মাণ্ডূক্য উপনিষদ ও তার প্রভাব

দার্শনিক চিন্তা-ঐতিহ্যে মাণ্ডূক্যোপনিষদের প্রভাব

মাণ্ডূক্যোপনিষদ্ প্রধান ১৩টি উপনিষদের মধ্যে একটি। পৃথিবীর দর্শন ঐতিহ্যে এই উপনিষদটির ভূমিকা অনবদ্য।

বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন (১৫০-২৫০ খ্রিস্টাব্দ) যেমন বুদ্ধের দর্শন ও গ্রিক দার্শনিক পাইরোর (৩৬০ – ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সংশয়বাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি তার উপর মাণ্ডূক্যোপনিষদেরও প্রভাব ছিল (এই গ্রিক দার্শনিক পাইরো আবার বুদ্ধের (৫৬৩ থেকে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে জীবিত) দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। টাইমন, আর্কেলিসের মত অনেক দার্শনিক পাইরোর সংশয়বাদের বিকাশ সাধন করেন, দেকার্ত সহ আধুনিক সংশয়বাদীদের দর্শনে তাদের প্রভাব রয়েছে)। সব মিলেই নাগার্জুন তার দর্শন শূন্যবাদের ধারণা দেন। শূন্যবাদ অনুসারে, আমি সহ এই জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা জানা যায়না বা কোনভাবেই এই বিষয়ে কিছু বলা যায়না, এই সংশয়ের অবস্থাকেই নাগার্জুন নাম দিয়েছিলেন শূন্য। শূন্যবাদের ধারণা মহাযানী ও বজ্রযানী বৌদ্ধমতের অন্যতম ভিত্তিস্বরূপ। বর্তমানে চীন, জাপান ও ভিয়েতনামে মহাযানী বৌদ্ধমত এবং চীনের তিব্বত ও ইনার মঙ্গোলিয়া অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার একাংশে বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত। পূর্বভারতের শাক্তধর্ম বজ্রজানী বৌদ্ধমতের দ্বারা প্রভাবিত।

মাণ্ডুক্যোপনিষদের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই বেদান্ত (বা উপনিষদভিত্তিক) দার্শনিক গৌড়পাদ (খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতক) ও আদি শঙ্করাচার্য (৭০০ – ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) বেদান্তের অদ্বৈতবাদী ভাষ্য বা অদ্বৈতবাদ নামক দর্শনটি প্রদান করেন, এই দর্শন অনুসারে ব্রহ্ম, জগৎ ও আত্মা অভেদ। এই জগৎ ও আত্মা আসলে ব্রহ্মেরই মায়া বা অবভাস মাত্র। ব্রহ্ম ছাড়া জগতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এই দর্শনে নাগার্জুনের শূন্যবাদী দর্শনেরও প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। শঙ্করের অদ্বৈতবাদী দর্শন অনেকটা বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যবাদী দর্শনের মত হওয়ায় অনেক ব্রাহ্মণই শঙ্করকে “ছদ্ম বৌদ্ধ” বলে উপহাস করতেন। পরবর্তীতে ভক্তিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা বৈষ্ণব সম্প্রদায় তাদের দার্শনিক প্রয়োজনে বেদান্ত বা উপনিষদের বিভিন্ন ভাষ্য রচনা করেন। তারা অদ্বৈতবাদকে ভালো চোখে দেখেননি, তারা একে বেদবিরোধী বলে মনে করতেন (চৈতন্য বা তার শিষ্য ষড়গোস্বামীরা এই তালিকায় পড়েন)। কিন্তু তারপরও তাদের উপর অদ্বৈতবাদের প্রভাব ছিল, যেমন বৈষ্ণব দার্শনিক নিম্বার্কের (খ্রিস্টীয় ১২শ-১৩শ শতক) ভেদাভেদবাদ ও চৈতন্য (১৫শ শতক) বা ষড়গোস্বামীর অচিন্তভেদাভেদবাদে আত্মাকে একই সাথে পরমাত্মা বা ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সাথে ভেদ ও অভেদ কল্পনা করা হয়। এই অভেদ কল্পনায় অদ্বৈতবাদের প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া এই বৈষ্ণব দার্শনিকরা অদ্বৈতবাদকে খণ্ডন করেই নিজেদের দর্শন নির্মাণের প্রচেষ্টা করেছেন।

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের গ্রীক দার্শনিক অ্যামোনিয়াস সাক্কাস (১৭৫-২৪২ খ্রিস্টাব্দ) নিওপ্লেটোনিজম বা নব্যপ্লেটোবাদ নামক নতুন দার্শনিক শাখার জন্ম দেন। পরবর্তীকালে প্লোটিনাস ও পরফিরি সহ অনেকে এর বিকাশ সাধন করেছিল। নব্যপ্লেটোনিজম অনুসারে ঈশ্বর নির্গুণ, তার উপর কোন গুণ আরোপ করা যায়না। তিনি এক, এই জগৎ তারই প্রকাশ, আর মানবাত্মা বিশ্বাত্মারই অংশবিশেষ। হ্যাঁ, অ্যামোনিয়াস সাক্কাস কেবল প্লেটোর দ্বারাই প্রভাবিত হননি, তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন মাণ্ডূক্যোপনিষদের দ্বারাও। নব্যপ্লেটোবাদীরা ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রধান শত্রু, তারা নির্গুণ ব্রহ্মের ধারণা, বিশ্বের একত্বের ধারণা, মানবাত্মার বিশ্বাত্মার অংশ হবার ধারণাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই দীর্ঘকাল ধরে খ্রিস্টধর্মের সাথে যুদ্ধ করে করে একসময় ইউরোপে নিওপ্লেটোনিজমের পরাজয় ঘটে। কিন্তু নিওপ্লেটোনিজম বিলুপ্ত হয়নি। তা প্রবেশ করে ইসলামী দর্শনে। আল কিন্দী (৮০১-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ), আল ফারাবি (৮৭২ – ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও ইবনে সিনাকে (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) বলা হয় ফালাসিফা দার্শনিক। এই ফালাসিফা দর্শন ছিল নিওপ্লেটোনিজমের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত।

ফালাসিফা দার্শনিকরা নিওপ্লেটোনিস্ট গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে রেখেছিলেন। পরে এদের দর্শন ইউরোপে পৌঁছে যায়। খ্রিস্টীয় দার্শনিকরা এই অদ্বৈতের ধারণাকে সহ্য করত না। জিওরদানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) নামক এক খ্রিস্টীয় রেনেসাঁ দার্শনিক নিওপ্লেটোনিস্ট দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকটা অদ্বৈতবাদের মতই দর্শন প্রদান করলেন। তার এই দর্শনকে সর্বেশ্বরবাদ বা প্যানথিজম বলা হয়। পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টীয় সমাজের অধীশ্বর ক্যাথোলিক চার্চ স্বভাবতই একে ভালোভাবে নিল না, ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হল। ব্রুনোর ঘটনার পর কোন খ্রিস্টান আর এই দর্শনের বিকাশ সাধনের সাহস পায়নি। ফলে যিনি এগিয়ে এলেন তিনি ছিলেন একজন নিজ সম্প্রদায় থেকে বিতারিত ইহুদি, স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি এই দর্শনের বিকাশ সাধন করেন, কিন্তু সেই সময় সবচেয়ে উদার প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্র হোল্যান্ডে থেকেও নাস্তিক্যবাদ প্রচারের অভিযোগের কারণে এই দর্শন প্রকাশ করতে পারেননি, চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হত। মৃত্যুর পর তার মহামূল্যবান দর্শন প্রকাশ করা হয়। পাশ্চাত্য দর্শনের বিকাশ সাধনের স্পিনোজার গুরুত্ব অপরিসীম। তার দর্শন সমগ্র এনলাইটেনমেন্ট ফিলোসফি বা জ্ঞানালোকের যুগের দর্শনকে প্রভাবিত করে। তিনি প্রভাবিত করেছিলেন শোপেনহাওয়ার, হেগেল, রুশো, শেলিং, মার্ক্স, আইনস্টাইন, ফিখটে, লাইবনিজ, রাসেল, ভিটগেনস্টাইন, ফ্রয়েড, আলথুজার, হার্ট, কোলরিজ, লেভি স্ট্রসের মত চিন্তাবিদদেরকে। বর্তমান যুগের জীবিত চিন্তাবিদ অ্যান্টোনিও নেগরি, আরভিন ইয়ালকমদের উপরেও স্পিনোজার প্রভাব রয়েছে।

নিওপ্লেটোনিজম শেষের দিকে অনেকটা মিস্টিক বা মরমীধর্মী হয়ে যায়। এই দর্শন এরপর প্রভাবিত করে খ্রিস্টীয় মরমীবাদ নস্টিক ধারাকে ও ইসলামী মরমীবাদ সুফী ধারাকে। সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবি (১১৬৫ – ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ) ও জালাল উদ্দিন রুমির (১২০৭ – ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ) দর্শনে দেখা যায় এই ধারার প্রভাব। আর এরপর ভারতবর্ষে যখন সুফিরা এদের দর্শনকে বহন করে নিয়ে আসে, তখন মনে হল যেন ভারতবর্ষ থেকে উদ্ভূত দর্শন পুনরায় ভারতবর্ষেই ফিলে এলো।

বাংলায় নবজাগরণের সময় যে ব্রাহ্মধর্মের বিকাশ ঘটে তাতে একই সাথে খ্রিস্টীয় দর্শন ও বেদান্ত দর্শনের প্রভাব দেখা যায়। এদের দর্শনে কলোনিয়াল স্পনসরশিপ ছিল বলেই খ্রিস্টীয়দর্শনের প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বিবেকানন্দ (১৮৬৩ – ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) যখন ব্রাহ্মসমাজে ছিলেন তখন তিনি যেমন মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন, তেমনি অদ্বৈতবাদেরও বিরোধী ছিলেন। পরে তিনি অদ্বৈতবাদকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ও ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করার পর অদ্বৈতবাদকে ব্যবহার করে তার নিজের দর্শন নব্যবেদান্ত তৈরিতে মন দেন। এই নব্যবেদান্ত প্রচণ্ডভাবে অদ্বৈতবাদ প্রভাবিত।

মাণ্ডূক্যোপনিষদ রচিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০ থেকে ০ অব্দের মধ্যে। অর্থাৎ কমন ইরার সূচনার খুব একটা আগে এটি রচিত হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে, যে গ্রন্থটি সারা পৃথিবীর চিন্তাকে প্রভাবিত করল, সেই গ্রন্থটির রচয়িতা কে তাই জানা যায়নি।

টীকা ও ব্যাখ্যা সহ মাণ্ডূক্যোপনিষদের কণ্ডিকাসমূহ

ভূমিকা

এখানে মাণ্ডূক্যোপনিষদকে ব্যাখ্যা ও টীকা সহ প্রমিত বাংলা ভাষায় প্রাঞ্জল করে প্রকাশ করার একটা প্রচেষ্টা নিয়েছি মাত্র। উপনিষদ নিয়ে যেসব গ্রন্থ দেখি তার ভাষা খুব জটিল, দার্শনিক তত্ত্বগুলোকেও খুব জটিল করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেই সাথে এগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে অসংলগ্নতাও লক্ষ্য করি। এখানে এই ব্যাপারগুলোকে দূর করার চেষ্টা করেছি। এই লেখাটিতে বন্ধনীর ভেতরে যে কথাগুলো লেখা সেগুলো আমার নিজেরই, যে টীকাগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোরও অনেকগুলো আমার নিজেরই দেয়া।

১ম কণ্ডিকা

এই বাচক ও বাচ্য, অভিধান ও অভিধেয় সবই ‘ওম’ অক্ষরাত্মক। ওঙ্কার (“ওম” এর আরেক নাম) বা ব্রহ্মের নিকটবর্তী রূপে সেই ওঙ্কারের সুস্পষ্ট নির্দেশ কথিত হচ্ছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবই ওঙ্কার; এবং আর যা কিছু ত্রিকালের অতীত তাও ওঙ্কারই।

টীকা

“এই বাচক ও বাচ্য, অভিধান ও অভিধেয় সবই ‘ওম’ অক্ষরাত্মক।”

বেদের দুটি উক্তি “সমস্ত শব্দই ওঙ্কারাবয়ব আকারের বিকার” এবং “অর্থ বা বাচ্য বিষয়মাত্রই শব্দাত্মক” থেকে বোঝা যায় যে কোন শব্দ ও তার অর্থ উভয়ই ওঙ্কার। ব্রহ্মকে অভিধান ও অভিধেয় এর সাহায্যেই জানা যায়, তাই ব্রহ্মও ওঙ্কার (প্রশ্নোপনিষদ ৫/২)। কাউকে জানতে হলে তার নামের সাহায্যেই জানতে হয়। এই নাম ও নামের অধিকারী (নামী) এক বা অভিন্ন। ব্রহ্মকে যখন কার্যসমূহের কারণরূপে চিন্তা করা হয় তখনই তিনি বাচ্য বা অভিধেয় বা নামী রূপে প্রতিভাত হতে পারেন। কিন্তু কার্যকারণের অতীত চিন্মাত্র বা কেবল চেতনাময় ব্রহ্ম ওঙ্কারেরও বাচ্য থাকেন না, অর্থাৎ তাকে ওঙ্কার দিয়ে প্রকাশ করা যায়না।

“ওঙ্কার বা ব্রহ্মের নিকটবর্তী রূপে সেই ওঙ্কারের সুস্পষ্ট নির্দেশ কথিত হচ্ছে।”

ওঙ্কার দিয়ে কার্যকারণরূপী ব্রহ্মকে জানা যায়, কিন্তু কার্যকারণাতীত চেতনমাত্র ব্রহ্মকে জানা যায়না বা ওঙ্কারের দ্বারা তাকে প্রকাশ করা যায়না। ওঙ্কার তাই ব্রহ্মকে জানার একটি উপায় মাত্র, কিন্তু নিজে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মের প্রকাশক নয়। ওঙ্কার তাই ব্রহ্মের নিকটবর্তী।

(পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আত্মা চারটি পাদ বা অংশবিশিষ্ট। এই চারটি পাদের তিনটি প্রকৃতপক্ষে আত্মার অংশ যার সাহায্যে আত্মা বাহ্যজগৎ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ও অন্তর্জগৎ সম্পর্কে প্রজ্ঞালাভ ও সুষুপ্তির সময় আনন্দলাভ করে, চতুর্থটি লোকাতীত ব্রহ্মই। আত্মার এই তিনটি অংশের জন্য আমার নিজেকে আমি মনে হয়, যেখানে আমার এই আত্মা বা আত্ম বা আমিত্ব ব্রহ্মেরই বিবর্ত বা অবভাস বা মায়া মাত্র। আত্মার এই তিনটি অংশ ব্রহ্ম বা ওঙ্কারের তিনটি মাত্রা (অ, উ এবং ম) নির্দেশক। তবে এই ওঙ্কারে তিনটি মাত্রাই আছে, তা আত্মার তিনটি পাদকেই নির্দেশ করে। ওঙ্কার দ্বারা আত্মার চতুর্থ পাদকে নির্দেশ করা যায়না, যা হল তুরীয় বা সমাধিলব্ধ বা লোকাতীত ব্রহ্ম, কোন শব্দের দ্বারাই এই ব্রহ্মের এই অংশকে প্রকাশ করা যায়না। চতুর্থ পাদকে প্রকাশ করতে পারেনা বলে ওঙ্কার আংশিক ব্রহ্মস্বরূপ, পূর্ণাঙ্গ ব্রহ্মস্বরূপ নয়। তাই ওঙ্কার পূর্ণাঙ্গভাবে ব্রহ্মের প্রকাশক নয়, ব্রহ্মের নিকটবর্তী। আত্মার তিনটি অংশকে প্রকাশ করে এই ওঙ্কার নিজেকে ব্রহ্মের অংশ হিসেবে জ্ঞানদান করে বলে এই ওঙ্কার একই সাথে ব্রহ্মকে জানার উপায়ও বটে। পরবর্তীতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।)

২য় কণ্ডিকা

এই সবই ব্রহ্ম, এই আত্মা ব্রহ্ম, এই আত্মা চতুষ্পাৎ বা চারটি অংশবিশিষ্ট।

টীকা

“এই সবই ব্রহ্ম”

পূর্বে যে সমস্ত বিষয়কে ‘ওম্’ বলা হয়েছে, সেগুলোর সবই ব্ৰহ্ম। পূর্বে ওঙ্কারকে মূলত বাচকরূপে ধরে বাচ্য অর্থসমূহের, অর্থাৎ ব্রহ্মের সাথে তার ঐক্য দেখান হয়েছে; অর্থাৎ ওঙ্কার ছিল সেক্ষেত্রে ব্রহ্মকে প্রকাশ করার জন্য একটি শব্দ মাত্র। কিন্তু এখন এখানে ওঙ্কার বা প্রণবকে (ওঙ্কারের আরেক নাম প্রণব) প্রধানত বাচ্য ব্রহ্মেরই স্বরূপ হিসেবে ধরে ওঙ্কার ও ব্রহ্মের ঐক্যকে দেখানো হয়েছে। এখানে ওঙ্কার আর ব্রহ্মকে প্রকাশ করার জন্য একটি শব্দ মাত্র নয়, ওঙ্কার শব্দটি নিজেই ব্রহ্ম (তবে পূর্ণাঙ্গ ব্রহ্ম নয়, আংশিক ব্রহ্ম, ব্রহ্মের একটি অতিরিক্ত অংশ রয়েছে যাকে কোন শব্দের দ্বারাই প্রকাশ করা সম্ভব নয়, ব্রহ্মের এই অংশ তুরীয় বা সমাধিলব্ধ বা ভাবসম্ভব বা লোকাতীত, পরে এসম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে)। এতে পূর্বের কথাগুলোরই পুনরুক্তি হয়নি, কারণ বাচ্য ব্রহ্মের সাথে বাচক ওঙ্কারের ঐক্য না দেখিয়ে কেবল বাচকের সাথে বাচ্যের ঐক্য দেখালে সন্দেহ হতে পারে যে এই ঐক্য গৌণ মাত্র। এভাবে বাচ্য ও বাচকের একত্ববােধ হলে বাচ্য ব্রহ্মের সাথে বাচক ওঙ্কার একত্রে বিলীন হয়ে যায়। এখানে “ওঙ্কার” ব্রহ্মের প্রকাশক মাত্র নয়, “ওঙ্কার” নিজেই ব্রহ্মস্বরূপ। (৮ম ও ১২শ কণ্ডিকা দ্রষ্টব্য)।

“এই আত্মা ব্রহ্ম”

পরোক্ষভাবে যে ব্রহ্ম সর্বস্বরূপ বা সবকিছু, প্রত্যক্ষভাবে সেই ব্রহ্মই আত্মা।

“এই আত্মা চতুষ্পাৎ বা চারটি অংশবিশিষ্ট”

“পাদ” শব্দের অর্থ হচ্ছে যে উপায়ে ব্রহ্মকে পাওয়া যায় বা জানা যায় (উপনিষদ অনুসারে ব্রহ্মকে জানার অর্থই ব্রহ্মকে লাভ করা বা মোক্ষলাভ করা)। এই অর্থে প্রথম তিন পাদ হচ্ছে ব্রহ্মকে জানার উপায় (পরে এগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া হবে)। আবার যাকে পাওয়া যায় তিনিও পাদ শব্দেরই বাচ্য। আর বাচ্য ও বাচক যেহেতু একরূপ তাই ব্রহ্ম নিজেই চতুর্থ পাদ। সব মিলে ব্রহ্ম চারটি পাদ বিশিষ্ট।

(এদিকে প্রথম তিনটি পাদ আত্মারই অংশ। কিভাবে আত্মার অংশগুলো ব্রহ্মকে জানার উপায় হতে পারে তা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। এই উপনিষদটির পরবর্তী কণ্ডিকাগুলোতে আমরা দেখব আত্মার এই পাদগুলোর দ্বারা আত্মা বাহ্যজগৎ, অন্তরের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞা ও সুষুপ্তাস্থায় আনন্দ লাভ করে। এই কণ্ডিকায় বলা হয়েছে এই আত্মাই ব্রহ্ম। তাই আমরা আমাদের আত্মার দ্বারা যে এই জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আনন্দ লাভ করি তা আসলে ব্রহ্মই লাভ করে থাকে। আত্মার এই পাদগুলোর সাথে ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন থাকে। কিন্তু ব্রহ্মকে জানতে হলে প্রথমে আত্মার পাদকে জানতে হয়, এরপর এগুলো যে অবভাস আমার আত্মার অবভাস বা বিভ্রম বা বিবর্ত তা অনুধাবন করতে হয়। (৭ম কণ্ডিকায় ৪র্থ পাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যারোপ ও অপবাদের ব্যাখ্যা দেবার সময় এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।))

৩য় কণ্ডিকা

জাগ্ৰত অবস্থা যার ভােগস্থান, যিনি বহির্বিষয়ে বা বাহ্য বস্তুর বিষয়ে (নিজের অন্তরের বিষয় নয়, অন্তরের বাইরের বিষয়সমূহ) অনুভূতিসম্পন্ন, যার সাতটি অঙ্গ, যার উনিশটি মুখ (অর্থাৎ উপলব্ধি ও কর্মের ১৯টি উপায়), যিনি স্থূল বিষয় ভােগ করেন – সেই বৈশ্বানরই (অর্থাৎ নিখিল-নরস্বরূপ, সর্বজীবাত্মা, বিরাট) আত্মার প্রথম পাদ।

(এর দ্বারা আত্মার যে অংশের কারণে ব্যক্তি তার জাগ্রত অবস্থায় বাহ্যজগত সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে তার কথা বলা হচ্ছে। এই পাদকে বৈশ্বানর বলা হয়েছে ও একে ব্রহ্মের সাথে অভেদ বা অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে।)

টীকা

“জাগ্ৰত অবস্থা যার ভােগস্থান”

আত্মার বৈশ্বানর-পাদ ব্যক্তির জাগ্রত অবস্থাতেই বাহ্যজগৎ সম্পর্কিত জ্ঞানলাভ বা জ্ঞানের ভোগ করে।

“যার সাতটি অঙ্গ”

স্বর্গ হচ্ছে ব্রহ্মের মাথা, সূর্য ব্রহ্মের চোখ, বায়ু ব্রহ্মের প্রাণ, আকাশ ব্রহ্মের শরীর, জল ব্রহ্মের মূত্রাশয়, পৃথিবী ব্রহ্মের পা, তাকে আহ্বান করার অগ্নি হচ্ছে ব্রহ্মের মুখ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৫/১৮/২)।

“যার উনিশটি মুখ”

১৯টি মুখ দ্বারা উপলব্ধি ও কর্মের ১৯টি উপায়ের কথা বলা হয়েছে। দশটি ইন্দ্রিয়; পাঁচটি প্রাণ; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চিত্ত – সব মিলে ১৯টি।

“যিনি স্থূল বিষয় ভােগ করেন, সেই বৈশ্বানরই…”

বৈশ্বানর দ্বারা বোঝানো হয়েছে নিখিল-নরস্বরূপ, সর্বজীবাত্মা, বিরাটকে। এখানে জাগ্রত অবস্থায় অবস্থিত বিশ্বের বা ব্যষ্টি প্রাণীর অবস্থাকে বৈশ্বানর বা বিরাট বলা হয়েছে। এক্ষত্রে বিশ্ব ও বৈশ্বানর এক।

“সেই বৈশ্বানরই আত্মার প্রথম পাদ”

প্রপঞ্চের মিথ্যাত্ববােধকালে, অর্থাৎ যখন সব বাহ্যবস্তু, আত্মা, ঘটনাকে মিথ্যা বা অবভাস বা মায়া বলে বোধের সঞ্চার ঘটে, তখন এই বিশ্বেস্বররূপ বৈশ্বানরই প্রথমে লীন হয়, বা তার অনস্তিত্বের বোধ হয়। তাই এটাই প্রথম পাদ।

৪র্থ কণ্ডিকা

স্বপ্নাবস্থা যার ভােগস্থান, যিনি অন্তঃস্থ মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে জানেন, যার সাতটি অঙ্গ, যার উনিশটি মুখ, যিনি শুধু কেবল বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে ভােগ করেন ভােগ করেন, সেই তৈজসই আত্মার দ্বিতীয় পাদ।

(এর দ্বারা আত্মার যে অংশের কারণে ব্যক্তি তার স্বপ্নে মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞা সম্পর্কে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারেন তার কথা বলা হচ্ছে। এই পাদকে তৈজস বলা হয়েছে ও একে ব্রহ্মের সাথে অভেদ বা অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে।)

টীকা

“স্বপ্নাবস্থা যার ভােগস্থান”

আত্মার তৈজস-পাদ স্বপ্নাবস্থাতেই অন্তঃস্থ মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে জানেন বা প্রজ্ঞাকে ভোগ করেন।

“স্বপ্নাবস্থা যার ভােগস্থান, যিনি অন্তঃস্থ মনের বাসনা বা সংস্কাররূপ প্রজ্ঞাকে জানেন”

বৃহদারোণ্যক উপনিষদ ৪/৩/৯ এও একই বিষয় আছে।

“সেই তৈজসই আত্মার দ্বিতীয় পাদ”

এখানে তৈজস দ্বারা স্বপ্নাবস্থায় পাওয়া ব্যষ্টি প্রাণীর কথা বোঝানো হচ্ছে। স্বপ্নাবস্থায় দেখা বিষয়গুলো জাগ্রত অবস্থায় দেখা বিষয়ের মত হয় না। প্রকৃতপক্ষে এটি হল বিষয়শূন্য ও কেবল প্রকাশস্বরূপ। এই বিষয়শূন্য ও কেবল প্রকাশস্বরূপ প্রজ্ঞার যিনি আশ্রয় সেই ব্রহ্মকে বোঝানো হয়েছে। এই তৈজস ও হিরণ্যগর্ভের ঐক্য রয়েছে।

৫ম কণ্ডিকা

ঘুমন্ত ব্যক্তি যে সময়ে কোনও কাম্য বস্তু প্রার্থনা করে না এবং কোনও স্বপ্ন দেখে না, তাই সুষুপ্তি। যিনি সুষুপ্তিতে স্থিত, অ-বিক্ষিপ্ত বা বিক্ষেপ-রহিত বা একীভূত (একাগ্র), কেবল অনুভূতিস্বরূপ, আনন্দময়, এবং অসন্দিগ্ধরূপে অনায়াসে আনন্দ-ভােগকারী, ও স্বপ্নাদির দ্বারস্বরূপ, সেই সুষুপ্তাভিমানী প্রাজ্ঞই আত্মার তৃতীয় পাদ।

(এর দ্বারা আত্মার যে অংশের কারণে ব্যক্তি তার ঘুমন্ত অবস্থায় বা সুষুপ্তিতে বিশেষরকমের আনন্দ ভোগ করতে পারেন তার কথা বলা হচ্ছে। এই পাদকে প্রাজ্ঞ বলা হয়েছে ও একে ব্রহ্মের সাথে অভেদ বা অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে।)

টীকা

“ঘুমন্ত ব্যক্তি যে সময়ে”

জাগরণ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থাই নিদ্রা; জীব তিন অবস্থাতেই নিদ্রিত। কারণ কোন অবস্থাতেই আত্মা ব্রহ্মকে অনুভব করতে পারে না। জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থায় দোষ আরও বেশি কারণ তাতে ব্রহ্মকে সঠিকভাবে না অনুভব করে ভুলভাবে অনুভব করা হয়। এভাবে চিরসুপ্ত জীবেরও প্রতিদিনকার স্বপ্ন ও সুষুপ্তিতে একটি বিশেষত্ব আছে। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১/৩/১২)

“যিনি সুষুপ্তিতে স্থিত, অ-বিক্ষিপ্ত বা বিক্ষেপ-রহিত বা একীভূত”

জাগরণ ও স্বপ্নাবস্থায় জগতকে ব্রহ্মের থেকে, আত্মাকে পরমাত্মার থেকে আলাদা বলে মনে হয়, এটাই মনোবিক্ষেপ। এজন্যই জগৎ ও ব্রহ্মের এবং আত্মা ও পরমাত্মার দ্বৈততাকে সত্য মনে হয়। কিন্তু সুষুপ্ত অবস্থায় সেই অনুভূতি থাকেনা। এখানে তাই আত্মা পরমাত্মার সাথে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু এই অবস্থায় পুরোপুরিভাবে দ্বৈততা লীন হয়না, কারণ ঘুম ভাঙলে পুনরায় দ্বৈত জগতের উৎপত্তি হয়।

“স্বপ্নাদির দ্বারস্বরূপ”

সুষুপ্তাভিমানী প্রাজ্ঞ থেকে স্বপ্ন ও জাগরণ উৎপন্ন হয়।

“প্রাজ্ঞই আত্মার তৃতীয় পাদ”

আগের মত এখানেও প্রাজ্ঞ (অর্থাৎ জীব) ও ঈশ্বরের অভেদ দেখা যায়।

৬ষ্ঠ কণ্ডিকা

এই প্রাজ্ঞই সর্বেশ্বর, ইনি সর্বজ্ঞ, ইনি অন্তর্যামী, ইনি সকলের উপাদানকারণ; তাই ইনিই জগতের মূল উপাদানগুলোর (ভূতসমূহ) উৎপত্তি ও বিলয়-স্থান।

(এখানে অধিবিদ্যিক ঈশ্বরের সাথে এই প্রাজ্ঞের অভেদ দেখা যাচ্ছে)

৭ম কণ্ডিকা

যিনি তৈজস নন (কারণ অন্তরে অনুভব করেন না), বিশ্ব নন (কারণ বাহ্য বিষয়ে অনুভব করেন না) , স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যবর্তী অনুভূতিসম্পন্ন নন, প্রাজ্ঞ নন, যুগপৎ সর্ববিষয়ের জ্ঞাতা নন, জড় নন, যিনি অদৃশ্য, অব্যবহার্য (ইনি “অমুকরকমের” – এরকম ব্যবহারের অযোগ্য), অগ্রাহ্য (ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায়না), অননুমেয় (বুদ্ধির সাহায্যে অনুমান করা যায়না), অচিন্ত্য (চিন্তা করা যায়না), অনির্দেশ্য (শব্দের দ্বারা নির্দেশ করা যায়না), যিনি কেবল ‘আত্মা’ এই প্রতীতির গম্য (সর্বাবস্থায় একই আত্মা আছেন এরকম ধারণার দ্বারা অনুসন্ধান করা যায় এমন, বা কেবল ‘আত্মা’ প্রভৃতির প্রতীতির গম্য), যিনি প্রপঞ্চের বিরামস্বরূপ (জাগরণ সহ বিভিন্ন প্রপঞ্চের বিরামস্থান), শান্ত (অবিক্রিয় বা যা অন্য কিছুর সাথে বিক্রিয়া করেনা), শিব (মঙ্গলময়) ও অদ্বিতীয় (সব এক, জগৎ ও ব্রহ্ম, আত্মা ও পরমাত্মা আলাদা নয়), তাকেই বিবেকীরা চতুর্থ বা তুরীয় (সমাধিমগ্ন, ভাববিহ্বল, লোকাতীত) মনে করে থাকেন। তিনিই আত্মা, তিনিই বিজ্ঞেয় (যাকে জানতে হবে)।

(উল্লেখ্য যে, সকল শব্দ আত্মা থেকেই উদ্ভূত হয়, ব্রহ্মের এই অংশ আত্মার ৩টি পাদের অতিরিক্ত, তাই এই চতুর্থ পাদকে কোন শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটিকে তাই তুরীয় (সমাধিমগ্ন, ভাববিহ্বল, লোকাতীত) বলা হয়েছে)।

টীকা

“তাকেই বিবেকীরা চতুর্থ বা তুরীয় মনে করে থাকেন”

ভ্রান্তিবশত রজ্জুকে (রশি) সাপ, দণ্ড এবং জলধারা বলে মনে হলে, সাপ, দণ্ড ও জলধারা – এই তিনটির সাথে রজ্জুকে যে অর্থে চতুর্থ বলা যায়, সেই অর্থেই অবিদ্যা-কল্পিত তিনটি পাদের সাথে অবিচ্ছেদ্য পরমাত্মাকে তুরীয় (চতুর্থ) বলা হয়।

“তিনিই আত্মা, তিনিই বিজ্ঞেয়”

উপনিষদ অনুসারে বিদ্যাবস্থায় জ্ঞানের বিষয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এর বিভেদ নেই, অর্থাৎ যে জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে, যে জ্ঞান লাভ করছে, এবং যার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে তা বিভেদ নেই। বিদ্যা-উৎপত্তির পূর্বে তার বিজ্ঞেয়ত্ব (জানতে হবে এমন বৈশিষ্ট্য) ছিল বলে বিদ্যাবস্থায় ভূতপূর্বগতি অনুসারে তাকে বিজ্ঞেয় বলা হয়েছে।

(গুরুর মুখ থেকে উপনিষদের বিদ্যা লাভ করতে হয়। এই বিদ্যা-উপদেশের জন্য তিনি যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন তা হল অধ্যারোপ ও অপবাদ। অসর্পভূত রজ্জুতে সাপের ধারণা আরোপ করার মতো বস্তুতে অবস্তু আরোপকে অধ্যারোপ বলে। এই আলোচনায় বস্তু হচ্ছে অদ্বয় ব্রহ্ম আর অবস্তু হচ্ছে অজ্ঞানাদি জড়সমূহ। বিদ্যা উপদেশের যে সময়ে গুরু বস্তুর উপর অবস্তু, অর্থাৎ অদ্বয় ব্রহ্মের উপর অজ্ঞানাদি জড়সমূহের বিষয়গুলোকে আরোপ করেন তাই হল অধ্যারোপ। এরপর জ্ঞানের সাহায্যে ভ্রম দূর হলে রজ্জুর বিবর্ত (বিভ্রম রূপ) সর্প যেরকম রজ্জুমাত্ররূপে মনে হয়, সেরকম যে বিচারের ফলে জগদ্‌জ্ঞান (জগৎ সম্পর্কে বিভ্রম বা অবভাস) বিনষ্ট হয়ে ব্রহ্মের বিবর্ত জগৎ ব্রহ্মরূপ বলে মনে হয় তার নাম অপবাদ।

৩য় থেকে ৬ষ্ঠ কণ্ডিকা পর্যন্ত ব্যষ্টি ও সমষ্টিভেদে তিনটি পাদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল, যা ছিল অধ্যারােপ। এখানে আত্মার বিভিন্ন পাদের সাহায্যে আত্মার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে, আমরা আত্মার সাহায্যে যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আনন্দ লাভ করি তার কথা বোঝানো হয়েছিল। এই ৭ম কণ্ডিকায় এসে এগুলোর অপবাদ করা হল। এর মাধ্যমে জানানো হল যে আত্মার এই পাদগুলোর কারণে আমাদের নিজেদের আত্মকে আমাদের বলে মনে করা হয়, আমাকে আমি বলে মনে হয়, কিন্তু এই আমি ও আমার আত্মার পাদগুলো আসলে ব্রহ্মেরই বিবর্ত বা অবভাস মাত্র।)

৮ম কণ্ডিকা

অভিধেয়প্রাধান্যে বর্ণনাকালে যে ওঙ্কার আত্মার সহিত অভিন্ন, অভিধানপ্রাধান্যে বর্ণনাকালেও সে প্রণব আত্মার সাথে অভিন্ন। এই ওঙ্কার মাত্রারূপেও বিদ্যমান। আত্মার পাদগুলোই ওঙ্কারের মাত্রা এবং প্রণবের মাত্রাগুলোই আত্মার পাদ। অকার, উকার ও মকার – এরাই প্রণবের মাত্রা।

টীকা

“অভিধেয়প্রাধান্যে বর্ণনাকালে যে ওঙ্কার আত্মার সহিত অভিন্ন, অভিধানপ্রাধান্যে বর্ণনাকালেও সে প্রণব আত্মার সাথে অভিন্ন।”

২য় কণ্ডিকার প্রথম টীকায় বলা হয়েছিল, পূর্বের রচনাগুলকে ওঙ্কারকে বাচ্য বা অভিধেয় প্রাধান্য অবলম্বনে চিন্তা করা হয়, কিন্তু এখন এখানে ওঙ্কারকে বাচক বা অভিধান প্রাধান্য-অবলম্বনে বর্ণনা করা হচ্ছে। এখানেও তাই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। ওঙ্কার চতুষ্পাৎ বা চারটি পাদ বিশিষ্ট আত্মার সাথে অভিন্ন বা এক থাকে। ওঙ্কারকে যখন বাচক হিসেবে ধরা হয় তখন সেই ওঙ্কার বা প্রণবই হল সেই আত্মা।

“অকার, উকার ও মকার – এরাই প্রণবের মাত্রা।”

ওঙ্কার বা ওম = অ + উ + ম। অর্থাৎ ওঙ্কার বা প্রণব অকার, উকার ও মকারের সমষ্টি। ওঙ্কারের এই তিনটি মাত্রাকে আত্মার তিনতি পাদের সাথে অভিন্ন বলে দাবি করা হচ্ছে।

৯ম কণ্ডিকা

বৈশ্বানর এবং ওঙ্কারের অকার উভয়েই ব্যাপক অথবা উভয়ই আদি। তাই জাগরিত-স্থান বৈশ্বানরই প্রণবের প্রথম মাত্রা অকার। যে উপাসক এটি জানেন, তিনি সমুদয় কাম্য বিষয় লাভ করেন। এবং সর্বাগ্রণী বা সর্বপ্রথম হয়ে থাকেন।

টীকা

“বৈশ্বানর এবং ওঙ্কারের অকার উভয়েই ব্যাপক অথবা উভয়ই আদি।”

১ম কণ্ডিকার টীকায় বলা হয়েছিল “সমস্ত শব্দই ওঙ্কারাবয়ব আকারের বিকার”, এটি ওঙ্কারের মাত্রাগুলোর ব্যাপকতা নির্দেশ করে। এদিকে ৩য় কণ্ডিকায় আত্মার যে পাদের সাহায্যে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় তাই বৈশ্বানর। বাহ্যজগৎ ব্যাপক বলে বৈশ্বানরও ব্যাপক।

“যে উপাসক এটি জানেন”

যে উপাসক জানেন যে, আত্মার বৈশ্বানর নামক পাদ ও বাচক ব্রহ্মস্বরূপ ওঙ্কারের অকার এক ও অভিন্ন তার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ব্রহ্মের যে অংশের কারণে অবভাস হিসেবে আমরা বাহ্যজগৎ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করি তা হচ্ছে ব্রহ্ম (বা ওঙ্কারের) অ-কার।

১০ম কণ্ডিকা

একদিকে তৈজস বিশ্ব বা বৈশ্বানরের চেয়ে উৎকৃষ্ট (বৈশ্বানরকে অনেক স্থানে বিশ্ব বলা হয়েছে), অন্যদিকে উকার অকারের চেয়ে উৎকৃষ্ট। তাই তৈজস হল দ্বিতীয় মাত্রা উ-কার। আবার একদিকে তৈজসের স্থান বৈশ্বানর ও প্রাজ্ঞের মধ্যবর্তী, অন্যদিকে উকারের স্থান অকার ও মকারের মধ্যবর্তী, তাই তৈজস হল ওঙ্কারের দ্বিতীয় মাত্রা উকার। যিনি এটি জানেন ও উপাসনা করেন তিনি বিজ্ঞানপ্রবাহকে উৎকৃষ্ট বা বর্ধিত করে থাকেন এবং শত্ৰু ও মিত্রের কাছে তুল্যরূপ হন (এখানে বিজ্ঞান দ্বারা চেতনাকে বোঝানো হয়েছে)। তার বংশে অব্রহ্মজ্ঞের জন্ম হয় না।

টীকা

“যিনি এটি জানেন ও উপাসনা করেন”

যে উপাসক জানেন যে, আত্মার তৈজস নামক পাদ ও বাচক ব্রহ্মস্বরূপ ওঙ্কারের উকার এক ও অভিন্ন তার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ব্রহ্মের যে অংশের কারণে অবভাস হিসেবে আমরা অন্তরের সংস্কার বা বাসনারূপী প্রজ্ঞালাভ করি তা হচ্ছে ব্রহ্ম (বা ওঙ্কারের) উকার।

১১শ কণ্ডিকা

প্রলয়ের সময় প্রাজ্ঞে প্রবিষ্ট ও উৎপত্তিকালে তা থেকে বের হওয়ায় বিশ্ব ও তৈজস কর্তৃক পরিমিত হয় এবং ওঙ্কারের সমাপ্তিকালে মকারে প্রবিষ্ট হয়ে পুনরুচ্চারণকালে পুনরায় উৎপন্ন হওয়ায় মকারকর্তৃক অকার ও উকার প্রস্থকর্তৃক শস্যাদির মতো পরিমিত হয় বলে অথবা সুষুপ্তিকালে বিশ্বতৈজস (বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদ) প্রাজ্ঞে (সুষুপ্তির সাথে সম্পর্কিত পাদ) লীন হয় বলে, এবং ওঙ্কার উচ্চারণকালে অকার ও উকার মকারে লীন হয় বলে সুষুপ্তি যার ভােগস্থান সেই প্রাজ্ঞ তৃতীয় মাত্রা মকার। যিনি এইরূপ জানেন তিনি এই সব পরিমাপ করেন, জগতের যাথাত্ম্য বা অসারতা জানেন, জগতের লয়ের আধার, অর্থাৎ কারণস্বরূপও হয়ে থাকেন।

প্রাজ্ঞ ও মকার উভয়ই পরিমাপক অথবা বিলয়ের আধার বলে সুষুপ্তি যার ভোগ স্থান সেই প্রাজ্ঞই প্রণবের তৃতীয় মাত্রা মকার। যিনি এটি জানেন, বা যে উপাসক এরকম উপাসনা করেন, তিনি সমস্ত জগতের পরিমাপক হন (অর্থাৎ জগতের যাথাত্ম্য জানেন), এবং জগতের লয়ের আধার বা আশ্রয়স্বরূপ, অর্থাৎ কারণস্বরূপও হয়ে থাকেন।

টীকা

“প্রাজ্ঞ ও মকার উভয়ই পরিমাপক অথবা বিলয়ের আধার বলে সুষুপ্তস্থান প্রাজ্ঞই প্রণবের তৃতীয় মাত্রা মকার।”

৫ম কণ্ডিকা আলোচনার সময় বলা হয়েছে জাগরণ ও স্বপ্নাবস্থায় জগতকে ব্রহ্মের থেকে, আত্মাকে পরমাত্মার থেকে আলাদা বলে মনে হয়, তাই জগৎ ও ব্রহ্মের এবং আত্মা ও পরমাত্মার দ্বৈততাকে সত্য মনে হয়। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় সেই অনুভূতি থাকেনা। এখানে তাই আত্মা পরমাত্মার সাথে একীভূত হয়ে যায়। তবে এই অবস্থায় পুরোপুরিভাবে দ্বৈততা লীন হয়না, কারণ ঘুম ভাঙলে পুনরায় দ্বৈত জগতের উৎপত্তি হয়। এভাবে সুষুপ্তিতে আত্মার বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদ লোপ পায় এবং সুষুপ্তি ভাঙলে পুনরায় বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদের উদ্ভব ঘটে। এভাবে সুষুপ্তাভিমানী প্রাজ্ঞ-পাদের দ্বারা বৈশ্বানর ও তৈজস-পাদ পরিমিত হয়। এদিকে ওঙ্কার বা ওম শব্দটির সমাপ্তি হয় মকারের দ্বারা, আবার একবার ওম বলার পর যখন পুনরায় ওম উচ্চারণ করা হয় তখন নতুন অকার ও উকারের আগে মকারই আসে। এভাবে ওঙ্কারের অকার ও উকারকে মকার বাউন্ডারি হিসেবে পরিমিত করে। এসব কারণে প্রাজ্ঞ ও মকার উভয়ই পরিমাপক ও বিলয়ের আধার।

“সুষুপ্তি যার ভোগ স্থান সেই প্রাজ্ঞই”

আত্মার প্রাজ্ঞ-পাদ সুষুপ্তি দশায় আনন্দভোগ করে।

“এবং আশ্রয়স্বরূপ (অর্থাৎ জগতের কারণস্বরূপও) হইয়া থাকেন।”

ব্রহ্মই জগতের আশ্রয়স্বরূপ ও কারণস্বরূপ। তার সাথে তিনি নিজেকে অভেদ কল্পনা করেন।

১২শ কণ্ডিকা

এভাবে আত্মার তিনটি পাদ ও ওঙ্কারের তিনটি মাত্রার একত্ব বা অভেদের জ্ঞান লাভ করার পর অবশেষে ব্যক্তির কাছে মাত্রাহীন ওঙ্কার চতুর্থ বা তুরীয় (সমাধিলব্ধ বা লোকাতীত), ব্যবহারাতীত, জগতের নিবৃত্তিস্থল, মঙ্গলময় (অর্থাৎ পরমানন্দ), অদ্বিতীয় আত্মরূপে পর্যবসিত হয়। যিনি এটা জানেন, তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় প্রবেশ করেন।

টীকা

“মাত্রাহীন ওঙ্কারকে”

মাত্রাহীন ওঙ্কার বলতে এখানে ব্রহ্মের সেই অংশকে বোঝানো হচ্ছে যাকে ওঙ্কার বা ওঙ্কারের কোন মাত্রার দ্বারা প্রকাশ করা যায়না। এটি আত্মার তিনটি পাদের বাইরের চতুর্থ বা তুরীয় পাদ, যা সমাধিলব্ধ বা লোকাতীত। ওঙ্কারের দ্বারা একে প্রকাশ করা যায়না।

“ব্যবহারাতীত”

এই চতুর্থপাদ তুরীয় ব্রহ্মকে ওঙ্কারের মত কোন বাচক দ্বারা প্রকাশ করা যায়না, তাই বাচক লীন হয়ে যায়, বাচক না থাকায় বাচ্যের ধারণাও বর্তমান থাকে না, তাই বাচ্যও লীন হয়ে যায়। একারণে এই তুরীয় ব্রহ্ম বাক্য ও মনের অতীত হয়, অর্থাৎ ব্যবহারাতীত হয়।

“জগতের নিবৃত্তিস্থল”

রজ্জু যেরকম সর্পের নিবৃত্তিস্থল তেমনি ব্রহ্ম জগতের নিবৃত্তিস্থল। পূর্বে যে রজ্জুকে সাপ বলে মনে হয়েছিল ভুল ভাঙ্গার ফলে এখন আর রজ্জুকে সাপ বলে মনে না হয়ে রজ্জু বলেই মনে হয়। একইভাবে পূর্বে যে ব্রহ্মকে জগৎ বলে মনে হয়েছিল ভুল (এখানে মায়া বা অবভাস বা বিবর্ত) ভাঙ্গার পরে একে ব্রহ্ম বলেই মনে হয়। তাই ব্রহ্মই জগতের নিবৃত্তিস্থল।

“মঙ্গলময় (অর্থাৎ পরমানন্দ), অদ্বিতীয় আত্মরূপেই পর্যবসিত হয়।”

এই তুরীয়-স্বরূপ ওঙ্কার বা ব্রহ্মের কোন পাদ ও মাত্রা নেই। তাই ওঙ্কারের যে তিনটি মাত্রা রয়েছে তা এই মাত্রাহীন ওঙ্কার বা ব্রহ্মে লীন হয়ে গিয়ে ক্রমে পরমাত্মাতেই পর্যবসিত হয়।

“তিনি স্বয়ং পরমাত্মায় প্রবেশ করেন।”

তার আর পুনর্জন্ম হয় না। ওঙ্কার অবলম্বনে পরব্রহ্ম ও আত্মার ঐক্য ধ্যান করলে তার ক্রমমুক্তি বা ক্রমশ মোক্ষলাভ হয়।

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.