রাষ্ট্রদর্শনের নতুন ধারা

ভূমিকা

জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ন্যায় রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রেও রেনেসাঁর যুগান্তকারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রেনেসাঁর প্রারম্ভ থেকেই মধ্যযুগের ধর্মপ্রভাবিত রাষ্ট্রদর্শনের স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ এক নতুন রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলার আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। মধ্যযুগের স্কলাস্টিক চিন্তাবিদরা ধর্মযাজকদের পার্থিব ক্ষমতার সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রকে চার্চের পরিচালনাধীন রাখার চেষ্টা করেন। টমাস একুইনাস সেন্ট অগাস্টিন প্রমুখের প্রভাবে এ ধারণা উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ও এরিস্টটলীয় লজিকের যুক্তির সাহায্যে এসব চিন্তাবিদ ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে চার্চের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার যৌক্তিকতা প্রমাণের প্রয়াস পান। তাদের মতে, মঙ্গল প্রতিষ্ঠা যেকোনো সরকারের লক্ষ্য হওয়া কাম্য। যে শাসক এ লক্ষ্যে কাজ করেন তিনি সুশাসক, যিনি তা অমান্য করেন কিংবা এর প্রতি উদাসীন থাকেন তিনি কুশাসক। কুশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা বাঞ্ছনীয়।

খ্রিস্টধর্মের নিয়মানুযায়ী জনগণের আধ্যাত্মিক মঙ্গল প্রতিষ্ঠাই হওয়া উচিত আদর্শ শাসকের লক্ষ্য। কারণ তাতেই নিহিত তার সর্বোচ্চ মঙ্গল। সুতরাং যে শাসক খ্রিস্টীয় ধর্মমত মানেন না কিংবা চার্চের বিরোধিতা করেন, তিনি তার প্রজাদের ন্যায্য অধিকার ব্যাহত করেন। আর যখনই তিনি তা করেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সঙ্গত। চার্চের ক্ষমতার উৎস পার্থিব নয়, ঐশ্বরিক। এদিক থেকে চার্চ ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিনিধিস্বরূপ। যেকোনো ধর্মীয় ব্যাপারে চার্চ মানুষের শেষ ও চূড়ান্ত আদালত। খ্রিস্টধর্মের সমর্থন ও প্রচারই এর একমাত্র কাজ। কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি দর্শন, কি বিজ্ঞান- এ সবই শেষ বিশ্লেষণে চার্চের অধীন। আর দর্শনের ন্যায় রাষ্ট্রতত্ত্বও ধর্মতত্ত্বের অধীনস্থ দাসস্বরূপ।

রেনেসাঁ ও সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ইউরোপ মধ্যযুগের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমশ আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মতো রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণায়ও মধ্যযুগীয় অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গির বিলোপ ঘটে, চার্চের ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে এবং এর স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয় শুরু হয়। জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা নাগরিকদের মধ্যে যে শুধু ঐক্যবোধই জাগিয়ে তুলেছিল তা নয়, বরং জাতীয়তার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলেই প্রতিটি রাষ্ট্র তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে দাবি করে। রাষ্ট্র সম্পর্কে এই অভিনব ধারণা সরকার ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কেও নতুন ধারণা সৃষ্টি করে।

মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাস চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার অব্যাহত বিবাদ ও সংঘর্ষের ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পোপের কর্তৃত্বের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে সম্রাটকে পোপের কাছে জবাবদিহি করার যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জোর প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছে। স্কলাস্টিক চিন্তার পতনের পর্বে ক্যাথলিক চিন্তাবিদদের কেউ কেউ চার্চের সর্বময় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করছেন। এ বিরোধিতা বিশেষ করে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে রেনেসাঁ ও সংস্কার আন্দোলনের সময়। আর এ প্রবল ও ব্যাপক বিরোধিতার ফলেই রচিত হয় আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি।

ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি.)

মধ্যযুগের রাষ্ট্রনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ ও আক্রমণ পরিচালনা করেন ইতালির বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli, ১৪৬৯-১৫২৭)। ম্যাকিয়াভেলির জন্ম ইতালির অন্তর্গত ফ্লোরেন্সে। তার বাবা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন আইনজীবী। তার সময় ইতালির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। ইতালি তখন পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত পাঁচটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্র ইতালির ওপর আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়ে ওঠে। এছাড়া ইতালির তদানীন্তন সরকারও তখন গভীরভাবে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলি এক তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ফ্লোরেন্সের ইতিহাস (History of Florence), লিভির প্রথম দশক সম্বন্ধে প্রবন্ধ (Essay on the First Decade of Livy) এবং রাজকুমার (The Prince) নামক গ্রন্থে তিনি তার মতাবলি ব্যাখ্যা করেন।

রাজনীতি, বিজ্ঞান এবং ধর্মের ব্যাপারে চার্চের প্রভাবমুক্ত এক সম্মিলিত, স্বাধীন ও সার্বভৌম ইতালিয় জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে খ্রিস্টীয় নীতি প্রয়োগের ঘোর বিরোধী। তার মতে, রাজনৈতিক ব্যাপারে ব্যক্তির ওপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাব খুবই মারাত্মক। কারণ রাজনৈতিক কার্যকলাপে তা ব্যক্তিকে নিরুৎসাহিত করে ফেলে। এদিক থেকে প্রাচীন রোমান ধর্ম ছিল খ্রিস্টধর্মের চেয়ে ঢের বেশি ভাল। কারণ দেশহিতৈষী সুনাগরিক গড়ে তোলার পক্ষে রোমান ধর্ম খুবই সহায়ক ছিল।

ম্যাকিয়াভেলির মতে, তৎকালীন স্পার্টা, রোম ও ভেনিসের ক্ষমতাসীন সরকার দেশ ও জাতির পক্ষে ছিল খুবই প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর। এজন্যেই তিনি এদের অনুকরণে আধুনিক গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের সুপারিশ করেন। তবে এ ধরনের শাসনতন্ত্র শুধু সেখানেই সম্ভব যেখানে জনগণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নাগরিকদের পক্ষে স্বাধীনতা একান্ত আবশ্যক। যে দেশে দুর্নীতি ও দুষ্কর্ম ব্যাপক সে দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হলে নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র আবশ্যক। কারণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ঐক্য ও সমৃদ্ধির জন্য শাসক তখন প্রয়োজনবোধে শক্তি, প্রতারণা, কঠোরতা প্রভৃতি যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আর রাষ্ট্রে বিরাজমান অরাজকতা ও দুর্নীতির তুলনায় যেকোনো পদক্ষেপই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। ম্যাকিয়াভেলি বলেন, শাসকের মধ্যে শৃগালের বুদ্ধি ও সিংহের শক্তির সমন্বয় ঘটা উচিত।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, প্লেটো এরিস্টটলের সময় থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত মনে করা হতো যে, রাষ্ট্রের একটি উচ্চতর নৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এই লক্ষ্য অর্জনের উপায়মাত্র। রাষ্ট্রের এই প্রচলিত নৈতিক উদ্দেশ্যের ধারণাকে ম্যাকিয়াভেলি প্রত্যাখ্যান করেন। রাজনীতিকে তিনি নীতিশাস্ত্র ও ধর্ম থেকে পৃথক বলে ঘোষণা করেন। বিশেষ করে প্রিন্স গ্রন্থে শাসকের আচরণ প্রসঙ্গে তিনি পরম্পরাগত ও প্রচলিত নৈতিকতাকে সুস্পষ্টভাবে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, কি নীতি, কি ধর্ম, এদের কোনোটিরই কোনো নিজস্ব মূল্য নেই। এগুলো উদ্দেশ্য সাধনের উপায়মাত্র। রাজনীতি ও ক্ষমতাই হওয়া উচিত শাসকের পরম লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ম্যাকিয়াভেলি বলেন, যে শাসক নিয়ত নীতিনিষ্ঠ, সৎ ও ভালো থাকেন তার পতন অনিবার্য। টিকে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই শৃগালের মতো চতুর এবং সিংহের মতো দুর্ধর্ষ হতে হবে। প্রয়োজনবোধে তাকে ধর্মবিশ্বাসের ভান করতে হবে, আবার নাস্তিকও সাজতে হবে। তবে যথার্থ শাসক তার এ কপটতাকে সুচতুরভাবে ঢেকে রাখবেন।

ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তাকে অনেকেই কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে তিনি যে বিরূপ মত পোষণ করেছেন এবং শাসককে তার ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য নৈতিক অর্থনৈতিক নির্বিশেষে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাকে অনেকেই নিন্দা করেছেন। তবে ম্যাকিয়াভেলির মতের সঠিক মূল্যায়নের জন্য তার সমসাময়িক ইতালির শোচনীয় অবস্থার কথা বিবেচনা করা দরকার। ইতালির সমাজে তখন দুর্নীতি ও হানাহানি যে ব্যাপক ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল, তাতে শক্তিকে শক্তি দিয়ে এবং কৌশলকে কৌশল দিয়ে মোকাবেলা করা ছাড়া শাসকের পক্ষে অন্য কোনো সহজ পথ খোলা ছিল বলে ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন নি। আর তার এ পরিকল্পনা ও প্রস্তাব যে অভিনব ছিল তা-ও বলা চলে না। রাজনীতিবিদ ও ধর্মযাজকদের অনেকেই সেদিন তাদের কার্যসিদ্ধির সুবিধার জন্য এই দ্বৈত মানদণ্ড গ্রহণ করতেন। ব্যবহারিক জীবনে তারা যা করতেন তাকেই মতবাদ হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। রাষ্ট্রকে রক্ষা করার অন্য কোনো কার্যকর উপায় ছিল না বলেই তিনি এ নীতির সমর্থন করেন। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে নতুন ধারণার সাথে সঙ্গতির পক্ষে এবং ধর্মতত্ত্ব ও চার্চনিরপেক্ষ একটি রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেদিন এ নীতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

বিবদমান ও বিভক্ত ইতালিকে একটি বলিষ্ঠ জাতীয় ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। একটি শক্তিশালী ইতালি জাতি গঠন ছিল তার রাজনৈতিক চিন্তার মূল লক্ষ্য। তার চিন্তাধারায় যত ত্রুটি-বিচ্যুতিই খুঁজে পাওয়া যাক-না কেন, তিনি যে একজন বাস্তববাদী চিন্তাবিদ ও নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। রাষ্ট্রতত্ত্বকে ধর্মতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করে তিনি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন বটে; কিন্তু ঠিক এ কারণেই তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছেন আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের পথিকৃৎ হিসেবে।

স্যার টমাস মোর (১৪৭৮-১৫৩৫), জেন্টাইল (১৫২১-১৬১১) ও জ্যা বোঁদা (১৪৩০-১৫৯৬)

ম্যাকিয়াভেলির পর ইংরেজ চিন্তাবিদ স্যার টমাস মোর (১৪৭৮-১৫৩৫) তার ইউটোপিয়া (Utopia, 1518) গ্রন্থে রাষ্ট্রের এক সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পরিকল্পনা করেন। এর পর লক্ষ করা যায় ফরাসি চিন্তাবিদ জ্যা বোঁদার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ (Six liveres de la Republique, 1557) এবং ইতালির চিন্তাবিদ এলবোরিকো জেন্টাইলের যুদ্ধের নিয়ম (De Jure Belli, 1558)। এই তিনজনের প্রত্যেকেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপর জোর দেন। অবশ্য নাস্তিকদের ব্যাপারে তারা কেউই সহিষ্ণুতার সমর্থন করেন নি। নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তারা তিনজনই ম্যাকিয়াভেলির বিরোধী ছিলেন। তবে রাষ্ট্রতত্ত্বকে ধর্মতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্র থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে তারা ম্যাকিয়াভেলিকে সমর্থন করেন।

জেন্টাইল (১৫২১-১৬১১): জেন্টাইল (১৫২১-১৬১১)-এর মতে, খ্রিস্টীয় পাঁচটি আজ্ঞা (commandments) ঐশ্বরিক আইনের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। এছাড়া সবই মানবিক আইনের অন্তর্ভুক্ত। মানবপ্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ও মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তিসমূহই হবে মানবিক আইনের ভিত্তি।

জ্যা বোঁদা (১৪৩০-১৫৯৬) : জ্যা বোঁদা (১৪৩০-১৫৯৬) ছিলেন ষোলো শতকের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। আইন ও রাষ্ট্রের ভিত্তি মানব প্রকৃতি-জেন্টাইলের এ মতের স্থলে তিনি এক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার সাহায্য নেন এবং রাষ্ট্র কী, সার্বভৌমত্ব কী প্রভৃতি রাষ্ট্রনৈতিক ধারণার সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন প্রকার সরকারের ধারণাকে তিনি বাতিল করে দেন এবং রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণন্ত্রের মধ্যে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকে সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট সরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন। রাজতন্ত্রকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে প্রজারা রাজার আইন এবং রাজা ঈশ্বরের বা প্রকৃতির আইন পালন করেন এবং নাগরিকদের স্বাধীনতা ও সম্পত্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। এ পর্যন্ত কেউ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ধরন, এ দুয়ের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেননি। যেমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজতান্ত্রিক কিংবা অভিজাততান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হওয়াতে আপত্তিকর কিছু আছে বলে এর আগে মনে করা হতো না।

জোহান্স এলুসিয়াস (১৫৫৭-১৬৩৮)

জোহান্স এলুসিয়াস (১৫৫৭-১৬৩৮) একজন বিশিষ্ট আইনদার্শনিক বলে পরিচিত। তিনি ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে হেরবর্ন ও সেইগেনে এবং ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এমডেনের সিন্ডিকে আইনবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার রচিত আইনবিষয়ক গ্রন্থাবলির মধ্যে প্রধান ছিল ডিকোয়ি ওলজিকা (Dicoeologica, 1617)। পলিটিকা (Politica, 1603) ছিল তার প্রধান রাষ্ট্রতাত্ত্বিক গ্রন্থ। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থটির পরিবর্তিত ও পরিবার্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

আঠারো শতকের শুরু পর্যন্ত চালু থাকার পর ক্রমশ তার মত বিস্মৃত হয়ে যায়। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে এলথুসিয়াসের মত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মতে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিহিত থাকে জনগণের মধ্যে। একে কোনোমতেই বিভক্ত বা হস্তান্তর করা চলে না। তবে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ওপর রাষ্ট্রের যে ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় তাকে রদ বা বাতিল করা যায়। রাজাকে সার্বভৌম বলা ঠিক নয়; কারণ তিনি রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান কর্মকর্তা মাত্র। ব্যক্তিমাত্রই রাষ্ট্রের প্রজা বটে; কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিহিত থাকে সমাজে। রাজার কাছ থেকে সামজিক অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা থাকবে। রাজা ও প্রজাদের মধ্যকার চুক্তি যদি রাজা লঙ্ঘন করেন, তা হলে আলোচ্য সংস্থা রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত, নির্বাসিত কিংবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবে।

হুগো গ্রোসিয়াস (১৫৮৩-১৬৪৫)

জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রবর্তন করে জ্যা বোঁদা যেমন আধুনিক রাষ্ট্রতাত্ত্বিক চিন্তার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তেমনি হল্যান্ডের চিন্তাবিদ হুগো গ্রোসিয়াস (১৫৮৩-১৬৪৫) স্মরণীয় হয়ে আছেন আন্তর্জাতিক সার্বভৌমত্বের ধারণার গোড়াপত্তন করে। আজকাল একচ্ছত্রবাদ (absolutism) বলতে যা বোঝায়, তিনি সে মতের সমর্থন করেন। আন্তর্জাতিক আইনের জনক বলেও তিনি পরিচিত। যুদ্ধ ও শান্তির আইন (The Law of War and Peace) তার পধান গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি স্টোয়িক মতবাদ রোমান আইনের অনুকরণে প্রাকৃতিক অধিকার সম্পর্কে একটি নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাকৃতিক আইন অলিখিত। মনুষের প্রজ্ঞাসম্মত প্রকৃতিই তার ভিত্তি। এ আইন সম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয়। স্বয়ং ঈশ্বরও একে বদলাতে পারেন না। প্রাকৃতিক আইন ছাড়া আরো এক প্রকার আইন রয়েছে যাকে বলা যায় মানবিক আইন। ইতিহাস থেকেই এ আইনের উৎপত্তি। উপযোগিতার নীতির ভিত্তিতে মানুষ এ আইন প্রণয়ন করে থাকে।

এরিস্টটলকে সমর্থন করে গ্রোসিয়াস বলেন, স্বভাবগতভাবে মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ ও সমাজের সম্পর্ক যেমন অঙ্গাঙ্গি, তেমনি সমাজ ও আইনের সম্পর্কও অচ্ছেদ্য। সমাজের স্থিতি ও নিরাপত্তার পক্ষে আইন অপরিহার্য। এ আইনের সাহায্যেই আবার বিকশিত হয় মানুষের বিবেক ও প্রজ্ঞা। বেআইনী উপায় অবলম্বনের ফলে মানুষের সমাজজীবন বিঘ্নিত হয়। এজন্যই মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে এমনসব সমাজিক নিয়ম ও আইন যেগুলো তাদের সমাজিক নিরাপত্তা, উন্নতি ও অগ্রগতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে তার প্রাকৃতিক অধিকার সীমিত করতে হয়।

রাষ্ট্রীয় সংগঠনের উৎপত্তি এবং রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে গ্রোসিয়াস বলেন, রাষ্ট্রের ভিত্তি একদিকে যেমন মানবপ্রকৃতি অন্যদিকে তেমনি প্রজ্ঞা। মানুষ সামাজিকতার প্রতি আকৃষ্ট বলে দলবদ্ধ ও সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে চায়। আবার বিচার-বিবেচনার পর মানুষ বুঝতে পারে যে, পরস্পরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বসবাস করা এবং রাষ্ট্র গঠন করা তার পক্ষে শ্রেয়। রাষ্ট্র ঈশ্বরের কৃত্রিম সৃষ্টি নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক প্রতিষ্ঠান। নাগরিকদের স্বাধীন সম্মতি, অর্থাৎ চুক্তির ওপর রাষ্ট্র নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকৃত অধিকারী জনগণ। তবে যেকোনো সময় তারা রাজা কিংবা কোনো শ্রেণীর কাছে তা হস্তান্তর করতে পারে।

প্রাক্-সামাজিক আদিম অবস্থায় প্রত্যেকেরই অপরের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কিংবা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান ব্যক্তিগত প্রতিশোধের স্থান দখল করেছে। প্রতিশোধ নয়, ব্যক্তির সংস্কার ও অন্যায়ের প্রতিরোধ শাস্তির উদ্দেশ্য। একমাত্র ঈশ্বরই মানুষকে পাপের জন্য শাস্তি দিতে পারেন। অন্যায়কারীকে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে শুধু অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য। এক রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক অধিকার লঙ্ঘন করে তখন যুদ্ধকে অন্যায় বা বেআইনী বলা যায় না। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অন্য রাষ্ট্র দ্বারা বিপন্ন হলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। তবে যেকোনো অবস্থায়ই যুদ্ধ পরিচালিত করা উচিত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রদর্শন

মানবিক ও প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে এই যে পার্থক্য তা মধ্যযুগেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ধর্মদর্শনের ক্ষেত্রে একই সময়ে লর্ড হারবার্ট অব সেরবারি (১৫৮১-১৬৪৮) এ পার্থক্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এ নবায়িত পার্থক্যের ফলশ্রুতি হিসেবে ব্যবহারিক দর্শনের ক্ষেত্রে যে আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে, তা উনিশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এর পরেও কান্টফিখটের সময় পর্যন্ত প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জিনিসের এ পার্থক্য বলবৎ ছিল। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যের উৎস হিসেবে, সর্বপ্রকার অন্যায় অশুভের প্রতিকারকল্পে মানুষ তখন আদিম অবস্থার দিকে ফিরে তাকাবার প্রয়াস পায়।

এ আদিম অবস্থাকে কেউ অভিহিত করেছেন প্রকৃতি বলে, কেউ-বা আবার এর নাম দিয়েছেন প্রজ্ঞা। নামের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এ আদিম অবস্থা বলতে সবাই নির্দেশ করেছেন এমন এক শক্তিকে যা অস্থায়ী কিংবা পরিবর্তনশীল নয়, বরং সর্বত্র সমান ও চিরস্থায়ী-যা প্রত্যাদিষ্ট কিংবা অর্জিত নয়, বরং সার্বিক ও সহজাত। যেমন: প্রাকৃতিক আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গ্রোসিয়াস বলেন, যা সর্বকালে সর্বত্র আইন বলে স্বীকৃত ও প্রচলিত তা-ই প্রাকৃতিক ধর্মের সারবস্তু। এছাড়া অন্য কেউ কেউ আবার বলেন, খাঁটি, সত্য, সুস্থ ও মূল্যবান বলতে তাকেই বোঝায় যার সঠিক ও শাশ্বত যথার্থতা আছে। এছাড়া আর যা কিছু আছে তা শুধু অতিরিক্ত ও মূল্যহীনই নয়, অশুভও বটে। এ সবই অপ্রাকৃতিক ও দূষিত। অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ (deism) এ মতের এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এ মত অনুসারে, ওপরে উল্লিখিত সংজ্ঞা অনুয়ায়ী যা প্রাকৃতিক কিংবা প্রাজ্ঞিক নয়, তাই অপ্রাকৃতিক ও প্রজ্ঞাবিরুদ্ধ।

আইনদর্শনের বিভিন্ন সমস্যার প্রশ্নে প্রটেস্টান্ট চিন্তাবিদদের মধ্যে লুথার মেলাঙ্খথন রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক উৎপত্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। লুথারের প্রেরণার উৎস ছিল বাইবেল। তার মতে, শাসকমাত্রই ঈশ্বর দ্বারা মনোনীত। আর ঈশ্বর দ্বারা মনোনীত বলেই সব শাসক পবিত্র। তবে একই সঙ্গে তিনি আবার আইন ও রাজনীতিকে আন্তর মানুষের সাথে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। মেলাঙ্খথন তার এলিমেন্টস্ অব এথিক্স (Elements of Ethics) গ্রন্থে এরিস্টটলের মত অনুসরণ করেন। ওল্ড্রেনড্রগ (মৃ. ১৫৬১), নিকোলাস হেমিং (১৫১৩-১৬১০) উইস্কলার (মৃ. ১৬৪৮) মেলাঙ্খথনের মত অনুসরণ করেন।

অগাস্টিন ও লুথারের চিন্তায় ইচ্ছার বশ্যতা সম্পর্কে যে মত দেয়া হয় তার বিরোধিতা করেন জেস্যুইটগণ। তারা প্যালাগীয় ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যবাদ সমর্থন করেন। তাছাড়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঐশ্বরিক বলে ধর্মসংস্কারকরা যে মত প্রচার করেছিলেন। জেস্যুইটগণ তারও বিরোধিতা করেন। তাদের মতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঐশ্বরিক নয়, প্রাকৃতিক। এবং চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্রের বিকাশ ও বিবর্তন ঘটে। এছাড়া তারা জনগণের সার্বভৌমত্বের সমর্থন করেন। যেমন: জেস্যুইট সঙ্ঘের অন্যতম সদস্য বেলারমিন (১৫৪২-১৬২১) জনগণকে রাজার ক্ষমতার উৎস বলে অভিহিত করেন। যে জনগণ রাজার হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করেন তারা আবার সে ক্ষমতা ফিরিয়ে নেয়ার এবং অন্যের কাছে তা হস্তান্তর করার অধিকার রাখেন। জেস্যুইট সঙ্ঘের অপর এক বিশিষ্ট সদস্য জুয়ান ম্যারিয়ানা (১৫৩৭-১৬২৪) মনে করেন যে, রাজার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরও জনসাধারণের কাছে বেশিরভাগ ক্ষমতা অবশিষ্ট থেকে যায়। প্রয়োজনবোধে রাজার কাছে কৈফিয়ত তলব করার অধিকার জনগণের আছে। রাজা যদি অসদাচরণের মাধ্যমে দেশকে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেন এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে ধর্ম ও আইনকে অবহেলা করেন, তা হলে জনগণের শত্রু হিসেবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত, এমনকি হত্যা করা চলে। মোটকথা, স্বেচ্ছাচারতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার যেকোনো প্রচেষ্টাই বৈধ।

আধুনিক রাষ্ট্রের বিবর্তন

এতক্ষণ আলোচিত মতগুলোর মধ্যে মধ্যযুগের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে কী করে আধুনিক রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবর্তন হলো তার একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব কথাটিকে আধুনিককালে যে অর্থে বোঝা হয়, সে অর্থে মধ্যযুগে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ছিল না। মধ্যযুগের শাসকরা কতিপয় সীমিত অধিকার ভোগ করতেন। ঠিক তেমনি সামন্ত প্রভুদের নিজস্ব কিছু অধিকার ছিল। তবে এ নিয়ে সম্রাট, রাজা ও ভূস্বামীদের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষ দেখা দিত। রাজার ক্ষমতা নির্ভর করত তার সামরিক শক্তি ও ভূস্বামীদের সমর্থনের ওপর। সামন্তবাদ ও ভূস্বামীদের পতনের পর জার্মানি ও ইতালিতে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ক্রমশ কতিপয় রাজ্যের স্কুল ও দুর্বল ফেডারেশনে খণ্ডিত হয়ে যায়। ফ্রান্সের অবস্থা ছিল এর বিপরীত। একাধিক রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত দুর্বল ফেডারেশন থেকে সেখানে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী একজন রাজার অধীনে একটি যুক্তরাষ্ট্র বা জাতির উদ্ভব ঘটে। ইংল্যান্ডে পূর্বের ন্যায় কেন্দ্রীভূত রাজ্যই রয়ে গেল। তবে জনগণের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সেখানেও রাজার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে। সে যাই হোক, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা ক্রমশ বিকাশ লাভ করল। ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলেই কেবল রাষ্ট্র সার্বভৌম হলো এবং এর কার্যাবলি বিস্তৃত হয়ে আধুনিক রূপ লাভ করল।

আধুনিক যুগের প্রথম দিকে রাষ্ট্রের প্রবণতা ছিল একচ্ছত্রবাদের দিকে। সতেরো শতকের শেষার্ধে এবং আঠারো শতকের প্রথমার্ধে (চতুর্দশ ল্যুই) এ প্রবণতা সবচেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। এ সময় স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড সহ পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সর্বত্রই কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এ মতে, রাজাই ঈশ্বরের যথার্থ প্রতিনিধি। সুতরাং তার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন নাগরিকদের কর্তব্য। রাজাই রাষ্ট্রের মূর্ত প্রতীক। নাগরিকদের তিনি যতটুকু অধিকার দিয়ে থাকেন ততটুকুই তাদের প্রাপ্য, এর বেশি নয়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা পূর্বাপর অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। অবশ্য এলথুসিয়াস, লক, রুশো প্রমুখের চিন্তায় একচ্ছত্রবাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়, তা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে সহায়ক প্রমাণিত হয়।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, জানুয়ারি, ২০০৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.