প্রাচীন যুগের বা প্রাচীন যাজকদের খ্রিস্টীয় দর্শন

Table of Contents

ভূমিকা

৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আদেশে এথেন্সে দার্শনিক আলোচনা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর গ্রিক ধর্ম ও দর্শন কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর এরপর থেকে পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপন করে খ্রিস্টীয় দর্শন। কিন্তু সেই ৫২৯ খ্রিস্টাব্দের চারশ বছরেরও বেশি কাল আগেই ধর্মের সমর্থনে সেই খ্রিস্টীয় দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ হওয়া শুরু হয়। খ্রিস্টীয় যুগের শুরুতেই সূচিত হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্য ও হেলেনিক দর্শনের পতন। ঠিক একই সময়েই আবার শুরু হয়েছিল খ্রিস্টধর্মের ক্রমিক বিস্তার। প্রথমদিকে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ইহুদিদের মধ্যেই সীমিত ছিল; কিন্তু ক্রমশ তা অন্যান্য জাতির মধ্যেও বিস্তারলাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত তা সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতাকে জয় করে ফেলে। খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব ছিল এক বিপ্লবের প্রতীক। তদানীন্তন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অব্যবস্থা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক তীব্র প্রতিবাদ এবং ধর্মীয় বাহ্যানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ও এটি ছিল একটি বিদ্রোহ। আর এ জন্যই এ ধর্ম ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল সমাজের সেসব মানুষের যারা শিকার হয়েছিল নানারকম সামাজিক শোষণ ও নির্যাতনের, স্বপ্ন দেখেছিল এক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার।

প্রথমদিকে খ্রিস্টধর্মের মত ও আচার-অনুষ্ঠানাদি ছিল অপেক্ষাকৃত কম জটিল। যিশুখ্রিস্ট পুনরায় আবির্ভূত হবেন, মানুষকে নতুন করে ন্যায় ও সত্যের পথপ্রদর্শন করবেন, এই ছিল সেদিনের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের আশা ও বিশ্বাস। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়কে তারা সরল বিশ্বাসে মেনে নিত, যুক্তির আলোকে কিছুই পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করত না। আর এসব ব্যাপার নিয়ে বেশি আলোচনা করাকে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষও ভালো চোখে দেখতেন না। ধর্মীয় প্রত্যাদেশের অকাট্যতাকে সন্দেহ করা ছিল এক বড় অপরাধ। এ ধরনের সন্দেহপোষণ করাকে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ বলে মনে করা হতো। বলা বাহুল্য, এ ধরনের বিরুদ্ধাচরণের পরিণতি ছিল খুবই অপ্রীতিকর।

এসব কারণে খ্রিস্টীয় দর্শনে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন চিন্তা স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত হতে পারে নি। তবে খ্রিস্টধর্ম যখন ক্রমশ বিস্তারলাভ করতে শুরু করে, তখন তা ক্রমবর্ধমানভাবে গ্রিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের নিজেদের মধ্যেও ধর্মের বিভিন্ন অনুশাসন নিয়ে ক্রমশ নতুন নতুন বিতর্ক ও মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। আর এসব বিরোধ মীমাংসার জন্য ধর্মের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্যাগানরা খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে নানারকম আপত্তি উত্থাপন করে এ ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে। বিশেষ করে তারা খ্রিসটধর্মকে একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্ম এবং প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক মতবাদসমূহের চেয়ে নিকৃষ্ট বলে সমালোচনা করে। প্যাগানদের এসব আপত্তির মোকাবেলা করার জন্যও যথেষ্ট যুক্তিতর্কের প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়া সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে খ্রিস্টধর্মকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্যও এর বিভিন্ন মত ও অনুশাসনের বুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান জরুরি হয়ে পড়ে। যেমন: শিক্ষিত মানুষের কাছে শুধু একথা বলাই যথেষ্ট ছিল না যে, যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের পুত্র এবং খ্রিস্টধর্মের তুলনায় অন্যান্য ধর্ম মিথ্যা। এসব কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এবং খ্রিস্টধর্মই যে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়, একথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তিপ্রমাণের প্রয়োজন ছিল। এসব কারণেই ধর্মীয় অনুশাসন ও আপ্তবাক্যসমূহের সমর্থনে দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ যুক্তির অবতারণা করতে শুরু করেন।

খ্রিস্টীয় দর্শনের উৎস ছিল একাধিক। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় প্লেটোর কথা। জড় ও চিদাত্মা (spirit), এ দুয়ের মধ্যে প্লেটো আগেই পার্থক্য নির্দেশ করেছিলেন। নৈতিকতার ক্ষেত্রে তিনি আপেক্ষিকতাবাদী মতবাদের বিরোধী ছিলেন, এবং ‘লজ’ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, ধর্মের নীতি দ্বারাই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। তার চেয়েও প্রত্যক্ষ ছিল প্লোটিনাস প্রচারিত নব্যপ্লোটোবাদের প্রভাব। ঈশ্বরের অতিবর্তন, অমঙ্গলের অবাস্তবতা, আত্মার প্রাধান্য, এসব নব-প্লোটোবাদী মত খ্রিস্টীয় মতের বিকাশ যথেষ্ট প্রভাববিস্তার করেছিল।

তাছাড়া এরিস্টটলের মতের প্রভাবকেও কোনোমতেই উপেক্ষা করা যায় না। মধ্যযুগের প্রারম্ভে যদিও প্লেটোর চেয়ে এরিস্টটলের মতের প্রভাব কম ছিল, পরের দিকে মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে এরিস্টটলের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। খ্রিস্টধর্মে এরিস্টটলের যেটুকু প্রভাব প্রবেশ করেছিল, তা ছিল প্রধানত পদ্ধতিগত। কোন্ পদ্ধতির অনুশীলনে যৌক্তিক সমাধান বের করা যায়, এরিস্টটল থেকে খ্রিস্টধর্ম তাই শিখেছিল। এ জন্যই দেখা যায় যে, স্কলাস্টিক দার্শনিকগণ এরিষ্টটলের লজিককে নিশ্চিত সত্য আবিষ্কারের একটি অকাট্য পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

নৈতিকতার ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বও স্টোয়িকদের কাছে ঋণী ছিল। স্টোয়িকদের ন্যায় খ্রিস্টান ধর্মবেত্তাদের অনেকেই আত্মসংযম ও ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করার অভ্যাস করেন, নৈতিক জীবনকেই একটি স্বতঃলক্ষ্য বলে জ্ঞান করেন। তা ছাড়া স্টোয়িকদের ঈশ্বরচালিত বিশ্বরাষ্ট্রের ধারণাটিকেও খ্রিস্টান ধর্মবেত্তাগণ সাদরে গ্রহণ করেন।

গ্রিক ও রোমান প্রভাবের চেয়ে খ্রিস্টীয় চিন্তায় হিব্রু প্রভাবই ছিল বেশি। বিশেষ করে ফিলো মধ্যযুগীয় দর্শনে প্রবল প্রভাববিস্তার করেন। রূপকের ব্যবহার, বিশ্বতাত্ত্বিক ধারণা, সৃষ্টিতত্ত্ব, নৈতিক আদর্শ-ফিলোর এসব মতবাদ মধ্যযুগীয় উত্তরাধিকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া পাপসংক্রান্ত যে মতবাদ মধ্যযুগে প্রবল ছিল, তাতেও হিব্রু প্রভাব সুস্পষ্ট। গ্রিক দর্শনে এ ধারণা অনুপস্থিত ছিল। মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছে, তাকে উদ্ধার করা একান্ত প্রয়োজন, এ জন্যই ঈশ্বর মানবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে মানবজাতির উদ্ধারের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন-এ ছিল খ্রিস্টধর্মের মূলকথা। আর এ মতই মধ্যযুগে প্রবল ছিল।

খ্রিস্টীয় দর্শনের শুরু হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে। তখন থেকে শুরু করে ন’শতক পর্যন্ত যে ভাবধারা প্রচলিত ছিল তাকে বলা হয় প্রাচীন যাজকদের যুগ (Patristic period)। খ্রিস্টীয় ন’শতক থেকে শুরু করে পনেরো শতক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কালকে বলা হয় স্কলাস্টিক যুগ (Scholastic period)। যিশু ও তার ভক্ত শিষ্যদের কেউই কেতাবি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব কিংবা অধিবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি ছিল খ্রিস্টের স্বপ্ন, তার চিন্তার মূল লক্ষ্য ও উপজীব্য। এ উদ্দেশ্যেই তিনি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন একটি সুষ্ঠু জীবনপ্রণালী। জীবনের গূঢ় অর্থ উপলব্ধি করার এক অবিরাম প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধান লক্ষ করা যায় যিশুর ধর্মে। এই প্রচেষ্টা নিছক আবেগ বা আধ্যাত্মিকতার ওপরই প্রতিষ্ঠিত নয়, এর জন্য গোটা মানুষের আত্মসমর্পণ আবশ্যক। কোনো পুরস্কার পাওয়ার অভিলাষ নয়, ঈশ্বর মানুষকে পরিত্যাগ করেছেন কেন, এ প্রশ্নের সদুত্তর আবিষ্কার এর লক্ষ্য। যিশুর অনুসারীদের কেউ কেউ তার ওপর দেবত্ব আরোপের বিরোধী ছিলেন। তাদের মতে, যিশু কোনো দেবতা নন, উচ্চতর পবিত্রতা ও নৈতিক আদর্শের প্রতীক একজন পয়গম্বরমাত্র। আধুনিককালের চিন্তাবিদদের মধ্যেও অনেকেই যিশুকে স্বর্গীয় দেবতা না ভেবে, ভেবে থাকেন যথার্থ জীবনের অনুসারী, মানুষের একজন আদর্শ সেবক ও ত্রাণকর্তা হিসেবে।

সেন্ট পল (৫ – ৬৪/৬৫ খ্রি.)

সেন্ট পল (Paul the Apostle) ছিলেন খ্রিস্টধর্মের একজন বিশিষ্ট সংস্কারক। খ্রিস্টধর্মকে প্রকৃত আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার কাজে তিনি এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। মূলত তারই প্রচেষ্টায় খ্রিস্টধর্ম প্রাচীন ধর্মসমূহের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। ট্যারসাস্ নামক এক শিক্ষাকেন্দ্রে পল শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। তার রচনাবলি থেকে বোঝা যায় যে, তিনি গ্রিক দর্শনের সাথে (বিশেষ করে স্টোয়িক দর্শনের সাথে) পরিচিত ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন রোমান নাগরিক। ফলে অতি সহজেই তিনি রোমান সভ্যতার সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন।

খ্রিস্টধর্মের প্রসারের ক্ষেত্রে পলের অবদান অপরিমেয়। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, খ্রিস্টধর্মের আবেদন কোনো বিশেষ জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই তিনি ঘোষণা করেন যে, মুসার আইন নয়, খ্রিস্টের বিধানই খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কঠোরভাবে পালন ছিল ইহুদিধর্মের এক অত্যাবশ্যক উপকরণ। কিন্তু পল-এর মতে, আচার অনুষ্ঠান নয়, বিশ্বাসই ধর্মের মূল উপকরণ। তার এমতই খ্রিস্টীয় একতার ভিত্তি। খ্রিস্ট ঈশ্বরের পুত্র- এ বিশ্বাস ছিল প্রত্যেক খ্রিস্টানের জন্য অপরিহার্য। যিশু নিহত হয়েছিলেন কেন? আদমের পাপের ফলে মানবজাতির যে বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটি থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য। পলের মতবাদ ও বিশ্বাস এমন কতকগুলো শর্তহীন সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, মুক্তিকামী জনসাধারণের কাছে যার আবেদন ছিল খুবই ব্যাপক ও গভীর।

বলা বাহুল্য, বিশ্বাসংক্রান্ত পলের এই ধারণা ছিল প্রাচীন দার্শনিকদের অনুসৃত প্রজ্ঞার আদর্শের চেয়ে স্বতন্ত্র। সেন্ট পল এবং পরবর্তীকালের অগাস্টিনলুথারের ব্যাখ্যা অনুসারে, বিশ্বাসের সাথে ঐশ্বরিক আদেশ গ্রহণ করার একটি সুনির্দিষ্ট মানসিকতা জড়িত। এ ধারণা মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ঈশ্বরকেন্দ্রিক এক প্রেক্ষাপটের দরজা উন্মুক্ত করে। পল বার বার ঈশ্বরের কৃপার কথা বলেছেন। কথাটি পাশ্চাত্য ধর্মতত্ত্বে এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যে, এর ফলে তা আজকাল একটি মামুলি কথা বলেই বিবেচিত। কৃপার ধারণাটির প্রকৃত অর্থ যে কী, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্যই দেখা যায়, ধর্মতত্ত্ববিদরা বারবার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন: “আমরা কি ঈশ্বরের কৃপার উপযুক্ত?” “আমরা কি ঈশ্বর নির্বাচিতদের অন্তর্ভুক্ত?” এসব প্রশ্ন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির খেয়ালখুশির ন্যায় ঈশ্বরের কৃপাও যেন এক অনিশ্চিত ব্যাপার।

সেন্ট পল তার সমাজদর্শনে খুবই রক্ষণশীলভাবাপন্ন ছিলেন। তার সময়ের খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেকেই যিশুর দ্বিতীয় আবির্ভাবকে এতই নিশ্চিত এবং এতই আসন্ন বলে মনে করতেন যে, তারা প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্মের প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠেন। ক্রীতদাসেরা তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং সাধারণ মানুষ নানারকম অনৈতিক অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকি, দীক্ষা অনুষ্ঠানসমূহকেও রীতিমতো মদ্যপান ও লাম্পট্যের আড্ডায় পরিণত হতে দেখা যায়।

নৈতিক পবিত্রতার ব্যাপারে সেন্টপলের মনোভাব আপসহীন ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু সামাজিক আদর্শের ব্যাপারে তার মতাদর্শ ছিল নিতান্তই অস্পষ্ট। এ ব্যাপারে তার অভিমত ছিল অনেকটা এ রকম: ক্রীতদাসদের ক্রীতদাসই থাকতে দাও। খ্রিস্টানদের সম্রাটের আদেশ মেনে চলতে হবে। শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটবে; কেননা (পল এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন) যিশুখ্রিস্ট দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হবেন।

প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মে দর্শনের প্রভাব

সেন্ট পলের রচনাবলি এবং হিব্রুদের ধর্মীয় দলিলপত্র থেকে জানা যায় যে, যিশু- উপাসকদের মধ্যে এমন অনেক প্রতিভাবান ভাবুক ব্যক্তি ছিলেন যারা প্রকৃত অর্থে দর্শন ও অধিবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। এসব প্রাজ্ঞ পণ্ডিতব্যক্তিরা সমসাময়িক নব্য পিথাগোরীয়বাদীনব্যপ্লেটোবাদী দর্শনের আলোকে যিশুকে ঈশ্বরের পুত্রঅবতার বলে ঘোষণা করেন। তবে ঈশ্বরপিতা, ঈশ্বরপুত্র ও পবিত্রাত্মা এই তিনের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে তারা কোনো সর্বসম্মত মীমাংসা দিতে পারেন নি।

পরবর্তী দুই শতকে বিভিন্ন দলের মধ্যে বির্তকের বিষয় ও সিদ্ধান্তের সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, এদের কোনটি যে ধর্মবিরোধী, আর কোনটি যে রক্ষণশীলতার পরিচায়ক বলে চিহ্নিত হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে শেষ পর্যন্ত যেসব মতকে প্রত্যাদিষ্ট বলে গ্রহণ করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে এরা ছিল (আংশিকভাবে হলেও) দার্শনিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত, আবার দার্শনিক চিন্তারই ফলশ্রুতি।

নস্টিক সম্প্রদায় (খ্রিস্টীয় ১ম – ৪র্থ শতক) 

প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় নষ্টিক (Gnostic) সম্প্রদায়সমূহের কথা। তারা তাদের মতবাদ গঠনে নব্যপ্লেটোবাদ ও প্রাচ্যের কিছু ধর্মীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রোক্লাস যেভাবে বহু-ইশ্বরকে দেখেছেন, নস্টিকরাও তেমনি খ্রিস্টধর্মকে দেখেছেন। নস্টিক মতের উদ্ভব ঘটে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে। ইহুদিরা যে নিজেদের ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি বলে দাবি করত, নষ্টিকরা তা স্বীকার করেন নি। খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হয়েও তারা ইহুদি পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব গ্রহণ করেন নি। ইহুদিদের ইন্দ্রিয়বিলাস এবং বহুবিবাহ প্রথাকে তারা নিন্দা করতেন। তারা যিশুকে ঈশ্বরের প্রথম এবং সর্বোত্তম বিকিরণ বলে বিশ্বাস করতেন এবং তার উপাসনা করতেন। তাদের মতে, যিশু যদি পৃথিবীতে অবতীর্ণ না হতেন, এবং বিভ্রান্ত মানুষকে ঈশ্বরের পথপ্রদর্শন না করতেন, তা হলে মানুষের পক্ষে মোক্ষলাভ অসম্ভব হত। সমসাময়িক অখ্রিস্টান গোত্রগুলোর ন্যায় নস্টিকরাও জাদুবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের কার্যকারিতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

নস্টিক সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি শাখা ছিল। এসব শাখার মধ্যে ব্যাসিলিডিয়ান, ভেলেন্টিনিয়ান, মারকিয়নাইট এবং ম্যানিকিয়ান শাখা বিখ্যাত ছিল। প্রত্যেক শাখারই নিজস্ব যাজক, মন্দির ও ধর্মগ্রন্থ ছিল। নস্টিকদের মতবাদ একটি শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে অগ্রসর হয়ে ম্যানিকিয়বাদ নামে চার শতকের শেষ এবং পাঁচ শতকের শুরু পর্যন্ত বেশ জোরদার ছিল।

ঈশ্বরের ত্রিত্ব ও ঈশ্বরপিতার সাথে ঈশ্বরপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক

ঈশ্বরের ত্রিত্ব (trinity) নিয়ে এবং বিশেষ করে ঈশ্বরপিতার সাথে ঈশ্বরপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে এই সময়ে বেশ বাকবিতণ্ডা চলছিল। যারা যিশুকে শুধু একজন পয়গম্বর বলে মনে করতেন, তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন প্যাট্রিপ্যাসিয়ানরা। তারা যিশুকে পিতা বলে মনে করতেন এবং বলতেন, যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়াতে আসলে পিতাই ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে স্যাবেলিয়ানরা পিতা, পুত্র পবিত্রাত্মা-এ তিনটিকে একই ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের তিনটি দিক বলে মনে করতেন। অন্যদিকে ছিল আবার আরেকটি দল, পরবর্তীকালে যার প্রতিনিধিত্ব করেন এরিয়াস। এ দলের মতে, পুত্র ছিল একই দ্রব্যজাত ভিন্ন একটি সৃষ্টসত্তা। এ ছাড়াও ছিল মোন্টানিস্টস্ নামে আরেকটি গোত্র, যারা চার্চের আওতায় জাগতিকতা ও ধর্মতত্ত্ব, এ দুয়ের অবতারণা পছন্দ করতেন না। তারা নিজেদের পবিত্রাত্মার প্রেরিতপুরুষ বলে মনে করতেন এবং তারই নেতৃত্বে আদিম খ্রিস্টধর্মের পুনঃস্থাপনে উৎসাহী ছিলেন।

এসব বিরুদ্ধ মতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে যে দু’জন চিন্তাবিদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন ক্লেমেন্টওরিজেন। এরা উভয়েই ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়াস্থ চার্চের সদস্য। এরা সমসাময়িক দর্শনে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং উভয়েই অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাদের মতে, অন্যান্য ধর্মের অপূর্ণতা আছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তাদের মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এরা উভয়েই ফিলোর লোগোস মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক বর্ণনায় উভয়েই এ মতের সাহায্য নেন এবং ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যায় উভয়েই ফিলোর রূপকপদ্ধতির অনুসরণ করেন।

জাস্টিন মার্টার (১০০ – ১৬৫ খ্রি.)

পরিচয়

জাস্টিন মার্টার (Justin Martyr) ছিলেন একজন প্রাথমিক খ্রিস্টান অ্যাপোলজিস্ট এবং দার্শনিক। তার বেশিরভাগ কাজ হারিয়ে গেছে, তবে দুটি এপোলোজি বা কৈফিয়ত এবং একটি সংলাপ টিকে গেছে। তার সবচেয়ে সুপরিচিত পাঠ্য প্রথম কৈফিয়ত জোরালোভাবে খ্রিস্টান জীবনের নৈতিকতাকে ডিফেন্ড করে, এবং রোমান সম্রাট অ্যান্টোনিনাসকে চার্চের নিপীড়ন ত্যাগ করতে রাজি করার জন্য বিভিন্ন নৈতিক এবং দার্শনিক যুক্তি সরবরাহ করে। অধিকন্তু, তিনি ইঙ্গিত করেন “খ্রিস্টধর্মের বীজ” আসলে ইতিহাসে লোগোসের প্রকাশ রূপে খ্রিস্টের জন্মের আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। আর তা হয় সক্রেটিস এবং প্লেটো সহ অনেক ঐতিহাসিক গ্রীক দার্শনিকের মাধ্যমে যাদের রচনা তিনি ভালভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, এবং তাদেরকে তিনি অজানা খ্রিস্টান (unknowing Christians) হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি তদকালীন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জুডিয়ার গ্রিক-ভাষী শহর ফ্লেভিয়া নিয়াপলিসে (আধুনিক নাবলুস) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার ডায়ালগ উইথ ট্রাইফো গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে তিনি পূর্বের স্টোইকবাদ, পেরিপেটেটিকবাদ এবং পিথাগোরীয়বাদ সম্প্রদায় হয়ে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন। তিনি সেই গ্রন্থে সংলাপের আকারে উল্লেখ করেন, “তার মধ্যে ঈশ্বরের দূতদের ভালোবাসা এবং খ্রিস্টের বন্ধুরা ভর করেছে।” নিজের বেশ কিছু ছাত্র সহ জাস্টিন শহীদ হয়েছিলেন। ক্যাথলিক চার্চ, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ, ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্স চার্চ, লুথেরান চার্চ এবং অ্যাংলিকানিজমে তাকে সেইন্ট হিসেবে সম্মান করা হয়। তার প্রথম কৈফিয়ত ও দ্বিতীয় কৈফিয়ত – এই দুটি গ্রন্থকে খ্রিস্টীয় কৈফিয়তের সর্বপ্রথম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, এবং অনেক পণ্ডিত এই কাজকে একটি সাধারণ রোমান প্রশাসনিক কৈফিয়তের বাইরে কৈফিয়তের এক নতুন ধারার সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন।

ফার্স্ট এপোলোজি

ফার্স্ট অ্যাপোলজি (First Apology) বা প্রথম কৈফিয়ত তিনি রোমান সম্রাট অ্যান্টনিয়াস পায়াসের (৮৬-১৬১ খ্রিস্টাব্দ) উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি কেবল খ্রিস্টান হবার জন্য একজন ব্যক্তিকে নির্যাতন করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেন এবং সমসাময়িক খ্রিস্টীয় দর্শন, ধর্মীয় অনুশীলন ও আচারের ব্যাখ্যা দেন। দর্শনের সাথে খ্রিস্টধর্মের সমীকরণ জাস্টিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখানে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করার জন্য দার্শনিক পদের দ্বারা কৈফিয়তের গুরুত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

মিশরের প্রিফেক্ট ফেলিক্সের নথি অনুসারে প্রথম কৈফিয়ত গ্রন্থের সময়কাল নির্ণয় করা হয়েছে ১৫৫-১৫৭ খ্রিস্টাব্দ। রবার্ট গ্রান্ট দাবি করেছেন যে এই কৈফিয়তটি মার্টারডম অফ পলিকার্প গ্রন্থের প্রতিক্রিয়ায় রচিত হয়, যা এই কৈফিয়তটি রচনার সময়েই সংঘটিত হয়েছিল। এই সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করে যে কেন এই কৈফিয়তটি বিশেষ করে আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে শাস্তির দিকে মনোনিবেশ করেছিল, যা খ্রিস্টীয় দার্শনিক পলিকার্পকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সূত্রকে নির্দেশ করে। এও সাধারণত মনে করা হয় যে, দ্বিতীয় কৈফিয়ত মূলত বৃহত্তর প্রথম কৈফিয়ের অংশ ছিল, যদিও এই বিষয়টি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

প্রথম কৈফিয়তের প্রথম অধ্যায়গুলিতে জাস্টিন সমসাময়িক খ্রিস্টানদের প্রতি মূল সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন; যথা, নাস্তিক্যবাদ, অনৈতিকতা এবং সাম্রাজ্যের প্রতি অবিশ্বস্ততা। তিনি প্রথমে যুক্তি দিয়েছিলেন যে খ্রিস্টধর্মের “নাম” নিজেই শাস্তি বা তাড়না দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ নয় এবং তিনি সাম্রাজ্যকে এর পরিবর্তে কেবল দুষ্ট কাজের জন্য শাস্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে তিনি লেখেন, “কারণ নাম থেকে অনুমোদন বা শাস্তি কোনকিছুই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা যদি না তার সাথে কোন ভাল বা মন্দ কর্ম জড়িত থাকে।” তারপরে তিনি অভিযোগগুলিকে আরও সরাসরি সম্বোধন করেন, যার মধ্যে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা রোমান দেবতাদের প্রতি “নাস্তিক” তবে “সত্যিকারের ঈশ্বরের” প্রতি নয়। তিনি স্বীকার করেন যে কিছু খ্রিস্টান অনৈতিক কাজ করেছে, কিন্তু তিনি কর্মকর্তাদেরকে এই ব্যক্তিদেরকে খ্রিস্টান নয় বরং অপরাধী হিসাবে শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। এই দাবির সাথে জাস্টিন খ্রিস্টান নামটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা সম্পাদিত দুষ্ট আচরণ থেকে আলাদা করার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এবং বলেন অপরাধীরা খ্রিস্টধর্মের নামকে কলুষিত করছে এবং এরা সত্য “খ্রিস্টান” নয়। অবশেষে, তিনি খ্রিস্টানদের যে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করার জন্য অভিযোগ করা হয় তা নিয়ে আলোচনা করেন, তিনি বলেন কীভাবে খ্রিস্টানরা কোন রাজ্যের নাগরিক হতে চায়, কিন্তু সেই রাজ্য মানুষের নয় বরং ঈশ্বরেরই।

যুক্তিবাদী দর্শন হিসাবে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করার জন্য জাস্টিন তার প্রথম কৈফিয়তে অনেক কিছুই লেখেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে একজন খ্রিস্টান কীভাবে তার অনুসারীদের জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে পারে, এবং খ্রিস্টান শিক্ষাগুলির সাথে পৌত্তলিক পুরাণসমূহের কত নিবিড় সমান্তরালতা রয়েছে, যার কারণে পৌত্তলিকদের দ্বারা সমসাময়িককালে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন করাকে তিনি অযৌক্তিক দাবি করেন। জাস্টিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সারগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে লোগোস এর বিবরণ। লোগোস হচ্ছে যুক্তি এবং জ্ঞানের শৃঙ্খলার একটি দার্শনিক ধারণা। প্রথম কৈফিয়ত জুড়ে জাস্টিন যুক্তি দিয়েছিলেন যে যীশু খ্রীষ্ট হ’ল লোগোসের অবতার, যা তাকে এই প্রমাণের দিকে নিয়ে যায় যে, যে ব্যক্তিই কখনও যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন, এমনকি তারা যদি খ্রিস্টের পূর্বেও বাস করে থাকেন, তারাও খ্রিস্টের আকারে লোগোসের সাথে সংযুক্ত ছিলেন, আর তাই তারা এইভাবে খ্রিস্টানই ছিলেন। এই সারটি জাস্টিনের খ্রিস্টধর্মের প্রতিরক্ষা বোঝার পক্ষে সর্বাত্মক, এবং খ্রিস্টান কৈফিয়ত রচনায় একটি যুগান্তকারী বক্তব্য ছিল। “লোগোস” শব্দটির ব্যবহারটি ইঙ্গিত দেয় যে জাস্টিন সম্ভবত পূর্ববর্তী দার্শনিক শিক্ষাগুলির দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তবে জাস্টিন যুক্তি দেখান যে এই শিক্ষাগুলি কেবলমাত্র আংশিক সত্যকেই উপস্থাপন করে কারণ তারা সামগ্রিক লোগোসের কেবলমাত্র একটি অংশের সাথে যুক্ত ছিল। জাস্টিনের জন্য, খ্রিস্টধর্ম সম্পূর্ণ সত্যের (লোগোস) প্রতিনিধিত্ব করে, যার অর্থ খ্রিস্টধর্ম কেবল একটি অর্থবোধক দর্শনই নয়, এটি জ্ঞান এবং যুক্তির সর্বোচ্চ স্তর অর্জনের জন্য পূর্বের চিন্তাগুলোকে পরিপূর্ণ ও সংশোধন করে।

প্রথম কৈফিয়ত সমসাময়িক খ্রিস্টান অনুশীলন সম্পর্কিত সর্বাধিক বিস্তারিত বিবরণগুলোর মধ্যে একটি। যারা অভিসিঞ্চিত বা বাপ্টাইজড হয় “তাদেরকে আমরা সেখানে নিয়ে আসি যেখানে জল আছে,” সেখানে “তাদের পুনর্জন্ম হয় যেমনটা আমাদের হয়েছিল”। অভিসিঞ্চন বা বাপ্টিজম নিয়ে আলোচনার পরে, জাস্টিন তার ট্রান্সাবস্ট্যানশিয়েশন শিক্ষার মাধ্যমে ইউক্যারিস্ট অনুশীলনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, “এখানে আমাদের শেখানো হয় যে এই খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পার্থনাসূচকভাবে যিশুকে ধন্যবাদ দেয়া হয়, যেখান থেকে আমাদের রক্ত ও মাংস রূপান্তরের মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়, সেই রক্ত ও মাংসের দ্বারাই যিশু অবতারপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।” পরিশেষে, তিনি সাপ্তাহিক রবিবারের সভাগুলি সম্পর্কে তথ্য দেন, যেখানে ইহুদি পয়গম্বরদের সম্পর্কিত পাঠ, ধর্মপ্রচারক বা অ্যাপসলদের স্মৃতিচারণ, প্রার্থনা এবং ভোজনের আয়োজন থাকে।

জাস্টিনের কৈফিয়ত কী পরিমাণে পূর্ব এবং ভবিষ্যতের কৈফিয়ত থেকে পৃথক হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট জাস্টিন পণ্ডিত পল পারভিস উল্লেখ করেছেন যে প্রথম কৈফিয়ত তার আগের যে কোনও কৈফিয়তের থেকে আলাদা নয়। এটি নিজেকে আইনি পিটিশন হিসাবে উপস্থাপন করে, যা একটি প্রমাণ রোমান প্রশাসনিক জঁরা যেখানে কোন অভিযুক্ত তার উপর আরোপকে পরিবর্তিত করতে চান (এই ক্ষেত্রে, খ্রিস্টানদেরকে খ্রিস্টান হবার জন্য নয় বরং খারাপ কাজের ভিত্তিতে অভিযুক্ত করার জন্য বলা হচ্ছে)। কিন্তু রচনাটিতে খ্রিস্টান অনুশীলন এবং বিশ্বাসের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে পারভিস যুক্তি দিয়েছিলেন যে “এখানে জাস্টিন যা করেছেন তা হল স্বাভাবিক রোমান প্রশাসনিক কার্যবিধিকে হাইজ্যাক করে তা দিয়ে গসপেলের বাণী প্রচারের একটি বাহনে রূপান্তর”। এডিনবার্গের সারা পারভিস আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে কৈফিয়তকে “খ্রিস্টধর্মের স্বপক্ষে কোন অস্পষ্ট রচনা হিসেবে” মনে না করে একে একটি আলাদা প্রকরণ হিসেবে ভাবা উচিত যা জাস্টিন মার্টার উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং টারটুলিয়ানের মত পরবর্তীকালের লেখকেরা পরিমার্জন করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে খ্রিস্টান অনুশীলনের ব্যাখ্যার গুরুত্বও পণ্ডিতরা লক্ষ করেন। রবার্ট গ্রান্ট উল্লেখ করেছেন যে, জাস্টিন প্রাথমিক চার্চ অনুশীলনের পিছনে ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি বিস্তারিত বিবরণ দান করেন নি। বরং তার উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টীয় জীবনের প্রকৃত প্রকৃতিঃ তুলে ধরা এবং পৌত্তলিক সমালোচকদের নিন্দিত দাবিগুলোকে খণ্ডন করা।

সেকন্ড এপোলোজি

জাস্টিন মার্টারের দ্বিতীয় কৈফিয়ত বা সেকেন্ড অ্যাপোলজি লেখা হয়েছিল সম্ভবত জাস্টিন মার্টারের প্রথম কৈফিয়তের একটি পরিপূরক হিসেবে। এই রচনার কিছু বিষয় যা রোম নগরীর প্রিফেক্ট হিসেবে লোলিয়াস আর্বিকাসের দায়িত্বে থাকার সময় ঘটেছিল, যা থেকে মনে হয় এই রচনাটি খ্রিস্টীয় ১৫০ থেকে ১৫৭ অব্দে লেখা হয়। এই কৈফিয়তটি রোমান সিনেটকে সম্বোধন করে লেখা হয়। দ্বিতীয় কৈফিয়তের উদ্দেশ্য ছিল সমসাময়িক সাম্প্রতিককালের আর্বিকাসের দ্বারা খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের প্রকৃত কারণকে প্রকাশ করা। এটি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেয়া অভিযোগ ও প্রচারের অযৌক্তিকতাও প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল।

জাস্টিন একটি নির্দিষ্ট নারীর গল্পের বর্ণনা করেছেন যিনি যিশুর শিক্ষা শুনে এবং খ্রিস্টান হয়ে গিয়ে তার স্বামীর অনৈতিক আচরণ অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। মতবিরোধগুলি তীব্র হওয়ার কারণে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে আকাঙ্ক্ষিত হয়েছিলেন, কিন্তু তা করতে উৎসাহিত না হওয়ায় তিনি এই সম্পর্কটি অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু একদিন তা নৈতিকভাবে অসহনীয় হয়ে যায় এবং তিনি তার স্বামীকে বিবাহ বিচ্ছেদের বিল প্রদান করেন। স্বামী সম্রাটের সামনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে পাল্টা জবাব দিলেন। কিন্তু যখন তিনি তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন নি, তখন তিনি খ্রিস্টান নেতাদের বিরুদ্ধে যান, যাদেরকে প্রিফেক্ট আর্বিকাস কঠোরভাবে নির্যাতন শুরু করেন।

জাস্টিনের মতে পতিত এঞ্জেল ও দানবরাই (Demon) ঈশ্বরের পুত্র ও ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি সাড়া দেয়া ঈশ্বরের লোকদের বিরুদ্ধে এরকম ঘৃণাকে জাগিয়ে তোলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বুক অফ এনোকের (১ এনোক) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যাকে জাস্টিন ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দেখতেন। এই দানবরা হ’ল তাদের আত্মা যারা প্রলয়ের পূর্বে পতিত এঞ্জেল এবং নারীদের মিলনের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং যারা বন্যা বা প্রলয়ের ফলে ধ্বংস হয়েছিল। তারা যাদুকরী শিল্প, তর্পন এবং এরকম ভয়ঙ্কর ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে যা মানুষকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। খ্রিস্টানরা যীশুর নামে তাদের থেকে এই দানবদের বহিষ্কার করে (exorcism)।

খ্রিস্টানদের উপর নরমাংস ভক্ষণ এবং যৌন অনৈতিকতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। জাস্টিন জিজ্ঞাসা করেছেন যে যদি এটিই হয় এবং খ্রিস্টানরা যদি আনন্দ উপভোগের দ্বারাই তাড়িত হয়ে থাকে, তাহলে তারা কেন কেন মৃত্যুর ভয় পায়না, এবং তারা যা বিশ্বাস করে তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। মৃত্যুর মুখে খ্রিস্টের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করে যে তারা আনন্দের সন্ধানকারী নয়। বিপরীতে, অভিযোগকারীরা এমন ধর্ম ব্যবস্থাকে অনুসরণ করেন যেখানে উচ্চবংশজাত পুরুষরা স্যাটার্নের মতো দেবতাদের উদ্দেশ্যে মানুষকে বলি দেয় এবং যেখানে লজ্জা ছাড়াই প্রকাশ্যে যৌন অনৈতিক আচরণ করা হয়। তিনি চিৎকার করে বলেন: তবে এখনও যদি কেউ একটি উচ্চ বেদিতে উঠে চিৎকার করে বলত, “তোমরা লজ্জা কর, লজ্জা কর! তোমরা নিরপরাধদেরকে সেই দোষে অভিযুক্ত করছ যা তোমরাই প্রকাশ্যে করে থাকো, নিজের এবং এই নিরপরাধদের উপর সেই সব বিষয় আরোপ করো যা নিজেদের উপর ও নিজেদের দেবদেবীদের উপর আরোপ কর। তোমরা ধর্মান্তরিত হও; বুদ্ধিমান হন।”

তিনি খ্রিস্টানদের চিত্রিত করেছেন এমন মানুষ হিসেবে যারা ঈশ্বর ও তার বাক্যকে (যীশু খ্রীষ্ট) ভালবাসেন। তার ইচ্ছা এই যে যাতে পৃথিবীর খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হবার তার আবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তিনি এই কথাগুলো বলে শেষ করেন: “সচেতন বিচার অনুযায়ী আমাদের মতবাদগুলি লজ্জাস্কর নয়, বরং এটি অন্যান্য যেকোন মানব দর্শনের তুলনায় উচ্চতর; এবং যদি তা নাও হয় তাহলেও তারা সটাডিস্ট, ফিলিনিডীয়, নৃত্যশিল্পী এবং এপিকিউরিয়ানদের এবং এরকম অন্যান্য কবিদের শিক্ষার মত নয়…  আর তাই এখন থেকে আমরা চুপ করে থাকব, আমরা যতটা সম্ভব করেছি, সেই সাথে প্রার্থনা করি যাতে সকল মানুষ সত্যের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠে। এবং আপনারাও নিজেদের জন্যই দর্শন ও দয়ার সাথে ন্যায়বিচার করুন!”

আইরেনিয়াস (১৩০-২০২ খ্রি.)

আইরেনিয়াস (Irenaeus) স্মিরনা নামক স্থানে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লীয়নস্-এর বিশপ নিযুক্ত হন। তিনি নস্টিক ও অন্যান্য ধর্মবিরুদ্ধ মত খণ্ডনে আত্মনিয়োগ করেন। রক্ষণশীল ক্যাথলিক মত ব্যাখ্যায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সমকালীন অধিবিদ্যক ও পৌরাণিক দ্বৈতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা ও সমীক্ষা করেন। প্রত্যয় ও ইন্দ্রিয়জ বস্তুর মধ্যে প্লেটোদর্শনে যে দ্বৈততা বর্তমান, তা-ও তিনি পর্যালোচনা করেন। তার মতে, এ দ্বৈতবাদ ঈশ্বরকে সীমিত করে এবং ঈশ্বর ও তার বিরুদ্ধ নীতিকে তৃতীয় এক ব্যাপকতর সত্তার অন্তর্ভুক্ত করে। এই তিনটি আবার চতুর্থ এক ব্যাপকতর সত্তার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে। ফলে এক অনবস্থা দোষের (infinite regress) সৃষ্টি হয়।

আইরেনিয়াস-এর চিন্তার মূল বিষয় মানুষের পতন। তিনি শয়তানের শক্তির ওপর জোর দেন। তার মতে, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ এবং খ্রিস্টের ওপর ব্যক্তিগত বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমেই কেবল এই অশুভ শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব। আইরেনিয়াসের মতে, খ্রিস্টের মৃত্যু ছিল একটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এতে শুধু ঈশ্বরের প্রতি খ্রিস্টের আনুগত্যই প্রমাণিত হয় নি, বরং তা শয়তানের বন্ধন থেকে আমাদের মুক্তও করেছে। খ্রিস্টকে গ্রহণ করার পর প্রত্যেকের উচিত ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপন এবং খ্রিস্টধর্মের সমর্থন করা।

ক্লেমেন্ট (১৫০-২১৫ খ্রি.)

খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে ক্লেমেন্ট-এর (Clement of Alexandria) ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মা-বাবা ছিলেন প্যাগান। প্যাগান ধর্ম ছেড়েই তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার দর্শকর্মের বেশিরভাগ সম্পন্ন হয় আলেকজান্দ্রিয়ায়। শিক্ষক হিসেবে ওখানে তিনি প্রভৃত সম্মান ও গৌরব অর্জন করেছিলেন। তার রচনাবলির মধ্যে ‘প্রোট্রেপটিকাস’ (Protrepticus) বিখ্যাত। এতে তিনি প্যাগান ধর্মসমূহের সমালোচনা করেন। ‘প্যাডাগোগাস’ (Paedagogus) গ্রন্থে তিনি শিক্ষার সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করেন। নীতিবিদ্যা, দর্শন ও ধর্ম সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন ‘স্ট্রোমাটেইস’ (Stromateis) নামক গ্রন্থে।

খ্রিস্টধর্মের পরবর্তী পর্যায়ে যে কঠোরতা দেখা যায় ক্লেমেন্টের নৈতিক মতে তা ছিল না। তিনি যাত্রা, নাটক ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের নিন্দা করতেন ঠিকই, তবে তিনি কঠোর সংযমের সমর্থন করেন নি। তার মতে, আতিশয্য দ্বারা নয়, প্রাজ্ঞিক আদর্শ দ্বারাই নৈতিক জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত। স্যালভেশন বা পাপমুক্তির অধিকার সব মানুষেরই আছে; এর সাথে মানুষের সামাজিক পদমর্যাদার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের যাবতীয় কাজকর্মে তার আন্তর উদ্দেশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি ভোগ করাতে আপত্তিকর কিছু নেই; তবে এর ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া মঙ্গলজনক নয়। তার মতে, পার্থিব ধনসম্পদ সবাই মিলে ভোগ করা এবং মানুষের মুক্তির কাজে এদের ব্যবহার করাই আমাদের নৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ক্লেমেন্ট তার দার্শনিক মতে নব-প্লেটোবাদী চিন্তা দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেমন: ঈশ্বরপিতার স্বরূপ অনির্বচনীয়; পুত্রই পিতার ঐশ্বরিক মন; পুত্রের মাধ্যমেই পিতা সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করেন; পুত্রের মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হন-তার এসব উক্তিতে প্লোটিনাসের মতের পূর্বাভাস লক্ষ করা যায়। এছাড়া ইহলোক নয়, এক সুদীর্ঘ শুদ্ধিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ বিচারের দিন আত্মার ভাগ্য নির্ধারিত হয় বলে তিনি যে মত প্রকাশ করেন, তার সাথেও নব-প্লেটোবাদী মতের সাদৃশ্য দেখা যায়। (বিশেষ করে নিওপ্লেটোনিক দার্শনিক প্রোক্লাসের (৪১২-৪৮৫ খ্রি.) দর্শনের সাথে মেলে, যদিও তার জন্ম ক্লেমেন্তের অনেক পরে, কিন্তু এরকম চিন্তা ক্লেমেন্তের সময় ও পূর্বেও নিওপ্লেটোনিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিল।)

প্রোক্লাসের ন্যায় ক্রেমেন্টও বলেন, শুভ-অশুভ নির্বাচন করতে গিয়ে মানুষ যখন তার স্বাধীন ইচ্ছা ও শক্তির অপব্যবহার করে, তখন সৃষ্টি হয় পাপ। তবে প্রোক্লাস ও নস্টিকদের ন্যায় তিনি অশুভের নির্বাচনকে মানুষের অপূর্ণতার পরিচায়ক বলে মনে করতেন না। আদমসৃষ্টি সম্বন্ধে নস্টিকদের মতবাদ তিনি খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। নষ্টিকদের মতে অপূর্ণ হিসেবেই আদমের সৃষ্টি। সুতরাং আদমের (এমনকি গোটা বিশ্বের) সৃষ্টি ঈশ্বরের নয়, একজন অশুভ স্রষ্টারই কাজ। ক্লেমেন্ট এ মতের বিরোধিতা করেন। ক্লেমেন্ট আদিপাপ (original sin)-এ বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মতে, আদমের পতন মানবজাতিকে কলুষিত করতে পারে না। মানুষ পৃথিবীতে পূর্ণ হিসেবেই জন্মায়। মানুষের যাবতীয় দুঃখ-দুর্ভোগ তার নিজের কৃতকর্মের ফল, তার স্বাধীনতার অপব্যবহারের ফলশ্রুতি।

টেরটুল্লিয়ান (১৫৫-২২০ খ্রি.)

টেরটুল্লিয়ান-এর অবদান ছিল আইরেনিয়াসের অবদানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ১৫৫ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। তার রচনাবলিতে খ্রিস্টধর্মের আইনের দিকটি বিশেষ গুরুত্বলাভ করেছে। তবে ক্লেমেন্টওরিজেনের ন্যায় অনুধ্যানিক ক্ষমতা তার ছিল না।

টেরটুল্লিয়ানের মতে, ঈশ্বর জগতের শাসক। তার প্রতি অনুগত থাকাই মানুষের প্রধান পুণ্য। আমরা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা অগ্রাহ্য করি, তা হলে আমাদের নরকের আগুন ভোগ করতে হবে। তিনি দেখাতে চান যে, ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের প্রতিটি অনুশাসন অন্যান্য অনুশাসনের চেয়ে উৎকৃষ্ট। জীবনের শেষ দিকে তিনি ক্যাথলিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জাগতিকতা ও রাজনীতির আতিশয্য দেখে বিরক্তবোধ করেন এবং এ দল পরিত্যাগ করে মোন্টানিস্ট সম্প্রদায়ে যোগদান করেন।

দর্শনের ইতিহাসে টেরটুল্লিয়ান তার একটি উক্তির জন্য বিখ্যাত। উক্তিটি ছিল ক্রুশে ঈশ্বরের নিজেকে উৎসর্গ করার ব্যাপারে প্রচলিত খ্রিস্টীয় মত সম্বন্ধে। উক্তিটি ছিল এরকম: “এটি বিশ্বাসযোগ্য, কেননা এটি উদ্ভট; এটি নিশ্চিত, কেননা এটি অসম্ভব।” এ উক্তির অর্থ এই যে, ধর্মীয় প্রত্যাদেশ উদ্ভট হলেও সত্য। প্রত্যাদেশ গ্রহণের জন্য যুক্তি-প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। বিশ্বাসের ভিত্তিতেই প্রত্যাদেশের সত্যতা গ্রহণ করতে হয়।

টেরটুল্লিয়ানের মতে, ঐশ্বরিকজ্ঞানের নিশ্চিত উপায় ইনটুইশন বা স্বজ্ঞা। স্বজ্ঞার প্রামাণ্য যুক্তিপ্রমাণ, এমনটি খ্রিস্টীয় প্রত্যাদেশের চেয়েও অধিকতর নিশ্চিত। স্বজ্ঞার গ্রামাণ্যের ওপর আস্থা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিশ্বজগতের অন্তর্নিহিত রহস্যাবলি নিয়ে। আলোচনা করেন। ত্রয়ীবাদ সম্পর্কে তার আদিমতে প্লোটিনাসের মতের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এ মতে, পুত্র পিতারই সম্প্রসারণ। এর অর্থ বুঝাতে গিয়ে তিনি সূর্যের দৃষ্টান্ত দেন। সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থেকেই তার নিজ আলোতে নিজেকে বিকীর্ণ করে থাকে। পরের দিকে অবশ্য ত্রয়ীবাদবিরোধী মতাবলির খণ্ডন প্রচেষ্টায় তিনি পুত্র ও পিতার পার্থক্যের ওপর অতিশয় জোর দিয়েছিলেন এবং তা করতে গিয়ে কখনো কখনো একটিকে অপরটির অধীন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

পরিশেষে টেরটুল্লিয়ান স্টোয়িকদের মতের প্রতিধ্বনি করে বলেন, আত্মা সৃষ্ট, সুতরাং জড়ীয়। শুধু তা-ই নয়, তার নিজের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য, শক্তি প্রয়োগের জন্য, জীবন ও আনন্দের সব সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের জন্য আত্মাকে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়। সুতরাং (নস্টিকদের মতের সমালোচনা করে তিনি বলেন) আত্মা যে অশুভ নয়, তা-ই নয়, বরং তা সম্পূর্ণ শুভ; আর একে অশুভ বলে নিন্দা করা স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের ওপর কটাক্ষ করারই নামান্তর। মৃত্যুর পরেও দেহের প্রয়োজন ও আবেদন চলতে থাকে। আর এ জন্যই পরিণামে ঘটে দেহের পুনরুত্থান ও আত্মার সাথে দেহের পুনর্মিলন।

ওরিজেন (১৮৫-২৫৩ খ্রি.)

ওরিজেন (Origen) ছিলেন ক্লেমেন্টের শিষ্য। তিনি বয়সে ক্লেমেন্টের চেয়ে প্রায় ত্রিশ বছরের ছোট ছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। শুধু খ্রিস্টীয় সাহিত্যেই নয়, গ্রিক দর্শনেও তিনি একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন। ক্লেমেন্টের ন্যায় তারও দর্শনের প্রতি গভীর আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ছিল। প্লোটিনাস ও ক্লেমেন্টের উগ্র মরমিবাদের প্রতি তার সমর্থন ছিল না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বুদ্ধিবাদী। তার মতে, স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে প্রাপ্ত দার্শনিক সত্যকে অগ্রাহ্য বা অবজ্ঞা করা অনুচিত। সুতরাং কোনো খ্রিস্টান চিন্তাবিদের পক্ষেই গ্রিক মনীষার অবদান উপেক্ষা করা উচিত নয়। ক্লেমেন্টের ন্যায় তিনিও ঈশ্বরের অতিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। আমরা ঈশ্বরের স্বরূপ জানতে পারি না; কিন্তু তাই বলে ঈশ্বর আমাদের অভিজ্ঞতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, এ কথা বলা যথার্থ নয়। ঈশ্বরের স্বরূপ সরাসরি না জানতে পারলেও ঈশ্বরের কার্যকলাপের মাধ্যমে আমরা তার সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। ক্লেমেন্টের ন্যায় তিনিও ফিলোর লোগোস মতের আলোকে পুত্র এবং পিতার সম্পর্ক বর্ণনা করেন। পুত্র পিতার প্রজ্ঞাবিশেষ। সৃষ্টিকর্মে এবং খ্রিস্টীয় প্রত্যাদেশে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও বুদ্ধি ব্যক্ত হয়। ওরিজেন পবিত্রাত্মার ওপর ক্লেমেন্টের চেয়ে বেশি মনোনিবেশ করেন। তার মতে, পবিত্রাত্মার সহায়তায়ই মানবাত্মা খ্রিস্টীয় সত্য গ্রহণ করে এবং পরিণামে পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

ঈশ্বরের একত্বের সঙ্গে ত্রিত্বের সমন্বয় করতে গিয়ে ওরিজেন বলেন যে, আসলে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি শুধু তিনটি পৃথক ব্যক্তিতে প্রকাশিত। ওরিজেনের মতে, ঈশ্বরের এই তিন মূর্তি সহ-নিত্য (co-eternal)। তবে তিনি তাদের সহ-সমান (co- equal) মনে করতেন কি-না, এ নিয়ে মতভেদ আছে। পুত্রকে পিতার অধীন বা তাবেদার করার দায়ে প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিকগণ তাকে অভিযুক্ত করেন। তার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি সহ-নিত্যতাকে সৃষ্ট পৃথিবী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। তার মতে, ঈশ্বর পূর্ণ ও নিত্য। সুতরাং এমন কোনো অতীত কালের কল্পনা করা যায় না, যখন ঈশ্বরের সৃজনীকর্ম চালু ছিল না। একই কারণে এমন কোনো সময়ের কথা ভাবা যায় না, যখন সৃষ্টি বর্তমান ছিল না। এ থেকে এটুকুই প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ব ঈশ্বরের মতোই নিত্য। ঈশ্বর নিজেও এ নিয়মের কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারেন না; কারণ পরিবর্তনমাত্রই ঐশ্বরিক শক্তি ও ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার নিত্যতা ও পরিপূর্ণতার পরিপন্থী।

একটি বিষয়ে অবশ্য ক্রেমেন্ট ও ওরিজেন তথা পরবর্তীকালের রক্ষণশীল খ্রিস্টান দার্শনিকগণ নব-প্লেটোবাদের চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। নব-প্লেটোবাদীদের মতে, যে প্রক্রিয়ায় ‘এক’ থেকে স্বর্গীয় প্রজ্ঞা ও বিশ্বাত্মার সৃষ্টি, বিশ্ব ও জড়ের সৃষ্টি সেই একই প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণমাত্র। মানবাত্মা ও জড়জগৎ উভয়েই একই স্বর্গীয় দ্রব্যের নিম্নতল স্তর। সুতরাং স্বর্গীয় দ্রব্যের সাথে তাদের কোনো মৌলিক গুণগত পার্থক্য নেই। নব- প্লেটোবাদীদের এসব কথা খ্রিস্টান দার্শনিকগণ স্বীকার করেন না। তাদের মতে, পুত্র তৈরি নয়, বরং সন্তান হিসেবে উৎপন্ন। পবিত্রাত্মা তৈরি নয়, গতিশীল। মানবাত্মা ও জড়জগৎ উৎপন্ন নয়, আবার গতিশীলও নয়, বরং তৈরি। এরা ঐশ্বরিক সত্তা থেকে বিকীর্ণ নয়। ঈশ্বর এদের সৃষ্টি করেছেন; তবে যে দ্রব্যের সমবায়ে এদের সৃষ্টি, তা ঐশ্বরিক দ্রব্যের চেয়ে পরিমাণগত ও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র।

উল্লেখ্য, নিওপ্লেটোনিজম অনুসারে ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি, বরং সব তার থেকে বিকীর্ণ হয়েছে এই সিদ্ধান্তের কারণ ছিল যে তাদের মতে পরম সত্তা ইচ্ছা করেননা, এটা তাকে সীমিত ও সসীম করে। এই পরমসত্তা নির্গুণ। কিন্তু ক্লেমেন্ট ও ওরিজেন ত্রিত্বের ধারণা ফিলো প্রভাবিত ছিল, এখানে ঈশ্বর নিওপ্লেটোনিকদের ঈশ্বরের মতো নির্গুণ নন বরং তার কল্যাণ ও শক্তি – এই দুই গুণ থাকে। তিনি জগৎ থেকে অতিবর্তী হলেও লোগোস তৈরি করেন যা সোফিয়া বা জ্ঞান এবং স্পিরিট সমৃদ্ধ হয় ও জগৎ গঠনে ভূমিকা রাখে। এই অতিবর্তী ঈশ্বর ও তার তৈরি লোগোস ছাড়াও হলি স্পিরিট নামে আরেকটি বাইবেলীয় কনসেপ্ট রয়েছে যেটা মানুষকে ঈশ্বরের পথে গাইড করে। এই তিন ভিন্ন কিন্তু আবার এসেনশিয়ালি একও। এই সব নিয়েই ট্রিনিটি।

ওরিজেনের মতে, সৃষ্টজগৎ ও জীবের স্বভাব নিত্য। এ থেকে বোঝা যায় যে, মানবাত্মাও নিত্য এবং জন্মের আগেই তা অস্তিত্বশীল ছিল। ওরিজেন পূর্বঅস্তিত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। ক্লেমেন্টের ন্যায় তিনিও মুক্তিকে একটি জাগতিক প্রক্রিয়া বলে, এবং মানুষের পার্থিব জীবনকে সে প্রক্রিয়ারই একটি অধ্যায়বিশেষ বলে মনে করতেন। পুত্রের মাধ্যমে পিতা সৃষ্টি করেছিলেন একটি পূর্ণ ও নিখুঁত পৃথিবী, আর স্বাধীনইচ্ছার অধিকারী আত্মাদের সৃষ্টি করেছিলেন সেই পৃথিবীতে বসবাস করতে। তাদের কেউ কেউ সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করল (যেমন করেছিল লুসিফের) এবং তাতে তাদের এমনই পতন হলো, যার পর তাদের আর মুক্তিলাভ সম্ভব হলো না। যারা তাদের স্বাধীনতাকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের কাজে ব্যবহার করেছে, তারাই গঠন করতে পেরেছে স্বর্গীয় ক্রমবন্ধন। আবার যারা আংশিকভাবে পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, অথচ ঈশ্বরের প্রেম থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয় নি, তারাই গ্রহণ করেছে দেহ, এবং পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে মানুষ হিসেবে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পাপ জিনিসটা আসলে আদি; কারণ মানবদেহে আত্মার উপস্থিতিই পতনের প্রতীক। এক অর্থে তা আদম থেকেই প্রাপ্ত; কারণ আদম থেকেই মানবদেহের সূত্রপাত। আদমের স্বর্গচ্যুতির পর তার দেহ থেকেই পরবর্তীকালে মানবদেহের উৎপত্তি। তবে মানুষের স্বাধীনতা পূর্বাপর অক্ষুণ্ণ রয়েছে। মানুষের স্বাধীনতা ঈশ্বরের পূর্বনিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে। মানুষ কীভাবে তার স্বাধীনতা ব্যবহার করবে, তা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত নয়। মানুষের যাবতীয় পুণ্য কাজে ঐশ্বরিক নির্দেশ ও সমর্থন আছে ঠিকই, কিন্তু ঈশ্বর পুণ্যকর্মে মানুষকে বাধ্য করেন না।

পার্থিব অশুভ মানুষের নিজেরই কর্মফল এবং মানুষের সব দুঃখ-কষ্ট তার পাপের পরিণতি। তবে আমাদের পার্থিব জীবন কোনোমতেই আমাদের অনন্ত শাস্তি বা মুক্তি নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। শাস্তি ও মুক্তির গোটা ব্যাপারটিই অনিশ্চিত; আর এই অনিশ্চয়তা নিয়েই মানবাত্মা তার দেহত্যাগ করে। মানুষের চূড়ান্ত ভাগ্য আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয়ে থাকে। ক্লেমেন্টের ন্যায় ওরিজেনও বিশ্বাস করেন যে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অনুক্রম শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। এর পূর্ব পর্যন্ত যিশুকে গ্রহণ করা না করা এবং নিজ মুক্তির পথ সুগম করা না করার স্বাধীনতা প্রত্যেক আত্মারই রয়েছে। শেষ বিচারের দিন মুক্তিপ্রাপ্ত সব আত্মা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা হিসেবে তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যাবে। ওরিজেনের মতে, পরিণামে পুণ্যের জয় হবে, এবং অশুভ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।

সিপ্রিয়ান (২১০-২৫৮ খ্রি.), এমব্রুস (৩৩৯-৩৯৭ খ্রি.) ও জিরোম (৩৪২-৩৪৭ – ৪২০ খ্রি.)

আদি খ্রিস্টীয় মত বিকাশের ক্ষেত্রে টেরটুল্লিয়ানের ন্যায় সিপ্রিয়ানও (Cyprian) এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। তিনি কার্থেজ-এর বিশপ ছিলেন। ২৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন। তার সময়ে চার্চের একতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। চার্চের বাইরে অন্য কোনো উপায়ে মুক্তিলাভ অসম্ভব বলে তিনি ঘোষণা করেন। স্বাধীন মতামতে বিশ্বাসী তদানীন্তন ধর্মবিরুদ্ধ সম্প্রদায়সমূহের সাথে তার বিবাদ ছিল।

এমব্রুস (Ambrose)-এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সিপ্রিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গির মতোই বাস্তববাদী। এমব্রুস ছিলেন চার্চের একজন যথার্থ রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি। অংশত তারই অনুপ্রেরণায় অগাস্টিন ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। মিলানের বিশপ থাকাকালে তার সাথে সম্রাটের যোগাযোগ ছিল, আর এ ভাবেই তিনি সম্রাটকে খ্রিস্টীয় নীতি দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।

জিরোম (Jerome) আনুমানিক ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যের প্রতি তিনি এমব্রুসের চেয়েও বেশি আগ্রহী ছিলেন। রোমের সাথে তার পরিচয় ছিল খুবই গভীর। সেখানেই তিনি অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষাগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি দৈহিক ভোগসুখে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তিনি ঋষি হয়ে যান এবং সন্ন্যাস জীবনকে উৎকৃষ্টতর জীবন বলে মনে করেন। বাইবেল অনুবাদ করে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতায় এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যান। কিন্তু দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিরোমের গুরুত্ব ছিল অগাস্টিনের গুরুত্বের চেয়ে অনেক কম।

সেন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.)

পরিচয়

ওরিজেন এবং অগাস্টিনের (Augustine of Hippo) মধ্যবর্তী সময়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে নি। তবে সময়টি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ তখনই প্লোটিনাসের আবির্ভাব ঘটে। খ্রিস্টীয় চিন্তায় (বিশেষ করে প্রাচ্যের গীর্জাসমূহে) প্লোটিনাসের প্রভাব ছিল খুব তাৎক্ষণিক, ব্যাপক ও সুগভীর। পাশ্চাত্যে তার প্রভাব অনুভূত হয় পরে অগাস্টিনের প্রভাবে। তবে একবার সুদৃঢ় হওয়ার পর তা এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, অনেকের মতে মধ্যযুগেও এরিস্টটল নয়, তিনিই ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব। ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে নাইসীয় ধর্মমত ঘোষিত হয় এবং ত্রয়ীবাদের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়। তখন থেকে ঈশ্বরের সঙ্গে যিশুর মানবীয় আকারের সম্পর্ক কী, তাই হয়ে দাঁড়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কের বিষয়। ত্রয়ীবাদের ন্যায় এ প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা থেকেও বহু বিতর্কমূলক সিদ্ধান্তের সৃষ্টি হয়।

অগাস্টিন ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে ট্যাগাস্টা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন প্যাগান এবং মা ছিলেন খ্রিস্টান। যৌবনে তিনি উপযুক্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি ল্যাটিন সাহিত্য পছন্দ করতেন। সিসেরোকে তিনি সর্বকালের একজন মহান চিন্তাবিদ বলে শ্রদ্ধা করতেন। তার পরবর্তীকালের স্বীকারোক্তি অনুসারে যৌবনে তিনি নানারকম উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত ছিলেন। এক উপপত্নীর গর্ভে তার একটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল। কিছুদিন তিনি সংশয়বাদী ছিলেন। এরপর কিছুকাল তিনি মানী মতবাদে আস্থাশীল ছিলেন। পরে তিনি ক্যাথলিক ধর্মমতে দীক্ষিত হন। ৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি কার্থেজ-এর নিকটবর্তী হিপোর বিশপ নিযুক্ত হন। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। তার গ্রন্থাবলির মধ্যে ‘কনফেশন্‌স্’ (Confessions) এবং ‘সিটি অব গড’ (City of God) বিখ্যাত। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় মতবাদের বিস্তারের ক্ষেত্রে এ দুই গ্রন্থের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কথিত আছে যে, কাথলিক মতে অগস্টিনের দীক্ষালাভের মূলে ছিল প্লোটিনাসের রচনাবলির সাথে তার পরিচয়। ইতোমধ্যে প্লোটিনাসের ‘এন্নিয়্যাডস্’ গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়। প্লেটোর প্রতিও অগাস্টিন গভীর শ্রদ্ধাপোষণ করতেন এবং প্লেটোকে সির্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বলে মনে করেন। তবে তার কাছ থেকে আমরা এরিস্টটল সম্পর্কে কিছুই শুনতে পাই না। ধর্মান্তরের ফলে অগাস্টিনের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। বুদ্ধি ও বিচারমূলক চিন্তার স্থলে তিনি বিশ্বাসের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। মানুষ ও তার সম্ভাবনার স্থলে তিনি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দেন। তিনি তার দার্শনিক রচনায় এটুকু বুঝিয়ে বলেন যে, ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোনো বাস্তবসত্তা (reality) নেই, থাকতেও পারে না। ঈশ্বর থেকে পৃথক হওয়া মাত্রই মানুষ চির অভিশাপে নিপতিত হয়। কিন্তু ঈশ্বরকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে নির্মল প্রশান্তি লাভ করে। অগাস্টিনের মতে, শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয়, ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্য ঐশ্বরিকপ্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য। ঈশ্বর যে আছেন, তা আমরা কী করে জানি? এ ধরনের একটি বাস্তবসত্তা যে আছে, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি কী করে? ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অগাস্টিনের কোনো সংশয় ছিল না। সত্য শিব ও সুন্দরের অনুসন্ধানে আমরা যে ধারণা দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকি, তা হলো এই যে, সত্য শিব ও সুন্দর নিঃশর্ত বা অনপেক্ষভাবে বিদ্যমান। অগাস্টিনের মতে, আপেক্ষিক মানদণ্ডমাত্রই অনপেক্ষ মানদণ্ডের নির্দেশক। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে এই অনপেক্ষ মানদণ্ড নিরর্থক হয়ে যায়। তাছাড়া আদিকারণের আবশ্যিকতা, বিশ্বের বুদ্ধিসম্মত রূপ ও বৈশিষ্ট্য, ঈশ্বরের অস্তিত্বে সর্বজনীন বিশ্বাস প্রভৃতিও ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এসব ধারণা সত্য। আর সত্য বলেই তারা আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয়ও বটে। সুতরাং যে সত্তা থেকে এসব ধারণার উৎপত্তি, এবং এরা যার নির্দেশক, তা-ও সমানভাবেই আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয় হতে বাধ্য। সুতরাং বলা চলে যে, আবশ্যিক ও অপরিবর্তনীয় স্বভাবের একটি সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। আর সেই সত্তাই ঈশ্বর। বুদ্ধির সাহায্যে আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে যা জানি, তিনি শুধু তাই নন, তার চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য মানবীয় অভিজ্ঞতা, শক্তি ও অন্যান্য কলাকৌশলের মাধ্যমেই ঈশ্বরের অন্তঃসারকে জানা যায় না। তবুও ন্যায় শুভ প্রজ্ঞা সর্বশক্তিমত্তা সর্বজ্ঞতা প্রভৃতির ধারণা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আংশিকভাবে হলেও ইঙ্গিত করে।

এসব গুণ তথা ঈশ্বরের প্রজ্ঞাসম্মত বৈশিষ্ট্য মূর্ত ও প্রকাশিত হয় পুত্রের ব্যক্তিত্বে। প্লেটো যেসব প্রত্যয় (Ideas)-এর কথা বলেছিলেন, ঈশ্বর সেগুলোর পরিকল্পনা করে থাকেন পুত্রের মাধ্যমে। এসব প্রত্যয় বিশ্বের ‘প্যাটার্ন’ বা আদর্শ হিসেবে কাজ করে। আবার পুত্রের মাধ্যমেই এবং প্রত্যয়সমূহের অনুকরণেই ঈশ্বর ইন্দ্রিয়জগৎ সৃষ্টি করেন। প্রসঙ্গত, এই প্রত্যয়জগৎ শুধু সার্বিকেরই নয়, বিশেষ প্রত্যয়ের উৎসস্থল। এসব প্রত্যয় মিলে একটি সুসংহত সমগ্র সৃষ্টি করে। এই সুসংবদ্ধ ও বুদ্ধিসম্মত বিধানের অনুকরণে যে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করা হয়, তা স্বাভাবিক কারণেই সুন্দর ও শুভ হয়ে থাকে।

দর্শন

সৃষ্টিবিষয়ক মতবাদে অগাস্টিন ক্লেমেন্ট ওরিজেন প্রচারিত রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় মতবাদের সমর্থন করেন। প্লেটোর মতে, ঈশ্বরের পাশাপাশি পূর্ব-অস্তিত্বশীল জড় থেকে বিশ্বের সৃষ্টি। অগাস্টিন এ মতের সমর্থন করেন নি। প্লোটিনাসের মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, কাল (time)-সৃষ্টির আগে বিশ্ব ঈশ্বর থেকে বিকীর্ণ হয় নি। সুতরাং বিশ্ব ঈশ্বরের সহ-নিত্য হতে পারে না। আবার (ওরিজেনের মতের বিরুদ্ধে) বিশ্ব কোনো চিরন্তন সৃষ্টিক্রিয়ার চিরন্তন অভিব্যক্তিও নয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে শূন্য থেকে এ জগতের সৃষ্টি। ওই বিশেষ মুহূর্তটিই ছিল প্রথম মুহূর্ত। সুতরাং জগৎ ও কালের সৃষ্টি হয় একই সঙ্গে। জগৎ যদি অনন্ত না হয়ে থাকে, তাহলে জগৎসৃষ্টির পূর্ববর্তী সময়ে ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি অনাবশ্যক ছিল বলে উত্থাপিত আপত্তির উত্তর অগাস্টিনের এ মতে পাওয়া যায়। আবার মুহূর্তের খেয়ালখুশির বশবর্তী হয়েই ঈশ্বর জগৎসৃষ্টি করেছিলেন বলে প্রচলিত যুক্তির উত্তরও এ মতে পাওয়া যায়। জগৎ সৃষ্টির এবং অন্য কোনো জগৎ সৃষ্টি না করে এই জগৎ সৃষ্টির ঐশ্বরিক সংকল্প ঈশ্বরের নিজের মতোই অনন্ত। সৃষ্টির আগে কালেরই অস্তিত্ব ছিল না। জগৎ সৃষ্টির সঙ্গেই কালের সৃষ্টি হয়। ঈশ্বর চিরন্তন, আর এর অর্থ এই যে, তিনি কালের অতীত। এমন কোনো কাল ছিল না যখন ঈশ্বর ছিলেন না। মোটকথা, জগৎ সৃষ্টি ঈশ্বরের মুহূর্তের খেয়ালখুশি নয়, বরং এক সুচিন্তিত পরিকল্পনারই ফলশ্রুতি।

অগাস্টিন তার জ্ঞানবিষয়ক মতবাদে সম্ভাব্যতার সমর্থন করেন নি। তার মতে, আমরা কখনো আপেক্ষিক মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত হতে পারি না। বস্তুত, নিছক সম্ভাব্যতার সাহায্যে সত্য আবিষ্কার করা যায় না। চিরন্তন সত্য প্রাপ্তির উপায় দুটি। এদের প্রথমটি বাহ্যবস্তু পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষণ; কেননা এতে ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ পায়। সত্য লাভের দ্বিতীয় উপায় আত্ম-ধ্যান। আত্ম-ধ্যানের মাধ্যমেই আমরা আমাদের মধ্যে যে স্বর্গীয় শক্তি রয়েছে, সেই শক্তিকে উপলব্ধি করতে পারি।

আত্মসত্তার অস্তিত্ব প্রসঙ্গে অগাস্টিনের বক্তব্যে আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের জনক ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০)-এর মতের পূর্বাভাস লক্ষ করা যায়। নিজ অস্তিত্বের ধারণা থেকে শুরু করে তিনি দেখাবার চেষ্টা করেন যে, আসলে সংশয় বিশ্বাসকে প্রতিপাদন ও প্রমাণ করে। তিনি বলেন, “কোনোরকম উদ্ভট কল্পনা ছাড়াই আমি জানি যে, আমি ‘আমি’ হিসেবেই আছি, আমি জানি এবং ভালোবাসি। কেউ কেউ কেতাবি যুক্তির মাধ্যমে প্রায়শই প্রশ্ন তুলেন: ‘তুমি যদি ভুল কর তাহলে?’ এসব যুক্তিকে আমি ভয় করি না, কারণ আমি জানি, যদিও আমি ভুল করি তবু আমি আমি-ই থেকে যাই। কারণ যার কোনো অস্তিত্ব নেই, সে ভুল করতে পারে না। সুতরাং আমার ভুল আমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।” সব চেয়ে বড় কথা, ‘আমি’ বা আমার আত্মার অস্তিত্ব সন্দেহ করার অর্থ হলো আত্মাকে স্বীকার করা। কেন না সন্দেহকারীকে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে; আর চিন্তা করতে হলে তাকে অবশ্যই অস্তিত্বশীল হতে হবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমরা চিন্তাশীল সত্তা বা আত্মা।

টেরটুল্লিয়ান আত্মাকে জড়ীর স্বভাবের বলে মনে করতেন; কিন্তু অগাস্টিনের মতে, আত্মা একটি অজড়ীয় আধ্যাত্মিক সত্তা। চিরন্তন ও অজড়ীয় সত্তাকে যে আত্মা অনুধাবন করতে পারে, তা-ই আত্মার অজড়ত্ব ও অমরত্বের প্রমাণ। তবে প্লেটো ও ওরিজেনের ন্যায় অগাস্টিন আত্মার প্রাক-জন্ম অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। আত্মার উদ্ভব সম্পর্কে অগাস্টিন ছিলেন অনিশ্চিত ও দ্বিধাগ্রস্ত। তার মতে, আত্মা ঈশ্বর থেকে বিকীর্ণ নয়। জড়জগৎ ও আত্মা উভয়েই একই সময়ে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট, তবে সন্তানসন্ততির আত্মা কি মাবাবার আত্মা থেকে প্রাপ্ত, না সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট ও তারই নির্দেশে পৃথিবীতে আগত প্রতিটি নতুন দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট, এ নিয়ে তিনি মোটেও নিশ্চিত ছিলেন না। প্রত্যেক আত্মার আকস্মিক সৃষ্টিবিষয়ক মতবাদ রক্ষণশীল মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার

আগে, এ প্রশ্নটি বেশ কিছুকাল ধরে খ্রিস্টীয় চার্চ ও ধর্মবেত্তাদের মধ্যে আলোচিত হয়। প্রত্যেক আত্মাই অনন্য। তিনটি বৃত্তির কল্যাণে আত্মায় ঈশ্বরের প্রকৃতি প্রতিফলিত। এই তিনটি বৃত্তি হলো বুদ্ধি, ইচ্ছা ও স্মৃতি। তবে চেতনার সব উপাত্ত আসে বাইরের জগৎ থেকে। ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার উৎস ইন্দ্রিয়জগৎ। প্রত্যয় জগতের জ্ঞান আমরা পেয়ে থাকি ঐশ্বরিক আলোর সাহায্যে এবং প্রাকসিদ্ধ উপায়ে, অভিজ্ঞতা- নিরপেক্ষভাবে। পরিবর্তনশীল ও ভ্রান্তিপ্রবণ মানবমন কীভাবে সার্বিক সত্যের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারে, এর উত্তরে অগাস্টিন বলেন, ঐশ্বরিক আলোর সাহায্যেই তা সম্ভব। এই ঐশ্বরিক আলোই মানুষের জ্ঞানে নিশ্চয়তা প্রদান করে। প্রত্যেক মানুষই এই আলো পেতে পারে। এর সাহায্যেই মানুষ চিরন্তন প্রত্যয় এবং সত্যমিথ্যা, শুভাশুভ প্রভৃতির জ্ঞান লাভ করে।

ভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা আদমের পতনের ফলশ্রুতি। আদম ও ইভ পাপ করেছিলেন বলেই তাদের বংশধর সব মানুষ পাপী। পতনের ফলে প্রজ্ঞার আলোক স্তিমিত হয়ে যায় এবং এর ফলে আমরা আর আমাদের আন্তর্শক্তির সাহায্যে প্রত্যয়ের সন্ধান পেতে পারি না। আর তা পারি না বলেই যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব এবং গোটা মানবজাতির মঙ্গল ও মুক্তির জন্য তার মধ্যে সত্যের প্রত্যাদেশ। একমাত্র যিশুই মানুষের পাপমোচনে সাহায্য করতে এবং ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভে মানুষকে সাহায্য করতে পারেন। ঐশ্বরিকজ্ঞান শুধু বৌদ্ধিক নয়, নৈতিক কার্যকলাপেরও লক্ষ্য। ঐশ্বরিকজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ লাভ করে স্থায়ী আনন্দ ও শান্তি, ঐশ্বরিকজ্ঞানের আন্বেষা মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করে ঈশ্বরের নগরের সদস্য হিসেবে। যারা এই অন্বেষাকে গভীরভাবে না নিয়ে খেয়ালখুশির বিষয় হিসেবে নিয়ে থাকে, তারাই চিহ্নিত হয়ে থাকে পার্থিব নগরের সদস্য হিসেবে। তাদের জন্য ঐশ্বরিক কৃপা অত্যাবশ্যক। জ্ঞান ও পুণ্যের অগ্রগতি সমানভাবে সাধিত হওয়া উচিত। সুতরাং (এরিস্টটলএপিকিউরীয়গণের মতের বিরুদ্ধে তিনি বলেন) নৈতিক জীবনকে সুখলাভের উপায় হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। ঐশ্বরিকজ্ঞানপ্রাপ্ত জীবনের প্রতীক হিসেবে (স্টোয়িকরা যেমন বলেছিলেন) নৈতিক জীবন নিজেই একটি লক্ষ্য। প্লেটোর মতের প্রতিধ্বনি করে অগাস্টিন বলেন, ঈশ্বরই পরম শুভ। সর্বপ্রকার প্রেম ও ইচ্ছাকে এই পরমশুভ, অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রেম ও ইচ্ছায় পরিণত করাই হওয়া উচিত নৈতিক কার্যকলাপের লক্ষ্য।

মানুষকে ঈশ্বর নিষ্পাপ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন, স্বর্গে থাকতে দিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা ও শক্তির অপব্যবহার করে স্বর্গচ্যুত হয়। এভাবেই পৃথিবীতে পাপ ও অশুভ প্রবেশ করে ও তখন থেকেই স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত মানুষের মধ্যে আদি পাপ সংক্রমিত হয়। তাই মানুষ অভিশপ্ত। কিন্তু ঈশ্বর কৃপাবশত মানুষকে পাপমুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করেন এবং হিব্রুদেরকে মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে নির্বাচিত করেন। তবু মানুষ ক্রমশ ঈশ্বরকে ভুলে যায় ও দুর্নীতি-অপকর্মে লিপ্ত হয়। শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর বন্যা পাঠান, যার ফলে নূহ নবী ও তার পরিবারবর্গ ছাড়া গোটা মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তবু নূহের বংশধরেরা পূর্বপুরুষের ন্যায় পাপাচারে পুনরায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক মহৎ লোক সৎ জীবনযাপন করতে থাকে। অসংখ্য পাপী লোক অধ্যুষিত শয়তানের নগরের পাশাপাশি তারা একটি ঈশ্বরের নগর গড়ে তোলে। এসব পূণ্যবান ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ইহুদি পুরাণে বর্ণিত সেসব নবী-পয়গম্বরগণ, যারা সমসাময়িক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, মানুষের মুক্তির পথ সুগম করেছিলেন।

যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের পর যারা তাকে গ্রহণ করল এবং তার উপদেশ অনুসারে কাজ করল, তারাই মুক্তি পেল, ঈশ্বরের নগরের অধিবাসী হওয়ার সুযোগ পেল। এরপর মানুষের ইতিহাসের এক অবিরাম সংঘাত সূচিত হলো। ঈশ্বরের নগর ও পাপীতাপীদের নিয়ে গঠিত পার্থিব নগরের মধ্যে এই সংঘাত চললো। এ দুই নগরের বাহ্য ও দৃশ্যমান অভিব্যক্তি একদিকে চার্চ, যা ঈশ্বরের কৃপার বাহন ও বিশ্বস্তদের আবাসভূমি, অন্যদিকে সব পার্থিব ও অধার্মিক কার্যকলাপ, যেগুলো আধ্যাত্মিক ও খ্রিস্টীয় জীবনের পরিপন্থী। ঈশ্বরের নগর ও শয়তানের নগরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব ও শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। তখনই মানুষের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যেসব পুণ্যবান মানুষ যিশুকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের পাপের জন্য অনুশোচনা করে ঈশ্বরের পথে পরিচালিত হয়েছিলেন, তখন তারা তাদের পুরস্কার পাবেন এবং অনন্তকাল ধরে পরম গৌরবের সাথে ঈশ্বরের নগরে বাস করতে থাকবেন। অন্যদিকে যারা যিশুকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং পাপকার্যে লিপ্ত হয়েও কোনোরকম অনুশোচনা করে নি, তারা হবে অভিশপ্ত এবং চিরদিন নরকের নির্যাতন ভোগ করবে।

পেলাগীয় ধর্মবিরুদ্ধ মতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যও অগাস্টিন ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পেলাগিয়াস ও তার অনুসারীগণ আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্টের ন্যায় আদি পাপের ধারণাকে অস্বীকার করেছিলেন। এ মত অনুসারে, আদমের পতন গোটা মানব জাতির পাপের ফল। এই পাপময় অবস্থায়ই আমাদের জন্ম ও মৃত্যু এবং এর জন্য আমাদের ভোগ করতে হয় শাস্তি। একমাত্র যিশুর কৃপা আমাদের উদ্ধার করতে পারে। এ মতের বিরুদ্ধে পেলাগীয়রা বলেন; মৃত্যু পাপের শাস্তি নয়, একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এর সাথে আদমের পতনের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ পাপ নিয়ে জন্মায় না। জন্মকালে প্রতিটি মানবাত্মাই থাকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। নিজের কার্যকলাপের ফলেই সে পাপী হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, আমরা খ্রিস্টধর্মের সাহায্য ছাড়াই পাপ থেকে বিরত থাকতে এবং আমাদের পবিত্রতা রক্ষা করতে সক্ষম। এ জন্যই খ্রিস্টের আবির্ভাবের আগেও অনেকেই সৎ ও ধর্মানুরাগী জীবনযাপন করে মুক্তিলাভ করেছে। আবার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত না হয়ে মারা গেলেই যে নরকে যেতে হবে, এমন কথা বলা অযৌক্তিক। দীক্ষিত না হয়ে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে এসব শিশু নরকে যাবে, একথা বলা হাস্যকর নয় কি?

রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় মতের পক্ষে এসব কথা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। এ মত অনুসারে খ্রিস্টীয় অবতার ও মুক্তির ধারণা অতিরিক্ত ও অনাবশ্যক। অগাস্টিন তাই এ মতের বিরুদ্ধে গ্রহণ করলেন এক দৃঢ় পদক্ষেপ। ৪১১ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজের কাউন্সিলে এ মতকে সরকারিভাবে নিন্দা করা হয়। আদি পাপের পক্ষে অগাস্টিন তখন বলেন, ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সুতরাং বিশ্বসৃষ্টির আগেই তিনি আদমের পাপ ও পাপের পরিণতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সুতরাং একথা বলা চলে যে, আগে থেকেই ঈশ্বর কিছু মানুষকে পাপমুক্ত এবং অন্যদের অভিশপ্ত করার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন।

অগাস্টিনের এ মত থেকে একটি জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়। প্রশ্নটি এ রকম: ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান কি পূর্বনিয়ন্ত্রণের নির্দেশক নয়? এর ফলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থন এবং ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার সাথে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার সামঞ্জস্যবিধান অগাস্টিনের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এ নিয়ে তখন যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়, তা আজো খ্রিস্টীয় চিন্তাবিদদের ভাবনার বিষয়। অগাস্টিনের মত প্রসঙ্গে অন্য যে প্রশ্নটি পরবর্তীকালে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তা হলে এই ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও ঐশ্বরিক বুদ্ধি, এ দুয়ের মধ্যে কোনটি প্রথম ও প্রধান? ঈশ্বরের স্বরূপ কি তার ইচ্ছার ফল, নাকি তার ইচ্ছাই তার স্বভাবের ফল? টেরটুল্লিয়ান এ দুই বিকল্প মতের প্রথমটির সমর্থক ছিলেন, কিন্তু অগাস্টিন ছিলেন দ্বিতীয়টির পক্ষে। ঈশ্বর যা ইচ্ছা করেন তা শুভ, তবে তিনি ইচ্ছা করেন বলেই যে তা শুভ, একথা ঠিক নয়। বরং তিনি ইচ্ছা করেন এ জন্য যে, তা আসলেই শুভ। শুভ ও অশুভ ঈশ্বরের নির্দেশে সংঘঠিত হয় না; বরং শুভ ও অশুভই ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অনুপ্রাণিত করে। ঈশ্বরের স্বাধীনতা আত্মনিয়ন্ত্রণের নির্দেশক কি না, এ প্রশ্নটি নিয়ে পরবর্তীকালে টমাস একুইনাস ডান স্কোটাসের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। টমাসীয় আত্মনিয়ন্ত্রণবাদই পরে ক্যাথলিকদের স্বীকৃত মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

পরবর্তীকালের চিন্তায় অগাস্টিনের প্রভাব

পরবর্তীকালের চিন্তায় অগাস্টিনের প্রভাব ছিল অপরিমেয়। তিনি শুধু মধ্যযুগের চিন্তার ভিত্তিই স্থাপন করেন নি, প্লেটোবাদকে তিনি শুধু খ্রিস্টীয় আদর্শের উপযোগী করেই ব্যাখ্যা করেন নি, একইসঙ্গে তিনি খ্রিস্টীয় দর্শনের এমন এক সুসংবদ্ধ রূপও দিয়েছিলেন, যা ক্যাথলিকবাদ প্রোটেস্টান্টবাদ-এ দুয়ের ওপরই প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এজন্য দেখা যায় যে, অগাস্টিনীয় দর্শন লুথার, যুয়িঙ্গলি ও ক্যালভিন প্রমুখ প্রোটেস্টান্ট সংস্কারকের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। তা ছাড়া অগাস্টিনের সমাজদর্শন পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্মেষ ও বিবর্তনকেও প্রভাবিত করে।

তার ইতিহাসদর্শন কেবল ধর্মীয় আন্দোলনসমূহেই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনেও বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। আজকের দিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে যে সংঘর্ষ ও সংগ্রাম চলছে তাতেও সেই একই নির্বিচারবাদ, একই ধর্মোন্মত্ততা, অনপেক্ষ মানদণ্ডের প্রতি একই বিশ্বাস লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন বিরোধী মতাদর্শের সংঘর্ষে সবাই যেন আজ নিজ নিজ মতাদর্শের অকাট্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত। তাই তারা চায় না অন্যের সঙ্গে আপোস করতে, উগ্রমত পরিহার করে মধ্যপথ গ্রহণ করতে।

অগাস্টিনের ঈশ্বরকেন্দ্রিক মত পাশ্চাত্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির পরও, বিভিন্ন প্রকৃতিবাদী মতবাদের বিস্তার সত্ত্বেও ঈশ্বরে বিশ্বাস আজো আধুনিক সভ্যতার অংশ হিসেবে অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অগাস্টিনের সময় থেকে পাশ্চাত্যের মানুষ ক্রমবর্ধমানভাবে অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেছে। এই অন্তর্মুখী মনোভাবই আধুনিক মানুষ ও প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে পার্থক্যের এক বড় কারণ। প্রাচীন গ্রিকরা ভারসাম্য ও সংযমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করত এবং অন্তর্দর্শনকে নিন্দা করত। কিন্তু অগাস্টিনই প্রথম ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত অহং বা ‘আমি’-কে দর্শনের এক মূল সমস্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অস্তিত্ববাদ ও অন্যান্য আধুনিক দার্শনিক আন্দোলন ঈশ্বরের এই ধারণাকে হয়তো গ্রহণ করে নি; কিন্তু অগাস্টিনের ন্যায় তারাও ব্যক্তির সমস্যাকে দর্শনের একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করছে। এ অর্থে অস্তিত্ববাদীদের বিশ্বাসবিবর্জিত অগাস্টিনপন্থি বলে অভিহিত করা যায়।

আমাদের একথা উপলব্ধি করা দরকার যে, অগাস্টিন তার প্রশ্নাবলির যেসব উত্তর দিয়েছেন সেগুলো নয়, বরং তিনি যেসব তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, সেগুলোতেই তার গুরুত্ব নিহিত। বিশ শতকে আজ আমাদের কাছে তার বিশ্বতাত্ত্বিক মতকে সেকেলে ও অচল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, সেগুলোর আবেদন কালজয়ী। অগাস্টিনের ন্যায় আজো মানুষ নিশ্চয়তার অনুসন্ধান করে, নিজেদের কার্যকলাপের পরিমাপ ও মূল্যায়নের একটি সুষ্ট মানদণ্ড পেতে চায়। অগাস্টিনকে তাই উপেক্ষা করা চলে না, পাশ্চাত্য সভ্যতার সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পক্ষে তার প্রভাব ছিল অপরিসীম।

অগাস্টিন-উত্তর খ্রিস্টীয় দর্শন

অগাস্টিনের মৃত্যুর (৪৩০ খ্রি.) মধ্য দিয়ে এক সৃজনশীল যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। তার মৃত্যুর বিশ বছর আগে, অর্থাৎ ৪১০ খ্রিস্টাব্দে গথরাজা এলারিক রোম লুণ্ঠন করেন। এর বিশ বছর পর হান রাজা এটিলা পরিচালিত অনুরূপ আক্রমণের হাত থেকে রোম কোনোরকমে রক্ষা পায়। এরপর দুই দশক অতিক্রান্ত হতে না হতেই পশ্চিম রোমের শেষ সম্রাট সিংহাসনচ্যুত হন এবং তার জায়গায় জার্মানির এক ভাড়াটে ব্যক্তি রাজত্ব করেন। এরপর দীর্ঘ চারশ’ বছর ধরে পশ্চিম ইউরোপ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পশ্চিম ইউরোপে এই অন্ধকার যুগে স্থায়ী ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল চার্চ। তখন চার্চ-ই ছিল প্রাচীন সংস্কৃতি ও খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। খ্রিস্টধর্ম তখন ক্রমশ নতুন নতুন স্থানে নতুন নতুন জাতিতে বিস্তৃত হতে থাকে। চার্চ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণ ও নতুন জ্ঞানের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চার্চ যে ভূমিকা পালন করে, তাতেই তৈরি হয়ে ওঠে স্কলাস্টিক আন্দোলনের ভিত্তি।

ছদ্ম ডাইওনিসিয়াস (আনু. ৪০০ – ৫০০ খ্রি.)

ধ্যান-অনুধ্যানের প্রতি পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যের ঝোঁক ছিল অনেক বেশি। আর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে অধিকতর সংহতি ও শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল বলে সেখানে খ্রিস্টীয় দার্শনিক চিন্তায় অন্ধকার তেমন দ্রুত নেমে আসতে পারে নি। অগাস্টিনের মৃত্যুর এক শতাব্দী পরে কনস্টান্টিনোপলে ডাওনিসিয়াস ছদ্মনামে (Pseudo-Dionysius the Areopagite) এক খ্রিস্টান দার্শনিকের রচনাবলি প্রকাশিত হয়। ‘স্বর্গীয় নামসমূহ’ (Divine Names), মরমি ধর্মতত্ত্ব (Mystical Theology), ‘স্বর্গীয় ক্রমবন্ধন’ (Celestial Hierarchy) এবং ‘যাজকীয় ক্রমবন্ধন’ (Ecclesiastical Hierarchy) – এই ছিল ছন্ম ডাইওনিসিয়াস-এর রচনাবলি। এ ছাড়াও দশটি চিঠি তার রচনার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এসব রচনা ছিল মরমিধর্মী। তবে শুধু মরমিবাদীরাই নয়, সেন্ট এলবার্ট, সেন্ট টমাস একুইনাস প্রমুখ পেশাদার ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকগণও এসব রচনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ছদ্ম ডাইওনিসিয়াস তার এসব রচনায় ‘এক’-এর অনির্বচনীয়তা, মানবাত্মা ও বিশ্বজগৎ পর্যন্ত বিকিরণ-এর সম্প্রসারণ, সব জিনিসের ত্রয়ী গঠনসহ প্লোটিনাসপ্রোক্লাসের প্রধান মতসমূহকে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে প্রয়োগ করেন। এসব মত ছিল সর্বেশ্বরবাদী ও গোঁড়ামতবিরুদ্ধ। এদের মাধ্যমে প্রাচীন জগতের দর্শন মধ্যযুগে প্রবেশের সুযোগ পায়। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় মরমিবাদে এসব রচনার বেশ প্রভাব দেখা যায়। মূলত এদের অনুপ্রেরণায়ই অনেক চিন্তাবিদ গোঁড়ামতবিরুদ্ধ নতুন মত প্রচারে সাহস পান। এরপর আস্তে আস্তে প্রাচ্যদেশসমূহেও অন্ধকার নেমে আসে। এ সময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে মুসলমানরা আধিপত্যবিস্তার করতে সক্ষম হয়, এবং শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বিথিয়াস (আনু. ৪৮০-৫২৪ খ্রি.) ও পরবর্তী

এইমাত্র যেসব ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করা হলো, তাদের কথা বাদ দিলে পঞ্চম শতক থেকে নবম শতক পর্যন্ত খ্রিস্টীয় জগতে গুটিকয়েক উল্লেখযোগ্য দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে ইটালিরাজ থিওডোরিকের মন্ত্রী বিথিয়াস (Boethius, ৪৮০-৫২৪) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। রাজনৈতিক যশ ও সুনামের উচ্চ শিখরে ওঠেও এই হতভাগ্য চিন্তাবিদ দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে প্রথমে কারাবরণ এবং পরে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন।

বিথিয়াস তার বন্দিদশায় ‘কন্সোলেশন অব ফিলোসফি’ শীর্ষক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তীকালের চিন্তার এ গ্রন্থের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আলফ্রেড দি গ্রেট এটিকে এঙ্গলো স্যাকসন ভাষায় এবং সসার, লীডগেট ও এলিজাবেথ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। রেনেসাঁর প্রারম্ভে গ্রন্থটি জার্মান, ফরাসি, ইটালীয়, স্পেনীয় ও গ্রিক ভাষায় প্রকাশিত হয়। বিথিয়াস যখন কারাগারে বন্দি, তখন একজন সুন্দরী স্ত্রীলোকের বেশে দর্শন তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিয়েছিল, এ গ্রন্থে তিনি তা বিবৃত করেছেন। সুন্দরী মহিলারূপী দর্শন তাকে বলেন: পৃথিবী পরিচালনা ও শাসনের মূলে রয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর, সুতরাং সবকিছুই পরিণামে ভালো। বিথিয়াস যদি তার ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এর অর্থ হবে এই যে, প্রকৃত শুভ ও প্রকৃত আনন্দ কিসে নিহিত তা তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃত শুভ ও প্রকৃত আনন্দ পার্থিব ধন-সম্পদ বা বিষয়-বৈভবে নিহিত নয়। ঐশ্বরিক প্রেম ও ঐশ্বরিকজ্ঞানই এদের উৎস ও আকর। পার্থিব কোনকিছুই তা দিতে পারে না, আবার নিয়েও যেতে পারে না। আবার আপাত অশুভ ও অমঙ্গলের অস্তিত্ব ঈশ্বরের পরম মঙ্গলময়তা ও ন্যায়পরতায় বিশ্বাসের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। মন্দ লোকেরা কখনো প্রকৃত উন্নতি অর্জন করতে পারে না। হীনতা ও পাপাচার তাদের স্থায়ী মঙ্গল অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। নিজেদের কৃতকর্ম দ্বারাই তারা তাদের সত্যিকারের সত্তাকে ধ্বংস করে দেয়। বাহ্য দৃষ্টিতে তাদের সমৃদ্ধশালী বলে মনে হলেও আসলে তারা সমৃদ্ধশালী নয়। দৈহিক দিক থেকে জীবিত হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে তারা মৃত। তারা দুষ্কর্মে যতই কৃতকার্য হয়, তাদের যন্ত্রণা ততই দীর্ঘায়িত হয়। মৃত্যুর পর তারা শাস্তিভোগ করবে, অথবা এক যন্ত্রণাদায়ক পাপমোচন প্রক্রিয়া ভোগ করবে। বিথিয়াসকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয় যে, সবকিছুই ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও ঐশ্বরিক পরিকল্পনা অনুসারে সংঘটিত হয়। অদৃষ্টও ঐশ্বরিক ইচ্ছার অভিব্যক্তি। অদৃষ্ট এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে ঐশ্বরিকবুদ্ধি ঐশ্বরিকপরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করে এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু ও ঘটনাকে আমাদের কাছে লক্ষ্যহীন ও বিশৃঙ্খল মনে হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের দৃষ্টিতে জগতের আদর্শ সুস্পষ্ট এবং তার কার্যকলাপ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ঈশ্বর যদিও অদৃষ্টের মাধ্যমে সবকিছুকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করেন, তাতে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হয় না। ঈশ্বর সবকিছুই আগে থেকে দেখেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, এ তিনটি কালকেই ঈশ্বর যুগপৎ প্রত্যক্ষ করেন এবং বিশ্বের নিত্যতাকে তিনি একটি চিরন্তন ঘটনা হিসেবে দেখে থাকেন। তবে ঈশ্বরের এই পূর্ব- জ্ঞানের অর্থ এই নয় যে, তিনি সবকিছুকে আগে থেকে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন। আমরা ঠিক কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা প্রয়োগ করবো, কোন পরিস্থিতিতে আমরা কী নির্বাচন করব, তা ঈশ্বরের পূর্বজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তবে আমরা কখন কী করছি, ঈশ্বর তা দেখতে পাচ্ছেন বলে যে বিশ্বাস, তা আমাদের কুপথ থেকে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।

বিথিয়াস ছিলেন গ্রিক দর্শনে সুপণ্ডিত। তিনি ল্যাটিন ভাষায় এরিস্টটলের গ্রন্থাবলির যে অনুবাদ করেন, এর জন্য মধ্যযুগর দার্শনিকগণ তার কাছে ঋণী ছিলেন। তিনি নিজেও যুক্তিবিদ্যার ওপর কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থ পরবর্তীকালে যুক্তিবিদ্যাবিষয়ক মতাবলির ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এ ছাড়া পাটিগণিত, সংগীত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি কয়েকটি গ্রন্থ সংকলন করেন। সংগীত শাস্ত্রের ওপর তার একটি গ্রন্থ আজো সংগীতবিষয়ক জ্ঞানের একটি মূল্যবান উৎস হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত।

বিথিয়াস খ্রিস্টান ছিলেন কি-না, এ বিষয়টি বিতর্ক সাপেক্ষ। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে কুসংস্কারমুক্ত। তার ‘কনসোলেশন অব ফিলোসফি’ গ্রন্থটিতে খ্রিস্টীয় প্রভাবের তেমন কোনো চিহ্নই দেখা যায় না। তবে খ্রিস্টীয় মতাবলি বিষয়ক কতিপয় রচনা তার ওপর আরোপ করা হয়ে থাকে। এগুলো যদি সত্যিই তার রচনা হয়ে থাকে, তা হলে এটুকু বলা যায় যে অন্তত যৌবনে তিনি খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।

বিথিয়াসের নামের সাথে ক্যাসিওডোরাসের নামও উল্লেখ্য। বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন বিথিয়াসের চেয়ে কিছু ছোট। তিনিও থিওডোরিকের অধীনে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারি ছিলেন। তিনি বার্ধক্য পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তার প্রভূত অবদান ছিল। গ্রিক দার্শনিকদের রচনাবলি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের সুবিধার্থে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করার কাজে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, সংগীত, পাটিগণিত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত গ্রন্থাবলি মধ্যযুগে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

বিথিয়াসের পর ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চায় এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ল্যাটিন সংস্কৃতির পতন, ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় জড়বাদ, সামন্তবাদের উদ্ভব, নব-অতীন্দ্রিয়বাদ প্রভৃতি কারণে জ্ঞানচর্চার গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। ধর্মযাজকদের তরফ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ ও সংকলনের যে চেষ্টা করা হয়, তা-ও স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়। তবে এ সময়ের দুটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এদের একজন ইসিডোর (মৃ. ৬৩০ খ্রি.)। তিনি ছিলেন সেভিল- এর আর্চ বিশপ। আবার তিনি ছিলেন তার যুগের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তার রচনাবলির মধ্যে একটি বিশ্বকোষ ও একটি ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একই শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভেনারেবল বিডি। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর রচনাবলি ছাড়াও তিনি অগাস্টিন, জিরোম ও ইসিডোরের রচনাবলির সারসংক্ষেপ ও ভাষ্য রচনা করেন। তাছাড়া তিনি ‘ইংরেজ জাতির যাজকীয় ইতিহাস’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ড. আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স ২০০৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.