কনফার্মেশন বায়াস বা নিশ্চিতকরন পক্ষপাত

ভূমিকা

কনফার্মেশন বায়াস অনেক নামেই পরিচিত, যেমন কনফার্মেটরি বায়াস, মাইসাইড বায়াস, কনজেনিয়ালিটি বায়াস। বাংলায় একে নিশ্চিতকরন পক্ষপাত বলা যায়, তবে অধিক পরিচিতির জন্য এই লেখায় একে কনফার্মেশন বায়াসই বলা হবে। কনফার্মেশন বায়াস হচ্ছে মানুষের মধ্যে থাকা সেই প্রবণতা যার কারণে সে এমন সব তথ্যেরই অনুসন্ধান করে বা সেগুলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে, বা সেগুলোকে সিলেক্ট করে, বা এমনভাবে স্মরণ করে যেগুলো তার মধ্যে থাকা বিশ্বাস ও মূল্যবোধকেই সাপোর্ট করে। অনেককেই দেখা যায় এমন সব তথ্য নির্বাচন করছেন যেগুলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে, বা সেই সব তথ্যকে অগ্রাহ্য করছেন যেগুলো তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে যায়, বা ধরুন কোন দ্ব্যর্থতামূলক বা অস্পষ্ট বা এম্বিগুয়াস এভিডেন্স পাওয়া গেছে যেখান থেকে নিশ্চিত কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়না, কিন্তু ব্যক্তি সেই এভিডেন্স থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসছেন যা তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বলতে হয় যে ব্যক্তির মধ্যে কনফার্মেশন বায়াস রয়েছে। ব্যক্তির মধ্যে এই কনফার্মেশন বায়াসের মাত্রা সব সময় একই রকম থাকেনা। এটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয় যখন ব্যক্তি কোন কিছুর নির্দিষ্ট ফল বা আউটকাম আকাঙ্ক্ষা করে, বা আবেগের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যায় বা এমন কিছু সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় যা সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে যেমন ধর্মসম্পর্কিত বিষয়। বেশিরভাগ লোকের পক্ষে কনফার্মেশন বায়াস থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, কিন্তু তারা এটাকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যেমন শিক্ষার দ্বারা ও ক্রিটিকাল থিংকিং এর দক্ষতায় নিজেকে প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে।

তথ্য অনুসন্ধানে বায়াস, এই সব তথ্যের ব্যাখ্যায় বায়াস, এবং কোন কিছু স্মরণ করার ক্ষেত্রে বায়াস – এগুলোকে নির্দিষ্ট চারটি সাইকোলজিকাল এফেক্টকে ব্যাখ্যা করার কাজে নিয়ে আসা হয়েছে –

  • ১। এটিচুড পোলারাইজেশন (যেখানে বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ পক্ষের সামনে একই তথ্য বা এভিডেন্স নিয়ে আসার পর তাদের মধ্যকার মতানৈক্য আরও বেড়ে যায়)
  • ২। বিলিফ পারসেভারেন্স (যেখানে ব্যক্তির সামনে এমন কোন এভিডেন্স যদি তুলে ধরা হয় যেটা তার মধ্যে থাকা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তাহলেও তার বিশ্বাসটা থেকে যায়)
  • ৩। ইর‍্যাশনাল প্রাইমেসি এফেক্ট (যেখানে ব্যক্তি তার সাথে পূর্বে কয়েকবার ঘটা বিষয়ের তথ্যের উপর বেশি নির্ভর করে)
  • ৪। ইল্যুসরি কোরিলেশন (যেখানে ব্যক্তি ভুলভাবে দুটো ঘটনা বা পরিস্থিতিকে সম্পর্কিত করে বা এদের মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে মনে করে)

১৯৬০ এর দশকে সংঘটিত হওয়া বেশ কিছু সাইকোলজিকাল এক্সপেরিমেন্ট থেকে দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে একটি বায়াস কাজ করে যার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে থাকা বিশ্বাসগুলোকে কনফার্ম বা নিশ্চিত করতে চায়। পরে এই গবেষণাগুলো নিয়ে কাজ হয় এবং এই বায়াসকে ব্যক্তির মধ্যে কাজ করা এমন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার জন্য ব্যক্তি কোন ধারণাকে একপাক্ষিকভাবে টেস্ট করে, অন্যান্য বিকল্পগুলোকে অগ্রাহ্য করে একটি সম্ভাবনায় ফোকাস করে। এই নতুন বায়াসের ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ কেউ উইশফুল থিংকিং বায়াসের কথা আনেন, বার কেউ কেউ মানুষের ইনফরমেশন প্রোসেস করার সীমাবদ্ধ ক্ষমতার কথা আনেন। কিন্তু আরেকটা নতুন প্রস্তাবও চলে আসে, আর তা হচ্ছে, মানুষ একটি কনফার্মেশন বায়াস প্রদর্শন করে, কারণ মানুষ একটি স্বাভাবিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কোন কিছু নিয়ে তদন্ত না করে নিজেদের ভুল হবার ক্ষতির দিকটা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে।

যাই হোক, কনফার্মেশন বায়াসের কারণে আসা ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক, অরগানাইজেশন-সংক্রান্ত, আর্থিক (Financial) ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয় সহ বিস্তৃত ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। এই বায়াস ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওভারকনফিডেন্স বা অতিআত্মবিশ্বাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে এবং বিরোধপূর্ণ এভিডেন্স বা প্রমাণ দেখার পর সেই বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। যেমন ইন্ডাক্টিভ রিজনিং বা আরোহী যুক্তির উপর ভিত্তিতে তৈরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে। ইন্ডাক্টিভ রিজনিং এর ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সাপোর্টিভ এভিডেন্সগুলো জমা করা হয়। এক্ষেত্রে যদি বায়াস কাজ করে তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সিস্টেমিক এরর দেখা যায়। একইভাবে একজন পুলিস ডিটেক্টিভ কোন তদন্তের শুরুতে একজন সাসপেক্টকে সনাক্ত করতে পারেন, কিন্তু এরপর তিনি তার এই সাসপেক্ট এর সাথে সম্পর্কিত ডিসকনফার্মিং এভিডেন্স, মানে যেসব এভিডেন্স সাসপেক্টের দোষী সাব্যস্ত হবার বিরুদ্ধে যায় সেগুলোকে অগ্রাহ্য করতে পারেন, ও কেবল কনফার্মিং এভিডেন্স, মানে যেসব এভিডেন্স তাকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে যায় সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারেন। একজন চিকিৎসক তার ডায়াগনোস্টিক সেশনে শুরুতে একটা ডিজর্ডারের কথা ভাবতে পারেন ও এরপর এমন সব এভিডেন্সই সিলেক্ট করতে পারেন যেগুলো তার প্রাথমিক ডায়াগনোসিসের পক্ষে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই কনফার্মেশন বায়াস অনেক বেড়ে গেছে এতে ফিল্টার বাবল বা এলগোরিদম এডিটিং এর জন্য, যার ফলে ব্যক্তির সামনে মূলত সেই সব বিষয়ই আসে যেগুলোর সাথে তার সম্মত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, আর যেসব বিষয়ের তার বিরুদ্ধে যাবে সেগুলো তার সামনে আনা হবেনা।

সংজ্ঞা এবং কনটেক্সট

ইংলিশ সাইকোলজিস্ট পিটার ওয়াসন প্রথম কনফার্মেশন বায়াস নামটি প্রণয়ন করেন। তিনি বলেন এই কনফার্মেশন বায়াস হচ্ছে এমন একটি প্রবণতা যেখানে মানুষ সেই সব তথ্য পছন্দ করে যা তার বিশ্বাসসমূহ ও মূল্যবোধগুলোকে শক্তিশালী করে এবং একবার সেই তথ্য দ্বারা তাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধসমূহ শক্তিশালী হলে তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যায়।

কনফার্মেশন বায়াসগুলো হলো ইনফরমেশন প্রোসেসিং এর একটি সমস্যা। এটি বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্ট (সেলফ-ফুলফিলিং প্রোফেসি এর একটি প্রকরণ) থেকে আলাদা। সেলফ ফুলফিলিং প্রোফেসি হয় যখন ব্যক্তি কোন কিছু ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এরপর এমন আচরণ করেন যা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হওয়ায় অবদান রাখে। এটি বায়াস হয় কারণ ব্যক্তি মনে করেন তার কাজের জন্য নয় বরঙ তিনি এটি ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলেই এটি ঘটেছিল। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যক্তি একটি গাছ লাগিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করল যে গাছটি খুব ভাল ভাবে বেড়ে উঠবে ফল দেবে। এর পর সেই ব্যক্তি নিজেই সেই গাছটির যথেষ্ট যত্ন নেয়া শুরু করল, ফলে গাছটিও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল, আর এরপর সেই ব্যক্তি ভাবলো সে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই ফলেছে। বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্ট একটি বিশেষ ধরনের সেলফ-ফুলফিলিং প্রোফেসি যেখানে ব্যক্তি গাছের মতো কোন বস্তুর বদলে কোন ব্যক্তিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এরপর তিনি এমন কোন আচরণ করেন যা যেই ব্যক্তিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলো তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যার ফলে সে নিজেই তার উপর করা ভবিষ্যদ্বাণী যাতে সত্য হয় তার জন্য কাজ করা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক তার একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে সে পরের পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করবে। শিক্ষক এই কথাটি সেই শিক্ষার্থীকে বললেনও। এরপর সেই শিক্ষার্থী সেই শিক্ষকের এই ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজে খুব ভালো করে পড়াশুনা শুরু করল, সেই সাথে শিক্ষক নিজেও সেই শিক্ষার্থীর উপর বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করলেন। এসবের প্রভাবে শেষ পর্যন্ত সেই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খুব ভাল ফলাফল করল, আর শিক্ষক মনে করলেন সেই শিক্ষার্থীকে নিয়ে তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে। কনফার্মেশন বায়াস এই বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্টের থেকে ভিন্ন কেননা, বিহ্যাভিওরাল কনফার্মেশন এফেক্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজে ভূমিকা রাখে তার নিজস্ব বিশ্বাস বা মূল্যবোধের পক্ষে আউটকাম যাতে আসে সেজন্য, কিন্তু কনফার্মেশন বায়াসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কেবল তার বিশ্বাস বা মূল্যবোধের পক্ষে তথ্য নির্বাচন, স্মরণ ও ব্যাখ্যা করেন, নিজে কোন আচরণের মাধ্যমে কোন কিছু তার পক্ষে নিয়ে আসেননা।

কনফার্মেশন বায়াস এর পরিসর কতটা তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কতিপয় মনোবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের পক্ষে এভিডেন্স সংগ্রহ করা ও তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এমন উপসংহারের সাথে সম্পর্কিত এভিডেন্সগুলোকে অগ্রাহ্য করেন। কিন্তু অন্যান্য মনোবিজ্ঞানীগণ কনফার্মেশন বায়াসকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। তাদের মতে, কনফার্মেশন বায়াস হলো কোন এভিডেন্স সংগ্রহের সময়, সেগুলোকে ব্যাখ্যা করার সময়, বা স্মৃতি থেকে এভিডেন্সগুলো স্মরণ করার সময় ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসসমূহকে রক্ষা করার প্রবণতা। যাই হোক, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কনফার্মেশন বায়াস কোন ইচ্ছাকৃত প্রতারণা নয় বরং স্বয়ংক্রীয়, অনিচ্ছাকৃত কৌশলের ফল।

প্রকরণ

তথ্যের পক্ষপাতদুষ্ট (বায়াসড) অনুসন্ধান

গবেষণা বারবার দেখিয়েছে যে, মানুষের মধ্যে সাধারণত তাদের বর্তমান অনুমান বা হাইপোথিসিজ অনুসারে একপেশে প্রমাণ সন্ধান করার প্রবণতা কাজ করে। তারা সমস্ত প্রাসঙ্গিক প্রমাণ খুঁজে দেখার পরিবর্তে, প্রশ্নগুলি এমনভাবে রাখে যাতে তাদের তত্ত্বের সমর্থনে ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায়। তারা এমন পরিণতি খোঁজে যা তাদের ধারণা সত্য হলে ঘটতে পারে, তাদের ধারণা মিথ্যা হলে যা যা পরিণতি ঘটতে পারে তা নিয়ে তারা অনুসন্ধান করতে চায়না। যেমন, কেউ যদি তার অনুমান করা সংখ্যা ৩ খুঁজতে হ্যাঁ/না প্রশ্ন ব্যবহার করে, তাহলে সে প্রশ্ন করতে পারে, “এটি কি বিজোড় সংখ্যা?” এই ধরনের প্রশ্ন “পজিটিভ টেস্ট” বা “ইতিবাচক পরীক্ষা” নামে পরিচিত, যদিও নেগেটিভ টেস্ট বা নেতিবাচক পরীক্ষা যেমন “এটি কি জোড় সংখ্যা?” প্রশ্নটি থেকেও একই তথ্য বা উত্তর আসতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে মানুষ এমন পরীক্ষা খোঁজে যা ইতিবাচক উত্তর নিশ্চিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষকে এরকম ছদ্ম-পরীক্ষা বা স্যুডো-টেস্ট এবং সত্যিকারের নির্ণায়ক পরীক্ষার (জেনুইনলি ডায়াগনোস্টিক) মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বললে তাঁরা সত্যিকারের নির্ণায়ক পরীক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেয়। মানে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এই বায়াসের শিকার হয়না, এগুলো মানুষের অজ্ঞাতসারেই ঘটে।

যাই হোক, পজিটিভ টেস্টকে পছন্দ করার ব্যাপারটি নিজেই বায়াস না, কেননা পজিটিভ টেস্টগুলো খুব ইনফর্মেটিভ হতে পারে। তবে, অন্যান্য প্রভাবের সাথে মিলিত হলে, এই কৌশলটি বিদ্যমান বিশ্বাস বা ধারণাগুলি নিশ্চিত বা কনফার্ম করতে পারে, সেগুলি সত্য হোক বা না হোক। বাস্তবে প্রমাণ বা এভিডেন্সগুলো প্রায়শই জটিল এবং মিশ্রিত হয়, যেমন কারো আচরণের একটি দিকে মনোনিবেশ করে বিভিন্ন বিরোধী ধারণাকেই সমর্থন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যেকোন হাইপোথিসিসের পক্ষেই প্রমাণ খোঁজার প্রচেষ্টা সফল হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এর একটি উদাহরণ হল প্রশ্নের ভাষার উপর নির্ভর করে উত্তর কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে সেই ব্যাপারটা। যেমন, ‘আপনি কি আপনার সামাজিক জীবনে অসন্তুষ্ট?’ – এই প্রশ্নের উত্তরদাতাদের তুলনায় ‘আপনি কি আপনার সামাজিক জীবনে সন্তুষ্ট?’ – এই প্রশ্নের উত্তরদাতারা অধিকতর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এমনকি প্রশ্নের শব্দের সামান্য পরিবর্তনও মানুষকে পাওয়া তথ্য অনুসন্ধান করার উপায় এবং অতঃপর যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় তাকে প্রভাবিত করতে পারে। কাল্পনিক চাইল্ড কাস্টডি কেইস একটি গবেষণায় এটি দেখানো হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীরা পড়েছিলেন যে প্যারেন্ট ক একাধিক ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মধ্যমমানের উপযুক্ত অভিভাবক। এদিকে প্যারেন্ট খ এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে কিছু নজরকাড়া ভালো এবং খারাপ গুণাবলী ছিল, যেমন সেই প্যারেন্ট শিশুর সাথে ভালই ঘনিষ্ঠ ছিল, কিন্তু সে এমন একটি চাকরি করতো যার কারণে তাকে দীর্ঘকাল বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। অংশগ্রহণকারীদের যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, “কোন প্যারেন্টের কাছে শিশুর অভিভাবকত্ব বা কাস্টডি থাকা উচিত?” তখন বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী প্যারেন্ট খ-কে বেছে নিয়েছিলেন, কেননা তারা মূলত ইতিবাচক গুণাবলী খুঁজছিলেন। তবে, যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, “কোন প্যারেন্টকে অভিভাবকত্ব থেকে বঞ্চিত করা উচিত?” তারা নেগেটিভ গুণাবলী খুঁজেছে এবং বেশিরভাগ উত্তর দিয়েছেন যে প্যারেন্ট খ-কেই অভিভাবকত্ব থেকে বঞ্চিত করা উচিত, যার অর্থ প্যারেন্ট ক এর শিশুর অভিভাবকত্ব পাওয়া উচিত। মানে প্রশ্নের ধরণ অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের উত্তর বদলে যাচ্ছে।

একই ধরনের গবেষণাগুলি দেখিয়েছে যে মানুষ তথ্যের জন্য একটি পক্ষপাতদুষ্ট অনুসন্ধানে যুক্ত হয়, কিন্তু এও দেখা গেছে যে, তাদের মধ্যে পক্ষপাতহীন অনুসন্ধান করারও একটি প্রবণতা কাজ করে যা তাদের পক্ষপাতদুষ্ট অনুসন্ধানের প্রবণতাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। একটি গবেষণায় প্রাথমিক পরীক্ষায়, অংশগ্রহণকারীরা একটি সাক্ষাৎকার বা ইন্টারভিউ এর ভিত্তিতে অপর একজন ব্যক্তির অন্তর্মুখী–বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব মাত্রা মূল্যায়ন করেছিলেন। তারা প্রদত্ত তালিকা থেকে ইন্টারভিউই (যাদের ইন্টারভিউ নেয়া হবে) প্রশ্নগুলি নির্বাচন করেছিলেন। যখন ইন্টারভিউইদেরকে অন্তর্মুখী হিসেবে পরিচয় করানো হয়, অংশগ্রহণকারীরা এমন প্রশ্ন নির্বাচন করেছিলেন যা এদের অন্তর্মুখী হবার ব্যাপারটিকেই নিশ্চিত করে, যেমন, “উচ্চশব্দের পার্টিকে কেন আপনার অপ্রীতিকর বলে মনে হয়?” যখন ইন্টারভিউইদেরকে বহির্মুখী হিসেবে বর্ণনা করা হয়, প্রায় অংশগ্রহণকারীরা এমন সব প্রশ্ন করেন যেগুলো ইন্টারভিউইদের বহির্মুখিতাকেই নিশ্চিত করে, যেমন, “আপনি একটি বিবর্ণ পার্টিকে কিভাবে প্রাণবন্ত করবেন?” বলাই বাহুল্য যে, এই ধরণের প্রশ্নগুলি ইন্টারভিউইদের সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাগুলোর মিথ্যা প্রমাণের জন্য তেমন কোন সুযোগই দেয়না।

ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য বা পারসোনালিটি ট্রেইট মানুষের বায়াসড সার্চ প্রোসেস বা পক্ষপাতদুষ্ট অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। সিলেক্টিভ এক্সপোজার নামে একটা বিষয় আছে, যখন মানুষ তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এর বদলে কনসিস্টেন্ট বা সঙ্গতিপূর্ণ তথ্যের  সন্ধান করে তখন সিলেক্টিভ এক্সপোজার ঘটে (কনফার্মেশন বায়াসের কারণেই হয়)। এই সিলেক্টিভ এক্সপোজারের সাথে সম্পর্কিত বাহ্যিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি নিজেকে কতটা রক্ষা করবে তা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হয়। ব্যক্তি কতটা তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এমন যুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে তা পরীক্ষা করার জন্য একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ আত্মবিশ্বাস বা কনফিডেন্স লেভেল বিশিষ্ট ব্যক্তি নিজেদের যুক্তি গঠনের জন্য বেশি করে নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিরোধী তথ্যগুলো খুঁজে বার করে। এদের এই আচরণ অপোজিশনাল নিউজ কনজাম্পশনের একটি প্রকরণ যেখানে ব্যক্তি পালটা যুক্তি বের করার জন্য বিরোধী পার্টি বা দলের সংবাদগুলোর সন্ধান করে। অন্যদিকে নিম্ন আত্মবিশ্বাস বা নিম্ন কনফিডেন্স লেভেলের লোকেরা নিজেদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এমন তথ্যের সন্ধান করেনা, বরং তারা নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পক্ষে যায় এমন তথ্যের সন্ধান করে। মানুষ সেই সব এভিডেন্সই তৈরি করে ও মূল্যায়ন করে যেগুলো তার নিজেদের বিশ্বাস ও মতের পক্ষে বায়াসড। তবে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বা কনফিডেন্স লেভেল বেশি থাকলে তা ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের স্বপক্ষে তথ্যের পছন্দকে কমিয়ে ফেলে।

আরেকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি জটিল নিয়ম-আবিষ্কার বা রুল-ডিস্কাভারি টাস্ক দেয়া হয়েছিল, যেখানে কম্পিউটার দ্বারা সিমুলেটেড হওয়া অবজেক্টগুলো সরানোর সাথে সম্পর্কিত ছিল। কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর বস্তুগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চলেছিল, আর অংশগ্রহণকারীদের কাজ হলো সেই নিয়মগুলো বের করা। এটা করার জন্য অংশগ্রহণকারীরা তাদের অনুকল্প বা হাইপোথিসিজগুলো টেস্ট করার জন্য কম্পিউটার স্ক্রিনের অবজেক্টগুলোকে “ফায়ার” করতে পারতো। দেখা যায়, দশ ঘণ্টার একটি সেশন ধরে অনেকগুলি চেষ্টা করার পরেও, কোনো অংশগ্রহণকারী সিস্টেমের নিয়মগুলি বের করতে পারেনি। তারা সাধারণত তাদের হাইপোথিসিজগুলো কনফার্ম করার চেষ্টা করেছে, এবং বিকল্পগুলি বিবেচনা করায় আগ্রহী ছিলনা। তাদের কাজের হাইপোথিসিজগুলো খণ্ডন করে এমন বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ দেখার পরেও তারা প্রায়শই একই পরীক্ষাগুলি চালিয়ে যেতে থাকে। কিছু অংশগ্রহণকারীদের সঠিক হাইপোথিসিস-টেস্টিং শেখানো হয়েছিল, কিন্তু এই নির্দেশনাগুলির প্রায় কোনো প্রভাবই তাদের ওপর পড়েনি।

(চলবে)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.