ইউরোপে সামন্ততন্ত্র, ম্যানর ও শিভ্যালরি

সামন্ততন্ত্রের ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য

৯ম ও ১০ম শতকে ইউরােপে কেন্দ্রিয় শাসন ভেঙে পড়লে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা দেখা যায়। এসময় ভূমি নির্ভর অভিজাত ও সরকারি কর্মচারীরা সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রের পরিবর্তে সামন্ততন্ত্র নামে এক ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকল্প শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে যা ইউরােপে পাঁচশাে বছর স্থায়ী হয় (৮০০-১৩০০ খ্রি.)। পূর্বে সম্রাট ও রাজা যে সার্বভৌম শাসনের অধিকার ভােগ করতেন, কিন্তু রাজতন্ত্রের দুর্বলতা, ম্যাগয়ার, ভাইকিং ও স্যারাসেন বা মুসলিমদের দ্বারা বৈদেশিক আক্রমণ এবং ৯ম ও ১০ম শতকের অরাজক অবস্থার কারণে বৃহৎ ভূস্বামীরা সেই অধিকার লাভ করেন; ডিউক, কাউন্ট ও ভাইকাউন্টরা যারা আগে রাজার হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, তারা নতুন শাসক হয়ে বসেন। এর ফলেই সামন্তযুগের সূচনা হয়।

৯ম শতকের প্রায় মধ্যভাগে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পর্বের নিদারুণ বিশৃঙ্খল যুগে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে স্থানীয় অভিজাত ও কাউন্টগণ যে বিশেষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা প্রথা প্রতিষ্ঠা করেছিল – এই ব্যবস্থা বা প্রথা সামন্তব্যবস্থা বা সামন্তপ্রথা (Feudal system বা Feudal order) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। অবশ্য এই প্রথার অস্পষ্ট আত্মপ্রকাশ মেরােভিঞ্জীয় গলেও লক্ষ করা যায়। সেখানেও বর্বর জার্মানরা প্রায় অনুরূপ নৈরাজ্যের মােকাবিলায় এবং দুর্বল শরণাগতের আশ্রয় রূপে সামন্তপ্রথার প্রায় অনুরূপ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ইতিহাসবিদদের একাংশ প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যেও এই ব্যবস্থার উৎপত্তি লক্ষ করেছেন। যাই হােক, খ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১২শ শতক ছিল পশ্চিম ইউরােপীয় সামন্ততন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের যুগ। ফিফ (Fief) এবং ম্যানর (Manor) ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এই প্রথার অন্যতম স্তম্ভ। ফিফ ছিল, “An estate of land held on condition of feudal services”, অর্থাৎ এগুলো ছিল সামন্তপ্রভুর প্রতি সামন্ততান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে অধীনস্থ প্রজা কর্তৃক প্রাপ্ত ভূখণ্ড। আর ম্যানরগুলি ছিল, “An area of land controlled by a lord in middle ages”, অর্থাৎ মধ্যযুগে অভিজাত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জমি ছিল ম্যানর। প্রভুর বিশাল বসতবাটী ব্যতীত বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র ছিল এই ম্যানরের অন্তর্ভুক্ত। অধীনস্থ প্রজারা সেখানেই চাষবাস করত এবং উৎপন্ন খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত প্রভুর হাতে তুলে দিত। কিছুটা ব্যাপক অর্থে সামন্তব্যবস্থা বা ফিউডাল অর্ডারের অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি সামন্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা ফিউডাল পলিটিকাল অর্ডার, এখানে ক্রমােচ্চ স্তরবিন্যাসে সাজানাে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখা যায় যার সর্বোচ্চে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন রাজা এবং তার অধীনস্থ ছিলেন ফিউডাল লর্ডগণ ও লর্ডদের অধীনস্থ ছিলেন প্রজা বা ভাসালগণ। এই প্রথায় রাজা বা কেন্দ্রীয় শাসন ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল।

সামন্ততন্ত্র (Feudalism) শব্দটির সংজ্ঞা এবং ব্যঞ্জনা সবসময় এক ছিলনা। ফরাসী বিপ্লবের সময় সামন্ততন্ত্র কথাটি পূর্বতন সমাজের (ancien regime) এর বহু দুরাচার ও নিপীড়নের কালিমালিপ্ত একটি শব্দ হিসেবে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতো। এখনও সধারণ মানুষের কাছে শব্দটি প্রায় অভিন্ন অর্থ বহন করে। অনৈতিহাসিক এই অপব্যাখ্যা উপেক্ষা করলেও সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি, বিকাশ ও চরিত্রের বিশ্লেষণ বিষয়ে এবং তার রীতিনীতিগুলির তাত্ত্বিক আলােচনার ক্ষেত্রে পণ্ডিত মহলে বেশ মতানৈক্য রয়েছে। তবে মধ্যযুগীয় ইউরােপে সামন্ততন্ত্র যে আদিম, প্রাচীন ও জীর্ণ হয়ে যাওয়া উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে আকস্মিকতাহীনভাবেই সংঘাতের পরিণাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং প্রতীচ্যে রােমান ও জার্মান উপাদানের সংমিশ্রনের ফলেই যে তার বিশিষ্ট অবয়বটি রচিত হয়েছিল তা রেনেসাঁর সময়ের পণ্ডিতদের কাছেও খুব স্পষ্টই ছিল। এই ব্যবস্থার মধ্যে রোমান ও জার্মান উপাদানের অনুপাত সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই, তবে অনেকে এই বিতর্কটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননা। (“The precise admixture of once Roman and German clements in the pure feudal mode of production is of much less importance than their respective distribution in the varient social formations which emerged io mejieval Europe.” Perry Anderson : ‘From Antiquity to Feudalism.’)।

সামন্ততন্ত্র ছিল মানবসমাজের বিকাশের একটি বিশেষ স্তর। এই ব্যবস্থার কয়েকটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। মরিস ডব (Maurice Dobb) সামন্ততন্ত্রকে, বিশেষত ইংল্যান্ডের সামন্ততন্ত্রকে প্রধানত একটি উৎপাদন ব্যবস্থা (mode of production) হিসাবে দেখেছেন। বিষয়টি তিনি তার Studies in the Development of Capitalism (1946) গ্রন্থে পর্যালােচনা করতে গিয়ে নিম্নস্তরের প্রযুক্তি, অনুন্নত শ্রম বিভাজন, গৃহস্থ বা গ্রামীণ সমাজের ভােগের জন্য উৎপাদন (বৃহত্তর বাজারের জন্য উৎপাদন নয়), বাধ্যতামূলক শ্রমসেবা, ভূমিদাসত্ব প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মার্ক ব্লক (Marc Bloch) তার মৌলিক রচনা Feudal Society (vol. II) গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলােচনা প্রসঙ্গে অধীনস্থ কৃষক শ্রেণির (তার ভাষায় “subject peasantry”) কথা বলেছেন। সামন্তপ্রভু নির্মমভাবে এই শ্রেণির কাছ থেকে উদ্ধৃত্ত আদায় করত। এক্ষেত্রে মজুরি প্রদানের কোনাে প্রশ্নই ছিল না, কারণ মুদ্রা-অর্থনীতির প্রসার তখনও লক্ষ করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে আরও লক্ষণীয় যে ব্লক সামন্ততন্ত্র শব্দটির পরিবর্তে ব্যাপকতর অর্থবহ সংজ্ঞা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (Feudal Society) কথাটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী। তার এ বিষয়ে রচিত এবং দুই খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থের নামকরণও অনুরূপ। ক্যালমেটিও (Calmette) সামন্ততন্ত্র শব্দটির পরিবর্তে ব্যাপকতর সংজ্ঞাবহ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (feudal society) কথাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। এক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্র শব্দটি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, এটি হচ্ছে এমন কতকগুলি প্রথা, বিধি ও প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি যেগুলো দ্বারা সমাজের কিছু স্বাধীন বা মুক্ত মানুষকে (vassal) অপর একজন প্রতিপত্তিশালী স্বাধীন মানুষের (lord) প্রতি আজীবন আনুগত্য স্বীকার ও সেবার (বিশেষ করে সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে) অঙ্গীকার একটি বাস্তব ঘটনা হয়ে ওঠে, অন্যদিকে আশ্রিতকে সর্বতােভাবে রক্ষা করা ও তার জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা লর্ডের পক্ষে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে ধার্য হয়। সাধারণত অধীনস্থ ভাসালের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য লর্ডকে তার স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ ‘ফিফ’ হিসেবে শর্ত সাপেক্ষে দান করতে হতো। যে সমাজকে সামন্ততান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া হয় সেখানে ভূমির ওপর ক্রমোচ্চস্তরে বিন্যস্ত অধিকার (graded system of rights) একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে আর ‘ফিফ’ এর (প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার ও বিনতিদ্বারা লব্ধ ভূমিস্বত্ত্ব) মাধ্যমে বন্দোবস্ত করা কৃষিযােগ্য জমিতেই উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখা হয়।

সামন্ততন্ত্র দ্বারা মানব সমাজের বিকাশের এমন একটি স্তর বােঝায় যার অতি স্পষ্ট, অপরিহার্য কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলো হচ্ছে –
(১) নানা কারণে সমাজভুক্ত সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও নির্ভরতার দ্রুত ও ক্রমবর্ধমান প্রয়ােজন
(২) সমাজের উপরের স্তরে পরাক্রান্ত ও যােদ্ধৃশ্রেণীর কিছু মানুষের অবস্থান
(৩) স্থাবর বা ভূসম্পত্তির মালিকানার শ্রেণীবিন্যাস (যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের প্রশ্ন ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত), এবং
(৪) রাষ্ট্রের অক্ষমতা ও সংহতির অভাবের জন্য ঐসব উচ্চশ্রেণীর মানুষের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন।

বিস্তারিতভাবে বললে সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো এভাবে বর্ণনা করা যায় –

  • ১। সামন্ততন্ত্র ছিল এমন একটি ব্যবস্থা বা order যা বিভিন্ন কারণে সমাজের সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও নির্ভরতার দ্রুত ও ক্রমবর্ধমান প্রয়ােজন মেটাতে উদ্ভূত হয়েছিল। নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ ছিল পরবর্তী ক্যারােলিঞ্জীয় শাসকদের আমলে সৃষ্ট নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের মূলে ছিল ক্যারােলিঞ্জীয় রাজপুত্রদের মধ্যে সংঘটিত ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও নবপর্যায়ে ম্যাগিয়ার, সারাসেন ও ভাইকিংদের আক্রমণ
  • ২। সমাজের উচ্চস্তরে একটি শক্তিশালী যােদ্ধাশ্রেণির অবস্থান ছিল সামন্ততন্ত্রের অপর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। বলাবাহুল্য, অসহায় ও দুর্বলের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়ােজনেই এদের আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে, কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে এরা বিচ্ছিন্নতাকামী কাউন্ট ও ডিউকদের শামিল হয়েছিল। শিভালরি (Chivalry) প্রথা এদের মধ্যেই বিকশিত হয়েছিল। এরাই ছিল সেই প্রথার ধারক ও বাহক নাইটগণ (Knight), যারা flower of feudalism নামে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
  • ৩। স্থাবর বা ভূসম্পত্তির মালিকানার শ্রেণিবিন্যাস ছিল এই প্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইতিপূর্বেই বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযােগে অভিজাত শ্রেণি নিষ্কর জমির (benefice) ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। বলা বাহুল্য, এই বিশাল ভূসম্পত্তি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সামন্তপ্রভুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতএব তিনি চাষবাস এবং অন্যান্য কাজে অধীনস্থ প্রজা বা ভাসালদের নিয়ােগ করতেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এই দুই শ্রেণির (অর্থাৎ lord a vassal-এর) মধ্যবর্তী স্তরে অসংখ্য Intermediary বা মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। ভাসালদেরও নিজস্ব অধীনস্থ ভাসাল থাকতো, যারা সাব-ভাসাল (sub-vassal) নামে পরিচিত ছিল। ভূসম্পত্তির পরিমাণ এত বিশাল হত বলেই এই শ্রেণিবৈচিত্র্য উদ্ভূত হয়েছিল এবং শ্রেণিগুলির একটি hierarchical order বা স্তরবিন্যাসও ছিল।
  • ৪। সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ম্যানর ভিত্তিক উৎপাদন। সামন্ততন্ত্রের পর্বটি ছিল একটি দুর্বল মুদ্রা অর্থনীতির যুগ। প্রধানত এই দুর্বলতার ফল হিসাবে পরবর্তীকালে একটি বিশেষ সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন প্রথা ম্যানর (Manor) গড়ে ওঠে। কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে ম্যানর ছিল মূলত একটি এস্টেট (Estate) যার সীমানার ভেতর বাস করতেন লর্ড ও তার প্রজারা। ঐ লর্ডের জমিতে প্রজা কর্তৃক উৎপাদিত উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের অংশীদার হওয়াই ছিল ম্যানরের ভূস্বামীর কর্তৃত্ব প্রয়ােগের অন্যতম উদ্দেশ্য।
  • ৫। শর্তসাপেক্ষে ভূস্বামী কর্তৃক অধীনস্থ প্রজাকে রাজস্বের বিনিময়ে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের স্বত্ব দান ছিল সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই শর্তগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল প্রজা কর্তৃক প্রদেয় নানা প্রকার কর ও বাধ্যতামূলক বেগার শ্রমদান। ধীরে ধীরে ইউরােপের বহু অঞ্চলে স্বাধীন কৃষকের অস্তিত্বের অবসান ঘটে এবং এই শ্রেণি সার্ফ বা ভূমিদাসে পরিণত হয়।
  • ৬। এই প্রসঙ্গে সামন্তপ্রথার সঙ্গে সম্পর্কিত আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যায় এবং এগুলো ছিল পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নিম্নস্তরের প্রযুক্তি, অনুন্নত শ্রম-বিভাজন এবং গৃহস্থ বা ক্ষুদ্র গ্রামীণ সম্পদের ভােগের জন্য উৎপাদন (এবং কখনােই বৃহত্তর বাজারের জন্য উৎপাদন নয়)।
  • ৭। সবশেষে বলা যায় একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় শক্তির উপস্থিতি ছিল সামন্তপ্রথার অন্যতম রাজনৈতিক (বা শাসনতান্ত্রিক) বৈশিষ্ট্য। আঞ্চলিকতাবাদের স্বীকৃতি ছিল সামন্ততন্ত্রের মূল মন্ত্র। এই আঞ্চলিকতাবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন সামন্ত অভিজাত শ্রেণি যারা নিজ স্বার্থে সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর নিজ প্রভাবিত অঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে রাজার কার্যত কোনাে কর্তৃত্ব ছিল না।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো পশ্চিম ও মধ্য ইউরােপের সামন্ততন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সামন্তপ্রথার কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্যও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রুসেডাররা জেরুসালেম রাজ্যে যে বিশিষ্ট সামন্তপ্রথা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে ভ্যাসালদের অধিকার অনেক বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছিল। হয়তাে অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ক্রুসেডাররা ভ্যাসালদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জার্মানির যে সমস্ত রাজ্যে, যথা স্যাক্সনি ও ফ্রিসিয়ায় ম্যানর-ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি আদৌ ছিল না সেখানে ভ্যাসাল প্রথা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ফ্রান্সের নরমাঁদি ছিল একটি ব্যতিক্রম যেখানে ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একটি কার্যকরী ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ঐতিহ্যের কিছু প্রভাব ইংল্যান্ডেও অনুভূত হয়েছিল উইলিয়ামের আমলে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে নর্মান বিজয়ের পরবর্তীকালে Allodial বা নিষ্কর নিঃশর্ত ভূসম্পত্তির অবসান ঘটে এবং সমস্ত কৃষিযােগ্য জমিকেই রাজার প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ শাসনাধীনে স্থাপন করা হয়।

এই ধরণের সমাজব্যবস্থা ১০ম থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের খণ্ডিত অংশগুলোতে, যথা ফ্রান্স, জার্মানী, বারগাণ্ডি, আর্লেস, ইতালি, এবং ইংলণ্ডে, স্পেনের খ্রীস্টানশাসিত অঞ্চলে, নিকটপ্রাচ্যের লাতিন প্রিন্সিপ্যালিটিগুলোতে পূর্ণবৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। ভিন্ন সময়ে এবং অন্যত্র প্রায় একই ধরণের সমাজ ব্যবস্থার দেখা যায়। কেউ কেউ এ জন্য প্রাচীন মিশর, ভারতবর্ষ, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে, আরব দেশসমূহ, তুরস্ক সাম্রাজ্য, রাশিয়া ও জাপানে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু যেসব সাদৃশ্যের জন্য তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, বিশ্লেষণের পর এইসব বৈশিষ্ট্য খুব কমই পাওয়া যায়। পশ্চিম ইউরােপের সামন্ততন্ত্র মেরােভিঞ্জীয় ফ্রাঙ্ক রাজ্যে (গলে) মােটামুটিভাবে স্পষ্টরূপ ধারণ করতে শুরু করে। কিন্তু যথাসম্মত অর্থে সামন্ততন্ত্র একদা ক্যারােলিঞ্জীয় শাসনাধীন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলেই বিকশিত হতে থাকে। অবশেষে পশ্চিম ও মধ্য ইউরােপের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সামন্ততন্ত্র পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১০ম থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত ইউরােপের ইতিহাসের এই পর্বকে গানশ (E. L. Ganshof) ‘classical age of feudalism’ আখ্যা দিয়েছেন।

সামন্ততন্ত্রের উৎস্য নিয়ে বিতর্ক, রোমান ও জার্মান সমাজে এর পূর্বরূপ

রােমান সাম্রাজ্যের শেষ পর্বের ইতিহাসে সামন্ততন্ত্রের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জার্মান সমাজব্যবস্থার মধ্যেও এর কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। জার্মানরা রােমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলে এই দুই বৈশিষ্ট্যের মিলনে পশ্চিমে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়। ক্যারােলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যে (৮০০-৮৮৮ খ্রি.) এই সব বৈশিষ্ট্যের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই সাম্রাজ্যের সম্রাট শার্লমেনের মৃত্যুর পর (৮১৪ খ্রি.) দ্রুতগতিতে সামন্ততান্ত্রিক লক্ষণগুলোর বিকাশ ঘটে। প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে ধনী অভিজাতরা অধীনস্থদের রক্ষার দায়িত্ব নিতেন (Roman Patrocinium), বিনিময়ে অধীনস্থ ব্যক্তি প্রভুকে সেবা ও সীমাহীন আনুগত্য দিত। প্রভু ও অধীনস্থের এই সম্পর্ক (Patron-client relationship) সামন্ততন্ত্রের মূল ভিত্তি। ফ্রান্সে কেলটিক অভিজাতরা ভ্যাসালদের ওপর কর্তৃত্ব করতেন। ফ্রান্স হল সামন্ততন্ত্রের আদি উৎপত্তিস্থল। জার্মান সমরনায়করা অধীনস্থদের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ আদায় করে নিতেন (comitatus)। ইউরােপের সামন্ত ব্যবস্থা এসব বৈশিষ্ট্যগুলোকে গ্রহণ করে নেয়।

ইংরাজি Feudalism শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে লাতিন ফিওডালিস (Feodales) এবং ফরাসি ফেওদালিতে (Féodalité) শব্দটি থেকে। সামন্ততন্ত্রের উৎসরূপে রােমান না জার্মান কোন উপাদানগুলোর আপেক্ষিক গুরুত্ব সর্বাধিক, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত ১৮শ শতাব্দীর ফ্রান্সেই হয়েছিল। আজও এই বিতর্কের অবসান ঘটেনি। একদিকে যেমন রােমান আমলের অনুগামী পৃষ্ঠপােষক প্রথার (Client-Patron System) মধ্যে সামন্তপ্রথার উৎস পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি জার্মান কমিটেটাস (Comitatus) প্রথাও এর অন্যতম উৎস হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। ফ্রান্সে এই বিতর্কে ১৮শ শতকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বুলঁভিয়ের এবং আবে দুবা। বুলঁভিয়ের জার্মান তত্ত্বের মর্মার্থ ও ১৮শ শতকে সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ এবং উন্নত অভিজাত শ্রেণির বিশেষ অধিকার খর্ব করার রাজকীয় প্রচেষ্টা ফ্রাঙ্ক সংবিধানের মূলনীতির বিরােধী। তার মতে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব জার্মান প্রথার মধ্যেই। অন্যদিকে দুবার রােমান তত্ত্বের সংক্ষিপ্তসার এই যে, অভিজাত বর্গের অধিকারের পূর্বেই রাজতন্ত্রের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিফসমূহের অধিকার অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে ফরাসিরাজের কোনাে বাধ্যবাধকতা ছিল না। বস্তুত, অভিজাত শ্রেণি যেসব অধিকার আত্মস্থ করেছিল, তা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা কাপেতীয় বংশীয় রাজবংশ করেছিলেন। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের মূলে ছিল রােমান ঐতিহ্য, যেখানে অভিজাত নয়, রাজার আধিপত্যই স্বীকৃত হয়েছিল।

কীভাবে মেরােভিঞ্জীয় গলে একটি বিশৃঙ্খল যুগের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্তপ্রথার উদ্ভব ঘটেছিল তা পর্যালােচনা করেছেন বিশিষ্ট সামন্ততান্ত্রিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ E L. Ganshof তার Feudalism গ্রন্থে। বলাবাহুল্য, এই উদ্ভবের ক্ষেত্রে বর্বর জার্মানদের কিছু অবদান ছিল। অবশ্য গানশ আমাদের একথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে রােমান আমলে গল প্রদেশে ‘বুসলেরি’ (buccellarii) নামক ভাড়াটিয়া সৈন্যরা (গানশফের ভাষায়, private bands of soldiers’) বিশিষ্ট মানুষদের দেহরক্ষীরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। আগামী দিনে এদের কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল সামন্তপ্রথা। অবশ্য এর পাশাপাশি গানশ জার্মান ‘কমিটেটাস’ প্রথারও উল্লেখ করেছেন। কমিটেটাসরা ছিল বুসলেরিদের মতাে যােদ্ধা শ্রেণি, যারা স্বেচ্ছায় একজন দলপতির অধীনস্থ হত এবং তার হয়ে লড়াই করত। গানশ শেষপর্যন্ত উপরােক্ত সৈনিকদের দ্বৈত উদ্ভবের কথা বলেছেন এবং তিনি এই দুটি উৎসের মধ্যে কোনটির ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। তার ভাষায় : “The bodies of armed retainers whom we meet during the Merovingian period had thus a double origin, and it is not possible to say whether they owed more to their Roman or to their Germanic predecessor.” (Feudalism)”।

পূর্ববর্তী যুগের সমাজে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও বিধি-বিধানগুলোর অধিকাংশের ভিন্ন নাম ও চেহারায় অবস্থানের কারণে সেগুলোর সঠিক উৎস সন্ধান আজ খুব কঠিন একটি কাজ। রােমান আমলের শেষের দিকে ভূমিস্বত্ব বিষয়ে প্রিক্যারিয়াম (Precarium) নামক একটি প্রথা গড়ে উঠেছিল। এই প্রথানুসারে বহু কৃষিজীবী বিধিসম্মতভাবে ভূস্বামীর কাছে কৃষিযােগ্য জমি প্রার্থনা করে ভূমিস্বত্ত্ব লাভ করতো। লিখিত দলিলপত্র ছাড়াই ও বিনা রাজস্বে এই বন্দোবস্ত করা হলেও ভূস্বামী জমি থেকে প্রার্থীকে উৎখাতের অধিকারী রয়েই যেতেন। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য কৃষকের ভূমিস্বত্ত্ব ভােগ নির্ভর করতো রাজস্ব দেয়া না দেয়ার ওপর, আর ভূস্বামীকে তা নিয়মিত দিতে পারলে আজীবন, এমনকি বংশানুক্ৰমিকভাবে সেই ভূখণ্ডটি ভােগদখলের অধিকার পাওয়া যেতো। অধঃস্তন ব্যক্তির যথাবিহিত প্রার্থনা ছাড়াও ভিন্ন উপায়ে কৃষিযোগ্য জমির বন্দোবস্ত করার প্রথা রোমান সমাজে প্রচলিত ছিল। ঋণভারে জর্জরিত ক্ষুদ্র ভূস্বামীগণ অনেক ক্ষেত্রেই ঋণদাতাকে তার জমির স্বত্ত্বদান করে মূল ভূখণ্ডের একটি অংশ নিয়মিত রাজস্ব দানের শর্তে ভােগ দখল করার অনুমতি লাভ করতেন। আবার ক্ষেত্র বিশেষে নিরাপত্তার আশায় ছােট ক্ষেতমালিক পরাক্রান্ত প্রতিবেশীর শরণাপন্ন হতেন, এরপর সেই ছোট ক্ষেতমালিক জমির স্বত্ত্ব তার কাছে হস্তান্তরিত করে রাজস্বদানের বিনিময়ে সেই জমিতে কৃষি উৎপাদন করার অধিকার পেলেও জমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করা না করা সম্পূর্ণরূপেই লর্ডের ইচ্ছার অধীন হয়ে যেতো। অবশ্য বাস্তবক্ষেত্রে এভাবে ভূমিস্বত্ব ত্যাগ করা সত্ত্বেও সাধারণত প্রজাদের জমিচ্যুত করার ঘটনা ছিল বিরল। এই জাতীয় প্রথার ফলে ভূস্বামীগণ ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদনকে লাভজনক করার সুযােগ পেতেন। রােমান আমলের শেষের দিকে প্রিক্যারিয়াম প্রথার মাধ্যমে চার্চের ভূসম্পত্তির বৃদ্ধির ঘটনা খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। জমি প্রার্থনা অথবা জমির স্বত্ত্ব ত্যাগ উভয় পদ্ধতিই ভূসম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে দ্রুত এবং উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটায়। তাছাড়া শর্ত সাপেক্ষে জমির বন্দোবস্ত করার ফলে চার্চের অধীনস্থ ও সাধারণত বিশাল ভূসম্পত্তিতে সহজতরভাবে কৃষি উৎপাদনের সম্ভাবনার কথাও বাদ দেওয়া চলে না। আর চার্চকে ভূসম্পত্তির মালিকানা অর্পণ করে প্রিক্যারিয়াম হিসেবে তা আবার গ্রহণ করাটা যে অতিশয় পুণ্য কাজ – সে তথ্য প্রচারেও চার্চের তৎপরতা কিছু কম ছিল না। 

আবার ব্যক্তিবিশেষের উপর সাধারণ মানুষের নির্ভরতার যে প্রথা সামন্ততন্ত্রে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল তার উৎসও রােমান আমলে নিহিত আছে। ধনাঢ্য ও পরাক্রান্ত রোমানগণ কিছু সংখ্যক বাধ্য অনুচরবেষ্টিত হয়ে থাকতে চাইতেন। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল পৃষ্ঠপােষক (Patronus) ও দাক্ষিণ্যপুষ্ট অনুগামীর (clientes); আর প্রথাটি পরিচিত ছিল পেট্রোসিনিয়াম (Patrocinium) নামে, আবার এতি প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সিস্টেম বা ক্লিয়েন্টেলিজম (Clientelism) নামেও পরিচিত। রােমান শাসনের অন্তিম লগ্নে সমাজে অনিশ্চিয়তা বৃদ্ধির ফলে এই প্রথা ব্যাপকতর হয়ে ওঠে। ভূমিহীন কৃষক অথবা বেকার জনেরও আশ্রয় ও পরিবারবর্গের ভরণপােষণের আশায় সর্বতােভাবে তার সেবা করার অঙ্গীকার করে স্থানীয় কোনও লর্ডের শরণাপন্ন হতেন। এই সেবা (Service) লর্ডের ক্ষেত-খামারে অন্যান্য ক্রীতদাস এবং অধীনস্থ কৃষকদের (coloni) সঙ্গে কৃষি উৎপাদনে ব্রত হওয়া অথবা তার অনুচর বাহিনীতে যােগ দিয়ে সামরিক কাজে অংশ নেওয়া – যে কোনও রূপ নিতে পারতো। এছাড়াও ক্ষুদ্র ভূসম্পত্তির মালিকগণ প্রায়ই কোনও শক্তিশালী পক্ষের অবিচারের প্রতিকারের আশায়, রাজস্ব ফাঁকি দেবার আশায় বা অন্য কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের জন্য প্রতিপত্তিশালী ভূস্বামীকে পেট্রোনাস (Patronus) রূপে মেনে নিতেন।

তবে ঐতিহাসিক কারণে রােমান সমাজ ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে এমন অনেক প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতির সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলোর সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের একাধিক বৈশিষ্ট্যের বিস্ময়কর সাদৃশ্য খুজে পাওয়া যায়। জাপানের দাইমিও (daimio), বুশি (bushi) ও সামুরাই (Samurai)-দের সঙ্গে ভ্যাসালদের (প্রাক-সামন্ততন্ত্র অধ্যায়ে জার্মানদের comitatus ও রােমান-গলদেশের clientela) মিল ছিল অনেক এবং পূর্বোক্তগণ প্রভুর কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে যে ভূমিস্বত্ত্ব লাভ করতে ‘ফিফ’- এর সঙ্গেও তার খুব বেশি তফাৎ ছিল না। আরব দেশ ও তুরস্কের ইকতা (iqta) সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ১৩শ ও ১৬শ শতকে রাশিয়াতেও শর্তাধীন ভূমিসত্ত্ব লাভের বহু দৃষ্টান্তের খোঁজ পাওয়া যায়। আর পশ্চিম ইউরােপে মেরেভিঞ্জীয় শাসনাধীন ফ্রাঙ্করাজ্যে সামন্ততন্ত্র প্রথম স্পষ্ট আকার নিতে আরম্ভ করলেও, বিধিসম্মত. পারিভাষিক অর্থে একদা-ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ল্যয়র ও রাইন নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলেই সামন্ততন্ত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিছু দূরবর্তী এলাকা দক্ষিণ ফ্রান্স বা রাইনের পূর্বতীরস্থ স্থানগুলোতে যে সব সামাজিক প্রতিষ্ঠান মানবজীবন নিয়ন্ত্রণ করতো তার প্রকৃতি ছিল কিছু আলাদা। তবে ১০ম থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত যে কালসীমা তার মধ্যেই ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সামন্ততন্ত্রকে পূর্ণ বিকশিতরূপে দেখা যায় এবং এই পর্বকেই ঐতিহাসিক গ্যানশফ (F. L. Ganshof) ‘ক্লাসিকাল এজ অফ ফিউড্যালিসম্’ রূপে অভিহিত করেছেন।

বর্বর আক্রমণ ও ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষ থেকে সামন্ততন্ত্রের সূচনা

বর্বর আক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন এই লেখাটি – “৯ম-১০ শতকে ইউরোপে স্যারাসেন-ম্যাগিয়ার-ভাইকিঙ আক্রমণ, ১১শ-১২শ শতকে দক্ষিণ ইতালি-সিসিলিতে নর্মান বিজয় ও নর্মান রাজ্য

সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের পেছনে সামরিক প্রয়ােজনেরও বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা ছিল। রাজা ও ভূস্বামী অধীনস্থ ভ্যাসালের কাছ থেকে কর ও সামরিক সাহায্য নিতেন। ইউরােপে ভাইকিং, ম্যাগয়ার ও স্যারাসেন আক্রমণ শুরু হলে এই সামরিক সাহায্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অশ্বারােহী বাহিনীর প্রয়ােজনে চার্লস মারটেল চার্চকে ‘বেনিফিস’ দিতে বাধ্য করেন। সাধারণ কৃষকের পক্ষে ঘােড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করা সম্ভব হত না বলে ভূস্বামীরা সামরিক বাহিনী গড়ে তােলেন এবং ভূমি ও শাসনের অধিকার ভােগ করেন। চার্লসের মৃত্যুর পর ক্যারােলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। সেই সময়ে অভিজাতরা নিজেদের ক্ষমতা ও অধিকার সংহত করে নেয়। তারা সাময়িকভাবে যে অধিকারগুলো পেয়েছিলেন তা বংশানুক্রমিক হয়ে দাঁড়ায়। চার্লস দ্য বল্ড সামন্তপ্রভুদের এই বংশানুক্রমিক অধিকার স্বীকার করে নেন। সামন্ত যুগে প্রত্যেক মানুষের ছিল একজন প্রভু, প্রত্যেক কর্মচারীর একজন ভূস্বামী। প্রত্যেকটি পদ ও জমি বংশানুক্রমিক হয়েছিল; এভাবে ইউরােপে সামন্ততন্ত্র পূর্ণ পরিণত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। বেনিফিসের নাম হয়েছিল ফিফ। ভূস্বামী তার অন্যান্য অধিকারের সঙ্গে কর স্থাপন ও আদায়, বাজার স্থাপন, মুদ্রা প্রচলন ও বনজসম্পদ আহরণের অধিকার লাভ করেন।

৮৪৩ সালে ভার্দুনের সর্বনাশা বণ্টনের পরই ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের খণ্ডিত অংশগুলির ওপর স্থলপথে এবং সমুদ্র ও নদীপথে দীর্ঘস্থায়ী ভাইকিং, ম্যাগিয়ার ও স্যারাসেন দস্যুদলের আক্রমণের অভিঘাতে কাউন্ট-নির্ভর এবং অপূর্ণাঙ্গ সাম্রাজ্যিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এই বর্বর আক্রমণের প্রতিরােধের মতো উপযুক্ত সামরিক ব্যবস্থা শাসকদের ছিল না, আর ফ্রাঙ্ক অভিজাতদের মধ্যে যারা দক্ষ ও অসামান্য ছিলেন তাদের অধিকাংশই নিহত হয়েছিলেন বিগত অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়। ফলে এই অনিশ্চিত ও অত্যন্ত দুঃসময়ে সম্রাট শার্লমান প্রবতিত কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবহমান ও সক্রিয় রাখার মতো কেউই ছিলেন না। রাজশক্তির এই স্পষ্ট অধােগামিতার সুযােগে ৮৫০ সালের মধ্যে বৈধানিকতা তুচ্ছ করে ক্যারোলিঞ্জীয় শাসনাধীন ভূখণ্ডে বেনিফিসগুলিকে বংশানুক্রমিক করে তােলেন পরাক্রান্ত ভূস্বামীগণ, পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে কেন্দ্রীয় শাসন সচল রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীবৃন্দ–মিসি ডােমিনিসিগণ বিলুপ্ত হয়ে যান, আর রাজকীয় ভ্যাসালরা (vassi dominici) রাজস্বার্থ উপেক্ষা করে আঞ্চলিক স্বার্থের সঙ্গে হাত মেলাতে শুরু করেন। এই দুরবস্থা ও অরাজকতার সুযোগে ৯ম শতকের শেষ পাদে কাউন্টগণও নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন রাজন্যবর্গের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। বর্বর আক্রমণের এই দুর্দিনের পটভূমিকাতেই দেখা যায় পূর্বতন ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশের আত্মরক্ষা ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য অবৈধভাবে নির্মিত ডিউক ও কাউন্টদের দুর্গের ভূমিকা। গ্রামীন সমাজে এই দুর্গগুলো একই সঙ্গে আশ্রয় ও কারাগারের প্রতীক হয়ে ওঠে। আকস্মিক আক্রমণের সময় বিপন্ন কৃষককুল সেইসব অবৈধ দুর্গে পেতো নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু দুর্গাধিপতি ভূস্বামীগণ ক্রমশ নবপ্রবর্তিত ‘ফিফ’ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, ম্যানরভিত্তিক কৃষি উৎপাদনের পত্তন করে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন ক্রমশ তা স্বাধীন কৃষকের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে পরবর্তী দুশাে বছরে প্রায় গােটা মহাদেশে সামন্ততন্ত্ররূপে অগণিত মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করে। তবে এই প্রক্রিয়া ৯ম শতকের শেষে আরম্ভ হলেও নিকট অতীতের বহু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও বিধিবিধানের মধ্যে এর পূর্বাভাস খুঁজে পাওয়া দুরূহ নয়।

মেরোভিঞ্জীয় শাসনামলে সামন্ততন্ত্রের উৎস্য

মেরােভিঞ্জীয় শাসনাধীন গলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা সম্পূর্ণরূপে শাসকের ব্যক্তিত্ব নির্ভর হওয়ায় সে রাজ্যে অরাজকতা প্রায়ই দুঃসহ হয়ে উঠতো। শাসক পরিবারের মধ্যে অন্তদ্বন্দ্ব এবং ফ্রাঙ্ক রাজপরিবারে পিতৃসম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বন্টনের প্রথাও শাসন বিভাগের স্থায়িত্বের অন্তরায় ছিল। পরবর্তীকালে অষ্ট্রেসিয়া (Austrasia), নিউস্ট্রিয়া (Neustria) ও বার্গান্ডির (Burgundy) স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে রাজপরিবারের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষার অশুভ প্রয়াস যুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তােলে। ৬ষ্ঠ শতকে রাজা ক্লভিসের পুত্র-পৌত্রদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বন্য, হিংস্র জন্তুদের আচরণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই দীর্ঘ সময়ে শাসকবর্গের পক্ষে প্রজাদের নিরাপত্তা বিধানের স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হয়নি। সংখ্যায় অল্প এবং প্রাথমিক কর্তব্য পালনে অমনােযােগী রাজকর্মচারীদের অদক্ষতাও শাসনযন্ত্রকে জীর্ণ এবং অকেজো করে দিয়েছিল। এই ধরণের সমাজেই ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র অনুচরবাহিনী গড়ে ওঠে এবং সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ এদেরই শরণাপন্ন হয়। আর পরাক্রান্ত নেতৃস্থানীয় অভিজাতগণ রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির কামনায় অনুগত ও বাধ্য জনবল বৃদ্ধিতে উৎসাহিত হতেন। একজন স্বাধীন প্রজা অন্য কোনও স্বাধীন প্রজার কাছে এভাবে নিরাপত্তার আশায় আত্মসমর্পণ করলে তাদের বলা হতো ingenui in obsequio বা দায়বদ্ধ স্বাধীন প্রজা। সমাজে সাধারণ মানুষের এ জাতীয় অবস্থান্তরের ঘটনা অতি প্রাচীন। এর মধ্যে অভিনবত্ব এখানেই যে মধ্যযুগের গল বা বর্তমান ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে, সংখ্যাতীত ক্ষেত্রে মানুষ শর্তসাপেক্ষে অন্যের শরণাগত হতে বাধ্য হয়েছিল। আর গলে প্রাচীন একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব – bucellarii (সশস্ত্র অনুচরবাহিনী) মানুষের সামাজিক অবস্থার এই পরিবর্তন সহজতর করে দেয়। Bucellarii নামধেয় রক্ষীবাহিনী সাধারণত বিশিষ্ট অভিজাতবর্গের দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হতেন এবং ‘বর্বর’ আক্রমণের পর্ব সমাপ্ত হলেও বিশেষ বিশেষ এলাকা যেমন ল্যয়র নদীর দক্ষিণাঞ্চলে এ প্রথা যে থেকে গিয়েছিল তা ভিসিগথ শাসক ইউরিখের আইনাবলী থেকে জানা যায়। ফ্রাঙ্কদের মধ্যে প্রচলিত এ ধরণের প্রথা comitatus (জার্মান ঐতিহাসিকগণ যাকে বলেছেন gefolgschaft) অনুযায়ী কিছু সংখ্যক স্বাধীন যােদ্ধা স্বেচ্ছায় কোনও দলনেতার অধীনে তার স্বার্থসিদ্ধ করার জন্য একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধবিগ্রহে অংশ নিতো। ঐতিহাসিক পেরি এন্ডারসনের মতে এই কমিটেটাস (comitatus) এবং প্রাচীনতর রোমান প্রতিষ্ঠান পেট্রোসিনিয়ামের (patrocinium) মধ্যেই vassalage এর উৎপত্তি নিহিত আহে যদিও এই প্রথাদ্বয়ের আনুপাতিক গুরুত্ব নির্ণয় দুঃসাধ্য।

৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিয়ে ingenui in obsequio বা দায়বদ্ধ প্রজাগােষ্ঠী তৈরী হয়েছিল। যে সব প্রজা রাজার শরণাগত হতো তাদের বলা হতো antrustiones অথবা trustis ভুক্ত মানুষ। Trustis একটি ফ্রাঙ্ক শব্দ যায় শেষাংশ এসেছে লাতিন একটি শব্দ থেকে যা comitatus এর সমার্থক। তাই antrustiones-দের রাজানুচর রূপে বর্ণনা করা যায় এবং এই সম্প্রদায়ভুক্তগণ তিনটি বিশেষ অধিকার বা wergeld ভােগ করতো –

  • ১। এদের কেউ নিহত হলে ঘাতককে নিহতব্যক্তির পরিবারবর্গকে সাধারণ নরহত্যার শাস্তিস্বরূপ দেয় জরিমানার তিনগুণ বেশি দিতে হতো (রাজার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় তার এই বিশেষ সম্মান)।
  • ২। যে কোনও স্তর থেকে এলেও সমাজে এদের স্থান হতো উঁচুতে এবং 
  • ৩। রণকুশলতার জন্য সে রাজার দেহরক্ষীরূপে বিশেষ মর্যাদা লাভ করতাে। অবশ্য antrustiones-দের নিযুক্ত করতে পারতেন একমাত্র রাজা বা রাজমহিষী।

অন্যান্য স্বাধীন প্রজাও ব্যক্তিগতভাবে রাজা বা অন্য কোনও পরাক্রান্ত অভিজাতের অধীনতাপাশে বদ্ধ হলে তাদের পরিচয় হতো gasundi রূপে। যেহেতু এদের অধিকাংশ সমাজের নিচের স্তর থেকে আসতো সেজন্য ক্রীতদাস সম্পর্কে ব্যবহৃত শব্দগুলো যেমন vassus বা puer-কে এদের সম্পর্কেও প্রয়োগ করতে কেউ দ্বিধা করতেন না (vassus শব্দটির উৎপত্তি celtic শব্দটি givas ( বালক ভৃত্য) থেকে, আর লাতিনে এর পরিবর্তিত রূপ হয় vassus), এভাবে ভবিষ্যতে এই vassus শব্দটি টিকে যায়, আর এতে সংযােজিত হলো নতুন অর্থ এবং ব্যঞ্জনা। অবশ্য মেরােভিঞ্জীয় যুগেও vassus শব্দটি সঙ্কীর্ণ অর্থেই ব্যবহৃত হতো, কিন্তু ৮ম শতকে পরাক্রান্ত ভূম্যধিকারী প্রভুর উপর সর্বাংশে নির্ভরশীল প্রজা সম্পর্কে শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

মধ্যযুগীয় সমাজে একজন স্বাধীন প্রজার উপর অপর একজনের রক্ষণাবেক্ষণের সর্বপ্রকার দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়ার প্রথাকে লাতিনে বলা হতো পেট্রোসিনিয়াম (patrocinium), জার্মান ভাষায় mundium অথবা memdeburdis আর ফরাসীতে maimbour। শব্দটিতে নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠারও একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। যে বিধিসম্মত উপায়ে একজন স্বাধীন প্রজা নিজেকে অন্যের আশ্রয়ে সমর্পণ করতে তাই পরিচিত ছিল commendatio বা commendation রূপে। ক্যারোলিঞ্জীয় যুগে শব্দটির বহুল ব্যবহার হলেও ৫ম শতকে গলে প্রথাটি যে অপরিচিত ছিল না তা ভিসিগথ শাসক ইউরিখ এর আইনাবলীর থেকে এবং ৬ষ্ঠ শতকে রচিত তুরের (Tours) গ্রেগরীর Historia Francorium থেকে জানা যায়। মেরােভিঞ্জীয় আমলে Formalae Turonenses নামক বিধানেও commendation সম্পর্কে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য পাওয়া যায়। এই মূল্যবান দলিলটিতে দেখা যায় কোনও বিশেষ প্রভুর উদ্দেশ্যে জনৈক স্বাধীন প্ৰজার স্বীকারোক্তি ও জীবিকা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় সে সদাশয় ও মাননীয় প্রভুর (doininus) শরণাপন্ন হচ্ছে এবং গ্রাসাচ্ছদনের নিশ্চিত ব্যবস্থার বিনিময়ে শক্তি এবং সাধ্যমতো প্রভুর সেবা করার অঙ্গীকার করছে। সে এই শপথও গ্রহণ করছে যে জীবদ্দশায় প্রভুর সেবা থেকে বিরত হবে না। স্বাধীন প্রজা কর্তৃক dominus বা লর্ডকে সেবা ও সম্মানদানের অঙ্গীকার কিন্তু নিঃশর্ত ছিল না। এ জাতীয় প্রথায় আত্মসমর্পণের স্বাধীন সত্তা নষ্ট হতো না, আর লর্ডও আশ্রিতের অন্নবস্ত্র ও নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হতেন। তুর (Tours) এর দলিলে এ কথাও স্পষ্ট ঘােষণা করা হয়েছে যে ভাসালের মৃত্যুতে এ জাতীয় চুক্তি বাতিল বলে গণ্য করা হবে। commendation তখন পর্যন্ত ছিল একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক কি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থা কার্যকর হতো তার আভাস পাওয়া যায় পারীর কাছে প্রাপ্ত একটি দলিলে (Marculf)। আক্ষরিক অর্থেই রাজার হাত স্পর্শ করে অশ্রিয়প্রার্থী বা antrustio সেবা ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতেন। ঐ সময়ে এ জাতীয় অনুষ্ঠান সার্বজনীন না হওয়াই সম্ভব এবং এর জন্য কোনও পূর্ব নির্ধারিত ছক ছিল না। বিভিন্ন অবস্থা ও পরিবেশের প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই এই অনুষ্ঠানের উপর এসে পড়তো। আর ভাসালের কাছে প্রভু ঠিক কি ধরণের সেবা দাবী করতেন তার আভাসও তুর এর দলিল থেকে পাওয়া যায় না। সম্ভবত গৃহস্থালীর কাজে, অথবা কৃষি উৎপাদনে কিংবা সামরিক প্রয়োজনে আবার ক্ষেত্র বিশেষে এই তিন ধরণের কাজেই তাকে বাবহার করা হতো। অপর পক্ষে লর্ড কিভাবে আশ্রিতের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতেন তারও কোনও নিদিষ্ট নিয়ম ছিল না। সাধারণত গৃহকাজে নিযুক্ত করে বা সামান্য বৃত্তি দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করা হতো, আবার একখণ্ড কৃষিযোগ্য জমি দিয়ে আশ্রিতের ভরণপােষণের ঘটনাও বিরল নয়। বিশেষ করে যে সমাজে কৃষিই ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা এবং সম্পদের উংস সেখানে ভূমিদান বা বন্দোবস্ত করে আশ্রিতের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ভূমিসত্ত্ব সমত জমি দান করার ঘটনা বিরল না হলেও সাশ্রয়প্রার্থ, সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে জমির বন্দোবস্তই হিল সাধারণ রীতি। এই ব্যবস্থানুযায়ী ভূসম্পত্তির মালিক ছোট বা বড় জমি, দীর্ঘকালের জন্য এমনভাবে বন্দোবস্ত করতেন যে অধীনস্থপ্রজা তা ভোগদখল করার অধিকার (real right) লাভ করতেন। রোমান আইন অনুসারে একে বলা হতো ius in re aliena। রোমান শাসনের অন্তিম পর্যায়ে এবং ফ্রাঙ্ক আমলে জমির এ ধরণের বন্দোবস্ত বহুল-প্রচলিত হয়ে উঠেহিল। বিশাল ভূসম্পত্তির (villae) অংশে (mansi) ভূম্যধিকারীগণ স্বয়ং কৃষি কাজ করতেন না, নিদিষ্ট খাজনার বিনিময়ে বা বিনা পারিশ্রমিকে কৃষিকাজ করার শর্তে coloni, বা laeti বা ক্রীতদাসদের হাতে তা তুলে দেওয়া হতো। যাবজ্জীবনের জন্য এই বন্দোবস্ত হলেও কার্যত ত৷ বংশানুক্রমিক হয়ে দাড়াতো। জমির এ জাতীয় বিলিবন্দোবস্ত সর্বাধিক প্রচলিত হলেও এর অসুবিধাও ছিল একাধিক। জমির মূল্য বা মান অনুযায়ী রাজস্ব বা বেগার খাটুনীর পরিমাণ নির্ধারিত হতো এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা দায়বদ্ধ প্রজার পক্ষে অত্যধিক হয়ে উঠতো। তবে সম্পূর্ণ নিষ্কর জমি এবং বাধ্যতামূলক শ্রমদানের শর্তবিহীন জমির বন্দোবস্তও বিরল ছিল না। ক্রমশ প্রজার পক্ষে সুবিধাজনক শর্তাধীন জমির বন্দোবস্ত থেকেই ‘বেনিফিসিয়াম’ (beneficium-benefice বা benefit) শব্দটির উৎপত্তি। মেয়েভিঞ্জীয় আমলের বহু দলিলে এ জাতীয় বিলি বন্দোবস্তের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এই সময়ে এক ধরনের চুক্তি বা প্রিকারিয়ার (precaria) উদ্দেশ্যই ছিল সূবিধাজনক শর্তে অথবা বিনা শর্তে কৃষিযোগ্য ভূমির বন্দোবস্ত করা। এ জাতীয় ব্যবস্থায় জমির উপসত্ত্ব ভোগের অধিকার লাভ করতেন গ্রহীতা। বন্দোবস্তের সময় চুক্তি-সম্বলিত দুটি দলিল তৈরী হতো – দাতা এবং গ্রহীতা প্রজার জন্য। Precuria শব্দটি চুক্তি এবং দলিল দুইই বােঝালেও অনুগৃহীত প্রজার উপসত্ত্ব বােঝাতেই বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রিকারিয়া অনুযায়ী এক বিশেষ ধরণের জমির বন্দোবস্ত চালু হলো যার শর্তানুযায়ী কৃষি উৎপাদনের জন্য উলেখযােগ্য পরিমাণ জমি বিনা বা নামমাত্র রাজস্বের বিনিময়ে যাবজ্জীবনের জন্য জন্য প্রজাকে দেওয়া হতো। এ ধরণের বন্দোবস্তে ভূস্বামীদের রাজী হওয়ার পেছনে অনাবাদী জমিতে কৃষি উৎপাদনে কৃষককে উৎসাহিত করা অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তি-বিশেষকে অনুগৃহীত করার উদ্দেশ্য থাকাও অসম্ভব নয়।

মেরোভিঞ্জীয় আমলে যে এই বিশেষ ধরণের বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় অ্যাল্‌সেস-এর অ্যাডালবার্টের পুত্র এবারহার্ডের ৭৩৫ সালের একটি দলিলে। ম্যারব্যাকের অ্যাবিকে ভূসম্পত্তি দানের অভিপ্রায় ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে বেনিফিসিয়াম হিসেবে তিনি যেসব জমির বন্দোবস্ত করেছিলেন তারও একটি তালিকা দিয়েছেন। অবশ্য এই দৃষ্টান্ত থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না যে ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবস্থাটি ব্যাপক হয়ে উঠেছিল।

ম্যানর হলো বিশাল, স্বয়ংসম্পূর্ণ ভূসম্পত্তি (coloni), অধীনস্থ কৃষক দ্বারা যার মধ্যে কৃষি উৎপাদন পরিচালিত হতো এবং উৎপন্ন শস্যের প্রায় সবটাই ম্যানর প্রভু বা লর্ডের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হতো। এই ম্যানর কিন্তু একান্তই রােমান-গলদেশীয় প্রতিষ্ঠান, যার বীজ ছিল ‘fundus’ অথবা ‘villa-র মধ্যে। জার্মানদের মধ্যে এ জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না বলেই মনে করা হয়, আর ধ্রুপদী অধ্যায়ে রােমান সমাজে কলােনাসদের অবস্থিতি এবং একদা স্বাধীন জার্মান কৃষককুলের প্রায় বাধ্যতামূলক commendation প্রথার মধ্য দিয়ে সামরিক নেতৃবর্গের অধীনস্থ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই ভূমিদাস প্রথার (Serfdom) উৎপত্তি। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের মতো বিচার বিভাগীয় ও শাসন সংক্রান্ত বহু প্রথা প্রতিষ্ঠানই ছিল সঙ্কর (hybird)। বিচার ব্যবস্থায় আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে শাসক ও শাসিতের যৌথ দায়িত্বের ঐতিহ্য এবং লিখিত ও সুবদ্ধ রােমান আইনের প্রভাব সামন্ততন্তাধীন বিচার ব্যবস্থার উপর ছায়াপাত করেছিল। এ ছাড়াও মধ্যযুগীয় সমাজে কিছুটা নির্বাচন সাপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষ জার্মান সমর নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে সামন্ততন্ত্র-নির্ভর রাজতন্ত্রের মধ্যে রােমান সাম্রাজ্যিক, স্বৈরাচারী, পবিত্র শাসকের আদর্শ ওতপ্রােতভাবে মিশে গিয়েছিল।

ক্যারোলিঞ্জীয় শাসনামলে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ

ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে সামন্ততন্ত্রের এই সব অর্ধস্ফুট বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট আকার নিতে শুরু করে। ৮ম শতকের শেষার্ধে ‘ভাসালেজ’ (বিনতিস্বীকার) এবং ‘বেনিফিস’ (ভূমিস্বত্ত্বদান) প্রথা ধীরে ধীরে পরস্পর সংলগ্ন হতে থাকে, আর ৯ম শতকের মধ্যে বেনিফিস অতি দ্রুত অনারের (honor, honour, অর্থাৎ শাসন বিভাগীয় পদ ও পদাধিকার) সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। রাজা কর্তৃক ভূ-সম্পত্তি দান আর শুধুমাত্র বদান্যতা-প্রসূত ‘দান’ হিসেবে বিবেচিত হত না, সেগুলো নির্দিষ্ট কতকগুলো দায়দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে ভাসাল কর্তৃক অর্জিত শর্তাধীন ভূমিস্বত্বে পরিণত হয়। ভ্যাসাল সৃষ্টি এবং ভ্যাসালদের বেনিফিস দানের প্রথা ক্যারোলিঞ্জীয় শাসকবৃন্দ কর্তৃক একটি নীতি হিসেবেই পরিচালিত হতে দেখা যায়। তারা এই প্রথা দ্বারা আপন শক্তি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং ক্যারোলিঞ্জীয় শাসনের পরিধি বৃহত্তর করার আশা পােষণ করতেন। ফলে বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক প্রথা ও বিধি অত্যন্ত

অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তৃতীয় পিপিন দ্বারা সূচিত হলেও শার্লমান এবং লুই দ্য পায়াসের রাজত্বকালে এই প্রবণতা নীতি হিশেবে অনুসৃত হতে আরম্ভ করে। সম্রাট শার্লমানের সময়ে ফ্রাঙ্ক রাজ্যের অসামান্য বিস্তার এবং এই বিপুল ভূখণ্ড শাসনের জন্য যথােপযুক্ত কর্মচারীর অভাব ভ্যাসাল প্রথার প্রচলন দ্বারা মেটাতে উৎসাহিত করেছিল সম্রাট ও তার পরামর্শদাতাদের। তারা আশা করেছিলেন রাজা এবং বিশপ, অ্যাবট ও কাউন্টদের ভ্যাসল ও সহভাসালদের নিয়ে একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তুলে তার সঙ্গে আধাসামরিক ব্যক্তিদের যুক্ত করতে পারলে সংখ্যায় ও দক্ষতায় এবং অস্ত্রশস্ত্রের যথােপযুক্ততায় তা সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিবৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। বিচার বিভাগীয় কাজে কাউন্ট প্রভৃতি কর্মচারীদের সহায়তা করার জন্যও এদের নিয়ােগ করা হতো। বিভিন্ন বিভাগের রাজকর্মচারীদের উপর সম্রাটের আধিপত্য দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যে রাজকীয় ভ্যাসালদের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও শার্লমান কাউন্ট এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের তার ভাসালে পরিণত করে তাদের রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য অটল রাখার প্রয়াসী হয়েছিলেন। ৮৪৩ সালে ভার্দুনের বণ্টনের পরেও ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের খণ্ডিত অংশগুলোতে এই প্রথা চালু রাখার চেষ্টা হয়। প্রধান রাজকর্মচারীদের অধঃস্তনগণও যে প্রথমােক্তদের ভ্যাসালে পরিণত হতেন তার নজির ওয়েস্ট ফ্রান্সিয়ার ঐ সময়ের ইতিহাসে সহজলভ্য। সামাজিক মর্যাদার ইতর বিশেষ সত্ত্বেও সমসাময়িক দলিলপত্রে এদের vassi dominici সম্প্রদায়ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া কাউন্ট, মারগ্রেভ এবং ডিউকগণ কখনো কখনো রাজার কাছ থেকে এমন ‘বেনিফিসে’র দায়িত্ব লাভ করতেন যার অবস্থিতি ছিল তাদেরই শাসনাধীন অঞ্চলের মধ্যে। নবলব্ধ এসব বেনিফিসের সঙ্গে তাদের পদগুলোকেও (honor) ‘বেনিফিস’ হিসেবে মনে করার একটা প্রবণতা এদের মধ্যে দেখা দিতো। বলাবাহুল্য, রাজাও এ জাতীয় অপব্যাখ্যার কোনও বিরােধিতা করতেন না। গ্যানশফ মনে করেন যে ঐসব উচ্চপদে কর্মচারীদের নিযুক্ত করার সময় রাজা স্বয়ং তার কর্তৃত্বের অংশ হস্তান্তরিত করার প্রতীক হিসেবে কোনও বস্তু তাদের দান করতেন এবং এই অনুষ্ঠান লর্ড কর্তৃক ভ্যাসলিকে বেনিফিস দানের অনুরূপ ছিল। সেন্ট বার্টিনের কাহিনীতে (Annals of St Bertin) হিন্‌কার (Hincar) ‘honor’ অর্থে প্রদেয় ভূ-সম্পত্তি ও পদ (কাউন্ট বা বিশপের) দুই-ই উল্লেখ করেছেন। সমস্ত ৯ম শতক ধরে বেসামরিক পদগুলো এ জাতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমম্বিত (beneficial character) হতে থাকে। সাধারণ ভাসাল যেমন তাদের বেনিফিসগুলোকে বংশানুক্রমিক করার চেষ্টা করতেন তেমনি প্রয়াস দেখা যেতো ‘honor’ বা উচ্চপদগুলির ক্ষেত্রেও। ৮৭৭ সালের মধ্যেই ‘honour’ এবং ‘beneficium’-কে বৈধানিক স্বীকৃতি ছাড়াই অভিন্ন ও সমার্থক করার চেষ্টা প্রায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছিল। এই প্রক্রিয়া পূর্ব ফ্রান্সিয়াতে দ্রুততর এবং ব্যাপকতর হয়েছিল বলে মনে হয়। ৯ম শতকে শুধুমাত্র অযাজক গণ্যমান্যগণই যে তাদের পদগুলোকে রাজশক্তির নিকট প্রাপ্ত ‘বেনিফিসে’ রূপান্তরিত করেছিলেন তাই নয়, লুই দ্য পায়াসের সময় থেকে বিশপ এবং অ্যাবটগণও (যারা তখনও রাজকর্মচারীরূপেই বিবেচিত হতেন) রাজসমীপে বিধিসম্মতভাবে নতি স্বীকার করতেন এবং তাদের ‘episcopatus’ অথবা ‘abbatia’ বেনিফিস রূপেই পরিগণিত করা হতো। ট্রয়সের (Troyes) বিশপ প্রডিনাসের (Prudinus) একটি বিবরণ থেকে জানা যায় ৮৩৭ সালে সেইন নদী ও ফ্রিসিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সমস্ত বিশপ তরুণ রাজা চার্লস দ্য বল্ডের শরণাগত হয়ে তার প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করার জন্য সম্রাট কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলেন। এর থেকে স্পষ্টই বােঝা যায় যে ঐ সময়ে বিশপ, অ্যাবট এবং কাউন্ট, মারগ্রেভ প্রভৃতি অন্যান্য রাজকর্মচারীর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হতো না। এই প্রথা যে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে অনুসৃত হতো বা বিশপ ও অ্যাবটগণ কর্তৃক গৃহীত শপথ বাক্য অন্যান্যদের থেকে যে পৃথক ছিল না সে বিষয়ে বােধহয় সন্দেহের অবকাশ নেই।

কিন্তু ক্যারােলিঞ্জীয় শাসকগণ যে আশায় এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন তা সিদ্ধ হয়নি। ভ্যাসাল প্রথাকে সার্বজনীন করে তাকে শাসন-যন্ত্রের অঙ্গীভূত করা এবং অকাতরে বেনিফিস দানের ফলে রাজশক্তি দ্রুত হীনবল হতে থাকে। সম্রাট শার্লমানের শাসনের অবসানকালে এ তথ্য প্রকট হয়ে গিয়েছিল যে, যে বন্ধন (bona) লর্ড ও ভ্যাসালকে সংযুক্ত করতো তা প্রত্যক্ষ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অবিলম্বে কার্যকর হওয়ায় রাজানুগত্যের অনুভূতির থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রাজানুগত্য ও প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কর্তব্যের মধ্যে সংঘাত বাধলে ভাসালদের উধ্বতন প্রভুর পক্ষ বেছে নিতে দেরী হচ্ছে না। ৮১১ সালে সামরিক প্রয়োজনে আহুত একটি সম্মেলনে এ তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল যে রাজকীয় বাহিনীতে বহু প্রজা যোগ দেয়নি কারণ তাদের প্রভুদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হতে আহ্বান জানানো হয়নি। উর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং তাকে অনুসরণ করাই তারা শ্রেয় বলে বিচার করছে। এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ, যারা রাজার প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিরূপে গণ্য হতেন তারাও রাজার বিপক্ষীয় দলের কাছ থেকে আরও বেশি লাভজনক বেনিফিস পাবার লোভে নিজেদের কর্তব্য ও দায়দায়িত্ব অগ্রাহ্য করতেন। ভ্যাসালপ্রথার সঙ্গে জড়িত প্রাচীন বিধিনিষেধগুলো এভাবেই পরিবর্তিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবস্থায় অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় আর বেনিফিসের অস্তিত্ব রাজশক্তির বিকাশের এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পথরোধ করতে শুরু করে। ৯ম শতকে, বিশেষ করে পশ্চিম ফ্রান্সিয়াতে বেনিফিস ভােগের ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিকতা অধস্তন কর্মচারীদের ওপর রাজ্যর অধিকার ক্ষুন্ন করতে থাকে এবং এ জাতীয় বিপজ্জনক ধারণারও সৃষ্টি হয় যে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের রাজার প্রতি কর্তব্য পালন তাদের প্রতি রাজার যথাযথ কর্তব্য পালনের প্রতি নির্ভরশীল। তাছাড়া ভ্যাজাল প্রথা অতি ব্যাপক হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের প্রয়ােজন সাধনের জন্য প্রায় কোনও মুক্তমানুষকেই (freeman) পাওয়া যেতো না, যদিও ব্যক্তি বিশেষের ভাসালে পরিণত হওয়া তার রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের অন্তরায় সৃষ্টি করার কথা নয়। ভ্যাসলগণ উধ্বতন প্রভুর সামরিক বাহিনীতে যােগ দিতেন, এবং বিচারালয়ে ভ্যাসলের পক্ষেই প্রভুকে অবতীর্ণ হতে দেখা যেতো। এ জাতীয় প্রথা বন্ধ করার ব্যাপারে রাজশক্তির অসহায়তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ৮৫৩ সালে একটি অনুশাসনে (Capitulary of Servais) যাতে রাজা চার্লস দ্য বল্ড দস্যুতস্করদের দমন করার জন্য মিসিদের (Missi) আদেশ দিয়ে ঘােষণা করেছেন, যদি কেউ এই দুবৃত্তদের আশ্রয় দেয় তবে আশ্রয়দাতার প্রভুর কর্তব্য হলে তার ভ্যাসলকে রাজাদেশ লঙ্ঘন করার অপরাধের শাস্তির জন্য রাজ সমীপে হাজির করা। অনুশাসনটিতে এই সত্যই প্রকারান্তরে পরিস্ফুট হয়েছিল যে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার জন্য রাজাকেও ভূমীপ্রভুর শরণাপন্ন হতে হতো। ৯ম শতকের মধ্যেই ভ্যাসালগণ এভাবেই কেন্দ্রীয় শাসনের আওতার বাইরে চলে গিয়েছিলেন। অবশ্য রাজশক্তির এই অভাবনীয় অধঃপতনের জন্য ‘ভ্যাসালেজ’ প্রথার কেন্দ্রাতিগ প্রবণতাকেই এককভাবে দায়ী করা অনুচিত। রাজশক্তির একটা উল্লেখযােগ্য অংশ ৯ম ও ১০ম শতকে ফ্রান্স, ইতালী ও জার্মানীর ডিউকদের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার জন্য সামন্ততন্ত্র ছাড়া অন্যান্য বহুবিধ কারণ দায়ী ছিল। তবে এসব সুবিশাল ভূসম্পত্তিগুলো (principalities ও duchies) যে সামন্ততন্ত্র ও ভ্যাসাল প্রথার সহায়তাতেই গড়ে উঠেছিল তাও তর্কাতীত।

এই প্রসঙ্গে রাজার প্রত্যক্ষ অধীনস্থ ভাসালদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। রাজকীয় ভ্যাসালগণ ‘honores’ দ্বারা ভূষিত না হলেও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বেনিফিস ভােগ করতেন এবং এরা রাজানুগত হওয়ায় দুঃসময়ে রাজা এদের উপরেই নির্ভর করতে বাধ্য হতেন। অবশ্য ১০ম শতকের শুরুতেই এদেরও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। সমস্ত দেশে অরাজকতা ও কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযােগ কাউন্ট, মারগ্রেভ এবং ডিউকগণ এদেরও স্বীয় প্রভাবাধীনে আনতে সমর্থ হন। ৯ম শতকের শেষে অথবা ১০মের শুরুতে ওভারেনে (Auvergne) গেরুল্ড (Geruld of Aurillac) রাজানুগত থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু অ্যাঁকুতার উইলিয়ম দ্য পায়াসের আগ্রহাতিশয্যে শেষ পর্যন্ত স্বয়ং রাজার বশংবদ থাকতে সমর্থ হলেও নিজ ভাগিনেয় রেনল্ডকে সানুচর উইলিয়মের ভ্যালে পরিণত করেন। জার্মানীতে এই সময়েই রাজার বশবর্তী ভ্যাসালগণই স্যাক্সনী, ফ্রাঙ্কোনিয়া, সােয়াবিয়া ও ব্যাভেরিয়ার পরাক্রান্ত ডিউকদের বিরুদ্ধে রাজশক্তির প্রধান সহায়রূপে বিবেচিত হতেন। ৯৩৬ সালে প্রথম অটো রাজপদে বৃত হলে রাজশক্তির পুনরুদ্ধারের আশায় তিনি এই সব প্রতাপান্বিত ডিউকদের রাজকীয় ভাসালে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। ঐতিহাসিক উইডুকাইও লিখেছেন যে এদের অনেকে রাজার প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ নিয়েছিলেন এবং রাজশত্রুর বিরুদ্ধাচরণের প্রতিশ্রুতিও রাজাকে দান করেছিলেন। এই সময়ে ভ্যাসাল প্রথার কুশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়ােগ দ্বারা রাজশক্তিকে সম্পূর্ণ নিঃস্বতা ও শক্তিহীনতার অভিশাপ থেকে যে রক্ষা করা সম্ভব ছিল সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

১০ম থেকে ১২শ শতকের সামন্ততন্ত্রের ধ্রুপদী যুগ

১০ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যেই সামন্ততন্ত্রকে ব্যাপকতম রূপ পরিগ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেছেন ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ, আর গ্যানশফ্‌ও মােটামুটি এই কাল-সীমাকেই সামন্ততন্ত্রের ‘ক্লাসিকাল এজ’ রূপে বিবেচনা করেন। এই অধ্যায়ে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের ওপর যেসব রাজ্য গড়ে উঠেছিল শুধু সেখানেই নয়, ইউরোপের অন্যত্রও সামন্ততন্ত্রের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা বাস্তব ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। ১০৬৬ সালে নরমাঁদির (Normandy) ডিউক উইলিয়ম কর্তৃক ইংল্যান্ড বিজিত হবার ফলে ঐ দ্বীপপুঞ্জ এবং স্পেন খ্রিস্টান জাতিগুলো কর্তৃক আংশিকভাবে পুনরাধিকৃত হলে সেখানে সামন্ততান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার পত্তন হয়। জার্মান ও তার পার্শ্বস্থ স্লাভ অধ্যুষিত দেশগুলিতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে যদিও ঐ অঞ্চলের ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে সামন্ততন্ত্রকে কিছুটা পরিবর্তিতরূপে দেখা গিয়েছিল। আর ক্রুসেডারদের মাধ্যমে সুদূর জেরুসালেম রাজ্যে, সিরিয়ার খ্রীষ্টান অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে, চতুর্থ ক্রুসেডের ফলে লাতিন জাতি অধিকৃত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষে (যদিও এ অধিকার ছিল স্বল্পায়ু) ও গ্রীসের লাতিন প্রিন্সিপ্যালিটিগুলোতে সামন্ততন্ত্র প্রবর্তিত হয়। বলা বাহুল্য পূর্বাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সামন্ততন্ত্র ছিল ভিন্নধর্মী। ক্রুসেডের বিজিত দেশগুলোতে প্রবর্তিত সামন্ততন্ত্রকে ‘colonial’ বা ঔপনিবেশিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরস্পর বিচ্ছিন্ন এসব এলাকায় সামন্ততান্ত্রিক বিধানাবলী এমন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট একটা আকৃতি পেয়েছিল যা অন্যত্র দুর্লভ বলেই মনে হয়। অ্যাসাইজেস অফ জেরুসালেম (Assizes of Jerusalem) থেকে জানা যায় যে রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত হওয়ার জন্যই হয়তো এসব অঞ্চলে ভ্যাসলিদের অধিকারগুলো অনেক বেশি গুরুত্ব লাভে সমর্থ হয়েছিল। বার্সেলােনা প্রদেশ (স্প্যানিশ মার্চ রূপে যা ক্যারোলিঞ্জীয় আমল থেকে ১২০৮ সাল পর্যন্ত ফরাসীরাজের অধিকারভুক্ত বলে মনে করা হতো) ছাড়া স্পেনের অন্যান্য অংশে সামন্ততান্ত্রিক বিধি বিধানগুলোকে ভিন্ন চরিত্র গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল। ইতালী ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হলেও মধ্যযুগের ইতালীর বিভিন্ন রাজ্য ও প্রিন্সিপ্যালিটিগুলোতে বিচিত্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাবে এবং উত্তর ও মধ্য ইতালীতে এবং পােপ-শাসিত অঞ্চলে সামন্ততন্ত্রের চরিত্র ছিল ভিন্ন। সিসিলির নর্মান রাজ্যেও সামন্ততন্ত্রের চেহারা ছিল আলাদা। কিন্তু ফ্রান্স, বার্গাণ্ডি-আর্লে রাজ্যে, জার্মানীর পশ্চিমাঞ্চলে এবং দক্ষিণ জার্মানীতে ১০ম ও ১১শ শতকে সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল প্রায় অভিন্ন। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় সামন্ততন্ত্র এমনই সার্বিক হয়ে উঠেছিল যে কোনও স্বাধীন প্রজা (যার সংগ্রহে একটি অশ্ব ছিল, সমাজে যার কিছু মান মর্যাদা ছিল এবং যুদ্ধ-বিদ্যাকে যে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল) কোনও পরাক্রান্ত ভূস্বামীর ভাসালে পরিণত হতে দ্বিধা করতো না। তার নিজস্ব কিছু জমি থাকা সত্ত্বেও লর্ডের কাছ থেকে ‘ফিফ’ হিসেবে কিছু ভূ-সম্পত্তি তার প্রাপ্য হতো। অঞ্চল বিশেষে সামান্য কিছু হেরফের হলেও এটাই হয়ে উঠেছিল সাধারণ প্রথা। যে সব এলাকায় ম্যানরভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যেমন ফ্রিসিয়া ও স্যাক্সনী – সেখানে অবশ্য ভ্যাসাল প্রথা অতি সীমাবদ্ধ ছিল। ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সম্রাট চতুর্থ হেনরীর বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল তাকে ম্যানর প্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা ও সমাজের উপরের স্তরে সামন্ততন্ত্রের প্রসারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলে মনে করা হয়।

ফ্রান্সের নরমাঁদিতে সামন্ততন্ত্র যেসব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে সেগুলোই চালু হয়। নরমাঁদি ছিল ফ্রান্সের সেই বিরল এলাকাগুলোর অন্যতম যেখানে ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেই ঐতিহ্যের কিছু প্রভাব ইংল্যান্ডে বাহিত হয়েছিল উইলিয়ামের দ্বারা। তাছাড়া সাগরপারে সামাজতন্ত্র পৌঁছেছিল এক ভ্যাসাল বাহিনীর নেতার দ্বারা। এই দুই কারণে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে সামন্ততান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। নর্মান বিজয়ের পর ইংল্যান্ডে ‘অ্যালেডিয়াল’ (allodial) বা নিঃশর্ত ও নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, এবং কৃষিযােগ্য সমস্ত ভূমিই প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে রাজশক্তির অধীনে আনা হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতাই বিজেতা উইলিয়ামকে তার নতুন রাজ্যে সামন্ততন্ত্রকে রাজশক্তির সহায়করূপে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল।

উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে স্থান ও পরিবেশের পার্থক্যের জন্য সামন্ততান্ত্রিক বিধিবিধানে বহু বৈচিত্র সত্ত্বেও প্রায় সমগ্র মহাদেশে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবস্থার মধ্যে এমন কতকগুলো সাধারণ নিয়ম সক্রিয় ছিল যেগুলো সর্বত্র লর্ড ও ভাসালের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতো। ফিফগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থাও এ কারণে অবিঘ্নিত ছিল। ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে পশ্চিম ইউরােপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্ভরযােগ্য বিবরণ পাওয়া যায় রাজানুশাসনগুলো (royal capitularies) থেকে, কিন্তু ‘ক্ল্যাসিকাল এজ’ বা ধ্রুপদী যুগের সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে তথ্যের জন্য শুধু রাজকীয় আইনাবলির ওপর নির্ভর করলে চলে না। অবশ্য এই বিষয়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্ৰম কাউন্ট দ্বিতীয় উইলিয়াম কর্তৃক প্রবতিত প্রভাঁসের For calquier এর জন্য বিধানাবলি, ‘দ্য অ্যাসাইজ অফ কাউন্ট জিওফ্রয়’, (ব্রিটানী সম্পর্কে প্রযােজ্য) এবং এনোর (Hainault) জন্য প্রবতিত Charte feodale ( ১২০০ সাল)। এ ছাড়া বিশেষ বিশেষ সনদ, বর্ণনাত্মক রচনা এবং আইন শাস্ত্রের ওপর ভাষ্য ও মৌলিক রচনাগুলোও (treatises) এই অধ্যায়ের সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে আলােকপাত করে।

সামন্ততন্ত্রে ভূ-সম্পত্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সত্ত্বেও এই কাঠামােতে একমাত্র মানবিক উপাদান হিসেবে ভ্যাসাল প্রথাই বিশেষ মনােযােগ দাবি করে। বেনিফিস ছাড়াও এ সময়ে অসংখ্য ভ্যাসালের সৃষ্টির কথা জানা যায় এবং ভাসালের সংজ্ঞা ক্যারােলিঞ্জীয় যুগের মতো থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চলে তা ভিন্নভিন্ন নামে (যেমন vassus, vassllus, homo, fidelis, miles ইত্যাদি) পরিচিত ছিল। ১১০৭ সালে সম্রাট পঞ্চম হেনরী ফ্লাঁদর বা ফ্লেন্ডার্সের কাউন্ট সম্পর্কে miles শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন, পরে অবশ্য শব্দটি অপ্রচলিত হয়ে যায়। লর্ড বােঝাতে সাধারণত senior শব্দটি ব্যবহৃত হতো, dominus সুপ্রচলিত না। ‘Seigner’ প্রথাসিদ্ধ হলেও suzerain শব্দের ব্যবহার দেরিতে হলেও অঞ্চল বিশেষে বেশি চালু হয়। জার্মান ভাষায় Herr শব্দটিও ব্যবহৃত হবার কথা জানা যায়।

কমেন্ডেশন (Commendation) অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই লর্ড এবং ভাসালের সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই সময় উভয় পক্ষের দায়দায়িত্ব এবং অবশ্য পালনীর কর্তব্য নির্ধারণ করে প্রণীত চুক্তিগুলির অসংখ্য নিদর্শন সহজলভ্য। নরমাঁদির শাসক উইলিয়াম লঙ্গসউড কিভাবে ৯২৭ সালে চার্লস দ্য সিম্পল এর ভ্যাসলে পরিণত হয়েছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন ঐতিহাসিক Richer। ১০০২ সালে নব-অভিষিক্ত রাজা দ্বিতীয় হেনরীর জার্মানীর পূর্বাঞ্চলে আগমণের পর যারা পূর্ববর্তী রাজার বশংবদ ছিলেন তারা কেমন করে নতুন রাজার হাতে নিজেদের হাত রেখে তার আনুগত্য স্বীকার করে তাকে সেবা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করলেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় মাসিবার্গের থিয়েটমারের লেখায় (Thietmar of Merseburg)। ১১২৭ সালে কাউন্ট ক্লিটোর কর গ্রহণ ও চুম্বন দ্বারা ভ্যাসালগণ তার প্রতি সর্বাবস্থায় বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করেন।

হোমেজ (Homage, Fr. Hommage ; Lat. Hominium, Ger. Maunschaft, Dutch Mauchap) বা বিনতি প্রদর্শন অনুষ্ঠানটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ভ্যাসালগণ নিরস্ত্র ও শিরস্ত্রান বিহীন অবস্থায় নতজানু হয়ে প্রভুর কর নিজেদের করদ্বয়ের মধ্যে গ্রহণ করে আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা ঘােষণা করতেন। সাধারণত তারা “Sire, je devien Vostre hom” বা “I become your man” এই বাক্যটি আবৃত্তি করতেন, আর প্রভু এর উত্তরে বলতেন, “Je vos recoif et pran a home” বা “I accept you”। অবশ্য এই ঘােষণার থেকে করা গ্রহণ করার প্রথাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা মধ্যযুগে প্রাচীনকালের মতােই শারীরিক ভঙ্গিমার মূল্য ও ব্যঞ্জনা মুখের কথার থেকে অনেক বেশি ছিল। এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আত্মসমর্পণ ও শরণাগতকে আশ্রয় ও আশ্বাস দানের প্রতিশ্রুতি ঘােষণা। প্রভুর কর নিজের হাত দুটিতে গ্রহণ করে সর্ব সমক্ষে ভ্যাসাল তার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের অভিপ্রায় জানাতেন আর ভ্যাসালের হাত গ্রহণ করে প্রভুও শারণাগতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করার সম্মতি জানাতেন।

হােমেজ যেহেতু স্বাধীন প্রজার আত্মসমর্পনের প্রতীক সেজন্য জার্মানীতে ১২শ শতকের আগে ministerialis বা পরাধীন নাইটগণ এই অনুষ্ঠান করার অধিকারী ছিলেন না। অবশ্য পরবর্তীকালে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির পর তাদেরও বিনতি স্বীকার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যেতাে। আর এই অনুষ্ঠানের পর ভাসালের আর স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত সত্তা বজায় রাখা সম্ভব হতো না বলে হোমেজ অনুষ্ঠানের আয়োজন ভ্যাসালদের স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে করতে হতো। কিন্তু ক্ষেত্র ও কাল বিশেষে প্রজাদের ওপর প্রভুর কর্তৃত্ব খুব বেশি হলে, ভ্যাসালদের এই তানুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটতো। অরডেরিকা ভিটালিসের (Ordericus Vitalis) কাছ থেকে জানা যায় যে ১১০৫ সালে নরমাঁদির ডিউক রবার্ট তার ভ্যাসাল এভ্রেয়ুক্সের (Evreux) কাউন্টকে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম হেনরীর কাছে সমর্পণ করেছেন যেমন করে অশ্ব বা বৃষ হস্তান্তরিত হয়।

বিনতি জ্ঞাপন (homage) অনুষ্ঠানের পর উচ্চারিত হতো শপথবাক্য (Fealty, Lat. Fides, Ger. Treue, Fr. Féauté অথবা foi)। দণ্ডায়মান অবস্থায় ভাসাল ধর্মগ্রন্থ বা পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্পর্শ করে এই শপথ নিতেন। প্রভুর প্রতি আজীবন বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার গ্রহণ সমাপ্ত হতো শপথ বাক্য উচ্চারণের দ্বারা। ফ্লাঁদরে এই প্রথা যে ১২শ শতক পর্যন্ত চালু ছিল, তার প্রমাণ মেলে ইংল্যান্ডরাজ প্রথম হেনরীর উদ্দেশ্যে কাউন্ট দ্বিতীয় রবার্টের আনুগত্য স্বীকার ও শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ১০৪১ সালে জার্মানীর সম্রাট তৃতীয় হেনরীর প্রতি বােহেমিয়ার ডিউক প্রথম ব্রিটিশ্লাভের আনুগত্য-স্বীকারোক্তি। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তিনি প্রভুর প্রতি ভাসালের যথাবিহিত বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করে প্রতিজ্ঞা করবেন যে রাজার সুহৃদদের প্রতি বন্ধুত্ব ও বৈরীদের প্রতি বৈরিতা প্রদর্শনেও তিনি অটল থাকবেন। ১২৩৬ সালে জনৈক ভাসাল গৃহীত একটি শপথ বাক্য পাঠ করলে দেখা যায় যে তা ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ এবং পবিত্র-চিহ্ন স্পর্শ করে কায়মনােবাক্যে প্রভুর প্রতি বশংবদ থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার দ্বিধাহীন ঘােষণা। সাধারণত এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতো প্রভূর বাসগৃহে বা “ফিফ’-এর প্রধান কার্যালয়ে, কখনো কখনো বিশাল ফিফের অধিকারীগণ প্রভূর ভূ-সম্পত্তি ও নিজস্ব জমির সীমানা নির্ধারক কোনও স্থানে এর আয়ােজন করতেন। যাজক ভূম্যাধিকারীর ভাসালগণও এভাবে শপথ নিতেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হতো চুম্বন দানের মধ্য দিয়ে। হস্তস্পর্শের মতো চুম্বন দানও দৃশ্যমান বলে তা দর্শকদের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করতো এবং এর দ্বারা সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে আন্তরিকতার সুরটুকু পরিস্ফুট হয়ে উঠতাে। ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে এই অনুষ্ঠানে উচ্চারিত শপথ বাক্যের বহু শব্দের উৎস বিজয়ী (জার্মান) ও বিজিত (রােমান)-দের ভাষার মধ্যে নিহিত আছে যদিও কোনও কোনও শব্দের (যেমন homage) সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়ের প্রয়ােজন অনুসারে। এই তথ্য দ্বারা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপর বিগতকালের সংখ্যাতীত রীতিনীতির প্রভাব যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি তা যে একান্তই যুগ প্রয়ােজনের উত্তর হিসেবে সৃষ্ট হয়েছিল তাও স্পষ্ট করে দেয়।

ফ্রান্স, জার্মানী এবং ইংল্যান্ডে বিনতিজ্ঞাপন ও আনুগত্য স্বীকার গৃহী এবং যাজক – উভয় শ্রেণীর ভাসালের পক্ষে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হলেও ১২শ শতকে চার্চে সংস্কার আন্দোলনের ফলে এই অনুষ্ঠান ক্রমশ যাজক ভ্যাসালগণের ‘ইনভেস্টিচার’ এর সময় আর অপরিহার্য থাকেনি। এমন কি বার্গাণ্ডি-আরলে অঞ্চলে ১৩শ শতকে সাধারণ ভাসালদের ক্ষেত্রেও হোমেজ (homage) অনুষ্ঠান বিনতিজ্ঞাপন ছাড়া শুধু বিশ্বস্ততার শপথ গ্রহণই প্রথা হয়ে ওঠে। হয়তো মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের থেকে সম্পত্তির মূল্য ইত্যাদি অধিকতর গুরুত্ব পাওয়ার ফলেই এই সব প্রথা সংক্ষিপ্ত হতে আরম্ভ করে। প্রভাঁস, লােম্বার্ডি প্রভৃতি স্থানে ১২শ শতকে উর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণই ভ্যাসালগণ যথেষ্ট বলে মনে করতেন। তবে পােপের রাজ্যে, সিসিলিতে এবং ফ্রান্সের নরমাঁদিতে হােমেজ প্রথার আয়ু ছিল দীর্ঘতর।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ এই আনুগত্য স্বীকার প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ছিল মৌখিক, তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত হলে বা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রয়োজন থাকলে লিখিত দলিল তৈরী হতো। উদাহরণস্বরূপ ১১০১ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম হেনরী ও ফ্লাঁদরের কাউন্টের মধ্যে এবং লিজ এর বিশপ ও এনাল (Iainauilt) কাউন্টেস রিচিল্ডার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দলিল রচিত হয়েছিল। এ জাতীয় বিশেষ দলিল ছাড়াও এমন বহু লিখিত চুক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে ভ্যাসাল লিপিবদ্ধ করেছেন যে, তিনি কোন বিশেষ উর্ধ্বতন প্রভুর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ আর অঙ্গীকার পালনে অক্ষম হলে কি শান্তি তার প্রাপ্য। ১২শ শতকের শেষে এবং ১৩শ শতকে ফরাসীরাজ তার কিছু ভ্যাসালকে লিখিত দলিলের বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে যেতেন এবং রাজনৈতিক স্বার্থে সেগুলো ব্যবহার করতেন।

বিনতি স্বীকার ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরই ভ্যাসলের উপর উর্ধ্বতন প্রভুর প্রত্যক্ষ এবং তাৎক্ষণিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো। অবশ্য আইনত এই অধিকার অবাধ বা নিরঙ্কুশ ছিল না। ভ্যাসালের স্বাধীন সত্ত্বা বিনষ্ট হয় অথবা তার রাজানুগত্য বিঘ্নিত হয় এমন কিছু করা লর্ডের পক্ষে অবৈধ ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই বৈধানিক নিষেধ সম্মানিত হতো না, বিশেষ করে ‘বেনিফিস’ পান নি এমন ভ্যাসালদের উপরে অথবা প্রচণ্ড পরাক্রান্ত ভূ-স্বামীদের পক্ষে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়ােগই রীতি হয়ে উঠেছিল। ভ্যাসলের আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিভিন্নভাবে সম্মানপ্রদর্শণ যেমন প্রভুর অশ্বারােহনের সময় রেকাব ধরা, বিশেষ বিশেষ স্থানে পার্শ্বচর রূপে প্রভুকে  সঙ্গদান করা আবশ্যিক বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এ ছাড়াও যে সংখ্যাতীত উপায়ে উর্ধ্বতন প্রভু ভ্যাসালের উপর অধিকার প্রয়ােগ করতেন তা উপলব্ধি করা যায় ফ্লাঁদরের কাউন্টের ওপর তার উর্ধ্বতন প্রভু ইংলণ্ডেশ্বরের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপকতা বােঝাবার জন্য ব্যবহৃত বাক্যটি – ‘soon he became his’ থেকে।

দ্বিপাক্ষিক শর্তাধীনেই হতো ভ্যাসাল পদের সৃষ্টি এবং উর্ধ্বতন প্রভু ও ভ্যাসাল উভয়ের যথাবিহিত দায়দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সক্রিয় থাকতো এই প্রথা। ১০২০ সালে শার্ত্রের (Charteres) বিশপ ফুলবার্ট অ্যাকুতাঁর ডিউক পঞ্চম উইলিয়ামকে লেখা এক পত্রে ভ্যাসালপদ সৃষ্টির ফ্লে যে সমস্ত দায়দায়িত্ব সৃষ্টি হতো তার এক বিশ্লেষিত বিবরণ দিয়েছেন। তার মতে ভ্যাসালদের দুটি দায়িত্ব সম্পর্কে সদা সচেতন থাকা কর্তব্য – নিরাপত্তা রক্ষা করা, এবং বিশ্বাসী, সৎ ও সহজলভ্য হওয়ে সেবার মনোবৃত্তি সজাগ রাখা। অর্থাৎ ভ্যাসালের কর্তব্য প্রভুর শারীরিক নিরাপত্তা, তার বিষয় আশয় রক্ষা করা, দুর্গ সম্পকিত তথ্য সংগোপন রাখা, বিচারকার্য সম্পকিত অধিকার রক্ষায় প্রভুকে সাহায্য করা, তার সম্পত্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ও নিজেকে উর্ধ্বতন প্রভূর সেবায় সদা সর্বদা নিয়ােজিত রাখা। শুধু ক্ষতির হাত থেকে রক্ষাই নয় সর্বপ্রকারে তার উপকার করাও ভাসালের কর্তব্য। অনুরূপ ভাবে উর্ধ্বতুন প্রভুও তার ভ্যাসালের প্রতি এ জাতীয় মনোভাব প্রদর্শন করবেন এবং কর্তব্য পালনে উদাসীন থাকবেন না – এটাই সকলে আশা করতো। শার্ত্রের ফুলবার্ট এবং ১৩শ শতকের খ্যাতনামা আইনজ্ঞ ফিলিপ দ্য রেমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সাধারণভাবে অঙ্গীকার পালন ছাড়াও ঊর্ধ্বতন প্রভুকে কতকগুলি নিদিষ্ট দায়িত্ব বহন করতে হতো। ভ্যাসালের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা ও তার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা ছিল তার প্রাথমিক কর্তব্য। ব্র্যাকটন নির্দ্বিধায় লিখেছেন যে সর্বপ্রকার শত্রুর হাত থেকে শরণাগতকে রক্ষা করা এবং তার জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করা ‘হোমেজ’ অনুষ্ঠানের তাৎপর্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রয়োজন হলে উর্ধ্বতন প্রভুকে সামরিক সাহায্য দিয়েও ভ্যাসালের স্বার্থ রক্ষা করতে হতো। ১০৭১ সালে রবার্ট দ্য ফ্রিসিয়নের হাত থেকে ফ্লাঁদরের কাউন্টেস রিচিল্ডা ও তার পুত্র তৃতীয় আর্নুল্‌ফকে রক্ষার জন্য তাদের উর্ধ্বতন প্রভু ফরাসীরাজ প্রথম ফ্রান্সিসের সামরিক সাহায্য প্রেরণ একটি সুবিদিত ঘটনা। যে কোনও বিচারালয়ে ভাসালের পক্ষ অবলম্বন ও প্রভুর পক্ষে আবশ্যিক বলে মনে করা হতো। তাছাড়া ভাসালকে সর্বাবস্থায় সুপরামর্শ দান ও তার প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শন শুধুই উধ্বতন প্রভুর মানবিক কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো না, এর মধ্যে বাধ্যবাধকতার অনুচ্চারিত সুরটি অগ্রাহ্য করা যায় না। আর কোনও ভ্যাসালকে ফিফ দান করার অলিখিত শর্তই ছিল বেহাত হয়ে যাওয়া থেকে তাকে রক্ষা করা।

ভ্যাসালকে নিজ রাজসভায় অথবা পরিবারে বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত ব্যাখা অথবা তাকে ‘ফিফ’ দান করা – এই দ্বিবিধ উপায়েই উর্ধ্বতন প্রভু ভরণপােষণের (maintenance) দায়িত্ব পালন করতেন। কখনাে কখনো তাকে এলড (allod নিষ্কর জমি) দানেও উপকৃত করা হতো। আবার বহু ক্ষেত্রে ভ্যাসালকে ফিফ দানে অস্বীকৃত হতেন ভূস্বামী। Beneficed Vassal-এর সঙ্গে ‘domestic vassal’-এর মৌলিক পার্থক্য জার্মানী, ফ্রান্স এবং ইংলণ্ডে অতি স্পষ্ট ছিল। অবশ্য ‘ফিফ’ লাভের জন্য আগ্রহ সর্বদেশের ভ্যাসালদের মধ্যেই তীব্র থাকাই স্বাভাবিক। ক্ষেত্র বিশেষে অনেকে ‘বেনিফিস’ ছাড়াই ভাসাল হতে স্বীকৃত হতেন এবং কয়েক বছর বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেওয়ার পর ফিফ লাভের সৌভাগ্য তাদের হতাে। আবার শুধুমাত্র ফিফ দান করেই ঊর্ধ্বতন প্রভুর কর্তব্য শেষ হতো না। কোনও অঞ্চলে ভ্যাসালকে বাৎসরিক পােষাকদানও প্রথা হয়ে গিয়েছিল। লিজ-এর বিশপ প্রতি বছর খ্রীস্ট জন্মােৎসবের সময় এনোর (Hainault) কাউন্ট ও তার তিন প্রধান জামাতাকে পরিচ্ছদ দানে আপ্যায়িত করতেন বলে জানা যায়।

ফুলবার্ট তার পত্রে দুটি শব্দ – অক্সিলিয়াম (auxilium) এবং কনসিলিয়াম (concilium) ব্যবহার করেছেন। সামন্ততন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের যুগে অক্সিলিয়াম শব্দটির দ্বারা সামরিক সাহায্যদানই বােঝাতো। কিন্তু ইংল্যান্ডে অক্সিলিয়াম শব্দটি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হতো আর সামরিক সাহায্যে প্রসঙ্গে সেখানে সারভিটাম মিলিটিস (servitum militis) বা মিলিটারে সারভিটিয়াম (militare servitium) শব্দগুলো প্রচলিত ছিল। অবশ্য এই যুগে সামরিক সাহায্যের প্রশ্নটিই ভাসালেজ প্রথার পত্তনে মূল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তবে এই সাহায্যের প্রকৃতি সর্বত্র এক রকম ছিল না। কোথাও ভ্যাসালকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের পুরো দায়িত্বই বহন করতে হতো, কোথাওবা আংশিকভাবে বহন করতে হতো। আর ক্ষুদ্র ফিফের মলিকদের (সংখ্যায় যারা ছিলেন অসংখ্য) কাছ থেকে এ জাতীয় সাহায্যের প্রত্যাশা করা হতো না। তবে এদের অনেকেই উর্ধ্বতন প্রভুর ব্যক্তিগত সেবায় নিযুক্ত থাকতেন। অনেক সময় শর্ত অনুযায়ী ভ্যাসালকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নাইট (knight) সহ লর্ডের সাহায্যে ব্রতী হতে হতো। ১১শ শতক থেকেই দেখা যায় ফিফের গুরুত্ব বা আয়তন অনুসারে যােদ্ধাদলের সংখ্যা নিরূপিত করার প্রথা গড়ে উঠেছিল। ১২শ শতকে দেখা যায় জার্মানীর শাসক রােমে সম্রাট পদে অভিষিক্ত হবার জন্য যাত্রা করলে তার সহযাত্রীরূপে ভ্যাসালদের যাওয়াও বাধ্যতামূলক বলে বিবেচিত হতো। ফ্রান্সে ১১শ শতাব্দী থেকে একটি প্রথা চালু হয়, এই অনুযায়ী ভাসালদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত চল্লিশদিন) তার উর্ধ্বতন প্রভুর সেবা করতে হবে। কখনাে কখনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রও নির্ধারিত করে দেওয়া হতো। তবে এ ব্যবস্থা ছিল ব্যক্তিগত। কি কি কারণে ভাসালের দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার অজুহাত গ্রাহ্য হবে তাও বিবেচিত হতো লর্ডের ইচ্ছানুসারে। সেসময়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে সামরিক সাহায্য দান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সেবার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ম্যানরের পবিদর্শন ব্যাপারে উর্ধ্বতন প্রভুর গৃহস্থালীর প্রয়ােজনে, সংবাদ আদান প্রদানের জন্য, অন্যত্র গমনের সময় প্রভুকে সাহচর্য দান এইসব সেবার (Servitum) অন্তর্ভুক্ত ছিল। পারীর (Paris) বিশপের ভ্যাসালগণের একটি বিচিত্র দায়িত্ব পালন করতে হতো। নতুন বিশপ নির্বাচিত হলে শােভাযাত্রা সহকারে নবাগতকে তার কথিড্রাণে বহন করে নিয়ে যাওয়া তাদের সেবার (Servitum) অন্তর্গত বলে মনে করা হতো। কখনো কখনো নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে (স্কুটেজ, Fr. ecuage, Lat. Scutagium) ভ্যাসালগণ সামরিক কর্তব্য পালনের দায় থেকে অব্যাহতি লাভ করতেন। ইংল্যান্ডে, বিশেষ করে সাধারণ ভ্যাসালগণের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা গ্রহণ ছিল বেশ পুরনো প্রথা। প্লান্টাজেনেট বংশীয় শাসকগণ নিয়মিতভাবে ছোটবড় সব শ্রেণীর ভ্যাসালদের ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রয়োগ করতেন। এভাবে সংগৃহীত অর্থের দ্বারা রাজকর্তৃত্বাধীন স্থায়ী  সেনাবাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব হতো। ১২শ ও ১৩শ শতকে ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই প্রথার প্রচলন হলেও উর্ধ্বতন প্রভুকে ভ্যাসালগণের সামরিক সাহায্য দানের রীতি রয়েই গিয়েছিল।

সামরিক সাহায্য দান ছাড়া প্রভুর প্রয়োজনে ভ্যাসালদের আর্থিক সাহায্য দানেও বাধ্য করা হতো। ১২শ ও ১৩শ শতকে এই জাতীয় সাহায্যদান (অ্যাদ/ aid) প্রচলিত হলেও কোন কোন অঞ্চলে এর উপলক্ষ্য ও পরিমাণ ভিন্ন হতে দেখা যায়। নরমাঁদিতে তিনটি এবং ফ্রান্সের বাকি অংশে চারটি কারণে এই অ্যাদ আদায় করার প্রথা চালু ছিল। উর্ধ্বতন প্রভুর বন্দিত্ব মুক্তির জন্য, জ্যেষ্ঠ পুত্রের ‘নাইট’ রূপে অভিষেকের সময়, জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহকালে এবং প্রভুর ক্রুশেডে অংশ নেবার প্রাক্কালে ইংল্যান্ডে এই প্রথা চালু থাকলেও জার্মানীতে তা ছিল সীমাবদ্ধ।

শার্ত্রের ফুলবার্ট অক্সিলিয়ামের সাথে কনসিলিয়াম বা প্রভুকে সুপরামর্শ দানের দায়িত্বের কথাও উল্লেখ করেছেন। উর্ধ্বতন প্রভুর আহ্বানে তার সাথে উপস্থিত হওয়া এবং জরুরি বিষয়ে মতামত দেওয়া ভ্যাসালের পক্ষে আবশ্যিক বলেই বিবেচিত হতো। ১১শ শতকের শেষার্ধে ফ্রান্স ও জার্মানীতে বছরে কতােবার এই উদ্দেশ্যে উর্ধ্বতন প্রভুর কাছে ভ্যাসালের উপনীত হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল তা পূর্ব-নির্ধারিত হয়ে থাকতো। জার্মানীতে হােয়েনস্টফেন বংশীয় শাসকগণ সর্বস্তরের প্রজার পক্ষে এই কর্তব্য (Hoffahrt) অবশ্যপালনীয় বলে ঘোষণা করেন। অধস্তন ভ্যাসালদের এই কারণে উর্ধ্বতন প্রভুর পরিষদে (Curia, Curtis) উপস্থিত হয়ে রাজা বা লর্ডকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দান, তথ্যাদি সরবরাহ, সমস্যা সমাধানের উপায় বলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হতো এবং কালক্রমে এই পরিষদ কনসিলিয়াম রূপেই পরিচিত হয়ে ওঠে।

ফ্রান্সের বার্গান্ডি-আরলে (Burgandy-Arles) এর কোথাও কোথাও, রোন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে, লাঙ্গদকের এলাকা বিশেষে এবং পিরেনিজ পর্বতমালার কোনও কোনও উপত্যকায় সর্বপ্রকার দায়দায়িত্ববিহীন ভ্যাসালদের কথা শোনা যায়। উর্ধ্বতন প্রভুর প্রয়ােজনে কখনো কখনো নিজেদের দুর্গ ছেড়ে দেয়া বা কিছু কালের জন্য তাদের আদর-আপ্যায়ণের ব্যবস্থা ছাড়া এদের নির্দিষ্ট কোনও কর্তব্য-পালন আবশ্যিক ছিল না। এই শ্রেণীর ভ্যাসালদের franc fief (feudum francum) বলা হতো। এদের অস্তিত্ব এই তত্ত্বই প্রমাণ করে যে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের মতো সম্পত্তির ভূমিকাও ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ।

বিনতিজ্ঞাপন ও আনুগত্য স্বীকার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার হওয়ায় তা উর্ধ্বতন প্রভু ও ভাসালের মধ্যেই সীমিত থাকতো। লর্ডের সঙ্গে সাব-ভ্যাসালের (sub-vassal) কোনও যােগাযােগ গড়ে ওঠা সম্ভবপর ছিল না। জাঁ দ্য ব্লানোর (Jean de Blanot) একটি উক্তির মধ্যেই এই সাধারণ ও সার্বজনীন নিয়মের প্রতিফলন দেখা যায় – “The vassal of my vassal is not my vassal.”। যে কোনও ভাসাল তার অধীনস্থ ভাসালদের উর্ধ্বতন প্রভুর কাজে নিয়োগ করতে পারতেন কিন্তু তার দ্বারা প্রভুর সঙ্গে অধস্তন ভাসালদের কোনও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না। তবে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির মূল্য ও গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে পরবর্তীকালে এই প্রথা চালু হয়েছিল যে কোনও উর্ধ্বতন প্রভুর উত্তরাধিকারী-বিহীন অবস্থায় মৃত্যু হলে তার ভ্যাসালগণ মৃতব্যক্তির উর্ধ্বতন প্রভুর ভ্যাসালরূপে পরিগণিত হবেন যতােদিন না প্রয়াত লর্ডের আইনোনুমোদিত উত্তরাধিকারী স্থিরীকৃত হচ্ছে। তবে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি হতো যখন একই ব্যক্তি বিভিন্ন লর্ডের ফিফ গ্রহণ করতেন। এই ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব পালন, বিশ্বস্ততা রক্ষা, উর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি যথাবিহিত কর্তব্য পালনের ব্যাপারে অসুবিধা দেখা দিতো। এ জাতীয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে যাবার জন্য ভ্যাসালগণ কোনও বিশেষ প্রভুর প্রতি আনুগত্য স্বীকারে ইতস্তত করতেন। অবশ্য ১০ম শতকে অরিল্যাক এর জেরাল্ড (Gerald of Aurillac) এবং এভ্রেমুক্স-এর উইলিয়ামের আচরণ ছিল এর ব্যতিক্রম। উইলিয়াম ঘােষণা করেছিলেন, “আমি রাজা ( ইংল্যান্ডের প্রথম হেনরী) এবং ডিউক (নরমাঁদির রবার্ট) উভয়েরই অনুরক্ত, কিন্তু আমি এদের মধ্যে একজনেরই ভ্যাসাল হবো।” জার্মানীতে ১১শ শতকে একই সঙ্গে একাধিক প্রভুর ভ্যাসালে পরিণত হওয়া অপ্রচলিত থাকলেও ১২শ শতকে তা পুর্ণমাত্রায় শুরু হয়ে যায়। ব্যাভেরিয়ার ফ্যালকেনস্টাইনের কাউন্ট সিবোটো (Siboto) একই সময়ে কুড়িজন প্রভুর ভ্যাসাল ছিলেন। যে পারস্পরিক সম্পর্ক, আনুগত্য ও পৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতে ভ্যাসালেজ প্রথা গড়ে উঠেছিল এই প্রবণতা তা বিনষ্ট করবে আশঙ্কা করে একে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। ৮৯৫ সালের এক দলিলে দেখা যায়, যে ঊর্ধ্বতন প্রভুর কাছে বেশি পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি অনুগ্রহ-দান হিসেবে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো ভ্যাসালগণ তার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করতে আগ্রহী হতেন। একটি দলিলে দেখা যায় জনৈক প্যাটোরিকাস ঊর্ধ্বতন প্রভু হিসেবে রবার্টকেই বেছে নিয়েছেন কেননা বেরেঙ্গারের (Bernger) থেকে প্যাটোরিকাসের কাছে বেশি পরিমাণ ভূসম্পত্তি পাবার আশা ছিল। কোথাও কোথাও অবশ্য প্রাচীনতম বন্ধনকেই নিবিড়তম জ্ঞান করা হতাে।

১১শ শতকে ফ্রান্সে লিজেন্সি (Liegeancy, Fr. ligesse) নামে আরও একটি প্রথার সৃষ্টি হয় এবং সেটি ক্রমশ লোথারিঞ্জিয়া, দক্ষিণ ইতালী এবং ইংল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়ে। একজন ভ্যাসালের একাধিক ঊর্ধ্বতন প্রভু সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে স্থির হয় লর্ডদের মধ্যে এমন একজনকে মনোনীত করা প্রয়ােজন যার প্রতি ভ্যাসাল-প্রথার সমস্ত বিধি বিধান অবাধে প্রযুক্ত হবে। এই লর্ড পরিচিত হবেন ডোমিনাস লিজিয়াস (dominus ligious) বা লিজ লর্ড (liege lord) রূপে। ইনি ছাড়া ভ্যাসালগণ অন্য কোনও ঊর্ধ্বতন প্রভুর কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন না। কিন্তু এই নতুন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স, লোথারিঞ্জিরা প্রভৃতি অঞ্চলে পরাক্রান্ত ভূস্বামীগণ কয়েকজন লর্ডের ‘লিজম্যান’ রূপে প্রতিষ্ঠা অর্জনে সচেষ্ট হন, নতুন শর্তবন্ধনও সৃষ্টি হতে থাকে। এই প্রথার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ১২শ শতকের শুরুতে ফরাসীরাজ স্বীয় কর্তৃত্বাধীন সমস্ত ভ্যাসাল যাতে রাজানুগত্যে অটল থাকেন তার দিকে দৃষ্টি দেন। ১১০১ সালে ফ্লাঁদরের কাউন্ট ইংল্যান্ডের প্রথম হেনরীর ভ্যাসালে পরিণত হলেও ফরাসীরাজের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কথা ঘােষণা করেন। ইংল্যান্ডে প্রথম হেনরীর সময় থেকে প্রতিটি চুক্তিতেই ভ্যাসালের রাজানুগত্যের আবশ্যকীয়তার ওপর গুরুত্ব আরােপিত হতো এবং ‘লিজ হােমেজ’ একমাত্র রাজার প্রতি প্রযুক্ত করার বিষয়ে তীক্ষ্মদৃষ্টি রাখতেন রাজপক্ষীয়গণ। জার্মানীতে রাজন্যবর্গ ও পরাক্রান্ত ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণাধীন সার্ফ-নাইট (Serf-Knight) বা মিনিস্টারিয়েলেসগণ (ministeriales) কালক্রমে অন্যান্য লর্ডদের কাছ থেকে ফিফ গ্রহণ করতে আরম্ভ করলে সেখানেও লিজ হােমেজের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হন ঊর্ধ্বতন প্রভুরা। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ফ্রেডরিখ বার্বারােসা এই প্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন যে সাম্রাজ্যের প্রত্যেক রাজন্য এবং মুখ্যভূস্বামী কেবলমাত্র সম্রাটের প্রতি “লিজহোমেজ” জ্ঞাপন করবেন। ঊর্ধ্বতন প্রভু ও ভ্যাসালের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের সময় তার মধ্যে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের কথাও যাতে উল্লিখিত থাকে সে বিষয়েও তার দৃষ্টি ছিল। কিন্তু সমসাময়িক কালের এই প্রবণতার বিরুদ্ধাচরণে তিনি সফল হতে পারেন নি।

সামন্ততন্ত্রের প্রচলিত বিধান অনুসারে কোনও ভ্যাসালের পক্ষে এককভাবে চুক্তি ভঙ্গ করার উপায় ছিল না। ঊর্ধ্বতন প্রভু স্বেচ্ছায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া পর্যন্ত তিনি আনুগত্যে অটল থাকতে বাধ্য ছিলেন। জার্মানীর বেশির ভাগ অঞ্চলে এই নিয়মই চালু ছিল। ঊর্ধ্বতন প্রভু পরিবর্তনে আগ্রহী ভ্যাসালকে প্রথমোক্তের অনুমতি সাপেক্ষে আদিচুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো। কিন্তু ১২শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেখা যায় (বিশেষ করে ফ্রান্সে ও জার্মানীর পশ্চিমাঞ্চলে) যদি কোনও ভ্যাসাল স্বেচ্ছায় ফিফের ওপর অধিকার পরিত্যাগ করে ঊর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি দায়দায়িত্ব পালনের থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য প্রকাশ্যে আবেদন করতেন তাহলে তা মঞ্জুর হতো। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভূসম্পত্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের ভূমিকাই ছিল সর্বাধিক। ফিফের ওপর অধিকার ত্যাগ না করে প্রভুর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে বিরত থাকা বিশ্বাসঘাতকতা বা বিদ্রোহ রূপে বিবেচিত হতো। অবশ্য বিশ্বাস ভঙ্গের কারণ ঘটলে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শাস্তি দান ছাড়া বিকল্প কোনও ব্যবস্থা কার্যকর হতো না। ভ্যাসাল অন্য কোনও গুরুতর অপরাধ করলে তাকে ফিফচ্যুত করার প্রথা ছিল। ১০৩৯ সালে একটি দলিলে দেখা যায় কাউন্ট জেফ্রে মাৰ্তেলের হত্যাপরাধে অভিযুক্ত ওয়াল্টার নামক জনৈক ভ্যাসালের ভূসম্পত্তি ঊর্ধ্বতন প্রভু কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ১১৭৬ সালে এনাের (Hainault) কাউন্টের হাতে দুর্গের অধিকার সাময়িকভাবে তুলে দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় অনুরূপ শাস্তি দেওয়া হয়ছিল জ্যাক দ্য ভ্যানকে (Jacques d’ Avesnes)। দুর্বিনীত ভ্যাসালকে ফ্রান্সে এভাবেই শাস্তি দেওয়া হতো। তবে ঊর্ধ্বতন প্রভুর কর্তব্যচ্যুতিও ফিফের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতো। এসব ক্ষেত্রে ভ্যাসাল তার ঊর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য থাকতেন না এবং সুবিধা হলে ফিফের ওপর নিজ কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করতেন। আর উর্ধ্বতন প্রভু ও তার ভাসালের সম্পর্ক ব্যক্তিগত হলেও ফিফকে বংশানুক্রমিক করা, বা ভূসম্পত্তি তার নিজ পরিবারে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা প্রত্যেক ভ্যাসলের পক্ষেই নিতান্ত স্বাভাবিক ছিল। এ কারণে বিধিসঙ্গত না হলেও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বংশক্রমিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। অবশ্যই এরকম ঘটনা ঘটা ভূসম্পত্তির আকৃতি, প্রকৃতি, মূল্য ও গুরত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা : ম্যানর

সামন্ততান্ত্রিক সমাজে প্রধানত সামরিক সাহায্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীন মানুষের মধ্যে যে ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিন্যাস রচিত হয়েছিল তার প্রকাশ সীমাবদ্ধ ছিল অপেক্ষাকৃত উপরের স্তরে। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য সমাজের নিম্নতর স্তরে প্রভু ও অধীনস্থ প্রজার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে যে প্রাচীনতর ও দীর্ঘায়ু প্রতিষ্ঠান সামন্ততন্ত্রের কাঠামোতে স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা পরিচিত হয়ে ওঠে ম্যানর (ফ্রান্সে-সেইন্যরি, Seigneuric) নামে। ভ্যাসাল এবং হােমেজ প্রথাজাত কর্তৃত্ব ঊর্ধ্বতন প্রভুকে বিচিত্র এবং বিভিন্ন লাভের (Profit) অধিকারী করে তুলতো, কিন্তু গ্রামীন অর্থনীতির বিভিন্ন ব্যবহারিক দিকের প্রতি দৃষ্টি রেখেই পরিচালিত হতো ম্যানর। মার্ক ব্লখের বিচারে ম্যানর ছিল প্রধানত ‘এস্টেট’ (estate, terre) যার সীমানার মধ্যে বসবাস করতেন লর্ডের প্রজাগণ (subjects), আর লর্ড বা ভূস্বামীর জমিতে প্রজাকর্তৃক উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ভাগীদার হওয়াই ছিল কর্তৃত্ব প্রয়ােগের মূল লক্ষ্য। অধীনস্থ প্রজাবৃন্দের ওপর ভূস্বামীর অধিকারের মাত্রা ও ব্যাপকতার বিচারে ম্যানর বা ম্যানরে অন্তর্গত গ্রাম অথবা গ্রামগুলোকে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আঞ্চলিক বা স্থানীয় বিভাগ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। (“The manor, or rather the manorial village–for there were sometimes more than one village on a large manor–was the local unit of feudal government.” Thompson & Johnson.)

মধ্যযুগের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশ, জমির উর্বরতা শক্তিই দায়ী ছিল না, সামাজিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, জমির পূর্বতন মালিকদের রীতিনীতি, জন্ম-মৃত্যুর হার ইত্যাদির প্রবল প্রভাবও অনুভূত হয়েছিল অর্থনীতির রূপ পরিগ্রহণের মধ্যে। ক্রমে এগুলো সবই প্রতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়ে বিশেষকালের মানুষের আচার ব্যবহার, বিধিবিধান, একের সঙ্গে অপরের সম্পর্ক নির্ধারণ করতে শুরু করে, এবং দায়দায়িত্ব, অধিকার, কর্তব্যের যথাবিহিত বণ্টনের একটা প্রথা গড়ে তােলে। মধ্যযুগীয় সমাজের এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ম্যানর ছিল অতি বিশিষ্ট। ম্যানরের মূল কাঠামােটা এক এবং অভিন্ন থাকলেও অঞ্চল বিশেষে এবং বিভিন্ন সময়ে তার বহিরঙ্গে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল।

সাধারণত আকারে বিশাল, স্বনির্ভর এই প্রতিষ্ঠান ইউরােপের সর্বত্র একই ভাবে বা একই সময়ে গড়ে ওঠেনি। কোথাও কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণরূপে ম্যানর-নিয়ন্তিত, কোথাও বা অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষেত-মালিক বিচ্ছিন্নভাবে কৃষিকাজ সম্পন্ন করতো। জার্মানী ও ইংল্যান্ডের বহু আগেই ফ্রান্স ও ইতালীর অঞ্চলবিশেষে ম্যানরের দেখা পাওয়া যায়। সম্রাট শার্লম্যানের রাজত্বকালেই ল্যয়র ও মিউস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিশাল ক্ষেতখামার গড়ে উঠেছিল, আর ৯ম শতকের মধ্যেই গলদেশের উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল প্রায় সমস্ত ইতালী, ক্যাটালোনিয়া, রাইনল্যান্ড, মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানীতে ম্যানরই হয়ে ওঠে মধ্যযুগীয় উৎপাদন ব্যবস্থার মূল উতস। ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কে এই ব্যবস্থার পত্তন হয় ১০ম শতকে। গল দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশ এবং স্যাক্সনীর সমতল ভূমিতে অন্য অঞ্চলের মতো ম্যানরের আবির্ভাব হয়নি, কারণ এই এলাকার কয়েক সহস্র একর জুড়ে গড়ে ওঠা ক্ষেতখামারের পাশেপাশেই ছোট ছোট ক্ষেতখামার ছিল যেগুলোর মালিকেরা রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনও প্রভুর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়নি। স্বাধীন কৃষকের এই ভূসম্পত্তি অ্যালড (allod) নামে পরিচিত ছিল আর অ্যাকুতাঁতে এগুলোর অস্তিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ফ্রিসল্যান্ড, উত্তর হল্যান্ডে এবং এইডার (Eider) ও এল্‌ব নদীর মুখে কিয়েল খালের পশ্চিমাংশে, নরওয়ে, এবং সম্ভবত সুইডেনে ম্যানরের পত্তন কোনও সময়েই হয়নি। 

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ম্যানর ছিল জমিদারের ভূসম্পত্তি। আকারের খুব ছোটো, এমনকি সাধারণ একজন নাইটের জীবিকা নির্বাহের পক্ষে অনুপযুক্ত ম্যানরও সম্পন্ন কৃষকের ক্ষেতখামারের থেকে বৃহদায়তন হতো। ম্যানরের সীমানার মধ্যে শুধুমাত্র ভূস্বামীর ক্ষেতখামার, বাসগৃহই থাকতো না, এখানকার কৃষিযোগ্য জমি-খণ্ড কৃষক প্রজাদের (subjects) মধ্যে বিলিবন্দোবস্ত করে দেওয়া হতো। ম্যানরে যে পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন হতো তার মধ্যে কর্ষণযােগ্য ভূমি এবং প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক অর্থনীতিরই ছিল মুখ্য ভূমিকা। এই ব্যবস্থায় শ্রম বা শ্রমলব্ধ উৎপাদনকে পণ্য হিসেবে গ্রাহ্য করা হতো না। আর, উৎপাদনে যার ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ সেই কৃষক ছিল উৎপাদনের মাধ্যম এবং ভূমির সঙ্গে সে আবদ্ধ ছিল একটি নিদিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক-সূত্র দ্বারা। এই সম্পর্কের চরিত্র বহুল পরিমাণে এবং প্রায় সর্বত্র নিয়ন্ত্রিত হতো ভূমিদাস প্রথা বা Serfdom-এর রীতিনীতি দ্বারা। ম্যানরের মধ্যে যে জমিতে কৃষকেরা বসবাস করতো বা যেখানে কৃষিকাজ সম্পন্ন হতো, বলা বাহুল্য তার ওপর তাদের মালিকানা বর্তাতো না। এই ভূসম্পত্তি সম্পূর্ণরূপেই ছিল ম্যানর প্রভুর নিয়ন্ত্রণাধীন। তারা তাদের আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়ােগ করে ভিল্যন-সার্ফদের (Villien-Serf) কাছ থেকে উৎপন্ন শস্যের বেশির ভাগটাই ভােগ করতেন। শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন ছাড়াও ভিল্যনসার্ফগণ ম্যানর প্রভুর জন্য বিভিন্নভাবে শ্রমদানে বাধ্য থাকতো এবং তার খাস-জমিতে নিদিষ্ট সময়ের জন্য কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত থাকাও ছিল তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। অধীনস্থ ভিল্যন-সার্ফদের ওপর ম্যানর প্রভুর এই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ক্রমশ অর্থনৈতিক শােষণ ও সর্বপ্রকার শাসন-সম্পর্কিত ক্ষমতা প্রয়ােগের রূপ নেয়। তাছাড়া ম্যানরের এই দ্বিধাবিভক্ত ভূসম্পত্তি থেকে ভূস্বামীর আয়ও হতো দ্বিবিধ – ভূস্বামীর নিজস্ব বা খাস জমি-খামার থেকে এবং অধীনস্থ প্রজাদের (পারিভাষিক অর্থে যারা ভিল্যন-সার্ফ ‘Villien-Serf’ রূপে পরিচিত ছিল) দেয় রাজস্ব থেকে। খাস জমিতে শস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য ভূস্বামী নির্ভর করতেন কৃষক-প্রজাদের শ্রমের ওপর। তাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রজাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বহুলাংশে নিরূপিত হতো ভূস্বামীর (লর্ড অফ দ্য ম্যানর) কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য শ্রমের চাহিদার ওপর। এর ফলেই সামজিক দিক থেকে কৃষক-প্রজার স্বাধীনতা লুপ্ত হয়েছিল। জীবিকা নির্বাহের জন্যে কৃষক প্রজারা ম্যানরের জমিখণ্ডে আবদ্ধ এবং ভূস্বামীর প্রাপ্য রাজস্ব এবং শ্রমদানে (বেগার খাটায়) অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতো। কোনও লিখিত বা অলােচনা-নির্ভর চুক্তিপত্রের ওপর তাদের বেগার খাটার প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারিত হতো না, তা সব সময়েই ঠিক হতো ম্যানরের নিজস্ব রীতিনীতির ওপর এবং ম্যানর-প্রভু কর্তৃক সেই রীতিনীতির ব্যাখ্যা ও তার প্রয়ােগের সাফল্যের ওপর। কৃষক-প্রজার এই অধীনতা বা দায়বদ্ধতা অন্যভাবেও ভূস্বামীকে লাভবান করতো। সাধারণভাবে যে সমস্ত অধিকার মানুষ জন্মগত বলে করে, যেমন স্থানান্তরে বসতি স্থাপন, বিবাহ করা, পুত্রকন্যার বিবাহ দেয়া, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ঠিক করা, জমি বা গবাদি পশু বিক্রয় করা অথবা রাজকীয় বিচালয়ের দ্বারস্থ হওয়া – এগুলো কৃষক-প্রজা ভােগ করতে পারতো কেবলমাত্র ম্যানর-প্রভুর সম্মতি সাপেক্ষে এবং এ সম্মতি পাওয়া যেতো উপযুক্ত পরিমান অর্থ দণ্ড দিয়ে। প্রজাদের এই অধীনতা এবং অর্থদণ্ড দিয়ে কিছু অধিকার ভােগ করার প্রথা বলবৎ থাকায় ভূস্বামী প্রভু তাদের ওপর বহুবিধ শাসন ও বিচারের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিশদ্ধ স্বৈরাচারী আচরণ করতে দেখা যেতো। স্থানীয় শান্তিরক্ষা, ফৌজদারী আইন প্রয়োগ সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতো এদের ওপর। ফলে নিয়মিত বিচারালয়ের অধিবেশিন এবং জুরী নিয়োগের দায়িত্ব বহন করতেন ম্যানর-প্রভু। সুতরাং প্রয়োজন অনুসারে জুরী হিসেবে কাজ করা বা আদালতে হাজিরা দেয়াটাও প্রজাদের বাড়তি কাজ হয়ে উঠেছিল। বলা বাহুল্য বিচারে জরিমানা বাবদ আয়ের সবটাই ম্যানর প্রভুর ঘরে জমা পড়তো।

ম্যানর ছিল সম্পূর্ণরূপেই একটি মধ্যযুগীয় প্রতিষ্ঠান এবং সে যুগের বিশিষ্ট সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এর সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার যে ম্যানরের বহু বৈশিষ্ট্যই এমন এক অথনৈতিক মূল-ব্যবস্থা (rootstock) থেকে আহরিত হয়েছিল যাকে বিশেষভাবে মধ্যযুগীয় বলা যায় না, যার অস্তিত্ব বিভিন্ন যুগে ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যেতো। অতি বিশাল ভূসম্পত্তিকেই এই অর্থনৈতিক মূল ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করা যায়। কিভাবে এই অতি বৃহৎ ভূসম্পত্তি সৃষ্ট হয়েছিল এবং কেমন করে এগুলোর আকৃতি প্রকৃতির তারতম্য ঘটেছিল এবং কেমন করেই বা এগুলো একান্তরূপে মধ্যযুগীয় কতকগুলো বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ম্যানরে রূপান্তরিত হয়েছিল তার ব্যাখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে।

সামাজিক বিবর্তনের আদিপর্বে জমি, বিশেষ করে কৃষিযোগ্য ভূমিই ছিল শক্তি সম্পদের একমাত্র উৎস এবং এই জমির মালিকানাই সৃষ্টি করেছিল সামাজিক বৈষম্য। কিন্তু অতি উচ্চ এবং পরাক্রান্ত এবং অতি দীন এবং সাধারণ মানুষ – মধ্যযুগের প্রারম্ভে এই দুই স্তরে বিভক্ত সমাজের অস্তিত্বের সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ ঘটেনি। ১৯শ শতকের জার্মান ঐতিহাসিক চর্চার কাছে পরিতক্ত হয়েছে এই দুই স্তরে বিভক্ত সমাজের চিত্র। জার্মান ঐতিহাসিকগণ টিউটনিক সমাজে আদিম সাম্য এবং গণতন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানের প্রবল উপস্থিতির দিকে গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে মধ্যযুগের সূচনায় ইউরােপের সমাজের ইতিহাস কতকগুলো গােষ্ঠীর উত্থান পতনের কাহিনী এবং এই সমাজে ব্যক্তির পরিবর্তে জমির মালিক ছিল ‘ট্রাইব্যাল-কমিউন’। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার এই প্রকৃতিই সমাজে গণতন্ত্রসম্মত শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে চলেছিল।

সুতরাং মধ্যযুগের আদিপর্বে (যাকে বহু ঐতিহাসিক ‘ডার্ক এজ’ (Dark Age) আখ্যা দিয়েছেন) রােমান ভিলার (Villa) মতো সুবিস্তৃত জমিদারী, ইউরোপের বিকাশ অঞ্চলের মানুষের জীবনের অতি পরিচিত, এবং স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। আর এর পত্তনের পেছনে কোনও আকস্মিকতা ছিল না। ৮ম ও ৯ম শতকে এধরণের বিশাল ভূসম্পত্তির অস্তিত্ব বিষয়ে প্রচুর প্রমাণও সহজলভ্য। মেরোভিঞ্জীয় এবং ক্যারোলিঞ্জীয় আমলে রাজকর্মচারী ও অনুচরবৃন্দের মধ্যে তাদের কাজকর্ম বা সেবার বিনিময়ে রাজকীয় ভূসম্পত্তি ফিফ হিসেবে বন্টিত হতো। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্যার্থেও বিশালাকৃতির ভূসম্পত্তি দানের প্রথা প্রচলিত হয়। ক্রয় বা জবর-দখলের মাধ্যমে এই জাতীয় সম্পত্তি স্ফীততর হতে থাকে। যেসব এলাকায় কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়েছিল বা ভাইকিং এবং ম্যাগিয়ার আক্রমণের ফলে স্থায়ী অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে পরবর্তী কালে ৯ম শতক থেকেই সুপরিচিত ফিউডাল এস্টেট বা সামন্ততান্ত্রিক ভূসম্পত্তি গড়ে উঠতে থাকে। এভাবে বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন কারণে ইউরোপের প্রায় সর্বত্র বৃহদায়তন জমিদারির সৃষ্টি হয়। ব্রিটেনেও অ্যাংলো-স্যাক্সন বিজেতারা ‘রোমানো-ব্রিটিশ’ আমলে সৃষ্ট সামাজিক স্তরবিভেদের সুযোগ গ্রহণ করে এবং ভিলাগুলোর মালিক হয়ে ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চলে বড়ো বড়ো ম্যানরের প্রতিষ্ঠা করে। আর ইউরোপের অন্যত্র যেমন ঘটেছিল, এ ব্যবস্থা পত্তন হবার সঙ্গে সঙ্গে তা ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়।

কিন্তু এভাবে সৃষ্ট হলেও ম্যানররূপে সক্রিয় এবং ম্যানরের সমস্ত বৈশিষ্ট নিয়ে বিকশিত হবার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কতকগুলো সামাজিক এবং রাজনৈতিক গুণ অর্জন করতে হয়েছিল। এবং এই গুণগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই অন্যযুগের ভূসম্পত্তির সঙ্গে ম্যানরের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এই মতের সমর্থক যে মধ্যযুগীয় ম্যানরগুলো তাদের বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল শাসন কাজে তাদের ভূমিকার জন্য এবং সমাজে ম্যানরের বিশিষ্ট ভূমিকার উৎস হচ্ছে এই ঘটনা যে এই ভূসম্পত্তিগুলো লর্ড বা ম্যানর প্রভুরা শাসকের কাছ থেকে ফিফ হিসেবেই গ্রহণ করতেন, অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ আপৎকালে শাসককে সাহায্য দেয়ার এবং শাসনব্যবস্থা সচল রাখার শর্তাধীনে এই সম্পত্তির স্বত্ত্ব লাভ করতেন ভূম্যধিকারীগণ। যতদিন এই ভূমিকা বা কর্তব্যপালনে তারা সক্ষম ছিলেন ততদিনই এ জাতীয় ভূসম্পত্তি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অঙ্গরূপেই থেকে গিয়েছিল।

১২শ শতক পর্যন্ত ভিলান-সার্ফই (Villien-serf) ছিল ইউরােপের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এদের কেউ কেউ ছিল প্রাচীনকালের ক্রীতদাসদের উত্তরপুরুষ, আবার কারো কারো পূর্বপুরুষ ছিল স্বাধীন প্রজা। এই দুই পৃথক শ্রেণীর মানুষের সন্তান-সন্ততিদের উন্নয়ন ও অবনমনের মধ্য দিয়ে একই সামাজিক সুর স্থিত হওয়ার পর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে ৯ম শতকের শেষার্ধে এবং ১০ম শতকের সূত্রপাতেই সমাপ্ত হয়। ক্রীতদাসত্বের স্তর থেকে যারা সার্ফ বা ভূমিদাসের পদে উন্নীত হয়েছিল তাদের অবস্থান্তর আরম্ভ হয় খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে। এই সময়েই ভূস্বামীগণ সচেতন হয়ে ওঠেন যে বৃহৎ আকারের ক্ষেতখামার (latifundia) শুধুমাত্র ক্রীতদাস-শ্রমের ওপর নির্ভরশীল হলে তা মোটেই লাভজনক হয়না। অধিক ফসল উৎপাদনে দাসেদের কোনও আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক এবং তত্ত্বাবধানের অসুবিধা থাকলে তাদের দিয়ে ক্ষেতখামারের কাজও বিঘ্নিত হয়। সে সময়ে ক্রীতদাসদের সংখ্যাধিক্য ও সহজলভ্যতার জন্য ক্ষেতখামারে খুব বেশি মূলধন বিনিয়োগ না করলেও চলতো। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ‘অগাস্টাসের শান্তির’ ফলে ক্রমশঃ ক্রীতদাস সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় এবং মোটামুটি ২য় শতক থেকে ভূস্বামীগণ এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়ে ওঠেন যে বৃহদায়তন এইসব ক্ষেতখামারে উৎপাদন ব্যবস্থাকে লাভজনক রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। তাছাড়া খ্রীস্টের  আদর্শে প্রভাবিত হবার আগে থেকেই ইউরােপীয় সমাজে ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়াটা পুণ্য কাজ বলে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল। ৩য় শতকের খ্রীস্টান প্রচারকদের প্রভাবে এই জাগ্রত মানবতাবােধ প্রবলতর হয়। সদ্যোমুক্ত এইসব দাসগণ ‘ল্যাটিফুণ্ডিয়া’র ছােটখাটো অংশে কৃষিকাজে নিযুক্ত হলেও পূর্বতন প্রভুর বহুবিধ কাজ-কর্ম (তার খাসজমিতে কৃষি উৎপাদন ছাড়াও) করে দিতে বাধ্য ছিল। তাছাড়া রােমান সাম্রাজ্যের সায়াহ্ন-লগ্নে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে ভূম্যধিকারীগণ যে কোনও উপায়ে তাদের ক্ষেতখামারের কাজ অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হন। এই প্রয়ােজনের তাগিদেই আবির্ভূত হয় কলােনি (Coloni) নামক বিশেষ এক শ্রেণীর কৃষকের যারা ভূস্বামীদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে জমি নিয়ে কৃষিকাজ করতো। এভাবেই ল্যাটিফুণ্ডিয়া বা ভিল্লার (Villa) উৎপাদন ব্যবস্থা দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ক্ষেত-খামারের কাজ সচল রাখার এই পরিবর্তিত পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে এই সদ্যোমুক্ত দাস এবং কলােনিদের (Coloni) সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রিত করার জন্য শাসন বিভাগকেও অবস্থানুযায়ী নতুন এবং নির্দিষ্ট নিয়মকানুন তৈরী করতে হয়েছিল। এখন থেকে সার্ভি ক্যাসাটি (Servi casati) বা গৃহস্থদাস এবং স্বাধীন কৃষকদের কৃষিকাজের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ করা রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। ৩৭৫ সালে একটি আইনে করদাতাদের তালিকায় যাদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে তাদের বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। যে জমির সঙ্গে কৃষিজীবীগণ যুক্ত কেবলমাত্র সেই জমির সঙ্গে তাদের বিক্রয় আইনসম্মত বলে ঘােষিত হলো। পরবর্তীকালে এই মুক্তিপ্রাপ্ত দাসের কৃষিকাজ ভিন্ন অন্য কাজে নিয়ােগও সমর্থন করা হতো না। তবে তারা যে সম্পূর্ণরূপেই ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণাধীন তা নতুন করে বােঝাবার জন্যে তাদের আইনের আশ্রয় নেওয়া বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যােগদান অবৈধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে রােমান সাম্রাজ্যের এই স্বাধীন প্রজা বা কলোনিগণের সামাজিক অবস্থান কিন্তু পরবর্তীকালে জার্মান জাতিসমূহের বিজিত স্থানগুলোতে সমর-নায়কেরা কৃষিকাজ সম্পন্ন করার জন্য যেসব জার্মান জাতি-উদ্ভুত স্বাধীন প্রজাদের নিযুক্ত করেছিলেন তাদের থেকে আলাদা ছিল। খ্রীস্টীয় ৩য় শতক থেকেই অর্থনৈতিক কারণে রােমান শাসন বিভাগ কলোনি সম্প্রদায়ভুক্তদের কৃষিকাজের সঙ্গে নিবিড়তরভাবে জড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল। একই কারণে শিল্পজীবীদেরও নিজ নিজ বৃত্তির সঙ্গে এবং স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন বিভাগের কর্মীদের নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত রাখা অত্যাবশ্যক বলে মনে করা হতো। এরই ফলে ভূস্বামীগণ ইজারার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের বন্দোবস্ত করা পুরোনো ক্ষেতখামারে কৃষ্টি উৎপাদনে বাধ্য করতেন। অবৈধ হলেও সাধারণ দীন প্রজাদের এ প্রচেষ্টায় বাধাদান সম্ভব ছিল না। শাসন কর্তৃপক্ষও এ ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন কেননা সাম্রাজ্যের সামরিক প্রয়োজনে ভূস্বামীগণ এই কলোনি শ্রেণীভূক্ত প্রজাদেরই ব্যবহার করতেন এবং এদের কাছ থেকে কর আদায়ের দায়িত্বও তারাই বহন করতেন। ক্রমশ যেসব স্বাধীন প্রজা বা কলোনি ত্রিশ বছর বা তার বেশি কাল একই কৃষিক্ষেত্র কর্মরত ছিল তারা সেই জমির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলো। জমি ছেড়ে অন্যত্র যাবার চেষ্টা হয়ে দাঁড়ালো অবৈধ ও শাস্তিযােগ্য অপরাধ। কৃষিজীবীগণ শুধুমাত্র এই সুবিধাটুকু লাভ করলেন যে জমি থেকে তাদের আর উৎখাত করা আর সম্ভবপর রইলো না। যদিও ভূসম্পত্তির একাংশ থেকে দূরবর্তী অন্য অংশে তাদের স্থানান্তরিত করার কোনও বাধা ছিল না। ‘কলোনাস’ সম্প্রদায়ভুক্তদের স্বাধীনতার বিনিময়ে নিরাপত্তা অর্জন এভাবেই ঘটেছিল। অবশ্য রােমান সাম্রাজ্যের শেষদিনগুলোর নিঃসীম অনিশ্চয়তার মধ্যে এই বিধিভঙ্গের ঘটনা অবিরল হয়ে উঠেছিল, আর মেরেভিঞ্জীয় গলদেশে এবং লােম্বার্ড-অধীন উত্তর ইতালীতে বৃত্তি পরিবর্তন আইনােনুমােদিত হওয়ায় কৃষক প্রজার জমি পরিত্যাগ করা প্রায় স্বাভাবিক ছিল বলে অনুমিত হয়। রাষ্ট্রীয় এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পরাক্রান্ত ভূম্যধিকারীগণ স্বার্থরক্ষার জন্য নিজেদের হাতেই আইন তুলে নিতে বাধ্য হন। অবাধ্য ক্রীতদাসদের কারারুদ্ধ করার ক্ষমতা তাদের হাতে আর না থাকলেও দাসেদের ওপর যেসব অধিকার তারা প্রয়ােগ করতেন সেগুলো স্বাধীন কৃষকদের ওপরেও তারা নির্বিচারে ব্যবহার করতে আরম্ভ করলেন। ৫ম শতকের শেষার্ধে আরলের (Arles) ‘সৎবিশপ’রূপে পরিচিত ভূস্বামীও তার অধীনস্থ দুর্বিনীত প্রজাদের (কলােনাস ও মুক্ত-দাস) বেত্রাঘাতের আদেশ দিতেন বলে জানা জানা যায়। জাস্টিনিয়ানের সুখ্যাত আইনাবলীতেও এ জাতীয় অধিকারের বৈধতা স্বীকৃত হয়। ফলে কলোনাস বা স্বাধীন প্রজাদের সামাজিক অবস্থা হীনতর হতে থাকে এবং আইনের চোখে তখনও তারা স্বাধীন বলে স্বীকৃত হলেও মুক্তদাসদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য ক্রমশ মুছে যেতে থাকে।

রােমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনের সময় জার্মানগণ সকলেই স্বাধীন ও সমমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন বলে যে ধারণা ঐতিহাসিক মহলের একাংশে বলবৎ ছিল তা ভ্রান্ত বলে বহু পূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে। ‘ফ্রাঙ্ক’ শব্দটির অর্থ যে ‘স্বাধীন’ তাও কেউ আর স্বীকার কয়েন না। ট্যাসিটাসের রচনা থেকেই জানা যায় যে জার্মান সমাজে কৃষিকাজে নিযুক্ত বহু মানুষই ছিল ক্রীতদাস। রােমান সাম্রাজ্য আক্রমণকারী বিভিন্ন জার্মান গােষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যে অনুচরবাহিনী এসেছিল পরিবর্তিত পরিবেশে দলপতিদের ওপর তাদের নির্ভরশীলতার মাত্রা এতো বেশি ছিল যে তাদের স্বাধীন অস্তিত্বও ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে থাকে। তাছাড়া পরাক্রান্ত সমর-নায়কদের অধীনে বহু অর্ধস্বাধীন কৃষিজীবীকে কর্মরত দেখা যেতো। স্যাক্সনদের মধ্যে ল্যাটেন (Laten), ফ্রাঙ্কদের মধ্যে লিটন (Liten) রূপে পরিচিত এই শ্রেণীর কৃষকেরা পরবর্তীকালে সামগ্রিক ভাবে ‘লেইটস’ নামে (Laets) অভিহিত হতে থাকে। অবশ্য জার্মান অধিকৃত বিভিন্ন স্থানে এই সামাজিক স্তর বা শ্রেণীবিভাগ সত্ত্বেও জার্মানদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই যে স্বাধীন ছিল সে সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু শক্তিশালী দল নেতাদের ক্ষমতার প্রতি আসক্তি এবং দীনহীন ক্ষুদ্র কৃষিজীবীর নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য আকুলতাই শেষােক্তদের সামাজিক অধঃপতনের কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। তা ছাড়া ৮ম থেকে ৯ম শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে সংহতি এবং শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষিত হলেও তার আগের এবং পরের অধ্যায়ে রাজশক্তির অসহায়তার সুযোগে প্রজাপুঞ্জের ওপর শক্তিশালী ভূস্বামীদের অধিকার দৃঢ়তর হতে থাকে। নতুন করে বর্বর আক্রমণের আঘাত এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও সম্পূর্ণতর করে দেয়। রাষ্ট্র দুর্বলকে আশ্রয় দানে সমর্থ হওয়ায় সবলের হাতে আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের উপায়ন্তর ছিল না। 

ফরাসী পণ্ডিত মার্ক ব্লখ এই মত পােষণ করেন যে পরাক্রান্ত কোনও ভূস্বামীর কাছে স্বাধীন ক্ষেত-মালিকের জমি সমর্পণ করে তা শর্তসাপেক্ষে এবং অনুগ্রহ দান রূপে গ্রহণ করার পেছনে অর্থনৈতিক কোনও কারণ ছিলনা। কিন্তু পরবর্তিকালে গবেষকরূপে সুখ্যাত অধ্যাপক হজেট লিখেছেন যে এ তথ্য অনস্বীকার্য যে মধ্যযুগের সূচনায় ছোট ক্ষেত-মালিকদের পক্ষে রাজস্ব ও অন্যান্য কর দেয়ার অক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হয়ে  উঠেছিল। তাছাড়া নতুন জমিতে চাষাবাদের উদ্যোগ শুরু হয় এই সময় থেকেই এবং আর্থিক সংগতিহীন স্বাধীন কৃষকের পক্ষে তাতে অংশগ্রহণ করার অক্ষমতা পরিণামে তার দুর্গতি ও অনটনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অজন্মা ও গৃহপালিত পশুদের মধ্যে মহামারী মাঝেমাঝেই তাদের অবস্থা দুঃসহ করে তুলতো। এ জাতীয় চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে তাদের পক্ষে গৃহী অথবা যাজক শ্রেণীভূক্ত ভূম্যধিকারীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকতো না। ভূস্বামীগণও বিনাশর্তে শুধু পরোপকার করার জন্য কৃষকদের ত্রাণ করতেন না। অভাব মোচনের দায়দায়িত্ব গ্রহণের বিনিময়ে তারা নিরন্ন কৃষকদের কাছ থেকে বহুবিধ সুবিধা এবং অধিকার আদায় করে নিতেন। এভাবেই অসংখ্য স্বাধীন ছোটখাটো ক্ষেতমালিকগণ ধনী ভূস্বামীদের অধীনস্ত প্রজায় পরিণত হয়ে পড়তো।

তাছাড়া ধর্মীয় কারণে অনেকে চার্চকে ভূসম্পত্তি দান করতেন। এই সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিপত্তি ছিল ক্রমবর্ধমান এবং খ্রীস্টান সন্তদের পুণ্যস্মৃতি শ্রদ্ধায় অবনত করে রাখতো বহু মানুষকে। দীন-দরিদ্র কৃষকের পক্ষেও বৎসরান্তে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পত্তি বা উপঢৌকন দানে আগ্রহান্বিত হওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। আনুমানিক ৯০০ সালে ব্রেসিয়াতে সান্তা জিউলিয়ার ভূসম্পত্তি-সম্পকিত দলিলে দেখা যায় যে চৌদ্দজন স্বাধীন কৃষক তাদের ক্ষেতখামার প্রতিষ্ঠানটির কাছে তুলে দিয়ে শর্তসাপেক্ষে তা পুনর্গ্রহণ করে সেখানে কৃষিকাজ অব্যাহত রেখেছিল। ভূ-সম্পত্তির এ জাতীয় বন্দোবস্ত করার পেছনে সতত সক্রিয় ছিল অনটন, শান্তি ও অনিশ্চয়তার আতঙ্ক, আর ক্ষেত্র বিশেষে শুধু ধর্মীয় প্রেরণা। 

ভূস্বামী-প্রভুগণ শুধুমাত্র নবার্জিত অধিকার লাভেই সন্তুষ্ট থাকার পাত্র ছিলেন না। প্রাচীন জার্মান প্রথা ব্যান (ban)-এর মতো বহু রীতিনীতির সুযােগ গ্রহণ করে তারা শরণাগত প্রজাদের ওপর নিত্য নতুন অধিকার প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেছিলেন। ৯ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্ষেতখামারের শস্য উৎপাদন চালু রাখার এই নতুন ব্যবস্থায় লাভবান, পরাক্রান্ত ভূ-স্বামীগণ কখনাে স্বার্থান্ধ ও নির্মম উপায়ে, কখনো বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের অক্ষমতা ও ঔদাসীন্যের সুযােগে অপরিসীম ক্ষমতার অধিশ্বর হয়ে উঠলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রভুর মধ্যযুগের ইউরােপ খাস জমিতে বেগার খাটা ছাড়াও কৃষিজীবীদের ওপর আরোপিত দায়দায়িত্বের মধ্যে (ফরাসী ভাষায় banalités) ছিল প্রভুর যাতাকলে শস্যাদি চূর্ণ করা, তার রুটি তৈরির কারখানায় নিজেদের রুটি তৈরী এবং তার ‘winepress’এ দ্রাক্ষা পেষাই করতে বাধ্য থাকা এবং এজন্য প্রভুকে অর্থ দেয়া, এমন কি গৃহপালিত পশুদের প্রজননের জন্যেও তারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রভুর গৃহপালিত পশু ব্যবহার করতে বাধ্য ছিল। banalités ছাড়া সিভেজ (Chevage) বা ‘তেই’ (taille) নামক করের প্রবর্তন আরম্ভ হয় ক্যারোলিঞ্জীয় অধ্যায়ের শেষ লগ্নে। সিভেজ (বার্ষিক মাথাপিচু কর) পূর্বে শুধুমাত্র মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেদের পক্ষেই দেয় ছিল, এর সঙ্গে পরে ‘রিলিফ’ নামক কর যুক্ত হয়ে ভিল্যন-সার্ফদের উপর প্রবর্তিত হয়। ক্যারোলিঞ্জীয় শাসন শেষ হওয়ার পর ভূস্বামীগণ, বিশেষ করে ফ্রান্সে, বিভিন্ন খাতে রাজস্ব গ্রহণ না করে স্যঁস (Cens) বা বার্ষিক রাজস্বরূপে অর্থ গ্রহণ করতেন। জার্মানীর তুলনায় ফ্রান্সে এইসব করের চাপ ১২শ শতকের মধ্যেই সহ্যাতীত হয়ে ওঠে। তবে বেগার খাটানোর অজুহাতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটলেও জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য পরিবার পিছু দায়দায়িত্বের সামান্য হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটে।

তাছাড়া ম্যানরগুলো সব সময়েই এক বা একাধিক গ্রামের সবটুকু নিয়েই গড়ে উঠতো না, একটি ম্যানরের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামের কিছু কিছু অংশ বা একটি গ্রামের অংশ বিশেষের ওপর একটি ম্যানরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এই অবস্থায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে ম্যানর-প্রভুদের আনুগত্য সেবা ইত্যাদির সম্পর্ক অতি জটিল হয়ে দাঁড়াতো। শাসন ক্ষমতা এভাবে ঘন সন্নিবিষ্ট হওয়ায় বা ক্ষেত্র বিশেষে তার অধিক্রমন হওয়ায় প্রজাদের দায়দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অসংখ্য বাস্তব অসুবিধা দেখা দিতো। আবার এ সমস্ত কিছুর ওপর কোথাও কোথাও দেখা যেতো পুরনো শাসন বিভাগীয় কর্মচারীদের অধিকার-ক্ষেত্র যা ভূ-সম্পত্তির সীমানার ভিত্তিতে নয়, শুধুমাত্র ভৌগােলিক ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কতৃত্বের এই পরস্পর-বিরোধী দাবী দাওয়ার সঙ্গে ম্যানরের মধ্যে এজমালী জমি, অ্যালড এবং ভিরগেটের (Virgate) অবস্থিতি গ্রমীণ সমাজে শাসনতান্ত্রিক অংস্থা অতি গ্রন্থিল করে তোলে। ভিল্যান-সার্ফগণের সমস্যা বৃদ্ধি ছাড়াও এই প্রাতিষ্ঠানিক বৈচিত্র্য সামন্ততন্ত্রের বিকাশের ওপর যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল তা সন্দেহাতীত।

ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই যে সুবিশাল ভূসম্পত্তি গড়ে উঠেছিল এবং যেখানে প্রতিদিন ভূস্বামী প্রভু বা ম্যানর-লর্ডের অধীনে সহস্র সহস্র মানুষ কর্মরত ছিল সেগুলোর চরিত্র অবশ্যই সর্বত্র অভিন্ন ছিলনা। ভৌগলিক, রাষ্ট্রনৈতিক কারণে, ভূ-সম্পত্তির আকৃতি-প্রকৃতির বৈসাদৃশ্যের জন্য এগুলোর পরিচালনা-ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য গড়ে ওঠে। এ জাতীয় ভূমিগুলো সাধারণত তিনটি ভাগে বিভক্ত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হতো : মানবপ্রভুর খাস জমি (demensne), ভিল্যান-সার্ফদের মধ্যে বন্দোবস্ত করে দেওয়া জমি এবং কমনল্যান্ড আব অনাবাদী এজমালী জমি ও অরণ্য। এই সমগ্র অঞ্চলের কৃষি এবং খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ব্যবস্থা (খামার, গোলা, খাটাল, কামার, ছুতোর প্রভৃতির কর্মশালা, যাঁতাকল ইত্যাদি) ভূস্বামী প্রভুর বাসগৃহ (manor-house) থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ম্যানর হাউস প্রায় সর্বত্রই প্রকার বেষ্টিত হওয়ায় সুরক্ষিত থাকতো (লাতিনে-এগুলিকে বলা হতো Curtis, এবং ইতালীতে এবং জার্মানীতে যথাক্রমে পরিচিত ছিল Corte এবং Hof নামে)। ভাইকিংরাই প্রথম ‘manoir’ শব্দটি ভূ-স্বামী প্রভুর বাসগৃহ বােঝাতে ব্যবহার করতে শুরু করে, কালক্রমে সমগ্র ভূসম্পত্তিটিই ঐ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। খাস-জমিতে কৃষি উৎপাদন সাধারণত ভিল্যন-সার্ফ দ্বারাই পরিচালিত হলেও প্রায়ই দাসদের বা মজুরী দিয়ে অতিরিক্ত ‘জন’ নিয়ােগের প্রয়োজন দেখা দিতো। অবশ্য ৯ম শতক থেকে দেখা যায় যে প্রজাদের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করার সময় খাস জমিতে অধীনস্থ প্রজাদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষেতখামারের কাজ করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বেগার খাটুনীর সময় সর্বত্র একই ছিল না। কোথাও সপ্তাহে তিন দিন, কোথাও তারও বেশি দিন প্রভুর জমিতে কৃষিকাজ করতে বাধ্য হতো অধীনস্থ প্রজাগণ। এছাড়া শস্য সংগ্রহের কালে অতিরিক্ত লােকজনের প্রয়োজন হওয়ায় কৃষক-পরিবারের একাধিক মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে খাস-জমিতে পরিশ্রম করতে হতো। নর্মান-বিজয়ের আগে ইংল্যান্ডে ‘famuli’ শ্রেণীভুক্তদের দিয়ে (এদের সামাজিক অবস্থা প্রায় দাসেদের মতোই ছিল) এই জাতীয় সমস্ত কাজ করানোর প্রথা ছিল বলে জানা যায়। তবে মহাদেশে কৃষিকর্মরত দাস শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা এই সময়ে উল্লেখযােগ্য ভাবে কমে গিয়েছিল। ‘ফার্ফা’ (Farfa) ম্যানরে দায়বদ্ধ প্রজার সংখ্যা ছিল ১৪০০, দাসের ১৩। আবার এই দাসের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল লর্ডের পারিবারিক কাজকর্মে নিযুক্ত। সান্তা জিউলিয়ার বিশাল ভূ-সম্পত্তিতে ৪৭৪১ জন প্রজার মধ্যে দাস ছিল ৭৪১ জন। অঞ্চল বিশেষে ১১শ শতকের পর দিন-মজুরী দিয়ে ‘জন’ নিয়ােগই প্রথা হয়ে উঠেছিল।

ভিল্যান-সার্ফদের দায়দায়িত্ব কিন্তু শুধুমাত্র ক্ষেতখামারের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। ম্যানর-লর্ডের নানাবিধ প্রয়ােজন মেটাতেও বাধ্য ছিল তারা। তার পশুবাহিত শকটগুলি সচল রাখা, কাঠ এবং কাঠের যন্ত্রাদি সরবরাহ করা, চাক থেকে মােম সংগ্রহ করার কাজ প্রায় সর্বত্রই তাদের দিয়েই সম্পন্ন করা হতো। মুক্তিপ্রাপ্ত দাস এবং তাদের আত্মীয় পরিজনকে নিযুক্ত করা হতো প্রভুর কর্মশালায় (workshop)। তাঁত-ঘরে কাপড় বােনা বা পশম ব্যবহারযােগ্য করা, ধাতু নির্মিত যন্ত্রাদি তৈরীও (কোদাল, লাঙল, ইত্যাদি) বাদ যেতো না। এ সব ক্ষেত্রে লর্ডের দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র কাঁচামাল সরবরাহ করা। ভিল্যান-সার্ফদের সামাজিক কাজকর্মও ম্যানর লর্ডের বিনা অনুমতিতে সম্পাদিত হতো না। কন্যার বিবাহ অথবা পুত্রের যাজক-বৃত্তি অবলম্বনের (যদিও এ জাতীয় ঘটনা ছিল অতি বিরল) পূর্বে ভূ-স্বামীর সম্মতি লাভ (অবশ্যই অর্থদানের বিনিময়ে) আবশ্যকীয় ছিল। কৃষকপরিবারস্থ কোনও রমনীর আচার-ব্যবহারে ত্রুটি ঘটলে তাকে জরিমানা দিতে হতো। এ জাতীয় অসংখ্য নিয়মকানুন প্রতিনিয়ত ভিল্যান-সার্ফদের ম্যানর লর্ডের প্রতি নিঃসীম বশ্যতার প্রতীক হয়ে উঠছিল।

ভিল্যান-সার্ফশ্রেণীভুক্তগণের মধ্যেও স্তরবিভাগ ১২শ শতক থেকে শুরু হয়েছিল। এদের মধ্যে সব থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল সেই সব প্রজাগণ যারা পরাক্রান্ত ভূস্বামীর শরণাপন্ন হয়েও নিজেদের ক্ষেতখামার সমর্পণ করেনি। জার্মানীতে মান্টমেন (muntmen) নামে পরিচিত এই শ্রেণীর প্রজারা যথেষ্ট মর্যাদা ভোগ করতো। ফ্রান্সে commendes শ্রেণীভূক্তগণ মান্টমেনদের সমগােত্রীয় হলেও কালক্রমে সাধারণ ভিল্যান-সার্ফদের সঙ্গে তাদের সব পার্থক্যই অবলুপ্ত হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে ‘socman’, জার্মানীতে ‘landasse’, এবং ফ্রান্সে ‘libre vilain’-দের নিজেদের উর্ধ্বতণ-প্রভু নির্বাচনের স্বাধীনতা ছিল এবং বন্দোবস্ত করা জমিতে কৃষি উৎপাদন ছাড়া ম্যানর প্রভুর অন্য কোনও ব্যক্তিগত কাজে তাদের বেগার খাটানো ছিল অবৈধ। এদের থেকেও বেশি সৌভাগ্যবান ছিল অ্যালডের (allod) মালিকগণ। এদের আনুগত্য নিবেদিত হতো সরকারের উদ্দেশ্যে, কোনও সমস্ত-প্রভুর নিয়ন্ত্রণ এই শ্রেণীভুক্তদের ওপর প্রযুক্ত হতো না। কোথাও কোথাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূ-সম্পত্তির অন্তভুক্ত কৃষক-প্রজাগণ স্ব স্ব ক্ষেতের উৎপন্ন শস্য ভােগ করতে পারতো, তবে প্রধান প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় তাদের গীর্জা বা মঠে মােম সরবরাহ করতে হতো।

আল্পসের দক্ষিণে বেশ কিছু অঞ্চলে লিখিত চুক্তি অনুযায়ী স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী জমি বন্দোবস্তের কথা জানা যায়। পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনজনিত বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও এই জাতীয় কিছু লিখিত দলিলপত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। লিভেলো (Livello) নামক চুক্তি অনুযায়ী জমির বন্দোবস্ত করা হতাে ২৯ বছরের জন্য এবং চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হলে নতুন করে আবার তা চালু করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এদের অস্তিত্ব ইতালীতে ভূমিদাস প্রথার অনুপস্থিতি প্রমাণ করে না। ক্যাটালােনিয়াতেও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ভিল্যান=সার্ফদের দ্বারাই শস্য উৎপাদনের প্রথা ছিল, যদিও কাস্টিল, লাইঁয়াে এবং অস্টুরিয়াতে ভিল্যান-সার্ফদের সঙ্গে ভূ-স্বামীদের সম্পর্ক ছিল শিথিলতর। অনেক ক্ষেত্রে অধীনস্থ প্রজার সঙ্গে প্রভুর সম্পর্ক নিরূপিত হতো বন্দোবস্ত করা জমির আয়তনের ওপর। ‘Bordiers’ এবং ‘Cothars’ শ্রেণীর ক্ষুদ্র ক্ষেতগুলো প্রভুর পূর্ণ অধীনতা স্বীকারের শর্তেই প্রজাগণ গ্রহণ করতো। এধরণের ব্যবস্থা প্রায় সার্বজনীন হয়ে উঠলেও বেশ কিছু অঞ্চলে কিছু কিছু গ্রাম ভূস্বামীর কর্তৃত্বের বাইরে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে কৃষি উৎপাদনে নিযুক্ত থাকতো। এসব এলাকার কৃষিজীবীদের সামাজিক অবস্থা, বলা বাহুল্য, অনেক বেশি উন্নত হতো।

কিন্তু যে সমস্ত অঞ্চলে ম্যানর গড়ে উঠেছিল সেখানে মুষ্টিমেয় ম্যানরলর্ড প্রাচুর্য ও বিলাসিতার মধ্যে, অসংখ্য ভিল্যান-সার্ফের নিত্য-সেবায় স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাতেন। অবসরকালে যুদ্ধ বিগ্রহ করে, অধীনস্থ প্রজাদের ওপর প্রভুত্ব ফলাতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সামাজিক দিক থেকে, অন্তত ১২শ শতক পর্যন্ত এই প্রভু-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তাদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে অনেক দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও ম্যানর-প্রভু বদান্যতা প্রদর্শনে কুণ্ঠিত হতেন না এবং পরোক্ষভাবে বহু ম্যানর জীবিকা নির্বাহের সুযােগও তারা করে দিতেন। ম্যানর গড়ে ওঠার আদি যুগেও কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের কোনও সমতা ছিল না। এর প্রধান কারণ অবশ্যই তাদের ক্ষেতখামারের আয়তন, জমির উর্বরতা, অনুর্বরতা এবং ম্যানর-প্রভুর অধিকার প্রয়োগের তারতম্য। পপারিংঘি (Poperinghee) নামক স্থানে প্রতিটি কৃষক পরিবারের জমির আয়তন ছিল ১৭ থেকে ৩০ হেক্টর, আবার সেইন্ট জারমেইন ডেস প্রেসের (St Ger niain des Pres) অ্যাবির অধীন চারটি গ্রামে কৃষকদের জমির অতন ৪.৩৫ থেকে ৯.৬৫ হেক্টরের বেশি ছিল না। তা ছাড়া কৃষিক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যারও কৃষকদের জীবনযাত্রার মান নিরূপণে একটা ভূমিকা ছিল। বিশাল ক্ষেত কর্ষণ করার জন্যে ম্যানর-প্রভু বেশির ভাগ সময়েই গাে-মহিষ-অশ্বাদি সরবরাহ করতেন। কিন্তু মনুষ্যেতর কোনও প্রাণী পাওয়া যাক বা না যাক কৃষককে কোদাল বা হাের (hoe) সাহায্যে জমি বীজবপনের উপযােগী করতে হতো। এ ছাড়া পশমী বস্ত্র তৈরীর জন্য ভেড়ার লোম সংগ্রহ তার অসংখ্য বেগার খাটুনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনাবাদী অঞ্চলে, জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ আরম্ভ হলে, বলা বাহুল্য, তাদের দুর্দশার অন্ত থাকতো না। কৃষক পরিবারের উদ্বৃত্ত সময়টুকু অধিকাংশই ম্যানর-প্রভুর সেবায় নিয়োজিত করতে হতো।

তবে ম্যানর-গ্রভু কর্তৃক কৃষকগণকে জমি থেকে উৎখাতের ঘটনা এই সময়ে বিরল ছিল। সাধারণত কৃষিজীবীদের বংশানুক্রমিকভাবে একই জমিতে কৃষি উৎপাদনে রত থাকতে দেখা যেতো। তবে দাস বংশোদ্ভুতগণের ক্ষেত্রে জ্ঞাতিদের অধিকার স্বীকারে ভূ-স্বামীগণ রাজী হতেন না। এ ছাড়া উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধিবিধানগুলো স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারেই নিয়ন্ত্রিত হতো এবং ভূ-সম্পত্তি অবিভক্ত রাখা ছাড়া ম্যানর-প্রভু এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন না। অবশ্য ম্যানর গড়ে ওঠার এই পর্বে কৃষিযোগ্য ভূমির প্রাচুর্য ও জনসংখ্যার স্বল্পতার জন্য পারিশ্রমিক দিয়ে জনমজুরের সাহায্যে বিশাল ভূসম্পত্তিতে কৃষি উৎপাদনের অসুবিধা ও ব্যয়বাহিল্যের কথা চিন্তা করেও তারা ভিল্যান-সার্ফদের উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ভোগ দখলের কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন না। নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কৃষি উৎপাদনের থেকে নিজ ভরণপোষণে সক্ষম দায়বদ্ধ কৃষিজীবী দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে কৃষিকাজ সম্পন্ন করা তাদের পক্ষে একই সঙ্গে লাভজনক ও স্বস্তিকর ছিল নিঃসন্দেহে।

ফরাসী ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ ম্যানরগুলোর আয়তন বৃদ্ধির বিভিন্ন কারণের কথা আলোচনা করেন। যাজক ও অযাজক ভূস্বামীদের আপন আপন নিয়ন্ত্ৰণাধীন এলাকার বিচার বিভাগীয় ও রাজস্ব সংগ্রহের বিশেষ সুবিধাদানের প্রথা ফ্রাঙ্ক শাসন ব্যবস্থারই একটা অঙ্গ ছিল। এই সমস্ত ভূসম্পত্তি কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন ছিল এবং এগুলোর সীমানার মধ্য উল্লেখযােগ্য আয়তনের অ্যালডিয়াল (allodial বা নিস্কর ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত) ভূ-সম্পত্তির অবস্থানও বিরল ছিল না। এ জাতীয় অবস্থিতির জন্য রাজকর্মচারীদের পক্ষে এইসব নিষ্কর ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত ভূ-সম্পত্তির সঙ্গে যােগাযােগ রাখা দুরূহ, প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠায় কালক্রমে শাসকের সম্মতিতে সেগুলোও ম্যানরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া ম্যানরের আয়তন বৃদ্ধির জন্য বলপ্রয়ােগের ঘটনা তো ছিলই। ডুমসডে বুকে (Doomsday Book) প্রাক্‌-নর্মাণ বিজয় ও পরবর্তীকালের জমি সংক্রান্ত যে সমস্ত তথ্য বিধৃত আছে তার থেকে দেখা যায় যে এই অল্পকালের মধ্যে পরাক্রান্ত ভূস্বামী কর্তৃক প্রতিবেশী কৃষিজীবীদের ছােটখাট ক্ষেতখামার অনায়াসে এবং বিনা বাধায় গ্রাস করা হয়েছে সংখ্যাতীত ক্ষেত্রে। স্বেচ্ছায়, চুক্তি করে নাইট (Knight) কর্তৃক ‘অ্যালড’ ‘ফিফে’ পরিণত করার মতো বহু অ্যালডের কৃষিজীবী মালিকও প্রভাবশালী ম্যানর-প্রভুর কাছে জমি সমর্পণ করে, আবার তার ভূমিস্বত্ব লাভের ফলেও ম্যানরের বিস্তার হয়েছিল। মার্ক ব্লখের ধারণা যে সব অঞ্চলে ম্যানর প্রথা প্রায় পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় প্রবর্তিত হয়েছিল সেখানে তার প্রবল ও অতি-সজীব অস্তিত্বের ফলে ক্ষুদ্র ও সামান্যের পক্ষে আত্মসমর্পণ হয়ে উঠেছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।

রাজশক্তি ও সামন্ততন্ত্র

মধ্যযুগীয় ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের এই ক্রমােন্নত স্তরের যে কাঠামাে গড়ে উঠেছিল তার মতে, অস্বাভাবিক মনে হলেও, শীর্ষবিন্দুতে অধিষ্ঠিত উর্ধ্বতম প্রভু-রাজশক্তিই হিল দুর্বলতম। সামন্ততান্ত্রিক তত্ত্বানুযায়ী মধ্যভূস্বামীদের ওপর মুখ্য ভূস্বামীদের, বা ভিল্যন-সার্ফদের ওপর মধ্যভূস্বামীগণের অধিকারের মাত্রার হেরফের থাকলেও তার চরিত্র প্রায় সর্বত্র ছিল অভিন্ন। কিন্তু উর্ধ্বতম প্রভু বা রাজা নিজ ভাসালগণের সঙ্গে আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার শপথের সূত্রে আবদ্ধ হলেও সমাজে স্তর বা শ্রেণীগত সম্পর্কের দায়দায়িত্বের সংবদ্ধতার জন্য এবং সেগুলো অনুক্ষণ সক্রিয় থাকায় সর্বশ্রেণীর প্রজাপুঞ্জের থেকে তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্ন। রাজশক্তি কখনােই সামগ্রিক ভাবে প্রজাবৃন্দকে স্পর্শ করতে পারতাে না, কেননা অসংখ্য মধ্যকের মধ্যে বন্টিত হয়ে গিয়েছিল তার অধিকার। স্বীয় খাসভূসম্পত্তিতে সর্বময় প্রভু হলেও সমগ্র দেশে সার্বভৌম ক্ষমতা-রহিত হয়ে তিনি একটি প্রতীকে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। আর এই ভূমি থেকে সংগৃহীত রাজস্বটুকুই ছিল তার নিয়মিত আয়ের প্রধান উৎস। সামরিক প্রয়োজন ছাড়া তিনি তার ভাসালগণের কাছে সেবার (Service) দাবি করতে পারতেন না। অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র রাজশক্তিকে সামন্ততন্ত্রজাত এই নিষ্ক্রিয়তা ও অসহায়তার অভিশাপ সহ্য করতে হয়নি। আপন শক্তির স্থায়িত্ব এবং রাজদণ্ডের মর্যাদা রক্ষার উপায় কোনও কোনও দেশের শাসক খুঁজে পেয়েছিলেন যদিও তাদের সাফল্যের মাত্রা সর্বত্র অভিন্ন ছিল না। কিন্তু এই ধরণের রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থায় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল, দেশ শাসনের লক্ষ্য ও পদ্ধতি নিয়েছিল সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে। ধ্রুপদীযুগের শেষ পর্বে ও মধ্যযুগের শুরুতে রাজশক্তির একান্ত বশংবদ ও সহায়ক – চার্চ রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামাের অন্যতম অচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে আপন ভূমিকা পালন করতো কিন্তু ৯ম শতকের শেষার্ধ থেকেই সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং এই ব্যবস্থার অলঙ্ঘনীয় বিধিবিধানের প্রভাবে তা স্বতন্ত্র ও স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অবশ্য ভ্যাসালগণের ওপরে শাসন-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের নতুন এই ভূমিকা সত্ত্বেও চার্চ অগণিত মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের নিয়ন্তারূপে তার প্রভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। আর ভূ-সম্পত্তির স্বার্থ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষার জন্য, অযাজক ভূম্যধিকারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিরােধের জন্য সামরিক সাহায্য-ব্যবস্থার দায়িত্ব বহন করতো তার অগণিত ভ্যাসালগণ। অবশ্য সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই রাজশক্তির দুর্বলতার একটি নিঃসীম, অফুরন্ত এবং স্বাভাবিক উৎস ছিল এ ধারণা পােষণ করা অযৌক্তিক। অলিভিয়ার মার্টিন (M. Olivier Martin) লিখেছেন যে ভ্যাসাল প্রথা এবং রাজশক্তির সত্তা পরস্পর বিরোধী বা একে অন্যের জাতশত্রু ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক বিধানাবলীর মধ্যে এমন বহু উপাদানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলোকে আপন শক্তিবৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করা রাজার পক্ষে সব ছিল। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপন স্বার্থসিদ্ধির কাজে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করেছিলেন শাসকবর্গ, কিন্তু জার্মানিতে ভিন্নতর পরিবেশে, পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় রাজশক্তির পক্ষে সামন্ততন্ত্রের বশীভূত হওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। ইতিহাসের ধারার এই বৈচিত্র্যের জন্য একই প্রতিষ্ঠানের দ্বিমুখী ভূমিকা মধ্যযুগের সামাজিক বিকাশকে নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক করে তুলেছিল।

শিভ্যলরী

মধ্যযুগীয় সমাজের বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা, সমকালীন মানুষের চোখে যা অন্তহীন বলে মনে হতো, এবং যার ফলে আত্মরক্ষার্থে অতিবর্গের অনুচর পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা, ও আরও পরে, ভ্যাসাল প্রথা সৃষ্টি হয়েছিল, তাই ১৩শ শতকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছিল। সম্ভ্রান্তগণের উচ্চকুলজাত যোদ্ধা (Knight) দ্বারা পরিবৃত থাকার প্রবণতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল ‘flower of feudalism’ রূপে বন্দিত শিভ্যলরী (Chivalry)। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অভিজাত বংশীয় তরুণদের অশ্বারোহণ, মৃগয়া ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলাই ছিল তাদের শিক্ষাদীক্ষার প্রধান অঙ্গ। তা ছাড়া পরাক্রান্ত কোনও লর্ডের পার্শ্বচর রূপে নিযুক্ত হয়ে তার বিভিন্ন প্রয়োজনে সশরীরে উপস্থিত হওয়া এবং অধস্তনদের শাসনে সাহায্যে করা, রাজসভা বা গণ্যমান্যের সমাবেশে পরিশীলিত আচারব্যবহার করা তরুণদের কর্তব্য বলে মনে করা হতো। এসব বাস্তব প্রয়ােজন সিদ্ধ করা ছাড়াও এই প্রথা বা রীতিনীতির মধ্যে মহত্তর কিছু অনুভূতির সঞ্চার করেছিল শিভ্যলরী। অল্পবয়সী এসব শিক্ষার্থী-যােদ্ধার মধ্যে উচ্চবংশোচিত গুণাবলীর বিকাশে সহায়তা করা, মহৎ আদর্শের বাস্তবরূপায়ণের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তোলা, ভাবী-নাইটদের নিবেদিতপ্রাণ রূপে সৃষ্টি করা ছিল শিভ্যলরীর মর্মকথা। রাজসভা বা লর্ডের দুর্গের সঙ্গে যুক্ত, বংশ কৌলীন্যে বিশিষ্ট প্রায় সকলকে স্পর্শ করেছিল এই নতুন আদর্শ। নাইটদের জন্য এবং তাদের কেন্দ্র করেই শিভ্যলরীর বিকাশ হলেও তার প্রভাব হয়ে উঠেছিল দূরগামী, প্রতিষ্ঠা সুগভীর।

মধ্যযুগে মানব সমাজের শুভাশুভ যে এই অঙ্গুলীমেয় নাইটদের ওপর নির্ভরশীল সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলেন অসংখ্য মানুষ। এমনকি ধূসর অতীতেও যে অতুলনীয় শৌর্য ও প্রবল-প্রাণের নাইটদের অস্তিত্ব ছিল সে বিশ্বাসে স্থিত হয়ে জাঁ মলিনে (Jean Molinet) লিখেছেন যে দেবদূত মাইকেলের অসামান্য ও অলৌকিক কীর্তি কাহিনীর মধ্যেও নাইটদের আদর্শ প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। Froissart, Monstrelet, d’ Escouchy প্রভৃতির রচনায় আছে মধ্যযুগীয় সমাজের ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা, অতলান্ত স্বার্থপরতা ও নৃশংসতার পরিবেশে নাইটদের স্বার্থহীনতা, শৌর্য ও বীর্যের মহত্তম প্রকাশ, আর্ত ও অসহায়ের ত্রাণে তাদের সদা-তৎপরতার উচ্ছ্বসিত কর্ণনা। ভূলােক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে শিভ্যলয়ীর রীতিনীতি দ্বারা – এই মধুর মিথ্যাটিই হয়তো মধ্যযুগীয় রাজনীতির আবর্ত ও নগ্ন কুটিলতাকে ভুলে থাকার একমাত্র উপায় ছিল। 

‘শিভ্যলবী শব্দটি ‘Cavalry’-র সমার্থক এবং উভয়ের উৎপত্তি লাতিন শব্দ ‘Caballus’ (horse) থেকে। শব্দটির অর্থই এ তথ্য পরিস্ফুট করে দেয় যে রুদ্ধ কক্ষে, নিরুপদ্রব পরিবেশে মস্তিষ্ক চর্চা নয়, আলস্যের শিথিল প্রহরাও নয়, কর্মচাঞ্চল্যই ছিল নাইটদের জীবনের মূলকথা। সর্বসাধারণের থেকে সদা পৃথক হয়ে থাকতো তার সম্ভ্রান্ত, বর্মাবৃত, অশ্বারোহী মূর্তিটি। নাইটদের এই বিশেষ ধরণের জীবনযাত্রার উৎস সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন সেকাল এবং একালের ঐতিহাসিকবৃন্দ। অনেকে ট্যাসিটাসের রচনায় বিভিন্ন জার্মান গোষ্ঠীর মধ্যে সমর বিদ্যায় আগ্রহী কিশোরকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত সাধারণ সভায় উপস্থাপিত করে তাদের যোদ্ধৃসম্প্রদায়ভুক্ত করার কাহিনীর প্রতি দৃশটি আকর্ষণ করেছেন। আনুগত্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে কোনও ‘বিশিষ্টের’ নিত্য-সহচর হওয়ার এই প্রথার সুন্দর বিকাশ হয়েছিল আরব অধিকৃত স্পেনে। শৌর্য ও আভিজাত্যের অনুশীলন, মহৎ আদর্শকে আপন আচরণে উদ্ভাবিত করার সাধনা, নারীদের প্রতি পরিশীলিত আচরণ এবং প্রেম ও সমরের জন্য আত্মবিসর্জনের সংকল্প ইত্যাদি অসামান্য গুণাবলির বিকাশে এই মুরগণ (Moor) প্রভাঁসের (Provence) নাইটদেরও ম্লান করে দিয়েছিলেন। এসব প্রভাব ছাড়াও সামন্ততান্ত্রিক রণনীতির আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে শিভ্যলরীর ব্যাপক প্রসার জড়িত ছিল বলে কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন। ১১শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে সৈন্যদের অশ্বারোহণে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপনীত হবার পর পদাতিক হিসেবেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যেত। প্রথা ছাড়া অশ্বগুলির অনুপযুক্ততাও এর জন্য দায়ী ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে উপযুক্ত (শক্তিশালী ও বেগমান) অশ্বের (charger, destrict) ব্যবহার চালু হওয়ায় ভারী বর্মাবৃত ও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত যােদ্ধাদের পক্ষে অশ্ববাহিত অবস্থাতেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভবপর হয়। অনেকের ধারণা যে বাইজানটাইন ‘Cataphracti’ শ্রেণীর অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীর দৃষ্টান্তেই পশ্চিম ইউরোপের রণ পদ্ধতির এই অমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। যুদ্ধাশ্বের এই ব্যাপক ব্যবহার স্বাভাবিক কারণেই যুদ্ধবিগ্রহে প্রধান ভূমিকা অভিজাত যােদ্ধাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। মূল্যবান অশ্ব ছাড়াও বর্ম, শিরস্ত্রাণ, ঢাল, তরবারি, বর্শা, রেকাব, জিন ইত্যাদির ব্যয়ভার বহন সাধারণ শ্রেণীর মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল। এভাবে যুদ্ধের এই অর্থনৈতিক দিকটি প্রথম থেকেই শিভ্যালরীর অভিজাত চরিত্র নির্ধারিত করে দেয়।

যুদ্ধ-বিদ্যার এ জাতীয় পরিবর্তনের কথা স্মরণ রেখেই অভিজাত বংশের বালকদের কোনও সম্ভ্রান্ত সামন্ত-প্রভুর সভার সঙ্গে যুক্ত করে (তখন সে dainoiseau রূপে পরিচিত হতো) অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে উচ্চবংশীর রীতিনীতিতেও অভ্যস্ত করে তােলার ব্যবস্থা হতো। Tournament বা দ্বন্দ্বযুদ্ধ ও শস্ত্র-ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ ছিল এ সময়ে তার নিত্যকর্ম। কিছু পরে, তরুণ বয়সে কোনও নাইটের পার্শ্বচর রূপে (Squire, ecuyer) তার যুদ্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ আসতো। এর পর উপযুক্ত সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আপন যোগ্যতা ও শৌর্যবীর্যের প্রমাণ দেখাতে পারলে তরুণটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে (Ceremony of adoubement) ‘নাইট’ অভিধায় সম্মানিত করা হতাে। নাইট হয়ে শিভালরীর আদর্শকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ-অধ্যবসায়ে স্বীয় আচরণে প্রকাশ করার সৌভাগ্য, বলা বাহুল্য জন্মগত ছিল না। এই সুবদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্যপদ আপন যােগ্যতাবলে অর্জন করতে হতো। গুণগত বিচারে উত্তীর্ণ সার্ফগণের কেউ কেউ বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে নাইট রূপে স্বীকৃত হলেও তা ছিল নিতান্তই ব্যাতিক্রম। তেমনি রাজকুলােদ্ভবগণ এই সম্মানিত অধিকার অন্মসূত্রে লভ্য বলে দাবী করলেও তা সব সময়ে স্বীকৃতি লাভ করতো না। ইংরেজ ঐতিহাসিক G. G. Coulton লিখেছেন, “The order was the blossom of a caste-system.” শিভ্যলরী যাদের আচার-আচরণে, জীবনযাত্রার প্রতি মুহূর্তে বিকীরিত হতাে সেই নাইটদের অসামান্য সম্মান ও মর্ধাদা ভােগের সঙ্গে সুকঠিন দায়িত্ব পালনও ছিল আবশ্যিক।

নাইটগণ একটি সংবদ্ধ সম্প্রদায়রূপে আবির্ভূত হবার পর এবং শিভ্যলরীর আদর্শ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হলে চার্চের দৃষ্টিও এ বিষয়ে আকর্ষিত হয়। মধ্যযুগে মানবজীবনের অন্যান্য আচার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে খ্রীস্টান চার্চ বহু ধর্মীয় রীতিনীতিও শিভালরীর আদর্শের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। অবশ্য সেকালে ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনও আন্দোলনের পক্ষে পূর্ণতা অর্জন সম্ভবপরও ছিল না। সে কারণে পূণ্যপ্রভ ও পবিত্ৰাত্মাদের জীবনাদর্শ অনুসরণও নাইটদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায়। তাদের মধ্যে বিশ্বাস, দাক্ষিণ্য ও নম্রতা (faith, charity এবং humility) প্রভৃতি গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে চার্চ এই অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠানটিকে আপন উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহারের জন্য, আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে শেষ পর্যন্ত শিভ্যলরী আপন অযাজকীয় সত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হলেও, নাইটদের প্রায়ই চার্চের সেবায় আত্মনিয়ােগ করতে দেখা যেতো। তাছাড়া ‘Knights of the Bath’ নামে নাইটদের একাংশ শুধুমাত্র চার্চের কাছেই আত্মনিবেদন করেছিলেন।

প্রবাস-প্রসূত উদ্বর্তন, পুরাকালের খ্যাতকীর্তি বীরগণের প্রতি-পদক্ষেপ অনুসরণ প্রায় প্রতিটি নাইটের জীবনের ধর্ম হয়ে উঠেছিল, আর প্রতিটি নাইটেরই জপমন্ত্রে পরিণত হয়েছিল রাজা আর্থারের কাহিনী। চার্লস দ্য বােন্ডেকে গায়েন (Gawain) এবং ল্যান্সলটের দৃষ্টান্তের মতাে আলেকজান্দার, হ্যানিবল ও সীজারের কীর্তিকাহিনীও আচ্ছন্ন করে রাখতো। তাদের সর্বাবস্থায় অকুতোভয় থাকা, ছলনা বা কপটবর্জিত রণনীতি অবলম্বন করা, মুখ-নিঃসৃত বাক্যকে প্রাণের থেকে বেশি মূল্য দেওয়া এবং শরণাগতকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করার অগণিত এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিগতদিনের ইতিহাস থেকে আহরণ করে নাইটদের জীবনে তা প্রতিফলিত করার প্রেরণা দিয়েছিল শিভ্যলরী। তাছাড়া ভােগ-বিলাসে ও সুখে বিগতস্পৃহ এবং দারিদ্রে অম্রিয়মাণ থাকার আদর্শও তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রিত করতো। উইলিয়াম জেমস লিখেছেন যে ঐশ্বর্য-লুব্ধতা থেকে মুক্তি এই অভিজাতদের জীবনে একটি পরমোজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। প্রাণ সম্বল করে (এবং প্রয়োজনে তাও তুচ্ছ করার মনােভাব নিয়ে) কিছুটা স্বপ্ন রাজ্যের বাসিন্দা এই নাইটদের জীবনে খ্রীস্টান সন্ন্যাসীর রিক্ততা ও বিষয়-আসক্তি-হীনতার স্পর্শ খুজে পাওয়া কঠিন নয়। বহু ক্ষেত্রে চার্চ নাইটকে ধর্মধারকে রূপান্তরিত করে তাকে পবিত্র ও শ্রীমণ্ডিত করে দিয়েছিল। কিন্তু ভূলােকের প্রয়ােজন সাধনের জন্য, পার্থিব সমাজের একটি অতি মূল্যবান অঙ্গ হিসেবে যার আবির্ভাব আধ্যাত্মিকতার গহনে তাকে আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। রণশক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে উদ্দীপিত নাইটের জীবনে পূর্ণতার সঞ্চার করেছিল একনিষ্ঠ, সর্বজয়ী প্রেম। নাইটের সকল কর্ম, সব প্রচেষ্টা, শৌর্যবীর্য প্রদর্শন ও আত্মবিসর্জনের জন্য তার সদাপ্রস্তুতি, তার ঈর্ষণীয় গুণাবলীর অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশের মধ্যে অন্তঃসলিলা ফগ্লুধারার মতো প্রবহমান ছিল মনােনীতা নারীর প্রতি তার হৃদয়ের আকূতি। মধ্যযুগীয় শিভ্যলরীর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছিল এই নাইট ও তার ‘লেডি-লাভ’ (Lady-love) এর সুমধুর সম্পর্ক। এই প্রার্থিতা নারী, (যাকে নাইটের অদেয় কিছুই ছিল না, যাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন উচ্ছ্বসিত হতো) কিন্তু নাইটের জায়া নন, কেননা পরিণয় ও প্রেমকে ভিন্ন করে রাখাই ছিল শিভ্যলরীর রীতি। আর এই আরাধ্যা নারীই ছিলেন নাইটের সকল ত্যাগ, বীরত্ব ও মহানুভবতার মহত্তম প্রেরণা। এই প্রেমের স্বীকৃতি লাভের জন্য বা তা স্বীকৃতি লাভে ধন্য হলে নাইট তার প্রেমিকার জন্য সর্বস্ব ত্যাগের, অসাধ্য সাধনের সাধনা করতেন আজীবন। শিভালরীর প্রধান উপজীব্য এই অসামাজিক, পরকীয়া ও চার্চ-অসমর্থিত প্রেমই সেকালের চারণ-কবিদের (উঃ ফ্রান্সের trouvéres, দঃ ফ্রান্সের troubadours, জার্মানীর minnesingers) রচনার প্রধান প্রেরণা। আর বাঞ্ছিতার প্রতি শ্রদ্ধাস্নিগ্ধ আচরণই নারী জাতির প্রতি নাইটদের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাদের প্রতি সম্ভ্রমবােধ, তাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় অতন্দ্র মনােযােগ, জীবনের বিনিময়ে তাদের সঙ্কট-ত্রাণের অঙ্গীকার শুধু নাইট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাকে সমগ্র ইউরােপীয় সমাজের একটি মহৎ উত্তরাধিকারে পরিণত করে দিয়েছিল এই শিভ্যলরী।

কিন্তু প্রতিটি খ্রিস্টানের পক্ষে যেমন নিজ জীবনে ধর্মীয় আদর্শ উদ্ভাবিত করা সম্ভব হয়নি তেমনি প্রত্যেক নাইটের পক্ষেও সম্ভব হয়নি শিভ্যলরীর সমস্ত শর্ত পালন করে নিজ জীবন অম্লেয় রাখা। মানব জীবনের আদিম প্রবৃত্তিগুলো, অসংযম ও অহঙ্কারের পথ বেয়ে কলুষিত করে দিয়েছিল অসংখ্য নাইটের জীবন। সম্মুখ সমরে বীরত্ব ও মহত্ত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরক্ষণে নৃশংস হত্যাপরাধে অপরাধী হয়েছেন অনেকে, আত্ম-সম্মান বােধের অতুলনীয় প্রকাশ যার মধ্যে ঘটেছে তিনিই হয়তো ল্যান্সলট বা ট্রিস্টামের মতো ব্যাভিচারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন একাধিক সুখী পরিবার, দুর্বলকে অসহায়কে রক্ষা করা যাদের দ্বিতীয় ধর্ম বলে বিবেচিত হতো, তাদের অনেকেই অনভিজাত বলে, কায়িক পরিশ্রমে রত বলে অবজ্ঞা করেছেন দীন-দরিদ্রকে, তুচ্ছ কারণে সংহার করেছেন নিরস্ত্র কৃষককে। আভিজাত্য-বােধ নাইটদের মানবিকতাকে আচ্ছন্ন করেছে বার বার, বহুকাল ধরে, পশ্চিম ইউরােপের সর্বত্র। জার্মান কবিগণ যখন শিভ্যলরীর বন্দনায় মুখর তখনই হয়তাে অসংখ্য জার্মান নাইটকে অকারণ হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযােগের পৈশাচিক আনন্দ উপভােগ করতে দেখা গেছে। ক্রুসেডে যে সমস্ত নাইট অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শিভ্যলরীর সামান্যতম প্রভাবও খুঁজে পাওয়া সুকঠিন ছিল। এদের নিষ্ঠুরতা, অর্থলিপ্সা ও ক্ষুদ্রতা শিহরিত করে দিয়েছিল সমসাময়িক মুসলমান সমাজকে। অবশ্যই এরা ছিলেন ব্যতিক্রম, কিন্তু এই ভ্রষ্টদের সংখ্যাও নিতান্ত নগণ্য ছিল না।

প্রায় সমস্ত ১৩শ শতাব্দী ধরে ফ্রান্সের রাজন্যবর্গ ও আভিজাত ভূস্বামীদের দরবারই ছিল শিভ্যলরীর লালনক্ষেত্র। বলা বাহুল্য রাজনীতির অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত ফরাসীরাজ এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহান্বিত হননি। ইংল্যান্ডের অবস্থাও অনুরূপ ছিল, কিন্তু জার্মান অভিজাতবর্গের আর্থিক সংগতি ও অবসর এ জাতীয় দরবার গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। নাগরিক জীবন-যাত্রায় অভ্যস্ত ইতালীয় আভিজাতগণ শিভ্যলরীর সামরিক দিকটি ব্যবহারেই বেশী আগ্রহান্বিত ছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে, শিভ্যলরীকে বিকশিত করে তােলার পরিবেশ ১২শ শতক থেকেই তৈরী হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাদীক্ষার প্রসারের সঙ্গে এ অঞ্চলের ধনী-ভূস্বামীদের পক্ষে নাইটদের জন্য নানাবিধ অনুষ্ঠানের (অস্ত্র ক্রীড়া, দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ প্রভৃতি) আয়ােজন করা এবং চারণ কবিদের পৃষ্ঠপােষকতা করা সম্ভবপর হয়েছিল। আর এখানেই শিভ্যলরীর ললিত দিকটিকে বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায়। নাইটগণের পৃষ্ঠপােষকদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন সার্থক কবি এবং বার্ট্রান দ্য বর্নের (Bertran de Born) মতো ক্ষুদ্র সামন্ত-প্রভু এবং রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের মতো রাজা (তার শিক্ষাদীক্ষা হয়েছিল আঁকুতাতে) ‘ত্রুবাদুর’ রূপে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আঁকুতার কাউন্টেস ইলিয়েনরের দরবার উত্তর ফ্রান্সে শিভ্যলরীর আদর্শ প্রসারের কৃতিত্ব দাবী করতে পারে।

আঁকুতার কাউন্টেস এলেনরের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সাথে শিভ্যলরীর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সম্পর্ক আছে আদিনারীবাদেরও। এলেনর অফ অ্যাকুইটাইন (Eleanor of Aquitaine, ১১২২ বা ১১২৪ খ্রি. – ১২০৪ খ্রি.) ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে রাণী থাকার সময়কালে সেই দুই দেশে কোর্টলি লাভ (courtly love) এর ধারণা নিয়ে এসেছিলেন। কোর্টলি লাভ হচ্ছে একটি সাহিত্যিক ধারণা যার দ্বারা সম্ভ্রান্ত নারীদের বিবাহবহির্ভূত প্রেমসর্বস্ব ভালোবাসাকে বোঝানো হয়। সেসময় সম্ভ্রান্ত পরিবারে, বিশেষ করে রাজকীয় পরিবারে প্রেম করে বিয়ে হতোনা, বিবাহ ছিল অভিভাবকদের মধ্যকার চুক্তির মতো। বিবাহ হতো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে। সম্ভ্রান্তদের এই বিয়েতে প্রেম সম্পর্কে যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে তা সেভাবে ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহের পর দেখা যেতো স্বামী তার হৃদয় কোন মিস্ট্রেসকেই দান করে রেখেছেন, স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক নামমাত্র। এই অবস্থায় সম্ভ্রান্ত নারীদের মধ্যে প্রেমের অভাব দেখা যায়, এই পরিস্থিতিতেই নাইট ও চারণ কবিদের সাথে তাদের দেহহীন রোমান্টিক প্রেমের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা এতক্ষণ পড়ে বুঝে গেছেন শিভ্যলরীরই একটি অংশ ছিল, এই প্রেমকেই অনেকে কোর্টলি লাভ বলেছেন। কোর্টলি লাভকে তাই বৈবাহিক সম্পর্কে যে ভালোবাসার অভাব রয়েছে তার প্রকাশের একটা উপায় বলা যায়। সেই সময় লিরিক কবিতাগুলোতে কোর্টলি লাভ এর ধারণা তৈরি হয় ও সম্ভ্রান্তদের মধ্যে এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ভালোবাসায় শারীরিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল, কেবল কেবল দেহহীন প্রেমই অনুমোদিত ছিল। তবে কিছু কিছু সাহিত্যে দৈহিক সম্পর্কও দেখা যায়। এলেনরই যে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে কোর্টলি লাভ এর ধারণা প্রথম প্রচলন করেন তা জোড় দিয়ে বলা যায় না, কিন্তু তিনি যে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ছিলেন ও এর পেছনে তার একটা বিশাল অবদান আছে তা স্বীকার করতেই হয়।

সাহিত্যে এরকম প্রেমের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন এলেনরের পয়টিয়েরস শহরের কোর্টে কোর্টলি লাভের চর্চা হত। এরকম সাহিত্যগুলোতে শিভালরি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। শিভালরি দ্বারা নাইটদের আচরণবিধি বোঝানো হলেও নারীদেরকে সম্মান করাও সেসময় শিভালরির অংশ হয়ে ওঠে। আর সেটা সেই সময়ে যখন নারীদেরকে পাপী মনে করার প্রবণতা ছিল, তাদেরকে বুদ্ধিতে ও নৈতিকতায় দুর্বল মনে করা হত। মেরিওলজি (যিশুর মা মেরিকে নিয়ে স্টাডি) নামক থিওলজিকাল আইডিয়া জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে মধ্যযুগে নারীদের সম্মান কিছুটা বৃদ্ধি পায়। শিভালরিতে তার প্রভাব রয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই কোর্টলি লাভকে তদকালীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামন্ততন্ত্র, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখে। আবার অনেকে একে সেইসময়কার নারীদের ভালোবাসাহীন বন্দী জীবন থেকে মুক্তি হিসেবে দেখেন। বোঝাই যাচ্ছে, তদকালীন ধর্মীয় সমাজ এই ব্যাপারটিকে ভালভাবে নেয় নি। ত্রয়োদশ শতক থেকে কোর্টলি লাভের প্রতি নিন্দা শুরু হয়। চার্চ একে “sexual rebellion” বা “যৌন বিদ্রোহ” বলে উল্লেখ করেন। আরেক আদিনারীবাদী ক্রিস্টিন দে পিজঁ তার ১৪০৩ সালে প্রকাশিত কার্টেসি গ্রন্থ বুক অফ থ্রি ভারচুস (Le Livre des trois vertus)-এ কোর্টলি লাভকে অবৈধ প্রেমের সম্পর্কের জাস্টিফিকেশন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এলেনর অফ অ্যাঁকুতার পয়টিয়ের্সের কোর্ট আরেকটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রেম সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ১২শ শতকের লেখক এন্ড্রিয়াস ক্যাপেলেনাস তার দি আর্ট অফ কোর্টলি লাভ গ্রন্থে লেখেন, এলেনর, তার কন্যা মেরি, নারবোন এর ভিসকাউন্টেস আরমেনগার্দ ও ইসাবেল অফ ফ্লেন্ডার্স সেই কোর্টে বসে প্রেমিক প্রেমিকাদের ঝগড়া শুনতেন এবং বিচারকমণ্ডলী হিসেবে কাজ করতেন। এন্ড্রিয়াস এরকম ২১টি কেস নথিবদ্ধ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটি কেস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল সেটি ছিল “বৈবাহিক সম্পর্কে কি সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে?” বিচারকমণ্ডলী সিদ্ধান্তে আসেন, “বৈবাহিক সম্পর্কে সত্যিকারের ভালোবাসা একেবারেই সম্ভব নয়”।

যাই হোক, ১২শ শতক অতিক্রান্ত হবার আগেই ল্যয়র নদীর অপর পারেও নাইটদের প্রভাবিত করেছিল শিভ্যলরীর আদর্শ। আলবিজেনসিয়ান ক্রুসেডে প্রভাঁসের বহু মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হলেও শিভ্যলরী ইতিমধ্যে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে সমাদৃত হওয়ায় তা রক্ষা পেয়ে যায়। অবশ্য শ্যাম্পেন প্রভৃতি স্থানের অভিজাতবর্গ শিভ্যলরী ধর্মীয় ও সামরিক দিকটিতেই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আজীবন একটি নারীর প্রতি একনিষ্ঠ থাকা বা প্রণয়ের জন্য সব পণ করার দুর্মর প্রতিজ্ঞা তারা সমর্থন করতেন না। তবু সামগ্রিক ভাবে এই মহৎ আদর্শ নারী জাতির প্রতি সম্ভ্রমবােধ, পরিশীলিত আচরণ, বিভিন্ন সামাজিক গুণের বিকাশে ফরাসী সমাজের রুক্ষতা থেকে থেকে মার্জিত নম্রতায় উত্তরণে সহায়তা করেছিল, সুভদ্র করে তুলেছিল ফরাসী অভিজাতবর্গকে। অ্যাঁকুতার মতো শ্যাম্পেনের খ্যাতিও হয়েছিল দূর বিস্তৃত এবং এরই ফলে ১৪শ শতকে ইংল্যান্ড, জার্মানীসহ পশ্চিম ইউরােপের বহু দেশের অভিজাত ভূস্বামী তাদের পুত্র-সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য, আচার আচরণ মার্জিত ও উচ্চবংশােচিত করার মানসে ফ্রান্সের বিভিন্ন দরবারে পাঠানো শুরু করেন। এভাবেই সমস্ত পশ্চিম ইউরোপে উচ্চকুল জাতদের সামাজিক আচার আচরণের একটি রীতি, সৌজন্য, ভদ্রতা ও শালীনতার একটি সাধারণ মানদণ্ড গড়ে ওঠে, আর তাই শ্রেণী বৈষম্যের সীমান্ত অতিক্রম করে সামান্য কিছু পরিবর্তিত হয়ে সমগ্র ইউরােপীয় সমাজের একটি স্থায়ী ও অমূল্য উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে। ইউরােপের বিভিন্ন দেশের রীতিনীতি, সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা এবং শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিয়েছে শিভ্যলরী। ‘রোলাঁর-গান’ (Chanson de Roland) লেখার সময় থেকে সারভেন্টিসের (Cervantes) ‘ড কুইয়োটি’ (Don Quixote) প্রকাশনার কাল পর্যন্ত অসংখ্য সৃজনধর্মী রচনায় শিভ্যালরীর আদর্শে-অনুপ্রাণিত-নাইট চিত্রিত হয়েছেন শ্রদ্ধা, মমতা, কখনাে বা কৌতুক মিশ্রিত ভালবাসায়। অতিশয্য ও মাত্রা-জ্ঞানহীনতার অসংখ্য চিহ্ন ধারণ করে থাকলেও জীবনকে শিল্প-গুণান্বিত করার সাধনায় সার্থক হয়েছে শিভ্যলরী আর সে কারণে তাকে মানব-সভ্যতার প্রগতির একটি প্রতীক রূপে গ্রহণ করতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।

সামন্ততন্ত্রের গুরুত্ব

সামন্ততন্ত্রকে নৈরাজ্য ও নিঃসীম বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সমার্থক হিসেবে বিচার করার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষের দেরী হয়েছে অনেক। এখনও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই বহু মানুষের মনে নিগৃহীত, শােষিত ভূমিদাসদের অসহনীয় দুর্দশা, সমাজের সর্বস্তরে অশিক্ষা, স্থূলতা এবং মানব চরিত্রের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর নির্বাধ লীলার ছবিই অবধারিতরূপে আগে আসে। কিন্তু এর সঙ্গেই স্মরণে আনা দরকার যে সামন্ততন্ত্রের একটি শুভপ্রসূ এবং সৃজনশীল দিকও ছিল। মধ্যযুগের এই পর্বেই অদম্য কৃষককুল কর্তৃক অরণ্য ও বন্ধ্যাত্ব জয়ের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা শুরু হয়ে অনেক বেশি কর্ষণযােগ্য ভূমি মানুষের কর্তৃত্বাধীনে আনা হয়েছিল, এই সময়েই প্রেম ও সমরে উদ্দামতা মানুষের বর্ণবহুল জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাষা হয়ে উঠেছিল। অনাস্বাদিত এক বলিষ্ঠতামণ্ডিত, নিস্তরঙ্গ, নিরুপদ্রব জীবনের প্রলোভন ত্যাগ করে, বিপদ, মৃত্যু ও নরকের চিন্তা বর্জন করে এই অধ্যই অসংখ্য নাইট জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে পেরেছিলেন, সত্য রক্ষার গুণ অসম্ভবকে সম্ভব করার ব্রতে উদ্দীপিত হয়েছিলেন। সাধারণভাবে নারীজাতি, বিশেষ করে সম্ভ্রান্ত নারীদের সম্পর্কে পুরুষ-শাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনও শুরু হয় এই সময়েই। আর ভয়ঙ্কর দুর্দিনে, প্রচণ্ড ‘বর্বর’ আক্রমণে বিধ্বস্ত খ্রিস্টান জগতের সামাজিক নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট দূর করে উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিকত্বে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে যার সৃষ্টি সে সমাজব্যবস্থা যে অসফল হয়নি ইতিহাসই তার প্রধান সাক্ষী। আর এ তথ্যও বিস্মৃত হওয়া অনুচিত যে অপটু, অস্থায়ী ও বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর সাহায্যে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধে সমসাময়িক শাসকদের অক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততন্ত্র-উদ্ভাবিত সমরনীতিই দীর্ঘকাল ইউরােপকে বিধ্বংসী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছিল এবং ভ্যাসাল বাহিনীর দ্বারা পরবর্তীকালের সামরিক উদ্দেশ্য পূরণের পথ প্রশস্ত করে দিতেও সমর্থ হয়েছিল। তাছাড়া মধ্যযুগে মঠগুলোর নিভৃতি যেমন ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনচর্চা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয় তেমনি ম্যানর-প্রভুর দূর্গগুলো হয়ে ওঠে প্রেমগীতি ও রােমান্টিক সাহিত্যের লালনক্ষেত্র। ভ্রাম্যমান চারণ কবিদের সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এবং উদার দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন মধ্যযুগের দুর্গেশগণ।

ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ধীর, নিশ্চিত অবক্ষয়ের সমকালীন ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পত্তন। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই শাসককুলের ব্যর্থতার জন্য দায়ী নয়; কেন্দ্রীয় শাসনের অপসরণজাত সংখ্যাতীত সমস্যার উত্তর হিসেবেই এর সৃষ্টি। আর এ তথ্যও অনস্বীকার্য যে বহু ক্ষুদ্র দেশে সামন্ততান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা সফল-শাসনের কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। ফ্লাঁদর, অ্যাঞ্জু, নরমাঁদি এবং, নর্মান বিজয়ের পর ইংল্যান্ডের ইতিহাস এ তথ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে যে সামন্ততন্ত্রাধীন থেকেও ঐসব অঞ্চলের শাসন বিষয়ক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রয়ােজন সুষ্ঠুভাবেই মেটানাে সম্ভব হয়েছিল। ভ্যাসালপ্রথা এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে অটল কোনও বৈরীতা যে ছিল না, সামন্ততন্ত্র যে কেন্দ্রীয় শক্তির জাত-শত্রু হিসেবে সৃষ্ট হয়নি এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তির কুশলী ও সম্যক ব্যবহারে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি যে সম্ভব তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ড ও তার কিছু পরে ক্যাপেতীয় ফ্রান্সের রাজকীয় বৃত্তান্তে। লর্ড ও ভ্যাসালের যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যেই পরবর্তীকালের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের বিভিন্ন ধারার বহু উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব এবং সামন্ত প্রভুদের নিজ অধিকার রক্ষায় তীক্ষ্ণ ও অতন্দ্র প্রহরীর মধ্যে পশ্চিম ইউরােপের বহু মূল্যবান গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্বাভাস যে পাওয়া যায় এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত বহু ঐতিহাসিক। (অধ্যাপক সিডনী পেন্টার তার “ফিউড্যালিস অ্যান্ড লিবার্টি” গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন)। একটি সামন্ততান্ত্রিক দলিল (feudal document) হিসেবে রচিত হলেও ‘ম্যাগনা কার্টা’র মধ্যে উত্তরকাল ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষার অমূল্য সংকেতসূত্র পেয়েছে, এর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে এই নীতির অনুচ্চারিত ঘােষণা যে শাসিতের বিনা সম্মতিতে কর প্রবর্তন অবৈধ। তাছাড়া লর্ড ও ভ্যাসালের স্বার্থে পারস্পরিক সুপরামর্শ দানের প্রথার মধ্যে উর্ধ্বতন প্রভু কর্তৃক অধঃস্তনের মত ও মন্ত্রনার মূল্যদানের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল্যও অস্বীকার করা অসম্ভব।

পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন সম্পর্কে জানতে পড়ুন এই লেখাটি –
আধুনিক যুগের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে এর পুনরুজ্জীবন

সেই সাথে পড়ুন এটিও
ব্ল্যাকডেথ-দুর্ভিক্ষাদি কারণে ১৪শ শতকে ইউরোপের বিপর্যয় ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ

তথ্যসূত্র

  • মধ্যযুগের ইউরোপ, ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ. – ১০৪-১৫৪
  • আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন : মধ্য পঞ্চদশ থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতক, বাসবেন্দ্র বসু, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর, ২০১২, পৃ – ২৫ – ৩০
  • আধুনিক ইউরোপের আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০ – ১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ২০১৪, পৃ – ২৯ – ৩১

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  2. আধুনিক যুগের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে এর পুনরুজ্জীবন –

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.