আধুনিক যুগের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে এর পুনরুজ্জীবন

(এই নিবন্ধটি ১৪শ শতকে ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি কারণে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় ও এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে ঘটে যাওয়া কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। তাই এই নিবন্ধটি পড়ার পাশাপাশি “ব্ল্যাকডেথ-দুর্ভিক্ষাদি কারণে ১৪শ শতকে ইউরোপের বিপর্যয় ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ” শীর্ষক নিবন্ধটিও পড়তে পারেন। সামন্ততন্ত্র্যের উদ্ভব ও চরিত্র সম্পর্কে জানতে “ইউরোপে সামন্ততন্ত্র, ম্যানর ও শিভ্যালরি” শীর্ষক নিবন্ধটি পড়তে পারেন।)

Table of Contents

পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন

সামন্ততন্ত্রের অন্তঃসারহীনতা ও এর পতনের সময়কাল

১৪শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ইউরােপীয় সমাজ ব্যবস্থায় সামন্ততন্ত্রের প্রভাব শিথিল হতে আরম্ভ করে। অবশ্য এই প্রবল, ব্যাপক এবং দীর্ঘ-দিনের-পুরােনো ব্যবস্থার বিলুপ্তি খুব দ্রুত ঘটেনি। সামন্ততন্ত্রাধীন উৎপাদন পদ্ধতির পূর্ণ বিকাশের জন্য যেমন কয়েক শতাব্দীর প্রয়ােজন ছিল, তেমনি তার তিরােধানও অতি ধীরেই ঘটেছিল। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্ততন্ত্রকে দুর্বল এবং পরিণামে আকজো করে দেওয়ার পেছনে বহু বিচিত্র কারণকে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায় এবং এই কারণগুলোর গুরুত্ব ও তীব্রতা সব দেশে সমমাত্রারও ছিল না, ইউরোপের সর্বত্র একই গতিতে সামন্ততন্ত্রের অবসান হয়নি। পশ্চিম ইউরােপ যখন সামন্তপ্রভাব মুক্ত হতে শুরু করে তখন পূর্ব ইউরােপ ও রাশিয়ায় কৃষক নতুন করে সামন্তপ্রভুর অধীনস্থ হয়ে ভূমিদাসে (serf) পরিণত হয়। অবশ্য আঞ্চলিক এবং পরিস্থিতি-নির্ভর এসব কারণ ছাড়াও সাধারণ এবং সার্বজনীন কিছু প্রভাব দীর্ঘদিন সক্রিয় থেকে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় সুনিশ্চিত করে দেয়। ১২শ শতক থেকেই পশ্চিম ইউরােপের উৎপাদন ব্যবস্থার রীতি ও পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন, তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপান্তরের প্রচণ্ড অভিঘাত সামন্তন্ত্রের অন্তর্নিহিত অসামাঞ্জস্য ও ভুলগুলোকে যেমন প্রকট করে, তেমনি তার কাঠামােতেও ভঙ্গন ধরায়। ফলে ১৫শ শতকের পরে সামন্ততন্ত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে না গেলেও তার অস্তিত্ব অন্তঃসারশূন্য, প্রাণস্পন্দন-বিহীন হয়ে পড়ে। আর তাকে কেন্দ্র করে বা সক্রিয় রাখার জন্য যে সংখ্যাতীত বিধিবিধান সৃষ্ট হয়েছিল তা অর্থহীন হয়ে যেতে শুরু করে, সমাজবদ্ধ মানুষ-মাত্রেরই বিবিধ ও বিচিত্র সামন্ততান্ত্রিক নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ থাকার প্রয়ােজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সামন্ততন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছিল, যথা ইংল্যান্ডে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে (অর্থাৎ গৃহযুদ্ধ এবং প্রথম স্টুয়ার্ট স্বৈরতন্ত্রের সাময়িক অবসানের পর), ফ্রান্সে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে (ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্বে) এবং রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (বলশেভিক বিপ্লবের পর্বে)।

সামন্ততন্ত্রের পতনের কারণ

সামন্ততন্ত্রের সহজাত রক্ষণশীলতা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ

অধ্যাপক মরিস ডব (Maurice Dobb) বলেন, সামন্ততন্ত্রের সহজাত রক্ষণশীলতাই তার অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। তার মতে, ম্যানরগুলি প্রথম থেকেই একটি সুনিদিষ্ট আকার ও পরিধি নিয়ে গড়ে ওঠার ফলে জনসংখ্যাবৃদ্ধিজাত সমস্যা স্থিতিস্থাপকতা-বর্জিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাবদ্ধতা প্রকট করে দিতে থাকে। ১২শ ও ১৩শ শতকে পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন স্থানে কৃষক উপনিবেশ পত্তন ও অনাবাদী জমি কৰ্ষণ-উপযােগী করার মূলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার কোনও তাগিদ ছিল না। এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বাণিজ্য বিস্তার ও নগরগুলির উত্থানেরই প্রত্যক্ষ ফল। অবশ্য ম্যানরগুলো যে একেবারেই সম্প্রসারিত হতে পারতো না তা নয়, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি রেখে বেড়ে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। ফলে ভূমিদাস (serf) পরিবারের ‘অবাঞ্ছিত’ সন্তানগণ ম্যানরের মধ্যে জীবিকার ব্যবস্থা করতে অক্ষম হয়ে অসামাজিক জীবনযাপনে বাধ্য হতো অথবা ভারাটে সৈন্যদলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়তো। পশ্চিম ইউরোপে প্রায় সর্বত্র এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, এ থেকে সামন্ততন্ত্রের সৃজনধর্মী বা বিপ্লবাত্মক কোনও ভূমিকা গ্রহণে অক্ষমতা প্রমাণিত হয়ে যায়।

সামন্তপ্রভুদের সংঘাত ও গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় আসক্তি

১২শ শতকের আগে থেকেই ভূসম্পত্তির আয়তন ও ভ্যাসালের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উধ্বতন-প্রভুদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রকট হয়ে ওঠে, যা সামন্ততন্ত্রের একটি উল্লেখযােগ্য অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ছিল। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাতেও পুজিপতিদেরকে মুনাফার জন্য প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের মিল আছে। কিন্তু সামন্ততন্ত্রে দীর্ঘ পরিচিত, অভ্যস্ত ও গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতি আসক্তি দেখা যায়, যার সাথে ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের কোন মিল নেই। সামন্ততন্ত্রের এই দিকটিও একে ব্যর্থ করে তোলে। সামন্ত-প্রভুদের এই ভূমি ও ক্ষমতালিপ্স৷ ইউরোপের সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন সংঘাত ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করে সমাজ জীবনে ক্ষতের সৃষ্টি করত এবং উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তর না ঘটিয়ে অহরহ তাকে অচল করে দিত।

সামন্তশ্রেণীর ব্যয়বহুল জীবন ও শিভ্যালরী

সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং শাসকশ্রেণির ক্রমবর্ধমান রাজস্বের চাহিদা সামন্তপ্রথার অবক্ষয়কে প্রকট করে তুলেছিল। অভিজাত পরিবারগুলির আয়তন ও তাদের অনুচরদের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল উৎপাদন কিন্তু সে হারে বৃদ্ধি পায়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিত্যনৈমিত্তিক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লুঠ সন্ত্রাসের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া। ১২শ শতক থেকে শিভারি (Chivalry) সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ হয়ে ওঠে। অস্ত্রশস্ত্র ও লড়াই প্রদর্শনের খেলা, নাইটদের অশ্বারােহণ প্রতিযােগিতা ও ভােজসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলিকে কে করে অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে বৈভব-প্রদর্শনের প্রতিযােগিতা এই সময় থেকেই আরম্ভ হয়। এর ফলে সামন্তপ্রভূরা নতুন করে ব্যয়বাহুল্যের সম্মুখীন হয়।

নতুন স্থাপিত গ্রামাঞ্চলে সামন্ততন্ত্রহীনতা

hôtes বা কৃষক-উদ্যোগে-স্থাপিত উপনিবেশগুলোতে নতুন পত্তন করা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদ ছাড়াই) গ্রামাঞ্চলে কৃষিজীবীগণ প্রথম থেকেই সামন্ততান্ত্রিক নিয়মকানুনের আগড়ে অতি ক্ষীণভাবে আবদ্ধ ছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদ ছাড়াই উপনিবেশগুলি প্রতিষ্ঠিত হত। বেগার খাটুনীর দায় এদের উপর চাপানাে চলতো না এবং উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্ত অংশ বিয়েও এদের কোনও বাধা ছিল না। উৎপন্ন শস্যের উদ্বৃত্ত অংশ এরা ইচ্ছামতাে বিক্রয় করতে পারত। ম্যানরগুলোর ওপর পরােক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার ছাড়াও hôtes-গুলো বেশ কিছু সংখ্যক কৃষিজীবীর হাতে নগদ অর্থ সঞ্চিত হবার ব্যবস্থা করে দেয়। শহরগুলির মতাে এরাও ম্যানরগুলির অবক্ষয়ের উপর পরােক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

ভূমিদাসদের উপর শোষণ
শোষণের স্বরূপ ও এর ফলে উৎপাদনে অবনতি

ম্যানর-প্রভুগণ কর্তৃক ভূমিদাসদের অতি-শােষণকেও সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় ও নিস্তেজ করে তোলার জন্য দায়ী করা হয়। ভূস্বামী প্রভুরা ভূমিদাসদের প্রতি মানবিক আচরণ করতেন না, তাদের শ্রমের যথােচিত মূল্য বা মর্যাদা দান করতেন না, অথচ তাদেরই শ্রমলব্ধ উৎপাদনের উপর ক্রমবর্ধিষ্ণু ভূস্বামী পরিবারগুলো ও তাদের অনুচরবর্গ নির্ভরশীল ছিল (পরগাছার মতাে এই অনুচরবৃন্দ ম্যানর প্রভুকে ঘিরে থাকতেন বলে এরা parasitic class নামে পরিচিত ছিলেন)। এভাবে একটি চরম সংকটের যুগে ভূমিদাসদের ওপর খাজনা ও অন্যান্য দায়দায়িত্বের বােঝা ক্রমশ বৃদ্ধি করে ভূস্বামীরা ইতিপূর্বে প্রজাবর্গের প্রতি অনুসৃত মহান পিতৃতান্ত্রিক আদর্শক্রে (যা সদাশয় স্বৈরতান্ত্রিক আদর্শের নামান্তর ছিল) নিজেরাই ভঙ্গ করছিলেন। এই সময়ের অবিরাম সংঘর্ষ, লুণ্ঠন ও নিপীড়ন এক দিকে যেমন ভূস্বামীর আর্থিক অবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতাে, তেমনি ক্ষেতখামারের অশেষ ক্ষতি সাধন করে কৃষি উৎপাদনে স্থায়ী বিঘ্ন ঘটাতো।

এছাড়া দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ফলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সংকোচন এবং শাসক শ্রেণীর রাজস্বের চাহিদা সামন্ত ব্যবস্থায় সংকট ডেকে এনেছিল। অভিজাত পরিবারগুলোর আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অনুচরদের সংখ্যা, বিলাস-ব্যসন বেড়েছিল কিন্তু উৎপাদন সে হারে বাড়েনি। পশ্চিম ইউরােপে যুদ্ধ ও লুটতরাজ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ সবের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। অভিজাত শ্রেণীর ব্যয় বেড়েছিল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, বাড়তি আয়ের জন্য তারা কৃষকের কাধে বাড়তি করের বােঝা চাপিয়েছিল।

অতিশোষণের ফলে কৃষক-বিদ্রোহ

এই অতি-শােষণের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া রূপে দেখা দিয়েছিল একাধিক কৃষক বিদ্রোহ যা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কৃষক শ্রেণি সামগ্রিকভাবে এই অভ্যুত্থানগুলিতে অংশগ্রহণ না করলেও কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এতে শামিল হয়েছিল বড়াে কৃষক এবং ছােটো, প্রান্তিক কৃষকের জোট। এক্ষেত্রে বড়াে চাষির প্রতিবাদ ছিল নানাপ্রকার বাধানিষেধের বিরুদ্ধে আর ছােটো চাষি বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিল স্বল্প মজুরির বিরুদ্ধে। কৃষক ছাড়াও এই অভ্যুত্থানে শামিল হয়েছিল সেইসব শ্রেণি, যাদের উপস্থিতি একটি কৃষক সমাজে অপরিহার্য ছিল, যথা – কারিগর, ছােটো ব্যবসায়ী এবং দিনমজুরগণ। ইংল্যান্ডে জমির বাজার গড়ে উঠেছিল, জমিদার যেমন জমি কিনেছিল, ক্ষুদ্র কৃষকও সংখ্যাও তেমনি বেড়ে চলেছিল। বড় বড় ভূস্বামীরা তাদের অধিকারসমূহ সুদৃঢ় করতে গিয়ে কৃষক বিদ্রোহ ডেকে আনেন।

সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের সব উপকরণের মালিক ছিল ভূস্বামী (জমি, মূলধন, শ্রমিক, বাজার, পরিচালন, কাঁচামাল)। ভূস্বামী উৎপাদনের বেশিরভাগ আত্মসাতের চেষ্টা করত। কৃষকের অধিকার হরণ করা হয়। নানা বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করে রাখা হয়। উৎপাদনের উদ্বৃত্ত নিয়ে (উৎপাদনের বাজার মূল্য থেকে উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়) অভিজাত ও কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব জার্মানি, ফ্রান্স ও ইংলন্ডে কৃষক বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

শোষণের ফলে ভূমিদাসদের ম্যানর ত্যাগ ও ১৪শ শতকে বাণিজ্যের প্রসারের ফলে শহরে জীবিকার বিকল্প উপায়

হেনরি পিরেন মনে করেন যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটায় শহর গড়ে উঠলে ম্যানরীয় উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর তার প্রভাব পড়েছিল। শােষণ ও নির্যাতনের ফলে অনেক ভূমিদাসই ম্যানর ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও যতদিন না ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য নগরের পত্তন তাদের জীবিকা নির্বাহের একটি বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ততদিন পলাতক-ভূমিদাসসহ সংখ্যা উল্লেখযােগ্য হয়ে ওঠেনি। এই কারণেই ম্যানর ত্যাগের ঘটনা ১২শ-১৩শ শতকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও ১৪শ শতকে তা একটি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়।

প্রাচীন ম্যানরীয় সংগঠনগুলি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় অঞ্চলে ভােগ করা হত, আমদানি-রপ্তানি খুব কম ছিল। ১৪শ ও ১৫শ শতকে ইউরােপে অনেক শহর গড়ে উঠেছিল, এই সব শহরে শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং আর্থিক লেনদেন নির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। নব-প্রতিষ্ঠিত শহরগুলোর শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের উন্নতির মূলে ছিল বুর্জোয়া শ্রেণি। এই বুর্জোয়া শ্রেণী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খাদ্যশস্য ও ভােগ্যপণ্যের ওপর ছিল নির্ভরশীল। শহরে বণিকদের তত্ত্বাবধানে শিল্প পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছিল, শিল্প পণ্য বিক্রি ও খাদ্যশস্য বেচাকেনার অনেক বাজার গড়ে উঠেছিল। সামন্তপ্রভুর জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনের জন্য প্রয়ােজন ছিল প্রচুর অর্থের। সামন্তপ্রভুরা ভূমিদাসদের মুক্তি দিয়ে এই অর্থের একাংশ সংগ্রহ করেছিল।

এই শহরগুলোতে শিল্পজাত পণ্যের সাথে সাথে খাদ্যশস্যেরও কেনাবেচা চলত। ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটলে ও ইউরােপের বিভিন্ন দেশে নগর গড়ে উঠলে, উন্নত ও মুক্ত জীবনের আশায় বহু ভূমিদাস মানব থেকে পলায়ন করে সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং এক্ষেত্রে তারা নিরাশ হয়নি। ১৪শ শতকে এটি একটি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছিল।

নগরগুলোর মধ্যে মুক্তির সঙ্গে জীবনধারণের উপযােগী কাজকর্মের প্রতুলতা, সামাজিক মর্যাদালাভের স্থির আশ্বাস ভূমিদাসদেরকে পুরােনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে উৎসাহিত করে। আর দ্রুত গড়ে-ওঠা বাণিজ্যকেন্দ্র ও জনপদগুলোতেও যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমিক, কারিগর এবং সৈন্যসামন্তের প্রয়ােজন থাকায় নগরকতৃপক্ষগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিদাসদের ম্যানর পরিত্যাগে উৎসাহিত করতেন। এর ফলে ম্যানরগুলোতে অশেষ ক্ষতি হয়।

ভূস্বামীদের দ্বারা কৃষকপ্রজাদেরকে খাস জমির ইজারা দান

যে অল্প সংখ্যক ভূমিদাস ম্যানরে থেকে গিয়েছিল তাদের উপর শােষণের মাত্রা বৃদ্ধি করেও পুরােনো উৎপাদনের পরিমাণ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। উপায়ান্তর না থাকায় বহু ভূস্বামী অর্থের বিনিময়ে ভূমিদাসদের অব্যাহতি দিতে আরম্ভ করেন, এবং ইউরােপের বিস্তৃত অঞ্চলে ব্যাপকভাবে খাসজমি কৃষকপ্রজাকে লীজ (পাট্টা বা ইজারা) দেওয়া শুরু হয়ে যায়। এসব কারণেই অতি দ্রুত গ্রামীন-অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে অর্থের বিনিময়ে ভূমিদাসদের বেগার খাটা থেকে অব্যাহতি দান একটি প্রথা হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু একটা সময়ে এটাও আর সামন্তপ্রভুদের কাছে লাভজনক বলে বিবেচিত হচ্ছিল না।

১৪শ শতকে কৃষিব্যবস্থায় রূপান্তর ও ভূস্বামীদের জমি ইজারা দেবার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই নিবন্ধটির “কৃষিতে বিপর্যয় ও পতনোন্মুখ সামন্ততন্ত্র” অংশটি পড়ুন।

জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি

অনেক ঐতিহাসিক ১৪শ শতকের জনসংখ্যা হ্রাসকে সামন্ততন্ত্রের পতনের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক পোস্তান ও লাদুরি, এই সময়ের জনসংখ্যা হ্রাসের সাথে এর পূর্বের শতকের জনসংখ্যার বৃদ্ধিকেও সম্পর্কিত করেন।

জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। বিপর্যয়ের পূর্বে ১২শ ও ১৩শ শতকে ইউরোপের বাণিজ্য ও উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল, তাই ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক জমিতে চাষ বসানাে হয়, কিন্তু সেখানে উৎপাদন কম হয়। এদিকে জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্যশস্য ও চাষজমির যােগান তেমন না বাড়ায়, এদের চাহিদা বেড়ে যায়, আর তার ফলে পশ্চিম ইউরোপে বাড়ে খাদ্যশস্যের দাম। খাদ্য শস্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় লাভ তুলে নিতে সামন্তপ্রভুরা খাজনা বাড়ায়, কৃষকের কাঁধে অনেক কর চাপায়, কৃষকদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রম দান করতে হত। এসবের ফলে কৃষকের অবস্থার অবনমন ঘটে, অধিক খাজনা নিয়ে সামন্তপ্রভুদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটে।

কিন্তু ১৪শ শতকে এই ধারার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে। দুর্ভিক্ষ ও প্লেগের বিপর্যয়ে বহু লােক মারা গেলে ইউরোপের জনসংখ্যা হ্রাস পায়। তদকালীন সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার উপকরণগুলো হল ভূমি, মূলধন, শ্রমিক (এক্ষেত্রে ভূমিদাস), বাজার, পরিচালন ব্যবস্থা ও ম্যানর। বিপর্যয়ের ফলে প্রচুর ভূমিদাস মারা গেলে, অর্থাৎ উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ শ্রমিক সরবরাহ কমে গেলে কৃষিক্ষেত্রে মন্দা দেখা যায়। এর ফলে কৃষিজমি ও খাদ্যশস্যের চাহিদা কমে, তাই এগুলোর দামও কমে। এর ফলে খাজনার পরিমাণও যায় কমে। এদিকে কৃষিজমির তুলনায় ভূমিদাসের পরিমাণ অনেক কমে গেলে ভূমিদাস বা শ্রমের চাহিদা বেড়ে যায়, অর্থাৎ ভূমিদাসের শ্রমের দাম বা মজুরি বেড়ে যায়। শ্রমের দাম বাড়ায় ভূমিদাসের আয় বাড়ে, ফলে কৃষকদের স্বাধীনতাও বেড়ে যায়। তাই কৃষকের অবস্থার উন্নয়ন হয়। কৃষকের স্বাধীনতা তদকালীন ভূমিদাসপ্রথা ও সামন্ততন্ত্রে একরকম আঘাত সৃষ্টি করে। ভূমিদাসদের শ্রমের মজুরি বাড়ে, কিন্তু খাজনা বাড়েনি। এর ফলে ভূস্বামীরা সংকটে পড়েন, রাজস্বের পরিমাণ কমে যায়, রাজকোষে টান পড়ে। তাছাড়া ভূস্বামীদের আয় কমে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বৃদ্ধি পায়, ফলে তাদের ব্যয়ও বেড়ে যায়।

যাই হোক, ভূস্বামীরা সংকটে পড়লে ও তাদের আয় কমে এলে তারা বাধ্য হয়ে তাদের খাস জমি অর্থের বিনিময়ে কৃষকদেরকে লিজ বা ইজারা দান করে। আগেই অর্থনৈতিক মন্দার কারনে রাজস্ব কমে গিয়েছিল, জমি ইজারা দানের ফলে তা আরও কমে যায়। রাজস্ব কমে যাওয়ায় ও রাজকোষে টান পড়লে কৃষকদের উপর নতুন করে অনেক করারোপ ও শোষণ করা শুরু করে। কিন্তু কৃষকরা তা আর মানতে চায়নি, পূর্বের অবস্থায় ফিরতে চায়নি। ফলে অসন্তোষ দানা বাঁধে, অনেকে পালিয়ে নগরে গিয়ে কারিগরি পেশা বেছে নেয়, আবার অনেক কৃষক একত্রে মিলে কৃষক-বিদ্রোহের সূচনা করে। অনেক ক্ষেত্রে এইসব বিষয় তদকালীন সমাজে কৃষকের অবস্থা, ভূস্বামীদের অবস্থায় পরিবর্তন সৃষ্টি করে, সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ফাঁটল ধরায়।

তবে সংকট শুরু হলেও পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্র আরাে কিছুকাল টিকেছিল। পরে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত পতন ঘটে। লাদুরি লিখেছেন যে এই বিপর্যয়ের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ভূমিদাস প্রথা প্রায় উঠে গিয়েছিল। এসব দেশে প্রায় সব কৃষক স্বাধীন ছিল, সারা ১৬শ শতক ধরে এই প্রবণতা বজায় ছিল। ভূমিদাস প্রথা উঠে গেলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়ে। ১৭শ শতকে জনসংখ্যা হ্রাসের প্রবণতা বন্ধ হয়নি, জমি, আয় ও বণ্টন ব্যবস্থার ওপর এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল। জনসংখ্যার এই হ্রাস-বৃদ্ধি সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও পতনের একটি বড় কারণ। এই হ্রাসবৃদ্ধির পটভূমিকায় সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা পুরােপুরি বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।

১৪শ শতকে জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ ছিল দুর্ভিক্ষ ও ব্ল্যাকডেথ। এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই নিবন্ধটির “বিপর্যয়ের স্বরূপ” অংশটি পড়ুন।

বিনিময় অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থার বিকাশ
বিনিময় অর্থনীতিতে সামন্তসমাজের অনুপযোগিতা

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল সুইজি (Dr. Paul sweezy) এই বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে দীর্ঘকাল পশ্চিম ইউরােপীয় অর্থনীতি ছিল এমন এক ব্যবস্থা-নির্ভর যার লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র ভােগের জন্য উৎপাদন (Production for use)। এই ব্যবস্থা চালু থাকা কালীন অল্প কিছু ভােগ্যপণ্য গঞ্জ, সাময়িক বাজার বা ফেরিওয়ালার মাধ্যমে ক্রয়বিক্রয় হতো। প্রথাটিকে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে গণ্য করা যায়। কিন্তু ১০ম শতক থেকে যখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল বিস্তার ঘটে এবং ব্যবসায়ীগণ বহির্বাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন তখন কেবলমাত্র ভােগের জন্য উৎপাদন শেষ হয়ে গিয়ে বিনিময়ের অর্থনীতির (economy of exchange) আবির্ভাব হয়। কিন্তু রপ্তানির উদ্দেশ্যে, কাঁচামাল বাদে অন্যান্য পণ্য-উৎপাদনের জন্য যে পটুত্ব ও শ্রমবিভাজন অত্যাবশ্যক ছিল তা ম্যানরের উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা সিদ্ধ হবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তাই এই পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থার ফলে তৈরি ভােগ্যপণ্যের কিছু অংশ নাগরিকদের ব্যবহারে লাগতো, আর গ্রামের কৃষিজীবীগণও নগরের বাজারে তাদের কৃষিপণ্য বিক্রয়বাবদ অর্থে এর অংশবিশেষ কিনতে সক্ষম হতো। এভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা (Production for market) সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা প্রকট করে দেয়।

বিনিময় অর্থনীতির বিকাশের ফলে উৎপাদকদের মুনাফার উপর আসক্তি

বিনিময়ের অর্থনীতি নামে এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন আরো এক উপায়ে উৎপাদকদের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিয়েছিল। ১০ম-১১শ শতক থেকেই উৎপাদকগণ মুনাফা-সঞ্চয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে ও ক্রমশ মুনাফাই এই উৎপাদন ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। প্রত্যক্ষভাবে যারা পণ্য উৎপাদন করতো তারা ছাড়াও পরােক্ষভাবে যে সব ভূস্বামী এই ব্যবস্থার আওতায় এসে পড়তেন তাদেরও এই প্রবণতা প্রভাবিত করে। ফলে শুধু ব্যবসায়ী ও বণিকরাই নয়, ভূস্বামী সম্প্রদায়ও উৎপাদনের এই ব্যবসায়িক দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন ও আরও বেশি রাজস্বের জন্য তারাও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অর্থের জন্য ভূস্বামী সম্প্রদায়ের এই অস্থিরতা ও লোভ কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক অঞ্চলে সর্বপ্রথম ম্যানরের ভাঙ্গন

যেসব স্থানে বিচিত্র ও অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেসব স্থানেই অর্থনৈতিক রূপান্তরের অভিঘাতে ম্যানর এবং ভূমিদাস প্রথা সর্বপ্রথম ভেঙে পড়তে আরম্ভ করে। ফ্লাঁদর (Flanders), উত্তর ইতালী, দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্স এবং জার্মানীর রাইন উপত্যকায় অসংখ্য মানুষ শিল্পোৎপাদন ও বাণিজ্যিক প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ফ্লাঁদর এবং নরমাদিতে (Normandy) ম্যানর-প্রভুগণ পরিবতিত অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য ভূমিদাসদের মুক্তি দিয়ে তাদের সঙ্গে সুবিধাজনক শর্তে জমির বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে ১৩শ শতকের মধ্যেই সেখানকার ভূমিদাস প্রথার অস্তিত্ব অতি ক্ষীণ হয়ে পড়ে।

বাজারে চাহিদা আছে এমন কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও দক্ষ শ্রমিক বা দিনমজুর নিয়োগ

এই নতুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে অনেক ভূস্বামী স্বয়ম্ভরতার আদর্শ ছেড়ে দিয়ে ভূপ্রকৃতির আনুকূল্য অনুযায়ী ম্যানরের মধ্যে নিকটস্থ বাজারে চাহিদা আছে এমন কৃষিপণ্যের উৎপাদনে মনােনিবেশ করেন। ফলে কোনও কোনও ম্যানরের বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্রে শুধু গম বা রাই (জই) বা পশুপালনক্ষেত্রে মাখন বা চীজ, অথবা দ্রাক্ষা উৎপাদনের সুবিধা থাকলে সুরা তৈরী আরম্ভ হয়ে যায়।

ইউরােপে মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি (money economy) চালু হওয়ায় এই জাতীয় ভােগ্যপণ্য উৎপাদনের ব্যাপারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য ভূস্বামীরা মজুরী দিয়ে দক্ষ শ্রমিক বা দিনমজুর নিয়ােগ করে চাষ শুরু করান। এতে শুধু যে তাদের মুনাফার আশা বৃদ্ধি পেত তাই নয়, ম্যানরের বহুবিধ শাসন-সংক্রান্ত দায় দায়িত্বের হাত থেকে তারা অব্যাহতি পেতেন।

বড় বড় সামন্ত ম্যানরগুলোতে তখনাে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের প্রথা ছিল। মাঝারি ও ছােটো আয়তনের জমিদারিগুলোতে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরেছিল। নাইট, জেন্ট্রি ও ছােটো ভূস্বামীরা সামন্ততান্ত্রিক অধিকারসমূহ বজায় রাখতে আর তেমন আগ্রহী ছিল না। এরা দিনমজুর দিয়ে চাষ করাতে বেশি আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে বড় ম্যানরগুলি তখনও বেগার শ্রমদানকে আঁকড়ে ছিল এবং ম্যানর-অধিপতিরা তাদের অধিকারকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অসন্তোষ ও বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করেছিল।

বিনিময় অর্থনীতি মানেই সামন্তপ্রথার বিলোপ নয়, তবে ভূমিদাসদের উপর শক্তিশালী প্রভাবক বটে

পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন স্থানে বিনিময়ের অর্থনীতি চালু হওয়া মাত্রই সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল এমন মনে করা ভুল। নতুন এই অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্যেও অন্তত কিছু কালের জন্য দাসত্ব, ভূমিদাসত্ব অথবা স্বাধীন কারিগর শ্রেণীর মানুষের ও শ্রমিকের সহাবস্থান সম্ভব ছিল। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যেমন বেশী মজুরির হার শ্রমিকদের স্থান ধেকে স্থানান্তরে যেতে প্রলুব্ধ করে, তেমনি ম্যানর-ছেড়ে-আসা প্রাক্তন ভুমিদাসদের আয়ত্তাধীন নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সুখ-সুবিধা ম্যানরে থেকে যাওয়া ভূমিদাসদের উপর স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব বিস্তার করে। এখানেই ১০ম-১১শ শতক থেকে ভূমিদাসদের অর্থের বিনিময়ে সামন্ততান্ত্রিক দায়-দায়িত্বের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার প্রবল ইচ্ছার সূচনা হয়।

ম্যানরের রক্ষণশীলতা ও দূর পাল্লার বাণিজ্যে অনুপযোগিতা, শ্রমবিভাগহীনতা এবং দিনমজুর ভিত্তিক কর্মশালার উদ্ভব

পল সুইজি জানিয়েছেন যে দূর পাল্লার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়ে। ম্যানরকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা দক্ষ ছিল না, এই উৎপাদন ব্যবস্থা ইউরােপের ক্রমবর্ধমান শহর ও গ্রামের চাহিদা মেটাতে পারেনি। এজন্য ভূমিদাস-নির্ভর কর্মশালাগুলো উঠে যেতে থাকে, শুরু হয় দিনমজুর নির্ভর কর্মশালার। নতুন ধরনের কর্মশালায় শ্রম বিভাজন ছিল (division of labour)। একজন শ্রমিক সুতাে কাটা থেকে বস্ত্রবয়ন সব কাজ করত না। ইউরােপের সামন্ত শ্রেণীর রুচি ও মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটেছিল। তারা চেয়েছিল নতুন ধরনের ভােগ্যপণ্য। পুরনাে উপাদন ব্যবস্থা নতুন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য যােগ্য ছিল না।

ম্যানরগুলোর পক্ষে ভিন্ন-প্রকৃতির-উৎপাদন ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। বহুকাল ধরে একই ধরনের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকায় এবং শ্রমবিভাজনের ধারণা-বর্জিত হওয়ার ফলে তাৎক্ষণিক ভােগ ছাড়া বিনিময়ের জন্য পণ্য উৎপাদন সেখানে প্রায় অসম্ভব ছিল। তাছাড়া অধিকাংশ ম্যানরের আকৃতি তার সফল নিয়ন্ত্রণের অন্তরায় হয়ে উঠতো এবং ম্যানর-প্রভু ও কৃষিজীবী প্রজাদের বহু প্রাচীন রীতিনীতি, অধিকার ও দায়িত্বের গ্রন্থিলতার পরিবেশে মুনাফার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সম্যক ব্যবহার অসম্ভব ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থার এই রক্ষণশীলতা, পরিবর্তনবিমুখতা বা নিরুপায়-নিশ্চলতাই (conservative and change-resisting character) সামন্ততন্ত্রকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছিল।

মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতির ফলে কৃষকদের নগদে খাজনা পরিশোধ

ইউরােপে মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ইউরােপের কৃষকরা নগদ অর্থে প্রভুর দেয় খাজনা মিটিয়ে দিতে থাকে। তাদের আর উৎপন্ন শস্য দিয়ে কর মেটাতে হত না। ফলে তার ওপর সামন্তপ্রভু যেসব বিধি-নিষেধ চাপিয়েছিল তা উঠে যায়, বেগার শ্রমও আর দিতে হত না। স্বভাবত এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ম্যানরগুলির অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।

ইউরােপের সব জমি ম্যানরের অধীন ছিল না। ৬০ শতাংশ জমিতে ছিল ম্যানরভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা, বাকী ৪০ শতাংশে কৃষক স্বাধীনভাবে শস্য উৎপাদন করত। বেশ কিছু জমির মালিক ছিল ভিলেন ও ক্ষুদ্র কৃষক। স্বাধীন ও অধীন সব শ্রেণীর প্রজা সামন্তপ্রভুকে নগদে কর দিত।

নগদ লেনদেনের ফলে নানাবিধ কর প্রবর্তন ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের গুরুত্ব বৃদ্ধি

ক্যাশ ইকোনমি বা নগদ লেনদেন প্রথা চালু হওয়ায় ইংলণ্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে শাসকবৃন্দ শুধুমাত্র খাসজমিজাত আয়ের উপর নির্ভর না করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর উপর নানাবিধ এবং নিয়মিত-দেয় কর প্রবর্তনে মনোযােগী হতে থাকেন। নবােদিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস হওয়ায় তারা শাসন ক্ষেত্রে অধিকতর এবং সক্রিয়তর ভূমিকা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাদের সাফল্যের মাত্রাও অভিজাত ভূস্বামীদের নিরঙ্কুশ ও অনাক্রমনীয় প্রতিষ্ঠায় ফাটল ধরাতে শুরু করে। শাসনক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের ভূমিকার স্বরূপ বা তাদের প্রতিনিধিত্বের মাত্রা যাই হােক না কেন মধ্যযুগের শেষার্ধে সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের সভাতে স্পেনের কোটিতে (cortes) ফরাসীরাজ চতুর্থ ফিলিপের ডাকা এস্টেটস এর অধিবেশনে অথবা প্রথম এডোয়ার্ডের পার্লামেন্টে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ এ তথ্যই প্রমাণ করে দিয়েছিল যে সামন্ত-প্রভুদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের অবসান সমাগত।

বুর্জোয়া শ্রেণী ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সৃষ্টি, এবং একে অপরকে সহায়তা

সামন্ততন্ত্র শুধু একটি উৎপাদন ব্যবস্থা নয়, বরং এটি ভূমির উপর নির্ভরশীল একটি আর্থ-সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। তাই সামন্ত-সমাজের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংকট বা আর্থ-সামাজিক সংকট প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। এই পর্বে পশ্চিম ইউরােপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। সামন্ততন্ত্রের প্রকৃতিগত ও সাংগঠনিক পরিবর্তন রাজশক্তিকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠে কেন্দ্রীয়-শাসন প্রবর্তনের সুযােগ করে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশ নেওয়ার ফলে সামন্তবর্গের সংখ্যা হ্রাস ও কুসেডের প্রতিক্রিয়ারও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল, এটি যােগ্যতর রাজপুরুষের প্রভাব-প্রতিপত্তি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবার সুযােগ সৃষ্টি করে। ফ্রান্সে ভ্যালোয়া, ইংল্যান্ডে টিউডর এবং স্পেনে হ্যাপ্সবার্গ রাজবংশ স্বৈরাচারী ও অনিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালের রাজারা, ইতালীর নগর-প্রধানগণ এবং জার্মানীর রাজন্যবর্গ এই প্রক্রিয়াতেই স্থায়ী এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন।

নর্মান বিজয়ের পর ইংল্যান্ডে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয় যে, রাজাই দেশের সমস্ত ভূসম্পত্তির অধীশ্বর, তিনিই প্রজাদের আনুগত্যের একমাত্র দাবীদার, ভ্যাসালের সেবা ও সাহায্য পাবার অদ্বিতীয় অধিকারী। ১২৮৫ সালে সেখানে কৃষিজমি খণ্ডীকরণ নিষিদ্ধ করে এ ব্যবস্থা বলবৎ করা হয় যে, জমি হস্তান্তরিত হলে ভূসম্পত্তির নতুন মালিক উর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি অনুগত থাকতে আর বাধ্য হবেন না, তিনি একান্তভাবেই রাজনিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে যাবেন। মহাদেশের অন্যান্য স্থানে এই প্রথা প্রবর্তিত হতে বেশ কিছু দেরী হলেও যে সব দেশে শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সেখানে এই তত্ত্ব নীতিগতভাবে প্রবর্তিত হতে আরম্ভ করে যে, রাজাই দেশের যাবতীয় ভূসম্পত্তির একমাত্র প্রভু।

সামন্ত প্রভুদের একাংশ এবং উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী এই স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র গঠনের কাজকে সমর্থন যুগিয়েছিল। পেরি অ্যান্ডারসন লিখেছেন, শুধু বুর্জোয়া বা শুধু সামন্ততন্ত্রের ওপর নির্ভর করে স্বৈরাচারী বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই দুই শ্রেণীর সহায়তা নিয়ে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র নিজেকে শক্তিশালী করেছিল। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলে সামন্তপ্রভুরা তাদের অনেক অধিকার হারায়, অনেক সুযােগ সুবিধা তাদের হাতছাড়া হয়। সামন্ততন্ত্রের উৎসভূমি ফ্রান্সে সামন্তপ্রভুরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (Fronde) তাদের অধিকারসমূহ বজায় রাখতে পারেনি।

ইউরােপের বিভিন্ন দেশের কৃষকদের মধ্যে যেমন নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছিল তেমনি বুর্জোয়া ও জেন্ট্রির মতাে সামাজিক শ্রেণীর উত্থান লক্ষ্য করা যায়। ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের কেন্দ্র রূপে ১২শ শতক থেকেই নগরগুলির পুনরুজ্জীবন। ইউরােপে নগরায়ণের প্রসার ঘটলে বণিক ও বুর্জোয়া শ্রেণী শক্তিশালী হয়। এরা সামন্ত ব্যবস্থার বিরােধী ছিল ও রাজতন্ত্রের পক্ষ নিয়েছিল।এরা সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। নগর-সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে গ্রামীণ সামন্ত-সভ্যতার মিল ছিল না। ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলি সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, এরা রাজশক্তির পক্ষ নিয়েছিল। এদের কাম্য ছিল কেন্দ্রিভূত শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে এই শ্রেণী শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে রাজতন্ত্রের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিল। ইংলন্ডের জেন্ট্রি শ্রেণী সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে টিউডর রাজতন্ত্রকে সহায়তা দিয়েছিল। ফ্রান্সে বুর্জোয়ারা রাজার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছিল। ফ্রান্স ছিল সামন্ততন্ত্রের আদি উৎস ভূমি, এখানে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় প্রথম শুরু হয়েছিল। ফ্রান্সের সামন্তপ্রভুদের অনেকে স্বৈরাচারী কেন্দ্রিভূত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজতন্ত্রের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিল। রাজারা শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করলে এরা তার নেতৃত্ব দেন। এরা সৈন্য ও অর্থ দিয়ে রাজাদের সাহায্য করেছিল। প্রশাসন, বিচার ও আইনসভায় এরা প্রাধান্য পেয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় তাদের আগের মতাে আর আগ্রহ ছিল না, সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ দমনে এরা রাজার সঙ্গে সহযােগিতা করেছিল।

এদিকে সামন্ত আগ্রাসন ও প্রভাব বিস্তার থেকে রক্ষার্থে নগরগুলি প্রায়শই রাজশক্তির দ্বারস্থ হত। এরকম একটি পরিস্থিতিতে রাজা একদিকে যেমন নগর ও শহরগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন, অন্যদিকে তেমনি তিনি সেখানকার বাণিজ্যের মুনাফার একটি অংশ রাজস্ব হিসাবে অর্জন করতেন। এইযুগে রাজশক্তি বহু নগরকে স্বশাসনের অধিকার সংবলিত স্বাধীনতার সনদ (Charters of Freedom) প্রদান করেছিলেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতাে পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলোতে রাজতন্ত্রও শহরের এই আঁতাত ও পারস্পরিক সহযােগিতা সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামােকে দুর্বল করে দিয়েছিল।

এই দেশগুলোতে রাজার প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সামন্ত-সেনার ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে আসতে থাকে। খ্রিস্টীয় ২য় সহস্রাব্দের সূচনায় যেখানে ফরাসি সামরিক শক্তির প্রধান উৎস ছিল সামন্ত সৈন্যবাহিনী, সেখানে ১২শ-১৩শ শতকে এদের স্থলাভিষিক্ত হয় স্থায়ী সৈন্যবাহিনী। ইংল্যান্ডেও স্ট্যান্ডিং আর্মি গঠনের পূর্বাভাস ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকেই পাওয়া যায়, ১৫শ শতকেই ওই সৈন্যবাহিনীর বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হয়। রাজার সামরিক শক্তিবৃদ্ধির সুফল ভােগ করেছিলেন ফিলিপ অগাস্টাস ও ৯ম লুইয়ের মতাে শাসকরা।

অবশ্যই সামন্ত প্রভুরা সর্বত্র বিনা-সংগ্রামে আত্মসমর্পণ করেন নি, এমন কি পরিণামে পরাস্ত হলেও সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ভােগ করার জন্য এবং নবােদিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রভাব প্রতিরােধের মানসে তারা শাসন বিভাগের বিভিন্ন পদ গ্রহণ করে আপন সাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষমতাচ্যুত হলেও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামন্তবর্গের অপরিসীম প্রভাব মধ্যযুগের অবসানের পরেও অটুট ছিল।

রাজার আহ্বান করা সভা ও সমাবেশগুলোর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব

সামন্ততন্ত্রের দুর্বলতা-প্রসূত একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রাজার আহ্বান করা সভা ও সমাবেশগুলোর ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। ইতিপূর্বে যেধরনের সভাগুলির প্রধানত প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকত, ১৪শ শতাব্দী থেকে সেগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। ক্রমশ এই সভাগুলোতে বণিক গােষ্ঠীগুলির সক্রিয় উপস্থিতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংল্যান্ডের সভাগুলিতে জেন্ট্রির অবস্থান অনুরূপভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের এই সভাগুলো হাউজ অফ পার্লামেন্ট রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

সম্প্রসারণে অক্ষমতা ও খাদ্যশস্যের লাভের পরিমাণ কম হওয়া

পেরি অ্যান্ডারসন (Perry Anderson) জানাচ্ছেন যে সামন্ত ব্যবস্থার পতনের আসল কারণ হল এই ব্যবস্থা তার সম্প্রসারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। এই ববস্থায় নতুন করে অনাবাদী পতিত জমি চাষে আনার সুবিধা ছিল না। উৎপাদন ব্যবস্থা গতিহীন হয়ে পড়েছিল। সামগ্রিকভাবে কৃষিজ উৎপাদন কমেছিল, বাণিজ্যিক পণ্য (cash crops) আঙুর, শণ, পশম ইত্যাদি উৎপাদনের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছিল। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মন্দা দেখা দিলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সংকট তীব্র আকারে দেখা দিয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা হল সামন্ততন্ত্রের পতনের একটি কারণ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৩৩৮-১৪৫৩ খ্রি.), ইংলন্ডের কৃষক বিদ্রোহ (১৩৮১ খ্রি.) ও গােলাপের যুদ্ধ (১৪৫৫-৮৫খ্রি.), ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ এবং জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ (১৫২৪-১৫খ্রি.) হল সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।

সাংগঠনিক ক্ষেত্র ও সামাজিক বিধিব্যবস্থায় সামন্ততন্ত্রের ব্যর্থতা ও অসামঞ্জস্য

উৎপাদন পদ্ধতির ব্যাপারে সামন্ততন্ত্রের এই অন্তনিহিত দুর্বলতা ও কালােপযােগী হয়ে ওঠায় ব্যর্থতা ছাড়াও তার সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এবং সামাজিক বিধিব্যবস্থার মধ্যে ব্যর্থতা ও অসামঞ্জস্য ক্রমশ স্পষ্টতর হতে থাকে। ১৪শ শতক থেকেই পশ্চিম ইউরােপের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তনশীলতার বেগ সঞ্চার হয় ও ভূস্বামী নিয়ন্ত্রিত স্থানিক ও ব্যক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা ক্রমশ অনুপযােগী হয়ে ওঠে। ইউরােপের বিভিন্ন দেশে রাজকীয় বিচারালয়ের উন্নততর ব্যবস্থা, সুবিচারের সহজলভ্যতা, দক্ষ, বিশ্বস্ত ও কর্মনিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্মচারীপুষ্ট-কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আঞ্চলিক সামন্তপ্রভুদের ওপর সাধারণ মানুষের নির্ভরতা কমিয়ে দিতে শুরু করে।

সােনারূপার উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মুদ্রার ক্রয়মূল্যের দ্রুত হ্রাস ও ভূমিদাসদের অব্যাহতি

মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময় থেকে সােনারূপার উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মুদ্রার ক্রয়মূল্য দুত হ্রাস পেতে শুরু করে। এটা সামন্ততন্ত্রের পতনে ভূমিকা রেখেছিল। এছাড়া জার্মানি ও অস্ট্রিয়া থেকে রূপা ও তামার নিষ্কাশন শুরু হলে বণিকরা সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, এতে সামন্তদের আধিপত্য কমেছিল।

সামরিক বাহিনীর পরিবর্তন

যে সামরিক শক্তি কুক্ষিগত করে সামন্তবর্গ দীর্ঘদিন প্রবল প্রতাপ অগণিত মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন তারও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায় মধ্যযুগের শেষার্ধে। ১৩শ শতক পর্যন্ত ইউরােপের পয়ে প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনীই ছিল সামন্ত প্রভুদের নির্দেশাধীন। সর্বাঙ্গে অশ্বারােহী বর্মাবৃত নাইটগণ সাবেকী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে প্রধান অংশ নিতেন। আর ম্যানরের মধ্যেকার দুর্গগুলো দীর্ঘকাল ধরে সামন্ত প্রভুদের সামরিক শক্তির কেন্দ্র ও তাদের অখণ্ড প্রতাপের প্রতীকরূপে বিরাজ করে আসছিল। প্রাকার ও জলপূর্ণ গভীর পরিখা বেষ্টনীর বন্দোবস্ত করে দুর্গগুলোর রক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি সাধনও করা হয়েছিল। কিন্তু ১৪শ শতকের শুরু থেকেই গুরুভার বর্মাবৃত অশ্বারোহী নাইটদের সমরক্ষেত্রে আধিপত্যের অবসান আরম্ভ হয়ে যায়। কুর্ত্রে (Courtrai) ১৩০২, ক্রেসি (Crésy) ১৩৪৬, এবং পােয়াতিয়ের (Poitiers), ১৩৫৬, এর রণাঙ্গণে পদাতিক বাহিনীর দক্ষ ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারের দ্বারা একদা-অপরাজেয়-অশ্বারোহী বাহিনীর অহঙ্কার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তী শতকে দীর্ঘ বল্লমধারী পদাতিক সুইডিশ সেনাগণ ১৪৭৬ সালে পরপর তিনবার বার্গান্ডির ডিউক চার্লস দ্য ব্ল্যাস-এর নাইটদের শােচনীয়ভাবে পরাজিত করে দেয়। ১৬ষ শতকেও অশ্বারােহী নাইটদের সর্বাঙ্গ বর্মাবৃত করে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা গেলেও তাদের রক্ষার জন্য বল্লমধারী পদাতিক ও তীরন্দাজ বাহিনীর সহযােগিতা অপরিহার্য ছিল। ১৪শ শতক থেকে গােলাবারুদের ব্যবহার শুরু হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণাধীন যে সামরিক বাহিনী অপ্রতিহত প্রভুত্ব ভােগ করে আসছিল তার অবসান নিশ্চিত হয়ে যায়। বন্দুকধারী সেনা ও গােলন্দাজ বাহিনী সামরিক ব্যাপারে অচিন্ত্যনীয় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৫শ শতকের শেষের দিকে সামন্ত-প্রভুদের পরাক্রম ও আত্মরক্ষার প্রাণকেন্দ্র দুর্গগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে নিতান্ত অসহায় হয়ে পড়ে এবং একদা সবল লর্ডের দম্ভ ও আধিপত্যের প্রতীক দুর্গগুলো নিরীহ শ্যাঁতোতে (Chateau) পরিণত হয়ে যায়।

মধ্যযুগে রাজা ও সামন্ততন্ত্রের বিরোধের শেষে রাজার জয়লাভ, জাতীয় রাজতন্ত্রের অগ্রগতি : ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স

মধ্যযুগে, সামন্ততন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের পর্বে কেন্দ্রীয় শক্তি বা রাজা সবসময় দুর্বল হতেন না। এই পর্বে রােমান আইনের ব্যাখ্যাও সর্বক্ষেত্রে স্পষ্ট ছিল না – এতে রাজা শক্তিশালী বা দুর্বল হতে পারতেন। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একদিকে সামন্তপ্রভু যেমন অলঙ্ঘনীয় কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা (privilege) ভােগ করতেন, অন্যদিকে তেমনি মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক কাঠামাের শীর্ষে অবস্থিত রাজাও কোনাে বিচ্ছিন্নতাকামী বা স্বাধীনচেতা অভিজাতের আনুগত্য দাবি করতে পারতেন।

রাজা এবং সামন্ত ছাড়া সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামাের অন্যতম স্তম্ভ ছিল রােমান ক্যাথলিক চার্চ। রােম সাম্রাজ্যের অবসানে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের যুগে এই চার্চ ছিল প্রশাসনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক ও বাহক রূপেও চার্চ যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে রাজশক্তির সঙ্গে চার্চ এবং পােপের হার্দিক ও সহযােগিতামূলক সম্পর্ক থাকলে সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামাের মধ্যেও রাজতান্ত্রিক শক্তির প্রতিপত্তি অর্জন সম্ভব ছিল। ফ্রান্সে তাই ঘটেছিল।

সাম্রাজ্যের সঙ্গে জাতীয় রাজতন্ত্রের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয়েছিল জাতীয় রাষ্ট্রগঠন তথা রাজতন্ত্রের অগ্রগতির ক্ষেত্রে। মধ্যযুগের অন্তিম পর্বে জাতীয় রাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্র ধীরে ধীরে স্পষ্ট আকার ধারণ করতে থাকে। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র (Absolutism) ছিল এই রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। ইতিপূর্বে, মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য একপ্রকার বিশ্বজনীন রাষ্ট্রচেতনার উদ্ভবে সহায়তা করেছিল। সেইযুগে রাজা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সার্বভৌমত্বের প্রকৃত অধিকারী হতেন না—প্রকৃত সার্বভৌমত্বের অধিকারী ছিলেন পোপ। রাষ্ট্রের জাগতিক (temporal) এবং ধর্মীয় (religious) ক্ষমতা এর ফলে দ্বিধাবিভক্ত হতে বাধ্য ছিল। সামন্তপ্রথার (feudal order) উপস্থিতি এই বিভাজনকে আরও স্পষ্ট ও ঋজু করে তুলেছিল। বলাবাহুল্য, এই রাজতন্ত্র ছিল দুর্বল রাজতন্ত্র।

কিন্তু মধ্যযুগের অন্তিম পর্বে সামন্তশক্তির দুর্বলতা, প্রোটেস্ট্যান্ট, অন্যান্য পোপতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের প্রসার এবং সর্বোপরি নিদারুণ তুর্কি আঘাতের ফলে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এই কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের ওপর স্বৈরতান্ত্রিক জাতীয় রাজতন্ত্র তথা রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে।

পশ্চিম ইউরোপেই এই রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রথম গড়ে উঠতে থাকে। এখানে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে যে প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, সপ্তদশ শতকে তা মোটামুটি স্পষ্ট রূপ ধারণ করে। এই গড়ে ওঠার মূলে দুটি কারণ লক্ষ করা যায়, যথা— (ক) সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের সূচনা এবং (খ) পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে (আইবেরীয় উপদ্বীপে) খ্রিস্টান রাজ্যগুলির মুসলমান-বিরোধী ধর্ম-যুদ্ধ। এই ধর্ম-যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল এমন এক সুসংবদ্ধ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যা জাতীয় রাষ্ট্রই দিতে পারত।

পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে যে সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং স্পেন। এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এরা ছিল অন্যতম প্রধান ইউরোপীয় শক্তি এবং এদের রাষ্ট্রনৈতিক তথা প্রশাসনিক পরীক্ষানিরীক্ষা আগামী দিনের ইউরোপকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আগ্রাসী সামন্ততান্ত্রিক হামলা থেকে সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে চার্চ সামন্তযুগের সূচনা থেকেই রাজতন্ত্রের প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতে উভয়েই উপকৃত হয়েছিল এবং ফরাসিরাজ মধ্যযুগীয় খ্রিস্টধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপােষকের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। এই স্বীকৃতি ফরাসি রাজতন্ত্রকে আনুষ্ঠানিক বৈধতা প্রদান করে একে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এদিকে ইংল্যান্ডের প্রক্রিয়া ছিল কিছুটা ভিন্ন, সেখানে চার্চ এবং সামন্তশ্রেণি সম্মিলিতভাবে রাজতন্ত্রের বিরােধিতা করার দরুন প্রথম যুগে ইংরেজ রাজশক্তি ফরাসি রাজশক্তির মতাে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হতে পারেনি। ইংল্যান্ডের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়েছিল আরও পরবর্তীকালে, ৮ম হেনরির (১৫০৯-১৫৪৭) আমলের রিফর্মেশনের যুগে। সেখানে টিউডর রাজশক্তি স্বয়ং চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট এবং সক্ষম হয়েছিল। ১৬শ শতকে মঠগুলোর বিলােপসাধন করেছিলেন অষ্টম হেনরি। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাদের বিপুল পরিমাণ অস্থাবর ও ভূসম্পত্তি। নতুন গ্রাম্য ভদ্ৰশ্রেণি বা জেন্ট্রি সেই সম্পত্তির সিংহভাগ ক্রয় করে লাভবান ও সম্পদশালী হয়েছিল। এরাই শক্তিশালী রাজতন্ত্রের অন্যতম সহায়করূপে আবির্ভূত হয়েছিল।

ফ্রান্স : মধ্যযুগেই কাপেতীয়দের অধীনে ফরাসি জাতীয় রাজতন্ত্র তথা রাষ্ট্র ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। কাপেতীয় নৃপতিরা, বিশেষত দ্বিতীয় ফিলিপ অগস্টাস (১১৮০- ১২২৩) নবম লুই (১২২৬-১২৫২) বিচ্ছিন্নতাকামী সামন্ত শক্তিগুলিকে কঠোর হস্তে দমন করে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আরও পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতকে ফরাসি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ধীরে ধীরে স্পষ্ট আকার ধারণ করতে থাকে। ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন যে আলোচ্য পর্বটি ছিল ফরাসি রাজতান্ত্রিক প্রশাসন বিকাশের একটি যুগসন্ধিক্ষণ। শিম্যান (Sheman) তার আলোচনায় দেখিয়েছেন যে আলোচ্য পর্বে ফ্রান্সে একদিকে ছিল তার পরবর্তী মধ্যযুগীয় সংবিধান (যা বিকেন্দ্রীকরণকে উৎসাহিত করেছিল), অন্যদিকে ছিল প্রাচীন ব্যবস্থার (ancien regime) সঙ্গে সম্পর্কিত সুস্থিতি ও শৃঙ্খলার প্রতিশ্রুতি। উভয় প্রবণতার মধ্যে চলেছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও টানাপোড়েন। শেষপর্যন্ত অবশ্য প্রাচীন ব্যবস্থাই সফল হয়েছিল। কিন্তু পি. জে. কনি (P. J. Coveney) এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তার মতে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক ছিল ফরাসি রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নয়নের যুগ। তার ভাষায় a dynamic process । যাইহোক, প্রাচীন ব্যবস্থাও অষ্টাদশ শতকের অস্তিমপর্বে কালজীর্ণ হয়ে ফরাসি বিপ্লবকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ত্বরান্বিত করেছিল।

ইংল্যান্ড : ইংল্যান্ডে জাতীয় রাষ্ট্র বিকশিত হয়েছিল টিউডর ও প্রথম যুগের স্টুয়ার্টদের (Early Stuarts) নেতৃত্বে। প্রথম যুগে ইংল্যান্ডীয় রাজতন্ত্রের ভিত্তি ছিল কিছুটা দুর্বল, পরবর্তীকালে অবশ্য তা শক্তি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল, বিশেষত টিউডর বংশীয় শাসক রানি প্রথম এলিজাবেথের (১৫৫৮-১৬০৩) রাজত্বকালে, যখন রানি সার্থকভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথম মেরি (১৫৫৩-১৫৫৮) (সিংহাসনের দাবিদার) এবং স্পেনীয় আর্মাডার মোকাবিলা করেছিলেন। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে একটি landmark বা পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী ঘটনা। ওই বছরে সপ্তম হেনরি (১৪৮৫-১৫০৯) তার ইয়র্কিস্ট প্রতিদ্বন্দ্বীকে বসওয়ার্থের যুদ্ধে পরাস্ত করে যে ‘নতুন রাজতন্ত্রের’ (New Monarchy) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ইংল্যান্ডকে একটি শক্তিশালী স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে পরিণত করেছিল। ইংল্যান্ডে অভিজাতদের রাজানুগত অধীনস্থ প্রজায় (Vassal) পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া রাজতন্ত্রের অন্যতম সামাজিক ভিত্তি ছিল নতুন গ্রাম্য ও স্থানীয় ভদ্রশ্রেণি (Gentry) এবং বণিক সম্প্রদায়। পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে লর্ডস সভা ( House of Lords) এবং কমন্স সভায় (House of Commons) এরা প্রতিনিধিত্ব করত। অভিজাতরা লর্ডস সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আর কমন্স সভা ছিল মূলত ভদ্রশ্রেণি ও বণিকদের প্রতিনিধি সভা। কমন্স সভা একেবারে গুরুত্বহীন ছিল এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, কারণ চতুর্দশ শতকে তাদেরও বেশকিছু আইন প্রণয়ন এবং নাকচ (veto) করার অধিকার প্রদান করা হয়। এইভাবে যে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছিল এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা বা নীতি (policy of checks and balance) অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছিল, তা গৃহযুদ্ধের যুগে এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত স্টুয়ার্টদের আমলে বিনষ্ট হয়েছিল। এর মূলে ছিল গৃহযুদ্ধের ফলে প্রতিষ্ঠিত কমনওয়েল্থ ও অলিভার ক্রমওয়েলের স্বৈরতন্ত্র এবং স্টুয়ার্টদের ক্যাথলিকবাদ বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস। কিন্তু কমনওয়েলথের অপসারণ ও ১৬৮৮-র গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution, 1688) এই ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তন-প্রসূত নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। গণতান্ত্রিক প্রবণতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার ভিত্তি দৃঢ়তর হয়েছিল।

জার্মানি ও ইতালিতে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভবে ব্যর্থতা : জার্মানিতে ইনভেস্টিচার কন্টেস্টের তীব্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে জার্মান চার্চ ও অভিজাত সামন্তর যৌথ বিরুদ্ধাচরণ জার্মান রাজশক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। সেখানে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটি দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। জার্মানি ও ইতালিতে অবশ্য জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি—এক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্র যত না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল উভয় রাষ্ট্রের ওপর অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়াস, ধর্মীয় বিভেদ, জাতীয় চেতনার অভাব প্রভৃতি। জার্মানির উত্তরাঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রসার দক্ষিণের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছিল— দক্ষিণাঞ্চল ছিল মূলত রোমান ক্যাথলিক, তারা উত্তরের সঙ্গে কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে চায়নি। 

রাজা ও সামন্তপ্রভূ-চার্চ এর পরস্পরবিরােধী স্বার্থে মধ্যযুগে অসংখ্য সংঘাতের সৃষ্টি হয় এবং মধ্যযুগের অবসানের পর এই সংঘর্ষে মূলত রাজশক্তিই বিজয়ী হয়েছিল। অবশ্য এই পরিস্থিতি কেবল পশ্চিম ইউরােপেই বিরাজমান ছিল। পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াও স্বৈরতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু তার প্রকৃতি ভিন্ন ছিল। বরং সেই অঞ্চল প্রত্যক্ষ করেছিল সামন্তশক্তির পুনরভ্যুত্থান বা পুনর্জাগরণ

শেষ কথা

সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির দুর্বলতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও হ্রাস, মুদ্রা-অর্থনীতির ব্যাপক প্রসার, অবাধ বাণিজ্য ও নগরের সম্প্রসারণ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান প্রভৃতি আর্থ-সামাজিক কারণে সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটেছিল। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্ল্যাকডেথ শুরু হলে সামন্ততন্ত্র একটি কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৩৩৮-১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ), ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহ (১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ) ও গােলাপের যুদ্ধ (১৪৫৫-৮৫ খ্রিস্টাব্দ), ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ, জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ (১৫২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি ঘটনা ছিল সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।

বাস্তব ক্ষেত্রে ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুবিশাল ভূসম্পত্তির অস্তিত্ব আরো বহুকাল টিকে ছিল যদিও কোথাও কোথাও বর্ধিষ্ণু কৃষক কিছু পরিমাণ জমি কিনে বা অসংখ্য hotes বা কৃষক উপনিবেশে প্রায়-স্বাধীন কৃষিজীবীগণ সামন্ততান্ত্রিক দায়দায়িত্ব ছাড়াই কৃষি-উৎপাদন অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পশ্চিম ইউরােপের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এবং উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যে সর্বাত্মক রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল তার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের পক্ষে বাতিল-হয়ে-যাওয়া, জীর্ণ এবং নিঃস্ব একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ক্ষীণ অস্তিটুকু বজায় রাখাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবন

দ্বিতীয় ভূমিদাসত্বের যুগ

১৫শ ও ১৬শ শতকে পশ্চিম ইউরােপের বহু দেশে পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল (capitalist mode of agriculture) অর্থনীতির বিকাশ ও প্রসার ঘটেছিল এবং এই প্রক্রিয়া সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু এসময় পূর্ব ইউরােপে, অর্থাৎ পােল্যান্ড, বােহেমিয়া, হাঙ্গেরি ও রুশ সাম্রাজ্যে সামন্তপ্রথা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। পূর্ব ইউরােপের কৃষক নতুন করে ভূমিদাসত্বের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (Frederick Engels) মনে করেন, এই পর্ব ছিল দ্বিতীয় ভূমিদাসত্বের যুগ।

পশ্চিম ইউরোপে বিশেষায়িত পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থা, খাদ্যশস্যের চাহিদা, পূর্ব ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবন

পশ্চিম ইউরােপে পুঁজিবাদী কৃষিতে বিশেষায়ণ (specialisation) শুরু হয়েছিল। ভৌগােলিক অবস্থান, ভূমির প্রকৃতি ও আবহাওয়ার কারণে কৃষিতে বিশেষায়ণ হয়। পশ্চিম ইউরােপে পশম, মাংস, তুলা, শণ, ফল ইত্যাদির উৎপাদন বেড়েছিল। বাজারের চাহিদার দিকে তাকিয়ে প্রচুর পুঁজি ও শ্রমিক বিনিয়ােগ করে উৎপাদন বাড়ানাে হয়েছিল। পশ্চিম ইউরােপে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছিল, গবাদি পশুর চাহিদা বেড়েছিল। পশ্চিম ইউরােপের এই চাহিদা মেটাতে এগিয়ে এসেছিল কৃষি-নির্ভর পূর্ব ইউরােপ।

পশ্চিম ইউরােপে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণে সামন্ততন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল দুর্বল, শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়নি। রাজাদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, আমলাতন্ত্র, কর ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা ছিল না। কৃষকেরা সংঘবদ্ধ, সংগঠিত হতে পারেনি, অপরদিকে সামন্তপ্রভুরা ছিল খুব শক্তিশালী। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউরােপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অভিঘাতে সামন্ততন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল এবং এর স্থলে উন্নত আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে এই সময়ে জাতীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১৬শ শতকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় সামন্ত প্রভুরা বড় বড় খামার স্থাপন করে কৃষিজ উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছিল। পশ্চিম ও পূর্ব বা মধ্য ইউরােপের উৎপাদন ব্যবস্থার পার্থক্য তাদের মধ্যে বিভাজন রেখাটি স্পষ্ট করে দিয়েছিল। পশ্চিম ইউরােপে ছিল পুঁজিবাদী কৃষি যেখানে বাণিজ্যিক পণ্য বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হত। তার সঙ্গে ছিল শিল্প পণ্য-বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতি ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। এর চালিকা শক্তি ছিল বুর্জোয়া শ্রেণী। পূর্ব ইউরােপে ছিল সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, শিল্প পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্য ছিল খুবই কম। এর চালিকা শক্তি ছিল সামন্তপ্রভুরা।

১৬শ শতকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সুযােগ গ্রহণ করে এরা বিশাল ম্যানর গড়ে তুলেছিল। এই ম্যানরগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ প্রভূত ছিল এবং অধীনস্থ প্রজা-উৎপাদিত উদ্বৃত্তের একটি সিংহভাগ সামন্তপ্রভুরাই ভােগ করত। এই শ্রেণি ছিল একাধারে শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ। তুলনামূলক বিচারে অধীনস্থ প্রজা বা কৃষক ছিল দুর্বল ও অসংবদ্ধ। এই পরিস্থিতি সামন্ততান্ত্রিক শােষণের পক্ষে আদর্শ ছিল।

থুনেন বলয় ও ইউরোপ জুড়ে উৎপাদন পদ্ধতির পার্থক্য

১৬শ শতকে ইউরােপের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কৃষির বিশেষায়ণ ও আঞ্চলিক পরিবর্তন প্রধাণত তিনটি কৃষি বলয়ের সৃষ্টি করেছিল। থুনেনের নামানুসারে একে বলা হয় ‘থুনেন বলয়’ (Thunen)। প্রথম বলয়ের মধ্যে ছিল ইউরােপের শিল্পোন্নত অঞ্চলসমূহ, দ্বিতীয়টিতে ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী অঞ্চল আর তৃতীয়টিতে ছিল গােখাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল। জুটল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি এবং রাশিয়া হয়ে ইউক্রেন পর্যন্ত তৃতীয় অঞ্চলটি প্রসারিত ছিল। এই অঞ্চল পশ্চিম ইউরােপকে গবাদি পশু সরবরাহ করত। থুনেন জানিয়েছেন যে কেন্দ্রিয় বলয় (শিল্পোন্নত অঞ্চল) থেকে যতদূরে যাওয়া যায় উৎপাদন পদ্ধতি তত অদক্ষ, কম কর্মক্ষম এবং উৎপাদনের পরিমাণও কম। থুনেন আরও জানাচ্ছেন যে উত্তর ও পশ্চিম ইউরােপের সঙ্গে তাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়, এই পার্থক্য হল উৎপাদন পদ্ধতিতে। দ্বিতীয় ভূমিদাসত্ব হল এই পার্থক্যের কেন্দ্রস্থিত ঘটনা। উৎপাদনের পদ্ধতি অনুযায়ী পূর্ব দিকের এ (Elbe) নদী পশ্চিম ও পূর্ব ইউরােপের মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরি করে দিয়েছিল। এর পশ্চিম দিকে হল পুঁজিবাদী কৃষি নির্ভর শিল্প বাণিজ্য কেন্দ্রিক পশ্চিম ইউরােপ, প্রথম বলয়, পূর্ব দিকে সামন্ততান্ত্রিক পূর্ব ইউরােপ, দ্বিতীয় বলয়।

পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধবিগ্রহ

নানান কারণে পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে কৃষকের সংখ্যা কমেছিল। বড়াে বড়াে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল এই যুগে, তার সঙ্গে ছিল সামাজিক অভ্যুত্থান। জন জিজকার নেতৃত্বে বােহেমিয়াতে হুসাইট যুদ্ধ (১৪১৯-৩৪ খ্রি.) চলেছিল। মােঙ্গলরা রাশিয়ার ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালিয়েছিল। মােঙ্গল আক্রমণে রাশিয়ার বহু শহর ধ্বংস হয়েছিল, রাজন্যবর্গের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলেছিল। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে বহু লােক মারা যায়।

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের কারণ

পূর্ব ইউরােপের শহরগুলো পশ্চিমের তুলনায় অনেক দুর্বল ছিল, শহরে শিল্প-পণ্য উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেন-দেন তেমন ছিল না। শহরকেন্দ্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী তেমন শক্তিশালী ছিল না। রাজাও সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে শহরের জন্য সুযােগ-সুবিধা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করে নিতে পারেনি। ১৫শ শতকে পূর্ব ইউরােপের কৃষিতে মন্দা চলেছিল, শহর অঞ্চলের দুর্বলতা পূর্ব ইউরােপে সামন্তপ্রভুদের শােষণমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

১৫শ শতকের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটলে পূর্ব ও মধ্য ইউরােপের সামন্তপ্রভুদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। এদিকে পশ্চিমের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাদ্যশস্যের প্রয়ােজন ছিল। সামন্তপ্রভুরা বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বড়াে বড়াে ম্যানর বানিয়েছিল। এসব ম্যানরে কর্মরত কৃষকদের ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে।

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে সামন্তপ্রথার সম্প্রসারণের অনেকগুলো কারণ ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হল পশ্চিম ইউরােপে খাদ্যশস্যের চাহিদা বৃদ্ধি, পূর্ব ইউরােপে নগরায়ণের অনগ্রসরতা, শহরগুলোর দুর্বলতা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর অভিজাত শ্রেণীর আধিপত্য। শস্য রপ্তানি বাড়লে অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছিল, সামন্তব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত হয়েছিল।

কৃষিজ পণ্যের রপ্তানির সাথে সামন্ততন্ত্রের সম্পর্ক

১৬শ ও ১৭শ শতকের ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন যে এই পর্বে পূর্ব ও মধ্য ইউরােপ থেকে প্রচুর পরিমাণে কৃষিজ পণ্য, খাদ্যশস্য ও কাচামাল রপ্তানি হতে থাকে। পােল্যান্ডের ডানজিগ বন্দর ছিল শস্য রপ্তানির একটি বড়াে ঘাঁটি। পূর্বাঞ্চলের বড় বড় ম্যানরগুলো ছিল কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও বিপণন সংস্থা।

বিশিষ্ট ফরাসি ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ মনে করেন যে জার্মানির পূর্বাঞ্চল এবং স্লাভ অধুষিত অঞ্চলগুলোতে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে ভূমিদাসত্বের বন্ধন কঠিন হওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। French Rural History গ্রন্থে তিনি বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছেন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ব্লখ এক্ষেত্রে সাধারণভাবে শস্য বাণিজ্যের উল্লেখ করেছিলেন। বিশেষভাবে রপ্তানি বাণিজ্য সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলেননি। পরবর্তীকালে মরিস ডবও বিষয়টি পর্যালােচনা করতে গিয়ে রপ্তানি বাণিজ্য সম্বন্ধে কোনাে মন্তব্য করেননি। কিন্তু এক্ষেত্রেও উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ব্লখের বিশ্লেষণে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে ভূমিদাস প্রথার বন্ধন আরও কঠিন হয়েছিল এমন ইঙ্গিত হয়তাে আছে। কিন্তু ডব মনে করেন যে দুটি বিষয় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

বস্তুত, ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসারের ফলেই সামন্তপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য লক্ষ করা যায়। যারা মনে করেন যে ইউরােপের পূর্বাঞ্চলে ভূমিদাস প্রথা উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছিল রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপক পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন—স্নিডার ভ্যান বাঘ ও পােস্তান। সাম্প্রতিককালে ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইনও একই মত পােষণ করেছেন। ফার্নান্দ ব্ৰদেলও এই মতের অনুগামী। কিন্তু ব্ৰদেল ভূমিদাসত্ব বিকশিত হওয়ার জন্য একটি অভ্যন্তরীণ কারণের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার মতে, এই অভ্যন্তরীণ কারণ ছিল গ্রামীণ অভিজাত (সামন্ত) শ্রেণির প্রাধান্য; এরা শহর ও রাষ্ট্রের দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করেছিল।

অন্যদিকে, পেরি অ্যান্ডারসন, আর্নস্ট ক্লাইমা, রবার্ট ব্রেনার এবং অন্যান্য কয়েকজন ঐতিহাসিক মনে করেন যে আকস্মিক রপ্তানি বাণিজ্য বিস্তারের ফলে পূর্ব ইউরােপে ভূমিদাস প্রথা উগ্র রূপ ধারণ করেছিল – এই অভিমত গ্রহণযােগ্য নয়। ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসারের ফলে শ্রেণিবিন্যাসেরও বিবর্তন ঘটে – একথা ব্রেনার অস্বীকার করেননি। কিন্তু শুধুমাত্র শস্যের বাজারের উদ্ভবের ফলে চাষি ভূমিদাসে রূপান্তরিত হয়েছিল এ মত ব্রেনার স্বীকার করেননি। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, যে যুগে জার্মানির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কৃষক ভূমিদাসে রূপান্তরিত হচ্ছিল সেই যুগেই জার্মানির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থাপন্ন ও সচ্ছল চাষিরা শস্য উৎপাদনে নিজেদের অধিকারসুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তােলার ফলেই এই অধিকার অর্জন সম্ভব হয়েছিল।

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের কৃষকদের উপর সামন্তপ্রভূদের শোষণ

কৃষকদের সব অধিকার হরণ করে তাদের ভূমিদাসে পরিণত করা হয়। পশ্চিম ইউরােপে সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার, শােষণ বাড়লে ভূমিদাসরা পালিয়ে শহরে গিয়ে আশ্রয় নিত, সেখানে কাজ ও স্বাধীনতা দুই পেত। পূর্ব ইউরােপে তা হত না, এখানে সামন্তপ্রভুরা তাদের জমির সঙ্গে বেঁধে ফেলেন।

পূর্ব ইউরােপে সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা এমনভাবে কমে গিয়েছিল যে বহু জমি অনাবাদী হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের জমিতে বেঁধে রাখার জন্য সামন্তপ্রভুরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছিল। পশ্চিম ইউরােপের মতাে তারা কম শ্রম-নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে পারেনি, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি কৌশলের ব্যবহার ছিল না। সামন্তপ্রভুরা কৃষকদের গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ শহরগুলো ছিল দুর্বল, অনুন্নত, শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা স্থাপিত হয়নি।

১৫শ ও ১৬শ শতকে পােল্যান্ড, রাশিয়া, প্রাশিয়া, ব্রান্ডেনবার্গ, বােহেমিয়া ও লিথুয়ানিয়ায় কৃষকদের জমির সঙ্গে বেঁধে রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, আইন-কানুন তৈরি হয়েছিল। কৃষকদের ওপর নতুন করে সামন্তকর বসানাে হয়, পালিয়ে গেলে তাদের ধরে এনে শাস্তি দেওয়া হত। বাধ্যতামূলক শ্রমের (forced labour) মাত্রা বেড়েছিল, ১৬শ শতাব্দীর অন্তিম পর্বে মেকলেনবার্গের চাষীকে সপ্তাহে তিনদিন শ্রমদান করতে হত। পোল্যান্ডে ছদিনের শ্রম আদায় করা হত। এদের অনেকেই জমির স্বত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। পূর্ব ইউরােপে পােল্যান্ড ছিল সামন্ততন্ত্রের সবচেয়ে বড়াে ঘাঁটি। এখানে পিওত্রোকোর আইনবিধি দিয়ে কৃষকদের বেঁধে রাখা হয়েছিল।

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে ম্যানরের বিস্তার এবং ম্যানরীয় প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে কৃষকদের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করে তাদের ভূমি-দাসে পরিণত করেছিল। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার ভূস্বামী শ্রেণি পলাতক কৃষকদের বিনা বিচারে ফাঁসি দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছিল। ১৬শ শতাব্দীর প্রারম্ভে দুর্বল টিউটনিক অর্ডার ভেঙে পড়লে, ঐ প্রথার অন্তর্ভুক্ত যােদ্ধাশ্রেণি অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে য়ুঙ্কার (Junker) শ্রেণি গড়ে তুলেছিল। সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত অথচ জমির সঙ্গে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ কৃষকের ওপর এই শ্রেণির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ফার্নান্দ ব্ৰদেল লিখেছেন যে ১৫শ শতকে যে সব কৃষক স্বাধীন ছিল ১৬শ শতকে তারা স্বাধীনতা হারিয়ে ভূমিদাসে পরিণত হয়। জার্মানির সাইলেশিয়ার কৃষকদের বাধ্যতামূলক শ্রমদানের কোনাে সীমা ছিল না। রাশিয়ার কৃষকরা ঋণভারে জর্জরিত ছিল, ঋণের চাপে তারা স্বেচ্ছায় ভূমিদাসত্ব গ্রহণ করেছিল।

সামন্তপ্রভুদের স্বার্থের অনুকূল বেগার শ্রম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ব ইউরােপ ছিল অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ, পশ্চিম ইউরােপ অগ্রসর, সম্প্রসারণশীল। পূর্ব ইউরােপে শিল্প-পণ্যের উৎপাদন কম ছিল এবং এই পণ্য উৎপাদনের ওপর সামন্তপ্রভুদের প্রভাব ছিল। ঐতিহাসিকরা এই অর্থনীতির নাম দিয়েছেন ভােরওয়ার্ক (Vorwerke)। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সামন্তপ্রভুদের স্বার্থের অনুকূল ছিল, এর ভিত্তি ছিল বেগার শ্রমদান প্রথা। ভূস্বামীর শ্রমের যােগানের ৬৩ শতাংশ আসত ভূমিদাস প্রথা থেকে, বাকী ৩৭ শতাংশ শ্রম ছিল দিন-মজুরদের। দিন-মজুর দিয়ে চাষ করালে সামন্তপ্রভুদের লাভের ৩৩ শতাংশ কমে যেত। সুতরাং তারা ভূমিদাস দিয়ে চাষ করিয়ে লাভের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছিল। বেগার শ্রম সহজলভ্য ছিল বলে ভূস্বামীরা উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চায়নি, প্রযুক্তির প্রয়ােগ করেনি।

ভূস্বামী উৎপাদকদের উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করেছিল বলে অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে ওঠেনি, সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়েনি, সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হয়। শিল্পের বিকাশ না ঘটায় শহরগুলি অবক্ষয়ের মুখে পড়েছিল। এরা অ্যান্টি-মার্কেন্টাইলিস্ট (anti-mercantilist) নীতি অনুসরণ করে চলেছিল, রপ্তানিযােগ্য পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়নি। শহরগুলি শিল্প পণ্যের আমদানিকে উৎসাহ দিয়েছিল, যা পশ্চিম ইউরােপের মার্কেন্টাইলিস্ট (Mercantilist) অর্থনীতির ঠিক বিপরীত। মার্কেন্টাইলিস্ট অর্থনীতি আমদানি কমানাে, রপ্তানি বাড়ানাের ওপর জোর দিয়েছিল, দেশের সম্পদ বাড়ানাের কথা ভেবেছিল। এজন্য পূর্ব ইউরােপে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ে সমভার অর্থনৈতিক বিকাশ (balanced economic development) সম্ভব হয়নি।

কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীন বাজারের নিম্ন চাহিদা, মুদ্রা-নির্ভর অর্থনীতির অনুপস্থিতি, কৃষিপ্রযুক্তির অভাব

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপ থেকে শস্য রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল ওই অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে না ওঠা এবং গড়ে না ওঠার কারণ ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার স্বল্পতা। এটি সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবক্ষয়ী রূপকেই প্রকট করে তুলেছিল। পেরি অ্যান্ডারসনও মনে করেন যে পূর্বাঞ্চলে দ্বিতীয় ভূমিদাসত্বকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তা ছিল অনুন্নত ও পশ্চাদপদ। তিনি আরও বলেছেন যে পূর্ব ইউরােপের ম্যানরভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা পশ্চিমের তুলনায় অনেক কম, উৎপাদনশীল ও গতিসম্পন্ন ছিল। এর মূলে ছিল গ্রামীণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নির্মম সামাজিক দমননীতি।

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে কৃষি নির্ভর যে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলনা। তাদের শস্য রপ্তানি-বাণিজ্য পশ্চিম ইউরােপ ও বিশ্ব বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই শস্যের বাজারে ওঠা-নামা দেখা দিলে পূর্ব ইউরােপের কৃষক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেত। এই কৃষি অর্থনীতি অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপরও খানিকটা নির্ভর করত। কিন্তু কৃষি উৎপাদনের সুষ্ঠু বণ্টন না থাকায় এজন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বাড়েনি, শহরগুলির উন্নতি হয়নি বরং অনেক শহর অবক্ষয়ের মুখে পড়েছিল। মুদ্রা-নির্ভর অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়নি। অর্থনীতি গতিহীন, স্থিতিহীন, অস্থির ছিল। পূর্ব বা মধ্য ও পশ্চিম ইউরােপের অর্থনীতির মধ্যে ক্রমশ ব্যবধান বাড়তে থাকে। পূর্বের ম্যানরীয় উৎপাদন ব্যবস্থা পশ্চিমের সঙ্গে তুলনায় অনেক কম গতিসম্পন্ন ও উৎপাদনক্ষম ছিল। পূর্ব ইউরােপে কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু সেই অনুপাতে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন তেমন বাড়েনি। পূর্বের গ্রামীণ অর্থনীতি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। এই পশ্চাদগামিতার একটি বড় কারণ হল ভূস্বামীর অর্থনৈতিক, আইনগত ও ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব, অপরদিকে কৃষকের সামগ্রিক অধিকারহীনতা। সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর সিনর প্রভুর সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ ছিল।

উপজাতি সর্দার ও উচ্চবর্গের লোক-ভিত্তিক পশ্চাৎপদ ও পশ্চিমের পুঁজিবাদ নির্ভর স্বামন্ততন্ত্র, পশ্চিমের সামন্ততন্ত্রের সাথে পার্থক্য

পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে উপজাতি সর্দারদের অনুচররা ভূস্বামী হয়ে বসেছিল, উচ্চবর্গের মানুষ জমি কিনে ভূস্বামী হয়েছিল। এই সামন্ততন্ত্র ছিল অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ। পশ্চিম ইউরােপের সামন্তপ্রভুরা ছিলেন অনেক বেশি সংস্কৃতিবান, রুচিবান, অনেক বেশি আলােকিত। পূর্ব ইউরােপের সামন্তপ্রভু ভূমিদাসদের শােষণ করে তার লাভের মাত্রা বজায় রেখেছিল। উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে, নতুন কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করে বা শিল্প-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে তারা আয় বাড়ানাের চেষ্টা করেনি। পশ্চিমের পুঁজিবাদী সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির সঙ্গে এই সামন্ত প্রভুরা পরােক্ষভাবে যুক্ত হয়েছিল। শস্য, পশম ও মাংসের বিনিময়ে তারা বিলাস দ্রব্য ও অন্যান্য ভােগ্য পণ্য সংগ্রহ করত। সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত সামন্তপ্রভুরা। ভূমিদাস প্রথা ছিল তার উৎপাদনের প্রধান উপকরণ। এই অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। প্রচলিত সামন্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে সামন্তপ্রভু উৎপাদন বাড়ানাের প্রয়াস চালিয়েছিল, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিনিময় ছিল। এক ধরনের একচেটিয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল এটি। সামন্তপ্রভুরা উৎপাদন, বণ্টন, সরবরাহ, রপ্তানি-বাণিজ্য সব নিয়ন্ত্রণ করত। পশ্চিমের উদীয়মান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে তারা ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ বজায় রেখে চলেছিল। পূর্ব ইউরােপ ছিল পশ্চিমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপূরক, এখানকার খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের যােগান তাদের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছিল।

তথ্যঋণ

১। মধ্যযুগের ইউরোপ – ১ম খণ্ড, নির্মলচন্দ্র দত্ত, ৩য় সংস্করণ, ডিসেম্বর, ১৯৯৪, পৃ – ১৫৪ – ১৬১
২। আধুনিক ইউরোপের আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০ – ১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ২০১৪, পৃ – ২৯ – ৪২
৩। আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন : মধ্য পঞ্চদশ থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতক, বাসবেন্দ্র বসু, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর, ২০১২, পৃ – ২৫ – ৪৮

3 Trackbacks / Pingbacks

  1. ব্ল্যাকডেথ-দুর্ভিক্ষাদি কারণে ১৪শ শতকে ইউরোপের বিপর্যয় ও এর ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ – বিবর্তন
  2. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ
  3. রাশিয়ার ইতিহাস  – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.