রোমান সাম্রাজ্যে সাহিত্য, দর্শন, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম

Table of Contents

সম্রাট অগাস্টাসের (খ্রি.পূ. ২৭ – খ্রি. ১৪ অব্দ) সময় সাহিত্যচর্চা

স্বর্ণযুগ : অগাস্টাসের সময়ে ইতালির যেসব জায়গায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে রােমান সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়েছিল। অগাস্টাসের যুগে ল্যাটিন সাহিত্যে নতুন মাত্রা আসে। তার আগের সময়টা, যেখানে সিসেরাে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই দুইয়ে মিলে অগাস্টাসের সময়টাই ছিল রােমের সংস্কৃতিতে স্বর্ণযুগ। অগাস্টাস নিজেও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন আর লেখক সম্প্রদায়কে নানাভাবে উৎসাহিত করতেন।

মিসিনাস : এই প্রসঙ্গে বলা খুব প্রয়ােজন যে অগাস্টাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন সিলনিয়াস মিসিনাস। মিসিনাস অগাস্টাসের সাথে সেই স্কুলজীবন থেকেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যুদ্ধের শেষ কয়েকটা বছর মিসিনাস রােমেই ছিলেন। অগাস্টাস যখন শেষ যুদ্ধটি পরিচালনা করছিলেন তখন তার অবর্তমানে তিনিই রােমের দেখাশােনা করছিলেন। যুদ্ধ শেষে শান্তি এলে মিসিনাস অগাস্টাসকে চিরকালের জন্য যুদ্ধ বন্ধ করতে অনুরােধ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতাব্দীর দিকে, ততদিনে মিসিনাস অনেক ধনী হয়ে উঠেছেন, দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি তার ধনদৌলত রােমের শিল্প সাহিত্য চর্চায় ব্যয় করতেন। তার এই কাজের জন্য তিনি এতই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে সেখান থেকেই মিসিনাসের মতাে কথাটি ব্যবহার হতে লাগল। কোনাে ধনী ব্যক্তি যখন তার টাকাপয়সা শিল্পের জন্য অকাতরে বিলান, তখনই তাকে ‘মিসিনাসের মতাে’ বলা হয়ে থাকে।

ভারজিল :

  • পরিচয় : পাবলিয়াস ভারগিলিয়াস মারাে হলেন সবচেয়ে বড় লেখক যিনি মিসিনাসের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছিলেন। পাবলিয়াসকে সাধারণত ইংরেজিতে ভারজিল নামে ডাকা হয়। ভারজিল খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে মানতুয়ার কাছে একটি খামারে জন্মেছিলেন। ফিলিপির যুদ্ধের পরে, যেখানে অগাস্টাস জুলিয়াস সিজারের হত্যাকারীদের হত্যা করে তার সর্বশেষ বিজয় অর্জন করেন, তখন বিজয়ী দলের সেনাদের ইতালিতে বসবাস করার জন্য জায়গা উপহার দেয়া হয়। (এটা ছিল যুদ্ধ জয়ের পরে বিজয়ীদের কৃতজ্ঞতা জানানাের সাধারণ নিয়ম।) খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে সেরকম যুদ্ধজয়ী সেনাদের জন্য জায়গা করে দিতে ভারজিলের বাবাকে তার নিজের খামার থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ভারজিলের ততদিনে কবি হিসেবে বেশ নাম-ডাক হয়েছে। আবার অগাস্টাসের শাসনকালের একজন প্রধান ব্যক্তি হিসেবেও সবাই তাকে চেনে। তখন গ্যানিয়াস আসিনিয়াস পােলিও (তিনিও ছিলেন একজন কবি আর শাসক) ইতালির সেই অংশে দায়িত্বরত ছিলেন। আসিনিয়াস পােলিও, ভারজিলের জায়গা হাতছাড়া হওয়া থেকে রক্ষা করেন আর সে সময়ে তাকে মিসেনিয়াসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
  • শান্তি-সমৃদ্ধি নিয়ে আসা শিশু ও খ্রিস্টানদের চোখে যিশু : একলগ নামে পরিচিত ছােট ছােট লেখাগুলাের মধ্যে ভারজিলের কাজ ছিল একেবারে প্রথম দিকের। সেসবের মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই একলগ, যাতে একটি আসন্ন জন্মগ্রহণকারী শিশুকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। সেই শিশুটি পৃথিবীতে শান্তি আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। কেউ অবশ্য সঠিক বলতে পারেনি কাকে নিয়ে এই লেখাটি তিনি লিখেছিলেন। হতে পারে তিনি তারই কোনাে পৃষ্ঠপােষককে খুশি করার জন্য এটা লিখেছিলেন যার স্ত্রী ছিলেন তখন গর্ভবতী। পরে অবশ্য খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ধরে নিয়েছেন যে ভারজিল যিশুখ্রিস্টের কথা আগে আগেই জানতেন আর তাই লিখে গিয়েছিলেন, হয়তােবা না জানলেও তিনি ধারণা করেছিলেন। এই কারণে খ্রিস্টধর্মে ভারজিল একজন জনপ্রিয় আরাধ্য মানুষ। তিনশ বছর পরে দান্তের লেখা ডিভাইন কমেডিতে ওই চরিত্রটি ছিল ভারজিলই, যে কিনা দান্তেকে নরকের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
  • জারজিকস কাব্য এবং বিপরীতে ইতালির অভিজাত ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের জীবন : মিসিনাসের উপদেশ শুনে ভারজিল ‘জারজিকস’ নামে কাব্য রচনা করেছিলেন যেখানে ইতালির গ্রামের কৃষিকাজের বর্ণনা এসেছে। (জারজিস নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে যার মানে হলাে কৃষক।) এই লেখার পেছনে হয়তাে অগাস্টাসের একটা উদ্দেশ্য ছিল যে তিনি চাইতেন ইতালিতে কৃষিকাজের প্রসার ঘটুক। (অগাস্টাস অবশ্যই চাইতেন যে রােমানদেও দৈনন্দিন জীবনে সবরকমের কল্পিত সৎ চরিত্রের বিকাশ ঘটুক। তাদের সম্মানিত পূর্বপুরুষেরা যেমন সত্যবাদিতা, সততা, সাহসী, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমের প্রতীক ছিল, আবার একই সাথে তারা ছিল বিশ্বাসী স্বামী, অমূল্য পিতা আর জীবন উৎসর্গকারী দেশপ্রেমিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে অগাস্টাস তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাই তার সময়ের ইতালি ছিল আমাদের আজকের যে কোনাে একটি দেশের মতােই কেবল নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য ব্যস্ত একটি সমাজ। আভিজাত্য যে রাজ্যের প্রতিটি কোণে ঢেলে দেয়া হয়েছিল। আর উচ্চ শ্রেণির মানুষদের করার মতাে তেমন কোনাে কাজ ছিল না বলে তারা আমােদপ্রমােদেই নিজেদের ডুবিয়ে রাখত। তারা সুযােগ পেলেই বিয়ে করত, সহজেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারত, প্রচুর খেত আর পান করত। তারা তাদের অবসর সময় চমৎকারভাবে উপভােগ করত। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণির জন্য ছিল বিনামূল্যে খাদ্য, নানারকমের জমকালাে প্রদর্শনী আর আনন্দদায়ক খেলাধুলার আয়ােজন। নীতি বিশারদেরা এই অবস্থার সমালােচনা করতেন। অন্য জাতির সাথে, এমনকি তাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের সাথে তুলনা করে তারা বলতেন যে তাদের দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কটু সমালােচনায় কোনাে কাজ হয়নি। দেশের সামাজিক পরিস্থিতি একই রকমের ছিল। ভারজিলের ‘জারজিকস’ তাই ল্যাটিনের শুদ্ধতম রূপ হিসেবে গ্রহণযোেগ্য হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কেবল ধনী শ্রেণিই অবসরে সে ধরনের সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকত। তাই ওরকম আরামের জীবনধারা ফেলে কৃষিকাজের দিকে ফিরে আসার কোনাে প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।)
  • ভার্জিলের এনিয়েড : ভারজিলের সাহিত্যচর্চার পরবর্তী বছরগুলাে এনিয়েড (Aeneid) নামে বারাে বণ্ডবিশিষ্ট এক মহাকাব্য রচনায় কেটে যায়। ধরে নেয়া হয় এটাও তিনি শুরু করেছিলেন অগাস্টাসের অনুরােধেই। পটভূমির দিক দিয়ে চিন্তা করলে এনিয়েড, হােমারের সাহিত্যের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। ট্রয়ের যােদ্ধা এনিয়েড, অ্যানিয়াস হলাে সেই কাব্যের নায়ক। এটা তার পুড়তে থাকা ট্রয়ের থেকে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী। তার যাত্রা আর ভ্রমণ ছিল নানারকম উত্তেজনায় ভরা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি ইতালিতে এসে উপস্থিত হন। কাহিনীতে দেখানাে হয় যে তিনিই রােমের পত্তন করেন আর তার উত্তরাধিকারীদের জন্য সমৃদ্ধ করে গড়ে তােলেন। সেখানে অ্যানিয়াসের ছেলের নাম থাকে জুলুস, যার ঔরসে জুলিয়ান পরিবারের (জুলিয়াস সিজার আর অগাস্টাসের) জন্ম হয়। কবি তার কাব্যের উপরে বহুবছর ধরে কাজ করে গেছেন। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব উনিশ সালে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় তখনও এটার উপরে কাজ করছিলেন। শুদ্ধতা আর সৌন্দর্যের চরম মাপকাঠিতে পৌঁছেনি ভেবে তিনি মৃত্যুর আগে পুরাে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে যান। অগাস্টাস সেই নির্দেশ সফল হতে দেননি। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত অন্য কাউকে দিয়ে আরও কিছু কাটাছেড়ার পরে অগাস্টাস সেটি প্রকাশ করেন। ভারজিল রােমান কবিদের মধ্যে সবচেয়ে মহান হিসেবে পরিচিত।

হােরেস : তারপরেই যার নাম উল্লেখযােগ্য, তিনি হলেন হােরেস (কুইনটাস হােরাটিয়াস ফ্ল্যাকাস)। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫ সালে ইতালির দক্ষিণ দিকে তার জন্ম হয়। তিনি রােম আর অ্যাথিনায় লেখাপড়া করেন। তিনি যেন জ্ঞানচর্চার জন্যেই জন্মেছিলেন। তাই সেনা হিসেবে রােমান বাহিনীতে যােগদান করা তার জন্য ছিল ভয়ংকর বিপর্যয়ের মতাে। তিনি অ্যাথিনায় থাকতে জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়। গ্রিসে সিজারের হত্যাকারীর বাহিনীতে তিনি যােগদান করেন। ফিলিপির যুদ্ধে একজন পরিচালক হিসেবে তিনি সশরীরে যােগ দেন। সেখান থেকে জীবন বাঁচাতে তিনি পালিয়ে আসেন। হােরেস পরাজিত দলের অংশ হয়েও জীবন হারাননি। শুধু ইতালিতে নিজের পারিবারিক সম্পত্তি হারান। তিনি জীবিকার জন্য সােজা রােমে চলে যান। সেখানে তিনি ঘটনাচক্রে ভারজিলের সংস্পর্শে আসেন। ভারজিল তাকে মিসেনাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মিসেনাস তাকে একটি খামারের দায়িত্ব দেন যাতে তার আর্থিক কোনাে অনটন না থাকে। তার সাহিত্য সহজে অগাস্টাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সত্যি বলতে তার ছােট কবিতা আর রম্য রচনা আজও সমাদৃত। মিসেনাসের মৃত্যুর পরপরই খ্রিস্টপূর্ব আট সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ওভিড : অগাস্টাসের সময়কার শেষ কবি ছিলেন ওভিড (পাবলিয়াস ওভিডয়াস নাসাে)। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে রােমের সত্তর মাইল পূর্বে তিনি জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা কবি। নিজের জীবদ্দশায় তার কবিতা ধনী শ্রেণির কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই তার রচনাও বাধাহীনভাবে এগিয়ে গেছে। ওভিডের কবিতায় প্রেম-ভালােবাসার বিষয়টি এত খােলাখুলিভাবে এসেছিল যে মাঝে মধ্যে সেসব অগাস্টাস আর শাসক শ্রেণির কোনাে কোনাে ব্যক্তি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা চাইতেন রােমে কেবল অতীতের রােমান সংস্কৃতিই বজায় থাকুক। ওভিডের বিখ্যাত বইয়ের নাম “রূপান্তর” (মেটামরফোসেস) যেখানে ল্যাটিন ভাষায় গ্রিসের পুরনাে কাহিনীগুলাে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই প্রাচীন গ্রিসের কাহিনীর মধ্যেও ছিল বিদ্রোহের ছোঁয়া যা ওভিডের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতাে। পরবর্তীকালে ওভিড অগাস্টাসের মেয়ে জুলিয়ার সাথে বদনামে জড়িয়ে পড়েন। অগাস্টাস মেয়ের ওপরে ভীষণ রেগে যান। তিনি তাকে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে দেন। তারপর জুলিয়া হাজার অনুরােধ করলেও তিনি তাকে কিছুতেই আর ক্ষমা করেননি। ওভিডের প্রতিও অগাস্টাসের আক্রোশ ছিল সাংঘাতিক। ৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাকে নির্বাসনে যেতে আদেশ করেন। দানিয়ুবের মােহনায় ওভিড জীবনের শেষ আট বছর নিতান্তই গেঁয়াে এক জায়গায় পার করে দেন। অগাস্টাসের মন জয় করার চেষ্টায় সেখানে বসে তিনি পাতার পর পাতা বিষাদে ভরা কবিতা লেখেন। কিন্তু অগাস্টাস আর তাকে রােমে ফিরে আসার অনুমতি দেননি। সেই নির্বাসনে থাকাকালীন সময়ে ১৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।

লিভি : অগাস্টাসের সময়কার শ্রেষ্ঠ গদ্যকার ছিলেন লিভি (টিটাস লিভিয়াস)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ সালে পাদুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সরাসরি রাজ্য ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে লিখতেন। তবে অগাস্টাস তাকে সহ্য করতেন কারণ তিনি সরাসরি কখনও রাজনীতিতে অংশ নেননি। আবার তার রাজনৈতিক লেখাগুলাের মধ্যে ভালাে হাস্যরসও থাকত। তিনি সারাজীবন রাজনীতির বাইরে থেকেই সেসব নিয়ে লেখালেখি করে কাটিয়েছেন। অগাস্টাসের অনুরােধে তিনি রােমের পত্তন থেকে শুরু করে ড্রুসাসের সময়কাল পর্যন্ত পুরাে ইতিহাস এক অমূল্য রচনায় তুলে ধরেছিলেন। এই একই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপরে তিনি ১৪২টি বই লিখেছিলেন। তার ইচ্ছে ছিল ইতিহাসটি তিনি অগাস্টাসের মৃত্যু পর্যন্ত লিখে যাবেন। কিন্তু অগাস্টাসের আগেই তার নিজের মৃত্যু ১৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে সেই কাজে সমাপ্তি টানতে বাধ্য করে। লিভি ছিলেন রােমান ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তখনও, এমনকি আজও। তবে দুঃখের বিষয় হলাে তার ১৪২টি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৫টি বই পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে। বাকিগুলাের সম্পর্কে কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত আকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তা যথেষ্ট নয়। লিভি জনপ্রিয় হওয়ার আশায় লিখতেন, এটাই ছিল তার সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে দুর্বল দিক। পাঠককে আকর্ষণ করতে গিয়ে তিনি মজার মজার গল্প বারবার লিখতেন আর একই ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা বারবার করে করতেন। মুখেমুখে ফেরা কিছু প্রাচীন রােমান গল্প তিনি লিখেছেন কেবল পাঠককে ভােলাবার জন্য কিন্তু খতিয়ে দেখেননি সেসবের আদৌ কোনাে বাস্তব ভিত্তি আছে কি না। রােমান ইতিহাসের সবটুকুই উন্মােচিত হয়েছে রােমের নিজস্ব সাহিত্যিকদের মাধ্যমে যারা রােমের সৃষ্টি থেকে যা দেখেছেন তা লিখে গেছেন। বেশির ভাগের মতো, লিভির লেখারও সেই রােমান ইতিহাসের অংশগুলাে পুনরুদ্ধার করা গেছে। তাই আকস্মিকভাবে সেগুলাে পেয়ে যাওয়াতে আমরা রােমের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। অন্যান্য যেসব উৎস থেকে জানা গেছে তা খুব বিচ্ছিন্ন, একটানা নয়।

রোমানদের জুডিয়া দখল থেকে যীশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ

রোমান নিয়ন্ত্রণের পূর্বে ইহুদি জাতি

সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ যে ঘটনাটি অগাস্টাসের শাসনামলে ঘটেছিল, তা হলাে শিল্প আর সাহিত্যের বিকাশ। সেই শিল্পের সাথে যুদ্ধের হার জিত বা রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার কোনাে সম্পর্ক ছিল না। এটা কেবলই আড়ালে থাকা একজন মানুষের, রাজ্যের কোণে কোথাও আড়ালে বসে একমনে করে যাওয়া কাজের ফল আসার মতাে। এমনকি বেশির ভাগ মানুষ সেই জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে সে সময় জানতও না। সিরিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত জুডিয়া। সেখানকার অধিবাসীদের বলে জুডিয়ানস বা জিউইশ বা ইহুদি। তারা ভয়ংকর একেশ্বরবাদী জাতি। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৬০০ সাল পর্যন্ত তারা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে গর্বের সাথে টিকেছিল। প্রথমদিকে দেশটি রাজা ডেভিডের শাসনে বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যাবিলনের অধিবাসীরা রাজ্যটি সাবাড় করে ফেলে। তারপর একশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পারস্যের লােকেরা তাদের দখল করা রাজ্য আবার দখল করে নেয়। তারপরে জেরুজালেমে ইহুদিরা আবার তাদের নিজস্ব মন্দির বানাতে সক্ষম হয়। জেরুজালেম ছিল তাদের প্রাচীন রাজধানী। ইহুদিরা জুডিয়ায় থেকে গেল বছরের পর বছর। তারা ছিল পারস্যের অধীনে। তাদের না ছিল কোনাে রাজা আর না ছিল কোনাে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সংগঠিত সেনাবাহিনী। কিন্তু তারা ছিল তাদের ধর্মের প্রতি ভয়াবহ নিষ্ঠাবান। আর তাদের অন্তরে আগের দিনের স্বাধীনতার স্মৃতি জ্বলজ্বল করত সারাক্ষণ। পারস্যের লােকেরা সম্রাট আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে ছিল। আর তারপরে সেলুকাসের আবিষ্কৃত সেলুসিড রাজ্যের অধীন হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮ সালে সেলুসিড রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক চতুর্থ অ্যান্টিওকাস ইহুদিদের ধর্মকে অনৈতিক ঘােষণা দেন। তার ইচ্ছে ছিল ইহুদিদের সবাইকে তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে গ্রিসের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবেন। তাদের জীবনাচরণ পুরােপুরি বদলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করবেন। ইহুদিরা তখন বিদ্রোহ করে। তাদের নেতা জুডিয়াস ম্যাকাবিয়াস আর তার ভাইয়ের নেতৃত্বে তারা শেষ পর্যন্ত সেলুসিড রাজ্যের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়। প্রায় একশ বছরব্যাপী ম্যাকাবিসের অধীনে সেই রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিল। ইহুদিরা তাদের নিজস্ব রুচিতে নিজেদের জীবন পরিচালনা করতে পারত।

রোমানদের দ্বারা ম্যাকাবিসের উচ্ছেদ, ক্ষমতায় অ্যান্টিপ্যাটার ও তারপর হেরোডের নিষ্ঠুর শাসন

খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রােমানরা পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ততদিনে ম্যাকাবি পরিবারের লােকেদের মধ্যে কারা ইহুদিদেরকে শাসন করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছে। যারা হেরে গিয়েছিল তারা রােমানদের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। রােমান শাসকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ম্যাকাবিয়ান রাজ্যকে পুরােপুরি ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে ইহুদিদের শাসন করার জন্য এমন কাউকে তারা বসাবে যে কিনা পরবর্তীকালে রােমের শাসকের ইচ্ছানুযায়ী চলবে। জুডিয়ায় তারা নেতার বিরুদ্ধশক্তি তৈরি করে শেষে অ্যান্টিপ্যাটারকে বসিয়েছিল। এই পরিকল্পনার মধ্যে যেটুকু চালাকি ছিল, তা হলাে অ্যান্টিপ্যাটার ইহুদি ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইডিউমিয়ান (অথবা বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী যাকে বলে এডোমাইট), ইডুমিয়া অথবা এডােম। তারা ছিলেন জুডিয়ার দক্ষিণ দিকের বসবাসকারী। ম্যাকাবিস তাদেরকে জোর করে ইহুদি ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। তাই তাদের আর ইহুদিদের মধ্যে হাজার বছর ধরে এক ধরনের শত্রুতা ছিল। অ্যান্টিপ্যাটারকে ইহুদিরা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তারা সবসময় তাকে একজন বহিরাগত মনে করত। তিনি ইহুদি ধর্মের সাথে যতই ঘনিষ্ঠ হয়েছেন বা যতই বিচক্ষণভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছেন, সেসব কিছুই ইহুদিরা পাত্তা দেয়নি। তখন রােমানরা বুঝতে পেরেছিল যে অ্যান্টিপ্যাটার কখনও এই রাজ্যটাকে নিজের মতাে করে পাবে না আর সবসময়ই রােমের উপরে নির্ভর করে থাকবে। অ্যান্টিপ্যাটারের দ্বিতীয় পুত্র ছিল হেরােডস (তিনি ইংরেজদের কাছে হেরােড বলে পরিচিত), খ্রিস্টপূর্ব ৩৭ সালে তিনি জুডিয়া দখল করে নেয়। যদিও দখল করা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু হেরােড তারপর বুঝতে পারল যে সেখানে শাসনকাজ চালানাে তত সহজ নয়। তিনি ইহুদিদের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ইহুদি ধর্ম পালন শুরু করলেন। তিনি জেরুজালেমের মন্দিরের উন্নতিসাধন করেছিলেন। যেহেতু এটা প্রকৃত সলমনের মন্দির থেকে দূরে তাই ইহুদিদের সুবিধার জন্য তিনি সেটা করেছিলেন। যাই হােক, তিনি ছিলেন খুব নিষ্ঠুর এবং সন্দেহপ্রবণ মানুষ। তিনি অন্তত দশবার বিয়ে করেছিলেন। স্বার্থে আঘাত লাগলে, কথায় কথায় নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে পর করে দিতে তার কখনও কোনাে সমস্যা হয়নি। শােনা যায় একবার তার ছেলে অগাস্টাসের কাছে এসে বলেছিল, “আমি হেরােডসের ছেলে না হয়ে তার পােষা শূকর হলেও ভালাে হতাে”।

ইহুদিদের একজন মাহিসার স্বপ্ন

ইহুদিরা হেরােডকে ঘৃণা করা শুরু করে। তাদের মনে অবশ্য অন্য রকম এক আশাও ছিল। শত শত বছর পেরিয়ে যাচ্ছিল, তাদের সামনে ব্যাবিলনিয়রা এলাে, পারস্যের, গ্রিসের, রােমের মানুষেরা ছড়ি ঘােরাল, তবু তাদের জীবনে শান্তি আসেনি। তারা স্বপ্ন দেখত, কোনাে একদিন ডেভিডের কোনাে উত্তরাধিকারী আসবে তাদের রাজা হয়ে। তারপর তাদের সব অশান্তি দূর হবে। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, পৃথিবীতে নিজেদের জীবনযাপনের স্বাধীনতা পাবে। ইহুদিরা রাজার মাথার উপরে তাদের পবিত্র তেল ঢেলে তাকে শুদ্ধ করে নেয়। এরপর রাজা হয়ে যায় তাদের কাছে পবিত্র। তারপর তারা নিজেদেরকে রাজার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। আধুনিক সমাজে যেমন দেখা যায়, রাজাকে মুকুট পরানাের অনুষ্ঠান। রাজাকে মুকুট পরানাে হলে তারপর তিনি হয়ে ওঠেন সবার মধ্যমণি। হিব্রু ভাষায় পবিত্রকরণের পরে সেই রাজাকে তারা ডাকে মাসিহা। ইহুদিরা বছরের পর বছর কল্পিত একজন মাসিহার অপেক্ষায় ছিল। যেমন অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ইহুদি ম্যাকাবিউস যেভাবে সেলুসিড রাজাকে পরাজিত করেছিলেন, সেরকম একটা স্বপ্ন তাদের চোখে সবসময় ছিল। তারা জানত, তার মতাে আরেকজন মানুষ, এখনও যদি তাদের নেতা হয়ে আসে তাবে রােমকে পরাজিত করতে পারবে নিশ্চয়ই। অন্যান্য ইহুদিরা, যারা বুঝতে পেরেছিল যে অগাস্টাসের সময়ে রােম আসলে সেলুসিড রাজ্যের তুলনায় হাজার গুনে শক্তিশালী, চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের সময়ে তারা নিজেদের মুক্তির বিষয়ে ততটা নিশ্চিত ছিল না। অবশ্য তারাও এক ধরনের অতি অলৌকিক স্বপ্নের ঘােরে দিন কাটাত। তারা ভাবত একজন আসবেন, যিনি শুধু ইহুদি রাজ্যকেই বাঁচাবেন তা নয়; সেই মাসিহা তাদের রাজ্যে সুবিচার আর পবিত্রতা কায়েম করবেন, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করবেন আর সমস্ত পৃথিবীকে এক এবং অদ্বিতীয় বিধাতার বিশ্বাসে ফিরিয়ে আনবেন। জুডিয়ায় সে সময়ে অনেকেই সে রকমের মাসিহা হয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকে জাতিকে সেভাবে সাহায্য করার জন্য সবার সমর্থন চেয়েছেন। সে ধরনের লােকদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযােগ দেখা গেছে। হেরােড আর রােমানরা চুপচাপ তাদের এই ভুইফোড় মাসিহা হয়ে ওঠা আর দেশের ভেতরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হওয়ার কাণ্ডকারখানা দেখছিল।

যিশু খ্রিস্টের জন্ম

তারপর বাইবেলের নতুন বিভাগের গসপেল দ্য সেইন্ট ম্যাথিউ-এর দ্বিতীয় পর্বের কাহিনী অনুযায়ী একটি শিশুর জন্ম হলাে যার নাম যিশু (গ্রিকে যাকে বলে যশােয়া)। তার জন্ম হলাে হেরােডের রাজ্যের শেষ প্রান্ত, বেথেলহামে। এই মাসিহার ব্যাপারে যাবতীয় অলৌকিক তথ্য এখানে সেখানে পাওয়া যায়, যেমন পাওয়া যায় বাইবেলের পুরনাে বিভাগে। হােরােড সদ্য জন্মানাে এই শিশুর কথা জানতে পারার পরে, বেথেলহামের দুই বছরের কম বয়সী সব শিশুকে মেরে ফেলার আদেশ দেন। কিন্তু শিশু যিশুকে ততক্ষণে মিশরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাইবেলের দ্বিতীয় বিভাগ ছাড়া এই ঘটনার উল্লেখ অন্য আর কোথাও নেই। তবু এর উল্লেখ করা হলাে এই কারণে যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময়ের সাথে ঘটনাটিকে সম্পর্কযুক্ত করার প্রয়ােজন আছে। হােরােডের শাসনামলের পাঁচশ বছর পরে সিরিয়ার ধ্যানী ডিওনিসিয়াস এক্সিগিউয়াস বাইবেল আর রােমান ইতিহাস ঘেটে সিদ্ধান্ত নেন যে রােমান ক্যালেন্ডার (এইউসি) অনুযায়ী যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেন ৭৫৩ সালে। পরে ইউরােপের সাধারণ মানুষেরা এই হিসাব মেনে নেন। সুতরাং রােমান ক্যালেন্ডার ৭৫৩ সালটি ১ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে দেখানাে হয়। তাই রােমের পত্তনের সালটি দাঁড়ায় খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সাল। যাই হােক ডিওনিসিয়াস তার গণনায় নিশ্চয়ই কোনাে ভুল করেছিলেন কারণ এটা সত্য যে রােমের ক্যালেন্ডারের ৭৪৯ সালে তিনি মারা যান, যেটা ছিল তার হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ৪ সাল। যদি হেরােড যিশুর জন্মের কারণে ওই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে যিশু নিশ্চয়ই জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালের আগে অথবা তারও আগে। (এটা ভাবা আসলে খুবই হাস্যকর যে যিশু জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে বা তারও আগে, কিন্তু ডিওনিসিয়াসের গণনা ইতিহাসের বইগুলােতে এতই পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে এটা বদলানাে বেশ কঠিন আর অসম্ভব একটা ঘটনা হবে।)

হেরোডের উত্তরাধিকারীগণ ও রাজ্যের ভাগাভাগি

হেরােড যখন মারা যান, তখন তার তিন পুত্র বর্তমান ছিল যাদের তিনি রাজ্যটি ভালােভাবে ভাগাভাগি করে দিয়ে যেতে পারেননি। তারা প্রত্যেকেই রাজ্যের বিভিন্ন অংশের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন। হেরােড আর্কেলাস জুডিয়ায় আর জুডিয়ার উত্তরে সামারিয়ায় শাসন করেছিলেন। হেরােড অ্যান্টিপাস শাসন করেছিলেন গ্যালিলি আর সামারিয়ার উত্তরে পেরিয়ায়, যেটা ছিল জর্ডান নদীর পূর্বদিক। আর হেরােড ফিলিপ শাসন করেছিলেন ইটুরিয়া যেটা গ্যালিরির উত্তরপূর্ব অংশ। অ্যান্টিপাস আর ফিলিপ তাদের জীবদ্দশায় ক্ষমতায় ছিল কিন্তু আর্কেলাস থাকতে পারেননি। ইহুদিদের রাজধানী জেরুজালেমেই আর্কেলাসের ক্ষমতার পতন হয়। তাই ইহুদিরা রােমের অন্যায় হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সবসময় অভিযােগ করত। ৬ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টাস আর্কেলাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে গাউলে নির্বাসন দেন। তার বেশ কিছু কাল পরে জুডিয়া আর সামারিয়া রােমের শাসকদের নির্ধারিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে।

যিশুর জনপ্রিয় হয়ে ওঠা

আবার এদিকে যিশুর জন্মস্থান হিসেবে বেথেলহামকে ভাবা হয় যেটা কিনা জেরুজালেমের দক্ষিণ দিকের ছােট্ট একটি শহর। আর তাদের প্রাচীন কল্পকথা অনুযায়ী সে জায়গাটিকেই কোনাে একজন মাসিহার জন্মস্থান হবে বলে ধারণা করা হতাে। (যদিও হাজার বছর আগে সেখানেই জন্মেছিলেন ডেভিড।) যিশুর পরিবার গ্যালিলির একটি শহর নাজারেথে বাস করত। তখন জায়গাটির নাম গ্যালিলিই ছিল। সেটা ছিল অ্যান্টিপাসের রাজত্ব। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন যিশু। তিনি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলেন তখন তার ছিল অনেক অনুসারী। তার আদর্শ, শিক্ষা আর ব্যক্তিত্ব মানুষকে তার দিকে চুম্বকের মতাে টানত। তার কিছু কিছু অনুসারী তাকে সেই প্রাচীন কল্পকথার মাসিহাই মনে করেছিল। (আর এখন তার বিষয়ে বলতে গেলে মাসিহা শব্দটি আসবেই। তিনি তার জীবন দিয়ে সেটি অর্জন করেছিলেন। তখন থেকেই শত শত, হাজার হাজার মানুষ তাকে মাসিহা রূপে দেখে আসছে। তখন থেকেই তার স্বর্গীয় স্বভাবের জন্য তিনি মানুষের প্রিয়।) গ্রিক ভাষায় পবিত্রকরণ আসলে ‘খ্রিস্টিয়করণ’। আর হিব্রুতে ‘মাসিহা যশােয়া’ ইংরেজিতে হয়ে দাঁড়ালাে ‘জিসাস ক্রিস্ট’ বা যিশুখ্রিস্ট। এটাই ছিল তার গ্রিক থেকে পাওয়া ইংরেজি নাম। হেরােড আর রােমের কর্তৃপক্ষ লক্ষ করেছিল যে যিশুখ্রিস্টের মধ্যে আস্তে আস্তে মাসিহার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর থেকে তাদের জন্য বিপদ ধেয়ে আসতে পারে এটা তারা অনুমান করতে পেরেছিল। ইহুদি ধর্মের লােকেরাও বুঝতে পারছিল, যে কোনাে সময়ে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে আর পুরাে বিষয়টি তাদের আওতার বাইরে চলে যেতে পারে। রােমের সামান্য আক্রমণের প্রত্যুত্তরে তাদের ইহুদি জাতি যেভাবে জেগে উঠবে তাতে রাজ্যকে পুরােপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে। (অর্ধশত বছর পরে এমনই ঘটেছিল। তাই তাদের তখনকার ভয় আসলে অমূলক বা বােকামি ছিল না।) যিশুর জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন তিনি জেরুজালেমে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেও ততদিনে একজন মাসিহার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই তিনি একটি গাধার পিঠে চেপে শহরে প্রবেশ করেন। এভাবেই বাইবেলের প্রথম বিভাগে মাসিহার আগমনের কথা বর্ণনা করা আছে। তাই শহরের বাসিন্দারা সাথে সাথে তাকে মাসিহা হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ

রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা যিশুকে নীরবে গ্রেফতার করল। তারা মনে করেছিল যিশুর অনুসারী লােকদের আর জেরুজালেমে বসবাসকারী ইহুদি জাতির মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে আগেভাগেই তাকে গ্রেফতার করেছিল। যিশুর অনুসারীদের মধ্যে একজন, যার নাম ছিল জুডিয়াস ইসকারায়ট, তিনি তার লুকিয়ে থাকার জায়গার সন্ধান দিয়ে দেন। এজন্যই কোনাে গােলমাল ছাড়া তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। ইহুদিরা তাদের ক্ষমতা দেখাতেই এমনটা করে।  ইহুদি নেতাদের কাছে যিশুর অপরাধ ছিল তাদের ধর্মের প্রতি এক ধরনের কটাক্ষ করা। তারা মনে করত যিশু নাস্তিক। তাই নিজেকে মাসিহা বলে প্রচার করছে। তাদের বিশ্বাস ছিল যিশু যা বলছে তা সত্য নয়। রােমানদের কাছে যিশুর অপরাধ ছিল কেবল রাজনৈতিক। তাদের মতে মাসিহা সেই হতে পারে যে কিনা ইহুদিদের রাজা হবে। আর যিশু যদি নিজেকে মাসিহা বলে পরিচয় দেন তবে তিনি আসলে ইহুদিদের রাজা হতে চাচ্ছেন। সুতরাং সেভাবে দেখলে তিনি আসলে রােমান শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। কারণ রােমান শাসকরা মনে করত, ইহুদিদের জন্য একজন রাজা নির্বাচন করে দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই আছে। সম্ভবত ২৯ সালে (রােমান ৭৮২ সালে) যিশুকে বিচারের জন্য পন্টিয়াস পাইলেটের সামনে আনা হয়। আর্কেলাসের অপসারণের পর থেকে পন্টিয়াস ছিলেন ষষ্ঠ শাসক। তাকে এই ঘটনার মাত্র তিন বছর আগে নিয়ােগ দেয়া হয়। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, পন্টিয়াস যিশুকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। কেবল ইহুদিদের চাপে পড়েই তিনি বিচারকাজ চালাতে বাধ্য হন। ইহুদিদের ধর্মীয় নেতারা মনে করেছিলেন যে যিশুকে ছেড়ে দেয়া মানে ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা আর এর ফলে দেশের ভেতরে বিদ্রোহের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে রােমান আক্রমণের আশঙ্কাও ছিল অবশ্যম্ভাবী। বাইবেলে আছে ধর্মীয় নেতা কাইয়াপাস বলেছেন, “এটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে বহু মানুষের ভালাের জন্য একজন মানুষকে মরতে হবে। এভাবে যদি পুরাে জাতি রক্ষা পায় তাে তাও গ্রহণযােগ্য।” পাইলেট যদি যিশুকে বিচারব্যবস্থার অধীনে আনতে চাইতেন তাহলে তার অপরাধ রােমান আইনের আওতায় ফেলা ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না। কারণ তার এখতিয়ারের মধ্যে ছিল কেবল রােমান আইন প্রয়ােগ করা। তাই যিশুর আগমন রােমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবেই ধরে নেয়া হলাে। তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত হলাে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা। এ ধরনের শাস্তি পূর্বদিকের প্রদেশগুলােতে আর রােমে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ইহুদি বা গ্রিকরা কখনও এই শাস্তি কোথাও প্রয়োগ করেনি। তবে রােমে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে ইতালির স্পার্টেকাসের পক্ষে লড়া মৃত্যুপণকারী বিদ্রোহীদের নির্বিশেষে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। ইতালির প্রধান সড়ক অ্যাপ্লিয়ান ওয়ের দুপাশে, মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে অন্তত ছয় হাজার ক্রুশে ধরা পড়া বিদ্রোহীদের শরীর ঝুলছিল। এভাবে শেষে যিশুকেও ক্রুশে ঝােলানাে হলাে। কেবল এক সাধারণ বিদ্রোহীর মতাে তার জন্যও একই শাস্তি বহাল হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল, এভাবেই যিশুর কাহিনী শেষ হয়ে গেল। কোনাে রােমানরা তখন ভুলেও ভাবেনি যে এই অন্তিম শাস্তি যে তলে তলে একটি নতুন যুগের ভূমিকা।

তদকালীন রোমান সমাজের আদর্শ এবং ধর্মীয় প্রথা

রোমানদের ধর্ম, রাজার প্রতি শ্রদ্ধা ও গ্রিক প্রভাব

সেই থেকে রােমান আর ইহুদি সংস্কৃতির মধ্যে লড়াই চলতেই থাকল। লড়াই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে চলতেই থাকল। এই লড়াই যেন চলতেই থাকবে, কেবল স্থান-কাল-পাত্র বদলে যাবে। রােমানদের ধর্ম বেশিরভাগ এট্রুস্কানদের কাছে ধার করা, শুরু থেকে বলতে গেলে মূলত কৃষিভিত্তিক। তাদের অসংখ্য দেবদেবীর আত্মা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিরই বিভিন্ন শক্তির বাহক। তাদের বেশিরভাগ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে, আর চাষের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনায় নিবেদিত। সাধারণত সব ধর্মীয় আচার শেষ পর্যন্ত কৃষিকে আরও উন্নত করার উদ্দেশে ছিল নিবেদিত। যে সমাজে কৃষিকাজে উন্নতিসাধন না করলে মানুষকে না খেয়ে থাকতে হতাে সেখানে ধর্মীয় আচার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে কৃষির উন্নতি করার চেষ্টা অবশ্যই অনুধাবনযােগ্য। তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান নিয়ম রীতির জন্যও অনেক দেবতা ছিল। সেই দেবদেবীদের আদর্শ অনুযায়ী তাদের জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনায়াসে কেটে যেত। ধর্মীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই সাধারণ। সে রকম একটা ব্যাপারের জন্য একজন ব্যস্ত আর ক্লান্ত কৃষক যতটুকু সময় ব্যয় করতে পারে ঠিক ততটুকুই করত। এই প্রাচীন ধর্মে রাজ্যের হস্তক্ষেপে একটিই মাত্র নতুন নিয়ম সংযােজিত হয়েছিল, তা হলাে রাজকীয়ভাবে সম্রাটের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এই সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে তাদের মৃত্যু পরবর্তীকালের জন্য একরকম ধরাবাধা আন্তরিকতাবিহীন শ্রদ্ধার প্রতিশ্রুতি দেয়া হতাে। একই অনুষ্ঠানে মৃত সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে স্বর্গীয় দেবতা হিসেবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হতাে। রােমের উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা যখন গ্রিক সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা ঘােষণা করল, গ্রিসের প্রথাগত ধর্ম তখন যেন রােমের ধর্মের মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করল। রােমের ধর্মীয় দেবতা জুপিটার আর গ্রিসের জিউস একই দেবতা। আবার রােমানদের মিনার্ভা আর গ্রিসের এথেন্স একই দেবী। যাই হােক, কাগজে কলমে গ্রিস আর রােম, দুই রাজ্যেরই ধর্মের কঠোর অনুশাসন আসলে ততদিনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রােমের উচ্চশ্রেণির মানুষেরা ধর্মীয় অনুশাসনগুলাে কেবল যন্ত্রের মতাে, কিছুটা উদাসীনভাবে পালন করে আসছিল।

শিক্ষিত শহুরে এলিটদের বিশ্বাস

প্রাচীন কোনাে ধ্যান ধারণা এ ধরনের কোনাে সমাজের জন্য উপযুক্ত নয় যেখানে কেবল সংস্কৃতিবর্জিত কৃষিজীবীরাই বাস করে না, যেখানে বাস করে অভিজাত, শিক্ষিত, শহুরে যারা পৃথিবীতে এসেছে তাদের সভ্য মন নিয়ে, সুরুচিসম্পন্ন কিছু করার জন্য। সেই শ্রেণির আগ্রহ কেবল একটি ভালাে ফলনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার থেকে অনেক বড় কিছুতে। তাদের ভাবনায় ছিল একটি সুখী জীবনের স্বপ্ন; চমৎকারভাবে অবসর কাটানাের, তাদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটানাে আর জাগতিক জীবনের যাবতীয় প্রয়ােজন মেটানাের স্বপ্ন। গ্রিকরা এই আদর্শের একটি জীবনাচরণের মাধ্যমে সুখ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল আর রোমানরাও তাদের সাথে অলিখিতভাবে যােগ দেয়।

এপিকিউরাস

এক ধরনের অদ্ভুত আদর্শের প্রবক্তা ছিলেন এপিকিউরাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ সালে গ্রিসের সামােস দ্বীপে বাস করতেন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৬ সালে তিনি এধিনায় একটি স্কুল স্থাপন করেন। সেই স্কুল খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঠিক তেমনই ছিল। এপিকিউরাস তার আগের কিছু গ্রিক দার্শনিকের দর্শন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী কতকগুলাে ছােট ছােট পরমাণু দিয়ে তৈরি। এই পরমাণু বা একগুচ্ছ পরমাণুর পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের উপরেই পৃথিবীর যাবতীয় পরিবর্তন নির্ভর করে। এপিকিউরিয়ান আদর্শের এই জায়গায় পৃথিবীর যাবতীয় পরিবর্তন আর মানুষের বেড়ে ওঠার রহস্য নির্ভর করে দেবদেবীর ইচ্ছার উপরে, এই ধরনের বিশ্বাসের জন্য তেমন কোনাে স্থান ছিল না। এই আদর্শটি এক ধরনের নাস্তিকতা, সেই সাথে গোঁড়ামি মুক্তও বটে। তারা নিজেদের শুধু শুধু ঝামেলায় ফেলার চেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় অনুশাসনগুলাে বেশ আনন্দ নিয়েই পালন করত। এরকম একটি মহাজাগতিক অবস্থায়, যেখানে পরমাণুগুলাে সবসময় এদিক সেদিকে ছােটাছুটি করছে, সেখানে মানুষ দুটো জিনিসের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারে: আনন্দ এবং বেদনা। এই আবিষ্কারের কারণ ছিল মানুষকে বোঝানাে যে মানুষ যেন আনন্দের পুরােটা উপভােগ করে আর বেদনায় যতটা পারে কম মুষড়ে পড়ে। তাই এপিকিউরাসের মতে, কোনাে কিছুর সামান্য অংশ যদি কাউকে ব্যাপক আনন্দ দিতে পারে তবে সেই একই জিনিসের প্রচুর লভ্যতা যে আরও বেশি আনন্দ দেবে তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই। না খেতে পেয়ে উপােস থাকা যেমন কষ্টকর তেমনি অতিরিক্ত খেয়ে হজমের গণ্ডগােল করে ফেলাও একই রকমের বেদনাদায়ক। পরিমিত খাদ্য গ্রহণের মধ্যেই খাবার খাওয়ার আনন্দ লুকিয়ে আছে। একইভাবে জীবনের আর সব আনন্দের উপকরণের ক্ষেত্রেও তাই। অন্যদিকে মানুষের নিজের মনের শান্তি মেটানাের কথা ভুললেও চলবে না। শেখার ও জানার আনন্দ, বন্ধুত্বের আবেগ, ভালােবাসার প্রশান্তি, এসবের মধ্যেই মানুষের মানসিক মুক্তি লুকিয়ে আছে। এপিকিউরাসের মতে শুধু শরীরের আনন্দ-উত্তেজনার চেয়ে এই সব জাগতিক আনন্দের মধ্যে ঢের বেশি লাভ।

পরবর্তী প্রজন্মের বিকৃত এপিকিউরিয়ানিজম

পরবর্তী প্রজন্মের তার মতাদর্শী সব মানুষ এপিকিউরাসের মতােই জ্ঞানী আর ধৈর্যশীল ছিল না। কারণ শরীরের চাওয়া-পাওয়াকে প্রধান্য দেয়া ছিল খুব সহজ আর সেসবের উপরে কোনাে বিধিনিষেধ আরােপ করা ছিল খুব কঠিন। যে যাই বলুক, আজ যে আরাম আয়েশ হাতের কাছে বিদ্যমান তাকে অবহেলা করার কোনাে যুক্তি আছে? পরের জন্য অপেক্ষা করে থাকলে হয়তাে খুব দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই এই “এপিকিউরান” শব্দটি পরবর্তীকালে ভাষায় সংযােজিত হয় “আভিজাত্যে অবগাহন” করার অর্থ নিয়ে। আলেক্সান্ডারের আমলের পরের শতাব্দীতে এই এপিকিউরিয়ান মনােভাব ইহুদি আর গ্রিকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে গেল। যেসৰ ইহুদিরা গ্রিক সংস্কৃতিকে ভালােবেসে নিজেদের ধর্ম বিসর্জন দিয়েছিল তাদের বলা হতাে “এপিকিউরিয়ান”। আর আজকের দিনে কোনাে অন্য ধর্মের মানুষ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে বলে “এপিকরস”। রােমানরা এপিকিউরিয়ান ধারায় বিশ্বাসী হয়ে গেল। রােম গ্রিসের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদশালী ও শক্তিশালী ছিল। রােমের যে কোনাে শহর গ্রিসের যে কোনাে শহরের চেয়ে বেশি অভিজাত সাজসজ্জায় সজ্জিত ছিল। দেখতে দেখতে রােমের এপিকিউরিয়ানিজম খােদ গ্রিসের তুলনায় বিশাল হয়ে দেখা দিল। রাজ্যের ভেতরে সব জায়গায় নিজেকে যে কোনাে রকম আরাম আয়েশে ডুবিয়ে দেয়ার সময়ে এপিকিউরিয়ানিজমের দোহাই দেয়া হতাে।

পেট্রোনিয়াস ও তার এপিকিউরিয়ানিজম

রােমান এপিকিউরিয়ানের জলন্ত উদাহরণ হতে পারেন হেইয়াস পেট্রোনিয়াস। তিনি রােমে কনসল হিসেবে কাজ করেছিলেন। আবার এশিয়া মাইনরে বিথিনিয়ায় তিনি গভর্নর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি তার সারা জীবনই আভিজাত্য আর আরাম আয়েশে কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু এভাবে জীবন কাটানাের পরেও তিনি সেই জীবনযাপন পদ্ধতিকে নানান রকম কটাক্ষ করতেন। তার লেখা “স্যাটিরিকন” বইয়ে তিনি তার বিশ্বাসের কথা লিখে গেছেন। এই বইয়ে তিনি আভিজাত্যে জীবন কাটানােকে এক ধরনের ভুল বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল লােকেদের চেয়ে যাদের হাতে বেশি টাকা আছে, তারা আরাম আয়েশের পেছনে যে ধন দৌলত খরচ করে তা কেবলই অপচয়। যাই হােক, তার এই নতুন তত্ত্ব এতই প্রশংসিত হলাে যে এই বিষয় নিয়ে কথা উঠলে তিনি নিরাের সহচর হয়ে গেলেন। নিরাে তার উপরে এই ব্যাপারে যে কোনাে মতবাদ দেয়ার জন্য নির্ভর করতেন। তার সাহায্যে নিরো আরও নিত্যনতুন সময় কাটানাের খেলা আর মজার কাজকর্ম আবিষ্কার করতে লাগলেন। তাকে ডাকা হতাে “আর্বিটার এলেগ্যানটিয়ারাম” (রুচি আর স্বকীয়তার প্রতীক)। কখনও আবার তার নামের সাথে মিলিয়ে তাকে “পেট্রোনিয়াস আর্বিটারও” বলা হতাে। নিরোর অনেক বন্ধু আর অধস্তনদের মতাে পেট্রোনিয়াসের শেষটাও হলাে বেশ খারাপ। নিরাে যখন-তখন যার-তার ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতেন। পেট্রোনিয়াসকেও সন্দেহ করা শুরু করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পেট্রোনিয়াস অন্যের হাতে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি আত্মহত্যা করেন।

জেনো অফ সাইপ্রাস ও তার স্টয়সিজম

গ্রিক দর্শনের দ্বিতীয় বিখ্যাত স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন জেনো। (ধরে নেয়া হয় যে তিনি ফিনিশিয়ান পরিবারের।) তিনি জন্মেছিলেন আধা গ্রিক আর আধা ফিনিশিয়ান হয়ে। প্রায় এপিকিউরাসের জন্মের সময়ের কাছাকাছি সাইপ্রাস দ্বীপে তিনি জনুগ্রহণ করেন। জেনাে, এপিকিউরাসের মতােই অ্যাথিনায় একটি স্কুল তৈরি করেন। বাজারের মাঝখানে এক জায়গায় তিনি তার স্কুল স্থাপন করেন। তার স্কুলের বারান্দা আর করিডাের ট্রোজান যুদ্ধের নানান দৃশ্যের আঁকা ছবি দিয়ে ভরা ছিল। একে বলা হতাে “স্টোয়া পইকিল” (ছবি আঁকা বারান্দা)। আর সেখানে জিনাের পড়ানাের পদ্ধতিকে বলা হতাে “স্টয়সিজম”। স্টয়সিজমেও একজন মাত্র দেবতার কথা বলা হয়। একেও তাই একরকমের একেশ্বরবাদ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু আরও কিছু ছােটখাটো দেবদেবীর উপরেও যে স্বর্গীয় কিছু কিছু ক্ষমতার জন্য নির্ভরতা ছিল সেটা অবশ্য দেখা গেছে। কোনাে কোনাে মানুষকেও আবার দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করার কাহিনী শােনা যায়। এভাবেই হয়তাে তারা তাদের কট্টরপন্থী ধর্মীয় আচার আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক হতে চেয়েছিলেন। স্টয়সিজম মানুষকে দুঃখবেদনায় অহেতুক ডুবে থাকতে নিরুৎসাহিত করত। তবে বিষাদ থেকে উতরানাের জন্য ফুর্তি করে সময় কাটাতে কখনও বলেনি। কারণ মানুষ তার জন্য সঠিক আনন্দ খুঁজে পায় না; যদিও বা পায়, সেই আনন্দ কেবল মানুষের জন্য আরেকরকম ব্যথার সৃষ্টি করে। মানুষের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ফুরিয়ে গেলে সেই স্মৃতি নিয়ে সে কেবল হা-হুতাশ করে। ধনসম্পদ একসময় খরচ হয়ে যায়, স্বাস্থ্য নষ্ট হয় আর ভালােবাসা মরে যায়। তাই স্টয়সিজমে উদ্বুদ্ধ স্টয়িকরা নিজেদেরকে আনন্দ ও বেদনার উর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করত। নিজেদের এভাবেই তারা তৈরি করত যেন সুখ বা দুঃখের দাস না হয়ে পড়ে। সুখ-দুঃখের মােহ আর যন্ত্রণা থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। কেউ যদি কিছু আশা না করে তবে তার আশাহত হওয়ারও কোনাে ভয় বা দুশ্চিন্তা থাকে না। একজন মানুষের সব ধরনের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক সে নিজে। তাই তারা মনে করত মানুষ যদি নিজের প্রভু হয় তাহলে আর অন্য কারও দাস তাকে হতে হবে না। কেউ যদি এরকম আদর্শ একটি জীবনযাপন করে তবে দৈনন্দিন জীবনের অনিশ্চয়তা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আজকের দিনে ইংরেজি ভাষায় “স্টইক” শব্দটি “আনন্দ-বেদনার প্রতি নির্লিপ্ত” অর্থে ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবে এরকম একটি আদর্শ এপিকিউরিয়ানের মতাে অত বেশি জনপ্রিয় হলাে না। কিন্তু কিছু কিছু রােমানের কাছে মনে হলাে এটা রােমের প্রাচীন ধর্ম অনুযায়ী পরিশ্রমের প্রতি সৎ হওয়া, ভয়-ভীতির উর্ধ্বে উঠে যাওয়া, এসবের মতােই। তারা স্টয়সিজমের আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করল। সেই ভয়ংকর বিলাসে গা ভাসানাের দিনেও রােমের কিছু কিছু মানুষ স্টয়সিজমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল।

স্টয়িক সাহিত্যিক সেনেকা

সে সময়ের রােমান স্টয়িকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলেন সেনেকা (লিউসিয়াস অ্যানাউয়াস সেনেকা)। তিনি জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে স্পেনের করবা (বর্তমানে করডােভা) অঞ্চলে। তার বাবা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী আর তরুণ সেনেকাও আইন নিয়ে পড়াশােনা করেছিলেন। তিনি রােমে একটি স্টয়িক স্কুলে পড়েন আর একজন সুবক্তা হিসেবে এতই পরিচিত হন যে ক্যালিগুলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ক্যালিগুলার মৃত্যুর পরে সেনেকার সাথে ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনার কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে সম্রাট ক্লডিয়াস ৪১ খ্রিস্টাব্দে তাকে রােম থেকে বহিষ্কার করেন। অবশ্য মেসালিনাকেও পরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ক্লডিয়াসের পরের স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনা সেনেকাকে আবার সাম্রাজ্যে ডেকে নিয়ে আসেন তার ছােট ছেলে নিরােকে পড়ানাের জন্য। সেনেকা নিরােকে স্টয়িক মতে পরিচালনা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়, সেই শিক্ষা নিরাের জীবনে কোনাে ছাপ ফেলতে পারেনি। সেনেকা স্টয়িক দর্শনের উপরে প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন। গ্রিক সাহিত্যিক ইউরিপিডিসের অনুকরণে তিনি গ্রিসের প্রাচীন কাহিনীগুলাে বহুবার লিখেছিলেন। কিন্তু পুরােপুরি স্টয়িক চিন্তাভাবনার না হয়ে সেগুলাে এত বেশি আবেগে পরিপূর্ণ আর ভালােবাসায় সিক্ত ছিল যে সেগুলােকে স্টয়িক লেখা হিসেবে পরেও তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সেসবই একমাত্র রােমান বিয়ােগান্তক কাহিনী যা আজ এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। তার নিজের সময়েও তিনি এত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন যে সহজেই নিরাের বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। নিরাে তার নিজের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। রােমানরা অনেকে যেমন মনে করত যে নিরাের বেশিরভাগ লেখা আসলে সেনেকা লিখে দেন, এই ভাবনাটা নিরােকে খুব বিরক্ত করে রাখত সারাক্ষণ। কিন্তু সত্যিই তিনি নিরাের নামে কিছু লেখা লিখেছিলেন। সেনেকাকে গৃহবন্দী হতে হয়েছিল। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ তুলে তাকে নিজের বাড়িতেই নির্বাসিত করা হয়। তারপর তাকে সে অবস্থায়ই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়।

দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের চিন্তাধারা ও রহস্যবাদী ধর্ম

রােমের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা এপিকিউরিয়ানিজম অথবা স্টয়সিজম, কোনাে মতবাদের সাথেই নিজেদের একাত্ম করতে পারেনি বা করবে এমন আশা করা যায়নি। তাদের সম্পদের এবং অবসরের এতই অভাব ছিল যে তারা প্রকৃত এপিকিউরিয়ানস বা স্টয়িক কী করে হয়ে উঠবে তা ভাবার সুযোগ পায়নি। এছাড়া তাদের আর করারই বা কী ছিল। কারণ তাদেরকে সুখকে অবজ্ঞা করতে বলা হতাে নিতান্তই হাস্যকর। যাদের জীবনে ন্যূনতম আমােদপ্রমােদ অনুপস্থিত তাদেরকে সেটা অবজ্ঞা করতে বলার কোনাে মানে হয় না। তাদের জন্য সামান্য সান্তনাই ছিল যথেষ্ট। একজন দ্ররিদ্র মানুষ যতটুকু পর্যন্ত কল্পনা করতে পারে। তাদের জন্য এমন কোনাে পথের কল্পনাই যথেষ্ট ছিল যে পৃথিবীর এই দুর্বিষহ জীবনের পরে, মৃত্যুপরবর্তীকালে কেবলই শান্তি অপেক্ষা করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিসের রহস্যবাদী বা মিস্টিক ধর্মে, যেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানও সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না, কেবল আয়ােজকরাই সেখানে অংশ নিতে পারত; এমনকি যারা সেখানে অংশগ্রহণ করত তারাও ফিরে এসে সেখানে কী হলাে না হলাে, সেসব কিছুই কাউকে বলতে পারত না। তাদেরকে একরকমের বােবা হয়ে যেতে হতাে। এখান থেকেই তাদের ধর্মের ব্যাপারে “মিসটিক রিলিজিয়ন” বা “রহস্যবাদী ধর্ম” কথাটি প্রচলিত হয়েছে। এখনও ইংরেজিতে এই অতীন্দ্রিয়তাকে গােপন, ব্যাখ্যার অতীত বা ব্যাখ্যার অযােগ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই ধরনের গােপন শেষকৃত্যানুষ্ঠান, তখন যেমনই হােক, খুব আবেগ আর গাম্ভীর্যের সাথে পালিত হতাে। উপস্থিত সবাই একই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতাে। তারা আয়ােজকদের সাথে এক হয়ে মৃত্যুপরবর্তী নতুন জীবনে প্রবেশের শপথ নিত। এই কৃত্যানুষ্ঠান থেকে তারা তাদের জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হতাে। তারা অনুভব করত যে এখানে, এই পৃথিবীতেই তাদেরকে এক হতে হবে। এক হয়ে তারা শপথ গ্রহণ করত যে মৃত্যু তাদের পৃথক করতে পারবে না। তারা নিজেদের ভেতরে বিশ্বাস আনত যে এই পৃথিবী তাদের জন্য শেষ গন্তব্য নয়, এটি একটি রাস্তা মাত্র। তাদের জন্য মৃত্যুর পরে আরও ভালাে কিছু অপেক্ষা করছে। গ্রিক আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন বা অতীন্দ্রিয় বা রহস্যবাদী ধর্মগুলাের মধ্যে সবচেয়ে পুজনীয় ছিল এলিউসিনীয় রহস্যবাদ। এই ধর্মের কেন্দ্রে ছিল এলিউসিস। এটি ছিল এথেন্স শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরপশ্চিমে। গ্রিক প্রাচীন কাহিনী ডিমিটার ও পার্সিফোনের উপর নির্ভর করে এই ধর্ম গড়ে উঠেছিল। পার্সিফোন হেউডের লুক্কায়িত রাজ্যের আড়ালে ছিল বহুদিন। আবার তাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা হলাে। এই ধর্মের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক হলাে, এই ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করত শরতের শস্যভরা ক্ষেতে কোনাে মানুষ মারা গেলে আবার বসন্তের কোনাে দিনে ফিরে আসবে। মূল কথা হলাে এই ধর্ম ভীষণ সম্মানজনক পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল। আরেকটি রহস্যবাদী ধর্ম ছিল “অর্ফিক রহস্যবাদ”। এই ধর্মের প্রবক্তা ছিলেন অর্ফিউস, যিনি হেইডের একজন উত্তরাধিকারী। এই ধর্মের মাধমেই তিনি পরিচিত হন। গ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার পতনের পরেও তাদের এই প্রাচীন ধর্মগুলাে একই রকম গুরুত্ব নিয়ে পালন করা হতাে।

নিরো ও রহস্যবাদী ধর্ম

এলিউসিনিয়ান ধর্মের জনপ্রিয়তা এতই প্রবল ছিল যে খােদ সম্রাট নিরাে ৬৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসে সফরে এলে তিনি এই ধর্ম গ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু নিরাের সেই ইচ্ছাকে গ্রহণ করা হয় না। কারণ নিরােকে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হতাে। এই ক্ষমার অযােগ্য অপরাধ তাকে চিরদিনের জন্য সেই ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের অংশ হতে বাধা প্রদান করেছিল। এভাবে এই আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ধর্মের প্রতি মানুষ তার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল। বিষয়টি ছিল, যারা এই ধর্মের নিয়মকানুন সৃষ্টি করেছে তারা কখনও কারও জন্য এই নিয়মের কাছে হার মানবে না। সে সম্রাট নিরােই হােক আর যে-ই হােক না কেন। অবশ্য অন্য সবকিছুতেও নিরােকে নিয়ে গ্রিসের মানুষেরা হাসাহাসি করত। কবিতা আবৃত্তি, সংগীত আর নাট্টাভিনয়ের বিশেষ প্রতিযােগিতার ব্যবস্থা তারা সবসময় করত সম্রাট নিরাের জন্য। আর সবসময় খেয়াল রাখত যে নিরাে যেন সেসব প্রতিযােগিতায় সর্বোচ্চ সম্মানের প্রাইজ পেতে পারে। ধর্মীয় নেতাদের পক্ষ থেকে এগুলাে ছিল নিরাের জন্য আরও বেশি সম্মান প্রদর্শন। কারণ নিরাে, যে কিনা নিজেকে কখনও নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে দেখা সহ্য করতে পারেন না, ধর্মে অংশগ্রহণের আবেদন খারিজ করাতে তার মনে ভয়ানক কোনাে কষ্ট যেন না আসে। গ্রিসের এসব আধ্যাত্মিক ধর্মই সেখানকার প্রাচীনতা আর উন্নতির চিহ্ন বহন করত।

হেলেনিস্টিক জগতের বাইরের ধর্মের প্রভাব

  • এশিয়া মাইনোরের দেবী সিবেলি : রােম সাম্রাজ্য তারপর পূর্বদিকে বর্ধিত হতে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে রােম একসময় পূর্বের আবেগী আর উৎসবের আমেজপূর্ণ ধর্মগুলাের সান্নিধ্যে আসে। সেগুলাের মধ্যে অনেকগুলােতে আবার সেই জন্ম-মৃত্যু আর পুনর্জন্মের বিশ্বাস আছে। দেখলে মনে হতাে সেগুলো গ্রিসের আধ্যাত্মিক ধর্মের সেই এক ঋতুতে মৃত্যুবরণ করে আরেক ঋতুতে জেগে ওঠার বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত। এশিয়া মাইনরের দিকে সিবেলি (Cybele) নামে দেবীর আরাধনা তখন খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। একে অনেকাংশে গ্রিক ডেমিটারের মতাে লাগত। সিবেলির আরাধনার আধিপত্য একসময় গ্রিস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালে রােমানরা যখন কার্থেজীয় সেনাপ্রধান হানিবেলের বিপক্ষে তাদের দীর্ঘ যুদ্ধ লড়ছে, তখন তারাও সিবেলির কাছে প্রার্থনা করত। স্বর্গ থেকে সিবেলির হাত দিয়ে পৃথিবীতে গড়িয়ে পড়া একটি পবিত্র পাথর এশিয়া মাইনর থেকে রােমে বিশেষ উৎসবের মধ্যে দিয়ে বয়ে আনা হয়। প্রথম দিকে এই কথিত পবিত্র পাথর, তার সাথে উপস্থিত একগাদা ধর্মযাজক আর তাদের জড়িয়ে নানান উৎসবে রােমানরা একটু বিব্রত বােধ করে। কিন্তু শুরুর দিকের বছরগুলােতে সিবেলির পূজা বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল।
  • মিশরের আইসিস, ও অসিরিস থেকে সেরাপিস : মিশরীয় দেবত্ববাদও একসময় রােমে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গ্রিক সভ্যতার সময়ে মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেব আর দেবী ছিল অসিরিস আর আইসিস। অসিরিস দেবতা একবার মৃত্যুবরণ করে আবার পুনর্জন্ম লাভ করেন। তিনি নিজের আকৃতি পরিবর্তন করে একটি পবিত্র ষাঁড় এপিসের মাধ্যমে আবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রিকদের কাছে অসিরিস-এপিস দেবতার নাম হলাে “সেরাপিস”। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে গ্রিসে সেরাপিসের পূজা খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। এক শতাব্দী পরে এই পূজার নিয়ম রােমে প্রবেশ করা শুরু করল। অগাস্টাস প্রাচীনপন্থী ছিলেন বলে এই পূজা বন্ধ করার আদেশ দিলেন। কিন্তু পরে ক্যালিগুলা একে উৎসাহ দান করেন। ডিমিটার, সিবেলি আর আইসিসের মতাে দেবীরা বিশেষ করে মহিলাদের কাছে ছাড়াও বাকি সকলের কাছেও বেশ সমাদৃত ছিল, বিশেষ করে যারা ভালােবাসা আর সহমর্মিতার প্রতি দুর্বল। দেবতারা বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধ আর রােষের। আর তাই যুদ্ধরত সেনারা করত দেবতার আরাধনা।
  • পারস্যের মিথ্রাস : রােমান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিক থেকে, পার্থিয়া অথবা পার্সিয়া (পারস্য) থেকে মিথ্রাস নামে এক স্বর্গীয় দেবতার আবির্ভাব হলাে। মিথ্রাস সূর্যের দেবতা ছিল। তার ছবিতে সবসময় দেখা যেত যে তিনি একটি ষাঁড়কে ছুরিবিদ্ধ করছেন। ছবিতে তিনি ছিলেন পূর্ণ তরুণ। আর তাই তার অনুসারীরা ষাড় বধ করে তার পূজার ব্যবস্থা করত। মহিলারা এই পূজায় অংশগ্রহণ করত না। কারণ মিথ্রাস ছিল শক্তি আর বীর্যের প্রতীক। মিথ্রাসের পূজা বেশিরভাগ করত সেনারা। টিবারিয়াসের শাসনামলে প্রথম রােমে মিথ্রাসের আগমন ঘটে।

ক্যালিগুলা থেকে নিরোর সময় পর্যন্ত (৪১-৬৮ খ্রি.) ইহুদিদের অবস্থা

জুডিয়ায় ইহুদিদের বিদ্রোহ

এর মধ্যে জুডিয়ায় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ইহুদিরা হেরােডসের আর তার পরিষদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল। তার শাসনে অনাস্থা পােষণ করছিল। একজন মাসিহার জন্য তাদের আজীবনের অপেক্ষা খুব সাংঘাতিক পর্যায়ে উপনীত হলাে। কিন্তু এর জন্য নিজেদের ধর্মের সাথে কোনাে সমঝােতা করতেও তারা ছিল নারাজ। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের ম্যাকাবিস আর তার ভয়ংকর শক্তিশালী বিদ্রোহী সাথীদের তাদের ধর্মের প্রতি সহৃদয়তা আর চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে মতবাদ তাদের হৃদয়ে তখনও জ্বলজ্বল করছিল। সম্রাটের প্রতি যে কোনাে ধরনের সম্মান প্রদর্শন যা কিনা ইহুদিদের দৃষ্টিতে সম্রাটকে বা তার কোনাে চিহ্নকে পূজা করা হচ্ছে মনে হলেই তারা ক্রমাগত সেই আচরণ প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানাত। পন্টিয়াস পাইলেট যখন যথােপযুক্ত সাজসজ্জা করে জেরুজালেমে প্রবেশ করেন তখন তার বাহনের উপরে সম্রাট টিবারিয়াসের একটি ছবি আঁকা ছিল। সেই ছবিকে তারা এক ধরনের উপাসনার বস্তু বলে মনে করে। তাই পন্টিয়াস শহরে ঢােকার সাথে সাথেই সেখানে দারুণ বিদ্রোহ দেখা দেয়। পন্টিয়াস পাইলেটের যুদ্ধ পতাকার মধ্যে সম্রাট টিবারিয়াসের ছবি ছিল। সেই সময়ে টিবারিয়াস কোনাে ধরনের উটকো ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তখনই সবকিছু থেকে তার ছবি অপসারণের আদেশ দেন। ইহুদিরা মনে করত তাদের বিধাতাই এক এবং অদ্বিতীয়। তাদের বিধাতা ছাড়া বাকি সব উপাসনার জিনিস তাদের কাছে ছিল বিরক্তিকর আর পরিত্যাজ্য। বিধাতার প্রশ্নে এরকম আপােষহীন ব্যবহারের কারণে ইহুদিদের প্রতি রাজ্যের মানুষের সমর্থন দিন দিন কমে যেতে লাগল। কারণ পুরাে রাজ্যে একমাত্র ইহুদিরা ছাড়া বাকি সবার একের অধিক উপাসনার বিষয়বস্তু ছিল। আর তারা অন্য ধর্মবিশ্বাসের প্রতিও সহনশীল ছিল। গ্রিকদের কাছে ইহুদিরা বেশি অপছন্দের হয়ে উঠল কারণ তারা একাধিক বিধাতার উপাসনা করত আর তাদের জীবনাচরণও ছিল ভিন্ন। ইহুদিরা তাদের নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরে অন্য কোনাে মানুষের সংস্কৃতি বা আচরণের প্রতি এতটুকু আগ্রহী ছিল না। অন্যদের আরাধনার বস্তু সম্পর্কে জানতেও তাদের কোনাে আগ্রহ ছিল না।

ক্যালিগুলার খরচে স্বভাব, নিষ্ঠুরতা, দেবত্ব ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খুন

টিবারিয়াসের কোন সন্তান বেঁচে ছিলোনা, দত্তক নেয়া পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্র জার্মানিকাসের একজন পুত্র গেইয়াস সিজার (ডাক নাম ক্যালিগুলা) বেঁচে ছিল, যিনি ১২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির যুদ্ধক্ষেত্রের ক্যাম্পে জন্মান ও জীবনের প্রথম কয়েক বছর কাটান। ক্যালিগুলা অগাস্টাস আর টিবারিয়াসের মতাে রােমের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে ভাবিত ছিলেননা। পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা হতো যার ফলে তিনি ভয় পাওয়া আর মানুষকে সন্দেহ করার চরিত্র গঠন করেন। জুডিয়ার প্রথম হেরােড রাজার নাতি হেরােড অ্যাগ্রিপার মতো পূর্ব দিকের কতিপয় রাজপুত্রের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়, যাদের থেকে গল্প শুনে তিনি পূর্বের রাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বােধ করতেন। টিবারিয়াসের মৃত্যুর পর ক্যালিগুলা (রা. ৩৭ – ৪১ খ্রি.) সম্রাট হলেন। তিনি খুব স্বাধীনচেতা আর প্রাণবন্ত ছিলেন, তার বিচারকাজ পূর্বের মতো ঘটনাবিহীন ও নীরস ছিলনা, ম্লান হয়ে যাওয়া সব জায়গা ঝকমক করতে লাগল। কিন্তু বেশি স্বাধীনচেতা স্বভাবের জন্য এক বছরেই তার রাজকোষ উজাড় হয়ে গেল। ৩৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলার মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলাে। দীর্ঘ অসুস্থতা তার মানসিক অবস্থা বদলে দিয়েছিল, তবে আগের কয়েক বছরও তিনি ভালাে অবস্থায় ছিলেন না। ৩৮ সালের পরে ক্যালিগুলার খরচের বাতিক মারাত্মকভাবে বেড়ে গেল। তিনি যেভাবে পারেন অর্থের জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন ও সেজন্য নানারকম নিপীড়ন শুরু করেন। যে কোনাে ধনী লােকের বিরুদ্ধে কোনােরকমে রাজনৈতিক প্রতারণার অভিযােগ উঠলে তা অমূলক হলেও তার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সম্রাটের কোষাগারে চলে আসত, যেমন মৌরিতানিয়ার রাজা টলেমির সমস্ত সম্পত্তির হরণ, যাকে তার উত্তরাধিকারী মার্ক অ্যান্টনিকে সহ রােমে ডেকে এনে হত্যা করা হয়। ক্যালিগুলা পূর্বের অঞ্চলের রাজতন্ত্রের নেয় রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করতে চাইতেন ও অগাস্টাসের আইন-কানুন পরিবর্তন করতে চাইতেন। রোমানরা অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বে মৃত মানুষদের দেবতা মনে করে উপাসনা করতো (ইহুদিরা এই সংস্কৃতির বিরোধী ছিল), কিন্তু ক্যালিগুলা পূর্বের অঞ্চলের, বিশেষ করে মিশরের ফারাওদের মতো জীবিতাবস্থায় দেবতা হিসেবে পূজিত হতে চাইতেন। তার পূর্বে অগাস্টাস ও টিবারিয়াস প্রিন্সেপ বা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়েছিলেন যা অসাধারণ পদ হলেও রোমান নাগরিক ছিল, কিন্তু ক্যালিগুলা হতে চান নাগরিকতার ঊর্ধ্বে একজন বিধাতা, আর প্রজারা হচ্ছে তার দাস, যেখানে তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব হয়। রােমানদের কাছে সত্যিকার অর্থে একজন তরুণ সম্রাটকে তাদের দেবরাজ জুপিটারের মতাে পােশাক পরতে দেখা আর জুপিটারের মন্দিরে মূর্তি সরিয়ে দিয়ে নিজের মূর্তি স্থাপন করার আদেশ খুবই অদ্ভুত ঠেকছিল। ফলে তারা সম্রাটের ওপর বিরক্ত হয়। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু হয় ও ৪১ সালে তার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র সফল হয় ও একদল বিদ্রোহী প্রিতােরিয়ান পাহারাদারের হাতে তিনি তার স্ত্রী আর কন্যা সহ খুন হন।

ক্যালিগুলার সময়ে ইহুদিদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা

আলেক্সান্দ্রিয়া সে সময়ে মিশরের রাজধানী। শহরটিতে তখন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গ্রিক মানুষের বাস আর সেদিক দিয়ে রােম ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু আলেক্সান্দ্রিয়ার ভেতরে ইহুদিদের একটি বড় কলােনি ছিল যেটিকে মনে হতাে শহরের ভেতরেই আরেকটি অন্য রকমের শহর। অগাস্টাস তাদের বিশেষ সুযােগ সুবিধা প্রদান করেছিলেন। (কারণ অগাস্টাসের শেষ যুদ্ধে তারা তাকে সমর্থন দিয়েছিল ও সাহায্য করেছিল।) সুবিধাগুলাের মধ্যে ছিল, দেশের নানারকম আচার ব্যবহারে অংশগ্রহণের থেকে তাদের অব্যহতি দেয়া, সেনাবাহিনীতে যােগদানের ব্যাপারে কোনাে বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। এদিকে এই দুই কারণে গ্রিকরা রুষ্ট হয়েছিল। আলেক্সান্দ্রিয়ায় গ্রিকরা তাদের থেকে পৃথক ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল। তাই ইহুদিরা ক্যালিগুলার কাছে সুবিচারের আশায় আবেদন পাঠিয়েছিল। গ্রিকরা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল যে বােধহীন সম্রাট ইহুদিদের কোন কথায় কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসেন তার কোনাে ঠিক নেই। তাই গ্রিকরা তাড়াহুড়াে করে সম্রাটের কাছে ইহুদিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি আবেদন পাঠাল। তারা সম্রাটকে জানাল যে ইহুদিরা সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাের সভায় ইচ্ছে করে উপস্থিত হয়নি তাই তারা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহী। ক্যালিগুলা চাইতেন সম্রাট হিসেবে রাজ্যের সব জায়গায় তার খুব আরাধনা হােক। তাই তিনি রাজ্যের বিভিন্ন মন্দিরে তার মূর্তি স্থাপনের আদেশ দিয়েছিলেন। রাজ্যের অনেক জায়গায় তার আদেশ সাথে সাথে পালন করা হলাে। মন্দিরে অনেক মূর্তির সাথে আরেকটি পাথরের টুকরাে স্থাপন করার মধ্যে নতুন কী? এখন তারপর যেটা হলাে, ক্যালিগুলা তার মূর্তি জেরুজালেমের মন্দিরে স্থাপনের আদেশ দিলেন। সম্রাটের ধারণা ছিল, একেশ্বরবাদী ইহুদিরা একটিমাত্র মানুষের মূর্তি মন্দিরে দেখলে খুশি হবে। কিন্তু আসলে এ রকম একটি ব্যাপার ইহুদিদের জন্য এতটাই অপছন্দের ছিল যে তারা এটি মেনে নেয়ার আগে মৃত্যুবরণ করতেও রাজি ছিল। সিরিয়ার গভর্নর ক্যালিগুলাকে চিঠি লিখে জানালেন ইহুদিদের প্রতিক্রিয়ার কথা। আর সম্রাটের আদেশটি মানতে শুধু শুধুই দেরি করতে থাকলেন। ক্যালিগুলা এই খবর জানার পরে ইহুদিদের রাজ্যে হামলা করাটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঠিক তখনই তিনি নিজেই নিহত হন। যাই হােক ইহুদিদের অভূত্থান না ঘটানাের জন্য ক্যালিগুলার মৃত্যু যথা সময়ে হয়েছিল বলে তার পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত ইহুদিদের উপরে হামলা ঠেকিয়ে রাখা গেল।

ক্লডিয়াস ও হেরোড অ্যাগ্রিপার সময়ের সুশাসন

ক্লডিয়াস সম্রাটের আসনে আসীন হওয়ার পর ক্যালিগুলার পুরনাে বন্ধু হেরােড অ্যাগ্রিপাকে ইহুদিদের রাজা বানিয়ে জুডিয়ায় বসালেন। এভাবে জুডিয়া আবারও তাত্ত্বিকভাবে রােমের অধীনে চলে এলাে। হেরােড অ্যাগ্রিপা ইহুদিদের মন জয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। আর সত্যিই ইহুদিদের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে সফল এবং জনপ্রিয় একজন শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। (এরকম গল্প শােনা যায় যে একবার এক সভায় তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন যে, তার দুর্ভাগ্য যে তিনি একজন ইহুদি নন। এটাই ছিল তার প্রতি ইহুদিদের ভালােবাসার মূল কারণ। সেই সভায় তিনি আরও বলেছিলেন যে “আমি ইহুদি না হলেও, তােমরা ইহুদি আর তােমরা আমার ভাই।”) দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার রাজত্ব ছিল খুব অল্প দিনের। মাত্র তিন বছর পরেই তা ফুরিয়ে যায় তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। ৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নিরো ও দ্বিতীয় হেরোড অ্যাগ্রিপার সময় সম্পদ লুণ্ঠন ও ইহুদিদের বিদ্রোহ

তার পুত্র দ্বিতীয় হেরােড অ্যাগ্রিপা কিছুদিনের জন্য জুডিয়ার কিছু অংশে শাসনকাজ চালান। তারপর জুডিয়াকে আবারও একটি প্রদেশ হিসেবে রােমের যথােপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। সেই কর্তৃপক্ষের সদস্যরা ছিল নেহায়েত লােভী। তাদের একজনকে সম্রাট নিরাে ইহুদিদের মন্দিরের কোষাগার লুট করতে পরামর্শ দিলাে। তখন ইহুদিদের মধ্যে রােমের বিপক্ষের মৌলবাদী শক্তির (যাদের বলা হয় জেলটস) প্রভাব খুব বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় হেরােড অ্যাগ্রিপ্পা সে সময়ে জেরুজালেমেই ছিলেন। সবাইকে তিনি শান্ত হতে বলছিলেন। কিন্তু তার কথা কেউ শােনেনি। ৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে (৮১৯ রােমান সাল) ইহুদিরা রােমের বিরুদ্ধে ভয়ংকর শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। রােমান নাগরিকরা কিছুদিনের মধ্যেই ইহুদিদের বিদ্রোহের ভয়ানক শক্তি আঁচ করে বিস্মিত হলাে। জুডিয়ায় উপস্থিত সেনাবাহিনীরা অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না।

ইহুদিদের বিদ্রোহ দমন ও মন্দির ভাঙ্গন

নিরাে তাই তিনটি বড় সেনাবাহিনীর দলকে সেখানে পাঠালেন। সেনাবাহিনী ভেসপাসিয়ানের (টাইটাস ফ্লেভিয়াস সাবিনাস ভেসপাসিয়ানাস) নেতৃত্বে পূর্বদিকে রওনা দিলাে। ক্লডিয়াসের অধীনে তিনি জার্মানিতে কাজ করেছিলেন আর দক্ষিণ ব্রিটেনর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ে তিনি সেনাবাহিনীকে অগ্রসর করিয়ে উইট দ্বীপ দখল করেছিলেন। ৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনসল হিসেবে আর তারপর আফ্রিকা প্রদেশের গভর্নর হিসেবে কাজ করেন। তাকে যে নতুন দায়িত্ব দেয়া হলাে তা তিনি খুব দক্ষতার সাথেই পরিচালনা করছিলেন। কাজ ঠিকঠাক মতাে এগােচ্ছিল তবে ইহুদিরা মৃত্যু পর্যন্ত লড়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। ৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভেসপাসিয়ান জুডিয়া থেকে রােমে ফিরে যান। কিন্তু তার পুত্র টাইটাস (টাইটাস ফ্লেভিয়াস সাবিনাস ভেসপাসিয়ানাস) তার বাবার মতােই ছিলেন। তিনি তার বাবার অর্ধসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। ৭০ খ্রিস্টাব্দের এই সেপ্টেম্বর তিনি জেরুজালেমের দখল নিয়ে নিলে মন্দিরটি দ্বিতীয়বারের মতাে ভাঙা হয়। (প্রথমবার ব্যাবিলনীয়রা ভেঙেছিল প্রায় পাঁচশ বছর আগে।) টাইটাস পরের বছর রােমে গিয়ে এই বিজয় উদ্যাপন করেন। টাইটাসের সেই বিজয় স্মরণে বানানাে তােরণ এখনও রােমের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও লােকে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে টাইটাসকে স্মরণ করে।  যেসব ইহুদিরা তখনও বেঁচে ছিল আর সেখানেই ছিল, তারা ভীষণ হতাশ হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে দেখল জুডিয়ায় তারা পড়ে রয়েছে অসীম ধ্বংসের মুখে। তাদের প্রাণপ্রিয় মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে, থামিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ধর্মীয় উপাসনার পদ্ধতি। আর তাদের চোখের সামনে জেরুজালেমে রােমান সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব, রোমান সাম্রাজ্যে এর প্রবেশ ও বিকাশ

ইহুদিদের গ্রিক ভাষা গ্রহণ ও রোমে বসবাস

ইহুদি রাজ্য জুডিয়ার প্রথম ধর্মটি ছিল ইহুদি ধর্ম যেটি জুডিয়া থেকে ইহুদিদের মাধ্যমেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইহুদিরা রাজ্যের বিভিন্ন দিকে, বিশেষ করে পূর্বদিকে গিয়ে থাকা শুরু করল। রােমের ভেতরেও তাদের বিশাল এক কলােনি গড়ে তুলেছিল। একসময় এমন হলাে যে জুডিয়ার বাইরে অবস্থানরত ইহুদিদের সংখ্যাই জুডিয়ার চেয়ে বেড়ে গেল। তারা একসময় হিব্রু ভাষা ভুলে গিয়ে গ্রিক শেখা শুরু করল, কিন্তু তাই বলে তাদের ধর্ম ভুলে গেল না। তাদের পবিত্র বই বাইবেল গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল যেন তারা তা পড়তে পারে। কারণ খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালে এমন অনেক ইহুদি ছিল যারা তখন আর প্রাচীন হিব্রু ব্যবহার করে যােগাযােগ করতে পারত না। সে সময়ে এমনও ইহুদি ছিল যারা গ্রিক ভাষায় নিজেদের শিক্ষিত করে তুলেছিল কারণ যেন নিজেদের ধর্ম নিয়ে গ্রিকে তর্ক করতে পারে। তখন রােম অথবা গ্রিসে গ্রিকে কথা বলাই ছিল স্বাভাবিক। গ্রিক ভাষায় শিক্ষিত ইহুদিদের মধ্যে অসাধারণ ছিলেন ফিলাে জুডাইয়াস (ফিলাে দ্য জিউ)। ফিলাে জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ায়। পূর্ণবয়সে তিনি রােমে আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।  ক্যালিগুলার সাথে ইহুদিদের সমস্যা সমাধানই ছিল সেই আবেদনের উদ্দেশ্য।

রোমান সমাজে ইহুদিদের অবস্থা

স্বাধীন রাষ্ট্র থাকার শেষের দিকে আর সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যাওয়ার প্রথম দিকে রােমের অনেক অধিবাসীদের মধ্যেও ইহুদি ধর্ম কিছু পরিবর্তন এনেছিল। এমনকি সমাজের উঁচু অবস্থানে আছেন এমন অনেকেও ইহুদি ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ইহুদি ধর্ম যদি তাদের গোঁড়া মনােভাব থেকে কিছুটা ছাড় দিত তবে তা আরও দ্রুত ছড়িয়ে যেত। অন্যান্য ধর্মেও নানান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিলাে কিন্তু তাদের অনুসারীদের কখনও সম্রাটের ধর্মীয় বন্দনায় অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়নি। ইহুদিরা তাদের অনুসারীদের নিশ্চিত করত যে তারা সমাজের অন্যান্য ধর্মের সবচেয়ে নির্দোষ কোনাে অনুষ্ঠানেও যেন যােগদান না করে। সুতরাং রােমানদের মধ্যে কেউ যদি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে চাইত তবে তাকে রাষ্ট্রের মূল ধর্ম প্রত্যাহার করতে হতাে। তারা বস্তুত সমাজ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হতাে আর অনেক সময় ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রতারণার দায়ে শাস্তি পেত। এত কিছুর পরে ইহুদিদের ধর্মপালন এতই কঠিন ছিল যে যদি কেউ ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তার ভেতরে থেকে শিক্ষা নিতে থাকে তাে তার পক্ষেই কেবল তা সঠিক ভাবে পালন করা সম্ভব। গ্রিক সভ্যতায় লালিত হয়ে এই ধর্মের কিছু অংশ পালন করা কারও জন্য খুব অযৌক্তিক আর বিব্রতকর হতে পারে। তারপর আবার কেউ যদি ইহুদি হতে চাইত তাে তাকে খত্না করার ব্যথাটা সহ্য করতে হতাে। শেষ পর্যন্ত ইহুদিদের প্রধান ধর্মীয় কার্যালয় হিসেবে জুডিয়াই টিকে রইল। বিষয়টি এমন ছিল যে জেরুজালেমের মন্দিরই সেই কেন্দ্র যেখানে তাদের বিধাতাকে পাওয়া যাবে। জুডিয়ায় ভয়াবহ বিদ্রোহ হওয়াতে ইহুদিরা, যারা ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিল তা আর হতে পারল না। ইহুদিরা তখন রােমের বড় শত্রু হয়ে উঠল। পুরাে রাজ্যের মধ্যে তারা তাদের জনপ্রিয়তা হারাল।

খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব

যাই হােক ইহুদি ধর্ম ততদিনে আর একটি মাত্র অভিন্ন ধর্ম নেই। সেখানে নানান দলাদলি হয়ে গেছে। কিছু কিছু দল আবার রােমেরই অন্যান্য ধর্মের মত কাজকর্ম করতে শুরু করে দিয়েছে। এদের মধ্যে একটি দল যিশুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গেল। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পরে মনে হয়েছিল যে তার অনুসারীরা তখনই যিশুর আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসবে, অন্তত তার মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের কাছে এটুকু প্রমাণিত হবে যে তিনি কোনাে মাসিহা জাতীয় কিছু ছিলেন না। সে জন্যেই এত সহজে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাই হােক, ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পরে তাকে আবার দেখা গেছে বলে একটি গল্প চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ধরে নেয়া হয়েছিল যে তিনি মৃত্যুর পরে আবার ফিরে এসেছেন। তিনি আসলে কোনাে সাধারণ মানব মাসিহা ছিলেন না, তিনি স্বয়ং রাজা যিনি ইহুদি রাজ্যে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। তিনি ছিলেন একজন স্বর্গীয় মাসিহা, ঈশ্বরের পুত্র। তার রাজ্য ছিল স্বর্গে আর তিনি শিগগির সেখানেই আবার ফেরত যাবেন (যদিও কেউ জানত না কবে)। তিনি সেখানে ফিরে যাবেন মানুষের পার্থিব জীবনের হিসাবনিকাশ করতে আর বিধাতার রাজ্যে নিজেকে আবার অধিষ্ঠিত করতে।

ইহুদিদের বিদ্রোহে খ্রিস্টানদের অনীহা ও জুডিয়ায় খ্রিস্টানদের জনপ্রিয়তা হারানো

খ্রিস্টানরা (এভাবেই যিশুর আদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষ আর অনুসারীদের ডাকা হতাে) প্রাথমিকভাবে ইহুদি ধর্মে আর আচার আচরণেই বিশ্বাসী থাকল তারপর ধীরে ধীরে তারা সেখান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলাে। অনেক ইহুদি জুডিয়ার জাতীয়তাবাদে তীব্রভাবে বিশ্বাসী ছিল। যে মাসিহা তার অনুসারীদের কষ্টভােগের জন্য রেখে গিয়ে নিজে মৃত্যুবরণ করেন এমন কোনাে নেতা তারা চায়নি। তারা চেয়েছিল সাহসী, বীর কোনাে মাসিহা যিনি কিনা রােমের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে। এটা রােমের বিরুদ্ধে তাদের হঠাৎ করে জেগে ওঠার পেছনে এক ধরনের অনুপ্রেরণা ছিল। কিন্তু ইহুদিদের এই রোম-বিরোধী বিদ্রোহে খ্রিস্টানরা অংশগ্রহণ করেনি। তারা তাদের মনমতাে মাসিহা ততদিনে পেয়ে গেছে। তারা মনে করত, রােম রাজ্য আর কতদিন টিকবে? আর ইহজাগতিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রবর্তনের ব্যাপারে ঈশ্বরের যে পরিকল্পনার গল্প তারা শুনেছে তা ততদিনে মিথ্যে হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। খ্রিস্টানদের ধর্ম ছিল আক্রমণ বর্জিত। শত্রুকেও ভালােবাসতে শেখানাে হতাে। কেউ এক গালে আঘাত করলে তাকে আরেকটা গাল পেতে দেয়াই ছিল তাদের শিক্ষা। তাই সিজারের বিরুদ্ধে বা সিজারের অধীন কোনাে মানুষের বিরুদ্ধে লড়ার কোনাে তাগিদ তারা বােধ করেনি। এই ধরনের মনােভাব তাদের ইহুদি বিদ্রোহে অংশগ্রহণে বাধা দেয়। ইহুদি রাজ্যে বসবাস করে, নিজেদের স্বার্থে রােমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ না করার দায়ে তাদেরকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। বিদ্রোহের পরে বেঁচে থাকা ইহুদিদের মাঝে তারা ব্যাপক হারে তাদের জনপ্রিয়তা হারায়। তাই সব ইহুদিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম আর ছড়িয়ে যেতে পারে না। সর্বোচ্চ সম্ভব চাপ দেয়া সত্ত্বেও, ইহুদিদের মধ্যে একজনও আজ পর্যন্ত যিশুকে তাদের মাসিহা হিসেবে মেনে নেয়নি।

পলের খ্রিস্টান হয়ে ওঠা ও তার সংস্কারসমূহ

কিন্তু ইহুদিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রচার হচ্ছে না বলে যে আর কোথাও হয়নি, তা নয়। ধর্মের এই প্রসারের জন্য খ্রিস্টানরা একজন প্রগতিশীল ইহুদির কাছেই ঋণী, যার নাম সাওল। ইহুদি রাজ্য ছাড়া বাইরে তিনি সাওল নামেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু রােমান উচ্চারণে তাকে বলা হতাে পল। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ সমুদ্রতীর ঘেঁষে টারসাস নামের এক শহরে পল জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন রােমান নাগরিক। তাই জন্মসূত্রে তিনিও রােমান নাগরিক হয়ে যান। তিনি জেরুজালেমে ইহুদি শিক্ষায় শিক্ষিত হন। আর তাই তিনি হয়ে ওঠেন গোড়া ইহুদি। তিনি এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে প্রথম প্রথম যখন খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে তাদের ধর্ম প্রচার শুরু করেছিল তিনি তাদের “নাস্তিক” আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ব্যস্ত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে উঠতি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি ছিলেন প্রগতিশীলদের নেতা। খ্রিস্টানবিরােধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি দামাস্কাসে আন্দোলনের কার্যকলাপে অংশ নিতে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, দামাস্কাসের পথে যিশুর ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তিনি সবকিছু যিশুর চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেন। আর ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তিনি হয়ে যান একজন অতি ভক্ত খ্রিস্টান। ইহুদি ধর্মের বাইরে অন্যান্য মানুষকে পল প্রাণপণে খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা দিয়ে যেতে থাকেন। শিক্ষা দান করতে করতে তিনি অনুভব করেন যে ইহুদি ধর্মের অন্তর্নিহিত জটিল নিয়মকানুনগুলাে ধার্মিক থাকার জন্য জরুরি নয়। বরং অনেক বাড়তি নিয়মনীতি মানতে গিয়ে মানুষ এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ধর্মের মূল বিষয়টি থেকে সরে যায়। (বাইবেলের ভাষায় “ফর দ্য লেটার কিলেথ বাট দ্য স্পিরিট গিভেথ লাইফ”।) খ্রিস্টান হতে চাইলে একজন অন্য ধর্মের মানুষকে নতুন করে খত্না করতে হতাে না। আবার ইহুদিদের ধর্মের কঠোর অনুশাসন অনুযায়ী নানান নিয়মের আওতায় আসতে হতাে না। এমনকি নিজের স্বকীয়তা ইহুদি রাজ্যের জাতীয়তাবাদের কাছে বিকিয়ে দিতে হতাে না। এমনকি জেরুজালেমের মন্দিরের কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার মতােও কোনাে ব্যাপার ছিল না।

এশিয়া মাইনোর, গ্রিস ও ইতালিতে খ্রিস্টধর্মের ছড়িয়ে পড়া

প্রায় হঠাৎ করেই খ্রিস্টধর্ম এশিয়া মাইনর আর গ্রিসের সব শহরগুলােতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এমনকি খােদ ইতালিতেও এই ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। যিশুর ক্রুশে বিদ্ধ হওয়া আর পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসা, এই পুরাে বিষয়টি জড়িয়ে যাবতীয় কাহিনী আধ্যাত্মিক ধর্মটিকে বারবার আরও বেশি স্মৃতিবহ এবং ঈঙ্গিতপূর্ণ করে তুলেছে। যিশুর মা মেরির মােলায়েম মুখ এই ধর্মকে দিয়েছে আরও কোমলতা। ভেতরের নির্দিষ্ট ভাবধারাটি অনেকটা স্টয়িক আদর্শের সাথে মিলে যায়। মানুষের মনে হলাে, এই ধর্ম এমন, যে তৈরি হয়েছে সবাইকে একটু শান্তি দেবার জন্য। এটা তাে সত্যি যে, ইহুদি ধর্মে নিয়মকানুন নিয়ে যত কড়াকড়ি, খ্রিস্টধর্মে তা কখনােই ছিল না। খ্রিস্টধর্ম ইহুদিদের সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষদের মধ্যেই বেশি করে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যারা এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা বেশিরভাগ পৃথিবীর জনপ্রিয় ধর্মগুলাের কোনােটাই অনুসরণ করত না (পাইন কাস্টমস)। গ্রিক সভ্যতায় অভ্যস্ত অনেক মানুষও এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা, মিথ্রেইজমের উৎসবের দিন ২৫শে ডিসম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে গ্রহণ

মিথ্রাইজম বা মিথ্রবাদ ছিল খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বড় প্রতিযােগী ধর্ম। কয়েকশ বছরব্যাপী তারা ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পালন করছিল। মিথ্রেইজম এক ধরনের সূর্য উপাসনাকারী ধর্ম। আর ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে সূর্য নিরক্ষরেখার থেকে দূরবর্তী অবস্থানে চলে যায় বলে সেই দক্ষিণায়নের সময়ে তারা তাদের উৎসব পালন করত। দুপুর বেলা সূর্য নামতে নামতে দক্ষিণের শেষ প্রান্তে চলে যায় আর তারপর ধীরে ধীরে আবার উত্তর দিকে হেলতে থাকে। একেই মনে করা হতাে সূর্যের পুনর্জন্ম। এটাই যেন তাদের নিশ্চয়তা দিত যে এই প্রবল শীত মিলিয়ে যাবে আর সূর্য আবার নতুন বসন্তের দিন সাথে নিয়ে আসবে। সেই বসন্ত তাদের কাছে হবে নতুন জীবনের পরিচায়ক। বছরের এই সময়টা অন্য অনেক ধর্মের লােকেরাও পালন করত। প্রাচীন রােমের মানুষেরা এই সময় কৃষির দেবতাকে স্মরণ করত। দেবতার নাম ছিল স্যাটার্ন আর উৎসবটির নাম হলাে স্যাটার্নালিয়া। স্যাটার্নালিয়া ছিল পুরুষদের (এমনকি দাসেরাও সেই সময়ে সাময়িকভাবে একই আসনে বসার সুযােগ পেত) মনােবলের প্রতীক। এই উৎসবে তারা ভােজন আর উপহার বিতরণে ব্যস্ত থাকত।  খ্রিস্টানরা ঋতুর উপরে নির্ভর করে সূর্যের এই পুনর্জন্মকে অবজ্ঞা করতে পারল না। এর বিরুদ্ধে না গিয়ে তারা একে গ্রহণ করল। এই নতুন উৎসবের কাছে তারা আবেগী হার মানল। বাইবেলে যেহেতু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, তাই তারা এমনিতেও জানত না যে যিশু কোন দিন জন্মেছিল। তারা ধরে নিলাে যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্ম হয়েছে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তারা বড়দিন হিসেবে তা পালন করছে। আর তাই তখন থেকেই খ্রিস্টমাস পালনের আচারের মধ্যে একটা স্যাটার্নালিয়ার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

নিরোর সময়ে রোমে খ্রিস্টান-বিদ্বেষ, অগ্নিকাণ্ড এবং পল ও পিটার সহ খ্রিস্টানদের মৃত্যুদণ্ড

খ্রিস্টানদের প্রতি রোমে বিদ্বেষ ও হানাহানি

রােমানদের কাছে অন্তত যিশুর জন্মের অর্ধ শতাব্দী পরেও খ্রিস্টধর্ম ইহুদি ধর্মের একটি শাখামাত্র বলে মনে হতাে। আসলে তারা এই বিশেষ শাখাটির উপরে একটু বিরক্তই ছিল যেহেতু এই ধর্মে প্রবেশ করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। যেহেতু খ্রিস্টানরা রােমের প্রকৃত দেবতাদের আরাধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিত না তাই তাদেরকে নাস্তিক মনে করা হতাে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহণ করছে না তাই তাদেরকে মনে করা হতাে রােমানদের জন্য বিপজ্জনক আর পরিত্যাজ্য। তখনকার দিনে রােমানদের মনােভাব খ্রিস্টানদের প্রতি এমন উগ্র ছিল ঠিক যেমন আমেরিকানদের কমিউনিস্টদের প্রতি। ৬৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই রেষারেষি এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল যে রােমে ভয়ানক গণ্ডগােল লেগে গেল। ছয়দিনব্যাপী চলতে থাকা সেই হানাহানিতে রােম শহর প্রায় ধ্বংস হতে বসল। এরকম একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার সূত্রপাত যে কী করে হলাে তা আর কারও বুঝতে বাকি রইল না।

রোমে অগ্নিকাণ্ড ও নিরো

রােমের দরিদ্র মানুষেরা দুর্বল কতকগুলাে ভাঙাচোরা কাঠের তৈরি পাঁচিল বানিয়ে নিজেদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু তখনকার দিনে আজকের মতাে আগুন প্রতিরােধ করার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না, আবিষ্কারও হয়নি। তখন শহরের এক জায়গায় আগুন লাগলে দেখতে দেখতে পুরাে শহর অনায়াসে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। নিরাে ক্ষমতায় আসার আগে আর পরে শহরে বেশ কয়েকবার আগুন লেগেছিল। কিন্তু সেবারের ৬৪ খ্রিস্টাব্দের এই আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য। শহরে যখন আগুন লাগল, সম্রাট নিরাে তখন ছিলেন রােমের দক্ষিণে তিরিশ মাইল দূরে অ্যান্টিয়াম সমুদ্র বন্দরে (বর্তমানে অ্যানজিও)। রােমে আগুন লাগার খবর যখন নিরাের কাছে পৌঁছল তখন তিনি আগুন প্রতিহত করার জন্য যতরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব তা করতে লাগলেন। যারা ততক্ষণে গৃহহীন হয়ে পড়েছে তাদেরকে সাময়িকভাবে নতুন জায়গায় ঠাঁই দিলেন।  প্রকৃতপক্ষে লােকদেখানাে চাকচিক্য প্রদর্শন করার নেশা একসময় তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। হতবুদ্ধি হয়ে দিগন্ত রেখায় আগুনের হলকার দিকে তিনি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। চারদিকে আগুনের আগ্রাসন দেখে তার পুড়তে থাকা ট্রয়ের কথা মনে পড়েছিল। তিনি তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র (লাইর) হাতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। ট্রয়ের আগুনের সামনে সেই গান গাওয়া থেকে নিজেকে নিবৃত করতে পারেননি। এই দৃশ্য আজও মানুষ কথায় কথায় মনে করে যে রােম যখন পুড়ছিল, নিরাে তখন বেহালা (যদিও তার পরের কয়েক শতাব্দীতেও বেহালা আবিষ্কার হয়নি) বাজাচ্ছিলেন। যে কারণে আগুন লেগেছিল, তাকে প্রতিহত করতে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলাে। ধ্বংসের প্রাথমিক ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠা গেলে, বাসস্থানগুলাে নতুন করে তৈরি করা শুরু হলাে। এবারে ইমারতগুলাের উচ্চতা আরও বাড়িয়ে নেয়া হলাে আর নিচের তলাগুলােতে আগুন যেন না ধরে সেরকম অদাহ্য পদার্থের ব্যবহার শুরু হলাে। এটা রােমকে নতুন করে একটি আধুনিক নগরী হিসেবে ঢেলে সাজানাের একটা সুবর্ণ সুযােগ ছিল। কিন্তু মালিকেরা আগের মতাে করে যার যা ছিল তেমনই আবার বানাতে লাগলেন। সুতরাং রােম আবারও সেই আগের মতােই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠল। শুধু সম্রাট নিরাে নিজের জন্য একটি নতুন ইটে মােড়ানাে কংক্রিটের তৈরি চাকচিক্যময় প্রাসাদ বানানাের সুযােগ লুফে নিলেন। আগুন প্রতিরােধকারী পদার্থের তৈরি শক্তপােক্ত প্রাসাদটি পরবর্তীকালে যারা অনুকরণ করতে সমর্থ ছিল তাদের জন্য একটি আদর্শ ইমারত হয়ে উঠেছিল।

অগ্নিকাণ্ডের জন্য খ্রিস্টানদের দোষারোপ, তাদের শাস্তি এবং পল ও পিটারের মৃত্যুদণ্ড

রােমের মানুষেরা মনে করেছিল যে নিরাে নিজেই শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তাে শহরে তার শত্রু বেড়ে যাওয়ার খবর শুনে দিশেহারা হয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নিরাে বুদ্ধি খাটিয়ে তখন এই দোষটা খ্রিস্টানদের উপরে চাপিয়ে দিলাে। মানুষের রােষ আগে থেকে এমনিতেই তাদের দিকে ছিল। তাই এভাবেই প্রথম তাদের আনুষ্ঠানিক বিচার আচার শুরু হলাে। তাদের একে একে হত্যা করা হলাে। তাদের কাউকে কাউকে নিরস্ত্র অবস্থায় সিংহের খাঁচায় ঠেলে দেয়া হলাে। অন্যদের জন্যও নানান ভয়ংকর মৃত্যু নিশ্চিত করা হলাে। খ্রিস্টানদের নিয়ম অনুযায়ী তাদের নেতা পল তখন রােমেই ছিলেন। আরেক নেতা পিটারও ছিলেন। অনুসারীরাও প্রায় সবাই সেখানে ছিলেন। (পিটারকে রােমের প্রথম বিশপ হিসেবে নির্বাচন করা হয় তাই তিনিই রােমের প্রথম পােপ ঘোষিত হন।) পল এবং পিটার দুজনকেই ধর্মের কারণে ভয়ানক মৃত্যুবরণ করতে হয়।  তাদের দুজনের জন্য বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থা এত কঠোর হয়েছিল যে এমনকি খ্রিস্টান নয় এমন মানুষও তাদের জন্য প্রার্থনা করেছিল। রােমের সাধারণ মানুষদের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তি মওকুফের আবেদন উচ্চারিত হয়েছিল। এই ধরনের ভয়াবহ পরিণতি পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মের জন্য কুফলের বদলে সুফল বয়ে আনে। এই ঘটনার সূত্র ধরেই খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার অরম্ভ হয়।

ফ্লেভিয়ান রাজবংশের (৬৮ – ৯৬ খ্রি.) সময়ে ইহুদি ও খ্রিস্টান

ভেস্পাসিয়ানের ক্ষমতায় আরোহন এবং ভেস্পাসিয়ান-টাইতাসের ইহুদি বিদ্রোহ দমন

বিদ্রোহের মাধ্যমে ৬৮ সালে নিরোর পতনের পর রোমান সাম্রাজ্যে চার সম্রাটের বছর (রা. ৬৮ – ৬৯ খ্রি.) শুরু হয় যেখানে একে একে চারজন সম্রাট – গ্যালবা, মার্কাস সালভিয়াস, অথাে, আউলুস ভিটেলিয়াস ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু এরা টিকতে পারেননি, শেষে জেনারেল ভেস্পাসিয়ান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ভেস্পাসিয়ান ধীরে ধীরে ইহুদিদের বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়েছিলেন ও রােমান সাম্রাজ্যের শস্যক্ষেত্র মিশর দখল করেছিলেন। মিশর দখল তাকে রােমে খাদ্য সরবরাহের উপরে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছিল। তিনি ইতালিতে প্রবেশ করে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ভিটেলিয়াসকে পরাজিত ও হত্যা করেন ও ৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভেস্পাসিয়ান সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত হন। নিজস্ব জাতির মধ্যে ভেম্পাসিয়ানের নাম ফ্লেভিয়াস ছিল বলে তিনি ফ্লেভিয়াস বংশের প্রবক্তা। তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী ছিলেন টাইটাস। টাইটাস জুডিয়ায় ঝটিকা হামলা চালিয়ে জেরুজালেম দখল করে ফেলেছিলেন। টাইটাস ৭১ সালে জুডিয়ার বিদ্রোহ দমন করে সেখানকার দখল নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। রােমান সাম্রাজ্যের জন্য এটি বিশাল ঘটনা ছিল যার কৃতিত্ব এই পিতা-পুত্রের ছিল ও তখন থেকে থেকেই এই নতুন বংশের শাসন কাজের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। ৭৯ সালে ভেস্পাসিয়ানের মৃত্যু হলে টাইটাস তার বাবার আসনে অধিষ্ঠিত হন। জুডিয়ায় যুদ্ধ চলাকালিন টাইটাস হেরােড দ্বিতীয় অ্যাগ্রিপার বােন বেরেনিসের সংস্পর্শে আসেন। তারা দুজন দুজনের প্রতি আসক্ত হন। যুদ্ধ জয়ের পরে টাইটাস যখন রােমে ফিরে আসছিলেন তখন সিদ্ধান্ত নেন যে বেরেনিসকে সাথে নিয়ে যাবেন আর তাকে বিয়ে করবেন। বেরেনিস ইহুদি ছিলেন বলে রােমের অধিবাসীরা এই অসম বিবাহ মেনে নেয়নি, ফলে টাইটাস তাকে জুডিয়ায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য হন। ৮১ সালে মাত্র দুই বছর রাজত্ব করে টাইটাস মৃত্যুবরণ করেন ও তার পর তার ভাই ও ভেস্পাসিয়ানের আরেক পুত্র ডমিশিয়ান রোমান সম্রাট হন।

ডমিশিয়ান ( রা. ৮১ – ৯৬ খ্রি.) এর আমলে সেনাবাহিনীর সন্দেহ, ব্যর্থ ষড়যন্ত্র, প্রতিক্রিয়ায় দার্শনিক ও ইহুদি-খ্রিস্টান হত্যা

ডমিশিয়ানের অন্তর্মুখী স্বভাব তাকে বারবার একাকিত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। একই ঘটনা অর্ধশতাব্দী আগে টিবারিয়াসের সাথেও ঘটেছিল। যেহেতু তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না তাই কারও সাথে সহজ, স্বাভাবিক হতে পারতেন না। আর তাই তিনি যতই নিজের ভেতরে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন, কোর্টের সদস্যরা, সেনাবাহিনীর প্রধানেরা তার প্রতি ততই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠত। তারা সবসময়ই ডমিশিয়ান কী ভবছেন, এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগত। প্রায়ই তারা একে-ওকে ফাঁসিতে ঝােলানাে হবে, এ ধরনের গুজবে কান দিয়ে আশঙ্কায় ভুগতেন। ডমিশিয়ানের এ ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা তাকে জেনারেলদের কাছে জনপ্রিয় হতে বাধা দিয়েছিল। তাই জেনারেলরা একসাথে হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলাে। জার্মান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান অ্যান্টোনিয়াস স্যাটার্নিয়াস তার বাহিনীসহ ৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে নিজেকে সম্রাট ঘােষণা করল। স্যাটার্নিয়াস জার্মানির কিছু অসভ্য উপজাতির কাছে সাহায্য চাইলেন। সেই অসভ্য জাতিগুলাের উপর নির্ভর করলে তাকে রােমান সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হতাে। সুসংগঠিত রােমান বাহিনীর হাতে মারা পড়ে সাম্রাজ্যের আনাচেকানাচে তাদের মৃত শরীরগুলাে পড়ে থাকতে দেখা যেত। অসভ্য জাতিরা সামনে এগিয়ে আসতে সাহস পেল না। ডমিশিয়ান প্রাথমিক অবস্থায়ই বিদ্রোহ দমন করে ফেললেন। ডমিশিয়ানের সন্দেহপ্রবণ মন এই ঘটনার পর থেকে আরও বেশি সতর্ক হয়ে গেল। তিনি এই বিদ্রোহে কলকাঠি নাড়ার ক্ষেত্রে যাদের হাত আছে বলে মনে করলেন সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার শান্ত স্বভাব এই ঘটনার পরে একেবারে বদলে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিশােধপরায়ণ। তিনি রােমের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিককে ফাঁসিতে ঝােলালেন। তিনি মনে করেছিলেন, যেহেতু তারা একটি আদর্শ মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেন, সুতরাং তারা সব সম্রাটের বিপক্ষের শক্তি। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত ইহুদিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিলেন কারণ তার মনে হয়েছিল তারা ইহুদি হওয়াতে কখনােই কোনাে ফ্লেভিয়ানের পক্ষের হতে পারেন না। খ্রিস্টানদের উপরেও নানান অত্যাচারের কথা শােনা গেছে কারণ রােমানরা তখনও তাদেরকে ইহুদিদেরই একটি অংশ বলে মনে করত। ডমিশিয়ানের শাসনের শেষ বছরগুলো সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল। ৯৬ সালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হয় যেখানে সম্রাজ্ঞী নিজেও অংশগ্রহণ করেন। ডমিনিয়াসকে বন্দী করে হত্যা করা হয়।

নার্ভা (রা. ৯৬ – ৯৮ খ্রি.)

ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞান-প্রকৌশল চর্চায় রৌপ্যযুগ 

ইতিহাস চর্চা : নার্ভার মাধমে রােমান রাজ্যে যে শান্তি, নিরাপত্তা উন্নতির ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, তাতে রােমের অভিজাত শ্রেণি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। রােমান ঐতিহাসিকেরাও নার্ভার পরের সব সম্রাটদের বর্ণনা করতে গিয়ে আগের সব সম্রাটের আমলকে অন্ধকার যুগ বলে বর্ণনা করেছেন। সিনেটের প্রতি সহনশীলতা দেখানােই এর মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা হয়তাে সেভাবে নজর দেননি। সে যুগে প্রতিশােধপরায়ণতা ছিল অনেক প্রকট। ঐতিহাসিকদের লেখা যে কয়েকটি বই বেঁচে গেল, তাতে দেখা গেল যে আগের সমস্ত সম্রাটেরা সবাই ছিলেন অন্ধকার যুগের প্রবক্তা। কিন্তু তখনকার এক একজন সম্রাট যতই খারাপ হােন না কেন, সিনেটের ঐতিহাসিকদের লেখায় তাদের যত খারাপ বর্ণনা করা হয়েছে, বাস্তবে তারা আদৌ সেরকম ছিলেন কি না সন্দেহ। তদকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদগণ হলেন –

  • টেসিটাস : ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন কর্নেলিয়া টেসিটাস। ফ্লেভিয়ানদেৱ সময় থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল আর ডমিশিয়ানের সময় পর্যন্ত বেশ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি ছিলেন অ্যাগ্রিকোলার মেয়ের স্বামী। ব্রিটেনে রোমান সংস্কৃতি প্রচারের ব্যাপারে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি অগাস্টাসের মৃত্যুর সময় থেকে শুরু করে ডমিশিয়ানের সময় পর্যন্ত সম্রাটদের ইতিহাস রচনা করেছিলেন। সিনেটের প্রতি প্রজাতন্ত্রীয় মতবাদে বিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি ইতিহাসগুলাে লিখেছিলেন। তাই ওই সময়টাতে কোনো সম্রাটের মধ্যেই তিনি ভালাে কিছু দেখতে পাননি। বিশেষ করে তিনি সাংঘাতিকভাবে টিবারিয়াসের নিন্দা করেছিলেন। হয়তো টিবারিয়াসের চরিত্রের সাথে ডমিশিয়ানের মিল পাওয়া যায় সেজন্য।  টেসিটাস অ্যাগ্রিকোলার একটি জীবনী গ্রন্থ লিখেছিলেন। ব্রিটেনর ইতিহাসের উপরে আলােকপাত করেছে বলে বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৮৯ থেকে ৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টেসিটাস রােমে ছিলেন না। সেই সময়টায় মাঝে মাঝে তিনি জার্মানিতে থাকতেন। জার্মানির ইতিহাস নিয়ে তখন তিনি একটি বই লিখেছিলেন। জার্মানির সেই শুরুর দিনগুলাের বিষয়ে যদি আমরা জানতে চাই তাহলে বলা যেতে পারে তার বইটি অবশ্যই প্রয়ােজনীয়। বইটি পড়লে অবাক হতে হয় যে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা কত নিখুঁত। টেসিটাস প্রতিটি ঘটনার বর্ণনায় পারতপক্ষে নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তিনি ওই বইয়ে জার্মানির লােকদের সাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত জীবনাচরণের সাথে রােমের মানুষদের আকণ্ঠ বিলাসিতায় ডুবে থাকা জীবনের তুলনা করেছেন। তবে নিজের মতামত জাহির করার জন্য তিনি হয়তাে একটি পরিস্থিতিকে অনেক বেশি উপরে তুলে আরেকটিতে অনেক বেশি নিচে নামিয়ে এনেছেন।
  • স্যুটোনিয়াস : আফ্রিকার সমুদ্রতীরে ৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেকজন তরুণ ইতিহাসবিদের আবির্ভাব হয়েছিল। তার নাম গেইয়াস স্যুটোনিয়াস ট্র্যাঙ্কুইলাস। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম “বারােজন সম্রাটের জীবন”। এই বইটি জুলিয়াস সিজারসহ ডমিশিয়ান পর্যন্ত তার পরের এগারাে জন সম্রাটের জীবনের গল্প। স্যুটোনিয়াস গুজবে রটা গল্প মজা করে লিখতে পছন্দ করতেন। সাধারণ ঐতিহাসিকেরা যেসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন, তিনি সেগুলাে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। যাই হােক, সেসব মজাদার গুজবের বর্ণনার কারণে তার বইটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল আর আজও একই আগ্রহ নিয়ে পঠিত হচ্ছে।
  • জোসেফ : তখনকার যুগে রােমান নন কিন্তু জনপ্রিয় এমন একজন ইতিহাসবিদ হলেন ইহুদি জোসেফ। তিনি নিজের নামের রােমানিয় রূপ দিয়েছিলেন ফ্লেভিয়াস জোসেফাস। তিনি ৩৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কেবল ইহুদি শিক্ষায়ই শিক্ষিত নন, রােমান শিক্ষাও গ্রহণ করেন জোসেফাস। তাই দুই সংস্কৃতিতেই সমানভাবে বিচরণ করতেন তিনি। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রােমে যান রােমান সংস্কৃতি আরও ভালাে করে শিখতে। আবার জুডিয়ায় ফিরে এসে সেখানকার সংস্কৃতির সাথেও তাল মেলান। দুই জায়গার জাতীয়তাবাদের উন্নতিকল্পে তিনি সমানভাবে কাজ করে যান। তবে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি: ইহুদিদের মধ্যে যখন বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল তখন রােমের বিরুদ্ধে একটি সেনাদল নিয়ে তিনিও রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। তিনি অনেকটা সময় ধরে শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে সফলতার সাথে লড়ে গিয়েছিলেন। যখন শেষ সময়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে তখন অন্য আর সব পরাজিত কাপুরুষ নেতার মতো তিনি আত্মহত্যা করেননি। বরং সে জায়গায় তিনি ভদ্রভাবে মাথা নত করে ভেস্পাসিয়ান আর টাইটাসের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই সে শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি রােমান নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে রােমে বসবাস করে কাটিয়েছেন। তিনি ৯৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের জাতিকে ত্যাগ করার বিষয়টি নিয়ে তিনি মর্মাহত হননি, তা নয়। ইহুদি বিদ্রোহের স্মৃতিচারণ করে তাই বই লিখেছিলেন। নাম ছিল “ইহুদিদের যুদ্ধ”। ভেস্পসিয়ানের শাসনামলের শেষের দিকে বইটি ছাপা হয়। ইহুদি বিদ্রোহী হিসেবে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ আনা হয়েছে, আত্মজীবনী গ্রন্থে সেসব যুক্তি খণ্ডন করেছেন। আরেকটি বইয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন কেন এবং কীভাবে ইহুদিরা বিদ্রোহের দিকে এগিয়ে গেছে, কতটা অত্যাচারিত হয়ে, কী বিপর্যয়ের মুখে তারা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে। তার বিখ্যাত বই হলাে “ইহুদিদের স্বর্ণযুগ” (দ্য জুইশ অ্যান্টিকুইটিস) যাতে ইহুদিদের প্রাচীন ইতিহাস (বাইবেলকে নতুন করে বর্ণনা করাসহ) থেকে শুরু করে তাদের বিদ্রোহের সূচনা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। বইটিতে একটি প্যারাগ্রাফে নাজারেথের যিশুর কথা বলা হয়েছে। এটাই বাইবেলের দ্বিতীয় পর্বের বাইরে অন্য কোথাও যিশুর সম্বন্ধে নতুন কোনাে তথ্যসমৃদ্ধ বই। অবশ্য বেশিরভাগ জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা মনে করেন যে বাইবেলের বাইরে যিশুর সম্পর্কে এসব বর্ণনা পুরােপুরি সত্য নয়। পরে টিবারিয়াসের সময়ে আবার কিছু খ্রিস্টানের সহায়তায় জোসেফাসের বর্ণনা যে ভিত্তিহীন আর যথেষ্ট নয়, এ নিয়ে জুডিয়ায় আলােচনাও হয়েছে।

রম্য রচনা : ফ্লেভিয়ানদের রাজত্বের সময়টায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য সমালােচকরা এইসব সাহিত্যকে অগাস্টাসের সময়কার সাহিত্যের সাথে তুলনা করে খুব উচ্চমানের বলে মনে করেন না। তারা ফ্লেভিয়ানের সময়কে সাহিত্যের “রৌপ্যযুগ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই রৌপ্যযুগে জনপ্রিয় ছিলেন তিনজন অসাধারণ রম্যলেখক। রম্যলেখকরা সব খারাপ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসিঠাট্টা মিলিয়ে গল্প লিখতেন। ঠাট্টার মাধ্যমে খোঁচা দিয়ে তারা মানুষকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করতেন। রম্যলেখক তিনজন হলেন পার্সিয়াস (আউলাস পার্সিয়াস ফ্ল্যাকাস), মার্শাল (মার্কাস ভ্যালেরিয়াস মার্শালিস) আর জুভেনাল (ডেসিমাস জুনিয়াস জুভেনালিস) –

  • পার্সিয়াস : পার্সিয়াস ছিলেন প্রথম আর প্রকৃতপক্ষে এসেছিলেন ফ্লেভিয়ান আমলের আগে। সে কারণে তিনি ক্লডিয়াস আর নিরােকে নিয়েও রম্যরচনা লিখেছিলেন। জেনারেলরা কেউ যখন তাদের আদর্শ থেকে এতটুকু নেমে গেছেন তখনই পার্সিয়াস সেই ঘটনা নিয়ে রম্য লিখেছেন। প্রতিদিন এরকম লিখতে লিখতে এই বিষয়ে তিনি দক্ষ হয়ে উঠলেন। তিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মারা যান। এত অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ না করে তিনি যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন তবে তার রম্য সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতাে আর তার আরও বেশি নামডাক হতাে।
  • মার্শাল : খ্রিস্টাব্দে স্পেনে জন্মেছিলেন মার্শাল। নিরাের আমলে তিনি রােমে আসেন আর সেখানেই ১০৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার রম্যকবিতা, ছড়া, বিশেষ করে খুবই ছােট আকৃতির দুই থেকে চার লাইনের অনুকাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি ওই ধরনের ১৫০০ ছড়া লিখেছিলেন যেগুলাে চৌদ্দটি বইয়ে ছাপানাে হয়েছিল। তার চোখের সামনে যতরকম অসঙ্গতি তিনি দেখতে পেতেন, তাই নিয়েই লিখে যেতেন। তারপরে ছাপা হওয়ার সাথে সাথেই তার অনুকাব্য সকলের মুখে মুখে ফিরত। হয়তাে যাদের নিয়ে সেসব লেখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার রম্যের খোঁচা বছরের পর বছর ধরে খেয়ে এসেছেন। মার্শাল তার সময়ে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। টাইটাস আর ডমিশিয়ান দুজনেই তার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। এটা কিছুটা হতাে এই কারণে যে তার রচনা ছিল খুবই মজার আর কিছুটা এই কারণে যে তিনি তার রম্য রচনায় কিছু অসামাজিক বা অসভ্য বিষয়ের অবতারণা করতেন। তাই তার রম্য কৌতুক বেশিরভাগই ছিল কিছুটা আদি রসাত্মক। একটি স্বাভাবিক রসবােধপূর্ণ কৌতুক-কবিতার উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে – “Non amo te, Sabidi, nec possum dicere quare;/ Hoc tantum possum dicere, non amo te.” এর অর্থ হলাে, “তােমাকে ভালােবাসতে পারি না, সাবিডিয়াস, বলতেও পারি না কেন; শুধু এটুকু জানাে, পারি না ভালােবাসতে।” এই অনুকাব্যটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল থমাস ব্রাউনের আধুনিক সংস্করণে। ১৭৮০ সালে থমাস ব্রাউন যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন তার ডিন ডক্টর ফেলকে নিয়ে এই ছড়াটির প্যারােডি করে লিখেছিলেন: “ডক্টর ফেল, ভালােবাসি না তােমায়।/ কারণ শুধায়াে না আমায়;/ এ শুধু আছে আমার জানায়,/ ডক্টর ফেল, ভালােবাসি না তােমায়।”
  • জুভেনাল : জুভেনাল ছিলেন রম্যলেখকদের মধ্যে হয়তােবা সবচেয়ে বড় কিন্তু কিছুটা রসহীনও। মাঝে মাঝে সমাজের মধ্যে ঘটা দুর্বিষহ ঘটনায় তিনি এতটা বিমর্ষ হয়ে পড়তেন যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। তখন তিনি তার লেখায় হাস্যরসবােধের পরিবর্তে কঠোর কঠিন ভাষার প্রয়োেগ করতেন। তিনি রােমের লােকদের অযথা বিলাসিতা আর লােক দেখানাের স্বভাবকে ঘৃণা করতেন। তার লেখার মাধ্যমে স্বৈরাচারী কোনাে মানুষ বা একদল স্বেচ্ছাচারী লােককে একইরকমের প্রবল আক্রোশ নিয়ে আক্রমণ করতেন। তিনি রােমের মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে নানা কটাক্ষ করতেন। তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে তারা কেবল খাওয়া আর খেলার প্রতিযােগিতা উপভােগ করতে পারে। কিন্তু এটাই প্রমাণ করে না যে সম্রাটদের আমলে রােম পৃথিবীর আর সব সভ্য দেশের চেয়ে জঘন্য কোনাে জায়গা ছিল। সন্দেহ নেই যে আজ যদি জুভেনাল বেঁচে থাকতেন তবে এখনও তিনি একইরকমের রম্য কবিতা লিখে যেতেন, কঠিন হলেও সত্যি যে লিখতেন নিউইয়র্ক, প্যারিস, লন্ডন কিংবা মস্কোকে নিয়ে। এটা মনে রাখা দরকার যে খারাপ একটা পরিস্থিতিতে মানুষ অনেক পাপকাজে লিপ্ত হতে পারে কিন্তু আড়ালে আবডালে যে অনেক ভালাে ও দয়ালু মানুষ কিংবা ভদ্রলােকেরা থাকেন তারা তাদের মতাে কাজ করেই যান। সেসব খবর কখনও পত্রিকার প্রথম পাতায় আসেও না আর কেউ জানতেও পারে না।

স্পেইনভিত্তিক কবি ও অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ :

  • কবি লুকান : একটু প্রাচীন ধরনের কবিতা লিখতেন লুকান (মার্কাস অ্যানাইয়াস লুকানাস)। তিনি ৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের করডােবাতে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ নিরাের শিক্ষক সেনেকার ভাগ্নে ছিলেন তিনি। তার সবচেয়ে আলােচিত কাজ হলাে জুলিয়াস সিজার আর পম্পেইয়ের মধ্যেকার যুদ্ধ নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ। তার কাজের মধ্যে বলতে গেলে এটাই পুরােপুরি অক্ষত আছে। তিনি নিরাের বন্ধু ছিলেন। তবে এই বন্ধুত্ব যেমন তার জন্য তেমনই তার মামা সেনেকার জন্য গুরুতর হয়ে দেখা দেয়। নিরাে লুকানের কবিতার ব্যাপারে খুব হিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন আর তাকে জনসমক্ষে আবৃত্তি করতে বাধা দেন। একজন কবির জন্য এটা ছিল চরমতম শাস্তি। তার সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে তিনি নিরাের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। ধরা পড়লে লুকান আদালতের পক্ষের রাজসাক্ষী হয়ে যান আর তার সাথে ষড়যন্ত্রকারী বাকিদের পরিত্যাগ করেন। কিন্তু তার পরেও লুকানকে ধরে নিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়।
  • শিক্ষাবিদ ও অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ কুইন্টিলিয়ান : এরপরে রােমে আরও একটি স্প্যানিশ স্কুল গড়ে ওঠে। রৌপ্যযুগের দার্শনিকদের আদর্শ অনুযায়ী সেনেকা, মার্শাল আর লুকানের কথা মাথায় রেখে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন কুইন্টিলিয়ান। মার্কাস ফেবিয়াস কুইন্টিলিয়ান ৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে জন্মান। তিনি গ্যালবার সাথে কাজ করেছিলেন আর রােমে এসেছিলেন গ্যালবা যখন সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি রােমেই থাকা শুরু করেন। ছাত্রদের ভাষা ও বক্তৃতা দেয়ার কায়দা শেখান। তিনিই প্রথম শিক্ষক যিনি সম্রাটের অনুমােদন  অনুয়ায়ী শিক্ষাদান করার সুযােগ পান। ভেস্পাসিয়ানের তরফ থেকে তাকে এজন্য সাহায্য করা হয়। কুইন্টিলিয়ান সিসেরোর ঘাের সমর্থক ছিলেন। তিনি গ্রিক ভাষার ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে আর গ্রিসের ধরন অনুযায়ী রচনায় বেশি বর্ধনা আর অতি কাব্যিক বিষয়গুলাে পরিহার করার চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞান ও প্রকৌশল চর্চা : রােম কখনােই বিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিল না। সেটি ছিল গ্রিকের লােকদের জন্য প্রথম প্রশংসার বিষয়। রােমান সাম্রাজ্যের প্রথম শতাব্দীতে রােমানরা এসে বিজ্ঞানের প্রতি যে অবদান রেখেছিল তা পৃথিবীর যে কোনাে বিজ্ঞানের ইতিহাস বইয়ে বর্ণনা করা হয়। সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা হলেন –

  • প্লিনি : সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন প্লিনি (গেইয়াস প্লিনিয়াস সেকানডাস)। তিনি ২৩ খ্রিস্টাব্দে ইতালির উত্তর দিকে নােম কোমাম শহরে (আধুনিক কোমাে শহর) জনুগ্রহণ করেন। তিনি ক্লডিয়াসের সময়ে সেনাবাহিনীর দল নিয়ে জার্মানির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ছিল ভেস্পসিয়ান সাম্রাজ্য হারাবার পরের ঘটনা। তিনি ভেস্পাসিয়ানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সে সময় তিনি গাউলের কিছু অংশে আর স্পেনে গভর্নর হিসেবে কাজ করেন। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, পৃথিবীর সব বিষয়ে যার ছিল অপার আগ্রহ আর অনুসন্ধিৎসা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন জ্ঞানার্জনে। তার প্রধান রচনা “প্রাকৃতিক ইতিহাস” ৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল সাইত্রিশ খণ্ডে লিখিত আর টাইটাসকে উত্সর্গীকৃত। এটা কোনাে মৌলিক রচনা ছিল না। দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন বই থেকে সংগ্রহ করে পাঁচশ লেখকের লেখাকে একত্র করে তিনি এই বিশাল রচনাটির আয়ােজন করেছিলেন। রচনা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই নিরপেক্ষ আর রসবােধসম্পন্ন। বইটি মহাকাশ বিজ্ঞান এবং ভূগােল নিয়ে যথেষ্ট আলােচনা করেছে। তবে এর মূল বিষয় ছিল জীববিজ্ঞান। এখানে তিনি অসংখ্য পরিব্রাজকের রচনা থেকে উল্লেখযােগ্য অংশ লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানে পঙ্খীরাজ ঘােড়া, মৎস্য কন্যা, এক শিংওয়ালা ঘােড়া, মস্তকবিহীন মানুষ, দীর্ঘ পা-বিশিষ্ট অবাস্তব মানুষ আরও অনেক কিছুর মজাদার বর্ণনা আছে। বইটি ছিল মনােমুগ্ধকর আর এত বেশি কপি ছাপানাে হয়েছিল যে বহুদিন পর্যন্ত সব জায়গায় পাওয়া যেত। বাস্তবধর্মী সমস্যা নিয়ে লেখা বই কখনও এত বেশি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। প্লিনির রচনার খ্যাতি মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের প্রথম দিকে পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয় এবং একটি আশ্চর্যজনক সৃষ্টি হিসেবে সমাদৃত ছিল। একে সবসময়ে একটি পৃথক ঐতিহ্যবাহী কাজ হিসেবেই দেখা হতাে। প্লিনি জীবনের শেষে একটি ভয়াবহ নাটকীয় পরিণতির দিকে যান। টাইটাসের অধীনে তিনি নেপলসে একটি যুদ্ধজাহাজ বহরের দায়িত্বে ছিলেন। তার জায়গায় বসেই তিনি ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত হতে দেখছিলেন। অগ্ন্যুৎপাত কাছে থেকে দেখে লেখার মধ্যে নিখুঁতভাবে ঘটনাটি ফুটিয়ে তােলার জন্য তিনি সেটির কাছে গেলেন। কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করার কারণে লাভার ছাই আর ধোঁয়ার মধ্যে বন্দী হয়ে যান তিনি। পরে সেখানেই তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।
  • সেলসাস : অন্য জনপ্রিয় লেখকদের, যাদের লেখা অনেকদিন বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে একজন হলেন আউলাস কর্নেলিয়াস সেলসাস। টিবারিয়াসের সময়ে তিনি যেখানে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে মানুষকে গ্রিক শেখানাের চেষ্টা করেছেন। গ্রিক ঔষধের উপরে লেখা তার যে বইটা তিনি লিখেছিলেন সেটি আধুনিক যুগের প্রারম্ভে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তখন সেলসাসকে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল। সেটি ছিল তাকে দেয়া চরম সম্মান। ক্যালিগুলার আমলে পম্পােনিয়াস মেলা (সে সময়কার আরেকজন স্প্যানিশ জ্ঞানী ব্যক্তি) গ্রিক মহাকাশ বিজ্ঞানের উপরে নির্ভর করে একটি জনপ্রিয় ছােট ভূগােল বই লিখেছিলেন। তিনি সতর্কতার সাথে সেটি থেকে জটিল গাণিতিক বিষয়গুলাে বাদ দিয়েছিলেন যেন মানুষের জন্য পড়তে সহজ হয়। সে সময়ে তার এই মহাকাশবিজ্ঞানের বই খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি মধ্যযুগেও খুব সমাদৃত ছিল। মানুষের প্রাচীন ভূগােলের জ্ঞান বলতে যা বােঝায়, তা বইটিতে ছিল।
  • ভিট্রুভিয়াস : প্রকৌশল বিদ্যা, যাতে রােমানরা সবসময় এগিয়ে ছিল, সেই ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় কাজ হয় সে সময়ে। অগাস্টাসের আমলে ভিট্রুভিয়াস (মার্কাস ভিট্রুিভিয়াস পােলিও) একটি বিশাল আকৃতির স্থাপত্যবিদ্যার বই লেখেন আর সম্রাটকে উৎসর্গ করেন। বহু বছর তার বইটিই ওই বিষয়ে একটি আদর্শ লেখা হিসেবে গণ্য হতাে।
  • ফ্রন্টিনাস : বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় অবদান রাখার জন্য স্মরণ করা যেতে পারে সেটাস জুলিয়াস ফ্রন্টিনাসকে। তিনি ৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভেস্পাসিয়ানের অধীনে তিনি ব্রিটেন গভর্নরের কাজ করেন। তিনি সেনাবিজ্ঞান আর ভূমিজরিপের উপরে বই লেখেন। কিন্তু দুঃখজনক হলাে, তার বইগুলাে অবিকৃতভাবে পাওয়া যায়নি। ৯৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট নার্ভা তাকে রােমের জল সরবরাহের কাজ দেখাশােনা করার দায়িত্ব দেন। এর ফলে তিনি রােমের জল সরবরাহের বিভিন্ন দিক নিয়ে দুই ভলিউমে লেখা বইয়ের কাজ শেষ করেন। এটিই সম্ভবত মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন প্রকৌশল বিদ্যার বই। তিনি রােমান প্রকৌশলীদের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। কিন্তু মিশরিয় আর গ্রিক প্রকৌশলীদের সাথে তুলনা করলে সেটা তেমন কোনাে কৃতিত্বই নয়।
  • ডিওসকরিডেস : গ্রিসের বিজ্ঞানচর্চার আলাে কমে এলেও তা সাম্রাজ্যের প্রাচীন পথপ্রদর্শক ছিল। নিরাের অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন গ্রিক ডাক্তার ডিওসকরিডেস। তিনি গাছগাছড়া থেকে ঔষধ তৈরি করতে পছন্দ করতেন। এই সুবাদে গাছপালা ব্যবহার করে ঔষধ তৈরির পদ্ধতি বিষয়ে তিনি পাঁচটি বই লেখেন। এটিই হয়তাে ঔষধ তৈরির পদ্ধতি বিষয়ে সবচেয়ে প্রাচীন বই যা মধ্যযুগ পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
  • হিরো : বলতে গেলে একই সময়ে, অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার আমলে একজন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়। তার নাম ছিল হিরাে অথবা হিরােন। তিনিই ছিলেন প্রাচীন যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকৌশলী আর আবিষ্কারক। তিনি একটি শূন্য গােলাকার ফাঁপা বস্তু তৈরি করেছিলেন যার একটি বাঁকানাে হাতল ছিল। তাতে জল ফোটানাে যেত। হাতলের ভেতর দিয়ে বাষ্প বেরিয়ে এসে গােলাকার অংশটিকে ঘােরাত (আজকাল মাঠে জল দেয়ার জন্য এই সূত্রের ব্যবহার হয়)। এটিকে খুব প্রাচীন একটি স্টিম ইঞ্জিন বলা যেতে পারে। তখন যদি সমাজটা ততটা এগিয়ে থাকত যে তার এই আবিষ্কারের কদর জানত তবে সেখানে একটি শিল্প বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু সমাজের শিক্ষাদীক্ষা সেই পর্যায়ে ছিল না আর তাই সেই সূত্র কাজে কর্মে লাগাতে আরও সাতটি শতাব্দী লেগে গেছে। হিরাে বলবিদ্যা নিয়েও গবেষণা করতেন। তিনি বাতাসের গতিবিধি আর আচরণ নিয়ে গবেষণার পরে ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই কাজটি ছিল তার সময়ের জন্য অত্যন্ত আধুনিক।

উপসংহার : ক্যালিগুলা, নিরাে আর ডমিশিয়ানের সময়ে অস্থির অবস্থার মধ্যেই সাহিত্য আর বিজ্ঞানচর্চা অস্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলছিল। সে সময়ে দপ করে যে আলাে জ্বলে উঠেছিল, কেন যেন নার্ভা বা তার পরের যে সকল সম্রাট নার্ভার অনুসারী ছিলেন তাদের শাসনামলের শান্ত সময়ে আর সেভাবে জ্বলে ওঠেনি। বরং যেন সুস্থ সুন্দর নিয়মের আড়ালে সৃষ্টিশীলতায় ভাটা পড়েছিল।

ট্রাজান (রা. ৯৮ – ১১৭ খ্রি.)

খ্রিস্টানদের ওপর অনাচারের বিপক্ষে প্লিনি ও ট্রাজান

প্লিনি তার চিঠির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি সেই একচোখা চিঠিগুলাে ছাপিয়ে ছিলেন যেন মানুষ তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারে। সেগুলাের মধ্যে একটি চিঠি আজও মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চিঠিটি তিনি বিধিনিয়া থেকে ট্রাজানকে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি পড়লে মনে হয়, খ্রিস্টানরা যেন কেবল খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধেই শাস্তি পেয়ে যাচ্ছিল। এমনকি প্লিনি অনুভব করেছিলেন যে কোনাে খ্রিস্টান যদি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয় তবে যেন তার সাত খুন মাফ হয়ে যাবে। সে আগে ধার্মিক খ্রিস্টান থাকলেও কোনাে ক্ষতি নেই, তাকে মাফ করে দেয়া হবে। এছাড়াও প্লিনি মানুষকে যত্রতত্র বিনাদোষে শাস্তি দেবার ব্যাপারটি নিয়েও খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। নানান ঘটনা দেখে শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে খ্রিস্টানদের জীবনযাপন মােটেও অপরাধীর জীবনযাপন নয়। বরং তারা খুব শান্তিপূর্ণ কাজেকর্মে অভ্যস্ত। তাদের আদর্শ অত্যন্ত উচ্চমানের। আর তখন প্লিনি তার এই অনুভূতিকে চিঠির মাধমে জনসমক্ষে উপস্থিত করেন। সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে খ্রিস্টধর্ম একটি শান্তির ধর্ম বলেই এত দ্রুত প্রচার পাচ্ছে। নমনীয় না হয়ে এটি যদি মানুষে মানুষে হানাহানি আর মারামারি বাড়িয়ে দিত তাহলে বিস্তৃতির ক্ষেত্রে এর পথ রুদ্ধ হতােই। ট্রাজান প্লিনির আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। খ্রিস্টানদের যেন অপরাধী হিসেবে বেছে বেছে ধরে আনা না হয় আর তাদের ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য না করা হয়, এ ব্যাপারে তিনি আদেশ দেন। ট্রাজান বলেন, একমাত্র তারা যদি সত্যি কোনাে অপরাধ করে থাকে আর আইনত তাদের শাস্তিবিধান হয় তবেই যেন তাদের শাস্তি দেয়া হয়। (প্রশ্নাতীতভাবে প্লিনি আর ট্রাজানকে আধুনিক যুগে “খ্রিস্টানদের প্রতি দয়ালু” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।) ছােট প্লিনি চিঠিগুলাে লেখার পরে খুব বেশিদিন বাঁচেননি। হয়তাে তিনি বিথিনিয়ার গভর্নর থাকা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন।

অ্যান্টোনিনাস পায়াস (রা. ১৩৮ – ১৬১ খ্রি.)

তদকালীন খ্রিস্টধর্মের বিকাশ

অ্যান্টোনিনাস হয়তােবা সমস্ত রােমান সম্রাটের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে ভদ্র আর মানবিক। পিতৃঋণ শােধ করার মতাে আগের সব সম্রাটের তৈরি ভালাে ভালাে নিয়মকানুন তার অধীনে চমৎকারভাবে চলতে লাগল। তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি নমনীয় ভাব প্রদর্শনের জন্য আইন করেন। ততদিনে ইহুদি আর খ্রিস্টধর্মের মধ্যে সম্পর্কটি অন্য ধর্মাবলম্বী রােমানদের কাছে কিছুটা পরিস্কার হয়েছে। একই বৃন্ত থেকে জন্মগ্রহণকারী দুইটি ধর্মকে তখন মানুষ শত্রু মনে করত। যেহেতু হাড্রিয়ানের সময় পর্যন্ত ইহুদিরা জুডিয়ায় বিদ্রোহ জারি রেখেছিল, তাই খ্রিস্টানরা স্বাভাবিকভাবেই রােমের বন্ধু হয়ে গেল। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতাে, “শত্রুর শত্রু তাে আমার বন্ধুই হবে।” মানুষকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান করে ফেলা ইহুদি বানানাের চেয়ে সহজ ছিল। আর সেটা সফলভাবে করাও গেছে। তাই খ্রিস্টধর্ম খুব দ্রুত মহিলা, দাস আর দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এই মানুষেরা তাদের নিজের জীবনের জটিলতা নিয়েই ব্যস্ত থাকত যদিও দেশে শান্তি বিরাজ করছে অথবা দেশে একটি সুস্থ সরকার ব্যবস্থা আছে। খ্রিস্টানদের পরকালে বিশ্বাস, যার কারণে তারা মনে করত যে এই নশ্বর পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় জন্মের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার জায়গা, এখানকার কাজের ভিত্তিতে কেবল মানুষকে বিচার করা হবে যে সে পরকালে কতটা সুখী হওয়ার যােগ্যতা রাখে, এই শ্রেণির মানুষের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় তথ্য। তবু বহুদিন যাবৎ খ্রিস্টধর্ম কেবল শহুরে ধর্মই থেকে গেল। খামারে কাজ করা মানুষেরা এই নতুন ধ্যান ধারণার বাইরে রয়ে গেল। তারা তাদের জীবনে নতুন কিছু গ্রহণ করতে ভরসা পেত না। নিজেদেরকে প্রাচীন পদ্ধতির আওতায় রাখতেই বেশি শান্তি পেত। তাই তারা তাদের প্রাচীন ধর্মগুলাে নিয়েই বসে থাকল। সেই সময় “প্যাগান” শব্দটি সেরকম মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতাে, যারা না ইহুদি আর না খ্রিস্টান। কিন্তু তারা তাদের দেশীয় প্রাচীন কোনাে ধর্মে বিশ্বাসী। প্যাগান শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “পিজ্যান্ট” অথবা কৃষক থেকে এসেছে। আর “পাগাস” শব্দের অর্থ, যারা গ্রামে বাস করে। একইভাবে “হিথেন” শব্দের অর্থ যে হিথে বসবাস করে। হিথ মানে হলাে দূরবর্তী কোনাে অঞ্চল। কিন্তু তবু খ্রিস্টধর্মকে শহুরে পুঁজিবাদীদের নিজস্ব ধর্ম মনে করার কোনাে কারণ ছিল না। শিক্ষিতদের মধ্যেও এই ধর্ম একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল।

জাস্টিন মার্টার

এমনকি কিছু দার্শনিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জাস্টিনের কথা (যাকে সাধারণত তার মৃত্যুর ধরন অনুযায়ী জাস্টিন মার্টার বলা হয়ে থাকে)। তিনি ১০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জুডিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও রােমে তার “প্যাগান” ধর্মাবলম্বী পিতামাতা ছিলেন তার আর শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন গ্রিক ভাষায়, কিন্তু যিশুর মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের বিষয়ে ইহুদিদের জ্ঞানগর্ভ রচনাগুলাে এড়াতে পারেননি। তিনি নিজের আদর্শ বিসর্জন না দিয়েই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। তিনি তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার বলে খ্রিস্টধর্মের গােড়ার কথা আলােচনা করতেন। তাই তিনি হয়ে ওঠেন একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান “অ্যাপােলজিস্ট”। (অ্যাপােলজিস্ট হলাে তিনি, যিনি কোন কিছুর পক্ষে থেকে তার রক্ষা করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেন।) জাস্টিন মার্টার ইহুদিদের সাথে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক করতেন। রােমে তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে খ্রিষ্ঠান ধর্মের ব্যাপারে শিক্ষা প্রদান করা হতাে। তার রচনা হাড্রিয়ান আর অ্যান্টোনিনাস পর্যন্ত পৌঁছানাে উচিত ছিল যারা কিনা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি অতি উদার মনােভাব দেখিয়ে এসেছেন। অবশ্য ইহুদিদের বিদ্রোহ সত্ত্বেও অ্যান্টোনিনাস তাদের প্রতি সদয় ছিলেন।

মার্কাস অরেলিয়াস (রা. ১৬১ – ১৮০ খ্রি.) 

এপিকটেটাস ও মার্কাস অরেলিয়াসের স্টয়সিজম

মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন তাকে দত্তক গ্রহণকারী পিতার পরে একজন আদর্শ শাসক। পাঁচশ বছর আগে প্লেটো বলেছিলেন যে পৃথিবী কখনও ঠিকঠাকমতাে চলবে না যতক্ষণ না রাজারা সব দার্শনিক হয়ে যাবে কিংবা দার্শনিক রাজপুত্র জন্মাবে। মার্কাস অরেলিয়াসের ক্ষেত্রে প্লেটোর এই কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। মার্কাস একাধারে ছিলেন একজন শক্তিশালী শাসক আর সম্মানিত দার্শনিক। তার রচনা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। প্রকৃতপক্ষে মার্কাস অরেলিয়াস ছিলেন জোনাের আদর্শে বিশ্বাসী একজন স্টয়িক (জীবনের যাবতীয় অর্জন আর ব্যর্থতার প্রতি উদাসীন)। এমনিতে অ্যান্টোনিনাসের সময়েও স্টয়সিজম কিছুটা প্রশ্রয় পেয়ে আসছিল। রােমান সাম্রাজ্যের সেই সময়টিতে এর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এপিকটেটাসের মাধ্যমে। তিনি একজন গ্রিক যিনি জন্ম (৬০ খ্রিস্টাব্দে) থেকেই দাস ছিলেন। তার স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল আর একটি পা ছিল খোড়া (সম্ভবত কোনাে নিষ্ঠুর মনিবের রাগের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাকে খুব অল্পবয়সে রােমে আনা হয়। সেখানে তিনি স্টয়িক মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের বক্তৃতা শােনার সুযােগ পান। তিনি তাদের আদর্শে ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করার পরে তিনি একজন শিক্ষক হয়ে যান। নিজের মতাদর্শ শিক্ষা দিতে থাকেন। ডমিশিয়ানের সময় যখন দার্শনিকদের রােম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তখন এপিকটেটাসকেও রােম ছাড়তে হয়। এটা ছিল ৮৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তিনি অবসর গ্রহণ করে নিকোপেলিসে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। নিকোপেলিস হলাে অগাস্টাসের পত্তন করা শহর, অ্যাক্টিয়ামের কাছে মার্ক অ্যান্থনির সাথে শেষ যুদ্ধ জয়ের পরে অগাস্টাস এই শহরটি বানিয়েছিলেন। নিকোপােলিসে এপিকটেটাস জীবনের শেষ দিনগুলােতে শিক্ষা দান করে কাটান। এপিকটেটাস তার নিজহাতে কিছু না লিখলেও, তার শিক্ষা গ্রহণকারী অনেকের মধ্যেই তার আদর্শ লিপিবদ্ধ করা হয়ে গেছে। তার সবচেয়ে নামকরা ছাত্র ছিলেন আরিয়ান (অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জীবনী লেখক)। তিনি এপিকটেটাসের আদর্শ দুইটি খণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছিলেন যার কিছু অংশ উদ্ধার করা গেছে। এপিকটেটাসের দর্শন ছিল দয়ার আর মানবিকতার। যেমন তিনি বলতেন, “বাঁচ আর বাঁচতে দাও” এবং “সহ্য কর আর সংযম কর”। মার্কাস অরেলিয়াস যখন তরুণ ছিলেন তখনই স্টয়িক মতবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর পরবর্তীকালে সম্রাট হওয়ার কারণে স্টয়সিজমের শিক্ষা দান করতে করতে একজন বিশিষ্ট স্টয়িক হিসেবে পরিচিতও হয়েছিলেন। মার্কাস অরেলিয়াস সুখ ভােগে বিশ্বাস করতেন না, বরং তার বিশ্বাস ছিল উত্তেজনাবিহীন প্রশান্তিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা আর সংযমে। নিজের জীবনের পথে কোনাে কষ্টকর দায়িত্ব পালন থেকে তিনি পিছ পা হননি। তার জীবন যেমন যুদ্ধে যুদ্ধে এগিয়ে গেছে, তার মধ্যে নিজের সব চিন্তা ভাবনাকে একটি নােটবুকে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন তিনি। উদ্ধারকৃত ছােট্ট এ বইটির নাম তিনি দিয়েছিলেন “ধ্যান” (“মেডিটেশন”)। এই গ্রন্থটি আজও ব্যাপক জনপ্রিয় এজন্য যে, তার মতাে বিলাসবহুল জীবনে আর সম্মানিত অবস্থানে একজন মানুষ কী করে এত জ্ঞানপিপাসু আর ধৈর্যশীল হতে পারে।

মহামারী, রোমের জনসংখ্যা হ্রাস ও বার্বারিয়ানদের শহরে নিয়ে আসা

পূর্বদিকে ভারত আর চীনের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা আজীবনই কলেরা আর প্লেগের মতাে ভয়াবহ অসুখের প্রকোপে নাজেহাল ছিল। ওইসব দেশের মানুষ এই অসুখগুলাের সাথেই ওঠাবসা করত, মানে সেখানে সবসময়েই কোনাে না কোনাে এলাকায় এগুলাে লেগে থাকত। এক একবার এক একটি অসুখের প্রকোপ বেড়ে যেত, মহামারী আকারে একটি বিশেষ জীবাণুর নাম শােনা যেত। তারপর সেই মহামারী ভ্রমণকারী, সেনা বা ভয়ার্ত রিফিউজিদের শরীরে বাহিত হয়ে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। অন্য সববারের মতােই সেবার প্লেগ অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। অসুখটি ইউরােপে প্রবেশ করল। এটি এতই ভয়াবহ ছিল যে এথেন্সকে ঘায়েল করে ফেলল। এই ঘটনাটি মার্কাস অরেলিয়াসের ক্ষমতায় আসার ছয়শ বছর আগের। গ্রিসের সাথে স্পার্থার যখন লম্বা যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তখনকার ঘটনা এটি। রােগটি গ্রিসের মানুষকে এমনভাবে অসুস্থ করে ফেলে যেন মনে হয় এথেন্স যুদ্ধে হেরেই যাবে। এই প্লেগ অনেকটা এথেন্সের প্রতাপ কমিয়ে গ্রিসের ধ্বংস শুরুর জন্য দায়ী। মার্কাস অরেলিয়াসের শাসনামলের বারাে শতাব্দী পরে আরেকরকমের প্লেগ (বিখ্যাত কালাজ্বর) ইউরােপকে সাবাড় করে দিয়েছিল। সেবারে এই কালাজ্বর ইউরােপের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা কমিয়ে দেয়। এই দুই ভয়াবহ প্লেগের মাঝখানে একটি এসেছিল, মার্কাস অরেলিয়াসের সময়ে, সেটির গুরুত্বও কম নয়। এটা গুটি বসন্তের মহামারী হতে পারে। পার্থিয়ায় যেসব সেনা যুদ্ধে রত ছিল তারা অনেকে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হলাে। এই মহামারী তাদের ক্রমশ দুর্বল করে দিলাে। সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা শরীরে জীবাণু বয়ে রােমে আর অন্যান্য প্রদেশে নিয়ে এলাে। পুরাে সাম্রাজ্যের মানুষের মধ্যে ভয়াবহভাবে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়ল। যােদ্ধা আর কৃষকের সাম্রাজ্যে এমন ছাপ ফেলে গেল যে চিরকালের জন্য সেটি দুর্বল হয়ে গেল। গুটি বসন্তের প্রকোপে রােম শহরের জনসংখ্যা সেই যে কমে গেল, বিংশ শতাব্দীর আগে সেই সংখ্যা আর অগাস্টাস কিংবা ট্রাজানের সময়ের সমান হয়নি। এভাবে জনসংখ্যা কমে যাওয়াটা সাম্রাজ্যের জন্য একরকম ভয়ংকর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তাই মার্কাস অরেলিয়াস উত্তর দিক থেকে অসভ্য কিছু জাতিকে সেখানে এসে থাকার আহ্বান জানালেন। এটাই ছিল রােমান পেন্ডুলামের সর্বপ্রথম জার্মানির দিকে ঝুঁকে যাওয়া।

মহামারীর ফলে খ্রিস্টানদের ওপর হামলা ও বিদ্রোহের আশঙ্কা

ইতালির ভয়ার্ত জনগােষ্ঠী ওই মহামারীর জন্য কাউকে না কাউকে দোষ দিতে উদ্যত হলাে। তারা একাধারে খ্রিস্টানদের উপরে এর দোষ চাপিয়ে দিলাে। আর তখনই আরম্ভ হলাে ধর্মের কারণে মানুষের উপরে অত্যাচার। সেই সময়ে ডাইনি খুঁজে বের করার ঘটনায় যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন জাস্টিন মার্টার। কোনাে সন্দেহ নেই যে মার্কাস অরেলিয়াস তার আদর্শ অনুযায়ী এ ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মানুষকে বিরত করতে। কিন্তু গুজবে কান দেয়া মানুষের উদভ্রান্ত আক্রোশ সামলানাে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এটা নিশ্চিত ছিল যে মার্কাস অরেলিয়াস সাম্রাজ্যের আদর্শ এবং লক্ষ্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাজ্যের ধর্ম আর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি আর সবার থেকে চিন্তায় আর চেতনায় অন্যরকম ছিলেন। তার কাছে নিশ্চয়ই খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তখন হয়ে উঠেছিল দেশের শান্তি হরণকারী এক জাতি। তার শাসনামলের সেই সময়টাতে রােমে অশান্তি আর হানাহানি এতই বেড়ে গেল যে তার আগের কয়েক সম্রাটের আমলে এমনটা দেখা যায়নি। তিনি বুঝতে পারলেন যে দেশে বিদ্রোহের আশঙ্কা বাড়ছে আর তার পক্ষে সেটা সামাল দেয়া দুঃসাধ্য হবে। তাই খ্রিস্টানদের উপরে অত্যাচার যেটা তিনি অন্যায় হিসেবেই জানতেন, তা বন্ধ করার আইনানুগ উদ্যোগ নিলেন।

অ্যান্টোনাইনদের আমল 

শান্তির কাল

৯৬ খ্রিস্টাব্দে নার্ভার মৃত্যু থেকে শুরু করে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যু পর্যন্ত চুরাশি বছর ধরে রােমান সাম্রাজ্যে মানুষ মূলত শান্তিতেই ছিল। ওই বছরগুলােতে সরকার ব্যবস্থাকে ভদ্র আর ন্যায়পরায়ণ খেতাবই দেয়া চলে। সেই সময়ে পার্থিয়া, ডেসিয়া আর ব্রিটেনর সাথে যুদ্ধ লেগেছিল বটে, তবে সেসব রোম থেকে অনেক দূরে। সেসব যুদ্ধ হয়েছিল সাম্রাজ্যের বাইরের মাটিতে। আর তাই রােমান প্রদেশগুলােতে তেমন প্রলয়ঙ্করী কোনাে ছাপ ফেলতে পারেনি। বিদ্রোহীও কম ছিল না সে সময়টাতে। যেমন হাড্রিয়ানের সময়ে ছিল ইহুদি বিদ্রোহীরা। এসেছিল হঠাৎ করে জেগে ওঠা একজন জেনারেলের বাহিনী, সিরিয়ার যুদ্ধের সময়কার ঘটনা। ঘটনাটি ছিল ১৭৫ সালে আর তারা বিদ্রোহ সংগঠনের আশায় গুজব রটিয়েছিল যে জেনারেল মার্কোম্যানির হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যু হয়েছে। এই সমস্ত বিদ্রোহীদের দমন করা হয়েছিল অত্যন্ত নিপুণভাবে। এসব দুর্ঘটনা সেই সময়ের বিরাজমান শান্তির ক্ষেত্রে খুবই ছােট ছােট উপদ্রব। বলে রাখা ভালাে যে ১৮শ শতাব্দীর ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন তার বিখ্যাত বাণীতে বলেছেন যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত জাতির যত কালের যত রাজত্বের ইতিহাস আছে, তার মধ্যে রােমান সাম্রাজ্যের অ্যান্টোনাইনদের সময়ের মতাে এরকম সময় আর কখনও আসেনি। একই সাথে অসংখ্য মানুষ সে আমলে আশাতীত দীর্ঘ সময়ের জন্য শান্তিতে ছিল। একভাবে চিন্তা করলে তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কারণ আমরা যদি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে ভাবি, তাহলে অ্যান্টোনাইনরা ছিল সবচেয়ে সফল শাসক। অন্যান্য শতাব্দীতে যখন রাজ্যে রাজ্যে লাগাতার যুদ্ধ লেগে ছিল, তার চেয়ে সে সময়টা অনেক ভালাে ছিল। এমনকি তাদের শাসনামলের পরের কয়েকটি বছর, যখন কিনা নানারকম অসভ্য জাতির উৎপাত লেগে ছিল, সে সময়টার চেয়েও অ্যান্টোনাইনদের সময়টা ভালাে ছিল। আর তখন যখন অসংখ্য ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত সরকারের সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়ে তাে সে সময়টা ভালাে ছিলই। যে কেউ বলতে পারে যে আজকের এই উত্তপ্ত পৃথিবীটা (রােমসহ বাকি পুরাে পৃথিবী) যে অ্যাটম বােমার ভয়ংকর ছায়ায় ছেয়ে আছে, তার চেয়ে বরং সে সময়টা অনেক অনেক ভালাে ছিল।

এই কালের সমস্যা

এটা সত্য যে অ্যান্টোনাইনের সময়টা যদি শান্তি আর স্থিরতার হয়ে থাকে তবে তা ছিল রােমান সাম্রাজ্যের জন্য অস্বাভাবিক ধকলের পরে এক টুকরাে শান্তি আর স্থিরতা। কারণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল গ্রিক আর রােমানদের উপর্যুপরি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। একটি সাম্রাজ্য যখন এত বিশাল আর এত ভয়ংকর শক্তিশালী হয়, তখন তাকে অনেক ধাক্কা আর দুর্যোগ সহ্য করেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রােমান সাম্রাজ্য একটি বীরের মতো তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ােজিত করে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা যেন এক অতিমানব যােদ্ধার মতাে নিজের অস্তিত্ব জাহির করা। কিন্তু তারপরেও এর অবস্থা এতই আশঙ্কাজনক ছিল যে জয়ের পক্ষে যথেষ্ট নয়। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দের মহামারী হয়তােবা সাম্রাজ্যের মানুষের মধ্যে যেটুকু সাহস আর ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল তাও কেড়ে নিয়েছিল। একের পর এক সম্রাটের রােমকে দেখার মতাে আকর্ষণীয় একটি স্থানে পরিণত করতে চাওয়ার উদ্যোগ সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থাকে আরও ধসিয়ে দিয়েছে। অ্যান্টোনাইনদের সময়ে শতশত, হাজার হাজার রােমান নাগরিককে বিনা খরচে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। তখন প্রতি তিন দিনের মধ্যে একদিন থাকত ছুটি। আর সেই ছুটির দিনটিতে তাদের বিনােদনের জন্য রথের প্রতিযােগিতা, গ্ল্যাডিয়েটরে যুদ্ধ আর নানারকমের পশুপাখির খেলার ব্যবস্থা থাকত। এগুলাের সবই ছিল মারাত্মক ব্যয়সাপেক্ষ। তাছাড়া অল্পদিনের জন্য মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য অর্থনীতিকে দীর্ঘদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে এসব বিনােদনের ব্যবস্থা করাটা ছিল খুবই অবিবেচকের মতাে কাজ। (প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে যেসব রোমান ওই ধরনের বিনােদনে আগ্রহী ছিল, তারা খুব উপভােগ করত। নিজেদের উত্তরাধিকারীদের কথা তেমন একটা ভাবেনি তারা। তাদের জন্য কোনাে কিছুই রেখে যেতে চায়নি। এখন আমাদের এই প্রজন্ম যারা যথেচ্ছা পৃথিবীকে দূষিত করছে আর পৃথিবীর সীমিত সম্পদ ধ্বংস করছে তারাও একই ধরনের অপরাধে অপরাধী। তাই কেবল সেই যুগের রােমান নাগরিকদের দিকে আঙুল তােলার কোনাে অধিকার অন্তত আমাদের নেই।)

অ্যান্টোনাইন আমলের কতিপয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব

  • সাহিত্যিক লুসিয়াস অ্যাপােলেইয়াস : অ্যান্টোনাইনদের আমলের অতিরিক্ত বিনােদনে ভােগা জাতির একঘেয়ে জীবনে সাহিত্যের ভাণ্ডার দিনদিন কমে আসছিল। অ্যান্টোনাইনদের সময়ের শেষের দিকের একমাত্র উল্লেখযােগ্য সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হলেন লুসিয়াস অ্যাপােলেইয়াস, যিনি জন্মেছিলেন ১২৪ খ্রিস্টাব্দে নিউমিডিয়ায়। তিনি এথেন্সে শিক্ষা গ্রহণ করেন আর রােমে কিছুদিনের জন্য বসবাস করেন। কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান কার্থেজে। “সােনার গাধা” (দ্য গােল্ডেন অ্যাস) বইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। রচনাটিতে একজন মানুষের কল্পনার জগৎ দেখানাে হয়। একজন মানুষ হঠাৎ গাধায় পরিণত হয়ে যায় এবং তারপরে তার পশুজীবনে নানান মজাদার ঘটনা ঘটতে থাকে। “কিউপিড অ্যান্ড সাইক” নামে বিখ্যাত গল্পটি ওই বইয়েরই অন্তর্ভুক্ত। এটি প্রাচীন গল্প বলার ঢঙে লেখা অদ্ভুত এবং অসাধারণ একটি রচনা।
  • জ্যোতির্বিদ টলেমি : বিজ্ঞানচর্চা কমে আসছিল সে সময়ে। অ্যান্টোনাইনদের শাসনামলে বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে কেবল দুটো নাম উল্লেখযােগ্য। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন গ্রিক (অথবা মিশরিয়ও হতে পারেন) মহাকাশ বিজ্ঞানী। তিনি হাড্রিয়ান আর অ্যান্টোনিনাসের আমলে মিশরে বাস করতেন। তিনি হলেন ক্লডিয়াস টলেমিয়াস। ইংরেজি ভাষায় তিনি কেবল টলেমি, নামে পরিচিত। তিনি সমস্ত গ্রিক মহাকাশবিজ্ঞানীর কাজকে একত্র করে একটি এনসাইক্লোপেডিয়ার মতাে সংকলন তৈরি করেছিলেন। সেই বইটি মধ্যযুগেও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তিনি যদি ওই সংকলনটি না করতেন তবে প্রাচীন যুগের সমস্ত বিজ্ঞানীদের গবেষণার ইতিহাস একরকম হারিয়েই যেত। এটি যেন তার আগের পরে শত বছরের মহকাশ গবেষণার ইতিহাস। যেহেতু টলেমির আঁকা মহাবিশ্বের ছবিতে পৃথিবীকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, সেহেতু এই ধরনের মডেলে কেন্দ্রে পৃথিবী সম্পন্ন ছবিটিকে বলা হয় “টলেমির সিস্টেম”।
  • চিকিৎসক গ্যালেন : টলেমির চেয়ে বয়সে কিছুটা ছােট ছিলেন গ্যালেন। তিনি ছিলেন একজন গ্রিক চিকিৎসক যিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেন ১৩০ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রােমে বসবাস করা শুরু করেন এবং মার্কাস অরেলিয়াসের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তিনি ঔষধের উপরে গবেষণা গ্রন্থ লেখেন। তার বইগুলাে মধ্যযুগেও মানুষ পড়েছে। এমনকি আধুনিক যুগ পর্যন্ত সেসব ঔষধের প্রয়ােগ দেখা গেছে।

ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ও খ্রিস্টধর্মে দলাদলির সৃষ্টি

সে সময়ে সাম্রাজ্যের বােঝা বাড়ছিল আর স্বেচ্ছায় সেসব বােঝা বহনের মানুষের সংখ্যা দিনদিন কমছিল। মনে হচ্ছিল এভাবেই যেন বােঝার ভারে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে। আর হয়েছিলও তাই। যদিও এসব একঘেয়েমি আর ক্লান্তি সব ধরনের প্রচেষ্টাকে ঘায়েল করতে পারে না। তারপর একসময় পৃথিবীকে অটুট রাখার বাস্তব প্রয়ােজনীয়তা মানুষের মনে নাড়া দেয়। মানুষ নিজের সাথে বসবাসরত এই গ্রহটির সম্পর্ক গভীরভাবে বুঝতে শেখে। অবশ্য সে সময়ে বিজ্ঞান, শিল্পচর্চা আর সাহিত্যের যে তেমন কোনাে উন্নতি হয়নি এর সপক্ষে একটি যুক্তি দেয়া যায় যে বুদ্ধিমান মানুষেরা তখন একটি নতুন প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তা হলাে ধর্মতত্ত্ব (থিওলজি)। শুধু যে ইহুদি আর খ্রিস্টানরা নিজেদের ধর্ম নিয়ে তর্কে লিপ্ত ছিল তাই নয়। আবার তারা একসাথে হয়ে যে রােমের প্রাচীন ধর্মগুলাের বিরুদ্ধে লড়ছিল তাও নয়। কেবল খ্রিস্টানদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের অনেক দল হয়ে গেল। (একটি দল প্রাচীন মতে বিশ্বাসী হলে তাদের বলা হলাে “গোড়া” (অর্থোডক্স)। গ্রিক ভাষায় অর্থোডক্সের অর্থ হলাে “সরল বিশ্বাসী”। আরেকটি দল প্রাচীন ধর্মকে খারিজ করে দিয়ে নতুন নিয়মকানুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বলে তাদের বলা হলাে “নব্যতান্ত্রিক” (হেরেসিস)। গ্রিক ভাষায় হেরেসিস শব্দের অর্থ হলাে “নিজের জন্য বেছে নেয়া”।

নস্টিসিজমের উদ্ভব ও অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের সাথে সংঘাত

খ্রিস্টধর্মের প্রথম দিকের দশ বছর ধরে একদল খ্রিস্টান তাদের নিজস্ব এক ধরনের মতামত আঁকড়ে নিয়ে বসে ছিল। তাদের আদর্শকে বলা হয় “নস্টিসিজম”। এটা প্রাথমিক হেরেসিস দলের শুরু বলা যেতে পারে। নস্টিসিজম একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ হলাে জ্ঞান। নস্টিসিজম দাবি করত যে জ্ঞানই মুক্তি যা একমাত্র পৃথিবীকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। এখানে জ্ঞান বলতে আমরা পরিবর্তন আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা অর্জন করি তাকে বােঝায়। প্রকৃতপক্ষে নস্টিসিজমের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিস্টধর্মেরও আগে। সেই মতাদর্শের মধ্যে পার্সিয়ান ধর্মের কিছু ছায়া ছিল। মূলত পার্সিয়ান ধর্মের আদর্শে ভালােমন্দের বিচার আরেকটি অশুভ শক্তির বর্ণনা একইরকমের ছিল। ভালাে আর খারাপের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার বিষয়গুলােও ছিল একইরকম। খ্রিস্টধর্ম আসতে আসতে বেশ কিছু নস্টিসিজম অনুসারী খ্রিস্টধর্মের প্রতিপাদ্য বিষয়টি গ্রহণ করে নিলাে। কিছু কিছু খ্রিস্টান নস্টিসিজম অনুসারী বিধাতাকে সব শুভ শক্তির আধার বলে স্বীকার করত। কিন্তু মনে করত যে বিধাতার সাথে মানুষের যে দূরত্ব তা মানুষ কখনােই অতিক্রম করতে পারবে না। আসলে একটি অশুভ শক্তির প্ররােচনায় এই পৃথিবীর সৃষ্টি আর বাইবেলের প্রাচীন পর্যায় হিসেবে তার নাম হলাে জিহােভা। যিশু হলেন বিধাতার সন্তান যিনি জিহােভার হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে এখানে নেমে এসেছেন। সাধারণভাবে নস্টিসিজমের অনুসারীরা ছিলেন কিছুটা উগ্র। অন্যদিকে বাইবেলের পুরনাে পর্যায়ের স্বর্গীয় বিচার অনুযায়ী আজকে যাদের আমরা অর্থোডক্স মনে করি, সেই একই বর্ণনার জায়গা থেকে জিহােভাকে মনে করা হয় বিধাতা। জিহােভাকে অশুভ শক্তি মনে করা মানে তাদেরকে ভয়ানক দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়া। এটাই প্রথম এমন ঘটনা যা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলল। আর এই ঘটনার ভয়াবহতা এতটাই প্রকট হয়ে উঠল যে এই মতপার্থক্য খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মের মানুষদের বিদ্বেষের চেয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের বিদ্বেষই বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠল।

মন্টানাস, মাসিহার আগমনে বিশ্বাস ও পৃথিবীকে নেতিবাচক বলে ভাবা

খ্রিস্টধর্মের শিক্ষকেরাও তাদের নিজস্ব জ্ঞান আর মতবাদ জাহির করতে লাগলেন। তবে তারা অনুতপ্ত লোকেদের শিক্ষা আর সহযােগিতা করে যাচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন যার নাম মন্টানাস, তিনি অ্যান্টোনিনাস পায়াসের সময় নিজেকে বিধাতার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত বিশেষ একজন দূত হিসেবে দাবি করেন। তিনি মানুষকে ধর্মশিক্ষা দিতে থাকেন আর যিশুর দ্বিতীয় আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। এটাও বিশেষ মাসিহার জন্য এক ধরনের অপেক্ষা। ইহুদিরাও এরকম একজন মাসিহার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অপেক্ষা করে ছিল। কিছু ইহুদি শিক্ষকেরা তাদের বুঝিয়েছিলেন যে একজন বিশেষ মাসিহা আগমন অবশ্যম্ভাবী। তাদের বক্তব্য যারা শুনেছিল, সবাই বিশ্বাস করেছিল। যিশুর আবির্ভাবের পর যখন কিছু ইহুদি আর বেশিরভাগ অন্য ধর্মের মানুষেরা তাকে মাসিহা হিসেবে ধরে নিলো, আর অন্তর্ধানের পরে আরেকজন মাসিহার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রজন্মের পরে প্রজন্ম বসে রইল। অনেক প্রজন্ম পরেও তাদের মধ্যে হতাশা দেখা যায়নি। তারা একজন আরেকজনকে খবর পৌঁছে দিয়েছে যে আরেকজন মাসিহা আসবেন, আর এভাবেই প্রতি প্রজন্মে বিশ্বাসটি প্রবাহিত হয়েছে। (“জিহােভার সাক্ষী” (Jehovah’s Witnesses) দলটি আসলে তারাই যারা বিশ্বাস করে যে পুনরায় আরেকজন মাসিহার আগমন ঘটবেই ঘটবে।) মন্টানাস একটি বিশেষ ধর্মীয় দলের সৃষ্টি করেন যারা বিশ্বাস কত্রে যে যিশু আবার আবির্ভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। মানুষকে পার্থিব সবকিছু বর্জন করে, পাপ চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটি রক্ষণশীল জীবনযাপন করতে হবে। তিনি সেই ধর্মোপদেশই দিয়েছিলেন যাকে আজকের জগতে আমরা বলি “কঠোর নীতির অনুসারী” (“পিউরিট্যানিক্যাল”)। আর এভাবেই বেশিরভাগ মানুষ এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে নিজেদের সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতা অন্য আরেকটি উন্নত পৃথিবীর আশায় নিয়োজিত কবুল। তারা এই পৃথিবীর উন্নয়নসাধন করতে ভুলে গেল। আর ধীরে ধীরে বিদ্যমান পৃথিবীকে হয় মূল্যহীন না-হয় শয়তানের আখড়া ভেবে নিলাে।

ক্যারাকালা (রা. ২১১-২১৭ খ্রি.)

স্নানাগার

ক্যারাকালার শাসনামলে ক্যালিগুলার আমলের মতােই “ক্যারাক্যালার স্নানাগার” তৈরি হয়েছিল। স্নানাগারের আয়তন ছিল ৩৩ একর জায়গা। এখনও কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই জায়গাটি উৎসুক মানুষদের জন্য একটি বিশেষ দর্শনীয় স্থান হয়ে আছে। মানুষের স্নান করার অভ্যাস বলতে গেলে রােমান ইতিহাসের মধ্য দিয়েই জনপ্রিয় হয়েছে। তখনই বলতে গেলে স্নান করাটা একটা আভিজাত্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। জনসাধারণের জন্য স্নান করার জায়গাটা এমন করে সাজানাে যে পাশাপাশি অনেকগুলাে স্নানাগার, একজন মানুষ সেখানে ঘুরেফিরে স্নান সারতে পারে। অর্থাৎ, গরম জল, হালকা গরম জল এবং শীতল জলের ব্যবস্থা সেখানে থাকত। সেখানে বাষ্পে অবগাহনের জন্যও জায়গা ছিল। এছাড়া ছিল শরীরে তেল মাখানাে বা শরীর চর্চা করারও জায়গা। সেখানে এমনও জায়গা ছিল যে একজন অতিথি সেখানে আরাম করতে পারে, বিশ্রাম নিতে পারে, পড়তে বা গল্পগুজব করতে পারে, এমনকি চাইলে বসে কিছুক্ষণ আবৃত্তিও উপভােগ করতে পারে। এসব সুযােগসুবিধার জন্যে যে অনেক দাম দিতে হতাে তা না, বরং রােমানদের কাছে বেশ সুলভ ছিল ব্যাপারটা। এই স্নানাগারের জনপ্রিয়তা কিছুদিনের মধ্যেই তুঙ্গে পৌছল। অন্তত মৃত্যু পর্যন্ত মারামারি করে মরতে চাওয়া গ্ল্যাডিয়েটরের যুদ্ধ আর পশুপাখির যুদ্ধ দেখার চেয়ে এর জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। অবশ্য বলা বাহুল্য যে রােমান রম্য লেখক, স্টয়িক দর্শনের অনুসারী আর বেশিরভাগ খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে এসব স্নানাগার ছিল খুবই বিরক্তিকর আর এড়িয়ে চলার মত বিষয়। বিশেষ করে সেখানকার উদার নিয়মকানুনগুলো, যেমন নারী ও পুরুষের একসাথে স্নানের জন্য হাজির হবার ব্যাপারটা গোড়া চিন্তার লােকদের জন্য সহ্য করা কষ্টকর ছিল। তারা মনে করতেন যে সেখানে নানারকমের ব্যভিচার হতে পারে কিন্তু সম্ভবত এমনটি হওয়ার কথা কখনও শােনা যায়নি।

খ্রিস্টান লেখক বা চার্চ ফাদারগণ

চার্চ ফাদাররা

অর্ধশতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যে যখন কেবল হানাহানি বেড়েই চলেছিল, এমনকি সেই সূত্র ধরে মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুও হলাে, খ্রিস্টধর্ম কিন্তু ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে শহরে এবং আরও বেশি করে গ্রিক ভাষাভাষীদের শহরে ধর্মটি বেশি প্রসার পাচ্ছিল। একইসাথে খ্রিস্টধর্মের উপরে লেখালেখিরও যেন উর্ধ্বস্রোত বইছিল। খ্রিস্টধর্মের কোনাে বিশেষ দিক নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থাকাকালে কিংবা পরে মধ্যযুগেও যারা লিখেছিলেন, তাদের বলা হয় “চার্চ ফাদার”। তারা আবার যে ভাষায় লেখালেখি চর্চা করেছিলেন তার উপর নির্ভর করে এই চার্চ ফাদারগণ গ্রিক ফাদার এবং ল্যাটিন ফাদার নামে দুটো অংশে বিভক্ত। অবশ্য এটা বলা যাবে না যে, কোনাে কোনাে লেখক সেই ফাদারদের মধ্যে থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার এটাও বলা যায় না যে, কোনাে কোনাে ফাদার লেখালেখি করেছিলেন। আসলে চার্চ ফাদাররা এই দুই দলের যে কোনাে একটিতে ছিলেন।

ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া

পূর্বদিকে ক্লিমেন্টস অফ অ্যালেক্সান্দ্রিয়া (টাইটাস ফ্লেভিয়াস ক্লিমেনস) ছিলেন সে সময়ের চার্চ ফাদারদের মধ্যে অন্যতম। তার উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্মের উপরে গ্রিক জ্ঞানের আলােকপাত করা। এই ধর্মযাজক ১৫০ খ্রিস্টাব্দে এথেন্সে জন্মেছিলেন। তার পিতামাতা ছিল প্যাগান ধর্মের অনুসারী। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পূর্বেই হয়তাে কিছু প্যাগান শাস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই যেখান থেকে তার উদ্ভব, সেই অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই থাকতেন। তার শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতিটিকে তাই বলা হতাে অ্যালেক্সান্ড্রিয়ান ধর্মীয় ধারা। ক্লিমেন্ট খ্রিস্টধর্মকে দেখেছিলেন একটি দর্শন হিসেবে। তার মতে এটি কেবল গ্রিক ধর্মীয় পদ্ধতির পরের বিষয় ছিল না, বরং ছিল অনেক উর্ধ্বে। তিনি ইহুদি রচনা থেকে প্রয়ােজনীয় অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে সেগুলাে গ্রিক রচনার চেয়েও প্রাচীন। তিনি এটিও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেন যে গ্রিক ধর্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন ইহুদি ধর্মেরই একটি অংশ মাত্র। তার মতে প্রাচীন কালের ফাদারদের মধ্যে অন্য কেউ গ্রিক দর্শনের ব্যাপারে এত বিস্তারিত পড়াশােনা করেননি।

অরিজেন

ক্লিমেন্টের শিষ্যদের মধ্যে এখনও যার নাম উল্লেখযােগ্য মনে করা হয়, তিনি হলেন অরিজেন (অরিজিনেস)। ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে অরিজেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অরিজেন এসেছিলেন অ্যালেক্সান্ড্রিয়ার একটি খ্রিস্টান পরিবার থেকে। তার বাবা খ্রিস্টান হিসেবে শহীদ হন। ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নিজেকে এমনভাবে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন যেন নারীর সান্নিধ্য কিংবা সংসারের মােহ তাকে মাঝপথে বিরত করতে না পারে। তার এই প্লেটোনিক দর্শন এবং তার রচনা মানুষের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তাকে আগের সব দার্শনিকসহ ধর্মযাজকদের জনপ্রিয়তার উর্ধ্বে তুলে ধরল। সে যাই হােক, তিনি প্রচুর লিখেছিলেন আর বিশেষ করে তাকে সবসময় গ্রিক লেখক সেলসাসের বিপক্ষে সমান একটি প্রতিভা হিসেবে স্মরণ করা হয়। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পরের প্রথম শতাব্দীর বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার জন্য সেলসাস যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন তা নয়, কিন্তু অরিজেনের দেড় শতাব্দী পরে প্লেটোর দর্শনে বিশ্বাসী হিসেবে তার নামভাক হয়েছিল। সেলসাস খ্রিস্টধর্মের বিপক্ষে একটি সাধারণ এবং অগভীর বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের দর্শন তখন অল্প কিছু মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। এটাই ছিল প্যাগানদের মধ্যে একজনের লেখা প্রথম একটি বই যেখানে খ্রিস্টধর্মকে খুব বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেলসাসের যুক্তিগুলাে ছিল খুবই সাধারণ, যেসব বিষয় নিয়ে আজকের দিনে মুক্তচিন্তার যে কোনাে মানুষ ভাবে। তার উত্থাপিত বিষয়গুলাের মধ্যে কুমারী তরুণীর মা হওয়া, মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ফিরে আসা, আর এছাড়াও বিভিন্ন অসম্ভব ঘটনা যেসব ব্যাখ্যার অতীত। এছাড়াও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কী করে খ্রিস্টধর্ম গ্রিক ধর্মের আদর্শকে ভেঙে ভেঙে তৈরি হলাে এবং পরবর্তীকালে নিজেদের প্রসারের জন্য গ্রিক ধর্মের প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়াল। বইটি ছিল প্রচণ্ড বাস্তববাদী। সেই সাথে তা ভীষণ জনপ্রিয় একটি সাহিত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বইটি টিকে থাকতে পারেনি। তাই বইটির কথা তেমন শােনাও যায় না। অরিজেন সেলসাসের জনপ্রিয় বইটিতে যত যুক্তি ছিল তা খণ্ডন করার জন্য “সেলসাসের বিপক্ষে” নামে আরেকটি বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ে অরিজেন সেলসাসের লেখা বইয়ের নয় দশমাংশই তুলে দিয়েছিলেন যুক্তি খণ্ডনের জন্য। তাই বলতে গেলে অরিজেনের মাধ্যমেই সেলসাসের বইটি টিকে ছিল। অরিজেনের রচনাটি খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে লেখা সবচেয়ে জোরালাে একটি বই।

টারটুলিয়ান ও সিপ্রিয়ান

মার্কাস অরেলিয়াসের আমলের (১৬১-১৮০ খ্রি.) পরপর পশ্চিম দিকের প্রদেশগুলােতেও চার্চের লেখকদের উদ্ভব হয়েছিল। তখন প্রকৃতপক্ষে দর্শনচর্চা যেন কেন্দ্র গ্রিস ছেড়ে সারা সাম্রাজ্যের উর্বর মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। পশ্চিমা প্রদেশের লেখকদের মধ্যে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় তিনি হলেন টারটুলিয়ান (কুইন্টাস সেপটিমিয়াস প্লেরেন্স টারটুলিয়ানাস)। তিনি ১৫০ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রিক ভাষা পড়তে ও লিখতে পারা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে লেখালেখি করেছিলেন ল্যাটিন ভাষায়। তিনি প্যাগান পিতামাতার ঘরেই জন্মেছিলেন এবং একটি ভালাে কাজের আশায় রােমে এসেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি ১৯৭ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজে ফিরে আসেন। আর তারপর থেকে বাকি জীবন সেখানেই বসবাস করেন। তার রচনার মূল দিক ছিল তিনি নস্টিক দর্শনকে জনপ্রিয়তার তালিকা থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই বাস্তবিকভাবে নস্টিক দর্শনের ক্রান্তিকাল আরম্ভ হয়েছিল। টারটুলিয়ান ছিলেন একজন মন্টানিস্ট যিনি জীবনভর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের ব্যাপারে গোঁড়ামির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। পরে কার্থাজিনিয়ান চার্চ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি নিজের অনুসারী ব্যক্তিদের নিয়ে কাছাকাছি একটি মন্টানিস্ট লােকালয়ে গিয়ে থাকা শুরু করেন। সেখানে তার প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। ২২২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন আফ্রিকার সিপ্রিয়ান (থেসিয়াস সিসিলিয়াস সিপ্রিয়ানাস)। তিনি প্রায় ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কার্থেজে জন্মগ্রহণ করেন । তিনিও প্যাগান পিতামাতার ঘরে জন্মেছিলেন এবং পরে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তিনি অবশ্য কার্থেজে চার্চের বিশপ হিসেবেও কাজ করেন। তিনি তার রচনার মধ্যে টেরুলিয়ানের লেখার ধরনটি অবিকৃত রেখেছিলেন। ২৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি শহীদ হন।

নব্যপ্লেটোবাদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠা

খিস্টধর্মের ক্ষমতা দিনদিন এতই বেড়ে যাচ্ছিল যে সে সময় আলেক্সান্ডার সেভেরাসের রােমে সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা যে ইচ্ছে ছিল তা নেই হয়ে গেল। ধীরে ধীরে প্যাগান ধর্মের অনুসারী দার্শনিকেরা খ্রিস্টধর্মের বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। এর আগে ছিল স্টয়সিজম বা স্টোইকবাদ যা কিনা অভিজাত শাসক শ্রেণির অল্প কিছু মানুষকে তার আদর্শের দিকে টেনে আনতে পেরেছিল। কিন্তু মার্কাস অরেলিয়াসের মৃত্যুর সাথে সাথে সেই আদর্শের জনপ্রিয়তাও যেন হঠাৎ করেই মরে যায়। এরপর যে দর্শন সফলতার মুখ দেখেছিল, তা হলাে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দর্শন। তার নতুন ধরনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। জীবন এবং ধর্মকে তিনি নিজস্ব দর্শনে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন। তখন দার্শনিকদের কাছে নব্য প্লেটোনিক দর্শন এমনই একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাস আর না বাড়িয়ে তারা প্লেটোর মতবাদগুলােতেই নিজেদের আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেত। প্লেটোর অনুসারী নব্য দার্শনিকদের মধ্যে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য, তিনি হলেন প্লটিনাস। ২০৫ খ্রিস্টাব্দে রােমান পিতামাতার পরিবারে মিশরে তার জন্ম হয়েছিল। তিনি অ্যালেক্সান্ড্রিয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং রােমে আসেন ২৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তার মৃত্যুর আগে ২৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জটিল দর্শনের শিক্ষাদান করতে থাকেন। যদিও এই নব্য প্লেটোনিজম রােমান সাম্রাজ্যে বিশাল কোনাে প্রতিষ্ঠিত দর্শন হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে সফল হয়নি, কিন্তু প্লেটোর নানান দর্শন কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে খ্রিস্টান চার্চে প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে যেখানে খ্রিস্টধর্ম বেশি প্রসার পেয়েছে, সেখানে প্লেটোর দর্শনও জনপ্রিয় হয়েছে।

ডেসিয়াস (রা. ২৪৯-২৫১ খ্রি.) ও খ্রিস্টান নির্যাতন

ফিলিপাসকে হত্যা করে ডেসিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ

সেই হাজারতম বছরটি ফিলিপের জন্য কোনাে সৌভাগ্য বয়ে আনেনি। সাম্রাজ্যের চারদিকে বিভিন্ন বাহিনী বিদ্রোহ করছিল। ফিলিপ তার পক্ষের লােকদের মধ্যে একজন, ডেসিয়াসকে (গেইয়াস মেসিয়াস কুইনটাস ট্রাজানাস ডেসিয়াস) দানিয়ুবের তীরে পাঠিয়ে দেন সেখানকার বিদ্রোহ মেটানাের জন্য। সেখানে যাওয়ামাত্রই বিদ্রোহী সেনারা ডেসিয়াসকে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার অনুরােধ করে। ডেসিয়াস এই দায়িত্ব নিতে চাননি এবং তাদের বুঝিয়ে শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেনারা যখন তাকে সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করে দিয়েছে তখন তার আর কিছুই করার ছিল না। এরপর সেই সময়ে সেখানে যা যৌক্তিক, সেই ক্ষমতার জন্য লড়াই করা ছাড়া তার সামনে অন্য কোনাে রাস্তা খােলা ছিল না। বাধ্য হয়ে তাকে বিদ্রোহীদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পুরাে বাহিনী নিয়ে ইতালির দিকে রওনা দেন তিনি। ২৪৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ইতালিতে যুদ্ধ শুরু হয়। সেখানে সম্রাট ফিলিপকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। অবশ্যম্ভাবীভাবে তারপর রােমান সম্রাট হন ডেসিয়াস। ততদিনে ক্রমবর্ধমান খ্রিস্টানরা রােমান সাম্রাজ্যের সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করছিল। রোমানদের কাছে তারা ধীরে ধীরে বিরক্তিকর এবং ধ্বংসাত্মক উপাদানে পরিণত হচ্ছিল।

খ্রিস্টানদের স্টেইট রেলিজিয়ন পালন ও সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদানে অনীহা

এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টানদের প্রতি রোমানদের অসন্তোষের ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার। ২৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন সাম্রাজ্য জুড়ে সেভাবে দেখা যেত না। সেই সময় খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন ছিল স্থানীয় আকারে ও মূলত জনতার দ্বারা, স্থানীয় শাসক কর্তৃপক্ষ খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন করেছে এরকম ঘটনা হাতে গোনা ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা একই সাথে পাবলিক কাল্ট লিডারও ছিলেন। রোমান ধর্মগুলো গণ অনুষ্ঠান ও উৎসর্গ অনুষ্ঠানকে ঘিরেই আবর্ত হতো। আধুনিক ধর্মগুলোতে যেরকম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার দেখা যায়, সেসময় এরকম ছিলনা। তাই খ্রিস্টানদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে রোমান এলিটরা কখনও গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে রোমান সমাজের পাবলিক রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসগুলোই ছিল লোকাল কমিউনিটি ও সাম্রাজ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য উপাদান। এরকম ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে সম্মান দেয়া ছিল তাদের কাছে স্থিতিশীলতা ও সাফল্যের চাবিকাঠি। রোমান সাম্রাজ্যে রিলিজিয়াস সিনক্রেটিজম বা ধর্মীয় সমন্বয়বাদের চর্চা ছিল। সেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করতে পারত। কোন এক ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা সেখানে ছিল না। কিন্তু রোমান শাসকগণ রাষ্ট্রের উপর জনগণের আনুগত্য দবি করত। আর প্রজাদেরকে এই আনুগত্য প্রদর্শন করতে হতো সারা বছর জুড়ে এই পাবলিক সেরেমনিরগুলোর মাধ্যমে, অর্থাৎ বিভিন্ন রকম পান-ভোজনোৎসব ও অনুষ্ঠান উদযাপনের সাথে সাথে স্টেট রিলিজিয়নের চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের প্রকৃতিই এমন যে, তাতে অন্য কোন “ঈশ্বর” জড়িত থাকে এমন কোন আচার পালন করা যাবে না। এজন্য খ্রিস্টানরা ফিস্ট ডেগুলোতে, শোভাযাত্রায়, বলিদান বা ধূপ জ্বালানোর মতো কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করতো না। এটা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্নতার জন্ম দেয়। তারা রোমান সম্রাটের প্রতিও ধূপ দান করতো না, যেখানে সাধারণ জনগণের মনে সম্রাটকে দেবতার মতই দেখা হতো, আর যখন তাকে দেবতার মত করে দেখা হতো তখন তিনি হয়ে উঠতেন সমগ্র সাম্রাজ্যের মানবরূপ। তাই ধর্মীয় কারণে খ্রিস্টানরা সম্রাটের উপরেও আনুগত্য দেখাতো না। রোমান সাম্রাজ্য চাইত না যে রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোন সত্তা প্রজার আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াক। প্রজার কাছে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থানই হবে সর্বাগ্রে। কিন্তু খ্রিস্টীয় একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় সর্বোত্তম।

খ্রিস্টানদের প্রাইভেট পরিসরে ধর্ম পালন ও সভা এবং যিশুর রক্ত-মাংস খাবার সিম্বলিজমের কারণে রোমানদের সাথে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি

এদিকে খ্রিস্টানরা তাদের কার্যক্রমকে রাজপথ ছাড়িয়ে বাড়িঘর-দোকানপাটের মত প্রাইভেট পরিসরে নিয়ে যায়, আর ধর্ম, ঐতিহ্য এবং নগর ও জাতির মতো পাবলিক ইনস্টিটিউশনের মধ্যে যে স্বাভাবিক বন্ধন ছিল তাতে ভাঙ্গন ধরাতে শুরু করে। এভাবে তাদের দ্বারা “ধর্মের প্রাইভেটাইজিং” ছিল তাদের উপর নির্যাতনের আরেক কারণ। তারা কখনও কখনও গোপনে রাতের বেলায় মিলিত হতো, যা পাবলিক ইভেন্টে অভ্যস্ত প্যাগান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এর ফলে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে যায় যে তারা গোপনে অপরাধমূলক কাজ, লজ্জাজনক পাপ, নরভক্ষণ বা অজাচারের মত কার্যের সাথে জড়িত। এদিকে খ্রিস্টধর্মের ইউক্যারিস্ট আচারের মধ্যে মদকে যিশুর রক্ত ও রুটিকে যিশুর মাংস ভাবার একরকম সিম্বলিজম রয়েছে, এটা এই গুজবকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেয়। এছাড়া খ্রিস্টানদের অনেক রীতিনীতি ও ধ্যানধারণাই রোমান ঐতিহ্যের সাথে মিলত না। গিবন বলেন, খ্রিস্টীয় ধর্মান্তরিতগণ তাদের পরিবার ও অঞ্চল ত্যাগ করত, এবং বারবার ভবিষ্যতে দুর্দশা আসতে চলেছে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে তাদের প্যাগান প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করত। প্যাগানদের মধ্যে এরকম ভয় ঢুকে যাবার ফলে যেটা হয়, তারা রোমান সাম্রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, মহামারী সহ যেরকম ডিজাস্টারই আসুক না কেন সব দোষ চাপাতো খ্রিস্টানদের ওপর। আমরা দেখি খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষের দিকে টারটুলিয়ান লিখছেন, খ্রিস্টানরা দুর্যোগের জন্য দায়ী নয়, এথেকে তখনকার দিনে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে প্যাগানদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে অনুমান করা যায়।

নতুন ধর্ম খ্রিস্টধর্মকে হানিকর বলে ভাবা ও রোমান আচারপ্রথা নিয়ে কটূক্তি

রোমানরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাল্টের ইন্টিগ্রিটির সম্মান দিত, তাদের পূর্বপুরুষগত ঐতিহ্যকে সম্মান দিত। আর তাই দীর্ঘদিন ধরে রোমানরা খুবই এক্সক্লুসিভ ইহুদি সম্প্রদায়কে সহ্য করে এসেছে। সাধারণ রোমান জনগণ ইহুদিদেরকে পছন্দ না করলেও রোমান শাসকগণ ইহুদি ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছে। ইহুদিরা তাদের ইহুদি ট্যাক্স দিয়ে তাদের ধর্ম-কর্ম সব পালন করতে পারতো। কিন্তু খ্রিস্টানদের বেলায় তাদের প্রতি সেরকম দৃষ্টিভঙ্গি ছিলনা। যতদিন খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরই অংশ ছিল ততদিন কোন সমস্যা ছিলনা, ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, আর ঐতিহ্যকে রোমানরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু ৯৬ সালের পর রোমানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে খ্রিস্টান আর ইহুদিরা আলাদা। ইহুদিদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, কিন্তু খ্রিস্টানরা সেই ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্পূর্ণ নতুন এক সংস্কৃতি। এই নতুন উদ্ভূত সংস্কৃতিকে রোমানরা সুপারস্টিশাস বা কুসংস্কারমূলক হিসেবে দেখত। সেই সময় তাদের কাছে “সুপারস্টিশন” আমাদের কাছে যা কুসংস্কার যেরকম ঠিক সেরকমটা ছিলনা। এর দ্বারা রোমানরা এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাসকে বোঝাতো যা সমাজের জন্য হানিকর। তাছাড়া এই খ্রিস্টানরা এমন একজনকে পূজা করত (যিশু) যে কিনা ছিল রোমানদের দ্বারাই এক সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তাদের ধর্মগ্রন্থে ছিল রোমানদের বিরুদ্ধে কটূক্তি। তৃতীয় শতকের প্রথম দিকে দেখা যায় একজন রোমান মেজিস্ট্রেট বলছেন, “আমি সেইসব লোকের কথা অত শুনতে পারব না যারা রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলে”। এ থেকে এই মনে হয় যে, খ্রিস্টানরা সেসময় রোমান ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে কটূ কথা বলত। এভাবে খ্রিস্টানদের সাজাপ্রাপ্ত আসামীর পূজা করা, রোমান সম্রাটের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শন ও শপথ না করা, ধর্মগ্রন্থে রোমানদের নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা, আর সন্দেহজনকভাবে গোপনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার কারণে রোমান শাসক ও প্রজাগণ উভয়পক্ষই খ্রিস্টানদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হতে শুরু করে। উত্তাল জনতা কর্তৃক খ্রিস্টানদের উপর চড়াও হবার ঘটনাও দেখা যেতে থাকে, আর এমন ক্ষেত্রে জনগণকে শান্ত করার জন্য শাসকেরা তাদের ইচ্ছানুসারেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। সব মিলে এসব ঘটনাই খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্টানদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

ডেসিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণের পর সাম্রাজ্য জুড়ে জুপিটারের প্রতি সকলের বাধ্যতামূলক উৎসর্গের আদেশ

২৪৯ সালে ডেসিয়াস রোমান সম্রাট হলেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যপন্থী টাইপের লোক। এসেই তিনি রোমের “স্বর্ণযুগকে” পুনর্জাগরিত করার কাজ শুরু করলেন। তিনি সেন্সরের প্রাচীন কার্যালয় পুনরায় চালু করলেন, কলোসিয়ামও পুনর্নির্মাণ করলেন। এবার তিনি ঐতিহ্যবাহী রোমান রীতিনীতিও চালু করার কাজে হাত দিলেন। শুরুটা হলো ২৫০ সালের ৩ জানুয়ারিতে জুপিটার দেবতার প্রতি বার্ষিক উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। তিনি একটি অনুশাসন জারি করেন, যেখানে বলা হয় সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়েই দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ দিতে হবে, সাথে দেবতার উদ্দেশ্য ধূপ জ্বালাবার কথাও বলা হয়। তবে ইহুদিদেরকে এই কার্য থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এখন এরকম কোন সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে এই ডিক্রি ধার্য করার সময় খ্রিস্টানদেরকে টারগেট করা হয়েছিল বা তাদেরকে নির্যাতন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বরং ডেসিয়াসের এই আদেশকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে একতাবদ্ধ করার একটি উপায় হিসেবেই দেখা হয়েছিল। সম্রাটের এই আদেশ পালনকে তার প্রতি একরকম আনুগত্যের শপথ গ্রহণ হিসেবেই দেখা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সম্রাটের এই আদেশের ফলে খ্রিস্টানরা প্রথম তাদের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় চাপের স্বীকার হয়, সম্রাটের আদেশ পালনের এই অর্থ ছিল যে, হয় জুপিটারের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করো নয়তো মরো, এটা ছিল খ্রিস্টানদের কাছে “হয় ধর্ম ত্যাগ করো, নয় মরো” টাইপের কথা।

ডেসিয়াসের আদেশ না মানায় বহু খ্রিস্টানের মৃত্যু, পলায়ন ও লুকিয়ে ধর্মপালন

খ্রিস্টধর্ম অনুসারে খ্রিস্টানদের জন্য রোমান দেবদেবীদের উপাসনা করা বা সম্রাটের প্রতিকৃতির সামনে ধূপ জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই অনেক খ্রিস্টানরা সম্রাটের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালো। অনেক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রােমের সেই ধর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার চেয়ে শহীদের মৃত্যুবরণ করাকে শ্রেয় মনে করলেন। কিছু বিশিষ্ট খ্রিস্টান, যেমন পোপ ফ্যাবিয়ান, ব্যাবাইলাস অফ অ্যান্টিয়ক ও আলেক্সান্ডার অফ জেরুজালেমকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়। অরিজেন ছিলেন ডেসিয়াসের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য, যাকে সম্রাটের ক্রোধের শিকার হতে হয়। তাকে সরাসরি হত্যা করা হয়নি। তবে এত গুরুতর আহত করে ফেলা হয়েছিল যে তিনি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। প্রচুর খ্রিস্টানকে এই আদেশ না পালন করার জন্য হত্যা করা হয়। রােমের, অ্যান্টিয়ক এবং জেরুজালেমের বিশপদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। এটা জানা যায়না যে, সকলের এই আদেশ মানছে কিনা তা কতটা পরিমাণে কর্তৃপক্ষ নজর রাখতে পেরেছিল, কিন্তু জানা যায় যে কার্থেজের বিশপ সিপ্রিয়ান সহ অনেক খ্রিস্টান সেই সময় লুকিয়েছিলেন। রােম শহরের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা লুকিয়ে লুকিয়ে ধর্মপালন করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা ঝােপেঝাড়ে, মাটির নিচের রাস্তায়, শহরের বাইরে কবরস্থানে একত্র হতে শুরু করল। এই জায়গাগুলােকে তারা নির্দিষ্ট দিনে চার্চের মতাে ব্যবহার করতে লাগল। এসব হয়ে দাঁড়ালাে তাদের গােপন ধর্মচর্চার গােপন মিলনস্থান। আবার প্রচুর খ্রিস্টান বাধ্য হয়েই সম্রাটের আদেশ পালন করেছিল।

খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে এই আদেশের ফল

খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে এই আদেশের ফল ছিল গুরুতর। অনেক খ্রিস্টানই যারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো তারা এর ফলে ট্রমায় আক্রান্ত হয়। অনেকেই ধর্মত্যাগ করেছিল, কিন্তু এরা পরবর্তীতে পুনরায় খ্রিস্টধর্মে ফিরে আসতে চাইলে এদেরকে আর তার সুযোগ দেয়া হয়নি। ২৫১ সালে সম্রাট গথ নামক জার্মানিক ট্রাইবের আক্রমণে ডেসিয়াসের মৃত্যু হয়, আর তারপর থেকে তার এই আদেশ কার্যকর করাও বন্ধ হয়। সুতরাং খ্রিস্টানদেরকে খুব বেশিদিন এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি, আঠারোটা মাস তাদেরকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু কম সময়ের জন্য হলেও খ্রিস্টানদের কালেকটিভ মেমোরিতে এটি এতটাই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল যে এই সময়টা চার্চের জন্য একটি দানবীয় স্বৈরাচারের কাল হিসেবে আখ্যাত হয়। তবে ডেসিয়ানের নির্যাতনই খ্রিস্টানদের প্রতি শেষ নির্যাতন ছিলনা। পরবর্তীতে ২৫৭ সালে তারা সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের অধীনে নির্যাতনের শিকার হয়, আর ৩০৩ সালে সম্রাট ডিওক্লেশিয়ানের আমলে এই নির্যাতন আরও গভীরতর হয়।

গথদের আক্রমণ

সম্রাট ডেসিয়াসের সময় নতুন এক জার্মানিক ট্রাইব গথরা রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমণ করল। তারা হঠাৎ করেই যেন সেখানে আবির্ভূত হলাে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে এরা সুইডেনের দিকে বাস করো, বাল্টিক সাগরের দক্ষিনপূর্ব দিকের একটি দ্বীপ এখনও গোটল্যান্ড নামে পরিচিত। অগাস্টাসের (খ্রি.পূ ২৭ – খ্রিস্টীয় ১৪ অব্দ) শাসনামলের আগে আগে তারা সম্ভবত দক্ষিণ দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছিল এবং বর্তমানে যে জায়গাটা আধুনিক পােল্যান্ড বলে পরিচিত, সেই জায়গাটা দখল করে রেখেছিল। তারপর ধীরে ধীরে পরের শতাব্দীগুলােতে তারা সফলভাবে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যারাক্যালার (২১১-২১৭ খ্রি.) শাসনামলে তারা কৃষ্ণসাগরের তীরে পৌঁছে গেল। তখন তারা দুটো পৃথক দলে ভাগ হয়ে গেল। একটি দল পূর্বদিকে রওনা দিয়েছিল। সেই সমভূমি যেখানে তারা আস্তানা গড়েছিল তাকে এখন বলা হয় ইউক্রেইন। এদেরকে বলা হয় পূর্বদিকের গথ বা অস্ট্রোগথ। (“অস্ট” মানে জার্মানির প্রজাতি বা পূর্বদিক অথাৎ ইস্টের প্রজাতি)। দ্বিতীয় দলটি পশ্চিমদিকেই থেকে গেল। তারা রােমান প্রদেশ ডেসিয়ায় প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করতে লাগল। তাদের বলা হয় পশ্চিমা গথ বা ভিজি গথ। (“ভিজি” হয়তােবা পুরনাে কোনাে টিউটোনিক শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “ভালাে”।) তাই এই নামের অর্থ দাঁড়াল দয়ালু অথবা ভালাে। (তারা নিজেদের প্রশংসা করতে গিয়ে নিজেরাই হয়তাে এই নামকরণ করেছে।)

গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ডেসিয়াসের মৃত্যু

ক্যারাক্যালা গথদের বিরুদ্ধে লড়েছিল ২১৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তারা পুরােপুরি পরাস্ত হয়েছিল। কিন্তু রােমান বাহিনীর দুর্বলতার সুযােগ নিয়েই দিনে দিনে তাদের শক্তি আর সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ডেসিয়ায় অবস্থানকারী রােমান সেনাবাহিনী গথ উপজাতির আক্রমণ থেকে রােমকে বাঁচানাের চেয়ে নিজেদের সিংহাসনের জন্য লড়াই আর বিদ্রোহ নিয়েই বেশিরভাগ সময়ে ব্যস্ত ছিল। এছাড়া রােম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে বাইরে থেকে আসা উপজাতিদের সংখ্যা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে তাদের মধ্যে রােমের কোনাে প্রদেশ দখল করে ফেলার গােপন ইচ্ছা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তারা এখানে সেখানে লুটপাট চালাত নির্দ্বিধায়। ডেসিয়াসের আমলে গথ উপজাতি স্রোতের মতাে ডেসিয়ায় প্রবেশ করতে লাগল। তারা রােমানদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছাড়া বাকি সব জায়গা থেকে বলতে গেলে উৎখাত করল। তারপর দানিয়ুবের তীরে পৌঁছে তারা নদীর অপর পাড়ে চলে আসে। উপজাতীয়দের আক্রমণ ছাড়াও কেবল নিজেদের মধ্যেই দেড়শ বছর ধরে লড়াই করে প্রদেশগুলাে যেমন ভাঙাচোরা হয়ে পড়েছিল, তা দেখে তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়। ডেসিয়াস তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিছুকিছু যুদ্ধে জয়ীও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে বাইরের শত্রুর হাতে সম্রাটের খুন হওয়ার ঘটনা ছিল রােমান সাম্রাজ্যে সেটাই প্রথম।

পরবর্তী শাসকদের সময়কার অরাজকতা

ভ্যালেরিয়ানের (রা. ২৫৩ – ২৬০ খ্রি.) আমলে খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন ও রোমের উচ্চপদ সমূহে খ্রিস্টানদের প্রবেশ

ভ্যালেরিয়ানের আমলেও খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। সম্রাট ভ্যালেরিয়ান ২৫৩ সালে সিংহাসনে বসেন, কিন্তু এর পরের বছর থেকে তিনি পারস্যদের সাথে যুদ্ধ করতে রোমের বাইরে অবস্থান করেন। তিনি আর কখনও রোমে ফেরেননি, ২৬০ সালে তাকে বন্দি করা হয় এবং কয়েদী হিসেবে হত্যা করা হয়। ২৫৭ সালে তিনি সিনেটে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে দুটো চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রথমটিতে তিনি সকল খ্রিস্টান যাজকদেরকে রোমান দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে বলেন, এবং সমাধিস্থলে খ্রিস্টানদের সভা করা নিষিদ্ধ করেন। পরের বছর তিনি খ্রিস্টানদের সম্পর্কে সিনেটে আরেকটি চিঠি পাঠান, সেখানে তিনি লেখেন বিশপ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ চার্চ কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করতে হবে, এবং খ্রিস্টান সিনেটরদেরকে পদচ্যুত করতে হবে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে হবে, এবং তাদেরকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সেই সাথে যেসব সরকারী কর্তকর্তা-কর্মচারী ও সম্রাটের স্টাফ ও হাউজহোল্ড দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে চাইবে না তাদেরকেদাস বানানো হবে ও ইম্পেরিয়াল এস্টেটে কাজ করতে পাঠানো হবে। ভ্যালেরিয়ানের এই চিঠিগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে সেই সময় রোমান সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রেই উচ্চপদস্থ খ্রিস্টানরা কাজ করতেন। কথা হলো ডেসিয়াসের নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল ২৫১ সালে, আর তার এই নির্যাতন শুরু হয় ২৫৭ সালে। আর এই ৬ বছরের মধ্যেই খ্রিস্টানরা অনেক উচ্চপদস্থ আসলে আসীন ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায়, প্রথমত ডেসিয়াসের নির্যাতনের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ছিলনা, এবং খ্রিস্টানরা ধারাবাহিকভাবে সম্রাট কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হতেন না, যে সম্রাট ক্ষমতায় আছেন তার চিন্তাধারার উপর খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন নির্ভর করত। ভ্যালেরিয়ানের আমলে কার্থেজের বিশপ সাইপ্রিয়ান, রোমের বিশপ দ্বিতীয় সিক্সটাস এবং সেইন্ট লরেন্সের মতো বিশিষ্ট খ্রিস্টীয় যাজককে হত্যা করা হয়েছিল।

গ্যালিয়েনাসের (রা. ২৫৩ – ২৬৮ খ্রি.) শাসন, পশ্চিমাঞ্চল জেনারেলদের দখল ও পারস্য সম্রাট শাপুরের আক্রমণ

যাই হোক, গ্যালিয়েনাস বাবার বন্দীত্বের পরে সাম্রাজ্য চালানাে শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান নানান সমস্যার সাথে আরও এত বেশি বেশি উপজাতি হামলার সমস্যা শুরু হলাে যে সেই সময়টিকে বলা হয় “থার্টি টাইর‍্যান্টস” এর আমল। একই ভাবে অ্যাথেন্সের ইতিহাসেও সেই সময়টিকে অন্যায় অবিচারের আড্ডাখানা বলা হয়েছে। গ্যালিনিয়াস তার বাবার মতাে অত রাগী ছিলেন না। ডেসিয়ার লোকেরা খ্রিস্টানদের প্রতি তখন মারাত্মক অত্যাচার করছিল। তিনি তার বাবার মতাে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মােটামুটি সহনশীল থাকার একটি পথ বেছে নিয়েছিলেন। ২৬০ খ্রিস্টাব্দটি রােমান সাম্রাজ্যের জন্য কোনাে সুফল বয়ে আনেনি। এক এক সময় এমনও মনে হয়েছিল যে সাম্রাজ্যটি ভেঙে পড়ছে কিংবা কিছুতেই আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। যুগ্ম সম্রাটদের মধ্যে একজন অসহায়ের মতাে বন্দী আর আরেকজন বােকার মতাে যুদ্ধ করেই চলেছে। পশ্চিম দিকের পুরােটা অঞ্চল, যা কিনা সাম্রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ, তা যেন ভেঙেই পড়ল। একজন জেনারেল গাউল, স্পেন আর ব্রিটেনসহ সেই পুরাে অঞ্চলটি দখল করে নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। গ্যালিয়েনাস সেই জেনারেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, যে যুদ্ধে সম্রাটের পুত্রের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের ওই প্রদেশগুলাে উদ্ধারের প্রচেষ্টা তাকে বাদ দিতে হয়। আর তারপর পারস্য সাম্রাজ্যও ১৪ বছরব্যাপী স্বাধীন থাকে।

দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের (রা. ২৬৮ – ২৭০ খ্রি.) আমলে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড ও ভ্যালেন্টাইনস ডে

ক্লডিয়াস গথিকাসের আমলেই ভ্যালেন্টাইনস ডে এর সাথে সম্পর্কিত সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনী নিয়ে অনেক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে সাধারণ হিস্টোরিওগ্রাফি যা বর্ণনা করে তা অনেকটা এরকম – সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন যাজক ছিলেন, বা মধ্য ইতালির আম্ব্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর টার্নির প্রাক্তন বিশপ ছিলেন। বিচারক অ্যাস্টারিয়াসের অধীনে গৃহ-গ্রেফতার হয়ে থাকবার সময় তিনি অ্যাস্টারিয়াসের সাথে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন। তিনি তাকে যিশুর যথাযোগ্যতা, তার অলৌকিকতা সম্পর্কে বলেন। অ্যাস্টারিয়াস তাকে পরীক্ষা করার জন্য তার অন্ধ দত্তক কন্যাকে তার সামনে নিয়ে আসেন ও বলেন একে সুস্থ করে দিলে তিনি যা চাইবেন অ্যাস্টারিয়াস তাই করবেন। ভ্যালেন্টাইন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে শিশুটির চোখে হাত রাখলেন, শিশুটির দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো। অ্যাস্টারিয়াস বিনীতভাবে ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করলেন, এর বিনিময়ে তিনি কী চান। ভ্যালেন্টাইন অ্যাস্টারিয়াসকে বললেন তার নিজের বাড়ির আশেপাশের সকল মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলতে, এরপর তিন দিনের উপবাস করতে ও তারপর চার্চে গিয়ে বাপ্টাইজড বা অভিসিঞ্চিত হতে। বিচারক অ্যাস্টারিয়াস তাই করলেন ও এরপর তার অধীনে থাকা সকল খ্রিস্টান কয়েদীদেরকে মুক্ত করে দিলেন। অ্যাস্টারিয়াসের পরিবারের ও দাস-দাসী সকলেই বাপ্টাইজড বা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এভাবে রোমান নাগরিকদেরকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ভ্যালেন্টাইনকে আবার গ্রেফতার করা হলো এবং সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের সামনে নিয়ে আসা হলো। ক্লডিয়াস তাকে পছন্দ করা শুরু করলেন, কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ক্লডিয়াসকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকে। ক্লডিয়াস তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন। তিনি ভ্যালেন্টাইনকে বলেন তাকে হয় তার ধর্মত্যাগ করতে হবে নাহয় তাকে গদা দিয়ে প্রহার করে শিরোশ্ছেদ করে হত্যা করা হবে। ভ্যালেন্টাইন ধর্মত্যাগ করতে অস্বীকার করে, ফলে ২৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে বলা হলো সেভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি অ্যাস্টারিয়াসের কন্যাকে একটি নোট পাঠিয়েছিলেন যেখানে তিনি সাক্ষর করার সময় লিখেছিলেন “from your Valentine”। এই কথাটি আজকের প্রেমবার্তাগুলোতে তুমুলভাবে ব্যবহৃত হয়। তার মৃত্যুদিন ১৪ই ডিসেম্বর আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে পরিচিত, দিনটি ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করে। ভ্যালেন্টাইনের এই কাহিনীগুলো মধ্যযুগের শেষ পর্বের ক্রনিকলগুলোতে পাওয়া যায়। তিনি যেহেতু একজন খ্রিস্টীয় শহীদ ছিলেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই লোকে মুখে ফিরতে ফিরতে তার কাহিনী বিভিন্ন দিকে ডালপালা ছড়িয়ে নিয়েছে, কিন্তু তারপরও যে ব্যাপারটাকে নিশ্চিত বলা যায় তাহলো সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাসের আমলেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

ডিওক্লেশিয়ান (রা. ২৮৪ – ৩০৫ খ্রি.)

রোমে ডিওক্লেশিয়ানের হতাশা ও অতিমানব হয়ে ওঠা

৩০৩ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১০৫৬ সালে) ডিওক্লেশিয়ান রােমে আসেন। তার সেখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল ম্যাক্সিমিয়ানকে একটি সংবর্ধনা দেয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি কোনাে সুখকর উৎসব হয়নি। ডিওক্লেশিয়ানের এতদিন পরে রােমে ফেরত এসে কিছুই ভালাে লাগছিল না। রােমের মানুষরাও তাকে পছন্দ করছিল না। ডিওক্লেশিয়ান নিজের নামে সেখানে যাদুঘর, পাঠাগার এবং হাম্মামখানা তৈরির উদ্যোগ নেয়া স্বত্ত্বেও জনগণকে খুশি করতে পারছিলেন না। আদিম শহরের অধিবাসীরা একদা নােম পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া সম্রাটকে নিয়ে কেবল সমালােচনা আর কটুক্তি করাতেই ব্যস্ত ছিল। ডিওক্লেশিয়ান তাদের ব্যবহারে এত আঘাত পান যে মাসখানেক থাকার পরেই রােম ছেড়ে চলে আসেন। তারপরের ষােল বছরের মধ্যে ডিওক্লেশিয়ান সত্যিই অতিমানবের মতাে সম্রাটের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তখনকার নিয়ােগ করা সম্রাটেরা কেন, তার পরের সম্রাটেরাও তার গুণগান গাইত। সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ তিনি যে রকম সুষ্ঠুভাবে বজায় রেখেছিলেন তা সত্যিই মনে রাখার মতাে। রােমান সাম্রাজ্য তখন চলছিল চারজন অতিমানবের দ্বারা। তাদের অতিমানব মনে করা হতাে কারণ তারা অতি মানবের মতােই মানবীয় হিংসা-বিদ্বেষের উর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। চারটি ভাগ ছিল রােমান সাম্রাজ্যের। সেগুলাে হলাে, ১) ইতালির উত্তরপশ্চিমে ইউরােপিয়ান প্রদেশ, ২) ইতালি, মিশরের পশ্চিম দিকের আফ্রিকা, ৩) ইতালির পূর্বদিকে ইউরােপিয়ান প্রদেশ এবং ৪) এশিয়া ও মিশর। সাম্রাজ্যের প্রতিটি বিভাগ একজন মানুষের পক্ষে সামলানাের জন্য যথেষ্ট ছোট ছিল। সবাই নিজ নিজ এলাকা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে শাসন করতেন। তারপর প্রত্যেকের মত বা অমত সােজা সম্রাটের কাছে জানানাে হতাে এবং তারপর সেই মতাে ব্যবস্থা নেয়া হতাে। সেনাবাহিনীর দলগুলােকে স্বাধীন করে দেয়া হয়েছিল। তারা কেবল সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে সমান্তরালভাবে তাল মিলিয়ে চলত। প্রতিটি বাহিনীর একজন প্রধান ছিলেন যাকে বলা হতাে “ডাক্স” (অথবা “নেতা”) এরকম কোনাে নেতাকে আবার “কামস” (“সম্রাটের সঙ্গী”) নামে অভিহিত করা হতাে। সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার এই বিকেন্দ্রিকরণ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তার পরবর্তী প্রায় দশ বছরব্যাপী এভাবেই চলতে থাকে। যদিও চারজন মিলে সাম্রাজ্য একই তালে চালানাে এবং নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সােজা কথা নয়, কিন্তু কিছু কিছু অংশে হাজার বছরেরও বেশি সময়ে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়। যদিও একসময় মনে হয়েছিল যে সাম্রাজ্যটি ঝুঝি ভেঙেই পড়ছে, কিন্তু এর শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সেখানে বড় ধরনের মাত্রা যােগ করেছিল। এই উদাহরণ আজকের দিনে পর্যন্ত কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে টানা যায়। রােমানরা যাকে “ডাক্স” বা “কামস” বলত তাকেই আজকের দিনে আমরা “ডিউক” আর “কাউন্ট” বলি। এছাড়া ডিওক্লেশিয়ানের অধীনে সাম্রাজ্যটি যে একটি প্রতিষ্ঠানের মতাে কাজ করছিল, তার উত্তরাধিকারীরা খ্রিস্টান চার্চকে সেভাবে গড়ে তুলেছিলেন। ক্যাথলিক চার্চে যেমন আজকের দিনে একজন বিশপ থাকেন, যার অধীনে চার্চের পুরাে এলাকার দায়িত্ব থাকে, যাকে বলা যেতে পারে “ডিওসিস” (ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ দেখাশােনা করা)। তিনি চার্চের “ভিকার” (আজকের দিনে যাকে বলে ভাইস প্রেসিডেন্ট) বা প্রতিনিধিও বটে।

বিশপদের মাধ্যমে চার্চের ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা ও ডিওক্লেশিয়ানের বিরোধিতা

খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হবার কারণ

ডিওক্লেশিয়ানের নতুন প্রণীত আইনকানুনই যে দেশে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, তা নয়। ডেসিয়াস এবং ভ্যালেরিয়াসের সময়ে নির্বিচারে খ্রিস্টান নিধন সত্ত্বেও প্রজন্মের পর প্রজন্মের চেষ্টায় খ্রিস্টানদের শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এখন ডিওক্লেশিয়ানের সময় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে মােট জনসংখ্যার শতকরা দশ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন খ্রিস্টানদের জন্য আর কী চাই, এই দশ শতাংশই তাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। তারা ছিল খুবই সুসংগঠিত এবং নিজেদের বিশ্বাসে অনড়। একই সময়ে যেখানে কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা মনে হচ্ছিল যেন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়েছে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।  খ্রিস্টানদের এরকম ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার পেছনে নানান কারণও ছিল। যেমন একটি হলাে সাম্রাজ্যের ক্রমশ অবনতিতে সবার কাছে এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে উঠছিল যে পৃথিবীর সুদিন ফুরিয়ে আসছে এবং মৃত্যুর পরে যিশুর পুনরাগমনের দিন যেন ঘনিয়ে আসছে। যারা কঠোর বিশ্বাসী খ্রিস্টান ছিলেন তারা তাে ততদিনে জেনেই গেছেন যে এরকমটাই ঘটতে যাচ্ছে, আর যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন, তারা নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করতে লাগলেন। তখন ক্ষয়ে যেতে থাকা সমাজের উপরে দাড়িয়ে একজন পূজাপ্রেমী মানুষের জন্য পৃথিবীর বর্তমান কোনাে কিছু ভােগ করার চেয়ে পরকালের দিকে চাতকের মতাে তাকিয়ে থাকাকে শ্রেয় মনে হতাে। এই একটি বিষয় খ্রিস্টধর্মকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। খ্রিস্টধর্মে পরকালকে এত চমকপ্রদ করে বর্ণনা করা হয়েছিল যা তখন বিদ্যমান অন্য কোনাে ধর্মে করা হয়নি। সেই বর্ণনা শুনলে যে কোনাে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ত। আর তাছাড়া যখন সাম্রাজ্যে ছন্নছাড়া একটি অবস্থা চলছে তখন চার্চ যেন সরকার ব্যবস্থাপনার চেয়ে সাংগঠনিক দিক দিয়ে মানুষকে অনেক বেশি আশ্বস্ত করতে পেরেছে। তখন সমস্যাসংকুল ভয়াবহ পৃথিবীর বুকে খ্রিস্টধর্ম যেন শান্তির বাণী নিয়ে এসেছিল।

চার্চের বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এর বিবর্তন ও প্রসার

অন্যদিকে চার্চ যেখানে কিনা দিনে দিনে সংখ্যায় বেড়েই যাচ্ছিল কিন্তু আবার নানান সমস্যায় জর্জরিতও হচ্ছিল। চার্চ তখন আর এমন কোনাে প্রতিষ্ঠান ছিল না যেটাকে আগে মনে হতাে একদল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের একটি আড্ডাখানা, যারা নাকি শহীদ হওয়ার জন্য উদগ্রীব। সব ধরনের পরিবার থেকে তখন পুরুষ এবং মহিলা নির্বিশেষে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা শুরু করেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই খুব সাধারণ মানুষ আর তারা কেবল একটি সাধারণ জীবনেরই স্বপ্ন দেখত। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা তখন মানুষের জন্য হয়ে পড়েছিল নেশার মতাে এবং অবশ্যই খুব “সম্মানজনক”। খ্রিস্টধর্মের যে বিবর্তনগুলাে আসছিল সেগুলাে মানুষকে আরও বেশি আকৃষ্ট করার পক্ষে ছিল অসাধারণ। আরও বেশি শ্রদ্ধা আর উৎসর্গের নেশায় মানুষ বিনত হয়ে পড়ছিল। একটি শান্ত, অবাস্তব, অদৃশ্য একেশ্বরবাদের মধ্যে আসলে তেমন কোনাে নাটকীয়তা নেই। তাই খ্রিস্টধর্মে যিশুর অসহায় মায়ের নারীত্বের উপরে আলােকপাত করে ক্রমেই নাটকীয়তা আনা হচ্ছিল। যুবতী মেরি এবং তার সাথে আরও যুক্ত হলাে অসংখ্য সিদ্ধপুরুষ এবং আত্মত্যাগী শহীদ। এমনকি খ্রিস্টধর্মের নিয়মকানুনের মধ্যে কিছু রীতিনীতি অন্য ধর্ম থেকেও এসে পড়ছিল। এটাও খ্রিস্টধর্মকে প্রসার পেতে সাহায্য করেছিল। নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে এভাবে প্যাগান ধর্মের সাথে খ্রিস্টধর্মের পার্থক্যও আসছিল কমে। এটা প্যাগান ধর্ম থেকে আস্তে আস্তে মানুষকে খ্রিস্টধর্মের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে।

অঞ্চলভেদে খ্রিস্টধর্মের বিচ্যুতির বৃদ্ধি ও চার্চের দ্বারা তার নিয়ন্ত্রণ

যেহেতু ধর্মপালনের রীতিনীতিগুলাে ধীরে ধীরে অনেক বেশি জটিল এবং বিস্তারিত হয়ে পড়ছিল এবং একই সাথে ধর্মপালনকারীর সংখ্যাও যাচ্ছিল বেড়ে, তাই রীতিনীতিগুলােকে ভেঙে ভেঙে নানান দলের জন্য নানাভাবে গড়া ছিল খুব সহজ। বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে এবং বিভিন্ন চার্চে আলাদা নিয়মে ধর্মটি পালিত হতে লাগল। এমনকি একই চার্চের আওতায় বিভিন্ন দলের কাছেও রীতিনীতির পার্থক্য দেখা যেত। একেকজনের একেকরকমের দৃষ্টিভঙ্গি আর একেকরকম অনুভূতির বিষয়টি তার ধর্মপালনের রেওয়াজের মধ্যে প্রতিফলিত হতাে। ধর্মপালনের রীতিনীতির এই ভিন্নতা অনেকের চোখে খুব বেশি পাত্তা দেয়ার মতাে কোনাে ব্যাপার মনে হতাে না। তারা নিজেদের থেকে আলাদা কিছু করতে গেলে বড়জোর কাঁধ ঝাঁকিয়ে উপেক্ষা করে চলে যেত। কিন্তু কেউ কেউ আবার মনে করত, কে কীভাবে প্রতিটি রীতি পালন করছে তার উপরে তার ধর্মবিশ্বাসের সুফল বা কুফল নির্ভর করবে। কেউ কেউ মনে করত নির্দিষ্ট করে দেয়া নিয়ম থেকে সামান্য বিচ্যুতিও তাদের পরকালে ভয়াবহ সমস্যায় ফেলবে। সেরকম মানুষেরা সামান্য এতটুকু পরিবর্তনকেও ভালাে চোখে দেখত না। সেখানে তারা কেবল জীবদ্দশা কিংবা পরকালের কথাই বলত না, বলত অনন্ত জীবন এবং অসীম পরকালের কথা। এই ধরনের ভিন্ন মত এবং রীতির উপস্থিতি একটি চার্চকে বিভক্ত করে ভেঙে ফেলতে পারত। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভেতর লড়াই হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু এমনটা কখনােই হয়নি। কারণ চার্চে একটি নির্দিষ্ট পদাধিকার ছিল প্রত্যেকের। নিজেদের পদের মর্যাদা প্রত্যেকে চরমভাবে বজায় রাখত এবং একইসাথে অন্যের অবস্থানের প্রতি উদারতা বা সম্মান। উপরের পদ থেকে যে প্রথা বলে দেয়া হতাে তা নিচের দিকে সবাই মানতে বাধ্য ছিল। এভাবে একটি চার্চের দায়িত্ব একটি এলাকার বিশপের উপরে দেয়া হতাে। ধর্মের আচারব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনােরকমের বিতর্কের সৃষ্টি হলে তিনি তা মিটমাট করতেন। কিন্তু এক এলাকার একজন বিশপের সাথে আরেক এলাকার আরেকজন বিশপের বিতর্ক সৃষ্টি হলে, তখন? এমন যে হতাে না, তা নয়, প্রায়ই হতাে। কিন্তু তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এই বিষয়গুলাে সমাধানের জন্য “সিনডস” (গ্রিক শব্দ “সিনড” এর অর্থ সভা) ডাকা হতাে। সেই সভায় বিশপেরা একসাথে বসতেন এবং যে বিষয়গুলাে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সেসব উত্থাপন করতেন। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সেই সভায় আলােচনার মাধ্যমে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা সকল বিশপকে মানতে হবে। এভাবে পুরাে খ্রিস্টান সমাজ একটি নির্দিষ্ট আচার ব্যবহার এবং একই রকমের দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আসতে চেষ্টা করত। তাদের চিন্তাভাবনায় ছিল সবকিছুর সমষ্টি হিসেবে একটিমাত্র চার্চ যাকে তারা সর্বজনীন একটি আখ্যা দিতে চাইত। “সর্বজনীন” বা “ইউনিভার্সাল” ধারণাটি তাদের কাছে এসেছিল গ্রিক ধ্যানধারণা থেকে, যে চিন্তাকে তারা ক্যাথলিক চার্চে পরিণত করেছে।

পূর্ব ও পশ্চিমের বিশপদের অবস্থা

বিশপদের সম্মিলিত মতবাদ তখন অর্থোডক্সের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়াল। তাদের মতামতের বাইরে যে কোনাে ধারণাকে তখন নব্যতন্ত্র কিংবা বিরুদ্ধ মতবাদ বলে আখা দেয়া হতাে। নীতিগতভাবে সব বিশপদের গ্রহণযােগ্যতা ছিল সমান। কিন্তু বাস্তবচিত্রটা ছিল একটু অন্যরকম। যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি ছিল সেখানে বেশি বড় আকৃতির চার্চ থাকত এবং যত বড় চার্চ, তার প্রভাব তত বেশি ছিল। বেশি যােগ্য এবং খ্যাত খ্রিস্টানদের সেই বড় চার্চগুলােই আকৃষ্ট করত। অন্যদিকে বড় শহর, যেমন অ্যান্টিওক কিংবা অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার চার্চের বিশপকে মনে করা হতাে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের প্রভাব যেমন ছিল ধর্মের ক্ষেত্রে, তেমনই শিক্ষা, সাহিত্য এবং সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে। অবশ্য সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকের প্রদেশগুলােতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। সেসব জায়গায় বিশপদের নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মতবিরােধ দেখা যেত। সত্যি কথা বলতে গেলে সাম্রাজ্যের পশ্চিমভাগে খ্রিস্টানরা সংখ্যায় কম এবং স্বাভাবিকভাবেই অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায়, ডিওক্লেশিয়ানের আমলের আগ পর্যন্ত তাদের মাত্র একজনই বড় বিশপ ছিলেন। তিনি হলেন রােমের বিশপ।  সাধারণভাবে পশ্চিম সাম্রাজ্যে পূর্ব সাম্রাজ্যের চেয়ে শিক্ষার হার ছিল কম। তাই স্বভাবতই সেখানে দর্শনের ঐতিহ্য বা মতে বিভক্ত হওয়ার সুযােগও ছিল কম। প্রাচীন সেই সময়ে রােমের কোনাে বিশপই বড় লেখক কিংবা, সংগঠক হিসেবে পরিচিত হননি, তারা সবাই ছিলেন শান্ত স্বভাবের, ধর্মে কঠোর বিশ্বাস স্থাপনকারী মানুষ। তারা ধর্মের বিভিন্ন মতপার্থক্য নিয়ে কথা বলতেন না। তারা শুরু থেকেই নব্যতন্ত্র বা বিরুদ্ধবাদ থেকে নিজেদের যত্ন করে দূরে সরিয়ে রাখতেন। তাই শুরু থেকে শেষপর্যন্ত রােমের খ্রিস্টানেরা অর্থডক্স হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে রােমের কথা বলতে গেলে, রােম বলতেই মানুষ পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা বুঝত। রােম তখন ক্ষমতার কেন্দ্রীয় কার্যালয় হােক বা না হােক, মানুষের মনে রােমই ছিল শাসনের প্রতীক। আর রােমের বিশপ ছিল কারও কারও কাছে রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের মতােই ক্ষমতাবান। এই বিশ্বাসই ধীরে ধীরে এমন দৃঢ় হয়ে গেল যে মানুষ মনে করতে শুরু করল রােমের বিশপ পিটার হলেন যিশুর সবচেয়ে বড় শিষ্য বা ভক্ত। আর তাই যদিও প্রথম কয়েক শতাব্দীতে রােমের বিশপ তেমন আলােচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পৌঁছাননি, বিশেষ করে যদি অ্যালেক্সান্দ্রিয়া, অ্যান্টিওক বা কার্থেজ শহরের বিশপদের সাথে তুলনা করা হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে (অন্তত পৃথিবীর বেশিরভাগ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে) খ্রিস্টধর্মের মহাগুরু হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে ডিওক্লেশিয়ান

ডিওক্লেশিয়ান তখন সাম্রাজ্যের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখেন, তার ক্ষমতার জোর যেন অন্য কারও ক্ষমতার কাছে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। সেই ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছে চার্চ থেকে। এটি তাকে মারাত্মকভাবে বিরক্ত করে ফেলেছিল। কোনাে কোনাে জায়গায় উল্লেখ আছে চার্চের ক্ষমতার এই ব্যাপক প্রসার ডিওক্লেশিয়ানের অধীন মানুষদের এবং তার উত্তরাধিকারীদেরও নানানভাবে অপ্রস্তুত করেছে। ৩০৩ খ্রিস্টাব্দে ডিওক্লেশিয়ান তার সহকর্মী গ্যালেরিয়াসকে নিয়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা শুরু করলেন। তার মূল আপত্তিটি ছিল চার্চ (যাকে ডিওক্লেশিয়ান মনে করত তার প্রতি হুমকিস্বরূপ) নিয়ে এবং সেইসব মানুষদের বিরুদ্ধে যারা সাম্রাজ্যের সরকারের চেয়ে চার্চের উপরে বেশি নির্ভর করা শুরু করেছে। কিছু কিছু চার্চ ধ্বংস করা হলাে, ক্রুশগুলো ভেঙে ফেলা হলাে বিশপদের অধীনে থাকা পবিত্র গ্রন্থগুলাে টেনে হিচড়ে কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হলাে। এই অবস্থায় প্যাগান ধর্মের মানুষেরা যখন খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে উদ্ভ্রান্তের মতাে জেগে উঠল তখন প্রচুর খ্রিস্টান হত্যা করল তারা। স্বাভাবিকভাবেই তখন খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা সমস্ত সরকারি দপ্তর থেকে চাকরিচ্যুত হলাে, সেনাবাহিনী থেকে হলাে বিতাড়িত, বিচারালয় থেকে বহিষ্কৃত এবং সাধারণভাবে সমাজের সব স্তরে হতে লাগল লাঞ্ছিত। এটাই ছিল রােমান সাম্রাজ্যে শেষ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর খ্রিস্টান নিপীড়নের ঘটনা। তবে এটি পুরাে সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। কনস্টান্টিয়াস ক্লোরাস তখনকার চারজন রােমান শাসকদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে ধৈর্যশীল এবং শান্তিপ্রিয়। তিনি নিজে খ্রিস্টান না হওয়া স্বত্বেও তার এলাকায় খ্রিস্টান নিধনের বা লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটতে বাধা প্রদান করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন সূর্য উপাসনাকারী।  খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এই জোর অভিযান ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের শেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তিনি হয়তাে রাজত্ব করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। রােমে সেবারের বিরক্তিকর ভ্রমণ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে প্রজাদের কাছে থেকে ভালােবাসার বদলে ঘৃণা পাওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে হতাশ করেছিল।

ডিওক্লেশিয়ানের মৃত্যু

রােম থেকে নিকোমেডিয়ায় ফিরে আসার পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বয়স তখন ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি ততদিনে রাজত্বের বিশ বছর পার করেছেন এবং তার জন্য সেটি ছিল যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। গ্যালেরিয়াস ছিলেন তখন সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী। গ্যালেরিয়াস তখন সিংহাসনে বসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, সম্রাটকে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি নিতে অনুরােধও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১৫৮ সালে) ডিওক্লেশিয়ান সেটাই করেন। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক একটি ঘটনা যে একজন ক্ষমতাধর নিজের অসুস্থতা এবং অপারগতার কারণে সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে সেখানে বসার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ব্যতিক্রমধর্মী হলেও ঘটনাটি ঘটেছিল রােমান সাম্রাজ্যে। সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান ছিলেন এর নায়ক। প্রাক্তন সম্রাট সালােনা শহরে অবসর গ্রহণ করেন যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। সেখানে তিনি একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং জীবনের শেষ আটটি বছর সেখানেই কাটান। সেই রাজপুরীটি পরবর্তীকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ডিওক্লেশিয়ানের শাসনামলের তিনশ বছর পরে যখন সালােনা শহরে অসভ্য উপজাতিরা আক্রমণ করে তখন তারা এটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানে গিয়ে আস্তানা গাড়ে। রাজপুরীর চারদিকে বাসাবাড়ি গড়ে ওঠে। সেই নতুন শহরের নাম হয় স্প্যালাটাম। কালক্রমে শহরটি ইতালিয়ানদের কাছে স্প্যালাটো এবং যুগােস্লাভিয়ানদের কাছে প্লিট নামে পরিচিত হয়।

প্রথম কনস্ট্যান্টাইন (রা. ৩০৬ – ৩৩৭ খ্রি.)

কনস্ট্যান্টিয়াস ও গ্যালেরিয়াসের হাতে ক্ষমতা এবং গ্যালেরিয়াসের স্বজনপ্রীতি

চারজনের শাসন কী করে এক সুতােয় গাঁথা যায়, এ বিষয়ে ডিওক্লেশিয়ানের ছিল নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। যখন তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তিনি তার সহ-সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। এর কারণ হলাে দুজন সিজার উপাধিধারী গ্যালেরিয়াস এবং প্রথম কনস্টান্টিয়াস যেন একযােগে নিজেদের মতাে করে শাসন ব্যবস্থা চালাতে পারেন। এভাবে দুজন অগাস্টাসই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালো, আর দুজন সিজার হয়ে উঠল দুজন নতুন অগাস্টাস। তার এর পরের পদক্ষেপ ছিল, নতুন দুজন সিজার উপাধিধারী শাসনকর্তা নিয়ােগ। যৌক্তিকভাবে ভাবলে দুজন ভালাে, অভিজ্ঞ সেনা, শক্তসমর্থ, যােগ্য, সমর্থনকারী ব্যক্তিকেই দায়িত্ব দেয়া উচিত। তাহলেই কেবল নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গ্যালেরিয়াস এবং কনস্ট্যান্টিয়াসের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠতে পারবে এবং পরে নিজেদের মতােই যােগ্য উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করবে। কিন্তু ডিওক্লেশিয়ানের এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা যদি কাজে লাগত তবে তারপরে রােমান সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে আর কখনও লড়াই হতাে না এবং সাম্রাজ্যটি পেতো একের পর এক যোগ্য সম্রাট। দুর্ভাগ্যবশত দুজন অগাস্টাস উপাধিধারী শাসক নিজেদের মধ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেন। তারা দুজনেই নিজেদের পরিবারের ভালাের কথা চিন্তা করে, বাইরের কোনাে মানুষকে না ডেকে, একজন করে আত্মীয়কে সিজার উপাধি দিয়ে উত্তরাধিকারী বানাতে চান। সেখানে অবশ্য ডিওক্লেশিয়ানের উত্তরাধিকারী ছিলেন গ্যালেরিয়াস, যিনি পূর্বদিকের রােমান সাম্রাজ্য শাসন করতেন। তিনিও নিজেকে ডিওক্লেশিয়ানের মতাে প্রধান শাসনকর্তা না ভেবে পারতেন না যেমন প্রাক্তন সম্রাট নিজেকে ভেবেছিলেন। তাই গ্যালেরিয়াস সেই সুযােগে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে একজন ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকে সিজার উপাধি দিয়ে ফেললেন। তিনি এই বিষয়ে কনস্ট্যান্টিয়াসের সাথে আলােচনা করারও প্রয়ােজন বােধ করেননি। (তখন এটাও মনে করা হতাে যে কনস্টান্টিয়াস হয়তােবা গ্যালেরিয়াসকে খ্রিস্টানদের পৃষ্ঠপােষকতা করার জন্য বেশ অপছন্দ করেন। পরে অবশ্য এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। গ্যালেরিয়াসের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের তার অংশে খ্রিস্টান নিধন ছিল সাধারণ ঘটনা এবং সেটি ঘটেই চলেছিল।)।

সম্রাট হিসেবে লিসিনিয়াসের আগমন এবং ম্যাক্সিমিন ও ম্যাক্সেন্টিয়াসের দ্বারা গৃহযুদ্ধের সূচনা, পরাজয় ও মৃত্যু

শেষবারের মতাে ডিওক্লেশিয়ান কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ম্যাক্সিমিয়ানকে কার্যালয় থেকে বিতাড়িত করলেন এবং সে জায়গায় লিসিনিয়াসকে (রা. ৩০৮-২৪ খ্রি.) বসালেন। লিসিনিয়াস হয়ে গেল পশ্চিম অংশের সম্রাট। কন্সট্যান্টাইন তার যুগ্ম সম্রাটের আসন পােক্ত হতে দেখেই খুশি ছিলেন। ম্যাক্সিমিয়ানকে এভাবে অপমানিত হতে হলাে দ্বিতীয়বারের মতাে। সাধারণভাবেই তার ভীষণ আপত্তি এবং প্রতিহিংসা ছিল। এইসব ঘটনার পরে নিজের শ্বশুরকে হত্যা করা ছাড়া তার কাছে আর কোনাে উপায় ছিল না। ৩১১ খ্রিস্টাব্দে (১০৬৪ সালে) গ্যালেরিয়াসের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ম্যাক্সিমিন ডাইয়ার (রা. ৩১০-১৩ খ্রি.) আবির্ভাব হয়। ম্যাক্সিমিন ডাইয়া খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের হত্যার ব্যাপারে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। এভাবে নিজের প্রতাপের পরিচয় দিয়ে তিনি ইতালিতে শাসনের অধিকারে বসা ম্যাক্সেনটিয়াসের সাথে একটি চুক্তিতে আসেন। এভাবে আরেকটি নতুন গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। ইতালিতে ম্যাক্সেনটিয়াস এবং এশিয়া মাইনরে ম্যাক্সিমিন ডাইয়া, গাউলে অবস্থানকারী কন্সট্যান্টাইন এবং দানিয়ুবের তীরবর্তী প্রদেশের লিসিনিয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কন্সট্যান্টাইন ৩১২ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে প্রবেশ করেন। এটা ছিল তৃতীয়বারের মতাে ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে কোনাে সেনাবাহিনীর ইতালিতে প্রবেশ। কিন্তু আগের দুবারের মতাে কন্সট্যান্টাইন পরাজিত হননি, তিনি ম্যাক্সেনটিয়াসকে হারিয়ে দিলেন এবারে। পাে উপত্যকার কাছে তাকে পরাজিত করে কন্সট্যান্টাইন রােমের দিকে রওনা দিলেন। এই যুদ্ধের আগে কন্সট্যান্টাইন (পরের খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী) আকাশে একটি উজ্জ্বল ক্রুশ দেখতে পান। এটিকে তারা বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করেন। এটি কন্সট্যান্টাইনকে সেনাদের ঢালের উপরে একটি করে ক্রুশচিহ্ন বসিয়ে দিতে উৎসাহিত করে। এরপরে সফলতার উদ্দেশ্যে তাদের যুদ্ধে ঠেলে দেন। ম্যাক্সেনটিয়াসের বাহিনীও মারা পড়েছিল এবং ম্যাক্সেনটিয়াসকেও হত্যা করা হয়। কন্সট্যান্টাইন পশ্চিমের অধিপতি হয়ে যান এবং সিনেটের মাধ্যমে সম্রাট ঘােষিত হন। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে লিসিনিয়াস ম্যাক্সিমিন ডাইয়াকে পূর্বদিকের প্রদেশে পরাজিত করেন। তাকেও হত্যা করা হয়।

কনস্ট্যান্টাইনের খ্রিস্টধর্মের উন্নয়ন, আইনসিদ্ধ ধর্মে পরিণত করা ও ধর্মান্তর

কন্সট্যান্টাইন মাথার ওপরে স্বর্গে যখন ক্রুশের ছবি দেখেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল তিনি হয়তাে খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে গেছেন। হয়তােবা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয়নি। কন্সট্যান্টাইন আগাগােড়া বিচক্ষণ একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। সম্ভবত তিনি তখন টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মই হবে প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তিনি এটি বুঝতে পারার পরই সিদ্ধান্ত নেন, যে দিকটা জনগণের মধ্যে এত প্রকট হয়ে উঠছে সে দিকটার কিছু উন্নতি বিধান তার করা উচিত। তিনি খ্রিস্টান নিধন বন্ধ করেন। তিনি বলতে গেলে খ্রিস্টানদের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু ধর্মান্তরিত হননি। তারপর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এলে যখন তিনি ভাবলেন যে এতে কোনাে সমস্যা নেই, তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। (হাজার হলেও তার রাজত্বের প্রায় সমাপ্তি পর্যন্ত খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘুই ছিল।) কন্সট্যান্টাইন তার বাবার মতােই সূর্যদেবতার উপাসনা করতেন। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে উৎসাহ প্রকাশ করেন। ব্যাপ্টাইজেশনের মাধ্যমে তিনি জীবনের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান এবং মনে করেন যে সব শাস্তি থেকে তার মুক্তি ঘটুক যখন কিনা তার আর কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। লিসিনিয়াস ম্যাক্সিমিন ডাইয়াকে পূর্বদিকের প্রদেশে পরাজিত করে ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে (১০৬৬ রােমান সালে) কন্সট্যান্টাইনের সাথে মিলানে একটি সভার আয়ােজন করেন। সেখানে কন্সট্যান্টিয়ান এবং লিসিনিয়াস “মিলান চুক্তি” নামে একটি নিয়ম চালু করেন। তারা সাম্রাজ্যব্যাপী সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার আইন পাশ করেন। তারপর থেকে খ্রিস্টানেরা খােলামেলাভাবে তাদের উপাসনার কাজ চালিয়ে যেতে পারত। বস্তুত তখন থেকেই খ্রিস্টধর্ম একটি আইনসিদ্ধ ধর্মে পরিণত হলাে।

ডিওক্লেশিয়ানের মৃত্যু

সেই একই বছরে ডিওক্লেশিয়ান মৃত্যুবরণ করেন। তার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানাের পর থেকেই উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করতে গিয়ে সাম্রাজ্যে যেন তিনি গৃহযুদ্ধ লাগানাের নেশায় মেতে ছিলেন। আর খ্রিস্টানদের সাম্রাজ্য থেকে বিদায় করা হয়ে উঠেছিল তার আরেক নেশা। কিন্তু এর কোনাে কুফলই তাকে ছোঁয়নি। তিনি তার সুদৃশ্য রাজপ্রাসাদে জীবনের শেষ দিনগুলাে আনন্দেই কাটিয়েছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ম্যাক্সিমিয়ান একটি চিঠিতে ডিওক্লেশিয়ানকে আহ্বান জানিয়েছিলেন যেন তিনি ফিরে এসে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং শান্তি আনার চেষ্টা করেন। তখন ডিওক্লেশিয়ান সে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “তােমরা কি একবার সালােনায় এসে আমার বাগানটা দেখে যেতে পার যেখানে আমি নিজ হাতে সবজি লাগিয়েছি? এই সাম্রাজ্যের ক্ষমতার কথা আমাকে আর বলাে না।” বুদ্ধিহীন, ক্ষমতালােভী ম্যাক্সিমিয়ান শেষ পর্যন্ত ভীষণ বেদনাদায়ক মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন যেখানে কিনা ডিওক্লেশিয়ান মারা যান পরম শান্তিতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জ্ঞানী মানুষ হিসেবে মর্যাদায় আসীন ছিলেন।

ডোনাটিজম ও আরিয়ানিজমের বিকাশ, এদের বিরুদ্ধে ঘোষণা ও নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব

কনস্ট্যান্টাইনের বিরুদ্ধে লিসিনিয়াসের যুদ্ধ, পরাজয় ও মৃত্যু এবং একক ক্ষমতায় কনস্ট্যান্টাইন

প্রথম কন্সট্যান্টাইনের জন্য এক সময় সাম্রাজ্য বােঝা হয়ে দাড়াল। লিসিনিয়াস তার সাথে আলােচনায় বসলেন এবং ভাগ্যের পরিহাসে ভালাে একটা কোনাে ফলাফল এলাে না। শাসকেরা একে অন্যের প্রতি বৈরী হয়েই রইল। কন্সট্যান্টাইন যখন খ্রিস্টানদের প্রতি বেশি ঝুঁকে গেলেন, ঠিক তখন লিসিনিয়াস যেন তার বিরােধিতা করার জন্যই খ্রিস্টান বিরােধী আচরণ করা শুরু করলেন। ৩১৪ এবং ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় পরপর দুবার। দুবারই লিসিনিয়াস পরাজিত হন। লিসিনিয়াসকে হত্যা করা হলাে, যেন কন্সট্যান্টাইন একাই পুরাে সাম্রাজ্যের উপরে কর্তৃত্ব করতে পারেন।

নতুন নিয়ম-কানুন প্রচলন

কন্সট্যান্টাইন তারপরে ডিওক্লেশিয়ানের পদানুসরণ করে রাজ্যে নতুন নতুন নিয়মকানুন প্রচলনের ব্যাপারে মনােযােগী হলেন। ডিওক্লেশিয়ানের বেশিরভাগ নিয়মগুলােকেই একটু এদিক-ওদিক করে তিনি চালু করার চেষ্টা করলেন। যেমন, কন্সট্যান্টাইন সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলােতেও তার একচ্ছত্র এবং প্রত্যক্ষ শাসনের প্রমাণস্বরূপ ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে সব জায়গায় মুকুট চিহ্নিত মার্কাটি ছড়িয়ে দিলেন। সেটা ছিল একটি সরু, সাদা, মাথার ওপরে বাঁধার কাপড়ের টুকরাে যেটা কিনা পারস্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত কার্যালয় থেকে দেয়া হতাে। এবারে উত্তরাধিকারী সম্রাটের গুনে সেই কাপড়ের টুকরােটিতে আরও জাঁকজমক এলাে। এটিকে এখন সত্যিই রাজকীয় বলা যেতে পারে। এর আগে সেটি ছিল হালকা বেগুনি, রাজকীয় রঙ যাকে বলে, আর তার ওপরে মুক্তো খচিত নকশা। কন্সট্যান্টাইন অবশ্য ডিওক্রেশিয়ানের কিছু নিয়মকানুনের ছােটখাটো পরিবর্তনও করলেন। বড় যে পরিবর্তনটি আনলেন তা হলাে, কৃত্রিমভাবে অগাস্টাস আর সিজার পদবী দিয়ে মানুষকে উত্তরাধিকারী বানানাের পদ্ধতি বন্ধ করে নিজের পুত্রকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হবার সুযােগ দেয়ার কথা ঘােষণা করলেন। অন্যান্য অসভ্য জাতি থেকে মানুষ এনে সেনাবাহিনীতে নিয়ােগের নিয়ম তিনি বহাল রাখলেন। পাশাপাশি যেসব স্থানে জনসংখ্যা খুবই কম, সেসব জায়গায় তাদের বসবাস করতে উৎসাহিত করলেন। সাধারণভাবে ভাবলেই বােঝা যায় যে, এই পদক্ষেপটি রােমের জন্য সফল বা সুখকর হতাে যদি না রােমের সংস্কৃতি এত অন্যরকম না হতাে। রােমের সংস্কৃতির এমন একটি মাত্রা ছিল যেখানে বাইরে থেকে চট করে কোনাে রীতিনীতি প্রবেশের কোনাে সুযােগ ছিল না। রােমের সংস্কৃতি কখনােই বাইরের মানুষের সংস্কৃতিকে স্বাগত জানায়নি।

খ্রিস্টানদের পক্ষে আইনগত পরিবর্তন, পৃষ্ঠপোষকতা ও বিশপদের জন্য বিচারালয় প্রবর্তন

কন্সট্যান্টাইনের সময়টা ছিল আইনগত কিছু পরিবর্তনের জন্য স্মরণযােগ্য। যতগুলাে পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন বেশিরভাগই খ্রিস্টানদের পক্ষে গিয়েছিল। বন্দী এবং দাসদের প্রতি আইনের মনােভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক হয়েছিল। কিন্তু অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজকর্মের (বিশেষ করে যৌন) ওপর আগের চেয়েও কঠোর আইন করেছিলেন। তিনিই প্রথম রবিবারকে একটি বিশ্রামের দিন হিসেবে আইনত ঘােষণা দেন। কিন্তু আরেকদিকে ধর্ম অনুযায়ী রবিবার ছিল ঈশ্বরের জন্য বরাদ্দ। কন্সট্যান্টাইন নিজে খ্রিস্টান না হয়েও একজন খ্রিস্টানধর্মের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে কাজ করেছেন। একসময় তিনি চার্চে কী হয় না-হয় সেসব বিষয়ে জানতেও আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। আগে এক চার্চের সাথে আরেক চার্চের ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। এক বিশপ আরেক বিশপকে নিয়মনীতির জন্য নানা চাপ প্রয়ােগ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই যিনি তর্কে জিততেন তিনি অপর পক্ষকে তার ধারণা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করতেন। কন্সট্যান্টাইন একটি বিচারালয়ের প্রবর্তন করলেন যেখানে বিশপেরা এসে নিজনিজ মত প্রকাশ করতে পারবেন এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে মাননীয় সম্রাট রায় দেবেন। তারপরে যে দল জিতে যাবে তারা অবশ্যই তাদের মত প্রতিষ্ঠা করার সুযােগ পাবে।

কার্থেজীয় চার্চের ডোনাটিজম নিয়ে বিতর্ক, তাদের বিরুদ্ধে কনট্যান্টাইনের মত, ইসলামের আগমন পর্যন্ত এদের অস্তিত্ব

কন্সট্যান্টাইনের রাজত্বের প্রথমদিকে আফ্রিকার তুলনামূলক অসভ্য খ্রিস্টানদের নব্যতন্ত্রের মাধ্যমে চার্চের নিয়মকানুন নানান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পর্যায়টিকে বলা হতাে ডােনাটাস। কার্থেজের বিশপ এজন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। কন্সট্যান্টাইন বিচারালয় স্থাপনের পর প্রথমেই যে বিচারটি করতে বাধ্য হন তা হলাে সাধারণ বিশপদের সাথে ওই ডােনাটাস বিশপের মতপার্থক্যজনিত কারণে সংগঠিত সমস্যা নিয়ে। সেখানে মূল বিষয় হিসেবে উঠে এলাে যে একজন অযােগ্য মানুষ কি ধর্মগুরু হতে পারবে কি না। ডােনাটিস্টরা ছিল আধুনিক। তারা মনে করত চার্চ একটি পবিত্র জায়গা, বিধায় একজন ধর্মগুরু ততক্ষণই সম্মানজনকভাবে অবস্থান করতে পারেন যতক্ষণ তিনি কোনাে অনৈতিক কাজে যুক্ত না হচ্ছেন। যেমন ডিওক্লেশিয়ান এবং গ্যালেরিয়াসের আমলে খ্রিস্টান নিধনের নামে চার্চে যে অত্যাচার চালানাে হয়েছিল, তখন অনেক ধর্মগুরু ছিলেন যারা নিজেদের জীবন বাঁচানাের তাগিদে তাদের অধীনে থাকা পবিত্র বইগুলাে পােড়ানাের জন্য দিয়ে দিতে বাধ্য হন। যখন সেই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের অবসান ঘটে, তারা নিজনিজ চার্চে ফিরে গিয়ে আবার ধর্মগুরুর আসনে বসতে চান। এখন প্রশ্ন হলাে, তারা কি তখন আর সেই কাজের উপযুক্ত? আধুনিক বিশপেরা মনে করেছিলেন যে ধর্মগুরু যিনিই হন না কেন, তিনি অবশ্যই একজন মানুষ। মৃত্যুর মুখে একজন মানুষ যেমন নিজেকে বাঁচানাের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, তিনিও করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এরকম একটি পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করারও নিয়ম ছিল। এছাড়া এরকম একজন পাপী মানুষকে দিয়ে যদি অহেতুক চার্চের মতাে একটি মহান প্রতিষ্ঠান চালানাে হয় তবে তার মাহাত্য ক্ষুন্ন হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তখন এরকম একটি নড়বড়ে প্রতিষ্ঠানের উপরে কি কেউ আস্থা রাখতে পারবে? কী করে একজন সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হতে পারবে যে চার্চের ধর্মগুরুটি যােগ্য? খ্রিস্টানেরা এভাবেই চার্চকে রক্ষা করতে লাগল যে এটি একটি পরম পবিত্র প্রতিষ্ঠান। আর এর আধ্যাত্মিক শক্তি এতই বেশি যে একজন সঠিক মানুষের পরিচালনায় না চললেও এর মহিমা এতটুকু কমে না। কার্থেজে আফ্রিকান নব্যতন্ত্রে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের মধ্যে এই ধরনের কোনাে পরিবর্তন আনার মতাে কোনাে ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারা ছাড়া যারা পরিবর্তন চায়, তারা ৩১৬ সালে কন্সট্যান্টাইনের কাছে আবেদন করল। আদালত নব্যতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধে রায় দিলাে। কন্সট্যান্টাইন নিজে উপস্থিত থেকে দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শােনার পরে এ সিদ্ধান্ত নিলেন। এটি কারও জন্যই ভালাে হলাে না। প্যাগান ধর্মানুসারী সম্রাটেরা যেমন খ্রিস্টানদের সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি, তেমনি খ্রিস্টান সম্রাটেরাও হাজার চেষ্টা করেও নব্যতন্ত্রের উৎপাটন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সংখ্যায় কমতে থাকল কিন্তু কখনােই পুরােপুরি উবে গেল না যতদিন পর্যন্ত আরবের ঔপনিবেশিক শক্তি এসে তাদের সার্বিকভাবে বিনষ্ট করেনি বা তাদেরকে ইসলামে অন্তর্ভূক্ত করেনি। তারা আফ্রিকার উত্তর দিকের নব্যতান্ত্রিকদের এবং প্রাচীনপন্থী খ্রিস্টানদের একইরকমভাবে উৎপাটন করেছিল।

সম্রাটের চার্চের প্রধান হয়ে ওঠা, চার্চের সাথে সরকারের সংমিশ্রণ

এছাড়াও তখন কন্সট্যান্টাইনের আদর্শ তেমনভাবে অনুসরণ করা গেল না বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। সম্রাট তখন চার্চের প্রধানের মতাে করে কাজ করতে শুরু করল এবং চার্চের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি মেনে নিলেন। এটাই ছিল চার্চ এবং বিদ্যমান সরকারের মধ্যে এক ধরনের মতপার্থক্য কিংবা মতৈক্যের অবস্থান যেটা তখন থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখনও চলছে। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্টাইন যখন সাম্রাজ্যে সকল মতের উর্ধ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছিলেন, তখন তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি তার সহানুভূতি বেশ জোরেসােরেই প্রকাশ করছিলেন। তিনি বিশপদের একসাথে ডেকে একটি সভা করেছিলেন যেখানে তাদের মধ্যে বিরােধ মিটিয়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বিশপদের অধীনে চার্চের পুরাে ব্যবস্থা ছেড়ে দেয়ার নিয়ম তখন পুরনাে হয়ে গেছে। আবার প্যাগান সম্রাটদের অধীনে এভাবে চাষ্ট্রে কার্যক্রম চালানােও কারও কারও জন্য নিরাপদ মনে হতাে না। তারা চার্চের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের বিষয়টা নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারতেন না। এবারে অবস্থাটা বদলে গেল। সমস্ত বিশপদের অনুরােধ করা হলাে সাম্রাজ্যের সরকারি নিরাপত্তার আওতায় আসার জন্য। এটাই ছিল পৃথিবীব্যাপী চার্চের সাথে সরকারের সংমিশ্রণের প্রথম ধাপ।

ট্রিনিটির বিরুদ্ধে আরিয়ানিজম, নাইকিয়ার কাউন্সিলে তাদের বিরুদ্ধে রায় ও নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব

৩২৫ খ্রিস্টাব্দে বিশপেরা বির্থিনিয়ার নাইকিয়া শহরে জমায়েত হলেন। শহরটি ছিল ডিওক্লেশিয়ানের রাজধানী এবং তখন ছিল কন্সট্যান্টাইনের। এটা ছিল এমন একটি জায়গায় যেখান থেকে সহজেই অ্যালেক্সান্দ্রিয়া, আন্টিয়ক এবং জেরুজালেমে পৌঁছে যাওয়া যায়। পশ্চিম দিকটা নিয়ে কেউ ভাবত না কারণ সেসব জায়গা ছিল অনেক দূর আর স্পেনে তাদের জন্য অনেক বিশপ ছিল। তাদের সভার আলােচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল আরিয়ান নব্যতন্ত্র। অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট খ্রিস্টান ধারার নাম ছিল আরিয়ানিজম, ধর্মগুরু আরিয়াসের নাম অনুসারে। তখন প্রায় আগের দশক ধরে একনায়কের মতাে নিজস্ব মতামতে মানুষকে দীক্ষিত করে আসছিল। তার মতে একজনই মাত্র সৃষ্টিকর্তা আছেন এই মহাবিশ্বে এবং এখানকার সমস্ত কিছুই তার সৃষ্টি। তাদের মতে যিশুও সেই সৃষ্ট জিনিসগুলােরই একটি এবং তার অস্তিত্বও সীমিত। এই ভাষ্যমতে যিশু নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারেন না। এটাকে অন্যভাবে বললে, যখন যিশুর কোনাে অস্তিত্ব ছিল না, তখনও সেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে সেই সৃষ্টিকর্তার কিছু কিছু বিষয় ছিল যা যিশুর স্বভাবের সাথে মেলে কিন্তু কিছুতেই একবারে একভাবে তাদের বর্ণনা করা যায় না, অর্থাৎ ঈশ্বর ও যিশু এক ও অভিন্ন নয়। এই মতাদর্শের অনুসারীরা প্রথমে অ্যালেক্সান্দ্রিয়ায় এবং তারপর ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ল। এর বিরুদ্ধে যে দলটি ছিল তারা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করতো, এই দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলকজান্দ্রিয়ার ডিকন অ্যাথানাসিয়াস। তারা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করতেন, তাদের মতে ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর “ফাদার”, যিশু বা “পুত্র” এবং মানুষের প্রকৃতিতে কার্যকর থাকা “হলি স্পিরিট” এই তিনে মিলে হলো ট্রিনিটি, এই ট্রিনিটির তিনটি অংশই ঈশ্বরের সমান তিনটি দিক, এই তিনটি অংশ কেবল একই নয়, সেই সাথে এরা সকলেই শাশ্বত বা নিত্য যাদের কখনও সৃষ্টি করা হয়নি, এবং এই তিনটি অংশ একে অপরের সাথে অভিন্ন। আরিয়ানের দল এবং অ্যাথানিয়াসের দলের মধ্যে মতপার্থক্য এতই বেড়ে গেল যে একদল বিশপ আরেকদল বিশপকে ক্রমাগত অভিশাপ দিতে লাগল। কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়টিকে ভীষণ বিরক্তির সাথে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি যদি খ্রিস্টানদের চার্চের এই ক্ষমতা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন তবে সাম্রাজ্যে আরও বেশি প্রভাব খাটাতে পারতেন। কিন্তু সম্রাট হিসেবে তিনি চার্চে চার্চে এই বিবাদকে পুঁজি করে কিছুই করেননি। তিনি হয়তাে চেষ্টা করলে এই বিবাদ তখনই মিটিয়েও ফেলতে পারতেন। এই কারণে তিনি প্রথমে নাইকিয়া শহরে সভা ডাকলেন, ৩২৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত টানা সভা চলল। তারা শেষে অ্যাথানিয়াসের পক্ষে রায় দিলেন। এই মর্মে একটি সরকারি আদেশ জারি হলাে, যাকে বলে “নাইকিয়ার চুক্তি”। এই চুক্তি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে অ্যাথানিয়াসের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রভাবশালী বলে বর্ণনা করে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা এটি মেনে চলবে বলে ধারণা করা হয়। এটাই সব চার্চের ক্ষেত্রে একটি বাঁধাধরা নিয়ম হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এভাবেই অ্যাথানাসিয়ানদের অবস্থান পােক্ত হলাে। তখন থেকে এই ধারার খ্রিস্টধর্মকে নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্ম বলা হয়। ক্যাথোলিক চার্চ, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ সহ বিভিন্ন ধারার খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি পরবর্তীতে এখান থেকেই হয়।

আরিয়ানদের শক্তিশালী হয়ে ওঠা, পশ্চিম ও পূর্ব দিকে যথাক্রমে নাইসিনীয় ও আরিয়ানীয় খ্রিস্টধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ

যদিও নাইকিয়ার চুক্তি সে সময় তেমন ভালাে কোনাে ফল বয়ে আনেনি। যারা এই দলে আরিয়ান হিসেবে যােগ দিয়েছিল তারা আরিয়ান হিসেবেই ছিল এবং তাদের নিজেদের অবস্থান বলতে গেলে জোর করেই টিকিয়ে রেখেছিল। অবশ্য কন্সট্যান্টাইন নিজেও একসময় আরিয়ানদের অবস্থান পােক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। অথবা অন্তত নিকোমেডিয়ার বিশপ ইউসেবিয়াস এবং আরেকজন আরিয়ানের নেতাসহ কন্সট্যান্টাইনদের উপরে তাদের প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছিল। তখন অ্যাথানিয়াসদের জোর করে ফাঁসিতে ঝােলানাে হলাে। পূর্বদিকে এই বিতর্ক অর্ধশতাব্দী ধরে তেমনই চলতে লাগল। বিভিন্ন সম্রাটেরা নাইসিনীয়দের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আরিয়ানদের পক্ষে কথা বলে যেতে লাগল। এই অবস্থা সাম্রাজ্যের পূর্ব এবং পশ্চিম দিককে নতুন করে যেন দুই ভাগে বিভক্ত করে দিলাে। এমনিতেই পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে ভাষার পার্থক্যের জন্য আগে থেকেই দুটি ভাগ ছিল। পূর্বদিকে গ্রিক আর পশ্চিমে ল্যাটিন। এরপর আবার রাজনৈতিকভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে দুজন পৃথক সম্রাট ছিলেন। এখন সর্বশেষ বিভক্তির ধারক হিসেবে এলাে ধর্ম। পশ্চিম দিকের মানুষেরা কট্টরভাবে নাইসিনীয় রয়ে গেলেন, যখন কিনা পূর্বদিকে ব্যাপক হারে মানুষ নব্যতান্ত্রিক আরিয়ানদের পক্ষে যােগ দিলেন। এটাই ছিল ধর্মীয় মূল্যবােধের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভক্তির প্রথম ধাপ। এরপর ধীরে ধীরে পরের সাতটি শতক ধরে পূর্ব আর পশ্চিম দিকের খ্রিস্টধর্ম আরও পৃথক হয়ে গেল এবং তারা স্থায়ীভাবে আলাদা দুটো ধারা তৈরি করল।

কন্সট্যান্টিনােপল প্রতিষ্ঠা ও পূর্বের কনস্ট্যান্টিনোপল ও পশ্চিমের রোমের পেট্রিয়ার্কের দ্বন্দ

পূর্ব দিকের গুরুত্ব বৃদ্ধি ও রাজধানীর প্রয়োজনীয়তা

নাইকির চুক্তি বহাল থাকার সময়ে কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়গুলাে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখতেন। যেখানে ডিওক্লেশিয়ান সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে স্বৈরাচারের একটি আদল দিয়েছেন, সেখানে রাজধানী বলতে সত্যিকারের রােমকে বােঝানাে হতাে না। সম্রাট যেখানে থাকতেন সে জায়গাই রাজধানীর মর্যাদা পেত। তাই সম্রাটের অবস্থান অনুযায়ী রাজধানীর অবস্থান বদলে যেত। এক প্রজন্ম পরেও তখন ডিওক্লেশিয়ান, গ্যালেরিয়াস এবং কন্সট্যান্টাইনের আমলের পরে রাজধানী যেন পূর্বদিকে প্রধানত নিকোমেডিয়ায়ই অবস্থান নিয়েছিল। পূর্বদিকই ছিল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী, ধনী এবং প্রধান অংশ। সে সময়ে সাম্রাজ্যের সীমানা ছিল সবচেয়ে নড়বড়ে। ভাগ্যিস গথ আর পার্সিয়ানরা নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল তাই সম্রাটদের সেখানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও নিকোমেডিয়াই ছিল সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। কন্সট্যান্টাইন এই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন এবং তাই তিনি রাজধানীকে প্রাচীন শহর বাইজ্যান্টিয়ামে স্থানান্তরের কথা ভাবছিলেন। হাজার বছর আগে গ্রিকরা বাইজ্যান্টিয়াম শহর গড়েছিল (ইতিহাসে উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৭ সালে, রােমান ৯৬ সাল)। এই শহরের একটি জমজমাট অবস্থান ছিল একসময়। শহরটি ইউরােপের দিকে বসফোরাসের পাশে নিকোমেডিয়ার পঞ্চাশ মাইল পশ্চিমদিকে অবস্থিত ছিল। এটা ছিল সমুদ্রের একটি সরু অংশ, কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ধনী এবং জনবহুল দেশ গ্রিস, এশিয়া মাইনর এবং সিরিয়ায় বাণিজ্যের কারণে পৌঁছতে হলে সব জাহাজকেই সেই সরু নালা অতিক্রম করতে হতাে।

বাইজান্টিয়াম শহরের ইতিহাস

বাইজান্টিয়াম শহর হিসেবে গড়ে ওঠার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ হিসেবে এর মূল্য বুঝতে পেরেছিল। তাই সেভাবে শহরটি উন্নতির দিকেও এগিয়েছিল। এই শহরটি হয়তাে আরও অনেক বেড়ে উঠত যদি না তার চেয়ে ক্ষমতাশালী বড় শক্তির আক্রমণের শিকার না হতাে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০ সাল পর্যন্ত, অ্যাথিনিয়ানদের উত্থানের সময়টাতে এথেন্স পুরােপুরিভাবে কৃষ্ণসাগর বেয়ে আসা খাদ্যসামগ্রীর উপরে নির্ভরশীল ছিল। তাই এথেন্স চাইল বাইজান্টিয়ামের কর্তৃত্ব; প্রথমে পারস্যের সাথে, তারপর স্পার্টার সাথে এবং সবার শেষে ম্যাসিডনের সাথে দ্বন্দ্বের জন্য। বাইজান্টিয়ামের সব সময়ে আক্রমণকারী শক্তিগুলাের মােকাবেলা করার শক্তি ছিল। এর একটি প্রধান কারণ এর অবস্থান। এর তিনদিকে সমুদ্র থাকায় একে একদিক থেকে আক্রমণ করে কোনাে সুবিধা করা যাচ্ছিল না। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের পিতা ম্যাসিডনের ফিলিপ যখন সেখানে আক্রমণ করেছিল তখন বাইজান্টাইন খুব সহজেই তা প্রতিহত করেছিল। এটি ছিল ফিলিপের খুব অল্পকিছু পরাজয়ের একটি। বাইজান্টাইন প্রবল পরাক্রমশালী রােমান সাম্রাজ্যের দূরবর্তী একটি প্রদেশ হিসেবে যােগ দেয়। রােমানরা যখন পূর্বদিকে দাপটের সাথে শাসন করছিল তখন এটি একটি নিজস্ব পরিচালনায় সফল দেশ হিসেবে সাম্রাজ্যের সাথে যােগ দেয়। তখন ভেস্পাসিয়ানের শাসনামল চলছিল। ভেস্পাসিয়ান নিজস্ব দক্ষতায় পরিচালিত প্রদেশগুলাের শাসন নিজের হাতে তুলে নেন। তখন এশিয়া মাইনরের সাথে বাইজ্যান্টিয়ামও রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। কমােডাসের মৃত্যুর পরে বাইজ্যান্টিয়ামে কঠিন সময় আসে। এটি তখন নিগারদের বিরুদ্ধে সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের সংগঠিত যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যায়। সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস ১৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই শহরটি দখলে নিতে সক্ষম হন।

বাইজান্টিয়াম শহর থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল

এরপর কন্সট্যান্টাইনের চোখ যখন এই শহরের উপরে পড়ে তখন এটি আবার নতুন করে তৈরি করা হয়। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে এটি তার হাতে পড়ে এবং তখন লিসিনিয়াসের সাথে তার যুদ্ধ চলছিল। এই শহরের কার্যকারিতা এবং সম্ভাবনা নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। নিইকিয়ার সভার পরপর কন্সট্যান্টাইন বাইজান্টিয়াম শহরকে বাড়ানাের কাজে মনােযােগ দেন। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক এবং স্থাপত্যবিদ এনে শহরটি ঢেলে সাজানাের কাজে মনােনিবেশ করেন। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। কন্সট্যান্টাইনের পছন্দমতাে কাজগুলাে করার জন্য সাম্রাজ্যের ভেতরে ততটা দক্ষ মানুষ এবং প্রয়ােজনীয় উপাদান পাওয়া যাচ্ছিল না যাতে করে শহরটিকে তিলােত্তমা করে গড়ে তােলা যায়। তাই কন্সট্যান্টাইনের কাছে এরপর যা সহজ মনে হয়েছিল তিনি তাই করেছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রাচীন শহর থেকে বিখ্যাত মূর্তিগুলাে উঠিয়ে নিয়ে বাইজান্টিয়ামে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করা শুরু করলেন। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দের (রােমান ১০৮৩ সাল) মে মাসের ১১ তারিখে এই শহরটি নতুন রাজধানী হিসেবে ঘােষিত হয়। এটির নামকরণ হয় “নােভা রােমা” (নতুন রােম) অথবা “কন্সট্যান্টিনাে পােলিস” (কন্সট্যান্টাইনের শহর)। পরের নামটিই ল্যাটিন ভাষায় কন্সট্যান্টিনােপলিস এবং ইংরেজিতে কন্সট্যান্টিনােপল নামে পরিচিত হয়। আদি রােমের মতাে সমস্ত নিয়মকানুনও এখানে বহাল ছিল। নানারকমের খেলাধুলার প্রতিযােগিতা, এমনকি জনগণের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ পর্যন্ত সেখানে চলছিল। তার দশ বছর পরে কন্সট্যান্টিনােপলে রােমের সিনেট বসানাে হয় যা আসলে ছিল আগের চেয়েও অকার্যকর।

কন্সট্যান্টিনােপলের বিকাশ, প্যাট্রিয়ার্করা ও তাদের ওপর কনস্ট্যান্টিনোপলের প্রভাব

কন্সট্যান্টিনােপল খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। সম্রাটের বাসস্থান হিসেবে সেখানে বড় বড় সরকারি কর্মচারিদের আনাগােনায় শহরটি রমরমা হয়ে যায়। এটি তখন সাম্রাজ্যের সম্মানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠায় অনেক অভিজাত মানুষ রাতারাতি অন্যান্য প্রদেশ থেকে সেখানে গিয়ে থাকা শুরু করেন। এক শতকের মধ্যেই এটি রােমকে টেক্কা দিয়ে সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী হাজার বছরের মধ্যে এটি ইউরােপের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বৃহৎ শহর হিসেবে পরিচিত হয়। কন্সট্যান্টিনােপলের উপস্থিতি চার্চের কার্যকলাপকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করত। কন্সট্যান্টিনােপলের সময়ের বিশপেরাও তাকে খুব মানত কারণ সম্রাটের একেবারে কাছাকাছি থাকত শহরটি। কন্সট্যান্টিনােপল তখন বিশাল শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। যার বিশপেরা অন্য সমস্ত বিশপদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য পেতেন। এই বিশপদের বলা হতাে “প্যাট্রিয়ার্ক” যার মানে হলাে “প্রধান ফাদার”। ততদিনে ধর্মগুরুদের “ফাদার” বলে সম্বােধন করার রীতি হয়ে গিয়েছিল। তখন পাঁচ জন প্যাট্রিয়ার্ক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জেরুজালেমের বিশপ। বাইবেলের ঘটনাপ্রবাহের সাথে জেরুজালেমের সম্পর্কের কারণে তাকে একজন বিশিষ্ট প্রধান ধর্মগুরু হিসেবে মানা হতাে। অন্য চারজন হলেন রােমান সাম্রাজ্যের আরও চারটি বড় শহরের বিশপ। শহরগুলাে হলাে, রােম, কন্সট্যান্টিনােপল, অ্যালেক্সান্দ্রিয়া এবং অ্যান্টিয়ক। অ্যান্টিয়ক, জেরুজালেম এবং অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্কেরা কন্সট্যান্টিনোেপলের প্রভাবের নিচে চাপা পড়ে মােটামুটি কষ্টেই দিন কাটাতেন। তারা এই বিষয়টি নিয়ে একটু অসন্তোষের মধ্যে ছিলেন। কন্সট্যান্টিনােপলের অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রতি বিরক্ত এবং হতাশ বােধ করে কিছু প্যাট্রিয়ার্ক নাইসিনীয় ভাবনা থেকে সরে এসে এরিয়ানিজমের সাথে যােগ দেন। এই ঘটনায় তাদের একত্র শক্তি আরও কমে যায়। এর পরপরই কন্সট্যান্টিনােপলের প্যাট্রিয়ার্ক কেবল মুখে মুখে নয়, বরং কাগজে কলমে পূর্বদিকের সমস্ত নাইসিনীয় চার্চের প্রধান হয়ে বসেন।

রোমের পেট্রিয়ার্ক, এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্কের সঙ্গে দ্বন্দ্ব

রােমের প্যাট্রিয়ার্কের জন্য কন্সট্যান্টিনােপলের আইনকানুন মানা অত জরুরি ছিল না। কারণ ছিল দূরত্ব। এছাড়া রােমের প্যাট্রিয়ার্ক ছিলেন একমাত্র ল্যাটিন ভাষাভাষী প্যাট্রিয়ার্ক। পশ্চিম দিকের প্রধান প্যাট্রিয়ার্ক বলতে ছিল রােমের। সাম্রাজ্যের মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন যার নামের সাথে “রােম” শব্দটা উচ্চারিত হতাে। সম্রাট পুরনাে রােম থেকে নতুন রােমের দিকে যাত্রা করলেন বলে আরও বেশি ক্ষমতা, আরও বেশি প্রতিনিধি এবং আরও বেশি ধনদৌলতের সংস্পর্শে আসতে পারলেন। কিন্তু পুরনাে রােমে একটি ব্যাপার রয়েই গেল, তা হলাে রােমের বিশপ। তার পেছনে মদতদাতা হিসেবে ছিল সাম্রাজ্যের সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনা, কঠোর নাইসিনীয় দর্শন। এসবকিছু নব্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়াত সবসময়। পূর্বদিকের বিতর্কে পরিপূর্ণ অবস্থানের কাছে রােমের চার্চের মতবাদ তাদের কাছে একটি জাতীয়তাবাদের মতাে ভূমিকা রাখল একসময়। পূর্বদিকের গ্রিক মতবাদের মাধ্যমে যারা ধর্মপালন করতে চেয়েছিল তাদের স্থান রােম প্রায় পাঁচশ বছর আগে দখল করে নিয়েছিল। এখন তারাও রােমে এসে পশ্চিমা কায়দায় নিজেদের অবস্থান করে নিতে উৎসাহ পেল। এভাবে শত শত বছরব্যাপী খ্রিস্টধর্মের ধারক হিসেবে রােম আর কন্সট্যান্টিনােপলের বিশপদের মধ্যে লড়াই বেঁধে ছিল। এই লড়াই দিনে দিনে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে কিন্তু কখনােই কোনাে দল জয়লাভ করেনি।

গথদের বিদ্রোহ দমন ও কনস্ট্যান্টাইনের মৃত্যু

কন্সট্যান্টাইন তার রাজত্বের শেষের দিকে বাধ্য হয়ে আরেকবার একটি অসভ্য জাতির আক্রমণ মােকাবেলা করেন। তৃতীয় শতাব্দীর অরাজকতার পরে সীমানার দিকে আর কোনাে হামলা হয়নি বললেই চলে। ডিওক্লেশিয়ান এবং কন্সট্যান্টাইনের রাজত্বে সেনাবাহিনী এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে তারা সীমানার দিকে কড়া নজর রাখতে সফল হয়েছিল। তখন একটি গৃহযুদ্ধ লেগে গেলেও সেনাবাহিনী সেটি প্রতিহত করতে পারত। ৩৩২ খ্রিস্টাব্দে গথ উপজাতি দানিয়ুবের তীরবর্তী সীমায় আবার আক্রমণ করল। কন্সট্যান্টাইনকে সেখানে ছুটে যেতে হলাে। এবারে কন্সট্যান্টাইন সফলভাবে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। গথরা শােচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। তারা লজ্জিত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। কন্সট্যান্টাইনের শরীর ততদিনে ভেঙে পড়ছিল। তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সের দিকে স্বাস্থ্যবান ছিলেন কিন্তু তখন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলাে, কন্সট্যান্টিনােপলে তিনি জীবনের শেষ সময়গুলাে কাটাননি। তিনি বায়ু পরিবর্তনের জন্য তার জীবনের শেষ অবসর কাটিয়েছেন পুরনাে নিকোমেডিয়া শহরে। সেখানে একসময় তার শারীরিক অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। তখন তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে (১০৯০ রােমান সালে) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একত্রিশ বছর আগে তিনি ব্রিটেনে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অগাস্টাসের পরে আর কোনাে সম্রাট এত দীর্ঘসময় ধরে সাম্রাজ্যের হাল ধরে থাকেননি। কন্সট্যান্টাইনের সময় খ্রিস্টধর্ম, সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং কন্সট্যান্টাইনােপলকে সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ধরে নেয়া হয়। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকেরা এই অবস্থাকে সম্মান দেখিয়ে তাকে “কন্সট্যান্টাইন দ্য গ্রেট” বলে অভিহিত করেন। কিন্তু সম্রাট যতই পরাক্রমশালী হােক না কেন, রােমান সাম্রাজ্যের ধীর পতন কেউ ঠেকাতে পারেনি। কন্সট্যান্টাইনও ডিওক্লেশিয়ানের মতাে সাম্রাজ্যের পতনকে কিছুটা দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন বটে, তবে থামাতে পারেননি।

দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস (রা. ৩৩৭ – ৩৬১ খ্রি.)

তিন ভাইয়ের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াসের একক ক্ষমতা গ্রহণ

কন্সট্যান্টাইন বেঁচেছিলেন তার তিন পুত্রের মাধ্যমে। তারা হলেন দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন (রা. ৩৩৭-৪০ খ্রি.), দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস (রা. ৩৩৭-৬১ খ্রি.) এবং কন্সট্যান্স (রা. ৩৩৭-৫০ খ্রি.)। সাম্রাজ্যটি তাদের তিনজনের মধ্যে ভাগাভাগি করা হলাে। পূর্বদিকের পুরাে অংশটি মেঝাে ছেলে দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াসের অধীনে চলে গেল। পশ্চিম দিকের অংশকে দুই ভাগ করে বড় এবং ছােট ছেলে নিয়ে নিলেন। কন্সট্যান্টাইন পেলেন ব্রিটেন, গাউল এবং স্পেন। কন্সট্যান্স পেলেন ইটালি, ইলিরিয়া এবং আফ্রিকা। এই তিনজন ছিলেন প্রথম রােমান সম্রাট যাদের খ্রিস্টান মতে শিক্ষা দান করা হয়েছিল। এর ফলে সাম্রাজ্যের সব জায়গায় যদি একটি শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন আসত তাহলে খুব ভালাে হতাে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটি হয়নি। কন্সট্যান্টাইনের ছেলেরা সবাই ছিল খুব নিষ্ঠুর এবং অসচেতন। যেমন বলা যায়, দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াসের ক্ষমতায় বসার পরে প্রথম কাজই ছিল তার দুজন আত্মীয়কে হত্যা করা। তিনি ধরে নিয়েছিলেন তারা সিংহাসন নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হতে পারে। অন্য ভাইদের মতাে দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন সবচেয়ে বড় হবার সুবাদে সম্রাটদের প্রধান হওয়ার দাবি জানালেন। কন্সট্যান্স যখন এই দাবি নাকচ করে দিলেন এবং সবার জন্য সমান সম্মান দেয়ার কথা বললেন, দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন ইতালিতে হামলা করলেন। কন্সট্যান্স জিতে গেলেন এবং দ্বিতীয় কন্সট্যান্টাইন হেরে গিয়ে ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে হত্যার শিকার হলেন। কিছুদিন পর্যন্ত বাকি দুইভাই সাম্রাজ্য শাসন করলেন। কন্সট্যান্স পশ্চিমে এবং দ্বিতীয় কন্সট্যান্টিয়াস পূর্বদিকের অংশে। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্স বন্দী হলেন তারই একজন সেনাপ্রধানের মাধ্যমে যিনি সম্রাটকে বন্দী করে সিংহাসনে বসতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস পশ্চিমের দিকে অভিযান শুরু করলেন এবং সেনাপ্রধানকে হারিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এভাবে ৩৫১ খ্রিস্টাব্দে রােমান সাম্রাজ্য আবার একজন মাত্র সম্রাটের শাসনাধীনে এলাে, তিনি হলেন এই দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস। সেই সময়টা যে খুব শান্তির ছিল, তা নয়। একচ্ছত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তিনি পার্সিয়ানদের সাথে লড়তেই ব্যস্ত ছিলেন।

আর্মেনিয়ার খ্রিস্টীয় রাষ্ট্র হয়ে ওঠা, খ্রিস্টীয় রোমের পক্ষ গ্রহণ, পারস্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসার, শাপুরের খ্রিস্টান নিধন ও রোমের সাথে যুদ্ধের সূচনা

৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কন্সট্যান্টাইনের মৃত্যু হলে রােমান সাম্রাজ্য দুর্বল হাতে চলে গিয়েছিল। সেই সুযােগে শাপুর রােমের পশ্চিম দিকে আক্রমণ করে বসে। পার্সিয়ার জন্য রােমে আক্রমণ করা নতুন কিছু ছিল না। বলতে গেলে সেটি তার আগের আট শতক ধরে চলছিল। তাকে এবারের যুদ্ধে আরও নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছিল, তা হলাে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে বিতর্ক। এত কিছুর পরেও খ্রিস্টধর্ম রােমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে সর্বজনীন ধর্মের মর্যাদা পায়নি। উৎসুক খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে চার্চ এবং মিশনারি গড়ে তুলতে তৎপর ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন গ্রেগরি যাকে “দ্য ইলিউমিনেটর” বলে ডাকা হতাে। প্রাচীন ইতিহাসের হিসেবে তিনি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রেগরির বাবা সন্তানের বাল্যকালেই মারা যান। একজন খ্রিস্টান সেবিকা শিশুটিকে এশিয়া মাইনরে নিয়ে আসেন এবং তাকে খ্রিস্টান হিসেবে মানুষ করেন। একই সাথে তিনি উত্তরপূর্ব দিকেও আর্মেনিয়ার উর্বর ভূমিতে সফর করেন। সেখানে এমনিতেই খ্রিস্টানদের আধিপত্য ছিল, গ্রেগরির আগমনে যেন ষোলকলা পূর্ণ হলাে। ৩০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি আর্মেনিয়ার রাজা টিরিডেটসকে ধর্মান্তরিত করে ফেলেন। তাকে সাথে নিয়ে প্যাগান ধর্মের শেষ বিন্দু পর্যন্ত শেষ করে ফেলেন এবং খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘােষণা করে দেন। এভাবে আর্মেনিয়া হয়ে গেল প্রথম খ্রিস্টধর্মের রাষ্ট্র। রােম নিজে তখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্যাগান ধর্মের অনুসারী ছিল। আর যে সময়ে আর্মেনিয়া খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ঠিক তখনই ডিওক্লেশিয়ান এবং গ্যালেরিয়াসের নেতৃত্বে রােমে সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান নিধন কর্মসূচি চলছিল। প্রথম কন্সট্যান্টাইন যখন রােমকে খ্রিস্টধর্মের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন তখন ক্ষমতার অপব্যবহার যে মানুষকে বিমুখ করে রেখেছিল, তা কিছুটা কমল। আর্মেনিয়া চার শতক ধরে রােম আর পারস্যের (তারও আগে পার্থিয়ার) মাঝখানে দুলছিল। তখন কন্সট্যান্টাইনের হস্তক্ষেপে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী আর্মেনিয়া প্যাগান পারস্যকে ছেড়ে দিয়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী রােমকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারল। অন্যদিকে পারস্যেও খ্রিস্টধর্ম কোনাে না কোনােভাবে প্রবেশ করতে লাগল। এখন যদি প্যাগান পারস্য আর খ্রিস্টান রােমের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে, তাে পারস্যের খ্রিস্টানরা কার পক্ষ নেবে? রাজা শাপুর তাই তার রাজ্যে খ্রিস্টান ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এর পরবর্তী অবস্থায় রােমের সাথে পারস্যের যুদ্ধটা কেবল ভূমি দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না, এটি হয়ে উঠল ধর্মের জন্য যুদ্ধ।

রোম ও পারস্যের যুদ্ধ, উভয় রাষ্ট্রের সমস্যার কারণে অচলাবস্থা

দ্বিতীয় শাপুর এবং দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াসের মধ্যে প্রথম দীর্ঘ যুদ্ধটি লেগে থাকল প্রকৃতপক্ষে রােমের খ্রিস্টান শক্তি এবং পূর্বদিকের খ্রিস্টান বিরােধী শক্তির সাথে। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস পারস্যের তরুণ রাজার বিরুদ্ধে তেমন শক্তির পরিচয় দিতে পারলেন না। তিনি পারস্যের বাহিনীর কাছে ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকলেন। কিন্তু ওদিকে পারস্যের বাহিনীরাও এতটা ক্ষমতা দেখাতে পারেনি যে রােমে ঢুকে পড়ে রােমের কোনাে প্রদেশ দখল করে বসে থাকবে। বিশেষ করে মেসােপটেমিয়ার উপরের দিকে নিসিবিসের দুর্গ, যেটি অ্যান্টিয়কের তিনশ মাইল উত্তরপূর্ব দিকে, রােমের প্রবল শক্তির প্রতীক ছিল সেটি। শাপুর সেই প্রদেশ দখলের চেষ্টায় তিন তিনবার আক্রমণ করেছিলেন। তিনবারই তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তারপর কোনাে রাজাই যুদ্ধের ব্যাপারে আর ততটা আগ্রহী ছিলেন না। শাপুর অসভ্য উপজাতিদের বারংবার আক্রমণের কারণে রাজ্যের পূর্বদিকের খারাপ অবস্থা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এটাই রােমের উপরে আক্রমণের সময়ে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছিল। অন্যদিকে কন্সট্যান্টিয়াস ধর্ম এবং বংশ নিয়ে বিচিত্র সমস্যায় পতিত ছিলেন।

জুলিয়ান (রা. ৩৬১-৬৩ খ্রি.)

কনস্ট্যান্টিয়াসের উত্তরাধিকারী গ্যালাস ও জুলিয়ান

কনস্ট্যান্টিয়াসের দুই ভাই কোনাে উত্তরাধিকারী না রেখেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কনস্ট্যান্টিয়াসের নিজেরও কোনাে সন্তান ছিল না এবং পরিবারের অন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের তিনি হত্যা করেছিলেন। এখন একজন উত্তরাধিকারী খোঁজার জন্য তিনি কোথায় যাবেন? এমন কাউকে কি তিনি খুঁজে পাবেন যার সাথে রাজত্বের এই গুরুভার কিছুটা ভাগাভাগি করা যায় আর নিজের অবসরের সময়ে যার উপরে আস্থা রাখা যায়? তার আশেপাশে ছিল কেবল প্রথম কন্সট্যান্টাইনের পাতানাে ভাইয়ের দুই ছেলে। পাতানাে ভাইকেও কনস্ট্যান্টিয়াস ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। ভাইয়ের ছেলে সেই তরুণদ্বয় (যারা দুজন ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্মেছিলেন, তাই নিজেরা ছিলেন সৎ ভাই) ছিলেন কনস্ট্যান্টিয়াস ক্লোরাসের নাতি। তারা দুজন হলেন গ্যালাস এবং জুলিয়ান (রা. ৩৬১-৬৩ খ্রি.)। তাদের বাবার হত্যাকাণ্ডর সময়ে তারা ছিল কেবলই শিশু। কন্সট্যানিশিয়াস হয়তাে ভেবেছিলেন এই অবােধ শিশুদের মেরে ফেলে কোনাে লাভ নেই। গ্যালাস বেশ বড় ছিলেন তাই তাকে কন্সট্যান্টিনােপল থেকে বহিষ্কার করে কড়া প্রহরায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ানকে (বাবার মৃত্যুর সময়ে মাত্র ছয় বছর বয়স হওয়াতে) কন্সট্যান্টিনােপলেই রাখা হলাে। তাকে নিকোমেডিয়ার ইউসেবিয়াস নামে শিক্ষকের অধীনে খ্রিস্টান মতে শিক্ষাদান করা হয়। ইউসেবিয়াস ছিলেন আরিয়ান বা নব্যতান্ত্রিক বিশপদের মধ্যে প্রধান একজন। (কনস্ট্যান্টিয়াস মানসিকভাবে নিজেও একজন এরিয়ানিস্ট ছিলেন।) গ্যালাস এবং জুলিয়ান কেউই জানত না যে কখন হঠাৎ করে কনস্ট্যান্টিয়াস তাদের মৃত্যুর পরােয়ানা জারি করবে, তাই তাদের তরুণ বয়সটি ছিল খুবই অস্বস্তিকর এবং অনিশ্চয়তায় ভরা।

জুলিয়ানের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার আচরণ

জুলিয়ান রােমান সাম্রাজ্যের ভিন্নধর্মী একজন সম্রাট হয়ে ওঠেন এক দিক দিয়ে। তিনি খ্রিস্টান শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নিজে খ্রিস্টান ছিলেন না। শিক্ষা গ্রহণের পরেও খ্রিস্টধর্ম তাকে আকর্ষণ করেনি। দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিয়াস তার পুরাে পরিবারকে হত্য করেছিলেন এবং জুলিয়ান সারাজীবন হত্যার আদেশের অপেক্ষায় ভয়াবহ দিন কাটিয়েছিলেন। এটাই যদি খ্রিস্টধর্মের প্রকৃত চেহারা হয়ে থাকে তবে এটি কী করে অন্য নিষ্ঠুর ধর্মগুলাে থেকে পৃথক বা শান্তির ধর্ম বলে গণ্য হবে? তাই তিনি দেখলেন যে প্যাগান ধর্মাবলম্বী (সাম্রাজ্যের অর্ধেক মানুষ তখনও প্যাগান ধর্মাবলম্বী ছিল) দার্শনিকরাই তাকে বেশি আকর্ষণ করে। সেইসব প্যাগান দার্শনিকদের মধ্যে তিনি বরং গ্রিসের প্রাচীন দার্শনিকদের প্রতিভার ছোঁয়া পেতেন, পেতেন তাদের চিন্তাধারার মতাে উদারতা। সাত শতাব্দীর সেই স্বর্ণযুগ তাকে মনে করিয়ে দিত সেইসব দার্শনিক এবং বােদ্ধাদের আদর্শ। মনে মনে জুলিয়ান একজন প্যাগান ধর্মাবলম্বী এবং গােপনে ইলিউসিনিয়ান আদর্শের অনুসারী হয়ে গেলেন। জুলিয়ান চাইতেন প্লেটোর সময়কার সেই চমৎকার সময়টা আবার নতুন করে সৃষ্টি করতে যখন একজন দার্শনিক শিক্ষকের মতাে করে শিষ্যদের শিক্ষাদান করতেন এবং অন্য দার্শনিকদের সাথে মত বিনিময় করতেন। অবশ্য সেই সময়টিও ছিল জুলিয়ানের আমলের মতােই নিষ্ঠুর এবং অস্থির। কিন্তু তারপরেও এমন একটা কিছু সে সময়ে মানুষের চিন্তাচেতনায় ছিল যা তখনও তাদের সেইদিকে টানত। তারা সেই অতীতের খারাপ দিকগুলাে উপেক্ষা করে কেবল ভালাে দিকগুলাে নিজেদের মনে জিইয়ে রেখেছিল। কনস্ট্যান্টিয়াসের মৃত্যুর পরে যখন জুলিয়ান সম্রাটের আসনে বসলেন, তিনি নিজেকে পুরােপুরি একজন প্যাগান হিসেবে ঘােষণা করলেন। এরপর থেকেই ইতিহাসে জুলিয়ান সম্পর্কে বলতে গিয়ে “ধর্মান্তরিত জুলিয়ান” (Julian the Apostate)। এই কথার মাধ্যমে এটাই বােঝানাে হতাে যে একজন যাকে সবাই এক ধর্মের বলে মনে করত, তিনি হঠাৎ করে নিজের সেই ধর্মটি ত্যাগ করে নিজেকে অন্য ধর্মের অনুসারী বলে ঘােষণা দেন। (তবে অবশ্যই আগের সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে কেউ ধর্মান্তরিত মনে করত না। কারণ তিনি প্রকাশ্যে ছিলেন প্যাগান এবং ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এটি বিশেষ করে নির্ভর করে সেই ঐতিহাসিকের উপরে যিনি ইতিহাসটি লিখছেন।)। জুলিয়ান খ্রিস্টধর্মকে ছােট করার কোনাে চেষ্টা করেননি। তার বদলে বরং তিনি সাম্রাজ্যে ধর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্যাগান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান সবার সাম্রাজ্যে ধর্ম পালন এবং প্রচারের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন তিনি। এছাড়াও তিনি খ্রিস্টধর্মের ভেতরেই বিভিন্ন নব্যতান্ত্রিক শাখাগুলাের প্রতি সহনশীলতা বাড়ানাের জন্যও মানুষকে বােঝাতে থাকেন। এক একটি দল যে বিশপদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল তাদের তিনি পুনরায় কাজ করতে আদেশ দেন। এটি ছিল কেবলই তার নিজস্ব মতামত যে খ্রিস্টধর্মের বিশুদ্ধতা নিয়ে এই দলাদলি বন্ধ হােক। নাইসিনীয়বাদ, আরিয়ানিজম, ডােনেটিজমের মতাে আরও ডজনখানেক ধর্মীয় ধারা যখন নিজেদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল তখন খ্রিস্টধর্মের মতাে নব্য ধর্মের সুসংহত হওয়ার মতাে কোনাে স্থান ছিল না। এতগুলাে প্রতিযােগী ধর্মের মাঝখানে খ্রিস্টধর্ম পাত্তাই পায়নি। (সম্রাটের দূরদর্শিতা সঠিক ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়ও তেমনই ঘটছিল। জুলিয়ানের সাম্রাজ্যেও এটি অবাক হওয়ার মতাে কোনাে ঘটনা ছিল না।)। মানবিক গুণাবলীতে ভরপুর জুলিয়ান নিজস্ব জীবনে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ মেনে চলতেন। আইনকানুন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুব হিসেবি, কোনাে বিষয়ে কোনাে উগ্রতা ছিল না তার, নীতির বাইরে যাওয়া ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। অনেকের মতে তিনি প্যাগান হলেও ছিলেন তার পূর্বের খ্রিস্টান রাজাদের চেয়েও বেশি খ্রিস্টানমনস্ক। তিনি প্যাগান ধর্মের মূল বিশ্বাসকেও খ্রিস্টধর্মের মতাে একেশ্বরবাদে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে খ্রিস্টান বিরােধীদের চেয়ে খ্রিস্টানেরাই জুলিয়ানকে বেশি সমর্থন করত। একজন কঠোর প্যাগান তাদের কাছে নিশ্চয়ই সমর্থনযােগ্য হতাে না।

পারস্যের বিরুদ্ধে বিজয় ও মৃত্যু

নিজেকে সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে স্থির করে তারপরে ধর্মের বিষয়টিও ফয়সালা করা হলে জুলিয়ান যুদ্ধের দিকে মনোযােগ দিলেন। জুলিয়ান তার সেনাবাহিনীকে সিরিয়ার দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে পারস্যের সেনাদের সাথে পুরনাে লড়াই নতুন করে শুরু করলেন তিনি। সেখানে তিনি তার দুঃসাহসিক লড়ার ক্ষমতা দেখানাের আরেকটি সুযােগ পাবেন বলে আশা করছিলেন। গাউলে থাকতে তিনি গ্রেট জুলিয়াসকে অনুকরণ করছিলেন। এখানে পূর্বদিকে এসে তিনি অনুকরণ করা শুরু করলেন গ্রেট ট্রাজানকে। তিনি ইউফ্রেটিস নদীর উপরে যুদ্ধ জাহাজের বহর সাজালেন এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে ট্রাজানের মতাে মেসােপটেমিয়ার তীর ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি পারস্যের রাজধানী টেসিফোনে পৌঁছে গেলেন। তারপর টাইগ্রিস পেরিয়ে প্রতি লােকালয়ে পারস্যের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করলেন। যাই হােক, জুলিয়ান একটি বড় ভুল করে বসলেন। তার তারুণ্যে টগবগে সেনাবাহিনী তাকে এমন করে ঘিরে রেখেছিল যে তার মনে নিজেকে ট্র্যাজান মনে করার মতাে অহংকার হরহামেশা জেগে উঠত। এমনকি তিনি মনে করতেন তিনি আলেক্সান্ডারের চেয়েও কোনাে অংশে কম নন। তিনি টেসিফোন দখল করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু এবারে পারস্যের সেনাবাহিনীকে হাত করার পরিকল্পনা করতে লাগলেন, যেমনটা করেছিলেন আলেক্সান্ডার। কিন্তু জুলিয়ান জানতেন না যে ইতিহাসে আলেক্সান্ডার একজনই হয়। চতুর শাপুর রাজ্যের অনেক জায়গায় তার নিজস্ব সেনা দলকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারা ছিল রােমান সেনাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পারস্যের সেনাবাহিনীরা পুরাে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জুলিয়ান নিজের সেনাদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করে কমিয়ে নিতে আরম্ভ করেন। পারস্যের সেনাদের প্রতি পদক্ষেপে হারিয়ে দিয়ে তিনি সেই মরুভূমি আর প্রচণ্ড গরম রাজ্যটি থেকে যুদ্ধ বন্ধ করে ফিরে আসেন। জুলিয়ান যতদিন বেঁচে ছিলেন, রােমান সেনাবাহিনী প্রতিটি যুদ্ধেই জিতেছিল। কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধের পরে তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের (রােমান ১১১৬ সাল) ২৬ জুলাই জুলিয়ানের শরীরে একটি বর্শা এসে বেঁধে। বর্শাটি কে বা কোথা থেকে ছুঁড়েছে তা কেউ বলতে পারেনি। এমন একটি গল্প শােনা যাচ্ছিল যে একজন পারস্যের সেনা বর্শাটি ছুঁড়েছে কিন্তু পরে বর্শাটি পরীক্ষা করে বলা হয়েছিল যে সেটি ছুঁড়েছে একজন রােমান খ্রিস্টান সেনা। বিশ মাস রাজত্ব করার পরে জুলিয়ান মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। একটি বিখ্যাত (কিন্তু সম্ভবত বানানাে) গল্প অনুযায়ী জানা যায় যে, সম্রাটের শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল “ডিকিস্তি, গ্যালিলি” (তােমার জয় হয়েছে, ওহ গ্যালিলিয়ান)। কিন্তু এটি যদি তিনি নাও বলে থাকেন তবু ধরে নেয়া যায় যে, তার জয় হয়েছিল।

শেষ প্যাগান শাসক, প্যাগান ধর্মের প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, কনস্ট্যান্টিয়াসের বংশের সমাপ্তি

প্যাগান ধর্মকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল মনােভাব তৈরি করার যে ব্রত তিনি নিয়েছিলেন তাতে অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। তবে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সেসব প্রচেষ্টা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। আর কোনাে প্যাগান এভাবে রােমান সাম্রাজ্যের সিংহাসন ধরে থাকতে পারেননি। রােমান সংস্কৃতির দাপটের ভেতরে কোনাে প্যাগান সম্রাট এভাবে নিজের আদর্শ চাপিয়ে দিতে সফল হননি। প্যাগান দার্শনিকেরা তার পরের দেড়শ বছর ধরে এথেন্সে শিক্ষাদান করে যান। ২৯৩ খ্রিস্টাব্দে রােমান সাম্রাজ্যের চার জন শাসকের মধ্যে কনস্ট্যান্টিয়াস যখন থেকে একজন শাসক হয়েছিলেন, তারপর সত্তর বছর পার হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তার পাঁচজন বংশধর পুরাে সাম্রাজ্যে অথবা কিছু অংশে শাসন করে গেছে। জুলিয়ানের অবশ্য কোনাে সন্তান ছিল না। আর তার মৃত্যুর সাথে সাথেই কনস্ট্যান্টিয়াসের শেষ পুরুষ উত্তরাধিকারীর মৃত্যু হলাে।

প্রথম ভ্যালেন্টিনিয়ান (রা. ৩৬৪ – ৩৭৫ খ্রি.) ও ভ্যালেন্স (রা. ৩৬৪ – ৩৭৮ খ্রি.)

জোভিয়ানের (রা. ৩৬৩-৬৪ খ্রি.) ক্ষমতা গ্রহণ, শাপুরের সাথে শান্তিচুক্তি, বিভিন্ন অঞ্চল ত্যাগ ও মৃত্যু

জুলিয়ানের মৃত্যুর সাথে সাথে সেখানকার সেনাবাহিনী জোভিয়ানকে (রা. ৩৬৩-৬৪ খ্রি.) সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করে দেন। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ সেনাপ্রধান তবে একজন নাইসিনীয় খ্রিস্টান। মানুষের মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না যে, ধর্মের ক্ষেত্রে যে ভয়ংকর ওলটপালট করে জুলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে, তার ঝাঁঝ তিনি পরকালে ভােগ করবেন। সেসময় একজন খ্রিস্টান সম্রাটের অধীনেই রোমান জনগণ নিরাপদ বােধ করছিল। জোভিয়ান প্রথমেই সফলভাবে দুটো কাজ করেছিলেন। প্রথমত তিনি জুলিয়ানের ধর্ম নিয়ে করা আইনকানুন নিষিদ্ধ করে কনস্ট্যান্টিয়াসের আমলের খ্রিস্টীয় আইন চালু করলেন। (তখন এসব করতে তাকে কোনাে প্যাগান-নিধনও করতে হয়নি।) দ্বিতীয়ত শাপুরের সাথে শান্তিচুক্তির নামে তিনি কনস্ট্যান্টিয়াসের এবং জুলিয়ানের আমলে করা সেনা আইনগুলাে প্রত্যাহার করলেন। তিনি আর্মেনিয়া এবং তার কাছাকাছি আরও কিছু জায়গা ছেড়ে দিলেন যেসব কিনা ডিওক্লেশিয়ানের আমল থেকে রােমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। বিশেষ করে যেটি খুব পরিতাপের সাথে উল্লেখ করা যায় সেটি হলাে তিনি নিসিবিসের দুর্গও ছেড়ে দিলেন যা কিনা শাপুর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেও দখল করতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে। জোভিয়ান এই শান্তি চুক্তির আওতায় এলেন কারণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি রােমকে একটি সুরক্ষা কবচের মধ্যে রেখে নিজে কন্সট্যান্টিনােপলে ফিরে যেতে পারেন। যাই হােক, ফিরে যাওয়ার সেই পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যানন্টিনােপলে যায় কেবলই তার মৃতদেহ।

ভ্যালেন্টিনিয়ান ও ভ্যালেন্সের ক্ষমতা গ্রহণ ও জনসাধারণের উন্নতির ব্যর্থ প্রচেষ্টা

জোভিয়ানের মৃত্যুর ফলে সৈন্যেরা আরেকজন সক্ষম সরকারি কর্মচারিকে সম্রাটের আসনে বসিয়ে দিলেন। তিনি হলেন ভ্যালেন্টিনিয়ান, যিনি প্যানােনিয়ায় জন্মেছিলেন। তিনি তার ভাই ভ্যালেন্সের সাথে মিলে একযােগে শাসনকার্য পরিচালনার কাজ করতে লাগলেন। ভ্যালেন্টিনিয়ান ছিলেন একজন নাইসিনীয় খ্রিস্টান, যেখান থেকে পরবর্তীতে ক্যাথোলিক খ্রিস্টধর্ম থেকে অন্যান্য মেইনস্ট্রিম খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব ঘটে। তবে তিনি তদকালীন খ্রিস্টধর্মের নব্যতন্ত্রের ব্যাপারে মােটামুটি সহনশীল ছিলেন। অন্যদিকে তার ভাই ভ্যালেন্স ছিলেন একজন ভয়ানক নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্ট। তাদের ধর্মানুভূতি এবং মেজাজমর্জি পুরােপুরি আলাদা হওয়া সত্ত্বেও দুই ভাই একসাথে মিলে বেশ ভালােই রাজ্য শাসন করছিলেন। ভ্যালেন্টিনিয়ান দুজনের মধ্যে কাজের ব্যাপারে বেশি সমর্থ ছিলেন। তার শিক্ষাদীক্ষা কম ছিল তাই অভিজাত শ্রেণির কাছে তিনি তেমন গ্রহণযােগ্য ছিলেন না। তবে সাধারণ মানুষ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি বিধানে তৎপর ছিলেন। তবে তার সকল প্রচেষ্টাই পণ্ড হয়। সাম্রাজ্যের উন্নতিকল্পে তার নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপই ব্যর্থ হয় কারণ সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে দেশের সব সম্পদ সেই খাতেই চলে যাচ্ছিল।

প্রথম থিওডােসিয়াস (রা. ৩৭৯-৯৫ খ্রি.)

প্যাগানদের ধর্মান্তর, খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অ্যাম্ব্রোসের প্রভাবে প্যাগানদের বঞ্চনা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো, আরিয়ানদের বিলুপ্তি

গ্রেশিয়ান এবং থিওডােসিয়াসের আমলে শাসনের স্রোত শেষ পর্যন্ত প্যাগান ধর্মের বিরুদ্ধে বইতে লাগল। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানেরা তখন আরও বেশি সফল হতে লাগল। তখন স্রোতের মতাে মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে লাগল। খ্রিস্টান সম্রাটের অধীনে ধর্মান্তর যেন তাদেরকে নেশার মতাে পেয়ে বসল। এমন অবস্থায় কোনাে কোনাে প্যাগান ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টধর্মকে মুখে মুখে কটাক্ষ করলেও অন্তরে তেমন বিশ্বাস করত না। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা খ্রিস্টান স্কুলে পড়ত আর চার্চে গিয়ে দীক্ষা নিত। তাদের বড়মুখে কিছু বলার ছিল না, কারণ তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকারের খ্রিস্টান হয়ে উঠছিল। এভাবেই গ্রিস আর রােমান সংস্কৃতির অন্তিম রাতগুলাে কাটছিল। প্যাগান ধর্মের মৃত্যুশয্যায় যারা আধিপত্য করছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান হলেন অ্যাম্ব্রোস (অ্যাম্ব্রোসিয়াস)। তিনি জন্মেছিলেন ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। তার পিতা ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি। তিনি নিজেও সরকারি চাকরিতে যােগদান করেন কিন্তু শুরুতেই মিলানের বৃদ্ধ বিশপের মৃত্যু নিয়ে নানান বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। নাইসিনীয় আর আরিয়ানদের তৈরি করা জটিলতার মধ্যে তিনি পুরােপুরি ফেঁসে যান। তারপর তিনি নাইসিনদের পক্ষে এমনভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেন যে ৩৭৪ সালে তাকে বিশপ বানানাের জন্য নির্বাচনে দাঁড় করানাে হয়। ৪র্থ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের সম্রাটেরা যখন মিলানে তাদের বিচারালয় বসালেন তখন পশ্চিমের প্রদেশগুলাের মধ্যে সেই শহরের বিশপের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। অন্তত কিছুদিনের জন্য রােমের বিভিন্ন বিশপের গুরুত্বও ছাড়িয়ে গেল সে শহরটি। আর সেই সময়ে চার্চের সর্বেসর্বা পদে ছিলেন নির্ভীক, তীক্ষ্ম অ্যাম্ব্রোস। অ্যাম্ব্রোস তখন যেন গ্রেশিয়ানের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন। তিনি গ্রেশিয়ানকে সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার আইন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করান। সাম্রাজ্যের যে ভাবমূর্তি প্যাগান ধর্মের ওপরে টিকেছিল তা এর ফলে গুড়িয়ে গেল। ৩৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেশিয়ান তার উপাধি “পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস” প্রত্যাহার করেন। এই উপাধির বলে তিনি সাম্রাজ্যের প্যাগান ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন। রােমান সিনেট থেকে প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও কমিয়ে দিলেন। তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে যে “শিখা অনির্বাণ” জ্বালিয়ে রেখেছিল তাও তিনি নিভিয়ে দিলেন। বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন যে সাম্রাজ্যে প্যাগান ধর্মের লােকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। অ্যাম্ব্রোস যে কেবল সম্রাটের মন জয় করলেন তাই নয়, তিনি প্যাগান এবং আরিয়ানদের বিরুদ্ধেও এক ভয়াবহ শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হলেন। নাইকির সভার পুরাে অর্ধশতাব্দী পরে পূর্বদিকের সম্রাট থিওডােসিয়াস একজন কট্টর নাইসিনীয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। ঠিক সেই সময় থেকে সাম্রাজ্য থেকে নব্যতন্ত্র (আরিয়ান ধারা) বিলুপ্ত হতে শুরু করল। তখন সব ধরনের খ্রিস্টধর্ম নয়, কেবল নাইসিনীয় খ্রিস্টধর্মই সেখানে প্রধান হয়ে উঠল।

সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি

৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৪৮ সালে) থিওডােসিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে তারপরেও সাম্রাজ্য ঠিকঠাকমতােই চলছিল। তার পরের দেড় শতাব্দীব্যাপী উত্তর দিক থেকে জার্মানিক জাতির হামলাও দক্ষতার সাথে ঠেকিয়ে আসছিল। বিভিন্নপর্বে সাম্রাজ্যটি পারস্যের সেনাবাহিনীর মােকাবেলাও করেছে এবং সেনাপ্রধানদের নিজেদের মধ্যে বাঁধা যুদ্ধও মিটিয়েছে। এর মধ্যে খ্রিস্টানদের সাথে প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের এবং খ্রিস্টানদের ভেতরেই দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে জমে ওঠা লড়াই সামলেছে। সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং তারা দলে দলে অ্যাড্রিয়ানোপলে মৃত্যুবরণ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলাে, শাসন চলে গেছে জার্মানদের হাতে। কিন্তু তখনও সাম্রাজ্যের সকল সীমানা নিরাপদ এবং অবিকৃত ছিল। এর থেকেই বােঝা যায় যে আশেপাশের জার্মানিক জাতিরা আসলে সুসংগঠিত ছিল না। তারা কখনও একজন দক্ষ নেতার অধীনে একত্র হয়ে সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালাতে পারেনি। তারা ঝটিকা আক্রমণে অভ্যস্ত ছিল। রােম যখন ভেতরের গৃহযুদ্ধের ঝামেলায় জর্জরিত ছিল, তখনই কেবল এধরনের সামান্য হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যথেষ্ট যােগ্যতার সাথে সুসংগঠিত হওয়া ছাড়া রােমান সেনাবাহিনীর মােকাবেলা করা তাদের জন্য ছিল অসম্ভব একটি বিষয়। বলতে গেলে বাইরে থেকে কোনাে দল এসে রােমান সাম্রাজ্যের ভেতরে আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার চেয়ে রােমানদের নিজেদের হাতেই যেন সাম্রাজ্যটি নির্মূল হয়ে যাচ্ছিল। থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর সময়েও সাম্রাজ্যের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না, যা তার পরের দেড়শ বছরের মধ্যে দাঁড়ায়। কিন্তু সাম্রাজ্যের অবস্থা এতটা করুণ আগে কখনও হয়নি। দেড় শতাব্দী ধরে সম্রাট এবং সেনাপ্রধানদের সমস্ত চেষ্টা, তাদের অমানুষিক পরিশ্রম বলতে গেলে অরেলিয়ান, ডিওক্লেশিয়ান, কন্সট্যান্টাইন, জুলিয়ান, ভ্যালেন্টিনিয়ান এবং থিওডােসিয়াসের পরিবারের বংশগত ধারা অটুট রাখতেই ফুরিয়ে গেছে। পারস্য তখনও সিরিয়ার পথ নির্দেশনার জন্য বসে আছে, জার্মান জাতি দানিয়ুবের তীরে যখনই পারছে তখনই আক্রমণ করে চলেছে (হানরাও তাদের তাল দেয়ার জন্য সবসময় তৈরি আছে), অরাজকতা সৃষ্টির একটি সুযােগও কেউ হারায়নি। এরকম ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে, এমনকি ডিওক্লেশিয়ানের রাজত্বের পরের অর্ধশত শতাব্দীর অরাজকতা সত্ত্বেও, সাম্রাজ্যে এমনও জায়গা ছিল যেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। মিশর এবং সিরিয়া বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। সেই অরাজকতার সময়ে সেই স্থানগুলাের ধনী মানুষেরা আরও ধনী হতে লাগল, আর দরিদ্ররা হয়ে পড়ল আরও বেশি দরিদ্র। মােটের ওপরে রাজকীয় আইনকানুনের জাহাজ যেন ডুবতে বসেছিল, প্রতি দশকে যেন আরও একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিল, বলতে গেলে কোনােরকমে ভেসে ছিল। জনসংখ্যা আরও দ্রুত কমে গেল। শহরগুলাে যতটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। শাসনব্যবস্থা দুনীতির চাপে পুরােপুরি অকার্যকর এবং অদক্ষ হয়ে পড়ল।

প্যাগান সাহিত্য ও দর্শনের সমাপ্তি, খ্রিস্টীয় ল্যাটিন সাহিত্যের বিকাশ, এবং খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব

প্যাগান সাহিত্যিক সিমাকাস ও আসোনিয়াস, ইহুদিদের শান্তিপূর্ণ ধর্ম পালনের অবসান ও দার্শনিকদের দার্শনিক চিন্তা বন্ধ

জ্ঞানী মানুষদের জীবনযাত্রার মানও সে সময় অনেক নেমে গিয়েছিল। প্যাগান সাহিত্য শেষবারের মতাে সামান্য ধপ করে জ্বলে উঠে যেন নিভে যাওয়ার উপক্রম হলাে। তাদের শেষ উল্লেখযােগ্য সাহিত্যিক ছিলেন কুইন্টাস অরেলিয়াস সিমাকাস যিনি ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্যাগান সাহিত্যে রােমের বিখ্যাত এবং প্রগতিশীল সাহিত্যিক। তিনি সরকারি উচ্চপর্যায়ে কাজ করেন এবং সততা আর মানবিকতার জন্য তার নামডাক হয়। প্যাগান ধর্মের বিষয়ে লেখালেখির পক্ষে তিনি ছিলেন নির্ভীক এবং খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক বিকাশের আগমুহূর্তে জনগণের উদ্দেশে উত্তরের আশা না করে তিনি অনেকগুলাে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তিনি প্যাগান সিনেটরদের প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া দলটির নেতৃত্ব দিতেন এবং গ্রেশিয়ান যখন সিনেট থেকে যুদ্ধজয়ের বেদিটি সরিয়ে ফেলেছিলেন, তখন সিমাকাস দ্বিতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ানের কাছে একটি অভিযােগপত্র লিখেছিলেন। রােমের প্রাচীন ঐতিহ্যের বেদিটি আবার সেখানে সসম্মানে বসানাের জন্য তিনি দাবি জানিয়েছিলেন। এসব নিয়ে নানান ঝামেলা হলেও পরে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তিনি রােমে উচ্চপদেই চাকরিরত থাকেন। শেষে তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া রােমান কবি ডেসিমাস ম্যাগনাস অসােনিয়াস প্যাগান ধর্মের পক্ষে কিছু লেখালেখি করেছিলেন। তিনি ৩১০ খ্রিস্টাব্দে বুর্ডিগালায় (বর্তমান বাের্ডিওক্স) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শাস্ত্র শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবা ১ম ভ্যালেন্টিনিয়ানের নিজস্ব চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসক বাবার সন্তান ডেসিমাস তরুণ গ্রেশিয়ানকে শিক্ষাদানের কাজে নিয়ােজিত হন। অফিসে সবাই যেন তাকে মেনে নেন, সেজন্য সেখানে তিনি মুখে মুখে খ্রিস্টান সাজার চেষ্টা করতেন। গ্রেশিয়ানের শাসনামলে তিনি অনেক সম্মান এবং উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু গ্রেশিয়ানের মৃত্যুর পরে তিনি তার নিজস্ব শহরে গিয়ে থাকা শুরু করেন। তিনি আশি বছর বয়সে মারা যান এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত বেশ নিম্নমানের কিছু কবিতা রচনা করে যান। খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে বিভিন্ন স্থানে দলে দলে ইহুদিরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ধর্মীয় উপাসনা করতে পারত। খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে সেটি যেমন বন্ধ হলাে, কিছু গ্রিক দার্শনিকও তাদের চিন্তা চেতনা বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। ডায়োজেনিস এবং সাইনিক তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য।

খ্রিস্টান ল্যাতিন সাহিত্যিক জেরোমি ও ল্যাতিন ভাষায় বাইবেল ভালগেট

খ্রিস্টান ল্যাটিন সাহিত্য এর মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। মিলানের লেখক অ্যাম্ব্রোস প্রচুর লিখেছিলেন, তবে জেরােমির (ইউসেবিয়াস সফ্রোনিয়াস হিয়েরােনিমাস) লেখা ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জেরােমি ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ইলিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যদিও খ্রিস্টান পরিবারে জন্মান, কিন্তু প্যাগান শিক্ষা এবং সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। বাইবেলভিত্তিক রচনায় ল্যাটিন ভাষার এলােমেলাে আর দুর্বল ব্যবহার তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বাইবেলকে নির্ভুল ল্যাটিন ভাষায় লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই চিন্তা মাথায় রেখে তিনি পূর্বদিকে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি কেবল গ্রিক শিখেছিলেন, তাই নয়, শিখেছিলেন হিব্রুও। একই সাথে তিনি বাইবেলকে ল্যাটিনের প্রকৃত রূপে অনুবাদ করেছিলেন। জ্ঞানী র‍্যাবিসের ভূমিকাও তিনি অস্বীকার করেননি। বাইবেলের যে প্রকাশনাটি “ভালগেট” নামে পরিচিত সেটি তার প্রচেষ্টার ফসল। (এর নামকরণের কারণ হলাে, “ভালগার” মানে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ভাষায়, অর্থাৎ সে সময়ে পশ্চিমে মানুষের মুখের যে ভাষা ছিল তা হলাে ল্যাটিন। তিনি বাইবেলের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ যে হিব্রু বা গ্রিকে রচিত হয়েছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসে তাকে একটি পরিপূর্ণ ল্যাটিন আকার দিতে সক্ষম হন। তখন থেকেই খ্রিস্টান নাইসিনীয় ও পরবর্তীতে ক্যাথোলিক চার্চগুলােতে “ভালগেট” ব্যবহৃত হয়ে আসছে।)। জেরােমি রােমে একবার ফিরে এসেছিলেন কিন্তু বেশিদিন থাকেননি। তিনি তারপরে আবার পূর্বদিকে যাত্রা করেন এবং বেথেলহামে ৪২০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব

সাধারণত উপাসনালয়ের পুরােহিতরা খুব আড়ম্বরবিহীন জীবনযাপন করতেন। এক দিক দিয়ে এছাড়া তাদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না, কারণ বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে জীবনের প্রয়ােজনীয় সবরকম সুযােগ সুবিধাও পাওয়া যেত না; অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের লােকালয়ে ছিল তাদের বাস। আবার তারা যেভাবে জীবনযাপন করতেন, তাতে বলতে গেলে স্বেচ্ছায় শরীর এবং মনের সকল চাহিদার উর্ধ্বে উঠে যেতেন। তারা মনে করতেন এভাবে নিজের সমস্ত ইচ্ছে থেকে মুক্ত হলেই তারা পুরােপুরি বিধাতার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করতে সক্ষম হবেন। শরীর এবং মনের কামনা-বাসনাকে অগ্রাহ্য করার এই পদ্ধতিকে তারা “সন্নাস ব্রত” (“অ্যাসেটিসিজম”) বলে উল্লেখ করেছেন যা গ্রিক শব্দ “অ্যাস্কেটিকস” থেকে এসেছে যার অর্থ গ্রিসে ছিল “শরীরচর্চা করা”। গ্রিক খেলােয়াড়রা যখন স্বাস্থ্য এবং প্রতিযােগিতার জন্য অনুশীলন করতেন তখন তাদের জীবনের যাবতীয় বিলাসিতা ভুলে যেতে হতাে। এছাড়া অন্য অর্থে “অ্যাসেটিক” বলতে, প্রশিক্ষণে রত কোনাে ব্যক্তিকে বােঝায়। প্রাথমিক পর্যায়ের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা বলতে গেলে কিছুটা সন্নাসী ধরনের ছিলেন। কারণ তারা রােমান সমাজের আরাম-আয়েস, আনন্দ উদযাপনের নিয়মরীতি বা প্রতিমা পূজাকে অনৈতিক মনে করতেন। যাই হােক, খ্রিস্টধর্ম যতই সফলতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তাদের আচার আচরণও তেমন সন্নাসীর মতাে হয়ে যাচ্ছিল। তখন বিষয়টি এমন হয়ে দাড়াল যে, কেবল খ্রিস্টান হওয়াই যেন যথেষ্ট নয়, সন্নাসী হতে হবে।

সন্ন্যাসী অ্যান্থনি ও সিমিওন

খ্রিস্টান সন্নাসীদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযােগ্য সন্নাসী হলেন অ্যান্থনি, যিনি ছিলেন মিশরের একজন নাগরিক। তিনি সম্ভবত একশ বছর বেঁচে ছিলেন, ২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৫০ সাল পর্যন্ত। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মরুভূমির মাঝখানে একা, বিলাসবর্জিত জীবনযাপন শুরু করেন। পরবর্তীকালে লেখকেরা তাকে নিয়ে নানান নাটকীয় কাহিনী লিখেছিলেন। (যেমন অ্যানাসিয়াস লিখেছিলেন তাকে নিয়ে। লেখক এরিয়ানিস্টদের বিরুদ্ধে অ্যান্থনির আবেগী বিরােধিতা খুব উপভােগ করতেন।) অ্যান্থনি তার জীবনে সমস্ত ভােগ বিলাস থেকে অনেক দূরে থাকতেন। অ্যান্থনির কথা সে যুগে এবং পরেও অনেক উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেজন্যেই মিশরের মরুভূমি ছিল সন্ন্যাসীদের আখড়া। এর জনপ্রিয়তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সত্যিকারের ধার্মিকদের কাছে, এই সন্ন্যাসব্রত এবং তার পথে জীবনের সমস্ত ভােগ বিলাস ত্যাগের ব্রত অবশ্যই একটি আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। তারা মনে করতো এটাই পরকালে স্বর্গে যাওয়ার সহজ রাস্তা। সন্ন্যাসব্রত পালন করতে গিয়ে কেউ কেউ তার নিজস্ব পৃথিবীতে এমন ভাবে ডুবে যান যে তার বাইরের জগতের সাথে তার আর কোনাে সম্পর্ক রাখতেন না। বাইরের সবার কাছে এদের জীবনপদ্ধতি অনেক সময়ই খুবই অর্থহীন মনে হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সিমিওন নামে একজন সিরিয়ান সন্নাসীর কথা। তিনি ৩৯০ থেকে ৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং খুবই অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য এক সন্নাস জীবনযাপন করেছেন। তিনি উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেন এবং তার উপরে বসবাস আরম্ভ করেন। তিরিশ বছরব্যাপী দিনে এবং রাতে, সব রকমের আবহাওয়ায় তিনি স্তম্ভের উপরেই ছিলেন, কখনও নেমে আসেননি। তাকে তার বসবাসের পদ্ধতি অনুসারে সিমিওন স্টাইলাইটস (গ্রিক ভাষায় স্টাইলাইটস শব্দের অর্থ স্তম্ভ) নামে ডাকা হতাে। তিনি যেরকম জীবন কাটান সেটি বেশিরভাগ মানুষের জন্যই চিন্তার অতীত।

সন্ন্যাসবাদের সমালোচনা ও বিশপ বেসিলের সংস্কারের মাধ্যমে বেসিলীয় সন্ন্যাসবাদীদের মানব কল্যানের নিমিত্তে সামাজিক কর্মে যোগদান

অবশ্যই বেশিরভাগ মানুষই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে যে, এ ধরনের একটি জীবনযাপন সত্যিকার অর্থে বিধাতাকে কতটুকু প্রসন্ন করতে পারে। এছাড়াও নিভৃতচারী একাকি সন্নাসীরা, যারা স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছিলেন, তারা যেমন পৃথিবীর লােভলালসা পরিহার করতে পেরেছিলেন তেমনি আরেকভাবে ভাবলে তারা জীবনের দায়িত্ব এবং পরিশ্রমও পরিহার করেছিলেন। সমাজের প্রতি দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবল নিজের আত্মার শান্তির জন্য গ্রহণ করা এরকম সন্ন্যাসব্রতকে অনেকেই সমালোচনা করতে শুরু করলো। সিসারির বিশপ বেসিল তাই এই সন্নাস্বতের পাশাপাশি আরেকটি ধ্যানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এশিয়া মাইনরের ক্যাপাডােসিয়ার রাজধানী ছিল সিসারি। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে বেসিল এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যারা চার্চের ইতিহাসে অনেক অবদান রেখেছেন। বেসিল ছিলেন সন্নাসীদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। সচক্ষে তাদের জীবনাচরণ দেখার ইচ্ছে থেকে তিনি মিশর এবং সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের শক্তিকে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করার জন্য এর চেয়ে আরও গ্রহণযােগ্য পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে একবারে একাকি থাকার চেয়ে একটি ছােট দল মানুষের মাঝখানে থাকা হয়তাে বেশি উপযুক্ত হতে পারে। তিনি একটি দল গঠন করেন। কিন্তু দেখা যায়, সেই পুরাে দলটিই জীবনের লােভ লালসা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছে। অবশ্য তিনি সেই দলটিকে কেবল ধ্যানে মগ্ন হয়ে না থেকে সামাজিক কাজকর্ম এবং প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকতে বলেছিলেন। এছাড়া তিনি উল্লেখ করে দিয়েছিলেন যে, তারা যে কাজ করবে তা যেন কেবল বিধাতার প্রতি উৎসর্গের জন্য না করে, বরং তা করতে হবে মানুষের মানবিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে। এর অর্থ দাঁড়ায় সেই দলটিকে একটি লােকালয়ের মধ্যখানে বসবাস করতে হবে, যাতে করে তাদের ভালাে এবং মানব কল্যাণে করা কাজের ফসল সেখানকার মানুষ পেতে পারে। একই সাথে পৃথিবীতে পাপ পরিহারের সাথে সাথে সন্নাসীরা পৃথিবীর মানুষের জন্য ভালাে কিছু করে যেতে পারেন বলে তিনি মনে করতেন। যাই হােক, এই ধরনের বেসিলিয়ান (বেসিলের জীবনাচরণ অনুযারী) সন্ন্যাস সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে বেশি তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে ৫ম শতাব্দীতে এটি ইতালিতে জনপ্রিয় হয়।

আর্কাডিয়াস (৩৮৩-৪০৮ খ্রি.), অ্যানোরিয়াস (রা. ৩৯৩-৪২৩ খ্রি.) এবং রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব

আর্কাডিয়াস ও অ্যানোরিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ, এবং রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্তি

থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর পরে তার দুই তরুণ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। আর্কাডিয়াস ছিলেন তার বড় ছেলে, যার বয়স তখন ছিল সতের। তিনি কন্সস্ট্যান্টিনােপােলে বসবাস করে সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে শাসন শুরু করেছিলেন। অনােরিয়াস ছিলেন ছােট ছেলে, যিনি মিলানে থাকতেন এবং পশ্চিম দিকের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। আর্কাডিয়াস এবং অনােরিয়াস ছিলেন বয়সে তরুণ, দুর্বল এবং অসমর্থ। তারা যখন ক্ষমতা হাতে নেন, থিওডােসিয়াসের আদেশ অনুয়ায়ী তারা ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতিরক্ষার আওতায়। গ্যালিক সেনাপ্রধান রুফিনাসের দায়িত্বে ছিলেন আর্কেডিয়াস এবং স্টিলিকো ভ্যান্ডালের দায়িত্বে ছিলেন অনােরিয়াস। সেই দুই সেনাপ্রধানের মধ্যে সবসময় বিরােধ লেগে ছিল। রুফিনাস পূর্ব ইলিরিয়া দখল করেন আর স্টিলিকো সেটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তাদের বিরােধ নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিতে সক্ষম হননি। ডিওক্লেশিয়ানের শতাব্দীর পর থেকে, এটা সত্যি যে কাগজে কলমে সাম্রাজ্যকে এভাবে দুই ভাগে ভাগ করে শাসনকার্য চালানাে হচ্ছিল। বাস্তবে ছিল একই সাম্রাজ্য এবং যুগ্ম সম্রাট। যেমন ধরা যাক, কোনাে আইন যখন পাশ করা হতাে তখন, দুজন সম্রাটের সম্মতিতেই তা করা হতাে। কিন্তু অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ শতাব্দী থেকে রােমান সাম্রাজ্যে দুজন কনসল নির্বাচিত করার যে নিয়ম চলে আসছিল, তা তেমনই ছিল। একজন কনসল রােমে থাকতেন এবং আরেকজন থাকতেন কন্সট্যান্টিনােপলে। (এই নিয়ম ৫৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। তাই সবাই বলে যে এই প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার বছরেরও বেশি ধরে কার্যকর ছিল।)। বাস্তবে থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর পর থেকে সাম্রাজ্য পুরােপুরি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দুই অংশের মধ্যে ক্রমাগত গণ্ডগােল লেগে থাকে। এক অংশের প্রণীত আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য অংশের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াত। এই ধরনের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সম্রাটেরা দুজনই নিজেদের দিকের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে ভালাে কিছু হাতিয়ে নিতেন। বিশেষ করে প্রাদেশিক বৈরী ভাব সাম্রাজ্যের দুই অংশের মধ্যে ঝামেলা আরও বাড়িয়ে তুলত। ইলিরিয়া ছিল পশ্চিম দিকের একটি শহর যা প্রকৃতপক্ষে পূর্ব আর পশ্চিম অংশের মাঝখানে সীমানা হিসেবে কাজ করত। অবশ্য কন্সট্যান্টিনােপলের শাসক এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। এই ঘটনার কারণেই ইলিরিয়াকে নিয়ে দুই অংশের শাসকের মধ্যে শক্রতার সূত্রপাত হয়। এই শত্রুতা তাদের এমন পর্যায়ে নিয়ে গেল যে বাস্তবে সাম্রাজ্যটি দুই ভাগ হয়ে গেল। দুই অংশে দুই উচ্চাভিলাষী এবং অসহনশীল সম্রাট কেবল কাগজে কলমে নয়, সত্যিকার অর্থে সাম্রাজ্যকে দুই ভাগ করে ফেললেন।

পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিশপদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ ও জন ক্রিসস্টম

এছাড়াও সাম্রাজ্যের দুই ভাগের মধ্যে ছিল আরেক ধরনের দলাদলি (থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর সময়েও যা তেমন প্রকটভাবে দেখা যায়নি) তা অনেক বেশি মাথাচারা দিয়ে উঠল। এই দলাদলি ছিল ধর্মীয়। এভাবে পূর্ব এবং পশ্চিমের, অর্থাৎ রােম এবং কন্সট্যান্টিনােপলের বিশপদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়ে গেল। এই ধর্মীয় দলাদলি এতই তীব্র ছিল যে তা সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশকে একেবারে আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিলাে। জন নামের গ্রিক চার্চগুলাের ফাদারদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বিশপকে কেন্দ্র করে এই তর্কবিতর্ক চরমে পৌঁছে গেল। বিশপ জনকে ক্রিসস্টম (“সােনার মুখ”) নামে ডাকা হতাে। এরকম নামকরণের কারণ ছিল তার বক্তৃতা। অসাধারণ বাগ্মী এই বিশপের কথা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। জন ক্রিসস্টম ৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্টিয়কে একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা দেখে সহজেই অনুমান করা যেত যে তিনি একজন অসাধারণ আইনজীবী হতে পারতেন। যাই হােক, ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের জন্য কর্ম স্থির করেন এবং নিভৃতচারী সন্ন্যাসী খ্রিস্টানে পরিণত হন। বছরের পর বছর তিনি নিজেকে অ্যান্টিয়কের পূর্বদিকের এক মরুভূমিতে লুকিয়ে রাখেন। সেখানে ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে সেখান থেকে স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয় কেবল অসুস্থতার কারণে। ফিরে এসে তিনি চার্চের ফাদার হয়ে যান। তিনি অসাধারণ দক্ষতায় বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার জ্ঞান নয়, তার বলার মাধুর্যই তাকে জনপ্রিয় করেছিল। তিনি নিজের জীবন একটি আদর্শের উপরে চরমভাবে নির্ভর করে কাটিয়েছেন। নিজের সমস্ত ধনদৌলত তিনি হাসপাতাল, স্কুল স্থাপন করতে এবং দরিদ্রদের সেবায় ব্যয় করেছেন। এসবের মাধ্যমেই তিনি মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে, থিওডােসিয়াসের মৃত্যুর তিন বছর পরে কন্সট্যান্টিনােপলের ধর্মগুরুর মৃত্যু হয়। জন ক্রিসস্টম সে জায়গায় মনােণীত হন। এরপরে তিনি তার প্রভাব আরও বেশি করে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন এবং তা বিস্তার লাভ করল। তার ধর্মোপদেশ, অমরত্ব এবং বিলাসিতার প্রতি বিরুদ্ধ উচ্চারণ দিনে দিনে বলিষ্ঠ হতে লাগল। তিনি ধর্মযাজকদের কৌমার্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিশেষ করে একজন কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেননি তবে সকলেই তার ধাঁরালো নির্দেশের আওতায় পড়ত। (কখনও তার যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে এই কারণে যে তিনি ছিলেন ভয়ানক বদরাগী) তাই স্বাভাবিকভাবে তার চার্চের ধর্মগুরুদের মধ্যেই কারও কারও সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল। বিশেষ করে যাদের ওপরে তার নিয়মের বােঝা পড়ল তারা ক্ষেপে গেলেন। যেমন অ্যালেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ, থিওফিলাস ছিলেন বিলাসী। তাই ক্রিসস্টমের উপরে তিনি খুব ক্ষিপ্ত হলেন। ঘটনাক্রমে থিওফিলাস ছিলেন সম্রাজ্ঞী ইউডােক্সিয়ার প্রিয়, যিনি স্বামীকে সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। আবার ওদিকে ইউডােক্সিয়া ক্রিসস্টমকেও পছন্দ করতেন তার ভাষণের জন্য। ক্রিসস্টমের সমালােচনার তীরে বিদ্ধ হলেও ইউডােক্সিয়া অবশ্য মােটামুটি ভালােভাবেই তার জীবন কাটিয়েছেন।

জন ক্রিসোস্টমের নির্বাসন

৪০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশেষ সভা ডাকা হয়, যেখানে থিওফিলাস, জন ক্রিসস্টমকে অরাজকতার অভিযােগে অভিযুক্ত করেন। অপরাধের একটি বিচারকাজের ব্যবস্থাও সেখানে করা হয়। জন ক্রিসস্টম সেখানে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানান এবং সে কারণে তাকে আগেভাগেই ধর্মগুরুর পদ থেকে বহিষ্কার করে বন্দী করা হয়। মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে ইউডােক্সিয়া দুদিন পরে তাকে আবার ডেকে আনেন। সেটি অবশ্য ছিল মানুষের বিক্ষোভ শান্ত করার একটি চেষ্টামাত্র। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি সভা ডাকা হলাে যেখানে নাক গলানাের মতাে জার্মান লােকদের কন্সট্যান্টিনােপলে ডাকা হয়নি। কারণ তখন জন ক্রিসস্টম কিংবা থিওফিলাস, যেই জিতুক না কেন, সেনাদের তাতে কিছু আসতো-যেতো না। তারা কেবল জানত আদেশ প্রতিপালন করতে। সেই আদেশ যদি হয় নিরীহ মানুষকে হত্যা করার, তবে তাদের তাই করতে হতাে। জনগণ এই বিষয়ে আগে থেকেই জানত, তাই তাদেরও কিছু বলার ছিল না। দ্বিতীয়বারের মতাে বন্দীদশায় পড়লেন জন ক্রিসস্টম। কন্সট্যান্টিনােপল থেকে চারশ মাইল দূরে, এশিয়া মাইনর বাড়তে বাড়তে যেখানে পূর্বদিকের সীমানায় গিয়ে পৌঁছেছে, জন ক্রিসস্টমকে সেখানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। যদিও সেখানে থাকার সময়ে সাম্রাজ্যের সকল অনুসারীর সাথে তিনি সবসময় যােগাযােগ রক্ষা করতেন। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার যে তিনি সেখানে বসে নির্ভীকভাবে রােমের বিশপের কাছে এবং পশ্চিমের সম্রাটের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি তাদের আবেদন জানিয়েছিলেন তার অপরাধটি আবার নতুন করে বিবেচনা করার জন্য। কন্সট্যান্টিনােপলের বিচারালয়ের গ্রহণযােগ্যতার পক্ষে এটি ছিল জঘন্যতম একটি কাজ। এই কাজের মাধ্যমে তিনি পশ্চিমের সম্রাটের বিশালতা প্রমাণ করেন এবং ধর্মীয় অঙ্গনে রােমের বিশপের সর্বোত্তম অবস্থানকে নিশ্চিত করেন।

জন ক্রিসোস্টমের মৃত্যু, তার সিদ্ধপুরুষে পরিণত হওয়া, কনস্ট্যান্টিনোপলের ধর্মীয় গুরুত্ব হ্রাস ও রোমের গুরুত্ব বৃদ্ধি

ইউডােক্সিয়া ততদিনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু বিচারালয়ে আর যারা ছিলেন, তারা অনুমান করেছিলেন যে এই ধাঁরালাে চিন্তার অধিকারী বৃদ্ধ মানুষটিকে কোনােভাবে চুপ করাতে হবে। তাকে আগের চেয়ে আরও দূরবর্তী স্থানে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। এবারে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলাে সাম্রাজ্যের উত্তরপূর্ব দিকের প্রান্তে। ৪০৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পরের বছর পশ্চিমের সম্রাট আর্কাডিয়াসও মৃত্যুবরণ করেন। তবে জনের মৃত্যুও কন্সট্যান্টিনােপলের মানুষদের ধর্মীয় পুরনাে চিন্তাধারা থেকে বের করে আনতে পারল না। জনের সমস্ত স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ নতুন কোনাে ধর্মগুরুকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আর এটি করা ছাড়া অন্য কোনাে উপায় ছিল না। জনের মৃতদেহ তার মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে পূর্ণ সম্মানের সাথে কন্সট্যান্টিনােপলে ফেরত আনা হয়েছিল। তার সব অপরাধ যেন উল্টো হয়ে গেল। তাকে একজন ধর্মীয় সিদ্ধপুরুষ বলে ধরে নেয়া হলাে। ওদিকে আর্কাডিয়াস এবং ইউডােক্সিয়ার যে পুত্রসন্তানেরা তখন সিংহাসনে আসীন ছিলেন তারা পিতার অপকর্মের জন্য একটি প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান আয়ােজন করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তেমন কোনাে লাভ হলাে না। কন্সট্যান্টিনোেপলের ধর্মীয় গুরুত্ব কমতেই থাকল। অবশ্যম্ভাবীভাবে কন্সট্যান্টিনােপলের ধর্মীয় গুরুত্বও কমে গেল। এভাবে রােমের বিশপের গুরুত্ব গেল বেড়ে। পরেরটাই বলতে গেলে সত্য হলাে। পশ্চিমা ধর্মগুরুদের মধ্যে মিলানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার প্রতিযােগিতায় তখন এক বিরাট ওলটপালট হয়ে গেল।

ভিসিগথদের নেতা অ্যালারিক ও থিওডােরিক এবং ভিজিগথিক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

অ্যালারিকের গ্রিসে আক্রমণ ও তদকালীন গ্রিসের অবস্থা

তিনি জানতেন সেখানে আর বেশি ঘাটাঘাটি করে কোনাে লাভ নেই। তাই কন্সট্যান্টিনােপল বাদ দিয়ে তিনি মােটামুটি দুর্বল গ্রিসের দিকে রওনা দিলেন। তিনি জানতেন সেখানে তাকে ঠেকানাের কেউ নেই। গ্রিস তখন অন্য কিছুর জন্য বিখ্যাত না হলেও প্রায় একশ বছর ধরে যে সেখানে শান্তি বজায় ছিল, সেটা সবাই জানত। গ্রিস তখন আগের সেই ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে এসেছে ঠিকই তবে তখনও সেই আগের দিনের বিলাসিতা আর প্রাচুর্যের স্বপ্নে বিভাের। বেশিরভাগ প্রাচীন মন্দির এবং মূর্তি বা স্মারক স্থাপত্য ভেঙে পড়েছিল সময়ের সাথে সাথে। কিছু কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এসবের কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ গ্রিসকে পাশ কাটিয়ে নতুন শহর কন্সট্যান্টিনােপলের দিকে ঝুঁকেছিল, আর কখনও বা নতুন খ্রিস্টান শাসকের সিদ্ধান্তও এর পেছনে কাজ করেছে। মন্দিরগুলাে জনশূন্য পড়ে ছিল, ডেলফি নিজেই যেন ভেঙেচুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। খ্রিস্টানদের হাতে তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ইলিউসিনিয়ান ঐতিহ্য স্বাভাবিকভাবেই খুব হেলাফেলা করে দেখাশােনা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে সময়ে গথিক জাতির দল অ্যালারিকের সাথে, তারা যদিও নব্যতান্ত্রিক বা এরিয়ানিস্ট খ্রিস্টানই ছিল, কিন্তু ইলিউসিস মন্দিরে ঢুকে পড়ল। ৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১১৪৯ সালে) সেরেসের পুরনাে মন্দিরটি ভেঙে পড়ল আর এভাবেই সেই প্রাচীন কীর্তিটির সমাপ্তি হলাে।

হিপোর অগাস্টিন, সম্রাট তৃতীয় ভ্যালেন্টিনিয়ান (রা. ৪২৫ – ৫৫ খ্রি.) ও আফ্রিকায় গাইজারিকের ভ্যান্ডাল রাজ্য

আফ্রিকায় ক্ষমতায় ভ্যান্ডালরা

স্পেনের ভ্যান্ডালেরা ভিসিগথদের আগ্রাসনের কারণে কোণঠাসা হয়েছিল। দক্ষিণ দিকে প্রদেশগুলােতে নানান বাধা বিপত্তির মধ্যেও কোনােরকমে নিজেদের জন্য একটু জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেখানকার পরিস্থিতি ছিল তাদের অনুকূলে এবং নিজেদের জন্য তারা বেশ ভালাে অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সুবাদে তারা পরবর্তী একশ বছরব্যাপী ক্ষমতার চর্চা করতে পেরেছিল। স্থানটি ছিল রােমান সাম্রাজ্যে আফ্রিকার অংশ। আফ্রিকার উত্তর দিকের সমুদ্রতীর থেকে শুরু করে মিশরের পশ্চিমভাগ এবং কার্থেজের মতাে বড় শহর সেখানকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অগাস্টিন ও তারুণ্যে তার ম্যানিকিজমে ঝুঁকে পড়া

আফ্রিকা আগে থেকেই খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাদের অবদানের ব্যাপারে সমৃদ্ধ ছিল। বলতে গেলে পিউরিটান নব্যতন্ত্রের কেন্দ্রই ছিল আফ্রিকা। এছাড়া ছিল মন্টানিস্টস আর ডােনেটিস্টদের জন্মস্থান। প্রথমদিকের খ্রিস্টান লেখক টেরুলিয়ান আর সিপ্রিয়ানের মতাে মানুষরাও জন্মেছিলেন সেখানে। তখন ইতিহাসে রােমান সাম্রাজ্যের পতনের মুখে আফ্রিকা ছিল চার্চের ল্যাটিন ফাদার অগাস্টিনের (অরুলিয়াস অগাস্টিনাস) আবির্ভাবের স্থান। অগাস্টিন ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে, কার্থেজের ১৫০ মাইল পশ্চিমে একটি ছােট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন প্যাগান এবং তার মা ছিলেন একজন খ্রিস্টান। তিনি নিজে একসময় নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে ততটা স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলেন। তারপর তারুণ্যে পৌঁছে তিনি এক নতুন ধর্মের প্রতি ঝুঁকে যান, যার নাম ম্যানিকিজম

ম্যানিকিজম উত্থান ও শীর্ষে পৌঁছনো

ম্যানিকিজম ধর্মের নাম হয়েছিল তার উদ্ভাবনকারী ম্যানির নামে। ২১৫ সালে পারস্যে মানি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি নতুন ধর্মীয় ধারা সৃষ্টি করেন যাতে প্রাচীন মিথ্রাইজম খুব জোরালােভাবে এসেছিল এবং একইসাথে এসেছিল কিছু পারস্যের ধ্যানধারণা। সেই ধর্মে আলাে এবং অন্ধকারের প্রভাব ছিল সমান অর্থাৎ একই সাথে ভালাে এবং মন্দ শক্তির সমান অস্তিত্ব ধরে নেয়া হতাে। (ইহুদিরাও পারস্যের শাসনামলে এই ধরনের দ্বৈত শক্তির প্রভাব মেনে নিয়েছিল। সেই সময় থেকেই সমস্ত মন্দ কাজের বাহক হিসেবে স্যাটানকে বলা হতাে “ অন্ধকারের দেবতা”। স্যাটান যেন ঠিক বিধাতার মতােই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল মানুষের কাছে। যদিও না ইহুদিরা, না খ্রিস্টানরা, কেউই কখনও স্যাটানকে বিধাতার সমান ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেনি।)। পারস্যে সবসময় এই দ্বৈত ক্ষমতার অস্তিত্ব থাকলেও ম্যানি ইহুদি ধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম থেকে যা পেয়েছিলেন তার মাধ্যমে নিজের সৃষ্টি করা ধর্মে খুব শক্তভাবে বিষয়টিকে বর্ণনা করলেন। যদিও পারস্যের ধর্ম এই ধর্মের মধ্যে অনেকটা প্রচ্ছন্নভাবে ছিল কিন্তু খ্রিস্টধর্ম রােমে প্রধান ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার আগে ম্যানির ধর্ম বেশ প্রচার পেয়েছিল। ডিওক্লেশিয়ানের চোখে ম্যানির ধর্ম ছিল খুবই সন্দেহজনক একটি সংস্কৃতি। তিনি মনে করতেন রােম দখল করার জন্য এটি পারস্যের একটি চাল। ২৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাই এই ধর্মকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে একটি প্রচারাভিযান চালান। এই ঘটনাটি ঘটেছিল তার খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালানাের একই ধরনের ঘটনার ছয় বছর আগে। বলা বাহুল্য, কোনাে প্রচারাভিযানই কোনাে কাজে আসেনি। আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা বলতে গেলে একদিক দিয়ে ম্যানির ধর্মের প্রচারের জন্য সুবিধাই বয়ে এনেছিল। খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সম্রাট তার হাত বাড়িয়ে দিলেন খ্রিস্টধর্মের একটি বিশেষ দলের প্রতি। সেটি ছিল নব্যতন্ত্র বা এরিয়ানিজম। পরে মূলধারার নাইসিনীয়রা সম্রাটের আনুকূল্য পেয়েছিল। যখন যে দলের প্রতি সম্রাটের বিরাগ ছিল তারাই অনিরাপদ বােধ করত এবং সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইত। তাই তখন দুই দলের খ্রিস্টান থেকেই প্রচুর মানুষ ম্যানির ধর্ম গ্রহণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভালাে আর মন্দ শক্তির মধ্যে যেন এক তুমুল লড়াই লেগে গেল। যারাই সেই ধর্ম গ্রহণ করেছিল, মনে করত আলাে এবং অন্ধকার জগতের মধ্যে যুদ্ধে তাদের জিততে হবে, কারণ পৃথিবীতে ইতিবাচক শক্তি কেবল তারাই। যারা তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতি বিরক্ত আর সন্দেহের চোখে তাকাত, তাদের কাছে ম্যানির ধর্ম এক ধরনের মুক্তি মনে হলাে। ম্যানির ধর্ম এভাবে শীর্ষে পৌঁছল অগাস্টিনের সময়ে।

অগাস্টিনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ও তার চিন্তাধারা

অগাস্টিন নিজে ছিলেন নিও-প্লেটোনিজমের ভক্ত। তিনি প্লোটোনিয়াসের রচনা খুব মনােযােগ দিয়ে পড়তেন। ম্যানির ধর্ম এবং নিও-প্লেটোনিজম বলতে গেলে অগাস্টিনের উত্থানের জন্য দুটো বিশেষ ধাপ। তবে সত্য এবং আদর্শের জন্য তার ক্রমাগত অনুসন্ধান এবং তার মায়ের অনুপ্রেরণা এক পর্যায়ে তাকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি উৎসাহী করে তুলল। ৩৮৪ সালে তিনি মিলানে চলে গেলেন। (মিলান ছিল সে সময়ে পশ্চিম দিকের সাম্রাজ্যের ধর্মীয় কেন্দ্র। বিশপ অ্যাম্ব্রোস তাকে ধর্মান্তরিত করেন। ৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাপ্টাইজড বা অভিসিঞ্চিত হন। তিনি আফ্রিকায় ফিরে আসেন। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিপাে রেজিয়াসের বিশপের পদে অধিষ্ঠিত হন। স্থানটি ছিল তার জন্মস্থানের উত্তরে একটি ছােট সমুদ্রবন্দর। এখন একে ডাকা হয় বােন বলে। শহরটি এখন আলজেরিয়ার একটি শহর। অগাস্টিন ২৪ বছরের জন্য সেখানে ছিলেন। অগাস্টিনের জন্যই শহরটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অগাস্টিনের পাঠানো চিঠি সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে পাঠানাে হয়েছিল। নানারকমের আফ্রিকান ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার ছিলেন। তিনি চিঠি লিখে সকলকে জানিয়েছিলেন যে, প্রতিটি মানুষ এক জন্মগত পাপ নিয়ে জন্মায়। অ্যাডাম আর ইভ যখন সৃষ্টিকর্তার আদেশ অমান্য করে ইডেন গার্ডেন থেকে পৃথিবীতে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই সময় থেকেই মানুষ তার কাঁধে সেই পাপের বােঝা টেনে বেড়াচ্ছে। তাই মানুষ এর থেকে বাঁচতে চাইলে নিজেকে বাপ্টাইজড করতে পারে। তিনি সকলকে বােঝাচ্ছিলেন যে ব্যাপ্টিটাইজ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করা মানে নিজের অসীম জীবনের জন্য ভয়াবহ কুফল বয়ে আনা। তিনি পরকালে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন। তিনি মনে করতেন যে মানুষের ভাগ্য আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা আছে। বিধাতা নিজেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছেন। পৃথিবীতে এমন কিছুই ঘটে যা বিধাতার পরিকল্পনার বাইরে। বিশপ থাকা অবস্থায় শুরুর দিকে অগাস্টিন লিখিত বইয়ে নিজের দোষের কথা লিখে তা থেকে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। নিজের প্রাথমিক পর্যায়ের ভুলভ্রান্তি তিনি সেখানে গােপন করার কোনাে চেষ্টা করেননি। বইটি সবসময়ের জন্যই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল।

অগাস্টিনের চোখে রোম বিধাতার প্রিয় স্থান এবং প্যাগানদের বিরুদ্ধে তার খ্রিস্টীয় অ্যাপোলজি প্রদান

রােমে অ্যালারিকের হামলার পরে অগাস্টিন মনে করেছিলেন যে বিধাতার প্রিয় রাজ্যে যেন অসুরের হামলা হয়েছে। এটাকে তিনি খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে প্যাগানের হামলা হিসেবেই দেখতেন। প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা মনে করত যে রােম যে এত কাল ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মকে অবলম্বন হিসেবে নিয়ে আছে সেই কারণেই রােমের এই উত্থান। এখন যেহেতু রােমে খ্রিস্টধর্মের আগ্রাসন লক্ষ করা যাচ্ছে তাই প্রাচীন ধর্মের দেবদেবীরা রােমের মানুষের প্রতি রুষ্ট এবং সাম্রাজ্যটি ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। তারা আরও মনে করত যে খ্রিস্টধর্মের বিধাতা যদি মানুষকে রক্ষা করতে পারেই তবে সাম্রাজ্যের এই অবস্থা কেন? কেন তিনি অ্যালারিকের হামলার হাত থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করছেন না? অগাস্টিন তার বইয়ে তার জানা সমস্ত ইতিহাস আওড়েছেন। কী করে রােমান সাম্রাজ্য এবং রােম শহর কখন গড়া হয়েছে, কখন কার আবির্ভাবে ভেঙে পড়েছে, সব ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি বােঝাতে চেয়েছিলেন যে এই উত্থান এবং পতন যেন এই রাজ্যের ভাগ্যেই লেখা ছিল। কিন্তু অ্যালারিক যখন রােমে আক্রমণ করে তখন রােমের ধর্মের ওপরে তিনি কোনাে আঘাত করেননি। বরং রােমের ধর্মকে বেশ সম্মানের সাথে নাড়াচাড়া করেছেন। আর কখনই বা রােমের কোনাে ধর্মীয় বিধাতা কোনাে শহরকে অসভ্য জাতির আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন? সুতরাং যেদিক দিয়েই ভাবা হােক না কেন, রােম হলাে বিধাতার একটি প্রিয় স্থান যা হাজার আক্রমণের পরেও মাথা উঁচু করে টিকেছিল এবং থাকবে। রােমের ভাগ্যে যেন তেমনই লেখা। অগাস্টিনের একজন শিষ্যের নাম ছিল পলাস অরােসিয়াস। তিনি জন্মেছিলেন স্পেনের তারাগােনায়। অগাস্টিনের নির্দেশে তিনি পৃথিবীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বইটির নাম ছিল, “প্যাগানদের বিরুদ্ধে যে ইতিহাস”। এই বইটি তিনি অগাস্টিনকেই উৎসর্গ করেন। তিনিও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে রােমান সামাজ্য পড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলাে তার একের পর এক ভুল। খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং প্রসার রােমকে ধ্বংস করেনি, বরং রােমে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। অগাস্টিনের বিখ্যাত বইটি রচনা শেষ হয়েছিল ৪২৬ খ্রিস্টাব্দে। তারপর তার জীবনের বাকি বছরগুলােতে তিনি আগের চেয়ে ভালাে সময় দেখে যেতে পেরেছিলেন।

গাইজারিকের কাছে আফ্রিকায় রোমানদের পরাজয়, তাদের অগাস্টিনের হিপো দখল, অগাস্টিনের মৃত্যু

মৌরিতানিয়া আর নামিবিয়ার পাহাড়ী আর জংলা জায়গার মানুষ কখনও সমুদ্রপথে জাহাজের বহরের সাথে ভেসে আসা রােমান আইনকানুনকে মেনে নিত না। এছাড়াও সেখানে ছিল ডােনেটিস্ট এবং অন্যান্য খ্রিস্টান ধারা যেগুলাের প্রধান ধর্মগুরু ছিলেন হিপাের বিশপ অগাস্টিন। তিনি সবসময়ই যে কোনাে নব্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে নাইসিনীয়দের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন রকমের যুক্তি নিয়ে তৈরিই থাকতেন। অনেক পরে বনিফেসিয়াস নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং বিচারালয়ের কাছে ক্ষমা চান (ঈটিয়াস তখন গাউলের বাইরে অবস্থান করছিলেন)। তবে যাই হােক, ততদিনে গাইজারিক আফ্রিকার বেশিরভাগ স্থান নিজের অধীনে নিয়ে নিয়েছেন। রােমান সাম্রাজ্যের হাতে বাকি ছিল কেবল কার্থেজ, হিপাে আর সিট্রা (হিপাের দক্ষিণে একশ মাইল দূরে)। এরপর গাইজারিক ধীরে ধীরে হিপােয় আক্রমণ চালালেন। সমুদ্রপথে যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম আনতে হলাে বলে যুদ্ধটি সংগঠিত করতে করতে প্রায় দুই বছর লেগে গেল। সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশও একবার যুদ্ধের জিনিসপত্র টেনে নেয়ার জন্য কিছু যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে পশ্চিমকে সাহায্য করল। তবে তার পরেও কোনাে লাভ হলাে না। গাইজারিক পরপর দুবার বনিফেসিয়াসের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিলাে। ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে তারা হিপাে দখল করে নিলাে। অগাস্টিন অবশ্য এই দুর্ভাগ্য সচক্ষে দেখার জন্য জীবিত ছিলেন না। হিপােতে আক্রমণের শুরুর সময়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

থিওডােরিকের অস্ত্রোগথিক রাজ্য ও প্রথম ক্লোভিসের ফ্র্যাঙ্ক রাজ্যের উদ্ভব

ইতালি ও ইলিরিয়ায় অস্ট্রোগথিক রাজ্যের শাসন

৬ষ্ঠ শতকের শেষ সিকিভাগ যে ইতালির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। অ্যালারিকের হামলার সময়কার দুঃস্বপ্নের সময়টার সাথে তুলনা করলে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সেই সব কিছুর পরে থিওডােরিকের অধীনে ইতালিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গ। তিন শতাব্দী আগে মার্কাস অরেলিয়াসের শাসনামলের পরে তেমন সময় আর আসেনি। এক একবার এমনও মনে হচ্ছিল যে রােমান সংস্কৃতি বােধ হয় আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ করছে।

  • থিওডোরিকের উত্তরাধিকারী ক্যাসিওডোরাস : ক্যাসিওডােরাস ছিলেন থিওডােরিকের উত্তরাধিকারী। ক্যাসিওডোরাস ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। তিনি তার জীবন দান করেছিলেন দুটো উপাসনালয়ের ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ এবং দেখাশােনা করতে। তিনি নিজেও ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ব্যাকরণ নিয়ে চর্চা করে কাটাতেন। তিনি নিজেও গথদের উপরে একটি মহামূল্যবান ইতিহাস লিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
  • দার্শনিক বোয়েথিয়াস : বােয়েথিয়াস (অ্যানিসিয়াস ম্যানলিয়াস সেভিরিনাস বােয়েথিয়াস) ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে শেষ দার্শনিক। তিনি ৫১০ খ্রিস্টাব্দে কনসলের দায়িত্বে ছিলেন এবং তার দুই পুত্রও ৫২২ খ্রিস্টাব্দে কনসল ছিলেন। বােয়েথিয়াস ছেলেদের ওরকম পদে অধিষ্ঠিত দেখে শান্তি পেয়েছিলেন কিন্তু তখন এমন একটা অবস্থা ছিল যে সকলকে নামমাত্রই কনসল হয়ে থাকতে হতাে। (দুর্ভাগ্যক্রমে বােয়েথিয়াসকে বন্দী করলেন বয়স্ক থিওডােরিক। কারণ থিওডােরিক দার্শনিকদের ভয় পেতেন। তিনি মনে করতেন পূর্ব দিকের সম্রাটের সাথে মিলে দার্শনিকেরা তার ক্ষতি করতে পারে। শেষে বােয়েথিয়াসকে তিনি ফাঁসিতে ঝােলান!)। বােয়েথিয়াস ছিলেন একজন খ্রিস্টান, তবে তার ধর্মের আদর্শের কথা কোনাে লেখায় প্রতিফলিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্যাগান রােমান রাজ্যের উপরে স্টয়সিজমের একটি প্রচ্ছন্ন ছায়া লেগেই ছিল। তিনি অ্যারিস্টটলের কিছু লেখা ল্যাটিনে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়াও সিসেরাে, ইউক্লিড এবং প্রাচীন কিছু দার্শনিকদের নিয়ে মন্তব্যধর্মী রচনাও লিখেছিলেন। এসব কাজ বেঁচে ছিল মধ্যযুগের মধ্যভাগ পর্যন্ত। প্রাচীন যুগের সেসব কাজগুলাে পরে হারিয়ে গেলেও বােয়েথিয়াসের লেখাগুলাে প্রাচীন যুগের শেষ আলােটুকু ছড়াতে পেরেছিল অনেকদিন।

 নাইসিনীয় ও এরিয়ানদের ইন্টিগ্রেশনের অভাব এবং ফ্র্যাঙ্ক জাতির নেতা প্রথম ক্লোভিসের সয়সন্স জয়

এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের সময়টাতে রােম যদি জার্মানিক জাতিগুলাের সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হতাে এবং জার্মানির আগ্রাসনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতাে তাহলে জার্মানি এবং রােম একত্রে মিলে রােমান সাম্রাজ্যের চেয়েও শক্তিশালী এক সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জার্মান নেতাগণ ছিলেন এরিয়ানিস্ট এবং রােমানরা নাইসিনীয়। তাই কোনােরকমে জার্মান এবং রােমানরা মিললেও মিলতে পারতেন, কিন্তু নাইসিনীয় আর এরিয়ানিস্টরা কখনও নয়। গাউলের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থানকারী ফ্র্যাঙ্ক জাতি তার আগের অর্ধ শতাব্দী ধরে চুপচাপ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তারা ক্লোভিস নামে একজন শক্তিশালী নেতা পেয়ে গেল। ৪৮১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি ক্ষমতায় এলেন। মাত্র পাঁচ বছর সেখানকার লােকদের শাসন করার পরপরই তিনি রাজ্যের আয়তন বাড়ানাের কাজে মনােযােগ দিলেন। ক্লোভিসের প্রথম লক্ষ্য ছিল সিয়াগ্রিয়াস। ৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (রােমান ১২৩৯ সালে) সিওসনস সিয়াগ্রিয়াসকে আক্রমণ করে তিনি হত্যা করলেন। আর এভাবেই পশ্চিম দিকের রােমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা শেষ শাসকের সমাপ্তি হলাে। তারপর থেকেই সেখানকার স্থানীয় লােকদের হাতে চলে গেল সেখানকার শাসনব্যবস্থা।

পশ্চিমে রোমানদের অবসান এবং প্যারিস ভিত্তিক ফ্র্যাঙ্ক রাজ্যের হাত ধরে পশ্চিম ইউরোপের ঘুরে দাঁড়ানো

একটি দীর্ঘ যুগের সমাপ্তি ঘটছিল তখন। ১২৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে সেই সময়টার যখন টিবার নদীর তীরে ছােট্ট গ্রাম রােমের পত্তন হয়েছিল। রােম নিজেই যেন নিজেকে প্রাচীন কালের শ্রেষ্ঠ সভ্যতায় পরিণত করেছিল। শ্রেষ্ঠ জাতি হয়ে শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা। সেই সাম্রাজ্য হাজার হাজার মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযােগ করে দিয়েছিল। উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে চালানাের অভিনব নিয়ম তারাই আবিষ্কার করেছিল। পূর্বদিকের ধর্ম তারা গ্রহণ করেছিল এবং কালক্রমে সেই ধর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিল আরও বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর মধ্যে। কিন্তু তখন সেই ১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমের কোথাও এমন কোনাে শাসক ছিলেন যাকে সরাসরি রােমান শাসকদের উত্তরাধিকারী বলা যায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ ছিল তখনও অখণ্ড। সেখানে তখন কোনাে সম্রাট ছিল না কিন্তু বর্ধিত হয়ে তা যেন উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এক হয়ে যাচ্ছিল। নতুন সভ্যতার বিকাশে রােমান সভ্যতার হাত যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল পূর্ব সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকের শেষ বিন্দুও যখন অবশিষ্ট ছিল, ইউরােপ তখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানাের চেষ্টা করল। এমন আর কে ছিল যে কিনা সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে নতুন সভ্যতার সূচনা করবে? ফ্র্যাঙ্কস আর গথরাই সেখানে উপস্থিত ছিল কেবল। লােম্বার্ডস, নর্থমেন, আরবীয়, আরও যাদের কথা উল্লেখ করা হয় না, তারা কেবল সেই দুই জাতিকে অনুকরণ করছিল। সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশও নতুন সভ্যতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকে ফ্র্যাঙ্করাই ছিল একমাত্র জাতি যারা তখন রােমান শাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার যােগ্যতা রাখত। সয়সন্সে ক্লোভিসের বিজয়ের মাধ্যমে ফ্র্যাঙ্কদের নতুন সভ্যতার আলাে উঁকি দিয়েছিল, একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সেই থেকেই ফ্র্যাঙ্ক সংস্কৃতির সূচনা এবং সমাদৃত হয়ে ওঠার ইতিহাসের শুরু। তবে সেই যাত্রা আর রােমকে কেন্দ্র করে শুরু হয়নি, হয়েছিল প্যারিসের হাত ধরে। প্রকৃতপক্ষে সেই গতিই যেন প্রাচীন যুগকে মধ্যযুগে এবং তারপর আজকের এই আধুনিক যুগে, আমাদের কাছে এনে উপস্থিত করেছে।

তথ্যসূত্র

  • The Roman Empire, Isaac Asimov, Houghton Mifflin Harcourt (June 1, 1967)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.