ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, সমালোচনামূলক তত্ত্ব ও নয়া বাম

“ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল শব্দটি ১৯৫০ এর দশক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্মান প্যারা-মার্কসবাদী আন্দোলনকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার ইতিহাস বিশের দশকের গোড়ার দিক থেকে শুরু হয় এবং সামাজিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে যুক্ত। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রচুর একাডেমিক এবং প্রচারমূলক আউটপুট মানবতাবাদী বিজ্ঞানের বহুবিধ ডোমেনকে একত্রিত করে।” (Kolakowski, Main Currents of Marxism, p. 1060) ।

Table of Contents

ভূমিকা, উদ্ভব ও বিষয়বস্তু

ভূমিকা

বিংশ শতকের আটের দশকের প্রায় শুরুতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতিক এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তার প্রেক্ষিতে অনেকে একটি বাস্তবোপযোগী মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদের অসারতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কসবাদের ওপর শিক্ষিত মানুষের আস্থা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায়। এ কথা সত্য যে একটি প্রায়োগিক মতবাদ হিসেবে মার্কসীয় দর্শন ও স্ট্র্যাটেজি সাফল্য লাভ করতে পারেনি। অবশ্য একটি রাজনীতিক মতাদর্শের বাস্তব সাফল্য সবকিছু নয়। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে অ্যাডাম স্মিথ যে অবাধ-বাণিজ্যনীতির পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে আর্থনীতিক সংকট মোচনের একটি অন্যতম হাতিয়ারের মর্যাদা দিয়েছিলেন, বিশ শতকের তৃতীয় দশকের বিশ্বব্যাপী মন্দা (depression) বা সংকট সেই অবাধ- বাণিজ্যনীতির মূলে সজোরে কুঠারাঘাত করেছিল। একুশ শতকের মহামন্দা (Great Depression) আর-একবার সেই অবাধ-বাণিজ্যনীতির ওপর অসারতার সিলমোহর চাপিয়ে দিল। যে উদারনীতিবাদের জয়গানে আমরা আজও অকৃপণ তার সূত্রপাত ঘটেছিল প্রখ্যাত চুক্তিবাদী জন লক্-এর হাতে এবং বিগত কয়েক শতক অনেকগুলি চড়াই-উত্রাই পথ অতিক্রম করে একুশ শতকের গোড়ায় যে উদারনীতিবাদ পাওয়া যায় তা লক, বেনথাম, মিল প্রমুখের উদারনীতিবাদ থেকে স্বতন্ত্র ঘরাণার। আবার যেসমস্ত রাষ্ট্রকে উদারনীতিক বলে সাড়ম্বরে প্রচার করা হয় তারা সবাই সমগোত্রীয় নয়। একইভাবে মার্কসীয় দর্শন বিশ্লেষণকালেও একে সর্বদা একই রকম নয়। মার্কস-এঙ্গেলস কতকগুলি আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিপ্লব, শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্র-অর্থনীতির (Political economy) নানাদিক সম্পর্কে কিছু কিছু মতামত ব্যক্ত করেছিলেন এবং সমাজের যারা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ তারা কীভাবে এবং কী পরিমাণে শোষিত ও নির্যাতিত তার চিত্র সবার সামনে উন্মোচিত করে গেছেন। আর কী কী উপায়ে তারা সেই শোচনীয় এবং অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে পারে তার কথা বলে গেছেন। তাই আর্থসামাজিক রাজনীতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তাদের সুপারিশও যে বদলে যাবে তা বলাই বাহুল্য। যাই হোক, মার্কসীয় দর্শনের কেন্দ্রীয় ধারাটি বা মুখ্য বক্তব্য বিষয় ও তার বিদ্যাবিষয়ক দিকগুলি বিশ্বের অনেক অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইউরোপ ও আমেরিকার অসংখ্য খ্যাতিমান পণ্ডিত মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিন-এর চিন্তাধারা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন এবং করছেন।

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল কী এবং এর উদ্ভব

গত শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের কয়েকজন পণ্ডিতব্যক্তি লেনিন-উত্তর মার্কসবাদ আলোচনার নিমিত্ত সমবেত হয়েছিলেন। পণ্ডিতদের উদ্দেশ্য ছিল মার্কসবাদ বলতে সঠিক কী বোঝায় সে- সম্পর্কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা। তারা Institute of Social Research নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন এবং সেই সংস্থাই পরবর্তীকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল নামে পরিচিত। ডেভিড হেল্ড, বোটোমোরসহ একাধিক মার্কসবাদী চিন্তাবিদ মনে করেন যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (Frankfurt School) নামটি একটু বিভ্রান্তিজনক কারণ এই স্কুল বা গোষ্ঠীর সমস্ত সদস্য যে মার্কসীয় দর্শন সম্পর্কে সহমত পোষণ করতেন তা নয়। তবে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষদিক থেকে এই গোষ্ঠীর সদস্য বলে যারা পরিচিত ছিলেন তারা মোটামুটি সকলে লেনিনোত্তর যুগের মার্কস এবং এক্সোলস-এর চিন্তাধারার নানাদিক নিয়ে পণ্ডিতি আলোচনায় নিজেদেরকে নিমগ্ন করে রাখতেন। আলোচনার মধ্যে সাবলীলতা এবং প্রণালীবদ্ধতা আনার জন্য তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন বলে তাদের গঠিত সংস্থাকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বলা হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে এই স্কুলের আত্ম- প্রকাশ ঘটলেও কোলাকাউস্কি মনে করেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬০) যে পাঁচের দশকের শুরুতে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল শিক্ষা ও আলোচনার জগতে প্রতিষ্ঠালাভ করতে পেরেছিল। যে কয়েকজন পণ্ডিত (যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন ইহুদি) মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনার কাজ আরম্ভ করেছিলেন তারা para-Marxist নামে পরিচিত ছিলেন। কোলাকাউস্কি লিখেছেন, “ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল শব্দটি ১৯৫০ এর দশক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারা-মার্কসবাদী আন্দোলনকে নির্দেশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।” লেনিন-এর মৃত্যুর পর স্তালিন যেভাবে মার্কসীয় দর্শনের ব্যাখ্যা শুরু করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত খুবই বিব্রতবোধ করেন। কারণ তাদের মনে এমন সন্দেহ জাগে যে মার্কস-এঙ্গেলস প্রকৃতপক্ষে কী বলেছিলেন যা স্তালিন এইভাবে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। অর্থাৎ মার্কসবাদ সম্পর্কে স্তালিন-এর ব্যাখ্যায় জার্মানির কয়েকজন পণ্ডিত সন্দেহপ্রকাশ করেন। সুতরাং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিক দিকগুলির জন্ম মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থেকে। অর্থাৎ এই গোষ্ঠীর সদস্যরা মনে করতেন যে বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে রাশিয়ায় এবং অন্যত্র মার্কসীয় দর্শন নিয়ে যেসব ব্যাখ্যা দেখা যাচ্ছে সেগুলি কী পরিমাণে মার্কস-এঙ্গোলস-এর মূল বক্তব্যের সঠিক অনুগামী সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিশেষ করে তাদের মতে, স্তালিন এবং আরও কয়েকজন মার্কসীয় চিন্তাধারাকে নিজেদের ইচ্ছা মোতাবেক ব্যাখ্যা করেছেন যা মার্কসবাদের বিকৃতরূপ ছাড়া অন্যকিছু নয়। মার্কসবাদকে এই বিশ্লেষণের সামিল করতে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা রাজি হননি এবং তাদের এই ভিন্নমত থেকে জন্ম নেয় মার্কসীয় চিন্তা ও দর্শনের একটি নতুন স্রোত যাকে কোলাকাউস্কি আধা-মার্কসীয় আন্দোলন বা Para Marxist Movement নামে অভিহিত করেছেন। আধা মার্কসীয় এই কারণে যে নতুন আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মার্কসবাদের বিশ্লেষণ ও পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। কিন্তু তাকে বিকৃত করার প্রবণতা রোধ করতেই হবে।

মূল বক্তব্য

বোটোমোর সম্পাদিত Dictionary of Marxist Thought-এ প্রকাশিত প্রবন্ধের লেখক বলেছেন, “১৯২০ এবং ১৯৩০ দশকে জার্মানিতে উদ্ভূত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের উৎপত্তি মার্কসবাদের অর্থ নিয়ে বিতর্ক বা একটি ব্যবহারিক উদ্দেশ্য নিয়ে এর ডিজাইন করা তত্ত্বের পরিসরের সাথে অবিচ্ছেদ্য” (p. 208)। ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর সদস্যরা মার্কসীয় দর্শনের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাকে মূল বা আদি মার্কসবাদ থেকে স্বতন্ত্র করার সুযোগ নেই। যে পরিস্থিতিতে মার্কস ও এঙ্গেলস রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলির ব্যাখ্যা করেছিলেন সেগুলি অনুধাবন করে ওই দর্শনকে বিশ্লেষণ করতে হবে। নিজের পছন্দমতো মার্কসবাদকে ব্যাখ্যা করে তার বিকৃতিকরণ অসমর্থনযোগ্য। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা দেখেছিলেন যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে মার্কসবাদ অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরোপের কয়েকটি দেশে বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলন চরম বিপর্যয়ের মুখে এসে উপস্থিত হয়। জার্মানিতে বামপন্থী রাজনীতিক দলগুলি জনগণের ওপর প্রভাব স্থাপনে ব্যর্থ হয়। মার্কস- এঙ্গেলস আশা করেছিলেন যে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে সমাজবাদী আন্দোলন বা মার্কসবাদভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন প্রবল আকার নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও শ্রমিক-স্বার্থবিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি যদিও শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে অত্যাচার ও শোষণ অব্যাহত ছিল। সর্বোপরি লেনিন-এর মৃত্যুর পরে স্তালিন যেভাবে রাশিয়াকে শাসন করেছেন এবং মার্কসবাদের ব্যাখ্যা করে চলেছেন তাকে সঠিক মার্কসবাদ বলে গণ্য করা যায় না। বরং বলা যেতে পারে-degeneration of the Russian revolution into Stalinism and the rise of Fascism and Nazism (রাশিয়ান বিপ্লবের স্ট্যালিনবাদে অধঃপতন এবং ফ্যাসিজম এবং নাৎসিবাদের উত্থান), জার্মানি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের অনেক মার্কসবাদী মনে করলেন যে মার্কসবাদের এই জাতীয় বিকৃতিকরণ বা ব্যাখ্যা মেনে নেয়া যায় না। মার্কসবাদের এই বিকৃতিকরণকে এরা (ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা) misleading ও dangerous নামে অভিহিত করেছেন। অনেকে বলেন যে ফ্রাঙ্কফুর্ট-স্কুলের সদস্যরা মনে করতেন যে পুঁজিবাদীব্যবস্থার কুফল থেকে সমাজকে মুক্ত করার অন্যতম উপায় হল সমাজবাদ স্থাপন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শনকে যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে তা সমাজতন্ত্র স্থাপনের পক্ষে সহায়ক হতে পারে না। স্তালিন কেবল মার্কস-এর চিন্তাধারাকে বিকৃত করেননি, কৌশলগত ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যার ফলে সাধারণ মানুষের মনের ওপর মার্কসবাদ একটি ভান্ত ধারণা সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্র, সরকার, দল, প্রশাসন ইত্যাদি সবকিছুকে স্তালিন ও তার বশংবদ ব্যক্তিরা ভুল পথে পরিচালিত করেছিলেন। ফলে মার্কসবাদ কঠিন সংকটের মুখে পড়েছিল। সুতরাং “সঠিক সামাজিক কার্যক্রম কেবলমাত্র সঠিক দলীয় লাইনের প্রচারকে অনুসরণ করবে” (Correct social action would follow merely from promulgation of the correct party line), আরও বলা হয়েছে, “ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলকে সরাসরি একটি অ্যান্টি-বলশেভিক র‌্যাডিকালিজম এবং একটি ওপেন-এন্ডেড বা সমালোচনামূলক মার্কসবাদের সাথে সম্পর্কিত করা যেতে পারে।” (The Frankfurt School can be associated directly with an anti-Bolshevik radicalism and an open ended or critical Marxism.) Bottomore, p. 208.

মৌলিক বক্তব্য ও নীতি

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল কী বলতে চায়?

জার্মানির ফাঙ্কফুর্ট স্কুল বা যে-গোষ্ঠী মার্কসবাদ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জন্য গঠিত হয়েছিল তার সদস্যরা সমমতাবলম্বী ছিলেন না। অথবা বলা যেতে পারে যে, গোষ্ঠীর সকল সদস্য মার্কসীয় দর্শনের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাননি। মার্কসবাদকে অনেকগুলি প্রেক্ষিত থেকে তারা ব্যাখ্যা করতেন। ফলে বিশ্লেষণ কার্যত বহুশাখাবিশিষ্ট হয়ে পড়েছিল। এ-রকম হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অন্যতম সদস্য ম্যাক্স হোরখেইমার (Max Horkheimer) ছিলেন একাধারে সমাজতত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং সমাজমনোবিদ। অন্য একজন সদস্য ফ্রিডরিখ পোলোক (Friedrich Pollock) ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা-বিশারদ। থিওডোর অ্যাডর্নো (Theodor Adorno) ছিলেন দার্শনিক। আবার কেউ কেউ সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকও ছিলেন। ফলে সবাই যে একই শিক্ষাধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা নয় এবং এ-কারণে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা মার্কসীয় দর্শন আলোচনাকালে স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে বিসর্জন দিতে চাননি। অবশ্য এ কথা সত্য যে মার্কস-এঙ্গেলস তাদের বিস্তর লেখার মধ্যে নানা বিষয়ের যে অবতারণা করেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই স্কুলের সদস্যদের আলোচনা বৈচিত্র্যের দ্বারা বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। ডেভিড হেল্ড তার প্রবন্ধে (বোটোমোর-এর বইতে প্রকাশিত) লিখেছেন যে সমাজ সম্পর্কে স্কুলের সদস্যদের ভাবনা ছিল মুখ্য। সেজন্য সমাজের বিভিন্ন দিক তাদের বিশ্লেষণে স্থান পেয়েছিল। সমাজকে তারা সমালোচনামূলক দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং এ-বিষয়ে তাদেরকে রাজনীতিবিদ বা প্রশাসক কারোরই হুমকি বা নির্দেশ অনুযায়ী চলতে চাননি। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কসবাদকে সঠিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতেই হবে। আর এ-ক্ষেত্রে স্তালিন বা তার সমগোত্রীয় একগুঁয়ে রাজনীতিবিদদের নির্দেশ তারা মানতে রাজি নন। বলা বাহুল্য, স্তালিন-এর পাণ্ডিত্য এবং মার্কস ও এঙ্গেলস-এর দর্শন সম্পর্কে তার জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে অনেক শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত সন্দেহ পোষণ করতেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা একটি বিষয়ে ঐকমত্যে উপস্থিত হয়েছিলেন যে স্তালিন তার লৌহশাসনে মার্কসীয় দর্শনকে পূর্বনির্ধারিত এবং নিজের পছন্দ মতো একটি ছকে ফেলে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। স্তালিন-এর এই আচরণের দরুন মার্কসবাদ তার সঠিক মর্যাদা ও অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। বলা হয়েছে, “মার্ক্সবাদ যে তার স্ট্যালিনবাদী প্রকাশে দমনমূলক হয়ে উঠেছিল সে স্বীকৃতই নিশ্চিত করে যে এর মতবাদগুলি অবশ্যই সত্যের চাবিকাঠি প্রদান করে না”, Bottomore, op. cit., p. 209. সুতরাং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যদের বিশ্লেষণকে একটি প্রতিবাদী-বিশ্লেষণ বা আন্দোলন বলা যায়। কারণ এই স্কুলের সদস্যরা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন স্তালিনীয় গণ্ডি থেকে মার্কসবাদকে বের করে এনে সবার সামনে এবং সঠিকভাবে উপস্থাপিত করতে যাতে সবাই জানতে পারে মার্ক্স প্রকৃতপক্ষে কী বলতে চেয়েছিলেন।

সমাজ, শ্রেণিসংগ্রাম এবং সর্বহারা

পুঁজিবাদী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে অর্থনীতি যে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা সহমত পোষণ করতেন। অর্থাৎ অর্থনীতি হল সমাজের আসল চালিকাশক্তি। সর্বহারা শ্রেণি নিজের মুক্তির জন্য সংগ্রাম অবশ্যই করবে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে লেনিন যা বলেছিলেন তার সারার্থ হল কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। লেনিন এ কাজে (শ্রমিক শ্রেণিকে উদ্দীপিত করার কাজে) পার্টি ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা বিশেষ করে হোরখেইমার অন্য উপাদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি বলেছেন যে বুদ্ধিজীবী বা অগ্রণী বাহিনীর চেয়ে সর্বহারা শ্রেণির সদস্যরা সচেতনতা অর্জন করে নিজেদেরকে পুঁজিবাদী শ্রেণির বিপরীত মেরুতে প্রতিষ্ঠিত করে এবং শ্রমিক শ্রেণি ও পুঁজিবাদী শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রগুলি সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে যার ফলে শ্রেণিবৈরিতা তীব্রতর হয়ে ওঠে। হোরখেইমার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, এবং তা হল সমাজের দুটি প্রধান শ্রেণির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলে শ্রেণি-বৈরিতার কলেবর স্ফীত হতে থাকে। হোরখেইমার যা বলেছেন তার সারমর্ম হল পার্টি, অগ্রণী বাহিনী বা বুদ্ধিজীবী এদের ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দুটি প্রধান শ্রেণির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং তার থেকে জাত সচেতনতা। এ প্রসঙ্গে হোরখেইমার-এর বক্তব্যের সঙ্গে রোজা লুক্সেমবার্গ-এর বক্তব্যের সুন্দর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা লক্ষ করেছিলেন যে বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে মেলবন্ধন সুদৃঢ় হওয়ার ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পুঁজিপতিদের কব্জার মধ্যে চলে যায়। এর ফলে সমাজের দুটি প্রধান শ্রেণির মধ্যে সংঘাত বেড়ে যায়। একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করে এবং রাষ্ট্র একচেটিয়া কারবারিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার কাজে এগিয়ে আসে। হোরখেইমার এবং অন্যেরা বলতে চেয়েছেন যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠী কমিউনিস্ট পার্টির গঠন ও তার অবাধ কাজকর্ম অনুমোদন করবে না এবং করেও না। এই অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষেরা কেবল সচেতনতা অর্জন করে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং সেই সচেতনতাই তাদেরকে শ্রেণিসংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রশাসনের আসল স্তম্ভ হল আমলাতন্ত্র। শ্রমিকশ্রেণিকে সংগ্রাম করতে হলে কেবল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধাচরণের মধ্যে বন্দি থাকলে হবে না, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। হোরখেইমার-এর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে ম্যাকলেলান বলেছেন: The class consciousness of the exploited is the weapon of the struggle for emancipation, সচেতনতা হল মুক্তির একমাত্র বা অন্যতম উপায়।

নীতি বা বৈশিষ্ট্য

কোলাকাউস্কি (পৃ. ১০৬১) ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন যেগুলিকে আমরা এই গোষ্ঠীর নীতি হিসেবে গণ্য করতে পারি।

  • (১) এই গোষ্ঠীর সদস্যরা মার্কসবাদকে একটি আদর্শ নিয়ম (norm) বলে মনে করেন না। বিদ্যমান সমাজের সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, আর্থিক ও অন্যান্য দিক বিশ্লেষণ করার সময় মার্কস-এঙ্গেলস-এর বক্তব্য বিষয়কে স্মরণ করেন। অর্থাৎ ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল মার্কসীয় দর্শনকে সমাজবিশ্লেষণের শেষ কথা বলে মনে করে না। এই স্কুল সমাজের নানাদিক ব্যাখ্যাকালে মার্কসবাদের সাহায্য নিয়ে থাকে। ফলে অ-মার্কসবাদীদের বক্তব্য অতি সহজে এই গোষ্ঠীর আলোচনায় স্থান দখল করে নিতে পেরেছে। যেমন হেগেল, কান্ট, নিৎসে (Nietzsche), ফয়েড প্রমুখেরা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সভ্যগণের আলোচনায় স্থান পেয়েছেন। এককথায় বলা যেতে পারে যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল হলেও গোঁড়া ছিলেন না।
  • (২) ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলকে রাজনীতি-বর্জিত বলে মনে করা হয় কারণ কোনো রাজনীতিক দলের প্রতি এর সংশ্রব বা আনুগত্য ছিল না এবং রাজনীতিক আন্দোলন করার কথা এই স্কুলের সদস্যরা ভাবেননি। বিশেষ করে কমিউনিজমের প্রতি এ স্কুলের দুর্বলতা থাকলেও এর প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাবার কথা একবারও ভাবেনি। বরং স্কুলের সদস্যরা সাম্যবাদের তীব্র নীতি বা বৈশিষ্টা সমালোচক ছিলেন।
  • (৩) কোলাকাউস্কি বলেছেন যে গত শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে Lukacs এবং Korsch-এর মার্কসীয় চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অনেকে স্কুলের সদস্যদের Lukacs- এর শিষ্য বলে মনে করতেন।
  • (৪) এই স্কুলের সদস্যরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করে সমাজের নানা দিক বিশ্লেষণের কথা ভাবতেন। তারা নতুনভাবে চিন্তা করে যেসব সিদ্ধান্ত নিতেন সেগুলি পরে একটি স্বতন্ত্র তত্ত্বের গোড়াপত্তন করে যাকে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব বা Critical Theory বলা হয়ে থাকে। কোলাকাউস্কি এর সদস্যদের বক্তব্যকে all embracing praxis বলেছেন।
  • (৫) স্কুলের সদস্যরা মার্কস-এর পরকীকরণ (alienation) বা বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব স্বীকার করে নিলেও এই বিচ্ছিন্নতা শ্রেণি-সচেতনতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেননি। মার্কস- এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখেরা মনে করতেন যে সর্বহারা শ্রেণি সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বৈপ্লবিক মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল তা মনে করেনি। প্রলেতারিয়েতরা বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন হলে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিপ্লব দেখা দিত।
  • (৬) ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা যে পদ্ধতি ও স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মার্কসবাদ বিশ্লেষণ করতেন তার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে তারা নিঃসন্দেহে সংশোধনবাদী ছিলেন। কিন্তু কোলাকাউস্কির মতে এই স্কুল নিজেদেরকে একটি বৈপ্লবিক বৌদ্ধিক আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করতো (school regarded itself as a revolutionary intellectual movement)। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল সমাজের আমূল পরিবর্তন চাইত এবং সেই অর্থে একে সংস্কারপন্থী বলে মনে করা যায় না। এই স্কুলকে বাস্তববাদী বলা চলে এবং ইউটোপীয় ভাবনা একে আবিষ্ট করতে পারেনি।

হার্বার্ট মারকিউস (১৮৯৪-১৯৭৯ খ্রি.)

মারকিউস এবং মার্কসবাদ

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল-এর যে কয়জন কৃতি পণ্ডিত মার্কসবাদ এবং আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে গভীর এবং তাত্ত্বিক আলোচনা করে গেছেন তাদের মধ্যে হার্বার্ট মারকিউস-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ১৮৯৪ সালে তার জন্ম এবং প্রয়াণবছর হল ১৯৭৯। প্রথম জীবনে তিনি জার্মানির সামরিক বিভাগে কাজ করেছিলেন এবং পরে ওই কাজ ছেড়ে দার্শনিক চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন। হেগেল সহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় দার্শনিকের দর্শনচিন্তা নিয়ে মারকিউস গবেষণা করেন। কিন্তু হিটলার-এর ইহুদি-বিদ্বেষ নীতি এবং অন্যান্য কারণে তিনি জার্মানি ত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন এবং সেখানে গিয়ে দর্শনচিন্তা ও মার্কসীয় দর্শনের অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে মার্কসবাদের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং মার্কসবাদ পড়তে এবং চিন্তা করতে গিয়ে হেগেলীয় দর্শনের দিকে তার আকর্ষণ গড়ে ওঠে। কার্যত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের যেসব সদস্য হেগেল ও মার্কসকে একসঙ্গে যুক্ত করে একটি যৌথ চিন্তা তৈরির দিকে অগ্রসর জড়িত হচ্ছিলেন মারকিউস তাদের অন্যতম। স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় তিনি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সভ্য ছিলেন এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতিও করতেন। জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে তিনি জার্মানি ত্যাগ করে আমেরিকায় বসবাস করতে যান। কোলাকাউস্কি বলেছেন যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্য থাকাকালীন তিনি নেতিবাচক দ্বান্দ্বিকতার (negative dialective) প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। হেগেল-এর দ্বান্দ্বিকতা এবং অন্যান্য অনেক ধারণা তিনি গ্রহণ করে নিলেও ধর্ম বা বিশ্বসত্তা ইত্যাদিকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। মার্কস-এর প্যারিস ম্যানাস্ক্রিপ্ট (Paris Manuscript) সম্পর্কে তিনি প্রথমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বিপ্লব তত্ত্ব এবং সমাজ সম্পর্কে তাদের ধারণা মারকিউস-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তার উল্লেখযোগ্য বই হল Reason and Revolution এবং এই বইখানি বিশ্বের পণ্ডিতসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কোলাকাউস্কি বলেছেন যে মানুষের চিন্তা ও চেতনা এবং সমাজ যুক্তির ভিত্তিতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু মার্কস যেমন বলেছেন যে দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে সমাজের বিবর্তন ঘটে এবং শেষপর্যন্ত সমাজে দেখা দেয় বিপ্লব যার থেকে জন্ম নেয় শ্রেণিহীন সমাজ। হেগেল অনন্তসত্তার আবির্ভাবকে দ্বান্দ্বিকতার ফসল বলে ঘোষণা করেছো। মারকিউস-এ দুয়ের মধ্যে যে মিলনসাধন করেছেন। এটা ব্যাখ্যা করে কোলাকাউস্কি বলেছেন, “মার্কিউজের মতে, হেগেলীয় ও মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের অপরিহার্য ভিত্তি বিষয় এবং বস্তুর পরিচয় নিয়ে নয়, বরং যুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে, যা একই সময়ে স্বাধীনতা এবং সুখের বাস্তবায়ন।” (The essential basis of Hegelian and Marxian dialectic, according to Marcuse is not the movement towards the identity of subject and object, but towards the realisation of reason, which is at the same time the realisation of freedom and happiness)। শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ নয়, সুখ ও স্বাধীনতা অর্জন হল আসল জিনিস। যুক্তির সার্থক প্রয়োগ এদের অর্জনকে বাস্তব সত্যে পরিণত করে।

হেগেল এবং মার্কস- এর মধ্যে মিলনসেতু রচনা

আগেই বলা হয়েছে যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিতেরা মার্কসীয় দর্শনকে স্তালিনীয় দৃষ্টিতে বা গতানুগতিকভাবে ব্যাখ্যায় ব্রতী হননি। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিত ব্যক্তিরা এবং বিশেষ করে মারকিউস নতুনভাবে মার্কসীয় এবং হেগেলীয় দর্শন ব্যাখ্যা করে এদের মধ্যে মিলন ঘটিয়েছেন। মারকিউস তার Reason and Revolution বই-এর এক জায়গায় লিখেছেন, “মার্কসীয় তত্ত্বের সমস্ত দার্শনিক ধারণা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণীভুক্ত, যেখানে হেগেলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণীভুক্তগুলি সব দার্শনিক ধারণা। (all the philosophical concepts of Marxian theory are social and economic categories, whereas Hegel’s social and economic categories are all philosophical concepts.)” মারকিউস একটি ছোট্ট কথায় মার্কস ও হেগেল-এর দর্শনের মধ্যে সুন্দর পার্থক্যটি বলে দিয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক যে শোষিত হয় এবং আস্তে আস্তে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে হেগেল বোধ করি সে-সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তিনি তার দার্শনিক দৃষ্টি দিয়ে সেই বিচ্ছিন্নতা বা পরকীকরণ (alienation) ব্যাখ্যা করেননি বা করতে সক্ষম হননি। ম্যাকলেলান বলেছেন যে হেগেল শ্রমের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। কিন্তু মার্কস শ্রমিকের পরকীকরণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হেগেলীয় দর্শনে আমরা philosophical labour-এর অস্তিত্ব পাই এবং মার্কসীয় দর্শনে alienated labour পাই। মারকিউস বলতে চেয়েছেন যে এ দুটির কোনোটি এককভাবে সঠিক নয়। পুঁজিবাদী-ব্যবস্থায় শ্রমিক সংগ্রাম করে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব স্থাপন করলেই যে তাদের শোষণের অবসান ঘটবে এবং তারা সুখী হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। মারকিউস বলেছেন যে, সমাজে যুক্তিনির্ভর বিপ্লব আনতে হবে যা পুঁজিবাদের বিলোপসাধন করে সমগ্র সমাজে সুখ নিশ্চিত করবে। সুতরাং যুক্তির প্রাধান্য ও সুখের নিশ্চিতকরণ এই দুটি বিষয় মারকিউস-এর চিন্তাজগতে বিশেষ আসন করে নিয়েছিল। মারকিউস মনে করতেন যে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিপ্লবের কথা ভাবলে চলবে না। যে-কোনো বিপ্লবের কাজ হবে যুক্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুখের পরিবেশ তৈরি করা। তাই তিনি বলেছেন যে বিশ্বের যেসব স্থানে পুঁজিবাদের অবসানের জন্য বিপ্লব করা হয়েছে সেগুলিতে হয়তো পুঁজিবাদের অবসান ঘটেছে কিন্তু যুক্তির প্রতিষ্ঠা ও সুখের আগমন ঘটেনি। তিনি আরও বলেছেন যে একটি বিপ্লব করা যেতে পারে এবং বিপ্লবের নেতৃত্বে যারা থাকে তারা বলতে পারে যে শোষণ, শাসন ও নির্যাতন থেকে সাধারণ মানুষ মুক্ত। কিন্তু কতটুকু তারা মুক্ত, তা বিপ্লবের নেতারা বলে দিলে চলবে না, সাধারণ মানুষ বলবে তারা মুক্ত কি না এবং যুক্তি দিয়ে তারা বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবে। স্বাধীন মানুষ যুক্তি সহকারে সবকিছু ব্যাখ্যা করার পর যদি দেখে যে তারা মুক্ত এবং সুখী তাহলে সেটাই মেনে নিতে হবে। পরের মুখে ঝাল খেলে চলবে না।

বিপ্লব সম্পর্কে মারকিউস

বিপ্লব সম্পর্কে বলতে গিয়ে মারকিউস কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তার ধারণায় উন্নত পুঁজিবাদী-ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের কুফল অনেক এবং সেগুলি দূর করতে না পারলে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। সুতরাং বিপ্লবই পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু বিপ্লব সম্পর্কে মারকিউস ভিন্নমত পোষণ করতেন। তার মত হল একটি প্রলেতারীয় বিপ্লব পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী-ব্যবস্থায় শিল্পপতিরা উন্নতধরনের যে উপরিকাঠামো তৈরি করেছে এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থা দ্বারা সমাজব্যবস্থাকে যেভাবে গড়ে তুলেছে তা সম্পূর্ণরূপে পুঁজিবাদের অনুগামী এবং এ অবস্থায় পুঁজিবাদীকে ক্ষমতাচ্যুত করা গেলেও উপরিকাঠামো এবং উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার তৈরি ব্যবস্থাকে নিমেষে ধ্বংস করে ফেলা যাবে না এবং যদি ধ্বংস করা যায় তাহলে সমগ্র সমাজের নতুনভাবে পুনর্গঠন কীভাবে সম্ভব তা সহজে বোধগম্য নয়। সুতরাং বিপ্লবকে আলাদিনের প্রদীপ মনে করা ঠিক নয়। প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশকে অক্ষুণ্ণ রেখে এবং স্বতন্ত্রভাবে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে প্রলেতারীয় বিপ্লব নিজের পছন্দমতো সমাজ গড়ে তুলতে পারবে বলে মারকিউস মনে করেননি। মারকিউস বলেছেন যে সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও বিপ্লবের অনুকূলে পরিস্থিতি গড়ে উঠেছে কি না তা আগে দেখতে হবে। শুধু তাই নয়, বিপ্লব যে প্রয়োজন সে সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা অবশ্যই থাকবে।

এই শর্ত আরোপ করে মারকিউস মার্কসীয় ধারণার কিঞ্চিৎ সংশোধন করেছেন। মারকিউস আর একটি প্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। পুঁজিবাদে বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন ইত্যাদি সবকিছু আছে। কিন্তু পুঁজিবাদ উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের একটি অংশকে যে সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে বিপ্লবের পরে সমাজের ওই অংশ সেই স্বাচ্ছন্দ্য ও সুযোগকে পরিত্যাগ করতে রাজি হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আবার সর্বহারা শ্রেণি শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লবের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করলেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নত ধারা ও কাঠামোকে কীভাবে নতুন সমাজের পরিবেশে প্রয়োগ করা হবে সে- বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পুঁজিবাদের উন্নত প্রাযুক্তিক কলাকৌশলকে সমাজতন্ত্রে অক্ষুন্ন রাখতে হলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়টি এসে যায় এবং বিপ্লবীরা তা করবে কি না সে-নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। মারকিউস মার্কস-এর পরকীকরণ নিয়ে কিছু আলোচনা করেছেন। তার মতে শ্রমজীবী মানুষ যদি বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে অনিবার্য বলে মনে করে এবং তাকে সুখের আকর বলে ধরে নেয় তাহলে বিচ্ছিন্নতা বা পরকীকরণ সম্বন্ধে তারা বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে নাও পারে। সুতরাং কোন ব্যবস্থা মানুষকে সুখ দেবে তা সুখ সম্পর্কে মানুষের ধারণার ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে সচেতনতারও একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ব্যক্তি কী চায় এবং সুখ কোত্থেকে আসবে সে-সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকা দরকার।

বিপ্লবোত্তর সমাজে মনস্তাত্বিক সংঘাত দেখা দিতে পারে

বিপ্লবোত্তর সমাজের স্বরূপ কেমন হবে এবং প্রযুক্তিবিদ্যার সফল প্রয়োগ সমাজকে কীভাবে পরিচালিত করবে সে সম্পর্কে মারকিউস মনোগ্রাহী আলোচনা করেছেন। ধরে নেওয়া হল যে বিপ্লব এসে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করল, যার ফলে বিজ্ঞান ও প্রাযুক্তিক কলাকৌশলের ব্যাপক প্রয়োগ সমাজকে নানাভাবে সমৃদ্ধশালী করে তুলল। বিপ্লবের আগে নানা শ্রেণি এবং জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈষম্য ছিল তার বিলোপ ঘটে গেল। একটি সংগঠনের উচ্চপদাধিকারী এবং তার অধীনস্থ একজন কর্মচারী একই মডেলের গাড়ি ব্যবহার করছেন, উভয়ের জীবনযাত্রা বা লাইফ-স্টাইলের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। উভয়েই তাদের সন্তানদের একই বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। ফলে একজন সাধারণ কর্মচারী এই মর্যাদা ও সুযোগের অধিকারী হয়ে তৃপ্তি পেতে পারেন। কিন্তু মারকিউস বলেছেন যে এই বাহ্যিক তৃপ্তি সংঘাতের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে না। বিভিন্ন মানুষের মনে হতাশা, হীনমন্যতা, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ দেখা দিতে পারে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দেয়। এসব ক্ষেত্রে যুক্তি কাজ করে না। দ্বেষ, হিংসা, হতাশা প্রাধান্য পায় এবং সেখান থেকে জন্ম নেয় পারস্পরিক বিরোধ।

বিপ্লব মানুষকে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা উপহার দিতে পারে, কিন্তু তার মনের আমূল পরিবর্তন রাতারাতি আনতে পারে না। মানুষের মনে যুক্তিহীনতা, অহংকার, স্বার্থপরতা ইত্যাদি থাকে এবং তার বহিঃপ্রকাশ যে-কোনো সময়ে ঘটতেই পারে। সেজন্য মারকিউসসহ অনেকে বলেন যে সমাজের বৈষয়িক পরিবর্তন ঘটানো একমাত্র কাজ নয়, মানুষের মনের মধ্যে যুক্তিবাদিতার বীজ বপন করা খুবই জরুরি। বিপ্লব এই কাজটি সবসময়ে যে করবে এমন নিশ্চয়তা নেই। মারকিউস একজায়গায় বলেছেন: “সবচেয়ে উন্নত শিল্পাঞ্চলে অর্জিত জীবনমান শান্তিকামী উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত উন্নয়নের মডেল নয়।” (The standard of living attained in the most advanced industrial areas is not a suitable model of development if the aim is pacification)। উন্নতমানের ভোগ্যবস্তু সাধারণ মানুষের হাতে দিয়ে তাদেরকে সাময়িকভাবে খুশি করা যেতে পারে, কিন্তু তাদের মনে যুক্তিবাদিতার উন্মেষ ঘটানো সহজ কাজ নয়। মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখেরা ভেবেছিলেন যে সাম্যবাদের আগমন পুঁজিবাদী সমাজের কুফলকে নির্বাসন দেবে। কিন্তু মারকিউস বিশ শতকের শিল্পোন্নত সমাজের অভ্যন্তরীণ দিকগুলি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সমৃদ্ধি সব ত্রুটি অপসারিত করতে পারে না। আর বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় যে সমাজতন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল সেটি সাধারণ নাগরিকের অধিকাংশ মৌলিক প্রয়োজন দূর করতে পারেনি। এইসব আলোচনাকালে মারকিউস ফ্রয়েড-এর ধারণা ও যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। ব্যক্তির তৃপ্তিসাধন কোথা থেকে আসবে সে-সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে শিক্ষার কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন মানুষের মনে যুক্তিবাদিতা (rationality) পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। মার্কসীয় দর্শনের সফল প্রয়োগও সে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। মারকিউস মার্কসবাদের কেন্দ্রীয় ধারণাকে বর্জন না করে ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক দর্শনের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছেন, তিনি বলতে চেয়েছেন যে বস্তুগত চাহিদার তৃপ্তি সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়, মনের তৃপ্তিসাধনের কথাও ভাবতে হবে এবং মারকিউস সে কথাই বলেছেন।

সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)

সমালোচনাত্মক তত্ত্ব বলতে কি বোঝায়?

ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠী বা স্কুলের একটি বিশেষ অবদান হল সমালোচনাত্মক অথবা সমালোচনামূলক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। এই গোষ্ঠীর শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতগণ মার্কসীয় দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে কেবল শ্রেণিসংগ্রাম, বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিজেদেরকে বন্দি করে রাখেননি। বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে সমাজবিজ্ঞানের যেসমস্ত শাখার বিকাশ সাধন ঘটেছিল মোটামুটি তাদের সবগুলিকে একটিমাত্র ছাতার তলায় এনে মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিন-এর চিন্তাধারার সঙ্গে মিশিয়ে তারা এক নতুন চিন্তা বা দর্শনের গোড়াপত্তন করে গেছেন এবং এভাবে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, চিন্তাবিদদের যুক্তিগুলির ওপর গড়ে ওঠা যে তাত্ত্বিক কাঠামো তা একদিকে যেমন অত্যন্ত জটিল অন্যদিকে তেমন একাধিক বিদ্যাবিষয়ক ধারার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই বলা হয়েছে যে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব হল: Complex and multidisciplinary, সমালোচনাত্মক তত্ত্বের সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া যেতে পারে, “সমালোচনামূলক তত্ত্বকে এমন এক তত্ত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা সামাজিক অনুশীলনের অন্তর্নিহিত কাঠামো উন্মোচন এবং তাদের মধ্যে নিহিত সামাজিক জীবনের সম্ভাব্য বিকৃতি প্রকাশে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণাত্মক এবং নৈতিক ভিত্তি প্রদান করতে পারে।” (Critical theory has been defined as theory which can provide the analytical and ethical foundation needed to uncover the structure of underlying social practices and to reveal the possible distortion of social life embodied in them.) অর্থাৎ সমাজের নানান্তরে যেসমস্ত আচার-আচরণ ও ক্রিয়াকলাপ সদাসর্বদা ঘটে যাচ্ছে সেগুলিকে একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা বা সংজ্ঞার দ্বারা বিশ্লেষণ করা যায় না। ঘটনাগুলি সঠিক প্রেক্ষাপটে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে কেবল মার্কস-এর বিপ্লব, শ্রেণি- সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ধারণার মধ্যে বন্দি থাকলে চলবে না। মার্কস-এর বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতাকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদসারা অস্বীকার করেননি বা করতে চাননি। কিন্তু তারা সমাজব্যবস্থাকে বৃহত্তর আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আজ সমাজকে কী দিয়েছে এবং কোথায় নিয়ে গেছে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব তার ওপর আলোকপাত করতে চায়। সমালোচনাত্মক তত্ত্ব সচেতনতা, যুক্তিবাদিতা, সুখ বা তৃপ্তিসাধন, মানুষের আবেগ বা অন্যান্য অনুভূতিকে বিবেচনার মধ্যে এনে একটি ব্যাপক তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। সমালোচনাত্মাক তত্ত্ব মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা বা পরকীকরণ তত্ত্বকে মেনে নিতে পারেনি এবং মার্কস যেভাবে সচেতনতা ও পরকীকরণ তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করেছেন, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা তার বিরোধিতা করেছেন। সমাজের পুনর্গঠন বা আমূল পরিবর্তনে সর্বহারা শ্রেণির বিশেষ ভূমিকার কথা মার্কস বা তার অনুগামীরা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল-এর সদস্যরা তা বলেননি। এই তত্ত্ব আরও বলতে চেয়েছে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ সমাজকে অনেক কিছু দিলেও এ সবকিছুই মানুষের তৃপ্তিসাধন করতে পারেনি এবং না পারার অন্যতম কারণ হল মানুষের যুক্তিবাদিতা এবং অন্যান্য আচরণ তার মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। অতএব একটি গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক কাঠামো প্রস্তুত করতে হলে এ দিকটি বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে।

সমালোচনাত্মক তত্ত্ব এবং দৃষ্টবাদ

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, বিশেষ করে এর অন্যতম সদস্য হোরখেইমার (Horkheimer) ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের বক্তব্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সমালোচনাত্মক তত্ত্বের সঙ্গে দৃষ্টবাদ বা positivisim-এর সংযোগের দিকটি তুলে ধরেছেন এবং বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে ডেভিড ম্যাকলেলান বলেছেন (পৃ ৩০০), “ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সমালোচনামূলক তত্ত্ব প্রধানত পজিটিভিজমের দিকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।” (the critical theory of Frankfurt School was aimed largely at positivism.) সুতরাং সমালোচনামূলক তত্ত্বের সঙ্গে দৃষ্টবাদের সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত হতে হলে দৃষ্টবাদ ধারণাটি কী সে বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন।

অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তার Politics বইতে সংজ্ঞাদানকালে বলেছেন, “সামাজিক এবং সত্যিই সমস্ত ধরনের অনুসন্ধানের তত্ত্ব অবশ্যই কঠোরভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলির প্রতি অনুগত থাকতে হবে।” (The theory that social and indeed all forms of enquiring should adhere strictly to the methods of natural sciences.) অর্থাৎ প্রাকৃত-বিজ্ঞান পর্যালোচনার জন্য যেসমস্ত পদ্ধতি অবলম্বিত হয় সেগুলি সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণে অনুসৃত হলে তাকে দৃষ্টবাদ বলা যাবে। কোঁত (Comte) সর্বপ্রথম দৃষ্টবাদ ধারণাটির কথা বলেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানের নানা ধারণা পর্যালোচনার জন্য কোঁত মূল্যবোধ সংবলিত পদ্ধতি (Value-judgment) প্রয়োগের বিরোধিতা করে বলেন যে কেবল বিজ্ঞান-নির্দেশিত পথই সমাজবিজ্ঞানের নানাদিক বিশ্লেষণে সহায়তা করতে পারে। মূল্যবোধ এবং ভালো ও মন্দকে ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞান আলোচনায় নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। আরও বলা হয়েছে, “পজিটিভিজমের সমর্থকরা দাবি করেন যে, বিজ্ঞান সহ সামাজিক বিজ্ঞান কোন ভেল্যু-জাজমেন্ট বা মূল্য বিচারের জায়গা নয়।” (Supporters of positivism assert that science including social science is not the place for value judgment.) অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত এবং অনুচিত ইত্যাদির স্থান যেমন প্রাকৃতবিজ্ঞানে নেই তেমনি নেই সমাজবিজ্ঞানে। দৃষ্টবাদের প্রবক্তারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেছেন যে উচিত, অনুচিত প্রভৃতিকে ভিত্তি করে পরম্পরাগত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পণ্ডিতেরা সমাজবিজ্ঞানের নানা দিক ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু উচিত, অনুচিত এবং মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ এবং পণ্ডিত সবার ধারণা এক নয়। সুতরাং সমাজবিজ্ঞানের যে-কোনো শাখা সম্বন্ধে গ্রহণযোগ্য আলোচনা করতে হলে অস্তিবাদ অর্থাৎ প্রাকৃত বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতেই হবে। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজবিকাশের ধারা বিশ্লেষণের জন্য যেসব পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, দ্বান্দ্বিকতা ইত্যাদি। মার্কস হেগেল-এর দ্বান্দ্বিক নীতির সাহায্যে সমাজবিকাশের নানা পর্যায় ব্যাখ্যা করলেও তিনি সযত্নে তার বিশ্বসত্তা বা World Spirit বা চরম ধারণা বা Absolute Idea ইত্যাদিকে পরিহার করে সমাজের কেবল বস্তুগত দিকগুলির উন্মোচন করে গেছেন এবং এইদিক থেকে বিচার করে মার্কসবাদীরা বলেছেন যে কোঁতের মতো মার্কসও দৃষ্টবাদের সহায়তায় সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছিলেন। সেইজন্য অনেকে মার্কসবাদ ও সমালোচনাত্মক তত্ত্বকে দৃষ্টবাদের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেন।

সমালেচনায়ক তত্ত্ব ও হোরখেইমার

১৯৩৭ খ্রি.-এ হোরখেইমার একটি প্রবন্ধ লেখেন যার নাম Traditional and Critical Theory, এই প্রবন্ধের একেবারে শুরুতে তিনি প্রশ্ন করেছেন তত্ত্ব বা theory কী? সংজ্ঞায় তিনি বলেছেন, “বেশিরভাগ গবেষকের কাছে তত্ত্ব হল কোনো বিষয়ের সম্পর্কিত প্রস্তাবনার সমষ্টি, এই প্রস্তাবনাগুলি এমনভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত যে কিছু প্রস্তাবনা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং বাকি প্রস্তাবনাগুলি এই ভিত্তি থেকে উদ্ভূত হয়।” (Theory for most researchers is the sum total of propositions about a subject, the propositions being so linked with each other that a few are basis and the rest derive from these.) হোরখেইমার-এর মতে একটি তত্ত্বের দুটি দিক রয়েছে। একটি হল এই তত্ত্ব কতকগুলি মৌলিক (basic) প্রস্তাব (propositions)-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই মৌলিক প্রস্তাবের সঙ্গে আরও কতকগুলি সাধারণ প্রস্তাব জড়িত বা সম্পর্কিত থাকে। একটি তাত্ত্বিক কাঠামো যদিও মৌলিক প্রস্তাবগুলির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তবুও সাধারণ স্তরের প্রস্তাবগুলি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করার হেতু নেই। অর্থাৎ সকল প্রকার প্রস্তাবই তাত্ত্বিক কাঠামো প্রকৃতির কাজে সহায়তা করে। সমাজের বন্ধুগত দিকগুলি সম্যকরূপে অনুধাবন করে এবং সমাজে ব্যক্তির প্রকৃত স্থান নির্ণয় করে গবেষক সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করবেন। কাল্পনিক বা মূল্যবাধকেন্দ্রিক ধারণাকে ভিত্তি করে সামাজিক কাঠামোর বিশ্লেষণে প্রয়াসী হবেন না। ব্যক্তির চারিদিকে যে বস্তুগত পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার স্বরূপ নির্ণয়ে গবেষক অগ্রসর হবেন এবং এ কাজে তিনি কল্পনা, ভাবাবেগ, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেবেন না। মার্কস তাই করেছিলেন। আদিম সমাজ থেকে শিল্প সমাজের নানা স্তর বস্তুবাদী দৃষ্টি দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করে গেছেন। হোরখেইমার লিখেছেন, “ব্যক্তিকে সাধারণত তার অস্তিত্বের মৌলিক শর্তগুলি সহজেই মেনে নিতে হবে।” (The individual as a rule must simply accept the basic conditions of his existence.) বস্তুগত পরিস্থিতি বা অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে সমাজ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বা বাস্তববাদী বিশ্লেষণ করা যায় না। সমালোচনামূলক তত্ত্বের মূল বক্তব্য বিশ্লেষণ করে কোলাকাউস্কি বলেছেন যে বুর্জোয়া চিন্তাবিদগণ সমাজব্যবস্থার নানাদিক সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা না করে বিজ্ঞানকে স্বতন্ত্রভাবে দেখার চেষ্টা করতেন এবং এইভাবে তারা যে তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করতেন তার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক দেখা যেত না। বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা মনে করতেন বিদ্যমান সমাজ যেমনটি আছে তাকে ঠিক সেইভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং তা করে সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব তৈরি করা দরকার। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য তো অনেকে চেষ্টা চালাতে পারে কারণ সমাজের বিভিন্ন দিক তাদের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার থেকে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সৃষ্ট হয়। শ্রেণিসমাজে যেসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে তাদের প্রভাব সমাজের নানা শ্রেণির ওপর নানাভাবে পড়ছে এবং বিভিন্ন শ্রেণির লোকেরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। সমালোচনামূলক তত্ত্ব তাই বলতে চায়।

সমালোচনায়ক তত্ত্বের নীতি

কোলাকাউস্কি সমালোচনাত্মক তত্ত্বের কয়েকটি নীতির উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে সমালোচনামূলক তত্ত্ব নিজেকে সামাজিক আচরণ (social behavior) হিসেবে মনে করে। তার বর্ণিত নীতিগুলো –

  • (১) এই তত্ত্ব স্বীকার করে না যে, বিদ্যমান সমাজের নিয়মকানুন, শ্রমবিভাগ নীতি, সমাজের নানা শ্রেণির লোকেদের কাজ ইত্যাদি স্বাভাবিক এবং অনিবার্য (natural and inevitable)। অর্থাৎ শ্রমবিভাগ নীতি থেকে আরম্ভ করে সমাজের নানা লোকের কাজকর্ম, আচরণ ইত্যাদি স্বাভাবিক নয়, মানুষের সামগ্রিকভাবে সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি।
  • (২) সমালোচনাত্মক তত্ত্ব আরও বলে যে, যদিও সমাজ নানা গোষ্ঠী বা অংশে বিভক্ত, চূড়ান্ত বিচারে সমাজ একটি সামগ্র্য। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন অংশ মানুষ নিজে তৈরি করেছে এবং সেই তৈরির পেছনে রয়েছে মানুষের সংকীর্ণ স্বার্থ, বা প্রয়োজন। কিন্তু সমাজের এই বিভাজন মেনে নেওয়া যায় না। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যে এমন নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যে একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে অন্যগোষ্ঠী বা অংশ থেকে আলাদা করার উপায় নেই।
  • (৩) এই তত্ত্ব নিজেকে ধারণার মধ্যে বন্দি করে রাখতে চায় না। চিন্তা ও মূলসুত্রগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার কথা বলে। তাই একে বলা হয় theory of praxis. সমাজের অতীতের কার্যাবলি থেকে যে শিক্ষা বা ধারণা অর্জিত হয়েছে সমালোচনামূলক তত্ত্ব সেগুলি বাস্তবে প্রয়োগ করার কথা বলে এবং এর উদ্দেশ্য হল বর্তমান সমাজব্যবস্থার চেয়ে আরও উন্নতমানের সমাজ গঠন করা।
  • (৪) সমাজের পরিবর্তনের একাধিক উপায় আছে এবং এই তত্ত্ব জঙ্গি উপায়ের ওপর জোর দিতে চায়। তাই এই তত্ত্বকে ধ্বংসাত্মক (কৌশল) সক্রিয়তার ওপর আস্থা স্থাপন করতে দেখা যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সমালোচনাত্মক তত্ত্বকে প্রয়োগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে এর প্রবক্তারা জড়িয়ে ফেলেছেন।
  • (৫) মার্কস-এঙ্গেলস-এর মতো এই তত্ত্ব সংগ্রাম ও বিপ্লবের কথা প্রচার করে। কারণ নতজানু হয়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর হৃদয়ে পরিবর্তন আনা যে যাবে না তা এর প্রবক্তাগণ মার্কসীয় গুরুত্ব ভালোভাবে জানতেন।
  • (৬) সমালোচনাত্মক তত্ত্ব বলে যে, এমন একটি সমাজ তৈরি করা দরকার যে-সমাজে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিভেদ থাকবে না। মার্কসকে অনুসরণ করে এই তত্ত্ব বলেছে যে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার প্রথার বিলোপসাধন করতে হবে। সমালোচনাত্মক তত্ত্ব মানবজাতির মুক্তির কথা বলে।
  • (৭) মার্কস এবং তার অনুগামীরা যেমন সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের মাধ্যমে একটি শ্রেণিহীন, শোষণহীন আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন এই তত্ত্ব তেমনটি বলে না। কোলাকাউল্কি তাই বলেছেন যে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব নির্দিষ্ট ইউটোপিয়ার উল্লেখ করেনি। সার্বিকভাবে সমগ্র সমাজে সুখ বিরাজ করুক সে-কথাই বলে।
  • (৮) এই তত্ত্ব সমাজের আমূল পরিবর্তনের ওপর জোর দিতে চায়। সমাজ সংস্কার করে এর রূপান্তর ঘটাবার নির্দেশ তত্ত্ব দেয় না। সমগ্র সমাজকে আগাপাছতলা বদলে ফেলতে হবে। কিন্তু কীভাবে এই পরিবর্তন আসবে তার উল্লেখ এই তত্ত্বে নেই।
  • (৯) এই তত্ত্ব সর্বহারা শ্রেণিকে সবকিছুর ঘটক বা সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করে না। সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ বিশেষ একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠী সমাজের পরিবর্তন আনতে সক্ষম এবং অন্যেরা অপ্রয়োজন এমনটি তত্ত্ব বলে না।

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের অবদান

স্তালিনোত্তর যুগ মার্কসীয় আলোচনার বাড়িয়েছিল

বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় যে বিপ্লব হয়েছিল মার্কসবাদের প্রায়োগিক দিকটি এর ফলে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ এবং চিন্তাশীল জনগণের মনে প্রভূত পরিমাণে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু লেনিন-এর মৃত্যুর পরে রাশিয়ায় ক্ষমতা দখলের লড়াই-এ শেষপর্যন্ত স্তালিন জয়লাভ করায় অনেকের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। প্রশাসক ও নেতা হিসেবে স্তালিন-এর যতই যোগ্যতা থাক না কেন তার নিষ্ঠুরতা এবং ক্ষমতা দখলের জন্য নিকৃষ্ট মানসিকতাকে প্রশ্রয়দান শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মেনে নিতে পারেননি। অনেকে আবার রুশবিপ্লবকে স্তালিনবাদে রূপান্তরিত হতে দেখে রীতিমতো বিমর্ষবোধ করেন কারণ মার্কসবাদের এই অবনমন তারা কল্পনা করেননি। স্তালিন-এর আমলে মার্কসবাদ আমলাতন্ত্র-সর্বস্ব, দল-সর্বস্ব ও সর্বোপরি ব্যক্তি- সর্বস্ব হয়ে উঠেছিল। বিশ শতকের তিনের ও চারের দশকে অনেকের মনে একটি বিষয় উঁকি মারতে শুরু করেছিল এবং তাহল মার্কস-এঙ্গেলস তো এই পরিণতি চাননি। তারা সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব ও শ্রেণিসংগ্রাম করে সমাজের আমূল পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন এবং তারা চেয়েছিলেন সর্বহারা শ্রেণির একনায়কী শাসনে একটি শ্রেণিহীন, শোষণহীণ ও বৈষম্যহীন সমাজ স্থাপিত হোক। কিন্তু স্তালিন যা করেছিলেন বা করতে চেয়েছিলেন তার সাথে মার্কসবাদের ছিটেফোঁটা সাদৃশ্য নেই। এই সন্ধিক্ষণে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের আবির্ভাব ঘটল। এই স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদকে সংকীর্ণ প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে চাননি। অর্থাৎ মার্কসবাদ বলতে কেবল স্তালিনবাদ বা বলশেভিকবাদ বোঝায় না। স্তালিন যেভাবে মার্কস-এঙ্গেলস-এর ভাবনাচিন্তাকে রাশিয়ায় প্রয়োগ করেছিলেন তাতে শিক্ষিতমহল মার্কসীয় দর্শনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাই ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদকে ক্লাসিকালের (classical) গন্ডি থেকে বের করে এনে বিদ্যাবিষয়ক জগতের বৃহত্তর প্রাঙ্গণে উপস্থাপিত করার উদ্যোগ নিতে আরম্ভ করেন। এই স্কুলের সদস্যরা দেখলেন যে, Marxism became a repressive ideology in its Stalinist manifestation (মার্কসবাদ তার স্ট্যালিনবাদী প্রকাশে একটি দমনমূলক আদর্শে পরিণত হয়েছে।), অতএব মার্কসীয় দর্শনকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা দরকার। কিন্তু “শাস্ত্রীয় মার্ক্সবাদী ধারণাগুলি একাধিক ঘটনা (স্টালিনবাদ, ফ্যাসিজম) ব্যাখ্যা করতে অপর্যাপ্ত, কিন্তু এটাও বিবেচ্য যে, ওয়েবার এবং ফ্রয়েডের ধারণা এবং তত্ত্বগুলি মার্ক্সবাদীদের মুখোমুখি সমস্যাগুলির সমাধানে জরুরি সূত্র প্রদান করে।” (Classical Marxist concepts are inadequate to account for a range of phenomena (Stalinism, fascism) but also that the ideas and theories of Weber and Freud provide vital clues to problems that face Marxists.) (Bottomore, p. 209)। সহজ কথা হল মার্কস-এঙ্গেলস যা বলেছেন তাকে স্তালিনবাদের নবতম সংস্করণ বলে মনে করা অনুচিত। ফ্রয়েড এবং ম্যাকস ওয়েবার-এর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্কসবাদের আলোচনা জরুরি। সেইজন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদ বিশ্লেষণের নিমিত্ত সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানকে একই ছাতার তলায় আনলেন।

অণুস্তর থেকে নিখিলস্তরে মার্ক্সবাদের উত্তরণ

বলশেভিকবাদ যেভাবে মার্কসবাদকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং পার্টিকেন্দ্রিক করে ফেলেছিল তা রীতিমতো সংশয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল সমালোচনাত্মক তত্ত্ব প্রচার করে মার্কসবাদকে অণুস্তর থেকে নিখিলস্তরে উন্নীত করে। অনুস্তর (micro-level) হল ক্ষুদ্র গণ্ডি, অর্থাৎ মার্কসবাদ মানে বিপ্লব ও শ্রেণিসংগ্রাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বলল যে, মার্কসীয় দর্শন নিখিলস্তরের (macro-level) কথা বলে। রাষ্ট্র কেবল আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কর্মপরিধির মধ্যে সীমিত থাকতে চায় না। সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, উপরিকাঠামো ভিত্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। মার্কস-এঙ্গেলস সহ অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন যে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে সর্বহারাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাহেতু বিপ্লব আসবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে ওইসব দেশে বিপ্লব আসেনি। ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদের সাহায্যে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা পাওয়া অসম্ভব। অন্তত ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল তাই দাবি করে। এই স্কুলের মতে মার্কস-এর আমলে রাষ্ট্রের যে কর্মপরিধি ছিল এবং রাষ্ট্রকে তিনি যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন উভয়ের ক্ষেত্রে এসে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। রাষ্ট্রকে উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিক বলে মনে করলে চলবে না। এর বৃহত্তর ভূমিকা রয়েছে। মার্কস যে অর্থে এবং যেভাবে ভিত্তি ও উপরিসৌধকে ব্যাখ্যা করেছেন বিশ শতকের চারের ও পাঁচের দশকে সেভাবে ব্যাখ্যা করলে চলবে না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির (political economy) ধরন বা চরিত্র অনেক বদলে গেছে। ফ্রয়েড, ওয়েবার, কান্ট প্রমুখেরা যেসব মন্তব্য করেছেন বা দর্শনকথা লিখে গেছেন তাদের সঙ্গো মার্কস-এঙ্গেলস-এর বক্তব্য বিষয়ের সমন্বয়সাধন প্রয়োজন। লেখক বোটোমোর-এর সম্পাদিত বইতে প্রকাশিত প্রবন্ধের বলেছেন, “রাষ্ট্রের আরও বেশি ক্ষেত্রে বিস্তার, ‘বেস’ এবং ‘সুপারস্ট্রাকচার’ এর ক্রমবর্ধমান জড়িত হওয়া, তারা যেটিকে “সংস্কৃতি শিল্প” বা কালচার ইন্ডাস্ট্রি বলে অভিহিত করেছে তার বিস্তার, একনায়কতন্ত্রের উন্নয়ন, সবকিছু ইঙ্গিত দেয় যে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে অন্যান্য উদ্বেগসমূহের সাথে একীভূত করা আবশ্যক। তাই রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক সমালোচনা, মনোবিশ্লেষণ এবং অন্যান্য শাখাগুলি সমালোচনামূলক তত্ত্বের কাঠামোতে স্থান পেয়েছে।” (The expansion of the state into more and more areas, the growing interlocking of “base ” and “superstructure”, the spread of what they called the “culture industry”, the development of authoritarianism, all implied that political economy had to be integrated with other concerns. Hence political sociology, cultural criticism, psychoanalysis and other disciplines found a place in the framework of critical theory.) (p. 209). সহজ কথা হল মার্কসবাদকে অনুস্তর থেকে নিখিলস্তরে উত্তরণ ঘটাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল-এর সদস্যরা সমালোচনামূলক তত্ত্বের মাধ্যমে সম্পাদন করেছেন। আর এ কাজটি করতে গিয়ে তারা হেগেল, কান্ট, ওয়েবারকে টেনে এনেছেন এবং সেইসঙ্গে দৃষ্টবাদ (positivism) ধারণাটিকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের আবির্ভাব না ঘটলে মার্কসবাদ সোভিয়েত বলশেভিক- বাদের মধ্যে সীমাবন্ধ থাকত।

পুঁজিবাদের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন

মার্কসবাদ সম্পর্কে কেউ কেউ এমন মনোভাব পোষণ করেন যে এই স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তেমনটা নয়। এই স্কুল মার্কসবাদকে সমালোচনা- মূলক দৃষ্টি দিয়ে এবং ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে বিচার-বিশ্লেষণ করেছে, যে-কারণে এর সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিতদের আলোচনার মধ্যে পুঁজিবাদবিরোধী মনোভাব লক্ষ করা যায়। স্কুলের সদস্যরা পুঁজিবাদের সমালোচনায় দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না।

  • (১) এরা বলেছেন যে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে এবং উভয় উভয়কে নিয়ন্ত্রণে সাফল্যলাভ করেছে। অবশ্য এর ফলে পুঁজিপতি ও জনপ্রশসানের শীর্ষনেতাদের আখেরে লাভ হয়েছে। দেখা গেছে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্রিক ক্রিয়াকর্মে নিত্যই হস্তক্ষেপ করে যার উদ্দেশ্য হল একচেটিয়া সংগঠনের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। প্রশাসনের বাধাহীন মদত না পেলে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিকবিরোধী কাজে স্বার্থ চালিয়ে যেতে ও মুনাফার কলেবর বাড়াতে সক্ষম হবে না।
  • (২) অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির এই গাঁটছড়ার ফলে জনপ্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় আমলাদের হাত শক্ত হয়েছে এবং এরা পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে। আমলাশ্রেণির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছে। অবশ্য এর ফলে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার বিশেষ উন্নতিসাধন ঘটেনি।
  • (৩) পুঁজিবাদের এবং একচেটিয়া কারবার বা সংগঠনের সমৃদ্ধিসাধন শ্রমবিভাগ- নীতিকে আরও সুনিশ্চিত করেছে। শ্রমবিভাগ নীতি যত সূক্ষ্ম হয়েছে সাধারণ শ্রমিকের অবস্থা তত বেশি খারাপ হয়েছে। তাদের পক্ষে এক বিভাগ বা এক সংগঠন থেকে অন্য বিভাগ অথবা সংগঠনে উন্নত সুযোগের জন্য যাওয়ার সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে গেল। তাই বলা হয়েছে, “অধিকাংশ পেশা আণবিকীকৃত ও বিচ্ছিন্ন ইউনিটে পরিণত হয়।” (The majority of occupations become atomised and isolated units.) (Bottomore, p. 211)।
  • (৪) বিকল্প পেশার সন্ধানে এক সংগঠনের শ্রমিকের পক্ষে অন্য সংগঠনে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সংকুচিত হওয়ায় শ্রমিকদের ওপর মালিকদের প্রাধান্য স্থাপনের সুযোগ অনেক বেশি বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্ডিতব্যক্তি (যারা স্কুলের সদস্য) এমন মত পোষণ করেছেন যে মালিকপক্ষ শ্রমিকশ্রেণির ওপর একাধিপত্য স্থাপনে বাড়তি সুযোগ পেয়ে যায়।
  • (৫) ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল আর-একটি দিক বা প্রবণতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যাকে নিম্নোৰুৰূপে বর্ণনা করা যেতে পারে। পুঁজিবাদ নিজের বিকাশ ও সংরক্ষণের জন্য এক নতুন “কালচার” বা সংস্কৃতি গড়ে তোলে যাকে এই স্কুল একটি শিল্প (industry) বলেছে। এর ফল হল পরিবারের সন্তান পিতা-মাতার দৃষ্টান্ত বা জীবনযাত্রাকে অনুসরণ না করে একচেটিয়া কারবার কর্তৃক সৃষ্ট কৃষ্টির অনুগামী হওয়া অধিকতর কাম্য বলে মনে করে; কারণ পরবর্তীকালে এই প্রথা বা প্রবণতা তার জীবনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে পারবে। সমগ্র সমাজব্যবস্থার ওপর পুঁজিবাদ এইভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করে ফেলে।

নয়া বাম (New Left)

বাম এবং নয়া বামের উদ্ভব প্রসঙ্গে

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রসঙ্গে রাজনীতিক চিন্তাধারার নানাদিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, এই স্কুলের অগ্রগণ্য সদস্যরা মার্কসবাদ-বিরোধী ছিলেন না, বরং এই মতাদর্শকে সঠিক প্রেক্ষিতে (যা বৃহত্তর প্রেক্ষিত নামে পরিচিত) বিচার বিশ্লেষণ করা এবং স্তালিনবাদ ও বলশেভিকবাদের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের করে আনার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এর ফলে বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে মার্কসবাদের একপ্রকার পুনরুজ্জীবন হয় বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন। ইউরোপ ও আমেরিকার পণ্ডিতমহলে এই মতাদর্শকে ঘিরে উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। যে-সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যরা মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন তার দু’এক দশক পরে ইউরোপের নানা জায়গায় মার্কসীয় দর্শন সম্পর্কে পণ্ডিত ব্যক্তিদের আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু দেখার বিষয় হল ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মতো তারা মার্কসীয় দর্শনকে স্তালিনবাদ এবং সোভিয়েত মার্কা সাম্যবাদের বেড়াজালে বন্দি করে রাখতে চাইলেন না কারণ ইতোমধ্যে তারা এদুটি সম্বন্দ্বে উৎসাহহীন হয়ে পড়েছিলেন। ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে অনেক পণ্ডিতব্যক্তি মার্কসীয় দর্শনে খুবই আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তারা দেখলেন যে ইউরোপের নানা দেশে যেসমস্ত মার্কসবাদী পার্টি গড়ে উঠেছিল তারা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়নি। প্রতি পদে সোভিয়েত কমিউনিস্ট বাম বামের এবং নয়া উদ্ভব প্রসলো একেবারে বিশ্লেষক পার্টি তাদের নিয়ন্ত্রণ করত বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেত যা তাদের নিকট অনভিপ্রেত ছিল।

যারা এই পথের পথিক তাদেরকে নয়া বাম (New Left) অভিহিত করা হয়। নয়া বাম-এর সদস্যরা মার্কসবাদে নামে আস্থাশীল কিন্তু সোভিয়েত আধিপত্যবাদ স্বীকার করতে গররাজি। তাই এইসব চিন্তা করে একজন বলেছেন, “নতুন বামপন্থী আন্দোলন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর সোভিয়েত আধিপত্যের ক্ষয়ীভবন থেকে উত্থিত হয়েছে, যেমনটি ১৯৫৬ সালে সিপিএসইউ-এর বিশতম কংগ্রেসে শুরু হওয়া ডি-স্ট্যালিনাইজেশন প্রক্রিয়া (de-Stalinisation process) দ্বারা দেখানো হয়েছে।” (New Left emerged from the disintegration of Soviet hegemony over the international communist movement as shown by the de-Stalinisation process began at the Twentieth Congress of the CPSU in 1956.) সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা স্তালিন সম্পর্কে হতাশ হয়ে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, সেসময় থেকই নয়া বামের যাত্রা শুরু। পূর্ব ইউরোপের দেশ, চিন প্রভৃতি দেশের মার্কসবাদীরা স্তালিনবাদের নিন্দা করে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে তারা মার্কসবাদে আস্থাশীল হলেও স্তালিনবাদ মানতে রাজি নন। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসীয় দর্শনের মূল বক্তব্য বিষয় নিজ নিজ অধলের বিশেষ পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ প্রয়োগের কথা ভাবে এবং তা করতে গিয়ে মার্কসবাদ সম্পর্কে মস্কোর ব্যাখ্যা সন্তর্পণে বাতিল করে দেয়। ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদের বিরুদ্ধে এইভাবে বিশ্বের নানা জায়গায় বিদ্রোহ দেখা দিতে লাগল এবং চিনের মাওপন্থীইটালির কমিউনিস্ট পার্টিকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এইভাবে জন্ম নেয় নয়া বাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল এবং নয়া বাম উভয়কে স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী আন্দোলন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এ ছাড়া কোলাকাউস্কি সহ অনেক মার্কসবাদী স্তালিনবাদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মার্কসবাদে আস্থা হারিয়েছিলেন।

নয়া বামের বৈশিষ্ট্য

নয়া বামের রাজনীতিক মতাদর্শকে কোলাকাউস্কি একটি জটিল বিষয় (complex phenomena) নামে অভিহিত করেছেন। তার কথায়, “নয়া বাম এমন একটি জটিল ঘটনাবলীর সাক্ষী, যা একদিকে, মার্ক্সবাদী অভিধানের বিশ্বজনীনতার দিকে নির্দেশ করে, এবং অন্যদিকে, এই মতবাদের বিঘটন (disintegration) এবং আধুনিক সামাজিক সমস্যাগুলির প্রতি এর অপর্যাপ্ততাকে নির্দেশ করে।” (New Left is a complex of phenomena witnessing on the one hand, to the universalisation of Marxist phraseology and on the other disintegration of the doctrine and its inadequacy to modern social problems.) (p. 1177)। নয়া বামকে স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্যাবিষয়ক প্রতিক্রিয়া বলে ছেড়ে দিলে চলবে না। বিশ শতকের পাঁচের দশকের পর থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এবং তৃতীয় বিশ্বে জাতীয়তাবাদের এক নতুন ঢেউ লক্ষ করা যায়। এসব দেশের কমিউনিস্টরা মার্কসবাদ মেনে নিলেও সোভিয়েত নেতৃত্ব মানতে চাননি। তখন তারা জাতীয়তাবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এরা বলতে লাগলেন ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকলে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিশ্বের নানা জায়গায় যেসমস্ত নয়া বামের বৈশিষ্ট্য জটিল পরিস্থিতি এবং সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

সুতরাং মার্কসবাদের মূল কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে বিশ্বের নানা জায়গায় গড়ে ওঠা স্বতন্ত্র পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন-প্রদত্ত মার্কসবাদের ব্যাখ্যার প্রতি অকৃত্রিমভাবে অনুগত থাকলে চলবে না। নতুন আর্থ- সামাজিক-রাজনীতিক পরিস্থিতি কী চায় সেদিকে তাকিয়ে মার্কসবাদের প্রায়োগিক দিকটি বিবেচনা করতে হবে এবং এই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় নয়া বাম। কিন্তু বিশ্বের নানা অঞ্চলের পরিস্থিতি আলাদা, সর্বত্র মার্কসবাদের সাধারণ নীতি বা মূলসূত্র একতরফাভাবে প্রয়োগের অবকাশ নেই। এই বৈচিত্র্যের জন্য মার্কসীয় দর্শনের একটি সাধারণ তাত্ত্বিক কাঠামো বা মূলসূত্র বের করে তাকে সর্বত্র এককভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। আবার যারা মার্কসবাদকে সামনে রেখে নিজ নিজ দেশের নানা সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন তাদের এই প্রচেষ্টা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট আকার ধারণ করেছিল তা হল, মার্কসীয় দর্শন সমরূপতা (uniformity) হারিয়ে ফেলে। চিনের মাও জেদং, ঝৌ এন লাই প্রমুখ নেতারা বললেন যে, যেহেতু চিন একটি কৃষিভিত্তিক দেশ সেখানে মার্কসবাদের হুবহু প্রয়োগ সম্ভব নয়। ইটালি ও ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসীয় দর্শন স্বীকার করে নিলেও জাতীয় স্বার্থকে মার্কসবাদের আন্তর্জাতিক স্বার্থের নিকট বিসর্জন দিতে চায়নি। ইটালির অনেক কমিউনিস্ট নেতা ইটালি সরকারের ন্যাটো নামক সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার বিরোধিতা তো করেননি বরং সমর্থন জানিয়েছিলেন। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার অনেক বুদ্ধিজীবী নয়া বাম মতাদর্শের প্রতি প্রকাশ্যে আস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল বিশ্বের নানা প্রান্তে সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতাদের প্রাধান্য স্থাপনের উদগ্র বাসনা, হাঙ্গেরির ওপর সোভিয়েত আগ্রাসন প্রভৃতি সমালোচিত হলেও “শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শ হিসেবে মার্ক্সবাদের প্রতি আনুগত্য জোরদারভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল।” (The fidelity to Marxism as the ideology of the working class was strongly emphasised.) (Kolakowski, p. 1178).

নয়া বামের তাত্ত্বিক দিক

বিপ্লব এবং নয়া বাম

বিপ্লব সম্পর্কে নয়া বাম যে ধারণা পোষণ করে তা রীতিমতো চমকপ্রদ কারণ ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদীদের মতে, পরিস্থিতি সম্যকরূপে অনুধাবন না করে বিপ্লবের ডাক দেওয়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। আর এই উপলব্ধি এসেছিল অতীতের ঘটনাবলি থেকে। বিপ্লবের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ থাকা প্রয়োজন যাকে মার্কসবাদীরা ripeness for revolution বলেছেন। বিপ্লব করার পক্ষে উপযুক্ত সময় তৈরি হলেই তবে বিপ্লব করা যাবে। সবকিছু না বুঝে এবং স্ট্র্যাটেজি না জেনে বা তৈরি না করে বিপ্লবের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপ্লবের সাফল্য অনিশ্চিত থেকে যাবে, এই হল নয়া বাম মতবাদের সমর্থকদের ধারণা। তারা আরও বলেছেন যে বিপ্লবের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করা নিছক বুর্জোয়া মানসিকতা ও রণনীতি (strategy)। এর থেকে মুক্ত না হতে পারলে বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। নয়া বামরা সেজন্য বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় না থেকে এর জন্য সংগঠন প্রস্তুতের দিকে সতর্ক ও প্রয়োজনীয় নজর দেওয়ার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদীরা তাদের কৌশল নিয়ে বলতেন যে, শিল্প ও কলকারখানায় যেসমস্ত শ্রমিক কাজ করে তারা বিশেষভাবে রাজনীতি-সচেতন এবং পুঁজিপতিদের শোষণ ও নির্যাতন বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সর্বোপরি নানা কারণে শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ। এসব কারণে পুরনো আমলের মার্কসবাদীরা শিল্প সর্বহারাদের নিয়ে বিপ্লবের কথা কেবল ভাবেনি নি, সেই সাথে তারা চাইতেন যে, বিপ্লবে তারাই নেতৃত্ব দিক। কৃষক, লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত (lumpen proletariat) প্রমুখদের নিয়ে যে বিপ্লব করা যেতে পারে তা তারা ভাবেননি।

কিন্তু নয়া বাম-এর সমর্থকগণ পুরানো ধারণাকে বাতিল করে বললেন যে শিল্প-সর্বহারা, কৃষক সাধারণ স্তরের শোষিত নির্যাতিত মানুষ, লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত প্রভৃতি সবাইকে একটিমাত্র সংগঠনের আওতায় এনে বিপ্লবের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে কি হয়নি সে গবেষণায় কালক্ষেপ করলে বিপ্লব করা যাবে না। একটি সংগঠন তৈরি করে দুর্দমনীয় গতিতে বিপ্লব করার দিকে এগোতে এবং শত্রুপক্ষের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাতে হবে। সংগঠন ও অলোকসামান্য মানসিক বল এবং দৃঢ়তা হল বিপ্লবের অন্যতম পূর্বশর্ত। বিপ্লব করে শত্রুপক্ষের শিবিরকে ধ্বংস করে ফেলা দরকার। নয়া বাম-এর রণকৌশল বা বক্তব্য বিশ্লেষণ করে কোলাকাউস্কি বলেছেন, “অপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই, বিদ্যমান রাষ্ট্র এবং শাসনকারী এলিটদেরকে বলপ্রয়োগে ধ্বংস করা উচিত, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে তর্ক না করে বিপ্লব নিজের ভালো সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেবে।” (There is no reason to wait, existing states and governing elites must be destroyed by force, without arguing about the political and economic organisation of the future revolution will decide these in its own good time.) (pp. 1178-9). লেনিন হয়তো একে হঠকারিতা বলতেন। কিন্তু নয়া বাম বলতে চায় যে সঠিক বা সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত নয়। অপেক্ষা করলে বিপ্লব-বিরোধীরা সুযোগ পেয়ে যাবে এবং তারা বিপ্লবের প্রস্তুতি বানচাল করে দেবে।

বিপ্লব হবে সার্বিক

নয়া বাম-এর প্রবক্তারা সর্বাত্মক (total) বিপ্লবের কথা বলতেন, যার অর্থ হল পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবকিছুকে ধ্বংস করে নতুন শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি গড়ে তোলা এবং এ কাজে পুরানো ব্যবস্থার কোনোকিছুর সঙ্গে সমঝোতা করার প্রশ্ন ওঠে না। নয়া বাম যে সর্বাত্মক বা সার্বিক বিপ্লবের কথা বলে তা বিশেষ ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সার্বিক বিপ্লব সম্পর্কে বলতে গিয়ে কোলাকাউস্কি বলেছেন, “বিপ্লবটি বিশ্বব্যাপী, সম্পূর্ণ, পরম, সীমাহীন, সবকিছুর আলিঙ্গনকারী হতে হবে।” (The revolution must be worldwide, total, absolute, unlimited all embracing.) (p. 1199), নয়া বাম-এর তাত্ত্বিক প্রবক্তারা সার্বিক বিপ্লবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন এই কারণে যে, পুঁজিবাদী-ব্যবস্থা তার অপশাসন, মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা, শোষণ করার প্রবণতা, জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে সমগ্র সমাজকে কলুষিত করেছে, যার ফলে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ ধরে গেছে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগারগুলি পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষাকারী কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তাই নয়া বাম লক্ষ করল যে নতুন সমাজ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গবেষণাকেন্দ্রগুলিকে পুঁজিবাদের বজ্রমুষ্টি থেকে মুক্ত করা জরুরি।

নয়া বাম-এর উদ্ভব এবং উত্থান থেকে আরও জানা যায় যে ইউরোপ এবং আমেরিকার কোনো কোনো জায়গায় এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে নয়া বাম-এর বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্ম মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে গিয়ে সীমাবদ্ধ হয় এবং আস্তে আস্তে সমাজের অন্যান্য অংশে তার প্রভাব পড়ে এবং এইভাবে সর্বাত্মক বিপ্লবের ব্যাপ্তি ঘটে। নয়া বাম-এর উত্থানের আগে অনেকে পুঁজিবাদের অমানবিক শোষণ এবং নির্যাতনের কথা বলতেন। কিন্তু এর কবল থেকে সমাজকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে হলে যে সার্বিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং সেই বিপ্লবের নেতৃত্বে যে ছাত্রসম্প্রদায় থাকবে সে-প্রসঙ্গের উল্লেখ কাউকে করতে দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে নয়া বাম বলতে চায় যে সর্বপ্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা জরুরি এবং তারপর সমগ্র সমাজের মুক্তি আনতে হবে এবং সর্বাত্মক বিপ্লবই একমাত্র হাতিয়ার। কেন সর্বাত্মক বিপ্লবের কথা নয়া বাম বলেছে তার পক্ষেও যুক্তি এবং সমর্থন দেখাতে ভুল করেননি। পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হল একটি সামগ্র্য অর্থাৎ অবিভাজ্য। এর শেকড় একটিমাত্র দেশের সমাজে বিস্তারলাভ করেনি, বিশ্বের সর্বত্রই এটি তার সক্রিয় উপস্থিতি সুনিশ্চিত করেছে। সুতরাং পুঁজিবাদকে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে সার্বিক বিপ্লব ছাড়া বিকল্প কিছু নেই, এমনকি সংস্কার বা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ও বৈধ উপায়ে পুঁজিবাদের কুফল থেকে সমাজকে মুক্ত করা যাবে না। সুতরাং অবিভাজ্য এবং আপাদমস্তক কলুষিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হল সর্বাত্মক বিপ্লবের ঢাক দেওয়া এবং এই বিপ্লবের অনুকূলে পরিস্থিতি গড়ে উঠেছে কি ওঠেনি সেদিকে তাকাবার প্রয়োজনীয়তা নেই।

সার্বিক বিপ্লবের নেতৃত্বে কারা থাকবে?

নয়া বাম মনে করে যে কেবল ছাত্রসমাজই এই সার্বিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারে এবং কারণ হিসেবে এর সমর্থকগণ যা বলেছেন তার সারার্থ হল শ্রমিকশ্রেণি রাজনীতির দিক থেকে সচেতন ঠিকই এবং সংঘবন্ধও বটে। কিন্তু বুর্জোয়ারা নানাবিধ কূটকৌশলের মাধ্যমে তাদের মনের বৈপ্লবিক চেতনা ও চিন্তাকে দাবিয়ে রেখেছে অথবা বলা যেতে পারে যে পঙ্গুত্বের স্তরে নামিয়ে নিয়ে গেছে। তা ছাড়া শ্রমিকদের “পিছুটান” বলে একটি বিষয় আছে যা অস্বীকার করা যায় না। শ্রমিকরা বিপ্লবে অংশ নিলে ছাঁটাই-এর ভয় থেকে যায় এবং কর্মচ্যুতি মানে সমগ্র পরিবারকে উপোস বা অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া। কৃষকদের ওপর নয়া বাম বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি কারণ তারা অসংগঠিত এবং জমিদারদের নিকট দায়বদ্ধ। সমাজের অন্যান্য শ্রেণির লোকেরাও যে এগিয়ে এসে বিপ্লবে অংশ নিয়ে সমাজকে বুর্জোয়া-শাসন থেকে মুক্ত করবে তার সম্ভাবনা অনুজ্জ্বল। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মে এসে যায় ছাত্রসমাজের কথা। নয়া বাম বলে যে ছাত্রসমাজ শোষিত ও উপেক্ষিত, সর্বোপরি এদের পিছুটান নেই, বিপ্লবের প্রতি এদের সহজাত আকর্ষণ প্রশ্নাতীত (At the present time students were the most oppressed members of society and therefore the most revolutionary. Kolakowski, p. 1179)।

ছাত্রসমাজের এই পরিস্থিতির কথা ভেবে নয়া বাম ছাত্রদের নেতৃত্বে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিপ্লব করে সমাজকে শোষণমুক্ত করার কথা বলেছে। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখেরা যেখানে শিল্প-সর্বহারাদের নিয়ে বিপ্লবের কথা বলেছিলেন এবং ওপর লেনিন এসে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের ডাক দেওয়ার জোর দিয়েছিলেন নয়া বাম এগুলিকে নস্যাৎ করে ছাত্রসমাজকে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাল। গত শতকের ছয়ের দশক থেকে বিশ্বের নানা জায়গায় নয়া বাম-এর নেতাদের আহ্বানে বিপ্লব দেখা দিতে লাগল এবং কম বেশি সর্বত্রই ছাত্রসমাজ নেতৃত্ব দিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নয়া বামের নেতৃত্বে অনেক বিপ্লব হয়েছিল। এমন কি আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলি নয়া বাম-এর বৈপ্লবিক আহ্বান থেকে মুক্ত ছিল না। কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি জায়গায় মার্কিন বুর্জোয়া ও সামরিক নেতারা যে নৃশংস কাজ করেছিল নয়া বাম তার তীব্র সমালোচনা করে। তৃতীয় বিশ্বের নানা অঞ্চলে মার্কিন পুঁজিবাদ নয়া উপনিবেশবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদ গড়ে তোলার যে প্রস্তুতি চালাচ্ছিল তার বিরুদ্ধে নয়া বাম-এর আদর্শে আস্থাবান ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। নয়া বাম-এর তাত্ত্বিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং পৃষ্ঠপোষকগণ এই নতুন আন্দোলনকে খাঁটি (genuine) বলে মনে করতেন। কারণ পরম্পরাগত মার্কসীয় পদ্ধতি অবলম্বন করে বিপ্লব করা এবং সমাজকে বুর্জোয়া অপশাসন থেকে মুক্ত করা অলীক আশা ছাড়া অন্যকিছু নয়। নয়া বাম আরও বলে যে বিশ শতকে কেবল দুটি দেশে (চিন ও রাশিয়া) মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বিপ্লব হয়েছে। তৃতীয় দুনিয়ার কোথাও হয়নি। কারণ মার্কস-এর কৌশল অকেজো হয়ে পড়েছে।

স্বাধীনতা, সাম্য ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান

নয়া বাম বিশ শতকের ছয়ের ও সাতের দশকে একদিকে পশ্চিমের কল্যাণ-রাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানতে পেরেছে যে সমাজে লিঙ্গ এবং জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্য থেকে গেছে, সংসদীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এদের বিলোপসাধনে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার অনুশীলন নামক ধারণাগুলি অর্থহীনতার স্তরে উপস্থিত। পেটম্যান (Paterman) তার দুটি গ্রন্থে (Participation and Democratic Theory এবং The Problem of Political Obligation: A Critique of Liberal Theory) সংসদীয় গণতন্ত্রকল্যাণ-রাষ্ট্রের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে পশ্চিমের সব গণতন্ত্রে লিঙ্গ ও অন্যান্য বৈষম্য থাকায় স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করার সুযোগ সাধারণ নাগরিকরা পায় না। পেটম্যান-এর মতে, “রাষ্ট্র অনিবার্যভাবে প্রতিদিনের জীবনের অসমতার রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনরুৎপাদনে আবদ্ধ।” (The state is inescapably locked into the maintenance and reproduction of the inequalities of everyday life.) (Political Theory and the Modern State, p. 177). অন্যদিকে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখেরা সোৎসাহে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে সর্বহারার একনায়কত্ব স্থাপন ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্যকে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য প্রভৃতির পুনরুজ্জীবনের পক্ষে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করলেন। পরম্পরাগত মার্কসবাদ নির্বাচন, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, পুরসমাজ বা নাগরিক সমাজের গুরুত্ব ইত্যাদির যে বিপুল প্রয়োজনীয়তা আছে তা মানতে চাইলেন না। তাই তারা বললেন, পরম্পরাগত সংসদীয় গণতন্ত্র ও পরম্পরাগত মার্কসীয় দর্শন উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ত্রুটির দ্বারা আচ্ছাদিত। সি. বি. ম্যাকফারসন তার The Life and Times of Liberal Democracy বইতে বলেছেন যে, গোঁড়া মার্কসবাদী এবং দুরদৃষ্টিহীন উদারপন্থীরা ভয়ংকর ভুল করে বসে আছেন। সংসদীয়ব্যবস্থা অথবা সর্বহারার একনায়কত্ব কোনোটি নির্ভুল পথের নির্দেশ দিতে পারেনি। এবার আসরে অবতীর্ণ হল নয়া বাম। এর নেতারা গোঁড়া মার্কসবাদী পথ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন সংস্কারপন্থী সংসদীয়ব্যবস্থা উভয়কে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। পউলান্ডজাস (Poulantzas) হলেন নয়া বাম-এর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী। তিনি বললেন যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনাকে বুর্জোয়া আখ্যা দিয়ে লেনিন ভুল করেছিলেন। সমাজজীবনের সম্যক বিকাশের জন্য এদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তিনি আরও বললেন যে বিপ্লব, বুর্জোয়া-শাসনের অবসান ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু বিপ্লবোত্তর সমাজে যে সমাজতন্ত্র স্থাপিত হবে তার মধ্যে থাকবে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থাপনা। রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছিলেন, “সাধারণ নির্বাচন ছাড়া, প্রেস এবং সমাবেশের অবাধ স্বাধীনতা ছাড়া, মতামতের মুক্ত সংগ্রাম ছাড়া, প্রতিটি পাবলিক প্রতিষ্ঠানে জীবন নিভে যায়।” (Without general elections, without unrestricted freedom of press and assembly, without free struggle of opinion, life dies out in every public institution.) (উদ্ধৃতিটি হেল্ড-এর বই থেকে গৃহীত, পৃ. ১৭৮)।

সমাজবাদী বহুত্ববাদ

পউলান্তজাস (Poulantzas) সমাজতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে মিলনসেতু রচনার মাধ্যমে এক নতুন সমাজতন্ত্র গঠনের কথা বলেছেন যাকে সমাজবাদী বহুত্ববাদ (Socialist pluralism) নামে অভিহিত করা যায়। পউলান্তজাস হলেন নয়া বাম-এর একজন শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক নেতা। গত শতকের আটের দশকের গোড়ায় তার সুপরিচিত গ্রন্থ State, Power and Socialism নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় এবং বাম রাজনীতি মহলে আলোড়ন তোলে। পউলান্তজাস বলেছেন যে ক্লাসিকাল মার্কসবাদ কেবল সমাজবাদ স্থাপনের ওপর জোর দেয়। কিন্তু গণতন্ত্র ও সমাজবাদের সংমিশ্রণ প্রয়োজন। অবশ্য বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথা পাঁচের দশক থেকে বলে আসছেন। তাই যদি হয় তাহলে পউলান্তজাস-এর সমাজতান্ত্রিক বহুত্ববাদের থেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কি স্বতন্ত্র। পউলান্ডজাস-এর সমাজতান্ত্রিক বহুত্ববাদ সমাজতন্ত্রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চায়। তার মতে রাষ্ট্রের রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সামাজিক কাঠামো হবে সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু এই কাঠামো সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক হবে। অর্থাৎ গণতন্ত্রে যেমন বহুত্ববাদিতা প্রাধান্য পায় পউলান্তজাস-এর সমাজবাদে গণতন্ত্রের অগ্রাধিকার থাকবে। তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করে ডেভিড হেল্ড বলেছেন, “সংসদ, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও খোলামেলা এবং দায়বদ্ধ করে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হবে, এবং স্থানীয় স্তরে নতুন রূপের সংগ্রাম নিশ্চিত করতে হবে যে সমাজ, সেইসাথে রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক হয়, অর্থাৎ, এমন প্রক্রিয়াগুলিতে অধীন যা দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে।” (The state must be democratised by making parliament, state bureaucracies and political parties more open and accountable while new forms of struggle at one the local level must ensure that the society, as well as the state, is democratised, that is, subject to procedures which ensure accountability.) (p. 178).

পউলান্তজাস যে-বিষয়টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছেন তা হল রাষ্ট্রের, সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি বড়ো কথা নয়, এই সমাজতন্ত্রে গণতান্ত্রিক নীতি কী পরিমাণে কার্যকর অবস্থায় আছে তাও বিচার্য। আর তার জন্য প্রয়োজন দায়বদ্ধতা (accountability)। সমাজ সমাজতন্ত্রের নীতি মোতাবেক শাসিত হলেও গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি প্রবর্তন করার ক্ষেত্রে গাফিলতি থাকবে না। নয়া বাম বলতে চায় যে বিশ শতকের প্রথমদিকে সমাজবাদকে পর্যাপ্ত বলে মনে করা হত। কিন্তু পরে দেখা গেল যে ব্যক্তিত্বের সম্যক বিকাশ এবং সমাজের সুষম গঠন ও ব্যক্তিস্বার্থমুখী কার্যকলাপ এবং সর্বোপরি ন্যায়বিচার স্থাপনের জন্য সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উপস্থিতি অপরিহার্য। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যেসমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেগুলিকে সমাজতন্ত্রের সার্বিক ও সফল বিকাশের উপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। পউলান্তজাস মনে করেন যে ক্লাসিকাল মার্কসবাদ এই দিকটির ওপর বিশেষ নজর দেয়নি। রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইতে লেনিন গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও পার্টির প্রাধান্য ও সর্বহারার একনায়কত্বকে তিনি প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়েছেন যার ফলে গণতন্ত্র উপেক্ষিত।

তথ্যসূত্র

  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ২০১৯
  • Kolakowski, L. (2005). Main Currents of Marxism: Its Rise, Growth and Dissolution. Oxford University Press. (first published in Polish in 1976-1978)
  • Bottomore, T. B. Political Sociology.
  • Pateman, C. (1970). Participation and Democratic Theory. Cambridge University Press.
  • Pateman, C., The Problem of Political Obligation: A Critique of Liberal Theory.
  • Macpherson, C. B. (1977). The Life and Times of Liberal Democracy. Oxford University Press.
  • Poulantzas, N. (1978). State, Power and Socialism. New Left Books.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.