প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা

রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম

রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম গ্রিসে : “Political Thought, as we know it in the west, was the invention of the Greeks. Before the Greeks governments and subjects had, of course existed, but hardly politics as we understand them.” – Wayper. রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পণ্ডিত ব্যক্তিরা দেখিয়েছেন যে আমরা যাকে রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনীতিক মতবাদ বলে অভিহিত করি তার জন্ম প্রকৃত পক্ষে প্রাচীন গ্রীস দেশে। ভারতবর্ষ চীন ও মিশরে প্রাচীন কালে রাষ্ট্রচিন্তার অস্তিত্ব থাকলেও আধুনিক কালে যাকে রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনীতিক মতবাদ বলা হয় তা এই সমস্ত দেশে ছিল না। এই দেশগুলিতে সরকার ছিল প্রধানত স্বৈরতান্ত্রিক। “রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতা”, “ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক” প্রভৃতি বিষয়গুলি ভারত, চীন বা মিশর দেশের রাষ্ট্রচিন্তায় বিশেষ স্থান করে নিতে পারে নি। ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত স্বৈরতান্ত্রিক রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এছাড়া রাজনীতিক মতবাদের একটি সুসংহত রূপ এই সমস্ত দেশে বিকশিত হতে পারেনি। পক্ষান্তরে, ব্যক্তিবাধীনতা, রাজনীতিক কর্তৃত্ব, রাষ্ট্র প্রভৃতি ধারণাগুলি প্রাচীন গ্রীসে জন্মলাভ করে। গ্রীসের পণ্ডিত ও দার্শনিকগণ যুক্তি সহকারে রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ করার পরে কতকগুলি মূল সূত্র প্রস্তুত করেন এবং পরবর্তীকালে এগুলি বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি করলেও পুরােপরি বর্জিত হয়নি। তদুপরি গ্রীক দার্শনিকরা কেবল রাষ্ট্রনীতিকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্লেষণ করেন নি, এর সঙ্গে তর্কবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়গুলিকেও সংযুক্ত করেন। এবং এর ফলে রাষ্ট্রনীতি বিষয়টি অনেকখানি সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।

গ্রিসে রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভবের কারণ : প্রাচীন গ্রীসের সমাজব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রে শ্রেণীর আবির্ভাব হওয়ায় রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। মার্ক্সবাদীগণ মনে করেন শ্রেণী শােষণের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্র কাজ করতে আরম্ভ করে। রাষ্ট্রের এই ভূমিকা রাষ্ট্রনীতির উম্ভবকে ত্বরান্বিত করে তােলে। ধর্ম সম্পর্কে গ্রীক দার্শনিকগণ অনেকটা নিস্পৃহ মনােভাব পােষণ করতেন। ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ে নি। এই কারণে রাজনীতি অনেকটা স্বাধীনভাবে বিকশিত হবার সুযােগ লাভ করে। রাষ্ট্র সম্পর্কে তারা কোন অতিকথা সমন্বিত ধারণা পােষণ করতেন না। গ্রীসের নানা নগর সরকারের উন্থানপতন প্রায়ই ঘটত। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি সব জাতীয় শাসন-ব্যবস্থা নগর-রষ্ট্ৰগুলিতে দেখা যেত। এদের কার্যপ্রণালী পণ্ডিত ব্যক্তিগণ বিশ্লেষণ করার সুযোেগ পেতেন এবং নানা প্রকার বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত টানতেন। অ্যারিস্টটল দেড় শতাধিক পুররাষ্ট্রের সংবিধান বিচার করার সুযােগ লাভ করেছিলেন। বিভিন্ন শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে পণ্ডিতেরা তর্কবিতর্ক করতেন। কোন কোন পুররাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু থাকায় সরকারী ক্রিয়াকলাপে জনগণ অংশগ্রহণের সুযোগ পেত এবং এর থেকে তারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করত। তত্ত্ব ও বাস্তবের সঙ্গে একটা প্রাতিসঙ্গিকতা গড়ে ওঠায় রাষ্ট্রনীতি সমৃদ্ধশালী হবার সুযােগ পেয়েছিল। প্রতিটি পুররাষ্ট্রের রাজনীতিক ব্যবস্থা পৃথক হবার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ দেখা যেত। তুলনামূলক আলােচনাও পণ্ডিত ব্যক্তিরা করতেন। প্রাচীন গ্রীসে এমন কতকগুলি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, রাষ্ট্রনীতির উপর যাদের প্রভাব কোন প্রকারে অস্বীকার করা চলে না। সক্রেটিসকে হত্যা প্লেটোর মনে এমন আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল যে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাছাড়া সামরিক শক্তির উপর কোন কোন রাষ্ট্রের গুরুত্ব আরােপকে অনেকে ভাল মনে গ্রহণ করেন নি বলে বিকল্প রাষ্ট্রনীতির কথা তারা ভেবেছিলেন।

প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য

যুক্তিকে অগ্রাধিকার : প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল যুক্তিকে সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া। গ্রীক দার্শনিকগণের যুক্তিবাদিতা অত্যন্ত প্রবল ছিল। তারা মনে করতেন যে জীবন ও জগৎ যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ অবস্থায় যুক্তিকে অস্বীকার করার কোন হেতু নেই। সমাজের প্রতিটি ঘটনার পেছনে যুক্তি অবিরত কাজ করে চলেছে। ব্যক্তি নিজে যুক্তিবাদী এবং তাই সে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত। আবার প্রতিটি ঘটনাকে মানুষ যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার পর সিদ্ধান্ত টানে এবং গ্রহণ ও বর্জনের নীতি স্থির করে। অর্থাৎ অযৌক্তিক কোন কিছুকে ব্যক্তি প্রাধান্য দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলাকে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। গ্রীক দার্শনিকরা আরও মনে করতেন যে সারা বিশ্বে যুক্তি সর্বত্র কাজ করে এবং তাই এখনও পর্যন্ত নৈরাজ্য আসতে পারে নি।

বিশ্বজগত কসমস : ওয়েপার বলেছেন যে গ্রীক দার্শনিকরা সবপ্রথম নিখিল বিশ্বকে কসমস (Cosmos) হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। কসমসকে তারা শৃঙ্খলা (order) বলে মনে করতেন। কসমস বা শৃঙ্খলার বিপরীত হল বিশৃঙ্খলা। এই কসমস আইনের দ্বারা শাসিত। তারা আরও মনে করতেন আইন, শৃঙ্খলা বা সামগ্রিকভাবে কসমসের পেছনে ঈশ্বরের নির্দেশ কাজ করে। ঐশ্বরিক নির্দেশে এই শৃঙ্খলা মনুষ্য সমাজে সুন্দর ভাবে কাজ করে চলেছে। কসমসের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নীতিশাস্ত্র, সামাজিক ও আইনী সমস্যার মধ্যে। ঈশ্বরের উপর এই অকৃত্ৰিম আস্থা স্থাপনের জন্যই গ্রীক সমাজে সংহতি ও শৃঙ্খলে বজায় ছিল বলে মনে করা হয়। কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগােষ্ঠী ঐশ্বরিক নির্দেশ অগ্রাহ্য করার সাহস পেত না। এভাবে গ্রীক সমাজে ধর্ম, রাজনীতি ও আইনী ব্যবস্থা একত্র মিশে গিয়েছিল।

পুরাকথা ও গ্রীক সমাজ : প্রাচীন গ্রীক সমাজ ঈশ্বরের প্রভাবাধীন ছিল বলে পণ্ডিত ব্যক্তিগণ মনে করেন, পুরাকথার একটি বিশেষ ভূমিকা সমাজের সকল স্তরে দেখা যেত। এই পুরাকথাগুলি আইনসংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করত। আইন প্রণয়ন ও বলবৎকরণ উভয়বিধ কাজ পুরাকথা করত। আধুনিক কালে আমরা আইনের যে চরিত্র দেখতে পাই প্রাচীন গ্রীসে তেমনটি ছিল না। তখনকার দিনের আইনের মধ্যে থাকত ধর্ম, নৈতিকথা ও পুরাকথার প্রভাব। ফলে জনসাধারণ আইনগুলিকে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা সহকারে মেনে চলত। সামাজিক ক্রিয়াকর্মেও পুরাকথার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। সমাজের সমস্ত কাজ পুরাকথার ভিত্তিতে বিচার করা হত। পুরাকথা বা ধর্মীয় নির্দেশের বাইরে কোন ব্যক্তির যাবার ক্ষমতা ছিল না। শাসকরা পুরাকথাকে সামনে রেখে আইন প্রণয়ন ও বলবৎ করত। ঐশ্বরিক আইন ও পুরাকথার নির্দেশ লঙ্ঘন করার অর্থ হল বিশ্বজগতে যে সুশাসন বিরাজ করছে তাকে অস্বীকার করা। প্রাচীন গ্রীক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এভাবে ধর্ম ও পুরাকথা সক্রিয় অবস্থায় ছিল।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা : রাষ্ট্র সম্পর্কে গ্রীক ধারণা একটু আলাদা ধরনের। গ্রীক দার্শনিকগণ মনে করতেন যে রাষ্ট্র হল যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ও আচরণের ফসল। প্লেটো, অ্যারিস্টটল সহ কোন দার্শনিক মনে করেন নি যে চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। স্বাভাবিক উপায়ে এর জন্ম। তবে মানুষের যুক্তিবাদী ধারণা আচরণ এই স্বাভাবিক বিকাশকে সমৃদ্ধশালী করেছে। প্রাচীন গ্রীক চিন্তাধারায় রাষ্ট্রকে কেবল একটি রাজনীতিক বা আইনী সংগঠন হিসেবে মনে করা হয় নি। একে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও মনে করা হত এবং নাগরিকগণ নৈতিকতার পুর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধনের নিমিত্ত রাষ্ট্রের আঙিনায় এসে হাজির হয়। রাষ্ট্র তাদের কাছে ছিল সদগুণের প্রতীক। গ্রীক দার্শনিকগণ রাষ্ট্রের জৈবতত্ত্ব ও ভাববাদী ধারণায় বিশেষভাবে আস্থাশীল ছিলেন।

ন্যায়বিচার ও প্রকৃতি সম্পর্কিত ধারণা : প্রাচীন গ্রীসে প্রকৃতিকে আইনের উৎস বলে মনে করা হত। পরে অবশ্য এই ধারণা বদলে যায়। মনুষ্যসৃষ্ট আইনের উপর জোর দেওয়া হয় এবং লিখিত আইন প্রণয়নে অনেকে অগ্রণী হয়। আইন, যুক্তিবাদিতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি ধারণা প্রাচীন গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তায় বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। গ্রীকরা জিউসকে (Zeus) সর্বজনীন ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে মনে করত এবং তার নির্দেশ লঙ্ঘন করা মানে ন্যায়বিচার লঙ্ঘন করা ও সমাজবিরােধী কাজে লিপ্ত হওয়া। বিখ্যাত কবি হােমারও নানা কবিতা ও কাব্যে ন্যায়বিচারের উল্লেখ করেছেন। ন্যায়বিচার ও প্রথা যাতে লঙ্ঘিত বা উপেক্ষিত না হয় তার জন্য গ্রীকরা আইনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিত।

গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তা নগররাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল : গ্রীকরা রাষ্ট্রনীতিকে আইন, রাজনীতি ও নৈতিকতার প্রেক্ষাপটে বিচার করে গেছেন। কিন্তু সবকিছু আলােচনা গড়ে উঠেছিল পুররাষ্ট্র বা নগররাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। এখানেই গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নগর-রাষ্ট্রের চৌহদ্দীর বাইরে তারা তাদের চিন্তাধারাকে বিস্তারিত করেন নি। নগর-রাষ্ট্রের জন্ম, বিকাশ বা শ্রীবৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক – এসবের মধ্যেই রাষ্ট্রচিন্তা আবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্র বলতে গ্রীক দার্শনিকদের কাছে নগর-রাষ্ট্রই বােঝাত। বার্কার বলেছেন যে গ্রীক দর্শন বলতে আলাদা দর্শনের কথা মনে হলেও নগর-রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে গ্রীক দর্শন স্বাতন্ত্র তৈরী করতে পারেনি। গ্রীকগণ যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মনীষাকে নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলেছিল। অনেকে বলেন গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তা নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হবার জন্য সর্বজনীনতা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তা নয়, এই রাষ্ট্রচিন্তা বহুক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। ভাববাদী চিন্তা আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হলেও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, কার্যাবলী ইত্যাদি ক্ষেত্রে এটি আজও প্রাসঙ্গিক।

গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী : ওয়েপার বলেছেন যে গ্রীক দার্শনিকগণ ব্যক্তিগতবাদী ছিলেন। ব্যক্তির সর্ববিধ কল্যাণ কামনার জন্য তারা নানাবিধ সুপারিশ করে গেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ। তাছাড়া গ্রীক দার্শনিকরা যেমন যুক্তিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তেমনি তারা মনে করতেন প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ চিন্তাধারা অনুযায়ী সমস্ত বিষয়কে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, কোন বিষয় বা মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। ব্যক্তিত্বের পুর্ণাঙ্গ বিকাশ হলে জাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি সাধন ঘটবে বলে তারা মনে করতেন। ওয়েপার বলেছেন যে ব্যক্তিকে এই দষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখবার ফলে তারা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক স্থায়ী অবদান তৈরী করে গেছেন। এমন কি আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ব্যতীত জাতীত সভ্যতার বিকাশ সম্ভব নয়।

গ্রীক দার্শনিকরা সমাজকে উপেক্ষা করেননি : গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে ব্যক্তির পর্যাপ্ত গুরত্ব থাকলেও সমাজ একেবারে উপেক্ষিত এমন কথা একেবারে বলা যায় না। অন্তত ওয়েপার তা মনে করেন না। গ্রীকরা যৌথ জীবন-যাপন প্রণালীতে আস্থাশীল ছিল। তারা মনে করত যে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন সমাজে ন্যায়বিচার লঙ্ঘন করে। তারা একত্র মিলিত হয়ে পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিত। নগররাষ্ট্রকে লোকসমাজ বলে অভিহিত করা হত। লোক সমাজের সদস্যদের মধ্যে একটা সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় থাকত। গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তা তাই সংঘর্ষ বা বিরোধ নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করেনি। এঙ্গেলস নিজেই স্বীকার করেছেন যে প্রাচীন গ্রীসে শ্রেণীবিন্যাস পাকাপােক্ত হয় নি। শ্রেণী-ব্যবস্থা জন্মলাভের পরে যে ধরনের রাষ্ট্র দেখা দিয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে সেই ধরনের রাষ্ট্র ছিল না।

সােলোন ও পিথাগােরাস

সপ্তপ্রাজ্ঞ ও গ্রীক রাজনীতি : প্রাচীন গ্রীসের রাজনীতি সম্পর্কে পরিচিত হতে হলে সপ্তপ্রাজ্ঞ-এর (Seven Sages) বিষয় এসে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর শেষ ভাগ ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সাতজন প্রাজ্ঞ বা ঋষির আবির্ভাব ঘটেছিল। অল্প কয়েকজন ছাড়া এই সাতজন ঋষির নাম সম্পর্কে পণ্ডিত ব্যক্তিরা আদৌ একমত নন। এরা দার্শনিক হলেও আইন প্রণয়ন ও রাজনীতিতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন এবং এ সমস্ত বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। সপ্তপ্রাজ্ঞ-এর কোন কোন প্রাজ্ঞ কেবল বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না, সেগুলি যুক্তি সহকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। থেলিস (Thales) ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ। তিনি মনে করতেন যে সম্পদের বিষম পুঞ্জীভবন ও দারিদ্র্য রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার পক্ষে ক্ষতিকারক। সপ্তপ্রাজ্ঞরা সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বনের সুপারিশ করতেন যাতে করে সমাজে কোন রকম অশান্তি দেখা না দেয়। পুররাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতিকে তারা সব সময় অগ্রাধিকার দিতেন।

থেলিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

সোলোন ও গ্রীক রাজনীতি : প্রাচীন গ্রীক রাজনীতির একজন বিখ্যাত প্রবক্তা হলেন সােলােন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩৮-৫৫৯)। তিনি ছিলেন আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদ এবং এথেন্সের অধিবাসী। তদানীন্তন এথেন্সে বিভিন্ন বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা, পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। এমনকি অ্যারিস্টটল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে সমগ্র এথেন্সে তার স্থান ছিল শীর্ষে। সােলােনের সমকালীন এথেন্সে নানা শ্রেণী ও গােষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ প্রায়ই দেখা দিত। তবে সকল শ্রেণীর লােকেরা তাকে সম্মান করত বলে তিনি তাদের নেতা ও শাসক নির্বাচিত হন এবং সুস্থিতির নিমিত্ত আইন প্রণয়ন কাজে নিজেকে নিয়োগ করেন। সােলােন প্রণীত আইন এথেন্সের সামাজিক ও রাজনীতিক কাঠামােতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।

সোলোন প্রবর্তিত সংস্কার : সমাজের ধনবৈষম্য দূর করার জন্য সােলােন সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব আনেন। এর ফলে ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ঋণগ্রহীতারা লাভবান হয়। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় ঋণ বাতিল করে দেন। তিনি দান প্রথার বিলােপসাধনের ব্যবস্থা করেন এবং কোন ব্যক্তিকে ঋণের দায়ে যাবজ্জীবন দাস হয়ে থাকার ব্যবস্থা লোপের আদেশ দেন। সমাজকে সােলােন কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং প্রতিটি শ্রেণী থেকে কতজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে তারও সুপারিশ তিনি করেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি নাগরিককে প্রতিবাদ এবং প্রয়ােজনে মামলা রুজু করার অধিকার দেন। সোলোন আইনের অনুশাসনের কথা বলে গেছেন। এটি তার ন্যায়বিচার সম্পর্কিত ধারণার একটি অংশ। নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য তিনি সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে গেছেন।

পিথাগোরাস : ইতিহাসে পিথাগােরাস একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ হিসেবে পরিচিত। দর্শন সম্পর্কে তিনি যে সমস্ত মন্তব্য প্রকাশ করতেন সেগুলি অনেক সময় রাজনীতি সম্পর্কিত হয়ে উঠত। পিথাগােরাস এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং অভিজাত শ্রেণীর শাসনের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল বলে পণ্ডিতেরা বলেন। তিনি নিজে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে দর্শন ধর্ম নীতিশাস্ত্র ও অঙ্কবিদ্যা শিক্ষা দিতেন। তিনি মনে করতেন সমাজের সকল ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা থাকা একান্ত প্রয়ােজন। একই নীতি তিনি তার শিক্ষাকেন্দ্রে প্রবর্তন করেছিলেন। তার মতে যুক্তিবাদিতা ও ন্যায়বিচার হল সমাজের ভিত্তি এবং এ দুটি লঙ্ঘিত হলে সমাজের অধোগমন ত্বরান্বিত হবে। শাসকের উচিত যে কোন প্রকারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা। আর এর জন্য দরকার আইনের প্রাধান্য। আইন অনুযায়ী সমাজ শাসিত হবে, এবং সকলকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা হবে। একজন সমালােচক বলেছেন যে প্রাচীন গ্রীসে পিথাগােরাস সর্বপ্রথম ঘােষণা করেন যে যুক্তি অনুযায়ী সমাজের সংস্কার করা দরকার। এবং এইভাবে অগ্রসর হলে ন্যায়বিচারের আবির্ভাব ঘটবে। পিথাগােরাস মনে করতেন যে একমাত্র ঈশ্বর চরম ন্যায়বিচার ও যুক্তির প্রাধান্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। ঈশ্বরের পরেই এই দায়িত্ব অর্পিত হয় শাসক ও অভিভাবকদের উপর। আইনের প্রতি আনুগত্যহীনতা কোন অবস্থায় বরদাস্ত করা হবে না। আইনের প্রতি আনুগত্যকে সর্বোত্তম গণ বলে তিনি মনে করতেন। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেছেন যে আইনের প্রতি আনুগত্যকে সুনিশ্চিত করতে হলে একে ত্রুটিহীন করা অত্যাবশ্যক। আইনের পাশাপাশি সমাজে প্রথাগত নিয়মকানুনও বিরাজ করবে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলি ত্রুটিপূর্ণ হলেও জনসাধারণকে লঙ্ঘন করার অনুমতি দেওয়া হবে না। পিথাগােরাস ও তার অনুগামীদের ধারণা হয়েছিল যে সমাজে প্রকৃত নেতৃত্ব না থাকলে নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে এবং এজন্য নেতৃত্বের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনে সকলের যােগ্যতা থাকে না বলে তিনি অভিজাততন্ত্রের কথা বলে গেছেন। অর্থাৎ যোগ্য ও প্রতিভাবান ব্যক্তিরাই দেশ শাসন করবে। সমাজের গােষ্ঠীবিশেষের স্বার্থের দিকে শাসক নজর দেবে না। সুযােগসুবিধা সকলের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার চেষ্টা শাসক করবে। বিচারিক ক্রিয়াকর্মের দায়িত্ব কেবল অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের উপর ন্যস্ত থাকবে, যুবক শ্রেণীকে রাষ্ট্রিক কাজকর্মে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে নৈতিক বিকাশ ও চরিত্র গঠন। আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীকে পরিশীলিত করবে শিক্ষা, তাই তিনি শিক্ষার উপর জোর দেয়ার কথা বলেছেন।

পিথাগোরাসের চিন্তাধারার মূল্যায়ন : প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মত পিথাগােরাস যদিও রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করে যাননি, তবুও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে তখনকার দিনের রাজনীতি সম্পর্কে তিনি মােটামুটি অবহিত ছিলেন। গণতন্ত্র বা জনগণের শাসনের উপর তার কোন আস্থা ছিল না এই কারণে যে সাধারণ লােকের দ্বারা শাসনকার্য চলতে পারে না। জনগণের মত অনুযায়ী চলতে গেলে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হবে বলে তিনি ও তার অনুগামীরা মনে করতেন। পিথাগােরাস প্রবর্তিত পথ অনুসরণ করে তার অনুগামীরা গ্রীসের রাজনীতি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করতেন। এমনকি নগররাষ্ট্রের প্রশাসনে জড়িত থাকতে তাদেরকে দেখা যেত। সম্পদের বিষম বণ্টনকে তিনি বিপ্লব বা অশাস্তির মুখ্য কারণ বলে ভাবতেন এবং এই কারণে জমির সুষম বণ্টনের প্রধান কারণ বলেছেন। তার মতে ধনীরা কারো কাছ থেকে উপঢৌকন নিতে পারবে না তবে গরীবরা তা করতে পারবে। এই নীতি অনুসরণ করলে সমাজে সাম্য আসবে। নতুন জায়গায় অতি সহজে জমি বা সম্পদকে সুষম ভাবে বণ্টন করা যেতে পারে। গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়বিচারের যে প্রাধান্য আমরা দেখি তার নির্মিতি অনেকখানি পিথাগােরাসের হাতে। পরে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল একে নানাভাবে বিকশিত করে তােলেন। ঈশ্বরকে সমাজ-ব্যবস্থার চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের মর্যাদা দেয়া হলেও আইন ও যুক্তিবাদিতার প্রাধান্য আমাদেরকে আশ্চর্যান্বিত করে। সমাজের সংহতি সম্পর্কে তিনি যা বলে গেছেন আজও তা যথেষ্ট মূল্যবান বলে মনে হয়।

হেরাক্লিটাস ও ডেমােক্রিটাস

হেরাক্লিটাসের দর্শনচিন্তা : গ্রীসের অন্তর্গত এফেসাস (Ephesus) নামক স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দে দ্বন্দ্ববাগীশ (dialectician) ও দার্শনিক হেরাক্লিটাস জন্মগ্রহণ করেন। প্লেটোপূর্ব গ্রীসে তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত দার্শনিক। প্লেটোর দর্শনচিন্তা ও দ্বান্দ্বিকতার প্রধান উৎস ছিলেন হেরাক্লিটাস। দার্শনিক হলেও তিনি গ্রীসের রাজনীতিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং নানা প্রকার ক্রিয়াকর্মে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতেন। হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক ও আইনী মতামত জানতে হলে তার সমগ্র দর্শনচিন্তা সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়ােজন। তার দর্শনচিন্তার সারকথা হল দ্বান্দ্বিকতা। বিশ্বজগত প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তন আসছে পরস্পর বিরােধী শক্তি থেকে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তি পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে না। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরােধিতার ফলে জন্ম নেয় নতুন এক শক্তি বা উপাদান। এটিও একজায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। দ্বন্দ্বহীন ঐক্যে উপস্থিত হবার জন্য ঐ শক্তিগুলি অবিশ্রান্ত এগিয়ে চলে। তিনি বলেছেন প্রকৃতির রাজ্যে আছে দিন এবং রাত্রি এবং সমাজে আছে ভাল এবং মন্দ। এমনিভাবে জীবন ও মৃত্যুকে ঘিরে জীব। দ্বন্দ্ব থাকলেও বিশ্বজগৎ একটা শৃঙ্খলার মধ্যে অবস্থান করে। বিশ্বশৃঙ্খলা ঈশ্বর বা মানুষের তৈরী নয়। জড়বাদী সমাজে এই শৃঙ্খলা আপন গতিতে চলে এবং মানুষ সহ সমগ্র জীবজগৎ সেই শৃঙ্খলার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে। এই হল হেরাক্লিটাসের বাকি জড়বাদ বা dialectical materialism. সমগ্র বিশ্বকে হেরাক্লিটাস বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করেন নি। একটি সর্বজনীন শক্তি সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। এর মধ্যেই দ্বান্দ্বিকতা কাজ করছে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ন্যায়বিচার ও উঘাটিত হচ্ছে সত্য। এমন কি এই দ্বান্দ্বিকতা থেকে নৈতিক ও রাজনীতিক ধারণা বেরিয়ে আসছে। (“Everything in the world occurs in accordance with universal logos, i.e. in strife and by necessity, therefore, justice and truth consists in living upto its dictates…. The notions of universal strife and eternal war of opposites underlie not only in cosmological and epistemological views of Heraclitus, but also his ethical social and political conecptions.”) (Nersesyants—Political Thought of Ancient Greece. Moscow 1986, p. 41)।

হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক ধারণা : হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তিনি অভিজাততন্ত্রের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। সমাজকে তিনি মােটামুটি দুটি প্রধান গােষ্ঠীতে বিভক্ত করেছিলেন – মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে নিয়ে একটি গােষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে নিয়ে আরেকটি গােষ্ঠী। প্রথম গােষ্ঠীর সদস্যরা তার মতে বিজ্ঞ বা দার্শনিক এবং প্রশাসন পরিচালনে দক্ষ। দ্বিতীয় শ্রেণী হল জনগণ এবং শাসনকার্যে আদৌ দক্ষ নয়। এই দুই বিরােধী শ্রেণীর মধ্যেকার দ্বন্দ্বের কথা হেরাক্লিাস উল্লেখ করেছেন। অগণিত জনগণের সঙ্গে জড়িত কোন কিছুর প্রতি তার সমর্থন বা সহানুভূতি ছিল না। যেহেতু সাধারণ মানুষ দক্ষ বা অভিজ্ঞ নয় তাদের পক্ষে শাসন পরিচালনা করা অসম্ভব। এই কারণে তিনি গণতন্ত্রকে অকাম্য বা খারাপ শাসন-ব্যবস্থা বলে বর্জন করেছেন। বিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞের মধ্যে বন্দকে হেরাক্লিটাস অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করতেন এবং এই বলে তিনি প্রথম শ্রেণীর পক্ষে আছেন বলে ঘােষণা করতেন। গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও অভিজাততন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা তিনি তার পরিবার থেকে পেয়েছেন, পারিবারিক সূত্রে হেরাক্লিটাস ছিলেন অভিজাত। নিজ রাষ্ট্র এফেসাসে যে গণতন্ত্র ছিল তাকে তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। প্রশাসনের মধ্যে একটা উৎকর্ষ বজায় থাকুক তিনি তাই কামনা করতেন। কেবল বিজ্ঞ ও দক্ষরাই উৎকর্ষ সষ্টি করতে পারে। অভিজাততন্ত্রের সমর্থক হলেও যারা জন্মসূত্রে অভিজাত সম্প্রদায়ের লােক তাদের প্রতি তার কোন সমর্থন ছিল না। তার মতে গুণাবলীর সাহায্যে আভিজাত্য অর্জন করতে হবে। বুদ্ধি ও মেধা ব্যতিরেকে কেবল জন্মসূত্রে দিয়ে আভিজাত্য অর্জন করা যায় না।

হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক দর্শন এলিটীয় : উপর্যুক্ত আলােচনা থেকে স্পষ্ট যে হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক দর্শন পুরােপুরি এলিটীয় ছিল। তার আদৌ মনে হয় নি যে সাধারণ মানুষ শাসনকার্য চালাতে পারে। এই এলিটীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেকে তাকে হেরাক্লিটাসের প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিহিত করেন। কিন্তু এই ধরনের রাজনীতিক দর্শন এলিটীয় এমন সাধারণীকরণ যুক্তিযুক্ত নয়। অভিজাত মনােভাবাপন্ন ও অভিজাত শ্রেণীর শাসন কায়েম করতে চাইলেও তিনি বংশানুক্রমিক অভিজাততন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না। তার এলিট কর্তৃক শাসন-ব্যবস্থাকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের একটা বিকল্পরপ বলে মনে করেন। অনেকে আবার নয়া-অভিজাততন্ত্র বলে অভিহিত করতে চান। হেরাক্লিটাসের অভিজাততন্ত্র পরম্পরাগত অভিজাততন্ত্র থেকে পুরো আলাদা। যাই হােক, এলিটবাদ যে গণতন্ত্রের অস্বীকৃতি বহন করে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

আইন সম্পর্কে হেরাক্লিটাসের ধারণা : আইন ন্যায়বিচার ইত্যাদি সম্পর্ক হেরাক্লিটাস বিস্তারিত আলােচনা করে গেছেন। তিনি বলেছেন যে সমাজে বৈধতা ও আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনগণের উচিত দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। কারণ আইনের অনুশাসন ব্যতিরেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি ঐশ্বরিক আইনকে মনুষ্যসৃষ্ট আইনের উৎস বলে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বজনীনতা ও ন্যায়বিচার মনুষ্যসৃষ্ট আইনের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। বলা বাহুল্য, বিশ্বজনীনতা তার দর্শনের একটা উল্লেখযােগ্য দিক। একটা বিশ্বজনীন শক্তি সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে এবং কোন একটা বিশেষ সমাজ সেই সার্বিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবস্থান করতে পারে না। এই কারণে বিশ্বজনীন নিয়ন্ত্রকের (universal logos) সঙ্গে মানবিক আইনের সামঞ্জস্য থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। মানুষের জন্য যারা আইন তৈরী করবে তাদেরকে বিশ্বজনীন নিয়ন্ত্রক বা ঐশ্বরিক আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে। কিন্তু এই দক্ষতা সকলে অর্জন করতে পারে না। তাই তিনি অল্প কয়েকজন দক্ষ ব্যক্তির শাসন সম্পর্কে নানা আলােচনা করে গেছেন। এই কারণে হেরাক্লিটাসের রাজনীতিক মতবাদকে এলিটীয় বলে বর্ণনা করা হয়। আইন সম্পর্কে তার চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে অল্প কয়েকজনের দ্বারা তৈরী আইন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কথা তিনি বলেছেন। লােকায়ত বিজ্ঞতার (popular Wisdom) উপর তার অনাস্থা ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। তিনি এক জায়গায় বলেছেন “One man is to me ten thousand, if he be the best.” অর্থাৎ আইন অন্যান্যরা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে কারণ তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই।

হেরাক্লিটাসের অবদান : হেরাক্লিটাসের দ্বান্দ্বিকতা পরবর্তীকালে প্লেটো, হেগেল ও মার্কস গ্রহণ করেন। অভিজাত সম্প্রদায় বা এলিট গােষ্ঠীর শাসনের প্রতি প্লেটো অনুরক্ত হয়ে পড়েন। কার্ল পপার বলেছেন, “Hegel, the source of contemporary historicism, was a direct follower of Heraclitus, Plato and Aristotle.”। তিনি যে দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন আজও সমাজ সেই দ্বন্দ্বের থেকে মুক্ত নয়। তবে দ্বন্দ্বের চেহারা পাল্টেছে।

ডেমোক্রিটাসের জড়বাদী চিন্তা : প্রাচীন গ্রীসের আরেকজন বিশিষ্ট দার্শনিক হলেন ডেমােক্রিটাস (Democritus, ৪৬০-৩৭০ খ্রি.পূ.)। গ্রীসের এক বর্ধিষ্ণু পুররাষ্ট্রে ডেমােক্রিটাসের জন্ম হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের যাবতীয় শাখাপ্রশাখায় তার বিচরণ ছিল অবাধ। ধর্ম নীতিশাস্ত্র আইন রাষ্ট্রনীতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান কোনটাই তার আয়ত্তের বাইরে ছিল না। বস্তুজগতের সবকিছু বিষয় নিয়ে ডেমােক্রিটাস চিন্তাভাবনা করতেন। তিনি মনে করতেন বস্তুর অস্তিত্ব থেকেই মানুষ নানাপ্রকার চিন্তা করে এবং তারপর সিদ্ধান্ত টানে। বস্তুজগতকে তিনি বহুসংখ্যক অ্যাটম বা পরমাণুর সময় বলে মনে করতেন। এই পরমাণুগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচরণ করে এবং এদের গতির পেছনে কোন ঐশ্বরিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃত শক্তি কাজ করে না। এই হল তার জড়বাদী ধারণার সারকথা। লেনিনের মতে ডেমােক্রিটাস অত্যন্ত সুন্দরভাবে বাস্তববাদী ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে মনােগত বিষয় নিয়ে তিনি একদম কোন আলােচনা করেননি তা নয়। ব্যক্তির বৌদ্ধিক জগতে ভাবের বা ধারণার উদ্ভব ঘটতে পারে।

বিবর্তনবাদ সম্পর্কে ডেমোক্রিটাস : মানুষ হঠাৎ একদিন এই সমাজ তৈরী করেনি। তিনি বলেছেন যে বিবর্তনের পেছনে মানুষের একটা সাংগঠনিক ভূমিকা অবশ্যই আছে। আর সেটি তার প্রকৃতিগত। অর্থাৎ মানুষের প্রকৃতি হচ্ছে সংগঠন গড়ে তােলা। অতএব বিবর্তনের ধারা ও মানুষের প্রকৃতি এই দুই উপাদান মিলে সমাজকে সেই বর্বর যুগ থেকে সভ্য যুগে নিয়ে এসেছে। সঙ্গলিপ্সাও সমাজ গঠনের উপাদান। কিন্তু আসল কথা হল বিবর্তন। বাঁচার তাগিদেই মানুষ প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করেছে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাধ্য করেছে নিয়ন্ত্রণে থাকতে। সমাজ গঠন বা বিবর্তনে ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক আইনের কোন ভূমিকা নেই। এটিও ডেমােক্রিটাসের জড়বাদী ধারণার অন্য এক দিক। তিনি বলেছেন যে মনুষ্য সমাজ বিবর্তনের ফলে গঠিত হলেও এর প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তােলার পেছনে মানুষের যে অবদান আছে তা কোন প্রকারে অস্বীকার করা চলে না। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে মানুষ নিজেদের প্রয়ােজনে সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে সমাজের সবকিছুই বিবর্তনের ফলে হয় নি।

রাষ্ট্রের চরিত্র এবং ডেমোক্রিটাস : ডেমােক্রিটাস যেভাবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা বা স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন তার সারকথা হলো অভিন্ন স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীন নাগরিকেরা একত্র মিলিত হয় এবং সেটি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের আকার ধারণ করে। সভ্যতা যখন বিকশিত হয়নি তখন এর কােন অস্তিত্ব ছিলনা। বিবর্তন ও মানুষের সচেতন প্রচেষ্টা একে গড়ে তুলেছে। কোন বাইরের শক্তি এসে রাষ্ট্রের গােড়াপত্তন করেনি। রাষ্ট্রকে তিনি কেবল একটি রাজনীতিক সংগঠন বলে মনে করেননি, মানুষের নৈতিকতা ও আদর্শ এই রাষ্ট্রের মধ্যে পুর্ণমাত্রায় বিকশিত হবে। ডেমােক্রিটাস যে ধরনের রাষ্ট্রের কথা বলেছেন আমরা তাকে আদর্শ রাষ্ট্র বলব। পরে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল এই আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রভূত আলোচনা করেছেন। তার পরিকল্পিত (আদর্শ) রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থের বাস্তবায়নের স্থান ছিল না। একমাত্র অভিন্ন স্বার্থই রাষ্ট্রের আওতায় আসবে। এভাবে তিনি রাষ্ট্রকে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে গেছেন। অভিন্ন স্বার্থকে তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থ বলে গেছেন এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ সব সময় ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান পাবে। রাষ্ট্র যে অভিন্ন বা সমষ্টি স্বার্থের প্রতীক এ কথাটা পরে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও রুশো স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন। আমরা বলতে পারি রুশোর গণ-অভীপ্সার উৎস অনেকখানি ডেমােক্রিটাসের রাষ্ট্র ও স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণা।

রাষ্ট্র নৈতিকতার প্রতীক : ডেমােক্রিটাস বলেছেন যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করবে। গােষ্ঠী বা ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে চলবে না। কিন্তু এই আনুগত্যের ভিত্তি রাষ্ট্রের বৈধতার প্রতি নয়। রাষ্ট্র একটি বৈধ প্রতিষ্ঠান হলেও ডেমােক্রিটাস একে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেছেন যে রাষ্ট্র নিজেই একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। অন্যভাবে বলা যায় যে রাষ্ট্র বৈধ ও নৈতিক উভয় প্রকার সংগঠন। তবে নৈতিকতার আধিপত্য বেশি। রাষ্ট্র কেবল একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, সর্বোচ্চ নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ, অতএব নাগরিক এর নিকট আনগত্য দেখাতে বাধ্য। ডেমােক্রিটাস ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ককে নৈতিকতার দিক দিয়ে বিচার করেছেন। সমালােচকগণ বলেছেন যে কেবল ডেমােক্রিটাস নন পরবর্তীকালের অন্যান্য দার্শনিকও ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে বৈধতার আবরণে আবৃত করেন নি। তিনি বলেছেন যে রাষ্ট্রের নিকট আনুগত্য প্রদর্শন ব্যক্তির একটি নৈতিক দায়িত্ব।

আইন ও আনুগত্যের তত্ত্ব : কেন নাগরিক আইনের প্রতি বাধ্যতা দেখাবে? একে কি একটি নৈতিক দায়িত্ব বলে? ডেমােক্রিটাস বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করেছন। তার মতে সাধারণ মানুষ বা অনভিজ্ঞরা আইন রচনা এবং শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। একমাত্র দক্ষ ও অভিজ্ঞরা এই কাজ করে। সরকারকে তিনি যােগ্যতর ব্যক্তির শাসন বলে অভিহিত করেছেন। এই অবস্থায় সাধারণ ব্যক্তির উচিত আইন মেনে চলা। সকলের পক্ষে শাসন করা সম্ভব নয়, এবং এই কারণে তিনি গণতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারেন নি। কারণ গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন এবং একে তিনি প্রকৃত শাসনের মর্যাদা দেন নি। যে কোন ব্যক্তি যেমন শাসক হতে পারে না তেমনি শাসক হবার আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও যােগ্যতা অর্জনের কথা তিনি বলেছেন। সরকার পরিচালনার জন্য প্রচুর দক্ষতা ও কৌশল থাকা আবশ্যক। এছাড়া কতকগুলি সদগুণও অর্জন করতে হবে। অযােগ্য ব্যক্তিরা শাসনক্ষমতায় বসলে কর্তব্যে অবহেলা দেখা দেবে এবং প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে না। যেকোন প্রশাসককে জনগণের চাহিদা ও স্বার্থ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। এজন্য তিনি বলেছেন যে যােগ্য ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত শাসনে ব্যক্তি আইনের প্রতি বাধ্যতা অবশ্যই দেখাবে।

ডেমোক্রিটাসের মূল্যায়ন : ডেমােক্রিটাসের রাষ্ট্রদর্শন বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হলেও প্রাচীন গ্রীসে তা ছিল না। অপরাধীর শাস্তিবিধান ও সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপন সম্পর্কে তিনি যে অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন তা আজও প্রণিধানযােগ্য। অপরাধী কঠোর শাস্তি না পেলে সমাজকে কলুষমুক্ত করা যাবে না। সমকালীন পণ্ডিত ও দার্শনিকগণের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এমনকি পরবর্তী কালের রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনকে তিনি বহুলাংশে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের পূর্বসূরী। সফিস্ট বা যুক্তি দর্শনবাদিগণের উপর তার স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা কেবল ডেমােক্রিটাসের রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য নয়, একই বৈশিষ্ট্য আমরা প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মধ্যে দেখতে পাই। আইনের প্রতি আনুগত্য দেখাবার কথা তিনি বললেও আইন উদ্দেশ্যবর্জিত হবে অথবা জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হবে এমন কথা তিনি বলেন নি। অর্থাৎ আইনের পরমলক্ষ্যবাদের তত্ত্বটি তার মনে ছিল বলে সমালােচকগণ মনে করেন। গণতন্ত্রের অকার্যকারিতা ও কুৎসিত রূপ দেখে ডেমােক্রিটাস হতাশ হয়েছিলেন এবং তদানীন্তন ঘটনাবলী এর জন্য দায়ী।

সফিস্ট বা যুক্তিদর্শনবিদ

সফিস্ট কী এবং কেন? : প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তায় সফিস্ট বা যুক্তিদর্শনবিদদের একটি বিশেষ স্থান লক্ষ্য করা যায়। সফিস্ট শব্দটি গ্রীক শব্দ সফস (sophos) থেকে এসেছে যার অর্থ হল জ্ঞান। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে পারসিয়ান আক্রমণকারীদেরকে পরাজিত করে এথেন্স নিজ শক্তিমত্তার পরিচয় দেয় এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। এই রাজনীতিক পরিবর্তনের ফলে বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও নানা বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার সুযােগ পান। বস্তুজগৎ মনুষ্য প্রকৃতি ও নানাপ্রকার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পণ্ডিত ব্যক্তির বিশ্লেষণ শুরু করেন এবং এই বৌদ্ধিক আলােচনায় যারা অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন তারা সফিস্ট নামে পরিচিত। সােইকোফ্রন, হিপ্পিয়াস, প্রােটোগােরাস এবং প্রডিউস প্রভৃতি সফিট ছিলেন বিখ্যাত।

সফিস্টদের দর্শনের বৈশিষ্ট্য : কেউ কেউ সফিস্টদেরকে কুতার্কিক বলে অভিহিত করেন। কারণ যে কোন বিষয় সম্পর্কে সফিস্টরা চুলচেরা হিসেব বা বিশ্লেষণ করতেন। উদ্দেশ্য বিরােধীপক্ষকে কূটতর্কে পরাজিত করা। সাধারণ মানুষের বােধগম্য কোন বিষয় নিয়ে সফিস্টদের ভাবনাচিন্তা ছিলনা। উইল ডুরান্ট বলেছেন যে সফিস্টরা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। এদের আবির্ভাব গ্রীক দর্শনকে উর্বর করে তুলেছিল। সফিস্ট নানা জায়গায় ভ্রমণ করে জ্ঞান বিতরণ করতেন। তবে সেগুলি জটিল দর্শন বিষয়ে আবদ্ধ থাকত। জনসাধারণ বিশেষ উৎসাহ বােধ করত না। সফিস্টদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তি দিয়ে যে কোন বিষয়কে বিশ্লেষণ করা ও সিদ্ধান্ত টানা। কোন বিষয়ের বাস্তবতা সফিস্টদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। সফিস্টরা ছিলেন ভ্রাম্যমান শিক্ষক। শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করতেন। তাদের শিক্ষাদান ও যুক্তি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল বলে পণ্ডিতগণ তাদেরকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বলেন। সফিস্টদেরকে কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী বা গােষ্ঠীভুক্ত করা যায় না। বিচ্ছিন্নভাবে তারা জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিতরণ করতেন। ম্যাক্সে বলেছেন (পঃ ৩৬) সফিষ্টরা কোন বিশেষ মতবাদ বা মতাদর্শ প্রচার করে যান নি। সত্যের খাতিরে তারা সত্য প্রচার করেন নি, উদ্দেশ্যের বিশেষ উপায় হিসেবে সত্য প্রচার করতেন। তারা বলতেন সর্বজনীন, শাশ্বত ও চরম সত্য বলতে কিছুই নেই। কোন নীতি সর্বত্র সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। চিন্তা ও দর্শন জগতে সফিস্টরা কোন সুসংহত ও নিরবচ্ছিন্ন তত্ত্ব বা মতবাদ সষ্টি করে যেতে পারেননি। বার্কার বলেছেন যে তারা পুরােপুরি শিক্ষক বা পুরােপরি দার্শনিক ছিলেন না। এটাই তাদের সম্পকে বড় ত্রুটি। তবে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় তারা অবাধে বিচরণ করতেন। কোন কোন সফিস্ট খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় বিশেষ দক্ষতা দেখাতে পারতেন। নিজ নিজ বস্ত্রাদি প্রস্তুতে কেউ কেউ দক্ষ ছিলেন। নিজ হাতে কেন প্রস্তুত বস্ত্র পরিধান করে হিপ্পিয়াস অলিম্পিক ক্রীড়ায় অংশ নিয়েছিলেন।

সফিস্টদের রাজনীতিক ধারণা : সফিস্টরা প্রণালীবদ্ধভাবে কোন রাজনীতিক দর্শন বা চিন্তা প্রচার করে যান নি। তবে অতীতে রাজনীতিকে ঐশ্বরিক নির্দেশের গণ্ডীতে আবদ্ধ করে রাখার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তারা তা করেন নি। তারা মনে করতেন Man is the measure of all things. অর্থাৎ মানুষকে দিয়েই সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যক্তির যুক্তিবাদিতার ঊর্ধ্বে কোন কিছু থাকতে পারেনা। যুক্তি সহকারে ব্যক্তি রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানের সব দিক বিশ্লেষণ করার পর সিদ্ধান্ত নেবে। পণ্ডিতেরা বলেন সফিস্টরা প্রবুদ্ধকরণের প্রবর্তন করে গেছেন। অতীতে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে রাজনীতির চত্বর থেকে ব্যক্তিকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত এবং সফিস্টরা এসে সেই ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এজন্য বলা হয়েছে সফিস্টদের প্রচেষ্টায় রাজনীতি নতুন ধারায় বইতে শুরু করে। আইন নৈতিকতা ইত্যাদির আলােচনা পদ্ধতি তারা বদলে দেন। উইল ডুরান্ট বলেছেন যে সফিস্টদের রাজনীতিক ভাবনাকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। একটি হল রুশােপন্থী, অন্যটি নিটশেপন্থী (Nietzsche)। রুশাের মত সফিস্টদের কেউ কেউ মনে করতেন প্রকৃতি ভাল, খারাপ হল সভ্যতা। প্রকৃতি মানুষকে সমান করে ও স্বাধীনতা দিয়ে তৈরী করেছে। সভ্যতার বিকাশের ফলে এই দুটি জিনিস ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে। নিটশের মত কোন কোন সফিস্টের এই ধারণা হয়েছিল যে প্রকৃতি আদৌ ভাল নয় এবং মানুষ অসমান। সবলকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুর্বলরা নৈতিকতা নামক ধারণাটি তৈরী করেছে। ক্ষমতা হল সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। প্রতিটি মানুষ ক্ষমতা অর্জন করতে চায়। সমস্ত প্রকার সরকারের মধ্যে অভিজাততন্ত্র হল শ্রেষ্ঠ। অভিজাতদের হতে ক্ষমতা তুলে দেয়াই বিজ্ঞজনােচিত কাজ। সফিস্টরা সর্বপ্রথম স্বাধীন চিন্তা করার পথ প্রবর্তন করেন এবং এর ফলে সমাজে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল তৈরী হয়। যুক্তি দিয়ে বিচার না করে কোন বিষয় গ্রহণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। এর ফলে সমগ্র এথেন্সে স্বাধীন চিন্তার একটা পরিবেশ তৈরী হয়ে যায় এবং সেজন্য পরে এথেন্স জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় গ্রীস দেশে উল্লেখযােগ্য স্থান দখল করে। একজন সমালােচক বলেছেন যে গ্রীসের জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক প্রবুদ্ধকরণ সফিস্টরাই জাগিয়ে তুলেছিলেন।

গ্রীসের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান

ভূমিকা : আধুনিক কালে আমরা যাকে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা নামে অভিহিত করি তার সুত্রপাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল থেকে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী এবং নাগরিকের কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়গুলো এই দুই গ্রীক দার্শনিকের আলােচনায় মুখ্য স্থান অধিকার করেছিল। এরা সমসাময়িক ঘটনা ও প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলােচনা করলেও আধুনিক কালে তাদের বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। সুতরাং এই দুই দার্শনিকের রাষ্ট্রচিন্তা সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাদের সমকালীন প্রতিষ্ঠানগুলাে সম্পর্কে আলোচনা আবশ্যক। এই দিকে লক্ষ্য রেখে স্যাবাইন বলেছেন, “In order to understand at all accurately what their theories meant, it is necessary to realize at least roughly what kind of institutions they had in view.” প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল সমকালীন ঘটনাবলী ও সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে আলােচনা করতেন এবং কিভাবে সমাজকে সঙ্কটমুক্ত করে একটা আদর্শ সমাজ গড়ে তােলা যায় সে ব্যাপারে তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে গেছেন। যাইহােক, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবার আগে সংক্ষেপে আমরা গ্রীসের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করে নেব।

ক্রীতদাস ব্যবস্থা : গ্রীসের জনসংখ্যা প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সমাজের সবচেয়ে নীচু স্তরে ভল ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের ব্যবহার এত সার্বিক এবং সমাজের সঙ্গে এমন ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল যে গ্রীক সমাজ থেকে একে বিচ্ছিন্ন করা যেত না। ক্রীতদাসব্যবস্থা একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। সমাজের প্রগতির চাকাকে এই ক্রীতদাস সচল করে রেখেছিল। সমাজের উঁচু শ্রেণীর সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সার্বিক বিকাশ সবকিছুই ছিল ক্রীতদাসকেন্দ্রিক। আবার গ্রীসের রাজনীতিক চিন্তাধারার উপর ক্রীতদাসের প্রভাব ছিল অপরিসীম। আধুনিক কালে আমরা যেমন কর্মচারী ও মালিক অথবা মধ্যযুগে ভাগচাষী ও সামন্তপ্রভুর মধ্যে সম্পর্কের কথা ভাবি, প্রাচীন গ্রীসীয় সমাজব্যবস্থা বলতে ক্রীতদাস ও উঁচু শ্রেণীর সপর্কের উল্লেখ করতে হয়। গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তাকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে অবসরভােগী শ্রেণী (leisure class)। কিন্তু এই শ্রেণীর অবসর, চিন্তা, সখ ও বাচ্ছন্দ্য সব কিছুই ক্রীতদাসের উপর নির্ভর করত। ক্রীতদাসরা অবসরভােগী শ্রেণীকে কায়িক পরিশ্রমের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিতে পেরেছিল বলে এই শ্রেণীকে উন্নত রাষ্ট্র ও দর্শন চিন্তার মধ্যে নিমগ্ন রাখতে পেরেছিল। প্রাচীন গ্রীসে ক্রীতদাসের এত ব্যাপক ব্যবহার ছিল যে মােট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল ক্রীতদাস। সমাজের যাবতীয় কায়িক পরিশ্রম করার দায়িত্ব ছিল ক্রীতদাসের উপর। অথচ তখনকার সমাজ ব্যবস্থা এমন ছিল যে কোন-রকম সুযােগসুবিধার অংশীদার হবার অধিকার তাদের ছিল না। প্রাচীন গ্রীসের ক্রীতদাসকে আমরা দধীচি বলতে পারি। রাজনীতিক অধিকার তারা ভােগ করতে পারত না। (Gettell- History of Political Thought, p. 36)। এককথায় আধুনিক কালে শ্রমিকশ্রেণীকে বাদ দিয়ে যেমন অর্থনীতির কথা চিন্তা করা যায় না, তেমনি প্রাচীন গ্রীসের ক্রীতদাসকে বাদ দিয়ে গ্রীক সমাজ-ব্যবস্থা বিশেষ করে অর্থনীতির কথা ভাবা যায় না। (“…as an institution slavery was as characteristic of the city-state economy as wage-earning is of the modern.” – Sabine-History of Political Theory, p. 4)।

বিদেশী : গ্রীসের জনসংখ্যার দ্বিতীয় শ্রেণী হল বিদেশী (resident foreigners)। গ্রীসের সঙ্গে ইউরােপের অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক যোগাযােগ ও আদানপ্রদান তখন ছিল খুবই উন্নত। সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ছিল। ফলে জনসাধারণের যাতায়াত ছিল। এ অবস্থায় এথেন্সে বহু বিদেশী স্থায়ীভাবে বসবাস করত। কিন্তু তারা গ্রীসের নাগরিকত্ব পায়নি। কারণ স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিক করার পদ্ধতি তখন প্রচলিত ছিল না। স্থায়ীভাবে বসবাসকারী এই সমস্ত ব্যক্তি গ্রীসের নাগরিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং বিদেশী ও নাগরিকের মধ্যে কোন পার্থক্য টানা যেত না। সমাজ জীবনের তারা ছিল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ক্রীতদাসদের মত বিদেশীরা রাজনীতিক অধিকার ভােগ করতে পারতনা।

নাগরিক : পরিশেষে ছিল নাগরিক। আধুনিক কালে আমরা নাগরিক বলতে যা বুঝি প্রাচীন গ্রীসে তা ছিল না। নগর-রাষ্ট্রের নাগরিকদের একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল। বিদেশী ও ক্রীতদাসের ঊর্ধ্বে ছিল তাদের অবস্থান। নগর-রাষ্ট্রের সদস্য হতে না পারলে কেউ নাগরিক পদবাচ্য হতে পারত না। নাগরিক সদস্য হবার শর্ত হল রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ। (“…for a Greek, citizenship always meant some participation in public business much or little.” Sabine-History of Political Theory, p. 5)। গ্রীকদের কাছে নগররাষ্ট্র ছিল অনেকটা পরিবারের মত। পরিবারের সদস্যরা যেমন পারিবারিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব প্রমাণ করে তেমনি নগর-রাষ্ট্রের সদস্যরা রাজনীতিক কাজকর্মে অংশ নিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ করত। যারা পারত না তারা নাগরিক হবার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হত। আধুনিক কালে নাগরিকত্বকে বৈধতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। প্রাচীন গ্রীসে বৈধতার প্রশ্ন গুরুত্ব পায়নি। রাষ্ট্রিক কাজকর্মে সহযােগিতার প্রশ্নটাই ছিল বড়। গ্রীসে নারীর কোন রাজনীতিক অধিকার ছিল না ও রাষ্ট্রের কাজকর্মে তারা পুরষকে সাহায্য করতে পারত না। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় পুরুষ একচেটিয়া সুযােগ ও অধিকার ভােগ করত।

প্রকাশ্য সভা : প্রকাশ্য সভা ছিল এথেন্সের সর্বোচ্চ রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। সর্বাধিক ক্ষমতা প্রকাশ্য সভা ভােগ করত। প্রকাশ্য সভা গঠিত হত কেবল নাগরিকদের নিয়ে। বিশ বছরের বেশি যে সমস্ত নাগরিকের বয়স কেবল তারাই প্রকাশ্য সভায় যােগদান করতে পারত। বছরে দশবার প্রকাশ্য সভার অধিবেশন বসত। বিশেষ প্রয়ােজনে সভার জরুরী অধিবেশন আহ্বান করার নিয়ম ছিল। সভায় মিলিত নাগরিকরা নানা বিষয়ে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এ-আলােচনা থেকে সভা সম্বন্ধে কোন উচ্চাশা পােষণ করা ন্যায়সঙ্গত হবে না। সমালােচকরা বলেন রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক কাজকর্মে সভার তেমন কোন উল্লেখযােগ্য অবদানের স্বাক্ষর নেই। প্রকাশ্য সভায় মিলিত হওয়াই ছিল গ্রীক নাগরিকদের অন্যতম কাজ। পরবর্তী কালে গ্রীসের এই ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আসনে বসানো হয়েছে। (Direct democracy conducted by the whole people assembled is rather a political myth than a form of government. Sabine-History of Political Theory, p. 6)। কিন্তু যেভাবে আমরা নাগরিকের সংজ্ঞা আলােচনা করেছি তার থেকে প্রকাশ্য সভাকে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ মনে হওয়া স্বাভাবিক।

পাঁচশত’র পরিশদ : সভা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও নগর-রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক কাজকর্ম সভার দ্বারা পরিচালনা করা সম্ভব হত না। শাসনকার্যের যাবতীয় দায়দায়িত্ব পাঁচশত’র পরিষদের (Council of Five Hundred) উপর ন্যস্ত ছিল। অবশ্য প্রাচীন গ্রীসে পাঁচশত’র পরিষদের মধ্যে আমরা কোন নতুনত্ব দেখি না। কারণ, সভার আয়তন অনেক বড় বলে দৈনন্দিন শাসনকার্য চালানো সম্ভব ছিল না। আধুনিক শাসন-ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের উৎস মনে হয় গ্রীসের এই জাতীয় শাসন-ব্যবস্থা। পাঁচশত’র পরিষদের সদস্য নির্বাচন হতো এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। গােটা এথেন্স প্রায় একশর মত অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। একটা অঞ্চলকে বলা হত ডেমেস (demes)। এই সমস্ত ডেমেস থেকে পাঁচশ জন প্রতিনিধিকে লটারীর সাহায্যে নির্বাচন করে পরিষদে পাঠানো হতো। এই ব্যবস্থাকে এথেনীয়রা গণতান্ত্রিক মনে করত, কারণ লটারীর সাহায্যে মনোনয়নের মধ্যে প্রত্যেকটি নাগরিকের একটা করে সুযােগ পাবার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু অন্য উপায় হলে সে সুযােগ কোন নাগরিক নাও পেতে পারত। (Athenians considered their system to be more democratic than merely voting, because the use of lots gave every nominated citizen a chance to be elected. Gettell-History of Political Thought, p. 37)। পরিষদের সদস্যরা মাত্র এক বছরের জন্য ডেমেস থেকে মনােনীত বা নির্বাচিত হবার সুযোগ পেত।

পরিষদের কাজ : আধুনিক কালে যেমন ক্ষমতা বিভাজন নীতি অনুযায়ী আইনসভা আইন প্রণয়ন করে ও শাসন বিভাগ শাসন করে, প্রাচীন গ্রীসে তেমনি সভা সামগ্রিকভাবে নীতি নির্ধারণ করত ও পরিষদ নীতিসমূহকে কার্যকর করত। অর্থাৎ, প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন করাই ছিল পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব। পরিষদকে পরিষদের কাজ সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্ত্রিসভার সঙ্গে তুলনা করা চলে, যদিও পাঁচশতর পরিষদ মন্ত্রিসভার চেয়ে আয়তনে বহুগুণ বড়। বিদেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ ও বিদেশের রাষ্ট্রদূতদের গ্রহণ, নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ছিল পরিষদের কাজ। আইনের খসড়া তৈরী করে সভায় পরিষদ পেশ করত। নীতি নির্ধারণ ছাড়া নীতিকে কার্যকর বা সভার নির্দেশাবলীকে বাস্তবে রূপায়িত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন পরিষদকে করতে হত। ম্যাজিস্ট্রেটরা পরিষদের অধীনে থাকত। পরিষদ অপরাধীকে কারাদণ্ড দিতে পারত। অর্থব্যবস্থা, কর ও সরকারী সম্পত্তির উপর পরিষদের নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল।

পরিষদের ক্ষমতা চরম নয় : আইনের খসড়া প্রস্তুত থেকে আরম্ভ করে প্রশাসন পরিচালনা পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়ে পরিষদের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও এই ক্ষমতাকে কোন প্রকারে নিরঙ্কুশ বলা চলে না। কারণ, পরিষদ কতখানি ক্ষমতা ভােগ করবে তা নির্ভর করত সভার উপর। যুদ্ধ ঘােষণা, সন্ধি স্থাপন, নতুন কর স্থাপন, বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে জোট তৈরী এবং অন্যান্য যাবতীয় গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নে পরিষদ সভাকে এড়িয়ে যেতে পারত না। সভার অনুমতি নিয়ে পরিষদ সমস্ত বিষয়ে আইন তৈরী করত। তবে পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন সভা কোন ব্যাপারে পরিষদের কাজে অযথা ব্যাঘাত বা বিঘ্ন সৃষ্টি করত না।

আদালত (Courts) : সভা ও পাঁচশতর পরিষদ ছাড়া এথেন্সের অন্য একটি বাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হল আদালত। ডেমেস (demes) প্রায় দুহাজার প্রতিনিধিকে প্রতি বছর নির্বাচন করত। এদের ভেতর থেকে লটারী করে আদালতে সদস্য বা জুরি স্থির করা হত। যে কোন ত্রিশ বছর বয়স্ক এথেনীয় নাগরিক জুরি পদের প্রার্থী হতে পারত। এথেন্সের আদালত আজকালকার আদালতের মত ছিল না। আদালত একটা আইনসভার আয়তনবিশিষ্ট ছিল। আদালতের সদস্যসংখ্যা ২০১-এর কম হত না। আবার কখনও ৫০১ হত বা একেও ছাড়িয়ে যেত। আমরা আশ্চর্য হলেও এথেনীয়রা এই ব্যবস্থা পুরোপুরি মেনে নিয়েছিল এবং একে গণতান্ত্রিক বলত। (The theory behind such large numbers was that the courts were the people, acting in particular cases to register popular approval or disapproval. Gettel – History of Political Thought, p. 38)। কারণ, কোন না কোন সময়ে সমস্ত নাগরিক বিচারকের আসনে বসার সুযোগ পেত। অর্থাৎ রাষ্ট্রিক সুযােগসুবিধা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির হাতে আবদ্ধ থাকুক এথেনীয়রা তা চাইত না।

আদালতের কাজ : আদালতকে নানাবিধ কাজ করতে হত। ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার বিচার আদালত করত। আদালতের রায় ছিল চূড়ান্ত। কারণ, এখেত্রে আপীল করার জন্য কোন উচ্চতর আদালতের ব্যবস্থা ছিলনা। এথেনীয়রা যে কারণ দেখাত তা হল আদালতই সমগ্র জনসাধারণের প্রতিনিধি এবং তাদের হয়ে রায় দিচ্ছে। সুতরাং উচ্চতর আদালত গঠন করে জনগণকে উপেক্ষা করা চলে না। সেটা হত অগণতান্ত্রিক। (Sabine-History of Political Theory, p. 10)। আদালত আইনের বিচার করতো এবং কোন আইন প্রচলিত প্রথা বা এথেনীয় সংবিধানের বিরােধী হলে আদালত তা বাতিল করে দিত। এথেনীয় আদালতের এই ক্ষমতা আমাদেরকে আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আইনের বৈধতা বিচার করার ক্ষমতা থাকায় আদালত আইন বিভাগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত। বস্তুতপক্ষে আদালতের এ কাজকে আইন বিভাগীয় কাজ বলা যেতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ন্ত্রণ আদালতের জন্য একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনটি উপায়ে আদালত ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ন্ত্ৰণ করত : (১) আদালত ম্যাজিষ্টেট পদপ্রার্থীর যােগ্যতা নিরূপণ করত। ঠিকমত যােগ্যতা না থাকলে প্রার্থীকে অযােগ্য ঘােষণা করতে পারত। ফলে অযােগ্য ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট পদে আসীন হতে পরিত না। (২) ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজকর্ম বিচার করার ক্ষমতা আদালতের ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটদের যা খুশি তাই করার ক্ষমতা ছিল না। (৩) ম্যাজিস্ট্রেটদের অক্লান্ত কাজকর্ম তদারকি করার ভার ছিল আদালতের উপর। জনসাধারণের অর্থ যাতে ঠিকমত খরচ হয় সেটাই ছিল এথেনীয়দের উদ্দেশ্য এবং এইজন্য তারা আদালতের উপর ভর দিয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটদের এই সমস্ত বিধিনিষেধের মধ্য থেকে কাজ করতে হত বলে তাদের পক্ষে স্বৈরাচারী বা দলনীতিপরায়ণ হবার সুযােগ ছিল না।

আদালতের মূল্যায়ন : এথেনীয় আদালতের বহুমুখী কাজ ও ক্ষমতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। গােটা শাসনব্যবস্থার মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আদালত অপরিহার্য ছিল। তাই স্যাবাইন বলেছেন, “Athenian Courts were, undoubtedly the keystone of the whole democratic system.” (Sabine-History of Political Theory, p. 9)। এমনকি আধুনিক কালের উন্নত বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও এথেনীয় বিচারব্যবস্থাকে উন্নততর বলে মনে হয়। সমস্ত নাগরিককে বিচার কাজে অংশগ্রহণের সুযােগ করে দিয়ে এথেনীয় পদ্ধতি একদিকে গণতন্ত্রের ভিত দৃঢ় করে তুলেছিল অন্যদিকে জনগণের দায়িত্ববােধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছে পাছে তারা কর্তব্যে অবহেলা করে অথবা নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে সেইজন্য আদালত তদারকির কাজ করত। এর অন্যতম লক্ষ্য প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। আজকাল অমবড়সমান (ombudsman) পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন এথেন্সে এই জাতীয় প্রথা ছিল তা ভাবলে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়।

সৈন্যাধ্যক্ষ বোর্ড : সভা, পরিষদ ও আদালত ছাড়া প্রাচীন গ্রীসের অন্য একটা প্রতিষ্ঠান ছিল সৈন্যাধ্যক্ষ বাের্ড। দশজন সৈন্যাধ্যক্ষকে নিয়ে এই বাের্ড গঠিত হত। ম্যাজিস্ট্রেট বা পরিষদের তুলনায় এই বাের্ডের স্বাধীনতা একটু বেশি ছিল। সৈন্যাধ্যক্ষরা নাগরিকদের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত হত এবং পুনরায় নির্বাচিত হবার সযােগ পেত। গােটা এথেন্সের নিরাপত্তার দায়িত্ব এই দশজন সৈন্যাধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত ছিল। সামরিক কাজকর্ম সৈন্যাধ্যক্ষরাই চালাত। আবার বিদেশ সংক্রান্ত কাজ যদিও তত্ত্বগত ভাবে সভা ও পরিষদের উপর ন্যস্ত ছিল, তা সত্ত্বেও সৈন্যাধ্যক্ষ বাের্ড এসব বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করত। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সৈন্যাধ্যক্ষকে কেবল সামরিক বা নিরাপত্তামূলক কাজ করত না, অন্যান্য কাজও করতে হত। রাজনীতির সঙ্গে সৈন্যাধ্যক্ষ বাের্ড জড়িয়ে পড়ত। (The office, therefore, was not really a military post but in certain cases a political office of the highest importance. Sabine-History of Political Theory, p. 9)।

উপসংহার : গ্রীসের গণতন্ত্রের পরিধি ছিল খুবই সঙ্কীর্ণ। কারণ, গণতান্ত্রিক অধিকার সবাই ভােগ করতে পারত না, কেবল নাগরিকরাই ভােগ করত। আর সকলে নাগরিক হবার সুযোগ পেত না। কিন্তু এই প্রাথমিক ত্রুটি সত্ত্বেও আমরা বলব গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা এথেন্সবাসীরা দিত। প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে বিচারব্যবস্থা সর্বত্র জনগণ নিজেদের পূর্ণ কতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করত। বিশেষ করে বিচারব্যবস্থা ও বিচারালয় কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ন্ত্রণ সত্যই প্রশংসনীয়। আজকাল পথিবীর সব দেশে পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই সুদূর অতীতে গ্রীসের জনগণ পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের প্রয়ােজনে ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে বিচার-ব্যবস্থার অধীনে এনেছিল। অতীত গ্রীসে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ছিল। এই গণতন্ত্র কতখানি কার্যকর অবস্থায় ছিল পণ্ডিত ব্যক্তিরা সে-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। অমিরা বলি সভার আদৌ কোন গুরত্ব ছিল না বা সভা পরিষদের উপর বিন্দুমাত্র তদারকি করতে পারত না এমন কোন প্রমাণ আমরা আজ পর্যন্ত পাই নি। প্রাচীন গ্রীসের সমাজ-ব্যবস্থার একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক হল এর ক্রীতদাস প্রথা। আমরা এর নিন্দা করি। কিন্তু তদানীন্তন গ্রীসের দিকে তাকালে একে ততখানি নিন্দা করা চলে না। সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ক্রীতদাস প্রথা। শুধু গ্রীস নয় ইউরােপের কোন দেশ ঘৃণ্য ক্রীতদাস প্রথা থেকে মুক্ত ছিল না। এমন কি ১৯শ শতাব্দীতেও ক্রীতদাস প্রথা আমেরিকায় বজায় ছিল এবং এর জন্য একটা গৃহযুদ্ধও হয়ে গেল। নাগরিক কর্তৃক বিচারক নিয়ােগ এখনও পথিবীর কোন কোন রাষ্ট্রে দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক যুগের ক্ষমতা বিভাজন নীতি ও বিচারালয়ের প্রাধান্য প্রাচীন গ্রীসে প্রচলিত ছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা বলতে আমরা যা বুঝি তা ‘‘মিনি আকারে” প্রাচীন গ্রীসে ছিল। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে গ্রীসের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলাে এই দুই দার্শনিকের উপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল।

তথ্যসূত্র

  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, জুলাই ২০১৩, পৃ. ১-২০

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.