রাশিয়ার ইতিহাস (১৩শ – ১৮শ শতক)

(সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

ভূমিকা

রাশিয়া পৃথিবীর মধ্যে ভৌগােলিক দিক থেকে অন্যতম বিশাল রাজ্য। রাশিয়ার জনগােষ্ঠী জাতিগত দিক থেকে স্লাভ জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বাল্টিক সাগর থেকে কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূল-অবধি বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ডে নীপার আর নিস্তার নদীর তীর বরাবর এবং ওকা আর ভলগা নদীর উত্তরী বাক বরাবর বাস করত পূর্বী স্লাভরা, অর্থাৎ রুশি, ইউক্রেনি এবং বেলােরুশিদের পূর্ব পুরুষেরা। (সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১০)। প্রাচীন স্নাভরা খুবই পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। কৃষি তাদের প্রধান পেশা ছিল অনেকেই পশু পালন করত, আবার অনেকেই মাছ শিকার করত। স্লাভরা অতিথিবৎসল মানুষ। সামরিক অভিযানের সময় প্রত্যেকটি উপজাতির একজন নেতা নির্বাচন করতেন। তাকে প্রিন্স বলা হত। কালক্রমে এই প্রিন্সের পার্শ্বচর দল নিয়ে গড়ে ওঠে সামরিক বাহিনী। প্রিন্সের পার্শ্বচর দলের সদস্যদের বলা হত দ্রুঝিন্নিক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্লাভ কৃষিজীবীরা জঙ্গলাকীর্ণ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভূমিখণ্ড পরিষ্কার করে সেগুলােকে আবাদি ভূমিতে পরিণত করে। তারা চাষের হাতিয়ার আরাে উন্নত করে তােলে। পশুপালক শ্রেণী বড় বড় পশুর পাল পালন করত, আর তারা ঘােড়াকে লাঙ্গল টানতে অভ্যস্ত করেছিল। তারা ধাতুগুলাে দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন লােহার-কুড়াল, ছুরি ও অন্যান্য নতুন অস্ত্র তৈরি করত। কৃষি এবং কারিগরি শিল্পের উন্নতির ফলে বিনিময় প্রথা গড়ে উঠে। প্রত্যেকটি পরিবার নিজের প্রয়ােজনের অতিরিক্ত কৃষিজাত দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের চেষ্টা করে উদ্ধৃত্ত সম্পদের বিনিময়ে কর্মকার, কুম্ভকার এবং চামড়া প্রস্তুতকারকের তৈরি জিনিস পেতে। প্রিন্স পরিবারগুলাে তাদের ধনদৌলতের জোরে বিশিষ্ট হয়ে উঠে। তারা ধনদৌলত বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হত। প্রতি বছর শরতের শেষের দিকে প্রিন্স এবং তার দ্রুঝিনিক কাছাকাছি বসতিগুলাের সবার কাছ থেকে নজরানা আদায় করত। সাধারণ কৃষকরা শস্য, তৈল, কাঁচা চামড়া নজরানা দিত। এর ফলে তাদের উদ্বৃত্ত কিছুই থাকত না। প্রায়ই অবশিষ্ট শস্য দিয়ে পরের ফসল তােলার সময় অবধি চলত না। সাধারণ শােষিত মানুষ শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার সাহস করত না। কেননা সশস্ত্র দ্রুঝিন্নিকদের বিরুদ্ধে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য ছিল না। উপজাতির অন্যান্য মানুষের হাড়ভাঙা মেহনতের ফল জবরদস্তি করে দখল করে নিয়ে প্রিন্সরা আর তাদের পার্শ্বচর দলগুলাে ধনী হত।

৯ম শতকে স্লাভভূভাগে বিভিন্ন শহরের পত্তন হলে বাণিজ্যের বিকাশ হয়। প্রথম প্রথম শহরবাসীরা ছিল কারিগর-সওদাগর। প্রিন্সরা আর তাদের দ্রুঝিনিকরা শীঘ্রই শহরবাসী হল। কোনাে প্রিন্স যে অঞ্চল থেকে নজরানা আদায় করত তাকে বলা হত প্রিন্স রাজ্য। ৯ম শতকে কিয়েভের প্রিন্সরা শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তােলে। এদের তখন নাম ছিল রুশ। কিয়েভ রুশ রাজ্য ছিল উত্তরের বাল্টিক সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর অবধি, পূর্বে ভল্গা, আর দন নদীর উত্তরী ভাগগুলাে থেকে পশ্চিমে দভিনা নেমান আর ভিস্টুলা নদীর উত্তরী বাকগুলাে অবধি বিস্তৃত ভূভাগ। পরে কিয়েভ রুশ এর উত্তর পূর্বে পেচোরা আর দভিনা নদীর কূল বরাবর বসবাসকারী উপজাতিগুলােকেও কিয়েভের প্রিন্সরা নিজেদের শাসনাধীন করেছিল। এই রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা ছিল প্রিন্সদের আর ধনী ভূ-স্বামী ‘বােইয়ারিন’দের হাতে। কৃষিজীবীদের হাল ক্রমাগত খারাপ হয়ে পড়ছিল। (সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃ. ১৪)। কৃষকরা অনেক সময় প্রিন্সের দ্রুঝিন্নাকে পরাস্ত করে এবং প্রিন্সকে হত্যা করে তাদের বিদ্রোহ জানাতাে। ১১শ শতকে কিয়েভ ইউরােপের সবচেয়ে বড় শহরের অন্যতম ছিল। এই শহর ঘিরে ছিল বড় বড় মাটির বাধ তার ওপর ছিল লম্বা লম্বা গাছের উঁচু পাচিল। এই বাধ আর পাচিল শহরটিকে যাযাবর আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। যাযাবররা ক্যাস্পিয়ান সাগর আর কৃষ্ণ সাগরের কূল থেকে এসে রুশ এ আক্রমণ চালাত। কিয়েভ শহরে শ্রমজীবী মানুষেরা যেমন – কর্মকার, কাঠের মিস্ত্রী, কুম্ভকার, অন্যান্য কারিগররা থাকত মাটির মধ্যে অর্ধেকটা তলানাে ছােট ছােট কুটিরে, তাদের কর্মশালা থাকত এই কুটিরে কিংবা তার পাশেই কিয়েভ এর রুশ কারিগররা অস্ত্র নির্মাতা, মণিকার, ধাতু খােদাইকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। শ্রমজীবীদের ছােট ছােট আনাড়ি বাড়িগুলাের মাঝে মাঝে থাকত কিয়েভের ধনী বােইয়ারিন আর সওদাগরদের বাড়ি। এগুলাের সুন্দর নকশাটা না জানালাওয়ালা উঁচু ইমারত কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা এসব বাড়ি দেখতে কেল্লার মতাে। সওদাগর আর বােইয়ারিরা সবাই ধনী ছিল। কিন্তু সবচেয়ে ধনী ছিল কিয়েভের শাসক, যিনি গ্র্যান্ড প্রিন্স উপাধি ধারণ করেছিলেন। একটা উঁচু পাহাড়ে ছিল প্রাসাদ-দুর্গ, তার প্রাঙ্গণে সব সময় বহু লােকের সমাগত থাকত। তরবারি আর বল্লমে সজ্জিত দ্রুঝিন্নিকরা থাকত সব সময়ে। রাষ্ট্রের শাসন চালাত প্রিন্সরা। তাদের জারি করা আইনগুলাে দিয়ে ধনীরা সুরক্ষিত হত, আর কৃষিজীবী এবং কারিগররা ষােলআনাই গ্র্যান্ড প্রিন্স আর বােইয়ারিনদের অধীন হয়ে পড়ত। এইসব অন্যায় আইন কানুন মানতে যারা নারাজ হত তাদের প্রিন্সের বিচারে নির্মম শাস্তি পেতে হত। ৯ম শতকে কিয়েভ রুশ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পরে খ্রিস্টীয় অর্থোডক্স চার্চ প্রিন্সদের ক্ষমতার মদত দিত। সমকালীনদের বিবরণ অনুসারে, ১১শ শতকের কিয়েভে গির্জা ছিল প্রায় ৪০০টা। অন্যান্য ইমারতের চেয়ে গির্জাগুলাে উঁচু ছিল – এটা ছিল খ্রিস্টধর্মের ক্ষমতার প্রতীক। তখনই কিয়েভে নির্মিত হয়েছিল সেন্ট সােফিয়ার ক্যাথিড্রাল। এসব নিখুঁত স্থাপত্য রূপ এবং এর ভিতরকার শ্রী এখনাে লােকের বিস্ময়ের বস্তু। (সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃ. ২৪)। 

১৩শ শতকে তাতার-মােঙ্গলরা বা গোল্ডেন হোর্ড ট্রান্স-ককেশিয়ার শহরগুলােকে বিধ্বস্ত করে (রুশরা গোল্ডেন হোর্ডের লোকেদেরকে তাতার বলতো)। চেঙ্গিস খানের জ্যেষ্ঠপুত্র জুচির ছেলে বাতু খানের পরিচালনায় তাতার-মােঙ্গলরা রিয়াজান প্রিন্স রাজ্য আক্রমণ করে। প্রিন্সের দ্রুঝিন্নাক আর শহরের সমস্ত মানুষ ভ্লাদিমিরের প্রিন্সের নিকট সাহায্যের আবেদন জানায় কিন্তু তাতে সাড়া না দেয়ায় রিজানের পতন হয়। এরপর তাতার-মােঙ্গলরা ভ্লাদিমির দখল করে। এরপর তারা নভগােরদ শহর দখলের জন্য অভিযান করে। নভগােরদের চারদিকের বন, জলাভূমি, হ্রদ অতিক্রম করা মােঙ্গলের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ১২৪০ সালে মােঙ্গলবাহিনী কিয়েভ দখল করে শহরটি জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে ক্রমে মোঙ্গল আক্রমণে রুশ জনপদগুলাে বিধ্বস্ত হয়। তাতার-মােঙ্গলরা ভলগা আর দন নদী বরাবর স্তেপভূমিতে বসতি স্থাপন করে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, এবং তারা রুশদের কাছ থেকে নজরানা আদায় করে। প্রায় দুই শতাব্দীর বেশি-কাল তাতার-মোঙ্গল আধিপত্য রুশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত করেছিল। তাতার-মােঙ্গলদের আক্রমণের সুযােগে জার্মান সুইডেনের নাইটরা ১৩শ শতকে পশ্চিম দিক থেকে রুশ ভূভাগে আক্রমণ চালায়। ১২৪০ সালে সুইডেনের নাইটরা নেমান নদীর পারে এসে নভগােরদ শহরটি দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু তরুণ প্রিন্স আলেক্সান্দার নেভকি ১২৪২ সালের এপ্রিল মাসের গােড়ার দিকে চুদস্কয়ে হ্রদের ধারে জার্মান নাইটদের পরাজিত করেছিলেন। ‘বরফের লড়াই’ নামে পরিচিত এই লড়াইয়ে রুশিরা পূর্ণ জয় লাভ করল। পশ্চিম থেকে জার্মান নাইটদের আগমন বন্ধ হল। জার্মানদের দাস হবার দুর্ভাগ্য থেকে রুশিরা রক্ষা পেল। বাল্টিক রাষ্ট্রগুলাের মানুষও আক্রমণ-অভিযানকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রবলতর করল। (সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃ. ৩২)।

কিপচাক সাম্রাজ্য অথবা গােল্ডেন হাের্ড

মােঙ্গলদের জাতীয় ইতিহাসে কিপচাক সাম্রাজ্যের (গােল্ডেন হাের্ড) অভ্যুদ্বয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ মােঙ্গল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এটিই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এছাড়া ইউরােপের বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসায-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই সাম্রাজ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। চেঙ্গিস খানের পুত্র ও প্রধান উত্তরাধিকারী ওগােদাই-এর আমলে ১২৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভল্গা নদীর অববাহিকা অঞ্চল ও সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি এলাকাসহ রাশিয়া মােঙ্গলদের পদানত হয়। এই অভিযান জুচির পুত্র বাতুর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং তিনিই কিপচাক মােঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাতুর বংশধরেরা সাধারণত ‘গােল্ডেন হাের্ড’ নামে পরিচিত। (এস. লেন-পুল: the Mohammadan Dynasties. বৈরুত, ১৯৬৬ পৃ: ২২২)। খুব সম্ভবত বাতু কর্তৃক ব্যবহৃত ‘সি ওরদা’-অর্থাৎ সােনালি তাবু থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়া সােনালি রং ছিল মােঙ্গলদের জাতীয় রং। এই সাম্রাজ্য দক্ষিণে ককেশাস পর্বতমালা, পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর এবং উত্তরে পােল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর রাজধানী ছিল সারাই। ভল্গা-নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত এই রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং বাতু। বাতু ছিলেন অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী। বাতু খানের পরিচালনায় তাতার-মােঙ্গলরা (রুশরা গোল্ডেন হোর্ডকে তাতার বলতো) বর্তমান রাশিয়ার রিয়াজান প্রিন্স রাজ্য আক্রমণ করে। প্রিন্সের দ্রুঝিন্নাক (প্রিন্সের পার্শ্বচর দলের সদস্য) আর শহরের সমস্ত মানুষ ভ্লাদিমিরের প্রিন্সের নিকট সাহায্যের আবেদন জানায় কিন্তু তাতে সাড়া না দেয়ায় রিজানের পতন হয়। এরপর তাতার-মােঙ্গলরা ভ্লাদিমির দখল করে। এরপর তারা নভগােরদ শহর দখলের জন্য অভিযান করে। নভগােরদের চারদিকের বন, জলাভূমি, হ্রদ অতিক্রম করা মােঙ্গলের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ১২৪০ সালে মােঙ্গলবাহিনী কিয়েভ দখল করে শহরটি জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে ক্রমে মোঙ্গল আক্রমণে রুশ জনপদগুলাে বিধ্বস্ত হয়। মােঙ্গলরা ভলগা আর দন নদী বরাবর স্তেপভূমিতে বসতি স্থাপন করে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, এবং তারা রুশদের কাছ থেকে নজরানা আদায় করে। প্রায় দুই শতাব্দীর বেশি-কাল তাতার-মোঙ্গল আধিপত্য রুশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত করেছিল। ১২৩৭ থেকে ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি সমগ্র রাশিয়া অধিকার করেন এবং বিজয়ীবেশে পােল্যান্ড ও হাঙ্গেরির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ফলে গােটা ইউরােপ বাতুর নেতত্বে পরিচালিত মােঙ্গল বাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাক্রমে এসময় ওগােদাই খানের মৃত্যু হলে ইউরােপের বিরুদ্ধে সমর অভিযান স্থগিত রাখা হয়। সুচতুর বাতু কারাকোরামে অনুষ্ঠিত কুরিলতাই এর অনুষ্ঠানে যােগাদন করা থেকে বিরত থাকেন এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কিপচাক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।

কিপচাক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাতু খান ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার ভাই বার্কে (১২৫৬-১২৬৬ খ্রি.) তার স্থলাভিষিক্ত হন। মােঙ্গল খানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন। বার্কে ছিলেন ১৩শ শতাব্দীর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মােঙ্গল নরপতি। তিনি ‘নতুন সারাই’ নামক একটি চমৎকার নগরী নির্মাণ করেন। বার্কের রাজত্বকালে ককেশাস অঞ্চল অধিকারের প্রশ্নে পারস্যের হালাকু খান ও আবাগা খানের সাথে তার তুমুল সংঘর্ষ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এছাড়া বার্কের ইসলাম গ্রহণ ও বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবােধের জন্যও ইল-খান নরপতিদ্বয়ের সাথে তার তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইল-খান মোঙ্গলবাহিনীকে তেরেখ্‌ এর যুদ্ধে পরাজিত করেন। বার্কে বিশেষ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পারস্যের মােঙ্গলদের প্রধানতম শত্রু মিশরের মামলুকদের সাথে এক অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে মিশরের সাথে কিপচাক অঞ্চলের তুর্কি ও মােঙ্গল ক্রীতদাস ব্যবসায়ে উভয়দেশ বিশেষভাবে লাভবান হয়। এছাড়া মিশর থেকে বহু শিল্পী, কারিগর ও ধর্ম প্রচারকদের কিপচাক সাম্রাজ্যে প্রেরণ করা হয় এবং উভয় দেশের মধ্যে বিশেষ সাংস্কৃতিক যােগসূত্র গড়ে ওঠে। ১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে বার্কে মৃত্যুবরণ করেন।  বার্কের মৃত্যুর পর বাতু খানের সাক্ষাৎ বংশধরগণ পরবর্তী এক শতাব্দীব্যাপী গােল্ডেন হাের্ডের শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এদের মধ্যে মঙ্কে তিমুর (১২৬৭-৮০ খ্রি.), তুদা মঙ্কে (১২৮০-৮৭ খ্রি.) তুলাবুঘা (১২৮৭-৯০ খ্রি.) তুখতু (১২৯১-১৩১২ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে রাজত্ব করেন। এরপর ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে উজবেক খান সারাই এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং এই সঙ্গে কিপচাক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়। উজবেক খান ছিলেন এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। তার আমলে কিপচাক সাম্রাজ্য উন্নতির শীর্ষ-শিখরে আরােহণ করে। তিনি সারাই এর পরিবর্তে নতুন সারাইতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এই নতুন রাজধানীতে তিনি সুরম্য মসজিদ, বিদ্যানিকেতন, শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকা গড়ে তােলেন। এছাড়া এই আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ভূমধ্যসাগর ও বাল্টিক-সাগরীয় অঞ্চলের সাথে চীনের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে কিপচাক মােঙ্গলগণ বিশেষ লাভবান হন। ১৩শ শতাব্দীর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা এই নতুন রাজধানী পরিদর্শন করেন এবং উজবেক খানের রাজত্বকালের নানামুখী উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। (এইচ. এ. আর. গিব :The Travels of Ibn Batuta. (১৩২৫-১৫৪ খ্রি.) দ্বিতীয় খণ্ড, লন্ডন, ১৯৭১)। তার আমলে গােল্ডেন হাের্ড একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাজ্যে পরিণত হয় এবং চেঙ্গিস খানের ‘উলাঙ্গ ইয়াছার’ পরিবর্তে ইসলামী শরীয়তের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। (জি. হ্যাম্বলি: Central Asia. নিউইয়র্ক, ১৯৬৯, পৃ: ১১৯)।

কিপচাক সাম্রাজ্যে ইসলামী শাসন প্রবর্তন যুগপৎ মােঙ্গল ও রাশিয়ার ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ এর ফলে উভয় জাতির মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবােধের সৃষ্টি হয় এবং ভবিষ্যতে একজাতি হিসেবে এদের মিলন অথবা সমন্বয় সাধন সুদূরপরাহত হয়ে দাঁড়ায়। (পূর্বোক্ত : পৃ: ১২০)। তবে উজবেক খান নিষ্ঠাবান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পরধর্মের প্রতি বিশেষ উদার ও সহনশীল মনােভাবের পরিচয় দেন। উজবেক খানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ বিশেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উজবেক খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে যদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতেন তবে তার ভবিষ্যৎ বংশধরগণ রাশিয়ার জারের স্থান দখল করতে পারতেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। (বি. স্পুলার : The Muslim World. (মোঙ্গল যুগ, দ্বিতীয় খণ্ড) লিডেন ,১৯৬০, পৃ: ৫৩)। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে মােঙ্গলদের স্বতন্ত্র সত্তা অবশ্যই বিলুপ্ত হয়ে যেত। উজবেক খানের উত্তরাধিকারীগণ একাদিক্রমে সকলেই মুসলমান ছিলেন এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাকে রাশিয়ার মুসলিম তাতার জাতির জনক ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। উজবেক খানের নামানুসারে আজও মধ্য-এশিয়ায় উজবেক জাতি এবং তাদের দেশ উজবেকিস্তান বিদ্যমান রয়েছে এবং এর রাজধানী তাসখন্দ।  উজবেক খানের পর জানি বেগ (১৩৪০-৫৭ খ্রি.) কিপচাক মােঙ্গল সিংহাসনে আরােহণ করেন। জানি বেগ একজন পরাক্রমশালী রাজ্য বিজেতা ছিলেন। এসময় পারস্যে চরম রাজনৈতিক অরাজকতা চলছিল। তিনি এর পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে তিন লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে ককেশাস পর্বতমালা অতিক্রম করেন এবং প্রথমে তাবরিজ ও পরে আজারবাইজান দখল করেন। এছাড়া তাবরিজ অধিপতি মালিক আশরাফও তার হাতে নিহত হন কিন্তু এসময় পারস্যে ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয় এত দ্রুতগতিতে এই মহামারী বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে কেবল ক্রিমিয়াতেই ৮৫ হাজার লােকের অকালমৃত্যু ঘটে। জানি বেগ এই মহামারীর তীব্রতায় ভীত হয়ে পড়েন এবং দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু খুব সম্ভবত এই প্লেগের জীবাণু তার দেহে প্রবেশ করায় তিনি অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। এলে তার পারস্য ও ককেশাস বিজয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়।  জানি বেগের পর বিরদি বেগ (১৩৫৭-৫৯ খ্রি.) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মাত্র দুই বছর রাজত্ব করার পর তিনি হঠাৎ আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুতে কিপচাক সাম্রাজ্যে গৃহবিবাদ ও আভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে এই সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। তার ওপর এসময় মােলদাভিয়া ও লিথুয়ানিয়া নামে দুটি মোঙ্গল বিরােধী নতুন রাজ্যের ও গ্র্যান্ড ডিউকের নেতৃত্বে মস্কোতে নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটে। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে উজবেক খান মস্কোর শাসনকর্তা প্রথম ইভানকে গ্র্যান্ড ডিউক উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে লিথুয়ানিয়ার রাজ্য ব্লু ওয়াটার্স এর যুদ্ধে পোডোলিয়ার তাতার শক্তিকে পরাজিত করে কিয়েভ দখল করেন। এরপর মস্কোর গ্র্যান্ড ভিউক তাতার সেনাপতি মামাইকে ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে ডন নদীর তীরে কুলিকোভার যুদ্ধ নামে এক প্রচণ্ড যুদ্ধে পরাজিত করেন

এই যুদ্ধটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলা যাক। ১৪শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মস্কোর প্রিন্সরা মােঙ্গলদের (সুবর্ণ ওর্দা বা গোল্ডেন হোর্ড) নজরানা দিতে অস্বীকার করে। মােঙ্গলরা কর আদায়ের জন্য মস্কোভিয়া আক্রমণ করে। ১৩৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মােঙ্গলরা নেপ্রিয়াদ্‌ভা নামক স্থানে রুশদের বাধার সম্মুখীন হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেক লােক নিহত হয়। এই লড়াইয়ে প্রিন্স দ্‌মিত্রি প্রতিভাশালী এবং সাহসী নেতা প্রতিপন্ন হন এবং তার নাম হয়ে দাঁড়ায় দ্‌মিত্রি দন্‌স্কোই। কুলিকোভার যুদ্ধে মােঙ্গলদের পরাজয় রুশদের মনে সাহস সঞ্চার করে এবং মস্কোকে কেন্দ্র করে ১৫শ শতকে ঐক্যবদ্ধ রুশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হয়। রুশ ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। নভগােরদ আর তভেরের সওদাগররা মস্কোভিয়া মহারাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে থাকে। রুশ কারিগরদের খ্যাতি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মস্কোভিয়া মহারাজা ক্রমে সমস্ত রুশ ভূমিকে একত্র করে অন্যান্য সমস্ত প্রিন্সকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এভাবে গড়ে ওঠে রাশিয়া রাষ্ট্র এবং মস্কোভিয়া রাজধানীতে পরিণত হয়। রুশিদের সঙ্গে উত্তরের এবং ভলগা অববাহিকার জাতিগুলি – মারি, মােৰ্দভা, ইউগরা, কোমি, পেচোরা, কারেলীয় এবং অন্যান্য জাতি মিলিত হল রাশিয়া রাষ্ট্রে। ফলে রাষ্ট্রটি বহুজাতিক হয়ে ওঠে। যাই হোক, যুদ্ধে পরাজিত হলেও এর ফলে কিপচাক সাম্রাজ্যের ক্ষমতা চিরতরে নির্বাপিত হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে এসময় তােখতামিশ নামক জনৈক শক্তিশালী নরপতি সারাই এর সিংহাসন অধিকার করেন। তােখতামিশ বাতুর ভাই ওরদার বংশধর এবং হোয়াইট হাের্ডের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ার দিগ্বিজয়ী নরপতি তৈমুরের সাহায্যপুষ্ট হয়ে কিপচাক তাতার শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তােখতামিশ ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে সাফল্যের সঙ্গে মস্কো অবরােধ করেন এবং গ্র্যান্ড ডিউককে কর প্রদানে বাধ্য করেন। কিন্তু তােখতামিশের নেতৃত্বে গােল্ডেন হাের্ডের এই সৌভাগ্যকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তােখতামিশ তৈমুরের প্রতি অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে তার অনুপস্থিতিতে ট্রান্সঅক্সিয়ানা আক্রমণ করেন। এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তৈমুর ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং ককেশাস পর্বতমালা অতিক্রম করে তােখতামিশকে আক্রমণ করেন এবং তেরেখ্‌ এর যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। বস্তুত তেরেখ এর যুদ্ধে তােখতামিশের পরাজয়ের ফলে রাশিয়ার গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্যের মৃত্যুঘণ্টা ধ্বনিত হয়। তৈমুরের সেনাবাহিনী ত্বরিতগতিতে সমস্ত রাশিয়া তছনছ করে দেয়। কিন্তু রাশিয়ায় স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করার কোন ইচ্ছাই তৈমুরের ছিল না। ফলে রাশিয়া থেকে তৈমুরের প্রত্যাবর্তনের পর তােখতামিশ পুনরায় রাজধানী সারাই অধিকার করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু তার পূর্বের সেই শক্তি আর ছিল না। তিনি অচিরেই তৈমুর কুলুঘ নামক জনৈক সেনাপতির কাছে পরাজিত হয়ে লিথুয়ানিয়ার যুবরাজ ভিটোল্ডের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং সেখানে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।  তোখতামিশের পর সারাই এর ক্ষমতা দখলের জন্যে বিভিন্ন মােঙ্গল গােত্রের খানদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষে অবশেষে এদিগু খান নামে জনৈক শক্তিশালী নােগাই অধিপতি ক্ষমতা দখল করেন। তিনিই ছিলেন গােল্ডেন হাের্ডের সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ নরপতি। এদিগু খান ১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে লিথুয়ানিয়ার যুবরাজ ভিটোল্ডকে পরাজিত করে কিপচাক সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এছাড়া তৈমুরের বংশধরদেরকে পরাজিত করে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিজম অধিকার করেন এবং বােখারা পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর ১৪০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মস্কো অবরােধ করে মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউকের কাছ থেকে বহু পরিমাণ অর্থ ও উপঢৌকন আদায় করেন। কিন্তু ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দে এদিগু খানের মৃত্যু হলে কিপচাক সাম্রাজ্য আবার হীনবল হয়ে পড়ে এবং এই অঞ্চলের ওপর কাজান (১৪৩৮-১৫৫২খ্রি.) অস্ত্রাখান (১৪৬৬-১৫৫৪ খ্রি.) এবং ক্রিমিয়া (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) নামে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি রাজ্য গড়ে ওঠে। এই রাজ্যগুলোর অধিপতিগণ অবশ্যই সকলেই চেঙ্গিস খানের পুত্র জুচির সাক্ষাৎ বংশধর ছিলেন। যাই হোক, গােল্ডেন হাের্ডের এই আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে মস্কো ও লিথুয়ানিয়ার ডিউকগণ উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে তাতার শক্তিকে পর্যুদস্ত করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৬শ শতাব্দীব্যাপী গােল্ডেন হাের্ড কোনক্রমে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এসময় গােল্ডেন হাের্ডের ক্ষমতা ও শাসন রাজধানী সারাই এর চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং এটি তখন সাধারণত ‘গ্রেট হাের্ড’ নামেই অভিহিত হত। (Encyclopaedia of Islain. লন্ডন, ১৯৬০ প্রথম খণ্ড, পৃ: ১১০৮)। অবশেষে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রেট হাের্ড ও রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

রুশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং সম্প্রসারণ 

মােঙ্গল আধিপত্যের সময় রাশিয়ার জনগণ রুশ শহরগুলাে ছেড়ে উত্তরপূর্ব রুশের বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওকা নদীর পাড় বরাবর এবং ভলগার উত্তরী বাকগুলাে বরাবর নতুন জমি আবাদ হয় এবং এগুলাে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ১৩শ শতকে মস্কো শহর। রিয়াজান স্মােলেন্স্ক এবং নভগােরদ অঞ্চল দিয়ে ঘেরা মস্কোভিয়া (মস্কো) রুশ সওদাগর ও কারিগরদের আবাসভূমিতে পরিণত হয়। মস্কোর শাসকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। ১৪শ শতকের গােড়ার দিকে ইভান কালিতা মস্কোভিয়ার গ্র্যান্ড প্রিন্স পদ লাভ করেন। এ সময় মস্কোভিয়ার প্রিন্সগণ মােঙ্গলদের কর প্রদান করত। ইভান কালিতার পৌত্র গ্র্যান্ড প্রিন্স দ্‌মিত্রি মস্কো ক্রেমলিন ঘিরে শক্তিশালী নগর তৈরি করে তাকে সুরক্ষিত করেন। ১৪শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মস্কোর প্রিন্সরা মােঙ্গলদের (সুবর্ণ ওর্দা বা গোল্ডেন হোর্ড) নজরানা দিতে অস্বীকার করে। মােঙ্গলরা কর আদায়ের জন্য মস্কোভিয়া আক্রমণ করে। ১৩৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মােঙ্গলরা নেপ্রিয়াদ্‌ভা নামক স্থানে রুশদের বাধার সম্মুখীন হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেক লােক নিহত হয়। এই লড়াইয়ে প্রিন্স দ্‌মিত্রি প্রতিভাশালী এবং সাহসী নেতা প্রতিপন্ন হন এবং তার নাম হয়ে দাঁড়ায় দ্‌মিত্রি দন্‌স্কোই। 

কুলিকোভার যুদ্ধে মােঙ্গলদের পরাজয় রুশদের মনে সাহস সঞ্চার করে এবং মস্কোকে কেন্দ্র করে ১৫শ শতকে ঐক্যবদ্ধ রুশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হয়। রুশ ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। নভগােরদ আর তভেরের সওদাগররা মস্কোভিয়া মহারাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে থাকে। রুশ কারিগরদের খ্যাতি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মস্কোভিয়া মহারাজা ক্রমে সমস্ত রুশ ভূমিকে একত্র করে অন্যান্য সমস্ত প্রিন্সকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এভাবে গড়ে ওঠে রাশিয়া রাষ্ট্র এবং মস্কোভিয়া রাজধানীতে পরিণত হয়। রুশিদের সঙ্গে উত্তরের এবং ভলগা অববাহিকার জাতিগুলি – মারি, মােৰ্দভা, ইউগরা, কোমি, পেচোরা, কারেলীয় এবং অন্যান্য জাতি মিলিত হল রাশিয়া রাষ্ট্রে। ফলে রাষ্ট্রটি বহুজাতিক হয়ে ওঠে।  

ইভান (৩য়) দি গ্রেট (১৪৬২-১৫০৫) ও তৃতীয় বাসিল (১৫০৫ – ১৫৩৩)

যে সকল রাষ্ট্রনেতা রুশদেরকে মােঙ্গলদের শাসন থেকে মুক্ত করেছিলেন মস্কোর গ্র্যান্ড প্রিন্স তৃতীয় ইভান (Ivan the Great) ছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান। তিনি ১৪৬২ সালে মস্কোভির সিংহাসনে বসেছিলেন। সে সময় মস্কোভির প্রিন্সরা তাতার খানদের বাৎসরিক কর দিত। তৃতীয় ইভান প্রথম তাতারদের কর দিতে অস্বীকার করেন। এ সময় তাতারদের রাজ্যের নাম ছিল “গোল্ডেন হোর্ড”, তাদের খান ছিলেন খান আহমদ। তৃতীয় ইভান কর দিতে অস্বীকার করলে ১৪৮০ সালে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মস্কো অভিযান করেন। উগ্রা নদীর তীরে রুশ সৈন্যরা তাতারদের সম্মুখিন হয়। রুশরা তাতারদের নদী অতিক্রম করতে দেয়নি। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাতার-মােঙ্গলরা নদীর পারাপারি রুশদের সামনাসামনি হয় কিন্তু কোনাে পক্ষ লড়াই শুরু করতে সাহস করেনি। এরপর তাতাররা রাশিয়া ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে রাশিয়া ২০০ বছরের মােঙ্গল আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়। তাতার-মােঙ্গলদের পরাজয়ের ফলে মস্কোভিয়ার গ্র্যান্ড প্রিন্সদের ক্ষমতা আরাে বৃদ্ধি পায়। ১৫শ শতকে রাশিয়ার রাষ্ট্রের আয়তন বার গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। ভলগা নদীর মধ্য আর দক্ষিণ বাক বরাবর সমস্ত ভূমি এবং সাইবেরিয়ার বিশাল অংশ রাশিয়ার অধিকারে চলে আসে।

তৃতীয় ইভান রাশিয়ার রাজ্য ও শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ সময় মস্কোভি রাজ্যের উত্তরে নভগােরড (Novgorod) রাজ্য লিথুয়ানিয়ার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মস্কোভির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় এবং নভগােরড ও লিথুয়ানিরা ঐক্যবদ্ধ রাজ্যে পরিণত হয়। লিথুয়ানিয়া ও মস্কোভির মধ্যবর্তী সীমানা নিয়ে বিরােধ দেখা দেয়। উত্তর-পূর্বে কাজান নামক স্থানের শাসনকর্তাগণ গোল্ডেন হোর্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, দক্ষিণে অস্ত্রাখানক্রিমিয়ার শাসনকর্তাগণ তাতার শাসনমুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতা ঘােষণা করে। এই অবস্থায় তাতারগণ মস্কোভির রাজাকে তাতার বিরােধী শক্তিগুলােকে উসকানির জন্য দায়ী করে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতন হলে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের খ্রিষ্টানরা রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এই অবস্থায় তৃতীয় ইভান নিজ মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বাইজান্টাইন সম্রাটের কন্যাকে বিবাহ করেন এবং পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে তৃতীয় ইভান খ্রিস্টানদের আশ্রয়দাতার মর্যাদা পান। 

তৃতীয় ইভান যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে সুজদলি ও এর নিকটবর্তী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাে অধিকার করেন, নভগােরদ রাজ্য মস্কোভির অন্তর্ভুক্ত করেন। নভোগোরদ দখলের ফলে পশ্চিম ইউরােপের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যিক যােগাযােগ স্থাপন করা সহজ হয়। মস্কোভি রাজ্য বিস্তারে লিথুয়ানিয়া সুইডেনের সহায়তা লাভ করলে তৃতীয় ইভান ডেনমার্কের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। এ ছাড়া তৎকালীন পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাটের সাথে তৃতীয় ইভান সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। 

তৃতীয় ইভানের শাসনব্যবস্থা : মস্কোভিয়ার শাসক তৃতীয় ইভান শাসনকার্য চালাতেন দু’মার (ভূস্বামীর) সাহায্যে। এই ভূস্বামীদের বােইয়ারিন বলা হত। দু’মার আসন পদ মূলত ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে বােইয়ারস্কায়া দু’মায় অনেক সময় গ্র্যান্ড প্রিন্সের সঙ্গে তাদের বিরােধ হত। তৃতীয় ইভানের দৌহিত্র চতুর্থ ইভান বােইয়ারিনদের কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। তৃতীয় ইভানের সময় রাশিয়ার সমাজকাঠামাে ছিল সামন্ততান্ত্রিক ধাচের। সমাজের উচ্চশ্রেণীভুক্ত ছিল বােইয়ারিনরা। তারা সেনাবাহিনীতে কাজ করত এবং জমি ভােগ করত। সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল ভূমি দাস। যারা বােইয়ারিনদের জমি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তৃতীয় ইভান বােইয়ারিনদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল না হয়ে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য রাজকীয় অনুগত একটি অভিজাত শ্রেণী গঠন করেছিলেন। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধা দেওয়া হত।

তদকালীন রাশিয়ার সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে “আধুনিক যুগের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে এর পুনরুজ্জীবন” নিম্বন্ধটির “পূর্ব ও মধ্য ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবন” অংশটি পড়ুন।

ইভানের কৃতিত্ব : তৃতীয় ইভান রাশিয়াকে প্রথম তাতার আধিপত্য থেকে মুক্ত করে রাশিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তিনি প্রথম রাশিয়ার ঐক্য স্থাপনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তিনি নৃশংস ও কঠোর হলেও তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও কূটনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী। তিনি বাইজানটাইন সম্রাটের কন্যাকে বিয়ে করে রাশিয়ার গৌরব এবং নিজ পরিবারের ঐতিহ্য বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি প্রথম ‘রাশিয়ানদের জার’ (Zar of all the Russians) উপাধি ধারণ করেছিলেন। (সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃ. ৫২)। তিনি ভবিষ্যৎ রাশিয়ার উত্থানের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। 

তৃতীয় ব্যাসিল (Basil III, ১৫০৫ – ১৫৩৩) : তৃতীয় ইভানের মৃত্যুর পর তার পুত্র তৃতীয় ব্যাসিল মস্কোভির জার পদ লাভ করেন। রাজপদ সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাসিল উচ্চ ধারণা পােষণ করতেন। তবে শাসনকার্যে তিনি পিতার ন্যায় পারদর্শী ছিলেন না। শাসনকার্যে তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী তবে তিনি পিতৃ আরাধ্য ঐক্য নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তার শাসনকালে বােইয়ারিনরা বিদ্রোহ করেছিল এবং অনেকে মস্কো শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এরা শাসনকার্যে জারকে পরামর্শ দিতেন কিন্তু ব্যাসিল ডুমার মতামত অগ্রাহ্য করে বিদ্রোহী বােইয়ারিনদের শাস্তি দিয়েছিলেন। 

চতুর্থ ইভান (১৫৩৩ – ১৫৮৪)

তৃতীয় ব্যাসিলের মৃত্যুর পর তার ৯ম বর্ষীয় পুত্র চতুর্থ ইভান (Ivan IV, The Terrible) রাশিয়ার জার পদ লাভ করেন। নতুন জার নাবালক থাকায় বােয়াইনগণ শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে রাশিয়ার জাতীয় ঐক্য বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১৬ বছর বয়সে চতুর্থ ইভান নিজ হাতে শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। শাসনক্ষমতা লাভ করে তিনি স্বার্থবাদী ও কুটিল বােয়াইনদের কঠোর শাস্তি দেন এবং অনেককেই জীবন্ত অবস্থায় কুকুর লেলিয়ে দেন। তার নিষ্ঠুরতার ভয়ে বােয়াইনগণ ভীত হয়ে পরে। চতুর্থ ইভানের নিষ্ঠুরতার জন্য তাকে ইভান দা টেরিবল বলা হয়। চতুর্থ ইভান শাসনক্ষমতা লাভ করে অনেকটা দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু রাজত্বের শেষ পর্যায়ে তিনি অনেকটা অস্থির ও নিষ্ঠুর হয়েছিলেন। 

চতুর্থ ইভানের পররাষ্ট্রনীতি : চতুর্থ ইভান পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে অনেকটা দক্ষ ও সাহসী ভুমিকা পালন করেছিলেন। তিনি লিভুনিয়ার সামন্তদের পরাজিত করে নারভা নামক বন্দরটির নিরাপত্তা সাধন করেছিলেন। নারভা ছিল নভগােরডের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সুইডেন লিভুনিয়াবাসীদের এই বন্দরটিতে গােলযােগ বাধাতে উসকানি দিয়েছিল। চতুর্থ ইভান লিভুনিয়ার সামন্তদের দমন করে রাশিয়ার ব্যবসায়িদের স্বার্থরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সুইডেন এবং পােল্যান্ডের শত্রুতার কারণে রাশিয়াকে এ বন্দরটি হারাতে হয়েছিল। 

ইরানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন : রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান সেসময় শিক্ষাদীক্ষায় ও ব্যবসাবাণিজ্যে উন্নত ছিল। চতুর্থ ইভান ইরানের সাথে বাণিজ্য যােগাযােগ স্থাপনের জন্য ক্রিমিয়া দখলের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তিনি তাতারের খানদের অধীনে অস্ত্রাখান এবং কাজান দখল করে পূর্বাঞ্চলের দেশগুলাের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি পশ্চিম ইউরােপীয় বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। বিশেষ করে রাশিয়ার অর্থনীতিক উন্নতির জন্য পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলাে থেকে শিল্পী ও কারিগরদের রাশিয়া আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করে সেটিকে রুশ উপনিবেশে পরিণত করেছিলেন। বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য তিনি শ্বেত সাগরের তীরে আর্চেঞ্জেল নামে একটি বন্দর স্থাপন করেছিলেন। 

চতুর্থ ইভানের অভ্যন্তরীণ নীতি : রাশিয়ার ভূমধ্যকারী বােয়াইনরা চতুর্থ ইভানের বিরােধিতা করায় অভ্যন্তরীণ শাসন ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট যােগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি বােয়াইনদের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য তাদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। বােয়াইনদের সভা দু’মার বদলে তিনি তার অনুগত লােকদের নিয়ে একটি নতুন সভা গঠন করেছিলেন। এই অনুগত শ্রেণী রুশ কৃষক ও কারিগরদের শােষণ করতে থাকে। তার শাসনকালে ১৫৭১ সালে তাতারগণ রাশিয়া আক্রমণ করে। ফলে কৃষকদের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে ওঠেছিল। চতুর্থ ইভান গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সাথে সদ্ভাব রক্ষা করে চলতে পাবেননি এবং মেট্রোপলিটনের সঙ্গে তার মতবিরােধ হওয়ায় তাকে তিনি প্রাণদণ্ড দেন। নভগােরদের অনেক কৃষক তার নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করলে তিনি কয়েক হাজার কৃষককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। 

রাশিয়ার অরাজকতার যুগ : চতুর্থ ইভানের মৃত্যুর পর রাশিয়ায় রাজনৈতিক গােলযােগ দেখা দেয়। ভূম্যধিকারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বৈদেশিক আক্রমণ, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক দুর্দশা এই যুগের রাশিয়ার জনজীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করেছিল। সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত গােলযােগের সুযােগে কোসাক জাতি রাশিয়ার অভ্যন্তরে লুটতরাজ শুরু করলে জনজীবন আরাে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। এই অরাজকতার সময় পােল্যান্ড রাশিয়া আক্রমণ করে তা দখল করে। এতে রুশগণ খুবই অপমান বােধ করে। ফলে তারা সমবেতভাবে পােলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রাশিয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনে। স্বাধীনতা লাভের পর রাশিয়ার সকল শ্রেণীর প্রতিনিধি সভা জেমস্কি সবাের (Zemski Sobor) আহবান করা হয়। এই প্রতিনিধি সভা প্রাচীন বােয়ার পরিবারের মিখায়েল রোমানকে রাশিয়ার জারপদে অভিসিক্ত করে। রােমানফ রাজবংশ থেকে আধুনিক রাশিয়া যাত্রা শুরু করে। 

মিখায়েল রােমানফ (১৬১৩ -১৬৪৫) ও আলেক্সিস (১৬৪৫ – ১৬৭৬)

মিখায়েল রােমানফ (Michael Romanoff, ১৬১৩ -১৬৪৫): ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে মিখায়েল রােমানফ রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে, রাশিয়ার জার পদ লাভ করেছিলেন। ফলে জাতীয় স্বার্থে অরাজকতা দূর করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল শ্রেণীর মানুষ জার মিখায়েল রােমানফকে সমর্থন দিয়েছিলেন। নতুন জার ভূম্যধিকারী সামন্তদের মধ্য থেকে দক্ষ কর্মচারী সরকারি কাজে নিয়ােগ দেন। এই কর্মচারীরা কালক্রমে রাজ-অনুগত বিশ্বাসী কর্মী হয়ে ওঠেছিলেন। 

রাশিয়া জাতির পুনর্গঠন : মিখায়েল রােমানফ রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ শাসন পুনর্গঠনের জন্য মনােযােগ দেন। তিনি রাজশক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য বিদেশী ভাড়াটিয়া সৈন্য নিয়ােগ করেন। ফলে জারের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি পুনর্গঠন কাজ সুষ্ঠুরূপে বাস্তবায়নের সুযােগ পান। 

রাশিয়াকে বিদেশী শাসন মুক্তকরণ : মিখায়েল রােমানফের সময় রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক গােলযােগের সুযােগে পােল্যান্ড ও সুইডেন রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মিখায়েল রােমানফ পােল্যান্ড ও সুইডেনকে রাশিয়ার কতক স্থান ছেড়ে দিয়ে রাশিয়াকে বিদেশী শাসনমুক্ত করেন। ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে পােল্যান্ড ও সুইডেনের সাথে রাশিয়ার সন্ধি স্থাপন করেন। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এ সন্ধি করলেও পরবর্তী সময় মিখায়েল রােমান পােল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু পরাজিত হয়ে পুনরায় সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। 

আলেক্সিস (Alexis, ১৬৪৫ – ১৬৭৬) : মিখায়েল রােমানফের মৃত্যুর পর তার পুত্র আলেক্সিস ১৬৪৫ সালে রাশিয়ার জার পদ লাভ করেন। তিনি রাশিয়ার জাতীয় গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য পিতার অনুসৃতনীতি অনুসরণ করেছিলেন। তিনি কোসাকদের বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে হােয়াইট রাশিয়া (White Russia) এবং লিটল রাশিয়ার (Little Russia) অধিকাংশ এবং কিয়েভ দখল করেছিলেন। এ সকল স্থান দখলের ফলে সমগ্র রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। 

ইউরােপীয় আদর্শ গ্রহণ : আলেক্সিস রাশিয়ায় ইউরােপীয় সংস্কৃতি প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি পশ্চিম ইউরােপীয় ব্যবসায়ী ও কারিগরদের রাশিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পশ্চিমে ইউরােপের কাপড়, আসবাবপত্র এবং কারুশিল্পের বহু দ্রব্যাদি রাশিয়া আমদানি করেছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাকে পিটারের পথ প্রদর্শক বলা যায়। আলেক্সিসের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় থিয়ােডর ১৬৭৬ – ৮২ এই ছয় বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ছিলেন অকর্মণ্য ও দুর্বলচিত্তের শাসক। 

রাশিয়ার জার মহান পিটার (১৬৮২-১৭২৫) 

রাশিয়ার ইতিহাসে জার পিটার দি গ্রেটের (Peter the Great) রাজত্বকালে একটি উল্লেখযােগ্য অধ্যায়। তাকে আধুনিক রাশিয়ার জন্মদাতা বলা হয়। পিটারের নিজের সময়ের কথা বলতে গেলে, রাশিয়া তার প্রচেষ্টায় স্পষ্টভাবে তার বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল, এর বিশাল অংশ তার সময়ে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিতে ভূমিকা রাখার জন্য সংগঠিত হয়েছিল, এবং এর ইতিহাস ইউরোপের ইতিহাসের এবং ক্রমবর্ধমান বিশ্বের ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। প্রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়ান রাজতন্ত্রের মতো রাশিয়াও ইউরোপের শক্তিগুলির মধ্যে একটি বলে বিবেচনা করা হত।

পিটারের সিংহাসনে আরােহণের সময় রাশিয়ার অবস্থা

মহান পিটার যখন রাশিয়ার সিংহাসন লাভ করেন তখন রাশিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক এবং রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই ছিল পশ্চাৎপদ। ১৭শ শতাব্দীতে রাশিয়া ইউরােপ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, যার ফলে রাশিয়াকে ইউরােপীয় দেশ মনে করা হত না। ইউরােপীয় দেশগুলাের সাথে রাশিয়া কোনাে ক্ষেত্রেই সমকক্ষ ছিল না। 

রাশিয়ার ভৌগােলিক অবস্থান : রাশিয়া আয়তনে বিশাল দেশ। এশিয়া এবং ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে রাশিয়া গঠিত ছিল। আর্কটিক সাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর এবং ওবি উপসাগর হতে কিয়েভ পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে রাশিয়ার অবস্থান ছিল। পশ্চিম দিকে লিটল রাশিয়ার একাংশ পােল্যান্ডের অধিকারে ছিল। পােল্যান্ড সুইডেনের সাথে সমঝােতা করে রাশিয়ার বাল্টিক সমুদ্রে প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। দক্ষিণে তুর্কি সাম্রাজ্যের অনুগত ক্রিমিয়ার খান কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার প্রবেশপথ বন্ধ করে রেখেছিল। শ্বেত সাগর তীরে অবস্থিত আৰ্চেঞ্জেল বন্দর ভিন্ন অপর কোনাে পথে রাশিয়ার পক্ষে সমুদ্রে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ সাগর বছরে ৯ মাস বরফে আবৃত থাকত। ভৌগােলিক প্রতিবন্ধকতার জন্য রাশিয়া ইউরােপ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় জীবনযাত্রা ও আচার-আচরণে রাশিয়া ছিল একটি এশীয় দেশ। শুধু খ্রিষ্টধর্ম ইউরােপের সাথে একটি সংযােগ রক্ষা করত। 

সামাজিক অবস্থা : ১৭শ শতাব্দীতে রাশিয়ার সমাজ ছিল পশ্চাৎপদ। সমাজের জনগােষ্ঠীর অধিকাংশ ছিল ভূমিদাস এবং অভিজাতরা ভূমিদাসদের শােষণ করত। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশমান হওয়ায় রাশিয়ার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটেনি। অভিজাত শ্রেণী ভূসম্পত্তি এবং সরকারি রাজপদের অধিকারী ছিল। কৃষকরা ছিল ভূমিদাস। তারা ‘মির’ নামক গ্রাম্য সমিতির অধীনে অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় জীবনযাপন করত। চিন্তা ও চেতনায় সবক্ষেত্রেই মানুষ ছিল পশ্চাৎপদ। এজন্য রাশিয়াকে বলা হত ইউরােপীয় সভ্যতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। (Russia is the last-born child of European civilization.) 

ধর্মীয় অবস্থা : রাশিয়ায় গ্রিক অর্থডক্স চার্চ প্রতিষ্ঠিত ছিল। রুশরা ছিল গোড়া খ্রিস্টান। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য থেকে যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হয়েছিল তাতে রুশরা দীক্ষা লাভ করেছিল। রাশিয়ার জার শেষ বাইজানটাইন সম্রাটের কন্যাকে বিয়ে করায় রাশিয়া গ্রিক অর্থডক্স চার্চের পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল। রাশিয়ার চার্চের সর্বোচ্চ যাজককে পেট্রিয়ার্ক (Patriarch) বলা হত। কালক্রমে পেট্রিয়ার্ক প্রভাবশালী হয়ে নিজকে জারের প্রভাবমুক্ত করে। ফলে পেট্রিয়ার্ক রাজক্ষমতার একরকম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। 

অর্থনৈতিক অবস্থা : রাশিয়া ছিল কৃষি অর্থনীতির অধিকারভুক্ত দেশ। শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার না থাকায় অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। সাধারণ মানুষের খাদ্যের অভাব না থাকলেও তাদের অর্থের প্রাচুর্য ছিল না। সামন্ত অর্থনীতিতে সাধারণ কৃষক ছিল শােষণের শিকার। এ ছাড়া বােয়ারদের বিদ্রোহ ও আনুগত্যহীনতার জন্য দেশে অশান্তি বিদ্যমান ছিল। জার আলেক্সিসের সময় থেকে সর্বপ্রথম বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক জীবন অনুকরণের চেষ্টা শুরু হয়। 

রাজনৈতিক অবস্থা : রাশিয়ায় নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারি রাজতন্ত্র ছিল। ডুমা নামক অভিজাত সভা জারকে পরামর্শ দিত। এই সভার মতামত গ্রহণ করা জারের ইচ্ছাধীন ছিল। জেমস্কি সবোর নামে সর্বশ্রেণির একটি সাধারণ সভাও ছিল। এ সভায় ১৬১৩ সালে মিখায়েল রােমানফকে জার পদে মনােনয়ন দিয়েছিল। ভায়োভােড (Viovode) নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে মির বা গ্রাম্য সমিতির যোগাযােগ রক্ষা করত। মির সাধারণত পুলিশ ও বিচারকদের দায়িত্ব পালন করত। ভায়ােভােডগণ মিরের সকল কাজে তত্ত্বাবধান করত। জারের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল গির্জার প্রধান পেট্রিয়ার্ক। ধর্মীয় ব্যাপারে তার প্রভূত প্রভাব ছিল এবং স্ট্রেলজি নামক জারের দেহরক্ষীবাহিনী জারকে যেমন রক্ষা করত তেমনি ভয় দেখিয়ে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করত। 

পিটারের সিংহাসন লাভ, শিক্ষা ও বিদেশ ভ্রমণ

পিটারের সিংহাসন লাভ : রাশিয়ার জার আলেক্সিসের মৃত্যুর পর পিটার ১৬৮২ সালে এক পরিবারিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সিংহাসন লাভ করেন। পিটারের পিতা আলেক্সিসের দুজন রাণী ছিল প্রথম জন মেরিয়া মিলােস্লাভস্কী এবং দ্বিতীয় জন নটালিয়া নারিনি। এই দুই রাণীর ১৩ জন সন্তান ছিল। ১৬৭৬ সালে আলেক্সিস মৃত্যুবরণ করলে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আলেক্সিস এবং মেরিয়া মিলােস্লভস্কীর পুত্র থিওডর ১৬৭৬ সালে সিংহাসন লাভ করেন। তার রাজত্বকালে নারিস্কিনগণ, তাদের সমর্থক ও নাটালিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র পিটারকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু ১৬৮২ সালে থিওডর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে পিটারকে জার হিসেবে ঘােষণা করা হয়। পিটারের বৈমাত্ৰীয় ভ্রাতা সন্ন্যাস রােগাক্রান্ত ও প্রায় অন্ধ ইভানের সিংহাসনের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর পনের দিন পর স্ট্রেলজি ক্রেমলিন আক্রমণ করে নারিস্কিনদের অনেককেই হত্যা করে। পিটারের পরিবারের অনেক সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ও হট্টগােলের মধ্যে ইভানের ভগ্নী সােফিয়ার অভিভাবকত্বের অধীনে ইভানের সাথে পিটারকে যৌথভাবে জার হিসেবে ঘােষণা করা হয়।

পিটারের শিক্ষাজীবন : ১৬৭২ সালে ৩০ মে ক্রেমলিনে পিটার জন্মগ্রহণ করেন। পিটার কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করেননি। পাঁচ বছর বয়সের সময় নিকিটা জোটভকে পিটারের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয় এবং তার তত্ত্বাবধানে পিটার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৬৮২ সালে রাজনৈতিক হট্টগােলের কারণে তার গৃহশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায় এবং তাকে ক্রেমলিন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পিটার মস্কোর নিকটবর্তী প্রেয়ােব্রাঝেনস্কো গ্রামের আলেক্সির রাজপ্রাসাদে সময় অতিবাহিত করেন এখানেই পিটার সামরিক শিক্ষায় মনােযােগী হন। ১১ বছর বয়সে পিটার পােটেশনী নামক একটি সৈন্যদল গঠন করেন। পিটারের তত্ত্বাবধায়ক সােফিয়া পিটারের ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনীকে প্রয়ােজনীয় অর্থ, গােলাবারুদ ও পােশাক সরবরাহ করে। পিটার প্রেসবুর্গে একটি দুর্গ নির্মাণ করে সেটিকে সামরিক শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণত করেন। তিনি সেখানে নৌবিদ্যায় শিক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রথম রাশিয়ার ইয়াউজা নদীতে এবং পরবর্তী সময়ে মস্কোর নিকটে একটি জলাশয়ে এবং তৃতীয়বার পেরেয়াস্লাভ হ্রদে নৌবাহিনী তৈরির প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তিনি ডাচ, জার্মান বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নৌবাহিনী পত্তন করেন। পিটার ওলন্দাজ নাবিক ফ্রাঞ্জ টিমারমানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। পিটারের ওলন্দাজ বন্ধু ফ্রাঞ্জ টিমারমান পিটারকে গণিত, বীজগণিত, গােলাবারুদ ও দুর্গ নির্মাণ কৌশল শিক্ষা দেন। পিটার ডাচ বণিকের অনুকরণে পােশাক-পরিচ্ছদ ও কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও জীবনধারা অর্জন করেন। জার্মান বসতি কর্তৃক সরবরাহকৃত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও পশ্চিম ইউরােপ সম্পর্কে ধারণা পরবর্তীকালে পিটারকে প্রভাবিত করেছিল। ১৬৮৯ সালে ২৭ জানুয়ারি পিটার ইউডক্সি লােপুকিনকে বিয়ে করেন কিন্তু দু মাস পরেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তার সমর্থকগণ সােফিয়াকে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব থেকে উৎখাত করে। পিটারের মামা লেভ নারিস্কিন পিটারের অভিভাবকত্ব লাভ করেন। এ সময় পিটার বিদেশ ভ্রমণ করেন। 

পিটারের বিদেশ ভ্রমণ : ১৬৯৩ এবং ৯৪ সালে পিটার শ্বেত সাগরের তীরে অবস্থিত আর্চঅ্যাঞ্জেল বন্দর ভ্রমণ করেন। এটি ছিল তার প্রথম সমুদ্র দর্শন। এ সময় পিটারের দুজন বিদেশী সহচর ছিল। একজন স্কচম্যান পেট্রিক গরডােন এবং অন্যজন সুইচ ফ্রান্সিস লেফোর্ট। পিটার তাদেরকে নৌবাহিনীর এডমিরাল নিযুক্ত করেন। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ পিটারের সহচর হন। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মস্কোর অভিজাত পরিবারের ইভান বুটুরলিন, প্রিন্স মিখায়েল গালটসিন, প্রিন্স ফেডাের রােমডানােভস্কী ও বরিস শেরেমেটেভ। আলেকজান্ডার মেনশিকোভ ছিলেন আস্তাবলের কর্মচারীর সন্তান। ১৬৯৪ সালে মাতা নটালিয়া মৃত্যুবরণ করলে পিটার নিজ হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নেন। ১৬৯৫ সালে তুর্কিদের কাছ থেকে আজভ বন্দর দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি ক্যাথারিন নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন। 

পরের বছর পিটার তুর্কিদের কাছ থেকে আজভ বন্দর দখল করেন। এরপর তিনি ইউরােপ ভ্রমণ করেন। ১৬৯৭ সালে মার্চ মাসে পিটার মিখাইলভ নাম ধারণ করে ২৫০ জন সহকর্মী নিয়ে ইউরােপ ভ্রমণে যান। রিগা ও লিবের ভিতর দিয়ে তিনি ভ্রমণ আরম্ভ করেন। এ সময় তিনি প্রথম বাল্টিক সাগর দর্শন করেন। সেখান থেকে পিটার মিট, কনিংসবার্গ ও বার্লিনে যান। তিনি হল্যান্ডে চার মাস অতিবাহিত করেন। ১৬৯৮ সালে তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখানে জনজীবন অবলােকন করেন। এপ্রিল মাসে তিনি হল্যান্ডে ফিরে আসেন। এরপর তিনি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি ইতালি ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু স্ট্রেলজি বিদ্রোহের খবর পেয়ে ১৬৯৮ সালে অগাস্টে রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি দীর্ঘ আঠার মাস ইউরােপ ভ্রমণ করেছিলেন। ছদ্মবেশে ইউরােপ ভ্রমণ করলেও তার পরিচয় প্রকাশ হয়েছিল। কনিংসবার্গে তিনি ব্রান্ডেনবার্গের ইলেক্টর তৃতীয় ফ্রেডারিকের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ব্রান্ডেনবুর্গের ইলেকট্রেস সােফিয়া শার্লটের সাথে নৈশভােজে অংশ নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়াম তাকে অভ্যর্থনা দিয়েছিল। তিনি অস্ট্রিয়াতে সম্রাট লিওপােল্ডের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মস্কো ফেরার পথে তিনি পােল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাসের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন।

ইউরােপে ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ইউরােপের সামরিক সংগঠন, নৌচলাচল ও জাহাজ নির্মাণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। তিনি কনিংসবার্গে গােলাবারুদের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স সমাপ্ত করেছিলেন। হল্যান্ডে তিনি জাহাজ নির্মাণ কারখানায় সাধারণ শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি ইংরেজদের শিল্প কারখানা, জাহাজ নির্মাণ স্থান, জাদুঘর, হাসপাতাল ও সরকারি ভবন পরিদর্শন করেছিলেন। এ ভ্রমণের সময় স্থাপত্য, প্রকৌশল, দুর্গ নির্মাণ, পুস্তক প্রকাশনা, শরীর বিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, চিত্রকলা, ক্ষোদাই বিদ্যা এবং দন্ত চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশােনা করেছিলেন। ইংল্যান্ডের ডেপ্টফোর্ডে পিটার ছয় সপ্তাহ অতিবাহিত করেন। তিনি লন্ডন, অক্সফোর্ড, উলউইচ ও পাের্টসমাউথ পরিদর্শন করেন এবং ইংরেজদের জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ফ্যাক্টরি, ওয়ার্কসপ, অভজারভেটরি, টাকশাল, লন্ডন টাওয়ার ও নাট্যশালা অবলােকন করেন। তিনি ইংরেজদের নৌবাহিনীর কৌশল অভিযান উপভােগ করেন। ইংল্যান্ডে ছয় মাস অবস্থানের পর তিনি হল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা পৌঁছেন। ভিয়েনাতে অবস্থানের সময় মস্কোর গভর্নর প্রিন্স রােমডানােভস্কি পিটারকে স্ট্রেলজি বিদ্রোহের সংবাদ দেন এবং দেশে ফেরার জন্য অনুরােধ করেন। পিটারের গােয়েন্দা পুলিশ স্ট্রেলজি বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র উদঘাটন করেছিল। পিটারের পাশ্চাত্য ভ্রমণ আরম্ভ হওয়ার কয়েক দিন আগে এ ষড়যন্ত্র করা হয়। এ ষড়যন্ত্রের নেতাদেরকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এরপর দ্বিতীয় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। স্ট্রেলজিরা তাদের ক্ষমতা হ্রাস ও বকেয়া বেতনের জন্য বিদ্রোহ করেছিল। তাদেরকে আজভ ও দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে পাঠানাে হয়েছিল। এদিকে তারা নির্বাসন ও অপমানকর মনে করেছিল। বিদেশে পিটারের মৃত্যুর গুজবে অনুপ্রাণিত হয়ে সােফিয়াকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠার আশায় ১৬৯৮ সালে কয়েকটি রেজিমেন্ট মস্কো অভিমুখে যাত্রা করে। গরডােলের সৈন্যরা তাকে পরাজিত করে বন্দি করে। পিটার দেশে ফিরলে ১৬৯৮ সালে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এবং ১৬৯৯ সালে জানুয়ারিতে তাদেরকে কঠোরভাবে হত্যা করা হয়। পিটার নিজে জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রায় ১২ শত লােককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মৃত্যুদেহ অঙ্গচ্ছেদ অবস্থায় কয়েক মাস ফেলে রাখা হয়। 

স্ট্রেলজি বিদ্রোহ দমনের পর তিনি রাশিয়ায় পাশ্চাত্য পােশাক ও জীবনধারা প্রচলনের জন্য আইন করেন। তিনি মস্কো ফেরার পরের দিন পাশ্চাত্য পােশাক পরিধান করে জনগণের সামনে বের হন এবং তিনি রাজসভার রাজভাড় টুরগেনেভের সহায়তায় একটি কাঁচি দিয়ে রাজসভার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাড়ি কামিয়ে দেন। এ সময় তিনি লম্বা হাতা টপকোটের পরিবর্তে হাঙ্গেরীয় বা জার্মান পােশাক পরার নির্দেশ দেন। ধর্মযাজক ও কৃষকরা এ নির্দেশের আওতায় পড়েনি। যারা তার নির্দেশ মানত না তদেরকে জরিমানা করা হতাে। গোড়াপন্থি রুশ খ্রিস্টানগণ যারা দাড়ি রাখা ধর্মীয় কাজ মনে করতেন, তারা দাড়ি না কামিয়ে জরিমানা দেন। ফলে প্রজাদের বহিরাবরণের পাশ্চাত্যকরণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

পিটারের বিভিন্ন আভ্যন্তরীন সংস্কার 

পিটারের উদ্দেশ্য ও নীতি : পিটার ইউরােপ ভ্রমণ করে রুশদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। রুশরা ইউরােপীয় সভ্যতার প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সামাজিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রেই পশ্চিম ইউরােপ থেকে পিছিয়ে ছিল। সে সময় বরফাবৃত শ্বেতসাগর ভিন্ন বাল্টিক বা কৃষ্ণসাগরের পথে ইউরােপের সাথে কোনাে যােগাযােগ ছিল না। এ অবস্থায় তিনি রাশিয়ায় জাতীয় জীবন পরিবর্তনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তিনি রাশিয়াকে ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বাল্টিক অথবা কৃষ্ণসাগরে এবং সম্ভব হলে উভয় সাগরেই রাশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার প্রয়ােজন ছিল। কারণ এই দুই সাগরের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরােপের সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যােগাযােগ স্থাপন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু ঐ সময়ে বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী স্থানসমূহ সুইডেনের নিয়ন্ত্রণে এবং কৃষ্ণসাগর ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। কাজেই এই দুই সাগরে প্রবেশ লাভের জন্য সুইডেন ও তুরস্কের সাথে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, রাজতন্ত্রের প্রতিপক্ষ ও বিরােধী শক্তিগুলােকে নির্মূল এবং শাসন ব্যবস্থাকে সংস্কার করার প্রয়ােজন ছিল। এ ছাড়া অর্থডক্স চার্চের প্রধান পেট্রিয়াকের ক্ষমতা খর্ব করে ধর্মধিষ্ঠানের ওপর রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব স্থাপন করা প্রয়ােজন ছিল। পিটার তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেন।

পিটারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার : পিটার রাশিয়ার রাজশক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য সামরিক শক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এজন্য তিনি প্রথমেই সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন করেন। নিয়মিত স্থায়ী বেতনভােগী সেনাবাহিনী গঠন ও নৌবাহিনী গড়ে তােলেন। ১৭শ শতাব্দীতে রাশিয়াতে মিলেশিয়া নামে একটি সেনাবাহিনী ছিল। ১৬৯৫ সালে পিটার যখন তুর্কিদের বিরুদ্ধে অভিযান করে আজভ বন্দর দখল করতে চেয়েছিলেন সে অভিযানে মিলেশিয়ারা অংশগ্রহণ করেছিল। প্রেযোব্রাঝেনস্কোতে পিটার গার্ডবাহিনী গঠন করেছিলেন। ১৬৯০-৯১ সালে এসব বাহিনীকে সামরিক ইউনিটে পরিণত করেন। পিটার কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিবারকে একজন করে সৈন্য সরবরাহ করতে নির্দেশ দিতেন। সে সময়কার নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক লােকসমাজ সেনাবাহিনী থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রত্যেক সৈন্যের জন্য একজন নতুন সৈন্য সরবরাহ করতে হতাে। নিয়ােগের আগে তালিকাভুক্ত সৈন্যদেরকে সেনা সদর দপ্তরে রাখা হত। সেখানে তারা সামরিক প্রশিক্ষণ পেত। ১৭১৬ সালে নতুন আর্মি রেগুলেশন জারি করা হয়। পিটারের রাজত্বের শেষে নিয়মিত সেনাবাহিনীর যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ। এদের সাথে যােগ হত ১ লক্ষ কসাক এবং কালমিক এবং অন্যান্য পূর্বাঞ্চলের জনগােষ্ঠী থেকে অনির্দিষ্ট সংখ্যক স্থানীয় সৈন্য। 

নৌবাহিনী গঠন : রুশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পিটার। ১৬৯৬ সালে প্রথম নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ নির্মাণ করা হয়। ১৭০৩ সালে ইনিগ্রয়া দখল এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গ নগর প্রতিষ্ঠার পর পিটার সির নদীর তীরে নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজত্বের শেষ দিকে রাশিয়ার বাল্টিক নৌবহরে ৮০০ বিভিন্ন ধরণের নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল। নৌবাহিনীতে নাবিকের সংখ্যা ছিল ২৮০০০। সুইডেন এবং তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এ নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার : পিটার রাজশক্তিকে সর্বাত্মক করার জন্য শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করেন। তিনি ডুমা নামক অভিজাত সভা এবং জেমস্কি সবাের (Zemski Sobor) নামক সাধারণ সভা বাতিল করেন। এগুলাের পরিবর্তে তিনি নিজ মনােনীত নয় জন সদস্য নিয়ে সিনেট নামক এক রাজকীয় সভা গঠন করেন। শাসনকার্যকে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেকটিকেই সিনেটের অধীনে স্থাপন করেন। সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৭২টি বিভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেকটিতে একজন করে গভর্নর এবং একটি করে ক্ষুদ্র সহায়ক সভা স্থাপন করেন। শহর এলাকায় একটি করে পৌরসভা স্থাপন করা হয় এবং এ সকল সভা সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত একজন উচ্চপদস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা হয়। প্রত্যেকটি গ্রামকে গ্রাম্য মির (Village community) এর অধীনে আনা হয়। এভাবে গ্রাম থেকে কেন্দ্রীয় শাসন পর্যন্ত প্রতিস্তরই জারের কর্তৃত্বে এনে সংঘবদ্ধ হয়। (ড. কিরণ চন্দ্র চৌধুরী, আধুনিক ইউরােপ, পৃ. ৩১৬)।

ধর্মীয়, সংস্কার : পিটার রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের প্রধান পেট্রিয়ার্কের ক্ষমতা হ্রাস করে। সে স্থলে পবিত্র ধর্মসভা নামে একটি সভার ওপর চার্চের পরিচালনার ভার ন্যস্ত করেন। এ সভার সদস্যগণ প্রায়ই সামরিক নেতাদের মধ্য থেকে নেওয়া হতাে এবং ধর্মের সাথে এদের কোন সম্পর্ক থাকত না। তিনি গির্জার সম্পত্তি ও আয় বাজেয়াপ্ত করেন। তার এ ধর্মনীতি রুশ চার্চকে একটি সরকারি দপ্তরে পরিণত করে। 

সামাজিক সংস্কার : পিটার রাশিয়ার সমাজকে পাশ্চাত্য সমাজের অনুকরণে আধুনিক করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি সকল প্রকার মুদ্রার ওজন হ্রাস করেন এবং পরােক্ষ কর প্রবর্তন করেন। শ্মশ্রু, কফিন, মৌমাছি পালন, স্নানাগার, পােশাকের দ্রব্য, লবণ বিক্রি ও অরুশ উপজাতির বিয়ের ওপর কর ধার্য করেন। এটি স্ফিত অর্থযােগান দিতে ব্যর্থ হয়। এটি প্রত্যক্ষকর প্রদানকারী ব্যক্তি বা শ্রেণির পরিবর্তন করায়। ১৬৭৮ সালে আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক পরিবারের ওপর প্রত্যক্ষ কর ধার্য করা হত। ১৭১০ সালে নতুন একটি আদমশুমারির নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৭১৯ সালে আদমশুমারি অনুযায়ি পুরুষ কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং প্রত্যেক পুরুষের ওপর পােল ট্যাক্স ধার্য করা হয়। এটি রাজস্ব বৃদ্ধি করে যা ১৭২৪ সালে বাজেটের আয়ের শতকরা ৫০ ভাগ যােগান দেয়। এ ব্যবস্থা কর্ষণযােগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কর দিতে কৃষকদেরকে বেশি জমি চাষ করতে হয়। 

শিল্পের উন্নতি : পিটার রাশিয়ার শিল্পায়নে উৎসাহ দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের সরবরাহ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সৈন্য ও নাবিকের পােশাকের জন্য পিটার অস্ত্র-শস্ত্র ও গােলাবারুদ উৎপাদন এবং বস্ত্র বয়নের ওপর জোর দেন। কাগজ উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করা হয়। ১৭২৩ সালে পিটার একটি ডিক্রি জারি করে রাষ্ট্রের সকল বিভাগে কেবল রুশ উৎপাদিত কাগজ ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তার রাজত্বের শেষ দিকে রাশিয়ায় পশম শিল্প, লিলেন শিল্প, চামড়া শিল্প, বস্ত্র শিল্প ও অলংকার শিল্প উন্নতি লাভ করেছিল। তার সময়ে খনিজ ও ধাতু শিল্পের উন্নতি হয়। ১৬৯৫ ও ১৭২৫ সালের সময় কালে ৫২টি নতুন লৌহ কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলাে থেকে রাশিয়ার প্রয়ােজনীয় ৪০ ভাগ লৌহ আহরণ করা হতাে। রুশ কারখানার অর্ধেক ছিল রাষ্ট্র মালিকানা এবং অর্ধেক ব্যক্তি মালিকানায়। এক শতাব্দীর মধ্যে লৌহ উৎপাদনে রাশিয়া বিশ্বের মধ্যে অগ্রগামী হয়েছিল এবং রাশিয়া ইংল্যান্ডের লৌহের প্রয়ােজন মেটাত। পিটার রাশিয়ার শ্রম ও মূলধনের উন্নতি সাধন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা, বাধ্যতামূলক শ্রম এবং সংরক্ষিত শুল্কের ওপর রাশিয়ার উৎপাদন ও খনিজ শিল্পের বিকাশ নির্ভর করত। পিটার সম্পদ উন্নয়নের জন্য ব্যবসায়ী ও কোম্পানীগুলােকে মুলধন সরবরাই করত। কারখানায় শ্রমিকের অভাবের সমস্যা রাষ্ট্র সমাধান করত। কারখানায় বাধ্যতামূলক কাজ করার জন্য সকল প্রকার ভবঘুরে, বারবনিতা ও অনাথদের তালিকাভুক্ত করা হত। কম জনসংখ্যাসম্পন্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় খাস জমির কৃষকদেরকে কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হত। কারখানায় কর্মরত ভূমিদাসদেরকে তাদের প্রভু ফেরত নেয়ার দাবি করতে পারত না। রাষ্ট্র উচ্চ প্রােটেক্টিভ শুষ্ক যন্ত্রপাতি ও কাচামাল আমদানির অধিকার ও কর মওকুফ করে। শিল্প উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়। পিটার নাগরিকদের দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে শ্রেণীভুক্ত করেন। পিটার ভরিয়ান্টসভাে নামে ভূম্যধিকারী সমাজের পরিবর্তন আনেন। প্রথমে তাদেরকে বিদেশে অথবা সেন্টপিটার্সবুর্গে পিটার স্থাপিত গণিত বিদ্যালয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হতাে। কোর্স সমাপ্ত করতে ব্যর্থ যুবকদেরকে কৌমার্য গ্রহণ করতে হতাে। এরপর নবীন ভরিয়ানিনদেরকে (ভরিয়ান্টসভাের সদস্য) সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী অথবা আমলাতন্ত্রের চাকরি নিতে হতাে। হেরাল্ডমাস্টার নামে একজন কর্মকর্তা ভরিয়ানিনের ক্যারিয়ার নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি প্রত্যেক পরিবারের একটি রেজিষ্টার রাখতেন এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে সকলকে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করতেন।

উত্তরাধিকারী আইনের পরিবর্তন : পিটার রাশিয়ার উত্তরাধিকারী আইন পরিবর্তন করেন। আগে মৃত জমিদারদের জমিদারি সন্তানদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করা হতাে। এটা জমিদারিকে অলাভজনক ইউনিটে ভাগ করত। ফলে তারা কর প্রদানের ক্ষমতা হারাত। তা ছাড়া এতে মানুষের কাজের হারের অপচয় হতাে। এ অসুবিধা দূর করার জন্য পিটার ১৭১৮ সালে এন্টেল ল জারি করেন। এতে বলা হয় যে, একজন জমিদারের জমিদারি তার একজন সন্তান পাবে। সে সন্তানকে জমিদার নিজে নির্বাচন করবেন। পিটার মনে করতেন অন্যান্য সন্তানরা জমির ওপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করতে ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে চাকরি নিতে বাধ্য হবে। পিটার ১৭২২ সালে পদমর্যাদা পুনর্গটনে পরিবর্তন আনেন। এটি অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের শ্রেণি কাঠামােতে মৌলিক পরিবর্তন আনে। তখন কেবল ভরিয়ান্টসভাের সদস্যরা চাকরি করত। যদি অন্য সম্প্রদায়ের সদস্যরা চাকরি করে তা হলে তাদেরকেও অভিজাত সাম্রাজ্যভুক্ত করা উচিত। এ উদ্দেশ্যে তিনি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের সকল পদমর্যাদাকে ১৪টি সমপর্যায়ের গ্রেডে সমরিন্যাস করেন। আমলাতন্ত্রের যারা ওপর দিক থেকে ৮ম গ্রেডে পৌঁছাবে তারা অভিজাত পদমর্যাদা পাবে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে নিম্নতম কমিশন পদমর্যাদায় পৌঁছলে তারা অভিজাত, সম্প্রদায়ভুক্ত হবে। সামরিক ও অসামরিক শাখায় পদ নিম্নতম গ্রেড থেকে আরম্ভ হতাে। দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হতাে। অভিজাতরা ভূমিদাস রাখা ও পােলট্যাক্স না দেয়ার সুবিধা ভােগ করত। 

কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক সংস্কার : পিটার কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কলেজিয়াল সিস্টেম প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ৯টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রের বিষয়সমূহকে ৯টি বিভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বে থাকত একটি কলেজ। কলেজগুলাে ছিল – (১) বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগ; (২) রাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ; (৩) বিচার বিভাগ; (৪) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগ; (৫) সেনাবাহিনী বিভাগ; (৬) নৌবাহিনী বিভাগ; (৭) ব্যবসা-বাণিজ্য বিভাগ; (৮) নিষ্কাশনক্ষম শিল্প ও উৎপাদন বিভাগ; (৯) রাষ্ট্রীয় ব্যয় বিভাগ। একজন প্রেসিডেন্ট, একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং একজন বৈদেশিক উপদেষ্টার সমন্বয়ে এগার সদস্যবিশিষ্ট একটি বাের্ড দ্বারা প্রত্যেক বিভাগ শাসিত হতাে।

রাষ্ট্রীয় বিভাগ : পিটার ১৭০৭ সালে এক ডিক্রি দ্বারা রাশিয়াকে ৮টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। এই ৮টি প্রদেশ হলো – (১) ইন্সারল্যান্ড, পরে সেন্টপিটার্সবুর্গ; (২) মস্কো; (৩) কিয়েভ; (৪) স্পেলেনক্স; (৫) আৰ্চঅ্যাঞ্জেল; (৬) কাজান; (৭) আজফ; (৮) সাইবেরিয়া। ১৭১১ সালে প্রদেশের সংখ্যা ৯ এবং ১৭১১ সালে ১২তে বৃদ্ধি করা হয়। প্রত্যেক প্রদেশ একজন গভর্নর এবং ৮ থেকে ১২ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি বাের্ড দ্বারা শাসিত হতাে। গভর্নর কর্তৃক সরবরাহকৃত প্রার্থীর তালিকা থেকে সিনেট সদস্য মনােনয়ন করা হতাে। আবার প্রত্যেক প্রদেশকে কাউন্টি নামে ক্ষুদ্রতম অংশে ভাগ করা হয়। কাউন্টিসমূহ ছিল স্থানীয় প্রশাসন মৌলিক ইউনিট। একজন প্রেসিডেন্ট ও কয়েকজন কর্মকর্তা দ্বারা একটি কাউন্টি শাসিত হতাে। প্রত্যেক কাউন্টির অধীনে ছিল কয়েকটি জেলা উয়েজদ। প্রত্যেক জেলায় একজন ভূমি কমিশনার দ্বারা শাসিত হতাে। তার অনেক দায়িত্ব ছিল, এর মধ্যে প্রধান দায়িত্ব ছিল কর আদায় করা। 

পৌর প্রশাসন সংস্কার : পিটার রাশিয়ার পৌর প্রশাসনের সংস্কার করেছিলেন। ১৭২৪ সালে রাজকীয় ফরমান বলে পৌর নাগরিকদেরকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। যথা : (১) ধনী বণিক, চিকিৎসক, ঔষধ প্রস্তুতকারক, স্বর্ণকার, বাণিজ্য জাহাজের ক্যাপটেন ও চিত্রকরের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম গিল্ড; (২) ক্ষুদ্র বণিক, ব্যবসায়ী ও কারিগর নিয়ে গঠিত দ্বিতীয় গিল্ড; (৩) শহরে অন্যান্য অধিবাসী, ভাড়াটে শ্রমিক ও সাধারণ শ্রমিক সমন্বয়ে গঠিত সাধারণ জনগণ। প্রেসিডেন্ট ও কয়েকজন সদস্য নিয়ে গঠিত ম্যাজিস্ট্রেটের (সিটি কাউন্সিল) হস্তে নগর প্রশাসন ন্যস্ত করা হয়। এসব কর্মকর্তারা প্রথম দুটি গিল্ড দ্বারা নির্বাচিত হতেন। কেবল প্রথম গিল্ডের সদস্যরা সিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তা নির্বাচিত হতে পারতেন। 

গির্জার সংস্কার : পিটার রুশ গির্জাকে সংস্কার করেন। পিটার যখন সিংহাসনে বসেন তখন রুশ গির্জার পেট্রিয়ার্ক ছিলেন পেট্রিয়ার্ক জোয়ালিস ১৬৯০ সালে তার মৃত্যু হলে এড্রিয়ানকে প্রেট্রিয়ার্ক পদে স্থলাভিষিক্ত করেন। ১৭০০ সালে এড্রিয়ান মৃত্যুবরণ করলে জার প্রেট্রিয়ার্ক পদটি শূন্য রাখেন। তিনি রুশ গির্জার রক্ষক ও প্রশাসক হিসাবে স্টিফেন জ্যাকরনস্কিকে নিয়ােগ দেন। ১৭২১ সালে পেট্রিয়ার্কেট বিলুপ্ত করে পবিত্র সাইনড নিয়ােগ করেন। ১৭০১ সালে গির্জার ধর্মীয় ও মঠের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ধর্মযাজক ও মঠসমূহকে রাজস্বের কিছু অংশ ভােগ করার ব্যবস্থা করা হয়। অবশিষ্ট অর্থ সেনাবাহিনীর ব্যয় মেটানাের জন্য খরচ করা হয়। ধর্মীয় আদালতের ক্ষেত্র সীমিত করা হয়। ১৭২১ সালে চার্চ স্ট্যাটিউট দ্বারা পেট্রিয়াকেট বিলুপ্ত করা হয় এবং এটি হােলি সাইনড নামে একটি কলেজিয়াল সংস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। হােলি সাইনড অন্যান্য প্রশাসনিক বিভাগের অনুরূপ ছিল। তবে এর একটু পার্থক্য ছিল। সেটি হল ধর্মযাজক ও মঠাধ্যক্ষের মধ্য থেকে এর সদস্য নিযুক্ত করা হত। ১৭২২ সালে ডিক্রি দ্বারা হােলি সাইনডকে একজন প্রধান প্রােকিউরেটরের অধীনে দেওয়া হয়। পিটার হােলি সাইনডের সদস্য নিযুক্ত করতেন। প্রধান প্রােকিউরেটর যিনি একজন অধর্মযাজক ছিলেন, তিনি গির্জার প্রশাসনের প্রকৃত কর্তায় পরিণত হন এবং সিনেটের অধীনে হােলি সাইনড একটি সরকারি বিভাগ হিসেবে কাজ করে। ১৭২২ সালে একটি ডিক্রির মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তখন থেকে হােলি সাইনডের অনুমতি ছাড়া কোনো নতুন গির্জা নির্মাণ করা যাবে না। সে সময় মঠসমূহ ছিল কুসংস্কার আচ্ছন্ন ও দুর্নীতির কেন্দ্র। পিটার মঠগুলােকে লাম্পট্য ও নাশকতামূলক কর্মের আখরা মনে করতেন। ১৭২৩ সালে এক ডিক্রিতে বলা হয়, নতুন ধর্মযাজক নিয়ােগ করা যাবে না এবং মৃত্যুজনিত কারণে সৃষ্ট শূন্য পদ সাবেক সৈন্য দ্বারা পূরণ করা হবে। ১৭২৪ সালে এক ডিক্রি দ্বারা বলা হয় মঠের প্রধান উদ্দেশ্য হলাে অসুস্থ, বৃদ্ধ, অভাবগ্রস্ত ও অনাথদেরকে সাহায্য করা। 

শিক্ষা সংস্কার : পিটার রাশিয়ার শিক্ষা বিষয়ে নতুন ধ্যান ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি কিছু রুশকে কিছু বিষয়ে পড়াশােনা করতে বাধ্য করেন। তার শাসনকালের শুরুতে মক্কা ও কিয়েভে একটি করে ধর্মীয় একাডেমি ছিল এবং মস্কোতে একটি সাধারণ একাডেমি ছিল। তিনি রাশিয়াতে নৌবিদ্যা, কামান বিষয়ক বিদ্যা, অর্থনীতি, ভাষা ও প্রকৌশল জ্ঞান শিক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। তিনি মস্কো ও পিটার্সবুর্গে কতগুলাে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাম্রাজ্যব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করেন। ১৭১৪ সালে প্রত্যেক প্রদেশকে দুটি করে গণিত স্কুল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। ১৭২২ সালে বিয়াল্লিশটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত ও পরিচালিত স্কুলগুলাের সাথে অন্যান্য স্কুল আত্তীকরণ করা হয়। পিটারের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার ঘটে নি। এর কারণ ছিল ধর্মযাজকদের সন্তানদের জন্য ১৭২১ সালে থেকে গির্জা কর্তৃক পুনর্গঠিত একটি সংকীর্ণ স্কুল ব্যবস্থা। যারা গণিত স্কুলে যেত গির্জা স্কুল তাদের অনেককে আকর্ষণ করে। এটি কেবল একটি অপেশাগত স্কুল ছিল। মেরিয়ানবর্গের লুথারপন্থী প্যাস্টর গ্লুক মস্কোতে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাচ্য ও ইউরােপীয় ভাষা, সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র, দর্শন, অশ্বারােহণ বিদ্যা, শিষ্টাচার ও শালীনতা। সকল শিক্ষক ছিলেন বিদেশী। ১০ বছরের মধ্যে এর ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পায়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পিটার রাশিয়ার বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বার্লিনের কোনিগলিন প্রেসিস একাডেমি ও লন্ডনের রয়াল সােসাইটির অনুকরণে এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথমে এর সকল প্রফেসর, ফেলাে ও তাদের ছাত্রদেরকে জার্মানি থেকে আনা হতাে। কিন্তু পরে এটি একটি রুশ প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।

ক্যালেন্ডার ও বর্ণমালার সংস্কার : পিটার ১৭০০ সালে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে বর্ষপঞ্জি পূনঃর্গঠন করেন। এরপর থেকে রাশিয়া পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকে গণনা করে যিশু খ্রিষ্টের জন্ম থেকে সন তারিখ গণনা করে। তিনি প্রাচীন সিরিলিক বর্ণমালার অক্ষরের সংখ্যা হাস করে ও অবশিষ্ট বর্ণগুলােকে ল্যাটিন মডেলের কাছাকাছি এনে এ বর্ণমালার পুনর্গঠন করেন। তিনি প্রথম রুশ সংবাদপত্র প্রকাশ করেন এবং জরুরি ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রযুক্তিক গ্রন্থের অনুবাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি মস্কোর রেড স্কয়ারে প্রথম নাট্যানুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। তিনি বাধ্যতামূলকভাবে মহিলাদের অবরুদ্ধতার অবসান ঘটান এবং তিনি এসেমব্লিসের ব্যবস্থা করেন। এখানে অভিজাতরা সস্ত্রীক একে অপরের সাথে আড্ডা, নাচ ও নাস্তা দ্বারা আপ্যায়ন করে অবাধে মেলামেশা করত। 

পিটারের চরিত্র : পিটার ছিলেন অসাধারণ চরিত্রের মানুষ। তবে তার ক্রোধ ছিল অনিয়ন্ত্রিত। তিনি সাধারণ শিষ্টতা পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী। রাষ্ট্রের সকল কাজ নিজ হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার পরিণত সকল আইন নিজ হাতে লিখতেন। মন্ত্রীর স্বাক্ষরে প্রেরিত সকল কূটনৈতিক চিঠিপত্র তিনি বারবার পড়তেন। একই দিনে অসংখ্য প্রশ্নের সমাধানে তার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল। তিনি অন্তরে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তা পরিবর্তন হতাে না। তার কাছে মানুষের জীবন ছিল অর্থহীন। তিনি রাশিয়া কর্তৃক বােথনিয়া উপসাগরের দখলকৃত এলাকায় তিনি রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল তিনি যাতে প্রতিদিন নৌবাহিনী দেখাশোনা করতে পারেন। সেন্টপিটার্সবুর্গ প্রথম ছিল এটি জলাভূমি। এটিকে তিনি একটি মনােরম রাজধানীতে পরিণত করেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাজার হাজার মানুষের শ্রম, জীবন এবং অগণিত সম্পদ ব্যয় হয়েছিল। পিটার তার সহকর্মীদের খুব গুরুত্ব দিতেন আবার অনেক সময় তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করতেন। তিনি ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। তার একান্ত সহচরদের ঘুষি ও ভারী লাঠি দ্বারা আঘাত করতেন। উচ্চ-নিম্ন সকল শ্রেণির মানুষকে চাবুক দ্বারা আঘাত করতেন। তিনি ছিলেন আবেগপ্রবণ ও নিষ্ঠুর। তিনি তার প্রথম জীবনের উপপত্নী অ্যানি মেন্সকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। তার রানী জারিণা ক্যাথারিনের সহচরী মেরিয়া হেবিলটনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন কারণ সে তার সদ্য প্রসূত শিশুকে হত্যা করেছিল। পিটারের সংস্কার সমর্থন না করায় নিজপুত্র ও উত্তরাধিকারী জারেভিচ আলেক্সিমকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। ১৭১৯ সালে পল দুর্গে পিটার তাকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করেন যার ফলে তার মৃত্যু হয়। 

পিটারের পররাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন

পিটার দ্য গ্রেট ইউরােপীয় রাজনীতিতে রাশিয়াকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণসাগর, বাল্টিক সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে রুশ নৌবহরের অবাধ প্রবেশের জন্য পরিকল্পনা করেন। এজন্য তার বৈদেশিক নীতিকে উষ্ণ জলনীতি ও পশ্চিমে জানালা উন্মুক্ত করা নীতি নামে অভিহিত করা হয়। পিটারের বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নের পথে তুরস্ক, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড এবং সুইডেন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ বাল্টিক সাগর ছিল সুইডেনের দখলে এবং কৃষ্ণসাগর ছিল তুরস্কের দখলে। 

আজফ বন্দর দখল : পিটার তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগে কৃষ্ণসাগর উপকূলে আজফ বন্দর দখল করার পরিকল্পনা করেন। আজফ বন্দরের বিরুদ্ধে পরিচালিত দুটি অভিযানের সাথে পিটারের সামরিক জীবন আরম্ভ হয়। ১৬৯৫ সালে আজফ দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৭৯৬ সালে নৌবাহিনীর সাহায্যে আজফ বন্দর পিটার দখল করেন। আলােচনার পর ১৭০০ সালে স্বাক্ষরিত এক সন্ধির দ্বারা  তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় মুস্তফা (১৬৯৫-১৭০৩) রাশিয়াকে আজফ বন্দর ছেড়ে দেয়। 

সুইডেনের সাথে যুদ্ধ : আজফ বন্দর অধিকারের পর পিটার সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। এ উদ্দেশ্যে সুইডেনের বিরুদ্ধে ১৬৯৯ সালে রাশিয়া, পােল্যান্ড ও ডেনমার্ক সমন্বয়ে একটি গােপন কোয়ালিশন গঠন করেন। ডেনমার্ক ও পােল্যান্ড প্রথম যুদ্ধ শুরু করে। পােল্যান্ড সুইডেনের অধীনস্ত রিগা দখল করতে ব্যর্থ হয়। সুইডেন ডেনমার্ককে পরাজিত করে। এরপর রাশিয়া সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ১৭০০ সালে ২০ নভেম্বর নার্ভাতে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পিটার পলায়ন করে জীবন রক্ষা করেন। সুইডেন সৈন্যবাহিনী অনেক রুশ জেনারেলকে গৃহবন্দি করে ও প্রচুর গােলাবারুদ দখল করে। এরপর পিটার হতাশ না হয়ে সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করেন। ইতােমধ্যে পােল্যান্ডের রাজা অগাস্টাসের (১৬৯৭-১৬০৬) বিরুদ্ধে সুইডেনরাজ দ্বাদশ চার্লস (১৬৯৭-১৭১৮) ব্যস্ত থাকায় পিটার সামরিক শক্তি পুনর্গঠনের সুযােগ পান। দ্বাদশ চার্লস পােল্যান্ডের সিংহাসনে লেওসিনস্কিকে বসান। সুইডেনের সেনাবাহিনী অন্য জায়গায় ব্যস্ত থাকায় পিটার লিভোনিয়া ও ইনিগ্রয়া দখল করেন এবং সেখানে ১৭০৩ সালে মে মাসে সেন্টপিটার্সবুর্গ নগর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭০৭ সালে শেষের দিকে সুইডেন রাজ দ্বাদশ চার্লস রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করেন এবং গ্রোডনাে দখল করেন। এরপর সুইডেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ায় প্রবেশ করে মুগিলেভ দখল করে। সুইডেন রাজ দ্বাদশ চার্লস রাশিয়া অভিমুখে অগ্রসর না হয়ে লিভােনিয়া থেকে জেনারেল লােরেন হপ্টের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু পথে রুশবাহিনী লােরেন হপ্টকে পরাজিত করে। এই দুরবস্থায় দ্বাদশ চার্লস দক্ষিণ দিকে ইউক্রেনে অবস্থিত হন এবং ইউক্রেনের জেনারেল মাজেপার সাথে একটি চুক্তি করেন। ১৭০৯ সালে চার্লস পিটারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৭০৯ সালে ২৭ জুন রুশবাহিনী পােলটোভাতে সুইডিশ বাহিনীকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করে। রুশরা দুই হাজার সুইডিশ সৈন্যকে বন্দি করে এবং চার্লস নিজে আহত হন। চার্লস ও মাজেফা তুরস্কে পালিয়ে যান এবং ১৭০৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মাজেফা মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে বাল্টিক সাগরে রুশ প্রাধান্য স্থাপিত হয়। দ্বাদশ চার্লস তুরস্কে আশ্রয় লাভ করলে পিটার তুরস্কের সাথে যুদ্ধ না করে মিত্র সংগ্রহে মনােনিবেশ করেন। ইতােমধ্যে চার্লসের আশ্রিত পােল্যান্ডের রাজা লেজসিনস্কি নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে পােসেরানিয়া পালিয়ে যান এবং বৈধ রাজা অগাস্টাস পােল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। ১৫০৯ সালে অক্টোবর মাসে পিটার পােল্যান্ডের রাজা অগাস্টাসের সাথে এক চুক্তি করেন। অক্টোবরে সুইডেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও ডেনমার্কের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর পিটার প্রাশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডারিকের (ডিউক ১৬৮৮-১৭০১, রাজা ১৭০১-১৭১৩) সাথে একটি আত্মরক্ষামূলক চুক্তি করেন। ইতােমধ্যে বাল্টিক উপকূল ও ফিনল্যান্ডে সুইডেনের সাথে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৭১০ সালে রাশিয়া ভিবাের্গ, রিগা, রেভাল ও অন্যান্য শহর দখল করে।

তুর্কিদের সাথে যুদ্ধ : সুইডেন রাজ দ্বাদশ চার্লস তুরস্কে অবস্থান করায় পিটার তুরস্ক সুলতানকে বলেন যে, চার্লসকে যেন তুরস্ক থেকে বিতাড়িত করা হয়, নতুবা যুদ্ধ অনিবার্য হবে। তুর্কি সুলতান তা অগ্রাহ্য করলে পিটার তুরস্কের অধীন খ্রিস্টান অধ্যুষিত মলডাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া খ্রিস্টান গভর্নরদের সাথে এক গােপন চুক্তি করেন। স্বাধীনতার বিনিময়ে তারা পিটারকে সাহায্য করতে রাজি হয়। ১৭১১ সালের প্রথম দিকে পিটার ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে তুরস্কে আক্রমণ করেন। তুর্কি বাহিনী রুশ বাহিনীর মােকাবেলা করে। এ অবস্থায় পিটার তুরস্কের সাথে সন্ধি প্রার্থনা করেন। ১৭১১ সালে ১১ জুলাই রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এ সন্ধি অনুযায়ী আজফ বন্দরটি তুরস্ককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। দ্বাদশ চার্লস যুদ্ধে পরাজিত হলেও পিটারের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৭১৩-১৪ সালে রুশ সৈন্যবাহিনী সুইডেন অধিকৃত ফিনল্যান্ড দখল করে। ১৭১৪ সালে ২৫ জুন হ্যানগুডে রুশ সেনাবাহিনী সুইডিশ নৌবাহিনীকে পরাজিত করে অল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে। রুশ সেনাবাহিনী স্টকহােমের ১৫ মাইলের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়। রুশ সেনাবাহিনী সুইডেনের জার্মান প্রদেশসমূহ দখল করে। হামবুর্গ ও লিউবেক থেকে রুশরা প্রচুর অর্থ লাভ করে। ১৭১১ সালে রুশ বাহিনী সুইডেনে প্রবেশ করে সুইডেনের উপকূল ধ্বংস করে। রুশ অগ্রগামী কসাক বাহিনী স্টকহােমের দুই মাইলের মধ্যে অবস্থিত হয়। এদের মধ্যে চার্লস মৃত্যুবরণ করলে সুইডেন রাশিয়ার সাথে নিস্টাডাটের সন্ধি স্বাক্ষর করে। ১৭২১ সালে ৩০ আগস্ট স্বাক্ষরিত এ সন্ধির মাধ্যমে রাশিয়া লিভোনিয়া, ইস্তোনিয়া, ইনিগ্রয়া ও কেরেলিয়ার একাংশ এবং ভিভোর্গ নগর ও জেলা এবং ওসেল ও ডাগাে দ্বীপ দখল করেন। এসবের বিনিময়ে সুইডেন ফিনল্যান্ড ফিরে পায় এবং দুই মিলিয়ন ওলন্দাজ টালার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। সুইডেনের পরাজয়ের ফলে রাশিয়া উত্তর ইউরােপের শ্রেষ্ঠশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

পিটার দূরপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছিলেন। ১৬৮৯ সালে চীনের সাথে একটি চুক্তি করে রেশম ও সূক্ষ্ম পশমের বাণিজ্য উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সুদূর উত্তরে কামচাটকা পর্যন্ত রুশ সীমান্ত প্রসারিত করেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কুরিলকে রুশ ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় কিভ ও বােখারা নামে দুটি মুসলিম অধ্যুষিত মুসলিম ভূখণ্ড দখল করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এতে ব্যর্থ হন। 

পিটার পারস্য- ও কাস্পিয়ান উপকূলে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পারস্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, ভারতে যাওয়ার একটি পথ বের করার সম্ভাবনা যাচাই এবং আর্মেনিয় রেশম ব্যবসার তুরস্কের মধ্য দিয়ে পথবন্ধ করে সেন্টপিটার্সবুর্গের ভিতর দিয়ে পথকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে, পিটার ১৭১৫ সালে তার দূত ভােলিনস্কিকে ইস্পাহানে পাঠান। ভােলিনস্কি একটি বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করেন যা রুশ বণিকদেরকে পারস্যের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার সুযােগ করে দেয়। পিটারের প্রেরিত দূত পারস্যের দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে পিটারকে পারস্য আক্রমণে উৎসাহিত করেছিলেন। এ সময় পিটার উত্তরে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় পারস্য আক্রমণ করতে পারে নি। ১৭২২ সালে পারস্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পারস্যের শাহ দ্বিতীয় তাহমাস্পকে (১৭২২-১৭৩২)  সাহায্য করার অজুহাতে পিটার ভল্গানদী দিয়ে নৌবাহিনী নিয়ে অস্ত্রখানে অবতরণ করেন। রাশিয়া ডেররেন্ট, বেস্ট ও বাকু দখল করে। পরে পারস্যের সাথে শান্তিচুক্তি হয়। এ সন্ধির দ্বারা রাশিয়া এসব বন্দর ও কাস্পিয়ান সাগরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি পারস্য প্রদেশ দখল করে নেয়। পিটারের উদ্দেশ্য ছিল এ সকল অঞ্চলে দুর্গ স্থাপন করে খ্রিস্টান বসতি স্থাপন করা এবং মুসলমানদেরকে নির্বাসন দেওয়া। এ সকল অঞ্চলে খনিজ দ্রব্য আহরণের জন্য সার্ভে করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পিটারের মৃত্যুতে এ সকল পরিকল্পনা বাতিল হয় এবং নব অধিকৃত প্রদেশসমূহকে অস্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করা হয়। 

পিটারের কৃতিত্ব : পিটার রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় তন্দ্রা থেকে জেগে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার চেষ্টায় রাশিয়া ইউরােপের রাজনীতিতে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতির দিক দিয়ে ভবিষ্যতে রাশিয়া কোন পথে চলবে সে ইঙ্গিত তিনিই দিয়ে গিয়েছেন। আধুনিক রাশিয়ার ভিত্তি স্থপতি হিসেবে রাশিয়া তথা ইউরােপের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। পিটার যখন রাশিয়ার জার পদ লাভ করেন তখন রাশিয়া ছিল অসংহত এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ রাষ্ট্র এবং এটি সুইডেন, পােল্যান্ড ও তুরস্কের আক্রমণের শিকার ছিল। তিনি রাশিয়াকে একটি শক্তিশালী ও সুসংহত রাষ্ট্র হিসেবে রেখে যান, যা তখন উত্তর ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পিটারের পূর্বে ইউরােপের রাজনীতিতে রাশিয়া একটি নগর রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু পিটার তাকে সম্মান ও ক্ষমতার অবস্থানে উন্নীত করেন। তখন থেকে বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি রাশিয়া এশিয়াকে অর্ধবর্বর অবস্থা থেকে প্রগতিশীল ও আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন সংস্থার প্রবর্তন করেন। রাশিয়ার জনগণ রক্ষণশীল মনােভাবাপন্ন হওয়ায় তিনি স্বৈরাচারী নীতি গ্রহণ করে প্রশাসনকে সংঘটিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী ও জ্ঞানদীপ্ত শাসক। তিনি তার স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী শাসনকে  জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন। তার বৈদেশিক নীতি ছিল সাফল্যমণ্ডিত। তার শক্তিশালী বৈদেশিক নীতির জন্য রাশিয়া বাল্টিক সাগরে আধিপত্য পায় এবং রাশিয়া পাশ্চাত্যের সাথে যােগাযােগের সুবিধা লাভ করে। এর দ্বারা পাশ্চাত্য সভ্যতা দ্বারা রাশিয়া আলােকিত হয় এবং উন্নতি লাভ করে। 

মহান দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬২-১৭৯৬)

আধুনিক রাশিয়ার উন্নয়নের পশ্চাতে যে সকল শাসনে অবদান রয়েছে দ্বিতীয় ক্যাথারিন (Catherine Il, the great) তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক রাশিয়ার স্থপতি পিটার রাশিয়াকে আধুনিকায়নে এবং ইউরােপের মধ্যে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলার এন্য যে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ক্যাথারিন তাকে পূর্ণতা দান করেন। এজন্য ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, “While Peter had worked but road little and never thought, catherine did all three.” (By birth she was not ever a Russian, but a Princess of Protestant Germany whom dynamic Consideration made the wife of the heir to the Russian crown, Hayes p, 380.)। ক্যাথারিন রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করে রাশিয়াকে আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে ক্যাথারিন ছিলেন পিটারের যােগ্য শিষ্যা। পিটারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি নিজের ক্ষমতাকে সর্বাত্মক করে তুলেছিলেন। এটি ভিন্ন পশ্চিম ইউরােপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি রুশ জাতির মধ্যে যাতে বিস্তার লাভ করতে পারে সেজন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না। ইউরােপের স্বৈরতান্ত্রিক যুগের ইতিহাসে রাশিয়ার ক্যাথরিন নিঃসন্দেহে একজন উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একাধারে জনদরদী, অপরদিকে স্বৈরাচারী ছিলেন। এজন্যই তাকে বলা হত ‘জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী‘। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তিনি পিটারের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছিলেন। পিটার বাল্টিক ও কৃষ্ণসাগরের পথে পশ্চিম ইউরােপের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের ইচ্ছুক ছিলেন। পিটার বাল্টিক সাগর উপকূলে রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন কিন্তু কৃষ্ণসাগরের তীরে তার সকল প্রচেষ্টা বিফল হয়েছিল। ক্যাথারিন পিটারের এই অসমাপ্ত কার্য সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করে রাশিয়াকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ক্যাথারিনের অন্যতম নীতি ছিল। 

অভ্যন্তরীণ নীতি

ক্যাথারিন ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক। জার্মানিতে তার জন্ম হলেও রাশিয়াতে বিয়ের পর তিনি একজন সত্যিকার রুশ দেশপ্রেমিকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি রাশিয়ার ভাষা, পােশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার সবকিছু গ্রহণ করে রুশ দেশীয় মহিলায় পরিচিত হয়েছিলেন। রাশিয়ার জাতীয় জীবনে আদর্শ তিনি রুশদের অপেক্ষা অধিকতর নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করেছিলেন। তিনি বিবেক বর্জিত হলেও তিনি আশ্রিতদের প্রতি দয়া, বিদ্বান ও বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। শাসনকার্যে কোনাে রকম মানসিক দুর্বলতা তিনি কখনাে দেখাননি। যখন যে রূপ কঠোর হওয়া প্রয়ােজন তখন সেরূপ ব্যবহার করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ক্যাথারিন স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে প্রসিদ্ধ অর্জন করেছিলেন। তবে তার স্বেচ্ছাচারিতা ছিল রাশিয়ার স্বার্থে। রাশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তিনি সংস্কারমূলক নীতি তার করে রাশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনকে উন্নত করতে চেয়ে ছিলেন। 

শাসন ব্যবস্থার সংস্কার : ক্যাথারিন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য সমগ্র দেশিকে ৪৪টি প্রদেশে ভাগ করেন। প্রদেশগুলােকে আবার জেলায় বিভক্ত করা হয়। প্রদেশ ও জেলা কর্মচারীদেরকে ক্যাথারিন নিজে নিয়ােগ দিতেন। স্বৈরশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করলও তিনি প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলাকে সহ্য করতেন না। শাসন ব্যবস্থা বিন্যাসের জন্য তিনি একটি কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ গঠন করেছিলেন এবং শাসন পরিচালনায় তিনি অভিজাত শ্রেণীর সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা তার হাতেই ন্যস্ত ছিল। 

আইন সংস্কার : ক্যাথারিন দেশের আইন-কানুন একত্রে সন্নিবদ্ধ করে প্রকাশ করার প্রয়ােজন বােধে সেগুলাের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য তিনি একটি বিশেষজ্ঞ সমিতি স্থাপন করেছিলেন। এর দ্বারা প্রচলিত আইনের শাসন নিশ্চিত করা হয় এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়ােগ নিশ্চিত করা হয়। 

ধর্মীয় সংস্কার : ক্যাথারিন গির্জাকে রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং গির্জার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করেন। তিনি পেট্রিয়ার্ককের বিশেষ সুযােগ-সুবিধা রহিত করেন। গির্জা রাষ্ট্রীয়করণের ফলে তিনি একাধারে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় বিভাগে প্রধান শাসকে পরিণত হন। 

অর্থনৈতিক সংস্কার : ক্যাথারিন কৃষি, শিল্প-কারখানা স্থাপন ও বাণিজ্য সংস্কার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি মার্কেনটাইল নীতি অনুসরণ করে। বিদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক ধার্য করে দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষিত করেন। তিনি যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিসাধন করে আন্তঃপ্রাদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সাধন করেছিলেন।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎসাহ দান : রাশিয়ায় পাশ্চাত্যের শিক্ষা বিস্তারের জন্যও ক্যাথারিন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সেন্টপিটার্সবুর্গকে সাহিত্য, শিল্পকলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এনসাইক্লোপিডিয়ার আদি প্রণেতা ফরাসি দার্শনিক ও লেখক দিদেরোকে তার সভায় সাদরে আমন্ত্রণ করেছিলেন। ক্যাথারিন রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে রুশ নাগরিকদের শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন।  

জনহিতকর কার্যাবলি গ্রহণ : জনদরদি ক্যাথারিন জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য রাশিয়ার প্রধান প্রধান শহরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ইম্পিরিয়াল মেডিকেল কমিশন গঠন করেছিলেন। তবে ক্যাথারিনের অভ্যন্তরীণ নীতি সমালােচনার উর্ধ্বে ছিল না। তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক হলেও কৃষকদের উন্নতির জন্য কোনাে চেষ্টা করেন নি। স্কুল স্থাপন করে জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তােলার চাইতে বহির্জগতে খ্যাতি বৃদ্ধি তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। তবুও তার নীতিগুলাে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে এনেছিল।

পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্র বিষয়ে ক্যাথারিন পিটারের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করেছিলেন। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম ইউরােপের রাজনীতিতে রাশিয়াকে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। কৃষ্ণসাগরের তীরে রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার করে পশ্চিম ইউরােপের সাথে যােগাযােগের নতুন পথ উন্মুক্ত করতে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। তুরস্কের অনেক অঞ্চল অধিকার, পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ ক্যাথারিনের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল।  

প্রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক : প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট বা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (১৭৪০-১৭৮৬) নিজ স্বার্থে ক্যাথারিনকে রাশিয়ার তৃতীয় পিটারের (১৭৬২) সাথে বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় বসে ক্যাথারিন প্রাশিয়ার সাথে পূর্বেকার মিত্ৰতা চুক্তি নাকচ করেন। অবশ্য, পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ ও অন্যান্য সামরিক প্রয়ােজনে তিনি পরে প্রাশিয়ার সাথে মিত্রতা বজায় রেখে চলছিলেন। প্রাশিয়ার প্রভাবে ক্যাথারিন ইঙ্গ-আমেরিকান যুদ্ধে (১৭৭৫-১৭৮৩) ইংল্যান্ডকে সাহায্য করেন।

পােল্যান্ডের প্রতি অনুসৃত নীতি : ক্যাথারিন পােল্যান্ডের দুর্বলতার সুযোগে সেখানে আধিপত্য স্থাপনে মনােযােগী হন এবং ১৭৬৩ সালে পােল্যান্ডের রাজা তৃতীয় অগাস্টাসের মৃত্যু হলে নিজ মনােনীত প্রার্থী স্টেনিস্‌ল্যস পােনিয়াটস্কিকে পুনরায় সিংহাসনে স্থাপন করেন। পােল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার সুযােগ নিয়ে তিনি পােল্যান্ড রাজ্য আত্মসাৎ করার জন্য প্রাশিয়ার ফ্রেডারিকের সাথে এক গােপন চুক্তি করেন। ১৭৭২ সালে প্রথম পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ডুইনা নদী থেকে নিপার নদীর মধ্যবর্তী সকল স্থান অধিকার করেন। ১৭৯৩ সালে তিনি দ্বিতীয় পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ‘লিটল রাশিয়া’ পূর্ব পােল্যান্ড, মিঙ্কস দখল করেন। পােল্যান্ডের যে অংশটুকু তখনাে অবশিষ্ট ছিল সেখানে এক বিদ্রোহ দেখা দিলে ১৭৯৫ সালে ক্যাথারিন তা কঠোর হস্তে দমন করেন এবং ঐ বছরই তৃতীয় এবং শেষবার পােল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ করা হয়। এবার রাশিয়া গ্যালিশিয়া ও ডুইনার মধ্যবর্তী সকল স্থান লাভ করে।

তুরস্কের প্রতি অনুসৃত নীতি : ক্যাথারিনের অন্যতম কৃতিত্ব ছিল পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তুরস্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করা এবং তুরস্কের অধীনস্ত স্থান দখল করে রাশিয়ার সীমানা বৃদ্ধি করা। পােল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তুরস্কের রাজ্য ছিল, ফলে পােল্যান্ডে রাশিয়ার প্রভাব তুরস্কের ভীতি সৃষ্টি করেছিল। ফ্রান্স তুরস্ককে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইন্ধন দিলে তুরস্ক যুদ্ধ ঘােষণা করে কিন্তু পরাজিত হয়ে ১৭৭৪ সালে কুসুককেইনারজি সন্ধি স্থাপন করে। এই সন্ধির শর্তানুসারে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে আজফ বন্দরটি লাভ করে এবং বসফোরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী দিয়ে ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্য জাহাজ প্রেরণের অধিকার লাভ করে এবং রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধীনে সকল গ্রিক চার্চের স্বার্থরক্ষার অধিকারও লাভ করে। এই ধর্মীয় সুবিধা লাভ করে রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুযােগ পায় এবং ভবিষ্যতে ক্রিমিয়া দখল করার সুযােগ লাভ করে। প্রাচ্য সমস্যার সূত্রপাতে এই সন্ধির গুরুত্ব ছিল। ১৭৮৩ সালে ক্যাথারিন ক্রিমিয়া দখল করা এবং তুরস্ক সাম্রাজ্য ভাগ করে নেয়ার জন্য পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফের (১৭৬৫-১৭৯০) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ১৭৮৭ সালে ক্যাথারিন তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। কিন্তু দ্বিতীয় জোসেফের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় লিওপােল্ড (১৭৯০-১৭৯২) পবিত্র রোমান সম্রাট হন। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার আগ্রাসীনীতি রােধ করার জন্য হল্যান্ড, প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ড অষ্ট্রিয়াকে ভীতি প্রদান করে। ফলে দ্বিতীয় লিওপােল্ড যুদ্ধ ত্যাগ করেন। ক্যাথারিন আরাে কিছুদিন একাকী যুদ্ধ চালিয়ে ১৭৯২ সালে জাসির সন্ধি দ্বারা যুদ্ধের অবসান ঘটান। এ সন্ধির দ্বারা রাশিয়া গুচাকভ বন্দর লাভ করেন।

ক্যাথারিন পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে শক্তিশালী নীতি অনুসরণ করে আজফ, ইউক্রেইন ও ক্রিমিয়া অধিকার করে রাশিয়ার রাজ্য সীমা বৃদ্ধি করেছিলেন। তবে ক্যাথারিনের পররাষ্ট্রনীতিও সমালােচনার উর্ধ্বে ছিল না। তিনি তুরস্ক গ্রাস নীতি অনুসরণ করে প্রাচ্য সমস্যার সৃষ্টি করেছিলেন। পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ করে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কাজ করেছিলেন। রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়ার মধ্যবর্তী একটি নিরপেক্ষ দেশ বিনষ্ট করে তিনি নানা প্রকার জটিলতার সৃষ্টি করেছিলেন।

কৃতিত্ব বিচার : দ্বিতীয় ক্যাথারিন ছিলেন একজন পরাক্রমশালী রাজ্ঞী। তার অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নে রাশিয়া ইউরােপে একটি শক্তিশালী, আগ্রাসী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তিনি মহান পিটারের উত্তরসূরি ছিলেন। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং দর্শন ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তার রচিত জীবনস্মৃতি, নাটক প্রভৃতি তার সাহিত্য চর্চার নিদর্শন। ভলতেয়ার, দিদেরাে প্রমুখ ফরাসি মনীষীদের সাথে তার পত্রালাপ ছিল। তার রাজত্বকালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়। তিনি নিষ্ঠুর ছিলেন এবং সম্ভবত ক্ষমতা লাভের জন্য স্বীয় স্বামী তৃতীয় পিটারকে হত্যা করেন। তবুও আমরা মােট লাভের দিক দিয়ে বিচার করলে বলতে পারি যে, রাশিয়ার সীমা ও শক্তি বৃদ্ধি করে ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়াকে তিনি আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এটা স্বীকার করতেই হবে যে, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতেও তিনি ছিলেন পিটারের সুযােগ্য অনুগামিনী। 

কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনােত্তর যুগে মােঙ্গলদের ইতিহাস

কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই অঞ্চলের ওপর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে স্থানীয় তুর্কী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার উচ্চাভিলাষী যুবকদের মধ্যে এক প্রবল প্রতিযােগিতা শুরু হয়। ফলে মধ্য-এশিয়া ও রাশিয়ায় (ভল্গা নদী ও কৃষ্ণসাগরীয় অববাহিকা অঞ্চল) কয়েকটি স্বাধীন তাতার রাজ্যের সৃষ্টি হয়। তাতাররা ছিল একটি তুর্কীভাষী জনগোষ্ঠী। এদের রাজ্যগুলোর মধ্যে কাজান (১৪৩৭-১৫৫৭ খ্রি.), অস্ত্রাখান (১৪৬৬-১৫৫৬ খ্রি.) ও ক্রিমিয়া (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

কাজানের তাতার বংশ (১৪৩৭-১৫৫৭ খ্রি.):  ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ মােহাম্মদ (কিপচাক – ১৪১৯-২৩, ১৪২৮-৩৭, কাজান – ১৪৩৮-৪৫)  কাজানের তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাতু খানের (১২২৭-১২৫৫) বংশধর ছিলেন। কাজান রাজ্যটি ভরা নদী অববাহিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অতি প্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মোঙ্গলদের হাতে এই অঞ্চল পতনের পূর্বে কাজান বুলগেরিয়ার অধীনে ছিল। কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনের পর কাজানে এই নতুন তাতার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউকের কাছে এটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বংশের মধ্যে মুহম্মদ আমীন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তার আমলে কাজান উন্নতির শীর্ষ শিখরে আরােহণ করে। তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে নিয়মিত কর আদায় করতে সক্ষম হন এবং সাফল্যের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী স্লাভ রাজ্যগুলো আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ আমীনের মৃত্যুতে এই বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ অস্ত্রাখান ও ক্রিমিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই প্রতিবেশী রাজ্য দুটির সাথে কাজানের শত্রুতা লেগেই থাকত। কিন্তু তবুও ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে সাহিব গিরাই খানের নেতৃত্বে কাজানের তাতারগণ সাফল্যের সঙ্গে মস্কো আক্রমণ করেন। এসময় বিশেষ রাজনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে তিনি ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের (১৪৪৪-১৪৪৬, ১৪৫১-১৪৮৬) সাথে মিত্ৰতা স্থাপন করেন। কিন্তু জার ইভানের (১৭৬২-১৭০৫) আমলে রাশিয়া বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তিনি কাজানের ওপর নিজ প্রাধান্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর হন। প্রথমত তিনি কাজানে একজন রাশিয়াপন্থী তাতার খানকে গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ কাজানের তাতার অধিবাসীগণ মুসলমান হওয়ায় তুরস্কের অটোমান সুলতানের প্রতিই তাদের আন্তরিক আনুগত্য ছিল। সুতরাং ইভান সরাসরি কাজান অধিকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলে কাজান শহরটি ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার অধীনস্ত হয়। এবং একজন রাশিয়াপন্থী খানকে কাজানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে কাজান দখল করতে রাশিয়ার প্রায় আরও পাঁচ বছর সময় লাগে এবং ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে কিপচাক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী কাজানের তাতার রাজ্য স্থায়ীভাবে রাশিয়ার পদানত হয়। রাশিয়া কর্তৃক কাজানের তাতার রাজ্য অধিকারের পরবর্তী ইতিহাস বড়ই করুণ ও হৃদয়বিদারক। কারণ তখন থেকে পরবর্তী দুইশত বছরব্যাপী এই অঞ্চলের তাতার মুসলমানদের ওপর রাশিয়ার খ্রিস্টান শক্তি ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক অকথ্য অত্যাচার চালায়। তাতারগণ অবশ্য রাশিয়ার জারদের এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করেনি। ১৬শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তারা অন্তত দশবার প্রবল বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। সর্বস্তরের তাতার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যােগদান করে। কিন্তু প্রতিবারই এই বিদ্রোহ চরম নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহ রক্তপাতের মাধ্যমে দমন করা হয়। জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিনের (১৭৬২-১৭৯৬) আমলে অবশ্য কাজানের তাতারদের ওপর থেকে এই অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত হয়। তিনি তাতার মুসলমানদেরকে বিশেষ ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রদান করেন। ফলে রাশিয়ার জার শাসনের সাথে তাতার মুসলমানগণ বহু ক্ষেত্রে সহযােগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। কিন্তু ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সেনাবহিনী মধ্য এশিয়া জয় করলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুশ খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অসহিষ্ণুতা আবার প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ১৯শ শতাব্দীব্যাপী প্রায় দুই লক্ষ তাতার মুসলমানকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। (জি. হ্যাম্বলি : Central Asia. লন্ডন, ১১৬১-শীর্ষক গ্রন্থের “The Tatars of Kazan Under Russian Rule”-আলোচনাটি দ্রষ্টব্য: পৃ: ১৮৭-১৯২)। ২০শ শতাব্দীর শুরু থেকে কাজানের তাতার জাতির মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। আবু নাসার খুসাভি ও আবুল কাইয়ুম নাসারি প্রমুখ ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে এক ব্যাপক গণচেতনার সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা বর্জন করে তাতারগণ আধুনিকতা ও প্রগতির পথে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও গড়ে ওঠে। রাশিয়ার বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা অধিকার করলে কাজান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের তাতার মুসলমানদেরকে বিশেষ অধিকার প্রদান করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসবাসকারী এই তাতার মুসলমানগণ ক্রমাগতই তাদের পূর্বেকার জাতীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে প্রবল রুশিকরণ নীতির প্রভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে।

অস্ত্রাখানের তাতার বংশ (১৪৬৬-১৫৫৬ খ্রি.) : ১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ বিন কুচুক (কিপচাক – ১৪৫৯-৬৫, অস্ত্রাখান – ১৪৬৫-৬৬) বা তার পুত্র প্রথম কাসিম (১৪৬৬-১৪৯০) অস্ত্রাখানের তাতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মতো তার পিতা  কুচুক খানও (১৪৩৩-১৪৫৯) কিপচাক শাসক ছিলেন, যিনি কিপচাক শাসক উলুঘ খানের পর কিপচক শাসক হয়েছিলেন। আর পিতার পর ১৪৬৫ সালে তিনিই কিপচাক শাসক হন, তবে পরে তিনি নিজ ভ্রাতা আহমেদ খান বিন কুচুকের (১৪৬৫-১৪৮১) কাছে কিপচাকের শাসন ক্ষমতা হারান ও অস্ত্রাখান খানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এমনও জানা যায় যে, ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ মুহম্মদ আততায়ীর হাতে নিহত হলে কাশিম খান পলাতক অবস্থায় রাশিয়ার জারের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মস্কো সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন। পরে রাশিয়ার জার তাকে অস্ত্রাখান অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং নিজ প্রতিভাবলে তিনি স্বাধীন অস্ত্রাখান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অস্ত্রাখানের তাতার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কাশিম খানের নামানুসারে এদেরকে ‘কাজিমােদের খান বংশ’ বলেও অভিহিত করা হয়। অস্ত্রাখান ভল্গা নদীর মােহনায় অবস্থিত বিধায় এর অর্থনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অস্ত্রাখানের তাতারগণ দুর্ধর্ষ যােদ্ধা ছিল। অনেক সময় তারা রাশিয়া ও পােল্যান্ডের বেতনভােগী ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসেবে কাজ করত। অস্ত্রাখানের তাতার খানদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবদুর রহমান খান (১৫৩৪-৩৮ খ্রি.) রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বস্তুত তখন থেকেই অস্ত্রাখানের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রতিবেশী রাজ্য ক্রিমিয়া ও কাজানের সাথে বিভিন্ন সময় যুদ্ধের ফলেও অস্ত্রাখান হীনবল হয়ে পড়ে। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার জনৈক দরবেশ আলী খানকে অস্ত্রাখানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু দরবেশ আলী পরে ক্রিমিয়া ও অটোমান তুর্কিদের বশ্যতা স্বীকার করে তাদের সঙ্গে যােগদান করেন। ফলে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে জার দরবেশ আলীকে পদচ্যুত করে অস্ত্রাখান অধিকার করেন। অস্ত্রাখানের তাতার মুসলমান প্রাধান্য খর্ব করার জন্য রাশিয়ার জার হাজার হাজার কোসাক অধিবাসীকে অস্ত্রাখানে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি অস্ত্রাখান শহরটির পুনঃনির্মাণ করেন এবং পরবর্তী দুই শতাব্দী যাবৎ এটি কাম্পিয়ান সাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। (১৯শ শতাব্দীর শেষ সময় থেকে বাকু কাস্পিয়ান সাগরের শ্রেষ্ঠ নৌবন্দরে পরিণত হয়।)। বর্তমানে অস্ত্রাখানের তাতার মুসলমানগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি হলেও তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি।

ক্রিমিয়ার তাতার বংশ (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই অঞ্চলের ওপর গড়ে ওঠা তাতার রাজ্যসমূহের মধ্যে ক্রিমিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। ক্রিমিয়ার এই তাতার বংশের রাজত্বকাল দীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছর স্থায়ী হয় এবং পর্যায়ক্রমে বাষট্টিজন তাতার খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ক্রিমিয়ার তাতারগণ ১৫শ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করতে থাকে। কাজান বংশের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহম্মদের জনৈক ভাই তাশ-তিমুর তােখতামিশের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই ক্রিমিয়ার তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। (তোখতানিশ হোয়াইট হোর্ডের অধিপতি ছিলেন। পরে তিনি ‘গােল্ডেন হাের্ড’ অধিকার করেন।)। তবে তার পুত্র হাজী গিরাইকেই (১৪৪১-১৪৫৬) সাধারণত এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। হাজী গিরাই-এর নামানুসারে ক্রিমিয়ার তাতার নরপতিগণ গিরাই খান বলেও পরিচিত। ক্রিমিয়ার গিরাই খানগণ প্রথমত পােল্যান্ডের ডিউকের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন। কিন্তু ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ (১৪৪৪-১৪৪৬, ১৪৫১-১৪৮৬) কর্তৃক কাফফা নামক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি অধিকৃত হলে ক্রিমিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ তখন থেকে ক্রিমিয়ার খান মেঙ্গলি গিরাই (১৪৬৯-৭৫, ১৪৭৮-১৫১৫) মূলত তুর্কি সুলতানের অধীনত মিত্রশক্তিতে পরিণত হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বাস্তব ক্ষেত্রে অক্ষুন্নই ছিল। মেঙ্গলি গিরাই এর আমলকে ক্রিমিয়ার তাতার রাজত্বের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা যায়। তিনি বাহ্যত তুর্কি সুলতানের অধীনতা স্বীকার করলেও মূলত এটি ক্রিমিয়ার পক্ষে ছিল বিরাট সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয়। কারণ তিনি সুশিক্ষিত তুর্কি সেনাবাহিনীকে নিজের প্রয়ােজনে রাশিয়া, পােল্যান্ড ও কোসাকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। এছাড়া তিনি ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই তুর্কি বাহিনীর সাহায্যের কাফফা থেকে জেনােয়ার শত্রু-বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।  ক্রিমিয়ার রাজধানী ছিল বাগ্‌সে-সারাই, এর বর্তমান নাম সিঙ্কোরোপোল। ১৬শ শতাব্দীতে ক্রিমিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে এসময় তাতারদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধ-বিগ্রহই ছিল তাদের অন্যতম প্রধান পেশা এবং এর ওপরই বহুলাংশে নির্ভর করত তাদের উন্নতি আর অবনতি। এসময় ক্রিমিয়ার তাতারগণ সাফল্যের সঙ্গে পােল্যান্ড, রাশিয়া ও কোসাকদের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি কয়েকটি সমর অভিযান পরিচালনা করে। এমনকি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দৌলত গিরাই এর নেতৃত্বে তারা রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভানকে (১৫৩৩-১৫৮৪) পরাজিত করে রাজধানী মস্কো নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং জারকে কর প্রদানে বাধ্য করে। গিরাই খানের নেতৃত্বে প্রায় দুই পক্ষের এক বিরাট তাতার বাহিনী ছিল। এছাড়া বহু তাতার সৈন্য অটোমান তুর্কি বাহিনীতে যােগদান করে এবং দক্ষিণ পূর্ব ইউরােপীয় যুদ্ধক্ষেত্রে খ্রিস্টান শত্রু-বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে। এসময় ক্রিমিয়ার গিরাই খানগণ ককেশাস, কারবারদান, দাগেস্তান ও রুমেলিয়ার ওপরও তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তুর্কি সুলতানদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ক্রিমিয়ার তাতারগণ এভাবে রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রতি বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। রাশিয়ার বিখ্যাত জারিনা ক্যাথারিন ক্রিমিয়ার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।

তিনি সর্বপ্রথম কৃষ্ণসাগরের ওপর রাশিয়ার প্রাধান্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং এর মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত মহামতি পিটারের নীতিরই বাস্তবায়ন ঘটে। ফলে রাশিয়ার জারের হাতে যথাক্রমে ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়া বিধ্বস্ত হয় এবং ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত রুশ ও কোসাক বাহিনী ক্রিমিয়ার রাজধানী বাগসে-সারাই অধিকার করে। বহুদিন পূর্ব থেকেই প্রাচ্য সমস্যার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়া সর্বদাই একটি বিরাট সমস্যার কারণ ছিল। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ক্রিমিয়া তাই উভয় শক্তির কাছেই বিশেষ উদ্বিগ্নের কারণ ছিল। এছাড়া কোসাকগণ যেমন রাশিয়ার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছিল তেমনি ক্রিমিয়ার তাতারগণও মুসলমান হওয়ায় তুর্কি সুলতানের প্রবল সমর্থক ছিল। কিন্তু এসময় তুরস্ক ক্রমাগতই হীনবল হয়ে পড়তে থাকে এবং পক্ষান্তরে রাশিয়া উত্তরােত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে তুর্কিগণ এসময় রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হয় এবং ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক কুচুককায়নারজির সন্ধিতে ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বিনিময়ে তুর্কি সুলতান রাশিয়ার জারের কাছ থেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলেন। ফলে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েও যেমন একদিকে ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার পরােক্ষ প্রভাব অক্ষুন্ন রইল অন্যদিকে তেমন তুর্কি সুলতানের ওপর ক্রিমিয়ার তাতারদের ধর্মীয় আনুগত্যের বন্ধন অটুট রইল। কাজেই ক্রিমিয়া সমস্যার মূলত কোন সমাধান হল না। এসময় সর্বশেষ ক্রিমিয়ার খান শাহীন গিরাই এর সাথে তুর্কি সুলতানের মনােমালিন্যের সুযােগ নিয়ে রুশ-বাহিনীর কুচুকায়নারজির সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে পুনরায় ক্রিমিয়া অধিকার করল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে এক আনুষ্ঠানিক ঘােষণার মাধ্যমে জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করলেন। প্রথমে তুরস্ক এই ঘােষণার বিরােধিতা করলেও ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে সাক্ষরিত জ্যাসির সন্ধিতে তুর্কি সুলতান ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকার করে নিলেন।  রাশিয়ার অধীনে ক্রিমিয়ার তাতার জাতির পরবর্তী ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক। যদিও ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ই এপ্রিলের ঘােষণায় ক্রিমিয়ার তাতারদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকবে বলে আশ্বাস দেয়া হয় তবুও বাস্তবে তা হয়নি। রাশিয়ার জারের উস্কানিতে তাতার মুসলমানদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর ঘটানাের চেষ্টা চলল এবং তাদের ওপর নেমে এলো এক চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্যাতন। ফলে বাধ্য হয়ে ক্রিমিয়ার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক তাতার মুসলমান স্বদেশ ত্যাগ করে তুরস্ক ও মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিল। এছাড়া ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলে এই অঞ্চল সাময়িকভাবে ইংরেজ ও তুর্কিদের অধীনে চলে যায় এবং তার ফলে তাতার মুসলমানদের ওপর নতুন করে এক মহাবিপদ উপস্থিত হয়। কারণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়। ফলে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার পাঁচ লক্ষ তাতার মুসলমানের স্থানে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা মাত্র এক লক্ষে এসে দাড়ায়। (জি. হ্যাম্বলি: Central Asia, লন্ডন, ১৯৬৯ শীর্ষক গ্রন্থের ”The Crimea under Russian Rule”. আলােচনাটি দ্রষ্টব্য: পৃ: ১১২-১১৭)।

যাই হোক, সৌভাগ্যবশত নানা অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়েও ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের মধ্যে ২০শ শতাব্দীর প্রারম্ভে নবজাগরণ দেখা দেয়। ইসমাইল বে নামক জনৈক সুশিক্ষিত ও উদারপন্থী তাতার নেতার অবদান এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি তাতার মুসলমানদের সনাতন শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করেন। তার সুযােগ্য নেতৃত্বে হতাশাগ্রস্ত, ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাতার মুসলমানগণ আধুনিকতা ও প্রগতির পথে পরিচালিত হয়। তিনি ‘তারজুমান’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং এর মাধ্যমে তার সংস্কারধর্ম আন্দোলন বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সমসাময়িক মুসলিমবিশ্বের প্যান ইসলামী মতবাদ এবং সেই সঙ্গে তুরকের নব্য তুর্কি দলের জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তার নেতৃত্বে ক্রিমিয়ার তাতার যুবশক্তি ‘মিল্লি ফিরকা’ (অর্থাৎ জাতীয় দল) নামে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তবে নানা জাতির সংমিশ্রণে গঠিত ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানগণ একান্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ায় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বলশেভিকগণ ক্রিমিয়া অধিকার করলে সেখানকার তাতার মুসলমানদের জীবনে এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। কারণ বলশেভিকগণ ক্রিমিয়াকে সােভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদান করে। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাতারদের ‘মিল্লি ফিরকা’ বা জাতীয় দলের কোয়ালিশন সরকার পর্যন্ত গঠন করা হয়। যদিও প্রকৃত ক্ষমতা রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই ছিল তবুও তাতার মুসলমানগণ সীমিতভাবে স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্ত হয় এবং তাদের ভাষাকে অন্যতম আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। এছাড়া তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ দেয়া হয় এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরতে নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের এই সুদিন বেশিকাল স্থায়ী হল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মস্কো সরকার তাতার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য তাদের ওপর পূর্বাপেক্ষা কঠিনতর আঘাত হানে। ফলে বহু তাতার নেতা এই অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়ে প্রাণ হারায় এবং নতুনভাবে আবার তাতারগণ দেশত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতে ক্রিমিয়ায় তাতার মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা মাত্র তেইশজনে এসে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময় ক্রিমিয়া জার্মানির পদানত হলেও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে রুশ বাহিনী হিটলারকে পরাজিত করতে সক্ষম হলে ক্রিমিয়া শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু দেশদ্রোহিতার অপরাধে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানগণ পুনরায় মস্কো সরকারের কোপানলে পতিত হয়। ফলে বহু তাতার মুসলমানকে স্বদেশ থেকে উৎখাত করে সাইবেরিয়া অথবা মধ্য-এশিয়ায় দেশান্তরিত করা হয় এবং ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এভাবে বহু ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ক্রিমিয়া এবং সেই সঙ্গে সেখানকার তাতার মুসলমান জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

তথ্যসূত্র 

  • সা. আলেক্সেয়েভ, ভ. কাৎসভ, আ. ক্রোইৎস্কি – সােভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
  • ড. কিরণ চন্দ্র চৌধুরী, আধুনিক ইউরােপ
  • আধুনিক ইউরোপ (১৪৫৩-১৭৮৯), মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৩৮-২৬১

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.