মওলানা আবুল কালাম আজাদের দর্শন (১৮৮৮-১৯৫৮)

ভূমিকা

এ উপমহাদেশের এক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক হলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮)। সাধারণত তিনি পরিচিত একজন রাজনীতিক হিসেবে। কিন্তু তার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি যে এক প্রগাঢ় ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাসদর্শনের ওপর রচিত এবং ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক হিসেবে তার অবদান যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, একথা আজও অনেকের কাছে অজানা। আজাদের বাবা দিল্লির শেখ মােহাম্মদ খয়েরউদ্দিন (মৃ. ১৯০৯) ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মবেত্তা ও সুফি। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের ওপর আরবি ও ফার্সি ভাষায় রচিত অনেকগুলাে গ্রন্থের মাধ্যমে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম জাহানের সর্বত্র। ঘটনাক্রমে তিনি মক্কায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন এবং ওখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। এভাবেই একদিন তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন মদিনার মুফতি শেখ মােহাম্মদ বিন জাহিরের ভাগ্নীর সঙ্গে। ভারতীয় বাবা এবং আরবীয় মায়ের সংসারে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন আবুল কালাম আজাদ। তার বাবা যেমন ছিলেন মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও বিভিন্ন ভাষায় সুপণ্ডিত, তেমনি তার মা ছিলেন আরবি ভাষা ও ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানের অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। 

আজাদের বয়স যখন দশ বছর, তখন তার বাবা ভারতীয় ভক্ত ও অনুরাগীদের অনুরােধে মক্কা থেকে কলকাতায় আসেন এবং ওখানেই অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন। শৈশব থেকেই আজাদের অসাধারণ মেধা ও বিদ্যানুরাগের পরিচয় পাওয়া। যায়। তিনি তার মার কাছে আরবি এবং বাবার কাছে ফার্সি ও উর্দু ভাষা শেখেন। তার বাবারই এক আরবীয় বন্ধুর কাছে তিনি শিক্ষালাভ করেন ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলা ও বিজ্ঞানে। কথিত আছে যে, অতি শৈশবেই তিনি কোরআন মুখস্থ করে ফেলেন এবং বিশের কোঠায় পদার্পণের আগেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের জ্ঞান আয়ত্ত করে সকলকে অবাক করে দেন। তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায় দারস-ই-নিজামী পাঠক্রমে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, ফিক্হ, ইতিহাস, ভূগােল ও আইনবিজ্ঞানের সমবায়ে গঠিত এই স্নাতক পাঠক্রম তিনি সম্পন্ন করেন কৃতিত্বের সঙ্গে। এরপর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন কায়রাের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং ওখান থেকে ইসলামি আইনবিজ্ঞানে ব্যাপক প্রশিক্ষণ লাভের পর স্বদেশে ফিরে আসেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। 

তার পরবর্তী জীবন ছিল আরাে ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্যময়। তিনি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন এ শতাব্দীর গােড়ার দিকে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন দুঃসময়ে। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অনাহার ও মহামারী-পীড়িত জনগণের তিনি নেতৃত্ব দেন তাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আজাদ তার নেতৃত্বে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন এবং অক্ষুন্ন রাখেন ব্যাপক বিপুল জনপ্রিয়তা। এভাবেই তিনি নিজেকে সুপরিচিত ও সুস্থিত করে তােলেন একজন খাটি মানবতাবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে। ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক হিসেবে তিনি তার মতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন তারজুমান-আল-কোরআন (১৯৩০) গ্রন্থে। ইসলামের সর্বজনীন প্রগতিশীল বাণীর ব্যাখ্যা ও সমর্থনই ছিল এ গ্রন্থের প্রধান প্রতিপাদ্য। তার দাবি ছিল ইসলাম একটি প্রাকৃতিক স্বভাবসম্মত ধর্ম, এ ধর্মের বাণী যে কোনাে বিশেষ মহলের জন্য নয়, বরং পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রেরিত এবং হিন্দু-মুসলমানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরােধ দূরীকরণ ইসলামের লক্ষ্য, এটাই তিনি বােঝাতে চেয়েছেন এ গ্রন্থে। 

সৈয়দ আহমদ, ইকবাল ও আজাদ

সৈয়দ আহমদ খানের প্রতি আজাদ যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তার আদর্শ দ্বারা। অবশ্য কোনাে কোনাে বিষয়ে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তিনি ভিন্নমত পােষণ করেছেন। যেমন, সৈয়দ আহমদের মতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য মুসলমানদের পক্ষে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আজাদ এ মতকে সঠিক বলে মনে করেননি। তার মতে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করতে হবে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ওপর। এ দুই সম্প্রদায় যখন মনে করবে যে, সব মানুষের উৎস অভিন্ন, সবাই একই জাতির সদস্য, অথচ তারা বিভিন্ন নাম-পরিচয় গ্রহণ করেছে নিজেরা এবং নিজেরাই ধ্বংস করেছে মানবজাতির একতাকে, তখনই তারা মুক্তি লাভ করতে পারবে বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে।

এ ছাড়া সৈয়দ আহমদ একদিকে মনে করতেন যে আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরআনে কোনাে ভুল থাকতে পারে না। কিন্তু অন্যদিকে আবার তিনি একথাও বলেন যে, পরবর্তীকালের সব বৈজ্ঞানিক নিয়ম সঠিক ও তর্কাতীত। এর দ্বারা তিনি হয়তাে চেয়েছিলেন ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার যে-কোনাে বিরােধের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিতে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আজাদের (এবং ইকবালের) দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। তিনি ইসলাম ও বিজ্ঞানের এ ধরনের কোনাে বিরােধ দ্বারা বিচলিত হননি, হওয়ার কারণ আছে বলেও মনে করেননি। কারণ, তার মতে, কোরআন প্রধানত একটি অনুপ্রেরণামূলক ধর্মগ্রন্থ, পদার্থবিদ্যা কিংবা ভূগােলের পাঠ্যপুস্তক নয়। তার মতে, কোরআনে যেসব তথ্যগত উক্তি রয়েছে সেগুলাে রচিত ও অবতীর্ণ হয়েছিল সেদিনের সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-পরিস্থিতির আলােকে, সুতরাং পরবর্তীকালের পরিবর্তিত পরিবেশেও এরা একইভাবে প্রযােজ্য হবে, এমন কথা বলার কোনাে কারণ নেই, প্রয়ােজনও নেই। এ ধারণার পরিবর্তে  ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে অন্য কোনাে ধারণা দিলে তারা শুধু বিভ্রান্তই হবে, ধর্মের বাণী সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে না। প্রত্যাদেশ ও বিজ্ঞানের আওতা যেখানে মূল্যবিষয়ক অবধারণ (value judgment)-এর অকাট্য ভিত্তি তথা বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার উৎসস্থল, সেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শুধু তথ্যবিষয়ক উক্তি ও প্রাকৃতিক নিয়মের উৎস।

কোনাে কোনাে বিষয়ে আজাদের মতে ইকবালের মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বস্তুত, ইকবালের চিন্তার কোনাে কোনাে দিককে আজাদ এগিয়ে নিয়েছেন অপেক্ষাকত সুসংবদ্ধ পরিণতির দিকে। কিন্তু কোরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহ ও মানুষের সম্বন্ধ প্রভৃতি কিছু বিষয়ে আবার তার মত ছিল ইকবালের মতের চেয়ে ভিন্ন। যেমন, ইকবাল কোরআনকে বােঝার চেষ্টা করেছেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও অধিবিদ্যক চিন্তার আলােকে। আজাদের পদচারণা আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট কথার আলােকে জগতের ঘটনাবলি এবং প্রাকৃতিক ও নৈতিক নিয়মাবলি ব্যাখ্যার দিকে। ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যায় আজাদ প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেন কোরআনের ওপর, এবং তিনি হাদিসের উদ্ধৃতি দেন কেবল তখনই যখন তা তার যুক্তিকে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে ইকবাল কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি নির্ভর করেন ইজতিহাদ ও ইজমার ওপর। 

আজাদ ছিলেন শিবলীর ন্যায় আলীগড় আন্দোলনের আদর্শবিরােধী, আপােসবিহীন। বুদ্ধিবাদের পরিবর্তে উদার মানবতাবাদ এবং বিশুদ্ধ অনুধ্যানের স্থলে গতানুগতিকতা ও আধুনিকতার সমন্বয়বিধানই ছিল তার অভীষ্ট লক্ষ্য। তার এই শেষ দৃষ্টিভঙ্গিটিতে সৈয়দ আহমদের বিশেষ প্রভাব লক্ষণীয়, যদিও সৈয়দ আহমদকে তিনি নিন্দা করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় (Humayun Kabir, India Wins Freedom (1959), p.71)। সৈয়দ আহমদের ন্যায় আজাদও তাকলিদ প্রত্যাখ্যান করেন এবং জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন মৌল প্রশ্নের সমাধানের লক্ষ্যে কোরআনের ওপর নির্ভর করেন। আজাদের মতে, কোরআনের মূল লক্ষ্য চারটি –

  • প্রথমত, কোরআন আল্লাহর গুণাবলিকে সঠিক প্রেক্ষিতে হাজির করতে চায়।
  • দ্বিতীয়ত, কোরআন জীবন, প্রকৃতি ও জগতে বিদ্যমান কার্যকারণ নিয়মের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে।
  • তৃতীয়ত, কোরআন মরণােত্তর জীবনে বিশ্বাস করে একটি প্রাণবাদী ও নৈতিক নীতি হিসেবে, এবং
  • সবশেষে তা মানুষকে শুভজীবনের আদর্শ ও নিয়মাবলি প্রদান করে।

তার মতে, ওহি মানুষের কাছে সম্পূর্ণ নতুন কিছু হাজির করে না। জ্ঞানবিজ্ঞানের ভিত্তিতে তা শুধু ব্যাখ্যা করে মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তি ও প্রবণতাসমূহকে। বুদ্ধির ভূমিকার ওপর কোরআন বারবার গুরুত্ব আরােপ করেছে বলে সৈয়দ আহমদ খান যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন আজাদ তা সমর্থন করেন। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় দুটি নীতি কার্যকর রয়েছে। এ দুই নীতিকে বুদ্ধির আলােকে অধ্যয়ন ও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমেই রয়েছে এমন এক একক সুসমঞ্জস প্রাণনীতি যা সমগ্র সৃষ্টিকে সম্বদ্ধ ও ধারণ করে। সৃষ্টির প্রতিটি জিনিস অন্য সব জিনিসের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রত্যেকটি জিনিসই বৈজ্ঞানিক লক্ষ্যে সৃষ্ট জগতের অন্তঃসারে অধিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, যে-নিয়ম সব সৃষ্টবস্তুকে পারস্পরিক সম্বন্ধে সম্বন্ধ করে তা হলাে কার্যকারণ নিয়ম। রাত-দিন, জোয়ার-ভাটা, আলাে-ছায়া, ক্রিয়াপরতা-নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতির পালাবদল পূর্ণতার সন্ধানে মানুষের কর্মবাদকে সীমিত করে। রাত ও দিনের ব্যবধান জীবনকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। দিনের আলাে মানুষকে সহায়তা করে জীবনের ক্রিয়াপরতায় নিবদ্ধ থাকতে এবং রাতের অন্ধকার রয়েছে তাকে বিশ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। (Turjiman al-Qurun. (Eng. trans, hy W. A. Latif). p. 59.)। পালাবদলের নিয়মের পাশাপাশি রয়েছে দ্বিগুণন নিয়ম। নতুন প্রজননের মাধ্যমে প্রাণ দ্বিগুণিত করে নিজেকে এবং এভাবেই অর্জন করে তার লক্ষ্য। প্রাণিজগতের অধিকাংশ সদস্যের ন্যায় মানুষ আবির্ভূত হয় নারী ও পুরুষ হিসেবে। এই ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রেমসৃষ্টি এবং মানসিক শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে তারা যেন জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মােকাবেলা করতে পারে। 

ইসলাম ও মানবতাবাদ

তার মতে, আল্লাহ ও মানুষের সম্পর্ক প্রেমের সম্পর্ক। এখানে আজাদ সুফিবাদের অনুসারী, যদিও তাতে একই সঙ্গে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বেরবেদান্তের প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে। ঈশ্বরপ্রেমকে যথার্থভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে আল্লাহর সৃষ্টজীবদের প্রেম দ্বারা। মানুষের এ দ্বৈত প্রেমের ভিত্তিতেই আজাদ রচনা করেছেন তার একত্ববাদী দর্শন ও উদার মানবতাবাদ। আজাদ জোর দিয়ে বলেন, কোরআনে যে প্রেমের মানবতাবাদ বিঘােষিত তা মানবপ্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মবিরুদ্ধ নয়, কোরআন মানুষকে তার শত্রুদের ভালােবাসতে বলে না। বাইবেলের নির্দেশাবলিকে কোরআন বুদ্ধিসম্মত করেছে ক্ষমাশীলতাকে একটি মহৎ গুণ বলে প্রশংসা করে। অন্যদিকে নিরাপত্তার কারণে প্রয়ােজন হলে প্রতিশােধ নেয়াকে কোরআন অনুমােদন করে। 

মানুষের ইতিহাসে বিবর্তন স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হয়নি বলে শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, আজাদ সে মত সমর্থন করেন। তার মতে, আল্লাহর তরফ থেকে নবী-পয়গম্বরদের মাধ্যমে প্রত্যাদিষ্ট সত্য পরবর্তীকালে বিকৃত ও দূষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে নবীগণ তাদের পূর্বসূরিদের বাণীসমূহকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন নবী মােহাম্মদের ক্ষেত্রে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। তার মতে, প্রাগিতিহাস ও ইতিহাস-প্রক্রিয়ায় সব সমাজে বিশ্বাসের পশ্চাদমুখিনতা লক্ষণীয়। নবীদের মাধ্যমে কালে কালে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশের সাহায্যে মানুষ বহুঈশ্বরবাদ থেকে ক্রমশ একেশ্বরবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছে। খােদ একেশ্বরবাদেও আবার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে প্রচুর। একেশ্বরবাদের প্রারম্ভিক ঈশ্বরভীতির ধারণা ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে ঈশ্বরপ্রেমের বারণায়। এভাবেই মানুষ ফিরে পেয়েছে তার হারানাে বিশ্বাস।

চৈনিক ধর্মদর্শন, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, জরথুস্ত্রবাদ, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টধর্ম এবং গ্রীক চিন্তায় বিদ্যমান স্রষ্টার ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে আজাদ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি প্রধানত হিন্দুধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়নে আগ্রহী। তার মতে, হিন্দুধর্ম একেশ্বরবাদী ও বহুঈশ্বরবাদী, এ উভয় দাবিই মেটাতে প্রয়াসী। ইসলামধর্মকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এমন একটি স্বভাবসিদ্ধ ও সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে যা পৃথিবীর সর্বকালের সব মানুষের জন্য দিগদর্শন প্রদানে সক্ষম। (Tarjuman al-Quran, vol. I. p. 180. ৪ Ibid.Vol. 1, p. 311.)

প্রশ্ন ওঠে, ইসলাম যদি সর্বজনীন ধর্মই হতাে, তা হলে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা কোরআনের বিরােধিতা করেছিলেন কেন। উত্তরে আজাদ বলেন, কোরআন অন্যান্য ধর্মকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে বলে নয়, অন্যান্য ধর্মকে সত্য বলে মেনে নেয়ার কারণেই সেসব ধর্মাবলম্বীরা কোরআনের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তার মতে, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা যেখানে তাদের নিজেদের ধর্মেই সব সত্য নিহিত বলে দাবি করে এবং অন্য সব ধর্মকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চায়, সেখানে কোরআন সব ধর্মের সত্যতাকে স্বীকার করেছে দ্ব্যর্থহীনভাবে, আর এজন্যই অসন্তুষ্ট হয়েছে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা। যেমন, মুসার আইনকে অকাট্য বলে ঘােষণা করার কারণে ইহুদিরা কোরআনের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করে। কিন্তু আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কোরআন যখন যিশুর বাণীকে সত্য বলে ঘােষণা করলাে, তখনই শুরু হলাে অসন্তোষ ও বিবাদ। 

আজাদ বলেন, মানবসমাজের সুখসমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা সব ধর্মেরই লক্ষ্য। কিন্তু তবু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কিছু-কিছু বাহ্য প্রভেদ লক্ষণীয়। এর কারণ এই যে, মানবসমাজের অবস্থা ও কাঠামাে সবসময় ও সর্বত্র অভিন্ন নয়। যেসব অবস্থায় যিশু তার বাণী প্রচার করেছিলেন, সেসব অবস্থা আর যেসব অবস্থায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলাে এক ও অভিন্ন ছিল না। এ ছাড়া, এ দুই ধর্মগ্রন্থের কাঠামাে ও পদ্ধতিও কোনাে কোনাে দিক দিয়ে ভিন্নতর ছিল পরিস্থিতি ও পরিবেশের তাগিদে। যিশুখ্রিস্টের সময়টি ছিল এমন যে তখন তার পক্ষে শুধু নীতিবােধ ও আত্মিক বিশুদ্ধতার ওপর জোর দেয়াই যথেষ্ট ছিল। কারণ, তখন মুসার আইন বলবৎ ছিল। কিন্তু কোরআন যখন অবতীর্ণ হয়, তখন পরিবেশটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তাই কোরআন থেমে থাকতে পারেনি মুসার আইনের পরিসীমায়, এগিয়ে যায় আরাে অনেক দূর এবং প্রণয়ন ও প্রয়ােগ করে কিছু সময়ােপযােগী বিধিবিধান। আর তা করতে গিয়ে কোরআনকে অবলম্বন করতে হয় এমন এক নতুন প্রকাশভঙ্গি যেখানে উপদেশবাণী ও বিধিমালাকে ব্যাখ্যা করা হলাে সঠিক, সুস্পষ্ট ও ব্যবহারিক ভাষায়, বাইবেলে অনুসৃত নিছক রূপক ও উপমার সাহায্যে নয়। অবশ্য তার এই যুক্তির ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন করা যায় – তাহলে মুহম্মদ-পরবর্তী সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন কোন নবী এলো না, বা কোরানে কেন বলা হলো যে মুহম্মদই শেষ নবী…

তথ্যসূত্র

  • মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৩৩০-৩৩৪
  • Humayun Kabir, India Wins Freedom (1959)
  • Turjiman al-Qurun. (Eng. trans, hy W. A. Latif)

1 Comment

  1. খুব সুন্দর আর্টিকেল। যদিও আপনার লেখা সংশয়. কমে পড়েছিলাম, কিন্তু এই সাইটটা একটা রত্ন…🧡

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.