নব্যপ্লেটোবাদ

ভূমিকা

দর্শনের ইতিহাসে নব্যপ্লেটোবাদ বা নিওপ্লেটোনিজম এক বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। নব্যপ্লেটোবাদ গ্রীক (হেলেনিক) চিন্তাধারার শেষ স্তর। এটি তিনটি পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে। প্লটাইনাস এবং তার রোমস্থ সম্প্রদায় প্রবর্তিত নব্য প্লেটোবাদের প্রথম পর্যায় মূলত ছিল হেলেনিক। পরবর্তীকালে ইয়ামব্লিকাসের নেতৃত্বে সিরীয় সম্প্রদায় এবং প্রোক্লাসের এথেনীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বহুদেববাদের একটি পূর্ণাঙ্গ গোষ্ঠীগত মতে রূপান্তরিত হয়। যারা যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা-অনুধ্যানের চেয়ে অলৌকিক জাদু-কৌশল অভ্যাসই জ্ঞানলাভের উপায় বলে মনে করেছিলেন এবং যারা পূর্ববর্তীদের রচনাবলীর নীরস, মিথ্যাপাণ্ডিত্যপ্রকাশক ও প্রায় উপহাস্যকর ভাষ্য রচনা করেছিলেন তাদের হাতে তৃতীয় এবং সর্বশেষ পর্যায়ে এটি এক অতিপ্রাকৃত রহস্যবাদে পরিণত হয়। তাই দার্শনিক চিন্তাধারার ইতিহাস-প্রণেতাদের কাছে প্লেটোবাদের প্রথম পর্যায় আকর্ষণীয়, এর দ্বিতীয় পর্যায় তুলনামূলকভাবে স্বল্পাকর্ষণীয়, আর এর তৃতীয় পর্যায় আলোচনাযোগ্যই নয়।

প্লেটো এরিস্টটলের চিন্তাধারাই ছিল এই দার্শনিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস। নব্যপ্লেটোবাদীগণ মনে করতেন যে, প্লেটো ও এরিস্টটলের মতের সামঞ্জস্যবিধানের মাধ্যমে তাঁরা এর প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নব্যপ্লেটোবাদর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এমোনিয়াস স্যাক্কাস। খ্রিস্টীয় তিন শতকের প্রথমার্ধে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর দার্শনিক মত প্রচার করেন। স্যাক্কাস ও তাঁর বিখ্যাত শিষ্য প্লটাইনাসের আমলে রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র সামাজিক নৈতিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে পরিচালিত হচ্ছিল বর্বরদের আক্রমণ। অসংখ্য যুদ্ধ ও বিপ্লবের ফলে যে রক্তক্ষয় হয় তার ফলে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকজন সম্রাটের পরিবর্তেন ঘটে। এদের এই দ্রুত উত্থান-পতনের মূলে ছিল সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনী নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করে এবং ক্রমশ এতই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে, সেনাকর্মকর্তারা যেকোনো ব্যক্তিকে সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত ও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতেন। সৈন্যদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। তাদের লুটতরাজ জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জেনারেলগণ রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রকৃত জনকল্যাণের দিকে তাঁরা মোটেও ভ্রূক্ষেপ করতেন না। এসব অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করতে থাকে।

রাজনৈতিক প্রেরণার অবনতির সঙ্গে সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধেরও অবক্ষয় সূচিত হয়। প্রচলিত প্রাচীন মূল্যবোধের প্রতি রোমান সম্রাটগণ মোটেও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে আত্ম-শৃঙ্খলা বলেও কিছু অবশিষ্ট ছিল না। আবার ফৌজদারি আইন এতই কঠোর ও বর্বরোচিত হয়ে ওঠে যে, নির্দোষ মানুষকেও অনেক সময় লাঞ্ছিত হতে হয়। কথায় কথায় মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করার প্রথাও চালু করা হয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ মুষ্টিমেয় ভূস্বামীর কুক্ষিগত হয়ে পড়ে এবং ক্রীতদাস দ্বারা চাষাবাদের কাজ সম্পন্ন করা হয়। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা ক্রমেই ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অসুখবিসুখের প্রাদুর্ভাব এবং জন্মের হার হ্রাস পাওয়ার ফলে জনসংখ্যা হ্রাস পায়। ফলে দেশীয় লোকদের জায়গায় টিওটনিক ও সেমিটিক জাতীয় লোক আমদানি করা হয়।

চিন্তা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এক বিরাট ক্ষতিসাধিত হয়। ল্যাটিন সাহিত্য অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক ভাষার অবতারণা কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী প্রমাণিত হয়। মৌলিক ললিতকলার চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রাচীন রোমান ধর্ম অনেকটা অচল হয়ে পড়ে। এর স্থলে প্রাচ্যের ধর্মসমূহের প্রচলন ঘটে। এসব ধর্মের প্রচলন রোমান জীবনে নতুন উপকরণের সংযোজন ঘটায়। রোমানদের অনেকের কাছে খ্রিস্টধর্ম ও প্রাচ্যের গূঢ় ধর্মসমূহ একই পর্যায়ভুক্ত ছিল। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে কোনোমতেই বন্ধ করা সম্ভব হলো না, বরং অচিরেই তা রোমান সভ্যতাকে গ্রাস করে ফেলে।

এমোনিয়াস স্যাক্কাস ও তাঁর দার্শনিক শিক্ষা সম্পর্কে আমরা খুব বেশিকিছু জানি না। তাঁর জন্ম খ্রিস্টান পরিবারে: কিন্তু পরে তিনি হেলেনিক ধর্মে দীক্ষত হন। মানুষ ও শিক্ষক হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে অতিপ্রাকৃত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বলে বিশ্বাস করতেন। বিশেষ করে প্লটাইনাস তাঁর কাছে ঋণী ছিলেন। তিনিই প্রথম দার্শনিক, যিনি প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানেরহ প্রচেষ্টা চালান। আর এ জন্য তিনি ব্যাপক সুখ্যাতিও অর্জন করেছিলেন।

প্লটাইনাস ছাড়াও এমোনিয়াসের যে কয়েকজন শিষ্য ছিলেন তাদের মধ্যে লঙ্গিনাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি প্লেটোর ‘ফিডো’ ও ‘টাইমীয়ুস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ভাষ্য রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি প্লটাইনাসের দার্শনিক গ্রন্থাবলির ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেন। আত্মা একটি জড় পদার্থ – স্টোয়িকদের এ মতকে তিনি স্যাক্কাসের ন্যায়ই প্রত্যাখ্যান করেন। প্লটাইনাসের মতে, প্রত্যয়গুলো (Ideas) স্বর্গীয় মনের চিন্তামাত্র। কিন্তু লঙ্গিনাস মনে করতেন যে, এরা প্যার্টান বা আদর্শ হিসেবে আগে থেকেই সৃজনী বুদ্ধির বাইরে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল ছিল এবং পরে তাদেরই অনুকরণে জগৎসৃষ্টি করা হয়।

প্রথম পর্যায় : প্লটাইনাস (২০৪/৫ – ২৭০ খ্রি.)

প্লটাইনাসের পরিচয়

নব্যপ্লেটোবাদের প্রবর্তক প্লটাইনাস (খ্রিস্টীয় ২০৪/৫ – ২৭) খ্রীষ্টীয় ৩য় শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়কদের মধ্যে অবিসংবাদিতরূপে অন্যতম। এরিস্টটল যেমন তাঁর দার্শনিক কর্ম দ্বারা প্লেটোর সব অনুসারীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তেমনি প্লটাইনাসও এমোনিয়াস স্যাক্কাসের শিষ্যদের ছাড়িয়ে যান। কোনো কোনো ভাষ্যকার ও সমালোচকের মতে, প্লটাইনাস প্লেটো ও এরিস্টটলের চেয়েও উঁচুমানের দার্শনিক ছিলেন। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব, রেনেসাঁ এবং গ্যেটে এমারসন প্রমুখ কবির ওপর প্লটাইনাসের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তার জীবন ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের প্রায় সকল তথ্যই তার শিষ্য পরফিরির লেখা সংক্ষিপ্ত জীবনীর ওপর নির্ভরশীল। প্লটইনাসের জীবনের শেষ ছয় বছর পরফিরি তার বক্তৃতাবলী শুনেছিলেন এবং ঘনিষ্ঠরূপে তাকে জানতে পেরেছিলেন। প্লটাইনাসের জীবনের প্রথম ত্রিশ বছর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। প্লটাইনাস মিশরে এবং অনেকের মতে লাইকো অথবা লাইকোপোলিস্ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের পর প্রচলিত শিক্ষাক্রম সমাপ্ত করার জন্য তাকে আলেকজান্দ্রিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে তরুণ শিক্ষার্থীরূপে তিনি বিভিন্ন দার্শনিকের কাছে পাঠ গ্রহণ করেন, কিন্তু তাদের শিক্ষা তাকে তৃপ্ত করতে পারল না। অবশেষে আঠাশ বছর বয়সে তিনি তার আকাক্ষিত বাক্তির সন্ধান পান এ্যামনিয়েস সাক্কাস-এর (খ্রিস্টীয় ১৭৫-২৪২) মধ্যে। অনেকের মতে এ্যামনিয়েস সাক্কাসই নব্যপ্লেটোবাদী তাবধারার প্রথম চিন্তানায়ক। তিনি খ্রীষ্টধর্ম পরিত্যাগ করে আলেকজান্দ্রিয়ায় অধ্যাপনা করতে আসেন এবং সেখানেই তিনি প্লটাইনাস, ওরিজেন, লংগীনাস ও অন্যান্যদের নিজ শিষ্যরূপে পান। প্লটাইনাস দশ বছর তার অধ্যাপনা শোনেন। এই সময়ে শেষদিকে প্রাচ্য জ্ঞান-দর্শনের প্রতি আকর্ষণের জন্য তিনি সম্রাট গর্ডিয়ান পরিচালিত পারস্যরাজের বিরূদ্ধাভিযানের সঙ্গে পূর্বদেশ পরিভ্রমণের সুযোগ গ্রহণ করলেন। সম্রাটের সেনাবাহিনী মেসোপটেমিয়ায় উপস্থিত হলে সম্রাট আততায়ীর হাতে নিহত হন এবং প্লটাইনাস বহুকষ্টে এন্টিয়কে উপনীত হন। খ্রিস্টীয় ২৪৪ সালে তিনি রোমে যান এবং সেখানেই জীবনের অবশিষ্টকাল যাপন করেন ও অধ্যাপনায় নিরত থাকেন। তিনি সাধক প্রকৃতির ব্যক্তি এবং একজন রহস্যবাদী দার্শনিক ছিলেন। তিনি দেহধারণকেই লজ্জাকর মনে করতেন; পার্থিব জীবনের সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে নিজেকে উন্নত রাখতে সর্বদা চেষ্টা করতেন এবং এক আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে তিনি সর্বদাই দিব্য-দর্শনের সন্ধানে নিরত থাকতেন, অথচ সমাজ ও কর্তব্যবোধ তিনি কখনো ত্যাগ করেন নি। ক্রমশ তাঁর কাছে বহু শিষ্যের সমাগম ঘটে। সম্রাট প্যালিনাস ও সম্রাজ্ঞী স্যালেনিনা ছিলেন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত। এই রাজকীয় দম্পতির ওপর তাঁর প্রভূত প্রভাব ছিল। তাঁরা তাঁকে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এর ভিত্তিতে একাটি আদর্শ নগর প্রতিষ্ঠার জন্য জমি মঞ্জুর করেছিলেন; কিন্তু রাজদরবারের কিছু লোকের চক্রান্তের ফলে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় নি। কোনো কোনো ভাষ্যকারের মতে, খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে প্লটাইনাস সম্রাটের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করায় সম্রাট প্যালিনাস খ্রিস্টানদের প্রতি সদয় ব্যবহার ও খ্রিস্টানদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। প্লটাইনাসকে রোমানরা যে কতটুকু শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তা পরফিরি রচিত ‘লাইফ অব প্লটাইনাস’ গ্রন্থটি পাঠ করলে বোঝা যায়। এই গ্রন্থে পরফিরি তাঁর শিক্ষকের গভীর অভিনিবেশ ও শ্রেষ্ঠত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরফিরির মতে, কণ্ঠের এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে প্লটাইনাস ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ বছর বয়সে প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর অন্তিম কথাগুলো ছিল এরকম : “আমার মধ্যে যে স্বর্গীয় সত্তা ছিল তাকে আমি এখন সর্বব্যাপ্ত স্বর্গীয় সত্তার কাছে ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছি।”

প্লেটোর মত প্লটাইনাসও মানুষ অপেক্ষা অধিকতর দিব্য শক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন সত্তায় বিশ্বাস করতেন। প্লটাইনাস ছিলেন একজন ধর্মীয় ও মরমিভাবাপন্ন দার্শনিক। আধ্যাত্মিক সত্তা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিলাভই ছিল তাঁর দার্শনিক চিন্তার মূল্য লক্ষ্য। পরফিরির মতে, প্রোটিনাস তাঁর জীবদ্দশায় মোট চারবার মরমি অভিজ্ঞতার সাহায্যে দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। তাঁর মরমিবাদ ও ঈশ্বরভক্তি ছিল খুবই সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত। এতে ধর্মীয় কুসংস্কার বা খেয়ালখুশির কোনো স্থান ছিল না। এর ভিত্তি ছিল এমন এক সুসংবদ্ধ দর্শন যাতে মানুষের সঙ্গে জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্কের এক সংহত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও প্লটাইনাস মনে করেন যে, শুধু বিচার বিশ্লেষণের সাহায্যে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করা যায় না। ঐশীজ্ঞানের শেষ পরিণতি অপরোক্ষ অনুভূতি। যে বিশ্লেষণী চিন্তা থেকে জ্ঞানপ্রক্রিয়ার উদ্ভব তাকে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত এগিয়ে না নিলে ঐশীজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় ভাবসমাধি (ecstasy) লাভ করা যায় না। তার মতে বিভিন্ন দেবতা যাদের বলা যায় উচ্চতর পর্যায়ের অপ্রাকৃত শক্তি, সাধারণ অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পৃথিবী প্রভৃতি সৌরজাগতিক অন্যান্য সত্তা। এরা সকলেই বিশ্বাত্মার সৃষ্টি। উক্ত দেবগণ সকলেই চৈতন্য-জগতের নিম্নতর এক পরিমণ্ডলে অবস্থান করেন এবং তারা সকলে মূলত এক অথবা বলতে গেলে একই সকলের মধ্যে বিরাজমান। চন্দ্র অবস্থান করেন চৈতন্য-জগৎ এবং তনিম্নতর জগতের সীমান্তরেখায। চন্দ্র অপেক্ষা উধ্বতর যে কোনো সত্তাই দেবতা। বিভিন্ন অপ্রাকৃত এবং সৌরজাগতিক শক্তিসমূহ চৈতন্য জগতের নিম্নতর পরিমণ্ডলে অবস্থান করে। অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ বিশ্বাত্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীতে বাস করে। তারা চিরন্তন এবং চৈতন্যের উপাদানে তাদের দেহ গঠিত। তারা উধ্বস্থিত চৈতন্য-জগৎ দেখতে পান ; তাদের অনুভবশক্তি ও স্মৃতিশক্তি আছে এবং তারা মানুষের আবেদন শুনতে পান। এছাড়া তারা নিজেদের আগ্নেয় এবং বায়বীয় আচ্ছাদনে নিজেদের আবৃত করতে পারেন। সূর্য নক্ষত্ররাজি এবং পৃথিবী আমাদের প্রার্থনা শোনেন এবং ভবিষ্যৎ সংঘটনের পূর্বাভাষ দেন। কিন্তু তারা প্রাকৃতিক নিয়মানুগ বলে কোনো কার্য ঘটাতে পারে না। যদিও প্লটইনাসের দর্শন অত্যন্ত ধর্মকেন্দ্রিক তবুও তিনি প্রকাশ্য পূজা-অর্চনার প্রতি অনাসক্ত ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে প্রত্যেক মানুষের উচিত স্বর্গীয় করুণা লাভের জন্য ঊর্ধ্বাভিসারী প্রেমের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা; অবশ্য “দেবগণই আমাদের কাছে আসবেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে না।” মন্দির নয়, মানুষের হৃদয়ই দেবতাদের বাসস্থান।

পঞ্চাশ বছর বয়সে প্লটাইনাস প্রথম গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেন। এর আগে তিনি মৌখিকভাবে দর্শন প্রচার করতেন। কথিত আছে যে, তাঁর বক্তৃতার ভাষা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, এবং বক্তৃতাকালে তিনি তাঁর শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন। তবে লেখার প্রতি তাঁর তেমন কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাঁর মনে যখন যে ধারণার উৎপত্তি হতো, তখনই তিনি তা টুকে রাখতেন। এসব লেখার ভাষা ছিল দুর্বোধ্য। এছাড়া তাঁর চোখ এতই খারাপ ছিল যে, তিনি তাঁর লেখা কোনোদিন পরিবর্তন বা পরিশোধন করতে পারেন নি। তাঁর হাতের লেখাও ছিল দুর্বোধ্য। ফলে অন্যের পক্ষে তাঁর লেখা পরিশোধন করা ছিল এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কোথাও এটি ছিল অসংস্কৃত বা অপরিমার্জিত। তবুও এটি সাহিত্যিক সৌন্দর্যের একটি উদাহরণ হয়ে যায়। তাঁর ছাত্র পরফিরি তাঁর রচনা সংগ্রহ করেন এবং নিজের পছন্দ অনুসারে সাজিয়ে প্রকাশ করেন। চুয়ান্নটি গ্রন্থকে পরফিরি যে ছ’টি পৃথক ভাগে বিভক্ত করেছিলেন তাদের প্রত্যেকটির ন’টি করে পুস্তক ছিল। এদের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘এনিয়াডস’ (Enneads)। প্লটাইনাসের গ্রন্থাবলি আজও দর্শন সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত।

  • প্রথম ‘এন্নিয়াড’-টিতে আলোচনা করা হয়েছে নৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে। পুণ্য আনন্দ শুভের প্রকারভেদ, অশুভের সমস্যা সংসারবিরাগ প্রভৃতি সমস্যা এর প্রধান আলোচ্য বিষয়।
  • দ্বিতীয় ‘এন্নিয়াড’-এর আলোচ্য বিষয় পদার্থিক জগৎ। এতে নক্ষত্ররাজি, অব্যক্ততা ও বাস্তবতা, চক্রাকার গতি, গুণ ও আকার প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
  • তৃতীয় ‘এন্নিয়াড’-এ আলোচিত হয়েছে প্রোটিনাসের জগৎবিষয়ক মতবাদের ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য। এখানে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা রয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্বাসের সমস্যা, নিত্যতা ও কাল এবং প্রকৃতির গঠন উল্লেখযোগ্য।
  • চতুর্থ ‘এন্নিয়াড’-এ আত্মার স্বরূপ ও ক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তা ছাড়া এতে আত্মার অমরত্ব এবং সংবেদন ও স্মৃতি সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে।
  • পঞ্চম এন্নিয়াড’-এর আলোচ্যবিষয় স্বর্গীয় সত্তার অভিব্যক্তি। এখানে প্লটাইনাসের প্রত্যয়বিষয়ক মতবাদের ব্যাখ্যা এবং বৌদ্ধিক সৌন্দর্যের ওপর একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে।
  • ষষ্ঠ ‘এন্নিয়াড’-এ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। তাদের মধ্যে সংখ্যা, স্বাধীন ইচ্ছা এবং বিভিন্ন প্রকারের বাস্তবসত্তা বিষয়ক আলোচনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এই রচনাবলীতে তিনি প্লেটোর বক্তব্যের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা ও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। প্লেটোর “মঙ্গল” (Good), এরিষ্টটলের “আত্মা” এবং স্টোয়িকদের “বিশ্বাত্মা”-র সমন্বয় সাধন করেছেন; এছাড়া এরিস্টোটল পরবর্তী যাবতীয় দার্শনিক প্রবণতার যেমনযথ প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। স্টোয়িক এপিকিউরিয়ান সম্প্রদায়ের জড়বাদের বিরুদ্ধে তিনি তার আধ্যাত্মবাদ উপস্থাপিত করেছেন, ‘নব-একাদেমীর সংশয়বাদের বিরুদ্ধে জ্ঞানের সম্ভাবনায় বিশ্বাসী আশাবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। নস্টিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে তিনি নিজ অদ্বৈতবাদ প্রণয়ণ করেন এবং এক্লেক্টিকদের প্রয়োগবাদের বিপরীত প্রয়োগ-নিরপেক্ষ মূল্য ও পরম সত্য স্বীকার করেন। জ্যোতিষীদের পূর্বনিয়ন্ত্রণবাদের পরিবর্তে তিনি প্রতিপন্ন করেন যে অমঙ্গলের মূল ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা।

প্লটাইনাসের মতের সঙ্গে প্লেটোর মতের বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। প্লেটোর ন্যায় প্লটাইনাস আধ্যাত্মিক প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি প্লেটোর মরমিবাদ ও প্রত্যয়ের বাস্তবতা গ্রহণ করেন। তবে প্লটাইনাস সার্বিকের ন্যায় বিশেষ বস্তুরও প্রত্যয় আছে বলে মনে করতেন। প্লেটোদর্শনে যে সামাজিক আকর্ষণ লক্ষণীয়, প্লটাইনাসে তা নেই। দার্শনিক রাজার সাহায্যে মানুষের সংস্কার সম্ভব – এ কথা প্লটাইনাস বিশ্বাস করতেন না। এ জন্যই তিনি তাঁর অধিবিদ্যার আদর্শাবলিকে রাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োগ করেন নি। প্লেটোদর্শনে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের সমাবেশ দেখা যায়। কিন্তু প্লটাইনাস ছিলেন প্লেটোর চেয়ে বেশি একাগ্রচিত্ত, একই নীতিতে অধিকতর অবিচলিত। সারাজীবন তিনি যে বিশ্বাসে অটল ছিলেন তা এই যে, পার্থিব জীবন স্বর্গীয় বিশুদ্ধতা থেকে বিকীর্ণ, এবং আত্মা অবশ্যই ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলিত হবে।

প্লটাইনাসের ঈশ্বরতত্ত্ব ও পদার্থবিদ্যা

ঈশ্বর চিন্তার অতীত : প্লটাইনাসের মতে, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এক অনন্ত সত্তার প্লাবনধারা। ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলনই এর উদ্দেশ্য। ঈশ্বর সব অস্তিত্বের, সব বিরোধ ও বৈপরীত্বের, দেহ ও মনের রূপ ও উপাদানের উৎস। কিন্তু তিনি নিজে সর্বপ্রকার বহুত্বের ঊর্ধ্বে। তিনি সম্পূর্ণরূপে এক। সবকিছুই তাঁর মহাএকত্বের অন্তর্ভুক্ত। তার থেকে সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে, অথচ তিনি নিজে অন্যকিছু থেকে সৃষ্ট নন। ঈশ্বর থেকেই সবকিছুর উদ্ভব। তাঁর একত্ব সব বহুত্বের পূর্ববর্তী, সব বহুত্বের ঊর্ধ্বে। তাঁর সম্পর্কে আমরা যা বলি, তা-ই তাকে সীমিত করে। সুতরাং তাঁর ওপর আমরা সৌন্দর্য মহত্ত্ব চিন্তা বাসনা ইচ্ছা অভীপ্সা ইত্যাদি কোনো গুণই আরোপ করতে পারি না; কেননা এসব গুণ সীমিত শক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর কী নন, শুধু তা-ই আমরা বলতে পারি। তিনি আসলে কী, তা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা তাঁকে সত্তা বলে বর্ণনা করতে পারি না; কেননা সত্তা চিন্তনীয়। যা চিন্তনীয়, তাতে বিষয় ও বিষয়ীয় ধারণা রয়েছে। ঈশ্বর বিষয়-বিষয়ীর দ্বৈততা দ্বারা শৃঙ্খলিত নন। বরং তিনি এর বহু ঊর্ধ্বে। তিনি সাধারণ অর্থে এক নন; তিনি মহাএকত্ব। ঈশ্বর সম্বন্ধে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, তিনি সব চিন্তার অতীত।

ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি, তার ওপর চেতনা ও ইচ্ছা আরোপ তাকে সীমিতকরণ : জগৎ ঈশ্বর থেকে উদ্ভূত বটে; কিন্তু ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন নি; কারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য চেতনা ও ইচ্ছা আবশ্যক। ঈশ্বরে চেতনা বা ইচ্ছা আরোপ করা তাঁকে সীমিত করারই শামিল। ঈশ্বর জগৎসৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি, কিংবা জগৎ থেকে বিবর্তিতও হন নি; কেননা ঈশ্বর পরম পূর্ণসত্তা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর থেকে নির্গত বা বিকীর্ণ হয়েছে। যে পদ্ধতিতে ঈশ্বর থেকে জগতের সৃষ্টি, প্লটাইনাস তাকে বিকিরণ (emanation) বলেছেন। ঈশ্বর থেকে বিশ্বজগৎ কীভাবে বিকীর্ণ হলো, প্লটাইনাস তা কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। সূর্যরশ্মি যেভাবে সূর্য থেকে নিঃসৃত হয়, আগুন যেভাবে তাপ বিকিরণ করে, স্বতঃসিদ্ধ থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত নিঃসৃত হয়, ঈশ্বর থেকেও বিশ্বজগৎ সেভাবে বিকীর্ণ হয়েছে।

ঈশ্বর জগতের ওপর নির্ভরশীল নন তাই অপরিবর্তিত থাকেন : এসব রূপক উপমার ব্যবহার করে প্লটাইনাস শুধু ঈশ্বরের পরম শক্তি ও স্বাধীনতাই প্রকাশ করেছেন। ‘কারণ’ কখনো নিজেকে কার্যে হারিয়ে ফেলে না; কার্যও কারণকে সীমিত করে না। জগতের আদি কারণ হিসেবে ঈশ্বর জগতের ওপর নির্ভরশীল নন; বরং জগৎই ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। শিশুর জন্মের পরও যেমন জনক-জননী একইভাবে চলতে থাকে, তেমনি জগৎসৃষ্টির পরও ঈশ্বর অপরিবর্তিত থেকে যান। সৃষ্টির ফলে ঈশ্বরের পূর্ণতা বিঘ্নিত হয় না। ঈশ্বর ইন্দ্রিয়ের অগম্য বিশুদ্ধতম আলোকশিখা। তিনি সর্বপ্রকার তাপ ও সত্তার উৎস। তবে অন্ধকার সেখানে গাঢ়তম, সেখানেই তিনি উপস্থিত। তিনি সর্বত্র বিদ্যমান, অথচ সৰ্বাতীত।

ঈশ্বর থেকে জগতের বিকিরণের তিনটি প্রধান স্তর ও ঈশ্বরের ‘চিন্তা’ : ঈশ্বর থেকে জগতের বিকিরণের তিনটি প্রধান স্তর রয়েছে: এক, বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি; দুই, আত্মা এবং তিন, জড়। প্রথম স্তরে ঈশ্বরের সত্তা বুদ্ধি ও প্রত্যয়, এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তাকেই চিন্তা করেন; তিনি বিশুদ্ধ আদর্শ জগৎকে ধ্যান করে থাকেন। চিন্তা ও ধারণাবলি, বিষয় ও বিষয়ী এ পর্যায়ে একীভূত; অর্থাৎ তারা দৈশিক ও কালিকভাবে পৃথক নয়। স্বর্গীয় সত্তার চিন্তারত মন ও সে মনের চিন্তায় কোনো প্রভেদ থাকে না। ঈশ্বরের চিন্তা পরিপূর্ণ সত্য বলেই এমনটি হয়ে থাকে। ঈশ্বর তাঁর নিজ চিন্তাসমূহকেই চিন্তা করে থাকেন; আর এসব চিন্তা তার সারধর্ম থেকেই উদ্ভূত। ঈশ্বরে চিন্তার কর্তা ও চিন্তা এক ও অভিন্ন। তবে ঈশ্বরের চিন্তা বিশ্লেষণী চিন্তা নয়; অর্থাৎ ঐশী চিন্তা এক ধারণা থেকে অন্য ধারণায়, আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে গমন করে না। ঈশ্বরের চিন্তা এমন এক স্বাত্তিক স্থিরচিন্তা, যার মাধ্যমে প্রত্যয়সমূহকে একই সঙ্গে ধ্যান করা হয়ে থাকে। সহজ অভিজ্ঞতার জগতে যেমন অনেক বস্তু রয়েছে, তেমনি সে জগতে প্রত্যয়ের সংখ্যাও অনেক। বিশেষ বস্তুর সংখ্যা যত, প্রত্যয়ের সংখ্যা তত। এসব প্রত্যয় নিছক প্রত্যয়ই নয়, একইসঙ্গে গতিশীল শক্তির আধার। প্রত্যয়গুলোর মধ্যে প্রভেদ রয়েছে ঠিকই, তবে প্লেটোর ন্যায় প্লটাইনাসও মনে করেন, প্রত্যয়গুলোর সমন্বয়ে একটি একক সিস্টেম গঠিত। প্রত্যয়ের এই সিস্টেমেই ঈশ্বরের পরম একত্ব প্রতিফলিত হয়ে থাকে।

প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুর জন্য ঈশ্বরের মনে একটি করে প্রত্যয় ও বিকীরণের দ্বিতীয় স্তরে বিশ্বাত্মা : দৃশ্যমান জগতের প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুর জন্য ঈশ্বরের মনে একটি করে প্রত্যয় রয়েছে। বিশুদ্ধ চিন্তার জগৎ দেশহীন ও কালহীন। এটি এমন একটি পূর্ণ, চিরন্তন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ, যা ইন্দ্রিয় জগতের মডেল বা আদর্শস্বরূপ। প্রত্যয়গুলো শুধু আদর্শই নয়, ক্রিয়াশীলও বটে। বিকিরণের প্রতিটি স্তরে তারা পরবর্তী স্তরের নিমিত্ত কারণ হিসেবে উপস্থিত থাকে। বিকিরণের দ্বিতীয় স্তরে বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে নির্গত হয় আত্মা। আত্মার স্বভাব বুদ্ধির অনুরূপ ; তবে আত্মা বুদ্ধির চেয়ে দুর্বল। আত্মা বিশুদ্ধ চিন্তার বা বুদ্ধির প্রতিবিম্ব। আত্মা জড়জগৎ ও প্রত্যয় জগতের মধ্যবর্তী। উভয় জগতের স্বভাব আত্মায় বর্তমান। আত্মা অতীন্দ্রিয় জগতের অধিবাসী। বিশুদ্ধ চিন্তাস্থিত প্রত্যয়জগৎ আত্মার মধ্যেও বর্তমান। আত্মা নিজেও বিশুদ্ধ একটি প্রত্যয়। বিশুদ্ধ চিন্তার অবভাস হিসেবে আত্মা প্রাণস্বরূপ ও সক্রিয়, বিশুদ্ধ চিন্তার মতোই চিরন্তন ও কালাতীত। বিশুদ্ধ চিন্তার ক্রিয়া আত্মার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আত্মা যে কেবল জড়জগতের বাইরে অবস্থিত তা-ই নয়, জড়জগতের ওপর আত্মার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই। আত্মার আত্মসংবিদ আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রতীতি, স্মৃতি ও ধ্যান নেই। এই আত্মা হলো বিশ্বাত্মা।

বিশ্বাত্মা থেকে এক দ্বিতীয় আত্মা বা প্রকৃতির বিকীরণ, তৃতীয় ও সর্বনিম্ন স্তর জড় : এতক্ষণ যে আত্মার কথা বলা হলো প্লটাইনাস তাকে বিশ্বাত্মা বলেছেন। বিশ্বাত্মা থেকে এক দ্বিতীয় আত্মা বিকীর্ণ হয়। প্লটাইনাস এর নাম দিয়েছেন প্রকৃতি। ব্যক্তির আত্মা যেমন তার দেহের সঙ্গে যুক্ত, প্রকৃতিও তেমনি জগতের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতি থেকে অন্যান্য আত্মার উদ্ভব। প্রকৃতি হচ্ছে বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি। প্রকৃতির শক্তি বিস্তার জড়কে আকার সমন্বিত করে বিচ্ছুরিত করে দেয়। প্রকৃতি-শক্তি যান্ত্রিক নয়, উদ্দেশ্যযুক্ত। সত্য কারণ একমাত্র উদ্দিষ্ট কারণ (Final Cause)। নিমিত্ত কারণ হচ্ছে আত্মা যে সকল বস্তু প্রয়োেগ করে তাদেরই অংশ। বিশ্বাত্মার পদচিহ্ন প্রত্যক্ষজগতের মধ্যে পরিলক্ষিত। আত্মা এই জগতে যে সকল সামঞ্জস্য লক্ষ্য করে তা এই জগতের ওপর সেই বিশ্বাত্মা চিহ্নিত ‘আকার’ মাত্র। আত্মার নিচের স্তরে যখন ঐশ্বরিক শক্তি বিকীর্ণ হয়, তখন সৃষ্টি হয় ভৌত পদার্থের। ভৌত পদার্থই ঐশ্বরিক শক্তির ক্ষীণতম প্রকাশ। কোনো একটি উপায় বা উপলক্ষ ব্যতীত আত্মা তার শক্তিপ্রয়োগ করতে পারে না; এ জন্যই আত্মা সৃষ্টি করে জড়। আর এই জড়ই হলো বিকিরণের তৃতীয় ও সর্বনিম্ন স্তর। এমনিতে জড় এক অন্ধকারময় অতল গর্ভের মতো। প্লেটো এরই নাম দিয়েছিলেন অসত্তা। জড় সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয়। জড় যে আসলে কী, তা বোঝা কঠিন। কারণ তা সর্বপ্রকার রূপ, সীমাবন্ধন ও অবধারণের অতীত। অন্ধকারকে যেমন দেখা যায় না, তেমনি জড়েরও স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না। অন্ধকারকে দেখা আর কিছুই না দেখা যেমন এক, তেমনি জড়ের ধারণা করা, আর কিছুই ধারণা না করা ও এক। জড়ের একমাত্র স্বভাব এই যে, তা বস্তুর আশ্রয়।

জড়ের সত্তা, বিশ্বাত্মা থেকে জগতের বিকিরণ অবিরাম ও অবিভাজ্য ক্রিয়া, কালের সৃষ্টি  : প্লটাইনাসের মতে, জড়ের কোনো বিশিষ্ট সত্তা নির্ণয় করা যায় না। জড় এমনই একটি বস্তু, যার স্বভাব কল্পনা করা না গেলেও এর অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয়। জড়ের প্রভাব শুধু দেহেই নয়, বুদ্ধিতে ও আত্মাতেও বিদ্যমান। মন জড়ের চেয়ে যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেন, মন দেহের অধীন। মন দেহের প্রভাববর্জিত বা অপার্থিব বস্তু নয়। চিন্তা, ধারণা ও সংস্কারের সঙ্গে জড় অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বিশ্বাত্মা থেকে জগতের বিকিরণকে প্লটাইনাস কোনো একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত ব্যাপার বলে মনে না করে, মনে করেছেন বিশ্বাত্মার প্রকৃতির অনিবার্য পরিণতি হিসেবে। বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে বিশ্বাত্মার বিকিরণ, জড়ের সৃষ্টি, বিভিন্ন বস্তুতে জড়ের বিভাজন ইত্যাদি সব মিলে সৃষ্টি করে একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। বিমূর্ত চিন্তা এ প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু মূলত গোটা ব্যাপারটিই একটি নিত্য ও অবিভাজ্য ক্রিয়া। এরিস্টটলের ন্যায় প্লটাইনাসও বিশ্বের অনাদিত্বে বিশ্বাসী। একইসঙ্গে আবার তিনি বলেন, জড় পর্যায়ক্রমে রূপগ্রহণ করে, এবং বিশ্বাত্মা তার চলার সুবিধার্থে কালের সৃষ্টি করে। আবার তিনি স্টোয়িকদের পর্যায়ক্রমিক পুনরাবির্ভাব মতবাদও গ্রহণ করেন। কিন্তু এসব মতবাদের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে হবে কী করে, তা তিনি ব্যাখ্যা, করেন নি। তবে সম্ভবত তিনি এ কথা বলতে চান যে, জগৎ সবসময় ছিল এবং সবসময়ই থাকবে। আর ইন্দ্রিয়জগতের অংশগুলো পরিবর্তনশীল হলেও সামগ্রিক অর্থে ইন্দ্ৰিয়জগৎ অনাদি। ‘কাল’ হচ্ছে একটি প্রতিরূপ (copy) যার সাহায্যে বিশ্বাত্মা অনন্তকে রূপান্তরিত করেন, যখন তিনি নিত্য সামান্যধারণাবলীকে (Ideas) প্রাকৃতিক নিয়মাবলীতে রূপান্তরিত করতে চান। তাই কাল’ ‘একটি উদ্দেশ্যযুক্ত আকার (Category) এবং সেজন্য এটি জগৎ-অতিক্রান্ত উদ্দেশ্যাভিমুখী এক জাগতিক শক্তির দৃষ্টান্ত। কাল একটি আকার যার সাহায্যে বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি সৃষ্টি ও জনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একরূপ থেকে অন্যরূপে প্রকাশিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রগতি চৈতন্যনিহিত সেই গতিরই প্রতিরূপ যা পরিবর্তনহীন, নিত্য এবং সামান্যধারণা বা ভাবজগতের। জগৎ-ব্যাপার সৌরমণ্ডলীয় পর্যায়ক্রমে বিবর্তিত হয় যতদিন পর্যন্ত সকল ব্যক্তির সৃষ্টি বিশ্বাত্মা সম্পন্ন না করে। তারপর সূত্রপাত হয় আরেক নুতন জগৎ-সংস্থার। তাই বিশ্বকে অনন্ত বলা যায় এই অর্থে যে এটি বিভিন্ন আদি মধ্যঅন্ত সমন্বিত সমীম জগৎ-সংস্থার অনন্ত পারম্পর্যধারা। প্লটাইনাসকৃত এই প্রত্যক্ষজগতের বিভিন্ন আকার বা রূপ পরিকল্পনায় এরিষ্টটলের প্রভাব সুস্পষ্ট। উক্ত। বিভিন্ন আকার হচ্ছে (১) জড়, আকার এবং উভয়ের সমাহার, (২) সম্পর্ক (৩) গুণ (৪) পরিমাণ (৫) দেশ (৬) কাল এবং (৭) গতি।

ধারণার জগতের তিন জোরা ক্যাটাগরিজ : ধারণা বা প্রত্যয়ের জগৎ বা চৈতন্য-জগৎ হলো বিশ্বাত্মার উপরিপর্যায়ের সর্বোচ্চ পরম এক বা ঈশ্বর, ঈশ্বরের প্রতিরূপ, ঈশ্বরের নিজেরই প্রতিফলন। এটি ঈশ্বরেরই বিচ্ছুরিত আলোক যার সাহায্যে ঈশ্বর নিজেকেই দেখেন। ধারণার জগৎ হচ্ছে ভাবজগৎ, সামান্যধারণার জগৎ—এটি প্রত্যক্ষ জগতের আদর্শরূপ। ঈশ্বরের প্রতিরূপ বলে এটি সরচেয়ে উৎকর্ষ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই ধারণার জগতে দেশের খণ্ডতা নেই, এবং এটি অনন্ত কেননা এটির মধ্যে কোন অতীত, ভবিষ্যৎ নেই, কেবল এক নিত্য বর্তমান আছে। ধারণার জগতে তিন জোড়া জ্ঞানের রূপ বা আকার (Categories) আছে – চৈতন্য এবং সত্তা (চিন্তা এবং বস্তু), ঐক্য এবং পার্থক্য, স্থিতি এবং গতি, ( অপরিবর্তনীয়তা এবং পরিবর্তন)। কিন্তু এই মত সত্ত্বেও অসঙ্গতভাবে প্লটাইনাস কখনও চৈতন্যের উল্লেখ করেননি, জ্ঞানের আকারগুলোর তালিকায় চৈতন্য ও সত্তা উভয়েরও উল্লেখ করেননি। তার দর্শনে ধারণার জগতের এই চৈতন্য পৃথক পৃথকরূপে সত্তা, স্থিতি এবং গতি প্রত্যেকটি জানতে পারে। এদেরকে জানা হলো চৈতন্যের নিজের সম্পর্কে জ্ঞান বা আত্মজ্ঞান। জানা একটি ক্রিয়া এবং ক্রিয়াই গতি বলে এই আত্মজ্ঞানের মধ্যেই গতি নিহিত। এই চৈতন্যের সাথে ধারণা জগতের সত্তা অংশের পার্থক্য আছে। চৈতন্য এর জানা একটি ক্রিয়া এবং এই জানা যেহেতু নিজেকে জানা, তাই বলা যায় এই ক্রিয়া হলো নিজের অভিমুখী। এই নিজের অভিমুখী ক্রিয়াতেই সত্তার ধারণা নিহিত। জানা-ক্রিয়া কোন সত্তা নয়, সত্তা হলো যা অস্তিত্বশীল বলে জানা যায় তা। নিজের অভিমুখে জানা ক্রিয়াটি কাজ করছে, এর অর্থ হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, এভাবে চৈতন্য থেকে জানা-ক্রিয়া বা আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে সত্তা প্রতিপাদিত হয় বা সত্তার ধারণা পাওয়া যায়। আবার যেহেতু জ্ঞান ক্রিয়া বা গতি, এবং এক গতি অন্য গতি থেকে উৎপন্ন বা শেষ হতে পারেনা, তাই বলা যায়, সেই জ্ঞানরূপ গতির অবশ্যই অন্য কোন উৎস ও লক্ষ্য আছে, যা সেই গতি থেকে ভিন্ন, বা বলা যায় চৈতন্য-জ্ঞান ছাড়াও কোন কিছু আছে যা চৈতন্য-জ্ঞান বা গতির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। চৈতন্য-জ্ঞানের এই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যই হচ্ছে সত্তা। তাহলে বলা যায় সত্তা থেকে চৈতন্য বা জ্ঞান বা ক্রিয়ার উদ্ভব হয় এবং সত্তাতেই তা শেষ হয়, তার মানে সত্তা হলো ক্রিয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু প্লটাইনাস আবার বলছেন সত্তা কেবল ক্রিয়া-সম্ভাবনা নয়, একই সাথে ক্রিয়াও, অর্থাৎ চৈতন্য-জ্ঞানের ক্রিয়া সত্তা। কিন্তু তা আবার পূর্বে আলোচিত বক্তব্যগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়। এখানেই প্লটাইনাস নিয়ে আসেন ঐক্য ও পার্থক্যের ধারণা। সত্তা ও চৈতন্যের মধ্যে প্রথমে আমরা পার্থক্য দেখলাম যেখানে চৈতন্য সত্তা থেকে উদ্ভুত ও শেষ হয়, আবার সত্তাকে যখন ক্রিয়া বলে বিবেচনা করা হয় তখন আমরা পাই ঐক্যের ধারণা। একইভাবে যখন চৈতন্য কাজ করে, আত্মজ্ঞান লাভ করে তখন পাই ক্রিয়া বা গতি, কিন্তু যখন এই ক্রিয়া সত্তায় মিশে যায়, সত্তাই ক্রিয়া হয় বা সত্তায় শেষ হয় তখন পাই স্থিতি। সব মিলে ধারণার জগতে এই তিন জোরা ক্যাটাগোরিজই বিদ্যমান হচ্ছে – চৈতন্য ও সত্তা, ঐক্য ও পার্থক্য, স্থিতি ও গতি।

বিশেষ ধারণার সাথে সর্বব্যাপক ধারণার সম্পর্ক : চৈতন্য সরল নয়। চৈতন্যের অন্তর্নিহিত ভেদ আছে, নাহলে ধারণার জগতে বা চৈতন্য-জগতে বিভিন্ন চেতন সত্তা বা ধারণার মধ্যে সংযোগ এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকতো না। কিন্তু বিভিন্ন ধারণা কেবল পরস্পর ভিন্ন তাই নয়, তারা পরস্পর অভিন্নও বলা যায়। কেননা তারা একে অপরের মধ্যে বর্তমান। তারা একের মধ্যে বহু এবং বহুর মধ্যে এক, বহর সমন্বয়ে এক। সমস্ত বিশেষ ধারণা এক সর্বব্যাপক ধারণা বা চৈতন্যে বিধৃত। সেই সর্বব্যাপক ধারণা বা চৈতন্য স্ব-নির্ভর এবং বিশেষ ধারণা বা চেতনসত্তা সকলও স্ব-নির্ভররূপে থাকে, কিন্তু তবুও ঐ সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল উক্ত চেতন সত্তা বা ধারণাসমূহ আবার ধারণা বা চেতন সত্তাসমুহে বিধৃত সেই সর্বব্যাপক চৈতন্য। এভাবে প্রত্যেক বিশেষ ধারণা বা চেতন সত্তা একত্রে স্ব-নির্ভর এবং সর্বব্যাপক চৈতন্যে বা ধারণায় বিধৃত এবং সেই সর্বব্যাপক চৈতন্যও স্ব-নির্ভর এবং বিশেষ চেতনসত্তা সমূহে বিধৃত। সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণা হচ্ছে প্রকৃত বিদ্যমান সকল বিশেষ চেতন সত্তা বা ধারণাসমূহের সমষ্টি এবং তাদের প্রত্যেকটি নিহিত রূপে থাকে উক্ত সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণায়। ব্যক্তির চৈতন্য (spirit) সেই সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণার অন্তর্মুখী ক্রিয়ার ফল এবং ব্যক্তিআত্মা এটির বহির্মুখী ক্রিয়ার ফল।

চৈতন্য ও চৈতন্য-জগত একটি অপরটি ছাড়া থাকতে পারেনা, ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য : চৈতন্য এবং চৈতন্য-জগৎ দুইয়ের মধ্যে এক এবং একটি অপরটি ছাড়া থাকতে পারে না। এই দুইয়ের মধ্যে একত্ব উচ্চতর আর একটি ঐক্যকে নির্দেশ করে যা বিশুদ্ধ ঐক্য বা এক, যার মধ্যে কোন দ্বিত্ব নেই। প্লটাইনাস এই দ্বিত্ব-বর্জিত ঐক্য-কে বলেন ‘পরম এক, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর এবং প্লেটোর মত তিনিও সেই ‘পরম এক’ এবং ‘পরম শ্ৰেয়ঃ’ ( The Good) অভিন্ন বলে মনে করেন। পরম এক কথাটি সংখ্যা বাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এটি এক ও একে যে দুই হয় সেই এক নয, কেননা সংখ্যাবাচক একত্ব ও বহুত্ব পরস্পর সাপেক্ষ। ঈশ্বর অন্যকিছু সাপেক্ষ নন। তিনি উৎস-স্বরূপ যেখান থেকে একত্ব ও বহুত্ব উৎসারিত। তিনি সকল ক্রিয়ার উর্ধ্বে, চেতন সত্তা এবং ধারণার (Ideas) চৈতন্য-জগতের উর্ধ্বে আমরা বলতে পারি তিনি কী নন, কিন্তু তিনি কী তা বলতে পারি না, কারণ তিনি সকল গুণ এবং বর্ণনার উর্ধ্বে। এমন কি আমরা যদি অন্য নিরপেক্ষ রূপে নয় অন্য সাপেক্ষরূপে তাতে সর্বোচ্চ গুণাবলীও আরোপ করি তবে এছাড়া বলতে হবে যে “এরাও যথেষ্ট নয়, এদের তুলনায় উচ্চতর গুণাবলী প্রযোজন।” তিনি অসীম। জ্ঞাত জগৎ থেকে পৃথক তার কোন জ্ঞান নেই, কেননা তাতে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্ক অতিক্রান্ত। তিনি কেবল সাধারণ চৈতন্যযুক্ত নন, তিনি মহত্তর চৈতন্য সম্পন্ন। কারণ তিনি সাক্ষাৎ দ্রষ্টা। তার জ্ঞান সাধারণ বিশ্লেষণ যুক্তির এমনকি চৈতন্যের স্বজ্ঞা-প্রত্যঙ্গের তুলনায় উচ্চতর। আমরা তাতে ইচ্ছা শক্তিও আরোপ করতে পারি না যদি ইচ্ছাশক্তি বলতে অবর্তমান কোনো বস্তুর আকাঙ্ক্ষা বোঝায়। কিন্তু তিনিই ইচ্ছাশক্তি এই অর্থে যে তিনি যা থেকে ইচ্ছা করেন তিনি তাই এবং তাতে এমন কিছু নেই যা তার ইচ্ছার পূর্ববর্তী। তিনি কোনো আবশ্যিকতার (necessity) অধীন নন, তাতে সবকিছুই অবশ্যিক। তিনি সর্বৈব মুক্ত, চৈতন্য-জগতের মুক্তির উৎস তিনি। যে উদ্দেশ্যময়তা বিবর্তনশীল জগতের লক্ষণ তিনি তার অধীন নন। তিনি আদি কারণ-স্বরূপ এবং পরম কল্যাণরূপে তিনি যা কিছু বর্তমান তার লক্ষ্য-কারণ। কিন্তু আদি ও লক্ষ্য-কারণরূপে তিনি যা কিছু ঘটান তার সাথে তিনি সমান নিত্য। কেননা তার উর্ধ্বে কিছু না থাকায় তিনি অন্যকিছুর অন্তর্গত নন-বরং তাতেই সকল কিছু বিধৃত। তিনি সকলের মধ্যে বিভক্ত নন অথচ সূর্য যেরূপ নিজে ক্ষয়িত না হয়ে আলোক ও উত্তাপ বিকিরণ করে সেইরূপ তিনিও অব্যয়রূপে সকল নিয়ে গঠিত। আমরা তাকে বলতে পারি আদি ক্রিয়াস্বরূপ, অথবা আদি শক্তি। কেননা, তিনি শক্তি ও ক্রিয়া এই দুইয়ের পার্থক্যের উর্ধ্বে। সেই পরম এক অথবা পরম কল্যাণ কেবল সাধারণ অর্থে কল্যাণ নন বরং সকল কল্যাণের উৎস। তিনি সৌন্দর্যসমন্বিত নন বরং তিনি কল সৌন্দর্যের সৌন্দর্যস্বরূপ (Beauty)। তিনি আদি সৌন্দর্য—যা কিছু সুন্দর তার উৎস।

প্লটাইনাসের মতে মনোবিজ্ঞান ও মানবাত্মা

বিষয়-বিষয়ীর দ্বিত্ব নেই, জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয়, অহং এর কারণে ভিন্ন মনে হয় : তার দর্শনে বিষয়-বিষয়ী দ্বিত্ব গৃহীত হয়নি। পরম সত্য চিন্ময়, কিন্তু এটি কখনোই মানসসৃষ্ট কিংবা মনের বাইরে এবং মন-নিরপেক্ষ সত্তা নয়। আত্মচেতনার একত্বেই জ্ঞাত চিন্ময় জগৎ এবং জ্ঞান-বৃত্তির দ্বিত্ব চিন্তার বিষয়বস্তু এবং চিন্তনক্রিয়ার ভেদ নিহিত। যিনি চৈতন্যরূপে দর্শন করেন তিনি এবং চিন্ময় এই জগৎ পরস্পর সাপেক্ষ, একটি ছাড়া অপরটির কোনো অর্থ হয় না।

জড়ের সাথে মিলন ও অহংজ্ঞানের মাধ্যমে আত্মার পতন : মানবাত্মা বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ। আর এ জন্যই তা অতীন্দ্রিয় ও স্বাধীন। দেহ ধারণের আগে আত্মা ছিল অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজগতের অধিবাসী, এবং তখন তা মরমি স্বজ্ঞার সাহায্যে চিরন্তন নওস বা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার ধ্যানে আবিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আত্মা শুভের জ্ঞানলাভ করে। এরপর যখনই তা তার দৃষ্টি জগৎ ও জড়ের দিকে নিবদ্ধ করলো, তখনই সূচিত হয় তার পতন। অহংজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই আত্মা অনন্ত জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পতন বা অবনতির ফলেই আত্মার দেহপ্রাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান জীবনে আমরা যেসব দুঃখভোগ করি, সেগুলোর সবই এ অবনতির শাস্তিস্বরূপ। জীবদেহধারণ প্রথমে আত্মার ইচ্ছাধীন ছিল – আত্মা স্বেচ্ছায় দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাসনা যখনই কার্যে পরিণত হলো, অমনি আত্মার স্বাধীনতা লোপ পায়। আর তখন থেকেই আত্মা প্রকৃতির অধীন হয়ে যায়।

বুদ্ধির সাথে আত্মার সম্পর্ক ও বুদ্ধির দিকে অগ্রসর হবার বাসনা, গভীর ধ্যান ও বৈরাগ্যে মুক্তিলাভ : বিশ্বাত্মার ন্যায় মানবাত্মাও জড় ও বুদ্ধির সমবায়ে গঠিত। মানবাত্মা জড়দেহের মধ্যে আবদ্ধ। সুতরাং তা জড়জগতের নিয়মাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার আদিনিবাস বুদ্ধির জগৎ, আর তাই জড়ের বন্ধনমুক্ত হয়ে আত্মা বুদ্ধির অভিমুখে অগ্রসর হতে চায়। বুদ্ধিজগৎ থেকে জড়জগতে অবতীর্ণ হলেও বুদ্ধির সাথে আত্মার সম্বন্ধ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায় নি। সূর্যের আলো একদিকে যেমন সূর্যের সাথে এবং অন্যদিকে পৃথিবীর সাথে যুক্ত, ঠিক তেমনি মানবাত্মা বুদ্ধিজগৎ ও জড়জগতের সাথে যুক্ত। যে বুদ্ধির জগৎ থেকে পতনের ফলে আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে সেই জগতে প্রত্যাবর্তনই তার শেষ লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে যদি সে ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ আত্মা যদি দেহের বন্ধনে আবদ্ধই থেকে যায়, তা হলে মৃত্যুর পর তা তার কর্মফল অনুসারে অন্যকোনো ব্যক্তি, ইতরপ্রাণী কিংবা উদ্ভিদের দেহের সঙ্গে যুক্ত হবে। সুতরাং মানুষের উচিত সৎকাজের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন। ইন্দ্রিয়সংযম ও বৈরাগ্য অনুশীলন এ ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে। কামনা বাসনাকে জয় করে নির্মল ভক্তিপূর্ণচিত্তে গভীর ধ্যানের সাহায্যেই কেবল আত্মা তার বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে। এভাবে মুক্তিলাভের পর পরিশেষে আত্মা শাশ্বত প্রত্যয়জগতে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করে।

আত্মার পরিশুদ্ধির তিনটি পথ : আত্মার পরিশুদ্ধি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শুধু প্রবৃত্তি দমনই যথেষ্ট নয়। আত্মাকে অবশ্যই দৈহিক কামনা জয় করে বাসনার পর্যায় অতিক্রম করে পুরোপুরি বিশুদ্ধ হতে হবে। এর তিনটি পথ রয়েছে। যথা : এক. ললিতকলা, দুই. প্রেম এবং তিন. তত্ত্বজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে এ তিনটি পৃথক পথ নয়, বরং একই পথের তিনটি শাখামাত্র। সুন্দরের চিন্তা, সুন্দরের সংস্পর্শ এবং সুন্দর ও পবিত্রের জ্ঞানই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে সহায়ক। যিনি একবার পরম সুন্দরের দর্শন পেয়েছেন, তিনি অন্য কোনো আনন্দের আকাঙ্ক্ষা রাখেন না। যিনি এই অনন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছেন, তিনিই দার্শনিক। তাঁর কাছে পার্থিব যেকোনো সৌন্দর্য তুচ্ছ। তিনি যে অব্যক্ত আনন্দের সন্ধান পান, এর জন্য তিনি যেকোনো পার্থিব সুখ সানন্দে বিসর্জন দিতে পারেন। এ আনন্দ থেকে যে আবেশের সৃষ্টি হয়, তা-ই মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগসূত্র।

উচ্চতর ভাবসমাধি অবস্থায় উন্নীত হয়ে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন ও মুক্তিলাভ : যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নয়, উচ্চতর ভাবসমাধি অবস্থায় উন্নীত হয়েই আত্মা ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন ও একাত্মবোধ করতে সক্ষম হয়। আত্মা ও ঈশ্বরের এ মিলনকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাদের অভিজ্ঞতার কোনো মাধ্যমে এর সংজ্ঞানির্দেশ সম্ভব নয়। শুধু নঞর্থকভাবে একে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা যেতে পারে। ভাবসমাধি অবস্থায় উত্তীর্ণ আত্মা আকারহীন, আত্মসংবিদহীন। এখানে আত্মা গতি ইচ্ছা আবেগ প্রজ্ঞা ও চিন্তাবিবর্জিত। এ অবস্থাকে দিব্যদর্শনও বলা চলে না। এটা বরং অন্য এক ধরনের ‘দেখা’ ও আত্মসমর্পণ। প্রচলিত অর্থে একে ঈশ্বরের সাথে মিলনও বলা চলে না; কেননা মিলন কথাটি দুটি স্বতন্ত্র জিনিসের একত্রে মিশ্রণকে নির্দেশ করে। কিন্তু আত্মা ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র নয়। দুটি এককেন্দ্রীয় বৃত্তের কেন্দ্র যেমন অভিন্ন, ঠিক তেমনি আত্মা ও ঈশ্বর অভিন্ন। আত্মা ও ঈশ্বর যে শুধু একত্রে অবস্থান করে তা-ই নয়, তারা অভেদ ও অভিন্ন। আত্মশুদ্ধিলাভের মাধ্যমে এবং পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা পুনরায় তার আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়। আত্মার মুক্তিপ্রচেষ্টার এটিই শেষ ও চূড়ান্ত ধাপ, এবং এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে জন্মান্তরবাদের। এখানে স্বাতন্ত্র্যবোধ নেই, দেশ কাল ও বহুত্বের চেতনা নেই। আত্মার পক্ষে এ অবস্থাপ্রাপ্তি সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্লটাইনাসের মতে, দার্শনিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যেহেতু এই অবস্থার ব্যাখ্যা করা যায় না এবং আমরা যেহেতু এর সন্তোষজনক বর্ণনা দিতে পারি না, সুতরাং আমাদের এ সত্য মেনে নেয়া উচিত যে, মরমি অভিজ্ঞতা বৌদ্ধিক বোধের অতীত। যুক্তিনিষ্ঠ তর্কালোচনেই আত্মার প্রকৃষ্ট প্রকাশ। আত্মচৈতন্যই আত্মার আত্মজ্ঞান। যেরূপ একটি দর্পনের প্রতিবিম্বে “আমরা নিজেদেরই অমর বলে দেখি” সেইরূপ আত্নচেতনায় আত্মা বিম্বিত হয়। ব্যক্তির কাম্য, যেমন, সামাজিক ন্যায়, পরস্পরের সহানুভূতি প্রভৃতি আত্মিক জগতেরই অন্তৰ্গত; তার বাইরে এইরূপ কোন কাম্য নেই। আত্মা যেহেতু অপরাপর আত্মার সাথে সম্পর্কযুক্ত সেইহেতু ব্যক্তিত্ব আত্মারই বৈশিষ্ট্য। আত্মা স্বরূপত ‘উদ্দেশ্যসাধক’ (teleological) এবং আত্মা ধারণা বা আদর্শাবলীকে মূর্ত করার জন্যই বাচিয়া থাকে। আত্মার নিজস্ব বিশেষ কার্যাবলী আছে, কিন্তু যখন এটি ইচ্ছা করে এটির ঐচ্ছিক কার্য ওপর থেকে অনুপ্রাণিত হয়, যা এটির নীচে থাকে তাকে আত্মা প্রত্যক্ষ সৃষ্টি শক্তিদ্বারা পরিচালিত করে। ব্যক্তি-আত্মা উচ্চতর জীবন থেকে নিম্নতর জীবনে আগমন করে এবং পুনরায় উচ্চতর জীবনেই প্রত্যাবর্তন করে। এটি স্বেচ্ছায় নেমে আসে যাতে নিম্নতম পর্যায় অবধি এটির বৃত্তিগুলো সঞ্চারিত হয়। এই পদ্ধতিতে আত্মা নিজের শক্তি প্রকাশ করে এবং ভালমন্দের জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু এটি ক্ষতিগ্রস্তও হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেই এটির নিম্নতর জীবনে আগমন দোষজনক। যত স্বল্পস্থায়ী এই নিয়েগমন ততই ক্ষতি কম। অবশ্য এই নিম্নাগমন সত্বেও আত্মার মর্মকোষ সদা শুদ্ধই থাকে।

চৈতন্য : প্লটাইনাস মানুষের দেহ, আত্মা ও চৈতন্য এই তিন অংশ পৃথক করেছেন। প্লটাইনাস বিবৃত মানুষের তিনটি অংশের তৃতীয় অংশ চৈতন্য। এটি আত্মার মতই জীবন নিহিত সূত্র। কিন্তু তুলনামূলকভাবে উচ্চতর পর্যায়েই এটি নিহিত। যদিও আত্মা চৈতন্যের নিম্নস্তরে, তবুও চৈতন্যের জন্য এটির মধ্যে যেন চুম্বকের মত আকর্ষণ—আত্মা চৈতন্যাপেক্ষী, চৈতন্যের স্পর্শ-সংস্কার গ্রহণ করে এবং সুন্দরতর হয়ে ওঠে, কারণ, চৈতন্য এবং চৈতন্যাগত বৃত্তিসকলই এটির প্রকৃত সৌন্দর্য। যখন আমাদের বিচারশক্তি চৈতন্যের স্পর্শ-চিহ্ন পায় তখন কেবল আমাদের সৌন্দর্যই বর্ধিত হয় না, আমরা নিজেরাই চৈতন্যের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয় আছে আমাদের নিম্নস্তরে, যুক্তি-বিচারের বিষয় থাকে আমাদের সমস্তরে; এবং চৈতন্যের বিষয় আমাদের উচ্চস্তরে; এবং এই শেষােক্ত বিষয় আমরা দেখতে পাই তখনই যখন চৈতন্যের আলোক আমাদের ওপর এসে পড়ে। চৈতন্যসদ্ভূত জ্ঞান বা চৈতন্য-প্রত্যঙ্গ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ এবং যুক্তি বিচার উভয় থেকে স্বতন্ত্র। এটি ধারণা বা আদর্শ জানার বৃত্তি এবং চৈতন্য এই ধারণাবলী জানিবার সময় নিজেকেই জানে। তাই যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে আত্মা অপর বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করে, চৈতন্য নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। আত্মজ্ঞানই এটির স্বরূপ-বৃত্তি। চৈতন্যের স্বরূপ যেহেতু জ্ঞান, তাই এটির জ্ঞান এবং সত্তা অভিন্ন। চৈতন্য-প্রত্যক্ষের সকল বিষয় (ধারণাবলী) সর্বদাই একত্রে অর্থাৎ এক নিত্য বর্তমানে তাদের নিত্য স্বরূপ নিয়ে চৈতন্যে বিধৃত হয়ে আছে, কিন্তু এই বিষয়গুলো চৈতন্য-বহির্গত নয়। উক্ত বিষয়গুলো নিয়েই চৈতন্য, যেমন বিভিন্ন অংশকে নিয়ে সমগ্র। প্রতিটি সামান্যধারণাই চৈতন্যরূপ এবং সমগ্র চৈতন্য প্রকৃত প্রস্তাবে সকল সামান্যধারণা। চৈতন্যের মধ্যেই সত্য এবং পরমতত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটি স্বীকৃত। পরম সত্য অপর কিছুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এটি নিজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি সৎ এবং এটির স্বরূপ কী তাও এটির অবহিত। তাই সত্তা, চৈতন্য-জ্ঞান এবং চৈতন্য এক এবং অভিন্ন। ফলত চৈতন্য, প্রকৃতজগতের জ্ঞান এবং প্রকৃত জগৎ অভিন্ন। তাদের পারস্পরিক পৃথক আলোচনা সম্ভব হলেও তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা পৃথক সত্তা নয়। প্লটাইনাস মানুষের ত্রি-অংশ বিভাগের অনুরূপ দিব্যতত্ত্বেরও ত্রিধাবিভাগ নির্ণয় করেছেন। প্লেটোর ‘টাইমস’ অনুসরণে তিনি বিশ্বাত্মা, দিব্যচৈতন্য এবং অদ্বৈতসত্তা বা পরমব্রহ্ম এই ত্রয়ী স্বীকার করেছেন। যে বিজ্ঞান চেতন-জগৎ নিয়ে আলোচনা করে তা দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান (Dialectic) বলে পরিচিত। এই বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলোর উৎপত্তি চৈতন্য থেকে। মানবাত্মা এই বিজ্ঞান অনুশীনেন করে, মানবাত্মা যে সূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ চৈতন্য সেই সূত্রাবলী আত্মাকে দেয়। এই সূত্রাবলী গ্ৰহণ করে মানবাত্মা উক্ত বিজ্ঞান প্রদত্ত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে, সংগ্রথিত করে যতক্ষণ না চৈতন্য-জ্ঞানে এসে উপনীত হয়। যে অনুপাতে মানবাত্মা ঐ মূলসূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ সেই অনুপাতে মানবাত্মাই চৈতন্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি একটি যৌক্তিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি যুক্তিশাস্ত্রকে অতিক্রম করে স্বজ্ঞাস্তরে (intuition) উন্নীত হয়।

মোক্ষলাভের অবস্থা : পরম এক যিনি সকল কিছুর মূলাধার, আমাদের অজ্ঞেয়। এমন কি চৈতন্য যখন নিজস্ব স্বজ্ঞা (intuition) এবং চৈতন্যজগৎ নিয়ে ব্যাপৃত থাকে তখন একে জানতে পারে না। কিন্তু প্রেমাকাঙ্ক্ষায় যখন চৈতন্য নিজেকে অতিক্রম করে তখন সেই মুহুর্তের জন্য এটি পরম একে রূপান্তরিত হয়, যাকে অবশ্য সে কখনও জানতে পারবে না। এসব মুহূর্তে দ্রষ্টা এবং দৃষ্টের, অন্বেষণকারী এবং অম্বিষ্টের একাত্মতা এতই সম্পূর্ণ হয় যে এটি জ্ঞাতা-জ্ঞেয় পার্থক্য অতিক্রম করে যায় এবং ফলত জ্ঞানের বা জ্ঞানের সম্ভাবনার প্রশ্ন সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এইসকল মুহূর্ত তখনই আসে যখন আমরা সেই পরম একের প্রতি প্রদীপ্ত প্রেমে নিজেদের নিরাবরণ করে ফেলি, এমন কি চৈতন্য-জগতের সব কিছু যখন খলিত হয়ে যায়। কারণ পরম একের উপলব্ধি তখন অসম্ভব যখন আমরা ‘অপর’-কে নিয়ে বিব্রত থাকি। মানবাত্মা কোনো কিছুর জন্য এমন কি স্বর্গের স্বর্গলাভের পরিবর্তেও সেই পরম একের সাথে নিজের একাত্ম অবস্থা ত্যাগ করবে না। তখন আত্মা এত উন্নতশীর্ষে আরোহণ করে যে এটি পূর্বে যে চৈতন্য-স্বজ্ঞাকে (spiritual intuition) অতিমূল্যবান মনে করেছিল তাকে তুচ্ছ ভাবে—যেমন একজন পথিক কোনো প্রাসাদে প্রবেশ করে প্রথমে প্রশংসা করে সজ্জিত সুন্দর সামগ্রীগুলো কিন্তু যখন গৃহপতি আসেন তখন তিনিই পথিকের সকল মনোযোগ আকর্ষণ করেন। চৈতন্য চিন্তার মাধ্যমে চৈতন্য-জগতকে জানে। চৈতন্য কোনো কোনো মুহূর্তে পরম একের প্রেমে সেই একেই রূপান্তরিত হয়। মানবাত্মা এবং ‘পরম এক’ দুটো সমকেন্দ্রিক বৃত্তের ন্যায় যখন পরস্পর মিলিয়া যায় তখন তারা অভিন্ন এবং পৃথক হলেই দুই। আত্মা যখন পরম ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হয়ে যায় তখন এটির যে দিব্য প্রত্যক্ষ হয় (vision) তা এতই সাক্ষাৎ যে বর্ণনা করা যায় না, কেননা যা প্রত্যক্ষ হচ্ছে তা যদি প্রত্যক্ষকারীর সাথে অভিন্ন বলে প্রতিভাত হয় তবে তিনি তাকে আপন থেকে পৃথক বলে বর্ণনা করতে পারেন না। অপর ব্যক্তি যিনি নিজে সেই দিব্য প্রত্যক্ষের আনন্দ লাভ করেননি তাকে তুমি এটি দেখাতে পার না। এইরূপ দিব্য-প্রত্যক্ষের সামর্থ্য যদিও সকল ব্যক্তিরই আছে তবুও অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই এটি কার্যে প্রয়োগ করতে পারেন।

উচ্চ ও নিম্ন আত্মা এবং আত্মার স্মৃতি : আত্মার কল্পনাবৃত্তি দুই প্রকার : (১) ইন্দ্ৰিয়জ (২) বুদ্ধিগত। প্রথমটি হচ্ছে নিম্নতর বা মননহীন আত্মার ওপর বহিরাগত অভিঘাতের ফল এবং দ্বিতীয়টি উচ্চতর এবং মননশক্তিসম্পন্ন আত্মার ওপর বাইরের অভিঘাত সৃষ্ট। এটি সংবেদন এবং যুক্তি-চিন্তার মধ্যবর্তী। উন্নত হলে এটিই ‘অভিমতে রূপান্তরিত হয়। স্মৃতি আত্মার অন্যতম শক্তি। স্মৃতি এবং পূর্বসংস্কারজ্ঞান (Recollction) পৃথক। স্মৃতি সর্বদা কাল সংশ্লিষ্ট এবং অভিজ্ঞতালব্ধ কোন বিষয় সম্পর্কিত। ধারণার (Ideas) সংস্কার জ্ঞান হয়। উচ্চ ও নিম্ন আত্মা উভয়েরই নিজস্ব স্মৃতি আছে। মৃত্যুর পর দুই আত্মা পৃথক হয়, কিন্তু একের মধ্যে যা ছিল তার অস্পষ্ট জ্ঞান অপরের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। যদিও উচ্চতর আত্মা মূলত উচ্চতর অভিজ্ঞতারই স্মৃতি রাখে এবং মহৎ সামান্যধারণাবলীর সংস্কারই স্মরণ করে। বন্ধুবান্ধব দেশ, স্ত্রী, সস্তানসন্ততির স্মৃতি উচ্চ এবং নিম্ন উভয় আত্মায় বর্ধমান, কিন্তু যতই উচ্চতর আত্মা বিকাশ লাভ করতে থাকে সেইসকল স্মৃতি ততই হ্রাস পেতে থাকে এবং অবশেষে সম্পূর্ণ ম্লান হয়ে যায়।

প্লটাইনাসের মত খ্রিস্টীয় কৃচ্ছতাবাদ নয় ও দাম্পত্যপ্রেম পরম একের সাথে চৈতন্যের একাত্মতার প্রতিচ্ছবি : সর্বোচ্চ আদর্শ হচ্ছে পরম কল্যাণ বা পরম ব্রহ্মের অনুধ্যান ও ক্রমশঃ তার সাথে একাত্মতায় উপনীত হওয়া এবং এই আদর্শ-অন্বেষায় যে পরিতৃপ্তি মানুষ পায় তাকে আত্মকেন্দ্রিক অথবা এমন কি পরার্থে কাম্য সুখের সাথে মিলিয়ে দেখলে ভুল হবে, কেননা ‘সুখ’ পরম শ্রেয়ের সূচক নয়, তা আমাদের কল্যাণ বা আপেক্ষিক শ্রেয়সূচক। এই আপেক্ষিক অর্থে জড়ের কল্যাণ হচ্ছে আকার (form); আকারের কল্যাণ দেহ ; দেহের কল্যাণ আত্মা; আত্মার কল্যাণ ধর্ম এবং ধর্মোপরি যে চৈতন্য আছে তা ; এবং চৈতন্যের কল্যাণ সেই পরম কল্যাণ (The Good)। এভাবে প্লটইনাসের মতে অগ্রবর্তী এক জগতের দিকে, অন্য এক জগতের অর্থাৎ চৈতন্য-জগতের দিকে এবং তা অতিক্রম করেও সেই পরম একের অনিরপেক্ষ ঐক্য, যা সকল কিছুর আদি উৎস, তার দিকে বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে উন্নীত হওয়ার মধ্যেই সকলকিছুব কল্যাণ নিহিত। তার অন্য জগতাভিমুখিতা যদিও কৃচ্ছতাবাদী এবং প্রাচীন খ্রীষ্টানদের মতের সাথে এক নয়, কেননা তারা অবিবাহিত জীবন যাপন সমর্থন করতেন ও দেহগত সকল ব্যাপার বর্জন করতে বলতেন। কিন্তু প্লটইনাসের মতে দাম্পত্যপ্রেম হচ্ছে পরম একের সাথে চৈতন্যের যে একাত্মতা তারই প্রতিচ্ছবি এবং হয়তো চৈতন্য-জগতাভিমুখে উন্নীত হওয়ার প্রথম সূত্রপাত। যদিও দেহের সাথে সংযোগ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তবুও দেহকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা উচিত নয়। মানুষ তার দেহকে “যা কিছু প্রয়োজন এবং দেয়া সম্ভব দেবে যদিও সে নিজে অন্য এক জগতের অন্তর্গত।” একজন সঙ্গীতজ্ঞ যেরূপ তার তার যন্ত্রটি ব্যবহার করে-যন্ত্রটি জীর্ণ হয়ে গেলেও সে যেরূপ বিনা যন্ত্রে গান গাহিতে পারে সেইরূপ মানুষও তার দেহের ব্যবহার করবে।

প্লটাইনাসের স্টোয়িক আত্মহত্যা ও নস্টিক নৈতিক নীচতার বিরোধিতা : প্লটইনাসের মতে জড় হচ্ছে অকল্যাণ (evil) কিন্তু জড় থেকে মুক্তিলাভের জন্য আত্মহত্যার যে আদর্শ স্টোয়িক দার্শনিকগণ দেন তা প্লটইনাসের সমর্থন পায়নি। এই মুক্তি লাভ করতে হবে জড়-কে আকারের (form) অধীন করে—জড়ত্বগ্রস্ত মানুষ ও তার দৈহিক কামনা ও আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চতর এক মানবসুত্তা ও তার পৃদ্ধিবৃত্তির অনুগত করে। মানুষের সর্বাত্মক নৈতিক নীচতা সম্পর্কে যে নস্টিক (Gnostic) মতবাদ আছে প্লটইনাস তার বিরোধী মত পোযণ করেন। তিনি মনে করেন যে নৈতিক অপরাধ সর্বদা কিছু না কিছু মঙ্গলের সাথে মিশে থাকে এবং কোনো মানুষই সম্পূর্ণত মন্দ না। দোষ-প্রবণতা চরিত্র থেকে আসে এবং চরিত্রের ভিত্তি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা। সর্বব্যাপক আত্মা স্বাধীনতা ও আবশ্যিকতা এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে।

প্লটাইনাসের সৌন্দর্যতত্ত্ব

প্লটাইনাস ‘এনীড্‌স্‌স-এর একটি অধ্যায়ে তার সৌন্দর্যতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন। সৌন্দর্যতত্ত্বকে দর্শনের একান্ত অন্তর্গত একটি অংশরূপে পরিচিত করান, দেহী ও আত্মিক সৌন্দর্যের এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য ও শিল্পের পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য খ্যাতি তারই প্রাপ্য। তার মতে সৌন্দর্য কেবল অনুপাত বা সুসঙ্গতিই ( harmony) নয়; কারণ তা হলে সৌন্দর্য কেবল বিভিন্ন সমগ্রের মধ্যেই থাকবে, সমগ্রের কানো অংশে থাকবে না, যেমন এক একটি সরল রঙে তা থাকবে না। সৌন্দর্য তা হলে সমভাবে কোনো কুশ্রী সমগ্রেরও গুণ থেকে পারে—যার হয়তো আভ্যন্তরিক অনুপাত আছে কিন্তু সৌন্দর্যের সাথে যার বিরোধ। সৌন্দর্য হচ্ছে প্রকৃতই বস্তুর গুণ আত্মা যা নিজ স্বরূপ অর্থাৎ চৈতন্যের সমধর্মীয় মনে করে এবং সুশ্ৰীত বস্তুর সেই গুণ যা আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপের অন্যধর্মীয় মনে করে। তাই বস্তু যেহেতু চৈতন্য-জগতের ভাব বা আকারে (forms) অংশ গ্রহণ করে. সৌন্দর্য জানতে গেলে আমরা এই আকারগুলো সম্পর্কেও অবহিত হই। কুশ্রী বস্তুতে যে পরিমাণে এই আকারের অভাব সেই পরিমাণে তা কুশ্রী এবং সুন্দর বস্তুর মধ্যে যে অনুপাতে এই আকার উপস্থিত সেই অনুপাতে তা সুন্দর। যা চরম কুশ্রী তা সকল আকার বর্জিত, “সকল দিব্য তাৎপর্যহীন”। এই আকারগুলো সকল অংশকে সংগ্রহিত ও একত্র করে এক একটি সমগ্র বা ঐক্য গড়ে তোলে এবং এভাবে সৃষ্ট সমগ্র সুন্দর ; এটির অংশগুলোও সেইরূপ সুন্দর। বিদেহী বস্তুমাত্রেরই সৌন্দর্য নির্ভর করে এটির কলুষমুক্তির ওপর। কুশ্রী চরিত্র মলিন কামনাসক্তি, কলঙ্কিত। শুদ্ধ আত্মা একটি ভাব বা আকারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। শ্রেয় এবং সুন্দর একই। পরম এক, পরম শ্রেয়ের সদৃশ হওয়াই আত্মার প্রকৃত সৌন্দর্য। যিনি সেই পরম এককে দেখেন নেই তিনি পরম কল্যাণরূপে তাকে কামনা করেন; যিনি দেখেছেন তিনি তাকে পরম সুন্দর বলে অভিনন্দিত করেন। ‘পরম কল্যাণ’ বা ‘পরম সুন্দর’ তাদেরই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে যারা একে ভাল বাসেন। যিনি দিব্য-দর্শন লাভ করতে ইচ্ছা করেন তার উচিত দেহী সৌন্দর্যের প্রতি চক্ষু বন্ধ করা। যদিও সত্য যে তিনি এই জগতের মহৎ বিষয় নিয়ে বিশেষত মহৎ কার্যাবলীর অনুধ্যান মাধ্যমে নিজেকে শিক্ষা দিতে পারেন এবং নিজে ক্রমশঃ সুন্দরতর হয়ে উঠতে পারেন। আত্মা নিজে সুন্দর হয়েই সৌন্দর্য দেখতে পায়। একজন শিল্পী সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করে অনুকরণ দ্বারা-এরিষ্টটলের এই অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে অনুকরণ নয় কল্পনা দ্বারাই শিল্পী সুন্দর সৃষ্টি করে এবং সেই শিল্পী অধিকতর জ্ঞানী স্রষ্টা। কেননা কেবল যা দেখা হয়েছে তারই প্রতিরূপ গড়তে পারে অনুকরণ কিন্তু কল্পনা যা দৃষ্ট হয়নি তাও সৃষ্টি করতে পারে। শিল্পী অনুপ্রাণিত হন চৈতন্য-জগতের ভাব বা আকার দ্বারা। অতএব তার ক্রিয়াশক্তি নিজেকে একাত্ম করে ফেলে সেই সৃজনশীল ‘পরম ক্রিয়াশক্তি’র (formative Activity) সাথে যে ক্রিয়াশক্তি সকল সৌন্দর্যের উৎস ও মূল। সেজন্যই শিল্পের মধ্যে যে স্বতস্ফূর্ততা দেখা দেয় তা কোনো কৃত্রিম দক্ষতার ফল থেকে পারে না কিংবা এমনকি চেষ্টিত কাজের মধ্যেও প্রকাশিত থেকে পারে না। প্রকৃতি সুন্দর কেননা এটি চৈতন্য-জগতের ‘ভাব’ বা ‘আকারে’ অংশ গ্রহণ করে।

দ্বিতীয় পর্যায়

প্লটাইনাস ছিলেন প্রাচীনকালের শেষ মহৎ দার্শনিক। মধ্যযুগে তার প্রভাব এমন কি অ্যারিস্টোটল অপেক্ষাও অধিক ছিল। মুসলমান সম্প্রদায় গ্রীক সাহিত্য চর্চা করে অ্যারিস্টোটলের ভাষ্য রচনা করার পূর্বে এবিষ্টটল কেবল প্লেটোর একজন শিস্যরূপেই পরিচিত ছিলেন। প্লটইনাসের মতবাদই প্রথমত প্যাগান ধর্মের, তারপর খ্রীষ্টধর্মের এবং অবশেষে ইসলামীয় রহস্যবাদ ও ও নব্যপ্লেটোবাদের একটি দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেছিল। প্লটইনাসের পরে কোনো নব্যপ্লেটোবাদী তার সমকক্ষ থেকে পারেননি। প্লটাইনাসের চিন্তায় দর্শনের যে উন্নতি হয়েছিল, সেটিকে স্থিতিশীল রাখার জন্য মৌলিক দার্শনিকের অভাব ছিল। যারা ঐ সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তাদের মধ্যে ম্যালকাস বা পরফিরি, ইয়ামব্লিকাস এবং প্রােক্লাসই প্রধান। তবে একমাত্র প্রোক্লাস ছাড়া আর কেউ মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন না। প্লটাইনাসের দার্শনিক শিক্ষার ব্যাখ্যা এবং এর সারমর্মের নতুন ভাষ্যপ্রদানের মধ্যেই তাঁরা তাঁদের চিন্তাকে সীমিত রাখেন। এ ছাড়া প্লটাইনাস নিজে যেসব ধর্মীয় গূঢ়তত্ত্বের চিন্তা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করতেন, তাঁর শিষ্যরা সেসব তত্ত্বের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং সেগুলোর ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ও অবিশ্বাস্য সঙ্কেত প্রবর্তন করেন। দেখতে দেখতে পরবর্তী নব্যপ্লেটোবাদীগণ এমন এক নৈতিক দ্বৈতবাদ ও বৈরাগ্যবাদের সমর্থন করতে শুরু করেন, যা কিনা প্রোটিনাস নিজেও কোনোদিন পছন্দ করতেন না। ঈশ্বরের স্বরূপ ব্যাখ্যায় ত্রয়ী নীতির প্রয়োগ এবং বিশ্বের স্বরূপ ব্যাখ্যায় ত্রয়ী নীতির অন্তর্ভুক্ত একাধিক ত্রয়ী নীতির প্রবর্তন প্লটাইনাস-উত্তর দর্শনের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই দেখা যায় প্লটাইনাসের শিষ্য এমিলিয়াস স্বর্গীয় প্রজ্ঞাকে তিনটি পৃথক সত্তায় বিভক্ত করেন। প্রথম সত্তা বিশ্বসৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করেন, দ্বিতীয় সত্তা এই ইচ্ছাকে একটি আদেশরূপে ব্যক্ত করেন এবং তৃতীয় সত্তা আদেশটিকে বাস্তবায়িত করেন। এমিলিয়াসের মতে, জীবাত্মাসমূহ বিশ্বাত্মারই অংশবিশেষ।

ম্যালকাস বা পরফিরি (২৩২-৩০১ খি.)

ম্যালকাস (২৩২-৩০১ খি.) ২৩২ খ্রীষ্টাব্দে ফিনিসিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে অধ্যয়ন করেন লংগীনাসের কাছে। এই সময়ে তিনি তার নামের পরিবর্তিত গ্রীক রূপ পরফিরি নাম গ্রহণ করেন। যখন তিনি ত্রিশ বছরের তখন তিনি প্লটইনাসে শিষ্য হন এবং প্লটইনাসের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সাথে ছিলেন ও তার মৃত্যু পর ৩০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রোমে অধ্যাপনা কবেন। তিনি প্লটাইনাসের রচনাবলী সংগ্রহ করেন এবং ‘এনিয়াডস’ নামে সুসংবদ্ধ সংকলনটির সম্পাদনা করেন। তিনি সেই রচনাবলীর সাথে একটি জীবনীতথ্যমূলক মূল্যবান ভূমিকা সংযোজিত করে দেন। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে এরিস্টটলের ক্যাটেগরিজ-এর একটি ভূমিকা মধ্যযুগ পর্যন্ত প্রামাণিক হিসেবে প্রচলিত ছিল। শুধু তা-ই নয়, গ্রন্থটি ছিল পরবর্তীকালের ফরম্যাল লজিক বা আকারী যুক্তিবিদ্যার ভিত্তিস্বরূপ। ভাবার্থের তেমন কোনো পরিবর্তন না করে পরফিরি তাঁর নিজের ভাষায় প্লটাইনাসের দর্শনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অবশ্য তিনি দেহধারী ও অশরীরী সত্তার মধ্যে যে পার্থক্য করেছিলেন, প্লটাইনাস নিজে তা করেন নি। তা ছাড়া প্লটাইনাসের মতো পরফিরি বিশ্বাস করতেন না যে, মানুষ পরবর্তী জন্মে পশুর পর্যায়ে অধঃপতিত হতে পারে। এনিয়াডস ছাড়াও তিনি পিথাগোরাসেরও একটি জীবনী রচনা কবেন।

যদিও মোটামুটি তিনি গুরুর শিক্ষায় বিশ্বাসী তবুও অ্যারিস্টোটলীয় জ্ঞানের আকার (Categories) সম্পর্কে প্লটইনাসের সমালোচনার সাথে তিনি একমত ছিলেন না এবং অ্যারিস্টোটলীয় জ্ঞানের আকার আলোচনাতে তিনি উক্ত আকারগুলোর সমর্থন করেন। এই গ্রন্থে তিনি পাঁচটি যৌক্তিক ধারণা বা ‘বিধেযক’ (Prclicables) নিয়েও আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে এই বিধেয়কগুলোর পার্থক্য সুস্পষ্ট করে তোলে যে ‘দ্রব্যত্ব’ বা ‘সত্তা (being) হচ্ছে সর্বোচ্চ ধারণা এবং এটি ‘পরফিরির বিভাগ নামে খ্যাত দ্বি-কোটিক বিভাগের (Division by Dichotomy) সূচনা করে। এই দ্বি-কোটিক বিভাগ সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ধারণা ‘দ্রব্য থেকে আরম্ভ করে ব্যক্তিমানুষ’ পর্যন্ত আসতে গেলে মধ্যবর্তী কয়েকটি ধারণা, যেমন, ‘পদার্গ, চেত-পদার্থ, ‘প্রাণী,’ এবং মানুষ, পরপর অতিক্রম করে আসতে হয়। পরফিরি এছাড়া এই সমস্যা উত্থাপন করেন যে সামান্য, উপজাতি, জাতি (Genus) প্রভৃতি কেবল মনোগত ধারণা কিংবা এদের মন-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। পুনরায় যদি এদের বহির্জগতে অস্তিত্ব থাকে তা হলে জিজ্ঞাস্য হয় যে এদের স্বরূপ কি জড়বস্তুর মত অথবা এরা কি নিরবয়ব? যদি নিরবয়ব (incorporeal) হয় তাহলে এদের বস্তু-নিরপেক্ষ নিজস্ব সত্তা আছে না এরা বস্তুতেই নিহিত? এই সমস্যাটি মধ্যযুগে দার্শনিক আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল। প্লটইনাসেব মধ্যে সেইটুকু কুসংস্কার ছিল যেটুকু সেই সময়ে থাকা সম্ভব ছিল, কিন্তু পরফিরি সম্পর্কে এটি বলা যায় না – অন্যান্য নব্যপ্লেটোবাদী সম্পর্কে আরো বলা যায় না। পরফিরি স্বীয় শিক্ষাগুরুর যে জীবনী রচনা করেন তাতে অপ্রাকৃত জাদু-শক্তি এবং দুস্কৃতিশক্তির প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ক প্রসঙ্গ উত্থাপন পরফিরির অন্যথায় বিশ্বাসযোগ্য সত্য পরিচয়টি বিকৃত করে দিতে পারে।

‘এবৃস্টিনেন্স’ শীর্ষক গ্রন্থে পরফিরি যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোর কোনো কোনোটি আধুনিককালে অনুসৃত কিছু কিছু নৈতিক আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর মতে, সুখমাত্রই পাপের আকর। ঘোড়দৌড়, যাত্রা-থিয়েটার, নাচ-গান, যৌনাচার প্রভৃতি যেকোনো অবস্থায়ই বর্জনীয়। মাংস খাওয়াকেও তিনি একটি গর্হিত কাজ বলে মনে করতেন। তাঁর দর্শনে এক গভীর ধর্মীয় অনুপ্রেরণা লক্ষ করা যায়। তাঁর স্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, “জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কথায় ও কাজে ঈশ্বরের উপস্থিতি স্বীকার করবে এবং ঈশ্বরকে সাক্ষী রাখবে। সব শুভ কাজের জন্য আমরা যেন ঈশ্বরকেই কৃতিত্ব দেই; কিন্তু সব অপকর্মের জন্য আমরা নিজেরাই যে দায়ী, একথা যেন আমরা মনে রাখি। ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ।” সব কাজকর্মে আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। সর্বোপরি আমাদের উচিত অধর্মকে এড়িয়ে চলা।

পরফিরি ছিলেন প্রচলিত ধর্মমতের ঘোর বিরোধী। তাঁর মতে, পরস্পরবিরোধী গোত্রসমূহ যেসব দেবদেবীর উপাসনা করে, তারা প্রকৃত দেবতা নয়, ভূতপ্রেত। যারা সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নয়, রূপকের সাহায্যে তাদের শিক্ষার জন্য দেবদেবীদের কল্পনা করা হয়। আর এজন্যই পশু-পাখি, এমনকি গাছ-পাথরকেও দেবতা বলে গণ্য করা হয়েছে। দার্শনিকের ধর্মই যথার্থ ধর্ম। দার্শনিক কোনোদিন তথাকথিত দেবতা বা শয়তানের উপাসনা করেন না। দার্শনিক পরম আধ্যাত্মিক সত্তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন।

ইয়ামব্লিকাস (২৪৫-৩২৫ খ্রি.)

নব্যপ্লোটোবাদের সঙ্গে যে ক্রমবর্ধমান ধর্মস্পৃহা লক্ষ করা যায়, ক্রমশ তা সেদিনের দার্শনিক চিন্তায় প্রাধান্যবিস্তার করতে থাকে। আর ধর্মস্পৃহা প্রবল হওয়ার সাথে সাথে তত্ত্বস্পৃহাও ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। দর্শনালোচনায় আকৃষ্ট না হয়ে মানুষ তখন ধর্মের জন্যই অস্থির হয়ে ওঠে। কুসংস্কার দূর করাতো দূরের কথা, দর্শনই তখন কুসংস্কারের অধীন হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে যে কয়েকজন দার্শনিক আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পরফিরির ছাত্র ইয়াম্বলিকাস (মৃ. ৩০৩ খ্রি.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আগে ধর্মতত্ত্বকে অধিবিদ্যার প্রতীক বলে মনে করা হতো; কিন্তু ইয়ামব্লিকাসের সময় থেকে অধিবিদ্যার স্থান নিতান্তই গৌণ হয়ে যায় এবং দেবদেবীরাই আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। দেবদেবীদের সংজ্ঞানির্দেশ এবং বুদ্ধির সাহায্যে তাঁদের সমর্থনই তখন দর্শনের মূল কাজ বলে বিবেচিত হয়।

সিরিয়ার অন্তর্গত ক্যালসীস নিবাসী (আনুমাণিক ৩৩০ খ্রঃ) ইয়ামব্লিকাস পাণ্ডিত্য এবং প্রতিভার জন্য খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তার অধিকাংশ রচনা, প্লেটোর সংলাপ’ এবং অ্যারিসটোটলের ‘Analytica’-র ওপর তার ভাত পাওয়া যায়নি। পিথাগোরাস সম্পর্কে একটি বৃহৎ রচনার অংশবিশেষ যদিও পাওয়া গিয়েছে। ইয়ামব্লিকাস রোমে পরফিরির অধ্যাপনায় যোগ দেন এবং তারপর সিরিয়ায় চলে যান ও সিরিয়ার নব্যপ্লেটোবাদী গোত্রের মুখ্যব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এই গোত্রের খ্যাতি ছিল পিথাগোরাস প্রণীত মতবাদের প্রাচ্য দৃষ্টিভঙ্গীসম্মত বিশ্লেষণ এবং অপ্রাকৃত জাদুরহসযবাদী প্রবণতার জন্য। অথচ প্লটাইনাস পরিচালিত রোমের দার্শনিকগোষ্ঠী তখনও গভীরভাবে গ্রীক মনোভঙ্গীসম্পন্ন ছিল, কেননা এটির জগৎকিরণবাদ (emanation) এবং কৃচ্ছতাবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিতত্ত্ব সত্ত্বেও এই গোষ্ঠী অনুধ্যানকেই (contemplation) সর্বোচ্চ স্থান দিতেন এবং সার্বিক যুক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করতেন।

ইয়ামব্লিকাসের দর্শন পিথাগোরাস প্লেটো এবং মিশর ও প্রাচ্যের ধর্মাবলী এবং জাদুরহস্যতত্ত্বের প্রভাবচিহ্নিত। এটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার চেয়ে প্যাগান দেবগোষ্ঠী, অপ্রাকৃত জাদু-রহস্যের প্রভাব এবং অলৌকিক বিভিন্ন শক্তি সম্পর্কিত বিশ্বাসকেই অধিক সমর্থন করে। তিনি এয়ী (Triad) সমন্বিত একটি যৌক্তিক পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন যার দ্বারা তিনি হোমার উল্লিখিত এবং অন্যান্য দেবতাবগের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন। প্লটইনাস কথিত ‘আত্মা’র ‘চৈতন্যে’ অংশ গ্রহণ এবং চৈতন্যের ‘পরম এক’-এ অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বিপরীত মত পোষণ করতেন। কেননা সেই পদ্ধতি সেই অনির্বচনীয় এক-এর অন্যনিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তার ব্যাঘাত ঘটায়। এই যুক্তির সহায়তায় তিনি খ্রীষ্টীয় ‘মানুষ-ঈশ্বর’ তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। তিনি ঈশ্বরের অন্য নিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তা থেকে গৌণ ত্রয়ী-সত্তা নির্ণয় করেন যা থেকে আবার তিন পর্যায়ের দেবতা – বুদ্ধিগ্রাহ্য, অতিপ্রাকৃত এবং জগৎ-নিহিত দেবতার আবির্ভাবের কথা বলেন। প্রথমোক্ত দুই পর্যায়ের দেবতাগণ জগৎ-অতিক্রান্ত, তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণ পিথাগোরাসের ‘সংখ্যা’, প্লেটোর সাপ্ত ধারণা বা অ্যারিসটোটলের ‘বিমূর্ত আকার’ ইত্যাদির সাথে অভিন্ন এবং তারাই আমাদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করেন। আত্মা এবং চেতনসত্তা কেবল তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে কিংবা অংশগ্রহণ করতে পারে।

ত্রয়ী সৃষ্টিতত্ত্ব : ইয়ামব্লিকাস পিথাগোরীয় সংখ্যাতত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং এর সাহায্যেই তিনি তাঁর ত্রয়ী সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, পরমেশ্বর সম্পূর্ণরূপে জগদতীত (transcendent)। ঈশ্বরে কোনো গুণ আরোপ করা চলে না। জীবজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পরমসত্তা থেকে উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় এক একক সত্তা, যা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং সংখ্যা ও বহুত্ব সৃষ্টিতে সক্ষম। অর্থাৎ জগৎ ও জীবসমূহ মূল একক সত্তা থেকে উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তার অংশবিশেষ। এই দ্বিতীয় একক সত্তা (যাকে বহুর মধ্যে এক বলা চলে) থেকে সৃষ্টি হয় তিন শ্রেণীর দেবতার। প্রথম শ্রেণীর দেবগণই কেবল বুদ্ধিবিশিষ্ট ; দ্বিতীয় শ্রেণীর দেবগণ বিশ্বের বাইরে অবস্থান করেন, আর তৃতীয় শ্রেণীর দেবদেবীরা বিশ্বের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। তাঁরাই সরাসরি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা এসব দেবদেবীর সংস্পর্শে এসে থাকি। এঁরাই সত্যিকার দেবদেবী। এঁরাই আমাদের প্রার্থনার লক্ষ্যবস্তু, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপলক্ষ, এবং এঁদের জন্যই আমরা তৈরি করি যজ্ঞবেদী।

অশুভ ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব, আত্মার মুক্তি সম্ভব নয়, ও দেবদেবীদের প্রতি আশ্রয় : পরফিরির ন্যায় ইয়াম্বলিকাসও অশুভ ভূতপ্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতে, মানবাত্মা অসংখ্য ভূতপ্রেত দ্বারা পরিবৃত। মানুষ যতই ধর্মকর্ম করুক-না কেন, তার পক্ষে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ অসম্ভব। মানুষ কোনো অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়ের প্রভাব বা দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। মরণোত্তর জীবনেও মানুষ সহজে ইন্দ্রিয় ও দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। প্লটাইনাসের মতে, শুভ কাজের মাধ্যমে আত্মার পক্ষে ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন সম্ভব, কিন্তু ইয়াম্বলিকাস এ মত সমর্থন করেন না। তাঁর মতে, মানবাত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে যে দূরত্ব, তা অনতিক্রম্য। প্লটাইনাসের মতে, আত্মা তার নিজস্ব শক্তিতেই অশুভ থেকে দূরে থাকতে এবং মোক্ষলাভ করতে সক্ষম ; কিন্তু ইয়ামব্লিকাসের মতে, আত্মা কোনোদিন নিজস্ব চেষ্টায় তা করতে পারে না।। অশুভ প্রেতাত্মাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে আত্মাকে অবশ্যই দেবদেবীদের সাহায্য নিতে হয়। আর এ জন্য তাকে নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। ইয়াম্বলিকাস পরফিরির ন্যায় জাদুবিদ্যার কার্যকারিতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারী বলে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতিও ছিল। কথিত আছে যে, মৃতব্যক্তির প্রেতাত্মার সাথে তিনি যোগাযোগ ও আলাপ করতে পারতেন।

তদকালীন রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মীয় অবস্থা ও বিপ্লব

রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের বিস্তারের সূচনা : ইয়ামব্লিকাসের মৃত্যুর প্রায় বিশ বছর আগে সেদিনের সিংহাসনের ছ’জন দাবিদারের একজন কনস্টেন্টাইন নাকি খ্রিস্টধর্মের প্রতীক ‘ক্রস’ (cross)-এর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। এ উপলক্ষে কনস্টেন্টাইনকে বলা হয়েছিল যে, তিনি যদি খ্রিস্টধর্মের প্রতীককে রাজকীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করেন, তা হলে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ ম্যাক্সেন্টিয়াসের সঙ্গে এক যুদ্ধে জয়ী হবেন। কনস্টেন্টাইন তা-ই করেছিলেন এবং পরিণামে ম্যাক্সেন্টিয়াস শুধু পরাজিতই হন নি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের সময় জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। কনস্টেন্টাইনের ভাগ্য ক্রমশই সুপ্রসন্ন হতে থাকে। তিনি সিংহাসনের অন্য প্রতিদ্বন্দীদের একের পর এক পরাজিত করে ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বলাভ করেন। এরপর তিনি খ্রিস্টধর্মকে রাষ্টীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে খ্রিস্টধর্মের বিস্তার শুরু হয়।

খ্রিস্টীয় নেতাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় আগ্রহ, তাদের মধ্যে ঝামেলা ও সম্রাটদের জড়িয়ে পড়া : খ্রিস্টীয় নেতারা অচিরেই রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং সম্রাটকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। এভাবে ধর্মীয় ব্যাপারাদি নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এসব ব্যাপারে তাঁদের আচরণ পূর্বেকার ধর্মযাজকদের অনুরূপ ছিল না। পূর্বেকার ধর্মযাজকদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না ; আর সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যাপারে প্রভাব বিস্তারেও তাঁরা আগ্রহী ছিলেন না। আবার অন্য ধর্মের প্রতি তাঁদের মনোভাবও ছিল সহানুভূতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ। এর আগে ধর্মীয় বাদানুবাদ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে নি, সম্রাটকে সাম্রাজ্যের ধর্মসংক্রান্ত কোনো গোলযোগও মেটাতে হয় নি। কিন্তু সম্রাট কনস্টেন্টাইন ও তাঁর ছেলে সম্রাট কনস্টেন্টিয়াস এসব ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়েন, এবং তাতে সাম্রাজ্যে নানারকম গোলযোগ সৃষ্টি হয়।

জুলিয়ানের ক্ষমতা লাভ ও প্রাচীন ধর্ম ও দর্শনের প্রতি আগ্রহ : ৩৬১ খ্রিস্টাব্দে কনস্টেন্টাইনের ভাইপো জুলিয়ান কনস্টেন্টিয়াসের পরবর্তী সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। খ্রিস্টধর্মের পরিবেশে প্রতিপালিত হলেও জুলিয়ান এই ধর্মকে পছন্দ করতেন না। বাইরের দিক থেকে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হলেও মনেপ্রাণে তিনি প্রাচীন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি প্রাচীন ধর্মের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং খ্রিস্টধর্মকে রদ করে দেন। এ জন্য খ্রিস্টানরা তাঁকে স্বর্ধমত্যাগী বলে অভিহিত করেন। জুলিয়ানের খ্রিস্টধর্ম রদ করার মূল কারণ ছিল প্রাচীন গ্রিস এবং গ্রিক জীবনপ্রণালীর প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ তথা দর্শনের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ। সেদিনের নব্যপ্লেটোবাদীদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বও এর অন্য এক কারণ ছিল। খ্রিস্টধর্ম রদ করার পরও জুলিয়ান খ্রিস্টানদের প্রতি কোনোরূপ নির্যাতন অনুমোদন করেন নি; যদিও খ্রিস্টধর্মের প্রসার বন্ধ রাখার সম্ভব সব ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সব ধর্মের প্রতি সহনশীল হওয়ার জন্য তিনি নাগরিকদের প্রতি আদেশ জারি করেছিলেন। তিনি বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং তাঁর দার্শনিক মত যে খ্রিস্টধর্মের মূলনীতির বিরোধী ছিল, তা বলাই বাহুল্য।

জুলিয়ানের ভিশন : প্রাচীন ধর্মের দোষত্রুটি সম্পর্কেও জুলিয়ান সচেতন ছিলেন। তিনি শুধু বুদ্ধি ও ক্ষমতারই অধিকারী ছিলেন না, একজন ভদ্র ও সাধুব্যক্তি হিসেবেও তাঁর ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। সমকালীন নৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি এমন এক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন যেখানে খ্রিস্টানদের প্রচারিত সব গুণ উপস্থিত থাকবে। তাঁর সমাজব্যবস্থা হবে এমন একটি বহুঈশ্বরবাদী ব্যবস্থা যা শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, নৈতিক দিক থেকেও পুনর্গঠিত ও পরিশোধিত হবে। এই নতুন ব্যবস্থাকে একটি ধর্ম বলে অভিহিত করাই ঠিক।

জুলিয়ানের বহুঈশ্বরবাদী বিশ্বাস : দেবদেবীদের সম্বন্ধে জুলিয়ানের মত ছিল অনেকটা পরফিরির মতের অনুরূপ। অর্থাৎ তাঁর মতে দেবদেবীরা কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তা নয়, বরং এমন প্রতীক যার সাহায্যে নিগূঢ় দার্শনিক সত্তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। জুলিয়ান সূর্যকে সার্বভৌম বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, সূর্যই প্রাণ ও আলোর উৎস, জগতের সব মঙ্গলের আকর। সূর্য পরাক্রমশালী শাসক, দেদবেদীদের সবচেয়ে বড় রাজা, স্বর্গ ও মর্তের প্রভু জুলিয়ানের এসব উক্তি থেকে বহুঈশ্বরবাদের প্রতি তাঁর সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে তিনি তাঁর এই নতুন ধর্মের একটি দার্শনিক ভিত্তিও দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এ মতের সাথে নব্যপ্লেটোবাদের সাদৃশ্য আছে, তবে তা পরফিরি ও ইয়ামব্লিকাসের মতের চেয়ে সরল। খ্রিস্টান অখ্রিস্টান নির্বিশেষে অনেকেই, জলিয়ানের নতুন বহুঈশ্বরবাদী মতের বিরোধিতা করেন, এবং এজন্যই রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা বুদ্ধিমত্তা উদারতা ও মহত্ত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনেকটা পরফিরি ও ইয়ামব্লিকাসের মতোই সমসাময়িক কুসংস্কারের শিকার হয়েছিলেন।

জুলিয়ানের মৃত্যুর পর সব কিছুর পুনখ্রিস্টীয়করণ এবং প্রাচীন অনুসারী ও নব্যপ্লেটোবাদীদের ওপর নির্যাতন : ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে সম্ভবত পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে জুলিয়ান প্রাণত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে খ্রিস্টধর্ম এতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যে, কোনোমতেই এর গতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। বরং জুলিয়ানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পরবর্তী সম্রাট জুভিয়ান খ্রিস্টধর্মকে পূর্বের রাজকীয় মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। সরকারি সমর্থন পাওয়ার পর খ্রিস্টানরা প্রাচীন ধর্ম ও দর্শনের অনুসারীদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। এক খ্রিস্টান জনতার হাতে নব্যপ্লেটোবাদী সম্প্রদায়ের তদানীন্তন প্রধান হাইপেশিয়া নাম্নী এক বিদূষী মহিলার প্রাণনাশ এর এক দুঃখজনক দৃষ্টান্ত। যাই হোক, প্রাচীন ধর্ম ও দর্শন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। মাত্র ত্রিশ বছর সময়ের মধ্যেই প্রাচীন ধর্মীয় মন্দির ও প্রতিষ্ঠানসমূহ খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায় এবং রোমান সিনেটকে সরকারিভাবে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়।

এথেন্সে গ্রিক দর্শন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা, সাইরিয়েনাসের এরিস্টোটলের সঙ্গে প্লেটোর নব্যপ্লেটোবাদী মিলন প্রচেষ্টা : সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মুখে গ্রিক সংস্কৃতি ও খ্রিস্টধর্মকে টিকিয়ে রাখার এক বিশেষ চেষ্টা চলে। এথেন্স নগরে দর্শন পাঠ ও অধ্যয়ন পুনরায় চালু করার জন্য যেসব দার্শনিক সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাইরিয়েনাস ও প্রোক্লাস-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সাইরিয়েনাসের রচনাবলির মধ্যে এরিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’-এর ওপর একটি ভাষ্য আজো পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে তিনি একমাত্র ইনডিভিজুয়াল বা বিশেষবস্তুই বাস্তব–এরিস্টটলের এ মতের সাথে সার্বিকই বাস্তব বলে প্লেটোর মতের সামঞ্জস্যবিধানের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, সংখ্যার সাহায্যে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কেননা গাণিতিক সত্তা (যেমন প্লেটো বলেছেন) সার্বিক ও বিশেষের মধ্যবর্তী বলে তাদের মধ্যে উভয়ের বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। সুতরাং সংখ্যা এমন একটি সত্তা, যা এরিস্টটলের মূর্ত বিশেষ সত্তা এবং প্লেটোর সার্বিক সত্তাকে যুক্ত করতে সক্ষম। এরিস্টটলের ওপর সাইরিয়েনাসের ভাষ্য লেখা হয়েছিল নব্যপ্লেটোবাদী পটভূমিতে। আর তা তিনি সম্প্রসারিত করেছিলেন প্লেটোর ‘পারমেনাইডিস’ ও ‘টাইমীয়ুস’-এর ওপর লেখা অপর দুটি গ্রন্থে। দুঃখের বিষয়, এ গ্রন্থদ্বয় অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। তবে ওখানে তিনি যেসব মতামত হাজির করেছিলেন, সেসব মতের সাথে তাঁরই ছাত্র। প্রোক্লাসের মতের খুববেশি পাথক ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রোক্লাস (৪২২-৪৮৫ খ্রি.)

পরচয় : প্রধান নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে তৃতীয়জন হচ্ছেন প্রোক্লাস (৪২২-৪৮৫ খ্রি.)। তিনি ৪২২ খ্রিস্টাব্দে কনস্টানটিনোপলের এক সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমত লাইসিয়াতে এবং তারপর আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষালাভ করেন। অল্পকাল তিনি এথেন্সে নেটোরিয়সের পুত্র গ্লটার্কেরর নিজসব সকুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং সেখানে শিক্ষা সমাপ্তির পর প্লটার্ক-এর পরবর্তী সিরিয়ানাসের সহযোগিতা করেন, তারপর তারই স্থলাভিষিক্ত হন। বলা হয়, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে অল্পদিনের মধ্যে তিনি ছাত্রমহলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। রোগ নিরাময়, বৃষ্টি আনা, ভূমিকম্প নিবারণ প্রভৃতি কাজে তিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার ব্যবহার করেন। তার মধ্যে বিশ্লেষণী চিন্তার সম্যক ক্ষমতার সাথে পুরাণতত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাসের সমন্বয় ঘটিয়াছিল এবং তিনি ইয়াম্বলিকাসের তুলনায় পুরাণতত্ত্বের সমর্থনে বিশ্লেষণী যুক্তির প্রয়োগ অধিক পরিমাণে করেছিলেন। বসতুত গ্রীক প্যাগান মতবাদের তিনি ছিলেন প্রকৃত স্কলাস্টিক চিন্তাবিদ। সিরিয়ানাসের মত তিনিও অর্ফিক এবং অন্যান্য নব্যপিথাগরীয় রচনাবলীকে উচ্চস্থান দিতেন। তিনি সমসত গুঢ়তত্ত্বে নিজে দীক্ষিত হন এবং নিজেকে তিনি সমগ্র জগতের রহস্যবাদের প্রবক্তা মনে করতেন। ইয়াম্বলিকাসের মত তিনিও খ্রীষ্টধর্মকে ঘৃণা করতেন এবং তার বিরোধিতা করেন। খ্রীষ্টধর্ম এই সময়ে সম্প্রসারণশীল এবং অত্যাচারী হবার মত যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। প্রোক্লাস দর্শন ছাড়া গণিত ও ব্যাকরণশাস্ত্র সম্বন্ধেও গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি প্লটাইনাস এবং ইয়াম্বলিকাসের চেয়ে অ্যারিসটোটলকে গভীরতর শ্রদ্ধা করতেন। অ্যারিস্টোটলের ‘অরগ্যান’ তার কণ্ঠসথ ছিল। প্লেটোর রচনাবলী সম্পর্কে তার ভাষ্যসকল যদিও ভ্রান্তব্যাখ্যামূলক, তবুও সূক্ষ্ম ও দক্ষতাসূচক। তার Institutis Theologica প্লটইনাসের মতবাদের মূলগত আলোচনা এবং Theologia Platonica-র মধ্যে আছে সেই মতবাদের ইয়ামব্লিকাসকৃত সংশোধনী ব্যাখ্যার বিবরণ। তার নিজস্ব দর্শন উভয়ের সমন্বয়। এজন্য তার দর্শন অনেক কম মৌলিক হলেও নব্যপ্লেটোবাদের চূড়ান্ত ফলসবরূপ। তিনি প্লটইনাসের মত অ্যারিসটোটলের এই মতবাদই গ্রহণ করেছিলেন যে বাহ্যবস্তুসকল আকার ও উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত এবং প্লেটো-অ্যারিস্টোটলকৃত দেহ, আত্মা ও চৈতন্যের পার্থক্য তিনি স্বীকার করতেন।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ব্যবহার : দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রোক্লাস ছিলেন পুরোদস্তুর যুক্তিবাদী। তিনি এলিয়াটিকদের প্রবর্তিত এবং সক্রেটিসপ্লেটো দ্বারা সম্প্রসারিত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুশীলন করেন। জেনো তাঁর নঞর্থক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে এলিয়াটিক মতবাদের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন। এ মতকে মিথ্যা মনে করলে যে স্ববিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়, তা প্রমাণ করাই ছিল জেনোর উদ্দশ্য। প্রশ্ন ও উত্তরের ক্রমিক অগ্রগতির মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়ের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দ্বারা সক্রেটিস ও প্লেটো তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতেন। প্রোক্লাসও অনুরূপভাবে কোনো বিশেষ ধরনের সত্যতা মিথ্যাত্বের সব সদর্থক ও নঞর্থক পরিণতি নিষ্কাশন করে দেখাবার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রোক্লাসের মতে, এভাবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুশীলন দ্বারা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে দু’ধরনের অভিজ্ঞতা খুঁজে পায়। এদের একটি ইন্দ্রয়গ্রাহ্য এবং অপরটি বুদ্ধিগ্রাহ্য। প্রথমটির লক্ষ্যবস্ত প্রকৃতিজগৎ আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্যবস্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ। প্রথমোক্ত জগতের যৌক্তিক অনুসন্ধানের পরিণতি শারীরবিদ্যা আর দ্বিতীয়টির পরিণতি ধর্মতত্ত্ব। অনির্বচনীয় পরম এক থেকে জগতের উৎপত্তি দেখাতে গিয়ে প্রােক্লাস ইয়াম্বলিকাসের অনুরূপ যুক্তি প্রয়োগ করেছেন। পরম এক থেকে বহুপদার্থের জগৎ পর্যন্ত পরিবর্তনের ধারাটি দ্বান্দ্বিক। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিটি এই সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে কার্য কারণ থেকে স্বতন্ত্র হলেও মূলত অভিন্ন; তাই কার্য সেই স্বতন্ত্র অবস্থা থেকে কারণে ফিরে যেতে চায়। তাই প্রত্যেক সংঘটনে তিনটি পর্যায় আছে। এরা হলো কারণের স্থায়িত্ব, ঘটনার উদ্ভব এবং তার স্থায়ী কারণে প্রত্যাবর্তন ও একাত্মতালাভ। সমগ্র পদ্ধতিটি এইরূপ বিভিন্ন ত্রয়ীর (triad) শৃঙ্খল। প্রােক্লাস তার তত্ত্ববিদ্যাগত ধর্মশাস্ত্রকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন এবং প্রত্যেক বিভাগে এই ত্রয়ীপদ্ধতি অনুসরণ করেন। হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাথে তার এই ছকের সাদৃশ্য এতই স্পষ্ট যে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।

একক সত্তার ধারণা : প্লটাইনাসের ন্যায় প্রোক্লাস ও পরম একক সত্তাকে অনির্বচনীয় বলে মনে করতেন। ‘এক’-কে যেমন প্রাণ বা চেতনা বলা যায় না, তেমনি আবার একে চিন্তা ও সত্তাও বলা চলে না। ‘এক’ নিত্যতা ও দেবত্বের ঊর্ধ্বে। এর সম্পর্কে আমরা শুধু বলতে পারি যে, তা আমাদের জীবনের উৎস (এ দিক থেকে ‘এক’ বলাই সঙ্গত) এবং সর্বপ্রকার প্রয়াস প্রচেষ্টার লক্ষ্য (এ অর্থে একে বলা চলে পরম শুভ)। তবে আল্‌ফা ও ওমেগা, আরম্ভ ও পরিণতি একই সঙ্গে প্রবহমান, কেননা ঐক্যই শৃঙ্খলা আর শুভই ঐক্য। ‘এক’ সৃজনশীল, কিন্তু সৃজনশীলতা এর একত্বে ব্যাঘাত ঘটায় না। যাবতীয় পদার্থ ‘এক’ থেকেই বিকীর্ণ। প্লটাইনাসের মতে, এক থেকে প্রথম বিকীর্ণ হয়েছে ঐশী প্রজ্ঞা। প্রোক্লাস এ মত সমর্থন করেন নি। তাঁর মতে, ঐশী প্রজ্ঞা নয়, সংখ্যার জগৎ ‘এক’-এর প্রথম বিকিরণ। এর প্রতিটি সংখ্যায়ই ‘এক’ প্রতিফলিত। সংখ্যা থেকেই ঐশী প্রজ্ঞার উদ্ভব।

ত্রয়ীতে বিশ্বাস : প্লটাইনাসের ন্যায় প্রোক্লাসও ত্রয়ী (triad)-এ বিশ্বাসী। তবে প্লটাইনাসের ত্রয়ী থেকে তাঁর ত্রয়ী স্বতন্ত্র। তাঁর মতে, প্রথমেই কল্পনা করতে হয় অনপেক্ষ ও অদ্বিতীয় ‘এক’-এর। এই অদ্বিতীয় এক থেকে সৃষ্টি হয় সত্তা, জীবন ও বুদ্ধির। যাকে কেবল রূপকার্থে এক পরম শ্ৰেয়র, পরম ব্ৰহ্ম এবং আদি কারণ বলা যেতে পারে, সেই পরম এক থেকে দিব্য উপাদানের প্রকাশস্বরূপ সত্তা (being), জীবন এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ চৈতন্য, এই তিনটি তত্ত্ব উদ্ভূত হয়। সত্তার স্বভাব অনন্ত। একক অনন্ত সত্তা থেকে সান্ত বা সীমিতের উৎপত্তি। অর্থাৎ পুনরায় সত্তা থেকে উদ্ভূত হয় অসীম, আদর্শ (The end) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ সসীম। জীবন বলতে বোঝায় অব্যক্ততা ও অস্তিত্বকে। এ দুয়ের সম্মিলন থেকেই জীবনের উৎপত্তি। অর্থাৎ জীবন থেকে উদ্ভূত হয় সম্ভাবনা, অস্তিত্ব এবং তাদের ঐক্য বোধগম্য জীবন। বুদ্ধি স্থির কিংবা চঞ্চল হতে পারে। বুদ্ধির এ দুই বৈশিষ্ট্যের মিলন থেকে সৃষ্টি হয় চিন্তা ও স্মৃতির। অর্থাৎ চৈতন্য থেকে উদ্ভূত হয় নিষ্ক্রিয় চিন্তা সক্রিয় চিন্তা (প্রত্যক্ষ) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ বিচারশীল চিন্তা। প্রথম ‘ত্রয়ী’ দিব্য উপাদানরূপে ঈশ্বরের পরিমণ্ডল। দ্বিতীয় ত্রয়ী অপ্রাকৃত শক্তিগুলোর এবং তৃতীয় ত্রয়ী চৈতন্য-জগতের পরিমণ্ডল। এই তিনপ্রকার ত্রয়ীর সাহায্যে প্রােক্লাস বহুদেববাদের একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নির্ণয় করেছেন। তিনি দিব্য উপাদানের এই দ্বান্দ্বিক পরিকল্পনাটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ব্যাপারে প্রয়োগ করেছেন। এই সমগ্ৰ পরিকল্পনাটি অবশ্য আমাদের কাছে কেবল বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের সবরূপ প্রকাশের জন্যই রচিত বলে মনে করতে হবে। সেই অনির্বচনীয় হচ্ছেন অতিপ্রাকৃত এবং অতিপ্রাকৃত উপায় মাধ্যমেই তাকে পাওযা যায়। ধর্মীয় সত্য আবিষ্কার করা যায় অলৌকিক জাদুশক্তির সাহায্যে। ঐশী প্রজ্ঞা বিশ্বাত্মার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে থাকে; আর এই বিশ্বাত্মার মাধ্যমেই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তা ও মঙ্গলময়তা ইন্দ্রিয়জগতে প্রতিফলিত হয়। ভৌত জগৎ বিশ্বাত্মার দেহস্বরূপ। বিশ্বাত্মা থেকেই তা বিকীর্ণ। বিশ্বাত্মার সাথে জগতের মিলন থেকেই প্রাণির সৃষ্টি। প্রোক্লাসের মতে, প্রকৃতির মাধ্যমেই বিশ্বাত্মা ও জগতের এই মিলন সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রকৃতিই যাবতীয় গতি ও পরিবর্তনের আকর। ঐশী নির্দেশ অনুযায়ী প্রকৃতি নিরন্তর ইন্দ্রিয়জগতের যাবতীয় কার্যকলাপ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতির মধ্যে মূল পার্থক্য এখানে যে, বিশ্বাত্মার সব কার্যকলাপ প্রজ্ঞাসম্মত, অথচ প্রকৃতির কার্যকলাপ অংশত প্রজ্ঞা দ্বারা এবং কিছুটা জড় দ্বারা প্রভাবিত। এ জন্যই বিশ্বের গতিপ্রকৃতি উদ্দেশ্য ও আবশ্যিকতার সংমিশ্রণ। প্লটইনাসের সাথে একমত হয়ে প্রােক্লাসও মনে করেন যে ‘অনির্বচনীয় ঐক্য থেকে যা কিছু নিঃসৃত হয় সকলই দিব্য উপাদানের ক্রমাবনতি অথবা ক্রমক্ষয়, যাতে নিম্নতর পদার্থসমূহ সর্বদা উচ্চতর পদার্থসমূহের অধীন হয়। কিন্তু যখন তিনি বললেন যে অন্যান্য ত্রয়ীগুলোতেও চৈতন্যের তিনটি পর্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন তিনি মনে হয় অন্তত পরোক্ষভাবে এই অধীনতার সম্পর্ক অস্বীকার করেন।

জড় অশুভ নয় : প্লেটো ও প্লটাইনাসের মতে যেমন, প্রোক্লাসের মতেও তেমনি জড়ের কোনো সংজ্ঞানির্দেশ সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়জগৎ ও বুদ্ধিজগতের ব্যাখ্যায় জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয়। তবে প্লটাইনাসের মতো প্রোক্লাস জড়কে অশুভ বলে মনে করেন নি। আংশিকভাবে হলেও জড় সদ্গুণের অধিকারী। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোনো অশুভ সত্তা নয়, স্বয়ং ঐশীদ্রব্যই জড়ের উৎপত্তির মূলে। মানবাত্মার উদ্ভব বিশ্বাত্মা থেকে। এর এক পা বুদ্ধির জগতে, অন্য পা ইন্দ্রিয়জগতে। সুতরাং সে একদিকে যেমন চিন্তা করে, অন্যদিকে তেমনি অনুভবও করে। আত্মার প্রজ্ঞাংশকে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করাতেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতি নিহিত। নৈতিক প্রগতির বিভিন্ন ধাপ ব্যাখ্যায় প্রোক্লাস এরিস্টটল, প্লেটো ও প্লটাইনাসের মত অনুসরণ করেন।

মানুষের ভূমিকা : মানবাত্মার উদ্ভব বিশ্বাত্মা থেকে। এ জন্যই মানবাত্মার স্বভাব শুভ। আত্মা যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন সে পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না। আত্মা নিয়ন্ত্রণের এই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। অন্যায়-অশুভের অনুষ্ঠান এর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপস্বরূপ। প্রোক্লাস তাই মনে করেন যে, অন্যায়-অশুভ অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা অপূর্ণ স্বাধীনতা। অপূর্ণতার ফলেই মানুষ তার স্বাধীনতাকে ভুলপথ নির্বাচনে ব্যবহার করে থাকে। ঐশীসত্তা কখনো অশুভকে নির্বাচন করতে পারে না। অপরপক্ষে, মানুষ যেহেতু অপূর্ণ, সুতরাং নিজ প্রকৃতি অনুসারে কাজ না করার ক্ষমতা তার থাকতেই হবে। আর এই ক্ষমতাই তাকে বাহ্যশক্তি ও কারণ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে বাহ্যশক্তির ক্রীড়নক করে তুলতে পারে। কিন্তু যেহেতু সে ইচ্ছা করলে শুভকে নির্বাচন করতে পারে, সেজন্যই শুভকে বাদ দিয়ে অশুভের নির্বাচনের নৈতিক দায়-দায়িত্ব তাকেই গ্রহণ করতে হবে। তবে ব্যক্তিমানুষ অশুভের নির্বাচন করলেও ঈশ্বর এই অশুভ এবং জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে সামঞ্জস্যবিধান করেন যে, এসব অশুভ জগতের পূর্ণতার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আবার মানবাত্মা যেন বাহ্য অশুভ শক্তিসমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়, এ জন্যই ঈশ্বর একে প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন। ঐশী সাহায্য না পেলে মানবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ কখনো সম্ভব হতো না।

ধর্মীয় আচার ও প্রার্থনার গুরুত্ব : প্রোক্লাসের চিন্তায় দার্শনিক মত ও প্রাচীন ধর্মতত্ত্বের এক সুন্দর সমন্বয় লক্ষ করা যায়। তাঁর দার্শনিক মতের অন্তরালে ধর্মভক্তি যে অত্যন্ত প্রবল ছিল, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর মতে, চূড়ান্ত মুক্তি বা মোক্ষলাভের জন্য মানুষের পক্ষে দেবতাদের সাহায্য অপরিহার্য। এ জন্যই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে দেবতাদের সন্তোষবিধান কাম্য। এ ব্যাপারে প্রার্থনা বা উপাসনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর সাহায্যে মানুষ ঐশী সত্তার দিকে অগ্রসর হতে এবং পরিণামে তার সাথে মিলিত হতে পারে।

পোক্লাসের নীতিতত্ত্ব : পোক্লাসের নীতিতত্ত্ব প্লটইনাসের নীতিতত্ত্ব থেকে পৃথক নয়। আমাদের নৈতিক দর্শন হচ্ছে সেই অনির্বচনীয় পরম একের দিব্যদর্শন। মানবাত্মা তখনই কেবল এটি লাভ করতে পারে যখন আত্মা নিজের অন্তরতম সবরূপে প্রবেশ করে যেখানে সেই পরম একের অবস্থিতি। যখন এটি ঘটে তখন আমরা দিব্যানন্দে অথবা ভাবোন্মত্ত অবস্থায় থাকি। কেবল এই অবস্থাতেই আমরা পরম একের সাথে একাত্ম হতে পারি এবং এই একাত্মতার মধ্যেই আমরা পরম অভীষ্টে উপনীত হই। একটি বিষয়ে তিনি প্লটাইনাস থেকে ভিন্ন মত পোষণ করেন যেহেতু তিনি স্বর্গীয় শক্তি এবং অপ্রাকৃত শক্তিসমূহের করুণালাভের উপায়রূপে জাদু-কৌশল চর্চা এবং ধর্মসম্মত বিধি ও অভ্যাসাদি পালনের নির্দেশ দেন।

তৃতীয় পর্যায়

জাস্টিনিয়ানের দ্বারা গ্রিক দর্শন, প্যাগানবাদ ও নব্যপ্লেটোবাদের সমাপ্তি

৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রোক্লাসের মৃত্যু ঘটে। এর পর এই দর্শনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়। প্রোক্লাসের উত্তরসূরিদের মধ্যে ড্যামাশিয়াস, ওলিম্পিলিওডোরাস ও সিম্পলিসিয়াসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। যাই হোক, তৃতীয় পর্যায়ের নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন রোমক স্কুলের এ্যামেলিয়াস এবং ইয়ুসটেকিয়াস; সিরিয়া সকুলের থিয়োডোরা, ক্রিসাথিয়াস, ঈডিসিয়া, ঈউসেরিয়াস, ম্যাকসিমাস, এবং হাইপেশিয়া ; এথেন্স স্কুলের ম্যারিনা, ঈসিভোরাস, জেনোডাটাস এবং ড্যামাশিয়াস। শেষোক্ত স্কুলের প্রধান ছিলেন ড্যামাশিয়াস। দার্শনিক হিসেবে তাঁরা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিলেন না; তবে তদানীন্তন পরিবেশ ও পরিস্থতি সম্পর্কে তাঁদের রচনাবলিতে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। নব্যপ্লেটোবাদ ও প্রাচীন ধর্মের অবস্থা তখন ছিল মৃতপ্রায়। কোনোমতেই এদের মধ্যে আর নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো না। শেষ পর্যন্ত এদের পরিসমাপ্তি ঘটে। ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে জাস্টিনিয়ান পূর্ব সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের আগে থেইে প্যাগানবাদ ও প্যাগান দার্শনিকদের দমনের যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছিল, জাস্টিনিয়ান সেসব ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করেন। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে তিনি দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করেন। জাস্টিনিয়ানের আদেশক্রমেই ৫২৯ খ্রিস্টাবে এথেন্স থেকে সবকটি দার্শনিক স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়, এবং তিনি এথেন্সে গ্রীক দর্শনের অধ্যাপনা নিষিদ্ধ করে দেন। ড্যামাশিয়াস, সিমপ্লিকিয়াস এবং অন্যান্য নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিকদের সাথে দেশান্তরিত হয়ে পারস্যে চলে যান। যদিও সেই দলের কেউ কেউ জুন্দি-শাহপুরস্থ নওসেরওয়ান প্রবর্তিত স্কুলে থেকে যান। তবুও কিন্তু সেখানে আশানুরূপ সুবিধা না পেয়ে পুনরায় ড্যামাশিয়াস, সিমপ্লিকিয়াস সহ অবশিষ্ট আরও অনেক কৃচ্ছসাধনের পর দেশে ফিরে আসেন। জাস্টিনিয়ান ও পারসিকদের মধ্যে ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। অবশেষে তাঁরা শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন। গ্রীক দর্শন অন্তর্নিহিত বিকার এবং অবক্ষয়ী-প্রবণতার জন্য ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছিল এবং হয়তো ক্রমশঃ আপনা থেকেই অবলুপ্ত হয়ে যেত, কিন্তু উক্ত সম্রাটের অসহনীয়তার জন্য এই দর্শনচিন্তা পূর্বদেশে প্রেরিত হলো। সেই দেশে এই চিন্তাধারা মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় পুনবায় পুষ্টি ও সমৃদ্ধি লাভ করল এবং পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যে এই চিন্তাধারাই ফিরে এলো অধিকতর সজীবতা এবং গৌরব সমন্বিত হয়ে।

তথ্যসূত্র

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স
  • প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, দ্বিতীয়খণ্ড, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন (সম্পাদনা)
  • Heinemann, F: Plotin, Leipzig, 1921.
  • Mackenna, S : Thc Enneades of Plotinus, London, 1917-19.
  • Ing., W. R. · The Philosophy of Plotinus, 2 Vol., 2nd ed, London and NY, 1929.
  • Brigg, C. · The Christian Platonists of Alexandria, Oxford, 1913.
  • Taylor, A. E. : Platonism and its iniluence.
  • Elomer. Paul : Platonism.
  • Walter Pater: Plato & Platonism.
  • Brehier, E : La Philosophic dc plotin, Paris, 1928.
  • Brchier, E ; (Bude): Plotin, Enneades, Gr. Text and Fr, Trans 6 Vol, Paris, 1930-40.
  • Arnou ; Le Desir de Dien Dans La Philosophic de Plotin, Paris.
  • Dodds – Select passages illustrating Neo Plutoni-m, S. P. CK. 1923.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.