পিথাগোরাস ও পিথাগোরীয় সম্প্রদায়

যাদের দ্বারা প্রভাবিত : থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস, ফেরেসাইডিস, থেমিস্টোক্লিয়া, অর্ফিকবাদ, জরাথুস্ট্রবাদ (?), গৌতম বুদ্ধ (?)
যাদেরকে প্রভাবিত করেন : জেনোফেনিস, এম্পেডোক্লেস, প্লেটো, নব্যপিথাগোরীয়বাদ, নব্যপ্লেটোবাদ

Table of Contents

পিথাগোরাস (খ্রি.পূ. ৫৬২ – ৪৯৩ অব্দ) ও পিথাগোরীয়দের ইতিহাস

পিথাগোরাস ছিলেন একই সাথে ছিলেন একজন দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, গণিতজ্ঞ ধর্ম ও সমাজনেতা ও ব্যবহারিক শিল্পী। বিশুদ্ধ গণিতের আবিষ্কার, গাণিতিক প্রমাণের ধারণাকে আরও জোরালো করে তোলার পেছনে তার অবদান অবিস্মরণীয়। রাসেল বলেন, গণিতশাস্ত্র বলতে যে প্রতিপাদনমূলক অবরোহী যুক্তিকে বোঝানো হয় তার সূচনাই করেন পিথাগোরাস, আর তার দর্শনের সাথে বিশেষ একধরণের রহস্যবাদ নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। তার সময় থেকে দর্শনের উপর গণিতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ভাবনা যেমন তার মধ্যে পাওয়া যায়, তেমনি মধ্যে লক্ষ্য করা যায় এমন সব ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা যা আজ অবধি দর্শনে ব্যাপক বিন এমনকি হাস্যরস বিদ্রুপের বিষয় হিসেবেও পরিগণিত হয়েছে। অন্যদিকে তাকে অনেকেই একজন উচ্চতর নীতিবাগিশ এমনকি সাধক গুরু বলেও গ্রহণ করেন। ধর্মপ্রচারক হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। ‘ফিলােসফি’ শব্দটি নাকি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। ‘ফিলােসফি’ (Philosophy) বা দর্শন বলতে তিনি বুঝতেন জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ (love of wisdom)। পিথাগোরাস সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ডায়োজিনিস তাকে ঐশ্বরিক দর্শনের পথপ্রদর্শন ও জনক রূপে একজন দেবতা, অতিমানব ও ঐশ্বরিক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু এগুলোকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়না। কারণ পিথাগোরাসের মৃত্যুর অনেক দিন পর জীবনীগুলো রচিত হয়। জীবনীগুলোতে কাল্পনিক ঘটনার প্রাচুর্য ও পিথাগোরাসের করা অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা, তার জীবন নিয়ে উদ্ভট কাহিনী এসব এত বেশি যে, সেগুলো থেকে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য বের করা অসম্ভব। কোন ব্যক্তি খুব বিখ্যাত হয়ে গেলে কাল্টে পরিণত হন, এরপর সময় অতিবাহিত হতে হতে তার চরিত্রের সাথে অতিমানবীয় বিষয়গুলো যুক্ত হতে থাকে সমাজেরই নিয়মে। আর এভাবে একসময় সেই ব্যক্তির আসল ঐতিহাসিক চরিত্রটিই হারিয়ে যায়। ঠিক এই জিনিসটাই ঘটেছে পিথাগোরাসের সাথে।

তবে পিথাগোরাস সম্পর্কে কিছু কিছু বিষয় মোটামুটি সঠিকভাবে জানা যায়। যেমন তার জন্ম হয়েছিল আনু ৫৬২ খ্রিষ্টপূর্বে, ছিলেন সামোস দ্বীপের অধিবাসী। সামোস দ্বীপ একটি আয়োনীয় দ্বীপ ছিল, কিন্তু অন্যান্য আয়োনীয় দার্শনিকদের সাথে তার সখ্যতা বা সম্পর্ক ছিলনা। তার জন্মস্থান সমােস দ্বীপ শহরের সাথে মাইলেটাস নগরীর কিছুটা বিরােধ ছিলাে। এই বিরােধ মূলত বাণিজ্য সংক্রান্ত। এই দুই নগর ছিলাে বাণিজ্যে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বি। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বােধ হয় শেষ অবধি চিন্তাজগতেও প্রভাব ফেলে। বৈষয়িক বাস্তবতা মানুষের চিন্তা-চেতনার ওপর যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এটি তারই একটি প্রমাণ বহন করে। কেউ কেউ তাকে দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র বললেও (!) অনেকে তাকে নিসার্কোস নামক এক ধনী ব্যক্তির পুত্র বলেন। তার সময়ে খিস্টপূর্ব ৫৩৫ সালের দিকে সামোস স্বীপটি শাসন করেন পলিক্রেটিস নামে এক স্বৈরাচারী শাসক। এই পলিক্রেটিস ছিলেন একজন হিংস্র ব্যক্তি। সম্ভবত, প্রথম দিককার প্রজাপীড়নকারী টাইরান্ট শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পলিক্রেটিস। তিনি বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। অনেক বছর ধরে তিনি খুবই সফল ছিলেন, আর সব কাজেই তিনি উন্নতি লাভ করেছিলেন। তার একটি বিশাল নৌবহরও ছিল। তিনি শতশত জাহাজ নির্মাণ করেছিলেন আর ছিলেন ঈজিয়ান সাগরের “মাস্টার”। সামােস ছিল মাইলেটাসের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সামােস দ্বীপের ব্যবসায়ীগণ স্পেনের সুদূর টারটেসাস নগরী পর্যন্ত গিয়েছিলেন। খনিজ সম্পদের জন্য টারটেসাস বিখ্যাত ছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫ অব্দে পলিক্রেটিস সামােস দ্বীপের স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ অব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি কোনাে নৈতিকতার ধার ধারতেন না। স্বৈরশাসনের প্রথম দিকে শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত তার দুই ভাইকে তিনি ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। তিনি তার নৌবহরকে মূলত জলদস্যুতার কাজে ব্যবহার করতেন। পারস্যের নিকট মাইলেটাসের সাম্প্রতিক বশ্যতা স্বীকারে তিনি লাভবান হন। 

পারস্যের পশ্চিমমুখী সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সাইটিক মিশরের রাজার সাথে মিলে পলিক্রেটিস একটি জোট গড়ে তোলেন। সেই সময়ে মিশরের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় আমহোস, যিনি খিস্টপূর্ব ৫৬৯ থেকে ৫২৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন। তিনি তার নামের গ্রিক সংস্করণ আমেসিস এর মাধ্যমেই বেশি সুপরিচিত। আমেসিস দারুণভাবে গ্রিক সংস্কৃতির অনুরক্ত ছিলেন। তিনি একজন গ্রিক দেহরক্ষী রাখতেন, ডেলফির উপাসনালয়ে উপহার পাঠাতেন, আর নোহক্র্যাটিসের বাণিজ্যিক ঘাটিকে শহরে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনি একজন বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী গ্রিক রাজার সাথে একই জোটে থাকতে পেরে সন্তুষ্ট ছিলেন যার সেনাবাহিনী তার জন্য বিরাট কাজে আসতে পারত। পলিক্রেটিস ও আমেসিসকে নিয়ে একটি কিংবদন্তী আছে। তিনি পলিক্রেটিসের নিরবচ্ছিন্ন সৌভাগ্যের ব্যাপারে কুসংস্কারাচ্ছভাবে ভীত ছিলেন। মিশরীয় রাজা অনুভবন করলেন, সুসমতা ফিরিয়ে আনার জন্য দেবতারা টাইরান্টদের জন্য ভয়ানক কিছু রেখেছে। তাই, আমেসিস পলিক্রেটিসকে নিজের কিছু জিনিস বিসর্জন দিতে বললেন। এটি পলিক্রেটিসের জন্য সামান্য কিছু দুর্ভাগ্য নিয়ে এসে সুসমতা ফিরিয়ে আনতে আর দেবতাদের শান্ত করতে পারে, আর পরিণতিতে সেখানে খুব খারাপ কিছু সংঘটিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। পলিক্রেটিস তার উপদেশ শুনে একটি দামি আংটি নিলেন, আর সেটিকে সমুদ্র নিক্ষেপ করলেন। কিছুদিন পরে, টাইরান্টদের প্রাসাদের একটি খাবার টেবিলে একটি মাছ নিয়ে আসা হলো, আর যখন সেটিকে কাটা হলো, তার ভিতরে আংটিটা পাওয়া গেল। এই খবর শুনতে পেয়ে আমেসিস বুঝতে পারলেন যে, পলিক্রেটিসের দিন ফুরিয়ে এসেছে, আর তিনি জোটটিও ভেঙে দিলেন। তবে জোট ভাঙ্গার জন্য প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন কারণ ছিল। পারস্যের রাজা ক্যাম্বাইসিস (Cambyses) মিশর জয়ের জন্য পূর্ণশক্তি নিয়ােগ করেন, তখন পারস্য রাজার জয়ের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই পলিক্রেটিস তার পক্ষ পরিবর্তন করেন। মিশর আক্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি তার রাজনৈতিক শত্রু দ্বারা গঠিত একটি নৌবহর পাঠান। কিন্তু নৌবাহিনীর নাবিকগণ বিদ্রোহ করে তাকে আক্রমণ করার জন্য সামােস দ্বীপে চলে আসে। অবশ্য, তিনি তাদের পরাজিত করেন। সে যাত্রা পলিক্রেটিস নাবিকদের বিদ্রোহ দমন করে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা তার হয়নি। অতিশয় লোভের ফলে অবশেষে তার পতন ঘটে। ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, সার্ডিসে পারস্যের প্রাদেশিক শাসক ঘোষণা করেন তিনি মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান, পলিক্রেটিস যদি সে বিদ্রোহে তাকে সাহায্য করেন তাহলে তিনি তাকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেবেন। পলিক্রেটিস তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মূল ভূখণ্ডে গেলে বন্দি হন এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। আমেসিসের আশঙ্কাই সত্য পরিণত হলো। তবে আমেসিস এটি দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কারণ তিনি তিন বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন।

প্রাচীন গ্রিসের স্বৈরাচারী বা টাইর‍্যান্টদের যুগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এখানে যান

একজন টাইরান্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পলিক্রেটিস সংস্কৃতি আর জনসম্পৃক্ত কাজকে অণুপ্রাণিত করতেন। ইয়ুপালিনাস নামে মেগারার এক লোককে ভাড়া করে তিনি একটি সরু জলপথ নির্মাণের কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। গ্রিকরা সবসময় বিমূর্ত চিন্তাধারাকে প্রাধান্য দিত, আর প্রায়োগিক প্রযুক্তিবিদ হিসেবে নিজেদের রেকর্ডের দিকে তাদের মনোযোগ ছিল কম। তাই ইয়ুপালিনাসের মতো ব্যক্তি সম্পর্কে কম তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে যা খুবই দুঃখের বিষয়। পলিক্রেটিস শিল্পকলারও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সামোসকে তিনি অনেক দর্শনীয় জনকর্ম দিয়ে সাজিয়েছিলেন। অ্যানাক্রিয়ন (Anacreon) ছিলেন তার সভাকবি। কিন্তু পিথাগোরাস পলিক্রেটিসের শাসন পছন্দ করেননি, সে কারণে তিনি সামোস ত্যাগ করে চলে যান। তৎকালীন স্বদেশীয় শাসকদের রােষানলে পড়েই তাকে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। আবার তিনি নিজেকে পলিক্রেটিসের সাথে সামোসের যৌথ মালিক ভাবতেন বলে পলিক্রেটাস ক্রমশ টাইর‍্যান্টে পরিণত হবার ফলে তিনি সামোস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বলা হয়, তিনি মিশর গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি অনেক জ্ঞান আহরণ করেন। এ তথ্য অসম্ভব নয়। তিনি তার জ্ঞানরাজ্যের অধিকাংশই সেখান থেকে শিখেছিলেন। আবার তিনি ফিনিশিয়া ও ব্যাবিলনে গিয়েছিলেন বলেও অনেকে বলে থাকেন, এই অঞ্চলগুলো থেকে তিনি ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে ধারণা লাভ করে থাকতে পারেন, এমন মতও আছে। তবে এই বিষয় সত্য হোক বা না হোক একথা নিশ্চিত যে, এটা নিশ্চিত যে তিনি দক্ষিণ ইতালির ক্রোটনে (Croton) স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তার সাথে আয়োনীয়দের বৈজ্ঞানিক ধারা বয়ে নিয়ে গেলেন যেটি পশ্চিম গ্রিকে একটি স্থান করে নিল, যদিও পিথাগোরাস ইতোমধ্যে থেলিসের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রকাশভঙ্গিকে ভেঙে ফেলেছিলেন। পরিবর্তে তিনি গোপনীয়তা, সন্নাসবাদ আর রহস্যময়তায় চিহ্নিত নতুন এক প্রকাশভঙ্গির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সামােসসহ অন্যান্য গ্রিক নগরের সাথে ইতালির ব্যবসায়িক যােগাযােগ ছিলাে। সেই সুবাদে অনেক সামােসবাসীই ইতালি গমনাগমন করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫ অব্দে পিথাগোরাস চলে আসেন দক্ষিণ ইতালির ক্রোটোনে (Crotone) শহরে, যা তদকালীন ইতালীর গ্রিক উপনিবেশ ছিল। সেখানেই তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সামোস ও মিলেটাসের মতো দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলো ধনী ও সমৃদ্ধ ছিল। তা ছাড়া পারসিকদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর আক্রমণের ভয় ছিল না। (সিসিলির গ্রিক শহরগুলোর কার্থেজিয়ানদের দ্বারা আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ইতালিতে এই বিপদের আশঙ্কাকে তেমন আসন্ন বলে মনে করা হয়নি।) সবচেয়ে বড় দুটি নগরী ছিল সাইবারিস (Sybaris) ও ক্রোটন। বিলাসিতার জন্য সাইবারিসের খ্যাতি প্রবাদ হয়ে আছে। ডিওডোরাসের (Diodorus) ভাষ্য অনুযায়ী সাইবারিসের সবচেয়ে সুদিনে সে নগরীর জনসংখ্যা ছিল তিন লাখ। অবশ্য সন্দেহ নেই যে এটা অতিরঞ্জন। আকারের দিক থেকে ক্রোটন সাইবারিসের প্রায় সমান ছিল। উভয় নগরীর জীবিকা ছিল আয়োনীয় পণ্যসামগ্রী ইতালিতে আমদানি করা। এর কিছু অংশ সে দেশে ব্যবহৃত হতো আর কিছু অংশ ফের রপ্তানি করা হত পশ্চিম উপকূল থেকে গল ও স্পেনে। ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। পিথাগোরাস যখন ক্রোটন পৌঁছেন তখন সে নগরী সদ্য লকরির (Locri) কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে তার আগমনের অল্প পরেই ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইবারিসের সঙ্গে এক যুদ্ধে ক্রোটন সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করে এবং সাইবারিসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। মিলেটাসের সঙ্গে সাইবারিসের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রোটন চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ক্রোটনের জনৈক ডেমোসেডিস (Democedes) প্রথমে পলিক্রেটিসের এবং পরে দারিয়ুসের চিকিৎসক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

ইতালী অঞ্চলে গ্রিক ঔপনিবেশিকতার যুগের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এখানে যান

ক্রোটোনেতে আসার কিছুদিনের মধ্যে তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন যাকে পিথাগোরীয়বাদ বা পিথাগোরীয়িজম বলা হয়, সম্প্রদায়ের সদস্যদের বলা হয় পিথাগোরীয় বা পিথাগোরীয়। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এই শহরে সম্প্রদায়টির প্রভাব ছিল। এটা কেবল দার্শনিক সম্প্রদায় ছিল বলা যায় না, এক দিক থেকে মিস্টিক স্কুল বা অতিন্দ্রীয় বা রহস্যবাদী সম্প্রদায় বলা যায়, অনেকটা উপাসক সম্প্রদায়ের মতই আরকি। এরিস্টোটল তার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি প্রথম দিকে গণিত ও পাটিগণিত নিয়ে কাজ করতেন, এবং পরবর্তীকালে এক সময়ে এই উচ্চ জ্ঞান অনুশীলন বাদ নিয়ে তিনি পেরিসাইডিস কর্তৃক অনুশীলিত অলৌকিক বিষয় চর্চা করতেন।’ যাই হোক, ক্রমশ এই সেক্টের নানান শাখাও গড়ে ওঠে। একটি শাখা সিনিকদের সাথে জুড়ে যায়, একটি শাখা প্লেটোবাদীদের সাথে মিশে যায়, একটা শাখা নব্যপিথাগোরীয়বাদ তৈরি করে যেখানে পিথাগোরাসের উপাসনাও করা হত। যাই হোক, পিথাগোরাস ক্রোটোনায় একটি মঠ স্থাপন করেন, সেই মঠের বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়ে যায়। আর সেই মঠকে কেবল দার্শনিক কেন্দ্র নয়, রাজনীতিরও ঘাঁটি ছিল। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলা এবং ব্যক্তিগত চরিত্রের বিশুদ্ধিসাধন ছিল তার সম্প্রদায়ের মূল লক্ষ্য। এজন্য সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সদস্যকে কিছু গােপন দীক্ষা অনুষ্ঠানে যােগদান এবং কঠিন শপথ গ্রহণ করতে হতাে। পিথাগোরাসের ফলোয়ার আর পপুলারিটি বাড়ার সাথে সাথে তার প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়ছিল, তাতে তৈরি হচ্ছিল তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। এদের সাথে তার সংঘর্ষও বাঁধে। শেষে তাকে প্রাণ নিয়ে দক্ষিণ ইতালীর আরেক শহর মেটাপন্টিয়নে (Metapontion, এই শহরও দক্ষিণ ইতালির একটি শহর) পালিয়ে যেতে হয় যেখানে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তিনি হয়ে ওঠেন পৌরাণিক রূপকথার ব্যক্তি (mythical figure), তার নামের সাথে যুক্ত হয় অনেক অলৌকিক ও যাদুশক্তির ঘটনা। কিন্তু তিনি আবার গণিতবিদদের একটি স্কুলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এরিস্টোটল তার সম্পর্কে বলেন, তিনি প্রথম দিকে গণিত ও পাটিগণিত নিয়ে  কাজ করেন, এবং পরবর্তীকালে এক সময়ে এই উচ্চ জ্ঞান অনুশীলন বাদ দিয়ে তিনি পেরিসাইডিস কর্তৃক অনুশীলিত অলৌকিক বিষয় চর্চা  করেন। এভাবে পিথাগোরাসের স্মৃতি দুই বিপরীতমুখী বিশ্বাস দ্বারা বিতর্কিত। এই বিতর্কের জট খুলে আসল সত্য বের করে আনা কঠিন। এজন্যই দর্শনের ইতিহাসে পিথাগােরাস হচ্ছেন সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং দুর্বোধ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। পিথাগােরাসকে কেন্দ্র করে যে ঐতিহ্য রয়েছে তা শুধু ব্যাখ্যাতীত সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ নয়, বরং সেই ঐতিহ্যের সামান্য ও ক্ষুদ্র বিতর্ক আমাদের নিকট খুবই কৌতূহলপূর্ণ মনােবিজ্ঞান উপস্থাপন করে। রাসেলের মতে সংক্ষেপে তাকে আইনস্টাইন ও (Mrs. Eddy) সংমিশ্রণ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। তিনি একটি ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধর্মীয় মতবাদের প্রধান দিকসমূহ ছিল আত্মার দেহান্তর এবং শিম (beans) খাওয়ার পাপ সম্পর্কে। তার ধর্মমত একটি ধর্মীয় বিধানে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। তার ধর্মমত দেশে একটি সন্ন্যাসরাজ্যও প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু শিম খাওয়ার কঠোরতার বিরুদ্ধে অচিরেই বিদ্রোহ দেখা দেয়।

পিথাগোরাস যখন তার সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন তখন বৃহত্তর গ্রীসে শান্তি ও শৃঙ্খলার খুব অভাব ছিল। তার সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। পিথাগোরীয়দেরকে তাই পিথাগোরাসের দ্বারা নির্ধারিত একটি সামাজিক ও নৈতিক পরিকল্পনা অনুসরণ করতে হত। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিগত চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সম্প্রদায়ের সভ্যদেরকে শপথ নিতে হত। যাকে আমরা পিথাগোরাসের দর্শন বলে জানি তা যে কতটা পিথাগোরাসের নিজের দর্শন চিন্তা, আর কতটা তার সম্প্রদায়ের সদস্য অর্থাৎ পিথাগোরীয়দের তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বার্নেট বলেন, পিথাগোরাসের দর্শনই বেশি, আবার স্টেইস বলেন পিথাগোরাসের দর্শন বলতে বুঝতে হবে পিথাগোরীয়দের দর্শন। (A Critical History of Greek Philosophy; Page 34)। এরিস্টোটল তার মেটাফিজিক্সে পিথাগোরাসের নাম উল্লেখ না করে, পিথাগোরীয়দের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। যাই হোক, পিথাগোরীয়দের অবস্থা খুব বেশি সুখের ছিলনা। অভিজাত দল ও গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে সেসময় এক তীব্র সংগ্রাম চলছিল। পিথাগােরীয়দের সহানুভুতি ছিল অভিজাত দলের প্রতি। এ জন্যই খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ ইতালির বিভিন্ন নগরে অভিজাত সরকারের সাথে পিথাগােরীয়দেরও উৎখাত করা হয়। তখন তাদের অনেকেই নিহত হয় এবং কেউ কেউ প্রাণভয়ে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীকালে তাদের আবার টারেন্টাম ও এথেন্সে দেখা যায়। তার বহু মঠ ধ্বংস হয়, মারা যায় তার বহু শিষ্যও।

এখানে তদকালীন ইতিহাস ও দর্শনের সম্পর্ক বিষয়ে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। মাইলেসীয় দর্শনের ধারার পর গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপটি দক্ষিণ ইতালির গ্রিক শহরসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। আয়োনিয়া থেকে দুই ধারায় সেখানকার পণ্ডিতরা অন্যান্য গ্রিক অঞ্চলে অভিবাসন করে। এক. যখন পারসিকরা আয়োনীয় ও ঈজিয়ান অঞ্চল সব দখল করে নেয়, এই সময় পিথাগোরাস ঈজিয়ান দ্বিপ সামোস ছেড়ে ইতালির ক্রোটনে তার জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চলে আসেন, সাথে আসে আয়োনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাও। আর দুই. যখন পারস্যের বিরুদ্ধে আয়োনিয়া বিদ্রোহ করে পরাজিত হয় ও তার ফলস্বরূপ পারসিকরা মিলেটাস নগর ধ্বংস করে দেয়। মিলেটাসের এই ধ্বংসের পর আয়োনিয়া আর কখনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের পুরনো সত্তা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার ঐতিহ্য চিরকালের মতো হারিয়ে যায়। মিলেটাসের ধ্বংসের পর দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলির গ্রিক ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোই হয়ে উঠেছিল গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন ধারক ও বাহক। সেই সময় আয়োনিয়া তো বটেই মূলভূমির গ্রিসও পারস্যের আক্রমণের হুমকিতে ছিল। কিন্তু দক্ষিণ ইতালি ছিল অনেকটাই নিরাপদ। ফলে সেই স্থানেই যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার নতুন সুযোগ গড়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। যাই হোক, প্রাচীন গ্রিক দর্শনের এই দ্বিতীয় ধারাটি অধিকতর ধর্মীয় ভাবাপন্ন এবং বিশেষ করে অর্ফিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল। এই দার্শনিক চিন্তাধারা কোনাে কোনাে দিক থেকে অধিকতর আকর্ষণীয় এবং কৃতিত্বের দিক থেকে প্রশংসনীয়। কিন্তু মাইলেসিয় দার্শনিক চিন্তাধারায় যতখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় মাইলেসিয়-পরবর্তী এই দার্শনিক চিন্তাধারায় ততখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় না। বলা যায়, পিথাগোরাসের সামোস ছেড়ে ক্রোটনে অভিবাসনের মধ্য দিয়েই প্রাচীন গ্রিক দর্শনের এই দ্বিতীয় ধাপের সূত্রপাত ঘটে।

এশিয়া মাইনোরে পারসিক আক্রমণ, আয়োনীয় বিদ্রোহ ও মিলেটাস ধ্বংস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

পিথাগোরীয়বাদী দর্শন

সংখ্যাই বস্তু, বস্তুই সংখ্যা

পিথাগোরীয়দের উপর গণিতের বিশেষ প্রভাব ছিল। তাদের দর্শনকে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে – সংখ্যাই বস্তু ও বস্তুই সংখ্যা। এই কথাটিকে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার, অর্থাৎ সংখ্যা হল বস্তু – এই ধারণা আর বস্তু হল সংখ্যা – এই ধারণাকে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করতে হবে। সংখ্যা হল বস্তু ধারণাটা মাইলেসীয়দের ধারণাকেও অতিক্রম করে যায়। মাইলেসীয়রা বলেছিল যা কিছু অস্তিত্বশীল সবই বস্তু বা মেটারিয়াল, পিথাগোরীয়রা সেই অস্তিত্বশীল বস্তুর মধ্যে সংখ্যার মত অ্যাবস্ট্রাক্টও নিয়ে এলো। তারা সংখ্যাটাকেও আসলে বস্তু বলে দাবি করে বসল। তাদের বিশুদ্ধ গণিতের আবিষ্কারে এই ধারণার প্রভাব আছে। আর দ্বিতীয় অংশ, মানে বস্তু হল সংখ্যা – এই ধারণাটা তারা পেয়েছিল আরেকটি ধারণার সিদ্ধান্ত হিসেবে, সেটা হল, তারাই প্রথম অনুধাবন করে যে প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গাণিতিক সূত্রকে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটি অনুধাবনের পর তারা সেখান থেকে সিদ্ধান্তে আসে যে বস্তুগুলো হল সংখ্যা। পিথাগোরীয়দের মতে সংখ্যা দ্বারা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ জগতের আদি উৎস হলাে সংখ্যা, সংখ্যাই আদি সত্তা। বস্তুজগতে মূল উৎস কোন বস্তুনিচয় নয়। বরং সকল বস্তুর মূল উৎস সংখ্যা। সংখ্যা দ্বারাই করুন গড়া। বস্তু মাত্রই সংখ্যার প্রকাশ। বস্তু বা বস্তুজগৎ হচ্ছে সংখ্যারই কপি বা অনলি মাত্র। সংখ্যা ও বস্তুর মধ্যে পিথাগােরীয়রা এই যে পার্থক্য করলেন, পরবর্তীকালে প্লেটোএরিস্টটলের দর্শনে তাই রূপ (form)উপাদান (matter)-এর পার্থক্য বলে পরিচিত হয়।  জড়ীয় উপাদান এবং তাদের গতিই ছিল মাইলেসীয়দের চিন্তার মূল লক্ষ্য ও উপজীব্য; কিন্তু পিথাগােরাস ও তার সমর্থকগণ উপাদানের জড়ভাগের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে আকৃষ্ট হলেন শৃঙ্খলা ঐক্য পরিণাম প্রভৃতির প্রতি।

মাইলেসীয়রা যেমন তাদের পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত আবিষ্কারে অভিভূত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে জড়ই প্রকৃতির মূল তত্ত্ব, তেমনি পিথাগোরীয়রা তাদের গণিতের আবিষ্কারে অভিভূত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে সংখ্যাই হল সব কিছুর মূলে, সংখ্যাই পরমসত্তা। পরবর্তী গ্রীক দর্শনে এই মাইলেসিয়ান ও পিথাগোরীয় মতবাদ দুই এর মিশ্রণেই আকার ও উপাদান (ফর্ম ও ম্যাটার) এর মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা দেখা যায় (বিশেষ করে প্লেটো ও এরিস্টোটলের ধারণায়)। পিথাগোরীয়দের দর্শনকে বলা যায় গাণিতিক অধিবিদ্যার দর্শন বা ম্যাথমেটিকো-মেটাফিজিকাল ফিলোসফি।

সংখ্যা নিয়ে পিথাগোরীয়দের ধারণা ও সংখ্যা থেকে জগতের উৎপত্তি

পিথাগােরীয় দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে, সব ধরনের পদার্থকে তাদের সংখ্যাগত সম্পর্ক অনুসারে ব্যক্ত করা যায়। সমতা ন্যায়পরতা সুযােগ-সুবিধা প্রভৃতি সব জিনিসের মূলেই একটি করে সংখ্যা আছে বলেও তারা মনে করতেন। আয়ত সংখ্যা (oblong number), ত্রৈকোণিক সংখ্যা (triangular number), পৈরামিডিক সংখ্যা (pyramidal number) প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার সংখ্যার নাম তারা উল্লেখ করেছেন। বস্তৃত, সংখ্যা যদি বস্তুর সারধর্ম (essence) হয়ে থাক, তা হলে সংখ্যার ব্যাপারে যা সত্য, বস্তুর ব্যাপারেও তা সত্য হতে বাধ্য। এ যুক্তিতেই পিথাগােরীয়রা সংখ্যার মধ্যে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন এবং সেগুলােকে জগতে আরােপ করেন। 

পিথাগােরীয়দের মতে, জগতের আদি উপাদান হচ্ছে ‘এক’। এক সংখ্যা থেকে বহু সংখ্যার উৎপত্তি। এক হচ্ছে মৌলিক সংখ্যা যার ওপর সকল সংখ্যা নির্ভরশীল। অন্য সকল সংখ্যা হলাে কতগুলাে একক বা এক সংখ্যার সমষ্টি। যে এক সংখ্যা থেকে সকল সংখ্যার উৎপত্তি হয় তাকে পরম এক (absolute unit/one) বলা হয়। পরম এক হচ্ছে সকল দেবতাদেরও দেবতা। অর্থাৎ আমরা যাকে ঈশ্বর বলি পিথাগােরাস হয়তাে তাকেই পরম এক বলেছেন। সংখ্যা প্রধানত দুই প্রকার জোড় ও বেজোড়। জোড় ও বেজোরের দ্বন্দ্বের কথা পিথাগােরীয়রা বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, জোড় ও বেজোড়ের দ্বন্দ্বের ফলেই জগৎ বিকশিত হয়। জগতের সকল পরস্পর বিরােধী শক্তি জোড় ও বেজোড় সংখ্যার দ্বন্দের সদৃশ। জোড় ও বেজোড় এর দ্বন্দের বিষয়টিকে আবার তারা অসীম ও সসীমের দ্বন্দ্ব বলেও চিহ্নিত করেছেন। জোড় সংখ্যাকে দুই দিয়ে ভাগ করা যায় বলে এটা দ্বি-ভাগকে সীমিত করে না। সুতরাং এটা অসীম। অন্যদিকে বেজোড় সংখ্যাকে দুই দিয়ে ভাগ করা যায় না তাই এটি দ্বি-ভাগকে সীমিত করে। তাই এটাকে সসীম বলা যায়। এই অসীম ও সসীমের দ্বন্দ্বই হলাে জগতের চরম বাস্তবতা। সসীম একক সংখ্যার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। আদি একের সাথে সম্পর্কিত হয়ে সসীম প্রথমে নিজে সংঘটিত হয়। এরপর প্রবল আকর্ষণে অসীমকে নিজের দিকে টেনে আনতে চায়। এ প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ সসীমের আকর্ষণে অসীম সীমিত হয়ে নির্দিষ্ট আকার ধারণ করলেই কোন বস্তু বা সত্তার উৎপত্তি ঘটে। এভাবে জগতের সকল কিছুই সৃষ্টি হয়েছে বলে পিথাগােরীয়রা ব্যাখ্যা করেন। 

এখান থেকে আমরা দেখি পিথাগােরাসের দার্শনিক মতে এনাক্সিম্যান্ডারএনাক্সিমিনিসের মতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তেমনি আবার এতে দ্বৈতবাদের সমর্থনও দেখা যাচ্ছে, যার সাথে পারসিকদের দ্বৈতবাদী ধর্মমতের সাদৃশ্য রয়েছে। অবশ্য পিথাগােরীয়রা যে গাণিতিক উপায়ে তাদের মত ব্যক্ত করেন পারসিকদের মধ্যে তা দেখা যায় না। পিথাগােরীয়রা গােটা বিশ্বকে অসীম ও সসীম – এই দুটি শক্তিতে বিভক্ত করেছিলেন। তাদের মতে বিশৃঙ্খলা অসীমের প্রকাশ, আর শৃঙ্খলা সসীমের প্রতীক। প্রথমে অসীম ছিল সার্বভৌম এবং তখন চারদিকে ছিল শুধু অন্ধকার ও বিশৃঙ্খলা। অতঃপর উদ্ভব হয় সসীমের, এবং একই সময়ে উদ্ভব হয় আগুন ও আলাের। এই অধিবিদ্যক দ্বৈতবাদ নৈতিক বিরােধের পরিচায়ক; কারণ অসীম অশুভ ও পাপাচারের এবং সসীম শুভের প্রতীক। পিথাগােরীয়দের মতে, অসীম স্ত্রীজাতীয় গুণাবলির এবং সসীম পুরুষজাতীয় গুণাবলির অধিকারী। দিবা ও রাত্রি, শুষ্ক ও সিক্ত প্রভৃতি বিভিন্ন গুণাবলির দ্বৈততায় এই বিরােধ অব্যাহত থাকে। অসীম ও সসীম-এর এই যে বিরােধ তাতে প্রাচীন গ্রিকদের প্রচলিত মানসিকতার নিদর্শন পাওয়া যায়। গ্রিকদের কাছে অসীম ছিল নিষেধ ও অশুভের আকর, আর সসীম শুভের উৎস। এ জন্যই পৌরাণিক উপাখ্যানে দেখা যায়, মানবীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সীমা অতিক্রম করার অপরাধে প্রমেথিয়ুসকে দেবতারা শাস্তি দিয়েছিলেন। এদিক থেকে গ্রিকরা আধুনিক চিন্তাবিদদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিলেন, কেননা আধুনিককালের মানুষ সাধারণত অসীমকেই যাবতীয় শক্তির মূল উৎস বলে মনে করে। যেমন, গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ (Faust)- এ মানুষের অনন্ত উচ্চাশা ও স্পৃহার কথাই বিধৃত। 

যে ধরনের দ্বন্দ্বে জগৎ বিকশিত হয় পিথাগােরাস এমন দশ ক্যাটাগরির দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরেছেন। এই দশ ক্যাটাগরি হল :১. সসীম-অসীম; ২. জোড়-বেজোড়; ৩. এক-বহু; ৪. ডান-বাম; ৫. নারী-পুরুষ; ৬. স্থিতি-গতি; ৭. বাঁকা-সােজা; ৮. আলাে-আঁধার; ৯. ভালাে-মন্দ এবং ১০. চতুর্ভুজ-আয়তক্ষেত্র। পিথাগােরীয়রা সংখ্যার বিভিন্ন নাম প্রদান করেছেন। অর্থাৎ সংখ্যা দ্বারা বিভিন্ন কিছু প্রকাশ করেছেন। তারা বিভিন্ন সংখ্যাকে বিভিন্ন প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাদের মতে – এক – বিন্দু, দুই – রেখা, তিন – সমতল, চার – কাঠিন্য, ঘনত্ব, পাঁচ – গুণ (Quality), ছয় – সজীবতা, প্রাণশক্তি, এবং সাত – বুদ্ধিমত্তা, ভালবাসা, বিজ্ঞতা। এভাবে বিভিন্ন সংখ্যাকে বিভিন্ন বিষয় বা ধারণার প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের পেছনে তেমন কোন যুক্তি বা নীতি ছিলাে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, এটা নিছক একটি সেচ্ছাচারী আত্মগত পন্থা বা নীতিহীন বিষয় মাত্র। এর একটি প্রমাণ হল এই যে, পিথাগােরীয়দের কেউ কেউ চারকে ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে চিহ্নিত করেন। আবার কেউ কেউ নয়কেও ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ন্যায়বিচারকে তারা সমানুপাতিক বিষয় বলে চিহ্নিত করেন। এই দিক থেকে যে কোন সমানুপাতিক সংখ্যা বা যাকে সমান ভাগে ভাগ করা যায় তা ন্যায়বিচারের প্রতীক হতে পারে। যেমন : ২ x ২ = ৪, আবার ৩ X ৩ = ৯ এই উভয় ক্ষেত্রে সমানুপাতিক তাক বিদ্যমান। 

পিথাগােরীয়রা জগতের উৎপত্তি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখান যে, সৃষ্টির পূর্বে বিরাজমান ছিলাে শূন্যতা। এই শূন্যতার মধ্যে আকার প্রদানকারী সত্তা হিসেবে ‘এক’ এর আবির্ভাব ঘটে। এক এর অবস্থান একটি গোলাকার পিণ্ডরূপে ছিলাে। এটি পূর্ণ আকারের আকার। এই পূর্ণ আকার এর সংস্পর্শে যখন শূন্য আসে তখনই আর শূন্যতা থাকে না। বিভিন্ন আকার প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন বস্তু বা বিষয় সৃষ্টি হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় এক বীজকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন বস্তু বা বিষয় সৃষ্টি হয়ে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই বিক্ষিপ্ত বস্তু বা বিষয়গুলােও সংখ্যা ছাড়া প্রকাশ করা যায় না। পিথাগােরীয়দের মতে, এই বিক্ষিপ্ত বস্তু বা বিষয়রাজি এক এর প্রভাবে বা আকর্ষণে জ্যামিতিক পাঁচটি উপাদানের সৃষ্টি করে। এই পাঁচ উপাদান হলাে: জল, বায়ু, আগুন, এবং ঈথার। এদের মধ্যে আগুনকে পিথাগােরীয়রা শ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত করেন। তাদের মতে আগুন পিরামিড আকৃতির কণা দ্বারা গঠিত। এই আগুনকে ঘিরেই পার্থিব জগতের সকল বস্তুরাজি আবর্তিত হয়। বিশ্বজগতের কেন্দ্র এক অগ্নিগােলকের ধারণায় পিথাগােরীয়রা বিশ্বাস করতেন। আমাদের পৃথিবীও এই গােলাকার অগ্নিকুণ্ডলীর চারপাশ দিয়ে ঘুরছে বলে তারা দাবী করেন। অর্থাৎ তারা সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের পূর্বাভাষ প্রদান করেন। হিপোলিটাসের ভাষ্যে, পিথাগোরীয়দের মতে যে এক থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয় তা হলো মোনাড (Monad), এই মোনাড থেকে তৈরি হয় ডায়াড (Dyad, গ্রিক ভাষায় যার অর্থ ‘দুই’)। ডায়াড থেকে আসে সংখ্যাসমূহ, সেখান থেকে আসে বিন্দু, সেখান থেকে রেখাসমূহ বা সসীমত্ব ইত্যাদি। এই মোনাড দ্বারা স্বর্গীয়তা, প্রথম সত্তা, সকল সত্তার সামগ্রিক রূপ, সকল কিছুর উৎস্যবিন্দু বোঝানো হয়েছে। জাগতিক বস্তুসমূহের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পিথাগােরাস সম্প্রদায় সংখ্যার মাধ্যমে আরও একটি উপায়ে ব্যাখ্যা দান করতে চেষ্টা করেছেন। তা হল: তারা দেখান যে, কতগুলি বিন্দু পাশাপাশি অবস্থান করলে একটি রেখা হয়। কতগুলি রেখা পাশাপাশি অবস্থান করলে গঠিত হয় তল। আর কতগুলি তলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে কোন বস্তু। তারা দেখান যে, এই বিন্দু, রেখা, তল সবই সংখ্যার দ্বারা প্রকাশযােগ্য। তাই সংখ্যা দ্বারাই জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায়। 

পিথাগোরীয়দের সংখ্যাকে বস্তু ভাবার কারণ

সবকিছুকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায় : পিথাগোরীয়রা দেখলেন সব কিছু গণনা করা যায়, অনেক কিছুকেই সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। অনুপাত, শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যকে ভিত্তি করে এই বিশ্বজগৎ দাঁড়িয়ে আছে যার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। অনুপাতকে একটি সংখ্যার সঙ্গে আরেক্কটি সংখ্যার সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। শৃঙ্খলাকে সংখ্যার সাহায্যে পরিমাপ করা যেতে পারে, যেমন সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত কোন সেনাদলের শৃঙ্খলা বা বিন্যাসের কথা যখন আমরা বলি তখন এই বোঝাতে চাই যে তারা একজন আরেকজনের থেকে একটি নিয়মিত ও নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করছে, যার প্রকাশের জন্য সেই দূরত্ব কত ফুট বা কত ইঞ্চি সেই সংখ্যার প্রয়োজন। এভাবে দুটি পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত বিষয়ের মধ্যকার সম্পর্ককে সংখ্যাসূচক অনুপাত দিয়ে প্রকাশ করা যায়, একাধিক সুবিন্যস্ত বস্তুর মধ্যে শৃঙ্খলাকেও সংখ্যার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। দ্রব্যের বিস্তার, আয়তন, আকৃতি, পারস্পরিক দূরত্ব, সংযোগ, অর্থাৎ বিভিন্ন জড়ের মধ্যকার সম্বন্ধকেও সংখ্যার দ্বারা প্রকাশ করা যায়। দুটি মৌলিক উপাদানের সংযোগে যখন একটি যৌগিক দ্রব্যের উৎপত্তি হয় তখন উপাদান দুটোর প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট পরিমাণে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়, তাই তাকেও সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্বকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যে অনুপাতগুলোর উপর ভিত্তি করে জগতের স্থিতি নির্ভর করে আছে তাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ ক্রয়া যায়, দ্রব্যের আকার বা ফর্মকেও সংখ্যা দিয়েই প্রকাশ করা যায়।

সঙ্গীতের প্রভাব : পিথাগোরাসের সময়ে সঙ্গীতের সঙ্গতি বা সামঞ্জস্য বা মিউজিকাল হারমোনি সম্পর্কে মানুষ আলাদাভাবে ভাবত না। জগতের মধ্যে যে সামঞ্জস্য বা সঙ্গতি আছে তার সাথে, মানে কসমিক হারমোনির মধ্যেই মিউজিক হারমোনি অন্তর্ভূক্ত ও অভিন্ন তেমনটাই মানুষ মনে করত। এদিকে সঙ্গিতের মধ্যকার সঙ্গতির মধ্যে যে গাণিতিক সূত্র কাজ করে তা প্রথম আবিষ্কার করেন পিথাগোরীয়রাই। সঙ্গীতে নোট বা সুরের যে পার্থক্যের কথা বলা হয়, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্রে যখন বিভিন্ন সুর বাজানোর সময় সুরগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় সেটা আসলে নির্দিষ্ট সময়ে কম্পন সংখ্যা বা কম্পাঙ্কেরই পার্থক্য। সঙ্গীতে যেবিরাম বা মিউজিকাল ইন্টারভালের ব্যাপারটি আছে তাও নির্ভর করে সংখ্যাগত অনুপাতের উপরেই। এভাবে মিউজিকাল হারমোনি বা সঙ্গীতের সঙ্গতি নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট গাণিতিক অনুপাতের দ্বারা। পিথাগোরীয়রা এটা আবিষ্কার করার পর ভাবে এই বিশ্বজগতের সঙ্গতিই একধরণের সঙ্গীতের সঙ্গতি। আর তাই সঙ্গীতের সঙ্গতির মত বিশ্বজগতের সঙ্গতিকেও প্রকাশ করা যায় সংখ্যার সাহায্যে। আর তাই তারা ধরে নেন জগতের মূলতত্ত্ব হল সংখ্যা। সংখ্যার থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি।

সীমাহীনকে রূপদান করে সীমা

মাইলেসিয়ান দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার দাবি করেছিলেন জগতের মূলতত্ত্ব হল সীমাহীন বা বাউন্ডলেস, এই সীমাহীন থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি। পিথাগোরীয়রা অ্যানাক্সিমেন্ডারের দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হন। তারা সেখানে সীমা বা লিমিটের ধারণাকে যুক্ত করে। তারা বলেন, এই সীমা বা লিমিট আসলে সীমাহীন বা বাউন্ডলেসকে আকার বা রূপ বা ফর্ম দান করে। এর উদাহরণ পাওয়া যায় সঙ্গীতে, যেখানে সংখ্যার অনুপাত বা নিয়ম আওয়াজকে রূপদানের মাধ্যমে সঙ্গীতের সৃষ্টি করে। সমগ্র বিশ্বের উপর এই ধারণাটিকে প্রসারিত করে তারা বললেন বিশ্বজাগতিক সঙ্গতির কথা, যেখানে সংখ্যার অনুপাত বা নিয়ম সীমাহীনকে রূপদান করে বিশ্বজগতের সঙ্গতি তৈরি করে, যেখানে এই সংখ্যার অনুপাত বা নিয়ম কাজ করে সীমা বা লিমিট হিসেবে। (বর্তমান বিজ্ঞান অনুসারে আমাদের এই মহাবিশ্বকে পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে পিথাগোরীয়দের সংখ্যার ধারণা, লিমিট মোটামুটিভাবে সেটাই, সেটাই তাদের মতে জগতের মূলতত্ত্ব।)

পিথাগোরীয়রা এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে ঘোষণা করলেন বস্তুগুলো হল সংখ্যা। জগৎ সংখ্যার দ্বারা গঠিত। থেলিস যেমন জল থেকে সব কিছুর উৎপত্তি বলেছিলেন, পিথাগোরাস সেভাবে বললেন সংখ্যা থেকে সব কিছু তৈরি হয়েছে। তবে এই সংখ্যা জড় বস্তু নয়, এটা অতীন্দ্রীয় বা সুপারসেন্সুয়াল। সংখ্যা থেলিসের জল, অ্যানাক্সিমেন্ডারের সীমাহীন ও অ্যানাক্সিমিনিসের বায়ু থেকে আলাদা। এটি যেকোন রকমের জড় থেকেই আলাদা। কিন্তু এর সাথে জড়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, এটি জড়কে সীমিত করে তাকে রূপ বা আকার প্রদান করে। তাই এও বলা যায় যে পিথাগোরীয়রা সংখ্যাকে মূল উপাদান বললেও জড় যে পূর্ব থেকেই আছে তাকেও শিকার করে নিয়েছে। আবার এও হতে পারে তারা আসলে জড়কে পূর্ব থেকে স্বীকার করেনি। সব জড় আসলে সংখ্যারই রূপ সেটাই মনে করেছেন। এই প্রসঙ্গে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি ধারণা সম্পর্কে বলতে খুব ইচ্ছা করছে।

ম্যাথমেটিকাল ইউনিভার্স হাইপোথিসিজ (MUH) ও পিথাগোরীয় চিন্তাধারার সম্পর্ক

কসমোলজিস্ট ম্যাক্স টেগামার্ক এর একটি স্পেক্যুলেটিভ TOE বা থিওরি অফ এভরিথিং আছে যা MUH বা ম্যাথমেটিকাল ইউনিভার্স হাইপোথিসিজ নামে পরিচিত। সেটা অনুসারে, মহাবিশ্বটা আসলে একটি ম্যাথমেটিকাল স্ট্রাকচার। এটা অনুসারে গণিত নিছকই মহাবিশ্বকে বর্ণনা করবার হাতিয়ার নয়, বরং এই মহাবিশ্বটাই একটি ম্যাথমেটিকাল স্ট্রাকচার, মহাবিশ্বে যেসব স্ট্রাকচারের গাণিতিকভাবে অস্তিত্ববান হওয়া সম্ভব হয়, আসলে তাই ফিজিকালি বা বাস্তবিকভাবে অস্তিত্ববান হয়, গাণিতিকভাবে কোন ঘটনা ঘটা, কোন স্ট্রাকচারের অস্তিত্ববান হওয়া সম্ভব না হলে বাস্তবে তা অস্তিত্ববান হওয়া সম্ভব নয়। এই ধারণা অনুসারে আমরা মানুষের মত অবজার্ভার বা পর্যবেক্ষকেরা আসলে সেলফ-এওয়ার সাবস্ট্রাকচারস বা SASs। যদি কোন ম্যাথমেটিকাল স্ট্রাকচার এতটাই জটিল হয় যে এটি (মানুষের মত) এমন সাবজেক্টিভ বা বিষয়ীবাদী (যে মনে করে তার স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইল আছে) সাবস্ট্রাকচার ধারণ করতে পারে, তাহলে সেই সাবস্ট্রাকচারদের (যেমন মানুষ) মনে হবে যে সে ফিজিকালি রিয়াল ওয়ার্ল্ড বা বাস্তব জগতে বাস করছে। এই ধারণাটি পিথাগোরাসের ম্যাথমেটিকাল মনিজম বা গাণিতিক অদ্বৈতবাদের একটি ফর্ম বলা যায় যা দাবি করেছিল সব কিছুই আসলে সংখ্যা। যাই হোক MUH এর অনেক সমালোচনাও আছে বিজ্ঞানমহলে।

আসলে পিথাগোরীয়রা এভাবে জগৎকে সর্বময় সংখ্যাই ভাবতেন ও সংখ্যাকে শুধু জগতের প্রকাশের মাধ্যম নয়, জগতকে “সীমিতকরণ” এর হাতিয়ার নয়, বরং সংখ্যারই প্রকাশ বলে ভাবতেন। তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ‘সব বস্তুই সংখ্যা’ এর ধারণা থেকে তাই মনে হয়। এখানে সীমা এর ব্যাপারটা হয়তো সংখ্যার সাথে অভেদ। সংখ্যা নিজেই একটি নিয়মে জগতের প্রকাশ ঘটিয়েছে সামঞ্জস্যতার নিয়মে, আর এই নিয়মই সীমা। হতেই পারে। পিথাগোরীয়দের দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটির দিকে যাওয়া যাক।

পিথাগোরীয়দের বস্তুকে সংখ্যা ভাবার কারণ

পদার্থমাত্রই সংখ্যা – এ কথা বলতে গিয়ে পিথাগােরীয়রা যে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সংখ্যা কথাটিকে যদি মূর্ত বস্তুর অর্থে না বুঝে আধুনিক অমূর্ত অর্থে বােঝা হয়, তা হলে পিথাগােরীয় মতের তাৎপর্য বােঝা যায়। তবে এর সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের একটি মতের সাদৃশ্য দেখা যায়। এ মতে, বস্তুর গাণিতিক ও সংখ্যাগত সম্পর্ক নির্ণয় যেকোনাে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের লক্ষ্য। পিথাগােরীয়রা হয়তাে ও মতেরই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন; কিন্তু সেদিনের অনগ্রসর ও অপরিপকু চিন্তার পরিবেশে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সুষ্ঠু ব্যাখ্যা ও প্রয়ােগের কথা কল্পনাই করা যেত না। সুতরাং অতি স্বাভাবিক কারণেই পিথাগােরীয়রাও তাদের মতবাদের সাহায্যে বস্তুর সাথে সংখ্যার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। সংখ্যা কীভাবে ভৌত দ্রব্য হিসেবে ব্যক্ত হতে পারে সে বিষয়ে তারা সুষ্ঠু ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন নি।

জগতের সবকিছুর অনুপস্থিতি কল্পনা করা যায়। কিন্তু সংখ্যার অনুপস্থিতি কল্পনা করা যায় না। পিথাগােরীয়রা দেখান যে, ওজনহীন এক জগতের কথা ভাবা যায়: কপ. রস-গন্ধ ছাড়া একটি জগৎও কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু সংখ্যাহীন জগতের কথা আমরা কখনও ভাবতে পারি না। তাই পিথাগােরীয়ানরা মনে করেন যে, সংখ্যাই হল জগতের মূল উপাদান। পিথাগােরীয়ানরা জগতের শৃঙ্খলা, ঐক্য, সামঞ্জস্যতা নিয়মানুবর্তিতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা দেখাতে চেষ্টা করেন যে, প্রকৃতির মধ্যে সুনিপুণ নিয়ম-শৃঙ্খলা বিদ্যমান। এখানে রয়েছে সামঞ্জস্যতা। সংখ্যা ছাড়া এই শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যা করা চলে না। তাছাড়া প্রকৃতিতে বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ বা মাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। নির্ধারিত মাত্রা বা পরিমাণ কম-বেশী হলে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হতাে। জগতের এই মাত্রা বা পরিমাণ সংখ্যা দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়। সংখ্যা ছাড়া বস্তু বা বিষয়সমূহের মধ্যকার সম্বন্ধের কথা চিন্তা করা চলে না। বস্তুসমূহের বিস্তার, আয়তন, অবস্থিতি, পারস্পরিক দূরত্ব ও সংযােগ ইত্যাদি সংখ্যা দ্বারাই প্রকাশ করা হয় । এমনকি জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সংগীত এদের প্রত্যেকটি বিষয়ও সংখ্যার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় বলে পিথাগােরীয়ানরা মন্তব্য করেন। 

এরিস্টোটল বলেছেন, পিথাগোরীয়রা মনে করত সংখ্যার উপাদান হল যুগ্ম বা জোড় ও অযুগ্ম বা বিজোড়। এদের মধ্যে জোড় হচ্ছে অসীম, আর বিজোড় হচ্ছে সসীম। এর মধ্যে ১ সংখ্যাটি অসীম ও সসীম উভয় থেকেই উদ্ভূত কারণ এটি জোড় ও বিজোড় উভয়ই। এই ১ সংখ্যা থেকেই তাদের মতে সব সংখ্যা ও সমগ্র বিশ্বজগতের উদ্ভব। কপলস্টোন বলছেন, পিথাগোরীয়রা সংখ্যাকে স্থানিকভাবে গণ্য করেছেন। ১ হল বিন্দু, ২ হল রেখা, ৩ হল তল বা সারফেস, ৪ হল ঘন। তাই যখন বলা হয় সব কিছুই সংখ্যা, তখন এর অর্থ হচ্ছে সব বস্তুই স্থানে অবস্থিত বিন্দু বা এককের (units) দ্বারা গঠিত, যেগুলোকে সংযুক্ত করলে একটি সংখ্যা গঠিত হয়। তারা এই বিন্দু, রেখা, তল ও ঘন নির্দেশক চারটি সংখ্যার যোগফল (১+২+৩+৪) বা ১০ সংখ্যাটিকে পবিত্র গণ্য করে। আর নিচ থেকে উপরে এগুলোকে বিন্যাস করে, অর্থাৎ নিচে ৪টি বিন্দু, তার উপর ৩টি, তার উপর ২টি ও তার উপর ১টি বিন্দুকে সাহিয়ে যে পিরামিডের আকার তৈরি হয় তাকেও পবিত্র বলে মনে করে। এই পিরামিডের নামে পিথাগোরীয়রা শপথ গ্রহণ করত। (Tetractys of the Decad)।

এখান থেকে বোঝা যায় কিভাবে তারা সংখ্যাকে জ্যামিতির সাথে সম্পর্কিত করে, আর জ্যামিতির সাথে রয়েছে জড়ের গঠনের সম্পর্ক। তারা এভাবে সংখ্যার ধারণা প্রয়োগ করে জড় সত্তার বিন্যাসের ক্ষেত্রে। কয়েকটি বিন্দুকে পাশাপাশি রাখলে রেখা, কয়েকটি রেখাকে পাশাপাশি রাখলে তল, কয়েকটি তলকে পাশাপাশি রাখলে একটি বস্তুর সৃষ্টি হয়। তাই বিন্দু, রেখা, তল এসব বাস্তব একক, কাল্পনিক নয়, যার দ্বারা সব প্রাকৃতিক বস্তু গঠিত। আর এভাবে সব বস্তু হল সংখ্যা। প্রতিটি জড় তাদের মতে এই ৪ সংখ্যাটির প্রকাশ। কারণ তিনটি মৌলিক উপাদান বিন্দু, রেখা ও তল থেকে চতুর্থ পদ রূপে প্রতিটি জড়ের উদ্ভব। এখন কথা হল বস্তুকে সংখ্যার সাথে অভিন্ন কল্পনায় কার প্রভাব বেশি? সংখ্যাকে জ্যামিতির আকারের মধ্য দিয়ে প্রকাশ নাকি সঙ্গীত সম্বন্ধীয় আবিষ্কার? এক্ষেত্রে একেকজন একেক কথা বলেছেন। বার্নেট বলেন সঙ্গীত নিয়ে আবিষ্কারের প্রভাব বেশি, আর কপলস্টোন বলেন সংখ্যাকে জ্যামিতির আকারের মধ্য দিয়ে প্রকাশের প্রভাব বেশি।

গণিত সম্পর্কে পূর্বের ভ্রান্ত ধারণা ও সেখান থেকে পিথাগোরাসের চিন্তার বিকাশ

অধিকাংশ বিজ্ঞান সূচনালগ্নে কিছু না কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, যা থেকে সেসব বিজ্ঞান একধরনের কাল্পনিক তাৎপর্য লাভ করেছে। জ্যোতির্বিদ্যা জড়িত ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে, রসায়নবিদ্যা আলকেমির (alchemy) সঙ্গে। গণিতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আরো বেশি সূক্ষ্ম একধরনের ভ্রান্তির। মনে করা হতো গাণিতিক জ্ঞান নিশ্চিত, নির্ভুল এবং বাস্তব জগতে প্রয়োগযোগ্য। তা ছাড়া, তা অর্জিত হয় শুধু চিন্তার দ্বারা, কোনো পর্যবেক্ষণের দরকার হয় না। ফলে গাণিতিক জ্ঞান থেকে একটি আদর্শ তৈরি হয়, দৈনন্দিন ব্যবহারিক জ্ঞান সে আদর্শের চেয়ে অনেক নিম্নমানের। গণিতের ওপরে ভিত্তি করে মনে করা হতো চিন্তা ইন্দ্রিয়ের চেয়ে এবং সংজ্ঞা পর্যবেক্ষণের চেয়ে শ্রেয়। ইন্দ্রিয়জগতের সঙ্গে গণিতের যদি বনিবনা না হয়, দোষটা গণিতের নয়, ইন্দ্রিয়জগতেরই। গণিতজ্ঞের আদর্শের নিকটবর্তী হবার নানা রকম পথ ও পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, তার ফলে যেসব পরামর্শ পাওয়া গেছে সেগুলো অধিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বে অনেক ভ্রান্তির উৎস হয়েছে। দর্শনের এই ধরনটির শুরু পিথাগোরাস থেকে।

পিথাগোরাস বলেছিলেন সব বস্তুই হচ্ছে সংখ্যা। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কথাটি যৌক্তিকভাবে অর্থহীন, কিন্তু তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা ঠিক অর্থহীন নয়। সঙ্গীতে সংখ্যার গুরুত্ব তারই আবিষ্কার আর সঙ্গীত ও পাটিগণিতের মধ্যে তিনি যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন তা আজও স্বরাত্মক মধ্যক (harmonic mean) ও সংগীতের সুরের ক্রমান্বয়িক উত্থান ও পতন (harmonic progression) – এই দুটো গাণিতিক পরিভাষার মধ্যে টিকে আছে। তিনি মনে করতেন সংখ্যাগুলো একেকটা আকৃতি-চাকতি বা খেলার তাসে যেমন থাকে। আমরা এখনো সংখ্যার বর্গ, ঘন ইত্যাদির কথা বলে থাকি। এই শব্দগুলো আমরা পেয়েছি পিথাগোরাসের বদৌলতেই। চতুষ্কোণ সংখ্যা, ত্রিকোণ সংখ্যা, পিরামিডাকৃতি সংখ্যা ইত্যাদির কথাও তিনি বলেছিলেন। একটি প্রশ্নকে আকৃতি দেওয়ার জন্য এই সব সংখ্যার নুড়ির (বা আমরা সাধারণত যেগুলোকে খুঁটি বলি) দরকার হতো। সম্ভবত পিথাগোরাস পৃথিবীকে পারমাণবিক মনে করতেন এবং মনে করতেন যে পৃথিবী বিভিন্ন আকৃতির পরমাণু দ্বারা গঠিত বস্তুকণা বা অণুর তৈরি। নন্দনতত্ত্বে যেমন পাটীগণিত মৌলিক জিনিস, তেমনি তিনি পাটিগণিতকে পদার্থবিদ্যার মূল পাঠ হিসেবে পাওয়ার আশা করেছিলেন।

সংখ্যার যুগ্ম ও অযুগ্ম উপাদানের ধারণা

কেন পিথাগোরীয়রা সংখ্যাকে যুগ্ম ও অযুগ্ম উপাদানে ভাগ করে প্রথমটিকে সীমাহীন ও দ্বিতীয়টিকে সীমিত হিসেবে গণ্য করে তার একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়। পিথাগোরীয়দের মতে এই সীমিত জগৎ এক অসীম বায়ুর দ্বারা পরিবেষ্টিত, যা এই সীমিত জগৎ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে (মাইলেসীয় দার্শনিক অ্যানাক্সিমিনিসের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে)। তাই জগতের বস্তুগুলোর মধ্যে সীমা ও অসীমের মিশ্রণ রয়েছে। তাই সীমা ও অসীম হল জগতের দুই উপাদান, এদিকে সংখ্যার দুই উপাদান যেহেতু যুগ্ম ও অযুগ্ম সংখ্যাগুলো, ও সংখ্যা ও বস্তু যেহেতু তাদের কাছে অভিন্ন, তাই এরা এদের একটিকে (যুগ্ম) অসীম ও আরেকটিকে (অযুগ্ম) সসীম হিসেবে দাবি করে। এদিকে এরিস্টোটল বলছেন, কোন কোন পিথাগোরাস অনুরাগী সংখ্যার ও জগতের উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরস্পর বিপরীতের একটি তালিকা করেন, যেমন সীমিত ও সীমাহীন, এক ও বহু, জোড় ও বিজোড়, আলোক ও অন্ধকার, ভাল ও মন্দ, ডান ও বাম, সোজা ও বাঁকা, পুরুষ ও নারী, চতুর্ভূজাকার ও আয়তাকার, স্থির ও গতি। বস্তু জগতের পরস্পর বিপরীত ধারণা অসীম ও সসীমের সাথে তারা সংখ্যার দুই বিপরীত ধারনা যুগ্ম ও অযুগ্মকে সম্পর্কিত করে।

বিশেষ বিশেষ বস্তুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যার আরোপ

পিথাগোরীয়রা বস্তুর সাথে সংখ্যাকে অভিন্ন ধরেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা বিশেষ বিশেষ বস্তুর উপর আরোপ করলেন বিভিন্ন সংখ্যাকে। অনেকের মতে এই আরোপনে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম দেখা যায় না, বরং দেখা যায় চূড়ান্ত রকমের খামখেয়ালিপনা। আগেই বলা হয়েছে ১ দিয়ে বিন্দু, ২ দিয়ে রেখা, ৩ দিয়ে তল, ৪ দিয়ে ঘন বোঝানো হত, এরপর ৫ দিয়ে জাগতিক গুণাবলি, ৬ দিয়ে প্রাণ, ৭ দিয়ে বুদ্ধি, স্বাস্থ্য, ভালবাসা ও জ্ঞানকে বোঝানো হত। এখানে ক্রমান্বয়ে ১ থেকে ৭ এ জগতের বিবর্তনের একরকম আভাসও পাওয়া যায়। যেমন, ১ বা বিন্দু থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে, ১ বা বিন্দু বা মাত্রাহীন থেকে প্রথমে তৈরি হল ২ বা রেখা যা একমাত্রি, সেখান থেকে তৈরি হল ৩ বা দ্বিমাত্রিক তল, সেখান থেকে তৈরি হল ৪ বা আমাদের দৃশ্যমান তৃমাত্রিক ঘনজগৎ। সেখান থেকে আসল ৫ বা যাবতীয় জাগতিক গুণাবলি, এই বিশ্বজগৎ। সেখান থেকে তৈরি হল ৬ বা প্রাণ, আর এরপর আসল ৭, প্রাণের বিপর্তনের মাধ্যমে বিকাশ হল বুদ্ধি, স্বাস্থ্য, ভালবাসা, জ্ঞান।

কোন বস্তুর উপর কোন সংক্যা আরোপ করা হবে তা নিয়ে পিথাগোরীয়দের মধ্যে বিতর্কও ছিল। কারও মতে ন্যায়পরায়ণতার সংখা হুয়া উচিৎ ৪, কারণ ন্যায়পরায়ণতা মানে হল সমানের বদলে সমানের প্রত্যার্পন। তাই ২ আর ২ যোগ করে ৪ হবে ন্যায়পরায়ণতা। আবার যেহেতু ৩ এর বর্গ ৯, তাই অনেকের মতে ৯ হল ন্যায়পরায়ণতার সংখ্যা। পিথাগোরীয়রা মনে করত পৃথিবী গোলাকার (globoid)। আর এটি বিশ্বজগতের কেন্দ্র নয়। তাদের মতে পৃথিবী কেন্দ্রস্থ এক অগ্নির চারদিকে আবর্তিত হচ্ছে। তবে এই অগ্নি সূর্য নয়। পিথাগোরীয়দের মতে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রও পৃথিবীর মতই সেই কেন্দ্রস্থ অগ্নির চারদিকে আবর্তিত হয়। পৃথিবী তার বাইরের সীমাহীন থেকে শ্বাসরূপে বাতাসকে গ্রহণ করে। এই বাতাসকেই অসীম বলা হয়েছে। এখানে পিথাগোরীয়দের উপর অ্যানাক্সিমিনিস এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়।

পিথাগোরীয়দের ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

পিথাগোরীয় সম্প্রদায়কে যতটা না দার্শনিক বলে মনে হয়, তার তুলনায় একে ধর্মীয় সম্প্রদায় বললে অত্যুক্তি হবে না। এদের ধর্মীয় আন্দোলন ছিল একরকম নৈতিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। জেলার বলেন, পিথাগোরীয়দের মূলনীতি, তত্ত্ব ও আচার-প্রণালী – সব কিছুর মূলে নিহিত ছিল জন্মান্তরবাদ। জন্মান্তরবাদকে কেবল পিথাগোরীয়দের দর্শনের সাথে সম্পর্কিত একটি আনুষঙ্গিক বস্তু হিসেবে ভাবলে ভুল হবে, এটা পিথাগোরীয়দেরকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছিল। পিথাগোরীয়রা জীবের বারবার জন্মগ্রহণের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের উপনিষদের ধারণার মত জীবাত্মার প্রাণীদেহ ধারণের ব্যাপারটাও তাদের দর্শনে ছিল। অরফিক (Orphic) ধর্মউপনিষদের মত পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের লক্ষ ছিল এই ভবচক্র, অর্থাৎ জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে ঐশ্বরিক আনন্দের মধ্যে প্রবেশ করা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান লাভ করা ছাড়াও, বুদ্ধির অনুশীলন, বিজ্ঞান ও দর্শনের অনুশীলন, ও বিশ্বের মুল তত্ত্বের অনুধ্যান – এসব আত্মার মুক্তিলাভের পক্ষে উপযোগী বলে তারা মনে করত। এই জাতীয় ধারণা থেকেই তাদের মধ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টার শুরু হয়।

পিথাগােরীয় সম্প্রদায় ছিল এক অতীন্দ্রিয় (Mystic) সম্প্রদায়। এই দার্শনিকেরা নিজেদের ধর্মসম্পর্কীয় আচার অনুষ্ঠানের এবং অলৌকিক ক্রিয়া কর্মের প্রবর্তন করেন। অলৌকিকতার প্রতি ছিল তাদের এক প্রবল অনুরাগ। সেই কারণে পিথাগােরাস্রে জীবনকে কেন্দ্র করে একাধিক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত। তার সম্পর্কে বলা হত যে, তিনি একই দিনে একই সময়ে মেটাপন্টাম্ (Metapontum) এবং ক্রোটোনায় (Crotona) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বন্য ভল্লুকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে পােষ মানিয়েছিলেন, যার ফলে ভল্লুকটি হয়ে গেল নিরামিষাশী। একবার অলিম্পিক খেলায় তিনি দেখিয়েছিলেন। যে, তার উরু সােনায় তৈরি। এই জাতীয় অনেক অলৌকিক গল্পই পিথাগােরাস্ সম্পর্কে শােনা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিকেরা এ ধরনের অলৌকিক কাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন।

পিথাগােরাস্ ধর্মমূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল অনেক অতিকথামূলক কাহিনী (Myths), যেমন ব্যক্তির অপর এক জগতে শেষ বিচার, তার পরে পুরস্কার বা শাস্তি, এবং তারপরে অপর এক জীবনে প্রত্যাবর্তন। এই সব বিষয় যদিও অ-বিজ্ঞানােচিত তবু তৎকালীন প্রচলিত ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে একেবারে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে গতানুগতিক ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে পিথাগােরীয়দের ধর্মীয় চিন্তার যে ব্যাপারে পার্থক্য লক্ষ করা যায় তা হল, শােধন বা পবিত্রকরণ (Purification) সম্পর্কে তার তার নতুন ব্যাখ্যা। অরফিক ধর্মে জাদু সম্পকীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মার শােধনকার্য সম্পন্ন হত। আত্মার মুক্তিলাভের সম্ভাবনা কম, না বেশি, তা নির্ভর করত উৎসর্গ এবং জাদুর দ্বারা মুগ্ধ করার উপর। কিন্তু পিথাগােরাস মনে করতেন যে, গণিত এবং সঙ্গীতের আলােচনাই আত্মার শােধন ও সামঞ্জস্য লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। আত্মােপলদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশই যে আত্মার শােধনের উপায়, পিথাগােরাস্ প্রদত্ত এই ব্যাখ্যাই ধর্মের ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি এবং ধর্মের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান যে অপ্রাসঙ্গিক নয়, এই ব্যাখ্যা এই বিষয়টিও সূচনা করে।

তিনি একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন যার মূলনীতি ছিল আত্মার পুনর্জন্ম ও শিমজাতীয় (bean) খাদ্য খাওয়ার পাপ। তার আত্মার পুনর্জন্ম সম্পর্কে এই ডায়ালোগটি বিবেচ্য –
ভাঁড় : বুনো হাঁস সম্পর্কে পিথাগোরাসের অভিমত কী?
ম্যালভোলিও : তার মত হচ্ছে, আমাদের পিতামহী বা মাতামহীর আত্মা দৈবক্রমে কোন পাখির রূপ ধারণ করতে পারে।
ভাঁড় : তার অভিমত সম্পর্কে তোমার এরূপ চিন্তা করার যুক্তি কী?
ম্যালভোলিও : আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার আত্মা সম্পর্কে চিন্তা করি, এবং কোনভাবেই তার অভিমত অনুমোদন করিনা।
ভাঁড় : বিদায় তাহলে। তাহলে তুমি অন্ধকারেই থাকো। আমি তোমার বুদ্ধিকে অনুমোদন না করা পর্যন্ত তুমি পিথাগোরাসের অভিমত সমর্থন করবে না। (Twelefth Night)

পিথাগোরাসের ধর্ম মূর্ত রূপ লাভ করে একটি ধর্মীয় জীবন বিধানের মধ্য দিয়ে, সে বিধানটি কোথাও কোথাও রাষ্ট্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল এবং সন্ন্যাসরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু অদীক্ষিত লোকজন শিম খাওয়ার জন্য লোলুপ থেকে যায় এবং বিদ্রোহ করে। পিথাগোরীয় জীবন-বিধানের কয়েকটি নিয়ম এখানে উল্লেখ করা যাক। পিথাগােরাসের ধর্মীয় বিধানের উল্লেখযােগ্য কিছু বিধান হচ্ছে – 

  • ১. শিম খাওয়া থেকে বিরত থাকবে।
  • ২. মাটিতে পড়ে থাকা কোনাে কিছু ওঠাবে না।
  • ৩. সাদা মােরগ স্পর্শ করবে না।
  • ৪. রুটি ভাঙবে না।
  • ৫. দাড়িপাল্লার তুলাদণ্ড অতিক্রম করবে না।
  • ৬. লােহা দিয়ে আগুন নাড়বে না।
  • ৭. সম্পূর্ণ রুটি খাবে না।
  • ৮. ফুলের মালা ছিড়বে না।
  • ৯. অপ্রশস্ত জায়গায় বসবে না।
  • ১০. হৃৎপিণ্ড খাবে না।
  • ১১. রাজপথে বেড়াবে না।
  • ১২. চড়ুইকে ঘরের চালে বাসা বাঁধতে দেবে না।
  • ১৩. আগুন থেকে পাত্র তােলার পর ছাইয়ের মধ্যে আগুনের কোনাে চিহ্ন রাখবে না, ছাইগুলাে নাড়াচাড়া করবে।
  • ১৪. আলাের পাশে রাখা কোনাে আয়নায় মুখ দেখবে না।
  • ১৫. শয্যা ত্যাগ করার পর বিছানার চাদর ভাজ করে রাখবে এবং চাদর থেকেশরীরের চিহ্ন মুছে ফেলবে। (Burnet-এর Early Greek Philosophy থেকে উদ্ধৃত। )

এই হিতােপদেশসমূহ ছিল প্রাচীন ট্যাবু-ধারণার নিদর্শন। মনে করা হয় পিথাগোরাসের গ্লুকোজ-সিক্স-ফসফেট-ডিহাইড্রোজিনেস ডেফিশিয়েন্সি ছিল। এই রোগে রক্তকণিকায় একটি প্রয়োজনীয় রেচকের (Enzyme) অভাব থাকে। ফলত কোন কোন বস্তুর সংস্পর্শে এলে রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়, শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয় এবং খুব শরীর খারাপ হয়। এই বস্তুর প্রধান হলো শিম (ফাঁকা শিম)। ভূমধ্যসাগরীয় গ্রিকদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা খুব বেশি। পিথাগোরীয়দের কাছে শিম নিষিদ্ধ বস্তু হওয়ার এটাই কারণ হয়ে থাকবে। পিথাগােরীয় নৈতিক আদর্শ ছিলাে অত্যন্ত কৃচ্ছতাবাদী নৈতিক আদর্শ। অত্যন্ত কঠোর ছিলাে তার অনেক নীতি-আদর্শ। এগুলাে মানা সাধারণের জন্য ছিলাে অত্যন্ত কষ্টের। তাই সকলে সব আদর্শ হয়তাে মেনে চলেননি। এমনকি পিথাগােরাস নিজেও তার প্রবর্তিত বিধানের সবকিছু মেনে চলেননি বলে প্রমাণ রয়েছে। যেমন তিনি মাংস ভক্ষণের প্রতিও নাকি নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু নিজে সম্পূর্ণভাবে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন নি। পিথাগােরাস ন্যায়বিচার বা ন্যায়ধর্ম (justice) নিয়েও কথা বলেছিলেন। তিনি গাণিতিকভাবে ন্যায়ধর্মকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, ন্যায়ধর্ম হলাে সমানুপাতিক কর্ম। কোন মানুষ যদি কাউকে আঘাত করে তাহলে ঐ ব্যক্তিকেও তদ্বারা আঘাত করার পদ্ধতিই হলাে ন্যায়বিচার।

পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ে ধর্মীয় আত্মসমীক্ষার ওপর জোর দেয়া হতাে। দিনের শেষে সম্প্রদায়ের সদস্যবর্গ তাদের সারাদিনের কাজকর্মের হিসাব-নিকাশ করতেন। যাবতীয় সম্পদ তারা যৌথভাবে ভােগ করতেন। কোনাে কোনাে চিন্তাবিদের মতে, প্লেটো তার সাম্যবাদী আদর্শে পিথাগােরীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পিথাগােরাস নারী পুরুষের সমান অধিকারের নীতিকে অনুমােদন করেন। তার মতে, নারী-পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের সৃষ্ট জীবসত্তা। দেহান্তরের অবিরাম প্রক্রিয়ায় ইহা মানব মানবী রূপে কখনও কখনও অবস্থান করে। তাই নারী-পুরুষকে প্রকৃতিগতভাবে উচ্চতর নিম্নতর এভাবে বিভক্ত করা চলে না। এমন হতে পারে যে, যে নারী-পুরুষকে আমরা একত্রে অবস্থান করতে দেখছি তাদের একজনের আত্মা তার পূর্ববর্তী অবস্থায় ইতর প্রাণির মধ্যে ছিলাে এবং অন্যজনের আত্মা ভালাে মানুষের মধ্যে বা উচ্চতর জীবনের মধ্যে অবস্থান করছিলাে। এই অবস্থা এমন যে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, কার আত্মা কোথায় ছিলাে এবং কোথায় থাকবে। তবে ব্যক্তিগত অর্জন তথা কর্মফলই নারী পুরুষ উভয়ের আত্মার পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারণ করবে বলে পিথাগােরীয়ানরা বিশ্বাস করতেন। পিথাগােরাস এমন একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে নারী-পুরুষের সমঅধিকার স্বীকৃত। পিথাগােরীয়ানদের মধ্যে নারী-পুরুষ বৈষম্য ছিলাে না। সম্পদের প্রতিও ছিলাে সকলের সম অধিকার। এমনকি কোন গাণিতিক বৈজ্ঞানিক আবিস্কারকেও তারা যৌথ আবিষ্কার বা যৌথ অর্জন বলে গ্রহণ করতেন। কেননা তারা বিশ্বাস করতেন যে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অবদানেই অর্জিত হতে পারে সভ্যতার আশির্বাদসমূহ। আর একধরনের মরমিবাদী চিন্তা থেকে মনে করা হতো যে সেগুলোর পেছনে আছেন পিথাগোরাস। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও এ-রকম ভাবা হত। মেটাপন্টিওনের লোক হিপ্পাসোস (Hippasos) নামে একজন সদস্য এই নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, এই পাপের ফলে ঐশ্বরিক অভিশাপে তারা জাহাজডুবির শিকার হয়েছিলেন। এভাবে নারী-পুরুষ সমতার এই পিথাগােরীয় মনােভাবও মূলত তাদের মরমী আদর্শ দ্বারা উৎসারিত ছিলাে। ঈশ্বর প্রেমের ওপরই তারা আত্মার উৎকর্ষতা বিচার করতেন। নারী পুরুষের বা লিঙ্গভিত্তিক উৎকর্ষতা বিচার এখানে গ্রহণযােগ্য ছিলাে না। যে কেউ তার আত্মার বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য অবান্তর।

পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ রাজনীতিবিদ ছিল না কিন্তু পিথাগােরাসের কিছু কিছু রাজনৈতিক চিন্তাধারার উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি খুব ছােট সম্প্রদায়কে (Communities) আদর্শ হিসেবে মনে মনে গ্রহণ করতেন, যেখানে কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব থাকবে না। সম্পত্তি হবে সমগ্র সম্প্রদায়ের যাতে সকলের অধিকার থাকবে। শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে স্ত্রীলােকদের সমান সুযােগ দেওয়া হবে। সঙ্গীত এবং গণিতে তারা সামাজিক জীবনে স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করবে। বৃহত্তর রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে, সম্প্রদায়কে বৃহত্তর রাষ্ট্রের নীতিকে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। কাজেই নিজের প্রত্যক্ষ গণ্ডির বাইরের সমস্যা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে সম্প্রদায়কে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। পিথাগােরীয় সম্প্রদায় রাজনীতি না করলেও ক্রোটনার সাধারণ নাগরিকদের উপর তারা তাদের নিয়মকানুন জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করত। বস্তুত এই সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ মনে করত যে, তারা দেশবাসীর আধ্যাত্মিক পথ-নির্দেশকের ভূমিকা গ্রহণ করবে, অর্থাৎ কিনা শাসন করবে। এর ফলে দেশবাসীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পিথাগােরীয় সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়, ফলে অনেক সভ্যকে নির্যাতন বরণ করতে হয়। পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ যেখানে একত্র মিলিত হত, তাদের সেই সমাবেশ স্থান পুড়িয়ে দেওয়া হল। সম্প্রদায়ের বহু সভ্য নিহত ও বিতাড়িত হল। সম্প্রদায় ভেঙে গেল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ থেকে ৪৩০ অব্দে এই ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক বছর পরে সম্প্রদায় পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়।

পিথাগোরাসের মরমীবাদ, জগতের মিথ্যাত্ব এবং আত্মার অমরত্ব ও পুনর্জন্ম

কর্নফোর্ড বলেন (From Religion to Philosophy, পৃ ২০১), পিথাগােরাসের দার্শনিক মতবাদ হলাে সেই মরমি ঐতিহ্যের প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী, যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক ধারার বিপরীতে স্থাপন করেছি। কর্নফোর্ড পারমিনাইডিসকে (Parmenides) বলেছেন যুক্তিশাস্ত্রের আবিষ্কর্তা। তিনি মনে করেন পারমিনাইডিস পিথাগোরাসবাদের এক দলছুট শাখা। তিনি আরো মনে করেন, প্লেটো নিজেও তার অনুপ্রেরণার মূল উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন পিথাগোরীয় দর্শনে। কর্নফোর্ড বলেন, পিথাগােরিয়বাদ হচ্ছে, অর্ফিক মতবাদের একটি সংস্কারধর্মী আন্দোলন, আর অর্ফিক মতবাদ হচ্ছে, ডায়োনিসীয় রহস্যবাদের একটি সংস্কারধর্মী আন্দোলন। দর্শনের ইতিহাসে বৌদ্ধিক মতবাদের এবং মরমিবাদের বিরােধিতা চিরন্তন। অলিম্পিক দেব-দেবী এবং অন্যান্য অ-ইন্দো-ইউরোপীয় দেব-দেবীর মধ্যে বিরােধিতা হিসেবে বৌদ্ধিক ও মরমিবাদের বিরােধিতা গ্রিকদের মধ্যে প্রথম দেখা দেয়। নৃ-বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অ-ইন্দো-ইউরোপীয় দেব-দেবীর সঙ্গে আদি বিশ্বাসের অধিকতর সাদৃশ্য ছিল। চিন্তার ইতিহাসের এই বিভাজনে পিথাগােরাস মরমিবাদের পক্ষ অবলম্বন করেন, যদিও তার মরমিবাদ বিশেষ এক ধরনের বৌদ্ধিক মরমিবাদ। তিনি নিজেকে অর্ধ-ঐশ্বরিক চরিত্রের অধিকারী বলে মনে করতেন। তিনি খুব সম্ভব বলেছিলেন, “এই পৃথিবীতে মানুষ এবং দেব-দেবী আছে, এবং পিথাগােরাসের মতাে মানুষও আছে।’ কর্নফোর্ড বলেন, তিনি যে মতবাদকে উৎসাহিত করতেন তা হচ্ছে অ-পার্থিব, ঈশ্বরের অদৃশ্য ঐক্যে সকল মূল্যবােধ স্থাপন, এবং দৃশ্যমান জগতকে মিথ্যা ও মায়াময় বলে নিন্দাজ্ঞাপন। এই দৃশ্যমান জগৎ এমন পঙ্কিল যেখানে স্বর্গীয় আলােকরশ্মি ভেঙে যায় এবং কুয়াশা ও অন্ধকারে তা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।’

পিথাগােরাসের ধর্মতত্ত্ব বলতে যা বােঝায় তা তার নৈতিক নিয়মাবলী এবং আত্মা সংক্রান্ত মতেরই সমন্বয়। পিথাগােরাস আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি আত্মাকে আধ্যাত্মিক সত্তা বলে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, দেহ হচ্ছে আত্মার বন্দিশালা। দেহকে তিনি মন্দির স্বরূপও মনে করেন । আত্মা হচ্ছে এই মন্দিরের পূজ্য বা আরাধ্য সত্তা। তবে আত্মাকে দেখা যায় না। কেননা ইহা এক অদৃশ্য আধ্যাত্মিক সত্তা । পিথাগােরানগণ এক অদ্ভুত ধরনের পােশাক পরিধান করতেন। কেননা আত্মার মন্দিরকে যথােপযুক্তভাবে আচ্ছাদিত করে রাখা জরুরি বলে তারা মনে করতেন। ডিকাইআরকোস বলেন, পিথাগােরাস আমাদের সর্বপ্রথম এই কথাগুলো বলেন, “আত্মা হচ্ছে একটি অমর বস্ত এবং এই আত্মা অন্যান্য প্রকার জীবন্ত বস্ততে রূপান্তরিত হয়। পুনরায় অস্তিত্বশীল সবকিছুই একটি বিশেষ চক্রের বিবর্তন ধারায় আবার জন্মগ্রহণ করে। কোনাে কিছু সম্পূর্ণরূপে নতুন নয়। জীবন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী সবকিছুকেই স্বগােত্রীয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।” (From Religion to Philosophy, পৃ ২০২)। অর্থাৎ সব প্রাণিই সমগােত্রীয়, বলা হয় সেন্ট ফ্রান্সিসের মতাে পিথাগােরাস প্রাণীকে ধর্মোপদেশ দিতেন। 

পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের অনুরাগীবৃন্দ যে নৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিল, তাকে কৃচ্ছতাবাদ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। পিথাগােরীয় সম্প্রদায় সভ্যদের চরিত্রের নৈতিক শুচিতার উপর গুরুত্ব আরােপ করত। সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ পশু-মাংস খাদ্যরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতেন। সীম, কড়াইশুটি , মটরশুটি প্রভৃতি আহার করা নিষিদ্ধ ছিল। তারা মনে করতেন দেহ আত্মার কারাগার স্বরূপ। কিন্তু আত্মহত্যার দ্বারা মুক্তিলাভের প্রচেষ্টাকে তারা সমর্থন করতেন না। কেননা পিথাগােরাস ঈশ্বরের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর সকল আত্মার স্রষ্টা। পিথাগোরীয়রা মনে করতেন পশু যেমন, মানুষের সম্পত্তি, মানুষও ঈশ্বরের সম্পত্তি, ঈশ্বরের অস্থাবর সম্পত্তি , যেমন মেষপাল। ঈশ্বরের অনুমতি ব্যতিরেকে তাদের খোঁয়াড় ছেড়ে চলে যাবার কোন অধিকার নেই। এই কারণে মানবজীবনকে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। পিথাগােরাস ও তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, যখন ঈশ্বর আত্মা সৃষ্টি করেছিলেন তখন আত্মা ছিলাে বিশুদ্ধ। কোন পাপ বা অশুভত্ব তার মধ্যে ছিলাে না। কিন্তু দেহান্তরের প্রক্রিয়ায় আত্মার মধ্যে বিভিন্ন পাপ-পঙ্কিলতা স্থান পায়। মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হলাে আত্মাকে পবিত্র করে দেহান্তর বা জন্মান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ করে ঈশ্বরের নিকট বিশুদ্ধ আত্মাকে ফিরিয়ে দেওয়া। আত্মা বিশুদ্ধ না হলে জন্মচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া মানবজীবনের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। এতেই মানবাত্মা পরম তৃপ্তি লাভ করতে পারে। একারণে পিথাগােরাস তার অনুসারীদের ঐশ্বরিক প্রেমে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি কঠোর কৃচ্ছতা সাধনসহ বিভিন্ন প্রকার সাধনা-প্রক্রিয়া প্রবর্তন করেন। তার অনেক শিষ্যই তার প্রবর্তিত নীতি তথা সাধন প্রক্রিয়া অনুশীলন করতে থাকেন। ফলে এক মরমী গােষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এই মরমী গােষ্ঠী এক সন্যাস রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেয়। কিন্তু অচিরেই তারা প্রতিরােধের মুখে পড়ে প্রতিহত হন। নীতিতত্ত্ব ও আত্মতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই পিথাগােরীয় ধর্মমত মূলত অর্ফিক মতের দ্বারা প্রভাবিত, অর্ফিক ধর্মমত অনুসারীরাও আত্মার দেহান্তর বা জন্মান্তরের ধারণায় বিশ্বাসী ছিল এবং দেহ থেকে আত্মাকে স্বতন্ত্র ও উন্নত সত্তা হিসেবে বিশ্বাস করত। দেহান্তরের প্রক্রিয়ায় আত্মা তার বিশুদ্ধতার পরিবর্তন করে এই ধারণাও অর্ফিকদের মধ্যে পাওয়া যায়। অর্ফিকগণও বিশ্বাস করত যে, আত্মা অমর, দেহ ধ্বংস হয়, কিন্তু আত্মা ধ্বংস হয় না। তাদের মতে, জন্মের ফলে আত্মা তার যে স্বর্গীয় পবিত্রতা হারায়, মৃত্যুর পর তা হেডেসে (Hades) পুনরায় পরিশােধিত হয় এবং পরে পুনরায় পৃথিবীতে নতুন জন্মলাভ করে। পিথাগােরীয় মতে, আত্মার বিশুদ্ধিলাভের মাধ্যমে জন্মমৃত্যু চক্র থেকে মুক্তিলাভ এবং ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়াই জীবনের লক্ষ্য। অর্ফিকদের মতাে পিথাগােরীয়রা দ্বৈতবাদী ছিলেন। মানুষের আত্মাকে তারা দেহের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে মনে করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের স্বরূপ তার আত্মার নিহিত দেহ ক্ষণস্থায়ী ভাবাবেগের অধিষ্ঠান এবং মৃত্যুতে তা বিনষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। ধর্মের লক্ষ্য আত্মাকে একটি নুিখত শুভ সত্তায় রূপান্তরিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। পাপাচার পরিণামে জয়ী হতে পারে না, কেননা তা এক ধরনের পীড়া। পরিপূর্ণ ধর্মীয় উকর্ষলাভের জন্য এক দীর্ঘ নৈতিক বিশুদ্ধি প্রক্রিয়ার প্রয়ােজন। তবে আত্মার সাথে ঈশ্বরের মিলনের লক্ষ্যে পিথাগােরীয়রা যে কৃচ্ছতা নীতি ও কঠোর সাধনা অনুমােদন করেন তার সাথে বৌদ্ধ দর্শনের অল্প-বিস্তর মিল লক্ষ্যণীয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বুদ্ধের আবির্ভাব পিথাগােরাসেরও কিছুকাল পূর্বে (খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে)।

সঠিক জীবন যাপনের জন্য সুসঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষাকে জীবনে পিথাগোরীয়রা বিশেষ প্রয়ােজনীয় বলে মনে করতেন। সেই কারণে নবাগতদের জন্য সুদীর্ঘ সময় ধরে মৌনতা অবলম্বন করা এবং কৃতকর্মের আত্মপরীক্ষার নিয়ম ছিল। তারা মনে করতেন যে, মানসিক কর্মই আত্মশুদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়, এই জীবনে দেহ থেকে মুক্তিলাভ করার নিশ্চিত উপায়। এর দ্বারাই মৃত্যুর পূর্বে মানুষের ইন্দ্রিয় সুখের কামনা বিনষ্ট হয়, ইন্দ্রিয়ের দমন সম্ভব হয়। পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের অনুরাগীবৃন্দ গীতবাদ্যের অনুশীলন এবং শরীরচর্চার বিবিধ প্রণালীকে উপরিউক্ত শুচিতালাভের বিভিন্ন প্রণালীর সহায়ক বলে গণ্য করতেন। তারা স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পথ্যগ্রহণের উপর গুরুত্ব আরােপ করতেন। এর কারণ হল, তারা মনে করতেন শরীরের চাহিদাকে সীমিত করার প্রয়ােজন আছে। বাহ্য প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্য শরীরকে উপযােগী করে তােলা প্রয়ােজন, যাতে শরীর হয়ে ওঠে মনের একটি উপযুক্ত করণ (Instrument)। প্রথম দিকে পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের অনুরাগীবৃন্দ শুচিতা অর্থে বুঝতেন আত্মাকে দৈহিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা কিন্তু পরবর্তী কালে তারা মনে করতেন শুচিতার অর্থ হচ্ছে আত্মাকে দৈহিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা নয় বরং বিজ্ঞান এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মার এবং শরীরচর্চা ও ভেষজ বিজ্ঞানের সাহায্যে দেহের শােধন। পিথাগােরীয় সম্প্রদায় যে ভ্রাতৃত্বের ধারণায় বিশ্বাসী ছিল তার মূলে ছিল বর্তমান জন্মান্তরবাদে ধারণা। যা কিছু প্রাণবান, এমনকি উদ্ভিদও পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত বলে এই সম্প্রদায় মনে করত।

পিথাগোরীয়বাদের সাথে অর্ফিকবাদের সম্পর্ক

অর্ফিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুশীলন পিথাগোরীয়বাদের মধ্যে সমান্তরাল উপাদান রয়েছে, এবং বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, পিথাগোরাস বা পিথাগোরীয়রা নিজেরাই প্রারম্ভিক অর্ফিকবাদী রচনাগুলো তৈরি করেছিলেন; অন্য সূত্র অনুসারে, পরবর্তী দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতেন, পিথাগোরাস অর্ফিকবাদের একজন দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন। পিথাগোরীয়বাদ ও অর্ফিকবাদের মধ্যে কোনটি কোনটিকে প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন পণ্ডিত বলেন, অর্ফিকবাদ ও পিথাগোরীয়বাদ দুটি ভিন্ন ধারা হিসেবে শুরু হয়, যা পরবর্তীতে কিছু সাদৃশ্যের জন্য একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায় বা এদের আলাদা সত্তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। অন্যেরা যুক্তি দেন, এই দুটো ধারার উৎপত্তি একই, এবং এদেরকে একই সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যাকে “অর্ফিকো-পিথাগোরীয়বাদ” বলা হয়। পিথাগোরীয়বাদ অর্ফিকবাদের প্রত্যক্ষ উত্তরসুরীর একটি অংশ, এই বিশ্বাসটি লেট এন্টিকুইটি বা শেষ প্রাচীন যুগে অস্তিত্বশীল ছিল, যখন নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিকগণ পিথাগোরীয়বাদী শিক্ষার অর্ফিকবাদী উৎপত্তিকে মেনে নেন। প্রোক্লাস লেখেন: “অর্ফিয়াস অর্ফিকবাদী রহস্যবাদের মাধ্যমে যেসব গোপন শিক্ষা দীক্ষাপ্রাপ্তদেরকে দান করেছিলেন, থ্রেসের লিবার্থায় অ্যাগ্লাওফেমাসের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর পিথাগোরাস সেগুলোকে বিস্তারিতভাবে শেখেন। এর ফলে তার কাছে ঈশ্বর সম্পর্কিত জ্ঞান প্রকাশিত হয় যা অর্ফিয়াস তার মা ক্যালিওপির কাছ থেকে শিখেছিলেন।” ১৫শ শতকে, নব্যপ্লেটোবাদী গ্রিক পণ্ডিত কনস্টান্টাইন ল্যাসকারিস (যিনি আরগোনটিকা অরফিকা কবিতাটি আবিষ্কার করেছিলেন) একজন পিথাগোরীয় অর্ফিয়াসকে বিবেচনা করেছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেল (১৯৪৭) উল্লেখ করেন, “অর্ফিকবাদীরা ছিলে একটি সন্যাসী সম্প্রদায়; দ্রাক্ষাসুরা তাদের কাছে কেবলই একটি প্রতীক ছিল, যা পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় স্যাক্রামেন্টে প্রবেশ করে। তারা যে নেশাকে খুঁজতেন তা ছিল ঈশ্বরের সাথে মিলনের “এনথুসিয়াজম” এর। তারা এভাবে মনে করতেন রহস্যবাদী জ্ঞানকে সাধারণ উপায়ে অর্জন করা যায় না। পিথাগোরাস হয়ে এই রহস্যবাদী উপাদান গ্রিক দর্শনে প্রবেশ করে, যিনি অর্ফিকবাদের একজন সংস্কারক ছিলেন, যেমনটা অর্ফিয়াস ছিলেন ডায়োনিসাসের ধর্মের সংস্কারক। পিথাগোরাস হয়ে অর্ফিকবাদী উপাদানগুল প্লেটোর দর্শনে প্রবেশ করে, এবং প্লেটো থেকে তা পরবর্তীকালের দর্শনে প্রবেশ করে যা যেকোন মাত্রায় ধর্মীয় ছিল।”

প্রাথমিক অর্ফিকবাদী এবং পিথাগোরীয় সূত্রসমূহের অধ্যয়নসমূহ তাদের সম্পর্কের বিষয়ে অধিকতর দ্ব্যর্থক, এবং যেসব লেখকগণ পিথাগোরাসের জীবদ্দশার আশেপাশের সময়কালের ছিলেন তারা কখনই অর্ফিকবাদে পিথাগোসাসের দীক্ষাপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেন নি, এবং সাধারণভাবে অর্ফিয়াসকে একজন পৌরাণিক চরিত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তারপরও খ্রিস্টপূর্ব ৫ম ও ৪র্থ শতকের লেখকগণ দুই মতবাদের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক খুঁজে পান। প্রকৃতপক্ষে কেউ কেউ দাবি করেন, পিথাগোরাস কেবল অর্ফিকবাদের দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন না, বরং তিনিই প্রথম অর্ফিকবাদী গ্রন্থ রচনা করেন। বিশেষ করে কিওসের আয়ন দাবিকরেন, পিথাগোরাস সেইসব কাব্য রচনা করেন যা পৌরাণিক চরিত্র অর্ফিয়াসের উপর আরোপ করা হয়, এবং এপিজেনিস তার অন ওয়ার্ক্স এট্রিবিউটেড টু অর্ফিয়াস গ্রন্থে কয়েকটি প্রভাবশালী অর্ফিক কাব্যকে প্রারম্ভিক পিথাগোরীয়দের রচনা বলে দাবি করেছিলেন, যাদের মধ্যে অর্ফিকবাদী কবি সার্কপ্সও একজন। সিসেরোর মতে, অ্যারিস্টোটলও দাবি করেছিলেন যে অর্ফিয়াসের অস্তিত্ব কখনই ছিল না, এবং পিথাগোরীয়রাই কিছু অর্ফিকবাদী কবিতার কৃতিত্ব সারকন নামে একটি চরিত্রকে দান করেছিল। পিথাগোরীয়বাদের মধ্য দিয়ে নব্যপ্লেটোবাদীরা অর্ফিয়াসের ধর্মতত্ত্বকে গ্রিসের উৎপত্তিগত ধর্মীয় ধারার কেন্দ্র হিসেবে মনে করতেন। তবে প্রারম্ভিক সূত্রগুলো অনুসারে অর্ফিকবাদী ধর্মের উদ্ভব ঘটে একটি মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ও অল্পসংখ্যক মানুষের ধর্মীয় আন্দোলন (ফ্রিঞ্জ মুভমেন্ট) হিসেবে, যেখানে এর পুরাণ ও ধর্মীয় আচারকে মূলধারার বাইরের ও অশাস্ত্রীয় বলে বিবেচনা করা হত, এবং এর মধ্যে এমন অনেক উপাদান ছিল যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ ও ৫ম শতকের মিশরীয় ধর্মের সদৃশ ছিল। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকেই অধিকতর সমর্থন করেন।

ডায়োনিসীয় রহস্যবাদ ও অর্ফিকবাদ সহ প্রাচীন গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদ সম্পর্কে জানতে পড়ুন “প্রাচীন গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদী ধর্মসমূহ” লেখাটি

জীবনের প্রতি নিরাসক্ততা, থিওরি ও গণিত

প্রশ্ন ওঠে, পিথাগোরাসের এই মরমিবাদী চিন্তাসমূহের সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা একধরনের নৈতিক সম্পর্ক, যে নৈতিকতায় চিন্তাশীল জীবনকে শ্রেয় মনে করা হতো। বার্নেট এই নৈতিকতার সারসংক্ষেপ করেছেন এ রকম – “আমরা এ জগতে আগন্তুক। আমাদের দেহ আত্মার সমাধিস্থল, কিন্তু আমাদের উচিত নয় আত্মহত্যার দ্বারা এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করা। কারণ আমরা হলাম পশুপাল আর ঈশ্বর আমাদের রাখাল। তার হুকুম ছাড়া আমরা পালাতে পারি না। এ জীবনে মানুষ আছে তিন প্রকারের। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যেমন তিন ধরনের মানুষ আসে ঠিক তেমনি। সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির মানুষ হচ্ছে তারা, যারা আসে কেনাবেচা করতে। তাদের ঠিক উপরের স্তরটিতে আছে তারা, যারা প্রতিযোগিতা করে। আর সর্বোত্তম স্তরে হচ্ছে তারা যারা কিছুই করে না, শুধু দেখে অর্থাৎ যারা নিরাসক্ত দর্শক। তাই সর্বোত্তম উৎকর্ষ হচ্ছে নিরাসক্ত বিজ্ঞান, আর যে ব্যক্তি নিজেকে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসর্গ করেন তিনি প্রকৃত দার্শনিক, তিনিই সবচেয়ে সফলভাবে নিজেকে মুক্ত করেছেন জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে।” (Early Greek Philosophy, page. 108)। পিথাগােরাস গৌতম বুদ্ধের মতাে জন্মচক্রকে অশুভ বলে চিহ্নিত করেছেন বলে মনে হয়। কেননা তিনিও বুদ্ধের মতাে ভবচক্র বা জন্মচক্র থেকে মুক্তি লাভের কথা বলেছেন। পিথাগােরাসের মতে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের প্রতি অনুরক্ত ব্যক্তিই ভবচক্র বা জন্ম-চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

প্রায়ই শব্দার্থের নানা ধরনের পরিবর্তন ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে থাকে। ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের আশায় কৃত ধর্মানুষ্ঠান বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ orgy শব্দটির মত theory শব্দটিও ছিল একটি অর্ফিক শব্দ। কর্নফোর্ড এর অনুবাদ করেছেন আবেগপূর্ণ সহানুভূতি সহযোগে অনুধ্যান। পিথাগোরাস বলছেন, যখন কেউ আবেগপূর্ণ সহানুভূতি-সহযোগে অনুধ্যান করে তখন তার অবস্থা হয় পীড়িত ঈশ্বরের মতো। অর্থাৎ, তার মৃত্যু হয় এবং আবার সে নতুন করে জন্ম নেয়। পিথাগোরাসের কাছে আবেগপূর্ণ সহানুভূতি সহযোগে অনুধ্যান ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, তার সূচনা গাণিতিক জ্ঞানের মধ্য দিয়ে। এইভাবে পিথাগোরাসবাদের মধ্য দিয়ে theory শব্দটি ক্রমে তার আধুনিক অর্থ অর্জন করেছে। কিন্তু পিথাগোরাসের দ্বারা উদ্বুদ্ধ সবার কাছে তা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের একটি উপাদান হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। পাঠশালায় যারা অনিচ্ছুকভাবে হলেও একটু-আধটু গণিত শিখেছে তাদের কাছে এটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু গণিতের আকস্মিক উপলব্ধির গভীর আনন্দলাভের অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, যারা গণিত ভালোবাসে, তাদের কাছে পিথাগোরীয় দৃষ্টিভঙ্গি-যদি সত্য নাও মনে হয়-পুরোপুরি স্বাভাবিক বলে মনে হবে। মনে হতে পারে, অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক তার অভিজ্ঞতার উপাদান-বস্তুর দাস, কিন্তু খাঁটি গণিতজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞের মতো এক নিজস্ব সুশৃঙ্খল সুন্দর জগতের স্বাধীন স্রষ্টা।

ফিলােসফি কথাটির সাথে পিথাগােরাসের নাম বিশেষভাবে যুক্ত। কথাটির প্রথম ব্যবহার ও প্রচলনের মূলে ছিলেন তিনিই। ফিলােসফি বলতে তিনি বুঝতেন জ্ঞানপ্রীতি বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ (love of wisdom)। তার মতে, দৈবসত্তার প্রতি যার আকর্ষণ ও ভক্তি রয়েছে, অর্থাৎ যিনি প্রজ্ঞার অনুরাগী, তিনিই যথার্থ মনুষ্য পদবাচ্য। দার্শনিক বলতে তিনি এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষকেই বুঝতেন। দার্শনিক শ্রেণী ছাড়াও আরাে দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছে : এক, যারা শুধু পার্থিব সাফল্য ও সম্মানের কাঙ্গাল এবং দুই, যারা ইন্দ্রিয়সুখের প্রতি আকৃষ্ট। জ্ঞানানুরাগী, পার্থিব সম্মানানুরাগী এবং ইন্দ্রিয়সুখানুরাগী – এই তিন শ্রেণীতে মানুষের শ্রেণীবিভাগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ থেকে বােঝা যায় যে, পিথাগােরীয় মতে, জ্ঞানানুরাগী দার্শনিক শ্রেণীই পরিণামে জয়ী হবে; আর অন্যেরা শুধু তাদের নিজ নিজ কর্তব্য সম্পাদন করবে। দার্শনিকদের বিশেষ মর্যাদার অধিকারী বলে চিহ্নিত করে পিথাগােরাস অভিজাত শ্রেণীর প্রতি তার বিশেষ সহানুভূতির দৃষ্টান্ত রেখে যান। দর্শনের প্রতি পিথাগােরাসের আস্থা ও ভক্তি ছিল প্রগাঢ়। দর্শন বলতে তিনি শুধু বিশ্বের মূলতত্ত্বের অনুসন্ধানকেই বোঝেন নি, বুঝেছেন ধর্মীয় মুক্তির পক্ষে সহায়ক জীবনযাত্রা প্রণালীকে। তবে দার্শনিক বলতে তিনি এমন ব্যক্তিকে বুঝেছেন যিনি বিভ্রান্ত জনতাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন ধর্মীয় পুরােহিতের মতাে। দার্শনিক শুধু ক্ষণিকের সুখ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না, নিত্য ও চিরন্তনের অনুসন্ধানেও ব্যাপৃত থাকেন।

এটা খেয়াল করা বেশ আগ্রহব্যঞ্জক যে, বার্নেট-বর্ণিত পিথাগোরীয় নৈতিকতা আধুনিক মূল্যবোধের সঙ্গে বিরোধাত্মক। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক মানসিকতার লোকজন মনে করে ফুটবল খেলায় দর্শকদের চেয়ে খেলোয়াড়রা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের ব্যাপারেও সে রকম। সাধারণ দর্শকজনতার চেয়ে তারা বেশি পছন্দ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত রাজনীতিবিদদের। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যোদ্ধা, অভিজাত, ধনিক এবং একনায়ক প্রত্যেকের শুভ ও সত্যের নিজ নিজ মানদণ্ড আছে। অভিজাত ব্যক্তি দার্শনিক তত্ত্বের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন, কারণ গ্রিক মনীষার সঙ্গে তার সংসর্গ হয়েছে, কারণ চিন্তাশীলতা একটি সদগুণ হিসেবে ধর্মের অনুমোদন লাভ করেছে এবং নির্মোহ সত্যের আদর্শ শিক্ষাজীবনকে মহিমান্বিত করেছে। অভিজাত হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবেন তিনি, যিনি এমন এক সমাজের একজন, যে সমাজে সবাই সমান, যারা দাসশ্রমের ওপরে নির্ভর করে বা এমন কিছু লোকের শ্রমের ওপরে নির্ভর করে জীবনযাপন করে, যারা প্রশ্নাতীতভাবে অধঃস্তন। এও খেয়াল করা দরকার যে, সাধু-সন্ন্যাসীরাও এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়বেন; তারা কর্মময় জীবনযাপন করেন না, তাদের জীবন চিন্তাশীল, ধ্যানপূর্ণ। সত্যের আধুনিক সংজ্ঞাগুলো চিন্তামূলক নয়, ব্যবহারিক। যেমন প্রয়োগবাদ বা প্রয়োজনবাদে সত্যের সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞাগুলো সূচিত হয়েছে অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে শিল্পতন্ত্রের দ্বারা। যে সমাজব্যবস্থা দাসপ্রথা সহ্য করে তার সম্বন্ধে যাই ভাবা হোক না কেন, উপরে বর্ণিত অর্থে যারা অভিজাত, বিশুদ্ধ গণিতের জন্য আমরা তাদের কাছেই ঋণী। চিন্তাশীলতার আদর্শ থেকে বিশুদ্ধ গণিতের জন্ম হয়েছিল বলে তা ছিল ব্যবহারিক কাজকর্মের উৎস। ফলে চিন্তাশীলতার মর্যাদা বেড়েছে, ধর্মতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র এবং দর্শনে চিন্তাশীলতার আদর্শের জয় হয়েছে। ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডের একটি উৎস না হলে চিন্তাশীলতার আদর্শ হয়তো এতটা মর্যাদা ও সাফল্য পেত না। এ পর্যন্ত যা ব্যাখ্যা করা গেল তা থেকে পিথাগোরাসের দুটো দিক বেরিয়ে আসে। একদিকে তিনি ধর্মীয় প্রবক্তা, অন্যদিকে বিশুদ্ধ গণিতজ্ঞ। উভয় দিকে তার গুরুত্ব ছিল অপরিমেয়। তবে একজন আধুনিক মানুষের কাছে এই দুটি দিক যতটা আলাদা মনে হতে পারে সে সময় কিন্তু ততটা ছিল না।

পিথাগোরীয়রা বুদ্ধিবাদী না অভিজ্ঞতাবাদী?

পিথাগােরীয়দের সম্পর্কে আজকাল যে প্রশ্নটি প্রায়শই আলােচিত হয়ে থাকে, তা হলাে এই : আধুনিক অর্থে তারা কি বুদ্ধিবাদী না অভিজ্ঞতাবাদী? এ প্রশ্নের কোনাে নিশ্চিত উত্তর নেই। জ্ঞান প্রসঙ্গে পিথাগােরীয়রা কখনাে কখনাে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের সমর্থন করেছেন। এ থেকে তাদের অভিজ্ঞতাবাদী বলে অভিহিত করা যায়। অবরােহ পদ্ধতির বাহক গণিতশাস্ত্র, বিশেষ করে জ্যামিতির প্রতি তাদের যে প্রগাঢ় আকর্ষণ, তা থেকে বােঝা যায়, অভিজ্ঞতাকে বাদ দিয়ে শুধু বুদ্ধির সাহায্যে জ্ঞানলাভ সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করতেন। তাই যদি হয়, তা হলে তাদের আবার বুদ্ধিবাদী বলা চলে। অবশ্য এভাবে জ্ঞান অর্জন সম্ভব কি না তা বিতর্কের বিষয়, এবং এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক আলােচনা ও তর্কবিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর সাথে তর্কশাস্ত্র, গণিত, অধিবিদ্যা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলাে জড়িত। উনিশ শতকে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতি প্রবর্তন এবং পদার্থবিদ্যায় এর প্রয়ােগ দ্বারা জ্যামিতিতে পূর্বতসিদ্ধ সংশ্লেষক (synthetic a priori) অজ্ঞান পাওয়া যায় বলে বুদ্ধিবাদীদের যুক্তি অভিজ্ঞতাবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেন। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, পিথাগােরীয়দের ধর্মীয় আকর্ষণ, বিশেষত শুদ্ধির জন্য তাদের যে ব্যাকুলতা, তা-ই হয়তাে তাদেরকে জড় জগতের সংস্পর্শমুক্ত। বিশুদ্ধ মানের প্রামাণ্য অনুসন্ধানের প্রেরণা যুগিয়েছে। আর সম্ভবত এই প্রত্যয় ও প্রচেষ্টাই জ্যামিতির ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযােগ্য অবদানের পক্ষে বিশেষ সহায়ক ছিল। সে যাই হােক, পিথাগােরীয়গণ যে বৌদ্ধিক মরমিবাদের পত্তন করেছিলেন, দার্শনিক পদ্ধতি হিসেবে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, এবং এর মূল উৎস ও প্রেরণা ছিল গণিতশাস্ত্র। 

পিথাগােরাসের মূল্যায়ন, অবদান, প্রভাব ও সমালোচনা

মূল্যায়ন

সংখ্যার মাধ্যমে আমরা জগতের সবকিছু গণনা করি। সংখ্যা হচ্ছে গণনার একক। কিন্তু সংখ্যা দ্বারা জগৎ সৃষ্টি একথা নিঃসন্দেহে একটি আজগুবি ধারণা বলেই আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয়। তবুও পিথাগােরীয়দের দর্শন কিছু দিক থেকে অবশ্যই গুরুত্বের দাবীদার। যেমন: 

  • (১) পিথাগােরীয়রা জগতের ঐক্য, সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেছেন। সংখ্যার মাধ্যমে এই শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যকে তারা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। 
  • (২) সংখ্যাতত্ত্বের মাধ্যমে আধুনিক গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতির তাত্ত্বিকভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে। সংখ্যার বর্গ, সংখ্যার ঘনাঙ্কের ধারণা পিথাগােরীয়গণই সর্বপ্রথম প্রদান করেন।  
  • (৩) আধুনিক দর্শনের ও বিজ্ঞানের ওপর জ্যামিতির প্রভাব ব্যাপকতর। জ্যামিতির গবেষণা পিথাগােরীয়দের সংখ্যাতত্ত্বের কাছে ব্যাপকভাবে ঋণী। 
  • (৪) গণিত ও ধর্মের মধ্যে সমন্বয়মূলক চিন্তা পিথাগােরাস থেকেই শুরু হয়। মধ্যযুগের ধর্মীয় দর্শন এমনকি কান্টের দর্শনের ওপর গণিত ও দর্শনের সমন্বয়ী ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। 
  • (৫) গণিত ও জ্যামিতি চর্চার মধ্যদিয়ে বা সংখ্যা নির্ভর জগৎ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে পিথাগােরাসপ্রমুখ দার্শনিকগণ অবরােহী পদ্ধতির প্রয়ােগ করেছেন। এই পদ্ধতি পরবর্তীতে দার্শনিকদের নিকট প্রিয় হয়ে ওঠে। প্লেটো, কান্ট প্রমূখ দার্শনিকগণও তদ্রপ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। 
  • (৬) বাট্রান্ড রাসেল দেখান যে, মরমীবাদের ভিত্তি জোড়ালাে করতে গণিতের সাহায্য নেওয়া যায়। পিথাগােরাস সেই ধরনের গাণিতিক দর্শনই প্রদান করেছেন।
  • (৭) আধুনিক ও সমকালীন দর্শনে দ্বন্দ্বতত্ত্ব বা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পিথাগােরীয় দর্শনে দ্বন্দ্বতত্ত্বের ইংগিত পাওয়া যায়। পিথাগােরীয়দের সংখ্যাতত্ত্বে জোড় ও বেজোড়ের দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং দেখানাের চেষ্টা করা হয়েছে যে, জোড় ও বেজোড়ের দ্বন্দ্বেই জগতের সবকিছু বিকশিত হচ্ছে। 

পিথাগােরাসের দর্শনের মান বিচার করতে হলে তকালীন যুগের কথা বিবেচনা করে করতে হবে। আজকের দিনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ পরিসরে পিথাগােরাসের দর্শন অনেকটা উপেক্ষার বিষয় হলেও ভাববাদী, মরমীবাদী, ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে পিথাগােরাসের অবদান ও প্রভাব অসামান্য। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন : “পিথাগােরাসের দর্শনে কোথায় ভুল ছিলাে অতি সম্প্রতি তা জানা সম্ভব হচ্ছে। তবে চিন্তার জগতে এতটা প্রভাব বিস্তারকারী অন্যকোন দার্শনিকের নাম আমার জানা নেই। আমি একথা বলছি একারণে যে, প্লেটোবাদকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তা মূলত পিথাগােরাসেরই দর্শন। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার কাছে নয়, বুদ্ধির কাছে বােধগম্য একটি শ্বাশ্বত জগতের পূর্ণাঙ্গ ধারণা তার (পিথাগােরাসের) দর্শনেই পাওয়া যায়। পিথাগােরাসের আবির্ভাব না হলে খ্রিষ্টানগণ যিশুকে ঈশ্বরের বাণীবাহক বলে ভাবতেন না। তার আবির্ভাব না হলে ধর্মতাত্ত্বিকগণ ঈশ্বর ও অমরত্ব। বিষয়ে যৌক্তিক প্রমাণ দিতে উদগ্রীব হতেন না। কিন্তু তার দর্শনের এসব বিষয় আজও অস্পষ্ট অবস্থায় রয়েছে।” 

সমকোণী ত্রিভূজের উপপাদ্য ও স্বতসিদ্ধ থেকে অবরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবের ধারণায় পিথাগোরাসীয় উৎস্য

পিথাগােরাস্ সম্প্রদায়ের বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপও উল্লেখযােগ্য। সম্প্রদায়ের সভ্যবৃন্দ নৈতিক আত্মসংযমের উপর গুরুত্ব আরােপ করতেন। তারা শিল্পকলা, কারিগরী শিল্প, শরীর চর্চা, সঙ্গীত, ভেষজবিদ্যা এবং গণিতের চর্চা করতেন। প্রাচীন গ্রীসের গণিত চর্চার মূলে পিথাগােরাসের উল্লেখযােগ্য অবদান বর্তমান। ইউক্লিডের ৪৭ নং প্রতিজ্ঞা (Proposition) পিথাগােরাসের উপপাদ্য বলে পরিচিত। পিথাগোরাস বা তার প্রত্যক্ষ শিষ্যদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি ছিল এই সমকোণী ত্রিভুজের উপপাদ্যটি। এটি অনুসারে, সমকোণী ত্রিভুজের সমকোণের সন্নিহিত বাহুদ্বয়ের উপরে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের যোগফল অপর বাহুটির বা অতিভুজের (hypotenuse) উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের সমান। মিশরীয়রা জানত যে ত্রিভুজের বাহুগুলোর মাপ ৩, ৪ ও ৫, সেটি একটি সমকোণী ত্রিভুজ হবে। কিন্তু মনে হয়, গ্রিকরাই সর্বপ্রথম খেয়াল করে যে, 3^2 + 4^2 = 5^2 হয় এবং এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তারাই প্রথম সাধারণ প্রতিজ্ঞার একটি প্রমাণ আবিষ্কার করে। পিথাগোরাসের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, তার উপপাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিষম জ্যামিতিক আকারগুলোও আবিষ্কৃত হয়, যার ফলে তার পুরো দর্শনকেই ভুল প্রমাণিত হতে দেখা যায়। সমকোণবিশিষ্ট একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজে অতিভুজের উপরে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্র অন্য দুই বাহুর উপর অঙ্কিত যেকোনো বর্গক্ষেত্রের দ্বিগুণ। ধরা যাক প্রত্যেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১ ইঞ্চি, তাহলে অতিভুজের দৈর্ঘ্য কত হবে? মনে করা যাক অতিভুজের দৈর্ঘ্য m/n ইঞ্চি। তাহলে m^2/n^2 = 2। যদি m ও n-এর একটি উৎপাদক গুণনীয়ক থাকে তাহলে তাকে বের করলে দেখা যাবে m অথবা n-দুটোর একটি অবশ্যই হবে বেজোড়। এখন m^2-2n^২, অতএব m^2 জোড় সংখ্যা, অতএব m জোড় সংখ্যা, অতএব n বেজোড় সংখ্যা। ধরা যাক, m = 2p, তাহলে 4p^2 = 2n^2, অতএব n^2 = 2p^2, অতএব n জোড় সংখ্যা এবং অতএব n হবে একটি জোড় সংখ্যা, যা কিনা পূর্ব সিদ্ধান্তের বিপরীত (Contra hyp)। সুতরাং m/n-এর কোনো ভগ্নাংশ অতিভুজটির পরিমাপ নির্ণয় করতে পারবে না। এই প্রমাণটির সারমর্ম তাই, যা রয়েছে ইউক্লিডের ১০ম খণ্ডে। (কিন্তুউ এই প্রমাণ ইউক্লিডের দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। প্লেটো সম্ভবত এই প্রমানের কথা জানতেন)। এ যুক্তি থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দৈর্ঘ্যের যে এককই আমরা ধরি না কেন, এমন কিছু দৈর্ঘ্য আছে যেগুলোর সঙ্গে ওই এককের কোনো সুনির্দিষ্ট সাংখ্যিক সম্পর্ক থাকে না। কথাটা বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, m ও n বলে এমন দুটো পূর্ণসংখ্যা থাকতে পারে না যে আলোচ্য দৈর্ঘ্যের m-গুণ তার এককের n-গুণ হবে। এতে করে গ্রিক গণিতবিদদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে পাটিগণিতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, স্বাধীনভাবে জ্যামিতিকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। প্লেটোর সংলাপগুলোতে এমন কিছু অনুচ্ছেদের দেখা পাওয়া যায় যা থেকে এই প্রমাণ মেলে যে, প্লেটোর যুগের জ্যামিতির স্বতন্ত্র প্রয়োগ প্রক্রিয়াধীন ছিল। ইউক্লিডের সময় তার উৎকর্ষ ঘটে। ইউক্লিড তার দ্বিতীয় পুস্তকে জ্যামিতির সাহায্যে অনেক কিছু প্রমাণ করেছেন, যেগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবে বীজগণিতের সাহায্যে করে থাকি। যেমন-(a+b)^2 = a^2 + 2ab + b^2। বিষমগুলোর ব্যাপারে অসুবিধার কারণেই তার কাছে এটা অনিবার্য মনে হয়েছিল। একই কথা প্রযোজ্য তার পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুস্তকে বর্ণিত ভগ্নাংশের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। বিষম-এর ব্যাপারে যত দিন পর্যন্ত কোনো যথার্থ পাটিগাণিতিক তত্ত্ব ছিল না তত দিন ইউক্লিডের পদ্ধতি, যা জ্যামিতিতে যতটা খাটানো সম্ভব ছিল, তাই ছিল সর্বোত্তম। দেকার্ত যখন স্থানাঙ্ক জ্যামিতি প্রবর্তন করেন এবং তা করে পাটিগণিতকে আবার সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যান, তখন তিনি বিষম-এর সমস্যাটি সমাধানের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেছিলেন। অবশ্য তার কালে সে ধরনের কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।

দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর জ্যামিতির প্রভাব গভীর। জ্যামিতি, যেভাবে তা গ্রিকদের হাতে প্রবর্তিত হয়, তা শুরু হয় কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ ধারণা দিয়ে (বা সেগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়) এবং তা থেকে অবরোহমূলক যুক্তির ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হতে কতকগুলো উপপাদ্যে পৌঁছে, যেগুলো মোটেই স্বতঃসিদ্ধ নয়। স্বতঃসিদ্ধ ও উপপাদ্যগুলোকে আমাদের অভিজ্ঞতার আওতাধীন বাস্তব স্থানে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে মনে হয় যে, স্বতঃসিদ্ধ কী, প্রথমে তা খেয়াল করে তারপর অবরোহ-পদ্ধতি ব্যবহার করে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটোকান্টকে এবং তাদের মধ্যবর্তী কালের অধিকাংশ দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স-এ বলা হয়েছে : আমরা এই-সব সত্যকে সত্য বলে মনে করি। এটা আসলে ইউক্লিডের অনুকরণ। ১৮ শতকের ন্যাচারাল রাইটস মতবাদ আসলে ছিল রাজনীতিতে ইউক্লিডের স্বতঃসিদ্ধগুলোর সন্ধান। (ফ্রাঙ্কলিন ‘স্বতঃপ্রমাণিত’ শব্দটি জেফারসনের ‘পবিত্র এবং অনস্বীকার্য’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন।)। স্বীকৃত প্রায়োগিক উপাদান থাকা সত্ত্বেও নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার আঙ্গিক আগাগোড়াই ইউক্লিড দ্বারা প্রভাবিত। ধর্মতত্ত্বও-তার নিখুঁত স্কলাস্টিক আঙ্গিকে-একই উৎস থেকে শৈলী গ্রহণ করেছে। ব্যক্তিগত ধর্ম এসেছে আধ্যাত্মিক অনুভূতি থেকে আর ধর্মতত্ত্ব এসেছে গণিত থেকে। পিথাগোরাসের মধ্যে উভয়েরই সাক্ষাৎ মেলে।

পরবর্তী দার্শনিক চিন্তায় পিথাগোরাসের গণিত-ভিত্তিক দর্শনের প্রভাব

দর্শন এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পিথাগােরাসের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রথমত, বিশুদ্ধ গণিতের আবিষ্কার, দ্বিতীয়ত, গাণিতিক প্রমাণের ধারাকে আরও জোরালাে করে তােলা। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, প্রমাণমূলক অবরােহাত্মক যুক্তি অর্থে গণিতের (mathematics in the sense of demonstrative deductive argument) শুরু তাকে কেন্দ্র করেই।  এরূপ সিদ্ধান্ত করা হয় যে, আকার এবং গঠনই বস্তুকে তার ব্যক্তিগত পরিচয় দান করে। এগুলি নিঃসন্দেহে পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের চিন্তাধারাই পরিমাণসূচক নিয়ম (Quantitative Laws) সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনা করেছিল এবং দর্শনের ক্ষেত্রে আকারবাদের (Formalism) আলােচনার সূত্রপাত করেছিল যার চরম পরিণতি প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়।

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শাশ্বত ও নির্ভুল সত্যের প্রতি বিশ্বাসের উৎস গণিত, একটি অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিগ্রাহ্য (Super-sensible) জগতের প্রতি বিশ্বাসের উৎসও তাই। জ্যামিতির কারবার, উদাহরণস্বরূপ, বৃত্ত নিয়ে। কিন্তু কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নিখুঁতভাবে বৃত্তাকার নয়। যত যত্নসহকারেই আমরা আমাদের কম্পাস ব্যবহার করি না কেন, অঙ্কিত বৃত্তে কিছু খুঁত, কিছু বিষমতা থেকেই যাবে। তাহলে এ থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, সব নির্ভুল যুক্তি কেবল ভাবনার জগতের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে নয়। এ পথে চিন্তা করলে স্বাভাবিকভাবেই আরো এগোনো যায় এবং দাবি করা যায় যে, ইন্দ্রিয়ের চেয়ে চিন্তা মহত্তর এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলোর চেয়ে চিন্তার বিষয়গুলো অধিকতর সত্য। শাশ্বতর সঙ্গে সময়ের সম্বন্ধ সম্পর্কিত মরমি মতবাদগুলোও বিশুদ্ধ গণিত থেকে প্রচুর রসদ পেয়েছে। কেননা, গাণিতিক বিষয়গুলো, যথা সংখ্যাগুলো, যদি আদৌ সত্য হয়, তবে সেগুলো শাশ্বত, সময়ের মধ্যে সেগুলোর অস্তিত্ব নেই। ঈশ্বরের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে এ ধরনের শাশ্বত বিষয় বলে মনে করা যেতে পারে। এখান থেকেই প্লেটোর এই মতবাদ এসেছে যে, ঈশ্বর একজন জ্যামিতিবিদ এবং এখান থেকেই  স্যার জেমস্ জীনসের (Sir James Jeans) এই বিশ্বাসের উৎপত্তি যে, ঈশ্বর গণিতের প্রতি আসক্ত। পিথাগোরাসের সময় থেকে এবং বিশেষ করে প্লেটোর সময় থেকে, মহাপ্রলয়বিশ্বাসী ধর্মের বিপরীতে বুদ্ধিবাদী ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে গণিত ও গাণিতিক পদ্ধতি দ্বারা।

পিথাগোরাসের সময় থেকে গণিত ও ধর্মতত্ত্বের যে সংমিশ্রণ শুরু হয়েছে তা-ই গ্রিসের ধর্মীয় দর্শন, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দর্শন এবং আধুনিক যুগে কান্ট পর্যন্ত ধর্মীয় দর্শনের স্বরূপ গঠন করেছে। পিথাগোরাসের আগে অর্ফিকবাদ ছিল এশীয় গুহ্যধর্মগুলোর অনুরূপ। কিন্তু প্লেটো, সেন্ট অগাস্টিন, টমাস অ্যাকুইনাস, দেকার্ত, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ ধর্মের সঙ্গে চিন্তনের, নৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পিথাগোরাস থেকে আগত সময়নিরপেক্ষ বিষয়ের প্রতি যৌক্তিক মুগ্ধতা-যা এশিয়ার সহজ-সরল মরমিবাদ থেকে ইউরোপের বৌদ্ধিকীকৃত ধর্মতত্ত্বকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে-তার এক ঘনিষ্ঠ মিশ্রণ ঘটেছে। পিথাগোরীয়রা গণিতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান বলে মনে করতেন। পিথাগােরাস নিজে কয়েকটি উপপাদ্য আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি তার সিদ্ধান্তগুলােকে স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার প্রতীক বলে মনে করতেন। গণিতশাস্ত্র ও ধর্মের এই সম্পর্ক একটি লক্ষণীয় ব্যাপার। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে প্যাসকেলদেকার্তকে আমরা পুনরায় এ বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করতে দেখি। প্যাসকেল ও দেকার্ত উভয়ের মধ্যেই গাণিতিক আকর্ষণ ও ধর্মীয় ভক্তির সংযােগ দেখা যায়। পিথাগােরীয়রা জ্যামিতিকে বিজ্ঞান হিসেবে সম্প্রসারিত করেছিলেন। স্বতঃসিদ্ধ (axiom), উপপাদ্য (theorem) ও অবরােহণ (demonstration) অনুসারে জ্যামিতির শ্রেণীবিভাগ করে তারা বিষয়টির একটি পরিপূর্ণ যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করেন। সংখ্যার শ্রেণীবিভাগ ও সমানুপাতের পঠনপাঠন এবং এদের ওপর জ্যামিতিক নীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে তারা পাটিগণিতেও যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। তাদের মতে, সব পদার্থকে পারস্পরিক সংখ্যাগত সম্পর্ক অনুসারে ব্যক্ত করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞান গাণিতিক সমানুপাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পিথাগােরীয় চিন্তায় এ ধারণার পূর্বাভাস ছিল। তবে পিথাগােরীয়দের মতাে আধুনিক বিজ্ঞানীরা নৈতিক ধারণাবলিতে সংখ্যা আরােপের পক্ষপাতী নন। পিথাগােরীয়দের মতাে গণিতকে ধর্মতত্ত্বের প্রস্তুতিপর্ব বলে মনে না করে আধুনিক বিজ্ঞানীরা একে প্রয়ােজন সিদ্ধির সহায়ক একটি কার্যকর জ্ঞানশাস্ত্র বলে মনে করেন। কেবল অতি সাম্প্রতিককালে এসেই পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব হয়েছে পিথাগোরাসের ভুলটা কী ছিল। রাসেল বলেছেন, “চিন্তার জগতে পিথাগোরাসের মতো প্রভাব বিস্তারকারী আর কোনো ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই। এ কথা বলছি এ কারণে যে, প্লেটোবাদে যা দেখা যায় তা বিশ্লেষণ কবলে দেখা যাবে তার সারমর্ম রয়েছে পিথাগোরাসবাদে। ইন্দ্রিয়ের কাছে নয়, বুদ্ধির সামনে উন্মোচিত একটি শাশ্বত জগতের পুরো ধারণাটিই এসেছে পিথাগোরাসের কাছ থেকে। পিথাগোরাস না থাকলে ক্রাইস্ট শব্দটাই ক্রিস্টানদের মাথায় আসত না। তিনি না থাকলে ধর্মতাত্ত্বিকদের ঈশ্বর ও অমরত্বের যৌক্তিক প্রমাণ অন্বেষণের প্রয়াসই জাগত না।”

পিথাগােরীয় দর্শনের সঠিক ব্যাখ্যা-ভাষ্যের ব্যাপারে , অসুবিধা রয়েছে। এ নিয়ে ভাষ্যকারদের মধ্যে তীব্র মতবিরােধ দেখা যায় পিথাগােরীয়দের কোনাে মূল রচনা আমাদের হাতে নেই। সুতরাং তাদের মতাবলি কোন্‌টি আদি, আর কোন্‌টি এর পরবর্তী সংস্করণ তা বলা কঠিন। পরবর্তীকালে ভাষ্যকারগণ তাদের কোনাে মতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন কি-না, কিংবা নিজেদের ইচ্ছামতাে তাদের মত বিকৃত করেছেন কি না, তা-ও হলফ করে বলা যায় না। যাই হােক, পিথাগােরীয় দর্শনে এমন কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা যায় যেগুলাে দর্শনের ইতিহাসে বিশেষ প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। যেমন, পিথাগােরীয়দের সীমিত’ ও ‘অসীম’-এর ধারণা প্লেটোকে প্রভাবিত করে। এরিস্টটলের দর্শনে রূপ ও উপাদানের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায়, এর অনুপ্রেরণা পিথাগােরীয়দের কাছ থেকেই প্রাপ্ত বলে মনে হয়। ‘সব জিনিসই সংখ্যা–পিথাগােরীয়দের এ মত শুধু প্লেটোকেই নয়, আধুনিক বিজ্ঞানকেও প্রভাবিত করেছে। কোনাে জিনিসকে গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে ব্যক্ত করা গেলে এর যথার্থ সত্তাকে বােঝা যায় বলে আমরাও আজ মনে করি না। যেমন, দ্রব্যের সংজ্ঞা ও পার্থক্যনির্দেশের জন্য রসায়নশাস্ত্রে শুধু সেসব সংখ্যার সাহায্যই নেয়া হয়, যেগুলাে তাদের অন্তর্ভুক্ত উপকরণগুলাের গাণিতিক অনুপাত বহন করে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে, বিশেষ করে প্রকৃত ও সম্ভাব্য জগতের স্বভাব ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মডেল তৈরির যে প্রচেষ্টা, তাতেও পিথাগােরীয়দের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, পদার্থবিদ্যা কলাবিদ্যা প্রভৃতির বিশ্লেষণে যারা আজ সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়ােগ করে থাকেন, তাদেরকেও পিথাগােরীয়দের অনুসারী বলে ভাবা যায়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান, সুরবিজ্ঞান ও শিল্পকলায় পিথাগোরীয়দের প্রভাব

জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে পিথাগােরীয়রা মৌলিক অগ্রগতিসাধন করেন। স্বয়ং পিথাগােরাস পৃথিবীকে গােলাকার বলে মনে করতেন। তার পরবর্তী অনুসারীরা পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র কেন্দ্রীয় আগুনের চারদিকে পরিক্রমণ করে বলে মনে করতেন। এ মতকে সূর্যকেন্দ্রিক মতের পূর্বাভাস বলা চলে । প্রাচীন ও মধ্যযুগের চিন্তাবিদরা এ মতে বিশ্বাসী ছিলেন না; কেননা তাদের মতে পৃথিবীই বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ ব্যাখ্যার জন্য পিথাগােরিয়রা একটি বিপরীত পৃথিবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। তারা দশ’-কে পূর্ণ সংখ্যা বলে মনে করতেন এবং নভােমণ্ডলে দশটি জ্যোতিষ্ক পরিক্রমণরত আছে বলে বিশ্বাস করতেন। তাদের মতে, পৃথিবীর চারদিকে যে বায়ু বিদ্যমান, তা গতিহীন এবং এর ভিতরে যা কিছু আছে তারা সব নশ্বর। সবচেয়ে ওপরিভাগের বায়ু নিয়ত গতিশীল, এবং এর অভ্যন্তরস্থ সব জিনিস স্বর্গীয়। সে দিনের প্রচলিত লৌকিক বিশ্বাস অনুসারে পিথাগােরীয়রা নক্ষত্র চন্দ্র সূর্যও অন্যান্য জ্যোতিষ্কগুলােকে দেবতা বলে মনে করতেন। তারা এও মনে করতেন যে, বিশ্বের সর্বোচ্চ গােলকগুলােতে উত্তাপ বিদ্যমান, আর এই উত্তাপই প্রাণের কারণ। মানুষ দেবতাদের সদৃশ, কেননা মানুষের মধ্যেও উত্তাপ রয়েছে। পিথাগােরীয়দের এ মতবাদে স্বর্গ ও মর্তের দ্বৈততার কথা বিঘােষিত। পিথাগােরীয়রা ভাবতেন যে, স্বর্গলােক পৃথিবীর চেয়ে উৎকৃষ্ট, এবং তাদের গঠনপ্রকৃতিও পৃথিবীর গঠনপ্রকৃতির চেয়ে স্বতন্ত্র। এ মত মধ্যযুগে গৃহীত হয় এবং রেনেসাঁর পূর্ব পর্যন্ত প্রচলিত থাকে। পরবর্তীকালে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস প্রমুখ বিজ্ঞানী দেখান যে, স্বর্গ ও পৃথিবী উভয়েই জগতের একই নিয়মের অধীন। 

সুরবিজ্ঞানেও (harmonics) পিথাগােরীয়দের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তারা। বুঝেছিলেন যে, সংখ্যাগত সমানুপাতের সাহায্যে সুর প্রকাশ সম্ভব। এ জন্যই তাদের দর্শনে সংগীতের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাদের মতে, সংগীতের সাথে মানুষের নৈতিক বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, সামরিক সুর মানুষের মধ্যে যুদ্ধংদেহী ভাবের সৃষ্টি করে; কিন্তু বিষাদময় সুর নৈরাশ্যবাদী ও অদৃষ্টবাদী ভাবের সৃষ্টি করে। পিথাগােরীয়গণ মনে করতেন যে, চারিত্রিক পরিবর্তনসাধনের মাধ্যমে সংগীত আমাদের আহলাদিত উচ্ছসিত কিংবা অলস ও উদাসীন করতে পারে। তারা এ-ও বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার বাহন হিসেবে এবং মানুষের বৌদ্ধিক ও নান্দনিক মানদণ্ডের উন্নতিবিধানে সংগীতের সুস্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সামঞ্জস্যের (harmony) ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পিথাগােরীয়রা এক সুদূরপ্রসারী নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শের রূপ দেন। তাদের কাছে সামঞ্জস্য ছিল শুভ ও শৃঙখলার প্রতীক। সামঞ্জস্য গ্রহগুলাের গতিবিধি এবং মানুষের গঠনপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু তা-ই নয়, সামঞ্জস্য দিব্য জগতের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। মানুষের উচিত এই দৈব সামঞ্জস্যের অনুশীলন ও অনুকরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক, নৈতিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সমানুপাত অর্জন করা। পিথাগােরীয় দার্শনিকদের আর্ট বা শিল্পকলা মানেই অনুকরণ। বাস্তবসত্তার চাবিকাঠি শিল্পকলাতেই নি কেননা শিল্পকলাই মানুষকে তার স্বগীয় উৎপত্তিস্থল ও অনন্ততার সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেয়। 

সমালোচনা

পিথাগােরীয় দর্শন সম্পর্কে সমালােচনা করতে গিয়ে স্টেইস্ (Stace) তাকে পরিপূর্ণভাবে অপরিণত দর্শন (Crude Philosophy) রূপে অভিহিত করেছেন। তার মতে, সংখ্যা সম্পর্কীয় মতবাদ শূন্যগর্ভ এবং নিরর্থক গাণিতিক রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে। হেগেলও পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের দার্শনিক চিন্তা সম্পর্কে বিরূপ সমালােচনা করেছেন। হেগেলের অভিমতানুসারে নির্দিষ্ট চিন্তার সঙ্গে নির্দিষ্ট সংখ্যাকে অনুষঙ্গবদ্ধ করার পদ্ধতিটি একান্তই খামখেয়ালির ব্যাপার। কেন পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের মতবাদ আমাদের কাছে আকর্ষণীয়, সেই সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে কপলস্টোন (Copleston) বলেন যে, প্লেটোর উপর পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের প্রভাবই এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার মতে, প্লেটো পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের আত্মা এবং অদৃষ্ট সম্পর্কীয় ধারণার নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পিথাগােরীয় সম্প্রদায়ের গাণিতিক গবেষণার দ্বারা প্লেটো বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কপলস্টোনের ভাষায়, “প্লেটোর চিন্তার পিথাগােরীয় সম্প্রদায় সুনির্দিষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। একথা বলা, তাদের কম প্রশংসা করা নয়।” (B. Russell : History of Western Philosophy: Page 56)। বার্ট্রান্ড রাসেল পিথাগােরাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “আমি অন্য এমন কোন লােকের কথা জানি না, চিন্তার ক্ষেত্রে যিনি তার মত এতখানি প্রভাবশালী ছিলেন। আমি এ কথা বলছি কারণ যাকে প্লেটোর মতবাদ (Platonism) বলে মনে হয়, তাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, স্বরূপত তা হল পিথাগােরাসের মতবাদ (Pythagoreanism)। এক শাশ্বত জগৎ যা ইন্দ্রিয়ের কাছে প্রকাশিত হয় না, অথচ বুদ্ধির কাছে প্রকাশিত হয়, তার সমগ্র ধারণাই তার কাছ থেকে পাওয়া। ঈশ্বরতত্ত্ববিদরা ঈশ্বর এবং অমরত্ব সম্পর্কে যে যুক্তিবিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের সন্ধান করেছিলেন তার মুলেও পিথাগােরাস। কিন্তু এ সবই পিথাগােরাসের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভাবে বিদ্যমান ছিল।”

পিথাগােরাসের সমসাময়িক দার্শনিক জেনােফেনিস (Xenophanes) তার জন্মান্তরবাদের জন্য তাকে উপহাস করেছিলেন এবং পিথাগােরাস পরবর্তী দার্শনিক হেরাক্লিটাস (Heraclitus) তার বিরুদ্ধে পল্লবগ্রাহীতার অভিযােগ আনয়ন করেন। রাসেল বলেন যে, অংশত পিথাগােরাসের জন্যই তার সময় থেকে দর্শনের উপর গণিতের প্রভাব লক্ষ করা যায়, সেই প্রভাব যেমন গভীর তেমনই দুর্ভাগ্যজনক (Both Profound and Unfortuate)। ভারতীয় দর্শন পরম্পরায়ও পিথাগােরাসের দর্শনের নাম, জ্ঞান এবং পদ্ধতি দেখা যায়।

তথ্যঋণ

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৩৮-৪৮
  • W. T. Stace, A Critical History of Greek Philosophy
  • Burnet, Early Greek Philosophy
  • Bertrand Russell : A History of Western Philosophy, Simon & Schuster, July 14, 1905
  • John Burnet : Early Greek Philosophy
  • Francis M. Cornford : From Religion to Philosophy: A Study in the Origins of Western Speculation, 1912
  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ১ম খণ্ড, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৪৯-৫৫
  • প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাশ্চাত্য দর্শনের কথা, ডঃ মোঃ শওকত হোসেন, তিথি পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৩৫-৪১

4 Trackbacks / Pingbacks

  1. প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শনের ভূমিকা ও আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. প্রাচীন এশিয়া মাইনোর : ফ্রিজিয়া ও লিডিয়া – বিবর্তনপথ
  3. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  4. এলিয়াটিক দার্শনিক সম্প্রদায় ও হেরাক্লিটাস – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.