সৈয়দ ও লােদী বংশ, বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্য, দিল্লী সালতানাতের পতন, বাবর, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও তৎপূর্বে উপমহাদেশের অবস্থা

Table of Contents

সৈয়দ বংশ (১৪১৪-১৪৫১ খ্রি.)

খিজির খান (রা. ১৪১৪-১৪২১ খ্রি.) 

ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলস্থ তৈমুরের শাসনকর্তা খিজির খান দিল্লী দখল করে সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেকে হযরত মুহাম্মদের এর বংশধর বলে দাবী করতেন এবং এজন্য তার রাজবংশ সৈয়দ বংশ নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য তিনি সত্যিই মুহম্মদের বংশধর ছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোন কোন ঐতিহাসিক সন্দেহ পােষণ করেছেন। খিজির খান যদিও তৈমুরের শাসনকর্তা ছিলেন এবং তৈমুরপুত্র শাহরুখের প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করতেন, তবুও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন স্বাধীন। তিনি নামমাত্ৰ অধীনতা প্রদর্শন করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। তিনি সাত বছর যাবৎ দিল্লী সাম্রাজ্য শাসন করেন। এসময় তিনি দিল্লী সালতানাতের হৃত অঞ্চলগুলাে পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। কিন্তু দিল্লী, পাঞ্জাব ও দোয়াব অঞ্চল ছাড়া তিনি অন্য কোন অঞ্চল দখল করতে পারেননি। দিল্লী সাম্রাজ্য এসময় এত ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে যে, সালতানাতের আয়ও কমে যায়। ফলে খিজির খান প্রয়ােজনীয় অর্থের অভাবে সেনাবাহিনীকে সুবিশাল আকার দিতে পারেননি। আর এজন্য বিশেষ কোন সামরিক অভিযান চালাতেও তিনি সক্ষম হননি। তবে তিনি কামাপিল, খাের, জালেসার, বিয়ােনার, পাতিয়ালা, গােয়ালিয়র, এটোয়া, মেওয়াট প্রভৃতি এলাকার জমিদার ও হিন্দু সরদারদের বিদ্রোহ ও বিরােধিতা দমন করতে সক্ষম হন। এ সকল অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মন্ত্রি তাজ-উল-মূলক। তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও সামরিক প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। 

খিজির খান বহিরাগত হলেও দিল্লী সালতানাতের অভিজাতবর্গের সাথে আপােষনীতি অনুসরণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি দিল্লীর পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে অভিজাত শ্রেণীর সহযােগিতা পাবার জন্য তাদের প্রতি সহনশীল মনােভাব পােষণ করেন এবং তাদেরকে পূর্বের ন্যায় সুযােগ সুবিধাসহ বসবাস করতে সুযােগ দেন। কিন্তু অভিজাত শ্রেণী খিজির খানকে মেনে নিতে পারেননি। এজন্য কতিপয় আমীর খিজির খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। এই বিদ্রোহী আমীরদের মধ্যে একটি দল ১৪১৬ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ মুবারকের অনুচর মালিক সাধুকে হত্যা করেন। ফলে খিজির খান এক বাহিনী পাঠিয়ে সিরহিন্দে তাদেরকে আক্রমণ করে বিতাড়িত করে দেন। পরের বছর তুঘান রাই-এর নেতৃত্বে তারা আবার বিদ্রোহ ঘােষণা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। অতপর তুঘান রাই আবার শক্তি সঞ্চয় করে সিরহিন্দ আক্রমণ করেন। কিন্তু খিজির খানের বাহিনীর কাছে চরমভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এরপর তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহী আমীরদের আর একটি গ্রুপ আমীর মহব্বৎ খানের নেতৃত্বে ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ফলে খিজির খান তার বিরুদ্ধে বদাউনে এক অভিযান চালিয়ে তাকে একটি দূর্গে অবরােধ করেন। ছয়মাস অবরােধের পর বিজয় যখন আসন্ন তখন খিজিরের কয়েকজন ক্রীতদাসের বিশ্বাসঘাতকতার প্রেক্ষিতে তিনি অবরােধ তুলে আনেন এবং পরে ঐ সকল ক্রীতদাসদের হত্যা করেন। তবে অভিযান সফল না হলেও খিজির খান মহব্বৎ-এর কাছে থেকে আর কোন বিরােধের সম্মুখীন হননি। এ অভিযান ছাড়া অন্যান্য অভিযানসমূহ তিনি সফলভাবেই সম্পন্ন করেন। খিজির খানের সর্বশেষ অভিযান ছিল মেওয়াটিদের বিরুদ্ধে। এ অভিযান যখন সফলতার সাথে সম্পন্ন হয় তখন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। এর অল্প কিছুদিন পর ১৪২১ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মে তিনি মারা যান। 

খিজির খান একজন যােগ্য, দয়ালু, শান্তিপ্রিয় শাসক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং ন্যায়বিচার ও প্রজাকল্যাণের প্রতি তার সদিচ্ছা প্রশংসাযােগ্য। তিনি দিল্লী শাসনে বহিরাগত হলেও বহুমখী গুণাবলীর জন্য প্রজাদের সমর্থন লাভ করেন। তিনি অভিজাত শ্রেণীর সমর্থন লাভ করলে দিল্লীর পরবর্তী ইতিহাস হয়তাে অন্যরকম হতাে। তার বহুমুখী গুণ ও কার্যাবলীর প্রশংসা করে ফিরিস্তা বলেন, “Khizir Khan was a great and wise king, kind and true to his word; his subject loved him with a greatful affection so that great and small, master and servent, sat and mourned for him in black raiment till the third day, when thay laid aside their mourning garments and raised his son Mubarak shah to the throne.” 

মুবারক শাহ (রা. ১৪২১-১৪৩৪ খ্রি.)

১৪২১ খ্রিস্টাব্দে খিজির খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুবারক শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি সৈয়দ বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নরপতি। সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি নিজ নামে খুত্বা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তার পিতা খিজির খান স্বাধীনভাবে শাসন করলেও তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারীদের অধীনতা স্বীকার করতেন। কিন্তু মুবারক শাহ তা অস্বীকার করে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যের অভিজাতগণ মুবারক শাহের পক্ষে থাকলেও চারিদিকে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা পিতার আমলের ন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলেও বহিরাক্রমণের আংশকা দেখা দেয়। অন্যদিকে রাজপুতরা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং দিল্লী রাজ্য আক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকে। এ সকল বিপদের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষার জন্য মুবারক শাহ সংগ্রামে লিপ্ত হন। তিনি প্রথমেই পাঞ্জাবের খােককারদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। দশরথ নামক নেতার নেতৃত্বে থােককাররা এ সময় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে জলন্ধরের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে মুবারক শাহের সেনাপতি ইসলাম খাঁ লােদী দশরথের আক্রমণ প্রতিরােধ করে জলন্ধর রক্ষা করেন। দশরথকে ধ্বংস করতে না পারায় মুবারক শাহ নিজে সসৈন্যে অগ্রসর হন। তার আগমনে দশরথ পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগােপন করেন। এরপর দশরথ প্রায়ই আত্মগােপন থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে আবার পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগােপন করতেন। এভাবে দশরথ দীর্ঘদিন যাবৎ মুবারকের রাজ্যে উৎপাত করতে থাকেন। মুবারকও দশরথকে প্রতিহত করার জন্য সবদা প্রস্তুত ছিলেন। ফলে মুবারকের জীবদ্দশায় দশরথ তেমন কোন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। 

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের “তুর্কাবাচ্ছা” নামক আর একটি দূর্ধর্ষ গােষ্ঠীর বিদ্রোহও সুলতান মুবারককে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। মুবারক যখন দশরথকে দমনে তৎপর তখন ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে তুর্কাবাচ্ছাদের নেতা পুলাদ বিদ্রোহ ঘােষণা করে তাবারহিন্দ নামক দূর্গটি দখল করে নেন এবং সেখানে স্বীয় ঘাঁটি স্থাপন করেন। সুলতান পুলকের বিরুদ্ধে মুলতানের শাসনকর্তা ইমাদুল মূলককে প্রেরণ করেন। ইমাদুল পুলাদকে বিতাড়িত করে তাবারহিন্দ দখল করেই ক্ষ্যান্ত থাকেন। এ সুযােগে পুলাদ কাবুলের সুলতান শেখ আলীকে ভারত আক্রমণে আহ্বান জানান। এতে শেখ আলী সাড়া দিয়ে ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকেন। এ সুযােগে পুলাদ আবার সদলবলে বের হয়ে লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকেন। পুলাদকে প্রতিরােধ করতে এসে মুবারকের অনুচর রাই ফিরােজ নিহত হন। এতে পুলাদের সুনাম ও প্রতিপত্তি আরাে বেড়ে যায়। মুবারক এ সময় পাঞ্জাবে শেখ আলীকে প্রতিরােধ করতে ব্যস্ত থাকায় পুলাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাকে দমন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। অবশেষে শেখ আলীর বাহিনীকে পরাজিত করে মুবারক বিশাল বাহিনী নিয়ে তাবারহিন্দে উপস্থিত হন এবং পুলাদকে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত ও নিহত করেন।

সুলতান মুবারকের আর এক অনন্য কৃতিত্ব কাবুলের মােগল নেতা শেখ আলীকে পরাজিত করে পাঞ্জাবসহ সীমান্ত রক্ষা করা। মুবারক যখন দশরথ ও পুলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত তখন ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে শেখ আলী পাঞ্জাব আক্রমণ করে দখল করেন। শেখ আলীর সাথে পুলাদের যােগাযােগ ছিল। শেখ আলী পাঞ্জাবসহ অত্র এলাকার শহর ও জনপদ একের পর এক দখল করে লুণ্ঠন চালাতে থাকেন। মুবারক তার বিরুদ্ধে পরপর কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করে ব্যর্থ হলে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে ইমাদুল মূলক ও ইসলাম শাহ-এর নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর সম্মুখে শেখ আলী দাঁড়াতে না পেরে কোনমতে পালিয়ে কাবুলে চলে যেতে সক্ষম হলেও তার ভ্রাতুস্পুত্র মুজাফফর অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং মুবারকের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। মুজাফফর নিজ কন্যাকে মুবারকের ভ্রাতুস্পুত্র মুহম্মদ শাহের সাথে বিবাহ দিয়ে সন্ধিকে আরাে দৃঢ় করেন। 

মুবারক শাহ জৌনপুরের শাসক ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ লড়াই করে বিয়ানা দখল করেন। তিনি মেওয়াটিদেরকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। বিদ্রোহী এটোয়ার রাজাকে আত্মসমর্পণ করতে এবং মালব রাজ হুসাং শাহকে গোয়ালিয়র হতে সরে যেতেও তিনি বাধ্য করেন। এভাবে সুলতান মুবারক শাহ একের পর এক যুদ্ধ করে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এ বহিরাক্রমণ প্রতিরােধ করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। সুলতান মুবারক অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সংস্কারেও মনোযােগ দেন। কিন্তু এজন্য প্রশাসনিক কিছু রদবদল করায় প্রধানমন্ত্রী সরওয়ার-উল-মূলক সহ কতিপয় আমীর-ওমরাহ ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের ষড়যন্ত্রে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় সুলতান আততায়ীর হাতে ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন। 

সুলতান মুবারক এক উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি দয়ালু, প্রজাহিতৈষী ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। বিপদে তিনি বিচলিত হতেন না এবং অসীম ধৈৰ্য্য ও সাহসের সাথে তা মােকাবেলা করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি স্থাপত্য শিল্পেরও পৃষ্ঠপােষক ছিলেন, যার প্রমাণ “মুবারকবাদ” শহর প্রতিষ্ঠা করে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা ও মসজিদ নির্মাণ। তারই পৃষ্ঠপােষকতায় ইয়াহিয়া-বিন-আহম্মদ সিরহিন্দ “তারিখ-ই-মুবারকশাহী” নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন। 

মুহম্মদ শাহ (১৪৩৪-১৪৪৫ খ্রি.)

মুবারক শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তার ভ্রাতুস্পুত্র মুহম্মদ শাহ ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। মুবারক শাহ নিঃসন্তান ছিলেন। তাই ভ্রাতুস্পুত্র মুহম্মদকে নিজ পুত্রের মত লালন-পালন করতেন। অনেকে তাই তাকে মুবারকের পালিত পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুহম্মদ যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী সরওয়ার-এর হাতে কুক্ষিগত ছিল। তিনি বড়যন্ত্র করে মুবারককে হত্যা করার পর মুহম্মদকে হত্যা করতে অগ্রসর হন। এতে সরওয়ারের প্রতিপক্ষ আমীর-ওমরাহগণ প্রমাদ গােনেন। তারা যেকোন মূল্যে মুহম্মদকে রক্ষার জন্য সেনাপতি কামাল-উল-মুলকের নেতৃত্বে সুসংঘবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন। সরওয়ার এর বিরুদ্ধে ও মুহম্মদের পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থান গ্রহণের ফলে অধিকাংশ অভিজাত কামাল মূলক-এর পতাকা তলে সমবেত হয়। অতপর কামাল-উল-মূলক সরওয়ারকে আক্রমণ করে পরাজিত ও নিহত করেন এবং মুহম্মদকে রক্ষা করে সিংহাসনে প্রকৃত সুলতানরূপে অধিষ্ঠিত করেন। মুহম্মদ কামাল-উল-মূলককে উজির পদে নিয়োগ করেন।

মুহম্মদ শাহ কামাল-উল-মূলকের সাহায্যে সিংহাসন লাভ করলে এসময় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তা দূর করতে পারেননি। মূলত তিনি শাসক ছিলেন না। যুদ্ধ বিদ্যায়ও তার তেমন কোন পারদর্শিতা ছিল না। মুহম্মদের অনুগত বাহিনী ও অভিজাত শ্রেণী সরওয়ারের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করার কাজে লিপ্ত থাকার সুযােগে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এসময় মুলতান স্বাধীন হয়ে পড়ে। দিল্লী ও তার আশেপাশে এলাকার জমিদারগণ সুলতানকে কর দেয়া বন্ধ করে নিজ নিজ এম ইচ্ছামত শাসন করতে প্রবৃত্ত হয়। মালবের শাসক মাহমুদ খলজী মেওয়াটিদের সহযােগিতায় দিল্লী আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। এহেন পরিস্থিতি মােকাবেলা করার মত ক্ষমতা ও যােগ্যতা মুহম্মদ শাহের ছিল না। তিনি মাহমুদ খলজীকে বাধা দিতে অসমর্থ হয়ে সিরহিন্দের শাসনকর্তা বহলুল লােদীর স্মরণাপন্ন হন। বহলুল লােদী একযুদ্ধে মাহমুদ খলজীকে পরাজিত করে বিতাড়িত করে দেন। এতে বহলুল লােদীর ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যায় এবং তিনি দিল্লীর সিংহাসনের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। মুহম্মদ শাহ ক্রমেই বহলুল লােদীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাকে খান-ই-খানন উপাধি দিয়ে নিজ সন্তানরূপে আখ্যায়িত করেন। এভাবে মুহম্মদের দুর্বলতা যতই প্রকাশ পেতে থাকে, বহলুল লােদী ততই ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র বিস্তার করতে থাকেন। তিনি দুর্ধর্ষ খােককারদের সাথে গােপনে আঁতাত করেন এবং তাদের সহযােগিতায় দিল্লী দখলের পরিকল্পনা করেন। এ সময় বহলুলের পরামর্শ মােতাবেক খােককাররা পাঞ্জাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে সুলতান মুহম্মদ তাদেরকে দমন করার জন্য বহলুলকে অনুরােধ করেন। বহলুল এ সুযােগে তাদেরকে সাথে নিয়ে ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী অভিমুখে অগ্রসর হন। কিন্তু সুলতান মুহম্মদ তা অবগত হয়ে তার নিজস্ব বাহিনী ও অভিজাতবর্গকে নিয়ে বহলুলকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

এভাবে বহলুলের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মুহম্মদ দিল্লীকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। এতে মুহম্মদের ক্ষমতা ও মর্যাদা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও সার্বিক পরিস্থিতির কোন উন্নত হলাে না। এসময় জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কি দিল্লীর কয়েকটি পরগণা দখল করে নেন। আমীর-ওমরাহগণও রাজ্যের পতন আসন্ন ভেবে নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে মুহম্মদ ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্বীয় পুত্র ও বদাউনের শাসনকর্তা আলাউদ্দিনকে দিল্লী ডেকে এনে তাকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। এর কিছুদিন পর ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুহম্মদ মৃত্যুবরণ করেন। 

আলাউদ্দিন আলম শাহ (১৪৪৫-৫১ খ্রি.)

মুহম্মদের মনােনয়ন অনুযায়ী তার মৃত্যুর পর পুত্র আলাউদ্দিন “আলম শাহ” উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অযােগ্য ও অপদার্থ সুলতান। তিনি সিংহাসনে আরােহণ করে চারিদিকে বিশঙ্খলা দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দিল্লী থেকে রাজধানী বদাউনে স্থানান্তর হবেন। বদাউনকে তিনি নিজের জন্য নিরাপদ মনে করেন। তার একমাত্র কৃতিত্ব ছিল বহলুল লােদী ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার দিল্লী আক্রমণ করলে তা ব্যর্থ করে দেয়া। তবে দিল্লীতে সুলতানের অনুপস্থিতি এবং শাসন ব্যবস্থায় তার অমনােযােগিতায় গােটা রাষ্ট্রের শাসন কাঠামাে ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় দিল্লীর রাজনৈতিক শূন্যতার সুযােগে উজির হামিদ খান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তিনি বহলুল লােদীকে দিল্লী দখলের জন্য গােপনে আমন্ত্রণ জানান এবং তাকে পূর্ণ সহযােগিতা করার আশ্বাস দেন। ফলে বহলুল আবার দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন এবং ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে বিনা বাধায় দিল্লী দখল করেন ও নিজেকে সুলতান বলে ঘােষণা করেন। এতে সুলতান আলম শাহের কোন প্রতিক্রিয়াই হলাে না। তিনি স্বেচ্ছায় বহলুল লােদীর অনুকুলে ক্ষমতা ত্যাগ করেন এবং বাকী জীবন বদাউনে কাটাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বহলুলও তার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। ফলে ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু পর্যন্ত আলম শাহ বদাউনে অবসর জীবন কাটান। এভাবে বহলুল লােদীর হাতে সৈয়দ বংশের অবসান হয় এবং লােদী বংশের যাত্রা শুরু হয়। 

লােদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬ খ্রি.)

ভূমিকা

দিল্লীর লােদী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বহলুল লােদী। তিনি জাতিতে হলেন আফগান। দিল্লীর তুর্কি শাসনামলে বহলুল লােদীর পূর্ব পুরুষরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাদেরই একজন মালিক শাহু ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বের শেষাংশে বিশৃঙ্খলার সুযােগে মুলতান আক্রমণ করেন। কিন্তু মুহম্মদ-বিন-তুঘলক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় মালিক শাহুর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শাহুর পৌত্র মালিক বাহরাম সুলতান ফিরােজশাহের রাজত্বকালে মুলতানে এসে মুলতানের শাসক মালিক মারদান দৌলতের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেন। বাহরামের জ্যেষ্ঠপুত্র মালিক সুলতান শাহ লােদী সৈয়দবংশের প্রতিষ্ঠাতা খিজির খানের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করেন। তিনি খিজির খানের সাথে এক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের পরিচয় দেন এবং প্রধান শত্রু মন্ত্রী ইকবাল খানকে হত্যা করতে সক্ষম হন। এতে তার প্রতি খিজির খান সন্তুষ্ট হন এবং ইসলাম খান উপাধি দিয়ে তাকে সিরহিন্দের শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। ইসলাম খানের এ নিয়ােগই লােদী বংশকে প্রশাসনের অংশীদারিত্বে পরিণত করে। তার নেতৃত্বেই সিরহিন্দিতে লােদীরা ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করে। ইসলাম খান সুলতান মুবারক শাহ ও মুহম্মদ শাহ-এর রাজত্বকালে বীরত্বপুর্ণ অবদান রেখে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তিনি নিজ ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা বহলুল লােদীকে সিরহিন্দে তার পরবর্তী শাসনকর্তা নিয়ােগে সুলতান মুহম্মদের সম্মতি লাভে সমর্থ হন এবং সে অনুযায়ী ইসলাম খানের মৃত্যুর পর বহলুল লােদী সিরহিন্দের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। বহলুল লােদী উচ্চাভিলাষী ও সুদক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। সুলতান মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে তিনি সুলতানের প্রধান অবলম্বনে পরিণত হন। অবশ্য সুলতানের দুর্বলতার সুবােগে দিল্লী আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হন। এরপর ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে আর একবার অভিযান চালিয়েও দিল্লী দখল করতে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ বংশের শেষ সুলতান আলম শাহের উজিরের বিশ্বাসঘাতকতায় ও সুলতানের নির্লিপ্ততায় বহলুল লােদী দিল্লী দখল করে সৈয়দ বংশের অবসান ও লােদী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। 

বহলুল লোদী (১৪৫১-১৪৮৯ খ্রি.)

সিরহিন্দের শাসনকর্তা বহলুল লােদী ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী দখল করে নিজেকে সুলতান বলে ঘােষণা দেন এবং নিজ নামে খুৎবা পাঠ করান। তিনি দিল্লী সালতানাতের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তিনি প্রথমেই হামিদ খানের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখেন এবং ক্রমশ তার ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় সুলতান বহলুল তা মঙ্গলজনক মনে না করে তাকে ক্ষমতাহীন করতে প্রবৃত্ত হন এবং কৌশলে তাকে বন্দী করেন ও পরে হত্যা করেন। এভাবে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের হােতাকে ধ্বংস করে সুলতানের ক্ষমতা মজবুত করেন। বহলুল উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি রাজ্যকে সম্প্রসারিত করতে মনস্থ করেন। তিনি প্রথমেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা দৃঢ় করতে সেই অঞ্চল পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সিরহিন্দ গমন করেন। এই সুযােগে কতিপয় আমীর-ওমরাহ গােপনে জৌনপুরের শর্কি শাসক মাহমুদ শাহকে দিল্লী দখলে আমন্ত্রণ জানালে মাহমুদ শাহ দিল্লী অভিমুখে সসৈন্যে অগ্রসর হন। এ খবর পেয়ে বহলুল দ্রুতবেগে দিল্লী ফিরে আসেন এবং মাহমুদ শাহকে জৌনপুরে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। এরপর বহলুল দিল্লীর অভিজাত শেণীর ওপর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মাহমুদের ফিরে যাওয়া এবং বহলুলের কঠোর পদক্ষেপে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অভিজাত শ্রেণীর সকলে তার আনুগত্য স্বীকার করেন। এরপর তিনি বিরােধী মনােভাবাপন্ন বিভিন্ন পরগণা ও প্রাদেশিক শাসন কর্তাদেরকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেন। তিনি একে একে মেওয়টের আহমদ খান, সম্বলের দরিয়া খান, কোয়েলের ইশা খান, সুকেতের মুবারক খান, রেওয়ারীর কুতুব খান, জৈনপুরের প্রতাপ সিংহ সহ এটোয়া, চান্দেরী, দোয়াব, গােয়ালিয়র প্রভৃতির শাসনকর্তাদের আনুগত্য লাভ করেন। তিনি জৌনপুরের শর্কি শাসকের বিরুদ্ধে পর পর কয়েকটি অভিযান চালিয়ে জৌনপুর দখল করেন এবং নিজ পুত্র বরবক শাহকে জৌনপুরের শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। এ সময় পাঞ্জাবের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতপর তিনি গােয়ালিয়রের রাজপুত রাজার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তা দখল করেন ও প্রচুর ধন-রত্ন হস্তগত করেন। গােয়ালিয়র দখল করে দিল্লী প্রত্যাবর্তনের পথে সুলতান বহলুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জালালী শহরের কাছে ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। 

বহলুল লােদী একজন যােগ্য ও দক্ষ সুলতান ছিলেন। তিনি কেবল লােদী বংশের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, দিল্লী রাজ্যের দীর্ঘদিনের অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলাও স্থাপন করেন। দীর্ঘদিন পর অভিজাত শ্রেণী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে রাষ্ট্রের সংহতি দৃঢ় করে। তিনি দিল্লী সালতানাতের ক্ষমতা ও মর্যাদা পুনপ্রতিষ্ঠিত করেন। রাজত্বকালের প্রায় পুরােসময়টাই যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় সুলতান তেমন কোন প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি। তবে প্রজাদের কল্যাণ সাধনে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ভালবেসে সকলের মন জয় করার পক্ষপাতি ছিলেন এবং এই নীতির দ্বারাই গােটা জাতি ও অভিজাত শ্রেণীকে সুসংঘবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন।

সিকান্দার শাহ (১৪৮৯-১৫৭১ খ্রি.)

বহলুল লােদীর মৃত্যুর পর ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে তার মনােনীত পুত্ৰ নিজাম খান “সিকান্দার শাহ” নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন, অবশ্য তিনি সিকান্দার লোদী নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি পিতার ন্যায় যােগ্যতা সম্পন্ন শাসক ছিলেন। তার সিংহাসনে আরােহণকে কোন কোন আমীর মেনে নিতে না পেরে বিরােধিতা করলে তিনি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। অতপর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জৌনপুরের শাসনকর্তা বরবক শাহ বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে সিকান্দার শাহ তাকে পরাজিত ও বন্দী করেন। তবে সুলতান তাকে ক্ষমা করে দেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান তাকে স্বপদে বহাল রাখেন। কিন্তু অনেকে আবার মনে করেন যে, তাকে ক্ষমা করলেও জৌনপুরের শাসনকর্তা পদে তাকে আর রাখা হয়নি। ড. আঃ করিমের মতে, “সিকান্দার বারবাক শাহকে পরাজিত ও বন্দী করেন এবং জৌনপুরের শাসনভার অন্যান্য আফগান আমীরদের হাতে সমর্পণ করেন। এর কিছুকাল পর জৌনপুরের জমিদার ও বাচগৌত্রীয় উপজাতিরা বিদ্রোহ করে। তারা পূর্ববর্তী শর্কি শাসক হােসেন শাহকে তাদের নেতা হিসেবে ঘােষণা করে। হােসেন শাহ শর্কি তাদের সহযােগিতায় এক বিশাল বাহিনী নিয়ে জৌনপুর দখলের জন্য অগ্রসর হলে সিকান্দার শাহ এক বাহিনী পাঠিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে হােসেন শাহ শর্কি আবার সিকান্দারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এবারও পরাজিত হয়ে পলায়ন করে তিনি বাংলায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তাকে আশ্রয় দেয়ায় সিকান্দার শাহ ক্ষুব্ধ হন এবং ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক অভিযান পরিচালনা করেন। তবে তেমন সুবিধা করতে না পেরে তিনি সন্ধি করে ফিরে আসেন। অবশ্য ইতােমধ্যে জৌনপুরের ওপর তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন এবং সেখানকার জমিদাররাও তার বশ্যতা স্বীকার করে। 

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর সাথে সিকান্দার লোদীর দ্বন্দ্বের কাহিনীটা একটু বিস্তারিত বলা দরকার। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (রা. ১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি.) সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছর রাজত্বের মধ্যে বহু বহিঃশক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন – কতকগুলির উদ্দেশ্য রাজ্যজয়, কতকগুলি আত্মরক্ষামূলক। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবার যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয় নি. হােসেন শাহের রাজ্যাভিষেকের দু’বছর বাদে দিল্লীশ্বর সিকান্দার লােদীর সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধে। সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহের যুদ্ধের প্রায় ১৩৭ বছর পরে এই প্রথম আবার দিল্লীর সুলতানের সঙ্গে বাংলার সুলতানের সংঘর্ষ হল। ‘মন্তখব্‌-উৎ-তওয়ারিখ’, ‘তবকাৎ-ই-আকবরী’, ‘মখজান-ই-আফগানী’ প্রভৃতি ইতিহাসগ্রন্থে এই সংঘর্ষের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা সংক্ষেপে এই – জৌনপুরের সুলতান হােসেন শাহ শর্কী ১৪৭৯ সালে বহ্‌লুল লােদীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও হৃতরাজ্য হয়ে বিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বহ্‌লুলের মৃত্যুর পর সিকান্দার লােদী যখন দিল্লীর সুলতান হন, তখন পাটনার শাসনকর্তা দিল্লীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ১৪৯৪ সালে বিদ্রোহ দমন করতে সিকান্দার লােদী পাটনায় আসেন, এই অভিযানে তার বহু ঘোড়া মারা পরে। এই খবর পেয়ে হােসেন শাহ শর্কী সিকান্দারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং কাশী পর্যন্ত তার পিছু পিছু ধাওয়া করেন। কাশীতে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়; তাতে পরাজিত হয়ে হােসেন শাহ শর্কী পালিয়ে আসেন, সিকান্দারও তার পিছু পিছু ধাওয়া করে আসেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হােসেন শাহ তখন হােসেন শাহ শর্কীকে আশ্রয় দেন এবং ভাগলপুরের কাছে কহলগাঁওতে তার থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। হােসেন শাহ শর্কী আলাউদ্দীন হােসেন শাহের আত্মীয় ছিলেন, আলাউদ্দীনের পৌত্রী ও নসরৎ শাহের কন্যার সঙ্গে হােসেন শাহ শর্কীর পুত্র জালালুদ্দীন শর্কীর বিবাহ হয়েছিল। হােসেন শাহ শর্কীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সিকান্দার লােদী বাংলার সুলতানের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৪৯৫ সালে সিকান্দারের সৈন্যদল কুৎলুগপুর থেকে মাহমুদ খান লােদী ও মুবারক খান নুহানির নেতৃত্বে যাত্রা করল। হােসেন শাহ্ও‌ তাকে বাধা দেবার জন্য তার পুত্র দানিয়েলের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী পাঠালেন। বিহারের বাঢ় নামক জায়গায় দুই পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হল, কিন্তু যুদ্ধ হল না। কিছুদিন পরে সিকান্দার লােদী হােসেন শাহের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করে স্বস্থানে ফিরে যান। নিয়ামতুল্লাহর ‘মখজান-ই-আফগানী’ এবং অন্য কোন কোন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সন্ধির সময় হােসেন শাহ প্রতিশ্রুতি দেন সিকান্দার শাহের শত্রুদের তিনি ভবিষ্যতে আর তার রাজ্যে আশ্রয় দেবেন না। বদাওনী ‘মন্তখব্‌-উৎ-তওয়ারিখে’ লিখেছেন, “দুই পক্ষ নিজের নিজের রাজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন।” বদাওনী এও লিখেছেন যে অনেক ঘােড়া মারা যাওয়ার এবং রসদ কমে যাবার ফলে সিকান্দারের বাহিনী বিশেষ অসুবিধায় পড়ে। ডঃ আবদুল করিম মনে করেন, আসলে দুই সুলতানের মধ্যে সন্ধি হয়নি, সিকান্দার ব্যর্থমনােরথ হয়ে ফিরে যান (বা.ই.সু.আ.. পৃঃ ৩৭১)। এর পরেও যে বিহার ও ত্রিহুতে হােসেন শাহের অধিকার অক্ষুন্ন ছিল, তার প্রমাণ আছে। এভাবে দিল্লীর পরাক্রান্ত সম্রাট সিকান্দার লােদী হােসেন শাহ্কে‌ দমন করতে এসে ফিরে গেলেন, হােসেন শাহের প্রাধান্যও বিন্দুমাত্র খর্ব হল না। এটি হােসেন শাহের পক্ষে বিশেষ গৌরবের ছিল।

যাই হোক, অতপর সুলতান সিকান্দার শাহ সুলতানের ক্ষমতা আরাে সুদৃঢ় করার জন্য আফগান জায়গীরদারদের প্রতি নজর দেন। মূলত এই সময় জায়গীরদাররা প্রভূত অর্থের মালিক হয়ে বসে এবং তারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দেয়। এমনকি, সুযােগ পেলে রাষ্ট্রীয় কার্যেও অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে তারা দ্বিধাবােধ করে না। সুলতান তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য হিসাব-নিকাশ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং অনিয়মের অভিযােগে অনেককে শাস্তি দেন। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ষড়যন্ত্র করলে সুলতান তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন। ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামাের ওপর সুলতানের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়ে পড়ে।

সুলতান শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত দোয়াবে শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কারণ উর্বর এলাকা দোয়াবে কোন কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তাই তিনি দোয়াবের নিকটবর্তী যমুনা নদীর পারে একটি শহর গড়ে তােলেন, যা আগ্রা নামে পরিচিত। তিনি এই শহরে একটি সেনাবাহিনী মােতায়েন রাখেন, যাতে দোয়াবের কৃষিকাজে কেউ বাধা দিতে না পারে। তিনি রাজপুত জাতিকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। তিনি বিরােধী মনােভাবাপন্ন অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তিনি ধােলপুর, গােয়ালিয়র এবং নারােয়ার প্রভৃতির বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি চান্দেরীর রাজ্যকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন। রণথম্ভোরও তার হস্তগত হয়। তার রাজত্বের শেষের দিকে গােয়ালিয়রের রাজা বিদ্রোহ ঘােষণা করলে তিনি আবার গােয়ালিয়রের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আক্রমণের পূর্বেই ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

সিকান্দার লােদী লােদী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের সীমাবৃদ্ধি করে ও রাজ্যের সকল বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দমন করে পিতার অসমাপ্ত কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। তিনি দিল্লী সালতানাতকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করেন। জায়গীরদারদের ক্ষমতা খর্ব করে এবং তাদের হিসাব-নিকাশ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তিনি যেমন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন তেমনি তাতে রাষ্ট্রের আয় ও ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকরা তার সুশাসনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি আগ্রা শহরের ভিত্তি স্থাপন করে ও সেখানে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা নির্মাণ করে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের প্রতি অনুরাগের প্রমাণ রেখে গেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগীও ছিলেন। তিনি নিজে ফার্সি ভাষায় অনেক কবিতা রচনা করেন। তার এ সকল কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন। স্যার উলসলে হেগ-এর মতে, “He was the greatest of the three kings of his house.”

ইব্রাহিম লােদী (১৫১৭-১৫২৬ খ্রি.)

সিকান্দার শাহ লােদীর মৃত্যুর পর পুত্র ইব্রাহিম লােদী ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু শুরুতেই তিনি নিজ ভ্রাতা জালালউদ্দিনের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। জালালউদ্দিন কতিপয় আমীরের সহযােগিতায় জৌনপুরের সিংহাসনে বসে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এতে সাম্রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সুলতান ইব্রাহিম লােদী ফতেহ খান ও খান জাহান-এর নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে জালালউদ্দিনকে পরাজিত ও হত্যা করেন। জালালউদ্দিনের সমর্থক আমীরদেরকে তিনি কঠোর শাস্তি দেন। এভাবে তিনি প্রাথমিক বিপদ কাটিয়ে উঠে তিনি শাসনকার্যে মনােযােগ দেন। 

ইব্রাহিম লােদী প্রথমেই গােয়ালিয়রের বিদ্রোহী রাজার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তা দখল করেন। কিন্তু মেবারের রানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে চরমভাবে পরাজিত হন। ইব্রাহিম পিতার ন্যায় আফগান অভিজাতদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হন। কিন্তু তারা তা মেনে নেয় নি। ফলে সুলতান অবাধ্য অভিজাতদের হত্যাসহ কঠিন শাস্তি প্রদান করতে থাকেন। এতে আফগান অভিজাতরা ষড়যন্ত্র করে বিহারের শাসনকর্তা দরিয়া খান লােহানীর নেতৃত্বে সুসংঘটিত হয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা করে। এতে যােগ দেন লাহােরের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদী, আলম খান, শেরশাহ শুর প্রভৃতি আফগান নেতৃবৃন্দ। তারা ইব্রাহিমের শাসনের অবসানের জন্য সুসংগঠিত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন এবং কাবুলের অধিপতি বাবরকে দিল্লী আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। ইব্রাহিম এ সকল ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করার জন্য যখন প্রস্তুত তখন বাবর সসৈন্যে লাহাের আক্রমণ ও দখল করেন। দৌলত খাঁ বাবরকে সাহায্য করলেও তিনি বিনিময়ে কিছু পেলেন না, উপরন্তু নিজ রাজ্য লাহােরও হারিয়ে বাবরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কিন্তু পরাজিত হয়ে তিনি দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন এবং ইব্রাহিম লােদীর ক্ষুব্ধ পিতৃব্য আলম খানের সহযােগিতায় দিল্লী আক্রমণ করেন। তবে এখানেও তিনি পরাজিত হন। ইব্রাহিম লােদী যখন এমনিভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত তখন বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী দখল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। ইব্রাহিম এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পানিপথ নামক স্থানে বাবরের মুখােমুখি হন। ফলে এখানে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়, যা পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লােদী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও পরাজিত ও নিহত হন। অতপর বাবর দিল্লী দখল করে লােদী বংশের শাসন তথা দিল্লী সালতানাতের অবসান ঘটিয়ে মােগল শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এভাবে ইব্রাহিম লােদীর দুঃশাসন ও স্বীয় আফগান দলপতিদের শত্রুতে পরিণত করার প্রেক্ষিতে এক বিয়ােগান্তক পরিণামের মধ্য দিয়ে ৩০০ বছরের অধিককালের দিল্লী সালতানাতের পতন ঘটে। বাবর ক্রমে অন্যান্য আফগান নেতা ও রাজপুতদের পরাজিত করে বিশাল মােগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। 

দক্ষিণ ভারতে বাহমনী এবং বিজয়নগর রাজ্যের উত্থান ও পতন 

ভূমিকা

১৪শ শতকের প্রথমপর্বে দাক্ষিণাত্যে ‘বাহমনী’ ও ‘বিজয়নগর’ নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দিল্লী সালতানাতের সাম্রাজ্যসীমা সর্বোচ্চ পরিধিতে বিস্তৃত করার নায়ক ছিলেন মুহম্মদ-বিন-তুঘলক। আবার তার রাজত্বকালেই পতনের পালা শুরু হয় এবং এ পতনের প্রথম দৃশ্যেই এই স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির অবতারণা হয়। মুহম্মদ-বিন তুঘলক রাজত্বের শেষভাগে উদ্ভুত বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তিনি অধিকারে রাখতে পারেননি। এর মধ্যে ‘বাহমনী’ ও ‘বিজয়নগর’ রাজ্য ছিল অন্যতম।

বাহমনী রাজ্য

১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহী আমীরগণ হাসান-এর নেতৃত্বে বাহমনী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এটাই প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। হাসান আবুল মুজাফফর আলাউদ্দিন ‘বাহমন শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং গুলবর্গা নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। মুহম্মদ-বিন-তুঘলক দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের পর থেকে এখানে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে সুলতান এ পরিকল্পনা বাতিল করে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেও অনেকে সেখানে থেকে যায়। ক্রমে দাক্ষিণাত্যে, বিশেষ করে, দেবগিরিতে মুসলমানদের সংখ্যা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলতান দেবগিরি থেকে চলে এলেও দেবগিরির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। কিন্তু ১৩৩৫ সালের পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তার প্রভাব দেবগিরিসহ দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রসমূহেও পড়ে। অবশ্য দেবগিরির প্রেক্ষাপট একটু আলাদা ছিল। সুলতানের কিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপ এখানকার পরিস্থিতির অনতি ঘটায়। এ সময় দেবগিরির অস্থায়ী শাসনকর্তা কুতলুঘ খানকে সুলতান দিল্লীতে সরিয়ে নিয়ে কুতলুঘ খানের ভাই নিজামউদ্দিন আলীম-উল-মূলককে দেবগিরির শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। এতে দেবগিরির আমীরদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মূলত কুতলুঘ খান একজন সুদক্ষ ও জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। তাকে সরিয়ে নেয়ায় দেবগিরির আমীর-ওমরাহগণ অসন্তুষ্ট হয়। ঠিক এ সময় দাক্ষিণাত্যের মালওয়ার শাসনকর্তা ‘সাদাহ আমীর’ নামে পরিচিত বিদেশী আমীরদের কয়েকজনকে হত্যা করলে দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য আমীরদের মাঝে ভীতির সৃষ্টি হয়। ফলে দাক্ষিণাত্যের আমীরগণ, বিশেষ করে, দেবগিরি ও গুজরাটের আমীরগণের প্ররােচনায় এখানকার সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘােষণা করে। সুলতান এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য গুজরাটে উপস্থিত হয়ে গুজরাট নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং দেবগিরিতে অবস্থানরত বিদেশী আমীরদেরকে গুজরাটে পাঠানাের জন্য শাসনকর্তা নিজামউদ্দিনকে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ মােতাবেক দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদেশী আমীরদেরকে তিনি তার কাছে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। পথিমধ্যে এ সকল আমীরদের মনে এ চিন্তার উদ্রেক হয় যে, সুলতান তাদেরকে হয়তাে হত্যা করার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন। তারা দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল বলেই এ ধরনের চিন্তা বা আশঙ্কা তাদের মাঝে জন্ম নেয়। তাই তারা আত্মরক্ষার জন্য পথিমধ্যে বিদ্রোহ করে এবং তাদের সহযাত্রী হিসেবে সুলতানের যে সকল অনুচরবর্গ ছিল তাদেরকে তারা আকস্মিক আক্রমণ করে হত্যা করে। অতঃপর দেবগিরি প্রত্যাবর্তন করে তারা দেবগিরির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ খবর পেয়ে সুলতান দেবগিরি আক্রমণ করে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করেন। বিদ্রোহীদের নেতা ইসমাইল মুখ দেবগিরির দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সেখানে সুলতান কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। হাসানসহ কয়েকজন বিদ্রোহী স্বীয় অনুচরবর্গ নিয়ে গুলবর্গায় পালিয়ে যায়। সুলতান মুহম্মদ-বিন-তুঘলক হাসানকে সদলবলে ধরার জন্য সেনাপতি ইমাদউদ্দিনকে গুলবর্গার দিকে পাঠান। কিন্তু হাসান ইমাদউদ্দিনকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং গুলবর্গায় স্বীয় অবস্থান মজবুত করেন। এদিকে গুজরাটে আবার বিদ্রোহ দেখা দিলে সুলতান দেবগিরির ভার জনৈক সেনাপতির হাতে অর্পণ করে গুজরাটে চলে আসেন। এতে সুলতান বাহিনী দুর্বল হয় পড়ে। ফলে পরিস্থিতি বিদ্রোহীদের অনুকূলে চলে যায়। হাসান ইমাদউদ্দিনকে পরাজিত করায় বিদ্রোহীরা তার নেতৃত্বে সমবেত হতে থাকে। এমতাবস্থায় তাদের নেতা বৃদ্ধ ইসমাইল মুখ হাসানের নিকট দায়িত্ব ছেড়ে দেন। হাসান নেতৃত্ব গ্রহণ করে গুলবর্গায় স্বাধীন রাজ্যের কথা ঘােষণা দিয়ে আবুল মুজাফফর আলাউদ্দিন ‘বাহমন শাহ’ নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন। 

হাসানের নামের সাথে বাহমন শব্দ থাকায় এ রাজ্যের নাম হয় ‘বাহমনী রাজ্য’। তবে বাহমন শব্দের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হাসান প্রথম জীবনে দিল্লীতে গঙ্গু নামক এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষীর কর্মচারী ছিলেন। এবং এই ব্রাহ্মণ প্রভুর শক্তি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই বংশকে বাহমনী বংশ ও রাজ্যকে বাহমনী রাজ্য নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, হাসান পারস্যের বিখ্যাত বীর ইসফান্দিয়ারের পুত্র বাহমনের বংশধর বলে নিজেকে দাবী করতেন এবং সেজন্যই তিনি নিজের নামের সাথে বাহমন শাহ সংযুক্ত করেন ও রাজ্যকে বাহমনী নামে অভিহিত করেন। 

হাসান সিংহাসনে আরােহণ করেই রাজ্য বিস্তারে মনােযােগ দেন। তিনি দিল্লীর অধিকার থেকে গােয়া, ধবল, কোলাপুর, তেলিঙ্গনা প্রভৃতি দখল করেন এবং নিজ অনুচরদের মধ্যে জায়গীর প্রদান করেন। তার রাজ্যসীমা উত্তরে বরঙ্গল থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পশ্চিমে দৌলতাবাদ থেকে পূর্বে ডােনগীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি সমগ্র রাজ্যকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। . ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৭ বছর বয়সে হাসান মারা যান। হাসানের মৃত্যুর পর পুত্র মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি সুযােগ্য শাসক ছিলেন। স্বীয় রাজ্যের সংহতি বিধান করে তিনি পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যসমূহের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং বিজয়নগর ও তেলিঙ্গনা রাজ্য দুটিকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। মুহম্মদের মৃত্যুর পর পুত্র আলাউদ্দিন মুজাহিদ ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে অভিজাত শ্রেণী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত হয়। তা সত্ত্বেও মুজাহিদ সীমান্তবর্তী হিন্দু রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন এবং সে ব্যস্ততার এক পর্যায় তারই এক জ্ঞাতী ভ্রাতা দাউদের হাতে তিনি নিহত হন। দাউদও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। তিনি মুজাহিদের অনুচরদের হাতে নিহত হন। 

অতঃপর দাউদের ভাই দ্বিতীয় মুহম্মদ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। এ সুযােগে বিজয় নগরের শাসক বাহমনী রাজ্যের এক বিরাট এলাকা দখল করে নেন। দ্বিতীয় মহম্মদ শান্তিবাদী নৃপতি ছিলেন। তিনি বিজয়নগরসহ পার্শ্ববর্তী রাজন্যবর্গের সাথে মিত্ৰতা নীতি গ্রহণ করেন। তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতিসহ জনকল্যাণ কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। তিনি ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। দ্বিতীয় মুহম্মদের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে বিরােধ দেখা দিলে সেই সুযােগে আলাউদ্দিনের পৌত্র তাজউদ্দিন ফিরােজ সিংহাসন দখল করেন। তাজউদ্দিন ফিরােজ শাহ সুযােগ্য শাসক ছিলেন। তিনি পরপর দু’টি যুদ্ধে বিজয় নগরের বাহিনীকে পরাজিত করলেও তৃতীয় একটি যুদ্ধে বিজয়নগরের নিকট পরাজিত হন এবং রাজ্যের কিয়দংশ হারান। তার রাজত্বকালে তৈমুর লং উত্তর ভারত আক্রমণ করেন। তাজউদ্দিন তৈমুরের নিকট দূত পাঠালে তৈমুর সন্তুষ্ট হন এবং দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু তার রাজত্বের শেষের দিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিলে তিনি ভ্রাতা আহম্মদকে সিংহাসনে রসিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ১৪২২ খ্রিস্টাব্দে আহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি রাজধানী বিদরে স্থানান্তর করেন। তিনি বিজয়নগরের এক বিশাল এলাকা মালব ও বরঙ্গল স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন। আহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আলাউদ্দিন সিংহাসনে আরােহণ করেন। ভ্রাতা মুহম্মদের বিদ্রোহ দমন করে তিনি বিজয় নগর রাজ্য অক্রিমণ করে পরাজিত করেন ও কর দিতে বাধ্য করেন। এছাড়া জালাল খানের বিদ্রোহও দমন করেন। ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর পুত্র হুমায়ুন সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হলে নাবালক পুত্ৰ নিজাম শাহ ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে নিজাম শাহের আকস্মিক মৃত্যুতে তার নাবালক ভ্রাতা তৃতীয় মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। 

তৃতীয় মুহম্মদ শাহের মন্ত্রী মাহমুদ গাওয়ানের যােগ্যতায় রাজ্যের ক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রাজত্বের শেষের দিকে তিনি গাওয়ানকে ভুল বােঝেন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। গাওয়ানের মৃত্যুতে রাজ্য আবার শক্তিহীন হয়ে পড়ে এবং দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। তৃতীয় মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে পুত্র মাহমুদ সিংহাসনে আরােহণ করেন। এ সময় বাহমনী রাজ্য বিদরে সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর পর আরাে চারজন সুলতান নামমাত্র সিংহাসনে বসেন। প্রকৃতপক্ষে বাহমনী রাজ্য বলতে তখন আর বাস্তবে কিছু ছিল না বললেই চলে। এ সময় রাজ্য ৫টি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং বাহমনী রাজ্যের অবসান ঘটে। 

মাহমুদ গাওয়ান

বাহমনী সুলতান তৃতীয় মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালের অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাহমুদ গাওয়ান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি তৃতীয় মুহম্মদের রাজত্বকালকে গৌরবান্বিত করেন। তিনি ইরানের অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন এবং দক্ষিণ ভারতে ব্যবসা শুরু করেন। তার প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দিন তাকে আমীর পদে নিয়ােগ দেন। আমীর হিসেবে তিনি প্রশংসনীয় অবদান রাখায় সুলতান হুমায়ুন তাকে মালিক-উত-তুজ্জার উপাধি প্রদান করেন। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ বছর বয়স্ক তৃতীয় মুহম্মদ সুলতান হলে রাজমাতা মখদুমা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন এবং মাহমুদ গাওয়ানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাহমুদ গাওয়ান প্রথমেই অভিজাত শ্রেণীর কোন্দল দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তিনি তার ব্যক্তিত্ব, সকলের প্রতি সমব্যবহার, সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার দ্বারা সকলের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। 

ইতােপূর্বে উড়িষ্যা ও তেলিঙ্গনার রাজা যৌথভাবে বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করে বিদর পর্যন্ত অধিকার করেন। গাওয়ান এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদেরকে বিতাড়িত করে বিদর মুক্ত করেন। এ সময় মালবের সুলতানের একটি আক্রমণও গাওয়ান প্রতিরােধ করেন। এরপর তিনি সীমান্তবর্তী হিন্দু রাজ্য কোঙ্গন আক্রমণ করে প্রচুর ধন সম্পদ হস্তগত করেন। কাঞ্চির বিরুদ্ধেও সফল অভিযান পরিচালনা করে ধন-সম্পদ লাভ করেন। এভাবে বাহমনী সাম্রাজ্য উড়িষ্যা থেকে গােয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দীর্ঘদিন পর এ রাজ্য তার নেতৃত্বে আবার শৌর্যবীর্য অর্জন করে। 

সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে গাওয়ান সুশাসন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করেন। তিনি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি আনয়ন করেন, সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেন, বিচার বিভাগ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন। তিনি প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে গতিশীল করেন। গাওয়ানের এ সকল অপরিসীম কৃতিত্বে ঈর্ষান্বিত হয়ে কতিপয় আমীর তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা পার্শ্ববর্তী শত্রু রাজাদের সাথে গাওয়ানের গােপন যােগসাজসের একটি মিথ্যা দলিল দ্বারা সুলতানকে ক্ষুব্ধ করেন। মদ্যপায়ী সুলতান তৃতীয় মুহম্মদ ষড়যন্ত্রকারীদেরকে বিশ্বাস করে গাওয়ানকে ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তার মৃত্যুতে বাহমনী রাজ্যই কেবল নয় ভারত একজন যােগ্য শাসক হারায়। গাওয়ানের মৃত্যুতে রাজ্যে আবার বিশৃঙ্খলা ও অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়। সুলতান তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। কিন্তু তখন আর করার কিছুই ছিল না। গাওয়ান একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন, সন্দেহ নেই। তার যােগ্যতা ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ঐতিহাসিকরা তাকে তুরস্কের কুপ্রিলী ও মুহম্মদ সােকোল্লী এবং হারুন-অর-রশীদের বার্মেকী উজিরের সাথে তুলনা করেছেন। 

বিজয়নগর রাজ্য

সুলতান মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে বাহমনী রাজ্যের ন্যায় আর একটি রাজ্যের উৎপত্তি হয়। এ রাজ্যটির নাম হলাে বিজয়নগর রাজ্য। যাদব বংশের সঙ্গম নামক জনৈক প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তির পাঁচ পুত্র সম্মিলিতভাবে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা দীর্ঘ ৩০০ বছর স্থায়ী ছিল। এ রাজ্যের মূল ভিত্তি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। চারটি হিন্দু রাজবংশ বিজয়নগর রাষ্ট্র শাসন করে। কিংবদন্তী অনুযায়ী জানা যায় যে, যাদব বংশীয় সঙ্গমের পাঁচ পুত্র ছিল এবং তাদের মধ্যে হরিহর ও বুক্কাই ছিলেন নেতৃস্থানীয়। দক্ষিণ ভারতের তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ তীরের অঞ্চলসমূহে মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে তার নেতৃত্ব দেন হরিহর ও বুক্কাই ভ্রাতৃদ্বয়। তারা সেই এলাকায় স্বাধীনতা ঘােষণা করে বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। 

সঙ্গম বংশ : বিজয় নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্কাই প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ সঙ্গম বংশ নামে পরিচিত। হরিহর ও বুক্কাই যুগ্মভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তারা তাদের রাজ্য উত্তরে কৃষ্ণা নদী থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তারা বাহমনী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এক যুদ্ধে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে হরিহর নিহত হন। অতঃপর বুক্কাই একাই বাহমনীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। অবশেষে ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাহিনীদের হাতে তিনিও নিহত হন। বুক্কাইয়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় হরিহর নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। ঐতিহাসিকরা তাকে বিজয়নগর রাজ্যের প্রথম স্বাধীন নরপতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তিনিই প্রথম রাজকীয় মহারাধিরাজ পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন। তার পিতা ও পিতৃব্য কোন রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেননি। সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি দ্বিগ্বিজয়ে বের হন এবং একে একে মহিশূর, কানাডা, ত্রিচিনােপল্লী, কাঞ্চি প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে সাম্রাজ্য সীমা বৃদ্ধি করেন। তিনি সুশাসন ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা গেলে উত্তরাধিকার নিয়ে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং যুদ্ধে প্রথম দেবরায় ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে জয়লাভ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু তিনি শাসক হিসেবে তিনি তেমন পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি। তিনি বাহমনী রাজ ফিরােজ শাহের নিকট পরাজিত হয়ে তার সাথে নিজ কন্যার বিবাহ দিতে বাধ্য হন। প্রথম দেবরায়ের পর বিজয়রায় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি মাত্র ৯ বছর শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় দেবরায় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বাহমনীদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু বারবার পরাজিত হয়ে কর দিতে বাধ্য হন। তার রাজত্বকালে ইতালীয় পরিব্রাজক নিকোলাই কন্টি ও পারসিক পরিব্রাজক আঃ রাজ্জাক বিজয় নগর রাজ্যে পরিভ্রমণে আসেন। তাদের বর্ণনা বিজয়নগর রাজ্যের ইতিহাসের অনন্য উপাদান। দ্বিতীয় দেবরায়ের পর ভ্রাতা বিজয়, বিজয়ের পর দ্বিতীয় দেবরায়ের পুত্র মল্লিকার্জুন এবং মল্লিকার্জুনের পর ভ্রাতা বিরুপাক্ষ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তারা সকলেই ছিলেন অযােগ্য। ফলে রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং শালুব বংশ ক্ষমতা দখল করে। 

শালুব বংশ : সঙ্গম বংশের রাজত্বের শেষের দিকে রাজ্যে যে অরাজকতা ও অশাস্তির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেন চন্দ্রগিরির শালুব বংশীয় নরসিংহ। তিনি একজন সামন্তরাজা ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। সঙ্গম বংশের শেষ রাজা বিরুপাক্ষকে বিতাড়িত করে তিনি সিংহাসনে বসেন এবং একে একে সকল বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দমন করে রাজ্যকে সুসংগঠিত করেন। ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে নরসিংহের মৃত্যুর পর নাবালক পুত্র তিস্ম সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং মন্ত্রী নরস নায়ক তার অভিভাবক হন। কিন্তু নরস তিস্মকে হত্যা করে নরসিংহের অপর পুত্র ইম্মাদিকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজের ইচ্ছামত শাসনকার্য চালাতে থাকেন। তবে তিনি রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হন। রাজ্যের সর্বত্র নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর নরস ইম্মাদিকে বিতাড়িত করে নিজেই সিংহাসনে আরােহণ করেন। এভাবে শালুব বংশের অবসান ঘটে। 

তুলব বংশ : ইম্মাদিকে বিতাড়িত করে নরস নায়ক সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি একজন সুযােগ্য রাজা ছিলেন। তিনি বিজয়নগর রাজ্যের হৃত গৌরব অনেকাংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে নরস নায়ক মারা গেলে জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর নরসিংহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। বীর নরসিংহ সিংহাসনে আরােহণ করায় শালুব বংশের সমর্থকরা রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এ সকল বিশৃঙ্খলা দমনেই তাকে আমৃত্যু ব্যস্ত থাকতে হয়। ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান এবং সৎ ভাই কৃষ্ণদেব রায় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি একজন দক্ষ ও উচ্চাভিলাষী রাজা ছিলেন। তিনি সিংহাসনে আরােহণ করে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমন করে রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাহমনী ও উড়িষ্যার কাছ থেকে অনেক এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। তিনি পর্তুগিজদের দমন করে উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান করেন। এভাবে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, পূর্ববর্তী রাজাদের আমলে হারানাে অঞ্চলসমূহের অধিকাংশ পুনরুদ্ধার, উপকূলীয় নিরাপত্তা বিধান প্রভৃতির মাধ্যমে বিজয়নগর রাজ্যকে শক্তিশালীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়, পতুর্গিজ পর্যটক পায়েজের বিবরণ থেকে। পায়েজ এ সময় বিজয়নগর রাজ্যে পরিভ্রমণে এসে অনেকদিন অবস্থান করে এতদাঞ্চল সম্পর্কে এক মনােজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যান। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায় মৃত্যুবরণ করেন। কৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর তার মনােনয়ন অনুযায়ী জ্ঞাতিভাই অচ্যুত রায় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ অবস্থার আরাে অবনতি ঘটে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে। এ রকম পরিস্থিতিতে অচ্যুৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন এবং পুত্র বেঙ্কট তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছয়মাস রাজত্ব করার পর অচ্যুতরায়ের ভ্রাতুস্পুত্ৰ সদাশিবরায় কর্তৃক বিতাড়িত হন। সদাশিবের রাজত্বকালে অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি তাদের হাতের ক্রীড়ানক হয়ে পড়েন। এদের নেতা ও মন্ত্রী রামরায়ই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেন। তবে তিনি যােগ্যতার সাথে শাসন করতে থাকেন। তিনি কূটনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতে মুসলিম রাজ্যগুলাের মধ্যে পারস্পরিক বিরােধ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। প্রথমদিকে সফল হলেও তার মুসলিমবিরােধী কিছু কার্যাবলী ঐ সকল রাজ্যগুলােকে ধর্মীয়ভাবে আঘাত করে। ফলে তারা একতাবদ্ধ হয়ে বিজয়নগর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তালিকোটার যুদ্ধে রামরায় চরমভাবে পরাজিত হন। এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ হিন্দু সৈন্য নিহত হয়। রামরায় বন্দী হন এবং তার শিরচ্ছেদ করা হয়। বিজয়নগর রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা মুসলমানরা দখল করে নেয়। অবশ্য রামরায়ের ভ্রাতা তিরুমল পালিয়ে গিয়ে পেনুগােত্তা নামক স্থানে রাজত্ব শুরু করেন। 

আরবিডু বংশ : তিরুমল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ আরবিডু বংশ নামে পরিচিত। সদাশিব রায় তখনও জীবিত ছিলেন এবং ক্ষুদ্র একটি এলাকা শাসন করতেন। তিরুমল সদাশিবকে বিতাড়িত করে তা দখল করে নেন এবং বিজয়নগর রাজ্যকে কিছুটা শক্তিশালী করতে সক্ষম হন। তিরুমলের পর পুত্র দ্বিতীয় রঙ্গ এবং দ্বিতীয় রঙ্গের পর অন্যপুত্র দ্বিতীয় বেঙ্কট সিংহাসনে আরােহণ করেন। তারা তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এ সময় রাজ্যে ক্রমেই বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দ্বিতীয় বেঙ্কটের পর তৃতীয় রঙ্গ সিংহাসনে আরােহণ করেন। এ সময় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তিনি বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন। ফলে রাজ্য বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনকর্তাদের নেতৃত্বে ছিন্নভিন্ন হয়ে কতগুলাে স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এভাবে বিজয়নগর রাজ্যের অবসান ঘটে। 

বিজয়নগর রাজ্যের ভূমিকা ও শাসনব্যবস্থা

বিজয়নগর রাজ্যটি দক্ষিণ ভারতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন সারা ভারতে মুসলিম সংস্কৃতি দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে তখন হিন্দুরা বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করতে সক্ষম হয়। প্রায় ৩০০ বছর যাবৎ এ রাজ্যটি আপন মহিমায় সমুন্নত থাকে। এ রাজ্যটি মুসলিম রাজ্যগুলাের ওপর তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হলেও বাহমনী রাজ্যটি এ রাজ্যের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল বিধায় বাহমনী রাজ্যটির ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব হয়। অনেকের মতে, বাহমনী রাজ্য শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও বিজয়নগর রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কারণে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোেগ পায়নি। অন্যথায় উত্তর হতে এ সময় যে দুর্বলতা ছিল তার সুযােগে বাহমনী সুলতানরা উত্তর ভারত দখল করে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত, আর তা এই হিন্দু রাজ্যটির জন্য আরাে হুমকি স্বরূপ হতাে।

বিজয়নগর রাজ্যের শাসন প্রকৃতি ভারতে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে গেছে। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনিক অবকাঠামাে তৈরী করে রাজারা এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। তারা শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি এককে ও স্তরে সুযােগ্য শাসক নিয়ােগ করে একটি সুনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনযন্ত্র চালু রাখেন। এ রাজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ভারতের মধ্যে এখানেই প্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, যদিও তা ধর্মভিত্তিক ছিল। বিজয়নগর রাজ্যে নারীর স্থান সম্মানজনক ছিল। অবশ্য বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের কর্তৃত্ব অব্যাহত ছিল। শাসকগণ ধার্মিক ছিলেন, তবে শাসনকার্যে উদার ছিলেন। এখানে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লােকেরাও নিরাপদে বসবাস করত। অর্থনৈতিকভাবেও বিজয়নগর রাজ্য সমৃদ্ধশালী ছিল এবং জনগণের তেমন কোন অভাব ছিল না। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাজাগণ যথেষ্ট পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। 

দিল্লী সালতানাতের পতন 

ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমায় ৩০০ বছরের অধিককাল চলার পর অবশেষে দিল্লী সালতানাতের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকরা এর দীর্ঘ প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে এর পতনের কারণসমূহ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এর কারণ দুরকম – আভ্যন্তরীণ ও বহিরাক্রমণজনিত।

অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ 

(১) একনায়ক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও দুর্বল ও অযােগ্য উত্তরাধিকার : দিল্লী সালতানাতের শাসন কাঠামাে একনায়ক ও স্বৈরতান্ত্রিক ছিল। সুলতানই ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে সুলতানের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভা প্রভৃতির ওপর সালতানাতের ক্ষমতা, মর্যাদা ও কার্যকারিতা নির্ভর করত। সুলতান শক্তিমান মানেই রাষ্ট্র শক্তিশালী আবার সুলতান দুর্বল মানেই রাষ্ট্র দুর্বল- এই ছিল দৃশ্যত রাষ্ট্রব্যবস্থা। দিল্লী সালতানাতে যেমন শক্তিমান শাসকের আবির্ভাব ঘটে, তেমনি দুর্বল ও অপদার্থ শাসকেরও আবির্ভাব ঘটে। তবে ৩০০ বছরের অধিককালের দিল্লী সালতানাতের অধিকাংশ সুলতানই ছিলেন অযােগ্য, অদক্ষ ও অপদার্থ। কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, বলবন, আলাউদ্দিন খলজী মুহম্মদ বিন-তুঘলক ছাড়া বাকি সকলেই ছিলেন অযােগ্য ও দুর্বল চিত্তের অধিকারী, তারা শাসনকার্যে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। উপরিউক্ত সুলতানগণের অন্তর্বর্তীকালেও অনেক দুর্বল শাসকের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু পরবর্তীতে যােগ্যতা সম্পন্ন সুলতানদের আবির্ভাব ঘটলে তারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেন। কিন্তু মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের পরবর্তীকালে আর কোন শক্তিমান শাসক ও বীর যােদ্ধার আবির্ভাব না হওয়ায় পতনকে রােধ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রীয় একনায়ক ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এই পরিণতির জন্য দায়ী ছিল সন্দেহ নেই। 

(২) উত্তরাধিকারের সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব  : দিল্লী সালতানাতের উত্তরাধিকারের কোন সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রনীতি ছিল না। ষড়যন্ত্র ও বাহুবলই ছিল সিংহাসন লাভের হাতিয়ার। আর এর সুযােগ গ্রহণ করত আমীর-ওমরাহগণ। তারা নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে দুর্বল চিত্তের যুবরাজ বা তেমন কাউকে সিংহাসনে বসানাের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতাে। যেমন- কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর কতিপয় আমীর “আরাম শাহ” নামক একজন অযােগ্য ব্যক্তিকে কুতুবউদ্দিনের পুত্র পরিচয়ে সিংহাসনে বসালে অন্যান্য আমীরগণ কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও বদাউনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিসকে সমর্থন করে দিল্লী দখলে আমন্ত্রণ জানান এবং এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইলতুৎমিস তাকে পরাজিত করে সিংহাসনে বসেন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তার মনােনীত রাজিয়াকে আমীরগণ সিংহাসনে না বসিয়ে ইলতুৎমিসের এক অযােগ্য পুত্র রুকনউদ্দিনকে বসান। কয়েক মাসের মধ্যেই রাজিয়া কতিপয় আমীরের সহযােগিতায় রুকনউদ্দিনকে পরাজিত করে সিংহাসন বসেন। এর কয়েক বছর পর আমীর-ওমরাহগণ রাজিয়াকে পরাজিত করে ইলতুৎমিসের অপর এক পুত্রকে সিংহাসনে বসান। এভাবে ষড়যন্ত্র ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বলবনের পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। বলবন স্বীয় জামাতা সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক মনােনীত হয়ে সিংহাসনে বসেন সত্য, কিন্তু সে মনােনয়নও মূলত বলবন স্বীয় একচেটিয়া কর্তৃত্ব বলে আদায় করেন। বলবনের পর আবার অভিজাত শ্রেণীর ইচ্ছামত সুলতান বদল হতে থাকে। এমনকি, আলাউদ্দিন খলজীও তরবারীর বলে সিংহাসন দখল করেন। এভাবে সালতানাতের প্রায় পুরাে সময়টি জুড়ে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সুলতান নির্ধারিত হওয়ায় সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হয়, যা সালতানাতকে প্রায় পতনােম্মুখ করে রাখত। 

(৩) সামরিক শক্তির ওপর নির্ভজ্ঞতা : দিল্লী সালতানাতের সুলতানগণের ক্ষমতার উৎস ছিল সেনাবাহিনী। তারা অস্ত্রের বলে ভারত বিজয় করেন এবং অস্ত্রের দ্বারাই সে বিজয়কে স্থায়িত্ব দিতে বদ্ধপরিকর হন। তারা জনগণের হৃদয় করতে বা জনসমর্থন লাভ করতে চেষ্টা করেননি বললেই চলে। ফিরোজ শাহ তুঘলক ছাড়া আর কেউই এমন কোন প্রজামঙ্গলকর কর্মসূচী গ্রহণ করেননি, যা সালতানাতের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থন সৃষ্টি করতে পারে। মূলত হিন্দু-প্রধান ভারতে মুসলমানরা যেমন ভারতীয়দেরকে বিশ্বাস করতে পারেনি, তেমনি ভারতীয়রাও মুসলমানদেরকে মেনে নিতে পারেনি। হিন্দুরা, বিশেষ করে রাজপুত জাতি মুসলিম বিতাড়নে সর্বদা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। ফলে মুসলিম শাসকরাও সমরশক্তির দ্বারা ভারতকে দাবিয়ে রাখার নীতিতে অবিচল ছিলেন। কিন্তু এভাবে সেনানির্ভর থাকায় সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে পড়ে। 

(৪) শাসক-শাসিতের মধ্যকার দূরত্ব ও সামন্তপ্রথা : দিল্লীর সুলতানী শাসনামলে শাসক ও শাসিতের মধ্যকার দূরত্ব শাসন ব্যবস্থাকে সবসময়ই দুর্বল করে রাখে। শাসক শ্ৰেণী কখনােই সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসেনি। সাধারণ মানুষও তাদের অভাব-অভিযােগ জানানাের জন্য শাসক শ্রেণীর কাছে আসতে পারেনি। ভারতীয় শাসন কাঠামাে ও সমাজ ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। এদের ভিত্তি ছিল জায়গীরদাররা। তারা ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার ওপর কর্তৃত্ব করত, শােষণ-পীড়ন করত। এ সকল সামন্ত প্রভুদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতাে। তাদের দ্বারা রায়তরা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হত। ভূমিতে রায়তদের কোন অধিকার ছিল না, যেকোন অজুহাতে যে কোন সময় ভূমি থেকে তাদেরকে উৎখাত করা হতাে। অন্যদিকে সুলতানরাও নির্ভরশীল ছিলেন এদের ওপর। তারা সুলতানকে যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ও অশ্ব সরবরাহ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অদক্ষ ও অনুপযুক্ত হতাে। সুলতানের পরিবর্তন হলেও রায়তদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হতাে না। এই মধ্যস্বত্ব শ্ৰেণীর হাত থেকে তাদের রক্ষা পাবার কোন সুযােগ ছিল না। এ অবস্থার কথা তারা সুলতানকে জানানােরও সুযােগ পেত না, সুলতানও কোনভাবে জানার চেষ্টা করতেন না এবং জানতে পারতেন না। এই দূরত্বের ফলে সাধারণ মানুষ এদেশকে ও শাসকদেরকে নিজেদের দেশ ও শাসক বলে ভাবতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষের সমর্থনের অভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রকৃতপক্ষে কখনাে দৃঢ় হতে পারেনি। এই সামন্তপ্রভূরা বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত থাকত এবং তাদের স্বার্ধের হানী ঘটলেই সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। এই কুফলের কথা ভেবেই আলাউদ্দিন খলজী জায়গীর প্রথা রহিত করেন। ইউরােপের সামন্তরা রাষ্ট্রের আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল, কিন্তু ভারতীয় সামন্তরা ছিল রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ স্বরূপ। 

(৫) প্রাদেশিক শাসকদের কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা : সালতানাতের পতনের অন্যতম কারণ ছিল প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কেন্দ্র বিমুখতা। প্রায়শই দেখা যায় যে, প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রদেশের ধন-সম্পদ ও সেনাবাহিনী নিজের মত করে পরিচালনা করে অঘােষিত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতেন। তারা যতদূর সম্ভব কেন্দ্র থেকে নিজেদেরকে আড়াল করে আলাদা শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হতেন এবং সুযােগ পেলেই স্বাধীনতা ঘােষণা করে সেই শক্তিকে কাজে লাগাতেন। কেন্দ্রকে শক্তিশালী না করে প্রদেশকে শক্তি কেন্দ্রে পরিণত করে তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল ও রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট করে সালতানাতের পতনকে ত্বরান্বিত করেন। 

(৬) শাসকদের আরামপ্রিয়তা ও বিলাসিতা : দিল্লী সালতানাতের অধিকাংশ সুলতানই ছিলেন আরামপ্রিয়। তারা শাসনকার্যে মনােযােগ না দিয়ে বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতেন। এ সকল বিলাসী কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের প্রভূত অর্থ ব্যয় হতাে। কোন কোন সুলতান বিলাসিতায় এত মত্ত্ব হয়ে পড়েন যে, শাসনকার্য সম্পূর্ণরূপে উজিরের ওপর অর্পণ করে দিনরাত হারেমেই পড়ে থাকতেন। সুলতানদের এ বিলাসিতা ও আরামপ্রিয়তার সুযােগে স্বার্থপর আমীর-ওমরাহগণ সুলতানদেরকে বিলাস সামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে সন্তুষ্ট রেখে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করতে প্রবৃত্ত হতাে। এতে প্রশাসন যন্ত্র দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়ত এবং কোন নিয়ন্ত্রক না থাকায় তারা যথেচ্ছাভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়ােগ করত, যা রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। 

(৭) সাম্রাজ্যের বিশালতা : সাম্রাজ্যের বিশালতা দিল্লী সালতানাতের পতনের অন্যতম কারণ ছিল। যদিও এ বিস্তৃতি আকস্মিকভাবে ঘটেনি, তা ছিল দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল; সুলতানরা স্বীয় সামরিক শক্তির দ্বারা এই বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে দিল্লী সালতানাত সম্প্রসারিত হতে হতে মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের সময় তা সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারতব্যাপী বিস্তৃত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এর সংহতি বিধান করা বা রক্ষা করার মত কোন সুলতানের আবির্ভাব হয়নি। ফলে মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বের শেষভাগ হতে সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তাই সাম্রাজ্যকে চূড়ান্ত পতনের দিকে ধাবিত করে। মূলত আলাউদ্দিন খলজী ও মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের ব্যক্তিগত যোগ্যতায় সাম্রাজ্যের এই ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলেও সে যুগের যোগাযোেগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে দূরবর্তী প্রদেশসমূহের বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। চারিদিকে একের পর এক প্রদেশসমূহের বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এই ভাঙ্গন পরবর্তী সুলতানগণ রোধ করতে পারেননি। 

(৮) হিন্দুদের বিরােধিতা : হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে হিন্দুদের সমর্থন মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক ছিল। কিন্তু দিল্লীর সুলতানরা তাদেরকে গুরুত্ব দেয়নি। পরবর্তীকালে মােগল সম্রাট আকবর যেমন হিন্দুদের সমর্থন পাওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, এরকম কোন উদ্যোগ সুলতানী যুগের কেহ গ্রহণ করেননি। ফলে হিন্দুদের সমর্থন সুলতানরা লাভ করতে পারেননি। উপরন্তু হিন্দুরা জবর দখলকারী মুসলমানদের বিতাড়িত করে রাজ্য ফিরে পাবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিল। তারা যেমন মুসলমানদেরকে মেনে নেয়নি, তেমনি মুসলিম শাসক শ্রেণীও তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। এর প্রেক্ষিতে হিন্দুরা যথারীতি মুসলিম শাসনের বিরােধিতা করে থাকে, যা দিল্লী সালতানাতের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 

(৯) ক্রীতদাস প্রথা : সুলতানী আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ক্রীতদাস প্রথা। দিল্লী সালতানাতের প্রথম দিকের কতিপয় সুলতান যেমন প্রথম জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন, তেমনি তারাও আবার প্রচুর ক্রীতদাস পালন করতেন। দিল্লী সালতানাতের যাত্রাই হয়েছে ক্রীতদাসদের মাধ্যমে। যেমন- মুহাম্মদ ঘুরীর বিশাল ক্রীতদাস শ্রেণীর অন্যতম কুতুবউদ্দিন আইবক ভারতের প্রথম সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন, ঘুরীর অন্যান্য অনেক ক্রীতদাস প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির পদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এমনিভাবে কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, বলবন, ফিরােজশাহ তুঘলক বিশাল ক্রীতদাস শ্ৰেণী পোষণ করতেন ও তাদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ােজিত করতেন। প্রথমদিকে এই ক্রীতদাস শ্রেণী সামাজ্যের আশীর্বাদ স্বরূপ হলেও পরবর্তীকালে তা অভিশাপে পরিণত হয়। বিখ্যাত কয়েকজন সুলতান ছাড়া বাকি পুরাে সময়টাতেই এই ক্রীতদাস শ্রেণী সামাজ্যের নিয়ন্তায় পরিণত হয়। তারাই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মূল হােতায় পরিণত হয় এবং নিজেদের ইচ্ছামত দুর্বল সুলতানকে সিংহাসনে বসিয়ে স্বার্থসিদ্ধিতে নিমগ্ন হয়। ফিরােজ শাহ তুঘলকের কালে ক্রীতদাস শ্ৰেণী রাষ্ট্রের বােঝায় পরিণত হয়, যা অর্থনীতির ওপর চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ক্রীতদাস শ্রেণীর এই নেতিবাচক ভূমিকা ও রাজকোষের ওপর চাপ দিল্লী সালতানাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।

(১০) অর্থনৈতিক সংকট : রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি অর্থনীতি। অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হলে শক্তিশালী ও বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করা যায়, শক্তিশালী প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়, প্রয়ােজনীয় সংস্কার সাধন করা এবং দেশের যােগাযােগ ও ভৌত অবকাঠামােসহ সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনসমর্থন লাভ করা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট থাকলে এসব ব্যয় অবলম্বন করা যায় না, ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে পড়ে। দিল্লীর অধিকাংশ সুলতান দুর্বল ও আরামপ্রিয় হওয়ায় তারা একদিকে প্রশাসনের দুর্নীতি দূর করতে ও প্রয়ােজনীয় রাজস্ব আদায় করতে পারেননি, অন্যদিকে বিলাস-ব্যসনে প্রভূত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে রাজকোষ শূন্যে পরিণত করেন। মুহম্মদ-বিন তুঘলকের রাজত্বকাল থেকেই সাম্রাজ্যে অর্থনৈতিক সংকটের সূত্রপাত ঘটে এবং পরবর্তী শাসকদের আমলে তা চরম আকার ধারণ করে। তারা অর্থ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি বিধায় শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও প্রশাসনও গড়ে তুলতে পারেননি। যার ফলে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরােধ করতে তারা ব্যর্থ হন।

(১১) মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের ব্যর্থতার প্রভাব : সুলতান মুহম্মদ-বিন তুঘলকের রাজত্বকালেই সাম্রাজ্যের সীমা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আবার এ সময়ই সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। ঐতিহাসিকদের মতে, মুহম্মদ-বিন তুঘলকের মহাপরিকল্পনাগুলাে একের পর এক ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং বিভিন্ন প্রদেশ স্বাধীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এ বিচ্ছিন্নতার ধারা অব্যাহত থাকে, যা কেউই আর রােধ করতে সক্ষম হয়নি। এজন্য কোন কোন ঐতিহাসিক তার এ ব্যর্থতাকে দিল্লী সালতানাতের পতনের জন্য দায়ী করেছেন। 

(১২) ফিরােজশাহ তুঘলকের সংস্কারসমূহের কুফল : ফিরােজশাহ তুঘলক একজন প্রজাহিতৈষী, ন্যায়পরায়ণ, শান্তিবাদী ও ধার্মিক শাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তার সংস্কারগুলাে সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। বিশেষ করে জায়গীর প্রথার পুনপ্রবর্তন, উত্তরাধিকার সূত্রে সামরিক ও সরকারি বিভিন্ন পণ লাভের নিয়ম প্রবর্তন এবং বিশাল ক্রীতদাস শ্রেণী গঠন সাম্রাজ্যের সংখ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। তিনি এ সংস্কারগুলাে এমন এ প্রবর্তন করেন যখন সাম্রাজ্যের সীমা দ্রুতবেগে সংকুচিত হয়ে আসে। এ অবস্থায় সুলতান হৃত অঞ্চলসমূহ পুনরুদ্ধার না করে কিংবা সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশটুকু সুসংহত ও শক্তিশালী না করে জায়গীর প্রথা ও উত্তরাধিকার পদ্ধতির সামরিকনীতি প্রণয়ন করে সালতানাতকে আরাে দুর্বল করে ফেলেন। আলাউদ্দিন খলজীর মত তেজস্বী ও শক্তিমান শাসক সালতানাতকে রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্য যে জায়গীর প্রথা রহিত করেন, ফিরােজশাহ তুঘলক তা আবার বলবৎ করে আত্মহননেরই ব্যবস্থা করেন। 

(১৩) জাতীয়তাবােধের অভাব : একটা রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের জন্য জাতীয়তাবােধের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ভারতের জনগণের মাঝে এ ধরনের কোন চেতনার বা মানসিকতার সৃষ্টি হয়নি। শাসকরাও জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি ও বিকাশের প্রয়ােজনবােধ করেননি বা জনগণকে সেভাবে উদ্বুদ্ধ করেননি। ইউরােপের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ১৫শ শতকের শুরুতেই জনগণের মাঝে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের চেতনা জেগে ওঠে ও জাতীয়তাবােধের সূচনা হয় এবং তারা মধ্যযুগীয় কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আধুনিক যুগের সূচনা করে। কিন্তু ভারতে এর কোন প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। ফলে দেশ বা সরকারের প্রতি জনগণের কোন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। জনগণ নিজেদেরকে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে বা এই দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে মনে করতে পারেনি। মূলত এই দেশ ও মাটিতে জনগণের কোন অধিকার না থাকায়, দেশ ও মাটির প্রতি তাদের কোন কর্তব্যবােধও জাগ্রত হয়নি। আর এজন্য দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবােধেরও জন্ম হয়নি। ফলে জনগণও রাষ্ট্রের শক্তির উৎসে পরিণত হয়নি। 

(১৪) অভিজাত শ্রেণীর ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি পরায়ণতা : অভিজাত শ্রেণীর ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতির গহীন গহ্বরে হাবুডুবু খেয়েই দিল্লী সালতানাত অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছে। প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পরই এই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ইলতুৎমিসের পর অভিজাত শ্রেণী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে এতই ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ে যে তারাই রীতিমত সুলতান মনােনীত ও অপসারণ করার যন্ত্রে পরিণত হয়। তারা রাজবংশের দুর্বল ব্যক্তিকে সিংহাসনে বানিয়ে নিজেদের প্রয়ােজনে তাকে ব্যবহার করত। এভাবে দিল্লী সালতানাতের প্রায় পুরাে সময়টাতেই ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় ছিল। বলবন, আলাউদ্দিন খলজী ও মুহম্মদ-বিন-তুঘলক ষড়যন্ত্রকারীদেরকে অনেকটা নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রীয় করতে সক্ষম হলেও অন্যান্য সুলতানগণ এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে বলা যায় আত্মসমপণ করেন। এই সকল অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সুলতান কায়কোবাদের উজির নিজামউদ্দিন, আলাউদ্দিন খলজীর প্রধান সেনাপতি মালিক কাফুর, কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহের আমলে খসরু শাহ প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এদের ষড়যন্ত্র, দুঃশাসন, দলাদলি গােটা সাম্রাজ্যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ সকল অভ্যন্তরীণ কারণে দিল্লী সালতানাত পতনােন্মুখ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বহিঃশত্রুর আক্রমণসমূহ পতনের চূড়ান্ত দায়িত্ব পালন করে।

বহিঃশত্রুর আক্রমণ জনিত কারণ 

(১) বারংবার সীমান্ত আক্রমণ : দিল্লী সালতানাতের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মধ্য এশিয়ায় মােঙ্গল শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। তারা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জনপদ দখল করে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে। ভারতে এদের প্রথম আগমন ঘটে ইলতুৎমিসের সময়। ইলতুৎমিস কৌশলে তাদেরকে নিবৃত করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীকালে আর সেভাবে সম্ভব হয়নি। মােঙ্গলদের আক্রমণ প্রবল বেগে শুরু হয় বলবনের সময়। এ সময় সীমান্তে এদের চাপ এত ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, বলবন সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন সীমান্তে মােঙ্গল প্রতিরােধের কাজে। তিনি একজন সমর কুশীল, দুর্ধর্ষ ও উচ্চাভিলাষী নরপতি হওয়া সত্ত্বেও মােঙ্গল প্রতিরােধ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ নীতি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। মােঙ্গল প্রতিরােধ কাজে যুবরাজ মুহম্মদ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেন। আলাউদ্দিন খলজী মােঙ্গলদের প্রতিরােধের জন্য তার সামরিক ও অর্থনীতিতে পর্যন্ত ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তিনি জায়গীর প্রথা রহিত করে নগদ বেতনে স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বাজার দর পর্যন্ত বেঁধে দেন। সুলতানের এ সকল কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্ধর্ষ মােঙ্গলদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষার জন্য সমরশক্তিকে যথাযথভাবে প্রয়ােগ করা। বলবন ও আলাউদ্দিন খলজীর ন্যায় শক্তিমান সুলতানদ্বয়কে যদি মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগ করতে না হতাে তাহলে হয়তাে তারা দিল্লী সালতানাতকে আরো সুসংগঠিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও নিষ্কন্টক করে যেতে পারতেন। কিন্তু মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে আত্মনিয়ােগ করতে গিয়ে তা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সুলতানগণ মােঙ্গলদের গতিরােধ করতে সক্ষম হননি। সীমান্তে মােঙ্গলদের তৎপরতা ভারতীয় সুলতানদের অনেক জনবল ও অর্থের ক্ষতি করে যা সালতানাতের পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। 

(২) তৈমুর লং-এর আক্রমণ : দিল্লীর সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তুঘলকের রাজত্বকালে দুর্ধর্ষ ও দিগ্বিজয়ী বীর তৈমুর লং ভারত আক্রমণ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, দিল্লী ও উহার কাছেস্থ এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দিল্লী নগরী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তুঘলক পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এতে দিল্লী সালতানাতের শাসন কাঠামাে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে এবং অল্পকাল পরই তুঘলক বংশের অবসান ঘটে ও দিল্লী তৈমুরের শাসনকর্তা খিজির খাঁর অধীনে চলে যায়। তবে তৈমুরের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি পরবর্তী কোন সুলতানই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। 

(৩) বাবরের আক্রমণ : ভারতে মুঘল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আক্রমণ দিল্লী সালতানাতের শেষ দৃশ্যের অবতারণা করে। কোনমতে টিকে থাকা দিল্লী সালতানাত ইব্রাহিম লােদীর দুঃশাসন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের প্রেক্ষিতে আরাে ভগ্নদশায় পরিণত হয়। ইব্রাহিম লােদীর একান্ত কাছের মানুষগুলােই দূরে সরে যায় এবং বাবরকে ভারত আক্রমণে আমন্ত্রণ জানায়। অতি সহজে বাবর ভারতে প্রবেশ করেন এবং ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লােদীকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন ও সেখানে মােগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে দিল্লী সালতানাতের চির অবসান ঘটে। তাই বলা যায়, ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী সালতানাত ৩২০ বছর কাল অবস্থান করার পর বিলুপ্ত হয় এবং এ বিলুপ্তি তথা পতনের পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাক্রমণজনিত বিভিন্ন কারণ কার্যকর ছিল।  

বাবরের ভারত বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা 

ভূমিকা

বাবরের ভারত বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষ অসংখ্য বিবাদমান রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তুঘলক বংশের শাসনের শেষভাগে দিল্লীর কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হ্রাস পেলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় ভারতে সার্বভৌম কোন রাজশক্তি ছিল না। শক্তিশালী রাষ্ট্র না থাকায় তখন বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যের মধ্যে সার্বভৌম শক্তি অধিকারের জন্য সংগ্রাম চলছিল। এর ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার রাজনৈতিক দৃষ্টিশক্তি তাদের ছিল না। সত্যিকার অর্থে একজন বিদেশী আক্রমণকারীর কাছে নতুন অঞ্চল বা দেশ দখল করবার জন্য যে অনুকুল পরিস্থিতি থাকা প্রয়ােজন বাবরের সমকালীন ভারতবর্ষে তার সব কিছুই ছিল। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, “India was a congeries of states at the opening of the 16th century and likely to be the easy prey of an invader who had the strength and will to attempt her conquest”. (Dr. Iswari Prasad, A Short History of Muslim Rule in India, P: 213)

রাজনৈতিক অবস্থা

দিল্লী রাজ্য : এ সময় দিল্লীর সালতানাত শক্তিশালী ছিল না। বাহালুল লােদী কর্তৃক স্থাপিত লােদী বংশের শাসনাধীনে তখন বিশাল কোন অঞ্চল ছিল না। বাহালুল লােদী ও সিকান্দার লােদী দিল্লী রাজ্যের সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সুলতান ইব্রাহীম লােদী দুর্বল শাসক হওয়ায় তার শাসন কর্তৃত্ব পাঞ্জাব, দোয়াব, জৌনপুর, অযােধ্যা, বিহারের কিছু অংশ এবং ত্রিহুতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বাহালুল লােদী ও সিকান্দার লােদীর শাসনামলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর কেন্দ্রীয় আধিপত্য থাকলেও ইব্রাহীম লােদীর শাসনকালে তা দুর্বল হতে থাকে। ঐতিহাসিক Erskine তার “A History of India under Babur and Humayun” গ্রন্থে লিখেছেন যে, “যদিও ইব্রাহীম লােদী এক সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, তবুও তার আমলে সাম্রাজ্যের সংহতির যথেষ্ট অভাব ছিল। লোদী রাজতন্ত্র ছিল কতকগুলাে স্বাধীন করদরাজ্য, জায়গীর ও প্রদেশের সমষ্টিমাত্র, করদ-রাজারা জায়গীদার ও প্রাদেশিক শাসকরা একপ্রকার স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করছিলেন।” লােদীরা ছিলেন আফগান জাতিভুক্ত। আফগানরা ছিল অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এবং কারও কর্তৃত্ব স্বীকারে তারা অভ্যস্ত ছিল না। তারা সুলতানকে তাদেরই একজন বলে মনে করত। সুলতানের সঙ্গে তাদের যে পার্থক্য আছে এ বিষয়টি তারা মানত না। কিন্তু ইব্রাহীম লােদী একজন আফগান হয়েও আফগান জাতির এই প্রকৃতিকে বুঝতে সক্ষম হননি। তিনি মধ্যযুগীয় ইউরােপীয় শাসকদের ন্যায় আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় (Divine Rights of Kingslhip) বিশ্বাসী ছিলেন এবং দাশবংশীয় সুলতান বলবনের মত রাজদরবারে গাম্ভীর্য ও কঠোর নিয়মের প্রবর্তন করেন। তিনি আফগান অভিজাতদের নতজানু হয়ে রাজদরবারে প্রবেশের নিয়ম চালু করেন। এই নিয়ম স্বাধীনচেতা আফগান অভিজাতদের মর্যাদা ও আভিজাত্যে চরম আঘাত হানে। তাছাড়া, ইব্রাহীম লােদী আফগান অভিজাত শ্ৰেণীকে ধ্বংস করতেও তৎপর হন এবং কয়েকজন আফগান অভিজাতকে হত্যা করে অন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেন। এর ফলে সুলতান আফগান অভিজাতদের চরম শত্রুতে পরিণত হন। অথচ ইব্রাহীম লােদীর পূর্বসুরী বাহালুল লােদী ও সিকান্দার লোদী আফগান অভিজাতদের ও যােদ্ধাদের সমর্থনের ওপর দিল্লী সুলতানির ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সুলতান ইব্রাহীম লােদীর আফগান বিরােধী এই মনােভাবের ফলে বহু উচ্চপদস্থ লােদী, লােহানী, ফারমুলা এবং নিয়াজী সম্প্রদায়ভুক্ত আফগান অভিজাত সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ সময় সুলতানের এক কাছে আত্মীয় আলম খান লােদী দিল্লীর সিংহাসন দাবী করেন এবং সুলতানের প্রতি অসন্তুষ্ট বহু প্রভাবশালী অভিজাত এই দাবীকে সমর্থন করেন। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদীর সঙ্গেও ইব্রাহিম লােদীর বিরােধ শুরু হয়। কারণ ইব্রাহিম লােদী দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার খানকে অপমানিত করেন। বিহারের আফগান অভিজাতরা দারিয়া খান লােহানীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। জৌনপুরেও আফগান অভিজাতগণ নাসির খাঁ ও মারুফ ফারমুলীর নেতৃত্বে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। এসব বিদ্রোহের ফলে সুলতানি সাম্রাজ্য প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় দৌলত খান লোদী এবং ইব্রাহীমের পিতৃব্য আলম খান লােদী ইব্রাহীম লােদীকে পরাজয়ের লক্ষে কাবুলের অধিপতি বাবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। বাবরও একজন দরদ রাজনীতিবিদ হিসেবে এই সুবর্ণ সুযােগকে কাজে লাগান। ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে বিখ্যাত পানিপথের যুদ্ধে তিনি দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদীকে পরাজিত ও নিহত করে উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেন।

বাংলা : সুলতানি শাসনের শুরু থেকেই বাংলা দিল্লী সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কিন্তু সুলতান ফিরােজশাহ তুঘলকের সময় হতে বাংলা স্বাধীন হয়ে যায়। বাবরের ভারত আক্রমণের সময় বাংলায় হুসেনশাহী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৮ খ্রীঃ) অত্যন্ত দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি তার রাজ্যের সীমানা উড়িষ্যা ও আসামের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি জৌনপুরের শাসক হুসেনশাহ শর্কিকে তার রাজ্যে আশ্রয় দিলে দিল্লীর সুলতান সিকান্দার লােদীর বিরাগভাজন হন। অবশ্য পরে তিনি সিকান্দার লােদীর সঙ্গে সম্মানজনক সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে বাংলা ও দিল্লীর সীমানা নির্দিষ্ট করেছিলেন। অনেকে বলেন, দক্ষ শাসক হিসেবে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্মিলনের এক সংস্কৃতি প্রচলন করেন। নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে তিনি হিন্দুদেরকে রাজ্যের উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেন। তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা। তার ঐকান্তিক উৎসাহে মালাধরবসু ‘ভগবদগীতা’, ‘কৃত্তিবাস রামায়ণ’ সংস্কৃত হতে বাংলায় অনুবাদ করেন। তাছাড়া, বিজয়গুপ্ত ‘পদ্মপুরাণ’ বা মনসামঙ্গল’, চন্দ্রদাস মনসাবিজয়’ প্রভৃতি কাব্য রচনা করেন। হিন্দুদের প্রতি তার উদারতার জন্য হিন্দু লেখকেরা তাকে ‘নৃপতি-তিলক’, ‘জগভূষণ’, ‘কৃষ্ণাবতার’ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করেন। তবে এই মতসমূহের বিরোধিতাও রয়েছে। দীর্ঘ ২৬ বছর কৃতিত্ব ও গৌরবের সঙ্গে রাজত্ব করে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ মৃত্যুবরণ করলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দীন নসরৎ শাহ ১৫১৯ খ্রীস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন। বাবরের উপমহাদেশ আক্রমণের সময় নসরৎ শাহ ছিলেন বাংলার সুলতান। নসরৎ শাহ বাবরের সঙ্গে সখ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাবর তার ‘আত্মজীবনী’তে শাসক হিসেবে নসরৎ শাহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নসরৎ শাহও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার আদেশেই মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হয়। তার শাসনামলে বাংলায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। 

গুজরাট : সুলতানি আমলের প্রথমদিকে গুজরাট দিল্লী সম্রাজ্যভুক্ত হয়। কিন্তু তুঘলক বংশের দুর্বলতার সুযােগে ১৪০১ খ্রীস্টাব্দে জাফর খাঁ নামক একজন ধর্মান্তরিত রাজপুত মুজাফফর শাহ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ১৪১১ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার পৌত্র আহম্মদ খান সিংহাসনে বসেন। আহম্মদ শাহ রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন মাহমুদ বেগারা (১৪৫৮-১৫১১)। তিনি তার শাসনামলে অসামান্য সামরিক দক্ষতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন করেন। তার সময়ে সর্বপ্রথম পর্তুগীজরা উপমহাদেশে আগমন করে ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। কিন্তু বেগারা তা প্রতিহত করেন। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পর্তুগীজদের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। বাবরের ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে গুজরাটের শাসনকর্তা ছিলেন বেগারার পুত্র দ্বিতীয় মুজাফফর শাহ। মুজাফফর শাহ তার গােটা জীবন যুদ্ধ-বিগ্রহে অতিবাহিত করেন। তার মৃত্যুর পর ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে পুত্র বাহাদুর শাহ গুজরাটের সিংহাসনে আরােহণ করেন। বাহাদুর শাহ মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের একজন চরম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। 

মালব : সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের সময় মালব স্বাধীনতা অর্জন করে। মালবের প্রাদেশিক শাসনকর্তা দিলওয়ার খান স্বাধীন শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৪০৬ খ্রীস্টাব্দে দিলওয়াবের পুত্র হুসাং শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজধানী এ সময় সমৃদ্ধশালী নগরীতে পরিণত হয়। ১৪৩৫ খ্রীস্টাব্দে হুসাং শাহের মৃত্যুর পর মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। মুহম্মদ শাহ ছিলেন অযােগ্য শাসক। তার অযােগ্যতার সুযােগে তার ক্ষমতাশালী মন্ত্রী মাহমুদ শাহ খলজী তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন এবং খলজী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মাহমুদ শাহ খলজী (১৪৩৬-১৪৬৯ খ্রীঃ) একজন সাহসী যােদ্ধা এবং সুশাসক ছিলেন। তিনি দিল্লী, গুজরাট, মেবার এবং বাহমনী রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করেন। তার শাসনামলে মালব একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়। ১৪৬৯ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। মাহমুদ শাহ খলজীর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তারই পুত্র গিয়াসউদ্দীন। কিন্তু ১৫০১ খ্রীস্টাব্দে গিয়াসউদ্দীনের পুত্র নাসিরউদ্দীন পিতাকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। ১৫১০ খ্রীস্টাব্দে নাসিরউদ্দীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় মাহমুদ খলজী সিংহাসনে বসেন। বাবরের ভারত আক্রমণের সময় মাহমুদ খলজী মালবের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন অযােগ্য শাসক। ফলে তার শাসনামলে রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা রাজপুত নেতা মেদিনী রাওয়ের হাতে ন্যস্ত হয় এবং সুলতান মেদিনী রাওয়ের হাতের পুতুলে পরিণত হন। ১৫৩১ খ্রীস্টাব্দে মালব গুজরাটের বাহাদুর শাহ কর্তৃক বিজিত হন। 

মেবার : বাবরের ভারত বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের অপর শক্তিশালী রাজ্য ছিল মেবার। তখন মেবারের রাজা ছিলেন রাণা সংগ্রাম সিংহ। রাণা সংগ্রাম সিংহ রাণা সংঘ হিসেবেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তার রাজধানী ছিল চিতাের। রাণা সংঘ ছিলেন একজন বড় যােদ্ধা। অসংখ্য যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অল্প করেছিলেন। তার বীরত্বের কাহিনী বাবরও তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন। তিনি ছিলেন রাজপুতদের দলপতি। দিল্লীর সুলতানি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগে তিনি ভারতের হিন্দুশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। দিল্লীর সিংহাসন দখল করবার বাসনাও তার ছিল। এ কারণে তিনি পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদীর মত বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল যে, বাবর লােদী বংশ ধ্বংস করে এবং দিল্লীর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে কাবুলে ফিরে যাবেন এবং সে সুযােগে তিনি দিল্লীর সিংহাসন দখল করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাণা সংগ্রাম সিংহের ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

সিন্ধু : সুলতান মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বের শেষের দিকে সিন্ধু স্বাধীন হয়ে যায়। ১৬শ শতকের প্রথমদিকে এই রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান ছিল। ১৪শ শতকের মধ্যভাগে সুমরা বংশ এই রাজ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সুমরা রাজবংশের দুর্বলতার সুযােগে ১৫২০ খ্রীস্টাব্দে কান্দাহারের শাসনকর্তা শাহ বেগ সিন্ধুর সুমরা শাসককে পরাজিত করে সিন্ধু রাজ্য দখল করেন। বাবরের আক্রমণের প্রাক্কালে সিন্ধু রাজ্যে শাহ বেগের ক্ষমতা চরম সীমায় পৌছেছিল। 

পাঞ্জাব : পাঞ্জাব ছিল দিল্লীর প্রতিবেশী রাজ্য। সুলতানী যুগের শেষপর্বে রাজ্যটি নামমাত্র সুলতানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাবরের ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে এই রাজ্যের শাসক ছিলেন দৌলতখান লােদী। দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদীর সঙ্গে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না। সেজন্য ইব্রাহীম লােদীকে শায়েস্তা করার জন্য দৌলত খান লােদী বাবরকে ভারত আক্রমণ করার জন্য আহ্বান করেছিলেন। এসব প্রেক্ষাপট থেকে অনুমান করা যায় যে, বাবরের ভারত অভিযানের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ওপর দিল্লীর তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অর্থাৎ পাঞ্জাব দিল্লীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকায় কোন বিদেশী আক্রমণকারীকে বাধা দেওয়ার মত কোন শক্তিই আর পাঞ্জাবে রইল না।  

কাশ্মীর : পাঞ্জাবের উত্তর-পূর্বে কাশ্মীর রাজ্য অবস্থিত ছিল। ১৩৩৯ খ্রস্টাব্দে শাহ মীর্জা নামে এক ভাগ্যান্বেষী মুসলিম কাশ্মীর রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন জয়নাল আবেদিন (১৪২০-১৪৭০ খ্রীঃ)। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতির চরম পৃষ্ঠপােষক ছিলেন এবং ধর্মীয় ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত উদার। ধর্মীয় উদারতার জন্য তাকে ‘কাশ্মীরের আকবর’ বলা হয়। ১৪৭০ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর কাশ্মীর রাজ্যে চরম অরাজকতা শুরু হয়। ১৫৪০ খ্রীস্টাব্দে মীর্জা হায়দার নামক হুমায়ুনের এক আত্মীয় কাশ্মীর জয় করেন।

উড়িষ্যা : উড়িষ্যা রাজ্যটি শক্তিশালী হিন্দু শাসকের অধীনে ছিল। এ কারণে দিল্লীর সুলতানদের পক্ষে উড়িষ্যার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। উড়িষ্যাও উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে বাংলা দাক্ষিণাত্যের দিকে সম্প্রসারণের চেষ্টা করলে উড়িষ্যা বাধা দিতে সক্ষম হয়েছিল। 

খান্দেশ : খান্দেশ রাজ্যটি তাপ্তী নদীর উপত্যকায় অবস্থিত ছিল। ১৪শ শতাব্দী থেকেই এই রাজ্যটি স্বাধীন ছিল। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মালিক রাজা ফারুকী। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে রাজত্ব করেন এবং ১৩৯৯ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। খান্দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী রাজ্য গুজরাটের সম্পর্ক ছিল খুবই বিরূপ। ফলে উভয় রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ সব সময় লেগেই থাকত। ১৫২০ খ্রীস্টাব্দে এই রাজ্যের শাসক তৃতীয় আদিল খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম মুহাম্মদ খান্দেশের সিংহাসনে বসেন। দূরত্বের কারণে বাবরের ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে এই রাজ্যের ওপর দিল্লীর রাজনৈতিক কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। 

বাহমনীরাজ্য: দিল্লী সালতানাতের দুর্বলতার সুযােগে ১৩৪৭ খ্রীস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহী আমীরগণ ‘হাসান’ এর নেতৃত্বে বাহমনী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে বামনী রাজ্যই প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাজ্য। হাসান ‘আবুল মুজাফফর আলাউদ্দীন বাহমন শাহ’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং গুলবর্গা নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। হাসান সিংহাসনে আরােহণ করেই রাজ্যবিস্তারে মনােযােগ দেন। তিনি গােয়া, তেলিঙ্গানী, ধবল, কোলাপুর দখল করে বাহমনী রাজ্যের সীমান্ত উত্তরে বরঙ্গল থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং দৌলতাবাদ থেকে পূর্বে ভঙ্গীর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। এই রাজ্যের শাসকদের দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত বিজয়নগর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়। ১৪৮১ খ্রীস্টাব্দে বাহমনী রাজ্যের একান্ত হিতৈষী প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ গাওয়ানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাহমনী রাজ্য পতনের দিকে অগ্রসর হয়। বাহমনী রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর বেরার, আহম্মদনগর, বিজাপুর, গােলকুন্ডা ও বিদর নামক পাঁচটি স্বাধীন বা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজ্যগুলাে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। দক্ষিণ ভারতে এক অংশের এরূপ সংঘাতমুখর অবস্থায় উপমহাদেশে বাবরের আক্রমণ সংঘটিত হয়।

বিজয়নগর রাজ্য : সুলতান মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে বাহমনী রাজ্যের ন্যায় বিজয়নগর নামে আর একটি রাজ্যের উৎপত্তি হয়। যাদব বংশের সঙ্গম নামে জনৈক প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তির পাঁচ পুত্র সম্মিলিতভাবে ১৩৩৬ খ্রীস্টাব্দে এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা দীর্ঘ তিনশত বছর স্থায়ী ছিল। এ রাজ্যের মূল ভিত্তি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। দাক্ষিণাত্যে ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণের পথে প্রধান বাধা ছিল এ রাজ্যটি। অধিকাংশ সময় এ রাজ্যটি বাহমনী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। বাবরের উপমহাদেশে আক্রমণের প্রাক্কালে এই রাজ্যের রাজা ছিলেন কৃষ্ণদেব রাও (১৫০৯-১৫৩০ খ্রীঃ)। কৃষ্ণদেব রাও বিজয়নগর রাজ্যের একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তার রাজত্বকালে বিজয়নগর রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে আরােহণ করে। তবে রাজ্যটি সর্বক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করলেও বাবরের আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় নি। 

বাবরের আক্রমণের সময় উপমহাদেশের যে চিত্র অঙ্কিত হল তাতে রাজনৈতিক অনৈক্যের চিত্রই পরিস্ফুত হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ভারতে তখন কোন সার্বভৌম রাজশক্তি ছিল না। এমতাবস্থায় বিদেশী যে কোন শক্তির পক্ষে ভারত বিজয় সহজ ছিল। বাবরও ভারতের অন্তসারশূন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা উপলব্ধি করে সঠিক সময়টি বেছে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেন নি। সুতরাং বলা যায়, ভারতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটই ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। বাবর নিজেই তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুজুক-ই-বাবরী’তে উপমহাদেশের এ সময়কার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি তার গ্রন্থে ভারতের পাঁচজন মুসলমান ও দু’জন হিন্দু রাজার উল্লেখ করেছেন। তার বর্ণনামতে, সে সময় ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল দিল্লী সুলতানের অধিকারভুক্ত ছিল, যদিও কয়েকটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্যও ছিল। মুসলমান শাসকদের বিরাট সেনাবাহিনী ছিল এবং বিরাট অঞ্চল তারা শাসন করতেন। বাবরের মতে, সেনাবাহিনী ও রাজ্যের আয়তনের দিক থেকে বিজয়নগর রাজ্যের নরপতি এবং চিতােরের রাণা সংঘ শ্রেষ্ঠ ছিলেন। রাণা সংঘের শৌর্যবীর্যের কথাও বাবর বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। (“The five kings who have been mentioned are great princes and all are Mussalmans and possessed of formidable armies and rulers of vast territories. The most powerful of the pagan princes, in point of territory and ariny, is the Raja of Bijoynagar. Another is the Rana Sanga who has attained his present high eminence, by his own valour and his sword. His original principality was Chittor” Babumama. SET: V. D. Mahajain, Muslim Rule in India, P:6)

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা

বাবরের ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতীয় উপমহাদেশ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। সুলতানী যুগে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু। তবে এ যুগে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় মুসলিম সমাজের বিস্তৃতি ঘটে। এ যুগে সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ফিরােজ শাহ তুঘলকের শাসনামল থেকে উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি লক্ষ্য করা যায়। লােদী শাসনামলে সিকান্দার শাহ লােদী হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। তবে সুলতানী যুগে দিল্লীর চেয়ে আঞ্চলিক রাজ্যগুলােতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। উদাহরণস্বরূপ বাংলা ও কাশ্মীর রাজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হুসেনশাহ এবং কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদিন উভয়েই ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু ও উদার শাসক। আলাউদ্দীন হুসেন শাহ হিন্দুদেরকে উচ্চরাজপদে নিয়ােগ দান করেছিলেন এবং তার পৃষ্ঠপােষকতায় হিন্দুধর্মগ্রন্থ ‘মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’ বাংলায় অনুদিত হয়েছিল। কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদিন হিন্দুদের জিজিয়া কর থেকে অব্যাহতি দান করেছিলেন। তার ধর্মান্ধ পিতার শাসনামলে যে সকল ব্রাহ্মণ কাশ্মীর রাজ্য ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি তাদেরকে পুনরায় কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনেন। তিনি তার রাজ্যে গােহত্যা নিষিদ্ধ করেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় ‘মহাভারত’, ‘রাজতরঙ্গিণী’ প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনুদিত হয়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কারণে আলাউদ্দীন হুসেন শাহকে ‘বাংলার আকবর’ এবং জয়নাল আবেদিনকে কাশ্মীরের আকবর’ বলা হয়ে থাকে। 

ইংরেজ ঐতিহাসিক Edward & Garrett তার ‘Mughal Rule in India’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, বাবরের ভারত আক্রমণের সময় যদিও ভারত রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল তবুও সে সময় ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য অক্ষুন্ন ছিল। তাদের মতে, ভক্তি আন্দোলনের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মনে সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এ সময় ইসলামধর্মে উদারনৈতিক সংস্কার আন্দোলন সুফীবাদে প্রকাশ পায়। ‘ভক্তিবাদ’ ও ‘সুফীবাদ’ সুলতানী আমলে ধর্মের ক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য সহজ করে তুলেছিল। স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রেও হিন্দু ও মুসলিম রীতির সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। 

অর্থনৈতিক অবস্থা

বাবরের ভারত আক্রমণের সময় ভারতীয় উপমহাদেশ যে যথেষ্ট সম্পদশালী ছিল তা বাবরের বিবরণ থেকে জানা যায়। বাবর ভারতীয় উপমহাদেশকে ঐশ্বর্যের দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সে সময় ভারতে কৃষি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। যদিও সময় সময় বিদেশী আক্রমণ এবং অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কারণে কৃষির ক্ষতি হত। এ সময় আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও পণ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানী হত। ভারতীয় পণ্যসামগ্রী বণিকেরা সমুদ্রপথে নিয়ে যেত মালয় দ্বীপপুঞ্জ, চীন এবং প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে। প্রধানত খাদ্যশস্য, কার্পাস, কাপড় ও চিনি বিদেশে রপ্তানী হত। বিদেশে ভারতীয় বস্ত্রের খুব চাহিদা ছিল। সে সময় বাংলার মসলিন কাপড় পৃথিবীময় সুনাম অর্জন করেছিল। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা সচ্ছল জীবন যাপন করত। অপরদিকে সাধারণ মানুষের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। 

জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর (রা ১৫২৬-৩০) ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা 

মুঘলদের পরিচয়

জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর কর্তৃক ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ‘মুঘল বংশ’ নামে পরিচিত। মুঘল কথাটি এসেছে ‘মােঙ্গল’ শব্দ থেকে যার অর্থ নির্ভিক। মােঙ্গলদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মঙ্গোলিয়ায়। তারা বহু দল-উপদলে বিভক্ত ছিল। উপদলগুলাের মধ্যে বাদ-বিসম্বাদ লেগেই থাকত। ক্রমে উপদল গুলাের মধ্য হতে একটি দল অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই দলের নেতা ছিলেন ইয়েসুকাই। ইয়েসুকাইয়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র তেমুচিন মােঙ্গলদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মঙ্গোলিয়ার সব উপদলগুলােকে একত্রিত করে প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্ধর্ষ তাতার জাতিকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ায় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তেমুচিনের অসাধারণ রণনৈপুন্য এবং সাংগঠনিক যােগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ মােঙ্গল দলপতিদের এক সভায় তাকে ‘চেঙ্গিস খাঁ‘ বা ‘অসীম শক্তিশালী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চেঙ্গিস খাঁর মৃত্যুর পর তার বিরাট সাম্রাজ্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার দ্বিতীয় পুত্র চাঘতাই খাঁ মধ্য-এশিয়া অঞ্চলের অধিকার লাভ করেন। এই চাঘতাই খাঁর বংশধর ছিলেন তৈমুর লঙ্গ যিনি ১৩৯৮ খ্রীস্টাব্দে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে সুলতানী সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত করেছিলেন। তুর্কী জাতির এই চাঘতাই বংশেই বাবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন এই চেঙ্গিস খাঁ ও তৈমুর লঙ্গের উত্তরপুরুষ। পিতার দিক থেকে বাবর ছিলেন তৈমুর লঙ্গ এর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ এবং মাতার দিক থেকে তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর অধস্তন ১৪শ পুরুষ। সুতরাং বাবরের ধমনীতে এশিয়ার বিখ্যাত দুই বীরের রক্ত প্রবাহিত ছিল। তবে প্রকৃত অর্থে বাবর মােঙ্গল বংশােদ্ভূত ছিলেন না। তৈমুরের দিক থেকে তিনি ছিলেন তুর্কী। তার মাতা কুতলুক-নিগার-খানম ছিলেন মধ্য-এশিয়ার মােঙ্গল নেতা ইউনুস খানের কন্যা। সে হিসেবে বাবরের মাতা ছিলেন স্বয়ং মুঘল বংশীয়া। যাইহােক, ভারতের তথাকথিত মুঘল সম্রাটেরা মুঘল জাতিগোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন না। তারা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে তুর্কী। বাবর তার আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবুরীতে নিজেকে চাঘতাই তুর্কী বলে অভিহিত করেছেন। তবুও ভারতবর্ষে বাবর প্রতিষ্ঠিত রাজ ‘মুঘল বংশ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

বাবরের প্রাথমিক জীবন

জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর ১৪৮৩ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার মধ্য এশিয়ার তুর্কীস্থানের এক ক্ষুদ্র রাজ্য ফরগনায় জন্মগ্রহণ করন। তার পিতার নাম ওমর শেখ মীর্জা এবং মাতার নাম কুতলুঘ নিগার খানম। বাবরের মাতা মধ্য এশিয়ার মােঙ্গল নেতা ইউনুস খানের কন্যা ছিলেন। পিতা ওমর শেখ মীর্জা ছিলেন রুশ-তুর্কীস্থানের অন্তর্গত ফরগনা নামক এক ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি। বাবরের বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশদ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তার ‘আত্মজীবনীতে’ দু’জন ব্যক্তিত্ব যথাক্রমে, একজন তার শিক্ষক শেখ মজিদ এবং অন্যজন পিতামহী দৌলত বেগমের নামােল্লেখ পাওয়া যায়। বাবরের ওপর এ দু’জন ব্যক্তিত্বের অসীম প্রভাব ছিল। শিক্ষক শেখ মজিদের কাছে বাবর আরবী, ফার্সী ও তুর্কী ভাষা অধ্যায়ন করেন। অপর দিকে অভিজ্ঞ পিতামহী তাকে আত্মনির্ভরশীল, সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণ হতে সাহায্য করেন, যা পরবর্তীকালে বাবরকে দুর্যোগ মােকাবেলা করতে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। 

বাবরের বয়স যখন এগার বছর তখন তার পিতা বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর বাবর ফরগনা রাজ্যের অধিপতি হন। সিংহাসনে আরােহণের পরেই বাবর তার কাছে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে উজবেক নেতা সাইবাণী খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হন। এই সাইবানী খানের বিরুদ্ধে বাবরকে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। শৈশব কাল থেকেই বাবর তার পূর্বপুরুষ তৈমুর লঙ্গের রাজধানী সমরখন্দ অধিকারের স্বপ্ন দেখতেন। কারণ সমরখন্দ ছিল মধ্য-এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও সৌন্দর্যময় নগরী। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই বাবর সমরখন্দে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিলে সে সুযােগে ১৪৯৭ খ্রীস্টাব্দে সমরখন্দ অধিকার করেন। কিন্তু নিজ রাজ্য ফরগনায় ষড়যন্ত্রের সংবাদে বাবাকে সমরখন্দ ত্যাগ করে ফরগনায় ফিরে যেতে হয়। ১৫০১ খ্রস্টাব্দে বাবর পুনরায় সমরখন্দ আক্রমণ করেন কিন্তু উজবেক নেতা সাইবানী খানের কাছে পরাজিত হন। এসময় তিনি আবার ফরগনা থেকেও বিতাড়িত হন। ফলে বাবরকে প্রায় এক বছরকাল নিরাশ্রয় এবং সম্বলহীন অবস্থায় যাযাবরের জীবন গ্রহণ করতে হয়। বাবরের এ সময়কালের অবস্থা বর্ণনা করতে যেয়ে ঐতিহাসিক ফিরিস্তা বলেন, ‘He was inoving from square to square like a king on a chessboard.’ কিন্তু এই চরম দুরাবস্থার মধ্যেও বাবর সাহস হারাননি। ১৫০৩ খ্রীস্টাব্দে বাবর পুনরায় সমরখন্দ ও ফরগনা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালান। কিন্তু আৰ্চিয়ানের যুদ্ধে তিনি সাইবানী খানের কাছে আবারও পরাজিত হন। ফলে বাবর পিতৃরাজ্য ফরগনা উদ্ধারের স্বপ্ন ত্যাগ করে কাবুলের দিকে দৃষ্টি দেন। 

১৫০৪ খ্রীস্টাব্দে বাবর কাবুলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযােগ নিয়ে হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে কাবুলের শাসক আধুকে পরাজিত করে কাবুল দখল করে পুনরায় রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এর মধ্যে বাবর পারস্যের সাফাভী বংশীয় রাজা ইসমাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তােলেন এবং ‘শিয়া’ মত গ্রহণের শর্তে পারস্যের রাজা বাবরকে ফরগনা ও সমরখন্দ দখলে সাহায্য দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এই পর্যায়ে বাবর বিনাযুদ্ধে বােখারা অধিকার করেন। অতপর তিনি সমরখন্দের দিকে অগ্রসর হন এবং ১৫১১ খ্রীস্টাব্দে সমরখন্দ অধিকার করেন। কিন্তু শিয়ামত সমর্থন করায় সমরখন্দের অধিবাসীরা বাবরের প্রতি বিরূপ হন। বাবর মাত্র আট মাস সমরখন্দের সিংহাসন অধিকারে রাখতে সমর্থ হন। ইতােমধ্যে উজবেকরা সাইবানী খানের পুত্রের নেতৃত্বে বােখারা আক্রমণ করে। ১৫১২ খ্রীস্টাব্দে বাবর গাজদাওয়ানের যুদ্ধে উজবেকদের কাছে পরাজিত হন। বাবর পুনরায় কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন। অতপর মধ্য-এশিয়ার রাজ্য স্থাপন অসম্ভব মনে করে বাবর ভারতবর্ষের দিকে মনােনিবেশ করেন। 

ভারতবর্ষে বাবরের প্রাথমিক অভিযানসমূহ

ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে বাবর কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক অভিযানে অবতীর্ণ হন। ১৫১৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি সিন্ধুনদ অতিক্রম করে বজৌর এবং পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভেরা অধিকার করেন। এরপর বাবর কুশব ও চেনাব নদীর অববাহিকা অঞ্চল বিনা বাধায় জয় করেন। ১৫২০ খ্রীস্টাব্দে বাবর বদখশান জয় করেন এবং পুত্র হুমায়ুনকে বদখশানের শাসনভার অর্পণ করেন। ১৫২২ খ্রীস্টাব্দে তিনি কান্দাহার জয় করেন এবং দ্বিতীয় পুত্র কামরানকে কান্দাহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ভারতের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলক কয়েকটি অভিযানে সাফল্য লাভ করে বাবর ভারতে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে ১৫২৪ খ্রীস্টাব্দে বাবরের সামনে সুবর্ণ সুযােগ মিলে যায়। এ সময় দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদীর সঙ্গে সদ্ভাব না থাকায় পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদী এবং ইব্রাহীম লােদীর পিতৃব্য আলম খান লােদী বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। সম্ভবত এ সময় মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহ বা রাণা সঙ্গাও বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। (An Advanced History of India, R.C. Majumdar, H.C. Raychaudhuri, Kalikinkar Datta- p. 419)। বাবর সানন্দে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ১৫২৪ খ্রীস্টাব্দে সসৈন্যে পাঞ্জাবে প্রবেশ করে প্রথমেই লাহাের অধিকার করেন। তারপর বাবর শিয়ালকোট, দিপালপুর এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য স্থান হস্তগত করেন।

পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলতখান লােদী আশা করেছিলেন যে, এই বিজয়ের পর বাবর গােটা পাঞ্জাবের ভার তার ওপর অর্পণ করে কাবুলে ফিরে যাবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় দৌলত খান বাবরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। বাবর দৌলত খানকে পরাজিত করে তাকে শিওয়ালিক পর্বতে বিতাড়িত করেন। অতপর বাবর পাঞ্জাব এলাকা দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার খান, ইব্রাহীম লােদীর পিতৃব্য আলম খান ও মুঘল আমীরদের মধ্যে বণ্টন করে কাবুলে ফিরে যান। কারণ এ সময় হুমায়ুনের রাজ্য বদাখশানে বিদ্রোহ শুরু হয়। বাবরের অনুপস্থিতির সুযােগে দৌলত খান লােদী পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে এসে পাঞ্জাব হতে আলম খান এবং পুত্র দিলওয়ার খানকে বিতাড়িত করে পাঞ্জাব পুনরুদ্ধার করেন। এমতাবস্থায় আলম খান লােদী কোন উপায় না দেখে কাবুলে গিয়ে বাবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। বাবর পাঞ্জাবের মুঘল আমীরদের আলম খানকে সাহায্যের জন্য নির্দেশ প্রেরণ করেন। কিন্তু আলম খান ভারতে ফিরে এসেই দৌলত খানের সঙ্গে হাত মেলান। বাবর আলম খান ও দৌলত খানের বিশ্বাসঘাতকতায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হন এবং উভয়কে শাস্তি বিধানের জন্য ১৫২৫ খ্রীস্টাব্দে ভারত বিজয়ের সংকল্প নিয় সসৈন্যে কাবুল হতে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। উপায়ন্তর না দেখে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদী বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পাঞ্জাব সহজেই বাবরের হস্তগত হয়। পাঞ্জাব দখলের ফলে বাবরের কাছে দিল্লী প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। 

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (১৫২৬)

বাবর দিল্লী আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে সসৈন্যে পাঞ্জাব থেকে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন। বাবরের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদী তাকে বাধা দেওয়ার জন্য দুটি অগ্রগামী আক্রমণকারী দল পাঞ্জাবের দিকে প্রেরণ করেন। কিন্তু দু’টি দলই বাবরের কাছে পরাজয় বরণ করে। ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে ১২ এপ্রিল তারিখে বাবর যমুনা নদীর তীর ধরে ঐতিহাসিক পানিপথ প্রান্তরে উপস্থিত হন এবং এখানেই তিনি যুদ্ধ শিবির স্থাপন করেন। বাবরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তার সঙ্গে মাত্র বার হাজার সৈন্য ছিল। যাইহােক, পানিপথেই বাবর তার যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তার সেনাবাহিনীকে ডান, মধ্য এবং বাম পদ্ধতিতে সাজান। (আব্দুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, পৃঃ ১৮০)। ডান দিকের সেনাবাহিনীকে তিনি পানিপথে শহর রক্ষার জন্য নিয়ােজিত রাখেন, মধ্যখানে ওস্তাদ আলী ও মােস্তফার নেতৃত্বে কামান ও গােলন্দাজ বাহিনী মােতায়েন করেন এবং বাম দিকে পরিখা খনন করে তথায় গাছপালা, ঝােপঝাড় ইত্যাদি ফেলে শত্রুবাহিনীর আক্রমণের অপেক্ষা করতে থাকেন। 

অপরদিকে, সুলতান ইব্রাহীম লােদীও প্রায় এক লক্ষ পদাতিক ও এক হাজার হস্তীবাহিনী নিয়ে পানিপথে পৌছান। ইব্রাহীম লােদীর বাবরের ন্যায় কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না। পানিপথে পৌঁছে দু’পক্ষই সৈন্য নিয়ে কয়েক মাইল ব্যবধানে ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে ১২ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিন মুখােমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে বাবর বিরক্ত হয়ে তার সৈন্য বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং বাবরের নির্দেশ মােতাবেক ২০ এপ্রিল রাতে বাবরের চার-পাঁচ হাজার সৈন্য হঠাৎ শত্রু শিবিরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু সেনাবাহিনী বাবরের নির্দেশ সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে না পারায় প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তবে এই আক্রমণে প্ররােচিত হয়ে ইব্রাহীম লােদীর বাহিনী ২১ এপ্রিল সকাল নয়টায় বীর বিক্রমে বাবরের ডান দিকের বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ইব্রাহীম লােদীর সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বাবর এই বিশৃঙ্খলার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে তার বাহিনীকে আফগান বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দেন। বাবরের নির্দেশানুযায়ী সৈন্যরা আফগান সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং উভয়পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে বাবর সর্বপ্রথম কামান ও বন্দুক ব্যবহার করেন। বাবরের গােলন্দাজ বাহিনী আফগান বাহিনীর ওপর প্রচন্ড কামানের গােলার আক্রমণ চালায়। কামানের গোলার আঘাতে আফগান সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, ইব্রাহীম লােদী প্রাণপন যুদ্ধ করেও তার সেনাবাহিনীর গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন। বাবরের হিসাব মতে, ১৫/১৬ হাজার আফগান সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারায়। (Five or six thousand men were killed in one place close to Ibrahim. Our estimate of the other dead, lying all over the field, was 15 to 16,000, but it came do be known, laler in Agra from the statements of Hindustanies, that 40 or 50,000 may have died in that battle.” – Baburnama, দ্রষ্টব্য – Musliin Rule in India, P:11) অবশ্য যুদ্ধে স্বয়ং ইব্রাহীম লােদী নিহত হন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সুলতান যিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ বিসর্জন দেন। বাবর দ্রুত দিল্লী ও আগ্রা অবরােধ করে তা দখল করেন। ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে ২৭ এপ্রিল দিল্লীর জামে মসজিদে বাবরের নামে খুৎবা পাঠ করা হয় এবং বাবর নিজেকে ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করেন। 

বাবরের সাফল্যের কারণ 

পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্য সত্যই এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাত্র বার হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি দিল্লীর অধিপতি ইব্রাহীম লােদীর বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। বাবরের সাফল্যের কারণসমূহ ছিল –

  • (১) বাবরের ভারত অভিযানের সময়কালে ভারতবর্ষ ছিল পারস্পরিক আত্মকলহে লিপ্ত কতগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাবেশ মাত্র। বিদেশী আক্রমণ মােকাবেলায় এসব রাজ্যসমূহের কোন ভূমিকাই লক্ষ্য করা যায়নি। একমাত্র দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদীই বাবরের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন।
  • (২) বাবরের আক্রমণ মােকাবেলা করতে ইব্রাহীম লােদী পানিপথের প্রান্তরে প্রায় এক লক্ষ সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু এদের মধ্যে সকলেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নিয়মিত সৈন্য ছিল না। এর অধিকাংশই ছিল অনিয়মিত বেতনভুক্ত সৈন্য। অর্থের বিনিময়ে সাময়িকভাবে তাদের নিয়ােগ দেয়া হত। এই অনিয়মিত বেতনভুক্ত সেনাদের না ছিল উন্নত অস্ত্র, না ছিল সঠিক প্রশিক্ষণ। স্বাভাবিকভাবেই এই দুর্বল সামরিক বাহিনী উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং সুসজ্জিত বাবরের বাহিনীর কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য হয়।
  • (৩) পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল বাবরের উন্নত রণপরিকল্পনা। রণক্ষেত্রে বাবর তার সৈন্যদের ডান, মধ্য এবং বাম সারিতে সাজিয়েছিলেন এবং শত্রু বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য দুটি ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অশ্বারােহী ও গােলন্দাজ বাহিনী প্রস্তুত বা রিজার্ভ রেখেছিলেন। সাক্ষেত্রে আফগান বাহিনী যখন বাবরের ডান দিকের বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে তখন বাবর তার রিজার্ভ বাহিনীকে ডানদিকের বাহিনীর সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন। এ অবস্থায় আফগান বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে বাবর বাহিনী চার দিক থেকে আফগান বাহিনীকে ঘিরে ফেলে এবং বাবরের বিজয় সুনিশ্চিত করে। কিন্তু ইব্রাহীম লােদীর কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না। 
  • (৪) ভারতবর্ষের সমর ইতিহাসে বাবরই সর্বপ্রথম গােলন্দাজ বাহিনী মােতায়েন এবং কামানের ব্যবহার করেন। গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের গর্জনে ও আঘাতে ইব্রাহীম লােদীর বিশাল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বাবর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের গর্জনে ও আঘাতে ইব্রাহীম লােদীর হস্তীবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের সেনাদলকেই ছত্রভঙ্গ করে দেয়।” প্রকৃতপক্ষে, বাবরের কামানের গর্জনই সেদিন পানিপথের প্রান্তরে ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। 
  • (৫) পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের পেছনে মধ্য এশিয়া, আরব ও ইরান থেকে আমদানীকৃত ঘােড়ার ভূমিকাও কম ছিল না। এসব ভাল জাতের ঘােড়া মুঘলবাহিনীকে ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন করে তুলেছিল। আফগান বাহিনীর ধীরগতিসম্পন্ন হস্তীবাহিনীর ওপর দ্রুতগামী ঘােড়া সফল আঘাত হেনে হস্তীবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। 
  • (৬) বাবর জানতেন ভারতবর্ষ বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের দেশ। ভারতে তাল তাল সােনা পাওয়া যায়। তিনি মুঘল বাহিনীকে নতুন দেশ জয় এবং তাল তাল সােনা লাভ করার জন্য এক নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে মুঘল বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন-মরণ সংগ্রামে প্ররােচিত হয়। এভাবে বাবরের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী এক দুর্ধর্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়। 
  • (৭) পরিশেষে, বাবর ছিলেন সে যুগের একজন বিজ্ঞ ও সুনিপুণ সেনানায়ক। মধ্য-এশিয়ায় বার বার সামরিক ব্যর্থতা তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বরং তার ব্যর্থতা লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাকে আরও অদম্য ও দৃঢ়সংকল্প করে তুলেছিল। যার ফল ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধে তার বিজয়। কিন্তু ইব্রাহীম লােদী ছিলেন সৈন্য পরিচালনায় ও যুদ্ধবিদ্যায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। পানিপথের রণাঙ্গনে তিনি উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়াই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ফলে যুদ্ধে তার পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। 

পানিপথের যুদ্ধের ফলাফল 

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক পরিবর্তন সূচনাহার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী –

  • (১) ১২০৬ খ্রীস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবক যে দিল্লী সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লােদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লােদীর পরাজয় এবং নিহত হবার মধ্য দিয়ে তার পতন সম্পন্ন হয়। অবশ্য তুঘলক বংশের পতনের সংগে সংগেই দিল্লী সালতানাতের পতনের সূচনা হয়, কিন্তু পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের বিজয় সেই পতনকে চূড়ান্ত রূপ দান করে। 
  • (২) ড. ঈশ্বরপ্রসাদের ভাষায়, “The battle of panipath placed the empire of Delhi in Babur’s hand” (A Short History of Muslim Rule in India, P: 220)। অর্থাৎ পানিপথের যুদ্ধ দিল্লী সাম্রাজ্য বাবরের হাতে তুলে দেয়। প্রকৃতই পানিপথের যুদ্ধের বিজয় দিল্লী সাম্রাজ্যের শাসন বাবর তথা মুঘলদের হাতে চলে যায়। যদিও বৃহত্তর ভারতে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাবরকে আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়ী হতে হয়, তবুও এ কথা বলা যায় যে, পানিপথের বিজয়ই ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। 
  • (৩) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর এক উন্নত যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শন করেন। এই যুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম গােলন্দাজ বাহিনী মােতায়েন এবং কামান ও বন্দুক ব্যবহার করেন। পানিপথের যুদ্ধের পূর্বে ভারতীয়রা কামান ও গােলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতীয়রা তাদের যুদ্ধ ব্যবস্থায় গােলন্দাজ বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি ঘটায়, যা পানিপথের প্রথম যুদ্ধেরই অবদান। 

রাজপুতদের সঙ্গে সংঘর্ষ : খানুয়ার যুদ্ধ (১৫২৭) ও চান্দেরী দুর্গ দখল (১৫২৮)

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয় বাবরকে দিল্লীর সিংহাসনের অধিকারী করলেও ভারতবর্ষের বিরাট অংশ তখনও তার কর্তৃত্বের বাইরে ছিল। এ সময় ভারতে বাবরের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপনের পথে প্রধান বাধা ছিল মেবারের রাজপুত নেতা রাণা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুত শক্তি। সুতরাং স্বভাবতই বাবরের দৃষ্টি রাণা সংগ্রাম সিংহের দিকে নিবন্ধ হয়। মেবারের রাজা সংগ্রাম সিংহ হিন্দু রাজপুত রাজাদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন শত যুদ্ধের বিজয়ী বীর। যুদ্ধ করতে করতে তিনি একটি চোখ, একটি হাত এবং একটি পা হারান কিন্তু তবুও তিনি যুদ্ধকে ভয় করতেন না। দুর্ধর্ষ এই রাজপুত নেতা দিল্লী সালতানাতের ধ্বংসস্তুপের ওপর ভারতে হিন্দুরাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বাবরকে দিল্লী আক্রমণে প্ররােচিত করেছিলেন। তার ধারণা ছিল বাবর তার পূর্বপুরুষ তৈমুর লঙ্গের মত ভারত বিধ্বস্ত ও ধন-সম্পদ লুট করে ফিরে যাবেন। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধের পর বাবর যখন ভারতে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু করেন তখন সংগ্রাম সিংহ বাবরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেন। ফলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। 

রাণা সংগ্রাম সিংহ বাবরের মােকাবেলায় ভিলসার রাজা সিলাহদি, মারওয়ারের ভীম সিংহ, চান্দেরীর মেদিনীরাও, দুর্গাপুরের রাওয়াল উদয়সিংহ, মেওয়াটের হাসান খান মেওয়াটি ও অন্যান্য ভারতীয় হিন্দু রাজাদের সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করেন। তিনি ১২০ জন রাজপুত সেনাধ্যক্ষ, ৮০ হাজার অশ্বারােহী ও ৫শত হস্তীবাহিনী নিয়ে বাবরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অপরদিকে বাবরও তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আগ্রার সন্কাছে সিক্রীর অদূরে খানুয়া নামক স্থানে সৈন্য শিবির স্থাপন করেন। তিনি পানিপথের যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সৈন্যদের ডান, মধ্য এবং বাম সারিতে সাজান। ডানে জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন এবং বামে শ্যালক সৈয়দ মাহদী খাজাকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। বাবর নিজের মধ্যে অবস্থানরত সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও তিনি ডান ও বামের সেনাবাহিনীর পাশে দু’টি রিজার্ভ বাহিনী মােতায়েন রাখেন এবং তাদের নির্দেশ দেন যে, যুদ্ধ আরম্ভ হলে তারা যেন শত্রু বাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ চালায়। 

১৫২৭ খ্রীস্টাব্দের ১৬ মার্চ শনিবার সকাল ৯টায় খানুয়ার প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। খানুয়াতেও বাবর কামানের ব্যবহার করেন এবং কামানের গােলায় টিকতে না পেরে রাণা সংগ্রাম সিংহের বিশাল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেও রাজপুতরা শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে মেওয়াটের হাসান খান, দুর্গাপুরের রাওয়াল উদয়সিংহ সহ বহু সেনাপতি ও সৈন্য নিহত হয়। সংগ্রাম সিংহ কোনরকমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এভাবে বাবর বিজয় লাভ করেন। 

খানুয়া যুদ্ধে রাণা সংগ্রাম সিংহের বিপর্যয়ের পর রাজপুতরা চাচ্ছেন রাজ্যের রাজা মােদিনীরাওয়ের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। বাবর এই সংবাদ পেয়ে ১৫২৮ খ্রীস্টাব্দের ২০ জানুয়ারী চান্দেরী দুর্গ অবরােধ করেন। রাজপুত বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাস্ত হয়। দুর্গে অবস্থানকারী প্রায় সকল রাজপুত সৈন্য মুঘলদের হাতে নিহত হয়। চান্দেরীর পতনের পর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকে বাধা দেবার মত রাজপুতদের শেষ শক্তিটুকুও নির্মূল হয়। 

খানুয়া যুদ্ধের ফলাফল 

খানুয়ার যুদ্ধকে উপমহাদেশের ইতিহাসে চূড়ান্ত মীমাংসাকারী যুদ্ধ হিসােন চিহ্নিত করা হয়। ফলাফলের দিক দিয়ে খানুয়ার যুদ্ধ পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধের ফলাফল –

  • (১) পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয় বাবরকে দিল্লী ও আগ্রায় প্রভুত্ব দান করেছিল মাত্র, কিন্তু ভারতবর্ষের বিশাল অংশ এমনকি উত্তর ভারতের বিরাট অংশ তখনও তার কবলের বাইরে ছিল। এ সমস্ত অঞ্চলে তার ক্ষমতা বিস্তারে প্রধান বাধা ছিল রাণা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুত শক্তি। ১৫২৭ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুত শক্তির পরাজয় বাবরের পক্ষে সমগ্র ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের স্থায়ী ভিত্তি স্থাপন সহজতর হয়। 
  • (২) দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লােদীর রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং মুসলমান নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহ ভারতবর্ষে হিন্দু রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি বিদেশী বাবরকে ভারত আক্রমণে প্ররােচিতও করেছিলেন। কিন্তু বাবর কর্তৃক দিল্লীতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তার স্বপ্ন প্রথম হােচট খায়। অতপর বাবরকে প্রতিরােধের লক্ষ্যে তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট গঠন করেন। কিন্তু খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুত সামরিক জোটের পরাজয় এবং অধিকাংশ রাজপুত নেতাদের নিহত হবার ফলে শক্তিশালী রাজপুত শক্তির পতন সাধিত হয়। 
  • (৩) খানুয়ার যুদ্ধে বাবরকে বাধা দানের জন্য রাণা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুত নেতাদের সমন্বয়ে যে সামরিক জোট গঠিত হয় সে জোটে মেওয়াটের হাসান খান এবং সুলতান সিকান্দার লােদীর পুত্র সুলতান মাহমুদ লােদী আফগানও সৈন্যসহ যােগ দিয়েছিলেন। গঠিত হয়েছিল রাজপুত-অফিগান জোট। কিন্তু খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের বিজয় এই রাজপুত-আফগান জোটের পরাজয় নিশ্চিত করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে হাসান খান নিহত হয়েছিলেন। 
  • (৪) খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুত শক্তির ধ্বংসের ফলে বাবর নামে ও কাজে দিল্লীর সম্রাট হন। সারা জীবন তিনি যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু কোথাও তিনি বেশীদিন স্থায়ীভাবে রাজ্য শাসন করতে পারেন নি। কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পারেন যে, দিল্লীর সিংহাসন তার জন্য নিরাপদ। সেজন্য তিনি কাবুলে ফিরে যাবার কথা ভুলে যান। তিনি তার রাজধানী কাবুল হতে দিল্লীতে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাবুলের পরিবর্তে দিল্লীর প্রাধান্য সূচিত হয়।  
  • (৫) খানুয়া যুদ্ধের পর বাবর ভারতবর্ষে সালতানাতের পরিবর্তে ‘মূলক’ বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও বাবর তার প্রজাসাধারণের কাছে উচ্চ মর্যাদা ঘােষণার জন্য পূর্ববর্তী শাসকদের ‘সুলতান’ উপাধি পরিত্যাগ করে ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। উপাধিগুলাের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য না থাকলেও তিনি যেন বোঝাতে চাইলেন যে, তার রাজ্য এবং তিনি পূর্ববর্তী রাজ্য এবং সুলতানদের চাইতে অনেক শ্রেয়। 

বাবরের সাফল্যের কারণ 

পানিপথের যুদ্ধের ন্যায় খানুয়ার যুদ্ধেও বাবর সাফল্য লাভ করেন। তার এই সাফল্যের মূলে কয়েকটি কারণ ছিল। 

  • (১) রাজপুত জাতি যােদ্ধা হিসেবে দুর্ধর্ষ হলেও তাদের সামরিক ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল ও প্রাচীনপন্থী। তাদের হাতে ছিল সেই প্রাচীন তীর-ধনুক, রথ, হস্তীবাহিনী ও পদাতিক বাহিনী। অপরদিকে বাবরের হাতে ছিল উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গােলন্দাজ বাহিনী। মুঘল গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের গর্জনই রাজপুত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুঘল বাহিনীর বিজয় সুনিশ্চিত করে। 
  • (২) রাজপুত সমাজব্যবস্থা ছিল সামন্তভিত্তিক। সামন্তরা সৈন্য বাহিনী পােষণ করত। কিন্তু বিভিন্ন সামন্ত প্রধানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় রাজপুত সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই দুর্বল বাহিনীর বিরুদ্ধে বাবরের পক্ষে বিজয় অর্জন সহজতর হয়। 
  • (৩) বাবরের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তার নতুন ‘তুলঘুমা’ নামক রণকৌশল। রণকৌশলটি ছিল এই যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তার সৈন্য বাহিনীকে ডান এবং বাম সারিতে সাজান। ওপরন্তু তিনি ডান এবং বামের সৈন্যবাহিনীর পার্শ্বে ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অশ্বারােহী বাহিনী রিজার্ভ রাখেন। যুদ্ধ আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবরের নির্দেশে এই রিজার্ভ বাহিনী শত্রবাহিনীর পিছন দিক থেকে ‘তুলঘুমা’ বা ঝটিকা আক্রমণ করে রাজপুত বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপর্যস্ত করে তােলে। ফলে সহজেই মুঘল বাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে। 
  • (৪) বাবর তার আত্মজীবনীতে ভারতবর্ষকে ‘তাল তাল সােনায় পূর্ণদেশ’ বলে অভিহিত করেন। বাবর মুঘল বাহিনীকে নতুন ভূখন্ড দখল করে সেই ‘তাল তাল সােনা’ লাভ করার জন্য এক নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে মুঘল বাহিনী বাবরের নেতৃত্বে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন-মরণ সংগ্রামে প্ররােচিত হয় এবং বিজয় ছিনিয়ে নেয়। 

আফগানদের সঙ্গে সংঘর্ষ : গােরার যুদ্ধ (১৫২৯) 

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত আফগানরা পুনরায় ইব্রাহীম লােদীর ভাই জৌনপুরের শাসক মাহমুদ লােদীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। এই খবর পেয়ে বাবর তার পুত্র আসকারীকে মাহমুদ লােদীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন এবং পরে নিজে এলাহবাদ, চুনার এবং বারানসী দখল করে বিহারের বক্সার নামক স্থানে উপস্থিত হলে অনেক আফগান সর্দার মাহমুদ লােদীর পক্ষ ত্যাগ করে বাবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। স্বীয় অনুচররা দলত্যাগ করায় মাহমুদ লােদী হতাশ হয়ে বাংলার সুলতান নসরৎ শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুতরাং বাবর বাংলার দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হন। ১৫২৯ খ্রীস্টাব্দে গােগরার যুদ্ধে তিনি আফগানদের শােচনীয় ভাবে পরাজিত করেন। বাংলার সুলতান নসরৎ শাহ শেষ পর্যন্ত বাবরের সঙ্গে সন্ধি করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন। এভাবে পানিপথ, খানুয়া ও গােগরা – এই তিনটি যুদ্ধে সাফল্যের ফলে ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র উত্তরাঞ্চল বাবরের হস্তগত হয়। তার সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অক্সাস থেকে শুরু করে পূর্বে গােগরা নদী এবং উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিণে গােয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। বলতে গেলে বাবর কাবুল হতে বাংলা পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি হন।

বাবরের সাথে বাংলার সুলতান নসরত শাহের দ্বন্দ্ব

এ প্রসঙ্গে নসরৎ শাহের সাথে বাবরের সংঘাতের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। নসরৎ শাহের রাজত্বকালের অন্যতম প্রধান ঘটনা ভারতে মুগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সঙ্গে তার সংঘর্ষ। হােসেন শাহের রাজ্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমা অতিক্রম করে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পাশেই ছিল পরাক্রান্ত সুলতান সিকান্দার লােদী রাজ্য। এইজন্য বাংলার সুলতানকে কতকটা সশঙ্কভাবেই থাকতে হত। কিন্তু নসরৎ শাহের সিংহাসনে আরােহণের দু’বছরের মধ্যেই লােদী সুলতানদের রাজ্যে ভাঙন ধরল। জৌনপুর থেকে পাটনা পর্যন্ত অঞ্চল প্রায় স্বাধীন হল এবং এই অঞ্চলে লােহানী ও ফর্মলী বংশীয় লােকরা মাথা তুলে দাঁড়ালেন। নসরৎ এদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করলেন। এর ফলে নতুন কিছু অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত হয়েছিল মনে করা যেতে পারে। 

এর পরবর্তী ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ বাবরের আত্মকাহিনীতে পাওয়া যায়। (Babur-Nāma. Translated by A. S. Beveridge. 1970 cdn.. pp. 533-677)। সেখানে আছে, ১৫২৬ সালে বাবর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লােদীকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লী দখল করেন এবং তখন থেকেই রাজ্যবিস্তারে মন দেন। আফগান নায়কেরা তার হাতে পরাজিত হয়ে পূর্ব ভারতে পালিয়ে গেলেন। ১৫২৬ সালের আগষ্ট মাসে হুমায়ুন কনৌজ ও জৌনপুর থেকে মারূফ এবং নাসির লােহানীকে বিতাড়িত করলেন। টস নদীর দক্ষিণ থেকে শুরু করে ঘােগরা পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল এইভাবে বাবরের রাজ্যভুক্ত হল এবং তার রাজ্যের সীমা নসরৎ শাহের রাজ্যের সীমাকে স্পর্শ করল। ২রা ডিসেম্বর, ১৫২৮-এ বাবর সমর-নায়কদের সঙ্গে আলােচনা করে স্থির করেন যে তার সম্পর্কে নসরৎ শাহের মনােভাব জেনে নেওয়া উচিত; বিশেষত তিনি বন্ধুভাবাপন্ন কিনা, তা নির্ণয় করা প্রয়ােজন। আফগানদের পশ্চাদ্ধাবন করার সময়ে ১৫২৭ সালের জানুয়ারী মাসে হুমায়ুন খরিদ লুণ্ঠন করেন। “খরিদ বর্তমান বালিয়া জিলার অন্তর্গত একটি পরগণা ছিল এবং ঘােগরা নদীর উভয় তীরে বিস্তৃত ছিল। বালিয়া জিলা গঙ্গা এবং ঘােগরা উভয় নদীর মধ্যস্থলে অবস্থিত এবং ঘােগরা নদীর উত্তরে সারণ জেলা অবস্থিত। গঙ্গা এবং ঘােগরা নদীর মােহনার কিছু উপরে ছােট গণ্ডক এবং কিছু নীচে বড় গণ্ডক নদী গঙ্গা নদীর সঙ্গে (গঙ্গা-ঘােগরার মিলিত অংশে) মিলিত হইয়াছে। বাবরনামায় বারবার উল্লেখিত সরু নদী ঘােগরা নদীরই শাখা বিশেষ (অধিকাংশ গবেষকের মতে বাবর খাস ঘােগরা নদীকেই (তার কোন শাখা-নদীকে নয়) “সরু” বলে অভিহিত করেছেন। প্রকৃত সত্য সম্ভবত তাই। আপাতত আমরা এই বিতর্কে প্রবেশ না করে বাবরের উক্তি অনুযায়ী আলােচ্য নদীকে “সরু”ই বলব।) এবং বালিয়া জিলায় গঙ্গা, ঘােগরা ও সরু নদীত্রয় মিলিত হইয়াছে। খরিদ ঘােগরা নদীর উভয় তীরে অবস্থিত হওয়ায় ইহার সামরিক গুরুত্ব ছিল অত্যধিক। বাবরের উদ্দেশ্য ছিল আফগানদিগকে শায়েস্তা করা, কিন্তু আফগানরা নদী পার হইতে পারিলে হয় বাংলার সুলতান নসরত শাহের অধীনে আশ্রয় নিত বা অন্যদিকে পলায়ন করিত, তাই ঘােগরা নদীর দক্ষিণ তীরস্থ খরিদ এলাকা দখল করা যেমন বাবরের জন্য অপরিহার্য ছিল, তেমনি নদী পার হইয়া যত্র তত্র আফগানদের পশ্চাদ্ধাবন করাও তাহার জন্য অপরিহার্য ছিল। তাই খরিদ-এর কর্তৃত্বের উপর বাবর এবং নসরত শাহের মধ্যে সম্পর্ক নির্ভর করে।” (ডঃ আবদুল করিম, বা.ই.সু.আ.. পঃ ৪১২-১৩)

এদিকে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের সিকান্দারপুরে ঘােগরা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এক মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ঐ অঞ্চল নসরৎ শাহের রাজ্যভুক্ত ছিল এবং খরিদে নসরৎ শাহ মুখতিয়ার (?) খান নামক এক ব্যক্তিকে সর-ই-লস্কর (সামরিক শাসনকর্তা) নিযুক্ত করেন। “উল্লেখিত সিকান্দরপুরে প্রাপ্ত নসরত শাহের শিলালিপির তারিখ ২৭ই রজব ৯৩৩ হিজরা বা ১লা মে, ১৫২৭ সাল। ইহাতে দেখা যায় যে, হুমায়ুন কর্তৃক খরিদ লুণ্ঠনের চারি মাসেরও পরে শিলালিপিখানি উৎকীর্ণ হয়। খরিদ লুণ্ঠনের পরে বাবর নসরত শাহের নিকট মােল্লা মােহাম্মদ মজাহবকে দূত নিযুক্ত করিয়া পাঠান এবং মােগলদের প্রতি নসরত শাহের মনােভাব নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। খরিদ পূর্বেই নসরত শাহের অধীনে থাকিলে নসরত শাহের এলাকা লুণ্ঠন করিয়া তাহার মনােভাব নির্ণয়ের চেষ্টা করার সঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।…আবার দেখা যায় ১৫২৯ সালের ১৮ই এপ্রিল তারিখে বাবর নসরত শাহের দূত ইসমাইল মীতাকে খরিদস্থ বাংলার বাহিনীকে সরাইয়া খরিদ-এ নিয়া যাইতে, অর্থাৎ ঘােগরা নদীর দক্ষিণ অংশ হইতে বাংলার বাহিনী সরাইয়া উত্তর অংশে নিয়া যাইতে বলিতেছেন। ইহাতে দেখা যায় যে, ঘােগরা নদীর দক্ষিণ তীরস্থ খরিদ-এ তখনও নসরত শাহের অধিকার অক্ষুন্ন ছিল।… “মনে হয়, বাবরের দিল্লী অধিকারের পূর্বে সম্পূর্ণ খরিদ নসরত শাহের অধিকারে আসে। পাণিপথের যুদ্ধের পরে মােগলেরা আফগানদের পশ্চাদ্ধাবন করিলে হুমায়ূন ঘােগরা নদীর দক্ষিণ অংশের খরিদ লুণ্ঠন করেন। নসরত শাহ হয়ত মােগলদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়াইবার জন্য ইচ্ছা করিয়াই হুমায়ুনকে বাধা দেন নাই। পরবর্তীকালে নসরত শাহ ঘােগরা নদীর দক্ষিণ তীরে তাহার কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু ইসমাঈল মীতাকে প্রদত্ত বাবরের শর্তে দেখা যায় যে বাবর নসরত শাহের এই কর্তৃত্ব স্বীকার করেন নাই।” (ডঃ আবদুল করিম, বা.ই.সু.আ.. পৃঃ ৪১৩-১৪)।

নসরৎ শাহ বাবর কর্তৃক বিতাড়িত আফগানদের অনেককে তার রাজ্যে আশ্রয় দিলেও বাবরের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করেন নি। বাবর খানুয়া যুদ্ধের (মার্চ, ১৫২৭ খ্রীঃ) পরে মুল্লা মজহবকে নসরৎ শাহের কাছে দূত হিসাবে পাঠালেন নসরৎ শাহ বাবরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও একাগ্রচিত্ত কিনা, তা জানবার জন্য। এই দূত এক বছরেরও বেশি সময় ফিরলেন না। ফলে ২রা ডিসেম্বর, ১৫২৮ সালে বাবর নসরৎ শাহের মনােভাব সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার প্রয়ােজন বােধ করলেন এবং তার কাছে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠালেন। অবশেষে ৩১শে ডিসেম্বর, ১৫২৮ তারিখে মুল্লা মজহব প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বাবরকে জানালেন যে নসরৎ বাবরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও তিনি বাবরের কাছে দৃত পাঠাচ্ছেন। তখন বাবরও স্থির করলেন যে বাংলা আক্রমণ করা তার পক্ষে উচিৎ হবে না এবং তার তুর্কী ও ভারতীয় আমীরদের ডেকে সেই কথা জানিয়ে দিলেন। নসরৎ শাহের দৃত ইসমাইল মীতা ২২শে জানুয়ারী, ১৫২৫ সালে বাবরের সভায় এসে সন্মান-প্রদর্শন করলেন। বাবর এর বর্ণনা এইভাবে দিয়েছেন, “বাংলার দূত ইসমাইল মীতা বাঙ্গালীর (নসরৎ শাহের) উপহার নিয়ে হিন্দুয়ানী পদ্ধতিতে আমার সঙ্গে দেখা করল। একটি তীর যতখানি যেতে পারে, ততখানি দূরত্বের মধ্যে এগিয়ে এলে সে শ্রদ্ধা দেখিয়ে আবার পিছিয়ে গেল। তারা (বাবরের লোকেরা) তাকে উপযুক্ত সম্মান-পরিচ্ছদ পরিয়ে দিল এবং আমার সামনে নিয়ে এল। সে আমাদের পদ্ধতি অনুসারে তিনবার হাটু গেড়ে এগোল, নসরৎ শাহের চিঠি দিল, তার আনা উপহারগুলি সাজিয়ে রাখল এবং প্রস্থান করল।” 

এর পরবর্তী কিছু সময়ের ঘটনা সম্বন্ধে আমরা কিছু জানতে পারি না, কারণ বাবরের আত্মকাহিনীর এই অংশ হারিয়ে গিয়েছে। মােটামুটিভাবে এই সময়েই আফগান নায়কদের একটি গােষ্ঠী বাবরের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। ইতিমধ্যে বিহারের লােহানী-প্রধান বহার খানের আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তার বালক পুত্র জলাল খান। শের খান সূর দক্ষিণ বিহারের জায়গীর গ্রহণ করলেন এবং জৌনপুরের শাসনকর্তার (মুঘলদের অধীন) সঙ্গে মিলে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উপায় খুঁজতে লাগলেন। এদিকে ইব্রাহিম লােদীর ভাই মাহমূদ নিজেকে ইব্রাহিম লােদীর উত্তরাধিকারী বলে ঘােষণা করেছিলেন। তিনি জৌনপুর অধিকার করলেন এবং বালক জলাল খান লােহানীকে আক্রমণ করে তার রাজ্য কেড়ে নিলেন। জলাল দলবল সমেত হাজীপুরে পালিয়ে গিয়ে তার পিতৃবন্ধু নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় চাইল। নসরৎ কিন্তু জলালকে হাজীপুরে আটক করে রাখলেন। এদিকে বিহারের আফগান নায়কেরা মাহমূদ লােদীর সঙ্গে যােগ দিলেন। এদের মধ্যে শের খানও ছিলেন। অতঃপর শের খান এবং মাহমুদ লােদী বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। মাহমুদ এবং শের গঙ্গার দুই তীর ধরে যথাক্রমে চুনার ও কাশীর দিকে রওনা হলেন। বিবন এবং বায়াজিদ নামে অপর দুজন আফগান নায়ক ঘােগরা নদী ধরে উত্তরে গােরক্ষপুরের দিকে রওনা হলেন। বাবরের আত্মকাহিনীতে এই বিবরণ পাওয়া যায়। শের খান দক্ষতার পরিচয় দিয়ে কাশী অধিকার করলেন। কিন্তু বিবন ও বায়াজিদের সারণ পর্যন্ত পৌঁছােতেই অনেক দেরী হয়ে গেল। এদিকে বাবর-বিরােধী-গােষ্ঠীর নেতা মাহমূদের অপদার্থতায় সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। বাবর ঐ সময় ঢােলপুরে ছিলেন। তিনি আফগানদের অগ্রগতির খবর পেয়ে আগ্রায় ফিরে এলেন এবং বিহারের দিকে সসৈন্যে রওনা হলেন। বাবরের অগ্রগতির খবর শুনে মাহমূদ কোন যুদ্ধ না করেই মাহােবাতে পালিয়ে গেলেন। বাবরের অন্যান্য প্রতিপক্ষের মধ্যে শের খান বেগতিক দেখে এক মাসের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করলেন। বিবন ও বায়াজিদ পালিয়ে গেলেন। বাবর ইতিমধ্যে তার সৈন্যবাহিনী সমেত গঙ্গা ও ঘােগরা নদীর সঙ্গমস্থলের দক্ষিণে আরি (আরা) পরগণায় এসে পৌঁছেছিলেন। উপরে বর্ণিত বাবর-বিরােধী অভিযানগুলিতে নসরৎ শাহ প্রত্যক্ষভাবে কোন অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে বাবর তার আত্মকাহিনীতে লেখেন নি। কিন্ত রিয়াজ-উস-সতীনে’ লেখা আছে, নসরৎ মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করবার জন্য ভরাইচ বা বহরাইচ অঞ্চলের দিকে কুৎব খাঁর অধীনে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন। নসরৎ যদি কোন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে থাকেন, তা মুগল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেনি নিশ্চয়ই। ফলে তার নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বাবর কোন প্রকাশ্য প্রমাণ পাননি। 

যাই হােক, শেষ পর্যন্ত নসরৎ শাহের সঙ্গে বাবরের সংঘর্ষ বাধল। বাবরের আত্মকাহিনী থেকে এই সংঘর্ষের পূর্বাহ্নের ঘটনাবলীর সারসঙ্কলন হলো – ৫ই এপ্রিল ১৫২৯ – এ বাংলার দূত ইসমাইল মীতাকে বাবরের তিনটি শর্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। (এই তিনটি শর্তের মধ্যে মাত্র একটি পরে বিবৃত হয়েছে। বাকী দু’টি সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।)। ১৫ই এপ্রিল ১৫২৯ – এ গুপ্তচর মারফৎ বাবর সংবাদ পান যে মখদুম-ই-আলমের নেতৃত্বে বাঙালীরা গণ্ডক নদীর তীরে ২৪টি স্থানে সমবেত হয়েছে এবং রক্ষাব্যবস্থা সুদৃঢ় করছে। তারা আফগানদের তাদের পরিবারবর্গকে গঙ্গা নদী পার করতে বাধা দিচ্ছে এবং আফগানদের তাদের (বাঙালীদের) সঙ্গে যােগ দিতে বাধ্য করছে। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখে বাবর মুহম্মদ জমান মীর্জাকে নিজের কাছে রাখলেন এবং শাহ ইসকান্দরকে তিন চারশাে লােক সঙ্গে দিয়ে বিহারে পাঠালেন। ১৬ই এপ্রিল ১৫২৯ সালে বহার খানের পুত্র জলাল খান (লােহানী) এবং তার মাতা দুদু বিবির কাছ থেকে একজন লােক এসে বাবরের সঙ্গে দেখা করে। নসরত শাহ জলাল খান ও দুদু বিবিকে “মন্ত্রমুগ্ধ” অর্থাৎ বন্দী করে রেখেছিলেন। তারা যুদ্ধ করে মুক্তি পান এবং বিহারে এসে পৌঁছেন। এখন তারা নদী পার হয়ে বাবরের শিবিরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। বাবরের পক্ষ থেকে বাংলার দূত ইসমাইল মীতাকে এই আদেশ দেওয়া হয় – তিনটি শর্ত অনেক দিন আগে নসরৎ শাহকে চিঠির মারফৎ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও কোন উত্তর পাওয়া যায় নি; দূত যেন নসরৎ শাহকে জানিয়ে দেয় যে নসরৎ শাহ বাবরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন এবং একাগ্রচিত্ত হলে শীঘ্রই উত্তর দেওয়া উচিত। 

১৭ই এপ্রিল ১৫২৯ এ বাবরের কাছে সংবাদ পৌছােয় যে (নসরৎ শাহের) খরিদ-এর সৈন্যরা ১০০ থেকে ১৫০ খানা নৌকা সমেত গঙ্গা এবং সরু নদীর মােহনায় জমায়েত হয়েছে। যেহেতু নসরৎ শাহের সঙ্গে বাবরের একপ্রকার শান্তি বিরাজ করছিল, এবং শান্তিই বাবরের লক্ষ্য ছিল, তাই বাবর এই বিষয়ে বিশেষ জোর দিলেন না। তিনি তার দূত মুল্লা মজহব এবং নসরৎ শাহের দূত ইসমাইল মীতাকে ডেকে তিনটি শর্তের কথা আবার বললেন এবং দুই দূতকে বাংলায় পাঠাবার সংকল্প করলেন। ১৮ই এপ্রিল ১৫২৯ – এ বাংলার দূত (ইসমাইল মীতা) দেখা করতে এলে বাবর তাকে বিদায়ের অনুমতি দিলেন এবং পরিষ্কার ভাষায় বললেন আমরা আমাদের শক্রদের পশ্চাদ্ধাবন করে বিনা বাধায় এদিক সেদিক যাব, কিন্তু তােমাদের অধীনস্থ এলাকার কোন ক্ষতি করা হবে না। তিনটি শর্তের একটিতে যেমন বলা হয়েছে, তােমরা তােমাদের খরিদস্থ সৈন্যবাহিনীকে আমাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে খরিদ-এ ফিরিয়ে নিয়ে গেলে আমাদের কিছু তুর্কী সৈন্য খরিদ-এর লােকদের অভয় দেওয়ার জন্য এবং তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যাওয়ার নিরাপত্তা বিধানের জন্য যাবে। কিন্তু তারা (খরিদস্থ বাংলার বাহিনী) যদি ফেরী ঘাট থেকে সরে না যায় বা অশােভন উক্তি থেকে বিরত না থাকে, কোন বিপদ এলে তাদের নিজ কর্মফলেই তা আসবে, তাদের অশােভন উক্তিই তাদের বিপদ ডেকে আনবে। ২০শে এপ্রিল, ১৫২৯ – বাংলার দূতকে সম্মান-পােষাক এবং উপহার দেওয়া হল এবং তাকে যাত্রার অনুমতি দেওয়া হল। কিন্তু বাংলার দূত চলে যাবার পরে কয়েক দিন পরেই বাবর জোর করে “সরু” নদী পার হবেন স্থির করলেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। অধিকাংশ আধুনিক গবেষকই মনে করেন যে, বাবর যখন দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেও নসরৎ শাহের কাছ থেকে তার সন্ধি-প্রস্তাবের কোন উত্তর পেলেন না, তখনই তিনি জোর করে “সরু” পার হবার সিদ্ধান্ত নিলেন, অর্থাৎ দোষটা নসরৎ শাহেরই। 

কিন্তু বাবর খানুয়া যুদ্ধের (মার্চ, ১৫২৭ খ্রীঃ) পরে মুল্লা মজহবকে নসরৎ শাহের কাছে দূত হিসাবে পাঠান। তখন বাবরের উদ্দেশ্য ছিল নসরৎ তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন কিনা তা জানা। মুল্লা মজহব বৎসরাধিককাল নসরতের কাছে ছিলেন, কোন উত্তর আনেন নি। এরপর ২রা ডিসেম্বর, ১৫২৮ তারিখে বাবর তুর্কী ও ভারতীয় আমীরদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করেন যে নসরৎ শাহ বন্ধুভাবাপন্ন ও একাগ্রচিত্ত কিনা – তা জানবার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি পাঠানাে হােক (Babur Nama, p. 628)। এরপর ৩১শে ডিসেম্বর, ১৫২৮ তারিখে মুল্লা মজহব ফিরে আসেন এবং বাবর তাকে একের পর এক খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে প্রশ্ন করে বুঝতে পারেন যে নসরৎ তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও একাগ্রচিত্ত (Babir-Nama, p. 637)। এরপর ২২শে জানুয়ারী ১৫২৯ খ্রীঃ নসরৎ শাহের দূত ইসমাইল মীতা বাবরের সঙ্গে দেখা করে শ্রদ্ধা দেখালে ও উপহার দিলে নসরৎ শাহের মনােভাব জানা ব্যাপারটির উপর আনুষ্ঠানিক যবনিকাপাত হল। অতঃপর ৫ই এপ্রিল তারিখে বাবর বাংলার দূতকে ডেকে তিনটি শর্তের কথা বলেন ও নসরৎ শাহকে তা জানাতে আদেশ দেন (Babur-Nama, p. 661)। ডঃ আবদুল করিম লিখেছেন, “বাবরের দূত এক বৎসরের বেশী সময় নসরত শাহের দরবারে কাটাইয়াও নসরত শাহের নিকট হইতে বন্ধুত্বের কথা ছাড়া তিনটি শর্তের সরাসরি জবাব পান নাই।” (বা.ই.সু.আ., পৃঃ ৪১৬) জবাব পাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ১৫২৯ সালের ৫ই এপ্রিল তারিখের আগে বাবর এই তিনটি শর্তের কথা বলেনই নি। যাই হােক, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ৫ই এপ্রিলের প্রস্তাবের উত্তর ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে না আসাতেই বাবর অধৈর্য হয়ে যান ও বাংলার দূতকে সেকথা বলেন। 

১৮ই এপ্রিল বাবর বাংলার দূতকে সবিস্তারে তার বক্তব্য বলেন। ২০শে এপ্রিল দূত বাবরের প্রস্তাব নিয়ে বাংলার রাজধানীর দিকে রওনা হন। এর আট দিন পরে ২৮শে এপ্রিল বাবর তুর্কী ও ভারতীয় আমীরদের সঙ্গে বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আসন্ন প্রস্তুতি সম্বন্ধে আলােচনা করেন। তার পাঁচ দিন পরে – ৩রা মে বাবরের বাহিনীর সঙ্গে বাংলার বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। এই আট বা তের দিনে সরু নদীর ওপারের বাংলার সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে কোন প্ররােচনা এসেছিল বলে বাবর তার আত্মকাহিনীতে লেখেন নি। বাবর ২০শে এপ্রিল তার বা নসরৎ শাহের দূত মারফৎ নসরৎ শাহকে চরমপত্র দেন নি যে তের দিনের মধ্যে তার সন্ধি-প্রস্তাবের উত্তর না এলে তিনি দুই রাজ্যের সীমান্ত পার হবার জন্য যুদ্ধ করবেন। অথবা, এই তের দিনের মধ্যে বাবরের দূত মুল্লা মজহব বাবরের কাছে ফিরে এসে বলেন নি যে নসরৎ সন্ধি করতে অসম্মত। আরা পরগণা থেকে বাংলার রাজধানী গিয়ে বাংলার সার্বভৌম সুলতানের কাছ থেকে সন্ধি-প্রস্তাব সম্বন্ধে অভিমত নিয়ে আরা পরগণায় ফিরে আসার পক্ষে তের দিন যথেষ্ট সময় নয়। নসরৎ শাহ ২০শে এপ্রিলের সন্ধি প্রস্তাবের উত্তর দিতে মােটেই দেরী করেন নি। ২০শে এপ্রিলের এক মাস পরে – ১৯শে মে তারিখে এই সন্ধি-প্রস্তাব সম্বন্ধে নসরৎ শাহের সম্মতিবাচক উত্তর বাবরের কাছে পৌঁছেছিল এবং এই সময় লাগা খুবই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে, সন্ধি-প্রস্তাব পাঠানাের পরেও বাবর তার উত্তরের জন্য উপযুক্ত সময় অপেক্ষা না করে এবং প্রতিপক্ষীয় বাহিনীর সংখ্যাল্পতা ও অপ্রস্তুত অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করে নিজের পরিপূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। বাবরের এই আচরণকে বিশ্বাসঘাতকতা ভিন্ন আর কিছুই বলা যায় না। 

যাই হােক, বাবরের আত্মকাহিনী অবলম্বনে তার বাহিনীর সঙ্গে নসরৎ শাহের বাহিনীর যুদ্ধের বিবরণ দেয়া যাক – বাবর বাংলার সৈন্যদের শক্তি এবং কামান চালনায় দক্ষতার কথা জানতেন, তাই নিজের বাহিনীকে অসাধারণ শক্তিশালী করে গঠন করেছিলেন। এরপর যখন ৩০শে এপ্রিল তারিখে জৌনপুর থেকে আরও ২০,০০০ সৈন্য এসে তার বাহিনীকে পুষ্টতর করে তুলল, তখন বাবর আক্রমণ শুরু করতে বিলম্ব করলেন না। ভারতীয় ও তুর্কী আমীরদের সঙ্গে বাবর যে পরামর্শ করেছিলেন, তদনুসারে – উস্তাদ আলী কুলী খান সরু নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত বাংলার বাহিনীর দিকে মুখ করে গঙ্গা ও সরু নদীর মাঝে উঁচু জায়গায় কামান বসালেন। তার সঙ্গে ছােট কামান চালাবার অনেক লােক ছিল। দুই নদীর সঙ্গমস্থল থেকে কিছু নীচে–গঙ্গার এ দিকের পারে ছােট কামান চালাবার আর একদল লােক নিয়ে মুস্তাফা প্রস্তুত রইলেন ওধারের এক দ্বীপের নিকটে অবস্থিত বাংলার হস্তী ও নৌবাহিনীর উপর গােলা বর্ষণ করে যুদ্ধ বাধাবার জন্য। মুহম্মদ জমান মীর্জা এবং তার বহু সহকারী মুস্তাফার পিছনে মােতায়েন হলেন প্রয়ােজনের জন্য সংরক্ষিত বাহিনী হিসাবে। উস্তাদ আলী কুলী ও মুস্তাফার অবস্থানের ঘাটিতে একদল মিস্ত্রী ও কুলিকেও রাখা হল; এইসব ঘাটি প্রস্তুত হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবরের পুত্র আসকারি এবং তার সহকারী সুলতানরা হলদী নামক স্থান দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে “সরু” নদী পার হয়ে শক্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে আট ক্রোশ উপরের একটি নদী পার হবার স্থান সম্বন্ধে সুলতান জুনৈদ ও কাজী জিয়াকে সংবাদ দেওয়া হল। জর্দ-রুই কিছু দাড়ী ও অন্যান্য লােক নিয়ে সেখানে যেতে নির্দেশিত হলেন। মাহমুদ খান নূহানী এবং কাজী জিয়া যদি সেই স্থানকে পার হবার উপযুক্ত বলে মনে করেন তাহলে তৎক্ষণাৎ পার হবার নির্দেশ তাদের দেওয়া হল, কারণ বাঙালীরা হলদী পথ আগলাবার জন্য তােক মােতায়েনের পরিকল্পনা করছে বলে গুজব রটেছিল। 

২৮শে এপ্রিল তারিখে সিকান্দারপুরের শিকদার মাহমূদ খানের কাছ থেকে চিঠি এল যে তিনি হলদী পথে পার হবার জন্য ৫০টি নৌকা সংগ্রহ করেছেন এবং মাঝিদের টাকা দিয়েছেন, কিন্তু বাঙালীরা আসছে শুনে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছে। ৩০শে এপ্রিল তারিখে বাবর স্থির করলেন যে, যারা সরু নদী পার হবার বিকল্প স্থান খুঁজতে গিয়েছেন, তাদের জন্য আর অপেক্ষা না করে নদী পার হবেন। অমাত্যদের ডেকে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বাবর বললেন যে অন্য কোন পার হবার স্থান যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না – তখন উস্তাদ আলী কুলী এবং মুস্তাফা কামান ও অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধ শুরু করে দিক এবং আসকারি আসবার আগেই শত্রুদের টেনে আনুক। তারপর বাবর সসৈন্যে গঙ্গা পার হয়ে উস্তাদ আলী কুলীর শক্তি বৃদ্ধি করবেন। এরপর আসকারির বাহিনী এসে গেলে সকলে যে যার জায়গায় থেকে সরু নদী পার হয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করবেন। মুহম্মদ-ই-জমান মীর্জা ও তার সহকারীরা মুস্তাফার কাছে থেকে গঙ্গার অপর পারে যুদ্ধ করবেন। গঙ্গার উত্তরের বাহিনীকে চারটি ভাগে ভাগ করে একটিকে আসকারির, দ্বিতীয়টিকে জলালুদ্দীন শর্কীর, তৃতীয়টিকে উজবেগ সুলতানদের এবং চতুর্থটিকে মুসা সুলতান ও জুনৈদ সুলতানের অধীনে রাখা হল। এই চার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন আসকারি। 

১লা মে প্রত্যুষে বাবরের বাহিনী গঙ্গা পার হতে শুরু করল। বাবর নিজে সকাল ৬টার সময়ে পার হলেন। দুপুরে জর্দ-রুই ও তার দলের লােকরা ফিরে এল। তারা নদী পার হবার বিকল্প স্থান খুঁজে পায় নি, কিন্তু নৌকা জোগাড় করার খবর নিয়ে এল। | ৩রা মে – বাবর ও তার বাহিনী যেখানে গঙ্গা পার হয়েছিলেন, সেখান থেকে আরও এক ক্রোশ এগিয়ে দুই নদীর সঙ্গমস্থলে পৌঁছােলেন। বাবর দেখলেন উস্তাদ আলী কুলী দীর্ঘ সর্পাকার হাতলযুক্ত কামান এবং ফিরিঙ্গী (পাথর নিক্ষেপ করার যন্ত্র) ব্যবহার করছেন। তিনি ফিরিঙ্গী থেকে ছোড়া পাথর দিয়ে বাংলার দুটি নৌকা ডুবিয়ে দিলেন। মুস্তাফাও তাই করলেন। বাবর যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কামান আনালেন এবং মীর্জা গােলামকে তার ভার দিলেন, তাকে অনেক সাহায্যকারীও দেওয়া হল। তারপর বাবর নৈশভােজ সেরে একটি নৌকায় ঘুমােতে গেলেন। সেই রাত্রেই প্রতিপক্ষের একজন লােক বাবরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার নৌকায় ওঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু বাবরের নৈশপ্রহরীরা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। লােকটি জলে একবার ঝাপিয়ে পড়ে আবার ফিরে এসে একজন প্রহরীর মাথায় অস্ত্রাঘাত করে তাকে সামান্য আহত করে এবং আবার নদীতে পড়ে সাঁতরে পালিয়ে যায়। 

৪ঠা মে প্রত্যুষে বাবর পাথর ছোড়ার জায়গায় গিয়ে তদারক করেন এবং প্রত্যেক কাজের জন্য লােক নিযুক্ত করেন। বাবর ঔগন বীণা মুগণ নামে একজন সেনাধ্যক্ষকে ১০০০-এর মত লােক সঙ্গে দিয়ে সরু নদী পার হবার চেষ্টা করতে পাঠিয়েছিলেন। ৪ঠা মে আসকারির তাবুর ওপার থেকে বাংলার একদল সৈন্য ২০/৩০টি নৌকায় করে এসে অবতরণ করল এবং ঔগনকে বাধা দিল। কিন্তু ঔগন ও তার বাহিনী তাদের যুদ্ধ করে হটিয়ে দিলেন, অনেকের মাথা কেটে ফেললেন, অনেককে শরাহত করলেন এবং ৭/৮টি নৌকা দখল করলেন। ঐ দিন বাঙালীরা নৌকায় করে গিয়ে মুহম্মদ-ই-জমান মীর্জার অবস্থানের কাছেও অবতরণ করল। কিন্তু আক্রান্ত হয়ে তারা পালাল, তাদের তিনটি নৌকা ভর্তি লােক ডুবে গেল এবং একটি নৌকা বাবরের লােকরা দখল করল। এই যুদ্ধে বাবরের অনুচর সাহসী “বাবা” খুব কৃতিত্ব দেখালেন। বাবর আদেশ দিলেন যে ঔগন বীর্দীর দখল করা বাংলার কয়েকটি নৌকায় চড়ে তার দলের কয়েকজন যােদ্ধা সরু নদীতে অগ্রসর হয়ে বাংলার সৈন্যদের ঘাটির ঠিক সামনে এক জায়গায় সমবেত হবে এবং ঐসন তিমুর সুলতান ও তুখতেহ বুঘা সুলতান সেখানে গিয়ে তাদের উপর নজর রাখবেন। এদিকে, ঐদিনই আস্কারির অধীন সৈন্যবাহিনীর এক বৃহদংশ সরু নদী পার হল। আস্কারি বাবরকে জানান যে তিনি বাংলার সৈন্যবাহিনীকে পরদিন পরিপূর্ণভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছেন। বাবর অন্য যাদের নদী পার হবার আদেশ দিয়েছিলেন, তাদের আসকারির সঙ্গে যােগ দিতে বললেন। ৪ঠা মে মধ্যাহ্নে উস্তাদ আলী কুলী বাঙালীদের লক্ষ করে ফিরিঙ্গী থেকে পাথর ছুঁড়তে লাগলেন। বাঙালীরাও কামান দেগে তার উত্তর দিল। বাবর লিখেছেন, “বাঙালীরা কামান চালানাের নৈপুণ্যের জন্য বিখ্যাত। আমরা এখন তার পরিচয় পেলাম। তারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে কামান চালায় না, যথেচ্ছভাবে চালায়।” অর্থাৎ কামান-চালানােতে বাঙালীদের হাত এত পাকা যে তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করার দরকার হয় না, যথেচ্ছভাবে কামান চালিয়ে তারা শত্রুদের ঘায়েল করতে পারে। বাবরের নির্দেশ অনুযায়ী ৫ই মে মধ্যরাত্রে ঔগন বীর্দীর দখল করা কয়েকটি নৌকায় চড়ে তার কয়েকজন যােদ্ধা অগ্রসর হল। কিন্তু বাংলার নৌবাহিনী এই সমস্ত নৌকার অগ্রগতি রােধ করল। এই সমস্ত নৌকার লােকরা বাবরকে খবর পাঠাল, “নিযুক্ত বাহিনী একটু এগিয়েই গিয়েছে। আমরা নৌকায় করে তাদের অনুসরণ করছিলাম। বাঙালীরা তা জানতে পেরে আমাদের আক্রমণ করল। (তাদের ছোড়া) পাথর লেগে একজন। নাবিকের পা ভেঙে গিয়েছে। আমরা এগিয়ে যেতে পারছি না।” ৬ই মে প্রত্যুষে বাবরের কাছে খবর এল যে ঐ সমস্ত নৌকা ফিরে এসেছে অর্থাৎ বাঙালীরা তাদের বিতাড়িত করেছে এবং আসকারির অধীন অগ্রসরমান বাহিনীকে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে। তখন বাবর তরিতগতিতে তার সমস্ত সৈন্যকে সমবেত করলেন এবং মুহম্মদ সুলতান মীর্জা ও তার সহকারীদের আদেশ পাঠালেন অবিলম্বে না পার হয়ে আসকারির সঙ্গে যােগ দিতে। ঐসন তিমুর সুলতান এবং তুখতেহ্‌ বুঘা খানকেও তিনি অবিলম্বে নদী পার হতে আদেশ দিলেন।  

ঐসন তিমুর সুলতার ত্রিশ চল্লিশ জন অনুচর ও তাদের ঘোড়া নিয়ে নদী পার হলেন। তাদের পার হতে দেখে একদল বাঙ্গালী পদাতিক সেন্য তাদের আক্রমণ করল। ঐসন তিমুরের সাত আটজন অনুচর তীর ছুঁড়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। ঐসন তিমুর ও বাকি সৈন্যেরা যুদ্ধের জন্য ঘোড়ায় চড়লেন; এদিকে আরও একখানা নৌকা নদী পার হতে শুরু করল। ঐসন তিমুরের ৩০/৩৫ জন অশ্বারোহী সৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বাংলার পদাতিক সৈন্যেরা পালাতেলাগল। ঐসন তিমুর সুলতানের অদম্য বিক্রম সমগ্র সৈন্যবাহিনীকে উৎসাহিত করে তুলল। ইতিমধ্যে বাবরের অন্য অনেক সৈন্য ও রণতরী বিনা বাধায় নদী পার হয়ে এপারে চলে এল। এই ব্যাপার দেখে বাংলার নৌবাহিনী নিরাশ হয়ে নদীর নীচের দিকে পালাতে লাগল। দরবেশ মুহম্মদ সরবন, দােস্ত ঈশান অগ, নুর বেগ এবং অন্যেরাও নদী পার হয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করলেন। তখন বাংলার সেনাপতি ব্যুহ না ভেঙে পদাতিক সৈন্যদের সামনে সমবেত করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। (বাবরের দলের) সুলতানরাও তাই করতে লাগলেন। তারা জয়লাভ করলেন এবং প্রতিপক্ষের সৈন্যরা একের পর এক ঘোড়া থেকে নেমে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে লাগল। কূকীর লােকেরা বসন্ত রাও নামে একজন বিখ্যাত পৌত্তলিককে ধরাশায়ী করে তার মাথা কেটে ফেলল; তার ১০/১৫ জন লােক কূকীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং তারা খণ্ড খণ্ড হয়ে কাটা পড়ল। তখন বাবর নিজেও নৌকায় নদী পার হয়ে রণক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করলেন। তার যে সৈন্যেরা তখনও নদী পার হয় নি, তাদের তিনি পায়ে হেঁটে নদী পার হতে আদেশ নিলেন। ৬ই মে দুপুরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। মুঘল সৈন্যেরা যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং নদী পার হয়ে সারণে উপনীত হল। খরিদের নিরহুন পরগণার কুন্‌ডীহ্‌ গ্রামে যখন বাবর পৌঁছােলেন, তখন জলাল লােহানী এসে তার সঙ্গে দেখা করলেন। বাবর জলালকে বিহারে তার সামন্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠা বলেন। 

কিন্তু নরতের দূরদর্শিতার জন্য বাবরের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বেশি দূর গড়াল না। ইতিপূর্বে বাবর প্রথমে গােলাম আলী নামক একজন দূত এবং পরে মুল্লা মজহব নামে আর একজন দূত মারফৎ নসরৎ শাহের সঙ্গে সন্ধি করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। উপরে বর্ণিত যুদ্ধের কয়েকদিন পর ১৯শে মে ১৫২৯ তারিখে গােলাম আলী বাবরের কাছে প্রত্যাবর্তন করে জানালেন যে অপর পক্ষ বাবরের তিনটি শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি করতে রাজী হয়েছেন। গােলাম আলীর সঙ্গে আবুল ফতেহ নামে মুঙ্গেরের শাহজাদার একজন লোক এসেছিলেন। এ লস্কর-উজীর হােসেন খান ও মুঙ্গেরের শাহজাদা এই দুজনের মারফত বাবরকে একটি চিঠি পাঠান। (‘লস্কর-উজীর’ উপাধি রাজার সেনাপতিরা পেতেন, তার প্রমাণ দৌলত কাজীর ‘সতী ময়নামতী’ কাব্য থেকে মেলে। এই কাব্যে দৌলৎ কাজী তার পৃষ্ঠপােষক আশরফ খান সম্বন্ধে লিখেছেন – সেনাপতি হৈল নানা সৈন্য অধিপতি/ আশরফ খান নামে শােভা হৈল অতি।।/ শ্ৰী আশরফ খান লস্কর উজীর।…”) তাতে এরা নসরৎ শাহের পক্ষ থেকে জানান যে তারা বাবরের শর্তে সম্মত এবং সন্ধি পালনের দায়িত্ব তারা গ্রহণ করছেন। বাবরের প্রতিপক্ষ আফগান নায়কদের কতক পর্যুদস্ত, কতক নিহত হয়েছিল, কয়েকজন বাবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল এবং কয়েকজন বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তার উপরে এই সময়ে বর্ষাও আসন্ন হয়ে উঠেছিল। তাই বাবরও সন্ধি করতে রাজী হয়ে অপর পক্ষকে চিঠি দিলেন। এভাবে বাবর ও নসরৎ শাহের সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটল। এই সংঘর্ষের পরে বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত কিছু অঞ্চল নসরতের হস্তচ্যুত এবং বাবরের রাজ্যভুক্ত হয়েছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। বাবর তার আফগান সমর্থক শাহ মুহম্মদ ফর্মুলীকে সারণের শাসনভার দিয়েছিলেন এবং খরিদ ও সিকান্দারপুরে পদার্পণ করেছিলেন বলে তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। কিন্তু এই সমস্ত জায়গা যে আগে বাংলার সুলতানের রাজ্যভুক্ত ছিল, তা তার শিলালিপি থেকেই জানা যায়। অথচ বাবর নিজেই লিখেছেন যে তিনি নসরৎ শাহের সঙ্গে বিজেতার মত আচরণ করেন নি, পূর্বঘােষিত সম্মানজনক শর্তে সন্ধি করেছিলেন। আসলে বাবর ও নসরৎ শাহের মধ্যে যে সন্ধি হয়েছিল, তারই শর্ত (বাংলার দূত ইসমাইল মীতাকে বাবর ১৮ই এপ্রিল, ১৫২৯ তারিখে যা বলেছিলেন, তার থেকেই এই শর্তের আভাস পাওয়া যায়) অনুয়ায়ী সিকান্দারপুর সমেত ঘােগরা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত খরিদের যাবতীয় এলাকা বাবরের অধিকারভুক্ত হয়েছিল। আর সারণের একাংশ যে আলাউদ্দীন হােসেন শাহের জীবদ্দশাতেই সিকান্দার লােদীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা জানা যায়। এই অংশই পরে বাবরের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নসরৎ শাহের সঙ্গে যুদ্ধের এক বছর আগে বাবর সারণ (অর্থাৎ সারণের এই অংশের) শাসনভার শাহ মুহম্মদ ফর্মুলীকে দিয়েছিলেন বলে তার আত্মকাহিনীতে লিখেছেন (Babur Nama, p. 675)। সারণের যে অংশ হােসেন শাহের রাজ্যভুক্ত ছিল, তা বাবরের সঙ্গে যুদ্ধের আগে ও পরে নসরৎ শাহের অধীনেই ছিল। এই অঞ্চল নসরৎ শাহের হস্তচ্যুত হবার কথা ওঠে না। 

১৫৩০ সালে বাবরের মৃত্যুর পরে মাহমুদ লােদী – বিবন, বায়াজিদ এবং শের খানের সহায়তায় মুগলদের বিরুদ্ধে আর একবার অভিযান করেন এবং বিহারের সীমা অতিক্রম করে ক্রমশ জৌনপুর অবধি অধিকার করেন ও লক্ষ্ণৌ ঘেরাও করেন। অবশেষে নিজের অযােগ্যতা ও শের খানের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে দাদরার যুদ্ধক্ষেত্রে মুঘলের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। চার্লস্ স্টুয়ার্ট তার History of Bengal-এ লিখেছেন যে এই অভিযানে নসরৎ শাহের পরােক্ষ সমর্থন ছিল। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ‘তবকাৎ-ই-আকবরী’তে লেখা আছে যে, হুমায়ূনের সিংহাসনে আরােহণের কিছুদিন পরে নসরৎ শাহ গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের কাছে অনেক উপঢৌকন সমেত মালিক মর্জান নামে একজন খােজাকে দূতরূপে পাঠান। মালিক মর্জান মাণ্ডুতে বাহাদুর শাহের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার কাছে খিলাৎ পান। ‘রিয়াজ’-এও এই কথা লেখা আছে। এই কথা বিশ্বাসযােগ্য বলে মনে হয়। বাহাদুর শাহ হুমায়ূনের প্রবল শক্র; তার সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হলে হুমায়ূন যখন নসরতের রাজ্য আক্রমণ করবেন, তখন বাহাদুর অপর দিক থেকে হুমায়ূনের রাজ্য আক্রমণ করবেন। সম্ভবত নসরতের এই বিজ্ঞােচিত কূটনৈতিক কার্যের ফলেই হুমায়ূন বাংলা-আক্রমণ থেকে বিরত হন। 

বাবরের মৃত্যু (১৫৩০) 

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর তার বিজয়ের ফল বেশীদিন ভােগ করতে পারেন নি। দীর্ঘ তিন মাস অসুস্থ থাকার পর ১৫৩০ খ্রীস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সম্পর্কে ঐতিহাসিক আবুল ফজল একটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন। তার বর্ণনানুযায়ী ১৫৩০ খ্রীস্টাব্দে বাবরের জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুন কঠিন পীড়ায় শয্যাশায়ী হন। চিকিৎসকরা তার জীবনের আশা ত্যাগ করেন। বাবর এ সময় পুত্রের শয্যার চার পাশে প্রদক্ষিণ করে খােদার কাছে প্রার্থনা করেন যেন খােদা নিজের  জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা দেন। আশ্চর্যের বিষয় এর পর থেকেই হুমায়ুন আরােগ্য লাভ করতে থাকেন এবং বাবর ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রিয়পাত্র হুমায়ুনের আরােগ্য লাভের দুই তিন মাসের মধ্যেই বাবরের মৃত্যু ঘটে। আধনিক ঐতিহাসিকেরা বাবরের মৃত্যু সংক্রান্ত এ কাহিনীকে কল্পনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন। আধুনিক লেখক অধ্যাপক শ্রী রামশরণ শর্মা ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত Culcutta Review-তে প্রকাশ করেছেন যে, বাবর রােগাক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেন। যাইহােক, বাবরের মৃতদেহ প্রথমে আগ্রার আরামবাগে কবর দেয়া হয় এবং পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কাবুলের এক মনােরম উদ্যানে পাহাড়ের পাদদেশে সমাধিস্থ করা হয়।

বাবরের শাসন ও কৃতিত্ব 

সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে মাত্র চার বছর রাজত্ব করেছিলেন। এই স্বল্পকালীন রাজত্বকালে তিনি যুদ্ধ বিগ্রহে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, রাজ্য সংগঠনে তিনি মননানিবেশ করতে পারেন নি। এজন্য তিনি ভারতে প্রচলিত তুর্ক-আফগান শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করেছিলেন। তবুও তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি আফগানদের দুর্বল মৈত্রীভিত্তিক রাজতন্ত্রকে একটি সুসংবদ্ধ তুর্কী একনায়কত্বে পরিণত করেন। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে পূর্বতন সুলতান উপাধি পরিত্যাগ করে ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি প্রতি পনের মাইল অন্তর ডাকচৌকি স্থাপন করে দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষার ব্যবস্থা করেন। তার শাসন ব্যবস্থা ছিল উদার ও অসম্প্রদায়িক । তিনি তুর্কী, আফগান ও হিন্দুদেরকে প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত করেন। তিনি দৌলত খান লােদীর পুত্র দিলওয়ার খান লােদীকে ‘খান-ই-খানান’ উপাধি প্রদান করেন এবং চন্দেরীর মেদিনীরাওয়ের দুই কন্যাকে হুমায়ুন এবং কামরানের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে উদারতার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর স্থাপন করেন। তিনি দিল্লী ও আগ্রায় অনেকগুলাে বাগিচা, নর্দমা, সেতু ও অট্টালিকা নির্মাণ করেন। 

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় বাবরের অবদান সম্পর্কে এতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ঐতিহাসিক আর. স্যানলি লেনপুল বলেন, “বাবর ছিলেন মধ্য-এশিয়া ও ভারত এবং তৈমুর ও আকবরের মধ্যে যােগসূত্র।…. সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে না হলেও তিনি এমন এ সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যা তার পৌত্র আকবর সুসম্পন্ন করেন।” (Babur, P: 9-10) ঐতিহাসিক স্মিথ (Smith) এর ভাষায়, সংগঠন অথবা বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম গ্রহণে বাবরের সময় অথবা সদিচ্ছা ছিল না। (The Oxford History of India.) ঐতিহাসিক এরস্কিন (Erskine) বলেন, “যুদ্ধ-বিগ্রহ দ্বারা উত্তর-ভারতের বিশাল অঞ্চলের অধিপতি হয়েও বাবর শাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস করতে পারেন নি। কেন্দ্রীয় শাসনের প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি।” (History of India under Babur and Humayun.)। ঐতিহাসিকদের মতে, বাবর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আকবরকে নতুন করে রাজ্য জয় ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল। তারা আরও বলেন, আকবর যদি পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুর বিরুদ্ধে জয়লাভ না করতেন তাহলে ভারতের ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা একটা নিষ্ফল ঘটনায় পর্যবসিত হত। একথা সত্য যে, ভারতবর্ষে চার বছর রাজত্বকালে বাবর যুদ্ধ-বিগ্রহে এরূপ ব্যস্ত ছিলেন যে, রাজ্য সংগঠনে তিনি মনােনিবেশ করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি যদি পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধে আফগান ও রাজপুত শক্তিকে বিধ্বস্ত না করতেন তাহলে পরবর্তীকালে আকবরের পক্ষে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যেত। বাবরই তার আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যগুলাে ছিল এবং তাদের মধ্যে যে শক্তিসাম্য ছিল তা তিনি ভেঙ্গে দিয়ে উত্তর-ভারতে এক নতুন সাম্রাজ্যিক ঐক্য স্থাপন করেছিলেন। বাবরই সর্বপ্রথম আফগান ও রাজপুত শক্তির সঙ্গে আনুগত্যের বিনিময়ে মৈত্রীর নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম যাযাবর চাঘতাই তুর্কী শক্তিকে ভারতীয়করণ করে এক নতুন সাম্রাজ্য গঠনের সূচনা করেছিলেন। আকবরের মধ্যে রাষ্ট্রনীতির বীজ তিনিই বপন করেছিলেন। (“Without depriving Akbar of his well-deserved greatness, it can be inaintained that the sceds of his policy were sown by his illustrious grand-father. The conception of a new empire based on a political outlook as distinct from religious or sectarian, of the place of the crown in the state, of setting the Rajput problem by alliance and matrimonial contacts and of emphasizing the cultural character of the court could be traced back to Babur. Thus Babur had not only shown the way to find a new empire but has also indicated the character and policy which should govern it. He had established a dynasty and a tradition in India which have few parallels in the history of any other country.” – P.R. Tripathi, Rise and Fall of the Mughal Empire, PP: 55-56.) 

বাবরের জীবনী লেখক ঐতিহাসিক Rushbrook Williams তার “Empire Builder of Sixteenth Century” গ্রন্থে বাবরকে ১৬শ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অভিহিত করেন। কাজেই সকল দিক বিবেচনা করে একথা বলা যায় যে, বাবরই প্রকৃতপক্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

বাবরের চরিত্র

এশিয়ার ইতিহাসে বাবর নিঃসন্দেহে একটি আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ চরিত্র। সমসাময়িক ও আধুনিক ঐতিহাসিকেরা বাবর সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর একটি আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যুবরাজ, যােদ্ধা এবং বিদ্বান হিসেবে মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের সঙ্গে তিনি যােগ্য আসন লাভের অধিকারী।” (A Short History or Mulsion Rulc in India.) বাবরের জীবনী লেখক রাসব্রুক উইলিয়াম বলেন, “বাবরের চরিত্রে আটটি বিশেষ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, যথা-সুউচ্চ বিচারবুদ্ধি, মহৎ উদ্দেশ্য, যুদ্ধ নিপুণতা, সুদক্ষ শাসন-কৌশল, প্রজাহিতৈষী, উদার প্রশাসনিক আদর্শ, সৈন্যদের হৃদয় জয়ের ক্ষমতা এবং আইনের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবােধ।” (Empire Builder of Sixteenth Century.) ঐতিহাসিক স্মিথ-এর মতে, “সমকালীন যুগে বাবর ছিলেন এশিয়ার নৃপতিদের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিভাসম্পন্ন এবং ভারতীয় নৃপতিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন লাভের অধিকারী।” (The Oxford History of India.) বাবর ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী ও নির্ভিক। তার দৈহিক শক্তিও ছিল অসীম। নিজেকে গৌরবের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সমগ্র জীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন। দু’বার সিংহাসন হারিয়েও তিনি হতাশ হননি, বরং যুদ্ধ করে তা পুনরুদ্ধার করেন। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও দুর্দমনীয় আকাঙ্খাই ছিল তার সাফল্যের প্রধান কারণ।

ব্যক্তিগত জীবনেও বাবর অত্যন্ত ভদ্র এবং কোমল প্রকৃতির ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন স্নেহময় পিতা, মহান ও প্রজাবৎসল শাসক। তার মাতৃভক্তি ও সন্তান বাৎসল্য প্রবাদ হয়ে আছে। তিনি তার ভাই, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও উদার ব্যবহার করতেন। খেলাধুলা ও শিকারের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। তৈমুর লঙ্গ ও চেঙ্গিস খানের বংশধর হয়েও তিনি রক্তপিপাসু ছিলেন না। বিজিত শত্রুর প্রতি তিনি উদারতা দেখাতেন। অবশ্য কখনও কখনও তিনি শত্রুর প্রতি কঠোর আচরণ করেছিলেন সত্য; কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। মধ্যযুগের নৈতিক কলুষতা থেকেও তিনি মুক্ত ছিলেন। তিনি করতেন ঠিকই কিন্তু কখনই সংযম হারাতেন না। সঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগ ছিল এবং তিনি নিজে গান রচনা করতেন। তিনি খােদাভক্ত ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। প্রকৃতিকেও তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। 

বাবরের সাহিত্যানুরাগও ছিল প্রগাঢ়। তিনি তুর্কী ও ফার্সী ভাষায় অনেকগুলাে কবিতা রচনা করেন। তুর্কী ভাষায় তার রচিত ‘দিউয়ান’ (তুর্কী কবিতার সংকলন) তার সাহিত্যিক প্রতিভার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মধ্যযুগের ইতিহাসে তার সাহিত্যনুরাগের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন – তুর্কীভাষায় লিখিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুজুক-ই-বাবরী’ । মানব সাহিত্যের ইতিহাসে এটি যেমন অমূল্য সম্পদ তেমনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও এটি এক অমূল্য দলিল। ঐতিহাসিক ড. আব্দুল করিম এই গ্রন্থের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “বাবরের নশ্বর দেহ অনেক আগে ধূলির সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যও বিলীন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তার আত্মজীবনী এখনও টিকিয়া আছে এবং তাহার কীর্তি ঘােষণা করিতেছে।” (ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, পৃঃ ১৮৮)। প্রকৃতই ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাবরের চরিত্রে নানা গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। 

তুজুক-ই-বাবুর (বাবরের আত্মজীবনী) 

‘তুজুক-ই-বাবুর’ বা বাবরের আত্মজীবনী মানব সাহিত্যের ইতিহাসে একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম। বাবর সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় গ্রন্থটি রচনা করেন। ভারতের তদানীন্তন পরিস্থিতি, ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভারতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী, তার ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, ব্যর্থতা অকপটে তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রাচ্যের অপর কোন নরপতি বাবরের মত এভাবে সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে স্থায়ী জীবন-স্মৃতি রচনা করেননি। শুধু ভারতবর্ষই নয়, বাবরের জীবন-স্মৃতিতে কাবুল ও ফরগনা রাজ্যেরও চমৎকার বিবরণ স্থান পেয়েছে। 

বাবরের আত্মজীবনী থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগােলিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বাবর তার গ্রন্থে তৎকালীন ভারতের পাঁচজন মুসলিম শাসক ও দু’জন হিন্দু শাসকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ভারতবর্ষের বেশী ভাগ অঞ্চল দিল্লীর সুলতানের অধীনে ছিল, যদিও সেখানে অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। পাঁচজন মুসলিম শাসকই শক্তিশালী ছিলন তাদের অধীনে বিরাট সেনাবাহিনী ছিল এবং বিরাট অঞ্চল তারা শাসন করতেন। তার মতে, রাজ্যের হিন্দু রাজাদের মধ্যে সেনাবাহিনী ও রাজ্যের আয়তনের দিক দিয়ে বিজয়নগর রাজ্যের নরপতি ও চিতােরের রাণা সংগ্রাম সিংহ ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তিনি তার আত্মজীবনীতে রাণা সংগ্রাম সিংহকে চুক্তিভঙ্গকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মনে হয় ইব্রাহীম লােদীর বিরুদ্ধে যদ্ধে সংগ্রাম সিংহ বাবরকে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সংগ্রাম সিংহ তা পরে পালন করেননি। পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধে ভারতীয়দের পরাজয় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন “Indians know how to die and not how to fight” অর্থাৎ ভারতীয়রা জানত কিভাবে মরতে হয়, কিন্তু কিভাবে যুদ্ধ করতে হয় তা তারা জানত না। বাবর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের গর্জন ও আঘাতে ইব্রাহীম লােদীর হস্তীবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের সেনাদলকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল এবং তার বিজয় সুনিশ্চিত করেছিল। 

ভারতবর্ষের অধিবাসীদের সম্পর্কে-বাবরের ভালাে ধারণা ছিল না। তিনি লিখেছেন, ভারতের অধিবাসীগণ সুদর্শন নয়, একত্রে মিলেমিশে বসবাস করার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ আছে সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। তাদের প্রতিভা নেই, কারিগরি জ্ঞান নেই এবং আবিষ্কারের দিকেও আগ্রহ নেই। তাদের ভালাে ঘােড়া নেই, ভালাে কুকুর নেই, বাজারে কোন ভালাে ফল নেই, বরফ ও শীতল জল নেই, স্নানাগার নেই, স্কুল-কলেজ নেই। তিনি ভারতীয়দের পােশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, চাষী এবং নিম্নশ্রেণীর লােকেরা উলঙ্গ থাকত, কারণ তারা শুধু লেঙ্গুট (Languta) পরত । 

তবে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বাবর কিছু প্রশংসাও করেছেন। তিনি লিখেছেন, ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ এবং এখানে তাল তাল সােনা পাওয়া যায় । বর্ষাকালে এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত ভালাে ও আরামদায়ক। দিনে কখনও কখনও ১০/১৫/২০ বার বৃষ্টিপাত হয়। যে কোন কাজের জন্য এখানে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যায়।

বাবর তুর্কী ভাষার তার ‘আত্মচরিত’ রচনা করেন। পরে বৈরাম খানের পুত্র আব্দুর রহিম খান-ই-খানান এবং পায়েন্দখান ‘তুজুক-ই-বাবর’ গ্রন্থটিকে দু’বার তুকী ভাষা থেকে ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি অনেক ইউরােপীয় ভাষায়ও অনুদিত হয়েছে। ১৮২৬ খ্রীস্টাব্দে লিডেন (Lyden) এবং এরস্কিন (Erskine) কর্তৃক এটি ইংরেজী ভাষায় অনুদিত হয়। এ. এস. বেভারিজ (A. S. Beveridge) প্রথম মূল গ্রন্থটিকে তুর্কী ভাষা হতে ইংরেজী ভাষার অনুবাদ করেন। ফলে অন্যান্য অনুবাদকৃত গ্রন্থ থেকে তার গ্রন্থটিকে অধিকতর নির্ভরযােগ্য ও বিশ্বস্ত বলে গণ্য করা হয়। ১৮৭১ খ্রীস্টাব্দে গ্রন্থটি ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়।

ঐতিহাসিক ইলিয়ট ও ডাওসন ‘তুজুক-ই-বাবুর’কে “বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও নির্ভরযােগ্য আত্মচরিত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।” (History of India as told by its own Historians) ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, “পূর্বদেশীয় কোন নরপতিই বাবরের ন্যায় এরূপ সুস্পষ্ট, মনােমুগ্ধকর এবং সত্যনিষ্ঠ আত্মজীবনী রচনা করেন নি।” (A Short History of the Muslim Rule in India.) ঐতিহাসিক লেনপুল মন্তব্য করেছেন, “বাবরের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তার লিখিত জীবনস্মৃতি আজও অমর ও অক্ষয় হয়ে আছে।” (Babur.) ঐতিহাসিক স্যার ডেনিসন রস বলেন, ‘বাবরের আত্মচরিত’ সর্বযুগের সাহিত্যের মননামুগ্ধকর এবং রােমাঞ্চকর সৃষ্টিকর্মগুলাের অন্যতম বলে গণ্য হবে।” (The Cambridge History of India-vol. 4)

তথ্যসূত্র

  • Dr. Iswari Prasad, A Short History of Muslim Rule in India
  • A History of India under Babur and Humayun, Erskine
  • Mughal Rule in India, Edward & Garrett
  • Babumama. SET: V. D. Mahajain, Muslim Rule in India
  • Babur-Nāma. Translated by A. S. Beveridge. 1970 cdn
  • An Advanced History of India, R.C. Majumdar, H.C. Raychaudhuri, Kalikinkar Datta- p. 419 
  • Rise and Fall of the Mughal Empire, P.R. Tripathi
  • Empire Builder of Sixteenth Century, Rushbrook Williams
  • বাংলার ইতিহাস : সুলতানী আমল, ডঃ আবদুল করিম
  • ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, ডঃ আব্দুল করিম
  • দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : ১৫২৬ খ্রী. হতে ১৮৫৭ খ্রী. পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা, ঢাকেশ্বরী লাইব্রেরী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ২৪-৫২
  • দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : প্রাচীনকাল থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, দিলীপ কুমার সাহা ও মোল্লা আমীর হোসেন, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৪১১-৪৩৩, ৪৫৫-৪৬৩
  • বাংলার ইতিহাস, সুখময় মুখোপাধ্যায়, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১৫, পৃ. ৪৪৪-৪৫, ৫৫৭-৬৭

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.