল্যাকোনিক নামের এলাকার কর্তা। স্পার্টা এবং অন্যান্য যে অঞ্চলে ডোরিয়ান বিজয়ীরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পেরেছিল, সেখানে তারা সেখানকার একমাত্র নাগরিক হিসেবে তাদের অবস্থান ধরে রেখেছিল। এখানে সরকারে শুধু তাদের কথাই গ্রাহ্য হত। এই শাসক শ্রেণি ছিল স্পারশিয়েট, আর যখন বইয়ে স্পার্টানদের কথা বলা হয়, তখন স্পারশিয়েটদের কথাই বোঝানো হয়। স্পার্টার অধিকৃত অঞ্চলে তারা সবসময়ই মোট জনসংখ্যার মধ্যে সংখ্যালঘু ছিল, আর পরবর্তী সময়ে, তারা ছিল মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও কম। স্পারশিয়েটরা শুধু যুদ্ধ করা আর সরকারে অংশ নেয়াকেই একমাত্র সম্মানজনক কাজ বলে মনে করত । কিন্তু, কাউকে না কাউকে বাণিজ্য আর শিল্পের কাজ ধরে রাখতে হত, আর এই দায়িত্ব পড়ল ক্ষুদ্ধ একটি দল পেরিইসির ওপর। এরা ছিল মুক্ত মানুষ যাদের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তারা সম্ভবত স্পার্টায় ডোরিয়ান-পূর্ব অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করত, যারা নিজেদেরকে বুদ্ধিমত্তার সাথে বহিঃশক্রদের সাথে জোটবদ্ধ করেছিল। স্পার্টান এলাকার সংখ্যাগুরু জনসংখ্যায় বিজিত লোকেরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা প্রতিরোধ করার মতো ভুলটি করেছিল। তারা পরাস্ত হয়েছিল, আর অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে দাসে পরিণত করা হয়েছিল। এই ভাগ্যবরণ-করা প্রথম শহর ছিল হেলোস, যার দুর্ভাগা অধিবাসীদের গণহারে দাস বানানো হয়েছিল। পরিণতিতে, ‘হেলট’ শব্দটি দিয়ে স্পার্টান দাসকে বোঝানো হত, সে বা তারা হেলোসের জনগণের উত্তরাধিকারী হোক বা না হোক। মাঝে মাঝে, কোনো কোনো হেলটকে স্পার্টার প্রতি ভালো সেবা দেওয়ার কারণে মুক্ত করে দেয়া হত, এবং তাদেরকে পেরিইসির পদবীতে যোগদানের অনুমতি দেয়া হত। যদিও, হেলটদের মানবাধিকারহীন প্রাণী হিসেবে দেখা হত আর তাদেরকে গ্রিক দুনিয়ার যে কোনো দাসের চেয়ে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা হত।

স্পার্টার শাসনব্যবস্থা : স্পার্টানরা গ্রিক অধিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিমুখ ছিল, তারা তাদের রাজাকে রেখে দিত যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে কোন প্রকার স্বশাসিত-সরকার থাকত। এর বাইরে স্পার্টার রাজকীয়ত্ব গ্রিক আর অগ্রিক উভয়ের থেকেই আলাদা ছিল, তাদের দুইজন রাজা ছিল বলে। অন্য কথায়, এটা ছিল দ্বৈতশাসন। এরূপ ঘটার কারণ ছিল, সম্ভবত, ডোরিয়ানদের মধ্য হতে দুটি আলাদা গোত্র স্পার্টা দখল আর জয় করার জন্য একীভূত হয়েছিল, যেখানে তারা তাদের দুই প্রধান গোত্রের পরিবারকে একসাথে শাসন করার সুযোগ দেয়ার জন্য একমত হয়েছিল। স্পার্টানরা নিজেরা এটা ব্যাখ্যা করার জন্য বলত যে, রাজা দুজন হচ্ছে প্রথম দিককার যমজ দুজন সম্রাটের উত্তরাধিকারী। যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে স্পার্টান রাজাদের ক্ষমতা অতি দ্রুত সীমাবদ্ধ হতে লাগল। সেনাদলের নেতৃত্ব দেয়া ছিল তাদের প্রধান কাজের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণভাবে তারা ছিল সেনাপতি, এবং স্পার্টার সীমানার বাইরেহ শুধু তাদের ক্ষমতা ছিল। দেশে তাদের সরকার ছিল ত্রিশ সদস্যের গোষ্ঠীতন্বের কঠোর নিয়ন্ত্রণে৷ রাজা দুজনও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন, কিন্তু ত্রিশ জনের মধ্যে তাদের কেবল দুটি ভোটই ছিল। বাকি আটাশ জনকে বেছে নেয়া হত স্পার্টানদের মধ্য থেকে যাদের বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছেছে। তারা ছিলেন ‘গেরুসিয়া’, গ্রিক ভাষায় যার অর্থ হল ‘প্রবীণ’| সেখানে পাঁচজন ‘এফোর’ থাকত, যারা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করত। কিছু নির্বাহীও থাকত, যারা দেখভাল করত যে গেরুসিয়াদের সিদ্ধান্ত ঠিকমত কার্যকর করা হচ্ছে । দেশে এবং স্থিতিশীলতার সময়ে, তাদের ক্ষমতা ছিল রাজাদের থেকেও বেশি এবং তারা রাজাদেরকেও জরিমানা করতে বা শাস্তি দিতে পারত যদি তাদের কোনো কাজ আইন বিরোধী হত। মোটের উপর, দুই রাজা আর একদল গোষ্ঠীতান্ত্রিকের দ্বারা এই অদক্ষ শহর-শাসন ব্যবস্থা স্পার্টাকে ঐতিহ্যগতভাবে ধীরগতির রাষ্ট্র করে তুলল, তার সাধে সাথে সে তার সরকারকে শেষ পর্যন্ত চালু রাখতেও ব্যর্থ হলো।

আর্গোস আর মেসেনিয়া

আর্গোস : অন্ধকার যুগে, যখন স্পার্টা ইউরোটাস উপত্যকার কর্তৃত্বে ছিল, আর্গোস ছিল পেলোপনেসাসের সবচেয়ে শক্তিশালী শহর। এই কর্তৃত্ব হোমার কর্তৃক পেলোপনেসাসের গ্রিকদের আর্গোস হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর্গোস কমবেশি স্পার্টার মতোই ছিল। এর রাজারা বহাল তবিয়তেই ছিলেন কিন্ত যখন স্পার্টা নিজেদের রাজাদের ধরে রাখে, তখন আর্গোসরা তাদেরকে একবারে পরিত্যাগ করে। তাদের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ছিল, কিন্তু তা স্পার্টাদের মতো এত শক্ত ছিল না।

আর্গোস ও এলিসের যুদ্ধ, স্পার্টার সহায়তা : আর্গোস তার ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করল ফিডনের নেতৃত্বে যে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ সালের দিকে তাদের শাসন করত। তার অধীনে আর্গোসরা আর্গোলিসের সাথে পেলোপনেসাসের পূর্ব-উপকূল আর পেলোপনেসাসের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সিথেরা দ্বীপকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। তিনি এমনকি পশ্চিম পেলোপনেসাসেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব ৭৪৮ সালে তিনি এলিসকে হটিয়ে অলিম্পিক গেমসের দখল নিয়ে নিয়েছিলেন, এবং নিজেই গেমসের সভাপতিত্ব করেছিলেন। এলিয়ানরা সাহায্যের জন্য স্পার্টার দিকে হাত বাড়াল, আর এর মাধ্যমে স্পার্টা আর আর্গোসের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে চলা লম্বা তিক্ত যুদ্ধের সূত্রপাত হল। পরবর্তীকালে যা ঘটেছিল, তার কমই জানা যায়, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে স্পার্টা জয়লাভ করেছিল, যার কারণে এলিয়ানরা অলিম্পিয়ান গেমসের ওপর নিজেদের অধিকার পেল, আর সেই গেমসের সব রের্কড মুছে ফেলল যেটাতে ফিডন সভাপতিত্ব করেছিল। ফিডনের মৃত্যুর পর আর্গোসরা দুর্বল হয়ে পড়ল, আর স্পার্টা সিথেরা ও পেলোপনেসাসের পূর্ব তীর দখলে নিতে সক্ষম হলো। আর্গোসরা আর্গোলিসে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল; তাদের প্রতিহিংসা গেল রয়ে। আর্গোসরা কখনো ভুলতে পারেনি যে তারা পেলোপনেসাসের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল, আর তাদেরকে পরাজিত করার জন্য স্পার্টানদের কখনো ক্ষমাও করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের একই স্বপ্ন ছিল, স্পার্টাকে পরাজিত করা । তারা যতটা সম্ভব ততটা স্পার্টার প্রতিটি শত্রুদলে যোগদান করল আর এমন কাজে যোগ দিত না যেখানে স্পার্টানরা নেতৃত্ব দেয়। যখন স্পার্টা সমুদ্রাভিমুখে পূর্ব দিকে অগ্রসর হল, তখন তারা পশ্চিমদিকে যেতে লাগল।

মেসেনিয়া : পেলোপনেসাসের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত দখলে নিয়ে স্পার্টান এলাকার পশ্চিমে ছিল মেসেনিয়ার অবস্থান। মাইসিনিয়ান যুগে এলাকাটির প্রধান শহর ছিল পিলোস, যা এর চমৎকার পোতাশ্রয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। ট্রোজান যুদ্ধের সময়ে, হোমারের মতে, এর রাজা ছিলেন নেস্টর, যিনি ছিলেন গ্রিক বীরদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানী। ডোরিয়ানরা স্পার্টার মত মেসেনিয়াও জয় করেছিল, কিন্তু মেসেনিয়াতে ডোরিয়ানরা প্রথম দিকের লোকদের সাথে মিশে গিয়েছিল। তারা তাদের যুদ্ধবাজির কাজ ধরে রাখেনি, আর তাই স্পার্টার ডোরিয়ানদের কাছে মনে হল তারা জন্মগতভাবেই নরম স্বভাবের মানুষ।

মেসেনিয়া ও স্পার্টার যুদ্ধ : মেসেনিয়ানরা সেরকম নরম স্বভাবের নাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলে, স্পার্টানদের বিশ বছরের স্থায়িত্বের দুটি যুদ্ধ করতে হয়েছিল মেসেনিয়া জয় করতে। এই যুদ্ধ দুটি সম্পর্কে কমই জানা যায়, কেননা গ্রিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে যাদের বর্ণনা পরবর্তীতে দীর্ঘদিন টিকে ছিল, তারা কিছু সংখ্যক যে কাহিনী অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন, সেগুলোকে চাকচিক্যময় কল্পগল্প বলেই মনে হয়। প্রথম মেসেনিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭৩০ সালের দিকে, যখন স্পার্টানরা হঠাৎ করেই মেসেনিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করল। কয়েক বছরের যুদ্ধ শেষে, মেসেনিয়ানরা তাদের রাজা এরিস্তোদিমাসের নেতৃত্বে ইথোমি পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করল, যেটি ছিল দেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত অর্ধমাইলের একটি চূড়া, যা মেসেনিয়ার শক্ত ঘাটি হিসেবেও কাজ করত। সেখানে মেসেনিয়ানরা দীর্ঘদিন অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৭১০ সালের দিকে, তারা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হল। স্পার্টানরা মেসেনিয়ানদের দীর্ঘ প্রতিরোধে ক্রুদ্ধ হয়ে তাদেরকে নির্মমভাবে হেলট দাসে পরিণত করল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৮৫ সালে মেসেনিয়ানদের সহ্যক্ষমতার বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তারা এরিস্টোমিনিজের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে বসল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এরিস্টোমিনিজকে একরকম অতিমানবে পরিণত করল, যে প্রায় এক হাতে মেসেনিয়ানদের সাহসী হতে অনুপ্রাণিত করেছে, আর যার চতুর নেতৃত্বে তারা স্পার্টার যোগ্যতর বাহিনীকে উপসাগরের কাছে আটকে দিল। অবশেষে, সতের বছর পর, অন্যতম এক মিত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যখন তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হারল, এরিস্টোমিনিজ আর ক্ষুদ্র একদল অনুগত বাহিনী দেশত্যাগ করে মুক্তভাবে বিদেশে পাড়ি জমাল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৮ সালে, মেসেনিয়া আবার উপরাষ্ট্রে পরিণত হলো। মেসেনিয়ান উদ্বাস্তুদের ইতালির সন্নিকটে সিসিলিতে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে, খিস্টপূর্ব ৭১৫ সালে, কালসিসের অভিবাসীরা একটি শহর প্রতিষ্ঠা করল, যারা এটাকে ‘জ্যাংকলি’ নামে ডাকত, যার অর্থ ছিল ‘মাড়াইয়ের আংটা’, কেননা যে নিম্নভূমির প্রান্তে এটি গড়ে উঠেছিল, তা আকৃতিতে মাড়াইয়ের আংটার সাথে মিলে যেত। মেসেনিয়ানরা শহরে রাজত্ব করতে আসলো, আর এর নাম তাদের অবরুদ্ধ নিজ শহরের নামে পরিবর্তন করে রাখল মেসানা।

স্পার্টানদের জীবন পদ্ধতি

মেসেনিয়ান যুদ্ধের প্রভাব ও স্পার্টানদের যুদ্ধবাজ হওয়া : মেসেনিয়ান যুদ্ধে স্পার্টাকে প্রচুর মূল্য দিতে হলো। অর্ধশতাব্দী ধরে চলা কঠিন যুদ্ধ সামরিক জীবনকে স্পার্টানদের চেতনার গভীরে প্রথিত করে দিল। তাদের কাছে মনে হলো নির্ভার হওয়ার সুযোগ তাদের নেই, যেখানে স্পার্টানরা সংখ্যায় ছিল অল্প, আর হেলটরা ছিল বিপুল পরিমাণে। নিশ্চিতভাবেই, স্পার্টানরা যদি কখনো সামান্য নির্ভার থাকত, তবে হেলটরা তৎক্ষণাৎ বিদ্রোহ করে বসত। অধিকন্ত, মেসেনিয়ান যুদ্ধ হোপলাইটদের ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ নির্দিষ্টভাবেই কঠোর করতে হয়েছিল সৈন্যদেরকে ভারী যুদ্ধপোশাক পরা আর ভারী অস্ত্র শানানোতে অভ্যন্ত করতে। যুদ্ধবাজি কোনো দুর্বলদের বাণিজ্য ছিল না, তাই স্পার্টানরা এসবের অনুশীলন করে নিয়েছিল।

শিশুদের সাথে আচরণ : এই কারণে স্পার্টানরা তাদের জীবনকে যুদ্ধের জন্য উৎসর্গ করেছিল। স্পার্টান শিশুদেরকে জন্মকালে যাচাই করে দেখা হত যে তারা শারীরিকভাবে সুস্থ । যদি সেটা না হত, তাহলে তাদেরকে পরিত্যক্ত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হত। সাত বছর বয়সেই তাদেরকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে ব্যারাকে বড় করা হত। তাদের শীত আর ক্ষুধা সহ্য করতে শেখানো হত, কখনো ভালো কাপড় পড়তে বা ভালো খাবার খেতে দেয়া হত না, সবরকম সামরিক কৌশল প্রশিক্ষণ দেয়া হত, আর কোনোরকম অজুহাত ছাড়া ক্লান্তি আর ব্যথা সহ্য করতে শেখানো হত। স্পার্টানদের নীতি ছিল কঠিন লড়াই করা, প্রশ্ন ছাড়াই আদেশ মেনে চলা, আর পিছিয়ে আসা বা আত্মসমর্পণ করার চেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। পালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন সৈন্যকে তার ভারী ঢাল ফেলে দিয়ে আসতে হত, নতুবা এটা তার গতিকে ধীর করে দিত; যদি সে মারা যেত, তাহলে তাকে তার ঢালের ওপর রেখে দেশে বয়ে নিয়ে আসা হত। তাইতো, স্পার্টান মায়েদের তাদের সন্তানকে বলতে হত তারা যেন “ঢাল নিয়ে বা ঢালের ওপর” যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে।

খাদ্যগ্রহণ : প্রাপ্তবয়স্ক স্পার্টানরা একটি সাধারণ টেবিলে বসে আহার করতেন, যেখানে সবাই হেলটদের পরিশ্রমে নিজেদের ভূমি থেকে উৎপন্ন দ্রব্যাদি নিয়ে এসে অবদান রাখতেন। (যদি কোনো স্পার্টান কোনো কারণে তার জমি হারিয়ে ফেলত, টেবিলে তার জন্য কোনো জায়গা থাকত না, যেটা ছিল তাদের জন্য খুবই অপমানজনক। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যাক স্পার্টান এই জায়গার অধিকার লাভ করত, কারণ জমিও খুব কম সংখ্যাক মানুষের হাতে চলে গিয়েছিল। এটি স্পার্টার দুর্বলতার উৎস ছিল, কিন্তু তাদের ইতিহাসের শেষের দিকেই কেবল তারা এটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করে।) সাধারণ টেবিলের খাবার সাজানো হত একজন মানুষের শুধু উদরপূর্তিতে আর তাকে বাঁচিয়ে রাখতে, এর বেশি কিছু নয়। কিছু নন-স্পার্টান গ্রিক, যারা ব্যারাকের স্পার্টানদের ভোজ্য পরিজের স্বাদ উপভোগ করেছিল, এই কথা বলত যে, মৃত্যভয় তুচ্ছ করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে স্পার্টানদের লড়াই করার ক্ষমতার ব্যাপারে সে আর বিস্মিত নয়। এইরূপ পরিজ যেন মৃত্যুকেই স্বাগত জানাত। পরবর্তী শতাব্দীতে স্পার্টানরা লিকারগাস নামে এক ব্যাক্তির উদ্ভাবিত এই জীবনপদ্ধতি ধরে রাখল, যিনি , তাদের ইতিহাস অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালের দিকে, মেসেনিয়ান যুদ্ধেরও অনেক আগে, জীবিত ছিলেন । কিন্তু, এটা নিশ্চিতভাবেই তা ছিল না, আর লিকারগাস নামে আদৌ কেউ ছিলেন , তাও সন্দেহ আছে।

সঙ্গীত, সাহিত্য ও কলা : এর প্রমাণ পাওয়া যায় খিস্টপূর্ব ৬৫০ সালের দিকে। স্পার্টা মনে হয় অন্যান্য গ্রিক নগর-রাষ্ট্র থেকে খুব বেশি আলাদা কিছু ছিল না। তার নিজস্ব শিল্প, সংগীত আর কবিতা ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে, লেসবোস থেকে টারপেন্ডার নামে একজন সংগীতকার স্পার্টাতে এসে সাফল্য লাভ করেছিলেন। তিনি সম্ভবত বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাকেই গ্রিক সংগীতের জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়/ স্পার্টান সংগীতকারদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন তারতিউস। এতিহ্যগতভাবে তিনি একজন এথেনীয় ছিলেন, কিন্তু তিনি একজন স্থানীয় স্পার্টানও হয়ে থাকতে পারেন। যেভাবেই হোক, তিনি দ্বিতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধের সময়ে জীবিত ছিলেন আর বলা হত তার সংগীত স্পার্টানদের নিত্যনতুন সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছে, যখন তাদের তেজ ক্ষীয়মাণ হয়ে যেত। শুধু দ্বিতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধের পরই সামরিক শক্তির ধ্বংসাত্মক হাত স্পার্টার সৃষ্টিশীল আর মানবীয় সবকিছুকে থামিয়ে দিল। শিল্প, সংগীত, সাহিত্য, সবকিছুতেই তা যেন যতি টেনে দিল। এমনকি স্পার্টানদের সংক্ষেপে আর যুক্তিপূর্ণভাবে কথা বলার বাগ্মিতা চর্চাও (গ্রিকরা সুপ্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত কথা বলতে ভালোবাসে) থেমে গেল। ‘ল্যাকনিক’ (ল্যাকনিয়া থেকে) শব্দটি দিয়ে স্বল্প ভাষায় খুব বলিষ্ঠভাবে কথা বলার গুণকে বোঝায়।

পেলোপনেসাস

স্পার্টানদের পেনোপনেসাসে প্রভাব : গ্রিক ঔপনিবেশিকতার যুগে স্পার্টাতে এটির কোনো বাস্তবিক ভূমিকা না থাকায় সেখানে এর সমাপ্তি সূচিত হলো, আর সেটি পেলোপনেসাসের দক্ষিণ তৃতীয়ার্ধে নিজেদের অবস্থান খুজে পেল। এটা ছিল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়, যার পেছনে এর সামরিক জীবনের প্রতি উৎসর্গতার অবদান ছিল। পেলোপনেসাসের অন্য গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো, অথবা যেগুলো তখনো স্বাধীন ছিল, তারা অত্যন্ত গভীরভাবে অবস্থার পর্যবেক্ষণ করেছিল। আর্গোস, নিশ্চিতভাবেই, মেসেনিয়াকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিল (স্পার্টার বিপক্ষে যায় এমন কিছু) দ্বিতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধের সময়ে, কিন্তু করিন্থ সেই সময়ে স্পার্টার পক্ষে। পেলোপনেসাসের মধ্যবর্তী অঞ্চলে স্পার্টার উত্তরে অবস্থিত আর্কেডিয়া নামের শহরগুলো বিশেষভাবে চিন্তিত ছিল। এই শহরগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল স্পার্টার পঁচিশ মাইল উত্তরের তেজিয়াহ আর তার বার মাইল উত্তরের মানটিনি। এরা পরস্পর ও অন্য আর্কেডিয়ান শহরগুলোর সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল, যার কারণে আর্কেডিয়ার পুরোটাই ছিল ভঙ্গুর অবস্থায়। যাই হোক, এরপর তারা তেজানদের নেতৃত্বে এক্যবদ্ধ হয়ে স্পার্টাকে মোকাবেলা করছিল। সুদীর্ঘ মেসেনিয়ান অগ্নিপরীক্ষার পর স্পার্টাকোন বড় যুদ্ধকেই হালকাভাবে নিতে ইচ্ছুক ছিল না, আর বহু দশক ধরে স্পার্টা আর আর্কেডিয়ার প্রতিদ্বন্দিতা যেন জোরদার হয়ে গেল। যাই হোক, খিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে, কিলন স্পার্টার অন্যতম ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। তিনি ছিলেন একজন কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তি যিনি তার সতর্ক দূরদৃষ্টির জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন, আর গ্রিসের সাত জ্ঞানী ব্যক্তির একজন হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। কিছু ইতিহাস অনুসারে তিনি এফরকেট প্রতিষ্ঠা করেন, তাই এটা হতে পারে যে তার অধীনে স্পার্টান রাজাদের ক্ষমতা দারুণভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কিলন অত্যন্ত শক্ত হাতে রাজ্য চালাতেন, আর আর্কেডিয়া সঠিকভাবে নিজেদের একীভূত করতে দোনমনা হওয়ায় স্পার্টা দ্রুতই তাদেরকে পরাজিত করল তেজিয়াকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া হল, আর এই কারণে তার নাগরিকেরা যারা নিজেদেরকে হেলটে পরিবর্তিত হতে দেখার ভয়ে ভীত ছিলেন, সত্যিই কৃতজ্ঞভাজন হয়ে গেলেন। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে আর্কেডিয়া স্পার্টার অনুগত মিত্র হয়ে ছিল আর তেজিয়ার চেয়ে অনুগত আর কেউই ছিলনা। বাকি ছিল কেবল আর্গোসরা যারা নিজেদের পরাক্রমের স্বপ্ন দেখে চলছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে, যখন স্পার্টা দ্বিতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, আর্গোসরা স্পার্টার বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। তখন থেকে এক শতাব্দী পর্যন্ত তারা ছিল নীরব নিশ্চুপ, যদিও ক্ষোভ আর ঘৃণায় পূর্ণ, কিন্তু অগ্রসর হওয়ার মত সাহসী তারা ছিল না। খিস্টপূর্ব ৫২০ সালে, ক্লিওমিনিজ স্পার্টার দুই রাজকীয় শক্তির একটিতে পরিণত হল। আর টাইরিনজের কাছে আর্গোসদের ওপর আরেকটি হার চাপিয়ে দিলেন। তেজিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ যে সত্যকে প্রকাশিত করেছিল, আর্গোসদের পরাজয় সেই বিষয়টিই পরিষ্কার করে দিল। স্পার্টা ছিল পুরো পেলোপনেসাস জুড়েই এক পরাশক্তির নাম। তাদের দখলে ছিল পেলোপনেসাসের এক তৃতীয়াংশ, আর বাকি স্বীকার হওয়ার ভয়ে ছিল ভীত। কোনোখানেই একজন সৈনিক স্পার্টার অনুমতি ছাড়া যেতে পারত না। প্রকৃতপক্ষে, স্পার্টাই ছিল তখন কর্তৃত্বশালী ক্ষমতাধর ভূখণ্ড আর প্রায় দুই শতাব্দী ধরে তাদেরকে গ্রিক দুনিয়ার নেতা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল।

স্পার্টানদের অক্ষমতা : কিন্তু, গ্রিককে নেতৃত্ব দেয়ার মতো পুরো যোগ্যতা স্পার্টার ছিল না। গ্রিকদের দেশে আর সাগরে উভয় জায়গাতেই বিচরণ ছিল, কিন্তু স্পার্টানদের তা ছিল না। গ্রিকদের ভূমধ্যসাগরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত আগ্রহ ছিল, কিন্তু স্পার্টানদের আগ্রহ ছিল শুধু পেলোপনেসাসকে ঘিরেই। গ্রিকরা ছিল দ্রুত, শৈল্পিক আর মুক্ত, অপরদিকে স্পার্টানরা ছিল ধীরগতির, নিরস আর একে অপরের কাছে বা সামরিক জীবনপদ্ধতির কাছে আবদ্ধ। পরবর্তী বছরগুলোতে, অন্য গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের গ্রিকদের কাছে কখনও কখনও স্পার্টান জীবন ধারণের পদ্ধতি পছন্দনীয় ছিল, কারণ এটা তাদের কাছে আধ্যাত্মিক মনে হয়েছিল আর তা স্পার্টাকে সামরিক গৌরবে অধিষ্ঠিত করেছিল বলে। কিন্তু, তারা এটা করতে গিয়ে ভুল করে বসল। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, জীবনের প্রতি ভালোবাসা – যা কিছুই জীবনকে মুল্যবান করে তোলে, সেখানে স্পার্টানরা কিছুই অবদান রাখেনি। তার শুধু বেশিরভাগ অধিবাসীর নির্মম দাসত্ব নির্ভর একটি নিষ্ঠুর, অমানবিক জীবনপদ্ধতি ছিল, আর ছিল কেবল পশুর মতো অন্ধ সাহসী হওয়ার গুণাবলিটাই। আর তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে অচিরেই সারবন্তুর চেয়ে প্রদর্শনটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল; তাদের এই ‘সুনাম’ কেবল তাদেরকে ঐ সময়টাতেই রক্ষা করত, যখন তাদের মূলই পঁচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হত, যখন তারা একের পর এক জয় করায়ত্ব করত, কিন্তু যখন অন্য রাষ্ট্রগুলো হারের ধাক্কা কাটিয়ে ফের এগিয়ে গেল, স্পার্টা গ্রিসের ওপর তার কতৃত্ব হারিয়ে ফেলল, যা আমরা একটিমাত্র পরাজয় থেকে দেখতে পাই। একটি প্রধান যুদ্ধে পরাজয় তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলত (এবং, তাদেরকে , অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে, সুসময়ের দিনগুলোর চেয়ে খারাপ সময়েই বেশি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হত)।

টাইর‍্যান্টদের যুগ

কৃষি থেকে বাণিজ্য

অনুর্বর কৃষিব্যবস্থা, নিম্ন জীবনযাত্রার মান ও ঔপনিবেশিকতার কারণে বাণিজ্যব্যবস্থার পুনর্জাগরণ : ঔপনিবেশিকতার যুগে ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রিকদের উপনিবেশ তৈরি হয়। এই ঔপনিবেশকতা ছিল তদকালীন গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহে ঘটে চলা পরিবর্তনেরই অংশ। ঔপনিবেশিকতার বিষয়টি সেই পরিবর্তনকে আরও জোরদার করে। মাইসিনীয় যুগে গ্রিসের বাণিজ্যব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল। কিন্তু ডোরিয়ান আগ্রাসনের পর জীবন কিছু সময়ের জন্য সাধারণ ও জৌলুসহীন হয়ে যায়। গ্রিক অধিবাসীরা এককালের সমৃদ্ধজীবনের প্রধান চালিকাশক্তি বাণিজ্যের বদলে এই সময়ে গ্রহণ করেছিল কৃষিব্যবস্থাকেই। এখানে প্রতিতি অঞ্চল কেবল নিজেদের দরকারী কাঁচামালই উৎপাদন করতো। তারা খাদ্যশস্য ও শাকসব্জি উৎপাদন করতো, দুধের জন্য গবাদি পশু রাখতো, উলের জন্য রাখতো ভেড়া আর মাংসের জন্য শূকর। এই সময় নগরগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাই খুব কম পরিমাণেই বাণিজ্যের দরকার ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হলো গ্রিস ভূপ্রাকৃতিক কারণেই অপেক্ষাকৃত অনুর্বর, তাই সব অঞ্চলে সব কিছু ভালোভাবে এখানে ফলতো না। আর তাই গ্রিকদের জন্য বাণিজ্যবিমুখী কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার অর্থই ছিল তাদের জীবনযাত্রার মানের নিচে নেমে আসা। প্রতিটি নগররাষ্ট্রকেই ব্যস্ত থাকতে হতো নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখার কাজে, এদিকে জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। এরফলে যখনই তাদের জনসংখ্যা বেড়ে যেত, তখনই তারা কোন উপনিবেশে যেতে বাধ্য হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে বাণিজ্যের সুদিন ফিরে আসে, আর সেই পুনর্জাগরণকে ত্বরাণ্বিত করতে ভূমিকা রেখেছিল এই ঔপনিবেশিকতাই। বিদেশ থেকে, যেমন সিসিলি বা কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চল থেকে, খাদ্য আমদানি করাও সম্ভব হয়। এসব এলাকা গ্রিসের চেয়ে বেশি উর্বর ছিল, আর সেসব জায়গায় কম পরিশ্রমে অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যেত। আমদানি করা খাদ্যের মূল্য পরিশোধ করার জন্য গ্রিক নগরগুলোকে গড়ে তুলতে হল শিল্প। তারা অস্ত্র তৈরি শুরু করল, খাদ্যশস্যের বিপরীতে মৃৎ শিল্প গড়ে তুলল। নগরগুলো ব্যস্ত থাকত ‘বিশেষায়িত খামার’ বা স্পেশাল ফার্ম তৈরিতে, আর সেখানে তারা খাদ্যশস্যের বদলে ওয়াইন বা জলপাই (যার জন্য গ্রিস খুব উপযোগী ছিল) বিনিময় করত। যে শহর শুধু একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর জন্যই খাদ্য উৎপাদন করতে পারত, তারা বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য কিনে আরও অনেক লোকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রস্তুত করতে পারত। তাই, বাণিজ্য আর ঔপনিবেশিকতার যুক্ত নগরগুলোতে জনসংখ্যা বেড়ে যায়।

নতুন বাণিজ্যব্যবস্থায় মুদ্রাব্যবস্থার আবির্ভাব : আত্তিকা আর আর্গোলিসের মধ্যে অবস্থিত ছিল ঈজিয়ান সাগরের ক্ষুদ্র অন্তাংশ, যাকে বলা হয় সারোনিক উপসাগর (Golfe Saronique or Saronic Gulf)। (Attica, যেখানে এথেন্স, ম্যারাথন, এফিদনিয়া, ইলিউসিস এর মত বিখ্যাত নগর বা অঞ্চল অবস্থিত, Argolis, যেখানে আরগস, টাইরিন্স, এপিডরাস, লারনা, হারমাইওনির মত বিখ্যাত নগর বা অঞ্চল অবস্থিত।) সারোনিক কালফের দ্বিপগুলোকে বলা হয় সারোনিক আইল্যান্ড। সারোনিক আইল্যান্ডের সংখ্যা ৭টি – Salamis, Aegina, Hydra, Poros, Spetses, Dokos, Agistri (আয়তনের দিক থেকে ক্রমহ্রাসমান)। তো দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বিপটি ছিল ঈজিনা, আয়তনে মাত্র ৮৩ বর্গ কিলোমিটার। দ্বিপটি পাথুরে আর অনুর্বর হলেও এটি ছিল গ্রিক নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল। এই সমৃদ্ধতার কারণ ছিল বাণিজ্য, সেই সাথে এরা ছিল ক্ষমতাশালীও। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের পেছনে ঈজিনার অবদান ছিল। আদিম যুগে মানুষেরা পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য করত, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিই নিজেদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় বস্তুর বিনিময়ে তাদের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় কিছু গ্রহণ করত। ধীরে ধীরে এই ধরণের বাণিজ্যের কাজে সোনা বা রূপার মত ধাতুর ব্যবহার শুরু হল। এই ধাতুগুলো ছিল আকর্ষণীয়, এগুলো নষ্ট হত বা ক্ষয়ে যেত না। আর এগুলো ছিল খুব বিরল যার কারণে সামান্য পরিমাণও অনেক দিন ব্যবহার করা যেত। এককথায় তারা বিনিময়ের উপযুক্ত মাধ্যম তৈরি করে ফেলল। কিন্তু ন্যায্য বাণিজ্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে সোনা বিনিময় করতে হত, যেমন একজোড়া গবাদি পশু বা এক টুকরো জমির জন্য। তাই বণিকদের দাড়িপাল্লা ওজন করতে হত যাতে সোনা বা রূপা ওজন করা যায়। এই ব্যাপারটা কিছু বিতর্কের জন্ম দিত, যেমন নিক্তি বা পাল্লা ঠিক আছে , বা সোনা বা রূপা খাটি । খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকের কোন এক সময়ে, এশিয়া মাইনরের লিডিয়ান জাতি নিশ্চিত বিশুদ্ধ ধাতু দিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাযুক্ত সোনা বা রূপার চাকতি তৈরি করতে লাগল। এরকম মুদ্রার ব্যবহার ছোট ছোট লেনদেনকে অনেকটাই সহজ করে দেয়, আর যারা এর উদ্ভাবন করেছিল, তাদের প্রত্যেকের উন্নতিতে অবদান রাখল। গ্রিসেও এই নতুন ধরণের মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়। একথা প্রচলিত যে, আর্গসের রাজা ফেলডন সর্বপ্রথমের ব্যবহার চালু করেন, কিন্তু আসলে তা হতে পারেনা, কারণ তিনি তার এক শতাব্দি আগে গ্রিসে শাসন করতেন। ঈজিনাই সর্বপ্রথম ব্যবসায় ব্যাপকভাবে মুদ্রার ব্যবহার শুরু করে। তার সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেতে পেতে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে এই সমৃদ্ধি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে। আর অন্য নগররাষ্ট্রগুলো এই ব্যাপারে তাদের অনুকরণ করতে থাকে।

পূঁজিবাদের বিকাশের কারণে সৃষ্ট সমস্যা, দাসব্যবস্থার বিকাশ : কিন্তু ক্রমপ্রসারমান সমৃদ্ধি বিপদ ডেকে আনে। যতই একটি শহর বেশি সম্পদশালী হয়ে পড়ছিল, ধনী বণিক নামে নতুন একটি শক্তিশালী ক্লাস এর উদ্ভব হতে থাকল। পুরনো ভূমিমালিক শ্রেণি নতুন এই ধনিক শ্রেণীর সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে চায়নি, যার কারণে সৃষ্টি হয় এক অস্থিতিশীল পরিণতি। প্রচুর পরিমাণে অর্থের আধিক্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, এতে দেখা যায় মুদ্রাস্ফীতি। এর অর্থ ছিল এই যে , যারা এই নতুন ধরণের উন্নয়নের অংশ নিতে চায়নি, বিশেষ করে কৃষক শ্রেণী, তাদের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেল, তারা হয়ে গেল ঋণগ্রস্ত। এই নতুন বাণিজ্যিক পরিস্থিতি দাসেদের উপর নির্ভরশীলতা বা দাসব্যবস্থাকে বৃদ্ধি করে। বণিকরা যেসব কারখানা বা খামার চালাত সেখানে প্রচুর পরিমাণে দাসেদের দরকার হয়, কারণ কারখানায় মৃৎপাত্র তৈরিতে, খামারে কাপড় তৈরিতে বিপুল দাস লাগত, আর এই দাসদের কেনা ও ভরনপোষণের সামর্থ সেইসব বণিকদের ছিল। আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সেকারণে মুদ্রাস্ফীতির কারণে কৃষকেরা যে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার কারণে তারা টিকতে না পেরে তারা দাসে পরিণত হতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশনের সময়কার শ্রমিক শ্রেণীই তখনকার সময়ের নব বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দাস শ্রেণী। সেই সময় ঐ অঞ্চলগুলো বণিক শ্রেণী ও দাস শ্রেণীতে বিভক্ত হতে থাকে।

নব্য বণিক শ্রেণীর সাথে পুরনো ভূমিমালিকদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সম্পর্ক, হ্যাভ ও হ্যাভ নট ক্লাসের সৃষ্টি : কৃষকেরা কৃষিকাজ ছেড়ে বণিকদের খামারে বা কারখানায় দাসবৃত্তিতে যোগদান করতে থাকলে পুরনো রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিমালিকদের স্বার্থ্যও ব্যাহত হয়, যেকারণে তাদের সাথে বণিকদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মুদ্রাব্যবস্থার আবির্ভাব এই পুরো প্রক্রিয়াকে খুব দ্রুত করে তোলে। কখনও কখনও পুরনো ভূমিমালিকানা ভিত্তিক ওলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্রগুলো শক্তিশালী মিত্র পাবার জন্য এই নব্য বণিক বা পুঁজিবাদী শ্রেণীকে গ্রহণ করে নেয়। সেক্ষেত্রে সেইসব অঞ্চলে কৃষকেরা ও কারিগরেরা বিরোধপূর্ণ অবস্থাতেই একত্রে বাস করতে থাকে। অন্যদিকে স্পার্টা এই বাণিজ্যিক সম্প্রসারণবাদ বা “বিশ্বায়ন” এর প্রভাব থেকে দূরেই থাকে। স্পার্টা মুদ্রার ব্যবহার ও বিলাসদ্রব্যের আমদানিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি পুরনো কৃষি পদ্ধতিটাই বহাল রাখে। এর ফলে তারা তাদের নিম্ন জীবনযাত্রার মানকেই বহাল রাখে, আর এটাকে তারা নাম দেয় স্পার্টান ধর্ম বা Spartan Virtue. তাদের সরকার স্থিতিশীল ছিল। (স্পার্টা ল্যান্ডলকড অঞ্চল ছিল, এর তাই কোন সমুদ্র তীর ছিল না। এর ফলে দ্বীপ ও উপনিবেশগুলোর সাথে এর পক্ষে সামুদ্রিক বাণিজ্য করাও সম্ভব হয়নি, নতুন বাণিজ্যব্যবস্থায় স্পার্টা তাই অংশগ্রহণ করতে পারেনি।) কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে এক নতুন ধরণের তিক্ততা ও হিংস্রতার জন্ম হতে থাকে। অঞ্চলগুলো কম পরিমাণে ধনি “হ্যাভ” ক্লাস আর ক্রমবর্ধিষ্ণু বিশাল পরিমাণে “হ্যাভ নট” ক্লাস এর জন্ম দেয়, অর্থাৎ দরিদ্র, “হ্যাভ নট” ক্লাসের মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই পরিস্থিতিটি সেই সব নগরেই বর্তমান ছিল যেগুলো বাণিজ্যে যোগদান করে।

আয়োনিয়ার টাইর‍্যান্টরা

টাইর‍্যান্টদের ক্ষমতারোহন : তদকালীন গ্রিসে যে অলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্র ছিল, জনগণকে যদি তাদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট করতে হয় তাহলে একজন নেতার প্রয়োজন পড়ে। সেসময় যে শ্রেণীপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল, আর নতুন আসা সমাজব্যবস্থায় তাতে কৃষক ও কারিগরদের জীবনযাত্রার মান যেভাবে কমে গিয়েছিল তাতে সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। এদের আন্দোলনের জন্য নেতার দরকার, আর তারা সেই নেতা পেয়েও যেত। কখনও কখনও এদেরকে নেতৃত্ব দিত কোন সম্ভ্রান্তই, যার সাথে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তির দ্বন্দ্ব ছিল। এই নেতারা যথেষ্ট সাহসী ছিল যার ফলে তারা জনগণকে অস্ত্র ও রসদ দিয়ে শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত করত। আর এই বিদ্রোহের পর সেই নেতা নিজে ক্ষমতা লাভ করত। আসলে, এমনও হতে পারে যে সেই নেতা কেবল ক্ষমতা দখল করার জন্যই প্রথমে সেরকম গণ-আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। এই নেতা কোন রাজা নয়, তার কোন অফিস নেই, আর তাই রাষ্টের ক্ষমতার প্রতি তার কোন আইনগত বা পবিত্র অধিকারও নেই। সে কেবলই একজন “মাস্টার” বা দাসপ্রভূ, আর কিছু নয়। গ্রিক ভাষায় এদের জন্য যে শব্দটি বরাদ্দ ছিল তা হল “টাইরানোস” (Tyrannos), যেখান থেকে টাইর‍্যান্ট (Tyrant) শব্দটি এসেছে। আজকের দিনে টাইর‍্যান্ট বলতে ডিকটেটর বা স্বৈরশাসককে বোঝানো হয়। আমরা শব্দটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করি। কোন শাসক নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মম হলে তার ক্ষেত্রে শব্দটিকে ব্যবহার করি। কিন্তু গ্রিসে টাইর‍্যান্টদের উপর এরকম নেতিবাচক ইমপ্রেশন দেয়া হত না। সেখানে টাইর‍্যান্ট বলতে বোঝানো হত সেইসব শাসককে যারা তাদের ক্ষমতা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেনি। হতেই পারে একজন টাইর‍্যান্ট ভাল মানুষ ও সহৃদয় শাসক।

টাইর‍্যান্টদের জনকল্যাণ : খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যে টাইর‍্যান্টদের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেল। ‘ঔপনিবেশিকতার যুগ’ এর শেষ অর্ধ তাই ‘টাইরান্টদের যুগ’ হিসেবে সুপরিচিত। এটি খুব একটা সুবিবেচক খেতাব ছিল না, কেননা এই যুগে টাইরান্টদের ছাড়াও আরও অনেক শহর ছিল, আর এর পরের অনেক শহর ছিল যেখানে টাইরান্টদের অস্তিত্ব ছিল। কখনো কখনো শহরে শান্তি আর সমৃদ্ধি এনে দেয়ার কারণে তারা দক্ষ শাসক বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন। যেহেতু সময়ের রদবদল আর জনগণের অসন্তোষ তাদের ক্ষমতা প্রাপ্তির অন্যতম কারণ ছিল, তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য উৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে নতুন পদ্ধতিতে সরকার ব্যবস্থাকে নিয়ে আসলেন। তাদের অধীনে অনেক সাধারণ মানুষের উন্নতি হয়েছিল। টাইরান্টরা জনগণের সন্তুষ্টির জন্য নতুন নতুন উৎসব চালু করে শহরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার মাধ্যমে (আর এভাবে কারিগরদের বিভিন্ন নির্মাণ কাজে যুক্ত করে আর তাদের সমর্থন নিয়ে) নিজেদের জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। টাইরান্টরা প্রথমেই আইওনিয়ার ক্ষমতায় এসেছিল, যেখানে এশিয়া যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সেখানে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন থ্যাসিবিউলাস যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬১০ সালের দিকে বৃহত্তর মিলেটাস শাসন করেছিলেন। তার অধীনে, মিলেটাস তার খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করল, আর প্রকৃতপক্ষেই, তারা ছিল গ্রিক দুনিয়ার সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু আর গুরুত্বপূর্ণ শহর। আর থ্যাসিবিউলাসের অধীনে, একদল নতুন মানুষের উত্থান হলো, যারা পরবর্তীকালে যেকোনো সংখ্যক টাইরান্টদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

থেলিস ও অন্যান্য দার্শনিকগণ : এদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন থেলিস যিনি খিস্টপূর্ব ৬৪০ সালের দিকে মিলেটাসে জন্গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সম্ভ্রান্ত কোনো এক গ্রিক মায়ের গর্ভজাত ছিলেন, আর মিশর ও ব্যাবিলনীয়া ভ্রমণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি গ্রিসে দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনেক প্রাচীন সভ্যতার ধারা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ব্যাবিলনিয়ানদের থেকে লোক-বিদ্যা আর জ্ঞান এবং সুর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট জ্যোতির্বিদ্যা শিখেছিলেন। আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ সালে৷ সংঘটিত একটি সূর্যগ্রহণের ক্ষেত্রে তার পূর্বানুমান লোকজনকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল, যা থেলিসের সম্মানকে দারুণ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মিশরীয় জ্যামিতিরও শিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে কিছু মৌলিক অগ্রগতিও আনয়ন করেছিলেন। প্রথমত, তিনি বালিতে বানানো, মোমে আচড় কাটা, বা টানা তারে তৈরি মোটা আর অনিয়মিত প্রকৃত রেখার চেয়ে শূন্য ঘনত্ব আর নিখুত সরলীকৃত কাল্পনিক রেখা নিয়ে বেশি কাজ করা প্রথম মানুষ ছলেন। দ্বিতীয়ত তিনি প্রচলিত লব্ধ জ্ঞানের বিরুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার করে নিয়মিত বিতর্কের সিরিজ দিয়ে এবং প্রত্যাশিত প্রমাণকে অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি হিসেবে উপস্থাপন করে গাণিতিক বক্তব্যসমূহ প্রমাণ করেছিলেন। এটি জ্যামিতিক উন্নতিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছিল, আর সেটি ছিল গ্রিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সাফল্য। আর পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে, চিরুনি ঘষা হলে তা যেভাবে হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করে, তিনিই ছিলেন সেই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা প্রথম ব্যক্তি। চিরুনির গ্রিক নাম ইলেকট্রন, আর সেইরূপ আকর্ষণকে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ‘ইলেকট্রিসিটির ফলাফল বলে অভিহিত করা হত। থেলিস লোহাকে আকর্ষণ করা এক প্রকার কালো পাথরকেও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন পাথরটি নিকটবর্তী ম্যাগনেসিয়া শহর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে এটিকে ম্যাগনেটিক লিথেসি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল, আর এ থেকে ম্যাগনেট বা চুম্বক শব্দের উৎপত্তি। সর্বশেষে, তিনি মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি, এর প্রকৃতি কী রকম, এর শুরুই বা হয়েছিল কিভাবে, সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন। এর জন্য তিনি দুটো ধারণা তৈরি করলেন। প্রথমে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন যে, দেবতা বা দেব বলে কিছু নেই বরং মহাবিশ্ব কিছু অপরিবর্তনীয় নিয়মাবলির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দ্বিতীয়ত, মানব-মন পর্যবেক্ষণ আর চিন্তার মাধ্যমে এসবের সাথে জড়িত কারণগুলো খুঁজে বের করতে পারে। বিজ্ঞানের সবকিছুই, থেলিসের সময়কাল থেকেই, এই দু’টি ধারণা দিয়ে চালিত হচ্ছে। পরবর্তী শতাব্দীতে মিলেটাসে এবং আইওনয়ার অন্য শহরগুলোতে অন্য অনেকেই থেলিসকে অনুসরণ করেছিলেন, আর এই পদ্ধতি অনুসরণকে “আয়োনীয় স্কুল” বা আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় নামে অভিহিত করা হয়, এরা আয়োনিয়ার মিলেটাস শহরের অধিবাসী ছিলেন বলে এদেরকে মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ও বলা হয়। এভাবে, থেলিসের শিষ্য, খিস্টপূর্ব ৬১১ সালে জন্ম নেয়া, তরুণ অ্যানাক্সিম্যান্ডারও মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। প্রতিযোগী শহর ইফেসাসে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সালের দিকে জন্ম নেয়া হেরাক্লিটাসও তাই করেছিলেন। প্রথম দিককার কোনো অনুসন্ধানমূলক লেখাই টিকে থাকেনি, আমরা সেগুলো জানতে পারি পরবর্তী লেখকদের লেখায় তাদের চিন্তাধারার সাধারণ তালিকার মধ্য দিয়ে। এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন পিথাগোরাস, যিনি খিস্টপূর্ব ৫৮২ সালের দিকে আয়োনীয় উপকূলের সামোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেকে একজন “ফিলোসফার’ (প্রজ্ঞার প্রেমিক) হিসেবে পরিচিত করিয়েছিলেন আর এই নামেই গ্রিক চিন্তাবিদেরা পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

পিটাকাস ও তার শাসন : মিলেটাসের টাইরান্ট থ্র্যাবিউলাস, মিলেটাসের বিজ্ঞানী থেলিসের সময়কালে, আরেকজন টাইরান্ট এওলিয়ান দ্বীপ লেসবোসতে রাজত করতেন। তিনি ছিলেন পিটাকাস, আর তিনি দ্বীপের প্রধান শহর মিটিলিনিতে শাসন করতেন। খিস্টপূর্ব ৬১১ সালের দিকে তিনি খুব বাজে আর নিষ্ঠুরভাবে টাইরান্ট শাসন করা এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। যখন তিনি সেটা সম্পন্ন করলেন, তখন তিনি দেখলেন যে তিনি নিজে টাইরান্ট হতে পারলেই পুরো শহর সুশাসন পাবে। অবশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৯ সালে শাসনভার আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করলেন এবং দশ বছর শাসন করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭৯ সালে, ৭০ বছর বয়সে, তিনি যখন দেখলেন যে তার দায়িত্ব শেষ আর সামান্যই তিনি করতে পারেন, তখন তিনি পদত্যাগ করলেন। পিটাকাস এত ভালোই শাসন করেছিলেন যে পরবর্তী শতাব্দীতে গ্রিকরা যখন সাতজন জ্ঞানী মানুষের তালিকা তৈরি করলেন, যারা ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সংকটময় সময়ে গ্রিক দুনিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে অন্ধকার থেকে প্রাচুর্য আর শক্তির দিকে রূপান্তর দেখা গিয়েছিল। যেখানে স্পার্টার ফিলনের সাথে পিটাকাসের নামও ছিল। তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিলেন থেলিস, তার বৈজ্ঞানিক সামর্থ্যের কারণে নয়, বরং তার প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক উপদেশাবলির কারণে (যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে)। তালিকার চতুর্থ জ্ঞানী মানুষ ছিলেন ক্রিওবিউলাস, যিনি একজন টাইরান্ট হিসেবে, খরিস্টপূর্ব ৫৬০ সালের দিকে, রোডস দ্বীপের এক শহরে রাজত্ব করেছিলেন।

অ্যালসিউস ও স্যাফো : পিটাকাসের অধীনে লেসবোস দারুণ সাংস্কৃতিক উন্নয়নের এক সময় পার করেছে। খিস্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে দ্বীপটিতে গ্রিক চারণ কবি আলসিউস প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি প্রেমের গান লিখতেন, আর তার পাশাপাশি যে শাসকদের তিনি মন্দ মনে করতেন, তাদের সমালোচনা করে কবিতাও লিখতেন। পিটাকাসের সময় তিনিও নির্বাসিত হয়েছিলেন, কিন্তু পিটাকাস অবসরে চলে যাওয়ার পর তিনি আবারও ফিরে আসলেন। আলসিউস সম্মুখ সমরের কোনো বীর ছিলেন না, কিন্তু তার সম্মন্ধে সবচেয়ে বেশি করে যা বলা হত, তা ছিল, একসময় এক যুদ্ধে তিনি “ঢাল ছুড়ে ফেলে এসেছিলেন।” অর্থাৎ তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে, লেসবোসতে স্যাফো নামে এক মহিলা কবি ছিলেন, যিনি সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম মহান মহিলা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সম্ভবত, আমরা তাকে সর্বপ্রথম আর সবার সেরা দুটোই বলতে পারি, যদি আমরা তার কাজগুলো নজরে আনতে পারতাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার সবগুলোই প্রায় হারিয়ে গেছে; কিন্ত রুচির ওপর সাধারণভাবেই ভরসা করা যায়।

মূলভূমির টাইর‍্যান্টরা

মেগারা : ব্যবসায়িক শহরগুলোর মধ্যে গ্রিক মূলভূমিতে কিছু উল্লেখযোগ্য টাইরান্ট বাস করত। গ্রিক প্রণালিতে অবস্থিত মেগারা শহর, খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ সালের থেকে পরের সময়কালে থিয়াজিনিজ নামের টাইরান্টের শাসনাধীন ছিল। তিনি একটি জলপ্রণালি নির্মাণ করেছিলেন, যা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করত, এবং সেটি ছিল বিভিন্ন ব্যবহারযোগ্য প্রকল্পের মাধ্যমে টাইরান্টদের নিজেদের জনপ্রিয় করার একটি নমুনা। সিলন (Cylon) নামে এথেন্সের এক অভিজাত লােকের সাথে থিয়েজিনেসের কন্যার বিয়ে হয়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছিল, যদি শক্তভাবে অগ্রসর হন, তাহলে তিনি এথেন্সের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। বিশেষ করে, যেখানে তিনি তাকে সাহায্য করার জন্য তার মেগারানিয়ান টাইরান্ট শ্বশুরের ওপরে ভরসা করতে পারেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩২ সালের এক ভােজ উৎসবের দিনে যখন এথেন্সবাসীরা তাদের উদযাপনে মজেছিল, সিলন তখন আরাে কিছু অভিজাত আর মেগারানিয়ান সৈন্যদের একটা দল নিয়ে অ্যাক্রোপলিস দখল করে নিলেন। অ্যাক্রোপলিস শহরের উচ্চতা ছিল শহরের কেন্দ্রীয় সুরক্ষার স্থল। নামের সাথে মিল রেখেই এটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত ছিল, আর প্রথম দিকের দিনগুলােতে এথেন্সের প্রথম বসতি স্থাপনের জায়গা ছিল, কেননা এতে করে এটিকে কিছু সংকল্পবদ্ধ লােকদের মাধ্যমে সহজেই রক্ষা করা যাবে সেই সকল শত্রুর হাত থেকে যাদেরকে অনেক পরিশ্রম করে ঢাল বইতে হবে। সাধারণভাবে, যারাই অ্যাক্রোপলিসের দখল নিতে পেরেছিল, তারাই শক্ত অবস্থানে থাকত। কিন্তু সিলন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সমর্থনহীনভাবে। তার মেগারানিয়ান সাহায্যকারীরা জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। গােষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন হয়তাে অজনপ্রিয় ছিল, কিন্তু জনগণ বিদেশি শাসকদের অধীনে যাওয়ার বিনিময়ে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এথেনীয় বাহিনী অ্যাক্রোপলিস অবরােধ করেছিল। তারা এটাকে তছনছ করে দেয়ার কোনাে চেষ্টা করেনি, শুধু পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত ক্ষুধাকাতর লােকদের সহযােগিতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। সিলন নিজে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু বাহিনীর বাকি অংশকে হত্যা না করার শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। সেই বছরে, এথেন্সের আরকন ছিলেন মেগাক্লিস, তিনি ছিলেন শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পরিবার আল্কমিওনিডির একজন সদস্য। মেগাক্লিস ভাবলেন, শর্ত থাকার পরও পুরাে দলটিকেই হত্যা করা সুবিবেচনাপূর্ণ কাজ হবে, তাই সেই বিশ্বাসঘাতকতাই করা হলাে। তিনি এথেনীয়দের এই কাজে বাধ্য করেছিলেন। যখন এই কাজ সম্পন্ন হলাে, এথেনীয়রা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, কেননা তারা এমন একটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলেন, যা ঈশ্বরের সামনে গভীরভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। পুরাে শহরের ওপর যাতে অভিশাপ না নেমে আসে, সেজন্য মেগাক্লিস আর তার পরিবারের অন্যদেরকে ধর্মদ্রোহিতায় অভিযুক্ত করা হলো আর শহর থেকে বহিষ্কার করা হলাে। একে ‘আল্কমিওনিডির অভিশাপ’ নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তী এথেনীয় ইতিহাসে যার গুরুত্বপূর্ণ পালাক্রমিক ছিল। সিলনের বাহিনী ধ্বংস হওয়াই চূড়ান্ত বিজয় ছিল না। এর মাধ্যমে এথেন্স মেগারার সাথে এক যুদ্ধে লিপ্ত হলো, আর থিয়েজিনিজেস সুদৃঢ় নেতৃত্বে মেগারার উত্থান ঘটল এবং এথেন্স ভুক্তভােগী হলাে।

কোরিন্থ : তিরিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কোরিন্থের নিকটে, টাইরানীর আরও বেশি জ্বলজ্যান্ত সাফল্যের উদাহরণ ছিল । তিনি ছিলেন সিপসিলাস যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৬ সালের দিকে করিন্থিয়ান টাইরানী লাভ করেছিলেন, এবং তিরিশ বছর পরে সেটি তার ছেলে পেরিয়ান্ডারের নিকট হস্তান্তর করেন। পেরিয়ান্ডার তার পিতার থেকেও বেশি সফল আর যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন, আর তার অধীনে কোরিন্থ তার গুরুত্বের শীর্ষে আরোহণ করল এবং গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংস্কৃতির শহরে পরিণত হলো। এটি ব্যবসায়িক দিক থেকেও সবচেয়ে সফল ছিল। পেরিয়ান্ডারের অধীনে সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল। কবি আরিওনকেও তার কার্যালয়ে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল (এই কবিকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী ছড়িয়েছিল – যেমন জলদস্যুরা যখন তাকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলেছিল, তখন একটি ডলফিন তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।) এই সময়কালে গ্রিকরা কাঠের বদলে পাথর দিয়ে উপাসনালয় তৈরি করতে শুরু করেছিল, আর কোরিন্থিয়ানরা উচ্চভূমিতে পাথরের স্থাপনা নির্মাণ করার কৌশল রপ্ত করতে পেরেছিল। আর কোরিন্থিয়ানরা উচ্চভূমিতে পাথরের স্থাপনা নির্মাণ করার কৌশল রপ্ত করতে পেরেছিল। তারা ধনুকাকৃতির খিলান ব্যবহার করত না, কিন্তু সারিবদ্ধ পিলার দিয়ে ভারী ছাদ দাঁড় করিয়ে রাখত। ভিতর দিয়ে পূর্ণোদ্যমে বয়ে চলা বাঁশি বা লম্বালম্বি খাঁজ কাটা সাধারণ পিলার তৈরির মাধ্যমে কোরিন্থ এই ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছিল যাতে করে পিলারগুলোকে উপরে খোদাই ছাড়া নকশাসহ বেশি লম্বা আর অভিজাত মনে হয়। এই ধরনের পিলারগুলো ছিল ডোরিক শ্রেণীর। আইওনিয়াতে আরও লম্বা এবং বিশালাকার সব পিলার ব্যবহার করা হত, আর সেগুলো মোটামুটি নকশাবৃত্ত হত। এভাবেই আইওনিক ধারা তৈরি হয়েছিল। (পরবর্তী শতাব্দীতে যে পিলারগুলো অনেক লম্বা আর বিশালাকৃতিয় এবং অভাবনীয়ভাবে অলংকৃত ছিল, সেগুলোকে কোরিন্থিয়ান ধারা বলা হত, কিন্তু এটা হয়েছিল যখন গ্রিক নকশা তার সুবর্ণ সময় পেরিয়ে এসেছিল)। জ্ঞানী সাতজন মানুষের একজন হওয়ার মতো সফলভাবে শান্তিতে থাকার পর খিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে পেরিয়ান্ডার মৃত্যুবরণ করেন । তিনি আবার তার জীবনের শেষ অংশে একজন নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন, যদিও এই ব্যাপারটি গোষ্ঠিশাসকদের কাছ থেকে উত্থাপিত, যাদের তিনি নির্বাসিত করেছিলেন এবং যাদের তার ব্যাপারে নাক সিটকানো মনোভাব ছিল। তার উত্তরাধিকারী ছিল তার ভাগ্নে যাকে খুব দ্রুতই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, আর এর সাথে সাথেই কোরিন্থের টাইরানীর সমাপ্তি ঘটল।

সিশিয়ন : খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে কোরিন্থের প্রায় দশ মাইল উত্তর-পশ্চিমের সিশিয়ন (Sicyon) শহরে রাজত্ব করতেন ক্লিসথিনিস নামক এক টাইরান্ট। ক্লিসথিনিস কোরিন্থ উপসাগরের উত্তরে নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন। সেটি এইরকম ছিল: ডেলফির নিকটে ফোসিয়ান (ফোসিস অঞ্চলে) শহর ক্রিসা, খিস্টপূর্ব ৫৯০ সালে, ওরাকলের দখল নেয়ার চেষ্টা করেছিল। এসবই নগর রাষ্ট্রের দলের সদস্যদের যারা ডেলফি নিয়ন্ত্রণ করত তাদের “প্রথম পবিত্র যুদ্ধের” দিকে সমন্বিত করেছিল ক্রিসাকে শাস্তি দেয়ার জন্য। যে সৈন্যদল ক্রিসাকে পরাজিত করেছিল, সেটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্লিসথিনিস। আক্রমণাত্মক শহরটিকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল, আর যারাই এই শহর পুনর্গঠন বা এখানে চাষাবাদ করার চেষ্টা করেছিল, তাদের উদ্দেশ্যে অভিশাপ উচ্চারিত হয়েছিল। বিজয়ের স্মারক হিসেবে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮২ সালের দিকে, ক্লিসথিনিস পিথিয়ান গেমস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

স্পার্টার হাতে মূলভূমিতে টাইরানির বিনাশ : গ্রিসের এই সময়কালে টাইরানিক শাসনও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিষয় হলো, যেখানে একজন রাজা আইন, রীতিনীতি আর ধর্ম ছারা সমর্থিত, একজন টাইরান্ট এসবের কিছুর ওপরই ভরসা করত না। তারা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করত, আর শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই সেটা কেড়েও নেয়া হত। তাইতো, টাইরান্টদের সবসময় সতর্ক আর সন্দেহপ্রবণ হয়ে আর কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে শাসন করতে হত। (এই কারণেই ‘টাইরান্ট” শব্দটি দিয়ে আজকের দিনে দুষ্ট প্রকৃতির শাসককেই বোঝায়)। তাইতো, তখনকার সবচেয়ে সামরিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র স্পার্টা কঠোরভাবে টাইরানির মোকাবেলা করল। স্পার্টা গোষ্ঠীতান্ত্রিক হয়েই ছিল আর কোথাও গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসনকার্যে সমস্যা হলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াত। স্পার্টার হস্তক্ষেপের কারণেই কোরিন্থ আর মেগারায় টাইরানীর যুগ শেষ হয়ে এসেছিল। এথেন্সের টাইরানিক শাসনেরও অবসান ঘটিয়েছিল স্পার্টা। এটা গ্রিসের এবং প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের ইতিহাসেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। সেদিকেই আমরা আলোকপাত করতে যাচ্ছি।

সামোস দ্বীপের পলিক্রেটিস ও পিথাগোরাস

খিস্টপূর্ব ৫৩৫ সালের দিকে সামোস স্বীপটি শাসন করেন পলিক্রেটিস নামে এক স্বৈরাচারী শাসক। এই পলিক্রেটিস ছিলেন একজন হিংস্র ব্যক্তি। সম্ভবত, প্রথম দিককার প্রজাপীড়নকারী টাইরান্ট শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পলিক্রেটিস। তিনি বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। অনেক বছর ধরে তিনি খুবই সফল ছিলেন, আর সব কাজেই তিনি উন্নতি লাভ করেছিলেন। তার একটি বিশাল নৌবহরও ছিল। তিনি শতশত জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন আর ছিলেন ঈজিয়ান সাগরের “মাস্টার”। সামােস ছিল মাইলেটাসের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সামােস দ্বীপের ব্যবসায়ীগণ স্পেনের সুদূর টারটেসাস নগরী পর্যন্ত গিয়েছিলেন। খনিজ সম্পদের জন্য টারটেসাস বিখ্যাত ছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫ অব্দে পলিক্রেটিস সামােস দ্বীপের স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ অব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি কোনাে নৈতিকতার ধার ধারতেন না। স্বৈরশাসনের প্রথম দিকে শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত তার দুই ভাইকে তিনি ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। তিনি তার নৌবহরকে মূলত জলদস্যুতার কাজে ব্যবহার করতেন। পারস্যের নিকট মাইলেটাসের সাম্প্রতিক বশ্যতা স্বীকারে তিনি লাভবান হন। 

পারস্যের পশ্চিমমুখী সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সাইটিক মিশরের রাজার সাথে মিলে পলিক্রেটিস একটি জোট গড়ে তোলেন। সেই সময়ে মিশরের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় আমহোস, যিনি খিস্টপূর্ব ৫৬৯ থেকে ৫২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন। তিনি তার নামের গ্রিক সংস্করণ আমেসিস এর মাধ্যমেই বেশি সুপরিচিত। আমেসিস দারুণভাবে গ্রিক সংস্কৃতির অনুরক্ত ছিলেন। তিনি একজন গ্রিক দেহরক্ষী রাখতেন, ডেলফির উপাসনালয়ে উপহার পাঠাতেন, আর নোহক্র্যাটিসের বাণিজ্যিক ঘাটিকে শহরে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি একজন বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী গ্রিক রাজার সাথে একই জোটে থাকতে পেরে সন্তুষ্ট ছিলেন যার সেনাবাহিনী তার জন্য বিরাট কাজে আসতে পারত। পলিক্রেটিস ও আমেসিসকে নিয়ে একটি কিংবদন্তী আছে। তিনি পলিক্রেটিসের নিরবচ্ছিন্ন সৌভাগ্যের ব্যাপারে কুসংস্কারাচ্ছভাবে ভীত ছিলেন। মিশরীয় রাজা অনুভবন করলেন, সুসমতা ফিরিয়ে আনার জন্য দেবতারা টাইরান্টদের জন্য ভয়ানক কিছু রেখেছে। তাই, আমেসিস পলিক্রেটিসকে নিজের কিছু জিনিস বিসর্জন দিতে বললেন। এটি পলিক্রেটিসের জন্য সামান্য কিছু দুর্ভাগ্য নিয়ে এসে সুসমতা ফিরিয়ে আনতে আর দেবতাদের শান্ত করতে পারে, আর পরিণতিতে সেখানে খুব খারাপ কিছু সংঘটিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। পলিক্রেটিস তার উপদেশ শুনে একটি দামি আংটি নিলেন, আর সেটিকে সমুদ্র নিক্ষেপ করলেন। কিছুদিন পরে, টাইরান্টদের প্রাসাদের একটি খাবার টেবিলে একটি মাছ নিয়ে আসা হলো, আর যখন সেটিকে কাটা হলো, তার ভেতরে আংটিটা পাওয়া গেল। এই খবর শুনতে পেয়ে আমেসিস বুঝতে পারলেন যে, পলিক্রেটিসের দিন ফুরিয়ে এসেছে, আর তিনি জোটটিও ভেঙে দিলেন।

তবে জোট ভাঙ্গার জন্য প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন কারণ ছিল। পারস্যের রাজা ক্যাম্বাইসিস (Cambyses) মিশর জয়ের জন্য পূর্ণশক্তি নিয়ােগ করেন, তখন পারস্য রাজার জয়ের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই পলিক্রেটিস তার পক্ষ পরিবর্তন করেন। মিশর আক্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি তার রাজনৈতিক শত্রু দ্বারা গঠিত একটি নৌবহর পাঠান। কিন্তু নৌবাহিনীর নাবিকগণ বিদ্রোহ করে তাকে আক্রমণ করার জন্য সামােস দ্বীপে চলে আসে। অবশ্য, তিনি তাদের পরাজিত করেন। সে যাত্রা পলিক্রেটিস নাবিকদের বিদ্রোহ দমন করে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা তার হয়নি। অতিশয় লোভের ফলে অবশেষে তার পতন ঘটে। ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, সার্ডিসে পারস্যের প্রাদেশিক শাসক ঘোষণা করেন তিনি মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান, পলিক্রেটিস যদি সে বিদ্রোহে তাকে সাহায্য করেন তাহলে তিনি তাকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেবেন। পলিক্রেটিস তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মূল ভূখণ্ডে গেলে বন্দি হন এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। আমেসিসের আশঙ্কাই সত্য পরিণত হলো। তবে আমেসিস এটি দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কারণ তিনি তিন বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন। একজন টাইরান্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পলিক্রেটিস সংস্কৃতি আর জনসম্পৃক্ত কাজকে অণুপ্রাণিত করতেন। ইয়ুপালিনাস নামে মেগারার এক লোককে ভাড়া করে তিনি একটি সরু জলপথ নির্মাণের কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। গ্রিকরা সবসময় বিমূর্ত চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দিত, আর প্রায়োগিক প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নিজেদের রেকর্ডের দিকে তাদের মনোযোগ ছিল কম। তাই ইয়ুপালিনাসের মতো ব্যক্তি সম্পর্কে কম তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে যা খুবই দুঃখের বিষয়। পলিক্রেটিস শিল্পকলারও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সামোসকে তিনি অনেক দর্শনীয় জনকর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন। অ্যানাক্রিয়ন (Anacreon) ছিলেন তার সভাকবি। 

পলিক্রেটিসের শাসনকালের এক গুরুতৃপূর্ণ পরিণতি ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে। পিথাগোরাস পলিক্রেটিসের শাসন পছন্দ করেননি, সে কারণে তিনি সামোস ত্যাগ করে চলে যান। তৎকালীন স্বদেশীয় শাসকদের রােষানলে পড়েই তাকে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। আবার তিনি নিজেকে পলিক্রেটিসের সাথে সামোসের যৌথ মালিক ভাবতেন বলে পলিক্রেটাস ক্রমশ টাইর‍্যান্টে পরিণত হবার ফলে তিনি সামোস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৯ সালে তিনি সামোস ত্যাগ করলেন, আর দক্ষিণ ইতালীর ক্রোটন দ্বীপে অভিবাসন করলেন। তিনি তার সাথে আয়োনীয়দের বৈজ্ঞানিক ধারা বয়ে নিয়ে গেলেন যেটি পশ্চিম গ্রিকে একটি স্থান করে নিল, যদিও পিথাগোরাস ইতোমধ্যে থেলিসের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রকাশভঙ্গিকে ভেঙে ফেলেছিলেন। পরিবর্তে তিনি গোপনীয়তা, সন্নাসবাদ আর রহস্যময়তায় চিহ্নিত নতুন এক প্রকাশভঙ্গির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপরও, পিথাগোরাস আর তার অনুসারীরা গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। সংখ্যার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে এবং উদাহরণস্বরূপ দুইয়ের বর্গমূলকে যে সঠিক কোনো ভগ্নাংশে প্রকাশ করা যায় না তা প্রদর্শন করে তারাই প্রথম “সংখ্যাতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বাদ্যযন্ত্রের তারগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট হলে যে বেশি শব্দ উৎপন্ন করে এবং এ দু’টো তারের মাধ্যমে উৎপাদিত বাজনা যে বেশি শ্রুতিমধুর হয় যদি তাদের দৈর্ঘ্য পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, এটি দেখিয়ে তারা শব্দ নিয়েও তাদের গবেষণা শুরু করেছিল। তারা জ্যোতির্বিদ্যাও পর্যবেক্ষণ করতেন, আর প্রথম তারাই বললেন পৃথিবী হল গোলাকার। এমনকি তারা এই তত্ত্বও দিলেন যে পৃথিবী মহাকাশে ভ্রমণ করে। পিথাগোরাসই বিখ্যাত পিথাগোরিয়ান তত্ত্ব এর আবিষ্কারক যেটি বলে সমকোণী ত্রিভূজের দুই পার্শের বাহুর বর্গ তার অতির্ভূজের বর্গের সমান। পিথাগোরাসের আন্দোলন শুধু বিজ্ঞান আর গণিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছিল, আর গোষ্ঠীতন্তরের ওপরে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। যখন ক্রোটনের গোষ্ঠীতন্ত্রকে উৎখাত করা হয়েছিল, তখন পিথাগোরাসও নির্বাসিত হয়েছিলেন। পিথাগোরিয়ানবাদ দুই শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

পিথাগোরাস ও তার দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান।

এথেন্সের উত্থান

অ্যাটিকার ঐক্য, এলিউসিনীয় রহস্যবাদ ও গোষ্ঠীশাসনের উদ্ভব

অ্যাটিকার একতাবদ্ধ হওয়া : সুপ্রাচীনকালে, এথেন্স অথবা যে ত্রিভুজাকৃতির উপদ্বীপের ওপর তা অবস্থিত, সেই অ্যাটিকার মধ্যে পার্থক্য করার মতাে কিছু ছিল না। ইলিয়াডে এর উল্লেখ ছিল, কিন্তু গ্রিক শক্তিকুলের মধ্যে এটি খুব একটা বড় শহর ছিল না। এর নেতা মিনেসথিউসের গুরুত্ব খুব একটা সেখানে দেয়া হয়নি। ট্রোজান যুদ্ধের পরবর্তী শতাব্দীগুলােতে, অ্যাটিকা ডােরিয়ান আক্রমণ আর তৎপরবর্তী বিশৃঙ্খলার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। আয়োনীয় হয়ে থাকা মূল ভূখণ্ডের গ্রিসের এটি একটি অংশ ছিল। ধীরে ধীরে প্রথম দিককার শতাব্দীতে, পুরাে অ্যাটিকাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। স্পার্টা যেভাবে ল্যাকোনিয়ার অন্য শহরগুলােতে প্রধান্য বিস্তার করেছিল, এথেন্স সেভাবে অ্যাটিকার অন্য শহগুলােতে প্রাধান্য লাভ করেছিল বলে এরূপ হয়নি। থিব্‌স যেভাবে একটি বিয়োটিয়ান কনফেডারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তেমনিভাবে এটি কোনাে এটিক কনফেডারেশনকে নেতৃত্ব দেয়নি। পরিবর্তে, এথেন্স একেবারেই ভিন্নধর্মী কিছু করার চেষ্টা করেছিল যা তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। এটি সম্প্রসারিত হয়ে একটি বড় শহরে পরিণত হলাে, যার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত ছিল পুরাে অ্যাটিকা। অ্যাটিকার যে কোনােপ্রান্তে জন্ম নেয়া মানুষই এথেনীয় বলে গণ্য হতেন, যেমন এথেন্স শহরে জন্ম নিলেই তিনি সেটা গণ্য হতেন। এথেনীয় কিংবদন্তী অনুসারে এর পিছনে অবদান ছিল ট্রোজান যুদ্ধে মিনেসথিউসের পিতা মাইসিনিয়ান বীর থিসিউসের। কিন্তু, এটা ভাবাও অযৌক্তিক যে, একজন মাত্র মানুষ একবারেই অ্যাটিকার একতা নিয়ে এসেছিলেন। বরং এটা ভাবাই যৌক্তিক যে ধীরে ধীরে প্রজন্মান্তরে এটা গড়ে উঠেছিল। যাই হােক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে পুরাে অ্যাটিকা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অ্যাটিকার সর্বশেষ যে অংশটি ইউনিয়নে নিয়ে আসা হলাে, তা ছিল এথেন্স শহরের চৌদ্দ মাইল দূরে উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কর্নারের ইলিউসিস।

এলিউসিসের ধর্মীয় প্রথা : এলিউসিসে বেশ কিছু ধর্মীয় প্রথা পালিত হত, যা অ্যাটিকা এবং গ্রিক দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ধরনের রীতিনীতি গ্রিকদের কাছে হােমার আর হেসিয়ডের অলিম্পিয়ান ধর্মের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অলিম্পিয়ানরা একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করতেন যা কবি আর সাহিত্যিকদের হাতে লেখা ছিল। এটা আসলে কোনাে আবেগিক রীতিনীতি প্রদান করেনি, আর ভবিষ্যতের কোনাে প্রতিশ্রুতিও সেখানে ছিল না। ওডিসিতে দেখতে পাই, যখন ওডিসিউস হেডিস গেলেন, আকিলিসের ছায়া দুঃখভারাক্রান্তভাবে বলতে পারল যে, মৃতদের দুনিয়ার রাজপুত্র হওয়ার চেয়ে পৃথিবীতে ক্রীতদাস হওয়াও ভালাে, সেটা পৃথিবীতে দাসের মতাে জীবন যাপন করা ব্যক্তিদের জন্য এক ধরনের সান্ত্বনা ছিল। তারা নিদেনপক্ষে মৃত্যুর পর উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। এলিউসিনীয় রীতিনীতি উপাসকদের ডিমিটার বা ডায়ােনিসাসের মতাে কিছু কৃষির দেবতা বা অরফিউসের মতাে কিংবদন্তীর নায়কের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পিত ছিল। রীতিনীতিগুলাে ঋতুগত পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যেরূপে শস্যদানা শরতে মরে যেত, কিন্তু বসন্তে আবার জেগে ওঠার জন্য বীজ রেখে যেত। এটা ছিল মৃত্যু আর পুনর্জন্মের এক নাট্যরঙ্গ, এবং শস্যদানার মতােই, ডায়ােনিসাস আর অরফিউস মৃত্যুবরণ করে আবার পুনর্জীবিত হয়েছিলেন, আর ডিমিটারের বােন পারসিফোনি প্রতি হেমন্তে হেডিসের কাছে অবতরণ করেছিল আর প্রতি বসন্তে ফিরে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের রীতিনীতি সহানুভূতিশীল জাদু বা সিম্প্যাথেটিক ম্যাজিক হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছিল এটা নিশ্চিত করতে যে ভূমি আবার উর্বর এবং ফসল হউক প্রচুর। এটা নিশ্চিতভাবে সেই সকল মানুষের, যারা এই রীতিনীতিতে অংশ নিয়ে এই ব্যাপারে আশ্বস্ত যে মৃত্যুর পর পুনর্জন্মের চক্রে তারাও আসবেন যাবেন। তাদের রাতিনীতির বিশদ গােপন রাখতে হত মৃত্যুর বেদনায়। রহস্যের গ্রিক প্রতিশব্দ হলাে ‘মিস্টিস’, তাই তাে, সেই সকল আচার অনুষ্ঠানকে বলা হত মিস্টিস বা মিস্টিরী রিলিজিয়ন বা রহস্যবাদী ধর্ম। এলিউসিনীয় রহস্যাবলি গ্রিক দুনিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত আর গােপনীয় ছিল। যদিও, এসকল ব্যাপার হাজার বছর ধরে চলেছিল, বাইরের লােকেরা কখনােই এই আচার অনুষ্ঠানের বিশদ খুঁজে বের করতে পারেনি। রহস্যপূর্ণ ধর্মটি আধুনিক দুনিয়াতে তার ছোঁয়া রেখে গেছে। যখন পশ্চিমা পুনিয়াতে রাজত্ব করার জন্য খ্রিস্টান ধর্মের উত্থান হলাে, রহস্যময় ধর্মের অনেক কিছুই তার ভিতর ছিল।

এলিউসিনীয় রহস্যবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান।

রাজশাসন থেকে গোষ্ঠীশাসন : ডােরিয়ান আগ্রাসন পরবর্তী অন্ধকার যুগে, গ্রিসের অপ্রধান বেশিরভাগ মতােই, এথেন্সও রাজার শাসনের থেকে গােষ্ঠীশাসনের শাসনের দিকে গেল। এথেনীয় ইতিহাস অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ১০৬৮ সালে রাজার শাসনের অবসান ঘটল। শেষ রাজা কন্ডেরাস পেলােপনেসাস থেকে আসা ডােরিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণান্তকর যুদ্ধ করছিলেন – কোনাে এক ওরাকল ঘােষণা করল, যে সৈন্যদলের প্রথমে মারা যাবে, তারাই জয়লাভ করবে। কন্ডেরাস ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুবরণ করলেন যাতে করে এথেন্স তার আয়োনীয় পরিচয় ধরে রাখতে পারে। এথেন্সবাসীরা ভাবল তিনি যেহেতু অত্যন্ত ভালাে রাজা ছিলেন, তার কোনো উত্তরাধিকার থাকা উচিত হবে না, কেননা কেউই সেরকম ভালাে কেউ হবেন না। (গল্পটি আসলে একটি রােমাঞ্চকর আলােচনার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না)। এথেন্সবাসীরা এটাও বলে থাকে যে, কন্ডেরাসের পরের সময়কালে রাজার পরিবর্তে আরকন, যার অর্থ নেতা, সেই নামে একজন ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথমদিকে আরকন সারাজীবনের জন্য শাসন করতেন আর, শাসনভার কন্ডেরাসের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পিতা হতে পুত্রের কাছে ন্যাস্ত হত যাতে করে রাজসভা আগের রাজার থেকে কেবল পদবীতে পরিবর্তীত হত। পরবর্তীতে, আরকনের দায়িত্ব দশ বছরের জন্য নির্ধারিত ছিল, আর তা তেমনভাবে পিতা হতে পুত্রের হাতে ন্যাস্ত হত না, যদিও তা রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে এটি অবশিষ্ট অভিজাত পরিবারগুলাের জন্যও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অবশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ৬৮৪ সালে, এথেন্স পুরােপুরি গােষ্ঠীতন্ত্রের শাসনে চলে গেল। অভিজাতদের থেকে বাছাই করা নয়জনের একটি দল এথেন্সের শাসনকার্য পরিচালনা করত। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আরকন, কিন্তু সেই বছরটি তার নামে নামকরণ করা ছাড়া আর তেমন কোনাে সম্মান তিনি পেতেন না। আরেকজন ছিলেন পােলমার্ক, যার হাতে সৈন্যদলের একক ক্ষমতা ন্যাস্ত ছিল। অভিজাতদের হাতে এরিওপোগাসের পুরাে নিয়ন্ত্রণ ছিল, যার অর্থ “এরিসের পাহাড়” তার নামকরণ হয়েছিল তাদের মিলিত হওয়ার স্থান থেকে। এটি ছিল এমন এক কাউন্সিল যা রাজনৈতিক ধর্মীয় বা আইনগত কোনাে প্রশ্নে উচ্চ আদালত হিসেবে কাজ করত।

সিলনের আক্রমণ প্রতিহতকরণ, লিখিত আইনের উদ্ভব ও ড্র্যাকোনিয়ান আইন

যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালের পরে, এথেন্স ব্যবসায়িক পুনরুজ্জীবনের অংশ হয়ে পড়ল, আর গােষ্ঠীতন্ত্রের শাসন ক্রমাগত অজনপ্রিয় হতে থাকল। অন্যান্য শহরে টাইরান্টদের উদাহরণের দিকে এথেন্সবাসীদের নজর ছিল। বিশেষ করে, এথেন্সের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রতিবেশী মেগারা থিয়েজিনেসের শাসনাধীন হয়ে গেল আর সেভাবে তারা ভালাে ছিল। সিলন (Cylon) নামে এথেন্সের এক অভিজাত লােকের সাথে থিয়েজিনেসের কন্যার বিয়ে হয়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছিল, যদি শক্তভাবে অগ্রসর হন, তাহলে তিনি এথেন্সের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। বিশেষ করে, যেখানে তিনি তাকে সাহায্য করার জন্য তার মেগারানিয়ান টাইরান্ট শ্বশুরের ওপরে ভরসা করতে পারেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩২ সালের এক ভােজ উৎসবের দিনে যখন এথেন্সবাসীরা তাদের উদযাপনে মজেছিল, সিলন তখন আরাে কিছু অভিজাত আর মেগারানিয়ান সৈন্যদের একটা দল নিয়ে অ্যাক্রোপলিস দখল করে নিলেন। অ্যাক্রোপলিস শহরের উচ্চতা ছিল শহরের কেন্দ্রীয় সুরক্ষার স্থল। নামের সাথে মিল রেখেই এটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত ছিল, আর প্রথম দিকের দিনগুলােতে এথেন্সের প্রথম বসতি স্থাপনের জায়গা ছিল, কেননা এতে করে এটিকে কিছু সংকল্পবদ্ধ লােকদের মাধ্যমে সহজেই রক্ষা করা যাবে সেই সকল শত্রুর হাত থেকে যাদেরকে অনেক পরিশ্রম করে ঢাল বইতে হবে।

সাধারণভাবে, যারাই অ্যাক্রোপলিসের দখল নিতে পেরেছিল, তারাই শক্ত অবস্থানে থাকত। কিন্তু সিলন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সমর্থনহীনভাবে। তার মেগারানিয়ান সাহায্যকারীরা জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। গােষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন হয়তাে অজনপ্রিয় ছিল, কিন্তু জনগণ বিদেশি শাসকদের অধীনে যাওয়ার বিনিময়ে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এথেনীয় বাহিনী অ্যাক্রোপলিস অবরােধ করেছিল। তারা এটাকে তছনছ করে দেয়ার কোনাে চেষ্টা করেনি, শুধু পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত ক্ষুধাকাতর লােকদের সহযােগিতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। সিলন নিজে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু বাহিনীর বাকি অংশকে হত্যা না করার শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। সেই বছরে, এথেন্সের আরকন ছিলেন মেগাক্লিস, তিনি ছিলেন শহরের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পরিবার আল্কমিওনিডির একজন সদস্য। মেগাক্লিস ভাবলেন, শর্ত থাকার পরও পুরাে দলটিকেই হত্যা করা সুবিবেচনাপূর্ণ কাজ হবে, তাই সেই বিশ্বাসঘাতকতাই করা হলাে। তিনি এথেনীয়দের এই কাজে বাধ্য করেছিলেন। যখন এই কাজ সম্পন্ন হলাে, এথেনীয়রা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, কেননা তারা এমন একটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলেন, যা ঈশ্বরের সামনে গভীরভাবে উচ্চারিত হয়েছিল। পুরাে শহরের ওপর যাতে অভিশাপ না নেমে আসে, সেজন্য মেগাক্লিস আর তার পরিবারের অন্যদেরকে ধর্মদ্রোহিতায় অভিযুক্ত করা হলো আর শহর থেকে বহিষ্কার করা হলাে। একে ‘আল্কমিওনিডির অভিশাপ’ নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তী এথেনীয় ইতিহাসে যার গুরুত্বপূর্ণ পালাক্রমিক ছিল। সিলনের বাহিনী ধ্বংস হওয়াই চূড়ান্ত বিজয় ছিল না। এর মাধ্যমে এথেন্স মেগারার সাথে এক যুদ্ধে লিপ্ত হলো, আর থিয়েজিনিজেস সুদৃঢ় নেতৃত্বে মেগারার উত্থান ঘটল এবং এথেন্স ভুক্তভােগী হলাে। এর ফলে অসন্তোষ জন্ম নিতে থাকল। যুদ্ধে অসফল কোনাে সরকার জনপ্রিয় হতে পারে। এর সাথে, সাধারণ জনগণ নিশ্চিত ছিল যে, অভিজাতরা, যারা এরিওপেগাস নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা তাদের ঐতিহ্যগত আইন দিয়েই শাসন করতেন। এই আইনগুলাে লিখিত আকারে ছিল না, ফলে কোনাে সিদ্ধান্ত ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ছিল , এটা বােঝা খুব কঠিন ছিল।

আইনের লিখিত রূপের জন্য জোর দাবি উঠল, যাতে করে কেউ তার স্বপক্ষে কিছু নির্দিষ্ট একটা প্রদর্শন করতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৬২১ সালে এথেন্সের প্রথম আইন সংকলন প্রস্তুত করেন ড্রাকো নামে এক অভিজাত। তার নামের অর্থ ছিল ড্রাগন। তার রচিত বিধান ছিল প্রকৃতপক্ষে কঠিন, এবং গােষ্ঠীতন্ত্রের শাসনের পক্ষে একচোখা। যেমন, এই আইনে ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ পরিশােধ না করতে পারতেন, তবে ঋণদাতা তার শরীরের মালিকানা নিয়ে নিতে এবং তাকে দাসে পরিণত করতে পারত। সম্পদের ওপর সংঘটিত বিভিন্ন রকম অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা ছিল, এমনকি যদি তা খুব ক্ষুদ্রও হত। উদাহরণস্বরূপ, মুলা চুরি করা মানেই ছিল তার মৃত্যু হবে। এই ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে কেউ ড্রাকোকে যদি জিজ্ঞাসা করত, কেন তা করা হয়েছে, সে হয়তাে উত্তর দিত, “কারণ আমি এর চেয়ে কঠিন কোনাে শাস্তির কথা ভাবতে পারি না।” বলা হয়, ড্রাকোর আইনগুলাে কালিতে নয়, রক্তে লেখা হয়েছিল। এই কারণেই অমানবিক, কঠিন আর নিদারুণ ব্যাপারগুলাে ‘ড্রাকোনিয়ান’ শব্দটির অর্থ হয়ে গেছে। তারপরও বলা যায়, লিখিত আইনগুলাে ছিল আসলেই এগিয়ে। একসময় সেটা যেহেতু এমন ছিল সেটি পর্যবেক্ষণ করা যেত সেরকমভাবে যেখানে প্রচণ্ডতা আর অন্যায় বিচার খুব সরলীকরণ করা হয়েছিল। এগুলাে পরিবর্তন করে উন্নত করার একটা প্রচেষ্টা অচিরেই শুরু হলাে। যখন নতুন ব্যবসায়িক অর্থনীতি এথেনীয় জীবনকে বারবার বিপর্যস্ত করতে লাগল আর গরিব কৃষকদের তাড়িয়ে নিয়ে দাস বানানাে হলাে, তখন পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক রূপ ধারণ করল। সেই কোরিন্থের উদাহরণ জ্বলজ্যান্তই ছিল যেখানে পেরিয়ান্ডার তার পিতার থেকে টাইরানী লাভ করে শক্ত হাতে শাসন করছিলেন, আর অভিজাত গৃহের সদস্যদের ধ্বংস করছিলেন।

সলোন এবং আইনের পরিমার্জন ও অর্থনৈতিক সংস্কার

এথেনীয় অভিজাতরা এটা বােঝার মতাে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন যে শান্তিপূর্ণভাবে কিছু হারানাে, শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে সবকিছু হারানাের চাইতে ভালাে। তাদের মধ্যে পুরাতন রাজকীয় পরিবারে সলােন নামে এক জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বাণিজ্য করে ধনী হয়েছিলেন এবং একজন কৌশলী কবি ছিলেন। খানদানী, ধনী আর প্রতিপন্ন সলােন ছিলেন একজন প্রজ্ঞা, দয়া আর শুদ্ধতার মানুষ, যিনি অন্যায়ের মধ্যে কোনাে আনন্দ খুঁজে পেতেন না। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৪ সালে, তাকে আরকন বানানাে হয় এবং আইনের পরিমার্জনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি কাজটি এত সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলেন যে তিনি পরবর্তী গ্রিকদের সাতজন জ্ঞানী মানুষের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার অর্জন করেছিলেন। আর ‘সলােন’ শব্দটি আইনপ্রণেতার প্রতিশব্দ হিসেবে চালু হলাে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একজন কংগ্রেসম্যানকে বােঝাতে এটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। সলােন সব ঋণ উঠিয়ে নিলেন যাতে করে জনগণ নতুন করে সব শুরু করতে পারে। তিনি ঋণের বিনিময়ে মানুষকে দাস বানানাের প্রথা নিষিদ্ধ করলেন এবং যারা ইতােমধ্যে দাসে পরিণত হয়েছিলেন, তাদেরকে মুক্ত করে দিলেন। যাদেরকে অ্যাটিকায় বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে আবার সরকারি খরচে ফিরিয়ে আনা হলাে।

এরপর তিনি খুনের দায় ছাড়া ড্রাকোর সব মৃত্যুদণ্ডগুলােকে বাতিল করলে ও এর ওপর তিনি সাধারণ নাগরিকদের দিয়ে নতুন আদালত প্রতিষ্ঠা করলে জনগণের মধ্যে যারা অভিজাত নিয়ন্ত্রিত এরিওপেগাসে নিজেদের অবিচারের শিকার ভাবতেন তারা জনগণের আদালতে এসে আপিল করতে পারতেন, যেখানে তারা অধিক সহানুভূতিশীল রায় পাওয়ার আশা করতে পারতেন। সলােন কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার আনার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বল্প মূল্যে আয়ােজনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি খাদ্যের রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, আর অন্য গ্রিক রাষ্ট্র থেকে এথেন্সে দক্ষ কর্মী নিয়ে আসাকে উৎসাহিত করতেন। এর ওপর, তিনি এথেনীয় সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আর সাধারণ জনগণকে নিজেদের দাবির ব্যাপারে উচ্চকিত হতে বলেছিলেন। ব্যক্তিবর্গের শাসনে তাদের মাধ্যমে সব কর্মকর্তা বেছে নেয়া আর সব বক্তব্য উপস্থাপনের বদলে আইন প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হলাে। আর গণপরিষদের সদস্যদেরও জনগণের মধ্য থেকেই নেয়া হত।

সাধারণ জনগণকে গণপরিষদের সভায় অংশ নেয়ার অনুমতি দিয়ে, সলােন ‘জনগণের শাসন’ এর দিক নজর দিলেন, তৈরি হল গণতন্ত্র, যার বিকাশে তিনি অনেক বড় পদেক্ষপ গ্রহণ করলেন। নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে, সলােন গণতন্ত্রের দিকে শুধু অল্প খানিকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এথেন্সবাসী তখনাে ধনসম্পদের ভিত্তিতে চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল, আর দুটো উচ্চ শ্রেণি থেকেই কেবল আরকন নির্বাচন করা হত। তখনাে নিম্ন শ্রেণিদের শুধু গণপরিষদে বসা ছাড়া কোনাে অধিকারই ছিল না। আর ভূসম্পত্তিকেই তখন একমাত্র সম্পদ হিসেবে গণনা করা হত। বিকাশমান দক্ষ শিল্পীদের শাসকবর্গের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হত না। এমনকি গণতন্ত্রের অভিমুখে প্রথম ধাপটিও অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। আগে থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল বলে এই ব্যাপারে সলােনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভয়ানক বিদ্রোহের সম্ভাবনা বেশ কিছুদিন ধরে ছিল, যেহেতু সলােন টাইরানী ছাড়াও গােষ্ঠীশাসনের বিকল্প কিছুর সন্ধান দিতে পেরেছিলেন, এথেন্স সুন্দর একটি বিকল্প হিসেবে গণতন্ত্রকে উপহার দিয়েছিল, যার কারণে আধুনিক পৃথিবীর কাছ থেকে তার অসীম কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য।

পিসিস্ট্রটাস

কিন্তু তারপরও মেগারার সাথে এথেন্সের অর্ধ-শতাব্দী পুরনাে যুদ্ধ চলছিল। এর প্রভাব ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছিল থিয়েজিনিসের মৃত্যুর পর, কিন্তু পুরাে শান্তি তখনাে আসেনি। বিশেষ করে সালামিসের মালিকানার প্রশ্ন নিয়ে দুই অঞ্চলের সংঘর্ষ কঠিন হয়ে উঠল। এটি ছিল সারনিক উপসাগরে অবস্থিত একটি ছােট্ট দ্বীপ, যেখানে অ্যাটিকার পশ্চিম উপকূল বেঁকে গিয়ে মেগারার উপকূলের সাথে মিলেছে। এটি কেবল এক মাইল দৈর্ঘ্যের, আর এতটাই নিকটে ছিল যে ইলিউসিস আর মেগারার তীর থেকে একে দেখা যেত। ড্রাকো আর সলােনের সময়, তা মেগারার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এথেন্সবাসী মনে করল, তাদেরও এর প্রতি দাবি আছে। এর সমর্থনে ইলিয়াডেও তারা প্রমাণ দেখতে পেল। বইয়ে বলা আছে, সালামিসের প্রতিনিধিত্ব করতেন বীর আয়াক্স, বীর হিসেবে যার স্থান আকিলিসের পরেই ছিল। কাব্যটির কিছু স্তবক থেকে এথেন্স সিদ্ধান্তে উপনীত হলাে যে, আয়াক্স আর এথেনীয়দের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান, তাইতাে সালামিস অ্যাটিকারই অংশবিশেষ। কিন্তু, এথেন্সবাসীদের দ্বীপটি দখল করে নেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলাে, আর মনে হলাে যে তারা এই ব্যাপারে আশাই ছেড়ে দিয়েছে। রুষ্ট হয়ে বৃদ্ধ হতে থাকা সলােন তাদের উদ্দীপিত করতে থাকেন। সৌভাগ্যজনকভাবে, সলােনের জ্ঞাতিভাই, পিসিস্ট্রটাস ছিলেন একজন পােলেমার্ক। আকর্ষণীয় ও দক্ষ পিসিস্ট্রটাস এথেনীয় বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ সালের দিকে সালামিস জয় করলেন, আর তাকে অ্যাটিকার সাথে যুক্ত করলেন। মেগারার সাথে দীর্ঘ যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটল। আর এরপরে মেগারা ক্ষুদ্র একটি শক্তি হিসেবে টিকে রইল, যা এথেন্সের প্রতি আর কোনাে হুমকিই হয়ে রইল না। কিন্তু সেখানে অভ্যন্তরীণ হুমকি ছিল। সলােনের সংস্কার এথেন্সবাসীদের কাছে কোনােভাবেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণযােগ্য হয়নি। অভিজাত পরিবারদের অস্তিত্ব তখনাে ছিল। মিলটিয়াডিসের নেতৃত্বে তারা আবার তাদের পুরনাে শক্তি ফিরে পাওয়ার আশা করতে থাকল।

তাদের বিপরীতে ছিল মধ্যবিত্তরা, যারা সলােনের সংস্কার গ্রহণ করেছিল। এই মধ্যবিত্তদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আল্কমিওনিডির একজন। অভিশাপ থাকা সত্ত্বেও সলােন পরিবারটিকে ফিরে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু গােষ্ঠীশাসকদের মধ্যে তারা অচ্ছুতই রইল। এই কারণে আর পাশাপাশি সলােনের প্রতি কৃতজ্ঞতাবােধ থেকে তারপর থেকে তারা গণতান্ত্রিকই রইল। এথেন্সবাসীদের মধ্যে অনেকেই মনে করল যে, সলােন বেশিদূর যেতে পারেনি। সালামিসের সফল বিজয়ী পিসিস্ট্রটাস তাদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করলেন আর তারা আকর্ষণীয় সেনাপতিকে অনুসরণ করতে প্রস্তুতই ছিল। তার উপর অততায়ীর হামলা হতে পারে ভেবে পিসিস্ট্রটাস নিজের জন্য একজন দেহরক্ষী নিয়ে আসলেন। আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৬১ সালে তিনি অ্যাক্রোপলিস দখল করলেন। সিলােনের চেয়ে সৌভাগ্যবান ছিলেন বলে পিসিস্ট্রটাস নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও এথেন্সের টাইরান্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এসব দেখে যাওয়ার মতাে বয়স হওয়ার পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে ৭০ বছর বয়সে সলােন মারা যান। তার এই ধরনের অনুভূতি অবশ্যই হচ্ছিল যে, তার সারা জীবনের প্রচেষ্টা বৃথা গেছে। আসলে তা ঠিক ছিল না। পিসিস্ট্রটাসের শাসন তার নিজেকে স্বৈরশাসক হিসেবে রূপায়িত করার জন্য যথেষ্ট কঠোর ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, দুটি ভিন্ন সময়ে তিনি ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। তাকে তাই খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়েছিল। দেশে তিনি সলােনের আইনই বলবৎ করে সেটাকে আরও উদারনৈতিক করে দিয়েছিলেন। আর বাইরে তিনি প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

যাই হােক, তিনি উত্তরে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। আঙ্গুর, জলপাই উৎপাদন করে আর কৃষ্ণসাগর থেকে শস্য আমদানি করে এথেন্স বিশেষায়িত কৃষির অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এথেন্সের জন্য তার নিজের আর কৃষ্ণসাগরের মাঝে জাহাজের জলপথগুলাে রক্ষা করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু এটি ছিল তার জীবন-রেখা। বিশেষ করে তার জন্য ঈজিয়ান সাগর আর কৃষ্ণসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত প্রণালিগুলাে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ছিল। কয়েক দশক আগে তারা হেলেসপন্টের এশিয়ান অংশে প্রাচীন ট্রয়ের নিকটে সিজিয়ামে একটি স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এটা ছিল লেসবিয়ান অঞ্চল, আর টাইরান্ট লেসবােসের পিটাকাস এথেনীয় বাহিনীকে পরাস্ত করে সেই জায়গা থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পিসিস্ট্রটাসের অধীনে এথেনীয়রা পুনরায় সিজিয়াম পুনরুদ্ধার করে। তখন তিনি থ্রেসিয়ান কেরসােনিসে এথেনীয় বাহিনীকে পাঠিয়ে একটি যুদ্ধে রত স্থানীয়দের সাহায্য করেছিলেন। থ্রেসিয়ান কেরসােনিস (থ্রেসিয়ান উপদ্বীপ) ছিল হেলেসপন্টের ইউরোপীয় পার্শ্বে অবস্থিত ষাট মাইল দীর্ঘ একটি একটি ভূখণ্ড (আধুনিককালে, এটি গালিপােলি উপদ্বীপ নামে পরিচিত)। সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে তিনি তার পুরনাে রাজনৈতিক শত্রু মিলটিয়াডিসকে বেছে নিলেন। সন্দেহ নেই, পিসিস্ট্রটাস মিলটিয়াডেসের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ভালাে বােধ করছিলেন। যুদ্ধে এথেন্সবাসীরা জয়ী হয়েছিল, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ সালে মিলটিয়াডেস সেই উপদ্বীপের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এভাবে এথেন্স হেলেসপন্টের উভয়দিকই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছিল, যার কারণে তার জীবনীরেখা ছিল নিরাপদ।

একজন টাইরান্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পিসিস্ট্রটাস সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তিনি হােমারের বইগুলি সতর্কতার সাথে সম্পাদনা করিয়ে সেই পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন, যেভাবে আজ আমরা সেগুলাে দেখতে পাই। তিনি অ্যাক্রোপলিসে নতুন উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন, আর এটি যাতে আরেক শতাব্দীতে পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়ে পরিণত হয়, সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তিনি নতুন নতুন উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন, আর পুরাতনগুলােকে আরাে জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলেছিলেন। বিশেষ করে ডায়ােনিসিয়াসের সম্মানে একটি নতুন উৎসব শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল কিংবদন্তীর প্রাণী অর্ধ-মানব অর্ধ-ছাগল প্রদর্শিত সাটিরের শােভাযাত্রা। সেখানে ডায়ােনিসিয়াসের সম্মানে ‘ট্রাগােইডিয়া’ গাওয়া হত (ছাগল সংগীত)। সেই ছাগল-সংগীতগুলাে সাধারণত আমােদপূর্ণ বা হৈচৈপূর্ণ হত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এমনকি রাজকীয় আর ভ্রাম্যমাণ কবিরাও উৎসবে ব্যবহারের জন্য ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্তবক রচনা করতে লাগলেন। রাষ্ট্রীয় কবিতায় তারা পুরাতন উপকথাই নতুন করে বলত, আর এভাবে মহাবিশ্বের রীতিনীতিগুলােকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তা ব্যবহৃত হত। এগুলােকে আজও ‘ছাগল-সংগীত’ বলা হয়, যাদেরকে ইংরেজিতে আমরা “ট্র্যাজেডি” বলি। প্রকৃতপক্ষে, ট্র্যাজেডিতে দলবদ্ধভাবে কোরাস সংগীত গাওয়া হয়। কিন্তু পিসিস্ট্রটাসের সময়ে থেসপিস নামের এক এথেনীয় কবির ডায়ােনিসিয়াস উৎসবের জন্য সংগীত লেখার সাহস হয়েছিল, যেখানে প্রায়ই কোরাস বন্ধ রাখা হত, আর তার বদলে একটি নির্দিষ্ট চরিত্র পুরাতন উপকথার গল্পগুলাে বলত আর অভিনয় করে দেখাত। এই লােকটি ছিল প্রথম অভিনেতা, আর আজকের দিনে আমরা, মজা করে, একজন অভিনেতাকে ‘থেসপিয়ান’ বলে ডাকি। পিসিস্ট্রটাস খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ সালে মারা গেলেন, সাথে সাথেই একজন ভদ্র আর ভালাে-স্বভাবের টাইরান্টেরও অবসান ঘটল।

ক্লিসথিনিসের ক্ষমতা লাভ ও স্পার্টার সাথে সংঘর্ষ

পিসিস্ট্রটাসের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র হিপ্পিয়াস আর হিপার্কাস টাইরানীতে অভিষিক্ত হলেন এবং ভ্রাতৃত্বের ভাবধারায় যৌথভাবে শাসন করতে লাগলেন। কিছু সময় তারা তাদের পিতার নীতিগুলাে বয়ে নিয়ে চললেন, আর এথেন্স শিল্প উৎসাহিত করার একটি শহর হিসেবে এগিয়ে চলল। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকেই কবি আর নাট্যকার এথেন্সে আসতে লাগল, যেখানে তারা সমর্থন আর সাহায্যের ব্যাপারে সংস্কৃতিবান টাইরানী শাসকদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, টিওসের কবি আনাক্রিয়নের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সামােসের পলিক্রেটিস। পলিক্রেটিসের মৃত্যুর পর হিপার্কাস তাকে এথেন্সে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু, এথেন্সের শান্তশিষ্ট টাইরানীর যুগের সমাপ্তি ঘটেছিল। হারমােডিয়াস আর এরিস্টোজিটন নামে দুই তরুণ এথেন্সবাসীর সাথে হিপার্কাসের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল, যার কিছুই আসলে টাইরানীর সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল না, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫১৪ সালে তারা তাকে গুপ্তহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। একজন টাইরান্টকে মেরে ফেলে আরেকজনকে শােধ নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়াটা পাগলামী হত বলে তারা দুজনকেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা ঠিকভাবেই কাজ করেনি। পরিকল্পনাকারীরা অনুমান করেছিলেন যে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। তাই তারা সময়ের আগেই আঘাত হানলেন। তারা হিপার্কাসকে হত্যা করতে সমর্থ হলাে, কিন্তু হিপ্পিয়াস পালিয়ে গেল। অবশ্যই তিনি পরে এর শােধ নিয়েছিলেন। হারমােডিয়াস আর এরিস্টোজিটনকে নিকাশ করা হলাে। এই গুপ্তহত্যার ঘটনা হিপ্পিয়াসকে ত্যক্ত বিরক্ত করে তুলল। তের বছরের আরামদায়ক শাসনে থেকে তিনি জীবনের কষ্টদায়ক ব্যাপারটি অনুধাবন করলেন যে টাইরান্টরা প্রতিদিনই বিপদের মধ্যে বাস করে। তিনি সবাইকেই সন্দেহ করলেন আর এক ভীতিকর শাসনের যুগের সূচনা করলেন। টাইরানিক শাসনে এথেন্সবাসীরা বিদ্রোহী হতে শুরু করল, এরফলে আল্কমিওনিডি পরিবার ক্ষমতায় আসবার সুযোগ লাভ করলো, এই পরিবার আরেকবার পিসিস্ট্রটাসের শাসনামলে নির্বাসনদণ্ড প্রদান করেছিলেন। এইসময় আল্কমিওনিডি পরিবারের প্রধান ছিলেন সেই মেগাক্লিসের নাতি ক্লিসথিনিস।

ডেলফির কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেকে অনুগ্রহভাজন করার জন্য ক্লিসথিনিস একটি চমৎকার উপসানালয় নির্মাণ করতে শুরু করলেন তার পারিবারিক খরচে। এর ফলে ডেলফির ওরাকলরা স্পার্টানদেরকে পরামর্শ দেয় যাতে তারা টাইরান্টদের হাত থেকে এথেনীয়দেরকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করে। স্পার্টানরা সত্যিকার অর্থে তা করার জন্য মনস্থির করেছিল। তখন তারা একক ক্ষমতাধর সামরিক শক্তি ছিল। তারা পেলােপনেসাসে সকল টাইরানিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গােষ্ঠীশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অ্যাটিকাতেও তাদের একইরকম কাজ করার ইচ্ছা ছিল তাদের। খ্রিস্টপূর্ব ৫১০ সালে স্পার্টার রাজা প্রথম ক্লিওমিনিস অ্যাটিকার দিকে অগ্রসর হলেন এবং হিপ্পিয়াসকে পরাভূত করে তাকে নির্বাসনে পাঠালেন। স্পার্টানরা নিশ্চিতভাবেই কোনাে স্বার্থ ছাড়া তা করেনি। চলে যাওয়ার আগে, তারা এথেন্সকে স্পার্টার মিত্রশক্তিতে যােগদান করতে রাজি করিয়েছিল। ক্লিওমিনিস নিশ্চিতই এথেন্সে একটি গােষ্ঠীশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশা করেছিলেন। যাই হােক, পুরনাে অভিশাপকে ধন্যবাদ যে, ক্লিসথিনিস আর আল্কমিওনিডি ছিলেন গণতান্ত্রিক, আর তারা শুধু সলােনের সংবিধানের দিকেই যায়নি, বরং গণতন্ত্রের পরবর্তী অগ্রগতির দিকেও তাদের নজর ছিল। গােষ্ঠীশাসকরা যখন দেখল বেশিরভাগ লােকই ক্লিসথিনিসের পক্ষে, তখন তারা এটা দেখিয়ে স্পার্টানদের সাহায্যের জন্য আহ্বান করল যে, অভিশাপে থাকায় আল্কমিওনিডি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৭ সালে ক্লিওমিনিস চলে এলেন আর আল্কমিওনিডির প্রস্থান ঘটল। কিন্তু এবারে ক্লিওমিনিস ঘটনাপ্রবাহকে হালকাভাবে নিলেন। তিনি তার স্পার্টানদের সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত গর্বিত ছিলেন, এবং সম্ভবত তিনি এথেনীয় উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বেশি অবজ্ঞাভরে গ্রহণ করেছিলেন। এই কাজ করবার জন্য তার বাহিনী ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র, আর সাধারণ জনগণের উত্থান অ্যাক্রোপলিসে তাকে বেকায়দায় ফেলে দিল। ত্যক্ত-বিরক্ত ক্লিওমিনিস ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হলেন আর স্পার্টায় ফিরে গেলেন।

ক্লিসথিনিস আবার জয়ের ধারায় ফিরে এলেন, আর একটি নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হলেন। তিনি অ্যাটিকাকে একটি জটিল পদ্ধতিতে দলভুক্ত করলেন এবং পূর্বের গােত্র আর শ্রেণির বিভাজনকে বাতিল করলেন। জনগণ যাতে নিজেদেরকে সেইসব পুরনো শ্রেণির সদস্য হিসেবে ভাবতে না পারেন তা নিশ্চিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। নতুন কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত দলের কোন ঐতিহ্যপ্রীতি না থাকায় কেবলমাত্র “এথেনীয়” পরিচয় ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিল না। তিনি সরকারে দরিদ্রতর শ্রেণির অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়িয়েছিলেন। যদিও এথেন্সে স্বাধীনতার মাত্রা বেড়েছিল, প্রাচীন দুনিয়ায় অ্যাটিকার সর্বত্র দাসদের অস্তিত্ব ছিল। দাসদের কোনাে অধিকার ছিল না আর এমনকি সবচাইতে অগ্রসর গ্রিক শহরগুলােতেও তাদের সাথে কখনাে কখনাে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা হত। এই ছিল গ্রিক সভ্যতার ভাগ্যলিপি যাকে তখন কোনভাবে দূর করা যায়নি। খুব কম গ্রিকই সেসময় দাসপ্রথাকে ভুল মনে করত। পরবর্তী বছরগুলােতে এথেনীয়রা টাইরান্টদের পতনকে এক নাটকীয়তায় নিয়ে গেল। তারা এথেন্সের টাইরানির পতন নিয়ে যে লিজেন্ড ও লোকগাথার জন্ম দেয় তাতে তারা স্পার্টানদের অবদানকে অনেকটা বাদই দেয়, অবশ্যই স্পার্টানদের কাছে বিব্রতকর হারের জন্য তা তারা করেছিল। এদিকে তারা হারমােডিয়াস ও এরিস্টোজিটনের মতো গুপ্তঘাতকদেরকে বীরে পরিণত করল, যদিও তাদের পরিকল্পনা অকার্যকর হয়েছিল ও টাইরানির পতনে তাদের ভূমিকা কমই ছিল। এথেনীয়রা হিপ্পিয়াসের নিষ্ঠুরতাকেও স্তাবকতায় পূর্ণ করেছিল, আর টাইরানী শব্দটিতে নেতিবাচকতা প্রবেশ করিয়ে একে একটি ঘৃণ্য ব্যাপারে পরিণত হতে সাহায্য করেছিল।

থিবান, স্পার্টান ও ক্যালসিডিয়ানদের সাথে দ্বন্দ্ব

টাইরানীর পতন আর গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এথেন্সবাসীকে বিশাল শক্তি আর আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল। পরবর্তী শতকে তারা যা করেছিল, তার সবটুকুতেই তারা সৌভাগ্যের স্পর্শ পেয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তারা অ্যাটিকার সীমানার একটু উত্তরে ক্ষুদ্র বিয়োটিয়ান শহর প্লাটিয়ার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। প্লাটিয়ানরা নিজেদের সেইসব লােকের উত্তরসূরী মনে করত যারা ছয় শতাব্দী পূর্বের বিয়োটিয়ান দখলের আগে থেকে সেখানে বাস করত। তাই তারা বিয়োটিয়ান যুক্তরাষ্ট্র বা থিবান নেতৃত্বে যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানাল। এথেন্স এই অস্বীকৃতিতে তাদের অটল থাকার ব্যাপারে অবদান রেখেছিল। থিবানরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫০৬ সালের দিকে তাদের সেই সুযােগ এলো। স্পার্টার ক্লিওমিনিস অ্যাটিকায় আগের বছরে তার ক্ষতির কথা স্মরণ করে এথেন্সবাসীকে সমূলে ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার পেলােপনেসিয় জোটকে নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে অ্যাটিকার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন, আর তীব্র আক্রমণ করলেন উত্তরদিক থেকে। একটি বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করতে তৎপর কালসিসও থিবানদের সাথে যােগ দিল। মনে হলাে এথেন্স পুরােই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু কোরিন্থ সেই সম্ভাবনাকে কমিয়ে দিল। এক শতাব্দী আগে পেরিয়ান্ডারের সময়কাল থেকে ঈজিনা ছিল তার বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী। এথেন্সের ধ্বংসের ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবেই ঈজিনার হাতে ছিল, যেহেতু এথেন্সের সাথে ঈজিনার দীর্ঘদিনের একটা শত্রুতা ছিল। কিন্তু কোরিন্থ স্পার্টার সাথে সামনে অগ্রসর হতে অস্বীকৃতি জানাল। তার বদলে তারা পেলােপনেসিয়ান জোট ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো। কোনােরকম আঘাত হানতে পারার আগেই আরেকবার হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হলাে ক্লিওমিনিসকে। এথেনীয়রা এখন থিবানদের অভিমুখে অগ্রসর হলাে যারা তাদের স্পার্টার জোট অসহায়ভাবে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারা থিবানদের পরাজিত করে প্লাটিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করল। ভেতরে চাপা ক্ষোভ পুষে রাখা থিবানরা এটা ভুলে যায়নি। আর এই কারণেই পরবর্তী শতাব্দীগুলােতে তারা প্লাটিয়া আর এথেন্স উভয়ের সাথেই তাদের শত্রুতা বজায় রেখেছিল। এথেনীয়রা আরও সহজেই কালসিডিয়ানদের পরাস্ত করেছিল, আর অ্যাটিকার সরু প্রণালি পেরিয়ে ইউবিয়া দ্বীপের একখণ্ড এলাকা কালসিডিয়া তাদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। এটা এথেন্সের হস্তগত হলাে আর অ্যাটিকার অংশে যুক্ত হলাে। এই উপনিবেশে বাস করা সবারই এথেনীয় নাগরিকত্বের ওপর পূর্ণ অধিকার ছিল। কিন্তু ক্লিসথিনিসের অধীনে এথেন্স যত বিপদের মুখােমুখি হয়েছিল, তা পরবর্তীতে গ্রিক দুনিয়ার বাইরে থেকে আসা হুমকির কাছে ক্ষুদ্রই ছিল। ডােরিয়ান আগ্রাসন পরবর্তী ৫০০ বছরে গ্রিকদের সৌভাগ্যজনকভাবে কোনাে উল্লেখযােগ্য বড় শক্তির মুখােমুখি হতে হয়নি। ক্ষীণবল মিশরীয়অগ্রসরমান আসিরিয়ানরা কোনাে হুমকি ছিল না। আর ফিনিসিয়ান ও কার্থেজিয়ানরা কেবলমাত্র প্রান্তসীমানার বাহ্যভূমিই স্পর্শ করতে পেরেছিল। টাইরান্টদের আমলে বিশাল কিছু ঘটনা পূর্বাঞ্চলকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আর ক্লিসথিনিসের সময়ে একটি দানবীয় শক্তি পূর্বপ্রান্ত দিয়ে গ্রিসে প্রবেশ করেছিল, আর পুরাে গ্রিসকেই সম্ভবত তাদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এই দানবীয় শক্তির নাম পারস্য

এশিয়া মাইনোর ও ইউরোপে পারসিক আক্রমণ এবং গ্রেকো-পারসিক যুদ্ধ (৪৯৮ – ৪৪৮ খ্রি.পূ.)

এই আলোচনায় যাবার পূর্বে এশিয়া মাইনোরে লিডিয়ার ইতিহাস জানা প্রয়োজন। তা পড়তে এখানে যান।

সাইরাসের এশিয়া মাইনোর বিজয়

লিডিয়ায় পারস্যরাজ সাইরাসের আক্রমণ : এশিয়া মাইনোরের লিডিয়ার রাজা ক্রিসাসের (খ্রি.পূ. ৫৬০-৫৪৬) শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পারসিকরাজ সাইরাস। মিডিয়ার ৫০০ মাইল দক্ষিণে ফারস নামে একটি অঞ্চল ছিল, যা গ্রিকদের কাছে পরিচিত পারসিস নামে, আজ আমরা একেই পারসিয়া বা পারস্য বলি। ভাষা আর সংস্কৃতিতে পারসিয়ানরা ছিল মিডিসের কাছাকাছি। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে, অথবা তার কাছাকাছি সময়ে, একজন পারসিয়ান গােত্রের নেতার ঘরে এক সন্তানের জন্ম হলাে। তার নাম দেয়া হলাে কুরুশ (অর্থ সূর্য), কিন্তু তিনি আমাদের কাছে সাইরাস (Cyrus) নামে পরিচিত, যা তার নামের গ্রিক সংস্করণের ল্যাটিন উচ্চারণ। পরবর্তীতে কিংবদন্তী তাকে মিডিয়ার শাসক আস্টিয়াজিসের নাতি বানিয়ে দেয়, কিন্তু তা আসলে নাও হতে পারে। সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৮ সালে পারসিয়ায় তার পিতার শাসনের উত্তরাধিকারী হন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ সালে তিনি মিডিয়ান রাজার বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের সূচনা করেন। তিনি আস্টিয়াজিসকে পরাভূত করে পারস্য সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হন। এই সাইরাসই এসময় বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে সাইরাস মিডিয়ার সাথে লিডিয়ার বিবাদের সুযােগ নিতে তৈরি হন।

ক্রিসাসের পরাজয় : চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করতে লিডিয়াও পিছপা ছিল না। ক্রিসাস ভাবলেন শত্রু মিডিয়ার অঞ্চলে শাসকের পরিবর্তনের ফলে পূর্বদিকে তার শক্তি বাড়িয়ে নেয়ার চমৎকার সুযােগ রয়েছে। পারসিকদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য অনুধাবন করার পর ক্রিসাসই সাইরাসকে সর্বপ্রথম আক্রমণ করেন। ক্রিসাস পরিসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কারণ গ্রীসের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র স্পার্টার সাথে তার সমঝােতা ছিল। এছাড়া ক্যালডীয়া এবং মিশরের সাথেও তার মিত্রতা ছিল। এ সময় তিনি ডেলফির মন্দিরে গিয়ে অ্যাপােলাে দেবতার নিকট ভবিষ্যদ্বাণী প্রার্থনা করেন। তিনি ডেলফির ওরাকলের সাথে পরামর্শ করেছিলেন আর ওরাকল তাকে আশ্বস্ত করল যে, “যদি ক্রিসাস হেলিস অতিক্রম করে, সে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ধ্বংস করবে।” কিন্তু ওরাকল এটা বলেনি যে কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হতে যাচ্ছে! ক্রিসাসও তাকে তা জিজ্ঞেস করেননি, ধরে নিয়েছিলেন পারস্যের কথাই বলা হচ্ছে। ক্রিসাস হেলিস (Halys) পার হয়ে গেলেন, যেখানে সাইরাসের সাথে এক যুদ্ধে তার মােকাবেলা হলাে। খৃষ্টপূর্ব ৫৪৬ অব্দের এই এ যুদ্ধে ক্রিসাস পরাজিত হন। ক্রিসাস তার মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় মিত্রদের নিকট থেকে সামরিক সাহায্য লাভ করার আগেই সাইরাস হাজার মাইল পথ দ্রুত অতিক্রম করে হ্যালিস নর্দীর সীমান্তে উপনীত হন। এছাড়া পারসিকরা আকস্মিকভাবে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। লিডিয়ান সৈন্যরা পারস্য উটের দুর্গন্ধে দিশেহারা হয়ে গেল, আর দ্বিধাগ্রস্ততার মধ্যে সাইরাস একটি পরিপূর্ণ বিজয় লাভ করলেন। তিনি হেলিসের প্রান্তসীমায় লিডিয়ানদের কব্জা করলেন, আর এরপর তিনি সারদিসের (Sardis) দখল নিলেন। এভাবে পারসিকরা লিডিয়া দখল করে এবং ক্রিসাস বন্দী হন। তবে সাইরাস ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা যিনি ক্রিসাসকে একজন সম্মানিত অতিখির মর্যাদা দেন ও একবাতায়নায় তাকে বসবাস করার অনুমতি দেন। সেখানে খৃষ্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে ক্রিসাসের মৃত্যু হয়। ডেলফির ওরাকল যে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কথা বলেছিল তা ছিল ক্রিসাসের নিজেরই সাম্রাজ্য। আর কোন দিন লিডিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। এটি ওরাকলের দ্ব্যর্থবােধক ঘােষণার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ, ঘটনা যাই ঘটুক, দ্ব্যর্থতার জন্যই ওরাকল যা বলতো তা সত্য হলো! এই কারণেই এরকম দ্ব্যর্থতাপূর্ণ ঘােষণাকে “ওরাকুলার” বা ডেলফিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

আয়োনীয় গ্রিক নগরগুলোয় সাইরাসের আক্রমণ : লিডিয়ার ধ্বংসের সাথে সাথে উপকূলে আর কোনাে গ্রিক শহরগুলোও হুমকির মুখে পড়ল। এবারও তারা ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হলাে। প্রিয়েনি নামক মিলেটাসের নিকটের একটি শহরের বায়াস অফ প্রিয়েনি (Bias of Priene) নামে একজন আয়োনীয় পলায়নের একটি পন্থা বাতলে দিলেন। তিনি সব গ্রিককেই জাহাজে করে পশ্চিমে সার্দিনিয়ায় পাড়ি জমাতে প্রস্তাব করলেন, যেটি তখন গ্রিক বসতি স্থাপনের জন্য কেবলই উপযুক্ত করা হয়েছে। বায়াসকে পরবর্তীতে সাতজন জ্ঞানী মানুষের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এরা পালিয়ে গেলেও বেশিরভাগ আয়োনীয় গ্রিকরা তাদের জায়গাতেই থেকে গেল, আর একে একে আয়োনীয় নগরগুলোকে সাইরাসের জেনারেলরা কব্জা করতে লাগল। আর এবারও একমাত্র মিলেটাস নগরই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হল। কিন্তু গ্রিক নগরগুলোর সাথে বোঝাপড়া করার আগেই সাইরাস দক্ষিণের দিকে আরও একটি বড় খেলা খেলবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬২ অব্দে নেবুচাদনেজার মারা যান আর ক্যালডীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন দুর্বল রাজারা। এই সাম্রাজ্য ক্রিসাসকে সাহায্য করতে চেয়েছিল কিন্তু তাতে ভাল কিছুই হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে সাইরাস সহজেই ক্যালডীয় সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেন। এরপর সাইরাস পূর্বমুখী যাত্রা করে ভারত ও চীনের সীমান্ত-অঞ্চল অব্দি কব্জা করে ফেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দে তিনি মারা যান। এভাবে গ্রিক দুনিয়ার একটি অংশ সাইরাসের এই বিশাল ভূখণ্ডের সাম্রাজ্যের একটি অংশ হয়ে গেল, যা গ্রিকদেরকে নিরাপদে বিশাল ভূখণ্ডের এই মহাদেশীয় অংশে ভ্রমণ করা সম্ভব করে দেয়। যে একজন গ্রিক এর সুবিধা নিলেন, তিনি হলেন মিলেটাসের হেকাটিউজ, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের ভেতর দিয়ে মুক্তভাবে ভ্রমণ করেছিলেন এবং ভূগােল আর ইতিহাসের ওপর বই লিখেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এগুলো টিকে নেই। পরবর্তী লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যার কাছে ইতিহাস ছিল দেবতা আর বীরদের কিংবদন্তী থেকেও বেশি কিছু। প্রকৃতপক্ষে, তিনি উপকথা সম্মন্ধে সন্দেহযুক্ত আর সরাসরি নিন্দামূলক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, যা একজন আয়োনিয়ানের কাছ থেকেই তখন আশা করা যেতো।

প্রথম দারিউসের ইউরোপ আক্রমণ

প্রথম দারিউসের ক্ষমতায় আসা : সাইরাসের মৃত্যুর পরও পারস্যদের দিগ্বিজয় চলতে লাগল। তার পুত্র ক্যাম্বিসেস (Cambyses) অনুধাবন করলেন মিশর তার সঠিক শিকার, কেন না এটিই ছিল পুরনো আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের একটি অংশ যা এখনাে স্বাধীন রয়ে গেছে। মিশর তখন ১৫০ বছর ধরে স্বাধীন ছিল, এবং তার রাজা, গ্রিসের বন্ধু এবং সামােসের পলিক্রেটিসের এক সময়ের মিত্র, আমেসিস, প্রচুর শক্তির সাথে সাইরাসের উত্থান এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি দেখছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালে মারা যান, ঠিক যখনই ক্যাম্বিসেস তার আক্রমণ সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পারসিয়ান বহিঃআক্রমণ সম্পূর্ণ সফল হলাে আর মিশর পারসিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গেল। ক্যাম্বিসেস যখন মিশরে ছিলেন, যেভাবেই হােক, দেশে একটি বিদ্রোহ দেখা দিল। ব্যাপারটি দেখার জন্য পেছনে ফিরে আসার পর, ক্যাম্বিসেস খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ সালে মারা যান, সম্ভবত দুর্ঘটনার বা আত্মহত্যার কারণে। পারস্য সাম্রজ্যের এর পরের চার বছর ছিল বিভ্রান্তি ও গৃহযুদ্ধময়। প্রতিষ্ঠার মাত্র এক প্রজন্ম পরেই এই সাম্রাজ্যটি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। পারস্যের রাজকীয় পরিবারের একমাত্র প্রথম দারিউসই সাম্রাজ্যকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। ৫২১ সালে তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং পারস্যের সকল বিদ্রোহকে শক্তি ও দক্ষতার সাথে দমন করেন, বিশেষভাবে তিনি দমন করেন ব্যাবিলনিয়ার বিদ্রোহটি, যা খুব বিপজ্জনক ছিল। তিনি অনুধাবন করলেন, পারস্যের এতদিনকার অবাধ দিগ্বিজয়কে থামিয়ে দেবার এটাই সঠিক সময়, কেননা এবারে এতদিন যাবৎ যেসব অঞ্চলকে জয় করা হয়েছে সেগুলোকেই ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিতে হবে। আর এই কাজটা সহজ ছিলনা। ১০ মাইলের একটা গ্রিক নগরকে পরিচালনা করা সহজ, কিন্তু পারস্য সাম্রাজ্য ছিল আজকের স্ট্যান্ডার্ডেও অনেক বিশাল, পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২৫০০ মাইল বিস্তৃত। এতে ছিল পর্বত, মরুভূমি, আর ভূমিতে যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল ঘোড়া বা উট। দারিয়ুস সাম্রাজ্যটিকে বিশটি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন, যার প্রত্যেকটির দায়িত্বে ছিলেন একজন শতরাপাভন বা রাজ্যের রক্ষাকর্তা। গ্রিকদের কাছে, এই শব্দটি ছিল সত্রপ, আমাদের কাছেও তাই, আর একেকটি পারস্য প্রদেশ হলাে ‘সত্রপি’। দারিয়ুস সাম্রাজ্যের পূর্বের সড়কসমূহের উন্নয়ন সাধন করেন ও নতুন সড়ক তৈরি করেন, উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখা। লিডীয়রা যে মুদ্রাব্যবস্থা আবিষ্কার করেছিল তিনি সেটাকে গ্রহণ করেন। এসব কারণে তার অধীনে পারস্য সাম্রাজ্যের উন্নতি লাভ করতে থাকে।

প্রথম দারিউসের ঈজিয়ান দ্বীপসহ ও বলকানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল : এভাবে সাম্রাজ্যে শান্তি ফিরে আসার পর দারিয়ুস চিন্তা করলেন, এবারে সাম্রাজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে নজর দেয়া যাক। সাইরাস এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করেছিলেন, ক্যাম্বিসেস তাতে আফ্রিকার অঞ্চলগুলো যোগ করেছিলেন। দারিয়ুসের জন্য তাই ইউরোপই বাকি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ সালে, দারিয়ুসের নেতৃত্বাধীন পারস্য সেনাদল ইউরোপের প্রণালি পেরিয়ে থ্রেসে অগ্রসর হল। এবারও পারস্যের সেনাবাহিনী সফল, এবং পারস্য সাম্রাজ্যে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে দানিয়ুব নদীর মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলাে। এই অভিযানে নতুন গ্রিক অঞ্চলগুলাে পারস্য সাম্রাজ্যে চলে আসে। দারিউসের পূর্বসূরী সাইরাস ইতিপূর্বে লিডিয়া দখল করেন। এই বিজয়ের ফলে পারসিকরা এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলের গ্রীক ভাষাভাষী নগরীগুলোর শাসকে পরিণত হয়। এরপর দারিউস গ্রিসে সমরাভিযান পরিচালনা করে গ্রিসের অংশবিশেষ ও ম্যাসিডােনিয়া পর্যন্ত এলাকাকে নিজের রাজ্যভুক্ত করতে পেরেছিলেন। অর্ধশতাব্দী পূর্বে পিসিস্ট্রটাস থ্রেসিয়ান কেরসােনিসে এথেনিয়ান বাহিনীকে পাঠিয়ে একটি যুদ্ধে যুদ্ধরত স্থানীয়দের সাহায্য করেছিলেন। থ্রেসিয়ান কেরসােনিস (থ্রেসিয়ান উপদ্বীপ) ছিল হেলেসপন্টের ইউরোপীয় পার্শ্বে অবস্থিত ষাট মাইল দীর্ঘ একটি একটি ভূখণ্ড (আধুনিককালে, এটি গালিপােলি উপদ্বীপ নামে পরিচিত)। সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে পিসিস্ট্রটাস তার পুরনাে রাজনৈতিক শত্রু মিলটিয়াডিসকে বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধে এথেন্সবাসীরা জয়ী হয়েছিল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ সালে মিলটিয়াডিস সেই উপদ্বীপের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যাই হোক, এবারে এই থ্রেসিয়ান কেরনোসিস পারস্যদের অধীনে চলে এলো। এমনকি লেমনস আর ইমব্রোসের মতাে দক্ষিণের ঈজিয়ান দ্বীপও পারস্য সাম্রাজ্যের হয়ে যায়। এভাবে দারিউসের সৈন্যরা প্রোপন্টিস থেকে স্ক্রাইমন নদী পর্যন্ত থ্রেস এবং লেমন্‌স ও ইমব্রোস দ্বীপকে পারসিক প্রদেশে পরিণত করেন। দারিয়ুস ইউরোপে তার অধীনস্ত অঞ্চলগুলোকে শান্তিতে শাসন করবেন এই আশা নিয়েই ফিরে এলেন। আর এটাই হবার কথা ছিল, যদিনা মিলেটাস ও এথেন্স তার শান্তিতে বাধা না দিত। 

শকদের বিরুদ্ধে দারিউসের অভিযান : দারিউস পশ্চিমদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে মূল ভূখণ্ডের গ্রীকদের প্রতি তার নীতির ভিত্তি কি হবে তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। আত্মীকরণ (absorption) করা ছিল এক্ষেত্রে একটি সমাধান। কিন্তু তিনি অবহিত ছিলেন যে, এশীয় ভূখণ্ডের গ্রীকরা ভাল যােদ্ধা, নাবিক, সভ্য, পৌরুষপূর্ণ এবং বিত্তবান। আবার গ্রীস আক্রমণ করার পূর্বে তাকে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয় যে, গ্রীস পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাতায়াত পথের কোন স্থান শক বা সিথিয়ান জাতি কর্তৃক আক্রান্ত হবে না। এ সময় শকরা দারিউসের রাজ্য আক্রমন করত। আপাতদৃষ্টিতে দারিউস সদ্য প্রতিষ্ঠিত শক সাম্রাজ্যকে আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণ সাগরের উত্তরদিকে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইউরােপীয় দৃষ্টিকোন থেকে এই সাম্রাজ্য ছিল একটি অগ্রবর্তী এলাকা। সম্ভবত ফিরতি যাত্রায় তিনি শকদের মূলভূখণ্ড বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এক্ষত্রে তিনি এই অভিযানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক দিক ও অসুবিধাকে ঠিকমত উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হন। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ অব্দে দারিউস বসফরাস প্রণালীর ওপর নৌকা সংযুক্ত করে নির্মিত একটি কৃত্রিম সেতুর ওপর দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেন। এর ওপর দিয়ে প্রণালী পার হয়ে তিনি দানিয়ুব এলাকার দিকে চলে যান। অতপর আয়োনীয় অঞ্চলের স্বৈরাচারী শাসকগণ কর্তৃক সরবরাহকৃত একই ধরনের নৌকাযােগে গঠিত সেতুর ওপর দিয়ে তিনি দানিয়ুব অতিক্রম করেন। কিন্তু শকরা দারিউসের বাহিনীকে রণক্ষেত্রে মােকাবেলা করার পরিবর্তে তার বাহিনীকে উপর্যুপরি হয়রানি করতে থাকে। তাছাড়া রসদ ও পানীয়ের নিদারুন অভাব দেখা দেয়। এসব কিছুর ফলে শক ভূখণ্ড জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি ভােলগা অঞ্চলে পর্যন্ত গমন করেন এবং এমনকি দক্ষিণ ইউক্রেন পর্যন্ত তিনি শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্ত্র শকরা ইউক্রেনের গভীর অভ্যন্তরভাগে আত্মগােপন করে এবং দারিউস তাদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক উভয় দিকই ছিল। ভিনসেন্ট এম স্ক্রামুজ্জা এবং পল এল, ম্যাককেন্ড্রিক এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “নেপোলিয়ন ও হিটলারের মতো তিনি খালি হাতে পশ্চাদপসরণ করেন, কিন্তু দানিউবের মুখ পর্যন্ত তিনি তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সাম্রাজ্য ছিল সেই সময়ের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ, এটি প্রায় বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ ছিল, এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অংশ নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত ছিল।” (Scramuzza et. al. 111)। এভাবে ৩৭ বছরের মধ্যে পারসিকরা নিজেদেরকে একটি শাসিত জনগােষ্ঠির পর্যায় থেকে শাসকের মর্যাদায় উন্নীত করে। তাদের এই সাম্রাজ্যে আনাতােলিয়া, মিশর, মেসােপটেমিয়া, ইরান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সাম্রাজ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ম্যাককে. হিল ও বাকলার লিখেছেন যে, ”তারা (পারসিক) একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার মধ্যে প্রাচীন ও সবচেয়ে সম্মানিত রাজ্যগুলো  ও প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের জনসাধারণও অন্তর্ভূক্ত ছিল, এরকম বিশাল রাজনৈতিক সংগঠনের দ্বারা এই অঞ্চলগুলোর একত্রীকরণ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।” (McKay et. al., 59)। তবে সাম্রাজ্য বিস্তৃতির চেয়ে যে নীতির ভিত্তিতে এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে তা ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিজিত অসংখ্য জাতিকে একই সরকারের অধীনে অনায়ন করা হয়, যদিও প্রত্যেক জাতির জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা হয়।

আয়োনীয় বিদ্রোহ (৪৯৯ – ৪৯৩ খ্রি.পূ.)

আয়োনীয় গ্রিকরা পারস্য আধিপত্যের অধীনে পুরােপুরি অসুখী ছিল। শুধু দাসত্বে আবদ্ধ হতেই তাদের বাকি ছিল। তখনাে তাদেরকে টাইরান্টদের আর শহরের ওপর চোখ রাখার নিমিত্তে একটা বার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান করতে হত। পারস্য প্রতিনিধিসহ পারস্যদের নিয়ােগ করা কিছু টাইরান্টের শাসন সহ্য করতে হয়েছিল তাদের। কিছু দিক দিয়ে এটা লিডীয়দের অধীনে থাকার চেয়ে খুব একটা খারাপ ছিল। যাই হােক, লিডীয় রাজধানী ছিল পঞ্চাশ মাইল দূরে, আর লিডীয় সম্রাটরা সবাই সংস্কৃতিতে মােটামুটি গ্রিকই ছিল। গ্রিক আর লিডীয়রা একে অপরকে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু পারসিক ম্রাটরা আয়োনিয়ার ২০০ মাইল পূর্বে সুসাতে শাসন করতো। এমনকি দারিয়ুস নিজেই নতুন একটি রাজধানী গড়ে তুললেন, যাকে গ্রিকরা বলত ‘পারসিপােলিস’ বা ‘পারস্যদের শহর’, এবং এটিও ছিল ৩০০ মাইল দূরে। দূরবর্তী পারস্য রাজারা গ্রিকদের সম্পর্কে কিছুই জানত না এবং তাদের প্রভাবের অনেক দূরে ছিল। তারা পূর্ববর্তী অ্যাসিরীয় আর ক্যালডীয় সম্রাটদের স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা গ্রহণ করেছিল আর গ্রিকরা তাদের নতুন প্রভুদের প্রাচ্যদেশীয় ভাবধারার কারণে অস্বস্তিবােধ করল। পারসিক শাসনের উদারতা সত্ত্বেও এসব নগরী অন্যান্য স্বাধীন গ্রীক নগররাষ্ট্রের মত স্বাধীনতা লাভের জন্য আকাঙ্ক্ষা পোষন করতে থাকে, তবে দারিউসের অধীনে পারস্য সাম্রাজ্য যে খুব উদার ছিল তাও বলা যাবে না। দার্দনেলিস বা হেলেসপন্ট অতিক্রমের পর থ্রেসীয় উপকূলের অংশবিশেষ জয়ের পর দারিউস সেখানে অতিরিক্ত করারােপ করেন। এই বিজয় এথেনীয়দের জন্যে হুমকির সৃষ্টি করেছিল। আয়ােনীয় গ্রিকরা তার নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। বিজিত এলাকার লােকদেরকে তিনি সেনাদলে জোর করে ভর্তি করাতে শুরু করেন। পারসিকদের এরকম শোষণ চলতে থাকলে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ সালে আয়োনীয়রা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে তখন তারা কোনাে নেতা খুঁজে পেলেই বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। তারা এই নেতৃত্ব খুঁজে পেলো এরিস্টোগােরাসের মধ্যে। তিনি মিলেটাসের দায়িত্বে ছিলেন, আর তার টাইরান্ট শ্যালক ছিলেন দারিয়ুসের দরবারে। এরিস্টোগােরাস পারস্যদের সুনজর হারালেন আর তার জীবনে বিপদও অনেকটা ঘনিয়ে এলো। এই বিপদকে পাশ কাটানোর জন্য তার হাতে একটাই পথ ছিল – পারস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, আর স্বাধীন আয়োনিয়ার প্রভু হিসেবে টিকে থাকা।

আয়োনীয় শহরগুলাে আগ্রহ সহকারে এরিস্টোগােরাসের বিদ্রোহে সাড়া দিল আর পারসিক সম্রাটের অধীনে শাসন করা তাদের টাইরান্টদের বিতাড়িত করলো। বিদ্রোহের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল এড্রিয়ানের স্বাধীন গ্রিক শহরগুলাের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া। এরিস্টোগােরাস প্রথমে গ্রিসের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি স্পার্টায় গেলেন, আর ক্লিওমিনিসকে তাদের বিদ্রোহে সাহায্য করতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ক্লিওমিনিস যখন শুনলেন সাগর থেকে ভূমি হয়ে পারস্যের রাজধানীতে যেতে তিন মাস সময় লাগে তখন তিনি এরিস্টোগােরাসকে তৎক্ষণাৎ চলে যেতে বলেন। কোন স্পার্টান সেনাদলই স্বদেশ থেকে তত দূরত্বে রওনা হতে চাচ্ছিল না। এরিস্টোগােরাস পরবর্তীতে এথেন্সে গিয়ে তাদেরকে তাদের বিদ্রোহে সাহায্য করতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন, আর সেখানে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। প্রথমত, এথেন্স নবলব্ধ গণতন্ত্রে রােমাঞ্চিত আর তাদের উত্তরসূরীরা পরবর্তীতে যুদ্ধে সংগ্রামরত ছিল। দ্বিতীয়ত, এশিয়া মাইনরের বিদ্রোহ করা শহরগুলােও ছিল এথেনীয়দের মতো আয়োনীয় আর গণতান্ত্রিক। তৃতীয়ত, নির্বাসিত এথেনীয় টাইরান্ট হিপ্পিয়াস এশিয়া মাইনরে কোনাে এক পারস্য সত্রপের দরবারে ছিলেন, আর বলাই বাহুল্য যে পারসিকরা হয়তাে তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার কোনাে প্রচেষ্টা নেয়নি। এটা এথেনীয়রা সহজে করত না আর একটা প্রতিরােধমূলক যুদ্ধ শুরু করাই শ্রেয়তম ছিল। এই সময়ে ক্লিসথিনিস এথেন্সের ক্ষমতা হারান। কেন এটা হলাে, তা জানা যায়নি, কিন্তু একটা ভালাে সম্ভাব্য কারণ ছিল যে তিনি এই আয়োনীয় অভিযাত্রার বিরােধী ছিলেন আর এর বিরােধিতায় পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাকে আর আল্কমিওনিডিকে পারসিকমুখী বলে দেখা হত আর অর্ধ শতাব্দী ধরে নগরে তাদের সরকারের খুব কম ক্ষমতাই ছিল।

এরিস্টাগােরাস জাঁকজমকের সাথে মিলেটাসে ফিরে এলেন এটা বলতে যে, এথেন্স জাহাজ আর লােক পাঠাবে, আর সব প্রস্তুতিই নেয়া হয়েছিল যার প্রস্তুতি হবে আয়োনীয় বিদ্রোহের জন্য। শুধু ভূগােলবিদ হেকাটিউস সাধারণ উত্তেজনার অংশ হতে অস্বীকার করলেন। তিনি এরকম কোনাে উদ্যোগকে বােকামি আর নৈরাশ্যজনক বলে আখ্যায়িত করলেন। তিনি বললেন, যদি আয়োনীয়রা সত্যিই বিদ্রোহ করতে মনস্থ করে, তাদের প্রথমেই একটি রণতরী প্রস্তুত করা প্রয়ােজন যা ঈজিয়ানের নিয়ন্ত্রণকে নিরাপদ করতে পারে; সেটা হবে তাদের সাফল্যের ক্ষেত্রে একমাত্র আশা। অন্যথায় পারসিকরা সহজেই তাদের কচুকাটা করবে। আয়োনীয়রা প্রথমদিকে থেলিস বা বায়াসের কথাও শােনেনি, আর এখন তারা হেকাটিউলসের কথায়ও কর্ণপাত করলাে না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৮ সালে, এথেন্স থেকে বিশটি আর এরিত্রিয়া থেকে আরও পাঁচটি জাহাজ পৌঁছল। এথেন্স এরিত্রিয়ার প্রতিবেশী আর এরিত্রিয়ার প্রতিপক্ষ কালসিসকে আট বছর আগেই এথেন্স পরাস্ত করেছিল বলে এরিত্রিয়া এথেন্সের পক্ষেই ছিল। বিদ্রোহের উত্থানের সময়ে, অন্যান্য গ্রিক নগর জেগে উঠল, থ্রেস আর সাইপ্রাস এমনকি এশিয়া মাইনরও পারস্য সাম্রাজ্যের সব উত্তর পশ্চিম প্রান্তেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। বিদ্রোহীদের প্রথম প্রচেষ্টা সাফল্য নিয়ে এলো। এরিস্টোগােরাস মিলেসিয়ান আর এথেনীয়দের পূর্বদিকে ঠেলে দিলেন, তারা অপ্রত্যাশিতভাবে পারস্যবাসীদের আক্রমণ করে সারদিস দখল করলেন। ভস্মীভূত শহরটি তারা দখলে নিলেন, আর তারপর আয়োনিয়ায় ফিরে এলেন। কিন্তু এটা কী এমন সুফল বয়ে আনল? বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যে একটি শহরের ভূমিকাই বা কী ছিল? যখন সেনাদল আয়োনীয় উপকূলে ফিরে এলো, তখন তারা পারস্যের এক বাহিনীকে সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষমান অবস্থায় পেলো। আয়োনীয়রা তাদের কাছে পরাস্ত হলাে আর এথেনীয়রা সিদ্ধান্ত নিল এটা মােটের উপর তাদের যুদ্ধ নয়, তাই তারা দেশে ফিরে এলো, কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেল।

দারিয়ুস ছিলেন ক্ষুব্ধ। তিনি তখন ছিলেন একজন ষাটোর্ধ বয়স্ক মানুষ, কিন্তু তখন তিনি তেমন ধরনের মানুষ ছিলেন না যার সাথে নিরাপদে মধ্যস্থতা করা যায়। তিনি ফিনিসীয় জাহাজ সংগ্রহ করে ঈজিয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন, সেটি সম্মন্ধে হেকাটিউস সুস্পষ্টভাবে আয়োনীয়দের সতর্ক করেছিলেন যে যদি তারা নৌ প্রস্তুতিতে হেলাফেলা করে, তবে তাই হবে। এখন আয়োনীয়রা গ্রিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আর অনিবার্য পরাজয়ের সম্মুখীন হলাে। এরিস্টাগোরাস গ্রেসে পালিয়ে গেলেন আর কিছুকাল পরে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য-ফিনিসিয়ান রণতরীগুলাে সাইপ্রাসে গ্রিক প্রতিরােধ ধ্বংস করে দেয় আর এখন তারা মিলেটাসের উপকূলে দাঁড়িয়ে গেল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ সালে, আয়োনীয়রা যে জাহাজগুলাে নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিল সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেল আর বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে গেল। পারসিকরা মিলেটাসে ঢুকে একে ভস্মীভূত করে দিল যদিও তারা অন্য গ্রিক শহরগুলাে নিয়ে তুলনামূলক মৃদুভাবে ব্যবস্থা নিল। মিলেটাসের শক্তি আর উন্নতির চিরতরে ইতি ঘটল; তারা পূর্বের অবস্থার আর কোনদিন পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। দারিয়ুস তার মেয়ের জামাই মারদোনিয়াসকে থ্রেসে প্রেরণ করেন সেই এলাকা জয় করার জন্য। এটা সফলভাবে করা হয়েছিল আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২ সালের দিকে সেটি আরও একবার পারিসিয়ান হয়ে গেল। মারদোনিয়াস তারপর সম্ভবত দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, কিন্তু তার রণতরী ঈজিয়ান সাগরে ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, আর তিনি ভাবলেন এই সময়ের জন্য ব্যাপারটার সমাপ্ত করে পারস্যে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়তর। বাকি ছিল গ্রিসের মূল ভূখণ্ড যারা তার ক্ষতি করেছিল। দারিয়ুস মনস্থ করলেন যে তিনি তাদের কাউকে ছেড়ে দেবেন না। সেইসব চুনােপুঁটি গ্রিক শহরের সাথে তার হিসাব মেলানাের দরকার ছিল, যারা তার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাহাজ পাঠানাের আর তার একটি শহর পুড়িয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। এথেন্স আর পুরাে গ্রিস এই কারণে ছিল ভয়ে কাঁপছিল। তখন প্রথমবারের মতাে, একজন শক্তিশালী এশিয়ান শাসক ঘৃণাভরে গ্রিসের দিকে নজর দিতে থাকলেন। পূর্বদিক থেকে, শতাব্দী জুড়ে, একটি ঝড়াে হাওয়া এগিয়ে আসতে থাকল যা গ্রিসের মূলভূমির দিকে এগিয়ে যেতে থাকল, এবং ঝড় ছিল আসন্ন। 

ম্যারাথনের যুদ্ধ 

যখন দারিয়ুস আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি বিভিন্ন গ্রিক শহরে দূত পাঠিয়েছিলেন যেগুলাে তখনাে স্বাধীন ছিল আর পারস্য অধীনস্ততা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। শুধু এভাবেই তারা নিজেদেরকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত। ঈজিয়ানের বেশিরভাগ দ্বীপই, যারা পারস্যের রণতরীর বিরুদ্ধে অন্যদের কাছ থেকে সাহায্যের আশা করতে পারেনি, প্রস্তাবটি মেনে নিল। দ্বীপগুলাের একটি, ঈজিনা, বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রিসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল বলে তারা দারিয়ুসের বশ্যতা মানতে রাজি ছিল, এমনকি দূত কর্তৃক এরকম বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব পাওয়ার আগেই তারা পারস্যের অধীনস্ততা মানতে রাজি ছিল। এই শত্রুতার ব্যাপারটি এথেন্সের স্মরণে থাকার কথা ছিল। মূল গ্রিস ভূখণ্ডের কিছু শহর বশ্যতা স্বীকার করল। যে একটি শহর তা করেনি, তা ছিল অবশ্যই স্পার্টা। তখন স্পার্টা তাদের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তিশালী ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ সালে, আয়োনীয় বিদ্রোহের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে, আর্গোস আবারও স্পার্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল এবং ক্লিওমিনিস তাকে আবারও পরাস্ত করলেন, এই সময়ে প্রাচীন শহর টাইরিনসের কাছে। ক্লিওমিনিস একটি ব্যক্তিগত বিবাদে বিজয়ী হয়েছিলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২ সালে, ডেমারেটাসকে জোর করে শাস্তি প্রদান করা হয়, এবং সে দারিয়ুসের দরবারে পালিয়ে যায়। নিজের চারপাশে বিজয়ের প্রভা থাকায়, ক্লিওমিনিস কিছু বারবারিয়ানের দাবির কাছে বশ্যতা স্বীকার করছিলেন না। এমনও গল্প আছে যে দারিয়ুসের দূত এসে যখন মাটি আর জল চেয়েছিল স্পার্টা কর্তৃক ভূমি আর সাগরে পারস্য অধিপত্য স্বীকার করে নেওয়ার চিহ্ন হিসেবে, তখন স্পার্টানরা দূতকে একটি কূপে নিক্ষেপ করে আর বলে, “সেখানে দুটিই একবারে পাবে।” 

এথেন্স এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। কিন্তু থেমিস্টোক্লিস নামে এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এথেনীয় ছিলেন, তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৮ সালে এথেন্সের আরকন। পাঁচ বছর আগে যা মিলেটাসের হেকাটিটাউসের যা মনে হয়েছিল, তারও তাই মনে হলো। তিনি বুঝতে পারলেন যে, পারস্য দানবদের রুখে দিতে হলে গ্রিক শহরগুলােকে সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে হবে। এথেন্সের কোনাে শক্তিশালী রণতরী ছিল না। আর এটা তৈরি করতে অর্থের দরকার ছিল, যে খরচটা এথেন্সবাসীরা কাঁধে নিতে মনে হয় ইচ্ছুক ছিল না। উপকূল থেকে পাঁচ মাইল দূরে থাকা এথেন্সে এমনকি কোনাে সমুদ্রবন্দরও ছিল না। থেমিস্টোক্লিস তাই করলেন যা তিনি করতে পারতেন। তিনি উপকূলের একটি স্থানকে ফর্টিফাই করলেন (দুর্গ নির্মাণ করলেন) যা পরবর্তীতে পিরিয়াস শহরে পরিণত হলাে। এটা একটি রণতরীর নিজস্ব আবাসস্থল হওয়ার কথা ছিল যা একদিন পরিণতি পাবে বলে তিনি আশা করেছিলেন, যদিও এরই মধ্যে এথেন্স যথেষ্ট পরিমাণে রণতরীর রক্ষাকবচ ছাড়াই বহিরাক্রমণের ধাক্কা প্রতিরােধ করতে যাচ্ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালের মধ্যে, দারিয়ুসের অভিযাত্রিক বাহিনী প্রস্তুত হয়ে পড়ল। এটা খুব বিশাল কিছু ছিল না, কিন্তু দারিয়ুস মনে করলেন গ্রিকদের শায়েস্তা করার জন্য এই ছোট বাহিনীই যথেষ্ট। তারা সরাসরি এড্রিয়ান পেরিয়ে যায় ও যে দ্বীপগুলাে সমস্যা করতে পারে মনে হয়েছিল সেগুলাে দখল করে। উদাহরণস্বরূপ, তারা দক্ষিণ-মধ্য এড্রিয়ানের নাক্রোসকে দখলে নিয়েছিল আর উত্তর-পশ্চিমে ইউবিয়া দ্বীপের দিকে গিয়েছিল। সেই দ্বীপে ছিল ইরিত্রিয়া যারা দারিয়ুসের চোখে এথেন্সের মতােই সারদিসকে পুড়িয়ে দেয়ার জন্য দোষী ছিল। ইরিত্রিয়াকে দখলে নিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, আর তা দেখে এথেন্স সাহায্য করতে সাহস করেনি। তার নিজের সুরক্ষার জন্য তার সব লােককে প্রয়ােজন ছিল। আর, প্রকৃতপক্ষে, যেখানে পারসিক বাহিনীর এক অংশ ইউবিয়া দখলে নিয়েছিল, আরেক অংশ অ্যাটিকায় অবতরণ করছিল (যেখানে এথেন্স অবস্থিত)। তাদেরকে হিপ্পিয়াস নিজেই পরিচালনা করে অ্যাটিকার পূর্ব উপকূলে, ম্যারাথন গ্রামের কাছে ক্ষুদ্র এক সমতলভূমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। 

এথেন্স, এরই মধ্যে, সাহায্যের জন্য ডাক পাঠাল আরেকটি নগর রাষ্ট্রের কাছে যারা পারসিকদের সাথে লড়াই করতে ভীত ছিল না, সেই নগর রাষ্ট্র হচ্ছে স্পার্টা। একজন পেশাদার দৌঁড়বিদ ফিদিপিদিসকে সাত মাইল দূরত্ব পাড়ি দিতে পাঠানাে হয়েছিল, কেননা দ্রুততা ছিল প্রয়ােজনীয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্পার্টানরা গ্রিসের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শহর ছিল আর তাদের পূর্ণিমার চাঁদ না ওঠা পর্যন্ত কোনাে বর প্রোজেক্ট শুরু না করার ঐতিহ্য ছিল। পূর্ণচন্দ্রের নয়দিন আগে ফিদিপিদিস তাদের কাছে পৌঁছলেন আর তারা আরও নয়দিনের আগে নড়াচড়া করতে অস্বীকৃতি জানালেন। ক্লিওমিনিস যদি ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে তিনি হয়তাে স্পার্টানদের অগ্রসর হতে বাধ্য করতেন, কিন্তু তিনি তার সহ-রাজন্য এফোরদের জোর করার কিছু সময় পর, তারা ক্লিওমিনিসের বর্ধিষ্ণু ক্ষমতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিল। অবশ্য এথেন্সকে এককভাবে পারসিকদের মােকাবেলা করতে হয়নি। প্লাটিয়া থিব্‌সের বিরুদ্ধে এথেন্সের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞ ছিল, আর তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ৯০০০ সৈন্যসমৃদ্ধ এথেন্স বাহিনীতে যােগ দিতে আরও হাজার লােক পাঠাল। ক্ষুদ্র গ্রিক সেনাবাহিনী একজন পােলেমার্ক আর দশজন সেনাপতি দ্বারা শাসিত ছিল। এই সেনাপতিদের একজন ছিলেন মিলটিয়াডেস। যে মিলটিয়াডেস থ্রেসিয়ান কেরসােনিস জয় করে সেখানে নিজেকে একজন টাইরান্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ইনি ছিলেন তারই নেফিউ। তরুণতর মিলিটিডিয়াস টাইরান্ট হিসেবে তার পিতৃব্যের উত্তরাধিকারী হয়ে কেরনোসিসের টাইর‍্যান্ট হয়েছিলেন এবং পারস্যরজ দারিউসের থ্রেস অভিযানের সময় বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। তবে পারস্যের বিরুদ্ধে আয়োনীয়দের বিদ্রোহের সময় তিনি পারস্যের বিরুদ্ধে যায়, আর আয়োনীয়রা পরাজিত হলে তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য থ্রেস ত্যাগ করে মাতৃভূমি এথেন্সে ফিরে আসেন। এবারে এই মিলটিয়াডেসই ছিলেন এথেন্সের প্রতিরােধের প্রাণপুরুষ। সেনাপতিদের কয়েকজন যুদ্ধ করাকে অর্থহীন মনে করলেন, তাই তারা আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করাই যৌক্তিক বলে মনে করেছিলেন। তবে মিলটিয়াডেস তাদের মধ্যে একজন ছিলেন না। তার জন্য লড়াই করাই কেবল জরুরি ছিল না, পাশাপাশি তিনি আক্রমণ করতেও মনস্থ করলেন। পারস্য সেনাদলের সাথে লড়ার অভিজ্ঞতা তার ছিল, আর তিনি জানতেন যে, গ্রিক হােপলাইটরা পারস্যের থেকে অস্ত্রশস্ত্র আর প্রশিক্ষণ উভয় দিকেই এগিয়ে আছে। মিলটিয়াডেসের ইচ্ছাশক্তিরই জয় হয় আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে এথেন্সের সেনাদল মিলটিয়াডেসের নেতৃত্বে ম্যারাথনে পারস্য সেনাদলের দিকে এগিয়ে চলল। 

এই ধাক্কায় পারস্য সেনাদল পিছিয়ে এলো। কোনাে এক কারণে তারা তাদের পদাতিক সেনাদের জাহাজে ফেরত পাঠিয়েছিল, আর এখন তাদের কোনাে ঘােড়সওয়ারই গ্রিক আক্রমণ ঠেকাতে উপস্থিত ছিল না। এথেন্সের হােপলাইটদের ভারী প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় কোনাে পাল্টা আঘাত হানতে না পেরে পারস্য পদাতিক সেনাদল অকাতরে মরতে লাগল। তারা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়ে তাদের জাহাজে ফিরে আসার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। পরবর্তীতে, এথেনীয় প্রতিবেদন অনুযায়ী, এথেনীয়রা যেখানে যুদ্ধে ১৯২ জন লােক হারিয়েছিল, পারসিকরা হারিয়েছিল ৬৪০০ জনকে। পারস্য রণতরীগুলাে অ্যাটিকার চারপাশে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদলকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়তাে পারত এবং এথেন্সকে সরাসরি আক্রমণ করতে পারত। কিন্তু তাদের মনােবল ভেঙে গিয়েছিল আর তার সাথে তাদের কানে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্পার্টার সেনাদল পথে আছে। তারা সিদ্ধান্ত নিল যথেষ্ট হয়েছে আর হিপ্পিয়াসকে সাথে নিয়ে ঈজিয়ান পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরে গেল। বৃদ্ধ হিপ্পিয়াসের টাইরানী ফিরে পাওয়ার আশা চিরতরে শেষ হয়ে গেল, আর ইতিহাস থেকে সে হারিয়ে গেল। এদিকে, এথেনীয়রা যুদ্ধের খবরের জন্য অপেক্ষা করছিল। যেকোনাে মুহূর্তে তারা পারসিকদের সাথে সাথে পলাতক সৈন্যদেরও দেখার আশা করছিল; তারা ভেবেছিল শহরটি পুড়িয়ে দেয়া হতে পারে, তাদেরকে মেরে ফেলা বা দাস বানানাে হতে পারে। ম্যারাথনের বিজয়ী এথেনীয় সেনাদল ভালাে করেই জানত তাদের শহরে একজন দৌঁড়বিদ পাঠাতে হবে যে সুসংবাদ বয়ে নিয়ে যাবে। ইতিহাস অনুসারে, সে ছিল সেই ফিদিপিদিস যে স্পার্টা থেকে সাহায্যের আশায় দৌঁড়ে এসেছিল। এখন সে ম্যারাথন থেকে এথেন্সে দৌঁড়ে এলো দারুণ গতিতে; শহরে পৌঁছল, কেবলমাত্র বিজয়ের খবরটা প্রকাশ করতে পারল আর মারা গেল। ম্যারাথন থেকে এথেন্সের দূরত্ব ছিল ২৬ মাইলের কিছু বেশি। ফিদিপিদিসের এই দৌঁড়ের সম্মানে খেলার ইভেন্ট হিসেবে ম্যারাথন দৌঁড় দৌঁড়ানাে হয় যার দৈর্ঘ্য ২৬ মাইল ৩৮৫ গজ। এই দৌঁড়ের জন্য বিশ্বরেকর্ড হলাে ২ ঘন্টা ১৪ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড, কিন্তু কেউই জানে না প্রথম ম্যারাথন দৌঁড় দিতে ফিদিপিদিসের কত সময় লেগেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই স্পার্টানরা যুদ্ধক্ষেত্রে এলো। তারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করে পারসিকদের মরে পরে থাকতে দেখল, আর এথেনীয়দের উচ্চ প্রশংসা করে ঘরে ফিরে গেল। তাদের যদি পূর্ণচন্দ্রের কুসংস্কার হেলা করার সুযােগ থাকত, তারাও যুদ্ধে থাকত আর জয়ী হওয়ার বেশিরভাগ কৃতিত্বই পেত। এভাবে গ্রিসের পরবর্তী ইতিহাস ভিন্ন কিছু হতে পারত। প্রকৃতপক্ষে, ম্যারাথনের যুদ্ধ সবসময়ই দুনিয়ার কল্পনাশক্তিকে শাণিত করেছে। এটা ছিল ডেভিড আর গােলিয়াথের লড়াই, যেখানে ছােট্ট ডেভিডই জিতেছিল। অধিকন্তু, প্রথমবারের মতাে, একটি যুদ্ধ হয়েছিল যার ওপর আমাদের আধুনিক জীবনের পদ্ধতি নির্ভর করছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালের সেপ্টেম্বরের ঐ দিনের আগে, অনেক বড়বড় যুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু আজ আমাদের কাছে মিশরীয়রা হিট্টাইটদের পরাজিত করেছিল, না হিট্রাইটরা মিশরীয়দের, অ্যাসিরীয়রা বারবারিয়ানদের পরাজিত করেছিল, না বারবারিয়ানরা অ্যাসিরীয়দের, পারস্যরা লিডীয়দের নাকি লিডীয়রা পারস্যদের, তা তেমন কোনাে পার্থক্য নিয়ে আসে না। এখানেই এটি ছিল আলাদা, যদি এথেনীয়রা ম্যারাথনে হেরে যেত, এথেন্স ধ্বংস হয়ে যেত (অনেকেরই মতে) আর তখন গ্রিস কখনোই সভ্যতার শীর্ষে যাওয়ার মতাে উন্নতি করতে পারত না, যে শীর্ষস্থানের থেকে আমরা আধুনিকরা উত্তরাধিকার লাভ করেছি। নিশ্চিতভাবেই, স্পার্টা যদি লড়াই করত, যদি তারা একাই থাকত, তাতেও তারা মনে হয় স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারত। কিন্তু, ভয়ংকর সামরিক শক্তি ছাড়া স্পার্টার দুনিয়াকে উপহার দেয়ার মতাে আর কিছু ছিল না। তাই, ম্যারাথনের যুদ্ধ ছিল একটি নির্ণায়ক যুদ্ধ এবং অনেকের মতেই এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম নির্ণায়ক যুদ্ধ যতটুকু আজকের আধুনিক দুনিয়া জানে। 

পারস্যে জারেক্সিসের ক্ষমতা লাভ ও তার বিরুদ্ধে এথেন্সের প্রস্তুতি

ম্যারাথনের পরাজয়ের খবর পেয়ে দারিয়ুস ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তার হাল ছেড়ে দেয়ার কোনাে ইচ্ছে ছিল না। তিনি এথেন্সের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আর এটা ছিল আগের চেয়ে বেশ বড়। কিন্তু, খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ সালে, তিনি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এথেনীয়রা এখনাে শাস্তিপ্রাপ্ত হলাে না- বুকে এই হতাশা নিয়েই তিনি মারা গেলেনএমনকি দারিয়ুসের শত্রুরাও কদাচিৎ ভালাে অবস্থানে ছিল। মিলটিয়াডেস এই সময়ের নায়ক ছিল। কিন্তু তার সাফল্য তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল তার এখন দিগ্বিজয়ী বীর হওয়ার জন্য যাত্রা করার সময়। তিনি এথেনীয়দের তার নেতৃত্বে লােকজন আর জাহাজ জড়াে করতে রাজি করালেন আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৯ সালে তিনি তাদের দিয়ে পারােস আক্রমণ করালেন যা ছিল ঠিক পশ্চিমের দ্বীপ। অজুহাত ছিল তারা পারসিক রণতরীতে একটি জাহাজ প্রদান করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার আক্রমণ ব্যর্থ হলাে আর তিনি ভাঙ্গা পা নিয়ে দেশে ফিরে আসলেন। ব্যর্থতার মতাে আর কিছুই ব্যর্থ হয় না। রুষ্ট এথেনীয়রা  অভিযানের সময়ে অশােভন আচরণের জন্য মিলটিয়াডেসের বিচার আর তাকে ব্যাপকভাবে জরিমানা করল। এর কিছু পরেই সে মারা গেল। স্পার্টার রাজা প্রথম ক্লিওমিনিস, যিনি স্পার্টাকে পেলােপনেসাসে আর গ্রিসের সামরিক নেতৃত্বে অবিসংবাদিত প্রভু বানিয়েছিলেন, তার ভাগ্য আরও খারাপ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৯ সালে তাকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, কিন্তু তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, যাকে প্রহরীদের মাধ্যমে আবদ্ধ করে রাখা হত। যেভাবেই হােক তিনি একটি তলােয়ার যােগাড় করতে পেরেছিলেন, যার সাহায্যে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। 

কিন্তু গ্রিস আর পারস্যের বিবাদের সমাপ্তি ঘটল না, যেহেতু পুরনো প্রজন্ম মৃত্যুবরণ করেছিল, নতুন প্রজন্ম ক্ষমতায় এসে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। সিংহাসনে আরােহণ করে গ্রিসকে পরাস্ত করার স্বপ্ন দেখেছিল দারিউসের পুত্র যিনি গ্রিকদের কাছে জারেক্সিস (Xarxes) নামে পরিচিত ছিলেন। জারেক্সিস তার পিতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলেন। প্রতিবেশী অঞ্চলে কী ঘটছিল তা মিশরীয়রা ভালোভাবেই খেয়াল রাখছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এবারে ম্যারাথনের যুদ্ধে পারস্যের পরাজয় ও দারিউসের বার্ধক্যের সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ সালে মিশরীয়রা বিদ্রোহ করে বসল। মিশর আশা করতে থাকে নতুন সম্রাটের প্রাথমিক ডামাডোলে মিশর তার স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে। দারিউসের পুত্র জারেক্সেস সিংহাসনে আরোহণ করে এথেন্স ও মিশরকে দেখতে পেলেন সমস্যাজর্জরিত। তাকে এবার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এথেন্সের বিরুদ্ধে তার পিতার প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছার কথা জারেক্সেসের জানা ছিল। এথেন্স একটি ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র আর মিশর একটি বিরাট দেশ, সম্পদশালী ও জনবহুল। কাজেই প্রথমে মিশরের সাথে হিসাব নিকাশ চুকাতে হবে। আপাতত গ্রীস আক্রমণের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয় আর বিশাল পারসিক সৈন্যবহর হতভাগ্য মিশরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিশর পরাজিত এবং পদানত হয়। তবে এই কাজে পারস্যকে তিনটি বছর ব্যয় করতে হয়। কাজেই জারেক্সেসের গ্রীস আক্রমণ তিন বছর পিছিয়ে যায়। এই তিন বছরের বিলম্ব এথেন্স ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিল। তারা তাদের নৌশক্তিকে উন্নত করতে সময় পেয়েছিল।

ম্যারাথনের যুদ্ধের পরে, এথেন্স গণতন্ত্রের বিনির্মাণে নতুন কিছু পদক্ষেপ নিল। আর বিভিন্ন সরকারি অফিস যা ক্লিসথিনিস সকল এথেনীয় মুক্ত মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, এখন অনেক লোক দ্বারা পরিপূর্ণ হতে লাগল, যাতে করে সব মুক্ত নাগরিকের সেখানে সমান সুযােগ থাকে। আরকন আর পােলেমার্কের ক্ষমতা কমিয়ে আনা হলাে আর গণপরিষদকে (Popular Assembly) সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর বানানাে হলাে। উচ্চশ্রেণির কাছে থাকা একমাত্র অস্ত্র ছিল এরিওপেগাস। সেই উচ্চ আদালত তাদের কাছে আরও এক চতুর্থাংশ শতাব্দী পর্যন্ত থাকার কথা ছিল। অধিকন্তু, এথেনীয়রা একটি নতুন কোনাে সম্ভাব্য টাইরানীর শাসন প্রতিরােধ করতে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা চালু করল। প্রতি বছরে একবার বিশেষ ভােটদানের জন্য একটি সুযােগ প্রদান করা হত। এই ভােটদানের জন্য নাগরিকেরা প্রত্যেকেই একটি ছােট মাটির পাত্রের টুকরো হাতে করে বাজারে জড়াে হত (মাটির পাত্র ছিল সস্তা এবং মাটির পাত্রের টুকরাে যে কোনােনখান থেকেই নিয়ে নেয়া যেত সহজেই)। গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক নাগরিকের নাম মাটির পাত্রের টুকরাের গায়ে স্ক্র্যাচ করে লেখা হত, এরপর সেটি তখন একটি পাত্রে রাখা হত। ভােটাভুটি শেষ হয়ে গেলে নামগুলাে গণনা করা হত, আর ৬০০০ এর বেশি ভােট যার নামে পড়তো তাকে নির্বাসিত করা হত। নির্বাসিত ব্যক্তি অসম্মানে থাকতো না আর সে তার সম্পত্তিও হারাত না। দশ বছর পরে সে ফিরে আসতে এবং তার পূর্বের অবস্থান বুঝে নিতে পারত। এভাবে নগর কর্তৃক নেয়া সাধারণ নির্দেশনার ওপর কিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এথেন্সবাসী টাইনারীকে দূরে রাখার আশা করত। মাটির পাত্রের টুকরাের গ্রিক প্রতি শব্দ ছিল ‘অস্ট্রাকন’, তাই শাস্তির জন্য প্রদত্ত ভােটকে ‘অস্ট্রাসিজম’ (সমাজ-বিচ্ছিন্ন) বলা হয়, আর শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে বলা হয় ‘অস্ট্রাসাইজড’। এথেন্সবাসীরা প্রথাটিকে এক শতাব্দীর কিছু কম সময় ধরে রেখেছিল, আর অন্য কোথাও এটা চালাবার চেষ্টা করা হয়নি। অস্ট্রাসিজম সর্বপ্রথম এথেন্সে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৭ সালের দিকে ব্যবহার করা হয়, যখন পিসিস্ট্রটাসের পরিবারের একজন সদস্যকে নির্বাসনে পাঠানাে হয়। কিন্তু, ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ট্রাসিজম পাঁচ বছর পরে সংগঠিত হয় আর ফলাফল প্রথাটিকে স্বতঃসিদ্ধ করে। ভােটটি এথেন্সে একটি বিবাদের ফলাফল হিসেবে এসেছিল, একটি নতুন বহিঃআক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হওয়ার সঠিক উপায় হিসেবে। 

অবশ্যই, ডেলফির ওরাকলের সাথে পরামর্শ করা হয়েছিল, আর পরবর্তী কাহিনী অনুযায়ী ফলাফল ছিল খুব খারাপ; পুরােপুরি পতনের ভবিষ্যদ্ববাণী করা হয়েছিল। এথেন্সের প্রশ্নকর্তা ভীত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে কোনাে আশার আল আছে , ওরাকলের পাদ্রীরা উত্তর দিল, যখন সব কিছুই হেরে গেছে, তখন কাঠের দেয়ালের একাই অজেয় থাকার কথা। এথেনীয়রা এর প্রতিবেদন দিতে ফিরে গেল আর তৎক্ষণাৎ সেখানে একটা বিতর্কের সূত্রপাত হলাে কাঠের দেয়াল কি হতে পারে সেটা নিয়ে। সেই সময়ের অন্যতম খ্যাতিমান এথেনীয় নেতা ছিলেন এরিস্টাইডিস। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি যিনি নতুন গণতন্ত্রকে অবিশ্বাস করতেন। যাই হােক, তিনি ছিলেন ক্লিসথিনিসের একজন সহযােগী, তিনি ম্যারাথনে যুদ্ধ করেছিলেন, এবং তিনি পরিপূর্ণ সততা আর একাগ্রতার জন্য খ্যাতিমান ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তার জীবনকালে এবং সেই সময় থেকে সবসময় ন্যায়পরায়ণ এরিস্টাইডিস নামে পরিচিত ছিলেন। এরিস্টাইডিস ধরতে পেরেছিলেন যে পাদ্রীদের পরামর্শ দেয়া কাঠের দেয়াল ছিল শুধুই কাঠের দেয়াল। তিনি মনে করলেন, এথেন্সবাসীকে এক্রোপলিসের আশেপাশে একটি শক্তিশালী কাঠের দেয়াল প্রস্তুত করা উচিত এবং সমগ্র অ্যাটিকা ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের সেখানে অবস্থান নেয়া উচিত। থেমিস্টোক্লিসের কাছে এটি ছিল পুরাে আহম্মকি, তার কাছে একটি নৌবাহিনীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার মতে কাঠের দেয়াল ছিল রণতরীর কাঠের জাহাজের দেয়ালকে নির্দেশ করার একটি কাব্যিক পন্থামাত্র। নতুন ধরনের একটি জাহাজের তখন ব্যবহার শুরু হয়েছিল যার নাম ছিল ট্রাইরিম (Trireme)। এর তিনটি দাঁড় টানার ঘর ছিল। যার অর্থ পুরনো ধরনের জাহাজের চেয়ে আরও বেশি দাঁড় টানার লােককে জাহাজের ভেতর স্থান দেয়া হত। ট্রাইরিমগুলাে ছিল দ্রুততর এবং অন্যান্য জাহাজের থেকে বেশি ব্যবহারযােগ্য। থেমিস্টোক্লিস দাবি তুললেন, ‘ট্রাইরিম তৈরি করো’। এই ট্রাইরিম হবে অজেয় আর এই ধরনের জাহাজের কাঠের দেয়াল থেকে পারস্যদের ধ্বংস করাও সম্ভব, যদিও বা তারা অ্যাটিকার সবকিছু দখল নিয়ে নেয় এবং এক্রোপলিসের ওপর অবস্থান নেয় তারপরও। নৌবাহিনী বানাবার অন্য কারণও ছিল। সেই সময় ঈজিনার সাথে এথেন্সের যুদ্ধ চলছিল। এথেন্স ঈজিনাকে দারিয়ুসকে সাহায্য করার আগ্রহের জন্য শাস্তি দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঈজিনার নৌবাহিনী ছিল গ্রিসের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী আর এথেন্স ও স্পার্টার মিলিত শক্তিও ঈজিনাকে নৌযুদ্ধে হারাতে পারত না। 

অবশ্যই, ট্রাইরিম তৈরি করা ব্যয়বহুল ছিল, কিন্তু এথেন্সের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল যে অ্যাটিকার দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ সালে রূপার খনির আবিষ্কার হয়েছিল। ফলে রাতারাতি এথেন্স ধনী হয়ে গিয়েছিল। এথেন্সের নাগরিকদের প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের নিজেদের ভােটদানের মাধ্যমে রূপার অংশ করায়ত্ত করার যাতে করে তারা অল্প পরিমাণে অর্থের বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত ধনী হতে পারে। থেমিস্টোক্লিস এতে প্রমাদ গুনলেন। সবার পকেটে কিছু অতিরিক্ত টাকা গেলে তা নগরের জন্য কি উপকারে আসতে পারে? অন্যদিকে, সব অর্থই যদি নৌবাহিনীতে বিনিয়ােগ করা হয়, তাহলে ২০০ ট্রাইরিম তৈরি করা যাবে।  এরিস্টাইডিস একে অর্থের অপচয় হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিরােধিতা করলেন এবং মাসের পর মাস এই বিতর্ক ক্রমেই বেড়ে চলতে লাগল, এদিকে মিশরে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করা হয়েছে, ফলে বিপদ ক্রমেই ঘনিয়ে আসতে লাগল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮২ সালে, এথেন্স একটি অস্ট্রাসিজম ভােট আয়ােজন করার সিদ্ধান্ত নিল, এবারে এরিস্টাইডিস আর থেমিস্টোক্লিসের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। এরিস্টাইডিস হেরে গেলেন আর তাকে নির্বাসনে পাঠানাে হলো, আর থেমিস্টোব্লিসকে ধরে রেখে তার কাঁধে এথেন্সের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলাে। তার নির্দেশনায় এথেন্সের নৌবাহিনী নির্মাণ করা হলাে। এই ভােটের ব্যাপারে দারুণ একটা গল্প আছে। একজন এথেন্সবাসী যে লিখতে জানত না, সে এরিস্টাইডিসকে তার পক্ষ হতে ভােট লিখতে বলেছিল। কার নাম আমি লিখব, জিজ্ঞাসা করল ন্যায়পরায়ণ এরিস্টাইডস। এরিস্টাইডিসের নাম, বলল ভােটার। ‘কেন’, জিজ্ঞাসা করলেন এরিস্টাইডিস। ‘এরিস্টাইডিস তােমার কী ক্ষতি করেছে? ‘কিছুই না’, উত্তর এলো। ‘সবাই তাকে ন্যায়পরায়ন এরিস্টাইডিস বলে। এই কথাটা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।” এরিস্টাইডিস নীরবে তার নিজের নাম লিখলেন আর চলে গেলেন। যাই হােক, অস্ট্রাসিজম এথেন্সকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এটা নিয়ে কোনাে সন্দেহই নেই যে যদি রণতরীগুলাে প্রস্তুত না করা হত, তাহলে এথেন্সকে হেরে যেতে হত, অ্যাক্রোপলিসের চারধারে যে রকম দেয়ালই তৈরি করা হােক না কেন, আর এর সাথে সাথেই মানবতার উজ্জ্বল আশারও পরাজয় ঘটত। এরিস্টাইডিস একজন বিশিষ্ট আর সৎ মানুষ ছিলেন, কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভুল, আর থেমিস্টোক্লিস ছিলেন সঠিক। যদি না জারেক্সিস সময়ের আগেই মিশরকে উড়িয়ে না দিতেন এবং রূপার খনির আবিষ্কার আর এথেনীয় ট্রাইরিম প্রস্তুত হওয়ার আগে গ্রিসকে অতি দ্রুত আক্রমণ করতে পারতেন, পৃথিবীর ইতিহাস তবে পুরােটাই ভিন্নরকম কিছু হতে পারত। 

পূর্ব-পশ্চিম দিক হতে আক্রমণ 

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালের মধ্যে জারেক্সিস মিশরের মিশন সমাপ্ত করলেন, তার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করলেন এবং এগিয়ে যেতে থাকলেন। ম্যারাথন যুদ্ধের দশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল এবং জারেক্সিস তা ভালােমতােই স্মরণে রেখেছিলেন। তিনি তার পিতার ভুলের পুনরাবৃত্তি না করতে এবং অতি ছােট বাহিনীর ওপর নির্ভর না করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। পরবর্তীতে গ্রিক ইতিহাসবিদেরা জারেক্সিসের নেতৃত্বের সেনাদলের আকার অতিরিক্ত করে দিয়েছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে পারস্য সেনাদলে সৈন্যসামন্তের সংখ্যা ছিল ১৭,০০,০০০। এটা খুবই অসম্ভব বলে মনে হয়, কারণ এত বড় বাহিনীকে গ্রিসের সেই সময়ে রসদ জোগানাে এবং ব্যবহার করা সম্ভবপর ছিল না। পারস্য সেনাদলের সত্যিকার আকার ছিল ৩,০০,০০০ এর বেশি নয় এবং সম্ভবত তা ২,০০,০০০ এর বেশি ছিল না। এমনকি এই সংখ্যাক সেনাকেও খাওয়ানাে, রসদ যােগানাে, নিয়ন্ত্রণ আর ব্যবহার করাও সহজ ছিল না। জারেক্সিস হয়তাে ক্ষুদ্রতর বাহিনী নিয়েও আরও ভালাে করতেন। জারেক্সিস নিজে সেনাদলের সাথে ছিলেন যেটি অভিযানের প্রতি তার প্রদত্ত গুরুত্ব প্রমাণ করে। তার সাথে তিনি স্পার্টার নির্বাসিত রাজা ডেমারেটাসকে নিয়ে এসেছিলেন। সেনাদল হেলেসপন্ট অতিক্রম করে থ্রেস পেরিয়ে মেসিডােনিয়ার দিকে অগ্রসর হলাে। মেসিডােনিয়া, যেটি এখন গ্রিসের ইতিহাস প্রবাহে প্রবেশ করল, এই সময়ে তা খুব কমই ধারণা দিতে পেরেছিল যে দেড় শতাব্দী পরে সেটি বিশ্বে নিজেদের সুনাম ছড়িয়ে দেবে। থেসালী আর কালসিডিসের উত্তরে অবস্থিত মেসিডােনিয়া ছিল অর্ধগ্রিক। এর লােকজন একটি গ্রিক উপভাষায় কথা বলত, এর শাসকরা গ্রিক সংস্কৃতি বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু গ্রিকরা সাধারণত মেসিডােনিয়াদের বারবাবিয়ানই মনে করত। প্রকৃতপক্ষে, ডােরিয়ান আগ্রাসন পর্যন্ত মেসিডােনিয়াকে গ্রিক অগ্রগতিতে অন্তর্ভুক্ত বলা যায় না, কিন্তু একটি ক্ষীয়মান রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল এবং নগর-রাষ্ট্রের ধারণা তাদের কাছে বিদেশি ব্যাপারাই ছিল। তিরিশ বছর পূর্বে দারিয়ুস যখন ইউরােপ আক্রমণ করল, মেসিডােনিয়া তার বশ্যতা মেলে নিল। কিন্তু তারা তাদের নিজস্ব রাজাদের এবং নিজস্ব আইন-কানুন ধরে রাখতে পেরেছিল। এখন যেহেতু জারেক্সিসের সময়, তাই মেসিডােনিয়ার রাজা প্রথম আলেক্সান্ডারকে বশ্যতার নবায়ন করতে হয়েছিল। তাকে তার সহানুভূতির কারণে পারস্য শক্তিতে যােগদান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কাহিনী বলে, তিনি গ্রিকদের সাথেই ছিলেন। মেসিডােনিয়া পার হয়ে জারেক্সিস দক্ষিণে অগ্রসর হলেন এবং গ্রিকের দিকেই এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। 

যখন জারেক্সিস তার আক্রমণ শুরু করলেন, গ্রিক নগরগুলাে কাছাকাছি এসে এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে একত্র হলাে যা তারা কখনাে হয়নি, আর ভবিষ্যতেও কখনাে হতে হয়নি। গ্রিকের একতা একটি জোটের আকার নিল, যেটি খ্রিস্টপূর্ব ৪৮১ সালে কোরিন্থ শহরে সংঘটিত হয়েছিল। এই কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থানীয় অংশে ছিল অবশ্যই স্পার্টা, কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে ছিল এথেন্স, ম্যারাথন যুদ্ধে অর্জন করা বিপুল সম্মানের কারণে। স্পার্টার প্রতি তার ঘৃণার কারণে আর্গোস যােগদানে অস্বীকৃতি জানাল, এবং থিব্‌স কোনােমতে সেখানে যােগদানে ইচ্ছে করল এথেন্স আর প্লাটিয়ার প্রতি তার বিদ্বেষ থাকার কারণে। কংগ্রেস গ্রিস দুনিয়ার বহিরাংশে ক্রিট, করসিরা ও সিসিলির কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে মনস্থ করল। ক্রিট ছিল অসহায় এবং খাবি খাওয়া অবস্থায়, আর তার কাছ থেকে কোনাে সাহায্য পাওয়ার আশা করা যেত না। করসিরার একটি ভালাে নৌবাহিনী ছিল যা গ্রিকদের জন্য মূল্যবান হতে পারত, কিন্তু করসিরা ক্ষতির সম্ভাবনার বাইরে ছিল এবং কোনাে বিপদে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায়নি। সে তাই নিরস্ত থাকল। যদি কোথাও থেকে সম্ভব হত গ্রিক দুনিয়ার পশ্চিম অংশ, সিসিলি, এবং ইতালি থেকেই সাহায্য পাওয়া যেত। এই অংশ ছিল ধনী ও সমৃদ্ধ এবং সেখানে টাইরান্টদের যুগ চলছিল। প্রকৃতপক্ষে, সিসিলি আর ইতালি কয়েক শতাব্দী ধরে টাইরান্টদের শাসনাধীন ছিল, গ্রিসে তাদের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার পরেও। সেই সময়ে, টাইরান্টদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন গিলন, যিনি সিরাকুজের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৫ সালে, গিলন তার সব প্রচেষ্টা কেন্দ্রিভূত করলেন সিরাকুসের ধনসম্পত্তি, ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং তিনি সফল হলেন, যার কারণে তার সময় থেকে প্রায় তিন শতক পর্যন্ত, সিরাকুজ ছিল পশ্চিম গ্রিসে সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর শহর। তখন এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, জারেক্সিসের হুমকির মুখে কাতর গ্রিসের গ্রিকরা সিরাকুজের দিকে অগ্রসর হয়েছিল সাহায্যপ্রাপ্তির আশায়। গিলন সেই সাহায্য প্রদান করার জন্য সম্মত হতেন যদি তাকে সম্মিলিত গ্রিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিতে দেয়া হত। এটা অবশ্যই স্পার্টানরা কখনাে মেনে নিত না, তাই প্রস্তাবটি মাঠে মারা গেল। আসলে, গিলন হয়তাে প্রস্তাবটি কঠোরভাবে দেননি যেহেতু তার নিজের দায়দায়িত্বও অনেক ছিল। এক শতাব্দী ধরে, পূর্ব সিসিলির গ্রিক পশ্চিম সিসিলির কার্থেজিয়ানদের সাথে ভয়ানক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। গিলনের সময়ে কার্থেজিয়ানরা একজন উদ্যমী নেতাকে খুঁজে পেল, যার নাম হ্যামিলকার। তিনি গ্রিকদের বিরুদ্ধে একটি বিশাল কার্থেজিয়ান বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তাদেরকে দ্বীপ থেকে চিরদিনের মতাে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। গ্রিক ইতিহাসবিদেরা, পরবর্তীতে দাবি করেছিল যে, কার্থেজিয়ানরা পারসিকদের সাথে মিলে কাজ করেছিল; তাদের মধ্যে কোনাে একটা চুক্তি ছিল যে তারা তাদের হাতের নাগালে থাকা সব গ্রিককে ধ্বংস করে দিবে। আসলেও তাই হতে পারত, আর যদি তাই হত, এটা হত বুদ্ধিদীপ্ত একটা কৌশল কারণ গ্রিক শক্তির প্রতিটি অর্ধকেই এতে পৃথকভাবে শত্রুর মােকাবিলা করতে হত। এমনকি তারা অন্যান্য আক্রান্ত শহরগুলাে থেকেও সাহায্য পেত না। 

থারমােপাইলির যুদ্ধ 

পতন হওয়ার সমস্ত অজুহাত সাথে নিয়েও, স্পার্টা আর এথেন্সকে তাই করতে হত, যা তারা একা করতে পারত। পারসিকরা দক্ষিণ দিকে যাত্রা করার পথে, থেসালীর দিকে প্রথমেই অগ্রসর হত। কোরিন্থের কংগ্রেসে থেসালীর প্রতিনিধি এটা দেখিয়ে সাহায্যের আবেদন করল। তিনি বললেন, যদি কোনাে সাহায্য না পাঠানাে হয়, তাহলে তাদের শত্রুর নিকট নিজেদের সমর্পণ করতে হবে। গ্রিকরা আসলে উত্তর থেসালীতে বাহিনী প্রেরণ করেছিল। সেখানে, থেসালীয়ান পদাতিক সৈন্যদলের সাথে মিলে, মেসিডােনিয়ার রাজা আলেক্সান্ডার তাদের সতর্ক করল, কিন্তু পারস্য বাহিনী ছিল মােকাবেলা করার জন্য অনেক বিশাল, তাই গ্রিকরা সেখানে থাকলে প্রয়ােজনহীনভাবে নিজেদের বলিই দিত। গ্রিকরা অন্য কোনাে উপায় না দেখে পিছিয়ে আসে। ফলে থেসালী সহ উত্তর গ্রিসের সকলে দ্রুত আত্মসমপর্ণ করে। ক্ষুদ্র গ্রিক বাহিনীর সফল হতে হলে একটি সংকীর্ণ স্থানের দরকার ছিল, এমন এক জায়গা যেখান থেকে শুধু বিশাল পারস্য বাহিনীর ক্ষুদ্র অংশকেই কেবল প্রেরণ করা যেত। গ্রিকরা তখন পারস্যদের সাথে সমানে সমানে যুদ্ধ করতে পারতো, আর সেক্ষেত্রে হোপলাইটরা জিতেও যেতে পারতো। এমন একটি জায়গা ছিল এথেন্সের ১০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ফসিসের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত থারমােপাইলির যাতায়াত পথ। এটি ছিল সাগর আর পাহাড়ের দেয়ালের মধ্যে অবস্থিত সমতল ভূমির অপ্রশস্ত অংশ। সেই সময়ে যাত্রাপথটি ছিল কোনাে কোনাে জায়গায় পঞ্চাশ ফুটের বেশি নয়। (বর্তমানে, এলাকাটি খনন করা হয়েছে এবং পাহাড় আর সাগরের মধ্যে অবস্থিত বিস্তৃত পটভূমি অনেকটাই প্রশস্ত।)

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালের জুলাইতে জারেক্সিসের বিশাল সৈন্যদল থার্মোপাইলির দিকে অবতরণ করতে লাগল এবং তাদের মােকাবেলা করতে সেখানে স্পার্টার রাজা লিওনিডাসের অধীনে ৭০০০ লােক ছিল। তিনি ১ম ক্লিওমিনিসের সৎ ভাই ছিলেন আর ক্লিওমিনিসের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আরােহণ করেছিলেন। স্পার্টার নির্বাসিত রাজা ডেমারেটাস জারেক্সিসকে সতর্ক করলেন যে, স্পার্টানরা নির্ভীকভাবে লড়বে, কিন্তু জারেক্সিস বিশ্বাস করতে পারলেন না যে এত ছােট একটি সেনাদল লড়াই করতে পারবে। যাই হােক, ৭০০০ গ্রিক গিরিপথটি ভালাে করে ধরে রাখলেন। তারা সেইসব অপ্রশস্ত এলাকায় পারস্যদের সাথে সমান তালে লড়লেন, এবং যেহেতু তারা আত্মবিশ্বাসে অগ্রবর্তী ছিল, তারা নিজেদের যতটুকু ক্ষতি হয়েছিল, তার থেকে বেশি শত্রুপক্ষের ক্ষতিসাধন করতে পারল । দিন কেটে যাচ্ছিল আর জারেক্সিস আরও মরিয়া হয়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু, পারস্যরা একজন ফোসিয়ান (ফোসিসের লোক) বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে এক সংকীর্ণ পথ খুঁজে পেল যা পাহাড়ের উপর দিয়ে থার্মোপাইলির আরেক দিকে গিয়ে পৌঁছেছে। পারস্য সেনাদলের মধ্য হতে একটি অংশকে আলাদা করে এই গিরিপথে পাঠানাে হলাে দূর থেকে গ্রিকদের পাকড়াও করতে। গ্রিকরা বুঝতে পারল যে, তাদের ঘিরে ফেলা হচ্ছে এবং লিওনিডাস তখন দ্রুত পিছু হটার আদেশ দিলেন। তার জন্য নয়, অবশ্যই ৩০০ স্পার্টানের জন্য, যারা সৈন্যদলের মেরুদণ্ড ছিল। যদি স্পার্টানরা পিছিয়ে আসত, তা লিওনিডাসের সারাজীবনের অসম্মানের ব্যাপার হত। তার থেকে মৃত্যুই বেশি গ্রহণযােগ্য ছিল। লিওনিডাসের পথে ১১০০ বিওটিয়ান সৈন্য ছিল কারণ তাদের অঞ্চল বিপর্যস্ত করা হত যদি গিরিপথে জারেক্সিস জোর খাটাতেন। বিওটিয়ানদের মধ্যে ৪০০ জন থিব্‌সের ছিল, আর বাদবাকি ৭০০ জন থিব্‌সের সাত মাইল পশ্চিমের থেসপিয়া থেকে আগত ছিল। যুদ্ধে থিবানদের আত্মসমপর্ণ করারই কথা ছিল, কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার আশাহীন অবরুদ্ধ কয়েক হাজার স্পার্টান আর থেসপিয়ান মাটি কামড়ে পড়ে রইল। তারা আঘাত করতে আর মারতে লাগল যেহেতু তাদের সেখানে দাঁড়ানাের শক্তি ছিল, আর শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করে গিয়েছিল। থার্মোপাইলি গ্রিকদের অবস্থান গ্রিকদের হৃদয়ে বীর গাঁথা হিসেবে জমা রইল আর মুক্তির সংগ্রামীদের শতাব্দী ধরে অনুপ্রাণিত করে গেল। যাই হােক, এটি ছিল গ্রিকদেরই পরাজয় এবং পারস্য সৈন্যদল খুবই নির্মমভাবে তাদের অগ্রযাত্রা পুনরায় চালু করতে পেরেছিল। 

সালামিসের যুদ্ধ

যে গ্রিক রণতরীগুলাে থার্মোপাইলির পঞ্চাশ মাইল পূর্বে উত্তর ইউবিয়ায় অবস্থিত আরটামিজিয়ামে ঘাঁটি গেড়েছিল, সেগুলো বিক্ষিপ্ত লড়াই এর মাধ্যমে পারস্যের নৌবাহিনীকে আটকে রেখেছিল। থার্মোপাইলির যুদ্ধের সংবাদ শুনে তারা গ্রিক জাহাজগুলো দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়াই সঠিক বলে মনে করলো। সুতরাং জারেক্সিস ভূমি ও সাগর দুই পথেই অগ্রসর হলেন। পারস্যদের কাছে অ্যাটিকা দারুণ অসহায় হয়ে পড়ল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালের ১৭ মে-সেপ্টেম্বর অথবা তার আশেপাশের সময়ে, জারেক্সিসের সেনারা এথেন্স নগরী দখল করে একে ভস্মীভূত করে দিল। জারেক্সিস এক্রোপলিসের ওপর অবস্থান নিলেন, এবং অবশেষ বিশ বছর পর, পােড়া সার্দিসের প্রতিশােধ নেয়া হলাে। কিন্তু এই এথেন্সে কোন এথেনীয়ই ছিলনা। অ্যাটিকার সকল জনগণকে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর অ্যাটিকা ও সালামিসের মধ্যবর্তী স্থানে গ্রিক জাহাজগুলো অবস্থান করছিল যেগুলোর অর্ধেকের বেশিই ছিল এথেনীয় ট্রাইরিম। ডেলফির ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হতে লাগল, যেহেতু সবকিছুই দখলে নেয়া হয়েছিল শুধু জাহাজের কাঠের দেয়ালই অবশিষ্ট ছিল, আর যেহেতু সেগুলাে অক্ষত ছিল এথেন্স তখনাে পুরাে পরাজিত হয়নি। যদিও গ্রিক নৌবাহিনী ছিল মূলত এথেনীয়, জাহাজের নৌ-অধিপতি ইউরিবিয়াডিস ছিলেন স্পার্টার, সেইসব সংকটময় মুহূর্তে গ্রিকরা স্পার্টান নেতৃত্বে নিরাপদ বােধ করত বলেই তাকে নৌসেনাপতি করা হয়। স্পার্টানরা সমুদ্রে তাদের ভবিষ্যৎ সম্মন্ধে অনিশ্চিত ছিল, আর ইউরিবিয়াডিসের স্পার্টার প্রতিরক্ষা ছাড়া আর কোনাে দূরবর্তী চিন্তা ছিল না। তিনি দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে পেলােপানেসাসকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, গ্রিসের যে অংশটি তখনও দখল হয়ে যায়নি। এথেনীয় নেতা থেমিস্টোক্লিস এর বিরুদ্ধে এত জোরালােভাবে বিতর্ক করলেন যে, ইউরিবিয়াডিস তার মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। তিনি তার নেতৃত্বাধীন সদস্যদের এর বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুললেন। থেমিস্টোক্লিস, উত্তেজনার বশে তার এক বাহু প্রসারিত করে চিৎকার করে বললেন, “আঘাত কর! তারপরও আমার কথা শােনাে।” স্পার্টানরা থেমিস্টোক্লিসের জ্বালাময়ী বক্তব্য এবং তার এথেনীয় পরিবারগুলােকে এথেনীয় ট্রাইরিমে ভরে ইতালির উদ্দেশে রওয়ানা দেয়ার হুমকি শুনে তার কথা মেনে নিল। স্পার্টাকে তখন দেখতে হত, নৌবাহিনীর সুরক্ষা ছাড়া তারা আর কতক্ষণ নিরাপদ থাকতে পারে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ইউরিবিয়াডিস থেকে যেতে রাজি হলেন।

থেমিস্টোক্লিসের ভয় ছিল যে দোনােমনা স্পার্টানরা আবারও তাদের মত পরিবর্তন করতে পারে, তাই তিনি একটি চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করলেন। তিনি পারসিকদের গােপন বন্ধু হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করে জারেক্সিসের কাছে বার্তা পাঠালেন এবং গ্রিক নৌবাহিনী পালিয়ে যাবার আগেই সেটিকে পাকড়াও করার পরামর্শ দিলেন।  পারস্যরাজ এতে খুশিই হলেন, কারণ তিনি ভাবলেন গ্রিস বিশ্বাসঘাতকে পরিপূর্ণ যারা সম্ভাব্য পারস্য বিজয়ের মুখে নিজেদের রক্ষা করতে চায়, ইতিমধ্যে একজন ফোসীয় বিশ্বাসঘাতক জারেক্সিসকে থার্মোপাইলি গ্রিক সেনাদলকে ফাঁদে ফেলতে সাহায্য করেছে, তাই থেমিস্টোক্লিসও যে তার মতই গ্রিক নৌবাহিনীকে ফাঁদে ফেলতে জারেক্সিসকে সাহায্য করবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। জারেক্সিস দ্রুত পারসিক জাহাজগুলােকে সালামিস আর মূলভূমির মধ্যে অবস্থিত সংকীর্ণ জলভাগের উভয় প্রবেশপথ বন্ধ করার জন্য অগ্রসর হওয়ার আদেশ দিলেন। প্রণালির মধ্যেই গ্রিক জাহাজগুলাে ফাঁদে আটকা পড়ল। জাহাজের অধিনায়কেরা সারারাত তর্ক করল, যাদের কেউ কেউ তখনাে প্রচণ্ডভাবে দাবি করছিল রণতরীগুলােকে দক্ষিণে নিয়ে যাওয়ার, আর এসবই থেমিস্টোক্লিস চেয়ে দেখছিলেন। যাই হােক, সেই রাতেই, ন্যায়পরায়ণ এরিস্টাইডিস ঈজিনা থেকে জাহাজের কাছে পৌঁছেলেন। তিনি তার নির্বাসনের কাল থেকেই ঈজিনাতে ছিলেন, কিন্তু চরম সংকটের মুহূর্তে থেমিস্টোক্লিস সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে এরিস্টাইডসকে ডাকা হােক, কেননা এথেন্সের সব লােককেই এথেন্সের প্রয়ােজন ছিল। এরিস্টাইডিস তাদেরকে বললেন, তাদের রণতরীগুলাে এই অবস্থায় লড়াই করা ব্যতীত প্রণালি থেকে বের হতে পারবে না, এবং দিন শেষে রণতরীগুলোর কমান্ডাররা হতবাক হয়ে দেখল যে আসলেই তাই। অনােন্যপায় হয়ে তাদেরকে লড়াই করতেই হয়েছিল। কিন্তু, এটা ছিল আবারও থার্মোপাইলির মতােই ব্যাপার, তবে এর একটি সুখী সমাপ্তি ছিল। পারস্যরাজ দেখলেন, অপ্রশস্ত প্রণালিতে তিনি তার সব রণতরীকে ব্যবহার করতে পারবেন না, তিনি কেবল একবারে তার জাহাজগুলাের একটি অংশকেই কেবল পাঠাতে পারবেন। গ্রিক ট্রাইরিমগুলাে ছিল অনেক বেশি ব্যবহারযােগ্য এবং সেগুলাে বাঁক নিতে, ধোকা দিতে এবং আঘাত করতে পারত, আর তাই পারস্য জাহাজগুলাে এক্ষেত্রে ছিল অসহায় শিকার মাত্র। গ্রিক রণতরীগুলাে একটি পরিপূর্ণ ও একপেশে বিজয় অর্জন করল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সাল বা এর আশেপাশে ২০ সেপ্টেম্বরে সালামিসের যুদ্ধে পারস্য রণতরীগুলাে ধ্বংস হয়ে গেল এবং গ্রিস বেঁচে গেল। এক্রোপলিসে বিজয়ােল্লাসে দাঁড়ানাের তিন দিন পরে জারেক্সিস তার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে দেখলেন। রণতরী ছাড়া তিনি কেবল অপ্রশস্ত অন্তরীপ দিয়েই পেলােপনেসাস আক্রমণ করতে পারতেন, আর দু-দুবার সরু বা অপ্রশস্ত পথে যুদ্ধ করার পর তিনি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে তিনি পারস্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং গ্রিসের সাথে যুদ্ধ তিনি তার শ্যালক মারদোনিয়াসের হাতে ছেড়ে দিলেন, এই মারদোনিয়াসই দারিয়াসের সময় থ্রেসে পুনর্বিজয় লাভ করেছিলেন। আর জারেক্সিস নিজে আর কোনদিন গ্রিসে ফিরে আসেননি। গ্রিকদের জয়ের ক্রেডিট সবচেয়ে বেশি কার ছিল তা নিয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে, তবে হয়তো সত্য নয়। গল্পটি হলো এই যে, যুদ্ধজয়ী সুখী গ্রিক সেনাপতিরা পরস্পর দেখা করে কে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবিদার তা নির্ধারণ করার জন্য একটি ভোটগ্রহণের আয়োজন করেছিল। এই গল্প মতে, প্রত্যেক সেনাপতিই প্রথম স্থানে নিজের পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন, আর প্রত্যেকেই দ্বিতীয় স্থানে রেখেছিলেন থেমিস্টোক্লিসকে। 

দক্ষিণ ইতালী ও সিসিলিতে হিমেরা ও সাইমির যুদ্ধ

এর মধ্যে সিসিলিতে কার্থেজীয় বিপদের কী হলো? কার্থেজিয়ান সেনাপতি হ্যামিলকার একটি উদ্ধত গ্রিক আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন, যদিও তিনি বেদিতে দাঁড়িয়ে দেবতাদের কাছে নিজের বলিদানের বিনিময়ে সামনের যুদ্ধে নিজেদের জয়লাভ চাইছিলেন। হ্যামিলকারের মৃত্যুর সাথে সাথেই, বিরােধী সেনাদল দুটো খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে সিসিলির উত্তর উপকূলে হিমেরায় পরস্পরের মুখোমুখি হলাে। এখানে গ্রিক বাহিনী দারুণ এক জয় অর্জন করল এবং কার্থেজিয়ান বিদ্বেষ প্রায় এক শতকের জন্য অবদমিত হলাে, লােককথা প্রচলিত যে, হিমেরার যুদ্ধ সালামিসের যুদ্ধের মতােই একই দিনে লড়া আর জেতা হয়েছিল, আর তাই এক দিনেই পূর্ব আর পশ্চিম উভয় অংশের গ্রিকরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল। কিন্তু এটি সত্য হওয়ার জন্য বিশ্বাসযােগ্য কিছু ছিল না। এই জয়ের ফলে অধিক বিখ্যাত আর শক্তিশালী হওয়া গিলন দুই বছর পরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ সালে মারা গেলেন। তার ছােট ভাই প্রথম হিয়েরাে হিমেরায় বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি এবারে টাইরানীতে আরােহণ করলেন, এবং তার অধীনে সিরাকুজ উন্নতি আর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লাগল। হিয়েরােকে তখনাে এট্রুস্কান নামে বিপজ্জনক শত্রুর মােকাবেলা করতে হয়েছিল। পঞ্চাশ বছর আগে, কার্থেজিয়ানদের সাথে মিলে, এট্রুস্কানরা করসিকা দ্বীপে এক ফিনিসীয় নৌবাহিনীকে পরাস্ত করেছিল, যা গ্রিক উপনিবেশের সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। তখন থেকেই এট্রুস্কানরা দক্ষিণ ইতালির গ্রিক বসতিগুলােকে দখল করতে দক্ষিণ দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ইতালির গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলাের মধ্যকার সবচেয়ে উত্তরের শহর সাইমি এট্রুস্কানদের চাপ সহ্য করতে পেরেছিল। যখন তারা অবরােধের শিকার হলাে, তারা হিয়েরাের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল। একটি সিরাকুজিয়ান রণতরী উত্তরদিকে ধাবিত হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৪ সালের সাইমির যুদ্ধে এট্রুস্কানদের পরাস্ত করল। এট্রুস্কানরা কার্থেজিয়ান বা পারসিকদের থেকেও খারাপ অবস্থায় পতিত হলাে, কেননা এই দুই দলের মতাে, তারা কখনােই গ্রিক পরাজয়ের রেশ থেকে বের হতে পারেনি। তারা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একসময় ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেল। 

আয়োনিয়া থেকে দক্ষিণ ইতালীতে গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের স্থানান্তর

সেই দিনগুলােতে সিসিলি আর ইতালিতে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। প্রথমে পারস্যের বিজয় ও তারপর পারস্যের বিরুদ্ধে আয়োনিয়ার বিদ্রোহের দমনের কারণে আয়োনিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে এই অঞ্চল গ্রিক বিশ্বে তার বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। এই দুর্যোগের ফলে আয়োনীয় চিন্তাবিদগণ অন্যান্য অঞ্চলে অভিবাসিত হন, যেমন আয়োনিয়া পারস্যের অধীনে শোষিত হবার কালে পিথাগোরাস সামোস ত্যাগ করে ইতালীর গ্রিক উপনিবেশ ক্রোটনে চলে এসেছিলেন। আয়োনিয়া থেকে আগত চিন্তাবিদরা নিজেদের সাথে তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাও নিয়ে আসেন। দক্ষিণ ইতালীর গ্রিক উপনিবেশগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকায় তারা মূলত সেই অঞ্চলগুলোতেই পাড়ি দেন। পিথাগােরাস ছাড়াও এই চিন্তাবিদদের একজন উদাহরণ হলেন জেনোফ্যানিস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ সালে কোনাে একটি আয়োনীয় শহর কোলফনে জন্মগ্রহণ করেন। আয়োনিয়া পারসিকদের অধীনে গেলে তিনি প্রথমে সিসিলিতে ও পরে দক্ষিণ ইতালিতে পাড়ি জমান। তিনি তার সেই তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি বলেছিলেন, পর্বতে শামুকের অবস্থান এটাই দেখায় যে পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলাে এখন বাতাসে আছে, তা হয়তাে একসময় সাগরের তলায় ছিল। জোনােফ্যানিস এলিয়াটিক দার্শনিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে পরবর্তী শতাব্দীতে আরাে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের আবির্ভাব হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালের দিকে দক্ষিণ পশ্চিম ইতালির উপকূলের শহর এলিয়াতে জন্মগ্রহণ করা পারমিনিডিস ছিলেন একজন পিথাগােরিয়ান, যিনি বিশ্বের প্রকৃতি সম্মন্ধে জটিল তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন, কিন্তু তার লেখালেখির কিছু অংশই কেবল টিকে ছিল। তার জেনাে নামে এক গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য ছিল, যিনি এলিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি পারমিনিডিসের চিন্তাকে আরাে সামনে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ইন্দ্রিয় সত্যে উপনীত হওয়ার মতাে নির্ভরযােগ্য মাধ্যম নয়। তিনি দাবি করেছিলেন, কেবলমাত্র কার্যকারণই এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। জেনাে গ্রিক চিন্তাবিদদের চারটি বিখ্যাত পন্থা দেখিয়ে এটি বােঝানাের চেষ্টা করলেন যে, যা আমরা ভাবি, যা আমরা দেখি, তা আসলে নাও হতে পারে। প্যারাডক্সের মাধ্যমে তিনি এর প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। জেনাের প্যারাডক্সগুলাের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটিকে বলা হয় “আকিলিস আর কচ্ছপ”। ধরুন, আকিলিস কচ্ছপের চেয়ে দশগুণ বেশি দৌঁড়াতে পারে এবং কচ্ছপকে ১০ গজ আগে থেকে শুরু করতে দেয়া হলাে। এর পরিণতিতে আকিলিস কখনােই কচ্ছপকে পার হয়ে যেতে পারবে না, কারণ যখন সে তাদের মধ্যকার ১০ গজের দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলবে, কচ্ছপটি একগজ এগিয়েই থাকবে। যখন আকিলিস সেই এক গজ অতিক্রম করে ফেলবে, তখন কচ্ছপটি একগজের দশভাগের একভাগ এগিয়ে থাকবে এবং এটা চলতেই থাকবে। যেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয় দেখায় যে দ্রুতগতির দৌঁড়বিদ ধীরগতির দৌঁড়বিদকে অতিক্রম করছে ও পার হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ইন্দ্রিয় মিথ্যা হতে বাধ্য (অথবা কার্যকারণটি অবশ্যই)। এই প্যারাডক্সগুলাে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ব্যবহারযােগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলােকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলাের প্রত্যাখ্যান বিজ্ঞানীদেরকে কার্যকারণের সাথে যুক্ত প্রক্রিয়াকে কাছ থেকে অনুসন্ধান করতে পরিচালিত করেছে। জেনােকে ডায়ালেকটিকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা হচ্ছে কার্যকারণের শিল্প সত্য উদঘাটনের জন্য, শুধুই একটি বিতর্ক জেতার জন্য নয়। 

সেই সময়ে আরেক গ্রিক বিজ্ঞানী ছিলেন ফিলােলাউস যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে ক্রোটনের টারেনটামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন পিথাগােরাসের শিষ্য এবং পৃথিবী যে নিজস্থানে স্থির নয়, বরং ঘুরছে, এই সত্য প্রচার করা প্রথম ব্যক্তি। তার মতে এটি একটি কেন্দ্রিয় আগুন’-এর চারপাশে ঘুরছে যেখান থেকে দৃশ্যমান সূর্য হচ্ছে শুধু একটি প্রতিফলন মাত্র। সিসিলিতে সময়ের সেরা দার্শনিক ছিলেন এমপিডােক্লিস। তিনি সিসিলির দক্ষিণ উপকূলে আক্রাগাসে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার নিজ শহরে একটি গােষ্ঠীকে উৎখাত করতে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু টাইরান্ট হতে অস্বীকৃতি জানালেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তার দিকনির্দেশনাতে যে, বিশ্ব চারটি মৌলিক পদার্থে গড়ে উঠেছে মাটি, জল, বায়ু ও আগুন। এই চার পদার্থের তত্ত্বটি তার মৃত্যুর ২০০০ বছর পরেও টিকে ছিল, যদিও আমরা এখন জানি এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এমপিডােক্লিস ছিলেন একজন পিথাগােরিয়ান যার বেশ কিছু রহস্যময় তত্ত্ব ছিল। তার নিজেকে নবী বা চমৎকারিত্বের লােক বলে দেখাতে কোনাে আপত্তি ছিল না। একটি লােককথা অনুযায়ী, তাকে জানানো হয়েছিল যে, তাকে একটি বিশেষ দিনে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হবে এবং একজন দেবতা বানানাে হবে। সেই দিন তিনি সম্ভবত এটনা পর্বতের গিরিখাতে লাফিয়ে পড়েছিলেন, যাতে করে তার সেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটাকে সবাই ভালাে একটা ভবিষ্যদ্বাণী বলে ধরে নেয়। এই ঘটনা ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে অথবা তার আশপাশের সময়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৬ সালে হিয়েরাে মারা যান এবং সিরাকুসিয়ান টাইরানি সাময়িকভাবে হলেও সমাপ্তিতে চলে এসেছিল। এরপরে ছিল অধশতাব্দীর নিস্তব্ধতা। সিসিলির স্থায়ী বাসিন্দাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে এটি ভেঙেছিল, যারা গ্রিকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও হার মেনেছিল। 

প্লাটিয়ার যুদ্ধ ও গ্রিসে পারস্যের চূড়ান্ত পরাজয়

যেখানে হিমেরার যুদ্ধ পশ্চিম গ্রিকের ওপর থেকে কার্থেজের মেঘ সরিয়ে নিয়েছিল, সেখানে সালামিসের যুদ্ধ গ্রিসের গ্রিকদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। পারস্য রণতরীগুলাে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পারস্য সেনাদল রয়েই গিয়েছিল। সেগুলাে উত্তরার্ধে নিজেদের বিরত রেখেছিল, কিন্তু যখন শীতকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলাে বিওটিয়ার দিকে অগ্রসর হলাে। সেখানে ছিল ক্ষুদ্রতর সেনাদল, তাই সহজেই তাদের পরিচালনা করা যেত এবং এটি ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি বিপজ্জনক। এটির নেতৃত্বে ছিলেন মারদোনিয়াস, যিনি ছিলেন একজন যােগ্য দলপতি, যিনি আপাত অমেধাবী জারেক্সিসকে চলে যেতে রাজি করিয়েছিলেন। জারেক্সিস তার কথায় সম্মত হন কারণ মারদোনিয়াস ছিলেনই এমন লোক যাকে দায়িত্ব দিয়ে নির্ভার থাকা যায়। আর এই বিষয়টা গ্রিকদের জন্য ভাল কিছু ছিলনা। মারদোনিয়াস প্রথমে মেসিডােনিয়ার রাজা প্রথম আলেক্সান্ডারকে এথেন্সে পাঠালেন তাদেরকে পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিক নীতি থেকে দূরে ঠেলে দিতে, কারণ তারা ইতিমধ্যেই পারস্যের হাত থেকে অ্যাথেন্সকে মুক্ত করে ফেলেছে। এথেনীয়রা তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তারা সবসময়ের ধীরগতির স্পার্টানদের দ্রুত আক্রমণে যেতে রাজি করাতে চেষ্টা করেছিল। যতক্ষণে স্পার্টানরা তাদের সেনাদের জোগাড় করতে সমর্থ হলাে, মারদোনিয়াস অ্যাটিকা আক্রমণ করলেন এবং এথেন্সকে আরেকবার পুড়িয়ে দিলেন। কিন্তু স্পার্টানরা তখন সমস্যার মধ্যে ছিল। থার্মোপাইলির লিওনিডাসের মৃত্যুর সাথে সাথে তার শিশুপুত্র সিংহাসনে আরােহণ করেছিল। কিন্তু সে একটি সেনাদলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে পরিপক্ক ছিল না। পসেনিয়াস নামে তার এক কাজিন, তার রিজেন্ট ও জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে। তার নেতৃত্বে ২০,০০০ পেলােপনেসিয়ানের সেনাদল উত্তরে অগ্রসর হলাে, যাদের মধ্যে ৫০০০ জনই ছিল স্পার্টান। এটা ছিল সম্ভবত গ্রিক ইতিহাসের কোনাে একটি অভিযানে স্পার্টার সর্ববৃহৎ অংশগ্রহণ। অন্যান্য গ্রিক শহর থেকে ক্ষুদ্র সেনাদলগুলোও তাদের সাথে যুক্ত হলাে, এরিস্টাইডিসের নেতৃত্বে ৮০০০ এথেনীয় সহ মােট গ্রিক সৈন্য সংখ্যা সম্ভবত ১,০০,০০০-এ গিয়ে ঠেকেছিল। এদের বিরুদ্ধে মারদোনিয়াসের কাছে সম্ভবত ১,৫০,০০০ পারস্য সেনা এবং তাদের মিত্ররা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ সালের আগস্ট মাসে দুই সেনাদল প্রাটিয়ায় মুখােমুখি হলাে এবং পরবর্তী যুদ্ধ ছিল তীক্ষ্ম ও কঠিন। একাধিকবার মনে হয়েছিল গ্রিকরা (যুদ্ধে ও যুদ্ধের পূর্বে যাদের পরিচালনা খুব অগোছালো ছিল) ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু স্পার্টান আর এথেনীয়রা ছিল অবিচল, এবং ম্যারাথনের মতােই তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র মুখােমুখি যুদ্ধে পারসিকদের তুলনায় তাদের বেশি সুবিধা দিয়েছিল। যুদ্ধের তুঙ্গস্পর্শী মুহূর্তে ১০০০ লােক নিয়ে চার্জ করতে আসা মারদোনিয়াস বর্শার আঘাতে মারা গেলেন এবং তার সাথে সাথে পারসিকদের মনােবলও হারিয়ে গেল। তারা পালিয়ে গেল এবং যারা বাঁচতে পারল তারা এশিয়ার পথ ধরল। গ্রিসের মূলভূমি এখন স্থল আর জল উভয় স্থানেই নিরাপদ হয়ে গেল। বিজয়ী গ্রিকরা থিব্‌সের দিকে অগ্রসর হলাে, যেটি পুরাে পারসিক যুদ্ধের সময় সবসময় পারস্যের সাথে থাকার জন্যই প্রস্তুত ছিল। এর ফলে তারা নিজেদের ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু তারা এতে করে কেবলমাত্র গ্রিকদের দ্বারা ভস্মীভূত হওয়াটাই নিশ্চিত করেছিল। থিবান গােষ্ঠীতান্ত্রিকদের নির্বাসিত করা হলাে আর গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা হলাে।

মিক্যালির যুদ্ধ এবং আয়োনিয়া ও ঈজিয়ান অঞ্চলের পারস্যের হাত থেকে মুক্তি

সমুদ্রেও চলছিল ঘটনার ঘনঘটা। যেহেতু পারস্যের প্রচুর রণতরী সালামিসে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এটা তাই প্রত্যাশিত ছিল যে গ্রিকরা বিজয়ের পরের সময়টায় আয়োনিয়ার দিকে শক্তভাবে অগ্রসর হবে। কিন্তু সেটা করার আগে, ধীরগতির স্পার্টানদের আক্রমণে যেতে রাজি করানাে হলাে, এবং এতেও বেশ খানিকটা সময় লাগল। পারস্য রণতরীগুলাের মধ্যে অবশিষ্ট যা ছিল তা সামােসে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল আর তারা সাহায্যের জন্য শেষমেশ স্পার্টানদের কাছে গেল। লিওটিকিডাস নামে একজন স্পার্টার রাজার অধীনে গ্রিক জাহাজগুলাে পূর্বদিকে অগ্রসর হলাে। কিন্তু, পারসিক রণতরীগুলাে আরেকটি সমুদ্র-যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই তারা সামােসের পূর্বদিকে আয়োনীয় উপকূলের একটি অংশ কেপ মিকালিতে (Cape Mycale) থেমে গেল। সেখানে তারা তাদের জাহাজগুলােতে এবং ভূমিতে গ্রিকদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। গ্রিকরাও চলে এলো, এবং পারসিক অবস্থানকে আঘাত করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করল। যুদ্ধের প্রবাহ গ্রিকদের জন্য অনুকূল হতে না হতেই বিভিন্ন আয়োনীয় ক্ষুদ্রাকায় সেনাদল, যাদের পারসিকরা তাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছিল, তারা বিদ্রোহ করে বসল। তারা তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল এবং এটাই পুরাে ব্যাপারটিকে নির্ধারণ করে দিল। পারসিকরা পালিয়ে গেল এবং মিক্যালির যুদ্ধের ফলে এশিয়া মাইনরের উপকুলীয় গ্রিক শহরগুলাে তাদের স্বাধীনতা ফিরে পেল, একসময় যেটি তারা শতবর্ষ আগে লিডিয়ার আলিয়াটিসের কাছে হারিয়ে ফেলেছিলপরবর্তী লােককথা বলে যে, মিকেলির যুদ্ধ আর প্লাটিয়ার যুদ্ধ একই দিনে লড়া এবং জেতা হয়েছিল। আসলে তা ঠিক ছিল না, কারণ মিকেলির যুদ্ধ সম্ভবত কয়েকদিন পরে লড়া হয়েছিল। এথেনীয়দের নির্দেশনা অনুযায়ী রণতরীগুলাে চলছিল (যেহেতু এথেন্স সবসময় কৃষ্ণসাগরের শস্য-সুফলা এলাকায় তার অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত ছিল) হেলেসপন্ট আর বসফরাসের এলাকা নিরাপদ করতে, আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ সালে পারস্য যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। আয়োনীয় বিদ্রোহ দিয়ে শুরু হওয়া বিশ বছরের যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে গ্রিক জলাভূমিসহ পুরাে ঈজিয়ান অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেল। গ্রিকদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের উল্লেখযােগ্য কারণসমূহ ছিল –

  • ১। বহুজাতির লােক নিয়ে গঠিত সেনাদলে একতার অভাব ছিল। 
  • ২। গ্রিকদের স্বজাতির প্রতি যে আনুগত্য ও মনােবল ছিল, পারসিকদের তা ছিল না। 
  • ৩। পারস্যভূমি থেকে বিরাট দূরত্বে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালানাে কঠিন কাজ ছিল।

গ্রেকো-পারস্য যুদ্ধের ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস 

পারস্য-যুদ্ধ চিরকালের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল শুধু তার গুরুত্বের জন্যই নয়, যে মানুষেরা এটি লিখেছিলেন তাদের মাধ্যমেও এটি হয়েছিল। ট্রোজান যুদ্ধ যেমন করে হােমারকে খুঁজে পেয়েছিল, পারস্য-যুদ্ধ ঠিক তেমনি হেরােডােটাসকে খুঁজে পেল। হেরােডােটাস খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ সালে আয়োনিয়ার এশিয়া মাইনর উপকূলে একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার তরুণ বয়সে তিনি প্রাচীন দুনিয়ার সব জায়গায় ভ্রমণ করে সবকিছু তীক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং মিশর আর ব্যাবিলনীয়ার পাদ্রীদের বলা গল্পগুলাে মনােযােগ দিয়ে শুনলেন। (কখনাে কখনাে তিনি একটু বেশিই বিশ্বাস করতেন সেই গল্পগুলাে, যা তারা আগ্রহী গ্রিক আগন্তুককে গিলিয়েছিল।)। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ সালের দিকে, তিনি পারস্য-যুদ্ধের ওপর একটি ইতিহাস রচনা করলেন। এটা এথেনীয় পাঠকদের জন্যই রচিত হয়েছিল, আর তাই এটি ছিল ব্যাপকভাবে এথেন্সের স্বপক্ষের। তিনি এথেন্সবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু এটা তার প্রশংসনীয় পুরস্কার হিসেবে সবটুকু ছিল না। তার কাজ ছিল বারবার কপি হবার জন্য যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক, আর তাই গ্রিক পুঁথিসমূহের অনেক ধ্বংসের মধ্যেও তার সৃষ্টিকর্ম পুরোটাই টিকে রইল, যা পরবর্তীতে বেশিরভাগ গ্রিক সাহিত্যের কীর্তিকেই বরবাদ করে দিয়েছিল। যেহেতু হেরােডােটাস হলেন প্রথম দিককার গ্রিক লেখক যার কাজ বিশদভাবে টিকে ছিল এবং যেহেতু তার মূল মনোেযােগ ছিল পারস্য-যুদ্ধই, সেহেতু ৫০০ সালের আগে গ্রিসের ইতিহাস শুধু অসম্পূর্ণভাবে জানা যায়। সৌভাগ্যক্রমে, হেরােডােটাস শুধু গ্রিসের প্রথম ইতিহাসই তুলে ধরেননি, তার সাথে সাথে পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে জড়িত বিভিন্ন জাতির কথাও বলেছিলেন। তিনি এই প্রাথমিক ইতিহাসগুলাে কিছুটা হালকাভাবে তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের আগের যে ঘটনাগুলাে আমরা জানি, তা হেরােডােটাসের মাধ্যমেই এসেছে এবং আমরা শুধু তার প্রতি কৃতজ্ঞই থাকতে পারি কারণ তিনি প্রাথমিক ইতিহাস আলােচনা করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

গ্রিসের স্বর্ণযুগ, এথেন্সের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা এবং এথেন্স-স্পার্টার সংঘর্ষের পূর্বাবস্থা

গ্রেকো-পারস্যের যুদ্ধের পর স্পার্টার সংকটপূর্ণ অবস্থা 

পসানিয়াসের অধোগতি ও অপরাধ : পারস্য যুদ্ধের ফলে স্পার্টা আর এথেন্স ছিল গ্রিসের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটো নগর। এথেন্সের ক্ষমতায় আরোহনের ফলে স্পার্টার ঈর্ষান্বিত হবার কথা, স্পার্টা ছিলও তাই। কিন্তু দুটো বিষয় স্পার্টাকে কার্যকরীভাবে এথেন্সের বিরােধিতা করা থেকে বিরত রেখেছিল। প্রথমত, এথেন্স তার এই নতুন শক্তি গ্রিসের মূলভূমির বদলে সমুদ্রে জয়েই ব্যবহার করে, এদিকে স্পার্টা ভূমিতেই শক্তিশালী ছিল, সমুদ্রে তারা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না। যেভাবেই হােক, তারা এথেন্সকে এড়িয়ে গেলো এবং শুধু তার ভূমির কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখল। দ্বিতীয়ত, পারস্য যুদ্ধের ঠিক পরবর্তী বছরগুলােতে স্পার্টা কিছু বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। একটা ব্যাপার ছিল, পসানিয়াস খারাপ আচরণ করেছিল। প্লাটিয়ার যুদ্ধের পর তিনি গ্রিসের নায়ক ছিলেন এবং তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৭ সালে বাইজোন্টিয়াম জয় করতে গেলেন। কিন্তু তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। স্পার্টায় প্রায়ই যেটা দেখা যেত, একজন স্পার্টান একবার স্পার্টার কঠিন বৈশিষ্ট্য আর শৃঙ্খলা থেকে বের হয়ে গেলে তিনি বিপরীত দিকের চরমপন্থায় চলে যেতেন। তখন বিদেশে সে বিলাসিতায় আনন্দ-ফুর্তি করত, আর টাকার জন্য লােভাৰ্ত থাকত। এটাই ঘটেছিল পসানিয়ানসের ক্ষেত্রে, তিনি বর্ণিল পারস্য পােশাক পড়ত এবং তাদের সহ-গ্রিকদের প্রতি উদ্ধতভাবে আচরণ করতেন, যেন তিনি নিজেই ছিলেন কোনাে প্রাচ্য দেশিয় সম্রাট। শীঘ্রই তিনি পারস্যদের সাহায্যে বৃহত্তর ক্ষমতা লাভ করার প্রচেষ্টায় জারেক্সেসের সাথে মধ্যস্থতা করতে লাগলেন (অথবা কমসে কম তিনি এটার জন্য সন্দেহযুক্ত ছিলেন)। এফোরেরা তাকে স্পার্টায় ডেকে নিয়ে এলেন, যারা তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অপর্যাপ্ত সাক্ষের কারণে তা পারেননি। তবে তাকে আর স্পার্টার সৈন্যদের নেতৃত্ব দিতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু, তিনি হেলেসপন্টে ব্যক্তিগত অভিযানে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি এথেনীয়দের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন এবং পারসিয়ানদের সাথে আলােচনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে দ্বিতীয়বারের মতাে স্পার্টায় ডেকে নিয়ে আসা হলাে, এবং যেখানে তিনি এমন কিছুর প্রতিজ্ঞা করলেন, যা স্পার্টানদের কাছে সবচেয়ে ক্ষমার অযােগ্য পাপ ছিল। তিনি হেলটদের দিয়ে একটা বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে গেল আর পসানিয়াস নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে একটি মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। তাকে মন্দির থেকে জোর করে বের করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই সেখানে তাকে খাবারদাবার ছাড়াই রেখে দেওয়া হলাে যতদিন না সে অনাহারে থেকে মরণাপন্ন না হয়, এরপর তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় কেননা তাকে পবিত্র স্থানে মরতে দিলে সেটা একটা অধর্ম হত। সে বাইরেই মারা গিয়েছিল। এটা ছিল ৪৭১ খ্রিস্টাব্দের দিকের ঘটনা। 

আর্গোস জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : এসব কিছুই স্পার্টার সম্মান হারানাের কারণ হলাে। অন্য গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলাে ভাবতে বাধ্য হলাে, যদি প্লাটিয়া আর মিকালির স্পার্টান বীরেরা বিশ্বাসঘাতক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, তাহলে কোনাে স্পার্টানকেই আর বিশ্বস্ত্র করা যায় না। অন্যদিকে এথেন্স ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ধীরগতির স্পার্টানদের মতাে পিছিয়ে পড়া ছিল না, এবং পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধে তারা সবসময়ই সবচেয়ে বেশি অগ্রসর ও গ্রহণযোগ্য ছিল। এরই ফলে অবশেষে প্রথম ক্লিওমিনিসের হাতে পরাজয়ের রেশ কাটিয়ে ওঠা আর্গোসরা আরও একবার পেলােপনেসাসে স্পার্টান প্রভুত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের প্রচেষ্টা নিল। মাইসিনিয়া আর টাইরিনজকে তার সাথে নিয়ে (বর্তমান সময়ে শুধু সামান্য ছােট্ট গ্রামই আছে, প্রাচীন গৌরবের কিছুই যেখানে অবশিষ্ট নেই) তারা প্রাথমিক সাফল্য পেল এবং অন্য শহরগুলােও তাদের সাথে যােগ দিল। এমনকি তেজিয়া, যারা যথারীতি স্পার্টানদের স্বপক্ষের ছিল, তারাও আর্গোসদের জোটে যােগ দিল। গ্রিক দুনিয়ার সর্বত্র এথেন্সের ক্ষমতার উত্থানকে প্রত্যুত্তর দেয়ার মতাে অবস্থার থেকে দূরে থাকা অবস্থায় স্পার্টা হঠাৎ করেই পেলােপনেসাসে নেতৃত্বের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হলাে যেখানে তাদেরকে নিরাপদেই এক শতাব্দী ধরে পরাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হত। সৌভাগ্যক্রমে, স্পার্টার সিংহাসনে প্রথম ক্লিওমিনিসের যােগ্য উত্তরসূরী হিসেবে এক তরুণ রাজা আসিন ছিলেন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় আরকিডেমাস, যিনি তার পিতামহ লিওটিকিডাসের তিরােধানের পর রাজা হয়েছিল। আরকিডেমাস খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ সালে তেজিয়াতে আর্গোস ও তার মিত্রদের পরাস্ত করলেন। যথেষ্ট হয়েছে ভেবে আর্গোস যুদ্ধ থেকে নিষ্ক্রিয় হলাে, কিন্তু তাদের আরকেডিয়ান মিত্র তেজিয়া প্রতিরােধ চালিয়ে গেল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ সালে দ্বিতীয় একটি যুদ্ধ সেটির পরিসমাপ্তি ঘটাল এবং স্পার্টা নিরাপদেই আরেকবার পেলােপনেসাসের প্রভুতে পরিণত হলাে। 

ভূমিকম্প ও হেলটদের বিদ্রোহ : কিন্তু আরকিডেমাসের জন্য মন্দতর কিছুই অপেক্ষা করছিল। সবচেয়ে কঠিন আঘাত করল এক শত্রু, যার সাথে এমনকি স্পার্টাও লড়াই করতে পারল না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ সালে এক ভূমিকম্পে স্পার্টা শহর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং কিছু সময়ের জন্য স্পার্টানরা হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে হেলটরা সুযােগ নিল। আট বছর আগে, পসানিয়াস তাদের আশার আলাে দেখিয়েছিল যে দুই শতাব্দীর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে পারে, কিন্তু এই পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে গেল। এখন স্পার্টান প্রভুরা সেই সময়ে অসহায় হয়ে পড়ল; আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এল। হেলটরা দ্রুত নিজেদের সংগঠিত করল এবং স্পার্টার সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করল। যখন স্পার্টানরা শ্বাস নেওয়ার সুযােগ পেল, হেলটদের তখন কোনাে সুযােগই ছিল না। যেমনটা তাদের পূর্বসূরীরা দুই শতাব্দী পূর্বে করেছিল, তেমনি হেলটরা ইথােমি পর্বতে পিছিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং নিজেদের সুরক্ষিত করল। তারা সেখানে পাঁচ বছর যুদ্ধ চালিয়ে গেল, সেটাকে কখনাে কখনাে ‘তৃতীয় মেসেনিয়ান যুদ্ধ’ বলা হয়। নিজেদের দাসদের পরাস্ত করতে স্পার্টার অনেক সময় লাগছিল, যা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত হানল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৯ সালে, অবশেষে হেলটদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হলাে, কিন্তু শর্ত ছিল তাদেরকে মেরে ফেলা হবে না বা আবার দাসত্বেও ফিরিয়ে নেয়া হবে না। স্পার্টানরা তাদেরকে স্পার্টা ছেড়ে যেতে দিতে রাজি হলাে, আর এথেনীয় জাহাজ তাদেরকে নউপ্যাক্টাসে নিয়ে গেল, যে ঘাটির্টিকে কোরিন্থ উপসাগরের উত্তরের উপকূলে এথেন্স খুঁজে পেয়েছিল। 

ডেলিয়ান লীগ ও এথেনীয় সাম্রাজ্যবাদ

এথেন্সের নেতৃত্বে ডেলিয়ান লীগের প্রতিষ্ঠা : যখন আভ্যন্তরীন বিষয়সমূহ, ভূমিকম্প আর বিদ্রোহ স্পার্টাকে বাধাগ্রস্ত করছিল, তখন এথেন্সের ছিল সৌভাগ্যের সময়, হিপ্পিয়াসের পতনের পর থেকেই এথেন্সের সমৃদ্ধির যুগের সূচনা হয়, এবারে সেই সমৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পেলো। পারসিয়ান কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার যেকোনাে প্রচেষ্টার হাত থেকে এশিয়া মাইনরের মুক্ত হওয়া শহরগুলােকে রক্ষার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সুরক্ষার দরকার ছিল। সেই রকম সুরক্ষা শুধুমাত্র এথেনীয় নৌবাহিনী থেকেই আসতে পারত। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ সালে মিক্যালির যুদ্ধের পরপরই এশিয়া মাইনর উপকূল আর ঈজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলাে পারস্যের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে তুলতে এথেন্সের সাথে জোট বাঁধতে শুরু করল। প্রতিটি শহরকেই ঐক্যবদ্ধ নৈবাহিনীতে জাহাজ অথবা কেন্দ্রীয় কোষাগারে অর্থ দিতে হত। প্রদানকৃত জাহাজ অথবা অর্থের হিসাব প্রত্যেকটি শহরের আকার এবং সমৃদ্ধি অনুযায়ী ন্যায়পরায়ণ এরিস্টাইডিস কর্তৃক সমন্বিত করা হত। আর এই কাজটি তিনি এতই ভালােভাবে করলেন যে কোনাে শহরই মনে করেনি যে তাকে বেশি পরিমাণে দিতে হয়েছে অথবা তার প্রতিবেশীকে কম দিতে হয়েছে। (এটা ছিল এরিস্টাইডিসের ন্যায়পরায়ণতা সম্মন্ধে বলা শেষ গল্প, কিন্তু তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পরিস্থিতি সেটিকে আরও বেশি করে সাক্ষ্য দিয়েছিল। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ধনী হওয়াতাে দূরের কথা, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৮ সালে তার মৃত্যুর পর তিনি যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, তা এমনকি তার শেষকৃত্যের খরচ মেটাবার জন্যও যথেষ্ট ছিল না।)। ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কোষাগার এথেন্সের একশত মাইল দক্ষিণপূর্বে ডেলসে অবস্থিত ছিল। ডেলস হলাে ক্ষুদে এক দ্বীপ, তা ম্যানহাটনের কেন্দ্রিয় উদ্যান থেকে বড় নয়, কিন্তু সেখানে কোষাগারের অবস্থানের কারণে, এথেনীয় নেতৃত্বে শহরগুলাের জোটকে বলা হত “ডেলসের ঐক্যজোট” বা ডেলিয়ান লীগ।

এথেন্সে দেয়াল নির্মাণ : ডেলোসের ঐক্যজোটের দুর্বল দিক ছিল এই যে, এথেন্স নিজেই রণতরীগুলাে দ্বীপাঞ্চল এবং এশিয়া মাইনর উপকূল রক্ষা করতে পারত, কিন্তু কোনাে শত্রু যদি অ্যাটিকার দিকে অগ্রসর হয়ে এথেন্স পুড়িয়ে দিত তাহলে এগুলো দিয়ে কীই বা লাভ হতো? পারস্য দুইবার এটা করেছিল, আর স্পার্টা এটা ভবিষ্যতে করতেও পারে। সালামিসের যুদ্ধের পর যার দারুণ সম্মানের কারণে থেমিস্টোক্লিসকেই এথেন্স ক্ষমতায় রাখে। তিনি একটি দারুণ দুঃসাহসী পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিলেন। পূর্বে ডেলফির ভবিষ্যদ্বাণীর নিয়ে তার নিজস্ব পাঠোদ্ধার অনুযায়ী কাঠের দেয়াল জাহাজের ভূমিকায় এথেন্সকে রক্ষা করেছিল। এখন সেই সময় এলো যখন এরিস্টাইডিসের পাঠোদ্ধার অনুযায়ী সত্যিকার দেয়াল তৈরি করা যায় – শুধু ঐ অ্যাক্রোপলিসের চারপাশে নয়, বরং পুরাে শহরকে ঘিরেই। বহিঃআক্রমণের ক্ষেত্রে যদি অ্যাটিকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়, তখন নগরবাসী শহরের ভেতর পশ্চাদগমন করতে এবং দেয়ালের পেছনে থেকে লড়াই করতে পারবে। স্পার্টা যথারীতি এটিকে বন্ধুত্ববিরােধী কাজ মনে করে এই ধরনের কাজের বিরােধিতা করল। স্পার্টার কোনাে দেয়াল ছিল না, আর তারা বলল, গ্রিসের সব শহরের দেয়ালই গুড়িয়ে দেয়া হােক। (গল্প আছে যে, স্পার্টা ভ্রমণকারী একজন জিজ্ঞাসা করেছিল কেন তাদের কোনাে দেয়াল নেই। উত্তর দ্রুতই এসেছিল, “স্পার্টার সৈনিকেরাই স্পার্টার দেয়াল”। আসলেই তাই ছিল। আর যদি সব সুরক্ষিত স্থানও ধ্বংস হয়ে যেত, স্পার্টার সৈনিকেরা পুরাে গ্রিসে একচ্ছত্র প্রভু হয়ে যেত।)। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও স্পার্টানরা ধীরে কাজ করলো আর এথেনীয়রা দ্রুত কাজ করলো। যখন স্পার্টানরা বিরোধিতা করছিল তখন থেমিস্টোক্লেস তাদেরকে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত রাখলেন, আর এদিকে তিনি দেয়াল তুলতে থাকলেন। পরে যখন স্পার্টানরা কাজ করার জন্য প্রস্তুত হলো ততক্ষণে দেয়াল এতটাই উঁচু করে ফেলা হয়েছিল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন থেমিস্টোক্লিস ম্যারাথনের যুদ্ধের পূর্বেই যে পাইরিয়াসের সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এথেন্সের সাথে সাথে সেটিও সুরক্ষিত হয়ে গেল।

থেমিস্টোক্লেসের ক্ষমতাচ্যুতি ও সিমনের ক্ষমতা গ্রহণ : কিন্তু, সকল সাফল্য সত্ত্বেও, থেমিস্টোক্লিস তার জনপ্রিয়তা হারাতে লাগলেন। বিত্তশালী হওয়ার কারণে তার মধ্যে এরিস্টাইডিসের মতাে চূড়ান্ত সততার অভাব ছিল এবং তিনি ঘুষ নেওয়ার অভিযােগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি তার নিজ যােগ্যতা আর বিজয়ের জন্য উদ্ধত গর্ব প্রকাশ করেছিলেন যা পুরােপুরি যুক্তিসঙ্গত ছিল, কিন্তু তা যেভাবেই হােক এথেনীয়দের অসন্তুষ্ট করল। তার যুদ্ধোত্তর বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ম্যারাথনের নায়ক মিলটিডিয়াসের পুত্র সিমন। তার পিতা আর এরিস্টাইডিসের মতাে সিমনও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন এবং এথেন্সে স্বল্পবিস্তর প্রভাবই রাখতেন। তা সত্ত্বেও তিনি গণতান্ত্রিক এথেন্সে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। নিশ্চিতভাবেই, ম্যারাথন যুদ্ধের পরের বছর তিনি তার পিতার ওপর ধার্য করা বিপুল পরিমাণ জরিমানা পরিশােধ করেছিলেন। তিনি তার সম্পদ ব্যবহার করে জনগণের ব্যবহারের জন্য উদ্যান আর স্থাপনা তৈরি করেছিলেন। তার উপর, এমনকি তিনি ছিলেন একজন যােগ্য সামরিক নেতা যিনি এথেনীয় বাহিনীকে বিজয়ের পর বিজয়ে নেতৃত্বদান করেছিলেন। পারস্য যুদ্ধের সময় সিমন এরিস্টাইডিসের নেতৃত্বে কাজ করেছিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৭ সালে তিনি এথেনীয় নৌবাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন। সাথে সাথেই তিনি স্পার্টার পসানিয়াসের কাছ থেকে বাইজেন্টিয়াম নিয়ে নিতে সমর্থ হলেন এবং এভাবে তিনি কৃষ্ণসাগরে এথেন্সের জীবনীশক্তিকে সুরক্ষা প্রদান করলেন। সিমন তার জনপ্রিয়তাকে থেমিস্টোক্লিসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেন আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৭২ সালে একটি ওস্ট্রাসিজম ভােটে থেমিস্টোক্লিস (১০ বছর আগে এরিস্টাইডিসের মতাে) ক্ষমতাচ্যুত হলেন। থেমিস্টোক্লিস এরিস্টাইডিসের চেয়ে কম সৌভাগ্যবান ছিলেন, কেননা তিনি আর কখনােই এথেন্সে ফিরতে পারেননি। প্রথমে তিনি ঈজিনায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে স্পার্টার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি হয়তাে একটা হেলট বিদ্রোহ সংগঠিত করার জন্য পসানিয়াসের পরিকল্পনায় যােগ দিতে পারতেন। যে কারণেই হোক, এথেন্স তাকে পরবর্তীতে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘােষণা করল এবং গ্রিস থেকে পুরােপুরি পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হলাে। তিনি এশিয়া মাইনরের পারসিয়ান অঞ্চলে পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং সেখানে তাকে খুব সদয়ভাবে গ্রহণ করা হলাে। থেমিস্টোক্লিস পারসিয়ানদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে সালামিসের যুদ্ধের কিছু আগে তিনি গ্রিক নৌবাহিনীকে ফাঁদে ফেলার জন্য যােগাড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছিলেন। পারসিয়ানরা আপাতত বিশ্বাস করল যে থেমিস্টোক্লিস সততার সাথেই গ্রিকদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন; যেমন গ্রিকরা বিশ্বাস করেছিল যে থেমিস্টোক্লিস প্রকৃতপক্ষেই পারসিয়ানদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। (থেমিস্টোক্লিসের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল তা কেউই কখনাে জানবে না। সম্ভবত এটাই ছিল যে, ধূর্ত এথেনীয় হিসেব করে রেখেছিলেন যে যুদ্ধ যেদিকেই যাক, জয় তারই হবে।)।  থেমিস্টোক্লিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯ সালে ম্যাগনেসিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একটি নিরাপদ গ্রিস, একটি মুক্ত এশিয়া মাইনর উপকূল এবং একটি সুরক্ষিত এথেন্স রেখে গিয়েছিলেন। বিশ বছরের রাজনৈতিক ক্ষমতার হিসেবে এটি খুব একটা খারাপ নয়। 

সিমনের এথেনীয় সাম্রাজ্যবাদ : থেমিস্টোক্লিসের নিবার্সনের পর, এথেন্সে সিমনই ছিলেন প্রধান। সেখানে থেমিস্টোক্লিস তীক্ষ্ণ স্পার্টানবিরােধী নীতিকে সমর্থন করেছিলেন, যেখানে সিমন ছিলেন স্পার্টানদের স্বপক্ষের। তিনি বিশ্বাস করতেন এথেন্সের স্পার্টার সাথে যুদ্ধকালীন জোট ধরে রাখা এবং তার সকল শক্তি পারস্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা উচিত। তিনি একজন কঠিন সাম্রাজ্যবাদীও ছিলেন; সেটি হলাে তিনি যতদূর সম্ভব ততদূরের এলাকায় এথেনীয় প্রভাব ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই, বাইজেন্টিয়াম জয়ের পর, তিনি তার নৌবাহিনীকে এটা নিশ্চিত করতেই ব্যবহার করলেন যেন উত্তর ঈজিয়ান উপকূলের গ্রিক শহরগুলাে ডেলসের ঐক্যজোটে যােগদান করে। এমনকি সিমন কোনাে সদস্যের ঐক্যজোট ছেড়ে যাওয়াও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ সালের দিকে, নাক্সোস দ্বীপ সিদ্ধান্ত নিল যেহেতু পারস্যের ব্যাপারটা দেখে নেয়া হয়েছে, তাই তার জাহাজগুলাে এখন এথেনীয় ঐক্যজোটে ব্যবহার করার বদলে নিজেদের জন্য ব্যবহার করে ঐক্যজোট ত্যাগ করে নিজেদের পথেই চলা উত্তম। সিমন অন্যরকম কিছু ভেবেছিলেন। ঐক্যজোট তার চোখে কোনাে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছিল না, ছিল এথেনীয় কর্তৃত্বের অধীন একটি জোট। তিনি নাক্সোস আক্রমণ করে, সুরক্ষা ধ্বংস এবং রণতরীগুলােকে দখল করে তাকে অধিগ্রহণ করলেন। দ্বীপটিকে রণতরীগুলাের জন্য সাধারণ জাহাজ তৈরি করার বদলে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে বাধ্য করা হলাে। 

সিমনের ক্ষমতা হারানো : যাই হােক, দেশে সিমনের বিরােধীপক্ষেরা শক্তিশালী হচ্ছিল। গণতান্ত্রিকেরা সিমনের অভিজাত ও স্পার্টানদের স্বপক্ষের মনােভাব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল এবং তারা এফিয়ালটিজের মধ্যে একজন নেতা খুঁজে পেল। এফিয়ালটিজের প্রধান লক্ষ্য ছিল এরিওপেগাস, যা ছিল রক্ষাণশীলদের শেষ ভরসা। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সিমন বিজয়ী হচ্ছিল, এফিয়ালটিজ কিছুই করতে পারত না। তিনি মেসিডোনিয়ার প্রথম আলেক্সান্ডার কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার দায়ে সিমনকে অভিযুক্ত করেছিলেন, কিন্তু সিমনের ওপর এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। নিশ্চিতভাবেই ডেমোক্র্যাটদেরকে সিমনকে কঠিনভাবে কিছু করার আগে তাকে পরাজিত হতে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ সালে, ভূমিকম্পের প্রবল বিপর্যয় আর হেলট বিদ্রোহ স্পার্টাকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছিল। সেটি নতুন কলহের সুযােগ সৃষ্টি করল। এফিয়ালটিজের কাছে যেন এটি ছিল এথেন্সের জন্য এক ঈশ্বরপ্রেরিত সুযােগ। তিনি এবারে হেলটদের সাহায্য করে স্পার্টাকে গুড়িয়ে দিতে চাইলেন। এর বিরুদ্ধে সিমন প্রচণ্ডভাবে লড়াই করলেন। তিনি এথেনীয়দের থারমােপাইলে স্পার্টানদের বলিদান এবং প্লাটিয়ায় তাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। গ্রিস, সিমনের কথামতাে স্পার্টার নেতৃত্বে চলল, আর এথেন্স ছিল দুই ষাঁড়ের একটি যৌথ বােঝা বহন করার মতাে অবস্থায়। যদি একজন ধ্বংসপ্রাপ্ত হত, সমস্ত গ্রিসই পঙ্গু হয়ে যেত। সিমনের যুক্তি ও জনপ্রিয়তার এক্ষেত্রে জয় হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬২ সালে, একদল এথেনীয় সৈন্যকে প্রেরণ করা হলাে স্পার্টাকে হেলটদের পরাজিত করার জন্য সাহায্য করতে, যারা গ্রিসের সবচেয়ে নির্মম দাসত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। এথেনীয় সৈন্যরা এই কাজে বিন্দুমাত্র সহজ বােধ করেনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্পার্টানরাই এথেন্সে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র সিমনকে ধ্বংস করেছিল, আর তারা এটা করেছিল অন্ধত্ব ও নির্বোধ ঈর্ষা থেকে। তারা নিজেদের দাসদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য এথেনীয়দের পৃষ্ঠপােষকতাকে সহজে নিতে পারল না। “তােমাদেরকে আমাদের প্রয়ােজন নেই” – স্পার্টানরা খুব নির্মমভাবেই সেটা উচ্চারণ করল এবং এথেনীয়দের এথেন্সে ফিরে যেতে আদেশ করল। স্পার্টানদের এই ব্যবহার এথেনীয়দের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সিমন তাদেরকে এই নিগ্রহের দিকে নিয়ে গিয়েছিল বলে তারা এবার তার ওপর চড়াও হলাে। একটি ওস্ট্রাসিজম ভােটের আয়ােজন করা হলাে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬১ সালে সিমন ক্ষমতাচ্যুত হলাে এবং এফিয়ালটিস ক্ষমতায় এলো। তিনি তৎক্ষণাৎ এরিওপেগাসকে দুর্বল করে দিলেন, শুধু খুনের বিচারেই তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দিলেন। জনপ্রিয় লােকসভার ক্ষমতা তারপর বেড়ে যেতে লাগল।

সমৃদ্ধির শিখরে এথেন্স

পেরিক্লিসের ক্ষমতা লাভ : এফিয়ালটিজ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন না, কেননা ওস্ট্রাসিজমের কিছু পরেই তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হলেন। কিন্তু এটি রক্ষণশীলদের জন্য কোনাে কাজে এলো না; কারণ এফিয়ালটিজের সুত্রে একজন আরাে সুদক্ষ ডেমোক্র্যাট বা গণতান্ত্রিক পেরিক্লিস স্থলাভিষিক্ত হলেন। পেরিক্লিস ম্যারাথনের বছর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা মিক্যালির যুদ্ধে একটি এথেনীয় বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর তার মা ছিলেন ক্লিসথিনিসের ভাগ্নী, তাই পেরিক্লিস মায়ের দিক থেকে আল্কমিওনিডির সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন সুশিক্ষিত এবং তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জেনো অফ এলিয়া। পেরিক্লিস তার শত্রুদের সবরকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ত্রিশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার সময়কালে এথেন্স তার সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছে ও স্বর্ণযুগের ছোঁয়া পায়। পেরিক্লিস স্বদেশে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে লাগলেন। তিনি তার কর্মকর্তাদের অর্থ প্রদানের প্রথা চালু করলেন, যাতে করে হতদরিদ্ররাও শহরকে সেবা দিতে পারে। তিনি শহরকে শক্তিশালী করার জন্যও কর্মরত ছিলেন। যদিও এথেন্স আর পাইরিয়াস উভয়েই সুরক্ষিত ছিল, শহরদুটোর মধ্যে ব্যবধান ছিল পাঁচ মাইলের। খাদ্যদ্রব্য আর রসদ বাইরে থেকে পাইরিয়াসে হয়তাে পৌঁছাতে পারত, কিন্তু পাঁচ মাইল দূরের বিচ্ছিন্ন এথেন্সে সেটা কেমন করে করে পৌঁছত? সমাধান ছিল পাইরিয়াস থেকে এথেন্সে একটি লম্বা দেয়াল তৈরি করা, যার মাধ্যমে একটি সুরক্ষিত জায়গা দিয়ে রসদ আর লােকজন নিরাপদে পার হতে পারে। এই উপায়ে এথেন্স আর পাইরিয়াসকে, ভূমির মধ্যে একটি দ্বীপ হিসেবে রূপান্তরিত করা যেত। লম্বা দেয়াল তৈরি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সালে সমাপ্ত হয়।

এথেন্সে নতুন নতুন স্থাপত্যকর্ম : পেরিক্লিস ডেলসের ঐক্যজোটের সাধারণ কোষাগারটিকে শুধু এথেন্সকে শক্তিশালী করার জন্যই ব্যবহার করেননি, তিনি এথেন্সকে সুন্দর করার কাজেও ডেলোসের এই কোষাগারটিকে ব্যবহার করেছিলেন। শুধু এথেন্সকে সজ্জিত করার জন্য কেন ঐক্যজোটের কোষাগার থেকে অর্থ খরচ করা হবে – এই বিষয়ে  জাস্টিফিকেশন পাওয়া, অর্থাৎ এটি ন্যায়সঙ্গত সেটা বের করা মুশকিল। তবুও মানুষ এর পক্ষে ছিল, আর বলতো এই ঐক্যজোট গ্রিসকে পারস্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দান করছে কারণ এথেন্স এতে ভূমিকা রাখছে। সেই সাথে এথেন্সের এই নতুন সৌন্দর্য কেবল এথেন্সের গৌরব ছিলনা, ছিল সমগ্র গ্রিসের গৌরব। আর মানুষের চোখে এথেন্সকে আরও বেশি গৌরবান্বিত করায় এর সম্মান ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়, আর এই রেপুটেশন এথেন্সের জন্য ঐক্যজোটটিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও কাজে দেয়। বিশেষ করে, পেরিক্লিস স্থপতি ইকটিনাসকে নির্দেশ দিলেন অ্যাক্রোপলিসকে দেবী এথেনা পলিয়াসের (অর্থাৎ নগরের দেবী এথেনা) উদ্দেশ্য একটি মন্দির নির্মাণ করে একে সাজাতে বলেন। এর ভাস্কর ছিলেন ফিদিয়াস। এটি পরিচিত হয়েছিল পার্থেনন নামে। এর শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ সালে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ সালের আগে তা সমাপ্ত হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে জন্ম নেয়া ফিদিয়াসকে সর্বকালের সেরা গ্রিক ভাস্কর হিসেবে মেনে নেওয়া হয় এবং পার্থেনন ছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। এটা সম্ভবত এ পর্যন্ত গড়া নিখুঁততম ভাস্কর্য ছিল এবং সবচেয়ে বিখ্যাতও। এটি অনেক বছর ধরেই ধ্বংসপ্রায় কিন্তু অ্যাক্রোপলিসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ডোরিয়ান শৈলীর আয়তাকার পিলারগুলো এখনাে সবাইকে গর্বিত ও সুন্দর প্রাচীন গ্রিসের কথা মনে করিয়ে দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৬ সালে ফিদিয়াস পার্থেননে এথিনার একটি বিশাল কাঠের মূর্তি প্রদান করলেন। যার চামড়া ছিল হাতির দাঁতের এবং পােশাক ছিল স্বর্ণে ঢাকা। ফিদিয়াস অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তিও খােদাই করেছিলেন, অলিম্পিক গেমস যে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হত, এটি তার সম্মুখে ছিল, এবং পরবর্তী গ্রিকদের মাধ্যমে এটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। প্রাচীন গ্রিসের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির মতাে ফিদিয়াসের জীবনেরও দুঃখজনক পরিসমাপ্তি ঘটে। এথেন্সের অভিজাতরা সবসময় পেরিক্লিসের শত্রু ছিল কিন্তু তারা কখনাে এথেনীয় জনগণের প্রতি মমতা থেকে তাকে দূরে সরাতে পারেনি, এবং তার অনেক বন্ধু তাকে আক্রমণ করার দুঃসাহস করে। তারা ফিদিয়াসকে দুইবার ভুলকাজ করার ব্যাপারে দোষারােপ করল, তার কাছে থাকা কিছু তহবিলের নয়ছয় করার জন্য এবং ধর্মদ্রোহিতার জন্য, কারণ এথেনার ঢালের মধ্যে তিনি যে অবয়ব তৈরি করেছিলেন, তাদের মতে তা ছিল তার নিজের ও পেরিক্লিসের ছবি। দ্বিতীয় বিচার হবার সময় ফিদিয়াস যখন কারাবরণ করেছিলেন তখন তার মৃত্যু হয়।

ঈস্কাইলাসের দ্বারা নাট্যশিল্পের বিকাশ : পারস্য যুদ্ধের পরের শতকগুলাে ছিল তিনজন মহান ট্র্যাজেডিয়ানের সময়, সম্ভবত তারা হােমার আর শেক্সপিয়ায়ের সময়ের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। প্ৰথমজন ছিলেন ঈস্কাইলাস (Aeschylus)। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালে জন্ম নেয়া ঈস্কাইলাস ম্যারাথনের যুদ্ধে লড়েছিলেন এবং সালামিস আর প্লাটিয়ার যুদ্ধেও উপস্থিত ছিলেন। পিসিস্ট্রটাসের সময়ে থেসপিস নামের এক এথেনীয় কবির ডায়ােনিসিয়াস উৎসবের জন্য সংগীত লেখার সাহস হয়েছিল, যেখানে প্রায়ই কোরাস বন্ধ রাখা হত, আর তার বদলে একটি নির্দিষ্ট চরিত্র পুরাতন উপকথার গল্পগুলাে বলত আর অভিনয় করে দেখাত। এই লােকটি ছিল প্রথম অভিনেতা, আর আজকের দিনে আমরা, মজা করে, একজন অভিনেতাকে ‘থেসপিয়ান’ বলে ডাকি। ঈস্কাইলাস এই থেসপিয়ান নাটকের ধারাকে আরও অগ্রসর করে নাট্যশিল্পের বিকাশ ঘটালেন। ট্র্যাজেডিতে যে কোরাস বা দলবদ্ধ সঙ্গীত গাওয়া হতো সেখানে ৫০ জন লোক একসাথে গাইতো। ঈস্কাইলাস এই দলকে পঞ্চাশ জন থেকে পনেরাে জনে সীমাবদ্ধ করেছিলেন এবং একজন দ্বিতীয় অভিনেতাকে নিয়ে আসেন। একজনের বদলের দুজন অভিনেতা কাজ করার ফলে নাটকে সংলাপ বা ডায়ালগের ব্যাপারটা সম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়া তিনিই প্রথমবারের মতাে নাটকে কস্টিউম, উঁচু জুতা, মুখােশ এবং অন্যান্য অনুষঙ্গের ব্যবহার চালু করেছিলেন, যাতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের বার্তাকে দর্শকদের কাছে আরও বেশি প্রামাণ্য করে তুলতে পারেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৮ সালের মধ্যে ঈস্কাইলাস নব্বইটিরও বেশি নাটক লিখেছিলেন। ডায়ােনিসিয়াসের সম্মানে এথেন্সের যে উৎসব হতো সেখানে নাটকের একটি বার্ষিক প্রতিযােগিতার আয়োজন করা হতো। এতে এস্কাইলাস তেরোবার প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো তার ৯০টি নাটকের মধ্যে মাত্র ৭টিই এখন টিকে আছে। তিনি বিভিন্ন সময় সিসিলি ভ্রমণ করেছিলেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৬ সালে, সিসিলির দক্ষিণ উপকূলের জেলা শহরে, পেরিক্লিস ক্ষমতার আসার কিছু পরেই তার জীবনাবসান হয়। একটি কিংবদন্তী আছে যে কচ্ছপের খােল ভাঙার প্রচেষ্টারত এক ঈগলের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। ঈস্কাইলাসের ন্যাড়া মাথাকে একটি পাথর ভেবে এটি কচ্ছপটিকে তার ওপর ফেলে দিয়েছিল বলে। এটি একটি বিখ্যাত গল্প, কিন্তু সম্ভবত এটি কল্পকাহিনী ছাড়া কিছুই না।

সফোক্লিসের হাতে নাট্যশিল্পের উন্নয়ন : সফোক্লিস ছিলেন ‘বড় তিনের’ বা ‘বিগ থ্রি’ এর মধ্যে দ্বিতীয় জন, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নব্বই বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তিনি ট্র্যাজেডিতে এস্কাইলাসের দুই জন চরিত্রের সাথে তৃতীয় আরেকজন চরিত্রকে নিয়ে এসেছিলেন, এবং ঈস্কাইলাসকে হারিয়ে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ সালে বার্ষিক নাট্যপ্রতিযােগিতায় জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি সর্বমােট আঠারাে বা বিশবার জিতেই চলেছিলেন। তিনি একশ’র ওপর নাটক লিখেছিলেন, কিন্তু এসবের মধ্যেও মাত্র সাতটিই টিকে আছে। তিনি শেষ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, কেননা তার বয়স যখন ৯০ হবার পথে, তখন তার পুত্র আদালতে সফোক্লিসকে তার নিজের বিষয়াবলির ব্যবস্থাপনায় তাকে অক্ষম প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফোক্লিস উন্মুক্ত আদালতে তার ঈডিপাস ইন কলোনাস নাটক থেকে একটি প্যাসেজ পড়ে শোনান, যে নাটক নিয়ে তখন তিনি কাজ করছিলেন। এরফলে তিনি খুব সহজেই মামলায় জিতে যান।

ইউরিপিডিসের নাটকের মানবিকতাবোধ : বিগ থ্রি এর শেষের জন হলেন ইউরিপিডিস, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক ছিলেন। যেখানে ঈস্কাইলাস আর সফোক্লিসের চরিত্রগুলাে, আভিজাত্যের আবেগ আর উদ্দেশ্য বজায় রেখে শক্ত আর উচ্চস্বরে কথা বলত, ইউরিপিডিস সেখানে নাটকগুলােকে জনগণের কাছে নিয়ে এলেন। তিনি মানব মনমানসিকতার সব বিষয় সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন এবং তার চরিত্রগুলােতে মানবিক সীমাবদ্ধতা ছিল, তারা দৈনন্দিন জীবনের মতই কথা বলতো। এর ফলে শীর্ষ সমালোচকদের দ্বারা তিনি সমালোচিতও হন। ফলে বার্ষিক নাট্যপ্রতিযোগিতায় তিনি মাত্র চারবার জয়লাভ করেন, (মৃত্যুর পর তিনি তার পঞ্চম জয়টি পেয়েছিলেন)। তিনি জীবনে গুণের কদরের ঘাটতি অনুভব করেছিলেন, তা সম্ভবত তার জীবনকে তিক্ত করে তুলেছিল। তাই সমাজকে পরিত্যাগ করে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছিলেন, আর সম্ভবত একজন নারীবিদ্বেষীতে পরিণত হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি মেসিডােনিয়া থেকে পাওয়া আমন্ত্রণের উত্তর দিতে এথেন্স ত্যাগ করেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। যাই হােক, তার মৃত্যুর পর তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল। তার লেখা বিরানব্বইটি নাটকের মাঝে আঠারােটিই ভালােভাবে টিকে আছে। 

এরিস্টোফ্যানিসের কমেডি ও স্যাটায়ার : চতুর্থ নাট্যকার কোনাে ট্র্যাজেডিয়ান ছিলেন না, ছিলেন স্বর্ণযুগের একজন কমেডি লেখক। তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৮ সালের দিকে জন্ম নেয়া এরিস্টোফ্যানিস। তার কমেডিগুলো নিম্নমানের রসিকতায় পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এগুলো কেবল হাস্যরসই তৈরি করত না। তার অস্ত্র ছিল বুদ্ধিদীপ্ততা আর সেই সময়ের দুর্বলতার বিরুদ্ধে তীক্ষ্ম স্যাটায়া। সেই সাথে তার কমেডিগুলো তাদের বিরুদ্ধে ছিল যাদেরকে তিনি পছন্দ করতেন না, যেমন ইউরিপিডিস। তিনি একটি ভূস্বামী পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং আচরণে ছিলেন রক্ষণশীল। তিনি গণতান্ত্রিকদের ব্যঙ্গ করতে কোনাে প্রচেষ্টাই হাতছাড়া করেননি। তিনি সেটা করতে পারতেন কারণ যে গণতন্ত্রকে তিনি আক্রমণ করেছিলেন, তা এতই অপ্রচলিত ছিল যে তিনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারতেন, এমনকি সেইসব মন্তব্য আজকের দিনে নাটকে উচ্চারিত করলেও কেউ তা সহজভাবে নিতে পারবে না। তার রচিত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি কমেডির মধ্যে এগারটি টিকে আছে। 

দার্শনিক অ্যানাক্সোগোরাস : সেই সময়ে আয়োনীয় বিজ্ঞান প্রায় সংকটাপন্ন ছিল, কিন্তু কিছু শেষ স্ফুলিঙ্গ তখন গ্রিক সুসময়কে জ্বালিয়ে রেখেছিল, এথেন্সের ভেতর ওে বাইরে উভয়স্থানেই। এনাক্সোগােরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে ক্লেডােমিনিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেটি ছিল বারােটি আয়োনীয় শহরের একটি। মধ্যবয়সে তিনি তার সাথে আয়োনিয়ার বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য নিয়ে এথেন্সে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তিনি পেরিক্লিস আর ইউরিপিডিসের মতাে মহান মানুষের বন্ধু হতে পেরেছিলেন। এনাক্সোগােরাস বিশ্বাস করতেন স্বর্গীয় বস্তুগুলাে (মহাকাশের) পৃথিবীর থেকে বেশি সুষমাণ্ডিত কিছু নয়, আর তারা একই রকম পদার্থে আর একই উদ্দেশ্যে গঠিত। তিনি বলতেন, তারা আর গ্রহমণ্ডলীগুলাে হলাে জ্বলন্ত পাথর এবং বিশেষ করে, সূর্যকে তিনি বিশ্বাস করতেন পেলােপনেসাসের আকারের একটি সাদা-পাথর হিসেবে। এনাক্সোগােরাস এথেন্সে চল্লিশ বছর ধরে শিক্ষাপ্রদান করলেন, কিন্তু তাকে তার জীবন শান্তিতে পার করতে দেয়া হয়নি। যেহেতু, তিনি পেরিক্লিসের বন্ধু ছিলেন, তাই তিনি এথেনীয় নেতার রক্ষণশীল শত্রুদের কাছে ভালাে একটা গুটি ছিলেন। এটা দেখানাে খুবই সােজা ছিল যে এনাক্সোগােরাসের চিন্তাধারা অলিম্পিয়ান ধর্মের বিরুদ্ধে। (যদি সূর্য প্রজ্জ্বলিত পাথর হয়, তাহলে সূর্যের দেবতা হেলিওসের কী হবে?)। পেরিক্লিস কষ্ট করে এনাক্সোগােরাসকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু দার্শনিক মনে করলেন এথেন্সে থাকা তার জন্য নিরাপদ নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৪ সালে, তিনি হেলেসপন্টের ল্যাম্পসাকাসে অবসরে গেলেন এবং সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। 

পরমাণুবাদী লিউসিপাস ও ডেমোক্রিটাস : আয়োনীয় বিজ্ঞানের শেষ ঝলক এসেছিল মিলেটাসের লিউসিপাসের সাথে, যার বিচরণ ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে এবং যিনি প্রথম ঘােষণা করেছিলেন যে বস্তু অনির্দিষ্টভাবে ভাগ করা পদার্থের সংমিশ্রণ নয়, বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত, যখন তা পাওয়া যাবে, তখন সেটাকে আর ভাগ করা যাবে না। এই মতামত তার এক শিষ্য ডেমােক্রিটাস বয়ে নিয়ে চললেন, যিনি খ্রিস্টপূর্ব খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালের দিকে আবডেরা শহরে জন্মেছিলেন। আবডেরা ৭০ বছর আগে পারস্যের সাইরাসের হাত থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের হাতে তৈরি হয়েছিল, তাই ডেমােক্রিটাসকে একজন আয়োনীয় হিসেবে ভালােভাবেই বিবেচনা করা যায়। তিনি লিউসিপাসের চূড়ান্ত বস্তুকণাকে ‘পরমাণু’ বলে নাম দিলেন। এই ধরনের পরমাণুর ব্যাপারে তার মতামত এই বিষয়ের আধুনিক বিশ্বাসের সাথে অনেক দিক দিয়েই মিলে যায়, কিন্তু সেগুলাে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সাধারণভাবে গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করতে পারল না।

চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিপোক্রিটাস : হেলিকারনাসাস শহরের নিকট এশিয়া মাইনর উপকূলের কস দ্বীপটি ছিল একটি ডােরিয়ান দ্বীপ আর তাই সেটিকে আয়োনিয়ার অংশ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তারপরও কিছু আয়োনীয় অনুপ্রেরণা তার দিকেও ভেসে এসেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালের দিকে হিপােক্রেটিস সেখানে জন্মান, আর পরবর্তীতে তিনি চিকিৎসার প্রথম যৌক্তিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে মানুষকে আর দেবতা ও দৈত্যদের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এই কারণেই, তাকে প্রায়ই ‘চিকিৎসাবিদ্যার জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তার নামে অনেক লেখাই আছে (হিপােক্রেটিক), কিন্তু এতে সন্দেহেরও বেশি রয়েছে কিছু যে এইগুলাে আসলে তারই ছিল। সেগুলাে আসলে তার স্কুলের কতক প্রজন্মের সংগৃহিত কাজ ছিল, এবং সেগুলাে পরবর্তী চিকিৎসকেরা তার নামে চালিয়ে দিয়েছিল অধিক পরিমাণে মনােযােগ প্রাপ্তির আশায়। হিপােক্রটিসের নীতিগুলাে পাওয়া যায় ‘হিপােক্রেটিসের শপথ’-এ, যা তার স্কুলের পরবর্তী সদস্যদের দ্বারা গ্রন্থিত হয়েছে এবং সেগুলাে আজও চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্ররা, তাদের প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপ্তিতে গ্রহণ করে। 

সফিস্টগণ ও প্রোটাগোরাস : পেরিক্লিসের সময়ে নতুন এক ধরনের শিক্ষিত মানুষের উদ্ভব ঘটে এথেন্সে যারা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত গুণাবলি শিক্ষা দিতে পারত। তারা ছিল ‘সফিস্ট’, যেটি গ্রিক শব্দ ‘শেখানাে’ থেকে এসেছিল। সেই সময়ে যেকোনাে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার ছিল কোনাে বিদ্যমান আইন বা কোনাে বিচারাধীন মানুষের বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা। অনেক সফিষ্ট প্রকাশ্যে দাবি করতেন যে, তারা মানুষকে যেকোনাে প্রশ্নের উভয় দিকেই তর্ক করতে শেখাতে এবং দুর্বল পক্ষকে চতুর যুক্তিতর্কর মাধ্যমে ভালাে অবস্থানে নিয়ে যাওয়াতে পারতেন। এটা জেনাের উদ্ভাবিত ডায়ালেকটিকের ঠিক বিপরীত ছিল এবং কারাে শিক্ষাকে ব্যবহার করার ঠিক সম্মানজনক একটা উপায় ছিল। সবার সেরা আর সবচেয়ে জনপ্রিয় সফিষ্ট ছিলেন প্রােটাগােরাস, যিনি ডেমােক্রিটাসের মতােই আবডেরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম গ্রিক ভাষা সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করতে এবং ব্যাকরণের নিয়মগুলাে বের করতে পেরেছিলেন। যেহেতু, তিনি পেরিক্লিসের বন্ধু ছিলেন, তার উপরে রক্ষণশীলদের শত্রুভাবপন্নতা নেমে এলো। পেরিক্লিসের মৃত্যুর অনেক পরে এবং যখন তার বয়স সত্তরের মতাে হয়েছিল, তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪১১ সালে, প্রোটাগােরাসকে নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, কারণ তিনি সবার সামনেই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে নাকি নেই। তাকে এথেন্সকে থেকে নির্বাসিত করা হলাে এবং তিনি সিসিলি যাওয়ার পথে সাগরের বুকে হারিয়ে গেলেন। 

এথেন্সের সংকট ও স্পার্টার সাথে যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি

স্পার্টার ঘুরে দাঁড়ানো : যদি কখনও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি  হতো যে, স্পার্টার কোন কিছু করার দরকার, কিন্তু তারা তাদের কোন কিছু না করার প্রবণতার দ্বারা বাজেভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় কিছুই করতে পারছে না, তখন এথেন্স তাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য তৎক্ষণাৎ সব কিছুই করতো। পেরিক্লিসের শুরুর দিককার সময়ে, এথেন্স দানবীয় শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, কারণ সে সবখানেই আঘাত হেনে যাচ্ছিল। তারা ঈজিনাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সালে কোরিন্থ আর মেগারার মাঝে এক বিবাদে অংশ নিয়ে কোরিন্থকে পরাস্ত করেছিল (এবং তাকে নিজের প্রবল প্রতিপক্ষে পরিণত করেছিল) এবং মেগারাকে তার সুরক্ষায় নিয়ে এসেছিল। সে স্পার্টার প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে আর্গোসের সাথে মিত্রতায় গেল। আর এর ওপর সে একটি শক্তিশালী লম্বা দেয়াল তৈরি করল। স্পার্টাকে এসব কিছুই মেনে নিতে হয়েছিল কারণ হেলটদের বিদ্রোহ তাদেরকে দুর্বল করে ফেলেছিল। কিন্তু, খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৭ সালে হেলট বিদ্রোহের চূড়ান্ত পরিণতিতে স্পার্টা ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার প্রভুত্ব মেনে নিতে বাধ্য করে।

মিশরে পারস্যের বিরুদ্ধে এথেন্সের পরাজয় : এথেন্স সিদ্ধান্ত নিল যে সে ভূমিতে স্পার্টার সাথে না লড়াই করার জন্য প্রস্তুত নয়, তাই সিমন (আগেই বলা হয়েছে সে স্পার্টার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল) সিমনকে এই আশায় ডেকে পাঠানাে হয় যে সে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি আয়ােজন করতে পারবে। সাময়িক যুদ্ধবিরতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ বাইরে থেকে একটি বিশাল আঘাত এসে পড়েছিল এথেন্সের ওপর। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালে তারা আয়োনিয়ার বিদ্রোহে সহায়তা করতে গিয়ে যে আহাম্মকির কাজ করেছিল এবারে তার চেয়ে বেশি আহাম্মকির কাজ করেছিল একটি অভিযান পাঠিয়ে। এই দ্বিতীয় অভিযান শুরু হয়েছিল জারেক্সেসের মৃত্যুর সাথে সাথে যিনি ৪৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গুপ্তহত্যার শিকার হন। এরপর জারেক্সেসের পুত্র প্রথম আর্তাজারেক্সেসের সিনহাসন গ্রহণ করার পূর্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই অস্থির সময়ে, মিশর আবারও বিদ্রোহ করে বসে, যেমনটি তারা করেছিল দারিয়ুসের মৃত্যুর পর। মিশর এথেন্সের কাছে সাহায্যের আবেদন করে, আর যেহেতু আয়োনিয়ায় তাদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই এথেন্স আবারও সাড়া দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে এথেন্স যা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালে ছিল তার চেয়েয়ো অনেক শক্তিশালী শহর, এবার সে আগের চেয়েও বড় নৌবাহিনী পাঠাল। আগের বার তারা যেখানে বিশটি জাহাজ পাঠিয়েছিল, কোন কোন উৎস মতে এবারে তারা পাঠিয়েছিল দুইশত জাহাজ (তথ্যটি অতিরঞ্জিতও হতে পারে)। পূর্বে এথেনীয়রা সারদিস দখল করে তাদের অভিযাত্রা শুরু করেছিল, আর এখন তারা শুরু করলো মিশরীয় শহর মেম্ফিস দখলের মাধ্যমে। কিন্তু পারসিয়ানরা প্রচণ্ড শক্তিমত্তার সাথে যুদ্ধে ফিরে এলো এবং এথেনীয়রা একটি আজব ও দূরবর্তী ভূখণ্ডে একদল বর্বর লােকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পিছিয়ে গেল। অল্প অল্প করে তাদের পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেল, এবং সময়ে সময়ে রিইনফোর্সমেন্ট পেলেও খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৪ সালের মধ্যে এথেনীয় সেনাদল পরাজয় বরণ করল। তাদের পরাজয় ছিল ভয়াবহ। এই যুদ্ধে এথেন্স যে লােকবল আর জাহাজ হারিয়েছিল তা বিবেচনায় এটা এথেন্সের জন্য যে বিশাল পরাজয় ছিল তা স্বীকার করতেই হয়। এর পাশাপাশি এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এথেন্সের আত্মবিশ্বাসেও প্রচণ্ডভাবে ভাটা পড়ে। 

এথেন্সের সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা, বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের ঐক্যজোট ত্যাগ ও সাম্রাজ্যবাদের পরিসমাপ্তি :  এই যুদ্ধে পরাজয়ের ধাক্কা এথেন্সের জন্য এতটাই বড় ছিল যে সে, এথেন্স আর তাদের ডেলোসের মধ্যে ডেলোসের ঐক্যজোটের কোষাগার রাখাটাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতে পারল না। তারা সেই অর্থসম্পদ এথেন্সে নিয়ে এলো এবং এর মাধ্যমে এথেন্স ডেলোসের ঐক্যজোট বা ডেলিয়ান লীগের অন্যান্য শহরগুলাের ওপর ছড়ি ঘোরাতে আরম্ভ করল। এই অবস্থায় ডেলিয়ান লীগকে কোন লীগ না, বরং একে এথেনীয় সাম্রাজ্য বলেই মনে হতো। এই “এথেনীয় সাম্রাজ্যের” মানচিত্রে বিওটিয়া আর মেগারা ছিল এথেন্সের নিয়ন্ত্রণে; ফোসিস আর আর্গোস তার সাথে জোটে ছিল। এমনকি পেলােপনেসাসে আকিয়ার কিছু শহরও তাদের সাথে জোট বেঁধেছিল। এর সাথে কোরিন্থ উপসাগরের উত্তর উপকূলের নউপ্যাক্টাসের নিয়ন্ত্রণ মিলে উপসাগরকে যেন প্রায় একটা এথেনীয় লেক বানিয়ে দিল, যেমনটা ছিল ঈজিয়ান সাগরও। কিন্তু এরই মধ্যে পারস্য সৈন্যদল মিশরকে করায়ত্ত করে সাইপ্রাস দ্বীপের দিকে এগিয়ে চলল, কেননা সাইপ্রাসও বিদ্রোহ করে বসেছিল। আবারও সিমনের নেতৃত্বে একটি এথেনীয় রণতরী পাঠিয়ে দেয়া হলাে পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সহায়তা করতে। সিমনের নেতৃত্বে পারস্যরা পরাভূত হল, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালে সিমন একটি অভিযানের মধ্যকালীন সময়ে মারা যাওয়ায় এথেনীয়রা পারস্যদের সাথে শান্তি স্থাপন করে। সবখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এথেনীয় সাম্রাজ্য ছিল তার শক্তির শীর্ষে , কিন্তু শীঘ্রই সমস্যা শুরু হলাে। একভাবে বলতে গেলে, এটা ছিল আবারও এথেন্সেরই ভুল। তারা ছিল সমুদ্রে শক্তিশালী, আর ভূমিতে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তাকে শুধু দুর্বলই করে যাচ্ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ সালে বিওটিয়া এথেনীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল। বিওটিয়া যদি কোনাে দ্বীপ হত, তাহলে এথেনীয় নৌবাহিনী ব্যাপারটা দেখতে পারত। কিন্তু, বিওটিয়া ছিল স্থলশক্তি, আর তারা যখন নিজেদের জন্য লড়ত তখন তারা ছিল খুবই কঠিন যােদ্ধা। এথেন্স বিওটিয়ায় একদল সেনা পাঠাল আর থিবসের কুড়ি মাইল পশ্চিমে কেরােনিয়াতে সেটি বিওটিয়ানদের মুখােমুখি হলাে। যুদ্ধে এথেনীয়রা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হলাে আর এর ফলে থিবস পুরাে বিওটিয়া আবারও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। তারা এথেন্সের প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া সব গণতান্ত্রিক ব্যাপারই ছুঁড়ে ফেলল এবং তার বদলে গােষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল। এই পরাজয়ের ফলে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। মাত্র ২ বছর আগে ফোসিয়ানরা ডেলফি অবরোধ করেছিল, আর স্পার্টা ফোসিয়ানদের পরাস্ত করতে একটি অভিযান পরিচালনা করে যা দ্বিতীয় পবিত্র যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়। নিশ্চিতভাবেই ফোসিয়ানরা পরাস্ত হয়েছিল, কিন্তু স্পার্টান সেনাদল চলে যাওয়ার পরেই, এথেন্স ফসিসের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাকে পুনরায় ডেলফি দখল করতে সাহায্য করে। কিন্তু এবারে ফোসিয়ানরা এথেন্সের এই সহায়তা ভুলে গেল। ফোসিসের অবস্থান ছিল বিওটিয়ার পশ্চিমে। বিওটিয়া এথেন্স নিয়ন্ত্রিত ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে গেলে এবার ফোসিসও তাদের সাথে  মিলে ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে যায়। বিওটিয়া ও ফোসিস বের হয়ে গেলে এরপর ইউবিয়া আর মেগারাও বিদ্রোহ করে বসল। পেরিক্লিস এবারে বিওটিয়ায় এথেনীয় সেনাদলকে নেতৃত্ব দিলেন। ইউবিয়া একটি দ্বীপ ছিল, তার ফলে সহজেই এথেন্স ইউবিয়াকে তাদের লীগে ধরে রাখতে সক্ষম হলো। কিন্তু মেগারা কোনাে দ্বীপ ছিল না, এটি পেলােপনেসাসের কাছ থেকে সাহায্য পায়, ফলে এথেন্স তাকে ধরে রাখতে পারেনি, এটি স্থায়ীভাবে এথেন্সের জোট থেকে বেরিয়ে গেল। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৬ অব্দে গ্রিক মূল ভূখণ্ডে ও তার পাশাপাশি সাগরে ক্ষমতা স্থায়ী করার সংক্ষিপ্ত এথেনীয় এক্সপেরিমেন্টের একটি অগৌরবজ্জ্বল সমাপ্তি ঘটল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এথেন্স স্পার্টার সাথে ত্রিশ বছরের একটি শান্তি চুক্তি সাক্ষর করলো।  

পেরিক্লিসের ক্ষতি এড়ানোর প্রচেষ্টা ও এথেন্স-স্পার্টার যুদ্ধ আশঙ্কা : পেরিক্লিস বহির্বিশ্বে ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এথেনীয় প্রতিপত্তিতে আসা এইসব বিভিন্ন আঘাতকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করলেন। তিনি এথেনীয় ঔপনিবেশিকদের উত্তর ঈজিয়ানের বিভিন্ন দ্বীপ ও থ্রেসিয়ান কেরসােনিসে প্রেরণ করলেন (যেখানে একসময় মিলটিডিয়াস শাসন করতেন)। এথেনীয় জাহাজগুলাে কৃষ্ণসাগরে (পেরিক্লিস নিজেই এরকম একটি অভিযানে গিয়েছিলেন) অনুপ্রবেশ করে উপকূলীয় এলাকার গ্রিক শহরগুলাের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করল। এথেন্স এমনকি নতুন নতুন নগর প্রতিষ্ঠা করে, যা গ্রিকরা গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে করেনি। এই শহরগুলোর মধ্যে ছিল ইতালির কালসিডিসি আর থুরির (Thurii) ঠিক পূর্বে উত্তর ঈজিয়ান উপকূলের (যেখানে এক শতাব্দী আগে সাইবারিস অবস্থিত ছিল) অ্যাম্ফিপোলিস নগর। কিন্তু এই সময়ে এথেন্স সহ পুরাে গ্রিস যেন আগ্নেয়গিরির মুখের ওপর বসে ছিল। শুধু বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের মধ্যেই যুদ্ধ হত না। প্রতিটি নগর রাষ্ট্রে গােষ্ঠীতান্ত্রিক আর গণতান্ত্রিকদের মধ্যে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলছিল। যখন একদল জয়লাভ করত, অন্যদল নির্বাসিত হত এবং প্রতিবেশী শহরগুলােতে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষারত থাকত। এমনকি এথেনীয় সাম্রাজ্যের ভেতরেও এই সংঘর্ষ পরিলক্ষিত হত। প্রিয়েন শহরকে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে সামােস দ্বীপ আর মিলেটাস শহরের মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ সালে বিবাদ বেঁধে গেল। এই বিবাদ এথেন্স অব্দি পৌঁছে গেল, যে মিলেটাসের পক্ষে ছিল। এথেন্স সামোসকে পরাজিত করে, ও সেখানকার অসন্তুষ্ট পরাজিতদের থেকে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সমস্যার আশঙ্কা করে এথেন্স সেখানে সামােস নিয়ন্ত্রণ করা গােষ্ঠীশাককে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গণতান্ত্রিক বা ডেমোক্র্যাটদেরকে নিযুক্ত করে। সামােস তৎক্ষণাৎ বিদ্রোহ করে গােষ্ঠীতন্ত্রকে পুনঃস্থাপন করে। এই ব্যাপারে ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এথেনীয়দের একবছর সময় লাগল (পেরিক্লিসের নিজস্ব নির্দেশে)। অন্য জায়গার বিদ্রোহগুলােকেও দমন করা হলাে, কিন্তু এগুলাে এথেন্সকে টালমাটাল করে দিল। গ্রিসে সংঘটিত এইসব ক্ষুদ্র বিবাদগুলাে স্পার্টাকে একদিকে, আর এথেন্সকে আরেকদিকে নিয়ে গেল। আগে হােক, পরে হােক, সেখানে একটা বিস্ফোরণ ঘটবেই তা বোঝা যাচ্ছিল।

পেলােপনেসাসের যুদ্ধ (৪৩১ – ৪০৪ খ্রি.পূ.)

এথেন্সের হস্তক্ষেপে কোরিন্থের ব্যর্থতা ও মেগারায় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধে স্পার্টার প্রবেশ

এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যে আসন্ন সংঘাতের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল তার সূত্রপাত হয়  করসিরা দ্বীপে। সেখানে তাদের গােষ্ঠীতন্ত্ৰ আর গণতান্ত্রিকদের মধ্যে এক তিক্ত যুদ্ধ চলছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৫ অব্দে, গােষ্ঠীতান্ত্রিকরা মাতৃশহর কোরিন্থের কাছে সাহায্য চাইল, সেখানেও তখন গােষ্ঠীতন্ত্রই চলছিল। কোরিন্থ অত্যন্ত আনন্দিত হয়েই সাহায্য করেছিল। তারা একটি নৌবাহিনী পাঠালো, যেটি করসিরিয়ান গণতান্ত্রিকদের দ্বারা খুব দ্রুতই পরাভূত হলাে। এর ফলে ক্ষুব্ধ কোরিন্থ আরও বিশাল অভিযাত্রিক দল তৈরি করল। দ্বীপের গণতান্ত্রিকরা স্বাভাবিকভাবেই এথেন্সের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল, যারা সর্বত্র গণতান্ত্রিকদের মহান সাহায্যকারী হিসেবে পরিচিত ছিল। এথেন্স দশটা জাহাজ পাঠাল। শুধু গণতন্ত্রের জন্য ভালােবাসার কারণেই তারা এটা করেনি। এথেন্সের এখন পশ্চিম দিকে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে কারণ তারা উত্তর ইতালিতে থুরি প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং বন্ধুত্বপূর্ণ করসিরা (যেটি ইতালির সমুদ্রপথে অবস্থিত ছিল) এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহায্যপূর্ণ হত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৩ অব্দে, করসিরা আর কোরিন্থের নৌবাহিনী পারস্যের মুখােমুখি হলাে। এবার কোরিন্থ ১৫০টি জাহাজ পাঠাল (প্রথবার সে যা পাঠিয়েছিল তার দ্বিগুণ) এবং ধীরে ধীরে সে করসিরিয়ানদের পিছু হটিয়ে দিল, যখন এথেনীয় জাহাজগুলাে দেখতে পাচ্ছিল যে, যুদ্ধ করসিরিয়ানদের বিরুদ্ধে ঝুঁকে যাচ্ছে, আরও বিশটি এথেনীয় জাহাজ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলাে, এই বিশটি জাহাজই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, এতে কোরিন্থিয়ানরা পিছু হটল ও আবার পরাজিত হলো। বলাই বাহুল্য কোরিন্থ পশ্চাদপ্রসরণ করতে বাধ্য হলেও তারা প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়। এথেন্সের বিরুদ্ধে শত্রুতার পেছনে তাদের অনেকগুলাে কারণ ছিল। এথেন্স একটি যােগ্য সমুদ্র শক্তি ছিল, যা পূর্বের প্রজন্মে কোরিন্থকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় দাঁড় করিয়ে দেয়, এবং কোরিন্থের এটি মনে করতে তিক্ত লাগত যে যখন প্রথম ক্লিওমিনিস তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে পারত, তখন সেই কোরিন্থের পেলোপনেসিয়ান লীগ থেকে বেরিয়ে যাবার  জন্যই প্রথম ক্লিওমিনিস এথেন্সকে পরাজিত করতে ও এতে গোষ্ঠীতন্ত্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এরপর বিশ বছর আগে এথেন্স মেগারার সাথে মিলে কোরিন্থকে ভূমিতে পরাস্ত করেছিল, আর এখন সে করসিরার সাথে মিলে তাকে সাগরে পরাস্ত করল। প্রতিশোধ নেবার জন্য কোরিন্থ কালসিডিসির পটিডিয়া শহরে (যেটি করিন্থিয়ানরা দুই শতক পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেছিল) তারা প্রভাব খাটিয়ে সেই শহরকে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররােচিত করল। কিন্তু এথেন্স দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখাল এবং যদিও পটিডিয়া এবং কালসিডিসির অন্যান্য এলাকা বিষয়টাকে বেশ কিছুকাল গরম রাখল, কিন্তু এটা এথেন্সকে খুব একটা বড় সমস্যায় ফেলার মত ছিলনা।

হতাশাগ্রস্ত অবস্থায়, কোরিন্থ স্পার্টার কাছে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কামনা করল। এই ক্ষেত্রে তারা স্পার্টার সমর্থ রাজা দ্বিতীয় আরকিডেমাসের কাছে প্রত্যাখ্যাত হলাে (তিনি চল্লিশ বছর পূর্বের ভূমিকম্পের ঘটনার আগেই ক্ষমতায় এসেছিলেন)। তিনি পেরিক্লিসের বন্ধু ছিলেন আর শান্তি বজায় রাখতে তিনি নিয়মিত তার সেরা করণীয় কাজটিই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এথেন্স আরকিডেমাসের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দিল। পেরিক্লিস একটি শক্ত অবস্থান অবস্থান নিতে এবং এথেনীয় শক্তি প্রদর্শন করতে মনস্থ করলেন। তিনি স্পার্টান জোটের বিশেষভাবে সংকটাপন্ন সদস্য মেগারার বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ঘােষণা করেন। এর অর্থ হলো কোনাে মেগারীয় বণিকই কোনাে এথেনীয় বন্দরে বাণিজ্য করতে পারবে না, যার অর্থ হলাে বলতে গেলে মেগারীয়রা আর কোথাওই আর বাণিজ্য করতে পারবে না। এখন যেহেতু নগর-রাষ্ট্রগুলো শিল্প আর বিশেষায়িত কৃষিতেই বাণিজ্য করত, তাই খাদ্য সহ সকল অর্থনৈতিক বিষয়াদি টিকিয়ে রাখতে বাণিজ্য অত্যাবশ্যক ছিল। শুধু বাণিজ্যের মাধ্যমেই শহরের খাবার আনা যেত। মেগারার বাণিজ্য ভেঙে পড়ায়, এটি শীঘ্রই দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে এটা স্পার্টাকে ভুল পথে পরিচালিত করে তুলল। নিজের চোখেই, নিরস স্পার্টানরা সমুদ্রের শক্তির ভীতিকর পরিণতি দেখতে পেল এবং তারা অনুধাবন করল যে যতদিন এথেন্স সাগর নিয়ন্ত্রণ করবে, ততদিন গ্রিসের মূলভূমিও নিরাপদ থাকবেনা। আর তাই এথেন্সকে আরও শক্তিশালী হবার পূর্বেই গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ অব্দে এফোরগণ আরকিডেমাসকে অগ্রাহ্য করে ঘোষণা করে যে এথেন্স স্পার্টার সাথে হওয়া ৩০ বছরের শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে দিয়েছে (তখন ৩০ বছরের মাত্র ১৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল), এবং এর মাধ্যমেই এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। এই যুদ্ধ পুরো গ্রিসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং গ্রিসের স্বর্ণযুগের সমাপ্তি ঘটায়। যুদ্ধটি থুকিডাইডিসের লিখিত ইতিহাস থেকে সবচেয়ে ভালােভাবে জানা যায়। তিনি যুদ্ধে একজন এথেনীয় সেনাপতি ছিলেন যাকে খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩ অব্দে অন্যায়ভাবে নির্বাসনে পাঠানাে হয়। সেই নির্বাসনকে তিনি একটি ইতিহাস লেখায় কাজে লাগিয়েছিলেন যা ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পক্ষপাতহীন ইতিহাসের নিখুঁত উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আমরা আজ মােটামুটি বলতে পারি, তিনি এথেন্সের বিপক্ষে পক্ষপাতদুষ্টতা দেখান নি, কারণ এটি তার নিজের শহর ছিল, আবার তিনি এথেন্সের পক্ষেও পক্ষপাতদুষ্টতা দেখাননি, কারণ এথেন্স তার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছিল। তার ওপর তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বাস্তববাদী, এবং কখনাে দেবতা, অভিশাপ, অথবা কুসংস্কারকে আমদানি করেননি (যা হেরােডােটাসও সবসময় করতেন)। যেহেতু যুদ্ধকে এথেনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, থুকিডাইডিস এথেন্সের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সম্মন্ধে সবচেয়ে ভালাে অবগত ছিলেন, এবং যেহেতু এথেনীয়দের শত্রু ছিল পেলােপনেসিয়ানরা (স্পার্টা আর কোরিন্থ), তাই যুদ্ধটি ‘পেলােপনেসিয়ান যুদ্ধ’ নামেই পরিচিত হয়।

এথেন্সে স্পার্টার ব্যর্থ অবরোধ, প্লেগ মহামারি ও পেরিক্লিসের মৃত্যু

পেরিক্লিস যুদ্ধের প্রত্যাশাই করেছিলেন এবং এর জন্য তার কৌশলও ঠিক করে রেখেছিলেন। তিনি দেখলেন স্পার্টার সাথে খােলাখুলি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার চেষ্টা করা নিরর্থক হবে। সেটি এথেন্সকে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে নিয়ে যাবে। এর পরিবর্তে তিনি সব এথেনীয়কে এথেন্স আর পাইরিয়াসের লম্বা দেয়ালের মধ্যে নিয়ে এলেন। স্পার্টানরা বাইরে যাই করত না কেন, এই দেয়ালের ভেতরটা ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ, অন্তত মানব শত্রুর হাত থেকে। আরকিডেমাসের নেতৃত্বে স্পার্টানরা শূন্য অ্যাটিকার দিকে এগিয়ে চলল এবং বাড়িঘর ও খামার ধ্বংস করে যা ক্ষতি করার কথা তা করল। হতবুদ্ধি এথেনীয়রা কিছুই করতে পারল না। খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এথেন্সের জাহাজ সাগরকে নিয়ন্ত্রণ করত ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসত। এরই মধ্যে, ঐ জাহাজগুলাে শত্রু শহরগুলাের বাণিজ্যে সংকট নিয়ে আসতে এবং তাদের উপকূলে ঝটিকা আক্রমণ চালাতে পারত। বেশিদিন পার হবার আগেই, পেরিক্লিস নিশ্চিত হলেন, স্পার্টানরা ক্ষত্রিগ্রস্ত খামারগুলাে ব্যবহার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং গ্রহণযােগ্য শর্তে শান্তিপ্রস্তাব মেনে নেবে। প্রথম বছরে পেরিক্লিসের পরিকল্পনা সফল হলাে। এথেনীয় জাহাজগুলাে নিঃসঙ্কোচে আক্রমণ চালাল, এবং তার বদলে, অ্যাটিকাকে বিধ্বস্ত করা ছাড়া পেলােপনেসিয়ানরা সামান্য কিছুই অর্জন করতে পারল। শীত আসার সাথে সাথেই স্পার্টানরা অ্যাটিকা ছাড়তে বাধ্য হলাে। এথেনীয়রা আগামী বছর এর চেয়েও আরাে বেশি কিছুর জন্য প্রস্তুত হলাে, স্পার্টাও এভাবে অনেক বছর ধরে চালিয়ে যাবার জন্য উদ্দমী ছিল। 

প্রথম বছরের শেষে, যুদ্ধে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের জন্য এথেন্সে গণ অন্তেষ্টিক্রিয়ার আয়ােজন করা হয়েছিল এবং সেখানে পেরিক্লিস অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বক্তব্য প্রদান করলেন। থুকিডাইডিসের প্রতিবেদন মতে, এটা ইতিহাসের অন্যতম সেরা বক্তব্য ছিল; ছিল গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার জন্য এক মহান স্মারক। পেরিক্লিস গণতন্ত্রের প্রশংসা করতেন প্রতিটা মানুষকে তাদের শাসক বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়ার জন্য, মানুষকে সমান মনে করার জন্য এবং দরিদ্র মানুষকেও শাসনের সুযােগ দেয়ার জন্য যদি মনে করা হয় সে নগররাষ্ট্রকে সাহায্য করতে পারবে, তাদের নগররাষ্ট্রকে বিদেশিদের জন্য খুলে দেয়ার ও কিছুই না লুকানাের জন্য, উৎসব আর আনন্দ ও নতুনদিনে জীবনের ভালাে জিনিসগুলােয় বিশ্বাস করার জন্য, স্পার্টানদের মতাে যুদ্ধে তাদেরকে প্রশিক্ষণ না দেওয়ার জন্য, কিন্তু যখন যুদ্ধ আসে তখন বীরের মতাে লড়ার সুযােগ করে দেওয়ার জন্য। তিনি বলতেন, “আমাদের শহর হলো গ্রিসের স্কুল-শিক্ষিকা।” এবং প্রকৃতপক্ষে শুধু গ্রিস নয়, তখন থেকে পুরাে দুনিয়াই, এথেন্সের স্বর্ণযুগ থেকে শিখতে সক্ষম হলাে। কিন্তু পেরিক্লিসের ভাষণই ছিল স্বর্ণযুগের শেষ স্মৃতি। মনুষ্য সমাজে এমনও এক শত্রু ছিল যার জন্য পেরিক্লিস কোনাে ব্যবস্থা রাখেননি – সেটি তার উপস্থিতি টের পাওয়াতে লাগল। 

খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে, স্পার্টান সেনাদল আবারও অ্যাটিকা আক্রমণ করল, আবারও একবার এথেনীয়রা লম্বা দেয়ালের ভেতর ভিড় করল। কিন্তু এই সময়, মহামারী ছড়িয়ে পড়ল। একটি ভয়াবহ প্লেগ যা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ল, তা প্রতিবারই মানুষ মেরে গেল। এথেনীয়রা তা চিকিৎসা করার উপায় জানত না এবং তার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। জনসংখ্যার বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করল এবং পুরাে প্রাচীন ইতিহাসে এথেন্সের জনসংখ্যা আর কখনাে সেই সংখ্যায় পৌঁছাতে পারেনি, যা তারা প্লেগে আক্রান্ত হবার আগে ছিল।  এথেন্স হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেল আর পেরিক্লিসকে ভােটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানাে হলাে জনগণের তহবিল নয়ছয় করার জন্য। পেরিক্লিসের কোনাে বিকল্প ছিল না, আর তাই তাকে পুনর্বহাল করা হলাে। প্লেগ তার কর্ম সেরেই ফেলেছিল, কিন্তু তার একটি মারাত্মক আঘাত বাকি ছিল। পেরিক্লিস নিজেই রােগাক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। (স্পার্টার আরকিডেমাসও বেশি দিন টিকলেন না, মারা গেলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে)।   

ক্লিওনের উত্থান, এথেন্সের সাফল্য ও স্ফ্যাকটেরিয়ায় স্পার্টানদের বন্দিত্ব

পেরিক্লিসের পতনের সাথে সাথে এথেন্সে দুই দলের উত্থান হলাে। একদল ছিল ভয়াবহ গণতান্ত্রিক, যারা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার পক্ষপাতি ছিল। তাদের নেতা ছিলেন ক্লিওন। সাম্প্রতিক বছরগুলােতে তিনি পেরিক্লিসের বিরােধিতা করে আসছিলেন, এই বিশ্বাস থেকে যে পেরিক্লিস তার নীতিতে অপ্রয়ােজনীয়ভাবে কঠোর ছিলেন। নিসিয়াসের নেতৃত্বে রক্ষণশীলেরা ছিল শান্তির স্বপক্ষে। ক্লিওন নিয়ন্ত্রণ অর্জন করলেন এবং বেশ কিছু বছর ধরে শক্তিমত্তার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন, কিন্তু পেরিক্লিসের স্থির, দূরদর্শী নীতি বাদ না দিয়ে। (ব্যঙ্গাত্মক কবি এরিস্টোফানিস শান্তির স্বপক্ষের দলের একজন ছিলেন এবং ক্লিওনকে বাঙ্গ করে বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন)। এথেন্স শত্রুদের ওপর নৌ-আক্রমণের নীতি চালিয়ে গেল। সমুদ্রে সাফল্য দুই বছর চেষ্টার পর খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে প্লাটিয়ার দখল নিতে সক্ষম হলাে এবং ম্যারাথনের দিন থেকে এথেন্সের অনুগত মিত্রটির জনসংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৪২৫ অব্দে, এথেনীয় নৌসেনা অধিপতি ডেমোস্থিনিস তার সর্বসেরা জয় অর্জন করলেন যখন তিনি পাইলোসের প্রমন্টরিকে আক্রমণ এবং করায়ত্ত করলেন, যেখানে একসময় স্পার্টান এলাকার কেন্দ্রে মেসেনিয়ার পশ্চিম উপকূলে একটি মাইসিনিয়ান শহর অবস্থিত ছিল। স্পার্টা কোন প্রতিক্রিয়া দেখানাে ছাড়া এটিকে ছেড়ে দিতে রাজি হলাে না। তারা পাইলোসে একদল সেনা পাঠাল। তারা পােতাশ্রয়ের একটি দ্বীপ স্ক্যাকটেরিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করল, এবং এথেনীয়দের ওপর আক্রমণ চালাল। কিন্তু, অস্থায়ীভাবে অনুপস্থিত এথেনীয় রণতরীগুলাে ফিরে এলো এবং স্পার্টান দখলকারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাল। অবরুদ্ধ স্পার্টানরা বেশ কয়েকশ স্পার্টান নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করল এবং স্পার্টান এফোররা সে সম্মন্ধে ভালােভাবেই অবগত ছিলেন। গণটেবিলে পূর্ণ অধিকার সম্পন্ন স্পার্টান নাগরিকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে লাগল আর তারা তখন ছিল মাত্র ৫০০০-এর চেয়েও কম। নাগরিক জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ এভাবে স্ক্যাকটেরিয়ায় আটকে পড়ল এবং স্পার্টার তাদেরকে হারানাের মতাে অবস্থা ছিল না।  স্পার্টা শান্তির জন্য প্রচেষ্টা নিতে মনস্থ করল। আটকা পড়া স্পার্টানদের বিনিময়ে সে উদার শর্ত উপহার দিতে প্রস্তুত ছিল। যদি পেরিক্লিস জীবিত থাকতেন, খুব সম্ভাবনা ছিল যে তিনি গ্রহণযােগ্য হতেন, কিন্তু ক্লিওন তার জন্য যোগ্য শাসক ছিলেন না। সে আরও একটু বেশি চাপ প্রয়ােগ করা থেকে নিজেকে থামাতে পারল না। তিনি বিশ বছর আগের হারিয়ে ফেলা ভূমি এলাকা ফিরে পেতে মেগারা, অ্যাকিয়া এবং আরও কিছু অঞ্চল দাবি করলেন। স্পার্টানরা নিজেদের অপমানিত বোধ করল এবং রাগান্বিত হয়ে স্পার্টায় ফিরে গেল। ফলে যুদ্ধ চলতে থাকল। প্রায় তৎক্ষণাৎই, মনে হতে লাগল যে ক্লিওন দায়িত্বে ব্যর্থ হতে চলেছে।

স্পার্টানদের ফাঁদে ফেলা ছিল এক জিনিস, কিন্তু তাদের আটক করা ছিল আরেক জিনিস। স্ফ্যাকটেরিয়া ছিল বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ আর ঝোপজঙ্গলে থাকা স্পার্টানকে ধরতে যাওয়া ছিল সিংহের খাঁচায় হাত দেয়ার মতো ব্যাপার। ফলে এই অবরােধ দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ফলভাবে চলতে থাকল, এবং অনেক এথেনীয় সুযোগ থাকতে ক্লিওনের শান্তি স্থাপন না করায় আফসোস করতে থাকল। ক্লিওন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে সবকিছু ঢেকে দিয়ে বলতে চাইলেন। তিনি বললেন, পাইলোসে এথেনীয় সেনাপতিরা কাপুরুষ ছিল। তিনি নিজের সম্মন্ধেও বললেন যে, তিনি চাইলে আরও ভালাে কিছু উপহার দিতে পারতেন, যদি তিনি সেখানে থাকতেন। নিসিয়াস তখন তার জীবনের অন্যতম বুদ্ধদীপ্ত কাজটি করলেন। তিনি দ্রুতই ক্লিওনকে পাইলোসে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাবনায় ভােট দেয়ার জন্য বললেন এবং ভােটটি পাস হলাে। ক্লিওন ভালাে মতােই ফাঁদে পড়লেন; তাকে চলে যেতে হলাে। ক্লিওনের ভাগ্য কিন্তু দারুণ সুপ্রসন্ন ছিল। তার পৌঁছানাের কিছু আগে, দুর্ঘটনাক্রমে লাগা এক আগুন স্ফ্যাকটেরিয়ার গাছপালা পুড়িয়ে দিল। ক্লিওন একটা ভয়াবহ আক্রমণ চালালেন এবং স্পার্টানরা ধোয়া আর ছাইয়ে ঢাকা পড়ে অবরােধের মধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এবং পরাজিত হয়ে গেল। ১২০ জন পুরােদস্তুর স্পার্টান নাগরিক আত্মসমর্পণ করল। ক্লিওন বিজয়ােল্লাসের সাথে স্পার্টান বন্দীদের নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। তারা অ্যাটিকায় পুনরায় অভিযানের সময় জিম্মি হিসেবে কাজ করল, এবং বেশ কয়েকটি গ্রীষ্মে স্পার্টানরা আর অ্যাটিকা দখল করতে আসেনি।

ব্রাসিডাসের অ্যাম্ফিপোলিস জয়, ক্লিওন ও ব্রাসিডাসের মৃত্যু, নিসিয়াসের শান্তিচুক্তি

এই জয় এথেন্সকে দ্বিগুণ শক্তি বৃদ্ধি করতে চালিত করল, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪ অব্দে, নিসিয়াস স্পার্টান দ্বীপ সিথেরা দখল করে নিলেন। তার ওপর, ক্লিওন অনুভব করলেন, পেরিক্লিস যে ভূ-সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন তার জন্য উন্মুক্ত আক্রমণ পরিচালনা করার এখন উপযুক্ত সময় এবং বুঝলেন স্পার্টানরা তা স্ফ্যাকটেরিয়ার বন্দীদের বিনিময়ে বদলাবদলি করবে না। এথেনীয়রা দক্ষিণদিকে আক্রমণ চালিয়ে মেগারার বন্দর নগরী নিসিয়াকে (Nisaea) দখল করে নিল। হয়তো মেগারারও পতন হয়ে যেত, আর এর মধ্য দিয়ে স্পার্টারও শান্তি চুক্তি লাভের একমাত্র আশার সমাপ্তি হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি, একজন নতুন স্পার্টান নেতৃত্বের উত্থানের কারণে। ইনি ছিলেন ব্রাসিডাস, স্পার্টান শিবিরের সবচেয়ে অস্পার্টানসুলভ, প্রাণবন্ত, বুদ্ধিমান, আকর্ষণীয় ও সাহসী যোদ্ধা। যুদ্ধের প্রথম বছরে তিনি মেসেনিয়ায় একটি আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের বিতাড়িত করেন, এবং পরবর্তীতে তিনি সাফল্যের সাথে স্ফ্যাক্টেরিয়ায় যুদ্ধ করেন। তবে একটি আঘাতের কারণে তাকে যুদ্ধ থেকে বিরতি নিতে হয়। এবার খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪ অব্দে তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন। ইস্থমাসে এসে তিনি এথেনীয়দেরকে মেগারা থেকে বিতাড়িত করলেন। এরপর তিনি উত্তর দিকে থেসালী ও মেসিডােনিয়া হয়ে কালসিডিসির দিকে ধাবিত হলেন, যা এথেন্সের খুব শক্তিশালী অবস্থান ছিল। 

এথেনীয়রা সাথে সাথে বিপদটা বুঝতে পারেনি। তাদের ইচ্ছা ছিল বিওটিয়ায় আক্রমণ করার। কিন্তু তারা ইউবিয়ার ঠিক বিপরীত দিকের উপকূলে ডিলিয়ামে থিবানদের হাতে বাজেভাবে পরাজিত হলো, এবং তারা নিজেদের ভূ-শক্তিতে পরিণত করার ব্যাপারে সকল প্রচেষ্টাই ত্যাগ করল। এখন কালসিডিসিতে কী হচ্ছিল সেই সম্পর্কে তাদের সচেতন হবার সময় চলে এলো। ব্রাসিডাস তার কৌশল আর কূটনীতিকে আশ্রয় করে (যা স্পার্টার মধ্যে প্রায় একদমই অনুপস্থিত ছিল) এবং মেসিডােনিয়ার পারডিকাসের কাছ থেকে সহায়তা লাভ করে শহরের পর শহরকে বিদ্রোহে লিপ্ত করালেন। সবশেষে, তিনি অ্যাম্ফিপােলিসের দিকে অগ্রসর হলেন। অ্যামফিপপালিস মাত্র তের বছর আগে এথেন্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এথেন্স শহরটির প্রতি গভীর সংযুক্ততা অনুভব করত। ইতিহাসবেত্তা থুকিডাইডিস অ্যাম্ফিপোলিসের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু তিনি তখন ঘটনাস্থলে ছিলেন না। অবরােধের খবর তার কাছে পৌঁছানাে মাত্রই তিনি দ্রুত ফিরে এলেন, কিন্তু তিনি যথাসময়ে পৌঁছতে পারলেন না। অত্যন্ত উদার শর্ত প্রদান করায় অ্যাম্ফিপোলিস খুব দ্রুত আত্মসমর্পণ করল। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্রাসিডাসের দক্ষতার জন্য থুকিডাইডিসকে খুব কমই দায়ী করা হয়েছে, কিন্তু ক্ষুব্ধ এথেনীয়দের কাউকে প্রয়ােজন ছিল অভিযুক্ত করার জন্য, আর তাই থুকিডাইডিসকে নির্বাসনে পাঠানাে হলাে। (এবং ভালাে দিক হচ্ছে, অন্যকিছু হলে হয়ত আমরা তার ইতিহাস লেখনীকে পেতাম না।) এবার বিপদে পড়ায় শান্তি স্থাপনের পালা ছিল এথেন্সের, আর তারা এক বছরের একটি শান্তিচুক্তি অর্জন করতে সফলও হলাে। কিন্তু ব্রাসিডাস স্পার্টান ক্লিওনের মতােই আবির্ভূত হলেন। তিনি বুঝলেন স্পার্টান বিজয়কে সম্পূর্ণ করার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দরকার। তাই তিনি তার অভিযান চালিয়ে গেলেন যা এথেনীয়দের জন্য যথেষ্ট অসন্তোষের কারণ হলো, ফলে শান্তিচুক্তি ব্যর্থ হলাে। 

এথেনীয়রা ক্লিওনের দ্বারস্থ হলাে। তিনি ছিলেন সেই বীর সেনাপতি, যিনি স্ফ্যাকটেরিয়া দখলে নিয়েছিলেন এবং ১২০ স্পার্টানকে কয়েদ করেছিলেন। তিনি কি ব্রাসিডাসের ব্যাপারে কিছু করবেন না? খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ অব্দে, ক্লিওন উত্তর অভিমুখে একদল সেনাকে নেতৃত্ব দিতে বাধ্য হলেন। তিনি কিছু সাফল্য লাভ করেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন অ্যাম্ফিপোলিস আক্রমণ করার চেষ্টা করলেন, ব্রাসিডাসের উন্নততর সামর্থ্য পুরাে ব্যাপারটিই পরিষ্কার করে দিল। তিনি ক্লিওনকে পরাস্ত করে বিজয় অর্জন করলেন। যুদ্ধে ক্লিওন নিহত হলেন, কিন্তু একইভাবে ব্রাসিডাসও নিহত হলেন। এইভাবে দুইদিক থেকেই যুদ্ধের নেতারা মারা গেলেন এবং শান্তির জন্য অবশেষে রাস্তা খুলে গেল। স্পার্টা বন্দি স্পার্টানদের ফিরে পেতে চাইল এবং আর্গোসের কাছ থেকে তারা যে বিপদের আশঙ্কা করছিল, তা থেকে মুক্ত হতে চাইল। এদিকে এথেন্স সব জায়গায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে তার কোষাগার ফাঁকা করে ফেলেছিল। এথেন্স মুক্তহস্তে মন্দিরের সম্পদ ধার করেছিল এবং এথেনীয় সাম্রাজ্যের শহরগুলাে থেকে নেয়া শ্রদ্ধার্ঘ্যও তাকে দ্বিগুণ করতে হয়েছিল। দুই পক্ষই যুদ্ধের জন্য উন্মাদ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪২১ অব্দে একজন এথেনীয় মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে স্পার্টার সাথে এথেন্সের শান্তিচুক্তি স্থাপিত হলো, যা ‘নিসিয়াসের শান্তি’ নামে পরিচিত। স্পার্টান বন্দীরা ফিরে গেল আর পরিস্থিতি সেইদিকেই গেল যা দশ বছর পূর্বে যুদ্ধ শুরু হবার সময় ছিল, শুধু অ্যাম্ফিপোলিসকে স্বাধীন থাকতে দেয়া হলো (প্রকৃতপক্ষে, এথেনীয়রা কখনাে সেই শহরকে ফিরে পায়নি।) দশ বছরের রক্তপাত আর দুর্ভোগ এথেন্স বা স্পার্টার জন্য তেমন কিছুই বয়ে নিয়ে আসতে পারল না, আর পুরাে গ্রিসকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেল। 

এথেন্সে আলসিবিয়াডিসের উত্থান ও স্পার্টার দ্বিতীয় এইজিসের সাফল্য

নিসিয়াসের শান্তি পঞ্চাশ বছর টিকে থাকার কথা ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এই শান্তি কখনাে শুরুই হয়নি। কোরিন্থ আর থিবস নগরী, সাথে অন্যরাও এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চায়নি। তারা এথেন্সের ধ্বংস চাইত, তার থেকে কম কিছু নয়। স্পার্টান বন্দীদের উদ্ধার তাদের জন্য কিছুই ছিল না। তখন, এথেন্সও এই ব্যাপারটায় রাগান্বিত ছিল যে অ্যাম্ফিপোলিস তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হলাে না এবং এই কারণে পাইলোস ও সিথেরা দ্বীপ স্পার্টার কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করল। তার ওপর এথেন্সে নতুন এক যুদ্ধবাজ নেতার উত্থান ঘটল। তিনি ছিলেন আলসিবিয়াডিস। তার মা ছিল পেরিক্লিসের কাজিন এবং তিনি আল্কমিওনিডির পরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন তার পরিবারের সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি এথেনীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ধনী, দেখতে সুন্দর, বুদ্ধিমান এবং আকর্ষণীয়, কিন্তু নীতিহীন। তিনি নিজের প্রতাপ দেখাতে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং এজন্য তার যুদ্ধের প্রয়ােজন ছিল। তার নিজস্বার্থ সিদ্ধির জন্য, তিনি এথেন্সকে যুদ্ধে ঠেলে দিতে পিছপা ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, তিনি এথেন্সকে ধ্বংস করার জন্য অন্য যে কারও চেয়ে অনেক বেশি কিছু করেছিলেন, আর তার কারণেই এথেন্সবাসীর ওপর পুনরায় যেন “আল্কমিওনিডির অভিশাপ” নেমে এলো। আলসিবিয়াডিস তার সাধের যুদ্ধের সুযোগ পেয়ে গেলেন পেলোপনেসাসে। সেখানে আর্গোস স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। ব্রাসিডাসের মতো সফল নেতা পাবার পরও স্পার্টার সম্মান পড়তির দিকে ছিল। আর আলসিবিয়াডিসকে স্পার্টার বিরুদ্ধে আর্গোস, এলিস ও মান্টিনিয়ার আর্কেডীয় নগরের সাথে জোটবদ্ধ হতে বেগ পেতে হলোনা। তিনি তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দান করলেন যে এথেন্স তাদেরকে স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য পাঠাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নিসিয়াস এই পেলােপনেসাসে অভিযাত্রার বিপক্ষে ছিলেন, ফলে এথেন্স এই দুয়ের মাঝে সংকটে পড়ে গেল। তিনি আর্গিভ ও তাদের মিত্রদের স্পার্টাকে পরাজিত করার জন্য বড় কোনাে বাহিনী পাঠাননি। এদিকে তিনি নিরপেক্ষ থেকে বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। তার পরিবর্তে, আলসিবিয়াডিস তার নিজের অধীনের অপর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য পাঠালেন। যুদ্ধে স্পার্টানদের নেতৃত্ব দান করেছিলেন দ্বিতীয় এইজিস (Agis II), যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে তার পিতা আরকিডেমাসের উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। এইজিসের নেতৃত্বে স্পার্টানরা তাদের চিরচেনা পেলােপনেসাসে আরেকবার যুদ্ধ করতে লাগল তাদের পুরনাে শত্রুদেরই বিপক্ষে, যাদের তারা ইতােপূর্বে অনেকবার হারিয়েছে। ৪১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মান্টিনিয়ার কাছে স্পার্টা আর্গোসের মিত্রশক্তিকে একটি নির্ণায়ক যুদ্ধে পরাস্ত করল। পেলােপনেসাসের অবস্থা আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো, যেখানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলো স্পার্টার হাতে। একমাত্র পরিবর্তন ছিল এই যে, এখানে স্পার্টা আর এথেন্স পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হলো। 

এথেন্সে নিসিয়াসের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষোভের আগুন ছিল, যা আরাে বেশি গণতান্ত্রিকদের মাধ্যমে জ্বলে উঠেছিল. তারা ক্লিওনের মৃত্যুর পর থেকে হাইপারবােলাসের নেতৃত্বে ছিল। তারা বুঝতে পারল যে নিসিয়াসের বিরোধিতাই এথেন্সকে স্পার্টার বিরুদ্ধে এথেনীয় জোটকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা থেকে বিরত রেখেছে। হাইপারবােলাস ওস্ট্রাসিজম ভােটের আহ্বান করলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে আলসিবিয়াডিসের অনুসারীরা তার সাথে যােগ দেবে এবং নিসিয়াসকে নির্বাসনে পাঠানাে হবে। ফলে তখন যুদ্ধ আরও গভীরভাবে চালানাে যাবে। কিন্তু নিসিয়াস আর আলসিবিয়াডিসের অনুসারীরা তাদের নিজেদের মধ্যে এক চুক্তিতে উপনীত হলেন। উভয়েই হাইপারবােলাসের বিরুদ্ধে গেলেন। আর হাইপারবোলাস হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন যে তাকেই নির্বাসিত হতে হচ্ছে। এই ঘটনাটি পুরাে ওস্ট্রাসিজম ব্যবস্থাকেই পরিহাস করল, এবং এথেন্সে আর কখনাে ওস্ট্রাসিজম ভােট অনুষ্ঠিত হয়নি। পদ্ধতিটি প্রায় এক শতাব্দীর মতাে টিকে ছিল আর তার সেবা প্রদান করেছিল। এখন এটার কাজ শেষ হয়ে গেছে। যাই হোক নিসিয়াসের শান্তির পরবর্তী দুই বছর যে প্রায়-শান্তিপূর্ণ অবস্থা ছিল তাতে এথেন্স শ্বাস নেবার সুযোগ পেল। পুনরায় এথেন্সে অর্থের সমাগম হলো ও এর আত্মবিশ্বাসও ফিরে এলো। এবার এথেন্স আলসিবিয়াডিসের পরিকল্পনামাফিক কাজে এগোবার জন্য প্রস্তুত। এথেনীয়দের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদেরকে দুই-দুইবার তাদের সামর্থ্যেরও বাইরে গিয়ে কাজে লিপ্ত করেছিল। প্রথমবার করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ অব্দে, যখন এথেন্স আয়োনীয় বিদ্রোহকে সাহায্য করার জন্য সেনা পাঠিয়েছিল। আর দ্বিতীয়বার করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে, যখন এথেন্স মিশরকে পারসিকদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য সেনা পাঠিয়েছিল। প্রথমটির ক্ষেত্রে তারা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় ও ফলত তারা পারসিকদের পরাজিতও করে। দ্বিতীয়বারের বেলায় অনেক ক্ষতির পরও অন্তত তারা সেই ক্ষতিকে অন্যান্য বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে পুষিয়ে নিতে পেরেছিল। কিন্তু এবারে তৃতীয়বারের বেলায় এথেনীয়রা যা করল তাতে তারা ছিল সবচেয়ে অসফল। এটি ছিল সিসিলিকে নিয়ে।

এথেন্সের সিসিলি অভিযান, আলসিবিয়াডিসের পলায়ন ও নিসিয়াসের দায়িত্ব গ্রহণ

এথেন্স সিসিলিকে একটি পাকা ফল ভেবেছিল যা কেবল পেড়ে নেবার অপেক্ষায় আছে, আর সেখানে এথেন্সের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল সাইরাকুজ। সাইরাকুজ সিসিলিতে বহিরাঞ্চলের হস্তক্ষেপকে একেবারেই সহ্য করত না। তখন সিসিলিতে সাইরাকুজই সবচেয়ে শক্তিশালী নগর ছিল, আর বহিরাক্রমণ তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি আঘাত করার কথা ছিল। অবশ্য সাইরাকুজ অন্যান্য সিসিলীয় নগরগুলোকে বিবাদে জড়িয়ে যাওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ অব্দে, পশ্চিম সিসিলির সিজেস্তা শহর প্রতিবেশী শহর সিলিনাসের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাে এবং এথেন্সেক সাহায্যের জন্য ডেকে আনল। আলসিবিয়াডিস সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন। সিসিলি আর ইতালির সমৃদ্ধ গ্রিক শহরগুলাে আলসিবিয়াডিসের কাছে খাঁটি সােনার মতাে মনে হলাে। পশ্চিমে এক সরাসরি ও অপ্রত্যাশিত আঘাত অপরিমেয় সম্পদের একটি এলাকা এথেনীয়দের হাতে নিয়ে আসতে পারত। সেই অঞ্চলের অধিকারে থাকা সিসিলিয়ান লােকবল ও অর্থবলের সাহায্যে এথেন্স পেলােপনেসাসে যুদ্ধে যেকোনাে প্রতিপক্ষকেই কোনাে সমস্যা ব্যতিরেকেই পরাস্ত করতে পারত। তার বিরােধিতা করবে এমন সাহস ছিল কার? আক্রমণের আরেক যৌক্তিক কারণ ছিল সাইরাকুজ। সে ছিল প্রকৃতপক্ষেই কোরিন্থের উপনিবেশ, এবং কোরিন্থ ছিল এথেন্সের চিরশত্রু, যে শহরটি এই ধ্বংসাত্মক পেলোপনেসীয় যুদ্ধটি শুরু করেছিল। সাইরাকুজ ছিল টাইরানী ও সিসিলিয়ান আইসোলেশনের ঐতিহ্যগত আবাসস্থল, আর তাই এটি গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী এথেন্সের সঠিক নিশানা ছিল। সর্বোপরি, সাইরাকুজ ছিল পশ্চিমের সবচেয়ে শক্তিশালী শহর, এবং যদি সে পরাস্ত হত, বাকিদের ভাগ্যেও তাই ঘটত। 

নিসিয়াসের অধীন রক্ষণশীল শান্তির দল এই বন্য পরিকল্পনাটির বিরুদ্ধাচরণ করল, কিন্তু আলসিবিয়াডিস এথেনীয় জনগণের কল্পনাশক্তিকে ধারণ করতে সক্ষম হলেন। এবং তারা অভিযাত্রার স্বপক্ষে ভােট দিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৫ অব্দে এক রাজকীয় নৌবাহিনী পাল তুলে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাে এবং জনগণ এতে এমন আনন্দিত ছিল যেন এটি কোনাে অভিজাত ছুটির দিন ছিল। কিন্তু এবার এথেনীয়রা ভুলের পর ভুল করেই চলল। সিসিলিয়ান অভিযাত্রা নির্বুদ্ধিতা ছিল তা প্রমাণিত হবার পরও আলসিবিয়াডিস ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি এটাকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহসী এবং সমর্থ ছিলেন। যদি এথেন্স প্রকল্পটি চালিয়ে যেতে চাইত, তার হাতেই এর নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হত। কিন্তু তা হয়নি, বরং নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন মানুষকে আনা হলাে, যার মধ্যে একজন ছিলেন নিসিয়াস। যেহেতু নিসিয়াস প্রথম থেকেই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন, কতটুকু শক্তিই বা তিনি এতে নিয়ে আসতে পারতেন। তিনি ছিলেন বেছে নেওয়া সবচেয়ে বাজে মানুষ, ছিলেন মধ্যমমাপের, সিদ্ধান্তহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর সেই সাথে খুব বেশি বুদ্ধিমানও তিনি ছিলেননা। (তিনি ছিলেন একজন অ-এথেনীয় এথেনীয়, যেমন ব্রাসিডাস ছিলেন একজন অ-স্পার্টান স্পার্টান।)। 

সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটি ঘটতে তখনাে বাকি ছিল। রণতরীগুলো ছেড়ে যাওয়ার আগে রাতের বেলা বেশকিছু ধর্মীয় মূর্তি ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়ায় একে ভয়ানক এক অশুভ সংকেত মনে করে এথেনীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। আলসিবিয়াডিস ইতােমধ্যে এলিউসিনীয় রহস্যাবলি নিয়ে বিদ্রুপ করার ব্যাপারে সন্দেহযুক্ত ছিলেন এবং নিসিয়াসের শান্তিবাদী দল দ্রুত আলসিবিয়াডিসকে এই ছিন্নভিন্নর কাজে অভিযুক্ত করল। আলসিবিয়াডিস শক্ত হাতে তার অপরাধহীনতাকে ধরে রাখলেন, এবং নিশ্চিতভাবেই আলসিবিয়াডিসও তার বিরাট অভিযাত্রা শুরু করার প্রাক্কালে সেইরকম উন্মত্ত ছিলেন না। ঘটনা সম্ভবত এটাই ছিল যে নিসিয়াসের শান্তিবাদী দল নিজেরাই ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিল আলসিবিয়াডিসকে দায়ী করার জন্য। যাই হোক, এটা ছিল ইতিহাসের অন্যতম রহস্য। কেউই সত্যটা কখনাে জানতে পারবে না। আবারও এথেনীয়রা সবচেয়ে বাজে সম্ভব কর্মপ্রক্রিয়াই বেছে নিল। তারা তৎক্ষণাৎ আলসিবিয়াডিসকে বিচারের মুখােমুখি করাতে পারত এবং রণতরীগুলোকে পাল তুলে দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত যতক্ষণ পর্যন্ত না বিষয়টা একভাবে না একভাবে নির্ধারিত হত। অথবা তারা আলসিবিয়াডিসকে রণতরী নিয়ে সিসিলি পর্যন্ত যেতে দিতে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না অভিযান শেষ হয়, সেইদিন পর্যন্ত বিচার স্থগিত রাখতে পারত। কিন্তু তারা এবার সেসবের দিকে না গিয়ে আলসিবিয়াডিসের নেতৃত্বে রণতরীকে পাঠাতে দিল, আর পরে একজন দূত পাঠিয়ে তাকে বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। এরফলে আলসিবিয়াডিস খুব সহজেই ধরে ফেলল যে তার অনুপস্থিতিতে তার শত্রুরা এথেন্সের নিয়ন্ত্রণ বাগিয়ে নিয়েছে, ফলে এথেন্সে ফিরে গিয়ে বিচারের মুখে যাবার অর্থ হবে আত্মহত্যার শামিল। আর নিশ্চই আলসিবিয়াডিস নিজ শহরের ভালাের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার মতাে লােক ছিলেন না। তিনি এথেন্সের ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে এবং তারপর স্পার্টানদের কাছে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করলেন। এর ফলে সিসিলির অভিযানের নেতৃত্ব চলে গেল অযোগ্য নিসিয়াসের হাতে। এথেনীয়রা সাইরাকুজের কাছে পৌঁছে কিছু বিজয় অর্জন করা শুরু করল, কিন্তু নিসিয়াস এমন মানুষ ছিলেন না যে এই বিজয়গুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করবেন। তিনি সবসময় দেরি করার কারণ খুঁজতেন, যাতে তিনি পিছিয়ে আসতে পারেন। যদি পরিপ্রেক্ষিত তাকে সামনে যেতে বাধ্য করত, তবে তিনি যত ধীরে এগোনো সম্ভব অগ্রসর হতেন। এরফলে সাইরাকুজিয়ানরা সবসময় নিজেদেরকে পুনরায় প্রস্তুত করে পাল্টা আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হতে পারত।

সাইরাকুজের সহায়তায় স্পার্টা ও এথেন্সের বিপর্যয়

আরও যা খারাপ হলো তা হচ্ছে স্পার্টায় গিয়ে আলসিবিয়াডিস ধীরগতির স্পার্টানদেরকে তার বাগ্মীতার জোড়ে উত্তেজিত করে সাইরাকুজের পক্ষ নিয়ে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে ও সিসিলিতে এথেনীয়দের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে রাজি করালেন। সিসিলিতে এই এথেনীয় অভিযাত্রা ছিল আলসিবিয়াডিসেরই মানসপুত্র। তাই যখন হলো না, তাই এবারে তিনি এথেন্সের এই অভিযাত্রাকে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুত হলেন। শীঘ্রই স্পার্টানরা সাইরাকুজের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিল। পরিণণিতে, স্পার্টা একটি ছােট সৈন্যদল সমেত খ্রিস্টপূর্ব ৪১৪ অব্দে জিলিপাস নামে এক সেনাপতিকে প্রেরণ করল। এদিকে নিসিয়াস অনেক ধীরে ধীরে কাজ করতে থাকলেও তারা আসলেই তাদের সাইরাকুজ অভিযাত্রায় জিতে চলেছিল। ফলে তাড়াতাড়ি এসে স্পার্টানরা ঠিক কাজই করেছিল। রাইরাকুজের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপের জন্য নিসিয়াস ধীরে ধীরে সাইরাকুজের চারপাশে একটি দেয়াল নির্মাণ করছিলেন। আর সাইরাকুজও এথেন্সের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই যাচ্ছিল। এদিকে নিসিয়াস দেরি করছিলেন বলে দেয়ালের পুরোপুরি নির্মাণ করার আগেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে জিলিপাস তার স্পার্টান সেনাবাহিনী নিয়ে সাইরাকুজে ঢুকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অনেক শক্তিশালী করে ফেলে আর নিসিয়াস সহ এথেনীয়দেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। সেই দেয়াল নির্মাণ আর কখনই সম্পূর্ণ হয়নি। এর ফলে এথেন্সের জয়ের সম্ভাবনা পুরোপুরি ভেস্তে গেল ঠিকই, কিন্তু এথেনীয়রা যদি দ্রুতগতিতে পশ্চাদপ্রসরণ করতে পারত তবে তারা তবুও তাদের ওপর নেমে আসা বিপর্যয়কে আটকাতে পারত। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে নিসিয়াস এথেন্স থেকে রিইনফোর্সমেন্ট চেয়ে পাঠাল। এতে নিসিয়াসের ব্লান্ডার আকারে আরও বড় হলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৪১৩ অব্দে, যেমন ডেমোস্থিনিসের (যে সেনাপতি কয়েক যুগ আগে পাইলোসকে সুরক্ষিত করেছিলেন) একটি নতুন অভিযান শুরু হলাে। ডেমোস্থিনিস সাইরাকুজে আক্রমণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটিকেও হটিয়ে দেয়া হলাে। ডেমোস্থিনিস নিসিয়াসের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান ছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি বুঝলেন যে এখানে করার মতাে একটি কাজই আছে, আর তা হলাে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়া। কিন্তু তার এমন মনে করায় তো আর কাজ হবেনা। দলপতি ছিলেন বোকা আর নির্বোধ নিসিয়াস। যখন আক্রমণ জেতার পথে ছিল, তখন তিনি আক্রমণে ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে জেতার সম্ভাবনা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন, আর এবার তিনি পিছিয়ে যাওয়ায় ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে পড়লেন, যখন পিছিয়ে আসাটাই অপরিহার্য ছিল। তিনি জানতেন যুদ্ধে হেরে এথেন্সে ফিরে এলে ব্যর্থতার দায়ভার তার ওপরই পড়ত, আর তাই এথেন্সের জনগণের ক্ষোভের মুখােমুখি হবার সাহস তিনি করেননি। তাই তিনি অযথা কালক্ষেপণ করছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৩ অব্দের ২৪ আগস্টে একটি চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নিসিয়াস এরফলে কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি পালন না করে কোনাে অভিযাত্রা এগিয়ে নিতে নিষেধ করলেন। যতদিনে সেসব সমাপ্ত হলাে, ততদিনে সাইরাকুজিয়ান নৌবাহিনী এসে সমুদ্রপথে তাদের পালাবার পথ আটকে দিল এবং দুটি নৌযুদ্ধে পরাস্ত হবার পর এথেনীয়রা ফাঁদে পড়ে গেল।

আশাহীন এই যুদ্ধে ভূমিতে যুদ্ধ করা ছাড়া এথেনীয়দের আর কিছুই বাকি ছিল না, যা জয়লাভ করা ছিল তাদের জন্য অসম্ভব। নিসিয়াস বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করল, এই বীরত্বই ছিল তার একটি মাত্র ভাল দিক। তবে তারা হেরে গেল, আর এথেনীয় সেনাদলের শেষ ব্যক্তিটিকেও মেরে ফেলা বা আটক করা হলাে, এবং যাদের আটক করা হলাে, তাদের প্রতি ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতার প্রদর্শন করা হলাে। ফলে তাদেরও মরতে বেশি বাকি ছিল না। নিসিয়াস আর ডেমোস্থিনিস, উভয়কেই মেরে ফেলা হলাে। এই সিসিলিয়ান অভিযানের ধ্বংসলীলা এথেন্সের প্রাণশক্তিকে চিরতরে নষ্ট করে দিল। এথেন্স পেলােপনেসাসের যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়ে যেতে থাকল এবং পরবর্তী শতাব্দীতে সে কখনাে কখনাে যুদ্ধে ভালােও করত – কিন্তু আর কখনাে সে আগের মতো চূড়ান্তভাবে আত্মবিশ্বাসী ছিল না, আর কখনাে সে বিরাট প্রকল্প হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। আর কখনাে সে ম্যারাথন বা সালামিসে দাঁড়াতে এবং শত্রুপক্ষকে তার মন্দতম পরিণতি উপহার দিতে পারেনি। ইতিহাসের এই সময়ে এসে যখন শোডাউন শুরু হলো তখন এথেন্স পিছিয়েই যেতে থাকল।

আলসিবিয়াডিসের সহায়তায় এথেন্স অবরোধ ও থ্রেসিবুলাসের ক্ষমতা লাভ

আলসিবিয়াডিস স্পার্টানদের সিসিলির দিকে ধাবিত করার সময় যেটুকু করেছিলেন, এথেন্সকে ধ্বংস করতে তার থেকে বেশি কিছুই করলেন। যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে স্পার্টানরা অ্যাটিকায় আক্রমণ করেত, এথেন্সের দেয়ালের ভেতর প্রবেশ করতে তারা ব্যর্থ হত, আর শীতকালে তারা অ্যাটিকা ত্যাগ করতে বাধ্য হতো। এর ফলে এথেন্সও শীতকালে তাদের গ্রীষ্মকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিত। এবার আলসিবিয়াডিস স্পার্টানদেরকে দেখালো, যদি তারা অ্যাটিকার বর্ডারে একটি দুর্গ তৈরি করে অবস্থান নেয়, তাহলে পুরো বছর জুড়ে তারা অ্যাটিকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে  পারবে, আর তার ফলে এথেনীয়রা শুধু বছরের একটা সময়ের জন্য এথেন্সের দেয়ালের ভেতরে থাকবে না, বরং পুরো বছরই দেয়ালের ভেতরে থাকতে বাধ্য হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৩ অব্দে, দ্বিতীয় এইজিসের অধীনে স্পার্টানরা উপদেশটি গ্রহণ করল এবং এথেনীয়রা দেয়ালের ভেতরে আটকা পড়ল। এমনকি তারা অ্যাটিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের রুপার খনিও ব্যবহার করতে পারল না যা তাদেরকে সত্তর বছর ধরে সম্পদ সরবরাহ করেছে। এথেনীয়দের কাছে বিপুল পরিমাণে অর্থ ছিল, যা অধিক সমৃদ্ধ সময়ে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল চরম প্রয়ােজনের মুহূর্তে ব্যবহার করার জন্য। সিসিলিতে ভয়াবহ বিপর্যয় আর স্পার্টানদের অ্যাটিকায় স্থায়ীভাবে প্রবেশের সাথে সাথে সেই সময় উপস্থিত হলাে। অর্থ ব্যবহার করা হলাে সিসিলিতে সেই ক্ষয়ক্ষতির প্রতিস্থাপন করতে, আর তার সাথে সাথে তারা সেই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেষ্টা করল যা স্পার্টানরা ঈজিয়ান সাগরের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।

ততক্ষণে স্পার্টা উপলব্ধি করল যে এথেন্স সাগরে পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে শেষ হবে না। ভালাে লাগুক আর না লাগুক, স্পার্টানকে একটি নৌশক্তি হতে হত। জাহাজ আর মাল্লার জন্য তার দরকার ছিল টাকা, আর টাকার জন্য সে জানতাে কোথায় যেতে হবে, স্থানটি হলো পারস্য। পারস্যরাজ আর্তাজারেক্সেস যতদিন বেঁচে ছিলেন শান্তি বজায় রেখেছিলেন আর যুদ্ধরত গ্রিকদের মধ্যে হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪ অব্দে তিনি মারা গেলেন। তার দুই পুত্র দ্রুতই গুপ্তহত্যার শিকার হলাে, আর তৃতীয়জন দ্বিতীয় দারিয়ুস নাম নিয়ে সিংহাসনে আরােহণ করলেন। সিংহাসন পাকাপোক্ত করার পর তিনি গ্রিসের প্রতি আক্রমণাত্মক নীতি চালু করে দিলেন। তবে তিনি সত্যিকার যুদ্ধবাজীতে আগ্রহী ছিলেন না, এক্ষেত্রে পারস্যের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভাল ছিলও না। এর বদলে তিনি আরও রক্তক্ষয়ী পদ্ধতিকে ব্যবহার করলেন। অর্থের ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি যুযুধান গ্রিক নগরগুলোকে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল করে দেবার নীতি গ্রহণ করলেন। স্পার্টাই ছিল অর্থের জন্য সবচেয়ে লালায়িত এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪১২ অব্দে স্পার্টা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ ও উত্তর অংশের সত্রপ টিসাফারনিজ এবং ফারনাবেজাসের সাথে একটি সমঝােতায় এলো। এদিকে এথেন্স বলতে গেলে হালই ছেড়ে দিয়েছিল। তার শেষ অর্থটুকুও ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাকে পরাজয়ের পর পরাজয় বরণ করতে হচ্ছিল, তার সাম্রাজ্যে চলছিল একের পর এক বিদ্রোহ, আর তার ওপর পারস্য তার বিশাল অর্থ স্পার্টাকে ধার দিয়েছিল। একটি শহর আর কত ভার নিতে পারে? 

এই শোচনীয় পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এথেনীয় রক্ষণশীলেরা খ্রিস্টপূর্ব ৪১১ অব্দে এথেন্সে গণতন্ত্র উঠিয়ে দিয়ে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। এই শাসনকে “চারশত” বা “ফোর হান্ড্রেড” বলা হতো, কেননা চারশ জন নিয়েই এই গোষ্ঠীতন্ত্র গঠিত ছিল। এরা স্পার্টাপক্ষীয় ছিল, আর স্পার্টানদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের সাথে শান্তিস্থাপন করতে চাইল, এমনকি স্পার্টান দেয়া যেকোন কঠিন শর্তেও রাজি হতে চাইল। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। এসময়ে সামোসে এথেনীয় নৌবাহিনী ছিল গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল। থ্রেসিবুলাস নামে এথেনীয় নৌবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ক্ষমতা দখল করে নৌবাহিনীর ওপর গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করলেন। এরফলে এথেন্সে কিছু সময়ের জন্য তখন দুইটি এথেনীয় সরকার ছিল, দেশে গােষ্ঠীশাসন আর সাগরে গণতান্ত্রিকরা। স্পার্টার কাছে এথেনীয় গােষ্ঠীশাসনের আত্মসমর্পণ ছিল মূল্যহীন, এই চারশতের গোষ্ঠীতন্ত্র নৌবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে না পারে। আর তাই স্পার্টা চারশতের সাথে বনিবনায় যায়নি। তার ওপর গােষ্ঠীশাসনের হাতে সরকারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং কয়েক মাসের মধ্যে ৫০০০ সদস্যের মধ্যপন্থী গােষ্ঠীশাসন দ্বারা সেটি প্রতিস্থাপিত হলাে। 

আলসিবিয়াডিসের নেতৃত্বে এথেন্সের ফিরে আসা, লাইস্যান্ডার ও সাইরাসের হাতে এথেন্সের পরাজয়

এরই মধ্যে, আলসিবিয়াডিস দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন। আকর্ষণীয় আলসিবিয়াডিস স্পার্টার রাজা দ্বিতীয় এইজিসের স্ত্রীর কাছে খুব আকর্ষণীয় হিসেবে পরিগণিত হলেন। এইজিস তাই এথেনীয়দের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হলেন এবং আলসিবিয়াডিসকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করলেন। ফলে তিনি তিন বছর আগে আলসিবিয়াডিস যেভাবে এথেন্স ত্যাগ করেছিলেন, এবারে খ্রিস্টপূর্ব ৪১২ অব্দেও তিনি তেমনি দ্রুত স্পার্টা ত্যাগ করলেন ও তার বিরুদ্ধে চলে গেলেন। তিনি পারসিক সত্রপ টিসাফারনিজের দরবারে পালিয়ে গেলেন। যখন সামােসের নৌবাহিনী একটি স্বাধীন শক্তিতে পরিণত হলাে, আলসিবিয়াডিস তাদের সাথে সমঝােতা করলেন। থ্রেসিবিউলাসের কাছেও তখন সঙ্গী নির্বাচনের মতো অত বিলাসিতার সুযোগ ছিলনা। আলসিবিয়াডিস ছিলেন সামর্থ্যবান মানুষ, আর তার তখন পারসিকদের ওপর প্রভাব ছিল। থ্রেসিবিউলাস তাকে তাই এথেনীয় শক্তিতে ফেরার আমন্ত্রণ জানালেন এবং তাকে নৌবাহিনীর দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। আলসিবিয়াডিস দ্রুত প্রমাণ করলেন যে তিনি তার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেননি। তিনি ঈজিয়ানে স্পার্টান জাহাজগুলােকে দেখামাত্র পরাজিত করে সেগুলোকে করায়ত্ত করলেন তাদের এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪১০ অব্দে প্রপন্টিসের দক্ষিণ উপকূলে সিজিকাসে স্পার্টান নৌবাহিনীর ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করলেন। স্পার্টা আর পারস্যের শত চেষ্টার পরেও সমুদ্রে এথেন্স পরাশক্তিই রয়ে গেল। এদিকে এথেন্সে গণতান্ত্রিকরা ধীরে ধীরে গােষ্ঠীশাসনের অবস্থানকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল,  যখন সিজিকাসের খবর এথেন্সে পৌঁছল তখন তারা আনন্দে মেতে উঠলেন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৮ অব্দে আলসিবিয়াডিস বিদ্রোহী আর শত্রু দের কাছ থেকে বাইজোন্টিয়ামসহ প্রণালির এলাকা যুক্ত করে আরও কিছু বিজয় অর্জন করলেন, যাতে করে এথেন্সের অস্তিত্ব নিরাপদ রইল। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৭ অব্দে তিনি মনে করলেন, এবারে এথেন্সে ফেরা নিরাপদ। তাকে বন্য আনন্দের সাথে অভ্যর্থনা জানানাে হলাে, পূর্ণ সেনাপতি বানানাে হলাে এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হলাে। এথেন্স তখন ভাবল, জেতার এটাই সুযােগ, আর তাই স্পার্টানদের শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলাে। কিন্তু বিজয়ের সুযােগ ছিল একটি বিভ্রম মাত্র। একে এথেন্স এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তার আর জেতার মত অবস্থা ছিলনা। তাও একটা কথা ছিল যদি এথেন্স আলসিবিয়াডিসের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস আনতে পারত, কিন্তু এথেন্স সেটাও করতে পারেনি। আলসিবিয়াডিসকে পুরােপুরি বিশ্বাস করা কখনও সম্ভবও ছিল না।

এই সময়ে এথেন্সের জন্য সর্বনাশ হিসেবে আবির্ভূত হলাে লাইস্যান্ডার নামে একজন সমর্থ স্পার্টান নৌ-সেনাপতির রূপ ধরে। তার প্রথম দিককার ইতিহাস জানা যায় না, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০৭ অব্দে, যখন সিজিকাসের বিজয়ের পর স্পার্টানরা তাদের নৌবাহিনী পুনর্গঠন করতে সক্ষম হলাে, তখন সবকিছু লাইস্যান্ডারের দায়িত্বেই ছিল। তখন, পারস্যের দ্বিতীয় দারিউস যুদ্ধে পারস্যের অংশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে তার পুত্র সাইরাসকে এশিয়া মাইনরে প্রেরণ করলেন। তরুণ সাইরাস ছিলেন বুদ্ধিমান এবং উদ্যমে পরিপূর্ণ, এক শতাব্দী আগের প্রথম দারিয়ুসের সময়ের পর থেকে পারস্যের সবচেয়ে বড় আশা। এই সাইরাস ‘তরুণ সাইরাস’ বা ‘সাইরাস দ্য ইয়ংগার’ হিসেবেই সাধারণভাবে পরিচিত, যার মাধ্যমে তাকে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’ বা প্রথম সাইরাসের থেকে আলাদা করা হয়। স্পার্টান এডমিরাল খুব দ্রুতই বিত্তশালী সাইরাসের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, এবং সাইরাস তার অর্থ ও লাইস্যান্ডার তার সামরিক সক্ষমতা দিয়ে এথেন্সের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করলেন। লাইস্যান্ডার সতর্কভাবে আলসিবিয়াডিসের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে চললেন, কিন্তু অপেক্ষা করলেন। পরবর্তীতে, আলসিবিয়াডিসকে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক সফরের জন্য তার নৌবাহিনীর বহর ছেড়ে বের হয়ে যেতে হলাে, কারণ এথেন্স বলতে গেলে অর্থশূন্যই হয়ে পড়েছিল। তিনি তার অধীনস্তদের খুব করে সতর্ক করেছিলেন, যাতে তার ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা কোন যুদ্ধেই না জড়ায়। কিন্তু তারা আরও কিছু স্পার্টান জাহাজ ধ্বংস করে গৌরবান্বিত হবার চেষ্টা করা থেকে নিজেদের দমাতে পারেনি। তারা আয়োনিয়ার উপকূলে লাইস্যান্ডারকে আক্রমণ করল এবং বাজেভাবে পরাজিত হলাে। আলসিবিয়াডিস অনেক দেরি করে ফিরলেন এবং এরমধ্যে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গিয়েছিল। 

ঈগােসপোটামির যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে এথেন্সের চূড়ান্ত পরাজয় ও যুদ্ধের সমাপ্তি

এতে তার কোনাে অপরাধ ছিল না, কিন্তু তা কোনাে বিষয় ছিল না। উত্তেজিত এথেনীয়রা বিশ্বাস না করে পারেনি যে আলসিবিয়াডিস আর লাইস্যান্ডারের মধ্যে কোনাে চুক্তি ছিল না, ফলে কার্যালয় থেকে আলসিবিয়াডিসকে সরিয়ে দেয়া হলাে। তৃতীয়বারের মতাে তিনি কোনাে বিপদের জন্য অপেক্ষা না করে চলে গেলেন থ্রেসিয়ান কেরসােনিসের উদ্দেশ্যে যেখানে তার কিছু সম্পত্তি ছিল। আর একবার এথেন্স অ্যাক্রোপোলিসের মন্দিরের সােনা ও রূপার অলঙ্কার গলিয়ে টাকা সংগ্রহ করে আরেকবার নৌবাহিনী গঠন করল। ফলে তাদের আরও একটি সমুদ্র বিজয় পাবার কথা ছিল স্পার্টান এফোরদের কারণে, যারা সবসময়ের মতাে সাফল্যের ব্যাপারে সন্দিহান থেকে লাইস্যান্ডারকে নৌবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৬ অব্দে স্পার্টানরা পরাস্ত হলাে, কিন্তু উত্তাল সাগর জয়ী এথেনীয়দের তাদের ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়াদের উদ্ধার করা থেকে দূরে রাখল। পরিণতিতে অনেক এথেনীয় প্রাণ হারাল। ভালাে যােদ্ধাদের জীবন এই সময়ে এথেন্সের জন্য ছিল অমূল্য সম্পদের মত, এই ক্ষতি বহন করা ছিল এথেন্সের জন্য দুঃসাধ্য। ধারাবাহিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে উন্মত্ততার দিকে ছুটে চলা এথেনীয়রা তাই তাদের নৌ-সেনাপতি বা এডমিরালদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করল এবং পুরােপুরি বেআইনীভাবে তাদের শিরােচ্ছেদ করল। কনন নামে একজন এডমিরাল যুদ্ধের দৃশ্যপটে ছিলেন না। তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন এবং নৌবাহিনীর এডমিরাল হলেন।

এদিকে সাইরাস তার নিজের পরিকল্পনা স্পার্টান বাতুলতার কাছে নষ্ট হতে দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি স্পার্টানদের কাছে লাইস্যান্ডারকে এডমিরালের পদে ফিরিয়ে আনার দাবি তুললেন, আর তাই করা হলাে। দীর্ঘ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এখন শুধু লাইস্যান্ডার বনাম কননই থাকল। তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ অবিরত রাখলেন, আর অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪০৫ অব্দে থ্রেসিয়ান কেরসােনিসের ঈগােসপোটামিতে সবকিছু পরিণতি দেখা গেল। এথেনীয় নৌবাহিনী তার রণতরীগুলােকে এমন একটি বিপজ্জনক অবস্থান নােঙ্গর করার জন্য বেছে নিল, যেখান থেকে তারা খুব সহজেই আক্রমণের শিকার হতে পারে এবং শত্রুদের প্রতিহত করার উপায়ও তেমন নেই। তখনাে নির্বাসনে থাকা আলসিবিয়াডিস কাছেই বাস করতেন। সম্ভবত এবার তিনি তার জীবনে প্রথমবারের মতাে একটি নিঃস্বার্থ কাজ করলেন। তিনি উপকূলে এসে এথেনীয়দের সতর্ক করলেন যে তাদের এই অবস্থান খুবই বিপজ্জনক। তিনি এথেনীয়দেরকে তাদের আয়ােজন পরিবর্তন করতে বললেন। কিন্তু তাকে শীতল কণ্ঠে জানিয়ে দেওয়া হলাে যে এথেনীয় নৌবাহিনী কোনাে বিশ্বাসঘাতকের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে না। কয়েকদিন পর লাইস্যান্ডার আচমকিতে আক্রমণ করলেন। কননের জাহাজ সহ বিশটি জাহাজ পালিয়ে দূরবর্তী সাইপ্রাসে চলে যেতে সমর্থ হলাে। বাকি সব এথেনীয় জাহাজ কোনাে যুদ্ধ ব্যতিরেকেই স্পার্টানদের দখলে নিয়ে নেয়া হলাে এবং নাবিকদের হত্যা করা হলাে। ঈগােসপোটামির যুদ্ধের মাধ্যমেই পেলােপনেসাসের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাল। এথেনীয়দের আর যুদ্ধের জন্য দেবার মতাে আর কিছুই ছিল না। তাদের তরুণদের পুরাে একটি প্রজন্মকে হত্যা করা হয়ছে, তাদের শেষ রণতরীও চলে গেছে, মন্দিরের স্বর্ণালঙ্কারসহ তাদের শেষ পয়সাটিও খরচ হয়ে গেছে, তাদের প্রতিরােধ করার শেষ ইচ্ছাও তিরােহিত হয়ে গেল।

লাইস্যান্ডার উত্তর ঈজিয়ান আর প্রণালির শহরগুলােকে কাবু করে ফেললেন, আর তাতে এথেন্সের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। যখন স্পার্টান নৌবাহিনী খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে পাইরিয়াতে আবির্ভূত হলাে, তখন এথেন্সকে অবশেষে তিক্ত সত্যের মুখােমুখী হতে হলাে, আর তারা একেবারে অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করল। স্পার্টানদের কিছু মিত্র এথেন্সকে পুরােপুরি ধ্বংস করে দিতে এবং তাদের জনগণকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে পরামর্শ দিল, কিন্তু স্পার্টা এই শেষ সময়টাতে এথেন্স সালামিস আর ম্যারাথনে গ্রিসের জন্য কী করেছে তা স্মরণে রাখল এবং ক্ষিপ্ত থিবানদের প্রতিবাদের মুখে এথেনীয়দের টিকে থাকার সুযােগ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে এথেন্সের লম্বা দেয়াল ভেঙে ফেলা হলাে এবং এথেন্সকে একটি গােষ্ঠীশাসনের অধীনে নিয়ে আসা হলাে। ঐ একই বছরে স্পার্টান প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতে পারসিক এলাকায় সুরক্ষার অনুসন্ধান করা আলসিবিয়াডিসকে সেখানেই গুপ্তহত্যা করা হলাে, সম্ভবত পারসিকরাজের আদেশেই তা করা হয়েছিল। ঐ বছরেই ইতিহাসবিদ থুকিডাইডিস তার দীর্ঘ নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। তবে থুকিডাইডিস তার পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস লেখার কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি, তিনি মাত্র ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্তই লিখেছিলেন।

স্পার্টার আধিপত্য ও পতন

পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পর এথেন্স, টাইরানী থেকে গণতন্ত্র ও সক্রেটিসের মৃত্যু

স্পার্টা তখন পুরাে গ্রিসে ছিল একক ক্ষমতাধর এবং পুরাে এক প্রজন্ম ধরে একক ক্ষমতাধরই ছিল। এই সময়টা স্পার্টান হেজিমনি নামে পরিচিত। হেজিমনি শব্দটা একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ “নেতৃত্ব”। কিছু কালের জন্য লাইস্যান্ডার স্পার্টায় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন, এর অর্থ তিনি সমগ্র গ্রিসেই তখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন। তিনি সকল স্থানে ওলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। গােষ্ঠীশাসন ছিল নিষ্ঠুরতম শাসন এবং একই সাথে এথেন্সে বরাবরই এটি ছিল দুর্বলতম। সেখানে এটি ছিল তিরিশজনের অধীনে ক্রিশিয়াসের নেতৃত্বে, যাদেরকে “থার্টি টাইরান্ট” বলা হত। ক্রিশিয়াস ছিলেন প্রায় আরেকজন আসিবাইডিস। তিনি ছিলেন মেধাবী, বুদ্ধিমান ও উদ্যমী। তাকে, আলসিবিয়াডিসের সাথে সাথে, ধর্মীয় মূর্তি ভাংচুরের ঘটনায় সন্দেহ করা হয় এবং এই কারণে কিছু সময়ের জন্য কারাবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তিনি আলসিবিয়াডিসকে ফিরিয়ে আনার জন্য সামােসে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০৭ অব্দে নির্বাসিত করা হয় তাকে। তার নির্বাসনকালে তিনি থেসালীতে বাস করতেন এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঈগোসপোটামির পর যখন তিনি এথেন্সে ফিরে এলেন, তখন তিনি গণতন্ত্রের ব্যাপারে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। একজন গােষ্ঠীশাসকে পরিণত হয়ে তিনি দ্রুত খেয়াল করলেন যে, তিনি পিছিয়ে আসতে পারবেন না। কিন্তু আরও বেশি করে সংঘাতপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন।

তিনি ক্ষমতা দখল করে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিকদের এথেন্স থেকে তাড়ানো এবং অন্যদের হত্যা করার মাধ্যমে আতঙ্কের যুগ শুরু করলেন। তিনি তার নিজের দলের সেইসব লােককেও হত্যা করেছিলেন, যাদের তিনি বেশি নরম মনে করেছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যে, তিনি এথেনীয়দের স্বাধীনতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে দেখালেন স্বাধীনতা আসলে কী ছিল। যাদেরকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন থ্রেসিবিউলাস, সাত বছর আগেও যিনি ছিলেন সামােসের গণতান্ত্রিক নৌবাহিনীর নেতা। এখন তিনি অ্যাটিকায় একটি দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে আরও কিছু নির্বাসিতকে জড়াে করে এথেন্সের এগার মাইল উত্তরের ফিলি দুর্গ দখল করলেন। গােষ্ঠীশাসকেরা দুইবার ফিলি থেকে গণতান্ত্রিকদের উৎখাত করার চেষ্টা করলেন এবং দ্বিতীয় লড়াইয়ে ক্রিশিয়াস খুন হন। থ্রেসিবিউলাস পাইরিয়াসের সর্বত্র ক্ষমতা লাভ করলেন, যেখানে গণতান্ত্রিকেরা সবসময় এথেন্সের থেকেও শক্তিশালী ছিল। অবশিষ্ট গােষ্ঠীশাসকরা স্পার্টার প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানাল, এবং লাইস্যান্ডার থ্রেসিবিউলাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে প্রস্তুতি নিলেন। যা গণতান্ত্রিকদের বাঁচিয়ে দিল তা হলাে স্পার্টার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। লাইস্যান্ডার স্পার্টান রাজা বা এফোরদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ছিলেন অধিকমাত্রায় সফল, এই সাফল্যে তিনি উদ্ধত হয়ে উঠলেন। স্পার্টার রাজা পসানিয়াস, এফোরদের সঙ্গে চুক্তি করে, নিজেকে লাইস্যান্ডারের স্থলাভিষিক্ত করলেন এবং তিনি গােষ্ঠীশাসকদের মােটেই রক্ষা করেননি, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০৩ অব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি এথেনীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে রাজি হলেন, আর এইভাবে তিনি এক শতাব্দী আগের প্রথম ক্লিওমিনিসের ভূমিকা পালন করলেন। 

গােষ্ঠীশাসকদের জন্য এটি একটি রক্তাক্ত ও দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা ছিল; এবং যদিও দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল, তবুও এই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র সামান্য গণতন্ত্র-বিরোধীদের জন্যেও তিক্ত হয়ে ওঠে। এই ব্যাপারটিই এথেনীয় গণতন্ত্রকে একটি দুর্ভাগ্যজনক কাজ করতে তাড়িত করে, আর তা হলো সক্রেটিসের হত্যা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ অব্দে জন্ম নেওয়া সক্রেটিস ছিলেন সাধারণ মানুষ, পরবর্তী জীবনে দরিদ্র, যিনি অনেক এথেনীয়ের হৃদয় জয় করেছিলেন, ধনসম্পদ আর সৌন্দর্য দিয়ে নয়, বরং গুণাবলি আর প্রজ্ঞা দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক যিনি কালসিডিসে লড়াই করেছিলেন। ডিলিয়াসের লড়াইয়ে তিনি আলসিবিয়াডিসের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। সক্রেটিস তার জীবন শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি এমনকি এনাক্সাগােরাসের অধীনে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু, উন্মত্ততা আর ধ্বংস সহকারে পেলােপনেসাসের যুদ্ধের আগমণ তাকে নিশ্চিত করল যে, বিশ্বজগৎ নয়, মানুষ হলাে মানুষের শত্রু, আর তাই বিশ্বজগৎ পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনের বাকি অংশে তিনি মানুষের বিশ্বাস ও জীবনপদ্ধতি বিবেচনা করে দেখেছেন। তিনি সদগুণ আর ন্যায়পরায়ণতার অর্থ আলােচনা করেন; কোথায় সত্যিকার প্রজ্ঞা রয়েছে তিনি সেটি বিবেচনা করে দেখতেন এবং এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তার অনুরক্ত শিষ্যদের জড়াে করতেন, এবং ব্যাখ্যা করার চেয়ে, তিনি প্রশ্ন করতেন। যাদের সাথে তিনি বিভিন্ন ব্যাপার ঠিকঠাক করার মতাে আলােচনা করেছিলেন, তিনি তাদের প্রশ্ন করতেন এবং ব্যাখ্যা করতেন ন্যায়পরায়ণতা বা সদগুণ বা প্রজ্ঞা বলতে তারা কী বােঝে। তখন, আরও প্রশ্ন করার মাধ্যমে, তিনি প্রকাশ করতেন যে বিষয়াবলি আসলে সহজ নয়; অর্থাৎ যা সত্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে তা আসলে এতটা নিশ্চিত নয়। যা মনে করা হয়, এমনকি সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য মতামতও সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে সমালােচনাপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দাবি করে। তিনি বলেন, “অপর্যবেক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যােগ্য নয়”। এলিয়ার জেনাের মতাে সক্রেটিসের কাছেও ডায়ালেকটিকই ছিল আসল জিনিস। বিতর্ক উত্থাপিত হত সত্য আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যে, এবং অন্য সফিস্টদের মতাে শুধু নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য নয়। 

সক্রেটিস তার বিরােধীদের নিরস্ত্র করতেন নিজে অজ্ঞতার অভিনয় করে এবং তাদেরকে তাকে নির্দেশনা দান করতে। তারপর তার বিরোধিদের দেয়া নির্দেশনা এগোতে এগোতে তারা গভীর ফাঁদে পড়ে যেত। একটি গল্প আছে, ডেলফির ওরাকল ঘােষণা করেছিল যে সক্রেটিস জ্ঞানীদের মধে সর্বশ্রেষ্ঠ, আর সক্রেটিস প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন যে, যদি তিনি অন্যদের চেয়ে জ্ঞানী হয়ে থাকেন, তা হয়েছে কারণ সব লােকের মধ্যে তিনিই একমাত্র জানেন যে, আসলে তিনি কিছুই জানেন না। এই না জানার আলোকে বলে “সক্রেটিক আয়রনি”। সক্রাটিসের শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন এরিস্টোক্লিস, যিনি সাধারণভাবে তার ডাকনাম প্লেটোতেই পরিচিত। সক্রেটিস কখনাে তার আদর্শকে লিখে রাখেননি, কিন্তু প্লেটো সক্রেটিসের সাথে অন্যদের আলােচনার বর্ণনা তুলে ধরে একটি আকর্ষণীয় সিরিজ লেখেন। এগুলাে হলাে প্লেটোর “ডায়ালগস”। এই ডায়ালগসে সক্রেটিস যাদের সাথে আলচনা করেছিলেন তাদের অনেকের নাম পাওয়া যায়। যেমন এদের মধ্যে একজন ছিলেন সফিস্ট গরজিয়াস অফ লিওন্টিনি। সেই আলােচনায়, সক্রেটিস সরকারের ভেতর নৈতিকতার আহ্বান জানান এবং ন্যায়পরায়ণ এরিস্টাইডিসকে এথেনীয় গণতন্ত্রের এক অনন্য নেতা হিসাবে বর্ণনা করেন। সেখানে সফিস্ট প্রােটাগােরাসের কথাও আছে। সক্রেটিস আর সফিস্ট প্রােটাগােরাস সদগুণের প্রকৃতি সম্মন্ধে বিতর্ক করেন এবং আলােচনা করেন যে এসব শেখানাে যায় নাকি যায়না। ডায়ালগগুলোর সবচেয়ে বিখ্যাতগুলোর মধ্যে একটি ছিল মদ্যপানের আসরের ডায়ালগ। এটাই ছিল “সিম্পোজিয়াম”, যার অর্থ হচ্ছে একত্রে মদ্যপান করা। সেখানে ভালোবাসার প্রকৃতি নিয়ে সাধারণ আলোচনা সংঘটিত হয়েছিল। এই আলোচনায় সেই ধরনের ভালােবাসাই সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত যেখানে ভালোবাসার বিষয় ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি, কিন্তু শারীরিক সৌন্দর্যযুক্ত ব্যক্তি নয়। আজও আমরা এই ভালোবাসাকে “প্লেটোনিক লাভ” বলি।

সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গি সকল এথেনীয়কে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।  তিনি কোন বিষয়ে আলোচনার সময় লোকজনকে বিচলিত করে দিতেন। এরপর তিনি তাদের কথা দিয়েই তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিতেন। এছাড়া তিনি প্রাচীন গ্রিক ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, যার ফলে অনেক রক্ষণশীল তাকে অধার্মিক ভাবেন, তারা মনে করেন যে সক্রেটিস এথেন্সের তরুণদের নষ্ট করে দিচ্ছেন। রক্ষণশীল ব্যঙ্গকারী এরিস্টোফেনিস  ৪২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে “দ্য ক্লাউডস” নামে একটি নাটক লেখেন, যেখানে তিনি সক্রেটিসকে নিয়ে অনেক তিক্ত ব্যাঙ্গ করেন। সক্রেটিস রক্ষণশীলদের মধ্যে খুব কুখ্যাত ছিলেন ঠিকাছে, কিন্তু তাই বলে গণতান্ত্রিকদের কাছে তিনি খুব একটা বিখ্যাতও ছিলেন না। সক্রেটিসকে তারা স্পার্টা-পক্ষীয় বলে মনে করেছিল। তাই, প্লেটোর দীর্ঘতম ডায়ালগ, “দ্য রিপাবলিক”-এ “ন্যায়বিচার কী?” এই প্রশ্নে সক্রেটিসের চিন্তাধারাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এই আলোচনায় “আইডিয়াল সিটি” বা “আদর্শ নগর” সম্পর্কে সক্রেটিস যে ধারণা দেন, সেখানে গণতন্ত্রের ধাচ খুব কমই ছিল, আর অনেকটাই ছিল স্পার্টার শাসনব্যবস্থার মত। আবার তার শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই এথেন্সের অনেক বড় ক্ষতি করেছিলেন। এদের একজন ছিলেন আলসিবিয়াডিস, যিনি ছিলেন “সিম্পোজিয়ামের” একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আরেকজন ছিলেন ক্রিশিয়াস নিজেই, যিনি থার্টি টাইরান্টস এর নেতা ছিলেন। প্লেটোর একটি ডায়ালগ “ক্রিশিয়াস” নামে পরিচিত। এখানে ক্রিশিয়াস আটলান্টিকের একটি দ্বীপের কথা বলেছেন, অনেক দিন আগে আটলান্টিক মহাসাগরে যার অস্তিত্ব ছিল। এটি ছিল উচ্চমাত্রায় সুসভ্য, কিন্তু একটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে এটি সমুদ্রগর্ভে পতিত হয়। এটা নিশ্চিত যে প্লেটো এই গল্পটি একটি কল্পকাহিনী হিসেবেই লিখেছেন, যার মাধ্যমে তিনি আদর্শ নগর সম্পর্কিত ধারণা দিতে পারেন। কিন্তু তখন থেকে অনেক লোকই আটলান্টিস নামে এক নগরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এসেছেন।

যাই হোক, সক্রেটিসকে শেষমেশ খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে পাঁচশত লােকের জুরির সামনে উপস্থিত করা হয় এবং অধার্মিকতা ও তরুণদের নষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, যদিও ধারণা করা হয় যে, তার আসল অপরাধ ছিল গণতন্ত্র-বিরােধিতা। সক্রেটিস সম্ভবত নির্দোষ বলে প্রমাণিত হতেন যদি না তিনি জুরিদের ওপর সক্রেটিসিয় পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন। ফলে তিনি তাদেরকে অসন্তুষ্ট করেন ও ২৮১-২২০ এর সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তিনি দোষী প্রমাণিত হন। সেই সময় দোষী ব্যক্তিকে হেমলক পান করানাের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত। হেমলক ছিল একটি বিষাক্ত লতা যা কোনাে ব্যথা ছাড়াই মৃত্যু নিয়ে আসে। ধর্মীয় কারণে সক্রেটিসের হেমলক পান করার জন্য ত্রিশ দিন দেরি ছিল। সেই বিরতিতে তিনি নিশ্চিতভাবেই পালিয়ে যেতে পারতেন; তার বন্ধুরা সব আয়ােজন সম্পন্ন করে রেখেছিল, এবং গণতান্ত্রিকেরাও বিষয়টা অন্যভাবে দেখে সন্তুষ্ট থাকত। কিন্তু, সক্রেটিস ছিলেন সত্তর বছরের বৃদ্ধ, আর ছিলেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তাই তিনি সারাজীবনের নীতির প্রতি এবং আইনের প্রতি অবিচল থাকতে চাইলেন, এমনকি সেই আইন অন্যায় হলেও। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো দুঃখ আর বেদনায় এথেন্স ত্যাগ করেন এবং প্রথমে মেগারা ও পরে সিসিলিতে গিয়ে অবস্থান করেন। তিনি সম্ভবত ভেবেছিলেন যে তিনি চিরতরে এথেন্স থেকে দূরে থাকবেন, কিন্তু তিনি অতি দ্রুত আবিষ্কার করলেন যে, পৃথিবী অনেক কঠিন এবং সব শহরেই মানুষই বােকা। তাই তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ অব্দে এথেন্সে ফিরে এলেন এবং এথেন্সের ঠিক বাইরের ভূমির ওপর একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। এই ভূমিটিকে এবং স্কুলটিকে আমাদের উচ্চারণে বলা হয় “একাডেমি”। 

পারস্যে গৃহযুদ্ধ, টেন থাউস্যান্ডস ও জেনোফোন

পারস্যের রাজপুত্র সাইরাস দ্য ইয়ংগার যেমনটা চেয়েছিলেন তাই হলো। তার কাছে যেন একেবারে ঠিক সময়টাতেই এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যকার সুদীর্ঘ ২৮ বছরব্যাপী পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। তবে সাইরাস কিন্তু স্পার্টানদেরকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেননি। তার মাথায় কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। আর এই পরিকল্পনাকে সার্থক করার জন্য তার কিছু নির্ভরযোগ্য গ্রিক সৈন্যের দরকার ছিল। তার পিতা দ্বিতীয় দারিয়ুস তাকে গ্রিসের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পাঠিয়েছিল, যাতে এর মাধ্যমে দুর্বল গ্রিসের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে এথেন্সের আত্মসমর্পণের বছরেই দ্বিতীয় দারিউসের মৃত্যু হয়। তার পরিকল্পনামাফিক আর পারসিকদের এগোনো হয়নি। কিন্তু এবার সাইরাস দ্য ইয়ংগার এক নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এই যুদ্ধের ফল ভোগ করতে চাইলেন। দ্বিতীয় দারিউসের মৃত্যুর পর পারস্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সাইরাসেরই বড় ভাই। দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেস নাম নিয়ে তার রাজ্যাভিষেক হয়েছে। কিন্তু কোন চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আরতাজারেক্সেস তদকালীন বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর আসনটি কব্জা করবেন, এটা সাইরাস কিছুতেই মেন নিতে পারেননি। তিনি পারস্যের সিংহাসন লাভের জন্য তার ভাইকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন ও সেই উদ্দেশ্যে সৈন্য জোগাড় করা শুরু করেন। তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রিক হপলাইটদের জোগাড় করতে পারলে তাদের দিয়ে এশীয় বাহিনীকে পরাজিত করে পারস্য সাম্রাজ্যকে কব্জা করা কঠিন হবেনা। উল্লেখ্য, সে সময়ে গ্রিক সৈন্যরাই ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শক্তি, পারস্য সহ এশিয়ার কোন শক্তিই তাদের সামনে টিকতে পারত না। আর ভূমিতে স্পার্টানরা তো ছিল সেরাদের সেরা। সেনাবাহিনী গঠনে সাইরাসকে বেগ পেতে হলো না। তার সাথে স্পার্টার লাভজনক চুক্তি হয়েছিল, আর পারস্যের সিংহাসনে একজন স্পার্টা-পক্ষীয় শাসক বসলে তাদেরই লাভ ছিল। তাই স্পার্টাও সাইরাসের পরিকল্পনামাফিক কাজই করল। এদিকে সে সময়ে গ্রিসের প্রজন্মটি ছিল সৈন্যতে ভরপুর, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের জন্যই এই প্রজন্মকে সৈন্য হিসেবে দীক্ষিত করা হয়েছে। সৈন্যের জীবিকা ছেড়ে নাগরিক জীবনে ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা এদের ছিলনা। যুদ্ধের ফলে গ্রিসের নগরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এরা সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরেও অভ্যস্ত হতে চায়নি। তাই যারা তাদেরকে অর্থ দিতে পারবে তাদেরকে সামরিক সেবা দিতে তারা আগ্রহী ছিল। সাইরাস ১০,০০০ এরও বেশি গ্রিক সৈন্য ভাড়া করলেন। লােকমুখে এরা পরবর্তীতে “দশ হাজার” বা “টেন থাউস্যান্ড” নামে পরিচিত হয়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন স্পার্টান সেনাপতি ক্লিয়ারকাস। পদপ্রাপ্ত বা র‍্যাংকপ্রাপ্ত সৈন্যদের মধ্যে একজন এথেনীয়ও ছিলেন। তিনি ছিলেন জেনোফোন, যিনি ছিলেন সক্রেটিসের একজন অনুগত শিষ্য।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০১ অব্দের বসন্তে এই টেন থাউস্যান্ড এশিয়া মাইনর থেকে ইসুসের উপসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হলো। জায়গাটা ছিল ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে উত্তর-পূর্বের কোনা। সাইরাস ক্লিয়ারকাস ছাড়া এই টেন থাউস্যান্ডের কাউকেই তার পরিকল্পনার ব্যাপারে জানায়নি, তারা জানতই না যে তারা গ্রিসের কোথাও লড়তে যাচ্ছে না, বরং যাচ্ছে সুদূর পারস্যে। কিন্তু এখন তারা যে পথ ধরে যাচ্ছিল তার ফলে বাহিনীর সবচেয়ে বোকা সৈন্যটিও বুঝে ফেলেছিল যে তারা তাদের চেনা গ্রিক জগৎ ছেড়ে অজানা পারস্যের দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কেবল হুমকি বা মিষ্টি কথা বা আরও বেশি অর্থ দিয়েই তাদেরকে অগ্রসর করানো যেত। শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হলো। তারা ইউফ্রেতিস নদীর কাছে পৌঁছে গেল এর তীর বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৫০০ মাইলেরও বেশি অগ্রসর হয়ে ৪০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীষ্মে কিউনাক্সা (Cunaxa) নগরে পৌঁছে গেল, যা ছিল ব্যাবিলন থেকে ৮৭ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। সেখানে সাইরাস দ্য ইয়ঙ্গারকে প্রতিহত করার জন্য তদকালীন পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেসের অনুগত সেনাবাহিনীকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সাইরাসের একটা উদ্দেশ্যই ছিল, আর তা হলো তার ভাই দ্বিতীয় আরতাজারেক্সেসের মৃত্যু। কিন্তু তার ভাইয়ের সেনাবাহিনী নিয়ে তার কোন সমস্যা ছিলনা, কেননা তিনি তার ভাইকে হত্যা করে একবার পারস্যের সিংহাসনে বসলে এই অনুগত সেনাবাহিনী তাকেই সম্রাট হিসেবে মেনে নেবে। তাই তিনি স্পার্টান সেনাপতি ক্লিয়ারকাসকে এই সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে না জড়িয়ে সরাসরি পারস্যের কেন্দ্রে গিয়ে আরতাজারেক্সেসকে আক্রমণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু একজন আদর্শ স্পার্টানের মত ক্লিয়ারকাসও ছিলেন সাহসী ও বোকা। তিনি সাইরাসের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। তিনি গোঁ ধরলেন, যুদ্ধ তিনি অর্থোডক্স স্পার্টান কায়দাতেই করবেন, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাদলকে ঘায়েল করেই তিনি বিজয় অর্জন করবেন। ফলে যা হবার তাই হলো, যুদ্ধও হলো, আর স্পার্টানরা এশীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হওয়ায় জয়ও তারাই পেল। কিন্তু আরতাজারেক্সেসের এতে কিছুই হলোনা। বডিগার্ডদের সুরক্ষার ভেতরে থেকে তিনি জীবিতই রইলেন। এটা দেখে সাইরাস প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। আরতাজারেক্সেসই যদি না মরেন তাহলে এই যুদ্ধে জিতে লাভ কী হলো। কোন রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই তিনি সোজা তার ভাই ও সম্রাট আরতাজারেক্সেসের দিকে চার্জ করলেন। আর্তাজারেক্সেস বডিগার্ডদের সুরক্ষায় ছিলেন, তাকে কিছু করতে হলোনা, বডিগার্ডরাই সাইরাসকে হত্যা করল।

এদিকে গ্রিকরা তো যুদ্ধে জিতল, কিন্তু যার জন্য তাদের যুদ্ধ করা সেই সাইরাসই তো অক্কা পেয়েছে, এখন তাদেরকে পে করবে কে? তারা তাদের দেশের বাড়ি ছেড়ে ১১০০ মাইল দূরে চলে এসেছে, আর তাদের ঘিরে রেখেছে এক শত্রুভাবাপন্ন পারস্য সেনাবাহিনী। এদিকে পারস্য বাহিনীরও হয়েছে আরেক জ্বালা। এই দশ হাজারেরও বেশি শক্তিশালী গ্রিক সৈন্যদেরকে তারা আক্রমণ করার সাহস জোগাতে পারছে না। তখন পারস্যের সত্রপ টিসাফেরনেস এই গ্রিক সেনাবাহিনীর কাছে এলেন। টিসাফেরনেসের সাথে গ্রিকদের সম্পর্ক ভাল ছিল, পেলোপনেসাসের যুদ্ধে তিনি স্পার্টানদের সহায়তা করেছিলেন। এই বিশ্বাসকে ব্যবহার করেই তিনি স্পার্টান জেনারেল ক্লিয়ারকাসের সাথে আলোচনায় যেতে চাইলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিসারফেরনেস ছিলেন আরতাজারেক্সেসের সমর্থক ও সাইরাসের বিরোধী। টিসারিফেরনেস ক্লিয়ারকাসকে তার তাঁবুতে আসতে বললেন, যেখানে তার সাথে তিনি যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। বেচারা ক্লিয়ারকাস ভাল মনেই রাজি হলেন, তার সাথে আরও চারজন জেনারেলও টিসারফেরনেসের তাঁবুতে প্রবেশ করল। কিন্তু এরপর ঠাণ্ডা মাথায় পারসিকরা এই গ্রিক সেনাপতিদেরকে হত্যা করল। টিসারফেরনেস একেবারে নিশ্চই ছিলেন যে কোন নেতৃত্ব ছাড়া এই সেনাবাহিনী হয় আত্মসমর্পণ করবে, তাতে হয়তো তারা পারস্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, অথবা তারা নেতৃত্বহীন অনিয়ন্ত্রিত জনতায় পরিণত হবেন যাদেরকে সহজেই পরাজিত করা যাবে। কিন্তু টিসারফেনেসের পরিকল্পনামাফিক কিছুই হলোনা। হলোনা, কারণ এই টেন থাউস্যান্ড এর মধ্যে ছিলেন জেনোফোন নামে এক এথেনীয়। এবার তিনিই এই দশ হাজারের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। তার নেতৃত্বেই এই গ্রিক সেনাবাহিনী তাদের নিজ ভূমি গ্রিসের দিকে ফিরে চলল। কিন্তু আগের ইউফ্রেতিস বরাবর পথ দিয়ে তারা যেতে পারল না, কেননা পারসিকরা সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে তাদেরকে এখন যেতে হবে এক সম্পূর্ণ নতুন ও অচেনা পথ দিয়ে, যার সম্পর্কে তারা কিছুই জানেনা। 

তারা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে তাইগ্রিস নদীর তীরে পৌঁছল, আর তারপর তাইগ্রিস বরাবর উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকল। পথিমধ্যে তারা নিনেভের ধ্বংসাবশেষে পৌঁছল, যা এককালে ছিল শক্তিশালী আসিরীয় সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানী। মাত্র দুই শতাব্দী আগে একে ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু এখন এটা এতটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত যে এই স্থানটি আসলে কিসের ধ্বংসাবশেষ তার সম্পর্কে জানতে তাদেরকে আশপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করতে হলো। সুদীর্ঘ পাঁচ মাস যাবৎ তারা এগিয়েই চলল। পথিমধ্যে তাদেরকে পারস্যের সেনাবাহিনী ও আদিবাসীদের আক্রমণকেও বারবার প্রতিহত করতে হয়েছে। এভাবে চলতে চলতে অবশেষে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ফেব্রুয়ারিতে তারা গ্রিক নগর ট্রাপেজাসে (Trapezus) পৌঁছল, যার পরেই ছিল কৃষ্ণসাগর। গ্রিকরা ছিল সামুদ্রিক জীবনে অভ্যস্ত। তাই যে গ্রিক ব্যক্তিটি পারস্য সাম্রাজ্যের হাজার মাইলের কঠোর ও রুক্ষ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তার কাছে সেটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা, সেই ব্যক্তি যদি এতদিন পর হঠাৎ করে সমুদ্র দেখতে পায় তাহলে তার আনন্দেরও আর বাঁধ থাকেনা। তারা “থালাসা! থালাসা!” (বা “সাগর! সাগর!”) বলে চিৎকার করতে করতে সমুদ্র তীরের দিকে ছুটে গেল।

জেনোফোনের অভিযান সমাপ্ত হলো। তিনি ফিরে এলেন তার স্বদেশভূমি এথেন্সে। কিন্তু ফিরে এসে তিনি কী দেখলেন? দেখলেন, যে এথেনীয় গণতন্ত্রকে তিনি এতদিন শ্রদ্ধা করে এসেছেন, যে এথেনীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য তিনি শপথ নিয়েছিলেন সেই গণতন্ত্রই তার প্রিয় গুরু সক্রেটিসকে হেমলক পান করিয়ে হত্যা করেছে। এই ঘটনা তার মনকে এথেনীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিঁষিয়ে দিল। তাই সতীর্থ প্লেটোর মত এথেনীয় গণতন্ত্রে বিতৃষ্ণ হয়ে তিনিও এথেন্স ত্যাগ করলেন। কিন্তু প্লেটো যেমন হতাশ হয়ে আবার এথেন্সে ফিরে এসে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি তা করেননি। জেনোফোন আর কোনদিনই এথেন্সে ফিরে আসেননি। তিনি পুরোপুরি স্পার্টান হয়ে যান। তিনি স্পার্টানদের সাথেই থাকতেন, এমনকি স্পার্টানদের হয়ে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতেন। তিনি টেন থাউস্যান্ড বা দশ হাজার গ্রিক সৈন্যের সেই অভিযানের কাহিনী নিয়ে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটি “অ্যানাবেসিস” (Anabasis) নামে পরিচিত। অ্যানাবেসিসের অর্থ হচ্ছে আপ-গোয়িং, অর্থাৎ চড়াই পথে গমন। গ্রিক অঞ্চল ছিল সমুদ্র তীরবর্তী তাই এই অঞ্চল ছিল নিচুতে, আর পারস্য অঞ্চল ছিল পাহাড়ময়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পারস্যের ভূমি তুলনামূলভাবে উঁচুতে। তাই গ্রিস থেকে পারস্যে যাবার পথ ছিল চড়াই এর পথ। আর তাই জেনোফোনের এই গ্রন্থের নাম দেন অ্যানাবেসিস। মিলিটারি হিস্টোরি বা সামরিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি হলো একটি ক্লাসিক। তবে জেনোফোন শুধু এই অ্যানাবেসিসই রচনা করেননি। থুকিডাইডিস ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অব্দি যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেই মারা যান। ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যুদ্ধের অবশিষ্ট ইতিহাস রচনা করে থুকিডাইডিসের কাজটি সমাপ্ত করেন আরেক প্রাক্তন এথেনীয়, এই জেনোফোন। তবে তার রচনা থুকিডাইডিসের মত নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ছিলনা। পেলোপনেসীয় যুদ্ধ কেবল নগর এথেন্সের বিরুদ্ধে নগর স্পার্টার যুদ্ধ ছিলনা। এই যুদ্ধ একই সাথে ছিল দুই শাসনপদ্ধতির যুদ্ধ, ছিল স্পার্টান গোষ্ঠীতন্ত্রের বিরুদ্ধে এথেনীয় গণতন্ত্রের যুদ্ধ। যুদ্ধে যে অঞ্চল স্পার্টা জিতত সেই অঞ্চলে তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত, আর যে অঞ্চল এথেন্স জিতত সেখানে এথেন্স তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত। অধিপতি নগররাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার আধিপত্যের নিশ্চয়তার উপায়, আর বিজিত নগররাষ্ট্রের দ্বারা বিজয়ী নগররাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি গ্রহণ ছিল বিজয়ীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যম। যে এথেনীয় গণতন্ত্র জেনোফোনের হৃদয়কে বিঁষিয়ে দিয়েছিল তার ইতিহাস তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে রচনা করতে পারেননি। তার লেখনি ঝুঁকে যায় স্পার্টা ও স্পার্টার গোষ্ঠীতন্ত্রের দিকে। তিনি ইতিহাস দিয়ে ঋণী করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই ইতিহাসে আমরা এথেনীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও স্পার্টান গোষ্ঠীশাসনের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ঠতা দেখি। কিন্তু তবুও জেনোফোনের লেখা এই ইতিহাস আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। কারণ তার এই রচনাটি ছাড়া সেই দিনগুলোর বিবরণ নিয়ে আর কোন ভাল রচনা নেই।

পারস্য ও থিব্‌সের বিরুদ্ধে স্পার্টার যুদ্ধ 

টেন থাউস্যান্ড বা দশ হাজারের এই অভিযাত্রা নিছকই একটি অভিযাত্রা ছিলনা। এটা ছিল অভিযাত্রার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। রাজকুমার সাইরাস দ্য ইয়ংগার যেন পারস্যের আলসিবিয়াডিস হিসেবে পরিগণিত হলেন। পেলোপনেসাস যুদ্ধে এথেনীয় জেনারেল ও শাসক আলসিবিয়াডিস যেভাবে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য শত্রুপক্ষ স্পার্টার পক্ষ নিয়ে নিজ মাতৃভূমি এথেন্সের দুর্বলতাই তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে তাদেরকে জয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, একই কাজ সাইরাস দ্য ইয়ংগারও করলেন মাতৃভূমি পারস্যের বিরুদ্ধে। স্বল্পকালীন সময়ের জন্য পারস্যকে গ্রিকদের মিত্র বলে মনে হলেও ভেতরে ভেতরে এরা সবসময়ই ছিল একে অপরের শত্রু। আর এই টেন থাউস্যান্ড এর অভিযাত্রাটি গ্রিকদের কাছে পারস্যের দুর্বলতাকে প্রচণ্ডভাবে প্রকট করে তুলল। আর মাতৃভূমির এই দুর্বলতা যেন আলসিবিয়াডিসের মত সাইরাস দ্য ইয়ংগারও শত্রু গ্রিক জগৎকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। আর সেটা কেবল পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিকদের জয়ের জন্য নয়। গ্রিকরা তো এর আগেও পারস্যের সেনাবাহিনীকে অনেকবার পরাভূত করেছে। কিন্তু এভাবে মাত্র দশ হাজার জনের একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী নিয়ে নিজ ভূম থেকে শত শত মাইল দূরে গিয়ে তদকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি পারস্যের নিজ অঞ্চলেই ঢুকে তাদেরকে পরাজিত করে আবার নিরাপদে গ্রিসে ফিরে আসা… গ্রিকদের কাছে এটা স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড় কিছু ছিল। এই অভিযাত্রা গ্রিকদের কাছে পরিষ্কার করে দেয় যে, পারস্য সাম্রাজ্যকে আপাতভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী বলে মনে হলেও তাদের কাছে এটা একটি দুর্বল রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই নয়। কয়েকজন ভাল জেনারেল সমেত একটি দৃঢ়সংকল্প সেনাবাহিনী পারস্যে গিয়ে প্রায় বাধাহীন ভাবেই যা খুশি করে চলে আসতে পারে। এমনকি ধীর গতির স্পার্টানরা, (স্পার্টানরা শক্তিশালী হলেও ধীর গতির জন্য তাদের দুর্নাম ছিল) যারা বড় কোন সেনাভিযান নিতে সবসময়ই গড়িমশি করে এসেছে, তারাও এবার পারস্যের দিকে পূর্বাভিমুখি সামরিক অভিযানের কথা চিন্তা করতে লাগল।

এদিকে পারস্যের এশিয়া মাইনোরের ক্ষত্রপ টিসারফেরনেস এশিয়া মাইনোরে ফিরে এসে গ্রুক নগরগুলোতে আক্রমণ শুরু করলেন। কেননা গ্রিকরা সাইরাস দ্য ইয়ংগারকে সহায়তা করেছে। স্পার্টাও তার বিরুদ্ধে নিজের সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে দ্বিধা করল না। আর তাদের সেনাবাহিনীতে এমন অনেকেই ছিল যারা সেই দশ হাজার এর বাহিনীতে অভিযান করেছিল। পারসিকরা ভাবল সমুদ্রেই আক্রমণ করাটা সবচেয়ে ভাল হবে। তাদের হাতে একজন এডমিরাল ছিলেন। আর ইনি হলেন সেই ইগোস্পোটামির যুদ্ধের এথেনীয় এডমিরাল কনন, যিনি ঈগোস্পটামি থেকে সাইপ্রাসে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এবারে তিনি যে করেই হোক স্পার্টার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হলেন। টিসাফেরনেস তাকে ৩০০টি পারশিয়ান ও ফিনিশিয়ান জাহাজের একটি নৌবাহিনীর এডমিরাল করে স্পার্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠালেন।

এর মধ্যে স্পার্টায় এক নতুন রাজার উত্থান ঘটেছে। মান্টিনিয়ার যুদ্ধের বিজেতা দ্বিতীয় এজিস ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান। স্বাভাবিকভাবেই তার তরুণ পুত্র তার স্থলে রাজা হবার কথা। কিন্তু তাকে নিয়ে একটা সন্দেহ ছিল। এই সন্দেহটা তার জন্ম পরিচয় নিয়ে। ইনি জন্মগ্রহণ করেন যখন আলসিবিয়াডেস স্পার্টায় অবস্থান করছিলেন এবং যখন এজিস আলসিবিয়াডেসকে তার সন্তানের পিতা বলে দৃঢ়তার সাথে সন্দেহ করেছিলেন তখন। এছাড়া এজিসের এক ছোট ভাইও ছিল এজিসিলেয়াস নামে। তিনি এবার সামনে এসে নিজেকে সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার বলে ঘোষণা করলেন। তবে তিনিও বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। তিনি ছিলেন জন্ম থেকেই খোঁড়া, সেই সাথে ছিলেন ক্ষুদ্রাকায়। স্পার্টায় একটি প্রাচীন প্রোফেসি ছিল, যেখানে বলা হয়েছিল “থেমে চলা শাসন থেকে সাবধান”। বিরোধীরা বলল খোঁড়া ব্যক্তি থেমে চলে, তাই খোঁড়া রাজা মানেই থেমে চলা শাসন। কিন্তু এজেসিলেয়াস বললেন, না, যে রাজা সত্যিকারের উত্তরাধিকারী নন তার শাসনই হলো থেমে চলা শাসন। বাক বিতণ্ডা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে লাইস্যান্ডার এসে এর মিটমাট করলেন। পেলোপনেসীয় যুদ্ধেই তিনি শেষবার ক্ষমতার স্বাধ নিয়েছিলেন, আর এরপর থেকে তিনি নিষ্ক্রীয় ছিলেন। এবারে তিনি ফিরে আসতে চাইলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন এজেসিলেয়াস একজন খোঁড়া বলে অস্পার্টানসুলভ হবে, আর তাই তাকে হ্যান্ডল করাও সহজ হবে। আর তাই লাইস্যান্ডারের সহায়তায় তিনিই দ্বিতীয় এজেসিলেয়াস নাম নিয়ে স্পার্টার সিংহাসনে বসলেন। কিন্তু লাইস্যান্ডার ভুল করেছিলেন। এজেসিলেয়াস ক্ষুদ্রকায় হলেও ছিলেন একজন আপাদমস্তক স্পার্টান, আর তাকে হ্যান্ডল করে এরকম মানুষের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে ছিলনা। লাইস্যান্ডার যেরকম ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, সেরকম বাইরেই থেকে গেলেন।

এজেসিলেয়াসের মধ্যে ছিল সামরিক গৌরবের তৃষ্ণা, আর তিনি টেন থাউস্যান্ড এর বাহিনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। ৩৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এশিয়া মাইনোরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। মনে মনে তিনি নিজেকে ট্রয়ের যুদ্ধের আগামেমনন হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, যে ছিল তারই মত এক পেলোপনেসীয় রাজা, যিনি পুরাণ অনুযায়ী ৮০০ বছর আগে এশিয়া মাইনোরের রাজ্য ট্রয়ের ওপর গ্রিকদের নিয়ে হানা দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন গ্রিসের সৌন্দর্য হেলেনকে। আগামেমনন যেমন অভিযানের পূর্বে বিওটিয়ার সমুদ্রোপকূলবর্তী নগর অওলিসে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, তিনিও সেখানে গিয়ে একইভাবে উৎসর্গ করলেন। কিন্তু বিওটিয়ার থিবানরা সেটা মেনে নিল না। কোন স্পার্টান রাজাকেই তারা তাদের অঞ্চলে দেবতার উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করতে দেবে না। তারা তাই এজেসিলেয়াসকে ধাওয়া করে সেখান থেকে বিতাড়িত করল। এজেলিসেয়াস এতে খুব অপমানিত বোধ করলেন, তিনি বারবার এটাই ভাবতে থাকলেন যে তার এই উৎসর্গ ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এশিয়া মাইনোরের অভিযানে ব্যর্থ হতে পারেন। আর এভাবে তিনি থিব্‌সের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠলেন, যা ভবিষ্যতে গ্রিসে স্পার্টার কার্যধারাকে প্রভাবিত করেছিল।

এশিয়ায় পৌঁছে এজেসিলেয়াস বুঝতে পারলেন জেনোফোন যা শিখিয়েছেন তা ঠিকই ছিল। তিনি এশিয়া মাইনোরে গিয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন ও সহজেই একের পর এক যুদ্ধে সত্রপ টিসাফেরনেস ও ফারনাবেজাসকে পরাজিত করতে থাকলেন। বিশেষ করে সারদিসে ৩৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের টিসাফেরনেসের পরাজয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। আর যেহেতু পারস্য সাম্রাজ্যে পরাজয়কে অপরাধ হিসেবে ধরা হতো তাই পরাজয়ের কিছু কাল পরেই টিসাফেরনেসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু পারসিকরা কি বসে থাকবে? তারাও এতদিনে গ্রিকদেরকে পরাজিত করার কিছু কায়দা শিখে ফেলেছে। তারা এজেসিলেয়াসকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হল ঠিকই, কিন্তু তাদের হাতে ছিল অনেক টাকা। এর আগে তারা পেলোপনেসীয় যুদ্ধে টাকা দিয়ে এথেন্সের বিরুদ্ধে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধ করার জন্য রাজি করিয়েছিল, স্পার্টাকে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে দিয়েছিল। তাতে এথেন্স পরাজিতও হয়েছিল। এবারে তারা স্পার্টার বিরুদ্ধে যাবার জন্য গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর ওপর টাকা ঢালতে শুরু করল। আসলে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো একটি আরেকটির বিরুদ্ধে এমনই শত্রুভাবাপন্ন থাকত যে এদের মধ্যে যুদ্ধ লাগাবার জন্য বেশি কিছু করতে হতো না। পাসরিক অর্থ ছাড়াই তদকালীন স্পার্টার বিরোধীরা স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিত। কিন্তু পারস্যের অর্থ তাদেরকে তাড়িত করতে নিশ্চই অবদান রেখেছে।

কোরিন্থ আর থিব্‌স ছিল স্পার্টার ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। এথেন্সের বিরুদ্ধে পেলোপনেসীয় যুদ্ধে এরা স্পার্টার মিত্র ছিল। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের সমস্ত লভ্যাংশ স্পার্টা একা ছিনিয়ে নেয়ার তারা ক্রমশ স্পার্টার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে  ওঠে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্পার্টাও টের পাচ্ছিল যে এই মিত্ররা ক্রমশ তার শত্রু হয়ে উঠছে, আর তাই এদেরকে থামাতে হবে। এদিকে কিছু কাল পূর্বেই স্পার্টার রাজা এজিসেলেয়াস যখন বিওটিয়ায় দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে যান তখন তিনি থিবানদের দ্বারা অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাই থিবানদের ওপর স্পার্টার প্রচণ্ড রাগ ছিলই। স্পার্টায় দুজন রাজা শাসন করতেন। এজেসিলেয়াস তখন এশিয়া মাইনোরে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। স্পার্টায় তখন অবস্থান করছিলেন রাজা পসানিয়াস। তিনি দক্ষিণ দিক দিয়ে অগ্রসর হলেন। আর লাইস্যান্ডার অগ্রসর হলেন উত্তর দিক দিয়ে। পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পর লাইস্যান্ডার আর কোন যুদ্ধে জড়াননি, এবারে তিনি আবার অস্ত্র ধরলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধে লাইস্যান্ডার প্রাণ হারান, আর পসানিয়াসও পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। ইতিমধ্যে এথেন্স থিব্‌সের স্পার্টাবিরোধী ঐক্যজোটে নাম লিখিয়েছিল, আর এখন আরগোস ও কোরিন্থও তাতে যোগ দিল। হঠাৎ করে এত শত্রুকে দেখে স্পার্টা ভীত হয়ে গেল। তখন স্পার্টার দরকার যেভাবেই হোক একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে শত্রুদের মোকাবেলা করা। কিন্তু স্পার্টান সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশই যে এশিয়া মাইনোরে পারস্যের সাথে যুদ্ধে রত। এবারে পারসিকরা যা চেয়েছিল, যার জন্য এত এত অর্থ খরচ করল তা বাস্তবায়িত হলো। যদি নিজের ঘরই পুড়ে যায় তাহলে দূরের বিজয় দিয়ে কী লাভ? তবুও একগুঁয়ে এজেসিলেয়াস কিছুতেই এশিয়া মাইনোরের প্রায় জিতে যাওয়া যুদ্ধ ফেলে রেখে ফিরে যেতে রাজি হননি। কিন্তু স্পার্টানদের শৃঙ্খলা, ঐতিহ্য, দায়িত্ব-কর্তব্য সংক্রান্ত চিন্তাই তাকে এই আবশ্যকীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। তিনি বাধ্য হলেন যুদ্ধ ত্যাগ করে তার সেনবাহিনী নিয়ে স্পার্টার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। এশিয়া মাইনোরে এবারে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করলেন, সাথে টেন থাউস্যান্ডের সেনাবাহিনীর যতজনকে পারা যায় তাদেরও নিলেন, জেনোফোনও তার সাথে ছিল। এরপর সেই সেনাবাহিনী নিয়ে স্পার্টার উদ্দেশ্যে চললেন। তবে অনেকেই এশিয়া মাইনোরে রয়ে গেল।

কিন্তু স্পার্টার পথে যেতে যেতেই এজেসিলেয়াসের কাছে দুঃসংবাদ এলো। এশিয়া মাইনোরের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরবর্তী ডোরিয়ান নগর নাইডাসের (Cnidus) কাছে এথেনীয় এডমিরাল কননের অধীনে পারসিক নৌবাহিনী  স্পার্টান নৌবাহিনীকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। পেলোপনেসীয় যুদ্ধের শেষ দিকে পারস্যের অর্থে স্পার্টানদের একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠিত হয়েছিল, আর বিগত দশ বছর ধরে এই নৌবাহিনীই ছিল গ্রিসের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌশক্তি। কিন্তু স্পার্টানদের এই নৌ-ক্ষমতা এই দশ বছরই স্থায়ী হলো। তাদের নৌবাহিনী আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এজিসেলেয়াসও বুঝতে পারলেন, নৌশক্তি ছাড়া স্পার্টানরা কিছুতেই আর পূর্বদিকে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না। কিন্তু নিরাশ হলেন না, মনোবল বজায় রাখলেন, আর এই সংবাদ পেয়ে যাতে স্পার্টান সৈন্যরা হতবল না হয়ে যায় তাই এই সংবাদটা তিনি স্পার্টান সৈন্যদের কাছে গোপন রাখলেন। তিনি  দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে করোনিয়াতে পৌঁছলেন, যেখানে পঞ্চাশ বছর আগে বিওটিয়া এথেন্সকে পরাজিত করেছিল। সেখানে এজেসিলেয়াস সম্মিলিত স্পার্টা-বিরোধী শক্তির মুখোমুখি হলেন। এজেসিলেয়াসের মধ্যে তখন থিবানদের বিরুদ্ধে পূর্বের রাগ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। স্পার্টা-বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। থিবানদের নেতৃত্বে স্পার্টা-বিরোধী জোট ভালই যুদ্ধ করছিল, কিন্তু শেষে তারা এজেসিলেয়াসের অধীনে স্পার্টার কাছে পরাজিত হলো। তবে এটাও ঠিক, এজেসিলেয়াস যুদ্ধটি কোন রকমে জিতেছিলেন। যাই হোক, এরপর তিনি বিওটিয়া থেকে স্পার্টার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিন্তু স্পার্টা-বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই একটি মাত্র জয়েই শান্তি আসেনি। পারস্যের অর্থসাহায্যের জন্যই হোক, আর স্পার্টার আধিপত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার কারণেই হোক , একের অপর এক গ্রিক নগর স্পার্টা-বিরোধী জোটের সাথে তাল মিলিয়ে স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, স্পার্টা-বিরোধী জোট শক্তিশালী হচ্ছে আর স্পার্টাকে তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। স্পার্টা তার ভবিষ্যৎ অবস্থার দিকে যখন তাকাচ্ছে তখন যুদ্ধ ছাড়া আর কিচ্ছু সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এই যুদ্ধ তো স্পার্টা চায়নি। এই যুদ্ধগুলো থেকে স্পার্টার পাবারও কিছু ছিলনা। পেলোপনেসীয় যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই স্পার্টা সমগ্র গ্রিসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, এই যুদ্ধগুলো জিতে তাই তার নতুন করে পাবার আর কিছুই ছিলনা, তবে যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে হারাবার জন্য সবই ছিল।

ইফিক্রেটিসের হাতে স্পার্টার পরাজয় ও পারস্যের সাথে শান্তিচুক্তি

এরই মধ্যে স্পার্টার একটি বিপর্যয় ঘটে গেল। ৩৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৬০০ জনের মত স্পার্টান শত্রু অঞ্চল কোরিন্থ দিয়ে যাচ্ছিল। শত্রুপক্ষের অঞ্চল দিয়ে গেলেও স্পার্টানরা ভীত ছিলনা। কারণ ৬০০ জন স্পার্টান সৈন্যের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হবার সাহস করার কথা কারওরি ছিল না, সে যদি স্পার্টান সেনাবাহিনীর তুলনায় কয়েকগুণ বড় সেনাবাহিনী নিয়েও আসে, তাহলো সেই সাহস তার হতোনা। কিন্তু এবারে পাশার গুটি পাল্টে গিয়েছিল। আর যিনি তা পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি একজন এথেনীয় জেনারেল, ইফিক্রেটিস। তিনি এক নতুন ধরনের সেনাদল প্রস্তুত করলেন। এরা ছিল হালকা অস্ত্র ও হালকা বর্মে সজ্জিত, এদেরকে বলা হতো পেল্টাস্ট। এদিকে স্পার্টানরা সহ যে গ্রিক সৈন্যরা যে ভারি অস্ত্র ও ভারি বর্মে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ করত তাদেরকে বলা হতো হপলাইট। এতদিন পর্যন্ত এই হপলাইটরা ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে অজেয়। এদের সাথে হালকা বর্মে সজ্জিত পারসিকরা বারবার পরাজিত হয়েছে। পেল্টাস্টদের সাথে হপলাইটদের সম্মুখ যুদ্ধ হলে তা হতো ভর বনাম ভরের যুদ্ধ, আর তাতে অবধারিতভাবেই হপলাইটদেরই জিতবার কথা। হপলাইটরা যেভাবে একের পর এক যুদ্ধে পারসিকদের হালকা অস্ত্র ও বর্মে সজ্জিত সেনাদলকে বিধ্বস্ত করে এসেছে, এখানেও তাই হবার কথা। কিন্তু এবারে ইফিক্রেটিস হালকা বর্মের দুর্বলতার চেয়ে এর উপকারিতাটিকেই বড় করে দেখলেন, আর এটাকেই তিনি কাজে লাগালেন। হালকা বর্মের কারণে পেল্টাস্টরা দ্রুত গতিতে স্থান পরিবর্তন করতে পারে। আর ইফিক্রেটিস এই দিকটাকেই কাজে লাগান। তিনি এদেরকে যত্নের সাথে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, এবং বারবার ড্রিল করান। এবারে কোরিন্থে ঐ ৬০০ স্পার্টানের ওপরে পেল্টাস্টরা আচমকা আক্রমণ করল। স্পার্টানরাও সাহসিকতার সাথেই তাদের মোকাবেলা করা শুরু করল। প্রথম দিকে স্পার্টানরা সহজেই তাদের ভারি বর্মের সুবিধা নিয়ে তাদের ঘায়েল করা শুরু করল। কিন্তু খুব দ্রুত তারা হাঁপিয়েও গেল। এদিকে পেল্টাস্টরা তাদের হালকা বর্মের কারণে খুব দ্রুত তাদেরকে ডজ করে এদিকে সেদিকে ছুটে গিয়ে আক্রমণ করতে থাকে। এতে একসময় স্পার্টান হপলাইটদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। আর এভাবেই চলতে চলতে একসময় স্পার্টানরা পরাজিত হয়।

স্পার্টানদের এই পরাজয়ের কথা শুনে সমগ্র গ্রিক জগৎ হা হয়ে গেল। এর আগে থার্মোপাইলিতে স্পার্টানরা পারস্যের কাছে পরাজিত হয়েছে, স্ফ্যাক্টেরিয়ায় পরাজিত হয়েছে গ্রিকদের কাছে। কিন্তু এই উভয়ক্ষেত্রেই বিরোধীপক্ষের সৈন্য সংখ্যা হয় অনেক বেশি ছিল, নয়তো তাদের অনেক বেশি সুবিধা ছিল। সেই যুদ্ধগুলো যেন ছিল অসম্ভব যুদ্ধ। তাই সেসব ক্ষেত্রে স্পার্টার সাহসিকতার সাথে আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে পরাজয় উল্টে তাদের গৌরবই বৃদ্ধি করেছিল, লজ্জার কারণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এবার? কোরিন্থে স্পার্টানরা অসম যুদ্ধে পরাজিত হয়নি, হয়েছে একেবারে সমান সমান যুদ্ধে। এই প্রথমবারের মত গ্রিক জগৎ জানতে পারল যে উন্নততর শক্তিমত্তা ও সাহসিকতা দিয়ে না হলেও উন্নততর সমর কৌশলের মাধ্যমে স্পার্টানদেরকে পরাজিত করা সম্ভব। এদিকে এই পরাজয়ের ফলে স্পার্টাও উপলব্ধি করল যে, স্পার্টার ভাগ্যাকাশে নেমে আসছে দুর্যোগের ঘনঘটা। ভালয় ভালয় এখনই যদি স্পার্টা তার বিরোধীদের সাথে শান্তি স্থাপন না করে, তাহলে গ্রিক জগতে এখনও পর্যন্ত যে আধিপত্য রয়েছে, সেটিও আর থাকবে না। যাই হোক, কেবলমাত্র পারস্যের নৌবাহিনী ও অর্থের প্রভাবেই এরকম শান্তি স্থাপন করা সম্ভব ছিল। ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টা পারস্যের সাথে শান্তিচুক্তিতে গেল। এই চুক্তিটিতে স্পার্টার প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন স্পার্টান এডমিরাল এন্টালসিডাস। তার নামানুসারেই চুক্তিটি এন্ডালসিডাসের শান্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিটির মাধ্যমে স্পার্টা পারস্যকে সকল এশিয়া মাইনোরের সকল গ্রিক নগর ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়। এক শতক পূর্বে সম্রাট জারেক্সেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে এশিয়া মাইনোরের গ্রিক নগরগুলোকে গ্রিকরা স্বাধীন করতে সক্ষম হয়। এথেন্স ও স্পার্টাই ছিল পারস্যের বিরুদ্ধে এই জয়ের নায়ক। এবারে স্পার্টাকে সেই জয়ের সমস্ত গৌরবময় ফল ত্যাগ করতে হলো। আর ত্যাগ করতে হলো কিনা এমন এক পারস্যের কাছে, যা জারেক্সেসের পারস্যের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল। এদিকে একবার এশিয়া মাইনোরের গ্রিক নগরগুলো শাসন করে পারস্যও তাদের শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। তাই প্রথম দারিউসের সময় তারা গ্রিক নগরগুলোর ওপর যেরকম দমনপীড়নমূলক আচরণ করেছিল, এবারে আর তা শুরু করল না। বরং এই অঞ্চলগুলোকে অনেকটাই স্বাধীনতা দেয়া হলো।

এই শান্তিচুক্তিটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই যে, এর মাধ্যমে পারস্য সকল গ্রিক নগরের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা করে। এর অর্থ এই যে, গ্রিক নগরগুলোর মধ্যে এতদিন ধরে যে ইউনিয়ন বা সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সবই ভেঙ্গে ফেলতে হবে, সব নগরই হবে একে অপরের থেকে “স্বাধীন”। এর ফলে কোরিন্থ ও আরগোসকে তাদের সংঘ ভেঙ্গে ফেলতে হলো। আর্কাডিয়ার ম্যান্টিনিয়া নগর পাঁচটি গ্রামে বিভক্ত হলো। এভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করলো যে অবশিষ্ট গ্রিক নগরগুলো দুর্বল থাকবে। কিন্তু স্পার্টার নিজের বেলায়? অবশ্যই স্পার্টা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তাকে তার অধীনে থাকা ল্যাকোনিয়া ও মেসেনিয়ার নগরগুলোকে স্বাধীনতা দান করতে হবে। এজেসিলেয়াসের প্রধান টারগেট ছিল থিব্‌স, যেখানে তিনি অপমানিত হয়েছিলেন। থিব্‌স ছিল বিওটিয়ান সংঘের প্রধান, এবং এজেসিলেয়াস চাইলেন এই সংঘটি ভেঙ্গে যাক, আর এর নগরগুলো সব মুক্ত হয়ে যাক। কিন্তু থিব্‌স তা প্রত্যাখ্যান করল। কিন্তু থিব্‌সের কতিপয় গোষ্ঠীতান্ত্রিক ছিলেন স্পার্টা-পক্ষীয়। তারা ক্যাডমিয়া অবরোধ করল (পুরাণ অনুসারে কিংবদন্তী পৌরাণিক বীর ক্যাডমাসের নামানুসারে ক্যাডমিয়ার নামকরণ করা হয়েছে)। এথেন্সের কেন্দ্রীয় দুর্গ যেমন ছিল অ্যাক্রোপোলিস, তেমনি ক্যাডমিয়া ছিল থিব্‌সের প্রধান দুর্গ। এই গোষ্ঠীতান্ত্রিকগণ ক্যাডমিয়াকে স্পার্টার কাছে হস্তান্তর করল। ৩৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টা এটি দখল করে, যা এতদিন ধরে অপমানিত এজেসিলেয়াসের স্বপ্ন ছিল। এই সময়ে অন্তত গ্রিসের মূলভূমিতে স্পার্টাই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী।

থিব্‌সের হাতে স্পার্টার পতন 

কিন্তু ঘৃণা এজেসিলেয়াসের মাথা বিগড়ে দিয়েছিল। থিব্‌সের ক্ষমতায় থাকা লোকজন ছিল স্পার্টা-পক্ষীয়। তাই থিব্‌স যদি স্বাধীন থাকতো তাহলে তা স্পার্টার মিত্র হয়েই চলত। কিন্তু বিগড়ে যাওয়া এজেসিলেয়াস স্পার্টাকে তার অধীনেই রাখতে চাইলেন। তিনি  ক্যাডমিয়াতে তার সেনাবাহিনী রেখে দিলেন। ফলে থিব্‌স স্থায়ীভাবে স্পার্টার শত্রু হয়ে গেল। থিব্‌স এবার খালি অপেক্ষা করতে লাগল কবে সে স্পার্টানদের থেকে মুক্ত হয়। এভাবে চারটি বছর থিব্‌স স্পার্টানদের দমন পীড়ন সহ্য করে গেল। অবশেষে পেলোপিডাস নামে একজন থিবান স্পার্টানদের বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পনা করলেন। ৩৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি কয়েকজন পুরুষকে নারীর বেশে সাজিয়ে স্পার্টানদের মদ্যপানের আসরে নিয়ে এলেন। স্পার্টান সেনাপতিরা এই ড্রিংকিং পার্টির আয়োজন করেছিলেন। এদেরকে হত্যা করাই ছিল থিবান ছদ্মবেশীদের লক্ষ্য। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একজন থিবান বিশ্বাসঘাতক স্পার্টান জেনারেলকে এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চিরকুটে একটি বার্তা লিখে পাঠান। জেনারেলকে চিরকুটটি দেবার সময় বলা হয়েছিল এখানে আগামীকাল সম্পর্কিত একটি জরুরি বার্তা দেয়া হয়েছে। স্পার্টান জেনারেল “আগামীকাল” এর কথা শুনেই চিরকুটটি না পড়ে রেখে দেন। আর সেজন্যই হয়তো তার জীবনে আর “আগামীকাল” এলো না। ছদ্মবেশী থিবানরা ছুড়ি দিয়ে আসরের সকল স্পার্টানকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর থিবান সৈন্যরা ক্যাডমিয়ায় ঝটিকা আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। আর মদের আসরের বিভ্রান্তিতে পড়ে স্পার্টান কমান্ডাররাও সহজে আত্মসমর্পণ করে। তবে আত্মসমর্পণ না করলেও পারত। কেননা পরাজিত হয়ে স্পার্টায় ফিরে আসার পর তাদেরকে পরাজয়ের শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা হয়। কিন্তু কমান্ডারদের হত্যা করলেই তো আর ক্যাডমিয়াকে ফেরত পাওয়া যায়না, আর কখনও তা করা যায়ওনি।

স্বাধীন হবার পর থিব্‌স আবার স্পার্টার বিরুদ্ধে এথেন্সের সাথে জোটবদ্ধ হলো। উদ্দেশ্য স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এবারে থিব্‌স ছিল একটি শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান শাসকের হাতে। ইতিহাসে থিব্‌স কখনও বুদ্ধির জন্য পরিচিত ছিলনা। থিব্‌স বিওটিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। আর এথেনীয়রা “বিওটিয়ান” শব্দটিকে ব্যবহার করতই “বোকা” বোঝাতে! কিন্তু এবার কেবল একজন নয়, দুজন পুরুষ হঠাৎ করে থিবানদের শাসক হয়ে সামনে এলেন। একজন হলেন পেলোপিডাস, যার ষড়যন্ত্রের কারণেই স্পার্টানদের থিব্‌স ত্যাগ করতে হলো। এতক্ষণে নিশ্চই তার যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেছে। আরেক জন ছিলেন পেলোপিডাসেরই বেস্ট ফ্রেন্ড, আর পেলোপিডাসের চেয়েও তার কাজের গুরুত্ব অধিক ছিল। তিনি ছিলেন ইপামিনন্ডাস। ইপামিনন্ডাস থিবান সৈন্যদের মধ্য থেকে একটি ছোট বাহিনী গঠন করলেন, যাদেরকে শপথ করানো হলো যে তারা মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করবে। এদেরকে “স্যাক্রেড ব্যান্ড” বলা হতো। আর এরাই ছিল থিবান সেনাবাহিনীর মুখ্য ভূমিকায়। এদেরকে দিয়েই ইপামিনন্ডাস স্পার্টানদেরকে ভূমিতে ঠেকিয়ে রাখলেন। অন্যদিকে এথেনীয়রা সমুদ্রে স্পার্টানদেরকে একের পর এক পরাজয়ের স্বাদ পাইয়ে দিচ্ছিল। স্পার্টা তার রনতরীগুলোকে এথেন্সের দিকে শস্য নিয়ে যাওয়া এথেনীয় ভেসেলগুলোকে আটকে দেবার চেষ্টা করছিল, যাতে এথেন্স খাদ্যের সংকটে পড়ে বাধ্য হয়ে পরাজয় মেনে নেয়। কিন্তু সেটা হয়নি। ৩৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাক্সোস দ্বীপের কাছে এথেনীয় নৌবাহিনী স্পার্টান নৌবাহিনীকে আটকে দেয় ও তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে প্রায় সমস্ত নৌবাহিনীকেই ধ্বংস করে ফেলে। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্পার্টান নৌবাহিনী চিরকালের মত সমুদ্র থেকে হারিয়ে ফেল।

তবে স্পার্টার এই দুর্দশার দিনে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য চলে এলো সিসিলির গ্রিক নগর সাইরাকুজ। পেলোপনেসীয় যুদ্ধে শত্রু এথেন্সের আক্রমণের হাত থেকে স্পার্টা তাদেরকে রক্ষা করেছিল। এবারে তাদের প্রতিদান দেবার পালা। নৌবাহিনীর মাধ্যমে এথেন্স যখন স্পার্টায় আক্রমণ করতে যাচ্ছিল তখনই সাইরাকুজের সহায়তায় এসে পৌঁছল। ফলে স্পার্টা আবার প্রতিরোধ করা শুরু করল। সাইরাকুজের এই সহায়তার কারণেই স্পার্টা-বিরোধীদের কাছে স্পার্টার পরাজয়ের অবস্থা থেকে স্পার্টা ও স্পার্টা-বিরোধীদের অবস্থা প্রায় সমান সমানের দিকে চলে গেল। এবারে অবস্থা এমন দিকে চলে গেল যে যুদ্ধ চলছে, কিন্তু তা কারও দিকেই যাচ্ছে না। কেউই আর ভাল বা খারাপের দিকে নেই। এই স্টেইলমেটের অবস্থায় সবসময় যেটা ঘটে সেটা হলো শান্তিচুক্তি। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ অব্দে সকলেই শান্তির জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। এখানেও এজেসিলেয়াসের বিগড়ে যাওয়া মাথা সব ভণ্ডুল করে দিল, বাধা আসলো থিব্‌সের বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষ থেকে। এজেসিলেয়াস দাবি করলেন শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে বিওটিয়ার সকল নগরকেই আলাদা আলাদাভাবে সাক্ষর করতে হবে, থিব্‌স সকল নগরের হয়ে স্বাক্ষর করতে পারবে না। এজেসিলেয়াসের এই সিদ্ধান্তের ফলে থিব্‌স আর স্পার্টার মধ্যে আবার সংঘাত তৈরি হলো। শেষ পর্যন্ত যা দেখা গেল তা হলো স্পার্টা আর এথেন্সের মধ্যেই কেবল শান্তি স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু থিব্‌স আর স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ চলছেই। আর এটাই এতদিন এজেসিলেয়াস চেয়ে এসেছিলেন। এবারে থিব্‌স সঙ্গীহীন, আর তার সেনাবাহিনীও স্পার্টার থেকে কম। এটাই তাদেরকে ধ্বংস করে দেবার সুযোগ। ৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পসানিয়াসের মৃত্যুর পর স্পার্টার আরেক রাজার স্থানে বসেছিলেন প্রথম ক্লিওব্রোটাস। তিনি থিব্‌সকে দমন করার জন্য উত্তর মুখে অভিযান পরিচালনা করলেন। এটা দেখে সবাই ভাবছিল থিব্‌সের ভবিষ্যৎ শেষ!

এদিকে থিব্‌সকে প্রতিরক্ষার জন্য ইপামিনন্ডাসও তার সৈন্যদেরকে সাজালেন। তিনি তার সেনাবাহিনীকে তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। সেনাবাহিনীর মধ্য এমন ডান দিকের অংশকে তিনি চিরাচরিত ফরমেশনেই রাখলেন। কিন্তু বাম দিকের অংশকে তিনি একটি ৫০ র‍্যাংক গভীরতার কলাম হিসেবে সাজালেন। পঞ্চাশ র‍্যাংক গভীরতার কলাম মানে হলো কলামটাতে সারিবদ্ধভাবে ৫০ জন সৈন্য আছে। উল্লেখ্য, এই বাম দিকের অংশটাই স্পার্টানদের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক অংশ ডান দিকের বিরুদ্ধে লড়বে। এই কলামটির পেছনের দিকের সৈন্যদেরকে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। তারা কেবল চার্জিং ও ডিফেন্সের সময় ভর হিসেবে কাজ করবে। ইপামিনন্ডাস চেয়েছিলেন এই গভীর র‍্যাংকের কলামটি সিজ উইপন ব্যাটারিং র‍্যামের কাঠের গুঁড়ির মত শত্রুপক্ষকে বিধ্বস্ত করবে। এরা আঘাত করবে স্পার্টানদের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ডাক দিককেই। আর সেই ডান দিক এই কলামের আঘাতে বিভ্রান্ত হয়ে কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে, মানে ঐ অংশের সৈন্য সংখ্যা কমে যাবার পর থিবান সেনাবাহিনীর মধ্য ও পূর্বাংশ স্পার্টান লাইনের বাদবাকিদেরকে সামলাবে। ইপামিনন্ডাসের এই কলামটিকে বলা হয় “থিবান ফ্যালাংক্স”, গ্রিক ভাষায় ফ্যালাংক্স এর অর্থ হচ্ছে  “কাঠের গুঁড়ি”।

থিব্‌সের দশ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে লিউক্ট্রা গ্রামে এই দুই সেনাবাহিনী একে অপরের মুখোমুখী হলো। স্পার্টানরা থিবানদের ফর্মেশন পর্যবেক্ষণ করল, আর তাদের নিজেদের লাইনকে ১২ র‍্যাংক গভীর করল। কিন্তু ১২ জনের শক্তিতে কি আর ৫০ জনকে আটকানো যায়? থিবান ফ্যালাংক্স চার্জ করল, আর ইপামিনন্ডাস যা পরিকল্পনা করেছিলেন তাই ঘটল। স্পার্টান লাইন বিধ্বস্ত হয়ে গেল এবং সেনাবাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে গেল। আর তার পরিণতি হলো ক্লিওমব্রোটাস সহ এক হাজার স্পার্টানের মৃত্যু। এক শতক পূর্বে থার্মোপাইলির যুদ্ধে লিওনিডাসের মৃত্যুর পর যুদ্ধক্ষেত্রে আরেকজন স্পার্টান রাজার মৃত্যু হলো। এর মধ্য দিয়ে থিব্‌স লাভ করল পুর্ণাঙ্গ বিজয়, আর স্পার্টান হেজিমনি চিরকালের জন্য হলো সমাপ্ত। ওরাকল যেমন বলেছিল “হল্টিং রেইন” বা “থেমে চলা শাসন” স্পার্টার বিপদ নিয়ে আসবে, খোঁড়া এজেলিসেয়াসের হাত ধরে যেন তাই হলো। স্পার্টা আর কোনদিন গ্রিসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। গ্রিসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, এখন স্পার্টার তার নিজের অঞ্চলকে রক্ষা করতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর স্পার্টার দুর্বলতা দেখে পেলোপনেসাসের স্পার্টার মিত্ররা তাকে ত্যাগ করল। আর্কাডিয়ার নগরগুলো স্পার্টা-বিরোধী লীগে যোগ দিল। ইপামিনন্ডাসের সাজেশনে আর্কাডিয়ান লীগ আর্কাডিয়ার রাজধানী হিসেবে ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেগালোপলিস নামে একটি নগরও প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্পার্টার বিরুদ্ধে এই নগরটির খুব প্রয়োজন ছিল। এর অবস্থান ছিল একেবারে পেলোপনেসাসের কেন্দ্রে, স্পার্টার অঞ্চলের ঠিক উত্তরেই।

এজেলিসেয়াস এবার আর্কাডিয়ার বিরুদ্ধে সেনাভিযান পরিচালনা করলেন। আর্কাডিয়াও শীঘ্রই থিব্‌সের কাছে সাহায্য চাইল। এবারই প্রথবারের মত দেখা গেল স্পার্টা থিব্‌সকে শায়েস্তা করতে উত্তর দিকে সেনাভিযান পাঠাচ্ছে না, বরং থিব্‌স স্পার্টাকে শায়েস্তা করতে দক্ষিণ মুখে সেনা পাঠাচ্ছে। আর থিব্‌সের এই আক্রমণের মুখে স্পার্টা এই প্রথম আবিষ্কার করল, স্পার্টান জীবনধারা আর আগের মত নেই, সেই জীবনধারা ক্রমশ ক্ষয়ে গেছে, আর স্পার্টান রাস্তা দিয়েও অনেক কম স্পার্টাম পূর্ণ নাগরিক চলাচল করছে। নিজেদের অঞ্চলের এই দুর্বলতা স্পার্টানরা ধরতে পারেনি। আর তা না জেনেই এতদিন যাবৎ স্পার্টানরা তাদের খ্যাতি ও মিত্রদের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু লিউক্ট্রার যুদ্ধে থিব্‌সের বিরুদ্ধে হারে স্পার্টানরা তাদের খ্যাতি হারিয়েছে, আর তার মিত্ররাও তাকে ত্যাগ করেছে। এবার স্পার্টার কাছে একটি ক্ষুদ্র ও অকার্যকরী সেনাবাহিনী ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। ইপামিনন্ডাস স্পার্টার কব্জা থেকে মেসেনিয়াকে মুক্ত করলেন। তিন শতক আগে স্পার্টানরা যে মেসেনিয়াকে পরাজিত ও করায়ত্ত করার মাধ্যমে তাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের সূচনা করেছিল, থিব্‌সের হাত ধরে সেই গৌরবের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে মেসেনিয়া স্বাধীন হলো। মেসেনিয়ার স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাধ্যমে মাউন্ট ইথোমির নিকটে পুরনো দুর্গের আশপাশের এলাকায় মেসিনি নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠিত করা হলো। উল্লেখ্য, এক শতক আগে সেই দুর্গটিকেই হেলোটরা অবরোধ করেছিল। এখন স্পার্টার কাছে অবশিষ্ট ছিল কেবল ল্যাকোনিয়া অঞ্চলই, আর তার চতুর্দিক ছিল শত্রুতে পরিপূর্ণ।

এভাবে স্পার্টার যখন প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থা, তখন পেলোপনেসাসের বাইরে থেকে তার কাছে সহায়তা এলো। এবারে তার সহায়তায় এগিয়ে এলো তার এতদিনকার শত্রু এথেন্স! তবে বরাবরের মতই এথেন্স এবার দয়ার জন্য কিছু করেনি। স্পার্টাকে সহায়তা করার পেছনে তাদের যথেষ্ট কারণ ছিল। থিব্‌সের কাছে স্পার্টার পরাজয়সমূহের মাধ্যমে স্পার্টা যেমন দুর্বল হয়েছিল, গ্রিক জগতে তাদের খ্যাতি ও আধিপত্য হারিয়েছিল, ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল থিব্‌সের সাথে। তারা ক্রমশ খ্যাতির শীর্ষে চলে গেল, আর শক্তিশালীও হলো। এথেন্স চায়নি যে থিব্‌স এতটাও শক্তিশালী হয়ে যাক। স্পার্টাকে পুরোপুরি পরাজিত করলে থিব্‌স আরও অনেক শক্তিশালী হয়ে যেত, আর তখন সমগ্র গ্রিক জগতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতো থিব্‌স, যা এথেন্স কখনই মেনে নিতে পারেনা। তাই থিব্‌সের বিরুদ্ধে ভর বাড়ানোর জন্য এবার এথেন্স স্পার্টার সাথে মৈত্রীবদ্ধ হয়। সেই সাথে স্পার্টাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে তার পুরনো মিত্র সাইরাকুজ। তারাও স্পার্টায় তাদের সৈন্য পাঠায়। এথেন্স ও সাইরাকুজের সহায়তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত এজেলিসেয়াস ল্যাকোনিয়াকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। এরপর থিবানদের আরও দু দুবার পেলোপনেসাসে আক্রমণ করেছিল, দুটোই তিনি ব্যর্থ করে দেন। এছাড়া থিব্‌স সোর্স থেকে জানা যায়, এসময়ে তারা গ্রিসের উত্তর দিকেও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল, ফলে ল্যাকোনিয়া জয়ের জন্য তারা খুব বেশি খরচ করতে পারেনি।

এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩৬২ অব্দে থিব্‌স শেষবারের মতো পেলোপনেসীয় উপদ্বীপে তাদের সব কাজের দফারফা করবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এবার ইপামিনন্ডাস নিজেই পেলোপনেসাসের উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এবারে চতুর্থবারের মতো থিব্‌স পেলোপনেসাস উপদ্বীপে আক্রমণ করল। ইপামিনন্ডাস এবারে স্পার্টা জয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু প্রায় আশি বছরের বৃদ্ধ এজেসিলেয়াস এখনও যথেষ্ট পরিমাণে স্পার্টান। তিনি সবরকমভাবেই ইপামিনন্ডাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এদিকে ইপামিনন্ডাসও স্পার্টাকে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। ম্যান্টিনিয়ার নগরের কাছে স্পার্টানদের বিরুদ্ধে থিব্‌সের যুদ্ধ হলো। এই যুদ্ধে থিব্‌সকে এবারে এথেন্স ও স্পার্টার মৈত্রীজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। আবারও ইপামিনন্ডাস তার সমর কৌশল থিবান ফ্যালাংক্স ব্যবহার করলেন। স্পার্টানরা এর আগে এই সমর কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে তারা কোন শিক্ষাই নেয়নি। এবারও থিবানদের ফ্লাইং কলাম তাদেরকে বিধ্বস্ত করে দিল। আরেক বার থিব্‌স স্পার্টার বিরুদ্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ জয়লাভ করল। তবে এই যুদ্ধ থিব্‌সের জন্যেও যে সুখকর ছিল তা নয়। তাদেরও একটা বড় ক্ষতি হল। স্পার্টান সেনাবাহিনী যখন বিভ্রান্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে ইপামিনন্ডাসের শরীরে একটি বর্শার আঘাত লাগে, আর তিনি মারা যান। এদিকে উত্তরের অভিযানে থিব্‌সের আরেক নেতা পেলোপিডাসেরও মৃত্যু হয়েছে। এবারে ইপামিনন্ডাসের মৃত্যুর মাধ্যমে থিব্‌সও তার প্রশাসনের ফার্স্ট র‍্যাংক থেকে ভেঙ্গে পড়ল।

এবারে স্পার্টা ও থিব্‌স উভয়েরই যখন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, আর উভয়ই যখন দুর্বল, সেই অবস্থায় একটি অচলবাস্থার সৃষ্টি হলো। এজেলিসেয়াস যেভাবেই হোক স্পার্টার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু স্পার্টার অবস্থা এখন এতটাই করুণ যে তিনি তার স্পার্টান বাহিনীকে অর্থের জন্য মারসেনারিতে পরিণত করতে বাধ্য হলেন। অনেক চেষ্টা করে তিনি স্পার্টাকে পুনরায় তাদের পুরনো দিনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যেতে প্রস্তুত করলেন। তখন মিশর পারস্যের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করে বসে। এজেসিলেয়াস মিশরকে তার সারভিস অফার করে, এবং তার সেনাবাহিনী সমেত মিশরে আসেন। কিন্তু এই বৃদ্ধবয়সে চাইলেই এজেলিসেয়াস যুদ্ধ করতে পারেন না। ৩৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বার্ধক্যের কারণে তার মৃত্যু হয়। তরুণ বয়সে এজেলিসেয়াস পেরিক্লিসের সময়ের এথেন্সের স্বর্ণযুগ দেখেছিলেন। দেখেছিলেন যখন এথেন্স ও স্পার্টা তাদের সমৃদ্ধি ও খ্যাতির শীর্ষ সময়ে অবস্থান করছিল। এরপর তিনি দেখেছেন কিভাবে একটি যুদ্ধে পরাজয়ের পর স্পার্টা তার শীর্ষ অবস্থান থেকে নামতে নামতে তার দুর্বলতম অবস্থায় চলে এসেছে। আর তারপর তিনি স্পার্টাকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি দশটি বছর যুদ্ধ করে গেছেন। আর এবার তিনি এক বিদেশী মাটিতে মৃত্যুবরণ করলেন, এমন কিছু উদ্ধার করার আশায়, যা কখনই আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

গ্রিক রৌপ্যযুগ এবং সাইরাকুজ, থেসালী ও কারিয়ার উত্থান-পতন

রৌপ্যযুগ 

সেই ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমগ্র গ্রিসে বিভিন্ন গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে যে ক্রমাগত যুদ্ধ চলছি তাতে গ্রিক সংস্কৃতি ক্ষয়ে যেতে থাকে। পেরিক্লিসের স্বর্ণযুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আর এরপর পরবর্তী শতকে যা ছিল তাকে বড়জোর “রৌপ্যযুগ” বলে আখায়িত করা যায়। আগেকার গ্রিসে যে আশাবাদ ছিল, এবারে সেটা দেখা যায়নি। পারস্য যুদ্ধের পুষে মনে হয়েছিল উন্নতি আর প্রবৃদ্ধি চলতে থাকবে। মনে হয়েছিল আদর্শ রাষ্ট্র দিগন্তেই দাঁড়িয়ে আছে। পেরিক্লিসের কাছে যদিও মনে হত যে ইতােমধ্যেই এথেন্স একটি আদর্শ শহর। এসময় দার্শনিকেরা তাদের নিজেদেরকে রাজনীতির ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলেন এবং মানুষ যাতে করে সমাজের সাথে সবচেয়ে ভালােভাবে যুক্ত হতে পারে সেই পদ্ধতিসমূহ বের করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পর দার্শনিকগণ রাজনীতি ও নগর নিয়ে  আলোচনা ত্যাগ করলেন, কারণ তাদের চোখে এগুলো ব্যর্থ ছিল। এবারে তারা নিজেদেরকে কেবল ব্যক্তি আর ব্যক্তিগত জীবন সংক্রান্ত চিন্তাতেই নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখলেন। তারা চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে একজন ব্যক্তি এই জগৎকে পাত্তা না দিয়েই চলতে পারেন যা পুরোপুরি মন্দ হয়ে গেছে, আর কিভাবে সেই ব্যক্তি নিজেকে কোন নীতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে তা নিয়েই তারা চিন্তা করতে থাকেন। 

এই দার্শনিকদের মধ্যে একজন হলেন এন্টিস্থিনিস। তিনি ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সক্রেটিস ও সোফিস্ট গর্জিয়াসের অধীনে শিক্ষালাভ করেন। এন্টিস্থিনিস বিশ্বাস করতেন যে নিজেকে সমাজের সাথে যুক্ত করার মধ্যে কোন সুখ নেই, বরং সুখ আছে এর সম্পূর্ণ বিপরীতে, সমাজ থেকে নিজেকে যতটা পারা যায় মুক্ত করার মধ্যে। অন্যের মতামতকে গ্রাহ্য না করার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার চেষ্টা করতে হবে, আর তাহলে তাকে আর অন্যের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হবেনা। সত্যিকারের স্বাধীন হবার জন্য নিজেকে সকল সম্পদ থেকে দূরে রাখতে হবে, কারণ সেই সম্পদ চলে গেলে, এমনকি সম্পদ হারানোর ভয়ের কারণে দুঃখের আগমন ঘটতে পারে। এন্টিস্থিনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও চূড়ান্ত অনুসারী ছিলেন ডায়োজিনিস, যিনি এশিয়া মাইনোরের কৃষ্ণসাগরের উপকূলবর্তী সিনোপিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ডায়োজিনিস এমন এন্টিস্থিনিসের মত মনে করতেন যে সাধারণ সুখ মানুষকে প্রকৃত সুখের কাছে নিয়ে যেতে পারেনা, একই সাথে তিনি এও মনে করতেন যে, ক্ষুধা ও বেদনা মানুষকে সদ্গুণ অর্জন করতে সহায়তা করে। আর এজন্য তিনি যতটা পারা যায় দুঃখের মধ্যে সময় কাটাতেন। তিনি একটি বড় টাবের মধ্যে থাকতেন যাতে তার ঘরবাড়ির প্রয়োজন না হয় ও সকল রকমের আবহাওয়াকেই তাকে ভোগ করতে  হয়। তার মতে একবার এই পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে কোন রকম বাজে আবহাওয়াই তাকে আর বিরক্ত করতে পারবে না, তার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। তিনি কাঠের বাটিতে পান করতেন, কিন্তু যেদিন তিনি দেখতে পেলেন একটি বালক দুহাতে জল নিয়ে পান করছেন, সেদিন থেকে বাটিকেও তার কাছে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা বলে মনে হতে লাগল। 

স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে যে ব্যক্তি এভাবে সমাজ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তার আছে সমাজকে খুব মন্দ বলে মনে হতে থাকবে। ডায়োজিনাসও অন্যান্য মানুষ সম্পর্কে খুব বাজে মত প্রদান করতে থাকেন। এ সম্পর্কে তার দিনের বেলায় বাজারে বাতি নিয়ে ঘুরবার একটি বিখ্যাত গল্প আছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো তিনি কেন দিনের বেলায় বাতি নিয়ে ঘুরছেন? উত্তরে তিনি বললেন, তিনি একজন সৎ ব্যক্তিকে খুঁজছেন। স্পষ্টাভাবেই তিনি বোঝালেন যে কোথাও সৎ ব্যক্তি নেই, এমনকি দিনের আলোতেও তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না, তাই তিনি অতিরিক্ত আলো যোগ করতে বাতি নিয়ে এসেছেন যাতে তাদেরকে খুঁজে পেতে একটু সুবিধা  হয়। ডায়োজিনিসের মতো দার্শনিকদেরকে কিনিকস (kynikos) বলা হতো। গ্রিক ভাষায় কিয়ন মানে ছিল কুকুর। এই দার্শনিকরা সবসময়ই মানব জাতির উদ্দেশ্যে বার্কিং ও স্নার্লিং করতো, অর্থাৎ ঘেউ ঘেউ করত ও খেঁক করে উঠত। তাই কুকুরের নাম থেকেই তাদের নাম হয় কিনিকস। তবে আমাদের কাছে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে সিনিক (Cynic)। আজ আমরা এই সিনিক শব্দটা তাদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করি যারা নিশ্চিত থাকে যে সকল কাজই মন্দ ও স্বার্থপর উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়। ডায়োজিনাসের মতো দার্শনিকের পরও সিনিকবাদ এতটা বিখ্যাত দর্শন হয়ে উঠত না। কিন্তু তা হয়েছিল সাইপ্রাসে জন্ম নেয়া জেনো অফ সিট্রিয়াম নামে এক দার্শনিকের কাছে, যিনি সিনিকবাদের একটি অধিকতর পরিশোধিত সংস্করণ উপস্থাপন করেছিলেন। জেনো অফ এলিয়ার সাথে তাকে এক করে দেখা যাবে না। অনেকের মতে তিনি আংশিকভাবে ফিনিশীয় ছিলেন। জেনো প্রথম দিকে সিনিক দার্শনিকদের কাছে পড়াশুনা করেছিলেন, কিন্তু ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি এথেন্সে তার নিজের চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে একটি দার্শনিক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শেখাতেন, একজন মানুষকে অবশ্যই তার আবেগের ঊর্ধ্বে যেতে হবে, তাকে তার আনন্দ ও দুঃখকে পরিহার করে চলতে  হবে, এবং এভাবে তাকে নিজের ভাগ্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, তা সেই ভাগ্য ভালই হোক, আর খারাপ। তার একমাত্র আগ্রহের বিষয় হওয়া উচিৎ সদ্গুণ ও কর্তব্য, এবং নিজে নিজের রাজা হবার মাধ্যমে তিনি কারও দাস হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। তিনি যে স্কুলে তার এই মতবাদ শিখিয়েছিলেন তার বারান্দায় রঙ্গিন ছবি আঁকা থাকতো। তাই তার স্কুলকে “স্টোয়া পইকাইল” বা ছবি আঁকা বারান্দা বলা হতো। সেখান থেকে তার দেয়া শিক্ষা “স্টোইসিজম” নামে পরিচিত হয়। আজকের দিনেও আমরা স্টোইক বলতে আনন্দ ও বেদনার প্রতি উদাসীন ও আবেগহীন ব্যক্তিকে বুঝে থাকি।

একজন ব্যক্তি যেমন নিজেকে বস্তুগত বিষয়াবলি থেকে দূরে রেখে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে, ঠিক তেমনি নিজেকে ভোগ বিলাসের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে। শেষোক্ত পন্থাকে বেছে নেয়া দার্শনিকের মধ্যে ছিলেন এরিস্টিপাস। তিনি ৪৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রোপকূলবর্তী শহর সাইরিনিতে (Cyrene) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এথেন্সে এসে সক্রেটিসের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি যে দর্শন প্রচার করেন তার সারবাক্য ছিল, কেবলমাত্র সুখই (pleasure) উত্তম, এবং বর্তমানের সুখ ভবিষ্যতের সুখের থেকে উত্তম। এই দর্শনেরই একটি কোমল সংস্করণ প্রচার করেন এপিকিউরাস যিনি ৩৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সামোসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামাতা ছিলেন এথেনীয়। ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি এথেন্সে আসেন এবং প্রচার করেন সুখই সর্বোত্তম বিষয়, কিন্তু তিনি এও জোর দিয়ে বলেন যে, সুখ কেবল নিয়ন্ত্রিত ও সদ্গুণের জীবন থেকেই আসে। তিনি ডেমোক্রিটাসের পরমাণুবাদকে গ্রহণ করেন, এবং তার দর্শন এপিকিউরিয়ানিজম নামে পরিচিত। আজকের দিনে এপিকিউরিয়ান বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি তার জীবনে ভাল জিনিসকে এপ্রিশিয়েট করেন।

এই সময়ে সাহিত্যও যেন পরিহারকৃত হয়। মহান এথেনীয় ট্র্যাজেডিয়ানরা আগে ঈশ্বর ও মানবের মধ্যকার মহৎ ও গভীর সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতেন যার দ্বারা তারা সমাজকে আলোকিত করতে চাইতেন। এরিস্টোফেনিস সেই সময়ের রাজনীতি নিয়ে লিখতেন। কিন্তু এথেন্সের পরাজয়ের পর এরিস্টোফেনিস রাজনীতি ত্যাগ করলেন এবং তিনি ফ্যান্টাসিকেই আশ্রয় করলেন। ট্র্যাজেডি সেসময় উধাও হয়ে যায়, আর কমেডি খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রচিত হতে থাকে। এই “নিও কমেডি” এর কালে কেবল ভালবাসা, ষড়যন্ত্র, চতুর দাস, সুন্দরী নারী ও অন্যান্য বিষয় নিয়েই কমেডি রচিত হতো। এরকম সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মিনান্ডার, যিনি ৩৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একশোরও বেশি নাটক লেখেন, যার মধ্যে কেবল একটিই টিকে আছে, সেটি ১৯৫৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। রৌপ্যযুগে এথেন্সে ফিডিয়াসের মত কোন ভাষ্কর ছিলেন না। পারথেননের মতো কোন মহান স্থাপনা তৈরি হয়নি। তবে সে সময়ে প্র্যাক্সিটেলেস নামে এক ভাষ্কর ছিলেন যাকে প্রথম শ্রেণীর ভাষ্কর বলা হতো। বর্তমানে একটি ভাষ্কর্যই আছে যাকে তার কাজ বলে ভাবা হয়, তা হলো শিশু ডায়ােনিসিয়াসকে কোলে নিয়ে হার্মিসের ভাষ্কর্য।

কেবল মাত্র গণিত ও বিজ্ঞানেই এথেন্স তার গতিধারা বজায় রেখেছিল। ইউডোক্সাস ছিলেন প্লেটোর শিষ্য, এবং তিনি ৪০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাইডাসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রধাণত একজন গণিতজ্ঞ ছিলেন, যিনি অনেকগুলো জ্যামিতিক প্রমাণ উদ্ভাবন করেন, যেগুলোকে প্রায় এক শতাব্দি পর ইউক্লিডের সারমর্মকৃত রচনাগুলোতে জায়গা করে নিয়েছিল। ইউডোক্সাস তার জ্যামিতি বিষয়ক গবেষণাকে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োগ করেন। তিনিই প্রথম গ্রিক ছিলেন, যিনি বলেছিলেন এক বছর ঠিক ৩৬৫ দিন নিয়ে গঠিত নয়, বরং ৩৬৫ দিনের চেয়েও ছয় ঘণ্টা বেশি। যদিও প্লেটো মনে করতেন গ্রহগুলো (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহষ্পতি, শনি, সূর্য ও চন্দ্র) পূর্ণাঙ্গ বৃত্তাকার পথে ঘোরে, এক্সোডাস তার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্লেটোকে সম্মত করান যে এরা বৃত্তাকার পথে ঘোরে না, অন্তত ঘোরে বলে দেখা যায়না। তিনি গ্রহগুলোর এই অবৃত্তাকার পথে ঘোরার একটি ব্যাখ্যাও দান করার চেষ্টা করেছিলেন। তার প্রচেষ্টা ছিল প্লেটোর দর্শনের পূর্ণাঙ্গার বৃত্তাকার পথে গ্রহের ঘুর্ণনের সাথে দৃষ্যত তার বৃত্তাকার পথে না ঘুর্ণায়মান হবার বিষয়টির মধ্যে একটি মেলবন্ধন করা। অর্থাৎ এমন একটা নীতি বের করা যার ফলে গ্রহগুলো পূর্ণাঙ্গ বৃত্তাকার পথে ঘুর্ণায়মান হলেও তাদের বৃত্তাকার পথে ঘুরছে না বলে মনে হবার একটা ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি যে ব্যাখ্যাটা দেন তা হলো, প্রত্যেকটি গ্রহই পূর্ণাঙ্গ গোলকে স্থাপিত থাকে, যেখানে গোলকটি সমভাবে বা ইভেনলি ঘুর্ণায়মান থাকে। সেই গোলকের মেরুগুলো আবার দ্বিতীয় গোলকে স্থাপিত থাকে এবং গোলকটি সমভাবে ঘোরে, তার মেরুগুলো আবার তৃতীয় গোলকে স্থাপিত থাকে, এভাবে চলতেই থাকে। এভাবে প্রত্যেকটি গোলকই সমভাবে ঘোরে, কিন্তু যখন সবগুলো গোলক সমভাবে ঘুর্ণায়মান থাকে, তখন তা দেখে আমাদের মনে হয় যে গ্রহগুলো সমভাবে ঘুর্ণায়মান নয়। এভাবে এউডোক্সাস মোট ২৬টি গোলকের অবতারণা করেন। কিন্তু তাতেও গ্রহগুলোর ঘুর্ণনের পুর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেয়া যায়নি। তার শিষ্য ক্যালিপাস অফ সাইজিয়াস তাই আরও ৮টি গোলক যোগ করেন। এভাবে মোট গোলকের সংখ্যা হলো ৩৪টি। এভাবেই হেভেনলি স্ফিয়ারের ধারণার সৃষ্টি হয়। আর এই ধারণাটি ২০০০ বছর ধরে চলতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটিকে যাদুঘরে পাঠান।

তবে সেই সময় কিছু গ্রিক জ্যোতির্বিদ ছিলেন যারা সঠিক পথেই ছিলেন। ৩৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনোরের কৃষ্ণসাগরের উপকূলে হেরাক্লিডিয়া পন্ডিকাস নগরে হেরাক্লিডেস নামে এক জ্যতির্বিদের জন্ম হয়। তাকে প্রায়ই তাই হেরাক্লিডেস পন্টিকাস নামে ডাকা হয়। তিনিও প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। তিনি দাবি করেন যে, গ্রহগুলোর ঘুর্ণনকে ব্যাখ্যা করার জন্য পৃথিবীকে গতিহীন ধরে প্রতি ২৪ ঘণ্টা পর পর গ্রহগুলোর পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘোরে এমনটা ধরবার দরকার নেই। বরং গ্রহগুলো স্থির আছে আর পৃথিবী একটি অক্ষ বরাবর ঘুর্ণায়মান এমনটি ধরেও এর ব্যাখ্যা করা যায়। হেরাক্লিডিস এও বলেছিলেন বুধ ও শুক্র গ্রহের ঘুর্ণনের জন্য এউডোক্সাসের গোলকের প্রয়োজন হয়না, এর চেয়ে এরা সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এমনটা ধরলেই হয়। ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সামোসে জাত এরিস্টারকাস হেরাক্লিডাসের এই ধারণাটি গ্রহণ করেন। তিনি পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের তুলনামূলক দূরত্ব পরিমাপ করেন। তার তত্ত্ব সঠিক ছিল, কিন্তু সেসময় গ্রিকদের কাছে মহাকাশ পরিমাপের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ছিলনা, তাই তার পর্যবেক্ষণে ভুল থেকে যায়। ফলে তিনি নির্ধারণ করেন যে সূর্য-পৃথিবীর দূরত্ব পৃথিবী-চন্দ্রের দূরত্বের বিশ গুণ, যদিও আসলে তা ছিল ৪০০ গুণ বেশি। তবুও তিনি উপসংহার টেনেছিলেন সূর্য অবশ্যই ব্যাসে পৃথিবীর চেয়ে সাত গুণ বড়। যদিও আসলে তা ছিল একশো গুণ বেশি, তবুও অ্যানাক্সোগোরাসের সময়ের থেকে তার জ্যোতির্বিদ্যা অনেক অগ্রসর ছিল। যেহেতু এইস্টারকাসের কাছে সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বড়, তাই সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে এমন ধরাটা অযৌক্তিক। তাই তিনি বলেছিলেন পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘোরে। যদিও এইস্টারকাসের হাত ধরে জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিক ধারণার উদ্ভব ঘটল, তবুও সেই সময়ে পৃথিবীর মত বিশাল ও কঠিন বস্তু মহাকাশ জুড়ে ঘুরছে এটা বিশ্বাস করাটা সেই সময়ের দার্শনিকদের কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। তাই এরিস্টারকাসের তত্ত্ব সেসময়ের লোকেরা গ্রহণ করেনি। জ্যোতির্বিদ্যাকে সঠিক পথে আনতে আরও দুই হাজার বছর লেগে গিয়েছিল।

সাইরাকুজের উত্থান ও পতন

কিন্তু গ্রিক সংস্কৃতির যখন পতন ঘটছিল তখন এটি বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিটি শহর, তাদের সামর্থ্যমতাে এথেন্সকে অনুকরণ করা শুরু করেছিল। এমনকি মূল ধারার গ্রিক জগতের বাইরে অবস্থান করা বারবারিয়ানরাও গ্রিক সংস্কৃতি ও গ্রিক সামরিক কৌশলকে গ্রহণ করা শুরু করেছিল। এর ফলে একটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটে যায়। এতদিন পর্যন্ত গ্রিক নগররাষ্ট্র বর্বর উপজাতি এব মিশর ও পারস্যের মতো প্রাচ্যের অঞ্চলগুলোর দ্বারা বেষ্টিত থাকায় বহির্বিশ্ব তাদের কাছে হুমকি ছিল না। বর্বর উপজাতিগুলোর কাছে গ্রিসের মতো উন্নততর সভ্যতা ছিলনা, তাদের উন্নত সমরকৌশল ছিলনা, তাই গ্রিক নগর রাষ্ট্রের কাছে এদের পেরে ওঠার কথাও ছিলনা। অন্য দিকে মিশর ও পারস্যের মত প্রাচ্য অঞ্চলের সৈন্যদের মধ্যে গ্রিকদের মতো প্রবল কর্মদক্ষতা ও শক্তি ছিলনা। কিন্তু গ্রিসের প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে গ্রিক ও কর্মদক্ষ হতে থাকে, ফলে এই অঞ্চলগুলো বিপজ্জনকও হয়ে যায়। কেননা এই অঞ্চলগুলোর অঞ্চল ছিল অধিকতর বৃহৎ, ফলে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদও ক্ষুদ্র গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর তুলনায় বেশি ছিল। পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পরের শতকে রাজনৈতিক একক হিসেবে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের ধারণা সেকেলে হয়ে যায়, ভবিষ্যৎ ছিল বৃহত্তর রাজ্যের। গ্রিকরা এপর্যন্ত তা স্বীকার করেনি, এবং তারা কখনো প্রতিবেশী নগররাষ্ট্রগুলোকে করায়ত্ত করতেও সক্ষম হয়নি, যার ফলে তারা নগর রাষ্ট্রের চেয়ে বড় কিছুর সৃষ্টি করতে পারে। এর বদলে নগর রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে রত থাকে, আর বাইরের জগৎ যে পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং তাদেরকে দমন করার মতো নতুন শক্তির সৃষ্টি হচ্ছে সেই বাস্তবতার থেকে দৃষ্টি সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখে।

বহির্বিশ্ব থেকে প্রথম এরকম যে শক্তির উত্থান ঘটল তা আসলে গ্রিকই ছিল, কিন্তু তা আসলে গ্রিসের বাইরের অঞ্চল ছিল। এর উত্থান ঘটে সিসিলিতে যেখানে বারবারিয়ান বিপজ্জনক অবস্থা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করতে থাকে। সাইরাকুজের বিরুদ্ধে এথেনীয় অভিযানের ব্যর্থতার পর কার্থেজ উপলব্ধি করে, এটাই গ্রিকদের ওপর পুনরায় আক্রমণের মোক্ষম সময়। তিন বছর ধরে কার্থেজিয়ানরা সংঘবদ্ধতাহীন গ্রিকদেরকে আক্রমণ করে, যারা পেলোপনেসীয় যুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ের জন্য মূলভূমির গ্রিকদের থেকে কোন রকম সহায়তা পায়নি। এরপর ৪০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডায়ােনিসিয়াস নামে সাইরাকুজের এক নাগরিক সাইরাকুজিয়ান সেনাপতিদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অপবাদ দেন।  নতুন জেনারেলদেরকে নিয়োগ দেয়া  হয়, যার মধ্যে ডায়ােনিসিয়াস নিজে একজন ছিলেন। ধীরে ধীরে ডায়ােনিসিয়াস বিচক্ষণতার সাথে সাধারণ জনতাকে প্রভাবিত করে তার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেন (যা পূর্বে পিসিস্ট্রটাস এথেন্সে করেছিলেন)। ক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে ডায়ােনিসিয়াস সাইরাকুজের টাইরান্ট হয়ে ওঠেন, এবং প্রথম ডায়ােনিসিয়াস নাম গ্রহণ করেন। ডায়ােনিসিয়াস কার্থেজিনিয়ানদের সাথে শান্তি স্থাপন করেন এবং সেই শান্তির সময়কালকে সাইরাকুজকে পুনর্গঠন করতে ব্যবহার করেন। এরপর তিনি গ্রিক প্রতিবেশী অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন, এবং ৩৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাকুজ কার্থেজের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। পরের পনেরো বছরে কার্থেজের বিরুদ্ধে সাইরাকুজ তিনটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, এবং এগুলোতে বিজয়ী হয়ে সিসিলির দ্বীপের ছয় পঞ্চমাংশ জয় করে নেয়। ৩৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কার্থেজিনিয়ানরা কেবল সিসিলির পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্তের সামান্য জায়গাই ধরে রেখেছিল। এটাই ছিল সিসিলীয় গ্রিকদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এরই মধ্যে ৩৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডায়ােনিসিয়াস ইতালির দিকে মনোযোগ দেন, এবং ইতালীয় “জুতার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে” নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইতালীয় উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলের গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোতেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি তিনি আদ্রিয়াটিক সাগর হয়ে এপিরাসেও তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল উত্তর-পশ্চিম গ্রিসের একটি উপজাতীয় এলাকা, যেখানে ধীরে ধীরে গ্রিক সংস্কৃতি প্রবেশ করছিল। 

ডায়ােনিসিয়াসের এত এত সাফল্যের পেছনে আংশিকভাবে অবদান রেখেছিল তার সমর প্রযুক্তি। তার প্রকৌশলীরাই প্রথমবারের মতো বড় পাথর ছোড়ার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল, যা ক্যাটাপাল্ট নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী যুদ্ধের ইতিহাসে এই ক্যাটাপাল্টের বিশাল ভূমিকা ছিল। আর ১৬০০ বছর পর এখান এটাই গানপাউডারের ব্যবহার আবির্ভাবে অবদান রেখেছিল। ডায়োনিয়াস অত্যন্ত সতর্কভাবে তার ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। কথিত আছে তার রাষ্ট্রীয় জেইলখানার চেম্বার ওপেনিং ছিল ঘণ্টা আকৃতির। এর ফলে হাজতের কয়েদিদের গোপন ষড়যন্ত্র তিনি শুনতে পারতেন। এটি তাই “এয়ার অফ ডায়ােনিসিয়াস” বা ডায়ােনিসিয়াসের কান নামে পরিচিতি পেয়েছে। তাকে এতটাই সতর্ক থাকতে হতো (তা সকল গ্রিক টাইরান্টদের ক্ষেত্রেই সত্য)  যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি কখনই স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না। এরই মাধ্যমে সাইরাকুজিয়ান সভাসদ ডেমোক্লেসের গল্পটি বিখ্যাত হয়, যিনি ডায়ােনিসিয়াসকে তার ক্ষমতার জন্য ঈর্ষা করতেন। ডায়ােনিসিয়াস তাকে এক রাতের জন্য টাইরান্ট হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ডেমোক্লেস আনন্দের সাথে তাতে সম্মত হন, এবং গৌরবময় ব্যাংকুয়েট মাথায় পরিধান করেন। এরপর তিনি আবিষ্কার করেন সকলে তার মাথার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছে। তিনি উপরের দিকে তাকালেন এবং সেখানে একটি উন্মুক্ত তরবারি ছিল, যা নিচের দিকে তাক করা ছিল, ঠিক তার উপরেই। সিলিং এর সাথে একটি মাত্র চুলে বাঁধা থাকা অবস্থায় এটি ঝুলছিল। এরকম তিক্তভাবেই ডায়ােনিসিয়াস ব্যাখ্যা করলেন, তার জীবন সবসময়ই এরকম হুমকির মধ্যেই থাকে, এবং ডেমোক্লেস যদি এক রাতের জন্যও টাইরান্ট হন তবুও তাকে এরকম হুমকির মধ্য দিয়েই যেতে হবে। এরপর থেকে এরকম ধারাবাহিকভাবে হুমকিস্বরূপ হওয়া যেকোন বিপদকে “সর্ড অফ ডেমোক্লেস” বলা হয়।

ডায়ােনিসিয়াসের শাসনামলের আরেকটি বিখ্যাত গল্প হচ্ছে পিথিয়াসের গল্প। পিথিয়াস টাইরান্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার দোষে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড লাভ করেছিলেন। কিন্তু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি মিটিয়ে ফেলার জন্য পিথিয়াসের কিছু সময়ের  দরকার ছিল। তাই পিথিয়াস যখন বাড়িতে থাকবে তখন তার জায়গায় হস্টেজ হিসেবে তার একজন ভাল বন্ধু ডেমনকে রাখা হয়েছিল। পিথিয়াস যদি সঠিক সময়ে না ফেরে তাহলে ডেমনকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হবে, এই ছিল শর্ত। ডেমন তাতে রাজিও হয়েছিল। যাই হোক, মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘনিয়ে এলো, কিন্তু পিথিয়াস তো নেই। ডেমনকে ফাঁস পড়ানো হলো। তাকে এখনই ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। এমন সময় দূর থেকে একজনের আর্তচিৎকার শোনা গেল। পিথিয়াস দূর থেকে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে যাতে তার জায়গায় সে মরতে পারে। এই দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ টাইরান্ট এতটাই প্রভাবিত হলেন যে তিনি পিথিয়াসকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বললেন, যদি তার এরকম বন্ধু থাকতো। এরপর থেকে এরকম অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বকে “ডেমন অ্যান্ড পিথিয়াস” বলা হয়।

সাফল্যের সাথে ৩৮ বছর শাসন করার পর ৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডায়ােনিসিয়াস শান্তিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। জীবদ্দশায় তিনিই ছিলেন গ্রিক জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। যদিও তার এই ক্ষমতাটা খুবই আনএপ্রিশিয়েটেড ছিল, কেননা তিনি মূলভূমি গ্রিসের লোক ছিলেন না। এটা আক্ষেপের যে, ঐতিহাসিকরা পেলোপনেসীয় যুদ্ধের পরবর্তী কয়েক দশকের ইতিহাসে কেবল স্পারড়টা, এথেন্স, থিব্‌স, কোরিন্থের সংগ্রাম ও জয় নিয়েই পড়ে থাকেন, কিন্তু এটা ভুলে যান যে সে সময় সাইরাকুজই ছিল গ্রিক জগতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক শক্তি। ব্যাপারটা এরকম যে, বিংশ শতকের প্রথম দশকগুলোতে ঐতিহাসিকগণ কেবল সংঘাতময় ইউরোপীয় শক্তিসমূহের ইতিহাস নিয়েই পড়ে আছেন, যেখানে এদের অনেক পশ্চিমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিল তখন সবচেয়ে শক্তিশালী। সত্যি বলতে কী, কখনও কখনও সাইরাকুজকে “প্রাচীন গ্রিসের নিউ ইয়র্ক” বলা হয়ে থাকে। যদি ডায়ােনিসিয়াসের তার নিজের মত সক্ষম কোন উত্তরাধিকারী থাকতো তাহলে সিসিলিই হয়তো যুক্ত-গ্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিত, সেই সাথে ধীরে ধীরে ক্ষমতায় আসতে থাকা অগ্রীক রাষ্ট্রগুলোকেও দমন করতেন। কিন্তু তা ঘটেনি। ডায়ােনিসিয়াসের উত্তরাধিকারী ও পুত্র দ্বিতীয় ডায়ােনিসিয়াস বা “ডায়ােনিসিয়াস দ্য ইয়ংগার” ক্ষমতায় আরোহনের কালে তরুণ ছিলেন, তিনি ডায়োন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন, যিনি ছিলেন প্রথম ডায়ােনিসিয়াসের শ্যালক।

ডায়োন ছিলেন প্লেটোর শিষ্য। ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো সাইরাকুজে ভ্রমণ করতে এলে তিনি প্লেটোর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। প্লেটো সেসময় টাইরানির সমালোচনা করে টাইরান্ট ডায়ােনিসিয়াসকে অফেন্ড করেছিলেন। ফলে ডায়ােনিসিয়াস ক্ষিপ্ত হয়ে প্লেটোকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিলেন কিন্তু দার্শনিক প্লেটোর জন্য দ্রুত মুক্তিপণ পাঠিয়ে তাকে এথেন্সে নিয়ে আসা হয়, যেখানে তিনি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। ডায়োন তাকে অনুসরণ করেছিলেন, এবং একাডেমিতে প্লেটোর শিষ্য হয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। এখন ডায়োজেনিসের মৃত্যুর পর ডায়োন প্লেটোকে আবার সাইরাকুজে আমন্ত্রণ জানান, এবং নতুন টাইরান্ট দ্বিতীয় ডায়োজেনাসের জন্য প্লেটোকে শিক্ষক নিযুক্ত করেন। প্লেটো আনন্দের সাথেই তাতে সম্মত হন। প্লেটোই বলতেন, যদি রাজা দার্শনিক না হন আর দার্শনিক রাজা না হন তাহলে তার আইডিয়াল স্টেট বা আদর্শ রাষ্ট্র কখনও প্রতিষ্ঠা হবেনা। এবার দ্বিতীয় ডায়ােনিসিয়াসকে শিক্ষা দানের মাধ্যমেই তিনি একজন রাজাকে দার্শনিক হিসেবে প্রস্তুত করার সুযোগ লাভ করলেন। কিন্তু কোন কিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোলো না, না ডায়োনের জন্য আর না প্লেটোর জন্য। দ্বিতীয় ডায়ােনিসিয়াস প্লেটোর দেয়া শিক্ষায় অস্থির হয়ে যান, এবং অনুভব করতে থাকেন যে ডায়োন নিজ হস্তে সিসিলিকে শাসন করার জন্যই তাকে স্কুলে আটকে রাখতে চাচ্ছেন। তাই ডায়ােনিসিয়াস ডায়োনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তাকে রাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করেন, এবং এরপর প্লেটোকেও তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করেন।

তবে ডায়োন আবার ফিরে আসেন, ৩৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সাইরাকুজ অবরোধ করে তরুণ ডায়ােনিসিয়াসকে বিতাড়িত করেন। ডায়নের দর্শন থেকে ভিন্ন হলেও তিনি দুজন ডায়ােনিসিয়াসের মতই টাইরান্টের শাসন অব্যাহত রাখেন। তবে দুই বছর পর ৩৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে তিনি মারা যান। এরপর দ্বিতীয় ডায়ােনিসিয়াস এই বিভ্রান্তকর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আবার ক্ষমতায় আরোহন করেন। এবার তিনি পূর্বের শাসকদের চেয়েও বেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন, অন্যদিকে তিনি খুব একটা সক্ষম শাসকও ছিলেন না। ফলে তার রাজ্যে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। শেষে সাইরাকুজিয়ান নাগরিকরা ৩৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদেরকে এই টাইর‍্যান্টদের হাত থেকে উদ্ধার করতে কোরিন্থ এর কাছে সহায়তার আবেদন করে। এটাকে এক ব্যর্থ আশা বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু কোরিন্থে ঠিক এই কাজের জন্যই একজন উপযুক্ত লোক ছিল, আর তিনি হলেন টিমোলিয়ন, একজন সৎ ও আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক। তিনি এত শক্তভাবে টাইরানীর বিরুদ্ধে ছিলেন যে যখন তার নিজের ভাই নিজেকে টাইরান্টে পরিণত করলেন, টিমোলিয়ন তাকে হত্যার অনুমতি দিলেন। এর রােষে তার নিজের পরিবার তাকে বিশ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। যখন সাইরাকুজ থেকে সাহায্যের আবেদন এলো, তখন তার বয়স ছিল প্রায় সত্তর, কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ এতে রাজি হয়ে গেলেন। ১২০০ সৈন্য  নিয়ে টিমোলিয়ন সিসিলিতে পৌঁছলেন আর দেখলেন এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে যেখানে তরুণ ডায়ােনিসিয়াসের দলবল শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। টিমোলিয়ন ডায়ােনিসিয়াসের আত্মসমর্পণকে মঞ্জুর করলেন, ডায়ােনিসিয়াস এরপর রাজকার্য থেকে অব্যাহতি নিয়ে কোরিন্থে গিয়ে বাকি জীবন শান্তিতে কাটিয়েছিলেন, এবং একটি স্কুল পরিচালনা করেছিলেন। টিমোলিয়ন তখন যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে শান্তি স্থাপন করলেন এবং নিজেকে সাইরাকুজের প্রভু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তিনি নির্বাসিতদেরকে সাইরাকুজে ফিরিয়ে আনলেন, সেখানে গ্রিস থেকে নতুন ঔপনিবেশিকদের মনােযােগ আকর্ষণ করলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, আর তারপর অন্যান্য সিসিলিয়ান শহরে গড়ে ওঠা টাইরানীকে নির্মূল করলেন। যখন কার্থেজ নাক গলানাের চেষ্টা করল তখন খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে টিমোলিয়ন তাদেরকে পরাস্ত করলেন। তিনি সবখানেই সফল ছিলেন, আর তার এই কাজ সমাপ্ত করার পর তিনি অবসর গ্রহণ করলেন, কেননা তিনি নিজের জন্য কোনাে ক্ষমতা চাননি। পরবর্তী বছরে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু প্রথম ডায়ােনিসিয়াসের অধীনে ক্ষমতার যে সংক্ষিপ্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রতিশ্রুতি ছিল, তা তার মৃত্যুর পরবর্তী বিচ্ছুঙ্খলার প্রজন্মে হারিয়ে গেল। এই সুযোগে ইতিহাস সাইরাকুজকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে চলে গেল, আর সাইরাকুজের ভাগ্য থেকে গ্রিসকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল, আর সেই সাথে তার নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ভাগ্যও।

থেসালীর উত্থান ও পতন

যখন সিসিলিতে ডায়ােনিসিয়াস শাসন করতেন, আর স্পার্টা তার পতনের দিকে ধ্বাবিত হচ্ছিল, তখন উত্তর গ্রিসে থেসালী অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল। মাইসিনীয় যুগে, যে ভূখণ্ড পরে থেসালীতে পরিণত হয়, তা ছিল আরগােনটদের নেতা জেসন এবং ইলিয়াডের বীর একিলিসের জন্মস্থান। এটি ছিল গ্রিসের সর্ববৃহৎ সমভূমি, উর্বর আর সুন্দর, অনন্য সুন্দর “ভেল অফ টেম্পি” (টেমপির ঘােমটা), যা গ্রিক লেখকদের লেখায় অমরত্ব পেয়েছিল, তার অবস্থান থেসালীতেই। থেসালী হলাে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের একটি স্থান যেখানে যুদ্ধের জন্য ঘােড়ার খুবই প্রচলন ছিল। অর্ধ-মানব অর্ধ-ঘােড়ার কিংবদন্তী “সেন্টরেরা” থেসালীতে বাস করত বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু কেন থেসালিতেই সেন্টরদের ধারণার উদ্ভব হলো? হতে পারে, প্রাচীন গ্রিকরা প্রথম এই অঞ্চলের লোকেদের মধ্যেই প্রথম ঘোড়সাওয়ারদেরকে দেখেছিল, ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে গ্রিকরা সেন্টর নামে এক পৌরাণিক প্রজাতিকে কল্পনা করে নেয়।

যদি থেসালী কোন ঐক্যবদ্ধ শাসন ব্যবস্থার অধীনে থাকত, তবে এটি হয়ত গ্রিসকে শাসন করতে সক্ষম হত। কিন্তু ডােরিয়ান আক্রমণের পরে থেসালি যেন গ্রিক ইতিহাসের মূল ধারার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তবে থেসালীর অশ্বারোহী সৈন্যরা পরবর্তী গ্রিক ইতিহাসে বিখ্যাতই ছিল আর এরা ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে খুব কার্যকরী ছিল। এদের একটি অংশ এথেন্সের টাইরান্ট পিসিস্ট্রটাসের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু এত শক্তিশালী ও কার্যকরী সৈন্য থাকলেও থেসালী শক্তিশালী ছিলনা, কেননা থেসালী ছিল বিবাদপূর্ণ গােত্রসমূহের দ্বারা বিভক্ত, যার ফলে থেসালীয়রা নিজ শক্তি ব্যবহারের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এরপর, ইপামিনন্ডাসের সময়কালে, থেসালীতে এক নতুন জেসনের উত্থান ঘটল। তিনি ছিলেন জেসন অফ ফিরি। ফিরি (Pherae) নগর ছিল মধ্য থেসালির একটি নগর। চতুর রাজনৈতিক কলাকৌশল আর ভাড়াটে সৈন্য বা মারসেনারিদের কৌশলপূর্ণভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে জেসন তার নেতৃত্বে থেসালীকে ঐক্যবদ্ধ করেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ অব্দে তিনি থেসালীয় গােত্রগুলাের প্রধান সেনাপতি বা জেনারেল ইন চিফ হিসেবে নির্বাচিত হন। যেহেতু স্পার্টা তার আধিপত্য বা হেজিমনির শেষ দিনগুলােতে গ্রিসে নগর-রাষ্ট্রের চেয়ে বড় কোনাে যূথবদ্ধতার বিরুদ্ধে ছিল, তাই জেসন থিব্‌সের সাথে জোটবদ্ধ হন। 

প্রায় তৎক্ষণাৎ লিউক্ট্রার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর জেসন তার অশ্বারোহী সেনাদলের প্রধান হয়ে কয়েকদিন পরেই যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখতে দক্ষিণ দিকে ধেয়ে এলেন (যেমন একসময় স্পার্টানরা উত্তর দিকে এসেছিল ম্যারাথনের অবস্থা দেখতে)। এরপর যখন স্পার্টা বিধ্বস্ত হয় আর থিব্‌স স্পার্টার এই বিধ্বস্ত অবস্থাকেই বজায় রাখাকে নিশ্চিত করায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে তখন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জেসন নিজেকে মূল গ্রিস ভূখণ্ডের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ হিসেবে মনে করতে থাকেন, তিনি গ্রিসে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং ঐক্যবদ্ধ নগররাষ্ট্রগুলােকে পারস্যের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনি হয়ত তা করতেন, তা আর হয়নি, কেননা খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হলেন। তার মৃত্যু থেসালীকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিল। ফিরির শাসনভার জেসনের ভাগ্নে আলেক্সান্ডারের হাতে ন্যস্ত হলাে। কিন্তু আলেক্সান্ডার একজন নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন, যার মধ্যে স্বল্পজীবী জেসনের চমৎকারিত্ব ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জেসনের অধীনে থেসালীয় ট্রাইবগুলো যেমন একত্র হয়েছিল, আলেকজান্ডারের অধীনে তা হলোনা, তারা নিষ্ঠুর আলেকজান্ডারের অধীনস্ততা মেনে নিলনা। ব্যাপারটি আরাে খারাপ হলাে, যখন থেসালীর উত্তরে অবস্থিত মেসিডােনিয়া থেসালির ওপর প্রভাব সৃষ্টির জন্য এদের বিভক্তি ও দুর্বলতার সুযােগটি লুফে নিল।

মেসিডােনিয়া সমৃদ্ধি লাভ করছিল। ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পশ্চিম কোনায় উপকূল থেকে বিশ মাইল দূরে অবস্থিত তার রাজধানী পেলা ছিল রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত কিছু গ্রিকের জন্য আশ্রয়স্থল। এথেনীয় নাট্যকার ইউরিপিডিস তার জীবনের শেষ দশ বছর মেসিডােনিয়ার দরবারে কাটিয়েছিলেন। জেসনের গুপ্তহত্যা মেসিডােনিয়ার জন্য রাস্তা খুলে দেয়, আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৯ অব্দে দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার সিংহাসনে আরােহণ করে থেসালীর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্ত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। অল্প কিছু সময়ের জন্য মেসিডোনিয়ার আলেক্সান্ডার ও ফিরির আলেকজান্ডারের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। থেসালীয় শহরগুলাে, যারা দুই আলেকজান্ডারের প্রভাব থেকেই মুক্ত হতে চাচ্ছিল তারা থিব্‌সের কাছ সাহায্যের আবেদন জানাল, উল্লেখ্য লিউক্ট্রার যুদ্ধের মাধ্যমে গ্রিসে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। প্রত্যুত্তরে থিব্‌স পেলােপিডাসের নেতৃত্বে উত্তরাভিমুখে অভিযাত্রা করে, যিনি স্পার্টান সেনাপতিদের বিরুদ্ধে তার ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে থিবান প্রতিপত্তির দিন শুরু করেছিলেন। পেলেপিডাস দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৮ অব্দে তার এক অভিজাতের হাতে মেসিডােনীয়রাজ দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের গুপ্তহত্যার ফলে চুক্তিটি ব্যর্থ হয়ে যায়। সেই গুপ্তঘাতক দ্রুতই আলেক্সান্ডারের জ্যেষ্ঠ পুত্র তৃতীয় পার্ডিকাসের রিজেন্ট বা রাজপ্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতা দখল করে নেন। পেলােপিডাসকে থিব্‌সে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তাকে এও নিশ্চিত করতে হয় যাতে মেসিডোনিয়া থেসালিতে ভবিষ্যতে আর কোন সংকটের সৃষ্টি না করে। এজন্য তিনি মেসিডােনীয় অভিজাত সম্প্রদায় থেকে কিছু জিম্মি বা হস্টেজ নিজের সাথে করে থিব্‌সে নিয়ে যান। এদের মধ্যেই ছিলেন মেসিডোনিয়ার নতুন রাজা তৃতিয় পার্ডিকাসের ১৩ বছর বয়সী কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফিলিপ।

তবে পেলোপিডাস যেভাবে মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডারকে সামলেছিলেন, ফিরির আলেক্সান্ডারের ক্ষেত্রে তার ভাগ্য সেভাবে প্রসন্ন হয়নি। থেসালিতে দ্বিতীয় অভিযানে পেলোপিডাস আলেক্সান্ডারের হাতে বন্দী হন। এক মাস যাবত তিনি থেসালিতে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। পরে ইপামিনন্ডাসের অধীনে এক থিবান বাহিনী আলেক্সান্ডারকে পেলোপিডাসকে মুক্ত করতে বাধ্য করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৪ অব্দে পেলােপিডাস থেসালীতে তৃতীয় অভিযান চালান আর সাইনোসেফালিতে (Cynoscephalae) আলেক্সান্ডারের সেনাদলের মুখােমুখী হন। সাইনোসেফালি ছিল ফিরির থেকে কাছেই, একটু উত্তরে। সেখানে থিবানরা একটি পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করে, কিন্তু পেলোপিডাস মারা যান। এরফলে ক্রুদ্ধ থিবানরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আলেক্সান্ডারকে আঘাত করে আর তাকে শান্তি স্থাপন করতে বাধ্য করে। এরপর আলেকজান্ডারকে তার নিজের ফিরি নগরেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। জীবন ধারণের জন্য তিনি পরে চোরাকারবারি শুরু করেছিলেন। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৭ অব্দে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে মারা যান। এভাবে গ্রিসের ওপর থেসালীয় হুমকির চিরতরে অবসান ঘটে। 

কারিয়ার উত্থান ও পতন

কিন্তু পূর্বদিকে আরেকটি হুমকির উত্থান ঘটল। এটি পারাস্য ছিল না, একটি পরাশক্তি হিসেবে পূর্বে পারস্যের অস্তিত্ব ছিল ঠিকই। কিন্তু গ্রিসের সাথে নতুন করে ঝামেলা বাঁধাবার অবস্থায় তারা ছিলনা। এবারে পূর্বদিকে যারা গ্রিসের জন্য হুমকি হয়ে এসেছিল তারা ছিল এশিয়া মাইনরের অভ্যন্তরের এক জাতি, যার নাম ছিল কারিয়া (Caria)। কারিয়ানরাই প্রথম থেকে এশিয়ামাইনোরের উপকূল নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু ডোরিয়ান আক্রমণের পরবর্তী যুগে যখন গ্রিকরা এশিয়া মাইনোরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করে তখন এরা সেই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এরপর তারা প্রথমে লিডিয়ার অধীনে চলে যায়, আর তারপর চলে যায় পারস্যের অধীনে। ইতিহাসে তারা এতদিন পর্যন্ত কোনাে স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে যেতে পারেনি, নিদেনপক্ষে স্পার্টার পতনের পরবর্তী সময় পর্যন্ত। তারপরে পারস্য শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে, কারিয়া স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতার অধিকারী হয়। তারা তাদের নিজস্ব নেতাদের অধীনে ছিল যারা নামমাত্র ছিল পারসিক সত্রপ, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা স্বাধীনই ছিল।

তাদের মধ্যে যােগ্যতম আর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছিল মাওসোলাস (Mausolus) যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৭ অব্দে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি এশিয়া মাইনোরের পুরাে দক্ষি- পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি তার রাজধানী অভ্যন্তরীণ কারিয়ান শহর থেকে সরিয়ে উপকুলীয় গ্রিক নগর হেলিকারনাসাসে (Halicarnassus) স্থানান্তর করেন (এই হেলিকারনাসাস ছিল ইতিহাসবিদ হেরােডােটাসের নিজ শহর)। ধীরে ধীরে তিনি এক নৌবাহিনী গড়ে তুলতে শুরু করেন, আর সেই নৌবাহিনী দিয়ে তিনি তার নতুন উপকূলীয় ঘাঁটি থেকে ঈজিয়ান সাগরে প্রধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। সেসময় ঈজিয়ান সাগরে যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সে হলো এথেন্স। স্পার্টার আধিপত্যের যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। আর ইপমিনন্ডাসের মৃত্যুর পর থিব্‌সও তার খােলসে ঢুকে গেছে, এরপর আর তারা কোনাে দূরবর্তী অভিযাত্রায় নিজেকে জড়ায় নি। ফলে এবার এথেন্স পুনরায় নিজেকে শক্তিশালী করার সুযোগ পায়, আরও একবার এথেন্স ঈজিয়ান সাগরকে শাসন করা শুরু করে, উত্তর দিকের অঞ্চলগুলোতে বিজয় অর্জন করে তার জীবনরেখাকে সুরক্ষিত করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঈজিয়ান সাগর নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে কারিয়ার শাসক মাউসেলাসকেও স্বাভাবিকভাবেই এথেন্সের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হবে। কিন্তু তার একটা সুবিধা ছিল এখানে। এথেন্স পুনরায় ঈজিয়ান সাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করলে ঈজিয়ান সাগরের অনেক দীপই এথেনীয় আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। তাদেরকে সহজেই মাউসোলাস নিজের পক্ষে নিয়ে আসা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৭ অব্দে মাউসোলাস তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার কাজ শুরু করেন। তিনি বৃহত্তর ঈজিয়ান দ্বীপগুলাের সাথে ষড়যন্ত্রে জড়ালেন এবং তাদেরকে তাদের এথেনীয় শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে রাজি করালেন। তাদেরকে দমন করতে এথেন্স তার নৌবাহিনী প্রেরণ করে, কিন্তু তা মাউসোলাসের নৌবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এতে এথেনীয় এডমিরালরা অপমানে পদত্যাগ করেন। কিন্তু একজন এথেনীয় এডমিরাল বা নৌসেনাপতি ছিলেন এর ব্যতিক্রম, তিনি হলেন ক্যারেস (Chares)। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫ অব্দে তিনি এশিয়া মাইনর ভূখণ্ডে পৌঁছান, এবং সাফল্যের সাথে পারস্যের সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আরও একবার পারস্য কতটা দুর্বল এবং কত সহজে এথেনীয় সেনাদল পারস্যের সেনাদলকে পরাজিত করতে সক্ষম তার প্রদর্শন হয়ে যায়। কিন্তু ক্যারেসের বিজয় সত্ত্বেও এথেন্স কোনাে বৃহত্তর অভিযান পরিচালনা না করবার সিদ্ধান্ত নিল। সাইরাকুজে অভিযানে ব্যর্থতার ভীতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেই পরাজয় তাদেরকে এরকম অভিযানের প্রচেষ্টা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত করেছে। তাই তারা জিতলেও মাউসোলাসের সাথে শান্তি স্থাপনে রাজি হলাে। বৃহত্তর ঈজিয়ান দ্বীপগুলাে যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তবে তাই হোক। এথেন্সের আর তাতে কোন আপত্তি ছিল না। এথেন্স তাদের ব্যাপারে আগ্রহ ত্যাগ করে দিল। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার কোনাে ইচ্ছাই আর অবশিষ্ট ছিল না। নিজেদের জীবনরেখাকে যদি নিরাপদ রাখার বাইরে আর বেশি কিছু তাদের চাওয়ার ছিল না। কিন্তু মাউসোলাস অবশ্যই সামনে অগ্রসর হওয়া চালিয়ে গেলেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৩ অব্দে হেলিকারনাসাসের পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের রােডস দ্বীপকে নিজ অঞ্চলে যুক্ত করলেন। কিন্তু তিনি তার বিজয়ের ফল ভোগ করে যেতে পারেননি, তার আগেই তিনি মারা যান। আর জেসন অফ ফিরির মতো তার মৃত্যুর সাথে সাথে গ্রিসে কারিয়ার প্রাধান্য বিস্তারের হুমকিও তিরােহিত হলাে।

মাউসোলাসের বিধবা পত্নী আর্টেমিসিয়া তার মৃত্যুতে শােকাক্রান্ত ছিলেন। তিনি তার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তুলতে চাইলেন। হেলিকারনাসাসের পােতাশ্রয়ে মাউসোলাসের স্মরণে একটি বিশাল সমাধিসৌধ নির্মিত হলো। এতে শুধু মৃতরাজার শবদেহই ছিল না, বরং রাজা মাউসোলাস আর আর্টেমিসিয়ার দৈত্যাকার মূর্তিও ছিল। সমাধিসৌধের উপরে একটি খোদিত রথ ছিল, আর ছিল শিল্পিত দেয়াল-নকশা। এই সমাধিসৌধটি মাউসোলাসাসের নামানুসারে মাউসোলিয়াম নামে পরিচিত হয়। আমরা যে সমাধিস্তম্ভ বা সমাধিসৌধ বোঝাতে Mausoleum শব্দটা ব্যবহার করি তার জন্ম এখান থেকেই। এটা ছিল রৌপ্যযুগের ফুরিয়ে আসা সংস্কৃতির একটি নিদর্শন, যার দ্বারা বোঝা যাচ্ছিল যে গ্রিক রুচি এবারে প্রদর্শন ও লােক দেখানাের দিকে ঝুকছে। সাধারণ ডােরিকস্তম্ভ তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের আশেপাশে ভাষ্কর ক্যালিমেকাস (Callimachus) বেশি নকশাময় কোরিন্থিয়ান স্তম্ভের প্রচলন করেন। গৌরবময় পার্থেননের জায়গা গ্রহণ করলো মাউসোলাসের সমাধিসৌধ, যা সত্যিকারের সৌন্দর্যময় হবার জন্য একটু বেশিই কারুকার্যময় ছিল। গ্রিক রুচির এই পরিবর্তন ধরা পরে তাদের সপ্তম আশ্চর্যের তালিকা প্রস্তুতিতে। গ্রিকরা যখন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যকে নির্বাচন করেছিল, তখন তারা তালিকায় এই মৌসলিয়ামকেই রেখেছিল, পার্থেননকে নয়। এই সময়ের আরেকটা “লােকদেখানাে বিস্ময়” ছিল ইফেসাসে। সেই নগরের পৃষ্ঠপােষক দেবী ছিলেন আর্টেমিস, আর তার সম্মানে একটি আকর্ষণীয় ও বিশাল মন্দির নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি গ্রিক ভাষায় আর্টেমিসিয়ন ও ল্যাটিনে আর্টিমিসিয়াম নামে পরিচিত হয়েছিল। এর নির্মাণ শুরু হয় ক্রিসাসের সময়ে, আর তা সমাপ্ত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪২০ অব্দের দিকে। এটি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, তা সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় স্থান করে নেয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দের অক্টোবরে যখন এই আর্টেমিসিয়াম আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আর এটি ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযােগ হিসেবে প্রমাণিত হয়। যখন অপরাধীকে পাকড়াও করা হলাে, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে কেন সে এই কাজ করেছে। সে জবাব দিয়েছিল যে তার নাম ইতিহাসে রাখার উদ্দেশ্যে সে এই কাজ করেছে। এই ইচ্ছাকে তিরােহিত করার জন্য তাকে হত্যা করা হয় আর আদেশ প্রদান করা হয় যাতে সব ধরনের রেকর্ড থেকে তার নাম মুছে ফেলা হয়, আর কখনই সেই নামটা আর উচ্চারিত না হয়। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল, কেন না তার নামটা কোনাে না কোনােভাবে টিকে ছিল এবং তা জানাও গিয়েছিল। সে ছিল হেরােস্ট্রেটাস (Herostratus) আর তাকে সবসময় মনে রাখা হবে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটিতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে ফেলা মানুষ হিসেবে।

মেসিডােনিয়ার উত্থান, ফিলিপ ও আলেকজান্ডারের বিজয় 

ফিলিপের উত্থান 

ক্ষমতালিপ্সু লােকদের মৃত্যু গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি। একটি বিপদ তিরােহিত হতে না হতেই আরেকটি বিপদ উকি দিল। সমস্যাটা ছিল এই যে তখন নগর-রাষ্ট্র ভিত্তিক শাসনপদ্ধতির দিনই তখন চলে গিয়েছিল। গ্রিস নগররাষ্ট্র-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা-নির্ভর বিশাল রাজ্যের দিকে যাবে কিনা সেটা প্রশ্ন ছিলনা। গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলো যে একটি শক্তিশালী একক রাজ্যের অধীনে একত্রিত হবে তা নিশ্চিতই ছিল। প্রশ্ন ছিল এই যে, কাদের অধীনে সমস্ত গ্রিস সেই একক রাজ্যভিত্তিক শাসনের অধীনে আসবে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৫ অব্দে কেউই মেসিডােনিয়াকে বিপদ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেনি। এই তো সেদিন ফিরির জেসন কর্তৃক মেসিডোনিয়া নিয়ন্ত্রিত হতো। এরও পরে রাজা দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের গুপ্তহত্যার পর গুপ্তঘাতক পরবর্তী রাজা তৃতীয় পার্ডিকাসকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শাসন করা শুরু করেন। এভাবেই মেসিডোনিয়া বারবার উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে, এর অবস্থা ছিল এমনই সংকটময়। সেই সাথে মেসিডোনিয়া ছিল অর্ধ-সভ্য উপজাতিগুলো দ্বারা পরিবেষ্টিত, যারা রাজ্যের জন্য সবসময়ই ছিল হুমকি। মেসিডোনিয়াকে সবসময় এসব গােত্রের মোকাবেলা করতে হত বলে গ্রিসে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তার খুব কম সুযোগই থাকতো। প্রকৃতপক্ষে এই মেসিডোনিয়া আসলে গ্রিক কেন্দ্র থেকে দূরে গিয়ে দক্ষিণের সভ্য গ্রিক ও উত্তরের বর্বর উপজাতিদের মধ্যকার কার্যকরী বাফার অঞ্চল হিসেবে কাজ করত।

কিন্তু, খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৫ অব্দে, পরিবর্তনের সূচনা শুরু হয়। সুযােগের অপেক্ষায় থাকা তরুণ রাজা তার গুপ্তঘাতক রাজপ্রতিনিধিকেই গুপ্তহত্যার শিকার বানালেন এবং মেসিডােনিয়ার একক শাসক হয়ে উঠলেন। আর তার পরের বছর, থেসালিতে জিম্মি থাকা তার ছােট ভাই ফিলিপ মেসিডােনিয়ায় ফিরে এলেন। ফিলিপকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ অব্দে থিব্‌সে জিম্মি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তার তিন বছরের সময়কালে তিনি থিব্‌সের শাসক ইপামিনন্ডাসকে জানার সুযােগ পেলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ ফিলিপ থিবান ফ্যালাংক্স, এবং এপিমিনন্ডাসের সেনা পরিচালনার নতুন কৌশল শিখে নেন। থিব্‌সে শেখা এই কৌশলগুলো ফিলিপ আর কখনই ভোলেননি। সেই সময় শত্রুদের দ্বারা জর্জরিত মেসিডোনিয়ায় ফিলিপের এই জ্ঞান ও সামর্থ খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কেননা তদকালীন মেসিডোনিয়ার অভ্যন্তরীন সংকট ছিল আশপাশের উপজাতিদের জন্য আক্রমণের আমন্ত্রণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৯ অব্দে এরকমই এক সীমান্ত-সংঘাতে রাজা পারডিকাসের মৃত্যু হয়। একে মেসিডোনিয়া চারদিক থেকে আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তার ওপর রাজা নিহত। ক্ষমতায় আরোহন করেছে তার বালকপুত্র তৃতীয় আমিন্টাস। মেসিডোনিয়াবাসীরা প্রমাদ গুণতে শুরু করে দিল। এই অবস্থাতেই মেসিডোনিয়ার হাল ধরেন ফিলিপ। তিনি বালক রাজার রিজেন্সি বা রাজ রাজপ্রতিনিধির পদ গ্রহণ করেন, কিন্তু ফিলিপ নিজেই ছিলেন একজন তরুণ, তার বয়স তখন মাত্র একুশ। ফিলিপ দায়িত্বে এসে একজন বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলেন। মেসিডোনিয়ার পশ্চিমে ছিল এপিরাস। সাইরকুজের প্রথম ডায়োনিসিয়াস এপিরাসে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর মাধ্যমে সাইরাকুজের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা তিরোহিত হবার পর এখন এপিরাস স্বাধীন। ৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এপিরাসের রাজার নিস বা ভ্রাতুষ্কণ্যা অলিম্পিয়াসকে বিবাহ করে ফিলিপ এপিরাসের সাথে মৈত্রীবদ্ধ হন।

এরপর অবিশ্বাস্য শক্তির সাথে ফিলিপ সবদিকেই আঘাত হানতে শুরু করলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৮ অব্দে বাইরের উপজাতিদের মেসিডোনিয়ার সীমান্তে আক্রমণের ইতি টানলেন। তিনি প্রথমে উত্তরে পায়োনিয়ানদের (Paeonian) ও তারপর উত্তর-পশ্চিমে ইলিরিয়ানদের আক্রমণ করে তাদেরকে মেসিডোনিয়া থেকে বিতাড়িত করেন। (পরবর্তী কালে অভিযানের মাধ্যমে তিনি এদের উভয়কেই পুনরায় বিধ্বস্ত করেন, এবং তাদের হুমকিকে চিরতরে নির্মূল করেন)। এভাবে উপজাতি গোত্রগুলোকে বিতাড়িত করে ও এপিরাসকে সুরক্ষিত করার মাধ্যমে ফিলিপ পূর্বে থ্রেস থেকে পশ্চিমে আড্রিয়াটিক পর্যন্ত সমগ্র উত্তর গ্রিসের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এবার তিনি ঈজিয়ানের দিকে নজর দিলেন ক্যালসিডিসির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কব্জা করে ফেললেন। ক্যালসিডিসির উপদ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর ছিল ওলিনথাস (Olynthus)। এটি কালসিডীয় নগরগুলাে নিয়ে একটি ঐক্যজোট গঠন করেছিল, যা ফিলিপের উচ্চাশার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন ঈজিয়ান নিয়ন্ত্রণ করা আরেক শক্তি ছিল এথেন্স। এই এথেনীয়রা বা ওলিন্থিরানরা কেউই প্রথমে ফিলিপকে কোনাে সমস্যা হিসেবে গণ্য করেনি। এতদিন পর্যন্ত মেসিডােনিয়ানরা তাদের কাছে উপদ্রবের চেয়ে বেশি কিছু ছিলনা, আর উভয় পক্ষই ফিলিপকে একে অপরের বিপক্ষে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেই চেয়েছিল। এদিকে ফিলিপও ঈজিয়ান নিয়ে উভয় পক্ষের লােভ ও সংঘাত থেকে সুবিধা নেয়ার কৌশল গ্রহণ করলেন, আর উভয়কেই বােকা বানালেন। তিনি এথেনীয়দেরকে ওলিন্থিয়ান অঞ্চলকে তাদের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্ত রাখলেন, আর ওলিন্থাসকে শান্ত রাখলেন তাদের প্রতিবেশী ও দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী পটিডিয়াকে তাদের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আর তারপর এভাবে তিনি যে অঞ্চলই জয় করলেন তার কোনটাই কাউকে না দিয়ে সব নিজের হাতেই রাখলেন। আর এথেনীয় ও ওলিন্থাসের ওপর তার প্রতারণার সকল ক্ষিপ্ত অভিযোগকেই তিনি ঠাণ্ডা মাথায় আনন্দের সহিত সহ্য করে গেলেন। তার এই এই সময়ের জয়গুলোর মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয় ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৮ অ্যাম্ফিপোলিস জয়। কয়েক মাস পরে, তিনি অ্যাম্ফিপোলিসের প্রায় ষাট মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি নগরকে পরিবর্ধন করে এর শক্তিবৃদ্ধি করেছিলেন, আর নিজের নামে নগরের নাম দিলেন ফিলিপ্পি। ফিলিপের এখানে নগর প্রস্তুতির কারণ ছিল। সমগ্র গ্রিসের ওপর তার আধিপত্যের স্বপ্নকে সার্থক করতে হলে তার দরকার অনেক অর্থের, যা দিয়ে তিনি গ্রিকদের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেরকে “কিনে নিতে” পারেন। এই ফিলিপ্পি নগরের নিকটেই ছিল অনেক মূল্যবান সােনার খনি। এগুলো থেকে ফিলিপ প্রচুর অর্থ উৎপাদন করেন।

সেই প্রথম দিককার সময়ে ফিলিপ তার নিজের বাহিনী পুনর্গঠনের কাজেও ব্যস্ত ছিলেন। তার ইতােমধ্যেই অশ্বরােহী সৈন্যবাহিনী ছিল, যা ছিল মেসিডােনিয়ার সেনাদলের ঐতিহ্যবাহী অংশ। কিন্তু তার যা প্রয়ােজন ছিল তা হলাে সুপ্রশিক্ষিত পদাতিক সেনাদল। এজন্য তিনি ইফিক্রেটিসের সমর কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পেটলাস্ট আর পাথর নিক্ষেপকারীদের বা স্লিংগারদের উপ-সেনাদল গঠন করেন। আরও উল্লেখযােগ্য যে ব্যাপারটি ছিল, তা হলো তিনি থিবান ফ্যালাংক্স কৌশলটি গ্রহণ করে তাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উন্নতি সাধনও করেছিলেন। তিনি থিবান ফ্যালাংক্স এর সরল কাঠের লগ মডেলের চেয়েও বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন। তিনি এর ঘনত্ব কমিয়ে দিলেন, ফলে সারি বা রো এর সংখ্যা কমে গেল, ফলে এখানে সেখানে সৈন্যদের পরিচালনা করা সহজ হয়ে গেল। পেছন দিকের সারির সৈন্যরা তাদের বিশাল আকারের বর্শাকে সামনের সারির সৈন্যদের ঘাড়ে রাখতেন, ফলে মেসিডোনিয়ান ফ্যালাংক্স সজারুর মতো দেখতে হয়। বর্শাগুলোকে স্থানান্তরিত করে ও ঘুরিয়ে এই সজারু যেকোন দিকে আক্রমণ করতে পারত।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে, অলিম্পিয়াস এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন, যার নাম রাখা হলো আলেকজান্ডার। একটি গল্প প্রচলিত আছে, যে দিন হিরােস্ট্রেটাস ইফেসাসের আর্টিমিসিয়াম পুঁড়িয়ে ফেলে সেদিনই আলেকজান্ডারের জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই গল্পটি সম্ভবত অনেক পরে তৈরি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফিলিপ জাতির সন্তুষ্টি অনুযায়ী তার সামর্থ্য প্রমাণ করতে পেরেছে। তার বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, যা সে মেসিডোনিয়ার রাজা তরুণ আমিনটাসের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবার মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হতে দিতে চাননি, বিশেষ করে যখন ফিলিপের নিজেরই একজন উত্তরসূরী ছিল। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে ফিলিপ আমিনটাসকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেই রাজা হলেন ও দ্বিতীয় ফিলিপ নাম গ্রহণ করলেন। 

এথেন্সের বক্তারা ও ডেমোস্থিনিসের সাথে ফিলিপের সংঘাত

পেলােপনেসিয়ান যুদ্ধের পরের শতাব্দীতে, এথেন্সে একদল নতুন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের উত্থান ঘটল, যারা ছিলেন সুবক্তা, এদেরকে “ওরেটরস” বলা হতো। তারা চিন্তাশক্তির জোরে গ্রিসে তাদের প্রভাব বিস্তার করলেন, যে চিন্তাগুলোকে তারা প্ররোচনামূলকভাবে ও যুক্তিসহকারে জনতার সামনে উপস্থাপন করতেন। এটাই নির্দেশ করে যে, কিভাবে ধীরে ধীরে কাজ থেকে কথার, কর্ম থেকে বক্তব্যের দিকে পরিবর্তিত হচ্ছিল। এই বক্তাদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতিমান একজন ছিলেন ইসােক্রেটিস (Isocrates), যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৬ অব্দে জন্মেছিলেন। নিজের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রদান করার মতাে প্রয়ােজনীয় কণ্ঠ তার ছিল না, কিন্তু তিনি লিখেছিলেন ব্যাপক, আর ছিলেন একজন কার্যকর শিক্ষক। ওরেটর বা বক্তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন তার শিষ্য। ইসােক্রেটিস ছিলেন এমন একজন গ্রিক, সম্ভবত একমাত্র গ্রিক, যিনি সেই সময়ের সঠিক শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন, আর তা ছিল এই যে, নগর-রাষ্ট্রের যুগ শেষ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০ অব্দে দিকে, তিনি একটি ধারণা বারবার প্রচার করতে লাগলেন, তা হলো গ্রিকদেরকে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়ে দিতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই একটি “প্যান-হেলেনিক” লীগে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদি তাদের একত্র হবার জন্য একটি সাধারণ শত্রুর প্রয়ােজন হয়, সেইক্ষেত্রে তাদের এক পুরনাে শত্রু সবসময়ই ছিল, যা হলো পারস্য। ইসােক্রেটিস একজন শক্তিশালী নেতার খোঁজ করছিলেন যিনি ঐক্যবদ্ধ গ্রিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে পারেন, এবং কিছু সময়ের জন্য, সাইরাকুজের প্রথম ডায়ােনিসিয়াকে নিয়েই তিনি সেই আশা করেছিলেন। কিন্তু ইসােক্রেটিস শেষ পর্যন্ত (আর তিনি একশত বছরের কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন) তার কথায় কর্ণপাত করার মতাে কাউকে পেলেন না। গ্রিসের হৃদয় ছিল আত্মহত্যায় উন্মুখ আর তারা আত্মহত্যা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। 

কিন্তু এথেনীয় বক্তাদের মধ্যে যিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ফিলিপের বিরুদ্ধে একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন ডেমোস্থিনিস। (তাকে একই নামের এথেনীয় জেনারেলের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না যিনি পেলােপনেসাসের যুদ্ধের সময় পাইলোসকে অবরুদ্ধ করেছিলেন এবং সাইরাকুজে মারা গিয়েছিলেন।) সুবক্তা ডেমোস্থিনিস জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে যখন এথেন্স কেবলই পেলােপনেসাসের যুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছিল। তার শৈশব ছিল খুবই কঠিন, কেননা তিনি যখন খুব ছােট, তখন তার পিতা মারা যান এবং কিছু আত্মীয় পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে আত্মেগােপন করে। ডেমোস্থিনিস নিজ প্রচেষ্টায় উপরে ওঠার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে বাধ্য হন। এবং তার অমানবিক কষ্ট নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে মহত্ত্বের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মাথার একদিক কামিয়ে রাখতেন বলে ধারণা করা হয় যাতে করে নিজেকে সবার অগােচরে রেখে অধ্যয়নে ব্যস্ত রাখা যায়। তিনি থুকিডাইডিসের সবকিছুই আটবারের মতাে টুকে নিয়েছিলেন তা ভালো করে পড়াশােনার জন্য। তার কথা বলায় কিছু সমস্যা ছিল, তাই তিনি মুখে পাথর রেখে কথা বলার অভ্যাস করেছিলেন পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলার উদ্দেশ্যে। তিনি থপথপ এগিয়ে চলা স্রোতের বিরুদ্ধেও চিৎকার করতেন যাতে করে তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়। অবশেষে, তিনি নিজেকে একজন বড় বক্তায় পরিণত করলেন; সর্বকালের অন্যতম সেরায়।

ডেমোস্থিনিসের এমন একটি এথেন্সের স্বপ্ন ছিল যা গ্রিসের সবার জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করবে, যারা বারবারিয়ানদের হুমকির মুখে থাকা কোনাে গ্রিক নগরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে। ডেমোস্থিনিসের কাছে ফিলিপ ছিল একজন বারবারিয়ান, আর তিনি উদ্বেগের সাথে লক্ষ করলেন যে মেসিডােনিয়ানরা উত্তর ঈজিয়ান উপকূল ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৫ অব্দে সমগ্র গ্রিসের পরিস্থিতি ছিল ফিলিপের ওপর নির্ভরশীল। সেই বছর ফোসিস তার ডেলফি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আরেকটি টানা প্রচেষ্টার একটি অংশ হিসেবে আরও একবার পবিত্র নগরটি দখল করল যা একসময় তার অঞ্চলের অংশ ছিল। এটি “তৃতীয় পবিত্র যুদ্ধ” এর সূচনা করল। থিবানরা ফোসিসের বিরুদ্ধে মাঠে নামল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৪ অব্দে ফোসিয়ানদের পরাস্ত করল, কিন্তু পুরােপুরিভাবে নয়। যখন থিবানরা চলে গেল, সমর্থ নেতৃত্বের অধীনে ফোসিস আবার তার প্রভাব বাড়িয়ে নিল আর এমনকি তারা উত্তরে থেসালীর অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে শুরু করল। অল্প সময়ের জন্য, মনে হলাে ফোসিস উত্তর গ্রিসে তার প্রভুত্ব অর্জনের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু থেসালীয়রা ফিলিপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল যিনি কেবলই উত্তরে তার সর্বশেষ অবস্থান দখল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পবিত্র ডেলফিকে রক্ষা করার ছলে তিনি দক্ষিণে অগ্রসর হলেন। ফোসিয়ানরা কিছু সময়ের জন্য তাকে আটকে দিতে সমর্থ হয়েছিল, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৩ অব্দে, ফিলিপ তাদেরকে পরাজিত করে থেসালীর সবটুকুই দখলে নিয়ে নিলেন। উত্তরের সবখান থেকে (ওলিন্থাস ছাড়া) শুরু করে থারমােপাইলের গিরিপথ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন প্রভু। জারেক্সেসের পর কোনাে “বারবারিয়ানই” গ্রিসকে এই অবস্থায় নিয়ে আসতে পারেনি। এথেন্স, স্পার্টা আর অন্যান্য গ্রিক নগরগুলাে সম্মিলিতভাবে ফোসিসকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসায় ফোসিসকে তখনকার মতো বাঁচানো গেল। কিন্তু যথারীতি কোনাে ঐক্যজোটই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারল না। স্পার্টা যা বিশ বছর আগে হারিয়েছিল তা সে পুনরুদ্ধার করতে তখনাে চেষ্টা করে যাচ্ছিল, আর আর্কেডিয়ার মেগাপােলিস আক্রমণ করতে পরিকল্পনা করেছিল। এথেন্স তাকে থামাতে চেষ্টা করল, ফলে ফিলিপ-বিরোধী ঐক্যজোটে ফাটল ধরল, ফলে ফিলিপের আছে তা পরাজিত হলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫২ অব্দে, ফিলিপ থ্রেসের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং সেই প্রণালীতে তার প্রভাব বাড়িয়ে নিলেন যেটি ছিল গ্রিসের জীবনীরেখার সমতুল্য। এটা ছিল শেষ খড়কুটো। মাউসোলাস মারা গিয়েছিলেন, আর এথেন্সকে লক্ষ্যচ্যুত করার মতাে কিছুই ছিল না। একজন অন্ধও দেখতে পাচ্ছিল যে মাউসোলাস যে পরিমাণে বিপজ্জনক ছিলেন, ফিলিপ ছিলেন তার থেকে অনেক অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাই, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫১ অব্দে, ডেমোস্থিনিস তার এক অন্যতম বক্তব্য প্রদান করতে চললেন। এটা বক্তৃতাটি ছিল প্রথম “ফিলিপিক”, বক্তৃতার কেন্দ্রে ফিলিপ ছিলেন বলেই বক্তৃতার এই নাম। আর তারপর থেকে “ফিলিপিক” শব্দটি কোনাে বিশেষ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কোনাে সরাসরি ও রুঢ়ভাবে দেয়া ভাষণ বােঝাতে ব্যবহৃত হত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোনাে ধর্মযুদ্ধে জড়িত হবার সময় এথেন্স অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছিল, ডেমোস্থিনিসের বাক্যবাণ কেবল দুর্বল সাড়াই জাগাতে পেরেছিল।

কিছু সংখ্যক এথেনীয় ছিল যাদের ডেমোস্থিনিসের মতাে মেসিডােনিয়া বিরােধী ধারণা ছিল না। তারা ফিলিপকে বিপজ্জনক বারবারিয়ান হিসেবে দেখত না, বরং একজন সীমান্তবর্তী গ্রিক হিসেবে দেখত যিনি নগর-রাষ্ট্রগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করে পারস্যের বিরুদ্ধে একটি প্যান-হেলেনিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে শক্তিশালী ছিলেন। ইসােক্রেটিস ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তার সাথে ছিলেন আরেকজন সুবক্তা ঈসকিনেস, যিনি ডেমোস্থিনিসের চেয়ে খুব একটা খারাপ ছিলেন না, এবং শান্তির স্বপক্ষের একজন হিসেবে টিকে ছিলেন। ডেমোস্থিনিসের বক্তব্যকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে ফিলিপ ওলিন্থাসসহ কালসিডিসির অবশিষ্টাংশের দিকে অগ্রসর হলেন। ওলিন্থাস ভীত হয়ে, এথেনীয় সাহায্যের জন্য আবেদন জানাল এবং ডেমোস্থিনিস সেই সাহায্য প্রদান করার জন্য তিনটি বক্তব্য প্রদান করলেন। এথেন্স যা করতে পারত, তা হলাে কিছু ভাড়াটে সৈন্যের প্রধান করে তার সেনাপতি কেরিসকে পাঠানো, কিন্তু তা ছিল একেবারে অপর্যাপ্ত। ফিলিপ কেরিসকে একদিকে সরিয়ে দিলেন আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৮ অব্দে ওলিন্থাস দখল করে নিলেন। 

এথেন্সের হাতে শান্তির আবেদন জানানাে ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। মধ্যস্থতা করতে ফিলিপের কাছে দশজন দূত পাঠানাে হলাে, যাদের মধ্যে ছিলেন ডেমোস্থিনিস আর ঈসকিনেস। ফিলিপ সতর্কতার সাথে একটার পর একটা অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টা বিলম্ব করাতে লাগলেন আর এই বিলম্বটা তিনি থ্রেসের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে নিতে কাজে লাগালেন। অবশেষে, তিনি সন্ধিতে স্বাক্ষর করলেন, যেখানে এথেন্সের কাছে থ্রেসিয়ান কেরসােনিস দিয়ে দেয়া হলো, এবং যেখানে আশি বছর পর এথেন্স অনিবার্যতায় কাছে মাথা নত করল ও অ্যাম্ফিপোলিসের সকল দাবি পরিত্যাগ করল। সন্ধি স্বাক্ষরের পরে ফিলিপ ফোসিয়ানদের শাস্তি দিতে থারমােপাইলের গিরিপথে ধীরস্থিরভাবে এগিয়ে গেলেন, যে ফোসিস দশ বছর ধরে ডেলফিকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। থিব্‌সের সাথে মিলে তিনি ফোসিসের কাছ থেকে ডেলফিকে নিয়ে নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৬ অব্দে, ফিলিপই (ডেমোস্থিনিসের ভাষ্য অনুযায়ী যে একজন গ্রিক নয়) পিথিয়ান গেমসে সভাপতিত্ব করেছিলেন, যা দুই শতাব্দী পূর্বে সিসিওনের ক্লিসথিনিস প্রথম পবিত্র যুদ্ধ উপলক্ষে উদ্বোধন করেছিলেন। 

থিব্‌সের পতন ও ফিলিপের গ্রিস জয়

ডেমোস্থিনিস ফিলিপের সাথে তার শত্রুতাকে দূরে রাখার মতাে কিছুকেই প্রশ্রয় দেননি আর তার সব প্রচেষ্টা তিনি সমর্পিত করেছিলেন মেসিডােনিয়ার বিরুদ্ধে নতুন আর অধিক সফল যুদ্ধ সংগঠিত করতে। ধীরে ধীরে তিনি এথেন্সের প্রো-মেসিডােনিয়া বা মেসিডোনিয়া-পক্ষের শক্তির চেয়ে অধিক শক্তি অর্জন করলেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৪ অব্দে তিনি একটি জ্বালাময়ী “দ্বিতীয় ফিলিপিক” বক্তৃতা প্রদান করলেন। কিন্তু, ফিলিপ তার নিজ রাস্তায় অটল থাকলেন এবং থ্রেসের যা বাকি ছিল তা দখল করতে থাকলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ অব্দে তিনি ঈজিয়ানের একশত মাইল উত্তরে ফিলিপ্পোপােলিস বা “ফিলিপের নগর” প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি আরও উত্তরাভিমুখে অগ্রসর হলেন যা দেড় শতাব্দী পূর্বে থ্রেসে দারিয়ুসের আক্রমণের সময় থেকে কেউ করতে পারেনি। সেই বছর, ডেমোস্থিনিস তার তৃতীয় ফিলিপিক বক্তৃতা প্রদান করলেন এবং বাইজেন্টিয়াম প্রােপন্টিসের গ্রিক নগরগুলােকে ফিলিপের বিরুদ্ধে জেগে ওঠাতে রাজি করালেন। তিনি এথেন্সকে সম্পূর্ণরূপে বাইজেন্টিয়ামকে সাহায্য করতে বাধ্য করলেন আর এটি যেন এথেন্স আর মেসিডােনিয়ার যুদ্ধের পুনর্নবায়ন করল। তখন ফিলিপ তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার মুখােমুখি হলেন, কেননা দীর্ঘ এক অবরােধের পরও তাকে তার বাইজেন্টিয়াম দখলে নেয়ার চেষ্টা পরিত্যাগ করতে হলাে। ফলে তার সম্মানহানি ঘটল আর ডেমোস্থিনিসের সম্মান বেড়ে গেল। 

কিন্তু ফোসিসের নগর অ্যাম্ফিসা (Amphissa) কিছু জমিতে চাষ করে আসছিল যা দুই শতাব্দী পূর্বে ক্রিসার অংশ ছিল এবং প্রথম পবিত্র যুদ্ধের পর যা এক অভিশাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। যে পাদ্রী এখন ডেলফি নিয়ন্ত্রণ করছিল, তিনি এই ব্যাপারে একহাত নিতে চাইলেন এবং “চতুর্থ পবিত্র যুদ্ধ” শুরু হয়ে গেল। আরও একবার ফিলিপকে আহ্বান করা হলাে আর শীঘ্রই তার সেনাদল কোরিন্থ উপসাগরের উপকূলে অবস্থান গ্রহণ করল। ডেমোস্থিনিস তখন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করলেন। তিনি থিব্‌সকে ফিলিপের বিরুদ্ধে এথেন্সের সাথে জোটে যোগ দিতে রাজি করালেন। থিবানরা, যদিও পঁচিশ বছর পূর্বে ইপামিনন্ডাসের মৃত্যুর পর থেকে খুব কমই সক্রিয় ছিল, তবুও তার স্মৃতি থেকে লিউক্ট্রা আর মানটিনির যুদ্ধের স্মৃতি মুছে যায়নি, এবং তারা নিজেদেরকে বড় সামরিক শক্তি মনে করত। ডেমোস্থিনিসও এটি বিশ্বাস করতেন, এবং থিবান সেনাদলের ছায়ায় নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতেন। পশ্চিম বিওটিয়ার কেরােনিয়ায় থিব্‌স আর এথেন্স একসাথে মেসিডনদের শক্তির মােকাবিলা করল। থিবান স্যাক্রেড ব্যান্ড যা এক প্রজন্ম আগে ইপামিনন্ডাসের হাতে গঠিত হবার পর থেকে কখনাে পরাজিত হয়নি, তারা মেসিডােনিয়ান ফ্যালাঙ্কসের মুখােমুখী হলাে। এটা ছিল মেসিডোনিয়ান ফ্যালাঙ্কসের জন্য প্রথম সত্যিকারের বড় পরীক্ষা। যুদ্ধটির ফলাফল ছিল গ্রিকদের জন্য ভয়াবহ। এথেনীয়রা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌঁড়ে পালাল। পলায়নকারীদের মধ্যে ডেমোস্থিনিসও ছিলেন, যিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিতে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। যুদ্ধের পর দৌঁড়ে পালানাের জন্য তাকে নিন্দা করা হয়েছিল, এবং তিনি যে বাক্যে তার প্রতি উত্তর দিয়েছিলেন, তা এখন বিখ্যাত। কিছুটা পরিবর্তন করলে তার মানে দাঁড়ায়, “যে যুদ্ধ করে আর দৌঁড়ে পালায়, সে আরেকদিন যুদ্ধ করার জন্য বেঁচে থাকে”)। 

কেরােনিয়ায় থিবানরা আরও সম্মানজনকভাবে লড়াই করল। স্যাক্রেড ব্যান্ড ভেঙ্গে পড়ল আর তা মেসিডোনিয়ান ফ্যালাংক্সের বিরুদ্ধে টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল। কিন্তু তারা পালিয়ে গেল না। শেষ সৈন্যটি পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে মারা গেল, যেমনটা ঘটেছিল থারমােপাইলির যুদ্ধে স্পার্টানদের ক্ষেত্রে। থিবানদের জন্য এটা পরাজয় ছিল, কিন্তু লজ্জা ছিলনা। এটি ছিল থিবান কর্তৃত্বের সমাপ্তি আর মেসিডােনিয়ান কর্তৃত্বের সূচনা, যা এক শতাব্দীর বেশিকাল ধরে টিকে ছিল। বলা হয় যে কেরােনিয়ার খবর শুনে ব্যাথিত হৃদয়ে বৃদ্ধ ইসােক্রেটিস মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু আসলে তা হবার ছিল না, সব সময়ই তিনি ছিলেন ফিলিপের পক্ষের, নিজেকে সময়ের সঠিক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, এবং ফিলিপকে পারস্যের বিপক্ষে সম্মিলিত গ্রিসকে নেতৃত্বে দিতে আহ্বান করেছিলেন (ঠিক যা ফিলিপ তখন করার পরিকল্পনা করেছিলেন)। এটাই হতে পারে যে ইসােক্রেটিস বৃদ্ধ বয়সের কারণেই মারা গিয়েছিলেন। কেরােনিয়ার যুদ্ধের সময়ে তার বয়স ছিল ৯৮ বছর। ফিলিপস থিব্‌স দখল করে তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করলেন কিন্তু এথেন্সকে অক্ষত ছেড়ে দিলেন এবং তার মহত্ত্বের কারণে এথেন্স তার কাছে আত্মসমর্পণ করল। এটা হয়তাে এথেন্সের অতীতের জন্য তার অনুরক্ততার কারণে হয়েছিল, কিন্তু এর সাথে তা হয়তাে এথেনীয় নৌবাহিনীর প্রতি তার সম্মানের কারণে হয়েছিল, যা তখনাে অক্ষত ছিল এবং তিনি যদি অ্যাটিকা অবরােধ করতেন, তখন এটি তাকে অনেক সমস্যায় ফেলতে পারত। 

শুধু পেলােপনেসাস অবশিষ্ট ছিল আর ফিলিপ এখন সেইদিকে অগ্রসর হলেন। স্পার্ট ছাড়া তিনি আর কোনােখান থেকেই প্রতিরােধের সম্মুখীন হলেন না। স্পার্টা একাই তার অতীতের গৌরবাজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করল। কাহিনী আছে যে ফিলিপ স্পার্টাকে এক বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যাতে বলা ছিল, “যদি আমি ল্যাকোনিয়ায় প্রবেশ করি, তাহলে আমি স্পার্টাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব।” স্পর্ধিত স্পার্টানরা নাকি প্রত্যুত্তর লিখেছিল একটিমাত্র শব্দে : “যদি!”। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যাকোনিজম। ফিলিপ হয়তাে অসহায় নগরটির গর্বের কারণে তার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্তবােধ করেছিলেন। তিনি হয়তাে থারমােপাইলির যুদ্ধের কথাও স্মরণ করেছিলেন এবং বুঝেছিলেন যে স্পার্টা তার কোনাে ক্ষতি করতে পারবে না। যেকোনাে কারণেই হােক স্পার্টার ওপর জোর খাটানাে ছাড়াই তিনি পেলােপনেসাস ত্যাগ করলেন। 

ফিলিপ এখন গ্রিসের সবটুকুরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন (বিভাজিত স্পার্টাকে ছাড়া), এবং তিনি সব গ্রিক নগরের সম্মিলিত কাউন্সিলের আহ্বান করলেন। তারা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দে কোরিন্থে মিলিত হলেন, যেমনটি তারা দেড় শতাব্দী পূর্বে পারসিক বিপদ মােকাবেলা করতে করেছিলেন। এইবার, যেমন করেই হােক, আলােচনার টেবিল ঘুরে গেল। তারা ফিলিপকে আদেশদাতা সেনাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ভােট দিল। এমনকি এশিয়া মাইনোরে অগ্রবর্তী মেসিডােনিয়ান বাহিনীকে প্রেরণ করা হলাে সাধারণ আক্রমণের পথ প্রশস্ত করতে। কিন্তু, এই মুহূর্তে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা দিল। ফিলিপ হয়তাে ডেমোস্থিনিসকে পরাজিত করে পুরাে গ্রিসে রাজত্ব করতে পারতেন, কিন্তু তার পরিবারে তার চেয়েও একজন শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন; তার এপিরট স্ত্রী, অলিম্পিয়াস। ফিলিপ অনেকদিন থেকেই অলিম্পিয়াসকে নিয়ে ক্লান্ত ছিলেন, অলিম্পিয়াস ছিলেন এক রুঢ় ও কঠিন নারী। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দে ফিলিপ তার সাথে বিবাহবিচ্ছেদ করার এবং তার এক সেনাপতির তরুণী ভাগ্নিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অলিম্পিয়াস এপিরাসে তার ভাইয়ের রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। তিনি ছিলেন ক্ষিপ্ত এবং যেকোনাে উপায়ে প্রতিশােধ নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ফিলিপ বিয়ের পিড়িতে বসলেন, এবং নতুন স্ত্রীর ঘরে এক সন্তানের জন্ম দিলেন। নতুন সন্তানের কারণে তার পুত্র আলেকজান্ডারকে উত্তরাধিকারী না বানানাের সম্ভাবনা বেড়ে চলছিল, এবং তার সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও বেড়ে যায়, যার ফলে ফিলিপের সব পরিকল্পনা বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফিলিপ সমস্যাকে আগাম প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিলেন এপিরাসের রাজাকে (অলিম্পিয়াসের ভাই) নিজের পাশে নিয়ে এসে। ফিলিপ তার কন্যার সাথে এপিরট রাজার বিয়ের প্রস্তাবনা পাঠালেন। প্রস্তাবটি গৃহিত হলাে আর বিয়ের উৎসব খুব আনন্দময় ও জমকালাে ছিল। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে এই বিয়ের উৎসবে গ্রিসের দিগ্বিজয়ী ফিলিপ, তার খ্যাতির শীর্ষে এবং এশিয়ার পদচারণার দ্বারপ্রান্তে থাকাকালীন সময়ে গুপ্তহত্যার শিকার হলেন। কারােই সন্দেহ ছিল না যে অলিম্পিয়াস গুপ্তহত্যাটি সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন এবং অনেকে সন্দেহ করেছিল যে এতে আলেকজান্ডারেরও হাত ছিল। 

আলেক্সান্ডরের উত্থান

ফিলিপের মৃত্যুর সাথে সাথেই স্বাধীনতা ফিরে পাবার আশায় গ্রিক নগরগুলাে আনন্দের সাথে জেগে উঠল। তারা পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে। গ্রিকদের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। কারণ ডায়ােনিসিয়াসের মৃত্যুর পর সাথে সাথে সাইরাকুজিয়ান শক্তির, জেসনের মৃত্যুর সাথে সাথে থেসালীয় শক্তির আর মাউসোলাসের মৃত্যুর সাথে সাথে কারিয়ান শক্তির অবসান ঘটেছিল। নিশ্চিতভাবেই ফিলিপের সাথে সাথে মেসিডােনীয় শক্তিরও নিঃশেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। ফিলিপের পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার নাম নিয়ে সিংহাসনে আরােহণ করলেন, তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ডেমোস্থিনিস সন্তুষ্টির সাথে উচ্চারণ করলেন, “একজন বালকমাত্র”। আর তার প্রতি খুব একটা নজরও দেয়া হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য ডেমোস্থিনিসের, আলেকজান্ডার কেবল একজন বালক ছিল না। ফিলিপ ছিলেন ইতিহাসের উল্লেখযােগ্য কয়েকজন অন্যতম যারা তাদের চেয়েও উল্লেখযােগ্য পুত্র রেখে যেতে পেরেছিলেন। তবে একভাবে, এটি ফিলিপের জন্য ছিল দুর্ভাগ্যজনক, কেননা তার বিরাট সব কীর্তি তার পুত্রের আরও বড় সব কীর্তির কারণে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। 

আলেকজান্ডারের শৈশব সম্মন্ধে কিছু বিখ্যাত গল্প প্রচলিত আছে। অন্যতম বিখ্যাত গল্পে বলা আছে, তিনি একটি বন্য ঘােড়াকে বশ মানিয়েছিলেন যা আর কেউ পারেনি। আলেকজান্ডার খেয়াল করেছিলেন যে ঘােড়াটি তার নিজের ছায়া দেখে আতঙ্কিত; তিনি তখন ঘােড়াটাকে এমনভাবে ঘােরালেন যেন এটির মুখ সূর্যের দিকে থাকে। যখন এর ছায়া এর পেছনে পড়ে থাকল, তখন ঘােড়াটি শান্ত হয়ে এলো এবং তাকে বাগে আনা সহজ হলাে। ঘােড়াটির কপালে ষাঁড়ের মাথার মতাে চিহ্ন ছিল, তাই তার এর নাম দেয়া হয় বুসেফলাস বা ষাঁড়ের মাথা। আলেকজান্ডার তার পরবর্তী জীবনের সবটুকুতেই এতে আরােহণ করেছিলেন আর এটি ছিল সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ঘােড়া।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৪২ অব্দে, যখন আলেকজান্ডারের বয়স ছিল চৌদ্দ, তাকে এক গ্রিক শিক্ষকের অধীনে দেয়া হলাে। এই শিক্ষক ছিলেন এরিস্টোটল, পরবর্তী সময়ে যাকে গ্রিক চিন্তাবিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এরিস্টোটল খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে কালসিডিসির স্টাজিরা নগরে জন্মেছিলেন। তার পিতা মেসিডনের ফিলিপের পিতা দ্বিতীয় আমিনটাসের কাছে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। সতের বছরের তরুণ এরিস্টোটল এথেন্সে ভ্রমণ করেছিলেন প্লেটোর নিকট অধ্যয়ন করার জন্য, তিনি ৩৬৭ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৭ সাল পর্যন্ত একাডেমিতে ছিলেন এবং প্লেটোর মৃত্যুর পরই সেই স্থান ত্যাগ করেন। যখন আলেকজান্ডার রাজা হলেন, এরিস্টোটল এথেন্সের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন এবং সেখানে “লাইকিওন” নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, যা ল্যাটিন উচ্চারণে ছিল লাইসিয়াম। এই নামকরণটি করা হয়েছিল নিকটবর্তী অ্যাপােলাে লাইকিওস (নেকড়ের শিকারি অ্যাপােলাে) এর মন্দিরের সম্মানে। এরিস্টোটলের লেকচারগুলাে অনেকগুলাে ভলিউমে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং তা সেই সময়ের জ্ঞানের এক ব্যক্তির বিশ্বকোষ হিসেবে এটি প্ৰজিনিধিত্ব করে, যার অধিকাংশই এরিস্টোটলের নিজের চিন্তা, পর্যবেক্ষণ আর সাংগঠনিক সামর্থকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি পুরােপুরি বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবৃদ্ধ ছিল না, কেননা এরিস্টোটল নীতিবিদ্যা, সাহিত্যের সমালােচনা, আর রাজনীতি নিয়েও কাজ করেছিলেন। সব মিলিয়ে তার ভলিউমের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০, যার মধ্যে মাত্র পঞ্চাশটির মতাে টিকে আছে। এরিস্টোটল নগর-রাষ্ট্রের প্রকৃত মৃত্যুর সময়েই বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক আলােচনা শুধু নগর-রাষ্ট্র নিয়েই ছিল। তিনি প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হলেও নগর রাষ্ট্রের বাইরে তিনি এক ইঞ্চিও দেখতে পাননি)।

এরিস্টোটল গণিত নিয়ে কাজ করেননি, কিন্তু তিনি গণিতের কাছাকাছি চিন্তার শাখা যুক্তির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি দারুণভাবে প্রস্তাবনা থেকে প্রয়ােজনীয় উপসংহার পর্যন্ত কার্যকারণের শিল্পের উন্নতি ঘটিয়েছিলেন এবং তাতে পরিপূর্ণতা এনেছিলেন। তার সবচেয়ে সফল বৈজ্ঞানিক লেখাগুলাে ছিল প্রাণীবিদ্যা নিয়ে। তিনি ছিলেন একজন সতর্ক এবং নিখুঁত পর্যবেক্ষক যিনি প্রাণীদের প্রজাতির শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে উৎসাহী ছিলেন। তিনি সমুদ্রের জীবনের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন এবং পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে ডলফিন সন্তানকে মাঠের পশুদের মতােই লালন-পালন করে। এই কারণে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে ডলফিন মাছ নয়, এবং এখানে তিনি তার সময়ের চেয়ে ২০০০ বছর এগিয়ে ছিলেন। পদার্থবিদ্যায় এরিস্টোটল অনেক কম সফল ছিলেন। তিনি ডােমােক্রিটাসের পরমাণুবাদ এবং হেরাক্লিসের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি ইয়ুডােক্সাসের হেভেনলি স্ফিয়ার ধরে এগিয়েছিলেন এবং তার সাথে আরও কয়েকটি যােগ করে সর্বমােট চুয়ান্নতে পৌঁছেছিলেন। তিনি এমপেডােক্লিসের চার পদার্থ গ্রহণ করেছিলেন এবং “ইথার” নামে পঞ্চম একটি যােগ করেছিলেন যাতে মনে করা হয় আকাশমণ্ডলী গঠিত।

আলেকজান্ডার এরিস্টোটলের শিক্ষার কতটুকু গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল অনিশ্চিত। তিনি কয়েক বছরের জন্য এরিস্টোটলের ছাত্র ছিলেন, এবং সেই বছরগুলােতে তিনি রাজপুত্রের দায়িত্ব নিয়েও ব্যস্ত ছিলেন। যখন তার বয়স ছিল ষোল, তখন তিনি ইতােমধ্যেই মেসিডােনিয়ার দায়িত্বে ছিলেন যখন তার পিতা বাইজেন্টিয়ামের অবরােধ নিয়ে ব্যস্ত। যখন ফিলিপ অবরােধে ব্যর্থ হচ্ছিলেন, তখন আলেকজান্ডার কিছু গােত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতে সফল হচ্ছিলেন। তখন মেসিডোনিয়া এক বালকের দায়িত্ব থাকায় এই গোত্রগুলো মেসিডােনিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়াকে নিরাপদ ভেবেছিল। কিন্তু তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে ১৮ বছর বয়সী আলেকজান্ডার কেরােনিয়ায় যুদ্ধ করেছিলেন। সেই যুদ্ধেই মেসিডোনিয়া থিব্‌সকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে তিনিই থিবান স্যাক্রেড ব্যান্ডের ওপর চার্জ করে তাদের বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন, যার বদৌলতে তার পিতা ফিলিপ সমগ্র গ্রিসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।

আর এখন তিনি বিশ বছর বয়েসী এক রাজা, যিনি অনন্য সাধারণ শক্তি প্রদর্শন করে আর বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে তার কাজ চালিয়ে গেলেন। মেসিডােনিয়ার ভেতরে যারা তার সিংহাসনের অধিকারকে বিতর্কিত করতে পারে তাদের তিনি দ্রুত তাদের হত্যার ব্যবস্থা করলেন। এর মধ্যে ছিল ফিলিপের দ্বিতীয় স্ত্রী, আর তার নবজাতক পুত্র, তার পাশাপাশি তার কাজিনকেও, যিনি একসময় তৃতীয় আমিনটাস হিসেবে সিংহাসনে বসেছিলেন। এসব করা সম্পন্ন হলে তিনি দক্ষিণদিকে গ্রিস অভিমুখে ধাবিত হলেন। গ্রিকদের উদযাপন ভেঙে পড়ল যখন তারা হঠাৎ করে বুঝতে পারল যে তরুণ ব্যক্তিটির মধ্য দিয়ে আগের চেয়েও বেশি প্রতাপশালী হয়ে আবারও ফিলিপ ফিরে এসেছে, তখন তারা তৎক্ষণাৎ চুপসে গেল। কোরিন্থে আলেকজান্ডার পারস্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিত গ্রিক সেনাদলের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হলেন, আর তার পিতার জায়গাটিতে বসলেন। 

কোরিন্থের বাইরে, আলেকজান্ডার ডাইয়ােজিনিস দ্য সিনিকের সাথে দেখা করলেন, তখন এই দার্শনিক ছিলেন মধ্য সত্তরের এক বৃদ্ধ। সাক্ষাৎকালে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত দার্শনিক তার টাবের বাইরে রােদ পােহাচ্ছিলেন। আলেকজান্ডার ডাইয়ােজিনিসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি তার জন্য কিছু করতে পারেন কিনা। ডাইয়ােজিনিস তরুণটির দিকে ফিরে চাইলেন যে তদকালীন গ্রিসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তিনি চিৎকার করে বললেন, “হ্যাঁ! সূর্যের আলাে থেকে সরে দাঁড়াও।” আলেকজান্ডার তাই করলেন, আর তার পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিলেন এই বলে, “যদি আমি আলেকজান্ডার না হতাম, আমি ডাইয়ােজিনিস হতে চাইতাম।” 

গ্রিসে তার কার্য সম্পন্ন করে, আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দের বসন্তে উত্তরে আবার ধাবিত হলেন, যেখানে আবারও বারবারিয়ানরা বালক রাজার বিরুদ্ধে সুবিধা নেওয়ার চিন্তা করেছিল। আলেকজান্ডার এত দ্রুত সব কিছু চূর্ণ করে এগােচ্ছিলেন যে কী ঘটছে তা বােঝার সময় তাদের খুব কমই ছিল। এক বজ্রবিদ্যুতের আঘাতই কেবল এর থেকে সূক্ষ্মভাবে কিছু করতে পারত। কিন্তু, যখন তিনি উত্তরে ছিলেন গ্রিসে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মারা গেছেন। তৎক্ষণাৎ থিব্‌স বিদ্রোহ করে আর ক্যাডমিয়াতে মেসিডােনিয়ান সৈন্যশিবির অবরুদ্ধ করে। ডেমোস্থিনিস থিবানদের অর্থ সরবরাহ করলো, আর এথেন্সকে তার সাথে জোটে আসতে রাজি করাল। কিন্তু তাদের নিঃশ্বাস নেয়ার খুব কমই সময় ছিল, আলেকজান্ডার আবারও খুব দ্রুত দক্ষিণ দিকে এগিয়ে আসার আগে সৈন্যদলগুলাে পরস্পরের মুখােমুখি হলাে, আর কিছু সময়ের জন্য থিবানরা তাদের অভ্যাসগত পরাক্রমের সাথে যুদ্ধ করল, কিন্তু আলেকজান্ডার আর তার ফ্যালাঙ্কসের বিরুদ্ধে কেউই দাঁড়াতে পারল না। যখনি থিবানরা চূড়ান্তভাবে পালিয়ে গেল, তারা এত কাছাকাছি অবস্থান করছিল যে তারা আর মেসিডােনিয়ানরা একসাথে নগরে প্রবেশ করেছিল। আলেকজান্ডার বুঝলেন তাকে গ্রিসের মন জয় করতে হবে যাতে করে তার বিরুদ্ধে কোনাে বিদ্রোহ না সংঘটিত হয়। তিনি বাইরে পারস্যে অভিযান চালাতে পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন দেশে কোনাে লড়াই যেন তাকে ফিরিয়ে না নিয়ে আসে যেমন অর্ধ-শতাব্দী আগে তা এজেসিলেয়াসকে দেশে টেনে নিয়ে এসেছিল। 

পরবর্তীতে, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় থিব্‌সকে ধ্বংস করলেন। তিনি অবশ্যই মন্দিরগুলাে সুরক্ষিত রেখেছিলেন, কিন্তু ব্যতিক্রম হিসেবে কবি পিন্ডারের বাড়িছাড়া এসব অট্টালিকা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন। কবির পংক্তি আলেকজান্ডার পছন্দ করতেন, এবং তিনি তার পূর্বসূরী প্রথম আলেকজান্ডারের জন্য প্রশংসাগাথা রচনা করেছিলেন। চুক্তি কার্যকর হলাে। এথেন্স দ্রুতগতিতে দিগ্বিজয়ীর নিকট নিজেকে সমর্পণ করল এবং আবারও এর অতীত ইতিহাস নগরটিকে রক্ষা করল। আলেকজান্ডার এমনকি ডেমোস্থিনিস আর অন্যান্য মেসিডােনিয়ান বিরােধী নেতাদের আত্মসমর্পণের জন্যও চাপ প্রয়ােগ করেননি। তিনি এখন তার দিগ্বিজয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলেন, এবং পুরােপুরিভাবে “আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট” নাম লাভ করলেন, যার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসে কমবেশি পরিচিত। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন গ্রিস এই অসাধারণ মানুষটির ভয়ের কারণে সম্পূর্ণ নীরবই ছিল, গ্রিসে তার বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ হয়নি।

আলেকজান্ডারের হাতে পারস্যের পতন 

পারস্যের ঘটনাবলি আলেকজান্ডারের অনুকূলে ছিল। ফিলিপ মেসিডােনিয়ার ক্ষমতায় আসা মাত্রই কিউনাক্সার বিজয়ী আর্তাজারেক্সেস মারা গিয়েছিলেন। তার উত্তরাধিকারী ছিলেন তৃতীয় আর্তাজারেক্সেস, যিনি পারস্য শক্তির শেষ প্রতাপ হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ অব্দে আরেকবার বিদ্রোহ করা মিশরকে বিধ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে আর্তাজারেক্সেস গুপ্তহত্যার শিকার হলেন। এবং তার এক দূরের আত্মীয় তৃতীয় দারিয়ুস তার উত্তরাধিকারী হলেন। পরপর দুটো গুপ্তহত্যায় কেঁপে ওঠা পারস্য নিজেকে এমন একজন সম্রাটের অধীনে আবিষ্কার করল, যিনি ভদ্র হলেও তার পাশাপাশি ছিলেন দুর্বল আর ভীতু। নিশ্চিতভাবেই তিনি ছিলেন আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা সর্বশেষ ব্যক্তি।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দের বসন্তে আলেকজান্ডার তার পিতার সেনাপতি এন্টিপেটারকে মেসিডােনিয়া আর গ্রিসের দায়িত্ব দিলেন, এবং তার পিতার আরেক জেনারেল পারমিনিওকে দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক বানিয়ে তার মহা অভিযান শুরু করলেন। আলেকজান্ডার ৩২,০০০ পদাতিক সৈন্য আর ৫০০০ ঘােড়সওয়ার নিয়ে হেলেসপন্ট পার হলেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন মাত্র বাইশ বছর বয়সী এবং তিনি আর কখনাে ইউরােপে ফিরে যাননি। হেলেসপন্টের অন্য পার্শ্বে, ট্রয়ের অংশে আলেকজান্ডার একটি ধর্মীয় উৎসর্গ পরিচালনা করলেন। তার পূর্বের এজেসিলেয়াসের মতােই তিনি নিজেকে পুনর্জন্ম নেয়া হােমারিক বীর ভাবতেন। তিনি ছিলেন একজন নতুন একিলিস, যেমনটা এজেসিলেয়াস নিজেকে একজন নতুন আগামেমনন হিসেবে বিবেচনা করতেন। তবে স্পার্টান পূর্বসূরী এজেসিলেয়াসের মতাে আলেকজান্ডারকে পিছিয়ে আসতে হয়নি, তিনি পারস্য-বিজয়ের কাজে চললেন। 

পারস্যের হয়ে লড়াই করা গ্রিক ভাড়াটে সৈন্যদের নির্দেশদাতা ছিলেন রােডসের মেমনন। তিনি ছিলেন একজন সামর্থ্যবান মানুষ। অনেকে মনে করতেন, যদি কেউ আলেকজান্ডারকে পরাজিত করতে পারেন, তবে তিনি এই মেমনন। তার সময়ে তিনি ফিলিপের বিরুদ্ধে কিছু সফলতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, এবং তিনি মেসিডােনিয়ান সেনাদলকে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পারসিকদের পরামর্শ দিলেন যাতে তারা ভূমিতে পিছিয়ে এসে আলেকজান্ডারকে তাদের দিকে আসতে প্ররোচিত করে। এই সময়ে পারসিক নৌবাহিনী ঈজিয়ান সাগরে গিয়ে গ্রিসের সাথে তার সাপ্লাই লাইন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া তার আরেকটি পরিকল্পনা ছিল গ্রিসে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উৎসাহ তৈরি করা, যেখান থেকে আলেকজান্ডার তার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য রণতরী লাভ করতে পারে। মেমননের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে হয়তো ইতিহাস অন্য রকম হতো। কিন্তু মেমননের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। স্থানীয় পারসিক সত্রপ তার কথায় কর্ণপাত করল না। তারা মনে করল আলেকজান্ডার হলাে শুধুই আরেকজন গ্রিক যে এজেসিলেয়াস আর কেরিসের মতাে কিছু সময়ের জন্য চেষ্টা করবে এবং তারপর চলে যাবে। তারা সেই স্থানেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং তাদের প্রদেশগুলােকে রক্ষা করতে উদ্বিগ্ন ছিল। 

যার নিকটে একসময় ট্রয় নগরী অবস্থিত ছিল, সেই গ্রানিকাস নদীর কাছে উভয়পক্ষের সৈন্য দল মুখােমুখি হলাে। আলেকজান্ডার তার অশ্বরােহী সৈন্যদের সামনে পাঠিয়ে দ্রুত আঘাত হানলেন যা পারসিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। এরপর তিনি তার ফ্যালাঙ্কসসহ অগ্রসর হলেন প্রচণ্ড লড়াকু গ্রিক ভাড়াটে সৈন্যদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। পারসিকরা চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হলো। আলেকজান্ডার গ্রিসে লুটের মাল ফেরত পাঠালেন এই বাণী উৎকীর্ণ করে “ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডার, এবং  ল্যাসেডেমোনিয়ানরা (স্পার্টান) ছাড়া গ্রিকরা এশিয়া নিবাসী বিদেশিদের কাছ থেকে এই লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছে।” শুধু স্পার্টাই আলেকজান্ডারের সাথে যােগ দেয়নি, আর আলেকজান্ডার, ফিলিপের মতােই, তাদের জোটে আসতে জোরাজুরি করেননি। এশিয়া মাইনরে আর কোনাে পারসিক সেনাদল ছিল না যা তাকে বাধা দেয়ার সাহস করতে পারে এবং আলেকজান্ডার সবগুলাে নগর দখলে নেয়ার আয়ােজন করলেন। 

সম্পূর্ণ ঈজিয়ান উপকূল আলেকজান্ডারের অধীনে এলো, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদে ছিলেন না। তখনাে দৃঢ়চেতা মেমনন, পরাজয় সত্ত্বেও, ঈজিয়ান দ্বীপগুলাে দখলে নিতে শুরু করলেন, এবং আলেকজান্ডারের সন্নিকটেই এক জলযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আলেকজান্ডারের সৌভাগ্য, মেমনন, লেসবােস অবরােধ করার সময়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে হঠাৎ মারা গেলেন, এবং পারসিকদের পক্ষ হতে শেষ বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিরােধের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল। আলেকজান্ডার তারপরে অভ্যন্তরীণ ভূখণ্ড গাের্ডিয়াসের দিকে অগ্রসর হলেন, যা চার শতাব্দী পূর্বে প্রাচীন ফ্রিজিয়ার রাজধানী ছিল। গাের্ডিয়াসে তাকে গাের্ডিয়ান নট দেখানাে হলাে এবং পুরাতন ভবিষ্যদ্বাণী শােনানাে হলাে, যে এটি খুলতে সফল হবে, সে পুরাে এশিয়া জয় করবে। “আসলেই,” তিনি বললেন, “তাহলে এভাবেই আমি এটাকে খুর্লে ফেলি!” এবং তলােয়ার তুলে তিনি এটাকে কেটে ফেলেন। তখন থেকেই “গোর্ডিয়ান নট কাটা” ফ্রেজটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে খুব কঠিন কিছুর সরাসরি ও শক্তি প্রয়ােগের সমাধান বােঝাতে।

আলেকজান্ডার দক্ষিণাভিমুখে ইসুস উপসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন, যেখানে সত্তর বছর আগে টেন থাউস্যান্ড সেনাদল বিরতি দিয়েছিল। তার হাতে এশিয়া মাইনরের সবটুকুই ছিল কিন্তু এখনাে পর্যন্ত তিনি শুধু ছােট শক্তিরই মােকবিলা করেছেন। গ্রানিকাসের যুদ্ধ নিঃসন্দেহে ছিল একটি অ্যাপেটাইজার, যার মধ্য দিয়ে তার সেনাদলের ক্ষুধা অনেক বেরে গিয়েছিল। এখন মেমনন মারা যাওয়ার কারণে পারসিকদের সাবধানতার পরামর্শ দেয়ার মতাে কেউ ছিল না। দারিয়ুস বুঝলেন আলেকজান্ডারকে আর বেশি এগােতে দেয়া অসম্ভব, তাই তিনি ইসুসে এক বিশাল সৈন্য সমাবেশ করলেন আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। বিশাল পারসিক সেনাদল আলেকজান্ডারের ক্ষুদ্র সেনাদলকে সংখ্যার দিক দিয়ে অনেকবার হারিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সংখ্যার তাৎপর্য এখানে ছিল খুবই অল্প। মেসিডােনিয়ান ফ্যালাঙ্কস কোনাে সমস্যা ছাড়াই বিশাল সংখ্যাকে কেটেছিড়ে ফেলতে পারত। তার উপর, দারিয়ুস নিজে যুদ্ধে ছিলেন আর এটি ছিল ভয়াবহ, কেননা তিনি ছিলেন এক অবিশ্বাস্য ধরণের কাপুরুষ। গ্রিক ভাড়াটে সৈন্যরা তার জন্য ভালােই লড়াই করছিল এবং কিছু সময়ের জন্য ফ্যালাঙ্কসকে পিছু হটিয়েও দিয়েছিল, কিন্তু যখন সৈন্যদের চাপ তাদেরকে নিজেদের অবস্থানে ফিরিয়ে আনল, এবং দারিউস নিজেও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন, তখন তিনি পড়িমড়ি করে সাথে সাথে পিঠটান দিলেন। বুদ্ধির সাথে পিছে হটার মতাে ব্যাপারও আছে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দারিয়ুসের পাগুলে লাফ ছিল আসলেই নৈরাশ্যজনক। পারসিকরা যুদ্ধটিতে হেরে গেল। 

তখনাে কম্পমান দারিয়ুস দূত পাঠিয়ে আলেকজান্ডারকে এশিয়া মাইনরের সবটুকু এবং তার সাথে বিশাল অংকের অর্থপ্রস্তাব করলেন, যদি সে এটিকে থামিয়ে দেয়। প্রস্তাবটি শুনে পারমিনিও বললেন, “যদি আমি আলেকজান্ডার হতাম, তাহলে আমি এটি গ্রহণ করতাম।” আর আলেকজান্ডার অবজ্ঞাভরে বললেন, “আমিও তাই করতাম, যদি আমি পারমিনিও হতাম।” আলেকজান্ডার পুরাে পারসিক সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের চেয়ে কম কিছু চাননি এবং যুদ্ধ চলতে থাকল। তিনি সিরিয়ান উপকূল ধরে এগিয়ে গেলেন, ফলে ফিনিসিয়ার নগরগুলাে একের পর এক তার কাছে আত্মসমর্পণ করল, শুধু টায়ার টিকে থাকল। তারা আলেকজান্ডারের প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দিল যদি তাকে তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার স্যাপার নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়া হয়, কিন্তু আলেকজান্ডার সবকিছুর চেয়ে কমকিছু কখনাে গ্রহণ করেননি। তিনি টায়ার অবরােধের জন্য প্রস্তুত হলেন, এবং তার পরে যা ঘটল তা ছিল ইতিহাসের অন্যতম অনমনীয়তা। টায়ার অপরিসীম ধৈর্যের সাথে সাত মাস টিকে থাকল আর আলেকজান্ডার সমান ধৈর্যের সাথে তা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে, টায়ারকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল এবং তিক্ত মেসিডােনিয়ানদের দ্বারা তারা খুব বাজেভাবে নিগৃহীত হয়। আরও কয়েক মাস মিশরের কাছে উপকূলীয় নগর গাজাতে নষ্ট হলাে, যা একসময় সাত শতাব্দী পূর্বে, বাইবেলের ফিলিস্তিনে বর্ণিত অন্যতম শহর ছিল। 

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে আলেকজান্ডার মিশরে প্রবেশ করলেন। পারস্যের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল, তাই মিশরীয়রা আলেকজান্ডারকে একজন স্বাধীনতাদাতা হিসেবে স্বাগত জানাল। তারা কোনােরকম সংগ্রাম ছাড়াই সাথে সাথেই তার পাশে দাঁড়াল। পারস্যের জন্য যা বাকি ছিল, তা হলাে সাগরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এরফলে পারস্যের নৌবাহিনীও নিষ্ক্রীয় হয়ে গেল, তাদের আর কিছুই করার ছিলনা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে, নীলনদের সবচেয়ে পশ্চিম দিককার মুখে, মেসিডােনিয়ান সম্রাট তার নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করলেন, যার নাম ছিল আলেক্সান্দ্রিয়া। এটা প্রাচীন দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত নগরে পরিণত হয়েছিল। মিশরে থাকাকালীন আলেকজান্ডার তার অভ্যন্তরে একটি মন্দিরেও ভ্রমণ করেন যা প্রকৃতপক্ষে মিশরীয় দেবতা আমনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল। গ্রিকদের কাছে তা ছিল “আমন”, যার সাথে তারা তাদের জিউসের মিল খুঁজে পেত, আর তাই এই মন্দিরটি নিবেদিত ছিল “জিউস আমনের” প্রতি। এই মন্দিরে আলেকজান্ডার নিজেকে আমনের পুত্র (অথবা জিউসের পুত্র) হিসেবে ঘােষণা করলেন আর নিশ্চিতভাবেই অনেক মানুষ ছিল যারা এটি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল। 

কিন্তু পারস্যের বিশাল এলাকা এখনাে অবিজিত এবং বিশাল সেনাদলের সাথে লড়াই ও তাদের পরাস্ত করা বাকি ছিল, তাই আলেকজান্ডার এশিয়ায় ফিরে এলেন। তিনি ইউফ্রেটিস থেকে টাইগ্রিস পর্যন্ত অভিযাত্রা চালিয়ে গেলেন, যেখানে গৌগামেলা আর আরবিলা নগরের মাঝে দারিয়ুস আরেকটি অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এমনকি সেখানে পারসিক সেনাদল আগের চেয়ে বড় ছিল, এই অবস্থান সতর্কতার সাথে বেছে নেয়া হয়েছিল, আর সমস্ত প্রস্তুতি চিন্তা আর সতর্কতার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দের ১ অক্টোবরে, গৌগামেলার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পারসিকরা রথের চাকার সাথে যুক্ত কাস্তের ওপর নির্ভর করত। এই ধারালাে ছুরিগুলাে, বিপুল বেগে মেসিডােনিয়ানদের দিকে ধাবিত হয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কিন্তু মেসিডােনিয়ান ঘােড়সওয়াররা আক্রমণাত্মকভাবে রথকে আক্রমণ করল এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি এমনকি ফ্যালাঙ্কস পর্যন্ত পৌঁছাল। ফ্যালাঙ্কস বরাবরের মতাে শত্রুবাহিনীকে সহজেই ছিন্নভিন্ন করে দিল। কিছু সময়ের জন্য দারিউস তার লােকদের এমনভাবে চালনা করলেন, যেন তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত যােদ্ধা। কিন্তু, এরই মধ্যে আলেকজান্ডার তাকে ভালাে করে জানতে পারলেন। তিনি তার ফ্যালাঙ্কসকে সরাসরি দারিয়ুসের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন আর সেই কর্কশ বর্শাগুলাে দারিউসের কাছাকাছি এসে গেল, দারিয়ুসের সামান্য সাহস এতে ভেঙে পড়ল, আর তিনি পেছনে ঘুরে পালিয়ে গেলেন। যুদ্ধের বাকিটা কেবল ধরপাকড়েই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রকৃত অর্থে এটাই ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের সমাপ্তি (সাইরাসের দ্বিগ্বিজয়ের দুই শতাব্দী পরে), কেননা পারস্য আর কোনাে সংগঠিত প্রতিরােধ করতে পারেনি। দারিয়ুসও আর আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেননি। আর আলেকজান্ডারকে এর পর পারস্যে স্থানীয় শক্তি ছাড়া আর কোন শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে হয়নি।

আলেকজান্ডারের অভিযানের সমাপ্তি ও মৃত্যু

গৌগামেলার যুদ্ধের পর , আলেকজান্ডার কোনাে প্রতিরােধ ছাড়াই ব্যাবিলন দখল করলেন আর কয়েক মাসের মধ্যে পারস্য ভূমির কেন্দ্রে অবস্থিত সুসায় অবস্থান নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে তিনি পারসিপপালিস দখল করতে গেলেন, যা দেড় শতাব্দী পূর্বে জারেক্সেসের রাজধানী নগর ছিল। গল্প প্রচলিত আছে যে, একটি মদের আসর উদযাপনের পর তিনি জারেক্সেসের সময়ে এথেন্সের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিশােধ নিতে পারসিপােলিস পুঁড়িয়ে দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আবারও দারিয়ুসকে ধরার প্রস্তুতি নিলেন, যিনি তখন পারসিপােলিসের ৪০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে মিডিয়ার কাজধানী একবাটানাতে অবস্থান করছিলেন। দারিয়ুস আর কোনাে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করেননি, বরং তিনি আলেকজান্ডার আসছে জেনে তৎখনাৎ পশ্চাদগমন শুরু করলেন, আর পূর্বদিকে বন্যগতিতে ছুটে গেলেন। তার সাথে থাকা সত্রপরা বুঝলেন তারা, মােটের উপর তাদের কাপুরুষ রাজাকে ছাড়াই ভালাে থাকবে, আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহ রেখে গেলেন যাতে তা আলেকজান্ডারের খুঁজে পান।

পরবর্তীতে দুই বছরে, আলেকজান্ডার পারস্য সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে অগ্রসর হলেন, এবং সত্রপ ও বর্বর উপজাতিদের সাথে লড়াই করলেন। তারা সাম্রাজ্যের সংগঠিত সৈন্যদলের চেয়ে অনেক ভালােভাবে লড়াই করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই আলেকজান্ডারের কাছে পরাস্ত হলাে। আলেকজান্ডার তার জীবনে কখনও বা কারও হাতে পরাজিত হননি। আলেকজান্ডারের সাফল্য তার নিজেকে ভাবতে বাধ্য করল সে প্রকৃতপক্ষেই সাধারণ মানুষের থেকে অনেক আলাদা, যাকে আইন বা প্রথা দিয়ে বাঁধা যায় না। ফিলিপের সময় পর্যন্ত মেসিডােনিয়ান সম্রাটরা ছিলেন বিশিষ্টজনের মধ্যে বিশিষ্টজন (হােমারের বর্ণিত রাজাদের মতাে), কিন্তু এখন আলেকজান্ডার পারসিক রাজাদের মতাে আচরণ করতে লাগলেন। তিনি তােষামােদী আর মােসাহেবী উপভােগ করা পছন্দ করতে শুরু করলেন আর লােকজন তার সামনে হামাগুড়ি দেবে এমন প্রত্যাশা করতে লাগলেন, যা করা মেসিডােনিয়ানরা ঠিক বলে মনে করত না। তার কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে লাগল, অথবা যদি তা নাও হয়, আলেকজান্ডার ক্রমান্বয়ে সংশয় আর সন্দেহ করতে থাকলেন যে তারা তা করছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দের শেষের দিকে, এখন যাকে আফগানিস্তান বলে সেখানে থাকাকালে, তিনি তার এক সেনাপতি ফিলােটাসকে ষড়যন্ত্র করার অভিযােগে বিচারের মুখােমুখি করে তাকে হত্যা করেন। ফিলােটাস ছিলেন পারমিনিওর পুত্র যিনি তখন হাজার মাইল পশ্চিমে মিডিয়ার সৈন্যদলের দায়িত্বে ছিলেন। নিশ্চিতভাবেই তার পুত্রের হত্যার খবর শােনার পর তিনি আর বিশ্বস্ত থাকতেন না। পশ্চিমদিকে পূর্ণগতিতে দূত পাঠানাে হলাে যাতে পুত্রের মৃত্যুর খবর পৌঁছানাের আগেই সেনাপতি পারমিনিওকে হত্যা করা হয়, আর হত্যাকাণ্ডটি সূচারুভাবেই সম্পন্ন করা হলাে। 

এই ঘটনাটি কতিপয় মেসিডােনিয়ান সেনাপতিকে আরও বেশি চাপা ক্রোধে পরিপূর্ণ করে তুলল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দে আলেকজান্ডার পারসিক সাম্রাজ্যের উত্তরপূর্ব প্রান্তে মারাকানাডায় অবস্থান করছিলেন (এটি আধুনিক সমরখন্দ।) সেখানে তিনি এক ভােজের আয়ােজন করেছিলেন আর সবাই একটু বেশিই পান করেছিল। ক্রমবর্ধমান রীতি অনুযায়ী আলেকজান্ডার তার পিতার থেকে কত বেশি বড় ছিল তা বলে কিছু মানুষ মােসাহেবীতে পূর্ণ বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিল। আলেকজান্ডার পুরােপুরি মাতাল ছিলেন। আর ফিলিপকে যত বেশি ব্যঙ্গ করা হতে লাগল, তাকে তত বেশি সন্তুষ্ট মনে হতে লাগল। ক্লিটাস নামের এক বহুদর্শী শেষ পর্যন্ত এটাকে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ফিলিপের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন আর গ্রানিকাসের যুদ্ধে তিনি আলেকজান্ডারের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ক্লিটাস ফিলিপের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন, এই বলে যে ফিলিপই মেসিডােনিয়ান বিশালত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন আর আলেকজান্ডার জয়গুলাে করায়ত্ত করেছেন ফিলিপের সৈন্যদলের মাধ্যমেই। সম্পূর্ণ মাতাল আলেকজান্ডার এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তিনি একটি বর্শা নিয়ে ক্লিটাসকে হত্যা করলেন। এটি আলেকজান্ডারের নেশা কাটিয়ে দিল এবং তার পরের কিছুদিন সে বিবেকের দংশনে অনুতপ্ত হলাে। কিন্তু তা ক্লিটাসকে ফিরিয়ে আনল না। এটি আলেকজান্ডারের ভেতর আসা পরিবর্তনকেও থামাতে পারল না। মেসিডােনিয়ার রাজা আর গ্রিকদের সেনাপতি হয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি নিজেকে গ্রিক, বারবারিয়ান, সব মানুষের উপরে বিশ্বজনীন সম্রাট হিসেবে দেখতে শুরু করলেন। তিনি রােকসানা নামে এক পারসিক রাজকুমারীকে বিয়ে করলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে এবং ৩০,০০০ পারসিককে সেনাবাহিনীতে কাজ করানাের জন্য মেসিডােনিয়ান পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেয়াতে শুরু করলেন।

একই বছরে, তাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানাল সেই এলাকার এক শাসক যে পুরু নামে পাঞ্জাবের এক সম্রাটের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। একটি ভালাে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য আলেকজান্ডারের খুব কমই অজুহাতের দরকার ছিল এবং তৎক্ষণাৎ তিনি সিন্ধু নদের দিকে দক্ষিণাভিমুখী যাত্রা করলেন। তা করতে গিয়ে তিনি পারসিক সাম্রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেন। কোনাে পারসিক সম্রাট, এমনকি সাইরাস বা দারিয়ুস প্রথমও ভারতের এতদূর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। এপর্যন্ত আলেকজান্ডার যত শত্রুর মুখােমুখি হয়েছিলেন, পাঞ্জাবে তিনি তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যােগ্যতমের মুখােমুখি হলেন। উল্লেখ আছে যে পুরু ছিলেন সাত ফুট লম্বা আর দেখতে চিত্তাকর্ষক। তার ছিল ২০০ হাতির সমন্বয়ে গঠিত বিশাল এক সেনাদল যে পরিস্থিতি সম্পর্কে আলেকজান্ডার একেবারেই ধারণা করতে পারেননি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে দুই সেনাদল হাইদাসপিস বা ঝিলাম বা বিতস্তা নদীর ধারে পরস্পরের মুখােমুখি হলাে, যা ছিল সিন্ধু নদের একটি শাখা। আর আলেকজান্ডার এশিয়ায় তার চার বড় যুদ্ধের শেষটিতে লিপ্ত হলেন। হাতিগুলাে ছিল সবচেয়ে বড় বিপদ কিন্তু তিনি আক্রমণ এড়ানাের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার বুদ্ধিদীপ্ত প্যাঁচ কষলেন, যা পুরুকে নিয়ন্ত্রণহারা করে ফেলল এবং তাকে নিয়ন্ত্রণহারা করেই রাখল, যাতে করে তার হাতিগুলাে পুরাে কার্যকারিতা নিয়ে অবতীর্ণ হবার সুযােগ না পায়। 

আলেকজান্ডার জয়লাভ করলেন, কিন্তু হাতির মাধ্যমে পাওয়া অভিজ্ঞতাটি ছিল ব্যাপক। পরবর্তী শতাব্দীতে, মেসিডােনিয়ান সম্রাটরা প্রায়ই যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি ব্যবহার করত, অনেকটা সেভাবে, যেভাবে আধুনিক সেনাদলগুলাে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। এই যুদ্ধে, আলেকজান্ডারের ঘােড়া বুসেফেলা, যা তাকে হাজার মাইল বয়ে নিয়ে এসেছে, তা অবশেষে মারা গেল আর আলেকজান্ডার তার ঘােড়ার সম্মানে বুসেফালা নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করলেন। যুদ্ধশেষে, তিনি উদ্ধত, নতজানু হতে অনিচ্ছুক পুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি কীরূপ আচরণ পেতে চান। “একজন রাজার মতাে!” পুরু জবাব দিয়েছিলেন, আর তিনি তাই পেয়েছিলেন। তিনি তার রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন এই শর্তে যে তিনি আলেকজান্ডারের জন্য একজন সত্রপ হিসেবে শাসন করবেন, আর পুরু তার বাকি জীবন এই দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে তিনি এক প্রতিপক্ষের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন।)

এখন আলেকজান্ডারের ইচ্ছা হলাে ভারত পেরিয়ে মহাসাগরে পৌঁছানাে যা তখনকার দিনের ভৌগােলিক সংজ্ঞা অনুযায়ী ছিল বিশ্বের শেষ প্রান্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে তার বাহিনী বেঁকে বসল। মেসিডােনিয়ান সৈন্যরা দেশ থেকে প্রায় ৩০০০ মাইল দূরে ছিল। তারা আলেকজান্ডারকে ছয় বছর ধরে অনুসরণ করেছে; যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ; যুদ্ধ জয় আলেকজান্ডার ছাড়া আর কারও কাছে রােমাঞ্চকর ছিল না। তার লােকেরা কেবল ফিরে যেতেই মনস্থ করল। আলেকজান্ডার গােমড়ামুখে তিনদিন বসে ছিলেন, এবং পরবর্তী কিংবদন্তী অনুযায়ী, তিনি কাঁদছিলেন কেননা তার জন্য জয় করার আর কিছুই ছিল না। অবজ্ঞাভরে, তিনি ফিরে যাওয়ার সম্মতি দিলেন। তার একটি রণতরী ছিল, যা সিন্ধু নদ ধরে এগিয়ে চলল, আর তার সেনাদল নদীর তীর ধরে এগােল। আবারও আলেকজান্ডারকে যাত্রাপথে শত্রুভাবাপন্ন গােত্রগুলােকে দমন করতে হলাে। এ সময় একটি নগর অবরােধ করার সময় আলেকজান্ডার ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন এবং দেয়ালের উপর থেকে লাফ দিয়ে নগরের ভেতরে পড়লেন, তার সাথে মাত্র তিনজন সঙ্গী ছিল, আর হতভম্ভিত হওয়া সেনাদল তাকে উদ্ধার করার জন্য পথ করার আগেই তিনি মারাত্মকভাবে আহত এবং প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। এটা ছিল তার সবচেয়ে গুরুতর আহত হওয়া, কিন্তু তিনি সেরে উঠলেন। রণতরীটিকে সিন্ধু নদের মুখ হতে সাগর ও পারস্য উপসাগর হয়ে ব্যাবিলনীয়ায় ফেরত পাঠানাে হলাে নিয়ারকাস নামে এক মেসিডােনিয়ান কর্মকর্তার অধীনে। এটি ছিল কোনাে পশ্চিমা রণতরীর ভারত মহাসাগরে প্রথম উপস্থিতি। 

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ অব্দে, আলেকজান্ডার আর তার সেনাদল গেড্রোসিয়ান মরুভূমি পেরিয়ে এলেন, যার মধ্যে এখন দক্ষিণ ইরান অবিস্থত। এটা ছিল একটা ভুল মস্তিষ্কপ্রসূত কাজ, কেননা সমতল ভূমি থেকে আসা সেনাদলকে টিকে থাকার সমর্থন দেয়া মরুভূমির পক্ষে সম্ভব ছিল না। মেসিডােনিয়ার সৈন্যরা ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রবল অত্যাচারের ভেতর দিয়ে গেল, এলাকাটির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলাে, আর তাদের সব যুদ্ধের চেয়েও বেশি হতাহতের ঘটনায় আক্রান্ত হলাে। কেউ কেউ গুজব ছড়াল যে আলেকজান্ডার তার সৈন্যদের ভারত পার হতে নারাজ হবার কারণে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে শাস্তি দিতে এটি করেছেন। যখন আলেকজান্ডার ব্যাবিলনীয়ায় ফিরে গেলেন, তিনি দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে আর সরকারকে পুনর্গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ১০,০০০ গ্রিক আর মেসিডােনিয়ান সৈন্যকে এক গণ-অনুষ্ঠানে এশিয়ান নারীদের বিয়ে করার আদেশ প্রদান করার মাধ্যমে গ্রিক আর বারবারিয়ানদের একত্র করার বিশাল প্রকল্প চালিয়ে গেলেন।  তার উপর, তিনি গ্রিক নগরগুলােকে বাধ্য করলেন তাকে দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাতে করে তার এমন লোকদেরও শাসক করা সম্ভব হয় যারা কোন মানুষের কাছে মাথা করতে চায়না। গ্রিক নগরগুলাে, এমনকি এথেন্সও, আলেকজান্ডারের দেবত্ব মেনে নিল প্রচুর তােষামােদ সহকারে, শুধু স্পার্টা তার প্রাচীন গর্ব ধরে রাখল। এফোরগণ বললেন, “যদি আলেকজান্ডার দেবতা হতে চায়, তাকে হতে দাও”, আর তারপর তারা পুরাে ব্যাপারটিকে উদ্ধতভাবে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। 

কিন্তু, দেবতা আলেকজান্ডারের ওপর মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে আসল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দের শেষ দিকে ইকবাটানায় অবস্থানকালে তার প্রিয় বন্ধু হিফেসটিওন মারা গেলেন, আর আলেকজান্ডার গভীরতম বিষাদে ডুবে গেলেন। আরও বেশি পরিমাণে মানুষ তার বাতিকগ্রস্ততাকে ভয় পেতে আরম্ভ করল। তার পরিকল্পনাগুলাে তখনাে আরাে ব্যাপক হচ্ছিল। তিনি আরব জয় করতে  যাচ্ছিলেন, অথবা তিনি পশ্চিমদিকে পাল তুলে কার্থেজ দখলে নিতেন। প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল আর পৃথিবী রুদ্ধশাসে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু, অবশেষে তার কিছুই ঘটেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের জুনে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর এমন কেউ কেউ আছেন যারা ধারনা করেন যে, আলেকজান্ডারের মৃত্যু তাদের দ্বারাই বিষপ্রয়ােগের মাধ্যমে হয়েছিল যারা ভেবেছিলেন যে তারা মহান সম্রাটের মৃত্যুতেই বেশি নিরাপদ থাকবেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের ১৩ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময়ে আলেকজান্ডারের বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ বছর। এবং মাত্র তের বছরের জন্য তিনি রাজত্ব করেছিলেন। তার ছােট্ট জীবনে তিনি অনেক অভিযাত্রা, অনেক জয়, অনেক খ্যাতি বগলদাবা করেছিলেন যা না আর কোনাে একজন মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি, অথবা সম্ভব হবে। এরকমও গল্প আছে যে সন্দেহবাতিক ডাইয়ােজিনিস, যার সাথে আলেকজান্ডার তার রাজত্বের একেবারে প্রথমদিকে কিছু সময়ের জন্য দেখা করেছিলেন, আলেকজান্ডারের মতাে একই দিনে মারা যান, নব্বই বছর বয়সে। এই গল্পটি সম্ভবত আরেকটি তৈরি করা গল্প যা গ্রিক ইতিহাসবিদেরা তৈরি করতে খুব ভালােবাসতেন।

আলেকজান্ডারের ভারত তাভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে প্রবেশ করুন।

আলেকজান্ডারের উত্তরসূরীগণ বা ডায়াডোকি, হেলেনিস্টিক সিসিলি ও এপিরাস

গ্রিসে এন্টিপেটারের হাতে স্পার্টান ও এথেনীয় বিদ্রোহীদের পরাজয়

অ্যান্টিপেটারের বিরুদ্ধে স্পার্টার যুদ্ধ ও ব্যর্থতা : স্পার্টা ছিল গ্রিসের এক নগর যেটি ফিলিপ আর আলেকজান্ডারের অধীনে একরকম স্বাধীনতা ধরে রেখেছিল। যে বছরগুলােতে ফিলিপ গ্রিসের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন, স্পার্টা তখন এজেসিলেয়াসের পুত্র তৃতীয় আর্কিডেমাসের শাসনাধীন। থিব্‌সের বিরােধিতা করতে আর পেলােপনেসাসে স্পার্টার পুরনাে প্রভুত্ব ফিরিয়ে আনতে তিনি যা করতে পারতেন তা করা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন এবং তার পিতার মতােই তার জীবন শেষ হলাে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে। উত্তরের স্থানীয় গােত্রগুলাের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ইতালির নগর টারেনটামের সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল, আর তারা মাতৃ-নগর স্পার্টার কাছে সেটির আবেদন জানাল। আর্কিডেমাস আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন আর যেদিন কেরােনিয়ায় গ্রিসের স্বাধীনতা হারিয়ে গেল সেই দিনেই ইতালিতে যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তার পুত্র তৃতীয় এইজিস স্পার্টার সিংহাসন দুটোর একটিতে আরােহণ করলেন, এবং ফিলিপের আক্রমণকারী সেনাদলকে “যদি”! উত্তর প্রদান করে তার রাজত্ব শুরু করলেন। তার শাসনামলে স্পার্টা ফিলিপ বা আলেকজান্ডার কারাে সাথেই যােগদানে অস্বীকার করল, এবং যদিও পুরাে দুনিয়া আলেকজান্ডারের কাজকর্মে সাড়া দিল, এইজিস শুধু তার নজর পেলােপনেসাসেই সীমাবদ্ধ রাখলেন। স্পার্টা যেন স্থায়ীভাবে তার মেসেনিয়ান যুদ্ধের দিনগুলােতেই থেকে যেতে মনস্থ করেছে। এশিয়ায় আলেকজান্ডারকে এড়িয়ে গিয়ে এইজিস পারস্যের কাছে অর্থ আর জাহাজের জন্য আবেদন জানান, যা নিশ্চিতভাবেই দেশে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে সমস্যা সৃষ্টি করার ইচ্ছাতেই ছিল। ইসুসের খবর এতে সাময়িকভাবে যতি টানলাে, কিন্তু যেহেতু আলেকজান্ডার এশিয়ার অজানা গভীরে বারবার অভিযাত্রা করছিলেন, এতে এইজিস আবারও সাহস ফিরে পেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে, পেলােপনেসাসের বেশিরভাগ পক্ষকে তার পেছনে রেখে, তিনি একটি আক্রমণের সূচনা করলেন। কিছু সময়ের জন্য পারসিক জাহাজ আর পারসিক অর্থে ভাড়া করা ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে তিনি সাফল্য লাভ করলেন। সর্বশেষে, তিনি মেগালােপলিস অবরােধ করলেন, যেটি ছিল এক আর্কেডিয়ান নগর, যা স্পার্টার প্রতি ঘৃণার কারণে মেসিডােনিয়ান-বিরােধী বিদ্রোহে যোগদান করেনি। স্পার্টা অবরােধ জোরদার করল, কিন্তু উত্তর থেকে এন্টিপেটার বিশাল মেসিডােনিয়ান সেনাদল নিয়ে চলে এলেন। স্পার্টা তার পুরনাে যুগের সাহস নিয়ে লড়াই করে গেল, কিন্তু তারা পরাভূত ও দিশেহারা হয়ে গেল আর এইজিসকে হত্যা করা হলাে। স্পার্টাকে এন্টিপেটারের কাছে জিম্মি হতে ও কঠিন জরিমানা দিতে হয়েছিল। কিন্তু পূর্বে ফিলিপ আর আলেকজান্ডারের মতােই এন্টিপেটার স্পার্টাকে ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকলেন। 

এথেন্সের ডেমোস্থিনিস : এথেন্স সাবধানতার সাথে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকল, কিন্তু ডেমোস্থিনিস প্রকাশ্যে স্পার্টাকে সমর্থন করলেন, আর তার কৌশল আবারও ব্যর্থ হলাে। তার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ঈসকিনেস ভাবলেন, এটাই ডেমোস্থিনিসকে আক্রমণ করে চিরতরে তার প্রভাব ধ্বংস করে দেওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। খিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে এথেন্স নগরের প্রতি তার অতীত সেবার কারণে ডেমোস্থিনিসকে সোনার মুকুট পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিল, আর তখন ঈস্কিনেস সেই পুরস্কারের বিপক্ষে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঈস্কিনেসের ভাষণ ছিল অনন্য সাধারণ, কিন্তু ডেমোস্থিনিস “অন দা ক্রাউন” নামে তার জীবনের অন্যতম সেরা ভাষণ দিয়ে তার জবাব দিলেন। ভাষণটির মাধ্যমে ডেমোস্থিনিসের বিজয় এতটাই পরিষ্কার ছিল যে, অপমানিত ঈস্কিনেস এথেন্স ছাড়তে বাধ্য হলেন। তিনি অবসর নিয়ে রােডসে গেলেন আর সেখানে একটি ভাষণের স্কুল পরিচালনা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলেন। পরবর্তী বছরগুলােতে, মুকুটের বিরুদ্ধে ঈস্কিনেসের ভাষণ পড়ে একজন ছাত্র প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছিল যে, কেমন করে ঈস্কিনেস এইক্ষেত্রে হেরে গিয়েছিলেন। “আহ!” ঈস্কিনেস অনুতপ্তভাবে বলেছিলেন, “তুমি বিস্মিত হবে না, যখন তুমি ডেমোস্থিনিসের জবাব পড়বে।” 

গ্রিসের গুরুত্বহীনতার মাধ্যমে হেলেনিস্টিক যুগের সূচনা : পারস্যের গভীরে থাকাকালীন আলেকজান্ডারকে যখন পেলােপনেসাসের যুদ্ধ সম্পর্কে বলা হলাে, তিনি উচ্চারণ করলেন যে তিনি ইঁদুরদৌঁড়ের যুদ্ধের ওপর বিরক্ত। আর তিনি ছিলেন সঠিক, কেননা যখন আলেকজান্ডার এশিয়া অতিক্রম করছিলেন, গ্রিসের ভেতর গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলাের যুদ্ধগুলাে উল্লেখ করার মতাে ছিল না এবং তা কোনাে ব্যাপারও ছিল না। নগরগুলাের মধ্যকার এই যুদ্ধ আরও দেড় শতাব্দী ধরে চলার কথা ছিল, কিন্তু ইতিহাস সেগুলােকে অতিক্রম করেই এগিয়েছিল। যদি গ্রিসে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ লড়ার মতাে অবশিষ্ট ছিল, তা হত বাইরের বড় কোনাে শক্তির সাথে, যাদের কাছে গ্রিস একটি যােগ্য যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে, আলেকজান্ডারের সাথে সাথে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৭ অব্দে শুরু হওয়া বিস্ময়কর হেলেনিক যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল, যে যুগে ইতিহাসের চোখ ছােট্ট গ্রিসের ওপর নিবদ্ধ ছিল, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর বছর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালকে সাধারণভাবে এর সমাপ্তি বলে ধরে নেয়া হয়। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী যে সময় গ্রিক সংস্কৃতি তখনাে প্রধান ছিল, কিন্তু গ্রিস নিজেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল, সেই যুগকে বলা হয় “হেলেনিস্টিক যুগ”।

এথেন্সে হারপালাস সমস্যা ও ডেমোস্থিনিসের শাস্তি : যদিও এইজিসের বিদ্রোহকে ঝেটিয়ে বিদায় করে এথেন্স বিপদকে এড়াতে পারল, ছয় বছর পরে তার রাস্তায় অতিরিক্ত প্রলােভন এসে দাঁড়াল। এটা এইরূপে এসে দাঁড়াল যখন গৌগামেলার যুদ্ধের পর আলেকজান্ডার ব্যাবিলনীয়া ছেড়ে পূর্বাভিমুখী যাত্রা করলেন তার দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ করার জন্য, তিনি তার এক সহযােগী হারপালাসকে রেখে গেলেন পারস্যের কোষাগারের দায়িত্বে। এটি হারপালাস নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করলেন, আর এমনভাবে কাজ করতে লাগলেন যেন আলেকজান্ডার ফিরবেন না। যখন তিনি বুঝতে পারলেন তার ধারণা ভুল ছিল এবং আলেকজান্ডার ফিরে আসছেন, তিনি কিছু সৈন্য, জাহাজ এবং বিশাল সম্পদ সহ গ্রিসে পালিয়ে গেলেন যা আধুনিককালের মূল্যে অনেক মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে তিনি নিজেকে এথেন্সে উপস্থাপন করলেন এবং প্রবেশাধিকার চেয়েও মেসিডােনিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য আবেদন জানালেন। ডেমোস্থিনিস তৎক্ষণাৎ তার মেসিডােনিয়া-বিরোধী অনুভূতিকে বিচক্ষণতার সাথে কাজে লাগালেন এবং এথেন্সে তাকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য তর্ক জুড়লেন। হারপালাস ক্রমাগত এটা দেখানাের চেষ্টা করে যেতে থাকলেন যে এথেন্স অর্থ দিয়ে কী করতে পারে; কতটা আগ্রহের সাথে অন্যান্য নগর আর এশিয়া মাইনরের সবটুকু আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তার পক্ষে যােগদান করবে, যদি সে তার কিছু অর্থ সঠিকভাবে বন্টন করে, এবং সেবশেষে ডেমোস্থিনিসের বিরােধিতা সত্ত্বেও তাকে নগরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলাে। এন্টিপেটার এথেন্সের কাছে দ্রুত নির্দেশ পাঠালেন যে হারপালাসকে পরিত্যাগ করতে হবে। নগরের মর্যাদার দিকে খেয়াল রেখে ডেমোস্থিনিস এর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখালেন। পরিবর্তে তিনি পরামর্শ দিলেন হারপালাসকে গ্রেফতার করার, তার অর্থ নিরাপত্তার জন্য পার্থেননে জমা করে রাখার এবং যখন আলেকজান্ডার এটির জন্য জিজ্ঞাসা করবে তখন এই অর্থের আলেকজান্ডারের কাছে সমর্পণ করার প্রস্তাব দেয়া হােক। এটি করা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে সমস্যাও ছিল। যে সময়টায় হারপালাস অর্থ নিয়ে এসেছিল আর যে সময়টায় এটি পার্থেননে জমা রাখার জন্য গণনা করা হয়েছিল, সেই সময়ে এর অর্ধেকটাই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এটা হয়েছিল কারণ হয়তাে হারপালাস তার কাছে থাকা অর্থের পরিমাণের ব্যাপারে মিথ্যা বলেছিলেন, কিন্তু আলেকজান্ডার কি তা বিশ্বাস করবে? আলেকজান্ডার কি এটাই বিশ্বাস করবে না যে এথেনীয়রা অর্ধেক চুরি করেছে? ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়ে গেল কেননা হারপালাস এথেন্স থেকে পালিয়ে ক্রিটে চলে গেলেন (যেখানে দ্রুতই তাকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছিল)। মনে হয় এথেন্সের নিজের স্বার্থেই একটা তদন্ত শুরু করা আর দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়াটাই ভালাে হত। তাই করা হলাে আর তালিকায় বেশ কিছু মানুষকে রাখা হলাে, যাদের মধ্যে মূল ব্যাক্তি ছিলেন ডেমোস্থিনিস। ডেমোস্থিনিস প্রায় নিশ্চিতভাবেই নির্দোষ ছিলেন, সম্ভাব্য ক্রুদ্ধ আলেকজান্ডারকে সন্তুষ্ট করতে দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হত, আর ডেমোস্থিনিস হত সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য বিসর্জন। ডেমোস্থিনিসকে এক অসম্ভব পরিমাণে জরিমানা করা হলাে, আর যখন তিনি এটা পরিশােধ করতে পারলেন না, তখন তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হলাে। তিনি জেল থেকে পালিয়ে আর্গোলিসে গেলেন।

প্রথম দিকে এথেন্সের নেতৃত্বে মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে গ্রিকদের জয় হলেও শেষে মেসিডোনিয়ার কাছে পরাজয় : পরবর্তীতে কী ঘটত তা বলা কঠিন ছিল, কিন্তু পরের বছরেই আলেকজান্ডার মারা গেলেন, তার ফিরে আসা ও শাস্তি দেয়ার সুযােগ ঘটার আগেই। তৎক্ষণাৎ (যেমন তের বছর আগে যখন ফিলিপ মারা যাওয়ার সময় হয়েছিল) গ্রিস সােল্লাসে মেসিডােনিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জেগে উঠল। (এরিস্টোটল ভয় পেলেন যে এথেনীয় দেশপ্রেমিকেরা হয়তাে এই ব্যাপারটি মনে রাখবে যে তিনি একসময় আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন, এবং তিনি দর্শনের বিরুদ্ধে এথেন্সকে আরেকটি অপরাধ করাতে চাননি। তিনি দ্রুত ইউবিরায় পালিয়ে গেলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দে সেখানে মৃত্যুবরণ করলেন।)। এথেন্সকে নেতৃত্বে রেখে একটি গ্রিক সেনাবাহিনী গঠিত হলে আর তাদের বিপক্ষে এন্টিপেটার মেসিডােনিয়ান বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কিন্তু, এটা মনে হচ্ছিল যে ফিলিপ আর আলেকজান্ডারের জাদু নিঃশেষ হয়ে গেছে, যেহেতু মেসিডােনিয়ানরা বিওটিয়ায় বাজেভাবে হেরে গিয়েছিল। এন্টিপেটারকে থারমােপাইলির উত্তরে লেমিয়ায় পিছিয়ে যেতে হয়েছিল এবং সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের পুরােটা জুড়ে ঐক্যবদ্ধ গ্রিক বাহিনী কর্তৃক অবরােধের শিকার হতে হয়েছিল। এই কারণে সংঘর্ষটি পরিচিত “লেমিয়ার যুদ্ধ” নামে। অবস্থা এতটাই অনুকূলে ছিল যে ডেমােস্থিনিস বিজয়ীর বেশে তার দেশের মানুষের কাছে বীর হয়ে এথেন্সে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন। নগরটিই তার হয়ে জরিমানা শােধ করে দিল আর কিছু সময়ের জন্য এরকম মনে হতে লাগল যে মহান বক্তার অনমনীয়তা সবকিছুকেই জিতে নিয়েছে এবং বিজয়ীর দিন তার হাতেই ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু অনুকূল অবস্থা আসলে ছিল এক ভ্রান্তি। এশিয়া থেকে এসে এন্টিপেটার বলপ্রয়ােগ করলেন আর যদিও গ্রিকরা কিছু সময়ের জন্য ভালাে করতে লাগল, বিশেষ করে তাদের পাশে থাকা কৌশলী থেসালিয়ান ঘােড়সওয়ার বাহিনীর কারণে, তবুও যুদ্ধে তারা হেরে গেল। তারা মধ্য থেসালীর ক্র্যাননে পরাজয় বরণ করল আর গ্রিকদের মনােবলে ফাটল ধরল। সাগরে তাদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। মেসিডােনিয়ানরা তাদের নিজস্ব নৌবাহিনী তৈরি করেছিল আর তারা নাক্সোসের দক্ষিণপূর্বের আমােরগােস দ্বীপে এথেনীয় জাহাজগুলাের মুখােমুখি হলাে। এখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দে এথেনীয় নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল আর তা হলাে শেষবারের মতাে। তখন পর্যন্ত যতবার কোন এথেনীয় রণতরী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন কোন না কোন রণতরী ঠিকই নিজেকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বের করে আনতে পেরেছিল। এমনকি এমনকি ঈগোসপোটামিতেও এটাই ঘটেছিল। কিন্তু এবার আর তা হলো না। আর কখনাে এথেনীয় জাহাজ সাগরে রাজত্ব করতে পারেনি। থেমিস্টোক্লিসের মাধ্যমে দেড় শতাব্দী পূর্বে এথেনীয় নৌশক্তির যে যুগের সূচনা ঘটেছিল, এভাবেই তার পরিসমাপ্তি ঘটল। গ্রিক ঐক্যজোট ভেঙে পড়ল আর একের পর এক নগর রাষ্ট্রগুলাে এন্টিপেটারের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এথেন্সও তাই করল, খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দের সেপ্টেম্বরে বন্দিত্বকে এড়িয়ে যাবার মূল্য হিসেবে এথেনীয়রা ডেমোস্থিনিসকে পরিত্যাগ করতে রাজি হলাে। কিন্তু ডেমোস্থিনিস আর্গোলিসের এক ক্ষুদ্র দ্বীপে পালিয়ে গেলেন, এবং এন্টিপেটারের লোকেরা সেখানে তাকে অনুসরণ করল। ডেমোস্থিনিস একটি মন্দিরে লুকিয়েছিলেন, তারা তাকে মন্দিরের বাইরে নিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করল, কিন্তু ডেমোস্থিনিস দীর্ঘ উপযােগিতাহীন লড়াইয়ে ক্লান্ত ছিলেন। তিনি কারাবরণ করলেন, তিনি বিঁষ পান করলেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দের অক্টোবরে তিনি মারা গেলেন। গ্রিকরা তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে এভাবেই পরাজিত হলো।

ডায়াডােকিদের মধ্যে যুদ্ধ

আলেকজান্ডারের উত্তরসুরির অভাব ও ডায়াডোকিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : এদিকে আলেকজান্ডারের মৃত্যুতে মেসিডােনের রাজকীয় পরিবারের অবশিষ্ট ছিল আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস, তার স্ত্রী রােকসানা, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে জন্ম নেওয়া এক পুত্র চতুর্থ আলেক্সান্ডার, সৎবােন থেসালােনাইকি এবং মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ভাই যিনি পরবর্তীতে চতুর্থ ফিলিপ হিসেবে পরিচিত হন। এদের কেউই শাসন করতে পারতেন না, আর তাই একজন রাজপ্রতিভূর দরকার ছিল। কিন্তু আলেকজান্ডার কোনাে রাজপ্রতিভূর নাম বলে যাননি। তার শেষ নিঃশ্বাসের সাথে সাথেই তিনি সম্ভবত পরবর্তী প্রেক্ষাপটের জন্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন এটা বলে, “সবচেয়ে শক্তিমানকে!” দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবচেয়ে শক্তিমান কেউ ছিল না। আলেকজান্ডারের সেনাদলে কিছু সংখ্যক সেনাপতি ছিলেন, সবাই ছিলেন অধিপতি, তারা প্রশিক্ষিত, সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সবাই যােগ্য, সবাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কেউ অন্য কাউকে একক ক্ষমতাধর অবস্থানে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। গুণে গুণে চৌত্রিশজন ক্ষমতায় ছিলেন আলেকজান্ডারের বিশাল রাজত্বের এখানে সেখানে। এই সেনাপতিদের বলা হতাে “ডায়াডােকি,” যার অর্থ “উত্তরাধিকারীরা”। ডায়াডোকিদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই ছিলেন এন্টিপেটার, যিনি গ্রিকদের সাথে লড়াই করে মেসিডােনে ফিরে এসেছিলেন। এশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতিমানরা ছিলেন ক্র্যাটেরাস, এন্টিগােনাস, পলিসপারকন, পার্ডিকাস, লিসিমেকাস, সেলুকাস আর ইয়ুমিনিস। মিশরে ছিলেন টলেমি। এইসকল সেনাপতি তৎক্ষণাৎ ভ্রমাত্মক ও অবিরাম যুদ্ধবাজিতে লিপ্ত হলেন, ঠিক যেমন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলাে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে একে অপরের অঞ্চলের ক্ষতিসাধন করত, এবারও ঠিক তাই হলো, কিন্তু অনেক বেশি পরিমাণে। যখনই কেউ উপরে উঠলেন, তখন অন্যরা তার বিরুদ্ধে সংঘটিত হতেন। যুদ্ধটি ডায়াডােকিদের পুত্র অথবা এপিগােনিদের ভেতরও চলতে থাকল। তাদেরকে এই নামে ডাকা হত, যার উদ্ভব গ্রিক শব্দ থেকে, যার অর্থ “পরবর্তীতে জন্ম”। 

মিশরে টলেমির বিরুদ্ধে পার্ডিকাসের পরাজয় : যুদ্ধ শুরু হয়েছিল পার্ডিকাসের মাধ্যমে, যিনি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সময় তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এবং যার অধীনে ছিল আলেকজান্ডারের মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ সৎ ভাই তৃতীয় ফিলিপ। পার্ডিকাস পুরাে সাম্রাজ্যেরই রাজপ্রতিভূ হবার আশা করেছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ ডায়াডােকি এটা হতে দিতেন না। পার্ডিকাস টলেমির বিরুদ্ধে এক সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিলেন, কিন্তু অভিযাত্রাটি ছিল অসফল। পার্ডিকাস তাই তার কিছু বীতশ্রদ্ধ কর্মকর্তার হাতে খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে গুপ্তহত্যার শিকার হলেন।

গ্রিস থেকে আসা ক্র্যাটেরাসের বিরুদ্ধে ইয়ুমিনিসের জয় : সেনাপতিদের যুদ্ধ এশিয়া মাইনরের দিকেও হতে যাচ্ছিল। একপার্শ্বে ছিলেন পাৰ্ডিকাসের সাথে জোটগতভাবে যুদ্ধ করা ইয়ুমিনিস। অন্যপক্ষে ছিলেন ক্র্যাটেরাস, যিনি কেবলই গ্রিস থেকে ফিরেছিলেন, যেখানে তিনি লেমিয়ার যুদ্ধে গ্রিকদের বিধ্বস্ত করতে এন্টিপেটারকে সাহায্য করেছিলেন। যুদ্ধে ক্র্যাটেরাসকে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু ইয়ুমিনিসকে তা সাহায্য করেনি কারণ তার মিত্র পার্ডিকাসও মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

গ্রিস, মেসিডোনিয়া ও থেসালোনিকিতে এন্টিপেটারের পুত্র ক্যাসান্ডারের ক্ষমতায় আসা : এন্টিপেটার মারা গেলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩১৯ অব্দে, এবং কিছু কারণে নিজের পুত্র ক্যাসান্ডারের বদলে মেসিডােনিয়ার রাজপ্রতিভূর পদ আর গ্রিসের নিয়ন্ত্রণ পলিসপারকনের হাতে ছেড়ে দেন। এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার কোনাে ইচ্ছাই ক্যাসান্ডারের ছিল না। তিনি প্রায় সব গ্রিক নগরের সমর্থন পেলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে এথেন্স দখল করলেন। এদিকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মা অলিম্পিয়াস ক্যাসান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন আর সৎ পুত্র তৃতীয় ফিলিপকে হত্যা করালেন। ক্যাসান্ডার অলিম্পিয়াসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন, তাকে পরাস্ত করলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১৬ অব্দে তাকে হত্যা করালেন। তিনি মেসিডােনিয়ার নিয়ন্ত্রণ দখল করলেন এবং আলেকজান্ডারের স্ত্রী রােকসানা এবং তার শিশুপুত্রকে বন্দী করলেন। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ অব্দে তিনি উভয়কেই হত্যা করলেন। আলেকজান্ডারের পরিবারের সবার মধ্যে কেবলমাত্র সৎ বােনটি অবশিষ্ট ছিল। ক্যাসান্ডার তাকে বিয়ে করলেন, আর বছর বিশেকের এক শাসনকাল নিয়ে থিতু হলেন। তিনি কালসিডিসির উত্তর-পশ্চিমে একটি নগর নতুন করে গড়ে তুললেন আর তার স্ত্রীর নামে নগরটির নাম দিলেন থেসালােনাইকি (এর আধুনিক নাম হলো সালােনিকি)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩১৬ অব্দে থিব্‌সকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন, বিশ বছর আগে আলেকজান্ডারের আগমনের কারণে হওয়া ধ্বংসস্তুপ থেকে আবারও থিব্‌সকে জাগিয়ে তােলা হলো।

অ্যান্টিগোনাসের ইয়ুমিনিসকে হারিয়ে এশিয়া মাইনোর দখল, সেলুকাসকে বিতাড়িত করে ব্যাবিলনিয়া দখল : ডায়াডােকিদের মধ্যে যে চারজন অবশিষ্ট ছিলেন, তারা হলেন এশিয়া মাইনরে এন্টিগােনাস আর ইয়ুমিনিস, ব্যাবিলনীয়ায় সেলুকাস আর মিশরে টলেমি। এর বাইরে, এপিগনির একজন ক্যাসান্ডার মেসিডােনিয়ায় শাসন করতেন। এই ব্যবস্থা ডায়াডােকি শ্রেণির সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এন্টিগােনাসের হাতে তছনছ হয়ে গেল। তিনি অংশবিশেষ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, চাইতেন সম্পূর্ণটাই। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৬ অব্দে তিনি যুদ্ধে ইয়ুমিনিসকে পরাস্ত ও হত্যা করেন, এবং এশিয়া মাইনরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলেন। তারপর ব্যাবিলনীয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে সেলুকাসকে বিতাড়িত করেন। এরপর এন্টিগোনাস তার এক চোখ দিয়ে (এক চোখে দেখা এন্টিগােনাসকে বলা হত “এন্টিগােনাস মনােফথালমাস” অথবা “একচোখা এন্টিগােনাস”) তার সেই সাম্রাজ্যের দিকে তাকালেন যা প্রায় তারই ছিল।

সেলুকাসের ব্যাবিলনিয়া পুনর্দখল (৩১১-৩০৯ খ্রি.পূ.) : সেলুকাস, টলেমি আর ক্যাসান্ডারের সাথে তার বিরুদ্ধে জোটে যােগদান করলেন। অবশিষ্ট ডায়াডােকিদের কেউই এন্টিগােনাসকে একক ক্ষমতাধর হিসেবে দেখতে চায়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে এন্টিগােনাসের কাছ থেকে ব্যাবিলনীয়া পুনর্দখল করেছিলেন। এরপর তিনি নিকানর ও এভাগোরাসকে পরাজিত করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো জয় করেন। অ্যান্টিগোনাস, তার পুত্র ম্যাসিডনের প্রথম ডেমেট্রিয়াসের সাথে ব্যাবিলনকে সংযুক্ত করার জন্য একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা ব্যর্থ হয়। সেলুকাসের বিজয় তার ব্যাবিলনের দাবি এবং বৈধতা নিশ্চিত করেছিল। তিনি শুধু ব্যাবিলনিয়া নয়, আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের পুরো বিশাল পূর্ব অংশ শাসন করেছিলেন, যেমনটি আপ্পিয়া নবর্ণনা করেছেন, “সর্বদা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ওঁত পেতে থাকা, সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী এবং কাউন্সিলে প্ররোচনামূলক সেলুকাস মেসোপোটেমিয়া, আর্মেনিয়া, ‘সেলুসিড’ ক্যাপাডোকিয়া, পারসিস, পার্থিয়া, ব্যাকট্রিয়া, আরব, তাপোরিয়া, সোগদিয়া, আরাকোসিয়া, হিরকানিয়া এবং অন্যান্য সংলগ্ন অঞ্চল শাসন করেন, যেখানকার জনগোষ্ঠী পূর্বে আলেকজান্ডার কর্তৃক বশীভূত হয়েছিল। তাই সাম্রাজ্যের সীমা সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার ফলে আলেকজান্ডারের পরে তার সাম্রাজ্যই এশিয়ায় সর্বাধিক পরিমাণে বিস্তৃত ছিল, ফ্রিজিয়া থেকে সিন্ধু পর্যন্ত পুরো অঞ্চলটি ছিল সেলুকাসের অধীন।” সে সময়ে টিকে থাকা ডায়াডােকিরা নিজেদেরকেও রাজা ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল, যা প্রকৃতপক্ষে সত্যই ছিল। কেননা আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য ততদিন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এন্টিগােনাস যেমন রাজা ছিলেন এশিয়া মাইনরে, টলেমি ছিলেন মিশরে, ক্যাসান্ডার মেসিডােনিয়ায়, এবং সেলুকাস ছিলেন ব্যাবিলনীয়ার রাজা।

এন্টিগোনাসের পুত্র ডিমিট্রিয়াসের হাতে টলেমির নৌবাহিনীর পরাজয় এবং সাগর ও সমুদ্রোপকুলের নিয়ন্ত্রণ লাভ : নিজের পক্ষে এন্টিগােনাসের ছিল তার পুত্র ডিমিট্রিয়াস, যিনি ছিলেন একজন যােগ্য সেনাপতি। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে, ডিমিট্রিয়াস গাজায় টলেমির হাতে পরাজিত হলেন, কিন্তু এই পরাজয় নির্ণায়ক যুদ্ধ ছিল না। ডিমিট্রিয়াস সমুদ্রের এলাকা দখল করতে চেয়েছিলেন, যা তখন টলেমির নিয়ন্ত্রণে ছিল। তিনি রণতরী জোগাড় করে খ্রিস্টপূর্ব ৩০৭ অব্দে এথেন্সকে দখল করে নিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩০৬ অব্দে সালামিসের যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে টলেমির কাছ থেকে সাইপ্রাস জয় করেন। এই মুহূর্তে, ডিমিট্রিয়াস সাগরগুলাে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এই জয়টিই এন্টিগােনাসের দরকার ছিল। তিনি ছিলেন পঁচাত্তর বছর বয়সী, আর তিনি বেশি অপেক্ষা করতে পারতেন না, কেবল মাত্র ‘রাজা’ হয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ডিমিট্রিয়াস, টলেমির বিরুদ্ধে তার বিজয় উদযাপন করতে উত্তর ঈজিয়ানের সামােফ্রেস দ্বীপে পাখনা সম্বলিত বিজয়ের দেবীর খােদিত মূর্তি তৈরি করেছিলেন। মূর্তিটি (পাখাওয়ালা বিজয়) আজও টিকে আছে, যার মাথা আর হাত নেই, কিন্তু পাখনা অক্ষত আছে। (এই সময়ের আরেকটি বিখ্যাত গ্রিক মূর্তি যা আজও টিকে আছে, তা হলাে হাতবিহীন খােদাই করা আফ্রোদিতি, ১৮২০ অব্দে মেলােস দ্বীপে যা পাওয়া গেছে। হেলেনিস্টিক যুগের অজানা কোনাে সময়ে এটা খােদাই করা হয় আর এটি সাধারণভাবে এর ইতালিয়ান নাম “ভেনাস ডি মেলাে”তে পরিচিত।)

ডিমিট্রিয়াসের রোডস জয়ে ব্যর্থতা এবং রোডসের সূর্যদেবের মূর্তি নির্মাণ : টলেমির নৌবাহিনীকে পরাস্ত করে ডিমিট্রিয়াস রােডস দ্বীপ দখলে নিতে চাইলেন, যেটি ছিল টলেমির মিত্র। তা করতে গিয়ে তিনি দেয়াল ধসিয়ে দেয়া আর নগর ধ্বংস করার জন্য দখল করার দারুণ যন্ত্র ব্যবহার করলেন, কেননা যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল দারুণভাবে যান্ত্রিক ব্যবস্থাময়। ডিমিট্রিয়াস এক বছর ধরে দখলে নেয়ার জন্য আঘাত হেনে গেলেন, কিন্তু রােডস দ্বীপবাসীরা অনমনীয়তার সাথে প্রতিরােধ করল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪ অব্দে ডিমিট্রিয়াসকে হাল ছেড়ে দিতে হলাে। এই অবরােধ এতই বিখ্যাত ছিল যে ডিমিট্রিয়াস পরিচিত হয়ে উঠলেন ডিমিট্রিয়াস পােলিওরসিটিস বা “অবরােধকারী ডিমিট্রিয়াস” নামে। এবার ছিল রােডসের পালা বিজয়কে স্মরণ করে একটি মূর্তি গড়ার। তারা অবরােধকারীদের ফেলে যাওয়া বস্তুগুলাে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল সূর্য দেবতার বিশাল এক মূর্তি তৈরি করার জন্য, কারণ তারা বিশ্বাস করতো এই সূর্যদেবই তাদেরকে রক্ষা করেছে। এটি তৈরি করতে অনেক বছর লেগেছিল আর খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ অব্দের আগে এর কাজ শেষ হয়নি। যখন তৈরি সম্পূর্ণ হলাে, টিকে থাকা বর্ণনা অনুযায়ী, এটি ছিল ১০৫ ফুট লম্বা। পােতাশ্রয়ের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকা, যেরকম এটি ছিল, এই মূর্তিটি বহুদূরে সমুদ্র থেকে আসা জাহাজগুলাে থেকে দেখা যেত। সূর্য দেবতার এই মূর্তিটি আমাদের কাছে “কলােসাস অফ রােডস” নামে পরিচিত আর এটি গ্রিকদের মাধ্যমে বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কলােসাস অফ রােডস অর্ধশতাব্দীর বেশি দাড়িয়ে থাকতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ২২৪ অব্দে এক ভূমিকম্প এটিকে ধ্বসিয়ে দেয় এবং পরবর্তী বছরগুলােতে এর সম্মন্ধে চালু গল্পগুলাে এর আকৃতিকে অতিরঞ্জিত করেছে। এটা এত বিশাল ছিল বলে ধারণা করা হয় যে এটি পা দুটো ফাঁক করে পােতাশ্রয় জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল আর জাহাজগুলাে সেখানে ঢুকতাে পা দুটোর ভেতর দিয়ে। এটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছিল এক রূপকথার গল্প।

সেলুকাসের ব্যক্ট্রিয়া জয়, সেলুকাস-মৌর্য যুদ্ধ ও চন্দ্রগুপ্তের কাছে পূর্বের বিভিন্ন অঞ্চল হারানো : ৩০৫ খ্রি.পূ.তে সেলুকাস ব্যাক্ট্রিয়া জয় করেন। এর ফলে ৩০৪ খ্রি.পূ.তে সেলুকিড-মৌর্য যুদ্ধ শুরু হয়। ৩০৩ খ্রি.পূ.তে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে আরাকোসিয়া (কান্দাহার), পারপামিসাডি (ফারাহ্‌), গেড্রোসিয়া (সিস্তান, বেলুচিস্তান) ও আরিয়া (হেরাত) (সম্ভবত) ছেড়ে দেন ও তার মেয়ের সাথে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহের মাধ্যমে সন্ধি স্থাপন করেন। বিনিময়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাকে ৫০০টি যুদ্ধহস্তী দান করেন, যেগুলোকে ব্যবহার করে সেলুকাস পরবর্তীতে ইপ্সুসের যুদ্ধে লিসিমেকাসের পক্ষে থেকে অ্যান্টিগোনাসকে পরাজিত করবেন এবং সিরিয়া ও পূর্ব এশিয়া মাইনোর দখল করে বিশাল সেলুসিড সাম্রাজ্য গঠন করবেন।

ডিমিট্রিয়াসের কাছে ক্যাসান্ডারের পরাজয় ও এথেন্স সহ গ্রিসের বেশিরভাগ অঞ্চল লাভ : রােডসের অবরােধের ব্যর্থতার পর ডিমিট্রিয়াস এথেন্সে ফিরে এলেন, যেটি মেসিডােনিয়ার ক্যাসান্ডারের হাতে অবরুদ্ধ ছিল। ডিমিট্রিয়াস এথেন্সকে মুক্ত করলেন, তারপর ক্যাসান্ডারের কাছ থেকে গ্রিসের বেশিরভাগ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে তাকে সম্মিলিত সভায় গ্রিক নগরগুলাের প্রধান সেনাপতি হিসেবে ভােট দেওয়া হলাে, যে সভা একসময় ফিলিপ আর আলেকজান্ডারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হত।

ক্যাসান্ডারের এশিয়া মাইনোরে এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠানো ও ইপসুসের যুদ্ধে ডিমিট্রিয়াস-এন্টিগোনাসের পরাজয়, এন্টিগোনাসের মৃত্যু : এদিকে ক্যাসান্ডার ডিমিট্রিয়াসের পিতা এন্টিগােনাসকে আক্রমণ করার জন্য এশিয়া মাইনরে সৈন্য পাঠালেন। গ্রিসকে ক্যাসান্ডারের হাতে আবারও ছেড়ে দিয়ে ডিমিট্রিয়াস তার পিতার সাথে যােগদান করতে এশিয়া মাইনরের দিকে ছুটতে বাধ্য হলেন। এন্টিগােনাস আর ডিমিট্রিয়াস বাকি সব ডায়াডােকিদের মুখােমুখি হচ্ছিলেন আর যুদ্ধটি খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ অব্দে মধ্য এশিয়া মাইনরের ইপসুসে সংঘটিত হলাে। এই যুদ্ধটি হাতিকে যুদ্ধের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চূড়ান্ত মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। হাইদাসপিসের যুদ্ধ থেকে কৌশলটি শিখে ডায়াডােকিরা সাধারণভাবে যখনই পেরেছে তখনই হাতির ব্যবহার করেছে। সেলুকাসও অ্যান্টিগোনাসের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছ থেকে পাওয়া যুদ্ধহস্তীকে ব্যবহার করেছিলেন। ইপসুসে প্রায় ৩০০ হাতি যুদ্ধ করেছিল, কিছু এক সেনাবাহিনীর সাথে আর কিছু অন্যদের সাথে। এন্টিগােনাসের অপেক্ষাকৃত কম হাতি ছিল আর তিনি পরাজিত হলেন। একাশি বছর বয়সেও তিনি ছিলেন অদম্য এবং মৃত্যুর সময়ও তিনি কেঁদে বলছিলেন, “ডিমিট্রিয়াস আমাকে রক্ষা করবে!” কিন্তু ডিমিট্রিয়াস তা পারেননি; তিনি কোনােমতে তার নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিলেন। ইপসাসের পর লিসিমিকাস লিডিয়া, আয়োনিয়া, ফ্রিজিয়া, অর্থাৎ এশিয়া-মাইনোর লাভ করেন, আর সেলুকাস সিরিয়া ও পূর্ব এশিয়া মাইনোর দখল করেন। ইপসুসের যুদ্ধ আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের আবার ঐক্যবদ্ধ হবার সব আশা শেষ করে দিল। কিন্তু, ডিমিট্রিয়াস পােলিওরসিটিস তখনাে শেষ হয়ে যাননি। তার কাছে তখনও তার নৌবাহিনী ছিল আর তিনি তার সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন। ক্যাসান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ অব্দে মারা যান আর তার উত্তরাধিকারী হিসেবে শুধু দুই পুত্রকে রেখে যান। কেউই মেসিডােনিয়াকে ধরে রাখার মতাে যােগ্য ছিলেন না আর ডিমিট্রিয়াস দ্রুত এই অবস্থার সুবিধা নিতে এগােলেন।

ডিমিট্রিয়াসের ক্যাসান্ডারের পুত্র চতুর্থ ফিলিপকে পরাজিত ও হত্যা করে মেসিডোনিয়া ও গ্রিস দখল : খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ অব্দে, তিনি এথেন্সে অবরােধ করলেন আর আরেকবার দখলে নিলেন। এটিকে তার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ডিমিট্রিয়াস আবারও গ্রিসের বেশিরভাগ জয় করে নিলেন আর তারপর ক্যাসান্ডারের তরুণ পুত্র চতুর্থ ফিলিপের কাছ থেকে মেসিডােনিয়াকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিলেন। কোন মর্মপীড়া ছাড়াই তিনি তরুণ রাজাকে হত্যা করালেন।পরবর্তীতে তিনি পেলােপনেসাসে প্রবেশ করে স্পার্টার দিকে অগ্রসর হলেন। এক প্রজন্ম আগে তৃতীয় এইজিসের অধীনে মেসিডােনিয়ার সাথে যুদ্ধের প্রচেষ্টার পর থেকে স্পার্টা ছিল নিষ্ক্রিয়। সে লেমিয়ার যুদ্ধে অথবা মাঝে-মধ্যে গ্রিকদের নিজেদের মুক্ত করার কোনাে প্রচেষ্টায় যােগদান করেনি। যদিও সে ডিমিট্রিয়াসকে ঠেকাতে পারত না, তবুও সে প্রতিবারের মতাে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানালো। শেষ মুহূর্তে অন্যখানে জরুরি প্রয়ােজনে ডিমিট্রিয়াসকে ডেকে নেয়া হলাে, এবং আবারও স্পার্টা বন্দীত্ব থেকে রক্ষা পেল। যে চমৎকারিত্ব তাকে ইপামিনন্ডাস, ফিলিপ, আলেকজান্ডার আর এন্টিপেটারের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, তা তাকে আবারও রক্ষা করল।

লিসিমেকাসের হাতে ডিমিট্রিয়াসের পরাজয় ও গ্রিস-মেসিডোনিয়া দখল, ডিমিট্রিয়াসের পুত্র এন্টিগোনাসের হাতে এশিয়া মাইনোর ও যুদ্ধের ধারাবাহিকতা : গ্রিস আর মেসিডােনিয়ার নিয়ন্ত্রণ বেশিদিন ডিমিট্রিয়াসের হাতে থাকল না। লিসিমেকাসের বাহিনীর হাতে তিনি বহিষ্কৃত হলেন। লিসিমেকাস ইপসুসে বিজয়ী পক্ষে ছিলেন এবং এশিয়া মাইনরের এন্টিগােনাসের অংশ তাকে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ২৮৮ অব্দে ডিমিট্রিয়াস যুদ্ধক্ষেত্রে ধরা পড়ার পর বন্দী অবস্থায় খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দে মারা গেলেন। তিনি গ্রিসে এক পুত্র রেখে গেলেন, আরেকজন এন্টিগােনাসকে, যাকে পরবর্তীতে তার পিতা ও পিতামহের যুদ্ধ টেনে নিয়ে যেতে হলাে।

সেলুকাসের হাতে লিসিমেকাসের পরাজয় ও মৃত্যু : খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দে, টলেমি চুরাশি বছর বয়সে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেন। অবশিষ্ট দুই ডায়াডােকি লিসিমেকাস আর সেলুকাস অনন্ত সংগ্রামে ক্লান্ত হননি। আয়োনিয়ান উপকূলের অভ্যন্তরে এশিয়া মাইনরের করিওপেডায়োনে তারা যুদ্ধে পরস্পরের মুখােমুখি হলেন, এবং সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ২৮১ অব্দে লিসিমেকাস পরাজিত ও নিহত হলেন। এখনাে কি সেলুকাস একক সর্বময় ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতে পারে? এটা হতে পারত। মিশরের বিরুদ্ধে তার এক অস্ত্র ছিল।

টলেমি সেরোনাসের দ্বারা সেলুকাসের গুপ্তহত্যা ও মেসিডোনিয়া দখল : সম্ভবত, টলেমির দুই পুত্র ছিল যার মধ্যে ছােটটি সিংহাসনে আরােহণ করেছিল। বড়টিকে অন্যত্র তার ভাগ্যের সন্ধান করতে হয়েছিল। উভয় পুত্রকেই টলেমি বলা হত (প্রকৃতপক্ষে, টলেমির সব উত্তরাধিকারীরই এই নাম ছিল) এবং তাদেরকে আলাদা করার জন্য উপাধি ব্যবহার করা হত। টলেমির জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিল টলেমি সিরােনাস, অথবা “বজ্রবিদ্যুৎ টলেমি”। টলেমি সিরােনাস এশিয়া মাইনরে পৌঁছলেন এবং সেখানে ছিলেন সেলুকাসের সুরক্ষাবলয়ে, যিনি ভেবেছিলেন নতুন টলেমি যিনি মিশরের সিংহাসনে বসেছেন, তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অস্ত্র হিসেবে সে কাজে আসবে। এরই মধ্যে টলেমি সিরােনাসের সহায়তায় সেলুকাস মেসিডােনিয়ার দিকে তার হাত বাড়ালেন, যেটি ডিমিট্রিয়াস পলিওরসিটিস আর লিসিমেকাসের পরাজয়ের কারণে এখন অনিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু, টলেমি সিরােনাসের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ অব্দে তিনি সেলুকাসকে গুপ্তহত্যা করালেন এবং তার নিজের জন্যই মেসিডােনিয়ার দখল নিয়ে নিলেন। এইভাবে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে ডায়াডােকিদের মধ্যে সর্বশেষের জনের প্রস্থান ঘটল। আর পঞ্চাশ বছরের নৃশংস আর অর্থহীন যুদ্ধের পরিণতি কী ছিল? আসলে, এসব ঘটেছিল আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর থেকেই।

ডায়াডোকিদের সময়রেখা

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীগণ সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এই উত্তরাধিকারীগণ ডায়াডোকি নামে পরিচিত ছিলেন, এবং তাদের সংঘাতের ফলে মেসিডোনীয় সাম্রাজ্য বিভিন্ন ডায়াডোকিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

  • ৩২৩ খ্রি.পূ. – (১) ব্যাবিলনে যে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পারটিশন হয় তাতে তৃতীয় ফিলিপকে রাজা এবং পারডিকাসকে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এবং সত্রপিগুলো ডায়াডোকিরা ভাগ করে নেয়। (২) লেমিয়ান যুদ্ধ। (৩) এন্টিপেটার লেমিয়ার দুর্গ অবরোধ করেন।
  • ৩২২ খ্রি.পূ – (১) এথেনীয়দের সাথে যুদ্ধে লিওনিটাস নিহত হন। (২) এথেনীয় জোটের বিরুদ্ধে ক্র্যাননের যুদ্ধে ক্রাটেরস পরাজিত হন। (৩) ডায়াডোকির প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। (৪) এন্টিপেটার, ক্রাটেরাস, এন্টিগোনাস, অ্যাসান্ডার এবং টলেমি পার্ডিকাসের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠন করেন।
  • ৩২১ খ্রি.পূ. – (১) হেলেসপন্টের যুদ্ধে ইউমেনেস ক্রাটেরাস ও নিওটলেমাসকে পরাজিত করেন। (২) পারডিকাস তার নিজ সেনাপতিদের হাতে নিহত হন। (৩) ট্রাইপারাডিসকাস বিভক্ত হয়।
  • ৩২০ খ্রি.পূ. – অ্যান্টিগোনাস ইউমেনেস, অ্যালসেটাস ও অ্যাট্টালাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
  • ৩১৯ খ্রি.পূ. – (১) অ্যান্টিগোনাস ইউমেনেসকে ওরকিনিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করেন। (২) নোরা অবরোধ। (৩) পলিপারকন নতুন রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হন। (৪) অ্যান্টিগোনাস আলকেটাস, আট্টালস এবং ডোকিমসকে ক্রেটোপলিসের যুদ্ধে পরাজিত করেন। (৫) অ্যান্টিগোনাস ক্লেইটাস দ্য হোয়াইটকে পরাজিত করেন। 
  • ৩১৮ খ্রি.পূ. – (১) ইউমেনেস সিরিয়া ও ফিনিশিয়ায় অভিযাত্রা করেন, এবং পলিপারকনের নির্দেশে একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। (২) পেইথন পার্থিয়ায় আক্রমণ করেন এবং এর সত্রপ ফিলিপকে হত্যা করেন। 
  • ৩১৭ খ্রি.পূ. – (১) পেইথনকে পূর্বাঞ্চলীয় সত্রপগণ পরাজিত করেন। (২) ইউমেনেস ফিনিশিয়া থেকে বের হন। (৩) এন্টিওনাস পূর্ব দিকে ইউমেনেসের সাথে যুদ্ধ করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। (৪) মেগালোপলিসে ব্যর্থ অবরোধ। (৫) ক্যাসান্ডার পলিপারকনকে পরাজিত করেন। (৬) ইউমেনেসকে পূর্বাঞ্চলীয় সত্রপগণ সহায়তা করেন। (৭) পেইথন এবং সেলুকাস এন্টিগোনাসের পক্ষে যোগ দেন। (৮) পারাইতাকেনের যুদ্ধ। (৯) অলিম্পিয়াস এবং ঈয়াসিডেস (Aeacides) মেসিডোনে আক্রমণ করেন। (১০) অলিম্পিয়াস তৃতীয় ফিলিপ আরিডিয়াসকে হত্যা করেন।
  • ৩১৬ খ্রি.পূ. – (১) ক্যাসান্ডার পিডনাতে অলিম্পিয়াসকে অবরোধ করেন। (২) অলিম্পিয়াসকে ক্যাসান্ডার মৃত্যুদণ্ড দেন ও কার্যকর করেন। (৩) গাবিয়েনির যুদ্ধে অ্যান্টিগোনাস বিজয়ী হন। (৪) ইউমেনেস ও অ্যান্টিজেনেসের ওপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। (৫) এপিরাসের ঈসিডিয়াসকে বিতাড়িত করা হয়। (৬) মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করে নেন।
  • ৩১৫ খ্রি.পূ. – (১) অ্যান্টিগোনাস পেইথনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। (২) সেলুকাস মিশরে পালিয়ে যান। (৩) এজিনরের পুত্র পেইথনকে ব্যাবিলনের সত্রপ ঘোষণা করা হয়।
  • ৩১৪ খ্রি.পূ. – (১) ক্যাসান্ডার, টলেমি ও লাইসিমেকাস অ্যান্টিগোনাসকে বিভিন্ন অঞ্চল ছেড়ে দেবার দাবি তোলেন। (২) ডায়াডোকির তৃতীয় যুদ্ধ শুরু হয়। (৩) অ্যারিস্টোডেমাসকে পেলোপনিসে পাঠানো হয়।
  • ৩১৩ খ্রি.পূ. – (১) টায়ারকে দীর্ঘ অবরোধের পর দখল করা হয়। (২) অ্যান্টিগোনাস এরপর কারিয়া ও লিডিয়া দখল করেন। (৩) গেটায় (Gatae) পন্টিক পেন্টাপলিসের সাথে জোটবদ্ধ হয় ও লাসিমেকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
  • ৩১২ খ্রি.পূ. – টলেমি প্রথম ডেমেট্রিয়াসের বিরুদ্ধে গাজার যুদ্ধে জেতেন।
  • ৩১১ খ্রি.পূ. – (১) সেলুকাস ব্যাবিলন জয় করেন। (২) সেলুকাস নিকানর ও এভাগোরাসকে পরাজিত করেন। (৩) সেলুকাস পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো জয় করেন। (৪) এন্টিগোনাস ও ক্যাসান্ডার-টলেমি-লাইসিমেকাসের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয়।
  • ৩১০ খ্রি.পূ. – (১) অ্যান্টিগোনাস পুনরায় ব্যাবিলন দখল করেন। (২) ক্যাসান্ডার চতুর্থ আলেকজান্ডার ও রোক্সানাকে হত্যা করেন।
  • ৩০৯ খ্রি.পূ. – (১) সেলুকাস অ্যান্টিগোনাসের কাছ থেকে ব্যাবিলন জয় করেন। (২) পলিপারকন হেরাক্লেসকে হত্যা করেন। (৩) টলেমি উপকূলীয় কারিয়া ও লাইসিয়া আক্রমণ করেন।
  • ৩০৮ খ্রি.পূ. – টলেমি সিসিয়ন, কোরিন্থ ও মেগারার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
  • ৩০৭ খ্রি.পূ. – প্রথম ডেমেট্রিয়াস তার অ্যান্টাগোনিস সেনাবাহিনী নিয়ে এথেন্সকে ক্যাসান্ডারের হাত থেকে মুক্ত করেন।
  • ৩০৬ খ্রি.পূ. – (১) প্রথম ডেমেট্রিয়াস সালামিসের যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে টলেমির কাছ থেকে সাইপ্রাস জয় করেন। (২) অ্যান্টিগোনাস রাজা উপাধি গ্রহণ করেন।
  • ৩০৫ খ্রি.পূ. – (১) সেলুকাস ব্যাক্ট্রিয়া জয় করেন। (২) সেলুকিড-মৌর্য যুদ্ধ শুরু হয়। (৩) রোডস অবরোধ।
  • ৩০৪ খ্রি.পূ. – সেলুকিড-মৌর্য যুদ্ধ
  • ৩০৩ খ্রি.পূ. – সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে আরাকোসিয়া (কান্দাহার), পারপামিসাডি (ফারাহ্‌), গেড্রোসিয়া (সিস্তান, বেলুচিস্তান) ও আরিয়া (হেরাত) ছেড়ে দেন।
  • ৩০২ খি.পূ. – (১) সিয়াসের দ্বিতীয় মিথ্রাডেটিসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। (২) লাইসিমেকাস হেলেসপন্ট অতিক্রম করে এশিয়া মাইনোরে আক্রমণ করেন।
  • ৩০১ খ্রি.পূ. – (১) অ্যান্টিগোনাস ইপসাসের যুদ্ধে পরাজিত হন। (২) প্রথম ডিমিট্রিয়াস এফিসাসে পালিয়ে যান। (৩) ইপসাসের পর লাইসিমিকাস লিডিয়া, আয়োনিয়া, ফ্রিজিয়া লাভ করেন, এবং সেলুকাস সিরিয়া দখল করেন। (৪) টলেমি সাইপ্রাস, প্যালেস্টাইন ও ফিনিশিয়া দখল করেন।
  • ৩০০ খ্রি.পূ. – (১) প্রথম ডেমেট্রিয়াস গ্রিসে অভিযান পরিচালনা করেন। (২) প্রথম ডেমেট্রিয়াস সেলুকাসের সাথে তার কন্যা স্ট্র্যাটোনিসের বিবাহের মাধ্যমে শান্তিস্থাপন করেন।
  • ২৯৭ খ্রি.পূ. – (১) পিরাস এপিরাসের রাজা হন। (২) ক্যাসান্ডার মৃত্যুবরণ করেন।
  • ২৯৪ খ্রি.পূ. – (১) প্রথম ডেমেট্রিয়াস পুনরায় এথেন্স জয় করেন। (২) টলেমি পুনরায় সাইপ্রাস দখল করেন। (৩) প্রথম ডিমিট্রিয়াস মেসিডোনের রাজা হন।
  • ২৯২ খ্রি.পূ. – (১) থিব্‌স অবরোধ। (২) গেটায় এর রাজা ড্রোমিকেটেস লাইসিমেকাসকে পরাজিত করেন।
  • ২৯১ খ্রি.পূ. – প্রথম ডেমেট্রিয়াস থিব্‌স জয় করেন।
  • ২৮৮ খ্রি.পূ. – পিরাস অফ এপিরাস ও লাইসিমেকাস মেসিডোনিয়া আক্রমণ করেন।
  • ২৮৭ খ্রি.পূ. – এথেন্স অবরোধ।
  • ২৮৬ খ্রি.পূ. – ডেমেট্রিয়াসকে সেলুকাস তার সেনাবাহিনী দিয়ে ঘিরে ফেলেন।
  • ২৮৫ খ্রি.পূ. – লাইসিমেকাস ও পিরাসের মধ্যে যুদ্ধ হয়।
  • ২৮৪ খ্রি.পূ. – (১) লাইসিমেকাস সমগ্র মেসিডোন দখল করে নেন। (২) লাইসিমেকাস অ্যাগাথোক্লেসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। (৩) অ্যাগাথোক্লেসের বিধবা পত্নী লাইস্যান্ড্রা সেলুকাসের কাছে পালিয়ে যান।
  • ২৮২ খ্রি.পূ. – প্রথম টলেমি সোটার মৃত্যুবরণ করেন।
  • ২৮১ খ্রি.পূ. – (১) করুপেডিয়ামের যুদ্ধে লাইসিমেকাস পরাজিত হন ও মারা যান। (২) টলেমি কেরাউনসের হাতে প্রথম সেলুকাস নিকাটর মারা যান।

সেলুকাসই ছিলেন সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা ডায়াডোকি। অ্যান্টিগনিড, টলেমিড ও সেলুকিডের মতো ডায়াডোকিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজবংশগুলো টিকে থাকতে ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

হেলেনিস্টিক সিসিলি 

গ্রিসের যে অংশখানি মেসিডােনিয়ান কর্তৃত্ব এড়িয়ে যেতে পেরেছিল, তা ছিল সিসিলি আর ইতালি। তাদের কাছে যেন ফিলিপ আর আলেকজান্ডারের কোনাে অস্তিত্বই ছিল না। কিছু সময়ের জন্য হেলেনিস্টিক সময়ের সিসিলি ছিল হেলেনিক সময়ের সিসিলির মতােই। কার্থেজ তখন পর্যন্ত তাদের শত্রু ছিল, যেমনটি তারা ছিল জারেক্সেস আর সাইরাকুজের দিনগুলােতে, আর টিমোলিয়নের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও সেখানে তখনাে টাইরানী বর্তমান ছিল। সাইরাকুজিয়ান টাইরানীর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিকদের মধ্যে ছিলেন আগাথােক্লিস, যিনি দারিদ্রের ভেতর দিয়ে তার জীবন পার করেছিলেন, কিন্তু চমৎকারিত্বের মাধ্যমে এক ধনী বিধবাকে বিয়ে করে সম্পদশালী হবার পথে এগিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক কাজকর্মের কারণে তাকে নগর থেকে বিতাড়িত করে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি একদল ব্যক্তিগত সেনা নিয়ােগ দিয়ে এখানে সেখানে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন দুনিয়ার সবকিছুর জন্য, যেন তিনি ছিলেন আরেকজন ডিমিট্রিয়াস। খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে তিনি সাইরাকুজের নিয়ন্ত্রণ দখলে নিতে সফল হলেন, এবং গােষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন আর টাইরানীর সমর্থকদের ছিন্নভিন্ন করে দিলেন।

নিশ্চিতভাবেই, তিনি নিজেও একজন টাইরান্ট ছিলেন, এই অর্থে যে তিনি ছিলেন এক একচ্ছত্র শাসক। কিন্তু, তিনি এমনভাবে শাসন করেছিলেন যাতে নিজেকে সাধারণ মানুষের ভেতর জনপ্রিয় রাখা যায়। তিনি যেন প্রায় ছিলেন অর্ধ শতাব্দী পরে জন্ম নেওয়া ডায়ােনিসিয়াস। অন্যদিকে কার্থেজিয়ানরা কোনাে ডায়ােনিসিয়াসকে চায়নি। তারা আরেকজন হ্যামিলকারের নেতৃত্বে সিসিলিতে বিশাল এক সৈন্যদল পাঠাল। এইজন পূর্বের হ্যামিলকারে চেয়ে অনেক বেশি সফল ছিলেন, যিনি একশত সত্তর বছর পূর্বে হিমেরায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এমনকি সাইরাকুজকেও করে ফেলেন অবরােধের অধীন। কার্থেজ সিসিলির সবটুকু দখলে নেয়ার এত কাছে কখনােই আসেনি, যখন প্রচণ্ড তাড়না থেকে আগাথোক্লিস একজন মেসিডােনিয়ানের মতই নিয়ে চিন্তা করছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ অব্দে তিনি কিছু সৈন্যসহ সাইরাকুজ থেকে বেড়িয়ে গিয়ে সাগর পেরিয়ে আফ্রিকার দিকে এগুলেন আর কার্থেজের নিকটবর্তী নগরগুলােতে আক্রমণ চালাতে শুরু করলেন। হতভম্ভ কার্থেজিয়ানরা ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে গ্রিকদের তাদের উপকূলে দেখতে পেয়ে অসহায় হয়ে পড়ল। তাদের হাতে কোনাে সৈন্যবাহিনী ছিল না, আর যে কাঁচা শক্ত মােটা কাপড়ের পােশাক তারা ঘষামাজা করতে সমর্থ হয়েছিল, সেগুলাে আগাথােক্লিসের প্রশিক্ষিত সৈন্যরা অতি সহজেই কেটে ফেলল। সিসিলিতে হ্যামিলকারের কাছে ভীত বার্তা পাঠিয়ে তাকে তার সৈন্যদলকে আফ্রিকায় পাঠাতে বলা হলাে। সাইরাকুজ দখলে নেয়ার আগে হ্যামিলকারের তা করার ইচ্ছে ছিল না। তাই তিনি দ্রুতগতিতে আক্রমণ চালালেন, পরাজিত আর নিহতও হলেন। এর সাথে সাথে সিসিলিকে সম্পূর্ণ বিজয় করার কার্থেজিয়ান আতিরােহিত হয়ে গেল।

পরবর্তীকালে কার্থেজিয়ান সৈন্যদল আফ্রিকায় ফিরে এলো এবং গ্রিকরা পরাজিত হলাে। কিন্তু তার আগে আগাথোক্লিস সিসিলিতে ফিরে এলেন এবং সাইরাকুজের শাসক হিসেবে আবারও তার দায়িত্ব শুরু করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৭ অব্দে তিনি গ্রিক দুনিয়ার সর্বত্র মেসিডােনিয়ান সেনাপতিদের প্রতিষ্ঠা করা রীতিনীতিকে অনুসরণ করে নিজে রাজা নাম গ্রহণ করলেন। আগাথােক্লিসের প্রকল্পের মধ্যে ছিল দক্ষিণ ইতালিতে সম্ভাব্য বিজয়, এমন কিছু যা ডায়ােনিসিয়াস করতে সফল হয়েছিলেন। সেই সময় দক্ষিণ ইতালিতে সবচেয়ে বিখ্যাত নগর ছিল ট্যারেনটাম। স্থানীয় ইতালিয়ান গােত্রগুলাের সাথে তাদের সবসময় সমস্যা লেগেই থাকত আর মােটামুটি ত্রিশ বছর আগে তারা স্পার্টার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে বাধ্য হয়েছিল। তৃতীয় আর্কিডেমাস সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এখন ইতালিয়ান গােত্রগুলাের হুমকি বর্তমান থাকায় এবং আগাগােক্লিস ইতালির জন্য নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দেয়ায় ট্যারেনটাম আরও একবার স্পার্টার কাছে আবেদন জানাল। 

কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২৮৯ অব্দে আগাগােক্লিস তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই মৃত্যুবরণ করলেন আর মনে হলাে ট্যারেনটাম তার সবরকম বিপদের মধ্য দিয়ে জয়লাভ করেছে। কিন্তু তা এমন হয়নি, কেননা এক নতুন আর ভীতি-উদ্রেগকারী বিপদের উত্থান ঘটল। মধ্য ইতালিতে রােম নামে এক নগর ছিল যা গত শতাব্দীতে নীরবভাবে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছিল; এত নীরবে তারা শক্তিশালী হয় যে এর সমৃদ্ধি গ্রিক দুনিয়ার কাছে প্রায় অগােচরেই থেকে গেছে, যার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল অবিশ্বাস্য আলেকজান্ডার আর তার অপ্রতিরােধ্য উত্তরসূরীদের দিকে। আগাগােক্লিসের মৃত্যুর সময় রােম মধ্য ইতালিয়ান শক্তিদের সাথে তার দীর্ঘ যুদ্ধ শেষ করল আর এখন পুরাে উপদ্বীপ থেকে গ্রিক নগরগুলােরও প্রভু হয়ে গেল। ট্যারেনটাম এখন নিজেকে স্থানীয় গােত্রগুলাের মুখােমুখি নয়, বরং আধুনিক সামরিক শক্তিসহ দারুণ সংগঠিত জাতির মুখােমুখি অবস্থায় আবিষ্কার করল। রােম দক্ষিণ ইতালির নগরগুলাের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করতে করল এবং তাদের মধ্যে কয়েকটির সাথে জোট গঠন করল। ট্যারেনটাম এতে ক্ষুব্ধ হলাে এবং যখন রােমান রাষ্ট্রদূতেরা নগরে এলো তাদেরকে বাজেভাবে অপমান করা হলাে। রােম তাৎক্ষণিকভাবে খ্রিস্টপূর্ব ২৮২ অব্দে যুদ্ধ ঘােষণা করল আর ট্যারেনটাম হঠাৎ করে সংযমী হয়ে গেল, আবারও সাহায্যের প্রয়োজন বােধ করল। আরেকবার স্পার্টার কাছে আবেদন জানানাে কোনাে কাজের কথা ছিল না; প্রয়ােজন ছিল আরও শক্ত কিছু ব্যবস্থার। ট্যারেনটাম তাই এড্রিয়াটিকের আশেপাশে সাহায্যের সন্ধান করল আর তারা যা পারত, তার মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী মেসিডােনিয়ান সেনাপতিকে বেছে নিল। সেনাপতিটি ছিলেন পিরাস (Pyrrhus), যিনি কিছু সময়ের জন্য ইতিহাসে রাজত্ব করেছিলেন। 

পিরাসের হাতে এপিরাসের উত্থান ও পতন

পিরাস ছিলেন এপিরাসের রাজা, যার অধীনে এপিরাস ইতিহাসের এক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। এপিরাসের প্রথম দিককার ইতিহাস ছিল কম গুরুত্বপূর্ণ, যদিও ক্ষমতাসীন রাজারা একিলিসের পুত্র পিরাসের উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের দাবি করত। নতুন পিরাসের রাজত্বকালে, এপিরাসের দাবি করা একমাত্র খ্যাতি ছিল এই ব্যাপারটি যে আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস ছিলেন এই ভূখণ্ডের রাজকুমারী, সুতরাং আলেকজান্ডার ছিলেন অর্ধেক এপিরট। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, অলিম্পিয়াসের এক কাজিন এপিরাসের সিংহাসনে বসলেন। তিনি ক্যাসান্ডারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। তার ছােট পুত্র পিরাস এইভাবে ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের দ্বিতীয় কাজিন, এবং তিনিই ছিলেন আলেকজান্ডারের একমাত্র আত্মীয় যিনি তার সামর্থ্যের ভগ্নাংশ দেখাতে পেরেছিলেন। 

পিরাসের বড় ভাই এপিরাসের সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন এবং কিছু সময়ের জন্য পিরাস ডায়াডােকিদের সৈন্যদলে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইপসুসে ডিমিট্রিয়াস পােলিওরসিটিসের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, যখন তার বয়স ছিল মাত্র সতের। পিরাস খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ খ্রিস্টপূর্বাদে এপিরাসের রাজা হন, কিন্তু শান্তিতে থাকতে তার বিরক্তি অনুভূত হত। শুধু যুদ্ধই তাকে আগ্রহী করত এবং তার যুক্ত হবার জন্য কিছু বড় প্রকল্প দরকার ছিল। এটি খ্রিস্টপূর্ব ২৮১ অব্দে ট্যারেনটামের আহ্বানের মাধ্যমেই এল এবং সত্যিকার অর্থেই তিনি আনন্দের সাথেই সাড়া দিলেন। তিনি ২৫০০ লােক আর কিছু সংখ্যক হাতি নিয়ে ট্যারেনটামে পৌঁছলেন, যেটি (হাতি) প্রথমবারের মতাে ইতালিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিল। পিরাস টারেনটামের নরম জীবনযাপনকে ঘৃণার সাথেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নাট্যমঞ্চগুলােকে বন্ধের আদেশ দিলেন, সব উৎসব স্থগিত করলেন এবং লােকজনকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলেন। ট্যারেনটিয়ানরা এতে বিস্মিত আর অসন্তুষ্ট হলেন; তারা রােমানদেরকে পরাজিত দেখতে চাইতেন, কিন্তু নিজেদেরকে কোনাে সমস্যায় ফেলে নয়। পুরাে বিষয়টি ছিল এই যে, তারা চাইতেন কাজটা অন্য কেউ করুক। যারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, পিরাস কেবল তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে এপিরাসে পাঠিয়ে দিলেন। বাকিরা এতে চুপ হয়ে গেল।

পিরাস ট্যারেনটামের পয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণে হেরাক্লিয়া নামক উপকূলীয় নগরে রােমানদের মুখােমুখি হলেন। তিনি তার হাতিদের অগ্রসর করলো এবং সেগুলাে রােমানদেরকে মাড়িয়েও দিল, যারা এই ধরনের জন্তুকে আগ্নেকখনাে দেখেনি। কিন্তু, জয়ের পর পিরাস যুদ্ধক্ষেত্রটিকে কিছুটা গুরুত্বের সাথে দেখলেন। রােমানরা পালিয়ে যায়নি। মৃতরা মাটিতে পড়ে ছিল, সেই সাথে অনেকেই আহত। এবং ভয়াবহ হস্তিকূল তাদেরকে ঘােরারও সুযােগ দেয়নি নিশ্চিতভাবেই, এটি কোনাে সহজ যুদ্ধ হতে যাচ্ছিল না। তিনি রােমানদের সাথে শান্তি স্থাপন করতে চাইলেন, কিন্তু পিরাস যতক্ষণ ইতালিতে ছিলেন, রােমানরা শান্তির আলোচনা করেনি। সুতরাং, যুদ্ধ চলতে থাকল। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৯ অব্দে পিরাস ট্যারেনটামের ১০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অসকিউলামে নতুন এক রােমান বাহিনীর মুখােমুখি হলেন। তিনি জিতলেন বটে, কিন্তু তা ছিল আরও কঠিনভাবে, কেননা রােমানরা হাতিদের মােকাবেলা করা শিখে যাচ্ছিল। এই সময় যখন পিরাস যুদ্ধক্ষেত্রটিকে দেখছিলেন, কেউ বিজয় উপলক্ষে তাকে অভিনন্দন জানাতে চেয়েছিলেন। তিনি তিক্ততার সাথে প্রতি উত্তর দিয়েছিলেন, “আরেকটি বিজয়, আর আমি হেরে গেলাম”। এখান থেকেই ‘পিরিক বিজয়” (“Pyrrhic victory”) অভিব্যক্তিটির উদ্ভব হয়েছিল। এর অর্থ জয় এত অল্প ব্যবধানে আর এত বেশি মূল্যে অর্জিত হয়েছে যে এতে পরাজয়ের সব প্রভাবই বিদ্যমান। হিরাক্লিয়া আর অসকিউলামের যুদ্ধ ছিল প্রথম উপলক্ষ যেখানে মেসিডােনিয়ান ফ্যালাঙ্কস রােমান লিজিওনের মুখােমুখি হলাে। আলেকজান্ডারের সময়কাল থেকে ফ্যালাঙ্কস ক্ষয়ে যাচ্ছিল, যাচ্ছিল ভারী আর অনিয়ন্ত্ৰণযােগ্য হয়ে, তাই একে চালনা করা ছিল বেশ কঠিন। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল সমতলভূমি, কেননা কোনাে অসমভূমিতে ফ্যালাংক্সের ঘন সংঘবদ্ধতা ওলট-পালট হয়ে যায়, আর তাতে এটি অসহায় হয়ে যায়। অন্যদিকে লিজিওন ছিল একটি নমনীয় ব্যবস্থা যেটিকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত লােকদের সাহায্যে হাতের মতাে বাইরের দিকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। অথবা হাতের মুষ্ঠির মতাে ভেতরের দিকে সংকুচিত করা যায়। এটি চলার পথে অসমতল ভূমিকে মানিয়ে নিতে পারে। এই দুই যুদ্ধে ফ্যালাঙ্কস লিজিওনকে পরাস্ত করল, আংশিকভাবে হাতির কারণে আর আংশিকভাবে পিরাসের সামর্থ্যের কারণে। ফ্যালাঙ্কসের আর কখনাে লিজিওনকে পরাজিত করার কথা ছিল না। 

এরই মধ্যে, আগাথােক্লিসের মৃত্যুর পর সাইরাকুজ ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল আর কার্থেজিয়ান বিপদ আবার হুমকি হয়ে দেখা দিতে লাগল। সাইরাকুজিয়ানরা পিরাসকে আহ্বান জানাল, যিনি প্রতি উত্তরে তার সেনাদলকে নিয়ে সিসিলিতে প্রবেশ করলেন। নিশ্চিতভাবেই, একসময় পিরাস রােমানদের বদলে কার্থেজিয়ানদের মােকাবেলা করেছিলেন, ফলে আগের চেয়ে তিনি এবার সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৭ অব্দের মধ্যে তিনি কার্থেজিয়ানদের দ্বীপের সবচেয়ে পশ্চিমের কোণে প্রবেশরত অবস্থায় পেলেন, যেরকম এক শতাব্দী আগে ডায়োনিসিয়াসের ক্ষেত্রে হয়েছিল, তাই ডায়োনিসাস তাদেরকে যে পরিমাণে বিতাড়িত করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি কিছু তার করার কথা ছিলনা। তার উপর তার জাহাজের ঘাটতি ছিল, যা থাকলে হয়তাে সরাসরি কার্থেজকে আক্রমণ করা সম্ভব হত, যেমনটি সিকি শতাব্দী আগে আগাথােক্লিস করেছিলেন। সুতরাং, তিনি ইতালিতে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, যেখানে তার অনুপস্থিতিতে রােমানরা ধীরে ধীরে উন্নতি করে চলছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫ অব্দে পিরাস অসকিউলামের ত্রিশ মাইল পশ্চিমে তৃতীয়বারের মতাে তাদের সাথে যুদ্ধে মোকাবেলা করলেন। এইবার রােমানরা হাতিকে মােকাবেলার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল। তারা জ্বলন্ত তীর ব্যবহার করেছিল আর হাতিগুলাে পুড়ে গিয়ে উন্মত্ত হয়ে পিরাসের নিজের বাহিনীকে চূর্ণ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে পালিয়ে গেল। এটি ছিল পরিপূর্ণ এক রােমান বিজয়। 

পিরাস দ্রুত তার অবশিষ্ট বাহিনীকে সাথে নিয়ে ইতালির বাইরে পাড়ি জমালেন, কোনাে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। রােম দক্ষিণ ইতালির সবটুকু দখলে নিয়ে নিল আর সেই দিন থেকে রােমানরা ছিল পরাশক্তি। যখন পিরাস এপিরাসে ফিরে এলেন, তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন, কেননা যুদ্ধই ছিল তার একমাত্র আগ্রহের বিষয়। তার কাছে আরেকটি সাহায্যের আবেদন এলো। এটি ছিল ক্লিওনিমাস, এক স্পার্টান রাজা, যিনি নিজেকে রাজা বানানাের প্রচেষ্টায় ছিলেন। পিরাস খ্রিস্টপূর্ব ২৭২ অব্দে পেলােপনেসাসে অভিযান চালান এবং স্পার্টা আক্রমণ করেন। স্পার্টা, নিশ্চিতভাবেই প্রতিরােধ করেছিল, কিন্তু স্পার্টার প্রায় পুরাে সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে পিরাসের তেমন কোনাে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু, ষষ্ঠবারের মতাে স্পার্টা অবরােধ থেকে বাঁচলাে যখন পিরাস আরও বেশি চাপ সৃষ্টিকারী সমস্যার কারণে ফিরে গেলেন। তিনি আর্গোসের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং রাস্তায়ই মারা পড়েন যখন কাহিনী অনুসারে এক নারী ছাদের ওপর থেকে তার দিকে একটা ইটের চাকতি নিক্ষেপ করেন। এটা একজন যােদ্ধার অসম্মানজনক পরিসমাপ্তি ছিল, এবং তার মৃত্যুর সাথে সাথেই, এপিরাসের গুরুত্ব হারিয়ে গেল।

গাউল জাতির বিরুদ্ধে গ্রিসের যুদ্ধ ও এন্টিগনিডদের ক্ষমতায় আরোহন

যখন পিরাস ইতালিতে গিয়েছিলেন, টলেমি সিরােনাস মেসিডােনিয়ায় তার অংশগুলােকে একত্রিত করছিলেন এবং যুদ্ধ-প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনুপস্থিতির কারণে তার নিজেকে অভিনন্দন জানানাের কারণ বিদ্যমান ছিল। টলেমির দুর্ভাগ্য, বিপদ সম্পূর্ণ নতুন দিক হতে এবং নতুন শত্রুর আকার নিয়ে তার কাছে আসছিল। গ্রিক কর্তৃক একটি প্রধান বারবারিয়ান আক্রমণের বেদনা সহ্য করার হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন এটি আবার দেখা দিল। এই বারবারিয়ানরা ছিল গাউল যারা নিদেনপক্ষে ব্রোঞ্জযুগে বেশিরভাগ ইউরােপিয়ান ভূখণ্ড দখল করেছিল। গণতাতীত কাল থেকে দানিয়ুব নদীর উত্তরে তাদের দলগুলাে প্রতিষ্ঠা পেয়ে এসেছিল।  প্রায়ই, জনংখ্যার চাপ বা যুদ্ধের পরাজয়ের কারণে গাউলদের গােত্রগুলাে দলে দলে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণে চলে আসছিল। এভাবে খ্রিস্টপূঞ্জ ৩৯০ অব্দে, গ্যালিক গােত্রগুলাে ঝাঁকে ঝাঁকে ইতালিয়ান উপদ্বীপে নেমে এসেছিল এবং রােম দখল করেছিল, যা তখন গুরুত্বহীন এক ছােট নগর ছিল ।

এখন, এক শতাব্দী পরে, এবার ছিল গ্রিসের পালা। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৯ অব্দে, ব্রেনাস নামে এক নেতার অধীনে, গ্যালিক বহিঃশত্রুরা দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে মেসিডােনিয়ায় চলে এলো। টলেমি সিরােনাস হঠাৎ করে নিজেদের বন্য যাযাবরদের মুখােমুখি আবিষ্কার করলেন যাদের বিরুদ্ধে তার নিজের বাহিনীকে চালনা করার খুব অল্প সময়ই রয়েছে। তার সেনাদলকে ছেটেও দেওয়া হলাে আর তাকে হত্যা করা হলাে। বেশ কয়েক বছর ধরে মেসিডােনিয়ায় কোনাে সরকারই ছিল না, শুধু ঘুরে বেড়ানাে বন্য দলগুলাে ছাড়া যাদের হাতে বিভিন্ন নগরগুলাে দখল হতে লাগল, যেমন করে তারা করতে পারে সেভাবে। এরই মধ্যে, আরও অধিক যুদ্ধ-লুষ্ঠিত মালের সন্ধানে, আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে গাউলরা খ্রিস্টপূর্ব ২৭৮ অব্দে গ্রিসে পৌঁছল। যেমন করে আজ থেকে দুই শতাব্দী আগে এথেন্স পারসিকদের মােকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল, তেমনি এখন তারা গাউলদের মােকাবেলায় নেতৃত্ব হাতে তুলে নিল। তার পার্শ্বে স্পার্টা নয়, বরং ছিল ঈতোলিয়ানরা (Aetolian)। তারা বাস করত ফোসিসের পশ্চিমে, আর হাজার বছর আগে ডােরিয়ান আক্রমণ তাদের নির্বীর্য করে দিয়েছিল। হেলেনিক যুগে গ্রিক ইতিহাসে কোনাে ভূমিকা না রাখার পর এখন তারা প্রতিপত্তিতে জেগে উঠল।   

একসাথে তারা থারমােপাইলিতে অবস্থান নিল আর একসময় যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক সেইভাবে এবারও ব্যাপারগুলাে ঘটতে লাগল। গ্রিকরা শক্ত প্রতিরােধ গড়ল, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্বাসঘাতকেরা বহিঃশত্রুকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অনুপ্রবেশের পথ দেখিয়ে দেয়। এই সময়, সৌভাগ্যজনকভাবে গ্রিক সেনাদলকে সাগরের পাশে সরিয়ে নেয়া হলাে, আর তাদেরকে লিওনিডাস আর তাদের লােকদের মতাে পরিণতি বরণ করতে হয়নি। গাউলরা ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে লাগল এবং ডেলফিকে আক্রমণ করল, যেটি এক বিশেষ মূল্যবান পুরস্কার ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর জমা করা সম্পদের কারণে; যে সম্পদকে কোনাে গ্রিক বা মেসিডােনিয়ান ছুঁয়ে দেখার সাহস করেনি। এখানে গাউলরা পরাজয় বরণ করল, সম্ভবত ঈতোলিয়ানদের হাতেই। এই কাহিনী ছিল অনেকটাই অজানা, কেননা পরবর্তী সময়ে পরাজয়ের জন্য দেবতাদের অলৌকিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হয়। বলা হয় বজ্রের শব্দ গাউলদের আতঙ্কিত করে দিয়েছিল, এবং পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা জলের তােড়ে, অনেকেই মারা গিয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই, সেখানে এক ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়েছিল। 

কিন্তু ঈতোলিয়ানরা হােক, ভূমিকম্প হােক বা দেবতারাই হােক, এই ব্যাপারটা সত্য হয়ে দাঁড়াল যে ব্রেনাস পরাজিত ও নিহত হয়েছিল এবং গাউলদের গ্রিস ত্যাগ করতে হয়েছিল। তাদের কেউ থ্রেসে ছিল, আবার কেউ এশিয়া মাইনরে পাড়ি জমিয়েছিল। গাউলদের প্রথম দিককার আক্রমণের মাধ্যমে মেসিডোনিয়া ধ্বংস হবার পর মেসিডােনিয়ানদের মধ্যে যে ব্যক্তিটি গাউলদের বিরুদ্ধে সফল মােকাবেলা করেছিল তিনি ছিলেন অ্যান্টিগোনাস গোনাটাস (অ্যান্টিগোনাস দ্য নক-নিড)। তিনি ছিলেন ডিমিট্রিয়াস পােলিওরসিটিসের পুত্র এবং এন্টিগ্লোনাস মনােফথালমাসের নাতি। প্রথম জীবনে তিনি জেনো দ্য স্টোইকের অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করে নিজেকে চালনা করেছিলেন দর্শনের সৌন্দর্যের দ্বারা। এখন তিনি সিংহাসন দখল করার সুযােগ লুফে নিলেন, যা তার পিতা আর পিতামহকে ধ্বংস করেছিল। জীবিত থাকলে বৃদ্ধ একচোখা এন্টিগোনাস আর অবরােধকারী দিমিত্রিয়াস এই এন্টিগােনাস গােনাটাসের সাফল্যের জন্য পরিতৃপ্তির হাসি হাসতেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৬ অব্দের মধ্যে তিনি মেসিডােনিয়ার রাজা হলেন। এপিরাসের পিরাস ইতালি থেকে ফিরে এলে তিনি লড়াইয়ে তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৩৯ অব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ বছর ধরে রাজা হিসেবে উপযুক্ত শান্তির সাথে তিনি রাজ্য শাসন করেছিলেন। তার উত্তরাধিকারীরা তার মৃত্যুর এক শতাব্দী পরও মেসিডােনিয়ায় শাসন করেছিল। 

স্বাধীনতার অবসান

একিয়ান লীগ 

ক্রমক্ষয়িষ্ণু গ্রিস : হেলেনিস্টিক যুগে গ্রিস দ্রুত নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আলেকজান্ডারের বিশাল দিগ্বিজয় এই ভূমিতে লুটের মাল ঢেলে দিয়েছিল, কিন্তু যদি সম্পদ বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে শিল্পায়নের মাধ্যমে উৎপাদন না বৃদ্ধি পায় তাহলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, গ্রিসেও তাই ঘটল। ফলস্বরূপ সেখানে কিছু মানুষ ধনী হলাে, আর অনেকে হলাে গরিব। পরিস্থিতি অনেকটাই ছিল ঔপনিবেশিক যুগের অতােই, কিন্তু তখন গণতন্ত্রের উন্নয়নের মধ্যে একটি সমাধান পাওয়া গিয়েছিল। এখন, হেলেনিস্টিক যুগে, বিদেশি আধিপত্য গ্রিসকে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে বাধা দিল। সামাজিক বিপ্লবের প্রচেষ্টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। এর চেয়েও খারাপ যা ছিল, তা হলো গ্রিক জনগণের গ্রিস ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার প্রবণতা, কেননা গ্রিসের ভবিষ্যত খুব একটা ভাল ছিলনা। তাদের মধ্যে ছিল বাইরের নতুন এলাকায় অভিবাসন করার প্রবণতা। সেই এলাকাগুলাে ছিল অপেক্ষাকৃত বড় আর ধনী, আর সেখানে মেসিডােনীয় সম্রাটরা স্থানীয় জনগণের আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে গ্রিক শিক্ষা আর গ্রিক শক্তি দানে প্রস্তুত ছিল। এই নতুন হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলো মূলভূমির গ্রিসের চেয়েও বেশি গ্রিক হয়ে গেল, আর সেই পুরনো গ্রিসের সাথে শিল্প ও বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করল, তাতে গ্রিস আরও বেশি সংকটের মুখে পড়ল। গ্রিসে জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল, সেই সময়টাতে প্রমাণ-আকারের নগরগুলাে ছােট নগরে পরিণত হয়েছিল আর ছােট নগরগুলাে হারিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যাপারও ছিল। প্রবল প্রতাপান্বিত মেসিডােনীয় প্রতিপত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ফিলিপ আর এন্টিপেটারের শাসনামলে মেসিডোনিয়ার যে শক্তি ছিল, তেমনটা আর থাকল না। মেসিডােনিয়া ক্ষীণকায় হয়েও পড়ছিল, প্রথমত এর বিপুল সংখ্যক লােক বাইরের দিকে নতুন জয় করা ভূখণ্ডে অভিবাসন করার কারণে, এবং দ্বিতীয়ত গাউলদের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে। এখানে সেখানে সেনাভিযান চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য মেসিডোনিয়ার ছিল না, উদাহরণস্বরূপ যেমনটা ছিল কোরিন্থে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬২ অব্দে কোরিন্থ এথেন্স অবরােধ করল। ২৫৫ খ্রিস্টপূর্বাদে সে আবারও এথেন্সের লম্বা দেয়াল ভেঙে ফেলল। নিশ্চিতভাবেই, খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫ অব্দের মধ্যেই, এথেন্সের সেই দেয়ালের আর প্রয়ােজন ছিল না। সে কোনাে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না আর আবার কখনাে সে যুদ্ধ করবেও না। 

ঈটোলিয়ান লীগ ও আরেটাসের অধীনে একিয়ান লীগ : তখনাে গ্রিসের বেশিরভাগ অঞ্চল মেসিডােনিয়ার কাছ থেকে এক ধরনের ছায়া স্বাধীনতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। তারা এটা করতে পেরেছিল মিশরের টলেমিদের সহায়তায়, যারা সবসময় মেসিডােনিয়াকে বাধা দেওয়ার জন্য তৎপর ছিলেন। এই স্বাধীনতা কিন্তু নগর-রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে ছিল না, কেননা তখন নগররাষ্ট্রের ধারণাটি ছিল কেবলই মৃত (পুরাে গ্রিক দুনিয়ার মধ্যে পুরনাে স্টাইলে মােটামুটি সমৃদ্ধ নগর-রাষ্ট্র ছিল সাইরাকুজ আর রােডস)। পরিবর্তে, গ্রিক স্বাধীনতা নির্ভর করে ছিল নগরগুলাের জোটের ওপর। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দের দিকে, ঈটোলিয়ার (Aetolia) গােত্রগুলাে ‘ঈটোলিয়ান লীগ”-এ সংগঠিত হলাে, যারা এবারে গ্রিক ইতিহাসে একটি ভূমিকা রাখতে শুরু করল। খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ অব্দে পেলােপনেসাসে একটি দ্বিতীয় লীগ প্রতিষ্ঠিত হলাে, যা ছিল অধিক পরিমাণে নগর-কেন্দ্রিক আর আধুনিক। কোরিন্থ উপসাগরের দক্ষিণের উপকূলের কিছু নগর নিয়ে একটি ইউনিয়নের রূপে এটি যাত্রা শুরু করে, তাই এর নাম দেয়া হয়েছিল “একিয়ান লীগ”। একটি প্রজন্ম ধরে এটি একটি গুরুত্বহীন স্থানীয় সংগঠন হিসেবেই টিকে ছিল। কিন্তু এটিতে যে পরিবর্তন নিয়ে এলেন তিনি ছিলেন সিসিওনের আরেটাস। আরেটাসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত পেলােপনেসাসকে একিয়ান লীগে ঐক্যবদ্ধ করা। খ্রিস্টপূর্ব ২৪২ অব্দে তিনি কোরিন্থের বিরুদ্ধে একটি দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন, এবং অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে এর কেন্দ্রীয় সুরক্ষাস্থল এক্রোকোরিন্থ দখল করেন। মেসিডােনীয় সেনাঘাঁটিকে বহিস্কার করা হলাে আর কোরিন্থ একিয়ান লীগে যােগদান করল। খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ অব্দের মধ্যে, এমনকি এথেন্সও তার মেসিডােনীয় সেনাঘাঁটিকে বহিস্কার করতে সমর্থ হলাে আর নিজেকে লীগের সাথে যুক্ত করল, যেটি এখন তার ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল। 

তৃতীয় ক্লিওমিনিসের অধীনে স্পার্টার উত্থান ও একিয়ান লীগের বারবার পরাজয় :  বড়ই বেমানানভাবে দুই লীগের বাইরে, গ্রিসে গুরুত্ব পাওয়ার মতাে আরেকটি শক্তি ছিল (যেটি, সত্যিকারে গ্রিক ভাবধারায়, প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ভেতর ছিল, এমন সংঘর্ষ যা শুধু মেসিডােনিয়াকেই সাহায্য করেছে।) যেটি হলাে স্পার্টা। স্পার্টা তখনাে দেড় শতাব্দী আগের এজেসিলেয়াসের দিনগুলাের স্মৃতিতে আসক্ত ছিল, এবং এমন কোনাে নগরের সংগঠনে এরা প্রবেশ করত না যার নেতৃত্ব তার হাতে থাকবে না। তাই এটি ছিল একিয়ান লীগের মহাশত্রু। আরেটাসের মতে স্পার্টা নতুন করে শক্তি অর্জনের চিহ্ন প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল। বাকি গ্রিসের মতােই এটি অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিল আর তাদের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে যােগ্য হতে পারে এমন মাত্র ৬০০ জন স্পার্টান ছিল। বাকি স্পার্টানরা প্রকৃতপক্ষে ছিল নিঃস, আর হেলটদের জন্য (তখনাে হেলটরা বর্তমান ছিল) মৃত্যু পর্যন্ত অনাহারে থাকা ছিল সাধারণ ব্যাপার। খ্রিস্টপূর্ব ২৪৫ অব্দে, নতুন রাজা চতুর্থ এইজিস ক্ষমতায় এলেন। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, একজন স্পার্টান বিপ্লবী। তিনি একটি নতুন ব্যবস্থা চেয়েছিলেন আর জমি ৪৫০০ নাগরিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার এবং তার মধ্যে পেরিওয়েসিকে (perioeci) অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি দাসদের ব্যাপারে কিছুই বললেন না, কিন্তু এটি ছিল কেবল শুরু। কিন্তু, গুটিকয়েক স্পার্টান যারা সবকিছুর মালিকানায় ছিল তা মানত না। তারা অন্য আরেকজন রাজা দ্বিতীয় লিওনিডাসের সমর্থন পেতে সমর্থ হয়েছিলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ২৪১ অব্দে ক্ষমতা দখল করে এইজিসকে বিচারের মুখােমুখি করে হত্যা করলেন। কিন্তু এটি স্পার্টায় পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাতে সমাপ্তি আনতে পারল না। খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫ অব্দে, দ্বিতীয় লিওনিডাস মৃত্যুবরণ করলেন এবং তার পুত্র তৃতীয় ক্লিওমিনিস রাজা হলেন। তিনি চতুর্থ এইজিসের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করলেন, এবং এইজিসের সকল কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। এর উপর, তিনি একজন অধিকতর শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যত লােককে পারলেন একত্র করলেন এবং তাদের পুরনো স্পার্টার কৌশলে যুদ্ধে লিপ্ত করালেন। তিনি একিয়ান লীগকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাস্ত করে এবং আর্কেডিয়ার বেশিরভাগ দখলে নিয়ে আর্কেডিয়ায় পৌঁছেছিলেন। এভাবে প্রাপ্ত সম্মান নিয়ে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২২৬ অব্দে স্পার্টায় ফিরলেন এফোরকে হত্যা করালেন, এবং প্রয়ােজনীয় অর্থনৈতিক পুনর্গঠন নিয়ে এলেন। তিনি তখন ছিলেন যেকোনাে সময়ের চেয়ে শক্তিধর আর খ্রিস্টপূর্ব ২২৪ অব্দে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে আরেকবার একিয়ান লীগের সেনাদলকে পরাস্ত করলেন, আর মেগালােপােলিসকে দখল ও হস্তগত করলেন। তিনি আর্গোসকেও দখলে নিলেন, আর কোরিন্থ ও অন্যান্য নগর তার সাথে স্বেচ্ছায় জোটে এলো।

মেসিডোনিয়ার হাতে স্পার্টার পরাজয় ও স্পার্টার একিয়ান লীগে প্রবেশ : আরেটাস তার চোখের সামনে একিয়ান লীগকে টুকরাে টুকরাে হয়ে যেতে দেখলেন। এটা চেয়ে চেয়ে দেখার চাইতে তিনি তাদের পরিচিত শক্রর দিকে ঝুঁকে পড়লেন এবং মেসিডােনিয়ার কাছে সাহায্যের আবেদন জানালেন। মেসিডােনিয়ায় তখন রাজা ছিলেন, এন্টিগােনাস ডসন, যার অর্থ হলাে “প্রতিশ্রুতি দানকারী এন্টিগােনাস”। প্রতিশ্রুতি দানকারীর কাছে আরেটাস সাহায্যের আবেদন জানালেন এবং এন্টিগােনাস আনন্দের সাথে তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিলেন আর তিনি তা করলেন। তিনি বেশ কঠিন করে দর-কষাকষী করলেন, যদিও কোরিন্থকে একটি মেসিডােনীয় সেনাঘাঁটির কাছে প্রদান করার কথা ছিল; তার নিজেরই একিয়ান লীগের প্রধান হবার কথা ছিল; এবং লীগের কথা ছিল তার সেনাদলকে সমর্থন করার। এটা নিশ্চিত ছিল যে এসবের অর্থ ছিল গ্রিসকে মেসিডােনিয়ার কাছে সমর্পণ করার, কিন্তু স্পার্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার কারণে আরেটাস এতে সম্মত হলেন। এন্টিগােনাস তার সেনাদলকে নিয়ে দক্ষিণ অভিমুখে অগ্রসর হলেন এবং, খ্রিস্টপূর্ব ২২২ অব্দে স্পার্টার পাঁচ মাইল উত্তরে সেলেসিয়াতে স্পার্টানদের মুখােমুখি হলেন। ক্লিওমিনিস আর স্পার্টানরা পুরনো জৌলুসে লড়াই করে গেলেন, কিন্তু এক শতাব্দী পূর্বের কেরােনিয়ার সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি হলাে। মেসিডােনীয়রা পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করল। অবশেষে দেড় শতাব্দী ধরে, এমনকি দুর্বল অবস্থায়ও, স্পার্টার শত্রুর দখল থেকে মুক্ত থাকার চমৎকারিত্ব ভেঙে পড়ল। ইপামিনন্ডাস, ফিলিপ, আলেকজান্ডার, এন্টিপেটার, ডিমিট্রিয়াস আর পিরাস সবাই নগরের দেয়াল থেকে ফিরে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের যে কারও থেকেই কম শক্তিমান এন্টিগােনাস ডসন স্পার্টায় প্রবেশ করলেন, এফোরদের প্রতিস্থাপিত করলেন এবং স্পার্টাকে একিয়ান লীগে যােগদানে বাধ্য করলেন। ক্লিওমিনিস পালিয়ে গেলেন মিশরে, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২১৯ অব্দে, স্পার্টার পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াতে না পেরে আত্মহত্যা করলেন। তার কাছে থাকা হাতিয়ারের তুলনায় তিনি বিস্ময়কর কাজ করেছিলেন; আর তিনি কেবল একজন সাহসী যােদ্ধাই ছিলেন না, একজন আলােকিত শাসকও ছিলেন। তিনি যা করেননি, তা ছিল এক বিস্ময়, যদি তিনি স্পার্টার সুবর্ণ সময়ে তাদের রাজা থাকতেন? এখানে বিতর্কের সুযোগ আছে যে যদিও ক্লিওমিনিস ব্যর্থতায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন আর আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা স্পার্টান।

পঞ্চম ফিলিপের মেসিডোনিয়ার অধীনে গ্রিস আর রোমের হুমকি : খ্রিস্টপূর্ব ২১৯ অব্দে, এন্টিগােনাস ডসন মারা গেলেন আর পঞ্চম ফিলিপ মেসিডােনিয়ার সিংহাসনে আরােহণ করলেন। ফিলি ধীরে ধীরে গ্রিসে তার প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব ২১৩ অব্দের পর, যখন আরেটাস মারা গেলেন। কিন্তু গ্রিসকে নিয়ে ফিলিপের পরিকল্পনা সেখানে স্থায়ী হত না। দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরগুলো হস্তগত করার পর রােম অনেক বেশি শক্তিধর হয়ে যাচ্ছিল, আর ফিলিপের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে এখানে এমন এক শত্রু আছে যে সবগুলাে গ্রিক নগর মিলিয়ে যে শত্রুদের পাওয়া যাবে, তার তুলনায় অনেক বেশি বিপজ্জনক। 

সাইরাকুজের পতন 

হিয়েরোর শাসনে সাইরাকুজ ও কার্থেজীয়দের বিরুদ্ধে রোম : কিছু সময়ের জন্য মনে হলাে (যখন পঞ্চম ফিলিপ রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে ছিলেন) রােম তার সকল বর্ধিষ্ণু শত্রুর কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরকম মনে হলাে কারণ অর্ধ শতাব্দী আগে ফিলিপের সময়ে, রােমের পিরাসকে পরাজিত করা আর দক্ষিণ ইতালি জয়ের পর, তাদের কার্থেজ নামে এক নতুন শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছিল। সিসিলিতে বিপদ দেখা দিল, যেখানে হিয়েরাে নামে এক নতুন সাইরাকুজিয়ান সেনাপতি ক্ষমতাধর হয়ে পড়লেন। তিনি পিরাসের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছিলেন আর এখন তিনি ইতালিয়ান ভাড়াটে সৈন্যদলের কয়েকটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেন যারা সিসিলিতে ঢােকার চেষ্টা করল আগাথোক্লিস তাদেরকে নিয়ে আসার পর। হিয়েরাে তাদেরকে পরাজিত করলেন, এবং সাইরাকুজিয়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ অব্দে তাকে রাজা বানাল দ্বিতীয় হিয়েরাে হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪ অব্দে হিয়েরাে নতুন করে ভাড়াটে সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ রচনা করলেন যারা ইতালির নিকটে সিসিলির প্রান্তে মেসানায় নিজেদেরকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। ভাড়াটে সৈন্যদলেরা দারুণভাবে নতুন ইতালিয়ান শক্তি রােমের কাছে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করল আর সে এতে সাড়াও দিল। হিয়েরাে বেশ কয়েকবার পরাজিত হলাে আর এটা দেখার জন্য যথেষ্ট জ্ঞানী ছিল যে রােম ভূমধ্যসাগর এলাকায় আধিপত্য করতে যাচ্ছে। তিনি রােমের সাথে এক জোটে যুক্ত হলেন আর জোটটিকে বিশ্বস্ততার সাথে রক্ষা করে চললেন। সিসিলিকে নিজস্ব হস্তক্ষেপের ব্যাপার বলে মনে করা কার্থেজিয়ানরা রােমান সৈন্যদলকে সেই এলাকায় প্রবেশ করতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। এইভাবে প্রথম পিউনিক যুদ্ধ শুরু হলাে। (এটিকে “পিউনিক” বলা হত কারণ প্রথমদিকে কার্থেজিয়ানরা ছিল ফিনিসিয়ান উপনিবেশ, আর ল্যাটিন ভাষায় ফিনিসিয়ানদের বলা হত “পােয়েনি”।)।  এই যুদ্ধ ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল, আর উভয় পক্ষই এতে দারুণজাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু রােম রণতরী তৈরি এবং সমুদ্রে কার্থেজিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। অবশেষে, রােম জয়লাভে সমর্থ হলাে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে, ৫০০ বছর অতিবাহিত হবার পর, কার্থেজিয়ানরা সিসিলি থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্বাসিত হলাে, আর তা হলাে চিরতরে। রােমানরা তাদের জায়গা দখল করে নিল, কিন্তু দ্বীপের পূর্বাংশের অর্ধেক তাদের মিত্র হিয়েরাের জন্য ছেড়ে দিল, আর সাইরাকুজ স্বাধীন থাকল। মােটের উপর, গ্রিক দুনিয়া এতে সন্তুষ্ট ছিল। কার্থেজ ছিল পুরনাে শত্রু যারা তাদের জন্য অনেকবারই উৎপাতের কারণ হয়েছিল। রােম ছিল অপেক্ষাকৃত নতুন, শান্তশিষ্ট এবং গ্রিক সংস্কৃতির প্রতি অপেক্ষাকৃত উদার। 

আর্কিমিডিস : গ্রিকরা এমনকি রােমানদেরকে ইলিউসিনীয় রহস্যবাদ আর ইস্থমান গেমসেও অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিল; এর অর্থ ছিল গ্রিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে রােমানদেরকে সভ্য শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং তাদেরকে তারা বারবারিয়ান বা বর্বরও মনে করত না। রােমান আধিপত্যের অধীনে সাইরাকুজ সমৃদ্ধ হতে লাগল। দ্বিতীয় হিয়েরাের শাসনামল সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয় তার একজন আত্মীয় আর্কিমিডিসের কারণে, যিনি প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আর্কিমিডিসের সম্মন্ধে বেশ কিছু দারুণ গল্প প্রচলিত আছে। তিনি লিভারের মূলনীতি আবিষ্কার করেছিলেন এবং সাধারণ একটি গাণিতিক ফর্মুলা অনুসারে এর কার্যাবলি ব্যাখ্যা করেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই, তিনি লিভার আবিষ্কার করেননি; সেটি জানা ছিল স্মরণাতীত কাল থেকে। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে লিভারের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্ভাব্য শক্তির কোনাে তত্ত্বগত সীমারেখা নেই এবং বলা হয় যে তিনি এই কথা বলেছিলেন, “আমাকে দাঁড়ানাের মতাে একটি জায়গা দাও, আমি পুরাে দুনিয়াকেই নাড়িয়ে দিতে পারব।” এতে অবাক হয়ে হিয়েরাে তাকে ভারী কিছুকে নড়ানাের জন্য চ্যালেঞ্জ জানালেন; পুরাে দুনিয়াকে নয়, কিন্তু ভারী কোনাে কিছু। তাই (কাহিনী অনুসারে) আর্কিমিডিস বন্দরে দাঁড়ানাে একটি জাহাজ বেছে নিলেন আর এটিকে মালপত্র আর যাত্রীতে পূর্ণ করে দিলেন। তিনি তখন একটি পুলি যন্ত্রের ব্যবস্থা করলেন (প্রকৃতপক্ষে একপ্রকার লিভার) আর, এর সাহায্যে জাহাজটিকে টেনে, একাই, সমুদ্র থেকে তীরে তুললেন, কোনাে এক খেলনা নৌকাকে টেনে আনার কাজের চেয়ে বেশি কষ্ট না করেই। এমনিক মুকুটের গল্পও আরও বেশি সুপরিচিত। কোনাে এক সময়ে, হিয়েরাে আর্কিমিডিসকে অনুরােধ করলেন এটা নির্ধারণ করতে যে, একজন স্বর্ণকারের কাছ থেকে তিনি যে একটি সােনার মুকুট বানাতে দিয়েছিলেন, তার সবটুকুই সােনার, নাকি এতে অসৎভাবে সস্তা রুপা বা তামা মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি বের করতে আর্কিমিডিসকে মুকুটের ওজন আর আয়তন উভয়ই বের করতে হত। ওজন বের করা ছিল সহজ, কিন্তু মুকুটটিকে সলিড আকৃতিতে না ভেঙ্গে এর আয়তন নির্ধারণ করা (অচিন্তনীয়) ছিল অসম্ভব। একদিন, আর্কিমিডিস এক পূর্ণ স্নানপাত্রে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন এবং লক্ষ করলেন তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেয়ামাত্র জল উপচে পড়েল। তার মনে হলাে, যে আয়তনের জল উপচে পড়েছে, তা তার শরীরের আয়তনের সমান, যা জলের স্থান পূর্ণ করেছে। এর মানে তিনি জলে ডুবিয়ে মুকুটটির আয়তন বের করতে পারবেন এটা পরিমাপ করে যে কত আয়তনের জল উপচে উঠেছে। উত্তেজনায় পাগল হয়ে, তিনি স্নানপাত্র থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলেন এবং (কাহিনী অনুযায়ী) নগ্ন হয়ে “ইউরেকা!” ইউরেকা! (আমি পেয়েছি! আমি পেয়েছি!) বলে চিৎকার করতে করতে সিকুজের রাস্তায় দৌঁড়ে হিয়েরাের প্রাসাদে গেলেন। এবং, প্রকৃতপক্ষেই, এখন যাকে “ঘনত্বের মূলনীতি” বলা হয়, তা তিনি পেয়েছিলেন। 

দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ, গ্রিকদের রোমের বিরুদ্ধে অবস্থান : কিন্তু, সাইরাকুজ আর রােমের সাধারণ শান্তি বিঘ্নিত হলাে এক প্রতিশােধপরায়ণ কার্থেজের কারণে। কার্থেজ কোনােমতেই নিজেকে পরাজয়ের কাছে স্তিমিত করে রাখেনি। সতর্কভাবে, কার্থেজ নতুন সম্পদের উৎস আর রােমের বিরুদ্ধে আক্রমণের নতুন ঘাঁটি হিসেবে স্পেনকে তাদের উপনিবেশ বানাল। অধিকন্তু, হ্যানিবল নামে একজন সেনাপতির উত্থান ঘটল যিনি নিঃসন্দেহে নিজেকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা যুদ্ধনেতা হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ অব্দে স্পেন থেকে ইতালীর দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন (পঞ্চম ফিলিপের মেসিডােনিয়ার সিংহাসনে আরােহণের ঠিক পরে) এবং এভাবে “দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ” শুরু হলাে। ইতালির ভেতরে, হ্যানিবল একের পর এক অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রােমান সৈন্যদলের মুখােমুখি হয়েছিলেন এবং তার বাহিনীকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করে রােমানদের অতি-আত্মবিশ্বাসের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তিনি তাদের ওপর তিনটি পরাজয় চাপিয়ে দিলেন, একের পর এক, এবং প্রতিটিই আগেরটির চেয়ে ছিল মন্দতর। খ্রিস্টপূর্ব ২১৬ অব্দে, দক্ষিণ এড্রিয়াটিক উপকূলে ক্যানিতে তৃতীয় পরাজয় ছিল সর্বকালের ধ্বংসযজ্ঞের কালােত্তীর্ণ যুদ্ধ; দুর্বল সেনাদলকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একটির বিরুদ্ধে চালনা করে পরিপূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ আনয়নের। রােম তার ইতিহাসে এত ভয়াবহ পরাজয় আর বরণ করেনি। ক্যানির পরে মনে হলাে রােমের দিন শেষ। নিশ্চিতভাবে মেসিডনের পঞ্চম ফিলিপও তাই ভেবেছিলেন, কেননা তিনি দ্রুত কার্থেজের সাথে একটি জোট বাঁধলেন। সাইরাকুজের দ্বিতীয় হিয়েরাে রােমের ওপর তার বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন, এবং জোটবদ্ধ ছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২১৫ অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার দৌহিত্র হায়েরােনিমাস, যিনি সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন, তিনি পঞ্চম ফিলিপের সাথে একমত হয়েছিলেন। তিনিও ভেবেছিলেন রােম নিঃশেষ হয়ে গেছে, আর দ্রুত কার্থেজের পাশে থাকতে তিনি তৎপর হলেন। কিন্তু, রােম শেষ হয়ে যায়নি। আসলে ক্যানির যুদ্ধের পরের বছরগুলাে ছিল রোমের উৎকৃষ্ট সময়। অনমনীয়তা এবং প্রায় অতি-মানবিক প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে রোম হ্যানিবলের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ চালিয়ে গেল। এবং যদিও রোম অবরুদ্ধ ছিল, তার এখনাে সাইরাকুজকে নিয়ে কিছু করার মতাে শক্তি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ অব্দে, একটি রােমান রণতরী এলাে সাইরাকুজে অবরােধ করতে (দুই শতাব্দী পূর্বে এথেনীয় রণতরীর পর এই প্রথম)। 

রোমের হাতে সাইরাকুজের পতন : সাইরাকুজ প্রায় তিন বছর ধরে পাল্টা লড়াই চালিয়ে গেল, যার প্রধান অবদান আর্কিমিডিসের। সেই বিজ্ঞানী, গ্রিক ঐতিহাসিকদের পরবর্তী গল্প অনুসারে, যারা গ্রিক মস্তিষ্ক বনাম রােমান শক্তির গল্প বলে উৎফুল্ল হত, তাদের মতে তিনি অসাধারণ সব যন্ত্রাদি আবিষ্কার করেছিলেন রােমানদের যুদ্ধে পরাভূত করতে। এগুলাের মধ্যে ছিল পােড়ানাের আয়না, লোহার আঁকর্শি, বিশেষ ধরনের গুলতি এবং এরকম আরও কিছু (যার বিশদ সম্ভবত সময়ের সাথে সাথে অতিরঞ্জিত হয়েছিল)। বলা হয় যে যখনই একটি দড়ি বা কাঠের টুকরাে সাইরাকুজের দেয়ালের উপরে দেখা যেত, রােমান জাহাজগুলাে মারাত্মক সাইরাকুজিয়ানদের অত্যাধুনিক যন্ত্রাদির নাগালের বাইরে যাবার জন্য পূর্ণগতিতে দাঁড় বাওয়া শুরু করত। কিন্তু অবশেষে শক্তিরই জয় হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ২১১ অব্দে, আর্কিমিডিসের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সাইরাকুজ রােমানদের দখলে চলে গেল। রােমান সেনাপতিরা আর্কিমিডিসকে জীবিত নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। কিন্তু, তিনি যখন বালুতে কিছু জ্যামিতিক সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন এক সৈন্য তার কাছে চলে এলাে। সৈন্যটি পঁচাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ আর্কিমিডিসকে তার সাথে আসার জন্য আদেশ করল। আর্কিমিডিস চিৎকার করে উঠলেন, “আমার বৃত্তের ওপর পা ফেল না।” এবং সৈন্যটি, যে মনে করল এই আহাম্মকের জন্য তার সময় নষ্ট করার সময় নেই, সে এই মহান মানুষটিকে হত্যা করল। এরপর থেকে সিসিলির পুরােটাই ছিল রােমানদের। পশ্চিমের স্বাধীন মানুষ হিসেবে গ্রিকদের ইতিহাস, যা পাঁচ শতক পূর্বে ঔপনিবেশিক যুগে শুরু হয়েছিল, তা স্থায়ী সমাপ্তিতে চলে এলাে। 

মেসিডােনিয়ার পতন 

প্রথম মেসিডোনীয় যুদ্ধ : ক্যানির যুদ্ধের পর, পঞ্চম ফিলিপ অল্প কিছুকালের জন্য গ্রিসের নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। এমনকি ঈটোলিয়ান লীগও জয়ী কার্থেজের বহিরাক্রমণ নিয়ে ভীত ছিল এবং ফিলিপের (কার্থেজের মিত্র) ওপরই তাদের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য নির্ভর করত। কিন্তু রােম, হ্যানিবলের সাথে তার মারাত্মক দ্বন্দ্ব আর সাইরাকুজে তার তাদের সাথে নৌযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও, অনেক কষ্টে গ্রিসে তার বাহিনীকে পাঠাতে সমর্থ হলাে। পুরাে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু তারা কার্থেজকে নৈতিক সমর্থন দেয়ার চেয়ে বেশি কিছু করা থেকে ফিলিপকে দূরে রাখল। হ্যানিবলের সাথে যােগদানের জন্য সৈন্যদল পাঠানাের মতাে পুরােপুরি সাহস তার ছিল না। তাছাড়া, রােম গ্রিসকে মেসিডােনিয়ার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে রোম ঈটোলিয়ান লীগ আর স্পার্টার সাথে মিত্রতায় গিয়েছিল। অবশেষে, কার্থেজিয়ান বিপদ রােমকে গ্রিসে পরিপূর্ণ বসতি স্থাপন থেকে বিতর রাখল, ফলে প্রথম মেসিডােনীয় যুদ্ধ অমীমাংসিতভাবে সমাপ্ত হলাে। 

পেলোপনেসাসে স্পার্টান ও একিয়ান লীগের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সমাপ্তি : রােমান-মেসিডােনীয় সংঘর্ষ পেলােপনেসাসে প্রতিফলিত হয়েছিল যেখানে একিয়ান লীগ (মেগাপােলিসের ফিলােপিমেনের অধীনে) মেসিডােনিয়ার সাহায্যের ওপর নির্ভর করত, এবং স্পার্টা নির্ভর করতো রোমান সাহায্যর ওপর, যারা পরস্পরের সাথে দ্বৈরথ চালিয়ে যাচ্ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০৭ অব্দে, স্পার্টান বিপ্লবী নেবিস (Nabis) শেষ রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন (স্পার্টায় ডােরিয়ান অবরােধের নয় শতাব্দী পর) এবং একজন টাইরান্ট হিসেবে ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি ঋণকে বিলুপ্ত করে আর জমির পুনর্বণ্টন করে চতুর্থ এইজিস আর তৃতীয় ক্লিওমিনিসের পুনর্গঠন কর্মসূচি সম্পূর্ণ করা পর্যন্ত তা চালিয়ে গেলেন। তিনি এমনকি দাসদেরও মুক্ত করলেন আর হেলােটিজমের গ্লানিময় পদ্ধতিরও পরিসমাপ্তি ঘটালেন। এর মধ্যে, দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ উত্তেজনার চূড়ান্তে পৌঁছে গেল। রােম তার নিজের একজন সফল সেনাপতির অধীনে এলো, যার নাম ছিল পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও। সিপিওর মতে, হ্যানিবলকে হারানাের একটি রাস্তা ছিল এক শতাব্দী আগের মতাে আগাগােক্লিসের পদ্ধতি অনুসরণ করা, এবং যুদ্ধকে কার্থেজের ওপর চাপিয়ে দেয়া। খ্রিস্টপূর্ব ২০২ অব্দে, তিনি ঠিক এমনটাই করেছিলেন। রাগান্বিত কার্থেজিয়ানরা হ্যানিবলকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। কার্থেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে, জেমা নগরে সিপিও হ্যানিবলের মুখােমুখি হলেন এবং তাকে পরাজিত করলেন। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ শেষ হলাে আর রােম জয়লাভ করল।

মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে রোমের দ্বিতীয় মেসিডোনীয় যুদ্ধ : এখন রােম তাদের দিকে নজর দিতে পারল যারা অন্ধকার দিনগুলােতে তার বিরুদ্ধে গিয়েছিল অথবা তার পতন ত্বরান্বিত করতে চেষ্টা করেছিল, আর তালিকার শীর্ষে ছিল মেসিডােনের পঞ্চম ফিলিপ। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে, রােম তার অজুহাত খুঁজে পেল (তারা সবসময় অজুহাতের জন্য অপেক্ষা করেছে, যদিও কখনাে কখনাে অজুহাত ছিল খুব সামান্য কিছু)। এটি ঘটল যখন রােডস আইল্যান্ড ফিলিপের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সাহায্যের আবেদন করল। রােম তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ঘােষণা করে দিয়েছিল যা দ্বিতীয় মেসিডােনীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়। রােমান জেনারেল টাইটাস কুইংটিয়াস ফ্লেমেনিনাস ধীরে এগােলেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে গ্রিস তার পাশে থাকবে এবং গ্রিসে রোমের আক্রমণ নিয়ে নিশ্চুপ থাকবে। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে, মেসিডােনীয় ফ্যালাঙ্কস আর রােমান লিজিওন থেসালীর সাইনােসিফালিতে মুখােমুখি হলাে, প্রায় এক শতাব্দী পূর্বের পিরাসের দিনগুলাের মতাে। লিজিওন জয়লাভ করল আর পঞ্চম ফিলিপ, তার ভগ্ন সেনাদলের পেছনে গাদাগাদি করে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় সন্ধির জন্য প্রার্থনা করল। তিনি মেসিডােনিয়ার দখল ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না। গ্রিসের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ধ্বংস হয়ে গেল এবং দেড় শতাব্দী পূর্বে দ্বিতীয় ফিলিপের সময় থেকে শুরু হওয়া গ্রিসের ওপর মেসিডােনীয় কতৃত্বের স্থায়ীভাবে অবসান ঘটল।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর গ্রিসের অবস্থা : খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে, ইস্থমিয়ান গেমসে, ফ্লেমেলিনিয়াস সব গ্রিক নগরের কাছে তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়ার ঘােষণা দিলেন এবং গ্রিস আনন্দে উন্মাতাল হয়ে গেল। কিন্তু, নগরগুলাের তাদের স্বাধীনতাকে সর্বপ্রথম ব্যবহার করল রােমের থেকে সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করে তাদের একে অপরকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে, তাদের পুরনো ঐতিহ্যের মতই। একিয়ান লীগ ফ্লেমেনিনাসকে রাজি করাল ঘৃণিত স্পার্টার ভীতু বিপ্লবী নেবিসকে ধ্বংস করায় সাহায্য করতে। ফ্লেমেনিনাস অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলেন আর, সাহসী স্পার্টান প্রতিরােধ সত্ত্বেও নেবিসকে আর্গোসের বাইরে হটিয়ে দিলেন (যেটি তিনি আগেই পুনর্দখল করেছিলেন)। এভাবে স্পার্টা আর আর্গোসের মধ্যে পাঁচ শতকব্যাপী বিবাদের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু, ফ্লেমেনিনাস স্পার্টাকে দখল করা থেকে লীগকে ঠেকিয়ে রাখলেন। যাই হােক ফ্লেমেনিনাস খ্রিস্টপূর্ব ১৯৪ অব্দে গ্রিস ত্যাগ করলেন এবং এটি একিয়ান লীগ আর ফিলােপিমেনকে সুযােগ করে দিল। তারা স্পার্টা আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করলেন এবং তাকে একিয়ান লীগে যােগদান করতে বাধ্য করলেন। নেবিস কিছু ঈটোলিয়ানের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হলেন এবং তার সাথে সাথে স্পার্টা অবদমিত হয়ে গেল। ফিলােপিমেন ছিলেন গ্রিক নগরগুলাের মধ্যকার যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা শেষ সেনাপতি, আর এই কারণে তাকে পরবর্তী সময়ে বলা হত “গ্রিকদের সর্বশেষ”। অবশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮৪ অব্দে, মেসেনিয়ায়, তার সময়ের পরিসমাপ্তি ঘটল যখন তিনি সেখানে একিয়ান লীগের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ দমন করতে চেষ্টা করছিলেন। 

একিয়ান লীগের সমাপ্তি ও রোমের হাতে গ্রিসের পতন

ঈটোলিয়ান লীগ ও তৃতীয় অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে রোমানদের জয় : গ্রিক নগরগুলাে তাদের মেসিডােনিয়া থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার মধ্যে আবিষ্কার করল যে যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের সার্বিক অবস্থার  কোন পরিবর্তন হয়নি, কেবল তাদের প্রভুর পরিবর্তন হয়েছে, মেসিডোনীয়দের জায়গায় এবার তাদের ওপর কর্তৃত্ব করছে রোমানরা। এই নিয়ন্ত্রণে থেকে ঈটোলিয়ান লীগ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল এবং বাইরের সাহায্যের সন্ধান করতে লাগল। পঞ্চম ফিলিপের কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশিত ছিল না নিশ্চিতভাবেই, যে আর কখনাে রােমানদের মুখােমুখি হতে সাহস করেনি। কিন্তু সেখানে ছিলেন আরেকজন মেসিডােনীয়, সেলুসিড সাম্রাজ্যের তৃতীয় এন্টিওকাস। তিনি পূর্বদিকে দিগ্বিজয় করেছিলেন আর নিজেকে আরেকজন আলেকজান্ডার হিসেবে কল্পনা করতেন। এর উপর তার দরবারে ছিল হ্যানিবলের উপস্থিতি, যিনি রােমকে নিচে নামানাের প্রচেষ্টা। কখনােই ত্যাগ করেননি এবং যিনি এন্টিওকাসকে পশ্চিমদিকে অভিযাত্রার জন্য আহ্বান করলেন। তিনি তাকে ইতালিতে সৈন্যদলকে প্রবেশ করানাের জন্য প্রস্তাব রাখলেন, যাতে এন্টিওকাস গ্রিসে আবির্ভূত হয়ে রােমানদের সেখান থেকে দূরে সরিয়ে দেন। এটা হয়তাে কাজ করত, কিন্তু ঈটোলিয়ানরা সমস্ত গ্রিক রােমের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এন্টিওকাসকে তার প্রধান প্রচেষ্টা গ্রিসে দিতে আহ্বান জানালেন। নিশ্চিতভাবেই, এটি সত্য হয়ে ওঠেনি। পুরাে গ্রিস কখনােই বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে জেগে ওঠেনি। যেহেতু ঈটোলিয়ান লীগ ছিল রােমান-বিরােধী, তাই একিয়ান লীগ ছিল রােমান-পক্ষের। কিন্তু, ঈটোলিয়ানদের অনুরােধে এন্টিওকাস গ্রিসকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৯২ অব্দে, গ্রিসে অনুপ্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি আনন্দ-ফুর্তিতে বৃথা সময় নষ্ট করলেন এবং ১৯১ অব্দে থারমােপাইলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রােমানরা তার বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাজিত করে, আর এন্টিওকাস তাতে এশিয়ায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এন্টিওকাসের পরাজয়ের ফলাফল হিসেবে ঈটোলিয়ান লীগ রােমের কাছে পুরােপুরি নিজেকে সমর্পণ করল। শুধু একিয়ান লীগই গ্রিক স্বাধীনতার অতি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ ধরে রাখতে পেরেছিল। 

তৃতীয় মেসিডোনীয় যুদ্ধে রোমের জয় : পঞ্চম ফিলিপের পুত্র পারসিয়ুস রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করলেন এবং সতর্কভাবে ঈটোলিয়ানদের কাছ থেকে সাহায্যের আয়ােজন সম্পন্ন করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭১ অব্দে, “তৃতীয় মেসিডােনীয় যুদ্ধ” দেখা দিল। অবশেষে রােমানরা খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮ অব্দে, মেসিডােনিয়ার ঈজিয়ান উপকূলের পিডনা নগরে এক চাতুর্যপূর্ণ যুদ্ধে জয়লাভ করল। আবারও মেসিডােনীয়রা সম্পূর্ণরূপে তছনছ হয়ে গেল। এটি মেসিডােনীয় ফ্যালাঙ্কসের জন্য ছিল শেষ যুদ্ধ। পারসিয়ুস পালিয়ে গেলেও ধরা পড়লেন, এবং তাকে রােমে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। মেসিডােনীয় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘােষিত হলাে। 

রোমে একিয়ান জিম্মিরা ও পলিবিয়াস : গ্রিকরা যেভাবে প্রত্যেক রােমান-বিরােধী বিদ্রোহকে সাহায্য করেছিল, তাতে রােমানরা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং তারা একিয়ান জিম্মিদের একটি দলকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আর কোনাে সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয়। জিম্মিদের মধ্যে ছিলেন পলিবিয়াস, যার জন্ম হয়েছিল মেগাপােলিসে খ্রিস্টপূর্ব ২০১ অব্দে, এবং যিনি ফিলােপিমেনের মৃত্যুর পর একিয়ান লীগের নেতাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। পলিবিয়াস রােমে কিছু রােমানের সাথে বন্ধুত্ব গড়লেন, যাদের মধ্যে ছিল তরুণ সিপিও, (সিপিও, যিনি হ্যানিবলকে পরাস্ত করেছিলেন, তার দত্তক নেওয়া নাতি) আর তাই রােমে তাকে খুব একটা কঠোরভাবে গ্রহণ করা হলাে না। সিপিও এতে লাভবান হলেন, কেননা পলিবিয়াস ছিলেন হেলেনিস্টিক যুগের গ্রিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলেন সেখানে বয়জ্যোষ্ঠ সিপিওর ভূমিকা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আর পছন্দনীয়ভাবে নিবন্ধিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫১ অব্দে, পলিবিয়াস সহ একিয়ান জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়া হলে পলিবিয়াস বেশিদিন গ্রিসে থাকলেন না। তিনি ইতিহাসবিদের আগ্রহ সহকারে দ্রুত আফ্রিকায় গেলেন একটি নতুন রােমান বিজয়ে তা বন্ধু সিপিওর সাথে যােগদান করতে। 

তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ ও চতুর্থ মেসিডোনীয় যুদ্ধে রোমানদের জয় : রােম তার কার্থেজকে চূড়ান্তভাবে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা ধরে রেখেছিল, যেটি এখন একটি অসহায় নগরই ছিল, কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগে রােমকে প্রায় ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যাকে কখনােই ক্ষমা করে দেয়া হয়নি। অবশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে, “তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে” রােম কার্থেজ আক্রমণ করার একটি অজুহাত তৈরি করল। স্পার্টার মতােই অসহায় কার্থেজ প্রতিরােধের জন্য উপায় বের করতে সমর্থ হলাে। অনমনীয় বীরত্বের মাধ্যমে (দুই শতাব্দী পূর্বে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তাদের টায়ারের স্বদেশিদের মতাে) তারা দুই বছর ধরে টিকে থাকতে সক্ষম হলাে। কিন্তু, কার্থেজের চূড়ান্ত ধ্বংস ছিল অনিবার্য এবং তাদের চূড়ান্ত পরিণতি চলে এলো খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ অব্দে। নগরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলাে এবং যে লােকেরা গ্রিক আর রােমানদের ভূমধ্যসাগরের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাদের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটল। কার্থেজে রােমানদের পূর্ব-অবরােধ গ্রিসে উত্তেজনা তৈরির আশাকে আবার জাগিয়ে তুলল। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে, মেসিডােনিয়ার শেষ রাজা পারসিউসের সন্তান হিসেবে ভান করা জনৈক ব্যক্তির অধীনে মেসিডােনিয়া বিদ্রোহ করল। “চতুর্থ মেসিডােনীয় যুদ্ধে” রােম দ্রুত সব প্রতিরােধকে চূর্ণ করল এবং, খ্রিস্টপূর্ব ১৪৮ অব্দে, মেসিডােনিয়াকে একটি রােমান প্রদেশে পরিণত করল।

একিয়ান লীগের অবসান ও রোমের হাতে গ্রিসের অধীনস্ততা : এরই মধ্যে একিয়ান লীগ আরেকবার স্পার্টার ওপরে তার শক্তি প্রদর্শনের সুযােগ তৈরি করে বসল। রােমানরা নগরগুলাের মধ্যে কোনাে প্রকারের যুদ্ধ নিষেধ করে দিয়েছিল, কিন্তু একিয়ানদের নজর শুধু স্পার্টার ওপরই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা দেখেছিল রােম মেসিডােনিয়াকে নিয়ে এতই ব্যস্ত যে সে এদিকে নজর দিতে পারবে না। ত্যক্ত-বিরক্ত রােমানরা আসলেই অত ব্যস্ত ছিল না এবং তারা সেখানে আপত্তি জানিয়ে বসল। লুসিয়াস মামিয়াসের অধীনে একদল সেনা পেলােপনেসাসে প্রবেশ করল। একিয়ান লীগ ভয়ে নিশ্চল হয়ে বসে থাকল এবং প্রতিরােধ করতে সাহস করল না, কিন্তু মামিয়াস সেটিকে পাত্তা দিলেন না। তিনি সেইসব রােমানদের একজন ছিলেন না, যিনি সেই সময়ে গ্রিক সংস্কৃতির প্রেমে পড়ে যাবেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ অব্দে কোরিন্থ দখলে নিলেন। এটি ছিল গ্রিসের সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী নগর, যদিও এটি কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তোলেনি, তিনি এটিকে শিক্ষা দেয়ার উপকরণ বানাতে চেয়েছিলেন। তাদের পুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল, নারী আর শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল, পুরাে নগরটিকেই যেন লুণ্ঠন করা হয়েছিল। একিয়ান লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, আর সব নগরকে গােষ্ঠীশাসনের অধীনে নিয়ে আসা হলাে। গ্রিক স্বাধীনতার শেষ ক্ষুদ্র ক্ষুলিঙ্গ নিভে গেল যদিও কিছু প্রহসন ধরে রাখা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব খ্রিস্টপূর্ব ২৭ অব্দের আগে গ্রিসকে আকিয়া (Achaea) প্রদেশ হিসেবে রােমান রাজত্বের অংশ বানানাে যায়নি। 

রোমান বিজয়ের পূর্বের হেলেনিস্টিক জগৎ

হেলেনিস্টিক এশিয়া মাইনর 

পারগামাম, বিথিনিয়া ও গাউল আক্রমণ : কিন্তু যদিও হেলেনিস্টিক সময়ে আলােছায়া গ্রিসের উপরে ঘনিয়ে এসেছিল, আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয় পূর্বদিকে গ্রিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছিল, আর গ্রিক পতনের যুগে এটি ছিল এথেনীয় মধ্যগগণের দিনগুলাের থেকে অধিক শক্তিশালী আর প্রভাবশালী। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়া মাইনরে হেলেনিস্টিক রাজত্বের একটি ক্ষুদ্র ধারার উত্থান ঘটল। এদের মধ্যে, একটি লেসবােস দ্বীপের উল্টোদিকের উপকূল হতে প্রায় আঠারাে মাইল অভ্যন্তরে পারগামাম নামের নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। পারগামামের উত্তরে, প্রপন্টাসের সীমান্তবর্তী ছিল বিথিনিয়া। এই এলাকাটি কার্যত স্বাধীনতা লাভ করেছিল পারস্যের শেষ দুর্বল বছরগুলােতে। এটি সেই স্বাধীনতা আলেকজান্ডারের জীবদ্দশাতেও ধরে রেখেছিল (যিনি ঐ এলাকায় কখনাে সৈন্যদল প্রেরণ করেননি) এবং তা ধরে রেখেছিল তার পরেও। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৮ অব্দে, এর শাসক নিকোমিডিস রাজার পদবি ধারণ করলেন। কিন্তু, তার শাসনামল নিরাপদ ছিল না, কেননা সেখানে সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিল। সাহায্যের খোঁজ করতে গিয়ে তার মনে হলাে গাউলদের ব্যবহার করা যায়, যারা বেশ কিছু বছর ধরে মেসিডােনিয়া আর গ্রিসে হামলা চালিয়ে আসছিল। তিনি এশিয়া মাইনরে গাউলদের এক গােত্রকে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু, তারা এসেছিল তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে। খুব দ্রুত তারা তাদের সামনে থাকা সমৃদ্ধ আর যুদ্ধহীন অবস্থায় থাকা নগরটিতে লুণ্ঠন শুরু করল। একটি প্রজন্ম ধরে, গাউলরা ছিল পশ্চিম এশিয়া মাইনরের আতঙ্ক। মনে হলাে সাড়ে চার শতাব্দী আগের সিমেরিয়ানদের সময় ফিরে এসেছে। অবশেষে পারগামামই সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলল। 

অ্যাটালাসের অধীনে পারগামাম ও গাউল নিয়ন্ত্রিত গালাশিয়া : খ্রিস্টপূর্ব ২৪১ অব্দে, প্রথম অ্যাটালাস পারগামান সিংহাসনে তার পিতা ইউমিনেসের স্থান গ্রহণ করলেন, আর তার সাথে সাথেই সাম্রাজ্যটির বিশালত্ব শুরু হলাে। অ্যাটালাস গাউলদের সাথে যুদ্ধ করলেন এবং তাদের পরাস্ত করলেন, তাদের হুমকির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে তিনি অ্যাটালাস সােটার বা “ত্রাণকর্তা অ্যাটালাস” নাম গ্রহণ করলেন। তার বিজয়ের সম্মানে, অ্যাটালাস এথেন্সে “মরণাপন্ন গাউল” (দ্য ডাইং গাউল) নামে এক মূর্তি খােদাই করলেন। এটাকে কখনাে কখনাে “মরণাপন্ন গ্লাডিয়েটর” (দ্য ডাইং গ্লাডিয়েটর) বলেও ভুল করে ডাকা হয়, আর এটি হেলেনিস্টিক শিল্পের অন্যতম বিখ্যাত নিদর্শন যা আজও টিকে আছে। গাউলরা মধ্য এশিয়া মাইনরের এক অঞ্চলে প্রবেশ করল, যেটি পরবর্তীকালে গ্যালাশিয়া (Galatia) নামে পরিচিত হয়েছিল। তারা দ্রুত সভ্য হয়ে গেল যখন তারা সেখানে থিতু হতে পারল। 

দ্বিতীয় ইউমিনিসের অধীনে পারগামাম ও মিশরের সাথে কাগজ নিয়ে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা : প্রথম অ্যাটালাস, তার সমসাময়িক সাইরাকুজের হিয়েরাের মতাে রোমকে উদীয়মান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং তার সাথে জোট বেঁধেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে তার পুত্র দ্বিতীয় ইয়ুমিনিস সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন, তার নেতৃত্বে পারগামাম তার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছল। এটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল লাভ করেছিল (রােমানদের সাহায্যে) এবং পশ্চিম এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ শাসন করতে লাগল, যেন লিডিয়ারই পুনর্জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় ইয়ুমিনিস মেধাবৃত্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি হেলেনিস্টিক দুনিয়ায় ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম। বৃহত্তমটি ছিল মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায়। মিশরই দুনিয়ার প্যাপিরাসের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত, আর প্যাপিরাসের ওপরই সেই দিনগুলােতে বই লেখা হত। মিশরের হেলেনিস্টিক শাসকেরা তাদের দ্বিতীয়-স্থানের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে প্যাপিরাস যেতে দিতে অনীহ ছিলেন আর তাই পারগামান গ্রন্থাগারিকদের বিকল্প কিছু খুঁজে বের করতে হয়েছিল। বিকল্প হিসেবে পশুর চামড়া ব্যবহার করা যেত। এগুলাে ছিল প্যাপিরাসের চেয়ে বেশি টেকসই, কিন্তু অনেক বেশি ব্যয়বহুল। পারগামামের কেউ একজন চামড়া নিয়ে কাজ করার একটি যন্ত্র বের করেছিলেন যাতে করে উভয় পাশেই লেখা যায়, এভাবে প্রতি চামড়ায় লেখার পরিমাণ দ্বিগুণ হলাে আর খরচও অর্ধেক হয়ে গেল। এই ধরনের চামড়াকে এখন “পার্চমেন্ট” বলা হয়, যা হচ্ছে “পারগামান” শব্দটির বিবর্তিত রূপ। 

পারগামাম ও বিথিনিয়ার রোমের কাছে রাজ্য সমর্পন : খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮ অব্দে তৃতীয় অ্যাটালাসের সময়কালের মধ্যে রােম হয়ে দাঁড়ায় মেসিডােনিয়া আর গ্রিসের নিয়ন্ত্রক, আর কোনাে সন্দেহ ছিল না যে রােম প্রাচীন দুনিয়ার সবটুকুই নিয়ন্ত্রণ করবে। অ্যাটালাস বুঝতে পারলেন তিনি তার লােকদের জন্য যে সেরা কাজটি করতে পারেন তা হলাে শান্তির সাথে অনিবার্যতাকে আলিঙ্গন করা। যখন খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ অব্দে তিনি মারা যান, তিনি তার রাজ্যকে রােমের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যারা এটিকে গ্রহণ করল আর এর বেশিরভাগকে “এশিয়ার প্রদেশ” (Province of Asia) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করল। বিথিনিয়ার রাজারা রােমান-বিরােধী মতাদর্শ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন এবং এটির জন্য তাদের ভােগান্তিও হয়েছিল, কিন্তু তাদের শেষ দুজন রাজা দ্বিতীয় নিকোমিডিস আর তৃতীয় নিকোমিডিস তাদের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তারা দুজন রােমান-পক্ষের হয়ে থাকলেন। যখন খ্রিস্টপূর্ব ৭৪ অব্দে, তৃতীয় নিকোমিডিস মারা গেলেন, তিনি তৃতীয় অ্যাটালাসের উদাহরণ অনুসরণ করলেন আর তার রাজ্য রােমানদের উপহার দিলেন। 

পন্টাসরাজ মিথ্রিডেটিসের হাতে রোমানদের পরাজয় ও এশিয়া মাইনোর দখল : কিন্তু এশিয়া মাইনরের কমপক্ষে একজন সম্রাট ভবিষ্যতের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। বিথিনিয়ার পূর্বে আর কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণ উপকূলে ছিল পন্টাস রাজ্য, যারা নিজেদের নাম নিয়েছিল কৃষ্ণসাগরের গ্রিক নাম থেকে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল ট্রাপেজাস, একটি উপকূলীয় নগর, যেখানে একসময় পৌঁছেছিল জেনােফোনের দশ হাজার। নিজেকে পন্টাসের রাজা বলা প্রথমজন ছিলেন মিথরিডেটিস যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ অব্দে পদবীটি ধারণ করেছিলেন। আড়াই শতক পরে তার উত্তয়াধিকারীরা রাজ্যটি শাসন করেছিল। তালিকায় সর্বশেষেরজন ছিলেন ষষ্ঠ মিথরিডেসি, যিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে শাসন করেছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ১২০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সাল পর্যন্ত। তিনি ছিলেন একজন যােগ্য ব্যক্তি যিনি পন্টাসের এলাকাকে প্রতিবেশী হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলােতে বিস্তৃত করেছিলেন। নিজের প্রতিপত্তি বাড়াতে গিয়ে, নিশ্চিতভাবেই মিথরিডেটিস রােমের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন, এবং যুদ্ধ হতে বাধ্য ছিল। মিথরিডেটিস তার প্রথম আঘাত হানলেন খ্রিস্টপূর্ব ৮৮ অব্দে। দারুণ আশ্চর্যজনকভাবে এশিয়া মাইনরের বেশিরভাগটা দখলে নিয়ে, প্রকৃতপক্ষে রােমান সৈন্যদলকে পরাজিত করে এবং রােমান নাগরিকদের তছনছ করে তিনি বড় রকমের প্রাথমিক সাফল্য লাভ করেন। তিনি তারপর ঈজিয়ান সাগর অতিক্রম করে গ্রিসে প্রবেশ করলেন। এথেন্স যুদ্ধবাজীতে অংশ নিল না, সে এইসব অনেক আগেই ছেড়ে এসেছিল, কিন্তু সে তখনাে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারত। এথেন্স মিথরিডেটিসকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিল এবং তাকে নগরে প্রবেশ করতে দিল। 

রোমানদের হাতে মিথ্রিডেটিসের পরাজয় ও এশিয়া মাইনোরে রোমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : রােমানরা এশিয়া মাইনোরে পরাজিত হয়েছিল কেননা কার্থেজ আর মেসিডােনিয়ায় তাদের সর্বশেষ দিগ্বিজয়ের পর তারা নিজেদের মধ্যেই রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই যুদ্ধে এখন একপ্রকার সাময়িক বিরতি ছিল, যা লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুলাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। নতুন রােমান সৈন্যদলের প্রধান হিসেবে সুলা খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ অব্দে গ্রিসে প্রবেশ করলেন, এথেন্স দখলে নিলেন এবং ভালাে করে এটি লুণ্ঠন করলেন। এথেন্স তারপরে আর কখনাে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ অব্দে, সুলা নিয়তিতে পূর্ণ কেরােনিয়ার ময়দানে মিথরিডেটিসের মুখােমুখি হলেন এবং তাকে হারিয়ে দিলেন। মিথিরিডেটিসকে পালিয়ে এশিয়ায় চলে যেতে হয়েছিল আর রােমানরাও তাকে অনুসরণ করল। খ্রিস্টপূর্ব ৮৪ অব্দে, মিথরিডেটিস রােমান শর্তানুযায়ী শান্তি স্থাপনে বাধ্য হলেন। আরও দুইবার তিনি রােমের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং আরও দুইবার তিনি পরাজিত হলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫ অব্দে, তিনি নিয়াস পম্পিয়াস ম্যাগনাসের (Gnaeus Pompeius Magnus) হাতে তৃতীয় পরাজয় বরণ করলেন, যিনি ইংরেজীতে পম্পি (Pompey) নামে খ্যাত ছিলেন আর খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ অব্দে আত্মহত্যা করলেন। তার পরে, এশিয়া মাইনরের সবটুকুই ছিল শক্তিধর রােমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে, যদিও এর কিছু অংশ কয়েক বছরের জন্য নামে মাত্র স্বাধীনতা ধরে রাখতে পেরেছিল। 

সেলুসিড সাম্রাজ্য এবং জুডিয়া ও ইহুদিদের পরিণতি

আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের যে অংশ এশিয়া মাইনরের পূর্বে পড়েছিল তা ছিল সেলুকাসের হাতে। তার রাজ্য প্রধানত ছিল সিরিয়া আর ব্যাবিলনিয়াকে কেন্দ্র করে, আর তাই এটি ছিল আড়াই শতাব্দী পূর্বের প্রায় পুরনো ক্যালডিয়ান সাম্রাজ্যের পুনর্জন্ম। উত্তর আর পূর্বে বিশাল ইরানিয়ান এলাকা কমবেশি নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর তাই মানচিত্রে দেখে মনে হত তিনি আলেকজান্ডারের বেশিরভাগ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছেন। তাই তিনি পরিচিত হিলন “সেলুকাস নাইকেটর,” বা “দিগ্বিজয়ী সেলুকাস” নামে। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে, সেলুকাস নিজে টাইগ্রিস নদীর তীরে এক নতুন রাজধানী গড়ে তুললেন, ব্যাবিলনিয়া থেকে খুব বেশি দূরে নয়, যা ছিল ইউফ্রেটিসের তীরে। নিজের নামে তিনি এর নাম দিলেন সিলিউসিয়া। সিলিউসিয়া সমৃদ্ধ হবার সাথে সাথে ব্যাবিলন ক্ষয়ে যেতে লাগল। ব্যাবিলন ছিল খ্যাতি আর গৌরবে পরিপূর্ণ, হিব্রু গােষ্ঠীপতি আব্রাহামের সময়ে যখন এটি প্রথম কোনাে সাম্রাজ্য শাসন করেছিল, সেই সময় থেকে। কিন্তু আলেকজান্ডারের মৃত্যু ছিল শেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার সাথে এর সংযােগ ছিল। খ্রিস্টান যুগের শুরু হতে হতে ব্যাবিলন ছিল নিনেভার মতােই মৃত। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে, সেলুকাস উত্তর সিরিয়ায় একটি নগর প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি তার পিতা এন্টিওকাসের নামে এর নাম দিলেন, আর নগরটি আমাদের কাছে এন্টিওক নামে পরিচিত। সেলুকাসের নাতির পুত্রের নাতির পুত্র ইহুদিদের ইহুদিধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন এবং তাদেরকে গ্রিক সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮ অব্দে তিনি ইহুদিধর্মকে অবৈধ ঘােষণা করলেন, এবং ইহুদীরা এর পরিণতিতে বিদ্রোহ করে বসল। যে পরিবারকে আমরা ম্যাকাবিজ নামে চিনি, তার অধীনে তারা সকল বিরাট বাধা অতিক্রম করে, খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ অব্দে একটি স্বাধীন জুডিয়ান বা ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হলেন। ম্যাকাবিয়ান সাম্রাজ্য নিজেরাই দারুণভাবে হেলেনিস্টিক ছিল। তাদের দুইজন রাজা গ্রিক নাম এরিস্টোবিউলাস ধারণ করলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০৩ অব্দে, আলেকজান্ডার নামে এক রাজা জুডিয়া শাসন করেছিল। ম্যাকাবিজদের সর্বশেষেরজনের নাম ছিল এন্টিগােনাস। জুডিয়ান বিদ্রোহের পর সেলুসিড সাম্রাজ্য ক্ষীয়মান হতে থাকল। খ্রিস্টপূর্ব ১৪১ অব্দের দিকে, এটি পূর্বদিকের বহিরাক্রমণকারীর কাছে ব্যাবিলনিয়াকে হারিয়ে ফেলল আর এন্টিওক পুরাে সাম্রাজ্যের একমাত্র রাজধানীতে পরিণত হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ অব্দে, রােমান সেনাপতি পম্পি কেবলই মিথরিডেটিসকে ধ্বংস করার পর, সেলুকাস নাইকেটরের বিশাল সাম্রাজ্যের এক স্মৃতিই দেখতে পেলেন, তিনি এটিকে একটি রােমান প্রদেশে পরিণত করলেন। পরের বছর, খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ অব্দে, জুডিয়াহকে একটি রােমান প্রদেশে পরিণত করা হলাে।  

আলেক্সান্দ্রিয়া 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়া নগর : হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলাের মধ্যে সবচেয়ে সফলটি ছিল মিশরে আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমির প্রতিষ্ঠা করা, যার উত্তরসূরীদের প্রায় তিন শতক মিশর শাসন করার কথা ছিল। প্রথম টলেমি রােডিয়ানদের ডিমিট্রিয়াস পলিসিটিসকে হারাতে সাহায্য করেছিল, কৃতজ্ঞতাবােধ থেকে, যারা তার নাম দিল “টলেমি সােটার” (ত্রাণকর্তা টলেমি)। এই নামেই তিনি ইতিহাসে পরিচিত। টলেমি সােটার তার রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন; যেখানে তিনি গ্রিক পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আর্থিক সাহায্য আর বাধাহীন পড়াশােনার সুযােগের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়টি গ্রিক শিক্ষার দেবী মিউসদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত ছিল, তাই এটি আমাদের কাছে মিউজিয়াম নামে পরিচিত। এটি ছিল প্রাচীন দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষার কেন্দ্র, আর এটার সাথে যুক্ত ছিল ছাপার যুগের আগের বৃহত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার। আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রিকভাষী নগরগুলাের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত নগরে পরিণত হলাে এবং প্রাচীন শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে টিকে ছিল সাত শতকের জন্য। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সব গােলমালের ভেতরও গ্রিক বিজ্ঞান টিকে ছিল। এরিস্টোটলের বিদ্যালয় লাইসিয়াম এক শতাব্দী পর্যন্ত দারুণভাবে চলেছিল। যেহেতু এরিস্টোটল বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে লেকচার প্রদান করতেন, এই বিদ্যালয়ে তার অনুসারীদের বলা হত “পেরিপাটেটিকস” (হাঁটাচলাকারী)।

থিওফ্রাস্টাস : পেরিপাটেটিকসদের অন্যতম ছিলেন থিওফ্রাস্টাস, যিনি লেসবােসতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭২ অব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্লেটোর অধীনে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন, তারপর এরিস্টোটলের একজন সহযােগীতে পরিণত হন। যখন, এরিস্টোটল মারা গেলেন, তিনি গ্রন্থাগারকে থিওফ্রাস্টাসের হাতে ছেড়ে গেলেন, যিনি লাইসিয়ামের দায়িত্ব গ্রহণ করে এরিস্টোটলের জীববিজ্ঞানের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করলেন। থিওফ্রাস্টাস প্রধানত লতাপাতার পৃথিবীর দিকে মনােযােগ ঢেলে দিলেন এবং কষ্টসাধ্যভাবে ৫০০-র উপর লতাপাতার প্রজাতির বর্ণনা করেছিলেন, আর এভাবে তিনি উদ্ভিদতত্ত্বের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৮৭ অব্দে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লাইসিয়ামের দায়িত্বে ছিলেন। 

স্ট্রাটো : থিওফ্রাস্টাসের উত্তরাধিকারী ছিলেন ল্যাম্পসাকাসের স্ট্রাটো। তিনি পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন এবং শূন্যস্থান, পড়ন্ত বস্তুর গতি এবং লিভারের মতাে ব্যাপার নিয়ে সঠিক ধারণা রাখতেন। কিন্তু, স্ট্রাটোর মৃত্যুর পর লাইসিয়াম হারিয়ে যেতে লাগল। স্ট্রাটো নিজেও আলেক্সান্দ্রিয়ায় শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন আর বিজ্ঞানের গতিধারা এথেন্স থেকে টলেমির নতুন রাজধানীর দিকে ধাবিত হচ্ছিল, যেখানে উদারহস্ত সম্রাটরা শিক্ষাকে সহায়তা দিতে ছিলেন একপায়ে খাড়া। 

ইউক্লিড : আলেক্সান্দ্রিয়ার মিউজিয়ামের একজন অন্যতম প্রাথমিক সদস্য ছিলেন ইউক্লিড যার নাম জ্যামিতির সাথে স্থায়ীভাবে যুক্ত, কেননা তিনি একটি পাঠ্যবই (এলিমেন্টস) রচনা করেছিলেন তখন থেকে কিছু বিষয়ের ওপর পরিবর্তনের সাথে নির্ধারিত মানের ওপর। কিন্তু, একজন গণিতবিদ হিসেবে ইউক্লিডের খ্যাতি তার নিজের গবেষণার কারণে ছিল না, কেননা তার পাঠ্যবইয়ের কেবল কিছু তত্ত্ব ছিল তার নিজস্ব। অনেকগুলােই ইয়ডোক্সাসের কাজ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। যেটি ইউক্লিড করেছিলেন, এবং যা ইউক্লিডকে মহান বানিয়েছিল, তা ছিল তিনি গ্রিকদের জড়াে করা সব গণিতের জ্ঞান নিয়েছিলেন এবং আড়াই শতাব্দীর কাজ একটি নির্দিষ্ট কাঠামােতে সংকলন করেছিলেন। বিশেষ করে, তিনি সূচনাবিন্দু হিসেবে স্বতঃসিদ্ধ আর প্রস্তাবনার একটি ধারার উদ্ভব করেছিলেন যা এসবের সংক্ষিপ্ততা আর আভিজাত্যের জন্য গ্রহণযােগ্যতা পেয়েছিল। তিনি তারপর উন্নতিকে অগ্রাহ্য করে এমনভাবে প্রমাণের পর প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন।  বাস্তবে, ইউক্লিডের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় কাজ করতেন এটি ছাড়া। তার সম্পর্কে একটি গল্প আছে (যেরূপ অন্য প্রাচীন গণিতবিদদের সম্পর্কেও বলা হয়) যে তিনি টলেমিকে জ্যামিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। যখন রাজা ইউক্লিডকে তার উপস্থাপনা সহজ করে করতে বলেছিলেন, তখন ইউক্লিড আপােসহীনভাবে উত্তর দিয়েছিলেন,”জ্ঞানের জন্য কোনাে রাজকীয় রাস্তা নেই।” 

এপোলোনিয়াস : ইউক্লিডের পঞ্চাশ বছর বা এরকম পরে আসা একজন গণিতবিদ ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া মাইনরের উপকূলের নগর পেরগার এপোলোনিয়াস। তিনি কার্ড নিয়ে কাজ করেছিলেন যা পাওয়া যেত কোনাে সমতলভূমি আর কোণের সংযােগে (কৌণিক বিভাগ)। এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, অধিবৃত্ত এবং অতি-অধিবৃত্ত। 

পিথিয়াস : হেলেনিস্টিক যুগে দুনিয়া প্রসারিত হয়েছিল এবং কিছু সংখ্যক গ্রিক পরিণত হলেন দারুণ পর্যটকে। এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন সম্ভবত মাসালিয়ার পিথিয়াস যিনি ছিলেন মহান আলেকজান্ডারের সমসাময়িক এবং যখন আলেকজান্ডার পূর্বদিকে প্রবেশ করেছিলেন, তখন তিনি দূরপশ্চিমে নতুন দুনিয়ার খোজ করছিলেন। পিথিয়াস আটলান্টিকের দিকে গিয়েছিলেন এবং তার প্রতিবেদন থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তিনি ব্রিটিশ অক্ষ এবং আইসল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন, ইউরােপের দক্ষিণদিকের জলধারা এমনকি বাল্টিক সাগরে ভ্রমণ করে। আটলান্টিক সাগরে তিনি জোয়ারকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন (যেটি ভূমিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরে চিহ্নিত করা যায়নি) এবং বললেন যে এটি চাদের কারণে সৃষ্ট; এটি এমন এক পর্যবেক্ষণ যেটিতে তিনি তার সময়ের চেয়ে ২০০০ বছর এগিয়ে ছিলেন। 

ডাইসিয়ারকাস : আরেকজন ভূগােলবিদ ছিলেন মেসানার ডাইসিয়ারকাস (Dicaearchus), যিনি এরিস্টোটলের অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং থিওফ্রাস্টাসর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি আলেকজান্ডার আর তার উত্তরসূরীদের দূর থেকে আগত সেনাদলের নিয়ে আসা প্রতিবেদন ব্যবহার করেছিলেন আগেরটির থেকে ভালাে প্রাচীন দুনিয়ার একটি উন্নত মানচিত্র আঁকতে। তিনিই প্রথম অক্ষাংশের রেখাগুলাে তার মানচিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। 

ইরাটোসথিনিস : কিন্তু, দেশ থেকে কোনােরূপ প্রভাবিত না হয়ে, সাইরেনের ইরাটোসথিনিস পিথিয়াস বা ডাইসিয়ারকাসের চেয়ে একটি বৃহত্তর ভৌগােলিক কীর্তি গড়েছিলেন। ইরাটোসথিনিস, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের দিকে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন, এবং যিনি আর্কিমিডিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তিনি পৃথিবীর আকার বের করার চেয়ে কম কিছু করেননি। তিনি এই ব্যাপারটি লিপিবদ্ধ করে রাখলেন যে গ্রীষ্মকালে সূর্যের উত্তরায়ণের দিনে (২১ জুনে) সূর্য দক্ষিণ মিশরের সাইইনিতে সরাসরি ছিল মাথার উপরে, একই সময়ে এটি আলেক্সান্দ্রিয়ার শীর্ষবিন্দু থেকে ৭ ডিগ্রি দূরে ছিল। এই পার্থক্য শুধু সাইইনি আর আলেক্সান্দ্রিয়ার ভূমির বক্রতার কারণে হতে পারে। দুই নগরের উত্তর দক্ষিণের প্রকৃত দূরত্ব জেনে ইউক্লিডের জ্যামিতি দ্বারা পৃথিবীর পরিধি সহজেই বের করা যেত। ইরাটোসথিনিসের সংখ্যাটি বিশ্বাস করা হয় ছিল ২৫,০০০ মাইল, যেটি সঠিক।  ইরাটোসথিনিস একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সময়ক্রমেরও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে সব ঘটনা ট্রোজান যুদ্ধ থেকে তালিকাবদ্ধ থাকবে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি নির্ভুল তারিখভুক্তি নিয়ে সচেতন ছিলেন। 

টেসিবিয়াস : গ্রিক বিজ্ঞান এর ব্যবহারিক দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিল না, কেননা প্রাচীন সময়ে, শারিরিক শ্রম ছিল দাসদের জন্য এবং তাদের পরিশ্রম কমানাের প্রয়ােজন খুবই কম বােধ হয়েছিল। (অধিকন্তু, মনে করা হত দাসরা মর্যাদার দিক থেকে স্বাধীন মানুষের নিচে।) কিন্তু এই অবস্থাতেও গ্রিকদের মধ্য থেকে শক্তিশালী প্রকৌশলীর জন্ম হয়েছিল। আর্কিমিডিস ছিলেন এদের মধ্যে একজন, তার লিভার আর গুলতি নিয়ে। আরেকজন ছিলেন গ্রিক উদ্ভাবক টেসিবিয়াস (Ctesibius), যিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫ অব্দের দিকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় জন্মেছিলেন। তিনি জলের ওজন এবং ঘনীভূত বাতাসের ওজন ব্যবহার করেও যন্ত্রপাতিকে নড়াচড়া করাতেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল একটি উন্নত জলঘড়ি, যেখানে একটি পাত্রে একটি স্থির গতিতে পড়া পানি একটি ভাসমান কিছুকে জাগিয়ে তুলত, যার একটি নির্দেশক ছিল যা একটি ড্রামে তার অবস্থানকে চিহ্নিত করে। সেই অবস্থান থেকে ঘণ্টার কাটা পড়া যেত। এই ধরনের ঘড়ি ছিল প্রাচীনকালের প্রাপ্ত সর্বশ্রেষ্ঠ সময়যন্ত্র।

আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর : জাদুঘর আর গ্রন্থাগারের বাইরেও যেটি যথেষ্ট সফল বলে বিবেচিত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘর। টলেমি সোটার এটারও নির্দেশনা প্রদানকারী কাঠামাে তৈরির ধারণা গ্রহণ করেছিলেন, যা রাতের বেলায় নাবিকদের আলেক্সান্দ্রিয়ার পােতাশ্রয় পর্যন্ত পথ দেখাতে পারে। তিনি নাইডাস থেকে সােস্ট্রাটাস নামে এক স্থপতি ভাড়া করলেন আলেক্সান্দ্রিয়ার একটি দ্বীপে কাঠামােটি তৈরি করতে। দ্বীপটির নাম দেয়া হয়েছিল ফেরােস এবং কাঠামােটিকেও এই একই নাম দেয়া হয়েছিল। কাঠামােটির ভিত্তি ছিল ১০০ বর্গফুট এবং এবং এর চূড়ায় একটি আলােকশিখা সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা হত। এর অনুরক্ত গ্রিকরা একে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। এটি ১৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে ছিল আর তারপর এটি ভূমিকম্পের কারণে আংশিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এটিকে নিঃশেষ হতে দেয়া হয়। (সপ্তাশ্চর্যের আশ্চর্যের ভেতর কেবল মিশরের পিরামিডই এখনাে টিকে আছে।) 

টলেমিড রাজবংশ ও গ্রিক মিশরের অবসান

প্রথম তিন টলেমির সময়কার সুশাসন : খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫ অব্দে, টলেমি সােটার তার দ্বিতীয় পুত্রের অনুকূলে সিংহাসন ছেড়ে দিলেন। (তার জ্যেষ্ঠ পুত্র টলেমি সিরােনাস মেসিডােনিয়ায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।) দ্বিতীয় টলেমি পুরনো মিশরীয় প্রথা গ্রহণ করেন যেখানে শাসকগণ তাদের বােনকে বিয়ে করে, কেননা অন্য কোনাে পরিবার এত উচ্চমানের ছিল না স্ত্রী সরবরাহ করার মতাে। তিনি তার পিতার মতাে বিজ্ঞান আর সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা চালিয়ে গেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ অব্দে, দ্বিতীয় টলেমির উত্তরসূরী হয়েছিলেন তৃতীয় টলেমি যার স্ত্রী ছিলেন সাইরেনের বেরেনাইসি। এখনাে পর্যন্ত টিকে যাওয়া একটি কিংবদন্তি আছে যে, বেরেনাইসি তার চুল কেটে ফেলে তা ভেনাসের মন্দিরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, দেবীকে উৎসর্গ করে, এই আশায় যে, এটি তার স্বামীকে যুদ্ধজয় শেষে দেশে ফিরিয়ে আনবে। চুলগুলাে অদৃশ্য হয়ে গেল (সম্ভবত চুরি হয়ে গিয়েছিল) এবং রাজকীয় জ্যোতির্বিদ সামােসের কনােন তৎক্ষণাৎ ঘােষণা করলেন যে এটিকে দেবীরা স্বর্গে নিয়ে গেছে এবং কিছু ঝাপসা তারাকে দেখিয়ে বললেন এগুলাে হচ্ছে উৎসর্গকৃত চুলগুলাে। ঐ তারকাগুলাে এখন “কোমা বেরেনাইসিস” নামে এক ক্ষুদ্র তারকামণ্ডলী গঠন করেছে, যাকে ল্যাটিনে বলা হয় “বেরেনাইসির চুল”। পরপর তিনজন যােগ্যতাসম্পন্ন রাজাকে পেয়ে মিশর এক শতাব্দীর সুশাসন পেল; লম্বা ইতিহাসের যেকোনাে সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে, আগে থেকে অথবা তারপর থেকেও।

রোডস দ্বীপের সমৃদ্ধির যুগের অবসান : দুর্ভাগ্যজনকভাবে টলেমিড রাজবংশের এই সুশাসন স্থায়ী হয়নি। তৃতীয় টলেমির পর সব শাসক ছিলেন দুর্বল আর অযােগ্য আর তাই টলেমিক মিশর ধীরে ধীরে পতনের দিকে গেল। এর সাথে সাথে গ্রিক বিজ্ঞানও ক্রমান্বয়ে ম্রিয়মান হয়ে যেতে লাগল। কেবল একজন প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানী এই সময়কে আলােকিত করেছিলেন আর তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ায় কাজ করতেন না। তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৯০ অব্দের দিকে জন্ম নেয়া নিসিয়ার হিপার্কাস, এবং তিনি সম্ভবত ছিলেন প্রাচীন কালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। তিনি রােডস দ্বীপে এক মানমন্দিরে কাজ করতেন। হেলেনিক সময়কালে রােডস ছিল অগুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, এটি স্বাধীনতা লাভ করল এবং যেখানে বাকি হেলেনিস্টিক দুনিয়া যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেখানে ব্যবসায় জড়িয়ে এটি ধনী আর সমৃদ্ধ হলাে। ডিমিট্রিয়াসের অবরােধের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরােধ দেড় শতাব্দী পূর্বে শুরু হয়েছিল, যে সময় এটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগর-রাষ্ট্র ছিল যখন নগর-রাষ্ট্রগুলাে ছিল মৃত আর মুমূর্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ২১১ অব্দে সাইরাকুজের পতনের পর রােডস ছিল একমাত্র অবশিষ্ট উন্নত নগর-রাষ্ট্র। কিন্তু, হিপার্কাসের সময়ে এর সমাপ্তি ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৭ অব্দে, তৃতীয় মেসিডােনীয় যুদ্ধের পর, রােম ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবসার প্রবাহ অন্যদিকে পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল রােডসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। রােডসকে তখন একটি রােমান মিত্র ও উপনগরে পরিণত করা হলাে খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ অব্দে। তারপর, সে আবারও ধীরে ধীরে অগুরুত্বপূর্ণতায় হারিয়ে যেতে লাগল। 

জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস ও পোসিডোনিয়াস : হিপার্কাস চন্দ্র আর সূর্যের দূরত্ব নির্ধারণে এরিস্টার্কাসের কাজগুলাে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এরিস্টার্কাসের সূর্যের চারির্দিকে পৃথিবী ঘােরার ধারণাটিকে গ্রহণ করেননি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি সতর্কভাবে, বিস্তারিত গণিতের সাহায্যে এমন একটি বিশ্বজগৎ সম্মন্ধে বিস্তারিত কাজ করেছিলেন যেখানে সব আকাশমণ্ডলীর বস্তু পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘােরে। হিপার্কাসই শক্তভাবে “ভূ-কেন্দ্রিক তত্ত্ব” উপস্থাপনা করেন; সতের শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকার মত যথেষ্ট শক্তভাবে, এরিস্টার্কাসের সূর্য-কেন্দ্রিক তত্ত্বের স্বপক্ষে এটিকে চিরতরে ছুড়ে ফেলার আগ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪ অব্দে হিপার্কাস বৃশ্চিক তারকামণ্ডলীতে এমন একটি তারা খুঁজে পেলেন, যা তিনি আগের কোনাে পর্যবেক্ষণের প্রতিবেদনে পাননি। এটি ছিল মহা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কেননা তখন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল (এরিস্টোটল কতৃক অনুমােদনপ্রাপ্ত) যে স্বর্গ চিরকালীন এবং অপরিবর্তনীয়। পূর্বের পর্যবেক্ষণগুলাের অনির্দিষ্ট ভাবপ্রকৃতির জন্য হিপার্কাস সহজে বলতে পারছিলেন না যে এটি বৈপরীত্যের একটি উদাহরণ। তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদরা একইরকম সমস্যায় পড়বে না। তিনি হাজারও উজ্জ্বল তারার সঠিক অবস্থান লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করলেন। এটি ছিল প্রথম নির্ভুল তারকা মানচিত্র। এটি করতে গিয়ে, হিপার্কাস অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ দিয়ে তারাগুলাে চিহ্নিত করলেন, যে পদ্ধতিটি পরে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থানান্তরিত হয়েছিল। হিপার্কাস উজ্জ্বলতার মাত্রা অনুযায়ীও তারাগুলােকে ভাগ করলেন (প্রথম মাত্রা, দ্বিতীয় মাত্রা এরকম আরও অনেক) যে পদ্ধতিটি এখনাে ব্যবহৃত হয়। তারপর, পুরনাে পর্যবেক্ষণ অধ্যয়ন করে তিনি “সূর্যের বিষুবরেখা অতিক্রমণের কালের নিখুঁততা” আবিষ্কার করলেন যার ফলাফল হিসেবে আকাশের যে বিন্দুতে উত্তরমেরুর বিন্দু সারা বছর ধরে ধীরে ধীরে সরে যায়। হিপার্কাসের পরে একজন অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিদ এলেন, যিনি হলেন এন্টিয়কের নিকটে সিরিয়ান নগর আপামিয়ার পসিডােনিয়াস। খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দের দিকে, তিনি ইরাটোসথিনিসের পৃথিবীর আকৃতি নিয়ে করা গবেষণার পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনি সূর্যের পরিবর্তে একটি তারাকে ব্যবহার করলেন, যেটি ছিল নিজে নিজেই একটি যােগ্য পরিবর্তক। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে, তিনি পৃথিবীর পরিধি হিসেবে পেলেন ১৮,০০০ মাইল, যে সংখ্যাটি ছিল অনেক ছােট। 

শেষ শক্তিশালী টলেমিড শাসক ক্লিওপেট্রা ও সিজার : খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দের মধ্যে, রােম দানবের মতাে হেলেনিস্টিক দুনিয়াকে ঢেকে দিতে লাগল। এশিয়া মাইনর নিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে, ধীরে ধীরে, তারা মেসিডােনিয়া আর মিশর দখলে নিয়ে নিয়েছিল, এবং শীঘ্রই সেলুসিড সাম্রাজ্যের যা অবশিষ্ট ছিল, তাও নিয়ে নিল। তখনাে পর্যন্ত মিশর টলেমিদের অধীনে ছিল। একা তারা তিন শতাব্দী আগের বিশাল মেসিডােনীয় দিগ্বিজয়ের অংশ হিসেবে টিকে রইল। সেখানে মিশরে তখন শেষ এক মহান হেলেনিস্টিক সম্রাটের উত্থান ঘটল, যাকে আমরা “মেসিডােনীয়দের শেষজন” বলতে পারি। তিনি কেনাে পুরুষ ছিলেন না, ছিলেন একজন নারী। তিনি ছিলেন ক্লিওপেট্রা। মনে রাখতে হবে, ক্লিওপেট্রা কোনাে মিশরীয় ছিলেন না, ছিলেন মেসিডােনীয়। ক্লিওপেট্রা নামটিও মিশরীয় ছিল না। এটি ছিল গ্রিক, যার অর্থ “বিখ্যাত পিতা” যে “ভদ্র সুন্দর”। এটি ছিল মেসিডােনীয়দের মধ্যে পরিচিত একটি নাম। যখন দ্বিতীয় ফিলিপ অলিম্পিয়াসকে তালাক দিয়ে একজন তরুণীকে বিয়ে করলেন, সেই তরুণীটিরও নাম ছিল ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রা যিনি মেসিডােনীয়দের মধ্যে ছিলেন সর্বশেষ, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা, দ্বিতীয় টলেমি ওলিটিস, অথবা “বংশীবাদক টলেমি” খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে মারা যান, এবং দুই অল্পবয়স্ক পুত্রের, তত্ত্বমতে, পরবর্তী রাজা হবার কথা ছিল। কিন্তু, তাদের বড় বােন ক্লিওপেট্রা নিজ দাবিতে রােমানদের সাহায্য পেয়েছিলেন; তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রােমানের সাহায্য, কাইয়ুস জুলিয়াস সিজারের সাহায্য। সুলার সময়কালের পর থেকে রােমান গৃহযুদ্ধ চলছিল এবং গ্রিসকে মাঝেমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। তাই, সিজার পম্পির (মিথরিডেটিসের বিজয়ী) সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ অব্দে, গ্রিসে তাকে ধরাশায়ী করলেন। সেখানে তিনি তাকে থেসালীর একটি জেলা ফারসেলিয়াতে পরাস্ত করলেন। পম্পি তখন পালিয়ে মিশর যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে তিনি দ্রুত মিশরীয়দের হাতে গুপ্তহত্যার স্বীকার হলেন যারা সিজারের সাথে কোন সমস্যা তৈরি হােক এটা চায়নি। তারপরে শীঘ্রই সিজার সেখানে চলে এলেন। মিশরে তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে দেখা করলেন এবং তাকে তার (সিজারের) সুন্দরী বলে মনে হলাে। তিনি দেখলেন তার ভাইয়েরা তার সাথে সিংহাসন ভাগ করে নিয়েছে এবং পরবর্তীকালে তিনি তাকে (ক্লিওপেট্রাকে) তার সাথে রােমে নিয়ে এলেন। 

মার্কাস এন্টোনিয়াস ও ক্লিওপেট্রার বনাম অক্টাভিয়াস : খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে, সিজার গুপ্তহত্যার শিকার হলেন এবং আবারও গৃহযুদ্ধ শুরু হলাে। ক্লিওপেট্রা সন্তর্পণে মিশরে ফিরে এলেন যেখানে তিনি নিজে বিপদের বাইরে থাকবেন বলে মনে করলেন। তিনি তার ভাইদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন আর সিংহাসনের একচ্ছত্র অধিকারী হলেন। কিন্তু সিজারের একজন প্রাক্তন সহযােগী মার্কাস এন্টোনিয়াস (ইংরেজিতে মার্ক এন্টনি হিসেবে সমধিক পরিচিত) সিজারের গুপ্তঘাতকের সন্ধানে পূর্বদিকে যাত্রা করেছিলেন। সেখানে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪২ অব্দে তিন শতাব্দী আগে মহান ফিলিপের গড়ে তােলা নগর ফিলিপ্পিতে মেসিডােনিয়ার দখল নিয়ে নিলেন তাদের পরাস্ত করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪১ অব্দে, মার্ক এন্টোনি ক্লিওপেট্রার সাথে দেখা করলেন এবং তিনিও তার প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তার সাথে থাকার কামনায় এবং একটি শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য তার দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে গেলেন। কিন্তু, সিজারের যােগ্য ভাগ্নে এবং পালিত পুত্র কাইয়ুস অক্টাভিয়ানুস (সাধারণভাবে তিনি ইংরেজীতে অক্টাভিয়ান নামে পরিচিত) দেশে নিজেকে শক্তিশালী করে নিচ্ছিলেন, যেহেতু রােমে শক্তি অর্জন করার মাধ্যমে মার্ক এন্টনি মিশরে তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীকালে, এই দুজনের ভেতর টক্কর লাগারই কথা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩১ অব্দে, ক্লিওপেট্রা আর মার্ক এন্টনির রণতরী কোরিন্থ উপসাগরের পঞ্চাশ মাইল উত্তরে গ্রিসের পশ্চিম উপকূলের নগর আকসিয়ামে অক্টাভিয়ানের রণতরীর মুখােমুখি হলাে। শেষবারের মতাে, হেলেনিস্টিক শক্তি রােমের মুখোমুখি হলাে, আর এটাই উপযুক্ত ছিল যে এটি হবে গ্রিক উপকূলে। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ক্লিওপেট্রা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তার জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। মার্ক এন্টনি তৎক্ষণাৎ তার লােকদের ছেড়ে তার পেছন পেছন গেলেন। যুদ্ধটি তারা হেরে গেল এবং অক্টাভিয়ান প্রভুতে পরিণত হলেন।

যুদ্ধের পরিণতি ও অক্টাভিয়াসের সম্রাট অগাস্টাস হয়ে ওঠা : মিশরে ফিরে এসে, ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ভুয়া খবর পেয়ে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে মার্ক এন্টনি আত্মহত্যা করলেন। অক্টাভিয়ান তাকে অনুসরণ করে তার সৈন্যদলকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করালেন। ক্লিওপেট্রা তার মুখােমুখি হলেন এবং তার চমৎকারিত্ব দিয়ে একজন রােমানকে জয় করার এক শেষ প্রচেষ্টা নিলেন। কিন্তু অক্টাভিয়ান কারও চমকারিত্বে মুগ্ধ হবার মতাে ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি এটা পরিষ্কার করে দিলেন যে সে তার সাথে রােমে ফিরে এসেছে একজন বিজিত শত্রু হিসেবে। তার একটি মাত্র তুরুপের তাস ছিল এবং তিনি সেটি খেলে ফেলেছেন। ঐতিহ্যবাহী কাহিনী অনুযায়ী, একটি বিঁষধর সাপ তার কাছে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনি (ক্লিওপেট্রা) তার কামড়ে আত্মহত্যা করলেন। মিশরকে দ্রুত রােমের সাথে যুক্ত করা হলাে এবং এইভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে, হেলেনিস্টিক সাম্রাজ্যের শেষটির পরিসমাপ্তি ঘটল। পিরাসের সময়কালে গ্রিক আর রােমানদের প্রথম সংঘর্ষের আড়াই শতক পর রােম চূড়ান্তভাবে পুরাে গ্রিক দুনিয়াকে অধিগ্রহণ করে নিল। এমনকি কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলের ক্রিমিয়াতে তখনাে টিকে থাকা গ্রিক শরগুলােও রােমান প্রভুত্ব মেনে নিল। অক্টাভিয়ান নিজের নাম নতুন করে রাখলেন অগাস্টাস এবং, যদিও তিনি গণপ্রজাতান্ত্রিক রােমানের কাঠামাে ধরে রাখলেন, নিজেকে তিনি রাজার মতােই ব্যক্তিতে পরিণত করেছিলেন। তিনি নিজেকে “ইম্পেরেটর” নামে পরিচয় দিতেন, যার অর্থ ছিল “নেতা”। ইংরেজিতে এই শব্দটি পরিণত হয় “এমপেরর” বা “সম্রাট” এ এবং অগাস্টাসের সাথে সাথে, খ্রিস্টপূর্ব ৩১ অব্দে (আকসিয়ামের যুদ্ধের বছরে), প্রাচীন দুনিয়ার ইতিহাস “রােমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে” পরিণত হলাে।

রােমান বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, খ্রিস্টধর্ম ও কনস্ট্যান্টিনােপল   

রোমান শাসনে গ্রিকদের অবস্থা ও খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব

হেলেনিস্টিক সাম্রাজ্যের করুণ অবস্থা : যদিও পুরাে হেলেনিস্টিক সাম্রাজ্য নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তারপরও গ্রিক সংস্কৃতি হারিয়ে যায়নি। এটি, প্রকৃতপক্ষে, ছিল আগের চেয়ে শক্তিশালী। রােম নিজেও গ্রিক চিন্তাধারা গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং যে সময়ে অগাস্টাস রােমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রােম নিজেও পরিণত হলাে একটি হেলেনিস্টিক রাজ্যে এবং সেটি হলাে সবার থেকে সেরা। কিন্তু গ্রিসের পতন চলতেই থাকল। রােমান সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগর এলাকায় দুই শতাব্দীর জন্য নিশ্চিন্ত শান্তি (প্যাক্স রােমানা বা রােমান শান্তি) নিয়ে এসেছিল, কিন্তু গ্রিসের জন্য এটি ছিল মৃত্যুর শান্তি। এর পরিবৃদ্ধির কালে রােম গ্রিসের প্রতি বাধাহীনভাবে নির্মম ছিল। কোরিন্থের ধ্বংসযজ্ঞ, রােডসের ইচ্ছাকৃত ক্ষতিসাধন, এথেন্সের করায়ত্তকরণ, গ্রিক মাটিতে রােমান গৃহযুদ্ধের লড়াই গ্রিসকে একটি পরিত্যক্তভূমি বানিয়ে দিয়েছিল। গ্রিক ভূগােলবিদ স্ট্রাবো অগাস্টাসের সময়ের গ্রিসের একটি বর্ণনা প্রদান করে গেছেন। এটি ক্ষতিগ্রস্ত নগরগুলাে আর অতিরিক্ত জনঅধ্যুষিত এলাকার একটি বিষাদময় চিত্র। 

জেসাস ক্রাইস্টের মৃত্যু ও গ্রিকদের কাছে পলের ধর্মপ্রচার : এমনকি এই সময়েও গ্রিসে একটি নতুন আর মহাশক্তির শুরুটা বােঝা গিয়েছিল। জুডিয়াতে জেসাস ক্রাইস্ট নামে এক নবীর উত্থান ঘটল (মেসিয়াহ জসুয়া)। তিনি কিছু অনুসারী জোগাড় করেছিলেন যারা জেসাসকে মানুষের রূপে ঈশ্বরের বিচরণ বলে মনে করেছিলেন। (এখন পশ্চিমা দুনিয়া জেসাসের জন্মের সময় থেকে বছর গণনা করে। এভাবে, ম্যারাথনের যুদ্ধ লড়া হয়েছে ৪৯০ বিসি, বিফোর ক্রাইস্ট (ক্রাইস্টের আগে))। জেসাসের জন্ম থেকে বছরগুলাে লেখা হয় এডি চিহ্ন দিয়ে। এর অর্থ হলাে “আন্নো ডমিনি” অথবা “আমাদের প্রভুর বছর”।) জেসাসকে ২৯ এডি’তে ক্রুশবিদ্ধ করার মাধ্যমে হত্যা করা হয়, কিন্তু অনুসারীরা তাদের বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চললেন। ক্রাইস্টের (ক্রিশ্চিয়ান) অনুসারীরা জুডিয়াতে অনেক দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন হেরেটিকস, এবং অন্যতম সক্রিয় যন্ত্রণা-ভােগকারী ছিলেন সল নামে একজন ইহুদী, যিনি এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ উপকূলে গ্রিকভাষী নগর টারসাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জেসাসের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর সল একটি আকস্মিক রূপান্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করলেন এবং একজন শক্ত খ্রিস্টানে পরিণত হলেন যেমনটি আগে তিনি ছিলেন একজন যন্ত্রণা-ভােগকারী। তিনি তার নাম পরিবর্তন করে পল রাখলেন এবং অইহুদীদের, বিশেষ করে গ্রিকদের কাছে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে লাগলেন। 

পলের ধর্মপ্রচার ও মৃত্যু : ৪৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে, পল এন্টিওক হয়ে, সাইপ্রাস আর এশিয়া মাইনরে ভ্রমণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে, তিনি কোরিন্থে প্রচারকার্য চালিয়ে মেসিডােনিয়া আর গ্রিসেও ভ্রমণ করলেন। ৫৩ খ্রিস্টাব্দে, তিনি এথেন্সে প্রচারকার্য চালালেন। সবশেষে, ৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে রােমে গেলেন এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করলেন। তার ধর্মপ্রচারের দিনগুলােতে, পল গ্রিকদের মধ্যে ধর্মান্তরিত লােকদের কিছু সংখ্যক শব্দ (সুসমাচার) দ্বারা আহ্বান করতেন। তাদের নাম বাইবেলে এসেছে নগরগুলাের বসবাসকারীদের নামের অধীনে যাদের প্রতি তাদের আহ্বান করা হয়েছিল। দুইজন ছিল কোরিন্থিয়ান, কোরিন্থের মানুষও তিনটি সুসমাচার আহ্বান করা হয়েছিল মেসিডােনিয়ার ফিলিপ্পি আর থেসালােসানি নগরের প্রতি; দুইটি “থেনাইফিয়ানদের প্রতি” এবং একটি “ফিলিপিয়ানদের প্রতি”। অন্যগুলাে ছিল প্রশিয়া মাইনরের নগরগুলাের প্রতি, একটি “ইফেসিয়ানদের প্রতি,” একটি “গ্যালাশিয়ানদের প্রতি এবং একটি “কলােসিয়ানদের প্রতি”। ইতিহাস অনুযায়ী, পল ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রথম রােমান যন্ত্রণাভােগের মধ্যে দিয়ে বীরের মৃত্যুবরণ করেন, সম্রাট নিরাের হাতে, যিনি ৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। 

সম্রাট নিরো ও হাড্রিয়ান : নিরো ছিলেন সেইসব সম্রাটদের মধ্যে একজন, এখন গ্রিস প্রায় মৃত হওয়ায় যিনি বেশি ভূখণ্ডের অধিকারী হতে ভালােবাসতেন এবং পুরনাে দিনগুলাের মত করে বেঁচে থাকার ভান করতেন। তার পছন্দতম ইচ্ছের মধ্যে ছিল ইলিউসিনীয় রহস্যবাদের উদযাপনে যােগদান করা, কিন্তু তাকে তা করতে দেয়া হয়নি কারণ তিনি নিজের মাকে হত্যা করিয়েছিলেন। সম্রাট হেড্রিয়ান, যিনি ১১৭ থেকে ১৩৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, তিনি মৃত গ্রিসের প্রতি চূড়ান্তভাবে রােমান ভালােবাসা প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি ১২৫ খ্রিস্টাব্দে এথেন্স সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি উৎসবে সভাপতিত্ব করেছিলেন, ইলিউসিনীয় রহস্যাবলিতে ছিলেন, এবং এর মন্দির বিশাল আর সুন্দর করে তৈরির কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি যােজকের ভেতর দিয়ে একটি খাল খনন করেছিলেন এবং এবং গ্রিক নগরগুলােয় যা অবশিষ্ট ছিল সেই কিছু পরিমাণ স্বাধীনতার অনুমতি প্রদান করেছিলেন, পুরনাে দিনগুলাের অনুকরণে।

বিজ্ঞানচর্চা : যেহেতু গ্রিস ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হয়ে যাচ্ছিল, গ্রিক বিজ্ঞানও শীর্ণ হয়ে পড়েছিল। অল্প কিছু নামই উল্লেখ করার মতাে অবশিষ্ট ছিল –

  • সোসিজিনিস : সােসিজিনিস ছিলেন একজন আলেক্সান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিদ, যিনি জুলিয়াস সিজারের সময় উন্নতি লাভ করেছিলেন। তিনি সিজারকে রােমান সাম্রাজ্যের জন্য একটি নতুন দিনপঞ্জিকা তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন, যা কথিত “জুলিয়ান দিনপঞ্জিকা” হিসেবে। এই দিনপঞ্জিকায়, প্রতি চার বছরের তিন বছর ছিল ৩৬৫ দিনের, আর প্রতি চতুর্থ বছর ছিল ৩৬৬ দিনের। এই দিনপঞ্জিকাটিই (যা পনেরাে শতক পর কিছুটা সমৃদ্ধ হয়েছিল) টিকে আছে এবং আজকের দিনের দুনিয়াতেও ব্যবহৃত হয়। 
  • ডাইওসকোরিডিস : নীরাের সময়ে, ডাইওসকোরিডিস নামে এক গ্রিক চিকিৎসক, রােমান সৈন্যদলের সাথে ভ্রমণ করেছিলেন এবং যে নতুন বৃক্ষাদি পেয়েছিলেন, সেগুলাে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, বিশেষ করে তাদের চিকিৎসাবিদ্যার বৈশিষ্টগুলাে নিয়ে। 
  • হিরো : আর সেখানে ছিল হিরাে, একজন গ্রিক প্রকৌশলী যিনি রােমান সাম্রাজ্যের শুরুর সময়ে আলেক্সান্দ্রিয়ায় কাজ করতেন। তিনি একটি ফাকা গােলকের উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন যার সাথে দুটি বাকানাে টিউব সংযুক্ত ছিল। যখন-গোলকের ভেতর জল ফোটানাে হত বাষ্প টিউবের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসত এবং গােলকটিকে দ্রুতবেগে ঘােরাত। এটি ছিল সাধারণ একটি “বাষ্পীয় ইঞ্জিন’। হিরাে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দরজা খুলতেন এবং মন্দিরের মূর্তিগুলাে নাড়াতেন। এইগুলাে ছিল কেবল কিছু যন্ত্র যাদের মাধ্যমে পুরােহিতরা হয়তাে বিশ্বাসপ্রবণ উপাসকদের উপর প্রভাব বিস্তার করত, অথবা মূর্তিগুলাে দিয়ে বিনােদিত করার জন্য চমৎকারিত্ব দেখাত ক্লান্তি আর ব্যাথাযুক্ত মনুষ্য দাসের পেশীশক্তির বদলে বাষ্পের শক্তি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার ধারণা এরপর বেশিদিন আগ্রহের বিষয় ছিল না। 
  • টলেমি : গ্রিক জ্যোতির্বিদদের মধ্যে সর্বশেষের জন ছিলেন ক্লডিয়াস টলেমিউস, যাকে সাধারণভাবে ইংরেজিতে টলেমি নামে ডাকা হয়। কিন্তু, তিনি মিশরের মেসিডােনীয় রাজার কোনাে আত্মীয় ছিলেন না। তিনি ১৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমান ছিলেন। টলেমি বিশ্বজগতের সেই পদ্ধতি গ্রহণ করলেন যা নিয়ে হিপার্কাস কাজ করেছিলেন এবং এতে নিজেই কিছু উন্নতি সাধন করেছিলেন। তার প্রধান গুরুত্ব এই ব্যাপারটিতেই আছে যে যেখানে হিপার্কাসের সব বই হারিয়ে গিয়েছিল, সেখানে টলেমিরগুলাে টিকে ছিল। পরবর্তীকালে চৌদ্দ শতাব্দী ধরে টলেমির বইগুলাে ছিল জ্যোতির্বিদ্যার মৌলিক বই, আর “ভূ-কেন্দ্রিক বিশ্বজগতের পদ্ধতিকে পরবর্তীকালে “টলেমিক পদ্ধতি” বলে ডাকা হত। টলেমি ভূগােলের ওপরেও লিখেছিলেন এবং তিনি পৃথিবীর পরিধি হিসেবে পসিডােনিয়াসের ১৮,০০০ মাইলের সংখ্যাটি গ্রহণ করেছিলেন, ইরাটোসথিনিসের সঠিক সংখ্যা ২৫,০০০-এর পরিবর্তে। প্রথম দিককার আধুনিক সময়ে এই ক্ষুদ্রতর সংখ্যা টিকে ছিল এবং যখন কলম্বাস পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে এশিয়া পৌঁছানাের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি টলেমির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ৩০০০ মাইলের যাত্রার  পরিমাপ করেছিলেন। তিনি যদি জানতেন যে এশিয়া ১১০০০ মাইল দূরে, তিনি হয়তাে তার যাত্রাই বাতিল করে দিতেন। 
  • গ্যালেন : গ্রিক প্রাণীবিদদের মধ্যে সর্বশেষের জন ছিলেন গ্যালেন যিনি ১৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পারগামামে জন্ম নিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ অব্দে, তিনি রােমে থিতু হয়েছিলেন, যেখানে কিছু সময়ের জন্য, তিনি সম্রাটের জন্য দরবারী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছিলেন। গ্যালেনের সেরা কাজ ছিল শরীরবিদ্যায়। যেহেতু মানব শরীরের ব্যবচ্ছেদ ছিল অশােভন, গ্যালেন জীবজন্তু নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি মানব শরীরের কার্যাবলির ওপর একটি সর্বাত্মক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন যা প্রাচীন দুনিয়া উপহার দিতে পারত এমন সবচেয়ে বিশদ ছিল এবং তার মৃত্যুর পর তের শতাব্দী ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলভিত্তি হিসেবে টিকে ছিল।
  • ডাইওফ্যান্টাস : গুরুত্ব পায় এমন গ্রিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বশেষেরজন ছিলেন ডাইওফ্যান্টাস যিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় কাজ করেছিলেন। তিনি জ্যামিতিতে গ্রিক বিশেষত্বের থেকে সরে গিয়ে প্রথমবারের মতাে বীজগণিতের উন্নয়নে কাজ করেছিলেন। 
  • রসায়নের পূর্বসুরি খেমিয়া ও এর অন্যতম চর্চাকারী জসমিয়াস : গ্রিক বিজ্ঞান অন্যান্য ভূখণ্ডের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল (প্রকৃতপক্ষে, এটি সবসময়ই ছিল)। মিশরের গ্রিকরা সেই ভূখণ্ডের প্রাচীন লােকবিদ্যা গ্রহণ করেছিলেন বস্তুর সারাংশ নিয়ে অনুসন্ধান করার এবং একটি বস্তুকে আরেকটি বস্তুতে পরিণত করার পদ্ধতির ক্ষেত্রে। গ্রিকরা এই বিজ্ঞানকে বলতে খেমিয়া (সম্ভবত মিশরীয়দের নিজের দেহকে দেয়া নাম খেম থেকে।) এই বিজ্ঞান ছিল আমাদের নিজস্ব রয়ায়নের পূর্বসূরী। ৩০০ অব্দের দিকে গ্রিক খেমিয়ার একজন চর্চাকারী জসমিয়াস এই বিষয়ে গ্রিক জ্ঞানকে একত্র করে একটি ভলিউমের সিরিজ লিখেছিলেন। 

ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চা : তদকালীন গ্রিক ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চাকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন –

  • ডাইওডোরাস : রােমান সময়ের গ্রিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে ছিলেন ডাইওডােরাস যিনি জুলিয়াস সিজারের সময়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি চল্লিশ খণ্ডে ইতিহাসের বই লিখেছিলেন যার মধ্যে শুধু প্রথম থেকে চতুর্থ, আর এগারতম থেকে বিশতমই টিকে আছে। ডায়াডােকিদের সম্মন্ধে আমরা যে তথ্যাবলি পাই, তার বেশিরভাগই এসেছে ডাইওভােরাসের কাছ থেকে। 
  • প্লুটার্ক : এর চেয়েও একজন উন্নতমানের লেখক ছিলেন কেরােনিয়ার প্লুটার্ক। তিনি ৪৬ অব্দের দিকে জন্মেছিলেন আর তিনি তার আত্মজীবনীগুলাের জন্য সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত ছিলেন। এটা চিন্তার বিষয় যে রােমানদের মতােই গ্রিকদেরও নিজেদের মহান সব মানুষ ছিল। তিনি “পাশাপাশি জীবন”-এর একটি ক্রমধারা লিখেছিলেন যেখানে একজন গ্রিককে একজন রােমানের সাথে তুলনা আর পার্থক্য করা হয়েছে। এভাবে, আলেকজান্ডার আর জুলিয়াস সিজারকে সমান্তরালভাবে লেখা হয়েছে, আর তাদের মিল আর অমিল নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। প্লুটার্কের স্টাইল এতাে চমৎকার ছিল যে তার বইগুলাে, বিরাট ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে গল্পের ছলে বলা। কাহিনীগুলাে নিয়ে, আজকের দিনেও সুপাঠ্য হিসেবে টিকে আছে। 
  • আরিয়ান : আরেকজন আত্মজীবনীকার ছিলেন নিকোমিডিয়ার আরিয়ান। তিনি ৯৬ অব্দের দিকে জন্মেছিলেন এবং তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আলেকজান্ডারের জীবনী। এটি ছিল টলেমি সােটারের প্রত্যক্ষ কাজের ওপর ভিত্তি করে এবং এটি হলাে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কীর্তি নিয়ে পাওয়া সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য কাহিনী। 
  • ডাইয়ােজিনিস : সর্বশেষে ছিলেন ডাইয়ােজিনিস লেউরশিয়াস যার-সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না শুধু এটা ছাড়া যে তিনি ২৩০ অব্দের দিকে বেঁচে ছিলেন। তিনি প্রাচীন দার্শনিকদের জীবনী এবং বাণীর সংকলন করেছিলেন। এটি খসরা বইয়ের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না এবং তেমন চমত্তার কিছুও নয়, কিন্তু এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর বেশিরভাগই টিকে আছে এবং গ্রিক চিন্তার অনেক নেতাদের সম্মন্ধে এইটুকুই সব যা অবশিষ্ট রয়েছে। 

গ্রিক অঞ্চলসমূহের খ্রিস্টীয়করণ ও প্রাচীন গ্রিক ঐতিহ্যের অবসান

এপিকটেটাসের নির্বিকারবাদ ও সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের অনুসরণ : রােমান শান্তির দিনগুলােতে গ্রিক দর্শন এর গুরুত্ব ধরে রেখেছিল। বিশেষ করে, নির্বিকারবাদ জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু অর্জন করেছিল। এটি ইপিকটেটাস নামে একজন গ্রিক দার্শনিক কর্তৃক রােমান দুনিয়াকে সবচেয়ে সফলভাবে শেখানাে হয়েছিল। তিনি ৬০ অব্দের দিকে এশিয়া, মাইনরের অভ্যন্তরের এক নগর হাইয়েরােপােলিসে জন্মেছিলেন। তার প্রথম জীবনে তিনি একজন দাস ছিলেন, কিন্তু মুক্ত হয়ে তিনি পূর্ণবয়স্ক জীবন কাটিয়েছিলেন নাইকোপােলিসে। এই নগর, যার নামের অর্থ ছিল “বিজয়ীর নগর”, তা এক শতাব্দী পূর্বে আকসিয়ামের যুদ্ধের নিকটবর্তী স্থানে অগাস্টাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সক্রেটিসের মতােই, ইপিকটেটাস তার শিক্ষাকে লেখনির কাছে সমর্পণ করেননি। কিন্তু, তার শিষ্যরা (একজন ছিলেন আরিয়ান) তার মতাদর্শ দূরে বহুদূরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস যিনি ১৬১ থেকে ১৮০ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, তিনি নির্বিকারবাদ নীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং এটিকে গ্রহণও করেছিলেন, এবং তাকে পরবর্তীকালে “নির্বিকার সম্রাট” নামে ডাকা হত। তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতায় আসার মতাে সবচাইতে দয়াবান আর সভ্য একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু, তার শাসনামল রােমান সাম্রাজ্যের ভালাে দিনগুলাের সমাপ্তিই চিহ্নিত করেছিল। 

নির্বিকারবাদের আবেদন হ্রাস, রহস্যবাদ ও নিওপ্লেটোনিজমের আবেদন বৃদ্ধি : মার্কাস অরেলিয়াসের পরে বেশ কিছু নিষ্ঠুর বা অযােগ্য সম্রাটরা এসেছিল। অসভ্য গােত্রগুলাে সাম্রাজ্যের সীমান্ত আক্রমণ করেছিল; রােমান লিজিওন পুতুল সম্রাটকে বসিয়েছিল এবং বিদ্রোহ করেছিল আর গৃহযুদ্ধ ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। সংক্ষেপে, রােমান শান্তির দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল আর সাম্রাজ্যটি দীর্ঘ পতনের মুখে প্রবেশ করেছিল। আংশিকভাবে এই পতনের কারণে এবং এর ফলাফলে বাড়বাড়ন্ত অভাবের কারণে প্রাচীন দুনিয়ার জনগণ নির্বিকারবাদের নীরস বিশ্বাস এবং গ্রিক দর্শনকে সাধারণভাবে পেল অপরিপূর্ণ হিসেবে। তাদের আরও বেশি আবেগিক কিছুর প্রয়ােজন ছিল, এমন কিছু যা উচ্চমাত্রার লক্ষ্য প্রদান করে যা এই দুনিয়ায় অর্জন করা যায় এবং কঠিন জীবন থেকে গৌরবদীপ্ত মুক্তির প্রশ্রুিতি প্রদান করে মৃত্যুর আগে ও পরে। রহস্যে পরিপূর্ণ ধর্মগুলাে ছিল এক ধরনের জবাব, কিন্তু অ-গ্রিক পূর্বদিক থেকে আসা কিছু ধর্মের ধারা গ্রিক রহস্যাবলির থেকে বেশি উত্তেজনা আর আশার প্রস্তাবনা রেখেছিল। এর মধ্যে ছিল মিশর থেকে বেছে নেয়া আইসিসের পূজা, এশিয়া মাইনর থেকে আসা সিবালি এবং পারস্য থেকে আসা মিথ্রাস। প্রাচ্যের এইসকল ধর্মের গুরুত্বের ওপর গ্রিক দর্শনের উত্তর দিয়েছিলেন প্লটিনাস যিনি ২০৫ অব্দের দিকে মিশরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শিক্ষা শুরু হয়েছিল প্লেটোর দর্শন প্লেটোবাদ দ্বারা, কিন্তু এর সাথে মিল রেখে প্রাচ্যধর্মের বেশ রহস্যময় কিছু মতবাদ যুক্ত হয়েছিল। এইভাবে “নব্য-প্লেটোবাদ” গ্রিক দর্শন আর প্রাচ্যের রহস্যময় গুপ্তবিদ্যার মাঝামাঝি একটি আবাসস্থল হিসেবেই ছিল। কিন্তু, নব্য-প্লোটোবাদের মধ্যে বিপ্লবাত্মক নতুন ধর্মগুলাে, যা রােমান দুনিয়ায় আছড়ে পড়েছিল, তার জোর আর আবেদন কম পরিমাণেই ছিল।

খ্রিস্টধর্মের জনপ্রিয়তা, রোমের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠা ও জুলিয়ানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্যাগান ধর্মের সম্ভাবনার সমাপ্তি : পলের মতাে মানুষেরা যারা তার পরে এসেছিলেন, তারা হয়ত তাদের বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা সুসমাচার প্রচার করতে থাকলেন এবং ক্রিশ্চিয়ানিটি শক্তি অর্জন করতে থাকল যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরাে সাম্রাজ্যের অর্ধেক লােক পরিণত হল খ্রিস্টানে। অবশেষে, ৩১৩ অব্দে, প্রথম কনস্ট্যান্টিন, যিনি ৩০৬ থেকে ৩৩৭ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন, তিনি রােমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে গ্রহণ করলেন। প্যাগানবাদ ফিরে আসার জন্য শেষ একটি প্রচেষ্টা নিল। ৩৬১ অব্দে, জুলিয়ান নামে কনস্ট্যান্টিনের এক ভাগ্নে সম্রাট হলেন। যদিও খ্রিস্টান হিসেবে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তিনি প্রাচীনত্বের একজন পূজারী ছিলেন। প্লেটোর দিনগুলাে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন ছিল তার এবং অখর্ন তিনি সম্রাট হলেন তিনি এটি করার চেষ্টা করলেন। তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘােষণা দিলেন আর সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম থেকে ক্রিশ্চিয়ানিটিকে সরিয়ে দিলেন। তিনি ইলিউসিয়ান রহস্যাবলি চালু করলেন এবং প্রাচীন পােশাকে এথেন্সে ঘুরে বেড়ালেন দার্শনিকদের সাথে কথা বলতে বলতে। কিন্তু, নিশ্চিতভাবেই এটি কাজে আসেনি। প্লেটোকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনার মতােই কঠিন ছিল আবারও গ্রিক দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনা। জুলিয়ান ৩৬৩ অব্দে এক যুদ্ধে মারা গেলেন এবং খ্রিস্টধর্ম আবারও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলাে। তখন থেকেই খ্রিস্টধর্ম পশ্চিমা দুনিয়ার প্রধান ধর্ম হিসেবে টিকে থাকল। 

প্যাগান ধর্ম ও গ্রিক সংস্কৃতির প্রাক-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের অবসান : খ্রিস্টধর্ম আবারও আনুষ্ঠানিক ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে প্যাগানবাদ দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে গেল –

  • দুই ধারার অনুসারীদের মধ্যে সাম্রাজ্যের এখানে সেখানে তিক্ত দাঙ্গার সৃষ্টি হলাে। ৪১৫ অব্দে, সেই ধরনের দাঙ্গা আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করল। সেটি গ্রিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আলেক্সান্দ্রিয়ার সমাপ্তি ঘােষণা করল এবং গ্রিক বিজ্ঞানেরও সমাপ্তি ঘটল।
  • গ্রিক সংস্কৃতির অন্যান্য চিহ্নও হারিয়ে গেল। অলিম্পিয়ান গেমস শেষবারের মতাে অনুষ্ঠিত হলাে ৩৯৩ অব্দে। তারপর সম্রাট থিওডােসিয়াসের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটির সমাপ্তি টানা হলাে এর অবস্থানের প্রায় বারাে শতাব্দী পর।
  • জিউসের বিশাল মূর্তি, যা আট শতাব্দী পূর্বে ফিদিয়াস তৈরি করেছিলেন, তা অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হলাে এবং এটি ৪৭৬ অব্দে আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
  • বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল; আর পুরনো মন্দির হয় ভেঙে ফেলা হলাে, নয়তাে চার্চে পরিণত করা হলাে। উদাহরণস্বরূপ, পার্থেননকে একটি গির্জায় পরিণত করা হয় এবং এথেনার মূর্তিকে সরিয়ে ফেলা হয়, যা পরে যে কোনােভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
  • শেষ আঘাত এল ৫২৯ অব্দে, যখন সম্রাট জাস্টিনিয়ান এথেন্সের একাডেমি বন্ধ করে দিলেন; যে একাডেমি নয় শতক আগে প্লেটো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • প্যাগান শিক্ষকেরা পারস্যের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন (পুরনো শত্রু এখন এক আশ্রয়স্থলে পরিণত হলাে) এবং প্রাক-খ্রিস্টান গ্রিক জীবনের শেষ চিহ্নও এতে মুছে গেল।

রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব-পশ্চিম ভাগ ও পূর্ব ভাগের গ্রিক ভিত্তিক খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উদ্ভব ও সমৃদ্ধি : আর এখনাে গ্রিস টিকে আছে। যে বইগুলাে সে লিখে গেছে, এর শিল্প ও সংস্কৃতি, এর ঐতিহ্য, এখনাে সেখানে টিকে আছে। যদি মেসিডােনীয় দুনিয়া এখন খ্রিস্টান হয়ে থাকে, ক্রিশ্চিয়ানিটি, বিশেষ করে রােমান সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশে, গড়ে উঠেছিল গ্রিক ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর ভিত্তি করে। ক্রিশ্চিয়ানিটির মাধ্যমে গ্রিক সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তা ধ্বংস হয়ে যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, রােমান সাম্রাজ্যের ক্ষয় পূর্ব অংশকে মুক্ত করেছে এবং ক্রিশ্চিয়ানিটির গ্রিক ধরনকে বিশেষ গুরুত্ব পেতে সাহায্য করেছে। এটি এমনভাবেই ঘটেছিল। মার্কাস অরেলিয়াসের সময়কালের পর রােমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতনের দিকে যাচ্ছিল এবং এটিকে কার্যকর রাখতে সম্রাট ডিওক্লিশিয়ান, যিনি ২৮৪ থেকে ৩০৫ শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন, তিনি সাম্রাজাকে দুইভাগে ভাগ করেছিলেন, একটি পশ্চিম ভাগ আর আরেকটি পূর্বভাগ। তিনি তার এক সহকর্মীকে পশ্চিম সাম্রাজ্যের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আর পূর্ব সাম্রাজ্যের দেখাশােনা করতেন তিনি। তত্ত্বগতভাবে, দুই সম্রাট পরস্পরকে সহযােগিতা করেছিলেন এবং একসাথে একটি রাজ্য শাসন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কখনাে একজন সম্রাট দুই ভাগেরই নিয়ন্ত্রণ লাভ করতেন এমনকি ডিওক্লিশিয়ানের সময়কালের পরও। কিন্তু, এটা আরও বেশি পরিলক্ষিত হলাে যে এই ভাগটি ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিভাজনকারী রেখা ছিল এড্রিয়াটিক সাগর। ইতালিকে নিয়ে পশ্চিম অর্ধ ল্যাটিনে কথা বলত এবং ঐতিহ্যগতভাবে ছিল শক্তিশালীভাবে রােমান। গ্রিসকে নিয়ে পূর্ব অর্ধ গ্রিসে কথা বলত এবং ঐতিহ্যগতভাবে ছিল শক্তিশালীভাবে গ্রিক। প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট কনস্ট্যান্টিন প্রথম পুরাে সাম্রাজ্যকে শাসন করেছিলেন, কিন্তু পূর্ব অংশকে অধিক সমৃদ্ধ আর মূল্যবান হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি সেখানে তার রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বসফরাসে পুরনো নগর বাইজেন্টিয়াম পুনঃনির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেছিলেন এবং নতুন করে নিজের নামে এর নাম দিয়েছিলেন কনস্ট্যান্টিনোেপল। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে এটি তার রাজধানী এবং সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিমান গ্রিকভাষী নগরে পরিণত হলাে। পুরাে সাম্রাজ্যকে শাসন করা শেষ সম্রাট ছিলেন থিওডােসিয়াস যিনি অলিম্পিয়ান গেমসের সমাপ্তি টেনেছিলেন। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যটি স্থায়ীভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ল।

পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন, পশ্চিমের রোমান ক্যাথলিক ও পূর্বের গ্রিক অর্থোডস্ক চার্চের বিরোধ, রুশদের অর্থোডক্সিতে ধর্মান্তরকরণ : পরবর্তী শতাব্দীজুড়ে রােমান সাম্রাজ্য পুনঃপুন বারবারিয়ানদের আক্রমণের স্বীকার হলাে এবং, ৪৭৬ অব্দে পশ্চিমা সম্রাটদের সর্বশেষজন রােমুলাস অগাস্টাস সাম্রাজ্যের প্রতি তার দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। তারপরে, কোনাে সম্রাট রােমে রাজত্ব করেননি এবং এটিকেই সাধারণভাবে “রােমান সাম্রাজ্যের পতন” হিসেবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু, পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য সাফল্যের সাথে ঝড়কে অতিক্রম করে গেল এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল, কিছু সংখ্যক সম্রাটের মাধ্যমে যারা সেটিকে অবিচ্ছিন্নভাবে টেনে নিয়ে গেলেন এক হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ের জন্য। এটি পশ্চিমাদের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু, এর পথ ধরে আরও অনেক কিছুই ঘটল। পশ্চিমে, খ্রিস্টানরা রােমের বিশপের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, যিনি পােপ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু, পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানরা কনস্ট্যান্টিনােপলের সম্রাটকে তাদের আধ্যাতিক নেতা মানতাে। গির্জার দুই শাখার মধ্যে সবসময় ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত এবং, অবশেষে, ৫০৪ খ্রিস্টাব্দে, দুই পথের পুরােপুরি বিভাজন ঘটল। সেইসময় থেকে, পশ্চিম গির্জা হলাে “রােমান ক্যাথলিক,” পূর্ব গির্জা হলাে “গ্রিক অর্থোডক্স”। উভয় দলই উত্তরের প্যাগানদের ধর্মান্তরিত করতে প্ররিশ্রম করেছিল, পূর্ণ বিভাজনের আগে ও পরে। গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় অর্জন করল যখন তারা শুধু বলকান উপদ্বীপের বুলগেরিয়ান অব সার্বদেরই নয়, বরং তার সাথে কৃষ্ণসাগরের উত্তরের বিশাল সমভূমির রাশিয়ান বা রুশদের ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হলাে। তখন থেকেই রাশিয়ানরা ছিল অর্থোডক্স, এবং এটি তাদের ক্যাথলিক পশ্চিম ইউরােপ থেকে পৃথক হতে সাহায্য করেছে যা এমন একটি বিষয় আজকের দিন পর্যন্ত যার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। 

ইসলামের আগমন, আরব ও স্লাভিক আক্রমণ

মিশরীয় ও সিরিয়ানদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং নিজস্ব খ্রিস্টধর্ম : পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য ঐতিহ্যগতভাবে কোনােমতেই রােমান ছিল না। মিশর আর সিরিয়ার মতাে এর অংশ বিশেষের অনেককাল আগে থেকেই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল, এবং গ্রিক সংস্কৃতি এই ঐতিহ্যকে উপর থেকে ঢেকে দিয়েছিল, কিন্তু তা ছিল খুব পাতলাভাবে। মিশরীয়দের আর সিরিয়ানদের এমনকি তাদের ক্রিশ্চিয়ানিটির ধরনেও ভিন্নতা ছিল এবং তারা কনস্ট্যান্টিনােপল আর গ্রিস ও এশিয়া মাইনরের গ্রিক এলাকার ধারণ করা মতবাদকেও বিশ্বাস করত না। বিদেশি আক্রমণকারীদের পক্ষে তাই সিরিয়া আর মিশরকে দখল করা ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ। সেখানকার অধিবাসীরা বাইরের আক্রমণকারীদের কনস্ট্যান্টিনােপলের সরকারের তুলনায় মােটেই খারাপভাবে দেখত না। পূর্বদিক থেকে নতুন করে আসা এক প্রাচীন বিপদের সাথে যুক্ত হয়ে এই ধরনের ব্যাপার সংঘটিত হলাে। সিরিয়ার পূর্বদিকের পার্সিয়ান সাম্রাজ্য রােমানদের হাতে কখনােই বিজিত হয়নি কিন্তু এটি গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে গেল।

সাসানীয় সাম্রাজ্যের উদ্ভব, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় খশরুর এবং পারস্যের বিরুদ্ধে হিরাক্লিয়াসের সফল অভিযান : ২২৬ অব্দে, ক্ষমতায় নতুন এক ধরনের সম্রাটের উত্থান ঘটল। এরা ছিল সাসানিদ নামের পারসিক কেননা এই ধারার প্রথম রাজার পিতামহের নাম ছিল সাসান। পরবর্তীকালে যা হলাে তা ছিল ছয় শতাব্দী পূর্বের পারস্য সাম্রাজ্যের নবসৃষ্টি। শুধু পুরনাে রাজ্যের সবচেয়ে পশ্চিমের অংশ বাদে, যেটি ছিল রােমান নিয়ন্ত্রণাধীন। চার শতক ধরে, কোনােরকম দোনােমনা বিজয় অর্জন করা ছাড়াই রােমান আর পারসিকরা নিয়মিত যুদ্ধে লিপ্ত থাকল। তারপর, ৫৯১ অব্দে, দ্বিতীয় খশরু পারস্যের সিংহাসনে আরােহণ করলেন। পূর্ব-রােমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ছিল বিস্ময়করভাবে সফল। ৬০৩ অব্দে, তিনি এশিয়া মাইনর বিজয়ের অভিযান শুরু করলেন। তিনি ৬১৪ অব্দে সিরিয়া, ৬১৫ অব্দে জুডিয়া ও ৬১৬ অব্দে মিশর দখল করে নিলেন। ৬১৭ অব্দে তিনি বসফরাসের সঙ্কীর্ণ প্রণালি পেরিয়ে কনস্ট্যান্টিনােপলের কয়েক মাইলের ভেতর পৌঁছে গেলেন। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব-রােমান সাম্রাজ্যের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা হলাে মূল গ্রিস ভূখণ্ড, সিসিলি, এবং আফ্রিকান উপকূলের লম্বা একটি অংশ। মনে হচ্ছিল জারেক্সেস আরেকবার বেঁচে উঠেছে এবং গ্রিস আরেকবার তার দয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে। ৬১০ অব্দে, হিরাক্লিয়াস রােমের সম্রাট হলেন। দশ বছর ধরে তিনি প্রস্তুতি নিলেন আর তারপর আঘাত হানলেন। তিনি শত্রুদের ওপর যুদ্ধ নিয়ে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার রণতরী ব্যবহার করে (পারসিকদের কোনােটাই ছিল না) হিরাক্লিয়াস ৬২২ অব্দে ইসুসে সেনাদল প্রবেশ করালেন। পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে, তিনি নতুন আলেকজান্ডার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পারস্যের অন্তঃস্থলে এগিয়ে চললেন এবং তাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলেন। ৬৩০ অব্দের দিকে হারানাে প্রদেশগুলাে পুনরুদ্ধার করা হলাে।

আরবদের দিগ্বিজয় ও আরব্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়া : কিন্তু, তিক্ত যুদ্ধ দুই পক্ষকেই বাজেভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। এমনকি, যখন এটি চলছিল, তখন মুহাম্মদ নামে একজন নতুন নবী আরবীয় উপদ্বীপে ইসলাম নামে এক নতুন ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করছিলেন। মুহাম্মদ ৬৩২ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন আর আরবরা, যারা ইতিহাসে সেভাবে তখনাে দাগ কাটতে পারেনি, তাদের উপদ্বীপ থেকে বের হয়ে দিগ্বিজয়ের উদ্দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তারা ৬৩৬ অব্দে জর্ডান নদীর এক শাখানদী ইয়ারমুকে পূর্ব-রােমান সাম্রাজ্যের বাহিনীকে পরাস্ত করল। ক্ষয়ে যাওয়া সাম্রাজ্য আর হতদ্যোম হিরাক্লিয়াস এই নতুন চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায় জেগে উঠতে পারলেন না। পরবর্তী দশক সাসানীয় সাম্রাজ্যকে পরাজিত আর জয় করতে ব্যয় করার পর আরবেরা আফ্রিকার দিকে এগােল। ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তারা আলেক্সান্দ্রিয়া দখলে নিল এবং যদি বিশাল গ্রন্থাগারের কিছু অবশিষ্ট থেকে থাকে, তখন সেটি ধ্বংস করা হলাে। ৬৭০ অব্দের মধ্যে, উত্তর আফ্রিকার অবশিষ্টাংশ দখলে নিয়ে নেয়া হলাে। আরব দিগ্বিজয় সিরিয়া আর মিশরের ওপর ছড়িয়ে থাকা গ্রিক সংস্কৃতিকে মুছে দিল। সেইসব এলাকায় ইসলাম ক্রিশ্চিয়ানিটিকে প্রতিস্থাপন করল এবং আরবী প্রতিস্থাপিত করল গ্রিক ভাষাকে। 

আরবদের গ্রিক জ্ঞানবিদ্যা গ্রহণ ও এর মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়ে পুনরায় ইউরোপে ফিরে আসা : কিন্তু, গ্রিক সংস্কৃতির মৃত্যু হলাে না। রােমানদের মতােই আরবদেরও ছিল মুগ্ধতা। আরবরা গ্রিক খেমিয়া গ্রহণ করল এবং এটিকে “আলকেমি” নাম দিল। তারা এরিস্টোটল, ইউক্লিড, গ্যালেন আর টলেমির কাজকে আরবিতে ভাষান্তর করল, সেগুলাে অধ্যয়ন করে এবং সেগুলাে সম্মন্ধে নিজেদের ধারাবিবরণী প্রদান করে তারা গ্রিক শিক্ষাকে একবারে সংরক্ষিত করল যখন এটি বারবারিয়ান পশ্চিম ইউরােপে একেবারে বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, যখন ১০০০ অব্দের পর পশ্চিম ইউরােপে শিক্ষা-দীক্ষার পুনর্জাগরণ ঘটেছিল, এটি সামনের দিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সেইসব একই গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বইয়ের মাধ্যমে, যখন তা আরবী থেকে ল্যাটিনে ভাষান্তরিত হয়েছিল।

গ্রিকভাষী এশিয়া মাইনোর, সিসিলি ও বলকান উপদ্বীপ নিয়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, আরব আক্রমণ প্রতিহতকরণ এবং মিশর, সিরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও সিসিলি হারানো : আরবীয় দিগ্বিজয়ের পর পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের যা অবশিষ্ট ছিল তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল বলকান উপদ্বীপ, এশিয়া মাইনর ও সিসিলি। এটি তখনাে নিজেকে রােমান সাম্রাজ্যই বলত; প্রকৃতপক্ষে শেষ পর্যন্ত এরা তাই করেছিল। কিন্তু, ঐতিহ্যগতভাবে এটি পুরােপুরিভাবে ছিল গ্রিক এবং হিরাক্লিয়াসের সময়ে গ্রিক ল্যাটিনের পরিবর্তে দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত হলাে। পশ্চিম ইউরােপিয়ানরা পুরাে মধ্যযুগ ধরে কনস্ট্যান্টিনােপলের শাসন করা রাজত্বকে “গ্রিক সাম্রাজ্য” বলত এবং এর পেছনে কিছু নায়সঙ্গত কারণও ছিল। পরবর্তী ইতিহাসবিদেরা হিরাক্লিসের সময়ের এবং পবর্তীকালের পূর্ব-রােমান সাম্রাজ্যকে কনস্ট্যান্টিনােপলের পুরনো নাম বাইজেন্টিয়ামের নামে “বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য” নামে ডাকতে শুরু করল, এবং এই নামেই এটি আজকে সমধিক পরিচিত। বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য এর কেন্দ্রে আরব আক্রমণকে প্রতিরােধ করতে পেরেছিল। ৬৭৩ অব্দে আরবরা কনস্ট্যান্টিনােপল অবরোধ করল, আর পাঁচ বছর ধরে স্থল আর সাগরে একে অবরুদ্ধ রাখল। এখানে আবারও, যেমন পাঁচ শতাব্দী পূর্বে রােমানরা সাইরাকুজ অবরােধ করেছিল, তেমনভাবে আবারও ছিল এটি গ্রিক মস্তিষ্ক বনাম অগ্রিক পেশিশক্তির লড়াই।  ঐতিহ্যগতভাবে, নতুন আর্কিমিডিস ছিলেন কালিনিকাস নামে একজন রসায়নবিদ, যিনি ছিলেন সিরিয়া থেকে মিশরে আসা একজন উদ্বাস্তু। তিনি এমন একটি জ্বলন্ত যৌগ্য আবিষ্কার করেছিলেন, যাতে একবার আগুন দেয়া হলে এমনকি জল লাগলেও জ্বলন্ত অবস্থায় থাকত। এর সঠিক গঠন জানা যায়নি, কিন্তু এতে অক্সিজেন সরবরাহ করার ও বিচূর্ণীভবনের জন্য নাপথা, পটাশিয়াম নাইট্রেটের মতাে দাহ্য উপাদান ছিল, যা জলের সংস্পর্শে এলে উত্তপ্ত হয়ে উঠত এবং জলের উপস্থিতিতেও যৌগটিকে জ্বলন্তই রাখত। এবার মস্তিষ্ক পেশীশক্তিকে পরাস্ত করল। গ্রিক আগুন আরবের জাহাজগুলাে পুড়িয়ে দিল এবং অবশেষে, আরবরা অবরােধ তুলে নিতে বাধ্য হলাে। বাইজেন্টিয়াম সেনাদল এশিয়া মাইনর পুনরুদ্ধার করল, কিন্তু সিরিয়া, মিশর আর উত্তর আফ্রিকা তারা চিরতরে হারিয়ে ফেলল। গ্রিক আর আরবদের মধ্যে যুদ্ধবাজী আরও কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে থাকল, কিন্তু এটি ছিল প্রান্তিক বিষয় যেখানে উভয় পক্ষের জন্য কোনাে চূড়ান্ত বিজয় ছিল অনুপস্থিত। গ্রিক দুনিয়ার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ পরাজয় ছিল কিছু দ্বীপ হাতছাড়া করা। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার ইসলামিক বাহিনী সিসিলির দখল নিয়েছিল ৮২৭ অব্দে। সেই দ্বীপে এবং দক্ষিণ ইতালিতে পনেরাে শতাব্দী ধরে প্রাধান্য বিস্তারের পর (এমনকি রােমানদের অধীনেও) গ্রিক সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটেছিল। পরবর্তীকালে, সিসিলিকে ক্রিশ্চিয়ানিটির দিকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা হয়েছিল পশ্চিম ইউরােপ থেকে জোর খাটিয়ে, এবং তখন থেকে দ্বীপটি সংস্কৃতিতে ছিল পশ্চিমা। 

স্লাভিক আক্রমণ প্রতিহতকরণ : উত্তর থেকে এক নতুন বিপত্তির উদ্ভব হলাে। ৭০০ অব্দের কিছু পরে উদ্ভব হবার পর স্লাভিক ভাষায় কথা বলা গােত্রগুলাে বলকান উপদ্বীপে আগ্রাসন চালাতে শুরু করল এবং তাদেরকে থ্রেস আর মেসিডােনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করা তাদের সাথে বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের সার্বক্ষণিক যুদ্ধ লেগে ছিল। ১০১৪ অব্দে বাইজেন্টিয়াম সম্রাট দ্বিতীয় বাসিলের হাতে তারা চূড়ান্তভাবে এবং ভয়ানকভাবে পরাস্ত হলাে। স্লাভিক লােকেরা গ্রিসের উত্তর অঞ্চলে টিকে থাকে (এমনকি আজও), কিন্তু তারা ক্রিশ্চিয়ানিটির গ্রিক ধারা গ্রহণ করেছিল আর সংস্কৃতিতে ছিল পূর্ব ইউরােপিয়ান। দ্বিতীয় বাসিলের অধীনে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছল, কিন্তু হায়, তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হবার মতাে ছিল না। 

তুর্কি আক্রমণের পর ক্রুসেড ও ৪র্থ ক্রুসেডে কনস্ট্যান্টিনোপল ও গ্রিক সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন

সেলজুক তুর্কিদের এশিয়া মাইনোর দখল : ১০০০ অব্দের দিকে, যাযাবরদের এক নতুন দল মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা ছিল তুর্কী। তুর্কীদের এক নির্দিষ্ট গােত্র যারা প্রথম প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তারা নিজেদেরকে সেলজুক নামের এক উত্তরসূরীর উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করত আর তাই তারা সেলজুক তুর্কী হিসেবে পরিচিত। তারা ইসলামিক ভূখণ্ডে ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ধর্মান্তকরণের আতঙ্ক নিয়ে তারা বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যকে লক্ষ্যবস্তু করল। এই সময়ে বাইজেন্টিয়াম সম্রাট ছিলেন চতুর্থ রােমেনাস। তিনি বেশ কয়েকবার সেলজুক তুর্কীদের পরাস্ত করেছিলেন, কিন্তু ১০৭১ অব্দে তিনি তার রাজ্যের পূর্ব-সীমান্তে তাদের সাথে যুদ্ধে মুখােমুখি এবং ভয়াবহভাবে পরাজিত হলেন। তুর্কীরা পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ল এবং উপকূলে গ্রিক আধিপত্যকে বন্দি করে এশিয়া মাইনরের অভ্যন্তর দখল করে নিল। এটি ছিল এশিয়া মাইনরে গ্রিক সংস্কৃতি স্থায়ীভাবে মুছে ফেলে এটিকে টার্কিশ হিসেবে রেখে যাওয়ার প্রক্রিয়ার শুরু। ১৯৭১ অব্দের পরে, প্রকৃতপক্ষে গ্রিক দুনিয়া সংকুচিত হয়ে সেই আকৃতি ধারণ করল, যেটি আঠারাে শতাব্দী পূর্বে উপনিবেশিকতার শুরুতে ছিল। (তুর্কীরা তাদের এশিয়া মাইনরের রাজ্যাংশকে বলত “রুম”। এটি ছিল তাদের “রােম”কে ডাকার ভঙ্গি, কেননা তারা নিজেদেরকে রােমান সাম্রাজ্য জয়ী হিসেবে বিবেচনা করেছিল।)।

ক্রুসেডের সূত্রপাত : এখন বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য দারুণ বিপদের সম্মুখীন হলাে এবং এ পশ্চিমের জাতিকূলের মধ্যে হতে সাহায্যের অনুসন্ধান করল। এটি তারা গুরুত্ব দেয়া ব্যতিরেকেই করেছিল, কেননা বাইজেন্টিয়ানরা পশ্চিমাদের বর্বর এবং নব্যতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচনা করত। পশ্চিমাদেরও বাইজেন্টিয়ানদের সম্বন্ধে সমান বাজে ধারণা ছিল এবং তাদের রক্ষা করার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিল না। কিন্তু, তারা সেলজুক তুর্কীদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল, কেননা তুর্কীরা সহিষ্ণু আরবদের থেকে সিরিয়া ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং এখন তীর্থকাজে জেরুজালেমে আগত খ্রিস্টানদের প্রতি বাজে আচরণ করছিল। সুতরাং পশ্চিমারা বাইজেন্টিয়ান আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতাে অবস্থায় ছিল। ফলাফল ছিল “একটি দুই শত বছরের সময়কাল,” যেটির শুরু হয়েছিল ১০৯৬ অব্দে, যে সময়ে পশ্চিমা সেনাদল নিয়মিত মার্চ করে বা জাহাজে করে পূর্বে ধাবিত হয়েছিল তুর্কীদের সাথে যুদ্ধ করতে। এই আন্দোলনকে বলা হয় “ক্রুসেড,” ক্রুশের ল্যাটিন শব্দ থেকে, যেহেতু পশ্চিমারা ক্রুশের জন্য, অর্থাৎ ক্রিশ্চিয়ানিটির জন্য যুদ্ধ করছিল। 

ভেনিসিয়ান ও জেনোয়িজদের দ্বারা বেশ কিছু অঞ্চলের ল্যাতিন নামকরণ : অধিক পরিমাণে বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য (অথবা এর ভেতর যা অবশিষ্ট ছিল) পশ্চিমা সৈন্যদের এবং, এমনকি এর চেয়েও বেশি পরিমাণে পশ্চিমা বণিকদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ল, বিশেষ করে ভেনিস আর জেনােয়ার বণিকদের। ১০০০ অব্দের পরে, এই ইতালিয়ান বণিকরা গ্রিষের বেশ কিছু এলাকার নতুন নামকরণ করল, এবং ইতালিয়ান নামগুলাে পশ্চিমের কাছে পরিচিত হয়ে উঠল। কিছু এখনাে টিকে আছে। উদাহরণস্বরূপ, মুলকে পাতার ল্যাটিন নাম থেকে পেলােপনেসাস পরিণত হলাে মােরিয়াতে কারণ ওরকমই উপদ্বীপের অসম প্রান্তগুলােকে দেখে মনে হত। কোরিন্থ উপসাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত নগর নপাকটাস, যেখানে এথেন্স স্পার্টান হেলটদের নিষ্ক্রিয় করেছিল, সেটির পরিচিতি হয়ে উঠল লেপান্তো নামে। পরিণতিতে কোরিন্থের উপসাগর পরিণত হলাে লেপান্তো উপসাগরে। আবার, গ্রিক নাম হিরাক্লিওন নামধারী ক্রিটের একটি নগর ভেনেসিয়ান বণিকদের মাধ্যমে নতুন নামকরণকৃত হলাে কান্ডিয়া নামে, এবং নামটি পুরাে ক্রিট দ্বীপের প্রতিই প্রয়ােগ করা হলাে। কর্সিয়ার নাম হলাে করফু আর এমনটা চলতেই থাকল। 

চতুর্থ ক্রুসেডে কনস্টান্টিনোপল দখল এবং গ্রিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনসমূহের ধ্বংসসাধন : কিন্তু যখন ক্রুসেডাররা তুর্কীদের পরাস্ত করতে বাইজেন্টিয়ানদের সাহায্য করছিল, তখন তারা গ্রিক জনগণের জন্য এক মহাবিপদ নিয়ে আসল। এটি ঘটেছিল, কারণ ক্রুসেডারদের একটি দল (যারা তখন “চতুর্থ ক্রুসেড” বলে যার পরিচিতি তার প্রস্তুতি নিচ্ছিল) ভেনেসিয়ানদের (যাদের জাহাজ তারা ব্যবহার করছিল) সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হবার বদলে কনস্ট্যান্টিনােপল আক্রমণ করতে রাজি করিয়েছিল। ভেনেসিয়ানদের জাহাজ ছাড়া ক্রুসেডাররা কোথাও যেতে পারত না। এবং কিছুসময় চিন্তা করার পর তারা তাদের হাতে আসা লুটের মালের ব্যাপারে চিন্তা করতে লাগল এবং এই ব্যাপারে রাজি হয়ে গেল। এই সময় বাইজেন্টিয়াম সম্রাট ছিলেন ষষ্ঠ আলেক্সিয়াস নামে এক দুর্বলচিত্ত যিনি ভেবেছিলেন তিনি ক্রুসেডারদের ব্যক্তিগত যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি কেবলই ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং শক্তি প্রয়ােগ, কূটবুদ্ধি ও বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ক্রুসেডাররা ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত রাজধানীটি দখল করে নিল। প্রধান ট্র্যাজেডি ছিল এটি। আজকের দিনে, মুদ্রণ প্রযুক্তি প্রতি বইয়ের হাজার কপি টিকিয়ে রাখা সম্ভব করেছে। কিন্তু, মুদ্রণ প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগের দিনগুলােতে এমনকি সেরা বইগুলােও কেবল কয়েক শত কপিতে টিকিয়ে রাখা যেত, কেননা প্রতি কপিকেই অনেক কষ্ট করে হাতে লিখে কপি করা হত। রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার মধ্যে যে কিছু বইয়ের কপিতে গ্রিক শিক্ষা আর সাহিত্য প্রশান্তিতে ছিল, তা হারিয়ে গেল। খ্রিস্টান উন্মত্ত জনতা কিছু সংখ্যক বইকে ধ্বংস করে দিল। বারবারিয়ান, যারা পশ্চিমা সাম্রাজ্য দখলে নিয়েছিল, তারা যা কিছু সেখানে অবশিষ্ট ছিল তা ধ্বংস করে দিল। ইসলামিক সেনাদল এন্টিওক, আলেক্সান্দ্রিয়া আর কার্থেজের মতাে জায়গায় গ্রন্থাগারগুলাে নিশ্চিহ্ন করে দিল, যদিও তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈজ্ঞানিক বইয়ের কয়েকটি সংরক্ষণ করেছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ১২০৪ অব্দের মধ্যে, যে একটি মাত্র জায়গায় গ্রিক শিক্ষার পুরাে অংশটি টিকে ছিল, এবং আজও অক্ষত আছে, তা হলাে কনস্টান্টিনােপল। কিন্তু, ক্রুসেডারদের দিগ্বিজয়ের জেলে, কনস্টান্টিনােপল নির্মমভাবে লুট আর ধ্বংস করা হয়েছিল এবং যিক শিক্ষার প্রায় সব মহান সম্পদ চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, এইধেবংসযজ্ঞের কারণে, সফোক্লিসের লেখা একশর বেশি নাটকের মধ্যে আমরা কেবল সাতটিই পেয়েছি। ১২০৪ অব্দের ট্র্যাজেডি কোনােভাবেই ঠেকানাে যেত না এবং, সর্বকালের জন্যই, শুধু গ্রিক দুনিয়ার বিস্ময়ের শুধু ক্ষুদ্রাংশই আমরা জানতে পারি। 

অটোমানদের উত্থান-পতন এবং গ্রিসের স্বাধীনতা

কনস্ট্যান্টিনােপলের পতন 

ল্যাতিন সাম্রাজ্যের অবসান ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তারপরও সমস্যা : দুই প্রজন্ম ধরে, গ্রিকরা পশ্চিমাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল, যারা তথাকথিত “ল্যাটিন সাম্রাজ্য” প্রতিষ্ঠা করেছে। পশ্চিমা সামতান্ত্রিক স্টাইলে তারা বিভিন্ন গােত্রপতিদেরকে টুকরাে টুকরাে অংশ পাঠিয়ে দিত। উত্তর-পূর্ব গ্রিস পরিণত হলাে থেসালােনিকার সাম্রাজ্যে (পনেরাে শতক পূর্বে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্যাসান্ডারের নগরসহ)। পেলােপনেসাস পরিণত হলাে প্রক্রিয়ার প্রধান কেন্দ্রে, আর অ্যাটিকা, বিওটিয়া আর ফোসিস পরিণত হলাে এথেন্সের ডিউকশাসিত এলাকায়। কিন্তু, গ্রিকরা পুরােপুরি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণে ছিল না। রাজকীয় পরিবারের একজন সদস্য উত্তর-পশ্চিম গ্রিসের নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তার নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে ডাকা হত এপিরাসের ডেসপােটেট নামে (এভাবে পিসের নিঃশ্বাস ফিরিয়ে আনা হয়েছিল)। বৈবাহিক সূত্রে রাজকীয় পরিবারের একজন আত্মীয় ক্রুসেডের সময়ে পশ্চিম এশিয়া মাইনরে তুর্কীদের থেকে পুনর্দখলকৃত ভূখণ্ডে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। এর রাজধানী ছিল নিসিয়ায় আর একে নিসিয়ার সাম্রাজ্য বলা হত। এর অঞ্চল ছিল। যেন প্রাচীন বিথিনিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করার মতােই একটি ব্যাপার। চূড়ান্তভাবে, কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ছিল গ্রিক ভূখণ্ডের পাতলা ফালি যেটির অন্তর্ভুক্ত ছিল সিনােপি আর ট্রাপেজাস নগরসহ কিছু গ্রিক নগর যেগুলাে কৃষ্ণসাগরের উত্তরে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপে টিকে ছিল। ট্রাপেজাস নগর তখন ট্রেবিজন্ড নামে পরিচিত হয়ে উঠল , তাই রাজ্যটি ছিল ট্রেবিজন্ডের সাম্রাজ্য। ল্যাটিন সাম্রাজ্যের কখনােই সেই শক্তি ছিল না এবং এটি এপিরাসের অপেক্ষাকৃত যােগ্য শাসকদের হাতে পড়ার কারণে বিপদের মধ্যেই ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১২২২ অব্দে, এপিরাসের স্বৈরশাসক থেসালােনিকা সাম্রাজ্য জয় করে নিলেন। কিন্তু, কনস্ট্যান্টিনােপল পড়ল নিসিয়ার অধীনে, এপিরাসের হাতে। মাইকেল পেলিওগাস ১২৫৯ অব্দে হলেন নিসিয়ার সম্রাট। তিনি বুলগেরিয়ান আর জেনােয়ানদের সাথে জোট বাঁধলেন এবং সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করলেন যখন ভেনেসিয়ান রণতরী (যেগুলাে ল্যাটিন কনস্টান্টিনােপলের পাহারায় ছিল) অনুপস্থিত থাকে। তারপর, এক আচমকা আঘাতে ১২৬১ অব্দে তিনি কনস্টান্টিনােপল দখল করে নেন। তিনি পরিণত হলেন অষ্টম মাইকেলে এবং বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য আবার গ্রিকদের দ্বারা শাসিত হতে লাগল। এর ইতিহাসের অবশিষ্ট দুই শতাব্দীতে, সকল বাইজেন্টিয়াম সম্রাটই ছিল মাইকেলের উত্তরসূরী। কিন্তু, বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের সামনে দুর্দিনই ঘনিয়ে আসছিল। এপিরাস আর ট্রেবিজন্ড ছিল স্বাধীন শাসনের অধীনে, আর ভেনিস ধরে রেখেছিল ক্রিট, ঈজিয়ান দ্বীপগুলাে, এথেন্সের ডিউকশাসিত এলাকা আর পেলােপনেসাসের বেশিরভাগ। এথেন্স, বাস্তবে, আর কখনাে বাইজেন্টিয়াম হয়নি। ১৩০০ অব্দের কিছু পরে, পশ্চিম থেকে একদল আক্রমণাত্মক অভিযাত্রী গ্রিসে পৌঁছল। তাদেরধ্যে অনেকেই ছিল স্পেনের পূর্বদিকের ক্যাটালােনিয়া থেকে আসা, আর অই দলটি পরিচিত ক্যাটালান রাজকীয় দল হিসেবে। ১৩১১ অব্দে, তারা এথেন্সের ডিউকশাসিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সমর্থ হলাে, যেটির তখন একটি অথবা আরেকটি পশ্চিমা অংশের হাতে ছিল তুর্কিদের হাতে খ্রিস্টানদের চুড়ান্ত পরাজয়ের আগ পর্যন্ত।

অটোমানদের উত্থান এবং তাদের এশিয়া মাইনোর ও বলকান অঞ্চল দখল : ১২৯০ এর মধ্যে, তুর্কীদের একটি নতুন দল গুরত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিল। তাদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন ওসমান, অথবা আরবিতে ওথমান। তার অনুসারীদের তাই বলা হত ওসমানালি তুর্কী অথবা অটোমান তুর্কী। ১৩৩৮ অব্দের মধ্যে, যে অঞ্চলটি ছিল নিসিয়ার সাম্রাজ্য, অটোমান তুর্কীরা তা মুছে দিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ এশিয়া মাইনর দখলে নিয়ে নিল। ১৩৪৫ অব্দে, বাইজেন্টিয়াম সম্রাট ষষ্ঠ জন অটোমান তুর্কীদের ইউরােপে ডেকে নিলেন, যিনি এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। এটি একটি বিরাট ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ১৩৫৪ অব্দের ভেতর, তুর্কীরা স্থায়ীভাবে ইউরােপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল (এবং আজ পর্যন্ত তারা মহাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে)। তুর্কীরা দ্রুত বলকান উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। সেই সময়ে, উপদ্বীপের প্রতিপত্তিসম্পন্ন মানুষ ছিল স্লাভ-ভাষী সার্বরা। তারা স্টেফেন ডুশানের অধীনে গ্রিসের উত্তরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করেছিল, যিনি ১৩৩১ অব্দে তার রাজত্ব শুরু করেছিলেন। তিনি এপিরাস, মেসিডােনিয়া আর থেসালী জয় করেছিলেন এবং এমনকি কনস্টান্টিনােপল আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি সম্ভবত তুর্কীদের থামাতে পারতেন, কিন্তু ১৩৫৫ অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন এবং তার রাজ্য কাঁপতে আরম্ভ করল। ১৩৮৯ অব্দে কসোেভােতে সার্ব আর তুর্কীরা পরস্পরের মুখােমুখি হলাে, যেটি এখন অবস্থিত সাবেক দক্ষিণ যুগােস্লাভিয়ায়। তুর্কীরা বিপুল বিজয় অর্জন করল আর পুরাে বলকান উপদ্বীপ তার পদপ্রান্তে হাজির হলাে। 

তৈমুর লং এর হাতে অটোমানদের পরাজয় : বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা তুর্কীদের অধিগ্রস্ত হতে পারত, কিন্তু তা হলাে না পূর্বে অপ্রত্যাশিতভাবে এক শক্তিশালী শত্রুর উদ্ভবের কারণে। তাইমুর নামে এক যাযাবর নেতা ১৩৬০ অব্দে ক্ষমতায় এলেন এবং এক দিগ্বিজয়ের অভিযাত্রা শুরু করলেন। তাকে বলা হত “তাইমুর লেন” (খোড়া তাইমুর) এবং ইংরেজিতে এটি পরিণত হয়েছিল ট্যামারলেনে। যেন বজ্রবিদ্যুতের আঘাতে, তিনি মধ্য এশিয়ার সবটুকু দখল করে নিলেন এবং প্রাচীন মারাকানাদা, সমরকন্দে তার রাজধানী বানালেন, যেখানে আলেকজান্ডার সতের শতাব্দী আগে ক্লিটাসকে হত্যা করেছিলেন। ট্যামারলেন রাশিয়ায় ঢুকে মস্কো পর্যন্ত, ভারত আক্রমণ করে দিল্লী দখল করে, সবদিকেই তার রাজত্বের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন। অবশেষে, তিনি যখন ইতােমধ্যেই ছিলেন সত্তর বছর বয়সী, তখন তিনি এশিয়া মাইনর আক্রমণ করলেন। তুর্কী সুলতান বায়েজিদ মধ্য এশিয়া মাইনরে আঙ্গোরার কাছাকাছি ট্যামারলেনের মুখােমুখি হলেন। (এর পূর্বেকার নাম আন্সিতে, এই নগর একসময় গ্যালাশিয়ার রাজধানী ছিল।) যুদ্ধে বায়েজিদ সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়েছিলেন এবং তাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হলাে। বিজয়ী ট্যামারলেন এশিয়া মাইনরে ধ্বংসলীলা চালালেনত্রবং সারদিসকে, যা ২০০০ বছর আগে লিডিয়ার রাজধানী ছিল, তাকে চুড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু, যখন ট্যামারলেন মারা গেলেন, তার বিশাল রাজত্ব তৎক্ষণাৎ ভেঙে পড়ল। ট্যামারলেনের আক্রমণ অটোমান সাম্রাজ্যকে এমনভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছিল যে কন্সস্ট্যান্টিপােলকে তা আরও অর্ধ-শত বছর টিকে থাকার সুযােগ করে দিল। কিন্তু সেই অর্ধ-শতাব্দীতে অটোমান তুর্কিরা তাদের শক্তি পূর্ণরূপে ফিরে পেল। 

অটোমানদের কনস্ট্যান্টিনোপল ও গ্রিকদের অন্যান্য অঞ্চল দখল : ১৪৫১ অব্দে, মুহাম্মদ দ্বিতীয় অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান হলেন এবং তিনি কনস্ট্যান্টিনােপলের সাথে ব্যাপারটি চিরতরে চূড়ান্ত করতে চাইলেন। ১৯৫৩ অব্দের ২৯ মেতে, পাঁচ মাসের অবরােধের পর, তুর্কীরা কনস্ট্যান্টিনােপলের দখল নিয়ে নিল এবং একাদশ কনস্ট্যান্টাইন পনেরাে শতক আগে অগাস্টাসের মাধ্যমে রােমান সম্রাটদের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল তার সর্বশেষেরজন, সক্রিয় থেকে বীরের মতাে যুদ্ধ করে মারা পড়লেন। কনস্ট্যান্টিনােপল স্থায়ীভাবে টার্কিশে পরিণত হলাে এবং এর নাম আবারও পরিবর্তিত হলাে। কনস্ট্যান্টিনােপলে ভ্রমণ করা গ্রিকরা বলত যে তারা “এইস টেন পােলিন”-এ বা “নগরে যাচ্ছে”। তুর্কীরা এই বাক্যাংশটি নিয়ে নিল, একে পরিণত করল ইস্তানবুলে, এবং একে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী বানাল। ১৪৫৬ অব্দে, মুহাম্মদ দ্বিতীয় পশ্চিমা শাসকদের থেকে এথেন্সের ডিউক শাসিত অঞ্চল নিয়ে নিলেন এবং ১৪৬০ অব্দে নিলেন পেলােপনেসাস। ১৯৬১ অব্দে, তিনি ট্রেজিবন্ড সাম্রাজ্যও দখলে নিলেন। সেই নগর, যেখানে জেনােফোনের সেনাদল সাগরের কাছে পৌঁছেছিলেন প্রায় ১৯শ শতক পূর্বে, তা গ্রিক রাজত্বের শেষ টুকরােতে পরিণত হলাে।

অটোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও গ্রিসের ক্ষমতা বৃদ্ধি

অটোমানদের আলবেনিয়া, ক্রিট ও সাইপ্রাস দখল : বলকানে তুর্কীদের বিরুদ্ধে অগ্রিক প্রতিরােধ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকল। খ্রিস্টান ক্ষমতার একটি অংশ ছিল এপিরাসে, যার উত্তরের অংশ পরিচিত হয়ে উঠল আলবেনিয়া নামে, একটি ল্যাটিন শব্দ থেকে যার অর্থ হলাে “সাদা,” সেই এলাকার তুষার-আবৃত পাহাড়ের চূড়া থেকে যার নামকরণ হয়েছিল। আলবেনিয়া ছিল জর্জ ক্যাস্ট্রিওটার নিয়ন্ত্রণাধীন। ক্যাস্ট্রিওটা ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মায়ের দিকের উত্তরসূরীদের জন্মভূমিতে এবং তিনি নিজেকে টার্কিশ নাম “ইস্কান্দার বে” (প্রভু আলেকজান্ডার)-তে পরিচয় দিতেন। এটি বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছিল স্ক্যান্ডারবার্গে। যখন তিনি বেঁচেছিলেন, তখন তিনি তুর্কীদের উপসাগরের কাছে থামিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ১৪৬৭ অব্দে তার মৃত্যুর পর আলবেনিয়াকে জয় করে এটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। এর ফলে শুধু গ্রিক দ্বীপগুলােই থাকল খ্রিস্টানদের হাতে, কিন্তু তারা ছিলেন পশ্চিমা খ্রিস্টান। ১৫৬৬ অব্দের ভেতর ভেনেসিয়ানদের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্রিট আর সাইপ্রাস দ্বীপ নিয়ে সংকট দেখা দিল, কারণ সেখানকার জনগণ (এবং গ্রিসের অন্যখানে) পশ্চিমাদের চেয়ে তুর্কীদের বেশি পছন্দ করত। এতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তুর্কীরা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সহ্য করে নিয়েছিল, যেখানে পশ্চিমা ক্যাথলিকরা তাদের অর্থডক্স প্রজাদের ক্যাথলিকবাদে রূপান্তরের জন্য চেষ্টা করেছিল। পশ্চিমারা তুর্কীদের চেয়ে বেশি কঠিন কর আরােপ করেছিল। তাই, সাইপ্রাসের গ্রিকরা স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত হয়েছিল, যখন ১৫৭১ অব্দে ভেনেসিয়ানদের সাইপ্রাস হতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তুর্কীরা তার দখল নিয়েছিল।

ভেনিশীয়দের কাছে গ্রিসে অটোমানদের দুবার পরাজয় ও শান্তিচুক্তি স্থাপনে বাধ্য হওয়া : সেই বছরে একটি পরাজয়ের মাধ্যমে টার্কিশ বিজয়ে সমতা আসল। লেপান্তো উপসাগরে (অথবা কোরিন্থ, এর গ্রিক নাম ব্যবহার করলে) একটি অটোমান রণতরী আর একটি খ্রিস্টান (প্রধানত স্প্যানিশ) রণতরীর মাঝে ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল দাঁড়-টানা জাহাজগুলাের মধ্যে লড়া শেষ যুদ্ধ, আর এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক খ্রিস্টান বিজয়। অটোমান তুর্কীরা লেপান্তোর যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠেছিল এবং সামনের দিকে এক উল্লেখযােগ্য সময় ধরে শক্তিশালী ছিল, কিন্তু যুদ্ধটি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল যে তুর্কিরা তাদের শীর্ষবিন্দু পার হয়ে এসেছে এবং পশ্চিম ইউরােপের উত্থিত শক্তির হাতেই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। লেপান্তোর এক শতাব্দী পর, তুর্কীরা জয়লাভের একটি শেষ প্রচেষ্টা নিল। সাগরে তারা ১৬৬৯ অব্দে ভেনেসিয়ানদের কাছ থেকে ক্রিট নিয়ে নিল। ভূমিতে তারা উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হলাে এবং ১৬৮৩ অব্দে ভিয়েনার প্রান্তে পৌঁছে গেল, যাতে করে মনে হলাে অস্ট্রিয়া পতনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ভেনেসিয়ান আর অস্ট্রিয়ান উভয়ই সফলভাবে পাল্টা আক্রমণ চালাল। ভেনেসিয়ানরা পেলােপনেসাসে আক্রমণ চালাল এবং একটি ভেনেসিয়ান রণতরী এথেন্সে অবস্থান নিল। এটি ছিল একটি বিরাট ট্রাজেডির সময়। এথেন্সকে রক্ষা করার জন্য তুর্কীরা সব জায়গায় গান পাউডার রেখে দিয়েছিল, এমনকি পার্থেননেও, যা তখনাে পর্যন্ত, ২০০০ বছর পঁড়িয়ে থাকার পরও, ছিল অক্ষত। ১৬৮৭ অব্দে একটি ভেনেসিয়ান কামানের গােলা অট্টালিকাটিতে আঘাত হানল এবং সর্বকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অট্টালিকাকে ধ্বংস করে দিল। কেবলমাত্র ছাদবিহীন পিলার গ্রিসের হারিয়ে যাওয়া গৌরবের দুঃখময় স্মৃতি হিসেবে আমাদের কাছে অবশিষ্ট রয়েছে। যখন ১৬৬৯ অব্দে তুর্কীরা একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হলাে (খ্রিস্টান শক্তির সাথে প্রথমবারের মতাে রাজি হওয়া শান্তিচুক্তি), তখন ভেনেসিয়ানরা পেলােপনেসাস ছেড়ে দিল। এটি ছিল সাময়িকভাবে, কেননা পেলােপনেসিয়ান গ্রিকরা শীঘ্রই শিক্ষাগ্রহণ করল যে ভেনেসিয়ানদের হাত তুর্কীদের থেকে অধিক ভারী। তারা তাই ১৭১৮ অব্দে তুর্কীদের সেই এলাকায় পুনর্দখলকে স্বাগত জানাল।

ফানারিওত গ্রিকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাধীন হবার স্বপ্ন : তুরস্কের অধীনে গ্রিকরা সংখ্যায় আর শক্তিতে পুনরুজ্জীবিত হলাে। টার্কিশ সহিষ্ণুতা আর অদক্ষতার অধীনে তারা তাদের ভাষা আর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছিল। কেউ কেউ এমনকি সম্পদশালী আর ক্ষমতাবানও হয়েছি এটি পুরনো বাইজেন্টাইন সুশীলদের জন্য, বিশেষত সত্য ছিল যারা ফার নামে ইস্তানবুলের একটি জেলায় বসবাস করত। ১৬৬৯ অব্দের পরে, যখন তুর্কীরা দেখল যে তাদের পশ্চিমা জাতিসমূহের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে যেতে হবে এবং অধিক শক্তিশালী সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করা যাবে না, তখন তারা এইসকল ফানারিওত গ্রিকদের কাছে গেল। সেই সময় থেকে, ফানারিওতরা টার্কিশ বিদেশি কাজগুলাে পরিচালনা করত এবং অনেকবারই তারা ছিল সিংহাসনের পেছনের প্রকৃত শক্তি। কিন্তু, পুরাে ১৭০০ সাল জুড়ে, অটোমান সাম্রাজ্য ক্ষয়ে যেতে লাগল এবং বর্ধিষ্ণু অদক্ষতা আর দুর্নীতির শিকার হলাে। ধীরে ধীরে গ্রিকদের তুর্কীদের কাছ থেকে স্বাধীন হবার স্বপ্ন বেড়ে যেতে লাগল, পশ্চিমাদের অধীনে আসার মূল্যের বিনিময়ে নয়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হবার স্বপ্ন। তারা গ্রিসের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড চেয়েছিল, যা গ্রিকদের দ্বারা শাসিত হবে।

গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জন : এই স্বপ্ন শক্তিশালী হতে লাগল, যখন রাশিয়া, এই সময়কালে, তুর্কীদের সাথে ধারাবাহিক যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল এবং কৃষ্ণসাগরের উত্তরে সমস্ত টার্কিশ এলাকা জয় করে নিয়েছিল। এটি টার্কিশ দুর্বলতাকে চিহ্নিত করল এবং গ্রিকদের জন্য নতুন করে বিদেশি সাহায্যের সম্ভাবনাকেও জাগ্রত করল। যেহেতু রাশিয়ানরা ধর্মীয় দিক থেকে ছিল অর্থোডক্স, গ্রিকরা তাদেরকে অনেক বেশি গ্রহণযােগ্য মনে করেছিল, যতটুকু ভেনেসিয়ানরা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি। রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া উৎসাহ নিয়ে, গ্রিক জোট ১৮২১ অব্দে তুর্কীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে জেগে উঠল। রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের মাধ্যমে তারা পেলােপনেসাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল, তারপর নিল কোরিন্থ উপসাগরের উত্তরের এলাকার। গ্রিক বিজয়ের কারণে অনেক পশ্চিমা আলােড়িত বােধ করল, কেননা তাদের কাছে এখনাে গ্রিকরা থেমিস্টোক্লিস আর লিওনিডাসের সময়েরই লােকজন। উদাহরণস্বরূপ, মহান ইংরেজ কৰি জর্জ গর্ডন লর্ড বায়রন ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন অত্যুৎসাহী প্রেমিক এবং তারা গ্রিসে গিয়েছিলেন এর বিপ্লবী বাহিনীতে যােগ দিতে। তিনি সেখানে ১৮২৪ অব্দে ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি ঈটোলিয়ার একটি নগর মিসােলােঙ্গিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু তুর্কীরা অগ্রসর হলাে এবং বিশেষ করে, তাদের সহ-ধার্মিক মিশরীয়দের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাল, যেটি তখন মেহমেত আলির শক্ত শাসনে ছিল। তুর্কী আর মিশরীয়রা ১৮২৭ অব্দের ৫ জুন আবারও এথেন্সের দখল নিয়ে নিল এবং পেলােপনেসাসে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে লাগল। মনে হলাে বিপ্লব প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সময়ে, তা সত্ত্বেও, গ্রিকদের জন্য পশ্চিমা সহানুভূতি বেড়েই যাচ্ছিল। গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স রাশিয়ার সাথে জোট বাঁধল এবং তারা তিনশক্তি তুরস্ককে বিরুদ্ধপরায়ণতা ছাড়তে আদেশ করল। তুরস্ক তা প্রত্যাখ্যান করল। ব্রিটিশ-ফরাসী রাশিয়ান সম্মিলিত রণতরী ১৮২৭ অব্দের ২০ অক্টোবর নাভারিনােতে তুর্কী-মিশরীয় রণতরীকে ব্যতিব্যস্ত রাখল এবং সহজেই এটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিল (নাভারিনাে হলাে পাইলোসের ইতালিয়ান নাম, যেখানে ফ্যাকটেরিয়াকে নিয়ে ধাইশ শতাব্দী আগে বিরাট এক যুদ্ধ লড়া হয়েছিল।) যুদ্ধ তৎক্ষণাৎ সমাপ্ত হলাে না, কিন্তু তুরস্ক নিজেদের অনিবার্যতার মুখােমুখি আবিষ্কার করল। ১৮২৯ অব্দে, তাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক শান্তিতে উপনীত হতে হলাে, যা গ্রিককে স্বায়ত্তশাসন দিল। প্রথমে এটি হবার কথা ছিল অনির্দিষ্ট তুর্কী প্রভুত্বের অধীনে, কিন্তু ১৮৩২ অব্দে গ্রিসের চুক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃতি পেল। সেই সময়, গ্রিসে অধিভুক্ত ছিল শুধু থার্মোপাইলের দক্ষিণের এলাকা, তার সাথে ইউবিয়া দ্বীপ। এথেন্স, নিশ্চিতভাবেই, গ্রিসের রাজধানী হলাে; মুক্ত রাজ্যের মুক্ত রাজধানী, একুশ শতক আগে ডেমোস্থিনিসের দিনগুলাের পর প্রথমবারের মতাে। 

আধুনিক গ্রিসের উদ্ভব ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে গ্রিসের সম্প্রসারণ

গ্রিস ও তুর্কি নিয়ে রাশিয়া বনাম ব্রিটেনের যুদ্ধ এবং গ্রিসের সম্প্রসারণ : নতুন রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮,০০,০০০, যার মধ্যে ছিল দুনিয়ার সেই প্রান্তের গ্রিকভাষী জনগণের এক-পঞ্চমাংশ। ব্রিটিশ অধিকৃত আয়োনিয়ান দ্বীপগুলােতে ছিল ২,০০,০০০ গ্রিক আর পুরােপুরি ৩০,০০,০০০ তখনাে ছিল তুর্কী নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। এক শতাব্দী ধরে, গ্রিক কৌশলের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল এই অন্য গ্রিকদের এবং তাদের দখলকৃত ভূখণ্ডগুলােকে তাদের রাজ্যে নিয়ে আসা। এই লক্ষ্যে গ্রিক প্রচেষ্টা ছিল রাশিয়া কর্তৃক সমর্থিত যারা অটোমান সাম্রাজ্যকে নিজ প্রয়ােজনে দুর্বল করতে চেয়েছিল (রাশিয়া ইস্তানবুল দখল করার স্বপ্ন দেখেছিল।) গ্রিসের বিরুদ্ধে ছিল গ্রেট ব্রিটেন, যারা চেয়েছিল একটি শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য যেটি এশিয়ায় রাশিয়ার উচ্চাশার ওপর একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে। ১৮৫৪ অব্দে, গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধে যােগদান করল। যেহেতু গ্রিক সহানুভূতি ছিল রাশিয়ার পার্শ্বে, একটি ব্রিটিশ রণতরী পাইরিয়াস অবরুদ্ধ করল গ্রিকদের টার্কিশ এলাকা দখলের সুযােগ নেওয়া থেকে দূরে রাখতে। পরবর্তীকালে ১৮৬২ অব্দে, গ্রেট ব্রিটেন এর জন্য প্রস্তুতি নিল আয়োনিয়ান দ্বীপগুলাে গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিয়ে, যেগুলাে সে নেপােলিয়ান সময় থেকে ধরে রেখেছিল। কিন্তু, গ্রিসের পরবর্তী সুযােগ এলো ১৮৭৫ অব্দে যখন রাশিয়া আবারও তুর্কীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। তিন বছরের কঠিন সংগ্রামের পর, রাশিয়ানরা জয়লাভ করল। যদিও তারা ইস্তানবুল দখল করতে পারেনি যেমনটি তারা করতে পারবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে, ব্রিটিশরা এগিয়ে এলো রাশিয়া কতৃক অটোমান সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার হাত থেকে বাচাতে। গ্রেট ব্রিটেনকে তুর্কীদের প্রতি তার দয়া প্রদর্শনের কারণে পুরস্কৃত করা হলাে তাদের থেকে সাইপ্রাসের দখল তাদের হাতে তুলে দিয়ে। গ্রিস যা করতে পারত (তুরস্কের পরাজয়ের পর জেগে ওঠা বিশ্বা-আশা থেকে) তা হলাে ১৮৮১ অব্দে থেসালী আর এপিরাসের অংশবিশেষ লাভ করতে। এদিকে, ক্রিটের গ্রিকভাষী দ্বীপগুলাে তাদের টার্কিশ প্রভুদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বিদ্রোহ করছিল। ১৮৯৭ অব্দে, গ্রিক সরকার ক্রীটান বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল এবং তুর্কীদের কাছে বাজেভাবে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু, পশ্চিমা হস্তক্ষেপ অটোমান-সাম্রাজ্যকে বাধ্য করল ক্রিটকে স্বায়ত্তশাসন দিতে এবং ১৯০৮ অব্দে, ক্রিট গ্রিস রাজ্যের অংশে পরিণত হলাে।

বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে বলকানে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রতিষ্ঠা ও অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপ হারানো : ক্রিট লাভ একটি অপ্রত্যাশিত বােনাস ছিল, কেননা ক্রিট থেকে ইলিউথেরিওস ভেনিজেলােস এসেছিলেন যিনি এখনাে পর্যন্ত সবচেয়ে যােগ্য প্রশাসক যাকে গ্রিস দেখেছে। ১৯০৯ অব্দে তিনি এথেন্সের ক্ষমতায় এলেন এবং দ্রুত বলকান উপদ্বীপ নিয়ে তার চিন্তা ব্যক্ত করলেন। ১৮০০’র দিকে, তুরস্কের পরাজয় উত্তর বলকানে ধীরে ধীরে ধারাবাহিকভাবে কিছু রাজ্যের সৃষ্টির কারণ হলাে। এরা ছিল মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া আর রুমানিয়া। তারা গ্রিস থেকে তখনাে টার্কিশ কিছু এলাকা দিয়ে আলাদা ছিল এবং তার মধ্যে ছিল আলবেনিয়া, মেসিডােনিয়া আর সেসব বলকান রাজ্যের নকশা। এই টার্কিশ এলাকাতেই তৈরি হয়েছিল এবং তারা একে অন্যকে ঘৃণা করত, এমনকি তারা তুর্কীদের যতটুকু ঘৃণা করত তার থেকেও বেশি। রাশিয়ার দেয়া সাহস সাথে নিয়ে ভেনিজেলােস একসাথে সব বলকান শক্তিকে কার্যকর করতে সমর্থ হলেন। তারা একটি জোট গঠন করল, এবং ১৯১২ অব্দে, অটোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করল। তুর্কীরা দ্রুত পরাজয় বরণ করল আর যেই সেটি আমলে নেয়া হলাে, বলকান রাজ্যগুলাে মুক্ত হয়ে তাদের একে অপরকে আবার ঘৃণা করতে শুরু করল। দ্বিতীয় একটি যুদ্ধে, বুলগেরিয়া নিজেকে বলকান শক্তিগুলাের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হিসেবে আবিষ্কার করল এবং, ১৯১৩ অব্দে তারা পরাজিত হলাে। এই দুটো বলকান যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে, অটোমান সাম্রাজ্য প্রকৃতপক্ষে ইউরােপ থেকে বাইরে চলে গেল, তার অনুপ্রবেশের ছয় শতাব্দী পরে অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরােপিয়ান এলাকা নিউ হ্যাম্পশায়ারের মতাে ক্ষুদ্র এলাকার আকারে কমে আসল, যা ছিল ইস্তানবুল আর এদিরনে নগরকে কেন্দ্র করে (এদিরনে হলাে আদ্রিয়ানাপােলের টার্কিশ নাম, যে নগরটির নামকরণ করা হয়েছিল রােমান সম্রাট আদ্রিয়ানের নামে, যিনি আঠারাে শতক পূর্বে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।) এই এলাকা আজকের দিন পর্যন্তও তুর্কী অধিভুক্ত। গ্রিস এপিরাস আর মেসিডােনিয়ার অংশসহ কালসিডিসিকে পেল, তার পাশাপাশি বেশিরভাগ ঈজিয়ান দ্বীপকে। তার এলাকা আর জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। অন্যান্য বলকান জাতিও নতুন অঞ্চল পেল এবং স্বাধীন আলবেনিয়া অস্তিত্ব লাভ করল। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রিসের লাভ ও সম্প্রসারণ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ১৯১৪ অব্দের আগস্টে ইউরােপে আঘাত হানল। এই যুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া (মিত্রশক্তি) ছিল একপার্শ্বে, জার্মানী এবং অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরী (অক্ষশক্তি) ছিল আরেক পার্শ্বে। অটোমান সাম্রাজ্য ১৯১৪ অব্দের নভেম্বর মাসে অক্ষশক্তিতে যােগদান করল এবং গ্রিসের উত্তরের প্রতিবেশী বুলগেরিয়া ১৯১৫ অব্দের অক্টোবরে তাদের সাথে যােগদান করল। গ্রিস বরাবরই রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং বুলর্গেরিয়া ছিল তাদের ঐতিহাসিক শত্রু, আর তাই গ্রিসের মিত্রশক্তিতে যােগদানের কয়েকটি যৌক্তিক কারণ ছিল, বিশেষ করে যেহেতু ভেনিজেলােস শক্তভাবে মিত্রশক্তির উদ্দেশ্যের পক্ষে ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি অবশেষে ১৯১৭ অব্দে তাই করলেন, তার জার্মান-পক্ষের রাজা প্রথম কনস্ট্যান্টিনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, যাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এটি ঘটার কারণে তা গ্রিসের জন্য ছিল দারুণ সৌভাগ্যের ছোঁয়া প্রাপ্তির ব্যাপার, কেননা মিত্রশক্তি ১৯১৮ অব্দে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল, এবং গ্রিস নিজেকে জয়ী পক্ষে আবিস্কার করল। এর ফলে, সে বুলগেরিয়ার কাছ থেকে ঈজিয়ান সাগরের উত্তর উপকূল (পশ্চিম থ্রেস) লাভ করল। (গ্রিসের উত্তরে সার্বিয়া আর মন্টিনিগ্রো একত্র হলাে, আর যােগ করা অঞ্চল নিয়ে পরিণত হলাে যুগােস্লাভিয়ায়)। থ্রেসের ক্ষেত্রে তা কিছুই হলাে না। তুরস্কের ঈজিয়ান উপকূলে ছিল ইজমির নগর। এটি ছিল স্মিরনার টার্কিশ নাম, যে নগরটি পঁচিশ শতাব্দী আগে আলিয়াটিস কতৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু এন্টিগােনাস মনােফথালমাস কর্তৃক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নগরের অর্ধেক জনসংখ্যা ছিল গ্রিক, এবং এই কারণে গ্রিকরা একে যুদ্ধলব্ধ অংশ হিসেবে দাবি করেছিল। গ্রিক যুক্তিতর্কের কাছে মিত্রশক্তি ধরাশায়ী হয়ে গেল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে শান্তিচুক্তিতে ইজমির ও তার আশেপাশের অঞ্চল গ্রিসকে উপহার দেয়া হলাে। পরিণতিতে, একদল গ্রিক সেনা ১৯১৯ অব্দে এশিয়া মাইনরে আগমণ করল তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে। 

অযোগ্য রাজা কনস্ট্যান্টিনের ক্ষমতায় আরোহন, অভিযান ও কামাল আতাতুর্কের কাছে পরাজয় ও ক্ষমতা হারানো, অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানের মাধ্যমে আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্কের জন্মলাভ ও জনসংখ্যা বিনিময় : কিন্তু ১৯২০ অব্দে, গ্রিকরা বােকার মতাে ভেনিজেলােসকে ক্ষমতাচ্যুত করল এবং তাদের অযােগ্য রাজা কনস্ট্যান্টিনকে ডেকে আনল। কনস্ট্যান্টিন বিরাট অভিযাত্রার স্বপ্ন দেখতেন এবং নিজেকে নতুন আলেকজান্ডার, আর তা না হলেও কমপক্ষে আরেকজন এজেসিলেয়াস হিসেবে দেখতেন। গ্রিকরা কেন ঈজিয়ান সাগরের পূর্ব উপকূল দখলে নিয়ে একে আরেকবার একটি গ্রিক লেকে পরিণত করবে না যেমনটি এটি একসময় ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সাল পর্যন্ত ২০০০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১৯২১ অব্দে, কনস্ট্যান্টিন গ্রিক সেনাদলকে পূর্বাভিমুখে অগ্রসর হবার এবং তুর্কীদের গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। কিন্তু, তুরস্ক নিজেকে পুনঃসংগঠিত করছিল। ক্রমাগত অদক্ষ সম্রাটের অধীনে দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধাগত ধারাবাহিক ক্ষতির পর ব্যাপারটিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করল। একজন শক্তিমান সেনাপতি মুস্তফা কামাল সেনাদলকে পুনঃসংগঠিত করলেন। আঙ্গোরায় (যেখানে পাঁচ শতক পূর্বে ট্যামারলেন তুর্কীদের গুড়িয়ে দিয়েছিল) কামালের সেনাদল ১৯২১ অব্দের আগস্টে গ্রিকদের মুখােমুখি হলাে, এবং তাদেরকে ঠাণ্ডা করে দিল। ১৯২২ অব্দে, তুর্কীরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। শত্রুভাবাপন্ন এলাকার গভীরে থাকা গ্রিক সেনাদল ভেঙে পড়ল এবং উন্মত্ত হয়ে পিছিয়ে এলো। ১৯২২ অব্দের ৯ সেপ্টেম্বর তুর্কীরা ইজমির দখলে নিল, যেটি এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। উভয় জাতি তখন পুরাে ব্যাপারটি নিস্পত্তি করার চেষ্টায় লিপ্ত হলাে। গ্রিসে, কনস্ট্যান্টিনকে দায়িত্ব পরিত্যাগ করে নিরুদ্দেশে যেতে বাধ্য করা হলাে, এবং ভেনিজেলােসকে ফিরিয়ে আনা হলাে। তুরস্কে, সুলতানকে দায়িত্ব পরিত্যাগ করে নিরুদ্দেশে যেতে বাধ্য করা হলাে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ছয় শতাব্দী ধরে ক্ষমতায় থাকার পর এর পরিসমাপ্তি ঘটল। এর জায়গায় মুস্তফা কামালের অধীনে গণতান্ত্রিক তুরস্ক গঠন করা হলাে। গ্রিস আর তুরস্ক তখন একটি চুড়ান্ত চুক্তিতে এলো যার মাধ্যমে ঈজিয়ান সাগরের পুরাে পূর্ব উপকূল থেকে গেল তুরস্কের। তার সাথে, জনসংখ্যা বিনিময়ের বাধ্যতামূলক আয়ােজন করা হলাে যাতে করে তুরস্কে বসবাসকারী গ্রিকরা গ্রিসে ফিরে যেতে পারে, এবং গ্রিসে বসবাসকারী তুর্কীরা তুরস্কে ফিরত পারে। এর অর্থ ছিল, প্রায় ৩০০০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতাে পূর্ব ঈজিয়ান উপকূলে কোনাে গ্রিকভাষী জনগণ থাকল না, কিন্তু এটি গ্রিক আর তুর্কীদের মধ্যে ১০০০ বছরের যুদ্ধবাজী শেষে সম্ভাব্য শান্তিকেও বােঝাল। আর তাই করা হয়েছিল। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গ্রিসের অবস্থা ও স্বাধীন রাষ্ট্র সাইপ্রাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে গ্রিক অঞ্চলগুলোতে মুসোলিনির নিয়ন্ত্রণ স্থাপন : এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও ছিল এমন কিছু গ্রিকভাষী ভূখণ্ড যারা গ্রিক নয়। গ্রেট ব্রিটেন তখনাে সাইপ্রাস অধিকার করে রেখেছিল, যা সে ১৮৭৮ অব্দে পেয়েছিল। তার সাথে, ১৯১১ অব্দে ইতালী তুরস্কের সাথে কিছু সফল যুদ্ধ লড়েছিল এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে রােডস দ্বীপসহ প্রতিবেশী কিছু ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিকারী হয়েছিল। সব মিলিয়ে সেখানে এক ডজনের মতাে দ্বীপ ছিল এবং এগুলােকে তাই ডােডিকানিস নামে ডাকা হত, যার অর্থ ছিল “বারােটি দ্বীপ”। ডােডিকানিস গ্রিসের সাথে ইউনিয়নে যুক্ত হবার জন্য ভােট দিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, কিন্তু ১৯২২ অব্দে, ইতালি ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতাে মুসােলিনির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে গেল, যে অঞ্চল অধিগ্রহণের নীতির প্রতি নিবেদিত ছিল, সেগুলােকে হাতছাড়া করার নয়। প্রকৃতপক্ষে, মুসােলিনি পরিণত হলেন গ্রিসের প্রধান শত্রুতে। ১৯৩৬ অব্দে গ্রিসও ক্রমাগত সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া ইউরােপিয়ান জাতিসমূহের সাথে যুক্ত হলাে যারা স্বৈরশাসনের স্বপক্ষে গণতন্ত্রকে পরিত্যাগ করছিল। গ্রিক স্বৈরশাসক ছিলেন জন মেটাক্সাস। মুসােলিনির বিপদ সেই বছরগুলােতে ঘনিয়ে আসছিল, বিশেষ করে তিনি যখন এডলফ হিটলারের সাথে জোট বাঁধলেন – জার্মানির অনেক বেশি ক্ষমতাশালী এবং বিপদজনক স্বৈরশাসক, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের ধকল পুরােপুরি কাটিয়ে উঠেছিল। ১৯৩৯ অব্দের এপ্রিলে, মুসােলিনি কোনাে লড়াই ছাড়াই আলবেনিয়া আক্রমণ ও দখল করেছিলেন এবং গ্রিসের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ছয় মাস পর, সেপ্টেম্বরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলাে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি ও জার্মানদের বিরুদ্ধে গ্রিসের পরাজয় : যুদ্ধের প্রথম বছরে জার্মানি ফ্রান্সকে গুড়িয়ে দিয়ে ব্যাপক বিজয় অর্জন করল, এবং ১৯৪০ অব্দের জুনে, ইতালি মনে করল জার্মান পক্ষেই যোগদান করা নিরাপদ। মুসােলিনি হিটলারের মতাে কিছু অসাধারণ যুদ্ধ জয়লাভের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪০ অব্দের অক্টোবরে, বিনা উস্কানিতে, তিনি তার সেনাদলকে গ্রিস আক্রমণ করার আদেশ প্রদান করলেন। সে এবং পুরাে দুনিয়া বিস্মিত হয়ে দেখল (সম্ভবত শুধু গ্রিকরা নিজেরা ছাড়া) যেন প্রাচীন দিনগুলাে ফিরে এসেছে। সংখ্যায় ছড়িয়ে যাওয়া গ্রিকরা এপিরাসের পাহাড়ে অনমনীয়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকল এবং ইতালিয়ানদের ঠাণ্ডা করে দিল। পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে, তারা ইতালিয়ানদের আলবেনিয়া পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেল। ১৯৪১ অব্দের জানুয়ারিতে মেটাক্সাসের মৃত্যুর পর গ্রিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তখনাে তারা তাদের সুবিধাজনক অবস্থান ধরে রেখেছিল। কিন্তু, যেভাবেই হােক এই যুদ্ধ, যেটি গ্রিক আর পারস্যের পুরনাে স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তার পরিণতি একই ছিল না। ইতালিয়ান স্বৈরশাসকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী শত্রু ময়দানে ছিল। ১৯৪১ অব্দের মার্চে, জার্মান বাহিনী বুলগেরিয়া দখল করে নিয়েছিল; এপ্রিলে এটি যুগােস্লাভিয়ার সেনাদলকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং দক্ষিণদিকে গ্রিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ব্রিটিশরা (যারা ছিল সেই সময়ে সর্বজয়ী জার্মানদের বিরুদ্ধে ময়দানে বাকি থাকা একমাত্র জাতি) সাহায্য পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এটি যথেষ্ট ছিল না। ব্রিটিশ আর গ্রিক উভয়ই পরাস্ত হলাে এবং ১৯৪১ অব্দের ২৭ এপ্রিল অ্যাক্রোপোলিসের উপরে জার্মান পতাকা উড়েছিল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয় এবং গ্রিসের রোডস ও ডোডিকানিস লাভ : কিন্তু, যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৪১ অব্দের জুলাই মাসে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করার মতাে বিশাল ভুল করে ফেলল। (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ায় একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, একটি সমাজতান্ত্রিক ধরনের সরকার গ্রহণ করেছিল, এবং এখন নিজেদেরকে তারা পরিচয় দিত সােভিয়েত ইউনিয়ন নামে।) হিটলার আরেকটি সহজ বিজয় প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু সেটি পাননি। তখন ১৯৪১ অব্দের ডিসেম্বরে, জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করল এবং যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি আর তার সাথে সাথে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামল। সােভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই শত্রু হিসেবে পেয়ে জার্মানি আর জয়ের আশা করতে পারত না। প্রতিটি ফ্রন্টে জার্মান বাহিনী ধীরে ধীরে পরাজিত হয়ে পিছু হটছিল।  ১৯৪৩ অব্দের ২৬শে জুলাই মুসােলিনি পদত্যাগে বাধ্য হলেন এবং ছয় সপ্তাহের মধ্যে ইতালি যুদ্ধের বাইরে চলে গেল। ১৯৪৪ অব্দের ১৩ অক্টোবর মিত্রবাহিনী গ্রিসে প্রবেশ করল এবং অ্যাক্রোপোলিসের উপর আবারও গ্রিক পতাকা উড়ল। ১৯৪৫ অব্দে স্বৈরশাসকদের যবনিকাপাত ঘটল। মুসােলিনি ইতালিয়ান গেরিলা বাহিনীর হাতে ধৃত হলেন, এবং ১৯৪৫ অব্দের ২৮ এপ্রিল তাকে হত্যা করা হলাে। বার্লিনের পতনের সাথে সাথে মে এর ১ তারিখে হিটলার আত্মহত্যা করলেন। মে এর ৮ তারিখের মধ্যে ইউরােপের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।  যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে, রােডস আর ডােডিকানিস ইতালি কর্তৃক গ্রিসের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলাে। 

সোভিয়েত বনাম মার্কিন-ব্রিটিশ প্রভাব নিয়ে গ্রিসে গৃহযুদ্ধ এবং মার্কিন-পন্থীদের বিজয় : কিন্তু, যুদ্ধের সমাপ্তি গ্রিসে শান্তি নিয়ে আসেনি। পুর্বে সােভিয়েত সেনাদলের এবং পশ্চিম আর দক্ষিণে অ্যাংলাে-আমেরিকান সেনাদলের অভিযাত্রার কারণে ইউরােপ থেকে নাৎসী স্বৈরশাসন উঠে যাওয়ার সাথে সাথে একটি নতুন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটল। স্বাধীন জাতিগুলাে ব্রিটিশ-আমেরিকান স্টাইল নাকি সােভিয়েত স্টাইলে সরকার গঠন করবে? সােভিয়েত সেনাদল গ্রিসের উত্তরে বলকান উপদ্বীপ এবং আলবেনিয়া, যুগােস্লাভিয়া ও বুলগেরিয়া দখল করেছিল। গ্রিসের তিন উত্তরের প্রতিবেশী, সবারই সােভিয়েত স্টাইলের সরকার ছিল। গ্রিসের কি হয়েছিল? হিটলারের সমাপ্তির পর চার বছর পরও এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর ছিল না, কেননা গ্রিসে গৃহযুদ্ধের উত্থান ঘটেছিল। সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল গ্রিক গেরিলা বাহিনী ছিল উত্তরে শক্তিশালী , যেখানে তারা গ্রিসের উত্তরের প্রতিবেশীদের থেকে সাহায্য পেয়েছিল। এথেন্সের সরকার, এদিকে, ছিল ব্রিটিশ-স্বপক্ষের এবং গ্রেট ব্রিটেন থেকে সাহায্য পেয়েছিল। কিন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার করা ব্যয় পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী গ্রেট ব্রিটেন বুঝল যে সে অনির্দিষ্টকাল যাবত গ্রিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে যেতে পারবে না। অধিক ধনী আর সমৃদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। ১৯৪৭ অব্দের ১২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারী ট্রুম্যান তা করতে সমর্থ হলেন এবং এই “ট্রুম্যান ডকট্রিন”-এর মাধ্যমে গ্রিক গেরিলা অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়ল। তার সাথে, ১৯৪৮ অব্দে যুগােস্লাভিয়া সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল এবং গ্রিক গেরিলাদের আর সাহায্য করতে অস্বীকার করল। অবশেষে, ১৯৪৯ অব্দে গেরিলারা তাদের সংগ্রাম ছেড়ে দিল এবং পশ্চিমা অংশে অবস্থান নেয়া সরকার সহ গ্রিস ছিল শান্তিতে। 

স্বাধীন রাষ্ট্র সাইপ্রাসের উদ্ভব : এথেন্সের সরকার ১৯৫০ অব্দে প্রবেশ করল সব গ্রিকভাষী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ সহকারে, কেবল একটি ব্যতিক্রম বাদে। সেটি ছিল সাইপ্রাস যা সত্তর বছর পরেও ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু, সাইপ্রাস ছিল একটি বিশেষ ধরনের সমস্যা। এটি পুরােপুরি গ্রিক ছিল না, উদাহরণস্বরূপ, যেমনটি ছিল ক্রীট আর করফু। সাইপ্রাসে বসবাসকারী ৬,০০,০০০ লােকের মধ্যে প্রায় ১,০০,০০০ ছিল ভাষার এবং সহানুভূতির দিক দিয়ে তুর্কী। অধিকন্তু, সাইপ্রাস ছিল গ্রিস থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে, কেননা এটি গ্রিসের সবচেয়ে পূর্বের অবস্থান রােডসের থেকে ৩০০ মাইল পূর্বে ছিল। অন্যদিকে, এটি তুরস্কের দক্ষিণ উপকূল থেকে ছিল ১৫ মাইল দূরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সাইপ্রাসে গ্রিসের সাথে ইউনিয়নে যুক্ত হবার শক্তিশালী আন্দোলন চলছিল, এটি সেখানকার সংখ্যালঘু তুর্কী ও তুরস্ক উভয়েই এটির বিরােধিতা করে আসছিল। পরিবর্তে, তুর্কীরা প্রস্তাব দিল সাইপ্রাস ভাগ হয়ে গ্রিক অংশ গ্রিসের সাথে এবং টার্কিশ অংশ তুরস্কের সাথে যােগ দিক কিন্তু, গ্রিক সাইপ্রিয়টরা সামান্য সময়ের জন্যও বিভাজনের দাবিতে কর্ণপাত করেনি। ১৯৫৫ থেকে সব ধরনের দাঙ্গা আর বিশৃঙ্খলা দ্বীপটিকে বিতস্ত্রত করে দিল, আর ব্রিটিশরা কিছু সময়ের জন্য কোনাে সমাধান খুঁজে পেলেন না, যা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে। অবশেষে, সাইপ্রাসকে জাতি হিসেবে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত হলাে, যেখানে একজন গ্রিক প্রেসিডেন্ট এবং একজন তুর্কি ভাইস-প্রেসিডেন্ট থাকবে। গ্রিক সাইপ্রিওটরা সরকার চালাবে, কিন্তু তুর্কী সাইপ্রিয়টদের ভেটো ক্ষমতা থাকবে যাতে করে তারা শােষিত বােধ না করে। ১৯৬০ অব্দের ১৬ আগস্ট সাইপ্রাস একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলাে। দ্বীপের নেতৃস্থানীয় অর্থোডক্স গির্জাপতি আর্চবিশপ ম্যাকারিওস হলেন প্রেসিডেন্ট, এবং ফাজিল কুচাক হলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। সাইপ্রাস জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হলাে এবং সবকিছুকে ভালােই মনে হলাে। এটা সন্তোষের ব্যাপার হবে, যদি শান্তি আর সমঝােতার ভঙ্গিতে গ্রিসের ইতিহাসকে সমাপ্তিতে আনা যায়, কিন্তু তা হবার নয়। ১৯৬৩ অব্দে প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিওস সাইপ্রাসের সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, টার্কিশ সংখ্যালঘুদের ক্ষমতা কমাবার উদ্দেশ্যে, যেটিকে তিনি ভেটো ক্ষমতার মাধ্যমে সরকারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। 

তথ্যসূত্র

  • Isaac Asimov, The Greeks : A Great Adventure, Houghton Mifflin Company Boston
  • Robin Waterfield, Creators, Conquerors, and Citizens: A History of Ancient Greece, Oxford University Press, Act I : The Archaic Period (750-480)
  • History of Western Philosophy, Bertrand Russel, 1945, ch. The Rise of Greek Civilization
  • V Scramuzza, V.M. and Mackendrick, The Ancient World  (New Your: Holt, Rinehart and Winston, 1958). 
  • McKay, John P. Hill, Bennett D. Buckler, John, A History of World Societies (Boston: Houghton Mifflin, 1992.

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. ফ্রিজিয়া ও লিডিয়া – বিবর্তনপথ
  2. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও দর্শনের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.