নিক্সন, ফোর্ড ও কার্টারের যুগ (১৯৬৯-১৯৮১ খ্রি.)

আভ্যন্তরীন বিষয়াবলি

রিচার্ড নিক্সন (১৯৬৯-১৯৭৪ খ্রি.)

ভূমিকা

১৯৬৯ সালের জানুয়ারীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর রিচার্ড এম. নিক্সনকে রুগ্ন অর্থনীতি, সামাজিক অসন্তোষ, ক্রমাবনতিশীল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানাের প্রতিশ্রুতি পালনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

অর্থনীতি ও সমাজ

যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালে উৎপাদন, মুনাফা এবং কর্মসংস্থান – সব ক্ষেত্রেই অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। শুধু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি (একমাত্র শেয়ারবাজার ছাড়া) অব্যাহত থাকে। অর্থনীতিবিদরা উৎপাদন এবং বেকারত্বের হার দুটোই বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দেন। “মুদ্রা সংকোচন” (টাইট মানি) সুদের হার অসম্ভব রকম বাড়িয়ে দেয়, নতুন বাসগৃহ নির্মাণের কাজে মন্দাভাব সৃষ্টি করে এবং তার ফলে আবাসিক সমস্যা এমনই প্রকট হয়ে ওঠে যে, ১৯৫০ সালের পর থেকে তেমনটা আর কখনাে দেখা যায়নি। ১৯৩০ এর দশকের অনুরূপ একটা মন্দাবস্থা ঠেকানাের ক্ষমতা সরকারের ছিল; কিন্তু এখানকার এই মন্দাবস্থায় অদ্ভুত একটা মুদ্রাস্ফীতির ভাব পরিলক্ষিত হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। নিক্সন প্রচলিত সােস্যাল সিকিউরিটির সুযােগ-সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেন; কিন্তু বৃদ্ধদের চিকিৎসা বাবদ অর্থ ব্যয়ের ওপর আয়কর পুরাে মওকুফ করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা থেকে তিনি পিছিয়ে যান। তবে ন্যুনতম আয়ের নিশ্চয়তা বিধানের সুপারিশ তিনি করেছিলেন।

আমেরিকানরা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান চর্চার ওপর বিশেষ মনোেযােগ দেয়। এটাকে বরাবরই তারা পবিত্র কর্তব্য বলে গণ্য করে এসেছে। তবে পল্লী এলাকা থেকে শহরমুখী জনসংখ্যার যে বিপুল চাপ শহরগুলোর ওপর এসে পড়ে, তাদের শহরে করে তােলার দায়িত্ব সম্পাদন, স্কুলগুলোর পক্ষে পষ্টতঃই সম্ভব হয় না। বর্ণ-একীকরণের প্রশ্নে পত্র-পত্রিকা সভা-সমিতিতে এতাে বেশী হৈ-চৈ শুরু হয়ে যায়, যার ফলে আদালত মামলা-মােকদ্দমার নথিপত্র স্তূপাকার হয়ে ওঠে, গভর্নররা আইনের নির্দেশ অমান্য করার হুমকি দিতে থাকেন এবং “আইন ও শৃঙ্খলার সমর্থকদের শিশুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত হতে প্ররােচিত করে। সবচেয়ে হতাশগ্রস্ত কৃষ্ণকায় তরুণদের বলতে শোনা যায় তারা স্বেচ্ছায় স্কুলের পা বিসর্জন দেয়নি; শ্বেতাঙ্গদের সংস্কৃতির পীঠ থেকে চলে আসতে তারা বাধ্য হয়েছে। তারা এই আশঙ্কাও ব্যক্ত করে যে, ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা বিশ্বের সবচেয়ে সুসজ্জিত এই সমাজে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে।

নিক্সন “কৃষ্ণকায় পুঁজিবাদ” অর্থাৎ কৃষ্ণকায়দের বস্তি এলাকায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করেছিলেন। শ্রমিক নেতৃত্বগ একে বর্ণবৈষম্য বলে আখ্যায়িত করেন; কৃষ্ণকায় সমালােচকরা বলেন, এসব বস্তি এলাকায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান টিকতে পারে না। ১৯৬৯ সালের “ফিলাডেলফিয়া পরিকল্পনার” লক্ষ্য ছিল কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষ্ণকায়দের গৃহনির্মাণ শিল্পে প্রবেশের নিশ্চয়তা বিধান, তবে এ পরিকল্পনার অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত মন্থর।

পৃথিবী নামে গ্রহটি

১৯৫৭ সালে ইউরি গ্যাগারিন একটি নভােযানে চড়ে বিশ্বের সর্বপ্রথম মানব হিসেবে পথিবীর কক্ষপথ পরিক্রমার গৌরব অর্জন করেন। তারপর থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সােভিয়েত ইউনিয়ন মহাশূন্যে সন্ধানী অভিযানের ক্ষেত্রে একের পর এক অনন্য সাফল্যের পরিচয় দেয়। ১৯৫৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে একটি যােগাযােগ উপগ্রহ ব্যবস্থা এবং একটি মহাশূন্য অনি কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়; যে প্রয়াস ১৯৬৯ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের সর্বপ্রথম অবতরণে পরিণতি লাভ করে। এর পর আরও কয়েকবার আমেরিকান নভােচারীরা চাঁদে অবতরণ করেন; কিন্তু আমেরিকান জনগণ এ ব্যাপারে নিরাসক্ত হয়ে পড়ে এবং এই সব মহাশূন্য অভিযানের খবর নিয়ে মাতামাতির দরুন তারা তাদের নিয়মিত টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে পাচ্ছে না বলে অনুযােগ করতে থাকে। খরচের পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়তে দেখে, যুক্তরাষ্ট্র মনুষ্যবিহীন নভােযান উৎক্ষেপণ, মহাশূন্যে রিলে স্টেশন নির্মাণ এবং এমন কি তার প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দী রাশিয়ার সঙ্গে সহযােগিতার পথ বেছে নেয়।

জীববিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল এই মর্মে সাবধান করে আসছিলেন যে, বাতাস এবং পরিবেশকে বিষাক্ত গ্যাস আর রাসায়নিক পদার্থের দ্বারা কলুষিত করে আমরা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনছি। তিন দশক ধরে তাদের এই হুশিয়ারীর পর শূন্যে ভাসমান পথিবী নামে এই গ্রহের নিরাপত্তা বিধানের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। ইতিমধ্যে জীবনধারণের অপরিহার্য বাতাস আর জলের (বিশেষ করে সমুদ্রের) যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায়; যার জন্য বিশেষভাবে দায়ী খনিজ তেলের বেহিসেবী ব্যবহার। জাতীয়তাবাদের বর্তমান শক্তির গতিক যে রকম তাতে এর নিশ্চিত সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি, যদিও সেসময় ঐ দূষণের ৯৮ শতাংশের জন্যেই দায়ী হচ্ছে বিশ্বের শ্বেতকায় জনসাধারণ এবং দোষটা প্রধানত আমেরিকানদের। ১৯৭০ এর দশকের গােড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র সেই উদারনৈতিক আমল থেকে সিকেয় তুলে রাখা কিছু আইন-কানুন ঝেড়েঝড়ে জল আর বায়ুকে কলুষমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়; কিন্তু এসব কাজে খরচ হয় প্রচুর।

বৈদেশিক ঘটনাপ্রবাহ

নিক্সন যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন আমেরিকান জনসাধারণ তখন শঙ্কা আর হতাশাভরে তাকিয়ে ছিল বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহের দিকে। শান্তির অন্বেষায় নিক্সন বিতর্কমূলক যেসব উদ্যোগ নিলেন, আমেরিকানরা তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার প্রথম-দফা কার্যকলাপের শেষে অবশ্য উত্তেজনার বেশ কিছুটা উপশম পরিলক্ষিত হয়।

চীন : জনগণের দৃষ্টিতে, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজ ছিল চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। চীনে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহত হলাে এবং ১৯৭২ সালের নির্বাচনী বছরে নিক্সনের পিকিং সফর সারা দুনিয়ায় আলােড়ন সৃষ্টি করলাে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী নীতিতে অবশেষে এটা স্বীকৃতি পেতে শুরু করলাে যে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির অস্তিত্ব বাস্তব সত্য। এতােদিনের জমাট বরফ গলে যাবার পর চীনা মূল ভূখণ্ড স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘে তাইওয়ানের স্থলাভিষিক্ত হলাে।

ভিয়েতনামীকরণ : নির্বাচনী অভিযান চলাকালে নিক্সন প্রতিশ্রুতি দিলেন, নির্বাচিত হবার পর তিনি তার ভিয়েতনাম শান্তি পরিকল্পনা ব্যক্ত করবেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঘােষণা করলেন, এই পরিকল্পনা হচ্ছে “ভিয়েতনামীকরণ”, অর্থাৎ লড়াই চালানাের দায়িত্ব প্রধানত দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে সরে আসা। তবে এই অপসারণ সম্পন্ন করতে যাতে যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় সেজন্যে তিনি কাম্বােডিয়ার শত্রু ঘাটিগুলোর ওপর আঘাত হানার জন্যে সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ দিলেন। আমেরিকানদের মধ্যে এই কার্যব্যবস্থার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। তারা দেশ জুড়ে শুরু করলাে ব্যাপক শান্তি আন্দোলন; যা ১৯৭০ সালের মে মাসে ওহায়াে অঙ্গরাজ্যের কেট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মর্মান্তিক একটি ঘটনায় পরিণতি লাভ করে। এই ঘটনায় যুদ্ধ-বিরােধী এক বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় ন্যাশনাল গার্ডদের হাতে চারজন ছাত্র নিহত হয়।

সামরিক বাহিনী : ১৯৬৯ সালের পর সিলেকটিভ সার্ভিস ব্যবস্থা সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামুলক ভতির জন্যে একটা লটারীর পদ্ধতি চালু করে। ভর্তির বয়সগত যােগ্যতা ছিল ঊনিশ বছর কিংবা কলেজের পাঠ সাঙ্গ হবার পর। এই পদ্ধতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোেগ কমাতে সক্ষম হলেও “শান্তিকালীন” বাধ্যতামূলকভাবে নিয়ােজিত সৈন্যদের দিয়ে অঘােষিত যুদ্ধ পরিচালনার চাপে বীতশ্রদ্ধ জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্যে সেটা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭২ সালে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ব্যক্তিদের নিয়ে সামরিক বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করার কাজ শুরু হয়ে যায়।

শান্তি নিষ্পত্তি : যেসব আমেরিকান যুদ্ধবন্দীর হদিস জানা ছিল কিংবা যারা বন্দী হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, ভিয়েতনামীকরণের পন্থায় তাদের সমস্যার কোন সুরাহা হলাে না। প্যারিসে শান্তি আলােচনা শেষ পর্যন্ত কিছুটা ফলপ্রদ বলে প্রতীয়মান হয় এবং ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আমেরিকান আলােচক হেনরী কিসিঞ্জার, উপযুক্ত সময়ের আগেই ঘােষণা করেন, “শান্তি হাতের নাগালে এসে গেছে।” চুক্তি সম্পাদন ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র ডিসেম্বরে উত্তর ভিয়েতনামের ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণের পন্থা বেছে নেয়। আলােচনার মাধ্যমে একটা সন্ধিচুক্তির ব্যবস্থা হয় ১৯৭৩ সালের জানুয়ারীতে। তিন মাস পরে যুদ্ধবন্দীরা (নিখোঁজ তালিকাভুক্ত সৈন্যদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ) স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকরা অল্পদিনের মধ্যেই টের পান যুদ্ধে ক্ষান্ত দেবার কোন অভিপ্রায় ভিয়েতনামীদের নেই এবং হতাশাগ্রস্ত শান্তিরক্ষীবাহিনীর চোখের সামনে হানাহানি অব্যাহত থাকে। অবশ্য আমেরিকান সৈন্যদের প্রায় সবাই তখন স্বদেশে ফিরে এসেছে। কংগ্রেসে ১৯৭৩ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোন রকম সামরিক সাহায্য প্রেরণকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। হেনরী কিসিঞ্জার এবং উত্তর ভিয়েতনামের লি. ডাক থাে তাদের শান্তি-প্রয়াসের স্বীকৃতি হিসেবে নােবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন; যদিও লি. ডাক থাে ভিয়েতনামে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার পটভূমিতে এই পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে; কিন্তু ভিয়েতনামীদের কাছে আমেরিকানদের উপস্থিতি ছিল আরও অনেক বেশী দীর্ঘস্থায়ী এক সংগ্রামের অন্তবর্তী একটা পর্যায় মাত্র।

নীতি ও রাজনীতি

নিক্সনের প্রথম-দফা কার্যকালের আগাগােড়াই কংগ্রেসের বিরােধিতা ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে থাকে। দরিদ্র-ভাতা (ওয়েলফেয়ার) প্রদানের ক্ষেত্রে অব্যবস্থার জঙ্গল সাফ করার প্রস্তাব দেয়ায় অনেকে নিক্সনের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। তিনি সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক ভর্তি সম্পর্কিত অভিযােগের অবসান ঘটান। নিঃস অসহায় ব্যক্তিদের অন্ন সংস্থানের জন্যে ১৯৬৮ সালের তুলনায় তিনি দশ গুণ বেশী অর্থ ব্যয় করেন। ১৯৬৯ সালে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে ওয়ারেন বার্গারকে তার মনােনয়ন দানের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি ওঠেনি; তবে সহযােগী বিচারপতি (এ্যাসােসিয়েট জাস্টিস) পদের জন্যে তার দুটি মনােনয়ন সিনেটে প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে হেলথ এডুকেশান অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের বাজেটে তার ভেটো বহাল থাকে। এ্যাটর্নী জেনারেল জন মিচেল, ডেমাক্র্যাটিক জাতীয় সম্মেলন চলাকালে দাঙ্গা বাধানাের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত সাতজন উগ্রপন্থীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে তাদের দণ্ডিত করতে সক্ষম হন। যদিও এ মামলার প্রকৃতি ছিল অন্তর্ভূক্ত এবং রাজনৈতিক। ১৯৭২ সালে সাংবিধানিক কারণে এই দণ্ডাজ্ঞা নাকচ হয়ে যায়।

সাংবিধানিক পরিবর্তন: ১৯৭১ সালে সাংবিধানিক সংশােধনীর দুটি প্রস্তাব প্রবল সমর্থন লাভ করে। ছাব্বিশতম সংশােধনীতে অষ্টাদশ বর্ষীয়দের ভােটাধিকার প্রদান, ১৯৭১ সালে অঙ্গরাজ্যগুলোর অনুমােদন লাভ করে। অপর সংশােধনটি ভাবাবেগপূর্ণ তুমুল বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কংগ্রেসে ধামাচাপা থাকার পর নারী-পুরুষ ভেদাভেদের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধকারী সমানাধিকার সংক্রান্ত সংশােধনী (ইকুয়াল রাইটস এ্যামেন্ডমেন্ট) চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং নিক্সনের অনুমােদনসহ অঙ্গরাজ্যগুলোর বিবেচনার জন্যে প্রেরিত হয়। ১৯৭৫ সালের গােড়ার দিকে এই অনুমােদনের জন্যে প্রয়ােজনীয় ভােটের মধ্যে চারটি অঙ্গরাজ্যের ভোট তখনও পাওয়া যায়নি। মহিলাদের অনেক সংগঠন এই সংশােধনীর অনুমােদনের প্রশ্নে তুমল আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭৩ সালে সুপ্রীম কোর্টের এক রায়ে বলা হয় অঙ্গরাজ্যগুলোর গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন গােপনীয়তার অধিকারের পরিপন্থী। তারপর গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করার জন্যে প্রস্তাবিত একটি সংশােধনী সম্পর্কে কংগ্রেসে শুনানী আরম্ভ হয়।

নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত প্রণালী : স্বাধীনতা সম্পর্কে নতুন প্রশাসনের চিন্তাধারা ছিল সংকীর্ণ। যেমন প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়, কেউ কোন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে কারারুদ্ধ রাখা যেতে পারে এবং ব্যক্তিগত বাসগৃহে আকস্মিক তল্লাসী চালানাের অনুমতি দানের জন্যে আইন প্রণয়নের প্রতিও সমর্থন জানানাে হয়। এ্যাটর্নী জেনারেল বর্ণ-বৈষম্য বিলােপের জন্য পরিকল্পিত আইনের প্রয়ােগ বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন। ওদিকে সুপ্রীম কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, শুধুমাত্র বর্ণগত সাম্যবিধানের খাতিরে ছাত্র-ছাত্রীদের বাসে করে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আনা-নেয়া করার দরকার নেই। ভাইসপ্রেসিডেন্ট স্পিরো অ্যাগনিউ সংবাদমাধ্যমগুলোর সমালােচনা করে বলেন, তারা গােড়া থেকেই পক্ষপাতদুষ্ট এবং তাদের “তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ” (ইনস্টান্ট অ্যানালিসিস) আপত্তিকর। নিক্সন প্রশাসন যে দেশের ভেতরে জনগণের ওপর গােয়েন্দাগিরির কাজে সি.আই.এ.-কে ব্যবহার করেছিলেন এবং এফ.বি.আই. যে ব্যাপকভাবে টেলিফোনের আলাপ আড়ি পেতে শােনার অবৈধ তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, সেটা পরে তদন্তের ফলে প্রকাশ পায়। 

১৯৭২ সালের নির্বাচন : রিপাবলিকান পার্টি সহজেই নিক্সন এবং এ্যাগনিউকে পুনর্মনােনীত করে। নিক্সন পার্টির জাতীয় কমিটিকে পাশ কাটিয়ে যান। ওদিকে প্রেসিডেন্টকে পুনর্নির্বাচিত করার জন্যে গঠিত নির্দলীয় কমিটির (ক্লীপ নামে পরিচিত) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে জন মিচেল এ্যাটর্নী জেনারেল পদে ইস্তফা দেন। ডেমােক্র্যাটিক পার্টি নব-প্রণীত বিধির অধীনে সর্ববয়সী নারী-পুরুষের মধ্য থেকে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করে এবং সম্মেলনে মনােনয়ন লাভ করেন সিনেটর জজ ম্যাকগভার্ণ। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে ম্যাকগভার্ন শেষ মুহূর্তে শান্তিবাদী প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন লাভের জন্যে নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলেন এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযানে তিনি ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্বপর্ণ একটি প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরেন। ম্যকগভার্ন তার সহযােগী ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রথমে সিনেটর টমাস ইগলটনকে বেছে নেন; কিন্তু ইগলটন এক সময় মনস্তত্ত্ববিদের চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং সে সময় ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার চিকিৎসা করা হয়েছিল – এ কথা জানাজানি হবার পর ম্যাকগভার্ন তাকে সরিয়ে সাজেস্ট গ্রাইভারকে তার জায়গায় দাঁড় করান। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কিসিঞ্জার ঘােষণা করলেন, শান্তি অর্জিত হতে আর দেরী নেই। তার এই ঘােষণায় ম্যাকগভার্নের ইতিমধ্যেই নিস্তেজ প্রচার অভিযান আরও মার খায়। নিক্সন একমাত্র ম্যাসাচুসেটস আর ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া ছাড়া অন্য সব কটি অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভােট করায়ত্ব করেন। নির্বাচনী অভিযানের সময় রিপাবলিকান পার্টির অবস্থা দাঁড়ায় এতিমের মতাে এবং নিক্সনের ব্যক্তিগত সাফল্য থেকে বিন্দুমাত্র লাভবান হতে পারে না। কংগ্রেসে ডেমােক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অক্ষুন্ন থাকে।

আভ্যন্তরীণ গণ্ডগােল : ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে, কংগ্রেস এবং জনগণের মধ্যে নিক্সনের প্রতি যে শুভেচ্ছার ভাব বিদ্যমান ছিল তার প্রায় সবই অন্তর্হিত হয়। ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থার সংস্কার পরিকল্পনা বিসর্জন দেয়া হয়। নিক্সন বাজেটে বর্ধিত অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাবে ভেটো প্রয়ােগ করেন এবং জনসনের “দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম” কার্যক্রমের অধীনে গঠিত যেসব দফতরের অস্তিত্ব তখনও বিদ্যমান ছিল তা ভেঙে দেন। ডলারের দরের ওঠা-নামা এবং মুদ্রাস্ফীতির দরুন প্রশাসনকে খুবই বেকায়দায় পড়তে হয়। কংগ্রেস নিক্সনকে তার মজুরী ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে কার্যকর করার অনুমতি দেয়; কিন্তু জনগণ এই নিয়ন্ত্রণ এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চারটি “পর্যায়ে” নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিকল্পনা থেকে নিক্সন ধীরে ধীরে সরে আসেন। মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস পাবার কোনই লক্ষণ দেখা যায় না। প্রশাসন সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে বিপুল পরিমাণ গম বিক্রির চুক্তি সম্পাদন করায় দেশে খাদ্যসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান দর আরও চড়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও শীর্ষস্থানীয় তেল কোম্পানীগুলোর কারসাজির দরুন ১৯৭৩-৭৪ সালে জ্বালানী তেলের সঙ্কট দেখা দেয়। কোন কোন অঙ্গরাজ্য ১৯৪০ সালের পর এই প্রথম জালানী তেলের রেশন ব্যবস্থা চালু করে। আমেরিকানরা আগের চাইতে আরাে ক্ষুদ্রকায় এবং অনেক কম হারে মােটরগাড়ী কেনার পথ বেছে নেয় এবং তাদের ভ্রমণের মাত্রাও অনেক খানি কমিয়ে দেয়; কিন্তু তাদের জ্বালানী অপচয়ের অভ্যাস বদলানাের চিন্তা অনেকের কাছেই আপত্তিকর মনে হয়। তেলের অভাব অবশ্য অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পারা যায়; কিন্তু সংরক্ষণের দৃঢ় সংকল্প ছাড়া এই সংকটের পুনরাবির্ভাবের আশঙ্কা থেকেই যায়। জনগণকে অবশ্য পরিবেশের ক্ষতির তােয়াক্কা না করে জ্বালানী তেল পুড়িয়ে নিজেদের ভােগবাসনা পরিতৃপ্ত করতেই বেশী আগ্রহী মনে হয়।

অ্যাগন্যুর পদত্যাগ : ১৯৭৩ সালের ১০ই অক্টোবর স্পিরো অ্যাগন্যু যুক্তরাষ্ট্রের পদত্যাগকারী দ্বিতীয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হন। এ্যাগন্যুর বিরুদ্ধে অভিযােগ আনা হয়েছিল যে, মেরীল্যান্ডের গভর্নর থাকাকালে তিনি আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন। তিনি এই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না বলে জানিয়েছেন। এছাড়া দুর্নীতি ও উৎকোচ গ্রহণের ব্যাপারে তার সংশ্লিষ্টতা সম্পকিত দলিল-পত্র হস্তান্তর করতেও তিনি সম্মত হন। এভাবে প্রেসিডেন্টের মধ্যে নিক্সনই সর্বপ্রথম সংবিধানের পঞ্চবিংশতি সংশােধনীর বিধান কার্যকর করার সুযােগ পান। এই সংশােধনীতে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদ শূন্য হয়ে পড়লে, কংগ্রেসের অনুমােদন-সাপেক্ষে একজন ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিয়ােগের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছিল। নিক্সন এই পদের জন্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও মর্যাদার অধিকারী কংগ্রেসে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা জেরাল্ড ফোর্ডকে মনােনীত করেন।

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সাফল্য : স্বদেশে নিক্সনের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকলেও প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ও সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরী কিসিঞ্জারের (১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি পররাষ্ট্র সচিব পদে বহাল হন) নেতৃত্বে তার পররাষ্ট্র নীতি চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বেধে ওঠার পর কিসিঞ্জার মিশর, সিরিয়া ও ইসরাইলকে সন্ধি স্থাপন এবং দীর্ঘমেয়াদী আলােচনায় প্রবৃত্ত হতে রাজী করান। ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালে সােডিয়ত ইউনিয়নে নিক্সনের সফর, জনগণের নিত্যব্যবহৃত শব্দ-তালিকায় “দাতাঁত” শব্দটি সংযুক্ত করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটায় এবং প্রত্যাশিত অস্ত্রপ্রসার নিরােধক চুক্তি সম্পাদন করাতে ব্যর্থ হলেও কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে সফল হয়।

কেলেংকারী ও ওয়াটারগেট মামলা

১৯৭২ সালের ১৭ই জুন ওয়াশিংটন ডি.সি.-র ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে ডেমােক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসের তালা ভেঙে অবৈধ প্রবেশের অপরাধে ক্রীপের (কমিটি ট রিইলেক্ট দি প্রেসিডেন্ট) নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান জেমস ম্যাককর্ড জুনিয়র এবং অপর চার ব্যক্তি গ্রেফতার হন। এই তস্করদের সঙ্গে ছিল আড়িপেতে শােনা ও আলােকচিত্র গ্রহণের সাজ-সরঞ্জাম এবং ১০০ ডলারের কিছু নােট। পরে তদন্তে প্রকাশ পায় যে, এই নােটগুলোর উৎস হচ্ছে “ক্রীপ’ তহবিল। অচিরেই জানা যায়, হােয়াইট হাউসের পরামশর্মাতা হাওয়ার্ড হান্টের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার তহবিলের এই অর্থ তস্করদের হাতে পৌছােয়। অক্টোবর নাগাদ এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, “ক্রীপের” উদ্যোগে ব্যাপকাকারে যে গােয়েন্দাগিরি ও রাজনৈতিক নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল, এই চৌর্যবৃত্তি ছিল তারই অঙ্গ। কংগ্রেস অতঃপর নির্বাচন পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে তদন্ত স্থগিত রাখে।

১৯৭২ সালের শেষভাগ থেকে ১৯৭৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই কেলেঙ্কারীর দাগ নিক্সন প্রশাসনের গায়ে লেপ্টে থাকে। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা জন ডীন, হােয়াইট হাউসের তরফ থেকে সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার অপচেষ্টা চলছে – এটা উপলব্ধি করার পর রাজসাক্ষী হিসেবে সব ঘটনা বিবৃত করতে এগিয়ে এলেন। ১৯৭৫ সালের পয়লা জানুয়ারী বিচার শেষ হলে দেখা গেল, চৌর্যবৃত্তি থেকে শুরু করে মিথ্যা সাক্ষ্যদান এবং বিচারের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে ক্ৰীপের সদস্য ও নিক্সনের কর্মচারীদের মধ্যে পনেরাে জন সাজা পেয়েছেন। এই কেলেঙ্কারীর সঙ্গে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা দেখে আমেরিকান জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার পর নিক্সন নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে, তার শীর্ষস্থানীয় সহকারীদের বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হননি।

ওয়াটারগেট মামলায় সরকার পক্ষের বিশেষ কৌসুলী আর্চিবল্ড কক্স এবং প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী অভিযান সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ তদন্তকারী সিনেটের একটি সিলেক্ট কমিটি, উভয়েই নিক্সন এবং তার সহকারীদের মধ্যে কথােপকথনের রেকর্ড করা টেপ তলব করেন। ওদিকে ফেডারেল জাজ জন সিরিকা নির্দেশ দেন, তলব করা এই টেপ গ্র্যান্ড জুরীর হাতে তুলে দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে টেপগুলি তার কাছে সােপর্দ করতে হবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জটিল সাংবিধানিক প্রশ্নের অবতারণা হয়। নিক্সন, কক্সের মামলার জবাবে তাকে বরখাস্ত করলেন। এ্যাটর্নী জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন এবং সহকারী এ্যাটর্নী জেনারেল উইলিয়াম রাকেলস হাউস এর প্রতিবাদে ইস্তফা দিলেন। পত্র-পত্রিকায় এই ঘটনা ‘স্যাটারডে নাইট ম্যাসাকার’ নামে চিহ্নিত হয়। নিক্সন কর্তৃক নবনিযুক্ত বিশেষ কৌসুলী লিওন জাওরী এবং এ্যাটর্নী জেনারেল উইলিয়াম স্যাক্সবী উভয়েই নতুন করে এসব টেপ তলব করেন এবং ওয়াটারগেট মামলা সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনাকে জোরদার করেন। প্রতিনিধি পরিষদের জুডিশিয়ারী কমিটিও ইমপিচমেন্ট (অভিযুক্তকরণ) প্রস্তাবের ওপর আলােচনার সময় বেশ কিছু টেপ তলব করে। নিক্সন নির্বাহী হিসেবে বিশেষ অধিকারের (এক্সিকিউটিভ প্রিভিলেজ) দোহাই দিয়ে সব অনুরােধই প্রত্যাখ্যান করেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদের কমিটির সঙ্গে একটা “আপােস-রফার’ ফল হিসেবে রেকর্ড করা কথােপকথনের কাটছাঁট করা লিখিত ভাষ্য হস্তান্তর করতে সম্মত হন। ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে (নজন বিচারকের আটজনই অভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেন, শুধু বিচারপতি রেনকুইস্ট মতামত প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন) বলা হলাে, সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে নির্বাহী হিসেবে বিশেষ অধিকার দেয়া থাকলেও, এ ক্ষেত্রে সেটা প্রযােজ্য নয়। কারণ এই মামলায় অপরাধমূলক চক্রান্তের সম্ভাবনা জড়িত রয়েছে। এই রায়ের প্রেক্ষিতে দাখিল করা সর্বশেষ টেপগুলো থেকে ওয়াটারগেট ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ব্যাপারে নিক্সনের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করার কোন উপায় থাকলাে না।

বেশীর ভাগ আমেরিকানই অবাক হয়ে ভেবেছে, এই চৌর্যবৃত্তি ও নাশকতামূলক কাজের সত্যিই কি কোন দরকার ছিল। জনমত যাচাইয়ের ফলাফল থেকে সন্দেহাতীতভাবে জানা গিয়েছিল যে, নিক্সন তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চাইতে অনেক এগিয়ে রয়েছেন এবং জয়লাভের জন্যে তার অবৈধ কোন কাজে জড়িত হবার কোনই দরকার ছিল না। আসলে প্রশাসনের বিকারগ্রস্ত কাল্পনিক বিপদের ভয়ই তাকে এই পথে এনেছিল। নিক্সনের নীতিজ্ঞানবজিত উপদেষ্টারা প্রচার অভিযান চালাকালে শুধু যে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন তাই নয়, সেই সঙ্গে নিক্সনের অনুমােদন নিয়ে তারা পূর্ণ তদন্ত পরিচালনার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলেন। দেশের স্বার্থের বদলে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে অধিকতর আগ্রহী আইন-শৃঙ্খলার ধ্বজাধারী এই প্রশাসন তার নিজের বেআইনী ক্রিয়াকলাপেরই শিকারে পরিণত হয়।

১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ এই রাজনৈতিক কেলেঙ্কারীর দুর্গন্ধে গােটা ওয়াশিংটনের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বিভিন্ন কর্পোরেশন কর্তৃক উভয় দলের নির্বাচনী প্রচার তহবিলে অবৈধ চাঁদা প্রদান এবং দুধের চড়া দামের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের দরাজ হাতে অর্থ ব্যয়ের বিবরণ ফাঁস হয়ে যায় এবং অনেক কংগ্রেস সদস্যই এসব কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।

পদত্যাগ ও পদপুরণ

শেষ টেপগুলো দাখিল করার পর বোঝা গেল, প্রতিনিধি পরিষদে গুরুতর দুর্নীতির অভিযােগে নিক্সনকে অপসারিত করার প্রস্তাবের অনুমােদন অবধারিত। অভিযুক্তকরণের তিনটি অনুচ্ছেদ, প্রতিনিধি পরিষদের জুডিশিয়ারী কমিটিতে ইতিমধ্যেই অনুমােদিত হয়ে গিয়েছিল। এগুলোতে নিক্সনের বিরুদ্ধে ওয়াটারগেট মামলায় বিচার পরিচালনার কাজে বাধা প্রদান, প্রতিনিধি পরিষদের সপিনা কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং টেলিফোনের কথােপকথন আড়ি পেতে শােনা, আয়কর অডিট ইত্যাদি পন্থার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের ব্যাপারগুলোও অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই দুঃসহ যন্ত্রণাকে আর বাড়তে না দিয়ে ১৯৭৪ সালের ৯ই আগস্ট নিক্সন পদত্যাগ করলেন। আমেরিকার ইতিহাসে কোন প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের ঘটনা এটাই সর্বপ্রথম। ফলে জেরাল্ড ফোর্ড তার স্থলাভিষিক্ত হলেন এবং মজার কথা, তিনিই হচ্ছেন সর্বপ্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যিনি জনগণের ভােটে নির্বাচিত হননি। ফোর্ড প্রতিশ্রুতি দিলেন নিক্সনের বৈদেশিক নীতির কোন পরিবর্তন তিনি ঘটাবেন না এবং “ওয়াটারগেটের দ্বারা সৃষ্ট দেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষত সেলাই করে তিনি জোড়া লাগাবেন।” কিন্তু ফোডের প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ সেই ক্ষতকে আরও উস্কে দেয়। দৃশ্যত অকারণ তাড়াহুড়াে করে তিনি নিক্সনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযােগ উত্থাপিত হবার আগেই তাকে শর্তহীন মার্জনা প্রদান করলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তলবনামা ফাঁকি দিয়ে যারা আত্মগােপন করেছিল এবং যারা সামরিক বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল একই সঙ্গে তাদের জন্যে শর্ত-সাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুরীর যে কার্যক্রম তিনি ঘােষণা করলেন তাতে মনে হলাে, দুটো অপরাধই সমশ্রেণীভূক্ত – একটার সঙ্গে অন্যটার কোন তফাত নেই। ক্ষমা মঞ্জুরীর শর্ত ছিল, যারা তলবনামা ফাঁকি দিয়েছে, তাদের সামরিকবাহিনীতে যােগ দিয়ে সেই মেয়াদ পূর্ণ করে দিতে হবে। কিন্তু এই শর্ত তারা প্রত্যাখ্যান করে। তবে পলাতক কয়েক হাজার সৈনিক তাদের কলঙ্কমােচনের জন্য আত্মসমর্পণ করে।

মুদ্রাস্ফীতি আর অর্থনৈতিক স্থবিরতার চাপ, দেশে যখন গুরুতর মন্দাবস্থার সৃষ্টি করেছিল, সে সময় দরকার ছিল বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তেমন নেতৃত্ব প্রদানে অহেতুক মন্থরতার পরিচয় দেন। নিক্সনের ক্যাবিনেট সদস্য ও সহকারীদের সরিয়ে নিজের পছন্দমতাে লােকজন নিয়ােগ করতে এবং নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেলসন রকফেলারের মনােনয়ন অনুমােদন করাতে পাঁচ মাসেরও বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। দেশের জনগণ যে কতােখানি অধীর এবং ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে তার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালের মধ্যবর্তী কংগ্রেসীয় নির্বাচনে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসম্পন্ন কংগ্রেস নির্বাচিত করে তারা তাদের ক্ষুব্ধ মনােভাব প্রকাশ করে।

জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৪-১৯৭৭ খ্রি.)

ফোর্ড সরকার

কিসিঞ্জারের পরামর্শ অনুযায়ী ফোর্ড নিক্সনের ব্যক্তিগত কূটনীতির ধারা অব্যাহত রাখেন। ফ্রান্স ও জাপানের সঙ্গে তিনি সম্পর্কের উন্নতি ঘটান এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি সম্পাদন করেন। বিদেশে তার এসব সফরের সমালােচনা করে বলা হয়, তিনি স্বদেশের সমস্যাবলীর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করছেন। ১৯৭৫ সালের শুরুতে ফোর্ড অর্থনৈতিক মন্দা, বৈরী একটি কংগ্রেস এবং ক্রমবর্ধমান গণ-অসন্তোষের সম্মুখীন হলেন। রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি সংক্রান্ত ভাষণে তিনি যে কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করলেন তাতে রেয়াতি হারে আয়কর প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও তা পেট্রোলের দাম কিছুটা বাড়িয়ে দেবে। কংগ্রেসে প্রবল বিরােধিতা তার এই কার্যক্রমের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তােলে।

প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে নিজস্ব সরকার গঠন করলেন। রিপাবলিকান দলের উদারনৈতিক শাখার কাছ থেকে তিনি পরামর্শ গ্রহণ করতে শুরু করলেন এবং নেলসন রকফেলারকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনােনীত করলেন; পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জারসহ নিক্সনের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা বহাল থাকলেন। আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক লক্ষ্য ও কিসিঞ্জারী কায়দায় ভ্রাম্যমাণ কূটনীতির সুফল পাওয়া যেতে থাকে, যেমন সােভিয়েতদের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, জেনেভায় মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে শান্তি আলােচনা এবং ফ্রান্স ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। আমেরিকানরা এশিয়ার দিকে বিশেষ নজর দেয়নি। কেবলমাত্র একটি ঘটনা উল্লেখযােগ্য। মার্কিন জাহাজ মায়াঙ্গুয়েজ ভিয়েতনামী জলসীমায় ভুলবশত প্রবেশ করায় ঐ ভাহাজের নাবিকরা যখন ভিয়েতনামীদের হাতে বন্দী হয় তখন ফোর্ড তাদের মুক্ত করার জন্য দ্রুত অভিযানের নির্দেশ দেন। ফোর্ডের স্বীয় ভাবমূর্তির উন্নতিকল্পে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণের ফলে এই মর্মে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় যে, আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর প্রতি তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বস্তুত আভ্যন্তরীণ সমস্যার অন্ত ছিল না। ফোর্ড কতৃক শাসনভার গ্রহণ করার মাত্র দুমাস পরই নির্বাচনের ফলে দেখা গেল কংগ্রেসের দুই তৃতীয়াংশ ডেমােক্র্যাটদের দখলে। নতুন কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বিরােধ লেগেই থাকল। ওয়াটারগেটের কালিমা সহজে মুছে যাবার ছিলনা। ১৯৭৫ সালে নিক্সনের চারজন ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা ওয়াটারগেটের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য দণ্ডিত হলেন এবং নিক্সন যেসব দলিল ও টেপ ফেলে এসেছিলেন সেগুলো উদ্ধার করার জন্য মামলা দায়ের করলেন। ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে ফোর্ডকে দুবার গুলি করার চেষ্টা করা হয়। সি.আই.এ. কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরে গুপ্তচরবৃত্তি ও বিদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকা সম্বন্ধে নয়া তথ্য উদঘাটন এবং নারী জাগরণের সমর্থক, ছাত্রনেতা এবং নাগরিক অধিকারের প্রবক্তাদের এফ.বি. আই. কতৃক হয়রাণী করার অপচেষ্টা প্রেসিডেন্টের পদকে আরও কালিমামণ্ডিত করে।

অর্থনীতি প্রেসিডেন্টের দুর্নীতির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিউ ইয়র্ক শহর যখন প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্ৰম, তখনও ফোর্ড নগরবাসী নেতৃবৃন্দের আবেদন-নিবেদন সত্তেও হস্তক্ষেপ করেননি। উল্টো তিনি নিউ ইয়র্ককে আর্থিক ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার অভিযােগে অভিযুক্ত করেন। যদিও নিউ ইয়র্কের সম্পূর্ণ শহরগুলো ও গ্রাম অঞ্চলে সেরকম সহানুভতি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি, হঠাৎ করে ১৯৭৫ সালে বেকারত্বের হার শতকরা ৮.৫ বেড়ে যাওয়ায় এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির ফলে সকলেই আচম্বিত হয়ে পড়ে। ১৯৭৬ নাগাদ যখন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার কিছুটা কমতে শুরু করেছে, তখন দেখা গেল যে এক ডলারের ক্রয়-মূল্য ১৯৬৭ সালে যা ছিল তার চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। যুবক এবং কষ্ণকায়দের মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা গড়ের হিসেবে বেশ উপরের দিকে রয়েছে। তব এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়া সত্তেও নতুন নতুন চাকুরী প্রার্থীদের (অধিকাংশই নারী) উৎসাহিত করে এবং বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সময়কালে শীতের আধিক্য, জ্বালানীর মূল্যবদ্ধি, খরা এবং জন্মহারের অবনতি, সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর আঘাত হানে। ১৯৭৬-৭৭ সালে শীতকালে জ্বালানীর তীব্র অভাব পরিবর্তিত সরকারের অবস্থা দুঃসহ করে তােলে। জন্মহারের অবনতির ফলে যে সকল শিল্প-প্রতিষ্ঠান শিশুদের চাহিদা মেটাতে নিয়ােজিত ছিল সেগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাত্র দশ বছর আগে যেসব স্কুল স্থাপিত হয়েছিল সেগুলো খালি হয়ে যায় এবং শিক্ষকদের চাকুরীচ্যুত করা হয়। সার ও কৃষিযন্ত্রের মূল্য-বদ্ধি এবং শস্যের প্রাচুর্যের ফলে কৃষিজাত দ্রব্য থেকে আয় কমে যায়। জ্বালানী সংকট এবং মালপত্র চলাচলের খরচ বেড়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন খাদ্যসামগ্রির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকে।

১৯৭৬-এর নির্বাচন

১৯৭৬ সালের প্রেসিডেন্টের পদের জন্য নির্বাচনী প্রচারকার্য প্রথমবারের মত প্রচারকার্য সংক্রান্ত অর্থ সাহায্য আইনের অধীনে শুরু হয়। এই আইনের বলে প্রার্থীদের প্রচারকার্যে ব্যক্তিগত ব্যয় সীমিত রাখার এবং প্রার্থীদের নিজস্ব প্রচারকার্যের জন্য আর্থিক সাহায্য দেবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাইমারী পর্যায়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক নির্বাচন অর্থনীতির দুঃসহ অবহাওয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলে দেখা যায় যে, রিপাবলিকান দলের সামনের দিকে রয়েছেন ফোর্ড এবং ডেমােক্র্যাট দলের জেমস ই. (জিমী) কার্টার যিনি পূর্বে জর্জিয়ার গভর্নর ছিলেন। প্রথম বাছাইয়ে উভয়ই তাদের দলের প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন লাভ করলেন। রক্ষণশীল রােনাল্ড রেগানের স্বপক্ষে জোর প্রচারকার্য ফোর্ডকে চূড়ান্ত মনােনয়ন লাভের জন্য ডানপন্থীদের দিকে ঝুকে পড়তে বাধ্য করে। ফোর্ড প্রতীক চিহ্নরপে রক্ষণশীল রবার্ট ডােলকে তার নির্বাচনী দোসর হিসেবে বাছাই করেন। এদিকে জিমি-কার্টার যিনি আধুনিক পপুলিস্ট হিসেবে নির্বাচনী অভিযানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি উদারপন্থীদের ভার নিরসন করলেন। ওয়ালটার মনডেলকে সম্ভাব্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনােনীত করে। উভয়পক্ষের নির্বাচনী প্রচার অসতর্ক উক্তির দ্বারা কিছুটা ক্ষতিসাধিত হয় বিশেষ করে যখন ফোর্ড প্রথমেই তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হলেন। বহিরাগত হওয়া সত্তেও (এবং বােধহয় এই জন্যই) কার্টার ফোর্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকলেন; নির্বাচনী অভিযানকালে দেখা গেল তাদের মধ্যে ব্যবধান কমে এসেছে। কার্টারের পক্ষে শতকরা ৫১ গণভােট এটাই নির্দেশ করলাে যে, তিনি শ্রমজীবী নগর অঞ্চল, কৃষ্ণকায় এবং দক্ষিণ এর পুরাতন সম্মিলিত জোটের নববিধানকেই পুনরাধিষ্ঠিত করেছেন। এই জোটকে মজবুত করার জন্য নতুন প্রেসিডেন্টকে সুষম আহ্বায়ক, প্রশাসনিক সংস্কার, বেকারদের চাকুরী সংস্থান এবং একটি “নীতিভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতি” অনুসরণ করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কার্টার দাবী করেছিলেন যে, তিনি ওয়াশিংটনের ক্ষমতার দালাল ও তাদের সংস্থার আওতা থেকে মুক্ত। এখন দেখা গেল তাকে তার নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য এদের সঙ্গেই নয়া সম্পর্ক স্থাপন করে কাজ করতে হবে।

জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১ খ্রি.)

ওয়াশিংটনে নয়া মুখ

জাতীয় মেজাজ বদলাতে শুরু করেছিল। পুরাতনপন্থীরা মানবাধিকারের সেই সব ধারার বিরােধিতা করতে শুরু করলাে যেগুলোতে সমকামীদের অধিকার রক্ষা করা হয়েছে এবং কেউ কেউ নারীমুক্তি রােধ করার জন্য সংঘবদ্ধ হতে লাগল, এমনকি হার্ডস্টনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সভার কতিপয় প্রতিনিধির আসন তারা দখল করে নেয়। প্রাক্তন ছাত্র, উগ্রপন্থীরা আইন রক্ষাকারীদের হাতে আত্মসমর্পণ করে পুরাতন ও নতুন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হলাে। গর্ভবতী নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা থেকে বাদ দেয়ার এবং গর্ভবতী পরিচারিকাদের বিনা বেতনে ছুটি নিতে বাধ্য করার যে রীতি মিল মালিকরা অনুসরণ করে আসছিল অর প্রতি সুপ্রীম কোর্ট রক্ষণশীল মনােভাব নিয়ে সমর্থন জানাতে শুরু করলাে। অত্যন্ত সুসংবদ্ধভাবে কংগ্রেস এবং অঙ্গরাজ্যের ব্যবস্থাপক সভার ওপর চাপ দেয়া হতে লাগলাে যাতে গর্ভপাতের জন্য কোন অর্থ মঞ্জুর করা না হয়। এলেন বাকের এই মর্মে অভিযােগ যে, এফারমেটিভ একশন কাৰ্যসূচী পাল্টা বর্ণবৈষম্যের শামিল, সুপ্রীম কোর্টের কর্ণগােচর করা হলাে এবং কিছুসংখ্যক উদারপন্থীও এর প্রতি সমর্থন জানালেন। এমনকি ন্যাশনাল এ্যাসােশিয়েশান ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালারড পিপল (NAACP) প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার দাবী সমর্থন করলাে, যার ফলে দরিদ্র কৃষ্ণকায় ক্রেতাদের অসুবিধা হবার সম্ভাবনা দেখা দিল।

আভ্যন্তরীণ অচল অবস্থা : কার্টার প্রথম বছরে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার দিকে বেশী দূর এগুতে পারেননি। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বৃদ্ধির ফলে প্রেসিডেন্টের সুষম বাজেট প্রণয়নের আশা তিরােহিত হলাে। কংগ্রেস তার নিজের কেলেংকারী ও আশংকার ফলে একগুয়েমী মনােভাব গ্রহণ করলো। কার্টারের নিজস্ব সমর্থকদের মধ্যে বিশেষ করে কৃষক, কৃষ্ণকায় ব্যক্তিবর্গ এবং শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। কৃষ্ণকায়দের বেকারত্ব সম্বন্ধে সরকারের ঔদাসীন্যের জন্য আরবান লীগের প্রধান প্রকাশ্যে সমালােচনা করলেন। ধর্মঘটকারী কৃষকরা ওয়াশিংটনে এবং সমতলে অবস্থিত কার্টারের নিজস্ব বাড়ি জর্জিয়ায় ট্রাক্টারের সমাবেশ দ্বারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলাে। শ্রমজীবীরা উচ্চ হারের মাসুলের পক্ষে তদবীর করতে লাগলাে এবং তারা অত্যন্ত নিরাশ হলাে যখন কার্টার ১৯৭৮ সালে জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকাল স্থায়ী কয়লা ধর্মঘটে টাফট-হার্টলী অ্যাক্ট প্রয়ােগ করে হস্তক্ষেপ করলেন। কয়লাখনির শ্রমিকরা আদেশ মানতে অস্বীকার করলাে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা নিষ্পত্তিতে পৌঁছান গেল। তা সত্তেও কার্টার কর্তৃক বি-১ বােমার বিমান নির্মাণে এবং বহুবিধ জলযান প্রকল্প গ্রহণে অসম্মতি এবং নিউট্রন বােমা প্রস্তুতিকে মূলতবী রাখায় উদারপন্থীরা উৎসাহিত বােধ করলেন।

প্রেসিডেন্টের শাসনমূলক পরিকল্পনাও আর এগোতে পারলাে না। তিনি জর্জিয়ান, কৃষ্ণকায় এবং মহিলাদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একটি সুষম মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। তিনি প্রতীক হিসেবে এক তৃতীয়াংশ কর্মচারীকে অব্যাহতি দিলেন, কিন্তু এক বছর পরই আবার কংগ্রেসকে অনুমোদনের জন্য অনুরােধ করলেন যাতে চলতি কর্মচারীর সংখ্যার দ্বিগুণ নিযুক্ত করা সম্ভব হয়। কার্টারের পণ্য ব্যবহার ও সংস্থা গঠন করার পরিকল্পনাটি কংগ্রেস নাকচ করে দিল, কিন্তু একটি সাধারণ আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব সমর্থন করলাে যার ফলে প্রশাসনিক শাখাকে পুনর্গঠন করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে দেয়া হলাে। কার্টার কতৃক একটি নতুন শিক্ষা বিভাগ খােলার প্রস্তাব এবং অসামরিক চাকুরীর পুনর্গঠনের পরিকল্পনার প্রতি কংগ্রেস উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া দেয়নি। একই ভাগ্য জটলাে নির্বাচন সংস্কারের ক্ষেত্রে যখন ভােটারদের নির্বাচন কেন্দ্রে রেজিষ্ট্রি করা সম্বন্ধে কার্টারের প্রস্তাব কংগ্রেস নাকচ করে দিলাে এবং নির্বাচনী কলেজ বিলুপ্ত করার জন্য শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবকে ধামাচাপা দেয়া হলাে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কার্টারকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখল যেমন রেখেছিল ফোর্ডকে। চরম আবহাওয়ার ফলে অর্থনীতি আবার বিপর্যয়ের সম্মখীন হলাে। ১৯৭৮ নাগাদ মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা মন্থর হলাে এবং বেকারত্বের হার সাত শতাংশে নেমে গিয়ে স্থিতিশীলতা অর্জন করলাে। কার্টার অর্থনীতিকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে আয়কর কমাবার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রস্তাব থেকে সরে দাঁড়ালেন যদিও কংগ্রেস আয়কর কমাবার অনুকূলে অনমনীয় মনােভাব গ্রহণ করলাে। কার্টার জ্বালানী সংরক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দিলেন এই অর্থে যে, এর ওপর জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল (এমনকি কংগ্রেসকে বােঝাবার জন্য তিনি তার বিদেশ যাত্রা বিলম্বিত করলেন)। কিন্তু তার প্রস্তাবসমূহ ১৯৭৮-এর বসন্তকাল পর্যন্ত পড়ে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত আইন পরিষদে আপোষমূলক বিল গৃহীত হয় যার ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলাে।

ওয়াশিংটন স্বীয় কলুষিত ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট বন্ধু আয়ব্যয়ক পরিচালক বার্টল্যালকে পদত্যাগ করতে হলাে যখন কংগ্রেস জর্জিয়ায় তার বিতর্কিত ব্যাংক লেন-দেন সম্বন্ধে তদন্ত শুরু করলাে। জনৈক কোরীয় ব্যবসায়ী টঙ্গন পার্কের সঙ্গে কয়েকজন কংগ্রেস সদস্যের নির্বাচনী অর্থের বিনিময়ে সুবিধা আদায়ের জন্য বন্দোবস্ত ফাঁস হয়ে যায় ও যে ব্যাপারে পার্টির নেতৃবন্দ সমেত বেশ কয়েকজন জড়িত ছিলেন তাতে কয়েকজন প্রাক্তন কংগ্রেস সদস্য অভিযুক্ত হলেন। কংগ্রেসের সামনে বিতর্কিত বিষয়ের অভাব ছিল না। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলাে এবং আইন পরিষদ এটাকে কোনমতে ঠেকিয়ে রাখলাে সামাজিক নিরাপত্তা কর বৃদ্ধি করে এবং সত্তর বছর বয়েসে বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের নিয়ম কার্যকরী করা স্থগিত রেখে; ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি হলাে বটে, কিন্তু কিছু লােক প্রাথমিক সবিধা লাভ থেকে বঞ্চিত হলাে। এই বিধান নির্বাচনী বছরে জনপ্রিয় ছিল না এবং ছয় মাসের মধ্যেই ইউজ ওয়েজ অ্যান্ড মিলস কমিটি সাধারণ তহবিল থেকে অর্থ যােগান দিয়ে কর বৃদ্ধি কমিয়ে দেবার পক্ষে ভােট দিল। সিনেট এবং হাউজের মধ্যে বেশ কয়েক মাস ধরে মতবিরােধ চলতে থাকার পর ফেডারেল সরকার কর্তৃক চিকিৎসার সাহায্যে গর্ভপাতের জন্য অর্থ কােন যোগান বন্ধ করা হলাে এবং সুপ্রীম কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা বলবত রাখল। (এই ধরনের আইন যেটা পূর্ববৰ্তী কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল পরে মুলতুবী রাখা হয়)।

পররাষ্ট্র নীতি সম্বন্ধে বিতর্ক : সিনেট অত্যন্ত স্বল্প ব্যবধানে দুটি চুক্তি অনুমােদন করলাে যার ফলে পানামা খালের নিরপেক্ষতা এবং এটাকে ক্রমশ পানামার নিকট ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তার বিধান করা হলাে। অবশ্য সামরিক হস্তক্ষেপের নিশ্চয়তা বিধান করে সিনেটের সংশােধনী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পানামাবাদীরা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলাে এবং এর ফলে ল্যাটিন আমেরিকায় অনুকল ভাবমূর্তি সৃষ্টি করার ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টা প্রায় বানচাল হয়ে গেল। চুক্তির পক্ষে এবং বিপক্ষে দুই ধরনের মত দেখা দিলাে। আলাপ-আলােচনা রিপাবলিকানদের আমলে শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন রক্ষণশীল আমেরিকানরা দাবী করতে লাগলাে যে, খাল এলাকা হলাে আমেরিকার ভূখণ্ড। কার্টার মানবাধিকারের উপর জোর দিয়ে এবং আরব জাতিসমূহ এবং আফ্রিকার কৃষ্ণকায় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার নয়া পররাষ্ট্র নীতি ঘােষণা করলেন। মানবাধিকারের ওপর তার গুরুত্ব আরােপ হয়তাে মুক্তিকামীদের হদয় বিগলিত করেছিল, কিন্তু এর ফলে সােভিয়েতদের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি সম্বন্ধে আলাপআলােচনাকে ব্যাহত করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল। জাতিসংঘে নতুন রাষ্ট্রদূত এনড্রু ইয়ং, যিনি ছিলেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একজন ঝানু নেতা, তিনি নিযুক্ত হলেন তৃতীয় বিশ্বের প্রতি কার্টারের মুখপাত্র হিসেবে। সরকারের বেশ কিছু সময় লাগলাে ইয়ং-এর কিছু উক্তিকে ঘষে-মেজে পুনর্ব্যাখ্যা করতে, কিন্তু ইয়ং কৃষ্ণকায় আফ্রিকার নেতাদের সত্যি শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইসরায়েলের সাথে মিশর ও সৌদিআরবকে জঙ্গী বিমান বিক্রয় করার জন্য কার্টারের প্রস্তাব ইসরায়েলে ক্ষোভের সঞ্চার করলাে এবং কংগ্রেসে বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হলাে। কার্টারের সবচেয়ে সফল কূটনৈতিক অভিযান হলাে কিউবায় যাবার জন্য নিষেধাজ্ঞার অবসান এবং ক্যাস্ট্রো সরকারের সঙ্গে বেসরকারী পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপনের সুত্রপাত করা।

রাজনৈতিক মঞ্চ : ১৯৭৮-এর প্রথম দিকে রিপাবলিকানরা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে উল্লসিত হয়ে বলতে শুরু করেছিল যে, প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমতে আরম্ভ করেছে। কার্টারের নিয়ােগসমূহের ফলে উপ-নির্বাচনগুলোতে রিপাবলিকানরা বেশ ভাল করলাে, তাছাড়া রিপাবলিকানদের হাতে ডেমােক্র্যাটদের চেয়ে বেশী অর্থ ছিল। রক্ষণশীল এবং উদারপন্থীরা রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্ব দখল করার জন্য প্রচেষ্টা চালালাে, যদিও কোন পক্ষ থেকে শক্তিশালী প্রতিযােগীর আবির্ভাব হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা কর বৃদ্ধি করার পর কংগ্রেস নির্বাচকদের সম্মুখীন হতে ভয় পেলাে এবং কার্টার কতৃক জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনাকে শরৎকালীন নির্বাচনের আগেই চালু করার প্রচেষ্টা তাদের আরও শঙ্কিত করে তুললাে। যাই হােক, কংগ্রেসে ডেমােক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রিপাবলিকানদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রাখল। জনসাধারণ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অধৈর্য হয়ে উঠলাে। কার্টার তার নির্বাচনী প্রচারের মাধ্যমে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করেছিলেন তার মধ্যেই নিহিত ছিল অসন্তোষের বীজ।

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি

ভূমিকা

প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রূপে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ক্ষমতা লাভের পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন কমিউনিস্ট জগৎকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন যে, রাজ্যজয় বা রাজ্যবিস্তারের দ্বারা নয়, শান্তিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার দ্বারা মানবজীবনকে ঐশ্বর্যপূর্ণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ব্যগ্র। ইতিপূর্বে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ক্ষমতলাভ করে কোরিয়াতে শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নিক্সন নির্বাচিত হবার পর ভিয়েৎনামে ও মধ্যপ্রাচ্যে শাস্তিস্থাপনের দায় গ্রহণ করেছিলেন। নিক্সন নির্বাচনোত্তর ঘোষণায় শান্তিস্থাপনের আকাংখা ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে, তার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাস করা এবং সেজন্য তিনি যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন তা হলো উন্মুক্ত পৃথিবী, উন্মুক্ত চিন্তার জগৎ, পণ্য ও ব্যক্তির বিনিময়ের জন্য উন্মুক্ত জগৎ, যে-জগতে কোন জাতি, বৃহৎ অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করে না। শক্তিদ্বন্দ্বে বিভক্ত ও ক্লান্ত দুনিয়াতে এই নবরূপায়ণ সম্ভব করতে হলে আন্তর্জাতিক বিরোধকে সংঘর্ষের পথ পরিহার করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্যের মীমাংসা করতে হবে। সেজন্য নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন যে, “Let all nations know that during this administration our lines of communication will be open.” এই চিন্তার বাস্তব রূপায়ণের জন্য নিক্সন কমিউনিস্ট জগতের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টায় পূর্ব-ইউরোপের কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রোমানিয়া পরিভ্রমণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ব ইউরোপের সাম্যবাদী দেশ পরিদর্শন করে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাসের প্রচেষ্টা করেছিলেন।

নিক্সন এশিয়ার দেশগুলোও পরিদর্শন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরের এলাকা পরিত্যাগ করবে না বলে নিক্সন ভারত পরিভ্রমণের সময় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের জুলাইতে তিনি এশিয়া ভ্রমণের সময় গুয়ামের ঘোযণায় বলেছিলেন, “We must avoid that kind of policy that will make countries in Asia so dependent upon us that we are dragged into conflicts such as the one that we have in Vietnum”. নিক্সন এশিয়ার দেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল হতে বলেছিলেন। গুয়ামের নীতির (Guam Doctrine) সাথে ব্যাংককে অব্যবহিত পরেই নিক্সন যে উক্তি করেছিলেন তার সামঞ্জস্য নেই। থাইল্যাণ্ডের রাজধানী ব্যাংককে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন যে, “The United States will stand proudly with Thailand against those who might threaten it from abroad or from within.” এই উক্তিতে এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষত মার্কিন সাহায্যপুষ্ট দেশগুলোতে স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। নিক্সনের শাসনের শুরুতে তিনি ভিয়েৎনাম থেকে সেনাপসারণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭০ সারে ১৮ই মার্চ তারিখে কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স নরোদ্যম সিহানুকের নিরপেক্ষ সরকারের পতন হয় এবং তার স্থলে জেনারেল লন নল (General Lon Nol) একটি নতুন সরকার গঠন করেছিলেন। লন নল সরকার ভিয়েৎকংদের কম্বোডিয়া থেকে উৎখাত করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। নিক্সনের সময়কার দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের, বিশেষ করে ভিয়েৎনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের পরিস্থিতি আলোচনা করার পূর্বে এইসব দেশের সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

নিক্সন-পূর্ব যুগে ভিয়েৎনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া

ভিয়েৎনাম

জেনেভা চুক্তির পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফরাসী প্রভাবের স্থলে মার্কিন প্রভাব স্থাপিত হয়। এই রাষ্ট্রের প্রধান বাও-দাইকে একটি গণভোটের সাহায্যে পদচ্যুত করে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী না-গো দিয়েন দিয়েম (Ngo-Dien Diem) নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করে। ১৯৫৬ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েৎনামে ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জেনেভাতে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তা কার্যকরী হয়নি। কারণ নাগো দিয়েন দিয়েম মার্কিন প্ররোচনায় উৎসাহিত হয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ১৯৬৩ সালে একটি অভ্যুত্থানের ফলে দিয়েম সরকারের পতন হয়। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বৌদ্ধদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামরিকবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপকেও দক্ষিণ ভিয়েৎনামের বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। ১৯৬৫ সালে কাও-কাই নামক একজন বিমানবাহিনীর অফিসার রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা আত্মসাৎ করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে কমিউনিস্ট চীনের প্রভাব এবং সাম্যবাদের প্রসারের ফলে এই অঞ্চলের শক্তিসাম্য যাতে বিঘ্নিত না হয় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ম্যানিলা চুক্তির দ্বারা যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা সিয়াটোর (SEATO) সৃষ্টি হয় তখন এই অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। দক্ষিণ ভিয়েৎনামের রাজ্যসীমা ও স্বাধীনতা রক্ষার অজুহাতে মার্কিন সরকার দক্ষিণ ভিয়েৎনাম সরকারকে ভিয়েৎকং গেরিলা বাহিনী ও উত্তর ভিয়েৎনামের বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য প্রেরণের নীতি গ্রহণ করেছিল। ভিয়েৎনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্তরে কেবলমাত্র উপদেষ্টা প্রেরণ করে ক্ষান্ত ছিল। ক্রমেই এই উপদেষ্টাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬১ সালে প্রথম মার্কিন সৈন্যদল ভিয়েৎনামে উপস্থিত হয়ে সরাসরি ভিয়েৎকং বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর ওপর উত্তর ভিয়েৎনামীরা গোলাবর্ষণ করেছে এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ শুরু করে। ১৯৬৫ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি প্লেকুর (Plekeu) নিকটবর্তী মার্কিন ঘাঁটির ওপর ভিয়েৎকং গেরিলাদের আক্রমণের অজুহাতে উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ ব্যাপকতর করা হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ম্যাকনামারা বলেছিলেন, “The major part of the US military task can be completed by the end of 1965″। কিন্তু এই আশা সফল হয়নি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট জনসন তার সান এন্টনিও প্রস্তাবে (San Antonio formula) উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে রাজি হয়েছিলেন। শর্ত ছিল উত্তর ভিয়েৎনাম সরকার দক্ষিণ ভিয়েৎনামের ভিয়েৎকংদের ভবিষ্যতে কোন সাহায্য প্রেরণ করবে না। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। কারণ উত্তর ভিয়েৎনাম সরকার ঘোষণা করে, ভিয়েৎকংদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং কোনদিনই উত্তর ভিয়েৎনাম থেকে তাদের সাহায্য প্রেরণ করা হয়না। এরপর তিন বছর ভিয়েৎনামে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে।

মার্কিন সৈন্যদের সংখ্যা ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাসে ছিল পাঁচ লক্ষ। এসময় জেনারেল ওয়েস্টম্যুরল্যান্ড আরও দুইলক্ষ মার্কিন সেনা প্রেরণ করার জন্য ওয়াশিংটনের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে নাপলাম, বিষাক্ত গ্যাস ও অন্যান্য আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এজন্য বার্ট্রান্ড রাসেল নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধী বিচারালয় ধরণের একটি ছায়া বিচারালয় গঠন করে জনসন ও অন্যান্য মার্কিন নেতাদের বিশ্বজনমতের দরবারে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। ১৯৬৭ সালের ৩১শে জুলাই রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট ভিয়েৎনাম যুদ্ধের চরিত্র বর্ণনা করে বলেছিলেন, “The war in Vietnam was not a war of communist aggression but a war of national independence against all foreigners, particularly Americans”. উ থান্ট এই সূত্রে উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ রেখে দক্ষিণ ভিয়েৎনামে সর্বপ্রকার সামরিক কার্যকলাপের ও বহিরাগত সাহায্যের অবসানের ভিত্তিতে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ভিয়েৎনামের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মারফতে শান্তিস্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করা হয়নি। ইন্দোচীনের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সভাপতিরূপে ভারত শান্তির জন্য আবেদন জানায় এবং ভিয়েৎনাম সমস্যা সমাধানের জন্য জেনেভা সম্মেলনের অনুরূপ সম্মেলন আহ্বান করতে অনুরোধ জ্ঞাপন করে, এই প্রস্তাবও ফলপ্রসূ হয়নি। এটি ছাড়া তদকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলসন ভিয়েৎনামে শান্তির জন্য ঘানা, ত্রিনিদাদ, নাইজেরিয়া ও ব্রিটেনের প্রতিনিধিদল প্রেরণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাবও গৃহীত হয়নি। ফলে ভিয়েৎনাম সমস্যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কারণ ১৯৬৫ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারিতে সাবেল সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ঘোষণা করেছিলেন, “The Soviet Union, China and the Korean Democratic People’s Republic are unanimous in their desire to curb the aggression to prevent the extension of hostilities in Indo-China”. কিন্তু ইতিমধ্যে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক তিক্ত হবার ফলে উত্তর ভিয়েৎনামের যুদ্ধে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপ কার্যকরী হয়নি। এরপরও এই যুদ্ধে সামরিক জয়লাভ যে কতদূর দুস্কর তা মার্কিন নীতির ব্যর্থতা থেকে প্রমাণিত হয়েছিল। এরমধ্যে ১৯৬৭ সালে মার্কিন প্রভাবিত নির্বাচনে ন-গোয়েন ভন থিও (Naguyen Von Thieu) দক্ষিণ ভিয়েৎনামের প্রেসিডেন্ট ও কাও-কাই ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভিয়েৎনামে সরকার বিরোধী কমিউনিস্ট গেরিলাবাহিনী বা ভিয়েৎকংদের আক্রমণে থিও সরকার বিপর্যস্ত হয়। ১৯৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারিতে ভিয়েৎনামের নববর্ষ বা ‘টেট’ উৎসবের সময় ভিয়েৎকংবাহিনী রাজধানী সাইগন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের ওপর গেরিলা পদ্ধতিতে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এই সময় ভিয়েৎকং বাহিনীর রাজনৈতিক সংস্থা জাতীয়মুক্তিফ্রন্ট (National Liberation Front) দক্ষিণ ভিয়েৎনামে একটি স্বতন্ত্র বিপ্লবী সরকার স্থাপন করেছিল। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশ এই বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দান করে, কারণ থিও সরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক মাত্র।

সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখতে ও উত্তর ভিয়েৎনামের সাথে শান্তি আলোচনায় যোগদান করতে সম্মত হয়। অবশেষে ১৯৬৮ সালের পয়লা নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শর্তবিহীনভাবে উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে সম্মত হলে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েৎনাম, ভিয়েৎকং ও মার্কিন প্রতিনিধিরা প্যারিসে শান্তি আলোচনার জন্য মিলিত হন। প্যারিসের শান্তি আলোচনায় প্রথমে মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এভারেল হ্যারিম্যান (Avarell Hariman)। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্বাচনের পর হেনরী ক্যাবট লজ (Henry Cabbot Lodge) হ্যারিম্যানের স্থালভিষিক্ত হয়েছিলেন। এরপর মার্কিন তরফে শান্তি আলোচনার নেতৃত্ব করেছিলেন ডেভিড ব্রুস (David Bruce)। জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীমতী ন-গোয়েন থি বিন (Nguyan Thi Binh) প্যারিসের শান্তি আলোচনায় যোগদান করেছিলেন। উত্তর ভিয়েৎনামের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব করেছিলেন জুয়ান থুই (Xuan Thui) এবং দক্ষিণ ভিয়েৎনামের প্রতিনিধিদের নেতার নাম ছিল কোহান আঙলাম (Qham-Ang Lam)। দক্ষিণ ভিয়েৎনামের প্রেসিডেন্ট থিও দাবি করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ ভিয়েৎনামকে একপক্ষ ও উত্তর ভিয়েৎনাম ও জাতীয় মুক্তিফ্রন্টকে অপরপক্ষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। কিন্তু উত্তর ভিয়েৎনাম, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতীয়মুক্তিফ্রন্ট এতে সম্মত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আট দফা প্রস্তাবে দক্ষিণ ভিয়েৎনাম থেকে ভিয়েৎকং, উত্তর ভিয়েৎনামী ও মার্কিন সৈন্য অপসারণের কথা বলা হয়। কিন্তু এই প্রস্তাব উত্তর ভিয়েৎনাম গ্রহণ করেনি। কারণ উত্তর ভিয়েৎনাম দাবি করে, দক্ষিণ ভিয়েৎনামে তারা ভিয়েৎকংদের কোন সাহায্য প্রেরণ করেনা এবং ভিয়েৎকংরা স্থানীয় অধিবাসীদের নির্বাচিত সরকারের হুকুমে চলে। তাই উত্তর ভিয়েৎনাম ও জাতীয়মুক্তিফ্রন্ট মার্কিন সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েৎনামী সরকার বাতিল করার জন্য দাবি করেছিল। কিন্তু এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ ইতিমধ্যে কম্বোডিয়াতে মার্কিন হস্তক্ষেপ ১৯৭০ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েৎনামে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু করেছিল, এরফলে প্যারিসের শান্তি আলোচনা ব্যাহত হয়। এদিকে ১৯৬৯ সালের ৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট হোচিমিনের মৃত্যুর ফলে উত্তর ভিয়েৎনামের প্রেসিডেন্ট পদে ভাইস প্রেসিডেন্ট টুন-ডাক থাং (Tun Duc Thung) নির্বাচিত হয়েছিলেন। হোচিমিনের রাজনৈতিক জীবনাদর্শ ভিয়েৎনামের মুক্তি আন্দোলনের পথ নির্দেশ করেছিল।

লাওস

এই প্রসঙ্গে লাওস ও কম্বোডিয়া নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করা যাক। পূর্বতন ফরাসী ইন্দোচীনের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে লাওস অন্যতম। উত্তর থেকে দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৬০০ মাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান লাওসে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এসময় লাওসের অধিপতি সিসাভং বঙকে স্বাধীন রাজ্যের অধিপতি বলে ঘােষণা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে ফ্রান্স এই এলাকায় পুনরায় প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। এসময় প্রিন্স পেতসারার (Prince Petsarh) নেতৃত্বে ব্যাংককে একটি প্রবাসী স্বাধীন লাওস সরকার গঠিত হয়, যা এটি ইসরাক নামে (Issrak) পরিচিত ছিল। প্রিন্স পেতসারার ভ্রাতা প্রিন্স সুভানাফুমা (Pince Souvanna Phournu) তার সহায় হয়েছিলেন। তার অন্য একটি ভ্রাতা প্রিন্স সুপানাভং (Prince Souphanou Vong) ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী-বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্ব করার দরুণ আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৯শে জুলাই লাওসের অধিপতি ও ফরাসী সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে লাওস ফরাসী শাসনাধীনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করেছিল। সুপানাভং এর বিরােধিতা করে লাওসীয় জনগণের মুক্তিফ্রন্ট বা প্যাথেটলাও বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলেন। এই মুক্তিফ্রন্টের সৈন্যবাহিনী ভিয়েৎকংদের সমগােত্রীয়। লাওস সরকারের সাথে এই বাহিনীর বিরােধ শুরু হয় এবং ১৯৫৪ সালে জেনেভা সম্মেলনের পূর্বে প্যাথেটলাও বাহিনী রাজধানী লুয়াং প্রবাঙ এর নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহ দখল করে নেয়। ১৯৫৪ সালে জেনেভাতে চৌদ্দটি জাতির সম্মেলনে ইন্দোচীনে শান্তি স্থাপিত হয়। এই সম্মেলন থেকে স্থির হয় যে, লাওস থেকে সকল বৈদেশিক সৈন্য অপসারিত হবে। ফোংসালে ও সামনুয়া অঞ্চল প্যাথেটলাও এর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। এরপর লাওস রাষ্ট্রসংঘের সদস্য হয়েছিল। লাওসে শান্তি স্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্তব্য পালনে অপারগ হয়ে ১৯৫৮ সালে কমিশন লাওস থেকে স্বেচ্ছায় অপসারিত হয়।

১৯৫৮ সালের নির্বাচনে লাওস হাকসার্ট (Lao Haksat) অর্থাৎ প্যাথেটলওয়ের রাজনৈতিক সংস্থা নির্বাচনে বয়কট করেছিল। এই নির্বাচনে একটি দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসীন হবার ফলে লাওসের শান্তি পুনরায় বিঘ্নিত হয়েছিল। এই সরকার জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে মার্কিন সাহায্য গ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছিল। এসময় লাওসের সরকার উত্তর ভিয়েৎনামী সৈন্যদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘে অভিযােগ উত্থাপন করেছিল। এই অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্য রাষ্ট্রসংঘ একটি অনুসন্ধান কমিটি নিযুক্ত করে। ১৯৬০ সালের নির্বাচনে পুনরায় দক্ষিণপন্থী প্রিন্স বন আমের (Ince Bon Oum) সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। এসময় লাওসে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি দেখা দিয়াছিল। কারণ বন আম সরকার সুপানাভংকে গ্রেপ্তার করেছিল। নিরপেক্ষ নীতির সমর্থক প্রিন্স সুভানাফুমার দলীয় ক্যাপ্টেন কংলী ও প্যাথেটলাও বাহিনী প্রিন্স বন আম (Boun Oum) ও জেনারেল নােসা ভনের (Nosa Von) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন আমকে সমর্থন করেছিল। এসময় জেনেভা সম্মেলনের যত সভাপতি সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন লাওসে উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তির জন্য আবেদন করে। এই আবেদনে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের পুনর্নিয়ােগের দাবি উত্থাপন করা হয় এবং লাওস সমস্যা সমাধানের জন্য জেনেভা সম্মেলনের অনুরূপ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সভাপতি হিসেবে ভারতও লাওসে শান্তিস্থাপনের জন্য আবেদন করেছিল। অবশেষে ১৯৬২ সালের জুন মাসে প্রিস সুভানাফুমা, প্রিন্স সুপানাভং ও প্রিন্স বন আমের মধ্যে আপােষ-আলােচনার ফলে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে লাওসে বামপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্যাথেটলাওপন্থীরা যুক্তরাষ্ট্রকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করে অভিযুক্ত করেছিল। প্রধানমন্ত্রী সুভানাফুমার সাথে প্যাথেটলাও এর বিরােধে যুক্তরাষ্ট্র সুফানাফুমাকে সমর্থন করে। প্যাথেটলাও ও লাওস সরকারের মধ্যে বিরােধ মীমাংসার জন্য জেনারেল দ্য গল প্যারিসে একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু এতে লাওসে গৃহযুদ্ধের অবসান হয়নি। লাওসের গৃহযুদ্ধের মূলে ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রভাব। এই ক্ষুদ্ররাষ্ট্রে বামপন্থীদের প্রভাবিত বা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ভিয়েৎনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশগুলোতে তার প্রভাব পড়বে বলে অনুমান করা হয়েছিল। জার রণক্ষেত্রে প্যাথেটলাও বাহিনীর সাফল্যের ফলে সুভানাফুমা সরকার চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে সুভানােফুমা জয়লাভ করেন।

কম্বোডিয়া

এবারে আসা যাক কম্বোডিয়ায়। উত্তরে এবং পশ্চিমে থাইল্যাণ্ড এবং উত্তরে ও পূর্বে ভিয়েৎনামের দ্বারা পরিবৃত সত্তর হাজার বর্গমাইল এলাকা কম্বােডিয়া নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে কম্বােডিয়াতে তাদের প্রাধান্য স্থায়ী করার জন্য ফরাসীরা ১৮ বছর বয়স্ক নরােদ্যম সিংহানুককে কম্বােডিয়ার রাজপরিবারের মধ্য থেকে নির্বাচিত করে সিংহাসনে স্থাপন করেছিল। ১৯৪৯ সালে কম্বােডিয়াকে ফরাসী কর্তৃত্বাধীনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দান করা হয়। ১৯৫৩ সালে সিংহানুক সাম্রাজ্যবাদের অন্তিমদশা এসেছে বলে উপলব্ধি করে স্বাধীনতা দাবি করেন এবং জেনেভা সম্মেলনের আগে তার দাবি স্বীকৃত হয়। জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কম্বোডিয়া থেকে বৈদেশিক সেনা অপসারিত হয়। ত্রিশ বছর কম্পোডিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন এই নরোদ্যম সিংহানুক। বৈদেশিক নীতিতে কম্বোডিয়াকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রদের মধ্যে অন্যতম বলেই গণ্য হতো। কম্বোডিয়ার নিরপেক্ষ নীতির জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এর বিরোধের শুরু। ১৯৬৩ সালে মার্কিন সাহায্যদানকারী রাজকর্মচারীদেরকে কম্বোডিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয়। ১৯৬৫ সালে কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিন্তু ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন উত্তর ভিয়েৎনামে বোমাবর্ষণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে কম্বোডিয়া পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এসময় সিংহানুক মন্তব্য করেছিলেন, “if the USA pulls out of the region, the weight of China will be too great for the small countries of South East Asia. They will all become Maoized.” (অর্থাৎ, এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরকে সরিয়ে নিলে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ছোট ছোট দেশের জন্য চীনের ভার অনেক বেশি হয়ে যাবে। এরা সবাই মাওবাদী হয়ে যাবে।)। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে ভিয়েৎনামে যুদ্ধরত উভয়পক্ষের দ্বারা কম্বোডিয়ার সীমান্ত লঙ্ঘন সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করেছিল। এসময় মার্কিন সরকারের তরফ থেকে ভবিষ্যতে কম্বোডিয়ার সীমান্ত লঙ্ঘন করা হবে না বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এসময় হোচিমিন সরকার সীমান্ত লঙ্ঘিত হলে কম্বোডিয়াকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তবুও কম্বোডিয়ার সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।

নিক্সনের যুগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

ভিয়েৎনাম

১৯৭০ সালের ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দোচীনে আন্তর্জাতিক তদারকীতে অবিলম্বে অস্ত্রসংবরণের জন্য এক নতুন পাঁচদফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি ভিয়েৎনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য স্থিতাবস্থার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নিক্সনের প্রস্তাবে উভয়পক্ষকে বিনাশর্তে সমস্ত যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদান করতে বলা হয়। এরপর একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের মারফত ইন্দোচীনে স্থায়ী শান্তিস্থাপনের জন্য আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত করা হবে। এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী অপসারণের জন্য সর্বসম্মত সময়সূচী তৈরি করা সম্পর্কে আলোচনা করতে স্বীকৃত হয়। কিন্তু উত্তর ভিয়েৎনাম সরকার নিক্সনের প্রস্তাবকে মার্কিনী বাহিনীর ইন্দোচীনে উপস্থিতিকে আইনসম্মত করার প্রচেষ্টা বলে বর্ণনা করেছিল। ১৯৭২ সালের ৪ঠা মে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভিয়েৎনামের ছয়টি বন্দরে মার্কিন মাইনের দ্বারা বিপজ্জনক করার ফলে শান্তি আলোচনার ছেদ পড়েছিল। এই সময় উত্তর ভিয়েৎনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ২৭শে জানুয়ারি একটি চুক্তির মারফতে সংঘর্ষের সাময়িক বিরতি হয়। পোল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হাঙ্গেরী ও কানাডা যুদ্ধবিরতির পরিদর্শক হয়েছিল। পুনরায় প্যারিসে শান্তি আলোচনা শুরু হলে এই পরিদর্শক রাষ্ট্রগুলো ও চীন, ফ্রান্স, সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া এবং ব্রিটেন এই আলোচনায় যোগদান করার জন্য আহুত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে প্যারিসের শান্তি আলোচনার ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েৎনামের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়।

১৯৭৫ সালের ২৩শে এপ্রিল ভিয়েৎনামে প্রেসিডেন্ট থিও পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ডাং-ভ্যান মিন তার স্থলে প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন। ৩০শে এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েৎনামী বিপ্লবী সরকার সাইগন দখল করে। ফলে উভয় ভিয়েৎনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। মার্কিন হস্তক্ষেপের দরুন ভিয়েৎনামে প্রায় ৫ লক্ষ মার্কিন সৈন্য হতাহত হয়েছিল ও বহুকাল উত্তর-দক্ষিণ ঐক্য বিঘ্নিত হয়েছিল। ভিয়েৎনামের যুদ্ধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নবজাগরণের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট টুন-ডাক থাং পরলোকগত হলে ফাম ভান ডং (Pham Van Dong) তার স্থলাভিষিক্ত হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মৈত্রী বন্ধন দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েত চুক্তির আদর্শে একটি ভিয়েৎনাম-সোভিয়েত চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে কমিউনিস্ট চীনের সম্প্রসারণ নীতি ও ওয়াশিংটন-বেইজিং আঁতাত বিরোধী এই চুক্তি বেইজিং ভালো চোখে দেখেনি।

কম্বোডিয়া ও লাওস

প্রেসিডেন্ট নিক্সন ক্ষমতালাভের পর ভিয়েৎনাম থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের ১৮ই মার্চ কম্বোডিয়ার নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স নরোদ্যম সিংহানুকের পদচ্যুতি ও জেনারেল লন নল কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ভিয়েৎনামে যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভিয়েৎকং ও প্যাথেটলাও বাহিনী এবং মার্কিন সৈন্যরা কম্বোডিয়ায় অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। কম্বোডিয়ার সৈন্যবাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে উত্তর ভিয়েৎনামী ভিয়েৎকংরা কম্বোডিয়াতে মেকং নদীর পূর্বে সকল স্থান অধিকার করে। ১৯৭০ সালের ২৯ শে এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে প্রথমে দক্ষিণ ভিয়েৎনামী সেনাবাহিনী কম্বোডিয়াতে প্যারটস বিক (Parrot’s Beak) অঞ্চলে প্রেরিত হয়। এর অব্যবহিত পরে কম্বোডিয়ার কম্পংচ্যাম (Kompong Cham) প্রদেশে ভিয়েৎকং বাহিনীর ঘাঁটির উদ্দেশ্যে মার্কিন অভিযান ফিস হুক (Fish Hook) এলাকায় প্রেরিত হয়েছিল। মার্কিন নৌ ও বিমানবহর এতে অংশ গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট জনসন ভিয়েৎনামে যুদ্ধ শুরু করার সময় ১৯৬৫ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে ঘোষণা করেছিলেন যে, “The United States still seeks no wider war.” বিচার্ড নিক্সন কম্বোডিয়াতে সৈন্য প্রেরণ করার সময় ঘোষণা করেছিলেন যে, “We shall avoid wider war.”। জনসন যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন নিক্সন তাতে শান্তিবারি নিক্ষেপ করবেন বলে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তা নিস্ফল প্রমাণিত হয়েছিল। রিচার্ড নিক্সন স্বদেশে তার আইনসভা বা কংগ্রেসের এবং বিদেশে কম্বোডিয়ার নবগঠিত সরকার কারো অনুমোদনের ওপর নির্ভর করেননি। ইতিমধ্যে উত্তর ভিয়েৎনামে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছিল। এটি প্যারিসে শান্তি আলোচনার ভবিষ্যতকে স্বাভাবিক ভাবেই অনিশ্চিত করেছিল। নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন যে, ৩০শে জুনের মধ্যে ভিয়েৎকং ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাবর্তন করবে। দক্ষিণ ভিয়েৎনামী সৈন্য সম্পর্কে কোন উক্তি তিনি করেননি। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে প্যারিসের শান্তি আলোচনার সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি হইয়ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অতঃপর ভিয়েৎনাম ও কম্বোডিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছিল।

১৯৭০ সালের জানুয়ারীতে কম্বোডিয়াতে ভিয়েৎকংদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই সরকার বিরোধী আন্দোলনের মূলে যারা ছিলেন তারাই মার্চ মাসে সিংহানুককে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৭০ সালের ১৮ই মার্চ কম্বোডিয়ার জাতীয়সভা সিংহানুককে পদচ্যুত করে চেং হেনগকে (Chen Heng) রাষ্ট্রপ্রধান, জেনারেল লন নলকে (Lon Nol) প্রধানমন্ত্রী ও প্রিন্স সিরিক মাটককে (Sirik Matak) উপপ্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা করেছিল। এতে মার্কিনপন্থী দক্ষিণ ভিয়েৎনামের থিও সরকার আনন্দিত হয়। এরপর কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে (Phnom Penh) মার্কিন সামরিক সাহায্য প্রেরিত হয়েছিল। এভাবে উত্তর ভিয়েৎনামী ও মার্কিন সৈন্যদের সংঘর্ষ কম্বোডিয়াতে নতুন ভিয়েৎনামের সৃষ্টি করেছিল। নিক্সন ক্ষমতা লাভের পর যে শান্তির ললিতবাণী শুনিয়েছিলেন তা আলেয়ার আলো বলে প্রমাণিত হয়েছিল। অতঃপর মার্কিন সৈন্য কম্বোডিয়া থেকে প্রত্যাহৃত হলেও লন নল সরকারি মার্কিন সাহায্যপুষ্ট বলে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠী ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রদের স্বীকৃতিলাভ করেনি। চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট দেশগুলো সিহানুকের প্রবাসী সরকারকে সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল। লাওসের রাজধানী লুয়ংপ্রবাঙ অভিমুখে এইসময় কমিউনিস্ট বাহিনী নব উদ্যমে অভিযান শুরু করেছিল। ইতিমধ্যে সমগ্র ইন্দোচীনে আন্তর্জাতিক তদারকীতে শান্তিস্থাপনের জন্য নিক্সন একটি প্রস্তাব দিয়াছিলেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে উত্তর ভিয়েৎনামে পুনরায় মার্কিনী বোমাবর্ষণ এই প্রস্তাবের অসারতা প্রমান করেছিল। ১৯৭৩ সালে প্যারিসের শান্তি আলোচনার সাফল্যের ফলে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহৃত হয়। স্বল্পকালের মধ্যে উত্তর ভিয়েৎগামী সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েৎনাম দখল করে ভিয়েৎনামকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। অতঃপর লন নল সরকারের পতন হয় এবং ভিয়েৎনামী সৈন্য কম্বোডিয়াতে প্রেরিত হয়।

অন্যদিকে ভিয়েৎকংদের সাথে কম্বোডিয়ার নতুন সরকারের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। ফলে কম্বোডিয়াতে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একদিকে ভিয়েৎকংদের অনুপ্রবেশ, অন্যদিকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ ভিয়েৎনামী সৈন্যদের হস্তক্ষেপ কম্বোডিয়াতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এসময় মার্কিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহৃত হয়। কম্বোডিয়ার সরকার এই সময় খেমের গণতন্ত্র নামে পরিচিত হয়। জেনারেল চেন হেনগ এই রাষ্ট্রপ্রধান ও জেনারেল লন নল এর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এই যুগে ভিয়েৎনাম সমর্থিত জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট কম্বোডিয়ার এই সরকারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কম্বোডিয়ার এই গৃহযুদ্ধের ফলে ১৯৭৫ এর ১২ই এপ্রিলে প্রিন্স নরোদ্যম সিংহানুকের সমর্থক খেমেররুজ বাহিনী কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেন দখল করে। কম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়া খেমেররুজের অধীন হলে চীনা সমর্থনপুষ্ট পল পটের নেতৃত্বে একটি সরকার স্থাপিত হয়। এই খেমেররুজ সরকারের অধীনে ও পল পটের নেতৃত্বে যে সন্ত্রাসবাদী নীতি অনুসৃত হয়েছিল তার ফলে কাম্পুচিয়ায় অগণিত নিরীহ নরনারী ও শিশুর প্রাণহানি হয়েছিল ও কাম্পুচিয়ার ৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৪ মিলিয়নে পরিণত হয়।

স্বদেশে ও বিদেশে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তার আগ্রাসী নীতির জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করেছিল যে, কম্বোডিয়াতে শতসহস্র মার্কিন সৈন্যের কবর রচিত হবে। ইন্দোনেশিয়া কম্বোডিয়াতে শান্তিস্থাপনের জন্য বিশটি জাতির সম্মেলন আহ্বান করেছিল। ভারত এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি। কারণ ভারতের মতে কম্বোডিয়াতে শান্তি স্থাপনের জন্য পুনরায় জেনেভা সম্মেলনের ন্যায় একটি সম্মেলন আহ্বান করার প্রয়োজন ছিল। ইতিমধ্যে লাওসে প্যাথেটলাও বাহিনীর অগ্রগতির ফলে সুভানাকুমা প্রকারের পতন হয় এবং রাজধানী লুয়াংপ্রাবাঙ প্যাথেটলাও সৈন্য বাহিনীর অধীনস্থ হয়। অবশেষে ১৯৭৩ সালে প্যাথেটলাও আপােয-মীমাংসার মারফতে একটি জাতীয় সরকার গঠনে সম্মত হইয়াছিল। ১৯৭৫ সালে লাওস একটি গণতন্ত্রে পরিণত হয়। লাওসে প্যাথেটলাও ও বামপন্থীদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত। সব মিলিয়ে কেবলমাত্র কম্বোডিয়া নয় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি মার্কিন হস্তক্ষেপের ফলে জটিল হয়ে উঠেছিল।

জিমি কার্টার

সোভিয়েতপন্থী উত্তর ভিয়েৎনামের হস্তক্ষেপে চীনাপন্থী পল পট সরকারের পতন হয় এবং সোভিয়েতপন্থী হেং সামোরিনের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ৯ই জানুয়ারিতে নতুন সরকার স্থাপিত হয়। কম্বোডিয়ায় এই ভিয়েৎনামের হস্তক্ষেপকে চীন বা চীনা সমর্থনপুষ্ট দল ও গোষ্ঠীগুলো ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়েছিল। ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্ট চীন কম্বোডিয়ার এই ঘটনা ও অন্যান্য বিষয়ে ভিয়েৎনামের সাথে মতপার্থক্য ও বিরােধের কারণে হ্যানয় সরকারকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে বলে মনস্থ করে। এসময় চীনা সৈন্য ভিয়েৎনাম সীমান্ত লঙ্ঘন করে আক্রমণ করে। সোভিয়েত রাশিয়ার তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এই ঘটনার জন্য চীনকে দস্যু ও অপরাধী বলে ঘােযণা করেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই ১৯৭৯ সালের ১৫ই মার্চে সেসময় ভারত পরিভ্রমণরত সাবেক সোভিয়েতের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সাথে যুক্ত বিবৃতিতে এই ঘটনাকে চীনের আগ্রাসন বলে নিন্দা করেছিলেন। রাশিয়া চীনকে ভিয়েৎনামের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের জন্য নিন্দা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এরকম ঘটনার জন্য সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিল। ভিয়েৎনাম বাহিনী সাফল্যের সাথে চীনের মােকাবেলা করাতে এই যুদ্ধের বিরতি হয়। কিন্তু চীনা সীমান্তে নিরাপত্তার কারণে ও কম্বােডিয়াতে হেং সামােরিনের সমর্থনে সামরিক সাহায্য প্রেরণ করার জন্য ভিয়েৎনাম শান্তির সময়ও বিশাল সৈন্যবাহিনী পােষণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই সৈন্যবাহিনীকে পৃথিবীর বৃহত্তম সৈন্যবাহিনী বলা হইয়াছে। ফলে ভিয়েৎনামের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল এবং উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের জন্য ভিয়েৎনাম সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য লাভের জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য গােষ্ঠী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভিয়েৎনামী সরকার শান্তি ও মৈত্রীতে আগ্রহী হয়। কিন্তু চীনা সীমান্তে ও কম্বােডিয়াতে ভিয়েৎনাম চীন ও কম্বােডিয়া থেকে বিতাড়িত বিভিন্ন গােষ্ঠীর সাথে মাঝে মাঝে সংঘর্যে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। চীনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের উন্নতির জন্য ব্রেজনেভ ও কোসিগিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষমেশ কম্বোডিয়ায় হেং সামরিণ বিরোধীগোষ্ঠী কমিউনিস্ট চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন

রিচার্ড নিক্সন

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যকার কোল্ড ওয়ারের ফলে মার্কসবাদী দুনিয়া ও তথাকথিত স্বাধীন দুনিয়ার বিরোধ সামরিক জোট ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছিল। ভিয়েৎনাম ও কম্বোডিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল। ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ মীমাংসার জন্য কোসিগিনের প্রচেষ্টা ১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারি তাসখন্দে ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। কিন্তু এরপরের যুদ্ধে পাকিস্তানে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে উপমহাদেশে পুনরায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক প্রতিদ্বন্দিতা শুরু হয়।

তবে ১৯৬৯ সালে মার্কিন মসনদে নিক্সনের অধিষ্ঠানের পর এই অবস্থার পরিবর্তন দেখা গেল। ২০শ শতকের মধ্যভাগে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রভাব বিশ্বের শান্তি বিঘ্নিত করছিল, এসময়েই সহাবস্থানের পথে নিরাপত্তা লাভের জন্য সুবৃহৎ শক্তিদ্বয়ের মধ্যে আগ্রহ দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে সােভিয়েত পররাষ্ট্র নীতির সমস্যা ছিল একাধারে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের নেতৃত্ব করা অপরদিকে বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মােকাবেলা করা। কমিউনিস্ট চীনের সাথে বিরােধের ফলে সাম্যবাদী জগতে সোভিয়েত প্রাধান্য কমে এসেছিল। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন নিকলাই পদগর্নি, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিলেন লিওনার্ড ব্রেনজেভ। আর ১৯৬৪ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন আলেক্সী কোসিগিন। এরা সকলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোল্ড ওয়ারের উত্তেজনা হ্রাসের প্রচেষ্টা করেন। পারমাণবিক শক্তির উৎকর্য এবং আণবিক ও হাইড্রোজেন বােমার আবিষ্কার সােভিয়েত রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে, ধনতন্ত্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহাবস্থান সােবিয়েত নীতি লক্ষ্য ছিল, যা ১৯৬৯ সালের মস্কো সম্মেলনে সমর্থিত হতে দেখা যায়। ৬৯ ও ৭০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই মহাকাশে বিভিন্ন রকমের সাফল্য দেখায়। কোসিগিন এই প্রসঙ্গে বলেন, “Let the sixth ocean outer space become an arena of international co-operation among the countries.” এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্রের তলদেশে ও মহাকাশে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে একমত হতে সচেষ্ট হয়।

সেসময় রাষ্ট্রসংঘে গৃহিত আণবিক অস্ত্রসম্প্রসারণ নিরোধচুক্তি সোভিয়েত-মার্কিন সমর্থন লাভ করে। পরস্পরের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৯শে মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া মস্কোতে পারস্পরিক সম্পর্কের মূলনীতি (Basic Principles of Relations) সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির মারফতে উভয় স্বাক্ষরকারী ঘোষণা করেছিল যে, “পারমাণবিক যুগে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি ব্যতীত সুবৃহৎ শক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক নির্বাচনের কোন সর্বজনগ্রাহ্য মূল্যবোধ নেই।” সাবভৌমত্ব, সমতা, আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করা ও পারস্পরিক সুবিধার নীতিতে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থার পার্থক্য সত্বেও দ্বিপাক্ষিক উন্নতির ভিত্তিতে স্বাভাবিক সম্পর্ক গঠন করতে সক্ষম। এসকল নীতিকে কার্যকরী করার জন্য সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে সামরিক শক্তির দ্বারা পরস্পরের মোকাবেলার কথা চিন্তা না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা হ্রাস করতে একমত হয়েছিল। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সকল প্রকার চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একমত হয়েছিল এবং পারস্পরিক স্বার্থে আলাপ-আলোচনা করতে এবং প্রয়োজনে শীর্ষসম্মেলনে মিলিত হতে উভয় রাষ্ট্র তাদের সম্মতিজ্ঞাপন করেছিল। অস্ত্রসজ্জাকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সীমিত করতে এবং রাষ্ট্রসংঘের নীতি অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য নিরস্ত্রীকরণের নীতিগ্ৰহণ করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এইসময় একমত হয়। আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি বিধানের জন্য, যোগাযোগের উন্নতির জন্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী ক্ষেত্রে সহযোগিতার উন্নতির উদ্দেশ্যে মস্কো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রদ্বয় সম্মতিজ্ঞাপন করে। সব মিলিয়ে পারস্পরিক স্বার্থে দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক গঠন করতে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একমত হয়েছিল।

কিন্তু কোল্ড ওয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি দুই দেশের সুসম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এপ্রসঙ্গে সেই সময়ে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার নয়া ঠাণ্ডা লড়াই সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শগত সংঘাত ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সােভিয়েত পত্র পত্রিকায় মাও সেতুং-এর নীতি অমার্ক্সীয় বলে ঘোষণা করা হয় এবং চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কঠোর সমালােচনা করা হয়। অন্যদিকে চীনা সমালােচকগণ বলেন যে জাতীয় স্বার্থই সােভিয়েত নীতির প্রধান নিয়ামক এবং আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের স্বার্থ সােভিয়েত সংশােধনবাদী নেতৃত্বের নিকট গৌণ। সােভিয়েত সমর্থকগণ চীনকে জঙ্গীবাদী ও সােভিয়েত নীতিকে শান্তির সমর্থক বলে ঘােযণা করেছিলেন। কিন্তু সােভিয়েত-চীন বিরােধের আদর্শবাদী বক্তব্যের ভিত্তি বাস্তব স্বার্থের মধ্যেই নিহিত ছিল। রাশিয়া ও চীনের সীমান্ত বিরােধ এই মতবিরােধের বাস্তব রূপায়ণ। জার শাসিত রাশিয়া ১৮৫৮ সালে আইগুনের চুক্তি (Treaty of Aigun) এবং ১৮৬০ সালের পিকিংয়ের চুক্তির (Treaty of pcking) দ্বারা চীনের যে সকল স্থানে আধিপত্য বিস্তার করেছিল তাদের মধ্যে ডামনেস্কি (Damansky) দ্বীপ ও উপুরী নদীর পূর্বতীর অন্যতম। এই বিরােধ মীমাংসার প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালের সােভিয়েত-চীনের আলােচনা ফলপ্রসূ হয়নি। প্রাভদা পত্রিকা মন্তব্য করেছিল সমবেত নেতৃত্বের প্রতি অবহেলা কুশ্চেভের অপসারণের কারণ। কিন্তু অনেকের মতেই চীনের সাথে বিরােধই ক্রুশ্চেভের পতনের অন্যতম কারণ। ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভের পর কোসিগিনের প্রধান কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তাসখন্দ চুক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। এর দ্বারা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত বিরােধের অবসান হয়। ক্ষমতা লাভের পর কোসিগিন বেইজিং ও হ্যানয় পরিভ্রমণ করেছিলেন, কিন্তু বেইজিংয়ের সাথে মস্কোর সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। দূরপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মার্কিন হামলায় বাধাদানের জন্য কোসিগিন হ্যানয়তে যে দৃঢ়সংকল্প ঘােযণা করেছিলেন কমিউনিস্ট চীন তাতে উৎসাহ প্রদর্শন করেনি।

১৯৬৫ সালে মস্কোতে আহুত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সম্মেলনে অন্যান্য দেশের থেকে মাত্র ১৬/১৭টি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল এবং এই সম্মেলনে রুশ-চীন নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। ১৯৬৭ সালে রুশ বিপ্লবের অর্ধশতাব্দী পূর্তি উপলক্ষে সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি চীনকে তার ব্যক্তিপূজা বা হঠকারিতা ত্যাগ করে অন্যান্য কমিউনিস্ট দলের সাথে সহযােগিতা করিতে বলে। ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে বুদাপেস্তে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দশদিন ব্যাপী সম্মেলন হয়, যা ছিল মস্কোতে আহুত সম্মেলনের প্রস্তুতিপর্ব। চীন তো এতে অনুপস্থিত ছিলই, সেই সাথে আলবেনিয়া, উত্তর কোরিয়া, উত্তর ভিয়েৎনাম, যুগােস্লাভিয়া ও কিউবাও এই সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিল। এই সম্মেলনের পর ১৯৬৯ সালের জুন মাসে মস্কোতে বিশ্ব কমিউনিস্ট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ৭৫টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধি প্রেরণ করে। এই সম্মেলনে সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী ব্রেজনেভ চীনের কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। ব্রেজনেভ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সমবেত ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে সীমান্ত সংঘর্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ডামনেস্কিকে কেন্দ্র করে সােভিয়েত-চীন সংঘর্য দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এসব সংঘর্যের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়িন ও কমিউনিস্ট চীনের সম্পর্ক এতদূর অবনতি হয়েছিল যে উভয় দেশের কূটনৈতিক দূতাবাসের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনা চলতে থাকে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ১৯৬৯ সালের ২২শে জুন খাবােরভস্কে উভয় দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্ত সংঘর্য তাতে বন্ধ হয়নি। আমূর তীরবর্তী অঞ্চলে সোভিয়েত অধিকৃত গােল্ডেনেস্কি দ্বীপকে কেন্দ্র করে পুনরায় পরিস্থিতির অবনতি হয়। ইতিমধ্যে কোসিগিন বিরােধ মীমাংসার জন্য চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইকে অনুরােধ করেন। ফলে সােভিয়েত-চীন বিরােধ মীমাংসার জন্য পুনরায় আলাপ-আলােচনা শুরু হয়। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে কম্বােডিয়াতে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়া ও চীন উভয়েই প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিল। কিন্তু কম্বোডিয়ায় পল পত সরকার গণহত্যা অনুষ্ঠিত করলে তার বিরুদ্ধে হেং সামরিণের অভ্যুত্থান এবং এই অভ্যুত্থানে ভিয়েৎনাম সেনাবাহিনী কর্তৃক সাহায্য দান চীনকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। ফলে সেই অজুহাতে চীন ভিয়েৎনাম আক্রমণ করে। এই ঘটনায় সােভিয়েত-চীন মতপার্থক্য হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা হ্রাসের জন্য সােভিয়েত-চীন বিরােধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। তাই মাও ও চৌ এনলাই এর পরবর্তী যুগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেং-এর নেতৃত্বে সােভিয়েতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করতে সচেষ্ট হয়। সােভিয়েত-চীন নয়া ঠাণ্ডা লড়াই এর তীব্রতা এর ফলে কমে আসে।

যাই হোক, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে “নয়া ঠাণ্ডা” লড়াইয়ের ফলে মস্কো-বেইজিং সম্পর্কের অবনতি হলে নিক্সন সেই সুযোগ নেন, ফলে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের উন্নতি হতে শুরু করে, এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেন নিক্সনের সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরী কিসিঞ্জার। নিক্সনের প্রচেষ্টায় পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জার চীন পরিভ্রমণ করেন, সেই সাথে ১৯৭১ সালে স্বয়ং নিক্সন কমিউনিস্ট চীনে পদার্পণ করলে উভয় দেশের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কের পথে সকল বাধা অপসারিত হয়েছিল। এই সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আক্রমণ শুরু করেছিল, চীনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি সাধন করার মাধ্যমে এবারে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট চীনের বিরোধকে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহারের প্রচেষ্টা করে। নিক্সন তার চীন পরিভ্রমণের সময় আশা করেছিলেন যে, উভয় দেশের বন্ধুত্বের একটি লংমার্চ বা দীর্ঘ যাত্রার সূত্রপাত হবে। তবে নিক্সন ও ফোর্ড কেউই তাদের দুই চীন নীতি (চীন ও তাইওয়ান উভয়কেই স্বীকার করার নীতি) থেকে সরেননি। ১৯৭৬ সালের ২৩শে অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা অধিকাংশ সদস্যদের ভোটে তাইওয়ানে চিয়াংকাইসেক প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতিনিধিত্ব খারিজ করে কমিউনিস্ট চীনকে সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিনিধিত্ব দান করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার দুই চীন নীতি পরিত্যাগ করতে পারেনি ও চিয়াংকাইসেকের মৃত্যুর পর তার পুত্র চিয়াং চিয়াংকুরের অধীন তাইওয়ান প্রতিরক্ষার জন্য মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিল। কিন্তু কার্টারের এই দুই চীন নীতির পরিবর্তন ঘটে।

জিমি কার্টার

কার্টার চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবার জন্য এক চীন নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি তাইওয়ানের পৃষ্টপোষকতা ত্যাগ করে কমিউনিস্ট চীনের সাথে সহযোগিতার দিকে ঝুঁকেছিলেন। নিক্সনের সময় থেকেই আমেরিকার সাথে কমিউনিস্ট চীনের বন্ধুত্ব শুরু হয়, কার্টারের এক-চীন নীতির ফলে তা আরও শক্তিশালী হয়। এইযুগে চীন-সোভিয়েত নয়া ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংকে সমর্থন করে স্বীয় উদ্দেশ্য সফল করতে চেয়েছিল, যদিও সর্বক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থের সাথে কমিউনিস্ট চীনের মিল হওয়া স্বভাবতঃই সম্ভবপর ছিল না।

১৯৭৭ সালে জিমি কার্টার প্রেসিডেন্টের পদলাভের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথম সল্টচুক্তি সম্পাদনের ফলে সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। ১৯৭৯ সালে জেনেভায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার ও ব্রেজনেভের শীর্ষসম্মেলনে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির অন্যতম দৃষ্টান্ত। কিন্তু ব্রেজনেভের এই প্রচেষ্টা বিভিন্ন কারণে সাফল্য অর্জন করেনি। এসকল কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সােভিয়েত হস্তক্ষেপ ও রেড আর্মির অনুপ্রবেশ, সােভিয়েত রাশিয়ার মিত্ররাষ্ট্র ভিয়েৎনাম কর্তৃক কম্বোডিয়ায় সৈন্য প্রেরণ, এবং মধ্যপ্রাচ্যে ও লেবাননে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইজরাইল বাহিনীর আগ্রাসন।

ভিয়েৎনাম ও কম্বোডিয়ার কথা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরাইল সংঘর্য ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। এই যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি পায়। আরব-ইজরাইল বিরােধের মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রসংঘ নিযুক্ত জারিং মিশন সোভিয়েত সমর্থন লাভ করে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে যুদ্ধের অব্যবহিত পরে প্রেসিডেন্ট পাদগর্নি মধ্যপ্রাচ্য পরিভ্রমণ করেছিলেন। সােভিয়েত নৌবাহিনীর ভূমধ্যসাগরে উপস্থিতি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। সােভিয়েত ইউনিয়ন সংযুক্ত আরব-প্রজাতন্ত্র ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধাস্ত্র ও সমরসম্ভার দিয়ে সাহায্য করেছিল এবং ইজরাইল অভিযােগ করিয়াছিল যে, সোভিয়েত পাইলটরা ইজরাইলের বিরুদ্ধে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রকে সাহায্য দান করে। এই অভিযােগ প্রমাণিত হয়নি। ইজরাইলের আগ্রাসনে বিব্রত আরব রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ইজরাইল সেনাদের আরব-অধিকৃত অঞ্চল ত্যাগের জন্য রাষ্ট্রসংঘের নির্দেশ সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইজরাইল সংঘকে কেন্দ্র করে যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছিল তার ফলে এবং ১৯৭৩ সালে আরব-ইজরাইল যুদ্ধের সময় ও তৎপরবর্তীকালে ইজরাইলের আক্রমণের বিরুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত সাহায্য, সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করেছিল। এতে সোভিয়েত রাশিয়া পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগােষ্ঠীর মতো তৈলস্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি। এজন্য আরব জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর সাম্যবাদ বিরােধিতা সত্ত্বেও সােভিয়েত-প্রীতি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট হবার পর কার্টারকে এশিয়া মহাদেশে ও ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধির জন্য নানা সমস্যার সমাধানে তৎপরতা প্রদর্শন করতে হয়। এসব সমস্যার মধ্যে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যের উপস্থিতি, ১৯৭৯ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌশক্তির বৃদ্ধি ও সাবেক সোভিয়েত মিত্ররাষ্ট্র ভিয়েৎনামের সেনাবাহিনীর কম্বোডিয়ায় হস্তক্ষেপ অন্যতম। একমাত্র সাময়িকভাবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট রেগনের শাসনের প্রাথমিক স্তর ব্যতীত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এই সকল অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত প্রভাব ক্ষুণ্ণ করার জন্য অতঃপর পরস্পরের মধ্যে বহুবিষয়ে একমত হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সমাধানের জন্য কার্টারের শাসনকালে ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে আনোয়ার সাদাত ও ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেগিন ক্যাম্প ডেভিডে মিলিত হয়ে একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্র মিশরের আরবদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করেছিল এবং এরপর সাদাত মিশরে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকা কালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব এই চুক্তির ফলে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

ইরানে মৌলবাদী কট্টর খোমনী নেতৃত্বও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ ছিল। ফলে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ৪৪ জন কর্মী স্থানীয় উগ্রপন্থীদের দ্বারা প্রায় ৪৪৪ দিন বন্দীদশায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। মৌলবাদী মুসলিম উগ্রপন্থীদের হতে তাদের দুর্দশা মোচন করার জন্য কার্টারের প্রেরিত কমান্ডোদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল। যাই হোক, আফগানিস্তান, ভিয়েৎনাম, কম্বোডিয়া, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতমুখী স্বার্থের জন্য ঠাণ্ডা লড়াই এর উত্তেজনা অনেক বেড়ে যায় ও দুই দেশের মধ্যে বিরোধও বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরােধের জন্য প্রথম সল্ট চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তীকালে ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমনের ফলে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছিল তার অবসান হয়। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে মহাকাশ এবং অস্ত্র প্রতিযােগিতার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুনরায় শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় আসা রেগনের নীতিগুলো, বিশেষ করে ইউরোপে পার্সিং ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে কোল্ড ওয়ারের উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন থেকে তার প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেয়। গর্ভাচেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের সেক্রেটারী হবার পর রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে রেগন ও গর্ভাচেভের জেনেভা শীর্ষ সম্মেলনের মিলিত হবার জন্য ঐকমত্য জ্ঞাপন এর অন্যতম উদাহরণ।

তথ্যসূত্র

  • American History at a Glance by Joan R. Gundersen and Marshall Smelser, Collins Reference; 5th edition (July 13, 1994), p. 290-304
  • আমেরিকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কাফি খান, বাংলাদেশ বুকস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৩২১-৩৩৭
  • আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস, অসিত কুমার সেন, কে পি বাগচি এ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ৩০২-৩০৬, ৩৫৩-৩৫৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.