মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায় : থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার ও অ্যানাক্সিমিনিস

Table of Contents

মাইলেটাসের ইতিহাস

মাইলেটাস ছিল এশিয়া মাইনোরে (তুরস্ক) অবস্থিত একটি উন্নত বাণিজ্যিক শহর। সেখানে ছিল অসংখ্য দাস জনগণ। স্বাধীন জনগণের মধ্যে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীর তিব্র সংগ্রাম ছিল।। রস্তভস্তেভ তার History of the ancient world গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মাইলেটাসের এই শ্রেনী সংগ্রামে প্রথমে দাস জনগণ জয়লাভ করে, ও অভিজাত শ্রেণীর স্ত্রী ও শিশুদের হত্যা করে। পরে আবার অভিজাত শ্রেণী প্রাধান্য বিস্তার করে ও জ্বলন্ত মশাল দিয়ে শহরের উন্মুক্ত স্থানে আগুন লাগিয়ে বিরুদ্ধবাদীদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।’ থেলিসের সময় এশিয়া মাইনোরে ছিল এমনই সংঘাতমত পরিস্থিতি। (Rostovtsev, History of the Ancient World, Vol.1, p. 204)।

৭ম ও ৬ষ্ঠ শতকে আয়োনিয়ার অন্যান্য বাণিজ্যিক শহরের মতই মাইলেটাসে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতিসাধন হয়। এই উন্নতির প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা অভিজাত ভূস্বামীদের হাতেই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অঞ্চলের বাণিজ্য সমৃদ্ধ হতে থাকলে, অন্যান্য অঞ্চলের সাথে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় ধনী বণিকদের হাতে। পরে এই ক্ষমতা চলে যায় স্বৈরশাসকের হাতে। এই স্বৈরশাসক যথারীতি গণতান্ত্রিক দলের সমর্থনেই খমতা দখল করে। সেই সময় এশিয়া মাইনোর ছিল লিডিয়ার রাজত্বের অংশ যার পশ্চিমের সামুদ্রিক শহরগুলো ছিল গ্রীকদের উপনিবেশ। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে ৫৪৬ অব্দ পর্যন্ত লিডিয়া স্বাধীনভাবে এশিয়া মাইনোর শাসন করে। এশিয়া মাইনোরদের ভাষা ছিল আনাতোলিয়ান ভাষা নামক আরেকটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা (গ্রীক ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয়)। লিডিয়ার রাজত্ব গ্রিসের সামুদ্রিক শহরের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত থাকলেও নিনেভের (৬০৬ খ্রিস্টপূর্ব) পতনের পূর্ব পর্যন্ত তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে লিডিয়া পশ্চিমী দেশসমূহের দিকে মনােযােগ প্রদানের সুযােগ লাভ করে। কিন্তু মাইলেটাস বিশেষ করে লিডিয়ার সর্বশেষ রাজা ক্রোয়েসাসের সঙ্গে যথারীতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সমর্থ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ অব্দে ক্রোয়েসাস সাইরাসের নিকট পরাজয় বরণ করে।

মাইলেটাসের সঙ্গে মিশরের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এ সময়ে মিশরের রাজা ভাড়াটে গ্রিক সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, এবং কিছু শহরকে গ্রিসের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেন। মিশরে প্রথম গ্রিক উপনিবেশ স্থাপনা ছিল মাইলেসিয় রক্ষীসেনা অধিকৃত একটি দুর্গ। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০-৫৬০ অব্দ পর্যন্ত মাইলেটাসের সবচেয়ে গুরুতর উপনিবেশ স্থাপনা ছিল ডাফনি। এখানে নেবুচাদরেজার দ্বারা নির্বাসিত জেরিমাইয়া এর অন্যান্য বহু ইহুদি শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়গ্রহণ করে (Jeremiah, xliii, 5 ff)। কিন্তু মিশর নিঃসন্দেহে গ্রিকদের প্রভাবিত করতে পারলেও ইহুদিদের প্রভাবিত করতে পারে নি। তবে সন্দেহবাদী আইওনিয়াদের প্রতি জেরিমাইয়াগণ ঘৃণা ছাড়া অন্য কোনাে কিছু উপলব্ধি করেছিলেন কিনা তা জানা যায়না।

মাইলেটাস ও আয়োনিয়ার তদকালীন ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “গ্রিক ইতিহাস – পর্ব ১: সভ্যতার উদ্ভব, স্পার্টা-এথেন্স ও টাইরান্টদের উত্থান” শীর্ষক লেখাটির টাইর‍্যান্টদের যুগ (Age of Tyrants) অংশটি পড়ুন।

ভূমিকা

প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি গ্রীসকে বিশ্বনন্দিত করেছেন কতিপয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। এখানেই ইউরোপীয় দর্শনের জন্ম। তবে গ্রীসের লোকদেরকে শুধু গ্রীক বলাটা যথেষ্ট নয়। গ্রীসের পূর্বদিকের ইজিয়ান সাগরের (aegean sea) পূর্বে কিছু ছোট ছোট দ্বীপ আছে, তারপর আছে তুরস্ক, তার পশ্চিমে অনেকখানি উপকূল অঞ্চল হল ছোট এশিয়া বা এশিয়া মাইনোর। প্রাচীনকালের গ্রীকদের প্রধান চার জাতির মধ্যে (আখিয়ান, এওলিয়ান, ডোরিয়ান, আয়োনিয়ান) আয়োনিয়ান বা আয়োনীয়রা এশিয়া মাইনোরে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সেই উপনিবেশে মোট ১২টি শহরের ইতিহাস-কথা রয়েছে, যাদের একটির নাম মিলেটাস। যে অঞ্চলে এই মিলেটাস তার নাম আয়োনিয়া।

আয়োনিয়ার অধিবাসীদের প্রায় সবাই নাবিকের জীবনযাপন করত, তাদের জীবিকা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। এজন্য তারা দূর দূরান্তে যাত্রা করত। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ট-৭ম শতকে তারা বহু দেশকে অনেকটা জানতে পারে, এই জানাজানির ভেতর দিয়ে সমগ্র অঞ্চলের নাম হয় গ্রীস। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও আয়োনীয়রা শিল্পকলাতেও অত্যন্ত পারদর্শী ও দক্ষ ছিল। বহির্জগতে গ্রিক কারিগরদের চাহিদা ছিল। এরা ব্যাবসার সাথে ভাব বিনিময়ও করেন। কার্লাগুহায় অঙ্কিত শিল্প নিদর্শন ও বিভিন্ন বৌদ্ধমঠের গায়ে খোদিত ভাষ্কর্য শিল্পের উপর গ্রিক ভাষ্কর্য রীতির সার্থক প্রভাব দেখা যায় (গান্ধার শিল্প)।

এই গ্রীকদের কেউ কেউ সৃষ্টির মূলতত্ত্বকে জানার জন্য চিন্তাভাবনা করেন। এই চিন্তাভাবনা থেকে গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে পুরনো শাখা আয়োনীয় সম্পরদায়ের থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস প্রমুখ দার্শনিকদের আবির্ভাব। এদের কেউ অগ্নিকে মূলতত্ত্ব বললেন, কেউ বায়ুকে, কেউ আকাশকে। আয়োনীয় দার্শনিক থেলিস (৬২৪ – ৫৪৭ খ্রিপূ) বললেন জলই আদি উপাদান। অ্যানাক্সিমেন্ডার (৬১১-৫৪৭ খ্রিপূ) বললেন বস্তুত মূল উপাদান নির্দিষ্ট কিছু নয়, এর আকার নেই। তিনি তার নাম দিলেন সীমাহীন বা বাউন্ডলেস (boundless)। অ্যানাক্সিমিনিস (৫৮৮-৫২৪ খ্রিপূ) বায়ুকে মূলতত্ত্ব বললেন। (এই সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের এক শতক আগে উপনিষদের দার্শনিকদের প্রশ্ন করে দেখা যায়, বিশ্বের মূল উপাদান কী? তারা বললেন এই মূল উপাদান হল পরম ব্রহ্ম।) তাদের দার্শনিক চিন্তার মুল উপজীব্য ছিল বিশ্ব সৃষ্টির উৎস্য কোথায় তা বের করা। আকাশচারী কল্পনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। অ্যানাক্সিমেন্ডার সেসময়ের জ্ঞাত জগতের একতা নকশা তৈরি করেন যা বহুদিন ধরে বণিকদের পথ প্রদর্শন করে। অর্থাৎ, তারা দার্শনিক ব্যবহার বা বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের দ্বারা নিজেদের জীবনবিমুখ করেন নি, তারা জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তাভাবনাকে বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছেন। এই দার্শনিকদের প্রশ্ন ছিল কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে। রাহুল সংকৃত্যায়ন তার দর্শন-দিগ্‌দর্শন গ্রন্থে বলছেন, “আয়োনীয় দার্শনিকগণ জীবনকে এত তুচ্ছ মনে করতেন না যে, তার জন্য পৃথক একটা চেতন চালকশক্তির প্রয়োজন হবে। মেঘগর্জন, বহমান নদী, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, দোলায়িত বৃক্ষ, স্পন্দিত পৃথিবী, প্রাণের স্ফূরণকেই প্রমাণ করে; এর জন্য কোন স্রষ্টা বা অন্তর্যামীকে জানার প্রয়োজন তারা বোধ করেননি। বস্তুজ্ঞানই তাদের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয়েছিল।” (তদকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে চার্বাক ও বৌদ্ধ দার্শনিকরাও সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসু ছিলেন না।)

মাইলেসীয় দার্শনিক সম্রদায়ের দার্শনিক তিনজন – থেলিস, অ্যানেক্সিমেন্ডার ও অ্যানেক্সিমিনিস। এই তিন দার্শনিকই মিলেটাস নগরের বাসীন্দা ছিলেন বলে তাদের মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায় বলা হয়, আবার তারা আয়োনিয়া অঞ্চলের লোক ছিলেন বলে তাদেরকে আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এর বিবেচনায় এদের সাথেও খ্রি.পূ. ৫ম শতকের ৩ জন আয়োনিয় দার্শনিক হেরাক্লিটাস, এনাক্সাগোরাসআর্কেলাওসকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এদের দর্শনই ইউরোপের দর্শনের আদি পর্যায়, গ্রীক দর্শন, এমনকি পাশ্চাত্য দর্শনের উদ্ভবের সূচনাও এদের থেকেই।

প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শনের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শনের ভূমিকা” লেখাটি পড়তে পারেন

থেলিস (খ্রি.পূ. ৬২৪-৫৪৬ অব্দ, মতান্তরে ৬৪০-৫৫০, ৬২৪-৫৪৭)

থেলিসের জীবন, বিজ্ঞান ও জ্যামিতিতে তার কৃতিত্ব

থেলিসকে সব দর্শনের প্রবর্তক বা জনক বলা হয় (W.T. Stace: A Critical History of Greek Philosophy P.20, Roberts. Brumbaugh : The Philosophers of Greece. P.12), এ ম্যান অফ সায়েন্স বলা হয় (John Burnet: Greek Philosophy, P.18)। তার বহুমুখী কর্মশক্তি ও অসাধারণ উদ্ভাবন ক্ষমতা ছিল। কথিত আছে, একদিন আকাশের তারা দেখতে দেখতে এমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি কুয়ার মধ্যে পড়ে যান। আরও কথিত আছে, তিনি পিরামিডের ছায়া থেকে পিরামিডের উচ্চতা মাপার কৌশল মিশরীয়দেরকে শিখিয়েছিলেন। তিনি সমুদ্র তীর থেকে সমুদ্রে অবস্থিত জাহাজের দূরত্ব আবিষ্কারের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আবার জলপাই তেলের ঘাটতি হবে ভেবে তিনি বাজার থেকে সস্তা দামে ঐ তেল কিনে পরে ঘাটতির কারণে চাহিদা বাড়লে তা বেশি দামে বিক্রি করে প্রচুর আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন। অ্যারিস্টোটল তার পলিটিক্স গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘ তার দরিদ্র অবস্থার জন্য তাকে কটাক্ষ করা হতো। শীতকাল আসার পূর্বেই আকাশের নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে বের করেন যে আগামী মৌসুমে জলপাই এর ফলন ভাল হবে। তাই হাতে সামান্য অর্থ থাকার পরও তিনি গ্রিস অ মাইলেটাসের সব জলপাইয়ের তেলকল ব্যবহারের জন্যটাকা জমা দেন। নিলাম ডাকার জন্য তার কোন প্রতিপক্ষ না থাকায়তিনি খুব সামান্য অর্থে তেলকল ভাড়া করেন। জলপাই সংগ্রহের সময় যখন অনেকে একই সাথে আকস্মিকভাবে তেলকল ভাড়া করার জন্য আগ্রহী হন তখন তিনি নিজ ইচ্ছানুসারে উচ্চমূল্যে সেগুলো ভাড়া দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। এভাবে তিনি প্রমাণ করেন, দার্শনিক ইচ্ছে করলেই খুব সহজে ধ্নী হতে পারেন, কিন্তু ধনী হওয়া তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভিন্ন এক ধরণের।’ গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান, বাস্তববুদ্ধি, তীক্ষ্ণ বোধশক্তি ও বিচিত্র কর্মদক্ষতার জন্য প্রাচীন গ্রীসে খ্যত ও সম্মানের পাত্র হন।

থেলিস সম্ভ্রান্ত কোনো এক গ্রিক মায়ের গর্ভজাত ছিলেন, আর মিশর ও ব্যাবিলনীয়া ভ্রমণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় তিনি গ্রিসে দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনেক প্রাচীন সভ্যতার ধারা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ব্যাবিলনিয়ানদের থেকে লোক-বিদ্যা আর জ্ঞান এবং সুর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট জ্যোতির্বিদ্যা শিখেছিলেন। আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ সালে৷ সংঘটিত একটি সূর্যগ্রহণের ক্ষেত্রে তার পূর্বানুমান লোকজনকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল, যা থেলিসের সম্মানকে দারুণ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মিশরীয় জ্যামিতিরও শিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে কিছু মৌলিক অগ্রগতিও আনয়ন করেছিলেন। প্রথমত, তিনি বালিতে বানানো, মোমে আচড় কাটা, বা টানা তারে তৈরি মোটা আর অনিয়মিত প্রকৃত রেখার চেয়ে শূন্য ঘনত্ব আর নিখুত সরলীকৃত কাল্পনিক রেখা নিয়ে বেশি কাজ করা প্রথম মানুষ ছলেন।

দ্বিতীয়ত তিনি প্রচলিত লব্ধ জ্ঞানের বিরুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার করে নিয়মিত বিতর্কের সিরিজ দিয়ে এবং প্রত্যাশিত প্রমাণকে অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি হিসেবে উপস্থাপন করে গাণিতিক বক্তব্যসমূহ প্রমাণ করেছিলেন। এটি জ্যামিতিক উন্নতিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছিল, আর সেটি ছিল গ্রিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সাফল্য। আর পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে, চিরুনি ঘষা হলে তা যেভাবে হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করে, তিনিই ছিলেন সেই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা প্রথম ব্যক্তি। চিরুনির গ্রিক নাম ইলেকট্রন, আর সেইরূপ আকর্ষণকে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ‘ইলেকট্রিসিটির ফলাফল বলে অভিহিত করা হত। থেলিস লোহাকে আকর্ষণ করা এক প্রকার কালো পাথরকেও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন পাথরটি নিকটবর্তী ম্যাগনেসিয়া শহর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে এটিকে ম্যাগনেটিক লিথেসি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল, আর এ থেকে ম্যাগনেট বা চুম্বক শব্দের উৎপত্তি।

সর্বশেষে, তিনি মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি, এর প্রকৃতি কী রকম, এর শুরুই বা হয়েছিল কিভাবে, সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন। এর জন্য তিনি দুটো ধারণা তৈরি করলেন। প্রথমে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন যে, দেবতা বা দেব বলে কিছু নেই বরং মহাবিশ্ব কিছু অপরিবর্তনীয় নিয়মাবলির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দ্বিতীয়ত, মানব-মন পর্যবেক্ষণ আর চিন্তার মাধ্যমে এসবের সাথে জড়িত কারণগুলো খুঁজে বের করতে পারে। বিজ্ঞানের সবকিছুই, থেলিসের সময়কাল থেকেই, এই দু’টি ধারণা দিয়ে চালিত হচ্ছে। পরবর্তী শতাব্দীতে মিলেটাসে এবং আইওনয়ার অন্য শহরগুলোতে অন্য অনেকেই থেলিসকে অনুসরণ করেছিলেন, আর এই পদ্ধতি অনুসরণকে “আইওনিয়ান স্কুল” বা আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় নামে অভিহিত করা হয়, এরা আয়োনিয়ার মিলেটাস শহরের অধিবাসী ছিলেন বলে এদেরকে মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ও বলা হয়। এভাবে, থেলিসের শিষ্য, খিস্টপূর্ব ৬১১ সালে জন্ম নেয়া, তরুণ অ্যানাক্সিম্যান্ডারও মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। প্রতিযোগী শহর ইফেসাসে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সালের দিকে জন্ম নেয়া হেরাক্লিটাসও তাই করেছিলেন।

থেলিসের রচিত কোন গ্রন্থের কথা জানা যায়না, তবে বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে তার জীবনী সম্পর্কে কিছু টুকরো কথা পাওয়া যায়। প্রথম দিককার কোনো অনুসন্ধানমূলক লেখাই টিকে থাকেনি, আমরা সেগুলো জানতে পারি পরবর্তী লেখকদের লেখায় তাদের চিন্তাধারার সাধারণ তালিকার মধ্য দিয়ে। এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন পিথাগোরাস, যিনি কিনা খিস্টপূর্ব ৫৮২ সালের দিকে আয়োনিয়ান উপকূলের সামোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেকে একজন “ফিলোসফার’ (প্রজ্ঞার প্রেমিক) হিসেবে পরিচিত করিয়েছিলেন আর এই নামেই গ্রিক চিন্তাবিদেরা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। যাই হোক, যেসব লেখা থেকে থেলিস সম্পর্কে জানা যায় সে অনুযায়ী সেই সময়ে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি হয় তার সাথে থেলিসের ঘনিষ্ঠতা ছিল, অবশ্য থেলিসের আগে বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল কিনা তা বিতর্কের বিষয়, কারণ থেলিসের আগ পর্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যা সহ বিভিন্ন বিষয় ধর্ম ও পৌরাণিক বিশ্বাসের দখল থেকে মুক্তি পায়নি। তবুও তখন জ্যামিতিতে মিশর, জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাবিলন ও নৌবিদ্যায় মিশরীয় বণিকরা বিখ্যাত ছিল। ব্যবসার জন্যই সম্ভবত থেলিস মিশরে যান ও সেখানকার জ্যামিতি শেখেন। কিন্তু মিশরীয়রা জ্যামিতির প্রয়োগ কেবল জমিজমা মাপার ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। থেলিসই প্রথমবার তা থেকে সমুদ্রের জাহাজের দূরত্ব মাপতে সক্ষম হন।

জ্যামিতিতে একটি কথা জানা এক জিনিস আর তা প্রমাণ করতে পারা আরেক জিনিস। প্রমাণ করার শর্তগুলো মিশরীয়রা স্পষ্ট করে জানাতে পারেনি, থেলিস পেরেছিল। যেমন, মিশরীয়রা জানত বৃত্তের ব্যাস বৃত্তকে দুইভাগে ভাগ করে। কিন্তু তারা তা প্রমাণ করতে পারত না। থেলিস এটি প্রমাণ করার পথ দেখান। তাই ইমানুয়েল কান্ট থেলিসকে প্রথম প্রকৃত গণিতজ্ঞের সম্মান দিতে চেয়েছেন। থেলিস মিশরীয় জ্যামিতির উন্নয়নে অনেক অবদান রাখেন। একইভাবে ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি উন্নয়ন ঘটান। ব্যাবিলনীয়রা কেবলমাত্র গ্রহ-নক্ষত্রের ছবি এঁকেছিল। ৫৮৫ সালে থেলিসই সেই ছকের উপর নির্ভর করে হিসাব করে দখান কবে গ্রহণ হবে। আকাশের তারার উপর নির্ভর করে দিক নির্ণয়ের যে কৌশল ব্যাবিলনীয়রা আয়ত্ত করেছিলেন, থেলিস গ্রীক জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে সেই কৌশল আমদানি করেন। গ্রিসের সাত জন জ্ঞানী ব্যক্তির মধ্যে (Seven Sages বা সপ্তপ্রাজ্ঞ) থেলিস ছিলেন অন্যতম। সপ্তপ্রাজ্ঞরা সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বনের সুপারিশ করতেন যাতে করে সমাজে কোন রকম অশান্তি দেখা না দেয়। পুররাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতিকে তারা সব সময় অগ্রাধিকার দিতেন। এদের প্রত্যেকেই এক একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। থেলিস মনে করতেন যে সম্পদের বিষম পুঞ্জীভবন ও দারিদ্র্য রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার পক্ষে ক্ষতিকারক। সপ্তপ্রাজ্ঞরা সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বনের সুপারিশ করতেন যাতে করে সমাজে কোন রকম অশান্তি দেখা না দেয়। পুররাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতিকে তারা সব সময় অগ্রাধিকার দিতেন।

প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে জানতে এখানে যান

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, থেলিসের সময়কাল সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাথমিক তথ্য হচ্ছে, তিনি একটি চন্দ্রসূর্যাদির গ্রহণ সংঘটিত হওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দেন এবং বিখ্যাত হন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, এই গ্রহণ খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দে সংঘটিত হয়। এই প্রাথমিক তথ্যের মতাে অন্যান্য প্রামাণিক তথ্যও তার কার্যাবলি সম্পর্কে উক্ত সময়কালকেই নির্দেশ করে। একটি গ্রহণ সংঘটিত হওয়ার সঠিক পূর্বাভাস প্রদান তার অসাধারণ সৃজনী প্রতিভা থাকার প্রমাণ বহন করে না। মাইলেটাসের সঙ্গে লাইডিয়ার সুসম্পর্ক ছিল এবং লিডিয়ার সঙ্গে ব্যবিলনের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ আবিষ্কার করেন যে, প্রায় ঊনিশ বছর পর পর পর্যায়ক্রমে গ্রহণ পুনঃসংঘটিত হয়। তারা প্রায় পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারতেন, কিন্তু সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে কোনাে প্রকার পূর্বাভাস দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কারণ সূর্যগ্রহণ একস্থানে প্রত্যক্ষিত হতে পারে আবার অন্যস্থানে প্রত্যক্ষিত নাও হতে পারে। ফলে তারা কতগুলাে বিশেষ তারিখ গ্রহণ প্রত্যক্ষণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত শুধু তাই জানতে পারেন। থেলিস সম্ভবত এসব বিষয় জানতেন। থেলিস নিজে বা উক্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ কেন পর্যায়ক্রমে গ্রহণ হয় তা জানতেন না।

বলা হয়, থেলিস মিশর ভ্রমণ করেন, এবং সেখান থেকেই তিনি গ্রিসবাসীর নিকট জ্যামিতিবিজ্ঞানের ধারণা নিয়ে আসেন। কিন্তু রাসেল এই বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জ্যামিতি বিষয়ে মিশরীয়দের জ্ঞান ছিল প্রধানত অভিজ্ঞতালব্ধ এবং আইনকানুনহীন ব্যবহারিক পদ্ধতি। একথা বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই যে পরবর্তীকালে গ্রিকদের আবিষ্কৃত অবরােহী প্রমাণ সম্পর্কে থেলিস অবগত ছিলেন। রাসেলের মতে, সমুদ্রতীরের দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের দূরত্ব, এবং পিরামিড থেকে প্রতিফলিত ছায়ার সাহায্যে পিরামিডের উচ্চতা পরিমাপের পদ্ধতিও তিনি আবিষ্কার করেন বলে মনে করা হলেও তা সঠিক নয়।

থেলিসের দর্শন

থেলিস তার দর্শন চিন্তার জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাত ছিলেন, কিন্ত এপর্যন্ত পাওয়া থেলিসের দার্শনিক মত মাত্র দুটি –

  • ১। থেলিসের মতে পরমসত্তা হল জল, জল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, জলের মধ্যেই সব কিছু বিলীন হয়ে যায়।
  • ২। পৃথিবী জলের উপর ভাসমান একটি সমতল চাকতি।

প্রথমটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দুটো প্রশ্ন ওঠে –

  • ১। থেলিস জলকেই সব বস্তুর আদি কারণ কেন মনে করলেন?
  • ২। কোন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া অনুসারে জল বিভিন্ন বস্তুতে পরিণত হয়েছে বা জল থেকে এই বিশ্বজগতের উদ্ভব হয়েছে?

থেলিস এই প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। ১ম প্রশ্নের ক্ষেত্রে এরিস্টোটল অনুমান করেন, সব পুষ্টিকর পদার্থের মধ্যে আর্দ্রতা আছে, আর যা কিছু আর্দ্র তা থেকেই উত্তাপের উৎপত্তি। জলের সাহায্যে জীব প্রাণ ধারণ করে, এছাড়া সব বীজের মধ্যে একটা স্যেঁতস্যেঁতে বা ভেজা ভাব রয়েছে। এসব দেখেই থেলিস এই সিদ্ধান্তে এসে থাকতে পারেন। ২য় প্রশ্নের ক্ষেত্রে জেলার (Zeller) অনুমান করেছেন, থেলিস উপাদানের সাথে গতিশক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মনে করতেন। (E. Zeller : Outlines of History of Greek Philosophy. P.27.)। বার্নেট বলেন, এরিস্টোটলের এই অনুমান পরবর্তী এক দার্শনিক দ্বারা প্রভাবিত যিনি বলেছিলেন বায়ু হচ্ছে সব কিছুর মূল এবং বায়ু ও জলের বাষ্পীভূত অবস্থা আসলে একই জিনিস। সেই দার্শনিক এও বলেছিলেন, বায়ুকে এক বিশুদ্ধ ও অধিকতর স্বচ্ছ আর্দ্রতার অবস্থারূপে ধরা যায়।

এরিস্টোটলের একটি সংক্ষিপ্ত উক্তি থেকে জানা যায়, জগতে যা কিছু দেখা যায় সবই ঈশ্বরের দ্বারা পূর্ণ। থেলিস বলেন, যেহেতু চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে তাই তার আত্মা বা প্রাণ আছে। দ্রব্যের মধ্যেও আত্মা বা প্রাণ আছে। থেলিসের এই মতই পরবর্তীকালে সজীব বস্তুবাদ (hylozoism) বা সর্বাত্মাবাদ (panpsychism) নামে পরিচিতি লাভ করে। বার্নেট অবশ্য এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। (Early Greek Philosophy. পৃ. ৫১)।

থেলিসের দর্শনের গুরুত্ব

থেলিসের বক্তব্যে নতুন কিছু নেই। তার আগে গ্রীক কবি হোমার ও হেসইডই কল্পনা করেছিলেন যে জল থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। মিশর ও ব্যাবিলনের প্রাচীন পুরাণেও এরকম কথাই লেখা আছে। ব্যাবিলনের পুরাণে আছে, এককালে সব কিছু জল ছিল, সৃষ্টিকর্তা মার্দুক আদি প্লাবন থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি করেছেন। ‘জল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, জলেই সব কিছুর পরিণতি’ – এই কথাটা থেলিসের দর্শনের মূলকথা হলেও এটা দার্শনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ জল থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি হবার ব্যাপারটা বিভিন্ন পৌরাণিক কল্পনায় উঠে এসেছিল। তাহলে প্রশ্ন আসে, থেলিসের চিন্তায় যদি নতুন কিছু নাই থাকে তবে তিনি কেন দর্শনের জনক। রাসেল বলছেন, “অ্যারিস্টটলের মতে, থেলিস মনে করতেন জলই বিশ্বের মূল উপাদান এবং জল থেকেই অন্যান্য বস্তু গঠিত। তিনি আরাে মনে করতেন, পৃথিবী জলের উপর ভাসমান।… এখানে সকল বস্তু জল থেকে সৃষ্ট এই উক্তিকে একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হিসেবে গণ্য করতে হবে, এবং কোনােভাবেই উক্তিটিকে বিচারবুদ্ধিহীন প্রকল্প হিসেবে গণ্য করা যাবে না। বিশ বছর পূর্বের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সকল বস্তুই হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্ট, যার দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে জল। প্রকল্প প্রণয়নে গ্রিকগণ ছিলেন অপরিণামদর্শী। কিন্তু মাইলেসিয় দার্শনিকগণ প্রকল্পসমূহকে কমপক্ষে অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণ করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। থেলিসের দর্শনের পরিপূর্ণ ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়ার পক্ষে খুব সামান্য তথ্যই জানা যায়। তবে মাইলেটাসে তার উত্তরসূরিদের সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য জানা যায়। একথা অনুমান করাও যুক্তিসঙ্গত যে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু কিছু বিষয় তারা থেলিসের নিকট থেকেই পেয়েছেন। থেলিসের বিজ্ঞান ও দর্শন ছিল অপরিপক্ক, কিন্তু তা আমাদের চিন্তা ও পর্যবেক্ষণকে উদ্দীপিত করতে সমর্থ ছিল।” যাই হোক, থেলিসের দর্শন অন্তত তিনটি বিষয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ –

  • ১। সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দেয়া : তাকে দর্শনের জনক বলার কারণটা হচ্ছে তিনিই প্রথম পৌরাণিক চিন্তার কাঠামোটাকে বাদ দিয়ে প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মেজাজ নিয়ে বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। থেলিসের আসল গৌরব হচ্ছে তিনি প্রথম জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে মার্দুক এর মতো সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে দেন। তিনি বিধাতা-পুরুষকে বাদ দিয়ে কেবল পার্থিব জিনিসের সাহায্যে পরমসত্তাকে চেনার চেষ্টা করেছিলেন, পৌরাণিক কল্পনাকে পেছনে ফেলে তিনি বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বরহস্যের সমাধান করতে চেয়েছিলেন। তার বক্তব্য আর যাই হোক, তা ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়, নয় পৌরাণিক কল্পনার ক্রীতদাস। তার দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিনি বললেন, এই বিশ্বজগতের বহুত্বের মূলে যে একটি মাত্র মূল কারণ বা তত্ত্বের উপস্থিতি রয়েছে। এটি বলে তিনি প্রাক-সক্রেটিস বা প্রিসক্রেটিক যুগের আলোচনার গতি-প্রকৃতি নির্দেশ করে দেন। সমস্ত প্রিসক্রেটিক যুগের আলোচনার বিষয়বস্তুই ছিল বিশ্বের বহুত্বের মূলে একটি মাত্র আদিম কারণের উপস্থিতি।
  • ২। বিশ্বজগতের ঐক্য ও বিভেদের মধ্যে ঐক্যের ধারণা : আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল থেলিস বিশ্বজগতের ঐক্য (unity of the world) সম্পর্কে ধারণা করেন। দর্শনের একটি লক্ষ হচ্ছে, একটি মাত্র মূলনীতি বা তত্ত্বের অনুসন্ধান (থিওরি অফ এভরিথিং) যা দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করা যাবে। অন্যভাবে বললে, দর্শন সত্তার একটি মাত্র সংহতি বা a single system of reality এর অনুসন্ধান করে। থেলিসের আগে এটা নিয়ে কেউ ভাবেনি। কপলস্টোন বলেন, তিনি বস্তুসমূহকে (things) একটি প্রাথমিক বা মূল উপাদানের ভিন্ন ভিন্ন রূপ হিসেবে ধারণা করেছেন। এভাবে থেলিস সর্বপ্রথম বিভেদের মধ্যে ঐক্য বা unity in difference এর ধারণা দেন। এই ঐক্যের ধারণায় অটল থেকে তিনি বহুত্বের বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন। থেলিস ভেবেছিলেন এই জগতের অসীম বৈচিত্র্যের মধ্যেও যথেষ্ট সংহতি আছে। আর এজন্যই জগতের একটি মাত্র তত্ত্বের কথা ভাবা যেতে পারে। এরকম ভাবনাই দর্শনের সূত্রপাত ঘটায়।
  • ৩। প্রশ্ন উত্থাপন : একজন দার্শনিকের কৃতিত্ব কেবল প্রশ্নের উত্তর দেয়ায় নয়, একই সাথে প্রশ্ন করাতেও। থেলিসও এই কৃতিত্বে কৃতী। তিনি যে প্রশ্ন উত্থাপন করেন তার সঠিক জবাব হয়তো তিনি দিতে পারেননি, কিন্তু যে প্রশ্নটি তিনি উত্থাপন করে গিয়েছিলেন, তার জবাব পরবর্তী সমস্ত কালের দার্শনিকেরাই খুঁজে গেছেন, আজকের যুগের পদার্থবিজ্ঞানীরাও এই থিওরি অফ এভরিথিং খুঁজতে ব্যস্ত। এছাড়া থেলিস পরবর্তী সময়ে অন্য আরেকটি প্রশ্ন গোটা দর্শন রাজ্য জুড়েই বিস্তৃত ছিল। তা হল, সবকিছু কি একটিমাত্র সত্তা থেকে নিঃসৃত?
  • ৪। মনের ধারণার বদলে বস্তুজগতের কার্যকারণ নিয়মে ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা : থেলিসের আগে বস্তুর বা ঘটনার কার্যকারণের ব্যাখ্যায় আনা হত কারও মন, ইচ্ছা এসবকে। থেলিস কোন ধারণার অনুসঙ্গের সাহায্যে বিষয়ের ব্যাখ্যা করেন নি, তিনি ব্যাখ্যা করলেন স্থান-কালে অবস্থিত বস্তুর সঙ্গে বস্তুর যে কার্যকারণ সম্পর্ক তার সাহায্যে।

থেলিসের দ্বারা দর্শনের সূচনা হবার সামাজিক কারণ

গ্রীক সভ্যতার চেয়ে ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয় সভ্যতা পুরোনো, কিন্তু তাও সেসব সভ্যতায় দর্শনের উন্মেষ না ঘটে গ্রীসেই কেন ঘটল? এটা থেলিসের একক প্রতিভার ফল নাকি জাতি হিসেবে গ্রীকদের প্রতিভার ফল? নাকি দুটোই? গ্রীকদের প্রতিভার ভিত্তি ছিল তাদের সমাজের কাঠামো। গ্রীক দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, দাস সমাজের প্রথম স্তরটা ছেড়ে যতই তারা দ্বিতীয় স্তরের দিকে এগিয়েছে ততই তাদের মধ্যে শৌখিন চিন্তা-বিভোরতার লক্ষণ দেখা গেছে। কিন্তু থেলিস যে সময়টার দার্শনিক, যে সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে ও যে সামাজিক শ্রেণীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল তা ছিল দাস সমাজের প্রথম দিক। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের আয়োনিয়ার রাজনৈতিক শক্তি অনেকটাই ছিল সওদাগর শ্রেণীর হাতে। এই শ্রেণী বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে পৃথিবীকে আরও ভাল করে জয় করতে চাইত। তারা সামাজক মেহনতে অংশগ্রহণ করে। দাসপ্রথা তখনও মেহনতি জীবনকে ঘৃণার চোখে দেখার স্তরে পৌঁছায়নি। এই আয়োনিয়ার সবচেয়ে কর্মমুখর শহর ছিল মিলেটাস। সেই মিলেটাস শহরের সওদাগর শ্রেণীরই একজন ছিলেন থেলিস। আর তাই তার কাছে ধর্মমোহটা প্রয়োজনীয় নয়, প্রয়োজনীয় ছিল বিজ্ঞান। আর তাই বিশ্বরহস্য ভেদ করার জন্য তিনি ধর্মমোহের দ্বারস্থ না হয়ে দ্বারস্থ হতে চাইলেন বিজ্ঞানের। ফলে বিশ্বের রহস্যের বর্ণনায় মার্দুকের মত সৃষ্টিকর্তার স্থান রইল না। থেলিস বললেন, এই বাস্তব জগতের একটিই পদার্থ, আর তা কোন আধ্যাত্মিক কিছু নয়, সেটি হল জল। থেলিসকে বস্তুবাদী করে তুলেছিল তার কর্মজীবনের সাথে বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এটাই তার চিন্তাকে আধ্যাত্মিকতাবাদ বা ভাববাদের মোহ থেকে সরিয়ে নেয়। এজন্যই তিনি লাভ করেন প্রথম দার্শনিকের গৌরব। জগতের অসীম ও অনন্ত বৈচিত্র্যের মূলে মাত্র একটি সত্তা রয়েছে, এই চিন্তাটাই থেলিসকে কেবল গ্রীক দর্শন নয়, এমনকি ইউরোপীয় দর্শন বা পাশ্চাত্য দর্শনও নয়, তাকে সর্বকালের দর্শনের জনক হবার কৃতিত্ব দান করে।

অ্যানাক্সিমেন্ডার (খ্রি.পূ. ৬১১–৫৫৭ অব্দ)

পরিচয় ও কৃতিত্ব

অ্যানাক্সিমেন্ডার খুব সম্ভবত থেলিসের সমসাময়িক বা শিষ্য ছিলেন। তার জন্মকাল সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা না গেলেও খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ অব্দে তার বয়স ৬৪ বছর ছিল বলে মনে করা হয়, এবং এই তথ্যকে অনেকাংশেই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করার যুক্তি রয়েছে। মাইলিসিয়ার অধিবাসীরা তাকে অ্যাপোলেনিয়ার একটি কলোনীর নেতা নির্বাচন করে, তাতে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ও অভিজাত পরিবারে জন্মের ব্যাপারে অনুমান করা যায়। অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকদের মত তিনিও রাজনীতিতে জড়ান। জ্যোতির্বিদ্যা ও ভৌগলিক জ্ঞানের জন্য তার খ্যাতি ছিল, তিনি থেলিসের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন ও তার গবেষণার ফল গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন, তবে সেই গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি প্রথম গ্রীক দার্শনিক যিনি গ্রন্থ লিখেছিলেন। এছাড়া তিনি সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রীক গদ্যলেখক। তিনি সর্বপ্রথম একটি মানচিত্র অঙ্কন করেন, সম্ভবত কৃষ্ণসাগরের নাবিকদের জন্য। জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোল চর্চার জন্য তিনি মডেল এর প্রবর্তন করেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। থেলিসের মত তিনিও ব্যবহারিক বিজ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি থেলিসের মত একজন যন্ত্রশিল্পী ছিলেন, ছিলেন থেলিসের মতই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অ্যানাক্সিম্যান্ডার ছিলেন পূর্ণমাত্রায় বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহলী। তিনিই সর্বপ্রথম মানচিত্র তৈরি করেন বলে মনে করা হয়। তার মতে, পৃথিবী একটি সিলিন্ডারের মতাে। অনেকের মতে তিনি বলেন যে, সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর মতােই বড়, বা সূর্য পৃথিবী থেকে সাতাশ বা আটাশ গুণ বড়। দার্শনিক চিন্তাধারায় তার মৌলিকত্ব বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিপূর্ণ। রাসেল তার সম্পর্কে বলেন, “যখনই তিনি মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন তখনই তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও বিচার বুদ্ধিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।” (“Wherever he is original, he is scientific and reationalistic.-B. Russell : History of Western Philosophy, P.46.)।

সীমাহীন বা বাউন্ডলেস এর ধারণা

তিনি বস্তুজগতের পরমসত্তার প্রকৃত রূপ সনাক্ত করতে চান। থেলিসের ন্যায় জলের মত কোন স্থূল বস্তুকে পরম বস্তু মানতে তিনি রাজি হননি, তিনি বস্তুজগতের এমন একটি সূক্ষ্ম বস্তুকে পরম সত্তা মনে করতে চান যা থেকে অগ্নি, বায়ু, জল, মাটি সব স্থূল বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে। তার কাছে এই আদিসত্তা হচ্ছে সীমাহীন বা বাউন্ডলেস। এটা হল সীমাহীন, অনন্ত, অসীম, অবর্ণনীয় বস্তু, যার থেকে সব কিছুর জন্ম হয়, ও সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। এটা কোন নির্দিষ্ট জড় নয়, এটা হল আকারহীন, অনির্দিষ্ট ও সকল প্রকার বৈশিষ্ট্যবর্জিত, মানে এতে কোনরকম বৈশিষ্ট্য বা গুণ নেই। কোন কিছু থেকে এই সীমাহীন এর উৎপত্তি হয়নি, এটি প্রথম থেকেই আছে, কোন কিছু থেকেই এটি গতিপ্রাপ্ত হয়নি (গতি অর্থ হল যার ফলে এটি বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে)। তবে মনে রাখতে হবে এই সীমাহীন আধ্যাত্মিক কিছু নয়। অ্যানাক্সিমেন্ডারের দর্শনে এই সীমাহীনও একটি বাস্তব জিনিস, জড় জগতের পদার্থ।

কেন তার কাছে মূল উপাদান সীমাহীন? কেউ মনে করেন, তিনি ভেবেছিলেন, জল যেহেতু বিশ্বের একটা নির্দিষ্ট অংশমাত্র, তাই এর পক্ষে বিশ্বের মূল উপাদান হওয়া সম্ভব নয়। অংশের সাহায্যে সমগ্রের ব্যাখ্যা দেয়া যায়না। তাই বিশ্বের মূল উপাদানকে হতে হবে অসীম ও সর্বব্যাপক। বার্নেট বলেন, অ্যানাক্সিমেন্ডারের চিন্তাজগতে একাধিক বিরুদ্ধ বিষয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। যেমন, উষ্ণ ও শীতল, আর্দ্র ও শুষ্ক। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মনে হয়েছিল থেলিস শুষ্কতার চেয়ে আর্দ্রতার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেছেন, আমাদের জ্ঞাত দ্রব্যসমূহের মধ্যে কোনাে একটি যদি মৌলিক দ্রব্য হতাে, তাহলে সেটি অন্য উপাদানসমূহকে জয় করতে সক্ষম হতাে, কিন্তু প্রকৃতিতে বিপরীত বা বিরুদ্ধ রূপ দেখা যায় যার কোনটাই কোনটাকে স্থায়ীভাবে জয় করে নিতে পারেনা। এরকম যত প্রকারের বিপরীত ও বিরুদ্ধ রূপ আছে সবই কোন অবিশেষ, অনির্দিষ্ট জড় থেকে বিচ্ছিন্ন বা পৃথক হয়ে এই বিশেষ বিশেষ বিপরীত ও বিরুদ্ধ রূপগুলো লাভ করেছে। এছাড়া এই জ্ঞাত পদার্থসমূহের মধ্যে যদি কোনটি অসীম হয় তাহলেও তা অন্য পদার্থসমূহকে জয় করে নেবে, কারণ এগুলোতে বিরুদ্ধ গুণ বর্তমান। তাই এই বৈপরীত্যময় বিশ্বে মৌলিক দ্রব্যটি হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ দ্রব্য। এই মৌলিক দ্রব্যের মধ্যে এক অনন্ত গতি বিদ্যমান ছিল, এবং এই অনন্ত গতির এক বিশেষ পর্যায়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়। অ্যানাক্সিমেন্ডার এই অনির্দিষ্ট ও নিরপেক্ষ জড়কেই প্রাথমিক উপাদান হিসেবে গণ্য করলেন। তিনি থেলিসের মত বিপরীত গুণগুলোর বিষয়টি বিবেচনা না করে একটি বিশেষ গুণের সাথে মূল উপাদানকে অভিন্ন ভাবাটাকে সমর্থন করতে পারেন নি। তার কাছে তাই সীমাহীন নিরপেক্ষ অবিশেষ কিছুই হল মৌলিক জড়, যেখান থেকে বিপরীত বা বিরুদ্ধ গুণগুলো পৃথক হয়ে বিভিন্ন সত্তা লাভ করেছে।

এরিস্টোটল বলেন, অ্যানাক্সিমেন্ডার ভেবেছিলেন, সীমাহীন থেকে বিপরীত গুণগুলো যেমন পৃথক সত্তা লাভ করে, তেমনি সেই সব পৃথক বস্তু উপাদানগুলো আবার সীমাহীনে মিলিয়ে যায়। যে উৎস্য থেকে বস্তুসমূহের উৎপত্তি, সেখানেই আবার তাদেরকে ফিরে যেতে হয়। এরা সময়ের ক্রমানুসারে একে অন্যের সন্তোষ বিধান বা ক্ষতিপুরণ করে থাকে। যদি এই মূল জড় উপাদান অসীম না হয়ে সসীম হত, তাহলে অসংখ্য জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হতে গিয়ে এই জড় উপাদান অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেত। কারও কারও মতে, অ্যানাক্সিমেন্ডার ভাবত জগৎ হল ধারাবাহিক। একটি জগতের সৃষ্টি ও ধ্বংসের পর আরেকটি জগতের সৃষ্টি হত। আবার কারও মতে অ্যানাক্সিমেন্ডারের জগৎ ধারাবাহিক নয়, বরং সমকালীন। তবে এই জগতের কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়।

অ্যানাক্সিমেন্ডারের দর্শনে জড় ও জীবজগতের বিবর্তন

কিভাবে এই আকারহীন, অনির্দিষ্ট, অবিশেষ জড় উপাদান থেকে অসংখ্য জগতের সৃষ্টি হল? এখানে স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। অ্যানাক্সিমেন্ডার এর এই প্রাথমিক উপাদান সীমাহীন, স্বয়ম্ভূ (নিজে নিজের সৃষ্টি করেছে বা আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে, কোন কিছু থেকে আসেনি), এটির বিনাশ নেই, এর গতিও অনন্ত। গতি বলতে এর পরিবর্তনের ব্যাপারটাকে বলা হচ্ছে। এই অনন্ত গতির একতি বিশেষ পর্যায়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়। আব্রাহামিক ও পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বের মত এটির সৃষ্টি হয়নি, কোন চেতন সত্তা হুট করে নিজের ইচ্ছায় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেনি, এর সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে। কেবল তাই নয়, অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে প্রাণীজগতেরও বিবর্তন ঘটেছে। তার মতে, সমুদ্র থেকেই সব জীবের উৎপত্তি। বর্তমান পৃথিবীতে যেসব প্রাণী দেখা যায়, নতুন পরিবেশের সাথে তাদের অভিযোজন বা সামঞ্জস্য বিধানের ফলেই তারা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। মানুষের উৎপত্তিও এভাবেই। তার মতে শুরুতে মানুষ অন্য প্রজাতিভূক্ত ছিল। এভাবে আধুনিক বিবর্তনবাদের সাথে অ্যানাক্সিমেন্ডারের বিবর্তনের মধ্যে একরকম সামঞ্জস্য পাওয়া যায়।

অ্যানাক্সিমেন্ডার বলেন গতির কারণেই সীমাহীন থেকে বিশেষ বিশেষ বস্তুর পৃথকীকরণ সম্ভব হয়। তার মতে, জগৎ গঠিত হবার মূলে রয়েছে বিপরীত বা বিরুদ্ধ বিষয়ের বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন হবার প্রক্রিয়া (seperating out of the opposites)। অবিশেষ, অনির্দিষ্ট, আকারহীন প্রাথমিক উপাদান গতির কারণে কোন এক অনিশ্চিত প্রক্রিয়ায় নিজেকে উষ্ণ ও শীতল এই দুইয়ে বিভক্ত করে, এরপর শীতল পরিণত হয় আর্দ্র ও সেঁতসেঁতে। এই আর্দ্র জড় উপাদান বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থিত পৃথিবীর রূপ গ্রহণ করল। উষ্ণ জড় উপাদান পৃথিবী বেষ্টনকারী অগ্নিমণ্ডলে পরিণত হল। পৃথিবী ছিল মূলত তরল। চারপাশের উত্তাপে পৃথিবীর জল ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের আবরণ সৃষ্টি করে পৃথিবীকে বেষ্টন করল। উত্তাপের প্রভাবে এই বাষ্প বিস্তৃতি লাভ করে অগ্নিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ও অসংখ্য চক্রাকৃতির খোসা রূপ গ্রহণ করে পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হতে থাকে, এরাই সূর্য, চন্দ্র, তারকা ইত্যাদি গ্রহ-নক্ষত্র। তার মতে বিশ্বজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত এই পৃথিবী নলাকার, যার উপরিভাগে মানুষ বাস করে, এর ব্যাস তার উচ্চতার তুলনায় তিনগুণ। কারও মতে তিনি মনে করতেন সূর্য পৃথিবীর থেকে ২৭ বা ২৮ গুণ বড়।

ভারসাম্য বজায় রাখার প্রাকৃতিক নিয়ম

অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে পৃথিবীতে সুনির্দিষ্ট পরিমাণে আগুন, জল ও মাটি ছিল। এগুলো সবই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার জন্য এক ধরণের অনিবার্য ও প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে। এর ফলে যেখানে আগুন থাকবে সেখানে ভস্মও থাকবে, এই ভস্মই হল পৃথিবী। এখান থেকে অ্যানাক্সিমেন্ডারের ন্যায়পরায়ণতা বা জাস্টিসের একটি ধারণা পাওয়া যায়, যা ভারসাম্য রক্ষার একটি অনিবার্য ও প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু অ্যানাক্সিমেন্ডারের দর্শনে এই অনিবার্য ও প্রাকৃতিক নিয়ম কোন ঈশ্বর নয়। (গ্রীকদের বিশ্বাসে এই ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারটা ছিল, যা নিশ্চিতভাবেই অ্যানাক্সিমেন্ডারদেরকে প্রভাবিত করে। তাদের কাছে ন্যায় তাই যা শাশ্বতভাবে সুনির্দিষ্ট সীমাকে অতিক্রম করেনি। তাদের কাছে মানুষ ও দেবতা সবই এই ন্যায়পরায়ণতার অধীনে ছিল। কিন্তু এই পরমশক্তি নিজে যেমন কোনাে ব্যক্তি নয়, তেমনি কোনাে পরম ঈশ্বরও নয়। অ্যানাক্সিমেন্ডার যে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বার উদ্দেশ্যে অবিরাম প্রচেষ্টার কথা বলছিলেন, গ্রীকরা সেইসব প্রাকৃতিক উপাদানকে দেবতা হিসেবেই কল্পনা করত।) একটি উপাদানের উপর অন্য উপাদানের অবৈধভাবে পদার্পন ছিল আনেক্সিমেন্ডারের ভাষায় অনাখ্যতা বা অন্যায় (Injustice)। গ্রীষ্মকালে উষ্ণ উপাদান ও শীতকালে শীতল উপাদানের ইনজাস্টিস দেখা যায়। এই বিশেষ উপাদানগুলোর এই ইনজাস্টিস এর ক্ষতিপূরণ হয় সীমাহীনের মধ্যে মিশে গিয়ে। এভাবে অ্যানাক্সিমেন্ডার মানুষের জীবনের আইনের ধারণাকে সমগ্র জগতের উপর প্রয়োগ করেন।

অ্যানাক্সিমেন্ডারের দর্শনের গুরুত্ব ও থেলিসের দর্শনের থেকে অগ্রগতি

  • ১। থেলিসের আদি উপাদান জলের থেকে অ্যানাক্সিমেন্ডারের আদি উপাদান সীমাহীন বা বাউন্ডলেস অগ্রগতি ছিল। কারণ এখানে বিমূর্ত চিন্তা বা এবস্ট্রাক্ট থট এর ব্যাপার দেখা যায়। এছাড়া অ্যানাক্সিমেন্ডারের এই মূল উপাদানের তত্ত্ব থেকে বিপরীত গুণের বস্তুগুলোর সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে থেলিসের জলও একটি। একটি বিশেষ উপাদানের তুলনায় একটি নির্বিশেষ সীমাহীন থেকে সব কিছু উদ্ভূত হয়েছে, এই ধারণাটি চিন্তার অগ্রগতিকেই নির্দেশ করছে।
  • ২। থেলিস তার আদিম তত্ত্ব জল দিয়ে কিভাবে বিশ্ব সৃষ্টি হল সেই ব্যাখ্যায় যাননি। কিন্তু অ্যানেক্সিমেন্ডার তার তত্ত্বের ধারণা থেকে কিভাবে অস্তিত্বশীল জগৎ এল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অর্থাৎ তার দর্শনে বিশ্বজগতের বিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এটাও একটি অগ্রগতি।

অ্যানাক্সিমিনিস (খ্রি.পূ. ৫৮৮-৫২৪ অব্দ)

অ্যানাক্সিমিনিসের জীবন

অ্যানাক্সিমিনিস মাইলেসিয় দর্শন ঘরানার ৩য় ও শেষ দার্শনিক। তার জন্মকাল সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে তিনি নিশ্চিতরূপে অ্যানাক্সিম্যান্ডারের পরবর্তী দার্শনিক এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ অব্দে আবির্ভূত হন। কারণ ঐ বছরই আয়োনীয় বিদ্রোহ দমনে মাইলেটাস পার্সিদের দ্বারা ধ্বংসতূপে পরিণত হয়। তিনি অ্যানেক্সিমেন্ডারের ছাত্র হতে পারেন। তিনিও একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার একটি ক্ষুদ্র অংশ পাওয়া যায়। তিনি থেলিস ও অ্যানেক্সিমেন্ডারের মত মৌলিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। বার্নেটের মতে তার দর্শন তার পূর্ববর্তী দর্শনের অগ্রগতি সূচনা না করে পশ্চাদগতির ইঙ্গিত করে।

জগতের আদিমতত্ত্ব হল বায়ু

অ্যানাক্সিমিনিস এর কাছে অ্যানাক্সিমেন্ডারের সীমাহীন এর ব্যাপারটি ছিল ধোঁয়াটে, আর থেলিসের জল ছিল স্থূল। তিনি এই দুইয়ের মধ্যে মিল ঘটানোর জন্য আদিমতত্ত্ব বা পরম পদার্থ হিসেবে আনলেন বায়ুকে। তার মতে বায়ু বিমূর্ত নয়, মূর্ত, কিন্তু সূক্ষ্ম। এছাড়া বায়ু যে বস্তুজগতের জিনিস, আধ্যাত্মিক কিছু নয় তা তো স্পষ্টই।

অ্যানাক্সিমেন্ডারের সাথে তার মতবাদের পার্থক্য হল তার আদিমতত্ত্ব অবিশেষ নয়, এটি একটি নির্দিষ্টগুণযুক্ত দ্রব্য, যেমনটা থেলিস ভেবেছিলেন। তবে অ্যানাক্সিমেন্ডারের সীমাহীন এর দুটি বৈশিষ্ট্য আছে যা বায়ুর মধ্যেও আছে। সেগুলো হল – (১) সীমাহীনতা ও (২) নিরবচ্ছিন্ন গতি। এই বায়ু স্থান বা স্পেইস-এ সীমাহীনভাবে বিস্তৃত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। গতিশীল ক্ষমতা বায়ুর অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ও গতির দ্বারাই তার মতে বায়ু থেকে জগতের উৎপত্তি হয়েছে।

কেন তিনি বায়ুকে আদিমতত্ত্ব বা পরমসত্তা হিসেবে গ্রহণ করলেন? মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া বাঁচে না, তাই বায়ুকে জীবনের মূল উপাদান বলে মনে হতে পারে। প্রাচীনকালে বায়ুকেই শ্বাস মনে করা হত, আর আত্মা বলতে বোঝাত যা প্রাণীতে চেতনা তৈরি করে। আত্মা ও বায়ুকে অভেদ কল্পনা করা হত অনেক সময়। ব্রামব্‌ বলেন, এভাবে বায়ু ও আত্মার অভেদকরণ প্রাণ ও জড়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে। অ্যানাক্সিমিনিস বললেন, “আমাদের আত্মা (যা আসলে বায়ু) যেমন আমাদেরকে ধরে রাখে, তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাস ও বাতাস সমগ্র জগৎকে পরিবেষ্টন করে থাকে।” তাই বায়ু হল জগতের মূল উপাদান। এই বায়ু থেকেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব বস্তুর উদ্ভব হয়েছে। অন্যান্য সব কিছু বায়ু থেকে তৈরি বস্তু থেকেই উৎপন্ন। জগৎ আসলে জগতের বাইরের সীমাহীন পুঞ্জ বা বাউন্ডলেস মাস থেকে শ্বাস বা বায়ু গ্রহণ করছে। এই বায়ুকে তিনি দেবতা বলে আখ্যায়িত করেন।

জগতের বিবর্তন ও বায়ু থেকে অন্যান্য উপাদানের সৃষ্টি

কিভাবে বায়ু থকে সব কিছুর উৎপত্তি হল সেক্ষেত্রে তিনি ঘনীভবন (condensation) ও সংকোচন (Rarefaction) এই দুটি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেন। প্রথমটি উষ্ণ হওয়া ও দ্বিতীয়টি শীতল হওয়া নির্দেশ করে। বায়ুকে দেখা যায় না, কিন্তু এই দুই প্রক্রিয়ার ফলে বায়ুকে দেখা যায়। অ্যানাক্সিমিনিস মনে করেন বায়ু সংকোচন হলে অগ্নির সৃষ্টি হয়, আগুন হল হালকা বায়ু। আবার বায়ু ঘনীভূত হলে প্রথমে জল, পরে মাটি ও আরও ঘনীভূত হলে পাথরে পরিণত হয়। এভাবে তার বিবর্তনের ধারণাটি নির্ভর করছে ঘনীভবনের মাত্রার উপর, আর এই মাত্রার পার্থক্যের উপর নির্ভর করে কোন দ্রবের সৃষ্টি হবে সেটা। আবার তার মতে যথাসময়ে জগৎ তার আদিম উপাদান বায়ুতে প্রত্যাবর্তন করবে। কপলস্টোন বলেন, তিনি মনে করেছিলেন বায়ু সংকুচিত হয়ে উত্তপ্ত হলে আগুন হয়, আর ঘনীভূত হলে শীতল ও কঠিন হয়, অর্থাৎ বায়ু হল মাঝামাঝি কিছু। জেলার বলেন, এই ঘনীভবন ও সংকোচনের ব্যাপারগুলো বায়ুমণ্ডলেই ঘটে। তিনি বায়ুমণ্ডলের এই প্রক্রিয়াগুলো প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বায়ুর আদিম উপাদানের সিদ্ধান্তে এসেছিলেন।

অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতই অনন্ত সংখ্যক জগতের মতবাদ সমর্থন করেন। প্রচলিত মতবাদ অনুসারে জগৎগুলো ছিল ধারাবাহিক, অর্থাৎ এক জগতের শেষের পর আরেক জগতের উৎপত্তি হবে, আর এভাবে জগতের সংখ্যা হবে অনন্ত ও অসীম। কিন্তু বার্নেট বলেন, এই দার্শনিকদের জগৎ এরকম ধারাবাহিক না হয়ে সমকালীনও হতে পারে। অর্থাৎ একই সাথে অসীম সংখ্যক জগতের অস্তিত্ব থাকতে পারে, এরকমটাও তারা ভেবে থাকতে পারেন। অ্যানাক্সিমিনিস মনে করতেন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার শুরুতেই পৃথিবীর উৎপত্তি হয়, আর এটি একটি সমতল গোলাকার থালার মত, যা বাতাসের উপর ভাসমান। গ্রহ নক্ষত্রগুলোও বাতাসের উপরেই ভাসছে। সমতল পৃথিবীকে বায়ুই উপরে ধরে রেখেছে। এর থেকে উত্থিত বাষ্প সংকুচিত হয়ে আগুনে পরিণত হয়, যার অংশবিশেষ বাতাসের চাপে তারায় পরিণত হয়। এগুলোর আকার পৃথিবীর আকারের মত আর এরা পৃথিবীকে আবর্তিত হয়ে আছে, বাতাসের উপর ভেসে ভেসেই। তিনি বলেন, আমাদের আত্মা বায়ু হওয়ার কারণে এবং আমাদের একত্রে ধারণ করে রাখার ফলে আমরা যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে পারি, তেমনি বায়ু সমস্ত পৃথিবীকে বেষ্টন করে। রাখে। এতে মনে হয় যেন পৃথিবী শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। অ্যানাক্সিমিনিস উপলব্ধি করেন যে চাঁদ সূর্য থেকেই আলো পায়, তিনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন। তিনি রংধনুরও একটা ব্যাখ্যা দেন। ঘন মেঘের উপর সূর্যরশ্মির পরিণতি থেকেই রংধনুর সৃষ্টি বলে তিনি ব্যাখ্যা করেন। সূর্যের যে রশ্মি ঘন মেঘকে ভেদ করে যেতে পারে না তাই রংধনুর সৃষ্টি করে।

অ্যানাক্সিমিনিসের দর্শনের গুরুত্ব

  • ১। দর্শনচিন্তার জন্য অ্যানাক্সিমিনিস প্রাচীনকালে অ্যানাক্সিমেন্ডারের চেয়ে বেশি প্রশংসিত হন, কিন্তু আধুনিককালের পণ্ডিতরা বলেন তার দর্শনচিন্তা ছিল যেন অ্যানাক্সিমেন্ডারের চিন্তা থেকে এক ধাপ পিছিয়ে আসা। অ্যানাক্সিমেন্ডার থেলিসের মূর্ত আদিম উপাদান থেকে সরে এসে যে বিমূর্ত আদিমসত্তার ধারণা দিয়ে চিন্তার অগ্রগতি আনলেন, অ্যানাক্সিমিনিস যেন সেখান থেকে পিছিয়ে গিয়ে আবার থেলিসের কাছেই ফিরে এলেন। অ্যানাক্সিমেন্ডারের চেয়ে তার ধারণা সুস্পষ্ট, কিন্তু অ্যানাক্সিমেন্ডারের চিন্তায় যেমন মূর্ত বিষয়কে ছাড়িয়ে বিমূর্তের চিন্তা রয়েছে, তা অ্যানাক্সিমিনিসের দর্শনে অনুপস্থিত।
  • ২। তবে একটি ক্ষেত্রে অ্যানাক্সিমিনিস অ্যানাক্সিমেন্ডারকে ছাড়িয়ে গেছেন, ও চিন্তার অগ্রগতি সাধন করেছেন বলা যায়। অ্যানাক্সিমেন্ডার তার সীমাহীন থেকে জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যায় বললেন, সীমাহীন থেকে বিরুদ্ধগুণের বস্তুগুলো পৃথকীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কিকরে সেটা হয়েছে, বা কোন পদ্ধতিতে তা হয়েছে সেগুলো বলা হয়নি। অ্যানাক্সিমিনিস তার দর্শনচিন্তায় ঘনীভবন ও সংকোচনের পদ্ধতির কথা আনেন, যার মাধ্যমে আদিম উপাদান বায়ু থেকে বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি হয়। এটাকে অ্যানাক্সিমেন্ডারের চিন্তার থেকে অগ্রসরতা বলতেই হয়।
  • ৩। তিন মাইলেসীয় বা আয়োনীয় দার্শনিকের মধ্যে অ্যানাক্সিমিনিসই সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আসলে মিলেটাসের দার্শনিক মতবাদ সামগ্রিকভাবে অ্যানাক্সিমিনিসের দর্শন নামেই পরিচিত ছিল। পিথাগােরাস এবং পিথাগােরাস-পরবর্তী দার্শনিক অনুধ্যানী চিন্তার ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। পিথাগােরিয় দার্শনিকগণ আবিষ্কার করেন, পৃথিবী গােলাকার। কিন্তু পরমাণুবাদীগণ অ্যানাক্সিমিনিসের সঙ্গে একমত পােষণ করে বলেন, পৃথিবীর আকার চাকতির (disc) মতাে।

মাইলেসীয় বা আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

  • ১। বিশ্বতাত্ত্বিক ধ্যানধারণা : আয়োনীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য হল এর বিশ্বতাত্ত্বিক ধ্যানধারণা। এই দর্শনে জগতের উৎপত্তির কারণ, স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই দার্শনিকরা ছিলেন মুক্তচিন্তক। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মুক্ত হয়ে তারা স্বাধীন ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাধারার দ্বারা তাদের মতবাদ তৈরি করেন। তাদের দর্শনে পাওয়া যায় প্রকৃতি, সেই সাথে বৈজ্ঞানিক চিন্তার আদি রূপ, তারা জল, সীমাহীন ও বায়ুর সাহায্যে জগতের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন, কোন আধ্যাত্মিক সত্তা থেকে নয়, আবার কেউ কেউ কিভাবে সেই সত্তা থেকে জগতের উৎপত্তি হয়েছে তারও ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন। তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার না করলেও, পরবর্তিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভবে তাদের দর্শনের প্রভাব রয়েছে। তারা ছিলেন জড়বাদী বা বস্তুবাদী, কারণ জগতের আদি কারণ তাদের মতে জড় বা বস্তু, কোন চেতনবিশিষ্ট সত্তা নয়। তাদের দর্শন ছিল অন্টোলজিকাল বা সত্তাতাত্ত্বিক, কারণ তারা জগতের আদি বা মূল সত্তা সম্পর্কেই জানতে ইচ্ছুক ছিলেন। তাদের দর্শন জড়বাদী হলেও ছিল সজীব জড়বাদী, কারণ তারা মনে করতেন সব পদার্থেই প্রাণের অস্তিত্ব আছে।
  • ২। নির্বিচারবাদ : তারা জ্ঞানতত্ত্বের দিক থেকে তারা নির্বিচারবাদী বা ডকমেটিক, কেননা তাদের দর্শনে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কোন কথা নেই। মানুষের জ্ঞানের সীমা কতখানি, মানুষ যা প্রত্যক্ষণ করে তাই বাস্তব কিনা, মানুষের সব কিছু জানার ক্ষমতা আছে কিনা এসব নিয়ে কিছু বলেন নি তারা। তারা ধরেই নিয়েছেন যে মানুষের মিনে জগৎ বিষয়ক সব সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা রয়েছে। তবে ইন্দ্রিয় জগতের মূল্যায়নে এদের জ্ঞানতত্ত্বের এই দিকটিও মূল্যবান। তারা সত্তা বা রিয়ালিটি ও অবভাস বা এপিয়ারেন্স এর মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দেশ করেননি, তাদের কাছে যা প্রত্যক্ষণের বিষয়, তাই সত্তারও বিষয় হয়ে গেছে। সত্তা ও অবভাসের মধ্যে পার্থক্য এনে তারা বলেন নি যে ইন্দ্রীয় জগৎ অলীক বা মিথ্যা যা পরবর্তী অনেক দার্শনিকই বলে গেছেন। তাদের কাছে ইন্দ্রিয় জগৎ যে প্রকৃত জগতের মতই সয় ও বাস্তব ছিল তা পাশ্চাত্য দর্শন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাদের দার্শনিক চিন্তার মুল উপজীব্য ছিল বিশ্ব সৃষ্টির উৎস্য কোথায় তা বের করা। আকাশচারী কল্পনায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা দার্শনিক ব্যবহার বা বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের দ্বারা নিজেদের জীবনবিমুখ করেন নি, তারা জীবনঘনিষ্ঠ চিন্তাভাবনাকে বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছেন।
  • ৩। বস্তুবাদ : তারা তাদের দর্শনে কোন জিনিসটিকে জগতের পরমসত্তা বলে বিবেচনা করেছিলেন তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের বস্তুবাদ, বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বের রহস্যভেদের চেষ্টা, পৌরাণিক চিন্তাধারা ও ধর্মকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসাটা। তারা কেউই প্রশ্ন করেন নি, কে এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছে, প্রশ্ন করেছেন কী থেকে বিশ্বের সৃষ্টি হল (ভারতবর্ষের চার্বাক ও বৌদ্ধ দর্শনের সাথে তুলনীয়)। তাদের দর্শনে আধ্যাত্মিকতার কোন স্থানই ছিলনা। বস্তুজ্ঞানই তাদের কাছে যথেষ্ট ছিল। আর তাদের গুরুত্ব এখানেও যে, তারাই পাশ্চাত্য দর্শনের বিকাশ ঘটানোর প্রথম প্রয়াস নেন। এর আগে গ্রীসে দর্শনচিন্তা বলতে কিছু ছিল না, এমনকি গ্রীক সভ্যতা যে মিশরীয়ব্যাবিলনীয় সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত সেখানেও দর্শনচিন্তার কোন অস্তিত্ব ছিল না। এই সমস্ত সভ্যতায় প্রথম দর্শন নিয়ে আসেন এই মাইলেসীয় দার্শনিকরাই। আর সেই দর্শন আসে তাদের জগৎ সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টা থেকেই। তাদের দর্শনে ঈশ্বরের উপর মানুষের ব্যক্তিত্বের আরোপ, অযৌক্তিক মানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈতিক ধারণার অনধিকার প্রবেশ কদাচিৎ দেখা যায়। তারা যে প্রশ্ন উত্থাপন করেন সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর তাদের চিন্তার মৌলিকত্ব ও বলিষ্ঠতা পরবররীকালের দার্শনিকদের অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে।
  • ৪। প্রাচ্যের সাথে যোগাযোগ ও অলিম্পিক প্রকৃতি : মাইলেসীয় দর্শনের অগ্রগতির মূলে ছিল ব্যাবিলন ও মিশরের সাথে গ্রীকদের যোগাযোগ। এদের সভ্যতা গ্রীক সভ্যতার চেয়ে পুরনো। তাছাড়া মিলেটাস ছিল একটি ধনী বাণিজ্যিক শহর। বিভিন্ন জাতির যোগাযোগের মাধ্যমে, ভাব বিনিময়ের কারণে এখানকার মানুষের মধ্যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস তেমন গভীরভাবে প্রোথিত ছিল না। আয়োনীয়বাসীর ধর্ম ছিল অলিম্পিক প্রকৃতির, তবে তারা এই ধর্মকে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল বলে মনে হয়না। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে দারিউসের কর্তৃত্বে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আয়োনীয়রা ছল হেলেনিক বিশ্বের সাংস্কৃতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। হেলেনিক বিশ্বের বা গ্রীসের অন্যান্য স্থানকে যেমন ডায়োনিসাস ও অরফিয়াসের ধর্মীয় আন্দোলনগুলো যেমন প্রভাবিত করেছিল, আয়োনিয়াকে এরা প্রভাবিত করতে পারেনি। গ্রীক দর্শনের পরবর্তী ধারাটি দক্ষিণ ইতালির গ্রীক শহরগুলোর সাথে সম্পর্কিত। এই ধারাটি অধিকতর ধর্মীয় ভাবাপন্ন ও বিশেষ অরফিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কোন কোন দিক থেকে অর্ফিক প্রভাবে প্রভাবিত দার্শনিক ধারাগুলো বেশি আকর্ষণীয় ও কৃতিত্বের দিক থেকে প্রশংসনীয় হলেও মাইলেসীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় যতখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তা পরবর্তী গ্রীক দর্শনচিন্তায় পাওয়া যায়না।
  • ৫। বিশ্বের স্বরূপ ও জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কিত কৌতূহল : মাইলেসীয় দার্শনিকগণ যে দুটি প্রশ্ন করেন, মানে (১) এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মূল সত্তা বা স্বরূপ কী, ও (২) সেই মূল ও আদি সত্তা থেকে কিভাবে দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি হল? এই দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য পরবর্তী পাশ্চাত্য দার্শনিকেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এই দুটো প্রশ্নই পরবর্তীতে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধন করেছে। এই দার্শনিকগণই পাশ্চাত্য দর্শনকে বিকশিত করার প্রথম প্রয়াস নিয়েছিলেন। রাসেল বলেন, এই মাইসেলীয় সম্প্রসায়ের গুরুত্ব তারা কী অর্জন করলেন তার জন্য নয়, বরং তাদের প্রচেষ্টার জন্য। (The milesian school is important not for what it achieved, but for what it attempted” – B. Russell; History of Western Philosopshy. P.47.)।

(ডায়োনিসীয়, অর্ফিক ধর্মীয় আন্দোলন সহ অন্যান্য গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদী ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই প্রবন্ধটি পড়ুন – প্রাচীন গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদী ধর্মসমূহ)

প্রচলিত ধর্মের প্রভাব

মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায় হল গ্রীক দর্শনের প্রথমযুগের দার্শনিক। গ্রীক দর্শনের প্রথম যুগে ধর্মের একটি বড় প্রভাব দেখা যায়, যদিও পরবর্তী গ্রীক দর্শনের যুগেও ধর্মের প্রভাব ছিল। গ্রীক ধর্মমতের প্রধান দুটো ধারা ছিল। এক হল হোমার ও হেসিয়ডের পৌরাণিক দেবদেবী ভিত্তিক ধর্মীয় মত, আরেকটি হল এলিউসীনীয় ও অর্ফিক মতের মত বিভিন্ন গূঢ় ধর্মমত। আয়োনীয়ায় কোনরকম গূঢ় ধর্মমতের প্রভাব ছিল না, তবে হোমার ও হেসিয়ডের পূরাণকেন্দ্রিক ধর্মমতের প্রভাব ছিল। আয়োনিয়ার দার্শনিক বস্তুবাদী ছিলেন, তাদের দর্শন পুরাণকে ত্যাগ করে গড়ে ওঠে, কিন্তু তারপরও তাদের দর্শন তদকালীন ধর্মমতের প্রভাবহীন হয়ে থাকতে পারেনি। তাই দেখা যায় তারা তাদের ব্যাখ্যায় দেবতাদের বিভিন্ন রূপকের ব্যবহার নিয়ে আসেন।

এছাড়া সেইসময় গ্রীকরা ছিলেন প্রকৃতিবাদী। তারা প্রকৃতিকে সজীব বলে মনে করত ও প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে মানুষের অনুভূতি, ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের আলোকে ব্যাখ্যা ও বিচার করত। তারা প্রকৃতি থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভাবত না, বরং প্রকৃতির সাথে একাত্মবোধ করত। আর প্রকৃতির সাথে এধরণের একাত্মবোধ করত বলে তারা ধর্মীয় অভিজ্ঞতার জন্য নিজেদের অন্তরের দিকে না তাকিয়ে বহির্প্রকৃতির দিকে তাকাতো। পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের পর অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক থেকে গ্রীকদের মধ্যে পারলৌকিক, মরমী ও বৈরাগ্যের মনোভাব শক্তিশালী হতে থাকে (সেই গূঢ় ধর্মমতগুলোর প্রসারের কারণেই)। কিন্তু আয়োনীয় দার্শনিকদের সময়ে গ্রীকরা তখনও যথেষ্ট ইহলৌকিক ও প্রকৃতিবাদী। গ্রীকদের এই প্রকৃতিবাদী মনন প্রভাবিত করেছিল আয়োনীয় দার্শনিকদেরকেও। তারাও প্রাণ বা চেতনাকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম চিন্তা করে, যার প্রভাব পড়েছিল তাদের দর্শনে। আয়োনীয় দার্শনিকরা তাই ভেবেছেন সব বস্তুতেই চেতনা আছে, তারা এভাবেই প্রাণের সাথে আদি সত্তা যেমন জল, বায়ু ও সীমাহীনের সম্পর্ক স্থাপন করাতে পেরেছেন, কিভাবে এই আদিসত্তা থেকে প্রাণের সৃষ্টি হল, জড় ও প্রাণের মধ্যকার সম্পর্ক কী তা নিয়ে ভাবতে পেরেছেন।

মাইলেসীয় সম্প্রদায় পরবর্তী পাশ্চাত্য দর্শনের ধারা

মাইলেসীয় দর্শনের ধারার পর গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপটি দক্ষিণ ইতালির গ্রিক শহরসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। আয়োনিয়া থেকে দুই ধারায় সেখানকার পণ্ডিতরা অন্যান্য গ্রিক অঞ্চলে অভিবাসন করে। এক. যখন পারসিকরা আয়োনীয় ও ঈজিয়ান অঞ্চল সব দখল করে নেয়, এই সময় পিথাগোরাস ঈজিয়ান দ্বিপ সামোস ছেড়ে ইতালির ক্রোটনে তার জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চলে আসেন, সাথে আসে আয়োনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাও। আর দুই. যখন পারস্যের বিরুদ্ধে আয়োনিয়া বিদ্রোহ করে পরাজিত হয় ও তার ফলস্বরূপ পারসিকরা মিলেটাস নগর ধ্বংস করে দেয়। মিলেটাসের এই ধ্বংসের পর আয়োনিয়া আর কখনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের পুরনো সত্তা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার ঐতিহ্য চিরকালের মতো হারিয়ে যায়। মিলেটাসের ধ্বংসের পর দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলির গ্রিক ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোই হয়ে উঠেছিল গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন ধারক ও বাহক। সেই সময় আয়োনিয়া তো বটেই মূলভূমির গ্রিসও পারস্যের আক্রমণের হুমকিতে ছিল। কিন্তু দক্ষিণ ইতালি ছিল অনেকটাই নিরাপদ। ফলে সেই স্থানেই যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার নতুন সুযোগ গড়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। যাই হোক, প্রাচীন গ্রিক দর্শনের এই দ্বিতীয় ধারাটি অধিকতর ধর্মীয় ভাবাপন্ন এবং বিশেষ করে অর্ফিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল। এই দার্শনিক চিন্তাধারা কোনাে কোনাে দিক থেকে অধিকতর আকর্ষণীয় এবং কৃতিত্বের দিক থেকে প্রশংসনীয়। কিন্তু মাইলেসিয় দার্শনিক চিন্তাধারায় যতখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় মাইলেসিয়-পরবর্তী এই দার্শনিক চিন্তাধারায় ততখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় না। 

এশিয়া মাইনোরে পারসিক আক্রমণ, আয়োনীয় বিদ্রোহ ও মিলেটাস ধ্বংস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

তথ্যঋণ

  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ১৩-৩৭
  • History of Western Philosophy, Bertrand Russel, 1945, p.43-47

5 Trackbacks / Pingbacks

  1. পিথাগোরাস (খ্রি.পূ. ৫৬২ – ৪৯৩ অব্দ), পিথাগোরীয়বাদ ও নব্যপিথাগোরীয়বাদ – বিবর্তনপথ
  2. এলিয়াটিক দার্শনিক সম্প্রদায় ও হেরাক্লিটাস – বিবর্তনপথ
  3. গ্রিক ইতিহাস – পর্ব ১: সভ্যতার উদ্ভব, স্পার্টা-এথেন্স ও টাইরান্টদের উত্থান – বিবর্তনপথ
  4. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও দর্শনের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  5. প্রাচীন এশিয়া মাইনোর : ফ্রিজিয়া ও লিডিয়া – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.