মার্ক্সীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ

এঙ্গেলসের চিন্তাধারা

১৯শ শতকের শেষার্ধে মার্ক্সের মার্ক্সবাদী মতবাদকে কেন্দ্র করে যে নারীবাদী মতবাদ গড়ে ওঠে তা মার্ক্সীয় নারীবাদ নামে পরিচিত। ১৮৮৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস একটা গ্রন্থ লেখেন, নাম “দি অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপারটি এন্ড দ্য স্টেট”। এখান থেকে প্রথম মার্ক্সীয় নারীবাদের ধারণা পাওয়া যায়। মার্ক্সবাদের আবির্ভাবের পর মার্ক্স-এঙ্গেলসই আরীর অধঃস্তনতার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ দেন, এবং শ্রেণী শোষণহীণ সমাজে নারীর পূর্ণমুক্তি কিকরে সম্ভব হতে পারে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এই নারীবাদ অনুসারে নারীর অধঃস্তনতা ও নির্যাতনের কারণ ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডের ফল নয়, পূঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজ কাঠামোই নারীর অধঃস্তনতার মূল। এখানে স্বেচ্ছাপ্রণোদনা বলতে পুরুষের ইন্ডিভিজুয়াল ক্যারেক্টারিস্টিক্সের কথা বলা হচ্ছে। নারীদের উপর পুরুষের বিভিন্ন দমনমূলক, নির্যাতনমূলক আচরণ এই স্বেচ্ছাপ্রণোদনার মধ্যে পড়তে পারে। কিন্তু মার্ক্সবাদী নারীবাদ এগুলোকে টারগেট না করে করছে পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজকাঠামোকে।
মার্ক্সীয় নারীবাদ ব্যক্তিমালিকানা কেন্দ্রিক শ্রেণিবিভক্ত সমাজকেই নারীর মর্যাদাহীনতা ও পরাধীনতার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করে। এ মতবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন লৈঙ্গিক পার্থক্য নয়, পুঁজিবাদের দ্বারা সৃষ্ট শ্রেণীবৈষম্যই নারী অধঃস্তনতার জন্য দায়ী। মার্ক্সীয় নারীবাদের কেন্দ্রে রয়েছে পরিবার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও উৎপাদন পদ্ধতি। এঙ্গেলস বলেছেন, ‘মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ নারীর পরাজয় ডেকে এনেছে। পুরুষ গৃহস্থালীর কর্তৃত্ব দখল করে, নারী হয় পদানত, শৃঙ্খলিত, পুরুষদের লালসার পাত্রী, সন্তান জন্মদানের পাত মাত্র।’ মার্ক্সীয় নারীবাদীরা নারীবাদের বিশ্লেষণে মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (historical materialism) এর ব্যাখ্যা প্রয়োগ করেছেন। তারা মনে করেন, নারীরা কেন নিপীড়িত, আর পুরুষেরা কেন নিপীড়িত নয়, তার ব্যাখ্যা করার জন্য নারীর উৎপাদন সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রয়োজন, কারণ মানব জীবনে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি (এই প্রসঙ্গে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে)। মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব তার চেতনাকে নির্ধারণ করে, কিন্তু চেতনা সামাজিক অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না।
মার্ক্স বলেন, নারী-পুরুষ উভয়েই যখন নিজেদেরকে শ্রমিক শ্রেণিতে সুসংহত করবে এবং তাদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনার সৃষ্টি হবে, তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিক শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে ধনিকতন্ত্রের সমাধি রচনা করবে, এবং মানব সমাজের উত্তরণ ঘটবে প্রথমে সমাজতন্ত্রে (socialism) এবং সর্বশেষে সাম্যবাদে (communism)। ধনিকতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষের উপর যে নতুন সমাজ গড়ে উঠবে সেখানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ থাকবে না, কেউ কারও উপর আধিপত্য খাটাতে পারবে না, নারী-পুরুষ সবাই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হবে। তখন শ্রেণিভেদ থাকবে না, নারী পুরুষ সবাই মিলে হবে এক সম্প্রদায়, স্বাধীন ও সমতাপূর্ণে সমান। শোষণহীন, প্রাধান্যহীন, শ্রেণীহীন নতুন সমাজে, সামাজিক তথা মানবিক অস্তিত্বরূপে, প্রতিটি মানুষের, পরিপূর্ণ ও সচেতন প্রত্যাবর্তন ঘটবে। মার্ক্স-এঙ্গেল তাদের Economic and Philosophic Manuscripts of 1844 এর Estranged Labour সেকশনে যেমনটা লিখেছিলেন, “The complete and conscious return of man himself as a social, that is, human being.”- তেমনটা হবে। মানে মানুষ তার মানব প্রকৃতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। মার্ক্স-এঙ্গেলের মতে, এই সময়ে মানুষের উপর মানুষের, নারীর উপর পুরুষের শোষণ বা প্রভুত্ব থাকবে না; প্রত্যেকের স্ব স্ব ইচ্ছায় কাজ করার স্বাধীনতা থাকবে, আর প্রত্যেকে যা যা হতে চায় তা হবার পথে কোন বাঁধা থাকবে না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, তাদের মতে, মার্ক্সের নতুন সমাজব্যবস্থা নারীর প্রত্যাশা পূরণ করবে, নারী হবে মুক্ত ও স্বাধীন, এতে নারীর উপর পুরুষের শাসন বিলুপ্তি হবে, যেসব শক্তি নারী নির্যাতনের কারণ, তারা পরাভূত হয়ে নিশ্চিহ্ন হবে, তাতে নারী মুক্তি পাবে। নতুন সমাজব্যবস্থায় মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন আসবে, কেউ প্রভু হতে চাইবে না, কাউকে ক্রীতদাস হতে হবে না। নারী-পুরুষ পরষ্পর মিলে একটি সামাজিক কাঠামো এবং সামজিক ভূমিকা গড়ে তুলবে যার ফলে নারী ও পুরুশ সকলে নিজ নিজ মানবিক সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধনে সক্ষম হবে। মার্ক্সীয় তত্ত্বে এলিয়েনেশন বলতে যেটা বোঝায়, “যদি আমরা আমাদের জীবনকে অর্থহীন মনে করি কিংবা নিজেদের অযোগ্য মনে করি”- এরকম আর থাকবে না।
এর আগে বলেছিলাম, মার্ক্সবাদী নারীবাদ নারীদের উপর পুরুষের দমনমূলক আচরণের, দৃষ্টিভঙ্গির কারণ ব্যক্তির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড বলে বলে মনে করে না, বরং কারণ হিসেবে মনে করে পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজকাঠামোকে। কিন্তু, মার্ক্সবাদী নারীবাদ মনে করে, নতুন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজকাঠামো না থাকলে পুরুষের মাঝে নারীদের উপর দমনমূলক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডও থাকবে না। অর্থাৎ, পুরুষের মধ্যকার সকল প্রকার লৈঙ্গিক দমনমূলক ও শোষণমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হচ্ছে একধরণের সমাজ-অর্থনৈতিক ও উৎপাদন সম্পর্কের বৈষম্য যেগুলো না থাকলেই লৈঙ্গিক সমতার সৃষ্টি হবে আর নারীমুক্তি ঘটবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মার্ক্সীয় নারীবাদ বা মার্ক্সবাদ এমনটা কেন মনে করে। এঙ্গেলস বলেন, পরিবারের উৎপত্তির আগে, নারী-পুরুষের মধ্যে বাছবিচারহীন অবাধ যৌন মিলন প্রচলিত ছিল। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন প্রকারের রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যৌনমিলন নিষিদ্ধ হতে হতে অবশেষে এক পুরুষ ও এক স্ত্রীর মধ্যে মিলন প্রতিষ্ঠিত হয়- অর্থাৎ বিবাহ ও পরিবারের সূত্রপাত হয়। এঙ্গেলসের মতে আদি পরিবার মাতৃতান্ত্রিক ছিল। মায়ের দিক দিয়ে বংশ ও উত্তরাধিকার পরিগণিত হত এবং নারীর হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল। কারণ, নারীর কাজকর্ম জীবনধারণের জন্য ছিল অপরিহার্য। এঙ্গেলসের মতে, পরিবার-সমাজ-উপজাতির সব প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নারী উৎপাদন করত। ঘর-গ্রিহস্থালীই ছিল তখন উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র, আর এই কেন্দ্র ছিল নারীর নিয়ন্ত্রণে। এঙ্গেলস বলেন, উৎপাদনের কেন্দ্র যতদিন নারীর হাতে ছিল, ততদিন নারীর প্রাধান্য ছিল। উৎপাদন স্থল পরিবর্তিত হলে নারীর প্রাধান্যও লুপ্ত হল। এঙ্গেলস বলেন, মানব সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সূচনা হওয়ার সাথে সাথে নারী নির্যাতনের সূত্রপাত ঘটে। মাতৃতন্ত্রের অবসানের পর সম্পত্তি ও নারীর উপর পুরুষের ব্যক্তিমালিকানা রীতি প্রতিষ্ঠিত হলে নারী পরাধীন হয়ে পড়ে।
এই ফাঁকে উৎপাদন, পুনরুৎপাদনের কথাটা বলে নেই। মারগারেট বেনস্টন ও পেগি মরটনদের মত মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্টরা বলেন, ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে দুই ধরণের শ্রম থাকে। এদের মধ্যে একটা হল প্রোডাক্টিভ বা উৎপাদনশীল, যেক্ষেত্রে ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে এর উৎপাদিত পণ্য বা সেবার একটা আর্থিক মূল্য থাকে। আর তার ফলে উৎপাদনকারীর সেই শ্রমকে মজুরির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা হয়। আরেকধরণের শ্রম হল রিপ্রোডাক্টিভ বা পুনরুৎপাদনশীল। এটা ব্যক্তিমালিকানাধীন জগতের সাথেই সম্পর্কিত। আর এই শ্রমের মধ্যে সেইসব শ্রম পড়বে, যেগুলো মানুষ তাদের নিজেদের জন্যই করে এবং সেখানে মজুরি পাবার কোন আকাঙ্ক্ষা থাকে না (যেমন ঘর পরিষ্কার করা, রান্না করা, সন্তান পালন করা)। উভয় ধরণের শ্রমই প্রয়োজনীয়। কিন্তু দেখা যায় এই বিভিন্ন ধরণের শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণে পার্থক্য হয়। আর সেই পার্থক্য তার পরিচয়ের সাথে সম্পর্কিত, লিঙ্গ পরিচয়। নারীরা দেখা যায় গৃহস্থালি জগতে কাজ করছে, যেখানে শ্রম হচ্ছে পুনরুৎপাদনশীল, আর তাই সেটা ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় থেকে যাচ্ছে ক্ষতিপূরণ-অযোগ্য, অস্বীকৃত।
দেখা যায়, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় ধরণের সংস্থার স্বার্থেই শ্রমশক্তিকে খুব সস্তায় সাপোর্ট করার জন্য নারীর শ্রমকে কোনরকম মজুরি ছাড়াই ব্যবহার করা হয় ও নারীকে শোষণ করা হয়। আর এর মাধ্যমেই উৎপাদনকারী অধিক মুনাফা অর্জন করেন। নিউক্লিয়ার বা একক পরিবারে যে পাওয়ার ডাইনামিক্স দেখা যায় তাতে গৃহস্থালী সমস্ত কাজই নারীর দ্বারা করানো হচ্ছে, আর এর মাধ্যমে পুরুষকে ঘরের কাজকর্ম থেকে মুক্ত রাখা হচ্ছে যাতে তাদের দ্বারা প্রয়োজনীয় উৎপাদনশীল কাজ করা যায়। অধিক মুনাফার আশায় পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এরকম পাওয়ার ডাইনামিক্সকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। মার্ক্সীয় নারীবাদীরা বলেন, উৎপাদনশীল শ্রম থেকে নারীদেরকে বঞ্চিত করে প্রাইভেট, পাবলিক উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আবার এঙ্গেলসে ফিরে যাই। তিনি মনে করতেন, নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের মূল কারণ এই যে, নারী নয়, পুরুষই সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি নামক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হলেই কেবল নারী নির্যাতন বিলুপ্ত হবে।
এঙ্গেলসের কথায় উৎপাদন পুনরুৎপাদনের কনসেপ্টটা যোগ করলে আমরা দেখি, যতদিন সমাজব্যবস্থা কেবল গৃহস্থালী দ্রব্যাদির উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল ততদিনই মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর কারণ তখন এই পুনরুৎপাদনের শ্রমগুলোই ছিল সমাজের একমাত্র শ্রম। বেঁচে থাকার জন্য এই শ্রমটারই প্রাধান্য সব থেকে বেশি যেটা নারীরাই করত। আর তাই উৎপাদনের কেন্দ্র নারীর হাতে থাকায় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কিন্তু এঙ্গেলের মতে তখনই পিতৃতন্ত্রের সূত্রপাত হল যখন প্রাথমিক শ্রমবিভাগ দেখা গেল। কৃষির বিকাশের পর দেখা গেল, নারীদের কাজ হল ঘর সামলানো, আর পুরুষের কাজ হল কৃষির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করা। এই প্রাথমিক শ্রমবিভাগে খাদ্য উৎপাদনই উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়, আর তাই সমাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পুরুষের হাতে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয়। এদিকে পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে উৎপাদনের জগৎ মনিটাইজড হয়, অর্থাৎ তাতে মজুরি যুক্ত হয়, যেখানে এই উৎপাদনশীল শ্রমের মজুরি পাওয়া যায়। এদিকে গৃহের জগৎ কখনই মনিটাইজড হল না, অর্থাৎ এখানে মজুরি সংযোজন হল না। আর এর ফলে সমাজে কেবলি নারীদের অধীনে থাকা গৃহস্থলী কাজের মূল্য কমে গেল। তাতে নারী ও পুরুষের ক্ষমতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাও পরিবর্তিত হয়ে গেল, নারীরা শোষিত হতে লাগল। এসব কারণেই মার্ক্স-এঙ্গেলস ও মার্ক্সীয় নারীবাদীরা মনে করতেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটলে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিনাশ হলে নারী-পুরুষের বৈষম্য আর থাকবে না, নারী নির্যাতন বিলুপ্ত হবে, নারী মুক্তি ঘটবে।
একজন নারীর স্বামী হিসেবে একজন পুরুষই থাকবে- এরকম একগামী পরিবার পুরুষেরই সৃষ্টি বলে এঙ্গেলস মনে করতেন। আর এরকম পরিবার গঠনের উদ্দশ্য হচ্ছে পিতার সম্পত্তি পুত্রে হস্তান্তর নিশ্চিতকরণ। কাজেই, একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে আপত্তি নেই, কিন্তু একজন নারীর একমাত্র স্বামী থাকতে হবে। এঙ্গেলসের মতে পিতৃসূত্র ও পিতৃতন্ত্রের মাধ্যমে পুরুষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, সম্পদশালী পুরুষ ও সম্পদহীন নারীর মধ্যে শ্রেণি বিভাজনের ফল। তিনি বলেন, “The first form of the family to be based not on natural but on economic condition”. অর্থাৎ, একগামিতাই পরিবারের প্রথম ধরণ, যা প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং অর্থনৈতিক কারণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই একগামী পরিরে ভালবাসা বা অঙ্গিকার নেই, বরং আছে ক্ষমতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা। নারী পুরুষকে ভালোবাসার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হলে, প্রথমে শ্রেণীসমাজকে বিনষ্ট করতে হবে, অর্থাৎ পুরুষের উপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা রদ করতে হবে।
যেহেতু বিবাহের সাথে এখন ভালোবাসার সম্পর্ক নেই, আছে কেবল ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পর্ক, কাজেই এঙ্গেলস বলেন, নারীকে স্বামীর নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে হলে তাকে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে হবে, পুরুষের অর্থনৈতিক অধীনতা থেকে নারীকে মুক্তি দিতে হবে। এক্ষেত্রে কিভাবে নারী মুক্তি বা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জিত হতে পারে তা নিয়েও এঙ্গেলস তার দি অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রোপার্টি এন্ড দ্য স্টেট গ্রন্থে লিখেছেন। এক্ষেতে নারীমুক্তি দুভাবে অর্জিত হবে-
  • (১) নারীকে বহিরঙ্গনে অর্থনৈতিক কর্মের সাথে যুক্ত হতে হবে- সমগ্র নারী সমাজকে জন শ্রমের সাথে পুনঃপরিচয় করতে হবে “Reintroduction of the entire female sex into public industry”।
  • (২) গৃহকর্ম ও সন্তানপালনের অর্থনৈতিক কর্মকে সমাজ অধিগ্রহণ করবে (Socialization of housework and child rearing)।

এঙ্গেলসের মতে, সমাজ গৃহকর্ম ও সন্তান পালনের দায়িত্ব নেবে, এ দায়িত্ব এককভাবে নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। গৃহকর্ম ও সন্তান পালনের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে নারী কর্মস্থলে অর্থনৈতিক, অর্থকরী কর্ম গ্রহণ ও পালন করবে। নারী অফিসে কলে-কারখানায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করবে। মার্ক্সীয় নারীবাদও তাই বলে।

পরবর্তীয় মার্ক্সীয় নারীবাদীগণ

পরবর্তীতে মার্ক্স-এঙ্গেলস এর এই চিন্তাধারাগুলো নিয়েই মার্ক্সীয় নারীবাদীরা আন্দোলনে অগ্রসর হয়। তাদের কর্মকান্ড, আন্দোলন নিয়েও অনেক কিছু বলার অবকাশ রয়েছে। এই নারীবাদে যে মূলনীতিগুলো ছিল সেগুলো মোটামুটি এরকম-

  • অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। পরিবারের তথাকথির আর্থিক ভিত্তি ধ্বংস করে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসার ভিত্তিতে পরিবারের পুনর্গঠন করতে হবে।
  • নারীকে জন-শিল্পে, বহিরাঙ্গনে, কলকারখানা, অফিস আদালতে কর্ম গ্রহণ করে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।
  • গৃহকর্ম ও সন্তান পালন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে সামাজিকভাবে সংগঠিত করতে হবে, সমাজ গৃহকর্ম ও সন্তানদের অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সেবা শিল্পে পরিণত করবে।
  • নারীর অর্থনৈতিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীমুক্তির পূর্বশর্ত।

বলা যায় এই নারীবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, পুঁজিবাদের উচ্ছেদ সাধন, নারীর গৃহশ্রমের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ আর এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের সকল নারীর মুক্তি। প্রতিবাদী প্রকৃতি, সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসবার তীব্র ইচ্ছা, তাদের অবদান প্রভৃতি কারণে নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় নারীবাদীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে তাদের আন্দোলন সম্পরকে কিছু কথা বলা দরকার। কয়েকজন মার্ক্সীয় নারীবাদী মজুরিভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গৃহকর্মকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য আন্দোলন করেছেন। শারলট পারকিনস গিলম্যান (১৮৯৮) সহ আরও কিছু সমাজতান্ত্রিকের লেখায় ক্ষতিপূরণযোগ্য পুনরুৎপাদনশীল শ্রম তৈরির ধারণা উপস্থিত আছে। তারা বলেন, ব্যক্তিমালাধীন বা প্রাইভেট ক্ষেত্রে কাজ করার ফলে নারীর শোষণ শুরু হয়েছে। গিলম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার ক্ষেত্রে এদের কাজের স্থানের ব্যবস্থা করলে, এদের কাজকে স্বীকৃতি দান করলে, এবং মূল্যায়িত করলে নারীর অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।

সম্ভবত, ক্ষতিপূরণযোগ্য পুনরুৎপাদনশীল শ্রমের সব থেকে উল্লেখযোগ্য প্রচারণা হচ্ছে আন্তর্জাতিক গৃহকর্মের বিনিময়ে শ্রম প্রচারণা (International Wages for Housework Campaign)। এটি ১৯৭২ সালে ইতালিতে ইন্টারন্যাশনাল ফেমিনিস্ট কালেক্টিভ কর্তৃক চালু হয়। সেলমা জেমস, মারিয়ারোসা ডালা কস্টা, ব্রিজেট গাল্টিয়ার এবং সিলভিয়া ফেডেরিচি এসময় একাডেমিক এবং পাবলিক ডোমেইনে প্রচুর পরিমাণে লেখা প্রকাশ করেন। যদিও এই প্রচারণা ইতালিতে একটি ছোট দল নিয়ে শুরু হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রচারণা সফল হয়। ফেডেরিচির সহায়তায় গৃহকর্মের বিনিময়ে মজুরির একটি শাখা নিউ ইয়র্ক এর ব্রুকলিনেও চালু হয়। হেইডি হার্টম্যান স্বীকার করেন (১৯৮১) এই আন্দোলনগুলো শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কিন্তু তারপরও এটি গৃহকর্মের মূল্য এবং অর্থনীতির সাথে এর সম্পর্কের ব্যাপারে একটি মূল্যবান ডিসকোর্স তৈরি করে।

মার্ক্সীয় নারীবাদীগণ আরেকটি সমাধানের প্রস্তাব করেন, যা নারীদের বাধ্যতামূলক ভাবে পুনরুৎপাদনশীল শ্রমের সাথে সম্পর্কিত। গতানুগতিক মার্ক্সীয় নারীবাদী আন্দোলন যেমন গৃহশ্রমের বিনিময়ে মজুরি প্রচারণা এর সমালোচনায় হেইডি হার্টম্যান বলেন, “এই প্রচেষ্টাগুলোতে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্কের দিকে না গিয়ে নারীর সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে এটাই ধরে নেয়া হয় যে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ককে নারীর সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্কের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়।” হার্টম্যান (১৯৮১) মনে করেন যে, গতানুগতিক আলোচনা নারী হিসেবে নারীর শোষণকে এড়িয়ে গেছে, আর তার চেয়ে বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সদস্য হিসেবে নারীর শোষণের দিকেই এটি মনোনিবেশ করেছে। গেইল রুবিন স্যাডোম্যাসিজম, বেশ্যাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি এবং নারী-সমকামী সাহিত্য, নৃতত্ত্ব এবং যৌন উপসংস্কৃতি এর উপর অনেক কিছু লিখেছেন। তিনি তার ১৯৭৫ সালের একটি রচনা দ্য ট্রাফিক ইন উইমেন: নোটস অন দ্য ‘পলিটিকাল ইকোনমি’ অফ সেক্স গ্রন্থে (যেখানে তিনি “সেক্স/জেন্ডার সিস্টেম” নামক শব্দটি ব্যবহার করেন) মার্ক্সবাদের সমালোচনা করে বলেন, সেখানে পুঁজিবাদের অধীনে লিঙ্গবাদ বা সেক্সিজমের বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ (অবশ্য তিনি এক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের মৌলিক বিষয়গুলোকে নাকোচ করে দেন নি)।

আরও সম্প্রতি, অনেক মার্ক্সীয় নারীবাদীই তাদের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন যেখানে নারীরা উৎপাদনশীল শ্রমে অংশগ্রহণ করার পর আরও খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে। ন্যান্সি ফলবর প্রস্তাব করেন যে, নারীবাদী আন্দোলনগুলো পুনরুৎপাদনশীল (প্রাইভেট) জগৎ এবং উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্রের (পাবলিক) জগৎ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর পুরুষের অধীনস্ত মর্যাদার বিষয়টিতে মনোনিবেশ করেছে। ২০১৩ সালের একটি সাক্ষাতকারে সিলভিয়া ফেডারিচি নারীবাদী আন্দোলনগুলোয় এটা বিবেচনায় আনতে বলেন যে, এখন অনেক নারীকেই উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়, যার ফল হয় তাদের “ডাবল বার্ডেন” (কর্মক্ষেত্র ও গৃহ দুইক্ষেত্রেই শোষণ)। ফেডেরিচি বলেন, তবুও যতদিন পর্যন্ত নারীরা অপরিশোধিত শ্রমের বোঝা থেকে মুক্তি না পাবে, ততদিন পর্যন্ত নারীমুক্তি ঘটবে না। আর এজন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন, যেমন তিনি কর্মক্ষেত্রে শিশুযত্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে মজুরি ব্যবধান কমাবার প্রস্তাব করেন। সেলমা জেমস (২০১২) এর সাক্ষাতকারেও ফেডেরিচির এই প্রস্তাবগুলো উঠে আসে, এবং এই ব্যাপারগুলো সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনগুলোতেও নিয়ে আসা হয়।

মার্ক্সীয় নারীবাদের সমালোচনা

এবার মার্ক্সীয় নারীবাদের মোটামুটি সব সমালোচনা নিয়েই একটু আলোচনা করছি। অনেক নারীবাদী বলেন, মার্ক্সীয় নারীবাদে নারীর উপর পুরুষের নির্যাতনের চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে প্রোলেতারিয়েতের উপর বুর্জোয়ার শোষণ। হেইডি হার্টম্যানের মত অনেক নারীবাদী লেখিকা বলেন, মার্ক্সীয় নারীবাদে নারী হিসেবে নারীর শোষণের আলোকপাতের চেয়ে, পুঁজিবাদী সমাজের সদস্য হিসেবে নারীর শোষণের দিকে মনোনিবেশ করেছে। গেইলি রুবিন বলেন, পুঁজিবাদের অধীনে সেক্সিজমের ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ।মার্ক্সীয় নারীবাদীরা এই ধারণা পোষণ করে যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব বিলুপ্ত হবে। কিন্তু দেখা যায় এটা সর্বাংশে সত্য হয় না। ব্যক্তিগত সম্পতির মালিক নয় এমন সর্বহারা শ্রেণীর মাঝেও পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব দেখা যায়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো যেমন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা প্রভৃতি দেশে দেখা যায় নারীরা শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়েছে, তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হয়েছে, কিন্তু তারপরও এসব দেশে নারীরা নিপীড়িত হয়েছে।

অনেক সময় দেখা যায় নারীরা বাইরে উৎপাদনশীল কাজ করে ঘরে ফিরলেও তাকে আবার গৃহের রিপ্রোডাক্টিভ শ্রমও দিতে হয়, যাকে এখন ডাবল বার্ডেন বা ডাবল ডে বলা হয়। কারণ নারীরা আজ যে গতিতে বাইরের প্রোডাক্টিভ লেবরে অংশগ্রহণ করছেন, পুরুষ সেই গতিতে গৃহে রিপ্রোডাকটিভ লেবরে অংশগ্রহণ করছেন না। এখনও গৃহের কাজকে অনেক পুরুষই কেবল নারীর জন্য বলেই মনে করে। আর তাই নারীকেই ঘরের ও বাইরের কাজ সামলাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বামী ঘরে ও বাইরে কোথাও কোন কাজ করে না, সারাদিন শুয়ে বসেই দিন কাটায়, এদিকে স্ত্রী পয়সা রোজগার, সংসার চালানো, বাচ্চাদেরকে মানুষ করা সহ যাবতীয় কাজ একা হাতেই সামলান। এক্ষেত্রেও স্বামীকে দেখা গেছে তার স্ত্রীকে নির্যাতন করতে। এছাড়া দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন এমন নারীও লিঙ্গ বৈষম্য, মজুরি ব্যবধান বা ওয়েজ গ্যাপের শিকার হন। তাদেরকে কর্মক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হন। তাই প্রোডাক্টিভ লেবর বা উৎপাদনশীল শ্রমে নিয়োজিত নারীরাও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন, যেকারণে সিলভিয়া ফেডেরিচির মত মার্ক্সীয় নারীবাদীও আন্দোলনে পুনরুৎপাদন শ্রমে নিয়োজিত নারীদের সাথে উৎপাদনশীল শ্রমে নিয়োজিত নারীদের শোষণের ব্যাপারটিকেও বিবেচনা করতে প্রস্তাব দেন।

নারীর উৎপাদনশীল শ্রম নিশ্চিত করলেও নারীরা বিভিন্ন রকমের লিঙ্গ বৈষম্য ও লৈঙ্গিক শোষণের শিকার হচ্ছে বলেই অনেক গবেষকই মনে করেন, মার্ক্সীয় নারীবাদ নারীর পারিবারিক নির্যাতনের যথাযথ কারণ ও প্রতিকার নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা একটি মানবতাবিরোধি কাজ। এক্ষেত্রে কেবল উৎপাদন প্রক্রিয়া সহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক বিষয়ের পরিবর্তন এনেও মানুষের মানসিকতা ও আচরণ পুরোপুরি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় নি। শ্রেণী বিলুপ্তি হলেই নারী মুক্তি হবে এরকম ধারণাতেও অনেকে তাই বিশ্বাস করেন না। অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক বলেন, মার্ক্সীয় নারীবাদে বাইরের উৎপাদনশীল শ্রমকে গুরুত্ব দেয়া হলেও, ঘরের পুনরুৎপাদনশীল শ্রম বা গৃহশ্রমকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক মনে করেন, মার্ক্সীয় নারীবাদীরা নারী-পুরুষ সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করে, পুঁজিবাদী সম্পর্ক ব্যাখ্যার উপরেই বেশি জোড় দেন, যা নারীমুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। মার্ক্সীয় নারীবাদীদের বিবাহ তথা পরিবার ব্যবস্থাকে নারীর অধঃস্তনতার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেন, আর পরিবার ব্যবস্থার উচ্ছেদ কামনা করেন। এক্ষেত্রে অনেকে মার্ক্সীয় নারীবাদকে সমালোচনা করেন কারণ তাদের যুক্তি, মানব অস্তিত্বের জন্য বিবাহ ও পরিবার বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া মার্ক্সবাদ সম্পর্কে যেসব সমালোচনা দেখা যায়, মার্ক্সীয় নারীবাদের ক্ষেত্রেও অনেক সময় সেই সমালোচনাগুলো করা হয়। বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের যে আন্দোলন একদিন আলোড়ন তুলেছিল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রসমূহের পতনের পর দেশে দেশে এ মতবাদ ক্ষয়িষ্ণু মতবাদে পরিণত হয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ

মার্ক্সীয় নারীবাদের আলোচনা এখানেই শেষ নয়, এই নারীবাদের সীমাবদ্ধতার আলোচনা বারবার সামনে আসবে। এরই মাঝে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ বা সোশ্যালিস্ট ফেমিনিজম নিয়ে আলোচনা শুরু করি। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ রেডিক্যাল বা আমূল সংস্কারপন্থী নারীবাদ ও মার্ক্সীয় নারীবাদের এক সংমিশ্রিত রূপ। এক্ষেত্রে রেডিক্যাল নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করে আসলে হয়তো ভাল হত, তবে আপাতত সেটা অন্য কোনদিনের জন্য তুলে রাখছি। মার্ক্সীয় নারীবাদের সীমাবদ্ধতার পটভূমিতেই সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তি মালিকানা এবং শ্রেণি বিভাজনই সমাজে নারী বৈষম্যের প্রধান কারণ – এই মতবাদ এই ধারণায় বিশ্বাসী। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন সভ্যতার ঊষালগ্নে নারীদের অবস্থা এইরকম শোষিত, নির্যাতিত ছিল না, বরং সমাজে তারা নেতৃত্ব দিতেন (এঙ্গেলসও এরকম কথাই বলেছিলেন, তার থেকেই অনুপ্রাণিত)। পরিবারের প্রতিপালনের দায়িত্ব ছিল প্রধাণত নারীদের। পুরুষেরা সে যুগে খাবার সংগ্রহে বা শিকারে যেতেন। কিন্তু এই খাবার সংগ্রহ ও শিকার করার কাজটি ছিল অনিশ্চিত। অন্যদিকে নারীরা নিশ্চিত খাবার, অর্থাৎ ফলমূল জোগাড় জোগাড় এবং সন্তান লালনের কর্তব্য কাঁধে নেয়ায় নারী সমাজ-পরিবারের উপরের আসনটি দখল করে নিয়েছিলেন।

কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে চাষাবাদের অগ্রগতি, নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার নারী জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনলেও নারীর আসনটিকে সমাজে পুরুষের চেয়ে অধস্তন করে দেয়। কারণ পুরুষ প্রযুক্তিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আর এক্ষেত্রে নারীরা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়- পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, ব্যক্তি মালিকানা, শ্রেণী-বিভক্ত সমাজ, কেউ উৎপাদক আবার কেউ উৎপাদিত দ্রব্যের মালিক। এসব কিছুর সাথে যুক্ত হয় রাষ্ট্র, পুরুষের স্বার্থ্যরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। কালক্রমে সমাজে পরিবারের দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়। পরিবার ব্যক্তির মানসিক শান্তি বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের কেন্দ্রস্থল না হয়ে পরিণত হয় পুঁজি গঠনের সহায়কে। এই নারীবাদ অনুসারে, সেই যে নারীরা বৈষম্যের শিকার হল, যুগের পর যুগ ধরে তাই চলে আসছে। সব যুগে, বিশেষ করে পুঁজিবাদী যুগ নারী শোষণকে আরও তীব্র করেছে। পুঁজিবাদ নারীর নারীত্বকে পুঁজি করে ব্যাবসা করেছে, আবার পুরুষের সাথে একই শ্রমে নারীকে কম মজুরি দিচ্ছে।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা বলেন, যেহেতু ব্যক্তি মালিকানা ও শ্রেণী বিভাজিত পুঁজিবাদী সমাজই পুরুষ প্রাধান্য এবং নারী বৈষম্যের মূল কারণ, সুতরাং নারী মুক্তি এবং নারী পুরুষ সমতার জন্য সমাজে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রয়োজন। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারাই সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ বিপ্লবই উৎপাদন এবং বণ্টন উভয় প্রক্রিয়ায় নারী এবং পুরুষ উভয়ের মাঝে সমতা আনবে। এই ব্যবস্থায় পরিবার ভেঙ্গে না গিয়ে বরং পরিবারের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মার্ক্সীয় নারীবাদীদের উপর অসন্তুষ্ট, কারণ মার্ক্সীয় নারীবাদী প্রবক্তরা নারী-পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলেননি, বললেও অতি সামান্য বলেছেন। তাদের মতে, মার্ক্সীয় নারীবাদ নারী নির্যাতনে পুরুষের ভূমিকা এড়িয়ে গেছে। তারা পুঁজিবাদ বা ধনিকতন্ত্র নিয়ে এমনভাবে জড়িয়ে গেছেন যে, তারা আর অন্য কিছুই চিন্তা করেন নি।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের অসন্তুষ্টির আরেকটি কারণ হচ্ছে সেক্স নিয়ে মার্ক্সীয় নারীবাদের নীরবতা। মার্ক্সীয় নারীবাদীরা পুরুষের সম্পর্ককে বুর্জোয়া-প্রোলেতারিয়েত শোষণমূলক সম্পর্ক হিসেবেই দেখেছেন। কারণ মার্ক্সীয় নারীবাদীরা “নারীর সেক্স বিষয়ক নির্যাতনের মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাকে মার্ক্সবাদের প্রধান তাত্ত্বিক ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করতে চান এবং শ্রেণী আধিপত্য ও জেন্ডার আধিপত্য উভয়কেই তারা অভিন্ন কাঠামোতে ব্যাখ্যা করতে চান”। (Want to link the marxist treatment of women’s sex-specific oppression with Marxism’s main theoretical system, incorporating domination both by class and by gender in the same explanatory framework. – Alison M. Jaggar, Faminist Politics and Human Nature)। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মনে করেন, এমন সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়। কারণ, শোষিত শ্রমিক ও নির্যাতিত নারীর ভোগান্তি এক ধরণের নয়।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ উৎখাত করে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেও নারীর সমস্যার সমাধান হয়নি। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর মতই নারীকে গৃহে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করতে হয়েছে। ধনতান্ত্রিক দেশে গৃহ-কর্ম ও জন-শিল্প কর্ম উভয়ের জন্যই যে নারীকে দ্বিগুণ বোঝা বইতে হয়, সমাজতান্ত্রিক দেশেও নারীদেরকে সেই একইভাবে দ্বিগুণ বোঝা বহন করতে হয়েছে। দেখা গেছে, ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সমাজতান্ত্রিক সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় রাষ্ট্রেই নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, পারিবারিক সহিংসতা ও প্রজনন স্বাধীনতার বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে খুব একটা স্থান পায় নি। অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, কেবলমাত্র পুঁজিবাদ নারী নির্যাতনের একক কারণ নয়, তাদের পুঁজিবাদের সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ স্বীকার করে যে, পুঁজিবাদের পতন না হলে নারীর মুক্তি নেই, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী প্রবক্তরা দাবী করেন যে, পিতৃতন্ত্র উৎখাত না করলে পুঁজিবাদ ধ্বংস হতে পারে না। কারণ, পুঁজিবাদ কর্মস্থলকে গৃহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে কিন্তু গৃহ থেকে কর্মস্থলের পৃথকীকরণ “এমন ইঙ্গিত দেয় না যে, নারী পরিবারের ভেতর এবং বাইরে পুরুষের অধীন কেন এবং পুরুষ কেন অন্য কিছু নয়” (Give no clues about why women are subordinate to men inside and outside the family and why it is not the other way around. – Heidi Hartmann – The Unhappy Marriage of Marxism and Feminism: Towards a More Progressive Union)।

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী প্রবক্তারা উপর্যুক্ত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, নারীমুক্তির জন্য পুঁজিবাদ বা ধনিকতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র উভয়ের উচ্ছেদ অপরিহার্য। তারা বলেন, জনগণের জড় বা অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো পরিবর্তন করতে হলে জনগণের মতাদর্শগুলোকে আগে বদলিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শগুলো নির্মূল না করলে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মূল করা যাবে না। নারীর ভবিতব্য এই যে, তাকে দুই রণাঙ্গনেই লড়াই করতে হবে, ধনিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শক্তিগুলো থেকে মুক্তিলাভের অন্য কোন উপায় নেই।

কতিপয় সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের মতামত

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- জুলিয়েট মিলেট, আইরিস ইয়ং এবং এলিসন জাগার। এবার এদের চিন্তাধারা ও আন্দোলন সম্পর্কে কিছু লেখার চেষ্টা করব।

জুলিয়েট মিশেলের অভিমত

জুলিয়েট মিশেল সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের প্রধান প্রবক্তা। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী হিসেবে নারী জাগরণের জন্য তিনি এক তাত্ত্বিক ভিত্তি বিনির্মান করেন। এই লক্ষ্যে তিনি লেখনি ধারণ করেন। তার রচিত সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী গ্রন্থগুলো হল Women: The Longest Revolution, Women’s Estate এবং Psychoanalysis and Feminism. জুলিয়েট মিশেল পুঁজিবাদকে জড় বা বস্তুগত, অর্থনৈতিক বিষয়, আর পিতৃতন্ত্রকে অজড়, অবস্তুগত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের মতাদর্শিক বিবরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, শ্রেণী সমাজ ধ্বংসের লক্ষ্যে নারীবাদী বিপ্লব সংগঠন করতে হবে। পুঁজিবাদ নারীর বর্তমান অবস্থার একমাত্র নিয়ামক বলে জুলিয়েট মিশেল স্বীকার করেন না। তার মতে “নারীর বর্তমান অবস্থান ও কর্মকাণ্ড একাধিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। শুধু উৎপাদনে ভূমিকা নয়, প্রজননে ভূমিকা, সন্তানের সামাজিকীকরণ ও যৌনতা নারীর অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের জন্য যৌথভাবে দায়ী। জুলিয়েটের ভাষায়, “সনাতন মার্ক্সবাদীরা ভুল করেছেন যে, অন্য তিনটি উপাদানকে অর্থনৈতিক উপাদানে পরিণত করা যায়, ফলে তারা নারীকে উৎপাদনে অংশগ্রহণে আহ্বান করেছেন এবং একই সঙ্গে পরিবার বিলোপ সাধনের বিমূর্ত শ্লোগান দিয়েছেন। অর্থনৈতিক চাহিদা এখনও মুখ্য বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য তিনটি উপাদান (প্রজনন, যৌনতা ও সামাজিকীকরণ) সম্পর্কে সঙ্গতিপূর্ণ নীতি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে” – Women’s Estate।

তার মতে, নারীকে শ্রমিক বা শ্রমজীবী হিসেবে নয়, প্রেমিকা, স্ত্রী ও মাতা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত পিতৃতন্ত্রের মতাদর্শ এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতি উভয়ই সমাজে নারীর বর্তমান অবস্থানের জন্য সমান দায়ী। এমন কি মার্ক্সবাদী বিপ্লব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারকে ধ্বংস করতে যদি সক্ষম হয়, তবুও নারী পুরুষের সমান হবে না। কারন, পিতৃতন্ত্র নারী ও পুরুষের মনমানস (Psyche) এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে, নারী নিজেকে পুরুষের অধীন ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে; নারী পুরুষের সমান নয় এ মনমানস যতক্ষণ না নারী ও পুরুষের মন থেকে মুছে ফেলা হবে, পুরুষ অধীনতার মনমানস থেকে যতক্ষণ না নারী ও পুরুষ মুক্তি লাভ করবে, ততক্ষণ নারীর মুক্তি আসবে না- পরিবার ভাঙলে বা পুঁজিবাদ বিনষ্ট হলেও নারীর অধীনতা থাকবে। কাজেই পিতৃতন্ত্র ও তার মতাদর্শ নির্মূল না হলে নারীর অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। এককভাবে পুঁজিবাদ বা এককভাবে পিতৃতন্ত্র ধ্বংস করে নারী মুক্তি সম্ভব নয়; পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র উভয়ের ধ্বংসাবশেষের উপর নারীমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জুলিয়েট মিশেলের মতে, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান নিরধারণের চারটি মানদণ্ড হচ্ছে উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, যৌনতা ও শিশুদের সামাজিকীকরণ।

জুলিয়েটের দৃঢ় বিশ্বাস, নারী নির্যাতন মানুষের মনমানসের গভীরে মূলীভূত। উদারপন্থী নারীবাদ, রেডিক্যাল নারীবাদ বা মার্ক্সীয় নারীবাদ- কেউই এই নির্যাতনের সঠিক সমাধান দিতে পারেন নি। সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে নারীর ভোটাধিকার, সহশিক্ষার বিস্তার বা সদর্থক কর্মপন্থা (affirmative action policies) নারীকে পুরুষের সমান করতে পারবে না, নারী ও পুরুষে সমতা স্থাপন করতে পারবে না। নারীর জন্য সকল পেশা ও অর্থকরী কর্মের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলে “নারীত্বের অভিব্যক্তি” (expression of feminity) বদলাতে পারে, কিন্তু নারীর অবস্থানের কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হবে না। অপরপক্ষে তার মতে, রেডিক্যাল নারীবাদীদের জৈবিক বিপ্লবও নারী মুক্তির সহায়ক হতে পারে না। কারন সমস্যাটি প্রজননের সমস্যা নয়, মনমানসের সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। প্রজননের নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে, কৃত্রিম প্রজনন প্রবর্তন করে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান অসম্ভব।

মার্ক্সীয় নারীবাদ অগ্রাহ্য করে জুলিয়েট বলেন, অর্থনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ উৎখাত করলে নারী পুরুষ যে জীবনক্ষেত্রে পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে, তা নয়। তিনি বলেন, নারী পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে উৎপাদী কর্মে অংশ নিলেই যে ছুটির পর সন্ধ্যায় তারা পরস্পর বাহু জড়িয়ে ধরে ঘরে ফিরবে, এমন মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। এ প্রসঙ্গে জুলিয়েট মাও সে তুং- এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন, “যৌথ কর্ম, সমতাপূর্ণ আইন প্রণয়ন, সমাজ কর্ত্রিক সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি পদক্ষেপ সত্ত্বেও, নারীর প্রতি চীনা জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে, গভীরভাবে এবং চিরতরে পরিবর্তিত হবার সময় এখনও আসেনি” (Despite collective work, egalitarian legistaltion, social care of children, etc. it is too soon for the Chinese really, deeply and irrevocably to have changed their attitude towards women,)- Psychoanalysis and feminism – Mitchell। তাই জুলিয়েট ভবিষ্যদ্বাণী করেন, পুরুষ ও নারীর মনমানস পিতৃতন্ত্রের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকলে, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে কদাপি পরিবর্তন আসবে না। নারী মুক্তির মাধ্যমে সমাজে মনুষ্যত্বের জয় ঘোষণা করতে হলে, পুঁজিয়াদ ও পিতৃতন্ত্র উভয়ের বিনাশ অপরিহার্য।

আইরিস ইয়ং এর অভিমত

আইরিস ইয়ং তার সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী মতবাদ তার দুটি প্রবন্ধে তুলে ধরেন, এগুলো হল: Socialist Feminism and the Limits of Dual System Theory, এবং Beyond the Unhappy Marriage: A Critique of Dual Systems Theory. আইরিসের মতে, “শ্রেণী”-কে বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করে নারীবাদীরা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে উভয় ব্যবস্থায় বিদ্যমান নারী নির্যাতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। তিনি বলেন, সমীক্ষায় দেখা যায়, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক দেশে নারী কম নির্যাতিত হয়, কাজেই তথাকথিত পুঁজিবাদী শ্রেণীবৈষম্যকে নারী নির্যাতনের একমাত্রকারণ হিসেবে উপস্থাপন করার পক্ষে এখন আর জোড়ালো যুক্তি নেই। আইরিসের মতে, “শ্রেণী” এর কনসেপ্টটি জেন্ডার ব্লাইন্ড, কাজেই শ্রেণীর ভিত্তিতে নারী নির্যাতন সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে না। তিনি জেন্ডার ব্লাইন্ড ক্লাস বা শ্রেণীর বিপরীতে কেন্ডার সাইটেড ডিভিশন অফ লেবর বা জেন্ডার সচেতন শ্রমবিভাজনকে নারী নির্যাতন ব্যাখ্যা করার সঠিক পন্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন, জেন্ডার ভিত্তিক শ্রম বিভাজনই নারীর অধঃস্তনতার মূল কারণ। তিনি যৌনতা, মাতৃত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তির মানদণ্ডে নারীর বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মার্ক্সীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের দ্বৈত ব্যবস্থা তত্ত্বের সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, শ্রেণী বিশ্লেষণ বা ক্লাস এনালাইসিসে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পরীক্ষা করা হয় এবং উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদন সম্পর্কের আলোচনা করা হয়। অন্যদিকে শ্রম বিভাজন বিশ্লেষণ বা ডিভিশন অফ লেবর এনালাইসিসে সমাজের উৎপাদনকারী প্রতিটি ব্যক্তির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়, ব্যক্তির সমস্যা ও ভূমিকা আলোচনা করা হয়। ক্লাস এনালাইসিসে বুর্জোয়া ও প্রোলেতারিয়েতের আপেক্ষিক ভূমিকা সাধারণভাবে আলোচনা করা হয়, কিন্তু ডিভিশন অফ লেবর এনালাইসিস গভীরে গিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, এটি কে আদেশ দেয়, কে আদেশ গ্রহণ করে, কে বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ করে, কে একঘেয়ে ক্লান্তিকর খাটুনি খাটে, কে কাঙ্ক্ষিত শিফটে কাজ করে, কে অনাকাঙ্ক্ষিত শিফটে কাজ করে, কে বেশি বেতন পায়, কাকে কম বেতন নিতে হয়, এসব নিয়ে আলোচনা করে। আর তাই ডিভিশন অফ লেবর এনালাইসিস তার মতে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করতে পারে যে, কেন নারী সবসময় আদেশ গ্রহণ করে, একঘেয়ে ক্লান্তিকর কাজ করে, অনাকাঙ্ক্ষিত শিফটে কাজ করে এবং কম বেতন পায়, আর অন্যদিকে কেন পুরুষ সবসময় আদেশ দেয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজ করে, কাঙ্ক্ষিত শিফটে কাজ করে এবং বেশি বেতন পায়।

আইরিস বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র অনিবার্যভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত, এবং ডিভিশন অফ লেবর এনালাইসিস, কেবল ক্লাস এনালাইসিস এর পরিপূরক নয়, একই সাথে পরিপূর্ণ বিকল্পও বটে। এখন জেন্ডার নিউট্রাল ক্যাপিটালিজম বা জেন্ডার নিরপেক্ষ পুঁজিবাদকে মার্ক্সিস্ট থিওরি ব্যাখ্যা করবে, আর জেন্ডার বায়াজড পেট্রিয়ার্কি বা জেন্ডার পক্ষপাতী পিতৃতন্ত্রকে ফেমিনিস্ট থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হবে এরকম ডুয়েল সিস্টেম থিওরি আইরিস ইয়ং মেনে নিতে পারেন নি। তিনি বলেন, একটি অভিন্ন থিওরি দিয়েই (মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্ট থিওরি) জেন্ডার বায়াজড ক্যাপিটালিস্ট পেট্রিয়ার্কি বা জেন্ডার পক্ষপাতী পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাদ আগে একরকম পুতৃতন্ত্র ছিল, এখনও পিতৃতন্ত্র আছে, এবং ভবিষ্যতেও পিতৃতন্ত্রই থাকবে। আইরিস বলেন, “আমার প্রতিপাদ্য এই যে, নারীর প্রান্তিকীকরণ এবং তার ফলে, গৌণ শ্রমশক্তি হিসেবে কর্মনির্বাহ পুঁজিবাদের অনিবার্য ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য” (My thesis is that marginalisation of women and thereby our functioning as a secondary labour force is an essential and fundamental characteristic of capitalism).- Beyond the Unhappy Marriage, A critic of the Dual System Theory – Iris Young.

এলিসন জাগারের অভিমত

সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের উপর এলিসন জাগারের একটা বই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর নাম হল Feminist Politics and Human Nature. এই গ্রন্থে এলিসন শ্রেণীর পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশনকেই নারীর সকল সমস্যার কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্রকে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্য দায়ী করেছেন। তিনি ঐ গ্রন্থে বলেন, “উদারপন্থী নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, অন্যায় বৈষম্যে ভোগে বলে নারী নির্যাতিত, ক্লাসিকাল মার্ক্সিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, গণ-উৎপাদন থেকে নির্বাসিত বলে নারী নির্যাতিত, রেডিক্যাল নারীবাদীরা মূলত যৌন ও প্রজনন সামর্থের উপর বিশ্ব-জোড়া পুরুষ নিয়ন্ত্রণকে রেডিক্যাল নারীবাদীরা নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ বলে দেখান, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মার্ক্সীয় বিচ্ছন্নতা মতবাদের সংশোধিত সংস্করণের আলোকে নারী নির্যাতনকে চিহ্নিত করেন।” এলিসনের মতে বিচ্ছন্নতাবোধ হচ্ছে জেন্ডারের মধ্যস্থতায় অনুভূত অভিজ্ঞতা (gender mediated experience)। তিনি নারীর বিচ্ছন্নতাবোধকে যৌনতা, মাতৃত্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তির প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন। এগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

যৌনতা (sexuality): একজন মজুরি শ্রমিক তার উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন; তার নিজের উৎপাদিত পণ্যের উপর তার অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ নেই। মালিক শ্রমিকদের উৎপন্ন পণ্য নিয়ন্ত্রণ করে, বিক্রী করে। একইভাবে নারী তার দেহ, তার উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন। একজন নারী ডায়েট করে, বেয়াম করে, পোশাক পরিধান করে তার নিজের জন্য নয়, সে মূলত নিজের রক্তমাংসকে পুরুষের আনন্দের জন্য সজ্জিত করে। কখন, কোথায়, কিভাবে, কে তার দেহ ব্যবহার করবে, তা নারীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। অন্যদিকে শ্রমিক যেমন ধীরে ধীরে নিজের কাছ থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে যন্ত্রে পরিণত হয়, যন্ত্রচালিত হয়ে পড়ে, নারীও তেমনি নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়- যে যত নিজের অঙ্গসৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য ভ্রূ তুলে ফেলে, অনভিপ্রেত লোম উৎপাটন করে, কোমর সরু করে, নিতম্ব, স্তনযুগল স্ফীত করে, নখ রঞ্জিত করে, তত সে পুরুষের ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়। অবশেষে শ্রমিক যেমন ডলারের পেছনে ধাওয়াকরে সহকর্মী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়, নারী তেমনি পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ, অনুমোদন, অনুরাগ লাভের জন্য অন্যান্য নারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে।

মাতৃত্ব (Motherhood): এলিসনের মতে মাতৃত্ব যৌনতার মত নারীতে বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করে। এলিসন দাবী করেন নারী তার প্রজনন শ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কারণ নারী নিজে নয়, অন্য কেউ ঠিক করে দেয় যে, নারী কয়টা সন্তানের জন্ম দেবে। অনেক ক্ষেত্রে নারীর গর্ভপাত বা বন্ধ্যাকরণের সিদ্ধান্ত নারীর হাতে থাকে না। নারী কিভাবে সন্তান প্রসব করবে, তা নারীর হাতে নেই, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ঠিক করে নারীর স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করানো হবে, না তার সিজারিয়ান অস্ত্রোপ্রচার করা হবে। ফলে নারী তার প্রজননের ফসল ও সন্তান ধারনের প্রক্রিয়া থেকেও বিচ্ছিন্ন। আধুনিক সমাজে নারী সন্তান পালন করে নিজের ইচ্ছায় নয়, ডাক্তারের ইচ্ছায়। ডাক্তার বলে দেয়, সন্তান কিভাবে রাখতে হবে, কি খাওয়াতে হবে, কখন খাওয়াতে হবে, তার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে। যে সন্তানের জন্য মা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাকে মানুষ করার ব্যাপারে মার ইচ্ছার মূল্য নেই, নিজের মনমত করে সন্তান মানুষ করতে হয়। এর চেয়ে মায়ের জন্য বিচ্ছিন্নতাবোধ আর কি হতে পারে।

বুদ্ধিবৃত্তি (Intellectuality): এলিসনের মতে, বুদ্ধির ক্ষেত্রেও নারী বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। নারী যেভাবে মানুষ হয়েছে তাতে তার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস নেই, আস্থাহীনতার জন্য নারীর প্রতিভা ও ধীশক্তির বিকাশ ব্যাহত হয়। সে নিজের সম্পর্কে এমন অনিশ্চিত যে, নিজের মনের কথা, নিজের চিন্তাভাবনা, নিএর স্বকীয়তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে জাহির করতে দ্বিধাগ্রস্ততার জন্য নারী তার যোগ্য উৎকর্ষ অর্জন করতে ব্যর্থ হয় এবং ফলশ্রুতিতে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে।

মার্ক্সবাদে বিচ্ছিন্ন বা এলিয়েনেটেড বলতে বোঝায় “যদি আমরা আমাদের জীবনকে অর্থহীন মনে করি কিংবা নিজেদের অযোগ্য মনে করি”। (If we either experience our lives as meaningless or ourselves as worthless). এলিসন বলেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রে নারীর উপর নির্যাতন সকলের কাছ থেকে, সবকিছু থেকে, বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করছে। তার মতে, নারীকে বুঝতে হবে যে, নারী নির্যাতনের মূলে বিচ্ছিন্নতাবোধ, এবং বিচ্ছিন্নতার মূলে পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র। বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়ে, নারীকে তার সমস্যার মূল যে পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের মিলিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র উৎখাত করে মুক্তি ছিনিয়ে আনতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.